৩০/১০/১৯৮৬-বদি ভাইয়ার ৫০০ টাকা

১২ কার্তিক ১৩৯৩

 

আজকে ভাইয়ার (বদি ভাই) কাছ থেকে ৫০০ টাকা পেলাম। একদিন ভাইয়াকে বলেছিলাম কিছু টাকা লাগবে, আমি তারপর ভুলেই গিয়েছিলাম । এই ভুলে যাবার পিছনে একটা কারনও আছে। আমি জানি আমাকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করবার লোক আসলে নেই। কোথা থেকে টাকাটা পাঠীয়েছেন আমার জানা নাই  কিন্তু তিনি দায়িত্তশীল ব্যত্তি, তাই ভুলে যায় নাই। টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েছেন। এটা একটা ভালবাসা হতে পারে, এটা একটা sympathy  ও হতে পারে  আবার এটা একটা প্রতিশোধ ও হতে পারে। যেটাই হোক আমি খুব খুশী হয়েছি। বদি ভাই আমাদের পরিবারের জন্য বেশ অনেক কিছু করেছেন। আমরা যখন খুব অভাবের মধ্যে ছিলাম, শুনেছি তিনি হাবিব ভাইকে অনেক সাহায্য করেছেন। ঢাকায় আমার থাকার কোন জায়গা ছিল না এবং এখনো নাই। ঢাকায় থাকতে হলে এখনো বদি ভাইয়ের বাসায়ই উঠতে হয়। আমার ঢাকায় আসার সেই কাহিনি মনে পড়ে গেল আজ। তাহলে আমার সেই ঢাকায় আসার গল্পটা বলি।

আমি যেদিন প্রথম ঢাকায় আসি, আমার একদম মন টিকতো না। আমি তখন মাত্র ক্লাস সেভেন এ পড়ি। মনে পড়ে অনেক কথা। সেই ১৯৭৬ এর কথা। আমি প্রথম যেদিন ঢাকায় প্রবেশ করলাম, ঢাকার একটা গন্ধ আমি পেয়েছিলাম। শহরের একটা গন্ধ আছে। এখন আর এই গন্ধটা পাই না। প্রথমে নৌকা, তারপর রিকশা তারপর বদি ভাইয়ের বাসা। প্রায় সকাল ১১ টার দিকে বদি ভাইয়ের বাসায় পৌঁছলাম। সঙ্গে হাবিব ভাই।  হাইকোর্ট চত্তর । হাইকোর্ট এলাকাটা বেশ বড়ো খোলামেলা জায়গা, মাঝে মাঝে শুধু হাঁটলেও ভাল লাগে। সময়টা কেটে যাচ্ছে। এটা একটা সাবলেট । সব কিছুই নতুন। বদি ভাই, হাবিব ভাইকে আমরা সবাই খুব ভয় পেতাম, আমি পারত পক্ষে এই লোক গুলোকে এড়িয়ে চলবার সুযোগ খুজতাম, আর এখন আমি একদম তাদের হাতের ভিতর। এক দিকে ভয় আরেক দিকে আমি গ্রাম মিস করছি, একদম একা একা লাগত। কোন কিছুই আমার ভাল লাগত না। ঢাকায় আসার পিছনে একটা কারনও ছিল, আমি ক্যাডেট কলেজে পরিক্ষা দিব। আমার কোন কাজ নাই, শুধু পড়াশোনা। আমার জন্য একটা রুম দেয়া হল আর সেখানে আমি হাদিয়া আপার সাথে রাতে ঘুমাতাম। হাদিয়া আপা হল বদি ভাইয়ের বোন। আমার থেকে অনেক বড় আপা। এক বার সম্ভবত বিয়ে হয়েছিল কিন্তু সেটা আমি সিওর না। আমাকে কেও ওরা কখন বলে নি।

বদি ভাইয়ের বউ কেও আমি ভয় পেতাম, কি জানি ওনারা শহরের লোক, আমার গার্জিয়ান আর বদি ভাইয়ের বউতোঁ আর যেনতেন লোক নন। সুতরাং আমার কোন কারন নাই বদি ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে খুব একটা সহজ হয়ে মিশবার। বদি ভাই খুব বড় একটা চাকরি করেন না, খুব হিসেব করে চলেন। WAPDA ( Water and Power Development Authority) র Section Officer.তবে ওনি office এ একজন দাপটওয়ালা লোক। সৎ লোক, প্রফেসনাল লোক।

হাদিয়া আপার খুব শখ যে তিনি ভাল ইংরেজি শিখতে চান। প্রায়ই দেখতাম ইংরেজি বাক্য মুখস্ত করছেন। তারও কোন কাজ নাই আসলে। বদি ভাইয়ের ছেলে সাকি খুব ছোট। হাদিয়া আপা পানের সাদা পাতা খেতে খুব পছন্দ করতেন, হয়ত এ একটা নেশা।  কিন্তু বাইরে গিয়ে কেনবার ক্ষমতা তার ছিল না। এই কাজ তা আমি তাকে করে দিতাম। আর আপা এই জন্য আমাকে খুব আদরও করতেন। হাদিয়া আপা আমাকে আরও একটা কারনে আদর করতেন। হাদিয়া আপাও এখানে একা। আমার কাছে একটা জিনিস খুব অবাক লাগত যে এই বাড়িতে মাত্র দু জন মহিলা, এক ভাবি, আর এক হাদিয়া আপা কিন্তু  ওনাদের মধ্যে ভাল মিল ছিল না। ঝগড়া হয়ত করতে আমি দেখি নাই কিন্তু একটা গ্যাপ ছিল। আমার এই বাড়ীর খাবার  খেতে ভাল লাগত না। রুটিটা মনে হত শক্ত আর ভাত গুলো মনে হত পাথর। তবুও ত আমাকে এখানে থাকতে হবে।

হটাত একদিন দেখলাম মেহের (আমার ইমিডিইয়েট বড় বোন বদি ভাইয়ের বাসায় চলে এসেছে। ভাল লাগলো যে আমাদের বাড়ীর আরও একজন এখন আমার সাথে আছে। কিন্তু আমরা দুজন যেন রাজ্যের কষ্টে এবং মনে ব্যথা নিয়ে দিন কাটাতে লাগলাম। বেশ পড়ে বুঝতে পারলাম যে মেহেরকে আসলে এখানে আনা হয়েছে সাকিকে রাখবার জন্য আর ভাবিকে ঘরের কাজে সাহায্য কবার জন্য। হাবিব ভাই মাঝে মধ্যে এখানে আসতেন।

আমার শরীর দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। একদিন হাবিব ভাই কোন এক সন্ধায় হাইকোর্ট এর বাসায় আসলেন এবং আমাকে দেখে ওনি অবাক হয়ে গেলেন। আমাদর কষ্ট হচ্ছে ব্যাপারটা ওনি বুঝলেন। অনেক পড়ে আমি জানতে পেরেছিলাম যে, আমার থাকার কারনে হাবিব ভাই বদি ভাইকে টাকা দিতেন। কিছু দিনের মধ্যে বদি ভাই তার বাসা বদল করলেন, এবার হাইকোর্ট নয়, আগামাসিলেন , ১২৫ আগামাসিলেন। আরও একটা পরিবার থাকে এখানে । আমার সঙ্গে তাদের খুব একটা ওঠাবসা নেই বললেই চলে। হাদিয়া আপাও আছেন। একদিন হটাত করে হাবিব ভাই বল্লেন, ছবি তুলতে হবে , জীবনে কোনদিন ছবি তুলিনি, ব্যাপারটা নতুন একটা অনুভুতির জোগান দিল। ক্যাডেট কলেজে ভর্তির জন্য ছবি লাগবে। আমার পরনে যে শার্টটি ছিল, এটা ভালমত ধোয়া ছিল না। আমি হাবিব ভাইকে বললাম, শার্টটা ধোয়া দরকার ছবি তোলার আগে। ওনি হাসলেন। আমি আজও অবদি ঢাকা শহর ঘুরে দেখিনি। বিশেস করে রাতের বেলায়। রঙ বেরঙের আলো, লাল, নীল, সবুজ আরও অনেক। এই প্রথম আমি ঢাকা শহর দেখলাম বলে মনে হল। বাসায় এসে আমি ভাবীকে খুব মজা করে ঢাকা শহরের বর্ণনা দিলাম, ওনারা বেশ মজা পেলেন আমার কথাশুনে । আসলে ওনারা আমার ঢাকা শহরের বর্ণনা শুনে মজা করেননি, মজা করেছেন আমার বালকশুলব কথা শুনে। আমার এই ঢাকা শহরের বর্ণনা তাদের কয়েকদিন হাসির খোরাক হয়েছিল বলে আমার ধারণা। 

কোন এক অজ্ঞেত কারনে আবার আমার  পোস্টিং হয়ে গেল সাহিদুল্লাহ হলে, হাবিব ভাইয়ের রুমে। হাবিব ভাই আমাকে তার হলে (সাহিদুল্লাহ হলে) নিয়ে এলেন। সবাই ব্যাচেলর। সেকুল ভাই (Applied Physics এর Lecturer), আবু সুফিয়ান ভাই (সম্ভবত তিনি ছিলেন অংকের ল্যাকচারার), আর হাবিব ভাই ছিলেন Statistics এর ল্যাকচারার।  তারা সবাই ঢাকা ইউনিভর্সিটির টিচার। এখানে মাঝে মাঝে সুবরনা মুস্তফা (পরে ওনি অনেক বড় অভিনয় শিল্পি হয়েছিলেন) আসতেন, হুমায়ুন আহমেদ (পরে তিনি অনেক বড় লেখক হয়েছিলেন) আসতেন।  যাগগে সে কথা। যেটা বলছিলাম, এখানে যার যার বিছানা আলাদা, আমি আর হাবিব ভাই এক সঙ্গে এক খাটে ঘুমাই। সবাই আমাকে খুব আদর করেন কিন্তু আমি তাদের সবাইকে ভয় পাই। মেহের চলে গেছে গ্রামে, আমি শহিদুল্লাহ হলে। আমার এখানে সবচে ভাল সঙগি হচ্ছে বেগমের মা। বেগমের মা হচ্ছে ভাইয়াদের জন্য কাজের বুয়া। তিন বেলা পাক করে দিয়ে যায়। পাতলা একটা মহিলা, দেখেই বোঝা যায় যে সে অভাবে আছে।  

  

West End High School এ ভর্তি হয়েছি, বেশ দুরে।  হাবিব ভাই আরও একটা পরিবারের সঙ্গে  আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন,তা হল Newton দের পরিবার। West End High School এ আমার বেশ দুজন ভাল বন্ধু জোটে গেল, একজনের নাম মালেক, আর একজনের নাম রুমি। প্রতিদিন আমি Dhaka Medical College এর পাশ দিয়ে Salimullah Hall পার করে Azimpur Palashi র মোড় পার হয়ে Azimpur Girls School এর পাশ দিয়ে West End School এ পৌঁছতে হয়। আমি সময় পেলেই রুমিদের বাসায় চলে আসতাম, ওরা থাকত Salimullah Muslim Hall এর পাশের Quarter এ। আমি অত্যন্ত ঘনিস্ঠ হয়ে মিশে গিয়ছিলাম ওদের সাথে। আসলে কোঁথাও আমার মেলা মেশার জায়গা ছিল না। গ্রামের একটা uncultured ছেলে, শহরের অনেকের কাছেই আমার কথার বাচনভঙগী, উচ্চারণ আর গ্রামের গেয়ো কিছু আচরণতো চোখে পড়তই। আজ রুমি কোথায় আছে আমি জানি না। সে হয়ত আমাকে আর মনেই রাখেনি। রুমিরাও অনেক বড় লোক ছিল না কিন্তু কোনদিন আমি ওদের বাসা থেকে না খেয়ে আসতে পেড়েছি এটা আমার মনে পড়ে না। রুমির একটা বড় বোন ছিল, আমাকে খুব আদর করত। আজ এই সব বোনেরা কোথায় আমার খুব জানতে ইচছে করে। হাদিয়া আপা মারা গেছেন, সেটা আম জানি, কিন্তু রুমির বোন, বেগমের মা, এরা যে এখন কে কোথায় আমি  কিছুই জানি না।

West End High School এর ক্লাস করা ছাড়া আমার এখানে একটাই কাজ, লেখাপড়া আর লেখাপড়া, ক্যাডেট কলেজের জন্য প্রিপারেসন নেয়া। আমি প্রতিদিন রটিন করে পড়াশোনা করি আর হাবিব ভাই আমার পরড়াশোনার খবর নেন। আমি প্রতিদিন সকালে TSC (Teachers Student Center) এর পাঁশে Dhaka University র মাঠে এবং জিমনেসিয়ামে ব্যায়্যম করতে যাই। এটা ও ক্যাডেট কলেজে ভর্তির একটা অংশ । Dhaka University র মাঠে এবং Dhaka University র জিমনেসিয়ামে আমার মত একজন পিচ্চি ছেলে ব্যায়্যম করতে যাওয়া কিছুতেই মানায় না, তারপরেও যারা (বড়রা) ওখানে ব্যায়্যম করতে যেতেন, তারা কখনও আমাকে কোশ্চেন করতেন না কে আমি বা কেন আমি ওখানে ব্যায়্যম করতে যাই । সময়টা ভালই কাটছিল কিন্তু সমস্যা হল, এখানে থাকার ব্যাপারটা নিয়ে। সবাইত ব্যাচেলর, আবার এখানে যার যার বিছানা আলাদা, আমি আসলে এখানে অনেক ভাবেই মানানসই নই। West End High School টা ও দূরে, হাবিব ভাই হয়ত অনেক কিছু ভেবে শেষ পর্যন্ত আমাকে Newton দের বাসায় রাখার প্লান করলেন। Newton ও ক্যাডেট কলেজে পরিক্ষা দেবে, সুতরাং ব্যাপরটা ম্যাচ করছিল। এখানে এসেও আমি একজন খুব ভাল বোন পেলাম। নাম জুয়েনা আপা। জুয়েনা আপা আমাকে খুব আদর করতেন। আমার অনেক কাজ, অনেক বকা, অনেক Emotional দাবী সবই পুরা করতেন । Newton খুব চাল্লু ছিল, আমি যা বুঝতে পারতাম আজ, Newton তা বুঝতে পারত তিন দিন আগে।

হাবিব ভাই ওলমোস্ট প্রতিদিন আসতেন আমাদের পড়াতে। সামনেই ক্যাডেট কলেজের পরিক্ষা। ক্লাসও করি আবার ক্যাডেট কলেজের প্রিপারেসনও নিচ্ছি ,

আমার ধারণা আমি চান্স পাব।

যাক, এবার যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তা বলি। এই বদি ভাই না থাকলে হয়ত আমি ভালভাবে ঢাকায় থাকতেই পারতাম না। ওঁনার অনেক অবদান আছে আমার জীবনে। ভাবীকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, ভাল মহিলা। খুব বেশি দাবী দাওয়া তার নাই। তার একটা সংসার দরকার এবং সেটা আছে। ব্যাস, ওনি খুশী।