কেরানীগঞ্জ মাইগ্রেশন-ষ্টাইল-৪

Categories

আমার বাবা যখন শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, আমাদেরকে যে কোনো ভাবেই হোক, যতো দ্রুত আদি নিবাস মুনশিগঞ্জ, সিরাজদিখানের কয়রাখোলা থেকে কেরানিগঞ্জে স্থান্তান্তর করতেই হবে। আমার খালুর সাথে আমার বাবা অতি গোপনে বিস্তারীত ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই স্থানান্তরের সবচেয়ে কঠিন বিষয়টা হচ্ছে গোপনীয়তা রক্ষা এবং কাজটা করতে হবে কেউ বুঝে উঠার আগেই। যদি ১ম পক্ষের কেউ বিন্দুমাত্র আভাষ পায়, তাহলে তাজির আলী, কিংবা অন্যান্যরা কিছুতেই আমাদেরকে কেরানিগঞ্জে আস্তে দিবে না, বাধা দিবে এবং এটা একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির স্রিষ্টি করবে যা ভাবাই যায় না।

আমার খালু ছিলেন কেরানিগঞ্জের বাক্তার চর এলাকার অনেক প্রতাপশালি একজন ধনাঢ্য মাদবর। আমার খালু (গনি মাদবর) এবং আমার বাবা হোসেন আলী মাদবর দুজনে একটা ব্যাপারে একমত হলেন যে, যেদিন তাজির আলী কয়রাখোলার বাইরে থাকবে, হোক সেটা কোনো এক রাতের জন্য বা দুই রাত, সেই সময়ে পুরু বাড়িটা না ভেংগে কয়েক শত লোক নিয়ে এক রাতের মধ্যে বাড়িটা কেরানীগঞ্জে শিফট করা। এদিকে খালু তার নিজের একটা জমিতে আমাদের কয়রাখোলার বাড়ির অবিকল মাপে মাপে সব কিছু খুড়ে রাখবেন যাতে এক রাতের মধ্যেই পুরু বারিটা স্থাপন করা সম্ভব হয়। কিন্তু সমস্যা হলো কয়রাখোলা থেকে বাক্তার চরে আসার মাঝপথে একটা নদী আছে। সেই নদী এতো বড় আস্ত একটা বাড়ি কিভাবে পার করা সম্ভব? এটার ও একটা বিহীত হলো। পরিকল্পনা হলো যে, খালু ২/৩ শত কলা গাছ দিয়ে নদীর উপর ভেলা বানিয়ে রাখবেন যাতে ঘর সমেত লোকজন পার হতে পারে।

এবার শুধু অপেক্ষার পালা, কবে তাজির আলী অন্য কোথাও বেরাতে যায়। ব্যাপারটা বেশীদিন সময় নিলো না। সমস্ত লোকজন ঠিক করা ছিলো, ভেলার জন্য কলা গাছ ও রেডি করা ছিলো, শুধুমাত্র আদেশের অপেক্ষা। তাজির আলী তার শশুড় বাড়িতে তিন চারদিনের জন্য বেড়াতে যাওয়ার আওয়াজ শুনা গেলো। এদিকে বাবা এবং খালু সেই সময়তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

ঠিক যেদিন তাজির আলি তার শশুড় বাড়ি চলে গেলো, ওই দিন রাতেই একদিকে আমার বাবা তার দলবল নিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি তুলে ফেলার ব্যবস্থা করলেন, খালূ নদীর উপর ভেলা সাজিয়ে ফেললেন, আর এদিকে আমার ভাই বাক্তার চরে পুরু বাড়িটা প্রতিস্থাপনের জন্যে দায়িত্তে থাকলেন।

মাত্র একটি রাত।

আর এই রাতের গহীন অন্ধকারেই আমার বাবা তার চার শতাধিক কর্মীবাহিনীকে নিয়ে, আমার খালু আরো দুই শতাধিক কর্মীবাহিনী নিয়ে আর অন্য দিকে আমার ভাই আরো প্রায় গোটা বিশেক পচিশেক লোক নিয়ে পুরু বাড়িটা ভোর হবার আগেই বাক্তার চরে সেট করে ফেললেন। গ্রামের মানুষ যখন ঘুম থেকে উঠলেন, তখন তারা একটা জিনিষ দেখলেন যে, কয়রাখোলায় আর বাড়ি নাই, অথচ বাক্তার চরে নতুন একটা বাড়ি দাঁড়িয়ে ছিলো। এটা কোনো আলাদিনের দৈত্যের কাহিনীকেও হার মানিয়েছে।

আমরা নতুন ঠিকানায় চলে এলাম। অন্যদিকে যখন তাজির আলীরা এই সংবাদ পেলো, তারা অনেক হৈচৈ লরেছে বটে কিন্তু ততোক্ষনে সব কিছু ওদের হাতের বাইরে চলে গেছে। এই নতুন ঠিকানায় এসে সবচেয়ে বড় কষ্টে ছিলেন আমার বাবা। তার সাম্রাজ্য ছেড়ে এখন তিনি নতুন এলাকায় কোনো কিছুই না। ভাগ্যের কি পরিহাস। গতকালের রাজা আজ অন্য কোথাও আরেকজনের প্রজা।

এখানে আমার (মেজর আখতার) একটা কমেন্ট করার খুব ইচ্ছে হলোঃ

শুধুমাত্র একটা বাড়ি তুলে আনাই কি মাইগ্রেশন? আর বাড়িতা তুলে না এনে কেনো আমার বাবা তার অর্থ খরচ করে বাক্তার চরে আরেকটা বাড়ি করলেন না? একটা নতুন বাড়ি করার পরেই তো তিনি আমাদের সবাইকে বাক্তার চরে মাইগ্রেট করাইতে পারতেন। এই জায়গাটায় আমার সাথে আমার বাবার বা খালুর বুদ্ধির সাথে এক হলো না। নিশ্চয়ই এর ভিতরে আরো কোনো মাহাত্য ছিলো যা এই মুহুর্তে আমার জানা নাই।