1993-1997
২৯/১১/১৯৯৭-ষ্টাফ কলেজ থেকে ভারত ভ্রমন
Categories
গত ২৩/১১/১৯৯৭ থেকে ছয় দিনের শিক্ষা সফরে মীরপুর ষ্টাফ কলেজ থেকে দেশী-বিদেশী ছাত্রদের নিয়ে আমরা পাশের দেশ ভারতে গিয়েছিলাম। আমাদের ষ্টাফ কলেজের ব্যাচে প্রায় শতাধিক ছাত্র বিধায় ছাত্রদেরকে তিনটি গ্রুপ করে ভাগ করা হয়েছে। কেউ কেউ ভারত, কেউ কেউ শ্রীলংকা আবার কেউ কেউ নেপাল। এটাই ষ্টাফ কলেজ থেকে প্রথম শিক্ষা সফর দেশের বাইরে। আর এটা এ বছরই চালু হলো। আমি ভারতে যাওয়ার চয়েজ দিয়েছিলাম। সে মোতাবেক গত ২৩ নভেম্বরে আমরা প্রায় ৩৭ জন স্টুডেন্ট ভারতের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করলাম। আমাদের সাথে আছেন ডিএস (ডাইরেক্টিং ষ্টাফ) লেঃ কর্নেল শফিক, লেঃ কর্নেল তানভীর, চীফ ইন্সট্রাকটর কর্নেল জহির, চীফ ইন্সট্রাকটর মইন ইউ আহমেদ এবং আরো কিছু। আমাদের শিক্ষা সফরটা একটা ডিপ্লোমেটিক ভিজিট হিসাবে গন্য ছিলো। আগে থেকে আমাদের বেশ কিছু অফিশিয়াল ভিজিট কনফার্ম করা ছিলো।
আমরা সকাল বেলায় যার যার ব্যাগ পেটরা নিয়ে জিয়া ইন্টার ন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম। ষ্টাফ কলেজ থেকে বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। ভারতে এটাই আমার প্রথম ভ্রমন। ভারতে গন্ডোগোল চলছে। বেশ ভালই গন্ডোগোল। কিন্তু তাতে আমরা শংকিত নই। আমাদেরকে প্রোটেকশন দেয়া ভারত সরকারের দায়িত্ত। আমরা কলকাতার গ্রান্ড হোটেল "হোটেল ইন" এ সবাই উঠেছি। কলকাতার পরিবেশ মূটামূটি ভালো। শান্ত। একটা জিনিষ খেয়াল করলাম যে, কলকাতা আর আমাদের ঢাকার গুলিস্থানের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নাই। সব জায়গায় বাংলা কথা বলার লোক। খায়ও বাংগালীদের মতো ডাল ভাত। তবে এখানে ঢোশাটা বেশ জনপ্রিয়। আমাদের হোটেলের পাশেই একটা সিনেমা হল আছে। ওখানে "দিল তো পাগল হ্যা" ছবিটি মাত্র রিলিজ হয়েছে। ৮ম লং কোর্ষের মেজর মোর্শেদ স্যার আমাদের স্টুডেন্ট কোঅর্ডিনেটরের কাজ করছেন। তাকে সাহাজ্য করছেন ৯ম লং কোর্ষের মেজর হক স্যার। কঠিন লোক বটে। সন্ধ্যা হতে না হতেই ডাক পড়লো যে, রাত আটটায় আমরা ইন্ডিয়ার ডিফেন্স এটাচির আমন্ত্রনে তার অফিশিয়াল বাসভবনে যেতে হবে। ড্রেস হবে সিরিমনিয়াল। মানে এসডি (সার্ভিস ড্রেস)। তড়িঘড়ি করে রেডি হতে হলো। বেশী দূর নয়, মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। পড়ে বুঝলাম, আসলে এটা ডিফেন্স এটাচির বাসা নয়, এটা এয়ারফোর্সের একটা মেস।
পৃথিবীর সকল আর্মির আস্তানাগুলি প্রায় একই ড্রিল অনুসরন করে। মেস ওয়েটারগন আমাদের দেশের মেস ওয়েটারদের মতোই ড্রেস আপ করা, মেসগুলিও প্রায় একই প্যাটার্নের, কালচার বা প্রাকটিসও তাই। ইন্ডিয়ার বেশ কিছু হাই অফিশিয়াল আমাদের উদ্ধ্যশ্যে কিছু কথা বললেন বটে কিন্তু কি বললেন, ভালো মতো বুঝাও গেলো না। আমরা অনেকেই যার যার গল্পে মশগুল ছিলাম। এরমধ্যে ধীরে ধীরে খাবার আসতে লাগলো, সফট ড্রিংক্স, হট ড্রিংক্স, সবই ছিলো। যে যার মতো যা খুশি খেতে পারেন। কোনো বাধা নাই। এর মধ্যে একজন মেস ওয়েটারের সাথে কথা হলো, নাম, জামিলুর। তার বাড়ি বাংলাদেশের চাপাইনবাবগঞ্জে। সে নাকি আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে তার বাবার সাথে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছিলো, আর বাংলাদেশে যায় নাই। এখন সে এয়ারফোর্স মেসে মেস ওয়েটারের কাজ করে। বাংলাদেশী কিছু অফিসার বেড়াতে এসেছে এখানে, তাতেই তার অনেক আনন্দ। যেনো বাড়ির মেহমান এসেছে বহুদিন পর।
রাতে ডিনার শেষ হলো। অনেক অফিসাররা ফ্রিতে বিয়ার আর মদ পেয়ে নাক ডুবিয়ে যেনো খেয়েই যাচ্ছিলো। রাত প্রায় সারে দশটায় আমাদের অনুষ্ঠান শেষ হলো। ফিরে এলাম হোটেলে। আমি, মেজর আকবর, মেজর আফতাব আর নাইজেরিয়ার মেজর লালা একরুমে থাকি। হটাত দেখি, কিছু অফিসার এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছেন। জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপারটা কি? পড়ে শুনলাম, কিছু অফিসাররা পাশের সিনেমা হলে 'দিল তো পাগল হায়" দেখার জন্যে যাচ্ছেন। এতো রাতে আবার সিনেমা? যাক, অসুবিধা নাই। আমি আর গেলাম না। তার কিছুক্ষন পর আবার একটা কেওয়াস শুনলাম। অফিসাররা সিনেমা হলে গিয়ে গেঞ্জাম করেছেন। কারন ইতিমধ্যে হলে সিনেমা শুরু হয়ে গিয়েছিলো, আবার কোনো সিটও খালি ছিলো না। তারা অনেকটা মাতাল অবস্থাতেই সিনেমা হলের ম্যানেজারকে জোর জবরদস্তি করে হলে ঢোকে সিনেমা দেখবেনই এই রকমের নাকি একটা আচরন করেছেন, যা অফিশিয়াল অভিযোগ হিসাবে ইতিমধ্যে দাখিল হওয়াতে বাংলাদেশের একজন দুতাবাসের কর্মকর্তা (নাম মেজর ফজলে আকবর) মধ্যস্ততা করে ব্যাপারটা মিটিয়ে দিয়েছেন। খুব দুক্ষজনক ব্যাপারটা। নতুন আদেশ জারী হলো যে, কোর্স ডিএস এর অনুমতি ছাড়া কেউ অযথা বাইরে যেতে পারবেন না। কিন্তু কেউ কি কারো কথা শুনে?
পরেরদিন আমাদের ভিজিট ছিলো ফোর্ট উইউলিয়াম দুর্গে। সকাল ১১ টায় সেখানে যেতে হবে। আমরা তার আগেই সেখানে পৌঁছে গেলাম। আগে অনেক নাম শুনেছি। কিন্তু এবার দেখলাম দূর্গ কি জিনিষ। চারিপাশ প্রায় ২০/২৫ ফুট উচু দেয়াল ঘেরা এবং দেয়ালের প্রশস্থতা প্রায় ৩০/৪০ ফুট। যার দ্বারা প্রচুর গাড়ি ঘোড়া চলে। ভিতরে দালান কোঠা সেই ব্রিটিশ আমলের। একেকটা বিল্ডিং এর উচ্চতা প্রায় ২০ ফুটের মতো। ফ্যানগুলি অনেক লম্বা লম্বা ডান্ডা দিয়ে ঝুলানো। প্রচুর গাছপালা। কমান্ডার ইন চীফ এলেন প্রায় একটার দিকে। নিজে আর তার এডিসি। কোনো ড্রাইভার দেখলাম না। তার নিজের গাড়িতেই স্টার আছে, সাথে আছে এম্বুলেন্সের মতো হর্ন। এডিসি গাড়ি ড্রাইভ করে এলেন, আর সেকেন্ড সিটার হলেন কমান্ডার। শীখ মানুষ। বেশ ফর্সা। অদ্ভুদ লাগলো ব্যাপারটা। আমাদের দেশে হলে গাড়ির বহরে আর এমপির গাড়ির ঠেলায় ভীর লেগে যেতো, কিন্তু এতো বড় অফিসার এলেন তাও আবার মাত্র এডিসি আর তিনি নিজে। ড্রাইভার ও নাই। ঘুরে ঘুরে বিল্ডিংগুলি আর আশপাশ দেখছিলাম। অফিসারদের থাকার জায়গাগুলিও বেশ অদ্ভুদ। এখানে যিনি ইনচার্জ, তার কোনো এসি রুম নাই। তবে গরমের দিনে যেনো পরিবেশ ঠান্ডা থাকে তার জন্য এক ধরনের পানির পাইপের মাধ্যমে সারাক্ষন পানির সঞ্চালন করে থাকে, তাতে বাতাস ঠান্ডা থাকে। আর আমাদের দেশ হলে তো এসির কারনেই পরিবেশ গরম হয়ে যেতো যদিও কমান্ডার নিজে ঠান্দায় থাকতেন। ইন্ডিয়া কেনো বড় হবে না? তাদের প্রতিটি কাজের মধ্যে ইকোনোমিক্যাল একটা বাজেট থাকে। এই যেমন কমান্ডার যখন এলেন, তিনি ইন্ডিয়ায় তৈরী মার্সিডিস গাড়িই নিয়ে এলেন। সেটা আবার এসি করা নয়। আর আমাদের দেশে তো জাপানিজ এসি গাড়ি না হলেই তার মান সম্মান থাকে না।
৩য় দিনে আমাদের যাওয়ার কথা দিল্লী। কিন্তু ভারত জুড়ে এতো গন্দগোল যে, আমরা যাবো কিভাবে সেটাই এখন বড় ধরনের প্রশ্ন হয়ে দাড়িয়েছে। বিজেপি, এক ধরনের বক্তব্য, কংগ্রেস আরেক ধরনের পালটাপাল্টি বক্তব্য এবং রামাবাই কিলিং নিয়ে অনেক বিতর্কিত আলোচনা টিভি জুড়ে চলছেই। আমাদের যাওয়ার কথা ছিল এয়ারপোর্ট হয়ে দিল্লিতে কিন্তু একেক বার একেক সংবাদ আসায় আমাদের মুড অফ জার্নি নিয়ে একটা অচলবস্থা তৈরী হলো। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো যে, আমরা বাসে করে কলকাতা থেকে দিল্লী যাবো। প্রায় ২২ ঘন্তার জার্নি। কলকাতা থেকে আমরা বাসে করে দিল্লী রওয়ানা হলাম। রাস্তা বেশ ভালো কিন্তু বেশ ফাকাও। আমাদের প্রোটেকসনের জন্য ইন্ডিয়ান আর্মির স্কট ছিলো, আর ছিলো হেলিকপ্টার দিয়ে আকাশ পথে টহলের ব্যবস্থা। প্রায় সন্ধ্যার দিকে দিল্লীতে পৌঁছলাম। হোটেল "সেরেনা" তে আমাদের থাকার জায়গা।
দিল্লীর শহর আসলেই আধুনিক একটা শহর। লাইফ যথেষ্ট পরিমান ফাষ্ট। দিল্লীতে ডিফেন্স মিনিশট্রি থেকে আমাদের জন্য একটা ভিজিট রেখেছেন। তাদের ডিফেন্স মিনিশট্রারের প্রতিনিধি আমাদের ব্রিফ করবেন। আমাদেরকে ডেকে আমাদের ডিএস জানালেন, আমরা যেনো কোন সেনসেটিভ প্রশ্ন না করি। এখানে আমরা ডিপ্লোমেটিক আলোচনায় আসিনি, তাই এমন কোনো প্রশ্ন যেনো আমরা না করি যাতে পরিবেশ অন্যদিকে টার্ন নেয়। কিন্তু কাজের বেলায় ঠিক সে রকম হয় নাই। মেজর হক স্যার এমন এক প্রশ্ন করে বসলেন, যা কিনা বেশ ভালই বিতর্কের জোগান দেয়। সেটা আর এখানে নাইবা বললাম। পড়ে এক সময় আবার বলা যাবে। আমরা দিল্লী ঘুরে বেড়ালাম। "ভাই" টেমপলে গেলাম। জায়গাটা বেশ সুন্দর। "ভাই টেমপল"টা হচ্ছে তিন ধর্মের জন্য একটা কমন প্রার্থনার স্থান। অদ্ভুত কন্সেপ্ট। এটা নাকি সম্রাট আকবরের সময় করা। ইন্ডিয়া গেট দেখলাম। এই জায়গায় ইন্ডিয়ার সব রাজনৈতিক নেতাদের বসবাস।
দিল্লী থেকে আমরা পরের দুপুরে আগ্রায় গেলাম। আগ্রায় "আকবরিয়া" হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা যখন বাস থেকে নামলাম, তখন একদল বাদ্যবাদক ড্রাম, পাইপার বাজিয়ে আমাদেরকে অভিবাধন জানালেন। দেখলাম, হোটেলের ঠিক সামনেই বিশাল করে ফুল আর ফুলের পাপড়ি দিয়ে ওয়েলকাম বাংলাদেশ লেখা। ভালো লাগলো। আমাদের বাক্সপেটরা নিয়ে গেলেন হোটেলের কর্মচারীরা। আসলে এটা ছিলো সম্রাট আকবরের নিজস্ব প্যালেস। এই প্রথম আমার জিবনে কোনো প্যালেসে রাত্রিজাপন করবো।
সম্রাট আকবরের প্যালেসটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বিশাল বিশাল রুম। খুবই সুন্দর। আমাদের আসার কারনে এখানে কোন গেষ্ট এলাউ করেনি সরকার। মানে শুধু আমরাই থাকবো এখানে দুই দিন আর এক রাত। আমরা জমায়েত হলাম সম্রাট আকবরের খাস কামরা সেটা ছিলো সেখানে। গিয়ে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। ওখানে যে ঝাড় বাতিটা আছে সেটার সাইজ প্রায় ডাবল রুমেরও বড়। আর এটার যে ডান্ডাটা সেটা একটা বিশাল পিলারের সমান। এই খাস কামরার যাওয়ার পর যেটা দেখালাম, এর পাশ দিয়ে একটা বেশ চওড়া রাস্তা গেছে, যার হাইট একটা লম্বা মানুষের সমান উচ্চতা। জিজ্ঞেস করলাম, এই রাস্তাটা কেনো যেখানে আরো রাস্তা বা প্রবেশ দ্বার আছে? আমাদের যে গাইড ছিলেন, তিনি বললেন যে, সম্রাট যখন হেরেমে বসতেন, তখন কোনো কারনে যদি তার রানী এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয় তাহলে এই হেরেম খানায় কি ঘটছে সেটা যেনো তার নজরে না আসে, সেই জন্য শুধুমাত্র রানির ব্যবহারের জন্য এই উচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা রাস্তাটা তৈরী। বুঝলাম, এমনি এম্নিতেই তো আর আকবর সাহেব সম্রাট হন নাই।রাতেই আগ্রার অনেক জায়গা ঘুরলাম। কিন্তু বেশী রাত হয়ে যাচ্ছে বলে বেশী দূর যাওয়া হচ্ছিলো না। রাতেই আবার আকবরিয়ায় ফিরে এলাম। আগামীকাল গাইড আমাদেরকে তাজমহল এবং আগ্রার আরো কিছু জায়গা আমাদের দেখাবেন। সকালেই আমাদের ভিজিট শুরু হবে। প্রথমে তাজমহল দিয়ে।
২৬/১১/১৯৯৭- কুতুব মিনার ভিজিট
দিল্লিতে থাকাকালে আমাদের সাথে থাকা গাইড কুতুব মিনার নিয়ে গিয়েছিলেন। লাল বেলে পাথরে তৈরী এই মিনারটি ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেকের আদেশে কুতুব মিনারের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে, তবে মিনারের উপরের তলাগুলোর কাজ সম্পূর্ণ করেন ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। প্রখ্যাত সুফি কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। কুতুব মিনার দেখার সময় আমাদের পাশেই একদল ছাত্রদের নিয়ে কিছু ভারতীয় টিচার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কুতুব মিনারের ইতিহাস বুঝাচ্ছিলেন। আমরাও তার কিছু কিছু তথ্য বিভ্রাটে ছিলাম। আমার মনে হলো যে, ঐ টিচাএ এই ভারতীয় ছাত্রদেরকে কুতুব মিনারের আসল সত্যটা না বলে এমন কিছু মন গড়া তথ্য দিচ্ছিলেন, যা কিনা কুতুব মিনারের নামে নেগেটিভ ভাব প্রকাশ পায়। আমরা কিছু বলি নাই কারন ইতিহাস তার নিজের ধারায় উম্মোচিত হয়। তবে কুতুব মিনারের ভঙ্গুর দশা দেখে আমার কাছে মনে হলো, এক সময় এই কুতুব মিনারটির আর কোনো অস্থিত্ত হয়তো থাকবে না।
২৬/১১/১৯৯৭- সম্রাট আকবর প্যালেস।
উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব
নভেম্বর
২৬
সম্রাট আকবরের প্যালেসে আমরা যখন পৌছাই তখন বেলা প্রায় ১২টা বাজে। সম্রাট আকবরের প্যালেসে ঢোকার সময়েই একটা হলঘর আছে যার মধ্যে আছে একটা ঝাড়বাতি। বিশাল বড়। এতো বড় ঝাড়বাতি আমি কখনো দেখিও নাই, আর কেউ কখনো বানিয়েছে কিনা আমার জানাও নাই। এই হল ঘরেই সম্রাট তার সহচরীদের নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করতেন। এখানে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে, আমরা যেখানে যেখানে ভিজিটে যাচ্ছি, সেখানে সেখানেই সেদিন অন্য কোনো আউট সাইডার ভিজিটর এলাউ ছিল না। ফলে আমরাই গাইডের সাহাজ্যে খুব নিরিবিলিতে পুরু জিনিষগুলি দেখার সুযোগ পাচ্ছিলাম, কোনো কোলাহল ছিলো না, কোনো ভীড়ও ছিলো না।
যাই হোক, সম্রাট আকবরের প্যালেসে এসে বেশ কিছু অটোমেটিক নিরাপদ বলয়ের ব্যবস্থা সম্রাটগন আগে থেকেই করে রেখেছেন। সেটা দেখলাম। যেমন-
(১) আগেকার দিনে সব সম্রাটগনই তাদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য, প্রতিটি মেইন গেট এমনভাবে তৈয়ার করেছেন যে, কোনো অতর্কিত হামলায় যেনো বেশ কিছু সময় পাওয়া যায়, এই ব্যবস্থাগুলি করা। আগেকার দিনে হাতী ছিলো শক্তির একটা প্রতিক। যখন কোনো বহির্গমন শত্রু হামলা করতে আসতো, তারা হাতীর ব্যবহার বেশী করতেন। তার সাথে করতেন ঘোড়ার ব্যবহার। হাতী এবং ঘোড়া যখন তার সমস্ত শরীর দিয়ে কোনো একটা বাধা ধাক্কা দিতে চায়, সেক্ষেত্রে তাকে একটা গতির মোমেন্টাম তৈরী করতে হয়। সম্রাটগন এই অংকটা জানতেন। তাই তাদের বাসস্থান এমন একটা উচু জায়গায় করতেন যার উচ্চতা স্বাভাবিক উচ্চতার থেকে প্রায় ১০০ /১৫০ ফুট উপরে। আর এই ১০০/১৫০ ফুট উপরে উঠতে কয়েক ধাপে ঢালুর ব্যবস্থা থাকতো। এই ঢালুগুলি এই রকম করে ঝিকজ্যাক করে তৈরী করা যাতে বাক থাকে, আর প্রতিটি বাক একেবারে ৯০ ডিগ্রী বাকানো। যাতে হাতি বা ঘোড়া কিছুদুর গিয়ে তাকে পুরুপুরি ৯০ ডিগ্রী ঘুরতে হয় এবং সে আবার শুন্য গতিতে চলে আসে। তাতে হাতী বা ঘোড়ার শক্তিও শুন্য হয়ে যায়। ফলে সম্রাট শাহজাহানের প্যালেসে কিংবা সমারট আকবরের প্যালেসে ঢোকতেও ঠিক এই রকমের কিছু প্রতিবন্ধকতা দিয়েই প্রবেশ পথ সুরক্ষিত। এইরকম প্রায় ৫ থেকে ৬টা বাক আছে, আর প্রবেশ পথগুলি একেবারেই মসৃণ নয়। হাতী বা ঘোরা এই অমসৃণ পথে চলতে তাদের পায়ে ব্যথা অনুভব করতো, ফলে পায়ে ব্যাথা পাবার কারনেও হাতী বা ঘোড়া সঠিক গতিতে আসতে পারতো না। এবড়ো থেবড়ো কংক্রিটের রাস্তা। আমরাই স্বাভাবিক জুতা নিয়ে ঐ রাস্তায় হাটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। প্রতিটা রাস্তার দুই ধারে আবার ছোট ছোট পটহোল আছে, যেখানে সেন্ট্রিরা রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো যাতে কোনো শত্রু ঢোকতে গেলে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মারা যায়।
(২) আমরা উঠে গেলাম সম্রাটের বাসভবনে। উঠেই দেখি, আরেক জগত। বিশাল চত্তর, চারিদিকে গাছগাছালীতে ভরা। একটা মালভূমির মতো। ঠিক মাঝখানে একটা পিতলের বিশাল বড় কলসি। এই কলসীটা এতো বড় যে, অনায়াসে ১০ বারো জন মানুষ এর মধ্যে খেলা করতে পারে। গাইড জানালো যে, শীতের দিনে সম্রাট এই কলসীতে পানি ভরে রাখতেন, সুর্যের তাপে এই পানি গরম হতো, আর রানী তার সহচরীদেরকে নিয়ে এই গরম পানিতে জলকেলি করতেন আর স্নান করতেন। রানী বলে কথা। তখন আমরা প্রশ্ন করলাম, তাহলে গরমের দিনে রানী কিভাবে ঠাণ্ডা জলে স্নান করতেন? গাইড জানালো, আমরা ওইটাও দেখবো কিভাবে সম্রাট রানীর জন্য ঠাণ্ডা জলের ব্যবস্থা করেছিলেন। রানী যেখানে স্নান করতেন, সেখানে কোনো সরাসরি প্রহরী নিয়োগ থাকতো না যাতে তারা দেখতে পায় রানীর গোসল বা জলকেলী। কিন্তু এলাকাটা এমনভাবে ঘেরাও করা যে, বাইরের থেকে কোনো বিপদের সম্ভাবনা নাই। সেভাবেই আউটার চত্তরে গার্ড নিয়োগ করা আছে। যাও আবার গার্ড, তারা আবার নপুংসক সব গার্ড। যাতে কেউ যদি শারীরিকভাবে উত্তেজিত হয়েও যায়, তাতে কোনো সক্ষম পুরুষ রানী কিংবা রানীরে দলবলের কোন ক্ষতির আশংকা না থাকে। শুধু এটাই শেষ নয়। কোনো কারনে যদি বৃষ্টি হয়, ঝড়ো পরিবেশ থাকে অথচ রানী গরম জলেই নিরাপদে অন্যত্র স্নান করতে পারেন, তারও ব্যবস্থা সম্রাট করে রেখেছিলেন। আরেকটি কামরা আছে যেখানে সূর্যের আলোক রশ্মি এমনভাবে ঐ রুমে পতিত হয় যেনো ঐ বড় কলসীতে রাখা পানি ঘরের ভিতরেই ধীরে ধীরে গরম হতে থাকে। সেখানে থাকতো মহিলা নিরাপত্তার বেষ্টনী। আর নিরাপদ দুরুত্তে নপুংসক কিছু রাইফেলধারী প্রহরী।
(৩) এবার গেলাম আমরা আরেকটি কামরায় যেখানে রানী তার সহচরীদের নিয়ে ঠান্ডা জলে গরমের দিনে স্নান করতেন। পাশেই গঙ্গা নদী। ঐ নদী থেকে পানির পাইপ দিয়ে সারাক্ষন ঠাণ্ডা পানির প্রবাহ থাকতো যাতে কামড়াটা সারাক্ষন জলীয় বাস্পের মাধ্যমে ঠাণ্ডা থাকে। আর এই ঠান্ডা পরিবেশে কলসীতে রাখা পানিও বেশ ঠাণ্ডা থাকে। রানী গরমের দিনে এই শীতল পানিতে স্নান করেন।
পুরু জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম, আর ভাবলাম, কোনো এক সময় এই সম্রাটদের পদচারনা এ সব স্থানে পড়েছে। তারা পুরু ভারতবর্ষ এসব প্রাসাদ থেকে পরিচালনা করতেন। এখানে সবার প্রবেশের কোনো অনুমতিও ছিলো না। অথচ আজ এতো বছর পর যে কেঊ ১০০ টাকার টিকেট কেটেই যখন তখন ঢোকে যেতে পারে। রাজা নাই, সম্রাট নাই, কোনো প্রহরী নাই, আছে তাদের সমস্ত স্মৃতি আর ইতিহাস। এখান থেকে তাজমহলের চুড়াগুলি দেখা যায়। গাইড বললেন যে, সম্রাট শাহজাহানের পরিকল্পনা ছিলো এই গংগার পাড়ে শাহজাহান মহল তৈরী করার। কিন্তু তার সে পরিকল্পনা বাস্তবরূপ নেবার আগেই তিনি তার ছেলের হাতে বন্দি হন এবং বন্দি অবস্থাতেই মারা যান। সম্রাট শাহজাহানের দেহ সমাধী করা হয় তাজমহলে নূরজাহানের কবরের পাশে। আর এই কবরটাই হচ্ছে একমাত্র আইটেম যা ব্যতিক্রম। আর এর ফলে তাজমহলের সেমিট্রিক্যাল চরিত্রকে আর সেমিট্রিক্যাল রাখে নাই। অর্থাৎ তাজমহলকে যেখান দিয়েই দুইভাগ করা হোক না কেনো, শাহজাহানের সমাধির কারনে এটা দুই ভাগের যে কোনো এক ভাগে থেকে যায় সম্রাটের দেহ, সব কিছুই আর সমান সমান থাকে না। সম্রাট শাহজাহান এমনভাবে তাজমহলটাকে গড়েছিলেন যে, যে কোনো দিক থেকেই কেউ প্রবেশ করুক না কেনো, তাজমহলের দুই পাশে সব সময় একই জনিষের একটি করে আইটেম পড়বে। এমন কি গাছগুলিও।
এই ছবিতে আমার পিছনে যে বিশাল চত্তরটা দেখা যাচ্ছে, এর ঠিক মাঝখানেই একতা বড় পিতলের থালা আছে যেখানে অনায়াসেই ৬/৭ জন মহিলা একসাথে পানিতে সাতার কাটতে পারেন। এখানেই রানী শীতকালে তার সহচড়িদেরকে নিয়ে জল কেলী করতেন। এতো বছর আগেও তারা তাদের জীবনের সবটুকু আনন্দ করেই এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। রাজা বা সম্রাটের কাছ থেকে তারা আক্ষরীক অর্থে কতটুকু মহব্বত আর ভালোবাসা পেয়েছে সেটা জানতেন শুধুমাত্র এ সব রানীরা কিন্তু বাহ্যিক ভাবে যদি দেখা যায়, তারা হয়তো মনের কষ্টকে আরাল করেই দিন পার করেছে। এটাই বা কম কিসের?
যখন ফিরে আসছিলাম, অনেক ভাবনা মনে আসছিলো। মনে হচ্ছিলো যেনো, এই মাত্র নবাবের সাথে আমরা দেখা করেই এলাম। কেনো মনে হচ্ছিলো এ রকম?
২৬/১১/১৯৯৭- তাজমহল ভিজিট
আমরা পরদিন (২৬ নভেম্বর) সকালে তাজমহলের উদ্দেশ্যে সবাই এক সাথে রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমাদের সাথে কোনো এক ইউনিভার্সিটির টিচার গাইড হিসাবে ছিলেন যিনি খুব ভালো ইতিহাস জানেন এবং ভাল ইংরেজি বলতে পারেন। তিনি একে একে তাজমহলের প্রবেশদ্বার থেকে সবকিছু বলতে থাকলেন কেনো এটা প্রিথিবিতে ৭ম আশ্চর্যের মধ্যে একটা স্থান পেয়েছিলো। আমরাও এর অনেক কারন জানতাম না। আমি এখানে কিছু কিছু ব্যাখ্যা তুলে ধরি তিনি আমাদেরকে কি কি বলেছিলেন।
প্রথমেই তিনি তাজমহল সৃষ্টির কারনগুলি উল্লেখ করলেন। মমতাজের আসল নাম ছিলো আরজুমান্দ বানু বেগম। মহলটির কাজ শুরু হয়েছিলো ১৬৩২ সালে আর শেষ হয়েছিলো ১৬৫৩ সালে। প্রায় ২১ বছর। শিল্পনৈপুণ্যসম্পন্ন একদল নকশাকারক ও কারিগর সৌধটি নির্মাণ করেছিলেন যারা উস্তাদ আহমেদ লাহুরির সাথে ছিলেন, যিনি তাজমহলের মূল নকশাকারক হওয়ার প্রার্থীতায় এগিয়ে আছেন। তাজমহলকে (কখনও শুধু তাজ নামে ডাকা হয়) মুঘল স্থাপত্যশৈলীর একটি আকর্ষণীয় নিদর্শন হিসেবে মনে করা হয়, যার নির্মাণশৈলীতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। যদিও সাদা মার্বেলের গোম্বুজাকৃতি রাজকীয় সমাধীটিই বেশি সমাদৃত, তাজমহল আসলে সামগ্রিকভাবে একটি জটিল অখণ্ড স্থাপত্য। এটি ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল। মমতাজ ছিলো সম্রাট শাহজাহানের ২য় স্ত্রী।
তাজমহলের সামনের চত্বরে একটি বড় চারবাগ (মুঘল বাগান পূর্বে চার অংশে বিভক্ত থাকত) করা হয়েছিল। ৩০০ মিটার X ৩০০ মিটার জায়গার বাগানের প্রতি চতুর্থাংশ উঁচু পথ ব্যবহার করে ভাগগুলোকে ১৬টি ফুলের বাগানে ভাগ করা হয়। মাজার অংশ এবং দরজার মাঝামাঝি অংশে এবং বাগানের মধ্যখানে একটি উঁচু মার্বেল পাথরের পানির চৌবাচ্চা বসানো আছে এবং উত্তর-দক্ষিণে একটি সরলরৈখিক চৌবাচ্চা আছে যাতে তাজমহলের প্রতিফলন দেখা যায়। এছাড়া বাগানে আরও বেশ কিছু বৃক্ষশোভিত রাস্তা এবং ঝরনা আছে। চারবাগ মানেই যাতে স্বর্গের বাগানের প্রতিফলন ঘটবে। তাজমহলের চত্বরটি বেলে পাথরের দুর্গের মতো দেয়াল দিয়ে তিনদিক থেকে বেষ্টিত। নদীর দিকের পাশটিতে কোনো দেয়াল নেই। এই দেয়ালবেষ্টনির বাইরে আরও সমাধি রয়েছে যার মধ্যে শাহজাহানের অন্য স্ত্রীদের সমাধি এবং মুমতাজের প্রিয় পরিচারিকাদের একটি বড়ো সমাধি রয়েছে।
(১) তাজমহলে ঢোকতে মোট চারটা গেট আছে, প্রতিটি গেট থেকে মেইন তাজমহল একই রকম দেখা যায়। একই রাস্তা, একই গাছ, গাছের সংখ্যাও সমান। প্রশস্ত, এবং দুরত্ত সমান। সব গাছ একই গাছ।
(2) যে গাছগুলি তাজমহলের প্রবেশ পথ থেকে মেইন বিল্ডিং পর্যন্ত লাগানো আছে, সেই গাছগুলি এমন একটা উচ্চতা পর্যন্ত বড় হবে যা রানীর জন্য সুবিধাজনক। গাছগুলিতে ফুল ফুটলে যেনো রানীর মাথা নুয়ে ফুল তুলতে না হয়, সখীদের নিয়ে হাটতে হাটতে ফুল তুলতে পারেন, ঠিক সেই পরিমান বড় হয়ে গাছ গুলি আর বড় হবে না। কি অদ্ভুদ।
(৩) তাজমহলের প্রবেশ পথে দাডিয়ে মেইন বিল্ডিং এ তাকালে চোখে পড়বে "লা ইলাহা ইল্লাললাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ"। এই লেখাটা যদি কাছে গিয়া দেখা যায়, দেখা যাবে যে, প্রতিটি অক্ষর কিন্তু সমান নয়। কিন্তু তাজমহলের প্রবেশ পথে দাড়াইয়া দেখলে প্রতিটি অক্ষর সমান মনে হবে। আর এটা সূর্যের আলোর প্রতিসরনাংকের ফর্মুলা কাজে লাগিয়ে করা হয়েছে। এটা খুবই সুক্ষ একটা গনিতের ফর্মুলা। এটা এই তাজমহলে এপ্লাই করা হয়েছে।
(৪) তাজমহলের যেখান দিয়াই কেউ ঢোকুক না কেনো, তাকে যদি দুই ভাগ করা হয়, তাহলে প্রতিভাগে সমান সংখ্যক গাছ, সমান সংখ্যক রাস্তা, সমান সংখ্যক বিল্ডিং, সমান সব কিছু হবে। তাই একে বলা হয় সিমেট্রিক্যাল কন্সট্রাকশন বা স্ট্রাকচার।
(৫) তাজমহলে একপাশে একটা মসজিদ আছে। তাজমহলের এই সিমেট্রিক্যাল হবার জন্য পাশাপাশি দুটো মসজিদ বানানোর নিয়ম নাই বলে, একপাশে একটা মসজিদ আর আরেকপাশে মসজিদের ন্যায় একটা জাওয়াব বানানো হয়েছে। বাহ্যিকভাবে দেখে বুঝার উপায় নাই, কোনটা মসজিদ আর কোনটা জাওয়াব । জাওয়াব আলাদা শুধু এর মেহরাম নেই আর এর মেঝে নকশা করা যেখানে মসজিদের মেঝে ৫৬৯ জন মুসল্লির নামাজ পড়ার জন্য কালো পাথর দিয়ে দাগ কাটা। তাজমহল দেয়াল ঘেরা আগ্রা শহরের দক্ষিণ অংশের একটি জমিতে তৈরি করা হয়েছিল যার মালিক ছিলেন মহারাজা জয় শিং। শাহজাহান তাকে আগ্রার মধ্যখানে একটি বিশাল প্রাসাদ দেওয়ার বদলে জমিটি নেন।
(৬) তাজমহলের চার পাশে চারটা বড় বড় পিলার আছে। স্বাভাবিক চোখে দেখলে মনে হবে যে, পিলারগুলি সোজা এবং খাড়া, কিন্তু আসলে এই পিলারগুলি একেবারেই সোজা খাড়া না। এই পিলারগুলি একটু বাইরের দিকে হেলিয়ে বানানো। কোনো কারনে যদি প্রাকৃতিক কারনে পিলারগুলি ভেঙ্গে পড়ে, পিলারগুলি যেনো কোনো অবস্থাতেই তাজমহলের ভিতরের সাইডে না পড়ে সেভাবে বানানো। এটা তার ওজনেই তাজমহলের বাইরের দিকে পড়ে যাবে, যাতে তাজমহলের কোনো ক্ষতি না হয়।
(৭) এবার যাই তাজমহলের ভিতরের অংশে। ভিতরে রঙ বেরংগের পাথর দিয়ে অনেক ইতিহাস লেখা। কখনো যৌবনের প্রতিক, কখনো কোনো প্রেমের কাহিনী। বিভিন্ন কালারের পাথর দিয়ে দিয়ে সমন্নয় করে একটা পাথর আরেকটা পাথরের সাথে নেচারালী লাগানো। কথিত আছে, সম্রাট শাহজাহান একটা পাথরও কেটে লাগাতে দেন নাই। অবিকল পাথরগুলি যেভাবে ছিলো সেটাই একটার সাথে আরেকটা খাপে খাপ মিলিয়ে মিলিয়ে সংযোগ করে লাগানো এবং প্রতিটি পাথর একে অপরের সাথে নিখুতভাবে লাগানো। কত বছর যে লেগেছে এই পাথর বাছাই করার জন্য, এবং তার সাথে রঙ এবং সাইজ মেলানোর জন্য, তার কোনো ইয়াত্তা নাই। ২১ বছর শুধু এম্নিতে এম্নিতেই লাগে নাই এই তাজমহল বানাতে।
(৮) পাথরগুলি সেমিট্রান্সপারেন্ট। যদি ওয়ালের বা দেয়ালের এক পাশ থেকে টর্চের লাইট দেয়া হয়, ওয়াল বা দেয়ালের উলটো দিকে এই লাইট বেশ প্রবাহিত হতে পারে।
(৯) রানী যেখানে শুয়ে আছেন, অর্থাৎ তার কবর, সেটায় যেনো কোনো ভিজিটর ভিজিট এর কারনে রানি বিরক্তবোধ না করেন, তার জন্য একই ডিজাইনে, একই তরিকায় ঠিক এমন জায়গায় আরেকটি কবরের মতো কবর বানানো হয়েছে যে, যেদিক থেকেই তাজমহলকে ভাগ করা হোক, একদিকে রানীর অরিজিনাল কবর আর অন্যভাগে রানীর রেপ্লিকা অর্থাৎ ফেক কবর ভাগে পড়বে। সমস্ত ভিজিটরদেরকে রানীর এই রেপ্লিকা কবর পর্যন্তই যেতে দেয়া হয়। কিন্তু আমরা যেহেতু ভারতের রাষ্ট্রীয় গেষ্ট হিসাবে বিবেচিত ছিলাম, ফলে আমরা খুব ভাগ্যবান যে, আমরা রানীর অরিজিনাল করব পর্যন্ত ভিজিট করার অনুমতি ছিলো। দেখে বুঝার উপায় নাই, কোনটা নূরজাহানের অরিজিনাল করব আর কোনটা নূরজাহানের ডুপ্লিকেট। দুটুর ডিজাইন, স্টাইল এবং সব কিছুই এক।
(১০) একষ্টিক থিউরী ব্যবহার করা হয়েছে এই তাজমহলের ভিতরে। একষ্টিক থিউরী হচ্ছে বাইরের কোনো শব্দ তার কোন সুর, কিংবা আওয়াজ নষ্ট না হয়ে বক্তা যে আওয়াজে যে সুরে কথা বলবেন, ঠিক সেতাই শুনা যাবে এই তাজমহলের ভিতরে বসেও। এটা দেখার জন্য আমাদে গাইড জানালেন যে, সম্রাট শাহজাহান, চেয়েছিলেন, যখন বাইরে আজান পড়বে, রানির ঘর থেকে যেনো অই আজানটা অবিকল কোনো শব্দ ডিসটরসন না হয় এবং রানি নূরজাহান ঠিক ঐ আওয়াজটাই শুনতে পান। এটা প্রমান করার জন্য গাইড প্রথমে আমাদেরকে একটা সুমধুর আওয়াজের অডিও শুনালেন বাইরে দাড় করিয়ে, তারপর নিয়ে গেলেন, রানীর কবরের পাশে। আবারো সেই সুমধুর আওয়াজটা বাজানো হলো। আসলেই ঠিক তাই, যে সাউন্ডটা আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম, তদ্রুপ রানীর ঘর থেকেও একই আওয়াজ শুনা যাচ্ছিলো।
(১১) তাজমহল একটা জাইরো সিস্টেমে তৈরী করা। অর্থাৎ পুরা তাজমহল কোনো কারনে যদি ভুমিকম্পের কবলে পড়ে তাহলে এটা অর্থাৎ পুরু তাজমহল প্রায় একদিকে সারে সাত ডিগ্রি অন্য দিকে সারে সাত ডিগ্রী হেলে গেলেও তাজমহলের কোনো ক্ষতি হবে না। অর্থাৎ দুই দিকে মিলে তাজমহল প্রায় ১৫ ডিগী হেলতে পারে। এর ফলে তাজমহল প্রায় ৭ রেক্টর স্কেলের ভুমিকম্প সহ্য করার মতো একটা স্ট্রাকচারাল ডিজাইন হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাজ মহল এর মধ্যে নাকি পর পর দুবার প্রায় এই সম পরিমান ভুমি কম্পে পড়েছিলো কিন্তু এই হেলতে পারা জাইরোর কারনে তাজমহলের কোনো ক্ষতিই হয় নাই।
(১২) তাজমহলে দাঁড়িয়ে যদি সকালবেলা পূর্ব দিকে সুর্য উঠা দেখেন, তাহলে সুর্য শাহজাহান মহল থেকে যেনো উদিত হচ্ছে এটাই বুঝা যাবে, এটা বছরের যে কোনো সময়ের জন্যই প্রযোজ্য। আবার শাহজাহান মহলে কেউ দাড়াইয়া যদি সুর্যাস্ত দেখেন, তাহলে বছরের যে কোনো সময় মনে হবে যে, সুর্য মমতাজ মহলের উপর দিয়ে সুর্যাস্ত হচ্ছে।
এই রকমের আরো অনেক বৈজ্ঞানিক কারন রয়েছে যার কারনে তাজমহল বিশ্ববাসীর কাছে ৭ম আশ্চর্যের মধ্যে একটা স্থান করে নিয়েছে। এটা কোনো স্বাভাবিক বিল্ডিং বা স্ট্রাকচার নহে। আমরা প্রায় ঘন্টা তিনেক তাজমহলে থাকার পর বেরিয়ে গেলাম সম্রাট আকবরের আস্তানায়।
০৬/০৩/১৯৯৬-ডমিনিকান ভ্রমন
Categories
হাইতিতে জাতী সংঘের অধীনে মিশন করতে এসে আশে পাশের অনেক গুলি দেশ বেরানর ইচ্ছা প্রথম থেকেই আমার ছিলো। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইচ্ছে ছিলো ডমিনিকান দেশটি ঘুরে দেখার। এর প্রধান কারন হলো, এতা হিসপানিওয়ালার একটি দেশ। অনেক ছোট বেলায় পড়েছিলাম ইবনে বতুতার কথা, তারপর সেই আমেরিকা আবিষ্কারের কথা। আমেরিকা আবিষ্কার যিনি করেছিলেন যেই জাহাজতা দিয়ে তিনি এসেছিলেন, এটা নাকি এই ডমিনিকানে এখনো আছে। এই রকম আরো অনেক কাহিনী ছোট বেলায় পরেছিলাম। স্বাভাবিক কারনেই এতো কাছে এসে ডমিনিকানে যাবো না, এটা হবে একতা অন্যায় বা অপরাধ।
যাই হোক, আমরা একতা গ্রুপ করে ফেললাম ডমিনিকানে যাওয়ার জন্য। গাড়ির পথ। হাইতির পাশাপাশি দেশ। আমাদের নিজস্ব গাড়ি আছে। ইউ এন এর গাড়ি। কোনো ভিসার দরকার নাই। ডমিনিকানের চেক পোষতে গিয়ে আমাদের জাতীসংঘের স্টাফ হিসাবে পরিচয় দিলেই আমরা ঢোকতে পারবো এতাই আমাদেরকে জানানো হয়েছিলো কন্সুলেট অফিস থেকে।
আমি, মেজর ইশতিয়াক (৯ম লং কোর্ষ), মেজর মোসাদ্দেক (১১ তম লং কোর্ষের), মেজর ফরিদ (১১তম লং কোর্ষের), মেজর ইলিয়াস (১৭ তম লং কোর্ষের) মেজর ফারুক (১০ম লং কোর্শগের) আর নেভীর একজন অফিসার মিলে আমরা সবাই বেরিয়ে গেলাম ডমিনিকানের উদ্দেশ্যে।
আকাবাকা পাহাড়ি সরু রাস্তা, আশেপাশে কোনো গ্রাম চোখে পড়লো না খুব একটা। মাঝে মাঝে কিছু লকের আনাগোনা দেখা গেছে আমাদের দেশের পাহাড়ি অঞ্চলের মতো কিন্তু তারা কোথা থেকে কই যায় বা কোথায় থাকে এ ব্যাপারে খুব একটা জানা হলো না। আমরা ছুটে চলছি তো চলছিই। ক্যারিবিয়ান পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূরা এখানেই অবস্থিত যার নাম পিকো ডুয়ার্তো। সেন্ট ডমিনিকের নামানুসারেই এই দ্বীপ টির নাম হয়েছিলো। এর রাজধানির নাম সেন্ট ডমিনিগো। বর্তমানে ডমিনিকানের প্রেসিডেন্ট হিসাবে আছেন লিওনেল ফার্নেন্দেজ।
প্রায় ৪ ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে প্রায় সকাল ১১ তার দিকে আমরা ডমিনিকান চেক পোষ্টে পৌঁছে গেলাম। খুব একটা সুরক্ষিত বর্ডার বলে মনে হলো না। আমাদের দেশের কিছু বিডি আর সেনাদের মতো লেথাজিক কিছু সৈনিক দিয়ে ডমিনিকা বর্ডারটার চেক পোষ্ট পাহাড়া দেয়া আছে। তবে মেইন গেটে কাতা তারের বেড়ায় কোনো লোক ঢোকতে পারে না এটা ঠিক। আমরা ইউ এন এর গাড়ি গেটের সামনে থামতেই গুটি কয়েক ডমিনিকান সৈনিক আমাদের কাছে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের আসার হেতু কি। হাইতি এবং ডমিনিকানের সাথে যে কমন শহর, তার নাম আসলে মন্ট ক্রিষ্টি। যদিও মন্ট ক্রিষ্টি ডমিনিকানেরই একটি শহর কিন্তু আমরা সেখানকার কো-বর্দার দিয়েই ডমিনিকানে ঢোকেছি।
এখানে একতা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম যে, হাইতিতে প্রায় ৯০% মানুষ কালো আর ডমিনিকানের প্রায় ৯০% লোক সাদা চামড়ার। পাশাপাশি দেশ কিন্তু বিস্তর তফাত। হেসিয়ান লোকগুলি অনেক অস্থির, চালাক আর ফ্রড জাতীয় কিন্তু ডমিনিকানের লোকগুলি ধীর স্থির, কো-অপারেটিভ, ভদ্র বলেই মনে হলো। গেটের সৈনিকগুলি আমাদের সবার পাস পর্ট নিয়ে চলে গেলো ভিতরে। প্রায় ৪০ মিনিট পর এসে জানালো যে, তারা আমাদের পাস্পোর্ট এখুনি ফেরত দিবে না, যখন আবার ব্যাক করবো, তখন গেট থেকে নিয়ে গেলেই হবে। আমরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, যে, যেহেতু আমরা ইউ এন এর গাড়ি নিয়েই ভিতরে যাবো, তখন যদি কোনো প্রশাসন কিংবা আইন বিভাগের কোনো কর্মকর্তা আমাদেরকে কিভাবে ডমিঙ্কানে প্রবেশ করলাম জিজ্ঞেস করে, তাহলে কি বল্বো? আমাদের কোনো সমস্যা হবে কিনা। ব্যাপারটা তারা বুঝতে পারলেন। ফলে আমাদের সাথে তাদেরই একজন একোম্পানি করবেন বলে রাজী হলেন। এতে আমাদের লাভ হলো দুটু। একজন বিনে পয়সায় গাইড পাওয়া গেলো আবার কোনো ঝামেলা হলে সেইই ব্যবস্থা নিবে।
আমরা ঢোকে গেলাম ডমিনিকানে। খুব সাজানো গুছান একতা দেশ। গরমের সিজন। দেখলাম, ছেলেমেয়েরা খুব নিরাপদেই গাছের ছায়ায় কেউ ঘুমাচ্ছে, আবার কেউ কেউ আড্ডা মারছে। সবাই খুব ভদ্র। আমাদেরকে দেখে অনেকেই এগিয়ে এলেন, হাত মিলালেন, হাসিখুসিতে অনেকে আবার ছবিও তুল্লেন/ ব্যাপারটা খুব মজার। অনেকেই ইংরেজী বলতে পারেন কিন্তু তাদের প্রধান ভাষা হচ্ছে স্প্যানিশ।
ডমিনিকানের প্রধান ধর্ম হচ্ছে রোমান ক্যাথোলিজম। এদের মুদ্রার নাম ডমিনিকান পেসো। আমাদের কাছে ডলার ছিলো, এদেশে ডলার চলে। কিন্তু কোনো কিছু কিনতে গেলে ডলার নেয় ঠিকই কিন্তু দেয় পেসো। আর এক ডলার সমান প্রায় ১৫০০ পেসোর সমান। হাইতিতে অবশ্য ওদের এক হেসিয়ান ডলারের সমান প্রায় ৫ হেসিয়ান ডলার। এদিক দিয়ে ডমিনিকান দের কারেন্সীর অবমুল্যায়ন ধরা যায়। ডমিনিকানে হেসিয়ান ডলার ও চলে। তবে বেশী আগ্রহী অয় তারা। আমরা খুব বেশী মার্কেটিং করার ইচ্ছায় এখানে আসি নাই, তাই এটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথ ব্যথাও নাই।
আমরা আশেপাশের কিছু জায়গা ঘুরে দেখলাম। আমরা আসলে মন্টি ক্রিষ্টি শহরের মধ্যেই ছিলাম। এর বাইরে যাওয়া সম্ভব হয় নাই কারন আমরা আবার সেদিনই হাইতিতে ফিরে যেতে হবে আর আমাদের রাত থাকার অনুমতি ছিলো না। দুপুরের দিকে আমরা একতা দোকান থেকে কিছু ড্রাই ফুড খেয়েই আবার বিকাল দুইতার দিকে হাইতির উদ্দেশ্যে র ওয়ানা দিয়ে চলে এলাম হাইতিতে।
আমাদের সেই হিস্পানিওয়ালার জাহাজ দেখা হয় নাই। কিংবা আরো বড় বর যে ইতিহাস পড়েছিলাম, তার কিছুই দেখা হয় নাই। এ জীবনে আর কখনো এদেশে আসা হয় কিনা আমার জানা নাই তারপরেও ভাবলাম, ডমিনিকান এর বর্ডার টা তো ছুয়ে গেলাম।
১৮/১২/১৯৯৫- হাইতির প্রেসিডেন্সিয়াল ভোট
Categories
অনেক চড়াই উতড়াইপার হয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা হাইতিতে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন করতে পারলাম। গতকাল ১৭/১২/১৯৯৫ তারিখে প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন হয়ে গেলো। এখানে মুলত ১৪ জন ক্যান্ডিডেটস ছিলো যার মধ্যে মুলত তিন জনের মধ্যেই লড়াইটা হয়েছে। প্রথম জন রেনে গারসিয়া প্রিভাল (যাকে সবাই রেনে প্রিভাল নামেই চিনে), তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্তে ছিলেন। অত্যান্ত অমায়িক একজন মানুষ। প্রায়ই তিনি আমাদের বেস ক্যাম্পে আসেন, সবার সাথে কথা বলেন, সন্ধায় এলে সবাই আমরা মিলে চা কফি খাই। বেশ সাধারন একজন মানুষ। একটা দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট যে এতো সাধারনভাবে আমাদের ক্যাম্পে আসেন, বুঝাই যায় না। এখানে তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারটা নিয়ে তিনি একেবারেই উদ্বিগ্ন নন। কারন পুরু বেস ক্যাম্পটাই নিরাপদ। এই ভাইস প্রেসিডেন্ট রেনে প্রিভাল গতকাল ইলেকশনে প্রায় ৮৮% ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছেন এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরিস্টিডের স্থলাভিষিক্ত হবেন আগামি ৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬ তারিখ থেকে। ভাইস প্রেসিডেন্ট রেনে প্রিভাল "ল্যাভালাস পলিটিক্যাল অরগ্যানাইজেশন" (যাকে সক্ষেপে বলা হয় ওপিএল) থেকে দাড়িয়েছিলেন। মুখ ভর্তি দাড়ি। দেখলে অনেকটা আমাদের এশিয়ান এশিয়ান টাইপের মনে হয়।
২য় ব্যক্তি ক্যান্ডিডেট হিসাবে ছিলেন লিও জুন। তিনি সতন্ত্র দল বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট থেকে দাড়িয়েছেন। ভোটের দিক দিয়ে তিনি মোট ভোট পেয়েছেন প্রায় ২.৫% । তাকে আমরা দেখি নাই। অন্তত আমি এখনো দেখি নাই। আর ৩য় ব্যক্তি যিনি ক্যান্ডিডেট হয়েছিলেন তাঁর নাম ছিলো ভিক্টোর বিনোত। তিনি দাড়িয়েছিলেন "কোনাকমঃ (KONAKOM) পার্টি থেকে। কোনাকম পার্টি আসলে মডারেট সোশ্যালিস্ট পলিটিক্যাল পার্টি যার ইংরেজী নাম হচ্ছে ন্যাশনাল কংগ্রেস অফ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং হেসিয়ানরা একে চিনে কোনাকম নামে। তাঁর ভোটের পরিমান ছিলো সবচেয়ে কম, মাত্র ২.৩%
বাকী ১১ জনের নাম ও আমরা প্রায় আগে খুব ভালভাবে শুনেছি বলে মনে হয় না। তাদের নাম গুলি এই রকমেরঃ
রেনে জুলিয়েন,
ক্লার্ক প্যারেন্ট- হেসিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি
ইদি ভোলেল - ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাটিক র্যালি
রিচার্ড ব্লাদিমির -প্যারাদাইস পার্টি
ফ্রান্সিস জীন - রিভুলেশনারী মিলিটারি ফোর্স
জীন আর্নল্ড ডুমাস-ন্যাশনাল পার্টি অফ ওয়ার্কার্স ডিফেন্স
জুলিও লারোসিলেরী-
মিষ্টার জোসেফ- হেসিয়ান সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি
গেরাল্ড ডাল্ভিয়াস - অল্টারনেটিভ পার্টি অফ হেসিয়ান ডেভেলপমেন্ট পার্টি
রকফেলার গুরি - ইউনিয়ন অফ ডেমোক্র্যাটিক প্যাট্রিওটস
ফার্মিন জীন লুইস
মজার ব্যাপার হলো বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরিস্টিড এই ইলেকশনে অংশ গ্রহন করেন নাই। করলে হয়ত তিনি পাশ করতেন। কিন্তু হেসিয়ান সংবিধানের বাধ্যবাদকতার জন্য তিনি অংশ গ্রহন করেন নাই। তবে তাঁর মনোনীত এবং তারই অধীনে ভাইস প্রেসিডেন্ট রেনে প্রিভালকে তিনি মনোনীত করেছেন। এবং ফলাফল তাইই হয়েছে যে, রেনে প্রিভাল জয়ী হয়েছেন। সেক্ষেত্রে ধরা যায় যে, যদি এরিস্টিড দাড়াতে পারতেন, তাহলে এবারো তিনিই প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন।
আমি বহুবার এই ধর্মজাজক মানুষটির সাথে মিশেছি। আমি তাঁর প্যালেসে প্রায় তিন মাস একটানা ডিউটি করেছি। মাঝে মাঝেই আমি তাঁর খুব কাছ থেকে অনেক সান্নিধ্য পেয়েছি।
০৫/১২/১৯৯৫-নর্থইষ্টার্ন এবং এমআইটি ভিজিট
Categories
ভাইয়া নর্থ ইষ্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে প্রোফেসারি করেন। এর ঠিক উলটো দিকেই হচ্ছে এম আই টি ইউনিভার্সিটি। ভাইয়া আমাকে ওনার ইউনিভার্সিটি তে নিয়ে গেলেন। আজ একটু শীত কম পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। বিশাল বড় একটা ইউনিভার্সিটি। ভাইয়ার অফিসে গেলাম, ভাইয়ার আরো অনেক কলিগ, তাদের অফিসেও গেলাম। এরা সবাই অনেক উচু দরের মানুষ। ভাইয়া আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, তুই ইউনিভার্শিটিটা ঘুরে ঘুরে দেখতে পারিস। কিন্তু ক্যাম্পাসের বাইরে যাস না। দুপুরে একসাথে অন্যান্য কলিগদের সাথে ক্যাফেটেরিয়ায় লাঞ্চ করবো। এর মাঝে আমি কিছু কাজ সেরে নেই, আর তুইও ঘুরে ঘুরে দেখ। ভালোই হলো। ভাইয়া সাথে থাকলে আমার সিগারেট খাওয়া হয় না। এবার আনন্দের সাথে সিগারেট খাওয়া যাবে।
আমি ভাইয়ার অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রথমেই যেখানে পৌঁছলাম, সেতাই আসলে স্টুডেন্ট ক্যাফেটেরিয়া। দেখলাম, অনেক ছেলেমেয়েরা একটা বোর্ডের সামনে বেশ সুন্দর করে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অদূরে দাঁড়িয়ে একতা সিগারেট ধরালাম। এখানে সিগারেট খাওয়া যায় কিনা আগে আমি চেক করে নিয়েছি। আমি দেখেছি এক ভদ্রলোক, সম্ভবত ছাত্রই হবে, সে সিগারেট খাচ্ছিলো। ফলে আমার ধারনা যে, এই স্থানে সিগারেট খাওয়া যায়। আমি সিগারেট খাচ্ছি আর ঐ জটলা ছেলেমেয়েদেরকে দেখছি। একজন একজন করে তারা কি যেনো একটা নোটিশ বোর্ডে পিন দিয়ে লাগাচ্ছে। লাগিয়েই আবার চলে যাচ্ছে।
আমার সিগারেট খাওয়া শেষ হলে আমি বোর্ডটির কাছে গিয়ে দেখি তখন মাত্র দুজন ছাত্র দাঁড়িয়ে। ওরা ইলেকশন পোষ্টার লাগাচ্ছে। কয়েকটি দলের ছাত্র ওরা। পোষ্টার দেখে বুঝলাম।
খুব মজার ব্যাপার হলো, যে যেই দলই করুক, তাদের নিজেদের মধ্যে কোনো দন্দ দেখলাম না। হানাহানি, হিংস্রতা, কিংবা একে অন্যের উপর রেষারেষি তো নাইই। আমাদের দেশে হলে ইতিমধ্যে মারামারি লেগে যেতো।
০২/১২/১৯৯৫- অস্ত্র ক্রয়
শেষ পর্যন্ত আমার আগ্নেয়াস্ত্র টা মনে হয় কেনাই হলো। বেরেটা পিস্তল। খুব সুন্দর। হাতের তালুতেই রাখা যায়। বব নামের একটি দোকান থেকে কিনতে গেলাম। কেনার আগে অনেকগুলি অস্ত্র দেখালো আমাকে। দোকানদারকে আগেই সমস্ত কাগজপত্র ফ্যাক্স করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ভাইয়া। ফলে এই দুইদিন দোকানদার সমস্ত কাগজ ভেরিফাই করে আজকে আমি যেটা কিনতে চাই সেতা কিনতে পারবো বলে দোকানে গিয়েছিলাম। দোকানীদের ছোট একটা এসি করা ফায়ারিং রেঞ্জ আছে। ওখানে টেষ্ট ফায়ার করা যায়। তবে সর্বোচ্চ ৫ রাউন্ড পর্জন্ত ফায়ার করতে পারবেন। আমি টেষ্ট করলাম। মাত্র ২০০ ডলার। খুবই সস্তা। বাংলাদেশ থেকে আমি যে আগ্নেয়াস্ত্রলাইসেন্স পেয়েছিলাম, সেটা করমুক্ত লাইসেন্স। ফলে আমাকে কোনো কর দিতে হবে না। যদি কর দিতে হতো, তাহলে আমাকে ৩৫০% ট্যাক্স দিয়ে এই অস্ত্র কিনতে হতো। তখন এর দাম পড়তো (২০০+ ৭০০)= ৯৫০ ডলার। কিন্তু আমার পড়ছে মোট ২০০ ডলার।
দোকানদার এই মর্মে জানালেন যে, আমি এখনই এই অস্ত্র সাথে করে নিয়ে যেতে পারবো না। ওনারা উক্ত অস্ত্র বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবেন, আমাকে বাংলাদেশ থেকে রিসিভ করতে হবে। কিছুই করার নাই কারন আমেরিকায় আমাই অস্ত্র সহ ঘুড়তে পারবো না, সেই অনুমতি আমার নাই। আবার আমি আমেরিকা থেকে হাইতিতেও অস্ত্র বিশেষ করে ব্যক্তিগত অস্ত্র নিয়ে যেতে পারবো না, হাইতির আইনেও আমি অনুমতি প্রাপ্ত নই। ফলে কবে নাগাদ দোকানদার এই অস্ত্র বাংলাদেশে পাঠাবে, সেই তারিখতা আমাকে বলে দিতে হবে যাতে বাংলাদেশে পৌছার পরেই যেনো বেশি দেরী না করে আমি এয়ারপোর্ট থেকে অস্ত্রটি তুলে নিতে পারি।
আমি তাতক্ষনিকভাবে কোনো নির্দিষ্ট তারিখ বলতে পারলাম না। তবে ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে কনফার্ম তারিখ বলতে পারবো এতা জানালাম। দোকানদার তাতেই মন্তব্য লিখে আমাদেরকে একটা চালান কপি দিয়ে দিলেন।
খুব ভালো লাগছে যে, অনেকদিনের আমার একটা শখের জিনিষ কেনা হলো। এতা দিয়ে আসলেই আমার কোনো উপকার হবে কিনা আমি জানি না কিন্তু শখ বলে কথা। মাসুদ সাথে গিয়েছিলো। ওর হাজার রকমের প্রশ্ন। ও নিজে একটা কিনতে পারবে কিনা, কিনলে কিভাবে এতা চালাইতে হয়। ইত্যাদি।
----------------------------------------------
৩০/১১/১৯৯৫-পিস্তল কেনার প্রস্তুতি
হাইতিতে আসার সময় বাংলাদেশ থেকে আমি একতা অনুমতি নিয়ে এসেছিলাম যে, যদি আমেরিকায় যাওয়া হয়, তাহলে ওখান থেকে একতা পিস্তল কিনবো। ভাইয়াকে গত সপ্তাহে জানালাম আমেরিকা থেকে পিস্তল কেনা যায় কিভাবে। ভাইয়া কোথায় কোথায় কি কি জানি ফোন করে করে আমাকে জানালেন যে, কেনা যাবে তবে বেশ কিছু কাগজপত্র লাগবে। তাঁর মধ্যে দুটো কাগজ আমার কাছে নাই আর বাকী সবগুলিই আছে। দুটূ কাগজের মধ্যে একটা হচ্ছে আমেরিকার দুতাবাস থেকে ছাড়পত্র এবং আমি যেখানে কাজ করছি (অর্থাৎ হাইতি, সেখানকার কন্টিনজেন্ট কমাডারের অনুমতি পত্র)।
আমি হাইতি থেকে আসার পথে কন্টিনজেন্ট কমান্ডারের কাছে এই ব্যাপারে এপ্লাই করে এসেছিলাম, ফলে ফ্যাক্সের মাধ্যমে চাইলেই সেটা পাওয়া যাবে। কিন্তু আমেরিকার দুতাবাস থেকে ছাড়পত্র কিভাবে নেবো? ভাইয়া, আমেরিকায় বাংলাদেশ দুতাবাসে ফোন করলেন। বাংলাদেশ এম্বেসী অফিসের ডি এ (ডিফেন্স এটাশে) হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুনসুর আহমেদ। এক সময় আমাদের ৯ আর্টিলারী ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন। আমার সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় আছে। ভাইয়া নিজেই কথা বললেন দুতাবাসের সাথে, হাবিলদার আছে একজন, সে ভাইয়ার ফ্যাক্স নাম্বারে ছাড়পত্র আগামী দু একদিনের মধ্যেই পাঠিয়ে দেবেন এবং সাথে সাথেই হার্ড কপিও ডি এইচ এল এর মাধ্যমে আমাদেরকে পাঠিয়ে দেবেন বলে নিশ্চিত করলেন। ফলে আমার অস্ত্র কেনায় আর কোনো ঝামেলা রইলো না। এবার খুজে বের করতে হবে কোথায় অস্ত্র বিক্রি করে। এতাও ভাইয়াই খুব আগ্রহের সাথে এখানে সেখানে যোগাযোগ করছেন। আমার কিছুই করতে হচ্ছে না।
২৯/১১/১৯৯৫-আমেরিকায় সেল
Categories
একটা মজার কথা না বললেই হচ্ছে না। আজ প্রায় ১৫ দিন পার হয়ে গেলো আমি ভাইয়ার বাসায় আমেরিকাতে এসেছি। এর মধ্যে অনেক জায়গায় গিয়ে অনেক পদের মার্কেটিং করছি ভাবিকে নিয়ে। বেশীরভাগ মার্কেটিং করছি কসমেটিক্স আর কিছু নিত্য ব্যবহারের জিনিষ। যখনই আমি ঐ যে এয়ারপর্ট থেকে পাওয়া কার্ডটি দিচ্ছি, সবাই খুব অবাক হচ্ছে। কারন এই কার্ডধারী খুব একজন সাধারন মানুষ হতে পারে না। যতোবারই কার্ড তা দেখিয়েছি, আমি লাইনে থাকা মানুষ গুলির মধ্যে প্রাইয়োরিটি পাচ্ছি, আর কোনো প্রকারের ভ্যাট, ট্যাক্স দিতে হচ্ছে না। এখানে প্রায় ৩০% ট্যাক্স দিয়ে সব কিছু কিনতে হয়। এর মানে আমি যদি ১০০ ডলারের একটা জিনিষ কিনি, আমাকে পে করতে হবে ১৩০ ডলার। কিন্তু আমার বেলায় ১০০ ডলারের জিনিষ ১০০ ডলারই। দারুন একতা ব্যাপার। এতা যখনই ভাইয়ার ক্লজ বন্ধু বান্ধবদের কাছে জানাজানি হয়ে গেলো, অনেকেই আমার এই কার্ড ব্যবহার করে অনেক মার্কেটিং করে নিলো। আমারো খুব ভালো লাগছিলো যে, আমি অন্তত একটা ব্যতিক্রমী জিনিষ উপহার দিতে পারছিলাম।
আরেকটি জিনিষ আমার কাছে খুব অবাক লাগলো যে, প্রায় সারা বছরই আমেরিকার দোকানগুলিতে "সেল" লেগেই থাকে। "সেল" মানে হচ্ছে ডিস কাউন্টে কোনো কিছু ছেড়ে দেওয়া। হিড়িক পড়ে যায় তখন। আবার এমন হয়েছে যে, গতকাল আমি একটা জিনিষ কিনেছি, কিন্তু সেল" হয়েছে আজ থেকে ঐ আইটেমটার উপর। আমি যদি গতকালের রিসিপ্ট নিয়ে ঐ দোকানে যাই, তারা আবার আজকের দিনের "সেল" এর হিসাব ধরে টাকা হিসাব করে আমাকে বাকী টাকা ফেরত দিবে। কি তাজ্জব ব্যাপার এই দেশে। শুধু তাই না। আরো একতা মজার কাহিনী চোখে পড়লো যে, প্রায় ১৫ দিন আগে কেউ একটা শার্ট বা প্যান্ট কিনে নিয়ে গেছে, ব্যবহার করেছে, ১৫ দিন পরে এসে দোকানে বল্লো যে, আমার এই শার্ড় টা আর ভালো লাগছে না, আমি ফেরত দিতে চাই, ওমা, তারা সব তাকা ফেরত দিয়ে দিচ্ছে আবার "সরি" ও বলছে যে, জিনিষটা ক্রেতার পছন্দ হয় নাই বলে। বাংলাদেশ হলে বাঙ্গালীরা সারা বছর খালী এভাবে মাগনা মাগনা কিনতো আর বদল করে করে নতুন জিনিষ নিয়ে আবার বদল করতো। এটা আমেরিকা। কোনো যুক্তি ছাড়া এরা দুই নম্বরী করে না।
২৫/১১/১৯৯৫-বোষ্টনে বাঙ্গালির দাওয়াত
Categories
সন্ধার সময় ভাইয়া আজকে আমাকে নিয়ে একটি বাঙ্গালী পরিবারে বেরাতে নিয়ে গেলেন। ভাইটির নাম বশীর। তিনি পাকিস্থানী। কিন্তু আপা আমাদের ঢাকার তেজকুনী পাড়ার মেয়ে। বহু বছর আগে তারা দেশ ছেড়েছে। আগে থেকেই সম্ভবত তারা জানতেন যে, আমি আসবো। ফলে আমার সুবাদে এবং ভাইয়ার সুবাদে আরো অনেক বাঙ্গালী পরিবারের কেউ কেউ এসেছেন। আমি কাউকে চিনি না বলে খুব একটা সখ্যতা গড়ে তুওলতে পারছি না। কিন্তু এদের মধ্যে অনেকেই আমাকে একটি প্রশ্ন বারবার করছিলেন যে, আমার ভাই আমেরিকার এতো বড় একতা ইউনিভার্সিটিতে প্রোফেসর কিন্তু আমি আর্মীতে গেলাম কেনো? আর্মী একতা ভালো প্রোফেশন না। তারা মনে করেন, Why should someone to choose a profession to kill someone to survive himself? Its risky and not a good profession.
আমি হেসে হেসেই বলছিলাম, কাউকে না কাউকে তো দেশের আর্মীতে যেতে হবে, সেতা না হয় আমরা কজন গেলামই।
পার্টিতে হাতে বানানো মিষ্টি খেলাম, পোলাও করেছিলো, সবাই খুব আনন্দের সাথে ত্রিপ্তি করে খেয়ে বল্লো, যাক, ছোট ভাইয়ের সুবাদে আজ নাকি তারা বাঙ্গালি খাবার খেলো।
২০/১১/১৯৯৫- বোষ্টন
Categories
এই কয়দিন ভাইয়ার বাসায় আছি। শীতের প্রকোপ কমছে না। বাইরে গেলেই তুষারপাত। গতকাল সবাই মিলে একটি ছবি দেখলাম। দি রেইন ম্যান। একটা অটিষ্টিক বাচ্চার কাহিনী। ইউসুফের সাথে প্রচন্ড মিল রয়েছে। সকালের দিকে আমি মাসুদের স্ক্লে গিয়েছিলাম। সুন্দর একটা স্কুল। কো-এডুকেশন অবশ্য। স্কুলে গিয়ে বুঝলাম মাসুদ খুব জনিপ্রিয়। ওর ক্লাশ টিচারের নাম মিস ম্যাপল। মাসুদ আমাকে ওর ক্লাশ টিচারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর ঊনি আমাকে বললেন যে, আমার পক্ষে সম্ভব কিনা হাইতির উপর একটা ছোট খাটো প্রেজেন্টেশন দেওয়া। আমি আসলে একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। তারপরেও বললাম, যদি ম্যাপ থাকে তাহলে আমি হয়ত চেষ্টা করতে পারি।
যেই বলেছি যে, আমি ৩০/৪০ মিনিটের একটা ক্লাশ নেবো, অমনি সব ছাত্ররা তাদের টেবিল চেয়ার রুমের একদিকে টানাটানি করে সরিয়ে দিলো, একটা হল ঘর হয়ে গেলো। এই চেয়ার টানাটানির সময় আমি আর মাসুদ মিলে ওদের কম্পিউটার থেকে হাইতির একটা ম্যাপ বের করে ফেললাম। আর আমি একটা ছোট নোট লিখে ফেললাম কি কি বল্বো আর কি কি বল্বো না।
বাচ্চারা খুব হাসি খুশীতে সবাই বসে পড়লো। আমারো খুব ভালো লাগছিলো এই সব পটেনশিয়াল বাচ্চাদেরকে কিছু একটা বলতে।
তাদের হাইতি সম্পর্কে যতোতা না উতসাহ, তাঁর থেকে বেশি উতসাহ দেখলাম আর্মীর জীবন নিয়ে। কি হয়, কিভাবে থাকি, কিভাবে অস্ত্র চালাই, সব অস্ত্র চালাইতে পারি কিনা। একটা গুলি করলে কতজন মরে, আমি শত্রুদেরকে কিভাবে ঘায়েল করি। আকাশ থেকে লাফ দিয়ে পড়তে পারি কিনা। যদি পারি, আর যদি আর না বাচি তাহলে কিভাবে কি আরো কতো যে কি?
হাইতিতে আমি কতজনকে এরেষ্ট করেছি, ওরা আমাদেরকে মারে কিনা, ওদের কি অস্ত্র আছে, সরকার সবাইকে একসাথে ধরে মেরে ফেলে না কেনো ইত্যাদি। ৪০ মিনিটের ক্লাস হয়ে গেলো প্রায় দেড় ঘন্টার। মিস ম্যাপেল শেষে এসে বললেন, মাসুদ এবং আমাকে অনেক ধন্যবাদ ওদেরকে সুন্দর কিছু বলার জন্য এবং আমি টাইম দেওয়ার জন্য।
ওদের স্কুল দেখে একটা জিনিষ বুঝলাম, স্কুলের প্রতিটি দেওয়ালে দেওয়ালে হরেক রকমের ইনফর্মেশন, ম্যাপ, বিভিন্ন সংবাদ এবং বিশেষ ব্যক্তিদের ছবি সহ তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী। মাসু মাত্র ক্লাস এইটে পড়ে। ওদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক বাস্তব ধর্মী। বিভিন্ন ধর্মের ছেলেমেয়েরা আহে। কয়েকজন মুসলমান ছাত্রো এবং ছাত্রীকে দেখলাম। ছাত্রীরা ছোট ছোট হেজাব পড়ে আছে। আমাকে দেখে সালামও দিয়েছে।
সুন্দর একতা সময় কাটলো আজ কে মাসুদের স্কুলে।
১৬/১১/১৯৯৫-আমেরিকা গমন- উইজার্ড ৯৫
Categories
বহুদিন ধরেই আমেরিকায় যাবো যাবো করে যাওয়া হচ্ছে না। এখান থেকে আমেরিকা মাত্র ৪৫ মিনিটের ফ্লাইট জার্নি। হাবীব ভাইয়ের সাথে প্রায়ই কথা হয়। হাবিব ভাইও আমাকে বারবার যাওয়ার জন্য বলছেন। অনেকে আবার একবার আমেরিকার ভিসা লাগানোর কথা বলছেন। এ জাতীয় ব্যাপারে আমি বড় উদাসীন। তারপরেও এতো কাছাকাছি এসে ভাইয়ার কাছে যাবো না এটা হয় না। তাই ভিসার জন্য এপ্লাই করেছিলাম, ভিসা পেয়েছি এক বছরের মাল্টিপ্যাল ভিসা। কেএলএম বিমানে টিকেট কাটা হয়েছে, ১৫ নভেম্বর, অর্থাৎ গতকাল। আমার ফ্লাইট সিডিউল হচ্ছে হাইতি-লোগান (বোষ্টন) সরাসরি।
যেহেতু বিমান বন্দরের সবাই আমাকে চিনে এবং এখানেই আমার ডিউটির জায়গা। ভাবলাম, শেষ মুহুর্তে গেলেও কোনো অসুবিধা নাই। আমার ফ্লাইট বিকাল ৫ টায়। ভিভিআইপির মতো ইমিগ্রেশনে গেলাম প্রায় সাড়ে চারটায়।
ওমা। গিয়ে দেখি বিমানের ডোর ইতিমধ্যে ক্লোজ হয়ে গেছে। ওরা তো আর জানতো না যে, আমি এই বিমানের যাত্রী। তাদেরকে আমি আগে থেকেও জানাই নাই। ফলে দোষটা যে আমার এটাতে কোনো সন্দেহ নাই। ইমিগ্রেশন অফিসার জানালো যে, স্যার, এখন তো আর কোনোভাবেই আপনাকে ঢোকানো সম্ভব না। আপনি এক কাজ করেন, নেক্সট ফ্লাইট আছে রাত আটটায়। কিন্তু ওটা সরাসরি না গিয়ে জেএফকে হয়ে তারপর কানেক্টিং ফ্লাইটে বোষ্টন এয়ারপোর্ট লোগানে যেতে হবে। কিছুই করার নাই।
ফলে আমি ওদেরকে বললাম, সেভাবেই তাহলে আমার ইমিগ্রেশন করে রাখেন। ওরা আমাকে একটু আগেভাগেই এম্বারকেশন টিকেট হাতে ধরিয়ে দিলো। কিন্তু এবার যাচ্ছি আমেরিকান এয়ারলাইন্সে। কেএলএম বাদ। আমার ভাই জানেন যে, আমি কেএলএম বিমানে সরাসরি ফ্লাইটে লোগানে নামবো। আমি এই চেঞ্জটা আর ভাইয়াকে জানাই নাই কারন যেহেতু যাচ্ছিই আর আমি যে এই রকম একটা বোকার মতো কাজ করে ফেলেছি সেটা আর জানাতে চাই নাই।
ঠিক সময় মতো আমেরিকান এয়ারলাইন্স বিমান জেএফকে এর উদ্দ্যেশে ছেড়ে দিলো। কাছাকাছি আসার পর পাইলট জানালেন, লোকাল আবহাওয়া অত্যান্ত খারাপ, বরফে আচ্ছাদিত এয়ারপোর্ট। আমরা নামার চেষ্টা করছি। কয়েকবার এটেম্পট নেবার পরেও পাইলট সম্ভবত নামার ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছিলো না। প্লেন নামলো রাত মোটামুটি সাড়ে নয়টায় এবং আমাদের লাগেজ পেতে পেতে আরো আধা ঘন্টা সময় পেড়িয়ে গেলো। যেহেতু এটা সরাসরি ফ্লাইট ছিলো না, ফলে জেএফকে থেকে আরেকটা আমেরিকান এয়ারলাইন্সের প্ল্যান ছেড়ে যাবার কথা রাত সোয়া দশটায়। আমি খুব তাড়াহুরা করছি। অনেক পেসেঞ্জার ইমিগ্রেশনের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করা যাবে না।
জেএফকে এয়ারপোর্টে পেসেঞ্জার লাইনে পেসেঞ্জারদের ইমিগ্রেশন সুবিধার জন্য কর্তৃপক্ষ চারটি লেনে সাইন বোর্ড দিয়ে রেখেছেন। প্রথম সারি হচ্ছে যারা প্রথম আমেরিকায় এসেছেন তাদের জন্য, ২য় সারি হচ্ছে যারা ডিপ্লোম্যাট তাদের জন্য, তৃতীয় সারি হচ্ছে যারা ২য় বার আমেরিকায় এসেছেন তাদের জন্য। আর ৪র্থ সারি হচ্ছে শুধুমাত্র আমেরিকানদের জন্য।
আমার বুঝতে কোনো অসুবিধা নাই। আমি ১ম আমেরিকায় এসেছি। ফলে আমি ১ম সারিতেই ঢোকে গেলাম। খুব বেশি লোক নয়। আমার টার্ন আসতে মাত্র ৪ জন বাকি। যেইমাত্র আমি ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে দাড়ালাম, তিনি একজন বয়স্ক মহিলা, আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালেন। আমি জিন্সের একটা প্যান্ট পড়া একটা ওভারকোট কাধে ঝুলানো। হাতে ছোট একটা ব্যাগ।
মহিলা অনেক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে কি যেনো ভাবলেন। প্রেমে পড়েছে কিনা বুঝতে পারছি না, আর প্রেমে পড়লেও লাভ নাই, আমার স্ত্রী এই বয়ষ্ক মহিলার থেকে ঢেড় সুন্দুরী। কিন্তু ওনার চোখ মুখ প্রেমের কথা বলছেনা, বলছে কিছু একটা ভুল হচ্ছে আমার সাথে। তিনি আমাকে একটু ভিতরে ডেকে নিয়ে গেলেন এবং ইমিগ্রেশন পুলিশকে কি যেনো বললেন।
হটাত করে তিন চার জন ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাকে এমনভাবে জেরা করা শুরু করলেন, আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ইংরেজী ভাষা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নাই, আমি ইংরেজীটা বাংলার মতোই ভালো বলতে পারি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ করে রেগে গেলে আমি বাংলার চেয়ে ইংরেজিতেই বেশি কথা বলতে সাচ্ছন্দ বোধ করি। তাই আমারও জেরা করতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তাদের ধারনা, আমি জাল ভিসা নিয়ে আমেরিকায় ঢোকার চেষ্টা করছি। এই ভিসা আমার নয়।
আমি বললাম, কেনো জাল ভিসা হবে?
তারা বল্লো যে, তারা বাংলাদেশ, পাকিস্থান, ইন্ডিয়ার পাসপোর্ট দেখলেই অনেক বেশী সতর্ক হয়ে যান, কারন বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এই তিন দেশের লোকেরা জাল ভিসা নিয়ে আমেরিকায় আসার চেষ্টা করে।
আমি বললাম, কে কি করলো, সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। আমি জাল ভিসা নিয়ে আমেরিকায় ঢোকবো কেনো? আমেরিকা এমন কি মধুর দেশ যে, আমাকে এই কাজ করতে হবে? তোমরা আমেরিকাকে কি মনে করো? সর্গরাজ্য?
আমার এমন কথায় পুলিশ একটু সতর্ক হয়ে গেলো। আমার কথার মধ্যে কোনো জড়তা ছিল না বরং ছিলো প্রচন্ড রাগ। তারা আমাকে আবার বল্লো যে, আমার ছবির সাথে নাকি আমার পাশপোর্টের ছবি মিল নাই। আমার মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো।
আমি বললাম, তাহলে পাশপোর্টে কি আমার দাদার ছবি নাকি আপনাদের প্রেসিডেন্টের ছবি লাগানো লাগানো যে আমাকে চেনা যাচ্ছে না? তারা আসলেই আমাকে নিয়ে বেকায়দায় পড়ে গেলো। এই রকম টাস তাস করে তো জাল ভিসাধারী কথা হয়ত কখনো বলে নাই বা বলে না। তাহলে কি কোনো ভুল হচ্ছে আমার সাথে?
আমি বললাম, আমার কানেক্টিং ফ্লাইট আছে সাড়ে দশটায়। যদি মিস করি, আমি আপনাদের দায়ী করবো এবং আমি সময়মতো আমার নেক্সট ষ্টেশনে পৌছতে চাই।
এবার আরো কিছু নতুন পুলিশ আসলো। আমাকে দেখলো, আমার পাস্পোর্ট দেখলো, তারপর বল্লো, স্যার আপনার কাছে কি আরো কোনো ছবি আছে? তারা আমার সাথে কোনো প্রকার ফালতু ব্যবহার করছে না, বরং আমিই একটু উত্তেজিত হয়ে কথা বলছি। কারন, আমি খুব এম্বেরাসড হচ্ছিলাম মনে মনে।
বললাম, দেখতে হবে, আমার ব্যাগে ছবি আছে কিনা। আমি ব্যাগ চেক করতে গিয়ে প্রথমে বেরিয়ে এলো আমার জাতিসংঘের আইডি কার্ড। পুলিশ সাথে সাথে ঐ আইডি কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখে বল্লো, স্যার আপনি কি জাতিসংঘে কাজ করেন?
বললাম, হ্যা।
এবার তাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলে গেলো। এবার তারা আমাকে বল্লো, ওহ স্যার, আপনি আগে কেনো বলেন নাই যে, আপনি জাতীসংগে কাজ করেন, তাহলে তো এতো বিরম্বনা হতো না?
আমাকে এবার তারা এতো সমীহ করে কথা বলা শুরু করলেন যে, তারা যেনো এখন অপরাধি আর আমি পুলিশ। বলি এবার ব্যাপারটা কোথায় তাদের ধান্দায় ফেলেছিলো।
ব্যাপারটা দাড়িয়েছিলো এই রকমঃ
আমি যখন আমেরিকার ভিসার জন্য এপ্লাই করি, হাইতির কন্সুলেট অফিস আমাকে ডিপ্লোম্যাট ভিসা ইস্যু করেছিল। যেহেতু আমি ডিপ্লোমেটিক হিসাবেই জাতীসংগে কাজ করছি। এটা আমার জানা ছিলো না। আমার ডিপ্লোমেটিক ভিসার কারনে আমার দাড়ানোর কথা ২য় সারিতে। যেহেতু আমি জানতাম না যে আমি ডিপ্লোমেট ভিসায় এসেছি, ফলে আমি এইবারই যেহেতু প্রথম আমেরিকায় এসেছি, ফলে আমি ২য় সারিতে না দাঁড়িয়ে দাড়িয়েছিলাম ১ম সারিতে। এতে ঐ বয়স্ক মহিলার প্রথম সন্দেহ হয় যেহেতু বাংলাদেশী পাসপোর্ট, আবার ভুল জায়গায় দাড়িয়েছি। বয়স্ক মহিলা বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন কারন আমার বয়স অল্প, ডিপ্লোম্যাট হবার মতো নয়। এদিকে সাধারনত ডিপ্লোম্যাটরা স্যুট টাই পড়ে এক্সিকুইটিভ হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে চলাচল করেন, আর আমি জিন্সের একটা প্যান্ট তাও আবার ওভারকোট যেটা নিয়েছি সেটা কাউ বয়ের মতো কাধে ঝুলিয়ে দাড়িয়েছি।
এতোগুলি অসামঞ্জস্যতা মহিলা সমন্নয় করতে পারছিলো না। ফলে তাঁর সন্দেহ হবারই কথা। তিনি আমাকে পুলিশের কাছে পাঠিয়েছিলেন ব্যাপারটা ভেরিফাই করার জন্য। কিন্তু এটা তো আর আমার জানার কথাও না আবার দোষও না।
আমি রীতিমত অফেন্ডেড ফিল করছিলাম এবং বললাম, আপনাদের কমপ্লেই রেজিস্টার আনুন, আমি আন্তর্জাতীক পেসেঞ্জার হিসাবে এয়ারপোর্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবো। আমি জানতাম, যদি আমাকে এইভাবে হেনস্থা করার জন্য যদি মিলিয়ন ডলারের মামলা করি, সরকার সেটা আমাকে দিতে বাধ্য এবং ইমিগ্রেশন পুলিশেরও শাস্তি হবে। তারা ব্যাপারটা ততক্ষনাত সামাল দেওয়ার জন্য আমাকে অনেক অনুনয় বিনয় করে বল্লো, স্যার, আমরা আসলে বুঝতে পারি নাই ব্যাপারটা। অভিযোগ আপনি করতে পারেন কিন্তু আমরা দুক্ষিত।
তারা তাদের ভুলটা যে একেবারে অমুলক নয় সেটা প্রমান করার জন্য আমাকে অনেক অনুরোধ করে প্রায় ৫০ গজ দূরে একটা রুমে নিয়ে গেলেন। কফি খাওয়ালেন এবং ঐ রুমে নিয়ে আমাকে যা দেখালেন, তা দেখে আমি হতবাগ। সেখানে বেশ কিছু বাঙ্গালী, পাকিস্তানী এবং ইন্ডিয়ান পেসেঞ্জারকে পিছনে হাত বেধে রাখা হয়েছে জাল ভিসার কারনে। তাদেরকে প্রপার ইন্টারোগেশন করে প্রমান করেছে যে তারা জাল ভিসায় আমেরিকায় ঢোকার চেষ্টা করেছে। এখন তাদেরকে আগামী কাল ফিরতি ফ্লাইটে যার যার দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
যাই হোক, আমি ব্যাপারটা বুঝেও না বুঝার ভান করলাম। এবার আরো সিনিয়র একজন পুলিশ এসে আমাকে বল্লো, স্যার, আজ সমস্ত কানেক্টিং ফ্লাইট বন্ধ কারন এতো তুষারপাত হচ্ছে যে, কোনো এয়ারপোর্টই ক্লিয়ারেন্স দিতে পারছে না। গত ২৫ বছরেও আমেরিকায় এতো পরিমান তুষারপাত হয় নাই। তাই আজকের এই তুষারপাতের কারনে এর নাম দেওয়া হইয়েছে "উইজার্ড ৯৫"। আগামিকাল বলা যাবে কখন কোন কোন ফ্লাইট যেতে পারবে। ইতিমধ্যে কয়েকটা ফ্লাইট নামার সময় মারাত্তক দূর্ঘটনায় পতিত হয়েছে। আজকে আপ্নারা যারা আমেরিকায় এসেছেন, তাদেরকে এই এয়ারপোর্টেই থাকতে হবে অথবা আপনাদেরকে রুম দেওয়া হবে, সেখানে আপনি থাকতে পারবেন। তবে স্যার, যেহেতু আপনার সাথে আমাদের একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে, আমরা আপনাকে একটা কিছু দিয়ে অনার করতে চাই যদি অভিযোগ না করেন।
আমি কিছুই বললাম না। এরপর সে আমাকে আরো একটি রুমে নিয়ে গেলেন। বেশ কিছুক্ষন পর আমার হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি যে কয়দিন এখানে থাকবেন, এই কার্ডটি দিয়ে যাইই কিনবেন, সব ট্যাক্স মাফ। এটা আমেরিকার ট্রেজারী ব্রাঞ্চ থেকে এবং এস এস ডিপার্টমেন্ট থেকে আপনার জন্য অনার। তারা আরো একটা অনার আমাকে করলেন, সেটা হল তাদের কাছে কিছু ভিআইপি রুম থাকে সেখানে নেক্সট ফ্লাইট না ছাড়া পর্যন্ত আমি থাকতে পারবো। যখন কোনো ফ্লাইট লোগানে যাবে, তারাই আমাকে ডেকে ফ্লাইটে তুলে দেবেন।
দেখলাম, খামাখা কেচাল করে লাভ নাই। আর আমি অভিযোগ করার পর আবার কোন ঝামেলায় পরে যাই তাই কি দরকার এইসব করে যখন তারা আমাকে এতো করে সম্মান দেখাচ্ছেন। আমি কার্ডটি নিলাম। আমি তখনো জানি না এই কার্ডের আসল মাহাত্য কি। তারপরেও সাথে করে নিয়ে গেলাম। কার্ডে আমার ছবি আছে যেটা ওনারা ইমিগ্রেশন করার সময় ওয়েব ক্যামে নিয়েছিলেন।
আমি ইমিগ্রেশন অথোরিটির নির্ধারিত স্যুটে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি ৬ ফুট লম্বা আরেক নিগ্রো পুলিশ অফিসারও আমার সাথে আছেন। তিনি ঐ স্যুটের দায়িত্তে।
আমি পুলিশ অফিসার (নাম তাঁর ফ্রান্সিস) কে জিজ্ঞেস করলাম, আমি যেনো সিগারেট খেতে পারি এমন একটা রুম দেয়। সে জানালো, এখানে সিগারেট খাওয়া যায় না। কিন্তু একটা করিডোর আছে সেখানে গিয়ে খাওয়া যায়। সে নিজেও সিগারেট খায় বলে মুচকি হেসে দিয়ে বল্লো, You Major must be a bad man like me, because we both smoke.
তখন রাত বেজে গেছে প্রায় বারোটার উপরে। আমি করিডরে দাঁড়িয়ে দেখালাম, বাইরে অনেক সাদা সাদা বরফ। আমার জীবনে আমি কখনো বরফ দেখি নাই। এইই প্রথম। ছুতে চাইলাম, ফ্রান্সিস আমাকে বল্লো, তুমি ওখানে যেও না, প্রচন্ড ঠাণ্ডা। চারিদিকে বিমান বন্দরের আলো কিন্তু এতো বরফ পড়ছে যে, বেশিদূর দেখা যায় না। বরফের বৃষ্টি এইই আমি প্রথম দেখে খুব ভালো লাগছিলো।
ভাবলাম, এবার ভাইয়াকে একটা ফোন করে বলি যে, আমি জেএফকে এয়ারপোর্টে আটকা পড়েছি, চিন্তা করো না। কারন ইতিমধ্যে আমার সিডিউল অনুযায়ী আমার লোগানে থাকার কথা। অনেকবার চেষ্টা করেও ভাইয়াকে পেলাম না। বারবার ভুল নাম্বারে চলে যাচ্ছে ফোন। ওপাশে যিনি ফোন ধরছেন, তিনি একসময় বিরক্ত হয়ে কি যেনো বলছিলো আমাকে, সেটা আমি ভালোমত বুঝতেও পারছিলাম না। কিছু আমেরিকানরা ভালোমত ইংরেজীও বলতে পারে না। নোয়াখালি টাইপের ইংরেজী বললে কি আর আমি বুঝবো? সে মনে হয় আমেরিকান নোয়াখালির লোক।
যাক, রাতে আর ঘুমানোর প্ল্যান করছিলাম না যদিও আমার রুম আছে। বাইরেই ফ্রান্সিসের সাথে প্রায় ১ ঘন্টা সিগারেট খেয়ে গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। ভালোই লাগছিলো। সে আসলে আমেরিকার অরিজিনাল লোক নয়। সে জ্যামাইকার মাইগ্রেটেড অফিসার। প্রায় ১৫ বছর আগে তাঁর পরিবার এখানে মাইগ্রেট করেছিলো। অনেক গল্প বল্লো। তাঁর ছেলেমেয়েদের কথা। তাঁর পরিবারের কথা। আর আমি বললাম, আমার আজকের ইমিগ্রেশনের বাজে ইন্সিডেন্টের কথা। সে খুব হাসলো। বল্লো, তুমি তো ইচ্ছে করলে অভিযোগ করলে বেশ কিছু কম্পেন্সেশন পেতে পারতা। আমেরিকা এইসব অভিযোগকে খুব ভয় পায়। ফ্রান্সিস জানালো, তাঁর ডিউটি আছে, যেতে হবে।
ফ্রান্সিস যাবে এমন সময় একজন মহিলা কোথা থেকে উদয় হয়ে আমাকে সিগারেট খেতে দেখে লাইটারের জন্য এগিয়ে এলো। বুঝলাম, সে সিগারেট খায়। এটাও আমার কাছে নতুন একটা অভিজ্ঞতা। মহিলারা স্মোকার। সেও আটকা পড়েছে এই উইজার্ড-৯৫ এ। যাবে ডেনভার। আমি এখানের কোনো রাজ্যই চিনি না।
ফ্রান্সিস চলে গেলো আর বলে গেলো, সিগারেট খাওয়া হয়ে গেলে যেনো রুমে চলে যাই, ওখানে কিছু ড্রাই ফুড আছে, ইচ্ছে করলে আমি সেসব বিনে পয়সায় খেতে পারি, কোনো বিল উঠবে না। আর এও বলে গেলো, ফ্লাইট চালু হলে সে আমাকে নিয়ে যাবে, কোনো অসুবিধা নাই। এখন মনে হচ্ছে, ইমিগ্রেশনে ঝামেলা হয়ে ভালোই হয়েছে। সুফল পাচ্ছি।
মহিলা আমার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে আর আমি কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাবো, কি করি, এইবারই আমেরিকায় প্রথম কিনা ইত্যাদি গল্প জুরে দিলো। যখন সে শুনলো আমি মেজর এবং জাতীসংগে কাজ করছি, তিনি একটু খুশী হয়েছেন বলে মনে হলো। কারন তাঁর একটা ছেলে আছে যে, আমেরিকার নেভিতে কাজ করে। বর্তমানে সে মালয়েশিয়া আছে। মহিলার নাম লিন্ডা।
আমি বললাম, আপনার এতো বড় ছেলে আছে যে কিনা নেভীতে কাজ করে? আপনাকে দেখে তো সে রকম মনে হয় না?
সে বেশ খুশি হলো মনে মনে যে, আমি তাকে অনেক ইয়াং বলে ভাবছি বলে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, বলেন তো, আমার বয়স কত হবে?
মনে মনে ভাবলাম, পৃথিবীর সমস্ত মহিলারা তাদের বয়স বাড়তে দেয় না। বয়স যাই হোক, সে সেটা গোপন রেখেই কম বয়সটা বলে থাকে আর কেউ তাকে ইয়াং বলুক সেটাই চায়। এটা হোক বাঙ্গালী মেয়ে আর হোক আমেরিকার ইংরেজী বলা কোন নারী। আমি চিন্তা করলাম, যদি উনার ছেলে নেভীতে কাজ করে, তাহলে কমপক্ষে ছেলের বয়স ২০। আর এই মহিলা যদি অন্তত ২০ বছর বয়সেও বিয়ে করেন, তাহলে মহিলার বয়স এখন প্রায় ৪০!। আমি বললাম, আপনার বয়স হয়তোবা ৪০ হবে।
ওরে বাপ, তাঁর চেহাড়াই বদল হয়ে গেলো। মনে হলো তাকে ৪০ বলায় তিনি ক্ষিপ্ত। হয়ত আশা করেছিলো আমি ২৫ বা ৩০ বল্বো।
লিন্ডা বল্লো, আমি কি এতোই বুড়া দেখাচ্ছি মেজর?
বুঝলাম, ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু এখন তো আর শোধরানোর কোনো পথ দেখি না। আমি বললাম, যদিও তোমার বয়স ৪০ হতে পারে কিন্তু তোমাকে ৩০ এর বেশী লাগে না।
খুশী হলো না। সিগারেট খাওয়া শেষ হলেই লিন্ডা আমাকে কোনো প্রকার সম্মোধন ছাড়াই বিদায় নিলো। আর বল্লো, ধন্যবাদ লাইটারের জন্য। বাই। বলে গট গট করে তাঁর হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে চলে গেলো। একবার পিছন ফিরে তাকালোও না। হায়রে মহিলাদের বয়স।
আরেক অভিজ্ঞতা হলো। বয়স যাই হোক, আমি আর কোনো মহিলাকে ৩০ এর বেশী বলব না বলে শিক্ষা পাইলাম। তাঁর বয়স ৯০ হলেই কি আর ৩০ হলেই কি। আমার তো কিছু যায় আসে না। কিন্তু খুশী তো করা গেলো কাউকে!! এইবা কম কি। কিসের পাল্লায় পড়লাম রে ভাই। প্রতি ক্ষনে ক্ষনে অভিজ্ঞতা বাড়ছে।
রাত তিনটার দিকে ফ্রান্সিস এলো রুমে। এসেই বল্লো, মেজর, তুমি কি এখন যাবা? একটা ফ্লাইট যাচ্ছে বোষ্টনে। লোকাল ফ্লাইট। ইথিউপিয়ান এয়ারলাইন্স। যদি যাও তাহলে ১০ মিনিটে রেডি হও, আমি নিয়ে যাবো। বললাম, এতো রাতে গিয়ে কি করবো। সকালে কোনো ফ্লাইট নাই?
ফ্রান্সিস বল্লো, সেটা এখনো ডিক্লেয়ার দেয় নাই। আমার মনে হয় তোমার যাওয়া উচিত কারন পুরু বিমান বন্দরে যে পরিমান যাত্রী আটকা পড়েছে, সকালের ফ্লাইট না ধরে তুমি বরং লোগানে গিয়ে নেমে যাও। আমরা তোমাকে ট্যাগ করে দেই যদি ওখানে রেষ্ট করার জন্য কোনো রুম লাগে সেটাও পাবা। আমরা তোমাকে একটা স্লিপ দিয়ে দেবো, সেটা লোগানে দেখালেই তুমি একটা ভালো রুম পাবে যদি চাও। সিদ্ধান্ত নিলাম, চলেই যাই। ফ্রান্সিস আমাকে চট করে একটা এয়ার ট্যাক্সিতে করে একেবারে বিমানের সামনে নিয়ে গেলো। ব্যাগপত্র ফ্রান্সিস নিজেই ক্যারি করে নিয়ে গেলো। আমি ইথুপিয়ান বিমানে উঠে গেলাম।
ফ্রান্সিসকে বিদায় দিতে আমার কষ্ট হচ্ছিলো, হয়তো ওর সাথে আমার আর দেখা হবে না। হ্যান্ডশেখ করতে গিয়ে বললাম, ফ্রান্সিস, তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমি তোমাকে মনে রাখবো। ফ্রান্সিস হেসে দিয়ে বল্লো, এটাই মজা। মিসিং পিপল সো সেডলী। তুমিও ভালো থেকো। একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে দিলো যদি কখনো এখানে আবার আসি, যেনো ওর মোবাইলে কল করি। কার্ডটা যত্ন করে পকেটে রাখলাম। আমি এখন প্লেনে বসে পড়েছি। অনেক পেসেঞ্জার, যদিও লোকাল প্লেন কিন্তু বেশ বড়। বেশীরভাগ মানুষই মনে হচ্ছে লোগানের বাসিন্দা। আমি একজন বয়স্ক মহিলার পাশে বসেছি। বয়স তাঁর প্রায় ৬০ এর কাছাকাছি।
প্রায় আরো ৪০ মিনিট ফ্লাই করে লোগানের উপর দিয়ে প্লেন হোবার করছে। এখানেও নামতে মনে হয় দেরী হবে। অনেক বরফে জমে আছে বিমান বন্দর। পাইলট জানালেন, আমরা নামতে নামতে আরো ১৫ মিনিট দেরী হবে।
আমরা শেষতক খুব নিরাপদেই নামলাম। লাগেজ নিতে যেতে হবে অনেক দূরে। প্রায় ১ কিলোমিটার দূর আমাদের লাগেজ ডেলিভারী পয়েন্ট। আমরা নেমেছি সি ব্লকে। একেকটা ব্লক এতো বড়? আমাদের জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টও তো ওদের একটা ব্লকের সমান না!!
লাগেজ নিলাম। এবার ভাইয়াকে ফোন করা উচিত। এয়ারপোর্টেই টেলিফোন বুথ আছে। পঞ্চাশ সেন্ট ড্রপ করে কথা বলা যায়। আমার কাছে মাত্র একটা কয়েন আছে। ডলার আছে কিন্তু আমার কাছে তো আমেরিকার কয়েন নাই। এদিকে কয়েন ছাড়া ফোন করা সম্ভব না। যাই হোক, কোথায় কয়েন পাবো সেটাও জানি না। যে কয়েনটা ছিলো সেটা দিয়েই চেষ্টা করলাম। ঐ একই সমস্যা। ভুল নাম্বারে ফোন চলে যাচ্ছে এবং একই বাসায় যাচ্ছে। আমি ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতেছিনা, আরে বাবা, যদি ভুল নাম্বারেই যাবে, তাহলে একই নাম্বারে যাচ্ছে কেনো?
এইবার ঐ পাশের ভদ্রলোক মনে হয় ব্যাপারটা বুঝতে পারছে যে, আমি কিছু একটা ভুল করছি। সে আমাকে বল্লো, আমি আসলে কোথায় ফোন করছি? এবার তাঁর কথাগুলি আমার কাছে ক্লিয়ার মনে হলো। আমি বললাম, এটা কি এই নাম্বার?
সে বল্লো, হ্যা, এটা এই নাম্বারই যেটা আমি বলেছি।
বললাম, আমি আসলে আমার ভাইকে ফোন করছিলাম যিনি থাকে বোস্টনে। এবার তিনি ব্যাপারটা বুঝে ফেললেন। বললেন, আপনি যেখানে আছেন, সেটা লোগান, যদিও ম্যাসাচুসেট এর অধীনে। আপনি আপনার নাম্বারের সাথে একটা ১ যোগ করেন, তারপর ডায়াল করেন, আপনি আপনার ভাইকে পেয়ে যাবেন। যদি ১ যোগ না করেন, তাহলে বারবার আমার নাম্বারেই কল আসতে থাকবে। আর এরইমধ্যে আমার কয়েন শেষ, লাইন কেটে গেলো। আমার কাছে আর কোনো কয়েনও নাই। কি মুশকিল। ভালো লাগলো অন্তত এটা জেনে যে, এবার আর ভুল হবে না। ভাইয়াকে ফোনে অন্তত পাওয়া যাবে।
কোথায় পাই কয়েন? একটা দোকানে ঢোকলাম এইভেবে যে, কিছু কিনি এবং কয়েন নেই। কিন্তু কোনো চেষ্টাই সফল হচ্ছে না। কয়েনের যোগাড় হচ্ছে না। হটাত দেখলাম, একজন পুরুষ ক্লিনার ফ্লোর ক্লিন করছে। ভাবলাম, তাকে জিজ্ঞেস করে দেখি সে আমাকে কিছু কয়েন দিতে পারে কিনা। লোকটিকে বলার সাথে সাথে সে বল্লো, তাঁর কাছে ৩ ডলার পরিমান কয়েন আছে। সেটা সে ৫ ডলার হলে দিয়ে দেবে। আরেক অভিজ্ঞতা। সব দেশের ৪র্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের এই এক সমস্যা। ধান্দাবাজী। মেনে নিলাম। কারন আমার কাছে এক টাকাও যা, এক ডলারও তা সেটাই মনে হচ্ছে এখন পর্যন্ত। আমি তাকে ৫ ডলারের একটা নোট দিয়ে ৩ ডলার সম পরিমাণ কয়েন নিলাম।
আমি ঐ ভদ্রলোকের কথা মতো ভাইয়ার বাসার নাম্বারের আগে ১ যোগ করে যেই না ডায়াল করেছি, অপর প্রান্ত থেকে আমার ভাবী ফোন ধরলেন। তিনি এতোই অবাক হলেন আমার ফোন পেয়ে যেনো কেদেই দিলেন। ভাবী বললেন, তুমি বেচে আছো? আমি বললাম, কেনো? আমি মরবো কেনো? কি ব্যাপার?
ভাবী বললেন, আরে ভাই, তুমি যেই প্ল্যানে লোগানে নামার কথা কাল, কেএলএম বিমান, সেটা নামার সময় ক্রাশ করেছে, বহু লোক চরম ভাবে আহত/নহত হয়েছে, কেউ কেউ বলছে মারাও গেছে এবং এখনো রেস্কিউ চলছে। তোমার ভাই তো তোমাকে খুজে খুজে পাগলের মতো অবস্থা। তুমি এখন কোথায় আছো?
আমি বললাম, আমি তো সি ব্লকে আছি। আর আমি তো জানি না যে, কেএলএম ক্রাশ করেছে। কোনো এক কারনে আমি তো ঐ ফ্লাইট মিস করে পরে আমেরিকান এয়ারলাইন্সে এসেছি জেএফকে হয়ে। এখন ইথুপিয়ান এয়ারলাইন্সে একটু আগে নামলাম। আমি ভালো আছি। এবার বলেন, ভাইয়াকে পাবো কিভাবে?
ভাবী এতোটাই আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন আমার সাথে কথা বলে যে, ভালোমতো কথাই বলতে পারছিলেন না। মরা মানুষের খোজ পাওয়া, চারটিখানি কথা তো আর না। ভাবী বললেন, তুমি যেখানে আছো সেখানেই থাকো, কোথাও যাবে না, আমি তোমার ভাইকে জানাচ্ছি। যেহেতূ তোমার কাছে মোবাইল নাই, তুমি কিন্তু ওখানেই থাকো। আর পারলে একটু পরে আমাকে তোমার কারেন্ট লোকেশানটা জানাও।
প্রায় ২০ মিনিট পর ভাইয়া হাজির। কি যে ভালো লাগলো ভাইয়াকে পেয়ে। ভাইয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, অনেক প্রেসারে ছিলাম তোকে নিয়ে। যাক আল্লাহর রহমত যে, তোকে ভালোভাবে পেলাম। তুই এখানে দাড়া, আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।
ভাইয়াকে নিয়ে আমি বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম। ভাইয়া নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। দুই ভাই, অনেক গল্প করতে করতে গাড়িতে আসছিলাম। চারিদিকে বরফ, রাস্তায় অনেক গাড়ি দিয়ে লোকজন রাস্তা ক্লিয়ার রাখার চেষ্টা করছে। প্রায় ৪০ মিনিট ড্রাইভ করে আমি আর ভাইয়া ভাইয়ার বাসার এসে হাজির হইলাম।
শান্তি। এক মাস থাকবো এখানে। মাসুদের সাথে দেখা হলো, ইউসুফের সাথে দেখা হলো। তখন বেলা প্রায় ১১টা দিন কিন্তু সূর্য মামার কোনো খবর নাই। চারিদিকে বরফের বৃষ্টি। গাছের চেহাড়া দেখলে মনে হয়, বরফের গাছ, আশেপাশের সবকিছু বরফে ঢেকে আছে। কি দেশ রে বাবা।
সারাদিন গল্প করলাম, বাইরে যাওয়ার কোনো স্কোপ নাই। ঘরের ভিতরে হিট করে ঘর গরম রাখা হচ্ছে। আমি আর মাসুদ এক রুমে থাকার প্ল্যান করেছি। ইউসুফ অন্য ঘরে। পুরু ঘরটাই কার্পেটে মোড়ানো। হাইতিতে গরম অথচ এখানে এসে পড়েছি উইজার্ড-৯৫ এর পাল্লায়। মানে শীতের দেশ।
১৫/১০/১৯৯৫-আলগোরের ভিজিট
কয়েকদিন যাবত অবর্ননীয় ব্যস্ততায় দিন কাটাচ্ছি। আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর হাইতিতে ভিজিটে আসবেন। সাথে আল গোরের স্ত্রীও আসবেন, এই জন্য। চারিদিকে অনেক কাজ, বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনীর বিভিন্ন প্রকারের নিরাপত্তা বিষয়ক ট্রেনিং, সেমিনার এবং রিহার্সেল, ইত্যাদি। ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের নিরাপত্তার জন্য চারটি লেয়ার নির্ধারন করা হয়েছে। ১ম লেয়ারে থাকবেন আমেরিকার ঈগল বেসের মিলিটারী, ২য় স্তরে থাকবেন আমাদের বাংলাদেশের সামরিক সদস্যগন, ৩য় স্তরে থাকবেন ইন্ডিয়ান এবং পাকিস্থান বাহিনী, আর ৪র্থ স্তরে থাকবেন সিভিলিয়ান পুলিশ প্লাস এয়ারপোর্ট সিকিউরিটির লোকজন। আমি কিউ আর এফ হিসাবে এস এস (সিক্রেট সার্ভিস) এর সাথে ১ম স্তর এবং ২য় স্তরের সাথে থাকবো। অর্থাৎ আল গোর যখন বিমান থেকে নাম্বেন, তখনো আমরা অর্থাৎ কিউ আর এফ দল তাঁর সাথে থাকতে পারবো। ভাইস প্রেসিডেন্টের গাড়ী বহরের সামনে পিছনে এস্কর্টে থাকবে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী। এর সাথে সিক্রেট সার্ভিসের লোকজনও।
আজ সকাল ৯টার সময়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট হাইতির বিমান বন্দরে নামলেন। সকাল থেকেই নিরাপত্তা খুবই জোরদার করা হয়েছে। নিয়মিত ফ্লাইট গুলির উপর অনেক করাকড়ি আরোপ করা হয়েছে। যাত্রীদের ইমিগ্রেশনে একেবারে কঠিন চোখ রাখা হচ্ছে। বাথরুম, এয়ারপোর্টের অলি গলি, লবি, সব জায়গায় কঠিন নজরদারী। হ্যান্ড লাগেজ গুলি চেক করা হচ্ছে আগের থেকে আরো বেশী। যাত্রীদের চেকিং করায় বেশী সময় নেওয়াতে ফ্লাইট গুলি, বিশেষ করে আউট গোয়িং ফ্লাইট গুলির যাত্রা বিলম্ব হচ্ছে। অন্যদিকে ইনকামিং ফ্লাইট গুলিরও যাত্রীদেরকে একটা সরল রেখায় যেতে বাধ্য করা হচ্ছে যাতে যাত্রীরা এদিক সেদিক না যায়। আমরা এরই মধ্যে কয়েক রাউন্ড দিয়ে ফেলেছি সব জায়গায়। সিসি ক্যামেরাগুলি চেক করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত যেনো কোনো একটা জায়গাও গ্যাপ না থাকে। ফুল কাভারেজ। এয়ারপোর্টের ছাদেও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে। যে সব জায়গায় আগে সংরক্ষিত ছিলো না, সহজেই কেউ যাতায়ত করতে পারতো, সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট বলে কথা।
আমাদের কাছে ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের এবং তাঁর স্ত্রীর ভিন্ন ভিন্ন ভিজিট সিডিউল দেওয়া আছে। ম্যাডাম এর নাম এলিজাবেদ টিপার। ভাইস প্রেসিডেন্ট বিমান বন্দরে নেমেই একটা বক্তৃতা দিবেন। তারপর তিনি চলে যাবেন প্রেসিডেন্ট এরিস্টিডের প্যালেসে। সেখানে তিনি এক বছর পূর্তি উপলক্ষে একটা ছোট খাটো ভাষন রাখবেন এবং হাইতির কেবিনেট সদস্যদের সাথে দি-পাক্ষীয় আলোচনা করবেন। কি নিয়ে আলোচনা করবেন তাঁর এজেন্ডা আমাদের কাছে নাই। অন্যদিকে ম্যাডাম এলিজাবেথ টিপার হাইতির একটি শহর সিটি সোলেতে স্বাস্থ্য কেন্দ্র ভিজিট করবেন। স্বাস্থ্য সেন্টারের নাম ও ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের স্ত্রীর নামের সাথে মিল আছেঃ এলিজাবেথ স্বাস্থ্য সেন্টার।
ঠিক ১১ টায় ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের অফিশিয়াল বিমান হাইতির এয়ারপোর্টে এসে নামলো। চারিদিকে সুনসান। কোনো দৌড়াদৌড়ি নাই। যার যার জায়গায় তারা কাজ করছেন। বিমানের দরজা খোলার পর আল গোরের দেহরক্ষীগন প্রথমে অস্ত্রসহ বিমানের গেট খুললেন এবং প্রায় ১০ মিনিট অব্জার্ভ করলেন পরিস্থিতি। অতঃপর ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর এবং তাঁর স্ত্রী একে একে বিমান থেকে বেরিয়ে এলেন। বিমানের ইঞ্জিন বন্ধ করা হলো না, সারাক্ষণ গেট খোলাই রাখা হলো। গেটে দুইজন শসস্ত্র পাহারা মূর্তির মতো দাড়িয়েই রইলেন।
বিমানের সামনেই একটা স্টেজ করা হয়েছিলো। যেখান থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর সবার উদ্ধেশে ভাষন দিলেন। আমরা খুব কাছ থেকে সেই ভাষণ শূনলাম কিন্তু সব সময় নজর ছিলো চারিদিকে যেনো কোনো অঘটন না ঘটে। এই সময় সমস্ত যাত্রিদের মুভমেন্ট সম্পুর্নরুপে বন্ধ করা হয়েছিলো। কারো বাথরুম দরকার হলেও এলাউ করা ছিল নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র আউত গেটে কয়েকটা ল্যাভাটরি স্থাপন করা হয়েছিলো, তাও আবার নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োজিত ছিলো। কারো অধিক জরুরী বাথরুমের প্রয়োজনে সেই আউটদোর ল্যাভাটরি গুলি ব্যবহার করতে পারবে।
প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর সবার উদ্দেশ্যে ভাষন দিলেন। এই ভাষনের সময় হাইতির প্রেসিডেন্ট হাজির ছিলেন না। আল গোর ভাষন শেষে গাড়িতে উঠবেন। ম্যাডাম টিপার ও তাঁর জন্য ভিন্ন মটরক্যাদ তৈরী ছিলো, তিনি আলাদা উঠবেন। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়।
আমি কখনো এই ধরনের নিরাপত্তায় কাজ করি নাই। ফলে প্রতিটি কাজ, ড্রিল, এবং স্তর আমার কাছে ছিলো নতুন। ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর যে গাড়িতে উঠবেন ঠিক সেই রকমের আরো তিনটা গাড়ি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলো। তিনি কোনটায় উঠবেন সেটা আমরাও জানি নাই। এটা জানে শুধু সিক্রেট সার্ভিসের লোক। তিনটা গাড়িতেই আমেরিকার ফ্ল্যাগ চড়ানো। একই ব্রান্ডের, একই চেহাড়া, একই কালার, সব কিছু এক। কালো গ্লাসে মোড়ান জানালা। বুলেট প্রুফ গাড়ি। যেই মুহুর্তে ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর ভাষন শেষ করলেন এবং গাড়িতে উঠার জন্য রেডি হলেন, অমনি দেখলাম, একোতা বলয় সৃষ্টি হয়ে গেলো। এবং খুব দ্রুত বলয়টা তৈরী হয়ে গেলো। এই চক্করের মধ্যে আমি এতো কাছে থেকেও বুঝতে পারলাম না ভাইস প্রেসিডেন্ট কোন গাড়িটায় উঠলেন। উঠার সাথে সাথে গাড়ির সামনে থাকা আমাদের এস্কর্ট এবং সিক্রেট সার্ভিসের দেওয়া এস্কর্ট গাড়ি এতো দ্রুত চলে গেলো যা একটা চমকের মতো। ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর হাইতির প্রেসিডেন্ট এরিস্টিডের প্যালেসে চলে গেলেন। থাকলেন ম্যাডাম টিপার।
ম্যাডাম টিপারের বেলায় ও ব্যাপারটা প্রায় একই রকমের ঘটলো। তাঁর সাথে দুইজন খুব সুন্দুরী মেয়ে বডি গার্ড হিসাবে সার্বোক্ষনিক থাকেন। আমি দেখলাম একজনমহিলা বডি গার্ড সবার সামনেই তাঁর উপরের জামাটা খুলে ফেললেন, কালো ব্রা দেখা যাচ্ছে, আর উপরের জামার পরিবর্তে এইবার তিনি একটা অস্ত্র সহহ জ্যাকেট পড়ে এতো দ্রুত ম্যাডামের গাড়িতে উঠে গেলেন যেনো বিদ্যুৎ। মেয়েটার বয়স সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ২৬ এর মধ্যে হবে। আমেরিকান মহিলা। ম্যাডাম প্রথম গাড়িটাতেই উঠলেন সেটা আমি ক্লিয়ার বুঝতে পারলাম।
ম্যাডাম টিপারকে নিয়ে আমাদের ব্যান কনের মেজর ফিরোজ এস্কর্টের কাজ করলো। আমরা পিছনের গাড়িতে ম্যাডামকে ফলো করছি। যাবো সিটি সোলের একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। ম্যাডাম ওখানে হেলথ সেন্টার দেখবেন, পরিদর্শন করবেন। সিটি সোল খুব বেশী দূর নয়। মাত্র ৪০ মিনিটের ড্রাইভ।
সিটি সোলে যাওয়ার পথে ঠিক সিটি সোলে ঢোকার পথেই হটাত দেখা গেলো বেশ অনেকগুলি জনতা রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে টায়ার পুড়িয়ে রেখেছে। ওরা ম্যাডাম টিপারের আগমনে আন্দোলন করছে এই কারন দেখিয়ে যে, ওদের জন্য যে টাকা পয়সা বরাদ্ধ হয়েছে, সেটা তাদের জন্য খরচ করছে না এরিস্টিড প্রশাসন। এর তীব্র প্রতিবাদে তারা ম্যাডাম টিপারের গাড়িতে আক্রমন। অনেক ইট পাটকেল ছুড়ে স্বাভাবিক এস্কর্ট গাড়ির বেশ কয়েকটা কাচ ভেঙ্গে ফেল্লো। আমাদের গাড়িও বুলেট প্রুফ (হাম্বি গাড়ী) এবং অন্তত দুইটা মাইন বিস্ফোরন থেকে রেহাই পায় এমন গাড়ি। মেজর ফিরোজ সেই ধরনের একটা গাড়ি এস্কর্টের কাজ করছিল। হেসিয়ান লোকজন চাচ্ছিলো ম্যাডাম টিপারকে পথে থামিয়ে দিয়ে কিছু একটা আদায় করতে। আমরা আসলে এই খবরটা পুর্বে জানতেই পারি নাই যে, সামনে এই ধরনের একটা প্রতিবাদ আন্দোলন হতে পারে। ব্যাপারটা একেবারেই স্পন্টিনিউয়াসলি ঘটে গেলো।
মেজর ফিরোজ আমাদের ওয়াকিটকিতে জানালো যে, সামনে বেশ গেঞ্জাম, স্থানীয় লোকজন রাস্তায় টায়ার পুড়িয়ে রাস্তা ব্লক করে রেখেছে এবং ভিভি আইপির গাড়িতে ঢিল ছুড়ছে। কি করা উচিত এখন? সবচেয়ে বড়সমস্যা হলো, এই ভি ভি আই পি কে নিয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমাদের নাই এবং নেওয়াও ঠিক না। কিন্তু এটাও বুঝতেছি যে, বেশীক্ষন এই অবস্থায় আটকে থাকলে সমস্যা আরো বেড়ে যাবে। এই খান থেকে যে কোনো উপায়েই বের হয়ে যাওয়া হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
মেজর ফিরোজ সহসাই তাঁর নেতৃীত্তে টায়ার পোড়া আগুনের উপর দিয়েই বুলেট প্রুফ গাড়ি চালিয়ে পার হয়ে যায়। সাথে অন্যান্য গাড়িগুলিও। এটা ছিলো খুবই একটা রিস্কি ব্যাপার। সফল হওয়াতে সবাই বাহবা দিলেন ঠিকই কিন্তু কোনো মেজর অঘটন ঘটে গেলে ব্যাপারটা দাড়াতো মারাত্তক। ম্যাডাম টিপার ব্যাপারটা খুবই উপভোগ করেছে বলে পরে সব বাংলাদেশীদেরকে প্রশংসা করেছেন। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয় নাই। ম্যাডাম টিপার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়ার পর সেখানেও অনেক লোকজন বিদ্রোহ করছিলো। তিন জন উত্তেজিত লোক তো কম্পাউন্দেই ঢোকে গিয়ে গাড়িতে ইট পাটকেল মারতে শুরু করে। টিয়ার গ্যাস ছুড়তে হলো বিদ্রোহী জনতাকে সামাল দিতে।
কিছুক্ষন পর হেসিয়ান বিদ্রোহী জনতারা আমেরিকার বিরুদ্ধেই স্লোগান দেওয়া শুরু করে এই বলে যার অর্থ এই রকম যে, গো হোম ইয়াংকি, গো। ইউ এন সদস্যদের গাড়িতেও তারা অনেক ইট পাটকেল ছুড়ে।
যাই হোক, খুব অসস্থিতেই গেলো দিনটা। কিন্তু আমাদের দেশের মিলিটারী সদস্যদের প্রশংসায় সিক্রেট সার্ভিস, ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর এবং ম্যাডাম টিপার অনেক মেসেজ দিলেন। এও বলে গেলেন যে, দেশে গিয়ে এই রকম একটা সাহসী পুর্ন কাজের জন্য "লেটার অফ এপ্রিশিয়েশন" ইস্যু করবেন। আমি জানি না সেটা আবার কি ধরনের কি।
যাই হোক, জাতিসংঘের মহাসচিব ভুট্রুস ঘালি গতকাল হাইতিতে এসেছেন। আজ বিকেলে ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর এবং মহাসচিব দুজনেই চলে গেলেন। একটা ব্যস্ত দিন গেলো সব মিলিয়ে। এয়ারপোর্টেই এই দুই ভিভিআইপি প্রায় ৩০ মিনিট একত্রে কি কি আলোচনা করলেন, তারাই জানে। এই সময়ে আমাদের নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিলো এতোটাই কঠিন যে, কোনো কেউ এর ভিতর দিয়ে পার পেয়ে যাবার মতো নয়।
১৪/১০/১৯৯৫-ভুট্রুস ঘালির হাইতি পরিদর্শন
আগে থেকেই দুটো খুবই ভিভিআইপির ভিজিট প্রোগ্রাম দেওয়া হয়েছিলো। প্রথমটা হলো জাতিসংঘের মহাসচিব ভুট্রুস ভুট্রুস ঘালি (সস্ত্রীক, লিয়া মারিয়া) এবং আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর (সস্ত্রীক, এলিজাবেথ টিপার)। অনেক প্রকারের কাজের মধ্যে এই দুটি ভিজিট নিয়ে প্রায় সব গুলি কন্টিনজেন্ট খুব ব্যস্ত। তাদের সিকিউরিটি বিশেষ করে। আজ দুপুরের দিকে জাতিসংঘের মহাসচিব ভুট্রুস ঘালি এবং তাঁর স্ত্রী লিয়া মারিয়া হাইতিতে এসেছেন। এই প্রথম আমি জাতিসংঘের মহাসচিবকে সরাসরি জীবন্ত চোখে দেখলাম। বেশ বয়স্ক লোক। তাঁর স্ত্রীও অনেক বয়স্ক। মহাসচিব ভুট্রুস ঘালি মিশরের লোক। প্রায় ৭০ এর উপর তাঁর বয়স।
আমাদের এস আর এস জি (Special Representative of Secretary-General) লাখদার ব্রাহিমী মহাসচিবকে সাদরে এয়ারপোর্টে রিসিভ করলেন। ভুট্রুস ঘালী এয়ারপোর্টে নেমেই সোজা চলে গেলেন হাইতিতে অবস্থিত ইউ এন হেড কোয়ার্টারে। সেখানে আমাদের যাওয়ার কোনো দরকার ছিলো না তবে আমাদের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার ফরিদ স্যার গেলেন।
আগামিকাল আবার আসবেন আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর। আমরা বিকালে তাঁর আগমনে অনেক প্রিপারেশন নিতে হলো। কোথায় কে কিভাবে নিরাপত্তা বিধান করবে সেতা একবার রিহার্সেল হলো। ব্যাপারটা মনে হচ্ছে যে, ভুট্রুস ঘালীর জন্য যে সব নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছে, তাঁর থেকে অনেক বেশী গুন নিরাপত্তা বলয় তৈরী এবং সে মোতাবেক প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই।
০৫/১০/১৯৯৩- মাকে মনে পড়ে
মাঝে মাঝে আমার মাকে খুব মনে পড়ে। আমার মা একজন অসামান্য personality সম্পন্ন মহিলা। তিনি শিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর ভিতরে অনেক গুন আছে। তিনি পাঁচ ওয়াক্কত নামাজ পরেন, কোন মিথ্যা কথা বলেন না। তাকে আমি ভীষণভাবে ভালবাসি। এইতো কদিন পর আমি ছুটি যাব এবং আমি তাকে দেখতে পাব। কিন্তুঁ এখনি তাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে। আমার মা আমাকে ভালবাসে তাঁর ছেলে হিসেবে তো অবশ্যই তবে ভালবাসে একজন রক্ষক হিসেবেও। আমি তাঁর পাশে আছি মানে সে আর কোন কিছুই ভয় পায় না। এই মাকে আমি ভালবাসি আমার জীবনের চেয়ে বেশি। আমি আজ পর্যন্ত আর কারও জন্য কাদিনি, কিন্তু আমার মণে হয় আমি মার জন্য অনেক বার কেদেছি কোন কারন ছাড়া। আমি আমার বাবাকে দেখিনি, আমার যখন জ্ঞান হয়েছে, আমি শুধু মাকেই দেখেছি। পাঁচজন কন্যা, আর একজন ছেলে, বড় ছেলে থাকে আমেরিকা এবং তাকে সব সময় ভয়েই থাকতে হয়। এটা কোন সাধারন পরিস্থিতি নয়। আমার মা তাঁর মেয়েদের ব্যাপারে অনেক কষ্ট তাঁর মনে আছে কিন্তু যার কোন সামর্থ্য নেই, সে কি করতে পারে? পারে শুধু কানতে আর একা একা বসে ভাবতে । আমরা সামর্থ্য নেই মাকে সাহায্য করবার। খুবই অল্প বেতনে চাকরি করি। আমি যখন ছুটিতে আসি, তখন আমার অনেক আজে বাজে কাজ থাকে যার জন্য আমি ঠিকমত সময়ও দিতে পারি না। গ্রামের কিছু অল্প শিক্ষিত বন্ধুবান্ধব যারা আমাকে খুব সমীহ করে, ওদের সঙ্গে সময় কাটাতে আমার খারাপ লাগে না। গ্রামের সরু পথ, যার দুপাঁশে ঘাস গজে আছে, রোডের পাঁশে কোন আলো নাই, অন্ধকার চারিদিকে, ফেরার পথে হাতে একটা সিগারেট, মন্দ না। পৃথিবীটা অনেক সুন্দর, আর এই সুন্দরের পিছনে মা একটা অনেক বড় ব্যাপার। যার সুন্দর এবং ভাল একটা মা আছে, তার সুন্দর একটা পৃথ্বী আছে। একটা ভাল মা একটা দেশের জন্য অনেক বড় ব্যাপার। সে নেতা তৈরি করে, সে আরও ভাল মা তৈরি করে, সে পৃথিবীটাকে গড়ে তোলে মধুর একটা পরিবেশ দিয়ে। তার প্রতিটি হাসিতে মায়ামমতা আর ভালবাসা আছে। আমার মা ঠিক তার মত। সে হাসলে আমার প্রান ভরে যায়, তার দুঃখে আমার চোখে জল আসে। আমি তাকে খুব ভালবাসি। আমি কখনো ভাবতে চাই না আমার কেমন যাবে দিনগুলো যখন আমার মা আর বেঁচে থাকবেন না। এখন আমার হাতে অনেক টাকা নাই, আমি চাইলেও আমি মাকে সাহয্য করতে পারি না কিন্তু আমি জানি একদিন আমার হাতে অনেক টাকা হবে এবং আমার কেন জানি খালি মনে হয়, মা তখন থাকবেন না। এটাই হবে সবচে দুঃখজনক।
৩০/০৯/১৯৯৫- হাইতির এয়ারপোর্টে প্ল্যান ক্রাশ
আমি, ক্যাঃ মুনীর, আর মেজর ফরিদ আমাদের ক্যাম্পের বাইরে একটা ছোট তাবুর আউটারে বসে আছি। ক্যাঃ মুনীর মালয়েশিয়ান হালাল ফুডের একটি প্যাকেট নিয়ে ওভেনে গরম করছে। এর ভিতরে মুরগীর মাংশ, চিজ, এবং কিছু রাইচ দেওয়া। বেশ খেতে। বেস ক্যাম্প থেকে ক্যাঃ জাহিদ এসেছে কিছুক্ষন আগে।
আমাদের প্রতিটি ক্যাম্পেই একটা করে ভিডিও ক্যামেরা থাকে। প্রয়োজন হলে আমরা এতার ব্যবহার করি। ক্যাঃ জাহিদ ভিডিও ক্যাম টি নিয়ে বাইনোকুলারের মতো বন্দরে বিমান উঠানামা দেখছে। সময়টা ধরা যায়, আড্ডার মতো। ফরিদ স্যার আগামী সপ্তাহের পেট্রোলিং সিডিউল বানাচ্ছেন। মাঝে মাঝেই আমাকে কাকে কখন দিলে কার সুবিধা হয় এতা নিয়ে আলাপ করছেন আর সিডিউল বানাচ্ছেন।
হটাত করে জাহিদের উচ্চস্বরে আমরা হচকচিয়ে গেলাম। জাহিদ এমনভাবে চিৎকার দিয়ে উঠলো যেনো মারাত্তক কিছু ঘটেছে।
আসলেই মারাত্তক কিছু ঘটেছে। আমরা পোর্ট অ প্রিন্স বিমান বন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্তে আছি। কিন্তু বন্দরের আভ্যন্তরীন ইমিগ্রেশি কিংবা চেকিং অথবা এক্সিট এইসব ব্যাপারে আমরা কোনো নাক গলাই নাও। এখানে বেশ কিছু প্ল্যান সারাদিনে উঠা নামা করে। একেবারে আমাদের চোখের সামনে। দেখতে ভালোই লাগে।
ঠিক এগারোটার সময় একটা ছোট সেসনা বিমান পোর্ট থেকে কিছুদূর উড্ডয়নের পরেই হটাত করে নীচে পড়ে গেলো। বিকট শব্দ আর বিশাল আগুনের ফুলকী। আমাদের ক্যাম্প থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে এসে সেসনাটি ভুপাতিত হলো। ক্যাঃ জাহিদ আসলে এমেচার হিসাবে এই সেসনার উড্ডয়নের ভিডিও করছিলো। ফলে সেসনাটি উড্ডয়নের সময় এবং পড়ে যাওয়ার সময়ের ভিডিওটা আসলেই অর ভিডিও ক্যামে রেকর্ড হয়ে গেলো।
বিমানটি মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর বিশাল হৈ চৈ শুরু হয়ে গেলো। ক্যাম্পের সৈনিক গন ভয়ে আতঙ্কিত। আর একটু পশ্চিম দিকে এসে বিমানটি ভুপাতিত হলেই আমাদের ঠিক ক্যাম্পের মাথায় এসে পরতো। ভাগ্যিস সেতা হয় নাই। তাহলে আরো বড় ধরনের সমস্যা হতো।
আমরা সবাই দৌড়ে গেলাম ঘটনাস্থলের কাছাকাছি। তখনো আগুন জ্বলছে। কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় ১ ঘন্টা পর আগুনের শিখা পরে যাওয়ার পর আমরা স্পটে ঢোকলাম। এর মধ্যে এফ বি আই, হেসিয়ান টেলিভিশন, আমাদের বেস ক্যাম্পের সিনিয়র অফিসার গন, এবং বিমান বন্দরের বড় বড় কর্তাগন সাথে হেসিয়ান পুলিশ এবং সিবপোল চলে এসেছে।
স্পটে গিয়ে দেখলাম, কেহই জীবিত নাই। মোট নাকি চার জন লোক ছিলো সেসনার ভিতর। তাঁর মধ্যে একজন মেয়ে, একজন পাইলট, আরেকজন পুরুষ এবং একজন কো-পাইলট। বিমানটির ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে এখানে সেখানে। মানুষুগুলি পড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোনো একটা অংশ ও নাই। কোনো বডি পার্তস পাওয়া গেলো না। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে কয়েক পিস মুরগীর মাংশ ইন্ট্যাক্ট অবস্থায় আছে, দুটু ব্ল্যাক লেবেল মদের বোতল ভেঙ্গে পড়ে আছে। আর পাওয়া গেলো কয়েক খন্ড হাড় গোড়। সেসনাটি মাত্র কয়েক মিনিট আকাশে ছিলো। আমাদেরকে অনেকে অনেক প্রশ্ন করছেন, কিন্তু ব্যাপারতা আমরাও ভালোভাবে খেয়াল করি নাই।
এর মধ্যে এভিয়েশন থেকে তদন্তের আদেশ এলো। আমরা যা দেখেছি, সেটা আগামীকাল তদন্তের কর্মকর্তাদের কাছে বলে একটা সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দিতে হবে। সন্ধায় আমাদের বেস কমান্ডার কঃ ফরিদ ডেকে পাঠালেন। একটু আগে আমরা ব্যানব্যাট থেকে ফিরে এসেছি।
এখানে একটা মজার ব্যাপার কাকতালীয় ভাবে ঘটে গেলো। ক্যাঃ জাহিদ ভিডিও ক্যামের মাধ্যমে যে ভিডিও টা করেছিলো সেখানে প্ল্যানটার উড্ডয়ন থেকে শুরু করে ভুমিতে পরার ভিডিও টুকু পুরুতাই করা হয়ে ছিলো। কিন্তু জাহিদ ভয় পেয়ে যাওয়ায় ভুমিতে পরার পর আগুন সহ প্ল্যানটির আর কোনো ভিডিও নাই। তাতে কি। এতাই তো অনেক রেয়ার একটা ভিডিও। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে (এটিসি) তে হয়ত কোনো ফুল ভিডিও হয়ে থাকতে পারে কিন্তু এটিসির বাইরে আমাদের কাছে ঠিক উড্ডয়নের এবং পতনের ভিডিও টা আছে। এতা জানার সাথে সাথে আমাদের কর্তব্যপরায়নতার একোতা বিশাল প্লাস পয়েন্ত হয়ে দারালোযে, আমরা কত সিন্সিয়ার যে, এই রকম ভাবে আমরা বেশ দায়িত্তের সাথে কাজ করি। আমরা বললাম যে, সাধারনত আমরা প্রতিটি বিমানের উড্ডয়নের সময় এবং নামার সময় ভিডিও করি। দিন শেষে আবার এইগুলি মুছে ফেলি। কোনো অঘটন থাকলে সেতা আমরা উর্ধতন কর্মকর্তাকে জানাই। আর তা না হলে আমরা ভিডিও গুলি আর সংরক্ষন করি না।
আমাদের এই ভিডিও তা হাইতির টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হলো। আমাদের কন্টিনজেন্টের সুনাম আরো বেড়ে গেলো যে, আমরা অনেক সচেতন আমাদের ডিউটির ব্যাপারে। বিবিসি টেলিভিশন আমার ইন্টারভিউ নিলেন, আমাদের সাথে বেস ক্যাম্পে ক্যাঃ জাহিদ, মেজর আলীর ও ইন্তারভিউ হলো বিবিসির। মেজর আলী অপস অফিসার হিসাবে কাজ করছে।
কারো সর্বনাশ আবার সেই সর্বনাশের ফলাফলে কারো আবার পুর্নিমার রাত। কারা মারা গেলো আমার জানা নাই, কিন্তু খুব অবাক হলাম যে, ওরা মদ নিয়ে চিকেন নিয়ে হয়ত বা মজা করার জন্যই আকাশে উঠেছিলো। কিন্তু স্রিষ্টিকর্তা কাকে কখন কিভাবে নিয়ে যাবেন, একমাত্র তিনিই জানেন। ওদের আর চিকেন বা মদ খাওয়া হয় নাই। তাঁর আগেই আকাশ থেকে ভুমিতে মৃত অবস্থায় ঝরে পড়েছে।
এলাকাটি পুলিশের হলুদ টেপ দিয়ে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করা আছে, ক্রাইম জোন বা নো এন্ট্র্যান্স হিসাবে। চারিদিকে পুলিশ পাহারা দিয়ে রেখেছে তদন্ত শেষ না হওয়া অবধি এটা থাকবে। তবে আমাদের প্রবেশের কোনো বাধা নাই।
১৯/০৯/১৯৯৫-অরুনিমার গল্প
গত শনিবার ইউ এন হেড কোয়ার্টারে গিয়েছিলাম আই ডি কার্ড করার জন্য। বিকাল তখন প্রায় চারটা। ফাকা অফিস। মাত্র দুইজন বিদেশী স্তাফ হাজির ছিলো। আমি যেতেই ওরা আমার ডিটেইলস নিয়ে নিলো। ফিঙ্গার প্রিন্ট, ছবি এবং ব্লাড গ্রুপ জেনে নিলো। আমার জন্ম সনদের বিপরীতে পাসপোর্ট দিতেই প্রায় সব গুলি কাজ যেনো এক সাথে ওরা পেয়ে গেলো। সবই আছে এর মধ্যে। যে মেয়েটা এইসব করছিলো সে সম্ভবত লোকাল এই হেসিয়ান। ভালো ইংরেজী বলতে পারে না। আমার সাথে দোভাষী ছিলো তাই কাজটা সহজেই করা গেলো। আই ডি কার্ড করতে গিয়ে একটা ঘটনা ঘটে গেলো যা সেদিনই লিখার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু সময়ের অভাবে লিখা হয়ে উঠে নাই।
ঘটনাটা তাহলে বলিঃ
আমি যখন প্রায় সব কাজ শেষ করে ফেলেছি, এমন সময় একটা ২২/২৩ বছরের একটি সুন্দর মেয়ে আমার কাছে এসে খুব সুন্দর করে ভারতীয় স্টাইলে দুই হাত নমস্কারের আদলে কূর্নিশ করলো। মেয়েটিকে দেখতে কিছুতেই ভারতীয় মনে হলো না কিন্তু তাঁর চেহাড়ায় একটা বাঙ্গালি বাঙ্গালী ভাব ছিলো। আমার সামনে এসে সে চমতকাত ইংরেজীতে বল্লো, আপনি কি ইন্ডিয়ান?
কেউ আমাকে ইন্ডিয়ান বললে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমি ইন্ডিয়ান নই, আমি বাংলাদেশী। ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশ এক নয়। তারপরেও বাংলাদেশ এখনো যেহেতু বিশ্ব দরবারে অতোটা পরিচিত হয়ে উঠে নাই, সবাই মনে করে বাংলাদেশ মানেই ইন্ডিয়া।
যাক, মেজাজ খারাপ না করেই বললাম, 'না, আমি ইন্ডিয়ান নই, আমি বাংলাদেশী।'
মেয়েটি ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশের পার্থক্যটা বুঝে দেখলাম। বল্লো, ও আচ্ছা, আপ্নারা ঢাকার লোক। ঢাকা তো বাংলাদেশের রাজধানী।
বললাম, হ্যা। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী।
মেয়েটি আর কোনো কথা বাড়াতে চাইলো না। কিন্তু আমার আগ্রহটা একটু বেড়ে গেলো।
আমি বললাম, আপনি কি কোনো ইন্ডিয়ানকে খুজছেন?
সে বল্লো, হ্যা, আমি নতুন কোনো ইন্ডিয়ান এলেই তাকে জিজ্ঞেস করি সে ইন্ডিয়ান কিনা।
বললাম, কেনো আপনি কোনো ইন্ডিয়ানকে খুজছেন?
মেয়েটি পাশেই কফি শপের দিকে ইংগিত করে আমি কফি খাবো কিনা জিজ্ঞেস করলো। আমি যেহেতু পেট্রোলিং এর কাজে বের হয়েছি, আমার কোনো তারাহুরা নাই। হয়ত, এই মেয়েটার কোনো সমস্যাও আমার পেট্রোলিং এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
মেয়েতী একোতা গোলাপি গেঞ্জি পড়া। মাথার চুলগুলি ছোট, বব কাটিং এর মতো। ভালো স্বাস্থ্য, ইন্ডিয়ান গায়ের রঙ, বেশ স্মার্ট। জিন্সের প্যান্ট পরা।
কফি খেতে খেতে সে আমাকে জানালো, সে ইউ এন এর সিভিল ডিপার্টমেন্টে পার্ট টাইম কাজ করে। সে আসলে থাকে পোর্টোরিকুতে। পাশেই আইল্যান্ডটা। ওখানে ওর মা আছে। তাঁর আর কোনো ভাই বোন নাই।
বাবা কি করেন, জিজ্ঞেস করতেই সে যেটা বল্লো, তা হলো, সে তাঁর বাবাকেই খুজছে। সে তাঁর বাবাকে কখনোই দেখে নাই। কোনো এক ইন্ডিয়ানের সাথে তাঁর মায়ের প্রেম ছিলো। তাঁর মা ছিলো মূলাট্টো। মানে না নিগ্রো না শ্বেতাঙ্গ। মুলাট্টো হচ্ছে নিগ্রো আর শ্বেতাঙ্গ টাইপের একটা মিক্সড ব্লাড। ইন্ডিয়ানরা শ্বেতাঙ্গ বলা যাবে না কিন্তু অনেক ইন্ডিয়ান আছে যারা বেশ ফর্সা। হতে পারে তাঁর মা আর ঐ ইন্ডিয়ানের ফলে মেয়েটির চেহাড়া অনেকটা মুলাট্টো ধরনের কিন্তু তাঁর মধ্যে মুলাট্টোর যা যা গুন বা আচরন, তাঁর থেকে অনেক আলাদা। বেশীর ভাগ আচরন আমার কাছে আমাদের সাব কন্টিনেন্ট এর মতোই মনে হলো।
মেয়েটির ভাষ্য যে, আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে কোনো এক ইন্ডিয়ান অই পোর্টোরিকুতে এসেছিলেন। তখন তাঁর মায়ের সাথে অই ইন্ডিয়ান লোকটির প্রেম হয়। প্রেম থেকে তারা একত্রে থাকতে থাকেন। বিয়ের মতো এইরকম কোনো ফর্মালিটিজ আসলে হয় নাই। যাকে আমরা লীভিং টুগেদার হিসাবে বলতে পারি।
বছর কয়েক পর এভাবে থাকার পর, এই মেয়েটির জন্ম হয়। মেয়েটির জন্মের মাত্র কয়েক মাস পরেই সেই ইন্ডিয়ান বাবা তাঁর স্বদেশের কোনো কাজে ইন্ডিয়ায় চলে যান। কথা ছিলো তিনি কাজ সেরেই আবার এই পোর্টোরিকুতে সন্তান-স্ত্রীর কাছে ব্যাক করবেন।
এই যে তিনি গেলেন আজ অবধি তিনি আর ফিরেন নাই। তাদের কাছে থাকার মধ্যে আছে শুধু কয়েকটি ছবি আর পুরানো একটা ঠিকানা। যেহেতু তাঁর মা কখনো পোর্টোরিকুর বাইরে যান নাই, বা তিনি জানেন না কিভাবে ইন্ডিয়া গিয়ে বাবাকে খুজতে হবে, ফলে সেই ২৩ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বাবার জন্য আজো তাঁর মা অপেক্ষাকরেন, তিনি ফিরে আসবেন।
মায়ের এই কষ্টে, এবং বিশ্বাসে মেয়ে এতো বছর পর নীরবে তাঁর বাবাকে খুজেন। এর মধ্যে সে দুইবার ইন্ডিয়াও গিয়েছিলো, কিন্তু তাঁর বাবার পোর্টোরিকুতে আসার কোনো রেকড়ড়দ তাদের ডাটাবেজে নাই, এমনকি যেই স্টেটের কথা তাঁর মা জানে সেই স্টেটে গিয়েও মেয়েটি তাঁর বাবার কোনো হদিস মিলাতে পারেন নাই।
বাবাকে পাওয়া না পাওয়ার জন্য তাঁর আফসোস নাই। না পেলেও তাঁর মনে যে অনেক কষ্ট তাও না। কিন্তু যখনই সে তাঁর মায়ের দিকে তাকায়, সে বুঝে, ভালোবাসায় কিভাবে মানুষ এক জনের জন্য সারাটা জীবন একা থাকতে পারে। তাঁর শুধু এইটুকু জানার দরকার যে, তাঁর বাবা কি আজো বেচে আছেন? নাকি এই পৃথিবীতেই নাই। যদি বেচে থাকেন, তাহলে কি অপরাধে তাঁর বাবা তাকে কিংবা তাঁর মাকে আর একবারের জন্য ও দেখা দিলেন না? যদি তাঁর বাবার আর কোনো ভালোবাসাই আর তাদের উপর না থাকে, সেটাও তারা মেনে নিতে মানষিকভাবে প্রস্তুত, কিন্তু সেতাও তো জানা দরকার।
কথা বলতে বলতে দেখলাম, কয়েকবার মেয়েটির গলা বুজে আসছিলো, হয়ত ইমোশনাল হয় গেছে। কফির কাপে চুমু দিয়ে একটু টাইম নিয়ে আবার বলতে থাকলো যে, আমার জন্ম নিয়ে আমি অতোটা উদাসীন নই কিংবা কোথাও কোনো কাজে আমার বাধা নেই। কিন্তু আমারো খুব জানতে ইচ্ছে করে, আমার বাবা কোথায়, কি করেন তিনি। তাঁর কি কখনো আমার কথা মনে পড়ে না? আমার মায়ের কথা না হয় বাদই দিলাম, আমার কথাও কি তাঁর মনে পড়ে না? কষ্ট হয় মাঝে মাঝে। আমার মা ইন্ডিয়ান রীতি অনুযায়ী প্রদিন সকালে বিকালে আমাদের ঘরে ধুপ জ্বালায়। তিনি নিজেকে ইন্ডিয়ান বউ মনে করেন আজো। এখন তাঁর বয়স হয়ে গেছে। আমি মাঝে মাঝে মাকে বলি, মা , তিনি হয়ত আর বেচে নেই। তা না হলে কারো না কারো নাড়ীর টানে তিনি একবার হলেও আসতেন। যে ব্যক্তিটা প্রথিবীতেই নাই, তাঁর জন্য কেনো তুমি এতো কষ্ট করছো?
মা মানতে রাজী নন।
জিজ্ঞেস করলা, এইখানে তো একটা ইন্ডিয়ান ব্যাটালিয়ান আছে, তুমি কি সেখানে গিয়ে খোজ করেছো কারো কাছে? বা কারো কাছে কি এতা নিয়ে আলাপ করেছো?
মেয়েটি বল্লো যে, হ্যা সে এই ব্যাপারে ইন্ডিয়ান কন্টিনজেন্টে একবার কোনো এক অফিসারের সাথে আলাপ করেছিলেন। সে ঠিকানা টা ধরে প্রায় তিন মাস পরে জানিয়েছিলো যে, যেই ঠিকানাটা আমার মা জানতেন, সেই ঠিকানায় এখন কোনো বসতি নাই। সেটা এখন নাকি কোনো এক শিল্প নগরী হয়ে সেখানে অনেক কলকারখানার রাজ্য হয়ে গেছে। আর সেই ২৫ বছর আগের কোনো ডাটা তারা দিত অপারগ।
অনেক্ষন কথা বললাম মেয়েটার সাথে। খারাপ লাগলো। কিন্তু আমারই বা কি করনীয়? আমি মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করলাম, সে হেসে দিয়ে বল্লো, মা তাকে ডাকে অরুনিমা হিসাবে, আর সে সবাইকে অফিশিয়াল নাম জানায় তামান্না হিসাবে।
তামান্নাই হোক আর অরুনিমাই হোক, বিকালটা আমাকে খুব ব্যথিত করে দিলো। পেট্রোলিং করার সময় বারবার অরুনিমার মুখখানা আমার চোখে ভেসে আসছিল আর ভাবছিলাম, গরীব নয় সে, তাঁর বাবার টাকার কোনো দরকার নাই। সে শিক্ষিত, তাঁর একটা গতি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, ইন্ডিয়ান বাবার কোনো সম্পত্তির জন্য তাঁর কোন তাড়া নাই, না আছে কোনো পারিবারিক ঐতিহ্যের চাওয়া পাওয়া। সে শুধু একটাই জানতে চায়, তাঁর বাবা কে, কোথায় আছে কিভাবে আছে। আর কিছুই না। একটা পরিচয়।
এই পৃথিবীতে কত রকমের কষ্টে মানুষ বসবাস করে তাঁর কোনো ইয়াত্তা নাই। কেউ টাকার কাংগাল, কেউ সম্পদের কাংগাল, কেউ ভালোবাসার কাঙ্গাল, আবার কেউ শুধু আমি কে, কি আমার পরিচয়, সেইটা পেলেই তাঁর সব সুখ।
১৬/০৯/১৯৯৫, হাইতি- শনিবার
Categories
আজ ছুটির দিন। বেশ দেরী করে ঘুম থেকে উঠেছি। ক্যাঃ মুনীর সারাক্ষন গান বাজিয়ে ক্যাম্পটাকে মাতিয়ে রাখে। একটু চটপটেই সে। দেশে ফোন করার একতাই নিয়ম, ট্রেসকম টেলিকোম্পনি থেকে প্রি-পেইড কার্ড কিনতে হয়। খুবই এক্সপেন্সিভ। তাই সব সময় কথা বলা যায় না। এখানে আরেকটা সমস্যা হলো, আমরা এখানে মাত্র ২৫% সেলারী পাই। দুপুরের পর আমার নিজের পেট্রোলিং আছে।
জাতিসংঘের আইডি কার্ড এখনো হাতে পাই নাই। ইউ এন হেড কোয়ার্টার আমাদের বেস ক্যাম্প থেকে বেশী দূরে নয়। ওখানে যেতে হবে আইডি কার্ড করার জন্য। অনেকেই করে ফেলেছে কিন্তু আমার এখনো যাওয়া হয় নাই। যদিও আজ বন্ধ্যের দিন কিন্তু আই ডি কার্ডের অফিসটা খোলা। ভাবছি, আজ পেট্রোলিং এ যাওয়ার পথে ইউ এন হেড অফিসে গিয়ে কাজগুলি শেষ করে ফেল্বো। আজ ভীড় একটু কম থাকবে। ড্রাইভার জাহাঙ্গীর আমাদের ড্রাইভার। কুজো হয়ে গাড়ি চালায় কিন্তু ভালো গাড়ি চালায়। ওকে আসতে বলেছি বিকাল তিনটায়। প্রায় তিন ঘন্তার পেট্রোলিং।
এই পেট্রোলিং এ আমাদের কাজ আসলে খুব সীমিত। আমরা গাড়ি চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যায়। কোথাকার কি পরিস্থিতিসেতা অবলোকন করি। কোনো অঘটন দেখা হলে আমরা সেখানে থামি। এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলি। ব্যাপারতা কন্ট্রোলে রাখার চেষ্টা করি। কোনো বেগতিক দেখলে আমরা সেটা তাতক্ষনিক আমাদের বেস ক্যাম্পে রিপোর্ট করি, সে মোতাবেক আমরা পরবর্তী কাজ গুলি করি।
০৭/০৯/১৯৯৫-পোর্ট অ প্রিন্স এয়ারপোর্টে
Categories
আমাকে পোস্টিং করা হয়েছে এয়ারপোর্ট দেখভাল করার। পোর্ট অ প্রিন্স এয়ার পোর্ট। বিমান বন্দরে প্রতিদিন সকালে যাই, সারা অফিস চত্তর একবার করে ঘুরে আসি। আমার সাথে আছে মেজর ফরিদ (১১ লং কোর্সের), ক্যাঃ শেখ মুনীরুজ্জামান ( মেহেরপুরের, আমার সাথে ৬ ফিল্ডে ছিলো) আর আছে ক্যাঃ জাহিদ। দুটি বড়বড় সৌদি তাবুতে আমরা আছি। তিন নম্বর তাবুটা আমাদের রিক্রেশন রুম। তাতে একটা দাবার সেট আছে, টিভিও আছে, ভিসিডি আছে, আর আছে একটা ছোট ফ্রিজ। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের তাবুতেও একটা করে টিভি আছে। আমরা শুয়ে শুয়েই টিভি দেখতে পারি। আমরা আমাদের এই ক্যাম্পে নামাজের জন্য আরেকটা তাবু করে দিয়েছি। এখানে নামাজের ব্যবস্তাহ আছে। বেশ গরম হাইতীর আবহাওয়া। এখানে নাকি কোনো শীতকাল নাই। সারা বছর আম ধরে। এদের কারেন্সি হেসিয়ান ডলার যার মান ১ ইউ এস ডলার দিলে ৫ হেসিয়ান ডলার পাওয়া যায়। আর এক ডলার দিয়ে প্রায় ৮ থেকে ১০ টা বড় বড় আম পাওয়া যায়। মানুষ গুলি খুব গরীব, আর পানির সংকট প্রচন্ড অথচ পাশেই ক্যারিবিয়ান সমদ্র।
০৩/০৯/১৯৯৫- ২য় দিন হাইতি
Categories
সকালে উঠেই অফিসে যেতে হলো। অনেক ফরমালিটিজ। জাতিসংঘের নিয়ম অনুসারে মেডিক্যাল কার্ড, নিহের ফর্ম পুরন করা, আইডি কার্ডের জন্য আরেক অফিসে যাওয়া, ভ্যাকসিন নেওয়া, অরিয়েন্টেশন ক্লাশ করা ইত্যাদির ভারে সারাটি দিন বেশ ভালই চাপের মধ্যে গেলো। আমরা হাইতির ভাষা বুঝি না, তাই দোভাষী এলো। একজনের নাম নাতাশা। প্রায় ৪০ বছরের মতো হবে। এখানকার সবাই ব্ল্যাক। প্রায় ৯৫% মানুষ ব্ল্যাক। আমি কখনো ব্ল্যাক মানুষ এতো কাছ থেকে দেখিনাই।
এদের দেখলে কোনো অবস্থাতেই ভালো লাগে না। নোংরা নোংরা মনে হয়। মেয়েগুলির নিতম্ব এতো বড় আর বুক পেট এতো উচু তাঁর সাথে মুখের চেহারা এতো বিদ্গুটে যে, এদের আমার ভালোই লাগছিলো না। কিন্তু আমি পজিটিভ মানুষ। তাদেরকে আমার ভালো লাগতে হবে এটাই সবচেয়ে বড় কথা। আমি এদের সাথে এদের জন্য এদের দেশে কাজ করবো অথচ আমি এদের কে পছন্দ করবো না, এটা অন্যায়, এবং করা উচিত না।
আমরা কে কোথায় কি ডিউটি করবো এটা এখনো কন্টিনজেন্ট কমান্ডার ভাগ করে দেন নাই বিধায় আমরা সবাই আপাতত বেস ক্যাম্পেই থাকছি, আর ক্যারাবানে ঘুমাচ্ছি।
০২/০৯/১৯৯৫- হাইতি গমন
Categories
২০ জুলাই ১৯৯৫ তারিখে আমাকে ৭ ফিল্ড রেজিমেন্ট থেকে ১ ফিল্ড রেজিমেন্টে পোস্টিং করা হয়েছিলো ১ ফিল্ডের সাথে হাইতিতে জাতিসঙ্ঘ মিশনে যাওয়ার জন্য। ১ ফিল্ডের নতুন নামকরন করা হয়েছে ব্যানব্যাট। এর মানে হলো বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন। আজ আমরা হাইতিতে আগমন করলাম। জাতিসঙ্ঘ মিশনে এটাই আমার প্রথম মিশন। আমাদের কোর্সের মেজর সাকির আমাদের সাথে আছে। ১২ লং কোর্সের মেজর জাহিদ (সিরিয়াল-১৪ নামে বেশী পরিচিত) আছে। ১১ লং কোর্সের মেজর ফরিদ, মেজর মোসাদ্দেক, ১০ লং কোর্সের মেজর ফারুক, ৯ লং এর মেজর ইশ্তিয়াক এবং মেজর সারোয়ার, ১৬ লং এর মেজর আলী (সুন্দর আলী নামেই সে বেশি পরিচিত)। এয়ারফোর্সের স্কোয়াড্রন লিডার শফিক স্যার (নায়ক রাজ রাজ্জাকের মেয়ে ময়নার জামাই) ও আছেন। আর্মি, এয়ারফোর্স এবং নেভী মিলিয়ে প্রায় ৬/৭ শত জোয়ান।
হাইতিতে আসার আগেই এর মধ্যে দুই দফায় দুটি দল ইতিমধ্যে চলে এসেছিল। তাদের কাজ ছিলো মেইন বডি আসার আগে সমস্ত বাসস্থান রেডি করা। শুধু তাইই নয়, এর আগে যে ইউনিট ছিলো বাংলাদেশের তাঁর থেকে সমস্ত মালামাল, গাড়ী, অস্ত্র ইত্যাদি বুঝে নেওয়া।
আমাদের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার কর্নেল ফরিদ (আর্টিলারী), তাঁর সাথে আরো ৬ জন লেঃ কর্নেল আছেন। আমরা প্লেন থেকে নেমে সবাই পোর্ট অ প্রিন্স বিমান বন্দরেই সবাই সারিবদ্ধ হয়ে প্রথমে ওকে রিপোর্ট নেয়া হলো। আমরা সবাই বাংলাদেশী ইউনিফর্ম পড়া। এই প্রথম ইউনিফর্ম পড়ে কোনো ভিন দেশে আমার আগমন। সারাদিন প্লেন জার্নিতে টায়ার্ড লাগছিলো। ক্ষুধাও ছিলো পেটে। আমাদের বেস ক্যাম্পে আসতে আসতে প্রায় রাত ৯ টা বেজে গেলো। আমরা সবাই পর্বে পর্বে বেস ক্যাম্পে এলাম।
কোনো স্যহায়ী বিল্ডিং নাই, প্লাস্টিকের ডোঙ্গার মতো ছোট ছোট ক্যারাবান। একটা ক্যারাবানে প্রায় ১৫ থেকে ২০ টির মতো রুম। আমার রুম মেট ১০ লং কোর্সের মেজর ফারুক স্যার। দুজনেই সিগারেট খাই। সুতরাং রুমে সিগারেটের ধুয়ায় প্রথম দিনই ভরে গেলো।
ইউনিফর্ম চেঞ্জ করে মেসে খেতে গেলাম। খেতে খেতে রাত প্রায় ১২ টা বাজলো।