Categories
গত ২৩/১১/১৯৯৭ থেকে ছয় দিনের শিক্ষা সফরে মীরপুর ষ্টাফ কলেজ থেকে দেশী-বিদেশী ছাত্রদের নিয়ে আমরা পাশের দেশ ভারতে গিয়েছিলাম। আমাদের ষ্টাফ কলেজের ব্যাচে প্রায় শতাধিক ছাত্র বিধায় ছাত্রদেরকে তিনটি গ্রুপ করে ভাগ করা হয়েছে। কেউ কেউ ভারত, কেউ কেউ শ্রীলংকা আবার কেউ কেউ নেপাল। এটাই ষ্টাফ কলেজ থেকে প্রথম শিক্ষা সফর দেশের বাইরে। আর এটা এ বছরই চালু হলো। আমি ভারতে যাওয়ার চয়েজ দিয়েছিলাম। সে মোতাবেক গত ২৩ নভেম্বরে আমরা প্রায় ৩৭ জন স্টুডেন্ট ভারতের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করলাম। আমাদের সাথে আছেন ডিএস (ডাইরেক্টিং ষ্টাফ) লেঃ কর্নেল শফিক, লেঃ কর্নেল তানভীর, চীফ ইন্সট্রাকটর কর্নেল জহির, চীফ ইন্সট্রাকটর মইন ইউ আহমেদ এবং আরো কিছু। আমাদের শিক্ষা সফরটা একটা ডিপ্লোমেটিক ভিজিট হিসাবে গন্য ছিলো। আগে থেকে আমাদের বেশ কিছু অফিশিয়াল ভিজিট কনফার্ম করা ছিলো।
আমরা সকাল বেলায় যার যার ব্যাগ পেটরা নিয়ে জিয়া ইন্টার ন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম। ষ্টাফ কলেজ থেকে বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। ভারতে এটাই আমার প্রথম ভ্রমন। ভারতে গন্ডোগোল চলছে। বেশ ভালই গন্ডোগোল। কিন্তু তাতে আমরা শংকিত নই। আমাদেরকে প্রোটেকশন দেয়া ভারত সরকারের দায়িত্ত। আমরা কলকাতার গ্রান্ড হোটেল "হোটেল ইন" এ সবাই উঠেছি। কলকাতার পরিবেশ মূটামূটি ভালো। শান্ত। একটা জিনিষ খেয়াল করলাম যে, কলকাতা আর আমাদের ঢাকার গুলিস্থানের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নাই। সব জায়গায় বাংলা কথা বলার লোক। খায়ও বাংগালীদের মতো ডাল ভাত। তবে এখানে ঢোশাটা বেশ জনপ্রিয়। আমাদের হোটেলের পাশেই একটা সিনেমা হল আছে। ওখানে "দিল তো পাগল হ্যা" ছবিটি মাত্র রিলিজ হয়েছে। ৮ম লং কোর্ষের মেজর মোর্শেদ স্যার আমাদের স্টুডেন্ট কোঅর্ডিনেটরের কাজ করছেন। তাকে সাহাজ্য করছেন ৯ম লং কোর্ষের মেজর হক স্যার। কঠিন লোক বটে। সন্ধ্যা হতে না হতেই ডাক পড়লো যে, রাত আটটায় আমরা ইন্ডিয়ার ডিফেন্স এটাচির আমন্ত্রনে তার অফিশিয়াল বাসভবনে যেতে হবে। ড্রেস হবে সিরিমনিয়াল। মানে এসডি (সার্ভিস ড্রেস)। তড়িঘড়ি করে রেডি হতে হলো। বেশী দূর নয়, মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। পড়ে বুঝলাম, আসলে এটা ডিফেন্স এটাচির বাসা নয়, এটা এয়ারফোর্সের একটা মেস।
পৃথিবীর সকল আর্মির আস্তানাগুলি প্রায় একই ড্রিল অনুসরন করে। মেস ওয়েটারগন আমাদের দেশের মেস ওয়েটারদের মতোই ড্রেস আপ করা, মেসগুলিও প্রায় একই প্যাটার্নের, কালচার বা প্রাকটিসও তাই। ইন্ডিয়ার বেশ কিছু হাই অফিশিয়াল আমাদের উদ্ধ্যশ্যে কিছু কথা বললেন বটে কিন্তু কি বললেন, ভালো মতো বুঝাও গেলো না। আমরা অনেকেই যার যার গল্পে মশগুল ছিলাম। এরমধ্যে ধীরে ধীরে খাবার আসতে লাগলো, সফট ড্রিংক্স, হট ড্রিংক্স, সবই ছিলো। যে যার মতো যা খুশি খেতে পারেন। কোনো বাধা নাই। এর মধ্যে একজন মেস ওয়েটারের সাথে কথা হলো, নাম, জামিলুর। তার বাড়ি বাংলাদেশের চাপাইনবাবগঞ্জে। সে নাকি আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে তার বাবার সাথে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছিলো, আর বাংলাদেশে যায় নাই। এখন সে এয়ারফোর্স মেসে মেস ওয়েটারের কাজ করে। বাংলাদেশী কিছু অফিসার বেড়াতে এসেছে এখানে, তাতেই তার অনেক আনন্দ। যেনো বাড়ির মেহমান এসেছে বহুদিন পর।
রাতে ডিনার শেষ হলো। অনেক অফিসাররা ফ্রিতে বিয়ার আর মদ পেয়ে নাক ডুবিয়ে যেনো খেয়েই যাচ্ছিলো। রাত প্রায় সারে দশটায় আমাদের অনুষ্ঠান শেষ হলো। ফিরে এলাম হোটেলে। আমি, মেজর আকবর, মেজর আফতাব আর নাইজেরিয়ার মেজর লালা একরুমে থাকি। হটাত দেখি, কিছু অফিসার এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছেন। জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপারটা কি? পড়ে শুনলাম, কিছু অফিসাররা পাশের সিনেমা হলে 'দিল তো পাগল হায়" দেখার জন্যে যাচ্ছেন। এতো রাতে আবার সিনেমা? যাক, অসুবিধা নাই। আমি আর গেলাম না। তার কিছুক্ষন পর আবার একটা কেওয়াস শুনলাম। অফিসাররা সিনেমা হলে গিয়ে গেঞ্জাম করেছেন। কারন ইতিমধ্যে হলে সিনেমা শুরু হয়ে গিয়েছিলো, আবার কোনো সিটও খালি ছিলো না। তারা অনেকটা মাতাল অবস্থাতেই সিনেমা হলের ম্যানেজারকে জোর জবরদস্তি করে হলে ঢোকে সিনেমা দেখবেনই এই রকমের নাকি একটা আচরন করেছেন, যা অফিশিয়াল অভিযোগ হিসাবে ইতিমধ্যে দাখিল হওয়াতে বাংলাদেশের একজন দুতাবাসের কর্মকর্তা (নাম মেজর ফজলে আকবর) মধ্যস্ততা করে ব্যাপারটা মিটিয়ে দিয়েছেন। খুব দুক্ষজনক ব্যাপারটা। নতুন আদেশ জারী হলো যে, কোর্স ডিএস এর অনুমতি ছাড়া কেউ অযথা বাইরে যেতে পারবেন না। কিন্তু কেউ কি কারো কথা শুনে?
পরেরদিন আমাদের ভিজিট ছিলো ফোর্ট উইউলিয়াম দুর্গে। সকাল ১১ টায় সেখানে যেতে হবে। আমরা তার আগেই সেখানে পৌঁছে গেলাম। আগে অনেক নাম শুনেছি। কিন্তু এবার দেখলাম দূর্গ কি জিনিষ। চারিপাশ প্রায় ২০/২৫ ফুট উচু দেয়াল ঘেরা এবং দেয়ালের প্রশস্থতা প্রায় ৩০/৪০ ফুট। যার দ্বারা প্রচুর গাড়ি ঘোড়া চলে। ভিতরে দালান কোঠা সেই ব্রিটিশ আমলের। একেকটা বিল্ডিং এর উচ্চতা প্রায় ২০ ফুটের মতো। ফ্যানগুলি অনেক লম্বা লম্বা ডান্ডা দিয়ে ঝুলানো। প্রচুর গাছপালা। কমান্ডার ইন চীফ এলেন প্রায় একটার দিকে। নিজে আর তার এডিসি। কোনো ড্রাইভার দেখলাম না। তার নিজের গাড়িতেই স্টার আছে, সাথে আছে এম্বুলেন্সের মতো হর্ন। এডিসি গাড়ি ড্রাইভ করে এলেন, আর সেকেন্ড সিটার হলেন কমান্ডার। শীখ মানুষ। বেশ ফর্সা। অদ্ভুদ লাগলো ব্যাপারটা। আমাদের দেশে হলে গাড়ির বহরে আর এমপির গাড়ির ঠেলায় ভীর লেগে যেতো, কিন্তু এতো বড় অফিসার এলেন তাও আবার মাত্র এডিসি আর তিনি নিজে। ড্রাইভার ও নাই। ঘুরে ঘুরে বিল্ডিংগুলি আর আশপাশ দেখছিলাম। অফিসারদের থাকার জায়গাগুলিও বেশ অদ্ভুদ। এখানে যিনি ইনচার্জ, তার কোনো এসি রুম নাই। তবে গরমের দিনে যেনো পরিবেশ ঠান্ডা থাকে তার জন্য এক ধরনের পানির পাইপের মাধ্যমে সারাক্ষন পানির সঞ্চালন করে থাকে, তাতে বাতাস ঠান্ডা থাকে। আর আমাদের দেশ হলে তো এসির কারনেই পরিবেশ গরম হয়ে যেতো যদিও কমান্ডার নিজে ঠান্দায় থাকতেন। ইন্ডিয়া কেনো বড় হবে না? তাদের প্রতিটি কাজের মধ্যে ইকোনোমিক্যাল একটা বাজেট থাকে। এই যেমন কমান্ডার যখন এলেন, তিনি ইন্ডিয়ায় তৈরী মার্সিডিস গাড়িই নিয়ে এলেন। সেটা আবার এসি করা নয়। আর আমাদের দেশে তো জাপানিজ এসি গাড়ি না হলেই তার মান সম্মান থাকে না।
৩য় দিনে আমাদের যাওয়ার কথা দিল্লী। কিন্তু ভারত জুড়ে এতো গন্দগোল যে, আমরা যাবো কিভাবে সেটাই এখন বড় ধরনের প্রশ্ন হয়ে দাড়িয়েছে। বিজেপি, এক ধরনের বক্তব্য, কংগ্রেস আরেক ধরনের পালটাপাল্টি বক্তব্য এবং রামাবাই কিলিং নিয়ে অনেক বিতর্কিত আলোচনা টিভি জুড়ে চলছেই। আমাদের যাওয়ার কথা ছিল এয়ারপোর্ট হয়ে দিল্লিতে কিন্তু একেক বার একেক সংবাদ আসায় আমাদের মুড অফ জার্নি নিয়ে একটা অচলবস্থা তৈরী হলো। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো যে, আমরা বাসে করে কলকাতা থেকে দিল্লী যাবো। প্রায় ২২ ঘন্তার জার্নি। কলকাতা থেকে আমরা বাসে করে দিল্লী রওয়ানা হলাম। রাস্তা বেশ ভালো কিন্তু বেশ ফাকাও। আমাদের প্রোটেকসনের জন্য ইন্ডিয়ান আর্মির স্কট ছিলো, আর ছিলো হেলিকপ্টার দিয়ে আকাশ পথে টহলের ব্যবস্থা। প্রায় সন্ধ্যার দিকে দিল্লীতে পৌঁছলাম। হোটেল "সেরেনা" তে আমাদের থাকার জায়গা।
দিল্লীর শহর আসলেই আধুনিক একটা শহর। লাইফ যথেষ্ট পরিমান ফাষ্ট। দিল্লীতে ডিফেন্স মিনিশট্রি থেকে আমাদের জন্য একটা ভিজিট রেখেছেন। তাদের ডিফেন্স মিনিশট্রারের প্রতিনিধি আমাদের ব্রিফ করবেন। আমাদেরকে ডেকে আমাদের ডিএস জানালেন, আমরা যেনো কোন সেনসেটিভ প্রশ্ন না করি। এখানে আমরা ডিপ্লোমেটিক আলোচনায় আসিনি, তাই এমন কোনো প্রশ্ন যেনো আমরা না করি যাতে পরিবেশ অন্যদিকে টার্ন নেয়। কিন্তু কাজের বেলায় ঠিক সে রকম হয় নাই। মেজর হক স্যার এমন এক প্রশ্ন করে বসলেন, যা কিনা বেশ ভালই বিতর্কের জোগান দেয়। সেটা আর এখানে নাইবা বললাম। পড়ে এক সময় আবার বলা যাবে। আমরা দিল্লী ঘুরে বেড়ালাম। "ভাই" টেমপলে গেলাম। জায়গাটা বেশ সুন্দর। "ভাই টেমপল"টা হচ্ছে তিন ধর্মের জন্য একটা কমন প্রার্থনার স্থান। অদ্ভুত কন্সেপ্ট। এটা নাকি সম্রাট আকবরের সময় করা। ইন্ডিয়া গেট দেখলাম। এই জায়গায় ইন্ডিয়ার সব রাজনৈতিক নেতাদের বসবাস।
দিল্লী থেকে আমরা পরের দুপুরে আগ্রায় গেলাম। আগ্রায় "আকবরিয়া" হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা যখন বাস থেকে নামলাম, তখন একদল বাদ্যবাদক ড্রাম, পাইপার বাজিয়ে আমাদেরকে অভিবাধন জানালেন। দেখলাম, হোটেলের ঠিক সামনেই বিশাল করে ফুল আর ফুলের পাপড়ি দিয়ে ওয়েলকাম বাংলাদেশ লেখা। ভালো লাগলো। আমাদের বাক্সপেটরা নিয়ে গেলেন হোটেলের কর্মচারীরা। আসলে এটা ছিলো সম্রাট আকবরের নিজস্ব প্যালেস। এই প্রথম আমার জিবনে কোনো প্যালেসে রাত্রিজাপন করবো।
সম্রাট আকবরের প্যালেসটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বিশাল বিশাল রুম। খুবই সুন্দর। আমাদের আসার কারনে এখানে কোন গেষ্ট এলাউ করেনি সরকার। মানে শুধু আমরাই থাকবো এখানে দুই দিন আর এক রাত। আমরা জমায়েত হলাম সম্রাট আকবরের খাস কামরা সেটা ছিলো সেখানে। গিয়ে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। ওখানে যে ঝাড় বাতিটা আছে সেটার সাইজ প্রায় ডাবল রুমেরও বড়। আর এটার যে ডান্ডাটা সেটা একটা বিশাল পিলারের সমান। এই খাস কামরার যাওয়ার পর যেটা দেখালাম, এর পাশ দিয়ে একটা বেশ চওড়া রাস্তা গেছে, যার হাইট একটা লম্বা মানুষের সমান উচ্চতা। জিজ্ঞেস করলাম, এই রাস্তাটা কেনো যেখানে আরো রাস্তা বা প্রবেশ দ্বার আছে? আমাদের যে গাইড ছিলেন, তিনি বললেন যে, সম্রাট যখন হেরেমে বসতেন, তখন কোনো কারনে যদি তার রানী এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয় তাহলে এই হেরেম খানায় কি ঘটছে সেটা যেনো তার নজরে না আসে, সেই জন্য শুধুমাত্র রানির ব্যবহারের জন্য এই উচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা রাস্তাটা তৈরী। বুঝলাম, এমনি এম্নিতেই তো আর আকবর সাহেব সম্রাট হন নাই।রাতেই আগ্রার অনেক জায়গা ঘুরলাম। কিন্তু বেশী রাত হয়ে যাচ্ছে বলে বেশী দূর যাওয়া হচ্ছিলো না। রাতেই আবার আকবরিয়ায় ফিরে এলাম। আগামীকাল গাইড আমাদেরকে তাজমহল এবং আগ্রার আরো কিছু জায়গা আমাদের দেখাবেন। সকালেই আমাদের ভিজিট শুরু হবে। প্রথমে তাজমহল দিয়ে।