২/৬/২০১৯ –কবুতর প্রেম  

আমি যে হোটেলটায় উঠেছি, তার করিডোরে একটা জায়গা আছে যেখানে ধুমপায়ীরা লবির নীচে না গিয়েও রুমের পাশে এই জায়গায়টায় দাঁড়িয়ে ধূমপান করতে পারেন। দাড়ানোর একটু জায়গা, পাশে হাই ভোল্টেজ একটা ট্রান্সফর্মার। কাচের জানালাটা খোলা যায় না কিন্তু একটা একজষ্ট ফ্যান দেয়া আছে যার মাধ্যমে সিগারেটের ধোয়াগুলি সহজেই করিডোর থেকে বাইরে বেরিয়ে যায় এবং করিডোরে সিগারেটের কোনো গন্ধ আর থাকে না। হোটেলের মালিক নিশ্চয় সিগারেট খান। তাই সিগারেট পায়ীদের প্রতি তার একটা মায়া নিশ্চয়ই আছে।

ওখানে প্রথম দিন সিগারেট খেতে গিয়ে একটা মজার জিনিস চোখে পড়লো। একটা কবুতর চুপ করে বসে আছে। আমাকে সে আজই প্রথম দেখলো, তাই তার মধ্যে একটু অস্থিরতা কাজ করছিলো। পাখীরা যখন ঘুমায় তারা ঘন ঘন চোখ মেলে আবার চোখ খোলে। তাতে তাদের কতটা ভালো ঘুম হয় তা আমি জানি না। পর পর দুটু সিগারেট খাইলাম শুধু কবুতরটাকে ভালো করে দেখার জন্য। কোনো ডিস্টার্ব করলাম না কারন ডিস্টার্ব করলে কবুতরটা হয়তো কাল থেকে আর এখানে আসবে না।

মিটুলকে নিয়ে আমি আই এল বি এস হাসপাতালে চলে গিয়েছিলাম একটু পরে। প্রায় সারাদিনই ওখানে ছিলাম। কবুতরটার কথা আর মাথায় আসে নাই। যখন আবার হোতেলে ফিরলাম, সিগারেট খেতে গিয়ে দেখি ঐ জায়গায়টায় আর কবুতরটা নাই। একটু খটকা লাগলো। সকালে আমার আচরনে কি কবুতরটা কোনো অনিরাপদ ভাব দেখেছিলো আমার কোনো আচরনে?

তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। আবারো আমি ঐ একই জায়গায় সিগারেট খেতে এসে দেখলাম এবার একটা নয়, দুটু কবুতর। সম্ভবত ওরা স্বামী স্ত্রী জোড়া। পাখার নীচ দিয়ে বুঝা যাচ্ছে পেট পুড়ে খাওয়া হয়েছে ওদের। এখন ওদের আর কোনো চিন্তা নাই। এই প্রানীকুলের মধ্যে সম্ভবত এক মাত্র মানুষই এক মাত্র প্রজাতী যাদের জন্য বড় বট অট্টালিকা লাগে, বড় বড় হাসপাতাল লাগে, বড় বড় গাড়ি ঘোড়া লাগে, বিস্তর খাবারের সমারোহ লাগে। আর অন্যান্য প্রানীদের কিছুই প্রয়োজন হয় না। তারা সকালে বেরিয়ে যায় ডানায় ভর করে, কেউ নিজের পায়ে ভর করে, সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে নিজের মনের আনন্দে স্রিষ্টিকর্তার এই বিশাল ভুবনে পেট পুরে খেয়ে রাতে নিশ্চিত মনে ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের বাচ্চাদের জন্যে ওরা কোনো কিছুই সঞ্চয় করার প্রয়োজন বোধ করে না, না প্রয়োজন বোধ করে কোনো বৃহৎ অট্টালিকা গড়ার। এদের রোগ হলে সেই বন জংগলের কোনো পাতা কিংবা খড় খেয়েই তাদের অসুখ সারিয়ে নেয়, ওদের জন্য কোনো মহামারী নাই, গায়ে ফেন্সি কোনো কাপড়ের দরকার নাই, রোধ বৃষ্টি ঝর যাইই থাকুক ওরা নিজেরাই নিজেদের মতো করে নিজকে বাচিয়ে রাখে। তারা একে অপরের সম্পত্তি দখলে যায় না, এরা এক গাছে থেকেও কারো উপর কারো শত্রুতা নাই।

আমার উপস্থিতি টের পেয়ে একটা কবুতর একটু নড়েচড়ে বস্লো, অন্যটা ঘুমের মধ্যেই যেনো পড়ে রইলো। বুঝলাম যেটা ঘুমের মধ্যে রইলো সেটা সকালে আমাকে দেখেছিলো। একটু হলেও সে হয়তো বুঝতে পেরেছিলো যে আমার থেকে ওদের কোনো অনিহা হবার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু নতুন কবুতরটা ঠিক এক ঠায়ে আমার দিকে চেয়ে থাক্লো। সে হয়তো ভাবছে, আমি কি করতে পারি কিংবা আমি কোনো ভয়ানক প্রানী কিনা।

আমি ইচ্ছে করলেও কবুতরটাকে হাত দিয়ে ধরতে পারবো না কারন আমি জানালার কাচের এ পাশে আর কবুতরগুলি জানালার কাছে ওপাশে, আর কাচটা ফিক্সড করে বন্ধ করা। আমার সিগারেট খাওয়া শেষ, তাই আবার রুমে চলে এলাম। অনেক রাতে আবার আমি যখন সিগারেট খেতে আসলাম, দেখলাম, খুব নিসচিন্তে মনে কবুতর দুটু ঘুমাচ্ছে। কিন্তু পাখীদের ৭ম ইন্দ্রিয় অনেক সেন্সেটিভ। আশেপাশে কে আছে বা কে যাচ্ছে তারা সেটা খুব সহজেই বুঝতে পারে। এবার দুটু কবুতরই একবার আড় চোখে আমাকে দেখলো বটে কিন্তু ভয়ের কোনো কারন নাই বিধায় আবার নড়ে চড়ে ঘুমিয়ে গেলো।

পরদিন বেশ সকালে সিগারেট খেতে এসে দেখি ওদের একটার ও কেউ নাই। পাখীরা আসলে আমাদের মতো নয় যে, আজ ছুটির দিন তো একটু বেশী বেলা করে ঘুমাবে বা আলসেমী করে গরাগড়ি যাবে। সকাল হলেই ওরা বেরিয়ে যায় নিয়মিত খাদ্যের খোজে, হোক সেটা শনিবার বা রবিবার। কিংবা শীত বা বর্ষা। এবার আমিও ওদেরকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় নাই, মনে মনে ভাবছিলাম যে, আমার সাথে ওদের একতা অলিখিত বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। আমি ওদের কেউ না কিন্তু আমিই ভাবছি ওরা আমার বেশ বন্ধুর মতো। পাখীদের সাথে এতো সহজে আসলে বন্ধুত্ব হয় না। এটা এমন না যে, একজন অপরিচিত মানুষকে যতটা তাড়াতাড়ি ফ্রেন্ড বানান যায়, ততোটা সহজ পাখীদের বেলায় হয় না। ওরা আসলে মানুষকে কখনো বন্ধু মনেই করে না। পোষা পাখীর বেলায় ব্যাপারটা অনেক আলাদা। তারা বশ্যতা মেনে নিয়েই মানুষের দাসত্ব করে।

সন্ধ্যায় আবার এলাম জায়গাটায়। দেখলাম, আবার তারা ফিরে এসেছে। ব্যাপারটা আমার কাছে এবার পরিষ্কার হয়ে গেলো যে, এতা ওদের আস্তানা। সকালে বেরিয়ে যায় আর সন্ধ্যা হলেই আবার তারা তাদের বাসায় ফিরে আসে। এই কবুতর গুলি যেহেতু এখানেই থাকে, ফলে ওরাও হয়তো বুঝে গেছে আমি এই জায়গার স্থায়ী বাসিন্দা নই। হয়তো কয়েকদিন থাকবো আমি, তারপর তারা জানে যে, অন্যান্য অতিথির মতো কদিন পর আমিও আর এখানে থাকবো না।

এ কয়দিন এই কবুতরটা আমার সিগারেট খাওয়ার পরিমানটা বাড়িয়ে দিয়েছে। সম্ভবত আমি এর প্রেমেই পড়ে গেছি। প্রতিদিন আমি সকালে ওদেরকে বাইরে যাওয়ার আগেই দেখতে আসি জানালাটার পাশে। সিগারেট খাই, আবার ইদানিং কফি নিয়েও আসি। যাতে বেশ কিছুক্ষন আমি কবুতরগুলির পাশে থাকতে পারি। বেশ ভালো সময় কাটছে আমার। মিটুলকে কবুতর গুলীর কথা বললাম। খুব একটা আহামরী খবর তার কাছে মনে হলো না। বল্লো, ভালই তো।

আজ রাতে যখন আমি আবার সিগারেট খেতে এলাম, ভাবলাম, ওদের ছবি নেই। খুব গোপনে মোবাইল ক্যামেরা বের করতেই মনে হলো কবুতর দুটু একটু ভয় পেয়েছে। একটা প্রায় উরাল দেয় দেয় ভাব, অন্যটা ও একটু নড়ে চড়ে বসলো। কিন্তু তার যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা মনে হলো না। ছবি তুললাম, কোন ফ্লেস ইউজ করলাম না কারন ফ্লেশ ইউজ করলে হয়তো ভয় পেতে পারে। আমি এখানে আর বেশীদিন থাকবো না, হয়তো আর মাত্র দুইদিন থাকবো। তারপর আমি আমার দেশে ফেরত যাবো। একটু মন খারাপ হচ্ছিলো যে, কবুতরগুলি আসলে আমার কেউ না কিন্তু কোথায় যেনো একতা মায়ায় ধরে গিয়েছিলো। যখন দেশে ফিরে যাবো, হয়তো আমি ইচ্ছে করলেও আর এই স্থানে এসে সিগারেট খাওয়ার বাহানা করে এই যুগল কবুতর গুলিকে দেখতে পাবো না।

কাল রাতে দেখলাম, কবুতরটা নাই। মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেলো। কেউ কি তাকে কোনো ভয় দেখিয়েছে কিনা। আজ রাতে আবার চেক করবো। রাতে আবার চেক করলাম, কবুতর গুলি আসে নাই। ভিতরে একতা কেমন যেনো কষ্টের মোচড় অনুভব করলাম। একটা সিগারেট ধরালাম, খুব ভালো করে দেখার চেষতা করলাম, আশেপাশে কোথাও কবুতরগুলি আছে কিনা। আমাদের বিল্ডিং এর পাশে আরো একটা উচু বিল্ডিনে অনেক গুলি কবুতর থাকে। তাহলে কি ওরা স্থান পরিবর্তন করেছে? কিন্তু কেনো? আগামিকাল সকাল ১২ তায় আমার হোতেল থেকে চেক আউটের সময়। বারবার কবুতর গুলির কথা মনে পড়ছিল। আমি সকালে আবার কবুতর গুলি ফিরে এসছে কিনা ওখানে গেলে দেখলাম, বাসাটা খালী কিন্তু দুটু পালক ওখানে পড়ে আছে। হাত দিয়ে ধরার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো পালক দুটিকে।

প্রেম বড় খারাপ জিনিস, হোক সেটা কোনো পাখীর সাথেই। মায়া হচ্ছে, গেলো কই কবুতরটা? কোনো বেজী কিংবা কোন শিকারী কি ওদের ধরে নিয়ে গেলো?

মন্টাই খারাপ হয়ে গেলো।