৩১/১২/২০২০-বন্ধু সাকুদাকে চিঠি

সাকুদা

সাকিরের চিঠিটি পরে বেশ মজা তো পেলামই তার সঙ্গে আমারও যেন আজ হইতে বহু বছর আগের কোন এক উচ্ছল এবং অফলদায়ক কর্মদীপ্ত সময়কার কথা মনে পরিতেছিল। সেই ১৯৮৩ সালের কথা সম্ভবত।

পরিবারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে পরিক্ষা দিয়া ১২ লং কোর্সে সিলেক্ট হইয়া ২৭ শে জুলাই ১৯৮৩ তে সবার সঙ্গে বিএমএ তে যোগ না দিয়া বর্ষার ঝমঝম বৃষ্টির অসাধারণ একটি দিনে সবুজে ঘেরা এবং অগোছালো গাছপালার সাড়ির মধ্যে গরে উঠা ঢাকা ইউনিভার্সিটির শহিদুল্লাহ হলের সেই টিচার্স কোয়ার্টারে অত্যন্ত মন খারাপ করে একা রবি ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ বইটা নিয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। কখনো কয়েক ফোটা এলোপাথাড়ি বৃষ্টির ছটা জানালা ভেদ করে আমার রবিঠাকুরের গল্পগুচ্ছ আবার কখনো আমার মুখের উপর আছড়ে পড়ছিল। আমার মন খারাপ কিনা কিংবা আমার ভিতরের কষ্টের শেষ অভিব্যাক্তি চোখের জলে বেরিয়ে যাইতেছিল কিনা তা নীরস বৃষ্টির ফোঁটার কারনে কারোরই বুঝবার অবকাশ হইতেছিল না। আজকের দিনের ডিজিটাল কোন যন্ত্রের কেরামতি থাকিলে হয়ত বুঝা যাইত যে, ঐ রোমান্টিক একটি বৃষ্টির দিনে কতটা অ-রমান্টিক পরিস্থিতি আমার ভিতরে খেলিয়া যাইতেছিল। আর আমার কষ্টের একটাই কারন ছিল যে, আমি সেনাবাহিনীতে আমার অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে ১২ লং কোর্সে যোগদান করিতে পারি নাই। কারন আমার পরিবার আমার জন্য স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় ইতিমধ্যে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করিবার জন্য কোন এক সনামধন্য ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ব্যবস্থা করিয়া ফেলিয়াছেন।

পরবর্তীতে পরিবারের উপর রাগ করিয়া আর কোন ভর্তি পরিক্ষা না দিয়াই আমি পরের কোর্স ১৩ বিএমএ তে যোগদানের গোপন কাগজখানা যোগাড় করিয়া ফেলিলাম। বলা যাইতে পারে সবার অজান্তে আমি যেন সেনাবাহিনীকে রেজিস্ট্রি মেরেজ করিয়া বসিলাম। কাউকেই আমার এই গোপন অভিসারের মত “সেনাবাহিনি-প্রেমের সাদির” কথা অথবা কাবিননামার মত “যোগদানের পত্রখানার” কথা কাউকেই বলিলাম না। শুধু দিন গুনিতেছিলাম কবে “শ্বশুর বাড়ীর মত” এক আস্তানা সেনাবাহিনির কোলে গিয়া নিশ্চিত হইব। কাউকেই কিছু বলছি না, ফুরফুরা মেজাজ আমার এখন, মাঝে মাঝে সেনাবাহিনীর কিছু নজরে আসিলে মনে হইত এইটা আমার, কিংবা মাঝে মাঝে আবার এও মনে হইত আমি সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বিখ্যাত লোক কিংবা আকাশচুম্বী অনেক আষাঢ়ে গল্পের কাহিনির মত ইত্যাদি। কিন্তু সব কিছু চলছিল অতি গোপনীয়ভাবে। এই অভিসারের সময়ের মধ্যে আমি বেশ কিছু ব্যক্তির সঙ্গে (ব্যক্তি বলা ভুল হইবে কারন তখনও তারা ব্যক্তির পর্যায়ে পরে বলিয়া মনে হয় না, তারা সবাই ১৯ কি ২০ বছরের বালক)।  পরিচয় ঘটিল। আকবর (বর্তমানে মেজর জেনারেল আকবর), হুমায়ূন (মেজর জেনারেল), মুক্তার (ইঞ্জিনিয়ার) এবং আমাদের সাকুদা। কি কারনে বা কোন উপলক্ষে বা কার অন্বেষণে  তারা ঐ শহিদুল্লাহ হলের ভিতর দিয়া যাইতেছিল তা আজ হয়ত তাদের জিজ্ঞেস করিলেও তাহাদের মনে পরিবে কিনা আমার সন্দেহ আছে।

সাকুদার সঙ্গে আমার এই প্রথম পরিচয় কিন্তু ঘনিষ্ঠ পরিচয় বলা যাইবে না। তারপরের কাহিনী তো বিএমএর ভিতরের। ওটা যে শ্বশুরবারি নয় আদৌ, সেটা প্রথম দিনেই আমি বুঝিয়া ফেলিলাম। মনে হইল শত সতিনের সংসার, কেউ কাউকে ছাড়িয়া দিবার নহে। সে এক আরেক রাজপরিবারের মত বটে কিন্তু সেখানে গুটিকতক নারায়ণের বাস আর বাকি সবাই অ্যালেক্স হ্যালির কুন্টাকিন্তির মত।

সাকুদার সঙ্গে আমার অনেক জায়গায় অনেক পরিস্থিতিতে দেখা হইয়াছে, কখনো কোন এক সভায়, কখনো সেনাবাহিনীর কোর্স করার জন্য, কখনো বন্ধু ফোরামে, আবার কখনো হটাত অসময়ে।  আমি সাকুদা সম্পর্কে নতুন কিছু বলিতে চাই না কারন সাকির যা বলিয়াছে তা নিতান্তই বাড়াইয়া কিছু বলে নাই। বরং সাকুদা সম্পর্কে আরও অনেক কিছু বলার পরিধি আছে বৈকি। আমি আর সাকুদা একসঙ্গে একত্রে কখনো কোন গ্যারিসনে কাজ করিবার অবকাশ হয় নাই। তারপরেও আমি সাকুদার একজন ভক্ত। ভক্ত এই কারনে যে, সাকুদা যখন বালক ছিল তখন সে গ্রামে ছিল। আর সেটা এমন এক গ্রাম যা আমার গ্রামের মত মিষ্টি, বন্ধুসুলভ যেখানে বৃষ্টির দিনে ৮-১০ বছরের যুবক শিশুরাও  উলঙ্গ হয়ে বৃষ্টির জলে নাচিয়া বেড়ায়, পাশের বাড়ীর বিজয়া নিজের বোন না হইয়াও বোনের অধিকার হইতে কম যায় না, নিজের সহপাঠির সঙ্গে সারাদিন মারামারি করিয়াও পরের দিন তাহার সঙ্গে দেখা না হইলে মন খারাপ হইয়া যায়। সাকুদার জীবন বারিয়া উঠিয়াছে ঠিক এমন একটি গ্রামে। সাকুদার সঙ্গে এই খানে আমার অনেক মিল রহিয়াছে বৈ কি। সাকুদা যখন শৈশব পার করিয়া যুবক হইল, তখন সে রাষ্ট্রের অনেকের চেয়ে অনেক উপরে পদার্পণ করিল বটে কিন্তু সাকুদা হটাত করিয়া ভারসাম্যহীন হইয়া পরে নাই, কৌতূহল বারিয়াছে বটে কিন্তু সীমানা অতিক্রম করিয়া জলে ভাসিয়া যায় নাই। কিন্তু সাকুদা তাহার এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও পরিবর্তন হইতে পারিত। কিন্তু সাকুদা তার ঐ বালক বয়সের চরিত্রটুকুন ধরিয়া রাখিয়াছিল। রবি ঠাকুরের মত বলিলে বলিতে হয় যে, একেবারে পাকা আম্রের মধ্যেই যে পতঙ্গ জন্মলাভ করিয়াছে যাহাকে কোন কালে রস অন্বেষণ করিতে হয় নাই, অল্পে অল্পে রসাস্বাদ করিতে হয় নাই, তাহাকে একবার বসন্ত কালের বিকশিত পুস্পবনের মধ্যে ছাড়িয়া দেওয়া হউক দেখি- বিকচোন্নুখ গোলাপের আধখোলা মুখটির কাছে ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহার কি আগ্রহ।  সাকুদা যেন ঠিক এই জায়গায় একই ভাবে রহিয়াছে। এক যে ছিল রাজা, বলিয়া গল্প শুরু করিলে কোন দেশের রাজা আর কোন রাজা, সেটা সাকুদার জানার কোন কালেই আগ্রহ ছিল না এবং এখনও তাহার ঐ অনাবশ্যক খবরদারীতে আগ্রহ নাই। সাকুদা আগে যেমন ছিল, বয়সের তারতম্যে তাহার মধ্যে কোন ঘাটতি হইয়াছে বলিয়া আমার মনে হয় নাই। সেই হাসি, সেই অস্থিরতা, আবার সেই স্থিরতা কিংবা সে মায়াবিনী লক্ষি পেচার মত লক্ষ্মী বালকের চরিত্রে তার কোন পরিবর্তন হয় নাই। আর এটাই হচ্ছে সাকুদার সবচেয়ে বর একটা গুন যেখানে আমি তার চরম ভক্ত।

আজ সাকুদা সত্যি অর্থেই  অনেকের কাছে “দা”। তার মুখাবয়ব বয়সের ভারে আধাপাকা দাঁড়ি, চিন্তার ভারে মাথার চুল খালিপ্রায়, আর কর্ম পরিসরের কঠিন পরিশ্রমের পর তার এখন অবসরের সময়। তিনি গতকাল তার চিরাচরিত কর্মস্থল হইতে ছুটি পাইয়াছেন। হয়ত বা তাহার কিছুটা মন খারাপ হইয়া থাকিবে তার সেই চেনা পরিচিত টেবিলে আর কখনো আগের মত বসিতে পারিবেন না এই ভাবিয়া, কিংবা সকালে অফিসের ব্যস্ততা থাকিবে না এই ভাবিয়া। কিন্তু জগত সংসার এমনই এক পরিসর যেখানে বেকার মানুসেরা আরও অধিক ব্যস্ত, আর ব্যস্ত মানুসেরা আরও  বেশি অবসর কাটান। এ এক গোলক ধাঁধাঁর মত বৃত্ত।

আমি সাকুদাকে আমার অন্তর হইতে অভিনন্দন জানাই আমাদের এই গোলক ধাঁধাঁর মত বৃত্তে পুনরায় প্রবেশ করিবার জন্য। আবারো বলি, ১৯৮৩ সালে যেদিন রাগ করিয়া আমার নিজের পরিবারের সমস্ত সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করিয়া যেই সেনাবাহিনীতে আমার আশ্রয় করিয়া নিয়াছিলাম, আবার সেই আমি পুনরায় ২০০৪ সালে সেনাবাহিনীর উপর রাগ করিয়া আমি আমার পূর্বের জগতে ফিরিয়া আসিয়া দেখিয়াছি, যত তারাতারি নিজের ঘরে ফেরা যায় ততই মঙ্গল। এই জগত টা আমার, আমার পরিবারের এবং এই জগতটা আমার পূর্বসুরিদেরও ছিল। এই জগতে ভয়ের অনেক কিছু আছে কিন্তু সেই ভয়ংকর পরিবেশে যারা পাশে আছে তারা সবাই আমাদের কেউ বন্ধু, কেউ আত্মীয়, কেউ বা আবার কেউনা কিন্তু তারা অনেকেই আমাদের মঙ্গল কামনা করে। শুধু একটাই অনুরোধ, মগজ আর “দিল” এক সঙ্গে একই কাজে লাগাইতে হইবে, সাফল্য তাহলে নিজের।

আমরা তোমার পাশে আছি সাকুদা। পাশে আছি অনেক ভালবাসা নিয়া, পাশে আছি তোমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য যখন তোমার মন খারাপ হইবে, পাশে আছি যখন তুমি মনে করিবে তোমার কাউকে প্রয়োজন।

ভাল থাকিও

মেজর আখতার (অবঃ)

তোমার বন্ধু