৩/৮/২০১৭-সন্তান

Categories

পৃথিবীতে সকল সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে কাছের সম্পর্ক হচ্ছে সন্তানের সহিত বাবামায়ের। আবার কখনো কখনো এই সম্পর্কটাই সবচেয়ে বোরিং অথবা খুব বিপদজনক হয়ে যায়। বোরিং বা বিপদজনক হয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে, তিলেতিলে গড়ে উঠা দিনের পর দিন এই সম্পর্কটা এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় যে, পিতামাতা না পারেন তার সন্তানকে বুঝতে না পারে সন্তান পিতামাতাকে বুঝতে। পিতামাতা কি চায়, আবার সন্তানও ঠিক কি করলে কি হবে সেটাও বুঝাতে পারে না। কিন্তু এটা ঠিক, এই অবস্থায় সন্তানরা তাদের প্রেক্ষাপট থেকে যেটা বুঝায়, তাতে অনেক ভয়ংকর এমন কিছু থাকে যা পিতামাতার সবধরনের আশঙ্কা শুধু বাড়তেই থাকে। তারা শিহরিত হন সমাজের মানুষগুলোর কাছে মাথা হেট হয়ে যাবে এই আশঙ্কায়, তারা অস্থির হয়ে যান সন্তানের অমঙ্গল হবে এই আশঙ্কায়, তারা ভাবনার চরম দুশ্চিন্তায় হামাগুড়ি দিয়ে শুধু ভাবতে থাকেন এই অবস্থা থেকে পরিত্রানের উপায় কি ইত্যাদি।  

এমন একটা পরিস্থিতিতে মাতাপিতা থাকেন একটা মানসিক কস্টের মধ্যে। একদিকে আদর করে কথা বললেও সন্তানের মেজাজের কাছে হেরে যান, আবার শাসন করে কথা বললেতো ব্যাপারটা আরো সিরিয়াস দিকে টার্ন নিতে থাকে। সম্পর্কে একটা উত্তেজনা তৈরী হয়। ধৈর্যহারা পিতামাতা যেমন সন্তানের উপর থেকে তাদের আদর, মহব্বত, স্নেহ তুলে নিতে পারেন না, আবার সন্তানের উপরও ভরসা করতে পারেন না। আবার অন্যদিকে তারা না পারেন তাদের উপর পিতামাতার দায়িত্ব পালনে বিরত থাকতে। সন্তানের একগুয়েমী যখন চরমে উঠে, তখন পিতামাতা এক সময় হাল ছেড়ে দেন। সম্পর্কটা ধীরে ধীরে এমন জায়গায় গিয়ে দাড়ায় যা ক্রমাগত দূর থেকে দুরেই যেতে থাকে। 

যে সন্তানের জন্য পিতামাতা দিনের পর দিন অমানসিক, শারীরিক, দৈহিক সব ধরনের কষ্ট খুব হাসিমুখে সয্য করতে পেরেছেন, যে পিতামাতা নিজের আনন্দের জন্য কিছুই না রেখে সন্তানের জন্য সব অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন, বিলিয়ে দিয়েছেন তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সুন্দর সময়টা, সুন্দর ক্যারিয়ারটা। যে সন্তানের জন্য নিজে না খেয়ে, নিজের আহ্লাদ, স্বপ্ন কোনো কিছুই পূর্ণ না করে জমিয়ে রেখেছেন নিরাপদ সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য, যখন এই পিতামাতাই দেখেন তার সন্তানেরা তাদের জন্য একবিন্দু পরিমান মহব্বত, ভালোবাসা তাদের অন্তরের মধ্যে নাই, তাদের কথাবার্তায় এমন কিছু ফুটে উঠে যা ভয়ঙ্করের চেয়ে আরো কষ্টের, তখন মনে হয় জীবন পরাজয় বরন করেছে। তখন পিছনের সব কষ্ট, ত্যাগ, আহ্লাদ, অপূর্ণ ইচ্ছেগুলি একসাথে চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়ে শুধু বলতে থাকে, তোমরা কোনো ইতিহাস থেকেই শিক্ষা গ্রহন করো না। তোমরা এই শিক্ষাটা ভুলে গেছো যে, মানুষ একা এই পৃথিবীতে এসেছে, এবং তাকে একা চলার জন্যই ঈশ্বর সেইভাবে গড়ে তোলছেন। তোমাদের এতো কিছুর ত্যাগের কোনো প্রয়োজন ছিলো না। গোস্যা হয় তখন নিজের কাছে, বুকের কোথায় যেনো চিনচিন করে ব্যথা হয় তখন। চোখ ভিজে আসে। কিন্তু কারো উপর রাগ হয় না, রাগ হয় শুধু নিজের উপর। কোথায় যেনো একবার পড়েছিলাম, ছেলেকে চেনা যায় যখন সে বিয়ে করে, মেয়েকে চেনা যায় যখন সে যুবতী হয়, বউকে চেনা যায় যখন স্বামী দরিদ্র অবস্থায় পতিত হন, আর স্বামীকে চেনা যায় বউ যখন গুরুতর অসুস্থ হন। আর সন্তানকে চেনা যায় যখন বাবা মা বৃদ্ধ হবেন। কিন্তু এই চেনা জানা করতে করতে আমাদের জীবনে আর সময় বেশি বাকি থাকে না। এই ধরনের একটা পরিস্থিতি প্রতিটি মানুষের জীবনে হয়ত কখনো কখনো আসেই। এটা একটা চক্রের মতো। কারন, দশ বছর বয়সী কোনো সন্তানকে যদি জিজ্ঞেস করেন, সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি কে? সে বলবে, মা বাবা। যখন তার বয়স চৌদ্দ, সেই বাবা মাই তার কাছে খুব বিরক্তিকর মনে হয়। যখন তার বয়স আঠারো, সে আর বাসার পরিবেশটাকেই আর সহ্য করতে পারেনা, বেরিয়ে যেতে চায়, স্বাধীন জীবনের আশায়। বয়স যখন পচিশ, তখন সে বুঝতে পারে, হয়ত বাবা মাই ঠিক ছিল। ত্রিশ বছর বয়সে এসে অন্তরে এইটা ধীরে ধীরে প্রোথিত হতে থাকে, আহা, আমার ভুলের জন্য যদি বাবা মাকে সরি বলতে পারতাম। পঞ্চাশ বছর বয়সে, বাবা মাকে হারাতে খুব ভয় করে সন্তানের। সত্তর বছর বয়সে এসে বাবা মাকে খুব মিস করে এই সন্তানেরা। কিন্তু তখন আর তারা কেহই এই পৃথিবীতে বেচে নেই। সন্তানের বয়স যতই হোকনা কেনো, কখনো কখনো মনে হয়, বাবা মাকে খুব প্রয়োজন। এটা শতবছর বয়সী কোনো সন্তানের জন্যও প্রযোজ্য। সন্তান বুড়ো হয়ে গেলেও সে বাবা মায়ের কাছে শিশুই থেকে যায়। একমাত্র সন্তানই বুঝতে পারে মায়ের অন্তরের ভিতরে তার অন্তর কিভাবে প্রতিক্রিয়া করে। কারন সে সেখানে অনেক গুলি সময় অতিবাহিত করেছে। জীবনে একটা সময় আসে যখন সন্তানেরা বাবা মায়ের উপদেশকে আর বেদবাক্য মনে করে না বরং বাবা মাই হয়ে যান তাদের জীবনের আদর্শ। সেই সময় অবধি তখন আর বাবা মা তাদের পাশে বেচে নেই।   

মাঝে মাঝে ঐ কথাটা মনে পড়ে যে, সন্তানদেরকে ধনী হবার জন্য কোনো শিক্ষা দিতে নাই, সন্তানদেরকে শিক্ষা দেওয়া দরকার তারা যেনো বুঝে কোনটায় সুখি হওয়া যায়। আমরা এখানেই যেনো বারবার ভুল করি। আমরা সন্তানকে একাধারে কিভাবে ধনী হয়ে নিরাপদ জীবন পায় সেটাও দেখি আবার এটা দেখতে গিয়ে কিভাবে সুখি হওয়া যায় এই বিসয়টা অনেকাংশেই অবহেলা করি। আমাদের উচিত সন্তানদেরকে তাদের চেলেঞ্জগুলোকে মুখোমুখি হতে দেওয়া, তাদেরকে কোনো চেলেঞ্জ থেকে বের করে আনা কোনো মাতাপিতারই সঠিক সিদ্ধান্ত হয়ত নয়। পিতামাতারা তখনই নিজেদেরকে ধন্য মনে করবেন যখন তাদের হাত খালি থাকা সত্তেও তাদের সন্তানেরা দৌড়ে এসে তাদের বুকের মধ্যে আছড়ে পড়বে। এর থেকে আর কি ভালো হতে পারে কোনো পিতামাতার জন্য?  

একজন মা সন্তান জন্ম দেওয়ার বহু আগেই তার সন্তান আসুক এই প্রত্যাশায় বুকভরে শ্বাস নেয়। আর যখন সে পেটে আসে, তখন থেকেই একজন নারী মা হয়ে যান আর ঐ মুহূর্ত থেকেই সে তার অনাগত সন্তানের প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকেন। আর সন্তান জন্ম নেওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে সেই মা তার সন্তানের জন্য মরতেও প্রস্তুত হয়ে যায়। আর এটাই হচ্ছে মা যিনি নয় মাস সন্তানকে পেটে ধরেছেন, তিন বছর তাকে তার বাহুতে রেখেছেন আর সারাজীবন তার অন্তরের ভিতরেই রাখেন। একজন দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মা পৃথিবীর যে কোন গোয়েন্দা সংস্থার থেকেও সাফল্যবান কারন তিনি যা করেন সবটুকু কোনো শর্ত ছারাই তার সন্তানের জন্য করেন। তাতে কোনো খাদ নাই। যেদিন কোল ঘেসে সন্তান আসে, তখন তার নতুন আরেক নাম হয়। তার নাম হয় "মা"। মা ই একমাত্র মানুষ যে, সন্তানের কোনো না বলা কথা বলার আগেই বুঝে নেয়। একটা কৌতুক পড়েছিলাম, মায়েরা সবসময় চান, তার আদরের মেয়ে যেন তার থেকে ভালো স্বামী পায়, আর ছেলের বেলায় মা মনে করেন, ছেলে যেনো তার মতো একজন বউ পায়। এটা কৌতুক শুনালেও এর মাহাত্য একটাই, মা সব সময় সন্তানের সবচেয়ে মঙ্গলটাই চান। আমি বাবাকে উপেক্ষা করছি না। বাবা অন্যরকম এক চরিত্র। প্রতিটি বাবার কাছে তার মেয়েরা একজন প্রিন্সেস, আর ছেলে সন্তানেরা একেকজন প্রিন্স। একজন মেয়ে হয়ত তার জীবনে প্রিন্সেস পাবে কিন্তু বাবা আজীবন কাল তার কাছে রাজা হিসাবেই থাকেন। বাবা হচ্ছেন সন্তানের কাছে সেই ব্যাক্তি যার সুত্র ধরে অন্য কোন পুরুসকে মেয়ে বুঝতে পারে কতটা তফাত বা উন্নত। ছেলে সন্তানের কাছে বাবা হচ্ছেন একজন হিরো, আর মেয়ের কাছে প্রথম ভালোবাসা। আর এটাই হচ্ছে বাবা। একটা সময় হয়ত আসবে যখন "আয় তো মা, কাছে বস", এই কথাটা শুনার জন্যও মন ব্যাকুল হয়ে কোনো কারন ছাড়াই চোখ বিনা দিধায় অশ্রু বিসর্জন দিবে। "লাভ এট ফার্স্ট সাইট" এই আদর্শ বানীটি একমাত্র প্রযোজ্য শুধুমাত্র বাবা মায়ের আর সন্তানের ক্ষেত্রে। পঙ্গু, কালো, নাক বোচা, বেটে বোবা যেমনই হোক না কেনো, বাবা মা ই একমাত্র ব্যক্তিত্ত যারা সন্তানের আগমনে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে। সন্তান জন্ম দেওয়া পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ, বাবা মা হওয়াও খুব সহজ কিন্তু সেই বাবা মা হওয়া খুব কঠিন যা সন্তানের জন্য প্রয়োজন। আজ হয়ত আমাদের সন্তানেরা এই ভালোবাসা উপলব্ধি করবে না, কিন্তু যখন করবে, তখন তারা ইতিমধ্যে পিতামাতা। প্রতিটি সাফল্যবান সন্তানের পিছনে আছেন প্রথমে তার মা, পরেরজন তার বাবা। আমাকে কোনো সন্তান যদি কখনো প্রশ্ন করত, কি করে আমি খুব ভাল একজন সন্তান হবো? আমি হয়ত বলতাম, এই প্রশ্নটা তুমি তোমার দাদা-দাদি অথবা নানা নানিকে করো। হয়ত তারা এই প্রশ্নের উত্তর আমার থেকে ভালো দিতে পারবেন।  

লেখাটা একটা কৌতুক দিয়ে শেষ করিঃ 

মা যখন রান্না ঘরে রাতের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত, এমন সময় তার ছোটছেলে এসে তাকে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিলো। তাতে লেখা ছিলোঃ

গতকাল বাগানে ঘাস কাটার জন্য পাওনা - ৫ টাকা

আমার রুম পরিস্কার করার জন্য পাওনা - ১ টাকা

পাশের দোকান থেকে মায়ের আদেশে ডিম কিনে আনার জন্য পাওনা - ১ টাকা

আমার ছোট বোনকে ১ ঘন্টার জন্য একা বাসায় পাহারা দেওয়ার জন্য পাওনা - ৫ টাকা

ময়লাওয়ালাকে ময়লা তুলে দেওয়ার জন্য পাওনা  - ২ টাকা

স্কুলে ভালো মার্ক শীট পাওয়ার জন্য পাওনা  - ৫ টাকা

টেবিল চেয়ার মুছে দেওয়ার জন্য পাওনা  - ২ টাকা

সর্বমোট ২১ টাকা 

মা চিড়কুটটি পড়ে তার ছেলের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন এবং হাতমুছে একটা কলম নিয়ে লিখলেন 

৯ মাস গর্ভে ধারন করার জন্য - নো চার্জ (ফ্রি)

সারারাত তোমার জর আর কাশির জন্য একা একা যখন জেগে থাকা - নো চার্জ (ফ্রি)

খাবার বানানো- নো চার্জ (ফ্রি)

খেলনা কিনে দেওয়া- নো চার্জ (ফ্রি)                                  

নাক পরিস্কার করা, গোসল করান, পায়খানা প্রশ্রাব পরিস্কার করা ইত্যাদি- নো চার্জ (ফ্রি)

বিছানা ভিজিয়ে দেওয়ায় সারারাত নিজে ভিজা জায়গায় শুয়ে তোমাকে শুকনা জায়গায় রাখা  - নো চার্জ (ফ্রি)

এ ছাড়া আমার ভালোবাসা - নো চার্জ (ফ্রি) 

এই লিখে মা তার ছোট ছেলেটির হাতে চিড়কুটটি দিলেন। ছোট ছেলেটি যখন এই চিরকুটটি পড়ছিলো, তখন তার গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিলো। সে নিসচুপ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে একবার ভাষাহীন চোখে সরাসরি মায়ের দিকে তাকিয়ে শুধু এটাই বলতে পারলঃ 

মা আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। 

এরপর সে একটা কলম নিয়ে চিড়কুটিতে লিখলোঃ  

পেইড ইন ফুল