১৬/১১/১৯৯৫-আমেরিকা গমন- উইজার্ড ৯৫

Categories

 

বহুদিন ধরেই আমেরিকায় যাবো যাবো করে যাওয়া হচ্ছে না। এখান থেকে আমেরিকা মাত্র ৪৫ মিনিটের ফ্লাইট জার্নি। হাবীব ভাইয়ের সাথে প্রায়ই কথা হয়। হাবিব ভাইও আমাকে বারবার যাওয়ার জন্য বলছেন। অনেকে আবার একবার আমেরিকার ভিসা লাগানোর কথা বলছেন। এ জাতীয় ব্যাপারে আমি বড় উদাসীন। তারপরেও এতো কাছাকাছি এসে ভাইয়ার কাছে যাবো না এটা হয় না। তাই ভিসার জন্য এপ্লাই করেছিলাম, ভিসা পেয়েছি এক বছরের মাল্টিপ্যাল ভিসা। কেএলএম বিমানে টিকেট কাটা হয়েছে, ১৫ নভেম্বর, অর্থাৎ গতকাল। আমার ফ্লাইট সিডিউল হচ্ছে হাইতি-লোগান (বোষ্টন) সরাসরি। 

যেহেতু বিমান বন্দরের সবাই আমাকে চিনে এবং এখানেই আমার ডিউটির জায়গা। ভাবলাম, শেষ মুহুর্তে গেলেও কোনো অসুবিধা নাই। আমার ফ্লাইট বিকাল ৫ টায়। ভিভিআইপির মতো ইমিগ্রেশনে গেলাম প্রায় সাড়ে চারটায়।

ওমা। গিয়ে দেখি বিমানের ডোর ইতিমধ্যে ক্লোজ হয়ে গেছে। ওরা তো আর জানতো না যে, আমি এই বিমানের যাত্রী। তাদেরকে আমি আগে থেকেও জানাই নাই। ফলে দোষটা যে আমার এটাতে কোনো সন্দেহ নাই। ইমিগ্রেশন অফিসার জানালো যে, স্যার, এখন তো আর কোনোভাবেই আপনাকে ঢোকানো সম্ভব না। আপনি এক কাজ করেন, নেক্সট ফ্লাইট আছে রাত আটটায়। কিন্তু ওটা সরাসরি না গিয়ে জেএফকে হয়ে তারপর কানেক্টিং ফ্লাইটে বোষ্টন এয়ারপোর্ট লোগানে যেতে হবে। কিছুই করার নাই।

ফলে আমি ওদেরকে বললাম, সেভাবেই তাহলে আমার ইমিগ্রেশন করে রাখেন। ওরা আমাকে একটু আগেভাগেই এম্বারকেশন টিকেট হাতে ধরিয়ে দিলো। কিন্তু এবার যাচ্ছি আমেরিকান এয়ারলাইন্সে। কেএলএম বাদ। আমার ভাই জানেন যে, আমি কেএলএম বিমানে সরাসরি ফ্লাইটে লোগানে নামবো। আমি এই চেঞ্জটা আর ভাইয়াকে জানাই নাই কারন যেহেতু যাচ্ছিই আর আমি যে এই রকম একটা বোকার মতো কাজ করে ফেলেছি সেটা আর জানাতে চাই নাই।

ঠিক সময় মতো আমেরিকান এয়ারলাইন্স বিমান জেএফকে এর উদ্দ্যেশে ছেড়ে দিলো। কাছাকাছি আসার পর পাইলট জানালেন, লোকাল আবহাওয়া অত্যান্ত খারাপ, বরফে আচ্ছাদিত এয়ারপোর্ট। আমরা নামার চেষ্টা করছি। কয়েকবার এটেম্পট নেবার পরেও পাইলট সম্ভবত নামার ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছিলো না। প্লেন নামলো রাত মোটামুটি সাড়ে নয়টায় এবং আমাদের লাগেজ পেতে পেতে আরো আধা ঘন্টা সময় পেড়িয়ে গেলো। যেহেতু এটা সরাসরি ফ্লাইট ছিলো না, ফলে জেএফকে থেকে আরেকটা আমেরিকান এয়ারলাইন্সের প্ল্যান ছেড়ে যাবার কথা রাত সোয়া দশটায়। আমি খুব তাড়াহুরা করছি। অনেক পেসেঞ্জার ইমিগ্রেশনের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করা যাবে না। 

জেএফকে এয়ারপোর্টে পেসেঞ্জার লাইনে পেসেঞ্জারদের ইমিগ্রেশন সুবিধার জন্য কর্তৃপক্ষ চারটি লেনে সাইন বোর্ড দিয়ে রেখেছেন। প্রথম সারি হচ্ছে যারা প্রথম আমেরিকায় এসেছেন তাদের জন্য, ২য় সারি হচ্ছে যারা ডিপ্লোম্যাট তাদের জন্য, তৃতীয় সারি হচ্ছে যারা ২য় বার আমেরিকায় এসেছেন তাদের জন্য। আর ৪র্থ সারি হচ্ছে শুধুমাত্র আমেরিকানদের জন্য।

আমার বুঝতে কোনো অসুবিধা নাই। আমি ১ম আমেরিকায় এসেছি। ফলে আমি ১ম সারিতেই ঢোকে গেলাম। খুব বেশি লোক নয়। আমার টার্ন আসতে মাত্র ৪ জন বাকি। যেইমাত্র আমি ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে দাড়ালাম, তিনি একজন বয়স্ক মহিলা, আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালেন। আমি জিন্সের একটা প্যান্ট পড়া একটা ওভারকোট কাধে ঝুলানো। হাতে ছোট একটা ব্যাগ।

মহিলা অনেক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে কি যেনো ভাবলেন। প্রেমে পড়েছে কিনা বুঝতে পারছি না, আর প্রেমে পড়লেও লাভ নাই, আমার স্ত্রী এই বয়ষ্ক মহিলার থেকে ঢেড় সুন্দুরী। কিন্তু ওনার চোখ মুখ প্রেমের কথা বলছেনা, বলছে কিছু একটা ভুল হচ্ছে আমার সাথে। তিনি আমাকে একটু ভিতরে ডেকে নিয়ে গেলেন এবং ইমিগ্রেশন পুলিশকে কি যেনো বললেন।

হটাত করে তিন চার জন ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাকে এমনভাবে জেরা করা শুরু করলেন, আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ইংরেজী ভাষা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নাই, আমি ইংরেজীটা বাংলার মতোই ভালো বলতে পারি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ করে রেগে গেলে আমি বাংলার চেয়ে ইংরেজিতেই বেশি কথা বলতে সাচ্ছন্দ বোধ করি। তাই আমারও জেরা করতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তাদের ধারনা, আমি জাল ভিসা নিয়ে আমেরিকায় ঢোকার চেষ্টা করছি। এই ভিসা আমার নয়।

আমি বললাম, কেনো জাল ভিসা হবে?

তারা বল্লো যে, তারা বাংলাদেশ, পাকিস্থান, ইন্ডিয়ার পাসপোর্ট দেখলেই অনেক বেশী সতর্ক হয়ে যান, কারন বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এই তিন দেশের লোকেরা জাল ভিসা নিয়ে আমেরিকায় আসার চেষ্টা করে।

আমি বললাম, কে কি করলো, সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। আমি জাল ভিসা নিয়ে আমেরিকায় ঢোকবো কেনো? আমেরিকা এমন কি মধুর দেশ যে, আমাকে এই কাজ করতে হবে? তোমরা আমেরিকাকে কি মনে করো? সর্গরাজ্য?

আমার এমন কথায় পুলিশ একটু সতর্ক হয়ে গেলো। আমার কথার মধ্যে কোনো জড়তা ছিল না বরং ছিলো প্রচন্ড রাগ। তারা আমাকে আবার বল্লো যে, আমার ছবির সাথে নাকি আমার পাশপোর্টের ছবি মিল নাই। আমার মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো।

আমি বললাম, তাহলে পাশপোর্টে কি আমার দাদার ছবি নাকি আপনাদের প্রেসিডেন্টের ছবি লাগানো লাগানো যে আমাকে চেনা যাচ্ছে না? তারা আসলেই আমাকে নিয়ে বেকায়দায় পড়ে গেলো। এই রকম টাস তাস করে তো জাল ভিসাধারী কথা হয়ত কখনো বলে নাই বা বলে না। তাহলে কি কোনো ভুল হচ্ছে আমার সাথে?

আমি বললাম, আমার কানেক্টিং ফ্লাইট আছে সাড়ে দশটায়। যদি মিস করি, আমি আপনাদের দায়ী করবো এবং আমি সময়মতো আমার নেক্সট ষ্টেশনে পৌছতে চাই।

এবার আরো কিছু নতুন পুলিশ আসলো। আমাকে দেখলো, আমার পাস্পোর্ট দেখলো, তারপর বল্লো, স্যার আপনার কাছে কি আরো কোনো ছবি আছে? তারা আমার সাথে কোনো প্রকার ফালতু ব্যবহার করছে না, বরং আমিই একটু উত্তেজিত হয়ে কথা বলছি। কারন, আমি খুব এম্বেরাসড হচ্ছিলাম মনে মনে।

বললাম, দেখতে হবে, আমার ব্যাগে ছবি আছে কিনা। আমি ব্যাগ চেক করতে গিয়ে প্রথমে বেরিয়ে এলো আমার জাতিসংঘের আইডি কার্ড। পুলিশ সাথে সাথে ঐ আইডি কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখে বল্লো, স্যার আপনি কি জাতিসংঘে কাজ করেন?

বললাম, হ্যা।

এবার তাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলে গেলো। এবার তারা আমাকে বল্লো, ওহ স্যার, আপনি আগে কেনো বলেন নাই যে, আপনি জাতীসংগে কাজ করেন, তাহলে তো এতো বিরম্বনা হতো না?

আমাকে এবার তারা এতো সমীহ করে কথা বলা শুরু করলেন যে, তারা যেনো এখন অপরাধি আর আমি পুলিশ।  বলি এবার ব্যাপারটা কোথায় তাদের ধান্দায় ফেলেছিলো।

ব্যাপারটা দাড়িয়েছিলো এই রকমঃ

আমি যখন আমেরিকার ভিসার জন্য এপ্লাই করি, হাইতির কন্সুলেট অফিস আমাকে ডিপ্লোম্যাট ভিসা ইস্যু করেছিল। যেহেতু আমি ডিপ্লোমেটিক হিসাবেই জাতীসংগে কাজ করছি। এটা আমার জানা ছিলো না। আমার ডিপ্লোমেটিক ভিসার কারনে আমার দাড়ানোর কথা ২য় সারিতে। যেহেতু আমি জানতাম না যে আমি ডিপ্লোমেট ভিসায় এসেছি, ফলে আমি এইবারই যেহেতু প্রথম আমেরিকায় এসেছি, ফলে আমি ২য় সারিতে না দাঁড়িয়ে দাড়িয়েছিলাম ১ম সারিতে। এতে ঐ বয়স্ক মহিলার প্রথম সন্দেহ হয় যেহেতু বাংলাদেশী পাসপোর্ট, আবার ভুল জায়গায় দাড়িয়েছি। বয়স্ক মহিলা বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন কারন আমার বয়স অল্প, ডিপ্লোম্যাট হবার মতো নয়। এদিকে সাধারনত ডিপ্লোম্যাটরা স্যুট টাই পড়ে এক্সিকুইটিভ হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে চলাচল করেন, আর আমি জিন্সের একটা প্যান্ট তাও আবার ওভারকোট যেটা নিয়েছি সেটা কাউ বয়ের মতো কাধে ঝুলিয়ে দাড়িয়েছি।

এতোগুলি অসামঞ্জস্যতা মহিলা সমন্নয় করতে পারছিলো না। ফলে তাঁর সন্দেহ হবারই কথা। তিনি আমাকে পুলিশের কাছে পাঠিয়েছিলেন ব্যাপারটা ভেরিফাই করার জন্য। কিন্তু এটা তো আর আমার জানার কথাও না আবার দোষও না।

আমি রীতিমত অফেন্ডেড ফিল করছিলাম এবং বললাম, আপনাদের কমপ্লেই রেজিস্টার আনুন, আমি আন্তর্জাতীক পেসেঞ্জার হিসাবে এয়ারপোর্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবো। আমি জানতাম, যদি আমাকে এইভাবে হেনস্থা করার জন্য যদি মিলিয়ন ডলারের মামলা করি, সরকার সেটা আমাকে দিতে বাধ্য এবং ইমিগ্রেশন পুলিশেরও শাস্তি হবে। তারা ব্যাপারটা ততক্ষনাত সামাল দেওয়ার জন্য আমাকে অনেক অনুনয় বিনয় করে বল্লো, স্যার, আমরা আসলে বুঝতে পারি নাই ব্যাপারটা। অভিযোগ আপনি করতে পারেন কিন্তু আমরা দুক্ষিত।

তারা তাদের ভুলটা যে একেবারে অমুলক নয় সেটা প্রমান করার জন্য আমাকে অনেক অনুরোধ করে প্রায় ৫০ গজ দূরে একটা রুমে নিয়ে গেলেন। কফি খাওয়ালেন এবং ঐ রুমে নিয়ে আমাকে যা দেখালেন, তা দেখে আমি হতবাগ। সেখানে বেশ কিছু বাঙ্গালী, পাকিস্তানী এবং ইন্ডিয়ান পেসেঞ্জারকে পিছনে হাত বেধে রাখা হয়েছে জাল ভিসার কারনে। তাদেরকে প্রপার ইন্টারোগেশন করে প্রমান করেছে যে তারা জাল ভিসায় আমেরিকায় ঢোকার চেষ্টা করেছে। এখন তাদেরকে আগামী কাল ফিরতি ফ্লাইটে যার যার দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে।

যাই হোক, আমি ব্যাপারটা বুঝেও না বুঝার ভান করলাম। এবার আরো সিনিয়র একজন পুলিশ এসে আমাকে বল্লো, স্যার, আজ সমস্ত কানেক্টিং ফ্লাইট বন্ধ কারন এতো তুষারপাত হচ্ছে যে, কোনো এয়ারপোর্টই ক্লিয়ারেন্স দিতে পারছে না। গত ২৫ বছরেও আমেরিকায় এতো পরিমান তুষারপাত হয় নাই। তাই আজকের এই তুষারপাতের কারনে এর নাম দেওয়া হইয়েছে "উইজার্ড ৯৫"। আগামিকাল বলা যাবে কখন কোন কোন ফ্লাইট যেতে পারবে। ইতিমধ্যে কয়েকটা ফ্লাইট নামার সময় মারাত্তক দূর্ঘটনায় পতিত হয়েছে। আজকে আপ্নারা যারা আমেরিকায় এসেছেন, তাদেরকে এই এয়ারপোর্টেই থাকতে হবে অথবা আপনাদেরকে রুম দেওয়া হবে, সেখানে আপনি থাকতে পারবেন। তবে স্যার, যেহেতু আপনার সাথে আমাদের একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে, আমরা আপনাকে একটা কিছু দিয়ে অনার করতে চাই যদি অভিযোগ না করেন।

আমি কিছুই বললাম না। এরপর সে আমাকে আরো একটি রুমে নিয়ে গেলেন। বেশ কিছুক্ষন পর আমার হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি যে কয়দিন এখানে থাকবেন, এই কার্ডটি দিয়ে যাইই কিনবেন, সব ট্যাক্স মাফ। এটা আমেরিকার ট্রেজারী ব্রাঞ্চ থেকে এবং এস এস ডিপার্টমেন্ট থেকে আপনার জন্য অনার। তারা আরো একটা অনার আমাকে করলেন, সেটা হল তাদের কাছে কিছু ভিআইপি রুম থাকে সেখানে নেক্সট ফ্লাইট না ছাড়া পর্যন্ত আমি থাকতে পারবো। যখন কোনো ফ্লাইট লোগানে যাবে, তারাই আমাকে ডেকে ফ্লাইটে তুলে দেবেন।

দেখলাম, খামাখা কেচাল করে লাভ নাই। আর আমি অভিযোগ করার পর আবার কোন ঝামেলায় পরে যাই তাই কি দরকার এইসব করে যখন তারা আমাকে এতো করে সম্মান দেখাচ্ছেন। আমি কার্ডটি নিলাম। আমি তখনো জানি না এই কার্ডের আসল মাহাত্য কি। তারপরেও সাথে করে নিয়ে গেলাম। কার্ডে আমার ছবি আছে যেটা ওনারা ইমিগ্রেশন করার সময় ওয়েব ক্যামে নিয়েছিলেন।

আমি ইমিগ্রেশন অথোরিটির নির্ধারিত স্যুটে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি ৬ ফুট লম্বা আরেক নিগ্রো পুলিশ অফিসারও আমার সাথে আছেন। তিনি ঐ স্যুটের দায়িত্তে।

আমি পুলিশ অফিসার (নাম তাঁর ফ্রান্সিস) কে জিজ্ঞেস করলাম, আমি যেনো সিগারেট খেতে পারি এমন একটা রুম দেয়। সে জানালো, এখানে সিগারেট খাওয়া যায় না। কিন্তু একটা করিডোর আছে সেখানে গিয়ে খাওয়া যায়। সে নিজেও সিগারেট খায় বলে মুচকি হেসে দিয়ে বল্লো, You Major must be a bad man like me, because we both smoke.

তখন রাত বেজে গেছে প্রায় বারোটার উপরে। আমি করিডরে দাঁড়িয়ে দেখালাম, বাইরে অনেক সাদা সাদা বরফ। আমার জীবনে আমি কখনো বরফ দেখি নাই। এইই প্রথম। ছুতে চাইলাম, ফ্রান্সিস আমাকে বল্লো, তুমি ওখানে যেও না, প্রচন্ড ঠাণ্ডা। চারিদিকে বিমান বন্দরের আলো কিন্তু এতো বরফ পড়ছে যে, বেশিদূর দেখা যায় না। বরফের বৃষ্টি এইই আমি প্রথম দেখে খুব ভালো লাগছিলো।

ভাবলাম, এবার ভাইয়াকে একটা ফোন করে বলি যে, আমি জেএফকে এয়ারপোর্টে আটকা পড়েছি, চিন্তা করো না। কারন ইতিমধ্যে আমার সিডিউল অনুযায়ী আমার লোগানে থাকার কথা। অনেকবার চেষ্টা করেও ভাইয়াকে পেলাম না। বারবার ভুল নাম্বারে চলে যাচ্ছে ফোন। ওপাশে যিনি ফোন ধরছেন, তিনি একসময় বিরক্ত হয়ে কি যেনো বলছিলো আমাকে, সেটা আমি ভালোমত বুঝতেও পারছিলাম না। কিছু আমেরিকানরা ভালোমত ইংরেজীও বলতে পারে না। নোয়াখালি টাইপের ইংরেজী বললে কি আর আমি বুঝবো? সে মনে হয় আমেরিকান নোয়াখালির লোক।

যাক, রাতে আর ঘুমানোর প্ল্যান করছিলাম না যদিও আমার রুম আছে। বাইরেই ফ্রান্সিসের সাথে প্রায় ১ ঘন্টা সিগারেট খেয়ে গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। ভালোই লাগছিলো। সে আসলে আমেরিকার অরিজিনাল লোক নয়। সে জ্যামাইকার মাইগ্রেটেড অফিসার। প্রায় ১৫ বছর আগে তাঁর পরিবার এখানে মাইগ্রেট করেছিলো। অনেক গল্প বল্লো। তাঁর ছেলেমেয়েদের কথা। তাঁর পরিবারের কথা। আর আমি বললাম, আমার আজকের ইমিগ্রেশনের বাজে ইন্সিডেন্টের কথা। সে খুব হাসলো। বল্লো, তুমি তো ইচ্ছে করলে অভিযোগ করলে বেশ কিছু কম্পেন্সেশন পেতে পারতা। আমেরিকা এইসব অভিযোগকে খুব ভয় পায়। ফ্রান্সিস জানালো, তাঁর ডিউটি আছে, যেতে হবে।

ফ্রান্সিস যাবে এমন সময় একজন মহিলা কোথা থেকে উদয় হয়ে আমাকে সিগারেট খেতে দেখে লাইটারের জন্য এগিয়ে এলো। বুঝলাম, সে সিগারেট খায়। এটাও আমার কাছে নতুন একটা অভিজ্ঞতা। মহিলারা স্মোকার। সেও আটকা পড়েছে এই উইজার্ড-৯৫ এ। যাবে ডেনভার। আমি এখানের কোনো রাজ্যই চিনি না।

ফ্রান্সিস চলে গেলো আর বলে গেলো, সিগারেট খাওয়া হয়ে গেলে যেনো রুমে চলে যাই, ওখানে কিছু ড্রাই ফুড আছে, ইচ্ছে করলে আমি সেসব বিনে পয়সায় খেতে পারি, কোনো বিল উঠবে না। আর এও বলে গেলো, ফ্লাইট চালু হলে সে আমাকে নিয়ে যাবে, কোনো অসুবিধা নাই। এখন মনে হচ্ছে, ইমিগ্রেশনে ঝামেলা হয়ে ভালোই হয়েছে। সুফল পাচ্ছি।

মহিলা আমার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে আর আমি কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাবো, কি করি, এইবারই আমেরিকায় প্রথম কিনা ইত্যাদি গল্প জুরে দিলো। যখন সে শুনলো আমি মেজর এবং জাতীসংগে কাজ করছি, তিনি একটু খুশী হয়েছেন বলে মনে হলো। কারন তাঁর একটা ছেলে আছে যে, আমেরিকার নেভিতে কাজ করে। বর্তমানে সে মালয়েশিয়া আছে। মহিলার নাম লিন্ডা।

আমি বললাম, আপনার এতো বড় ছেলে আছে যে কিনা নেভীতে কাজ করে? আপনাকে দেখে তো সে রকম মনে হয় না?

সে বেশ খুশি হলো মনে মনে যে, আমি তাকে অনেক ইয়াং বলে ভাবছি বলে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, বলেন তো, আমার বয়স কত হবে?

মনে মনে ভাবলাম, পৃথিবীর সমস্ত মহিলারা তাদের বয়স বাড়তে দেয় না। বয়স যাই হোক, সে সেটা গোপন রেখেই কম বয়সটা বলে থাকে আর কেউ তাকে ইয়াং বলুক সেটাই চায়। এটা হোক বাঙ্গালী মেয়ে আর হোক আমেরিকার ইংরেজী বলা কোন নারী। আমি চিন্তা করলাম, যদি উনার ছেলে নেভীতে কাজ করে, তাহলে কমপক্ষে ছেলের বয়স ২০। আর এই মহিলা যদি অন্তত ২০ বছর বয়সেও বিয়ে করেন, তাহলে মহিলার বয়স এখন প্রায় ৪০!। আমি বললাম, আপনার বয়স হয়তোবা ৪০ হবে।

ওরে বাপ, তাঁর চেহাড়াই বদল হয়ে গেলো। মনে হলো তাকে ৪০ বলায় তিনি ক্ষিপ্ত। হয়ত আশা করেছিলো আমি ২৫ বা ৩০ বল্বো।

লিন্ডা বল্লো, আমি কি এতোই বুড়া দেখাচ্ছি মেজর?

বুঝলাম, ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু এখন তো আর শোধরানোর কোনো পথ দেখি না। আমি বললাম, যদিও তোমার বয়স ৪০ হতে পারে কিন্তু তোমাকে ৩০ এর বেশী লাগে না।

খুশী হলো না। সিগারেট খাওয়া শেষ হলেই লিন্ডা আমাকে কোনো প্রকার সম্মোধন ছাড়াই বিদায় নিলো। আর বল্লো, ধন্যবাদ লাইটারের জন্য। বাই। বলে গট গট করে তাঁর হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে চলে গেলো। একবার পিছন ফিরে তাকালোও না। হায়রে মহিলাদের বয়স।  

আরেক অভিজ্ঞতা হলো। বয়স যাই হোক, আমি আর কোনো মহিলাকে ৩০ এর বেশী বলব না বলে শিক্ষা পাইলাম। তাঁর বয়স ৯০ হলেই কি আর ৩০ হলেই কি। আমার তো কিছু যায় আসে না। কিন্তু খুশী তো করা গেলো কাউকে!! এইবা কম কি। কিসের পাল্লায় পড়লাম রে ভাই। প্রতি ক্ষনে ক্ষনে অভিজ্ঞতা বাড়ছে।

রাত তিনটার দিকে ফ্রান্সিস এলো রুমে। এসেই বল্লো, মেজর, তুমি কি এখন যাবা? একটা ফ্লাইট যাচ্ছে বোষ্টনে। লোকাল ফ্লাইট। ইথিউপিয়ান এয়ারলাইন্স। যদি যাও তাহলে ১০ মিনিটে রেডি হও, আমি নিয়ে যাবো। বললাম, এতো রাতে গিয়ে কি করবো। সকালে কোনো ফ্লাইট নাই?

ফ্রান্সিস বল্লো, সেটা এখনো ডিক্লেয়ার দেয় নাই। আমার মনে হয় তোমার যাওয়া উচিত কারন পুরু বিমান বন্দরে যে পরিমান যাত্রী আটকা পড়েছে, সকালের ফ্লাইট না ধরে তুমি বরং লোগানে গিয়ে নেমে যাও। আমরা তোমাকে ট্যাগ করে দেই যদি ওখানে রেষ্ট করার জন্য কোনো রুম লাগে সেটাও পাবা। আমরা তোমাকে একটা স্লিপ দিয়ে দেবো, সেটা লোগানে দেখালেই তুমি একটা ভালো রুম পাবে যদি চাও। সিদ্ধান্ত নিলাম, চলেই যাই। ফ্রান্সিস আমাকে চট করে একটা এয়ার ট্যাক্সিতে করে একেবারে বিমানের সামনে নিয়ে গেলো। ব্যাগপত্র ফ্রান্সিস নিজেই ক্যারি করে নিয়ে গেলো। আমি ইথুপিয়ান বিমানে উঠে গেলাম।

ফ্রান্সিসকে বিদায় দিতে আমার কষ্ট হচ্ছিলো, হয়তো ওর সাথে আমার আর দেখা হবে না। হ্যান্ডশেখ করতে গিয়ে বললাম, ফ্রান্সিস, তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমি তোমাকে মনে রাখবো। ফ্রান্সিস হেসে দিয়ে বল্লো, এটাই মজা। মিসিং পিপল সো সেডলী। তুমিও ভালো থেকো। একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে দিলো যদি কখনো এখানে আবার আসি, যেনো ওর মোবাইলে কল করি। কার্ডটা যত্ন করে পকেটে রাখলাম। আমি এখন প্লেনে বসে পড়েছি। অনেক পেসেঞ্জার, যদিও লোকাল প্লেন কিন্তু বেশ বড়। বেশীরভাগ মানুষই মনে হচ্ছে লোগানের বাসিন্দা। আমি একজন বয়স্ক মহিলার পাশে বসেছি। বয়স তাঁর প্রায় ৬০ এর কাছাকাছি।

প্রায় আরো ৪০ মিনিট ফ্লাই করে লোগানের উপর দিয়ে প্লেন হোবার করছে। এখানেও নামতে মনে হয় দেরী হবে। অনেক বরফে জমে আছে বিমান বন্দর। পাইলট জানালেন, আমরা নামতে নামতে আরো ১৫ মিনিট দেরী হবে।

আমরা শেষতক খুব নিরাপদেই নামলাম। লাগেজ নিতে যেতে হবে অনেক দূরে। প্রায় ১ কিলোমিটার দূর আমাদের লাগেজ ডেলিভারী পয়েন্ট। আমরা নেমেছি সি ব্লকে। একেকটা ব্লক এতো বড়? আমাদের জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টও তো ওদের একটা ব্লকের সমান না!!

লাগেজ নিলাম। এবার ভাইয়াকে ফোন করা উচিত। এয়ারপোর্টেই টেলিফোন বুথ আছে। পঞ্চাশ সেন্ট ড্রপ করে কথা বলা যায়। আমার কাছে মাত্র একটা কয়েন আছে। ডলার আছে কিন্তু আমার কাছে তো আমেরিকার কয়েন নাই। এদিকে কয়েন ছাড়া ফোন করা সম্ভব না। যাই হোক, কোথায় কয়েন পাবো সেটাও জানি না। যে কয়েনটা ছিলো সেটা দিয়েই চেষ্টা করলাম। ঐ একই সমস্যা। ভুল নাম্বারে ফোন চলে যাচ্ছে এবং একই বাসায় যাচ্ছে। আমি ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতেছিনা, আরে বাবা, যদি ভুল নাম্বারেই যাবে, তাহলে একই নাম্বারে যাচ্ছে কেনো?

এইবার ঐ পাশের ভদ্রলোক মনে হয় ব্যাপারটা বুঝতে পারছে যে, আমি কিছু একটা ভুল করছি। সে আমাকে বল্লো, আমি আসলে কোথায় ফোন করছি? এবার তাঁর কথাগুলি আমার কাছে ক্লিয়ার মনে হলো। আমি বললাম, এটা কি এই নাম্বার?

সে বল্লো, হ্যা, এটা এই নাম্বারই যেটা আমি বলেছি।

বললাম, আমি আসলে আমার ভাইকে ফোন করছিলাম যিনি থাকে বোস্টনে। এবার তিনি ব্যাপারটা বুঝে ফেললেন। বললেন, আপনি যেখানে আছেন, সেটা লোগান, যদিও ম্যাসাচুসেট এর অধীনে। আপনি আপনার নাম্বারের সাথে একটা ১ যোগ করেন, তারপর ডায়াল করেন, আপনি আপনার ভাইকে পেয়ে যাবেন। যদি ১ যোগ না করেন, তাহলে বারবার আমার নাম্বারেই কল আসতে থাকবে। আর এরইমধ্যে আমার কয়েন শেষ, লাইন কেটে গেলো। আমার কাছে আর কোনো কয়েনও নাই। কি মুশকিল। ভালো লাগলো অন্তত এটা জেনে যে, এবার আর ভুল হবে না। ভাইয়াকে ফোনে অন্তত পাওয়া যাবে। 

কোথায় পাই কয়েন? একটা দোকানে ঢোকলাম এইভেবে যে, কিছু কিনি এবং কয়েন নেই। কিন্তু কোনো চেষ্টাই সফল হচ্ছে না। কয়েনের যোগাড় হচ্ছে না। হটাত দেখলাম, একজন পুরুষ ক্লিনার ফ্লোর ক্লিন করছে। ভাবলাম, তাকে জিজ্ঞেস করে দেখি সে আমাকে কিছু কয়েন দিতে পারে কিনা। লোকটিকে বলার সাথে সাথে সে বল্লো, তাঁর কাছে ৩ ডলার পরিমান কয়েন আছে। সেটা সে ৫ ডলার হলে দিয়ে দেবে। আরেক অভিজ্ঞতা। সব দেশের ৪র্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের এই এক সমস্যা। ধান্দাবাজী। মেনে নিলাম। কারন আমার কাছে এক টাকাও যা, এক ডলারও তা সেটাই মনে হচ্ছে এখন পর্যন্ত। আমি তাকে ৫ ডলারের একটা নোট দিয়ে ৩ ডলার সম পরিমাণ কয়েন নিলাম।

আমি ঐ ভদ্রলোকের কথা মতো ভাইয়ার বাসার নাম্বারের আগে ১ যোগ করে যেই না ডায়াল করেছি, অপর প্রান্ত থেকে আমার ভাবী ফোন ধরলেন। তিনি এতোই অবাক হলেন আমার ফোন পেয়ে যেনো কেদেই দিলেন। ভাবী বললেন, তুমি বেচে আছো? আমি বললাম, কেনো? আমি মরবো কেনো? কি ব্যাপার?

ভাবী বললেন, আরে ভাই, তুমি যেই প্ল্যানে লোগানে নামার কথা কাল, কেএলএম বিমান, সেটা নামার সময় ক্রাশ করেছে, বহু লোক চরম ভাবে আহত/নহত হয়েছে, কেউ কেউ বলছে মারাও গেছে এবং এখনো রেস্কিউ চলছে। তোমার ভাই তো তোমাকে খুজে খুজে পাগলের মতো অবস্থা। তুমি এখন কোথায় আছো?

আমি বললাম, আমি তো সি ব্লকে আছি। আর আমি তো জানি না যে, কেএলএম ক্রাশ করেছে। কোনো এক কারনে আমি তো ঐ ফ্লাইট মিস করে পরে আমেরিকান এয়ারলাইন্সে এসেছি জেএফকে হয়ে। এখন ইথুপিয়ান এয়ারলাইন্সে একটু আগে নামলাম। আমি ভালো আছি। এবার বলেন, ভাইয়াকে পাবো কিভাবে?

ভাবী এতোটাই আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন আমার সাথে কথা বলে যে, ভালোমতো কথাই বলতে পারছিলেন না। মরা মানুষের খোজ পাওয়া, চারটিখানি কথা তো আর না। ভাবী বললেন, তুমি যেখানে আছো সেখানেই থাকো, কোথাও যাবে না, আমি তোমার ভাইকে জানাচ্ছি। যেহেতূ তোমার কাছে মোবাইল নাই, তুমি কিন্তু ওখানেই থাকো। আর পারলে একটু পরে আমাকে তোমার কারেন্ট লোকেশানটা জানাও।

প্রায় ২০ মিনিট পর ভাইয়া হাজির। কি যে ভালো লাগলো ভাইয়াকে পেয়ে। ভাইয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, অনেক প্রেসারে ছিলাম তোকে নিয়ে। যাক আল্লাহর রহমত যে, তোকে ভালোভাবে পেলাম। তুই এখানে দাড়া, আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।

ভাইয়াকে নিয়ে আমি বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম। ভাইয়া নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। দুই ভাই, অনেক গল্প করতে করতে গাড়িতে আসছিলাম। চারিদিকে বরফ, রাস্তায় অনেক গাড়ি দিয়ে লোকজন রাস্তা ক্লিয়ার রাখার চেষ্টা করছে। প্রায় ৪০ মিনিট ড্রাইভ করে আমি আর ভাইয়া ভাইয়ার বাসার এসে হাজির হইলাম।

শান্তি। এক মাস থাকবো এখানে। মাসুদের সাথে দেখা হলো, ইউসুফের সাথে দেখা হলো। তখন বেলা প্রায় ১১টা দিন কিন্তু সূর্য মামার কোনো খবর নাই। চারিদিকে বরফের বৃষ্টি। গাছের চেহাড়া দেখলে মনে হয়, বরফের গাছ, আশেপাশের সবকিছু বরফে ঢেকে আছে। কি দেশ রে বাবা।

সারাদিন গল্প করলাম, বাইরে যাওয়ার কোনো স্কোপ নাই। ঘরের ভিতরে হিট করে ঘর গরম রাখা হচ্ছে। আমি আর মাসুদ এক রুমে থাকার প্ল্যান করেছি। ইউসুফ অন্য ঘরে। পুরু ঘরটাই কার্পেটে মোড়ানো। হাইতিতে গরম অথচ এখানে এসে পড়েছি উইজার্ড-৯৫ এর পাল্লায়। মানে শীতের দেশ।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *