৩১/০৫/২০১৬- সন্ধার গল্প

৩১/০৫/২০১৬- সন্ধার গল্প

১ম পর্ব

মাঝে মাঝেই আমি তার চোখের কোনায় অশ্রু দেখতে পাই। মাঝে মাঝে আবার আমি তাঁকে অন্যমনস্কও হতে দেখি। নাম ধরে ডাকলে সে হটাত যেন কোন এক ভাবনার জগত থেকে সম্বিত ফিরে পেয়ে আতকে উঠে জিজ্ঞেস করে, কিছু বললাম কি? আমি যখন তাঁকে অনেক আদর করি, আমি যখন তাঁকে অনেক অনেক সপ্নের কথা বলি, তখনো দেখি তারমধ্যে কোথায় যেন একটা নির্বিকার ভাব। আমি যখন তাঁকে অতি আদরের সহিত আলিঙ্গন করে বুঝবার চেষ্টা করি কি হয়েছে তার, তখন বুঝি আখি তার আরও ভেজা, নিঃশ্বাস তার প্রবল ধীর, অথবা পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল মুক্ত পরিবেশের চেয়েও সে আরও চুপচাপ। মনে হয় মনের ভিতরের কোন এক ব্যাথায়  কান্নায় রুপান্তরিত হয়ে কান্নাটা আরও গভীর থেকে ঢেউয়ের মত উপচে পরছে আমার দুই কাধের শিরা দিয়ে, আমার বুকের চারিধার দিয়ে। 

ভয় হয় আমার, চিত্ত শঙ্কিত হয়ে উঠে কোন এক অজানা ভয়ে। নিজেকে প্রশ্ন করি, এমন কিছু কি আছে যা আমার কাছে নাই? এমন কি কিছু আছে যা আমি তাঁকে দিতে পারিনি অথচ সেটা তার অনেক দরকার অথচ সে মুখ ফুটে বলতে পারছে না? এমন কি কিছু আছে যা বলার জন্য সে বুকে সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছে না অথচ বুক ব্যাথায় টনটন করছে? এমন কি কিছু হচ্ছে যা মানতে হচ্ছে অথচ মানা যাচ্ছে না? অনেক অজানা প্রশ্ন জাগে মনে। মাঝে মাঝে নিজেকে বড় দোষী মনে হয়। 

অনেক প্রশ্ন করেছি আমি তাঁকে। উত্তরে কখনো শুধু তার নির্বিকার আর নির্লিপ্ত চোখ আবারো জলে ভেসে গেছে, অথবা আরও নির্লিপ্ত হয়েছে বোবা এক অশরীরী জিবের মত। আবার কখনো উচ্ছল তরঙ্গের ন্যায় আমাকে অভাবিত এক ধাক্কায় নিমিষে ‘কিছুই না’ বলে ধর্তব্যের মধ্যেই বিষয়টি পরে না বলে তা উরিয়ে দিয়েছে। তারপরেও আমি তাঁকে পুনরায় সেই আগের মতই দেখেছি বারংবার, নির্লিপ্ত, ভাবলেশহীন নিথর কোন এক পাথরের মত।

আজ তার কথা শুনে শুধু তারই না, আমারও চোখ ভিজে এল শ্রাবনের ধারার মত।………

” আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। আমার বয়স তখন তের কি চৌদ্দ। সবে মাত্র স্কুল পাশ করে হাই স্কুলে পা রেখেছি। …………….(চলবে)

২য় পর্বঃ

” আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। আমার বয়স তখন তের কি চৌদ্দ। সবে মাত্র স্কুল পাশ করে হাই স্কুলে পা রেখেছি। প্রতিদিন আমি স্কুলে যাই চোখের কোনায় অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখি, অনেক বড় হওয়ার আশা নিয়ে আমি দুরু দুরু পায়ে স্কুলের দিকে হেটে চলি। আমি কখনো স্কুল কামাই করেছি এমন রেকর্ড আমার ছিল না। আমার গন্ডি শুধু স্কুল আর আমার পরিবার, আমার ছোট্ট সে ঘর, যেখানে আমি বাস করি আমাকে নিয়ে আর আমার সাথে থাকে আমার ছোট ছোট কয়েক ভাই বোন।বেশ ভালই কাটছিল আমাদের সংসার।

একদিন আমি স্কুলে ক্লাসে স্যারের পড়া নিয়ে অনেক জটিল অংকের ফরমুলা নিজের মাথায় আটিসাটি করে বুঝার জন্য যখন অনেক মগ্ন, তখন হটাত করে আমার বাবা আমার ছোট ভাইকে দিয়ে স্কুলে খবর পাঠালেন বাড়ীতে যেতে হবে। মনে ভয় হল, কি হয়েছে বাড়ীতে? কারো কোন দুসসংবাদ নাতো? গুটিগুটি পায়ে ছোট ভাইয়ের হাতধরে কাছেই আমার বাড়ীতে পৌঁছে দেখি দলবেধে অনেকলোক আমাদের বাড়ীতে বসে কেউ পান খাচ্ছেন, কেউ আবার খোশ গল্প করছেন। মনটা যে অজানা ভয়ে এতক্ষন সংকিত ছিল তা আর রইল না। খারাপ কিছু হয় নাই তাহলে। কিন্তু আমি অনেক বোকা। আমার জানা ছিল না যে, আমার জন্য আরও কঠিন একটা সংকাজনক অধ্যায় অপেক্ষা করছিল।

আমি বাড়ীতে পা রাখতেই মনে হল, আমাকে নিয়ে যেন সবার একটা বাড়াবাড়ি, সবাই কি নিয়ে যেন কানাঘুষা করছে, মিটিমিটি হাসছেও। কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অথচ আমি তাদেরকে চিনি না, কেউ আবার আমার গালে হাত দিয়ে একটু আলতো করে টিপে দিয়ে বলছে, বাহ কি সুন্দর দেখতে। ইত্যাদি। মাকে বললাম, মা এরা কারা? মা মুচকি মুচকি হেসে দিয়ে বললেন, মা, তোমাকে ওরা দেখতে এসেছে। তাদের ছেলের জন্য।

নিমিষের মধ্যে আমার বুকের চারিপাশটা একটা ওসয্য যন্ত্রনায় আমাকে মুচড়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমার পায়ের তল থেকে সবগুলো মাটি একসঙ্গে সরে যাচ্ছে। আমার চোখ সামনের কিছুই দেখছে না, সব ঝাপসা মনে হচ্ছে। মাকে বললাম, মা আমার পরাশুনা?

মা শুধু বললেন, দেখরে মা, আমরা অনেক বড়লোক নই। আমাদের এতো পরাশুনা করে কি হবে? কে আছে আমাদের? নিজেকে বড় অসহায় মনে হতে লাগলো। আমার বুকে জগদ্দল পাথরের মত একটা বিশাল পাথর এমনভাবে চেপে বসলো যে মনে হল আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কেউ আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চাচ্ছে। আমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমি দুর্বল নই কিন্তু আমি এখন প্রতিবাদ করার মত সাহস ও আমার নাই কিন্তু এটা বুঝতেছিলাম যে, আমাকে এই রাহু গন্ডি থেকে বের হতে হবে যে কোন উপায়ে।

লোকজন আমাকে দেখে গেলো। আমাকে নাকি খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। এই কথার মধ্যেই তারা যাওয়ার সময় আমার বাবা মাকে বলে গেলেন, অচিরেই সম্ভাব্য সব কিছু তারা করে ফেলতে চান। শুভ কাজে নাকি বিলম্ব করতে নাই। কি আমার ভাগ্য। আমি কি চাই, আমার কি স্বপ্ন আর আমাকে নিয়ে সবাই কি স্বপ্ন দেখছে। নিজেকে মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে আমি ভগবানের কাছে অনেক কাদলাম সেই রাতে। আমার ভাল ঘুম হয় নাই। যেটুকু ঘুম আসে, শুধু দেখতে পাই চারিদিকে মানুষগুলো আমাকে ঠাট্টা তামাশা করছে, আর দেখতে পাই আমার সেই সখের স্কুল বেঞ্চ গুলো যেখানে আমার অনেক সপ্নের কথা লেখা আছে আমার কাঠ পেন্সিলের দাগে দাগে।

রাত পোহাতেই আমি বাবাকে বললাম, বাবা, আমাকে তুমি এখন বিয়ে দিও না। আমি পরতে চাই। বাবা খুব সহজ সরল মানুষ। কোন কিছুই অনি কারো উপর জোর করে চাপিয়ে দেন না আবার কেউ তার উপর কেউ কিছু জোর করে চাপিয়ে দিলেও তার প্রতিবাদ করতে শিখেন নাই। অনেক্ষন চুপ করে দাড়িয়ে থেকে বাবা বললেন, আচ্ছা দেখি আমার এক খুব পরিচিত আপন জন আছে তার কাছ থেকে আমি শলা পরামর্শ করে জানাবো। তিনি আমাদের পরিবার কে খুব ভাল করে চিনেন আর খুব জ্ঞ্যানি মানুষদের মধ্যে একজন।

বললাম, তাহলে আমাকেও নিয়ে চল।

বাবা তাই করলেন। ভদ্রলোক খুব বেশি বয়সের নন। খুব বেশি হলে হয়তবা সাতাইশ কি ত্রিশ বছরের হবেন। অসম্ভব ধিরস্থির মানুষ। অনেক লেখাপড়া করেন তার বইয়ের স্তর দেখলেই বুঝা যায়। হাতে চমৎকার একটি সোনালী রঙের ঘড়ি, তার বসার ঘরটাও বেশ সাজানো।

বাবাকে দেখেই বললেন, কি চাচা কেমন আছেন? হটাত কোন আগাম বার্তা না দিয়েই কি জন্য চলে এলেন? আমার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন, কি নাম তোমার?

এমন করে নাম টা জিজ্ঞেস করলেন যেন তিনি আমাকে আরও কয়েকবার দেখেছেন কিন্তু এখন আর মনে করতে পারছেন না।

তিনি আর কেউ নন, তিনি সেই আপনি।

আমার বিয়ের কথা শুনেই আপনি আমার বাবাকে এমন করে ধমক দিলেন যে, আমার বাবার আর কোন বিকল্প পথ ছিল না আপনার কথার বাইরে কিছু করেন।

আমার আবার স্কুলের দরজা চালু হয়ে গেল। খুব ভাল লেগেছিল আপনাকে। পায়ে ধরে আপনাকে আমার সালাম করতে ইচ্ছে করেছিল সেদিন। তারপরের কাহিনী আপনি আর জানে না। কারন সবাই ধরে নিল, আপনাকে দিয়ে আমাদের বাড়ীর আর যাই হোক বেশি উপকার হবে না কারন আপনি একাই সব সিদ্ধান্ত পাল্টে দিতে পারেন, সে ক্ষমতা আপনার আছে ছিল এবং সেটা আমি দেখেছি।

 দিন যায় মাস যায়, আমি তখন মেট্রিক পরীক্ষার ছাত্রী। ইতিমধ্যে অর্ধেক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আর মাত্র দুইটা পরীক্ষা বাকি। ভাল পরীক্ষা হচ্ছে। তারপরেই আমি কলেজে ভর্তি হয়ে যাব। নতুন স্বপ্ন, নতুন দিগন্ত, নতুন ইচ্ছা। ঠিক পরীক্ষার আগের দিন সকাল হতে না হতেই আবার আরেক নতুন দল এসে হাজির আমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমার সারা শরীর ভয়ে হিম হয়ে আসছিল, একটু পরে আমার পরীক্ষা। যাকেই বলি, সে ই বলে, পরীক্ষা দিতে যেতে হবে না। ভাল পাত্র, সারা বছর ঘরের ধানের ভাত খায়। বাড়ীতে পাকা বিল্ডিং আছে। কত কিছু। আমি ঈশ্বরকে শুধু ডাকলাম। আমার মাথা কোন কিছুতেই কাজ করছিল না। কি হবে আমার পরীক্ষার, কি হবে আমার জীবনের? কেন কেউ আমাকে একটুও বুঝতে চাইছে না? আমার চোখ ভোরে শুধু কান্না পাচ্ছিল।

আমার শুধু আপনার কথা মনে হচ্ছিল সারাক্ষন। কিন্তু আমার কাছে না আছে আপনার কোন নাম্বার, না আছে কোন মাধ্যম যোগাযোগের।

মানুষ যখন খুব অন্তর দিয়ে ঈশ্বর কে ডাকে তিনি তার সারা দেন। আমি বাথ রুমের নাম করে কোন কাপড় চোপর না পাল্টিয়ে জুতা ছেড়ে খালি পায়ে সোজা পিছনের দরজা দিয়ে দৌর আর দৌর দিতে থাকলাম। আমার লক্ষ ঐ পরীক্ষার হল। যে করেই হোক আমাকে ই পরীক্ষার হলে পৌঁছতে হবে। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আমি যখন পৌঁছলাম, তখন ইতিমধ্যে দের ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। আমাকে দেখে আমার সব শিক্ষকরা এতটাই অবাক হলেন আর আমার চেহারা, চোখের পানিতে ভেজা আমার নয়ন দেখে তারা এতটাই উদ্বিগ্ন হলেন যে, আমাকে অন্তত আদর করে প্রধান শিক্ষকের রুমে নিয়ে পরীক্ষা তা দেওয়ার সুযোগ করে দিলেন।

আর ওদিকে আমাকে কোথাও না পেয়ে আমি পলায়ন করেছি এই মর্মে সবাই আমাকে প্রচন্ড দোষারোপ করতে কেউ একটুও পিছপা হলেন না। পরীক্ষা দিয়ে আমি আর আমাদের বাসায় ফিরে না গিয়ে আমার এক বন্ধুর বাসায় দুই দিন থেকে পরিক্ষাটা শেষ করলাম। মনে হল অন্তত একটা ধাপ তো পার করলাম?

এবার শুরু হল আরেক নতুন বিপদ। পরীক্ষার ফল বের হয়েছে কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাকে কলেজে ভর্তি করতে নারাজ কারন আমার পরিবারের কেউ আমাকে আর পরাবেন না এবং অন্যত্র বিয়ের ব্যবস্থা করছেন এই মর্মে কলেজ কর্তৃপক্ষকে সাফ জানিয়ে রেখেছেন। যাতে আমার কোন ভর্তি না করানো হয়। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হল। আজ মনে হল, আমি অসহায় নই আমি মানুষের অত্যাচারের কাছে জিম্মি। আমিও সেদিন শপথ করেছিলাম, আমি আমার ইচ্ছাকে অকালে মৃত্যু বরন করতে দেব না। কিন্তু কিভাবে? খুব খুজেছি আমি আপনাকে। কত জায়গায় যে আমি আপনাকে খুজেছি, কত মানুষের পিছন থেকে চেহারা দেখে মনে হয়েছে এই বুঝি আপনি। কত দিন যে আমি ঐ রাস্তার ধারে অপেক্ষা করেছি যদি কোনদিন আপনি ঐ রাস্তায় কখনো আসেন। আপনি কখনো আসেন নাই।

আমি এই ভাবে কতবার যে আমার সেই অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ের আসর ভেঙ্গে বার বার পলায়ন করেছি তার কোন ইয়ত্তা নাই। আর এভাবেই আমার মনে বিয়ে নামক জিনিসটা একেবারে বিরক্ত আর ঘৃণায় ভোরে গেলো। কেউ আমাকে দশ ভরি সোনা দেবে, করো বিয়া, কেউ আমাকে দুই লাখ টাকার কাবিন করবে , তো করো বিয়া, কেউ আবার আমাকে রাজ রানী করে রাখবে, করো তাঁকে বিয়া, কেউ আবার একেবারে বকলম কিন্তু চেহারা সুন্দ, তো করো তাঁকে বিয়া। কি এক অসজ্য যন্ত্রণায় আমি আর পেরে উঠতে পারছিলাম না। তারপরেও আমি আমার সাথে প্রতারনা করতে পারিনি। আমি কলেজের পড়াটাও শেষ করতে পারলাম।

গল্পটা এখানেই শেষ নয়, মাত্র শুরু…

তারপর ……। (চলবে) 

৩য় পর্ব 

কলেজের কেউ আমাকে ভর্তি করছে না। যখনই যাই, তখনই শুনি হয় অমুক স্যার নাই, আজ হবেনা, পরের দিন গেলে বলে আজ ফর্ম নাই, দুইদিন দেরি হবে। আবার যাই, তো শুনি ঐ কাগজ লাগবে তো ঐ কাগজ লাগবে। অনেক বিরম্বনা। মনে হল, কোথায় যেন কি ঠিক নাই। কলেজে ভর্তি হতে কি এমন হয়? তাহলে অন্য সব ছেলেমেয়েরা কি করে এতো সহজে ভর্তি হতে পারল? অথচ আমার বেলায় হচ্ছে না কেন? মন টা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছিল প্রতিদিন। প্রায় প্রতিদিন যাই, আর প্রতিদিন ই মন খারাপ করে ফিরে আসি। একদিন আমার এক ম্যাডাম আমাকে কাছে ডাকে নিয়ে বললেন, শুন সন্ধ্যা, তুমি এই কলেজে ভর্তি হতে পারবেনা কারন কয়েকদিন আগে এখানকার নেতা গোছের একলোক এসেছিল আমাদের কলেজে। এসে বলে গেছে তোমাকে সে ভালবাসে, তোমার সাথে ওর বিয়ে হবে, আর তাই তোমাকে আর তারা পরাতে চায় না। তাই কলেজ থেকে কেউ সাহস করছে না তোমাকে ভর্তি ফর্ম দিতে। আমি যে তোমাকে এ কথাগুলো বললাম, তুমি আমার নাম বল না। যদি সত্যি সত্যি ভর্তি হতে চাও, এমন কাউকে নিয়া আস যাকে এই সব লোকেরা ভয় পায়।

মনটা আমার এতো খারাপ হয়ে গেলো যে, আমার দুচোখ দিয়ে শুধু পানি পরতে লাগলো আর আমার বাবা মার উপর রাগ হতে লাগলো। আমার বাবা বা মা কি কখনোই আমাকে বুঝার চেষ্টা করবে না? আমি কি এতই বোঝা হয়ে উঠেছি তাদের উপর? নিজের কাছে নিজেকে একটা অমানুষ মনে হল আমার। আমার প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো। মনে মনে ভাবলাম, কে আছে এমন যে এই কঠিন একটা বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করতে পারে? আমি আমার জগতের সব আনাচে কানাচে সমুদের সুই খোঁজার মত করে খুজতে লাগলাম, কে আছে এমন সেই ব্যাক্তি? আমাদের কেউ আত্মীয়? বা আমার কোন পরিচিত মানুষ? নাহ, আমি কোথাও ভরসা করার মত কাউকে খুজে পেলাম না। আর যার কথা আমার বহুবার মনে হয়েছে সে আপনি। যখনই আমি কোন বিপদে পরি, আমি শুধু আপনার নামটাই মনে করি। আর ভাবি, কোথায় এই লোকটাকে পাব? আমি তো তার কোন সন্ধান জানি না। সন্ধান যে করি নাই তা নয়।

আমি আপনার অফিসে অনেকবার এসেছিলাম একা একা। কয়েকবার। কিন্তু আমার কি কপাল, কখনোই আমি আপনার নাগাল পাই নাই। হয় আপনি এইমাত্র বের হয়ে গেছেন না হয় ঐদিন আপনি অফিসেই আসেন নাই। ফিরে যেতে যেতে আমি শুধু কেদেছি আর ভেবেহি, আমার কি কেউ নাই? আপনার উপর আমার অহেতুক খুব রাগ হত। মাঝে মাঝে আমি আপনার উপর খুব অভিমান করতাম। মাঝে মাঝে আমি আপনার কাছে মিথ্যা মিথ্যা চিঠি লিখতাম আবার ছিরে ফেলতাম। কেন জানি মনে হত, আপনাকে আমার খুব দরকার। কলেজের ভরতির দিন প্রায় শেষ হয়ে আসছে। এমন সময় আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। সবাইতো আপনাকে চিনে। আর সবাই আপনাকে যে মানে এটা আমি জানতাম। আমি কম্পিউটারে কম্পোজ করে প্রিন্সিপ্যালের নামে একটা চিঠি লিখলাম আপনার নাম দিয়ে। যেখানে বলা ছিল যে, একজন ছাত্রীকে পাঠালাম, আপনার কলেজে ভর্তি করিয়ে নেবেন। বিস্তারিত পরে আলাপ  ইতি আপনার নাম।  

মধুর ন্যায় চিঠিটা কাজে লাগলো। আমি তো অবাক। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব শুধু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আপনাকে কেমন করে চিনি। আমি বেশি কথা না বলে শুধু বললাম, আমি তার আত্মীয়। ঠিক ঐ মুহূর্তে আমি যেন তার কাছে অতি ভক্তির একজন লোক হয়ে গেলাম। আমার ভর্তি হয়ে গেলো। মনটা তৃপ্তিতে ভরে উঠল, আমাদের পরিবারের কেউ জানল না যে আমার কলেজে ভর্তির সব কিছু হয়ে গেছে।

এতদিন যে অভিমান তা আপনার উপর আমার ছিল আজ যেন তা এক ভালবাসায় রূপ নিল। আমার বড্ড ভাল কাটল দিনের বাকি অংশটা। একটা মানুষের মিথ্যা এক খানা চিঠি এতো কাজ করে, তা আমার জানা ছিল না। কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না আসলেই এই চিঠি তার লেখা কিনা। হয়ত কারো মাথায় এটা আসেই না যে, কেউ তার নামে মিথ্যা একটা পত্র নিয়ে এমন জালিয়াতি করতে পারে। আর হতেও তো পারে চিঠিটি অনিই লিখেছে। জিজ্ঞেস করলে যদি আবার তিনি মনে কিছু করেন, তাই হয়ত কেউ জিজ্ঞেস করার সাহসই হয় নাই। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটলো।

কলেজ শুরু হতে হতে কয়েক মাস বাকি। এরমধ্যে আমি কদিন পরপরই বিয়ের সাজে বসি আর আমার সাধ্যমত বিয়ে ঠেকাই। কখনো কান্নাকাটি করে, কখনো বাড়ি থেকে পালিয়ে, আবার কখনো অত্যন্ত বাজে ব্যবহার করে আবার কখনো বড় কে নাজেহাল করে। কি যে এক পরিস্থিতি আমার। এরই মধ্যে গ্রামে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। আমাদের বাড়ীর পাশে প্রিয়াংকা নামের একটি মেয়েকে জোর করে বিয়েতে রাজি করানোর কারনে রাতে কাউকে না বলে সে আত্মাহুতি দিয়ে লিখে গেলো, ……আমি পরতে চেয়েছিলাম, আর তোমরা আমাকে পরতে না দিয়ে বিয়ে দিতে চেয়েছিলে। আমিই যদি ভাল না থাকি তাহলে আমার বিয়ে দিয়ে তোমরা কি সুখে থাকবে? তাই আমি তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে একেবারে সবার থেকে দূরে চলে গেলাম। তোমরা ভাল থেক। তোমরা আমাকে কেউ ভালবাসনি।”

ঘটনাটা গ্রামের চারিদিকে এতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যে, আমি এই ফাকে কিছুদিন যত পদের বিয়ের আয়োজন ছিল তা বন্ধ রইল। শুধু তাই নয়, গ্রামে একটার পর একটা যুবতি মেয়েদের সংসার শুধু ভাঙতে শুরু করল। কেউ স্বামীর অত্যাচারে, কেউ যৌতুকের অত্যাচারে, কেউ শ্বশুর বাড়ীর অত্যাচারে, কেউ অন্য কারনে। আমার ক্লাসে পরত এমন চেনা কয়েক জন স্বামীর ঘর ছেড়ে একেবারে বাপের আগের আস্তানায় ফিরে এল। কেউ সঙ্গে বাচ্চা নিয়ে কেউ আবার একা। বাল্য বিবাহের অনেক দোষ। কনে জানে না কি করে সংসার রক্ষা করতে হয় আবার বরের পক্ষ জানে না এই নিষ্পাপ কনেকে কিভাবে নিজের বাড়ীতে নতুন একজন আদুরে সদস্য করে মানিয়ে নিতে হয়। কেউ ছাড় দেয় না।

আমি আমার কলেজের পরাশুনা চালাতে লাগলাম। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার শুরু হল, সেই পুরানো উপদ্রব। বিয়ে কর আর বিয়ে কর। আমি এই বিয়ে নামক ঘটনাটা আমার মাথায় একটা বিষ ফোড়ার মত ঘুরতে লাগলো। বিয়ে জিনিস টা আমার কাছে এখন আতঙ্কের মত মনে হতে লাগলো। কি হবে এ রকম বিয়ে করে যেখানে একটা মেয়ে তার নিজের কোন দাম নাই, তার নিজস্ব কোন সত্তা নাই? 

বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি এইবার লাগামহীন ভাবে শক্ত হয়ে গেলাম। আমি বিয়ে করব না, আমি জীবনেও বিয়ে করব না এই প্রতিজ্ঞা সবাইকে জানিয়ে দিলাম। আর মনে মনে ভাবলাম, আমি আসলেই বিয়ে করব না।

পরীক্ষার ঠিক কয়েকদিন আগে আমার বড় জ্যাঠা আমাকে এইবার বিয়ে দিয়েই ছারবেন বলে মনঃস্থির করলেন। বাবাকে খুব অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করলেন। বাড়ীর অন্যান্য মানুষগুলো যেন শিকা ছিরে দই পরলে যেমন কুকুর আনন্দ করে ঠিক তার মত মনে হল। আমি ঠায় আমার রুমে দরজা বন্ধ করে বসে রইলাম। আমি কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম ঠিক বুঝতে পারি নাই। হটাত একটা অদ্ভুত শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। দরজার খিল খুলতেই দেখি আমার জ্যাঠা, কাকি, মামি সবাই দরজার সামনে দাড়িয়ে। কাজি এসেছে, আজকেই আমার বিয়ে। আমার আর কোন কিছুই সয্য হচ্ছিল না। নিপীড়নের একটা সিমা থাকে। ওরা সবাই অত্যাচারের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে।

কিছুই বললাম না। আমি জানি এখন আমার কথা কেউ শুনবে না। বাড়ীতে বিয়ের সরঞ্জামাদি চলতে থাকল, পান পাতা দিয়ে ঢালি সাজানো হল, মাছ, দাব, ফল মুল কত কিছু সব তৈরি করা হল। আমি জানি না কে আমার বড়, কোথায় আমার বিয়ে, ছেলে কি করে। আমাকে কোরবানির পশুর মত ঝাপ্টে ধরে গায়ে হলুদের জায়গায় নিয়ে বসান হল। আমার গায়ে হলুদ হয়ে গেলো। সারা শরীরে হলুদের গন্ধ। মনে হচ্ছে মরা মানুষের গায়ে থেকে যেমন গন্ধ আসে, আমার গায়ে হলুদের গন্দে যেন আমার তাই মনে হচ্ছিল। প্রতিটি মুহূর্তে আমি আমার জীবনের কি হতে যাচ্ছে তা কল্পনা করেও কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। আর ভাবছিলাম কি করে এখান থেকে পালানো যায়। আমি শান্ত হয়ে বসে ছিলাম কিন্তু ভিতরে আমার অশান্ত ঝড় চলছে। আমাকে শান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে বাড়ীর সবাই মনে করল, আজ আমার কোন সমস্যা নাই। আমি সব কিছুতেই সহজ করে মেনে নিয়েছি। আর এই সুযোগ টাই আমি নিতে চেয়েছিলাম। আমি বিয়ের আসর থেকে পলাইলাম।

আমার কেউ নাই। কোথায় যাব, কার কাছে যাব। শেষ পর্যন্ত আমি আমার নানিদের বাসায় নানিকে আমার সমস্ত কষ্টের কথা বললাম। নানি আমাকে তাদের ছোট একটা জায়গায় সারাদিন বন্দি থাকতে বললেন আর আমিও তাই করলাম। ছেলেপক্ষ মেয়েকে না পেয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, অনেক আজেবাজে অপবাদ দিয়ে, চরিত্রের সবগুলো কালিমা লেপন করে যা মনে আসে তাইই বলে একেবারে বিদায় নিলেন। আমি পনের দিন পর ঐ গোপন আস্তানা থেকে বের হলাম। কোথায় ছিলাম, কার সঙ্গে পালিয়েছি, কেমন করে পালিয়েছি তার অনেক বিস্তারিত ইতিহাস অনেকেই জানতে চাইলেও আমি আর ঐসব নিয়ে কথা বলার কোন রুচি মনে করি নাই।

কোন রকমে কলেজ পাশ করেছি। এইবার তো আমার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পালা। কিন্তু এটা তো আর আমাদের গ্রামের কলেজের মত নয় যে আবারো আমি আপনার নাম ভাঙ্গিয়ে সরাসরি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাব। এটা আমার জন্য বিশাল পাহারের মত মনে হল। কাউকেই কিছু বলার অবকাশ নাই, কেউ যে আমাকে একটা উপদেশ দিবে সেই মানুষটিও নাই। অথচ আমার কাউকে খুব দরকার। তারপরেও মনে হল, আপনাকে আমি খুজে বের করবই। আপনিই পারবেন এখন আমাকে এই স্থূল এবং বিরাটকায় সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু কোথায় আপনি?

ভাগ্য যখন সুপ্রসন্ন হয়, ভাগ্যদেবি তখন ঘরে পদার্পণ করে। কি আশ্চর্য, গ্রামের চারিদিকে একটা খবর ব্রেকিং নিউজের মত ছরিয়ে পড়ল। আপনি গ্রামে আসবেন। গ্রামের কার কি লাভ হবে আমি জানি না, কিন্তু আমি ঈশ্বরকে এই বলে কত যে প্রনাম করলাম যে, এইবার আমি আপনার সঙ্গে দেখা হবেই।

আপনি আমাদের গ্রামে এলেন এবং খুব ঘটা করেই এলেন। চারিদিকে পোস্টার, চারিদিকে চিঠি বিলি, আপনি আসছেন। গ্রামের কত লোক যে আপনার আসার অপেক্ষায় আছে। কেউ অপেক্ষায় আছে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, কেউ অপেক্ষায় আছে রাজনৈতিক লাভের জন্য, কেউ অপেক্ষায় আছে শুধু আপনাকে ভালবাসে বলে। আমিও তাদের মধ্যে একজন। মনে হল, আমি আপনাকে কত যুগ ধরে চিনি, কত কাছ থেকে চিনি অথচ আপনি আমাকে কখনো মনেও রাখেন নাই।

আপনি এলেন। সঙ্গে কত লোক আপনার। সারিসারি গাড়ি। কেউ নোট বই, কেউ ছাতা ধরা, কেউ আবার আপনার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য এক মুহূর্ত অপেক্ষা। আমি ঠায় দাড়িয়ে আছি ঐ সভাস্থলে। কখন আমি আপনাকে পাই।

আপনার কাজ শেষ। খাওয়া দাওয়া শেষ। আমার বুকের ভিতর কম্পন হচ্ছিল এই বুঝি আমি এতদিনের অপেক্ষার পালাটাকে হারিয়ে ফেলতেছি। আমার বুকে তখন দুরুদুরু কম্পন কিন্তু আমাকে যে পারতেই হবে। সাহস করে আমি আপনার একেবারে কাছে চলে এলাম। আপনি আমাকে দেখলেন। কাছে ডাকলেন। আমার বুক তখন ভুমি কম্পনের মত কাপছে।

আনার চোখে চোখে আমার চোখ পড়ল। আমি মুষড়ে যেতে থাকলাম। আপনি জান্তেও পারলেন না আমার ভিতরে কত বেগে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। আমার দিকে কিছুক্ষ তাকিয়ে থেকে নিজ থেকেই আমাকে ডেকে বললেন, কোথায় যেন আমি তোমাকে দেখেছিলাম?

আমার দুচোখ ভরে শুধু পানি শ্রাবনের ধারার মত ঝরতে লাগলো। আমি বললাম, আমি আপনার অমুক চাচার মেয়ে।

ও আচ্ছা, হ্যা তুমি তো একবার আমার কাছে গিয়েছিলে? কি করছ এখন? কোথায় পরাশুনা করছ? আর তুমি কাদছ কেন?

আমি শুধু কম্পিত গলায় এইটুকু বলতে পেরেছিলাম, আমি পরতে চাই, আমি বিয়ে করতে চাই না। অসংখ্য মানুষের ভিরে আমি কি বলেছি আর কি বলতে চেয়েছি, আমার মনে নাই। অনেক বার আমি বাড়ীতে একা একা কি বলব তা নিজে থেকে অনুশিলনও করেছিলাম কিন্তু সেই অনুশিলন কিছুই কাজে লাগে নাই আপনার সামনে এসে। সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। আমি মাথা নিচু করেছিলাম। বুদ্ধিমান মানুষদের সবকথা বলতে হয় না। আপনি এই দুই কথায় আমার অনেক কথার উত্তর যেন পেয়ে গেলেন। আপনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ঠিক আছে, আমি তোমার সঙ্গে পরে কথা বলব। আপনি আমাকে আপনার ফোন নাম্বারটা দিলেন। কি অদ্ভুদ আমার শিহরন। আমার মনে হয়েছিল, আমাকে আজ পর্যন্ত এই ভাবে কেউ ছুয়ে দেয় নাই। আমাকে আজ অবধি কেউ বলে নাই, ঠিক আছে আমি তোমার কথা শুনব। আজ মনে হল, আপনি আমাকে ছুয়ে দিয়েছেন, আমাকে আদর করেছেন, আমাকে শুনবেন এই আশ্বাস দিয়েছেন। একটা ফোন নাম্বার আর কিছুই না। আমি আপনার ফোন নাম্বার টা যে কতবার লিখেছি, আপনার নাম টা যে আমি কতবার লিখেছি। আমি সেই রাতে ঘুমুতে পারি নাই। শুধু আমার কাছে ঐ যে শিহরন, ঐ যে স্পর্শ, ঐযে চোখের চাহনি, আমাকে অনেক অনেক রাত অবধি জাগিয়ে রেখেছিল। আমি কি আপনাকে ভালবাসি? আমি কি আপনাকে দেবতা বলে জানি? আমি কি কারনে আপনাকে এক মুহূর্তে জন্য ও ভুলতে পারছি না? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? আমি কি কোন অলিক কিছু ভাবছি? আমার বাবা মা, জ্যাঠা, গ্রামের অনেকেই আমার এই অসভ্যতা পছন্দ করে নাই। আমাকে টার জন্য অনেক যন্ত্রনা সজ্য করতে হয়েছে বেশ কয়েকদিন। গ্রামের মানুষ অন্য সব কিছু ফেলে দিয়ে যেন আমার এই ঘটনাতাই আলাপের বস্তু হয়ে দারিয়েছিল। আমি তাতে কিছুই মনে করি নাই। পৃথিবীতে এতো মানুষ, চারিদিকে এতো জন মুখর পরিবেশ, কিন্তু কাউকে কিছু বলবার মত মানুষ পাওয়া বড়ই দায়।

৪র্থ পর্ব 

আমি আপনার ফোন নাম্বার পেয়েছি কিন্তু আমার কোন ফোন নাই। তাই আমি একদিন অনেক সাহস করে পাশে বাজারের এক ফনের দোকান থেকে আপনার নাম্বারে আমি ফোন দিলাম। আমি জানি না ঐ সময়ে আপনাকে ফোন দেওয়া ঠিক ছিল কিনা। অনেক্ষন রিং হল কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ আমার ফোনটা ধরল না। মনে মনে একটা কি ধরনের যেন ভয়-কম্পিত অনুভুতি কাজ করছিল আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু ফোনটা না ধরাতে আবার মনে হল, ভালই হয়েছে।

তারপরের দিন আবার আমি আপনাকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আপনি এবারও ফোন ধরলেন না। প্রথমদিন ফোন না ধরাতে বিশেষ কিছু মনে হয়নি কিন্তু দ্বিতীয় দিন ফোন না ধরাতে আমার কাছে ব্যাপারটায় একটু খটকা লেগেছিল। আমি আবারো ফোন দিয়েছিলাম। অনবরত রিং হচ্ছে কিন্তু পাশে কি কেউ নাই যে ফোনটা ধরে?

এইভাবে আমি আপনাকে দিনের পর দিন অন্তত প্রতিদিন একবার করে ফোন করতে লাগলাম আর বিফল মনোরথে বাড়ীতে ফিরে এলাম। বাজারের ফোনের দোকানদারও একটু বিরক্ত হতে শুরু করলেন। কাকে ফোন দিচ্ছেন যে ফোন ধরে না সে? আমি দোকানদারকে কিছুই বলতে চাইনি কাকে ফোন দিচ্ছি। কারন নাম বললেই দোকানদার তাঁকে চিন্তে পারবে।

এমন করে প্রায় দু সপ্তাহ পার হয়ে গেলো। একদিন দোকানদার আমাকে একটা পরামর্শ দিলেন।

‘দেখুন, এমনও হতে পারে যে তিনি অপরিচিত নাম্বার ধরেন না। তার থেকে একটা এসএমএস করে দিন। ধরলেও ধরতে পারে।

ব্যাপারটা খুব কাজে লাগলো। আমি সংক্ষিপ্ত একটা এসএমএস দিলাম, “আমি সন্ধ্যা, অমুক চাচার মেয়ে”।

ম্যাসেজটা বুলেটের মত কাজ করল। ঠিক কয়েক মিনিটের মধ্যেই আপনি আমাকে ফোন করলেন ঐ বাজারের নাম্বারে। আমি আপনার ফোন পেয়ে আত্তহারা হয়ে গেলাম। এই যে গত কয়েকদিন আমি আপনাকে চেষ্টা করেও পাচ্ছিলাম না, তার সবগুলো কষ্ট আমার এক নিমিষের মধ্যে শেষ হয়ে গেলো।

মনে হল আপনি ব্যাস্ত ছিলেন। আমাকে শুধু বললেন, আগামি অমুক দিন তুমি আমার অফিসে এতটার মধ্যে চলে আস। আমি থাকবো।

আমি আপনার অফিস চিনি। কিন্তু জানি নাই কখন আপনি অফিসে থাকেন। এবার আর মিস হবে না আমি জানি। আমার চিত্ত বিকশিত হয়ে উঠল। দোকানদারকে আমি অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, ভাই, অনেক উপকার করলেন।

আমার আর দিন কাটে না, রাত কাটে না। কবে আসবে সেইদিন। আমি যাব আপনার কাছে। দেখা হবে আপনার সাথে। কথা হবে মুখুমুখি বসে। আমার যত কথা, সব বলব আপনাকে। পারবো তো? (চলবে)

৫ম পর্ব

নির্দিষ্ট দিনটি অবশেষে এলো। খুব ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেছি। আকাশটা আমার মনের মতো ফুরফুরা নয়, একটু মেঘলা। যে কনো সময় ঝুপ করে বৃষ্টি হতে পারে। আমি আমার সব গুলি কাজ যথাসময়ে শেষ করে কাউকে কিছুই না বলে নিজের মতো করে সকাল সকালই বের হয়ে গেলাম। ছাতাটি সঙ্গে নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু যখন পুনরায় মনে হলো, তখন আমি বাড়ী থেকে অনেক দূর হেটে চলে এসেছি। ফিরে গেলে হয়ত দেরী হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় আর ছাতার জন্য ফেরা হল না।

প্রায় আধাঘন্টা ধরে আমি একটা রিক্সায় চড়ে আমি আপনার অফিসের সামনে এলাম। আজ আর আপনাকে না পাওয়ার আশংকা আমার ছিলো না। আমি আজ আপনাকে পাবো, সেটা আমার মন নিশ্চিত ছিলো। আমি আপনার অফিসের গেটে …………(চলবে)