সেদিন সমস্ত দিন বাহিরে ঝড় বৃষ্টি হইতেছিল। কিন্তু বিকালে আকাশ বড় পরিস্কার নীলদিগন্ত লইয়া, পৃথিবী তাহার সবুজ গাছপালার ঢালপালা সাজাইয়া খুব শান্ত হইয়া বসিয়াছিল। এই ঋতুতে কখন আকাশ মেঘলা হইয়া যায় আবার কখন ঝরঝর করিয়া আগাম কোন সংকেত না দিয়া অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়, তাহার কোন হদিস থাকে না যদিও আজ এই পরন্ত বিকালে কোন সংকেতবিহিন এইরূপ অঘটন ঘটিবে বলিয়া মনে হইতেছে না।
এমনি এক বিকালে "সুখালয়" এর প্রকান্ড বাড়িটার সামনে সবুজ লনের মধ্যে মা শেলি আর তার অষ্টাদশী রুনা চুপচাপ বসিয়া আছে। কাহারো মুখে কোন কথা নাই। অনেক্ষন ধরিয়াই শেলি কোন কথা না বলিয়া দুরের আকাশের দিকে আনমনে তাকাইয়া কি যেন গভিরভাবে ভাবিতেছে তাহার মুখ দেখিয়া তাহা বুঝিবার উপায় নাই। তবে তাহার মনটা যে বড় বিষণ্ণ এ ব্যাপারে নিশ্চিত করিয়া বলা যায়। পাশেই একটা মেলামিনের কাপে গরম কিছু চা লইয়া তারই অষ্টাদশী চঞ্চলা রুনা মায়ের কথা শুনিবার জন্য বসিয়া আছে। তাহারও মন খুব একটা শান্ত কিংবা চঞ্চলা কিনা বুঝা যাইতেছে না। তবে দুইজনের মনের অবস্থা নিরিক্ষা করিয়া এইটুকুন উপলব্ধি করা যায় যে, কোন এক ঝড়ের পূর্বের থমথমে মেঘময় নীলিমার মত, অথবা ঝড়ের প্রাক্কালে বাতাসেরা যেমন তাহাদের পরবর্তী গতিপথের নিশানা ঠিক করিবার জন্য শল্য পরামর্শ করার তাগিদে একেবারে নিসচুপ হইয়া যায়, অথবা ভুতলের সব বৃক্ষরাজিরা ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার লক্ষে পূর্বপ্রস্তুতিমুলক যতসব কার্যপ্রণালী আছে তাহার ব্যাপক আয়োজন চালায়, ঠিক ঐ রকম একটা থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হইয়াছে।
রুনা শেলির একমাত্র মেয়ে। বড় চঞ্চল এক চপলা কিশোরী। কিন্তু পিতার অভাবে বড় আদুরের রুনাকে শেলি কখনো কোন কষ্টের ভার নিতে দেয় নাই। এই সমাজ সংসারে যাহা কিছু সম্মান আর আনন্দের সহিত ভোগ করা যায়, তাহার কোনকিছুই শেলি রুনার জন্য কমতি রাখে নাই। একইসঙ্গে শেলি রুনার মা এবং বাবার দায়িত্ব পালনে কখনো ব্যর্থ হন নাই। ভাল স্কুল, দামী গাড়ি, প্রকান্ড বাড়ি, সুন্দর সুন্দর পোশাক-আসাকে শেলি রুনার জীবন একেবারে ভরিয়া রাখিয়াছে। কিন্তু আজ শেলি রুনার কাছে বড় অসহায়। তাহার অষ্টাদশী রুনা আজ শেলিকে এমন কিছুর সামনে আনিয়া দাঁড় করাইয়াছে যেখানে শেলি না পারিতেছে তাহার অতীত জিবনের কাহিনী শুনাইতে, না পারিতেছে তাহার সেই অতীত কাহিনী কোনভাবে লুকাইতে। রুনা পন করিয়াছে, সে তাহার পূর্বপুরুষের ইতিহাস, বিশেষ করিয়া তাহার জন্মদাতা পিতা, পিতামহির কথা তাহাকে জানাইতেই হইবে। না জানিতে পারিলে তাহার এই সমাজে এই সংসারে থাকিবার মত আর কোন গতিও নাই, কাহারো কাছে তাহার মুখ দেখাইবার মত পরিস্থিতিও নাই। আর তাহা না হইলে অচিরেই হয়ত রুনা তাহার যাহা আছে সব কিছু ছারিয়া অন্য কোথাও মুখ লুকাইয়া বাচিয়া যাইবে। এমন একটা পরিবেশে শেলির কাছে সমস্ত মানবজীবন আর বিশ্বরচনা এক দুর্ভেদ্য বলিয়া মনে হইতে লাগিল। কি দিয়া কোথা হইতে কি শুরু করিবে আর কোথায় গিয়া তাহার এই দুর্ভেদ্য রচনা শেষ করিবে, তাহার আগাগোরা কিছুই শেলির মাথায় আসিতেছিল না।
চায়ের কাপে চুমু দিতে দিতে রুনা মায়ের দিকে কয়েকবার আড় চোখে তাকাইল। মায়ের এই অতিব নিসচুপ বৈশিষ্ট রুনার কাছে আজ প্রথম নয়। মাকে যখন হইতে রুনা বুঝিতে শিখিয়াছে, তখন হইতেই সে দেখিয়াছে তিনি কোথাও বেড়াইতে যান না, তাহার কোন একান্ত বন্ধু বা বান্ধবি আছে তাহাও না, কাহারো সঙ্গে মা খুব একটা মিশেনও না। চাপরাশি, আর্দালি, পিয়ন সবাই যার যার কাজ করিয়া দিয়া যায়, এত বড় ব্যবসার কোথায় কি হইতেছে তাহার প্রতিদিনের হিসাব মা না রাখিলেও ব্যবসা যে ঠিকমতই চলিতেছে মা তাহার হিসাব হয়ত রাখেন। দিনের অধিকাংশ সময়ে মা ঘরেই থাকেন, শুধুমাত্র বিকালে একবার পারভিনের মাকে লইয়া ছাদের ঐ চিলে কোঠায় উঠিয়া বিশাল আকাশের দিকে তাকাইয়া শুধু সূর্যাস্ত দেখেন। এই সময় মায়ের সঙ্গে শুধু পারভিনের মা তাহার একান্ত সঙ্গিনী, আর কাউকেই মা তাহার কাছে রাখিতে পছন্দ করেন না। পারভিনের মা আমাদের বাড়ীতে অনেককাল ধরিয়া আছে, তখনো পারভিনের জন্ম হয় নাই। এখন পারভিন তাহার সংসার লইয়া অনেক দুরের এক শহরে স্বামীর সংসার করিতেছে। পারভিনের বাবাকেও আমি কখনো দেখি নাই। কোন এক অজ্ঞাত কারনে তিনি নিখোঁজ হইয়া রহিয়াছে। এইটুকুই আমি জানি। আমি আমার বাবাকেও দেখি নাই। যতবার মাকে জিজ্ঞসা করিয়াছি, মা কোন না কোনভাবে তাহা এরাইয়া গিয়াছেন। খুব বেশি পিড়াপীড়ি করিলে হয়ত তিনি "তোঁর বাবাকে আমি ..." এইটুকু বলিয়াই অন্য কোন এক প্রসঙ্গ টানিয়া আনিতেন। আমার বাবা কি জিবিত আছেন না মারা গিয়াছেন, তাহার কোন সদুত্তর আমার এখনো জানা নাই। মাকে আমি কখনো বিধবার মত শাড়ি পরিতে দেখি নাই, মাকে আমি বাবার কোন মৃত্যুবার্ষিকী পালন করিতেও দেখি নাই। আমি মাকে কখনো বাবার প্রসঙ্গে কোন কথা বলিতেও দেখি নাই। কি হইয়াছে তাহলে আমার বাবার? আমাদের সারা বাড়ীতে বাবার কিংবা দাদাদাদির কোন একটা ছবিও নাই। আমার মা সবার হইতে এমন আলাদা এক জগত লইয়া যেন বসবাস করিতেছেন। অথচ তিনি এই সমাজেরই একজন অতি গনমান্য মানুষদের মধ্যে একজন। অনেক মানুষের তিনি অসময়ের বন্ধুও বটে।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমার মা এত উদাসিন কেন? কি নাই তাহার? বাড়ি, গাড়ি, মানসম্মান, প্রতিপত্তি, যশ, টাকাপয়সা, ব্যবসা-বানিজ্য, সবই আছে তাহার। এই বয়সেও তিনি অনেক সুন্দরি মায়েদের থেকে অধিকতর সুন্দর। অনেক দামী শাড়ি হয়ত পরেন না কিন্তু দামী শাড়ি পড়িবার জন্য তাহার আয়েরও কোন কমতি নাই। আজ আমি মাকে বড় ভয় পাইতেছি। কারন আমি মাকে এমন কিছু কথা শুনাইয়া দিয়াছি, হয় মা আমাকে ছারিবেন, না হয় আমি মাকে ছারিব। কিন্তু আমাকে আমার পরিবারের ইতিহাস শুনাইতেই হইবে। তাহা না হইলে আমি কি করিয়া ঐ অপূর্বের বাসায় আমার বংশপরিচয় দেব? আমি তো অপূর্বকে ভালবাসি। আমার বারংবার শুধু এই কথা মনে করিয়া ভয় হইতেছিল যে, মা কি আমাকে এমন কিছু বলিবার জন্য প্রস্তুত যাহা আমি শুনিবার জন্য প্রস্তুত নই? ভয় যখন মানুষের উপর ভর করে, তখন তাহার রক্তের শিরায় শিরায় এক অজানা শিহরন তোলে, মনে হয় বুকের ভিতর কি যেন নাই, বা কি যেন দ্রুত হারাইয়া যাইতেছে। মাথা ভনভন করিতে থাকে, স্বাভাবিক আচরন আর স্বাভাবিক মনে হয় না।
মা নিরবতা ভাঙ্গিয়া আমার দিকে তাকাইয়া একটু মুচকি হাসিয়া আমার কাছে একটু আগাইয়া আসিয়া আমাকে জড়াইয়া ধরিলেন আর বলিলেন, 'তুমি অপূর্বকে ভালবাস?'
আমি বলিলাম, হ্যা, আমি অপূর্বকে ভালবাসি মা।
-অপূর্ব কি তোমাকে ভালবাসে?
আমিও মাকে জড়াইয়া ধরিয়া হাতের কাপটি মাটিতে রাখিয়া শুধুমাত্র ঘাড় নাড়াইয়া এই বলিয়া সংকেত দিলাম যে, মা যাহা জানিতে চাহিয়াছেন, তাহা সত্য এবং ইহার বাহিরে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই।
মা আমাকে এইবার তাহার বাহুবল হইতে ছাড়িয়া তাহার চেয়ারে হেলান দিয়া জিজ্ঞেস করিলেন, 'রুনা মা, তুমি আমার কাছ হইতে কি জানিতে চাও?'
বুঝিলাম, শতবার এরাইয়া যাওয়ার যে উত্তর আমি জানিতে চাহিয়াছিলাম, আজ মা তাহার সব উত্তর দিতে হয়ত নিজেকে প্রস্তুত করিয়া আমার সামনে হাজির হইয়াছেন। আজ হয়ত তিনি কোন কিছুই এরাইয়া যাইবেন না। হয়ত অন্যদিনের মত বলিবেন না যে, ;আমি তোঁর বাবা...' ইত্যাদি।
-মা, আমি আমার পরিবারের ইতিহাস জানিতে চাই। আমি আমার পূর্বপুরুষের ইতিহাস জানিতে চাই, আমি আমার বাবার ইতিহাস জানিতে চাই। কথাগুলি বলিতে আমার বুক কাপিতেছিল, আমার হাত কাপিতেছিল, আমার গলা ধরিয়া আসিতেছিল। আমি স্বাভাবিক নই এখন আমার মায়ের সামনে। অথচ এই মা আমার সবচেয়ে কাছের একজন মানুষ যাহাকে আমি কোন কিছুই বলিতে সংকোচবোধ করি না। কিন্তু আজ আমার অনেক ভয় করিতে লাগিল।
মা অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাহার দুইখানা হাত তাহার বিসন্ন মুখে একবার বুলাইয়া চোখের চশমাটা খুলিয়া শাড়ীর আচল দিয়া মুছিতে মুছিতে দূর আকাশের দিকে তাকাইয়া শুধু বলিলেন,-'মানুষের অনেক পুরানো ইতিহাস না জানাই বর্তমান সময়ের জন্য মঙ্গলকর, তারপরেও যদি কেহ তাহা জানিতে পন করিয়া বসে, তাহা হইলে তাহাকে তাহার অতীত জীবনের সত্যের মুখুমুখি দারাইবার যে জীবনীশক্তি দরকার, তাহা আছে কিনা জানা খুবই প্রয়োজন। তাহা না হইলে বর্তমানকে মানিয়া লইয়া বাচিয়া থাকিবার যে অনুশোচনা তৈরি হইবে তাহার থেকে পরিত্রান পাওয়া বড়ই দুস্কর। আমি তোমাকে এই উভয় সংকট পরিস্থিতে ফেলিতে চাহি নাই। তারপরেও যখন তুমি এতটাই পন করিয়া বসিয়া আছ, তোমার জীবনের কাহিনী তোমাকে আজ আমি শুনাইব। জানিতে পারা আর মানিয়া লইতে পারা সব তোমার উপর নির্ভর করে'।
আমার বড় ভয় করিতে লাগিল।
-আজ হইতে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমি তোমার মতই একজন চঞ্চলা যুবতি মেয়ে ছিলাম। কত হইবে আমার বয়স তখন? হয়তবা বাইশ কিংবা তেইশ। আমাদের গ্রামে তখনো বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল। অনেক চরাইউৎরাই পার হইয়া সেই অজপারাগায়ের সমস্ত বাল্যবিবাহের আইন কানুন ভাঙ্গিয়া আমি সবেমাত্র ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হইয়াছি। গ্রামে আমার বাবা অতি ধনি না হইলেও আমরা দরিদ্র ছিলাম না। আমরা তিনবোন, একভাই আর মাকে লইয়া আমার বাবা বেশ ভালই জীবনযাপন করিতেছিলেন। স্কুলের গন্ডি হইতে শুরু করিয়া ঐ ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত আসিতে আমি অনেকবার বিবাহের সম্বন্ধ লইয়া অনেক পেরেশানিতে ভুগিয়াছি। দাদা দাদির ধমক হইতে শুরু করিয়া, জ্যাঠা জ্যাঠির, ফুফা ফুফির সবারই কম বেশি ধমক আর মানসিক নির্যাতন খাইয়াছি। কিন্তু আমার বাবা আমার মনের ইচ্ছার কথা জানিতেন। তাহার হয়ত অনেক সাহস ছিল না কিন্তু তিনি আমাদের সব ভাইবোনদের মধ্যে আমাকে বিশেষ নজরে দেখিতেন বলিয়া আমার ইচ্ছার বাহিরে কখনো মতামত দেন নাই। বিশেষ করিয়া আমার বিবাহের বেলায় তো কখনই জোরাজোরি করেন নাই। গ্রামের পঞ্চায়েত, মুরিব্বিগন, এমন কি আমার দাদা দাদিদের কাছেও আমার বাবাকে আমার এই বিবাহ লইয়া অনেক কঠোর কথা শুনিতে হইয়াছিল। তখন সবেমাত্র দেশ স্বাধীন হইয়াছে, ফলে দেশে খুব একটা আইন শৃঙ্খলা নাই এবং একটা অরাজকতার বিশৃঙ্খলা বিরাজ করিতেছিল। যাহারা দেশ স্বাধীন করিয়া জীবিত ফিরিয়া আসিয়াছে, তাহাদের হইতেই এখন আমাদের সবচেয়ে বিপদের আশংকা বেশি মনে হইতেছিল। কোন এক অমাবশ্যার রাতে আমাদের গ্রামের নদীর ধারে আমার বাবার মৃত দেহখানি পাওয়া গেল।' কে বা কাহারা এই হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত ছিল তাহা আজো অবধি তাহার কোন কূলকিনারা হয় নাই।
এই বলিয়া মা কিছুক্ষন চুপ করিয়া থাকিলেন। আমার এতক্ষন যে ভয়টা আমাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছিল, তাহা আরও বেশি করিয়া চাপিয়া ধরিল। আমি কি কোন লোমহর্ষক ইতিহাস শুনিতে যাইতেছি? নাকি কোন এক রূপকথার গল্প শুনিতে যাইতেছি? ইহার পরে কি শুনিব যে আমার বাবাও আমার দাদার মত কোন এক অমাবশ্যার রাতে খুন হইয়া লাশ হইয়া গিয়াছিল? আমার শরীর হিম হইয়া আসিতে লাগিল।
মা বলিতে শুরু করিলেন, 'জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য হইল, সে একদিন মরিবেই। বিধাতাকে কেহ মানুক আর নাইবা মানুক, বিধাতা মানুষের জন্মের দ্বারা একটা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন, আর তাহা হইল, সে একদিন এই সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করিয়া, সমস্ত লোভ লালসা পিছনে রাখিয়া, সমস্ত ধন দৌলত হাত হইতে ছাড়িয়া দিয়া একা একা নিঃসঙ্গভাবে সবার চোখ হইতে চিরতরে আড়াল হইয়া যাইবেই। সময়টা হয়ত কারো শতবছর পর আবার কারো তারও আগে। কয়েকদিন অতি প্রিয়জনেরা তাহাকে লইয়া কান্নাকাটি করিবেন বটে কিন্তু সময়ের স্রোতে একদিন সব বিবর্ণ হইয়া কালের অতল গভীরে হারাইয়া যাইবে। তাহাকে আর কোথাও খুজিয়া পাওয়া যাইবে না। না তাহার উত্তরসূরিদের কণ্ঠে, না পূর্বসূরিদের। ইহাই এই জীবনের তথা পৃথিবীর সরল সমিকরন। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের সংসারটায় যেন অকস্মাৎ ছাদ ভাঙ্গিয়া মাথায় পড়িল। তিন বোন, এক ছোট ভাই আর মাকে লইয়া আমি যেন দেখিতে পাইলাম, এতদিন যাহারা বিনা দ্বিধায় আমাদের পরিবারে অন্নগ্রাস করিত, আজ তাহারা তাহাদের নিজ নিজ স্বার্থ লইয়া অতিশয় ব্যস্ত, দাদার সম্পত্তি লইয়া ভাগ বাটোয়ারা করিতে চারিদিকে পাঁয়তারাসমেত গোপনে একা কিংবা প্রকাশ্যে দল বাধিয়া শল্যপরামর্শ করিতেছে। পরিশেষে আমাদের ভাগ্যে যাহা জুটিল তাহা দিয়া আর যাহাই হোক, আমাদের লেখাপড়া, সংসার খরচ চলিতে পারে না। আমার মা হিমশিম খাইয়া দিশেহারা হইয়া দিক্বিদিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। আর এরই মধ্যে আরও একটা নব্য উৎপাত শুরু হইল। আমার বিবাহের সম্বন্ধ পাকাপাকি করা। আমার দাদা দাদিরা, ফুফা ফুফিরা, সবাই শক্ত করিয়া আমাদের কি প্রকারে বিশেষ উপকার করা যায় তাহার বুদ্ধি বাহির করিতে লাগিল। ফলশ্রুতিতে যাহা দারাইল, তাহা হইল, সবাই এবার আমার মাকে ঝাঁকিয়া ধরিল যে, এত লেখাপড়া করাইয়া কে কবে কোন লাট সাহেবের বউ হইয়াছিল? ধীরে ধীরে একে একে আমাদের সবার বিবাহ সম্বন্ধ ঠিক করিবার জন্য দিনের পর দিন মানসিকভাবে চাপের মুখে পরিতে হইল। আমরা যেন আর অধিক চাপ বহন করিবার মত শক্তি পাইতেছিলাম না।
কোন উপায়ন্তর না দেখিয়া একদিন আমি আমার মাকে বলিলাম, 'মা, শুনেছিলাম আমার বাবার এক অতি পরিচিত এক বাল্যবন্ধু আমাদের এই মহল্লায় বাস করত। তার অনেক ব্যবসা ছিল, অনেক দানখয়রাতও করতেন বলে তার সুনাম আজো এই মহল্লায় রয়েছে। তিনি যদিও আর এই মহল্লায় বাস করেন না কিন্তু শুনেছি তিনি নতুন রাস্তার পাশে বিরাট বাড়ি করে ওখানেই বসবাস করেন। খুজে পেতে খুব অসুবিধা হবে বলে তো আমার মনে হয় না। একবার কি তার সাথে দেখা করব?'
যাহাদের পেটে ক্ষুধা, যাহাদের আশ্রয়স্থল বলিতে এক ভগবান ছাড়া আর কেহ থাকে না, যাহাদের চারিদিকে হায়েনাদের মত অসংখ্য পিশাচ বসবাস করে, যাহাদের সাহায্য করা উতিচ অথচ তাহারাই যদি অত্যাচারি হইয়া যায়, তখন মানুষকুলে যদি এমন কাহারো একবার ক্ষিন সন্ধানের ছিটেফোঁটাও থাকে, যাহাকে ধরিয়া একবার নিরাপদ আশ্রয় পাইতে পারে, তাহা হইলে চেষ্টা করিয়া দেখিতে আপত্তি কি? আমার মা কিছুক্ষন ভাবিয়া আমার হাত ধরিয়া বলিলেন, 'চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।'
পরদিন আমি আর আমার মা সকাল সকাল ঐ নতুন রাস্তার ধারে আসিয়া হাজির হইলাম। আমাদের ইহাই প্রথম শহরে আসা নয় তারপরেও মনে হইতে লাগিল আজিকার আসা আর আগের বহুবার আসার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রহিয়াছে। শহরের রাস্তায় অসংখ্য মানুষের যাতায়ত, আমাদের গ্রামের দুই একজনের সহিতও আমাদের দেখা হইয়া গেলো। বিশেষ কোন কারন না দেখাইয়া আমরা তাহাদেরকে এক প্রকার এরাইয়াই গেলাম। অনেক খুঁজাখুঁজির পর বাড়িটির সন্ধান পাইলাম বটে কিন্তু তাহার সহিত দেখা করিবার যে তরীকা, তাহাতে আজ ফিরিয়া যাইতেই হইবে বলিয়া আমাদের আশংকা হইল। তিনি বাড়ি নাই বলিয়া গার্ডের সংক্ষিপ্ত উত্তরে আমাদের নতুন করিয়া আরেক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলিয়া দিল। দারোয়ান গেট বন্ধ করিয়া দিল, ভিতরে প্রবেশের কোন সুযোগ রইল না।
বাড়ি ফিরিয়া যাইবার অপেক্ষায় মা আর আমি দাঁড়াইয়া আছি, এমন সময় কালো একখানা গাড়ি বাড়ীর সুম্মুখে আসিয়া কিঞ্চিত একটি হর্ন বাজাইয়া গেট খুলিবার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া গেল। কালো গ্লাস দিয়া ঢাকা থাকায় ভিতরে কে বা কাহারা বসিয়া আছেন আমরা কিছুই দেখিতে পাইলাম না। দারোয়ান দ্রুত গেট খুলিতে গিয়া গেটের পাশে আমাদের দেখিয়া মনিবের সামনে অতি উচ্চকন্ঠে দূর দূর করিতে লাগিলেন। একটু অপমান বোধ হইতে লাগিল যেন আমরা কোন এক নমশূদ্রের দল এই ব্রাহ্মণ বাড়ীর গেটে আসিয়া দারায়াছি বলিয়া সমস্ত বাড়ীটি অপবিত্র হইয়া গেল। নিজের উপর নিজের খুব রাগ হইতে লাগিল।
মনের রাগ, আর অপমানে 'কেন আসিয়াছিলাম' এই অনুশোচনা লইয়া মা মেয়ে ধির পদক্ষেপে বাড়ীর দিকে রওয়ানা হইয়াছি, এমন সময় দারোয়ান আবার হন্তদন্ত হইয়া পিছন হইতে আমাদের ডাকিয়া বলিলেন,-'এই যে শুনছেন? সাহেব আপনাদেরকে ডাকছেন'। এই কথা শুনিয়া মনের ভিতর যেমন একটা আশার সঞ্চার হইল, তেমনি আবার সংশয়েরও সৃষ্টি হইল। কি জানি আবার কোনো অপরাধ হইল কিনা, কিংবা সাহেব আবার কি বলিয়া আমাদের নতুন করিয়া অপমান করিবেন কিনা ইত্যাদি।
এবার সাহেব নিজেই আগাইয়া আসিলেন এবং জিজ্ঞেস করিলেন, কোথা হইতে আমরা আসিয়াছি। মা তাহার ঘোমটাখানি সরাইবামাত্র মাকে দেখিয়াই সাহেব চিনিতে পারিলেন। অতি উচ্ছ্বসিত হইয়া মায়ের একেবারে কাছে আসিয়া সহাস্যে বলিলেন, 'আরে, এ যে আমাদের বৌদি? কি ব্যাপার এতদিন পর আমাদের মনে পড়ল?'
আমি লোকটিকে আগে কোথাও দেখিয়াছি কিনা মনে পরিতেছে না কিন্তু কোথাও তাহাকে দেখিয়াছি তাহা আমি নিশ্চিত। তাহার বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ কি তাহার কাছাকাছি হইবে। সুঠাম দেহ, পরিপাটি চুল, সাদা চেকের উপর ফোঁটা ফোঁটা কালো রঙের চেকে পরিহিত একটা শার্ট, হাতে সোনালী রঙের একটি ঘড়ি, বেশ মানাইয়াছে। মাথা ভর্তি চুল। মুচকি হাসিলেও ভাল লাগে আবার অট্টহাসিতেও বেমানান লাগে না। দুই চোখের মাঝখানে একটা কাল তিলক। বেশ হাসিখুশি একজন মানুষ বলিয়া মনে হইল। সাহেব মাকে একরকম পিঠে হাত দিয়া তাহার সহিত তাহাদের অন্দরমহলে লইয়া গেলেন। আমি মাকে শুধু অনুসরন করিয়া আমিও পিছুপিছু অন্দর মহলে প্রবেশ করিলাম। সাহেব বলিলেন, 'তোমরা একটু বস, আমি কয়েক মিনিট পর এসে তোমাদের সাথে কথা বলব'। এই বলিয়া তিনি তাহার ঘরে চলিয়া গেলেন।
আমরা তাহার ড্রইং রুমে বসিয়া আছি। বিশাল ঘর, চারিদিকে বিদেশী টাইলসের দেয়াল, সাজানো ঘরের মত আঙ্গিনা। পর্দাগুলি এসির বাতাসে ঝিরঝির হাওয়ায় অল্পঅল্প নরিতেছে, ঘরের একপাশে বিশাল একটা একুরিয়াম। রঙ বেরঙের মাছ তাহার ভিতরে খেলা করিতেছে। একুরিয়াম হইতে কখনো কখনো বুদবুদ উঠিতেছে, মনে হইতেছে মাছগুলি ডুবুরিদের মত নিঃশ্বাস ছারিতেছে। দেয়ালের এক কোনায় একটি মহিলার বিশালকায় একটি ছবি টাঙ্গানো আছে। শরীর ভর্তি গহনা। কানে গহনা, গলায় গহনা, নাকে গহনা, মাথার চুলের ঠিক মধ্যিখানে একটি মাথলা টিকি। মনে হইতেছে গহনাগুলি যেন ঠিক জায়গা মত বসিয়া মহিলার রূপ আরও শতগুনে বৃদ্ধি করিয়া দিয়াছে।
-এটা পারুলের ছবি। মা বলিলেন।
পারুল সাগর সাহেবের স্ত্রী। অনেক বছর আগে তিনি গত হইয়াছেন। পারুলের মৃত্যুর পর সাগর আর বিয়া করেন নাই। তাদের কোন সন্তানাদিও হয় নাই। পারুল যে বছর মারা গিয়াছে, তাহার পরের বছরই সাগর সাহেব আমাদের মহল্লা ত্যাগ করিয়া নতুন জায়গায় চলিয়া আসিয়াছেন। পারুল আমাদের গ্রামের মেয়ে ছিল। তবে পারুলের বয়স আমাদের হইতেও কম ছিল।
-'কিভাবে মারা গিয়াছিল'? আমি মাকে প্রশ্ন করিতেই মা বলিলেন, পারুলের প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় পারুল দেহত্যাগ করে। এই পারুলের নামেই পরবরতিতে সাগর সাহেব একখানা দাতব্যালয় দিয়াছিলেন আর ঐ দাতব্যালয় হইতেই তিনি অনেক দান খয়রাত করিতেন। কি কারনে কেন তিনি তার সেই দাতব্যালয় আর চালাইলেন না তাহা আমরা ভাল করিয়া বলিতে পারিব না। কিন্তু তিনি আর বিয়াথাও করেন নাই শুনিয়াছি।
-'এই যে বৌদি, কি মনে করে আজ এত বছর পর আমাদের মনে পড়ল? তোমরা একা আসলে কেন? দেওয়ান ভাই আসে নাই যে?'
বলিতে বলিতে আমাদের সামনের সোফায় আসন গ্রহন করিলেন। সাগর সাহেব ইতিমধ্যে তাহার একটু আগে পরিহিত জামা প্যান্ট পাল্টাইয়া একটা সাদা পাঞ্জাবির সঙ্গে মেরুন রঙের স্যালয়ার পড়িয়াছেন, হাতের ঘড়িটি এখন আর নাই। মনে হইল তিনি এইমাত্র স্নান করিয়া আসিয়াছেন। চুলগুলি এখনো ভিজা, গা হইতে একটা পারফিউমের গন্ধ আসিতেছে, তাহার আগমনে ঘরটি যেন সুগন্ধিতে ভরপুর হইয়া গেলো
তাহার প্রশ্ন শুনিয়া বুঝিতে পারিলাম, তিনি এখন আর আমাদের মহল্লার খবর রাখেন না। আমার বাবা দেওয়ান যে অপঘাতে মৃত্যুবরন করিয়াছে, সেই খবর তাহার জানা নাই। মা নিসচুপ হইয়া বসিয়া আছেন। ক্ষনিকপর মা তাহার জীবনের সমস্ত ঘটনা একে একে খুলিয়া বলিলেন। সাগর সাহেব অনেক্ষন ধরিয়া আমাদের সমস্ত ইতিহাস শুনিলেন। মাঝে মাঝে কিছু প্রস্ন করিলেন বটে কিন্তু তাহা নিতান্তই কিছু না। একসময় সাগর সাহেব আমার দিকে তাকাইয়া যা বলিলেন, তাহা এইরুপ-
-'তোমার বাবা আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন। আমরা ছোট বেলায় একসঙ্গে একই গ্রামে মানুষ হয়েছি। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে কোনও রকমে একমুঠো ভাত খেয়ে নদীতে গিয়ে ইচ্ছামতো ঐ ধলেশ্বরী নদীতে ডুব পারতাম, কখনো কখনো সন্ধ্যা নাগাদ মাছ ধরতাম। কোন কোন দিন নদীতে না যেয়ে একেবারে স্কুলের মাঠে গিয়ে ভররোদে মেন্ডা গাছের মেন্ডা দিয়ে ফুটবল বানিয়ে দুইজনে ফুটবল খেলতাম। কখনো আবার বড়দের সঙ্গে খেলায় অংশ নিতে গিয়ে আমরা দুজনে শুধুমাত্র গোল কিপার ছাড়া আর কোনখানেই খেলত পারতাম না। যদিও আমার থেকে তোমার বাবা প্রায় তিন চার বছরের বড় হবে কিন্তু তিনি ছিলেন আমার নিত্যদিনের একজন সঙ্গি। তোমার বাবার যখন বিবাহ হল তখন আমার বয়স হইবে বড়জোর চৌদ্দ কি পনের। তার কয়েক বছর পর আমি চলে আসি শহরের এক নামিদামী স্কুলে কিন্তু ছুটির দিনগুলুতে আমি গ্রামের ঐ আমাদের বাড়ীতে তোমার বাবার সঙ্গে সময়টা কাটাতে আমার বড় ভাল লাগত। তোমার বাবার আর পরাশুনা হল না। সারাদিন ক্ষেতের কাজ, খামারের কাজ, অনেক গরু পালত তোমার দাদা, তাদের নিত্যদিনের খাবার যোগার করা, নদীতে নিয়া গোসল করানো, বিকালে আবার তাদের খাবার খাওয়ানো, এসব নিয়ে তোমার বাবা এতটাই সময় কাটাত যে, আমিও একসময় আর ভাল করে সেই স্কুলের মাঠে খেলা করতে পারতাম না, ইচ্ছে করলেই আগের মত আর নদীতে গিয়ে অধিক সময় ধরে ডুবসাতার কাটতে পারতাম না। আস্তে আস্তে আমার কাছে গ্রামটা আর আগের মত মনে হচ্ছিল না। একদিন শুনলাম, আমার বন্ধু বাবা হয়েছে।' এই বলিয়া সাগর সাহেব মুচকি একটু হাসিয়া আমার দিলে আঙ্গুলি তুলিয়া বলিলেন, 'সেই বাচ্চাটি সম্ভবত তুমি। কি নাম তোমার? তোমার তো নাম জানাই আমার হল না।'
আমি এতক্ষন অবাক দৃষ্টিতে সাগর সাহেবের দিকেই তাকাইয়াছিলাম আর তাহার সেই ছোটবেলার আমার বাবার সাথে তাহার শৈশব কালের দিন গুলির কথা শুনিতেছিলাম।
আমার মনে পড়ে, আমি শুধু তাহাকে আমার নামটাই বলেছিলাম, - 'শেলি'।
সাগর সাহেব আবারো তাহার সেই হারানো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করিতে করিতে বলিতে লাগিলেন,
-'এত অল্প বয়সের বাবার কি দায়িত্ব, কি করতে হবে বাবা হিসাবে, তা সে হয়ত জানতই না। কত হবে তখন তার বয়স? হয়ত ষোল কিংবা সতের? তাহার আরও ব্যস্ততা বেড়ে গেলো। আমি গ্রামে গেলে আর আগের মত দিন কাটত না। যাক, সেসব কথা এখন বলে আর কি হবে? অনেক বছর পর আবার যখন তোমার বাবার সঙ্গে আমার দেখা হল, তখন আমি সবেমাত্র বিদেশ হতে পরাশুনা শেষ করে গ্রামে গিয়েছি। অনেক প্রতিবেশিকেই তখন আমি চিনি না। অনেকে দেশ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছেন, গ্রামটা আমুল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল।'
-আচ্ছা যাক সে ইতিহাস আজ আর না বলি। সাগর সাহেব আমাদের সবকথা শুনিয়া মাকে শুধু এইটুকু আশ্বাস দিলেন যে, তাহার অতিপ্রিয় বন্ধুর দেওয়ান পরিবারের জন্য তাহার যাবতীয় সাহায্য এবং সহযোগিতা যাহা কিছু লাগিবে, তিনি তাহার জন্য কোন কার্পণ্য করিবেন না। একে একে তিনি আমাদের সবার নাম জিজ্ঞাসা করিলেন, কে কোন ক্লাসে অধ্যায়ন করে, কিভাবে কখন কাহার কি লাগে সব আদ্যপান্ত জানিয়া লইলেন। তিনি আরও বলিলেন যে, যেহেতু তিনি সব সময় নিজে হাজির থাকিয়া সব দেখভাল করিতে পারিবেন না, ফলে লোক মারফত যাহা লাগিবে, তাহা তাহাকে জানাইয়া দিলেই বাকি সব ব্যবস্থা তিনি করিতে পারিবেন। এ ব্যাপারে আর কোন সন্দিহান রহিল না।
শেলী এই পর্যন্ত বলিয়া রুনার দিকে চাহিয়া এক্তা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আমাদের কষ্টের দিনগুলির সমাপ্তি হইলো, আমাদেরকে সাহাজ্য করার একজন মানব উপস্থিত হইলেন, আর কোনো সমস্যা রইলনা। গল্পটা এইখানে শেষ হইয়া গেলেই ভালো হইতো। কিন্তু গল্পটা আসলে এইখান থেকেই শুরু।
সাগর সাহেব আমার মাকে কিছু উপার্জনের রাস্তা বাহির করিয়া দিলেন। আমার মা হাতের কাজ জানিতেন বলিয়া কয়েকটি শেলাই মেশিন কিনিয়া দিলেন, বাড়িতে কয়েকটা গাভী কিনিয়া দিলেন যেনো আমরা সবাই মাঝে মাঝে দুধ খাইতে পারি। সবাই ছাত্র তাই তিনি ভাবিলেন আমাদের পুষ্টিকর খাবারের দরকার। আর প্রতি মাসে একটা অনুদানের ব্যবস্থাও করিয়া দিলেন। আমার মা অনুদানের ব্যবস্থাটা গ্রহন করিতে চাহিলেন না, কয়েকটা শেলাই মেশিন আর গাভীর ব্যাপারটাতেই আমাদের সংসার চালাইয়া নিতে পারিবেন বলিয়া আমার মায়ের ধারনা ছিলো কিন্তু সাগর সাহেবের মমতার কোনো কমতি ছিলো না, আর তার এই দানে কিছু কমিয়া যাইবে সেইটাও নয়। ফলে আমার মায়ের অগ্রাজ্য কোনো কাজে আসিলো না।
আমি আমার ভাইবোনদের লইয়া, আমার মাকে লইয়া আমাদের পরাশুনা লইয়া নতুন এক উদ্যমে আবার নতুন করিয়া জীবনের স্বপ্ন দেখিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, এইবার আর এই সুযোগ হারাইলে চলিবে না, সয়ং বিধাতা আমাদের একটা কুলে আনিয়া রাখিয়া গেলেন। শ্রদ্ধায়, বিনয়ে সাগর সাহেবকে আমার দেবতার মত মনে হইতে লাগিল। কচি মন, তার উপর দারিদ্র্যের উপদ্রপ, সব মিলিয়া মনে হইতে লাগিল, পৃথিবীতে ভালোলকের অভাব ঈশ্বর কম রাখেন নাই। তিনি তাহাদেরকে মাইলস্টোনের মতো এমন এমন জায়গায় রাখিয়া দিয়াছেন যেনো কেউ পথ হারাইয়া গেলে ওই মাইলস্টোন দেখিয়া আবার যাত্রা শুরু করা যায়।
এই বলিয়া মা অনেকক্ষন নিরব হইয়া রহিলেন। পারভীনের মা আসিয়া আমার মায়ের নীরবতা ভাঙ্গিয়া জিজ্ঞেস করিল- দিদি, আজ চিলে কুঠিতে বেড়াইতে যাইবেন? এই সময়তায় মা আর পারভীনের মা যতো কাজ কর্মই থাকুক, মা আমাদের বাড়ির ছাদের উপর বসিয়া সন্ধ্যার আগের সূর্যাস্ত দেখেন। আমি আজো জানি না, ওই একই জিনিসের উপর মায়ের কি আকর্ষণ, কি সেই অমোঘ টান যে, আজ পর্যন্ত কখনো আমার মাকে অই সূর্যাস্ত দেখা হয় নাই এমন হইয়াছে। চিলে কোঠায় ছোট এক্তা বেলকনি আছে, তাহার উপর টিনের একটা চাল আছে, বৃষ্টিরদিনে ওই চিলে কোঠায় মা আর পারভিনের মা একা বসে বসে তখন হয়ত সূর্যাস্ত দেখেন না কিন্তু বৃষ্টির শব্দ শুনেন। মানুসের জীবনের অনেক রহস্য আছে যা তাহার একান্ত ব্যক্তিগত। হয়ত ইহা কাহারো কাজে লাগিবে কি লাগিবে না তাহার কিছুই যায় আসে না কিন্তু যাহার এই সম্পদ তিনি হয়ত বুঝিয়া থাকিবেন ইহার ভিতরে কি শান্তি আর কি মহিমা। ঈশ্বর মানুষকে অনেক রহস্য রাখিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন। কাহারো সূর্য ভালো লাগে, কাহারো চন্দ্র ভালো লাগে, কেউ আবার চৈত্রের দুপুর ভালো লাগে আবার কারো শিতের সকাল।
(অসমাপ্ত)...