13/03/2022-যুদ্ধের ১৭ দিন পর ইউক্রেন

যুদ্ধের ১৭ দিন পর ইউক্রেন যুদ্ধে গোপনে গোপনে একটা কম্প্রোমাইজের কথা শুনা যাচ্ছে যে, জেলেনেস্কি রাশিয়ার তিনটা শর্তই মেনে যুদ্ধ বন্ধ হোক, সাভাবিক জীবন আবার ফিরে আসুক, তাতে সায় দিয়েছে। কিন্তু এই যুদ্ধ আমাদেরকে কি কি শিক্ষা রেখে গেলো?

যুদ্ধের প্রথম দিনে জেলেনেস্কি দৃঢ়কন্ঠে ঘোষনা দিয়েছিলো যে, ইউক্রেনের প্রতিটি ইঞ্চি তারা ডিফেন্ড করবে। কারন সে সেটাই বলেছিলো যেটা পশ্চিমারা ওকে বলতে বলেছিলো যে, We will defend every inch of land of our friendly allainaces. কিন্তু সেটা কেনো হলো না? যদি কিছুটা বিশ্লেষন করি দেখবো যে, জেলেনেস্কী চারটা ভুল করেছেঃ

(১) সে পশ্চিমা, ইউরোপ এবং ন্যাটোর সাপোর্টের উপর অতিরিক্ত ভরষা করেছিলো। জেলেনেস্কী জানতো যে, ইউক্রেন রাশিয়ার কাছে সবদিক দিয়েই দূর্বল। কিন্তু জেনেস্কী পশ্চিমাদের, ইইউ এবং এলায়েন্সেরের ভরষাকে একটা ট্রাম কার্ড হিসাবে ভেবেছিলো। আর এটা তাঁর কোনো দোষ না। কারন ১লা সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে জেলেনেস্কী এক ভাষনে বলেছিলো যে, স্বয়ং বাইডেন জেলেনেস্কিকে বলেছেন, ইউক্রেন ন্যাটোর মেম্বারশীপ পাবেই আর সেটা যেভাবেই হোক। শুধু তাই না, জেলেনেস্কি এটাও বলেছেন যে, এপ্রিল ২০২১ এ বাইডেন তাকে এই কথাও বলেছেন যে, ইউক্রেনকে কখনোই আমেরিকা একা ছেড়ে যাবে না যদি রাশিয়া বা অন্যকোন কেউ তাকে আঘাত করেও। জেলেনেস্কী ভেবেছিলো, রাশিয়ার এতো বড় আর্মি আনবিক বোমা ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রথমে ন্যাটো তথা অন্যান্য দেশের পারমানবিক হুমকীর মাধ্যমে আমেরিকা, ব্রিটেন, ইইউ, তাকে তৎক্ষণাৎ সাহাজ্য করবে, তারপরের ঘটনা তো আছেই, আর্থিক সাহাজ্য, ইত্যাদি।

কিন্তু ঘটনাটা ঘটেছে উলটা। আমেরিকা সামনে আসলো না, ন্যাটোকেও ব্যবহার করলো না, নো ফ্লাই জোনও তৈরী করলো না, আবার বিমানও দিলো না। তারা তাকে এটাও বলেছিলো যে, আমেরিকা, ন্যাটো, ইইউ সবাই রাশিয়াকে এমনভাবে বয়কট করবে যাতে তাঁর তেল, গ্যাস, ফুড কমোডিটি ইত্যাদি আর কেউ না নেয়। রাশিয়াকে পংগু করে দেয়া হবে। কিন্তু সেটাও হলো না। আর হলেও সেতার ইফেক্ট অনেক অনেক পরে হয়তো। কথায় কথায় আমেরিকা রাশিয়ার তেল/গ্যাস বয়কট করলো ঠিকই, কারন না রাশিয়ার রপ্তানী আমেরিকাকে ইফেক্ট করে , না আমেরিকার আমদানী আমেরিকাকে সাফার করায়। তারা দুটুই তেল, গ্যাসের দেশ। অন্যদিকে বিট্রেন কিন্তু বয়কট করার পরেও তেল গ্যাস রীতিমত নিতেই থাকলো কারন সেটা তাঁদের নিত্যদিনের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য। আবার অন্যদিকে ইইউ বাইডেনের এই অবরোধে রাজী হলো না। তারা আরো ৫ বছর সময় চাইলো। কারন প্রায় ৪০% তেল/গ্যাসের উপর পুরু ইউরোপ রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। তাঁদের জনগনের অসুবিধা তারা করতে পারবে না।

(২) জেলেনেস্কীর ২য় ভুল ছিলো-পশ্চিমাদের কাছে ইউক্রেনের গুরুত্তকে অনেক বেশী, এটাই সে মুল্যায়ন করেছিলো । জেলেনেস্কি ভেবেছিলো যে, ইউক্রেন হচ্ছে ইউরোপের একটা শিল্ড। জেলেনেস্কী ২২/০১/২০২২ তারিখে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে তাঁর এক ভাষনে বলেছিলো-গত ৮ বছর যাবত ইউক্রেন ইউরোপের শিল্ড হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ইউক্রেন গত ৮ বছর যাবত রাশিয়ার মতো এমন একটা বৃহৎ আর্মিকে ঠেক দিতে পারছে। শুধু তাইনা, গত ২১/০২/২০২২ তারিখে অনুরুপ ভাষনে জেলেনেস্কী এটাও বলেছিলো যে, ইউক্রেন ছাড়া ইউরোপের ডিফেন্স বলয় কোনদিন সুরক্ষিত নয় এবং ইউরোপ ইউক্রেনকে ছাড়া স্বয়ংসম্পুর্নও নয়। ফলে ইউক্রেনের টেরিটোরিয়াল সভরেন্টি যদি ইউরোপ না রক্ষা করে, তাহলে ইউরোপ নিজেই রাশিয়ার কাছে হুমকী। কিন্তু জেলেনেস্কি বুঝতেই পারে নাই যে, ইউক্রেন হচ্ছে এই ইউরোপের কাছে একটা এক্সপেন্ডেবল আইটেমের মতো। তারা তাকে ন্যাটোর সদস্যপদ আগেই দেয় নাই, এখন তো আরো অনেক বাধা। দিচ্ছে, দিবে, এই এপ্লিকেশন গ্রহন করা হয়েছে ইত্যাদি বলে ইউক্রেনকে আবার ছেড়েও দিচ্ছিলো না। আসলে ব্যাপারটা হলো যে, তারা তাকে শুধু পুতিনের বিরুদ্ধে একটা টুলস হিসাবে ব্যবহার করছিলো যেটা জেলেনেস্কি বুঝতেই পারে নাই। মজার ব্যাপার হলো, এই ইউজফুল টুলস এর একটা এক্সপায়ারী ডেট ছিলো। আর সেটা এই ২৪ ফেব্রুয়ারী যখন রাশিয়া ইউক্রেনকে আক্রমন করে।

এই একই ঘটনা ঘটেছিলো ১৯৮০ এ আফগানিস্তানে যখন পশ্চিমারা মুজাহিদিনদেরকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ফাইট করার জন্য অর্থ সাপোর্ট দিয়েছিলো। অথচ আফগানিস্তান কিন্তু পশ্চিমাদের কাছে স্ট্র্যাটেজিক্যালী ইম্পোর্ট্যান্ট ছিলো না। আসলে সেটা ছিলো জাষ্ট সোভিয়েটকে পশ্চিমাদের একটা ব্লাডি নোজ দেয়ার পরিকল্পনা। সেখানেও আফগানিস্থান রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের একটা টুলস ছিলো।

সেই একই কাজ কিন্তু আমেরিকা করেছে জর্জিয়ার সাথেও। জর্জিয়াকে পশ্চিমারা ন্যাটো মেম্বারশিপ দেয়ার কথা বলেছিলো ২০০১ সালে। পশ্চিমারা জর্জিয়াকে প্রচুর আর্মস দিয়েছিলো, অতঃপর জর্জিয়া যুদ্ধ করে জর্জিয়া রাশিয়ার সাথে। যখন যুদ্ধ শুরু হলো, পশ্চিমারা পুলআউট করলো। আবখাজিয়া নামে আরেকটা দেশের সৃষ্টি হয়েছিল ২০০৩ সালে। আবখাজিয়া রাশিয়ার খুবই অনুগত একটা দেশ যা জর্জিয়ার জন্য হুমকী।

এই ভুলটাই জেলেনেস্কি করলো যে, তাকে ন্যাটোর মেম্বারশিপ দেয়া হবে, ইইউর সদস্য করা হবে, আর ইউক্রেন ইইউর সবচেয়ে বড় ঢাল হিসাবে রাশিয়ার ফোরফ্রন্টে স্ট্র্যাটেজিক ইম্পোর্ট্যান্ট হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকবে, ভেবেছিলো। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে-ইউক্রেনের জন্য ন্যাটো একটা জাষ্ট কথার ঝুলি ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।

(৩) জেলেনেস্কীর ৩য় ভুলটা ছিল-সে পুতিনের রিয়েল ইনটেনশনকে পড়তে পারে নাই। আর পড়লেও ভুল পড়েছে। এটা অবশ্য জেলেনেস্কীর দোষ না। যুদ্ধ লাগার আগেও কেউ বুঝতে পারে নাই যে, পুতিন আসলেই ইউক্রেন এটাক করবে। জেলেনেস্কী ভেবেছিলো, থ্রেট আগেও ৮ বছর যাবতই ছিলো, রাশিয়া বারংবার থ্রেট দিতেই থাকবে, কিন্তু গত ৮ বছরের মতো পশ্চিমাদের ভয়ে রাশিয়া সাভাবিকভাবেই অন্তত যুদ্ধনামক ভয়াবহতায় জড়াবে না। এমন কি ২৮ জানুয়ারী ২০২২ তারিখে জেলেনেস্কির এক ভাষনে বলেছিলো যে, মিডিয়ার ভাষ্যে যেনো মনে হয় আমরা অতি শীঘ্র রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছি। কিন্তু রাশিয়া কখনোই যুদ্ধে জড়াবে না এটা নিশ্চিত। যুদ্ধ হবে এটা জেলেনেস্কীর মাথাতেও ছিলো না।

(৪) জেলেনেস্কির ৪র্থ ভুল টা ছিলো-জেলেনেস্কী সবসময় বিশ্বাস করতো যে, তাকে ন্যাটো, ইইউ, ইউকে, আমেরিকা, ফ্রান্স, কিংবা জার্মান সবাই সবকিছু দিয়ে একত্রে সাহাজ্য করবেই। সে বিশ্বাস হারায় নাই। ফলে সে পুতিনের কোনো কথায় রাজী না হয়ে শেষমেষ যুদ্ধেই থেকে গেলো। সে বুঝতেই পারে নাই যে, সবাই ‘অনলাইন’ যুদ্ধ করবে। আর সে মাঠে একা হয়ে যাবে।

যুদ্ধে একাই থেকে যাওয়ার কারনে হয়তো জেলেনেস্কী আপাতত হিরো হয়ে গেলো কিন্তু যখন যুদ্ধ থেমে যাবে, সবশর্ত মেনে ইউক্রেন আবার ফিরে আসবে, তখন ব্যাখ্যায় দেখা যাবে অনেকেই, জেলেনেস্কী কতটা ভুল করেছিলো। আর এই ভুল একদিন জেলেনেস্কীকে নামিয়ে আনবে ওদের দেশের ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে নীচে। আজকের দিনের ইউটিউব, ফেসবুক কমেন্টস একদিন ফেড হয়ে গিয়ে সেটাই সামনে আসবে যে, পুতিন প্রথমে যেটার দাবী করেছিলো সেটাই তো হলো, সারাবিশ্ব শুধু তাকিয়েই ছিলো, তাহলে ইউক্রেনের লিডারের এটা বুঝতে এতো দেরী করেছিলো কেনো? ইতিহাস তাঁর উত্তর দিবে। জনগন এতো কিছু বুঝে না, তারা বুঝে প্রতিদিনের আনন্দ, তাঁদের পরিবার আর সম্পর্ক। রাজ্য, রাজা, দেশ নিয়ে এতো কিছু তারা ভাবে না।

ইতিহাস এটাও বিচার করবে কিভাবে সারাবিশ্ব এই মানুষগুলিকে ধোকা দিয়েছে, যুদ্ধনামক এমন একটা ভয়াবহতায় ছেড়ে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে কথার ঝুলি ছেরেছে। বড্ড মায়া লাগে যখন দেখি, ছোট একটা বাচ্চা আহত মায়ের কোলে ঘুমিয়ে আছে, সে হয়তো জানেই না চারিদিকে যুদ্ধ। কিন্তু একদিন সে এই ইতিহাস পড়বে আর নিজের বিবেচনায় বুঝতে শিখবে, কোথায় সিনিয়াররা ভুল করেছিলো, আর কি করা উচিত ছিলো। তখন তাঁর কাছে আজকের দিনের এইসব হিরোইক ইউটিউবের কোনো মুল্য থাকবে না।

যুদ্ধ কারো জন্যই ভাল নয়। রাশিয়ার পুতিন ও একদিন তাঁর দেশে একটা খারাপ মানুষের মধ্যে মুল্যায়িত হবে। কারন সারা বিশ্ব কর্তৃক অবরোধের কারনে ওরাও প্রতিদিন কষ্টে থাকবে।

কিয়েভ খুব কঠিন রাস্তায় এটা শিক্ষা পেলো যে, পশ্চিমাদের, ইউরোপের কিংবা অন্যান্য এলায়েন্সের মিথ্যা নির্ভরশীলতায় এবং মিথ্যা সাপোর্টের আশ্বস্ততায় অসম দেশের সাথে যুদ্ধ করতে যাওয়া একটা খারাপ আইডিয়া।