Categories
আজ অরুর বিয়ে।
মান অভিমানের সাথে পরাস্ত অরু আজ রংগীন সাযে সাজিবে। বর আসিবে, গান বাজিবে, ছোট ছোট বালক বালিকারা নৃত্য করিবে। সবাই আনন্দে উদ্বেলিত হইবে। অথচ আজ অরুর মধ্যে কোনো প্রকারের আনন্দ নাই, না আছে কোনো অশ্রুজল। সব জল যেনো এই কয়দিনে শুকাইয়া মরুভুমি হইয়া গেছে। যেদিকেই অরু তাকায়, সেদিকে সে তাহাকে দেখিতে পায় কিন্তু কোথাও সে নাই। মরিচিকার মতো অরু যেনো শুনতে পায় তাহার ডাক, আবার পরক্ষনে চাহিয়া দেখে, তাহা তাহার ডাক নয়, হয়ত পাশের বাড়ির কোনো এক বয়ো বৃদ্ধ অরুকে আদরের সহিত কাছে ডাকিতেছে। অরুর কিছুতেই বিশ্বাস হইতেছে না, আজ হইতে তাহার নতুন কিছু শুরু হইবে। এই দেহ, এই মন, এই প্রান আর তাহার থাকিবে না। থাকিবে না তাহার জন্যেও যাহাকে অরু একদিন শপথ করিয়া বলিয়াছিল, পৃথিবীর সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করিয়া আজ অরু যেখানে দাড়াইয়ায় আছে, তাহা হইতে অরুকে কখনো পৃথক করা যাইবে না। সেদিনের সেই শপথের কথা আজো অরুর মনে পড়ে, চাদের আলোকে সাক্ষি রাখিয়া অরু নীলের দিকে তাকাইয়া অরু বলিয়াছিলো, আমি আছি , আমি নাই, আর এই আমির মধ্যে শুধু তুমি ছাড়া আর কেউ নাই। কোথায় গেলো এতো শপথ? কোথায় গেলো এতো সব আয়োজনের?
রাত হইয়া গিয়াছে। বর পক্ষ আসিয়াছে বলিয়া চারিদিকে শোরগোল শুনা যাইতেছে। কেউ কেউ গেট রক্ষার তাগিদে আর উপঢোকন পাইবার লক্ষে ছোট ছোট ছেলেমেরা কেউ কঞ্চি, কেউ বা ররেক রকমের রং এর বাহার, আবার কেউ কেউ টাকা গুছানোর রুমাল বাহির করিয়া একাগ্রচিত্তে অপেক্ষা করিতেছে।
বর আসিলেন, যথারীতি বিবাহ শেষ হইয়া গেলো। অরু না দেখিল তাহার নব বরকে, না বর দেখিলো নব বধুকে। অরুর কোন কিছুতেই আর কিছু বলিবার ছিলো না। অরু শুধু আরেকবার চাহিয়াছিল অরুর সমস্ত অভিমানের কথাগুলি তাহাকে আরেকবার বলিয়া সবার কাছ হইতে চিরতরে বিদায় নেওয়া। কিন্তু ইহার কিছুই আর অবশিষ্ট নাই।
অরু চলিয়া যাইতেছে বরের সাথে। পাল্কিতে করে। রাত গভীর হইয়া আসিতেছে। পালকির বাহকদের হুম, হুম শব্দে অরুর কান্নার শব্ধ শুনা যাইতেছে না বটে কিন্তু এক ছোট পাল্কির ভিতরে বসিয়া অরু আরো কিছুক্ষ ভাবিতে লাগিল, আজ তাহার সাথের বন্ধুটি যেনো কোথায় হারাইয়া গেলো। যাওয়ার সময় একটু দেখাও হইলো না। জীবনের বাকী দিন আর কখনো তাহার সহিত দেখা হইবে কিনা তাহারও কোন সম্ভাবনা নাই। হয়তো কোন একদিন এই দুনিয়া ছেড়েই এভাবে চলিয়া যাইতে হইবে। নিশিত অন্ধকারের এই রজনীতে পাল্কিতে বসিয়া অরু শুধু একটা কথাই বুঝিল, জীবনের হিসাব বড় কঠিন।
অরু বরের বাড়ি চলিয়া আসিয়াছে। বাসর ঘরের এতো আলো দেখিয়া অরুর আরো মন খারাপ হইয়া উঠিল। কথা ছিলো, এই রকমের একটি আলো ঝলমলে ঘরে তাহার সহিত অরু সারারাত গল্প করিয়া কাটাইয়া দিবে। কত কথা জমা হইয়া ছিলো। সে বলিয়া ছিলো, এই বাসর রাতে সে সহস্র আরব্য রজনীর গল্প দিয়া তাহাদের বাসর শুরু করিবে। আজ আর সেই আরব্য রজনীর গল্প বলিবার মানুষটি চিরতরে হারাইয়া গিয়াছে। কোথায় গিয়াছে, কেনো গেলো, তার হিসাব আর করিবার কোনো প্রয়োজন নাই।
দরজা খোলার শব্দ হইলো। অরুরু নতুন বর। কিছুই না বলিয়া অরুর নতুন বর ঘরের সমস্ত আলো এক ঝটিকায় নিভাইয়া দিয়া তিনি অরুকে পিছন হইতে জরাইয়া ধরিয়া কানের কাছে আসিয়া বলিল, "অরু, আরব্য রজনীর গল্প দিয়া শুরু করি আজকের এই বাসরের গল্প?"
অরু অজ্ঞান হইবার উপক্রম, তাহার কানকে বিশ্বাস করিতে পারিতেছিলো না। মানে রাগে অভিমানে দুক্ষে কষ্টে, ভালবাসায়, অরু তাহার দুই হাত বরের দিকে ঝাপ্তাইয়া ধরিয়া হুহু করিয়া অবিরাম শ্রাবনের ধারার মতো কাদিয়া তাহার সেই পুরানো বন্ধুর গলা ধরিয়া শুধু কাদিতেই লাগিলো।
অরুর এই কান্না এখন আনন্দের আর ভালবাসার। এতোক্ষন যে চাপা কষ্টটা অরুর বুকে জগদ্দল পাথরের মতো বসিয়া ছিল, এখন অরুর কাছে মনে হইলো, পৃথিবী বড় সুন্দর। বড় বাচতে ইচ্ছে হয় আজীবন।
আমি তোকে ভালোবাসি।