২৮/১১/১৯৮৬-অনিরাপদ আমি

 ১১ অগ্রায়ন, ১৩৯৩, ০৬০০ সকাল, শুক্রবার

আজকে ডাইরি লেখার কোন ইচছেই ছিল না আমার। তাও আবার এত সকালে। কিন্ত আমি যেন শান্তিতে নেই। আর এই অশান্তিটা কিসের আমি ভাল ব্যখ্যা করতেও পারছি না। একটা অসস্তি কাজ করে সারাক্ষন। হরেক রকমের চিন্তা মাথায় আসছে। আমি আসলে ব্যক্তিগতভাবে খুবই অনিরাপদ অবস্থানে আছি। অনিরাপদ বলতে যা বুঝায়, তা হলো, আমি আসলেই একা। যদি কেউ প্রশ্ন করে আমাকে, তোমার নাম কি? আমি বলব, আখতার। যদি প্রশ্ন করে, তোমার বাবার নাম কি? আমি উত্তর দেব, আখতার। যদি প্রশ্ন করে, তোমার মায়ের নাম কি? আমি তাও বলব আখতার। অর্থাৎ আমি একা।  যেদিন থেকে আমার জ্ঞ্যন হয়েছে সেদিন থেকে আমি অন্তত একটা জিনিস বুঝতে পেড়েছি যে, আমি একা। তবে আমার ভাই আমাকে একটা প্লাটফর্ম দিতে পেড়েছিল যার উপর দাঁড়িয়ে আজ আমি অন্তত একটা সম্মানজনক চাকরি করতে পারছি। একা বেচে যেতে পারব। এ যেন সাগরের সেই ওপারের গল্প। গল্পটা শুনিয়ে দিয়েছ, সাগরেও নামিয়ে দিয়েছ অথচ আমার না আছে বৈইঠা, না আছে নৌকা। সাতার দিয়ে আমি ওই পাড়ে যেতে পারব তো?

ছোট বেলার অভিজ্ঞতা আমার খুব একটা সুখের নয়। শুনেছি আমাদের বিশাল রাজত্ত ছিল একদা। জমিজমা ছিল অঢেল, আমাদের বাড়িতে নাকি কখন চুলা নিভত না। কে এল, আর কে গেল, কে খেয়ে গেল এটা এ বাড়ীর কোন ব্যাপার ছিল না। কিন্তু বাবা মারা যাবার পর এ বাড়িতে আর চুলা জ্বলতে চায় না। পাঁচটি বোন, একটা ভাই (আমি নিজে) আর একটা মা, সব দায়িত্ত পরল গিয়ে ঐ হাবিব ভাইয়ের উপর। উনার বয়সই বা কত? সবে মাত্র কলেজ পাশ দিয়েছে। এর মধ্যে আবার দেশে একটা যুদ্ধ (১৯৭১) হয়ে গেল। চারিদিকে হাহাকার, হাবিব ভাইয়ের জন্য না আছে সঞ্চিত টাকা, না আছে জমি থেকে পাওয়া শস্য, না আছে একটা চাকরি। অথচ তার রয়েছে এক বিশাল সংসার। গা শিউরে উঠে। কি কঠিন পথ। আর এটা বাস্তবতা।

হাবিব ভাই প্রতি সপ্তাহে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে আসতেন, এসে আমাদের পড়াতেন, আসার সময় দুই হাতে দুইটা ব্যাগে আটা এবং চাল নিয়ে আসতেন। ওটাই ছিল আমাদের সপ্তাহের খাবার। মা অনেক ক্যালকুলেসন করে করে কোন রকমে আমাদের খাওয়াতেঁন। রুটি বানালে বেশি আটা লাগে তাই আটা জ্বাল করে আমরা খেতাম। ব্যাপারটা রিফুজিদের মতো। আমি এই আটা জ্বাল খেতে পারতাম না। ফলে মা, কোন রকমে পাতলা একটা বা দুটু রুটি বানাতেন শুধু আমার জন্য। আমার বাকী পাচ বোনেরা এটা নিয়ে কখনো কোন প্রশ্ন তুলে নি। কারন তারা জানে আমি আতা জ্বাল খেতে পারি না, আবার তারা আমাকে একমাত্র ছোট ভাই হিসাবে খুবই স্নেহ করে। সপ্তাহে আমরা হয়ত দুইদিন ভাত খেতে পারতাম তাও আবার অর্ধেক পেট। পড়াশুনা করা আমার কাছে একটা বিরক্ত মনে হত। প্রায়ই হাবিব ভায়ের দিয়ে যাওয়া পড়াশুনাটা আমি শেষ করতে পারতাম না, সারাদিন সুধু খেলা করতে ভাল লাগত। আমি তখন মাত্র ক্লাস ফাইভে থেকে সিক্সে উঠেছি। হাবিব ভাই বুঝতে পারলেন, আমি গ্রামে ভাল মত পড়াশুনা করছি না।

একটা সময় ছিলো যখন এতো কষ্টের মধ্যেও অনিরাপদ মনে হতো না। কিন্তু আজ আমি কষ্টে নাই, তারপরেও কেনো এতো অনিরাপদ মনে হয়? অনেকবার ভেবে দেখেছি ব্যাপারটা। ভালো উত্তর খুজে পাই নাই। তবে একটা ভাবনা মনে হয়েছে যে, অনিরাপদ শুধু ভালো থাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। নিরাপদ জীবনের জন্য আশেপাশে আপনজনের প্রয়োজন। যখন ছোট বেলায় এতো আর্থিক কষ্টে ছিলাম, তখন মাথার উপর ভাই ছিলো, মা ছিলো, বোনেরা ছিলো। কিছু হলে তারা তো আছেন, এটা একটা ভরসার স্থান ছিলো। এখনো তারা আছেন, কিন্তু এখন তারা ঐ রকম করে নেই যে আগলে রাখবেন। এখন আমি বড় হয়েছি, অনেক কিছুই আমাকে আর কৈফিয়ত দিতে হয় না। কিন্তু যেদিন থেকে কৈফিয়ত দেওয়ার দিন শেষ হয়ে যায়, তখন নিজেই সব, নিজের সব কিছু নিজেকেই সামাল দিতে হয়। কিন্তু এতো বড় দুনিয়ায় সব তো একা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। তাই মাঝে মাঝে খুব ভয় করে, অনিরাপদ মনে হয়।

হয়তো, এটাই এটা সেটা যা আমার বেলায় হচ্ছে। জীবন বড় কষ্টের এবং বেচে থাকার নামই হচ্ছে বাহাদূরী।