আমি নিউলংকার বিডিআর ক্যাম্পের দায়িত্তে আছি। নির্জন পাহাড়িয়া এলাকা। শান্তিবাহিনীর আমল। সুদুর চট্টগ্রাম থেকে এই নিউলংকার ক্যাম্পে আসার জন্য কোনো যানবাহন নাই, পুরু পথ পায়ে হেটে আসতে হয়। এতো এতো উচু পাহাড় আর নালা যে, এক কিলোমিটার হেটে আসতে সময় লাগে প্রায় ২/৩ ঘন্টা। যেহেতু যানবাহনের সুযোগ নাই, তাই, আমার এই ক্যাম্পে যতো খাবার আসে, সবকিছু হেলিকপ্টার দিয়ে সরবরাহ করে। আবহাওয়া খারাপ থাকলে মাঝে মাঝে আমাদের ক্যাম্পের খাবারের সল্পতা দেখা যায়। তখন আমাদেরকে অনেক কম সরবরাহে জীবনযাপন করতে হয়। প্রতি ১৫ দিন পরপর হেলিসর্টি হয়। আমরা ব্যাপারটায় প্রায় অভ্যস্থ হয়ে গেছি যে, মাঝে মাঝেই আবহাওয়ার কারনে ক্যাম্পে হেলিসর্টি বিঘ্নিত হতেই পারে। এরফলে আমরা বিকল্প ব্যবস্থার স্রিষ্টি করি। যেমন, লোকাল লোকজনের কাছ থেকে কিছু চাল, কিংবা শব্জি, অথবা কখনো কখনো হাস মুরগী বা ছাগল জাতীয় বাজার কিনে দিনানিপাত করি।
পাহাড়িয়া এলাকার মানুষ বেশ গরীব। তারা অল্প দামেই এসব আমাদের ক্যাম্পে এসে বিক্রি করে। অনেক সময় তারা ভয়েও বেশি দাম বলে না বা ওরা হয়তো এ রকমই। অল্পতেই খুশী। ওদের জীবন যাত্রা একেবারেই সাদাসিদে। অনেক ট্রাইব। কোনো কোনো ট্রাইব গরু ছাগল হাস মুরগী কুকুর বিড়াল সবই খায়। কিন্তু সব ট্রাইবদের একই স্বভাব প্রায় যে, এরা কোনো খোয়াড়ে কোনো পশু বা জন্তু বন্দি করে পালন করে না। পাহাড়িয়া মানুষদের মতো এই জন্তুগুলিও সারাদিন পাহাড়ের এপাশে ওপাশে ঘুরে ঘুরে ঘাস কিংবা লতাপাতা খেয়ে পেট ভর্তি করে, আর পেট ভরে গেলে জন্তুগুলি যার যার বাড়িতে সয়ঙ্ক্রিয় ভাবেই পৌঁছে যায়। জন্তুগুলিও ওদের নিজের আস্তনা যেনো ভালো করেই চিনে। কখনো কখনো একপাল ছাগল, বা ভেড়া দলবদ্ধভাবে এক পাহাড় থেকে মনের আনন্দে ঘাস খেতে খেতে মাইলের পর মাইল হেটে আমাদের ক্যাম্পের পাশেও চলে আসে।
বর্ষার দিন চলছে। প্রায়ই আবহাওয়া চরমরুপে থাকে। কখনো কখনো ঝর, কখনো মুষল্ধারে বৃষ্টি হয়। আমরা যেখানে থাকি, তার উচ্চতা প্রায় ২/৩ হাজার ফুট। মাঝে মাঝে মেঘের ভেলা আমাদের গা ভিজিয়ে দিয়ে যায়। আমার বড্ড ভালো লাগে আকাশের এই লুকুচুরি। ইদানিং আবহাওয়া খারাপ থাকায় আমাদের ক্যাম্পে হেলিসর্টি আসতে পারছে না। পাহাড়িয়া ঝড় খুব বেপরোয়া। আমাদের ক্যাম্পের রসদ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পে চাউলের কোনো সমস্যা নাই কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সবজি বা কোনো মাংশের ব্যবস্থা নাই। আমরা প্রায় ৪০ জন মানুষ। প্রতিদিন হেলিসর্টির জন্য অপেক্ষা করি বটে কিন্তু প্রতিদিনই সেটা আবহাওয়ার কারনে বাতিল হয়ে যাচ্ছে।
বসে আছি ক্যাম্পের মেইন গেটের সামনে। এমন সময় দেখলাম, একটা কাল ছাগল ঘাস খেতে খেতে আমাদের গেটের সামনে এসে হাজির। আমার সেন্ট্রি বল্লো, স্যার, ক্যাম্পে তো কোনো কিছুই নাই, আবার কবে হেলিসর্টি আসবে সেটাও সিউর না। এই যে একটা ছাগল গেটের সামনে ঘাস খাচ্ছে, আমরা তো এটাকে জবাই করে আপাতত জীবন বাচাতে পারি। আমি বললাম, কার না কার ছাগল। কিভাবে জবাই করি? যদি মালিক পাওয়া যাইতো, তবে না হয় টাকা দিয়ে কিনে নিতে পারতাম। সেন্ট্রি বল্লো, স্যার যদি আমরা খেয়ে ফেলি, এক সময় অরিজিনাল মালিক হয়তো কাল বা পরশু এই ছাগল কোথায় গেলো খুজতে খুজতে ক্যাম্পে আসতেও পারে। তখন না হয় দাম দিয়ে দেবো।
একদিকে ক্যাম্পে কোনো খাবার নাই, অন্যদিকে কার না কার ছাগল জবাই করে খেয়ে ফেলবো, ব্যাপারটা আমার কাছে কখনো অবস্থায় কারনে সঠিক বলে মনে হলেও আবার পরক্ষনে এটা নীতি বিরুদ্ধ কাজ সেটাও মাথায় চলে আসে। আমি আসলেই আমার সৈনিকদের নিয়ে বেশ চিন্তায় আছি। এই চিন্তা নিয়েই ঘুমাতে গেলাম। পরদিন সকালে দেখলাম, ছাগলটা তখনো মেইন গেটের সামনেই শুয়ে আছে। এটা আর তার নিজ মালিকের ঘরে ফিরে যায় নাই। ব্যাপারটা আমার কাছে অসাভাবিক মনে হয়েছে। আরো অসাভাবিক মনে হয়েছে যে, কোনো উপজাতী তার ছাগলটা হারিয়ে গেছে এর জন্যে খুজতেও আসে নাই। কয়েকজন উপজাতী এর মধ্যে আমাদের ক্যাম্পে এসেওছিলো। কিন্তু কেউ বলতে পারে নাই আসলে এই ছাগলটা কার বা কে মালিক।
হেলি সর্টি না আসার কারনে আমার মাথাও বেশ অগোছালো মনে হচ্ছিলো যে, কিভাবে এই ৪০/৪২ জন সৈনিকের প্রতিদিনকার খাবার আমি ব্যবস্থা করবো। এক সময় মনে হইলো যে, যদি আগামি কালও দেখি ছাগলটা ক্যাম্পের গেটে আছে, তাহলে এটাকে জবাই করে খেয়ে ফেলবো। পরে যদি কেউ খুজতে আসে, তখন না হয় মাফ চেয়ে ন্যয্য মুল্য দিয়ে দেবো। আপাতত জীবনতো বাচুক। রাতে ঘুমাতে গেলাম। বাইরে প্রচন্ড ঝড়, সাথে তুমুল বৃষ্টি, আগামী কালও যে হেলিসর্টি হবেনা এ ব্যাপারে আমি নিসচিত।
সপ্নঃ
আমরা ছাগলটা জবাই করে ফেলেছি। ক্যাম্পের সবাই আনন্দের সাথেই এটার মাংশ ছারাচ্ছে। আজ ভালো একটা খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে, এই আনন্দে প্রায় সবাই ছোট এই ছাগলটার মাংশের দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও পাশেই একটা চেয়ারে বসে সৈনিক মাংশ ছারান দেখছি। ছাগলের মাংশ বানানো শেষ। বিকালে বাবুর্চি মাংশ রান্না করেছে। রাতে আমার রানার ভাত আর ছাগলের মাংশ নিয়ে এলো আমার জন্য। কিন্তু একি? আমি ছাগলের মাংশের পরিবর্তে মনে হলো এটা তো কুকুরের মাংশ মনে হচ্ছে! আমার খুবই ঘেন্না লাগল। আমি কিছুতেই মাংশটা খেতে পারলাম না। আমার ঘুম ভেংগে গেলো। আমি পরদিন দেখলাম, ছাগলটা তখনো মেইন গেটে শুয়ে আছে। কিন্তু এবার আর আমার সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হয় নাই। আমি মনে মনে ভাবলাম, এতা খাওয়া যাবে না। এতা আমার জন্য এইভাবে খাওয়া হারামের ইংগিত দিচ্ছে।