এই মানুষগুলি একসময় আর কারো সামনেই থাকবে না। এদের জীবনেও প্রেম এসেছিলো, এরাও কারো না কারো চোখে রানীর মতো ছিলো। বাল্যকালে সাথী সংগীদের নিয়ে এরাও নদীর ঘাটে গিয়ে জিলকেলী করতে করতে সারাটা পরিবেশ মুখরীত করে রাখতো। নীল আকাশের মধ্যে জ্যোৎস্না রাতের তারার মতো তারাও রাত জেগে হয়তো কোনো এক প্রেমিক বরের অপেক্ষায় মনের ভিতর সুখের আস্বাদন করেছেন। এরা বড় বড় সংসারের হাল ধরেছেন, সমাজে এরাও অনেক অবদান রেখেছে। এদের গর্ভে জন্ম নেয়া অনেক সুপুত্র কিংবা সুন্দুরী কন্যারা হয়তো আজো দেশে বিদেশে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু আজ তারা এতো চুপচাপ জীবন যাপন করছেন যেখানে তিনি নিজে ছাড়া আর কেউ পাশে নাই। না তার রাজা আছে, না তিনি এখন রানী আছেন। সময় মানুষকে কত পরিবর্তন করে দেয়। এই সময়ের কাছে আজো কেউ স্বাধীনতা পায় নাই, না পেয়েছে কোনো ক্ষমতা সময়কে পরিবর্তন করার। আদি যুগ থেকে যতো মানুষ এই দুনিয়ায় এসেছে, সবাই কোনো না কোনো সময় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এই পৃথিবীকে ত্যাগ করতে হয়েছে। আমরা যারা পিছনে পড়ে থাকি, তারা শুধু একটা মোহ, একটা স্মৃতি আর একটা কি যেনো নিয়ে শুধু অলীক ভাবনার জগতে অপেক্ষায় থাকি। একদিন আমিও এর থেকে পরিত্রান পাবো না। শুধু সময়টা পালটে যাবে এই রানীদের মতো।
কিন্তু আমার মনের ভিতরে এই সব রানীরা আজীবন রানীদের কিংবা রাজাদের মাতাই হয়ে থাকবেন। আমি এদেরই বংশের একটি ধারা। আরো বেচে থাকো তোমরা অনেক কাল খালা।
জীবন যেখানে যেমন। যে শিশুটি আজ জন্ম নিলো কেউ জানে না তার জন্য এই পৃথিবী কি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিংবা এই পৃথিবীকে সে কি দিয়ে যাবে। হতে পারে আজকে এই শিশুটি হয়তো এই পৃথিবীকে কোনো এক সময় নাড়িয়েও দিতে পারে বা এই পৃথিবী তাকেও নাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু এমন অনেক শিশুই এই পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয়, না তারা কোনো ভূমিকা রাখে, না পৃথিবী তাদেরকে মনে রাখে। এমন মানুষের সংখ্যাই বেশী। যুগে যুগে তারপরেও অনেক শিশু প্রকাশ্যে বা গোপনে পৃথিবীতে আসে যারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় আর একদিন সব কিছু ফেলে সবার থেকে আলাদা হয়ে আবার কোথাও অদৃশ্য হয়ে যায়। মাঝখানের এই সময়টায় খুব গুটিকতক মানুষ হয়তো নিজের মতো করে কাউকে কাউকে মনে রাখে কিন্তু তাও একসময় মনের স্মৃতি থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়। আমার সফুরা খালা, সামিদা খালা কিংবা আমার শায়েস্তা বুজি, বা সাফিয়া বুজিরা সম্ভবত এই রকমের কিছু মানুষ যারা সেই বহু বছর আগে শিশু হয়ে জন্ম নিলেও কোনো লাভ হয় নি কারো। তারা আজীবন যেনো এই দুনিয়ার বুকে একটা বোঝা হয়েই ছিলো। অথচ তারা হাজারো মানুষের থেকে অনেক ভালো মানুষ ছিলেন।
প্রায় দু বছর আগে আমি আমার পরিবার নিয়ে আমাদের গ্রাম থেকে বেশ দূরে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। বেশীক্ষন দেরী করি নাই কারন পরিবেশটা ঐ রকমের ছিলো না। কোনো রকমে আনুষ্টানিকতা শেষ করে ভাবলাম, যেহেতু গ্রামের পথেই আছি, যাই আমাদের গ্রামের বাড়িটা ঘুরেই যাই। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো, আলো বেশ কমে গিয়েছিলো। অনেকেই আমাকে চিনে না যদিও আমি এই গ্রামেরই একজন পুরানো বাসিন্দা। কিন্তু সময়ের সাথে আমার অনুপস্থিতি আমাকে আজ এই গ্রামে একজন নবাগত অতিথির মতোই মনে হচ্ছিলো। যারা আমার সমবয়সী ছিলো, তারাও অনেক বুড়ো হয়ে গেছে, অনেকেই চিনতেও ভুল করছিলো, আমি তো ওদের কাউকেই এখন চিনি না। ওদের চেহারা সুরুতে এমন বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে যে, জোয়ানকালে আমি যাদেরকে দেখেছি, তারা এখন দাদা নানার পর্যায়ে। না চেনারই কথা। তারপরেও কাউকে কাউকে আমি চিনতে পারছিলাম। গ্রামের বাড়িটা খা খা করছে, কেউ থাকে না এখানে। আগে মা থাকতেন, এখন থাকে আমার এক ভাগ্নে যে সারাদিন গাজা খায়।
ভাবলাম, আমার এক খালা ছিলো। নাম সফুরা বেগম। উনি কি জীবিত আছেন নাকি আর জীবিত নাই সেই খবরটাও আমার জানা নাই। তাঁকে খুব দেখতে মন চাইলো। মিটুলকে বললাম, চলো একটা বাড়িতে যাই। যদি উনি বেচে থাকেন, তাহলে মায়ের অভাবটা কিছুটা হয়তো পুরন হবে। আর যদি জীবিত না থাকেন, অন্তত জানতে পারবো, কবে থেকে আর তিনি এই পৃথিবীতে নাই। আলুকান্দা তার বাড়ি। অনেক খোজাখুজির পর শেষ অবধি সফুরা খালার বাসায় যেতে পারলাম। তিনি অসুস্থ্য। জর। একটা কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। চার পাঁচ দিন নাকি তিনি কিছুই খাচ্ছেন না। অনেক বয়স হয়ে গেছে। আমার মা যখন বেচে ছিলেন, তখন আমার এই খালা প্রায়ই আমার মায়ের সাথে দেখা করতেন, গল্প করতেন। আমাকে খুব আদরও করতেন। আসলে আমার মা, আমার সামিদা খালা আর এই সফুরা খালা এতোটাই ভালো আর নীরিহ মানুষ ছিলেন যে, তাদের ব্যাপারে আজ অবধি কেউ কোনো অভিযোগ করেছে সে ঘটনা ঘটে নাই। খালাকে ডাকা হলো। উনি ভালো মতো চোখে দেখেন না। এম্নিতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো, তারমধ্যে আবার আকাশ ছিলো খুব মেঘাচ্ছন্ন। বিদ্যুৎ ছিলো না। কোন রকমে খালাদের বাসায় যাওয়ার পর, আমি খালার বিছানায় গিয়ে বসলাম। খালাকে তার পুত্রবধুরা ডেকে তোলার চেষ্টা করলেন। আমাই যাওয়াতে সবাই অনেক খুশী হয়েছে। কি থেকে কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না।
খালাকে যখন আমি বললাম, আমি মেজর আখতার এসছি। খালা এম্নিতেই কানে কম শুনে মনে হয়, তার মধ্যে আমার নাম শুনে যেনো একটা অদ্ভুত মিথ্যা কথা শুনলেন এমন হলো। বল্লো-
কে? হামিদার ছেলে?
বললাম, হ্যা খালা।
উনার জর ছিলো প্রায় ১০৩ ডিগ্রী। আমার কথা শুনে তিনি বিছানা থেকে উঠে বসলেন। খালা প্রায় গত চার পাঁচ দিন বিছানায় উঠে বসতে পারেন না। কিন্তু আজ যেনো কোন অলৌকিক শক্তিতে তিনি একাই বিছানায় উঠে বসে পড়লেন। আমি খালাকে জড়িয়ে ধরলাম, খালাও আমাকে এমন করে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলেন যেনো এইমাত্র বাইরের মেঘাচ্ছন্ন আকাশটা ঘনকালো ঝপ ঝপ বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিলো সারাটা উঠান।
কতটা আদর? কিভাবে আদর করলে ভালোবাসা হয় মায়েদের? আমার সেটা জানা ছিলো। আমার মাও ঠিক এভাবেই আমাকে আদর করতেন। আমার মুখে দুই হাত দিয়ে একদম চোখের কাছে আমার মুখটা নিয়ে পানভর্তি মুখে ভিজা ভিজা চোখে ফিক করে হেসে দিয়ে বলতেন, অনেক বড় হ বাবা। আমার দোয়া আর দোয়া রইলো। সফুরা খালার ভাষাও এক। কি অদ্ভুদ। আমি তাঁকে কতোক্ষন জড়িয়ে ধরেছিলাম, আমার জানা নাই। সারাটা শরীর হাড্ডি, মাংশ বলতে কিছুই নাই। গরীব ছেলেপেলেরা যতোটা পারে তাদের মায়ের যত্ন নেয় বটে কিন্তু অন্তরের ভালোবাসায় হয়তো অনেক ঘাটতি আছে। তারপরেও তিনি বেচে আছেন যেটুক পান সেটা নিয়েই।
আমার মায়ের বাবার নাম ছিলো কেরামত আলী। আমার মায়ের কোনো ভাই ছিলো না। মাত্র দুইবোন- হামিদা খাতুন আমার মা আর সামিদা খাতুন আমার আপন খালা। কিন্তু সফুরা খালার বাবার নাম ছিলো চেরাগ আলি। তারও কোনো ভাই অথবা কোনো বোন ছিলো না। তিনি একাই একমাত্র কন্যা সন্তান ছিলেন চেরাগ আলীর। এই চেরাগ আলি এবং কেরামত আলি (মানে আমার নানারা) ছিলেন চার ভাই। অন্যান্য আর দুই ভাই ছিলেন সাবেদ আলি এবং লষ্কর আলী। উম্মেদ আলী ছিলেন এই চার ভাইয়ের বাবা। অর্থাৎ আমার মা খালাদের নানা।
আজ তারা কেহই বেচে নাই। শুধুমাত্র আমার সফুরা খালাই বেচে আছেন কালের সাক্ষী হয়ে। খুব ভালোবাসি আমি তোমাদের।