০২/১১/১৯৮৭-এপেন্ডিক্স যে ২

আমার এপেন্ডিক্স জে অধিনায়ক ব্রিগেডে পাঠিয়েছেন কিনা আমি জানি না। আমার এই এপেন্ডিক্স জে প্রথমে ইউনিট হয়ে ব্রিগেডের মাধ্যমে কমান্ডারের এপ্রোভাল হয়ে ডিভিশনে জিওসির কাছে যেতে হবে। জিওসি যদি এপ্রোভাল দেন, তাহলে তিনি এটা আর্মী হেড কোয়ার্টারে পাঠাবেন। তারপর চীফের এপ্রোভাল হলেই আমার চাকুরীচ্যুত হবে। লম্বা প্রোসেস। আমাদের জিওসি হলেন মেজর জেনারেল নুরুদ্দিন স্যার। আজ আমাকে ডিকিউ জানালেন যে, আগামি যে কোনো দিন জিওসির ইন্টারভিউ হতে পারে। রেডি থেকো। ভাবলাম, তাহলে হয়তো ব্রিগেড থেকে আমার এপ্লিকেশন ডিভিশনে পাঠানো হয়েছে।  

৩০/১০/১৯৮৭-এপেন্ডিক্স যে

আমাদের প্রতিটি ইউনিটেই আর্মির সব ফর্ম থাকে। এপেন্ডিক্স জে ফর্মটাও আছে। আমি একটা এপেন্ডিক্স ফর্ম নিয়ে আজ ফিল আপ করলাম। আগামিকাল অফিশিয়ালী জমা দেবো। ক্যাঃ শিহাব স্যার মানা করলেন। কিন্তু আমার তো আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না এই অবস্থায়। আমার এ ছাড়া আর কোনো উপায় আছে বলে মনে করি না। আর এই আর্মিতে আমার এমন কেউ নাই যে, আমি তার কাছে সাহাজ্য চাইতে পারি। আর আমার এখনো ক্যারিয়ার গড়ার অনেক সুযোগ আছে বাইরে। গেলে এখনি সময়। তাই আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। শিহাব স্যার অনেক পিঠা পাঠালেন আমার মেসে। ভাবী ও এলেন। খুব ভালো একজন মহিলা।

২৮/১০/১৯৮৭-উপধিন্যকের বাসায় যাওয়া

আমার অবস্থাটা খুব খারাপ। একদিকে মানষিক চাপ, অন্য দিকে ইউনিটের থেকেও অনেক চাপ। আমাকে ব্যস্ত রাখার সব ধরনের কৌশল সিও এবং উপ অধিনায়ক আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছেন। আমার কোনো স্বাধীনতা নাই, রেষ্ট করার সময় নাই, ডিউটি আর ডিউটি। দিন রাত অযথা ডিউটি। কোনো কাজ না থাকলেও কোনো না কোনো একটা কাজে আমাকে লাগিয়েই রাখা হচ্ছে।

আজ আমি উপ অধিনায়ক রফিক স্যারকে তার বাসায় গিয়ে দেখা করলাম। ভাবী দরজা খুললেন। বেশ স্মার্ট মহিলা। সম্ভবত মাথায় একটু কম চুল। তাই উপরে খোপা করেন। আমি স্যারের সাথে চা আর সিগারেট খেতে খেতে বললাম, স্যার আমি এপেন্ডিক্স জে দিতে চাই। এপেন্ডিক্স জে হচ্ছে সেচ্ছায় অবসর গ্রহনের একটি তরিকা। মেজর রফিক খুব চালাক লোক, তিনি মনে করেছেন, আমি হয়ত এমনিতেই ভয় দেখানো জন্য তাকে এটা বলতে এসেছি।

তিনি সাথে সাথেই বললেন, তুমি যদি এপেন্ডিক্স জে দাও, আমি ১ মাসের মধ্যে সেতা এপ্রোভ করিয়ে তোমাকে সাহাজ্য করতে পারি। আমি তার চালাকি বুঝি নাই কিন্তু আমি তো মনে মনে এতাই চেয়েছিলাম যেনো আমি এপেন্ডিক্স জে এর মাধ্যমে আর্মি থেকে বের হয়ে যাই।

খুব আনন্দের সাথে তার বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। এসে এপেন্ডিক্স জে এর কপি একটা কোথা থেকে পাওয়া যায় সেটা খুজতে থাকলাম।

২০/১০/১৯৮৭-কোর্ট অফ ইঙ্কোয়ারী

যেহেতু আমি আমার অপরাধ স্বীকার করেছি, ফলে ওয়ানম্যান কোর্ট অফ ইঙ্কয়ারী হল ২ দিনের মধ্যে যাতে আমার শাস্তি হয়ে গেলো 'কঠোর ভতর্সনা"। অর্থাৎ একটা লাল কালী। আমার উপ অধিনায়ক ছিলেন এই কোর্ট অফ ইনকোয়ারীর প্রেসিডেন্ট। আমার অবস্থা দিনকে দিন আরো খারাপ হতে থাকলো। ডিভিশনের মোটামূটি সবাই আমাকে এখন নামে চিনে, হয়ত কেউ কেউ আমাকে দেখলে চিনবে না যে, আমি লেঃ আখতার। মেসে অনেকেই ব্যাপারটা নিয়ে আমার সাহসের তারিফ করেন বটে কিন্তু আবার অন্যদিকে এটা করা ঠিক হয় নাই এই মন্তব্যও করে।

১৭/১০/১৯৮৭-রাত ১১ টা

আজ ডিভিশনে গিয়েছিলাম। মেজর সালাম আমাকে অনেক প্রশ্ন করলেন আমি জি ও সির নাম্বার ব্যবহার করে বিদেশে কনো কল করেছি কিনা। করলে কিভাবে করেছি। আমি কনো কিছুই লুকাইলাম না।

বললাম, আমি প্রায় সপ্তাহ খানেক যাবত মেজর আকবর স্যারকে একটা বেদেশী কল বুক করার জন্য অনুরোধ করেও কোন ফয়সালা হচ্ছিলো না। অথচ আমার খুব দরকার ভাইয়ার সাথে কথা বলার। এখন আমি যদি আপনাকে বা অন্য কাউকে বলি যে, আমি জি ও সির টেলিফোন থেকে ফোন করতে চাই, আপ্নারা আমাকে পারমিশন দিবেন না। সেই পারমিশন দিবেন না এই আদেশ পাওয়ার পর ও যদি ফোন করি তাহলে আমি ২ তা অপরাধ করার সামিল হবে। তাই আর আপনাদেরকে আমার বলার দরকার মনে করি নাই। ভুল একটাই হোক।

১৬/১০/১৯৮৭-আমেরিকায় ফোন

আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। যেভাবেই হোক আমাকে ভাইয়ার সাথে কথা বলতেই হবে। এভাবে আর থাকা যায় না। গতকাল আমি ডিভ ডিউটি অফিসার হিসাবে ডিউটি করছিলাম ডিভ হেড কোয়ার্টারে। ডিভ ডিউটি অফিসার হলোঃ প্রতিদিন একজন অফিসার ডিভ অফিসে টেলিফোন অপারেতর হিসাবে কাজ করে। সারা ডিভিশনের একটা রিপোর্ট নেয়, কে বা কারা সেনানীবাসে এলো বাইরের থেকে, কি গাড়ি কোথায় গেলো, কেনো গেলো, কিংবা এই জাতীয় অনেক রিপোর্ট ফোনে ফোনে নিতে হয় মেইন গেট, ইউনীট ইত্যাদি থেকে। অনেক রাত। আমি ডিভ অফিসের এক ক্লার্ক কে আমার কষ্টের কথাগুলি এম্নিতেই শেয়ার করছিলাম। তার নাম শাহজাহান। সে সিগন্যাল ইউনিটের ক্লার্ক। আমাকে সে একটা বুদ্ধি বাৎলে দিলো যে, স্যার, জিওসির একটা সরাসরি ফোন নাম্বার আছে যা থেকে প্রিথিবীর যে কোনো জায়গায় কল করা যায়। আপনি একটা সুযোগ নিতে পারেন আপনার ভাইয়ের সাথে কথা বলার। কিন্তু জিওসির নাম্বার বলে কথা, যদি জেনে যায়, তাহলে কিন্তু অসুবিধা হবে।

আমার কাছে এখন কি অসুবিধা হবে আর কি সুবিধা হবে এটা চিন্তা করার কোনো অবকাশ নাই। ভাইয়ের সাথে আমার কথা বলতেই হবে। ফলে আমি জিওসির নাম্বারটা ক্লোন করে জিওসির টেলিফোনের তার আমার টেলিফোনের সাথে কানেকশন করে ভাইয়াকে রাত ১১ তায় ফোন করলাম। প্রায় ১ ঘন্টা কথা বললাম ভাইয়ার সাথে। আমি আমার সমস্যার কথাগুলি জানিয়ে বললাম, আমার আর আর্মিতে থাকা সম্ভব না, যেভাবেই হোক আমি বের হতে চাই। ভাইয়া আগে থেকেই আমার এই আর্মীতে আসা নিয়ে খুব নারাজ ছিলেন। এইবার আমার আর্মী ছারার কথা শুনে তিনি আমার সিদ্ধান্তকে সায় দিলেন।

কিন্তু কিছুক্ষন আগে ব্রিগেডের ডি কিউ মেজর বদ্দ্রোজা স্যার জানাইলেন আমাকে ডিভিশনের জিএসও-২ (অপ্স) মেজর সালাম আমাকে ডিভিশনে যেতে বলেছেন। বুঝলাম, ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেছে।

১২/১০/১৯৮৭-ইউনিটেই একঘরে

কয়েকদিন পার হয়ে গেল কিন্তু আমি কিছুতেই আমেরিকার লাইন পাচ্ছি না। মেজর আকবর ও কোনো ভাবেই মিলিয়ে দেবেন এই কথা আর বলছে না। রহস্যটাই  বুঝতে পারছি না। এদিকে গতকাল রাত ১ টার দিকে হটাত করে এফ আই ইউ ইউনিটের অধিনায়ক ক্যাঃ ফেরদৌস (১০ লং) আমার রুমে এসে হাজির। এসে বললেন, তোমার রুম চেক করবো। আমার তো মেজাজ খারাপ। আমি তার সাথে এক প্রকার ঝগড়াই করা শুরু করলাম, এটা কোন ধরনের কথা? আমি কি ক্রিমিনাল?

তিনি আমাকে বললেন, এতা ইউনিট থেকে আমাদের জানানো হয়েছে তোমার রুম হটাত করে চেক করার জন্য। যাই হোক, ব্যাপারটা আমার কাছে অত্যান্ত সিরিয়াস মেটার বলেই মনে হলো আর নিজের কাছে খুব অপমান বোধ করতে লাগলাম।

আমি ইউনিটের মধ্যে মোটামুটি এক ঘরের মতো হয়ে গেলাম। অফিসাররা খুব একটা আমার সাথে মিশতে চান না। ভালভাবে কথা বলে না। কোথাও একতা গন্ডোগল মনে হচ্ছে।

০৯/১০/১৯৮৭-মিতুলদের আগমন সেনানিবাসে

আজ শুক্রবার। সকালে আমার ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ইউনিটে অধিনায়ক হটাত করে এক মিটিং ডাকাতে আমার আর যাওয়া হয় নাই। ভেবেছি বিকালে যাবো। মিটিং শেষ হলো সকাল ১০ টায়। আমি মিটিং শেষ করেই ভাবলাম, মেসে যাই, রেডি হৈ এবং পরে ইউনিভার্সিটিতে যাই। আমি মাত্র মেসে আএসেছি, এমন সময় মেসের ফোনে ফোন এলো যে, আমার গেষ্ট এসেছে ইউনিটে। আমি ভেবে পাইলাম না কে হতে পারে আমার গেষ্ট? মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। গেলাম ইউনিটে আবার। গিয়ে দেখি, ঊহ মাই গড। মিতুল, সুরাইয়া পারভীন তানি আর তার আরো কয়েক বন্ধু আমার ইউনিটে এসে হাজির। আমাদের ইউনিট নতুন সাভারে এসেছে বিধায় অফিস, ব্যারাক আর মেস সব এক বিল্ডিং এর মধ্যে। ওরা সব ইয়াং মেয়েরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে মিটিমিটি করে হাসছে আমি যখন রক্সায় করে ইউনিটের কোয়ার্টার গার্ডের সামনে নামছিলাম। লেঃ ওমর শরীফ ইউনিটেই ছিলো, কেরানীগঞ্জের ছেলে। সিও এবং অন্যান্য অফিসাররা সবে মাত্র মিটিং শেষ করে যার যার বাসায় চলে গেছে, ফলে ইমিডিয়েটলী কোনো রি-একশন পাইলাম না বটে কিন্তু আমি জানি এটা একটা ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। কারন মেয়েদেরকে অফিসার মেসে আনা হয়ত সম্ভব কিন্তু খোদ ইউনিটের অফিসে এভাবে আনা যায় না। এটা সাংঘাতিক সামরীক আইনের পরিপন্থি বলে আমাকে সিও সাহেব কড়া নোটিশ দিলেন।

আমি ওদেরকে আপাতত রিক্সায় করে আমার মেসে নিয়ে এলাম, দেখা যাক পড়ে কি হয়। এই ঘটনায় আমি খুবই চাপে পড়ে গেলাম। এফআইইউ ইউনিট আমার পিছনে সারাক্ষন জোকের মতো লেগে গেলো। সিও সাহেব আমাকে খুবই খারাপ নজরে দেখা শুরু করলেন, উপঅধিনায়ক মুখে এক কথা বলেন বটে কিন্তু কাজে অন্য রকম। আমাদের ইউনিটের ক্যাঃ শিহাব স্যার একমাত্র আমাকে একটু মনোবল দিয়ে যাচ্ছেন। ইউনিটে অনেক অফিসাররা আছেন (মেজর খলিল, মেজর শ ওকাত, লেঃ মুনীর, লেঃ সাদাত, আরো অনেকে কিন্তু সব ব্যাপারেই যেনো আমি টার্গেট। ব্যাপারটা আমার কাছে একটা মানসিক কষ্টের কারন হয়ে দাড়িয়েছে। এম্নিতেই আর্মীতে থাকার ইচ্ছাটা মরে যাচ্ছে, তারমধ্যে আবার পরিবেশ এমন হয়ে উঠছে যে, আর্মী থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাটা যেনো তড়িত হলেই বাচি।আমার প্রতিদিনের ডিউটি বেড়ে গেলো। এমন একটা ব্যাপার ঘটলো যে, আমার কোথাও যাওয়ার আর কোনো সময় হয়ে উঠছে না। আমি মিতুলকে আমাদের ইউনিটে আর কখনো এইভাবে না আসার জন্য বলে দিলাম। চাকুরীর প্রতি আর মায়া রাখতে পারছি না। হাপিয়ে উঠেছি। এমনিতেই এই আর্মিতে আমার আসার ইচ্ছে ছিলো না, তারপর আবার এই ধরনের একটা পরিস্থিতি যা আমার চাকুরীর জন্য কোনোভাবেই সুখকর নয়। ইউনিটে যাই করি, পদে পদে সিও খায়রুল স্যার আমার ভুল ধরার চেষ্টা করেন, উপ অধিনায়কও তার সাথে আরো জোগান দেন। ইউনিটের প্রতি আমার টান বা মহব্বত অনেক কমে গেলো। ভাবছি, হাবীব ভাইকে বল্বো যে, আমি আর আর্মিতে থাকতে চাই না। নেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু কথা তো বলতে হবে হাবীব ভাইয়ের সাথে। কিভাবে কথা বল্বো?

আমি আর্মি এক্সচেঞ্জে হাবীব ভাইয়ের আমেরিকার নাম্বারে কল বুক করতে বললাম। মেজর আকবর ওসি সিগন্যাল স্ট্যাটিক। তিনিই এই সব ব্যাপারে সাহাজ্য করতে পারেন। তার সাথে কথা বললাম, তিনি আমাকে আশসাস দিলেন, কথা বলিয়ে দেবেন আমার ভাইয়ের সাথে।

০২/১০/১৯৮৭-মিতুলের সাথে ডেইলী দেখা

সাভার পোষ্টিং হওয়াতে আমার সবচেয়ে যে লাভ তা হয়েছে তা হলো-আমি প্রায় প্রতিদিন মিতুলের সাথে জাহাঙ্গীর নগর ইউনিবার্সিটিতে দেখা করতে যেতে পারি। বিকাল হলেই আমি চলে যাই ইউনিভার্সিটিতে। সন্ধ্যা পর্জন্ত ওখানেই সময় কাটাই। মিতুল জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির ছাত্রী। তারসাথে তার বন্ধুদের মধ্যে সুরাইয়া পারভীন তানি, রোজী, রোজ, রোজী দিপু, কেকা, এই মেয়েগুলির সাথেই আমার খুব বেশি ভালো বন্ধুত্ত। আমার এই প্রতিদিনের যাওয়া আসা নিয়ে সম্ভবত কেউ নজর রাখছে। কিন্তু তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। বেসিক কোর্ষ থেকে যখন হালিশহর ত্যাগ করে যশোরে আসার পথে ঢাকায় অবস্থান করছিলাম, তখন মাসুস ইকবাল আমার সাথে একদিন রাত কাটালো মীরপুরে। ওর বাড়ি রাজশাহী। এর মধ্যে ভাবলাম, আমি যেহেতু ছুটিতেই আছি, দেখা করে আসি মিটুলদের সাথে। গত কয়েকদিন আগে আমি মিটুলের সাথে সেই সাভারে গিয়ে সারাদিন কাটালাম। এটাই আসলে আমার আর মিটুলের প্রথম একান্তে সাক্ষাৎকার। আমি না ধনী পরিবারের ছেলে, না আছে আমার কাছে অনেক জমানো পয়সা। যে কয়টা পোষাক আছে সেগুলিও যে খুব একটা সিলেক্টিভ তাও না। কিন্তু আমার মধ্যে এসবের কোনো বালাই ছিলো না। আমি যা, আমি সেটাই। আমি জানি আমার ভিতরে কি আছে, আর বাইরের পোষাক দিয়ে আমার ভিতরের আমিকে না পারবো লুকাতে, না পারবো কিছু বেশী দেখাতে। মিটুলের অবস্থাও যে আমার থেকে অনেক বেশী উন্নত সেটা আমি বলছি না। আসলে আমরা উভয়েই প্রায় একই রকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। ওর যেমন না ছিলো অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা চাহিদা না সে আমাকে আমার ব্যাপারে কিছু বেশী জানতে চেয়েছে। অনেক দিনের পরিচয় না হলেও যেহেতু পাশাপাশি বাড়িতেই আমরা থাকতাম, হয়তো সে সুযোগে আমার অনেকটা পরিচয় কিংবা ব্যক্তিত্ত সে জেনেই থাকবে।

যেদিন ওর সাথে আমি সাভারে প্রথম দেখা করতে যাই, আসলে আমার পরিকল্পনাই ছিলো কিছুটা সময় কাটানো আর ওর সাথে থাকা। সাভার স্মৃতি সৌধে একটাই রেষ্টুরেন্ট, সে রেষ্টুরেন্টেই আমি আর মিটুল খুব যত সামান্য খাবারই খেয়েছিলাম। এটা নিয়ে না আমার কোনো আফসোস ছিলো, না ওর। আমরা আসলে দুজনে দুজনকেই আজীবনের জন্য পেয়ে গিয়েছি বা আমাদের মধ্যে পৃথক হবার সম্ভাবনার কথা কখনোই মাথায় ছিলো না। এতা আসলে প্রেম ছিলো না। প্রেমটা আগের জনমেই ছিলো, এখন শুধু আবার এক সাথে হয়েছি, ব্যাপারটা এমন।

প্রতিদিন যাই ওর কাছে, না গেলে যেনো দিনটাই সফল হলো না। কি যেনো করা হলো না মনে হয়। অথচ থাকি মাত্র কয়েক হাজার গজ দূরে। এক বিকাল থেকে আরেক বিকাল যেনো কাটে না। আর এর মাঝেই আবার চিঠিও লিখছি মিটুলকে, পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে নয়, ব্যাট্ম্যান আতিয়ারের মাধ্যমেই সব চিঠি আসে আর যায়। ব্যাট্ম্যান আতিয়ারই যেনো হয়ে উঠেছে আমাদের ব্যক্তিগত পোষ্টম্যান। আমাদের এই যুগল সব প্রেম আর গোপন সব কথা, ব্যথা, আনন্দ হাসির সবচেয়ে কাছের যে মানুষটি মিটুলের পাশে ছিলো সেটা সুরাইয়া পারভীন তানি। কবে থেকে যে, তানি আমাকে ‘ছোটদা’ বলে ডাকা শুরু করেছে আমার মনে পড়ে না। তবে আমি ওর আসল না হলেও প্রকৃত একজন ভাই বটে। 

৩০/০৯/১৯৮৭ -রিক্রুট আত্তহত্যা

১৫ ফিল্ডের সৈনিক দের ট্রেনিং করাতে গিয়ে আজ একটা অঘটন ঘটে গেলো। রাতে রোল কল করার সময় একজন রিক্রুটের খোজ পাওয়া যাচ্ছিলো না। আমরা সব জায়গায় খোজাখুজি করেছি কিন্তু কোথাও তাকে পাওয়া গেলো না। আমরা ধরে নিলাম সে হয়ত পালিয়ে গেছে। কিন্তু তার ব্যাগ পত্র যেখানে থাকার কথা সবই আছে। তাহলে সে কোথাও লুকিয়ে আছে এটাই ধরে নেওয়া যায়।

হটাত এক সৈনিক এসে জানালো যে, স্যার আমাদের বিল্ডিং এর ৪ তলায় একটা বাথ্রুমের দরজা খোলা যাচ্ছে না। আমরা ঐ খানে চেক করতে পারছি না আসলেই কেউ ভিতরে আছে কিনা। আমরা সবাই তড়িঘড়ি করে বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে ফেললাম। আর সেখানেই পাওয়া গেলো সৈনিকের ফাসিতে ঝোলা লাশ।

আমি কখনো ফাসির লাশ দেখি নাই। আমি তার জিব্বাহ আর চোখ দেখে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। ফাসিতে মরা মানুষের জিব্বা কত বড় হয়ে যায় এটা এইই প্রথম দেখলাম। চোখগুলি মনে হচ্ছে তিন গুন বড় হয়ে বের হয় এসেছে। চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেলো। একটু পরে মাজেদ স্যার, অন্যান্য সিও, কিমান্ডার, বিএম, ডিকিউ, এফআইইউ ইউনিটের সবাই এসে হাজির।

ঘটনাটার কোর্ট অফ ইঙ্কয়ারীর আদেশ দিলেন অধিনায়ক। এখন কিভাবে কি হইলো এটা খুজে বের করার পালা।

২৬/০৮/১৯৮৭-রিক্রুটমেন্ট গ্রামে

গতকাল আমাদের গ্রাম থেকে ৪০ জনের একটা দল নতুন রিক্রুট মেন্টের জন্য আসার কথা ছিলো। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস, মাত্র একজন টার্ন অভার করলো। বাকীরা কেউ এলো না। ওরা বোকা। একটা চমৎকার সুযোগ হাতছাড়া করলো। হয়তো ওরা জানলোই না কি হতে পারতো ওদের জীবনে। মজিদ স্যারকে ব্যাপারটা জানালাম। তিনি হেসে দিয়ে বললেন, সবাইকে নিজের মতো ভাবো কেনো? তুমি একটা সুযোগ করে দিতে চেয়েছিলে, ওরা নেয় নাই, এতে তোমার তো কোনো দোষ নাই। বাদ দাও, যে কয়জন আসে, তাদের লিষ্টটাই ফাইনাল করে পাঠিয়ে দাও।

একটু খারাপ লাগলো যে, আমাদের গ্রামের লোকজন বুঝলো না। তবে কোনো এক সময় হয়ত ওরা আফসোস করবে এই সু্যগ তা না নেওয়ার কারনে যদি বুঝে আর কি। আর না বুঝলে কখনোই আফসস করবে না।

২১/০৮/১৯৮৭-রিক্রুটমেন্টের জন্য গ্রামে আসা

আমি গ্রামে এসে সরাসরি আমাদের গ্রামের হাই স্কুলে গেলাম অনেকের সাথে কথা বললাম। আর এটাও বললাম যে, যারা আর্মিতে আসতে চায়, আমি সাহাজ্য করতে পারবো, তোমরা আর্মিতে সৈনিক পদে এপ্লাই করো। বেশ সাড়া পেলাম। প্রায় ৪০ জনের মতো ইয়াং ছেলে পেলেরা আমার কথায় উতসাহী হয়ে আর্মি এপ্লাই করার কথা জানালো। আমি আগে থেকে প্রায় ১০০ ফর্ম সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে ৪০ জনের জন্য ফর্ম পুরুন করে নিয়ে এলাম আর বলে আসলাম আগামি ২৫ তারিখে সবাই সাভার সেনানীবাসে চলে এসো। আমি তোমাদের সবাইকে ভর্তি করিয়ে নেবো। আমি আসলে এই সুযোগটাই নিতে চেয়েছিলাম যে, অন্তত কিছু ছেলেপেলেদের আর্মিতে চাকুরী হোক।

২০/০৮/১৯৮৭-সোলজার রিক্রুটমেন্ট

সেনানিবাসে সোলজার রিক্রুটমেন্ট ক্যান্টনমেন্টেই হবে এই সার্কুলারে আমাকে ইউনিট থেকে ১৫ ফিল্ডের সাথে এটাচমেন্ট করা হলো। মনে মনে শান্তি পেলাম যে, এখন ইউনিটের অধিনায়কের বিরম্বনা থেকে রেহাই পাবো। কিন্তু ইতিমধ্যে অধিনায়কের পোস্টিং আদেশ চলে এসেছে। তার বদলি হয়েছে ডিজিএফআইএ। নতুন অধিনায়ক এসেছেন লেঃ কর্নেল খায়রুল আলম। একই সাথে উপঅধিনায়ক খলিল স্যারেরও পোস্টিং হয়ে গেলো। নতুন উপঅধিনায়ক এসেছেন মেজর রফিকুল হাসান স্যার।

কিন্তু ইউনিটে এই বদলীর কারনে খুব একটা শান্তি ফিরে এলো বলে মনে হলো না। আগেরবার ছিলো যে, অধিনায়ক আর উপ অধিনায়কের মধ্যে ছিলো সাপে নেউলের মতো সম্প্ররক, আর এখনকার অধিনায়ক আর উপঅধিনায়কের মধ্যে খুব মিল যেনো স্বামী স্ত্রী। তবী বেলায় স্বামী হচ্ছেন উপ-অধিন্যক আর স্ত্রীর ভুমিকায় আছেন অধিনায়ক সাহেব। কিন্তু তারা সৈনিক কিংবা অফিসারদের বেলায় সেই কঠোর কমান্ডই বহাল রাখলেন। আমার সাথে অবশ্য উপঅধিনায়কের সাথে একটু ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠলো। আমি ১৫ ফিল্ডের অধীনে সৈনিক নির্বাচন করার কাজে ব্যস্ত আছি। কিন্তু পাবলিকের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। মেজর মজিদ আমাকে জানালেন, দেখো তোমাদের আশেপাশের গ্রামগুলি থেকে ছেলেদের রিক্রুট করা যায় কিনা। আমি স্যারের কাছ থেকে ২ দিনের ছুটি নিয়ে আমাদের গ্রামে বাক্তার চর চলে এলাম।

১১/০৮/১৯৮৭-ক্লার্ক এডজুটেন্ট

এই কয়মাস ইউনিট স্থানান্তরীত হলো মীরপুর থেকে সাভার সেনানীবাসে। কি যে একটা ঝামেলা হয় এই ইউনিট ট্রাস্ফারের সময়। সব কিছুই তো নিতে হয়। তারমধ্যে আমি কোয়ার্টার মাষ্টার। এতো সৈনিক, এতো অফিসার, এতো সরঞ্জামাদি। সাভার সেনানীবাসে রাখার মতো জায়গাও নাই। শুনেছি যে, আমরা নাকি ব্রিগেডের অনেক কিছুই ঠিকমতো পালন করতে পারছি না আবার আমরা দূরে থাকায় আমাদের অনেক কর্মকান্ড নাকি ব্রিগেডের অফিসাররা ঠিক মতো মনিটর করতে পারেন না, তাই যতো অপ্রতুলই হোক, আমাদেরকে সাভার ৯ আর্টিলারী ব্রিগেডের কাছে নিতে হবে, তাই সাভার সাপোর্ট ব্যাটালিয়ানের কিছু বিল্ডিং এর অংশ আমাদের সৈনিকেরা থাকবে আর একেবারে সর্বশেষ বিল্ডিং এ আমাদের অফিস করা হবে। তাই হলো। আজ কয়েকদিন যাবত অমানষিক পরিশ্রম হচ্ছে। দিনরাত সমানে। ইউনিটেই খাই, ইউনিটেই ঘুমাই।

এর মধ্যে নতুন অফিসার এসেছে ২ লেঃ শেখ মুনিরুজ্জামান। মেহেরপুর বাড়ি। রেজিমেন্টেশন চলছে ওর। কমান্ডার কর্নেল মুনসুর ইউনিট ভিজিটে আসবেন। সে মোতাবেক যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব কমান্ডারের ভিজিটের জন্য ইউনিট রেডি করতে হবে। এই যে ভি আই পি দের দ্বারা ভিজিট, এটা একটা ভোকাস মনে হয় আমার কাছে। তিনি যখন আসেন, তিনি দেখেন, আহা, ইউনিট কি সুন্দর, ঝকঝকে তকতকে। সবাই যেন ঈদের মতো নতুন জামা কাপড় পড়ে সেজেগ্যজে থাকেন, কমান্ডার বা ভি আই পি এসে কতো সুন্দর বলে যান, আবার এতো সুন্দরের পরেও তার মন জয় হয় না, হাজার হাজার পয়েন্ট দিয়ে যান। ভাবখানা এই রকম যেনো, উনি মোঘল বংশের লোক। তার স্ট্যান্ডার্ড আরো বড়। যেই তিনি চলে গেলেন, আবার ফকিরা বানুর চেহারা। এর কোনো মানে হয়? অতচ এটা কমান্ডার নিজেও জানেন। তাহলে এই রকম লুকুচুরী কেনো?

আমাদের ইউনিটে হেড ক্লার্ক হিসাবে এসেছে ৪ মর্টারের হাবিলদার ক্লার্ক (জেসিও হওয়ার পর) মজিদ। আমার সাথে ৪ মর্টারে কাজ করেছে। অনেক কথা বলে অধিনায়কের ব্যাপারে কিন্তু শুধু আমাকে বলে। আমি তাকে সাবধান করে দেই কিন্তু তার উপদেশ দেওয়া বন্ধ হয় না।

অধিনায়ক সাহেব এখন আমাদের সব অফিসারের উপর ১০০% ক্ষেপা। একরাতে তিনি মিটিং ডেকে বললেন, যেহেতু আমি যে কোন কাজের ফিডব্যাক চাইলেই দেখি তোমরা হেডক্লার্ক, ব্যারাক এনসিও কিংবা অন্য কোনো স্টাফদের কাছ থেকে তথ্য নিয়েই আমাকে জানাও, তাই ইউনিটের এডজুটেন্ট আর কোয়ার্টার মাষ্টার হিসাবে দায়িত্তো পালন করবে হেড ক্লার্ক্সগন। জি ব্রাঞ্চের হেড ক্লার্ক এডজুটেন্ট, আর কিউ ব্রাঞ্চের হেড ক্লার্ক কোয়ার্টার মাষ্টার। মাই গড। তাইই হলো। আমরাও অধিনায়কের কথা মেনে নিলাম। সকালে প্যারেড স্ট্যাট দিতে হবে মজিদ সাহেবকে যেহেতু মজিদ সাহেব জি ব্রাঞ্চের হেড ক্লার্ক। আমরা বা এডজুটেন্টরা আর এই কাজে সামিল নই। ঘটনাটা কয়েক মূহুর্তের মধ্যে সারা ডিভিশনে ছড়িয়ে একটা মুখ রোচক কাহিনীতে পরিনত হলো। মেসে আমরা কারো সামনে মুখ দেখাতে পারি না। আমরা যাই বলি না কেনো, এটা আসলে একটা ব্রেকিং নিউজ ছাড়া আর কিছুই না।

যদিও হেড ক্লার্ক গন ইউনিটের এডজুটেন্ট আর কোয়ার্টার মাষ্টারের দায়িত্ত পালন করছেন কিন্তু তাদের নামে সামরীক নিয়মে কখনো কোরো বা 'আদেশ' করা যাচ্ছে না। তাদের মধ্যে এটা নিয়ে একটা কানাগুঞ্জন চলছে কেনো দায়িত্ত পালন করে কিন্তু তার বিনিময়ে তারা স্টাফ পে পাবে না? অধিনায়ক আসলে সামরিক নিয়মকে তোয়াক্কা না করেই এই কাজটি করেছেন যেটা আইনত একটা অপরাধ। কিন্তু অধিনায়ক তারপরেও কোনো তোয়াক্কা নাই। কমান্ডার ফেডআপ, বিএম মেজর সাকিল আর ডিকিউ মেজর বদ্রোজ্জাও ব্যাপারটা নিয়ে খুব বিব্রত। কোনো রিপোর্ট চাইতে গেলে তাদেরকে সাধারনত ইউনিটের এডজুটেন্ট অফিসার আর ইউনিটের কোয়ার্টার মাষ্টার অফিসারদের কাছেই চাইতে হয়। কিন্তু আমাদের ইউনিটে দুইজনই হচ্ছে জেসিও। তাদের না আছে ফোন না আছে সরকারী প্রোটকল। কি এক পরিস্থিতি করে রেখেছে অধিনায়ক আমাদের ইউনিটের।

পাশেই ১৫ ফিল্ড আর্টিলারী, অত্যান্ত সুন্দরভাবে চলছে ইউনিট। ১৫ ফিল্ডের উপ অধিনায়ক মেজর মজিদের সাথে মাঝে মাঝে আমার কথা হয়। ইউনিটে আসার সময় তিনি হোন্ডায় আসেন, আমাকে মাঝে মাঝে লিফট দেন। সেই সুবাদে অনেক কথা হয়।

০৩/০৬/১৯৮৭-নিতুন নিয়ম, রিক্সা বন্ধ

ইদানিং রোল কলে প্রায়ই দেখা যায় যে, যশোর সিএমএইচ এর রাস্তা দিয়ে আমাদের ইউনিটের ভিতর দিয়ে ঠিক রোল কলের সময় কিছু কিছু রিক্সা ঢোকে। যা অনেক বিব্রতকর। রোলকল শুরু হয় সাড়ে সাতটায়। ভাবছি, সাতটার মধ্যে আটটা পর্যন্ত এই গেট দিয়ে কোনো রিক্সা প্রবেশ নিষেধ করে দেবো। দরকার হলে আটটার পরে আবার চলবে। কিন্তু দেখা যায় আউট পাশ থেকে সব সৈনিকেরা ছয়টার মধ্যেই ইউনিট লাইনে ঢোকে যায়। তখন তো আর কেউ সেনানীবাসে ঢোকার কোনো লোকও থাকেনা। যারা ঢোকে তারা গুটিকতক সৈনিক যারা ফ্যামিল্যম্যান হিসাবে ইউনিটের বাইরে থাকে অথবা ছুটি থেকে আগমন করে অথবা কেউ সিএমএইচ থেকে বের হয়। এরজন্য বিকল্প রাস্তাও আছে। আমি ইচ্ছে করলে আমাদের আভ্যান্তরীন এই রাস্তাটা বন্ধ করেও দিতে পারি রাত সাতটার পর। অধিনায়ককে বললে আবার হরেক রকমের ব্যাখ্যা দিতে হবে, দরকার নাই। আগামীকাল এসএম সাহেব কে দিয়েই আদেশটা দিয়ে দেবো।

এই আর্মীতে একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছি। একবার যদি কেউ কোনো আদেশ দিয়ে ফেলে, আর সেটা যদি একজিকিউট করা হয়ে যায়, সেটা রদবদল করতে অনেক সময় লাগে। হয়ত দেখা যাবে, আজকে আমার একটা উদাসীন আদেশ বলে হয়তো কাল থেকে রিক্সা আসলেই বন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু এটাকে পুনরায় বহাল করার জন্য আমাকেই হয়ত ইউনিটের সিও সাহেবের অথবা ব্রিগেডের আদেশ নিতে হতে পারে। আর্মীর অফিসারগন কোনো রিস্ক নেন না। কিন্তু বাইরের বেসামরীক লোকজন কিন্তু আর্মীকে অনেক সাহসী কিছু মনে করে। তারা আর্মীকে ভয় পায়, কিন্তু আর্মী ভয় পায় নিজেদের। ১৯৭১ এর আর্মী আর ১৯৮৭ র আর্মী এক নয়। যতো দিন যাবে, এই আর্মী একদিন প্রোফেশনাল হবে ঠিকই কিন্তু এর যে অলিখিত বীরত্ব, অলিখিত সৌন্দর্য আর সাহসীকতার প্রতীক, এটা হারিয়ে যাবে। এর ব্যাখ্যা আমি এখন দিতে পারবো না। কিন্তু আমার কাছে এতাই মনে হচ্ছে। 

০৯/০৬/১৯৮৭-৪ মর্টার থেকে ৬ ফিল্ডে

আজ নতুন ইউনিট ৬ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারীতে যোগদান করলাম। মীরপুর সেনানিবাস, ঢাকাতে। লেঃ কর্নেল দাউদ আমাদের সিও। কয়েকদিন মেজর হান্নান উপ-অধিনায়ক ছিলেন, আমি আসার পর পরই উনার পোস্টিং হয়ে যায়। মেজর খলিল নতুন উপ অধিনায়ক। শোনা যায় অধিনায়কের সাথে উপ অধিনায়কের কোনো কিছুতেই মিল না হওয়ায় অধিনায়ক তদবির করে হান্নান স্যারকে কিছু একটা বরাতে শাস্তি দিয়ে অন্যত্র পোস্টিং করে দিয়েছেন। নতুন ইউনিট, তাই কোনো কিছুই নাই। এই ইউনিটে অফিসার আছেন লেঃ সাদাত স্যার, ক্যঃ শিহাব, (এই দুই জনেই আবার তারা কোর্সমেট), ব্যাটারী কমান্ডার হিসাবে আছেন মেজর সালেহ স্যার। এরশাদ সাহেবের সাথে তিনি কাজ করেছেন। বিষেষ করে বর্তমান চীফ জেনারেল আতিক স্যারের খুব প্রিয় মানুষ তিনি। ১৪ লং কোর্সের ২ লেঃ মুনীর আছে।

মীরপুর বাসা হওয়াতে আমার একটু লাভ হয়েছে। সময় আর সুযোগ পেলে মীরপুরেই বদি ভাইয়ের বাসায় যাওয়া যায় কিন্তু আমি খুব বেশি কম্ফোর্ট ফিল করি না ঘন ঘন যেতেও। কোথাও আমার ঢাকায় যাওয়ার যায়গা নাই, তারপরেও ঢাকার ছেলে যেহেতু, ঢাকাতে থাকলে মনটা ভালো লাগে। বদি ভাইয়ের বাসা আমার কখনোই নিজের বাসা বলে মনে হয় নাই। এখানে আমার জন্য ডেডিকেটেড কোনো রুম নাই, আমি এসে যে কিছু বন্ধু বান্ধব নিয়ে এখানে আড্ডা দেবো এসবের কোনো বালাই নাই। অন্য দশ জনের মতো আমিও এখানে একজন গেষ্টই বলা চলে। এটা তাদের দোষ নয়। আর আমার এই রকম আবদার করাও সমীচিন নয় যে, এখানে আমার কোনো অধিকার আছে। তারপরেও অন্য দশ জন থেকে হয়তো আমার প্রায়োরিটি একটু বেশি এখানে, এটুকুই। ফলে এখানে আসার জন্য আমি একেবারে পাগল থাকি না। এরপরেও তো একটা জায়গা আছে বলা যায়। বলতে পারি কাউকে যে, আমার বাসা মীরপুর। এতাই বা কম কিসের?

পাশেই আছে ৪৫ ইষ্ট বেংগল। ওখানে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের আমাদের ব্যাচের সমান আরেক অফিসার আছে। লেঃ রাকীব। নতুন হোন্ডা কিনেছে, ডেলহীম বাইক। নতুন হোন্ডা কিনলে যা হয়, বাইরে ঘুরাঘুরি একটু বেড়ে যায়। আমরা সবাই অস্থায়ী অফিসার মেস নামে ইউনিটের পাশেই ৪ তালা বিল্ডিং এ থাকি। আসলে কোনো মেস নাই এখানে স্থায়ীভাবে। আর যেটা আছে সেটা এএ আর্টিলারী ব্রিগেডের একটা মেস, খুব বেশি কিছু নাই। আমরা ঐ মেসের আন্ডারেই আছি, খাওয়া দাওয়া ওখান থেকে আসে, কিন্তু রুমেই বেশির ভাগ সময় খাই।

অধিনায়ক লেঃ কর্নেল দাউদ খুব সাংঘাতিক একরোখা মানুষ। খুব ছোট ছোট ভুলের কারনেও যে কোনো সৈনিক অথবা অফিসারদেরকে বড় বড় শাস্তি দেওয়ার পক্ষপাতি। ফলে সবাই অধিনায়কের উপর ভীষন ক্ষেপা। তাকে কোনো অফিসারই লাইক করেন না। উপঅধিনায়ক খলিল স্যার মাঝে মাঝে অধিনায়কের বিরদ্ধে কথা বলেন। কিন্তু আগের উপঅধিনায়কের দফা দেখে খুব বেশি মাতামাতিও করতে পারেন না। কারন লেঃ কর্নেল দাউদের রেকর্ড খুব ভালো না। তিনি ব্রিগেড কমান্ডার কিংবা জিওসি কাউকেই নাকি পরোয়া করেন না।

আমরা যদিও মীরপুর থাকি কিন্তু আমরা ৯ম আর্টিলারী (সাভার) ব্রিগেডের অধীনে। এই সুবাদে আমরা মাঝে মাঝেই সাভার ক্যান্টনমেন্টে যাই। আমি ৪ মর্টার রেজিমেন্টে থাকতে এডজুটেন্টের দায়িত্তে ছিলাম, কিন্তু এই ৬ ফিল্ডে আসার সাথে সাথে আমাকে কোয়ার্টার মাষ্টার বানানো হলো। আমি এই নিয়োগটাকে খুবই অপছন্দ করি। রেশনের হিসাব, গাড়ী, অস্ত্র আরো খুটিনাটি বিষয় নিয়ে সুক্ষ হিসাব করতে হয়। দেওয়ালে কখন চুনকাম করাতে হবে, কিংবা সৈনিকের পায়খানা কখন কখন পরিস্কার করাতে হবে এইসব আমার একদম ভালো লাগে না। তার মধ্যে রেশনের হিসাব তো একটা চুরির খনি।

সকালে পিটিতে সবাইকে আসা বাধ্যতামূলক। কিন্তু মাঝে মাঝে সিনিয়র ব্যাটারী কমান্ডারগন আসতে চান না। আর অধিনায়ক প্রতিদিন আসেন। কি ঝামেলা একটা। প্রতিদিনই আমাকে কারো না কারো নামে মিথ্যা বলতে হচ্ছে। অধিনায়ক জিজ্ঞেস করেন কেনো অমুক অফিসার আসে নাই, হয়তামি বানিয়ে কিছু একটা বলে দিয়ে আপাতত খালাস হচ্ছি। কিন্ত অধিনায়ক সাহেব আমার কথা ঠিক আছে কিনা, কিংবা অনুপস্থিত অফিসার ঠিক কথা আমাকে বলেছেন কিনা এটা উনি বিভিন্ন মাধ্যমে যাচাইয়ের চেষ্টা করেন বিধায় আমিও ধীরে ধীরে অধিনায়কের কাছে খারাপ হয়ে যাচ্ছি। এখানে উল্লেখ থাকে যে, সাদাত স্যারকে ইউনিটের এডজুটেন্ট বানানো হলেও তিনি ইউনিটে সকালে হাজির থাকেন না, তাই কোয়ার্টার মাষ্টার সকালে এডজুটেন্টের দায়িত্ত পালন করি। সাদাত স্যার ইন্ডিয়ায় যাবেন পিটি কোর্স করতে, তাই তিনি প্রি-কোর্সে আছেন অন্য একটা ইউনিটে।

বড্ড মানষিক কষ্টে দিনপাত করছি অধিনায়কের অধীনে। ব্যাটারি কমান্ডারদের হাতে অধিনায়ক কোনো ক্ষমতাই রাখতে চান না। ফলে ব্যাটারী কমান্ডারগন কোনো কাজও করছেন না। আর সবদোষ পরছে আমাদের উপর। ওদিকে স্যাররা এতো সিনিয়র মানুষ, কিছুই বলতে পারছি না। মাঝে মাঝে আমি স্যারদের অফিসে যাই, দুক্ষের কথা বলি কিন্তু স্যাররা আমাকে আদর করলেও তারা কোনো ব্যাপারেই কিছু করতে পারবেন না এটা আকার ইঙ্গিতে বলেন। সালেহ স্যার তো ফান করে মাঝেই মাঝেই বলেন, যে, ঐ মিয়া, অধিনায়কেরে বুঝাও, এতো ঠেলাঠেলী ভালো না। কিন্তু আমি তো কর্নেল দাউদের কাছে পোকামকড়ের সমান।

মেজর সালেহ স্যার যখন সচিবালয়ে কাজ করতেন, সে সুবাদে তিনি নতুন ইউনিট ৬ ফিল্ডের জন্য অনেক অনেক জিনিষপত্র ফ্রিতে এনে এই ইউনিটে দিয়েছেন। যেমন টাইপ রাইটার, আল্মারী, অনেক নতুন ফাইলপত্র, চেয়ার টেবিল, ফ্যান, আরো অনেক কিছু। কিন্তু অধিনায়ক তাতে খুব একটা খুশী নন সালেহ স্যারের উপর। তার ধারনা, সালেহ স্যার অধিনায়কের যে কোনো ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখেন।

মেজর সালেহ ভাবী অনেক স্মার্ট একটা মহিলা। হাতাকাটা জামা পড়েন। খুব ভালো ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। তিনি ইউনিটের অন্যান্য ভাবীদের সাথে খুব একটা মিশেন না। এতেও মনে হয় সালেহ স্যার কিছুটা সমস্যা পড়ছেন বিশেষ করে অধিনায়কের নজরে।কেনো সালেহ ভাবী সবার সাথে মিশেন না, কেনো এই, কেনো সেই ইত্যাদি।

অধিনায়ক আসলে আদার র‍্যাঙ্ক থেকে এই পর্যন্ত এসেছেন। তার চরিত্রের মধ্যে সেই ভাবটা কিছুটা রয়ে গেছে। শুনেছি তিনি তার প্রথম বউ মারা যাওয়ার পর তার শালিকে বিয়ে করেছেন। এটাও শুনি যে, তিনি এবং তার শালী নাকি যৌথ ভাবে ১ম স্ত্রীকে মেরে ফেলেছেন। বাকীটা কে জানে?  

০৫/০৪/১৯৮৭-এডজুট্যান্ট নিয়োগ

লেঃ লুতফর এডজুট্যান্ট থেকে রেলিংগুইসড হয়ে আমি এডজুট্যান্ট হয়েছি। নতুন অধিনায়কের আমলে নতুন এডজুট্যান্ট। অধিনায়কের অফিসের ওয়ালের সাথে আমার অফিসের দেওয়াল। একটা ফুটো করে দুই অফিসের মাঝে একটা লাল লাইট লাগানো আছে যাতে সি ও সাহেব লাল লাইট জালাইলেয়ামার এখানেও লাল বাতি জলে। এর মানে সিও সাহেব আমাকে ডাকছেন। এই ডাকাডাকি যে কতবার হয় দিনে মধ্যে, আমার আর সকালের পিটি করার দরকার হয় না। কিন্তু এডজুট্যান্ট বলে কথা, সব জায়গায় আমাকে প্যারেড স্ট্যাট দিতে হয় বিধায় অন্য কারো  ফাকি দেওয়ার সুযোগ থাকলেও আমার নাই।

আমাদের এসএম (সুবেদার মেজর) হাসেম সাহেব, খুবই কর্মঠ এবং ফাদারলি এসএম। লোকটারে আমার খুব ভালো লাগে। সে আমার কাজের পরিধির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্তপুর্ন ব্যাক্তি। বলা চলে যে, অধিনায়ক পুরু ইউনিটের বাবা মা হলে এস এম সাহেব হচ্ছেন পুরু সৈনিকদের বাবা মা।

আমি এডজুট্যান্ট হওয়াতে রোমিও ব্যাটারি খুব খুশী কিন্তু আমি জানি এখন রোমিও ব্যাটারী হোক আর পাপা বা কিউবেক যেই ব্যাটারীই হোক সবাই আমার কাছে সমান। আমি চেষ্টা করছি সারাক্ষন কাজে থাকতে। একদিকে ইউনিটের কর্মকান্ড, অন্যদিকে ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজরলুতফুল স্যারের চাপ, আর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার বাশার স্যার তো এক রকম ভীবিষিকা। ব্রিগেড কমান্ডারের বাড়ি সিলেটে। তাদের দেখলেই মনে হয় এতো বড় অফিসার?

সন্ধ্যায় রোল কল হয়। আমাকে আসতেই হয়। মাঝে মাঝে কিছু কিছু অফিসারগন ফাকি দেন। কোনো রকম ছুতা দিয়ে প্যারেড স্ট্যাট মিলিয়ে দেই।  আমার হেড ক্লার্ক নায়েব সুবেদার সামাদ সাহেব। কাজের চেয়ে অকাজ বেশি করেন। তবে আরেকজন ক্লার্ক আছে হাবিলদার মজিদ, সে চালাক চতুর। ম্যানেজ মাষ্টার।

প্রতিটি ব্যাটারীর প্রতিটি সৈনিকের ব্যক্তিগত ট্রেনিং পরিকল্পনা, এবং সারা বছরের পরিকল্পনা ব্রিগেডে জমা দিতে হয়। আর এই কাজটি বেশ স্টুপিড টাইপের কঠিন। এর মধ্যে ছুটি ছাটা, পি লিভ, এডমিন, আবার ট্রেনিং সব মিলিয়ে আসলে সেনাবাহিনীর এই ট্রেনিং কারিকুলামটা আসলে একটা ধাধা। দেখা গেলো যে, একটা সৈনিক ট্রেনিং করছে কিন্তু ক্লাশে নাই, সে হয়ত রেশন কালেকশনে গেছে। আবার কমান্ডার সাহেব ভিজিটে আসবেন, পুরু ক্লাশ মাঠের ঘাস কাটছে অথচ সেই সময় চলার কথা উইপন ট্রেনিং ক্লাশ। আমরাও নম্বর দিয়ে দিয়ে ক্যাডারগুলি পাশ করিয়ে দিচ্ছি সৈনিকদের। সৈনিকগন সব বুঝে, মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়, হাসে, ক্রিটিসাইজ করে। জুনিয়র অফিসারদের কাছে ওরা অনেক কথা বলে।

সৈনিক রা জুনিয়র অফিসারের কাছে যতোটা ওপেন। ততোটাই চুপ সিনিয়র অফিসারদের সাথে। এই ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। একটা সৈনিক যদি তার ব্যক্তিগত সমস্যাগুলি বিনা দ্বিধায় তার উপরস্থ অধিনায়কের কাছে খোলাখুলিভাবে বলতে অপারগ হন, একটা সময় আসবে যে, এইসব সৈনিকেরা তাদের প্রানটা দিয়ে অফিসার এবং অফিসার বর্গের পরিবারের জন্য ১০০% ডেডিকেটেড থাকবে না। জোর করে বশ্যতা হয় না। এখন যেটা চলছে, জোর করে বশ্যতা চলছে। কোন একটা সময় আসবে যে, এখন সৈনিকেরা অফিসারদেরকে জমের মতো ভয় পায়, আগামীতে অফিসাররা এইসব সৈনিকদেরকে ভয় পাবে। আর এর কারন অফিসারগন নিজেরাই।

০২/০১/১৯৮৭-কোর্স শেষে যশোর ফেরত

শুক্রবার যশোর ক্যান্টনমেন্ট-

কোর্স শেষ করে যশোর ক্যান্টনমেন্টে আবার ফিরে এসেছি। এই গ্যারিসনে আমাদের ১৩ লং এর অনেকগুলি অফিসার আমরা। লেঃ আকবর, লেঃ ইকবাল, লেঃ মাহফুজ, লেঃ ভাওয়ালি, লেঃ বারি, লেঃ এনাম, লেঃ শাহিন। লেঃ মইন, লেঃ আশফাক, লেঃ রুসদ, লেঃ আমির, লেঃ ইসা, এরা তো শুধু আমার ১৩ লং কোর্সের দোস্তরা।  কিন্তু বেসিক কোর্স করার পর ১৪ কিংবা ১২ লং কোর্সের অফিসাররাও এক রকমের কোর্সমেটদের মতোই হয়ে গেছে। ভালো সময় কাটছে কোর্সের পর থেকে ইউনিটে।

নতুন ব্যাটরী কমান্ডার মেজর ইশহাক স্যার। তার সাথে লুতফুল স্যার অন্য ব্যাটরী কমান্ডার। ওয়ালি স্যার হচ্ছেন ইউনিটের টুআইসি। সারাক্ষন সিগারেট খান। আর ইউনিটের সিও হচ্ছে কর্নেল মামুন স্যার। বেসিক কোর্সে যাওয়ার সময় অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কর্নেল আনিস স্যার, এখন লেঃ কর্নেল মামুন স্যার এসেছেন। কোনো কিছুতেই ভালো জ্ঞ্যান নাই। ফলে টুআইসি এবং ব্যাটারি কমান্ডারগন যার যার মতো করে স্বাধীনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কমান্ডার স্ট্রং না হলে বা কমান্ড স্ট্রং না হলে এমনই হয়। নতুন অধিনায়ক লেঃ কর্নেল মামুন স্যারের প্রথম দরবারের কথা আমার মনে পড়লে কেমন যেনো লাগে। তাহলে একটু বলিঃ

লেঃ কর্নেল মামুন স্যার দেখতে ললিপপের মতো। খুব রুচীশিল বলে আমার ধারনা কিন্তু আর্টিলারী খাতে ওনার জ্ঞ্যান খুব সীমিত। অবশ্য উনি এই ব্যাপারে কারো উপর মাষ্টারী করতেও চান না। উনি দরবারে বললেন, আমি রংপুর সেনানীবাসে ডিকিঊ থাকার সময় আমার উপর একটা গুরুদায়িত্ত ছিলো প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেবের মাকে দেখভাল করা। এরশাদ সাহেব আমার এই কাজে অনেক সন্তুষ্ট এবং এই সন্তুষ্টির কারনেই আমার মেজর থেকে লেঃ কর্নেল পদে প্রমোশন। ফলে আমি আর এর বেশি হয়ত প্রমোশন পাবো কিনা জানি না, তবে আমি খুশী যে, অন্তত অধিনায়ক হিসাবে আমি একটা সুযোগ পেয়েছি। আমি আমার কোরের উপর যে খুব ভালো জ্ঞ্যান রাখি, তাও না। তবে আমি যা চাই, আপনারা এমন কোনো কাজ করবেন না যাতে আমি আমার উপরের কমান্ডারদের কাছে কৈফিয়ত দিতে হয়। টাইম মতো প্যারেডে আসবেন, অফিসে আসবেন, ব্রিগেড বা ডিভিশন থেকে যে কাজ দেয়, সেগুলি আমি সবাইকে ভাগ করে দেবো, টু আই সি সাহেব ভাগ করে দেবেন, আপনারা সবগুলি কাজ ভালোভাবে করবেন, তাহলেই আমি সফল হতে পারবো। চুরি ডাকাতির কোনো কাজ যেনো না হয়, ছুটিতে গেলে সময় মতো ফিরে আসবেন, কারো কোন আকামের জন্য আমি কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। আমি জানি আমার আর কোনো প্রমোশন হবার সম্ভাবনা নাই, তাই আমি কাউকে পরোয়াও করি না। 

যাই হোক, এই ছিলো অধিনায়কের প্রথম দরবারের ম্যাসেজ। তিনি পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বেশী পছন্দ করেন, এই ব্যাপারে কোনো ছাড় নাই। তার একটিই ছেলে, মুনতাসির মামুন। তিনি এবং তার স্ত্রী খুব ভালো একজন পরিবার। এই জাতীয় অনেক কথা। কতটা প্রোফেশনাল আর কতোটা পারিবারিক সে কথা অধিনায়ক সাহেব এই দরবারে বলার মাপকাঠি জানেন না। তারপরেও অধিনায়ক, বলতেই পারেন।

সামনের সপ্তাহে শীতকালিন অনুশীলন শুরু হবে। ৫৬ দিনের অনুশিলন। খারাপ লাগে না। ইউনিটে অনেক মজার মজার অফিসারগন আছেন। ক্যাপ্টেন গনি স্যার (এইট লং কোর্সের), নাইন লং কোরসের আছেন রাজ্জাক স্যার, সারাক্ষন অফিসার হিসাবে তিনি অনেক ভালো এবং তার অনেক কোয়ালিটি আছে এইটা প্রমান করতেই ব্যতিব্যস্ত। তিনি সৈনিক র‍্যাংক থেকে পরবর্তীতে অফিসার পদে এসেছেন বলেই হয়তেটা তার কাছে একটা বাতিক কিন্তু আমরা যারা রেগুলার অফিসার হয়ে আর্মিতে এসেছি, সেটা নিয়ে কেউ মাথাও ঘামায় না। দশ লং কোর্সের লেঃ আমিন স্যারের জুরি নাই। মেয়েলী গলায় সুন্দর কথা বলতে পারেন আর মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ত করার ঊনার কোনো জুরি নাই। কিন্তু মানুষটা চমৎকার। লেঃ নিজাম স্যার হচ্ছেন আমার খুব পছন্দের একজন মানুষ। আমাদের মীরপুরের বাসিন্দা তিনি। আমি বেশীর ভাগ সময় নিজাম স্যারের সাথেই কাটাই। তিনি আমাদের কোয়ার্টার মাস্টারের দায়িত্তে আছেন। ১২ লং কোর্সের আমার ক্যাডেট কলেজের বন্ধু হচ্ছে লেঃ লুতফর। আপাতত এডজুট্যান্ত হিসাবে কাজ করছে। আমার রুমমেট।

৩য় লং কোর্সের মাহবুব স্যার মাই ডিয়ার লোক। দারুন মানুষ। ভালো মানুষ। পিচ্চি পুচ্ছি দু একটা ২ লেঃ আছে তার মধ্যে ১৪ লং কোর্সের আলমগীর, আমাদের মানিকগঞ্জের ছেলে। ভালো ছেলে, লাজুক গোছের। আর বরিশালের হেমায়েত করিম এই কয়দিন আগে কমিসন পেয়ে ৪ মরটারে এসেছে। এখনো পুব পশ্চিম কিছুই চিনে না। চিনে যাবে। 

একটু ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। সামনে শীতকালিন অনুশিলনের কারনে সবাই বেশি খাটাখাটি করাচ্ছে এবং করছে। আমাকে এডজুট্যান্ট বানানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু আমার এই সময় বেশি আগ্রহ নাই। দেখা যাক সিও সাহেব কি করেন।

মিতুলকে সময় দিতে পারছি না। তবে চিঠি লিখা অব্যাহত আছে।

২৮/১১/১৯৮৬-অনিরাপদ আমি

 ১১ অগ্রায়ন, ১৩৯৩, ০৬০০ সকাল, শুক্রবার

আজকে ডাইরি লেখার কোন ইচছেই ছিল না আমার। তাও আবার এত সকালে। কিন্ত আমি যেন শান্তিতে নেই। আর এই অশান্তিটা কিসের আমি ভাল ব্যখ্যা করতেও পারছি না। একটা অসস্তি কাজ করে সারাক্ষন। হরেক রকমের চিন্তা মাথায় আসছে। আমি আসলে ব্যক্তিগতভাবে খুবই অনিরাপদ অবস্থানে আছি। অনিরাপদ বলতে যা বুঝায়, তা হলো, আমি আসলেই একা। যদি কেউ প্রশ্ন করে আমাকে, তোমার নাম কি? আমি বলব, আখতার। যদি প্রশ্ন করে, তোমার বাবার নাম কি? আমি উত্তর দেব, আখতার। যদি প্রশ্ন করে, তোমার মায়ের নাম কি? আমি তাও বলব আখতার। অর্থাৎ আমি একা।  যেদিন থেকে আমার জ্ঞ্যন হয়েছে সেদিন থেকে আমি অন্তত একটা জিনিস বুঝতে পেড়েছি যে, আমি একা। তবে আমার ভাই আমাকে একটা প্লাটফর্ম দিতে পেড়েছিল যার উপর দাঁড়িয়ে আজ আমি অন্তত একটা সম্মানজনক চাকরি করতে পারছি। একা বেচে যেতে পারব। এ যেন সাগরের সেই ওপারের গল্প। গল্পটা শুনিয়ে দিয়েছ, সাগরেও নামিয়ে দিয়েছ অথচ আমার না আছে বৈইঠা, না আছে নৌকা। সাতার দিয়ে আমি ওই পাড়ে যেতে পারব তো?

ছোট বেলার অভিজ্ঞতা আমার খুব একটা সুখের নয়। শুনেছি আমাদের বিশাল রাজত্ত ছিল একদা। জমিজমা ছিল অঢেল, আমাদের বাড়িতে নাকি কখন চুলা নিভত না। কে এল, আর কে গেল, কে খেয়ে গেল এটা এ বাড়ীর কোন ব্যাপার ছিল না। কিন্তু বাবা মারা যাবার পর এ বাড়িতে আর চুলা জ্বলতে চায় না। পাঁচটি বোন, একটা ভাই (আমি নিজে) আর একটা মা, সব দায়িত্ত পরল গিয়ে ঐ হাবিব ভাইয়ের উপর। উনার বয়সই বা কত? সবে মাত্র কলেজ পাশ দিয়েছে। এর মধ্যে আবার দেশে একটা যুদ্ধ (১৯৭১) হয়ে গেল। চারিদিকে হাহাকার, হাবিব ভাইয়ের জন্য না আছে সঞ্চিত টাকা, না আছে জমি থেকে পাওয়া শস্য, না আছে একটা চাকরি। অথচ তার রয়েছে এক বিশাল সংসার। গা শিউরে উঠে। কি কঠিন পথ। আর এটা বাস্তবতা।

হাবিব ভাই প্রতি সপ্তাহে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে আসতেন, এসে আমাদের পড়াতেন, আসার সময় দুই হাতে দুইটা ব্যাগে আটা এবং চাল নিয়ে আসতেন। ওটাই ছিল আমাদের সপ্তাহের খাবার। মা অনেক ক্যালকুলেসন করে করে কোন রকমে আমাদের খাওয়াতেঁন। রুটি বানালে বেশি আটা লাগে তাই আটা জ্বাল করে আমরা খেতাম। ব্যাপারটা রিফুজিদের মতো। আমি এই আটা জ্বাল খেতে পারতাম না। ফলে মা, কোন রকমে পাতলা একটা বা দুটু রুটি বানাতেন শুধু আমার জন্য। আমার বাকী পাচ বোনেরা এটা নিয়ে কখনো কোন প্রশ্ন তুলে নি। কারন তারা জানে আমি আতা জ্বাল খেতে পারি না, আবার তারা আমাকে একমাত্র ছোট ভাই হিসাবে খুবই স্নেহ করে। সপ্তাহে আমরা হয়ত দুইদিন ভাত খেতে পারতাম তাও আবার অর্ধেক পেট। পড়াশুনা করা আমার কাছে একটা বিরক্ত মনে হত। প্রায়ই হাবিব ভায়ের দিয়ে যাওয়া পড়াশুনাটা আমি শেষ করতে পারতাম না, সারাদিন সুধু খেলা করতে ভাল লাগত। আমি তখন মাত্র ক্লাস ফাইভে থেকে সিক্সে উঠেছি। হাবিব ভাই বুঝতে পারলেন, আমি গ্রামে ভাল মত পড়াশুনা করছি না।

একটা সময় ছিলো যখন এতো কষ্টের মধ্যেও অনিরাপদ মনে হতো না। কিন্তু আজ আমি কষ্টে নাই, তারপরেও কেনো এতো অনিরাপদ মনে হয়? অনেকবার ভেবে দেখেছি ব্যাপারটা। ভালো উত্তর খুজে পাই নাই। তবে একটা ভাবনা মনে হয়েছে যে, অনিরাপদ শুধু ভালো থাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। নিরাপদ জীবনের জন্য আশেপাশে আপনজনের প্রয়োজন। যখন ছোট বেলায় এতো আর্থিক কষ্টে ছিলাম, তখন মাথার উপর ভাই ছিলো, মা ছিলো, বোনেরা ছিলো। কিছু হলে তারা তো আছেন, এটা একটা ভরসার স্থান ছিলো। এখনো তারা আছেন, কিন্তু এখন তারা ঐ রকম করে নেই যে আগলে রাখবেন। এখন আমি বড় হয়েছি, অনেক কিছুই আমাকে আর কৈফিয়ত দিতে হয় না। কিন্তু যেদিন থেকে কৈফিয়ত দেওয়ার দিন শেষ হয়ে যায়, তখন নিজেই সব, নিজের সব কিছু নিজেকেই সামাল দিতে হয়। কিন্তু এতো বড় দুনিয়ায় সব তো একা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। তাই মাঝে মাঝে খুব ভয় করে, অনিরাপদ মনে হয়।

হয়তো, এটাই এটা সেটা যা আমার বেলায় হচ্ছে। জীবন বড় কষ্টের এবং বেচে থাকার নামই হচ্ছে বাহাদূরী। 

২৩/১১/১৯৮৬-ঢাকায় গমন

০৬ অগ্রায়ন, ১৩৯৩

গত কয়েকটি বৃহস্পতিবার পরপর ঢাকায় গেলাম। কারনটা মানসিক ছাড়া আর কিছুই না। সেই সুদূর চিটাগাং থেকে ঢাকায় আসা আবার ঢাকা থেকে  চিটাগাং একই দিনে ফিরে যাওয়া খুব সহজ কাজ না। তারপরেও কাজটা আমার কাছে বোরিং মনে হয় নাই। এই আসা যাওয়ার মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত আরেকটা আশা জেগে থাকে। আর সেটা নিছক একজন মানুষকে দেখার নিমিত্তে। সবাই মনে করতে পারে যে আমি শুধু ভাবি আর ভাইয়াকে দেখতে এসেছি, আসলেই কি তাই? এর আগেও তো অনেক  বৃহস্পতিবার এসেছে, তখন এতো ঘন ঘন আসিনি, কেন? ব্যাপারটা আসলে মিতুল। যেদিন থেকে ও আমাকে চিঠি দিয়েছিল তারপর থেকে আমি বোধহয় একদিনও মিস করিনি যে আমি ওকে চিঠি লিখিনি। ব্যাপারটা একটা  নেশার মত হয়ে দাড়িয়েছে। ঢাকায় আসা যদি ভাইয়া আর ভাবীই কারন হত তবে আমার সবসময় বাসায়ই থাকা হত কিন্ত আমি বেশীর ভাগ সময় কাটাচ্ছি বাইরে বাইরে। সন্তান যখন বড় হয়, তার সাথে অভিভাবকদেরকে বন্ধুর মতো বসতে হয়, তার গতিবিধি বুঝতে হয়। আমার বেলায় এই দিকটা একেবারেই অনুপস্থিত। এই যে গত বৃহস্পতিবার ২২ নভেম্বর, অনেকক্ষণ বাইরে ছিলাম, যার ফলে বাসায় দুপুরের খাবার খাওয়া হয় নাই, রাতেও ফিরলাম অনেক রাতে। কোথায় যাচ্ছি, কেনো যাচ্ছি, এতো দূর থেকে কোনো কারন ছাড়াই ঢাকায় আসছি, আবার তড়িঘড়ি করে সেদিনই ব্যাক করছি, এইসব অভিভাবকদের খেয়াল করতে হয়। বাইরে থেকে খেয়ে আসছি, ঘরের খাবারে মন টিকছে না। পেটে খুধা নেই, তারপরেও খেতে হবে বাসায়। এটাই হচ্ছে। আজ রাতেই ১০ টায় আবার চিটাগাং যেতে হবে। খেতে বসলাম, ভাবী অভিমানের সুরে বললেন, তোমাকে খেতে হবে না। বুঝলাম, রাগ করেছেন। রাগ করারই কথা। ভাইয়া সকালে উঠে সেই ঘাঁট থেকে ছোট মাছ কিনে এনেছেন, ভাবী কষ্ট করে রান্না  করেছেন অথচ আমার খাওয়া হয় নাই। এটা কেমন কথা?

কারো উপরেই আমার রাগ নাই। কার উপর রাগ করবো? আমি তো বড়ই হচ্ছি একেবারে কোনো মালী ছাড়া। মালী ছাড়া বাগানে যতো সুন্দর আর দামী গাছই থাকুক না কেনো, তার বিকাশ তার মতো করেই হবে। যাই হোক।

গত শুক্রবারে মিরপুরে মিতুলের সংগে দেখা হল। আর দেখাটাও হল আকস্মিক। আমি আর লেঃ ভাওয়ালি আমাদের বাসা থেকে হেটে হেটে গাবতলি যাচ্ছিলাম সাভার যাব বলে। ঠিক মোড়েই মিতুলের সংগে দেখা। ও রিক্সায় হয়ত কোঁথাও যাচ্ছে। সম্ভবত ওদের বাসায় ফিরছে। আমাদের দেখে মিতুল খুব লজ্জায় পরেছে বুঝতে পারলাম। আমি হেসে দিলাম, মিতুলও। ভাওয়ালি বলছিল মিতুলকে নিয়ে সশস্র বাহিনি দিবসের অনুষ্ঠানে যেতে, কিন্তু মিতুলকে বললে কি আসলেই ও যেত? আমাদের সমাজ এখনো ঐ স্তরে পৌছায় নাই যেখানে পরের বাড়ির একটি মেয়ে ভালো লাগে বলেই আমার সাথে কোনো এক মেলায় যেতে দিবে। আমিও সেটা আশা করি না।

২৬/১১/১৯৮৬-মিতুলকে চিঠি

০৯ অগ্রায়ন, ১৩৯৩

মিতুল

এখানে সারাদিন কোলাহল থাকলেও রাত হলেই জায়গাটা একেবারে নিস্তবদ্দ আর নিঃশব্দ হয়ে ওঠে। মনে হয় লোকজন নেই, হয়ত কোনকালে ছিলও না। হাটি হাটি পা পা করে যখন সিঁড়ি বেয়ে ছাদে আসি, খোলা আকাশের নীচে দাড়াই, ঠিক তখনি সমস্ত আঁধার কিংবা জোসনা ভেদ করে নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী কোরে যেন প্রায়ই তুমি এসে হাজির হও আমার পাশে। তুমিও কি একা? রাত বাড়ে, আর তুমিও যেন আরও কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরো। কেন এমনটা হচছে? আমি কিন্তু তোমাকে নিয়ে এমন কোন অসম্ভব ভাবনা ভাবছি না, তারপরেও কেন ইদানিং এ মোহটা আমাকে চারিদিক থেকে আঁশটেপিষ্টে ঘিরে ফেলছে? আগে কোন কিছু হারানোর ভয় আমার মধ্যে কাজ করত না, কিন্তু ইদানিং কিছু একটা হারানোর ভয়ই সারাক্ষন কাজ করে। মনে হয় যদি সারাজীবন এর চাহিদা না থাকে তবে কেন এই চাওয়া? অর্ধপাওয়া যে আরও কষ্ট। আমার এ ভয়টা মূলত তোমাকে নিয়ে। কদিন যাবত আমি তোমার কোন চিঠি পাইনি। আজও পেলাম না। ভাল লাগছে না। তুমি ভাল আছ তো ? বিকেলে একটা পার্টি ছিল, ভাল লাগছিল না, তাই গেলাম না। আমি ভাল গানও গাই না আবার ভাল হারমনিয়ামও বাজাতে পারি না, কিন্তু কিছু কিছু গান হারমুনিয়মে আমি তোলতে পারি। যখন মন খারাপ থাকে, আমি হারমুনিয়ামে ঐ গানগুলো প্রায়ই বাজাই। আজ ঐ গানগোলোও ভাল লাগলো না। ভাবছি আগামী ৪ তারিখে আসব না, কারন ৬/১২/১৯৮৬ তারিখে একটা কনফারেন্স আছে। তোমাকে না পেলে আরও খারাপ লাগবে আমার ঐদিন। আমি ভাল আছি, তুমি ভাল থেক। কি লিখব আর আজ? তুমি ভালভাবে পড়াশুনা করবে, পড়াশোনার ক্ষতি করে রাত জেগে আমাকে চিঠি লেখার দরকার নেই। সময় পেলেই চিঠি লিখবে। আর আমি এটাও জানি, তুমি সময় কোন না কোন ভাবে বের করবেই। তানি ক্যামন আছে? ওকে চিঠি লিখেছিলাম, পেয়েছে কি? ওর প্রতি রইল স্নেহ আর শুভেচছা। আর তোমাকে? এক রাশ সবুজ ফুলের কিছু সুগন্ধিমাখা ভালবাসা।লাল ফুল আমার প্রিয় নয়।

আজ এখানেই।

আখতার

০১/১১/১৯৮৬-প্রভু

১৪ কার্তিক, ১৩৯৩

 

প্রভু, তুমি আপনাতে আপনি এত বিভোর হয়ে সারাশব্দহীনভাবে কেন বসে আছ? আমি তো আমার সব নিয়ে বসে আছি প্রভু ! আমি আমার সব বেদনা, সব হাসি, সব কান্না আর ভালবাসা নিয়ে তোমার জন্য বসে আছি। আমি তো আমার সব গোপন কথাগুলো সব উজার করে তোমাকে বলেছি, তুমি কি আমার কোন আরাধনাই শুননি? আমি তোমার  বিশ্বকে ভয় পাই, তুমি এই বিশ্ব ভর্তি করে রেখেছ লাল রক্ত, নীল রক্ত, কাল রক্ত, আরও কত পদের রক্তে ! আমি ঐ সব কিছুই চিন্তে পারিনা প্রভু। শুনেছি, বাঘের শত্র  মানুষ, কিন্ত মানুষের শত্রু বাঘ নয়, মানুষের শত্রু মানুষ। কারা এই মানুষ প্রভু? আমি কিভাবে চিনবো কে মানুষ আর কে মানুষ না? তুমিও কি চিনো না? এখানে নেকড়ে বাঘ আছে, কিন্ত তারা মানুষকে ভয় পায়, এখানে হায়ানারা আছে, কিন্ত তারা মানুষকে ভয় পায়, ওরা কোন মানুষ প্রভু ? আমি কি মানুষ না? ওরা কি আমাকেও ভয় পায়? মাঝে মাঝে আমি আমাকেও চিন্তে পারি না। আমি কি বেচে আছি? সুবোধ বালকের মত হেটে বেড়ানো, খাবারের সময় খাবার খাওয়া, ঘুমানোর সময় ঘুমানো, এটাই কি জীবন্ত মানুষের লক্ষন? আর কি কিছুই নেই? সেটা দাও আমাকে।

আমি বাচতে চাই, আমি কাদতে চাই, আমি হাসতে চাই।

৩১/১০/১৯৮৬-কোনো এক বিকেল

১৩ কার্তিক ১৩৯৩

কার্তিক এর বিকেলগুলোর একটা বৈশিষ্ট আছে আলাদা । ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ময়লা হাত পায়ে কলতলায় ভীর জমায়, হৈচৈ শব্দ, দূরে কাঁচা সড়কের ধার ধরে রাখালের গলাছাড়া গানের আওয়াজ, ভুবনের অন্ধ হয়ে যাওয়া ধীরে ধীরে, রাত নেমে আসে সবার অগোচরে। ঘরে ঘরে কুপির আলো জ্বলে উঠে। আর ঐ কুপির আলোর পাঁশে গোল হয়ে বসা একদল অমনযোগী ছাত্রের মনযোগী হয়ে পড়ার ভান করা দেখতে মন্দ না। গ্রামের এই দৃশ্য দেখতে খুব মজার। কুপি জ্বলছে, দূর থেকে কিছু দুরন্ত পোকামাকর কুপির আলো চুরির লোভে আত্মাহুতি, সবই সুন্দর। তার মধ্যে না শীত না গরম চমৎকার একটা আবহাওয়া। শহরে এর প্রভাব বোঝা যায় না, কিন্তু গ্রামে এটা একটা লোভনীয় ব্যাপার। গ্রাম এই তার রূপ কখনও বদলাতে পারে না। আর এই কারনেই কার্তিক কার্তিক মাসেই আসে, বর্ষা বর্ষাতেই আসে। হেমন্তকে পেতে চাও? গ্রামে চলে এস, শীত পেতে চাও? সবই এ গ্রামে আছে। পথ হারিয়ে ফেলেছ? বহু দূর? কোন অসুবিধা নেই, তোমাকে পথ দেখিয়ে দেবার অনেক মানুষ আছে। এখানে মানুষ বাস করে, এরা যন্ত্র নয়, এরা সবার দুখে কাঁদে, এরা হাসেও প্রানখুলে। তুমি অবাক হয়ে যাবে, ওদের পেটে খুধা আছে কিন্তু সর্বনাশার প্রতিহিংসা নেই। কার্তিক বড় আনন্দের মাস ওদের। ঘরে ঘরে ধান উঠবে, ঘরের বউরা অনেক ব্যাস্ত। ওরা সন্তান পালন করে বুকে আগলে রেখে, শ্যামকে তারা ত্রিপ্ত করে কলিজা দিয়ে, এরা কখন মা, কখন জননি, আবার কখন বা কন্যা। আমার মা এই গ্রামের একজন মানুষ ।

আমি যেখানে আছি, সেটা সাগরের পাঁশে একটা জায়গা। এখানে গ্রামের ছোঁয়া আছে, শহরের ছোঁয়া আছে, কিন্তু এটা আদর্শ গ্রাম নয়, এটা আবার আদর্শ শহরও নয়। এখানে মানুষগুলো গ্রাম চিনে কিন্তু শহরের ভাষা বলে, এখানকার মানুষ গুলো পল্লীগীতি বুঝে কিন্তু মাইকেল জেক্সনের গান গায়। এদের কষ্ট অন্য কেও বুঝে না, ওরাওঁ অন্যর কষ্ট বুঝতে চায় না।

ওরা কষ্টে আছে। আমি কি এখানে ভাল আছি?

৩০/১০/১৯৮৬-বদি ভাইয়ার ৫০০ টাকা

১২ কার্তিক ১৩৯৩

 

আজকে ভাইয়ার (বদি ভাই) কাছ থেকে ৫০০ টাকা পেলাম। একদিন ভাইয়াকে বলেছিলাম কিছু টাকা লাগবে, আমি তারপর ভুলেই গিয়েছিলাম । এই ভুলে যাবার পিছনে একটা কারনও আছে। আমি জানি আমাকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করবার লোক আসলে নেই। কোথা থেকে টাকাটা পাঠীয়েছেন আমার জানা নাই  কিন্তু তিনি দায়িত্তশীল ব্যত্তি, তাই ভুলে যায় নাই। টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েছেন। এটা একটা ভালবাসা হতে পারে, এটা একটা sympathy  ও হতে পারে  আবার এটা একটা প্রতিশোধ ও হতে পারে। যেটাই হোক আমি খুব খুশী হয়েছি। বদি ভাই আমাদের পরিবারের জন্য বেশ অনেক কিছু করেছেন। আমরা যখন খুব অভাবের মধ্যে ছিলাম, শুনেছি তিনি হাবিব ভাইকে অনেক সাহায্য করেছেন। ঢাকায় আমার থাকার কোন জায়গা ছিল না এবং এখনো নাই। ঢাকায় থাকতে হলে এখনো বদি ভাইয়ের বাসায়ই উঠতে হয়। আমার ঢাকায় আসার সেই কাহিনি মনে পড়ে গেল আজ। তাহলে আমার সেই ঢাকায় আসার গল্পটা বলি।

আমি যেদিন প্রথম ঢাকায় আসি, আমার একদম মন টিকতো না। আমি তখন মাত্র ক্লাস সেভেন এ পড়ি। মনে পড়ে অনেক কথা। সেই ১৯৭৬ এর কথা। আমি প্রথম যেদিন ঢাকায় প্রবেশ করলাম, ঢাকার একটা গন্ধ আমি পেয়েছিলাম। শহরের একটা গন্ধ আছে। এখন আর এই গন্ধটা পাই না। প্রথমে নৌকা, তারপর রিকশা তারপর বদি ভাইয়ের বাসা। প্রায় সকাল ১১ টার দিকে বদি ভাইয়ের বাসায় পৌঁছলাম। সঙ্গে হাবিব ভাই।  হাইকোর্ট চত্তর । হাইকোর্ট এলাকাটা বেশ বড়ো খোলামেলা জায়গা, মাঝে মাঝে শুধু হাঁটলেও ভাল লাগে। সময়টা কেটে যাচ্ছে। এটা একটা সাবলেট । সব কিছুই নতুন। বদি ভাই, হাবিব ভাইকে আমরা সবাই খুব ভয় পেতাম, আমি পারত পক্ষে এই লোক গুলোকে এড়িয়ে চলবার সুযোগ খুজতাম, আর এখন আমি একদম তাদের হাতের ভিতর। এক দিকে ভয় আরেক দিকে আমি গ্রাম মিস করছি, একদম একা একা লাগত। কোন কিছুই আমার ভাল লাগত না। ঢাকায় আসার পিছনে একটা কারনও ছিল, আমি ক্যাডেট কলেজে পরিক্ষা দিব। আমার কোন কাজ নাই, শুধু পড়াশোনা। আমার জন্য একটা রুম দেয়া হল আর সেখানে আমি হাদিয়া আপার সাথে রাতে ঘুমাতাম। হাদিয়া আপা হল বদি ভাইয়ের বোন। আমার থেকে অনেক বড় আপা। এক বার সম্ভবত বিয়ে হয়েছিল কিন্তু সেটা আমি সিওর না। আমাকে কেও ওরা কখন বলে নি।

বদি ভাইয়ের বউ কেও আমি ভয় পেতাম, কি জানি ওনারা শহরের লোক, আমার গার্জিয়ান আর বদি ভাইয়ের বউতোঁ আর যেনতেন লোক নন। সুতরাং আমার কোন কারন নাই বদি ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে খুব একটা সহজ হয়ে মিশবার। বদি ভাই খুব বড় একটা চাকরি করেন না, খুব হিসেব করে চলেন। WAPDA ( Water and Power Development Authority) র Section Officer.তবে ওনি office এ একজন দাপটওয়ালা লোক। সৎ লোক, প্রফেসনাল লোক।

হাদিয়া আপার খুব শখ যে তিনি ভাল ইংরেজি শিখতে চান। প্রায়ই দেখতাম ইংরেজি বাক্য মুখস্ত করছেন। তারও কোন কাজ নাই আসলে। বদি ভাইয়ের ছেলে সাকি খুব ছোট। হাদিয়া আপা পানের সাদা পাতা খেতে খুব পছন্দ করতেন, হয়ত এ একটা নেশা।  কিন্তু বাইরে গিয়ে কেনবার ক্ষমতা তার ছিল না। এই কাজ তা আমি তাকে করে দিতাম। আর আপা এই জন্য আমাকে খুব আদরও করতেন। হাদিয়া আপা আমাকে আরও একটা কারনে আদর করতেন। হাদিয়া আপাও এখানে একা। আমার কাছে একটা জিনিস খুব অবাক লাগত যে এই বাড়িতে মাত্র দু জন মহিলা, এক ভাবি, আর এক হাদিয়া আপা কিন্তু  ওনাদের মধ্যে ভাল মিল ছিল না। ঝগড়া হয়ত করতে আমি দেখি নাই কিন্তু একটা গ্যাপ ছিল। আমার এই বাড়ীর খাবার  খেতে ভাল লাগত না। রুটিটা মনে হত শক্ত আর ভাত গুলো মনে হত পাথর। তবুও ত আমাকে এখানে থাকতে হবে।

হটাত একদিন দেখলাম মেহের (আমার ইমিডিইয়েট বড় বোন বদি ভাইয়ের বাসায় চলে এসেছে। ভাল লাগলো যে আমাদের বাড়ীর আরও একজন এখন আমার সাথে আছে। কিন্তু আমরা দুজন যেন রাজ্যের কষ্টে এবং মনে ব্যথা নিয়ে দিন কাটাতে লাগলাম। বেশ পড়ে বুঝতে পারলাম যে মেহেরকে আসলে এখানে আনা হয়েছে সাকিকে রাখবার জন্য আর ভাবিকে ঘরের কাজে সাহায্য কবার জন্য। হাবিব ভাই মাঝে মধ্যে এখানে আসতেন।

আমার শরীর দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। একদিন হাবিব ভাই কোন এক সন্ধায় হাইকোর্ট এর বাসায় আসলেন এবং আমাকে দেখে ওনি অবাক হয়ে গেলেন। আমাদর কষ্ট হচ্ছে ব্যাপারটা ওনি বুঝলেন। অনেক পড়ে আমি জানতে পেরেছিলাম যে, আমার থাকার কারনে হাবিব ভাই বদি ভাইকে টাকা দিতেন। কিছু দিনের মধ্যে বদি ভাই তার বাসা বদল করলেন, এবার হাইকোর্ট নয়, আগামাসিলেন , ১২৫ আগামাসিলেন। আরও একটা পরিবার থাকে এখানে । আমার সঙ্গে তাদের খুব একটা ওঠাবসা নেই বললেই চলে। হাদিয়া আপাও আছেন। একদিন হটাত করে হাবিব ভাই বল্লেন, ছবি তুলতে হবে , জীবনে কোনদিন ছবি তুলিনি, ব্যাপারটা নতুন একটা অনুভুতির জোগান দিল। ক্যাডেট কলেজে ভর্তির জন্য ছবি লাগবে। আমার পরনে যে শার্টটি ছিল, এটা ভালমত ধোয়া ছিল না। আমি হাবিব ভাইকে বললাম, শার্টটা ধোয়া দরকার ছবি তোলার আগে। ওনি হাসলেন। আমি আজও অবদি ঢাকা শহর ঘুরে দেখিনি। বিশেস করে রাতের বেলায়। রঙ বেরঙের আলো, লাল, নীল, সবুজ আরও অনেক। এই প্রথম আমি ঢাকা শহর দেখলাম বলে মনে হল। বাসায় এসে আমি ভাবীকে খুব মজা করে ঢাকা শহরের বর্ণনা দিলাম, ওনারা বেশ মজা পেলেন আমার কথাশুনে । আসলে ওনারা আমার ঢাকা শহরের বর্ণনা শুনে মজা করেননি, মজা করেছেন আমার বালকশুলব কথা শুনে। আমার এই ঢাকা শহরের বর্ণনা তাদের কয়েকদিন হাসির খোরাক হয়েছিল বলে আমার ধারণা। 

কোন এক অজ্ঞেত কারনে আবার আমার  পোস্টিং হয়ে গেল সাহিদুল্লাহ হলে, হাবিব ভাইয়ের রুমে। হাবিব ভাই আমাকে তার হলে (সাহিদুল্লাহ হলে) নিয়ে এলেন। সবাই ব্যাচেলর। সেকুল ভাই (Applied Physics এর Lecturer), আবু সুফিয়ান ভাই (সম্ভবত তিনি ছিলেন অংকের ল্যাকচারার), আর হাবিব ভাই ছিলেন Statistics এর ল্যাকচারার।  তারা সবাই ঢাকা ইউনিভর্সিটির টিচার। এখানে মাঝে মাঝে সুবরনা মুস্তফা (পরে ওনি অনেক বড় অভিনয় শিল্পি হয়েছিলেন) আসতেন, হুমায়ুন আহমেদ (পরে তিনি অনেক বড় লেখক হয়েছিলেন) আসতেন।  যাগগে সে কথা। যেটা বলছিলাম, এখানে যার যার বিছানা আলাদা, আমি আর হাবিব ভাই এক সঙ্গে এক খাটে ঘুমাই। সবাই আমাকে খুব আদর করেন কিন্তু আমি তাদের সবাইকে ভয় পাই। মেহের চলে গেছে গ্রামে, আমি শহিদুল্লাহ হলে। আমার এখানে সবচে ভাল সঙগি হচ্ছে বেগমের মা। বেগমের মা হচ্ছে ভাইয়াদের জন্য কাজের বুয়া। তিন বেলা পাক করে দিয়ে যায়। পাতলা একটা মহিলা, দেখেই বোঝা যায় যে সে অভাবে আছে।  

  

West End High School এ ভর্তি হয়েছি, বেশ দুরে।  হাবিব ভাই আরও একটা পরিবারের সঙ্গে  আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন,তা হল Newton দের পরিবার। West End High School এ আমার বেশ দুজন ভাল বন্ধু জোটে গেল, একজনের নাম মালেক, আর একজনের নাম রুমি। প্রতিদিন আমি Dhaka Medical College এর পাশ দিয়ে Salimullah Hall পার করে Azimpur Palashi র মোড় পার হয়ে Azimpur Girls School এর পাশ দিয়ে West End School এ পৌঁছতে হয়। আমি সময় পেলেই রুমিদের বাসায় চলে আসতাম, ওরা থাকত Salimullah Muslim Hall এর পাশের Quarter এ। আমি অত্যন্ত ঘনিস্ঠ হয়ে মিশে গিয়ছিলাম ওদের সাথে। আসলে কোঁথাও আমার মেলা মেশার জায়গা ছিল না। গ্রামের একটা uncultured ছেলে, শহরের অনেকের কাছেই আমার কথার বাচনভঙগী, উচ্চারণ আর গ্রামের গেয়ো কিছু আচরণতো চোখে পড়তই। আজ রুমি কোথায় আছে আমি জানি না। সে হয়ত আমাকে আর মনেই রাখেনি। রুমিরাও অনেক বড় লোক ছিল না কিন্তু কোনদিন আমি ওদের বাসা থেকে না খেয়ে আসতে পেড়েছি এটা আমার মনে পড়ে না। রুমির একটা বড় বোন ছিল, আমাকে খুব আদর করত। আজ এই সব বোনেরা কোথায় আমার খুব জানতে ইচছে করে। হাদিয়া আপা মারা গেছেন, সেটা আম জানি, কিন্তু রুমির বোন, বেগমের মা, এরা যে এখন কে কোথায় আমি  কিছুই জানি না।

West End High School এর ক্লাস করা ছাড়া আমার এখানে একটাই কাজ, লেখাপড়া আর লেখাপড়া, ক্যাডেট কলেজের জন্য প্রিপারেসন নেয়া। আমি প্রতিদিন রটিন করে পড়াশোনা করি আর হাবিব ভাই আমার পরড়াশোনার খবর নেন। আমি প্রতিদিন সকালে TSC (Teachers Student Center) এর পাঁশে Dhaka University র মাঠে এবং জিমনেসিয়ামে ব্যায়্যম করতে যাই। এটা ও ক্যাডেট কলেজে ভর্তির একটা অংশ । Dhaka University র মাঠে এবং Dhaka University র জিমনেসিয়ামে আমার মত একজন পিচ্চি ছেলে ব্যায়্যম করতে যাওয়া কিছুতেই মানায় না, তারপরেও যারা (বড়রা) ওখানে ব্যায়্যম করতে যেতেন, তারা কখনও আমাকে কোশ্চেন করতেন না কে আমি বা কেন আমি ওখানে ব্যায়্যম করতে যাই । সময়টা ভালই কাটছিল কিন্তু সমস্যা হল, এখানে থাকার ব্যাপারটা নিয়ে। সবাইত ব্যাচেলর, আবার এখানে যার যার বিছানা আলাদা, আমি আসলে এখানে অনেক ভাবেই মানানসই নই। West End High School টা ও দূরে, হাবিব ভাই হয়ত অনেক কিছু ভেবে শেষ পর্যন্ত আমাকে Newton দের বাসায় রাখার প্লান করলেন। Newton ও ক্যাডেট কলেজে পরিক্ষা দেবে, সুতরাং ব্যাপরটা ম্যাচ করছিল। এখানে এসেও আমি একজন খুব ভাল বোন পেলাম। নাম জুয়েনা আপা। জুয়েনা আপা আমাকে খুব আদর করতেন। আমার অনেক কাজ, অনেক বকা, অনেক Emotional দাবী সবই পুরা করতেন । Newton খুব চাল্লু ছিল, আমি যা বুঝতে পারতাম আজ, Newton তা বুঝতে পারত তিন দিন আগে।

হাবিব ভাই ওলমোস্ট প্রতিদিন আসতেন আমাদের পড়াতে। সামনেই ক্যাডেট কলেজের পরিক্ষা। ক্লাসও করি আবার ক্যাডেট কলেজের প্রিপারেসনও নিচ্ছি ,

আমার ধারণা আমি চান্স পাব।

যাক, এবার যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তা বলি। এই বদি ভাই না থাকলে হয়ত আমি ভালভাবে ঢাকায় থাকতেই পারতাম না। ওঁনার অনেক অবদান আছে আমার জীবনে। ভাবীকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, ভাল মহিলা। খুব বেশি দাবী দাওয়া তার নাই। তার একটা সংসার দরকার এবং সেটা আছে। ব্যাস, ওনি খুশী।    

২৯/১০/১৯৮৬-হালকা হওয়া

১১ কার্তিক ১৩৯৩

সারাদিনের পরিস্রমের পর সন্ধা হলেই গোসল করার পর একটু “হালকা” হয়ে যাবার ইচছে করে। আর এই “হালকা” Period এ ইদানিং মিতুলকে নিয়ে বেশ চিন্তা করছি। এই মুহূর্তে আমি একটু “হালকা” র মধ্যে আছি এবং মিতুলের সাথে কথা বলতে ইচছে করছে। কিন্তু দেখা হলে কি কথা বলব? এটাকে বলে সঙ্গদোষ। মানুষের সাধারন প্রবৃত্তি হচ্ছে, সে সহজেই এমন কিছু সঙ্গ দোষের কারনে নিয়মিত হয়ে যায়, যা পরবর্তী সময়ে এটা ব্যক্তিগত, সামাজিক জীবনে চরম অবক্ষয় ডেকে আনে। আমার উচিত হচ্ছে না এই অফিসারদের সাথে সঙ্গ দোশের কারনে এমন কিছু করা যা আমার দ্বারা শোভা পায় না। নষ্ট হয়ে যাওয়া খুব সহজ কিন্তু ভালো হতেও পয়সা লাগে না। আমাদের উচিত ভালো কিছু করা। বিখ্যাত কোনো মিনিষির উক্তিকে ভুল্ভাবে ব্যাখ্যা করে তাকে নিজের জন্য কাজে লাগানো কোনোভাবেই উচিত নয়। তাতে লাভ হয় না। বরং ক্ষতিটাই বেশি। 

মিতুল তোঁমাকে বলছি, তুমি ইদানিং কেমন করে দিন গুলো কাটাচ্ছ?  নিশ্চয়ই তুমি আমার চিঠি পাবার আশায় আছ, নিশ্চয়ই টিভি দেখে অথবা মাঝে মাঝে গান শুনে। আর হয়তো মাঝে মাঝে আমার নাম লিখে শতবার মুছেমুছে।  আমি আসলে আমার অবস্থাটা কল্পনা করেই এই মন্তব্যটা করছি। আমি কি মেয়েটার প্রেমে পড়েছি? না দেখে তো একবার কার্লার প্রেমে পড়েছিলাম। সেই প্রেমের শেষটা জানি কি হয়েছিল? আমি আসলে মেয়েদেরকে বুঝতে পারি না। আকাশে চাঁদ উঠলে ওরা কবিতা আর শুনতে চায় না, ব্রিষ্টির দিনে সারা শরীর ভিজিয়ে গোছল করতে চায় না, অর্থওয়ালা ছেলে ওদের বেশ পছন্দ, আমি ধনী নই, আমার বাবা নাই, আমি একজন নিতান্তই সাধারণ ঘরের ছেলে। আমাকে পাবার জন্য অনেক সাধনার প্রয়োজন নেই, আমাকে পাবার জন্য শুধু হৃদয়টাই দরকার। আছে কি তোমার সেই হৃদয়? 

২৮/১০/১৯৮৬-মিতুলকে প্রথম চিঠি

১০ কার্তিক ১৩৯৩

আজকে মিতুলকে নিয়ে অনেকক্ষণ চিন্তা করার চেষ্টা করেছি। ওকে এখনো চিঠি লিখিনি, লিখব লিখব করে লেখা হয়ে ওঠছে না। আমি ভাবছি কি লিখব বা কি দিয়ে লেখাটা শুরু করব। একটা শুরু, এটা আমার কাছে যতটা না জারুরি, এটা মিতুলের কাছে ততটাই জরুরি হয়ে ওঠতে পারে। আজ ভাবছি ওকে চিঠি লিখব। ভাবছি অন্তত প্রথম চিঠিটা আমার  ডাইয়েরিতে লিখে রাখব। 

প্রিয় মিতুল

 আপনার চিঠি পেলাম। এতদিন পর আপনার চিঠি আমাকে বেশ আনন্দ দিলেও আরও বেশি অবাক করেছে যে আপনি আমাকে অনেকদিন ধরে মনে রেখেছেন এবং আপনি আমাকে ভুলে যাননি। ভাবতেই জিনিসটা ভাল লাগছে আর মনটাও ভাল লাগছে। নাহ, আমি আপনাকে ভুলতে ভুলতেও ভুলিনি। তবে আপনার আরেক নাম যে মিতুল তা আমার জানা ছিল না। নামের কারনে চিঠিটা প্রায় হারাতে বসেছিলাম, যাক, শেষ পরযন্ত হাত ছাড়া হয় নাই আর কি। অনেকবার আপনার চিঠিটা পরলাম, তারপরেও চিঠিটা পরতে ভাল লাগছিল। খুব খুশী হয়েছি আপনার চিঠি পেয়ে। ক্যামন কাটছে আপনার ওখানে? আমি আসলে কি লিখব আপনাকে আমি এখনো বুঝে উঠটে পারছি না, তবে আপনাকে লিখতে আমার ভাল লাগছে।

চিঠি লিখবেন, আমি ও আপনাকে চিঠি লিখব। ধন্যবাদ।

আখতার

২৭/১০/১৯৮৬-মিটুলের প্রথম চিঠি

৯ কার্তিক ১৩৯৩

আজ থেকে প্রায় ৫ মাস আগে মীরপুরে যে মেয়েটির সাথে আমার সারারাত টিভি দেখা হয়েছিলো, সেই মেয়ে, মিটুল, তার কাছ থেকে আজ আমি একটা চিঠি পেলাম। আমার জীবনে আজ পর্যন্ত যে কয়টি মেয়ে চিঠি লিখেছে, তার মধ্যে সে দ্বিতীয়। প্রথম জন ছিলো কার্লা। এই কার্লার সাথে আমার চিঠি আদান প্রদান হয় প্রায় ৪ বছর। কোনো ক্লান্তি বোধ করি নাই। বারবার মনে হয়েছে, আমি কখনোই যেনো ক্লান্ত হবো না। কিন্তু শেষ অবধি তার যবনিকা হয়েছে কোনো এক মর্মান্তিক শোকের মাধ্যমে। আমি সেই গল্পটা কখনই কাউকে বলতে চাই না।

চিঠিটি পেয়ে প্রথমেই ভরকে গেলাম। আমি এটা receive  করতে দ্বিধা বোধ করছিলাম কারন মিতুল নামে আমি কাউকে চিনিনা। তবুও receive করলাম এবং এটার কারনও ছিল। কারন হল মিতুল নামের ঠিক নিচেই Jahangir Nagar University লেখা ছিল। আর আমি Jahangir Nagar University তে ভর্তি হয়েছে এমন একজনকে চিনি, সেটা হল আসমা। যার কথা আমি আগেও লিখেছি। সত্যি তাই হল চিঠি খোলার পর। মিতুলই আসমা।

খুব সুন্দর চিঠি লিখেছে সে কিন্তু অতি সামান্য কথা।

“ঠিকানা ছিল না আপনাকে দেবার মত, তাই চিঠি লিখতে পারিনি। নিশ্চয়ই ভুলে  যান নাই। চিঠি লিখলে খুশী হব। আমাকে লেখার ঠিকানা দিলাম। চিঠির অপেক্ষায় থাকলাম।“ 

উপরে নীচে কোথাও কোনো সম্বোধন নাই। আমি কি বন্ধু, নাকি ভাই, নাকি প্রিয় কেউ, কিছুই উল্লেখ নাই। এলাকার ভাই হলে এক কথা, নাও না। আবার প্রিয় কেউ হলে অন্য রকমের সম্বোধন হবে। আর ও ট আমার বন্ধু হয়েই উঠেনাই এখনো। হয়তো সময়ই বলে দেবে কি সম্বোধন হবে কোনো এক সময়।

আসলে মিতুলকে আমি প্রথম দিন যতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম ও তার থেকেও বেশি বাস্তববাদী । আর একারনেই ও  আমাকে নির্ভয়ে চিঠি লিখেতে পেরেছে। বাংলাদেশটা এখনো অতটা আগায় নাই যেঁ ইচছে করলেই একটা মেয়ে নির্ভয়ে অন্য একটি ছেলেকে  চিঠি লিখেতে পারে। এটা একটা সাহসের ব্যপার। এ সমাজে আমরা যারা বাস করি, হয়ত এটা আগের শতাব্দির বা যুগের থেকে অনেক এগিয়ে আছে কিন্তু এর মানে এই নয় যে, প্রকাশ্যে আমরা এতা বলার সাহস করতে পারি যে, আমি অমুককে ভালোবাসি, অথবা অমুক আমাকে ভালবাসে। হয়ত এমন একটা যুগ সামনে এম্নিতেই আসবে যখন বাবা-মাই জিজ্ঞেস করবে, কেনো তাদের বাচ্চাদের কোন প্রিয় মানুষ নাই। এখন যেমন প্রিয় মানুষ থাকলে বাবা মায়েরা, অভিভাবকেরা অসস্থিতে ভোগেন, হয়ত এমন একটা সময় আসবে যখন বাবা মায়েরা কেনো তাদের প্রিয় মানুষ নাই তার জন্য অসস্থিতিতে ভোগবেন। আর এটাই হচ্ছে সময়ের বিবর্তন।

মিটুল আমাকে চিঠি লিখতে পারে নাই কারন তাকে আমার চিঠি যাওয়ার কোনো ঠিকানা সে দিতে পারে নাই। ওর বাসায় আমার চিঠি যাক, এতা যেমন ওর জন্য সস্থিদায়ক নয়, তেমনি আমার জন্যেও নয়। আর এখন যেহেতু সে ইউনিভার্সিটির হলে থাকছে, ফলে ঠিকানা একটা তো পাওয়াই গেলো যেখানে সব কিছুই রক্ষা হয়। যোগাযগের ব্যাপারটা থাকলো কিন্তু বাড়িতে গোপন রইলো। ব্যাপারটা এটাই ঘটেছে ওর বেলায়।

আমাদের বাড়ীর অথবা মিতুলদের বাড়ীর কেউ এখনো জানে না আমাদের এই যোগাযোগের ব্যাপারটা । আমি জানি তারা কেউ এইসব ব্যাপারে জানলে খুব একটা খুশিও হবে না। আর এ ব্যাপারে আমিও খুব একটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নই। কারন আমি আমার পরিবারকে চিনি, আমি বদি ভাইকে চিনি, আমি হাবিব ভাইকে চিনি, তারা আর যাই হোক হিটলারের বংশধর ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু আমি আগাগোড়া নিজের পছন্দেই কাজ করতে ভালোবাসি। আমার মতামতকে আমি সম্মান করি। তাতে অন্য কারো মতামত আমাকে আমার মতামতের উপরে স্থান দেবো সেটা সাবজেক্টের উপর নির্ভর করে। মিটুলের ব্যাপারতা নিয়ে আমি কোনভাবেই দিধাগ্রস্থ নই। কেউ যদি জানেও, আমার এইটুকুন সাহস আছে তা মুখুমুখি হবার।  

মিতুল সম্পরকে আমার কিছু মন্তব্য আমি আগেই করেছিলাম যদিও আমি তাকে মাত্র একটা পুরা রাত দেখেছি, একসাথে বসে টিভি দেখেছি। তাতে আমার যে ধারনাটা হয়েছে সেতা আবারো বলি, সে একেবারেই একটা সাধারন গোছের কঠিন প্রত্যয়ের মানুষ। প্রশংসায় খুশী হয়ত হয় কিন্তু সে নিজে জানে কোন প্রশংসা তার জন্য অতিরঞ্জিত আর কোন প্রশংসা তার জন্য প্রযোজ্য নয়। গা ভাসিয়ে দিয়ে আপ্লুত হবার মেয়ে সে নয়। তার মধ্যে আরো একটা গুনাবলী আমি মার্ক করেছি যে, অযাচিত ভাবে কারো ব্যাপারে মন্তব্য করাকে তার পছন্দের মধ্যে পড়ে না। অল্পতেই খুসী থাকার চেষ্টা করে। বলতে গেলে একটু সাহস রাখে সব কিছুতেই। এদেশের অধিকাংশ মেয়েরা হয় বাবা মায়ের নাম বেচে তার অস্তিত্ব জানান দেয়, অথবা যাদের নাই, তারা নিজেকে প্রতিষ্টিত করার চেষতা করে। আমার কাছে মনে হয়েছে মিটুলের ব্যাপারে দ্বিতীয়টা খাটে।

যাই হোক, অনেকদিন পর ওর চিঠি পেয়ে আমারো অনেক ভাল লাগছে, মনে হচ্ছে আমি ওর চিঠির জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। আজ সে চিঠিটা এসেছে। আমি কি ওকে খুজছিলাম? আমি আসলে কাকে খুজছিলাম? আমি ওর জন্যে বা ওর চিঠির জন্য কতোটা অপেক্ষায় ছিলাম, সেটা এই চিঠি পাবার আগে অতোটা খুচিয়ে দেখিনি, তবে মনে হলো, আমি অনেক অনেক খুশি হয়েছি।

কিছু কিছু কথা আমার মাঝে মাঝে “কাকে” যেন বলতে ইচছে করে। কিন্তু সেই “কাকে” পাই কোথায়? বড় বউদিকে মাঝে মাঝে বলি কিন্তু সব কি আর তার সাথে বলা  যায়?  কখন কখন এমদাদ কে শেয়ার করি, কিন্তু সে তো আর সেই “কাকে” নয় ।

মিতুল অনেক কিছু জানতে চেয়েছে। আমি কেমন আছি, আমার দিন কেমন যাচ্ছে, ইত্যাদি। কি জানাবো ওকে? আমি যদি বলি, আমি ভাল নেই, কি হবে এতে? আমি যদি বল, আমি মাঝে মাঝে হারিয়ে যাই, কিভাবে নেবে সে? আমি যদি বলি, আমি কাওকে ভালবাসতে চাই, কি করতে পারবে সে? আমি সেই “কাকে” চাই। ও কি সেই “কাকে”?

তারপরেও আমি ওকে চিঠি লিখব।

২২/১০/১৯৮৬-হতাশা

৪ কার্তিক ১৩৯৩

প্রচণ্ড হতাশা আর অধৈর্য আমাকে প্রতিনিয়ত ধরে বসেছে। হতাশ, কারন আমার আর ভালো লাগছে না এই রকমের একটা নিঃসঙ্গ জীবন। সেই যে যেদিন ঢাকায় পদার্পন করেছিলাম, সেই থেকে তো আমি একাই চলছি। আমার না আছে ডেডিকেটেট কোন বন্ধু, না আছে পরিবারের এমন কেউ যাদের জন্য আমাকে বাচার একটা কঠিন শপথ নিতে হয়। বড় ভাই আছেন, তিনি আমার শাসকের মতো। বোনেরা আছে কিন্তু তারা নিতান্তই বেচে আছে তাদেরকে নিয়েই। মা ও আছেন, কিন্তু তার তো শুধু ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই দেবার নাই। আর অধৈর্য!! আমার চারিপাশে আমার সমসাময়িক আর্মি অফিসারেরা একধরনের বেপরোয়া হয়ে উঠছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। কেউ মেয়ে, কেউ ড্রাগ, কেউ আবার  অশ্লিল ছবি ইত্তাদি নিয়ে। আর্টিলারি সেন্টার যেন একটা মানুষ নষ্টের কারখানা হয়ে উঠছে দিনে দিনে।

ইদানিং দেখতে পাচ্ছি, সিনিয়র স্টুডেন্ট অফিসাররা গোপনে মদ গিলছেন ছোটদের নিয়ে। কেউ আবার গাজার পোটলা ও সংরক্ষণ করছে যখন তখন খাওয়ার জন্য। মেসের ছাদে গেলে আকাশের বাতাস আর আগের মতো সুগন্ধি ছড়ায় না। ভেসে আসে গাজার তীব্র গন্ধ। অনেক রাত অবধি মেসে ভিসি আর চলে। দল বেধে ছোত বড় অফিসাররা মিলে গরম গরম ভিডিও ছবি চলে। তখন মেসের মেস ওয়েটারদের  কে আশে পাশে রাখা হয় না। একেবারে কেটলীতে করে চা এর ব্যবস্থা করে রাখা হচ্ছে। এর মধ্যে আবার কেউ ধীরে ধীরে সুরা পান ও করছেন।

ব্যাপারটা আর্টিলারী সেন্টারের কর্তৃপক্ষ হয়তো জানেন না। জানলে এসব করতে অনুমতি দেওয়ার কথা নয়। আমি একঘরে হয়ে যাচ্ছি। আমার এসব দেখতেও ভালো লাগছে না, আবার সারাটা মেসে যেনো কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে যাচ্ছে অফিসারেরা। ক্লাশে গিয়ে আজকাল অফিসাররা প্রায়ই ঘুম ঘুম চোখে ক্লাশ করছেন যেনো রাতে রাজ্যের পড়ায় ব্যস্ত ছিলেন।

১২/১০/১৯৮৬-হিন্দুদের পুজায় একদিন

২৫ আশ্বিন, ১৩৯৩

গতকাল সন্ধ্যার পর  হিন্দুদের এক পুজা দেখতে গিয়েছিলাম। পুজা দেখাটা আমার শখের মধ্যে একটা।  হিন্দু সমাজে কাস্টভেদে অনেক প্রকারের রেওয়ায চালু আছে। পথে যেতে যেতে  দেখলাম, একটা ছোট বালিকা তার থেকে আরও বড় একজন বালিকার সামনে দাঁড়িয়ে একটা হারিকেন জ্বালিয়ে মন্ত্র পড়ছে। আবার কেউ ভাইকে সামনে রেখে বোন, বোনকে সামনে রেখে ভাইও মন্ত্র পড়ছে। একটা সুতা পড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যাপারটা খুব বড় কিছু না কিন্তু এটা একটা রেওয়াজ হয়তো।

প্রতিটি ধর্ম ভালো কথা বলে, প্রতিটি রেওয়াজ কোন না কোন মহৎ একটা উদ্যোগে তৈরী হয়। এইসব উদ্যোগ পরবর্তীতে কে কিভাবে পরিশোধন করে সমাজে কি অঘটন আর কি শুভ লক্ষন নিয়ে আসে, তা দেখার জন্য অনেকটা সময় পার করতে হয়। আজকে এই যে রেওয়াজ টা দেখছি, তার মাহাত্য হচ্ছে, এতে বড় আর ছোটর মধ্যে একটা ভালবাসার বন্ধন তৈরি করা, একটা শ্রদ্ধার পরিবেশ সৃষ্টি করা। ছোতদের শিখিয়ে দেয়া যে, বড়দের সম্মান করতে হয়, আর বড়রা শিখে যে, ছোটদের ক্ষমাকরে দিতে হয়। এটা আজীবনকাল হয়তো চলবে আর এভাবেই বেঁচে থাকবে ওদের বন্ধন। হয়ত আজ সারদিন ওরা ঝগড়াও করেছিল, কিন্তু এখন সব ঝগড়া ভুলে পুজা করছে। একজন দিচ্ছে আর আরেকজন নিচ্ছে। দিনশেষে কারোর কোন  কষ্ট নাই আর। ছোট পুজার ছলে ক্ষমা চেয়ে নিলো আর বড় ভালবাসায় সিক্ত করে দিল ছোটকে। বড় সুন্দর  দৃশ্য। এই রকম আরো অনেক ছোট ছোট রেওয়াজ প্রায় সব ধর্মের মধ্যেই আছে।

পুজা মণ্ডপে পৌঁছে গেছি, গিয়ে দেখলাম দশহাতওয়ালা একটা মানব, সাথে একটা বাঘের মুখ। বাঘের মুখে মানবের ডান হাত কামড়ান। আরেক হাতে একটা তীর ছুড়ানো, অন্য হাতে ছায়া প্রদানের উৎস, প্রকৃত অর্থ প্রতিটি হাতে দাড় করানো হয়েছে। ওটা হচ্ছে দেবী। এই দেবীর আসে-পাশে আরও অনেক দেব-দেবি আছে। দেবীর পিছনে একটা মহাশূন্য আছে, তাতে কয়েকটা নক্ষত্রও জ্বলছে। পুরো জিনিষটা একটা ঘরের মধ্যে রাখা। ঘরের চারদিকে  মোমবাতি  জ্বালানো। আগরবাতিও আছে, কিছু সুগনধি আছে, পরিবেশটা ভাল লাগছে। একটু একটু ঠাণ্ডা আছে, কিন্তু শীত পড়েনি এখনো। দেবীর সামনে কিছু কুমারী, কিছু বৃদ্ধা, কিছু বিবাহিতা পুরুষ ও মহিলা  সজল নয়নে নতজানু হয়ে বসে আছে। আর তাদের এক পাঁশে একজন লোক বিভিন্ন ধরনের বাতি দিয়ে দেবতাকে বিভিন্ন ধরনের রঙে সাজিয়ে তুলছে। ঘরের বাইরে প্রচণ্ড জোরে জোরে ঢোল বাজতেছে, সঙ্গে পিলচি, এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র। বাজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক যুবক যুবতী নাচতেছে। পুরো জিনিসটা একটা পুজা। অনেকক্ষন পুজা মণ্ডপে থাকলাম, দেখলাম, কিছু খাওয়া হল এখানে। এটা ফ্রি। যে আসে সেই খেতে পারে। কে এখানে মুসলমান, আর কে এখানে খ্রিস্টান, তারা এটা ভাবে না। তারা ভগবানের জন্য পুজা করছে, এটাই বাস্তবতা।  রাজনীতির কোন আলাপ এখানে হয় না, মেয়ে মানুষ নিয়ে এখনে কোন আলাপ হয় না, এখানে যে যার মত করে ভাবে।

এখানে এখনো হিন্দুদের সাথে সব ধর্মের মানুষেরা তাদের পুজা মন্ডপে আসে। অনেকে আবার মূর্তি পুজা করে হিন্দু সমাজ এটা ভেবে পুজা মন্ডপের ধারে কাছেও আসেন না। আমি অনেকবার অনেকভাবে চিন্তা করে দেখেছি, কেনো এতো শু=ইক্ষিত হিন্দু মানুষগুলিও সাধারন একটা নিজের বানানো মাটির পুতুলের সামনে এই রকম করে নতজানু হয়ে পুজা করে? তারা কি বুঝে না যে, এটা একটা মূর্তি? এটার কোন ক্ষমতা নাই? এর কাছে চাওয়ার কিছুই নাই? জানে তারা। তাহলে তারপরেও কেনো করে? সম্ভবত ব্যাখ্যাটা এই রকম নয় যা খালি চোখে দেখা যায়।

ধরুন, আপনি একটা মেয়েকে বা কোনো এক ব্যক্তিকে অথবা কোনো এক ক্ষমতার উতসকে মন থেকে অনেক ভালোবাসেন, সম্মান করেন, অথবা এমন একটা ব্যাপার যে, আপনি তার জন্য নিজের জীবন ও বিপন্ন করতে দ্বিধা বোধ করবেন না। এই ভালো লাগার ব্যক্তিটি জীবন্ত একতা স্বত্বা। যখ সে আপনার সামনে থাকে, তার কারনে আপনি অনেক গর্হিত কাজ, অনেক অসদাচারন, কিংবা কোন অন্যায় কাহ করতে পারেন না। সে যদি আপনাকে কোনো কাজ করতে বারন করেন, আপনি বিনা দ্বিধায় তা পালন করেন। এটাই সেই স্বত্বার সবচেয়ে বড় ক্ষমতা। সে আপনার ইন্দ্রিয় কন্ট্রোল করে, আপনার মনোভাব পরিবর্তন করে, অথবা সে আপনাকে পরিচালিত ও করে। এই অবস্থায় ধরুন যে, সে আর আপনার সামনে নেই। আপনি মনে মনে তাকে আগের মতো ভালবাসেন, শ্রধ্যা করেন, তার আদেশ নিষেধ পালন করেন, কিন্তু যতোটা ইফেক্ট তার উপস্থিতিতে করা হয়, তার অনুপস্থিতিতে এই ইফেক্ট অনেকাংশেই কমে আসে। বা কমে যায়। এটা ইচ্ছা কৃত নয়। এতা একতা প্রভাব। কিন্তু যদি সেই একই ব্যক্তির একটা প্রতিমা বা ছবি বা এমন কিছু আলামত সামনে রাখা যায় যাতে মনোযোগ অন্যত্র চলে না যায়, তাহলে দেখা যাবে যে, একেবারে অনুপস্থিত অবস্থার থেকে প্রতিমা বা ছবি রাখলে মনোযোগের মাত্রাটা একটু বাড়ে। এজন্য বাড়ে যে, মনে হবে তিনি আমাকে দেখছেন বা আমি তার সামনেই আছি। আসল কথা হচ্ছে, পুজাকারী ব্যক্তি আসলেই এই প্রতিমাটাকে বা তার ছবিকে পুজা করছে না, করছে যার প্রতিমা বা ছবিটা সামনে আছে তাকে। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি যখন এই পুরু জিনিষটা দেখে, মনে হবে সে আসলে নিজের তৈরী এই মাটির মুর্তিকেই পুজা করছে। এখানেই দেখার আর বুঝার পার্থক্য।

যাক, আমি ধর্ম নিয়ে অনেক কথা বলতে চাই না। যার যার ধর্ম সে সে পালন করুক। কারন কে ঈশ্বর আর কে ভগবান আর কে আল্লাহ, এর বিচার প্রতিটি ব্যক্তির নিজসস ব্যাপার। ঈসশরের বা আল্লাহর কাছে সে নিজে একা জবাব্দিহি করতে হবে। ফলে অন্তরে তার কে বাস করে, কিভাবে বাস করে এটা জানেন শুধু একজন। সেই মহাম স্রিষ্টিকর্তা।

আজকের পুজা মন্ডপে এসে যা বুঝেছি তা হলোঃ একটা  সময় আসবে যখন ধর্ম নিয়ে আরো অনেক বিড়ম্বনা আছে। এই ধর্ম একদিন সমাজের মানুষগুলিকে আলাদা করে ফেলবে। এই ধর্মের কারনে কেউ সমাজ হারাবে, কেউ তার পরিচয় হারাবে। আবার এই ধর্মের কারনেই মানুষ একে অপরের সাথে দন্দে জড়িয়ে পড়বে, শান্তি নষ্ট হবে।  

আমি যদি আমার কথা বলি- সেটা হচ্ছে, মানুষ গুলিই প্রধান। আমার মুসলমান বন্ধুরা যেমন আমার কাছে প্রিয়, ঠিক তেমনি হিন্দু বন্ধুরা ও আমার কাছে সমান প্রিয়। ওদের থালায় খাবার খেতে আমার কোনো আপত্তি থাকে না। আবার ওদের প্রয়োজনে আমার শরীরের রক্ত ডোনেশন করতেও আমার কোনো দ্বিধা নাই। 

০৯/১০/১৯৮৬-কার্লার চিঠি

২২ আশ্বিন ১৩৯৩

আজ তোমার সেই চিঠি গুলো খুলে পড়লাম। একটি চিঠিতে তোমার লিপস্টিকে অনেকগুলো ছাপ তোমার ঠোটের। ইস, কি আনন্দে, কত ভরসা, কত আশা নিয়ে তুমি আমার কাছে এই চুমুগুলো সুদূর ১৪ হাজার মাইল দূর থেকে প্রতিদিন পাঠাতে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাঙলায় তুমি লিখতে, “ আমি তোমাকে ভালবাসি”। আমার মনে আছে, যেদিন তুমি প্রথম শাড়ি পড়ে আমাকে একটা ছবি পাঠালে, আমি অবাক হয়ে শুধু তাকিয়েছিলাম, কি সুন্দর তুমি। সাদা একজন বিদেশিনী, পড়নে বাঙলার শাড়ি, তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কি সুন্দর তোমার চুল, কালো নয়, সাদাটে, ঠোটে লিপস্টিক নেই কিন্তু লাল ঠোট, চোখে কাজল নেই কিন্তু মিষ্টি একটা চাহনি। আমার খুব তোমাকে ধরতে ইচ্ছে করেছিল, কিন্তু তুমি তো ১৪ হাজার মাইল দূরে।

 আচ্ছা, তোমার কি মনে পড়ে সেই প্রথম দিনের কথা? আমি তোমাকে কখনো দেখিনি, আমি তোমাকে কখনো জানতামও না। হটাত, একদিন আমার নামে এক চিঠি। ক্যাডেট কলেজে পড়ি, মাত্র ক্লাশ টেন এ পড়ি। আমরা দুপুরে খাবারের জন্য সবাই হাউজের সামনে একসঙ্গে দাড়াই। এই সময় চিঠি এলে দুপুরের খাবরের আগে হাউজ লিডার সবাইকে চিঠি গুলো যার যার হাতে দিয়ে দেন। অনেক সময় একই ক্যাডেট ঘন ঘন চিঠি পেলে FUN করার জন্য হাউজ লিডার ছোট খাটো মজা করেন সবার সামনে। আমি চিঠি না পেলেও আমার এই হাউজ লিডার এর ছোট খাটো মজা অনুভব করতাম। আমি কখনো কারো  কাছ থেকে চিঠি পাবার আশা করি না কারন, আমাকে চিঠি লেখার মানুষ নাই। তবে মাঝে মাঝে আমার বড় ভাই আমেরিকা থেকে অনেক উপদেসশমুলক চিঠি লেখেন যা আমার পড়তে ভাল লাগে না। তবুও তো পাই।  সেদিনও আমি একটা চিঠি পেলাম। নিশ্চয় আমার ভাইয়ের চিঠি। কি আর লিখবেন, ‘ভাল করে পড়াশুনা করিস, আমাকে চিঠি লিখিস। ইত্তাদি।‘ দুপুরের খাবার খেয়ে রুমে এলাম, বিছানায় গেলাম, চিঠিটা খুললাম, ওমা! একি! আমার ভাইয়ের চিঠি নয়, আর হাতের লেখা এত জঘন্য !!

"আমার নাম কার্লা ডুরাইন উইলসন। আমার ড্যাড তোমার ভাইয়ের সাথে একইওফিসেকাজ করে। ফলে তারা একে অপরেরবন্ধু। ড্যাডের বন্ধু হিসাবে একদিন আমি তোমার ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। তোমার ভাইয়ের বাসার ওয়ালে চমৎকার একটা ছবি আমার নজরে এলো। জিজ্ঞেস করলাম, ওটা কে? তোমার ভাই আমাকে জানালো এটা তুমি, তার ছোট ভাই। তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। আমার খুব ইচ্ছে হলো তোমার সাথে আমি ফ্রেন্ডশীপ করি। আমি তোমার ভাইয়াকে ব্যাপারটা জানাইতেই তিনি আমাকে তোমার সাথে চিঠিতে যোগাযগ করতে বললেন। আমি লোভ সামলাতে পারি নাই। আমি ক্লাশ সিক্সে পড়ি। তুমি কি আমার সাথে ফ্রেন্ডশীপ করবে? তোমার চিঠির আশায় থাকবো। চিঠি লিখো।" - কার্লা

এই ছিলো তোমার প্রথম চিঠি। 

তোমার প্রতি আমার কোন লোভ হল না, তোমাকে চিঠি লেখার ইচ্ছেও আমার হল না। এর অবশ্য অনেকগুলি কারন ছিলো। প্রথম কারন যে, আমি চিঠি লিখতে অভুস্থ নই। আর আমি মেয়েদের সাথে কিভাবে কি কথা বল্বো সে ব্যাপারে কোনোদিনই চেষ্টা করিনি। বলতে পারো, আমি একজন মেয়ে বিবর্জিত চরিত্র। ক্লাশ শেষে আমি সারাদিন মাঠে খেলা করি। খেলার প্রতি আমার অনেক বেশী ঝোক। আমি বেমালুম ভুলে গেলাম। কিন্তু আমি ভুলে গেলে কি হবে, তুমি ভুলনি। পরদিন, আবারো আরও একখান চিঠি।

"আমি মনে হয় অস্থির হয়ে আছি। কখন তোমার চিঠি পাবো। মাত্র গতকাল চিঠি লিখেছি, আজকেই আমার উত্তর পাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। কিন্তু কেনো যেনো বারবার মনে হচ্ছে, আমি যেনো তোমার সাথে কথা বলতে চাই। আমি তোমার ভাইয়ের কাছ থেকে ছবিটা নিয়ে এসেছি। তোমার ভাই কেনো যেন হেসে দিয়েছিলো। আচ্ছা, তোমার ছবিটা চেয়ে নেওয়া কি আমার ঠিক হয়েছে? তুমি আমাকে অনেকগুলি ছবি পাঠাবে।--ইতি কার্লা"

ব্যাপারটা যেনো কেমন হয়ে দাড়াচ্ছে। তার চিঠির অর্থ পরে মনে হচ্ছে, আমি তার সাথে না জানি কত জনমের পরিচিত। পর পর দুটো চিঠি পেলাম। কিন্তু আমার কেনো যেনো ওর প্রতি না কোনো টান অনুভব করলাম, না আখাংকা। পরদিন আবারো একই ঘটনা। এবার, অনেকগুলো ছবি। পরপর তিনদিন তিনটা চিঠি আমাকে নাড়া দিল। মনে হলো, এটা মনে হয় ঠিক নয় যে, আমি তাকে গ্রহন করি আর নাইবা করি, আমার সৌজন্যবোধ থেকেও জানানো উচিত, আমার মানষিকতাটা।  

আমি তোমাকে প্রথম চিঠি লিখতে বসলাম। আচছা, আমি কি তোমাকে প্রেমের চিঠি লিখেছিলাম? না, আমি তা করিনি কারন আমি তোমাকে ভালবেসে চিঠি লিখিনি। আমি নিতান্তই তোমাকে জানার জন্য চিঠি লিখেছিলাম। আমি তখন মাত্র ক্লাশ টেন এ পড়ি। আমার সেই চিঠিটি যা আমি তোমাকে লিখেছিলাম, সেটা ছিলো ঠিক এই রকমঃ

"আমি তোমার সবগুলি চিঠিই পেয়েছি। সময়ের কারনে বা ব্যস্ত আছি ক্লাশ নিয়ে এই কারনে আমি তোমার চিঠির উত্তর দিতে পারি নাই তা নয়। তোমার হাতের লেখা দেখে আমার একদম ভালো লাগে নাই। কিন্তু আজকে তোমার ছবি গুলি দেখে তোমাকেও আমার খুব ভালো লেগেছে। আজ মনে হয়েছে, সবার তো দেশে বন্ধু থাকে, কিন্তু আমার একজন বিদেশী বন্ধু থাকলে তো আরো ভাল। কিন্তু আমি তোমার মতো এতো ঘন ঘন চিঠি লিখতে পারবো না। আর আমার কাছে এখন অনেক ছবি নাই। যে কয়টা ছবি আছে, তার থেকে দুটো ছবি পাঠাইলাম। সামনে আমার পরীক্ষা।"

তুমি এক অদ্ভুত কাজ করে ফেলছিলে প্রতিদিন। প্রতিদিন আমি তোমার চিঠি পেতে শুরু করলাম। এর মানে তুমি প্রতিদিন চিঠি পোষ্ট করছ। আর আমিও এক নেশায় পড়ে গেলাম। তোমাকে চিঠি না লিখলে আমার যেন কি করা হল না মনে হয়। আর আমিও দেখলাম যে, তোমার চিঠি না পেলে আমারও আর ভাল লাগছে না। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, আমার এবং তোমার চিঠির ভাষা বদলে যেতে শুরু করছে। তোমার রোজকারের সব ঘটনা, কে তোমাকে কি বলল, কে তোমাকে আঘাত করল, তোমার টিচার,  তোমার বন্ধুরা কে কিভাবে তোমার সাথে ব্যবহার করে, সব যেন আমাকে না লিখলে তোমার আর ভাল লাগে না। ম্যানডি নামের তোমার একজন খুব ভাল বন্ধু ছিল যার সাথে তুমি তোমার নিজের গোপন বিষয় গুলু শেয়ার করতে। তুমি আমাকে মেন্ডির ব্যাপারেও অনেক বিস্তারিত লিখেছিলে। হঠাত একদিন ঐ মেন্ডিও আমাকে খুব মজা করে একখান চিঠি লিখেছিল।

"তোমাকে আমি দেখি নাই কিন্তু প্রতিদিন কার্লার কাছ থেকে যা শুনছি আর জানছি তাতে দেখার থেকে কম কিছু নয়। তোমরা কি একে অপরকে ভালোবাসো? তুমি তো দারুন চিঠি লিখো। তোমার প্রতিটি চিঠি আমি পড়ি। কার্লা আমাকে পড়ে শুনায়। ইশ, আমারো যদি তোমার মতো একজন এমন ভালো চিঠি লিখার বন্ধু থাকতো!!"

মেন্ডিও আমার আরও একজন অদেখা বিদেশী বন্ধু বনে গেল। ওরা একই ক্লাশে পড়ে। আমেরিকার ক্লাশ গুলি কি রকম, ওরা কিভাবে পড়ে, ওরা অফ তাইমে কি করে। বাবা মায়ের সাথে ওরা কিভাবে বাসায় একত্রে খায়, ঘুমায়, সব যেনো আমার জানা হয়ে যাচ্ছে ওর চিঠি পড়ে পড়ে। আমেরিকার ছেলেমেয়েরা কম বয়সেই অনেক পাকামো করে, ওরা অনেক কিছুই আমাদের থেকে একটু আগে বুঝে। এমনকি ভালোবাসাটাও।  

এমন করে প্রায় চার বছর কেটে গেল। এই চার বছরে কত যে তোমার চিঠি আমার বাক্স ভরে গেছে। জানো? বাক্সতার নাম কি রেখেছি? "আমেরিকার বেলুন"।

কি অদ্ভুত, আমাদের মধ্যে কোন ক্লান্তি, কোন থামাথামি নেই। আমরা ধীরে ধীরে একে অপরের জন্য শুধু যেন অপেক্ষা করছি কখন আমরা আমাদের দেখতে পাব, কাছে পাব। এটা এখন সত্যি সত্যি প্রেমে রুপান্তর হয়ে গিয়েছিল। মাত্র ক্লাশ টেনে পড়া একটি বাঙ্গালি ছেলে বিএমএ তে দুই বছর ট্রেনিং করে লেফটেন্যান্ট হয়ে গিয়েছি, তারপরেও আমার প্রেমের কোন ঘাটতি নেই। কে গো তুমি মানসী? কেন তুমি এত দূর থেকে আমাকে না দেখে ভালবাসতে শুরু করেছ? আমিও তো তোমাকে দেখিনি গো মেয়ে। কি হবে কখন যদি এই প্রশ্ন সামনে এসে হাজির হয়, আমাদের দেখা হওয়াটা কি ভুল হয়েছিল? যদি কখনো এই ধারণা হয়ও, আমি শুধু তোমাকে বলব, আমরা ভুল করিনি, আমাদের প্রেম সৎ এবং সত্যি ছিল। আমি তোমাকে ভুলব না। আমি এখনো এক অদেখা নারীর প্রেমেই আছি। এখন আমি তোমাকে ভালোবাসি।

০৫/১০/১৯৮৬-বদি ভাইয়ের বউ

                 

৫ কার্তিক, ১৯৯৩

বড় বউদি, তোমাকে আমি সাধারনত কখনো চিঠিপত্র লিখিনি। তুমিও আমাকে কখনো চিঠি লিখনি। এরমানে এই নয় যে আমি কিংবা তুমি আমাকে বা আমি তোমাকে ভালবাসি না। আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি, আমি তোমাকে আমার মায়ের মতই ভালবাসি। আমি একটা জিনিষ লক্ষ করছি যে, তুমি একটা জায়গায় ফেল করছ। আর তা হচ্ছে তুমি তোমার সন্তানদেরকে মানুষ করতে পারছ না। বিশেষ করে শাসন।  পারবে এত দূর নিয়ে যেতে সবাইকে?

একটা সময় আসবে যখন তুমি আর কখনো ওদের শাসন করতে পারবে না। কারন তখন শাসনের বয়সটাই থাকবে না। আজ তুমি যতোটা আদর করে ওদের অনেক অযাচিত আবদার, অনেক শৃঙ্খলা বহির্ভূত আচরণ, অনেক অগ্রহণযোগ্য ব্যবহার গলাদকরন করছো, কোন এক সময় এই অহেতুক আব্দারের প্রেক্ষাপটে তাদের বর হয়ে উঠা, তাদের বিশৃঙ্খল হয়ে বেড়ে উঠার মাশুল শুধু তুমি না, তোমার এই আদরের সন্তানদেরকেও দিতে হবে। তখন হয়ত এরাই তোমার দিকে আঙুল তুলে এইটা বলবে, কেনো আমাদেরকে যখন শাসন করার দরকার ছিলো, সেতা করো নাই? আজ মনে হচ্ছে তুমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাও না। মনে হচ্ছে তুমি আগামী প্রজন্মের যে ধারা এই পৃথিবীতে আসছে, তুমি সেই ধারনার থেকে অনেক পিছিয়ে আছো।

আমি যেদিন গ্রাম থেকে ঢাকায় আসি, সেদিন দেখেছিলাম, আমাদের গ্রাম এই অল্প দূরের ঢাকা শহর থেকে কত পিছিয়ে ছিলো। আর তার সাথে সাথে আমি দেখেছি, গ্রামের গর্ভে যারা তখনো বসবাস করছে, তারা ঢাকার সভ্যতা থেকে কতই না পিছিয়ে আছে। কথার বলার স্টাইল, একে অপরের সাথে ব্যবহার করার অভ্যাসে, কিংবা স্বপ্ন দেখার বাউন্ডারী পর্যন্ত জানে না ঐ সব গ্রামের মানুষগুলি। আমি গ্রাম থেকে এই শহরে এসে পুরুই একটা বেমানান প্রানীতে পরিনত হয়েছিলাম। কিন্তু আমি চলমান ছিলাম, আমি ব্যতিক্রম কি, কোথায় তার প্রতিকার, কি করা উচিত, সেটা ভাবতে বেশী সময় নিতে চাই নাই। আমি খুব দ্রুত ঢাকার পরিবেশের সাথে, মানুষগুলির সাথে, এই শহরের আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিয়েছিলাম। যতোদিন পারি নাই, সেটা আমার ব্যর্থতা নয়, সেটা আমার এডাপটেশনের জন্য সীমারেখার সীমাবদ্ধতা। তারপরে যখন আমি এই শহর থেকে আরো একধাপ এগিয়ে ক্যাডেট কলেজে গেলাম, তখন দেখেছি, সমাজের উচু স্তরের পরিবারের ছেলেমেয়েরা কিভাবে বেড়ে উঠে। তাদের কথাবার্তা, তাদের চলাফেরা ঢাকা শহরের মানুষগুলির থেকেও আলাদা। তাদের চিন্তা ধারা আলাদা, তাদের সব কিছু আলাদা। ঢাকা শহরে তোমাদের বাসায় এর চর্চা নাই। আর না থাকারও কথা। তোমরা সমাজের উচু স্তরের লোক নও। মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষ। আমি সেই অজ পাড়াগায়ের সাথে এই উচু স্তরের পরিবার গুলির মধ্যে যে পার্থক্য, যে দুরুত্ত, সেটা যথাসম্ভব বুঝবার চেষ্টা করেছি এবং আমাকে আমি ঠিক আমার পরিস্থিতির আওতায় তা মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছি। তারপর যখন আমি ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে সেনাবাহিনীর নতুন জগতে প্রবেশ করলাম, দেখলাম, এখানে আরেক জগত। এর সব ধরনের শাখা বা উইং আছে। গ্রামের অজ পাড়াগায়ের লোকজন ও আছে, মধ্যবিত্ত ঘরের অসচ্ছল সসদ্য ও আছে, আবার একেবারে উচু স্তরের সদস্য রাও আছে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, পাশাপাশি, কাছাকাছি, একই ইউনিফর্ম, একই রেশন, একই কমান্ড, অথচ কেউ কারো সাথে ম্যাচ করে না। কিন্তু সিস্টেম কাজ করে। এই এডাপ টেশন টা একটা জটিল বষয় কিন্তু একেবারেই সহজ আমার জন্য। কারন আমি সব গুলি স্তর ইতিমধ্যে নিজে পার হয়ে অভিজ্ঞ হয়ে এসেছি। তলাহীন গ্রামে বড় হয়ে দেখেছি, এখানে যারা ঐ তলাবিহীন সমাজ থেকে এসেছে তাদের কি মনের অবস্থা, তাদের কি চাহিদা। আবার তোমাদের সাথে আমি মধ্যবিত্ত ঘরের সদস্য হিসাবে এতাও অভিজ্ঞতায় পেয়েছি, এই মধ্যবিত্ত মানুষগুলির মানষিক অবস্থা কি, কি তাদের বৈশিষ্ট। ফলে সেনাভিনীর এই মধ্যবিত্ত সদস্যগুলি কে নিয়েও আমার খাপ খাইতে অসুবিধা হয় নাই। আবার ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুবাদে আমি উচু স্তরের মানুষ গুলির ব্যবহার, আচরণ, প্রত্যাশা, বৈশিষ্ঠও আমার জানা ছিলো। ফলে প্রতিটি স্তরের পরিবেশ, মানুষগুলির চাহিদা কিংবা তাদের সাথে উঠাবসা করার কৌশল আমার অনেকটাই জানা। এই সুবিধা গুলি কিন্তু আমাকে কেউ এমনি এমনি দেয় নাই, আমাকে প্রতিটি জিনিষ আহরন করতে হয়েছে, পাওয়ার জন্য আমাকে  সেই চেষ্টা গুলি করতে হয়েছে। 

আমি যদি সেই অজ পাড়া থেকে উঠে এসে এই স্তরে আসতে সক্ষম হই, তাহলে তুমি বা তোমরা কেনো এক ধাপ এগিয়ে থাকা তোমার সন্তানদেরকে আরেক ধাপা এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছো না? তোমার কাজ তো শুধু ঘরের রান্না বান্নাই না। পেটে সন্তান ধরেছো, তাহলে তাদেরকে আধুনিক সমাজের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য কি তোমার বা তোমাদের কিছুই করার নাই? ওরা পিছিয়ে পড়ছে মুল ধারার সমাজ থেকে। ওরা পিছিয়ে যাচ্ছে অবিরত যেখানে সমাজ, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। কোনো এক সময় তুমি বা বদি ভাই এর মাশুল দিয়ে হয়ত এটাই বলবে, দেশের জন্য অনেক কিছুই তো করলাম, কিন্তু নিজের পরিবারের জন্য কি করলাম? দেশ তোমাকে তোমার ঘরে এসে তোমাকে সেবা প্রদান করবে না। দেশের যাবতীয় কাঠামো গত সুবিধা তোমাকে পেতে হলে তোমার সন্তানদেরকে সেই স্তরে উঠিয়ে দিতে হবে। আর যেটা তুমি আজ করছো না। এটাই হচ্ছে তোমাদের ভুল।

 তোমার সঙ্গে হাবিব ভাইয়ের বউয়ের বিশাল একটা পার্থক্য আছে। তুমি কি সেই পার্থক্যটা বুঝো? তুমি সাগরের মত পানি আর সে দিঘিতে রাখা জল। তোমার সাগর সমান পানি অনেক সময় তৃষ্ণা মিটাবে না কারন সাগরের পানি পান করতে গেলেও তাকে অনেক শোধনাগারে শোধন করতে হয়। কিন্তু হাবীব ভাইয়ের বউ দীঘির জলের মতো পরিষ্কার, সেটা শোধনের জন্য অনেক বেশী পরিশ্রমের দরকার নাই। আমার এই কথাগুলি আজ হয়তো কোনো অর্থ বহন করে না কিন্তু হয়তবা আজ থেকে ৩০ বছর পর যদি আমরা বেচে থাকি, তার একটা পার্থক্য ধরা পড়বেই। আজ তোমার সংসার তোমার হাতে, তোমার রান্না করার পরিকল্পনা তোমার হাতে। আজ তোমার সাধ্যের মধ্যে যা কিছু ইচ্ছে হয় তুমি কোনো নাকোনোভাবে সেটা নিজের তরিকায় পুরুন করার ক্ষমতা তোমার হাতেই। কিন্তু কোনো এক সময় তোমার এই সংসার আর তোমার হাতে নাও থাকতে পারে। তখন এর চাবিকাঠি হয়ত অন্য কারো হাতে চলে যাবে। এখন তুমি শক্ত সামর্থবান, কিন্তু যখন তুমি শারীরিকভাবেও দূর্বল হয়ে পড়বে, সংসারের চাবিকাঠি আর তোমার হাতেথাকবে না, তখন মনে হবে, এই সংসার জীবনে কি আমি কিছুই করি নাই? নিজেকে তখন খুব অসহায় মনে হবে। আজ তোমার স্বামী তোমার রাজা। তার উপর তোমার অধিকার শুধু স্বামীহিসাবেই নয়, সে তোমার ধারন করে। কিন্তু কোনো এক সময়, যখন হয়ত সে আর থাকবে না, তখন তুমি অনেকের কাছেই একটা এক্সট্রা মালামালের মতো বোঝা হয়ে পড়বে। আমি আমার মাকে দেখেছি সে কতটা অসহায়। আমি আমার ভাইকে দেখেছি, পট পরিবর্তনে কতটা সময় লাগে। আজকের এই দিনটা আগামীকাল নাও একই থাকতে পারে। 

তুমি ভাল থেক।

১৯/০৯/১৯৮৬-ভগবানের প্রতি

 

হে ভগবান, তোমাকে কিছু বলার আমার সাহস নেই, তোমাকে আমার বুকের অফুরন্ত যন্ত্রনাগুলু দিয়ে প্রতিবাদ করারও শক্তি আমার নেই। কিন্তু তোমাকে ভালবাসা দিয়ে বেঁধে রাখবার ক্ষমতা বা অদম্য ইচ্ছেও আমার নেই। অথচ আমি অনেকবার সব দিক ভেবেছি, চিন্তা করেছি, কল্পনা করেছি, এই জগতে সবচেয়ে কে বেশী আমার আপন, আর সবচেয়ে কার উপর আমার রাগ। যতবারই আমি চারিদিক বিশ্লেষণ করেছি, আমি দেখেছি দু দিকেই তুমি। তোমাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসি। আবার তোমার উপরই আমার রাগ বা গোস্যা সবচেয়ে বেশী। ভালবাসি এ কারনে যে, তোমাকে অস্বীকার করার ইচ্ছে তুমি আমাকে দিয়েছ। ঘৃণার শক্তিও তুমি আমাকে দিয়েছ।  আমি ইচ্ছে করলে তোমাকে অস্বীকার করতেও পারি আবার মেনেও নিতে পারি। তাতে তুমি আমাকে কিছুই বলবে না। আর এ জন্য তোমাকে আমি ঘৃণা করার আগেই আমি তোমাকে পূজা দেই, অন্তর থেকে ভালো বাসি। আবার যখন খুব মন খারাপ হয়, তখন ভাবি, তুমি কেমন গো? চারিদিকের মানুষগুলির মতো আমাকে কেনো তুমি এটা দিলে না, ওটা দিলে না, একতা পরিবার দিলেনা, একটা খেলার ভাই দিলে না, ছলনা করার জন্য মিষ্টি একটা বোন দিলেনা, রাগ করার পিতামাতা দিলে না। কিছুই দিলে না। আবার ভাবি, তুমি তো আমাকে দুটো চমৎকার চোখ দিয়েছো, হাত দিয়েছো, পা দিয়েছো, সুস্থ্য শরীর দিয়েছো। আমি চোখ দিয়ে মন খারাপ হলে তোমার বিশাল নীলাকাশ দেখতে পাই, কোঠাও যাওয়ার প্রয়োজনে আমি সেই হিমালয়ের মতো পাহাড়ের চূড়ায় উথে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে আমাই আমার কষ্টের বেদনাগুলি ঐ চঞ্চলা সাগরের বুকে ছুড়ে দিতে পারি। আমার থেকেও তো অনেক হতভাগা মানুষ তুমি স্রিষ্টি করেছো যাদের তুমি এ গুলাও দাও নাই। রাগ থেমে যায়, কষ্ট কমে যায়, চোখ ভিজে আসে কোনো এক মায়াজালে। বাচিয়ে তো রেখেছো অন্তত। এটা তোমার বিশ্ব, এটা তোমার রাজত্ব, যাহ কিছু ঘটবে এখানে, সব তোমার আইন। খনিকের তরে যখন তুমি আমাকে তোমার এই মহাবিশ্বে নিয়ে যাও তখন আমি বুঝতে পারি তুমি কতটা বিশাল।

কবি নজরুলের ঐ গানটায় কবি একদম সত্যি কথাগুলিই বলেছেন-

খেলিছো, তুমি বিশ্ব লয়ে, হে বিরাট শিশু। ক্ষনেক্ষনে তুমি ভাংছো আবার ক্ষনেক্ষনেই তুমি আবার নতুন কিছু গড়ছো। রাশি রাশি রবি, সসী, গ্রহ নক্ষত্র সব কিছু তোমার পায়ের তলায় খেলনার মতো লুটুপুটি খায়, তোমার কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না। অথচ এই আমরা প্রতিনিয়ত কতই না কস্ট, কতইনা দুক্ষে আবার কতই না অহেতুক আনন্দে ফেটে পড়ছি। 

কোনো একদিন তোমার সাথে যেদিন আমার দেখা হবে, আমি শুধু একটা প্রশ্নই আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করবো। 

সবই যদি তুমি ঠিক করে রাখলে, সবই যদি তুমি নিয়ন্ত্রন করলে, তাহলে আমাকে এতো ভালোবাসা আর আখাংখা দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠালে কেনো? তাহলে ওইসব আখাংকা, ভালোবাসা, প্রত্যাশা কি নিছক মায়াজাল?

১৮/০৯/১৯৮৬-৭ই মে এর সেই মেয়েটা

মিটুল চৌধুরী, এটাই সেই ৭ মে তে দেখা মেয়েটি।

হটাত করে মনে পড়ে গেল একদিন একটা মেয়ের সাথে আমার দেখা হয়েছিল ৭ মে তে। কেনো দেখা হলো, কি কারনে দেখা হলো এই প্রশ্ন অবান্তর। পাশাপাশি বাসা, কেনো আগে দেখা হয়নি সেতাও যেনো একটা প্রশ্ন। বাইরে ছিলাম। যশোর সেনানীবাস থেকে ১০ দিনের ছুটিতে আছি, বেসিক কোর্ষের কারনে। এখান থেকেই আমি হালিশহর যাবো প্রায় এক বছরের একটা কোর্ষ করতে। কোনো কাজ নাই, সারাক্ষনই বাইরে বাইরে থাকি। লেঃ ভাওয়ালী আমার খুব ভালো বন্ধু, ফলে বেশীর ভাগ সময় আমি ওর সাথেই ঢাকার বিভিন্ন বন্ধুদের বাসায় আড্ডা দেই। কখনো দুপুরে ফিরি, কখনো ফিরতে ফিরতে রাত ও হয়ে যায়। বদি ভাই কিছু বলেন না, আর বলার কোনো কারন ও নাই। আমি কোনো অন্যায় করে বেরাচ্ছি না। আজ কোথাও যাওয়া হয় নাই। হয়তো দুপুর গড়িয়ে গেলে বিকালের দিকে বের হবার সম্ভাবনা আছে। বাসাতেই ছিলাম কিন্তু বদি ভাইয়ের সাথে বাজারে গিয়ে সকাল ১০ টার দিকেই বাসায় হাজির আমি। তখনি ওর সাথে দেখা হয়েছিলো। ভাবীর সাথে কি যেনো গল্পে গল্পে কিছু রান্নাবান্নার কাজে শরিক হয়েছিলো। সেদিন ওর মধ্যে একটা জিনিষ আমি লক্ষ্য করেছিলাম, ও ভাল মা হবে। ভাল বউ হবে কিনা জানিনা, আমিতো আর বিয়ে করিনি যে বুঝবো কি দেখলে বোঝা যাবে ভাল বউ হবে কিনা। তবে সব মানুষের উঠতি বয়সের কিছু লক্ষন ভবিষ্যতের কিছু লক্ষন তো থাকেই। আমি যেদিন ওকে দেখেছিলাম, বুঝেছিলাম যে, অন্য ১০ টি মেয়ের মতো ওর উচ্চাকাংখ্যা এই রকম নয় যে, যে করেই হোক, আমাকে বড় হতে হবে, আমাকে ধনী হতে হবে অথবা পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝি বা না বুঝি আমার এই চাই আমার ঐ চাই, ইত্যাদির মতো মনে হয় নাই। 

কিছু কিছু মানুষ বড় হয় মনে মনে। "মনে মনে বড় হওয়া" আবার কি জিনিষ? এটা হচ্ছে সেটা যা আমার মনে আছে আমি করবো, আমি হবো, বা আমি ওটা করে ঐটা করতে চাই। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আবার অসত উপায়েও সেটা অর্জন করতে নারাজ। ফলে, প্রতিদিনের কর্মে, প্রতিদিনের চেষ্টায় একটা প্রত্যয় সব সময়েই থাকে মনের গোপন স্বপ্নগুলিকে নিজের ক্ষমতায় রূপ দেয়া। এর জন্য যা যা প্রয়োজন, যতোটুকু চেষ্টার প্রয়োজন, সেটা নিয়ে লেগে থাকা। যদি এই চেষ্টায় সফল হয় তো ইচ্ছে পুরুন হয়ে গেলো। আর যদি চেষ্টা সফল না হয়, তাতেও কোনো দুঃখ নাই, কারন ক্ষমতা তো ছিলোই না সব সপ্নগুলি পুরনের। কারো উপরই দোষ চাপিয়ে দেয়া যায় না সপ্ন না পুরন হবার জন্য। আমি ওর মধ্যে এই রকম একটা উজ্জ্বল মনোভাব দেখেছি। আমার এই কথার মানে কিন্তু এটা নয় যে, সে অতি মানবী। হতে পারে কোনো একদিন হয়তো ও ওর স্বপ্নগুলিকে বাস্তবায়ন করতে পারবে। আমি ওর অন্যান্য সব বোনগুলিকে দেখি নাই কিন্তু যে দুজন বোন মীরপুরে আমাদের বাসার পাশে থাকে তাদের দেখেছি। বিস্তর একটা ফারাক চোখে পড়ে। ওরা ৮ বোন আর ৩ ভাই। আমি কাউকেই (শুধুমাত্র মীরপুরের ২ বোন ছাড়া) দেখি নাই। শুধু সেই রাতে ওর সাথে কথা বলে যা বুঝেছি, তা হলো, মনে মনে বড় হবার একটা তীব্র আখাংকা আছে। 

একটু একটু করে ভাবছি ওকে, আবার একটু একটু করে মনেও করছি। একটু একটু ভালোও লাগছে। 

১২/০৯/১৯৮৬-সপ্তাহ অন্তে ছুটি

হালিশহর, চট্টগ্রাম, আর্টিলারি অফিসারস মেস 

আজকে সকালেই week-end এ চিটাগাং থেকে ঢাকায় গেলাম। সকালে তারেকের বাসায় গেলাম। ওর আম্মার সাথে, ওর বোনের সাথে দেখা হল। আপা একজন ভীষন ভালো মানুষ। আমাকে ঊনি তাদের বাসার সদস্য হিসাবেই দেখেন। কখনো বুঝতে দেন না যে, আমি অন্য বাড়ির একজন মানুষ। কখনো বকেন, কখনো উপদেশ দেন, কখনো একসাথে মা আর সন্তানের মতো কেরম খেলেন। আপা পান খেতে খুব পছন্দ করেন। কিন্তু ওনার জীবনেও একটা দুঃখ আছে। কিছুদিন আগে ঊনি তার স্বামীকে ত্যাগ করেছেন। কেনো করেছেন, কি কারনে করেছেন, কার কতটুকু দোষ ছিলো আমার জানা নাই, কিন্তু তিনি একজন শিক্ষিকা, ফলে তার মানবিক গুন, সাধারন সেন্স সব কিছুই আমার কাছে যুক্তির মনে হয়েছে। যাক সে কথা বিস্লেসন করে হয়ত আমি কিছুই সুখের পাবো না। আপাদের সাথে সময়গুলি খুব আপন জনের মতো কাটছে, সেটাই আমার কাছে বড়। 

তবে একটা কথা ঠিক, আমাদের দেশে এখনো ছেলে পক্ষ মেয়ে পক্ষের মানুষগুলিকে এক প্রকার ইনফেরিওরিটির চোখেই দেখে। ভাবখানা এই রকম যে, মেয়েকে বিয়ে করে যেনো মেয়ের বাড়ির মানুষগুলিকে উদ্ধার করেছে তারা। কেনো এই রকম ধারনা? এটা অত্যান্ত নীচু মনের একটা পরিচয়। আমি এই ভাবটা বেশীর ভাগ পরিবারের মধ্যেই দেখেছি। গরীবই হোক আর বড় লোকই হোক, যাদের এই ভাবটা আছে, আমি হলফ করে বলতে পারি, রাজ্যের হুড়পরি কিংবা এঞ্জেল নিয়ে আসলেও তাদের কাছে মনে হবে, হয়তো আরো ভালো কিছু পাওয়া যেতো। ছেলেটার কি যোগ্যতা, ছেলেটা মেয়েটার যোগ্য কিনা, সেটা নিয়ে এই সব পরিবারের কোনো মাথাব্যথা নাই। সব দোষ যেনো ঐ মেয়ে পরিবারটির। আমাদের দেশে যদি এই ধারা চলতে থাকে, তাহলে একদিন এই সমাজ শুধুমাত্র মেয়েদের কাছেই জিম্মি হয়ে যাবে যেদিন মেয়েরা নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের দেশের মেয়েরা যেহেতু বেশীর ভাগই স্বাবলম্বী নয়, ফলে তারা এই যুগে এসে অনেক অন্যায় আবদার, অন্যায় আচরন কিংবা এমন কিছু ব্যবহার যা তার প্রাপ্য নয়, সেটাও সে সহ্য করে যাচ্ছে, কিন্তু তারা তাদের পরবর্তী জেনারেশনকে এমনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে যাতে তাদের পরবর্তী মেয়ে জেনারেশন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যায়। আর তখন যেটা হবে সেটা হচ্ছে, মেয়েদের একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত। তখন ছেলের পরিবারের কর্তৃত্ব আর চলবে না। এখন তো মেয়েরা ছেলের কর্তৃক ডিভোর্সড হয়, তখন ডিভোর্সড হবে ছেলেরা, মেয়েদের কর্তৃক।

ওখান থেকে মিরপুর গেলাম। গিয়ে দেখি ভাইয়া (বদি ভাই) কোরান শরিফ পড়ছেন আর ভাবী ঘর ঝারু দিচ্ছেন। আমাকে দেখেই হটাত আশ্চর্য হয়ে বললেন, “ছুটি পেয়েছ নাকি?” ভাইয়ার, বৌদির, মান্নার, সাদির সবার ছবি তুল্লাম আমার ক্যামেরা দিয়ে। নতুন ক্যামেরা কিনেছি, খুবই কম দামি কিন্তু শখ মেটানো যায়। ২লেঃ অফিসার, কতো টাকাই বা বেতন, সব মিলে মাত্র হাজারের উপর টাকা। এর মধ্যে সিগারেট, এর মধ্যে যাতায়ত, এর মধ্যে মেসিং, কাপড়- চোপড়, সবইত এর মধ্যে। “ওডী” করেই চলতে হয় সারা মাস।

এমদাদের বাসায় গিয়েছিলাম। গিয়ে এমদাদকে পেলাম। ও আজকেই যশোর চলে যাবে, আজকেই এসছিলো। ওখানে লুনা আর এমদাদের একটা ছবি তুললাম। আজই আবার চিটাগাং চলে যাবো।

আমি বুঝি না, কেনো এই ছোট একটা সময়ের জন্য এলাম, আবার আজই আমি চলে যাচ্ছি। আর এই জার্নিটাও কিন্তু ছোট না। আসা যাওয়া মিলে প্রায় ১১ ঘন্টার একটা ব্যাপার। সম্ভবত এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার যে, আমি বাসায় এলাম, আমার একটা বাসা আছে ঢাকায়। কিন্তু আসলেই কি আমার কিছু আছে এই ঢাকা শহরে? আমার গ্রাম আছে, কিন্তু গ্রাম আমাকে টানে না। বদি ভাইয়ের বাসা আছে, কিন্তু আমি সে বাসাটাকে কখনো আপন করে নিতে পারি নাই। বরং ওরাও আমাকে আপন করে নিতে পারে নাই। আমার মা আছেন কিন্তু তার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব না। আমার বোনেরা তাদের জীবন নিয়ে বেচে থাকতেই সংগ্রাম করছে। তাহলে আমি ঢাকায় কেনো আসি? আমার কাছে ঢাকা যেমন, হালিশহর তো একই। তারপরেও যেনো আমি কিছু খুজি।

কি খুজি?   

৯/৯/১৯৮৬-লুনার চিঠি

আজকে ওর চিঠি পেলাম। আর “ওর” বলাতে আবার অনেকেই ব্যাপারটা ভুল ব্যাখ্যা করতে পারে। ও আমার ছোট বোন লুনা, লেঃ এমদাদের আপন ছোট বোন। একটা ছবি পাঠিয়েছে পারুর ছবির  সংগে। পারুটা কে আমি চিনিনা। উপলক্ষ্য আমার জন্মদিন। গতকাল আমার জন্মদিন ছিল, আমার মনে নেই, কিন্তু ও মনে রেখেছে। একটা ভিউকার্ডও পাঠিয়েছে। লুনা সুন্দর চিঠি লিখে, যেমন এই  যে আজকের চিঠিটা। লিখেছে, “ভাইয়া, এখানে এই মিষ্টি মধুর লাজুক গাঁয়ে এসে থেমে গেছে ব্যস্ত ঘড়ির কাটা–সত্যি তাই। দীর্ঘ ৫ বছর পর আমি গ্রামে এসেছি। অতীতে ছিলাম একা, চঞ্চল ছোট্ট মেয়ে, আর এখন? চঞ্চলা তরুণী। তাই অতীতে যা ভালবাসিনি এখন সেটা বেশ ভাল লাগে।“ বাপরে বাপ কি পাকা পাকা কথা।

অনেকদিন যাওয়া হয় নাই ওদের বাসায়। পাশেই থাকে শহীদ ভাই। এমদাদের পরিবারের সাথে ওদের খুব মিল। শহীদ ছেলেটাও সাদামাটা। আমরা সবাই একটা ক্লাবের সাথে জড়িত। নাম সৃজনী সঙ্ঘ। আমরা যখন ছুটিতে আসি, তখন রেগুলার হই এই ক্লাবে কিন্তু খুব অল্পই ছুটি পাই। লুনারা ইব্রাহীমপুর থাকে। জায়গাটা কচুক্ষেতের পাশে। আমার ঐটা এলাকা নয়, তারপরেও আমি অনেকের সাথেই পরিচিত।

এবার আসি লুনার ব্যাপারে আরো একটু বলি। অসম্ভব ধরনের কালচারালা মাইন্ডেড একটা মেয়ে। যে কোনো বিষয় নিয়ে ওর সাথে আলাপ করা যায়। ওর সাথে যখন বসে আড্ডা দেই, তখন বড় আপা (লুনার বড়) মাঝে মাঝে এমন সব মন্তব্য করেন যেনো আমি আর লুনা প্রেমে পড়েছি, লুনা আমার হবু বউ। মাঝে মাঝে আমিও লুনাকে এতাই বলি, যে, বউ হবি? ও হাসে আর বলে- না থাক, দাদাই ভালো। আজীবন পাশে থাকা যাবে। বউদের কোনো সিউরিটি নাই। না আছে স্বামীদের।

এমদাদের বাবা (লুনার বাবা) ও খুবই খোলা মনের মানুষ। আর ওর মা তো আরেক লক্ষী ঘরের বউ। কি দিয়ে যে কি আপ্যায়ন করেন মাঝে মাঝে আমি খুব অবাক হই। ছুটিতে ওদের বাসায় না গেলে ভাবেন, বুঝি ভুলে গেছি, হয়তো আর মহব্বতটা আগের মতো নাই। অথচ আমি না কখনোই বদলাই, না কেউ আমাকে বদলে ফেলতে পারে। আমি জানি না, ‘সময়’ আমাদের সবাইকে কোন রাস্তায় একদিন নিয়ে যাবে।

৪/৯/১৯৮৬-ছবি

আজ পুরান একটা খাতা উল্টাতেই অনেক মজার মজার লেখা চোখে পড়ল। কোন অসতর্ক অবস্থায় কখন যে কি লিখেছিলাম নিজেরই মনে নেই। এক পাতায় লিখেছিলাম, “ছবি আমার জীবনে এক বিরাট অধ্যায় ফেলে যাচ্ছে বারবার। এক ছবি দেখে পাগল হয়েছিল কার্লা, আর টিভিতে বাংলা ছবি দেখে হয়ত পাগল হচ্ছে আরেকজন। কিন্তু ঐ দ্বিতীয় মানুষটির সম্পর্কে আমি কতোটুক জানি?”  আসমা মেয়েটি মাঝে মাঝে উদিত হয় আমার মনে, বিশেষ করে রাত এলে, অথবা বেদনায় বুক ভরে গেলে, মাঝে মাঝে মনে পড়ে ওর সুচিস্নাত মুখমণ্ডল ফজরের পরে। আচ্ছা, আমি কেন আসমা মেয়েটিকে নিয়ে ভাবছি?

মানুষ যখন একা থাকে, তার যখন আর কেউ থাকে না তার কথা বল্বার, বা তার কথা শুনবার, তখন সে কথা বলে রাস্তার ধারের বড় বড় গাছের সাথে। এটা দেখে হয়তো কেউ তাকে মানসিক ভারসাম্য হারানো কোনো ব্যক্তি বলে ভুল করতে পারেন বলে হয়তো অনেকে সে কাজটাও করতে পারেন না। তাই, তারা প্রায়শই ডায়েরী লিখেন, তাদের কথাগুলি কোনো এক কাল্পনিক মানুষকে বলেন, অথবা নিজে নিজেই কথা বলেন। যখন সময় পেরিয়ে যায়, যখন আরো একা একা হয়ে যায়, তখন আগের সেই লেখাগুলি হয়তো কোনো এক অফুরন্ত অবসরে উল্টাতে উল্টাতে এটাই তুলনা করেন, যে সময় গুলি পেরিয়ে গেলো তা কি বর্তমান সময়ের চেয়ে আরো নিঃসঙ্গ ছিলো? সেই নিঃসঙ্গতা মানুষকে দোলায়িত করে, হয়তো কখনো কখনো বিচলিতও করে। আমি আমাকে নিয়ে সব সময়ই বিচলিত ছিলাম, আর এখন সেই বিচলিত অবস্থার কোনো পপ্রিবর্তন হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।

যখন সবাই থাকা সত্তেও কেউ আসলে নেই বলে মনে হয়, তখন নিজের সাহসের উপর আর নিজের কনফিডেন্সের উপর ভরষা করার নাম আত্ম বিশ্বাস। আমিও সেই আত্ম বিশ্বাসের উপর ভর করেই সকাল দেখি, সন্ধ্যা পার করি আর পরবর্তী দিনের জন্য সাহস সঞ্চয় করে ঘুমাতে যাই। কিন্তু আমাকে দেখে কি বাইরে দেখে এটা বুঝার কোনো উপায় আছে যে, আমি নিঃসঙ্গ? মোটেও না। কারন আমার এই নিঃসঙ্গতা একান্তই আমার।

মিটুলের ব্যাপারটাও আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকে মাঝে মাঝে বুঝবার চেষ্টা করছি। আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আমাদের মানুষ গুলি এখনো অবধি ওই পর্যায়ে পৌছায় নাই যেখানে, পরনির্ভর কোনো পরিবার সদস্য তার মতামতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পরিবারের বাইরে পা রাখতে পারে বা এমন পর্যায়ে পৌছায় নাই যেখানে কারো উপরে হতাত করে নির্ভর করে তার নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থল নিমিষেই জলাঞ্জলি দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। সাহস আর সামর্থ এক জিনিষ নয়। কোনো কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সামর্থ লাগে আবার কোনো কোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে লাগে সাহস। কিন্তু বেশীর ভাগ সময়েই কোনো পরিস্থিতি সামালের জন্য লাগে দুটুই। আমার সাহস আছে, সামর্থ কতটুকু সেটা যাচাই করার সুযোগ নাই। আবার সামর্থের মধ্যে যতটুকু আছে, সেখানে অধিক রিস্ক নেয়াটা কতটা সাহসের ব্যাপার সেটাও আমি জানি না। সব কিছু নির্ভর করে আবারো সেই ‘সময়’।

আজ পুরান একটা খাতা উল্টাতেই অনেক মজার মজার লেখা চোখে পড়ল। কোন অসতর্ক অবস্থায় কখন যে কি লিখেছিলাম নিজেরই মনে নেই। এক পাতায় লিখেছিলাম, “ছবি আমার জীবনে এক বিরাট অধ্যায় ফেলে যাচ্ছে বারবার। এক ছবি দেখে পাগল হয়েছিল কার্লা, আর টিভিতে বাংলা ছবি দেখে হয়ত পাগল হচ্ছে আরেকজন। কিন্তু ঐ দ্বিতীয় মানুষটির সম্পর্কে আমি কতোটুক জানি?”  আসমা মেয়েটি মাঝে মাঝে উদিত হয় আমার মনে, বিশেষ করে রাত এলে, অথবা বেদনায় বুক ভরে গেলে, মাঝে মাঝে মনে পড়ে ওর সুচিস্নাত মুখমণ্ডল ফজরের পরে। আচ্ছা, আমি কেন আসমা মেয়েটিকে নিয়ে ভাবছি?

মানুষ যখন একা থাকে, তার যখন আর কেউ থাকে না তার কথা বল্বার, বা তার কথা শুনবার, তখন সে কথা বলে রাস্তার ধারের বড় বড় গাছের সাথে। এটা দেখে হয়তো কেউ তাকে মানসিক ভারসান্য হারানো কোনো ব্যক্তি বলে ভুল করতে পারেন বলে হয়তো অনেকে সে কাজটাও করতে পারেন না। তাই, তারা প্রায়শই ডায়েরী লিখেন, তাদের কথাগুলি কোনো এক কাল্পনিক মানুষকে বলেন, অথবা নিজে নিজেই কথা বলেন। যখন সময় পেরিয়ে যায়, যখন আরো একা একা হয়ে যায়, তখন আগের সেই লেখাগুলি হয়তো কোনো এক অফুরন্ত অবসরে উল্টাতে উল্টাতে এটাই তুলনা করেন, যে সময় গুলি পেরিয়ে গেলো তা কি বর্তমান সময়ের চেয়ে আরো নিঃসঙ্গ ছিলো? সেই নিঃসঙ্গতা মানুষকে দোলায়িত করে, হয়তো কখনো কখনো বিচলিতও করে। আমি আমাকে নিয়ে সব সময়ই বিচলিত ছিলাম, আর এখন সেই বিচলিত অবস্থার কোনো পপ্রিবর্তন হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।

যখন সবাই থাকা সত্তেও কেউ আসলে নেই বলে মনে হয়, তখন নিজের সাহসের উপর আর নিজের কনফিডেন্সের উপর ভরষা করার নাম আত্ম বিশ্বাস। আমিও সেই আত্ম বিশ্বাসের উপর ভর করেই সকাল দেখি, সন্ধ্যা পার করি আর পরবর্তী দিনের জন্য সাহস সঞ্চয় করে ঘুমাতে যাই। কিন্তু আমাকে দেখে কি বাইরে দেখে এটা বুঝার কোনো উপায় আছে যে, আমি নিঃসঙ্গ? মোটেও না। কারন আমার এই নিঃসঙ্গতা একান্তই আমার।

মিটুলের ব্যাপারটাও আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকে মাঝে মাঝে বুঝবার চেষ্টা করছি। আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আমাদের মানুষ গুলি এখনো অবধি ওই পর্যায়ে পৌছায় নাই যেখানে, পরনির্ভর কোনো পরিবার সদস্য তার মতামতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পরিবারের বাইরে পা রাখতে পারে বা এমন পর্যায়ে পৌছায় নাই যেখানে কারো উপরে হতাত করে নির্ভর করে তার নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থল নিমিষেই জলাঞ্জলি দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। সাহস আর সামর্থ এক জিনিষ নয়। কোনো কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সামর্থ লাগে আবার কোনো কোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে লাগে সাহস। কিন্তু বেশীর ভাগ সময়েই কোনো পরিস্থিতি সামালের জন্য লাগে দুটুই। আমার সাহস আছে, সামর্থ কতটুকু সেটা যাচাই করার সুযোগ নাই। আবার সামর্থের মধ্যে যতটুকু আছে, সেখানে অধিক রিস্ক নেয়াটা কতটা সাহসের ব্যাপার সেটাও আমি জানি না। সব কিছু নির্ভর করে আবারো সেই ‘সময়’।

২৩/০৮/১৯৮৬-সৃষ্টিকর্তার হৃদয় সৃষ্টি-২

শনিবার, আটিলারি  সেন্টার এবং স্কুল, হালিশহর,
চট্টগ্রাম।

 অনেকদিন পর ডায়েরি লিখতে বসলাম ।

 আশ্চর্য হওয়ার মতো বেশী আশ্চর্য যদি কিছু থাকে এ পৃথ্বীতে- সেটা হল সৃষ্টিকর্তার হৃদয় সৃষ্টি। অদৃশ্য  অস্পর্শ, এক কাল্পনিক অস্তিত্ব যার কোন আকৃতি নেই, প্রকৃতি নেই, যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, এবং নিজের কোন কন্ট্রোলেও নেই। বৃষ্টিরদিনে এ একরকম, চৈত্রে আরেক, বসন্তে বা শীতে এ আরেক রকম। কখনো এটা কারন ছাড়াই হাসে, কখনো কাদে, কখনো আবার কিছুই করে না। মানুষ এটাকে দিতে চায়, কিন্ত কেন জানি এটাকে কেও যেন নিতেও পারে না। একই ঘটনায় এই হৃদয় কখনো অভিভুত, কখনো বিচলিত, কখনো আবার নির্বাক।  এই আশ্চর্য ”হৃদয়” বস্তুটা কল্পনাপ্রিয়, কল্পনার জগতে সে অতি মহারাজা। আমার এই আশ্চর্য ”হৃদয়” বস্তুটাও মাঝে মাঝে ভীষণ অন্যরকম ভাবে life টাকে চিন্তা করে। আমি এর কারন খুজে পাই না। যেমন সেদিন ভাবছিলাম যে, আমি আর সে একা একা হাটতে হাটতে বহুদূর চলে গিয়েছি, বাড়ি ফেরার পথ ভুলে গিয়েছি, বাড়ির সবাই আমাদের জন্য হয়ত খুব চিন্তা করছে। চারদিক সন্ধ্যা হয়ে আসছে, একটু  একটু ঠাণ্ডা বোধ করছি আর ভাবছি কখন বাড়ী ফিরে যাব। মনে হচ্ছে বাড়ী ফিরলে দেখতে পাব যে, বাবা অস্থির, মা অস্থির, ভাই বোনেরা অস্থির। সন্ধার বাতি দিতেও ভুলে গেছে সবাই। এমন সময় আমরা বাড়িতে গিয়ে হাযির। আমাদের পেয়ে সবাই কি না আনন্দ…  

অথচ আমি জানি আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই, আমি কয়েক দিন বাড়ি না ফিরলেও কেউ আমার খোজ নেবে না। কারন আমার বাবা নেই, আমার মা আমাকে নিয়ে ভাবেন কিন্তু ওনার  কিছুই করার নেই, আমার বোনেরা এগুলু নিয়ে ভাবে না, আর আমার ভাই থাকেন আমেরিকা। থাকলেও ভাবতেন কিনা আমার জানা নেই। কারন আমার আর্মিতে আসা নিয়ে তিনি অত্তন্ত্য বেজার।

পরিবার একটা কনসেপ্ট, পরিবার একটা আইডেন্টিটি। পরিবার নামক বস্তুটি অনেক সময় কোনোকাজে নালাগলেও, এর সুনাম, এর দূর্নাম, এর বাহ্যিক পরিচয় কনো না কোনোভাবে সাহাজ্য করে। আমি তার থেকে যোজন যোজন দূরে।

২৩/০৮/১৯৮৬-সৃষ্টিকর্তার হৃদয় সৃষ্টি

হালিশহর, চট্টগ্রাম-

আশ্চর্য হওয়ার মতো বেশী আশ্চর্য যদি কিছু থাকে এ পৃথিবীতে- সেটা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার হৃদয় সৃষ্টি। অদৃশ্য, অস্পৃশ্য এক কাল্পনিক বস্তুকে আমরা যাকে হৃদয় বলে আখ্যায়িত করছি, তার গুনাবলী,তার আকৃতি- প্রকৃতি যাইই বলি না কেনো, তাকে ভালো মতো বিচার করার মতো আত্তা কিংবা সত্তা আমাদের কারোরই নাই। কোনো না কোনো একসময় সবকিছু ব্যর্থতায় ঝুকেই যায়। আজ যা ভেবেছি, হয়ত দেখা যায় কাল সেটা ভুল ভেবেছি বলেই মনে হয়। আজ যেটা ভুল মনে হয়েছে , হয়ত দেখা গেলো, আগামিকাল সেটাই ঠিক ছিলো বলে মনে হয়। আমরা মানুষ বলে হৃদয় নিয়ে কথা বলি, আত্তা নিয়ে কথা বলি, সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলি। অথচ মানুষের থেকে আকৃতিতে বিরাটকায়, শক্তিশালী এবং অনেক আয়ুধারী প্রানীরাও কিন্তু তাদের হৃদয় নিয়ে এতো মাথা ঘামায় না, সাফল্য নিয়ে গলদঘর্ম হয় না কিংবা ভবিস্যত পরিকল্পনায় কি করলে কি হবে সেটা নিয়েও ভাবে না। আর এই জন্যই মানুষের এতো দুর্ভোগ, অশান্তি এবং আশ্চর্য ধরনের এক সৃষ্টি।

মাঝে মাঝে আমি কেমন যেনো অন্যরকম হয়ে যাই। চারিদিকে যখন দৃষ্টি দেই, মনে হয় সবার একটা আলাদা পরিবার আছে, জগত আছে, সবাই একে অপরের জন্য হৃদয় দিয়ে ভাবে। কেউ কিছুক্ষনের জন্য হারিয়ে গেলেও আরেকজন তার হৃদয়ের কোনো এক প্রকোস্ট থেকে রক্তক্ষরনে ব্যথাতুর চোখে জল ফেলে, উদগ্রীব  হয়ে পথের পানে চেয়ে থাকে।  আমারো একটা পরিবার আছে, এই পরিবারের ইতিহাস অনেক গৌরবময় অথচ আজ এই পরিবারের ইতিহাসের পাতায় কোথায় যেনো বর্ষাকাল, অথবা ক্রান্তিকাল। এই পরিবারের সদস্যগন এখন নিজেদের জগতকে সামাল দিতে অপারগ, আলাদা আলাদা জগত তৈরীতে অপারাগ। কেউ কিছুক্ষনের জন্য কেনো, কয়েকদিনের জন্য হারিয়ে গেলেও যেনো খুজে নেওয়ার লোক নাই। আমি যদি এখন কোথাও পথ চলতে গিয়ে কোথাও হারিয়ে যাই, আমি জানি আমার জন্য কেউ কোথাও হয়ত দাঁড়িয়ে নাই। আর যারা আছে, তাদের হয়ত এমন কোনো শক্তি নাই যে, আমাকে হারিয়ে যাওয়া গহীন জঙ্গল থেকে ফিরিয়ে আনা।

হারিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসার যে ভালোবাসা, তার তুলনা ফিরে আসার মাঝেই। তারপরেও আমি কখনো হারিয়ে যেতে চাইনা। কারন আমার ফিরে আসার সম্ভাবনা নাই।

০৭/০৬/১৯৮৬-টাকা পয়সার টানাটানি

টাকা পয়সার খুব ক্রাইসিসে আছি। মাত্র ৭৫০ টাকার বেতনস্কেল দিয়ে কি আর এইভাবে চলে? প্রায় প্রতি মাসেই ওডি (ওভার ড্রাফট) করতে হচ্ছে। অথরিটি লেটার দিয়েই এখানকার ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হয়। যা বেতন পাই তার থেকে আমাদের খরচ বেশী। এদিকে লেঃ সাকির এই বেতন থেকেই টাকা জমিয়ে পাহাড় বানিয়ে ফেলতেছে। লেঃ সাবির তো রীতিমত ব্যবসাই শুরু করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে এই সাকির আর সাবিরই আমাদের লোনের ভরসা। কিভাবে ওরা টাকা জমায়?

খুলনার ছেলেদের একটা ভালো গুন আছে। ওরা যখন কেউ জানে সে খুলনার লোক, ওরা সবাই মোটামুটি এক হয়ে যায়। ভালো কাজ হোক আর খারাপ কাজেই হোক, ওরা দলবদ্ধ থাকে। ইদানীং সাবির হালিশহরে পুরানো গাড়ি ক্রয় বিক্রয়ের মধ্যে ঢোকেছে। মনে হয় বেশ কিছু পয়সা হাতে আছে। সে আবার ইদানিং হাতে কম্বেট কালারের ঘড়িও পড়ে। যখন বাইরে যায়, সে কম্বেট কালারের ঘড়ি পড়ে। যখন ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে থাকে, তখন সাধারন ঘড়ি পরে। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার দোস্ত? ক্ষনে ক্ষনে ঘড়ির মডেল পালটাচ্ছো?

উতুর পাওয়া না গেলেও এটা বুঝি যে, মিলিতারী ঘড়ি, মিলিটারী ক্যাপ, মিলিটারী ব্যাগ ব্যবহারে বেসামরিক পোষাকে সহজেই এতা প্রমান করা যায়, সে মিলিটারী পরিবারের সাথে জড়িত। তাতে কিছু তো লাভ হয়ই।

আমার এক মাসের মেসের টাকা প্রায় বাকী পরে গেছে। কিন্তু কোথায় যে সেলারীর টাকা খরচ করলাম, সেটাও বুঝি না। অন্যদের বেলায় যখন কারো টাকা পয়সা শর্ট পড়ে, তখন তারা হয় বাড়ি থেকে আনে অথবা কোনো বড় লোক আত্মীয় দের কাছ থেকে সাময়ীকভাবে ধার নেয়। আমার তো সেটাও নাই। ফলে আমাকে আমার নিত্য প্রয়োজনীয় সাধ আহ্লাদ কাট ছাট করেই টাকা পয়সার সামাল দিতে হবে। শুনেছি, আমাদের নাকী অনেক জমা জমি। কিন্তু এইসব জমা জমি আমাদের জীবনে কখনোই কাজে লাগলো না। যদি কোনো এসেট কাজেই না লাগে, তাহলে এইসব এসেট করে কি লাভ?

০২/০৬/১৯৮৬-বেসিক কোর্সের চেহারা 

আমরা যে বেসিক কোর্ষটা করছি, তার নাম হচ্ছে AOBC-4 (Artillery Officers' Basic Course-4). বেসিক কোর্সের যা নমুনা দেখছি তাতে মনে হয় না আমি খুব ভালো করছি। স্টাফরা (যারা এআইজি অর্থাৎ এসিস্ট্যান্ট ইন্সট্রাকটর গানারী, নামে পরিচিত) ইউনিটের অফিসারদের জন্য পক্ষপাতিত্ত করেন, আইজি  (ইন্সট্রাক্টর গানারী) অফিসারগনও মনে হচ্ছে তার একটু একটু ছোয়া আছে। আমাদের সাথে কিছু অনেক সিনিয়র অফিসাররা আবার বেসিক কোর্স করতে এসেছেন কারন তারা তাদের বেসিক কোর্সের সময় চার্লি (অর্থাৎ সি গ্রেড) পেয়েছেন বিধায় আবার ইম্প্রোভমেন্ট কোর্সের জন্য এসেছেন। তাদের মধ্যে ১ম লং কোর্সের মেজর মোজাম্মেল স্যার, মেজর শওকাত স্যার, মেজর জামাল স্যার। এরা সবাই আমাদের অনেক আইজির থেকেও সিনিয়র। কয়েকজন সিনিয়র আইজি আছেন তারা (যেমন মেজর জাকির, মেজর আশরাফ, মেজর রফিক, মেজর হাসান নাসির) ব্যক্তিত্ত সম্পন্ন অফিসার। ক্যাঃ লতুফুল হায়দার একেবারেই বাচালের মতো ক্লাশ নেন। তবে ক্যাঃ তারেক ভালো ক্লাশ নেন।

আমি পারতপক্ষে এইসব স্যারদেরকে এড়িয়ে চলি। আমার ভালো লাগে না তাদের ব্যবহার। ছোট ছোট লেফটেন্যান্টদের সাথে কোর্স করতে এসে যেনো তারা আবার লেফটেন্যান্টই হয়ে গেছেন এমন ভাব কিন্তু আবার তারা যে মেজর সেটাও দেখাইতে কার্পন্য করে না। সার্থ এমন জিনিষ যা শুধু নিজের জন্যই কাজ করে, এর বাইরে কিছু নাই। আমি জানি, এইসব বাচলামী বা গা ঘেষানোওভ্যাস কোনো এক সময় তাদেরকে অনেক মুল্য দিয়ে বুঝিয়ে দেবে যে, সিনিয়র-জুনিয়রের মধ্যে যে গ্যাপটা থাকার দরকার ছিলো বা রাখার দরকার ছিলো সেটা আজকে পালন করা হচ্ছে না বলে ভবিষ্যতে মুল্য দিতে হতে পারে।

বেসিক কোর্সে আমরা যারা আছি, তাদের মধ্যে আমার এমসিসি এর ব্যাচম্যাট লেঃ জাহিদ (১২ লং), লেঃ ইশা রুহুল করিম, এবং লেঃ লুতফর (১২ লং), অন্যান্যদের মধ্যে আছে লেঃ মোটা জাহিদ স্যার (সিরিয়াল ১৪ নামেই সবাই তাকে ডাকেন), লেঃ এনায়েত (১২ লং), লেঃ কাদের (১২ লং), লেঃ সিদ্দিক (১২ লং) , লেঃ বশীর (১২ লং), লেঃ জাহাঙ্গীর (১২লং), লেঃ মোমেন (১২ লং), লেঃ কাদের (১২ লং), লেঃ মাহফুজ (১২ লং), ১৩ লং এরও লেঃ মাহফুজ একজন আছে, লেঃ জাহাংগির (১৩ লং), লেঃ ফেরদৌস ((১৩ লং), লেঃ আলমাস (১৩ লং), লেঃ শহিদুল আলম (১৩ লং), লেঃ মাসুদ ইকবাল (১৩ লং), লেঃ সাকির (১৩ লং), লেঃ সাবির (১৩ লং), এই কয়েকজনের সাথেই আমার বেশ খাতির বেশী। আমার কোর্সম্যাট লেঃ জাহাঙ্গীর (জাহাঙ্গীর চা নামে পরিচিত) যেভাবেই হোক, তাকে বি প্লাস পেতেই হবে এই নীতিতে সে মুটামুটি আদাজল খেয়ে লেগেছে। লেঃ সাকির আছে খালি গান আর বাজনা নিয়ে। আর সাবির তো মুটামুটি একটা ব্যবসা সেন্টার খুলে ফেলেছে গোপনে গোপনে। খুলনার ছেলে, বুঝাই যাচ্ছে, বয়সের তুলনায় মাথা বেশি পাকা। লেঃ আকবরকে রীতিমতো ভয় পায় আমার আরেক কোর্সম্যাট লেঃ এটিএম হাসান (দাদা নামে সবাই তাকে মেনেই নিয়েছে)।  

ক্লাশে কি পড়ছি আর কি পড়াচ্ছে সেটা খুব একটা গরজ আছে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু প্রায় প্রতিদিন আমি আর লেঃ ইকবাল শহরে যাচ্ছি, ফিরছি রাত করে। লেঃ সাকিরের ক্যাসেট প্লেয়ার আমার খুব প্রিয় একটা যন্ত্র, আধুনিক গান আর সোলস এর গান শুনতে শুনতেই রাত পার হয়ে যায়।

সবার চরিত্রে এমন সব জিনিষ চোখে পড়ছে যা হাসার উদ্রেক জোগায়। যেমন, আমার কোর্সম্যাট লেঃ ফেরদৌস যখন মেসে চায়ের অর্ডার দেয়, চিৎকার করে বলে- এই কে আছিস রে, আমারে এক কাপ চা দাও, কিন্তু শুধু দুধ। লেঃ মোটা জাহিদ যখন ডিম ভাজির কথা বলে তখন তার ডিম ভাজিতে তেল কম হবে পোড়া পোড়া হবে, একটু আধটু হলুদ হবে , কাচা মরিচ বেশী হবে কিন্তু ঝাল হতে পারবে না। আবার ভাওয়ালী যখন পানি চায়, তখন মোটা গলায় বলবে- ঐ মেস ওয়েটার, এক গ্লাস ঠান্ডা গরম পানি দাও। লেঃ লুতফর সারাক্ষন কার পিছনে লাগা যায়, সেই মেজাজে কার্টুন আকতেই আছে আর মেসের আনাচে কানাচে পোস্টিং করেই যাচ্ছে। আইজি মেজর জাকির স্যার যখন লং ডিসটেন্সে কল করেন, তখন মনে হয় চার তলায় ছাদে গিয়ে কথা বললেই ঢাকার রিসিভার পরিস্কার কথা শুনতে পাবেন। ওদিকে মেজর রফিক এমন করে ইংরেজী বলেন যে, সয়ং ইংরেজরাই তার কাছ থেকে ইংরেজী শেখার জন্য কোচিং করতে হবে বলে আমার ধারনা। কমান্ডেন্ট কর্নেল হারুন যেদিক দিয়ে যান, ঐ এলাকায় একটা ঝড় শুরু হয়, আর আশেপাশে যতো ফিতাধারী সৈনিক আছে তাদের ডিমোশন হতেই থাকে। এআইজি জেসিও জাহাঙ্গীর সাহেব ছাত্র অফিসার দেখলেই ম্যাথ টেবিল দিয়া অংক ধরাইয়া দেন। লেঃ বশীর (১২ লং) কমান্ডান্ট হারুন স্যারের খুব প্রিয় মানুষ, যদিও তাদের বাড়ি একই জায়গায় নয়। কেনো বা কি কারনে মাঝে মাঝে আমাদের উদ্দেশ্যে কিছু উপদেশ বানী শুনালেই তিনি লেঃ বশীরের বরাত টানেন। আর কোর্সের মধ্যে রিউমার উঠছে, হারুন স্যার নাকি তার মেয়ের পাত্র খুজছেন, বশীর তার মধ্যে এক নম্বর লিষ্টে আছে। তাই ওরে সবাই জামাই বলেই ডাকে। আর বশীর মিয়াও ব্যাপারটা বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক, মিটিমিটি হাসে। আমার আরেক দোস্ত লেঃ রবী (১২লং) সব কিছুতেও খায় ধরা। অথচ ওর মতো ভালো একটা পোলা আর কেউ নাই, লেঃ ইশা রুহুলের মতো।

১৩/০৫/১৯৮৬ “বড় বাড়ীর বউ”

আটিলারি  সেন্টার এবং স্কুল, হালিশহর, চট্টগ্রাম। 

গত ১০ তারিখে হালিশহর এসেছি। হালিশহরে এটাই আমার প্রথম আসা নয়। বি এম এ থেকে যেদিন আমাদের পোষ্টিং অর্ডার শুনিয়েছিলো, তার কয়েকদিন পরেই এই আর্টিলারী সেন্টার এন্ড স্কুল আমাদেরকে একটা সম্ভর্ধনা দিয়েছিলো। তখনো একটা বেসিক কোর্ষ চলছিলো যেখানে আমাদের ৪ মর্টার রেজিমেন্টের ২লেঃ নিজাম স্যার, লেঃ রাজ্জাক স্যার আর লেঃ আমিন স্যার বেসিক কোর্ষ করছিলেন। ইউনিটে গিয়ে আমি এই সব অফিসারগুলিকে পেয়েছিলাম।

আজ প্রায় ৩ দিন পার হয়ে গেলো এসেছি। প্রচণ্ড ব্যস্ততা গেলো এই কয়দিন। অরিয়েন্টেশন ক্লাশ, বিকালে বৈ পত্র ইস্যু করা, আর্টিলারীর কিছু বেসিক মাল্পত্র ইস্যু করা, হাতিয়ার ইস্যু করা, ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে দিন আর রাত কখনো সময় করে উঠতে পারছিলাম না ডায়েরী লিখতে। আজ লিখতে বসলাম।

এবার ঢাকায় গিয়ে একটা মজার ঘটনা হল। যশোর থেকে ছুটি পেয়ে বদি ভাইয়ের বাসায় থাকাকালীন, গত ৭ মে ১৯৮৬, পাশের বাড়ির একটা মেয়ের সংগে আমার পরিচয় হল। তার নাম আসমা। মেয়েটিকে আমি কখনো দেখেছি কিনা মনে পরে না। মেয়েদের নিয়ে আমি আসলে খুব একটা ভাবিও না। আমি এ ব্যাপারে খুব বেশি উদাসিন। গানই গাইতে পারি না আবার মেয়ে মানুষ নিয়ে প্রেম। যাকগে সে সব কথা। মেয়েটি যখন এসেছেই তাঁর সাথে কিছুটা সময় আমি কাটাতেই পারি। আমি তো আর রবিন্দ্রানাথ নই যে তারে নিয়া আমি শেষের কবিতা লিখব। আচ্ছা, রবিন্দ্রানাথ কি কখনো “শেষের কবিতা”র মতো কোন “শুরুর কবিতা”ও কি লিখেছেন? মনে হয় না। এর কোন  কারন আছে নাকি?  

যাই হোক, মেয়েটি আমার বদি ভাইয়ের বউ এর সাথে বেশ নিবিড় ভাবে বেশ কথা বলছে। বুঝলাম, যে মেয়েটি ভাবীর বাসায় নতুন নয়। মেয়েটি ভাবীর সংগে খুব মজা করে চাল বাচছে আর ভাবী সবজি কাটছে। ভাবীর সংগে আমার সম্পর্কটা অনেকটা আদর্শ দেবর- ভাবীর মতই।  সুতরাং আমার খুব একটা বেগ পেতে হল না ওদের  সংগে আড্ডা দেওয়া।

আমি ওদের আসরে গিয়ে বসলাম, ভাবী কোন কারন ছাড়াই একটু মুচকি হাসলেন। ভাবখানা এমন যে প্রেম করতেই যেন আমি ওখানে বসেছি। মেয়ে মানুষ, হাসতেই পারেন, এই গুনটা বিধাতা মেয়ে মানুষকে দিয়ে খুব রহস্যময়ি করে রেখেছেন। অবশ্য ওরা নাকি অকারনেও হাসে, আবার অকারনেও কাঁদে। কোন মেয়ে মানুষ যদি এই ডায়েরি পড়ে, তাহলে আমার জেলও হতে পারে। আচ্ছা, মেয়েরা কারনে অকারনে কেন হাসে আবার কেন কাঁদে? কিন্তু আমি তো ভাবীকে কখন কাঁদতে দেখিনি। হতে পারে ওনি কাঁদতে শিখেন নি।  আর কাঁদলেও হয়ত কারো সামনে তিনি কখন কাদতে চাননি।  ভাবী তখনো মুচকি মুচকি হাসছেন। হটাত আমাকে বল্লেন, আখতার তুমি তো হাত দেখতে জানো, তাই না? দেখতো ওর হাতে কি লেখা আছে? এখানে বলা ভাল যে এই বয়সে আমার ধারনা সবাই একটু একটু  হাত দেখতে জানে, বিশেষ করে মেয়েদের হাত, আর সেটা পূরটাই মিথ্যা। এখন ভাবীর কাছে তো আর মিথ্যা হওয়া যাবে না। কাজ শুরু হল, আমি মেয়েটির হাত দেখা শুরু করলাম।

বেশ বিজ্ঞের মতো বললাম, আরে, একি?

মেয়েটি বল্লো, কি?

বললাম,রাজনীতি করার প্রবণতা আছে। 

যার সাথে প্রেম করবেন তাঁর সাথে বিয়ে হবে না।

পরীক্ষায় ভাল করবেন।

অনেক বড়লোক হবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।  

দিলাম তো মাথা ঘুরাইয়া। রাজনিতিতে নিয়া আসলাম, প্রেমের ব্যর্থতা, এবার কি হবে?  তবে মেয়েটি নিরিহ। তাঁর সম্পরকে আমি আসলে কিছুই জানি না। যাহা বলিলাম মিথ্যা বানাইয়া বলিলাম। সে বিশ্বাস করিল কিনা আমি তাহা তলাইয়া দেখিবার  প্রয়োজন মনে করিলাম না। তবে বলিয়া যেন মজা পাইলাম।

আমাদের বাসায় টিভি নাই, ভাবী আবার কয়েকটা টিভি অনুষ্ঠান দেখার ভক্ত। আর এই অনুষ্ঠান দেখার জন্য তিনি এই আসমাদের বাসায় অর্থাৎ আসমাদের বোনের বাসায় যান। সেদিন রাতে একটা বাংলা সিনেমা ছিল, “বড় বাড়ির বউ” আমজাদ  হুসেনের পরিচালনা। যেহেতু অনেক লম্বা সময় ধরে সিনেমাটা চলবে, সুতরাং আমি গেলে ভাবীর জন্য সুবিধাই হয়। বিশেষ করে ভাইয়ার পারমিশন পেতে মোটেই অসুবিধা হবার কথা নয়। গেলাম।

বেশ রাত, ধীরে ধীরে রাত বাড়ছে, আর দর্শক এর সংখ্যা কমছে। অবশেষে দর্শক থাকল খালী আমি আর ওই নিরিহ মেয়েটি।

কত কথা, আমি যেন বিজ্ঞ্য ব্যক্তি বনে গেছি আর কি। প্রায় সকাল হয়ে গেছে, সারা রাত টিভি দেখলাম আমি আর ওই নিরিহ মেয়েটি। খারাপ লাগেনি। হটাত দেখলাম, মেয়েটি আর নাই। আমি টিভির সামনে একা। কিছুক্ষন কেটে গেল, দেখলাম মেয়েটি এসেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় গিয়েছিলেন? সুন্দর  উত্তর, ফযর নামাজটা পরলাম। সংগে কিছু ফল আমার জন্য। এটাকে বলে আথিথেয়তা। বাসায় ফিরে এলাম। ঘুমাব।

বাসায় এসে লম্বা একটা ঘুম দিলাম। উঠলাম প্রায় ১২ টায়। গরমের দিন, সবখানে পানি থাকে না, আমাদের বাসায় আবার পানি থাকে। আসমা মেয়েটি আমাদের বাসায় পানি নিতে এলো। খড়খড়া রোদ, বাইরের রোদ দেখলেই বুঝা যায়, গরমের তান্ডব কত শক্ত। আমার রুমের ঠিক পাশেই টিউব ওয়েল। কেউ পানি নিতে এলে আর চাপকল চাপলে আমার কানে শব্দ আসবেই। আমি ঘরের ভিতর থেকেই জানালা দিয়ে তার সাথে কথা চালিয়ে গেলাম। ফলে আমার সংগে কিছুক্ষন কথাও হল তার।

সে আমার ঠিকানা চাইলো। আমি তাকে ঠিকানাও দিলাম। একটা  কাগজে লিখে দিলাম। আমি অবশ্য তার কাছ থেকে কোনো ঠিকানা চাইলাম না। কারন আমি ওদের ঠিকানা এম্নিতেই জানি। আবার চাইবো কি? ঠিকানা দেয়ার পরেই মেয়েটা এক কলসি পানি নিয়া তার বাড়িতে চলে গেলো। আমি জানালার পাশে বসে ভাবতে লাগলাম- 

গ্যাঞ্জাম মনে হয় পাকাইয়া ফেলিলাম।

৩০/০৪/১৯৮৬-বেসিক কোর্স-যশোর ত্যাগ

প্রি-কোর্ষ শেষ হয়ে গেছে। এই প্রি-কোর্ষের সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো কোনো রেজাল্ট নাই। আর থাকলেও এর কোনো মুল্য নাই। যেহেতু আমাদের কোর্ষটা প্রায় ৭/৮ মাসের জন্য, ফলে ইউনিট থেকে আমাদেরকে প্রথমে কয়েকদিন ছুটি দিয়ে দিলো যাতে সবাই যার যার পরিবারের সাথে কয়েকদিন একসাথে সময় কাটিয়ে হালিশহরে কোর্ষে যেতে পারে। তাই আজই আমাদেরকে ছুটি দিয়ে বলা হলো, যার যার বাসায় চলে যাও। তারপর বাসা থেকে সরাসরি চট্টগ্রামে হালিশহরে গিয়ে যোগদান করো।

আমরা সবাই ব্যাচলর মানুষ, খুব একটা ঝামেলা নাই। কিছু ইউনিফর্ম, কিছু বইপত্র, আর ব্যক্তিগত কিছু থাকতে পারে সাথে সিভিল কিছু কাপড় চোপড়, এইই আমাদের সম্বল। কারো কারো আবার ডেকসেট আছে, বাইকও আছে। আমার এসব কিছুই নাই। তাই অসুবিধাও নাই। বিছানার জাজিম নাকি নিতে হয়, বালিশ ছাড়া ঘুমাবো কই? তাই বালিশ চাদর এখন যেটা ব্যবহার করি সেগুলি নিতে হবে।  

আমার ব্যাটম্যানের নাম আতিয়ার রহমান। ব্যাটম্যান আবার কি?

তাহলে একটু বুঝিয়ে বলি। প্রতি অফিসারের একজন করে ব্যাটম্যান থাকে। ব্যাটম্যানটা হচ্ছে, একটা সিভিলিয়ান সার্ভেন্ট। ইউনিটেই খায়, ইউনিটেই ঘুমায়, আর আমরা ওকে যা পারি দেই। এটা অনেকটা পেটের ধান্দায় কিছু গরীব ছেলে পোলাপান আমাদের সাথে থাকে, ফুট ফরমায়েস করে, ইত্যাদি। আতিয়ার ছেলেটার বয়স প্রায় ১২ থেকে ১৩ হবে, ভালোই কাজ করে। ইউনিফর্ম ইস্ত্রি করা, বুট পালিশ করা, বিছানাপত্র গুছিয়ে রাখা, গেঞ্জি আন্ডারওয়ার ধুয়া, ফুট ফরমায়েশ খাটা ইত্যাদি করে এই ব্যাটম্যান। ছেলেটার বাড়িও যশোর। আমার সাথে সে হালিশহর যাবে বিধায় গত সপ্তাহে ছুটিতে গেছে। আজ সকালেই ইউনিটে এসে হাজির। আমি ঢাকায় ছুটিতে যাবো ১০ দিনের জন্য। আর এরমধ্যে ব্যাটম্যান আমার মালপত্র নিয়া চিটাগাং হালিশহরে ৮/৯ তারিখের দিকে চলে যাবে, আমি যাবো ৯ তারিখে। কারন ১০ তারিখে কোর্স শুরু। হালিশহর আমাদের আর্টিলারী ট্রেনিং সেন্টার। শুনেছি, কর্নেল হারুন আর্টিলারী সেন্টার এন্ড স্কুলের কমান্ডেন্ট। খুব নাকি একরোখা লোক। তার বাড়ীও আমাদের কেরানিগঞ্জ, শুনেছি। কিন্তু তাতে পুলকিত হবার কোনো কারন নাই আমার। আমি এসব গেরাইবাজিতে নাই।

হাসিনা পরিবহনে টিকেট কাটা আছে। যশোর থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য হাসিনা পরিবহনই সবচেয়ে ভালো। অধিনায়কের ইন্টারভিউ হয়েছে, অধিনায়ক অনেক উপদেশ দিয়েছেন। ব্যাটারী কমান্ডার খালী একটা কথাই বলেছেন, 'শোন মিয়া, লুতফররে টপকানো চাই, এক ব্যাচ জুনিয়ার হইয়া আর্মিতে আইছো, এইটাই সুযোগ তারে টপকাইয়া ভালো করার।' কিন্তু লুতফরের উপর আমার কোনো রাগ বা গোস্যা নাই। সে আমার ক্যাডেট কলেজের বন্ধু, ক্লাসমেট। আমি আর্মিতে আমার কারনেই ১২  লং কোর্সে যেতে পারি নাই। যদিও আমি সিলেক্ট হয়েছিলাম, আমার ভাইয়ের কারনে আমি যেতে পারিনি।

আমার ব্যাটারী কমান্ডার বা উপ-অধিনায়ক কেনো লুতফরকে নিয়ে এই কথা বললেন আমার জানা নাই। তবে উনি সারাক্ষন সিগারেট খান, বিশেষ করে মিকচার। আমি তার মিকচার বানাইয়া আগুন ধরাইয়া উনাকে সিগারেটের শলাটা হাতে তুলে দেই, উনি মনের সুখে টান দেন আর বলেন,

গাজা খাইছো কোনোদিন?

বলি, না স্যার।

উনি আবারো বলেন, খাইবা খাইবা, যাইতেছো তো বেসিক কোর্সে!! গাজা খাওয়াও শিখবা।

গাজা খাওয়া শিখবো কিনা জানি না, তবে আর্লোটিলারীর উপর বেশ কিছু শিখবো এটা জানি। লোকটিকে আমার পছন্দ। 

রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম। আহা- কি আনন্দ! কিন্তু সারাক্ষনই আমার ভিতরে আরেকটা দুঃখময় অনুভুতি কাজ করতো। আমি ঢাকায় যাচ্ছি বটে, অথচ ঢাকায় আমার থাকার কোনো জায়গা নাই সেই বদি ভাইয়ের বাসা ছাড়া। বদি ভাইয়ের বাসায় আমার থাকতেই হয় সেটা ভালো লাগুক আর নাইবা লাগুক। মা থাকেন গ্রামে-বেচারী নিজেই অসহায়। আমার আগমনে মা আনন্দ পান বটে কিন্তু সেই আনন্দটা আর দশটা মা যেমন তার ছেলের জন্য অনেক কিছু উজাড় করে দিয়ে নিজে মনে মনে শান্তি পায়, আমার মায়ের সেই সামর্থ না থাকায় মা হয়তো মনে মনে কষ্টও পান। আমি মাকে সেটা বুঝতেও দেই না আর মাকে কোনো প্রকার অসুবিধায় পড়ুক সেটা আমি করতেও চাই না। আমি মাকে আমার জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসি। 

গরীব ঘরের সন্তানদের অনেক কিছু ভুলে যেতে হয়। আমরা হয়তো এককালে গরীব ছিলাম না, কিংবা ভবিষ্যতেও হয়তো এমন দিনকালটা পালটে যাবে কিন্তু বর্তমান সময়টা আমার পক্ষে নয়। 

০১/০৪/১৯৮৬-বেসিক কোর্সের প্রি-কোর্স শুরু

বেসিক শব্দটাই বেসিক। অর্থাৎ সামরিক জীবনে পদার্পন করার পর বিএমএ এর সেই ট্রেনিং আর ইউনিটে কোনো কাজেই লাগে না। প্রতিটি ইউনিট তার পেশাদার মুল্যবোধে ব্যতিক্রম। ইনফ্যান্ট্রির কার্যকলাপ এক রকম, সিগন্যালস এর কাজ, আর্মারড এর কাজ, আর্টিলারীর কাজ যুদ্ধক্ষেত্রে সব আলাদা আলাদা। বিএমএ তে যে ট্রেনিং করেছিলাম, তা ছিলো সিভিলিয়ান থেকে মিলিটারীতে ট্রান্সফর্মেশনের ট্রেনিং। আদব কায়দা, ইটিকেটস, সামরীক ড্রিল, বেসিক কিছু মাইনর ট্যাকটিক্স, আর কিছু কমান্ড জাতীয় ব্যাপার স্যাপার। মুলত বিএমএ এর ট্রেনিং পুরুই আলাদা। যখন অফিসাররা কমিশন পেয়ে যায়, তারা যার যার আর্মস অনুযায়ী আবার নতুন করে বেসিক ট্রেনিং শুরু করে। আমি যেহেতু আর্টিলারীর অফিসার, আমাদের আর্টিলারীর উপরেই এখন যতো ট্রেনিং চলবে। আর এর প্রথম কোর্ষটাই হচ্ছে বেসিক কোর্ষ যার নাম 'আর্টিলারী অফিসার্স বেসিক কোর্ষ (এওবিসি) ।

গত শীতকালীন এক্সারসাইজে আমাকে যারা হাতে কলমে আর্টিলারীর উপরে গানসহ ট্রেনিং করিয়েছে, সেটাই আসলে এবার পেশাগতভাবে আমাদের কোর ট্রেনিং সেন্টারে শিখানো হবে শুদ্ধভাবে এবং পরীক্ষা নীরিক্ষা করে, বাস্তব সম্মতভাবে। এরই পূর্ব প্রশিক্ষন হিসাবে আমাদের ব্রিগেড সবগুলি নতুন অফিসারদেরকে নিয়ে সমবেতভাবে কোনো একটা ইউনিটের আন্ডারে বেসিক কোর্ষের জন্য প্রি-কোর্ষ করিয়ে তারপর সাধারনত বেসিক কোর্ষে পাঠায়।

এরই ধারাবাহিকতায় আগামী মাস থেকে আর্টিলারীর বেসিক কোর্স শুরু হবে। এরজন্য আজ হতে সব নতুন অফিসারদেরকে ব্রিগেডের আন্ডারে ২৬ ফিল্ড রেজিমেন্টের তত্তাবধানে ফিল্ড পোর্শন আর ৫ এডি এর আন্ডারে এএ (এন্টি এয়ারক্রাফট) পোর্শন শুরু হলো। গতকাল আমাদের রেজিমেন্টেশন পিরিয়ড ডিভিশন কর্তৃক তুলে দিয়ে অফিসার মেসে ইন করিয়ে দেয়া হয়েছে। সেটাও একটা নতুন অভিজ্ঞতা। আমরা এখন পুরুদমে অফিসার।

ইহা একটা ভালো খবর বটে কিন্তু এতোদিন সৈনিক মেসে যখন খাইতাম, তাহাদের মেন্যুই খাইতাম কিন্তু কোনো বিল দেওয়া লাগিতো না। গতকাল হতে অফিসার মেসে ইন হওয়াতে যাই খাবেন, তাই নিজের বিল দিতে হবে। মাত্র ৭৫০ টাকার বেতন। সিগারেটেই যায় এর তিন ভাগের এক ভাগ। এক প্যাকেট গোল্ড লিফ সিগারেটের দাম প্রায় ২০ টাকা। কখনো কখনো দোকানভেদে আবার তারও বেশি। বেতনের টাকায় চলা খুব মুষ্কিল। মেসে খাবারের বিল নাকি আসে প্রায় ৬০০ টাকার মতো। এর মধ্যে আরো অন্যান্য খরচ। কিভাবে চলে অফিসাররা? বেতন যদিও স্কেল অনুযায়ী ৭৫০ টাকা, কিন্তু ব্যাটম্যান ভাতা, এপয়েন্টমেন্ট ভাতা, এবং অন্যান্য মহার্ঘ্য ভাতাসহ হাতে পাই প্রায় ১৫০০ টাকার মতো। যাই হোক, তারপরেও একটা চাকুরী তো।

যেটা বলতেছিলাম। প্রি-কোর্সের যত না আয়োজন, বা লেখাপড়া, তার অধিক বেশি হইতেছে ২৬ ফিল্ডের ফিল্ড মেসে আমাদের আড্ডা। সকাল ৮টা হইতে ১ টা পর্যন্ত খালি গল্প আর মজার মজার আলোচনা। ইউনিটে গিয়া দেখাই, আহা কতই না কষ্ট করতেছি এই প্রি-কোর্সের লেখাপড়া লইয়া। বিকালেও প্রি-কোর্সের ব্যবহারিক হয়, কিন্তু কাজের কিছুই হয় না। মাঝখান থেকে বিকালে একটু আড্ডাটা ভালো করে জমে উঠে।

১২ লং কোর্সের লেঃ জাহিদ সাহেব মাঝে মাঝে এমন সব কাহিনী করেন আর সবাই মিলিয়া কোনো না কোনো ছুতা বাহির করিয়া তাহাকে ফান্দে ফেলিয়া তাহার নামে এইটা খায় তো ওইটা খায়। তার নাম দেয়া হয়েছে-স্যার জাহিদ। মজার মানুষ। ৫ এডির লেঃ মাহফুজ সাহেব তো হাটিবার সময় এমন একটা ভাব করেন যেনো উনি নবাব অথবা ব্রাহ্মণ, আর যদি সেটা না হয় তাহলে নির্ঘাত ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য। সবাই আড়চোখে একটু কথা তো বলিতেছেই কিন্তু তাহাতে তাহার কিছুই আসে যায় না। তিনি বাকা হইয়া আলতোভাবে পা ফেলিয়া ঘাড় মটকাইয়া চলেন। শুনেছি, তাহার এক ভাই চলচিত্রে নাকি নায়ক হয় হয় অবস্থা। নায়ক পরিবারের কেউ হাটিতে গিয়া একটু অভিনয় না করিলে কি আর ইজ্জত বাচে?

সেনাবাহিনীর লাইফটা কিন্তু অনেক ভ্যারাইটির। সকাল হইতে ব্যস্ততা কিন্তু কিসের যে ব্যস্ততা, তাহাই বুঝিতেছি না। অথচ কাহারো হাতে কোনো সময় নাই।

প্রি-কোর্ষের পুরু সময়টায় মনে হচ্ছে, একদল দুষ্টু পোলাপান একসাথে জড়ো হইয়া কোনো এক ইতিহাস রচিত না করিলেও সেখানে যে মহাজ্ঞানের কোনো অভাব নাই তা যে কোনো মুর্খও বুঝিতে পারে। শুধু প্রি-কোর্ষের সাময়িক আইজি (ইন্সট্রাক্টর গানারী) রাই তাহা উপলব্দি করিতে না পারিয়া শত শত অংকের হোমওয়ার্ক দিয়া পাশের টেলিফোনে কাহার সহিত তাহারা এতো মৃদুস্বরে  ফোনে আলাপ করে বুঝি না। তাহাদের ঠোট পর্যন্ত নড়িতে দেখিনা। যখন হটাত করিয়া ‘হা হা “ করিয়া হাসিয়া উঠেন, তখন তাহাদের দন্তবিকশিত হয়। এছাড়া তাহাদের কথা বলার সময় ঠোট পর্যন্ত নড়িতে দেখি না।

এই আইজি মহোদয়গন হলেন ২৬ ফিল্ডের লেঃ ফিরোজ, ৪ মর্টার রেজিমেন্টের ক্যাঃ গনী, ২৬ ফিল্ডের আরো একজন আছেন লম্বা অফিসার যাকে লম্বু গানার নামেই অনেকে চিনেন, ভদ্র দি গ্রেট, লেঃ রশীদ স্যার। মাঝে মাঝে আবার আর্টিলারী ব্রিগেডের বিএম (ব্রিগেড মেজর) মেজর আহসান উল্লাহ স্যারও ক্লাস নিতে আসেন। কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার বাকের প্রথম দিন ক্লাসে এসে গুরুগম্ভীর উপদেশ্মুলক কিছু জ্ঞান দিয়া গেছেন, অনেক কঠিন লোক। সিলেটি সম্ভবত। কথায় কথায় যে কাউরে এক্কেবারে সিলেটি ভাষায় গাল দিতে কার্পন্য করেন না।  

সময়টা কেটে যাচ্ছে, কিন্তু শিক্ষা কিছু হইতেছে বলিয়া মনে হইতেছে না। কারন ছাত্রগুলির পরিচয় পাইলেই বুঝা যাবে কি অত্যাধুনিক মনোযোগী সব ছাত্রের দল। আমাদের ৪ মর্টারের আমি আর লেঃ লুতফর, ২৬ ফিল্ডের ২লেঃ ইকবাল, আর লেঃ জাহিদ, ২৭ ফিল্ডের ২লেঃ আকবর, ৫ এডির ২লেঃ ইশা, আর ২লেঃ ভাওয়ালী, সাথে আছে ১২ লং এর লেঃ মাহফুজ, আরো অনেকে। কেউ কেউ আবার হেভী সিরিয়াস যেনো এইটাই বেসিক কোর্ষ। আমার আসলে কিছুই শিখা হয় নাই।

দিনের বেশীরভাগ সময় প্রি-কোর্ষেই থাকি, বিকালেও। আর রাতে এসে গান শুনি, লুতফরের হোম ওয়ার্ক কপি করি, আর ঘুমানোর আগে ডায়েরী লিখি।

১০/০৩/১৯৮৬-যশোর সেনানীবাসে প্রথম আগমন

গত সপ্তাহে অনুশীলন এলাকা থেকে মেইন সেনানীবাসে আসলাম। এইই প্রথম আমি যশোর সেনানীবাস দেখলাম। বিশাল সেনানিবাস। বড্ড সুন্দর। ৪ মর্টার আর্টিলারী ইউনিট যশোর মেইন সিএমএইচ এর একদম লাগোয়া। ইউনিটের অফিসসমুহ টিনশেডের মধ্যে। ব্যারাকগুলির কয়েকটা বিল্ডিং আবার কয়েকটা টিনশেড। পাশেই ৩৬ ইস্ট বেংগল ইউনিট। ইউনিটের দুইপাশ দিয়েই গাড়ির রাস্তা আছে। একটা রাস্তা (পুর্ব দিকের) দিয়ে ২৬ ফিল্ড, গানার্স ডেন, আর্টিলারী ব্রিগেড অফিস হয়ে ২৭ ইস্ট বেঙ্গলে যাওয়া যায়। আর পশ্চিম দিকের রাস্তা দিরে ৫ লাইট এএ আর্টিলারীতে যাওয়া যায়। এই রাস্তার শেষে আরেকটি রাস্তা মিলিত হয়েছে, যেটা দিয়ে আবার পুর্বদিকের ইউনিট তথা যশোর বিমান বন্দরের দিকেও যাওয়া যায়।

ইউনিটের ক্যান্টিনটা খুব ছোট তবে আসা যাওয়ার পথে পড়ায় যখন তখন ক্যান্টিনের সুবিধাটা পাওয়া যায়। সেনানীবাসের ভিতর বেসামরীক স্টাইলে কোনো দোকান পাট যত্র তত্র পাওয়া যায় না। ফলে ইউনিটের ক্যান্টিনগুলিই একমাত্র ভরসা। আমার রেজিমেন্টেশন চলছে। আমি বিএইচএম সাইদুরের রুমের পাশে একটা সিংগেল রুমে থাকি এখন। অনুশীলন থেকে আসার পর সেই রাতে আমি বি এইচ এম সায়েদুরের রুমেই ওর পাশের বেডে ছিলাম। এই কয়দিনে আমার জন্য আলাদা একটা সিংগেল রুম দেয়া হয়েছে। অফিসার মেসে যাওয়ার এখনো আমার বৈধতা হয় নাই। এই রেজিমেন্টেশন মানে হলো, একজন সৈনিকের মতো ওদের সাথেই থাকা, খাওয়া, ওদের সাথে মেলামেশা করা, ওদের সাথে ঘুমানো, ওদের সাথে রোলকলে যাওয়া, ওদের টয়লেট ব্যবহার করা এবং ওদের সাথে ট্রেনিং করার নামই হচ্ছে ওরিয়েন্টেশন বা রেজিমেন্টেশন। এর মাধ্যমে একজন অফিসার বুঝতে পারে একটা সাধারন সৈনিকের প্রত্যাহিক জীবনধারা কি রকমের, তাদের সাথে একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে মেশার এটা একটা বড় সুযোগ।

টিএ (টেকনিক্যাল এসিস্টেন্ট) হাঃ বারেক এখনো আমার ট্রেনিং এর জন্য দায়িত্তপ্রাপ্ত। আর্টিলারির ট্রেনিং এ অংক খুব গুরুত্তপূর্ন। আর এই টিএরাই হচ্ছে অংকের ভালো শিক্ষক। যদিও সৈনিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব বেশী না, কিন্তু যারা যারা যার যার ট্রেডে একটা সার্টেন স্ট্যান্ডার্ড মেইন্টেইন করে। সব অফিসারগন সৈনিকদেরকে তুমি করে বলে, শুধুমাত্র জেসিও যারা, তাদেরকে অফিসারগন আপনি করে সম্বোধন করে। আমারো একই নিয়মে সৈনিকদের  তুমি করে বলার কথা কিন্তু যারা সিনিয়র হাবিলদার তাদেরকে আমি 'তুমি' করে বলতে কেমন যেনো মুখে বাধে। আবার হাঃ বারেক যেহেতু আমার সরাসরি ট্রেনিং এর শিক্ষকের মতো, তাকে আমি 'তুমি' না বলে 'বারেক সাহেব' বলেই ডাকি। হাঃ বারেকের অনুপস্থিতিতে সার্ভেয়ার হাঃ মন্ডল আমার আরেক শিক্ষক। সারাক্ষন পান খায়। মজার লোক।

আমার ব্যাটারী কমান্ডার মেজর লুতফুল হক কেমন যেনো চটাং চটাং ভাবের লোক। কাউকেই তিনি খুব একটা পাত্তা দেন বলে মনে হয় না। আমি তাকে ভয় পাই। আমাদের ইউনিটের এবং অন্য কয়েকজন (মেজর ওয়ালী, মেজর লুতফল হক, মেজর ইশহাক, সাথে আর্টিলারী ব্রিগেড মেজর আহসান উল্লা, ওসি এমপি মেজর মাকসুদ আর ২৬ ফিল্ডের উপঅধিনায়ক কেএবি মাইনুদ্দিন) যখন একসাথে হয়, মনে হয়, এরাই সব, আর কেউ কিছুই না। এইসব অফিসারদেরকে দেখলে মনে হয় ফৌজি অফিসারগন আসলেই স্মার্ট।

আমরা অনেকগুলি কোর্সমেট এই যশোর সেনানীবাসে আছি। ৪ মর্টারে আছি আমি, ২৬ ফিল্ডে আছে ২লেঃ ইকবাল, ২৭ ফিল্ডে আছে ২লেঃ আকবর, ৪ সিগন্যাল ব্যাটালিয়ানে আছে ২লেঃ এমদাদুল বারী, ৩৮ ইস্ট বেঙ্গলে আছে ২লেঃ মইন, ২লেঃ শাহীন, ৫ এডিতে আছে ২ লেঃ তারক ভাওয়ালী। অন্যান্য ইউনিটেও আছে ২ লেঃ আশফাকুল বারী, ২ লেঃ সালাহ উদ্দিন। আর্মার ইউনিটে আছে ২ লেঃ রাকীব। অনেক কোর্সম্যাট। সন্ধার পর মাঝে মধ্যে কোনো কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হয় কিন্তু যেহেতু সবাই রেজিমেন্টেশনে আছি, ফলে অফিসার মেসের কোনো পার্টিতে আমাদের যাওয়ার কোনো অবকাশ নাই। 

অনেক বড় ক্যান্টনমেন্ট। এখনো পুরু ক্যান্টনমেন্ট আয়ত্তে আসে নাই কে কোথায় কিভাবে আছে।

০৪/০৩/১৯৮৬-যশোর সেনানিবাস

রাত ৩টা পাচ মিনিট

এই একটু আগে শেষ পর্জন্ত অনুশীলন শেষ করে সেনানীবাসে পৌঁছলাম। সেনানিবাসটা এখনো ভালো করেই দেখি নাই। তবে চমৎকার একটা লোকেশন আর ডেকোরেশন দেখে মনে হলো, বেশ সুন্দর। চারিদিকে আলো জ্বলছিল। সম্ভবত সবাই শীতকালিন মহড়া থেকে ফিরে আসবে বলে রিয়ার এসলন প্রতিটি ইউনিটেই মরিচ বাতি, লাল নীল আলো জালিয়েছে। খুব অবাক হয়ে দেখছিলাম সেনানীবাসের চেহাড়াটা। ভালো লাগছিলো।

ইউনিটে এসে পৌঁছেছি প্রাউ রাত দুইটার দিকে। গাড়ি বহর ইনট্যাক্ট অবস্থায় আছে, আগামিকাল সকাল ৯ টায় আনলোডিং এর কাজ চলবে। আমরা সবাই যার যার রুমে চলে এসছি। আমি এখনো অফিসার মেসে সামিল হই নাই। আমার অবস্থান একটা ব্যারাকে। শীতকালীন মহরার সময় ছিলাম তাবুতে আর এখন বিল্ডিং এ তবে সৈনিক দের সাথেই। বি এইচ এম সায়েদুরের পাশে আমার বিছানা। খুব টায়ার্ড সবাই। অনেকেই হাত মুখ না ধুয়েই যার যার বিছানায় মূটামুটি শুয়ে পড়েছে। আমার ঘুম আসছিলো না। আর এই সময় আমার ডায়েরী লিখার কোনো কারনও নাই, কারন আমি খুব টায়ার্ড। কিন্তু মনটা অনেক ভালো লাগছে এইজন্য যে, যে কারনে আমি গতকাল থেকে একটা অপরাধ বোধে নিমুজ্জিত ছিলাম, সেটা বুক থেকে সরে গেছে। তাহলে ঘটনাটা বলি। ঘটনাটা ঘটেছিলো গতকাল সকালে।  

আমরা তখন সবাই যার যার মালপত্র গুছিয়ে গাড়ির তালিকা অনুযায়ী মালামাল লোডিং করতে ব্যস্ত। সবাই কাজেই ব্যস্ত। কখন সেনানিবাসে ফিরে যাবে এই আনন্দে মালামাল লোডিং এর সময় একটু হৈচৈ হচ্ছে। বড় বড় আর্টিলারী কামান, তাবু, রেশন স্টোর, অফিসারদের মালামাল, অস্ত্র শস্ত্র, টিন, আরো কত কি যে লোডিং এর কাজ। আশেপাশের অনেক বেসামরিক লোকজন জড়ো হয়ে আছে আমাদের এই চলে যাওয়ার প্রিপারেশন দেখতে। ছোট ছোট ছেলেমেয়রা, বড়রা, আরো অনেকেই। গ্রামের বহু লোক জড়ো হয়ে আমাদের চলে যাওয়ার ব্যাপারটা অবলোকন করছে। এই এলাকার সবাই এখন জানে যে, আমরা সবাই চলে যাচ্ছি। হয়তো ওদের জন্যেও ব্যাপারটা খুব আনন্দের না।

আমি গ্রামের লোকজনের ভীড়ের মধ্যে বারবার একটা জিনিষ দেখার চেষ্টা করছি যে, ঐ বুড়িমা আছে কিনা। মনে মনে খুব আরাধনা করছিলাম, আহা যদি বূড়ি মা আসতো। যদি দেখা পেতাম। আমি কাউকে যে জিজ্ঞেস করবো, তার নামও জানি না, সে কার বাড়ির তাও জানি না। ফলে কাউকেই জিজ্ঞেস করতেও পারছিলাম না। একবার একটা স্কুলে পড়া বাচ্চা ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখানে এমন কোনো বুড়ি কি আছে যে, রাতের বেলায় ঐ রুপদিয়া গ্রামের বরই গাছের তলায় আখের রস জ্বাল দেয়? ছেলেটি মাথা চুলকিয়েছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে কে সেই বুড়ি খোজার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সেও এমন কঠিন প্রশ্নের উত্তর জানে না বলে সহজ করে মুখখানি মলিন করে হেসে দিয়ে বলেছে, জানি না স্যার। মনটায় কোথায় যেনো খচখচ খচ করতেই লাগলো। কিন্তু ঈশ্বর খুব মজার প্রভু। তিনি ব্যথা দেন, আবার ব্যথার ঔষধ দেন, তিনি হতাশ করেন কিন্তু আবার পুষিয়েও দেন। তিনি চোখের জলে আমাদেরকে বুক ভাসিয়ে দিয়ে আবার সেই চোখেই জলভরা আনন্দে বুক ফুলিয়ে দেন। আজ যেনো ঈশ্বর ঠিক সেটাই করলেন। 

হটাত দেখি একজন বুড়ি একটা থালা হাতে নিয়ে বেশ দূরে একা একা দাঁড়িয়ে আছে। আমার চিনতে একটুও অসুবিধা হইলো না, এটাই সেই বুডিমা। আমি মূটামূটি স্পিডে হেটেই বুড়ির দিকে গেলাম। বুড়ি আমাকে চিনতে পারে নাই। না পারারই কথা। কারন সে এমনিতেই চোখে ভালো দেখে না, তারপর ঐ রাতে সে আমাকে ভালো করে চিনতে পারার মতো করেও দেখে নাই।

আমি কাছে গিয়ে বুড়িমা বলতে সে যেনো আকাশের  চাঁদ হাতে পেলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে বল্লো, তোর জন্য দুই টুকরা আখের রসের মিঠাই নিয়া আইছি। এতো সৈনিক চারিদিকে, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি বুড়িমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আমি তোমাকে খুব মিস করছিলাম বুড়িমা। তোমার মিঠাই যতোটা না আমাকে মজা দিবে, তোমার সাথে দেখা হওয়াতে আমার মনটাই ভরে গেলো।

হাত দিয়ে বুড়িমার পা সালাম করে বললাম, বুড়িমা, আজ চলে যাচ্ছি। তোমার বাড়িতে আসবো। কি নাম বললে সবাই তোমাকে চিনবে? বুড়ি বল্লো, জসিমের মা।

আমি বুডিমাকে একটা চেয়ার দিতে বললাম। অনেক বুড়ো মহিলা। হয়তো বেশীক্ষন দাড়ায়ে থাকতে তার কষ্ট হবে। যতোক্ষন না আমাদের গাড়ি বহর রেডি হচ্ছিলো, গ্রামের মানুষ গুলির সাথে বুড়িমাও সেখানে ঠায় চেয়ারটায় বসেছিলো। কি জানি তার মনে কি খেলছিলো, কিংবা কি ভাবনা মনে নিয়ে সে আমাদেরকে বিদায় জানাতে এসেছিলো। গাড়িতে উঠার আগে আমি বুডিমাকে আবারো পায়ে ছুয়ে সালাম করে হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম, বুড়িমা, আমি আবার তোমাকে দেখতে আসবো। তুমি শুধু ভালো থেকো।

এবার অনুভব করলাম, বুড়ি একটু কাদছে। আমি সৈনিক, আমার কাদা নিষেধ। কিন্তু মনের ভিতরে কোন কারনে কি দুক্ষে যেনো আমারো একটা কাপুনী হচ্ছিলো। একবার মনে হচ্ছিলো, নিয়ে যাই বুড়িকে, আবার ভাবলাম, কোথায় নেবো? পৃথিবীর অনেক অলিখিত ভালোবাসা শুধু বয়েই চলে না, মাঝে মাঝে কোথাও গিয়ে থেমেও যায়।

তখন গাড়ি বহর লোডিং শেষ হয়ে গেছে, অধিনায়ক সাহেব ইউনিটের প্যারেড স্টেট নিতে চলে এসছেন, আমাকে প্যারেডে থাকতে হবে। আমি আর বুড়িমার কাছে থাকার কোনো সুযোগ নাই। বুড়িমাকে আমি পিছনে ফেলে সামনের দিকে ইউনিটের প্যারেডের দিকে হাটতে থাকলাম। মনে হলো, এতো শত শত চোখগুলি আমাকে দেখলেও এর মধ্যে শুধুমাত্র দুটু চোখ আছে যা এখন হয়তো জলে ভেসে যাচ্ছে। অথচ বুড়ি আমার কেউ নয়, আমিও বুড়ির কেউ নই।

জীবন বড্ড রহস্যময়।

০২/০৩/১৯৮৬-১ম শীত অনুশীলন সমাপ্তি

আগামীকাল আমাদের ‘শীতকালীন অনুশীলন’ বা শীতকালিন মহড়ার শেষ। ক্যান্টনমেন্ট এ ফেরার পালা। সবাই যার যার বাক্সপেটরা মোটামুটি গুছিয়ে রাখছে। আমার তেমন কিছুই নাই। আর থাকলেও রানার আছে, সে ধীরে ধীরে গুছিয়ে ফেলবে। এটা যেনো কেউ দুই মাসের জন্য কোথাও এসেছিলো, আগামীকাল তার ফেরার পালা। অনেক জায়গা দেখা হলো, অনেক অপরিচিত মানুষের সাথে কথা হলো, অনেক গ্রাম গঞ্জ চেনা হলো। হয়তো আবার এখানে কখনো আসি কিনা জানি না। এর আগেও আসা হয় নাই, আবার ভবিষ্যতে আসবো কিনা তাও জানা নাই। যে কোনো জায়গায় কিছুদিন অবস্থান করলে কিছু না কিছু স্মৃতি সাথে থেকেই যায়। কিছু স্মৃতি রেখে যাওয়া হয়। অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়, আর যাওয়ার সময় মনটা যেনো কেমন আনচান আনচান করে। জানি, এখানে থাকার জন্য আসিনি, এটাও জানি এখানে আমাদের কোনো সজন ও নাই, তারপরেও এলাকার মানুষগুলিকে কেমন যেনো ছেড়ে যেতে মনের ভিতর একটা চাপ অনুভুত হয়। সবার হয় কিনা জানি না কিন্তু আমার বেলায় এটা হয়। এখন আমি বাইরে বসে আছি, সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। একটা ক্যাম স্টুলের মধ্যে বসে ডুবে যাওয়া সূর্যের লাল আভাটা এখনো উপভোগ করছি। অফিসাররা অনেকেই এদিক সেদিক ঘুরতে গেছে। কোনো অফিসার নাই বললেই চলে। আমার যেতে ভালো লাগেনি, তাই ক্যাম্পেই আছি। আর তাছাড়া একজন না একজন অফিসারকে ক্যাম্পে থাকতেই হয়। আমিই রয়ে গেলাম। আমি আজো যশোর সেনানীবাস দেখিনি। কাল হয়তো প্রথম দেখতে পাবো। সেটা হয়তো আরেক নতুন পরিবেশ।

রুপদিয়া গ্রামটা আমার বেশ ভালো লেগেছিলো। এর চারিধারে ক্ষেত, আখ ক্ষেত, গাছ গাছালী, মানুষ গুলি অনেক গরীব, তবে চোর মনে হয় নাই। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও দেখেছি দলবেধে স্কুলে যায়, বড়রা তাদের গরু ছাগল নিয়ে সারাদিন ক্ষেতে কাজ করে। মহিলারাও পুরুষদের সাথে মিলে মিশে ক্ষেতে কাজ করে। এলাকায় যখন ইউনিফর্ম পড়ে হাটতাম, বড্ড ভালো লাগতো। অনেক বুড়ো, জোয়ান মানুষেরা খুব সমীহ করতো। কেউ কেউ ছালাম দিতো। আবার অনেকেই তাদের গাছের পেয়ারা, কিংবা ফল মুলাদি অফার করতো। কিন্তু আমি কখনো তাদের থেকে এসব খাইতাম না, খেতে বারন নাই কিন্তু আমার ইচ্ছে হতো না।

আজ আমার ঐ বুড়িমার কথা মনে পড়লো। বুড়িমার কথা মাঝে মাঝেই আমার মনে পড়ে। বেচাড়ি হয়তো আরো অনেকদিন একা একাই সেই গভীর রাতে আখের রস জ্বাল দিতেই থাকবে, তার কোনো সাথী নাই, সংগী নাই। জীবন বড় একা তার। ভাবলাম, যাই একবার দেখা করে আসি। এই কয়দিন আসলে বিভিন্ন কাজের চাপে আর এদিকে আসা হয় নাই। ফলে বুড়িমার সাথে বেশ কদিন দেখাও হয় নাই। কাল চলে যাবো, বুড়িমাকে দেখার খুব ইচ্ছে হলো।

রাতে পিকআপের ড্রাইভারকে বললাম যে, আমি আজ রাতে নাইট গার্ড চেকিং এ যাবো। যদিও আমার ডিউটি নাই। রাত ১ টায় পিক আপ নিয়ে গেলাম সেই বরই গাছটার কাছে। কিন্তু আজ বুড়িমা আখের রস জ্বাল দিতে আসেন নাই। খুব মর্মাহত হলাম এই ভেবে যে, আমি তার বাড়িও চিনি না। নামটাও জিজ্ঞেস করা হয় নাই। তাহলে তাকে এই রাতে খুজে বের করবো কিভাবে? মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। বুঝলাম, বুড়িমার সাথে আমার আর দেখা হলো না। অগত্যা ফিরে এলাম। মনের ভিতরে একটা খচখচ করতে লাগলো, আহা, সম্ভবত বুড়িমাকে না দেখেই আমাকে কাল চলে যেতে হবে। অনেকদিন হয়ে গেলো আসা হয় নাই। নিজেকে একটা অপরাধি মনে হতে লাগলো। কিন্তু মনে আরেকটা প্রশ্ন জেগে উঠলো, বুড়িমার কোনো অসুখ বিসুখ করেনি তো? অথবা বুড়িমা বেচে আছে তো? মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। যে উদ্দেশ্যে আজ নাইট গার্ড চেকিং আমার না থাকা সত্তেও আমি এসেছিলাম, সেটা আর হলো না।

০৫/০২/১৯৮৬-নাইটগার্ড চেকিং এর বিরম্বনা

'শীতকালীন মহড়া’ মানেই প্রায় সারা দিনরাতই ইউনিটের ভিতরে কোনো না কোনো অনুশীলন থাকে। ছুটির দিনেও কাজ থাকে। লেপাই পোছাই, এবং রক্ষনাবেক্ষন। সবচেয়ে জুনিয়র অফিসার হিসাবে কোনো কাজ নাই আমার কিন্তু সারাদিন কারো না কারো ডিস্পোজালে আছিই আছি। ইদানিং ইউনিটের  ক্যাঃ গনি স্যার আমাকে রাতের কিছু ডিউটি ভাগ করে দিয়েছেন। রাত ২ টা থেকে ৫ টার মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় নাইটগার্ড চেক করা। আসলেই নাইটগার্ড রাতে ডিউটি করছে নাকি ঘুমিয়ে আছে, এটা অত্যান্ত একটা বিবেচনার বিষয়। তারমধ্যে সিভিলিয়ান এরিয়ায় যখন অনুশীলন এলাকা। তাই এটাকে যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে দেখতে হয়। যে কোনো সময় যে কোন কাল্পনিক শত্রু (অর্থাৎ সাজানো শত্রু) আমাদেরকে এটাক করতে পারে বিধায় সেন্ট্রিকে জাগ্রত থাকতেই হয়। অনেক অস্ত্র, অনেক গোলাবারুদ, অনেক গাড়িঘোড়া।

কিন্তু প্রতিদিন তো আর রাত জেগে জেগে এই নাইট ডিউটিপোস্ট চেক করতে আর ভালো লাগছিলো না। দোস্ত লুতফরকে বললাম, কিরে দোস্ত, একি শুরু হইলো? প্রতিদিন আমাকেই রাতে ২ টা থেকে ৫ টার মধ্যে এতো দূরে দূরে হেটে হেটে আবার কখনো কখনো পিক আপে করে একা একা ডিউটি চেক করতে কি আর ভালো লাগে? তারমধ্যে আবার সারাদিন কাজেই তো থাকি। ঘুমানোর সুযোগ নাই। কিন্তু আমার লুতফর দোস্ত অপারগ। আদেশ মানেই আদেশ। কিচ্ছু করার নাই তার।

ভাবলাম, আমাকেই একটা বিহিত করতে হবে। কিভাবে এই আদেশ রহিত করা যায়। আমার মনে হলো, অধিনায়ক এটা জানেন না যে, আমার উপর এই রকম একটা টর্চার চলছে। তাই গতকাল একটা বুদ্ধি আটলাম। সেটা এই রকমেরঃ

সিও সাহেবের তাবুর পাশে উপঅধিনায়কের তাবু, তার পাশে এডজুটেন্ট লুতফর সাথে কোয়ার্টার মাষ্টার লেঃ নিজাম স্যারের তাবু, তার পাশেই ক্যাঃ গনি স্যারের তাবু। ব্যাটরীর অফিসারগন তাদের নিজ নিজ ব্যাটরীর লোকেশানে তাবু গেড়ে থাকেন। আমার তাবু সৈনিকদের তাবুর সাথে। প্রতিরাতে নতুন নতুন পাশওয়ার্ড দেওয়া থাকে। যখনই কোনো মানুষ বা সৈনিক অথবা অফিসার ক্যাম্প লোকেশানে আসে, রাতের বেলায় পাশওয়ার্ড চেকিং করার মধ্যে সে নিজেদের লোক নাকি অন্য কোথাকার লোক বা শত্রু পক্ষ সেটা বুঝা যায়। এই পাসওয়ার্ড প্রতিটি ইউনিটের জন্য আলাদা এবং অত্যান্ত গোপনীয়।  আমি যখন নাইটগার্ড চেক করতে যাই, তখন সেন্ট্রি আমাকে চ্যালেঞ্জ করে। তখন এই পাশওয়ার্ড বলতে পারলেই ওরা ধরে নেবে যে, আমি বহিরাগত নই, আমি তাদেরই একজন। এখানে একটা ছোট কৌশলের কথা বলি। পাস ওয়ার্ড সাধারনত দুইটা শব্দে বিভক্ত। যেমন ধরুন ‘গোল্ডেন ড্যাডি’। যখন কোনো সেন্ট্রি কাউকে পাস ওয়ার্ড চ্যালেঞ্জ করে, তখন সেন্ট্রি এই দুই শব্দের যে কোনো একটি শব্দ বলবে। আর যাকে চ্যালেঞ্জ করা হলো, তিনি বাকী শব্দটটা বলতে পারলেই নিজেদের লোক, আর না বলতে পারলেই তাকে চ্যাংদোলা। তো, সন্ধ্যার পরপরই আমি অধিনায়কদের তাবুর পাশে যারা রাতে ডিউটি দেয় তাদের বলে রাখলাম যে, আজ রাতে আমি তোমাদের গার্ড চেক করতে আসবো। তখন ডেমোর মতো আমাকে চ্যালেঞ্জ করবা। অর্থাৎ যখন সেন্ট্রি পোষ্ট চেক করতে আসবো, তারা যেনো আমাকে গলা ফাটিয়ে এমনভাবে সেন্ট্রি চ্যালেঞ্জ করে যেনো পুরু এলাকা শুনতে পায়।

আমি রাত সাড়ে তিনটায় কথামতো অধিনায়কের তাবুর পাশে আসার সাথে সাথে ডিউটিরত সৈনিক গলা ফাটিয়ে আমাকে বলে উঠল,

"থাম............... হাত উপর!! ......এগিয়ে আসুন......... তারপর সে পাশওয়ার্ডের অর্ধেক বল্লো, আর বাকীটা আমি বললাম। মিলে গেলো। সুতরাং আমি বহিরাগত নই এটা প্রমান হলো। কিন্তু

সৈনিকের এতো উচ্চস্বরে চিৎকার করার কারনে সিও সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। তিনি আসলেই খুব বিরক্ত হয়ে তাবু থেকে বের হয়ে এলেন। এসে আমাকে দেখে বললেন, কী ব্যাপার আখতার, এতো জোরে সেন্ট্রি চ্যালেঞ্জ কেনো? বললাম, স্যার প্রতিদিন আমি তো রাত ২ টা থেকে ৫ টার মধ্যে নাইট গার্ড চেক করি, তাই ভাবলাম, আমার নিজেরও ঘুমঘুম আসে, আবার ওরাও ঘুমে ঘুমে থাকে অনেক সময়, যদি জোরে চিল্লায়, তাহলে হয়ত ঘুমটা থাকবে না।

অধিনায়ক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রতিদিন তুমি কেনো রাত ২ তা থেকে ৫ টা পর্যন্ত গার্ড চেক করো? বললাম, স্যার এটাতো প্রায় সপ্তাহ খানেকই হয়ে গেলো করছি। আর যায় কোথায়। সিও সাহেবের এমনিতেই মেজাজ খারাপ তারমধ্যে আবার তার আইওর এই অবস্থা। সাথে সাথেই ডাকলেন এডজুটেন্ট আর ক্যা; গনি স্যারকে। অতো রাতে এডজুট্যান্ট আর ক্যাপ্টেন গনি স্যার এই শীতের কম্বল থেকে বের হয়ে এলেন। আর যায় কই? অধিনায়ক দিলেন এক বকা।

ক্যাঃ গনি স্যারের বুঝার বাকী নাই ব্যাপারটা। আর লুতফরও মিটি মিটি হাসছিলো। আগামীকাল থেকে আমার নাইটগার্ড চেকিং বন্ধ। অধিনায়কের আদেশ। আর আদেশ তো আদেশই।

অধিনায়ক বিরক্ত নিয়ে তার তাবুতে ঢোকে গেলেন। গনি স্যার চালাক মানুষ, আমার দিকে তীর্যক একখানা চাহনী দিয়ে এটাই বুঝালেন, তুমি যদি যাও ডালে ডালে, আমি যাই পাতায় পাতায়। বুঝলাম, নাইট ডিউটি বাদ হইলো বটে, কিন্তু নতুন কিছু আসিতেছে।

সামরীক বাহিনীর জীবন, বড় বৈচিত্র্যময়।  মাঝে মাঝে কোল্ডওয়ার হয় নিজেদের মধ্যে।

রাতের বেলায় সাধারনত একটি সেন্ট্রি পোষ্টে দুজন করে প্রহরী থাকে। অনেক সময় দেখা যায় যে, রাত যতো গভীর হয়, একজন আরেকজনকে ঘুমানোর জন্য সাহাজ্যও  করে, এটা বিপদজনক। তাই প্রতি রাতেই কোনো না কোনো অফিসার প্রতিটি সেন্ট্রি পোষ্ট কয়েকবার করে অকস্মাত চেক করেন।

সবসময় দেখা যায় যে, কনিষ্ঠতম অফিসারদের বেলায় এই রকম ভাগ্যে জুটে যে, প্রায় প্রতিরাতেই তাদের নাইট গার্ড চেক করতে হয়। আর অন্যান্য অফিসারগন নিরিবিলিতে শান্তিতে ঘুমাতে থাকেন। কিন্তু কতোক্ষন, কতোদিন একটানা করা যায়?

০২/০২/১৯৮৬-রুপদিয়ার বুড়িমা

এক্সারসাইজ এরিয়া বেশ বড়। একেক ব্যাটারী একেক জায়গায়। সবাই অস্ত্র, গোলাবারুদ, গান ইত্যাদি নিয়েই থাকে। সিভিলিয়ান এরিয়া, কখনো ক্ষেতের মধ্যে, কখনো আম বাগানে, কখনো জংগলের পাশে, কখনো নদীর ধারে আমাদের ব্যাটারী পজিশন গুলি মোতায়েন থাকে। দিনের বেলায় যথেষ্ট ট্রেনিং চলে, রাতেও চলে, তবে দেখা যায় যে, সাধারনত রাত ১০ টা ১১ তার পরে সব কিছু থিতো হয়ে আসে। তখন ইউনিটের এডজুট্যান্ট সাহেব রাতে সমস্ত গার্ড পোষ্ট গুলি সৈনিকরা ঠিকমতো জেগে পাহাড়া দিচ্ছে কিনা সেগুলি চেকিং করার ব্যবস্থা রাখে। আর এই চেকিং গুলি আমাদের মতো জুনিয়ার অফিসাররাই করে থাকে। সঠকভাবে চেক করা হলো কিনা সেটা আবার চেক ব্যাক করার সিশটেম ও আছে। ফাকির জায়গা কম।

প্রায় প্রতিদিন নাইটগার্ড চেক করতে হচ্ছে। একা একা। অনেক দূর দূর সেন্ট্রি পোষ্ট। চারিদিকে আখক্ষেত। রাতের অন্ধকার, মাঝে মাঝে ভয় লাগে, আবার মাঝে মাঝে শীতের রাত বলে একা একা গভীর রাত ভালই লাগে। একটু আগে আমি নাইটগার্ড চেক করে রুমে ফিরেছি। বাইরে খুব শীত। যশোর অঞ্চলটা শিতে কুয়াশায় রাতে একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও ঘন কুয়াশায় ১০ হাত দূরেও দেখা যায় না, আবার কোথাও কোথাও একেবারে ফকফকা পরিস্কার। আকাসে মেঘ থাকে আবার কখনো কখনো মেঘের ফাক দিয়া চাঁদও দেখা যায়। রাতের আকাশের একটা আলাদা রুপ আছে। যখন সেই গভীর রাতে একা কেউ বের হয়, তখন হরেক রকমের শব্দ, চি চি, ঝি ঝি, কুকুরের হটাত করে ডাক, বাতাসের বেগে কোথাও গাছ ঝন ঝন করে উঠে। একটা অন্য রকম পরিবেশ। এই পরিবেশেই আমি কখনো হেটে কখনো পিক আপ নিয়ে, আবার কখনো কখনো গান গাইতে গাইতে, কিংবা মাউথ অরগ্যান বাজাতে বাজাতে আমি সেন্ট্রি পোষ্টগুলির খুব কাছে চলে আসি। সেন্ট্রি পোষ্ট গুলি থেকে ডুরে এসেই আমি আমার মাউথ অরগ্যান বাজানো থামিয়ে দেই যাতে সেন্ট্রি বুঝতে না পারে কেউ এসছে। সেন্ট্রি জেগে থাকলে যে কোনো দিক থেকেই কেউ আসুক তার দেখার কথা। আর দেখলেই আমাকে চেলেঞ্জ করবে। সেন্ট্রী পোষ্টের চেলেঞ্জের একটা প্রক্রিয়া আছে। পাসওয়ার্ড থাকে দুই শব্ধের। একটা সে আমাকে বলবে আর বাকীটা আমি বল্বো, যদি মিলে যায়, বেশ, নিজেদের লোক। আর যদি না মিলে, তাহলে কাম সারছে। পাগলা ঘন্টা। গার্ড চেক করে শেষে আমি বেশ দূরে একটা বেশ আলর গুন্ডি দেখেছিলাম। ভাবলাম, সেন্ট্রি পোষ্টের গার্ড চেক শেষ করে সেখানে যাবো।

ওখানে গেলাম, গিয়ে দেখলাম, একজন বুড়ী। বুড়ি মহিলার সাথে প্রায় ২ ঘন্টা কাটালাম। আমার সব গার্ড চেক করা হয় নাই। তারপরেও আমি এই বুড়ি মহিলার সাথে বেশ অনেক্ষন সময় কাটালাম। অদ্ভুত সব মানুষের জীবন কাহিনী। পৃথিবীর চারিদিকে, আনাচে কানাচে, সর্বত্র একেকটা মানুষ একেকটা জলন্ত উপন্যাশ। 

এই বুড়িকে পেয়েছিলাম আসলে অন্য একটা কারনে। প্রথমবার গার্ড চেক করার সময় রাতের অন্ধকারে আমি মেঠোপথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। তারপরেও হাটতে হাটতে এগিয়ে দেখি, একটা বরই গাছের নীচে আগুন জ্বলছে। খুব শীত, ভাবলাম, কি জানি কোথায় এসে পড়েছি। যাক, একটু আগুন তাপাই আগে। শরীরটাও আর চলছে না। গাছটার কাছে যেতেই দেখলাম, প্রায় ৬০/৬৫ বছরের এক বুড়িমা, আখের রস জ্বাল দিচ্ছেন। একদম একা।

কাছে গিয়ে বললাম, বুড়িমা, তুমি এতো রাতে একা কি করছো? বুড়ি আমার কথা শুনেছে কিনা জানি না। সে কোনো উত্তর করলো না। আমি আরো কাছে গিয়ে বেশ জোরেই বললাম, বুড়ি মা!! কি আখের রস জ্বাল দিচ্ছো? এইবার বুড়ি মনে হয় শুনেছে। উত্তর করলো,

কে গা তুমি?

বললাম, আমি তোমার নাতি।

বুড়ি সম্ভবত আসলেই আমি তার নাতী মনে করে এগিয়ে এলো। ভালো করে হয়তো খেয়াল ও করেনি আমি সামরিক পোষাক পড়া এক ভিন দেশী যুবক। একটা পুরানো কাসার মগে আমাকে গরম গরম আখের রস খেতে দিলো। যখন সে আমাকে কিছুটা দেখেছে, তার সন্দেহ হয়েছে, আমি তার নাতি না। সে পাশে রাখা কুপিটা হাতে নিয়ে একেবারে আমার মুখের কাছে এনে হাত দিয়ে মুখে স্পর্শ করে বল্লো,

-আহা রে বালা কইরে চোহেও কিছু দেহি না। তুমি কে গো?

সে অবশেষে বুঝলো আমি আসলে একজন ফৌজ। কিন্তু তাতে তার কোনো অসুবিধা নাই। বল্লো, হামাক তো এখন আর চাওয়াল থাইকাও নাই, কোনো চাওয়াল নাইরে বাপ, তুমি হামাক দাদী বইলছ, তুমিই হামাক নাতি। যশোরের ভাষা। কিছুটা এখন বুঝি। প্রথম প্রথম অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম না।

খুব আন্তরীক। ভালো লাগলো। আমি আমার ক্যাম স্টুলটা পেতে চেয়ারের মতো করে বুড়ির কাছে বসে গরম আখের রস খাচ্ছি আর মাঝে মাঝে এই প্রশ্ন ঐ প্রশ্ন করছি। বুড়িও খুব মজা করে করে উত্তর দিচ্ছে। আমি যশোরের ভাষাটা ভালো বলতে পারি না, ভালো বুঝিও না। তাও বলছি।

জিজ্ঞেস করলাম, এতো রাতে শীতের মধ্যে তুমি একা একা এখানে আখের রস জ্বাল দিচ্ছো, আর কেউ নাই? ভয় করে না? 

বুড়ি অনেক্ষন চুপ থেকে বল্লো (সে যশোরের আঞ্চলিক ভাষায় কথাগুলি বলেছে কিন্তু আমি সেই ভাষাটা ভাল বলতে পারি না বলে নিজের ভাষায় লিখছি),

'মানুষ যখন বূড়ো হয়ে যায়, তখন সে আর কোনো কাজে লাগে না। তখন যে কাজগুলি অন্য সবার আরাম কেটে নেয়, সেই কাজগুলিই তাদের করতে হয়। এটাই এই সংসারের নিয়ম।' আর ভয়? সেটা এক সময় ছিলো। জীবনের ভয়, যৌবনের ভয়, ঘর পাওয়ার ভয়, ঘর হারানোর ভয়, আরো কতো কি!! এখন ওসব আর মনে আসে না। যেটা সবসময় মনে আসে, তা হলো, কবে যাবো। 

কিছুই বললাম না। অনেক মারাত্তক অভিমান, অনেক কষ্ট, অনেক না পাওয়ার বেদনা, জীবনের কাছে হেরে যাওয়ার আক্ষেপ, সবই ছিলো বুড়িমার এই ছোট কিছু কথায়। আবারো প্রশ্ন করলাম, বুড়িমা, দাদু আছে নাকি নাই?

নাহ, তোর দাদু মইরা গেছে সেই গত মাঘ মাসের আগের তিন মাঘ মাস আগে। সে থাকলে কি আর আমাকে এই রাতে আখের রস জ্বাল দিতে দিত?

বললাম, দাদুর সাথে কি প্রেম করে বিয়া করছিলা?

হেসে দিয়ে বল্লো, আরে না, আমাদের সময় কি আর প্রেম ছিলো? আমাদের সময় ছিলো মুরগীর বাচ্চার মতো ধরে পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া কোনো এক খদ্দেরের কাছে তুলে দেওয়া। এতে না ছিলো প্রেম, না ছিলো কোনো সপ্ন। হয়তো কেউ এই পরিস্থিতিতে সপ্ন দেখে, সপ্ন সফল হয়, প্রেম আসে, প্রেম সফল হয়। সবার হয় না। 

বললাম, তাহলে বিয়ে হইলো কিভাবে?

বুড়িমা আমার মগখানা নিয়া আবারো আরেক মগ আখের গরম রস দিয়া বল্লো,

'আমার বয়স তখন ১০ বছর। গ্রামের ছেলেমেয়েরা সবাই দল বেধে এখানে যাই ওখানে যাই, গ্রামে কাবাডি খেলা হয়, আমরা মেয়েরা দূর থেকে কাবাডি খেলা দেখি, পহেলা বৈশাখ হয়, আমরা মেলায় যাই, কত কিছু করতাম!! একদিন দেখি আমার চাচা চাচিরা আমাকে বল্লো, আমার নাকি বিয়া। বিয়া কি জিনিষ তাও বুঝি না। আমি বললাম, আচ্ছা। আমার বিয়া হইয়া গেলো। কাকে কি করলাম, কি বললাম, কি করতে হবে, কি কাজ আমার কিছুই বুঝি না। শশুড় বাড়িতে গিয়া বুঝলাম, আমার শাড়ি পরার নিয়ম, আমার আর গ্রামে কাবাডি খেলা দেখার সুযোগ নাই, মেলায় যাওয়া আমার জন্য নিষিদ্ধ। ঘরের অনেক কাজ, অথচ আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নাই। পালাইয়া আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু বাবা মায়ের কঠিন শাসনে মনের ইচ্ছা আর সাধ আহলাদ কোনো কিছুই আর আমার নাই। এইতো সংসার করতে করতে বাল বাচ্চা হইয়া গেলো। ওরা যার যার মতো ভালই আছে, শুধু আমিই রয়ে গেছি একা।

বুঝলাম, বুড়িমা ইমোশনাল হয়ে গেছেন। চুলায় কাঠ খড়ি দিচ্ছেন, আর কি যেনো ভাবছেন। চুলার আলোয় আমি বুড়িমার মুখখানা দেখলাম, তিনি তার শাড়ির আচল দিয়ে মুখখানা মুছলেন, সম্ভবত বুড়িমা কাদছেন। চোখের পানি এমন এক জল, যা কাউকে না দেখালেও সে তার ভাষা জানান দেয়, মুখের উপর তার রেখা এটে দেয়, চোখ আর সেই আগের চোখ থাকে না। চোখের বেদনাকে লুকানোর কোনো বৈজ্ঞানিক পন্থা আজো আবিষ্কার হয় নাই।

আমি আর তাকে কোনো অতীতের ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন করলাম না। বললাম, আজ কি খেয়েছে রাতে?

অনেক্ষন চুপ করে থেকে বললেন, বাড়ির পাশে জংগলে কলমি শাখ ছিলো, সেটা দিয়ে রাতে ভাত খেয়েছেন। তরকারী বলতে সেটাই। খুব ব্যথা অনুভব করলাম। অনেক বয়স্ক একজন মানুষ, কিন্তু দেখার কেউ নাই। আমি বুড়িমাকে পিছন থেকে তার মাথাটা শক্ত করে আমার বুকের কাছে টেনে ধরে বললাম, 'বুড়িমা, তুমি আমার বুড়িমা, আমি তোমার এখানে প্রতিদিন আসবো।'

বুড়িমা বল্লো, চলে যাইবা এখন? বসো, নাও, আরেক মগ রস খাও। বুঝলাম, বুড়িমার ভালো লাগছে আমার সঙ্গ। আমি আরো কিছুক্ষন থাকলাম বুড়িমার সাথে। যখন চলে আসবো, আমি বুড়িমাকে ৫০ টাকার একটা নোট হাতে দিয়ে বললাম, এটা তোমার পানের পয়সা। আমি সময় পাইলেই আবার আসবো।

তখন রাত প্রায় ৫ টা বাজে। সকাল হয়ে আসছে, রুমে যেতে হবে। আমি  যখন বিদায় নেবো, বুড়িমা আমার মাথা, মুখ, হাত, পিঠ, বুলিয়ে দিয়ে কি যেনো বললেন, বুঝতে পারি নাই, তবে তিনি যে আমার জন্য দোয়া করলেন সেটা বুঝতে পেরেছি।

আমি রুমের দিকে যে পথ দিয়ে এসেছিলাম, সেই দিকে আবার হাটা দিলাম। আজকে আর বাকী গার্ড গুলি চেক করার ইচ্ছা হলো না।

বারবার বুড়িমার মুখখানা ভেসে আসছিলো। তখন চারিধারে কিছু পাখীর কিচির মিচির শব্দ শুনা যাচ্ছিলো। নতুন আরেকটি দিনের গর্ভপাত হচ্ছে এই পৃথিবীতে। অনেক দূরে মাইকবিহীন ভোরের আজান ভেসে আসছিলো মনে হলো। প্রতিটি দিন আর প্রতিটি রাত কখনোই এক রকম নয়। কোনো রাত বড্ড ভারী, কোনো রাত হয়তো একেবারেই হালকা, আর আজকের এই রাতটা আমার যেনো ভাড়ির চেয়েও ভারী মনে হলো। আমার মায়ের কথা মনে পড়লো, আমার সেই পুরানো গ্রামের কথা মনে পড়লো। মাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছিলো।  

০৭/০১/১৯৮৬ রুপদিয়া অনুশীলন ক্যাম্প

এর মধ্যে আমার নতুন পোষ্টিং হয়ে গেলো। ছিলাম রোমিও ব্যাটারীতে, এখন পোষ্টিং করা হলো হেড কোয়ার্টার ব্যাটারীতে। আর সেখানে আমাকে ইউনিটের আইও (ইন্টিলিযেন্স অফিসার) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মজার একটা নিয়োগ। এটা শুনতে যতোটা গোয়েন্দা গোয়েন্দা মনে হচ্ছে, আসলে এটা তার ধারে কাছেও নাই। আমি এই আইও হিসাবে আসলে অধিনায়কের সরাসরি রানার হিসাবে কাজ করছি। রোমিও ব্যাটারী থেকে হেড কোয়ার্টার ব্যাটারিতে পোস্টিং হ ওয়ায় সব কিছু তে একটু বদল হলো, তার কারনটা পরে বুঝেছি যে, যেহেতু আমি সারাক্ষন অধিনায়কের রানারের মতো, ফলে একটু আধটু যেনো সবাই বেশী সমীহই করে। তাবু তাবুর জায়গায়ই তাবু থাকলো। মানে সৈনিকদের কাতারে। জনবলের হিসাবে আমি শুধু এখন হেডকোয়ার্টার ব্যাটারীতে সামিল। সিও সাহেব কখন কোথায় যাবেন, তার সিগারেট প্যাকেট নিয়েছেন কিনা, চশমাটা তিনি চোখের বদলে অন্য কোথাও রেখেছেন কিনা, তার হাতের লাঠিটা ঠিকমতো হাতে আছে কিনা, তার ফাইলপত্র বাহক হিসাবে আমি ফাইল পত্র নিয়েছি কিনা, কেউ তাকে কিছু দিলে সেটা আমি ক্যারি করছি কিনা। আবার সেটা ইউনিটে এসে কন্সার্ন লোকের কাছে দিচ্ছি কিনা, এইসব আসলে আইও সাহেবের কাজের প্রধান অংশ। সিও আনিস স্যার খুব রিজার্ভ মানুশ, অহেতুক খাটায় না। আদরই করেন। তার বড় মেয়ের নাম ফাতেমা। বেশী বয়স নয়। হয়ত ক্লাস এইটে পড়ে। কথায় কথায় জেনেছিলাম।

ব্যস্ততার শেষ নাই। আবার কোনো কাজ যে করছি সেটাও না। ছুটি ছাটাও নাই। আর আমি ছুটি ছাটার জন্য কোনো পেরেশানও করি না। কারন ঢাকায় গেলে আমার নিজেরও তো কোনো স্থায়ী ঠিকানা নাই। সেই গ্রাম। আর গ্রামে গিয়ে বেশীদিন থাকতেও ইচ্ছে করে না। বস্তুত একা মানুষের জীবনের চাহিদা কম। তবে তাদের বেচে থাকার জন্য অনেক পেরেশানী থাকে। এইজন্য এইসব একা মানুষ সারাক্ষন একটা মানষিক ক্লান্তিতে থাকে। আমারও তাই।

যখন কোনো অফিসারকে যে কোনো কারনেই হোক, কোনো এপয়েন্টমেন্ট দেয়া যায় না কিন্তু একটা তো কিছু দিতেই হবে, তখন এই আইও এপয়েন্টটা বড় জ্যাক একটা। লাগানো যায়। এই ব্যাপারটা ইউনিটের মোটামুটি সবাই জানে আর বুঝে। স্পেয়ার প্লাগ আর কি। তবে ২লেঃ এর উপরে আইও আজো আমি কাউকে দিতে দেখি নাই।

যদিও আমি অধিনায়কের আইও, কিন্তু কোচিং বন্ধ নয়। প্রতিদিন গান ড্রিল, টি এ (ট্যাকনিক্যাল এসিষ্টেন্ট), আর বোর্ড প্লটিং সহ বিভিন্ন লগারিদমের বৈ নিয়া বড় বড় অংক সাথে গানের এলিভেশন, ডিফ্লেকশন সুচারু রুপে বের করা চলছেই। আর আমার এন সি ও কোচিং শিক্ষকরা যতো পারে রাতে ব্যস্ত রাখার জন্য এমন এমন ভারী ভারী হোমওয়ার্ক দিতে থাকে যে, সারাদিনের পরিশ্রমের পর রাত ২ টা ৩ টা বেজে যায় শুধু এসব হোমওয়ার্ক করতে করতেই। ওদেরই বা দোষ দেই কিভাবে? পরেরদিন ব্যাটারী কমান্দাররা, উপ-অধিনায়ক সাহেব রাজার হালে নাস্তা করে ডিপ্লয় মেন্ট এরিয়াতে এসেই জিজ্ঞেস করে- প্রশিক্ষনের অগ্রগতি কি? হোম ওয়ার্ক দিয়েছে কিনা, আর সেই হোম ওয়ার্ক আমি শেষ করেছি কিনা, করলে আমার জ্ঞান কতটুকু, আমি কি বোধাই নাকি একটু মনোযোগী এই ফিডব্যাক তো তাদের দিতে হয়। আমার প্রশিক্ষক হলো হাবিলদার বারেক আর মন্ডল। বারেক পাতলা পোতলা মানুষ, এরা যদিও নন মেট্রিক কিন্তু এল্গোরিদম, লগারিদম, ইত্যাদিতে বেশ পাকা। আর মন্ডল কখন যে পান চিবায় না সেটা খুজে বের করা সম্ভব না। সারাক্ষন হাসি খুশিতেই থাকে। ভারিক্কি একটা ভাব আছে কিন্তু আমি যে একজন অফিসার সেটা তার কখনো ভুল হয় না। এস এম হাসেম সাহেব মাঝে মাঝে খোজ খবর নেয়, আর বলে, স্যার, কষ্ট হবে, চিন্তা কইরেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে। কি ঠিক নাই আর কি ঠিক হয়ে যাবে সেটাও আমি মাঝে মাঝে বুঝি না। তবে সে যে একজন ফাদারলী মানুষ, দেখলেই বুঝা যায়। রোমিও ব্যাটারির বিএইচএম (ব্যাটারী হাবিলদার মেজর) ছিলো সাইদুর রহমান। ভারিক্কি মেজাজ তবে বেশ ভালো। যদিও আমি আর রোমিও ব্যাটারিতে নাই, তারপরেও আমার বেশ খোজ খবর রাখে।

দিন চলে যাচ্ছে এক এক করে।

০১/০১/১৯৮৬ রুপদিয়া অনুশীলন, যশোর

গত ৩১ ডিসেম্বর তারিখে ৪ মর্টার রেজিমেন্টে আর্টিলারীতে আমার আগমন হয়েছে। অধিনায়ক লেঃ কর্নেল আনিস, উপঅধিনায়ক হিসাবে আছেন মেজর ওয়ালি উল্লাহ স্যার। ঊনি জেআরবি (জাতীয় রক্ষী বাহিনী) এর অফিসার। এখানে একটু বলে রাখি, জেআরবি মানে কি। জেআরবি হচ্ছে 'জাতীয় রক্ষী বাহিনী'। জাতীয় রক্ষীবাহিনী একটি নিয়মিত আধাসামরিক বাহিনী যা নবপ্রতিষ্ঠ বাংলাদেশে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে গঠন করা হয়। শুরুতে মুজিব বাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে এই বাহিনীর পত্তন করা হয়। ঢাকার শেরেবাংলা নগরে এই বাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। ক্যাপ্টেন এ এন এম নূরুজ্জামানকে রক্ষীবাহিনীর প্রধান করা হয়। আনুষ্ঠানিক নাম জাতীয় রক্ষীবাহিনী হলেও সাধারণত এই বাহিনীকে ‘রক্ষীবাহিনী’ বা সংক্ষেপে জেআরবি (JRB) বলে অভিহিত করা হতো। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে শেখ মুজিব নিহত হবার পর এই বাহিনী অবলুপ্ত করা হয়। অবলুপ্ত হওয়ার পর রক্ষীবাহিনীর অনেক সদস্য নিয়মিত সামরিক বাহিনীতে আত্মীকৃত হন। মেজর ওয়ালী স্যার সেই আত্তীকরনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। আমি রোমিও ব্যাটরীর এজিপিও (এসিস্ট্যান্ট গান পজিশন অফিসার) হিসাবে পোষ্টিং পেয়েছি। ছোট ছোট অফিসারদের মধ্যে আছে আমার কলেজের ব্যাচম্যাট লেঃ লুতফর রহমান (১২ লং কোর্সের), লেঃ নিজাম স্যার (১১ লং কোর্সের), লেঃ আমিন স্যার (১০ লং কোর্সের), লেঃ রাজ্জাক স্যার (৯ লং কোর্সের)। লেঃ গনি স্যার (৮ম লং কোর্সের)। ক্যাপ্টেন মাহবুব (৩য় লং কোর্স), সাথে ক্যাঃ শওকাত আলী বুলবুল স্যার, তিনিও ৩য় লং কোর্সের। ব্যাটরী কমান্ডার আছেন মেজর লুতফুল স্যার, আছেন মেজর ইসহাক স্যার।

ইউনিট অনুশীলনে আছে রুপদিয়ায়। ৫৬ দিনের অনুশীলন। সবাই ক্যান্টনমেন্টের বাইরে থাকে এই সময়। শীতকাল, তাবুর জীবন। আমার তাবুটি একেবারে সৈনিকদের সাথে লাগানো। বাথরুম করার জন্য বদনা হাতে নিয়ে সৈনিকদের টয়লেটেই যেতে হয়। একটু একটু লজ্জা লাগে। কেমন দেখা যায় যে, একজন অফিসার পায়খানা করার জন্য হাতে বদনা নিয়ে প্রায় ১০০ গজ দূরে পায়খানার জন্য যাচ্ছে, আর এটা প্রায় সব সৈনিকদের সামনে দিয়েই। 

ইউনিটে আসার পর সিনিয়ররা এমন এমন সব ব্যবহার করলেন, কই একটু খেদমত টেদমত করবেন, তা না। বরং কেউ মেস ওয়েটার সেজে, কেউ আর্দালী সেজে কেউ বা আবার নকল অধিনায়ক সেজে আমাকে কিভাবে নাস্তানাবুদ করা যায় সেইসব চেষ্টার কোনোই বাকী রয় নাই। মেডিক্যাল চেকআপের নামে ডাক্তার সেজে আসা এক অফিসার তো আমাকে রাতের বেলায় একেবারে দিগম্বর করে সবার সামনে ঘটার পর ঘন্টা রাতের কালো অমাবশ্যা রাতে দাড় করিয়েই রাখলো, তাও তো প্রায় ঘন্টা দুয়েক হবে। বুঝতেছি কি হচ্ছে, কিন্তু কিছুই বলার নাই, কিছুই করারও নাই।

শুধু একফাকে আমার দোস্ত লুতফর এসে বল্লো, পালন করে যা, যা বলছে। তা না হলে ঐ যে দেখছিস পুকুর, সারারাত ওখানেই কাটাতে হবে। লুতফরকে দেখে প্রানে একটু আশার বানী পেয়েছিলাম বটে কিন্তু মাত্র ৬ মাসের সিনিয়ার সে আমার কাছ থেকে, তার অবস্থা হয়তো একটু পুরানো কিন্তু এর মানে এই নয় যে, ওর গায়ের থেকে সেই বিএমএ এর শিটপটের গন্ধ মুছে গেছে। সেও এক প্রকার ভয়ে ভয়েই জীবন চালায়। লুতফর আমার ক্যাডেট কলেজের বন্ধু। আমরা মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে ১৫ ইনটেকের ব্যাচের ছাত্র। লুতফর ছিলো আমাদের কলেজ ক্যাপ্টেন।

যাক, শেষ হয়েছে সেদিনের তাদের নতুন অফিসারের সাথে রংগলীলা। পরেরদিন অধিনায়কের সাথে আমার ইন্টারভিউ হলো। বিশাল বড় তার তাবু। সামরীক বাহিনীর লোকেরা যে একটা তাবুকে এই রকম বালাখানা করিয়ে ফেলতে পারে, অধিনায়কের তাবু না দেখলে বুঝা যাবে না। টিভি, ফ্রিজ, আলীশান টেবিল, নীচে কার্পেট সবই আছে। অধিনায়ক আমাকে অনেক কিছু জানালেন, বুঝালেন, এবং বললেন, এই সামরীক বাহিনীর চাকুরীতে সবচেয়ে বেশি জরুরী হলো নিজেকে সামরীক বাহিনীর আদলে শিক্ষিত করে তোলা। খুব ভালো লাগলো অধিনায়কের কথা।

আমার দোস্ত লুতফর একটু পরে এলো। শুনলাম সে নাকি ইউনিটের এডজুটেন্ট। খুব পুলকীত হবার কারন নাই। গত কয়েকদিনে আমার ৬ বছরের ক্যাডেট কলেজের বাল্যবন্ধু লুতফরও অনেক পালটে গেছে। সামরিক জীবনে সিনিয়ার জুনিয়ারের মাহাত্য না কেউ বুঝলে তার কপালে দুঃখ আছে। এখানে যেনো আগের ইতিহাসের কোনো মুল্য নাই। থাকলেও সেটা খুবই কিঞ্চিত। এখানে কাজ করে জুনিয়রিটি আর সিনিয়রিটি। লুতফর আমার সিনিয়র। এটাই বড়।

সারাদিন কম্বেট ইউনিফর্ম পড়ে কোমরে একটা পিস্তল ঝুলিয়ে ম্যাপ আর বাইনোকুলার সাথে নিয়ে অগোছালো ক্ষেতের আড়, জংগল, কবরস্থান, সব কিছুই যেনো আমাদের চলার পথ, থাকার পথ, যুদ্ধ খেলার পথ। যেহেতু আর্টিলারীর কিছুই জানি না, তাই, আমার জন্য বেশ কিছু চতুর আর চৌকশ এনসিও বরাদ্ধ করা হলো যেনো আর্টিলারীর আদিপান্ত আমাকে শিখানো হয়। যাকে বলে বিনে পয়সায় কোচিং। এর মধ্যে আমার দোস্ত লুতফরও সামিল।

৩১/১২/১৯৮৫ রুপদিয়া অনুশীলন ক্যাম্প

বি এম এ থেকে পাওয়া ১০ দিনের ছুটি শেষ। পোষ্টিং অর্ডার হয়েছে যশোরে। যশোর সেনানীবাস, ৪ মর্টার রেজিমেন্ট আর্টিলারী। কখনো এর আগে যশোর আসি নাই। এবারই প্রথম। এই একটু আগেই ইউনিটে এসে পৌঁছলাম। সে এক নতুন অভিজ্ঞতা।

আমরা কয়েকজন একসাথে ঢাকা থেকে যশোরে এসে পৌঁছলাম। আমি, ২লেঃ এমদাদুল বারী, ২ লেঃ আশফাকুল বারী। নামলাম মনিহার সিনেমা হলের সামনে। মনিহার সিনেমা হলে নেমে পাশেই রেলওয়ে স্টেশনে চলে গেলাম কারন ইউনিটে বলা ছিলো যে, আমরা যশোর রেলওয়ে স্টেশনে থাকবো যেখান থেকে ইউনিটের গাড়ি আমাদেরকে পিক করবে। যদিও যশোর ক্যান্টনমেন্টে পোস্টিং কিন্তু আমাদের যেতে হবে সেখানে যেখানে আমাদের ইউনিট শীতকালীন অনুশীলনে করছে। নাম রুপদিয়া। আমি চিনি না। ইউনিট থেকে গাড়ি গিয়েছিলো আমাকে আনার জন্য।

অনেক্ষন বসে আছি আমি আর ওরা। কে যে আসবে তাকেও আমি চিনি না। সিগারেট খাচ্ছি আর বসে বসে যাত্রীদের আনাগোনা দেখছি। ওয়েটিং রুমে বসে আছি। প্রচুর যাত্রী। আমরা ভগ্ন সাস্থ্য ওয়ালা, গলাছিলা মুরগীর মতো হেয়ারকাট নিয়ে বসে আছি। আমরা যেমন যাত্রীদেরকে দেখছি, কিছু কিছু যাত্রী উতসুখ নয়নে আমাদেরকেও দেখছে। হয়তো ভাবছে-কিরে ভাই, এমন পোলাপান গুলি এভাবে হেয়ারকাট নিয়েছে কেনো?

পড়নে আমাদের সাহেবী পোষাক। বারী আবার হেট পড়েছে। ওর বাবা সিনেমার ফটোগ্রাফার। হয়তো সেই নায়ক নায়ক ভাবটা গত দুই বছের তড়েনিং এ ও পুর্ন বিলুপ্ত হয় নাই। এমন সময় একজন হালকা পাতলা ফৌজ, মুখে গোপাল ভাড়ের রাজার মতো গোফ, কিন্তু পরনে সামরীক ইউনিফর্ম, এসে হাজির। ওয়েটিংরুমে এসেই বল্লো, এখানে কে লেঃ আখতার স্যার? আমি তাকিয়ে দেখলাম, বেশ স্মার্ট একজন সৈনিক।

আমি সাড়া দিতেই সে আমার ব্যাগ গুছিয়ে একাই কাধে তুলে নিল, আমাকে গাড়ি কোথায় আছে দেখিয়ে বল্লো, স্যার, আমাকে ফলো করেন। গিয়ে দেখি একটা পিকআপ। পিকআপের সেকেন্ড সিটে বসলাম। ড্রাইভার আছে। নাম জব্বার। যে আমাকে আনতে গিয়েছিলো সে পিকআপের পিছনে গিয়ে বসলো। আগেই বলেছি- যশোর আমার এই প্রথম পদার্পন। কখনো আসি নাই। এই প্রথম। একটু একটু কেমন যেনো লাগছিলো।

গাড়ি বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর ড্রাইভার রাস্তার একপাশে থামিয়ে বল্লো, স্যার এসএম (সুবেদার মেজর) সাহেব বাজারে গেছেন, ঊনি এইখান থেকে উঠবেন। এস ম সাহেব কি, কে বা কি তার কাজ আমার কিছুই জানা নাই। বললাম, ওকে।

প্রায় ১০ মিনিট পর এসএম সাহেব এলেন। হাতে তার বাজারের একটা পোটলা। গায়ে ইউনিফর্ম, মাথায় টুপী নাই তাই তার টাক মাথা পুরুটাই রোদে চিকচিক করছে। আমার কাছে এসে সালাম দিয়ে বললেন, স্যার ভালো আছেন? আমি ইউনিটের এসএম হাসেম।

ওনার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, বয়স আমার থেকে প্রায় ডাবল। চুল একখানও নাই। মোটা একটা মানুষ। খুব বেশি কথা বলার নাই। হাসেম সাহেব উঠে গেলেন পিকআপের পিছনে। গাড়ি ছুটে চল্লো গন্তব্যের দিকে। প্রায় ৪০ মিনিট ড্রাইভ করে যেখানে থামলো, দেখি আশেপাশে বেশ জংগল, কিন্তু ভিতরটা বেশ সাজানো গুছানো।

আমি নামতেই রায়হান নামে একজন পিচ্চি টাইপের সৈনিক এসে আমার ব্যগ তুলে নিলো, হাসেম সাহেব কাকে যেনো কি বল্লো, ড্রাইভার আমাকে ছেড়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো। রায়হান আমাকে একটা ছোট তাবুতে নিয়ে গেলো, যার নাম ফোর্টি পাউন্ডার তাবু। ছোট একটা পরিসর। আমাকে এখানেই থাকতে হবে। তাবুর ভিতরে মাটি কেটে খাট বানানো, নাড়ার খেরা দিয়ে সেই খাট ভরা, আর খেরের উপরে একটা তোষক দেওয়া, এটাই আমার বালাখানা। খাটের পাশে পা রাখার জন্য মাটি কেটে একটু নীচু করে রাখা যাতে পা রাখা যায়।

খুব ক্ষুধা লেগেছে, বললাম, খাবারের ব্যবস্থা আছে কিনা। রায়হান বল্লো, স্যার একটু অপেক্ষা করতে হবে রান্না হচ্ছে। মিনিট যায়, ঘণ্টা যায়, খাবার আর রেডি হয় না। প্রায় ৩ টার দিকে রায়হান কয়েকটা রুটি  আর শব্জী নিয়ে এলো। দেখেই মেজাজ যেনো তেলে বেগুনে। বললাম, কি ব্যাপার, রুটি কেনো, ভাত নাই?

রায়হান অভিজ্ঞ রানার, বল্লো, স্যার ফিল্ড মেসে ইন হলেই আপনার পছন্দমতো খাবার খেতে পারবেন, আজ সৈনিক মেস থেকে খাবার আনা হয়েছে। আমরা দুপুর রুটি আর শব্জী খাই। ফিল্ড মেস আবার কি, আমি জিজ্ঞেস করলাম। রায়হান কি উত্তর দিবে ঠিক বুঝা গেলো না। শুধু বল্লো, স্যার আপনাকে দুই মাস আমাদের সৈনিকের সাথে থাকতে হবে, তাদের খাবার খেতে হবে, একই টয়লেট ইউজ করতে হবে। এই দুইমাস পার হবার পর অন্যান্য স্যারেরা যেখানে খায় সেখানে আপনি খেতে পারবেন। সেটাকে বলে ফিল্ড মেস।

হায় রে, একেই বলে নমসুদ্র আর ব্রাহ্মণ। আমি এখন নমসুদ্রের দলের মতো ব্রাহ্মণের দল থেকে আলাদা যদিও অফিসার। রায়হানকে বললাম, সিগারেট কিনবো কোথা থেকে, আমার তো সিগারেট লাগবে। রায়হান বল্লো, স্যার ক্যান্টিনে সিগারেট পাওয়া যায়, এনে দিচ্ছি। একটু পর রায়হান আমার কাছে এক প্যাকেট সিগারেট দিয়ে গেলো। আমি তো অবাক। কিরে ভাই, টাকা দিলাম না, পয়সা দিলাম না, সিগারেট চলে এলো? অনেক পরে জানলাম, ক্যান্টিন থেকে আমার নামে সিগারেট বাকী আনা যায়, মাস গেলে এর বিল দিতে হয়। ভালোই তো।

শুরু হয়ে গেলো সামরীক জীবন।

১৯/১২/১৯৮৫-১৩ লং পাসিং আউট

আজ আমাদের পাসিং আউট প্যারেড হয়ে গেলো। গত কয়েক মাস যাবত নিরবিচ্ছিন্ন পাসিং আউট প্যারেডের প্র্যাকটিস করতে করতে এক রকম রোবোটের মতোই হয়ে গিয়েছিলাম। সকাল থেকে শুরু হয় প্র্যাকটিস আর সেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। জেন্টেল্ম্যান ক্যাডেট থেকে কমিশন অফিসার হয়ে যাওয়ার এই বিশাল মেকানিজমে যা দেখেছি তা এক জীবিনের অভিজ্ঞতা।

              

যেদিন প্রথম বি এম এ তে ঢোকেছিলাম, সেদিন গেটে ঢোকেই হতভাগ হয়ে গিয়েছিলাম। এই কারনে যে, আমরা সবাই খুব সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় পড়ে এসেছিলাম। কেউ টাই পড়ে, কেউ কোট পড়ে, কেউ আবার বিদেশী স্টাইলের হেট পড়ে। সবার ভাবখানা এই রকম, জেনারেল সাহেব বনে গেছি ইতিমধ্যে। এই রকম একটা ভাব সবার মধ্যেই ছিল। আমি বি এম এ স্টাফ বাসে করে চিটাগাং থেকে হালি শহরের মধ্যে ঢোকি। যেই না গেটের ভিতরে ঢোকেছি, অমনি এক দল স্টাফ হটাত করে অতর্কিতে খাস আজরাইলের মতো গাড়ির সামনে এসে দাড়ালেন আর হুংকার ছাড়লেন, গেট ডাউন, নো টাইম।

আরে টাইম তো কিছু লাগবেই নাকি? এটা আবার কেমন কথা, নো টাম গেট ডাউন। সরু বাসের গেট, তারাহুরা করতে গয়ে গেটের মধ্যেই অনেকে আমরা আটকা পড়ে গেছি। তারমধ্যে কারো কারো হাতে আবার ছোট ছোট ব্যাগ। কিসের কি। স্টাফ রা এমন করে আমাদের সাথে আচরন করতে লাগলেন যেনো আমরা সবাই আসামী, আর দাগী কিছু।

কে শুনে কার কথা। শুরু হয়ে গেলো আজরাইলের মতো ব্যবহার। কেউ ধাক্কা দিচ্ছে, কেউ আবার টানাটানি করছে। কেউ আবার সুটকেস নামানোর জন্য একটু অপেক্ষা করছিলো, তাদেরকে ওই সুটকেসসহই কুলিমুজুরের মতো বসিয়ে দিয়ে সুটকেস সহকারে দৌড়াতে আদেশ দেওয়া হল। বসে বসে দৌড়ানো আমি এই প্রথম শুনলাম। প্রতিবাদ করবেন? কোনো উপায় নাই। এখানে কেউ কারো কথা শুনেও না, বুঝেও না। আপনি যদি না বুঝেন, সেটা আপনার সমস্যা এবং এর সমাধান- একটাই- কন্টিনিউয়াস রগড়া।

১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা সবাই বিশাল বিশাল ড্রেনের ভিতর সাতার কাটতে থাকলাম। ব্যাপারটা যেনো এই রকম, সবাই মাছ ধরছি, তাও আবার মনের আনন্দে। পায়খানা, পচা ময়লা, পলিথিন, আর কি যে আছে, তাও জানি না। এর মধ্যেই মাথা ভিজিয়ে ডুব দিয়ে কি যে রত্ন খোজা, কে জানে। উপরে দাঁড়ানো আজরাইল গুলি আবার মাঝে মাঝে এই রকম রংগ করছেন যে, “কি সাহেব, কিছু পেলেন? এখনো পান নাই? খুজতে থাকেন”

এই যে একটু আগে টাইটুই পড়ে বাবু হয়ে সেজেগুজে এসেছিলাম, এখন কাউকে দেখলে বুঝার কোনো উপায় নাই, কোনটা টাই আর কোনটা আমার মুখ। সারা বছর এই নোংরা পানি আর মল মুত্রের আড্ডাখানা ড্রেনটা আমাদের নদীর সাতারের একটা বদ্ধ খালের মতো মনে হলো। দূর্গন্ধ আর নোংরা পানিতে একাকার। ড্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মহামান্য রথীগন। কেউ টু শব্দ করলেই নতুন আইটেম। যা আরো ভয়াবহ। চল্লো এইভাবে প্রায় ৩০/৪০ মিনিট। তার পর পরের আইটেম।

দয়া পরবশ হয়ে মহারথী স্টাফ গন আমাদেরকে গলা অবধি ডুবে থাকা ড্রেন থেকে উঠে আসার আদেশ করলেন। আমরা হাসের বাচ্চার মতো সবাই কোনো টু শব্দ না করেই একে একে উঠে এলাম। এখানেও তাড়াহুড়া। কেনো আমি ওর আগে উঠতে পারলাম না, তাই, ওই দূরের গাছটাকে দৌড়ে গিয়ে একবার টাচ করে আসতে হবে। কি এক মহাজজ্ঞ।

এইভাবে প্রায় সারাটা বিকাল আর প্রায় রাত ১টা পর্যন্ত চল্লো আমাদেরকে সিভিলিয়ান থেকে ফৌজের ধারায় মোটিভেট করার কৌশল। কোনো খাওয়া দাওয়া নাই, কোনো রেস্ট নাই, কেউ কেউ আবার অতিরিক্ত টর্চারে বমিও করে দিচ্ছে। মহারথী স্টাফগন এর মাঝে আবার কৌতুক করে বলছেন, কেউ কি ক্ষুধার্থ? যে বলেছে, সে ক্ষুধার্থ, তাকেই ওই বমির কাছে নিয়ে গিয়ে বলছেন, খেতে পারেন। উফ, কি অমানুষ। কিন্তু কিছুই করার নাই। হয় ক্ষুধা নিবারন করবেন, না হয় ক্ষুধা আছে এটা বলা যাবে না।

রাত ৮টার পরে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো নাপিতের দোকানে। বিএমএ এর নাপিতও অনেক সেয়ানা।  মাথাটা ধরলেন, বাটির মতো করে ঘ্যাচাং করে চারিপাশ এমন করে কাটলেন, যা আমি আজো এই রকম বাটিছাট দেখি নাই। না আছে এর কোনো স্টাইল, না আছে কোনো ক্যারিশমা, না আছে কোনো মহব্বত। কোনো কথা বলবেন নাপিতের সাথে? ওরে বাবা, সেও আরেক দফা সামরীক জেনারেল। তবে চুল কাটার সময় মনে হইলো, আহা, কি শান্তি। অন্তত কিচুক্ষন সময় তো আজরাইলদের কাছ থেকে মুক্তি পাওয়া গেলো। আরামে চোখ বুজে আসে কিন্তু নাপিতের ঝাকুনিতে তন্দ্রা ভেংগে যায়। এইভাবে রাত শেষ হয়ে কখন যে ভোর হয়ে যায় টুকরো টুকরো শাস্তির বিনিময়ে বুঝতেই পারি নাই।

১ম টার্মকে বলা হতো শিটপট, মানে পায়খানার সমান এরা। ২য় টার্মকে বলা হয় বদনা। অন্তত কিছুটা সলিড বস্তূ, ৪র্থ টার্ম মানে মহারাজা। সর্বত্র তার রাজত্ব। শিটপটেরা কোনো সিনিয়রকেই আজ পর্জন্ত চোখে দেখে নাই। সিনিয়র দেখলেই চোখ বন্ধ। ভাবখান এই রকম যে, না জানি কোনো এক মহারাজারা যাচ্ছেন পাশ দিয়ে। বি এম এর ইতিহাস লিখে শেষ করা যাবে না। প্রতিদিন নতুন ইতিহাস, প্রতিদিন নতুন নতুন অভিজ্ঞতা।

এইভাবে ২ বছর পার করে আজ সেই কাঙ্ক্ষিত পাসিং আউট। কি যে অনুভুতি ভাষায় বুঝানো যাবে না। যে স্টাফগন একদিন আমাদেরকে কারনে অকারনে ট্রেনিং করানোর জন্যে অনেক বাজে ব্যবহারও করেছেন, আজ সেই সব স্টাফগনই র‍্যাংক পড়ার পর সামনে এসে স্যালুট দিয়ে বললেন, স্যার, কত ভুল করেছি, কিছুই মনে রাইখেন না। জড়িয়ে ধরলাম।

কাল চলে যাবো বিএমএ থেকে। এতো ছাড়তে চেয়েছিলাম এই স্থানটি, এর উপর কত রাগ, কত গোস্যা, আজ যখন আমাকে এই জায়গাটি ছাড়তেই হবে, তখন মনে হচ্ছে, এটা তো আমার জায়গা। ছেড়ে যেতে কিছুতেই মন চাইছে না। এই রাস্তা, এই পাহাড়, এই ডরমেটরী, এই পিটি গ্রাউন্ড, এই সব গাছপালা সব কিছু আমার চেনা। এখানে প্রতিটি জায়গায় আমার পায়ের চিহ্ন আছে, প্রতিটি মোড়ে মোড়ে আমার ঘামের গন্ধ আছে। তবু আমাকে যেতেই হবে নতুনকে স্থান দেওয়ার জন্য।

১০ দিনের ছুটি। এসেছিলাম সিভিলিয়ান হিসাবে, আজ বের হচ্ছি সামরীক মানুষ হিসাবে। ভবিষ্যৎ কি, কেমন, কোথায় আমার কিছুই জানা নাই।