২৯/৪/২০২২-ইউক্রেন যুদ্ধ সমাচার 

অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানগন (বিশেষ করে ইইউ, ইউকে, ফ্রান্স, জার্মানী অথবা ইউএস ইত্যাদি) তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা হয়তো একটা টেনিউর অথবা সর্বোচ্চ দুইটা টেনিউর। অনেকের আবার ২য় টেনিউরে রাষ্ট্রপ্রধান হবেন কিনা সে চিন্তায় সারাক্ষন কি কি করা যায়, কিভাবে কি পলিশি করলে ভোট বেশী পাওয়া যাবে তার মহাচিন্তায় মহাপরিকল্পনা করতে থাকেন। গ্লোবাল রাজনীতির থেকে নিজের জন্য রাজনীতিই বেশী করেন। অথচ রাশিয়ার পুতিন গত ২২ বছর যাবত প্রেসিডেন্ট হিসাবে তো বহাল আছেনই, তার উপর আগামী আরো ১৪ বছর তার প্রেসিডেন্সীর নিশ্চয়তাও রয়েছে। তারমানে ৩৬ বছরের একনাগাড়ের প্রেসিডেন্ট মিঃ পুতিন সাহেব। এমন একটা ঝানু রাজনীতিবিদ কি একেবারে কোনো হোমওয়ার্ক ছাড়া একা সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে খেলতে নামবে, এটা কি বিশ্বাস করা যায়? যত যাইই হোক, পুতিন এই ইউক্রেন যুদ্ধে হারার জন্য নামে নি, আর যুসশটা কতদিন চালাবে এটার সম্পুর্ন কন্ট্রোল আসলে পুতিনের হাতেই। আরো কিছু মাহাত্য তো আছেই।

ইউক্রেন আক্রমনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করিনা। কিন্তু জুলুমের রাজত্তে যখন কেউ না কেউ অধিক শক্তিশালী রাজ্য দারা প্রতিনিয়ত শোষিত হয়, তখন শোষকদের উপর কেউ জুলুম করলে সেটা অনেকটা মনের অজান্তেই সমর্থন পাওয়া শুরু করে যদিও আক্ষরিক অর্থে তা সমর্থনযোগ্য নয়। রাশিয়াকে সাপোর্ট করার পিছনে বেশীরভাগ মানুষের মনের ভাবটা ঠিক এইরকম। যাই হোক, ইউক্রেন যুদ্ধের কিছু আভাষ আমি পূর্বেই লিখেছিলাম, এবার মনে হচ্ছে সেগুলির বেশ কিছু নিদর্শন বাস্তবে প্রকাশ হতে শুরু করেছে। সেই পরিবর্তনগুলি কিঃ

ক।       ইউনিপোলার ওয়ার্ড অর্ডার পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন হয়তো ট্রাঞ্জিশন পিরিয়ড চলছে বলে বলা যায়।  

খ।        ডলার কারেন্সীর একচ্ছত্র রাজত্ব খুব অচীরেই শেষ হতে যাচ্ছে। পেট্রোডলারের যে রাজনীতি সারা দুনিয়ায় একচ্ছত্র দাদাগিরি চালিয়ে একটা ভারসাম্যহীন      অর্থনীতির বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো, সেটার প্রায় বিলুপ্তির সূচনা শুরু হয়ে গেছে।

গ।        মানি সিস্টেমের যে “সুইফট ব্যবস্থাপনা” সারাটা দুনিয়ায় প্রতিটি দেশকে জালের মতো একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে সবাইকে আটকে ফেলেছিলো, সেটা থেকেও দেশগুলি বিকল্প পথ পেয়ে যাচ্ছে।

ঘ।        পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার অর্থনৈতিক বলয়ে যতটা আঘাত হানার কথা ভাবা হয়েছিলো, ততোটা কিন্তু আঘাত হানতে পারেনি। রুবল সেই ধাক্কাটা প্রায় কাটিয়ে উঠে যাচ্ছে। ফলে রুবল একটা শক্তিশালী কারেন্সী হিসাবে আবির্ভুত হতে যাচ্ছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল কি ?

ক।       আমেরিকার প্রাথমিক ইনিশিয়াটিভে ন্যাটো যতোটা তাদের মধ্যে হুজুগে পড়ে বন্ডেড হয়েছিলো, এখন সেই ন্যাটো সদস্যদের মধ্যেই বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। কারন প্রতিটি দেশের চাহিদা আলাদা আলাদা। একটি দেশের মুলনীতি, মুল চাহিদা, মুল কাঠামোর সাথে অন্য যে কোনো দেশের মুলনীতি, মুল চাহিদা বা মুল কাঠামোর মধ্যে তফাত থাকেই। আর সেই তফাতের কারনেই একেক দেশের ভূমিকা একেক পরিস্থিতিতে একেক রকম হবে। প্রাথমিক হুজুগের বলয় থেকে বেরিয়ে যখন বাস্তবতায় দেশগুলি চোখ খুল্লো, তখন দেখা গেলো, নিজের দেশের জনগনের জন্য প্রয়োজনীয় তেল, গ্যাস, খাবার, কিংবা মৌলিক চাহিদার যোগানের জন্য যা দরকার আর যেখানে এটা আছে সেটার উপরেই তারা পুর্বান্নে নিষধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। আর সেই নিষ্রধাজ্ঞা যেনো এখন বুমেরাং হয়ে নিজেদেরকে আঘাত করছে। এর ফলে যা হচ্ছে- ন্যাটোর মধ্যেই একে অপরের উপর আস্থা কমে যাচ্ছে। এরা এখন আর আগের মতো দল বেধে মিটিং, সেমিনার, কিংবা দ্বি পাক্ষীয়, তৃপাক্ষীয় ক্লোজডোর বৈঠক করছে না। ভাটা পড়েছে সব কিছুতেই। এই অনাস্থার অনুপাতটা আরো বাড়বে দিনে দিনে।

খ।        জেলেনেস্কী বারবার সারা দুনিয়াকে রাশিয়ার তেল, গ্যাস ইত্যাদি না নিতে অনুরোধ করছে, নিষেধাজ্ঞায় রাখতে বলছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, জেলেনেস্কির এতো আকুতি মিনতি করে এই নিষেধাজ্ঞা পালনে কাউকে এতো অনুরোধ করার দরকার ছিলো না যদি সে নিজেই ইউক্রেনের উপর দিয়ে রাশিয়ার পাইপলাইন গুলিকে অকেজো করে দিতো। পাইপলাইনই যদি সচল না থাকে, নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও কেউ রাশিয়া থেকে তেল/গ্যাস নিতে পারতো না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে-জেলেনেস্কী তাহলে ইউক্রেনের উপর দিয়ে প্রবাহিত তেল/গ্যাস লাইন/পাইপ লাইন ধংশ করে দিলো না কেনো? এর কারন একটাই-যদি জেলেনেস্কী এই কাজটা করতো, তাহলে ইইউ নিজেই ইউক্রেনকে ধংশ করে দিতো। আর ২য় কারনটা হচ্ছে, জেলেনেস্কী নিজেও ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক লোকসানে পড়ত। তাই জেলেনেস্কী কোনোটাই করে নাই, এবং ইইউ নিজেও ইউক্রেনের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত রাশিয়ান পাইপ লাইনকে সবসময় সুরক্ষা দিয়ে সাপ্লাই সচল রেখেছে।

গ।         রাশিয়া কিন্তু তার অস্ত্র ভান্ডারের কিছুই আপাতত ব্যবহার করে নাই। বিশেষ করে আধুনিক যন্ত্রপাতী। যা করেছে সেটা নেহায়েতই একটা অবসলিট এবং পুরানো দিনের জাঙ্ক মেশিনারিজ দিয়ে। রাশিয়া এই ইউক্রেন যুদ্ধটা এখনই শেষ করতে চাইবে না। কারনঃ

(১)        রাশিয়া পেট্রোডলার কারেন্সী শেষ করে নিজেদের কারেন্সী বা চায়নিজ-রুবল-রুপি ইত্যাদির সমন্নয়ে একটা কারেন্সী প্রতিস্থাপিত না করা অবধি পুতিন ইউক্রেনের যুদ্ধটা চালিয়ে যাবে। আর এর মধ্যে দেয়া তার সেই সব পয়েন্ট তো আছেই যা সে উল্লেখ করেছে- নিউ নাৎসি, মিলিটারাইজেশন ইত্যাদি।

(২)        আগামী শীত হবে ইইউর জন্য একটা বিপর্যয়। কারন উক্ত শীতে রাশিয়ার তেল এবং গ্যাস, গম, যব, সিরিয়াল ইত্যাদির অভাবে ইইউর উপর একটা বিপর্যয় নেমে আসবে। তখন হয় ইইউ রুবলেই ট্রেড করবে, অথবা জনগন সাফার করবে। তাতে প্রতিটি দেশে বিক্ষোভ হবার সম্ভাবনা এবং তখন নেতারা নিজেদের গদি নিয়ে হুমকীর মধ্যে থাকবেন।

(৩)       এমতাবস্থায় সবাই ইউক্রেনকেই তাদের জীবন বিপর্য্যের কারন হিসাবে দায়ী করবে। ভুলে যাবে মানবতা, রিফুজিরাও সেই দেশ থেকে বিতাড়িত হবার সম্ভাবনা থাকবে। জেলেনেস্কী আত্তগোপনে চলে যাবেন, রাশিয়া তার নিজের পছন্দমত সরকার প্রতিস্থাপন করবেন। সেই সরকার এসে হয়তো রাশিয়াকে আবার আগের মতো সব কিছু করতে বলবেন যাতে ইইউর সাথে আবার সাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠে।   

কে কি ভুল করছে বলে মনে হয়ঃ

ক।       ওয়ার্শো ভেংগে যাবার পরে আসলে রাশিয়া কখনোই ইইউ অথবা আমেরিকার শত্রু ছিলো না। রাশিয়া অনেকটা ইউরোপের ধাচেই এগিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু আমেরিকা সর্বদা রাশিয়াকে তার চিরশত্রুই মনে করে। আসলে আমেরিকার শত্রু চিনতেও ভুল হয়েছে। তার শত্রু চীন, রাশিয়া নয়। তাই রাশিয়াকে ওর দলে নিয়ে চীনকে মোকাবেলা করা উচিত ছিলো আমেরিকার। ইউক্রেনকে দিয়ে অযথা রাশিয়ার গলায় পারা দেয়া আমেরিকার ঠিক হয় নাই। এতে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে চীন। আর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আমেরিকা এবং ইইউ ।

খ।        রাশিয়া যখন ন্যাটোর সদস্যপদ চেয়েছিলো, ন্যাটোর উচিত ছিলো রাশিয়াকে সদস্যপদ দেয়া। যদি সেই সদস্যপদ দিতো, তাহলে আজকে ইউরোপ থাকতো সবচেয়ে নিরাপদে, চীন থাকতো সবচেয়ে চাপে। এশিয়াও থাকতো চাপের মধ্যে। রাশিয়াকে ইচ্ছে করেই আমেরিকা সদস্যপদ দিতে চায় নাই। এটা একটা মারাত্তক ভুল ছিলো।

গ।        ইউক্রেন যুদ্ধে জেলেনেস্কী আসলে ইউক্রেনের মংগল কামনা করে নাই। যখন যুদ্ধশেষে ইউক্রেনের চিন্তাবিদেরা এই যুদ্ধের আগাগোরা নিয়ে বিশ্লেষন করবেন, তখন দেখা আযবে যে, জেলেনেস্কী আসলে ছিলো রাজাকার প্রেসিডেন্ট। আজকে তাকে ;হিরো’ আখ্যায়িত করলেও সব বিবেচনা করে একটা সময় আসবে যখন ইউক্রেনের মানুষেরা ‘জেলেনেস্কী’ নামটা ‘মীর জাফর’ নামের মতো হয়তো ব্যবহার করবে।