Categories
বুক ভরা অভিমান লইয়া অরু কাউকে কিছু না বলিয়া গত কাল অতিভোরে বাহির হইয়া গিয়াছিলো বটে। কিন্তু এখনো দিন অতিবাহিত হয় নাই, কেবল সন্ধ্যা নামিয়াছে, তাহাতেই অরুর মনে হইতে লাগিল, তাহার যেনো সব কিছু মিথ্যা হইয়া গিয়াছে। যখন অরু ঘর হইতে বাহির হইয়াছিল, তখনো জানালার বাহিরে কাঠালি গাছটার মাথার উপর ভোরের একখন্ড আভা উকি দিয়াছিল, অভিমান ছিল কানায় কানায় পূর্ন কিন্তু এখন দিনের শেষে আকাশের আলো আধারের ছায়ায় অরুর যেন অভিমানটা একটা কষ্টে পরিনত হইয়াছিল। অরুর মনে কোনো সন্ধির বিন্দুমাত্র আভাষ ছিলো। কিন্তু তাহার বুকের ভিতরে অভিমানের স্তুপ শতগুনে বাড়িয়া একটা পাহাড়ের রুপ নিয়াছিল। বড় কষ্ট, আর যন্ত্রনার এক মিছিলে অরুরু দুই গাল বাহিয়া কেবলি অশ্রু আর অশ্রুধার বহিয়া চলতেছিল। যতোই ক্ষন পার হইতেছিলো, অরু বুঝিতে পারিতেছিল, শামুকের সঙ্গে খোলসের যেমন সম্বন্ধ, অরুর সাথে যেনো ফেলে আসা সেই মানুষটির সম্বন্ধ। অরু যেনো দেহমনে তাহার সহিত আষ্টে পিষ্টে এটে গিয়াছিল। আজ তাহার থেকে অরু বন্ধন ছিন্ন করিয়া কি এক মুক্তির জন্য যেনো উদ্দেশ্যবিহীন কোনো এক গন্তব্যে বাহির হইয়া আসিয়াছিল। কিন্তু অরু কি আসলেই কোনো মুক্তি পাইয়াছে?
অরু বারবার নিজেকে এই প্রশ্নই করিতে লাগিলো। বড্ড একা, বড় অসহায় মনে হইতে লাগিলো চারিপাশ। বিপাশা খালের পাশে একা অরু বসিয়া শুধু তাহার জীবনের এতোগুলি সময়ের হিসাব কষিয়া কিছুই মিলাইতে পারিতেছিলো না। অরুর বারবার সেই সব দিনের কথা একে একে মনে পড়িতে লাগিলো যখন তাহার জন্য পথের পানে চাহিয়া থাকিতেও ভালো লাগিত তাহার অপেক্ষায়, কিংবা তাহার সহিত এক সাথে বসিয়া ইতিহাসের গল্প শুনা, অথবা তাহার বাহুতে বসিয়া কোনো এক অনাগত আবরারের সপ্নের কথা। অরু বাকরুদ্ধ।
অরুর প্রতি নিয়ত মনে হইতে লাগিল, আমি কি তাহার জন্য কিছুই করি নাই? আমি কি তাহাকে কনো কালেই ভালবাসি নাই? আমি কি কখনোই তাহার মনের ভিতরে ছিলাম না? যদি তাহাই হয় নাই, তাহলে এতোদিন কি ছিলো? অরু আর কিছুই ভাবিতে পারে না। সমস্ত আকাশের সন্ধাকালীন লাল মেঘ মেলাকে অরুর বড় বিষণ্ণ বোধ হইতে লাগিল।
দিন চলিয়া গেলো। রাত নামিবার সাথে সাথেই যেনো অরুর আরো মন খারাপ হইতে লাগিলো। চিৎকার করিয়া কাদিতে মন চাইলো অরুর। কিন্তু অরু যাহার ঘরে এখন বসিয়া আছে, তাহাদের কথা ভাবিয়া আর নিজের অকস্মাৎ অন্তর ধানের খবর লজ্জায় লুকাইবার নিমিত্তে অরুর আর আর্তনাদ করিয়া কাদা হইল না। অরুর বুকের হাহাকার, অরুর চোখের জলের ধারা বারবার অরুকে জীবনের কি মুল্য এই হিসাবের নিকটবর্তী নিয়া আসিয়াছিলো। কিন্তু জীবন শেষ করিয়া দেওয়া কি এতোই সহজ?
অরুর আরো মন খারাপ হইতেছিলো এই ভাবিয়া, যাহাকে সে ছাড়িয়া আসিয়াছে, তাহার এখন মনের অবস্থা কি? তিনিও কি অরুর জন্য এমন করিয়া হাহাকার করিতেছে? তাহার ও অরুর জন্য মন কাদিতেছে? যদি কাদিয়াই থাকিবে, তাহলে আজ সকালে অরুকে কেনো আগলাইয়া ধরিয়া রাখিলো না? যেমন করিয়াই রাখিয়াছিলে, তেমন করিয়াই তো ছিলাম। দুঃখ যে আছে আমার, এ কথা তাহার কি কখনই মনে আসে নাই? মরনের কথা বার বার মনে আসিতেছিল। কিন্তু মরনের কথা মনে হইলেও কোনো এক বাধনের কারনে মরনকেও ভয় হইতেছিল। আমার জন্য না, অরু ভাবিলো, আমার মরন কি তাহাকে জীবিত রাখিতে পারিবে? হয়ত সে আমার থেকেও বেশি অশ্রু পাত করিতেছে।
রাত গভীর। অরুর চোখে ঘুমহীন রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু অরুর চোখে কোনো ঘুমের ছাপ মাত্র নাই। বুকের পাজর গুলি যেনো কুকড়ে গিয়ে আরো ছোত হয়ে গেছে। পেটে ক্ষুধা নাই, মনে শান্তি নাই। অরুর বারবার মনে হইতেছিল, অনাদর আর আদরের কথা। অরু তো তার সর্ব কিছু দিয়া তাহাকে আদর করিয়াছিলো। কিন্তু তাহার প্রতি এতো অনাদর হইলো কেন? অনাদর জিনিষ তাই একটা ছাইয়ের মতো। সে ছাই হয়তো আগুনকে ভিতরে ভিতরে জমিয়ে রাখে কিন্তু বাইরে থেকে তার তাপটাকে বুঝতে দেয় না। তাহার কাছে অরুর যেনো সম্মান কমিয়া গিয়াছিলো। আত্ত সম্মান যখন কমে যায়, তখন অনাদরকে তো অন্যয্য বলে মনে হয় না। এক সময়ে তাহার আদরে আমার যে জীবন গড়িয়া উঠিয়াছিল আজ যেনো ঠিক সেইভাবেই অনাদরে আমার দুঃখের ব্যথাতা শতগুনে বাড়িয়া উঠিয়াছিল।
সব কিছুর পরেও অরুর বারবার মনে হইতেছিল, আমি কেনো তাহাকে ভুলিতে পারিতেছি না? সেও কি আমার মতো আমা বিহনে এইরুপ সকাল, সন্ধ্যা রাত ঘুমহীন ভাবে কাতাইতেছে। একবার ভাবিলাম, যাই ফিরে যাই। গিয়ে আবার জাপটে ধরে বলি, এই যে, আমি, অরু। তোমার অরু, আবার ফিরিয়া আসিয়াছি। আমি পারি নাই তোমাকে ছাড়িয়া একটি রাত অতিবাহিত করিতে। আমি পারি নাই তোমাকে একটি মুহুর্তে ভুলিয়া থাকিতে। আমি ফিরিয়া আসিয়াছি। আমি প্রতিটি মুহুর্ত বুঝিয়াছি, আমার সারাটা বিশ্ব জুড়িয়া চারিদিকে তুমি। আমি যেদিকে তাকাই, সেদিকেই শুধু তোমাকে পাই, হাত বারাই অথচ তুমি নাই। আমি জীবন্ত লাশ হইয়া চারিদিকে যেন পালাইতে নয়, তোমাকেই খুজিতেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি ফিরিয়া আসিয়াছি।
পরক্ষনেই, সম্বিত ফিরিয়া আসিলে অরু দেখিলো তাহার কপোল গরাইয়া শুধু অশ্রু দিয়াই তাহার কামিজ ভিজিয়া গেছে, তাহার চোখ ফুলিয়া গেছে। অরুর মনে কোনো শান্তি নাই। অথচ কাইকে অরু কিছু বলিতেও পারিতেছে না, কি হইলো, কেন হইলো, আর এখন কি হইবে।
অরুর কত কিছুই না আজ এই একা বসিয়া মনে পড়িতেছে। এই অরু ছিলো তাহার রাতের সাথি, তাহার একাকিত্তের বন্ধু, এই অরুই ছিল তাহার মনের সব কল্পনার রঙ মাখানো বাতিঘর। অথচ আজ অরু কত দূরে বসিয়া একা। কোনো কিছুরই হিসাব মিলাইতে পারিতেছে না অরু। কোথায় গেলো সেই নেশা, কোথায় গেলো সেই গল্প বলার মানুশটা? তাহার চোখের পাতার কথা মনে পড়ে, তাহার হাত ধরার ভালবাসার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে আপলোক চোখে তাকিয়ে অরুর মুখ দেখিয়া অবাক হইবার সেই ভালোবাসার চিহ্ন।
বেদখল জমির মতো আজ অরু তাহার কাছে বেদখল হইয়া পড়িয়াছে। অরুর জীবনের যেনো আর কোনো মুল্য নাই অথচ একদিন ছিলো, অরু ছাড়া তাহার দিন শুরু হইত না, অরু ছাড়া তাহার রাত নামিতো না।
অরুর মনে হইতে লাগিলো, কতদিন যে তাহার সহিত কথা হয় না? কতকাল যেনো অরু তাহাকে দেখিতে পায় নাই? অরুর অন্তর আর কলিজার দুই পাশ ছিড়িয়া ফুলিয়া একাকার হইয়া যাইতেছিলো।
এদিকে অরুর বিয়ের তোড়জোড় চলিতেছে চারিদিকে। অরুর এখন কি করা উচিত? ফিরিয়া যাইবে সেই তাহার কাছে? নাকি সমস্ত অভিমান আর কষ্ট লইয়াই অরু তাহার জীবনের আরেকটি নতুন অধ্যায় শুরু করিবে। অরু জানে না, কাল তাহার জন্য কি অপেক্ষা করিতেছে। অরু এইটাও জানে না, তাহাকে নিয়া বিধাতা কি খেলা খেলিতেছেন। অরু শুধু ওই নীল আকাশের দিকে তাকাইয়া বহু দূর দেখিতে পাইল একটা অস্পষ্ট আলো জালাইয়া কত সহস্র যাত্রী লইয়া আকাশ পথে একটা উড়ন্ত জাহাজ হারাইয়া যাইতেছে। একটু পর তাহার আর কোনো হদিস থাকিবে না।