৩১/১২/১৯৮৫ রুপদিয়া অনুশীলন ক্যাম্প

বি এম এ থেকে পাওয়া ১০ দিনের ছুটি শেষ। পোষ্টিং অর্ডার হয়েছে যশোরে। যশোর সেনানীবাস, ৪ মর্টার রেজিমেন্ট আর্টিলারী। কখনো এর আগে যশোর আসি নাই। এবারই প্রথম। এই একটু আগেই ইউনিটে এসে পৌঁছলাম। সে এক নতুন অভিজ্ঞতা।

আমরা কয়েকজন একসাথে ঢাকা থেকে যশোরে এসে পৌঁছলাম। আমি, ২লেঃ এমদাদুল বারী, ২ লেঃ আশফাকুল বারী। নামলাম মনিহার সিনেমা হলের সামনে। মনিহার সিনেমা হলে নেমে পাশেই রেলওয়ে স্টেশনে চলে গেলাম কারন ইউনিটে বলা ছিলো যে, আমরা যশোর রেলওয়ে স্টেশনে থাকবো যেখান থেকে ইউনিটের গাড়ি আমাদেরকে পিক করবে। যদিও যশোর ক্যান্টনমেন্টে পোস্টিং কিন্তু আমাদের যেতে হবে সেখানে যেখানে আমাদের ইউনিট শীতকালীন অনুশীলনে করছে। নাম রুপদিয়া। আমি চিনি না। ইউনিট থেকে গাড়ি গিয়েছিলো আমাকে আনার জন্য।

অনেক্ষন বসে আছি আমি আর ওরা। কে যে আসবে তাকেও আমি চিনি না। সিগারেট খাচ্ছি আর বসে বসে যাত্রীদের আনাগোনা দেখছি। ওয়েটিং রুমে বসে আছি। প্রচুর যাত্রী। আমরা ভগ্ন সাস্থ্য ওয়ালা, গলাছিলা মুরগীর মতো হেয়ারকাট নিয়ে বসে আছি। আমরা যেমন যাত্রীদেরকে দেখছি, কিছু কিছু যাত্রী উতসুখ নয়নে আমাদেরকেও দেখছে। হয়তো ভাবছে-কিরে ভাই, এমন পোলাপান গুলি এভাবে হেয়ারকাট নিয়েছে কেনো?

পড়নে আমাদের সাহেবী পোষাক। বারী আবার হেট পড়েছে। ওর বাবা সিনেমার ফটোগ্রাফার। হয়তো সেই নায়ক নায়ক ভাবটা গত দুই বছের তড়েনিং এ ও পুর্ন বিলুপ্ত হয় নাই। এমন সময় একজন হালকা পাতলা ফৌজ, মুখে গোপাল ভাড়ের রাজার মতো গোফ, কিন্তু পরনে সামরীক ইউনিফর্ম, এসে হাজির। ওয়েটিংরুমে এসেই বল্লো, এখানে কে লেঃ আখতার স্যার? আমি তাকিয়ে দেখলাম, বেশ স্মার্ট একজন সৈনিক।

আমি সাড়া দিতেই সে আমার ব্যাগ গুছিয়ে একাই কাধে তুলে নিল, আমাকে গাড়ি কোথায় আছে দেখিয়ে বল্লো, স্যার, আমাকে ফলো করেন। গিয়ে দেখি একটা পিকআপ। পিকআপের সেকেন্ড সিটে বসলাম। ড্রাইভার আছে। নাম জব্বার। যে আমাকে আনতে গিয়েছিলো সে পিকআপের পিছনে গিয়ে বসলো। আগেই বলেছি- যশোর আমার এই প্রথম পদার্পন। কখনো আসি নাই। এই প্রথম। একটু একটু কেমন যেনো লাগছিলো।

গাড়ি বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর ড্রাইভার রাস্তার একপাশে থামিয়ে বল্লো, স্যার এসএম (সুবেদার মেজর) সাহেব বাজারে গেছেন, ঊনি এইখান থেকে উঠবেন। এস ম সাহেব কি, কে বা কি তার কাজ আমার কিছুই জানা নাই। বললাম, ওকে।

প্রায় ১০ মিনিট পর এসএম সাহেব এলেন। হাতে তার বাজারের একটা পোটলা। গায়ে ইউনিফর্ম, মাথায় টুপী নাই তাই তার টাক মাথা পুরুটাই রোদে চিকচিক করছে। আমার কাছে এসে সালাম দিয়ে বললেন, স্যার ভালো আছেন? আমি ইউনিটের এসএম হাসেম।

ওনার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, বয়স আমার থেকে প্রায় ডাবল। চুল একখানও নাই। মোটা একটা মানুষ। খুব বেশি কথা বলার নাই। হাসেম সাহেব উঠে গেলেন পিকআপের পিছনে। গাড়ি ছুটে চল্লো গন্তব্যের দিকে। প্রায় ৪০ মিনিট ড্রাইভ করে যেখানে থামলো, দেখি আশেপাশে বেশ জংগল, কিন্তু ভিতরটা বেশ সাজানো গুছানো।

আমি নামতেই রায়হান নামে একজন পিচ্চি টাইপের সৈনিক এসে আমার ব্যগ তুলে নিলো, হাসেম সাহেব কাকে যেনো কি বল্লো, ড্রাইভার আমাকে ছেড়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো। রায়হান আমাকে একটা ছোট তাবুতে নিয়ে গেলো, যার নাম ফোর্টি পাউন্ডার তাবু। ছোট একটা পরিসর। আমাকে এখানেই থাকতে হবে। তাবুর ভিতরে মাটি কেটে খাট বানানো, নাড়ার খেরা দিয়ে সেই খাট ভরা, আর খেরের উপরে একটা তোষক দেওয়া, এটাই আমার বালাখানা। খাটের পাশে পা রাখার জন্য মাটি কেটে একটু নীচু করে রাখা যাতে পা রাখা যায়।

খুব ক্ষুধা লেগেছে, বললাম, খাবারের ব্যবস্থা আছে কিনা। রায়হান বল্লো, স্যার একটু অপেক্ষা করতে হবে রান্না হচ্ছে। মিনিট যায়, ঘণ্টা যায়, খাবার আর রেডি হয় না। প্রায় ৩ টার দিকে রায়হান কয়েকটা রুটি  আর শব্জী নিয়ে এলো। দেখেই মেজাজ যেনো তেলে বেগুনে। বললাম, কি ব্যাপার, রুটি কেনো, ভাত নাই?

রায়হান অভিজ্ঞ রানার, বল্লো, স্যার ফিল্ড মেসে ইন হলেই আপনার পছন্দমতো খাবার খেতে পারবেন, আজ সৈনিক মেস থেকে খাবার আনা হয়েছে। আমরা দুপুর রুটি আর শব্জী খাই। ফিল্ড মেস আবার কি, আমি জিজ্ঞেস করলাম। রায়হান কি উত্তর দিবে ঠিক বুঝা গেলো না। শুধু বল্লো, স্যার আপনাকে দুই মাস আমাদের সৈনিকের সাথে থাকতে হবে, তাদের খাবার খেতে হবে, একই টয়লেট ইউজ করতে হবে। এই দুইমাস পার হবার পর অন্যান্য স্যারেরা যেখানে খায় সেখানে আপনি খেতে পারবেন। সেটাকে বলে ফিল্ড মেস।

হায় রে, একেই বলে নমসুদ্র আর ব্রাহ্মণ। আমি এখন নমসুদ্রের দলের মতো ব্রাহ্মণের দল থেকে আলাদা যদিও অফিসার। রায়হানকে বললাম, সিগারেট কিনবো কোথা থেকে, আমার তো সিগারেট লাগবে। রায়হান বল্লো, স্যার ক্যান্টিনে সিগারেট পাওয়া যায়, এনে দিচ্ছি। একটু পর রায়হান আমার কাছে এক প্যাকেট সিগারেট দিয়ে গেলো। আমি তো অবাক। কিরে ভাই, টাকা দিলাম না, পয়সা দিলাম না, সিগারেট চলে এলো? অনেক পরে জানলাম, ক্যান্টিন থেকে আমার নামে সিগারেট বাকী আনা যায়, মাস গেলে এর বিল দিতে হয়। ভালোই তো।

শুরু হয়ে গেলো সামরীক জীবন।