Categories
একটা শিশু বড় করতে একটা গ্রাম লাগে। কথাটা বলেছিলেন আমার বড় ভাই কোনো এক সময়। তখন কথাটার অর্থ ভালো মতো বুঝতে পারিনি। আজ প্রায় দেড় দশক পরে এসে মনে হলো, কথাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং এর অর্থ অনেক বিশাল। আমার একটা ব্যাখ্যা আছে। একটা ছোট ছেলে শিশুকে দিয়েই একটা উদাহরন টানি।
যেমন ধরুন, একদিন বয়সের একটা ছেলেশিশু সে কথা বলতে পারে না কিন্তু সে ভালো ব্যবহার, আদর, আপ্যায়ন, মুখের অভিব্যক্তি, রাগ ইত্যাদির ইঙ্গিত খুব ভালো করে বুঝে। ফলে দেখবেন, আপনি হাসলে সেও হাসে, আপনি রাগ করলে সেও ভয় পেয়ে যায় ইত্যাদি। কিছু বাচ্চা কয়েক মিনিটের মধ্যেই অপরিচিত এক লোকের কোলে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠে আবার কিছু কিছু লোকের কাছে যেতেই চায় না বা কান্নাকাটি করে। ওই অবুঝ বাচ্চাটির কাছে কোন যুক্তি খাটে না, কে কি ভাবলো সে তাঁর পরোয়া করে না, তাঁর গলা ফাটিয়ে চিতকারে সে লজ্জাও পায় না। সে একেবারে খাটি অনুভুতি প্রকাশ করে।
সেই বাচ্চাটি ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে মায়ের সাথে, ঘরের অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের মধ্যেই বেশীর ভাগ সময় অতিবাহিত করে বলে যেহেতু বাচ্চারা খুবই সংবেদনশীল এবং অনুকরনপ্রিয়, ফলে অনেক অভ্যাস, অনেকগুন, অনেক বদগুন এবং অন্যান্য অনেক গুণাবলী এই বাসার লোকজনের কাছ থেকেই পেয়ে থাকে। স্বার্থপরতা, লোভ, দয়াশীলতা, রাগ, অভিমান, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিষ্ঠুরতাও এই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেই পায় বেশি। তারপরে সে যখন আস্তে আস্তে বাইরে যেতে থাকে, বন্ধুবান্ধব জোটে, ওই বন্ধুবান্ধবদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, তাদের পরিবারের থেকে পাওয়া ওইসব বাচ্চাদের অনেক গুনাবলীও এই বাচ্চাটি কিছু আমদানি করে ফেলে, রপ্ত করে ফেলে।। ফলে নেশাখোর বন্ধুর সাথে মিশলে, নেশায় পড়ে যায়, আবার ভালো বন্ধুদের সাথে মেলামেশায় অনেক উন্নত চরিত্রের অধিকারী হয়।
এখানে আরেকটা বিসয় খুব লক্ষ করা দরকার যে, আলোচ্য শিশুটির পারিবারিক সচ্ছলতার কিছুটা টানাটানিতেও শিশুটির অবুঝ মনে তাঁর অনেক আশা এবং প্রাপ্তির ঘাটতি থেকে যায় বলে তাঁরমধ্যে অন্য শিশুদের চাহিদা এবং তাদের প্রাপ্তির সাথে তুলনা করে সে নিজে নিজেও কিছুটা হতাশ গুণাবলীতে পেচিয়ে যায়। কেনো অন্য বাচ্চাদের এইটা আছে আমার নাই, কেনো অন্য বাচ্চারা যা চাইবে তাই পাবে অথচ আমি কেনো পাবো না ইত্যাদি। তাঁর এই হতাশ গুনাবলী একসময় বাড়তে থাকে এবং সে অন্যান্য শিশুদের তাদের চাহিদা মোতাবেক প্রাপ্তিকে নিজের বা নিজেদের না পাওয়ার ক্ষমতাকে অন্য বাচ্চাদের উপর তাঁর এক ধরনের ক্ষোভ, জিদ, ঘৃণা, কিংবা অপছন্দের কারন হয়ে দাঁড়ায়। তাতে নিজেদের অক্ষমতাকে না বুঝে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার প্রবনতাও বাড়তে থাকে। সমাজের উপর তাঁর ক্ষোভ, বাবা মায়ের উপর তাঁর রাগ, অথবা অপছন্দ কিংবা অশ্রদ্ধাবোধও বলতে পারেন বাড়তে থাকে। ব্যাপারটা এই রকম যেনো, কেনো অন্যবাচ্চারা সব পাবে আর আমি পাবো না। কেনো তাদেরই সব থাকবে আর আমার থাকবে না। কেনো আমার পরিবার আমার চাহিদার মতো সব কিছু দিতে পারবে না যেখানে তাঁরই সমবয়সী আরেক বাচ্চার সব কিছু থাকবে। এটা একটা স্যাডিস্ট ভাবধারা এবং এটা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। হয়ত সে নিজেও জানে না যে, এটা একটা খারাপ লক্ষন।
সচ্ছল বন্ধু বান্ধব্দের সাথে মেলামেশার সময় তাঁর মধ্যে না পাওয়ার প্রতিনিয়ত এই গোপন একটা রহস্যময় জিদ, রাগ কিংবা আচরন এক অন্যরকম চরিত্রে রুপান্তরীত করে ফেলে। আর এটা খুব সুপ্ত অবস্থায় তাঁর ভিতরে প্রতিনিয়ত স্থায়ী হতে থাকে। ইনফেরিওর কমপ্লেক্সে ভোগতে থাকে। ইনফেরিওর কমপ্লেক্স একটা রোগ। তাঁর সবকিছু পাবার একটা সুপ্ত বাসনা সবসময়ই মনের ভিতরে লালিত হয়। যারা নিজের চেস্টায় এই সুপ্ত বাসনাকে বাস্তবে রুপ দেওয়ার চেস্টা করে, তারা হয় পরিশ্রমী, কর্মঠ, এবং খুব হিসেবী। অনেকে এই হিসেবী গুনটাকে কেউ কেউ কিপ্টে বলেও ধরে নেয়। যাই হোক, এই নিজ চেষ্টায় সাধ পুরনের মানুষগুলির প্রতিটি ধাপে লক্ষ্য থাকে কিভাবে এই ঘাটতি নিজের চেষ্টায় পূর্ণ করবে। একসময় তারা সমাজের অনেক বড় একটা জায়গায় নিজেরদের জায়গা করে নেয়। কারন, তাঁর এতোদিনের পরিশ্রমের নীতীটা ইতিমধ্যে অভ্যাসে পরিনিত হয়ে যায় বলে সবসময় সে একই প্রকার পরিশ্রম করতেই থাকে। তাকে আর আটকানো যায় না। সে উঠতেই থাকে। পরিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি এটাই সে আবারো প্রমান করে দেয়। আর যারা এই সপ্ন লালন করে কিন্তু নিজের মেধা, পরিশ্রম দিয়ে এই বাসনা পূর্ণ করতে অলসবোধ করে, তারা সবসময় শর্ট খাট রাস্তা খুজে বেড়ায়। বিকল্প টার্গেট খুজতে থাকে। তারাই এক সময় নীতির বাইরে গিয়ে কাজ করে। অল্প পরিশ্রমে কিভাবে কোথা থেকে কি করলে বাসনাও পূর্ণ হবে আবার কস্টও করতে হবে না এই জাতীয় একটা সুযোগ খুজতে থাকে। এদের কিছুটা লজ্জা কম থাকে, এরা যে কোনো সময়ে নিজেদের স্বার্থে আচার আচরন পাল্টে ফেলতে পারে, এরা স্ট্যাবল থাকে না। যখন সে সুযোগ পায় বা টার্গেট পেয়ে যায় বলে ধারনা করে, তখন যতটা পারা যায়, ততোটাই তাঁর সদব্যবহার করার প্রবনতা থাকে।
এই টার্গেট খোজার ব্যাপারে সবচেয়ে সহজ পন্থা হচ্ছে, সচ্ছল পরিবারে কোনো না কোনো ভাবে ঢোকে পড়া। অথবা কোনো না কোনোভাবে এমন একটা জবে ঢোকে পড়া যেখানে জবের দোহাই দিয়েই অন্যকে ব্যবহার করা যায়। যদি সচ্ছল পরিবারকে টার্গেট করে এই বাসনা পূর্ণ করার প্রয়াশ থাকে, তখন ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই রকম যে, চাইনা কিন্তু না দিলে মেজাজ খারাপ থাকে, চাই না কিন্তু দিলে কি হতো? চাইবো না কিন্তু দিবেন না কেনো ইত্যাদি। আর যদি জবে ঢোকে, তাহলে তো ব্যাপারটা যেনো তাঁর মামার বাড়ির হাড়ি পাওয়ার মতো। অন্যকে জিম্মি করে ফেলা এবং তাঁর থেকে ফায়দা লুটা। এই সব ব্যক্তিত্তের সবচেয়ে প্রধান বাহ্যিকপ্রকাশ যে, তারা তাদের সামর্থ্যের বাইরে নিজেকে জাহির করে, রাগ করার যথেষ্ট কারন থাকা সত্তেও রাগ করে না (কারন রাগ করলে সুযোগ হারিয়ে যেতে পারে একটা ভয় থাকে), খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে, মিথ্যাটাকে সাবলিলভাবে উপস্থাপন করতে পারে যাতে মনে হবে সত্যি বলা হচ্ছে, স্বার্থের কারনে যুক্তির সাথে কথা বলতে পারে , বেশভুষা থাকে সুন্দর ফিটফাট, আর নিজের যা নাই, তাঁর থেকে বেশী দেখানোর প্রবনতা, সেটা যেভাবেই হোক। দেখা যায়, বাড়ির অনেক সমস্যা কিন্তু আইফোন চাই, সামর্থ্য নাই কিন্তু গাড়ি বাড়ি চাই। যোগ্যতা নাই কিন্তু সব পাবার আশা। এরা ধার করে হলেও অন্যকে আকৃষ্ট করার জন্য চাকচিক্য প্রদর্শন করে। এটা দরিদ্র আর ধনীর বাচ্চা বলে কথা নাই। এটা একটা ওরিয়েন্টেসনের অভাব। আর এই ওরিয়েন্টেসনটা প্রথমে আসে পরিবার থেকে। কিছুটা আসে সমাজের কিছু কিছু লোকের কাছ থেকে যাদের সাথে এই বাচ্চাটি ঘনঘন মেলামেশা করে। কিছুটা আসে পরিবেশ থেকে যে পরিবেশে সে চলাফেরা করে। আর এই পুরু ঘর থেকে শুরু করে অন্যান্য পরিবেশটাই আসলে একটা গ্রাম, একটা সমাজ।
এইসব মানুষগুলি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে মন থেকে শ্রদ্ধা করে না, কাউকে অন্তর থেকে সম্মান করে না, কাউকে আপন ভাবে না। এমন কি আজীবন কাল যে মাতাপিতা এদেরকে লালিত পালিত করেছে, তাদের প্রতিও এদের সম্মানবোধ থাকে না। তাদের কাছে প্রাপ্তিটাই বড়। সেটা যেখান থেকেই আসুক সেইই তাঁর কাছে প্রিয়, আর যখন দেখবে যে, কিছু পাবার আর আশা নাই, তখন তাদের চরিত্র আকস্মিকভাবে বদল দেখা যায়। তখন তাদেরকে আর আগের রুপে চেনা যায় না। এরা সব সময় সুযোগ খুজতেই থাকে। আর মজার ব্যাপার হলো, এরা সুযোগ পায়ও। কারন মানুষের অভিজ্ঞতা সবার একরকম থাকে না বলে বারবার কিছু মানুষ সবসময়ই এই জাতীয় লোভী মানুষের খপ্পরে পড়েই যায়।