যেদিন আমি চলে আসবো বলে মনোস্থির করেছিলাম, সেদিন শ্রাবনের রাত্রি ছিলো না। কিন্তু আমার দুই চোখে ছিলো থমথমে মেঘের আভা। আমি আকাশ দেখি নাই সেই রাতে কিন্তু বুঝেছিলাম, হয়তো আকাশে একটি তারাও নাই। প্রখর ইলেক্ট্রিক লাইটে আমার মনে হচ্ছিলো আমার শরীর-মন একটি অন্ধকার ঘরের মধ্যে বন্ধী। আমার চারিপাশে কোথাও কেউ নাই। শরীরের তাপমাত্রা জরের সমান কিন্তু জর ছিলো কিনা বুঝি নাই। আমি মৃত মানুষের মতো একপাশ হয়ে সারাটা রাত কাটিয়ে দিলাম। সকাল হলেই আমি চলে যাবো আমার এই চেনা পরিচিত ঘর থেকে। এই ঘরের প্রতিটি কনা, প্রতিটি আচর আমার চেনা। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে, আগামিকাল থেকে আমি আর এই ঘরটিতে কখনো ফিরে আসবো না। ভাবতেই আমার হৃদস্পন্দন যেনো থেমে গেলো, চোখ মুদে গেলো। মনে হলো, আমার দুটি নয়ন সমস্ত রুদ্ধ প্রীতি তোমার প্রতি সিঞ্চন করে বারবার অশ্রুপাত করছে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জানি না। ভোর হতে না হতেই ঘরের বাইরে কে যেনো টোকা দিলো। এতো সকালে আজ পর্যন্ত কেউ আমার এই একা ঘরে টোকা দেয় নাই। শরীরটা বড্ড ভারী মনে হচ্ছিলো। প্রচন্ড এক আলস্য নিয়া দরজা খুলতে পৃথিবীর সমস্ত অবাক করার বিষয়ের মতো আমাকে তুমি হতবাক করে দিয়েছিলে। প্রকাশ্য দিবালোকে তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে। কোনো আগামবার্তা নাই, কোনো কথা নাই, কিছুই না। তুমি এতো সকালে এসে আমার ঘরের দরজায় হাজির।
এমনিতেই শরীরে বল ছিলো না, তারমধ্যে অকস্মাৎ তুমি। আমার সারাটা শরীর কেপে কেপে উঠেছিলো, কিছুটা ভয়ে, কিছুটা কষ্টে আর এতোটাই বেদনায় যে, আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরলে, আমি তোমার বুকে একদম মিশে গেলাম, আমার সেই চেনা পরিচিত প্রশস্থ ভালোবাসার বুক। আমি হারিয়ে ফেলবো হয়তো আর কিছুক্ষন পর। তুমি আমাকে কতো আদরের সাথে জড়িয়ে ধরে কতই না আদর করলে। আমার বুকভরা অভিমান, আমার চোখভরা অশ্রু আর দুর্বল শরীরের কাপুনিতে তুমি কিছুই বুঝতে পারলে না, আমি হারিয়ে যাচ্ছি। শুধু, বললে, 'আমি আছি তো, ভয় পেও না'। হ্যা, তুমিই ঠিক, তুমি আছো, আমার সারাটা জীবনেই তুমি আছো, অন্তর জুড়ে আছ, মন জুড়ে আছো, আমার ভাবনায় আছো, আমার রক্তের প্রতিটা শিরায় আছো। দেহের সাথে মিশে থাকার নামই শুধু ভালোবাসা নয়, হাতে হাত ধরে একসাথে রাস্তা পার হওয়াই এক সাথে নয়, আমার প্রতিটি কল্পনায় তুমি ছায়ার মতো আছো। যেখানে তাকাই, আমি সব জায়গায় তোমাকে দেখতে পাই। হ্যা, তুমি আছো, ছিলে আর থাকবেও। তুমি ছিলে আমার বাবার ভুমিকায়, ছিলে আমার ভাইয়ের ভুমিকায়, ছিলে আমার মায়ের ভুমিকায়, তুমি ছিলে আমার প্রেমিক আর নির্ভরতার সবচেয়ে কাছের মানুষটি। আজো তাইই আছো।
তুমি শেষবারের মতো আমাকে বুকে নিয়া, কপালে, মুখে, নাকে, চোখে, সব জায়গায় আদর দিয়ে কিছুক্ষন পর অবশেষে চলে গেলে। আমি যতদূর দেখা যায়, জানালা দিয়ে এই প্রথম তোমার যাওয়াটা দেখলাম। চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। আর হয়তো কখনো তোমার সাথে আমার দেখা হবে না। তুমি এই সত্যটা না জেনেই সমস্ত ভরষা আর ভালোবাস নিয়েই অন্য দিনের মতো চলে গেলে। তুমি জানলেই না , কি রয়ে গেলো আর কি নিয়ে গেলে আর আমিই বা কি করে এটা করলাম। সারাটা দিন আমি কেদেছিলাম। সেদিন আর আমার যাওয়া হলো না।
কিন্তু বুকভরা অভিমান নিয়ে আমি পরদিন কাউকে কিছু না বলে অতিভোরে আমার চেনা পরিচিত ঘরটি ছেড়ে শেষ পর্যন্ত বেরই হয়ে গেলাম। এ খবরটি জানলো শুধু আমার সেই কুচক্রীকারিনী বন্ধুটি আর জানেন আমার ঈশ্বর। কিসের নেশায় যে আমি এতোটা দিকহারা হয়ে গিয়েছিলাম, আজো আমি মনে মনে ভাবি। আমার কেনো একবারের জন্যেও মনে হয় নাই যে, এই কালো মুখোশধারী সর্পহরিনীর সাথে আমার বিস্তর একটা ফারাক ছিল। তার স্বামী ছিল্ তার সংসার ছিল। সে তো এসেছিল অভিসার করতে, সে তো এসেছিল গোপন মিশনে। তার তো হারাবার কিছু ছিল না। যদি তার মিশন সার্থক না হয়, সে তো ফিরেই যাবে তার সেই চেনাগৃহে যেখানে অপেক্ষা না করে থাকলেও সামাজিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্পাপ অথবা আরেক অভিচারী ব্যভিচারক পুরুষ। তাদের মধ্যে ভালোবাসা থাকুক আর নাই বা থাকুক, সেটা কোন মাপকাঠি নয়। তাদের মাপকাঠি সামাজিক একটা বন্ধনে তারা আবদ্ধ। আর এই সামাজিক বন্ধনের কারনেই আমার কুচক্রীকারিনি আজ এই গোপন অভিসারে এসেও ফিরে যেতে পারে নিজ গৃহে। কিন্তু আমি তো ব্যভিচারী ছিলাম না!! আমি তো আমার জায়গাতেই ছিলাম! এই কুচক্রীকারিনী এসেছিলো সদাই করতে, যৌবনের সদাই, ভালোবাসার অভিনয়ের সদাই। আমি কেনো তার কুপরামর্শে আমার সংসার ছাড়লাম? কখনো কি তোমার এ কথাটা মনে হয় নাই যে, যে মহিলা-প্রজাতী তার নিজের স্বামীর অগোচরে নিজের দেহের সদাই করতে কোনো এক অপরিচিতের বাসায় নির্বিঘ্নে পর পুরুষের সাথে নির্ভয়ে আসতে পারে, তার কাছে আবার ভালবাসার মুল্য কি? তোমার কি কখনো মনে হয় নাই, যে, এটাই হয়তো তার প্রথম সদাই নয়? কি করে তুমি ভাবলে যে, সে এই সদাই করতে এসেছে শুধুমাত্র ভালোবাসার কারনে? সে না বুঝে ভালোবাসা, না বুঝে ভালোবাসার কষ্ট। সে শুধু বুঝে তার এই অমুল্য মেয়েলী সম্পদ শুধু লালসার কারনে ভোগ বিলাসের একটা যন্ত্র বিশেষ প্ন্য বটে। আর কিছু না। বেশ্যাদের জীবনের প্রয়োজনে হয়ত বেশ্যাগিরি করতে হয়, এটা অনেকেই করলেও মনে মনে ঘৃণা করে। তারপরেও জীবনের এটা ধরেই নেয়া যেতে পারে যে, সেটা যতোটা না পাপ, তার থেকে বেশি জীবনের প্রয়োজনে বেচে থাকার একটা পথ। কিন্তু এই কুচক্রিকারিনী তো জানতো যে, তাকে দেহ দান করতে হবে, তাকে সব কিছু উজার করে দিতে হবে, কিন্তু তার তো জিবিকার জন্য এইকাজ করার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। এর মানে একটাই, সে প্রফেশনাল। আমি এই প্রফেশনাল কুচক্রির কাছে প্রতিনিয়ত হেরে গিয়েছিলাম কিন্তু নষ্ট হয়ে যাইনি।