০২/০২/১৯৮৬-রুপদিয়ার বুড়িমা

এক্সারসাইজ এরিয়া বেশ বড়। একেক ব্যাটারী একেক জায়গায়। সবাই অস্ত্র, গোলাবারুদ, গান ইত্যাদি নিয়েই থাকে। সিভিলিয়ান এরিয়া, কখনো ক্ষেতের মধ্যে, কখনো আম বাগানে, কখনো জংগলের পাশে, কখনো নদীর ধারে আমাদের ব্যাটারী পজিশন গুলি মোতায়েন থাকে। দিনের বেলায় যথেষ্ট ট্রেনিং চলে, রাতেও চলে, তবে দেখা যায় যে, সাধারনত রাত ১০ টা ১১ তার পরে সব কিছু থিতো হয়ে আসে। তখন ইউনিটের এডজুট্যান্ট সাহেব রাতে সমস্ত গার্ড পোষ্ট গুলি সৈনিকরা ঠিকমতো জেগে পাহাড়া দিচ্ছে কিনা সেগুলি চেকিং করার ব্যবস্থা রাখে। আর এই চেকিং গুলি আমাদের মতো জুনিয়ার অফিসাররাই করে থাকে। সঠকভাবে চেক করা হলো কিনা সেটা আবার চেক ব্যাক করার সিশটেম ও আছে। ফাকির জায়গা কম।

প্রায় প্রতিদিন নাইটগার্ড চেক করতে হচ্ছে। একা একা। অনেক দূর দূর সেন্ট্রি পোষ্ট। চারিদিকে আখক্ষেত। রাতের অন্ধকার, মাঝে মাঝে ভয় লাগে, আবার মাঝে মাঝে শীতের রাত বলে একা একা গভীর রাত ভালই লাগে। একটু আগে আমি নাইটগার্ড চেক করে রুমে ফিরেছি। বাইরে খুব শীত। যশোর অঞ্চলটা শিতে কুয়াশায় রাতে একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও ঘন কুয়াশায় ১০ হাত দূরেও দেখা যায় না, আবার কোথাও কোথাও একেবারে ফকফকা পরিস্কার। আকাসে মেঘ থাকে আবার কখনো কখনো মেঘের ফাক দিয়া চাঁদও দেখা যায়। রাতের আকাশের একটা আলাদা রুপ আছে। যখন সেই গভীর রাতে একা কেউ বের হয়, তখন হরেক রকমের শব্দ, চি চি, ঝি ঝি, কুকুরের হটাত করে ডাক, বাতাসের বেগে কোথাও গাছ ঝন ঝন করে উঠে। একটা অন্য রকম পরিবেশ। এই পরিবেশেই আমি কখনো হেটে কখনো পিক আপ নিয়ে, আবার কখনো কখনো গান গাইতে গাইতে, কিংবা মাউথ অরগ্যান বাজাতে বাজাতে আমি সেন্ট্রি পোষ্টগুলির খুব কাছে চলে আসি। সেন্ট্রি পোষ্ট গুলি থেকে ডুরে এসেই আমি আমার মাউথ অরগ্যান বাজানো থামিয়ে দেই যাতে সেন্ট্রি বুঝতে না পারে কেউ এসছে। সেন্ট্রি জেগে থাকলে যে কোনো দিক থেকেই কেউ আসুক তার দেখার কথা। আর দেখলেই আমাকে চেলেঞ্জ করবে। সেন্ট্রী পোষ্টের চেলেঞ্জের একটা প্রক্রিয়া আছে। পাসওয়ার্ড থাকে দুই শব্ধের। একটা সে আমাকে বলবে আর বাকীটা আমি বল্বো, যদি মিলে যায়, বেশ, নিজেদের লোক। আর যদি না মিলে, তাহলে কাম সারছে। পাগলা ঘন্টা। গার্ড চেক করে শেষে আমি বেশ দূরে একটা বেশ আলর গুন্ডি দেখেছিলাম। ভাবলাম, সেন্ট্রি পোষ্টের গার্ড চেক শেষ করে সেখানে যাবো।

ওখানে গেলাম, গিয়ে দেখলাম, একজন বুড়ী। বুড়ি মহিলার সাথে প্রায় ২ ঘন্টা কাটালাম। আমার সব গার্ড চেক করা হয় নাই। তারপরেও আমি এই বুড়ি মহিলার সাথে বেশ অনেক্ষন সময় কাটালাম। অদ্ভুত সব মানুষের জীবন কাহিনী। পৃথিবীর চারিদিকে, আনাচে কানাচে, সর্বত্র একেকটা মানুষ একেকটা জলন্ত উপন্যাশ। 

এই বুড়িকে পেয়েছিলাম আসলে অন্য একটা কারনে। প্রথমবার গার্ড চেক করার সময় রাতের অন্ধকারে আমি মেঠোপথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। তারপরেও হাটতে হাটতে এগিয়ে দেখি, একটা বরই গাছের নীচে আগুন জ্বলছে। খুব শীত, ভাবলাম, কি জানি কোথায় এসে পড়েছি। যাক, একটু আগুন তাপাই আগে। শরীরটাও আর চলছে না। গাছটার কাছে যেতেই দেখলাম, প্রায় ৬০/৬৫ বছরের এক বুড়িমা, আখের রস জ্বাল দিচ্ছেন। একদম একা।

কাছে গিয়ে বললাম, বুড়িমা, তুমি এতো রাতে একা কি করছো? বুড়ি আমার কথা শুনেছে কিনা জানি না। সে কোনো উত্তর করলো না। আমি আরো কাছে গিয়ে বেশ জোরেই বললাম, বুড়ি মা!! কি আখের রস জ্বাল দিচ্ছো? এইবার বুড়ি মনে হয় শুনেছে। উত্তর করলো,

কে গা তুমি?

বললাম, আমি তোমার নাতি।

বুড়ি সম্ভবত আসলেই আমি তার নাতী মনে করে এগিয়ে এলো। ভালো করে হয়তো খেয়াল ও করেনি আমি সামরিক পোষাক পড়া এক ভিন দেশী যুবক। একটা পুরানো কাসার মগে আমাকে গরম গরম আখের রস খেতে দিলো। যখন সে আমাকে কিছুটা দেখেছে, তার সন্দেহ হয়েছে, আমি তার নাতি না। সে পাশে রাখা কুপিটা হাতে নিয়ে একেবারে আমার মুখের কাছে এনে হাত দিয়ে মুখে স্পর্শ করে বল্লো,

-আহা রে বালা কইরে চোহেও কিছু দেহি না। তুমি কে গো?

সে অবশেষে বুঝলো আমি আসলে একজন ফৌজ। কিন্তু তাতে তার কোনো অসুবিধা নাই। বল্লো, হামাক তো এখন আর চাওয়াল থাইকাও নাই, কোনো চাওয়াল নাইরে বাপ, তুমি হামাক দাদী বইলছ, তুমিই হামাক নাতি। যশোরের ভাষা। কিছুটা এখন বুঝি। প্রথম প্রথম অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম না।

খুব আন্তরীক। ভালো লাগলো। আমি আমার ক্যাম স্টুলটা পেতে চেয়ারের মতো করে বুড়ির কাছে বসে গরম আখের রস খাচ্ছি আর মাঝে মাঝে এই প্রশ্ন ঐ প্রশ্ন করছি। বুড়িও খুব মজা করে করে উত্তর দিচ্ছে। আমি যশোরের ভাষাটা ভালো বলতে পারি না, ভালো বুঝিও না। তাও বলছি।

জিজ্ঞেস করলাম, এতো রাতে শীতের মধ্যে তুমি একা একা এখানে আখের রস জ্বাল দিচ্ছো, আর কেউ নাই? ভয় করে না? 

বুড়ি অনেক্ষন চুপ থেকে বল্লো (সে যশোরের আঞ্চলিক ভাষায় কথাগুলি বলেছে কিন্তু আমি সেই ভাষাটা ভাল বলতে পারি না বলে নিজের ভাষায় লিখছি),

'মানুষ যখন বূড়ো হয়ে যায়, তখন সে আর কোনো কাজে লাগে না। তখন যে কাজগুলি অন্য সবার আরাম কেটে নেয়, সেই কাজগুলিই তাদের করতে হয়। এটাই এই সংসারের নিয়ম।' আর ভয়? সেটা এক সময় ছিলো। জীবনের ভয়, যৌবনের ভয়, ঘর পাওয়ার ভয়, ঘর হারানোর ভয়, আরো কতো কি!! এখন ওসব আর মনে আসে না। যেটা সবসময় মনে আসে, তা হলো, কবে যাবো। 

কিছুই বললাম না। অনেক মারাত্তক অভিমান, অনেক কষ্ট, অনেক না পাওয়ার বেদনা, জীবনের কাছে হেরে যাওয়ার আক্ষেপ, সবই ছিলো বুড়িমার এই ছোট কিছু কথায়। আবারো প্রশ্ন করলাম, বুড়িমা, দাদু আছে নাকি নাই?

নাহ, তোর দাদু মইরা গেছে সেই গত মাঘ মাসের আগের তিন মাঘ মাস আগে। সে থাকলে কি আর আমাকে এই রাতে আখের রস জ্বাল দিতে দিত?

বললাম, দাদুর সাথে কি প্রেম করে বিয়া করছিলা?

হেসে দিয়ে বল্লো, আরে না, আমাদের সময় কি আর প্রেম ছিলো? আমাদের সময় ছিলো মুরগীর বাচ্চার মতো ধরে পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া কোনো এক খদ্দেরের কাছে তুলে দেওয়া। এতে না ছিলো প্রেম, না ছিলো কোনো সপ্ন। হয়তো কেউ এই পরিস্থিতিতে সপ্ন দেখে, সপ্ন সফল হয়, প্রেম আসে, প্রেম সফল হয়। সবার হয় না। 

বললাম, তাহলে বিয়ে হইলো কিভাবে?

বুড়িমা আমার মগখানা নিয়া আবারো আরেক মগ আখের গরম রস দিয়া বল্লো,

'আমার বয়স তখন ১০ বছর। গ্রামের ছেলেমেয়েরা সবাই দল বেধে এখানে যাই ওখানে যাই, গ্রামে কাবাডি খেলা হয়, আমরা মেয়েরা দূর থেকে কাবাডি খেলা দেখি, পহেলা বৈশাখ হয়, আমরা মেলায় যাই, কত কিছু করতাম!! একদিন দেখি আমার চাচা চাচিরা আমাকে বল্লো, আমার নাকি বিয়া। বিয়া কি জিনিষ তাও বুঝি না। আমি বললাম, আচ্ছা। আমার বিয়া হইয়া গেলো। কাকে কি করলাম, কি বললাম, কি করতে হবে, কি কাজ আমার কিছুই বুঝি না। শশুড় বাড়িতে গিয়া বুঝলাম, আমার শাড়ি পরার নিয়ম, আমার আর গ্রামে কাবাডি খেলা দেখার সুযোগ নাই, মেলায় যাওয়া আমার জন্য নিষিদ্ধ। ঘরের অনেক কাজ, অথচ আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নাই। পালাইয়া আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু বাবা মায়ের কঠিন শাসনে মনের ইচ্ছা আর সাধ আহলাদ কোনো কিছুই আর আমার নাই। এইতো সংসার করতে করতে বাল বাচ্চা হইয়া গেলো। ওরা যার যার মতো ভালই আছে, শুধু আমিই রয়ে গেছি একা।

বুঝলাম, বুড়িমা ইমোশনাল হয়ে গেছেন। চুলায় কাঠ খড়ি দিচ্ছেন, আর কি যেনো ভাবছেন। চুলার আলোয় আমি বুড়িমার মুখখানা দেখলাম, তিনি তার শাড়ির আচল দিয়ে মুখখানা মুছলেন, সম্ভবত বুড়িমা কাদছেন। চোখের পানি এমন এক জল, যা কাউকে না দেখালেও সে তার ভাষা জানান দেয়, মুখের উপর তার রেখা এটে দেয়, চোখ আর সেই আগের চোখ থাকে না। চোখের বেদনাকে লুকানোর কোনো বৈজ্ঞানিক পন্থা আজো আবিষ্কার হয় নাই।

আমি আর তাকে কোনো অতীতের ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন করলাম না। বললাম, আজ কি খেয়েছে রাতে?

অনেক্ষন চুপ করে থেকে বললেন, বাড়ির পাশে জংগলে কলমি শাখ ছিলো, সেটা দিয়ে রাতে ভাত খেয়েছেন। তরকারী বলতে সেটাই। খুব ব্যথা অনুভব করলাম। অনেক বয়স্ক একজন মানুষ, কিন্তু দেখার কেউ নাই। আমি বুড়িমাকে পিছন থেকে তার মাথাটা শক্ত করে আমার বুকের কাছে টেনে ধরে বললাম, 'বুড়িমা, তুমি আমার বুড়িমা, আমি তোমার এখানে প্রতিদিন আসবো।'

বুড়িমা বল্লো, চলে যাইবা এখন? বসো, নাও, আরেক মগ রস খাও। বুঝলাম, বুড়িমার ভালো লাগছে আমার সঙ্গ। আমি আরো কিছুক্ষন থাকলাম বুড়িমার সাথে। যখন চলে আসবো, আমি বুড়িমাকে ৫০ টাকার একটা নোট হাতে দিয়ে বললাম, এটা তোমার পানের পয়সা। আমি সময় পাইলেই আবার আসবো।

তখন রাত প্রায় ৫ টা বাজে। সকাল হয়ে আসছে, রুমে যেতে হবে। আমি  যখন বিদায় নেবো, বুড়িমা আমার মাথা, মুখ, হাত, পিঠ, বুলিয়ে দিয়ে কি যেনো বললেন, বুঝতে পারি নাই, তবে তিনি যে আমার জন্য দোয়া করলেন সেটা বুঝতে পেরেছি।

আমি রুমের দিকে যে পথ দিয়ে এসেছিলাম, সেই দিকে আবার হাটা দিলাম। আজকে আর বাকী গার্ড গুলি চেক করার ইচ্ছা হলো না।

বারবার বুড়িমার মুখখানা ভেসে আসছিলো। তখন চারিধারে কিছু পাখীর কিচির মিচির শব্দ শুনা যাচ্ছিলো। নতুন আরেকটি দিনের গর্ভপাত হচ্ছে এই পৃথিবীতে। অনেক দূরে মাইকবিহীন ভোরের আজান ভেসে আসছিলো মনে হলো। প্রতিটি দিন আর প্রতিটি রাত কখনোই এক রকম নয়। কোনো রাত বড্ড ভারী, কোনো রাত হয়তো একেবারেই হালকা, আর আজকের এই রাতটা আমার যেনো ভাড়ির চেয়েও ভারী মনে হলো। আমার মায়ের কথা মনে পড়লো, আমার সেই পুরানো গ্রামের কথা মনে পড়লো। মাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছিলো।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *