৩০/১০/১৯৯১-খাসি কুকুর হয়ে গেলো

আমি নিউলংকার বিডিআর ক্যাম্পের দায়িত্তে আছি। নির্জন পাহাড়িয়া এলাকা। শান্তিবাহিনীর আমল। সুদুর চট্টগ্রাম থেকে এই নিউলংকার ক্যাম্পে আসার জন্য কোনো যানবাহন নাই, পুরু পথ পায়ে হেটে আসতে হয়। এতো এতো উচু পাহাড় আর নালা যে, এক কিলোমিটার হেটে আসতে সময় লাগে প্রায় ২/৩ ঘন্টা। যেহেতু যানবাহনের সুযোগ নাই, তাই, আমার এই ক্যাম্পে যতো খাবার আসে, সবকিছু হেলিকপ্টার দিয়ে সরবরাহ করে। আবহাওয়া খারাপ থাকলে মাঝে মাঝে আমাদের ক্যাম্পের খাবারের সল্পতা দেখা যায়। তখন আমাদেরকে অনেক কম সরবরাহে জীবনযাপন করতে হয়। প্রতি ১৫ দিন পরপর হেলিসর্টি হয়। আমরা ব্যাপারটায়  প্রায় অভ্যস্থ হয়ে গেছি যে, মাঝে মাঝেই আবহাওয়ার কারনে ক্যাম্পে হেলিসর্টি বিঘ্নিত হতেই পারে। এরফলে আমরা বিকল্প ব্যবস্থার স্রিষ্টি করি। যেমন, লোকাল লোকজনের কাছ থেকে কিছু চাল, কিংবা শব্জি, অথবা কখনো কখনো হাস মুরগী বা ছাগল জাতীয় বাজার কিনে দিনানিপাত করি। 

পাহাড়িয়া এলাকার মানুষ বেশ গরীব। তারা অল্প দামেই এসব আমাদের ক্যাম্পে এসে বিক্রি করে। অনেক সময় তারা ভয়েও বেশি দাম বলে না বা ওরা হয়তো এ রকমই। অল্পতেই খুশী। ওদের জীবন যাত্রা একেবারেই সাদাসিদে। অনেক ট্রাইব। কোনো কোনো ট্রাইব গরু ছাগল হাস মুরগী কুকুর বিড়াল সবই খায়। কিন্তু সব ট্রাইবদের একই স্বভাব প্রায় যে, এরা কোনো খোয়াড়ে কোনো পশু বা জন্তু বন্দি করে পালন করে না। পাহাড়িয়া মানুষদের মতো এই জন্তুগুলিও সারাদিন পাহাড়ের এপাশে ওপাশে ঘুরে ঘুরে ঘাস কিংবা লতাপাতা খেয়ে পেট ভর্তি করে, আর পেট ভরে গেলে জন্তুগুলি যার যার বাড়িতে সয়ঙ্ক্রিয় ভাবেই পৌঁছে যায়। জন্তুগুলিও ওদের নিজের আস্তনা যেনো ভালো করেই চিনে। কখনো কখনো একপাল ছাগল, বা ভেড়া দলবদ্ধভাবে এক পাহাড় থেকে মনের আনন্দে ঘাস খেতে খেতে মাইলের পর মাইল হেটে আমাদের ক্যাম্পের পাশেও চলে আসে। 

বর্ষার দিন চলছে। প্রায়ই আবহাওয়া চরমরুপে থাকে। কখনো কখনো ঝর, কখনো মুষল্ধারে বৃষ্টি হয়। আমরা যেখানে থাকি, তার উচ্চতা প্রায় ২/৩ হাজার ফুট। মাঝে মাঝে মেঘের ভেলা আমাদের গা ভিজিয়ে দিয়ে যায়। আমার বড্ড ভালো লাগে আকাশের এই লুকুচুরি। ইদানিং আবহাওয়া খারাপ থাকায় আমাদের ক্যাম্পে হেলিসর্টি আসতে পারছে না। পাহাড়িয়া ঝড় খুব বেপরোয়া। আমাদের ক্যাম্পের রসদ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পে চাউলের কোনো সমস্যা নাই কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সবজি বা কোনো মাংশের ব্যবস্থা নাই। আমরা প্রায় ৪০ জন মানুষ। প্রতিদিন হেলিসর্টির জন্য অপেক্ষা করি বটে কিন্তু প্রতিদিনই সেটা আবহাওয়ার কারনে বাতিল হয়ে যাচ্ছে। 

বসে আছি ক্যাম্পের মেইন গেটের সামনে। এমন সময় দেখলাম, একটা কাল ছাগল ঘাস খেতে খেতে আমাদের গেটের সামনে এসে হাজির। আমার সেন্ট্রি বল্লো, স্যার, ক্যাম্পে তো কোনো কিছুই নাই, আবার কবে হেলিসর্টি আসবে সেটাও সিউর না। এই যে একটা ছাগল গেটের সামনে ঘাস খাচ্ছে, আমরা তো এটাকে জবাই করে আপাতত জীবন বাচাতে পারি। আমি বললাম, কার না কার ছাগল। কিভাবে জবাই করি? যদি মালিক পাওয়া যাইতো, তবে না হয় টাকা দিয়ে কিনে নিতে পারতাম। সেন্ট্রি বল্লো, স্যার যদি আমরা খেয়ে ফেলি, এক সময় অরিজিনাল মালিক হয়তো কাল বা পরশু এই ছাগল কোথায় গেলো খুজতে খুজতে ক্যাম্পে আসতেও পারে। তখন না হয় দাম দিয়ে দেবো। 

একদিকে ক্যাম্পে কোনো খাবার নাই, অন্যদিকে কার না কার ছাগল জবাই করে খেয়ে ফেলবো, ব্যাপারটা আমার কাছে কখনো অবস্থায় কারনে সঠিক বলে মনে হলেও আবার পরক্ষনে এটা নীতি বিরুদ্ধ কাজ সেটাও মাথায় চলে আসে। আমি আসলেই আমার সৈনিকদের নিয়ে বেশ চিন্তায় আছি। এই চিন্তা নিয়েই ঘুমাতে গেলাম। পরদিন সকালে দেখলাম, ছাগলটা তখনো মেইন গেটের সামনেই শুয়ে আছে। এটা আর তার নিজ মালিকের ঘরে ফিরে যায় নাই। ব্যাপারটা আমার কাছে অসাভাবিক মনে হয়েছে। আরো অসাভাবিক মনে হয়েছে যে, কোনো উপজাতী তার ছাগলটা হারিয়ে গেছে এর জন্যে খুজতেও আসে নাই। কয়েকজন উপজাতী এর মধ্যে আমাদের ক্যাম্পে এসেওছিলো। কিন্তু কেউ বলতে পারে নাই আসলে এই ছাগলটা কার বা কে মালিক। 

হেলি সর্টি না আসার কারনে আমার মাথাও বেশ অগোছালো মনে হচ্ছিলো যে, কিভাবে এই ৪০/৪২ জন সৈনিকের প্রতিদিনকার খাবার আমি ব্যবস্থা করবো। এক সময় মনে হইলো যে, যদি আগামি কালও দেখি ছাগলটা ক্যাম্পের গেটে আছে, তাহলে এটাকে জবাই করে খেয়ে ফেলবো। পরে যদি কেউ খুজতে আসে, তখন না হয় মাফ চেয়ে ন্যয্য মুল্য দিয়ে দেবো। আপাতত জীবনতো বাচুক। রাতে ঘুমাতে গেলাম। বাইরে প্রচন্ড ঝড়, সাথে তুমুল বৃষ্টি, আগামী কালও যে হেলিসর্টি হবেনা এ ব্যাপারে আমি নিসচিত। 

সপ্নঃ 

আমরা ছাগলটা জবাই করে ফেলেছি। ক্যাম্পের সবাই আনন্দের সাথেই এটার মাংশ ছারাচ্ছে। আজ ভালো একটা খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে, এই আনন্দে প্রায় সবাই ছোট এই ছাগলটার মাংশের দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও পাশেই একটা চেয়ারে বসে সৈনিক মাংশ ছারান দেখছি। ছাগলের মাংশ বানানো শেষ। বিকালে বাবুর্চি মাংশ রান্না করেছে। রাতে আমার রানার ভাত আর ছাগলের মাংশ নিয়ে এলো আমার জন্য। কিন্তু একি? আমি ছাগলের মাংশের পরিবর্তে মনে হলো এটা তো কুকুরের মাংশ মনে হচ্ছে! আমার খুবই ঘেন্না লাগল। আমি কিছুতেই মাংশটা খেতে পারলাম না। আমার ঘুম ভেংগে গেলো। আমি পরদিন দেখলাম, ছাগলটা তখনো মেইন গেটে শুয়ে আছে। কিন্তু এবার আর আমার সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হয় নাই। আমি মনে মনে ভাবলাম, এতা খাওয়া যাবে না। এতা আমার জন্য এইভাবে খাওয়া হারামের ইংগিত দিচ্ছে। 

২৩/১০/১৯৯১-কেনো সেচ্ছায় হিলে আসা

জীবনে কিছু কিছু সময় থাকে যখন নিশ্চিত ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা জেনেও সে সেটাই করে। আপাতদৃষ্টিতে সিদ্ধান্তটা আত্তঘাতী বলে মনে হতে পারে, অথবা মনে হতে পারে মানষিক কোনো সমস্যা, কিন্তু যিনি এই মোড় ঘুরে যাওয়ার মতো কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তিনিই একমাত্র জানেন, কেনো এই আত্তঘাতীমুলক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বা নিতে হচ্ছে। কারো জীবনে যখন সারাটি দিন, ক্ষন অথবা মুহুর্ত বিপদের মধ্যেই থাকে, কিংবা এমন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই তার জীবন অতিবাহিত হয় যা সাভাবিক জীবন থেকে অনেক আলাদা, তখন কোনটা নিশ্চিত ক্ষতি আর কোনটা নিশ্চিত লাভ, এটা আর তখন বাছ বিচার করার সময় থাকে না, তেমনি থাকে না কোনো প্রাইয়রিটিও। সামনে যেটা আসে, সেটা আপাতত সামাল দিতে তখন যা যা করা উচিত বলে মনে হবে, সেটাই আসলে সঠিক সিদ্ধান্ত হিসাবে তাকে তাইই করতে হয়। হোক সেটা আত্তঘাতীমুলক বা এই জাতীয় কিছু। কখনো কখনো এই সিদ্ধান্তগুলি মানুষকে নিশ্চিত পরাজয়ের দারপ্রান্তে যেমন নিয়ে যেতে পারে, তেমনি পারে নিশ্চিত সাফল্যের দারপ্রান্তে নিয়ে যেতে। এটা এক প্রকারের গেম্লিং বলা যেতে পারে।

আমি যে সব ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে আমার প্রাত্যাহিক জীবন চালিয়ে যাচ্ছিলাম, তাতে আমার ব্যাপারে কি ঘটবে আর সেটা কিভাবে সামাল দেবো, এই বিচার আমারই ছিলো তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম না আমি কি পরাজয়ের পথে এগুচ্ছিলাম নাকি নিশ্চিত বিজয়ের পথে। আমার প্রাত্যাহিক জীবনে বেশ কিছু বিষয় ছিলো যা অনেকটা অমাবশ্যার দিন রাত্রির মতো। আমি বুঝতে পারছিলাম না, কিভাবে এই রাহু বৃত্ত অমাবশ্যার ছোবল থেকে আমার নিস্তার বা পরিত্রান। আর আমি এটাও বুঝতেছিলাম না, আমার এই অমাবশ্যার ক্ষন কিভাবে কেটে যাবে। অমাবশ্যা কবে কাটবে তার জন্য হয়তো জজ্ঞের আয়োজন করা যেতে পারে কিন্তু অমাবশ্যা কাটবে কিনা সেটা কোন ভাবেই জজ্ঞ নিশ্চয়তা দেয় না। অনেক সময় ছোট ব্যাপার বড় হয়, আর সেই বড় ব্যাপার থেকে তৈরী হতে পারে কোনো বড় ধরনের ঝামেলা। আমি ঠিক সে রকম একটা অমাবশ্যার পরিস্থিতিতে যেনো আছি।

বগুড়া সেনানীবাসে লোকেটিং ইউনিটে কর্মরত ছিলাম। আমার ওসি মেজর ইকবাল স্যার অনেক ভালো মানুষ কিন্তু চাপা সভাবের হওয়াতে তার সাথেও আমি অনেক কিছুই শেয়ার করতে পারছিলাম না। তাহলে ব্যাপারটা খুলেই বলিঃ

সেনানীবাসে একজন আর্মি অফিসারের বিয়ের বয়স অফিশিয়ালি নির্ধারন হয় তার বয়স কমপক্ষে ২৬ হতে হবে অথবা চাকুরীর মেয়াদ কমপক্ষে ৬ বছর যেটা আগে হয়। কিন্তু যে কোনো পরিস্থিতিই হোক আমি গত ৩০ শে মে ১৯৮৮ তারিখে কাউকে না জানিয়ে মিটুলকে বিয়ে করে ফেলি। এই ঘটনাটা জানাজানি হলে আমার শাস্তি হবে অনেক কঠোর এই কারনে যে, আমি আর্মির আইন ভংগ করে বিয়ে করেছি। সবচেয়ে কম শাস্তি হবে এই রকম যে, আমার অন্তত ২ বছরের সিনিয়রিটি কেড়ে নেয়া হতে পারে। তাই, আমার এখন কাজ হচ্ছে, সময় পার করা যাতে আমি আর্মির নিয়ম অনুসারে অন্তত হয় ২৬ বছর বয়সী হই অথবা চাকুরীর মেয়াদ অন্তত ৬ বছর পার করি। আর এটা হতে আমার আরো দেড় বছর বাকী। এই দেড় বছর আমাকে এতোটাই সাবধানে চলতে হবে যেনো কোনো গোয়েন্দা, কিংবা কোনো অফিশিয়াল তদন্তের মধ্যে পড়ে না যাই। ব্যাপারটা খুবই আতংকের। মিটুল (মানে আমার স্ত্রী) যেহেতু জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, ফলে ওকে হোষ্টেলে রাখাতে আমার অন্তত একটা বউ লুকানোর জায়গা ছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে মিটুল বগুরায় ওর এক বোনের বাসায় আসে যেখানে আমরা দেখা করি, রাত্রি যাপন করি। এটাও খুব বিপদজনক। কারন বগুড়া সেনানীবাস খুব ছোট একটা সেনানিবাস (বিশেষ করে জাহাজ্ঞিরাবাদ সেনানিবাস)। এখানে প্রতিটা অফিসারের মুভমেন্ট গোয়েন্দা সংস্থা খুব শক্ত করে মনিটর করে।

এমনই এক সময়ে আমাকে আমার আরপি (রেজিমেন্টাল পুলিশ) হাবিলদার (হাঃ মোজাম্মেল) কানে কানে একটা ইনফর্মেশন দিলো যে, স্যার, মিটুল চৌধুরী কে? আমার তো পিলে চমকে উঠার মতো অবস্থা। কারন মিটুল চৌধুরী সম্পর্কে বা এই নামটা তো অন্তত আমার আরপি হাবিলদার কোনোভাবেই জানার কথা নয়। জিজ্ঞেস করলাম, কেনো, কি হয়েছে? মোজাম্মেল জানালো যে, কোনো এক গোয়েন্দা বাহিনীর কেউ তাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে। ব্যাপারটা আমাকে ভীষনভাবে ভাবিয়ে তুল্লো। ভাবলাম, যদি সত্যি সত্যিই কেউ এ ব্যাপারে খোজ খবর নেয়, তাহলে, আমি ফেসে যাবো, আর সেটা খুব দ্রুত। এর থেকে মুক্তির একটা উপায় বের করতে হবে যাতে আমি নিরাপদে আরো দেড় বছর কারো চোখে না পড়ি।

অনেক ভাবলাম ব্যাপারটা নিয়ে। কারো সাথে এটা নিয়ে কোনো আলাপ আলোচনাও করতে পারতেছিলাম না। তাই নিজে নিজে দুটূ জিনিষ নিয়ে গবেষনা করলাম। (১) কোনো না কোনোভাবে আমার জানান দেয়া উচিত যে, মিটুল চৌধুরী আমার কি হয়। (২) জানান দেয়ার পর আমাকে ইমিডিয়েটলী লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়া যাতে আমাকে নিয়ে গোয়েন্দা বাহিনীর কারো অতিরিক্ত ইন্টারেষ্ট নিতে না হয়। সে মোতাবেক, পরেরদিন আমি আমার ওসিকে বললাম, স্যার, আমার বাড়ি থেকে আমার বিয়ের ব্যাপারে মেয়ে দেখা হয়েছে। আপাতত "এঙ্গেজমেন্ট" করতে হয়েছে কিন্তু বিয়ের বয়স হলে আমরা বিয়ে করবো। আমার ওসি মেজর ইকবাল হাসলেন, কেনো হাসলেন বুঝা গেলো না। শুধু বললেন, ভালোই তো।

আমি সবাইকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিতে চাই বলে যারা যারা এটা নিয়ে মাতামাতি করতে পারে সেখানে সেখানে একটা করে মিষ্টির প্যাকেট পাঠিয়ে দিলাম যেখানে লেখা ছিল, " মিটুল চৌধুরীর সাথে ক্যাপ্টেন আখতারের এঙ্গেজমেন্টের মিষ্টি"। ব্যাপারটা খুব কাজে লাগলো। মুটামুটি সবাই জানতে পারলো যে, আমার এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে মিটুলের সাথে কিন্তু বিয়ে পরে হবে। আর্মিতে বিয়ের বয়সের আগেও এঙ্গেজমেন্ট করার বিধান আছে। ফলে এটা কোন অপরাধ নয়। এবার আমার ২য় পলিশিতে পদার্পন করার পালা। অর্থাৎ লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়া। কিভাবে সেটা? ঠিক এর মধ্যে চিটাগাং হিল ট্রেক্সে ডেপুটেশনে যাওয়ার একটা অপসন চলে এলো। আর সেটা চিটাগাং হিল ট্র্যেক্সে বিডিআর এর সাথে সংযুক্তি। ছয় মাসের জন্য সংযুক্তি। আমি জানি এটা খুব রিস্ক কারন চিটাগাং হিলট্র্যেক্স একটা ঝুকিপুর্ন এলাকা যেখানে প্রতিদিন শান্তিবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে লড়াই করেই বেচে থাকতে হয়। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, ওখানে গেলে আমার লাইফ রিস্ক আছে কিন্তু তাতে লাভ হবে যে, আমি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যেতে পারবো। ফলে নরম্যাল সেনানীবাসে আমাকে নিয়ে আর কেউ মাতামাতি করবে না। আবার যদি না যাই, তাহলেও বিপদ। আমি প্রথম বিপদটাই বেছে নিলাম। এর কারন দুইটা। এক নম্বর কারন হচ্ছে-লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়া আর দ্বিতীয় কারন হচ্ছে কিছু টাকাও বাড়তি আসবে যেহেতু ওখানে রিস্ক এলাউন্স পাওয়া যায় আবার খরচও কম। আমার টাকারও দরকার ছিলো। এই উভয় সঙ্কট পরিস্থিতিতে আমি আমার ওসিকে বললাম যে, স্যার আমি বিডিআর এর সাথে সংযুক্তি হতে ইচ্ছুক। ডিভিশনে অনেকেই হিলট্রেক্সে যাওয়ার ব্যাপারে উদাসীন, সেখানে আমি ইচ্ছুক বিধায় অপ্সনটা পেতে সময় লাগে নাই। আমার অনুমতি মিলে গেলো। আর সেই সুবাদে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ তারিখে আমার অফিশিয়াল সংযুক্তি আদেশ জারী হলো। আর আমি এর মাঝে কয়েকদিন ছুটি কাটিয়ে গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে এই নিউ লংকারে ক্যাম্পে যোগ দিয়েছি।

চিটাগাং হিল ট্রেক্সে সচেতন থাকলে হয়তো বেচে যাবো কিন্তু প্লেইন ল্যান্ডে গোয়েন্দারা জোকের মত যেভাবে পিছনে লেগে থাকে তাতে সচেতন থাকলেও বেচে যাওয়ার সম্ভাবনা নাই। তাই হয়তো এই নিউ লংকার বিডিআর ক্যাম্প আমাকে বাচিয়ে দিতে পারে।

১৮/১০/১৯৯১-নিউলংকার ক্যাম্প-পর্ব ৪

জ্যোৎস্না সন্ধ্যায় যখন আমি ক্যাম্পের উঠোনের ঠিক মাঝখানে বসি, তখন দেখিতে পাই আকাশের মেঘমালা একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়া পাহাড়ি বাতাসের সাথে একাকার হইয়া কাধে কাধ লাগাইয়া, এক জায়গা হইতে অন্য জায়গায় দ্রুত স্থান পরিবর্তন করিতেছে। কখনো কখনো এই মেঘমালা চাদের কিরনকে পরিবেষ্টিত করিয়া আমার পুরু ক্যাম্পকে আবছা অন্ধকারে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করে, আবার কখনো কখনো মেঘগুলি এতো নীচু দিয়া প্রবাহিত হয় যে, আমার সারা শরীর ভিজিয়া যায়, আমার হাতে থাকা সিগারেটটাও সিক্ত হইয়া আসে। আর্মিতে আসিবার পর আমি অনেক রাত একা একা নির্জন কোনো গায়ের পথ ধরিয়া মাইলের পর মাইল হাটিয়া গিয়াছি। গহীনরাতে আমি সেই মেঠোপথে পেচাদের ডাক শুনিয়াছি। কখনো কখনো আলো আধারে ঘেরা কোনো এক পুকুরের পাশে বসিয়া ব্যংগ সমুহের নাক ডাকা শব্দও শুনিয়াছি।  এই পৃথিবীর রুপ দেখিয়া আমি দিনের আলোয় জেগে উঠা পৃথিবীর রুপের কোনো মিল খুজিয়া পাই নাই। আসলে ঘুমন্ত পৃথিবীর একটা রুপ আছে। জ্যোৎস্নায় ইহার রুপ এক রকম, আবার অমাবশ্যায় ইহার রুপ অন্য রকম। জাগ্রত পৃথিবীর রুপ ঘুমন্ত পৃথিবীর রুপের মতো নয়।

এখন রাত প্রায় বারোটা। আমার ক্যাম্পের সেন্ট্রিপোষ্টের প্রহরী ছাড়া আর সবাই ঘুমিয়ে আছে। আমার থেকে অনতিদূরের ঘরটায় নূর মোহাম্মাদ ওয়্যারলেস অপারেটর মৃদু হারিকেনে ঝিমাইতেছে। নূর মোহাম্মাদের পাশে থাকা ওয়্যারলেস যন্ত্রটা মাঝে মাঝে বেশ সিজিত হইয়া অন্য কোনো ষ্টেশন থেকে "হ্যালো হ্যালো" বার্তা দিয়া নীরবতা ভঙ্গ করিতেছে। আমি আকাশ থেকে ঝরে পরা নির্মল জ্যোৎস্নায় স্নান করিতেছি একা।

হটাত কারো পায়ের আওয়াজ পাইলাম। ঘাড় ঘুরাইয়া দেখিতে পাইলাম, হাবিলদার আব্দুর রহমান রুম হইতে বাহির হইলো। জিজ্ঞেস করিলাম, কোথায় কি কারনে বাহির হইলো। আমাকে একা উঠানে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া আব্দুর রহমানও একটু হচকচিয়ে গেলো। এতো রাতে তো আমাকে এই উঠনে দেখার কথা নয়। সালাম দিয়া বলিল, স্যার, ঘুম আসিতেছে না? আমি রহমানকে কিছুই বলিলাম না। প্রায় মিনিট পাচেক পর আব্দুর রহমান বাথরুম করিয়া আবারো তাহার ঘরে প্রবেশ করিতে যাইবে, এমন সময় আমার মনে হইল, আব্দুর রহমানের সাথে কিছু কথা বলি। আমি তাহাকে ডাকিয়া বলিলাম, -রহমান, কাল তোমার কি ডিউটি? অফ ডিউটি নাকি কোনো ডিউটি আছে?

আব্দুর রহমান সাবলিল ভংগিতে জানালো, -স্যার আগামিকাল আমার কোনো ডিউটি নাই। পরপর কয়েকদিন আমি ডিউটি করার কারনে আগামি দুইদিন আমার অফ ডিউটি। কিন্তু স্যার ক্যাম্পের মধ্যে অফ ডিউটি আর অন ডিউটির মধ্যে আসলে কোনো তফাত নাই। যেখানে থাকার ঘর তার পাশেই ডিউটির ঘর, আবার তার পাশেই রান্না ঘর তো তারই পাশে টিভি রুম। কতটুকুই বা জায়গা স্যার।

বললাম, বসো। আচ্ছা রহমান, তুমি সারাদিন জাল বুনো কেনো? এটা কি তোমার নেশা? আব্দুর রহমান পাশেই একটা ছোট কাঠের গুড়ি নিয়া আমার সামনে বসিয়া পড়িলো। আগেই একবার বলিয়াছিলাম যে, বিডিআর সৈনিকেরা আমাদের আর্মির সৈনিকের চেয়ে ঢেড় বেশী ফ্রি। তাহারা আমাদের আর্মির সৈনিকের চেয়ে অনেক বেশি পরিপক্ক। আব্দুর রহমান, কাঠের গুড়িটায় বসিয়া বলিতে লাগিলো-

স্যার, জাল বুনা আমার নেশা না। এটা বলতে পারেন আমার একটা ইনকামের পথ। আমি প্রতি তিনদিনে একটা জাল বুনি। এ যাবত কাল আমার ট্রাংকের মধ্যে প্রায় ৫০ টার বেশী জাল বুনা আছে। আমি যেদিন ছুটি যাবো, আমি এই জালগুলি সাথে করে নিয়ে যাবো। প্রতিটা জালে আমি প্রায় একশত করে টাকা লাভ করতে পারবো। তাতে আমি ৫০টি জালে হাজার পাচেক টাকা লাভ করবো। আমার পরিবারের জন্য টাকাটা অনেক কাজে লাগবে। আমার বড় ছেলেটা এবার মেট্রিক দেবে। মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। ভাল আছি স্যার সব মিলিয়ে।

আব্দুর রহমানের কথায় আমি খুবই অবাক হইলাম। মাত্র হাজার পাচেক টাকা তো বিডিআর সৈনিকের কাছে কিছুই না। যে পরিমান অবৈধ পন্য, চোরা কারবারীর মাল ,কিংবা বর্ডার সুরক্ষার নামে যে পরিমান অবৈধ নারকোটিক্স পাচার হয়, তাতে তো কোটি টাকার খেলা। আর এই আব্দুর রহমান কিনা মাত্র ৫ হাজার টাকাতেই এতো খুসি? আব্দুর রহমান এই নিশব্দ রাতে, একাকী আমাকে যাহা যাহা বলিলো, তাহাতে আমার রহমানের প্রতি বিনম্র ভালোবাসা আর শ্রধ্যায় মাথা হেট হইয়া আসিলো।

স্যার, যেদিন আমি প্রথম এই কর্মজীবনে আসি, আমি দেখেছি, কি হরিলুট হয় আমাদের এই কর্মজিবনে। এমনো হয়েছে যে, এক রাতের ইনকাম হয় লাখ লাখ টাকা। আমি আজ পর্যন্ত কোনোদিন কখনো কোনো অবস্থাতেই একটি টাকাও অবৈধভাবে কামাই করি নাই, খাইও নাই। অনেক সময় আমার সহকর্মীরা ভাগ বাটোয়ারা করে হয়ত আমার ভাগেরটা আমার তোষকের নীচে রেখে গেছে, আমি সেটা কোনোদিন খুজেও দেখি নাই, ধরেও দেখি নাই। কেউ যদি এই অবৈধ টাকা আমার তোশকের তল থেকে চুরী করেও নিয়া যায়, বা গেছে, তাতেও আমার কোনো কিছুই যায় আসে না। টাকাটাই তো আমার না। আমি সবসময় সৎ রোজগারে বিশ্বাসী ছিলাম, এখনো আছি, আল্লাহই যথেষ্ঠ আমার শান্তি আর সুখের জন্য। নামাজ পড়ি, রোজা করি, কারো সাথে ঝামেলায় যাই না, আমি আমার কাজগুলি ঈমানের সাথে করার চেষ্টা করি। কয়দিনই বা বাচবো স্যার। তারপর কি? আমি কি আমার এই সব সম্পদ, টাকা পয়সা সাথে করে নিয়ে যেতে পারবো? স্যার আমি মরনকে দেখেছি খুব কাছ থেকে। আমি দেখেছি কত বিত্তবান মানুষ অঢেল সম্পত্তির উপর শুয়ে থেকেও তার ওই সব টাকা কোনো কাজেই লাগে নাই। তাহলে কি লাভ এই পচা, অবৈধ আর দূষিত টাকা কামানো? তার থেকে আমি এই যে প্রতি তিন দিনে একটা জাল বানাই। আর যা লাভ হয়, সেটায় অনেক বেশী বরকতময় স্যার। আমার সাথে কারোই বনে না বলে ওরা আমাকে রদ্দিমাল বলেই কেউ কেউ টিটকারী করে, কেউ আবার বোকা বলে, কেউ আবার আমার কিছুই নাই বলে ফকিরন্নীও বলে। আমি তাতে কোনো কিছুই মাইন্ড করি না। আমি শুধু জানি, আমাকে সম্মানীত করার মালিক একমাত্র আমার প্রভু, আল্লাহ।

আব্দুর রহমান কথাগুলি বলিয়া চলিয়া গেলো। আর আমাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলো, স্যার, অনেক রাত হয়েছে, ঘুমাইয়া পরেন। খোলা আকাশে এভাবে বসে থাকলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। পাহাড়িয়া এলাকা, কেউ অসুস্থ্য হলেও তাকে সুস্থ্য করবার লোক আশেপাশে থাকে না। আব্দুর রহমান চলিয়া গেলো।

কি অদ্ভুত দর্শন আব্দুর রহমানের। টাকাই যদি সমস্ত সুখের মূল হইতো তাহলে আজ থেকে শত বর্ষ আগে যে সব রাজ রাজারা সমস্ত ভুখন্ডের মালিক ছিলো, তারা তো আর আজীবন কাল যেমন বাচিয়া নাই, তাদের বংশ ধরেরাও হয়তো আর রাজ রাজাদের মতো বিলাশ বহুল জীবনেও নাই। আমি আরো অনেক ক্ষন সেই জোস্নাস্নাত রাতের আলোতেই ক্যাম্পের উঠোনে বসিয়া রইলাম। পাশেই কোনো এক বাদুরগোছের কোনো নিশাচর হয়তো একটা গাছ হইতে আরেকটা গাছের ডালে যাইবার জন্য কুহুকুহু শব্দের মতো শব্দ করিয়া স্থান পরিবর্তন করিলো। লোকচক্ষুর অন্তরালে, ঘুমন্ত পৃথিবীর চরনতলে, একা একা কত ঘটনা, কত ইতিহাস, কত যে, গল্প তৈরী হয়, তাহা অনেকের হয়তো জানা নাই কিন্তু জীবন্ত পৃথিবীর তুলনায় ঘুমন্ত প্রিথিবীতেই বেশির ভাগ ইতিহাসের সুত্রপাত।

আমি আকাশের দিকে চাহিয়া ভগবানকে দেখার চেষ্টা করিলাম। আসলেই কি ভগবান অই আকাশের উর্ধতলে থাকেন? নাকি তাহার বিচরন ওই আকাশের উর্ধতল থেকে শুরু করিয়া আমার ক্যাম্পের এই সেন্ত্রিপোষ্টের একটি খাম্বার পাশেও থাকেন, অথবা ওই যে বাজপাখীটা এইমাত্র স্থান পরিবর্তন করিলো ইহার মনের ভিতরেও আছেন। সারাটি পৃথিবীর মানুষ যখন ঘুমায়, ভগবানের এতো বড় দুনিয়ায় তখন হয়ত অন্য কোনো গ্রহে, অন্য কোন নক্ষত্রে কিংবা অন্য কোনো এক অপরিচিত জগতে আমার মতো হয়ত কেউ আরেকট নিউলংকার ক্যাম্পে মাঝরাতে বসিয়া সেই ভগবানের রহস্য লইয়া ভাবিতেছে। কে জানে। 

দুনিয়া বড় রহস্যময় স্থান। এর দিন আর কাল যেমন সদা পরিবর্তনশীল, জীবন ও একদিন সব কিছু পরিবর্তন করিয়া তাহার নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়া স্থিত হইবে। তখন ইহার আগের ইতিহাস কেউ হয়তো আর মনেও রাখিবে না যেমন আজ থেকে হয়তো আরো ৫০ বছর কিংবা ৫ বছর পরে কেউ মনে রাখিবে না যে, আমি ঠিক এই স্থানে এক রাতে ঈশ্বরের কথা ভাবিয়া অনেকতা সময় পার করিয়াছি।

১২/১০/১৯৯১-নিউলংকার ক্যাম্প-পর্ব-৩

নিউ লংকার ক্যাম্প-পর্ব-৩ 

ক্যাম্প লাইফ ভীষন বোরিং। কতক্ষন একটা ছোট জায়গায় বন্দি হয়ে থাকা যায়? ভাবলাম, পাশের গ্রামগুলিতে মাঝে মাঝে ঘুরতে যাবো। ওদের সাথে একটা সামাজিক বন্ধন তৈরী করলে অসুবিধা কি? আমরা তো সমাজের বাইরে কেউ না। আর আমি তো এখানে আছিই এই সেতুবন্ধনের মতো একটা ভালো পরিবেশ তৈরী করে এই এলাকাকে নিরাপদ করা।  সে মোতাবেক, আমি একটা সিডিউল করলাম, কিভাবে কখন কি নিয়ে ওদের সাথে আলাপ করা যায়, কিভাবে ওদের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ হওয়া যায়। যে যতো কিছুই বলুক, আর্মির উপস্থিতি কোনো উপজাতী পছন্দ করে না। এটা তারা মনে করে তাদের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ। অনেকে হয়তো সরাসরি কিছু বলে না, কিন্তু তাদের আকার ইংগিত আর চালচলনে এটা খুবই স্পষ্ট। ওরা আসলেই আমাদের আর্মিকে পছন্দ করে না। কিন্তু বন্দুকের নলের সামনে আর যাই হোক, বাহাদুরী চলে না। তাই ইচ্ছা না থাকলেও ভালো সম্পর্ক আছে এটাই প্রকাশ করতে হয় প্রতিটি উপজাতীকে। অথচ আমি হয়তো বুঝতে পারছি না, কোন আচরনটা তাদের শুদ্ধ আর কোন আচরনটা আসলে লোক দেখানো। সত্য এবং মিথ্যার বসতির এই সম্পর্কের মধ্যে না জানা যেমন অনেক কথা থাকে, তেমনি অনেক বিপদের গন্ধও থাকে। না বলা কথা না জানার চেয়ে বিপদের গন্ধটা আচ করতে পারাটা অনেক বেশী জরুরী। তাই আমিও সচেতন হয়েই কিছুকিছু সময় পাশে পাংখু এলাকায় গ্রাম বাসীদের সাথে মেলামেশার চেষ্টা করছি। কিন্তু চোখ কান খোলা আছে।

আমি ক্যাম্প লাইফটাকে আরো সহজ এবং আরামদায়ক করার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। তার মধ্যে একটা হচ্ছে- ক্যাম্পে মাটি কেটে কেটে মাটির উপরেই ম্যাপের মত বিভিন্ন স্থান তৈরী করা যা বর্তমান আমার এলাকায় আছে। যেমন কার বাড়ির পাশে কার বাড়ি, কোন গ্রামের পর কোন গ্রাম, কোন কোন রাস্তা আছে কোন কোন জায়গায় যেতে, কোথায় টংঘর, কোথায় রুট প্রোটেকশন ক্যাম্পগুলি আছে ইত্যাদি। ক্যাম্পের সৈনিকদের বেশ সারা পাওয়া গেলো। আমরা যার যার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটা মুটামুটি মাটির অপারেশন রুম বানিয়ে ফেললাম।

আমার ক্যাম্পটা খুব বেশী বড় না। মোট ৫টা ঘর। একটা আমার ঘর, একটা মসজিদ, একটা ছোট ওয়্যারলেস রুম কাম সৈনিকের থাকার জায়গা, একটা টিভি রুম। আরেকটা ঘর বেশ বড় সেখানে সৈনিকেরা থাকে, সাথে একটা ক্যান্টিন। রান্নাঘর, বাথরুম, এগুলি সব আলাদা। প্রচুর গাছপালা আছে। ক্যাম্পের অদূরেই আরেকটা হিলটপ আছে যেখানে আমরা হেলিপ্যাড বানিয়েছি। যখন হেলিসর্টি হয়, তখন এই হেলীপ্যাডেই হেলিকপ্টার ল্যান্ড করে। আমাদের হেলিপ্যাডটা আমাদের সেন্ট্রিপোষ্ট এর অস্ত্র দ্বারা কাভার করা। এটা খুবই জরুরী। আমার রুমটা যেখানে, সেটা মেইন গেটের একদম সাথে। আমার ঘরটার পিছন দিয়ে ছোট একটা রাস্তা গেছে যাতে আমি অন্যান্য সেন্ট্রি পোষ্টগুলিতে অনায়াসেই যেতে পারি। ক্যাম্প সুরক্ষার জন্য আমি মোট তিনটা জায়গায় ইন্টারলক সিস্টেমে সেন্ট্রিপোষ্ট লাগিয়েছি। দিনের বেলায় সেন্ট্রি পোষ্টগুলিতে একজন আর রাতের বেলায় দুইজন করে ডিউটি করে। সবার কাছে একটা করে হুইসেল আর টর্চ লাইট দেয়া আছে। সেন্ট্রিপোষ্টের অস্ত্রটি একটি লোহার চেইন দিয়ে বাধা যাতে কোনো কারনে রাতের বেলায় সেন্ট্রি তার অগোচরে ঘুমিয়ে পড়ে, তাহলে শান্তিবাহিনী অস্ত্রটি তুলে নিয়ে যেতে না পারে।

আমি ক্যাম্পের তিনপাশেই তিনটা বেতের চেয়ারের মতো করে বাশের কঞ্চি দিয়ে দিয়ে চেয়ার বানিয়েছি যাতে আমি ওখানে বসতে পারি। পড়ন্ত বিকালে কিংবা খুব সকালে এই জায়গাগুলিতে বসে প্রাকৃতিক সউন্দর্য দেখতে বড্ড মিষ্টি মনে হয়। খুব ভোরের আকাশ আর সুর্যাস্তের আকাশে একটা বড্ড মিল আছে। দুটি সময়েই আকাশকে বড় নির্মল মনে হয়। লাল আভায় ফুটে উঠে চারিদিকের পাহাড়। সুর্যের প্রথম আলো যখন আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের উপর প্রতিফলিত হয়, তখন মেঘের রঙেও একটা শৈল্পিক রুপ ধারন করে।  দূরের পাহাড়ের গাছপালাগুলি আমার ক্যাম্প থেকে দেখলে এমন মনে হয় যেনো, আমি পুরু পাহাড়টার উপর থেকে নীচের বনরাজ্যকে দেখছি। আমার ক্যাম্প থেকে বঙ্গোপসাগরের পানি দেখা যায়। সেই সুদুর সাগর, নীল আকাশ আর পাশের পাহাড় একসাথে মিলে কি যে এক অদ্ভুদ নৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টি করে ভাবাই যায় না।  

মাঝে মাঝে সারাদিন বৃষ্টি হয়। মুষল্ধারে যখন বৃষ্টি হয়, তখন কোথা থেকে যে কয়েকটি কাক আমার ঠিক ঘরের নীচে বেল্কনীর মতো একটা জায়গায় এসে আশ্রয় নেয় জানি না। হয়তো আশেপাশেই এর বাসা। ব্রিষ্টির কারনে আবহাওয়া একটু ঠান্ডা থান্ডা ভাব থাকে, শীত শীত ভাব থাকে। আমি তখন কম্বল গায়ে দিয়ে ব্রিষ্টির পানি পড়তে দেখি। আমার গ্রামের কথা মনে পড়ে, আমার মায়ের কথা মনে পড়ে, আমার বাড়ির কথা মনে পড়ে। 

এবার বলি আমি এই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাথে কিভাবে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনাটা করলাম। পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষিত লোক নাই এটা বললে একেবারেই ভুল হবে। এদের সমাজের মধ্যেও এরা কাউকে মানে, কাউকে গুরু মনে করে আবার কাউকে শসাওন ও করে। এদের নিজস্ব একটা বলয় আছে যা আমাদের তথাকথিত সমাজের বাইরে। আমি এখানকার হেড ম্যানকে মাঝে মাঝে ডাকা শুরু করলাম। তাকে আমিও হেড ম্যান হিসাবে অথবা একটা গুরুজন হিসাবে দেখা শুরু করলাম। সে যখন ক্যাম্পে আসে, আমি তাকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়ার চেষ্টা করতে থাকলাম। ওরা অনেক কষ্ট করে যে ফসল ফলায়, তার থেকে কিছু ফসল নিজেদের জন্য রেখে সেই বহুদূর বাকীটা বিক্রি করে। আমরা অবশ্য আমাদের সব খাবার দাবার হেলি সর্টির মাধ্যমে চিটাগাং থেকে আসে বিধায় আমরা ইচ্ছা করলেও আমরা পাহাড়ি উপজাতীর কাছ থেকে সব পন্য কিনতে পারি না। তারপরেও আমি দেখেছি আমার সৈনিকেরা মাঝে মাঝে কিছু পন্য ওদের থেকে কিনে থাকে। তাই ভাবলাম, আমরা পরিকল্পনা করে যদি কিছু জিনিষ পত্র কিনতে থাকি, তাহলে ওরাও আর কষ্ট করে এতোদূর হাটে গিয়ে পন্য বিক্রি করতে হয় না। যারা এই পন্য ক্যাম্পের পাশেই বিক্রি করতে পারবে, তারাও ধীরে ধীরে ক্যাম্পের মানুষ গুলির সাথে একটা বন্ধুত্ত তৈরী করবে। এছাড়া আরেকটা বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি যে, প্রায়ই ওরা কিছু না কিছু ট্রাইবাল অনুষ্ঠান করে। আমি ওদেরকে বলেছি যে, যখন কোনো সাহাজ্য লাগবে আমি কিছু কিছু সাহাজ্য করতে পারবো, যেমন রঙ্গিন বেলুন দেয়া, কিংবা কিছু টাকা পয়সা দেয়া ইত্যাদি। এসবের একটাই কারন ছিলো যাতে ওরা মনে করে আমরা ওদেরকে নিষ্পেষিত করতে এখানে আসি নাই, আমরা আর ওরা একই দেশের নাগরিক। আমরা একে অপরের জন্য। দেশটা আমার যেমন, এই দেশটা তাদেরও। আমার এই কর্মশালা ভীষন কাজে দিলো। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝে গেলাম যে, আমরা যখন ওদের গ্রামে পেট্রোল করতে যাই, তাদের আচরন পালটে গেছে, তাদের ব্যবহার আগের থেকে অনেক বেশী আন্তরীক।

ভালোবাসা কে বুঝে না? একটা অবুঝ শিশু ও ভালোবাসা বুঝে যে হয়তো কোনো ভাষাই জানে না। একটা বোবা পশু ও ভালোবাসা বুঝে যে কিনা আমাদের মানুষের সমাজের কোনো আইনের ধার ধারে না। কিন্তু ভালোবাসায় অনেক ভালো ফল পাওয়া যায়। ক্যাম্প লাইফটা আগের থেকে অনেক ভালো লাগছিলো। এখন আর খুব একটা বোরিং লাগে না। কেউ না কেউ ক্যাম্পে আসেই। কখনো যুবক, কখনো মহিলা, কখনো বয়ষ্ক ব্যক্তিরা। মাঝে মাঝে কয়েক জন মিলেও ক্যাম্প দেখতে আসে। আমি নিরাপত্তার ব্যাপারটা মাথায় রেখে যতোটা সম্ভব তাদেরকে আপ্যায়ন করি। ওরা খুসি মনেই আবার ফেরত যায়। ওরা একটা জিনিষ বুঝে গেছে আমরা ওদের কোনো ক্ষতি করবো না। ওরাও আর আমার ক্ষতি করতে পারে এটার ঝুকিটাও কমে গেছে।

০৮/১০/১৯৯১-নিউলংকার ক্যাম্প-পর্ব ২

নিউ লংকার ক্যাম্প- পর্ব-২ 

উপকার করার মানসিকতা আর উপকার করার ইচ্ছা যদি কারো থাকে, কোনো না কোন একটা উপায় বের হয়েই যায়। ক্যাম্প গুলিতে যে সব সৈনিক রা থাকে, তারা অনেকটা সমাজের একেবারে বাইরের কোনো এক আলাদা সমাজের মতো। এরাই একটা আলাদা সমাজ। কিন্তু এদের পরিবার আছে, সন্তান আছে, নিজেদের বাবা মা আছে, আছে বন্ধু বান্ধব। এদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছুটি নিয়ে। একবার যদি কেউ এই পাহাড়ে ঢুকে যায়, তারা যেনো আর কারো মনের ভিতরেই থাকে না। আমার কাছে দুটু ক্যাম্পের সৈনিকরাই তাদের একতা আবদার বারবার পেশ করে যাচ্ছিলেন, ছুটি কিভাবে রেগুলার করা যায়।  সাজেক আর ওল্ডলংকারের সৈনিকদের ছুটির ব্যাপারে আমি ক্রমাগত মাথা খেলাচ্ছিলাম কিভাবে এসব সৈনিকদের ছুটিটার ব্যবস্থা করা যায়। একদিন পেট্রোল করতে গিয়া আমি উভয় ক্যাম্পের সৈনিকদের সাথে কিভাবে কি করা যায় এটা নিয়ে বিস্তারীত আলাপ করি। কারন তারা ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ককে আমার মতো কনভিন্স করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। সাজেকের এক সৈনিক আমাকে একটা সাজেশন দিলো যে, স্যার কোনোভাবে কি ইন্টারক্যাম্প সৈনিকের পোষ্টিং করা যায় যাতে কিছু সৈনিক আপনার ক্যাম্প থেকে আপনার সৈনিক হিসাবে হেলিসর্টির মাধ্যমে ছুটিতে যেতে পারে?

মাথায় বুদ্ধিটা এলো। কিন্তু আসলেই ইন্টারক্যাম্প সৈনিক পোষ্টিং তো আমার হাতে নাই, এটা করতে পারে ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক। তারপরেও আইডিয়াটা খারাপ মনে হলো না। ব্যাটালিয়ানের অধিনায়কেরও তো সৈনিকের ছুটিছাটা নিশ্চিত করার নৈতিক দায়িত্ত আছে। হতে পারে, আমার এই আইডিয়াটা অধিনায়ক মেনে নিতে পারে। ভাবলাম, এটা ওয়্যারলেস সেটে কথা না বলাই ভালো। অধিনায়ক যখন ক্যাম্প ভিজিটে আসবে, তখন তার সাথে বিস্তারীত আলাপ করবো।

আল্লাহর কি রহমত, এরই মধ্যে খবর পেলাম, বিডিআর ক্যাম্পগুলিতে সয়ং জিওসি ভিজিট করবেন। ভাবলাম, এটাই সুযোগ। আমি কি জিওসিকে সরাসরি সৈনিকদের এই পয়েন্টটা দিবো কিনা। আবার দিলে কি প্রতিক্রিয়া হয় সেটাও ভাবা দরকার। সব মিলিয়ে আমি সরাসরি জিওসিকে না বলাই উত্তম মনে করলাম। বরং আমি ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক মেজর জিয়াকে সৈনিকদের ছুটির এই সমস্যাটা তুলে ধরলাম যে, জিওসির ভিজিটের সময় যদি কোনো সৈনিক তার ছুটির সমস্যাটা তুলে ধরেন, তাতে ব্যাটালিয়ানের ইমেজ খারাপ হতে পারে এবং অধিনায়কের ব্যাপারেও জিওসির ধারনা খারাপ হতে পারে যে, এই ইউনিটে সৈনিকের এডমিন ভালোভাবে দেখা হচ্ছে না। মেজর জিয়া এবার ব্যাপারটা কিভাবে সমাধান করা যায়, সেটাও তিনি আমাকে ভাবতে বললেন। জিয়া স্যার চান না যে, ছুটির এই ব্যাপারটা জিওসির কানে আসুক। আমি মেজর জিয়াকে বললাম, যে, স্যার, যদি এমন হয় যে, আমার পাশের দুই ক্যাম্পের সৈনিকদেরকে পর্যায়ক্রমে আমার ক্যাম্পে ইন্টারচেঞ্জ করা যায়, তাহলে পাইলটদের বলে আমি ৩ জনের জায়গায় হয়ত ৪ জন তুলে দিতে পারবো। বিশেষ করে যখন এমআই ১৭ হেলি এখানে আসে। এমআই ১৭ হেলিতে বেশ কিছু অতিরিক্ত পেসেঞ্জার তোলা যায়। মেজর জিয়া ব্যাপারটা বুঝে রাজী হয়ে গেলেন। তার মানে দাড়ালো এটা যে, যারা যারা ছুটি যাবে ওই সাজেক এবং ওল্ডলংকার থেকে, শুধুমাত্র তারাই আমার ক্যাম্পে বদলি হবেন হেলিসর্টির আগে। বাকীটা আমরা এরেঞ্জ করে নেবো। এভাবেই আমি আমার ক্যাম্প, অল্ডলংকার এবং সাজেকের অনেক সৈনিকের বহুত আখাংকিত ছুটির একটা ফয়সালা করে ফেললাম। তাতে একটা মজার ব্যাপার ঘটে গেল যে, যদিও আমি সাজেক কিংবা ওল্ড লংকারের ক্যাম্প কমান্ডার না, কিন্তু আনঅফিশিয়ালি সৈনিকেরা ক্রমান্নয়ে যেন আমিই তাদের কমান্ডার এরুপ আচরন করে প্রচুর সমস্যা শেয়ার করতে লাগলো। দেখা গেলো, আমি যেদিন পেট্রোলে যাবো হয় সাজেক বা ওল্ডলংকারে, সেদিন যেনো ক্যাম্পগুলির সৈনিকেরা একটা আনন্দের মধ্যে থাকে যে, আমি যাচ্ছি তাই। আমিও যেনো অলিখিতভাবে ওদের ক্যাম্প কমান্ডারই ভাবতে লাগলাম। 

সৈনিক জীবনের মতো জীবন কোথাও নাই। আর এই জীবন কারো পক্ষেই কোথাও কৃত্তিম ভাবে পালন করা সম্ভব নয়। হাতে অস্ত্র আছে, সাথে আছে বুলেট, আর যার কাছে এটা সরকার বৈধ ভাবে সারাক্ষন রাখার লাইসেন্স করে দিয়েছেন, তারা সবাই প্রশিক্ষিত। অথচ ট্রিগারটা টিপার আগে সেই সৈনিক হাজারবার চিন্তা করে। সব তার হাতে কিন্তু কন্ট্রোলিং ক্ষমতা কমান্ডারের মনে। কি অদ্ভুত না!! আমি যতোক্ষন এই সৈনিক দের সাথে থাকি, বুক ভরা ভরষা আর নিরাপত্তা বোধ করি অথচ এরা আমার পরিবারের কেউ না, না কোনো আত্তীয় স্বজন। অথচ আমার পিপাসায় ওরা ব্যস্ত হয়ে উঠে, নিজের পানির বোতলের পানি নিজে পান না করে সেই পানিটা আমার জন্যে হাত বাড়ায়। আমার শরীরের গন্ধে ভরা ইউনিফর্মটা যতো তাড়াতাড়ি পারে ধুয়ে আবার সঠিক জায়গায় রেখে যায়। এর মতো মহব্বতের কম্রেড শীপ আমি কোথাও দেখি নাই। ওরা যখন ছুটি যায়, আর ছুটি থেকে ফিরে আসে, তখন যা ঘটে সেটা আনন্দের একটা ফিলিংস। ওরা এখন মনের সুখে বাড়ি যায়, জানে ওরা যতোদিন আমি আছি, ওদের আর ছুটির কোনো সমস্যা নাই। আবার যখন ফিরে আসে, তখন কেউ কেউ কিছু না কিছু যেনো নিয়ে এসে আমার হাতে দিতে পারলে মনে হয় যেনো কিছু একটা আনন্দ পেলো। ইউনিফর্মের মতো প্রেস্টিজিয়াস কিছু আর নাই। হোক সেটা বিডি আর অথবা আনসার কিংবা আর্মি। পুলিশের ব্যাপারটা আলাদা। ওদের মধ্যে এই বিশেষায়িত জীবনের লক্ষ্য সব সময় থাকে টাকার। টাকা যেখানে মূল, সেখানে মৌলিক গুনাবলী অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। পুলিশ কোনো ইউনিফর্মের ধার ধারে না। তাদের ইউনিফর্মে থাকে শুধু মানুষের অভিশাপের টাকা আর বেদনা।

০৫/১০/১৯৯১-নিউলংকার ক্যাম্প-পর্ব-১

 

নিউলংকার ক্যাম্প- পর্ব-১ 

পাহাড়ি জীবনের একটা আলাদা সৌন্দর্জ আছে। এই সৌন্দর্জ সমতল ভুমির সাথে কিছুতেই মিল নাই। এখানে পাহাড় কথা বলে, আকাশ কথা বলে, এখানকার গাছ গাছালিও কথা বলে। দিনের বেশীরভাগ সময় পাহাড় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে একেবারে নিস্তব্দ হয়ে, কখনো কখনো পাহাড় হয়ে উঠে গম্ভীর আবার কখনো কখনো মেঘের সাথে এই পাহাড়ের মধ্যে মিতালিও হয়। আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘমালা পাহাড়ের চুরায় চুরায় বসে থাকে, কখনো আবার রঙধনু হয়ে আকাশের সাথে দূর পাহাড়ের মধ্যে একটা সেতু বন্ধন গড়ে তোলে। বিধাতার কি অপরুপ খেলা।

এই পাহারের সর্বোচ্চ চূরায় বসে আমি যখন উচ্চস্বরে কথা বলি, পাহাড় তার প্রতিধ্বনি দিয়ে আমাকে সেই একই কথা আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দেয়। আমি মাঝে মাঝে উদাসীন হয়ে ক্যাম্পের কোনো এক স্থানে বসে বসে বন মোরগের ডাক শুনি, আবার মাঝে মাঝে পূর্নিমার রাতে হরিন শাবকের কচিকচি ঘাস খেতে দেখি। বানরেরা এখানে ঠিক বানরের মতো অসভ্য নয়। মানুষ দেখলে তারা মুখ ভেংচি করে দৌড় দিয়ে পালিয়ে যায় না। আবার বন্ধু মনে করে একেবারে কাছেও আসে না। কিছু কিছু অদ্ভুদ পাখী নজরে পড়ে। কোথা থেকে এরা উড়ে আসে আমি জানি না। কিন্তু বেশ সুন্দর। লম্বা লম্বা ঠোট আর বিভিন্ন রঙ এর।

অফিসার হিসাবে আমি একাই এই ক্যাম্পে আছি। আর আমার সাথে আছে প্রায় ৪০ জন বিডিআরের সৈনিক। আর্মির সৈনিকদের সাথে বিডিআরের সৈনিকদের মধ্যে আলাদা একটা পার্থক্য খুব সহজেই ধরা পড়ে। আর সেটা হচ্ছে, কনিষ্ঠতম বিডিআর সৈনিকও অফিসারের সাথে আর্মির সৈনিকের থেকে বেশী মিশুক। এখানে ওয়ারলেস অপারেস্টর হিসাবে সার্বোক্ষনিক কাজ করে নূর মোহাম্মাদ। ছেলেটা বেশ চটপটে। আমার যে রানার, তার নাম জসিম। আর্মির সৈনিকের চেয়ে এরা অফিসারেদেরকে অনেক বেশী সার্ভিস দেয়।

যখন পেট্রোল করে আসি, সারা শরীর ঘেমে একাকার, আর পা যেনো বিষিয়ে উঠে। প্রায় ২/৩ হাজার ফুট পাহাড় বেয়ে ক্যাম্পে উঠতেই তো জীবন শেষ। যখন ক্যাম্পে ফিরে আসি, একটা জিনিশ লক্ষ্য করলাম যে, জসীম দ্রুত আমার পায়ের বুট খুলে দেয়, মাঝে মাঝে আমার পাও এমনভাবে মালিশ করে দেয় যেনো কাজটা করতে ওর বেশ ভালই লাগছে। আমার কেমন যেনো ইতস্তত বোধ হয়, কিন্তু জসীম প্রায় জোর করেই কাজটা করে আর বলে, স্যার, আপনি হচ্ছেন, আমাদের নেতা। এটা আমার দায়িত্ত আপনাকে ভালো রাখা।

ক্যাম্পে একটা ছোট মসজিদ আছে। কে বা কারা এই মসজিদ প্রথম উদ্ভোধন করেছিলো আমার জানা নাই। তবে এখানে ৫ ওয়াক্ত নামাজ হয়। নামাজের ইমামতি করেন আমাদের সিনিয়র এক জেসিও। হাবিলদার রহমান নামে একজন হাবিলদার আছে আমার ক্যাম্পে, সে সারাক্ষন যখন ক্যাম্পে থাকে সুতা দিয়ে জাল বুনতে থাকে। হাবিলদার অন্যের সাথে খুব একটা মিশেও না। ব্যাপারটা আমার চোখ এড়ায় নাই। 

প্রতিদিন পেট্রোল করতে হয় না। সপ্তাহে তিনদিন আমরা আশেপাশের এলাকায় পেট্রোল করি। এই কয়দিনে আমি প্রায় প্রতিটা জায়গা যা আমাদের এরিয়ার অন্তর্গত, সবখানেই গিয়েছি। যেদিন পেট্রোল থাকে না, সেদিন আমি প্রায় সারাক্ষনই সৈনিকদের সাথে কোনো না কোন ব্যাপার নিয়ে আলাপ করি, গল্প করি। আর বিকাল বেলায় একমাত্র ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভিতে ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট দেখি। ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট বা ক্রিকেট খেলাটা আমার কখনোই বেশী পছন্দের ছিলো না। কিন্তু ক্যাম্পের এই বেকার জীবনে এই একটি মাত্র বিনোদন যন্ত্রতে যা দেখানো হয় সেটাই বিনোদনের অংশ হিসাবে আনন্দ নেবার চেষ্টা করি।

আমার উত্তরে যে ক্যাম্পটা আছে সেটা সাজেক, আর দক্ষিনে যে ক্যাম্পটা আছে সেটার নাম ওল্ড লংকার। সাজেকে প্রচুর কমলা হয়। আর এর পাশ দিয়ে চলে গেছে সাজেক রিভার। সাজেক রিভার পার হলেই ভারতের মিজোরাম শহর। কোনো ক্যাম্পেই অফিসার নাই। আমরা যেদিন উত্তরে যাই, সেদিন সাজেক আর যেদিন দক্ষিনে যাই সেদিন ওল্ড লংকারে যাই। এই যাওয়া আসার মাঝে অনেকগুলি গ্রাম পড়ে। এখানে বেশীর ভাগ ট্রাইব পাংখু। চাকমা খুব কম। পাংখু উপজাতীরা বেশ স্মার্ট। কেউ কেউ জিন্সের প্যান্ট আর গিটারও বাজায়। এখানে যিনি হেডম্যান, তিনি বেশ দয়ালু। সে পারা প্রতিবেশীদের খবরাখবর রাখে। তার বাড়িতে আমরা প্রায়ই যাই, খুব বেশি দুরেও না।

ক্যাম্পে যেহেতু আমার অঢেল সময় হাতে থাকে। ভাবলাম, দুটু প্রোজেক্ট হাতে নেয়া যায়। (এক) আমি ইংরেজীতে যতটুকু পারি চর্চা করবো যাতে আমার ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়ে। তাই ভাবলাম, ঢাকা কুরিয়ার নামে একটা টেবলয়েড ইংরেজী পত্রিকা সের দরে কিনে আনি। আমি সেগুলি পড়তে থাকি। পড়তে পড়তেই একসময় আমার ভোকাভেলুয়ারী বাড়বে। আর এর মধ্যে আমি বিবিসির ইংরেজী প্রোগ্রামটা রীতিমতো শুনবো তাতে কিভাবে ইংরেজীতে আরো ফ্লুয়েন্ট কথা বলা যায় সেটাও বাড়বে। আর আমার দ্বিতীয় প্রোজেক্ট হলো যে, আমি বাংলায় পবিত্র কোরান শরীফটা পড়বো এবং শেষ করবো। অন্তত জানতে পারবো আমাদের পবিত্র কোরান শরীফ আমাদের জন্য কি কি বার্তা দিয়েছেন।

বিডিআর এর সৈনিকরা ইতিমধ্যে আমার সাথে অনেক বেশী ফ্রেন্ডলী হয়ে গেছে। আর আমিও ওদেরকে যথেষ্ট পরিমানে আমার নিজের সৈনিকের মতোই দেখার চেষ্টা করি। অবসর সময়ে আমি কখনো কখনো ওদের সাথে তাশ, ক্যারম, কিংবা অন্য যে খেলাগুলি ক্যাম্পে বসে খেলা যায়, সেগুলি করি। ওরাও বেশ মজা পায়।

সন্ধ্যার পর আমরা বেশীরভাগ লোক খাওয়া দাওয়ার পর এশার নামাজের পর জিকিরে বসি। একটা পবিত্রতা আসে। জসীম, আমার রানার, আমাকে যতোটুকু সার্ভিস দেয়া যায়, দেয়।

একদিন জসীম আমাকে বল্লো, স্যার, আজ প্রায় ৬ মাস হয়ে গেলো ছুটি যাই না। বাড়িতে বউ আছে, ছোট একটা বাচ্চাও আছে। কোনো যোগাযোগ করতে পারি না। আমার মতো এ রকম অনেক সৈনিক আছে যারা ছুটির জন্য বসে আছে কিন্তু ব্যাটালিয়ান থেকে আমাদেরকে নামানো হচ্ছে না। দেখেন না স্যার, আপনি কিছু করতে পারেন কিনা। এ ব্যাপারটা আমার নজরে ছিলো না। আমি পরেরদিন আমার দোস্ত ক্যাপ্টেন মাহফুজের (ব্যাটালিয়ানের উপঅধিনায়ক) সাথে আলাপ করলাম। মাহফুজ যেটা জানালো সেটা একটা জাষ্ট মামুলি ব্যাপার। মানে, কোনো একটা সৈনিককে ক্যাম্প থেকে নামিয়ে ছুটি দিতে হলে দুটু পেট্রোল করতে হয়। এক, যে নামবে তার জন্য একটা, আর যে প্রতিস্থাপিত হবে তার জন্য একটা। ফলে সব সময় এই পেট্রোল করার লোক থাকে না। আবার সব সময় প্রতিস্থাপকের লোকও থাকে না। আমি যদি প্রতিস্থাপকের জন্য চাপ না দেই, তাহলে তারা ছুটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না।

ব্যাপারটা আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হলেও এর একটা সমাধান তো দরকার। কি করা যায়, এটা নিয়ে আমি আমার ক্যাম্পের সৈনিকদের সাথে পরামর্শ করলাম। ওয়্যারলেস অপারেটর চমৎকার একটা পরামর্শ দিল যে, স্যার, আমাদের ক্যাম্পে যখন হেলিসর্টি হয়, যদি আপনি ওই হেলিসর্টির সাথে একজন দুইজন করে আনা নেওয়া করতে পারেন, তাহলে এক্সট্রা কোন পেট্রোল করতে হয় না।  আর আমরা তো রতিন পেট্রোল করি না। আর যখন পেট্রোল করি, যাই মাত্র ২০ জনের মতো, কোনো কারনে যদি ছুটির কারনে ২/৩ জন কম ও থাকে বাকি ১৬/১৭ জন দিয়ে ক্যাম্প প্রোটেক্সন দেয়া কোনো ব্যাপার না। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হল।

আমার ক্যাম্পে যারা হেলিসর্টি দেয়, সেসব পাইলট সবাই আমার কোর্সমেট। তার মধ্যে আছে ফ্লাইট লেঃ রেজা, ফ্লাইট লেঃ কামরুল, ফ্লাইট লেঃ পাশা, আর ফ্লাইত লেঃ হাসান মাসুদ। আমি বললাম সবাইকে যে, ঠিক আছে, তোমরা সবাই একটা লিষ্ট করো কে কখন কখন ছুটি কয়দিনের জন্য যেতে চাও। সবাই একসাথে ছুটিতে যেতে চাইলে সেটা সম্ভব হবে না। যেহেতু পাইলট সবাই আমার বন্ধু মানুষ, আমি হয়তো ব্যাপারটা এরেঞ্জ করতে পারবো।

যখন এর পরেরবার হেলিসর্টি এলো, আমার বন্ধু কামরুল আসলো। আমি ওকে বললাম, ব্যাপারটা। ও আমাকে একটা ভালো বুদ্ধি দিল যে, এর পরেরবার যখন হেলিসর্টি হবে, তুমি তোমার ক্যাম্প থেকে কে নামতে চায় সেটা হেলিসর্টির মধ্যে যেনো ইনক্লুড করে দেই। এটা একতা ডিভিশনাল ফর্মালিটিজ। তা না হলে সেও কোনো পেসেঞ্জার নিতে পারবে না।

যেই কথা, সেই কাজ। আমি ব্যাপারটা সহজ করে ফেললাম। অধিনায়ক মেজর জিয়া প্রথমে একটু নারাজ ছিলেন কিন্তু আমার বলিষ্ঠ প্রতিবাদে সেও মানতে রাজী হলো। আমি বললাম, আমার প্রতিস্থাপকের দরকার নাই। আমাই ২/৩ জন কম সৈনিক নিয়েও সুন্দরমতো ক্যাম্প চালাতে পারবো। অধিনায়ক রাজী না হলে এই ব্যাপারটা সৈনিক নামানো সহজ ছিলো না।

এখানে একটা কথা বলা খুব দরকার যে, কেনো মেজর জিয়া আমার কথায় রাজী হতে বাধ্য হলেন। তিনি নিজে একজন অসত লোক। বিডিআর এর অনেক সোর্সমানি, জংগল কাটার টাকা, কিংবা সৈনিকের বাৎসরিক ছুটির টাকা নিজের একাউন্টে রেখে ইন্টারেষ্ট খাওয়া সবই তার ছিলো যেটা একতা নিষিদ্ধ কাজ, কিন্তু আমি জানতাম মেজর জিয়া এটা করেন। যখন তিনি রাজী হচ্ছিলেন না, আর নীতির কথা শুনাচ্ছিলেন, তখন আমি এক পর্যায়ে দূর্নীতির কথা বলে তার এই দুর্বল চারিত্রিক দিকটা আমি তুলে ধরেছিলাম। আর এই কথাগুলি আমার অপারেটর নূর মোহাম্মাদ তথা ক্যাম্পের সবাই জেনে গিয়েছিলো। আমার এ রকম প্রতিবাদী কথায় আমার সৈনিকেরা অনেক সাহস আর আমার উপর একটা ভরষার স্থান তৈরী করে ফেলেছিলো। তারা আমার এ রকম একটা ব্যবস্থাপনায় এতোটাই খুশি ছিলো যে, আমি যেনো তাদের সাক্ষত ত্রানকর্তা রুপে আবির্ভাব হয়েছিলাম।

প্রথম হেলিসর্টিতে নামানো হলো আমার রানার জসীমকে, সাথে আরো একজন। ব্যাপারটা যখন বাস্তবায়ন হচ্ছিলো, সবাই একটা হোপ করছিলো যে, আগামি কয়েক দিনের মধ্যে কারো না কারো টার্ন আসবেই। আর ব্যাপারতা তাইই ঘটতে লাগল। প্রতি হেলিতে আমি তিনজন করে ছুটিতে পাঠাতে লাগলাম। কোনো প্রতিস্থাপক ছারাই আমি আমার সৈনিকদেরকে ছুটিতে পাঠানো শুরু করলাম।

যখনই কোনো সৈনিক ছুটি থেকে আবার ক্যাম্পে ফিরে আসে, তখন কেউ না কেউ আমার জন্য কিছু না কিছু গিফট নিয়ে আসে। কেউ এক প্যাকেট সিগারেট, কেউ একটা ভালো পত্রিকা, কেউ দুটু ব্যাটারি, ইত্যাদি।

এ কাজটা করতে গিয়ে আমি আরো একটা সমস্যায় পরলাম। সাজেক এবং ওল্ড লংকারের সৈনিকেরা জেনে গেলো যে, আমার ক্যাম্প থেকে সৈনিকেরা এখন পালা করে ছুটিতে যেতে পারছে। কিন্তু ওই দুই ক্যাম্প থেকে তারা এ সুযোগটা পেতে চায়। কিন্তু এখন উপায়? উপায় তো একটা বের করতেই হবে। (চলবে)  

২৪/০৯/১৯৯১-বরকল ১ম পেট্রোল

নির্মম সত্য যখন কেউ বুঝাতে পারে না, অথবা বুঝতে চায় না, আর এই সত্য না বুঝানোর কারনে যখন কিছু মানুশ একাধারে নিষ্পেষিত হতে থাকে, তখন তারা নিজেরা বাচার জন্যে এমন কিছু পথ অবলম্বন করে যা সত্যের থেকে অনেক দূরে। আর এই সত্য যখন নিষ্পেষিত মানুষগন সবাই জেনেও গোপন রাখে, তখন যা হবার তাইই হয়- আর সেটা হচ্ছে বিপর্যয়। এই বিপর্যয় সবসময় ঘটে না। কিন্তু যখন ঘটে যাবে, আর যখন সত্যটা প্রকাশ্যে আসে তখন যারা এই সত্যটাকে আমলে নেন নাই অথচ নেওয়ার দরকার ছিলো, তখন তারাই উর্ধতন কর্মকর্তা বা পরিস্থিতির জন্য দায়ী হয়ে একপ্রকার অপরাধীই সেজে থাকেন। আর যখন নিজেরা তাদের অগোচরের কাহিনী একে একে প্রকাশ করতে থাকেন, তখন আমাদের সবার চক্ষু চরগগাছে রুপান্তরীত না হলেও বুকভরা কষ্টে অনেক জীবনকে বলি দেই। আজ আমার জীবনের প্রথম পেট্রোল করতে গিয়ে এটাই চোখে ধরা পড়লো।

আমরা সেই ভোর ৪টায় বেরিয়ে পড়েছিলাম পেট্রোল করার জন্য। আমাদের টার্গেট ছিল ব্যাটালিয়ান থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের কোনো এক গ্রামে যাওয়া আর যাওয়ার পথে রাস্তা ঘাটের কি পরিস্থিতি তা উপলব্ধি করা। আমাদের সাথে ৪৪ ইষ্ট বেংগলের কিছু ঝানু হাবিলদার আর একজন জেসিও ছিলো। আমি পেট্রোল কমান্ডার হিসাবে ছিলাম।

পেট্রোল নিয়ে বের হতে না হতেই মুশল্ধারে বৃষ্টি নেমে এলো। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা ভিজে চুপসে গেলাম। যেহেতূ আজই আমার প্রথম পেট্রোল, ফলে আমি বই মোতাবেক, পুস্তক মোতাবেক আর সিনিয়রদের উপদেশ মোতাবেক প্রতিটি পেট্রোল ড্রিল অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করছিলাম। কখনো স্টকিং, কখনো হল্ট, আবার কখনো কখনো খুব সন্তর্পণে চলা ইত্যাদি কোনো কিছুই বাদ দেই নাই। কিন্তু একটা জিনিশ আমি লক্ষ্য করলাম যে, আমার এই একনিষ্ঠতা আমার অন্যান্য পেট্রোল সদস্যরা মেনে নিতে পারছিলো না। আমরা হাটতে হাটতে প্রায় একটা ছড়ার পাশে দাঁড়িয়ে গেলাম, তখন বেলা উঠে গেছে। ছড়া পার হবার পুস্তকীয় নির্দেশনা মোতাবেক আমি যখন অন্যান্য সবাইকে নির্দেশনা দিচ্ছিলাম, বুঝলাম, এটা তাদের একেবারেই পছন্দ না।

ছরাটা তারপরেও পার হলাম আমার পুস্তকীয় ধারায়। ছরা পার হবার পর আমাদের যে উপঅধিনায়ক জেসিও আছেন, তিনি আমার কাছে এসে বললেন, স্যার আমরা তো সকালে নাস্তা করি নাই। ওইখানে একটা স্কুল ঘরের মতো ঘর আছে। প্রয়োজনীয় প্রোটেক্সন নিয়ে আমরা সবাই নাস্তাটা করে ফেলি। ভাবলাম, যুক্তি আছে। এই পাহাড়িয়া এলাকায় কতোক্ষন আর নাস্তা না করে হাটা যায়?

আমিও তাদের সাথে নাস্তা করতে বসলাম। এবার জেসিও সাহেব বললেন, স্যার, আপনি আজ নতুন পেট্রোল করতে এসেছেন। একটা কথা বলতে চাই, যদি কিছু মনে না করেন, আর যদি ব্যাপারটা গোপন রাখেন। বললাম, বলেন।

জেসিও বল্লো, যে, স্যার এ রকম নিয়ম মেনে প্রতিদিন পেট্রোল করা যায় না। এই যে আজকে আমরা সবাই পেট্রোল করতে বেরিয়েছি, খোদা না করুক যদি কোথাও কোনো অঘটন ঘটে, আবারো দিন নাই রাত নাই, খাওয়া নাই, নাওয়া নাই, এই আমাদেরকেই আবার অপারেশনে আসতে হবে। এই এক কাপড়েই থাকতে হবে দিনের পর দিন। তাই আমরা জানি কিভাবে শরীরকে ঠিক রাখা যায়। মানে স্যার, আমরা এখানেই থাকবো, আর কোথাও যাবো না। আমাদের যেখানে যাওয়ার দরকার টার্গেট অনুযায়ী, সেখানে যেতে আরো ঘন্টা দুয়েক সময় লাগবে। আবার সেখান থেকে ব্যাটালিয়ানে যেতে সময় লাগবে প্রায় আরো ৪ ঘন্টার মতো। মোট এই ৮ ঘন্টা এক নাগাড়ে হাটাহাটির পর যদি জরুরী কোনো অপারেশনে যেতে হয়, আমরা কি পারবো দিনের পর দিন এভাবে শারীরিকভাবে সাপোর্ট দিতে? তাই, যদি ব্যাপারটা গোপন রাখেন, আমরা এখান থেকে প্রতি আধা ঘন্টা পর পর ব্যাটালিয়ানে রিপোর্ট দেবো যে, আমরা কোথায় আছি। আর সেটা ম্যাপ দেখে দেখেই দিবো।

অবাক হলাম। বলে কি?

কিন্তু এটাই হলো নির্মম সত্য। মনে মনে ভাবলাম, নিজাম স্যার তো এই কারনেই মারা গেছেন। কারন দিনের পর দিন ওইসব এলাকায় না যাওয়ার কারনে শান্তিবাহিনী মনে করেছে যে, এসব এলাকায় আর্মির কেহ আসে না। তারা নিজের সময়মতো আদর্শ ফাদ পাতার সময় পেয়েছিলো আর অপেক্ষায় ছিল কোনো একদিন যদি আর্মির টহল এখানে আসে, সেদিন হবে প্রতিশোধের চরম মুল্য। আর এটাই হয়েছিলো নিজাম স্যারের বেলায়।

একবার ভেবেছিলাম, এই নির্মম সত্যটা আমি সিও সাহেবকে জানাই। আবার ভাবলাম, এটা কি শুধু আমিই জানি নাকি ইউনিটের অন্যান্য সবাই জানে খালি সিও ছাড়া? অথবা এমনো তো হতে পারে, সিও সাহেব নিজেও জানেন, কিন্তু তিনিও চুপ করেই আছেন? হয়তো জানে না খালি সেই ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার।

এভাবেই আমি আমার প্রায় প্রতিটা পেট্রোল করে সময় পার করলাম ওরিয়েন্তেশনের পিরিয়ড।

২৩/০৯/১৯৯১- বরকল আগমন

Categories

মানুষ যখন একে অপরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠে। তখন প্রথমে বিদ্রোহ হয় তাকে মন থেকে গ্রহনের বর্জনতায়। তারপর এটা সংক্রমিত হয় একজন থেকে আরেকজনে। এভাবেই কিছু সংখ্যক বিদ্রোহী যখন একটা দল হয়ে উঠে, তারা তখন তাদের ইথিক্যাল ভ্যালুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সেই এলাকার অন্যান্য মানুষের মনেও বিষ্ক্রিয়া চালাতে থাকে। বিষের মাত্রা যখন প্রায় সহনীয় পর্যায়ের থেকে বেশী মাত্রায় চলে যায়, তখন কমিউনিটি সংক্রমন হতে বাধ্য। আর যখনই কমিউনিটি সংক্রমন বাড়তে থাকে, তখন দেশের প্রচলিত নিয়মে এসব দলকে শায়েস্তা করার জন্য সরকার একের পর এক আইন বানাতে থাকে। আবার এই আইনের বার্তায় বিদ্রোহীরাও নতুন নতুন কৌশল স্রিষ্টি করে সরকার বাহাদুরকেও তাক লাগানর বাহাদুরি বা আস্পরা দেখাতে আহলাদি হয়ে উঠে। আর এই আহলাদির নাম- যুদ্ধ।

হিলে এখন সেই যুদ্ধ চলছে। শান্তিবাহিনীর স্বাধিকার আন্দোলনের চেয়ে যেনো মনে হয় ব্যাপারটা এখন গুটিকতক উপজাতীর নিজস্ব দেমাগে পরিনত হয়েছে। কেনো বললাম বা কেনো আমার কাছে এটা মনে হয়েছে সেটা বলি। আজই দুপুরের দিকে আমি বরকল পৌঁছেছি। চট্টগ্রাম থেকে আসা অবধি যতো ব্রিফিং শুনেছি, তার সবগুলি ব্রিফিং প্রায় একই রকম। কিন্তু এই বরকলে এসে ব্যাপারটা আমার কাছে অন্যরকম একটা ধারনা দিল। এখানে সবাই বিদ্রোহী নয়। শুধুমাত্র চাকমা গোষ্ঠীটাই এই বিদ্রোহের প্রধান হোতা। এখানে পাংখু আছে, মার্মা আছে, ত্রিপুরা আছে আরো অন্যান্য ট্রাইবস যারা শান্তিপূর্ন জীবন চায়। এর মানে হলো, আমরা যদি শুধুমাত্র এই চাকমা ট্রাইবটাকে আইসোলেশন করতে পারি, তাহলে সংখ্যাটা অনেক অংশে কমে যায়। যাই হোক, ব্যাপারটা আরো নিবিড়ভাবে দেখা এবং বুঝা দরকার। এখনি সব কল্পনা বাস্তব বলে উপসংহারে  আসা যাবে না।

বরকলে আসার জন্য সেনাবাহীনি পেট্রোল বোট ইউজ করে। কিন্তু সাধারন মানুষজন ব্যবহার করে বটবটি নামে ইঞ্জিন চালিত নৌকা। এতোক্ষন আমরা যারা বিডিআর এর সাথে সংযুক্তিতে ছিলাম, তারা একইসাথে ছিলাম। তাদের মধ্যে যারা ছিলো তারা হচ্ছে ৬ ফিল্ডের শাহরিয়ার (সে মদনে পোষ্টিং), আমি নিউলংকারে, ক্যাপ্টেন জামাল ১৪২০ ক্যাম্পে, তাসওয়ার রাজা (হাসন রাজার নাতি) আরেক ক্যাম্পে, ইকবাল (সিগ্ন্যালের) সেও মদনের আরেক ক্যাম্পে। ফলে আমি আর জামাল স্পীড বোটে রওয়ানা হলাম বরকলের উদ্ধেশ্যে। চমৎকার একটা লেক। খুবই সুন্দর। আমাদের স্পীড বোট প্রায় ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে কাপ্তাই থেকে রওয়ানা দিয়ে বরকলের দিকে যাচ্ছে। এতো লম্বা পথ হাই স্পীড বোটে আমার এটাই প্রথম। আশেপাশে উপজাতীদের কিছু কিছু বাড়িঘর চোখে পড়ে। অবাক লাগে, এরা কোথায় বাজার করে, কোথায় বেচাকেনা করে, কার কাছে করে আমার জানা নাই। আমরা সবাই ইউনিফর্ম পরা অস্ত্র নিয়ে বসে আছি। আমি জানি না যদি কোনো শত্রু আমাদেরকে এই অবস্থায় আক্রমন করে, আমরা কতটুকুই বা সামাল দিতে পারবো। শুনলাম আমাদের যাওয়ার রাস্তার দুই ধারে নাকি রুট প্রোটেক্সন আছে, চোখেও পড়েছে অনেক রুট প্রোটেক্সন ক্যাম্প।

৪০ মিনিট চলার পর আমাদের বোট একটা ঘাটে এসে থামলো। এটাই ৪৪ ইষ্ট বেংগলের প্রধান ব্যাটালিয়ান। আমরা নেমে গেলাম। সিনিয়র জেসিও মোজাম্মেল আমাদেরকে ঘাট থেকে রিসিভ করলেন। আমরা (আমি আর ক্যাপ্টেন জামাল) নিজেদের ব্যাগ বোটেই রেখে নেমে গেলাম। কারন আমাদের ব্যাগ নেওয়ার লোক আছে। ৪৪ ইষ্ট বেঙ্গলে যাওয়ার পর দেখলাম, প্রায় সবগুলি ঘরই বাশের বেড়া দিয়ে ঘেড়া। একদিকে সিও সাহেব তার পরিবার নিয়ে থাকেন, সেটা আবার মাটির প্রলেপে ওয়াল দেয়া। আর বাকী সবগুলি ঘর নিঘাত বাশের। আমরা অফিসার ফিল্ড মেসে ঢোকলাম। গিয়ে দেখলাম, ক্যাপ্টেন ইসমাত (১১ লং কোর্ষের) স্যার ভিডিওতে ইন্ডিয়ান ছবি দেখছেন। একটু পরে এলো আমার কোর্ষ্ম্যাট লেঃ তারেক। সে আমাদের ক্যাডেট কলেজের এক বছর সিনিয়র ছিলো। কিন্তু এখন আমাদের কোর্ষের সাথে কমিশন পাওয়ায় আমি আর আগের সম্পর্কটা ধরে তাকে ভাই বলি না। তুমি করেই সম্মোধন করি। সাথে আরো দুই কোর্ষম্যাট মামুন আর আব্দুল্লাহও এলো। ভালো লাগলো ওদের দেখে। একটু ভরষাও যেনো পেলাম। আমি আর্টিলারীর লোক, এখানে ওরিয়েন্টেশন করবো সেটা ওরা কিভাবে নেয় জানি না, তবে আমার কোর্সম্যাটদের দেখে একটু ভালো লাগলো।

ইসমাত স্যার এই ইউনিটের এডজুটেন্ট। আমরা ছবি দেখতে দেখতে ইসমাত স্যার বললেন, সিও সাহেব সন্ধ্যায় কথা বলবেন। সিও সাহেবের নাম, লেঃ কর্নেল আশফাক। স্যার এটাও বললেন, তার সামনে স্মার্ট হইও না কারন মানুষ বেশি সুবিধার না। একটু ভরকে তো গেলামই। উপঅধিনায়কের পদে আছেন মেজর মিজান স্যার। বেশ তোতলামিতে ভরপুর। আমার মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে, কমিশন পাবার সময় কি বিএমএ তে স্যারের এই তোতলামী ধরা পরে নাই? কিন্তু মানুষ হিসাবে বেশ ভালো। সিও সাহেবের কথার বাইরে যাবার কোনো অবকাশ নাই। তার দুই মেয়ে। লাঞ্চের পরে অনেক আলাপ করলাম ফিল্ড মেসে বসেই।

আলাপ আলোচনার পর আমরা আমাদের ব্যারাকে চলে গেলাম। কি এক অবস্থা। সৈনিকের সাথেই থাকা আর তাদের একই খাবার সবার জন্য। তবে আমরা ইচ্ছা করলে অফিসার মেসেও খেতে পারি। একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম যে, কোম্পানি কমান্ডারগন যার যার কোম্পানীর সাথেই ডাইনিং করেন। তাতে একটা লাভ হলো, কোনো টাকা লাগে না। হয়তো এই কিছু টাকা বাচানোর জন্যেও অফিসাররা সৈনিকদের সাথেই ডাইনিং করেন।

রাতে সিও সাহেবের সাথে আমাদের দেখা হলো। তিনি অনেক কিছু বললেন না, শুধু বললেন, আমাদের জন্য ওরিয়েন্টেশনের প্রোগ্রাম করা হয়েছে কিনা, আর করে থাকলে সেটা যেনো আমাদেরকে দিয়ে দেয়া হয়। আগামিকাল থেকেই পেট্রোল চলবে। আর প্রতিদিন পেট্রোল রিপোর্ট সিও সাহেবকে দেখাতে হবে।

আমরা যার যার ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের একটা করে কপি হাতে নিয়ে আবারো চলে এলাম যার যার ঘরে। আগামীকাল ভোর ৪ টায় আমার একটা পেট্রোল আছে। 

২২/০৯/১৯৯১-রাংগামাটিতে গমন

Categories

ছবির বামে ক্যাঃ জামাল, পরের জন ক্যাঃ মাহফুজ, ক্যাঃ ডাক্তার এবং আমি। মারিষ্যা জোনে এসেই রাতে খাওয়া দাওয়ার পর আমরা ২১ রাইফেল ব্যাটালিয়ানের অফিসার মেসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমার হাতে একটা ওয়ান ব্যান্ডের রেডিও। বিডি আর এর সাথে সনযুক্ত থাকবো আমি প্রায় ৬ মাসের অধিক। মানসিকভাবে তৈরী হয়েই এসেছিলাম ফলে এক প্রকার আনন্দেই ছিলাম যে, ইউনিটের কোনো প্যারা নাই, ক্যাম্পে শান্তি বাহিনীর শান্তি ভাংগা ছাড়া আর কোনো অশ্যান্তি হয়তো নাই।

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই রেডি হলাম। ২১ রাইফেল ব্যটালিয়ানের কোত থেকে একটা এস এম জি (সাব মেশিন গান) আমার নামে বরাদ্ধ করা হলো। এটা বিডিআর এর সাথে সংযুক্তি থাকা অবস্থায় আমার জিম্মায় থাকবে। সাথে এক বান্ডেল পোচ এমুনিশন। রাংগামাটিতে যেতে হলে একটা সিংগেল গাড়ি যাওয়ার নিয়ম নাই কারন এলাকাটা ঝুকিপুর্ন। তাই অন্তত দুটু গাড়ির একটি বহর নিয়ে যেতে হয়। সপ্তাহে দুইদিন ওই ঝুকিপুর্ন এলাকায় রুট প্রোটেকশনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর লোকজন চলাচল করে। এই রুট প্রোটেকশনের ব্যাপারটা আমার আগে জানা ছিলো না। রুট প্রোটেক্সন হচ্ছে, যখন কোনো কনভয় হিলে ঝুকিপুর্ন জায়গায় যায় বা আসে, তখন রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় আর্মি, বিডিআর এবং আনসার সম্বলিত প্রায় তিনজন করে একেকটা পয়েন্টে কিছু ভিজিবল রাস্তা বা একটা দায়িত্তপুর্ন এলাকা প্রোটেকশন দেয়া, যাতে শান্তিবাহিনী কোনো অপারেশন করলে দ্রুততম সময় এই বাড়তি লোকজন সামাল দিতে পারে অথবা দায়িত্তপুর্ন এলাকাটি নিরাপদ আছে সেটা নিশ্চিত করা।

রাংগামাটি যেতে রাংগামাটি আর চিটাগাং এর মাঝামাঝি একটা জায়গা আছে যার নাম, আমতলি। এখানে সবাই নেমে আর্মস লোড করে, একটা ব্রিফিং হয় এবং এই আমতলী থেকেই ঝুকিপুর্ন এলাকা বলে এয়ারমার্ক করা। আমতলি পর্যন্ত হিল আসলে বুঝা যায় না। প্রায় সমতলের মতো। এখান থেকেই বড় বড় পাহারের উতপত্তি। আমরা সবাই আর্মস লোড করে নিলাম। পিকআপ গাড়িতে একটা এলএমজি (লং মেশিন গান) ফিট করা, আর পিকআপের দুই ধারে সৈনিকরা এমনভাবে বসে, যাতে সবাই বাইরের দিকে তাদের আর্মস তাক করা থাকতে পারে। আকাবাকা রাস্তা। দুইধারে বিশাল বিশাল পাহাড়। কখনো গাড়ি নীচে নামছে, কখনো গাড়ী আবার পাহাড়ের কোল ঘেষে একেবারে চুড়ায় উঠে যাচ্ছে। ঈশ্বর তার সৃষ্টি এমন করে চোখের আড়ালে এতো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন, দেখলেই মন ভরে যায়। কখনো কখনো দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে দুরের আকাশ দেখা যায়। একটু ভয়ও লাগে। আবার এই ভয়কে উপচিয়ে প্রকৃতির সউন্দর্য এমনভাবে মনকে পুলকিত করে যা আমার হৃদয়ে কি যেনো পরম অনুভুতি জাগিয়ে দেয়। আমি ভয়বিসন্ন অন্তর নিয়ে একট মিশ্রিত ভালো লাগার অনুভুতিতে পুরু রাস্তাটা পার করলাম। যেহেতু শান্তিবাহিনী কখনো চোখে দেখি নাই, তাদের তান্ডবলীলাও আমার জানা নাই ফলে শান্তিবাহিনীর ধংসাত্তক কার্যকলাপের চিহ্ন আমার মনের মধ্যে ভেসে উঠে নাই বরং বর্তমান সময়ে প্রকৃতির রুপটাই আমাকে বেশী বিমোহিত করেছিল। কখনো কখনো মনে হয়েছিলো, একবার গাড়ি থেকে নেমে পাহাড়ের এই অদ্ভুদ রুপকে প্রানভরে দেখি, কিন্তু রুট প্রোটেকশনের নীতিমালা অনুযায়ী এটা করার কোনো নিয়ম না থাকায় দ্রুত গতিতেই একটার পর একটা দৃশ্য যেনো সিনেমার পর্দার মতো চোখের পলকে হারিয়ে যাচ্ছে।

দূরে কোথাও মেঘের ভেলা দেখা যাচ্ছে, আবার পরক্ষনেই সেই মেঘের ভেলা যেনো একেবারে আমাদের গাড়ির নিকটবর্তী হয়ে একটা উড়ন্ত বকের ঝাকের মতো পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। পাহাড়ের আকৃতির কারনে রাস্তাগুলিও একবার উত্তর থেকে দক্ষিনে, আবার কখনো কখনো পুর্ব থেকে পশ্চিমে লম্বা সারি হয়ে আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে। কখনো সূর্য ঠিক মাথার উপর, আবার কখনো সূর্য আমাদের পিছনে চলে যাচ্ছে। দূর পাহাড়ের কোল ঘেষে ঝর্না দেখা যায়, ভারতের পাহাড়গুলি আর আমাদের দেশের পাহাড়্গুলির মধ্যে একটা যোগসুত্র আছে। এদেশের পাহাড় যেখানে শেষ, হয়তো ভারতের পাহাড়গুলি সেখানেই শুরু। এই পাহাড়দের মধ্যে কোনো আঞ্চলিক বিরোধ নাই। তাদের একটা দেহের কিছু অংশ এদেশে থাকলেই কি আর ভারতে থাকলেই কি, এরা একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা যারা টেরিটরিয়াল বাউন্ডারি করে এদের পরিচয়ে বাধা দিয়ে বলি এটা আমাদের আর ওটা ওদের, তাদের এই পাহাড়দের কিছুই যায় আসে না। কোনো পাহাড় টেরিটরিয়াল আইন মানে না। তারা অনবরত একটা অবিচ্ছেদ্য অংশই হয়ে থাকে আজীবন।

প্রায় দুই ঘন্টা হাইস্পীডে গাড়ি চালিয়ে শেষ অবধি আমরা পাহাড়ের চুড়া থেকে নেমে রাংগামাটির প্লেন ল্যান্ডে চলে এলাম। এই রাংগামাটি শহরটা কি কখনো আগে পাহাড়ের মতো ছিলো কিনা আমি জানি না, কিন্তু দেখলে বুঝা যায় যে, এরাও তাদের পুর্বসত্তাকে হারিয়ে ফেলেছে মানুষের ক্ষুরধার কোনো বুল্ডজার বা সাবলের আঘাতে। এখন সে একটা সমতল ভুমি। অনেক পিচঢালা রাস্তা, বিল্ডিং এ ছড়াছড়ি। অনেক নিয়ন লাইট আর হরেক রকমের বিজ্ঞাপনে ভর্তি এই শহর। মানুষের মধ্যে কোনো আতংক নাই, কেউ বাজার করছে, বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে, কেউ আবার স্কুল থেকে ফিরে যাচ্ছে। দোকানীরা তাদের পন্য বেচাকেনায় মগ্ন। আশেপাশে কয়েকটা বিডিআর কিংবা আর্মির গাড়ি অলসভাবে টহল দিচ্ছে। আমরা রাংগামাটির বুকে এখন। প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। আমরা বিডিআর রেষ্ট হাউজে চলে এলাম। ভীষন সুন্দর একটা রেষ্ট হাউজ। ক্যাপ্টেন আখতার (১১ লং কোর্ষের), তিনি আমাদের রিসিভ করলেন। বিডিআর রেষ্ট হাউজটা একটা লেকের পাশে, আবার লেকের ঠিক পরেই পাহাড়। রেলিং দেয়া চারিদিকে। রেলিং এ দাড়ালে মনে হয় পানির উপরে দাঁড়িয়ে আছি। অদ্ভুদ সুন্দর রেষ্ট হাউজটা। আমরা খাবারের জন্য তৈরী হলাম। আগে থেকেই সম্ভবত আমাদের খাবারের কথা বলা হয়েছিলো। খেতে গিয়ে দেখলাম, বড় বর মাছের খন্ড। জিজ্ঞেস করতেই মেস ওয়েটার জানালো যে, এই মাছ কাপ্তাই লেকের থেকে আনা। এখানে জ্যান্ত মাছ পাওয়া যায় আর সেটা বেশ সস্তাই। অনেক ক্ষুধা লেগেছিলো। ভয়ের একটা গুন আছে। পেটে যতোই ক্ষুধা থাকুক, ভয় যখন ভর করে তখন পেটও তার ক্ষুধার কথা জানান দেয় না। যেই ভয় দূর হয়ে যায়, তখন পেটের ভিতর যতো ক্ষুধা এতোক্ষন চুপ করেছিলো, তা একঝাকে জেগে উঠে। মারাত্তক উগলে উঠে পেট খাবারের জন্য। আমাদেরও তাই হল। এতোক্ষন ক্ষুধাটা বুঝি নাই। এখন মনে হচ্ছে, রাজ্যের ক্ষুধায় পেট চু চু করছে। আমরা বেশ আনন্দের সাথেই দুপুরের খাবার খেলাম। 

আমাদের খাবারের পর ক্যাপ্টেন সাফিন (জিএসও-৩ অপারেশন) আমাদেরকে জানালো যে, রাত আটটায় কমান্ডারের ব্রিফিং হবে। সবাইকে ব্রিগেড অফিসে রাত আটটার মধ্যে থাকতে হবে। অনেক সময় হাতে। ভাবলাম, রাংগামাটি শহরটা ঘুরে দেখা যেতে পারে। আমাদের অনুরোধ রাখা হলো। আমরা দলবেধে ঘন্টাখানেক পর একটা স্কর্ট আর একটা পিকআপ নিয়ে রাংগামাটির বেশ কিছু জায়গা দেখলাম। ঝুলন্ত ব্রিজ, পরিত্যাক্ত পাহাড়ের কিছু অংশ, লেক, হাইড্রোলিক পাম্প, এবং জলবিদ্যুৎ এরিয়া সবগুলিই আমাদেরকে দেখানো হলো।

পানির যে কি শক্তি এই হাইড্রোলিক পাম্প এবং জলবিদ্যুত কেন্দ্র না দেখলে বুঝা যাবে না। অফুরন্ত পানির প্রবাহের একটা শব্দ আছে, অনবরত এই শব্দ মানুষকে বিমোহিত করে। হাজার হাজার টন পানি যখন একসাথে বেরিয়ে যাবার জন্য প্রতিযোগীতা করে তখন তার সামনে কি আছে আর কি নাই এটা কোনো ব্যাপার না। জলোচ্ছাস কি, তার কি তান্ডব, আর্টিফিশিয়ালভাবে এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কিছু আভাষ পাওয়া যায়। খুব অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে, দেশের সিংহভাগ বিদ্যুৎ এই কাপ্তাইয়ের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরবরাহ হয়। কোনো কারনে যদি এই জলাধার আর না থাকে, বা শুকিয়ে যায় বা কোনো আকস্মিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তাহলে দেশের অন্যান্য সব অঞ্চল অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়বে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। এটা ভাবতেই মাথা ঘুরে যায়। দেশের এই মুল্যবান সপদ এমন এক জায়গায় যেখানে সারা বছর ঝুকিপুর্ন। রাংগামাটি শহর দেখা হল। মন ভরলো না। আবার কবে আসি জানি না কিন্তু এর বিস্ময়কর স্মৃতি আমার মাথায় পুরে থাকল।

রাত আটটায় আমরা ব্রিগেড অফিসে গেলাম। কমান্ডার আসেন নাই। কিন্তু অপারেশন অফিসার মেজর লিয়াকত আমাদেরকে প্রায় এক ঘন্টা কিভাবে কি অপারেশন করতে হবে, কিভাবে পেট্রোল করতে হবে, শান্তিবাহিনির ট্রেন্ড কি, তারা কিভাবে কিভাবে অপারেশন করে, কোন কোন দল এখানে কাজ করে, তাদের কমান্ডাদের নাম এবং সংঘটন সম্পর্কে একটা ধারনা দিলেন। সন্টু লার্মা যিনি এই শান্তিবাহিনীর কমান্ডার তার সম্পর্কেও অনেক কথা জানলাম। কিছু নোট করলাম, কিছু মাথায় নিলাম, আবার অনেক কিছুই মাথার উপরে দিয়ে গেলো বলে মনে হল। ক্যাপ্টেন নিজাম স্যার কেনো এম্বুসে মারা গেলেন এই উদাহরন বারবার টানা হলো। ক্যাপ্টেন নিজামের কাহিনীটা কোনো এক সময়ে বিস্তারীত লিখবো। চলে এলাম রেষ্ট হাউজে। তখন রাত প্রায় ১১ টা। আমি যে রুমে আছি, সে রুমেই থাকে ক্যাপ্টেন আখতার। অনেক রাত অবধি স্যারের সাথে গল্প হলো। স্যার নতুন বিয়ে করেছেন, ভাবীর কথা অনেক আলাপ করলেন। তার মনের কষ্টের কথা, তার ভালো লাগার কথা, তার একাকিত্তের কথা অনেক বললেন। পাহাড়িয়া এলাকায় সব অফিসারের একটা আলাদা জগত আছে। এই জগতের কথা সবাই জানে না। এটা নিতান্তই নিজের আর গোপন। যাই হোক, আগামীকাল আমরা বরকলে অবস্থিত ৪৪ ইষ্ট বেংগলে ওরিয়েন্টেশনের জন্য রওয়ানা হবো। এই কয়দিনে আমি যেনো যাযাবরের মতো আজ এখানে, কাল ওখানে দিনকাল কাটাচ্ছি। কোনো স্থানের অভিজ্ঞতাই যেনো এক নয়।

প্রায় দেড়টার দিকে ঘুমিয়ে গেলাম।

২১/০৯/১৯৯১-২১ রাইফেল ব্যাটালিয়ান

আজই ২১ রাইফেল ব্যাটালিয়ানে সংযুক্ত হলাম। প্রকৃত হলো যে, কোনো বিডিআর ব্যাটালিয়ানে এটাই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। মেজর জিয়া (৮ম লং কোর্ষ) ২১ রাইফেলের অধিন্যক। তার সাথে উপঅধিনায়ক হিসাবে আছে আমার কোর্ষম্যাট আর্টিলারীর মাহফুজ। ২১ রাইফেল রিয়ারে রাত কাটালাম, আমার সাথে ১৪ লং কোর্ষের জামাল (ইঞ্জিনিয়ার) ও ২১ রাইফেলের সাথে এটাচড। রাতে বেশ জমিয়ে সবাই আড্ডা দিলাম বটে কিন্তু কোথায় যেনো একটা অস্থিরতা কাজ করছিলো আমার।

রাংগামাটিতে একদিন থাকবো। তারপর ওখানে রাংগামাটির ব্রিগেড কমান্ডার করত্রিক আমাদেরকে একটা রিসেপ্সন প্লাস ব্রিফিং করবেন। তারপর সেখান থেকে যার যার ব্যাটালিয়ানের জন্য সবাই চলে যাবো। আমাদের আবার বিডিআর ব্যাটালিয়ানে যাওয়ার আগে সেই এলাকায় অবস্থিত কোনো ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ানের সাথে অরিয়েন্টেশন করতে হবে। আমার মারিষ্যা জোনে আছে ৪৪ ইষ্ট বেংগল, আমাকে ৪৪ ইষ্ট বেংগলে প্রথম ৭ দিন অরিয়েন্টেশনের জন্য থাকতে হবে।

রাতে চট্টগ্রাম সেনানীবাসটা ঘুরলাম। সেই বেসিক কোর্ষের পর টিএ এন্ড এস (টার্গেট একুইজেশন এন্ড সার্ভে) কোর্ষ করার সময় এখানে কয়েকবার এসেছিলাম। তবে খুব একটা রাত কাটাই নাই এই সেনানীবাসে। এবারই প্রথম রাত কাটাচ্ছি। চট্টগ্রাম সেনানীবাস যশোর সেনানীবাস থেকে কিংবা সাভার, বা খুলনা ইত্যাদি সেনানীবাস থেকে একেবারেই আলাদা। বেশীর ভাগ অফিসারগন থাকে হিলে। যারা ছুটিতে যায় কিংবা ছুটি থেকে ফিরে আসে, তারাই একমাত্র এই অফিসার মেসগুলিতে থাকে। আর থাকে সার্ভিস কোরের অফিসাররা যাদেরকে হিলে যেতে হয় না। ফলে অফিসার মেসগুলি খা খা করে। তার মধ্যে আবার মেসগুলি পাহাড়ের ভাজে ভাজে যেনো লুকিয়ে আছে। এক ধরনের মাদকতা আছে এই মেসগুলিতে।

রাতের বেলায় যখন সেনানীবাসে ঘুরছিলাম, দেখলাম কোথায় মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছে, কোথায় কিভাবে কে কি করেছে তার কিছু ঐতিহাসিক জায়গা। এই চিটাগাং আমাদের দেশের অনেক বড় বড় ইতিহাসের সাথে জড়িত। 

ঘুমিয়ে গেলাম। সকাল অর্থাৎ ভোর ৫ টায় রওয়ানা দিতে হবে রাংগামাটির উদ্দেশ্যে।

২০/০১/১৯৯০-আগমন-২৯ ডিভ লোকেটিং

আসলে খুব হাপিয়ে উঠেছিলাম ৬ ফিল্ড রেজিমেন্টে। উপ-অধিনায়ক মেজর রফিকের ধুর্ততা যে কত গভীরের, সেটা যে না ভুক্তভোগী, সে বুঝবে না। খুবই চালাক একজন বান্দা। ৬ ফিল্ড আসলে প্রথম থেকেই বেশ বুদ্ধিদীপ্ত এবং জ্ঞানী সিও বা উপ অধিনায়ক পায় নাই। কিন্তু যারা সিও হিসাবে বা উপ অধিনায়ক হিসাবে এই ইউনিটে পোষ্টিং হয়েছেন, তারা কিন্তু কোনোভাবেই বোদাইও ছিলেন না। যেমন, রেইজিং সিও ছিলেন, লেঃ কর্নেল দাউদ, লেঃ কর্নেল আহসান উল্লাহ, লেঃ কর্নেল খাইরুল, আরো অনেকে। এই ক্ষুদ্র একটি ইউনিটে আমার ক্ষুদ্র সময়ে ৬ ফিল্ডে অনেক কিছু ঘটে গেছে। আমার জীবনের অনেক নতুন কিছু ঘটেছে। কোনোটা খুবই আনন্দের, আবার কোনোটা জীবনের জন্য খুবই মর্মান্তিক। কে জানে, ভবিষ্যত কি বা কোথায় যাচ্ছি।

গত পহেলা জানুয়ারীতে ৬ ফিল্ড রেজিমেন্ট থেকে আমার পোষ্টিং হয়ে গেছে। নতুন ইউনিট ২৯ ডিভ লোকেটিং। বগুড়া সেনানিবাস। বগুড়া এলাকায় দুটু সেনানিবাস আছে, একটার নাম মাঝিরা সেনানীবাস এবং আরেকটা জাহাংগিরাবাদ সেনানিবাস। ২৯ ডিভ লোকেটিং ইউনিট জাহাংগিরাবাদ ক্যান্টনমেন্টে।

মাইনর ইউনিট। মেজর ইকবাল ইউনিটের ওসি। বেশ ভদ্র মানুষ। হাসি খুসী মানুষ। থার্ড লং এর উনি। পাশেই ১ ফিল্ড রেজিমেন্ট, তার পাশে ৬ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ান এবং ৩২ এসটি ব্যাটালিয়ান। এখানে একটা ফিল্ড এম্বুলেন্স আছে। এই মিলিয়ে আসলে জাহাংগিরাবাদ সেনানীবাস। ১১ আর্টিলারী ব্রিগেড, ১ ফিল্ড এবং আমাদের ইউনিট একদম লাগোয়া।

১ ফিল্ডের সি ও লেঃ কর্নেল মাহবুব স্যার। আমার বেসিক কোর্ষের আই জি ছিলেন। তাকে সবাই পন্ডিত বলেই চিনে। আমার ২৯ ডিভ লোকেটিং ইউনিটে আমার সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে যে, আমারই কোর্ষ্মেট ক্যাপ্টেন আলমাস আছে। আমরা মোট তিন জন অফিসার ইউনিটে। ইকবাল স্যার, আলমাস আর আমি।

আমরা সবাই মেসে থাকি। সময়টা ভালোই কাটে। বেশ ঘরোয়া পরিবেশের মধ্যে জাহাংগিরাবাদ সেনানিবাস। শহরের কাছাকাছি। বগূড়া শহরে যেতে মাত্র সময় লাগে ১৫ মিনিট। বগুড়ায় আমার আরো একটি ভালো জিনিষ ছিলো যে, এই শহরেই মিতুলের এক বোন বাস করে। উনার সাথে আমার কখনো দেখা হয় নাই। আমি না উনাকে চিনি, না উনার জামাইকে চিনি , না উনার কোনো পরিবারের সদস্যকে চিনি। তবে শুনেছি উনি নাকি এখানে বেশ ভালো ব্যবসা করেন।

যে কারনে মিতুলের এই আত্তীয় আমার জন্য সুখবর হয়েছিলো সেটা হচ্ছে, মাঝে মাঝে যদি মিতুলকে বগুড়ায় আনার দরকার পড়ে তাহলে মিতুল ওর বোনের বাসায় থাকতে পারবে, আর আমিও ওখানে গিয়ে একটু ভালো সময় কাটাইতে পারবো।

দেখা যাক, জাহাংগিরাবাদ আমার জীবনে কতটা সমৃদ্ধি আনতে পারে। এখানকার জিওসি হিসাবে আছেন মেজর জেনারেল সাদিক। সিলেটী মানুষ। এডিসি হিসাবে কাজ করে লেঃ দেলোয়ার। সে এস টি ব্যাটালিয়ান থেকেই গেছে এই মাত্র কয়েকদিন আগে। দেলোয়ার আমার রুমের পাশি থাকতো, আমরা দুজনেই ভালো আর্ট করতে ভালোবাসতাম।

দেলোয়ার এডিসি হয়েই এসটি ব্যাটালিয়ান থেকে চেঞ্জ করে ইনফ্যান্ট্রিতে চেঞ্জ করলো। বুঝতেছি যে, সম্ভবত জেনারেল সাদিকের মেয়ের সাথে দেলোয়ার কনো সম্পর্ক করতে যাচ্ছে। 

০২/০৭/১৯৮৮-বিয়ের রিং

নতুন বিয়ে করে এসেছি। এই খবরটা জানে শুধু লেঃ আশফাক আর ক্যাঃ রেজা। অন্য কাউকে এই ব্যাপারে কিছু জানানো যাচ্ছে না। কারন মিলিটারী রুল অনুযায়ী আমার বিয়ের বয়স এখনো হয় নাই। সেমোতাবেক বিয়ে করার জন্য আমাকে আরো ৪ বছর অপেক্ষা করতে হবে। যেটা খুবই একটা কঠিন বিষয়। যদি জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে সেনা আইনে আমার অনেক ক্ষতি হবে। আমার চাকুরীচ্যুতও হতে পারে। আমাকে অনেক সাবধানে সব বিষয়ে আচরন করতে হবে।

বিয়ের পরে আমার হাতে একটা বিয়ের সোনার রিং আছে। এতা সম্ভবত আমার পড়া ঠিক হচ্ছে না। অনেকেই জিজ্ঞেস করে, এটা কি? আমি এড়িয়ে যাই। আর এম্নিতেও সোনার আংটির উপর আমার কোনো গরজ নাই। মিতুলের সাথে আমার যোগাযোগের একমাত্র উপায় প্রতিদিন চিঠি লিখা। অবশ্য সেও প্রতিদিন আমাকে চিঠি লিখছে। বাসার কেউ জানে না আমি বিয়ে করেছি। বদি ভাই, হাবীব ভাই কিংবা অন্য কেউওই জানে না যে, আমি বিয়ে করে এসেছি এই মে মাসে।

আমার বিয়ের ব্যাপারে যদি আমি আমার অভিভাবকদের উপর নির্ভর করতে হতো, তাহলে হয় আমি মিতুলকে সাভাবিকভাবে পেতাম অথবা ওর সাথেয়ামার বিয়েই হতো না। পরের অপশনটাই বেশি হতো। আমি যাকে চাই, সেটা আমার পেতে অসুবিধা কই? কিন্তু এখন অসুবিধাটা হচ্ছে আমার বিয়ের খবরটা গোপন রাখা। ভাবছি, এবার কোর্স শেষ করে আমার বিয়ের ব্যাপারটা আমার পরিবারের সাথে মিটিয়ে ফেল্বো। আমি এটাও জানি আমার এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বদি ভাই কিংবা হাবীব ভাই মেনে নিবেন না। তাতেও আমার সিদ্ধনাত আমাকে অটল থাকতে হবে। আমি আলাদা ব্যক্তিত্ত হয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামতকে প্রাধান্য দিতে চাই। এটা আমার পরিবারের ট্রেডিশন থেকে অনেক আলাদা। আমি তো জানি আমার একমাত্র আমিই সব। মা আমার পাশে থাকবেন ঠিকই কিন্তু আমারমায়ের তেমঙ্কোনো সামর্থ নাই যাতে তিনি সবার উর্ধে গিয়ে আমাকে একচ্ছত্রভাবে সাপোর্ট দিতে পারবেন। তবে আমার মা যে খুশী হবেন সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নাই।

আর বেশীদিন নাই কোর্স শেষ হবার। খুব তাড়াতাড়িই আবার সাভারে চলে আসবো।

৩০/০৫/১৯৮৮-বিবাহ

গিলাতলা সেনানীবাস, খুলনা

খুব ক্লান্ত শরীর। সারাদিন লং ড্রাইভের ক্লাশ ছিলো। মেসে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা বনে গিয়াছে। মনটা আজো খারাপ কারন আজো তাহার চিঠি আসে নাই। কয়েকদিন যাবতই আমি তাহার চিঠি পাইতেছি না। এমন হইবার কথা নহে। যেখানে প্রতিদিন তাহার চিঠি পাইয়া থাকি, সেখানে আজ প্রায় চারদিন যাবত তাহার কোনো চিঠি আমার কাছে আসিতেছে না, ইহা আমার জন্য একটি দুশ্চিন্তার কারন বটে। খুলনা শহর হইতে বেশ দূরে আমি সেই সাভার সেনানীবাস হইতে আসিয়া গিলাতলা সেনানীবাসে প্রায় তিন মাসের ড্রাইভিং কোর্স করিতে আসিয়াছি আমি। ইতিমধ্যে প্রায় দুইমাস পার করিয়া দিয়াছি। ক্লান্ত শরীরে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়া হাতে বানানো ক্যাপসটেইন মিকচার দিয়া সিগারেট বানাইয়া ঠান্ডা একটি কোকের বোতল মাঝে মাঝে চুমুক দিয়া অবশ এবং অলশ শরীরে সূর্যাস্তের পর নাতিদীর্ঘ সন্ধ্যাটি উপভোগ করিতেছিলাম। মনটা খুব ভালো নাই। আমি তাহার চিঠি পাইতেছি না। এমন সময় মেস ওয়েটার সুম্মুখে আসিয়া বলিল, “স্যার, দুপুর বেলায় আপনার একটা ফোন এসেছিলো ঢাকা থেকে। আপনাকে জরুরী ভিত্তিতে তাকে ফোন ব্যাক করতে বলেছেন। ব্যাপারটা নাকি খুব জরুরী। নাম তার…… ।” হটাত করিয়া আমার ক্লান্ত দেহ, অলশ মস্তিস্ক এবং নাতিদীর্ঘ সন্ধ্যাটি কেমন যেনো নাড়াচাড়া দিয়া আমাকে উত্তেজিত করিয়া তুলিলো। কারন মেস ওয়েটার যাহার নামে ফোন আসিয়াছিলো বলিয়া সংবাদটি দিলো, তাহার ফোন কস্মিনকালেও আমি আশা করি নাই এবং করিও না। বেশ এলোমেলো লাগিতেছিলো মনটা। সন্ধ্যাটা আরো কালো আকার ধারন করিয়া আমার সামনে যেনো আরো অন্ধকার করিয়া তুলিলো। শরতচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসে একবার লিখিয়াছিলেন, অন্ধকারেরও রুপ আছে, কিন্তু আজ এই অন্ধকার সন্ধ্যায় আমি শরতবাবুর সেই অন্ধকারের কোনো রুপ খুজিয়া পাইলাম না, যাহা পাইলাম তাহা কেবল দুসচিন্তা আর অবসন্নতা মিশ্রিত বিসন্নতা। যাহাই হোক, আমাকে ঐ ভদ্রলোককে যেভাবেই হোক ফোন করিয়া জানিতে হইবে কেনো সে আমাকে ফোন করিয়াছিল এবং আমার তাহাতে কী কী করনীয়।

এমনিতেই খুব ছোট র‍্যাংকের অফিসার আমি (মাত্র লেফটেন্যান্ট), তাহার মধ্যে এই খুলনা শহরে কোর্স করিতে আসিয়া আমরা এইস্থানে একটা বিদেশী নাগরিকের মতো অনেক অধীকারই আমাদের নাই বলিয়া মেসে রক্ষিত একমাত্র ল্যান্ড ফোনটি আমাদের জন্য এসডি কলের সুবিধা নাই, আর আজিকার দিনের মতো তখনকার দিনে হাতে হাতে মোবাইল কোম্পানীও এই সুযোগ করিয়া দেন নাই যাহাতে আমরা নিরিবিলিতে নিকটাত্মীয়, কিংবা প্রিয়জনের সাথে অবকাশ সময়ে কথা বলিতে পারি। যাহাই হোক, সন্ধ্যা ঘনাইয়া রাতের দিকে প্রবাহিত হইতে লাগিলো বটে কিন্তু আমার মাথা ক্রমশ দুসচিন্তায় সমাধানের দিকে না আগাইয়া আমাকে আরো উদ্বেলিত করিয়া বিহব্বল করিয়া তুলিতে লাগিলো।  প্রতিকুল পরিবেশে মাথা যতোই বিচলিত থাকুক, অন্তর থাকে তাহার থেকে আরো অধিক বিচলিত। আর বিচলিত অন্তর শুধু অন্তক্ষরনই করেনা মাঝে মাঝে ঈশ্বরের উপর এমন একটা ভাবনা লইয়া হাজির হয় যেনো কস্মিনকালেও কোনো ঈশ্বর বা ভগবান ছিলো কিনা তাহাই ভাবিতে মন চাহেনা। আর যতোক্ষন অন্তক্ষরন হয় ততোক্ষন পেটে অম্লের সৃষ্টি হয় আর অম্ল থেকে সৃষ্টি হয় এক ধরনের ঢেকুর। আর একবার যদি ঢেকুরের খনি তৈরী হয়ে যায়, তখন, সবচেয়ে খাইতে মজা লাগে শুধু সিগারেট। আমিও তাই একটার পর একটা ক্যাপসটেইন মিকচার দিয়া ঘনঘন সিগারেট বানাইয়া তৃপ্তি না হোক একটা চরম অস্থিরতার মধ্যে সময়টা পার করিতে লাগিলাম। অন্তক্ষরনের শেষে আরেকটি উপসর্গ দেখা যায়। আর তাহা হইলো, হটাত করিয়া অম্লের ঊর্ধ্বগতির কারনে মাথার গোল চাকতির ভিতরে এক প্রকারের চাপ অনুভুত হওয়ায় ফাক ফোকরের পাশ দিয়া কিছু কিছু গ্লোকজের মিশ্রনে হতবাক করার মতো কিছু সাহস আর বুদ্ধি জাগিয়া উঠে। আমারো তাহাই হইলো।

আমি আমার হইতে অধিক সিনিয়র কিন্তু এই কোর্সের রাজকীয় পরিবারের মতো একজন সিনিয়র শিক্ষকের নাম আমার মস্তিস্ক পর্দায় উদিত হইয়া উঠিলো যে, তাহাকে বলিলে হয়তোবা তাহার অধীনে থাকা দুস্প্রাপ্য ল্যান্ডফোনের  মাধ্যমে আমাকে সুদুর ঢাকায় ফোন করিবার সুযোগ করিয়া দিতেও পারেন। তাহার নাম ক্যাপ্টেন রেজা।  অষ্টম লং কোর্ষের। আমি তাহার রুমের সামনে গিয়া কয়েকবার পায়চারী করিতে থাকিলাম। আর মনে মনে অনেকবার কি কথা কিভাবে বলিবো, সেইটা নিজে নিজে কয়েকবার অনুশীলনের মতো কানে শুনা যায় এইভাবে নিজেকে শুনাইলাম। একবার ভাবিলাম, সব সত্য কথা বলিবো। আবার ভাবিলাম কিছু সত্য কিছু অসত্য (মিথ্যা নয়) মিশ্রন করিয়া একটা যুক্তি সঙ্গত কাহিনী বলিবো কিনা? যদি বলি, আমি প্রেম করিতেছি এবং গত কয়েকদিন যাবত আমি আমার প্রেমিকার কোনো চিঠিপত্র পাইতেছি না, তাহার সাথে আমার কথা বলিবার বিশেষ প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি কিভাবে তাহা গ্রহন করিবেন, সেটা আমার বোধগম্য হইতেছিলো না। আবার যদি বলি, বাড়িতে বিপদ, মহামারী হইয়াছে, কথা বলিবো বাসায়, এইজন্য তাহার ল্যান্ডফোনটা আমার ব্যবহার করিতে হইবে। আর তখন যদি তিনি অতি দয়া পরবশ হইয়া আমার পরিবারের খোজ খবর নিতে চাহেন, তখন আবার না হিতে বিপরীত হইয়া যায় ইত্যাদির আশংকা করিতেছি। সবচেয়ে বড় বিপদ হইলো যে, সত্য এবং অসত্যকে মিশ্রন করিয়া কাহিনী বানানো এবং তাহাকে একটা সত্যের যুক্তিক নাটকীয় অধ্যায় দেওয়া কতটা যে কঠিন তাহা ঐদিন বুঝিলাম। গলা শুকাইয়া যায়, মাথা ভনভন করিতে থাকে, বুক ধরফর করিতে থাকে আর গলার সুর মাঝে মাঝে এমন করিয়া ব্যাঙ্গ করে যে, নিজেই নিজের গলার সুর পরিচিত বলিয়া মনে হয় না, চিনিতে ভুল হয়। এমন একটা প্রতিকুল পরিস্থিতে শেষতক আমি ইহা মনস্থির করিলাম যে, যাহা বলিবো সত্য বলিবো। তাহার যদি অন্তর থাকিয়া থাকে তাহা হইলে তিনি আমাকে এই প্রতিকুল অবস্থা হইতে বাচিয়া যাইবার কোনো রাস্তাও তো বাতলাইয়া দিতে পারেন। আর যদি তিনি রাজকীয় পরিবারের সদস্য হইয়া আমাকে দন্ড দিতে চাহেন, তাহা হইলে তো আরো একটা বড় হাংগরের মুখে আসিয়া পড়িয়াছি বলিয়াই মনে করিতে হইবে।

-"এই কেরানীগঞ্জ, এইখানে কি করিস? কিছু বলতে এসেছিস নাকি?" হটাত করিয়া ক্যাপ্টেন রেজা তাহার রুম হইতে বাহির হইয়া আমাকে দেখিয়া ইহাই ছিলো তাহার ডায়ালগ। তিনি আমাকে বেশীর ভাগ সময় নাম না ধরিয়া ডাকিয়া আমার নিবাসস্থল কেরানীগঞ্জ বলিয়াই ডাকিতেন। এমিনিতেই আমি ধরাশায়ী রোস্তমের মতো অবস্থা তাহার মধ্যে আবার পরিকল্পনা ছাড়াই কি কথা বলিবো সেই পরিস্থিতি সামাল না দিতেই তাহার সামনে পড়িয়া গেলাম। এবার আর সত্য এবং অসত্য মিশাইয়া কিছু বলিবার অবকাশ রহিলো না। খুব সন্তর্পণে বারান্দায় দাড়াইয়া দাড়াইয়াই বলিলাম,-"স্যার, আমি ঢাকায় একটা ফোন করিতে চাই। মেসের ফোন কাজ করিতেছে না কিন্তু আমার ঢাকায় ফোন করা খুব জরুরী। তাই আপনার এখানে আসা। যদি অনুমতি দেন তো, আমার উপকার হয়।" কোনো কথা না বাড়াইয়া ক্যাপ্টেন রেজা স্যার বলিলেন, "কি ব্যাপার, গাল ফ্রেন্ড সমস্যা নাকি?"

কানের কাছে টাস করিয়া বোমা ফুটিলে যেমন কিছুক্ষন কানে আর কোনো শব্দ প্রবেশ করে না, অথবা নদীতে ঝাপ দিলে প্রথমকয়েক মুহূর্ত যেমন সাতারুর কানে স্থলবিশ্ব সম্পর্কে কোনো আওয়াজ তাহার কানে প্রবেশ করে না, আমারো হইলো ঠিক সেই অবস্থা। "গালফ্রেন্ড সমস্যা" কথাটি যেনো আমার কানের কাছে এইরুপ একটা ছোট খাটো টাস করিয়া বোমার মতো অথবা সাতারুর নদীতে ঝাপ দেওয়ার মতো ঘটনাই ঘটনাই ঘটিলো। সত্যই বলিলাম। কি নিদারুন আমার "স্যার", বড্ড ভালো আর দয়ালু, তার থেকে বেশী মিষ্ট কোনো ফল আছে বলিয়া তখন আমার "ক্যাপ্টেন রেজা"র চেয়ে কিছুই মনে পড়িলো না।  তিনি আমাকে তাহার ল্যান্ড ফোনটি ব্যবহার করিতে অনুমতি দিলেন।

আমি কয়েকবার ফোন করিবার পর অতঃপর  ঢাকার প্রান্ত হইতে এক ভদ্র মহিলা ফোন ধরিলেন। হ্যালো বলিতেই মনে হইলো তিনি যেনো আমার ফোন পাইয়া ৫ম বিশ্ব যুদ্ধের কোনো খলনায়ক তাহাকে এই বলিয়া ফোন করিয়াছে যে, আমি আপনাদেরকে খুব শিঘ্রই আক্রমনের নিমিত্তে আসিতেছি। তিনি আমাকে কোনো সুযোগ না দিয়া এই বলিয়া ফোন রাখিয়া দিলেন যে, কোন সাহসে আমি তাহার বাসায় ফোন করিয়াছি? শুধু তাহাই নয়, আর যদি তাহাকে ফোন করি, তাহা হইলে তাহার যাহা যাহা মিজাইল, আর আগ্নেয়াস্ত্র আছে তাহা দিয়াই আমাকে সমুলে ধ্বংস করিতে তিনি দিধাবোধ করিবেন না। তিনি আর কেউ নন, মেঝো ভাবী। কি হইলো, বুঝিতে পারিলাম না। আমি নাৎসি বাহিনীর কোনো কমান্ডারও না, কিংবা মিত্রবাহিনীর কোনো নৌবহরের কমান্ডারও না, তাহার পরেও তিনি আমাকে তাহার এমন শত্রু বলিয়া আমাকে এইরুপ আক্রমন করিলেন কেনো? যে ভদ্রলোক আমাকে ফোন করিতে বলিয়াছিলেন, তাহার সহিত আমার কোনো কথা বলা তো দুরের তাহা অবধি আমি পৌছাইতেই পারিলাম না। আমি আবারো ফোন করিলাম। এইবারও ফোন ধরলেন সেই ভদ্রমহিলা, মানে মেঝোভাবী।। আমি তাহার কথা বলা শুরু করিবার আগেই বলিলাম, আপা, আমি খুলনা হইতে বলিতেছি, জনাব (অমুকের সাথে) আমি কথা বলিবো। জরুরী কথা আছে। তাহার অন্তর যেনো একটু বিগলিত হইলো। মহিলাদের অন্তর কখন শক্ত হইয়া যায় আবার কখন বিগলিত হইয়া অঝোর ধারায় বর্ষা নামে ইহা নাকি বিধাতাই কনফিউশনে থাকেন। তিনি আর বেশী কিছু কথা না বাড়াইয়া ফোনখানা উক্ত ব্যক্তিকে ধরাইয়া দিলেন। কিন্তু আমার এইপাশ থেকে শুনিতে পাইতেছিলাম যে, তিনি তাহাকে এমন কিছু কথা বলিয়া শাসাইতেছিলেন যেনো তাহাদের ওখানে কি ঘটিতেছে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য আমাকে না দেওয়া হয়। বুঝলাম, কিছু একটা সিরিয়াস ম্যাটার। বুক ধরফর করিতেছিলো। বুকের ভিতর কেমন যেনো একটি আতংক পাথরের মতো ভর করিয়া আমার শ্বাস আর নিঃশ্বাসের দৈর্ঘ্য প্রস্থ এক করিয়া দিতে লাগিলো। উৎকণ্ঠায় আমার কপালের শিরায় শিরায় কেমন ঘামের শিশির বিন্দুর উৎপত্তি হইতে লাগিলো। আমি বুঝিতে পারিতেছিলাম, আমার শরীরের ভিতর রক্ত যতো দ্রুতই চলুক না কেনো, ঠোট  শুকাইয়া আসিতেছে, হাত পা ঠান্ডা হইয়া যাইতেছে। হাতের সিগারেট খানায় যেনো চুমুকের মতো টানিতে ইচ্ছা করিতেছিলো। কিন্তু সিগারেটখানা ইতিমধ্যে নিভিয়া গিয়া উতকট একটা গন্ধ ছাড়া আর কোনো স্বাদ দিতে পারিতেছিলো না। অবশেষে মুস্তাক সাহেব ফোন ধরিলেন। এই মুস্তাক সাহেবের কথাই আমার মেস ওয়েটার বলিয়াছিলো। তাহার সাথে আমার ইতিমধ্যে খুব একটা বেশি কথাবার্তা হয় নাই, তবে একদিন বা দুইদিন তাহার সাথে আমার দেখা হইয়াছিলো এবং অতীব ছোট খাটো কুশল বিনিময় হইয়াছিলো। আমি সালাম দিতেই তিনি আমাকে ফিরতি কোনো কুশল না দিয়া বলিতে লাগিলেন, "শুনেন আখতার সাহেব, আমি শুধু বলিয়া যাইবো, আপনি শুধু শুনিয়া যাইবেন, কোনো প্রশ্ন করিবেন না, হ্যা বা না দিয়া উত্তর ছাড়িয়া দিবেন। বেশীক্ষন আপনার সাথে কথা বলিবার সময় আমার হাতে নাই, আর থাকিলেও আমার পক্ষে হয়ত কথা বলিবার সুযোগ নাই।" এই বলিয়া তিনি যাহা বলিলেন, তাহা হইতেছে এইরুপঃ

-আমার ছোট বোনের বিয়া ঠিক হইয়াছে। আমেরিকার প্রবাসী। ছেলের বাড়ির সবাই মেয়েকে অত্যান্ত পছন্দ করিয়াছে। আমাদেরও ছেলের বাড়ির সবাইকে পছন্দ হইয়াছে, কিন্তু আমার বোন তাহাতে বাধ সাধিয়াছে যে, সে আপনার সাথে কোনো কথা না বলিয়া সে তাহার কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারিবে না। আমাদের সবার ধারনা, আপনি এই মুহূর্তে আপনার অফিশিয়াল নিয়মে বিবাহযোগ্য বয়স না হওয়ায় আপনি হয়ত আগাইয়া আসিতে পারিবেন না, হয়ত সময় চাহিয়া বসিবেন, যাহা আমাদের হাতে নাই। আমরা যোগ্যপাত্র পাইয়াছি, আমরা এই সুযোগ হাতছাড়া করিতে চাহি না। আপনিও যোগ্য নন এমন নয় কিন্তু আপনার অফিশিয়াল বাধ্যবাধকতার জন্য হয়ত আপনি এখনই কোনো প্রকারের সমাধান করিতে পারিবেন না। তাই সবার অমতে আমি এই বলিয়া সবাইকে বুঝাইবার মনস্থির করিয়াছি যে, যেহেতু মেয়ে একবারের জন্য হইলেও আপনার সাথে কথা বলিয়া তাহার সিদ্ধান্ত চুরান্ত করিতে চায়, তাই আজকে আপনাকে ফোন করা। এইবার আপনি সক্ষেপে আপনার বক্তব্য বলিতে পারেন। আর সেটা "হ্যা বা না"। 

আমি তাহার সাথে অধিক্ষন কথা বলিবার মানসিকতা দেখাইলাম না, শুধু বলিলাম, আমি মেয়ের সাথে কথা বলিতে পারিবো কিনা। তিনি আমাকে এই উপকারটুকু করিলেন। সে (আমার গার্ল ফ্রেন্ড অর্থাৎ মুস্তাক সাহেবের বোন) ফোন ধরিয়া কোনো কথা বলিতে পারিলো না। আমি এইপাশ হইতে শুধু তাহার ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাদিবার শব্দ পাইতেছিলাম। আমি তাহাকে কিছুক্ষন সময় দিলাম কাদিবার জন্য। আকাশ যখন কালো মেঘে ভরপুর হইয়া উঠে, চারিদিকের বাতাস যখন মেঘের এই কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন রুপ দেখিয়া হতভবের মতো স্থির হইয়া যায়, তাহার সহিত চারিপাশের গাছপালারাও ঢালপালা না নাড়াইয়া, পাতা না নাড়াইয়া একেবারে নিথর ভংগিতে দাড়াইয়া থাকে এইটা দেখিবার জন্য যে, আকাশের ওই মেঘ কি ঘন বরসায় বর্ষিত হইবে নাকি তাহার সহিত আরো ঘূর্ণিঝড়ের আবাস রহিয়াছে। আমি তাহার ফুফাইয়া ফুফাইয়া কাদিবার জন্য কিছুক্ষন সময় দিলাম, বাহির হইয়া যাক তাহার বুকের তপ্ত করুন কষ্ট, বাহির হইয়া যাক তাহার আবেগের কিছু মর্মান্তিক বেদনা। আমি চুপ করিয়া তাহার কান্নার শব্দগুলি শুনিতে লাগিলাম। এতো দুরের কান্নার আওয়াজ আমার মনের ভিতর প্রকান্ড একটা টর্নেডোর মতো শক্তি যোগাড় করিয়া কিছুক্ষন পর শুধু বলিলাম, – তুমি কি এখনো আমাকে ভালোবাসো? সে এই প্রশ্নে আরো কাদিয়া উঠিলো আর বলিল, "আমার আচরনে কি তোমার এইটাই শেষ পর্যন্ত মনে হইলো?" – বলিলাম, তুমি কি আমার আসিবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ চালাইয়া যাইতে পারিবে? যদি তোমার যুদ্ধে জিতার ক্ষমতা তোমার টিকিয়া থাকার ক্ষমতার বাহিরে চলিয়া যায়, তাহা হইলে তুমি শবমেহের হইয়া যাও। আমি আসিতেছি।" এই বলিয়া আমি ফোন ছাড়িয়া দিলাম এবং আমার পাশে রাখা ওই সিনিয়র স্যারের খাটের উপর বসিয়া পড়িলাম। আমার এহেনো আচরন এতক্ষন আমার ওই সিনিয়র অফিসার ক্যাপ্টেন রেজা খুব মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করিতেছিলেন। তিনি বিবাহিত মানুষ, আমার থেকে কয়েক বছরের সিনিয়র মানুষ, হয়তো অভিজ্ঞতাও বেশি। তিনি আমার কাছে আসিয়া বসিলেন। 

– বুঝিতে পারিয়াছি কি হইতেছে। যদি ভালোবাসো, তাহা হইলে আজই এই রাতে তুমি ঢাকার উদ্দেশ্যে বাহির হইয়া যাও। আমি সব সামলে নিবো। ভালোবাসা আর বিসসাসের থেকে বড় ভরসা প্রিথিবীতে আর নাই। আমি বলিলাম, স্যার, আমার হাতে একটি টাকাও তো নাই। আর আজ হরতাল চলিতেছে। আমার কি করা উচিত, আর কি করা উচিত নয় আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। তিনি আমাকে আমার রুমে যাইতে বলিলেন, আর বলিলেন, কাহারো সাথে যেনো আমি এই ব্যাপারটা নিয়া আলাপ না করি। বাকীটা তিনি দেখছেন। অসময়ে কেউ যখন অতি দুর্বল এক্তা হাতও বাড়াইয়া দেয়, তখন তাহা অতিকায় বড় একটা আশ্বাসের বস্তু হইয়া বাকীটা মনের জোরে আগাইতে পারা যায়। আমি আমার রুমে আসিলাম, আমার রুমের বন্ধুকে ব্যাপারটা খুলিয়া বলিলাম। সে আমার অত্যান্ত ভালো বন্ধু, আর সে আমার ব্যাপারটা পুরুই জানিত। ফলে তাহাকে বলিলে আমার কোনো অসুবিধা নাই এইটা আমার জানা ছিলো। আমার প্রুস্তুতির মধ্যে ছিলো শুধুমাত্র জামাটা বদল করা আর কোথায় কত টাকা আছে তা খুজিয়া বাহির করা। মানিব্যাগ রাখিতাম না, যা টাকা বেতন পাই তাহার বেশীর ভাগ চলিয়া যায় মেসের খাবারের বিল দিতে দিতেই। ফলে অবশিষ্ট টাকা কখনো বালিশের তলায়, কখনো মেট্রেসের তলায়, কখনো ড্রয়ারের কোনায় কখনো বা ব্যাটম্যানের কাছে রাখিতাম। সব জায়গায় খুজাখুজির পর সবমিলিয়ে আমি যাহা পাইলাম তাহাতে তিন শত টাকার উপরে নয়। মেস হাবিলদারকে তলব করিলাম এবং তাহার কাছ থেকে আরো পাচ শত টাকা ধার করিলাম। এইটা সেনাবাহিনীর একটা প্রচলিত ধারা যে, অফিসারগন মেস থেকে মাঝে মাঝে টাকা ধার নিতে পারেন যাহা মাসের শেষ সমন্নয় করা হয়। সব মিলিয়ে এখন আমার কাছে সম্বল মাত্র আটশত টাকার মতো।

একটু পর আমার সেই সিনিয়র স্যার ক্যাপ্টেন রেজা আমার রুমে ঢোকিলেন। বলিলেন, "বাডি, আজ রাত সাড়ে দশটায় সৌখিন পরিবহন ঢাকায় যাবে কিন্তু হরতালের কারনে সব সিট বিক্রি হয়ে গেছে।"  স্যার কোনো রকমে একটা সিট ম্যানেজ করিতে পারিয়াছেন। সৌখিন পরিবহন আমাদের গিলাতলা সেনানীবাসের সামনে দিয়েই ঢাকায় চলাচল করে। ফলে সৌখিন পরিবহনে যাইতে হইলে আমাকে আর কষ্ট করিয়া শহরে যাইতে হইবে না। স্যার আরো একটি উপকার করিলেন। তিনি আমাকে একটা পাচ শত টাকার নোট ধরাইয়া দিয়া বলিলেন, যুদ্ধে যাচ্ছো, উদ্দেশ্য তোমার প্রিয়জনকে উদ্ধার করা। ইহাতে আর কারো কোনো ক্ষতি করার দরকার নাই। মুল উদ্দেশ্য সফল হইলে যতো তারাতাড়ি আবার ফিরে এসো। আমি ম্যানেজ করিয়া লইবো তোমার ছুটি। আর ইহাও বলিলেন, এমন কিছু করিয়া আসিবা যাহাতে তুমি বাকী সময়টা নিশ্চিন্তে পরাশুনা করিয়া আবার তাহাকে ফিরিয়া পাও। কি তাহার ইংগিত ছিলো আমি তখনো বুঝি নাই আর তিনিও আমাকে খোলাশা করিয়া বলিলেন না। আমি শুধু স্যারকে জরাইয়া ধরিয়া বলিলাম, স্যার আমার জন্য একটু দোয়া করিবেন। এই যুদ্ধ আমার আর আমার মহিলার।

রাত এগারোটা বাজিয়া গিয়াছে, সৌখিন বাস এখনো আমাদের এলাকার কাছাকাছি আসে নাই। ফোন করিলাম। তাহারা এইবার এমন একটা সংবাদ দিলেন যে, বাস সম্ভবত ঢাকা পর্যন্ত পৌছাইতে পারিবে না কারন নদীর ওপাড়ে এখনো হরতালের কারনে পথঘাট অবরুদ্ধ রহিয়াছে। ফলে তাহারা এখনো সন্দিহান ঢাকার উদ্দশ্যে বাস ছাড়িবে কিনা। অবশেষে বাস আসিলো রাত বারোটার সময়। জনগনের অনুরোধে বাস মালিক যেই পর্যন্ত বাস যাইবে সেই পর্যন্ত লইয়া গেলেই হইবে এই শর্তে বাস ছাড়িলো। আমি যথারীতি বাসে উঠিলাম কিন্তু আমার সিটকে বা কাহারা দখল করিয়া আছে দেখিলাম। কোনঠাসা মানুষ, একটা খালি সিট থাকিলে কে বসিতে না চায়? কিন্তু আমি ঊঠার পর আমার সিটদখলদার সিট খালি করিয়া দিলেন।

মে মাস। আকাশের অবস্থা সেই সন্ধ্যা হইতেই খারাপ ছিলো। মাঝ রাতে বর্ষণ শুরু হইলো। আমাদের বাস চালক, এই অতিবর্ষণেও খুব সন্তর্পণে ধীরে ধীরে বাস চালাইতে থাকিলেন। যেখানে ফরিদপুর অতিক্রম করিবার কথা রাত তিন্টায়, সেই বাস ফরিদপুর অতিক্রম করিলো সকাল আটটায়। সকাল আটটায় আবার হরতালের নতুন দিন শুরু হইয়াছে। ফলে আমাদের বাস আর সামনের দিকে আগাইলো না। ওখানেই তাহার যাত্রা শেষ হইয়া গেলো। আমরা সবাই যার যার বাক্স পেট্রাসহ ফরিদপুরের কোনো এক বাজারের কাছে নামিয়া গেলাম। কিন্তু আমাকে তো যাইতেই হইবে। একদিকে হরতাল, অন্যদিকে আবহাওয়ার এই রকম একটা উত্তাল চেহাড়া। অশান্তমনে আমি এক্তার পর এক্তা বিড়ি ফুকিতেছি আর ভাবিতেছি কি করা যায়। আমি দেখিতে পাইলাম, কিছু কিছু ট্রাক স্থানীয়ভাবে অল্প অল্প দুরুত্তে চলাচল করছে। আমি এই সুযোগটি গ্রহন করিলাম। অনেক ট্রাকওয়ালারা সাধারনত অন্য কোনো পেসেঞ্জার তাহাদের ট্রাকে নিতে আগ্রহী হয় না কিন্তু আমি আমার সেনাবাহিনীর পরিচয় দেওয়াতে অনেকেই আমাকে ছোট ছোট লিফট দিতে সাহাজ্য করিলেন। এইভাবে আমি দৌলত দিয়া ঘাট পর্যন্ত আসিয়া হাজির হইলাম। এখানে আসিয়া দেখিলাম, রাজ্যের অসংখ্য মানুষ ঘাটে অত্যান্ত মানবেতরভাবে ফেরির জন্য অপেক্ষা করিতেছে। উত্তাল ঝড়ের কারনে সব ফেরি চলাচল বন্ধ। কখন ফেরি চালু হইবে কেহই বলিতে পারে না। নদীতে অনেক বড় বড় ঢেউ। নদী পার হইবার কোনো রাস্তা নাই। কিন্তু আমাকে তো যেভাবেই হোক এই সাগর পাড়ি দিতেই হইবে কারন আমার জন্য পথ চাহিয়া বসিয়া আছে কোনো এক মেয়ে যাহার সমস্ত শক্তি দিয়া সে তাহার ভালোবাসার জন্য যুদ্ধ করিতেছে।

আমি একটার পর একটা সিগারেট শেষ করিতেছি আর ভাবিতেছি কি করিবো। এমন সময় দেখিলাম, কিছু লোক এক্তা ছোট লঞ্চ নিজেরা ভাড়া করিবার উপক্রম করিতেছে আর লঞ্চওয়ালাকে তাহাদের জরুরী কাজের কাহিনী বলিয়া বেশী টাকার লোভ দেখাইয়া ব্যাপারটা এইরুপ বুঝানোর চেস্টা করিতেছে যে, যদি তিনি রাজী হন তাহা হইলে এই মানুসগুলির অনেক বিপদ থেকে রক্ষা পায়। ঈশ্বর সব সময়ই এক্তা পথ বাতলে দেন। এইবারও তাহাই হইলো। লঞ্চওয়ালা রাজী হইলেন নদী পার হইতে। আমিও সেই লঞ্চে উঠিয়া গেলাম। পানির যে কত শক্তি আর বাতাসের সাথে ইহার যে কি রুপ এক্তা বন্ধুত যদি পানি আর বাতাস একসাথে হয়, তাহা হইলে ইহাদের তান্ডব লীলা দেখাইবার জন্য যেনো ইহারা এতোটাই হিংশ্র হইয়া উঠে যাহারা দেখেন নাই তাহারা ভাবিতেও পারিবেন না ইহা কি। বা ইহার রুপ কি। একবার একদিকে লঞ্চ হেলিয়া পড়ে তো সব মানুষজন হুমড়ী খাইয়া অন্য দিকে ঢলিয়া পড়ে, আবার ভারসাম্য রক্ষায় যখন মানুষ অন্যদিকে ঢলিতে চাহে, তখন সেই একই রুপ হয় যাহা একটু আগে হইয়া ছিলো। এইভাবে হেলিয়া দুলিয়া আমাদে ছোট লঞ্চটা কোনো রকমে আরিচা ঘাটে আসিয়া পড়িল। যখন লঞ্চটি আরিচা ঘাটে পউছিলো তখন আমাদের কাহারো পরনের জামা আর সুস্ক নাই, কাহারো মাথার চুলও আর পরিপাটি নাই। সারারাত না খাওয়ার কারনে আমার প্রচন্ড ক্ষুধা লাগিয়াছিলো বটে কিন্তু আমার সেই ক্ষুধা আমার ইন্দ্রিয় অবধি পউছায় নাই।

এই পাড়ে আসিয়াও দেখিলাম হরতাল আরো কঠিন করিয়া পালন হইতেছে। রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় আর জন-জীবনের প্রয়োজন তাহাদের নিজস্ব বাস্তবতা। তাই অতীব প্রয়োজনে কিছু কিছু রিক্সা অল্প দুরত্তে ভাংগিয়া ভাংগিয়া চলিতেছে। আমি চলমান বৃষ্টি আর বাতাস উপেক্ষা করিয়া কোনো রকমে এক রিক্সা থেকে আরেক রিক্সায়, এইভাবে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত চলিয়া আসিলাম। এখানে একটা কথা বলিয়া রাখা খুব দরকার যে, আমার ভালোবাসার মেয়েটি ঢাকার যেই জায়গায় অন্তরীন হইয়া চাতক পাখীর ন্যায় আমার আসিবার জন্য উতসুখ হইয়া আছে, ওই স্থানটি আমি চিনি না। কিভাবে যাইতে হইবে আর কিভাবে তাহার অবধি পৌছাইতে হইবে ইহা আমার জানা নাই। তাই আমি মনেপ্রানে ভাবিলাম, আমি তাহার পিত্রিস্থল মানিকগঞ্জে আগে যাইয়া সেইখান হইতে কাহাকেও লইয়া আমি ঢাকার সেই অন্ত্রীন জায়গায় পৌছাইতে হইবে। আমি মানিকগঞ্জে পউছিলাম, সেখানে এক করুন অবস্থা আমার গোচরীভুত হইলো। শুনশান বাড়ি, কারো মুখে কোনো কথা নাই। আমাকে দেখিয়া তাহার বৃদ্ধ মা এইবার একটি অশনি শংকেতের আভাস পাইলেন। ভাবিলেন, কি হইতে কি হইয়া যাইবে কিছুই বলা যাইতেছে না। আজিকার আকাশের মতো তাহার পরিবারে একটা ঝর বহিতেছে, তাহার মধ্যে আমি আবার টর্নেডোর মতো সেই সুদুর খুলনা হইতে আগমনে তাহার মনের অবস্থা আরো শঙ্গিত বলিয়া মনে হইলো। তিনি আমাকে একা ছাড়িতে চাহিলেন না তবে এইটুক ভরসা দিলেন যে, তিনি আমাকে অপছন্দ করেন না। তিনি আমার সাথে ঢাকা যাইবেন বলিয়া মনস্থির করিলেন। সাথে তাহার আরেক কন্যার স্বামী। নুরুজ্জামান সাহেব। 

আমরা তিনজন একসাথে মানিকগঞ্জ হইতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলাম বটে কিন্তু আমার মন আরো একটি দুশ্চিন্তা ভর করিতে লাগিলো। পকেটের অবস্থা। হরতালের কারনে, ঝড় বৃষ্টির কারনে ভাংগিয়া ভাংগিয়া যাতায়তের কারনে অনুমানের চেয়ে বেশী খরচ হইয়া আমার পকেটে খুব সামান্য কিছু টাকা অবশিষ্ট রহিয়াছে যাহা জরূরি কোনো অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই সাভার সেনানিবাসের কাছে আসিয়া আমি আমার ব্যাংক মেনেজারের কাছে দেখা করিলাম আর তাহারা বাহিরে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। যেহেতু আমার আসল কর্মস্থল সাভার সেনানিবাস, তাই ব্যাংক মেনেজার একটু সদয় হইয়া আমাকে প্রায় আরো চার পাচ হাজার টাকার উত্তোলন করিবার (ওডি হিসাবে) অনুমতি দিলেন। বড্ড কাজে লাগিলো আমার এই সাহাজ্যটা। আবার আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইয়া গেলাম। পথ যেনো শেষ হইতে চায় না। স্কুটারে করিয়া আমরা সাভার হইতে ঢাকায় যাচ্ছি। রাস্তাঘাটে খুব একটা গাড়ি চলাচল করিতেছে না, কিছু রিক্সা আর কিছু স্কুটার লইয়াই আজ রাস্তার সংসার। আমি যখন ঢাকারা বাসায় পউছিলাম, তখন বেলা দুপুর। আমার আগমন হয়ত তাহারা কেহ জানিতো না। তাই আমাকে দেখিয়া অনেকেই তেলেবেগুনে জলিয়া উঠিলো এবং আমার সাথে কেহই ভালো ব্যবহার করিবার কোন চেস্টাই করিলো না।

যাহারা যাহারা ওই বেদেশী বরের সাথে আমার ভালোবাসার মেয়ের সাথে সম্বন্ধ পাকাপোক্ত করিয়া মনের সুখে পান চিবাইতে চিবাইতে সময়টা পার করিতেছিলেন, আমার আগমনে তাহাদের সেই পানের স্বাদে যেনো একটু গন্ডোগোল পাকাইয়া দিলো। কেউ পানের পিক ফালাইবার জন্য বাহিরে গিয়া আর ফিরিয়া আসিলেন না, কেউ আবার গোদগোদ করিতে করিতে আমাকে কেনো এখনো এই বাড়ি হইতে বাহির করিয়া দেওয়া হইতেছে না তাহা লইয়া কানাঘোসা করিতেছিলো। আমি বাড়িতে ঢোকিয়াই প্রথম যে কাজটি করিলাম, আমি আমার ভালবাসার মানুস্টিকে খুজিয়া তাহার সহিত কথা বলিবার জন্য দেখা করিলাম। দেখিলাম, তাহার চোখজোড়া মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতো ফুলিয়া আছে, বুঝিলাম বাহিরের আকাশের সহিত পাল্লা দিয়া সেও সারারাত হয়তো চোখের জল ফেলিয়াছে। পরনে তাহার কত দিনের মলিন কাপড় বুঝা যাইতেছিলো সেই দিকে তাহার কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। আমাকে দেখিয়া সে যেনো এইবার বাধভাংগা নদীর মতো আমাকে সবার সামনে জরাইয়া ধরিয়া কাদিতে কাদিতে বলিলো, আমাকে এইখান হইতে অন্য কোথাও লইয়া চলো। ওরা আমাকে মারিয়া ফেলিতেছে। 

প্রায় দুইদিন না খাওয়ায় আমার শরীরের অবস্থা যেমন হইয়াছে, শুধুমাত্র মনের জোরে আমি টিকিয়া আছি। কিন্তু এই বাসায় আমার কোনো খাওয়া জুটিবে কিনা সেটা নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত নই তবে ভদ্রতা বলিয়া যদি কিছু থাকে তাহা হইলে হয়তো বা আমার কপালে কিছু খাবার জুটিবে, আর না জুটিলেও আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি এইখানে খাইতেও আসি নাই, আর কেউ আমাকে সম্মান করুক সেইটা নিয়েও আমি ব্যস্ত নই। আমার কাজ ভিন্ন আর সেইটা সাফল্য হইলেই আমি সার্থক। দুপুরের দিকে তাহার দুইভাই বাহির হইতে আসিয়া প্রথমেই একজন এই রকম উচ্চস্বরে কাকে যেনো উদ্দেশ্য করিয়া এমনভাবে চিৎকার করিতেছিলেন যে, তাহার সব কথাই আমার কানে আসিতেছিলো। সেই কথাগুলির সারমর্ম হইলো এই যে, কেনো আমাকে এখনো এই বাড়ি হইতে বাহির করিয়া দেওয়া হয় নাই। আমি অনেক ধৈর্য সহকারে সমস্ত কিছু গলাদকরন করিতেছিলাম। তাহাদের কোনো কথায়ই আমি বিচলিত ছিলাম না। একটু পর তাহার দুইভাই এবং এক ভাবি আমার সাথে কথা বলিবেন বলিয়া মনস্থির করিলেন। তাহাদের এই সিদ্ধান্তে উপস্থিত অনেকেই মনঃক্ষুণ্ণ হইতেছিলেন এবং তাহাদের সিদ্ধান্ত মানিয়া লইতে চাহিতেছিলেন না। কিন্তু আমাকে তো কিছু বলিয়া এই বাড়ি হইতে বিদায় করিতে হইবে। সুতরাং আমার সাথে কথা না বলিবার আর কোনো অবকাশ রহিলো না। ফলে যাহারা যাহারা এই সিদ্ধান্তে নারাজ ছিলেন, তাহারা একে একে বাড়ি ত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিলেন। আমি তাহার দুই ভাই আর এক ভাবীর সামনে বসিয়া কথা আরম্ভ করিলাম।  

আজো আমার ওই কথাগুলি স্পষ্ট ভাবে মনে আছে। তাহা একেবারেই যেনো নিম্ন্রুপঃ

– ভাবী বলিলেন, দেখেন, আমাদের মেয়ের একটা ভালো সম্বন্ধ আসিয়াছে, ছেলে আমেরিকায় থাকে, অত্যান্ত ভালো পরিবার। আমরা আমাদের মেয়েকে ওই ছেলের সাথেই পাকাপাকি বিয়ার প্রস্তাব দিয়া দিয়াছি। আপনি অহেতুক গোল পাকাইয়া আমাদের মেয়ের জীবন নষ্ট করিবেন না। আমরা আপনার সাথে মেয়েকে বিবাহ দিতে পারিবো না। – আমার উত্তর ছিলো খুব সোজা। আমি বলিলাম, তাহা হইলে আমি যে মাঝে মাঝে আপনাদের মানিকগঞ্জের বাসায় সবার সাথে কয়েকবার ভর মজলিশে দেখা করিয়াছি, একসাথে বসিয়া খাওয়া দাওয়াও করিয়াছি, তখন কেনো আমাকে বারন করিলন না যে, ইহা আপনাদের পছন্দ নয়। আমার আর আগনোর প্রয়জন নাই?

– এই প্রশ্নে ভাবি বলিলেন, দেখেন আমরা জানি আপনার সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী আপনাকে বিবাহ করিতে আরো তিন থেকে চার বছর বাকী। এতো লম্বা সময়ে আমরা কেহই ভবিষ্যৎ বলিতে পারি না। কি এমন গ্যারান্টি আছে যে, আপনি এই কয়েক বছরে পরিবর্তন হইয়া যাইবেন না? তখন না আপনি আমাদের মেয়েকে আর পছন্দ করিবেন না আমরা আবার এই রকমের এক্তা সুপাত্র পাইবো সেইটারও কোনো গ্যারান্টি নাই। আমরা মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করিয়া আজ এইরুপ সিদ্ধান্ত লইয়াছি যে, আমরা ওই বিদেশী প্রবাশির সাথেই মেয়েকে বিবাহ দিবো।

– আমি গনক নই যে, ইহা বলিতে পারি যে, আগামি তিন চার বছর আমি বাচিয়াই থাকিবো কিনা। তবে আমি আমাকে চিনি, আমার উপর আপ্নারা ভরসা করিতে পারেন। আমি কথা দিতেছি যে, আমার অফিশিয়াল বিয়ের বয়স যেদিন হইবে তার থেকে এক মুহূর্তও দেরী করিবো না বিবাহের।

– ভাবী মানিলেন না।

আমি আবার বলিতে থাকিলাম যে, যদি এই বিস্তর সময় আমাকে আপ্নারা ভরসা করিতে না পারেন, তাহা হইলে আমাকে অন্তত আরো একমাস সময় দিন, আমি বর্তমানে খুলনায় একটা সেনা কোর্সে আছি,তাহা শেষ করি, ঢাকায় ফিরে আসি, আমি আমার নিজের সব গার্জিয়ানদের নিয়ে ঘটা করিয়া বিবাহ করিবো। হয়ত আমি সেইটা সেনাবাহিনীকে জানাইবো না কারন সেনাবাহিনী আমাকে তিন চার বছর আগে বিবাহ করিবার অনুমতি প্রদান করিবে না।

– তাহারা তাহাতেও তাহারা রাজী হইলেন না।

-আমি এবার সমস্ত সিদ্ধান্ত নিজের তরফ হইতে লইয়া লইলাম যে, যদি আপনাদের কোনো অপশনেই আমার উপর ভরসা করিতে না পারেন, তাহা হইলে আজি এক্ষুনী কাজীকে তলব করেন, আমি এই আজকের দিনেই আপনাদের মেয়েকে বিবাহ করিবো। এইবার তো আর কোনো যুক্তি তাহাদের খাটিল না। সিদ্ধান্ত হইয়া গেলো, আজই আমাদের বিবাহ হইবে। আমি বৈঠক হইতে উঠিয়া গিয়া আমার ভালোবাসাকে জানাইয়া দিলাম, আজ আমাদের বিয়া। আমি বলিলাম, চলো আমরা বাহির থেকে একটু ঘুরিয়া আসি, চা খাইয়া আসি, মুক্ত বাতাশে একটু দম লইয়া আসি। আমি আর সে দুইজনে আশেপাশেই একটি চায়ের দোকানে ঢোকিয়া চা খাইতে বসিলাম।অত্যান্ত নীচু মানের একটি চায়ের দোকান কিন্তু সেইটা আমাদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়। আমরা দুইজনে এখন একটু মুক্ত বাতাসে দম লইতে আসিয়াছি। সারাদিন ধকল গিয়াছে। আমরা চুপচাপ চা পান করিতেছি।

তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। খুব একটা লোকজন দোকানে নাই। হয়তো আমি আর ও। দোকানের মালিক আমাদেরকে হয়তো বারবার লক্ষ্য করিতেছিলেন। আমরা চা পান করছি ঠিকই কিন্তু আমাদের মধ্যে না আছে কোনো উচ্ছাস না আছে কোনো আবেগ। বিল দিতে গেলাম, দোকানি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করিলেন, "আমরা একে অপরের কি হই?"

বললাম, আজ আমাদের বিয়ে।

দোকানি এতোটাই হতবাক হইলেন যে, তিনি আর কোনো কথা বলতে পারিলেন না। শুধু বলিলেন, আমি অবাক হইতেছি যে, আপনাদের দেখিয়া কোনো বস্তির লোক বলিয়া মনে হইতেছে না, অথচ আপা খালি পায়ে এই দোকানে চা খাইতে আসিয়াছেন, আবার আপ্নারা যেনো কোনো কথাই কেউ কাহারো সাথে বলিতেছেন না। আমি বুঝতে পারিতেছি, আপ্নারা কোনো একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়া পার হইতেছেন। আমি দোয়া করি আপ্নারা সুখী হোন আর আজ আমি আপনাদের কাছ হইতে কোনো বিল নিতে চাই না। তিনি আমাদেরকে অনেক দোয়া করিলেন।

বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। দেখিলাম, কয়েকটি মুরগী কেনা হইয়াছে, কিন্তু কাটিবার লোক নাই, কিছু পোলাও হয়তো পাকানো হইবে, কিন্তু কে রান্না করিবে? একটু পরেই কাজী হয়তো আসিয়া পড়িবেন। মেয়ের মেঝো ভাই তাহার বোনের জন্য একটা শাড়ি, হয়তো কিছু কস্মেটিক্স কিনিতে বাহিরে চলিয়া গিয়াছেন। কনে কিছু না ভাবিয়া রান্না করিবার জন্য রান্না ঘরে চলিয়া গেলো। নিজের বিয়ে, নিজে রান্না করিবে, তারপর হয়তো একটু হাত মুখ ধুইয়া সাজোগূজো করিবে, তাহার পর আমাদের বিয়ে হইয়া যাইবে। লিলি নামের একজন মেয়ে যিনি কনের সমবয়সী, সে আসিয়া কনেকে রান্না বান্নায় একটু সাহাজ্য করিলো, অতঃপর সে তাহাকে হাতে মেহেন্দি আর মাথায় কিছু সাদা সাদা ফোটা দিয়া কোনো রকমে কনে সাজাইয়া ঘরের মধ্যে বসাইয়া দিলো। কাজী আসিলেন, কত টাকা কাবিন হইবে আমাকে জিজ্ঞেস করিলেন। আমি শুধু বলিলাম, এক টাকা হইতে আরম্ভ করিয়া শত কোটি টাকার যে কোনো একটি অংক যাহা তাহাদের মন কে শান্ততা দেয় তাহাই যেনো লিখিয়া লয়, তাহাতে আমার কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু কাবিনের খরচ দিবার মতো আমার কাছে কোন টাকা নাই। আর যদি কেহ আমাকে ওই কাবিনের খরচের সমপরিমান টাকা ধার দিতে চায়, দিতে পারে আমি পরে শোধ করিয়া দেবো।

অবশেষে তাহারা দশ লাখ টাকার কাবিনে বিবাহ হইবে বলিয়া মনস্থির করিলেন। কনের বিয়ের কাপড়, সাজ সরঞ্জামাদি, আলতা, কস্মেটিক্স এইসব নাকি বরের বাড়ি হইতেই দেওয়া হয়। তাই নিয়ম পালনের জন্য তাহারা আমাকে খরচের কথা বলিলে আমি বলিলাম, কিছুই আমার দেওয়ার মতো এখন সামর্থ্য নাই। এক কাপড়ে বিয়া হইলেও আমার কোনো আপত্তি নাই। তাহার পরেও বিয়া বলিয়া কথা। কনের বড় ভাই তাহার নিজের পকেটের টাকা খরচ করিয়াই মোট ৪৭২০ টাকায় সব কিনিয়া আনিলেন। আমার বিয়ের বাজেট এইটাই। ৪৭২০ টাকা। আজো আমার কাছে ওই রশিদটা সংরিক্ষিত আছে। ইহা একটি বিবাহের দলিল।

কাজী আসিলেন। বরের পক্ষ হইতে কে আসিয়াছে তাহা জিজ্ঞেস করিতেই আমি বলিলাম, -আমিই বর, আমিই বরের পিতা, আমিই বরের মাতা, আমিই বরের ভাইবোন এবং বরের সব। ইহা শুনিয়া কাজী আর কিছুই বলিলেন না। শুধু বলিলেন, অনেক বিবাহ করিয়েছি। কিছু গোপনে, কিছু কোর্ট ম্যারেজ হিসাবে, কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে। কিন্তু আজ দেখিলাম ইহা না প্রাইতিস্টহানিক না গোপন, না কোর্ট ম্যারেজ। ইহা একটি ওপেন প্রাতিষ্ঠানিক কোর্ট ম্যারেজের মতো যাহা আমার জীবনেও এক্টা ইতিহাস হইয়া রহিলো। আপ্নারা সুখী হোন।

আমাদের বিবাহ হইয়া গেলো। আজ ৩০ শে মে ১৯৮৮ সাল। 

৩০/০৪/১৯৮৮-খুলনায় ওএমটি কোর্স

গিলাতলা, খুলনা।

খুলনায় এলাম ওএমটি কোর্স করতে। এটা বেসিক্যালি গাড়ির কোর্স। ড্রাইভিং, রক্ষনাবেক্ষন, ইত্যাদি। সবই গাড়ি রিলেটেড। এ এস সি সেন্ট্রা এন্ড স্কুলে হয় এটা। অনেকগুলু কোর্সম্যাট। লেঃ আলমাস (আর্টিলারী), লেঃ সাকির, লেঃ আসফাক (ইষ্ট বেঙ্গল), লেঃ এনাম (সিগন্যাল), লেঃ সাইফ (ইষ্ট বেঙ্গল), আমি, লেঃ তোহা (১২ লং ইষ্ট বেঙ্গল), ৯ লং কোর্সের লেঃ জাহিদ স্যার এবং আরও অনেকে। কখনো খুলনায় এর আগে আসিনি। প্রায় মাস তিনেক থাকব। মেজর মোশাররফ স্যার আমাদের কোর্স ওআইসি। ক্যা; রেজা কোর্স কোর্ডিনেটর। এখানে সেনানীবাসটি খুব সুন্দর। খুলনা শহর থেকে বেশ দূরে। পাশ দিয়ে হাইওয়ে চলে গেছে। একদিকে একাডেমিক ভবনসমুহ, অফিসার মেস, আর রাস্তার উত্তর দিকে বিশাল ট্রেনিং গ্রাউন্ড। একটা জু আছে। ঘোড়া আছে আস্তাবলে অনেকগুলি। এখানকার কমান্ডেন্ট ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রব। শুনেছি ওনার বাড়ি নাকি আমাদের কেরানিগঞ্জে। খুলনায় ওএমটি (অফিসার্স মেকানিক্যাল এন্ড ট্রান্সপোর্ট কোর্স) কোর্সে আসার একটা মজার কাহিনি আছে। কাহিনীটা আর যাই হোক, আমার কাছে বেশ হাস্যকর মনে হয়েছে। তবে ঘটনাটা একটু খুলেই বলি।

আমার সিও হচ্ছেন কর্নেল খাইরল আলম (৪১ তম পাকিস্থানি ব্যাচ), অনেক সিনিওর মানুষ কিন্তু সোজা সাপটা এবং বেশী জ্ঞ্যান রাখেন বলে আমার কাছে মনে হয় নাই। আমাদের যে টুআইসি (মেজর রফিকুল হাসান), সে সিও সাহেবকে কাবু করতে বেশিক্ষন সময় নেয় না। যেহেতু সিও সাহেবের জ্ঞ্যানের একটু আধটু ঘাটতি আছে, সেহেতু টুআইসিকে সিও সাহেব জমা দিয়েই চলেন। আর সেই সুবাধে, টুআইসি সাহেব মাঝে মধ্যে সিও সাহেবের থেকে এক্ত বেশী স্মার্ট ভাব নিয়ে অন্যান্য অফিসারদের উপর খরগ চালাতে দ্বিধাবোধ করেন না। আমার আবার এই একটা জায়গায় মানতে অসুবিধা। ইউনিটে অনেকগুলু গুড়া গাড়া অফিসার আছি (আমি, ৮ লং কোর্সের সাহাব স্যার, অনেক সিনিওর মেজর সওকাত স্যার, খলিল স্যার, সালেহ স্যার, এহসান, মুনির, ওমর আর অনেকে)। শওকাত স্যার আর খলিল স্যার আবার কোর্স ম্যাট। সালেহ স্যার আবার অনেক ভাল জায়গা থেকে পোস্টিং এসেছেন, সুতারং এদেরকে স্পর্শ করা আমাদের সিও অথবা টু আই সি সাহেবের মুরুধ কম। সব পাঠার বলি আমরা যারা জুনিয়র। ঠেলা সামলাও।