প্রি-কোর্ষ শেষ হয়ে গেছে। এই প্রি-কোর্ষের সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো কোনো রেজাল্ট নাই। আর থাকলেও এর কোনো মুল্য নাই। যেহেতু আমাদের কোর্ষটা প্রায় ৭/৮ মাসের জন্য, ফলে ইউনিট থেকে আমাদেরকে প্রথমে কয়েকদিন ছুটি দিয়ে দিলো যাতে সবাই যার যার পরিবারের সাথে কয়েকদিন একসাথে সময় কাটিয়ে হালিশহরে কোর্ষে যেতে পারে। তাই আজই আমাদেরকে ছুটি দিয়ে বলা হলো, যার যার বাসায় চলে যাও। তারপর বাসা থেকে সরাসরি চট্টগ্রামে হালিশহরে গিয়ে যোগদান করো।
আমরা সবাই ব্যাচলর মানুষ, খুব একটা ঝামেলা নাই। কিছু ইউনিফর্ম, কিছু বইপত্র, আর ব্যক্তিগত কিছু থাকতে পারে সাথে সিভিল কিছু কাপড় চোপড়, এইই আমাদের সম্বল। কারো কারো আবার ডেকসেট আছে, বাইকও আছে। আমার এসব কিছুই নাই। তাই অসুবিধাও নাই। বিছানার জাজিম নাকি নিতে হয়, বালিশ ছাড়া ঘুমাবো কই? তাই বালিশ চাদর এখন যেটা ব্যবহার করি সেগুলি নিতে হবে।
আমার ব্যাটম্যানের নাম আতিয়ার রহমান। ব্যাটম্যান আবার কি?
তাহলে একটু বুঝিয়ে বলি। প্রতি অফিসারের একজন করে ব্যাটম্যান থাকে। ব্যাটম্যানটা হচ্ছে, একটা সিভিলিয়ান সার্ভেন্ট। ইউনিটেই খায়, ইউনিটেই ঘুমায়, আর আমরা ওকে যা পারি দেই। এটা অনেকটা পেটের ধান্দায় কিছু গরীব ছেলে পোলাপান আমাদের সাথে থাকে, ফুট ফরমায়েস করে, ইত্যাদি। আতিয়ার ছেলেটার বয়স প্রায় ১২ থেকে ১৩ হবে, ভালোই কাজ করে। ইউনিফর্ম ইস্ত্রি করা, বুট পালিশ করা, বিছানাপত্র গুছিয়ে রাখা, গেঞ্জি আন্ডারওয়ার ধুয়া, ফুট ফরমায়েশ খাটা ইত্যাদি করে এই ব্যাটম্যান। ছেলেটার বাড়িও যশোর। আমার সাথে সে হালিশহর যাবে বিধায় গত সপ্তাহে ছুটিতে গেছে। আজ সকালেই ইউনিটে এসে হাজির। আমি ঢাকায় ছুটিতে যাবো ১০ দিনের জন্য। আর এরমধ্যে ব্যাটম্যান আমার মালপত্র নিয়া চিটাগাং হালিশহরে ৮/৯ তারিখের দিকে চলে যাবে, আমি যাবো ৯ তারিখে। কারন ১০ তারিখে কোর্স শুরু। হালিশহর আমাদের আর্টিলারী ট্রেনিং সেন্টার। শুনেছি, কর্নেল হারুন আর্টিলারী সেন্টার এন্ড স্কুলের কমান্ডেন্ট। খুব নাকি একরোখা লোক। তার বাড়ীও আমাদের কেরানিগঞ্জ, শুনেছি। কিন্তু তাতে পুলকিত হবার কোনো কারন নাই আমার। আমি এসব গেরাইবাজিতে নাই।
হাসিনা পরিবহনে টিকেট কাটা আছে। যশোর থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য হাসিনা পরিবহনই সবচেয়ে ভালো। অধিনায়কের ইন্টারভিউ হয়েছে, অধিনায়ক অনেক উপদেশ দিয়েছেন। ব্যাটারী কমান্ডার খালী একটা কথাই বলেছেন, 'শোন মিয়া, লুতফররে টপকানো চাই, এক ব্যাচ জুনিয়ার হইয়া আর্মিতে আইছো, এইটাই সুযোগ তারে টপকাইয়া ভালো করার।' কিন্তু লুতফরের উপর আমার কোনো রাগ বা গোস্যা নাই। সে আমার ক্যাডেট কলেজের বন্ধু, ক্লাসমেট। আমি আর্মিতে আমার কারনেই ১২ লং কোর্সে যেতে পারি নাই। যদিও আমি সিলেক্ট হয়েছিলাম, আমার ভাইয়ের কারনে আমি যেতে পারিনি।
আমার ব্যাটারী কমান্ডার বা উপ-অধিনায়ক কেনো লুতফরকে নিয়ে এই কথা বললেন আমার জানা নাই। তবে উনি সারাক্ষন সিগারেট খান, বিশেষ করে মিকচার। আমি তার মিকচার বানাইয়া আগুন ধরাইয়া উনাকে সিগারেটের শলাটা হাতে তুলে দেই, উনি মনের সুখে টান দেন আর বলেন,
গাজা খাইছো কোনোদিন?
বলি, না স্যার।
উনি আবারো বলেন, খাইবা খাইবা, যাইতেছো তো বেসিক কোর্সে!! গাজা খাওয়াও শিখবা।
গাজা খাওয়া শিখবো কিনা জানি না, তবে আর্লোটিলারীর উপর বেশ কিছু শিখবো এটা জানি। লোকটিকে আমার পছন্দ।
রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম। আহা- কি আনন্দ! কিন্তু সারাক্ষনই আমার ভিতরে আরেকটা দুঃখময় অনুভুতি কাজ করতো। আমি ঢাকায় যাচ্ছি বটে, অথচ ঢাকায় আমার থাকার কোনো জায়গা নাই সেই বদি ভাইয়ের বাসা ছাড়া। বদি ভাইয়ের বাসায় আমার থাকতেই হয় সেটা ভালো লাগুক আর নাইবা লাগুক। মা থাকেন গ্রামে-বেচারী নিজেই অসহায়। আমার আগমনে মা আনন্দ পান বটে কিন্তু সেই আনন্দটা আর দশটা মা যেমন তার ছেলের জন্য অনেক কিছু উজাড় করে দিয়ে নিজে মনে মনে শান্তি পায়, আমার মায়ের সেই সামর্থ না থাকায় মা হয়তো মনে মনে কষ্টও পান। আমি মাকে সেটা বুঝতেও দেই না আর মাকে কোনো প্রকার অসুবিধায় পড়ুক সেটা আমি করতেও চাই না। আমি মাকে আমার জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসি।
গরীব ঘরের সন্তানদের অনেক কিছু ভুলে যেতে হয়। আমরা হয়তো এককালে গরীব ছিলাম না, কিংবা ভবিষ্যতেও হয়তো এমন দিনকালটা পালটে যাবে কিন্তু বর্তমান সময়টা আমার পক্ষে নয়।