২৯/০৮/২০২৪-আওয়ামিলীগের পরবর্তী রাজনীতি কবে

গত ২০২২ সালে শ্রীলংকান রুলিং পার্টি সমুলে দেশের আপামর জনসাধারন দ্বারা উৎখাত হলে রাজাপাকসের দলের সব এম পি, মন্ত্রী স্পিকার এবং তাদের সমস্ত নেতাকর্মীরা ঠিক আমাদের বাংলাদেশের গন অভ্যুত্থানের মতো অবস্থায় পড়ে বিতাড়িত হয়েছিলো। ঠিক সেই সময়ে শ্রীলংকা প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণের (বৈদেশিক ঋণ) ডিফল্ট করে। রাজাপাকসের দল উৎখাত হবার পর সেখানে একটা অন্তরবর্তীকালিন সরকার গঠিত হয়ে আপাতত রাজ্যের ভার কাধে তুলে নেয়। ভারত, চীন এবং আই এম এফ সহ অন্যান্য দেশ এবং বিশ্ব সংস্থাগুলি শ্রীলংকাকে কোন রকম্ভাবে টেনে তুলে একটা অবস্থানে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে যা এখনো বিদ্যমান। আমুল সংস্কার করার নিমিত্তে বর্তমান ইন্টেরিম সরকার কাজ করছে বটে কিন্তু কোনো রকমে সামাল দিয়ে এগিয়ে চলছে। আগামি ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে একটা সধারন নির্বাচনের মাধ্যমে আবারো দেশের রাজনৈতিক দল গুলির মাধ্যমে দেশ পরিচালনার জন্য আয়োজন করছে। রাজাপাকসের দলের এমন ভরাডুবি এবং জন সাধারনের মধ্যে বিরূপ মনোভাবের পরে সবাই একটা কথা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো যে, রাজাপাকসের দল শ্রীলংকায় আর ক্ষমতায় ব্যাক করতে পারবে না। আর পারলেও এর সময়কালটা হবে অনেক পরে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই আগামী নির্বাচনে রাজাপাকসের ছেলেই Namal Rajapaksa প্রেসিডেন্টশিয়াল ক্যান্ডিডেট হচ্ছেন এবং তার সমর্থনও কম নয়। তাহলে কি দাড়ালো? দাড়ালো যে, যারা প্রায় দেড় বছর আগে শ্রীলংকায় মানুষের বিরুদ্ধে এতো তান্ডব, এতো জুলুম করলো সেই তাদেরই ঘরের এক সদস্য পুনরায় রাজনিতিতে ফিরে এসে ক্ষমতার জন্য লড়াই করছে। হয়তো জয়ীও হয়ে যেতে পারে। যেখানে বলা হয়েছিলো বা ধারনা করা হয়েছিলো যে, রাজাপাকসের দল শ্রীলংকায় আবারো রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারে কিনা সন্দেহ।

এই উপরের বাস্তবতার নীরিক্ষে যদি আমি এবার আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করি, একটা প্রায় সমান আন্দোলন, সমান অভ্যুত্থান, সমান বিদ্রোহই হয়েছে বলে বলা যায়। আর এই গন অভ্যুত্থানে আগের হাসিনা রিজিমের সব মন্ত্রী মিনিষতার, এম পি, সচীব, প্রশাসনের হোমড়া চোমড়াও এক যুগে পালিয়ে গেছে এবং তাদের নেতা কর্মিরাও আত্তগোপনে রয়েছে। বড় বড় হোমরা চোমড়ারা কেউ কেউ দেশের বাইরে চলে যেতে পারলেও প্রায় শতভাগ কর্মীরা দেশের ভিতরেই গোপনে অবস্থান করছে। ধারনা করা হচ্ছে-এই আওয়ামিলীগ আগামি ২০/৩০ বছরের মধ্যে হয়তো আর রাজনিতিই করতে পারে কিনা সন্দেহ।

আমি ঠিক এই জায়গাতার সাথে একমত নই।

বাংলাদেশ আর শ্রীলংকান জন গোষ্টির মধ্যে অনেক তফাত আছে। ওরা শতভাগ শিক্ষিত এক জাতী, তাদের মধ্যে নৈতিকতার ব্যাপারটা আমাদের থেকে অনেক মাত্রায় ভিন্ন। ওরা সহজেই উত্তেজিত আর অস্থির হয়ে উঠে না। তারা বেশিরভাগ মানুষেরাই লজিকের মধ্যে বসবাস করে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের মানুষেরা যেটুকুই শিক্ষিত সেটাও সুশিক্ষিত না, একেবারে অস্থির একটা আবেগী জাতি। কখন যে তার মেজাজ উগ্র হয় আর কখন যে আবার আবেগীত হয় এটা একেবারেই সহজে বুঝা যায় না। টাকার লোভে, সম্পত্তির লোভে কিংবা বেনিফিটের লোভে আমাদের দেশের মানুষেরা এক নিমিষের মধ্যেই ভোল পালটে ফেলতে পারে। ফলে কাউকেই চরম্ভাবে বিশ্বাস করা যায় না। যে আজকে আমার পক্ষে আছে, আগামী এক ঘন্টা পরে সে আমার পক্ষে আছে কিনা আমি নিশ্চিত দিয়ে বলতে পারবো না। যাকে আপনি সৎ, ন্যায় এবং সাহসী ভেবে কাছে টেনে নেবেন, হয়তো দেখবেন আগামিকাল তার কন্ঠে সেই সুর যার অর্থ এক রকম অসৎ, অন্যায় এবং নিসচুপ। আওয়ামিলীগের হাতে এখন এতো টাকা এতো টাকা যে, প্রতিটি বাংগালীকে তারা কিনে ফেলার সামর্থ আছে।

দেশে এখন আওয়ামিলিগের বিপক্ষে কথা বলছে বটে কিন্তু এই ঢেউটা খুব দ্রুত থেমে যাবে যখন দেখা যাবে বি এন পি নির্বাচনের আগেই সেই পুরান চেহারায় ফিরবে, যেমন জমি দখল, বাড়ি দখল, রাস্তা দখল, চেয়ার দখল, ঘাট দখল, স্কুল কলেজ দখল ইত্যাদি। যা এখনই চোখে দৃশ্যমান। যে সংস্কারের কথা আমরা বারবার শুনে এসে আন্দোলন করেছি, সেই সংস্কার তো হবেই না, বরং একটা ক্ষুধার্থ দলকে নতুন করে তাদের পেট ভরানর জন্য ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া। সাধারন মানুষ আবারো হতাশ হবে। আজ থেকে ১৫ বছর আগে তো এই বি এন পি কেই মানুষ আরেকটা গন অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই ক্ষমতা থেকে নামিয়েছিলো, সেই তাদের চেহারা কি আদৌ পাল্টেছে? একদমই পালটায় নাই। এখন তারাই আবার সেই আগের চেহারায় ক্ষমতার স্বপ্ন দেখছে। নির্বাচনের আগেই তারা যা শুরু করছে বা করেছে সেতার সংকেত কিছুতেই ভাল লক্ষন নয়।

আর এই পরিস্থিতিটাই তো চাচ্ছে আওয়ামিলীগ।

এর আগে আরেকটা কথা না বললেই নয়। ১৯৭৫ সালের শেখ মুজিবকে হত্যা করার পর বাংলাদেশে সব গ্রামে গঞ্জে এক প্রকার আনন্দ উল্লাস চলেছিলো। কারন সেই সময়ের আওয়ামীলীগ বাংলাদেশের মানুষের উপর অনেক রকমের অত্যাচার, জুলুম, রাহাজানি করতে করতে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। মানুষ চেয়েছিলো আওয়ামিলীগের শাসন থেকে মুক্ত হোক। শেখ মুজিবের লাশটা পর্যন্ত মানুষ তার বারি থেকে উঠিয়ে নিয়ে কবর দিতে চায়নি। তখনো আওয়ামিলিগের নেতা কর্মীরা গোপনে চলে গিয়েছিলো। কোথাও তাদের কোন রাজনৈতিক কর্মকান্ড করতে দেখা যায়নি। অথচ ১৯৮১ সালে যখন বাংলাদেশে শেখ মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে, তখন এদেশের আওয়ামিলিগ সমর্থিত এবং কিছু নতুন সমর্থকরা সবচেয়ে বড় শো দাউন করে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে বরন করে নেয়। মাত্র ৬ বছরের ব্যবধান। এর পরের ঘটনা আমাদের সবার জানা। শেখা হাসিনা এদেশ শাসন করে প্রায় ২০ বছর।

তখন মিডিয়া এতো স্ট্রং ছিলো না, মানুষ যতটুকু পত্রকা পড়ে কিংবা টিভি দেখে তথ্য পেতো তার মধ্যেই এই সময়টায় আওয়ামীলিগ তাদের অবস্থান শক্ত করে ফেলতে পেরেছিলো। ভারত কিংবা যারা আওয়ামিলিগকে সমর্থন করতো পিছনে পিছনে, তারাও যতটুকু পেরেছে তথ্যের মাধ্যমে আওয়ামিলীগকে স্ত্রং পজিশনে আনার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত কিন্তু এদেশের জনসাধারনের মাইন্ড পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলো। তার পিছনে আরেকতা কারনঅ ছিলো যে, তখনকার রুলিং পার্টিও জনবান্ধব ছিলো না। তাই সরকারকে উৎখাত করতে ভারতের কিংবা আওয়ামিলীগের জন্য প্লাস পয়েন্ট ছিল। বর্তমানে অবাধ তথ্য প্রবাহ, সোস্যাল মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে তথ্য দেয়। এখন জনমত গঠন করা আরো সহজ।

বর্তমান ইন্টেরিম সরকার যেভাবে সংস্কার করার পথ বেছে নিয়েছেন, তাতে সব সেক্টর এক নাগারে তোলপাড়। ব্যাংকিং খাতে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনিতে, আমদানি রপ্তানী সেক্টরে, প্রশাসনে, শিক্ষা খাতে, মিডিয়া খাতে ইত্যাদি সব খাতে একটা অরাজকতা বিরাজ করছে। হুর হুর করে দ্রব্যের মুল্য বাড়ছে, চাহিদার তুলনায় যোগান কমে যাচ্ছে, প্রশাসনে স্থবিরতা বাড়ছে, ক্যাডারে ক্যাডারে বৈষম্য বাড়ছে, অবসরীদেরকে আবারো পদায়ন চলছে। একটা হযবল্রল অবস্থা। ওই যে বললাম, এদেশের মানুষ খুব অস্থির এবং আবেগী। এবার সেই অস্থরতা আর আবেগের স্থানটি নিয়ে খেলতে চাইবে আওয়ামিলিগ এবং আওয়ামিলিগ সমর্থিত রাষ্ট্র বন্ধুগুলি। বিশেষ করে ইন্ডিয়া।

ইন্ডিয়া বাংলাদেশের কাছে অনেক কিছুতেই ধরা নাই শুধুমাত্র তার ৭-সিস্টার্স ছাড়া। কিন্তু বাংলাদেশ ইন্ডিয়া লকড একটা দেশ হওয়ায় আমরা অনেক কিছুতেই ইন্ডিয়া নির্ভর।  আমদানি করি রপ্তানির প্রায় ১০ গুন বেশী। কাচামাল, খাদ্য পন্ন, টেক্টটাইল কাচামাল, আরো অনেক কিছু। কোন কারনে যদি ইন্ডিয়া আমাদেরকে এসব পন্য রপ্তানী না করে আমাদেরকে আরো বহু মুল্যে অন্য দেশ থেকে এসব কাচামাল, পন্য আমদানি করতে হবে। হয়তো সেটাও সমস্যা ছিল না যদি আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালি হত। সেখানেও আমাদের ভঙ্গুর অবস্থা। এর ফলে মানুষের ভোগান্তি ধীরে ধীরে চরমে উঠবে, মানুষ বর্তমান ইন্টেরিম সরকারের উপর ক্ষেপে যাবে, আবার একতা আন্দলন হতে পারে। আর এই আন্দলনে সবার সাথে গোপনে লুকিয়ে থাকা যুবলিগ, ছাত্রলীগ, আওয়ামীলিগ সংযুক্ত হবে সাধারন মানুষের বেশে। মানুষ ধীরে ধীরে আবেগ থেকে যখন সরে আসবে, কে জানে তখন হয়তো শেখ হাসি নয়, তাদেরই আরেকতা সদস্য আওয়ামিলিগের হাল ধরে আবারো রাজনিতিতে প্রবেশ করবে। যে আওয়ামিলিগকে এই মুহুর্তে আমরা ভাবছি কয়েক যুগ পরে হয়তো আবার রাজনীতিতে আসতে পারতো সেটা না হয়ে অচিরেই তাদের আবার পদার্পন হবে।