মুক্তার সাহেব একজন নামকরা শিল্পপতি, মোটামুটি বেশ ভালোই সবার কাছে পরিচিত। অন্যদিকে, আসমানী বেগমও স্বনামধন্য একজন প্রতিষ্ঠিত নারী। তাকেও সমাজের অনেকেই চিনেন এবং ভালো পরিচিতি আছে। অপরদিকে, সাবিত্রী অল্প বয়সের একজন নারী যার না ছিলো কোনো নামধাম, না ছিলো কোনো সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা। একজন গ্রাম্য এলাকার মেয়ে যে মুক্তার সাহেবের থেকেও প্রায় ৩০ বছরের ছোট। এই সাবিত্রীর সাথে মুক্তার সাহেবের পরকীয়া চলছে বলে চারিদিকে শোনা যাচ্ছে। আজকের ঘটনাবলী তার উপরেই।
আমি কেনো এই তদন্তটা হাতে নিয়েছিলাম সেটারও একটা কারন ছিলো। প্রায় ৩৩ বছর গর করার পর, সুখে শান্তিতে বসবাস করার পর, ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাওয়ার পরে কেনো এই পরিবারের মধ্যে এমন একটা রহস্য, সেটাই আমার জানার খুব শখ ছিলো। এই কারনেই আমি এই কেসটার ব্যাপারে উৎসাহী হয়েছিলাম। তবে একটা কথা সত্যি যে, মুক্তার সাহেবের সাথে একটা মেয়ের পরকীয়া চলছিলো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ৩৩ বছর একসাথে ঘর করার পর কি কারনে মুক্তার সাহেব আসমানী বেগমের অলক্ষ্যে একান্তে সময় কাটানোর জন্যে সাবিত্রীর সাথে গোপন প্রনয় শুরু করেন, সেই ইতিহাস না জানলে মনে হবে, হয়তো মুক্তার সাহেব আসলেই একজন চরিত্রহীন এবং দায়িত্বহীন কোনো এক সামাজিক কিট। সমাজে মুক্তার সাহেবই প্রথম ব্যক্তি নন যিনি ঘরে ভালোবাসার সুন্দুরী আসমানিদের রেখেও তার থেকে অনধিক সুন্দুরী বা অনধিক শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী এই সাবিত্রীদের সাথে প্রনয় করেন। কিন্তু অন্য সবার ব্যাপারে এই জাতীয় ঘটনা খুব মুখরোচক না হলেও, মুক্তার সাহেবদের এসব খবর যখন নড়ে উঠে, তখন অনেকে বাসীরুটিও গরম করে খায়। সবসময় গরম গরম পরোটাই যে মজাদার তা নয়, কিন্তু মুক্তার সাহেবদের মতো মানুষদের এসব ঘটনা চারিদিকে যখন রটায় তখন গরম গরম পরোটার চেয়েও এ ধরনের বাসীরুটির কদর অনেক গুন বেড়ে যায়। যখন মুখরোচক খবরের ক্ষিদে পায়, তখন রুটি, পরোটা, লুচির মধ্যে আর কোনো তফাত করা যায় না। কিন্তু মুক্তার সাহেবরা তাদের এই ঘটনার জন্য নিজ থেকে কোনো সংবাদের শিকার হতেও চান না। কারন, একদিনের মুখরোচক সংবাদ হবার জন্য কিংবা এই নশ্বর পৃথিবীতে জোরালোভাবে নামডাক থাকুক, ইতিহাস হোক, অথবা বিখ্যাত হোক এ লোভে কেউ এসব কাহিনীর নায়ক হতে চান না। এটা তো ঠিক যে, এই ‘বিখ্যাত হবো’ ধরনের ক্ষুধার জন্য কেউ সারা জীবনের তৈরী করা বছরের শব্জীক্ষেত জালিয়ে দেয়ও না। পাশ্চাত্যের ব্যাপার স্যাপার আলাদা। আমাদের এই দেশে এটা মানান সই নয়। তারপরেও শব্জী বাগান জ্বলে। আর সেটা ভুলেই হোক, আর ইচ্ছায়ই হোক, কিংবা অন্য কারো দ্বারাই হোক, জ্বলতেই থাকে। আর এর প্রধান কারন একটাই, আবর্জনা যেমন সবসময় সাদা কাপড়েই বেশী ফুটে উঠে, তেমনি কিছু কিছু অপবাদও এই মুক্তার সাহেবদের মতো সাদা কাপড়েই বেশী চোখে পড়ে। হাওয়া যখন কারো নামে গরম হয়, তখন আমরা অনেকেই বলি, শনির দশা চলছে। কিন্তু শনি এমন এক হাওয়ার নাম, যে, এই হাওয়ায় কারো নাম ভাসতে থাকলে তার পিছনের কি ইতিহাস, কি আচরন, সত্য-মিথ্যার চকলেটে মোড়ানো বোরহানীর মতো ঝাল-মিষ্টি-টক সবকিছুই তখন একসাথে যেনো উড়ে বেড়ায়। যে যেটা পছন্দ করে, তখন সে সেটাই ব্রেকিং নিউজের মতো যতো দ্রুত সম্ভব বাতাসের সাথে মাটিও গরম করে দেয়। তখন চায়ের কাপে, বাজারের দোকানে, কিংবা নদীর ঘাটেও এর পরিব্যপ্তি আর বিস্তার কম হয়না। আর যে বলীর পাঠা হয়, তার যত নাম ডাকই থাকুক না কেনো, তখন সে হয়ে উঠে বিষাক্ত খাবার। আর সেই খাবার যতো দামিই হোক, তা ফেলেই দিতে হয়। যদি তা গোড়া থেকে উপড়ে ফেলে না দেওয়া যায়, তখন তার মুল্য শুধু বিপদের আশংকাই বাড়িয়ে দেয় তা নয়, সেটা সমাজে একটা আইনের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু মুক্তার সাহেবের মতো ব্যক্তিত্তকে বিষাক্ত খাবার মনে করে আসমানী বেগমেরা তাকে ফেলেও দিতে চান না। তারা চান, কিভাবে এই বিষাক্ত খাবার আবার সিদ্ধ করে পুনরায় ঝলমলে পরিপাটি খাবারের টেবিলে পরিবেশন করা যায়। তাই হয়তো এমন গুরুতর অভিযোগের পরেও আসমানী বেগম চান যে, মুক্তার সাহেব ফিরে আসুক, আর সাবিত্রীরা ধংশ হোক। তাতেই হয়তো আসমানী বেগমেরা খুসি।
এসব পরকীয়ার কাহিনীর সাথে সাথে যেহেতু সে ব্যাক্তির পিছনের ইতিহাস, তার আচরন নিয়ে রমরমা পান্ডুলিপি এক হাত থেকে আরেক হাতে ছড়ায়ই, তাই এই মুক্তার সাহেবের অতীত ইতিহাস, কিংবা তার আচরন সম্পর্কে তার কাছ থেকেই জানা ভালো। এতে হয়তো কিছুটা রাখঢাক থাকতে পারে অথবা থাকতে পারে কিছু প্রচ্ছন্ন লুকানো তথ্য। সিংহভাগ তথ্য যখন একে একে সারিবদ্ধভাবে জোড়া লাগানো হবে, আমরা নিজেরাই বুঝতে পারবো, কোথায় কোন জায়গায় মুক্তার সাহেব কিছু ছেড়ে গেলেন, আর কোথায় কোন তথ্য নতুন করে আমদানী করলেন। সঠিকতার বিচার পাঠকের উপর। যে যেভাবে পারেন, তিনি তারমতো করে সেসব গড়মিল জায়গাগুলি নিজের মতো তথ্য যোগ করে প্রতিস্থাপন করলেই পূর্নাজ্ঞ গল্পটি নিজের মানসপটে ফুটে উঠবে। তাহলে শুনি তার নিজের মুখে দেয়া বিচারকের কাছে দেয়া তাঁর পরকীয়ার জবানবন্দী। বিচারকের পক্ষে আমিই সেই ব্যক্তি যে মুক্তার সাহেবের জবানবন্দী রেকর্ড করেছিলাম।
মুক্তার সাহেবের জবান বন্দি
-আমার বয়স তখন সবেমাত্র কুড়ি পেড়িয়েছে। টকবকে যুবক। স্বাধীনতা বলতে যা বুঝায় ঠিক সে রকম। সব প্রকারের মানসিকতা নিয়েই আমি সমাজের প্রতিটি স্তরে অনায়াসেই যাতায়ত করতে পারি। সবার সাথেই ছিলো আমার বন্ধুত্ত। গাজার আসরে যেমন আমি ছিলাম মুক্তার মতো, তেমনি পড়াশুনায় ভালো করার কারনে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তদের কাছে ছিলাম মুক্তার হারের মতো। আর নিম্নবিত্ত মানুষদের কাছে যতোটা না ছিলাম আদর্শগত মডেল তার থেকে বেশী ছিলাম গোপন হিংসার একটা অদেখা আলাপের বিষয়বস্তু। কোনো এক সময়ের জমিদার বাড়ির সন্তান যখন নিম্নবিত্ত পরিবারের মতো বেড়ে উঠে, তখন তার প্রাচীন উদ্ধত্তভাবের সাথে দেমাগ আর জিদটা হয়তো বেচেই থাকে যদিও সামর্থ বলতে কিছুই থাকে না। আমার ছিলো সেরকমের একটা জিদ আর দেমাগ। লেখাপড়ার প্রতি অনেক ঝোক ছিলো আমার, তাই, গ্রামের আর দশটা যুবকের থেকে আমি ছিলাম একেবারেই আলাদা। অদুর অতীতে কি ছিলো আর ওসব থাকলেও এখন কি হতে পারতাম, এই চিন্তাটা মাথায় একেবারেই ছিলো না, বা না ছিলো কোনো আফসোস যে, কেনো অন্যদের অনেক কিছু আছে আর আমাদের নাই। কিন্তু আখাংকা ছিলো অনেক, যেভাবেই হোক নিজের পরিশ্রমে সৎপথে অনেক বড় কিছু হবার। শুনেছিলাম, সুন্দুরী অনেক যুবতীর সফলতা বড় লোকের বেডরুম দিয়ে আসলেও কোনো যুবকের সফলতা কোনো বড় লোকের ঘরজামাই থেকে আসে না। আর যাদের আসে, তারা হয় নেহায়েত ভাগ্যবান নয়তো তারা জীবনের জন্য আজীবন মৃৎপ্রায় লাশের সব শর্তাবলী গলায় নিয়েই ভোগবিলাস করেন। আমার এই ধরনের না ছিলো কোনো মানসিকতা আর না ছিলো এর সুযোগের সন্ধান।
২১ বছর বয়সেই আমি আমার মেধার কারনেই হোক আর শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাইয়েই হোক, আমি দেশের একটি অত্যান্ত প্রতিষ্ঠিত এবং সম্মানজনক সেক্টরে অফিসার পদে চাকুরী পেয়ে যাই। যদিও আমার অন্যান্য সেক্টরে চাকুরী পাবার সম্ভাবনা ছিল আরো ঢের বেশী এবং সেসব সেক্টরেও প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হবার জন্য যে কোর্ষ এবং ডিগ্রী দরকার তার সিলেকসনেও আমি ছিলাম অনেকের থেকে অনেক উপরে। কিন্তু সেই সিলেকশনের পর কোর্ষ চালিয়ে যাবার মতো মসলা বা জোগান হাতে ছিলো না যা বর্তমান সেক্টরে সরাসরি পাওয়া যায় বিধায় আমাকে অনেক সিদ্ধান্ত নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেও পালটাতে হয়েছে। ফলে অন্যান্য সেক্টরের সপ্ন বাদ দিয়ে আমি বর্তমানকেই প্রাধান্য দিলাম যাতে আমি নিজেকে সাপোর্ট দিতে পারি এবং জীবন নিজের মতো করে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। একটা জিনিষ আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে, মাথার উপর ছাদ না থাকলে, যে দুফোটা বৃষ্টি আকাশ থেকে প্রথমেই ঝরে পড়ে, সেটা আমার মাথায়ই প্রথম পড়বে। আমার না ছিলো কোনো ব্যাকআপ সাপোর্ট, না ছিলো কোনো অবলম্বন। আমাকে কেউ সাহায্য করারও নাই। এখন না হয় আমি একা, পরিবার হয় নাই, বিয়েটাও করি নাই, ফলে দুশ্চিন্তা হয়তো একটু কম, কিন্তু কখনো যদি আমার পরিবার হয়, সন্তান হয়, তখনো আমি জানি, আমাকে দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার অসময়ে বা দুঃসময়ে সাহাজ্য করার কেউ নাই। এই কঠিন বাস্তবতাটা আমার মাথায় এমনভাবে গেথে গিয়েছিলো যে, আমার কখনো ভুল হয়নি এটা ভুলে যাবার যে আমি একা। আমার বিকল্প আমিই, আর কেউ নয়। এ সত্যটা আজ অবধি সত্যই।
এই অবস্থায় আমার সাথে দেখা হয় এই আজকের আসমানীর। কথা থেকে চিঠি, চিঠি থেকে আরো ঘনিষ্ঠতা, আর সেই ঘনিষ্ঠতা থেকে একসময় প্রনয়। আমার কিংবা আসমানীদের পরিবারের অনেকেই আমাদের এই ঘনিষ্টতা পছন্দ করে নাই। এখানে আরেকটা কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে, আমি কিন্তু এতিম ছিলাম না। আমারো মা ছিলো, ভাই ছিলো, বোনও ছিলো, ছিলো শুভাকাংখিও। কিন্তু তাদের অবস্থা এরকম নয় যে, আমার কোনো প্রয়োজনে হাত বাড়িয়ে কোনো আর্থিক সহায়তা করতে পারবেন, আমার পাশে দাড়াতে পারবেন বরং তারা তাদের আর্থিক দুরাবস্থার কারনে আমার দিকেই যেনো তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু এসব শুভাকাংখির একটা বড় সমস্যা হলো যে, নিজেরা কোনো কিছু সাহাজ্য করতে না পারলেও, তারা বিজ্ঞের মতো এমন কিছু মতামত, বা উপদেশ দেন যেনো ওরাই না জানি আমার অভিভাবক বা তাদের পরামর্শ না শুনলে আমার জন্য একটা বড় অপরাধ কিংবা ঘোরতর বিপদের আশংকা আছে। কিন্তু ওই যে বললাম, আমি বরাবর স্বাধীনচেতা মনের মানুষ, আর আমার চিন্তাধারার সাথে কারো চিন্তাধারা মিলুক বা না মিলুক সেটা আমার কাছে বড় কোনো বিবেচ্য বিষয় ছিলো না। আমি শুধু ভাবতাম, আমার সমস্ত কিছুর জন্য আমিই দায়ী। হোক সেটা উত্থানের বা পতনের। আমার উত্থানে হয়তো তখন তারা তাদের ভুল পরামর্শের কারনে চুপ থাকবেন, না হয় আমার পতনের কারনে তারা আরো কিছু শুনিয়ে দেবেন যে, তাদের পরামর্শ না শোনার কারনে আজ আমার এতো অধোপতন। কিন্তু এটাও জানি, সেই অধোপতন থেকে আবার আমাকে টেনে বের করে কোনো এক সঠিক রাস্তায় দাড় করিয়ে দেবার মতো তাদের না আছে সামর্থ বা না আছে কোনো মানষিকতা।
আসমানীর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হবার পর আমি নিজেও বুঝতে পারলাম, আমার অবস্থা থেকে আসমানীর অবস্থা আরো গুরুতর। আমি ছেলে মানুষ, কোনো না কোনোভাবে হয়তো অনেক কিছুই পার পেয়ে যাবো। কিন্তু আসমানী মেয়ে মানুষ, তার অবস্থা আরো শোচনীয় থাকায় তার অবস্থা আরো বিপদজনক। তারও না আছে তেমন শক্ত কোনো অভিভাবক, না আছে বাবা, না আছে এমন কেউ যাকে নির্ভর করে সে তার মেয়েলী জীবনের একটা সুখের স্বপ্নের কথা ভাবতে পারে। তার শুধু একটা ভরষাই ছিল। আর সেটা হলো আগত ভবিষ্যতে তার স্বামীর উপর। তার চাওয়া পাওয়া, আবদার, আর যতো অভিমান যেনো লুকায়িত আছে সেই স্বামীকে ঘিরে। আসমানী এটাও জানতো যে, জীবনে এই আদর্শগত স্বামী পেতে হলে তাকেও একটা লেবেল পর্যন্ত যেতে হবে, বিশেষ করে পড়াশুনার দিক দিয়ে। তাই, আসমানীর লক্ষ্য যেমন ছিলো ভালো একটা জীবনের জন্য, তেমনি লক্ষ্যকে সফল করার জন্য তাকে এই সমাজ সংসারে এমন করে পরিশ্রম করতে হবে যেখানে সবচেয়ে কম খরচে সবচেয়ে ভালো কিছু করা যায়। সরকারী ইউনিভার্সিটি হলো সেই লক্ষ্যভেদের একটা সহজ কৌশল। আসমানি তার পূর্ন সদ্ব্যবহার করেছিলো। ফলে একদিকে আসমানী লেখাপড়া চালিয়ে যেতে লাগলো অন্যদিকে আমাকেও সে ধরে রাখলো।
একটা সময় এলো যে, আমি আর আসমানী একা একাই জীবনসাথী হয়ে গেলাম। আমি আসমানীকে আমার জীবনের বাইরে কখনো ভাবি নাই। আর এই ভাবার মধ্যে ব্যাপারটা এমন ছিলো যে, আমার মতো আসমানীরও কেউ নাই। আমিই আসমানীর দেবতা, আমিই আসমানীর আত্তা, আমিই আসমানীর সর্বত্র। ওর রাগ অভিমান, চাওয়া পাওয়া, সুখ আহলাদ, হাসি কান্না, সবকিছুই আমি। আর আমার বেলায়ও আমি জানি কাউকে আমার কষ্টের কথা, ব্যাথার কথা, কিংবা পরিকল্পনার কথা আসমানিকে ছাড়া কারো সাথেই শেয়ার করা সম্ভব ছিলো না। আমরা আসলে আক্ষরীক অর্থেই অর্ধাংগিনি রুপে একে অপরের জন্য স্থির হয়ে গেলাম। ভাবলাম, একদিন আমাদের সব ঠিক হয়ে যাবে, আমরা সব কিছু আমাদের মতো করেই তৈরী করবো।
মুক্তার সাহেব কিছুক্ষনের জন্য থামলেন। একটা দীর্ঘশাস ছাড়লেন। কিছুক্ষন চুপ করেও রইলেন। আমি বুঝলাম, তিনি ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছেন। তারপর আবার শুরু করলেন-
আমরা সবাই সুকী হতে চাই।
-একটা জিনিষ জানেন? আমরা সবাই সুখী হতে চাই। ভাবি, ‘একদিন’ আমরা সুখী হবোই। এই “একদিন”, অদ্ভুত একটা সময়। সবসময় আমরা ভাবি, ‘একদিন’ আমার সবকিছু আমার মতো করে হবে, ‘একদিন’ আমি সবকিছু নিজের মতো করে পাবো, ‘একদিন’ আমি সবকিছু ছেড়ে নিজের মতো করে এই পৃথিবীকে দেখবো, দেখবো এর বিশালত্ব, এর সউন্দর্য, এর অপূর্ব রহস্যময়তা। কিন্তু আমি জানি না কবে সেই আমার ‘একদিন’। আমি জানিও না আমার সেই ‘একদিন’ আসলে কবে সেইদিন। আমি কিভাবে জানবো, সেই ‘একদিন’টা কবে আসবে আমার জীবনে? ছোট এই সমাজে যেখানে আমরা দৈনিন্দিন সবাইকে নিয়ে বসবাস করি, আমরা সেখানে চাইলেই সবকিছু করতে পারি না। শিশুকাল থেকে কৈশোর পার করা অবধি আমরা সবাই ওই ‘একদিন’ এর অপেক্ষায়ই থাকি যেদিন আমার সব ইচ্ছা পূরন হবে, আমি মুক্ত পাখীর মতো এই বিশাল আকাশে হাওয়ায় উড়ে উড়ে মেঘ দেখবো, নীচের সবুজ গাছপালা দেখবো, সাগর দেখবো, পাহাড় দেখবো। কিন্তু ক্রমেই যতো একেকটা স্তর পার করে যখন আরেকটা স্তরে পা রাখি, ততোই সামনে চলে আসে কোনো না কোন দায়িত্ব, কোনো না কোনো নতুন আরেকটা চ্যালেঞ্জ। সেটাকে মোকাবেলা করতে করতেই জীবনের বেশ কয়েকটি স্তর, ধাপ পার হয়ে যায়। আমাদের কারোই সেই ‘একদিন’ সময়টা যেনো আর আসে না। আজ আমরা নিজের সংসারের জন্য বাচি, কাল আমরা স্বামী বা স্ত্রীর জন্য বাচি, তারপর হয়তো সন্তানের জন্য বাচি, আর এভাবেই সামাজিক, পারিবারিক ইত্যাদির দায়বদ্ধতা আর জীবনের তাগিদে আমরা ক্রমশই জীবন নামক নদীতে শুধু ক্লান্ত হয়ে ভাসতেই থাকি। আর ভাবী, নিশ্চয় ‘একদিন’ আমার সব চ্যালেঞ্জ, সব ক্লান্তি কিংবা সব ঝামেলা শেষ হবে, আর তারপর ‘একদিন’ আমার আর কোনো ঝামেলা, সমস্যা কিংবা আমার সুখের নিমিত্তে কোনো বাধা থাকবে না। সেই ‘একদিন’ নিশ্চয় আমি আমার মতো করে সারা দেশ ঘুরতে পারবো, পার্টিতে নাচতে পারবো, পাখীর মতো যেদিকে খুশী মনের আনন্দে উড়ে বেড়াতে পারবো। কিন্তু আমার সেই ‘একদিন” যেনো আর কখনোই আসে না। বারবার কোনো না কোনো বাধা এসেই দাঁড়ায়। আসলে এই ‘একদিন’ কখনোই আমাদের জীবনে আসে না। কিন্তু যদি জীবনের সবসুত্র, সব মায়াজাল, সব জটিল সমীকরন ছিন্ন করে প্রকৃতির সাথে চলমান ধারাবাহিকতায় সার্থপরের মতো দেখি, তাহলে এটাই চোখে পড়বে যে, আসলে, ‘একদিন’ হচ্ছে আজকের এইদিন, আজই। এই আজকের দিনটাই আসলে আমার সেই ‘একদিন’। আজকের দিনটার জন্যই আমি বাচি। আজকের দিনের পর হয়তো আমার জীবনে আরো একটিদিন নাও আসতে পারে। তাহলে সেই আগামীর একদিনের জন্য আমি কেনো আজকের দিনটাকে বিসর্জন দেই? হয়তো আরো ‘একদিন’ আর কখনোই আমার জীবনেই আসবে না। আমার কাছে শুধু ‘একদিন’ই বাকী-আর সেটা আজ। যদি আমার সারাটা ক্যালেন্ডারেকে একটা একটা করে দিন ভাগ করে সিডিউল বানাই, দেখা যাবে, আজকের দিনটাই আমার বাস্তবতা। আর এই আজকের দিনটাই সেই ‘একদিন’। আর বাকী দিনগুলি আমার হাতেও নাই, আর যেগুলি চলে গেছে তাদের আমি কখনো ফিরিয়েও আনতে পারবো না। যেটা আছে আমার কাছে, সেটা আজ- আর এটাই সেই ‘একদিন’। তাই আমি শুধু আজকের দিনটার জন্যই বাচতে চাই। হাসতে চাই, খেলতে চাই, আকাশটা দেখতে চাই, বৃষ্টিতে ভিজতে চাই, পৃথিবীর সব গাছপালা, সব পাহাড় পর্বত, নীল আকাশ, সবকিছু দেখে প্রানভরে বাচতে চাই। আমি শুধু আমার জন্যই আজ বাচতে চাই। কালটা থাকুক আর সবার জন্য।
কথাগুলি বলার সময় মুক্তার সাহেব কেমন অন্য মনষ্ক হয়ে গিয়েছিলেন। যে মুক্তার সাহেব তাঁর অফিসে এতো বড় একজন মানুষ, সবাই তাকে যেমন সমীহ করে, তেমনি তাকে সবাই খুব কঠিন মানুষও মনে করে। অথচ আমার সামনে যিনি বসে আছেন, তাকে দেখে একবারের জন্য ও মনে হয় না তিনি ভিতরে এতো কঠিন একজন মানুষ। মানুষ কত বিচিত্র। মুক্তার সাহেবের এই ‘একদিন’ এর ভাবনাটা কি আমারো নয়? আমিও কি ঠিক এটাই ভাবি না? আমিও তো ভাবি, একদিন আমি সব পাওয়ার শান্তিতে শুধু রেষ্ট করবো, ঘুরবো, বেড়াবো, আনন্দ করবো। কিন্তু আমিও তো সেই ‘একদিনের’ নাগাল পাইনা। আসলেই তো, তাহলে আমার সেই একদিনটা কবে? মুক্তার সাহেব ঠিকই বলেছে, হয়তো সেই দিনটা আজই। কিন্তু আমি কি পারি ‘আজ’ ঠিক এই মুহুর্তে সব কিছু ছেড়েছূড়ে কোথাও একা চলে যাই? কিংবা সব কিছু ছেড়ে বেড়িয়ে যাই যতোদিন খুশি ততোদিনের জন্য? অভিনব অতৃপ্তির জীবনে এই ‘একদিন’ একটা মরিচিকা ছাড়া আর হয়তো কিছুই না। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত হয়তো আমরা এই ‘একদিন’ এর জন্যই বাচি কিন্তু সেই ‘একদিন’ কারো জীবনেই আসে না।
-যাই হোক, একটু ইমোশনাল কথা বলে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না। যেটা বলছিলাম, আসমানীর কথা।
-আমি আসমানীকে পেতে সবাইকেই ছেড়েছিলাম। আমি যে আমার পরিবারের সবাইকেই ছেড়েছিলাম তারা হয়তো কোনোদিন জানতেও পারে নাই কবে থেকে আমি তাদের মন থেকেই ছেড়ে পর করে দিয়েছি। এই ছেড়ে দেয়া আর পর করে দেয়াটা এমন ছিলো যে, না কারো সাথে আমার খারাপ সম্পর্ক, না কারো সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। কিন্তু সম্পর্কটা আছে। সম্পর্কটার চরিত্র এমন ছিলো যে, না আমি তাদের জন্য দায়িত্তশিল, না ওরা আমার জন্য। শুধুমাত্র আমার মা ছিলেন এই নির্বিকার সম্পর্কের বাইরে যিনি প্রকাশ্যেও আমাকে সাপোর্ট করেছিলেন এবং অপ্রকাশ্যেও। আসমানীর সাথে আমার সম্পর্ক স্থায়ী হবার পরে আমার একটাই লক্ষ্য ছিল, নিজেদেরকে সফল্ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। আর এই প্রতিষ্ঠার একটা বইশিষ্ঠ ছিলো। সেটা হলো যে, যদি কোনো কারনে আমার সব হোমওয়ার্ক শেষ না হয় এবং তারপুর্বেই আমার মৃত্যুবরন হয়, তাহলে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে আমার এই আসমানী। তাই যেভাবেই হোক, আমার বর্তমানকে কাজে লাগিয়ে আমার প্রথম দায়িত্ত হবে আসমানীকে সাবলম্বি করে তোলা। আমার পক্ষ থেকে যা যা করা দরকার সেটা আমার শক্তির পুরুটা দিয়ে এবং আসমানীর নিজের দক্ষতায় আমি সে চেষ্টায় ব্রত হয়েছিলাম। ওই যে আবারো সেই ‘একদিন’। ‘একদিন’ সব ঠিক হয়ে যাবের মতো।
-আসমানী আমার একটা প্রোজেক্ট। আমি আসমানীকে ঠিক সেভাবেই তিলে তিলে গড়ে তুলছিলাম। কিন্তু আমার একার আর্থিক সচ্চলতার উচ্চতা এমন ছিলো না যে, অচিরেই পাহাড়ের মতো একটা সাবলম্বি পরিস্থিতি তৈরী করে ফেলি। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, আমি আসমানিকে তার নিজের যোগ্যতায় গড়ে তুলতে সক্ষম হই আর সেই সক্ষমতায় আসমানিও একটা সরকারী চাকুরীর সুবাদে প্ল্যাটফর্ম পেয়ে যায়। আসমানীর এই প্লাটফর্মে আরো একটা বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়েছিলো আমার অন্যান্য আত্তীয়সজনের সাথে। যদিও আমার পরিবারের কারো সাথেই আমার তেমন সম্পর্ক টেকসই ছিলো না, তারপরেও আসমানীর চাকুরীটাকে অনেকেই সহজ করে মেনে নিতে পারে নাই। সবসময় তাদের অভিযোগ ছিলো, কেনো আমি আসমানীকে মহিলা হয়েও চাকুরী করার অনুমতি দিলাম, বিশেষ করে এই ইগোতে যে, স্ত্রীর রোজগারের উপর আমার ভরষা, স্ত্রীরা ঘরের বাইরে গেলে তাঁর চরিত্রস্খলনের সম্ভাবনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আসমানীর উপর আমার শতভাগ আস্থা ছিলো। আজকালকার ছেলেমেয়েদের লাইফ ষ্টাইলের মতো আসমানীর লাইফ ষ্টাইল ছিলো না। আজকাল ছেলেমেয়েরা ওদের জীবনটাকে টাইম পাস মনে করে আর টাইম পাসকে জীবন মনে করে। কাল পর্যন্ত যে গার্লফ্রেন্ড ছিলো আজ সে বোন, আর আজ যে বোন সে কাল হয়ে যায় গার্লফ্রেন্ড। চোখের পলকে প্রেম হয়ে যায়, আবার চোখের পলকে প্রেম ভেঙ্গেও যায়। আসমানির চরিত্র কখনোই এমন ছিলো না। আর আসমানীর উপর আমার সেই আস্থা একদিনে গড়ে উঠে নাই। তার মানসিকতা, তার ভালোবাসার গভীরতা আমাকে কখনো এটা সন্দেহ করার অবকাশ দেয় নাই যে, আসমানী কোনো না কোনো অবস্থায় তার নিজ গন্তব্য আর ভালোবাসা থেকে ছিটকে পড়বে। আর সে ছিটকে পড়েও নাই কখনো। বরং ছিটকে পড়েছিলাম আমি।
-খুব ভালোভাবেই চলছিলো আমাদের। আমাদের সন্তান হলো, সংসারে খরচ বাড়লো বটে কিন্তু দুজনের মিলিত চেষ্টায় আমাদের অন্তত প্রাত্যাহিক জীবন ধারনের নিমিত্তে কোনো দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছিলো না। আমরা ধীরে ধীরে আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে শুরু করলাম। ওইযে বললাম, আমার মাথা থেকে কখনো এটা সরে যায় নাই যে, আমার অবর্তমানে আমার নিজস্ব পরিবার যেনো থাকে সুরক্ষিত এবং সাবলম্বি। সেই লক্ষ্যটা আমার কোনোদিন বিচ্যুত হয় নাই। আগে শুধু আসমানীকে নিয়ে ভাবনা ছিলো, এখন তাঁর সাথে যোগ হলো আমার সন্তানেরা। তাই তাদের স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বাড়ি, নিরাপদে চলার জন্য গাড়ি, কিছু স্থায়ী আর্থিক উৎস যা যা লাগে আমি সেটার ব্যবস্থা করছিলাম। সময়ের সাথে সাথে সেটা আসলেই একটা স্থায়ী রুপও নিয়েছিলো। আর এই লম্বা সময়টার দৈর্ঘ ছিলো প্রায় ২৫ বছর। এই ২৫ বছরে আমি চড়াও উতড়াই পার হয়েই এখানে এসেছি। কেউ আমাকে সাহাজ্য করে নাই। না আমি কারো সাহাজ্যের জন্য পথ চেয়েছিলাম। এখন আমার আসমানি জানে সে সাবলম্বি, আমিও জানি আমার আসমানি সাবলম্বি। সে নিজে নিজে চলতে পারবে। তার একটা স্থায়ী আর্থিক উৎস আছে। এই বিশাল অবস্থানটা করতে আমাকে আমার জীবনের বহু মুল্যবান সময় পার করতে হয়েছে বটে কিন্তু এরই মধ্যে আমি আমার যৌবন পেরিয়ে মধ্য বয়স্ক পুরুহীতে পরিনিত হয়ে গেছি। আমি অনেক খুসী।
কিন্তু তারপর…।
এই পর্যায়ে এসে মুক্তার সাহেব একটা বেনসন এন্ড হেজেস সিগারেট ধরালেন। জবানবন্দি নেবার সময় আমরা মুক্তার সাহেবকে সর্বপ্রকার সুযোগ দিয়েছিলাম যাতে তিনি সাবলীল্ভাবে তাঁর মনের কথা বলতে পারেন। তিনি এককাপ কফি চাইলেন, এবং কফির কাপে চুমু দিলেন। তারপর আমাকে তিনি প্রশ্ন করলেন- বলুন তো, একটা মানুষের জীবন সুখী হয় কি কি জিনিষ থাকলে?
আমি বললাম, টাকা থাকলে, সম্পদ থাকলে, সমাজে একটা ভালো পজিসন ইত্যাদি থাকলে আর যদি শরীর সুস্থ থাকে, তাহলে তো সে সুখী মানুষ বলেই গন্য হয়।
মুক্তার সাহেব একটু মুচকী হাসলেন। তারপর বললেন,
-তাহলে কি আপনি বলতে চাচ্ছেন, রাস্তায় যে সব মানুষ ভিক্ষা করে, তারা কেউ সুখী নয়? কিংবা যাদের এক ফোটা সম্পদ নাই, তারা কি সুখী নয়? অথবা সমাজে যারা অনেক বড় বড় পজিশন নিয়ে বাস করেনা, তারা কি সুখী নয়? অথবা যদি বলি, বিছানায় অবশ হয়ে পড়ে থাকা সব মানুষই কি দুখী? তারা কি কোনো না কোনো স্তরে সুখী না? যদি এমন হতো যে, টাকা আছে, পয়সা আছে, অঢেল সম্পদ আছে, সমাজে মানসম্মান প্রতিপত্তি আছে আবার শারীরকভাবে সুস্থও আছে, তারা তাহলে কিসের নেশায় নিজের ঘরে থাকা সুন্দুরী স্ত্রীকে রেখে পুনরায় পরকীয়ায় মেতে উঠেন? সবাই কি পারভার্ট? নাকি যৌনতাই প্রধান? অথবা যদি বলি যে, ৯০ বছরের এক বৃদ্ধ যখন তার অঢেল টাকা পয়সা ব্যাংক ব্যালেন্স থাকার পরেও নিজের ৮৫ বছরের স্ত্রীর বিয়োগে আরেকটা বিয়ে করতে মানিসকভাবে প্রস্তুতি নেন, যখন তার যৌনতায়ও কোনো ক্ষমতা নাই, সে তাহলে এটা কিসের নেশায় করে? আমি অবিশ্বাস করছি না যে, সবক্ষেত্রেই আমার এই প্রশ্ন সঠিক বা সঠিক নয়, তবে এর অন্তরনিহিত গুর রহস্য খুজতে গেলে দেখা যাবে, এসবের কোনটাই এর উত্তর নয়। উত্তর লুকিয়ে আছে শুধুমাত্র না দেখা একটা অনুভুতিতে। আর সেটা হচ্ছে- একাকীত্ত বা নন একোম্প্যানিয়ন।
আমি কিছু বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু মুক্তার সাহেব তার হাতের ইশারায় আমাকে থামিয়ে দিয়ে আবার বলতে লাগলেন-
-হ্যা, হয়তো আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, এই একাকীত্ত কি বা এই নন-একোম্প্যানিয়ন এর মর্মার্থ কি। এটা বুঝবার জন্য আপানাকে কিছু সুক্ষ জিনিষের ভিতরে ঢোকতে হবে। আর সেটা হচ্ছে-অনুভুতি, আবেগ, তার সাথে মানবিক চাহিদা। মানবিক চাহিদার সাথে শারীরিক চাহিদার একটা যোগসুত্র থাকতে পারে যা আমি পরে বল্বো। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি আপনাকে ছোট একটা উদাহরন দেই। কখনো কি উপলব্ধি করেছেন যে, A person can be lonely in a crowdy city? অথবা কখনো কি ভেবেছেন যে, an one-month infant baby who has no idea about the world or even does not know how to talk, does understand our any language, can be a good accompanist as well!! অর্থাৎ একটা কোলাহলপুর্ন জনসমুদ্রের মধ্যেও কেউ একা। আশেপাশে হাজার হাজার লোক ঘুরছে, ফিরছে, খাচ্ছে, তামাশা করছে, আনন্দ করছে অথচ কোনো একজন এই ভীড়ের মধ্যেও একা। আবার অন্যদিকে দেখবেন, অনেক আপন লোকজন আপনার আশেপাশে আছে, কথা শুনার মতো লোকজনও আছে, কিন্তু তাদের থেকে আপনার কাছে মনে হবে একটা অবুঝ বাচ্চা যে কথাই বলতে শিখে নাই, যে আপনার কথার আগামাথা কিছুই বুঝে না, তারসাথেও আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারছেন। আপনি তাঁর কাছে একা নন। সে যেনো আপনার একাকীত্তের একজন ভালো সাথী। তার সাথে আপনি বিজ্ঞান নিয়ে আলাপ করতে পারেন, মহাকাশ নিয়া আলাপ করতে পারেন। হয়তো সে এসবের কিছুই বুঝে না। আপনি একাই তাঁর সাথে অনর্গল কথা বলে সময় অতিবাহিত করতে পারবেন। সে হয়তো কখনো কোনো কারন ছাড়াই কেদে দেবে, কখনো সে চার হাত পা নেড়ে নেড়ে কি জানি ভাব প্রকাশ করবে যার সাথে আপনার বিষয়বস্তুর কোনো মিল নাই, অথচ আপনি খুব ভালো সময় কাটাচ্ছেন। এই নবজাতক এক মাসের বাচ্চাটাও আপনার খুব ভালো সংগি হয়তো। এই অনুভুতি কি বুঝেন? আর এখানেই মানুষের সুখ এবং সাথীর সাথে আপনার চিরবন্ধন। এই বন্ধন থেকে আপনি কখনোই টাকার বিনিময়ে, সম্পদের বিনিময়ে, কিংবা আপনার সামাজিক উচ্চতার মাপকাঠিতে মুক্ত হতে পারবেন না। যতো বিপদই আসুক, যতো খারাপ সময়ই আসুক, এই বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায় না।
মুক্তার সাহেবের এই যুক্তি বুঝতে আমার বেশ অনেক সময় লেগেছিলো। হয়তো আমি আমার ছোট এই মস্তিষ্কে ব্যাপারটা তখনো ধারন করে উঠতে পারি নাই। কিন্তু যখন তিনি তার কাহিনিটার প্রায় শেষে, তখন আমার একটা কথাই মনে হয়েছিলো যে, যখন কোনো মানুষের দুঃখ থাকে, কষ্ট থাকে, অথবা থাকে ভিতরের কিছু কথা যা বলার জন্য মন ছটফট করে, তাহলে সে সবসময়ই চাইবে যে, সে অন্য কারো সাথে তার এই দুঃখটা, কষ্টটা, কিংবা অনুভুতিটা শেয়ার করতে। কেউ তো থাকবে যে, ওর কথা শুনবে। বুঝুক বা না বুঝুক সেটা আলাদা ব্যাপার, কষ্ট লাগব করুক বা না করুক সেটাও আলাদা ব্যাপার। কিন্তু কারো সাথে তো তার এই ব্যাপারগুলি শেয়ার করা দরকার। যখন এই লোকগুলি আর কাছে বসে তাকে আর সময় না দেয়, কিংবা যদি এমন হয় যে, তার এই ব্যাপারগুলি সে কারো কাছে আর শেয়ার করতে পারলো না, তখনই সে অনুভব করে, সে একা। আর এই একাকিত্ত মানুষটাকে ‘সময়’ নামক দানব বা বাহক ধীরে ধীরে সবার থেকে আলাদা করে এমন এক জায়গায় নিয়ে যায়, যেখানে সে খোজে কে আছে তার এই আবেগগুলি শোনার? আর যে শুনবে, তারই জিত, আর যারা শুনবে না, তারাই আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় এই মানুষটার গন্ডি থেকে। সে যেই হোক, হোক তার স্ত্রী, হোক তার প্রানের সন্তান অথবা প্রিয় বন্ধুবান্ধব। অন্যদিকে, আরেকদল, যারা এই সুযোগ লুফে নেয়, সে যতোই অশিক্ষিত হোক বা অসুন্দর, কিংবা তুলনামুলকভাবে নিম্নধাপের, তাতেও কিছুই যায় আসে না, তারাই হয়ে উঠে তার মনের মানুষ, কাছের মানুষ। আর তাই বারবার তার এই একাকিত্তে ভোগা মন ছুটে যায় তাদের কাছে যারা তাকে সময় দেয়, দেয় একটা কম্প্যানিয়ন। আর সেই কম্পেনিয়নের মানুষদের মধ্যে যদি জেন্ডারের পার্থক্য থাকে, তখনই সেটাকে আমরা তৃতীয় নয়নে বলি ‘পরকীয়া’।
আমি মুক্তার সাহেবকে প্রশ্ন করলাম, তাহলে কি এমন একাকিত্তে আপনি ভোগছিলেন যেখানে শেষ অবধি মনে হলো যে, এই ৩৩ বছর একসাথে থেকেও আপনি আসমানীর থেকে একা? অথবা কি এমন কারন ছিলো যা আপনাকে সবার থেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিয়েছে এই সাজানো সংসার, পাতানো সুখী জীবন থেকে?
মুক্তার সাহেব আবারো মুচকী হেসে বললেন,
-কই নাতো? আমি তো এই সাজানো সংসার বা পাতানো জীবন থেকে সরে যাইনি। ওই যে আপনাকে আগেই বলেছিলাম যে, বলীর সব পাঠা সবসময় বিষাক্ত হয় না। আর যদি হয়ও, আর যদি পাঠাটাকে বলী দিতে গেলে অনেক বিপদের সম্ভাবনা থাকে, কিংবা অনেক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তাহলে সেই পাঠা বিষাক্ত হলেও তাকে কোনো না কোনোভাবে পুনরায় শুদ্ধ করে ঝলমলে পরিপাটি খাবারের টেবিলেই পরিবেশন করা হয়। আমিও ঠিক সেরকম ঝলমলে টেবিলেই এখনো আছি। তবে এই ‘আছি’র মধ্যে অনেক অংশ জুড়ে আছে আসলেই ‘নাই’ আর অনেক অংশ জুড়ে আছে কিছু দায়িত্তবোধ। আমি ‘আছি’ আর আমি ‘দায়িত্তে আছি’ এই দুয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। জেলখানায় বন্দি কয়েদির পাশে জেলখানায় বন্দি নয় এমন কোন এক মানুষ যখন বলে, ‘আমি আছি’ তোমার পাশে, এর মানে কি, সেটা তো আপনি নিশ্চয় বুঝেন। এর মানে, কখন তার কি করলে এই জেলখানা থেকে কয়েদির মুক্তি মিলবে তার একটা প্রতিশ্রুতি, অথবা অসুস্থ হলে দূরপাল্লা পথ অতিক্রম করে সে তখন চোখে জলভরা চাহনীতে আপনাকে দেখতে আসবে তার একটা নিশ্চয়তা, আপনার কষ্টে সে ব্যাথিত হবে, আপনাকে সে প্রতিনিয়ত মিস করবে ইত্যাদি। অথবা জেলখানায় বন্দি থাকা অবস্থায় সে আপনার একাকিত্তকে মিস করবে ইত্যাদি। কিন্তু সেই প্রহরী যে কয়েদির দায়িত্তে আছে, সেও কিন্তু কয়েদির পাশেই থাকে। কিন্তু তাঁর ভুমিকা নিশ্চয় এক নয়। কয়েদির দায়িত্তে থাকা প্রহরীর কাজ যেনো কোনোভাবেই এই বন্দিদশা থেকে কয়েদি পালাতে না পারেন, এটাই তার প্রথম দায়িত্ত। কাছে থাকা আর দায়িত্তে থাকা কখনোই এক নয়। আমার কাজ যেনো সেই দায়িত্ত যাতে আমার এই সাজানো সংসার ভেংগে না যায়, আমার দায়িত্ত সেটা যাতে আমার অন্তত এই জীবদ্দশায় আমার আসমানীর জীবনে কোনো কষ্ট না আসে, আমার সন্তানের কোনো বিপর্জয় না আসে।
মুক্তার সাহেব আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা আগে দিলেন। তারপর তিনি শুরু করলেন আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর। আমি তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি বাক্য এতো তন্ময় হয়ে শুনছিলাম যে, মনে হচ্ছিলো আমি কোনো ফিলোসোফির ক্লাশে উচ্চমানের কোনো তত্তকথা শুনছি। বারবার মনে হচ্ছিলো, মুক্তার সাহেব জীবনকে যেভাবে দেখেন, আমরা হয়তো এর বাইরের প্রাঙ্গণ থেকে দেখি। আমরা যখন অন্দর মহলের আগরবাতির গন্ধটা আনন্দ করি, তখন মুক্তার সাহেব এই আগরের গন্ধের সাথে সাথে আগরের জ্বলে পড়ে ছাই হবার কষ্টটাও দেখেন। আমরা সাধারনভবে যাকে প্রকৃতি বা ন্যাচার বলি, মুক্তার সাহেব এটাকে শুধু ন্যাচার বলে ঘটনাপ্রবাহ এড়িয়ে যান না। তিনি এর অন্তরনিহিত কারনগুলি খোজেন। আর সেই কারনের মধ্যেই যেনো আসল রুপ আর ঘটনা ঘটার সবগুলি উপাদান খুজে পান। মুক্তার সাহেব এবার বলতে শুরু করলেন-
-জীবন একটাই। আজ থেকে শতবর্ষ আগে সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী মমতাজের জন্য যখন তাজমহল তৈরী করেন, তার ওই তাজমহল কতটা ভালোবাসা প্রকাশ করেছে সেটা জানার চেয়ে আমরা কি কখনো এভাবে ভেবে দেখেছি যে, সম্রাট কতোটা কষ্ট থেকে এই তাজমহল বানিয়েছেন? তাজমহলের ইমারতে কি সেই কষ্ট আমরা দেখতে পাই? আমরা যা দেখি, তা হচ্ছে শাহজাহানের ভালোবাসার নিদর্সন। যা দেখতে পাই, তা হচ্ছে মুল্যবান রত্নে খচিত একটা দামী প্যালেস। কিন্তু আমি যদি বলি এটা সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসার মৃত্যুর নিদর্সন? তাহলে কি ভুল হবে? যদি বলি এটা ভালোবাসার কষ্ট থেকে নির্বাসিত একাকি এক রাজার মনের কষ্টের আকুতি বা অনুভুতি? তাহলে কি ভুল কিছু বলা হবে? হয়তো দুটুই ঠিক। এখন আমার অনেকগুলি প্রশ্ন জাগে, সম্রাট শাহজাহানের ২য় স্ত্রী ছিলেন এই আরজুমান্দ বানু বেগম ওরফে মমতাজ। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন কান্দাহারী বেগম। রানী মমতাজ ছাড়াও সম্রাটের জীবনে আরো আটজন রানী এসেছিলো। তাহলে সম্রাট শাহজাহান শুধুমাত্র মমতাজের জন্যই এতোবড় একটা বিশ্বনন্দিত মহল তৈরী করলেন কেনো? আর কারো জন্যে নয় কেনো? এর অন্তর্নিহিত অনুভুতি হয়তো শুধু জানেন শাহজাহান নিজে। আমার মাঝে মাঝে এইরকম প্রশ্নও জাগে যে, এতো বড় বড় নাম যাদের, তারা কেনো একটিমাত্র নারীকে নিয়ে জীবনে সুখী হতে পারলেন না? শারীরিক চাহিদার কথা যদি বলি, তাহলে এক নারী কি দেয় না যা অন্য নারী দেয়? এর মানে হয়তো শারীরিক চাহিদাই সেখানে মুখ্য নয়। তাদের তো কোনো টাকা পয়সা, ধনদৌলত মান-ইজ্জত, প্রতিপত্তি, ক্ষমতার দাপট কোনো কমতি ছিলো না? তাহলে আবারো আমার ওই যে সেই আগের কথা ফিরে আসে। তারমানে, শুধু টাকা পয়সা, ধনদৌলত মান-ইজ্জর সম্মান প্রতিপত্তিই সুখী বা খুসী জীবনের একমাত্র ভিত্তিপ্রস্তর নয়। এর বাইরেও কিছু আছে যা যুগে যুগে কারো কারো ক্ষেত্রে প্রমানিত হয়েছে আর বেশীরভাগ মানুষের জীবনে তা প্রমানিত হয়ই নাই।
-আরেকটা ছোট তত্ত আমাদের সবার জানা থাকা দরকার যে, মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে অনেক কিছুই মেনে যায়। আর সেই মেনে যাওয়া আর মেনে নেয়ার মধ্যেও একটা ফিলোসোফি থাকে। মানুষ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোনো কিছুর আশায় হয়তোবা অনেক কিছুই নিজের মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানিয়ে নেয়। কিন্তু যখন মানুষ সেই আশার সফলতা পেয়ে যায়, যখন সে নিরাপদ দুরুত্তে পৌঁছে যায়, তারমধ্যে তখন ‘আমিত্ত’ কাজ করে। তারমধ্যে তখন বৈতরনি পার হয়ে নিরাপদ জোনে চলে আসায় সে তখন অনেক কিছুই আর আগের মতো অনুগত নাও থাকতে পারে। তখন ‘মেনে যাওয়া’ বা ‘মেনে নেয়ার’ বাধ্যবাধকতায় সে আর আটকে থাকে না। হয়তো ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটেছে আমার আসমানির মধ্যে। আমি বলছি না যে, সে সীমা অতিক্রান্ত করে আমাকে হেয় করছে অথবা সে আর আগের মতো নাই এমন না। কিন্তু একটা ব্যাপার তো সবার জীবনেই আসে, যার নাম ‘শ্লথ’। এই শ্লথ থেকে শুরু হয় নিয়মের মধ্যে নিয়ম ভাংগার সুক্ষ কিছু কর্ম। অর্থাৎ সময়ের সাথে পিছিয়ে যাওয়া, ডিমান্ডের সাথে ক্যাপাসিটির সমন্নয় না হওয়া। আমরা অনেকেই এটাকে বুঝি না। তখন যে কোনো পক্ষের কাছে এটা মনে হয়, মানুষটা যেনো আর আগের মতো নাই। ‘এই আগের মতো নাই’ ব্যাপারটাকে আমরা অনেকেই ভেবে থাকি তাচ্ছিলোতা। আর এটা যে আসমানীর মধ্যে ছিলো না সেটা ফেলে দেবার মতো নয়। আপনি আবার এটা ভাববেন না যে, আমি আসমানীর বিপক্ষে অভিযোগ তুলছি। না, এটা কখনোই হবে না। আসমানীও একজন মানুষ। তাঁর নিজের একটা জীবন আছে, সকীয়তা আছে, সে দাস নয়। আমি তাকে ক্রয় করে আনি নাই। তাহলে আমি আসলে কি বলতে চাচ্ছি?
-কোনো একদা যে আসমানীকে আমি যাই উপদেশ দিয়েছি, বিনা বাক্যে, বিনা দ্বিধায় সে সেটা বেদবাক্য মনে করে অন্ধবিশ্বাসে গভীর শ্রদ্ধার সাথে পালন করেছে। কখনো কখনো আমি আসমানীকে নিয়ে ভরদুপুরে একই বিছানায় শুয়ে কার্টুন ছবি দেখেও খিলখিল করে হেসেছি। অনেক পয়সা ছিলো না, তারপরেও পাশের কোনো এক অখ্যাত রেষ্টুরেন্টে গিয়ে ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়েও তৃপ্তি পেয়েছি। গাড়ি ছিলো না, রিক্সায় ঘুরে বেড়িয়েছি ঘন্টার পর ঘন্টা। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ পড়তে পড়তে কখন আমি অপূর্ব আর আসমানী লাবন্য হয়ে যেতো বুঝতেই পারতাম না। কিন্তু আজ হাতে প্রচুর পয়সা আছে, গাড়ি আছে, কিন্তু আমি সেই আসমানীকে খুজে পাই না। হয়তো আসমানীও সেই মুক্তার সাহেবকে খুজে পান না। এর মানে এইটা নয় যে, সে আমার কথা শুনে না বা শুনতে চায় না। কিন্তু তারমধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। যখন আমাদের অনেক কিছু ছিল না, তখন একটা রিক্সায় করে মাইলকে মাইল ঘুরেও আমাদের আনন্দ হয়েছে যা এখন এসি গাড়িতেও পাওয়া যায় না। একটা সময় ছিল যখন আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা কি করলে কি হবে, কি করলে আরো ভাল হবে, সেটা নিয়ে কোনো তর্কবিহীন আলাপ আলোচনা শলাপরামর্শ হয়েছে। আজ যেটা করা তো দুরের কথা, আলোচনা করার জন্য পরিবেশও নাই। আমি বলতে চাইলেও তার হয়তো সময় নাই শোনার। এরমানে এই নয় যে, সে আমাকে অগ্রাহ্য করছে। আমি বলতে চাচ্ছি, এটা নিয়ে আর কোনো শলাপরামর্শ হয়না। একটা সময় ছিলো যখন, আমার প্রিয় খাবারগুলিই শুধু টেবিলে শোভা পেতো, যা এখন আমাকে বলেই দিতে হয় হয়ত এটা নয় ওটা খাইলেই মনে হয় ভালো লাগতো। কখনো কখনো ইচ্ছে না থাকলেও তাদের পছন্দের খাবারের তালিকাটাই এখন আমার খাবারের তালিকা করে নিতে হয়। এরমানে এই নয় যে, আমি বললে সেটা তৈরী করা হবে না। কিন্তু আগে এটা বলতে হয় নাই। পরিবর্তন সবখানেই আসে, আমাদের সম্পর্কের মধ্যেও এসছে। আর এটার জন্য অভিযোগ করা বোকামী। সমৃদ্ধ জীবনের চেয়ে অভাবী জীবনে অনেক বেশী প্রেম আর ভালোবাসা থাকে। যদিও সেখানে ঝগড়াও থাকে, তবে সেই ঝগড়াটাও একটা ভালোবাসার অন্য রকমের বহির্প্রকাশ।
শীতের প্রথম সকাল যেমন ঝির ঝির বাতাসে কেমন একটা কটু অনুভুতি থাকে তেমনি একটা মিষ্টি অনুভুতিও অনুভুত হয়। পাশে পুষ্করিনীতীরের পাড়ে দম নেয়া একটা কোলা ব্যাং যেনো তাঁর সমস্ত ধ্যান ধারনাকে একদিকে পাশ কাটিয়ে সেই আগত শীতের রোদের আস্বাদ নিয়ে চোখ বুঝে থাকে, ঠিক তেমন আমিও যেনো মুক্তার সাহেবের তাঁর অনাগত কাহিনীর মর্মটা আস্বাদন করার নিমিত্তে অনেকটা দম নিয়েই বসেছিলাম। মুক্তার সাহেব তাঁর কথা বলতে থাকেন-
-জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন আপনি জানেন আপনাকে নিয়ে কেউ আর হৈচৈ করেনা, আগের মতো সর্বত্র আপনার সেই ভূমিকার প্রয়োজন নাই কিংবা আমি যদি চানও সেখানে আপনার উপস্থিতি বা বক্তব্য আর আগের মতো তেমন জায়গা করে নেয় না তখন আপনার এটা মানতে অবশ্যই কষ্ট হয় যে, আপনার প্রয়োজন হয়তো তাদের কাছে ফুরিয়ে গেছে। আপনি যেনো আছেন শুধুমাত্র কারো কারো বিশেষ প্রয়োজন মিটানোর জন্য। আপনার কখন একটু ছাদে হাওয়া খেতে ভাল লাগবে, সেই হাওয়া খাওয়ার সময় আগে তো একজন আসমানীর সংগ পাওয়া যেতো কিন্তু এখন তার জগত অনেক বিশাল। এখানে আপনিই একমাত্র মানুষ নন যাকে ঘিরে তার দিনের সিংহভাগ সময় আরাধনায় কাটবে। এর মানে আবার এই নয় যে, আসমানি অন্য কাউকে মন দিয়ে বসে আছে। আগে আপনার অনুপস্থিতি হয়তো তাকে একা করে দিতো বটে কিন্তু এখন সেটা সেরকম নয়। কেনো যেনো মনে হয় কি যেনো মিসিং। এখন সম্পর্কটা যেনো একটা ডকুমেন্টের মধ্যে নেমে গেছে। মানসিক টর্চারের মতো মনে হয় কিছু কিছু সময়। অল্পতেই যেনো সব কিছু ঘোলাটে হয়ে যায়। সবাই যেনো কেনো অনেক অস্থির। কাউকেই যেনো কেউ সহ্য করতে পারছে না। সবার মতামত ভিন্ন, সবাই ঠিক, আপনি একাই ঠিক আর সবাই ঠিক নয় এটা আর এমন না। আর এর ফলে আমার কাছে এটাই মনে হয়েছে যে, দূর্বল সময়টা ওরা সবাই পেরিয়ে গেছে বলেই হয়তো এখন আর আগের মতো সব কিছুতেই বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে এমনটা না। ব্যাপারটা জানি কেমন, সব না মানলেও তো সমস্যা তেমন নাই। উত্তর আর প্রতি-উত্তরের জামানা মনে হয় এখন, যেটা আগে ছিলো না। কম্প্রোমাইজ আর সাইলেন্ট থাকাই যেনো এখন সময়। কিন্তু এটা তো আমি চাইনি? আর এখান থেকেই সম্ভবত শুরু হয়, ‘অনীহা’ নামক একটা অনুভুতি।
-একটা জিনিষ সবসময় কারো মনে রাখা উচিত যে, ভালোবাসার যেমন একটা শক্তি আছে, অনিহারও একটা বিপদ আছে। অনিহার অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইমোশন যখন ধীরে ধীরে বুদবুদের মতো অন্তরে জমা হতে থাকে, একসময় সেটা সারা অন্তর জুড়েই এমনভাবে বিচরন করে যেনো ভালোবাসার বুদবুদের আর কোনো স্থানই থাকে না। অথচ আপনি জানেন, আগের সে ভালোবাসার বুদবুদগুলি তখনো মরে যায় নাই, বেচেই আছে কিন্তু কোনঠাসা হয়ে। তখন এই কোনঠাসা ভালোবাসার অতৃপ্ত বুদবুদগুলি জলবিহিন মাছের মতো অতি অল্প পরিসরে ছটফট করতে করতে একসময় কোনো এক দূর্বল ছিদ্র দিয়ে মনের অজান্তেই বেরিয়ে আসে। যখন এই ভালোবাসার বুদবুদগুলি একসাথে ঝাকেঝাকে বেরিয়ে আসে, তখন সেটা খুজতে থাকে কিছু নিরাপদ আশ্রয়। তাঁর তো কোথাও একটা জায়গা দরকার। আর সেই নিরাপদ আশ্রয় হয়ে দাড়ায় সাবিত্রীর মতো কিছু অসহায় মানুষ যারা একে স্থান দেয় সেই পূর্বেকার আসমানীদের মতো যখন আসমানীরা একসময় দূর্বল ছিলো, সাবলম্বি ছিলো না। সেই স্থানটা তখন দখল করে নেয় সাবিত্রীরা। তখনই ঘটে এক বিপ্লব। যে বিপ্লবের নাম, ওই যে বললাম, ‘আমি আছি’ আর আমি দায়িত্তে আছি’র মতো বিপ্লবে। কেউ কেউ এসব সাবিত্রীদেরকে ডাকে-নোংরা মেয়ে মানুষ, আর যারা এই নোংরা মেয়ে মানুষদের সাথে সময় কাটায় তাকেই আমাদের সমাজ বলে ‘পরকীয়া’।
-এবার, আপনিই বলেন, এই অতৃপ্ত আত্তা, এই শুষ্ক হৃদয় কখন কোথায় ভিজে আবার উজ্জিবিত হয় সেটার নির্ধারন করে কে তাহলে? এটা হয়তো আসমানিদের দোষ নয়, না মুক্তার সাহেবদেরও। এটা সময়ের একটা চক্র যখন কোনো মরুভুমি আচমকা কোনো অঝর ধারায় বৃষ্টির জলে সবুজ ঘাসের মাঠে রুপান্তিত হয়। তপ্ত বালিকনায়ও তখন সবুজ ঘাসের জন্ম হয়। প্রকৃতি মনে হয় এরকমই। সাবিত্রীরা আসলে দূর সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপ। আর সেই দ্বীপের চারিধারে যেমন নোনাজল থাকে, থাকে তাঁর সাথে সবুজ গাছরাজীরাও। শাখায় শাখায় পাখীরা কিচির মিচির করে, সন্ধ্যে বেলায় সব শান্ত হয়ে যে যার মতো ঘরে আসে। আমার মতো মুক্তার সাহেবেরাও সেই সাবিত্রীর কাছে এসে নির্ঝুপ শান্ত একরাতে চোখের অবশিষ্ট জল ফেলে হয়তো নিদ্রায় নিপতিত হয়। সুখ থাকে কিনা সেটা হয়তো মুখ্য ব্যাপার নয়, কিন্তু নিজকে আবিষ্কার করা যায়, আসলে আমরা কারা, আর কিসের নেশায় আমাদের ছুটে চলা।
মুক্তার সাহেব তাঁর চশমাটা খুলে একটু মুছে নিলেন, হয়তোবা তাঁর চোখের কোনে কিছু একটা ঝাপসা মনে হয়েছে। মুক্তার সাহেব অনেক শক্ত মানুষ, অল্পতেই তাঁর চোখ ভিজে আসে না হয়তো কিন্তু কষ্টটা তো কোথাও না কোথাও আছে।
এতোক্ষন আমি মুক্তার সাহেবের কথাগুলি খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম। কেনো জানি আমার কাছেও মনে হলো, মুক্তার সাহেব যেনো চোখে আংগুল দিয়ে আমার জীবনের কথাগুলিই বলে যাচ্ছেন। আমিও তো মাঝে মাঝে খুব একা, মাঝে মাঝে তো আমারো মনে হয়, কি যেনো মিসিং! আমার গিন্নীর সাথে, আমার পরিবারের সাথে, আমার অন্য সব সম্পর্কগুলির সাথেও তো আমি এ রকম একটা অনুভুতি পেয়েছি যেখানে আমিও মনে করেছি, আমার প্রয়োজন হয়তো ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে, আমি কারো কারো মনের বাসনা আর আগের মতো সফল করতে পারছি না। আমার হয়তো সাবিত্রি নাই, কিন্তু আমার তো কেহই নাই। কোথাও আমি মুক্তার সাহেবের অপরাধ হয়েছে বলে মনে হলো না। আবার এটাও মানা যায় না যে, কেনো এতো বছর পর আসমানিরা বদলে যায় কিংবা মুক্তার সাহেবেরা ছিটকে পড়ে যায় আরো একটা আসমানীর কাছে যাদের নাম সাবিত্রী। কেউ চলে যাবার পর হয়তো কিছু পরিবর্তন নজরে আসে। বিশ্বাস আর ভরষার যখন মৃত্যু হয়, তখন শারীরিক দুরুত্ত অনেকগুন বেড়ে যায়। আর এই দুরুত্ত বাড়ার সাথে সাথে তখন ‘সময়’ নতুন সম্পর্ক তৈরী করে। কষ্টের সময় যারা থাকে, তারাই তখন নিজের ফ্যামিলি হয়ে যায়। এই সময় ইচ্ছা থাকুক আর নাইবা থাকুক, অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। মুক্তার সাহেবদেরকে যখন শত ব্যর্থতার কারনেও আসমানীরা ছাড়তে চায় না, তখন হয়তো মেনে নেয় আসমানীরাও, আবার আসমানীরা আছে, এটা জেনেও মেনে নেয় সাবিত্রীরাও। মেনে নিতে শিখতে হয়। বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ দুজন মানুষের মধ্যে যখন ভালোবাসার এই অপুর্নতার সৃষ্টি হয়, তখন কোনো একজন তার কাংখিত সুখ কিংবা একাকিত্ত কাটানোর জন্য সেই সপর্কের বাইরে যেতেই পারে। এটা কারো নিজের ইচ্ছায় যে সবসময় হয় তাও না। আর যখনই পা একবার বাইরে ছুটে, তখন, তাকে আর বিয়ে নামক অলিখিত বায়বীয় সম্পর্কটা শক্ত ভীত তৈরী করতে সক্ষম হয় না। প্রবল স্রোতে তীরভাংগা পারের মতো প্রতিটা ক্ষনে এর ভাংগনের শব্দ পাওয়া যায়। আর যখন এই ভাংগা একবার শুরু হয় তখন চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। হয় তাকে মুক্ত করে দিতে হয়, আর তা না হলে মেনেই নিতে হয়। কাউকে জোর করে কিছুক্ষনের জন্য হয়তো চুপ করিয়ে রাখা যেতে পারে কিন্তু সত্য বেশীদিন লুকিয়ে রাখা যায় না। ফলে একদিকে যেমন আসমানীরা তাদের অধিকার ছেড়ে দিতে চায় না, আবার অন্যদিকে মুক্তার সাহেবদের ধরেও রাখা যায় না। অগাধ সম্পত্তির বিবেচনায় একটা কথা ঠিক যে, পৃথিবীতে এমন কিছু সম্পর্ক আছে যা সব সম্পত্তির থেকেও বড়। আর সে সম্পর্কটা হচ্ছে অনুভুতির সম্পর্ক। আর মুক্তার সাহেবরা হচ্ছেন এমন এক সম্পর্কের নাম, যারা সাফল্যের সিড়ি বেয়ে বেয়ে উপরের তলায় স্থান করে নিয়েছেন। তাদের এই সাফল্যের একটা ফেসভ্যালু থাকায় তাদেরকে সবাই ছেড়েও যেতে চায় না। মুক্তার সাহেবের মতো বলতে গেলে বলতে হয়, সীমা লঙ্ঘন আর সীমা শেষ এক জিনিষ নয়। আসমানি, সাবিত্রী আর মুক্তার সাহবদের এই ত্রিমাত্রার সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে সিমা লংগন হয়েছে কিন্তু সীমা শেষ হয়ে যায় নাই। তারা সবাই যেনো দুঃখের খাচায় বন্দি। আর এটাই সত্যি। সত্যিটা কখনো কল্পনা হয় না। আর কোনো কল্পনাকেও সত্যি বলা যায় না। সত্যি কখনো কারো এজেন্ডা হতে পারে না। সত্যি সেটাই যেটা বাস্তব। আসমানী বেগম যেমন বাস্তব, সাবিত্রীও বাস্তব। আর এই দুয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন মুক্তার সাহেব। সেটাও বাস্তব।
মুক্তার সাহেব চশমাটা মুছে, আমার দিকে একটু হাস্যোজ্জল নেত্রে তাকিয়ে আরো একটা কাপে কিছু কফি আর আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বলতে লাগলেন,
-একটা জিনিষ কখনো উপলব্ধি করেছেন? আপনি যখন অনেককেই কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন তারা ভালো আছেন, কিন্তু তারা জানেন তাদের সময়টাই ভালো যাচ্ছে না। সত্যি কথাটা বলার জন্যে সাহস থাকলেও সেটা আসলে পুরুপুরি কাউকে যে বুঝাবেন, সেটা মুখের কথায় বুঝানো যায় না। আয়নায় হয়তো আপনি কাউকে চেহারাটা দেখাতে পারবেন, কিন্তু কষ্টটা দেখাবেন কিভাবে? ভিতরের কষ্টটা কাউকে দেখানো যায় না। আর ভিতরটা কেউ দেখেও না, যদিও সত্যিটা ভিতরেই থাকে। সেই কষ্টেভরা সুর শুধু নিজের কান থেকে নিজের অন্তরেই ঘুরাঘুরি করে প্রতিধ্বনি করতে থাকে। অন্য কারো অন্তর কিংবা হৃদয়ে সেটা কোনোভাবেই আপনি পুশ করতে পারবেন না। আসলে একটা কথা আছে-কান্নার আহাজারীতে সুর থাকে না, থাকে বেদনা আর কষ্ট যে কষ্টের কোনো নাম নাই, যে কষ্টের রুপ কাউকে দেখানোও যায় না।
-যেদিন আমি প্রথম আসমানীকে দেখেছিলাম, ঠিক একই রকম ভাবেই আমি দেখেছিলাম এই সাবিত্রীকে। সাবিত্রীকে আমার খুজে বের করতে হয় নাই। সাবিত্রী ধরনীর ভাসমান এই পৃথিবীর কোন এক অসমতল প্লাটফর্মে একাই দাড়িয়েছিলো। তাঁর কি অতীত কিংবা কি ইতিহাস সেটা আমার জানা ছিলো না। আর আমি জানতেও চাইনি। একটা জিনিষ জানবেন, অনেক সময় এমনটা হয়, কারো মুখ দেখে কারো ভিতরের যন্ত্রনাকে উপলব্দি করতে পারবেন আপনি হয়তো। তখন কারো হয়তো মন চাইবে যে, তার কাছে যেতে, তার মনের কথা জানতে, কিন্তু আমাদের সমাজটা এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যেখানে সচেতন মানুষের মন বলে উঠে “মাথা ঘামিও না, যদি কোনো সমস্যায় পড়তে হয়!! যদি বিপদে জড়িয়ে পড়ো?” এই উপলব্ধিটা হয়তো সবাই করে। সবার মনকেই হয়তো ছুয়ে যায়। কেউ কেউ এগিয়ে আসেই না, আবার কেউ কেউ বিপদ জেনেও ঝাপিয়েও পড়ে। পাখীদের বেলায় কিংবা অন্য কোনো প্রানীদের বেলায় এটা কতটুকু, সেটা আমরা না কখনো ভেবে দেখেছি, না কখনো উপলব্ধি করেছি। ওরা দিনের শুরুতে আহারের খোজে বেরিয়ে যায়, পেট ভরে গেলে কোনো এক গাছের ঢালে বা পাহাড়ের কোনো এক ছোট সুড়ঙ্গে রাত কাটিয়ে দেয়। তাদের অট্টালিকার দরকার পড়ে না, ওরা কেউ কারো শত্রুতা করে না, কোনো পর্বনে বিশেষ কোনো কিছুর আয়োজনেরো দরকার মনে করেনা। কবে ছুটির দিন, কবে ঈদের দিন কিংবা করে কোন মহাযুদ্ধ লেগেছিলো সে খবরেও ওদের কিছুই যায় আসে না। ওদেরও সন্তান হয়, ওরাও দলবেধে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যায়, ওদের কোনো ভিসা বা ইমিগ্রেশনেরও দরকার পড়ে না। টেরিটোরিয়াল বাউন্ডারী ওদের জন্য কোনোদিন দরকার পড়ে নাই, আগামীতেও দরকার পড়বে না। ওরাও কষ্টে কিছুক্ষন হয়তো ঘেউ ঘেউ করে, কিংবা চিন্তিত হয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে চলে যায়, কিন্তু তাকে আকড়ে ধরে বসে থাকে না। ওদের সারাদিনের কর্মকান্ডের জন্য না কারো কাছে জবাব্দিহি করতে হয়, না কারো কাছে ধর্না দিতে হয়, এমনকি ওরা ঈশ্বরের কাছেও তাদের অপকর্মের কিংবা ভালোকর্মের কোনো জবাব্দিহিতা করতে হয় না। কোনো ট্যাক্স ফাইল নাই, কোনো ভ্যাট ফাইল নাই, না আছে কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স, না দরকার তাদের গাড়িঘোড়ার। তাহলে তো ওরাই আসলে শান্তিতে থাকে, মানুষের থেকে অধিক। পশুপাখীরা ওদের জীবনের ব্যর্থতা কিংবা সফলতার ডেবিট-ক্রেডিট করে না। কিন্তু মানুষের বেলায় এটা একেবারেই প্রজোয্য নয়। তাদের বিপদে কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হয়, কারো না কারো সাহাজ্য লাগে। যখন বিপদের এমন মূহুর্তে সে সেটাই পায় যেটা সে মুহুর্তেই দরকার, হয়তো তাতেই তাঁর জীবনটা ঘুরে যায় অন্যদিকে। যখন পায় না, তখন হয়তো আরো অতল গহব্বরে তলিয়ে একেবারেই হারিয়ে যায়। সাবিত্রীকে সেদিন দেখে এটাই মনে হয়েছিলো-জীবনের সাথে তাঁর বোঝাপড়ায় সে ব্যর্থ হয়েছে। অদ্ভুদ মায়াবী এক অপলক নেত্রে সে দাড়িয়েছিলো, পরে লক্ষ্য করেছিলাম, ওর মা ওর সাথেই ছিলো ভাষাহীন এক মুর্তির মতো, হয়তো শুধু সঙ্গ দেয়ার জন্যই। এই এমন একটা পরিস্থিতি আমার আর সাবিত্রীর মাঝখানে বয়ে যাচ্ছিলো নাম না জানা একটা কৌতূহল। আমি সাবিত্রীর কাছে গিয়ে এমনভাবে দাড়িয়েছিলাম যেনো আমি তার অনেক চেনা একজন মানুষ। সাবিত্রী হয়তো আশাই করে নাই আমার হাত বাড়িয়ে দেবার ব্যাপারটা। মনুষ্যত্তের অবনমন যেমন আছে, মনুষত্যের উত্তোরনও তেমন আছে। সন্দেহের বশে অসুবিধায় রয়েছে এমন মানুষকে দেখে কোনো প্রশ্ন করা মোটেই অহেতুক হস্তক্ষেপ নয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেসব সচেতন মানুষ সামাজিক লাঞ্ছনার ভয়ে সেই কষ্টে থাকা মানুষের পাশে দাড়াতে ভয় পায়। কিন্তু আমি সেটা করতে পারিনি। অসহায় নির্লিপ্ত আমার থেকেও প্রায় ৩০ বছরের ছোট এই সাবিত্রীকে আমি সমাজের ভয়ে একা ছেড়ে দেইনি। তাঁর কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, তার মুখে লুকিয়ে থাকা কষ্টের কথা অথবা তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া কোনো অত্যাচার কিংবা লাঞ্ছনার কোনো লুকানো কাহিনীর কথা। আর সেখান থেকেই শুরু হয় আমাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কের অদৃশ্য বন্ধন। আমি আমার একাকীত্তকে হয়তো কিছুটা হলেও লাঘব করতে পেরেছি, কিন্তু তাঁর কাছে আমি নিছক মুক্তার সাহেব নই, আমি হয়তো তাঁর কাছে এমন একজন যাকে আপনি বলতে পারেন-‘অলিখিত ভগবান’।
মুক্তার সাহেবের কথা শুনতে শুনতে আমি যেনো ফিলসোফির ক্লাসের কোনো লেকচার কিংবা রহস্যে ঘেরা জীবনের চর্চাবিহীন কোনো অধ্যায়ের যুক্তিতর্কের তত্ত শুনতেছিলাম এটাই মনে হচ্ছিলো। মাঝে মাঝে তিনি এমন কিছু কথা বলছিলেন, যার সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত নই কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতাও যেনো ছিলো না আমার। আমরা ঈশ্বরের কথা বলি, ভগবানের কথা বলি। কিন্তু কে সেই ঈশ্বর কিংবা ভগবান তাকে আমরা কখনো দেখি না। কিন্তু মনেপ্রানে এ বিশ্বাস থেকে প্রতিনিয়ত আমরা আমাদের সমস্যার কথা, আমাদের আবেগের কথা গোপন প্রার্থনার সাথে তাঁর কাছে বলে হয়তো মনের ভিতরের কষ্ট বেদনা দূর করার চেষ্টা করি। কিন্তু সবসময় কি তা আসলেই লাঘব হয়? দূর্বলই হোক কিংবা সবল, আমরা আমাদের ভাবাবেগের সবউত্তর যখন পাই না, তখন সেই ঈশ্বর কিংবা ভগবানের কাছে সমর্পন ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না জেনেও সেই ঈশ্বরের কাছেই আবার ফেরত আসি। এটা একটা সাইকোলজি। আমরা অনেক কিছু মেনে নেই কিংবা মেনে নিতে হয়। হয়তো সবাই সেটা মেনে নেয় না। মুক্তার সাহেবের বেলায় ব্যাপারটা কোন স্তরের তা নিরুপন করা কঠিন। তিনি যেমন ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন, তেমনি বিশ্বাস করেন মানুষ ঈশ্বরের একটা হাতিয়ার।
অলিখিত ভগবান? এটার ব্যাখ্যা কি? আমি মুক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম।
তিনি আমার এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি কথা চালিয়ে গেলেন।
-কিছু কিছু সময় আসে মানুষের জীবনে, যখন সবকিছু হাতের কাছে থাকলেও মনের অজান্তে মনে একটা না পাওয়ার আক্ষেপ তৈরী হয়। কি চেয়েছি, আর কি চাইনি, বা কি পেয়েছি আর কি পাইনি এই দুয়ের মধ্যে একটা টানাপোড়েন তৈরী হয়। এই টানাপোড়েন একটা হতাশা। কিন্তু যিনি বাস্তববাদী, যিনি ঈশ্বর বিশ্বাসী, তিনি এই টানাপোড়েনের ব্যাপারটা সমাধান করেন অন্যভাবে। তিনি ভাবেন-ভগবান মানুষের জন্য প্রতিটি দিন একই রকম করে পরিকল্পনা করেন না। আজ যে রবিবার আপনি হাসছেন, আগামী রবিবার আপনি নাও হাসতে পারেন, হয়তো সেদিন চোখের জলে প্রতিটি মুহুর্ত ভরে থাকবে আপনার। এই সপ্তাহটা হয়তো আপনার জন্য ভয়ানক অস্থির যাচ্ছে, কে জানে আগামী সপ্তাহটা হয়তো হবে একেবারেই সুন্দর ঝরঝরা। তাই হতাশ হবার কোনো কারন নাই। প্রতিটি ঝড় কিংবা বিপদের মাঝেও কিছু না কিছু সুসংবাদ থাকে, কিছু না কিছু ভালো জিনিষ আসে। একটা মৃত ঘড়ির দিকে তাকান, দেখবেন নষ্ট ঘড়িটাও দিনে দুবার একদম সঠিক সময় প্রকাশ করে। অপরিষ্কার জল খাবারের অনুপোযোগী হলেও সেটা আগুন নেভানোর কাজে লাগে। বোবা কিংবা বোকা বন্ধুও আপনার অন্ধ জীবনে রাস্তা দেখিয়ে দিতে পারে। এ রকম আরো অনেক বিকল্প উপায়ে মানুষ হতাশার অন্ধকার থেকে বাচার জন্য সঠিক ঘাটের সন্ধ্যান করেন। যখন তিনি সেখানেও ব্যর্থ হন, তখন তিনি স্থাপিত হন সেই ঘাটে যার আরেক নাম ‘তৃতীয় নদীর ঘাট’। কখনো কি এই “তৃতীয় নদীর ঘাটের” কথা শুনেছেন?
আমি তাঁর কথার উত্তর দেয়ার আগেই তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে থাকেন
-যতোক্ষন আপনি সঠিক ঘাটের সন্ধ্যান না পাবেন, ততোক্ষন পর্যন্ত আপনি উদ্দেশ্যহীন একজন মাঝি। নৌকা আছে, বৈঠা আছে, আর সেই নৌকা চলার জন্য পর্যাপ্ত নদীও আছে, কিন্তু আপনি তাঁর ঘাট খুজে পাচ্ছেন না। যতোক্ষন আপনি আপনার মনের মতো সঠিক ঘাট খুজে না পাবেন, তখন মন ছুটে যায় এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে। এই সাবিত্রীর মতো। নিজের মনের মতো করে কেউ যখন সেই সঠিক ঘাটের সন্ধ্যান পায়, তখন মন আর অন্য কোনো ঘাটে ফিরে আসতে চায় না। পুরানো ঘাটে ফিরে আসা আর সেই পুরানো ঘাটে নোঙ্গর করার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। হতে পারে আপনি যে ঘাটকে সঠিক ঘাট ভাবছেন, সেটাও ভুল। হতে পারে, সেই ভুলঘাটও আপনাকে ভুলপথে নিয়ে যেতে পারে। এই ভুলঘাট সবসময় একটা বিপদের সংকেত দেয়, কারন কেউ যখন একবার ভুলঘাটে তাঁর মন নোঙ্গর করে, সেখান থেকে হয়তো ফিরে আসার রাস্তাই আর তাঁর জানা থাকে না। রাস্তাটা একেবারেই অচেনা মনে হয়। আর অচেনা রাস্তায় অচেনা মানুষের কাছে আপনার চোখের জলের কোনো মুল্য থাকে না। আর মুল্যহীন জীবনে স্বপ্ন তো দূরের কথা বেচে থাকাই দূরুহ। কষ্ট থেকে বেরিয়ে যাবার তরে আরেক অচেনা দূরুহ রাস্তায় যখন মানুষ বেদনা নিয়ে বেচে থাকে, তখন সে জীবনের প্রতি মায়া হারিয়ে ফেলে, ভগবানের উপর সে আস্থা হারিয়ে ফেলে। ঈশ্বর আছে এটাই তখন আর বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু সময় এমন এক জিনিষ, সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু পালটায়। তবে আপাতদৃষ্টিতে বিবেচিত সঠিক ঘাটেই যেনো সেই মনের সুখ আর শান্তি বিরাজ করে, এটা ভেবেই মানুষ দ্বিতীয়বার নোঙ্গর করে। সাবিত্রীর সাথে আমার দেখা হবার পর, আমার কাছে একটা বিকল্প ঘাটের সন্ধ্যান বলেই মনে হয়েছিলো। এটা হয়তো সাবিত্রীর বেলাতেও একই উপলব্ধি। ঠিক, বেঠিক, ন্যায়, অন্যায় ইত্যাদির ব্যাপারে আমি কোনো প্রশ্ন করতে চাইনি। হতে পারে সাবিত্রীর কাছেও আমার ঘাটটাই সঠিক বলে মনে হয়েছে। আমরা দুজনেই জানি-এই ঘাটে আরো অনেক সম্পর্ক জড়িত কিন্তু সেই সম্পর্কগুলি যেনো পুরানো সুতায় সব পেছিয়ে দিশেহারা হয়ে আছে। তা দিয়ে আর নতুন জাল বুনানো সম্ভব নয়। আবার যে এলোপাতাড়ি বুনন আছে সেটাও চিরতরে ধংশ করা সম্ভব নয়। এই সম্ভব আর অসম্ভবের মধ্যেই যেনো নতুন আরেকটি বুনন বেধে গিয়েছিলো আমার আর সাবিত্রীর।
মুক্তার সাহেব একটু থামলেন। আরেকটা সিগারেট ধরালেন। এর ফাকে আমার মনের ভিতরে ঘুরপাক খাওয়া সেই কথাটার ব্যাপারে জানতে চাইলাম। ‘অলিখিত ভগবান’ বা ‘তৃতীয় নদী’। জিজ্ঞেস করলাম, আমরা নদীর তৃতীয় তীরের কথা অনেক সাহিত্যিকের লেখায় পড়েছি। যেমন হুয়াও হুইমারেস রোসার ‘দি থার্ড ব্যাংক অফ দি রিভার’। কিন্তু তৃতীয় নদীর তীরটা কি? আমি যেনো বোকার মতো একটা প্রশ্ন করেছি এমনভাবে মুক্তার সাহেব একটা অট্টহাসি দিয়ে একমুখ ধোয়া বের করে বললেন-
-হুয়াও হুইমারেস রোসার সেই বিখ্যাত উপন্যাস ‘দি থার্ড ব্যাংক অফ দি রিভার’টা তাহলে পড়েছেন? গল্পটা কি মনে আছে আপনার? যাক, মনে না থাকলেও সমস্যা নেই। আমি পড়েছি। একটু ঝালাই করি তাহলে। হুয়াও হুইমারেস রোসা একজন দক্ষিন আমেরিকার বিখ্যাত ছোট গল্পলেখক। এই গল্পে এক পরিবারের খুব দায়িত্বশীল একজন পিতা একদিন একটা ডিঙি নৌকা তৈরি করেন। ছোট ডিঙি। গলুইতে শুধুমাত্র এক চিলতে জায়গা। একজনের বেশি মানুষ সেখানে বসতে পারবেনা। বিশাল এবং সুগভীর একটা নদীর তীরে পরিবারের বসতি। নদীটা এতোই বিশাল এবং প্রশস্ত যে, অন্য তীর দেখাই যায়না। অতঃপর একদিন তিনি নদীপাড়ের বাড়িতে তার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিশাল, সুগভীর নদীতে তার ডিঙি ভাসিয়ে দিলেন। কোন খাবার বা অন্য কোন রসদও সঙ্গে নিলেন না। এমনকি শেষবারের মত পরিবারের কাউকে কোন উপদেশও দেবার চেষ্টা করলেন না। অদ্ভুত ব্যাপার হলো তিনি আর কখনো ফিরেও আসলেন না। কিন্তু আবার কোথাও চলেও গেলেন না। মাঝ–নদী বরাবর অনির্দিষ্টভাবে ঘোরাফেরা করতে লাগলেন। কখনো উজানে। কখনোবা ভাটিতে। কিছু কিছু সময়ে তিনি দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যান। কিন্তু কখনই এমন দূরে নয় যে তার উপস্থিতিটা পরিবারের সদস্যরা অনুভব করতে সক্ষম না। … মৃত্যুই কি নদীর তৃতীয় তীর? এটাই ছিলো তাঁর কথার সারমর্ম। কিন্তু আমি তাঁরসাথে একমত নই। কেনো জানেন?
আমি উত্তরে বললাম, না জানি না। আপনি বলুন।
-আসলে এই তীর কি, কোথায় তার অবস্থান, কিংবা এটা কি এমন কোনো নদী যার তীর সচরাচর গোচরীভুত হয় না, অথচ আছে? অথবা এই নদীর কি আরো তীর আছে যার নাম হয়ত ‘চতুর্থ তীর’? সবুজ গাছ-পালা, আকাবাকা মেঠোপথের শেষপ্রান্তে প্রাকৃতিক বড় সৌন্দর্য পরিবেষ্টিত বিশাল জলাধারের চলমান স্রোতের প্রাবাহমান যদি কোন নদী হয়, সেই নদীর তীর হয়তোবা কখনো এই বিশাল জনরাশির সবার কমন। এখানে সবার রোমাঞ্চ, আশা, বেদনা, সবার কাহিনীর এক মহাপুস্তকের মতো। হয়তোবা এটা কখনো সভ্যতার জীবনধারার বাহকরুপী কোনো সময়ের রাজত্ব হলেও হতে পারে কিংবা কখনো সেই দৃশ্যমান নদী অতীত বর্তমানের সুখ দুঃখের এই বিশ্বভ্রমান্ডের সাক্ষীর ধারকবাহক হলেও হতে পারে। আর সেটাকেই আমরা কখনো নদী, কখনো উপসাগর অথবা কখনো সাগর থেকে মহাসাগরের স্তরে বিন্যাস করে কতোইনা উপমা করে থাকি। এই নদীর স্রষ্টা আছে, এর নিয়ন্ত্রণকারী আছে, আর তার উপর সমগ্র মানবকুল একটা মিশ্র বিশ্বাস নিয়েই কেউ এর স্রষ্টাকে পুজা করে, কেউ তাকে অস্বীকার করে আবার কখনো কখনো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মায়াজালে আশা-নিরাশার ভারদন্ড নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। হয়ত এরই নাম “জীবন”, হয়তবা এরই নাম “সভ্যতা”। এই নদীর কিনারা থেকে পালিয়ে বেড়ানো মানে এই নয় যে, জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো কিংবা সভ্যতা থেকে হারিয়ে যাওয়া। এই বিশ্বভ্রমান্ডের কোথাও না কোথাও আরেক নদীর তীর আছে যেখানে তার কিনারা পাওয়া যায়। সেখানেও নতুন করে সভ্যতা, জীবন এবং নতুন কাহিনীর রচনা হতে পারে এবং হয়।
-কিন্তু সমগ্র বিশ্ব থেকে যখন আমরা মানবকুল সবকিছু ছেড়ে ছোট একটা গন্ডি শুধুমাত্র গুটিকতক আপনজনের পরিসীমায় আবদ্ধ করে একটা মায়াজাল আবিষ্ট করি, তখন দিনের সবকাজ শেষ করে যখন নীড়ে ফিরে এসে হিসাব কষি, তখন সামনে এসে দাঁড়ায় আরেকটি নদী। হয়ত তাঁর নাম “মন-নদী’। এই নদীতে চলমান জলের প্রবাহ নেই, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার নেই, পাহাড় নেই, আকাশ নেই, কিন্তু তারও আছে অনেক তীর। যা কখনো শান্তির মহাখুশিতে জলের ধারা বইয়ে চিকচিক করে জানান দেয়, ‘যা চেয়েছি তাই পেয়েছি’। আবার কখনো কখনো দুঃখের সীমাহীন যন্ত্রনায় সেই একই নদী তার দুই তীর জলের ধারায় শিক্ত করে নীরবে বলে যায়, ‘বড় যন্ত্রনায় আছি’। হয়ত তখন আমরা বলি, দুই নয়নের ধারা। নিজস্ব গন্ডির এই পরিসীমায় এই নদীর একক ধারক বাহক শুধু কিছু আপনজন, নিজে আর ব্যক্তিসত্তার অজানা উপাদানের সব সমীকরন। এখানে ঈশ্বর বাস করেন ক্ষনেক্ষনে, আবার ঈশ্বর উধাওও হয়ে যান ক্ষনেক্ষনে। এখানে ছোট গন্ডির গুটিকতক আপনজনের সার্থকতা, ব্যর্থতা, ভালোবাসা, দায়িত্বশীলতা, নির্ভরতা সবকিছু একেবারেই নিজস্ব। সমগ্র মানবকুলের হিসাব কিতাবের সাথে, সুখ দুঃখের সাথে, চাওয়া পাওয়ার সাথে, লাভ লোকসানের সাথে সব কিছু মিশে থাকে।
-এই নদীতে বাস করে “আমি”, আমার আমিত্ত আর আমার চারিধারের সব আমারত্ত। আর কেউ নেই। এখানে ঈশ্বর আমি, এখানে নিয়মের কোন বালাই নেই। এখানে আকাশের রঙ আমার নিজের মতো করে বানানো, আমার নদীর জল আমার ইচ্ছায় যখন যেভাবে খুশি প্রবাহিত হয়। এখানে আমার ইচ্ছাটাই সব। এখানে আমার ছোট ডিঙ্গী কখনো উজানে, কখনো ভাটিতে, কখনো নিরুদ্দেশে, কখনো জনসম্মুখে, কখনো কাছে কখনো দূরে যেথায় খুশী সেখানে আমার বিচরন। কাউকে আমার কিছু যেমন বলার নেই, কারো কোনো কিছুই আমার পরোয়া করারও কোন প্রয়োজন নেই। এখানে আমার কোন দায়িত্ববোধ নেই, আমার দায়িত্বও কারো উপর নেই। এখানে আমার সব নদীর উপস্থিতি যেমন আছে, তেমনি কোনো নদীর উপস্থিতিও আমাকে বিচলিত করে না। একদিক থেকে দেখলে এই নদীর কোন তীর নেই আবার আরেক দিক থেকে অনুধাবন করলে হয়ত দেখা যাবে এর আছে অজস্র তীর। কখনো উল্লাশের তীর, কখনো আনন্দের তীর, কখনো ব্যর্থতার তীর, কখনো সব হারিয়ে এক অবসন্ন জীবনের তীর। এখানে এই তীরে কেউ প্রবেশের অধিকারও নেই। এখানে আমার রশদের কোনো প্রয়োজন নেই, এখানে সর্বত্র আমি। আমি কি করতে পারতাম, কি করা উচিত ছিলো, কে কি করতে পারতো, কোথায় আমি ভুল করেছি, কোথায় আমার সার্থকতা ছিলো, কি আমার ভুমিকা হতে পারতো, কিংবা কি কারনে আমি আমার সবকিছু নিঃস্বার্থভাবে ছেড়ে আমি আমার তৃতীয় এই নদীতে একা পড়ে আছি, তার কোনো ব্যখ্যা আমি আর খুজতে চাই না। হয়ত কেউই এর কোনো উত্তর মেনেও নিবে না।
-এখন আরেকটি প্রশ্ন মনে আসে। তাহলো, এই তৃতীয় নদীটি কোথায়? কারো কাছে এই তৃতীয় নদীটি হয়ত বাস্তবের কোনো এক বিশাল জলপ্রবাহমান নদীর বুক, কারো কাছে হয়তবা ঘন গাছপালায় পরিবেষ্টিত এক নির্জন জঙ্গল, কারো কাছে হয়তবা এই বিশাল মানবকুলের ঘনবস্তির মধ্যেও একা কোনো জগত। কেউ বিশ্বাস করুক আর নাইবা করুক, এই নদী সবার আছে, কেউ তাকে গ্রহন করে, কেউ এর সন্ধান জানেও না। এই নদীতে ঝাপ দেওয়ার সামর্থ্য সবার থাকে না। কারন এর যেমন কোনো দৃশ্যমান তীর নেই, আবার সব তীরের ঘাটও এক রকম নয়। এর জলের রঙ সবনদীর মতো নয়। এর কোনো ঋতু নেই, যখন তখন বৃষ্টি, ঝড়, উল্লাস, আনন্দ, কান্না, পরিহাস সবকিছু ঘটে। আর এর একচ্ছত্র অনুভুতি, আস্বাদ, ইতিহাস শুধু নিজের আর কারো নয়। এই তৃতীয় নদীর কিনারে বসে শতবর্সী বয়োবৃদ্ধা তাঁর বাল্যকালের স্বপ্ন দেখেন, আবার কারো কারো অজান্তেই এই নদীর বালুচরে হেটে হেটে কোনো এক উদাসীন কিশোর তাঁর কল্পনার জগত পেড়িয়ে শতবর্ষ পরের কোনো এক জনবসতীর সপ্নজাল বুনন করেন। কেউ ফিরে আসে, কেউ আর ফিরে না। এই নদীর তীরে বসা সবাই একা, সবাই সুখী, আবার সবাই বিরহীর মতো। অথচ এতো কাছাকাছি থেকেও এদের মধ্যে কেউ সখ্যতা করেন না, কেউ কাউকে সম্মোহনও করেন না। যেদিন এই মন-নদী অবশান হয়, সেদিন সব তীরের ধারা একসাথে মন-নদীর সাথে তিরোধানও হয়। হয়ত তখন হুয়াও হুইমারেস রোসা্র লেখা “নদীর তৃতীয় তীর”টি আর কারো গোচরীতভুতও হয় না। সময়ের বিবর্তনে আমরা সবাই ঐ জেলের মতো হয়ত কোনো কোনো তীর থেকে খসে পড়ি। বৃন্তচ্যুত কলির তীরখসা জীবনের অজস্র তীরের যখন একচ্ছত্র ভীড় ঘনীভুত হয় মহামিলনে বা মহাবেদনায় অথবা মহাপ্রলয়ে, তখন চৈত্রমাসের তাপদাহের পর বৈশাখের কালো হিংস্র ঝড়ে তান্ডবের মতো আমরা শুধু সেটাই দেখি যা শ্রাবনের অঝোরধারায় এই মাটির ধরায় সবার পায়ে, মনে, ঘরে বা মানসপটে ভেসে উঠে।
উফ কি অসম্ভব সুন্দর উপস্থাপনা মুক্তার সাহেবের। জীবন সম্পর্কে তাঁর চিন্তাধারা সবার থেকে যেনো অনেক আলাদা কিন্তু অবাস্তব মনে হচ্ছে না। আমি মুক্তার সাহেবের কথা যতোই শুনছি, ততোই যেনো অভিভূত হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে-এগুলি তো আমারো ফিলোসোফি। এসেছিলাম, মুক্তার সাহেবের পরকীয়ার ব্যাপারে জবানবন্দী নিতে। কিন্তু আমি যেনো এখন জবানবন্দী নিচ্ছি জীবনের ফিলোসোফির। আমার মনের মধ্যে তখনো মুক্তার সাহেবের সেই কথাটি ঘুপাক খাচ্ছিল-‘অলিখিত ভগবান’। এটার ব্যাপারে মুক্তার সাহেবের ফিলোসোপিটা কি আসলে? জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু এবারো তিনি সেটা এড়িয়ে গেলেন। বললেন-আমি আসবো সে ব্যাপারটায়।
মুক্তার সাহেব আবারো সেই আসমানী এবং সাবিত্রীর প্রসঙ্গ আনলেন। কারন এখানে আসমানী এবং সাবিত্রীর ব্যাপারটা নিয়েই আমাদের সব আলোচনা করার কথা। মুক্তার সাহেব বললেন-
-দ্বৈত জীবনের নাম শুনেছেন কখনো? একে অন্য নামেও অনেকে চিনে-‘দিমুখী জীবন’। এই দ্বৈত জীবনের সবচেয়ে বড় গুন যে, ডান হাত জানে না বাম হাত কি করছে। মন জানে না, অনুভুতি কি করছে, শরীর জানে না তাঁর মস্তিষ্ক কি করছে। সবকিছু থেকে সবকিছু আলাদা। একটা জীবনের দুটু আলাদা আলাদা অধ্যায়। একে অন্যের অপরিচিত এই অধ্যায়গুলি। এই দুটি জীবনের মধ্যে যখন একটা জীবন অতি দুঃখেকষ্টে ভরে উঠে, তখন আরেকটা জীবন হয়তো এর ঠিক বিপরীতে থাকে। হয়তো সেখানে কোনো কষ্টই থাকে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো-এটা কখনোই সম্ভব নয় যে, দ্বৈত জীবনের মধ্যে এক জীবনের প্রভাব অন্য জীবনের উপর পড়বে না। আসমানী ছিলো আমার একটা জীবন আর সাবিত্রী ছিলো দ্বৈত জীবনের আরেকটা। আসমানী ছিলো আমার স্ত্রী কিন্তু সাবিত্রী ছিলো আমার সব। কখনো স্ত্রী, কখনো মেয়ে, কখনো বন্ধু, কখনো খেলার সাথী, কখনো পাঠক, কখনো অস্তিরতা, কখনো আবার শুধুই একজন বহুদূর পর্যন্ত হেটে যাওয়া কোন কম্পেনিয়ন। জীবনের গাড়ি একটা চাকার উপর টানতে টানতে অনেকেই যখন হাপিয়ে যায়, তখন এর জন্য দরকার হয় আরেকটা চাকার। আর সেই চাকাটার নাম হচ্ছে হয়তো স্ত্রী। কিন্তু মানুষ যখন নিঃসঙ্গতায় ভোগে, আর সেটা কাউকে অনেক বেশী কুড়ে কুড়ে খায়, তখন দরকার হয় একজন সঙ্গীর। যখন ওই সঙ্গীর নেহায়েত প্রয়োজন হয় অথচ তাকে সংগী করা যায় না, তখন সে কিছু একটা তো করেই। আর সেটা যে কেউ শুনলেও কখনো বিশ্বাস করবে না, অথচ ব্যাপারটা সত্যি। সাবিত্রী ছিলো তেমন একটা মানুষ। সে ছিলো আমার দ্বিমুখী জীবনের বাস্তব সত্তা।
তাহলে আপনি কি এই দ্বিমুখী জীবনে বাস্তব জীবনের থেকেও বেশী সুখী ছিলেন? কিংবা আপনি কি আসমানীর সাথে সেই জীবনে কোনো কারনে আফসোসে ছিলেন? আমি মুক্তার সাহেবকে প্রশ্ন করলাম।
-কেউ সুখী না। আমিও না, এমনকি আপ্নিও না। আবার সবাই সুখী, সেখানে আমিও সুখী। এই মাত্রাটা সময়ের সাথে সাথে কখনো প্রখর হয় আবার কখনো বুঝাই যায় না সুখের কোন স্টেজে আমরা অবস্থান করছি। এর ফলে যেটা হয় যে, কখনো কখনো নিজের সন্তানকেও নিজেরা চিনতে পারি না, আবার কখনো কখনো আমাদের সন্তানেরাও আমাদের চিনতে পারে না। সবার স্বকীয়তা আলাদা, সবার চিন্তাধারা আলাদা, সবার পছন্দ আলাদা, সবার সুখের সংজ্ঞাও আলাদা। এই আলাদা আলাদা স্বকীয়তা, চিন্তাধার আর পছন্দের ভীড়ে কারো সাথেই কারো কিছুই মিল নাই বিধায় কোনো না কোনো সময়ে এরা একটি বিন্দুতে এসে কনফ্লিক্ট তৈরী করে। এই কনফ্লিক্ট তৈরির বিন্দুটি যদি কেউ খুব সহজে অতিক্রম করে বেরিয়ে যেতে পারে, তারা অন্যের থেকে সুখী। কিন্তু এই বিন্দুটি এড়িয়ে যেতে লাগে অনেক আত্মত্যাগ আর কম্প্রোমাইজ। যতো বেশী ছাড়, ততো বেশী সহজ জীবন। কিন্তু এটা সবসময় পারা যায় না। একটা সময় গিয়ে আপনি আর কতটুকু ত্যাগ করতে পারেন? কতটুকু কম্প্রোমাইজ করতে পারেন? যখন এটা সীমার বাইরে চলে যায় বলে মনে হয়, কেউ সুখী নয়, আপনিও না, আমিও না, কেউ না। শুরু হয় দ্বিমুখী আত্মার সৃষ্টি। এই পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষই কোনো না কোনো সময়ে দ্বিমুখী জীবনে বসবাস করে। কেউ জেনে করে, কেউ না জেনে। এই দ্বিমুখী জীবনের সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে এর কোনটা আগা আর কোনটা মাথা তার হদিস পাওয়া যায় না। কখনো এর শেষ থেকে শুরু আবার কখনো মাঝপথ থেকে। যাদের দ্বিমুখী জীবন জীবনের প্রারম্ভেই শুরু হয় তাদের বেলায় এটা বলা অনেক কঠিন তাদের আসল অবয়াববটা কি। এই দ্বিমুখী জীবনের মানুষগুলি সর্বদা একটা বর্নচোরা রুপে এই সমাজে, এই সংসারে এমন করে বাস করেন যাদের মুখ এবং মুখোস কোনোটাই আলাদা করা যায় না। তাদের প্রতিটি দৃষ্টিভংগীতে থাকে আবছা আবছা কিংবা পরিকল্পিত কোনো ছায়ার রুপরেখা যেখানে সামনে থাকা মানুষগুলিকে তারা কখনোই সাধারন মানুষ হিসাবে দেখেন না। তারা যা দেখেন আর যা দেখান পুরুটাই একটা মাস্ক। যেদিন এই মাস্ক আলাদা করার মতো পরিস্থিতি আসে, তখন হাজারো রকমের প্রশ্ন মনে জেগে উঠে-কেনো, কিভাবে, কার জন্যে কিংবা কি প্রয়োজনে এই দ্বিমুখী জীবনের আবশ্যকতা? অনেকেই তখন মাস্ক পরিহিত মানুষটাকেই আসল মনে করে আসল মানুষটাকেই আর চিনতে পারেন না। পাশাপাশি কয়েক যুগ একত্রে বসবাস করার পরেও অনেক ক্ষেত্রেই এই দ্বিমুখী জীবনের সন্ধান পাওয়া যায় না অথচ ব্যাপারটা ঘটছে। ঘটছে প্রকাশ্যে, দিবালোকে আর সবার অজান্তেই। এটা যেনো সেই কচুরীপনা যা স্রোতের মধ্যে স্রোতের বিপরীতে চলমান। হটাত করে চোখে পড়ে না কিন্তু যখন নিজের অবস্থান থেকে সেই কচুরীপানা অনেক দূর অবধি চলে যায়, তখন হয়তো ব্যাপারটা দৃশ্যমান হয় কিন্তু তখন সেই কচুরীপানা আর হাতের বা দৃষ্টির মধ্যে থাকে না। সে চলতেই থাকে তারমতো। চলমান সমুদ্রে কিংবা ভরা নদীর বুকে ভেসে থাকলেও এই কচুরীপানা তার নিজের প্রয়োজনে একপেট জল সর্বদা নিজের করে ধরে রাখে যা তার হয়তো প্রয়োজনই নাই। কিন্তু দ্বিমুখী জীবনের মানুষগুলির এই প্রয়োজন আছে বলেই তারা কোনো সুযোগ নেয় না, তারা তাদের প্রয়োজনটাই আগে বিবেচনা করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। পিছনে কার কি হলো, তাতে তাদের ভাবার কোনো আবশ্যকতা মনে করে না। দ্বিমুখী জীবনের ভালোবাসায় প্রচুর খাদ থাকে কিন্তু এই খাদের উপরের চাকচিক্য এমনভাবে প্রতিফলিত হয় যা আসল সোনার রংটাকেই আরো আসল বানিয়ে চোখ ঝলসে দেয়, অন্যের মন আকর্ষন করে তাঁকে আরো কাছে আসার সুযোগ করে দেয়। আর এটাই সেটা যেখানে সমাজের মানুষগুলি প্রতিদিন প্রতারিত হয়। এখানে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো-দ্বিমুখী জীবনের সব মানুষগুলি আবার এ রকমের মুখোশ পড়ে থাকে না। তারা মুখোশের আরালেও বাস্তব। প্রতারনা নাই।
দ্বিমুখী জিবনের সত্তা দ্বিধা বিভক্ত। তাদের দুটুই পাশাপাসি বিচরন করে-ঘৃণা আর মাত্রাতিরিক্ত ভরষা, সত্যতা আর মিথ্যার বেশাত, কঠিনতা আর দূর্বলতা, মায়া এবং হিংসা। এই দ্বিমুখী জিবনের সময় আর অসময় বলে কিছু নাই। যখন প্রয়োজন তখন তারা উভয়ই ব্যবহার করতে কোনো দিধাবোধ করেন না। ফলে দেখা যায় যে, যাকে কেউ কোনোদিন এমন কোনো কাজ, এমন কোনো ভয়ংকর ঘটনা ঘটাতে পারে বলে ভাবেনও নাই, তারাই সেটা করে ফেলে। তখন তারা সবাইকে এমনভাবে তাক লাগিয়ে দেয় যে, সবার মনে এই প্রশ্ন জাগে এটা কিভাবে সম্ভব সেই তার দ্বারা যে কিনা একটা তেলাপোকা দেখলেও ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে থাকতো?
এখন প্রশ্ন জাগে, যদি সবাই তাদের জীবনে কোনো না কোনো সময়ে এই দ্বিমুখী জীবনে বসবাস করেই থাকেন, তাহলে দ্বিমুখী না কারা? আসলে এর উত্তর খুব কঠিন নয়। সবার দ্বিমুখী জীবনের সংগা এক নয়। কেউ কেউ অতি অল্প বিশয়েই তার দ্বিমুখী জীবনের শুরু আর শেষ আবার কারো কারো এই বৈশিষ্ট এমন যে, প্রতিটি বিশয়েই তারা দ্বিমুখী। কারো দ্বিমুখী জীবনের ধারা শুধুমাত্র বৈষয়িক, আবার কারো কারো দ্বিমুখী জীবন ব্যক্তিগত। কেউ দ্বিমুখী জীবন দিয়ে সমাজকে কলুষ্মুক্ত করেন, আবার কেউ দ্বিমুখী জীবন দিয়ে সমাজকে কলুষিত করেন। দুটু দ্বিমুখী জীবন একসাথেও চলতে পারে যদি তাদের সেই দ্বিমুখী জীবনের গতিপথ হয় একই রেলের উপর। যখন এই দ্বিমুখী জীবনের সাথে ভিন্ন ধারার দ্বিমুখী জীবনের সংযোগ হয়, তখন ভয়ংকর পরিনতি ছাড়া আর কিছুই আশা করা যায় না।
দাম্পত্য জীবনেও এমন কিছু সময় আসে যখন মানুষ পরিস্থিতির কারনে কখনো কখনো দ্বিমুখী চরিত্রে ঢোকে যায়। যখন কোনো মহিলার স্বামী তার স্ত্রীর প্রয়োজনটা বুঝতে না পেড়ে বড়গাড়ি, বড়বাড়ি বড় বড় সপ্নে বিভোর হয়ে সার্বোক্ষন তার নিজের সংসারে উদাসীন থাকে আর অন্যত্র ব্যতিব্যাস্ত হয়ে সময় কাটাতে থাকে, তাহলেই তার নিজের স্ত্রীর দ্বিমুখী জীবনে প্রবেশ করার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায় আর সেই মহিলাও দ্বিমুখী জীবনে তার নিজের অজান্তেই ঢোকে যায়। কারন, যখন একটা মেয়ে একা হয়ে যায়, নিজের ঘরে স্বামীর সংস্পর্শও ধীরে ধীরে অবহেলায় পরিনত হয়, যখন সারাদিন কাজকর্ম করার পর যখন মনে হয় কেউ শুধু হাতটা ধরুক। অথচ কেউ আর পাশে থাকে না, তখন তার একাকিত্ত বাইরে বেরিয়ে আসে। তখন তার চলাফেরা, আচার আচরন, মনোভাব দেখে কারো সন্দেহ থাকে না যে, সে একা। এরপরেই শুরু হয় ভয়ংকরতা। সমাজ তাঁকে স্পর্শ করার জন্য মুখিয়ে থাকে। একসময় সে তাঁর নিজের অজান্তেই দ্বিমুখী চরিত্রে প্রবেশ করে ফেলে। যদি পুরুষের বেলায় বলি-সেটাও একই রকম। পুরুষের বেলায় তখন সাবিত্রিদের আগমন হয়। সাবিত্রিরা শুধু আপনার দেহকেই মুলধন মনে করে না। ওরা মুলধন মনে করে আপনার অসহায়ত্বকে, আপনার একাকীত্বকে, আপনার আফসোসের উপলব্ধিকে। ইতিহাস খুজে দেখলে দেখবেন, বড়বড় মনিষীরা, বড়বড় ব্যবসায়ীরা কিংবা বড়বড় জ্ঞানীরা তাদের শেষ জীবনে এসেই এই আফসোসের সন্ধানটা পান। আর মৃত্যুর বিছানায় শুয়ে শুধু একটা কথাই বলে যান সবার উদ্দেশ্যে যে, আমি কি কারো জন্যেই কিছু করি নাই? কিংবা আমি তাহলে সারাজীবন কাদের জন্য এতো পরিশ্রম করলাম যখন আমার এই মুমুর্ষ সময়ে কেউ পাশে নাই কিংবা আমি যা চাই সেটা আর পাই না? এটাই মূল কথা। জীবনের শেষ সময়ে কেউ কারো কাছেই থাকে না কারন সবাই আলাদা। সবাই ব্যস্ত। তখন শুধু সামনে থাকে সাবিত্রীরা। হতে পারে এক সাবিত্রী থেকে নতুন আরেক সাবিত্রীর পরিবর্তন হয়। কিন্তু সাবিত্রীরাই শেষ একম্পেনিয়ন।
মুক্তার সাহেবকে আমি অনেকভাবেই যেভাবেই প্রশ্ন করছি না কেনো, আমি এখনো ঠিক কি কারনে আর কোন অপরাধে আসমানী বেগমের থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে গিয়েছিলেন, সেই একাকীত্তের পুরু চিরাচরিত ধারনাটা মনে হয় পাইনি। আমি তাই আবারো মুক্তার সাহেব কে প্রশ্ন করলাম,
আপনি বলছেন, আসমানী বেগম আপনার কথার অবাধ্য হয় না, তিনি কোনো পর পুরুষের সাথেও খারাপ কিছু করেন না, আবারো বলছেন, তিনি ঠিকই আছেন, তাহলে কোন জায়গায়টায় আপনি একটা দুরুত্ত দেখছেন যেখানে আপনার মনে হয় আপনি বঞ্চিত বা আপনাকে সঠিক আগের মতো আর মুল্যায়ন করছে না?
মুক্তার সাহেব সদা হাস্যের মানুষ। বেশ মিশুক আর জোরালো তার অকপ্ট বক্তব্য। তাঁকে ডাইরেক্ট প্রশ্ন ও করা যায়। তিনি আমাকে উলটা প্রশ্ন করলেন-
বাংলা একটা সিনেমা আছে। ইন্ডিয়ান। বেলাশেষে। দেখেছেন মুভিটা?
আমি বললাম, আমি খুব একটা মুভি দেখিনা। ছোত বেলায় দেখতাম, তাও কখনো এটা নেশার মতো ছিলো না। আর এখন তো কাজের চাপে সংবাদ ও দেখা হয় না।
মুক্তার সাহেব বলতে শুরু করলেন- তাহলে ‘বেলাশেষে’র মুভিটা র একটু কাহিনী বলি। হয়তো ব্যাপারটা আপনাকে আরো পরিষ্কার ধারন দিতে পারে।