যে বিষয়টায় যার যতো বেশী আশংকা, ভয়, দুশ্চিন্তা, মাঝে মাঝে সেটাই সত্যি হইয়া সেই আশংকা, ভয়, আতংক আর দুশ্চিন্তা বাস্তবরূপ নিয়া অমাবশ্যা হইয়া সামনে হাজির হয়। কখনো কখনো মানবসংকুল তাহাদের অমাবস্যার কথা চিন্তা করিয়া ইহাকে কাটাইবার জন্য হয়তো জজ্ঞের আয়োজন করিয়া থাকেন, কিন্তু জজ্ঞের দ্বারা সেই অমাবশ্যা কাটিবে কিনা, তাহা যিনি জজ্ঞ করিতেছেন, আর যাহাকে দিয়া জজ্ঞ করাইতেছেন কিংবা যাহার জন্য জজ্ঞ করা হইতেছে, কেহই কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেন না। ফলে জজ্ঞক্রিয়া উপেক্ষা করিয়াও কোনো কোনো সময় ছোট ছোট ব্যাপারই বড় বড় রূপ ধারন করিয়া বড় রূপ এবং অতঃপর বড় ধরনের ঝামেলার সৃষ্টি করিয়া থাকে। তখন ছোট ব্যাপারগুলিও আর কোনোভাবেই ছোট করিয়া দেখিবার অবকাশ থাকে না। আবর্জনা যেহেতু সবসময় সাদা কাপড়েই বেশি নজরে পড়ে, ফলে ছোট একটা আবর্জনাও অতি মসৃণ ধবধবে সাদা কাপড়ে এমন কটু দৃষ্টির সৃষ্টি করে যে, হয় সম্পুর্ন কাপড়টাকেই ব্যবহারের অযোগ্য মনে করিয়া ফেলিয়া দিতে হয়, নতুবা এই আবর্জনা লইয়াই সমাজের সর্বস্তরে চলাচল করিতে হয়। কিন্তু আজকে যাহার কাহিনী এই গল্পে উত্থাপন করা হইয়াছে, তিনি সমাজে এমন এক স্তরের মানুষ, তিনি আবর্জনা লইয়া চলিবার মানুষ নহেন। ফলে, যতো মুল্যবানই হোক, তাহাকে কাপড়খানাই ফেলিয়া দিতে হইলো।
ইহা আমার পরিবারের কাহিনী।
আমি অতি সাধারন জীবন যাপন করিতে অভ্যস্থ। সুস্থ্য এবং ন্যায়ভিত্তিক জীবনেই আমি আমার জীবন এবং আমার পরিবারকে গড়িয়া তুলিয়াছি। সময়ের এই বিশাল সাগরে আমি আমার জীবনের প্রতিটি ক্ষন, প্রতিটি মুহূর্ত তিলে তিলে সঠিক ব্যবহার করিয়া শুন্য হইতে আজ আমি এক বিশাল সাম্রাজ্য তৈরী করিয়া আমার দুই মেয়ে আর এক সুদর্শনা শিক্ষিত স্ত্রীকে নিয়া খুব ভালোভাবেই সমাজে মাথা উচু করিয়া দাঁড়াইয়াছি। ব্যবসায় যেমন আমি আমার ক্যাপাসিটি মোতাবেক উন্নতি করিয়াছি, তেমনি আমার ব্যক্তিগত জীবনেও মানসম্মানের কোনো কমতি ছিলো না এবং নাইও। এইসব সুখী জীবনের মধ্যেও আমার মনে একটা সুক্ষ আশংকা আর ভয় কাজ করিতো। আমি সবসময় ভাবিতাম আমি একা এবং আমাকে সাহাজ্য করিবার মতো কোনো পুরুষ আমার বংশে নাই বিধায় আমার অনুপস্থিতিতে কে বা কাহারা আমার এই বিশাল সাম্রাজ্য সামাল দিবে বা কাহার উপর আমি এই গুরুদায়িত্ত দিয়া যাইবো, ইত্যাদি ইত্যাদি লইয়া বেশ চিন্তিত থাকি। আমার স্ত্রী যথেষ্ট্য পারদর্শী হইলেও আজকের দিনের এই পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের আধিপত্যতাই কাজ করে বেশী বলিয়া আমি এমন কাউকে আমার পরিবারের দায়িত্ত দিতে খুজিতেছিলাম যিনি নিজেও উপকৃত হইবেন আবার আমার পরিবারের তথা আমার এই বিশাল সাম্রাজ্যের দায়িত্বও নিতে পারিবেন। অনেকবার আমি এই প্রচেষ্টা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সফল করিবার নিমিত্তে ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্কের, ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মানুষদের উপর আরোপ করিয়াছিলাম, কিন্তু আমি বারংবার আমার এই চেষ্টায় বিফল হইয়া পরিশেষে ভাবিলাম, মেয়েদের কিংবা তাহাদের স্বামীদের দ্বারাই এইবার আমার এই গুরুদায়িত্ত পালনে সচেষ্ঠ হইবো।
আমি যদিও বয়ষ্ক মানুষ কিন্তু সময়ের তালে আধুনিকতার যে ছোয়া আজ পৃথিবীর চারিদিকে বইছে, তাহা হইতে আমি কখনোই পিছাইয়া ছিলাম না। পুরাতন ট্র্যাডিশন আমি ঝাড়িয়া মুছিয়া ফেলিয়া দেই নাই, আবার নতুন যাহা ঘটিতেছে সেটাও আমার কাছে গ্রহনযোগ্য বলিয়া আমি তাঁর নির্যাস নিতে অপারগ নই। ফলে পুরানো দিনের বয়োবৃদ্ধ মানুষের ধ্যান ধারনাকে যেমন আমি সম্মান করি, তেমনি আধুনিক কালের নতুন নতুন কলা কৌশলের সাথেও অনায়াসেই খাপ খাওয়াইয়া চলিতে পারি। ইহার ফলে যাহা হইয়াছে তাহা হইলো পুরানো দিনের মানুষেরাও আমার খুব ভালো বন্ধু আবার নতুন যুগের আধুনিক মন মানষিকতায় গড়ে উঠা যুবকেরাও অনায়াশেই আমার বন্ধু বনিয়া যায়। আমি পুরানো দিনের মানুষ হইলেও আমার মেয়েরা আধুনিক কালের মানসিকতা নিয়া যেহেতু বড় হইয়াছে, ফলে আমার সাথে আমার মেয়েদের মধ্যে বিস্তর কোনো গ্যাপ ছিলো বলিয়া মনে হইতেছিলো না। তবে একটি জায়গায় আমি চরমরূপে ছিলাম। তাহা হইলো নিজের আত্তসম্মান আর ন্যায় পরায়নতার ব্যাপারে। ইহার কোনো কিছুর এদিক সেদিক হইলেই আমার নিজের নীতি হইতে এক পাও নড়িতে আমি ইচ্ছুক নই। একটা ছোট উদাহরন দিয়া এই কঠিন রুপটার বর্ননা না করিলেই নয়।
আমি আজ যেখানে দাড়াইয়া আছি, এটা সম্পুন্নই নিজের প্রচেষ্ঠায়। কাহারো কোনো কৃপা গ্রহন করিতে ইচ্ছুক ছিলাম না, এবং কাহারো কোনো কৃপা গ্রহনও করি নাই। ফলে কেহ তাহার কৃপায় বড় হইয়াছি, কিংবা কাহারো কাছ হইতে নির্লজ্জের মতো কিছু চাহিয়া বড় হই, ইহা কোনোভাবেই মানিতে পারি নাই এবং করিও নাই। তবে আমি নিজে খুশী হইয়া আমার নিজ উদ্যোগে যে কাউকে যাহা খুশী আমি তাহা দিতে কার্পন্য করিনা। কিন্তু কেহ আমার কাছ হইতে অযাচিতভাবে কিছু চাহিয়া তাহার মনোবাঞ্চনা হাসিল করিবেন তাহা আমি কখনো মানিয়া লইতে পারিনা। ব্যাপারটাকে আমি তখন লোভ আর লালসার মধ্যে বিবেচনা করিয়া থাকি।
আমার বড় মেয়ে, উম্মিকা, ডাক্তারী বিষয়ে পড়াশুনা করিতেছে। সবেমাত্র বগুড়া মেডিক্যাল (অর্থাৎ শহীদ জিয়া মেডিক্যাল কলেজ এন্ড হাসপাতাল) কলেজে ভর্তি হইয়াছে। একদিন আমার স্ত্রী আমাকে জানাইলো যে, উম্মিকা কোনো এক ছেলেকে পছন্দ করে যাহার বাড়ি আমাদেরই কেরানিগঞ্জ থানায়।
মেয়ে বড় হইতেছে, এদিকে আবার তাহার পড়াশুনার লাইন কোনোভাবেই ব্যবসায়িক নয়। অন্তত আমার ব্যবসা বুঝিয়া নিতে পারিবে এই রকম সেক্টরে সে পড়াশুনা করিতেছে না বিধায় আমি ধরিয়া নিয়াছিলাম যে, আমার বড় মেয়ে আমার প্লাস্টিক ইউনিট এবং গার্মেন্টস কিংবা অন্যান্য জে সকল ব্যবসা বানিজ্য আমার আছে সেসবে সে কখনোই হাল ধরিতে পারিবে না। অন্যদিকে আমার ছোট মেয়ে এখনো ভবিষ্যতে কি করিবে তাহাও আমার কাছে বোধগম্য নয়। ফলে আমি চাহিতেছিলাম যে, যদি আমার মেয়ের স্বামীরা আমার ব্যবসা এবং আমার পরিবারের উপ-অধিনয়কের অর্থাৎ সেকেন্ড ইন কমান্ড এর মতো হাল ধরে, তাহাতে তাহদেরও লাভ হইবে আবার আমিও আমার পরিকল্পনায় সার্থক হইবো।
জিজ্ঞেস করিলাম, ছেলে কি করে? আমার স্ত্রী আমাকে যাহা জানাইলো তাহা ঠিক এইরূপঃ
ছেলের বাবা একজন অবসর প্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা। বর্তমানে বয়স্ক হইয়াছে বিধায় কোনো কাজকর্ম করেন না। ছেলের মা গৃহিণী, তাদের একজন মেয়ে, ইতিমধ্যে বিবাহ হইয়া গিয়াছে। মেয়ের স্বামী একটা প্রাইভেট টেলি কমিউনিকেশন কোম্পানীতে ভালো পোষ্টে বিদেশে কাজ করে। আর এক ছেলে আছে যিনি আর্মির অধীনে ট্রাস্ট ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার হিসাবে কাজ করে। সে বড় ভাই এবং বিবাহিত, তাহার একটি মেয়ে আছে, যাহার নাম নোভা।
মেয়েরা যখন তাহাদের পছন্দের ছেলের কথা বলে, তখন আমার কোনো দ্বিমত থাকেনা। আমার নীতি হইলো যে, কোথাও না কোথাও একটা ভালো ছেলে, ভালো পরিবারের কাছে আমার মেয়েকে তো বিবাহ দিতেই হইবে। সেই পরিবারে কি পরিমান সম্পদ আছে, বা কত টাকা ক্যাশ আছে, বা তাহাদের কত কি আছে তাহা আমার কাছে বিবেচ্য নয়। আমার কাছে বিবেচ্য ছিলো, ভালো পরিবার, সৎ পরিবার। কারন, আমার যাহা আছে, সবশেষে গিয়ে তো আমার মেয়েরাই পাইবে। আর আমার মেয়েরা পাওয়া মানে তো আমার মেয়েদের স্বামীরাই এর সংরক্ষনের দায়িত্তে থাকিবে। ফলে ছেলেদের কি পরিমান কি আছে তাহা আমার কাছে কোনো ব্যাপার নহে।
আমি ছেলেটার বাড়ির সবার সাথে দেখা করার নিমিত্তে এবং যোগাযোগ বৃদ্ধির নিমিত্তে কয়েকবার নিজখরচে কখনো হোটেল রেডিসনে, কখনো বসুন্ধরা সীটির ভিআইপি রেস্টুরেন্টে, কিংবা কখনো অন্য কোনো ভালো ভেন্যুতে খাওয়া দাওয়া করিয়া কিছু সময় কাটাইতে থাকি, গল্প করিতে থাকি আর এই ফাকে তাহাদের পরিবারটিকে বুঝিবার চেষ্টা করিতে থাকি। যতটুকু বুঝিতে পারিতেছিলাম, তাহা হইলো এই যে, ছেলেটার পরিবার খুব সাদাসিদে, একেবারেই মধ্যবিত্তের কাছাকাছি। তাহারা সবাই একটা ফ্ল্যাটে একত্রে বসবাস করে। ফ্ল্যাটটি তাহাদের নিজেদের, হক গার্ডন কমপ্লেক্সে। যেহেতু তাহাদের আর্থিক সচ্ছলতার উপর আমার কোন আখাংকা ছিলো না, আর আমি চাহিয়াছিলাম একটা সাদাসিদে পরিবার, ভালো পরিবার, আমার কাছে ছেলেটার মা, বাবা, আর ভাইকেও খুব সাধারন গোছেরই মনে হইয়াছে। ফলে তাহাদের সহিত আমার আত্মীয়তা করিতে খুব একটা নেগেটিভ কিছু মনে হয় নাই। আমি পরোক্ষভাবে মানিয়াই নিলাম যে আমার কোনো আপত্তি নাই এই পরিবারের সাথে সম্পর্ক গড়িবার ক্ষেত্রে।
আমার এই সবুজ সংকেতে আমার মেয়ে আর ছেলেটা যখনই সময় পায়, ঘুরাঘুরি করে, তাহাদের বাসায় আসা যাওয়া করে, তাহারাও আমাদের সাথে বেশ ভালো একটা সম্পর্ক রাখিবার চেষ্টা করিতেছিলো। এখানে একটা কথা বলিয়া রাখা ভালো যে, আমি ব্যবসার নিমিত্তে এতোটাই ব্যস্ত থাকি যে, আমার মেয়ের মধ্যে আর ছেলেটার মধ্যে কখন কেমন সম্পর্ক উত্থান পতন হইতেছিলো তাহা জানিবার জন্য আমি আমার মেয়েকেও জিজ্ঞাসা করিতাম না। কারন ভালোবাসার মানুষদের মধ্যে কখনো কখনো দিনকাল এদিক সেদিক হইতেই পারে। ইহা নিয়া আমার খুব একটা ভাবনার বিষয় ছিলো না।
আমি সবসময় ভাবিতাম যে, যেহেতু ছেলেটার পরিবার ততোটা সচ্ছল নহে, ফলে আমারও কিছু দায়িত্ত থাকে তাহাদেরকে ভালো রাখিবার। আর যেহেতু মানষিকভাবে আমি প্রস্তুত আছি যে, এখানেই আমার মেয়ে বিয়ে করিবে, ফলে আজ হোক, কাল হোক আমাকে তো তাহাদেরকেও দেখভাল করিতে হইবে। তাহারাও তো আমারই পরিবারের অংশ। ছেলেটার নাম আজিজুল হাসান রানা।
দিন যায়, মাস যায়, আমি ভাবিলাম, যেহেতু রানা বিবিএ তে পরাশুনা করিতেছে, আমি যদি ওকে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম একটা কাজে লাগাইয়া দেই, তাহা হইলে সে হয়তো ধীরে ধীরে আমি কিভাবে ব্যবসা করি, ব্যবসা করিতে কি কি জ্ঞানের দরকার, কিংবা আমার যতো ব্যবসায়ীক লিংকগুলি আছে, তাহাদের সহিত রানাকে পরিচয় করাইয়া দেই, তাহা হইলে একদিন সে আমার অনুপস্থিতিতেই আমার এই সকল ব্যবসার হাল ধরিতে পারিবে। ইহা লইয়া আমাই আমার স্ত্রীর সাথে এবং মেয়ের সাথেও বিস্তর কথা বলি। সবাই মুটামুটি একটা জায়গায় সিদ্ধান্তে উপনীত হইলাম যে, আমি যদি রানাকে আপাতত আমার প্লাষ্টিক ইন্ডাস্ট্রিতে পার্টটাইম জবে ঢোকিয়ে দেই তাহা হইলে দুইটা লাভ হয়। একটা হচ্ছে, রানার কিছু উঠতি ইনকাম হয় যাহাতে সে নিজেকে অথবা তাহার পরিবারকে আপাতত ছাত্র অবস্থায় কিছুটা আর্থিক সাপোর্ট দিতে পারে, অন্যটি হচ্ছে রানার নিজেরও একটা ব্যবসায়ীক জ্ঞান বাড়বে, অভিজ্ঞতা হবে। সেই মোতাবেক আমি রানাকে মা ইন্ডসাট্রিজ লিমিটেডে আপাতত এক্সিকুইটিভ ডাইরেক্টর হিসাবে ১৫০০০ টাকার বেতনে (যখন ক্লাস থাকিবে না, তখনই আসিতে পারিবে এই শর্তে, কিন্তু লেখাপড়া ক্ষতি করে নয়) কাজে লাগাইয়া দিলাম। রানাদের নিজস্ব গাড়ি নাই বিধায় রানা পাবলিক ট্রান্সপোর্টেই ফ্যাক্টরীতে আসা যাওয়া করিতো কিন্তু যাওয়ার সময় আমি ওকে আমার গাড়িতে করিয়া বাসায় পৌঁছাইয়া দিতাম। আর গাড়িতে ভ্রমন করিবার সময়টায় আমি ওকে ব্যবসায়ীক অনেক জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করিতাম। যতোদূর মনে পড়ে, রানা নিজেও খুব মনোযোগের সাথে আমার এইসব উপদেশ খুব ভালোভাবে নিতেছিলো বলিয়া মনে হইতো।
কিন্তু আমি এতোটাই বোকা ছিলাম যে, আমি একটা জিনিষ বুঝিতে পারি নাই যে, কোনো কোনো সময় কিছু কিছু নাটক এমনভাবে বানানো হয় যাহাতে সাধারনের চোখে মনে হইবে ইহাই সব সত্যি কিন্তু এর পিছনের মুল উদ্দেশ্য অনেক গভীরে। এইসব নাটকে শুধু ভরষার স্থান তৈরীর জন্যই নাটক তৈরী করা হয়। এক্ষেত্রে ওর মা, ও নিজে, আর ওর ভাই ঠিক ওই রকম একটা চরিত্রে উদয় হইয়াছিলো। সত্যটা আমার চোখে ধরা পড়ে নাই। যেহেতু সত্যটা আমার চোখে পড়ে নাই, ফলে আমি প্রতিনিয়ত একটা মিথ্যাকেই বারবার সত্য হিসাবে দেখিতেছিলাম। আমার নজর ছিলো, কিভাবে আমি ওদের পুরু পরিবারটাকে সাহাজ্য করা যায়, কিভাবে রানাকে আমার মতো করে গড়ে তোলা যায়, কিভাবে আমি ওকে এমনভাবে তৈরী করি যাহাতে একসময় আমার সমস্ত ক্ষমতা, সমস্ত রাজ্য ওকে দেওয়া যায় এবং আমার এই তিলেতিলে গড়ে উঠা সাম্রাজ্য যাহাতে বিনষ্ট না হইয়া অতলে হারাইয়া যায় তাহার জন্য রানাকে তৈরী করা। আর ওদের উদ্দেশ্য ছিলো আমার ব্যবসা আর টাকা। কিন্তু যে কেউ তো আর এমনি এমনিই কাহারো কাছ থেকে সম্পদ বা ব্যবসা কিংবা টাকা পয়সার লোভ করিলেই পাওয়া যাইবে না। তাহার জন্য দরকার একটা টুলস। তাহারা চাহিয়াছিলো আমার কাছ হইতে টাকা পয়সা বানানোর মুল যন্ত্রটা, আমার ব্যবসা আর সম্পত্তি। রানা অতোক্ষন পর্যন্ত যতোক্ষন বিয়ের কাজটা সম্পন্ন হয় নাই ততোক্ষন একজন সাধারন বালক হিসাবেই সমাজে ছিলো। যেই রানা আমার সাথে আমার পরিবারের মধ্যে ঢোকিয়া গেলো, সে হইয়া গেলো অন্য কিছু। আমি যখন তাহাকে আমার প্লাষ্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের কিছু দায়িত্ত দিলাম, তাহাতেই সে দেখা শুরু করিয়া দিলো আকাশের তারার ভিতরের চন্দ্রাভিযান। আমি এইসব ষড়যন্ত্র কিছুই বুঝিতে পারি নাই। অনেক পরে আমি বুঝিয়াছিলাম যে, এইসব আইডিয়া বা নাটকের মুল রচয়িতা আসলে রানা নহে, বরং ইহার মাষ্টার মাইন্ড লেখক রানার মা আর রানার বোন। কিভাবে আমি ইহা বুঝিয়াছিলাম, সেটা পরে বিশদ বর্ননা করিতেছি।
যাহাই হোক, আমার মেয়ে রানার সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশিয়া একটা জিনিষ হয়তো বুঝিয়াছিলো যে, রানা কিংবা তাহার পরিবার না উম্মিকার সাথে ম্যাচ করে, না আমাদের মানসিকতার সাথে ম্যাচ করে। আমার মনে হয়, ধীরে ধীরে আমার মেয়েও হাপিয়ে উঠিতেছিলো রানার কিছু কিছু ব্যবহার নিয়া। কিন্তু সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হইলো যে, আমাকে আমার মেয়ে কখনোই রানার ভিতরের চরিত্রটি নিয়ে খোলামেলাভাবে আলাপ করে নাই। না আমার সাথে, না আমার স্ত্রীর সাথে। আর যেহেতু রানার পরিবার ইহা খুব ভালো করিয়াই জানিতো আমাদের পরিবার কি রকম, আর আমাদের মানসিকতা কি, ফলে তাহারাও আমাদেরকে হারাইতে চায় নাই। তাহারা সবসময় চাহিয়াছিলো যে, যে কোনো মুল্যেই হোক, তাহারা যেনো এই রকম একটা সোনার মুকুটের পরিবার হাতছাড়া না হয়। এই কারনে, যতোদিন ফাইনাল কিছু না হইতেছিলো অর্থাৎ বিয়া, ততোদিন রানার মা এমন একটা চক্র তৈরী করিয়াছিলো যাহাতে না আমার বোকা মেয়েটা আমাদেরকে কিছু বলার সুযোগ পায়, না আমি রানার চরিত্রের মধ্যে দুরভিসন্ধির কোনো খুত ধরিতে পারি। তাহারা আসলে আমাদের উপর এবং আমার পরিবারের উপর উম্মিকার সাথে বিয়ের মাধ্যমে একটা স্টিং অপারেশনের পরিকল্পনা করিয়াছিলো। আর সব স্টিং অপারেশনের একটাই উদ্দেশ্য থাকে। আর সেটা হইতেছে-ব্ল্যাক মেইল। তাহারা তাহাদের নাটকের সব চরিত্রের ডায়ালগ যেভাবে দরকার সেইভাবেই সাজাইবার মনঃস্থ হয়তো করিয়াছিলেন কিন্তু আমার চরিত্রের ডায়ালগ তো আমি ছাড়া আর কেউ লিখে দিতে পারিবে না। ফলে আমি ধীরে ধীরে কিছু একটার আভাষ পাইতে লাগিলাম যাহা এই ছেলেটির ব্যাপারে আমি আগে যাহা ভাবিয়াছি, এখন আর সেই রকম ভাবে তাহাকে খুজিয়া পাইতেছিলাম না। যেই সব গুনাবলীগুলি আমি পুরুষ মানুষের চরিত্রে দেখিলে ঘৃণা বোধ করি, আমি সেই সব গুনাবলী রানার মধ্যে বর্তমান দেখিতে পাইতেছিলাম। যেমন, কোনো কারন ছাড়া টাকা চাওয়া, কোনো কারন ছাড়া অহেতুক কাজে ফাকি দেওয়া, কিংবা কাজ না করিয়া কোনো বড় দায়িত্ত পাওয়া, আবার বড় দায়িত্ত পাইলেও তাহাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করিয়া কাজে ফাকি দেওয়া ইত্যাদি।
অন্যদিকে সম্ভবত আমার মেয়েও রানার উপর বেশ কিছু অযথা মাতাব্বরীর উপর বিরক্ত হইতেছিলো। এই বয়সের মেয়েরা যাহা চায় তাহা হইতেছে স্বাধীনতা, একটু রোমাঞ্চ, একটু বিলাসিতা। কিন্তু রানার মধ্যে এই সব কিছুরই চরম অভাব ছিলো। ইহার একটা কারন ছিলো বৈকি। রানা ছোট হইতে বড় হইয়াছে তাহার মায়ের আচল ধরিয়া। তাহার মা তাহাকে ঐ রান্না ঘরের চার দেওয়ালের বাইরে কি থাকে, কি ঘটে, কিংবা বাস্তব কি, তাহার কোনো কিছুই শিক্ষা দেয় নাই, দিতেও চায় নাই। ফলে রানা তাহার মা যাহাই বলিবে সে তাহাই সঠিক বলিয়া এক বাক্যে মানিয়া লইবে। উহা অন্যায় না ন্যায় নাকি বাস্তব নাকি অবাস্তব তাহা যাচাই করিবার তাহার কোনো অভ্যাস যেমন ছিলো না, তেমনি সে উহা লইয়া দ্বিতীয়বার মাথাও ঘামাইতো না। ভালোবাসা কি, রোমাঞ্চ কি, স্বাধীনতা কি কিংবা বন্ধুবান্ধব কি ইহার কোনো জ্ঞান তাহার মধ্যে ছিলো না। বয়সের তুলনায় সে এতোটাই অপরিপক্ক ছিলো যাহা আমি কিংবা আমার পরিবার বুঝিতে পারি নাই। যে বয়সে মানুষের যতোটুকু জ্ঞান হইবার দরকার, তাহা হইতে রানা অনেক পিছাইয়া ছিলো। এইসবের কারনে আমার মেয়ে ধীরে ধীরে মনে হয় রানার সঙ্গ হইতে বাহির হইবার জন্য চেষ্টা করিতেছিলো। কিন্তু আমার মেয়েও ছোট বলিয়া আমরা তাহাকেও পরিপক্ক মনে করিতাম না। ভাবতাম, সে হয়তো ইমোশনাল বা আবেগী।
একদিন রানার পরিবার আমাদেরকে আমার মেয়ের আর রানার সম্পর্ক কিভাবে কি করা যায়, এইটা নিয়া কথা বলিবার জন্য তাহাদের হক গার্ডেনে দাওয়াত করিলেন। যেহেতু আমি রানাকে ধীরে ধীরে চিনিতে শুরু করিয়াছিলাম, আবার এইটাও মনে হইতেছিলো যে, এখন ছোট বয়স, হয়তো আমার সাথে আমার গাইড পাইলে ধীরে ধীরে ঠিক হইয়া যাইবে। ব্যাপারটাকে আমি এইভাবেই নিয়াছিলাম। আমরা নীতিগতভাবে সম্পর্কটা মেনে নিলাম, তবে যেহেতু ওরা দুইজনেই এখনো পড়াশুনারত, ফলে পড়াশুনা শেষ না হওয়া অবধি আমরা ওদেরকে কোনো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না করার জন্যই একমত হইলাম।
কিন্তু আমার মেয়ে ধীরে ধীরে সম্ভবত রানার আভ্যন্তরীন চরিত্র, তাহার মানসিকতা, তাহার দায়িত্ববোধ বিবেচনা করিয়া তাহার উপর বিরক্ত হইতে লাগিলো। যেহেতু এখনো কোনো কিছুই করা হয় নাই, না এঙ্গেজমেন্ট, না আকত, ফলে আমার মেয়ে যেমন স্বাধীন ছিলো, তেমনি এখানে কোনো সম্পর্ক না হইলেও কিছুই যায় আসে না এটা ভাবিয়াই আমার মেয়ে ধীরে ধীরে রানার কাছ হইতে দূরে সরিয়া যাইবার উপক্রম হইতেছিলো। শুধু তাহাই না, সে তাহার বন্ধু মহলেও এইটা নিয়া বিস্তর আলাপ চারিতায় অভিজ্ঞতা নিতেছিলো। আমার মেয়ের এই পরিবর্তনটাও আমার চোখে পড়িয়াছিলো। যুগ খারাপ, সমাজ ব্যবস্থা এখন আগের থেকে অনেক দ্রুত পরিবর্তনশীল। তাই কে কিভাবে কোন আংগিকে কোন পরিকল্পনা করিয়া আমার এই সুখী এবং স্ট্যাবল পরিবারে আমাদের মেয়েদের বদৌলতে ঢোকিয়া পড়িবে এই আশংকায় আমিও আমার মেয়ের ধ্যান ধারনায় পজিটিভ হইতে পারিতেছিলাম না যেহেতু আপাতদৃষ্টিতে রানার পরিবারকে আমার অনেক ভালো পরিবার বলিয়া মনে হইতেছিলো। কোনো পরিবারই ১০০% পারফেক্ট নয়। তাই কিছু ভুলত্রুটি সহই আমি রানার পরিবারকে মানিয়া লইয়াছিলাম। রানা এবং রানার মা আমার মেয়ের এই দ্রুত পরিবর্তনে তাহারা আমার মেয়েকে হাতছাড়া হইয়া যাইবে এইরুপ একটা আশংকা করিতেছিলো। ফলে সবকিছু শেষ হইয়া যাইবার পূর্বেই হটাত করিয়া একদিন রানার মা, রানার বাবা, আর রানা আমাদের বাসায় মিষ্টিসমেত আসিয়া হাজির। তাহাদের কাছ হইতে আমাদেরকে এইরুপ একটা প্রোপজাল দিয়া বসিলেন যে, বাচ্চারা লেখাপড়া করুক, তাহাতে কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু কিছু একটা করিয়া রাখা ভালো। অর্থাৎ আকত জাতীয় কিছু একটা।
আমার মেয়ে ইতিমধ্যে নিজের সাথে বুঝাপড়া করিয়া সে একটা জায়গায় উপনীত হইতে পারিয়াছিলো যে, রানা আমাদের পরিবারের জন্য যোগ্য পাত্র নয়, আর আমার মেয়েরও এখন আর তাহাকে ভালো লাগে না। সে বাকিয়া বসিল। আমরা তখনো রানার চরিত্র সম্পর্কে অতোটা বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই যতোটা আমার মেয়ে বুঝিতে পারিয়াছিলো। কিন্তু যখনই কোনো প্রশ্ন করি কি কারনে রানাকে তাহার আর ভালো লাগে না, কিংবা কি কারনে সে আর রানাদের পরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক করিতে চাহে না, সে প্রশ্নের উত্তর আমার মেয়ে আমাদেরকে ঘুছাইয়া বলিতেও পারে না। ফলে আমাদের মধ্যে বিস্তর একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিংই রহিয়া গেলো। আমরা আমার মেয়েকে অনেক জোর জবরদস্তি করিয়াই বিবাহে রাজি করাইলাম। এইরুপ জোর জবরদস্তি করা হয়তো আমার অন্তত ঠিক হয় নাই। আমি কোনো অবস্থাতেই আমার মেয়েকে আমি জোর জবর দস্তি করিতাম না যদি সে আমাকে সঠিক কারন গুলি বলিতে পারিতো। যাই হোক, আমি রানাকে আর রানার পরিবারকে সত্যি অনেক ভালোবাসিয়াছিলাম বলে ভাবিয়াছিলাম, তাহাদের যাহা নাই, তাহা আমার আছে, আর আমার যাহা নাই, তাহা আমি উম্মিকার সাথে রানার বিবাহ দিলে সেই অভাবটা আমার পুরুন হইবে।
সোনার ডিম পাড়া মুরগীকে কেউ সোনার মুকুট পড়ায় না। এটা হয়তো ওরা বুঝে নাই। ওরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সপ্ন দেখছিলো, কিন্তু আমি জেগেছিলাম। আমি সারাক্ষন ওদের এই সপ্নটা ব্যাখ্যা করার প্রক্রিয়ায় ছিলাম। ওরা আমাকে সিড়ি হিসাবে হিসাবে দেখেছিলো বটে পাশাপাশি আগুন নিয়েও খেলছিলো। ওরা আকাশে উড়তে চেয়েছিলো, ওরা হয়তো ভেবেছিলো, আকাশে আগুন লাগে না। কিন্তু আকাশে যখন আগুন লাগে, সেই আগুনে জ্বলে পড়ে ছাড়খাড় হয় মাটি আর শুকিয়ে যায় নদীর জল। আকাশের হয়তো কিছুই পূড়ে না। যখন কোনো পরিস্থিতি নিজের কন্ট্রোলে না থাকে, আর সেই পরিস্থিতি যখন কেউ অন্যের হাতে তুলে দেয়, তখন যেটা হয় তা হচ্ছে নিজের সর্বোনাশ।
রানার পরিবার আমাদের এই রকমের একটা পরিস্থির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলো যা আমার হাতের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিলো।