18/03/2022-রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রভাব  

যুদ্ধ কোনো কালেই কারো জন্য ভালো সংবাদ বয়ে আনে নাই। দুটু মোরগের মধ্যে ফাইটিং এ ও দুটু মোরগই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আর যখন দেশ যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন দেশের মানুষের সাথে অন্যান্য প্রতিবেশী যারা যুদ্ধেই নেই, তারাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই তথ্যটা জানে না এমন নয়, তারপরেও যুদ্ধ হয়। এর একটাই কারন যে, সব প্রতিকুল আবহাওয়ায় ক্ষতির সাথে কিছু মানুষের ব্যবসা, আর সেই ব্যবসায় লাভ ও হয়। হতে পারে এই লাভটা অন্য এমন মানুষের যারা মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধটা চালিয়ে যাক এটাই দোয়া করছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার সাথে একটা অসম যুদ্ধ। এটা হবারই কথা না। কিন্তু তারপরেও হয়েছে এবং হচ্ছে। তাহলে এখানে কে ফাদে পড়লো, কাকে কে ফাদে ফেল্লো, এটা জানা আরো বেশী দরকার যাতে যুগে যুগে এই ফাদ পাতা ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নিতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে-ইতিহাস থেকে কেউ কখনো শিক্ষা নেয় না।

ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে অনেক গুলি বিশ্লেষন বেরিয়ে আসছে ক্রমাগত। আজ আমি একটা নিয়ে আলাপ করার চেষ্টা করছি। যার নাম ‘নিষেধাজ্ঞা’।

রাশিয়ার উপর পুরু বিশ্ব প্রায় হাজার খানেকের বেশী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা নিয়েই আজকের আলাপ।

২৪ শে ফেব্রুয়ারী তে যখন ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমন করে, পুতিন কি এসবের ব্যাপারে হোম ওয়ার্ক করে নাই? রনক্ষেত্র এক জিনিষ আর সারা দেশের অর্থনইতিক বিষয়টা আরেক জিনিষ। যদি পুতিন সেই রনক্ষেত্রের বাইরে দেশের অর্থনইতিক ব্যাপারটা নিয়ে হোম ওয়ার্ক না করে থাকেন, তাহলে আমি বল্বো এটা হয় আমাদের ভুল ধারনা, না হয় পুতিন বিচক্ষন নয়। কিন্তু ২২ বছর যাবত একটা রাষ্ট্রপ্রধান তাও আবার সুপার পাওয়ারের মতো দেশ রাশিয়ার, কেজিবির প্রধান, বয়ষ্ক ব্যক্তির পক্ষে এগুলি নিশ্চয় সে ভেবেছে। তাহলে এবার আসি, পুতিন এই অর্থনইতিক নিষেধাজ্ঞা কিভাবে মোকাবেলা করছে।

দেশের অর্থনীতিকে স্টাবল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

(ক)       রাশিয়াকে পশ্চিমারা সুইফট নামক  গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল সিস্টেম থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় আন্তর্জাতিক মার্কেটে লেন দেনে বিশাল অসুবিধার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ফলে রাশিয়া তাঁর নিজস্ব মীর নামক সিস্টেমের মাধ্যমে ইলেল্ট্রনিক ট্রান্সফার, বিদেশী ব্যংকের সাথে লেন দেন, মাষ্টার কার্দের বিকল্প মিরের মাধ্যমে লেন দেনের বিকল্প ব্যবস্থা করেছে। এটা হয়তো সারা বিশ্ব জুড়ে এখনই কাজ করতে সক্ষম হবে না কিন্তু প্রয়োজনীয় লেন দেনে কোনো অসুবিধা নাই। একটা সময় আসবে যখন এই পশ্চিমাদের একচ্ছত্র সুইফট এর বিকল্প হিসাবে একদিন মীর দাঁড়িয়ে গেলে, রাশিয়ার অর্থনইতিক নিষেধাজ্ঞা অচিরেই বেশ আবার পুনর্জীবন পেয়ে যাবে।

(খ)        পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা হচ্ছে রাশিয়ার রিজার্ভে যে ইউ এস ডলার এবং ইউরো ছিলো, সেতার উপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা। তাঁর মানে ডলার এবং ইউরো রাশিয়ার জন্য একেবারেই এখন নিরাপদ না। এর জন্যে রাশিয়া যা করেছে সেতা হলো- রাশিয়া এখন চায়নার মতো নিজস্ব কারেন্সীর মাধ্যমে বিদেশীদের সাথে ট্রেড করা শুরু করেছে। রাশিয়ার সাথে চায়নার মধ্যে রুবল-ইয়েন প্রথা চালু হয়েছে ইতিমধ্যে। ন্তুরষ্ক রুবলের মাধ্যমে রাশিয়ার সাথে ট্রেড লেন দেনে সম্মত হয়েছে। ভারতের সাথেও রুবল-রুপীর একটা সমঝোতা  হয়েছে তেল বিষয়ক লেন দেনে। এসব করার কারনে পুরু দুনিয়ায় যেখানে ডলার- ইউরোওই ছিলো একমাত্র ব্যবসায়ীক লেন দেনের কারেন্সী, সেটা ধীরে ধীরে কমে আসবে।

(গ)       আমদানী কারকদেরকে ডলারের বিপরীতে রুবলে পেমেন্ট প্রদানের নীতিমালায় রাশিয়া একটা প্যাকেজ ঘোষনা করেছে যে, বিদেশী সবার সাথে রাশিয়া ৮০% ডলার রেটে রুবলের পরিবর্তনে তাঁদের আমদানী দ্রব্যের দাম পরিশোধ করা। এতে যা হবে সেটা হলো- রুবল ধীরে ধীরে আন্ত্রজাতিক মুদায় পরিনত হবে এবং আমদানীকারকেরাও অনেক কিছু ২০% ছাড়ে মালামাল আমদানী করতে গেলে লাভবান হবে। তাঁর মানে এই যে, ডলারের বাজার একটা বিশাল এরিয়ায় অকেজো হয়ে যাবে।

(ঘ)        রাশিয়া ২০২২ সাল অবধি ইউরেসিয়া ইকোনোমিক ইউনিয়ন ভুক্ত দেশে সমস্ত পন্য রপানীতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কাজাকিস্থান, কিরগিস্তান ইত্যাদি। এর মাধ্যমে রাশিয়া তাঁর নিজের দেশের লোকদের নিত্যদিনের পন্যকে নিরাপদ করে ফেললেন। বাইরের লোকদের জন্য এসব নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য এখন অসুবিধায় পড়বে। তাঁদের জন্য পন্যের দাম হবে আকাশ্চুম্বি। তাতে রাশিয়ার কিছুই যায় আসে না। কারন রাশিয়া আগে নিজের দেশের মানুষকে ভোগান্তি থেকে বাচাবে।

(চ)        রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে ২০% করেছে। এর মাধ্যমে রাশিয়ার রুবলের দরপতন হ ওয়াতেও সাধারন জনগন রুবলের দরপতনে কিছুটা হলেও ইনফ্লেশন থেকে মুক্তি পাবে। প্রাইস স্ট্যাবিলিটি করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ এই পদিক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। এখানে একটা ব্যাপার জানা দরকার যে, সুদের হার বাড়ালে কিভাবে প্রাইস স্ট্যাবিলিটি ঠিক থাকে। সেটা একটা বিশাল অংকের হিসাব, তাই বিস্তারীত আলাপ করা হলো না। তবে জেনে রাখা ভালো যে, সুদের হার বাড়িয়ে প্রাইস স্ট্যাবিলিটি একটা সাময়িক পদক্ষেপ মাত্র। রাশিয়া এখানেই থেমে থাকেনি। ক্রেডিট ইন্সটিটুশন গুলিকে রাশিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাংক নতুন লোনে কোনো ইন্টারেস্ট নেবে না কিংবা কেউ যদি ডিফল্টার হয় রুবলের দরপতনে, তাদেরকে ডিফল্টার হিসাবে ধরা হবে না যতোক্ষন রুবল স্ট্যাবল না হয়। এর ফলে দেখা যাচ্ছে ২৪ ফেব্রুয়ারিতে যখন ১ ডলারের দাম ছিলো ১২০ রুবল, এখন সেটা ১০০ রুবলের নীচে চলে এসছে।

(ছ)        আন্তর্জাতিক লোনের ব্যাপারে রাশিয়ার দুটু পেমেন্ট সিডিউল ছিলো গত ১৫ মার্চে। কিন্তু ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক রাশিয়ার ডলার রিজার্ভ ব্লক করাতে সে ১১৭ মিলিয়ন ডলার পেমেন্ট করতে পারছিলো না। যদি রাশিয়া এই পেমেন্ট দুটু রিপেমেন্ট করতে না পারতো, তাহলে রাশিয়া আন্তর্জাতিকভাবে ব্যনাগকিং সেক্টরে একটা ডিফল্ট করে ফেলতে পারতো। একবার কোনো কোম্পানী বা দেশ যখন কোনো একটা জায়গায় ফল্ট করে, তখন তাঁর সি আই বি ও লাল হয়ে যায়। আর সি আই বি লাল হলে অন্য কোনো ব্যাংক বা দেশ তাঁর সাথে আর লেন দেন করতে পারে না। কিন্তু রাশিয়া তাঁর রিজার্ভ ফান্ড যেটা ডলার বা ইউরোতে ছিলো, ইতিমধ্যে বাজার রেটে ১১৭ মিলিয়ন ডলারের সমান রুবলে পেমেন্ট রিলিজ করার জন্য অফিশিয়ালী আদেশ দিয়ে দিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংককে। এখন যদি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সেটা রুবল কারেন্সীতে পেমেন্ট না করে, তাহলে এটার দায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের, রাশিয়ার না।

(জ)       রাশিয়া বিনা মুল্যে তাঁর নাগরিকদেরকে অনেক সুবিধা প্রদানের অঙ্গীকার করেছে এবং দেয়া শুরু করেছে। তাঁর মধ্যে জরুরী বিষয়গুলি হচ্ছে- ছাত্রদের টিউশন ফি, পারিবারিক ভরন পোষনের খরচ, সিনিয়ার সিটিজেন্দেরকে অতিরিক্ত রুবল প্রদান, চাকুরীজীবিদের বেতন বৃদ্ধি, পেন শনের টাকা বৃদ্ধি, পাবলিক সেক্টরে আরো অনেক কিছুর ছাড়।

(ট)        স্মল এবং মিডিয়াম এন্টারপ্রিনিউরদেরকে রাশিয়া সরকার প্রনোদোনা প্যাকেজ দেয়া হচ্ছে যাতে তারা এই রুবল দরপতনে তাঁদের ব্যবসা আগের মতো করতে পারে। সাবসিডিয়ারী, ক্রেডিট ফেসিলিটি সহ সব ধরনের ব্যবস্থা রাশিয়া ইতিমধ্যে ব্যবস্থা করেছে।

(ঠ)       নিষেধাজ্ঞার কারনে কোনো ব্যবসায়ী যেনো তাঁদের উতপাদিত দ্রব্য উতপন্নে কম না করে তাঁর জন্যে রাশিয়া সরকার যা যা লাগে তাঁর সব ব্যবস্থা করবে বলে আশহাশ দিয়েছে। আর সেসব পন্য আপাতত ডমেষ্টিক বাজারেই ব্যবহারের ঘোষনা দিয়ে কিন্তু বাইরে রপ্তানী করতে নিষেধ আরোপন করেছে। তাতে দেশের ভিতরে দ্রব্যমুল্য একটা নিয়ন্ত্রনে থাকবে এবং বহির্বিশহে অন্যরা সাফার করবে। এটাই রাশিয়ার পরিকল্পনা। এর মধ্যে রয়েছে চিনি, গ্যাসোলিন, মেটাল, গম, ডিজেল, এবং অন্যান্য রপ্তানীমুলক দ্রব্য।

(ডঃ)     বিদেশী কোম্পানীগুলি যারা রাশিয়াতে ব্যবসা বন্ধ করার জন্য বলেছে, রাশিয়া তাঁর ব্যবসায়ীদেরকে বলেছেন যে, তাঁর নিজের দেশের নাগরিকগন যেনো সেসব ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান নিজেরা চালায়। বিদেশীদের এই ব্যবসাগুলি চালাইতে যা অর্থের জোগান লাগবে, সেটা রাশিয়ান সরকার বহন করবে। এর সাথে রাশিয়ার সরকার এটাও বলেছে, যদি কোনো বিদেশী কোম্পানী রাশিয়ায় এখনো ব্যবসা করতে চায়, তাহলে তারাও একটা ছাড়ে করতে পারে কিন্তু যদি রাজী না হয়, তাহলে এসব কোম্পানীগুলি রাশিয়ার তরফ থেকে রাষ্ট্রীয়করন করে রাশিয়ানরাই চালাতে পারে। এদের মধ্যে রয়েছে- ম্যাডোন্যাল্ডস, ভক্স ওয়াগন, শেল, এপেল, মাইক্রোসফট, এইচ এন্ড এম, ইত্যাদি।

(ব)        চায়নার ইউনিপে রাশিয়ার সর্বত্র চালু করা যার মাধ্যমে মাষ্টার কার্ড, ভিসা কার্ডের ইফেক্ট কমে যায়। মীরের পাশাপাশি ইউনিপে দুটুই চালু থাকবে।

যে কোনো একটা নতুন সিস্টেম পুরুপুরী চালু হতে কিছুটা সময় লাগে। রাশিয়ার এসব বিকল্প যখন ধীরে ধীরে সফল হতে থাকবে, তখন বিশ্ব বাজারে যেটা হবে সেটা হলো- মাষ্টারকার্দের মতো কিংবা ভিসা কার্দের মতো সিস্টেম গুলি আর সার্বোজনীন থাকবে না। তারা বেশ বড় একটা বাজার হারাবে। এর সাথে রাশিয়ার মীর কিংবা চায়নার ইউনিপে নতুন করে একতা বিপ্লব দিবে।

বড় বড় কোম্পানীগুলি বিসশ বাজার থেকে অনেক গুটিয়ে আসবে, বাজার হারাবে। আমাদের দেশে এক সময় কে এফ সি, পিজা হাট একচ্ছত্র বাজার পেলেও এখন প্রচুর লোকাল পিজার বাজার ভর্তি যা অইসব বিদেশী দোকান গুলি থেকে অনেক সস্থা। হতে পারে মানের দিক দিয়ে হয়তো ততোটা নয়, কিন্তু তারপরেও অনেক সাধারন ক্লায়েন্ট লোকাল পিজা বাজারেরো ভীর কম না। এর মানে বেশ কিছু ক্লায়েন্ট হারানোর মতো।

রাশিয়ার র মেটারিয়াল অন্যান্য দেশে রপ্তানী না যাওয়াতে অইসব দেশের অনেক শিল্প মুখ থুবরে পড়ে যাবে। তেল, গ্যাসোলিন, গ্যাস, স্টীল, গম, বার্লি, চিনি, ইত্যাদির সল্পতার কারনে বিসশে একটা উর্ধগামী মুল্যের প্রভাব পড়বে। যা অন্যান্য দেশকেও বিপদেই ফেলবে। কিন্তু এর মধ্যে রাশিয়া ধীরে ধীরে সাবলম্বি হয়ে উঠবে।

এর অর্থ একটাই- অর্থনইতিক অবরোধে সবাই একইভাবে সাফার করবে, শুধু রাশিয়া একা নয়।