31/04/2020-রহস্য। 

রহস্য। 

এমন একটা নাম, যে নিজেই সবার কাছে এক রহস্য। এই পৃথিবীর প্রতিটি প্রানীর নিজস্ব একটা রহস্য থাকে। সে সেই রহস্য বুকে নিয়েই আজীবন প্রকাশ্য দিবালোকে সবার সাথে উম্মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায় যেনো আমরা যা দেখছি সেটাই সব, কিন্তু তার ভিতরে, অন্তরে, মনে বা মগজে হয়তো কিছু না কিছু রহস্যঘেরা জাল রয়েই যায়। এই রহস্যের কোনো কুলকিনারা নাই, না আছে সরল অভিব্যক্তি। এই রহস্য কখনো সত্যতায়, কখনো মিথ্যায় আবার কখনো দুঃখের ভারাক্রান্ত পিপায় কানায় কানায় ভরে থাকে। এটা খুব সহজ নয়, আছে কিনা বাস্তবে তাও সঠিক বুঝা যায় না কিন্তু নাই এটা বলা যাবে না। কোনো ভিক্ষুক আজীবন ভিক্ষে করে খেলেও দেখা যাবে সে আসলে কখনোই ভিক্ষুক ছিলো না, তার কাছে যা ছিলো তা দিয়ে হয়তো আর পাঁচ দশটা মধ্য ক্লাসের পরিবারকে আজীবন লালন করা যায়, অথচ রহস্য হচ্ছে সেই ভিক্ষুক সারাদিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে জরাজীর্ন কাপড় পড়ে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করাই ওর নেশা। এই রহস্য বুঝা মুষ্কিল। আবার দেখা যায়, সদাহাস্য যে মানুষটি আমার আর আপনার সামনে কখনো মন খারাপ করতে দেখা যায় না, হয়তো যখন সে নিতান্তই একা থাকে, অথবা গভীর রাতে যখন তার ঘুম ভাংগে, তখন হয়তো কোনো এক একাকীত্তের বেদনায় তার দুই চোখ জলে ভরে থাকে অথচ দিনের আলোয় তার ঠোটে সব সময়ই থাকে একটা মনকারা হাসি। কি সেই গোপন রহস্য?  অরু, শারমিন, মাধুরীর পরিচয়টা আমি ইতিমধ্যে দিয়েছি। কিন্তু এরা কি আসলেই কেউ ছিলো? সবার জীবনেই এমন কেউ থাকে যারা কোথাও না কোথাও অরু, বা শারমিন, মাধুরী, বা ঘষেটি বেগম অথবা মনিকা, বা পারু হয়ে বাচে। এরা মেরুদন্ডসম্পন্ন শক্তিহীন প্রানীর মতো ঠিকই কিন্তু যদি প্রয়োজনিয় পুষ্ঠির জোগান দেয়া যায়, মায়াবী ব্যবহারে মমতায় গড়ে তোলা যায়, তারা লিকলিক করে বড় সুফলা গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে কিন্তু বেশীর ভাগ সময়েই এরা থেকে যায় অপ্রকাশ্যে। রাস্তাঘাটে চলার সময়ে আমি এদের দিকে তাকাই, ভাবি আর আমার কল্পনায় ওরা জীবিত হয়ে উঠে এই ডায়েরীতে। অথচ আমি এদের কাউকেই চিনি না। তবে বড্ড মায়া হয় এদের জন্য। আমিও তো হতে পারতাম ওদের মতো কেঊ? 

এইসব ছিন্নমূল মানুষগুলির জীবনের গল্প আলাদা। এদের কান্নায় ভরে থাকে ভালোবাসা, এদের ভালোবাসায় ভরে থাকে বেদনার মতো অনেক কাহিনী। এটা তো ঠিক যে, কান্নার আহাজারীতে সুর থাকে না, থাকে বেদনা আর কষ্ট যে কষ্টের কোনো নাম নাই, যে কষ্টের রুপ কাউকে দেখানো যায় না। এরা এমনই কিছু মানুষ "অন্য দুনিয়া"য় একাই থাকে। আমাদের মানুষের সবচেয়ে বড় অক্ষমতা হচ্ছে-আমরা ভিতরেরটা দেখি কম, কিন্তু সত্যিটা সবসময় মানুষের ভিতরেই থাকে।  এইসব ছিন্নমূল মানুষেরও শৈশবকাল ছিলো, যৌবন ছিলো, হয়তো সেইসব শৈশব কিংবা যৌবন আমাদের অনেকের থেকেই আলাদা। সময়ের সাথে সাথে যে কোনো ডকুমেন্ট পালটে দেয়া যায়, যে কোন ডকুমেন্ট নকল করা যায় হুবহু আসলের মতো কিন্তু কেউ কি কখনো তার অতীতের সেই শৈশব, যৌবন পালটে দিতে পেরেছে? কিন্তু এইসব ছিন্নমুল মানুষগুলির সেটাও পালটে যায়, তাদের মুখাবয়বও পালটে যায়। বাচার জন্য পালটে ফেলতে হয় তাদের সব। তাই এসব "অন্য দুনিয়ার" মানুষগুলির বাহ্যিক চেহারা আমরা দেখতে পাই বটে কিন্তু এদের ভিতরের কষ্টটা আমরা না দেখতে পাই, না বুঝতে পারি। বাচার তাগিদে এরা নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়েও কাজ করে। তারা তাদের জীবনের পাহাড় অতিক্রম করার জন্য আপ্রান চেষ্টায় সারাটি জীবন একাই যুদ্ধ করতে করতে এক সময় হয় অকুল সাগরে ভেসে যায় অথবা হয়তো কোনো কিনারে এসে থেমে যায়। তারপরেও মানবিক গুনাবলীর অংশ হিসাবে এরাও প্রেম করে, এরাও ভালো একটা জীবন পাওয়ার আশায় ঘর বাধার সপ্ন দেখে। কিন্তু বেশীরভাগ সময়েই যখন প্রেম নামক এই দুধটুকু পুড়ে শেষ হয়ে যায়, তখন মনে হয় ঘোড়া এসেছিলো, ঘোড়া জলও খেয়েছিলো, কিন্তু কেউ কোনোদিন ঐ ঘোড়াকে বাস্তবে দেখে না।

এ জগতে সবচেয়ে বড় রহস্য বিধাতা নিজে, আর সেই রহস্যময়ী বিধাতা মানুষের জন্য আরো কিছু রহস্য তৈরী করে জাল বুনে রাখেন। তারমধ্যে অন্যতম "সময়", "সম্পর্ক", "মন", "অন্তর", "মায়া", "ভালোবাসা", আর "চোখের জলের" সাথে "ঠোটের হাসি"। রাগ, গোস্যা, ঘেন্না কিংবা হানাহানি কোনো রহস্য নয়। কেনো নয়? এই রহস্যের কোনো ব্যাখ্যা নাই।