গিলাতলা সেনানীবাস, খুলনা
খুব ক্লান্ত শরীর। সারাদিন লং ড্রাইভের ক্লাশ ছিলো। মেসে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা বনে গিয়াছে। মনটা আজো খারাপ কারন আজো তাহার চিঠি আসে নাই। কয়েকদিন যাবতই আমি তাহার চিঠি পাইতেছি না। এমন হইবার কথা নহে। যেখানে প্রতিদিন তাহার চিঠি পাইয়া থাকি, সেখানে আজ প্রায় চারদিন যাবত তাহার কোনো চিঠি আমার কাছে আসিতেছে না, ইহা আমার জন্য একটি দুশ্চিন্তার কারন বটে। খুলনা শহর হইতে বেশ দূরে আমি সেই সাভার সেনানীবাস হইতে আসিয়া গিলাতলা সেনানীবাসে প্রায় তিন মাসের ড্রাইভিং কোর্স করিতে আসিয়াছি আমি। ইতিমধ্যে প্রায় দুইমাস পার করিয়া দিয়াছি। ক্লান্ত শরীরে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়া হাতে বানানো ক্যাপসটেইন মিকচার দিয়া সিগারেট বানাইয়া ঠান্ডা একটি কোকের বোতল মাঝে মাঝে চুমুক দিয়া অবশ এবং অলশ শরীরে সূর্যাস্তের পর নাতিদীর্ঘ সন্ধ্যাটি উপভোগ করিতেছিলাম। মনটা খুব ভালো নাই। আমি তাহার চিঠি পাইতেছি না। এমন সময় মেস ওয়েটার সুম্মুখে আসিয়া বলিল, “স্যার, দুপুর বেলায় আপনার একটা ফোন এসেছিলো ঢাকা থেকে। আপনাকে জরুরী ভিত্তিতে তাকে ফোন ব্যাক করতে বলেছেন। ব্যাপারটা নাকি খুব জরুরী। নাম তার…… ।” হটাত করিয়া আমার ক্লান্ত দেহ, অলশ মস্তিস্ক এবং নাতিদীর্ঘ সন্ধ্যাটি কেমন যেনো নাড়াচাড়া দিয়া আমাকে উত্তেজিত করিয়া তুলিলো। কারন মেস ওয়েটার যাহার নামে ফোন আসিয়াছিলো বলিয়া সংবাদটি দিলো, তাহার ফোন কস্মিনকালেও আমি আশা করি নাই এবং করিও না। বেশ এলোমেলো লাগিতেছিলো মনটা। সন্ধ্যাটা আরো কালো আকার ধারন করিয়া আমার সামনে যেনো আরো অন্ধকার করিয়া তুলিলো। শরতচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসে একবার লিখিয়াছিলেন, অন্ধকারেরও রুপ আছে, কিন্তু আজ এই অন্ধকার সন্ধ্যায় আমি শরতবাবুর সেই অন্ধকারের কোনো রুপ খুজিয়া পাইলাম না, যাহা পাইলাম তাহা কেবল দুসচিন্তা আর অবসন্নতা মিশ্রিত বিসন্নতা। যাহাই হোক, আমাকে ঐ ভদ্রলোককে যেভাবেই হোক ফোন করিয়া জানিতে হইবে কেনো সে আমাকে ফোন করিয়াছিল এবং আমার তাহাতে কী কী করনীয়।
এমনিতেই খুব ছোট র্যাংকের অফিসার আমি (মাত্র লেফটেন্যান্ট), তাহার মধ্যে এই খুলনা শহরে কোর্স করিতে আসিয়া আমরা এইস্থানে একটা বিদেশী নাগরিকের মতো অনেক অধীকারই আমাদের নাই বলিয়া মেসে রক্ষিত একমাত্র ল্যান্ড ফোনটি আমাদের জন্য এসডি কলের সুবিধা নাই, আর আজিকার দিনের মতো তখনকার দিনে হাতে হাতে মোবাইল কোম্পানীও এই সুযোগ করিয়া দেন নাই যাহাতে আমরা নিরিবিলিতে নিকটাত্মীয়, কিংবা প্রিয়জনের সাথে অবকাশ সময়ে কথা বলিতে পারি। যাহাই হোক, সন্ধ্যা ঘনাইয়া রাতের দিকে প্রবাহিত হইতে লাগিলো বটে কিন্তু আমার মাথা ক্রমশ দুসচিন্তায় সমাধানের দিকে না আগাইয়া আমাকে আরো উদ্বেলিত করিয়া বিহব্বল করিয়া তুলিতে লাগিলো। প্রতিকুল পরিবেশে মাথা যতোই বিচলিত থাকুক, অন্তর থাকে তাহার থেকে আরো অধিক বিচলিত। আর বিচলিত অন্তর শুধু অন্তক্ষরনই করেনা মাঝে মাঝে ঈশ্বরের উপর এমন একটা ভাবনা লইয়া হাজির হয় যেনো কস্মিনকালেও কোনো ঈশ্বর বা ভগবান ছিলো কিনা তাহাই ভাবিতে মন চাহেনা। আর যতোক্ষন অন্তক্ষরন হয় ততোক্ষন পেটে অম্লের সৃষ্টি হয় আর অম্ল থেকে সৃষ্টি হয় এক ধরনের ঢেকুর। আর একবার যদি ঢেকুরের খনি তৈরী হয়ে যায়, তখন, সবচেয়ে খাইতে মজা লাগে শুধু সিগারেট। আমিও তাই একটার পর একটা ক্যাপসটেইন মিকচার দিয়া ঘনঘন সিগারেট বানাইয়া তৃপ্তি না হোক একটা চরম অস্থিরতার মধ্যে সময়টা পার করিতে লাগিলাম। অন্তক্ষরনের শেষে আরেকটি উপসর্গ দেখা যায়। আর তাহা হইলো, হটাত করিয়া অম্লের ঊর্ধ্বগতির কারনে মাথার গোল চাকতির ভিতরে এক প্রকারের চাপ অনুভুত হওয়ায় ফাক ফোকরের পাশ দিয়া কিছু কিছু গ্লোকজের মিশ্রনে হতবাক করার মতো কিছু সাহস আর বুদ্ধি জাগিয়া উঠে। আমারো তাহাই হইলো।
আমি আমার হইতে অধিক সিনিয়র কিন্তু এই কোর্সের রাজকীয় পরিবারের মতো একজন সিনিয়র শিক্ষকের নাম আমার মস্তিস্ক পর্দায় উদিত হইয়া উঠিলো যে, তাহাকে বলিলে হয়তোবা তাহার অধীনে থাকা দুস্প্রাপ্য ল্যান্ডফোনের মাধ্যমে আমাকে সুদুর ঢাকায় ফোন করিবার সুযোগ করিয়া দিতেও পারেন। তাহার নাম ক্যাপ্টেন রেজা। অষ্টম লং কোর্ষের। আমি তাহার রুমের সামনে গিয়া কয়েকবার পায়চারী করিতে থাকিলাম। আর মনে মনে অনেকবার কি কথা কিভাবে বলিবো, সেইটা নিজে নিজে কয়েকবার অনুশীলনের মতো কানে শুনা যায় এইভাবে নিজেকে শুনাইলাম। একবার ভাবিলাম, সব সত্য কথা বলিবো। আবার ভাবিলাম কিছু সত্য কিছু অসত্য (মিথ্যা নয়) মিশ্রন করিয়া একটা যুক্তি সঙ্গত কাহিনী বলিবো কিনা? যদি বলি, আমি প্রেম করিতেছি এবং গত কয়েকদিন যাবত আমি আমার প্রেমিকার কোনো চিঠিপত্র পাইতেছি না, তাহার সাথে আমার কথা বলিবার বিশেষ প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি কিভাবে তাহা গ্রহন করিবেন, সেটা আমার বোধগম্য হইতেছিলো না। আবার যদি বলি, বাড়িতে বিপদ, মহামারী হইয়াছে, কথা বলিবো বাসায়, এইজন্য তাহার ল্যান্ডফোনটা আমার ব্যবহার করিতে হইবে। আর তখন যদি তিনি অতি দয়া পরবশ হইয়া আমার পরিবারের খোজ খবর নিতে চাহেন, তখন আবার না হিতে বিপরীত হইয়া যায় ইত্যাদির আশংকা করিতেছি। সবচেয়ে বড় বিপদ হইলো যে, সত্য এবং অসত্যকে মিশ্রন করিয়া কাহিনী বানানো এবং তাহাকে একটা সত্যের যুক্তিক নাটকীয় অধ্যায় দেওয়া কতটা যে কঠিন তাহা ঐদিন বুঝিলাম। গলা শুকাইয়া যায়, মাথা ভনভন করিতে থাকে, বুক ধরফর করিতে থাকে আর গলার সুর মাঝে মাঝে এমন করিয়া ব্যাঙ্গ করে যে, নিজেই নিজের গলার সুর পরিচিত বলিয়া মনে হয় না, চিনিতে ভুল হয়। এমন একটা প্রতিকুল পরিস্থিতে শেষতক আমি ইহা মনস্থির করিলাম যে, যাহা বলিবো সত্য বলিবো। তাহার যদি অন্তর থাকিয়া থাকে তাহা হইলে তিনি আমাকে এই প্রতিকুল অবস্থা হইতে বাচিয়া যাইবার কোনো রাস্তাও তো বাতলাইয়া দিতে পারেন। আর যদি তিনি রাজকীয় পরিবারের সদস্য হইয়া আমাকে দন্ড দিতে চাহেন, তাহা হইলে তো আরো একটা বড় হাংগরের মুখে আসিয়া পড়িয়াছি বলিয়াই মনে করিতে হইবে।
-"এই কেরানীগঞ্জ, এইখানে কি করিস? কিছু বলতে এসেছিস নাকি?" হটাত করিয়া ক্যাপ্টেন রেজা তাহার রুম হইতে বাহির হইয়া আমাকে দেখিয়া ইহাই ছিলো তাহার ডায়ালগ। তিনি আমাকে বেশীর ভাগ সময় নাম না ধরিয়া ডাকিয়া আমার নিবাসস্থল কেরানীগঞ্জ বলিয়াই ডাকিতেন। এমিনিতেই আমি ধরাশায়ী রোস্তমের মতো অবস্থা তাহার মধ্যে আবার পরিকল্পনা ছাড়াই কি কথা বলিবো সেই পরিস্থিতি সামাল না দিতেই তাহার সামনে পড়িয়া গেলাম। এবার আর সত্য এবং অসত্য মিশাইয়া কিছু বলিবার অবকাশ রহিলো না। খুব সন্তর্পণে বারান্দায় দাড়াইয়া দাড়াইয়াই বলিলাম,-"স্যার, আমি ঢাকায় একটা ফোন করিতে চাই। মেসের ফোন কাজ করিতেছে না কিন্তু আমার ঢাকায় ফোন করা খুব জরুরী। তাই আপনার এখানে আসা। যদি অনুমতি দেন তো, আমার উপকার হয়।" কোনো কথা না বাড়াইয়া ক্যাপ্টেন রেজা স্যার বলিলেন, "কি ব্যাপার, গাল ফ্রেন্ড সমস্যা নাকি?"
কানের কাছে টাস করিয়া বোমা ফুটিলে যেমন কিছুক্ষন কানে আর কোনো শব্দ প্রবেশ করে না, অথবা নদীতে ঝাপ দিলে প্রথমকয়েক মুহূর্ত যেমন সাতারুর কানে স্থলবিশ্ব সম্পর্কে কোনো আওয়াজ তাহার কানে প্রবেশ করে না, আমারো হইলো ঠিক সেই অবস্থা। "গালফ্রেন্ড সমস্যা" কথাটি যেনো আমার কানের কাছে এইরুপ একটা ছোট খাটো টাস করিয়া বোমার মতো অথবা সাতারুর নদীতে ঝাপ দেওয়ার মতো ঘটনাই ঘটনাই ঘটিলো। সত্যই বলিলাম। কি নিদারুন আমার "স্যার", বড্ড ভালো আর দয়ালু, তার থেকে বেশী মিষ্ট কোনো ফল আছে বলিয়া তখন আমার "ক্যাপ্টেন রেজা"র চেয়ে কিছুই মনে পড়িলো না। তিনি আমাকে তাহার ল্যান্ড ফোনটি ব্যবহার করিতে অনুমতি দিলেন।
আমি কয়েকবার ফোন করিবার পর অতঃপর ঢাকার প্রান্ত হইতে এক ভদ্র মহিলা ফোন ধরিলেন। হ্যালো বলিতেই মনে হইলো তিনি যেনো আমার ফোন পাইয়া ৫ম বিশ্ব যুদ্ধের কোনো খলনায়ক তাহাকে এই বলিয়া ফোন করিয়াছে যে, আমি আপনাদেরকে খুব শিঘ্রই আক্রমনের নিমিত্তে আসিতেছি। তিনি আমাকে কোনো সুযোগ না দিয়া এই বলিয়া ফোন রাখিয়া দিলেন যে, কোন সাহসে আমি তাহার বাসায় ফোন করিয়াছি? শুধু তাহাই নয়, আর যদি তাহাকে ফোন করি, তাহা হইলে তাহার যাহা যাহা মিজাইল, আর আগ্নেয়াস্ত্র আছে তাহা দিয়াই আমাকে সমুলে ধ্বংস করিতে তিনি দিধাবোধ করিবেন না। তিনি আর কেউ নন, মেঝো ভাবী। কি হইলো, বুঝিতে পারিলাম না। আমি নাৎসি বাহিনীর কোনো কমান্ডারও না, কিংবা মিত্রবাহিনীর কোনো নৌবহরের কমান্ডারও না, তাহার পরেও তিনি আমাকে তাহার এমন শত্রু বলিয়া আমাকে এইরুপ আক্রমন করিলেন কেনো? যে ভদ্রলোক আমাকে ফোন করিতে বলিয়াছিলেন, তাহার সহিত আমার কোনো কথা বলা তো দুরের তাহা অবধি আমি পৌছাইতেই পারিলাম না। আমি আবারো ফোন করিলাম। এইবারও ফোন ধরলেন সেই ভদ্রমহিলা, মানে মেঝোভাবী।। আমি তাহার কথা বলা শুরু করিবার আগেই বলিলাম, আপা, আমি খুলনা হইতে বলিতেছি, জনাব (অমুকের সাথে) আমি কথা বলিবো। জরুরী কথা আছে। তাহার অন্তর যেনো একটু বিগলিত হইলো। মহিলাদের অন্তর কখন শক্ত হইয়া যায় আবার কখন বিগলিত হইয়া অঝোর ধারায় বর্ষা নামে ইহা নাকি বিধাতাই কনফিউশনে থাকেন। তিনি আর বেশী কিছু কথা না বাড়াইয়া ফোনখানা উক্ত ব্যক্তিকে ধরাইয়া দিলেন। কিন্তু আমার এইপাশ থেকে শুনিতে পাইতেছিলাম যে, তিনি তাহাকে এমন কিছু কথা বলিয়া শাসাইতেছিলেন যেনো তাহাদের ওখানে কি ঘটিতেছে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য আমাকে না দেওয়া হয়। বুঝলাম, কিছু একটা সিরিয়াস ম্যাটার। বুক ধরফর করিতেছিলো। বুকের ভিতর কেমন যেনো একটি আতংক পাথরের মতো ভর করিয়া আমার শ্বাস আর নিঃশ্বাসের দৈর্ঘ্য প্রস্থ এক করিয়া দিতে লাগিলো। উৎকণ্ঠায় আমার কপালের শিরায় শিরায় কেমন ঘামের শিশির বিন্দুর উৎপত্তি হইতে লাগিলো। আমি বুঝিতে পারিতেছিলাম, আমার শরীরের ভিতর রক্ত যতো দ্রুতই চলুক না কেনো, ঠোট শুকাইয়া আসিতেছে, হাত পা ঠান্ডা হইয়া যাইতেছে। হাতের সিগারেট খানায় যেনো চুমুকের মতো টানিতে ইচ্ছা করিতেছিলো। কিন্তু সিগারেটখানা ইতিমধ্যে নিভিয়া গিয়া উতকট একটা গন্ধ ছাড়া আর কোনো স্বাদ দিতে পারিতেছিলো না। অবশেষে মুস্তাক সাহেব ফোন ধরিলেন। এই মুস্তাক সাহেবের কথাই আমার মেস ওয়েটার বলিয়াছিলো। তাহার সাথে আমার ইতিমধ্যে খুব একটা বেশি কথাবার্তা হয় নাই, তবে একদিন বা দুইদিন তাহার সাথে আমার দেখা হইয়াছিলো এবং অতীব ছোট খাটো কুশল বিনিময় হইয়াছিলো। আমি সালাম দিতেই তিনি আমাকে ফিরতি কোনো কুশল না দিয়া বলিতে লাগিলেন, "শুনেন আখতার সাহেব, আমি শুধু বলিয়া যাইবো, আপনি শুধু শুনিয়া যাইবেন, কোনো প্রশ্ন করিবেন না, হ্যা বা না দিয়া উত্তর ছাড়িয়া দিবেন। বেশীক্ষন আপনার সাথে কথা বলিবার সময় আমার হাতে নাই, আর থাকিলেও আমার পক্ষে হয়ত কথা বলিবার সুযোগ নাই।" এই বলিয়া তিনি যাহা বলিলেন, তাহা হইতেছে এইরুপঃ
-আমার ছোট বোনের বিয়া ঠিক হইয়াছে। আমেরিকার প্রবাসী। ছেলের বাড়ির সবাই মেয়েকে অত্যান্ত পছন্দ করিয়াছে। আমাদেরও ছেলের বাড়ির সবাইকে পছন্দ হইয়াছে, কিন্তু আমার বোন তাহাতে বাধ সাধিয়াছে যে, সে আপনার সাথে কোনো কথা না বলিয়া সে তাহার কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারিবে না। আমাদের সবার ধারনা, আপনি এই মুহূর্তে আপনার অফিশিয়াল নিয়মে বিবাহযোগ্য বয়স না হওয়ায় আপনি হয়ত আগাইয়া আসিতে পারিবেন না, হয়ত সময় চাহিয়া বসিবেন, যাহা আমাদের হাতে নাই। আমরা যোগ্যপাত্র পাইয়াছি, আমরা এই সুযোগ হাতছাড়া করিতে চাহি না। আপনিও যোগ্য নন এমন নয় কিন্তু আপনার অফিশিয়াল বাধ্যবাধকতার জন্য হয়ত আপনি এখনই কোনো প্রকারের সমাধান করিতে পারিবেন না। তাই সবার অমতে আমি এই বলিয়া সবাইকে বুঝাইবার মনস্থির করিয়াছি যে, যেহেতু মেয়ে একবারের জন্য হইলেও আপনার সাথে কথা বলিয়া তাহার সিদ্ধান্ত চুরান্ত করিতে চায়, তাই আজকে আপনাকে ফোন করা। এইবার আপনি সক্ষেপে আপনার বক্তব্য বলিতে পারেন। আর সেটা "হ্যা বা না"।
আমি তাহার সাথে অধিক্ষন কথা বলিবার মানসিকতা দেখাইলাম না, শুধু বলিলাম, আমি মেয়ের সাথে কথা বলিতে পারিবো কিনা। তিনি আমাকে এই উপকারটুকু করিলেন। সে (আমার গার্ল ফ্রেন্ড অর্থাৎ মুস্তাক সাহেবের বোন) ফোন ধরিয়া কোনো কথা বলিতে পারিলো না। আমি এইপাশ হইতে শুধু তাহার ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাদিবার শব্দ পাইতেছিলাম। আমি তাহাকে কিছুক্ষন সময় দিলাম কাদিবার জন্য। আকাশ যখন কালো মেঘে ভরপুর হইয়া উঠে, চারিদিকের বাতাস যখন মেঘের এই কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন রুপ দেখিয়া হতভবের মতো স্থির হইয়া যায়, তাহার সহিত চারিপাশের গাছপালারাও ঢালপালা না নাড়াইয়া, পাতা না নাড়াইয়া একেবারে নিথর ভংগিতে দাড়াইয়া থাকে এইটা দেখিবার জন্য যে, আকাশের ওই মেঘ কি ঘন বরসায় বর্ষিত হইবে নাকি তাহার সহিত আরো ঘূর্ণিঝড়ের আবাস রহিয়াছে। আমি তাহার ফুফাইয়া ফুফাইয়া কাদিবার জন্য কিছুক্ষন সময় দিলাম, বাহির হইয়া যাক তাহার বুকের তপ্ত করুন কষ্ট, বাহির হইয়া যাক তাহার আবেগের কিছু মর্মান্তিক বেদনা। আমি চুপ করিয়া তাহার কান্নার শব্দগুলি শুনিতে লাগিলাম। এতো দুরের কান্নার আওয়াজ আমার মনের ভিতর প্রকান্ড একটা টর্নেডোর মতো শক্তি যোগাড় করিয়া কিছুক্ষন পর শুধু বলিলাম, – তুমি কি এখনো আমাকে ভালোবাসো? সে এই প্রশ্নে আরো কাদিয়া উঠিলো আর বলিল, "আমার আচরনে কি তোমার এইটাই শেষ পর্যন্ত মনে হইলো?" – বলিলাম, তুমি কি আমার আসিবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ চালাইয়া যাইতে পারিবে? যদি তোমার যুদ্ধে জিতার ক্ষমতা তোমার টিকিয়া থাকার ক্ষমতার বাহিরে চলিয়া যায়, তাহা হইলে তুমি শবমেহের হইয়া যাও। আমি আসিতেছি।" এই বলিয়া আমি ফোন ছাড়িয়া দিলাম এবং আমার পাশে রাখা ওই সিনিয়র স্যারের খাটের উপর বসিয়া পড়িলাম। আমার এহেনো আচরন এতক্ষন আমার ওই সিনিয়র অফিসার ক্যাপ্টেন রেজা খুব মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করিতেছিলেন। তিনি বিবাহিত মানুষ, আমার থেকে কয়েক বছরের সিনিয়র মানুষ, হয়তো অভিজ্ঞতাও বেশি। তিনি আমার কাছে আসিয়া বসিলেন।
– বুঝিতে পারিয়াছি কি হইতেছে। যদি ভালোবাসো, তাহা হইলে আজই এই রাতে তুমি ঢাকার উদ্দেশ্যে বাহির হইয়া যাও। আমি সব সামলে নিবো। ভালোবাসা আর বিসসাসের থেকে বড় ভরসা প্রিথিবীতে আর নাই। আমি বলিলাম, স্যার, আমার হাতে একটি টাকাও তো নাই। আর আজ হরতাল চলিতেছে। আমার কি করা উচিত, আর কি করা উচিত নয় আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। তিনি আমাকে আমার রুমে যাইতে বলিলেন, আর বলিলেন, কাহারো সাথে যেনো আমি এই ব্যাপারটা নিয়া আলাপ না করি। বাকীটা তিনি দেখছেন। অসময়ে কেউ যখন অতি দুর্বল এক্তা হাতও বাড়াইয়া দেয়, তখন তাহা অতিকায় বড় একটা আশ্বাসের বস্তু হইয়া বাকীটা মনের জোরে আগাইতে পারা যায়। আমি আমার রুমে আসিলাম, আমার রুমের বন্ধুকে ব্যাপারটা খুলিয়া বলিলাম। সে আমার অত্যান্ত ভালো বন্ধু, আর সে আমার ব্যাপারটা পুরুই জানিত। ফলে তাহাকে বলিলে আমার কোনো অসুবিধা নাই এইটা আমার জানা ছিলো। আমার প্রুস্তুতির মধ্যে ছিলো শুধুমাত্র জামাটা বদল করা আর কোথায় কত টাকা আছে তা খুজিয়া বাহির করা। মানিব্যাগ রাখিতাম না, যা টাকা বেতন পাই তাহার বেশীর ভাগ চলিয়া যায় মেসের খাবারের বিল দিতে দিতেই। ফলে অবশিষ্ট টাকা কখনো বালিশের তলায়, কখনো মেট্রেসের তলায়, কখনো ড্রয়ারের কোনায় কখনো বা ব্যাটম্যানের কাছে রাখিতাম। সব জায়গায় খুজাখুজির পর সবমিলিয়ে আমি যাহা পাইলাম তাহাতে তিন শত টাকার উপরে নয়। মেস হাবিলদারকে তলব করিলাম এবং তাহার কাছ থেকে আরো পাচ শত টাকা ধার করিলাম। এইটা সেনাবাহিনীর একটা প্রচলিত ধারা যে, অফিসারগন মেস থেকে মাঝে মাঝে টাকা ধার নিতে পারেন যাহা মাসের শেষ সমন্নয় করা হয়। সব মিলিয়ে এখন আমার কাছে সম্বল মাত্র আটশত টাকার মতো।
একটু পর আমার সেই সিনিয়র স্যার ক্যাপ্টেন রেজা আমার রুমে ঢোকিলেন। বলিলেন, "বাডি, আজ রাত সাড়ে দশটায় সৌখিন পরিবহন ঢাকায় যাবে কিন্তু হরতালের কারনে সব সিট বিক্রি হয়ে গেছে।" স্যার কোনো রকমে একটা সিট ম্যানেজ করিতে পারিয়াছেন। সৌখিন পরিবহন আমাদের গিলাতলা সেনানীবাসের সামনে দিয়েই ঢাকায় চলাচল করে। ফলে সৌখিন পরিবহনে যাইতে হইলে আমাকে আর কষ্ট করিয়া শহরে যাইতে হইবে না। স্যার আরো একটি উপকার করিলেন। তিনি আমাকে একটা পাচ শত টাকার নোট ধরাইয়া দিয়া বলিলেন, যুদ্ধে যাচ্ছো, উদ্দেশ্য তোমার প্রিয়জনকে উদ্ধার করা। ইহাতে আর কারো কোনো ক্ষতি করার দরকার নাই। মুল উদ্দেশ্য সফল হইলে যতো তারাতাড়ি আবার ফিরে এসো। আমি ম্যানেজ করিয়া লইবো তোমার ছুটি। আর ইহাও বলিলেন, এমন কিছু করিয়া আসিবা যাহাতে তুমি বাকী সময়টা নিশ্চিন্তে পরাশুনা করিয়া আবার তাহাকে ফিরিয়া পাও। কি তাহার ইংগিত ছিলো আমি তখনো বুঝি নাই আর তিনিও আমাকে খোলাশা করিয়া বলিলেন না। আমি শুধু স্যারকে জরাইয়া ধরিয়া বলিলাম, স্যার আমার জন্য একটু দোয়া করিবেন। এই যুদ্ধ আমার আর আমার মহিলার।
রাত এগারোটা বাজিয়া গিয়াছে, সৌখিন বাস এখনো আমাদের এলাকার কাছাকাছি আসে নাই। ফোন করিলাম। তাহারা এইবার এমন একটা সংবাদ দিলেন যে, বাস সম্ভবত ঢাকা পর্যন্ত পৌছাইতে পারিবে না কারন নদীর ওপাড়ে এখনো হরতালের কারনে পথঘাট অবরুদ্ধ রহিয়াছে। ফলে তাহারা এখনো সন্দিহান ঢাকার উদ্দশ্যে বাস ছাড়িবে কিনা। অবশেষে বাস আসিলো রাত বারোটার সময়। জনগনের অনুরোধে বাস মালিক যেই পর্যন্ত বাস যাইবে সেই পর্যন্ত লইয়া গেলেই হইবে এই শর্তে বাস ছাড়িলো। আমি যথারীতি বাসে উঠিলাম কিন্তু আমার সিটকে বা কাহারা দখল করিয়া আছে দেখিলাম। কোনঠাসা মানুষ, একটা খালি সিট থাকিলে কে বসিতে না চায়? কিন্তু আমি ঊঠার পর আমার সিটদখলদার সিট খালি করিয়া দিলেন।
মে মাস। আকাশের অবস্থা সেই সন্ধ্যা হইতেই খারাপ ছিলো। মাঝ রাতে বর্ষণ শুরু হইলো। আমাদের বাস চালক, এই অতিবর্ষণেও খুব সন্তর্পণে ধীরে ধীরে বাস চালাইতে থাকিলেন। যেখানে ফরিদপুর অতিক্রম করিবার কথা রাত তিন্টায়, সেই বাস ফরিদপুর অতিক্রম করিলো সকাল আটটায়। সকাল আটটায় আবার হরতালের নতুন দিন শুরু হইয়াছে। ফলে আমাদের বাস আর সামনের দিকে আগাইলো না। ওখানেই তাহার যাত্রা শেষ হইয়া গেলো। আমরা সবাই যার যার বাক্স পেট্রাসহ ফরিদপুরের কোনো এক বাজারের কাছে নামিয়া গেলাম। কিন্তু আমাকে তো যাইতেই হইবে। একদিকে হরতাল, অন্যদিকে আবহাওয়ার এই রকম একটা উত্তাল চেহাড়া। অশান্তমনে আমি এক্তার পর এক্তা বিড়ি ফুকিতেছি আর ভাবিতেছি কি করা যায়। আমি দেখিতে পাইলাম, কিছু কিছু ট্রাক স্থানীয়ভাবে অল্প অল্প দুরুত্তে চলাচল করছে। আমি এই সুযোগটি গ্রহন করিলাম। অনেক ট্রাকওয়ালারা সাধারনত অন্য কোনো পেসেঞ্জার তাহাদের ট্রাকে নিতে আগ্রহী হয় না কিন্তু আমি আমার সেনাবাহিনীর পরিচয় দেওয়াতে অনেকেই আমাকে ছোট ছোট লিফট দিতে সাহাজ্য করিলেন। এইভাবে আমি দৌলত দিয়া ঘাট পর্যন্ত আসিয়া হাজির হইলাম। এখানে আসিয়া দেখিলাম, রাজ্যের অসংখ্য মানুষ ঘাটে অত্যান্ত মানবেতরভাবে ফেরির জন্য অপেক্ষা করিতেছে। উত্তাল ঝড়ের কারনে সব ফেরি চলাচল বন্ধ। কখন ফেরি চালু হইবে কেহই বলিতে পারে না। নদীতে অনেক বড় বড় ঢেউ। নদী পার হইবার কোনো রাস্তা নাই। কিন্তু আমাকে তো যেভাবেই হোক এই সাগর পাড়ি দিতেই হইবে কারন আমার জন্য পথ চাহিয়া বসিয়া আছে কোনো এক মেয়ে যাহার সমস্ত শক্তি দিয়া সে তাহার ভালোবাসার জন্য যুদ্ধ করিতেছে।
আমি একটার পর একটা সিগারেট শেষ করিতেছি আর ভাবিতেছি কি করিবো। এমন সময় দেখিলাম, কিছু লোক এক্তা ছোট লঞ্চ নিজেরা ভাড়া করিবার উপক্রম করিতেছে আর লঞ্চওয়ালাকে তাহাদের জরুরী কাজের কাহিনী বলিয়া বেশী টাকার লোভ দেখাইয়া ব্যাপারটা এইরুপ বুঝানোর চেস্টা করিতেছে যে, যদি তিনি রাজী হন তাহা হইলে এই মানুসগুলির অনেক বিপদ থেকে রক্ষা পায়। ঈশ্বর সব সময়ই এক্তা পথ বাতলে দেন। এইবারও তাহাই হইলো। লঞ্চওয়ালা রাজী হইলেন নদী পার হইতে। আমিও সেই লঞ্চে উঠিয়া গেলাম। পানির যে কত শক্তি আর বাতাসের সাথে ইহার যে কি রুপ এক্তা বন্ধুত যদি পানি আর বাতাস একসাথে হয়, তাহা হইলে ইহাদের তান্ডব লীলা দেখাইবার জন্য যেনো ইহারা এতোটাই হিংশ্র হইয়া উঠে যাহারা দেখেন নাই তাহারা ভাবিতেও পারিবেন না ইহা কি। বা ইহার রুপ কি। একবার একদিকে লঞ্চ হেলিয়া পড়ে তো সব মানুষজন হুমড়ী খাইয়া অন্য দিকে ঢলিয়া পড়ে, আবার ভারসাম্য রক্ষায় যখন মানুষ অন্যদিকে ঢলিতে চাহে, তখন সেই একই রুপ হয় যাহা একটু আগে হইয়া ছিলো। এইভাবে হেলিয়া দুলিয়া আমাদে ছোট লঞ্চটা কোনো রকমে আরিচা ঘাটে আসিয়া পড়িল। যখন লঞ্চটি আরিচা ঘাটে পউছিলো তখন আমাদের কাহারো পরনের জামা আর সুস্ক নাই, কাহারো মাথার চুলও আর পরিপাটি নাই। সারারাত না খাওয়ার কারনে আমার প্রচন্ড ক্ষুধা লাগিয়াছিলো বটে কিন্তু আমার সেই ক্ষুধা আমার ইন্দ্রিয় অবধি পউছায় নাই।
এই পাড়ে আসিয়াও দেখিলাম হরতাল আরো কঠিন করিয়া পালন হইতেছে। রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় আর জন-জীবনের প্রয়োজন তাহাদের নিজস্ব বাস্তবতা। তাই অতীব প্রয়োজনে কিছু কিছু রিক্সা অল্প দুরত্তে ভাংগিয়া ভাংগিয়া চলিতেছে। আমি চলমান বৃষ্টি আর বাতাস উপেক্ষা করিয়া কোনো রকমে এক রিক্সা থেকে আরেক রিক্সায়, এইভাবে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত চলিয়া আসিলাম। এখানে একটা কথা বলিয়া রাখা খুব দরকার যে, আমার ভালোবাসার মেয়েটি ঢাকার যেই জায়গায় অন্তরীন হইয়া চাতক পাখীর ন্যায় আমার আসিবার জন্য উতসুখ হইয়া আছে, ওই স্থানটি আমি চিনি না। কিভাবে যাইতে হইবে আর কিভাবে তাহার অবধি পৌছাইতে হইবে ইহা আমার জানা নাই। তাই আমি মনেপ্রানে ভাবিলাম, আমি তাহার পিত্রিস্থল মানিকগঞ্জে আগে যাইয়া সেইখান হইতে কাহাকেও লইয়া আমি ঢাকার সেই অন্ত্রীন জায়গায় পৌছাইতে হইবে। আমি মানিকগঞ্জে পউছিলাম, সেখানে এক করুন অবস্থা আমার গোচরীভুত হইলো। শুনশান বাড়ি, কারো মুখে কোনো কথা নাই। আমাকে দেখিয়া তাহার বৃদ্ধ মা এইবার একটি অশনি শংকেতের আভাস পাইলেন। ভাবিলেন, কি হইতে কি হইয়া যাইবে কিছুই বলা যাইতেছে না। আজিকার আকাশের মতো তাহার পরিবারে একটা ঝর বহিতেছে, তাহার মধ্যে আমি আবার টর্নেডোর মতো সেই সুদুর খুলনা হইতে আগমনে তাহার মনের অবস্থা আরো শঙ্গিত বলিয়া মনে হইলো। তিনি আমাকে একা ছাড়িতে চাহিলেন না তবে এইটুক ভরসা দিলেন যে, তিনি আমাকে অপছন্দ করেন না। তিনি আমার সাথে ঢাকা যাইবেন বলিয়া মনস্থির করিলেন। সাথে তাহার আরেক কন্যার স্বামী। নুরুজ্জামান সাহেব।
আমরা তিনজন একসাথে মানিকগঞ্জ হইতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলাম বটে কিন্তু আমার মন আরো একটি দুশ্চিন্তা ভর করিতে লাগিলো। পকেটের অবস্থা। হরতালের কারনে, ঝড় বৃষ্টির কারনে ভাংগিয়া ভাংগিয়া যাতায়তের কারনে অনুমানের চেয়ে বেশী খরচ হইয়া আমার পকেটে খুব সামান্য কিছু টাকা অবশিষ্ট রহিয়াছে যাহা জরূরি কোনো অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই সাভার সেনানিবাসের কাছে আসিয়া আমি আমার ব্যাংক মেনেজারের কাছে দেখা করিলাম আর তাহারা বাহিরে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। যেহেতু আমার আসল কর্মস্থল সাভার সেনানিবাস, তাই ব্যাংক মেনেজার একটু সদয় হইয়া আমাকে প্রায় আরো চার পাচ হাজার টাকার উত্তোলন করিবার (ওডি হিসাবে) অনুমতি দিলেন। বড্ড কাজে লাগিলো আমার এই সাহাজ্যটা। আবার আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইয়া গেলাম। পথ যেনো শেষ হইতে চায় না। স্কুটারে করিয়া আমরা সাভার হইতে ঢাকায় যাচ্ছি। রাস্তাঘাটে খুব একটা গাড়ি চলাচল করিতেছে না, কিছু রিক্সা আর কিছু স্কুটার লইয়াই আজ রাস্তার সংসার। আমি যখন ঢাকারা বাসায় পউছিলাম, তখন বেলা দুপুর। আমার আগমন হয়ত তাহারা কেহ জানিতো না। তাই আমাকে দেখিয়া অনেকেই তেলেবেগুনে জলিয়া উঠিলো এবং আমার সাথে কেহই ভালো ব্যবহার করিবার কোন চেস্টাই করিলো না।
যাহারা যাহারা ওই বেদেশী বরের সাথে আমার ভালোবাসার মেয়ের সাথে সম্বন্ধ পাকাপোক্ত করিয়া মনের সুখে পান চিবাইতে চিবাইতে সময়টা পার করিতেছিলেন, আমার আগমনে তাহাদের সেই পানের স্বাদে যেনো একটু গন্ডোগোল পাকাইয়া দিলো। কেউ পানের পিক ফালাইবার জন্য বাহিরে গিয়া আর ফিরিয়া আসিলেন না, কেউ আবার গোদগোদ করিতে করিতে আমাকে কেনো এখনো এই বাড়ি হইতে বাহির করিয়া দেওয়া হইতেছে না তাহা লইয়া কানাঘোসা করিতেছিলো। আমি বাড়িতে ঢোকিয়াই প্রথম যে কাজটি করিলাম, আমি আমার ভালবাসার মানুস্টিকে খুজিয়া তাহার সহিত কথা বলিবার জন্য দেখা করিলাম। দেখিলাম, তাহার চোখজোড়া মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতো ফুলিয়া আছে, বুঝিলাম বাহিরের আকাশের সহিত পাল্লা দিয়া সেও সারারাত হয়তো চোখের জল ফেলিয়াছে। পরনে তাহার কত দিনের মলিন কাপড় বুঝা যাইতেছিলো সেই দিকে তাহার কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। আমাকে দেখিয়া সে যেনো এইবার বাধভাংগা নদীর মতো আমাকে সবার সামনে জরাইয়া ধরিয়া কাদিতে কাদিতে বলিলো, আমাকে এইখান হইতে অন্য কোথাও লইয়া চলো। ওরা আমাকে মারিয়া ফেলিতেছে।
প্রায় দুইদিন না খাওয়ায় আমার শরীরের অবস্থা যেমন হইয়াছে, শুধুমাত্র মনের জোরে আমি টিকিয়া আছি। কিন্তু এই বাসায় আমার কোনো খাওয়া জুটিবে কিনা সেটা নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত নই তবে ভদ্রতা বলিয়া যদি কিছু থাকে তাহা হইলে হয়তো বা আমার কপালে কিছু খাবার জুটিবে, আর না জুটিলেও আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি এইখানে খাইতেও আসি নাই, আর কেউ আমাকে সম্মান করুক সেইটা নিয়েও আমি ব্যস্ত নই। আমার কাজ ভিন্ন আর সেইটা সাফল্য হইলেই আমি সার্থক। দুপুরের দিকে তাহার দুইভাই বাহির হইতে আসিয়া প্রথমেই একজন এই রকম উচ্চস্বরে কাকে যেনো উদ্দেশ্য করিয়া এমনভাবে চিৎকার করিতেছিলেন যে, তাহার সব কথাই আমার কানে আসিতেছিলো। সেই কথাগুলির সারমর্ম হইলো এই যে, কেনো আমাকে এখনো এই বাড়ি হইতে বাহির করিয়া দেওয়া হয় নাই। আমি অনেক ধৈর্য সহকারে সমস্ত কিছু গলাদকরন করিতেছিলাম। তাহাদের কোনো কথায়ই আমি বিচলিত ছিলাম না। একটু পর তাহার দুইভাই এবং এক ভাবি আমার সাথে কথা বলিবেন বলিয়া মনস্থির করিলেন। তাহাদের এই সিদ্ধান্তে উপস্থিত অনেকেই মনঃক্ষুণ্ণ হইতেছিলেন এবং তাহাদের সিদ্ধান্ত মানিয়া লইতে চাহিতেছিলেন না। কিন্তু আমাকে তো কিছু বলিয়া এই বাড়ি হইতে বিদায় করিতে হইবে। সুতরাং আমার সাথে কথা না বলিবার আর কোনো অবকাশ রহিলো না। ফলে যাহারা যাহারা এই সিদ্ধান্তে নারাজ ছিলেন, তাহারা একে একে বাড়ি ত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিলেন। আমি তাহার দুই ভাই আর এক ভাবীর সামনে বসিয়া কথা আরম্ভ করিলাম।
আজো আমার ওই কথাগুলি স্পষ্ট ভাবে মনে আছে। তাহা একেবারেই যেনো নিম্ন্রুপঃ
– ভাবী বলিলেন, দেখেন, আমাদের মেয়ের একটা ভালো সম্বন্ধ আসিয়াছে, ছেলে আমেরিকায় থাকে, অত্যান্ত ভালো পরিবার। আমরা আমাদের মেয়েকে ওই ছেলের সাথেই পাকাপাকি বিয়ার প্রস্তাব দিয়া দিয়াছি। আপনি অহেতুক গোল পাকাইয়া আমাদের মেয়ের জীবন নষ্ট করিবেন না। আমরা আপনার সাথে মেয়েকে বিবাহ দিতে পারিবো না। – আমার উত্তর ছিলো খুব সোজা। আমি বলিলাম, তাহা হইলে আমি যে মাঝে মাঝে আপনাদের মানিকগঞ্জের বাসায় সবার সাথে কয়েকবার ভর মজলিশে দেখা করিয়াছি, একসাথে বসিয়া খাওয়া দাওয়াও করিয়াছি, তখন কেনো আমাকে বারন করিলন না যে, ইহা আপনাদের পছন্দ নয়। আমার আর আগনোর প্রয়জন নাই?
– এই প্রশ্নে ভাবি বলিলেন, দেখেন আমরা জানি আপনার সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী আপনাকে বিবাহ করিতে আরো তিন থেকে চার বছর বাকী। এতো লম্বা সময়ে আমরা কেহই ভবিষ্যৎ বলিতে পারি না। কি এমন গ্যারান্টি আছে যে, আপনি এই কয়েক বছরে পরিবর্তন হইয়া যাইবেন না? তখন না আপনি আমাদের মেয়েকে আর পছন্দ করিবেন না আমরা আবার এই রকমের এক্তা সুপাত্র পাইবো সেইটারও কোনো গ্যারান্টি নাই। আমরা মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করিয়া আজ এইরুপ সিদ্ধান্ত লইয়াছি যে, আমরা ওই বিদেশী প্রবাশির সাথেই মেয়েকে বিবাহ দিবো।
– আমি গনক নই যে, ইহা বলিতে পারি যে, আগামি তিন চার বছর আমি বাচিয়াই থাকিবো কিনা। তবে আমি আমাকে চিনি, আমার উপর আপ্নারা ভরসা করিতে পারেন। আমি কথা দিতেছি যে, আমার অফিশিয়াল বিয়ের বয়স যেদিন হইবে তার থেকে এক মুহূর্তও দেরী করিবো না বিবাহের।
– ভাবী মানিলেন না।
আমি আবার বলিতে থাকিলাম যে, যদি এই বিস্তর সময় আমাকে আপ্নারা ভরসা করিতে না পারেন, তাহা হইলে আমাকে অন্তত আরো একমাস সময় দিন, আমি বর্তমানে খুলনায় একটা সেনা কোর্সে আছি,তাহা শেষ করি, ঢাকায় ফিরে আসি, আমি আমার নিজের সব গার্জিয়ানদের নিয়ে ঘটা করিয়া বিবাহ করিবো। হয়ত আমি সেইটা সেনাবাহিনীকে জানাইবো না কারন সেনাবাহিনী আমাকে তিন চার বছর আগে বিবাহ করিবার অনুমতি প্রদান করিবে না।
– তাহারা তাহাতেও তাহারা রাজী হইলেন না।
-আমি এবার সমস্ত সিদ্ধান্ত নিজের তরফ হইতে লইয়া লইলাম যে, যদি আপনাদের কোনো অপশনেই আমার উপর ভরসা করিতে না পারেন, তাহা হইলে আজি এক্ষুনী কাজীকে তলব করেন, আমি এই আজকের দিনেই আপনাদের মেয়েকে বিবাহ করিবো। এইবার তো আর কোনো যুক্তি তাহাদের খাটিল না। সিদ্ধান্ত হইয়া গেলো, আজই আমাদের বিবাহ হইবে। আমি বৈঠক হইতে উঠিয়া গিয়া আমার ভালোবাসাকে জানাইয়া দিলাম, আজ আমাদের বিয়া। আমি বলিলাম, চলো আমরা বাহির থেকে একটু ঘুরিয়া আসি, চা খাইয়া আসি, মুক্ত বাতাশে একটু দম লইয়া আসি। আমি আর সে দুইজনে আশেপাশেই একটি চায়ের দোকানে ঢোকিয়া চা খাইতে বসিলাম।অত্যান্ত নীচু মানের একটি চায়ের দোকান কিন্তু সেইটা আমাদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়। আমরা দুইজনে এখন একটু মুক্ত বাতাসে দম লইতে আসিয়াছি। সারাদিন ধকল গিয়াছে। আমরা চুপচাপ চা পান করিতেছি।
তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। খুব একটা লোকজন দোকানে নাই। হয়তো আমি আর ও। দোকানের মালিক আমাদেরকে হয়তো বারবার লক্ষ্য করিতেছিলেন। আমরা চা পান করছি ঠিকই কিন্তু আমাদের মধ্যে না আছে কোনো উচ্ছাস না আছে কোনো আবেগ। বিল দিতে গেলাম, দোকানি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করিলেন, "আমরা একে অপরের কি হই?"
বললাম, আজ আমাদের বিয়ে।
দোকানি এতোটাই হতবাক হইলেন যে, তিনি আর কোনো কথা বলতে পারিলেন না। শুধু বলিলেন, আমি অবাক হইতেছি যে, আপনাদের দেখিয়া কোনো বস্তির লোক বলিয়া মনে হইতেছে না, অথচ আপা খালি পায়ে এই দোকানে চা খাইতে আসিয়াছেন, আবার আপ্নারা যেনো কোনো কথাই কেউ কাহারো সাথে বলিতেছেন না। আমি বুঝতে পারিতেছি, আপ্নারা কোনো একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়া পার হইতেছেন। আমি দোয়া করি আপ্নারা সুখী হোন আর আজ আমি আপনাদের কাছ হইতে কোনো বিল নিতে চাই না। তিনি আমাদেরকে অনেক দোয়া করিলেন।
বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। দেখিলাম, কয়েকটি মুরগী কেনা হইয়াছে, কিন্তু কাটিবার লোক নাই, কিছু পোলাও হয়তো পাকানো হইবে, কিন্তু কে রান্না করিবে? একটু পরেই কাজী হয়তো আসিয়া পড়িবেন। মেয়ের মেঝো ভাই তাহার বোনের জন্য একটা শাড়ি, হয়তো কিছু কস্মেটিক্স কিনিতে বাহিরে চলিয়া গিয়াছেন। কনে কিছু না ভাবিয়া রান্না করিবার জন্য রান্না ঘরে চলিয়া গেলো। নিজের বিয়ে, নিজে রান্না করিবে, তারপর হয়তো একটু হাত মুখ ধুইয়া সাজোগূজো করিবে, তাহার পর আমাদের বিয়ে হইয়া যাইবে। লিলি নামের একজন মেয়ে যিনি কনের সমবয়সী, সে আসিয়া কনেকে রান্না বান্নায় একটু সাহাজ্য করিলো, অতঃপর সে তাহাকে হাতে মেহেন্দি আর মাথায় কিছু সাদা সাদা ফোটা দিয়া কোনো রকমে কনে সাজাইয়া ঘরের মধ্যে বসাইয়া দিলো। কাজী আসিলেন, কত টাকা কাবিন হইবে আমাকে জিজ্ঞেস করিলেন। আমি শুধু বলিলাম, এক টাকা হইতে আরম্ভ করিয়া শত কোটি টাকার যে কোনো একটি অংক যাহা তাহাদের মন কে শান্ততা দেয় তাহাই যেনো লিখিয়া লয়, তাহাতে আমার কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু কাবিনের খরচ দিবার মতো আমার কাছে কোন টাকা নাই। আর যদি কেহ আমাকে ওই কাবিনের খরচের সমপরিমান টাকা ধার দিতে চায়, দিতে পারে আমি পরে শোধ করিয়া দেবো।
অবশেষে তাহারা দশ লাখ টাকার কাবিনে বিবাহ হইবে বলিয়া মনস্থির করিলেন। কনের বিয়ের কাপড়, সাজ সরঞ্জামাদি, আলতা, কস্মেটিক্স এইসব নাকি বরের বাড়ি হইতেই দেওয়া হয়। তাই নিয়ম পালনের জন্য তাহারা আমাকে খরচের কথা বলিলে আমি বলিলাম, কিছুই আমার দেওয়ার মতো এখন সামর্থ্য নাই। এক কাপড়ে বিয়া হইলেও আমার কোনো আপত্তি নাই। তাহার পরেও বিয়া বলিয়া কথা। কনের বড় ভাই তাহার নিজের পকেটের টাকা খরচ করিয়াই মোট ৪৭২০ টাকায় সব কিনিয়া আনিলেন। আমার বিয়ের বাজেট এইটাই। ৪৭২০ টাকা। আজো আমার কাছে ওই রশিদটা সংরিক্ষিত আছে। ইহা একটি বিবাহের দলিল।
কাজী আসিলেন। বরের পক্ষ হইতে কে আসিয়াছে তাহা জিজ্ঞেস করিতেই আমি বলিলাম, -আমিই বর, আমিই বরের পিতা, আমিই বরের মাতা, আমিই বরের ভাইবোন এবং বরের সব। ইহা শুনিয়া কাজী আর কিছুই বলিলেন না। শুধু বলিলেন, অনেক বিবাহ করিয়েছি। কিছু গোপনে, কিছু কোর্ট ম্যারেজ হিসাবে, কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে। কিন্তু আজ দেখিলাম ইহা না প্রাইতিস্টহানিক না গোপন, না কোর্ট ম্যারেজ। ইহা একটি ওপেন প্রাতিষ্ঠানিক কোর্ট ম্যারেজের মতো যাহা আমার জীবনেও এক্টা ইতিহাস হইয়া রহিলো। আপ্নারা সুখী হোন।
আমাদের বিবাহ হইয়া গেলো। আজ ৩০ শে মে ১৯৮৮ সাল।