১০/০৮/২০০৬-ভারতে ব্যবসায়ীক ভ্রমন

                                        

গত ২৮শে জুলাই দ্বিতীয় বারের জন্য ভারত যাচ্ছি। প্রথমবার গিয়েছিলাম ষ্টাফ কলেজ থেকে জাতীয় প্রোটোকলে ডিপ্লোমেটিক ভিসা নিয়ে। কিন্তু এবার যাচ্ছি বেসামরিক হয়ে এবং ব্যবসার উদ্দেশ্যে। আগেরবার ভিসা নিয়ে কোনো সমস্যা হয় নাই। কিন্তু এবার ইন্ডিয়ান ভিসা পেতে বেশ জটিলতায় পড়েছিলাম, খোদ ইন্ডিয়ান হাই কমিশনারের সাথে আমাকে ইনটারভিউ দিতে হয়েছিল। বিনা সিক্রী হাই কমিশনার হিসাবে আছেন বাংলাদেশে। ভিসা ইস্যু করার আগে আমাকে এম্বেসী অফিস থেকে জানানো হলো যে, আপনার ভিসা পেতে হাই কমিশনার এর সাথে ইন্টারভিউ দিতে হবে। ব্যাপারটা সাভাবিক না। তারিখ দেয়া হলো, আমি সময় মতো পৌঁছে গেলাম এম্বেসী অফিসে। কিন্তু উনি সরাসরি আমার ইন্টারভিউ নিতে পারেন নাই কারন যেদিন আমার তারিখ পড়েছিলো, সেদিন তিনি কোনো এক জরুরী কাজে হটাত অফিসের বাইরে ছিলেন। ফলে হাই কমিশনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাহেব আমার ইন্টারভিউটা নিলেন। বেশ মজার একটা সাব্জেক্ট নিয়ে তার সাথে আলাপ হয়েছিলো।

বাংলাদেশে এখন গার্মেন্টস সেক্টরে বেশ আন্দোলন চলছে। শ্রমিকরা অযথাই ফ্যাক্টরীগুলিতে আন্দোলন করছে কিছু খুচরা কারন নিয়ে। যেমন, তাদের বেতন বাড়াতে হবে, কারো কারো দাবী, ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দিতে হবে, আবার কারো কারো সরাসরি দাবী যে, পিস রেট এর কাজ আগে থেকেই তাদের বলে দিতে হবে, যদি পছন্দ হয়, করবে আর যদি পছন্দ না হয়, করবে না। এই রকম আরো অনেক অযুক্তিক দাবীও তারা করছিলো। ধারনা করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ এই সেক্টরে বেশ ভালো করায় পার্শবর্তী দেশগুলি বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরে একটা গন্ডোগোল পাকানোর চেষ্টা করছে। এর আরেকটা প্রধান কারন আছে। সেটা হলো, বাংলাদেশ সব বায়ারদের জন্য জিএসপি (Generalized System of Preferences) ইস্যু করে। এই জিএসপিটা আসলে কি? যার জন্য বায়াররাও এদেশে কাজ করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?

জি এস পি টা একটু ব্যাখ্যা করিঃ

যারা রপ্তানীমুখী শিল্প চালান, তারা যে র মেটেরিয়াল বাইরে থেকে আমদানী করেন, সেটার উপর সরকার কোনো ট্যাক্স নেন না যদি সেই রপ্তানী শিল্প পুনরায় উক্ত র মেটেরিয়াল দিয়ে বানানো মাল আবারো রপ্তানী করেন বাইরের কোনো দেশে। তাতে রপ্তানী কৃত মালটির সর্বশেষ মুল্য বেশ কম থাকে। এই সুবিধা বিশেষ করে পান, যারা এদেশ থেকে মাল কিনেন তারা। একটা উদাহ রন দেই, ধরুন, আমি সুতা আনবো বাইরে থেকে। সুতা এনে আবার শার্ট বানিয়ে সেই শার্ট বাইরেই রপ্তানী করবো। তাহলে এই সুতার উপর কোনো ট্যাক্স দিতে হবে না, আবার শার্ট রপ্তানিতেও আমাকে কোনো ট্যাক্স দিতে হবে না। এর ফলে যারা বায়ার, তাদের তৈরী মুল্য কম হয়। ভারতে এই সুবিধাটা নাই। ফলে ট্যাক্স যখন যখন যোগ হয়, যে শার্ট টা আমি ১০০ টাকায় বায়ারকে দিতে পারবো, সেটা ইন্ডিয়া ট্যাক্সের কারনে হয়তো গিয়ে দাঁড়াবে ১২০ টাকা। এই যে ২০ টাকা বেশি দিতে হলো বায়ারকে, সে এটা বিক্রি করে লাভ করতে হলে কমপক্ষে ১২০ টাকার বেশী মুল্য ধরতে হবে যখন ইন্ডিয়া থেকে শার্টতা সে নেবে। কিন্তু এদেশ থেকে নিলে তাকে কম্পক্ষেব ১০০ টাকার মুল্য এর বেশী হলেই তার লাভ হবে। এ কারনে বহু দেশ জি এস পির সুবিধার কারনে আমাদের দেশকেই পছন্দ করে অর্ডার দিতে। আবার যে কেউ জি এস পি চালু করতে পারেন না। যে দেশে র মেটেরিয়াল আছে, অর্থাৎ লোকালী পাওয়া যায়, তারা জি এস পির প্রবর্তন করতে পারে না। ফলে ইন্ডিয়া ইচ্ছে করলেও জি এস পি সুবিধা দিতে পারে না। তাই যদি এই জি এস পি এর নীতি পরিবর্তন করা যায় বা বাংলাদেশ থেকে জি এস পি তুলে দেয়া যায়, তাতে অন্যান্য দেশ একই কাতারে চলে এলে বাংলাদেশ চলমান প্রতিযোগীতায় টিকে না থাক্রই কথা। হয়তো এতাই কারন হতে পারে যে, একটা আন রেষ্ট চালিয়ে এই খাতকে সমুলে ধংশ করে দেয়া যাতে বায়াররা আর এদেশে এই ঝুকির কারনে অর্ডার না প্লেস করেন।   

যাই হোক, আমি ইন্ডিয়ান এম্বেসিকে এসব ব্যাপারে খুব একতা বিশ্লেষনে গেলাম না। খালি ভাসা ভাসা কিছু হাই হ্যালোর মধ্যেই থেকে গেলাম। অবশেষে আমার ভিসা হয়ে গেলো।

এখানে একটা ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয় যে, কি কারনে আমি ইন্ডিয়ায় যাচ্ছি। আমি গার্মেন্টস করছি বিধায় আমাকে মিঃ মুরাদ নামের এক ভদ্রলোক ফ্যাক্টরীতে এসে দেখা করলেন। তাকে আমি আগে থেকে চিনি না। কিন্তু আমার পার্টনার মিঃ মোহসীন শাহিন তাকে চিনেন। আমার অফিসে তিনি এসে বললেন যে, ওয়ার্লড ব্যাংক থেকে বিনা সুদে বেশ একটা লোন পাওয়া যায়, যা আমার মতো একজন ব্যবসায়ী অনায়াসেই গ্রহন করতে পারে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেনো ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আমাকে এই সুযোগটা দেবে? উত্তরে তিনি বললেন যে, ইন্ডিয়ার উড়িষ্যার যিনি কংগ্রেস (আই) এর মহাসচীব, তিনি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রতিনিধি (তিনি একজন অবসর প্রাপ্ত কর্নেল)। তিনি মুজিব সরকারের সময়ে শেখ মুজিবের একজন খুব কাছের মানুষের একান্ত পরিচিত। এই পরিচিত মানুষটি কখনো কোনো সুবিধা নেন নাই কিন্তু তিনি এখন আর্থিক দিক দিয়ে খুব ভালো অবস্থানে নাই। তাকে উক্ত কংগ্রেস নেতা সাহাজ্য করতে চান। আমি বললাম, কিভাবে? তিনি বললেন, যে, যদি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক লোন পাশ করে, তাহলে এর একটা অংশ উনি নিবেন, আর বাকী অংশ আমাদেরকে ৮ বছরের কিস্তিতে শোধ করে দিলেই হবে। কোনো ইন্টারেষ্ট হবে না। বস্তুত ব্যাপারটা এই দাড়ায় যে, এই ৮ বছরে যে ইন্টারেষ্ট হবে তার তুলনায় মুজিব সরকারের সময়ের এই গুরুত্তপুর্ন ব্যক্তির (নামটা বলা ঠিক হবে কিনা জানি না, তবু বলি, তার নাম মুসা সাহেব) নিয়ে যাওয়া টাকাও অনেক অনেক কম। তা ছাড়া বেশ বড় অংকের টাকা আমরা লোন নিতে পারবো যার কোনো ইন্টারেষ্টই নাই। হিসাব করে দেখলাম, লাভ আছে। তাই ওখানে বিস্তারীত আলাপ হবে।

আসলে আমি বিস্তারীত অনেক কিছুই জানি না এই লোনটা কিভাবে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আমাকে দিতে চায়। একটু রহস্য তো লাগছেই। আবার মজাও লাগছে। দেখি ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়। অন্তত ইন্ডিয়া তো বেড়ানো হলো, লোন হোক বা না হোক। আমি আর মুরাদ বাসে করে ইন্ডিয়ার জন্য রওয়ানা হয়ে গেলাম। মুরাদ বাংলাদেশে কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং এর উপর ছোট খাটো একটা ল্যাব চালায়। এ কয়দিনে মুরাদের সাথে আমার ঘন ঘন দেখা হওয়াতে অনেক বেশী ফ্রি হয়ে গিয়েছিলাম।

আমরা বেনাপোল বিডিআর ক্যাম্পে গিয়ে প্রথমে যখন থামলাম, তখন বেলা প্রায় ১১ টা। ওখান থেকেই আমাদের বর্ডার ক্রস করতে হবে। আমার বন্ধু মেজর মাহফুজ তখন বেনাপোল বিডিআর এর দায়িত্তে নিয়োজিত। আগেই ফোন করে রেখেছিলাম। আমি ওখানে যাওয়ার পর দেখলাম যে, বন্ধু মাহফুজ বেশ ভালো খাবার দাবারের আয়োজন করে রেখেছে কিন্তু ওর বিশেষ তাড়া থাকায় ক্যাম্পে থাকতে পারেনি। আমি বিডিআর ক্যাম্পে উঠে একটু ফ্রেস হয়ে নিলাম। সৈনিক সাত্তার এসে বল্লো যে, স্যার আপনাদের পাসপোর্টগুলি দেন, আমি ইমিগ্রেশন করিয়ে নিয়ে আসি, আর এরমধ্যে আপ্নারা একটু চা নাস্তা খেয়ে রেষ্ট করেন। প্রচুর লোকের ভীড়। আমার ধারনা ছিলো না যে, কত মানুষ বেনাপোল দিয়ে এভাবে ইন্ডিয়ায় যায়। প্রায় ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমাদের ইমিগ্রেসন হয়ে গেলো। লাগেজ তেমন ছিলো না। তাই আমরা অনায়াসেই বর্ডার পার হয়ে ওপাড়ে চলে এলাম, অর্থাৎ ইন্ডিয়া।  আমরা শ্যামলী বাসে চড়েছিলাম। বাংলাদেশের থেকে যে বাসটি বেনাপোল পর্যন্ত ঢাকা থেকে গিয়েছিল, সেটা বেনাপোলে গিয়েই শেষ। ইমিগ্রেশনের পরে ইন্ডিয়ার পার্টে আবার নতুন শ্যামলী বাসে উঠতে হয়। ইমিগ্রশনের ঠিক পরেই যে জায়গায়টায় আমরা বাসে উঠলাম, তার নাম আসলে বিস্তরভাবে বললে পেট্রোপোল হিসাবে ধরা যায়। বাংলাদেশের এপাড়ের সাথে ওপাড়ের মানুষের বৈশিষ্ঠের কোনো তফাত নাই। যদি কেউ না বলে দেয় যে, এই পার্টটা ইন্ডিয়া আর ওই পার্টটা  বাংলাদেশ, কারো বুঝার সাধ্যি নাই। মানুষের যেনো হুরাহুড়ি, কে কার আগে বাসে উঠবে। তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখলাম। মনে মনে ভাবলাম, সবার জন্য কিন্তু সিট রিজার্ভ করা আছে, তারপরেও কেনো যে মানুষগুলি এ রকম তাড়াহুরা করে বাসে উঠছে আমার বোধগম্য হচ্ছিলো না। এরমধ্যে চায়ের হকার, পানের হকার, সিগারেটের হকার, কেউ কেউ আবার ঘাড় টিপাবেন কিনা, কান খোচাবেন কিনা এই জাতীয় হরেক হরেক পদের সার্ভিসদাতার কোনো অভাব নাই। মুরাদ বল্লো, স্যার, পকেট সাবধান। এখানে যতো না ভালো মানুষের দেখা পাবেন, তার মধ্যে অর্ধেক পাবেন চোর।

আমরা বাসে চলছি, আর মাঝে মাঝে কোন জায়গা ক্রস করছি সেটা পড়ছি। বেনাপোল থেকে কলিকাতা পর্যন্ত যে সব প্রমিনেন্ট জায়গার নাম মনে আছে তার মধ্যে হল- সুবাসনগর, গোলকনগর, মন্দালপাড়া, বকচড়া, গাইঘাটা, ধর্মপুর, হাবরা, বামনগাছি, দমদমের কিছু অংশ এবং শেষে কলিকাতা। পথিমধ্যে আমাদের বাস ধর্মপুরে আধা ঘন্টার জন্য একটা হল্ট দিয়েছিলো। কলিকাতা যখন পৌঁছলাম, তখন বেলা প্রায় তিনটা বাজে। কি যে এক অবস্থা। পুরাই গুলিস্থান। মানুষের ভীড় আর দোকানপাটের এমন হযবরল, কোনো তফাত নাই আমাদের ঢাকা শহরের গুলিস্থান আর কলিকাতার মধ্যে। আমরা একটা হোটেলে উঠলাম। হোটেলে উঠে আমি আমার ব্যাগ একটা টেবিলে রেখে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হবো বিধায় লুংগি পড়ে বাথরুমে ঢোকলাম। মুরাদ রুমেই ছিলো। আমি বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে যখন বের হলাম, মুরাদের এক কথায় আমি হচকচিয়ে গেলাম।

মুরাদ বল্লো, আখতার স্যার, আমার মোবাইলটা পাচ্ছি না। আমি আমার মোবাইল চেক করতে গিয়ে দেখি, আমার মোবাইলটাও খুজে পেলাম না। কি তাজ্জব ব্যাপার!! বললাম, রুমে কি কেউ এসেছিলো?

মুরাদ বল্লো, হ্যা, একটা ক্লিনার বয় এসেছিলো।

সাথে সাথে ম্যানেজারকে জানালাম, কিন্তু ম্যানেজার আমাদের এমন কথা বললেন যে, আমরা একটা সহি পবিত্র হোটেলে উঠেছি, এখান থেকে কখনো কোনো কিছুই হারানোর রেকর্ড নাকি নাই। এর মানে হল আমরা অন্য কোথাও মোবাইল হারিয়ে এসেছি অথবা আমাদের কাছে কোনোকালেই কোনো মোবাইল ছিলো না। কিছুই বলার নাই। আমার সাধের ফোল্ডেড নকিয়া মোবাইল্টা হারিয়ে এখন সে অন্য কারো বাসর করছে। দুক্ষটা এখন অন্যটা। আমার সব কন্ট্যাক্ট নাম্বার গুলি হারিয়ে ফেললাম।

মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। কলিকাতায় আমাদের থাকা হবে না। আমরা আসলে যাবো, উড়িষ্যায়। তাই এক রাত থাকা হবে এই কলিকাতায়। আবার যাওয়ার সময় আমরা উড়িষ্যা থেকে পুনরায় কলিকাতায় আসতে হবে ঢাকার বাস ধরার জন্য। তখন আরেক রাত থাকা হবে।

আমি আর মুরাদ সন্ধ্যায় বের হলাম। একটা মোবাইল কিনতে হবে, সাথে ইন্ডিয়ার সিম। মুরাদ বহু বছর ইন্ডিয়ায় ছিলো, বাংগালুরে ওর শিক্ষা জীবন কাটিয়েছে। ফলে ও বেশ ভালো হিন্দি বলতে পারে এবং তার ইন্ডিয়া মানুষদের ব্যাপারে একটা ভালো ধারনাও আছে। শুধু তাইই নয়, ও ইন্ডিয়ার কোন শহর থেকে কোন শহরে কিভাবে কখন যেতে হয়, এ ব্যাপারে বেশ ভালো আইডিয়া আছে বলে আমি মুটামুটি আরামেই ছিলাম। মুরাদ জানালো যে, আগামীকাল সকাল ৮ টায় আমরা কলিকাতা থেকে ট্রেনে উড়িষ্যায় যাবো। ট্রেন স্টেসন এখান থেকে বেশি দুরেও নয়। সকালে সাতটায় বের হলেই নগদে টিকেট কেটে আমরা উড়িষ্যায় পৌছতে পারবো। কলিকাতা থেকে উড়িষ্যায় যেতে ট্রেনে প্রায় ৬/৭ ঘন্টা সময় লাগতে পারে। মানে আমরা হয়তো দুপুরের পরে গিয়ে হাজির হবো।

আমরা দুজনেই একেবারে সস্তায় দুটু মোবাইল কিনলাম। সাথে দুটু সিম। রাতে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। সম্ভবত কোনো পর্ব হচ্ছে এখানে। রাস্তাঘাট বেশ আলোকিত। রাতে ঢোষা আর সবজি খেয়ে ডিনার শেষ করলাম। যেহেতু ইন্ডিয়া, তারা হালাল হারাম বুঝে না, তাই সাধারনত আমি এসব দেশে কোনো মাংশ খেতে নারাজ। মাছ, ডিম, ডাল আর সব্জি দিয়েই আমি চালিয়ে নেই। এগুলিতে হারাম হালালের কোনো বালাই নাই। রাত ১০টার দিকে রুমে এসে ঢাকায় বাসায় কল করলাম, তারপর ঘুমিয়ে গেলাম।

পরেরদিন বেশ সকালেই ঘুম ভেংগে গিয়েছিলো। হাতমুখ ধুয়ে নামাজ পড়লাম। মুরাদ নামাজ পড়ে না সম্ভবত। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। ধর্ম যার যার। ঈশ্বরের কাছে জবাব্দিহিতা যার যার তার তার। একটা জিনিষ খেয়াল করলাম যে, যদিও ইন্ডিয়ানরা মুসল্মানদেরকে পছন্দ করে না, কিন্তু ব্যবসার খাতিরে কিছু কিছু নর্ম মানতেই হয়। আমরা যে হোটেলে উঠেছি, সেটা কোনো স্টারওয়ালা হোটেল না। তারপরেও দেখলাম, ছাদের এক কোনায় কোন দিকে কিবলা, সেটা মার্ক করা আছে। এরমানে হলো, এখানে বহু মুসলমান ব্যক্তিরা হয়তো আসে, আর তারা বারবার কিবলার দিক জানতে চায় বলে হোটেলওয়ালারা ব্যবসার সার্থে কিবলার দিকটা একটা এরো মার্ক দিয়ে ইন্ডিকেট করে রেখেছে। সাথে একটা জায়নামাজও রেখে দিয়েছে। অনুভুতিটা ভালো লাগলো।

আমি আর মুরাদ উড়িষ্যায় যাওয়ার জন্য সকালেই বের হয়ে গেলাম। ট্রেন স্টেসনে গিয়ে নাস্তা করলাম। এখানকার ট্রেন ষ্টেশনগুলি বাংলাদেশের ট্রেন ষ্টেসন গুলি থেকে অনেক পরিষ্কার এবং প্লাটফর্মটাও অনেক প্রশস্থ। তাছাড়া সকাল বেলা হওয়াতে হয়তো ক্লিনাররা পরিষ্কার করে গেছে, তাই আরো পরিষ্কার লাগছে। লোকজনের সমাগম খুব বেশী না। আমরা দ্রুতই টিকেট পেয়ে গেলাম। ট্রেন ছাড়বে সকাল সোয়া আটটায়। হাতে তখনো প্রায় ২০ মিনিট বাকী। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে আসেও নাই।

ঠিক সময়ে ট্রেন চলে এলো। আমরা ট্রেনে উঠে গেলাম। এবার লম্বা একটা জার্নি। উড়িষ্যায় আমি কখনো যাই নাই। ফলে ট্রেন জার্নিতে আমি যতোটুকু মজা করা যায়, সেটা উপভোগ করছিলাম। মানুষের হাবভাব দেখছিলাম, হকার এসব ট্রেনেও উঠে। চায়ের কেটলী নিয়ে চা ওয়ালাও উঠে। বাংলাদেশের ট্রেনগুলির মতোই। তবে একটা জিনিষ যে, এদের ট্রেনের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আমাদের দেশের ট্রেনের চেয়ে একটু ভালো। আমরা যখন উড়িষ্যায় পৌঁছলাম, তখন বেলা প্রায় ৩টা বাজে। ভুবনেশ্বর ট্রেন স্টেসনে নামতে হয় উড়িষ্যায় যেতে হলে। কলকাতা থেকে কেশবপুর- কসবা- নারায়নগড়-বালাসুর-ধর্মশালা-কুরুমিতা-ভুবনেশ্বর। একনাগাড়ে ছুটে চলল ট্রেন। মাঝে মাঝে কিছু কিছু বড় বড় ষ্টেসনে ট্রেন থামলো বটে কিন্তু খুব বেশী নেয় না। টাইম মেইন্টেইন করে বুঝা যায়। ভুবনেশ্বর থেকে মুরাদ একটা ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া করলো, কিভাবে কিভাবে কি বলল হিন্দিতে আমি সবটা বুঝতে না পারলেও বুঝলাম যে, আরো প্রায় ৩০/৪০ মিনিট লাগবে। ক্যাবওয়ালা আমাদেরকে ইনিয়ে বিনিয়ে হরেক রকম রাস্তা দিয়ে শেষতক সেই কর্নেল সাহেবের বাসায় নিয়ে হাজির।

বেশ বিশাল বাড়ি। এটা সরকারী বাড়ি, কংগ্রেসের উড়িষ্যার মহাসচীবের বাসা বলে কথা। আমরা যখন তার বাসায় পৌঁছলাম, তখন প্রায় ৪টা বাজে। মাঝে কোথাও খাওয়া হয় নাই। ভীষন ক্ষুধা লেগেছিলো। আমাদের আসার কথা দুপুরের মধ্যে। কিন্তু আমাদের কোনো গাফিলতি ছিলো না, তারপরেও প্রায় ঘন্টাদুয়েক দেরী হয়ে গেছে। কর্নেল বাসায়ই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমরা তার বাসার ড্রইংরুমে অপেক্ষায় আছি, তার সাথে দেখা হবে। প্রায় ২০ মিনিট পর কর্নেল আসলেন। এর মধ্যে কর্নেলের ওয়েটার আমাদেরকে একজগ পানি আর দুটু গ্লাস দিয়ে গেছেন। ইন্ডিয়ানদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ওরা বেশীর ভাগ মানুষ কিপটা। এক কাপ চা পাঠাবেন, সেই খরচটাও তারা ব্যয় মনে করেন। কিন্তু পানি তো পানিই। অসুবিধা নাই।

কর্নেল এলেন। তার সাথে প্রাথমিকভাবে আর্মি নিয়েই কথা হলো। তিনি আর্টিলারীর অফিসার, আমার মতো। অবসরের পর তিনি রাজনীতি বেছে নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি কংগ্রেস (আই) এর উড়িষ্যার মহাসচীব। অনেক বড় পোষ্ট এবং মর্যাদা। কিন্তু তার এই পোষ্টের মর্যাদা আমার কাছে একেবারেই ছোটলোক মনে হলো কারন আমরা সেই সুদুর বাংলাদেশ থেকে এসেছি তার সাথে দেখা করার জন্য, তাও আবার তারই দাওয়াতে। অথচ এককাপ চা অফার করার মতো সৌজন্যতাবোধ দেখতে পেলাম না। অবশেষে তার ওয়েটার গুনেগুনে ৪টা বিস্কুট নিয়ে এলেন। খুব হাসি পেলো। হায় রে আমার কর্নেল ভাই। যাই হোক, মেজাজ একটু খারাপ হচ্ছিল, আবার একটু অপমানবোধ করছিলাম।

কথায় আসি, বলে বললাম, স্যার, আমাদেরকে আপনি এখানে কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে আলাপের জন্য দাওয়াত করেছিলেন। আমরা কি সে ব্যাপারে বিস্তারীত কথা বলতে পারি? উনি প্রথমে আমাকে বাংলাদেশে সিমেন্টের ব্যবসা করলে কি রকম লাভ হতে পারে, আমার কোনো সিমেন্ট ব্যবসায়ীর সাথে পরিচয় আছে কিনা ইত্যাদি নিয়েই প্রথমে আলাপ শুরু করলেন। আসল কথা ছেড়ে উনি আমাকে যা নিয়ে আলাপ করা শুরু করলেন, আমি তার আগা মাথা কিছুই বুঝতেছিলাম না। আমি বাংলায় মুরাদকে বললাম, মুরাদ, কি ব্যাপার নিয়ে আসলে আমরা এখানে এসেছি, উনি কি এটা জানে?

মুরাদ বল্লো, স্যার জানে তো। নিশ্চয়ই তিনি এ ব্যাপারে আলাপ তুলবেন। শেষ পর্যন্ত তুল্লেন। আলাপের সার্মর্মটা বলি-

ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে তারা আমাকে ৭ মিলিয়ন ডলার লোন নিয়ে দিতে পারবেন। এটা একটা প্রনোদনা ফান্ড। যেহেতু তিনি উড়িষ্যার কংগ্রেস (আই ) এর মহাসচীব, ফলে তার পদমর্যাদায় তিনি ওয়ার্ল্ড ব্যংকের সাথে একটা ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং এ আছেন। তার কিছু প্রভাব রয়েছে। এই ৭ মিলিয়ন ডলার যদি আমরা নেওয়ার জন্য এপ্লাই করি, তাহলে এটা তিনি পাশ করিয়ে দিতে পারবেন। ইন্ডিয়ায় কেনো করছেন না তিনি এ প্রশ্নে জানালেন যে, এটা ইন্ডিয়ার কোনো ব্যবসায়ীর জন্য প্রযোজ্য হবে না, দিতে হবে ইন্ডিয়ার বাইরে যে কোনো মুসলিম দেশে। এই ফান্ডটা বেসিক্যালি কোনো আরব কান্ট্রি করছে এবং শর্ত হচ্ছে এটা কোনো মুস্লিম কান্ট্রিকে দিতে হবে। তো খুব ভালো কথা। আমি দুটু বিষয়ে কোয়ালিফাই করি। প্রথমত আমি ব্যবসায়ী এবং দ্বিতীয়ত আমি মুসলমান কান্ট্রি রিপ্রেযেন্টেটিভ করি। কথার দ্বিতীয় ভাগে উনি আমাকে মোটামুটি চমকে দিলেন। বললেন যে, এই ৭ মিলিয়ন ডলার যদি আমাকে তিনি পাইয়ে দেন, তাহলে ডলার পাওয়ার পর ২ মিলিয়ন ডলার উনি কেটে রাখবেন। আর বাকি ৫ মিলিয়ন ডলার আমি ইচ্ছে করলে মেরে দিতে পারবো। সে ব্যবস্থাও উনি করে দেবেন। এর মানে হলো নির্ঘাত চুরি। আমি এতোক্ষন খুব মনোযোগ সহকারে ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করছিলাম। উনি বললেন যে, এই যে ৫ মিলিয়ন ডলার আমি মেরে দেবো, এটা পুরাটাই আমার নয়। এর থেকে ২ মিলিয়ন ডলার দিতে হবে মুসা সাহেবকে যার থেকে মুরাদও কিছু পাবে আর বাকি ৩ মিলিয়ন আমার একার। আমি কর্নেল সাহেবকে একটা সিগারেট অফার করলাম। যে কোন দেশের যে কোন আর্মির এই একটা গুন আছে, জুনিয়র সিনিয়রের সামনেও সিগারেট ফুকতে পারে যদিও অনেক সময় সিনিয়রার সিগারেট খায় না। কিন্তু এই কর্নেল সাহেব সিগারেট খান, ফলে আমরা দুজনেই সিগারেট ফুকতে শুরু করলাম।

আমি বললাম, স্যার, আপনার অফারটা বেশ লোভনীয়। যে কেউ এটা লুফে নেওয়ায়র কথা। কিন্তু সম্ভবত আমি এই অফারটা নিতে পারবো না। আমি কোনো ডলার চুরীর মধ্যে নাই। আমি ভেবেছিলাম, এটা লোন, ব্যবসা করবো, লাভ করে আমি লোন ফেরত দেবো। কিন্তু এখন যা দেখছি যে, এটা আমার সেই স্বপ্নের পুর্বাভাষ যে, পানিটা পরিষ্কার কিন্তু এটা শোধন করা হয়েছে পায়খানার কোনো জলের ভান্ডার থেকে। আমি এভাবে কোনো ফায়দা চাই না। আপনি অন্য কোনো পার্টনার দেখতে পারেন। কর্নেল খুব মর্মাহত হলেন। বললেন, তিনি যদি এই অফার অন্য যে কোন মুসলিম কান্ট্রিতে যে কোনো ব্যবসায়ীকে অফার করতেন, নিঃসন্দেহে এটা তারা গ্রহন করতেন। আমার মতো তারা এভাবে প্রত্যাখান করতো না। আর যদি প্রত্যাখান করতোও তাহলে কিছুটা সময় নিতো ভাবার জন্য। আমি বললাম, আমি অন্য ১০ জনের মতো নই স্যার। এটা আমার কাছে অপরিষ্কার প্রপোজাল মনে হচ্ছে। এটা আমার কাছে হারাম মনে হচ্ছে। আমি হারাম খেতে চাই না।

আর বেশীক্ষন কথা বলার প্রয়োজন আমি মনে করিনি। প্রায় ৩০ মিনিট পর আমি আর মুরাদ বেরিয়ে গেলাম। আমি মুরাদকে বললাম, মুরাদ, আমি যদি জানতাম, ব্যাপারটা এ রকম, আমি তাহলে ঢাকা থেকেই এখানে আসতাম না। তোমার কি মন খারাপ আমার নেগেটিভ হওয়ায়? মুরাদ ভিতরে ভিতরে কি ভেবেছে জানি না, কিন্তু আমার কাছে এটা স্বীকার করলো যে, সেও এই রকম একটা প্রপোজাল সম্পর্কে জানতো না, আর জনলে মুরাদ আমাকে এখানে আনতো না।

আমাদের ক্যাব বাইরে দাড়িয়েই ছিলো। কথাশেষে আমরা পাশেই একটা হোটেলে একরাত থাকার জন্য একটা রুম বুকড করলাম। খুব শান্তি লাগছে যে, আমি একটা অপরাধ করলাম না। কার না কার টাকা, কার না কার হক, আমি এভাবে কিভাবে করবো? টাকাটাই সবচেয়ে বড় নয়। আমাকে এক সময় এসব টাকা পয়সা ছেড়েই দুনিয়া ত্যাগ করতে হবে। আমি অবৈধ কোনো কাজ করতে চাই না।

অতঃপর, উড়িষ্যায় এক রাত থাকার পর আবারো ফিরে এলাম কলিকাতায় তার পরেরদিন। এবার ঢাকায় ফিরে যাওয়ার পালা।

এখানে কিছু কথা না বললেই নয়। দেশ বিদেশে অনেক রাগব বোয়াল আছে, যারা আসলেই কেউ আছে বলে কোনো অস্তিত্ব নাই, তারা অনেক সময় শধু একটা ছদ্ধনামেই বিচরন করে। আসলে এই মুখুশওয়ালা মুখেশ নামধারী মানুষগুলির আদৌ কোনো চরিত্রই নাই। অথচ এদের  দোউরাত্ত আছে, প্রভাব আছে। এরা দেশের ভিতরে এবং বাইরে এমনকি বহির্দেশেও এই মুখেশরা ততপর, এক্সটরশন, স্মাগ্লিং সবই চলে এই মুখেশদের নামে। এই কথাটা রক্ত দিয়ে লিখে দিলেও কিছু যায় আসে না। মুখেশ একটা ধোকা দেওয়ার নাম। মনগড়া একটা চরিত্র। মুখেশ একটা মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই না। মাঝে মাঝে ক্ষেত্র বিশেষে এই মুখেশরা চরিত্র খোজে। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি হচ্ছি সেই খুজে পাওয়া বা বানানো আরেক কোনো মুখুশওয়ালা চরিত্র। যা কাজের শেষে আমার নিজের কোনো অস্তিত্তই রবে না। কিন্তু একটা সময় আসে, যখন জবাব্দিহিতার দরকার হয়। কিভাবে কখন জল মাথার উপর উঠে যায়, কেউ জানে না। হোক সেটা নিজের কাছে, হোক সেতা সমাজের কাছে কিংবা ঈশ্বর। ওই সময় কথা বা সত্য প্রকাশের নিমিত্তে উগলে নেওয়ার সময় হয়ে উঠে। হতে পারে আমি হয়তো একটা বলীর পাঠা। যখন কেউ বলির পাঠা হয়, তখন সে হয়ে উঠে বিষাক্ত খাবার। আর সেই খাবার যতো দামিই হোক, তা ফেলেই দিতে হয়। যদি তা গোড়া থেকে উপড়ে  ফেলে না দেওয়া যায়, তখন তার মুল্য শুধু বিপদের আশংকাই বাড়িয়ে দেয়। সব সময় বাজীতে জিতবেন, এটা কিন্তু ঠিক না। এখানে আরো একটা কথা থেকে যায়, কর্নেল সাহেব একটিভ রাজনীতিতে জড়িত। রাজনীতিতে কোনো কিছুই সারা জীবনের জন্য হয় না। না বন্দধুত্ত না শত্রুতা। যখন প্রয়োজন হয় তখন মিডিয়া আর পলিটিশিয়ান একে অপরের বন্ধু হয়ে যায়।

আমি যতোক্ষন এই কর্নেল সাহেবের মুল প্ল্যান জানতে পারি নাই, ততোক্ষন একটা স্বপ্নের মধ্যে ছিলাম। আমার ধারনা, মুরাদ বা মুসা সাহেব পুরু ব্যাপারটাই জানতেন। কিন্তু তারা আমাকে আগবাড়িয়ে কিছু বলেন নাই। একটা তাসের খেলার মতো কৌশল নিয়েছিলেন। ফলে কিছু তাস প্রকাশ্যে এসেছিলো, আর কিছু তাস তখনো আমার কিংবা তাদের জানা ছিলো না। ফলে এই খেলায় প্রত্যেকেই ভাবছিলো, হয়তো খেলাটার তুড়ুকের তাস তাদের কাছেই আছে। কিন্তু ধীরে ধীরে হলেও একেকটা তাস ভুল প্রমানীত হলো। তারপর হটাত করে সব তাস চারিদিকে প্রকাশ্য হয়ে চোখের সামনে চলে এল। ব্যাপারটা আর সাফল্যের মুখ দেখলো না। তাতে তাৎক্ষনিক কষ্ট পেলেন এই কর্নেল সাহেব। তার মধ্যে অনেক কিছুর অভাব ছিলো। রাজনীতিতে যদি মানবিকতা আর সচ্ছতা থাকতো তাহলে কেহই এই রাজনীতি করতে আসতো না। তিনি কোনো অবস্থাতেই আমার নজরে একজন ভালো, মানবিক এবং সচ্ছলোক ছিলেন না। কোনো কোনো সময় কিছু কিছু নাটক এমনভাবে বানানো হয় যাতে সাধারনের চোখে মনে হবে এটাই সব সত্যি কিন্তু এর পিছনের মুল উদ্দেশ্য অনেক গভীরে। শুধু ভরসার স্থান তৈরির জন্যই নাটক তৈরী করা হয়। আর এখানেও তাই ঘটেছিলো।

যাই হোক, হয়তো ঈশ্বর আমাকে দিয়ে এমন কোনো কাজ করাতে চান নাই, যা তিনি চান না।   

০১/০৮/২০০৫-৩য় বার সুপারসিডেড

আমার এপেন্ডিক্স-জে লঞ্চ করার কারনে এবার আমার প্রোমোশন হবার কথা না। আর সেটাই হয়েছে। আমি এবার প্রোমশনের ব্যাপারটা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাই নাই। কারন আমি ব্যক্তিগতভাবে আর চাচ্ছিলাম না যে, আমার প্রোমোশনটা হোক আর আমি আবার আর্মিতেই থেকে যাই। এবার আমার কমান্ডার আগেরজন নাই, ফার্ষ্ট লং কোর্সের সোর্ড প্রাপ্ত অফিসার আমাদের ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার। আমি যেহেতু আর ইন্টারেস্টেড না প্রোমোশনের ব্যাপারে, ফলে মজিদ কিংবা অন্যান্য অফিসাররাও আমাকে মূটামূটি ধরেই নিয়েছে যে, আমি আর থাকছি না। মজিদ আমার সাথে বেশ অন্তরঙ্গ ভাবে অনেক কথাই বল্লো। এটাও বল্লো যে, স্যার আপনি যদি এপেন্ডিক্স-জে টা সাবমিট না করতেন, খুব ভালো হতো। এবার আপনার প্রোমোশনটা হতোই।

আমার এমনিতেই এই ব্যাপারে মন ভালো ছিলো না, তারপর আবার আদিখ্যেতাভাব। বললাম, মজিদ, আমি জানি আমি বাইরে গিয়ে কি করবো। যে আমি আর্মিতে আর্মির জন্য এতো শ্রম দিতে পেরেছিলাম, সেই আমি এবার বাইরে গিয়ে নিজের জন্য শ্রম দেবো। আজীবন তো আর আর্মিতে থাকা যাবে না। যদি সেটাই হয়, দেখি না বাইরে গিয়ে কি করা যায়। তবে একটা জিনিষ আমি হলফ করে বলতে পারি যে, আজ যারা আমাদের মতো অফিসারদেরকে মুল্যায়ন করে নাই, কোনো এক সময় এই রাজনৈতিক দল আমাদের অনুপস্থিতির জন্য আফসোস করবে। আফসোস করবে এই কারনে যে, আমরা কোন রাজনৈতিক দল করতাম না। আমরা ছিলাম সত্যিকার অর্থে প্রোফেশনাল আর নিরপেক্ষ। তোমরা যারা পদ দখল করে আছো, তারা একসময় হয়তোবা এই কথাটা অক্ষরে অক্ষরে ফিল করবা যে, আজ যারা তোমরা দলের জন্য অনুপ্রানিত, কোন এক সময় অন্য দলের জন্যেও অনেক অফিসাররা অনুপ্রানিত হবে না এটা ভাবা উচিত নয়। তখন আর যোগ্য অযোগ্য বলে কোনো কথা থাকবে না। তোমরাই তো শিখিয়ে দিলা যে, আর্মিটাকে দলীয়করন করা যায়। আজ তোমরা ক্ষমতায় আছো, এমনো হতে পারে যে, যখন ক্ষমতা হাত ছাড়া হয়ে যাবে, তখন ওইসব অনুপ্রানিত দলকানা অফিসারদের জন্য তোমরা আর ঢোকতেই পারবা না। তখন মনে হবে শিড়দাড়াওয়ালা কিছু নীতিবান অফিসারদের দরকার ছিলো যারা ভোট কারচুপি করবে না, অন্যায় কাজ করবে না, এবং ন্যায় কাজ করার কারনেই হয়তোবা তোমরা আবার ক্ষমতায় আসতে পারতা। এর মাশুল তোমার দলকে দিতেই হবে। আমরা কোন না কোনোভাবে টিকে যাবো, বিলিন হয়ে যাবা তোমরা আর তোমাদের দল। আমি যদি প্রধানমন্ত্রীর কাছের কেউ হতাম, আমি তাকে ঠিক এই কথাগুলিই বলে পরামর্শ দিতাম যে, কোয়ালিফাইড লোক যখন থাকে না, তখন সাফার করে সবাই, আর সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয় দল। মাননিয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আপনার ভবিষ্যত খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। মাসুলটা হয়তো অনেক বড় আকারের দিতে হতে পারে। এটা বাংলাদেশ। তাই ন্যায় কাজ করে কোয়ালিফাইড অফিসারদেরকে এই আর্মিতে রাখুন। এতে আপ্নাদেরই লাভ বেশি হবে।

যাক, চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী। আমি এবার সুপারসিডেড হবার কারনে ঠিক জবাব দিয়ে দিলাম, আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হয়ে যেতে চাই। আমাকে ছেড়ে দেয়া হোক। মজিদকে বললাম, অন্তত এইটুকু উপকার আমার করে দাও তোমার দলিয় প্রধানকে বলে। মজিদ, রাজী হলো।    

০৫/০৭/২০০৫-ইকবালের সাথে আলোচনা

আমি যখন প্রায় সব কিছু ফাইনালাইজ এর পথে, তখন একদিন আমার দোস্ত মাসুদ ইকবালের সাথে রিভার সাইড নিয়ে বিস্তারীত আলাপ আলোচনার জন্য ওর অফিসে গেলাম। আমি ওকে প্রথমে বললাম, যে, মাসুদ রিভার সাইডের নাম শুনেছে কিনা। রিভার সাইডের নাম শুনেই ইকবাল বলে দিলো যে, ওটা একটা খুব খারাপ ফ্যাক্টরী এবং ওটা না নেওয়াই উত্তম। ইকবাল এমনো বল্লো যে, নাজিম সাহেব যদি ইকবালকে রিভার সাইড সুয়েটার্স বিনে টাকাতেও দিতে চায়, তারপরেও ইকবাল এটার ব্যাপারে উতসাহী নয়। জিজ্ঞেস করলাম, এর কারন কি? উত্তরে ইকবাল বল্লো যে, এই ফ্যাক্টরীতে সাবকন্ট্রাক্ট কাজ দিলে ওরা সুতাও বিক্রি করে দেয়। মাল তো দেয়ই না, বরং লায়াবিলিটিজে পড়তে হয়। আমি ইকবালকে বললাম, আরে, এটা তো বর্তমান ম্যানেজমেন্টের সমস্যা। আমরা যদি চালাই, তাহলে আমরা তো আর সুতা বিক্রি করে দেওয়ার কোনো কারন নাই। এরপরেও ইকবাল এটার ব্যাপারে কোনো উতসাহ দেখালো না। একটু খারাপ লাগলো। বললাম, এমনো তো হতে পারে যে, আমরা ভালো করবো। যেহেতু ইকবাল অনেকদিন যাবত গার্মেন্টস লাইনে আছে, ওর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা এই ফ্যাক্টরী দাড় করাতে পারবো বলে আমার ধারনা। কিন্তু ইকবাল তাঁর সিদ্ধান্তে একেবারেই অনড়।

একটু খারাপ লাগলো ইকবালের কথায় কিন্তু আমি দমে যাই নাই। বাসায় এলাম। তারপর আমি কয়েকজন অফিসারের সাথে একে একে কথা বললাম। তাঁর মধ্যে একজন ফেরদৌস স্যার, তারপরে কথা বললাম কেএম সাফিউদ্দিন স্যারের সাথে। আর বেশ রাতে কথা বললাম ফারুক স্যারের সাথে। সবাই এখনো পজিটিভ মুডেই আছেন বলে মনে হলো। ওইদিন মোহসীন সাহেবের সাথে মিটিং করার পর আমি সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকে একটু খোজ খবর নিতে গিয়েছিলাম তউহিদকে নিয়ে। ওখানে গিয়ে জানলাম যে, ব্যাংক রিসিডিউলিং করতে প্রায় ৪০ লাখ টাকার দরকার। রিসিডিউলিং মানে হচ্ছে রিভার সাইডের লোনটাকে আবার রেগুলারাইজেশন করা। এখন কিস্তি না দেয়ার কারনে এটা একটা খারাপ লোনে পরিনত হয়েছে। খারাপ লোন হলে সেসব কারখানায় ব্যাংক সাপোর্ট পাওয়া যায় না, আবার কোনো এলসিও খোলা যায় না। কাজও করা যায় না।

এই তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমি একটা আইডিয়া করলাম যে, আমাকে এই মুহুর্তে প্রায় লাখ ৫০ টাকার মতো নিয়ে মাঠে নামতে হবে। কিন্তু দূর্ভাগ্য হচ্ছে যে, আমার কিন্তু এতো টাকা নাই। আমি হয়তো পেন্সনের টাকা পেলে সর্বোচ্চ লাখ ২০ টাকা ইনভেস্টমেন্ট করতে পারবো। কিন্তু বাকীটা? ফলে আমি ধরে নিলাম, যদি ফেরদৌস স্যার, সাফি স্যার আর ফারুক স্যার জয়েন করেন, আমরা সবাই যদি ২০ লাখ করে টাকা ইনভেস্ট করি, তাতে টাকার সমস্যাটা আর থাকে না। আমি এই তথ্যটা উক্ত তিন অফিসারকে জানালাম। এবং আমাদের পরিকল্পনা হলো যে, আগামি বন্ধের দিন সবাই ফ্যাক্টরী দেখতে যাবো। তাঁর আগে কারো যদি কোনো অভিজ্ঞ গার্মেন্টস মালিক কিংবা কর্তার কাছে পরামর্শ নিতে হয়, আমরা নেবো।

খুব ভালো লাগছে এটা ভেবে যে, আমার সপ্নটা বাস্তবায়ন হচ্ছে ইনশাল্লাহ।

০৮/০৪/২০০৫-বাড়ির কাজ চলছে পুরুদমে।

বাড়ির কাজ চলছে পুরুদমে। প্রতিদিন মীরপুর গোলারটেক আমি যাই। বড্ড ভালো লাগে যখন দেখি একতা একটা করে ইটের গাথনীতে আমার একটা একটা করে তালা সম্পন্ন হচ্ছে। ঠিক যেভাবে চেয়েছিলাম, সেভাবেই যাচ্ছে। হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন থেকে ১৫ লাখ টাকার লোন ইতিমধ্যে পেয়ে গেছি। প্রতিমাসে কিস্তি প্রায় ১৮০০০ টাকা করে দিতে হবে। ১৫ বছর। অন্যদিকে আমার পেনসন কমুটেশন থেকেও লোন পেয়েছি ১০ লাখ টাকার। হাতে যে টাকা ছিলো, তাঁর সাথে এই লোনগুলি পাওয়াতে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, চারতালা পর্যন্ত আমি একনাগাড়ে করে ফেলতে পারবো। আমার বাড়ির ডিজাইন করে দিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ইঞ্জিনিয়ার রফিক ভাই। অত্যান্ত অমায়িক লোক। উনি সাধারনত কারো ব্যক্তিগত বাড়ির ডিজাইন করে দেন না কিন্তু বন্ধুত্তের খাতিরেই তিনি আমার জন্য কাজটা করে দিলেন।

এপেন্ডিক্স জে সাবমিট করে দিয়েছি। যেকোনো মুহুর্তে আমার ডাক পড়তে পারে হাইয়ার হেড কোয়ার্টারে। অপেক্ষা করছি তাঁর জন্য। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছেও একটা ডিও পাঠিয়েছি। একই প্রকারের ডিও পাঠিয়েছি চীফের কাছেও। লেঃ জেনারেল হাসান মাশউদ। কেনো জানি লোকটাকে আমার পছন্দ নয়। আমি এই ভদ্রলোককে কমান্ডেন্ট হিসাবে পেয়েছিলাম এসআই এন্ড টি তে (স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি এন্ড ট্যাক্টিক্স) সিলেটে। উনি বিএনপি ঘরোয়ার লোক।

আমার মা বেচে নেই কিন্তু শাশুড়ি মা বেচে আছেন। আমার খুব শখ ছিলো মা যদি দেখে যেতে পারতেন আমার একটা স্থায়ি ঠিকানা হচ্ছে ঢাকায়, খুব ভালো লাগতো। আমার শাশুড়ি আমার সাথেই থাকেন মীরপুরে। তাঁর ও খুব শখ আমার নতুন বাড়িতে তিনি থাকবেন। আমার খুব একজন মানুষ তিনি। দোয়া করি যেনো এই সব মা গুলিকে অনেক হায়াত দেন।

ইদানিং যেনো সব কিছু খুব ফাস্ট মুভ করছে। রিভার সাইড সুয়েটার্স এর ব্যাপারেও অনেক এগিয়ে গিয়েছি। কথাবার্তা চলছে বটে কিন্তু নাজিম সাহেবের মতিগতি খুব একটা স্টেবল মনে হচ্ছে না। আসলে তাঁর কাছে কয়েক কোটি টাকা লস কোনো ব্যাপারই না। মাঝে মাঝেই আমি নাজিম উদ্দিন সাহেবের আস্তনায় যাই। কিন্তু তাঁর সব সাংগ পাংগরা এতোটাই দুর্ব্রিত্ত যে, ওদের সাথে আমার যায় না। তারপরেও আমি বিশেষ কারনেই তাঁর সাথে একটা ভালো সম্পর্ক রাখছি।

তৌহিদের সাথে আমার প্রতিনিয়ত যোগাযোগ অব্যাহত আছে। সে চায় আমি ফ্যাক্টরীটা নেই। তৌহিদ আমাকে জানালো যে, এই ফ্যাক্টরীতে জনাব মোহসীন নামে একজন ডিএমডি হিসাবে কাজ করতেন। গার্মেন্টস লাইনে তিনি এতোটাই পাকা যে, যদি তাকে খুজে পাওয়া যায়, তাহলে আমার জন্য খুবই ভালো হয়। কারন তিনি মার্কেটিং জানেন, কষ্টিং জানেন, প্রোডাকসন জানেন এবং অত্যান্ত ভালো একজন মানুষ। আমি মীরপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকেই সবকিছু তৌহিদের মাধ্যমে ফ্যাক্টরীর সব বিষয়ে আপডেট নেই। লুতফর রহমান সাহেব কি করছেন, তাঁর মোটিভ কি, ইত্যাদি।

এর মধ্যে আমি ফা এপারেলস এ ভিজিটে গিয়েছিলাম, সাভারে, দেখেছি যে, প্রায় সব ওয়ার্কাররা বসে আছে। এখন নাকি কাজ নাই। জাবের জানালো যে, এটা একটা অফ সিজন, আর অফ সিজনে ওয়ার্কারদের কাজ না থাকলেও ছাটাই করা বুদ্ধিমানের কাজ না। কারন পিক টাইমে আবার ওয়ার্কার পাওয়া যায় না। সাথে লিখনকে নিয়ে গিয়েছিলাম। লিখনও আমাকে খুব একটা ভালো ফিডব্যাক দিতে পারলো আসলে একটা ভাল ফ্যাক্টরীর কি ক্রাইটেরিয়া থাকে। শুধু একটা কথা বল্লো যে, কমপ্লায়েন্স এর ব্যাপারে আরো কিছু কাজ করতে হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কমপ্লায়েন্স আসলে কি? এই কমপ্লায়েন্স মানেও আমাকে লিখন ভালো করে বুঝাতে পারলো না। হয়তো আমি বুঝবো না বলেই খোলাসা করে বলে নাই।

যাই হোক, আমি বারবার কেনো জানি রিভার সাইড সুয়েটার্স এর দিকে ঝুকে যাচ্ছি। তউহিদকে বললাম, মোহসীন সাহেবকে খুজে বের করো, আমি তাঁর সাথে কথা বল্বো। দেখি কোনো আইডিয়া দিতে পারেন কিনা।

০৬/০১/২০০৫-জেনাঃ শফিক ইন্টারভিউ

আমার ব্রিগেড কমান্ডার আমার প্রোমোশন না হওয়াতে আমি বুঝতে পারছি তিনিও খুব আপসেট। যখন কোনো ব্রিগেড লেবেলের অনুষ্ঠান হয়, তিনি আমাকেও সিওদের সাথে একতা চেয়ার রাখেন, কিংবা যখন সিওদের একান্ত কোনো মিটিং করেন বা এই জাতীয় কিছু এরেঞ্জ করেন, তিনি আমাকেও ডাকেন। অনেক সময় মজিদকে ডাকেন না। কারন তিনি এইটুকু জানেন যে, আল্টিমেটলী মজিদকে বল্লেও মজিদ শেষ পর্যন্ত আমাকে এসেই বলবে। তাঁর থেকে ভালো অন্যান্য সিওদের সাথে কমান্ডার আমাকেই ডাকেন, মজিদকে নয়। ব্যাপারটা ভালো লাগে, কিন্তু তারপরেও মনের ভিতরে একটা কি যেনো খস খস করতেই থাকে। কমান্ডারকে বললাম, স্যার, আমি কি এম এস এর সাথে দেখা করতে পারি? আমার জানার খুব শখ আসলে আমার প্রোমোশন না হবার পিছনের রহস্য টা আসলে কি? এটা কি ১৩ লং কোর্সের অফিসার আমি এই জন্য? যদি সেটাই হয় তাহলে এই প্রোমোশন বোর্ডে কিছু কিছু ১৩ লং কোর্সের অফিসারদের কিন্তু প্রোমোসন হয়েছে। তাহলে ওরা কি বিএনপি ঘেষা? আমি তো কোনো রাজনীতি করি না। এমন কি আওয়ামিলীগও করি না। তাহলে ব্যাপারটা কোথায় লুকিয়ে আছে রহস্যটা? কমান্ডার শেষ পর্যন্ত এম এস জেনারেল সফিকের সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দিলেন। সকালেই আর্মি হেড কোয়ার্টারে গিয়েছিলাম। অনেকদিন পর আসলাম আবার আর্মি হেডকোয়ার্টারে। অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নতুন অফিসার, নতুন নতুন মুখ।

স্যার দেখা দিলেন। প্রথমেই আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন, আমি স্যারকে চিনি আগে থেকেই, কিন্তু খুব একটা ব্যক্তিগত সখ্যতা নাই। অনেক কিছু নরম্যাল কথা বলার পর স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বলো কি কারনে আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছো? আমি বললাম যে, স্যার বেসিক্যালি আমি অনেক বছর আগে থেকেই একটা বিকল্প অপসন খুছিলাম কিভাবে আমার চাকুরীর ফিল্ড চেঞ্জ করা যায় কিন্তু সেটা যেভাবেই হোক ব্যাটে বলে মিলছিলো না। কিন্তু পর পর দুবার সুপারসিডেড হবার কারনে প্রক্রিয়াটা এবার আমি শুরু করতে চাই। কিন্তু তাঁর আগে আমার খুব জানার ইচ্ছা যে, আসলে কোন কারনে আমার বা আমার মতো আরো কিছু অফিসারের প্রোমোশন হয় নাই। এটা তো আমাদের জানার একটু ইচ্ছে হতেই পারে স্যার। আপনি যদি আমাকে খোলামেলা বলতেন, হয়তো নিজের কাছে একটা জবাবদিহিতার সুযোগ পেতাম।

স্যার খুব মুচকী হেসে বললেন, দেখো আখতার, আমি আসলে প্রোমোশন দেওয়ার মালিক নৈ, আমার কাজ তোমাদের ফাইলগুলি ঠিকঠাক মতো বোর্ডে দেয়া আর বোর্ডের কাজ সেগুলি বিশ্লেষন করে কাকে কিভাবে কি করবেন সেটা করা। হ্যা, প্রতিটা ফাইলে অনেক মন্তব্য থাকে, অনেক অব্জারভেশন থাকে, সেগুলি কাউকে কাউকে আবার চিঠি দিয়ে জানানো হয়, বা কন্সার্ন কমান্ডাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে জানানো হয় যাতে ওই অফিসারকে তারা জানাতে পারেন। তবে তোমার ব্যাপারে পার্টিকুলার কোনো বড় ধরনের অভিযোগ বা অব্জারভেশন ছিলো না। একটা পি ই টি তোমার এ সি আর থেকে মিসিং আছে, সেটা ছাড়া আর তেমন কোনো অব্জারভেশন পাওয়া যায় নাই। কিন্তু এসব হচ্ছে মামুলি ব্যাপার, বোর্ডে অনেক জেনারেল গন আরো কিছু উত্থাপিত হয়তো করেন যা সব সময় ফাইলে লিপিবদ্ধ করেন না, হোয়াইট, গ্রে বা ব্ল্যাক মন্তব্য থাকে যা আমি তোমাকে এই মুহুর্তে সেসব বলতে পারবো না। তোমার কোর্স মেট আছে মেজর ওয়াকার। সেটা নিয়ে এক সময় সম্ভবত তুমি ওর ফাইলটা নিয়ে কাজ করেছিলা, যেখানে বেশ কিছু মন্তব্য তুমি লিখেছো।

আমি হাসলাম। আর বললাম, স্যার, এই আর্মির জন্য আমি আমার পরিবারকে পর্যন্ত সময় দিতে পারি নাই। জীবনের এই ১৮/১৯ বছরের মধ্যে প্রায় সময়ই শুধু আর্মির সার্ভিস দেয়ার জন্য ম্যারেড ব্যচলর হিসাবেই মেসে মেসে কাটিয়েছি। আজ এতো বছর পর বুঝলাম, আসলে এটা আমার কখনো আপন ছিলো না। যাই হোক, আমি আজো জানতে পারলাম না কি কারনে আসলে আমার প্রোমোশনতা হলো না। আমি স্টাফ কলেজ করেছি, গানারী স্টাফ করেছি, জি এস ও -২ (অপ্স) ছিলাম, আর্মি হেড কোয়ার্টারে কাজ করেছি, সি জি এস এর সাথে কাজ করেছি, চীফের সাথে কাজ করেছি, অন্তত ৫ থেকে ৬ টা জেনারেলের সাথে ডাইরেক্ট কাজ করেছি, বিপসটের মতো একটা জায়গায় একা প্রায় ৩৫ টা দেশের সাথে ট্রেনিং কোওর্ডিনেট করেছি একা। আসলে এসবের কোনো মুল্য ছিলো না। কিন্তু যারা সারা বছর ক্যাটেগরি সি হয়ে আরাম আয়েস করেছে, কাজে ফাকি দিয়েছে, ওরা অপদার্থ বলে কোনো সিনিয়ররা পর্যন্ত ওদেরকে কোনো কাজ দিতে চাইতো না, তারাই সময় মতো আমাদের মাথায় বসে অধিনায়কগিরি করে আর আমরা তাদের অধীনে উপ অধিনায়ক, কিংবা বড় জোড় কোনো একটা ইউনিটে বা সংস্থায় পার্মানেন্ট সুপারসিডেড হয়ে কলুর বলদের মতো কিছু বেতনের জন্য কাজ করে যাই। আমার এই বেতনের অর্ধেক তাকাই তো খরচ হয়ে যায় আমার সিগারেটের পিছনে। আর্মির বাইরের দুনিয়াটা আমি দেখি না, কিন্তু ওটা যে এই আর্মির থেকেও অনেক বড় একটা পরিসর সেটা আমার জানা। আমি স্যার এপেন্ডিক্স যে সাবমিট করলে কাইন্ডলী আমার এপ্লিকেশনটা ফরোয়ার্ড করবেন। আমাকে অন্তত এই উপকারতা করবেন। আমি আপনার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ থাকবো। সবাই এই আর্মিতে আজীবন থাকবে না। হয়তো আবার আমাদের দেখা হবে বাইরের কোনো বড় পরিসরে যেখানে আমার আপনার চেয়ারের লেবেল সমান। আমি স্যার চীফকেও বলে যাবো কিছু কথা। উনাকে একটা ডিও লিক্ষেছি, প্রধান মন্ত্রীকেও। দেশের একজন নাগরীক হিসাবে তিনি আমার প্রধান মন্ত্রী, তাঁর কাছে আমার কষ্টের কথা বলাই যায়। যদি উনি সময় দেন, তো ভালো, না দিলে হয়তো আমার কিছু করার নাই।

সফিক স্যার আমাকে শান্তনার বানী দিয়ে বললেন, দেখো আখতার, সময় পালটায়, সময় সব সবার সময় এক রকম যায় না। আরেকতা বার সুযোগ নাও, দেখো কি হয়। দুবার যখন হয় নাই, তৃতীয় বার তো হতেও পারে। কিন্তু তুমি যদি এপেন্ডিক্স-জে দাও, তখন তোমার এপ্লিকেশন থাকাকালে আমরা ইচ্ছা করলেও তোমার ফাইল পরবর্তী বোর্ডে পাঠাতে পারবো না। সেক্ষেত্রে তোমার প্রোমোশন হয়তো কন্সিডার করবে না যা একটা সুযোগ ছিলো, সেটাও তুমি হারাবা। আমি বললাম, স্যার, অফিসে যেতেই ভালো লাগে না। এতো লম্বা সময় কাটাবো কিভাবে? জুনিয়র আন কোয়ালিফাইড একজন ছেলে আমার অধিনায়ক হিসাবে মাথায় ছড়ি ঘুরাবে, আর আমি প্রতিটি মুহুর্ত এটা হজম করে করে বেচে থাকতে হয়তো পারবো না।

যাই হোক, চলে এলাম। কিন্তু জানা হলো না আমার প্রোমোশন না হবার মুল রহস্য কি। 

২২/১২/২০০৪-জাবেরের সাথে বৈঠক

আমি রীতিমত হন্যে হয়ে একটা ব্যবসার কথা চিন্তা করছি। রিভার সাইড সুয়েটার্স যদি শেষ পর্যন্ত না নেয়া হয়, সেক্ষেত্রে আমি আরো কিছু বিকল্প চিন্তা করছিলাম। এই চিন্তা থেকে আমার কোর্সমেট জাবেরের সাথে ফোনে কথা বলি। কারন জাবের নিজেও একটা ফ্যাক্টরী চালায়, নাম "ফা এপারেলস", সাভার। জাবের আমার ব্যবসার চিন্তাভাবনা শুনে বল্লো যে, আমি ওর সাথেও ফা এপারেলসে পার্টনারশীপ করতে পারি যদি চাই। ওখানে ইতিমধ্যে আমার আরেক কোর্সমেট মেজর বশীর আছে, আর তাছারা আরো বেশ অনেক গুলি কোর্সমেট ইতিমধ্যে বেশ কিছু বাজেট ইনভেষ্টমেন্ট করেছে। তাঁর মধ্যে আছে মেজর সালাম, মেজর জসীম, মেজর নওরোজ, আরো অনেকে। অনেকেই নাকি প্রায় প্রত্যেকেই কমপক্ষে ১০ লাখ করে টাকা ইনভেষ্ট করেছে। কেউ কেউ বেশীও করেছে। ফলে আমি যদি চাই, তাহলে আমিও ওখানে ওদের মতো ইনভেষ্ট করতে পারি। জাবের রাতে আমার বাসায় এলো। সাথে বশীর। মীরপুরের বাসায় আমরা সবাই প্রায় ঘন্টা দুয়েক আলাপ করলাম। কিন্তু আলাপের মধ্যে আমি কিছুটা বিভ্রমের গন্ধ পাচ্ছিলাম।

                                

বিভ্রমটা তাহলে কি? আমাকে জাবের আর বশীর প্রোপোজাল দিলো যে, লাভে টাকা খাটাইতে। যদি লাভ হয় তাহলে পার্সেন্টেজ অনুযায়ী আমাকে লাভ দেয়া হবে। আমি তখন জাবেরকে বললাম যে, যদি লাভ না হয় এবং লস হয় তখন কি হবে? জাবের আমাকে বল্লো যে, লসের ভাগিদার ওরা, কিন্তু লাভের ভাগিদার থাকবো আমরা। আর এভাবেই নাকি অন্যান্য কোর্সমেটরা টাকা খাটিয়েছে। ব্যাপারটা আমার কাছে বিশেষ সুবিধার মনে হলো না। আমি জাবেরকে বললাম, আমার ইনভেষ্টমেন্টের সমান পরিমান শেয়ার দিতে আপত্তি কি? কিন্তু সেটা তারা রাজী নয়। আমি ব্যবসা বুঝি না কিন্তু হালাল হারাম বুঝি। আমার কাছে মনে হলো, জিনিষটা হালাল নয় যে, শুধু লাভ নেবো, লস নেবো না। আবার আমি এক অর্থে পার্টনার কিন্তু আবার শেয়ার হোলডার না। কনফিউজিং একটা স্টেট।

আমি জাবেরকে রিভার সাইড সুয়েটার্স এর কথা বললাম যে, আমি একটা ফ্যাক্টরী নিয়ে কথা বলতেছি। যদি ওটা হয়ে যায়, তাহলে আর জাবেরদের সাথে আমি যাচ্ছি না। জাবের আমাকে ডিসকারেজ করলো যে, তুই আগে আমার ফ্যাক্টরিটা দেখ, তারপর অন্য ফ্যাক্টরী নিয়ে ভাবিস। বললাম, আমি এম্নিতেও জাবেরে ফ্যাক্টরীতে ভিজিট করতে যাবো, টাকা ইনভেষ্ট করি আর নাইবা করি, অন্তত একটা অভিজ্ঞতা তো হবে। ডেট ঠিক করলাম যে, আমার এক আত্তীয় আছে, বেক্সিমকোতে চাকুরী করে, ওকে নিয়ে আগামী বন্ধের দিন ফা এপারেলস ভিজিটে যাবো। জাবের এবং বশীর চলে গেলো। আমি রিভার সাইডের মধ্যে বেশী টান অনুভব করলাম। অনেক রাত অবধি আবার তৌহিদের সাথে ফ্যাক্টরী নিয়ে কথা বললাম।

কথা বললাম, কিভাবে শেয়ার ট্রান্সফার করতে হয়, জয়েন্ট স্টক কি, ইত্যাদি। তৌহিদ বলল যে, হিরু নামের এক ভদ্রলোক আছে, যে এই সব শেয়ার ট্রান্সফার কাজগুলি করে। ওর সাথে বসে আলাপ করলেই আরো ব্যাপারটা ক্লিয়ার হবে।

১৫/১১/২০০৪-গোল্ডেন ইন-কাজ শুরু

গত পহেলা সেপ্টেম্বরে আমি আমার মিরপুরের বাড়ির কাজ শুরু করেছি। আমার কেনো যেনো বারবার মনে হয়েছিলো যে, আমার আর বেশীদিন এই আর্মিতে থাকা হবে না। তাই আমার ওই দুইটা ভাবনার সমস্ত কাজ খুব জোরেসোরে শুরু করেছিলাম। আমার হাতে মিশন থেকে প্রাপ্ত টাকা আছে ১১ লক্ষ ৩৪ হাজার টাকা। আর মিটুল মালয়েশিয়ায় ট্রেনিং করার কারনে কিছু টাকা সেভ করতে পেরেছে, তাঁর পরিমান নেহায়েত কম না, প্রায় চার লাখ টাকা। মোট পনেরো লক্ষ টাকা দিয়ে ভাবলাম যে, অন্তত একতলা একটা বাড়ি করলেও আমার থাকার ব্যবস্থাটা হয়ে যায়। মনে অনেক সাহস ছিলো, জোরও ছিলো। আর যেহেতু সিদ্ধান্ত প্রায় চুড়ান্ত করে ফেলেছিলাম যে, আমি আর থাকবো না আর্মিতে, ফলে আমার পিঠ প্রায় দেয়ালেই ঠেকে গিয়েছিলো। অফিসে যেতে ভালো লাগে না, কোথাও কোনো দাওয়াত খেতে যেতে ভালো লাগে না, অফিসাররা বাসায় এলে তাদের সাথেও আগের মতো আর গল্প করতে ভালো লাগে না। এটা একটা অত্যান্ত খারাপ সময় পার করছি।

একদিন শুনলাম যে, পেনশনের টাকা থেকে আগাম নাকি কমুটেশন করে কিছু লোন নেয়া যায়। যোগাযোগ করলাম এফসি আর্মিতে। ব্যাপারটা সত্য। আমি কালবিলম্ব না করে, তাড়াতাড়ি ১০ লক্ষ টাকার একটা লোনের দরখাস্ত করে দিলাম। টাকাটা পেলে আমার বাড়ি করতে খুব কাজে লাগবে। এখানে একটা কথা বলে রাখা খুব দরকার যে, যে জায়গায় আমি বাড়ি বানাচ্ছি, সেই জমিটা আমি কিনেছিলাম আমাদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে। উনি যখন আমেরিকায় ছিলেন, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত জনাব আজাদের মাধ্যমে আমমোক্তার বলে আমি তদানিন্তত প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের কাছ থেকে পৌনে তিন কাঠা জমি সর্বোমোট ১০ লাখ টাকায় কিনে নিয়েছিলাম। এই সংযোগটা হয়েছিলো আমাদের মীরপুর এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হোসেন খানের মাধ্যমে। এখন আমি সেই পৌনে তিন কাঠা জমির উপর আপাতত চার তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে আপাতত একতলা বাড়ি বানানোর নিয়ত করেছি। কারন বাকী তালা করার জন্য আমার কাছে বাজেট নাই।

আমি প্রতিদিন বাড়ির কাজ তদারকী করতে অফিসের পরে আর্মির জীপ নিয়ে, আর্মির ড্রেস পড়েই চলে আসি। বাড়ির কাজ দেখতে ভালো লাগে। অনেক রাত হয়ে যায় ফিরতে ফিরতে। আমি ক্যান্টনমেন্টের বাসায় থাকি। কিন্তু মন পড়ে থাকে এই নতুন বাড়ির কন্সট্রাকসনে। বদর ভাই একদিন বাসায় আসলেন, বদর ভাই হচ্ছে মিটুলের কলিগ, সিংগাইর বাড়ি। নিতান্ত ভদ্রলোক। কথাত কথায় জানালেন যে, উনার এক আত্তীয় আছেন হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনে। ওখান থেকেও বাড়ি বানানোর জন্য সহজ কিস্তিতে লোন নেয়া যায়। তাঁর নাম সিদ্দিক সাহেব। বদর ভাইকে নিয়েই গিয়েছলাম ওই অফিসে, ভাগ্য খুব ভালো। একতা এপ্লিকেশন করতে বললেন। দুই মাসের মধ্যে নাকি ১৫ লক্ষ টাকার একটা লোন দেয়া সম্ভব। এবার আমার বাজেট দারালো (হাতে ছিলো ১৫ লাখের মতো, পেনসন কমুটেশন থেকে পাবো ১০ লাখ টাকা আর হাউজ বিল্ডিং কর্পোরেশন থেকে পাবো আরো ১৫ লাখ টাকা) মোট ৪০ লাখ টাকা। এই টাকায় আমি একেবারে এক নাগাড়ে  চার তলা পর্যন্ত করে ফেলতে পারবো ইনশাল্লাহ। ঠিক ৪০ লাখ টাকায় হবে না জানি, কিন্তু দোকানে আরো লাখ দশেক তাকার মেটেরিয়াল বাকীতে নিলে হয়েই যাবে। আর সেই বাকীর তাকাগুলি আমার পেনসনের পর যে টাকা পাবো তা দিয়ে শোধ করা সম্ভব। অন্তত একটা কাজ হয়ে যাচ্ছে। একটা ফ্লোর নিয়ে যদি আমি আমার পরিবার নিয়ে থাকি, তাহলে বাকী ফ্ল্যাট গুলি থেকে একটা ভালো ইনকাম আসবে যা আর্মির বেতন থেকেও ডাবল। তাঁর উপরে মিটুল চাকুরী করে। আমার চলায় কোনো অসুবিধা নাই।

এখন পরবর্তী যে জিনিষটা দরকার, তা হচ্ছে একটা ব্যবসার প্ল্যান করা। আমি এই ব্যাপারে চারিদিকে খোজ খবর নিচ্ছি। দেখা যাক, কি হয়।

১১/১১/২০০৪-কর্নেল আব্দুল মজিদ সিও

ফেরদৌস স্যারের পোষ্টিং হয়ে গেলো, তাঁর পরিবর্তে ৪ ফিল্ডের সিও হিসাবে পোষ্টিং হয়েছে প্রধান মন্ত্রীর এ ডি সি হিসাবে কাজ করতো ১৪ লং কোর্সের আব্দুল মজিদের। এবার মজিদ সম্পর্কে কিছু বলি। আমি যখন আর্মি হেড কোয়ার্টারে কাজ করছিলাম, তখন একটা রিউমার উঠলো যে, খালেদা জিয়া তাঁর এডিসি হিসাবে মেজর আব্দুল মজিদকে চান। এম এস ব্রাঞ্চে তখন আমার দোস্ত মেজর আকবর ডি এম এস হিসাবে কাজ করছে। আমরা তখন আর্মি হেড কোয়ার্টারে প্রায় সাতজন কোর্সমেট একসাথে কাজ করছি। আমি এমটি ডাইরেক্টরে, ওয়াহিদ এমটি ডাইরেক্টরে, মেজর মতি, মেজর সালাম আর মেজর চৌধুরী সবাই এমটি ডাইরেক্টরেটে। মানে আমরাই ৫ জন কোর্সমেট এমটি ডাইরেক্টরেটে কাজ করছি। পুরু সেনাবাহিনীর ট্রেনিং কোনো না কোনোভাবে আমাদের হাতে। মেজর শহীদুল (যাকে আমরা চাচা বলে ডাকি) সে কাজ করে আর্টিলারী ডাইরেক্টরেতে, এমএস ব্রাঞ্চে কাজ করে মেজর আকবর, পিপি এন্ড পি তে কাজ করে মেজর আলমগীর। অন্যান্য ডাইরেক্টরেটে যারা কাজ করে তারাও আমাদের হয় এক কোর্স জুনিয়র বা এক কোর্স সিনিয়র। ফলে পুরা আর্মি হেড কোয়ার্টারের মধ্যে কোথায় কি হচ্ছে তা আমরা দিনের কোনো না কোন সময় একে অপরের কাছ থেকে জেনেই যাই।

ঠিক এমন সময় একটা খবর চাউড় হলো যে, ১৪ লং কোর্সের মেজর মজিদের জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া চেয়েছেন যেনো মজিদকে তাঁর ব্যক্তিগত এডিসি হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। এটা কোন বিস্ময়কর খবর না আসলে, এটা হতেই পারে যে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজস্ব একজন পরিচিত মানুষকে তাঁর ব্যক্তিগত এডিসি হিসাবে চান। কিন্তু বিস্ময়কর খবরটা হলো যে, যখন কোনো অফিসারের এই ধরনের পোষ্টিং হয়, তখন একটা প্যানেল হয়। সেই প্যানেলে চৌকস অফিসারদের নামের তালিকা থাকে। সেখান থেকে মেধা, শারীরিক যোগ্যতা, ক্ষিপ্রতা, আপটেক, ডিপ্লোমেটিক ভদ্রতা, কিংবা আরো অনেক কিছু বিবেচনা নেয়া হয়। বেষ্ট অফিসারতাই আসলে এতো বড় লেবেলের একটা পদে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। এটা তো শুধু দেশের ভিতরেই নয়, যখন প্রধান্মন্ত্রী দেশের বাইরে যাবেন, এই এডিসিরাই অন্যান্য দেশের বড় বড় জেনারেলদের সাথে ইন্টারেকশনে আসবেন। ফলে মেধাবী, শারীরিক যোগ্যতা, প্রেজেন্টেবল, মেধাশীল, ডিপ্লোমেটিক না হলে তাকে তো নেয়াই ঠিক না।

মেজর মজিদ মেধাশীল নয়, ষ্টাফ কলেজ করে নাই, নিজের আর্মসের আর্টিলারীর গানারী ষ্টাফ কোর্স টাও করতে পারে নাই, কোনো একটা কোর্সে যে টপ করেছে সে রেকর্ডও নাই, তাঁর কোর্স ১৪ তম লং কোর্সের মধ্যে সে একজন শেষের দিকের অফিসার, শারীরিকভাবে সে মেডিক্যালি ফিট নয় কারন সে ক্যাটেগরি "সী' একজন অফিসার। ক্যাটেগরি সি মানে তিনি মেডিক্যালী আনফিট, এবং কোনো কাজের জন্যই তিনি ফিট নন। তাঁর মধ্যে তাঁর আছে ডায়াবেটিস। এমন একটা অফিসারকে হটাত করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কেনো চয়েজ করলেন? সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলো। খোজ খবর নিয়ে যখন জানা গেলো, সেটা আরো স্বজনপ্রীতি ছাড়া আর কিছুই না। মেজর মজিদের বাবা খালেদা জিয়ার বাড়িতে মালির কাজ কিংবা কেয়ার টেকারের কাজ করেন বহুবছর যাবত। মজিদের বাবা সেই সুবাদে খালেদা জিয়ার সাথে ব্যক্তিগতভাবে জানা এবং চেনা, এবং বহুবছর যাবত আছেন। খালেদা জিয়া যখন গৃহিণী, অর্থাৎ জেনারেল জিয়া যখন বেচে ছিলেন, মজিদের বাবা তখনো তাদের বাড়িতে মালীর কাজই করতেন। মজিদের বাবা এখন খালেদা জিয়াকে অনেকভাবে অনুরোধ করেছেন যেনো তার ছেলেকে একটা ভাল পোষ্টে রাখেন, পারলে তাঁর এডিসি করে নেন। ব্যাপারটা হয়তো মজিদ নিজেই তাঁর বাবাকে এই রকমের একটা কথা বলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী খালেদার কাছে পাঠিয়েছেন। হয়তো খালেদা জিয়া আপাতত "এইটা আর কি এমন রিকুয়েষ্ট" মনে করে সেনাপ্রধানকে ব্যাপারটা কার্যকরী করার জন্য বলেছেন। তারপর আর যায় কই। প্রধানমন্ত্রীর একটা কথা সেনাপ্রধানের জন্য আদেশেরই নামান্তর।

সেনাবাহিনীর সমস্ত নর্ম ভেংগে, সমস্ত প্রথা অমান্য করে, পলিসি ব্রেক করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন কাউকে একটা সুযোগ করে দেন, তখন আর বেশী করে ভাবা দরকার হয় না যে, তিনি কতটুকু দেশনেত্রি বা কোনো বাহিনীকে তিনি কতটা সম্মান করেন। বুঝলাম, দূর্নীতির শেকর খুব উপরে। হয়তো কোনো এক সময় এই দলই তাঁর নিজের এ রকম দুর্নীতির কারনে এমন জায়গায় পা আটকে যাবে যখন দাপটওয়ালা অফিসার তাদের আশেপাশে খুজে পাওয়া যাবে না। যখন এই দলের জন্য কোনো চৌকস অফিসার লাগবে, তখন এই মজিদেরা না পারবে হাল ধরতে, না পারবে পুরা ক্রিটিক্যাল সময়ে অন্য কোন অফিসারদেরকে হাতে নিতে। এই দলের ভাগ্যে চরম দূর্ভোগ আছে অদুর ভবিষ্যতে। এখন শুধু দেখার অপেক্ষা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বি এন পি ই এক মাত্র প্রথম দল যেখানে দলীয় বিবেচনায় যোগ্য কে বাদ দিয়ে অযোগ্য কোনো অফিসারকে পদায়ন করেছে, আর যোগ্য ব্যক্তিদেরকে অসম্মান করেছে। এর মাশুল হয়তো এই রাজনৈতিক দলকে খুব বেশী ভোগাবে একদিন। সেদিন পর্যন্ত বেচে থাকলেই হয়।

মজিদ ইউনিটে এলো, ফেরদৌস স্যারের সাথে হ্যান্ডিং টেকিং হয়ে গেলো। আমি উপ অধিনায়কই রয়ে গেলাম। কিন্তু আমি এবার এডামেন্ট যে, যতো তারাতাড়ি সম্ভব, আমাকে আর্মি থেকে বের হতেই হবে। মজিদ পরেরদিন ইউনিটের দরবার নিবে। রাতে আমার সাথে একান্তভাবে কথা বল্লো। কি কথা হলো এবার বলিঃ

মজিদ আমাকে ওর অফিসে নিয়ে খুব সমাদর করে বল্লো, স্যার, আপনি যেমন আমাকে চিনেন, আমিও আপনাকে খুব ভালো করেই চিনি। আমি জানি আমার প্রোমোশন হবার কোনো কারন নাই। কিন্তু যেহেতু সুযোগ ছিলো, এতা পেয়েছি। আমি হয়তো ইউনিটের অধিনায়ক কিন্তু আপনি আমার সিনিয়র মানুষ এবং আপনার কোয়ালিফিকেশনের কোনো কমতি নাই। আমি সিও হলেও ইউনিট চালাবেন আপনি, আমাকে শুধু গাইড করবেন আমাকে কি করতে হবে, আর কি করলে ভালো হয়। আপনি আপনার মতো করে অফিস করবেন, ব্রিগেড থেকে যদি কোন অব্জারভেশন না আসে এমন কোনো কাজ ছাড়া আপনি সাধীনভাবে যা খুশী আপনি করবেন, আমার পক্ষ থেকে কোনো প্রকার চাপ নাই। কিছু কিছু প্রোটকল হয়তো আমাদের মানতে হবে কিন্তু সেতা শুধুমাত্র প্রোটোকলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, আমি মন থেকে আপনাকে জানাচ্ছি যে, আসলে আপ্নিই আমার সিও। আর আমি আপনাকে একতা কথা বলে রাখি, যদিও এবার আপনার প্রোমোশন হয় নাই, কিন্তু আগামিবার আমি নিজে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে আপনার ব্যাপারে জানাবো যাতে আপনি আপনার ডিও প্রোমোশন পান। আসলেই তো আপনার প্রোমোশন হওয়া দরকার ছিলো।

আমি সেদিন মজিদকে কিছুই বলি নাই। মজিদের কি দোষ। দোষ তো আমাদের সিস্টেমের। যে সিস্টেম তাঁর নিজস্ব আইন, নিজের পলিসি, কিংবা ধারাবাহিকতা ঠিক রাখতে জানে না। আর এই কারনেই বারবার অনেক যোগ্য অফিসাররা ঝরে যাবে, আর অযোগ্য অফিসাররা আর্মিতে থেকে যাবে। এই অযোগ্য আর্মি অফিসাররাই একদিন জেনারেল হবে, শিরদাড়া না থাকলেও কাধে চমকপ্রদ স্টার নিয়ে গাড়িতে স্টারপ্লেট নিয়ে, হাতে ছড়ি ঘুরাতে ঘুরাতে বলবে আমি সেনাপ্রধান, আমি অমুক, আমি তমুক। হতভাগ্য জাতি এভাবে পতনের মুখ দেখে।

আমি মজিদকে বললাম, মজিদ, আমি চাই না এই কয়দিনের জিন্য আমার অন্য কোথাও ঢাকার বাইরে পোষ্টি হোক, আর আমি চাই, প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা ডিও (ডেমি অফিশিয়াল লেটার) লিখতে। কারন আমি সত্যিই সুপারসিদেড হয়ে আর আর্মিতে চাকুরী করতে চাই না। এই একটা  ব্যাপারে তুমি আমাকে সাহাজ্য করলেই হবে। আমাদের মধ্যে আর বেশী কথা হলো না।

আমি এবার নিজের বাড়ি বানানোর জন্য মনযোগ দিলাম। আর আর্মি থেকে বের হয়ে গেলে কি ব্যবসা করবো সেটা নিয়ে একদম সিরিয়াস হয়ে গেলাম। আর এরসাথে আমি একটা এপয়েন্টমেন্ট চাইলাম এমএস (মিলিটারী সেক্রেটারী) এর সাথে দেখা করতে। বর্তমানে এম এস হিসাবে দায়িত্তে আছেন মেজর জেনারেল সফিক স্যার। তিনি সিগন্যালের লোক।  আরেকটা  ডিও চিঠি লিখলাম, সেনাপ্রধানকে যেনো আমি তাঁর সাথে একটা এক্সক্লুসিভভাবে সাক্ষাত করতে পারি। আমার কিছু কথা বলার আছে, তাই।

অপেক্ষায় আছি, কবে এম এস এবং সেনাপ্রধান আমাকে সাক্ষাত দেন। আমি এর মাঝে প্রধান মন্ত্রীকেও ডিও লেতার লেখার ড্রাফট করতে বসে গেলাম। আর্মি থেকে বের হয়ে যাবার আগে আমি আমার কিছু ব্যক্তিগত কথা এসব রাঘব বোয়াল তাইপের অফিসারদেরকে এবং দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলে যেতে চাই। আর এতা আমার বলার হক আছে।   

১০/০৯/২০০৪-২য় বার সুপারসিডেড

৪ ফিল্ডের মেইন বডি এরই মধ্যে মীরপুর চলে এসেছে। লেঃ কর্নেল ফেরদৌস অন্যান্য বাকী অফিসারদেরকে নিয়ে মীরপুরে চলে এসেছিলেন। ইউনিটে মেজর আলি, মেজর হায়দার, ক্যাপ্টেন মাহিফুজ, তাহমিনা এবং অন্যান্য সবাই চলে এসছে। ভরপুর ইউনিট। ৪৬ ব্রিগেডের দায়িত্ব অনেক, তারমধ্যে সেনাপ্রধানের বাসভবনের পাহাড়া, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের পাহাড়া ছাড়াও ঢাকায় যতো প্রকারের ইন এইড অফ সিভিল পাওয়ারের কাজ হয়, তাঁর সিংহ ভাগ কাজ আমাদের দায়িত্তের মধ্যে পড়ে। মেজর আলী আমার ৬ ফিল্ডের অফিসার। আমার হাত দিয়েই ওর রেজিমেন্টেশন হয়েছিলো। অমায়িক ছেলে। তাঁর উপর আবার আমার সাথে হাইতিতে মিশন করেছে। এখন আমার ইউনিটে আবার ব্যাটারী কমান্ডার। আমি ওদের সাথে একেবারেই মিলিটারী কমান্ড প্রতিষ্ঠিত করতে পারি না। অন্য দিকে মেজর হায়দার তো পোলাপানের মতো, সারাক্ষন 'বড়দা" বড়দা" বলেই কথা বলতে থাকে কারন মেজর হায়দার আমার মীর্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ছোট ভাই। ওর বাবা ছিলো আমার আর্টের শিক্ষক। ফলে ওর প্রতিও আমি কিছুইতেই উপ অধিনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারি না। আরো দুইজন মেজর আছে, ওরাও আমার সাথে এমন একটা সম্পর্ক করে ফেলেছে যে, এখন মনে হচ্ছে, আমি একটা হাসের মা। যেখানেই যাই, ওরাও দল বেধে আমার পিছু পিছুই যায়। খারাপ লাগে না। ভালই লাগে।

                                                                  

বাসা পাই নাই। তাই অফিসার্স মেসের তিন তলার ব্যারাকে আমরা সবাই অর্থাৎ বিবাহিত অফিসারগন দুইটা করে রুম নিয়ে নিয়ে থাকি। ফেরদৌস স্যারের পরিবার থাকে দোতালায়, আমি তিনতালায়, মেজর আলী আর মেজর হায়দার বাসা নেয় নাই কারন ওদের বাসা ঢাকায় আছে। অন্যান্য অফিসাররাও আমাদের বিল্ডিং এর মধ্যেই থাকে। প্রায়ই আমরা ওদেরকে ডেকে ডেকে দাওয়াত করে একসাথে খাই। কখনো আবার তরকারী কিংবা ভালো খাবার পাক করলে পাঠিয়ে দেই। ইউনিট হলো আসলে একতা পরিবার। আমাদের অফিস একদম আমাদের বাসার সাথে লাগোয়া। প্যারেড গ্রাউন্ডও একদম লাগোয়া। ব্যাপারটা এই রকম যে, ১০০ গজের মধ্যে সবকিছু। অনেক ব্যস্ত থাকতে হয় অফিশিয়াল কাজে কিন্তু তারপরেও একটা ভালো সময় যাচ্ছে।

প্রোমোসন বোর্ড শুরু হয়েছে। বেশ ৪/৫ দিন লাগবে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোশাররফ স্যার অনেকবার আমাকে ডেকেছিলেন। আমার সাথে কথা বলেছেন। একতা জিনিষ কমান্দার বুঝেছিলেন যে, আমাকে হয়তো এর আগেরবারই প্রোমোশন দেয়াটা উচিত ছিলো, কিন্তু কেনো দেয় নাই, এ ব্যাপারে তিনি অনেকবার আমাকে প্রশ্ন করলেও আমি আসলে ভালো কোনো উত্তর দিতে পারি নাই কারন আমাকে কখনো আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে লিখিত কিছুই জানানো হয় নাই কেনো আমার প্রোমোশনটা হয় নাই। ৪৬ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের প্রায় সব সিও, উপঅধিনায়ক, বিএম, ডিকিঊ, এবং অন্যান্য আশেপাশের ইউনিটের অফিসারগন ইতিমধ্যে আমার ডিভিশনাল লেবেলের এক্সারসাইজ, টিউট (TEWT, Technical Exercise Without Troops), মডেল ডিস্কাসনে মেধা আর যুক্তি দেখে, আমার শিক্ষার যোগ্যতা দেখে এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমি একজন যোগ্য কোয়ালিফাইড শিক্ষিত অফিসার যাকে প্রথমবারই প্রোমোশন দেয়াটা জরুরী ছিলো। যাই হোক, এবার সবাই আশা করছেন যে আমার প্রোমোশনটা হবে। কিন্তু আমার মন বলছিলো অন্য কথা।

প্রোমোশন বোর্ড আরম্ভ হবার আগে আমাকে অনেকেই একতা পরামর্শ দিয়েছিলো যে, আমার উচিত কিছু কিছু পরিচিত জেনারেল সাহেবদের বাসায় ব্যক্তিগতভাবে দেখা করার। কিন্তু আমার কাছে এটা খুব অপমানজনক মনে হচ্ছিলো। কারন, প্রোমোশন হবে আমার যোগ্যতা দিয়ে, আমার মেধা দিয়ে, আমার পারফরমেন্স দিয়ে, আমি কেনো বিভিন্ন জেনারেলদেরকে পটাতে যাবো বা অনুরোধ করতে যাবো? ফলে আমি কারো সাথেই দেখা করার অভিপ্রায় হলো না। যদি আমাকে এই আর্মি যোগ্য মনে না করে, যদি এই আর্মি মনে করে যে, আমার থেকেও আরো কেউ যোগ্যতা রাখে আমাকে টপকিয়ে প্রোমোশন পাবার, তাতে আমার কোনো কৈফিয়ত নাই বা দুঃখও নাই। কিন্তু কাউকে আগে থেকে আমি অনুরোধ করবো, তারপর তাদের দয়ায় আমার প্রোমোশন হবে এটা আমি চাই না।

বোর্ডের প্রথম দিন শেষে আমার সিও সাহেব ফেরদৌস স্যার বললেন যে, আজ যাদের নাম পর্যন্ত বোর্দে আলাপ হয়েছে, সে পর্যন্ত নাকি আমাদের নাম আসে নাই। বোর্ড আরো ৩ দিন চলবে, হয়তো আলাপ হয়ে যাবে, ইনশাল্লাহ হয়ে যাবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে বুঝলেন যে, আমাদেরতা হয়ে যাবে? ফেরদৌস স্যার আমাকে জানালেন যে, তিনি নিজ উদ্যোগে জেনারেল আমিনুল করিমের সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছেন, এবং জেনারেল আমিনুল করীম আমাকে খুব ভালো করেই চিনেন, আমার ব্যাপারটা নাকি খুব স্ট্রং ভাবে দেখবেন। আমার কাছে ব্যাপারটা খুব জোরালো মনে হয় নাই, তারপরেও ফেরদৌস স্যারের কথা আমি বিসশাস করি।

বোর্ডের দ্বিতীয় দিন পার হয়ে গেলো, কোনো খবর পেলাম না। রাতে ব্রিগেড কমান্দারকে দিনের শেষের ফলাফল জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, যে পর্যন্ত নাম মুটামুটি ড্রাফট হয়েছে সেখানে আমার নাম আছে। অর্থাৎ আমার আপাতত প্রোমোশন বোর্ডে নাম পাশ হয়েছে। কেনো জানি একটু সস্থি পেয়েছিলাম, কমান্ডার তো আমাকে অযথা মিথ্যা কথা বলবেন না। আর মোশাররফ স্যারের সাথে আমার সম্পর্কটা অত্যান্ত ফ্রেন্ডলী। আমি কাউকেই কোনো আগাম খবর দিতে চাই না। আমি আমার বউ মিটুলকেও কোনো খবর দিলাম না। কারন এখন যদি একটা আশা দিয়ে রাখলাম, আর পরে যদি সেটা নেগেটিভ হয়, তাহলে একটা ভালো সংবাদের যে আনন্দ সেটা থেকে বিচ্যুত হয়ে আরেকটা নেগেটিভ খবরের কারনে মনের ভিতর যে বেদনার সৃষ্টি হবে, সেই চাপ মিটুল নিতে পারবে কিনা সন্দেহ। ফলে আমি ওকে না ভালো, না খারাপ কোনোটাই দিতে চাই নাই ফ্রেস এবং চুড়ান্ত ফলাফল না পাওয়া পর্যন্ত।

এভাবে ৩/৪ দিন পেরিয়ে প্রোমোশন বোর্ড পার হল। প্রোমোশন বোর্ড শেষ। এবার ফলাফল প্রকাশিত হবে। সেই চুরান্ত ফলাফলে আমাকে জানানোও হলো যে, আমার এবারো কোন প্রোমশন হয় নাই। তবে আগেরবারের মতো আমাকে অন্ধকারে রাখা হল না। আমি কমান্ডারের কাছে জানতে চাইলাম, আমার কোথায় ঘাটতি ছিল? তিনি উত্তরটা দিতে গিয়ে নিজেও খুব লজ্জিত বোধ করছিলেন। কমান্ডার আমাকে জানালেন যে, ১৯৮৮ সালে কোনো এক ষান্মাসিক পিইটি (ফিজিক্যাল এফিসিয়েন্সী টেষ্ট) তে নাকি আমি জয়েন করি নাই। তাই আমার প্রোমোশন হয় নাই। কমান্ডার বোর্ডকে বলেছিলেন যে, যদি মেজর আখতারের একটা পিইটি ঘাটতি থাকে, তাহলে ওকে ডেকে আনি, সে ওই ঘাটতিটা এখন পুরা করে দিক, তাই বলে আজ থেকে ১৬ বছর আগের একটা পিইটির দোহাই দিয়ে এ রকম একটা চৌকষ অফিসারকে প্রোমোশন না দেয়াটা অন্যায়। এতে অনেক বদনাম হবে এই আর্মির প্রোমোশন বোর্ডের চেহারার। তাছাড়া উনি আরো ন্নাকি বলেছিলেন যে, এই গত এক বছরে তাহলে উনাকে কেনো জানানো হয় নাই যে, মেজর আখতারের একটা পি ই টি ঘাটতি আছে? তাহলে তো আমিই সেটা নিয়ে নিতে পারতাম? কিন্তু সেই গল্পের মতো বলতে হয় যে, যদি কারো দোষ ধরতে চান, তাহলে লক্ষাধিক কারন তো খুজেই পাওয়া যায়। আর সেই লক্ষাধীক দোষের যে কোনো একটা আপাতত এপ্লাই করলেই তো হয়। তাতে বোর্ডের তো আর দোষ দেয়া যাবে না। বাঘ আর হরিনের সেই পানি খাওয়ার গল্পের মতো।

বাঘ হরিন দুটুই একটা ঝর্নার মধ্যে পানি পান করছিলো। হরিন ভাতার দিকে আর বাঘ উজানের দিকে। বাঘের মনে হলো হরিনের একটা দোষ বের করে সেই দোষে ওকে ভক্ষন করা। তাই বাঘ হরিনকে বল্লো, ওই বেটা হরিন, পানি খাইতেছিস তো ঘোলা করতেছিস ক্যান? তোর ঘোলা পানি তো আমার দিকে আসতেছে। তখন হরিন বল্লো, বাঘ মামা, আমি তো ভাটায়, আর আপনি তো উজানে। পানি তো আপনার দিকে থেকে আমার দিকে আসতেছে। আমি আবার ঘোলা জল আপনার দিকে দিলাম কিভাবে? বাঘ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বল্লো, আরে বেটা তুই না হয় ঘোলা জল দিচ্ছিস না, কিন্তু তো আগে তোর দাদা একবার এই রকম করছিলো, তাই তোর দাদার দোষ মানে এখন তর দোষ। এই বলে হরিনকে ঘায়েল করে দিলো বাঘ মামা।

বোর্ড যে কোনো কারনেই আমাকে বা ১৩ লং কোর্সের অফিসারদেরকে প্রোমোশন দেবে না, তাই আজ থেকে ১৬ বছর পূর্বের কোনো এক পিইটি দেয়া হয় নাই, এই দোহাই দিয়ে আমার প্রোমোশন বন্ধ। কি তাজ্জব ব্যাপার।

বাসায় এলাম অফিস থেকে। বউ জিজ্ঞেস করলো, তোমার মন খারাপ দেখলেই বুঝা যায়, বুঝেছি, তোমার প্রোমশন হয় নাই। মিটুলেরও খুব মন খারাপ হলো। আম মিটুলকে শান্তনা দিলাম না। ফেরদৌস স্যার বাসায় এলেন। অন্যান্য অফিসাররাও বাসায় এলেন। আমার মন এম্নিতেই ভালো ছিলো না, তারপরে আবার অফিসাররা এসেছেন আমাকে শান্তনা দিতে। এটা আমার জন্য কোনোভাবেই গ্রহনযোগ্য বোর্ডের সিদ্ধান্ত মনে হয় নাই, আমি মেনে নিতে পারি নাই।

আরো খারাপ সংবাদ পেলাম যে, আমার ইউনিটের সিও হিসাবে যে আসতেছে, সে হচ্ছে ১৪ লং কোর্সের মজিদ যে কিনা কোনো ষ্টাফ কলেজ করে নাই, গানারী ষ্টাফও করে নাই, অন্যদিকে মেডিক্যালী সে ক্যাটেগরী সি। অর্থাৎ আনফিট। এমন একটা অফিসারের প্রোমোশন হয় কিভাবে? সে কথা আরেকদিন বল্বো।

০৫/০৭/২০০৪-৪ ফিল্ড এডভান্স পার্টি

মিটুল মালয়েশিয়া ট্রেনিং করে দেশে ফিরে এসছে। অনেক অসুবিধার মধ্যে ছিলাম মিটুলের এই দীর্ঘ সময়ে অনুপস্থিতির কারনে। তারপরেও কোনো রকমে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছি। আমার মেয়েরাও লক্ষী মেয়ের মতো ওরাও বুঝতে পেরেছিলো কিভাবে মাকে ছাড়া চলা যায়। শুধু মাকে ছাড়া নয়, বাবাকে ছাড়াও। এর মধ্যে আমার আরেকটা ভালো খবর ছিলো যে, ৪ ফিল্ড খোলাহাটি থেকে মীরপুর পোষ্টিং হয়ে আসবে এই সুবাদে আমি এডভান্স পার্টি নিয়ে আর কোয়ার্টার মাষ্টার রাকিবকে নিয়ে মীরপুর এসছি কয়েকদিন যাবত। তাতে যেটা হয়েছিলো যে, অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও আমার মেয়েরা আর আমি একসাথে বাসায় থাকতে পেরেছিলাম। মিটুল এখন দেশে চলে আসাতে আমি হয়তো এই বাসাটা ছেড়ে মীরপুর সেনানীবাসের একটা অস্থায়ী অফিসার্স ফ্যামিলী কোয়ার্টারে চলে যাবো। বাসা পেতে অনেক দেরী হবে কিন্তু মীরপুরের যেখানে অফিসারগন পরিবার নিয়ে থাকে সেটা ও একটা অফিসার্স মেস কিন্তু সেখানে কিছু কিছু অফিসার দুইটা মাত্র রুম নিয়ে পরিবার নিয়ে থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে স্থানীয় কমান্ডার। ৪ ফিল্ড ১২ ফিল্ড রেজিমেন্টকে প্রতিস্থাপন করছে। আমরা সমস্ত কিছু হস্তান্তর করছি। ১২ ফিল্ড চলে যাচ্ছে হিল ট্র্যাক্সে। ১২ ফিল্ডের সিও হিসাবে আছে ১২তম লং কোর্সের লেঃ কর্নেল বশীর। আমরা এক্সাথেই বেসিক কোর্স করেছিলাম। একটু কনফিউজড টাইপের অফিসার। কিন্তু মানুষ হিসাবে খারাপ না, সৎ বটে।

মীরপুরের ফিল্ড আর্টিলারী ৪৬ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্রিগেডের অধীনে। এর আগেও আমি একবার এই মীরপুর সেনানীবাসে ৭ ফিল্ডের সাথে চাকুরী করেছিলাম। তখন কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমামুজ্জামান। তাঁর সাথে আমি আরো একবার কাজ করেছিলাম বগুড়ায়। আমি আমার জিএসও-২ (অপ্স) এর শেষ প্রান্তে আর তিনি বগুড়ায় পোষ্টিং হয়ে আসলেন। আমি তাঁর সাথে মাত্র সপ্তাহ খানেক কাজ করেছিলাম। তারপর চলে গিয়েছিলাম গানারী ষ্টাফ কোর্সে। এবার ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার আছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোশাররফ স্যার। বিএনপির বনমন্ত্রীর ছোট ভাই বলেই সবাই জানে।  আমার সাথে প্রায়ই ইউনিটের হ্যান্ডিং টেকিং নিয়ে কথা হয়। খুব ঝামেলা হচ্ছে বশীরের সাথে আমার। আমরা যদিও ১২ এবং ১৩ লং কোর্সের অফিসার কিন্তু আমি বশীরকে তুই বা তুমি সম্বোধনই করি কারন আমরা ক্যাডেট কলেজের একই ব্যাচ। তবে বশীর ফৌজদার হাট ক্যাডেটের আর আমি মীর্জাপুর ক্যাডেটের। বশীরের ইউনিটের অনেক কিছুই বিশেষ করে হস্তান্তরযোগ্য আইটেমের সঠিক ইনভেন্টরী নাই। এর কোথায় কি তাঁর ও সঠিক ব্যাখ্যা নাই। আমি আবার সব কিছু বুঝে না নিলে পরবর্তীতে সব কিছুর ব্যাপারে আমাকেই জবাব্দিহি করতে হবে বিধায় কোনো ছাড় দেওয়ার ও কোনো অবকাশ নাই। ফলে নিত্য নৈমিত্তিক একটা খারাপ সম্পর্ক সৃষ্টি হচ্ছিলো। তারপরেও আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করছি যে করেই হোক কন্ট্রোল আইটেম গুলি ছাড়া অন্যান্য আনকন্ট্রোল আইটেমে ছাড় দেয়ার। ১২ ফিল্ড যাওয়ার পরেই আমরা ওদের খালী হ ওয়া ব্যারাক গুলি এবং অফিসার্স কোয়ার্টার গুলিতে উঠতে পারবো। তাঁর আগে আমি ওই কচুক্ষেতেই পরিবার রাখতে হবে।

আমি প্রতিদিনই কউক্ষেত বাসায় যেতে পারি। সকালে অফিসে চলে আসি আর সন্ধ্যায় আবার কচুক্ষেত বাসায় চলে যাই। এর মধ্যে কমান্ড নেটে আমি খোলাহাটিতে ফেরদৌস স্যারের সাথে কথা বলে তাকে প্রায়ই আপডেট দেই। ৪৬ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্রিগেডের কমান্দার থেকে শুরু করে বিএম, ডিকিউ সবাই আমাকে যথেষ্ট পরিমান সমীহ করেন। সময়টা ভালই যাচ্ছে।

সামনে আরো একটা প্রোমোশন বোর্ড আছে। আমার মনে এবারো একটা সন্দেহ জাগছে যে, এই বি এন পির আমলে আমাদের হয়তো আর প্রোমোশন হবে না। একটা বোর্ডে তো প্রোমোশন হয় নাই, এবার যে হবে সেতার ও কোনো নিশ্চয়তা নাই। তবে যেটাই হোক, যদি এবার প্রোমোশন না হয়, আমি ৩য় বারের জন্য কোনো চান্স নেবো না। এই চিন্তায় আমার কয়েকটা কাজ খুবই বাস্তবায়ন করা জরুরী হয়ে পড়েছিলো। তাঁর প্রথম কাজতা ছিলো, আমার একতা স্থায়ী বাড়ি বানানো যেখানে আমি সেনানীবাস থেকে বেরিয়ে গেলে নিজের বাড়িতে থাকতে পারি। দ্বিতীয় কাজটি ছিলো যে, যদি আর্মির চাকুরী ছেড়েই দেই, আমি কনো প্রাইভেট চাকুরী করতে চাই না। ফলে চাকুরীর বাইরে কি কি ব্যবসা করা যায় সেটা ভাবা। এই দুটু বিষয় আমার মাথায় সর্বক্ষন ছিলো।

১৮/০৩/২০০৪-মিটুল, মালয়েশিয়া ট্রেনিং

আজ আমি ঢাকায় এলাম একটা বিশেষ কাজে। কাজটা হলো আমার স্ত্রী আগামী কয়েকদিন পরে বিদেশ চলে যাবে ট্রেনিং করতে। তাকে সব কিছু ঠিক ঠাক করতে হলে আমাকে অনেকগুলি এক্সট্রা ব্যবস্থা করা দরকার।

এম্নিতেই আমি থাকি খোলাহাটি, ঢাকা থেকে অনেক দূর। এর মধ্যে আমার স্ত্রী মিটুলের আবার বৈদেশিক একটা ট্রেনিং এর নাম এসছে মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ায় সে ট্রেনিং এ যাবে কিনা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো। আমি এক কথায় বলে দিয়েছি যে, তাঁর মালয়েসিয়ায় ট্রেনিং এ যাওয়া উচিত। মিটুলের সেই ১৯৮৮ সাল থেকে যা যা ক্যারিয়ারে দরকার সাহাজ্য করা তাতে আমার কখনোও কোনো কার্পন্য ছিলো না। আর এর প্রধান কারন হলো, মিটুলকে সাবলম্বি করে তোলা। আমি জানি, আমার আসলে সাহাজ্য করার মতো আশেপাশে কোনো হোমরা চোমড়া নাই। না আছে আমার বাবার দিক থেকে কোনো সাহাজ্য, না আছে আমার শ্বশুর বাড়ির দিক থেকে কোনো সাহাজ্য। ফলে যদি আমাকে কেউ সরাসরি সাহাজ্য করার কেউ থাকে সেতা হচ্ছে আমার স্ত্রী মিটুল। আর সেইই যদি ওই অবস্থায় না থাকে বা নিজের পায়ে দাড়াতে না পারে, তাহলে আমাকে বা আমার পরিবারকে অথবা আমার অনুপস্থিতিতেই বা মিটুল কিভাবে সাহাজ্য করবে? এই চিন্তা ধারা থেকেই আসলে আমি সব সময় চেয়েছি মিটুল গড়ে উঠুক।

মিটুলের মালয়েশিয়ার কোর্স টা শুরু হবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে। প্রায় ছয় মাসের মতো একটা কোর্স। সমস্যা দাঁড়াবে যে, আমিও ঢাকায় আমার বাচ্চাদের কাছে নাই আবার এবার মিটুল ও থাকবে না। উম্মিকার বয়স মাত্র আট বছর আর কনিকার বয়স মাত্র তিন। এই দুইজনের জন্য দেখভাল করার কোনো লোক ও নাই। বাজার করার লোক, রান্না বান্নার লোক, যদি মেয়েরা অসুস্থ হয়, তাদেরকে হাসপাতালে নেওয়ারও কোনো লোক নাই। তারপরেও আমি মিটুলকে মালয়েশিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্তে আওটল থাকলাম। সব কিছু নির্ভর করে আল্লাহর উপর। বাড়িওয়ালা মেজর (অবঃ) ফেরদৌস স্যার ভালো মানুষ। অন্তত দরকারী প্রয়োজনে তাঁর ডাইরেক্ট সাহাজ্য পাওয়া যাবে এটা একটা ভরষার স্থান ছিলো।

নসিরন নামে আমার বাসায় যে কাজের মেয়েটি আছে, সে অত্যান্ত ভালো একজন মেয়ে। তাঁর কোনো আত্তীয় স্বজন নাই, আমরাই তাঁর বাবা, আমরাই তাঁর মা, আমরাই তাঁর সব। আর নসিরন নিজেও এটা জানে আর এতাও জানে আমাদের বাসা ছাড়া ওর আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। সে আমার মেয়েদের কাছেও অনেক প্রিয় একজন নসি আপু। সমস্ত কাজ কর্ম নসি করতে পারে। কিন্তু কথা বলে খুবই কম। সে নিজে অসত নয় এবং তাঁর চাহিদাও অনেক বেশী নয়। আমি যেভাবে মিটুলের অনুপস্থিতিতে ব্যাপারটা সামলাবো বলে ভাবছি সেতা হলো যে, আমি প্রতি সপ্তাহে ঢাকায় এসে নিত্য নৈমিত্তিক শুকনা বাজার গুলি করে দিয়ে যাবো। আর ডেইলী বাজার যদি লাগে, পাশেই দোকান পাট আছে, তাদের কে বলে দিলে ওরাই বাসায় পৌঁছে দেবে। দোকানদারদের সাথে আমার সম্পর্কটা আমি এমনভাবে তৈরী করেছিলাম যাতে আমার বাসা থেকে একটা চিরকুট দিলেও দোকানদারগন মালামাল বাসায় কাউকে দিয়ে পৌঁছে দেন। যদি বাকীতেও হয়, তাতেও যেনো সবাই মালামাল দিয়ে দেন এবং আমি ঢাকায় এসে সমস্ত টাকা পয়সা দিয়ে দেবো।

মিটুলের খুব মন খারাপ। কারন সে অনেকদিন থাকবে না, একটা মানসিক টেনসনে আছে বাচ্চাদের জন্য। এই টেনসনটা হয়তো থাকতো না যদি আমাদের বাসায় এমন কেউ থাকতো মুরুব্বি টাইপের যারা অন্তত বাচ্চাদেরকে আগলে রাখতে পারবে। আমার মন খারাপ নয়, আমি অনেক টেনসনেও নাই কারন আমি এভাবেই জীবনে বড় হয়েছি। যাদের জীবনে অনিশ্চয়তা সব সময়ই থাকে, তারা অনিশ্চয়তাকে জীবনের স্বাভাবিক দোসর হিসাবেই ধরে নিয়ে জীবন চালাতে থাকে। আমিও ঠিক সে রকমের একজন মানুষ।

১৫/১১/২০০৩-খোলাহাটিতে আবার

খোলাহাটি সেনানীবাসে এটাই আমার প্রথম আসা নয়, এর আগেও একবার এসেছিলাম ২০০১ সালে যখন আমি আর্মি হেডকোয়ার্টারে কর্মরত ছিলাম। তখন এসেছিলাম আমি ক্যাপ্টেন টু মেজর পরীক্ষার একটা গোপন প্রশ্নপত্র নিয়ে। আর এখন এলাম একেবারে পোষ্টিং নিয়ে। অনেক পরিবর্তন হয়েছে এলাকাটার। আগে তেমন গাছপালা ছিলো না, ফ্যামিলী কোয়ার্টারগুলি তখনো নির্মানাধীন ছিলো, এখন সেই গাছগুলি অনেক বড় হয়ে গেছে, বিল্ডিংগুলি যে নতুন সেটাও বুঝা যাচ্ছে আবার অনেক বিল্ডিং রঙ করা দরকার সেটাও বুঝা যাচ্ছে। আমি পরিবার নিয়ে আসি নাই, ফলে অফিসার মেসেই আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আজ পর্যন্ত যেখানেই পোষ্টিং হয়েছে, আমি আমার পরিবার নিয়ে কখনো থাকি নাই, শুধুমাত্র যখন বগুড়ায় লোকেটিং ইউনিটে চাকুরী করেছিলাম ১৯৯০ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত, তখন কয়েক মাসের জন্য আমি আর আমার স্ত্রীকে নিয়ে জাহাংগিরাবাদ সেনানীবাসে কোয়ার্টার নিয়ে থেকেছি। তখন কোনো বাচ্চা কাচ্চা হয় নাই, আমি আর মিটুলই ছিলাম। এবার আমি আমার দুই মেয়ে আর মিটুলকে ঢাকায় রেখেই আমি নিজে ব্যাচলর লাইফ লিড করার জন্য এই খোলাহাটিতে এলাম। মন ভালো নাই, প্রোমশনটা হয় নাই, কোনো কিছুতেই আর আগের মতো সিরিয়াসলি কাজ করতে মন চায় না। অনেক আগে থেকেই এই চাকুরীটা করবো না করবো না করছিলাম, কিন্তু সেটা অনেক কারনেই বাস্তবায়ন হয় নাই, কিন্তু এবার মনে হচ্ছে হয়তো আর থাকা যাবে না। এর আগে চাকুরী থেকে বের হতে পারি নাই অনেকগুলি কারনে যে, আবার নতুন একটা চাকুরী খুজতে হবে, নিজের বাসা নাই স্থায়ীভাবে, কোথায় থাকবো, কোথায় কি ধরনের আবার চাকুরী পাই সব মিলিয়ে আর্মির চাকুরীটাই ভালো মনে হয়েছে বিধায় আর যাওয়া হয় নাই। কিন্তু এবার প্রোমোশন না হওয়াতে আমার জুনিয়াররা যদি আমার সিনিয়র হয়ে আমার থেকেও কম কোয়ালিফাইড হয়ে আমাকে কন্ট্রোল করতে চায়, এটা আমি মানতে পারবো না। শেষ পর্যন্ত অবস্থা যেমনই হোক, আমাকে বেরিয়ে যেতেই হবে।

খোলাহাটি সেনানীবাস রংপুর সেনানীবাসের অধীনের একটা ব্রিগেড। কিন্তু রংপুর থেকে খোলাহাটি অনেক দূর বিধায় সেনানীবাসের সাভাবিক কার্যক্রমের মধ্যে কিংবা রুটিন অনেক দেখভালের মধ্যে এটা পড়ে না। এটা একটা লোকাল গ্যারিসন হিসাবে অনেকটাই আরামদায়ক। তাং কম।

সিও ফেরদৌস স্যারের সাথে যেহেতু ক্যাডেট কলেজে অনেক লম্বা সময় ধরে পরাশুনা করেছিলাম, ফলে, আমার সাথে তাঁর সখ্যতা অনেক ফ্রেন্ডলী। তিনিও আমার প্রোমোশন না হওয়াতে খুব আপসেট। আমরা একই সাথে স্টাফ কলেজ করেছি। খুব বেশী দরকার না হলে ফেরদৌস স্যার আমাকে অনেক চাপ দেন না কিংবা আমাকে অযথা হয়রানী করেন না। জুনিয়র অফিসারদের মধ্যে যারা আছে তারাও খুব ভালো। লেঃ মাহফুজ বর্তমানে এডজুটেন্টের কাজ করছে, লেঃ রাকিব করছে কোয়ার্টার মাষ্টারের কাজ। অনেক পরিশ্রমী ছেলেগুলি। আমি চেষ্টা করি যাতে ওরা আরো ভালো কিছু করতে পারে। ওরাও বুঝে যে, আমার লেঃ কর্নেল হবার কথা থাকলেও যে কোনো কারনেই আমার প্রোমোশন না হওয়াতে ওরাও কিছুটা মনক্ষুন্ন কারন এতো যোগ্যতা রেখেও যখন প্রোমোশন হয় না, এতে ওদের মধ্যেও ক্যারিয়ার গড়ার যে একটা অনুপ্রেরনা থাকার কথা তাতে মনে হচ্ছে ঢিলেমী এসছে।

নতুন মহিলা অফিসার নিয়োগ হয়েছে। আমাদের এই খোলাহাটিতে দুইজন মহিলা অফিসারের পোষ্টিং হয়েছে। আমার ইউনিটে এসছে ২লেঃ তাহমিনা আর পাশের ৮ ফিল্ডে এসছে ২লেঃ নাজনিন। দুজনেই খুব ভালো মেয়ে। তাহমিনার বাবা একজন অবসর প্রাপ্ত জেসিও। হয়তো একটা সময় আসবে যে, ওরা ইউনিট কমান্ড করবে, ব্রিগেড কমান্ড করবে। আমি যখন আর্মি হেড কোয়ার্টারে এমটি ডাইরেক্টরে ছিলাম, তখন মহিলা অফিসার নেয়া হবে কিনা এটার তোড়জোড় শুরু হয়। আমি মহিলা অফিসার নেওয়ার ব্যাপারে সর্বাত্তক পজিটিভ ভুমিকা রেখেছিলাম। আজ সেই ভুমিকার অংশ নিজের চোখে দেখে গেলাম। মহিলা অফিসারের কমিসন হয়েছে।

আমি প্রায়ই ঢাকায় যাই পরিবারের সাথে দেখা করার জন্য। ঢাকা থেকে একটি মাত্র বাস খোলাহাটিতে আসে আর তাঁর নাম হচ্ছে, "হক বাস সার্ভিস"। অন্যান্য বাসগুলি রংপুর পর্যন্ত এসেই থেমে যায় কিন্তু "হক" বাসটি খোলাহাটি পর্যন্ত আসে। খুব ভাল সার্ভিস না কিন্তু অন্তত এটা খোলাহাটি পর্যন্ত আসে বিধায় আমি সবসময় "হক" বাসের মাধ্যমেই ঢাকা থেকে আসি এবং যাই। এসি নাই।

আসলে আমি প্রতিদিন নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করছি।  কয়েকদিন আগে নতুন অফিসার হিসাবে আসা অফিসারদের জিওসির একটা সাক্ষাতকার ছিলো। আমারো উনি সাক্ষাতকার নিলেন। মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার। বাংলাদেশ আর্মির একজন ডেসিং এবং স্মার্ট অফিসার। উনার সাথে যখন আমার সাক্ষাত হয় বা ইন্টারভিউ হয়, আমি বেশ কিছু উত্তর জানার চেষ্টা করেছিলাম। সেটা আমি ছোট করে লিখছিঃ

জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় আমার সাথে অত্যান্ত চমৎকার ব্যবহার করলেন। উনি নিজেও আমার সব কোয়ালিফিকেশনগুলি দেখে একটা মন্তব্য করলেন যে, আমি আসলেই দুঃখিত যে, তোমার প্রোমোশনটা হয় নাই। আমি স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে, উনি তো আমাদের প্রোমোশন বোর্ডে ছিলেন, কোথায় আমার কি সমস্যা ছিলো যার কারনে আমার প্রোমোশনটা হয় নাই। সে ব্যাপারে কি আমি কিছু জানতে পারি? উনি তাঁর একটা ছোট নোটবই (নোট খাতা) বের করে কিছুক্ষন কি যেনো দেখলেন, পড়লেন, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে একটা কথাই শুধু বললেন যে, শোন মেজর আখতার, সবসময় যোগ্যতাই প্রোমোশনের জন্য ক্রাইটেরিয়া নয়। যখন কোনো সিনিয়র অফিসার মনে করে যে, সে তাঁর অধস্তন কর্মকর্তার থেকে কম কোয়ালিফাইড, তখন ওই জুনিয়ার অফিসারকে নিয়ে কাজ করতেও অনেকেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তুমি আমাকে জিজ্ঞেস না করে গানার জেনারেলদেরকে জিজ্ঞেস করো কেনো তারা তোমাকে ভয় পায়। জিজ্ঞেস করলাম, কে আমার নামে ভেটো ভোট প্রদান করেছে স্যার সেটা কি আমি জানতে পারি? উনি সরাসরি আমাকে বললেন না কিন্তু বুঝলাম, আরেক মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার (আর্টিলারী) আর মেজর জেনারেল শাহাবউদ্দিন হয়তো এই ব্যাপারে কোন মন্তব্য রেখেছেন। বড্ড খারাপ লাগল শুনে।

আমি জিওসিকে বললাম, স্যার, আমি সম্ভবত এপেন্ডিক্স যে লঞ্চ করতে পারি ভলান্টিয়ারভাবে আর্মি থেকে সুবিধা নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার জন্য। জিওসি বললেন, দেখো গানার, সময় সব সময় তোমার অনুকুলে হয়তো থাকবে না। একটু ওয়েট করো, হয়তো পরেরবার তোমার প্রোমোশন হবেই।

আমি বললাম, স্যার, যে আমি গত ১৮ বছরে কোয়ালিফাই করতে পারলাম না, কি এমন আমি করে ফেলবো যে, আগামি এক দুই বছরের মধ্যে আমার প্রোমোশন হয়ে যাবে?  তারপরেও উনি আমাকে অনেক এডভাইস করলেন। আমি জিওসিকে বললাম, স্যার, আমার কোনো কাজ করতে ভালো লাগে না আর। সকাল থেকে শুরু করে যে আমি এতো পরিশ্রম করতাম, এখন কেনো জানি মনে হয়, এসবের কোনো দরকার ছিলো না। এখানে পরিশ্রমের আর যোগ্যতার মুল্য আসলেই নাই। যখন ডিভিশনে বড় বড় কাজের জন্য দায়িত্ত দেয়ার ব্যাপারে অফিসার খুজে বেড়ায়, তখন খুজে খুজে আমাকেই বের করা হয়, যখন স্টাডি পিরিয়ড করার জন্য দিনে রাতে আমাকে স্ক্রিপ্ট তৈরী করে আর্মি হেডকোয়ার্টারে প্রেজেন্ট করতে হয়, তখন সবাই বাহবাই দেয় কিন্তু যখন প্রোমোশনের টেবিলে বসে, তখন আমাদের এই পরিশ্রমের কথা তারা ভুলেই যায়। তাহলে আর পরিশ্রম করার দরকার কি? জিওসি রেজ্জাকুল হায়দার আমাকে বুঝলেন। বললেন, আমার ডিভিসনে তোমার কোনো অবমুল্যায়ন হবে না। তুমি তোমার মতো করে চলো।

জিওসি অনেকবার কাউকে না জানিয়ে খোলাহাটিতে পিটি প্যারেডের সময় চলে আসতেন। আমি প্রায়ই এই পিটি প্যারেড মিস করতাম, কিন্তু জিওসি কখনো আমাকে কেনো মিস করছি, কেনো সময় মতো পিটিতে যাচ্ছি না, এ ব্যাপারে কোনোদিন প্রশ্ন করেন নাই। একসাথে মেসে নাস্তাও করেছি যখন ইউনিটে পিটি প্যারেড হচ্ছিলো। কথা হতো এই জেনারেলের সাথে। ভালো লাগতো।

এভাবে সময় যেতে থাকে, মন ভালো আর খারাপের মধ্যে আমি অনেক সময় পার্থক্য বুঝি না।

১৫/১০/২০০৩-১ম বার সুপারসিডেড

জর্জিয়ার মিশন শেষ করে ঢাকায় ফিরে এসেছি। ঢাকায় ফিরে এসেই শুনলাম আমাদের প্রোমশন কনফারেন্স হচ্ছে। মেজর থেকে লেঃ কর্নেল। আমি এখনো ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসায় আছি। যখনই কেঊ বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসে, তখন অনেকগুলি ফর্মালিটিজ করতে হয়। মেডিক্যাল চেক আপ, ক্লিয়ারেন্স, যদি মিশনে যাওয়ার সময় কোনো কিছু ইস্যু করে থাকি সেতা জমা দেয়া, আবার যদি কোনো পোষ্টিং হয় তাহলে তো আরো অনেক ফর্মালিটিজ। আমরা লগ এরিয়ার আন্ডারে আপাতত সুপার নিউমিরাল স্ট্যাটাসে আছি। প্রোমোশন কনফারেন্সে আমাদের প্রোমশন হবার কথা। অনেক রিউমার শুনছি, কেউ বলছে আমাদের অনেকের প্রোমশন হয়েছে আবার কেউ বলছে এখনো ফাইনাল নয়। টেনসনে তো অবশ্যই আছি কিন্তু আমার প্রোমশন না হবার কোনো কারন আমি দেখিনা। স্টাফ কলেজ করেছি, গানারী স্টাফ করেছি, ভালো ভালো জায়গায় পোস্টিং ছিলো, পদাতিক ডিভিসনের জিএসও-(অপারেশন-২) ছিলাম, আর্মি হেডকোয়ার্টারেও জিএসও-২ (ট্রেনিং) ছিলাম। মিশন করলাম দুইবার, কোথাও কোনো কিছুর ঘাটতি নাই। প্রোমোশন বোর্ডে আমাকে চিনে এ রকম অন্তত বেশীরভাগ জেনারেলরা আছেন। যেমন, জেনারেল ইকবাল করিম ভুইয়া (আমি যখন জিএসও-২ অপারেশন পদাতিক ডিভিসনে কর্মরত ছিলাম, তখন তিনি ছিলেন কর্নেল স্টাফ), জেনারেল মুবিন (আমি যখন এমটি ডাইরেক্টরে ছিলাম, তখন তিনি ছিলেন ডিএমটি), জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার (আমার ইউনিটের টুআইসি এবং সিও উভয়ই ছিলেন), জেনারেল সাহাব (আমরা বগুরায় একসাথে পাশাপাশি ইউনিটে কাজ করেছিলাম, তখন উনি ছিলেন ১ ফিল্ডের সিও আর আমি ছিলাম লোকেটিং ইউনিটের টুআইসি, একসাথে হাট হাজারীতে ফায়ারিং করেছি, প্রতিদিন প্রায় দেখা হতো), জেনারেল মইন ইউ আহমেদ (স্টাফ কলেজে উনি ছিলেন আমার ডিএস), সিজিএস জেনারেল ইকরাম (আমি যখন আর্মি হেডকোয়ার্টারে কাজ করেছি, তখন উনি আমার সিজিএস ছিলেন, বহুবার তাঁর সাথে আমার ইনটারেকসন হয়েছে), আছেন জেনারেল মুনিরুজ্জামান (আমার ৪ মর্টারের টুআইসি এবং সিও), মেজর জেনারেল রফিক (সিগ ন্যাল) এর সাথে আমি কাজ করেছি দুবার। একবার আমি স্টাফ কলেজ করার সময় তিনি ছিলেন আমার ডাইরেক্ট ডি এস আবার উনি যখন ৪ সিগ ন্যালের সিও ছিলেন বগুড়ায়, তখন আমি জি এস ও-২ (অপারেশন), এই রকম আরো অনেকগুলি জেনারেলের সাথে আমার ডাইরেক্ট কর্মজীবন পার হয়েছে। ফলে আমাকে বোর্ডে চিনবেন না এমন কেউ নাই। আর যারা চিনবেন না, তারাও আমার প্রোফাইল দেখলে অন্তত ভাববেন যে, আমার কোয়ালিটির কোনো কমতি নাই। ফলে আমি প্রোমোসন পাবো না, এটা আমার মাথায় আনতে চাই না।

কিন্তু যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই নাকি রাত হয়। বিএনপির রাজনৈতিক আমল। আমাদের ১৩ লং কোর্সের অনেক প্রবাব্যাল অফিসারকে টাচ করলো না। প্রোমশন কনফারেন্সের পর প্রায় ২ দিন হয়ে গেল, কিংক্রিত কোনো তথ্য পেলাম না। অবশেষে খবর পেলাম যে, আমাদের প্রোমশন হয় নাই। প্রায় শতভাগ ১৩ লং কোর্সের কারোরই প্রোমশন হয় নাই। এর প্রধান কারন, আমাদের একজন কোর্সমেট আছে মেজর ওয়াকার। সে আগের সেনাপ্রধান জেনারেল মুস্তাফিজের মেয়ের জামাই এবং আওয়ামীলিগের ঘরনার। সবার মন খারাপ। কেনো এই পলিটিক্স? যখন ফাইনাল প্রোমোশন তালিকা বের হলো, দেখলাম, আমাদের আর্টিলারীর কেউ প্রোমশন পায় নাই বটে কিন্তু আমাদের জিনিয়র ১৪ লং কোর্সের অন্য আর্মস এর অফিসারদের প্রোমোশন হয়েছে। এর মানে হলো, আমরা এবার সুপারসিডেড হয়ে গেলাম। আমার পোষ্টিং হয়ে গেলো খোলাহাটি, সইদপুর সেনানিবাসে ৪ ফিল্ডের টুআইসি হিসাবে। ওখানে আমার সিও হবেন আমাদেরই ক্যাডেট কলেজের আমার এক বছরের সিনিয়র ভাই লেঃ কর্নেল ফেরদৌস, ১০ম লং কোর্সের।  ভালো মানুষ। কিন্তু আমার মেজাজ ভাল নাই। ঢাকার বাসা ছাড়তে হবে। আমি আবার আমার পরিবারকে খোলাহাটিতে নিতে ইচ্ছুক না কারন মিটুলের কর্মস্থল ঘিওর ঢাকার এনসিটিবি (ন্যাশনাল কারিকুলাম টেক্সট বুক বোর্ড) তে।

এমতাবস্থায় নিরাপত্তার খাতিরেই আমাকে আমার পরবারকে এমন জায়গায় রাখতে হবে যেখানে মিটুল বাচ্চাদের নিয়ে একা থাকতে পারে। তাই, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসা ছেড়ে দিয়ে কচুক্ষেতে একটা বাসা ভাড়া করলাম, বাড়িওয়ালা অবসর প্রাপ্ত ফেরদৌস স্যার। আমাকে চলে যেতে হবে খোলাহাটিতে। 

০৮/১০/২০০৩- জর্জিয়া ত্যাগ

Categories

সেই পহেলা অক্টোবর ২০০২ তারিখে আমি জর্জিয়ার জাতীসংঘ মিশনে এসেছিলাম। আজ সেই জর্জিয়া থেকে চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছি। আর কখনো এই দেশে ফিরে আসা হয় কিনা জানি না। যেদিন প্রথম এদেশে ল্যান্ড করেছিলাম, সেদিন দেশটাকে যতোটা না আপন মনে হয়েছিলো, আজ দেশে ফিরে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছে, কিছুটা মায়া ধরেছে, অনেক লোকের সাথে পরিচয় হয়েছে, অনেক পরিবারের সাথে অনেক সখ্যতা হয়েছে, তাদের কারো কারো মুখখানা একেবারে চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলজ্বল করছে। এদের সাথে হয়তো আর কখনোই দেখা হবে না।

সোরেনা গামছাখুরদিয়ার পরিবারটা ছিলো আমার সবচেয়ে কাছের একটি পরিবার। ওর সাথে দেখা হলো না। দেদুনা বুকিয়া, রুসুদিন, কিংবা ওদের আরো অন্যান্য সদস্যরাও যেমন সালোমী, তামারা সবাই জানে আজ আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু দেখা করবার মতো কোনো উপায় নাই। ওরা কেউ কেউ থাকে সেই সুদূর টিবলিসিতে, কেউ আবার জুগদিদিতে, আবার কেউ গালীতে। যুদ্ধ বিপর্যস্ত এলাকায় আসলে কোনো কিছুই সঠিক নিয়মে চলে না।

এদেশের মানুষগুলি খুব ভালো ছিলো। ছোট ছোট বাচ্চারা বেশ মিশুক, মেয়েগুলি ওয়েষ্টার্নদের মতো ড্রেস পড়লেও উচ্ছৃঙ্খল নয়। তারা আমাদের দেশের মেয়েদের থেকেও অনেক রুচিশীল এবং পরিবারকেন্দ্রিক। এরা একটি মাত্র বিয়েতেই সুখী। পরিবার নিয়ে সুখে বসবাস করার জন্য যেভাবে স্বামীকে মেনে চলতে হয়, যেভাবে বাচ্চাদের নিয়ে চলতে হয়, ঠিক সেটাই করে। মেয়েরাই বেশীরভাগ সময় সংসারের হাল ধরে রাখে, আর পুরুষগুলি মদের নেশায় পড়ে থাকে।

একটা সময় ছিলো, রাশিয়ার আমলে এরা খুবই সাবলীল এবং বিলাসবহুল লাইফ লিড করেছে। কিন্তু পোষ্ট কোল্ড ওয়ার এর পরে রাশিয়ার অর্থনইতিক বিপর্যয়ের সাথে সাথে ওরা সবাই নিম্নবিত্ত পরিবারের মতো হয়ে গেছে কিন্তু আচার ব্যবহার রয়ে গেছে সেই আগের বিলাসবহুল পর্যায়ের। জুগদিদিতে থাকার সময় আমার ল্যান্ড লেডি ছিলো জুলি। তার দুইটা ছেলে আছে, নাম গোগা আর লেবানী। জুলির স্বামী আলেক একজন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু একটু ট্রিকি। একসময় প্রুচুর পয়সাকড়ি ছিলো। এখন হাতে কোনো পয়সাকড়ি আসে না। আমরা যে ভাড়াটা দেই, তাতেই ওদের সংসার চলে। গালী সেক্টরে থাকার সময় ল্যান্ড লেডি ছিলো মানানা। আর তার স্বামী ছিলো জামাল। ওদের সাথে আমার অনেক স্মৃতি জরিয়ে আছে। জুলির বয়স প্রায় পঞ্চাশ। মায়ের মতো। একদম ইংরেজী পারে না কিন্তু যেভাবে ইংরেজী বলে তাতে ওর কথা বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না।

এইতো গত ৪ অক্টোবর ২০০৩ তারিখে আমি আবারো জুলির বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। এক রাত থাকলাম। জুলি জানে আমি এক সপ্তাহ পরেই দেশে ফিরে আসবো। রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গলো একটা চমৎকার ছোয়ায়। আমি চোখ খুলতেই দেখলাম, জুলি আমার কপালে ঘুমন্ত অবস্থায় চুমু খেলো। আমার ঘুম ভেংগে গেলো। চোখ মেলতেই দেখলাম, জুলি আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখ তার ছলছলে। আমি তার দিকে তাকাতেই সে ফিরে যাচ্ছিলো। আমি বললাম, মামা, এদিকে আসো। মামা মানে মা, জুলি আমাকে জড়িয়ে ধরে একেবারে কান্নায় ভেংগে পড়লো। বল্লো, নো সি, নাহ? কাম এগেইন সন। অর্থাৎ তোমার সাথে আর কখনো কি দেখা হবে না? আবার এসো আমার ছেলে। কিছুই বলা গেলো না। সকালটাই একটা কষ্টের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিলো। ওরা খুব ভালো মানুষ। আমি আমার অনেক মালামাল কিছুই আনলাম না। একটা টেপ রেকর্ডার কিনেছিলাম, দিয়ে এলাম, অনেকগুলি গিফট কিনেছিলাম দেশে আনবো বলে। সব কিছু দিয়ে দিলাম। ওরা এক সময় অনেক ধনী ছিলো, ওদের এসবের কোনো প্রয়োজন ছিলো না রাখার, কিন্তু আমিই জোর করে দিলাম। খুব খুসি হলো। জুলি তার আলমারী থেকে ৬ টা গ্লাস সেট বের করে অতি যত্নের সাথে একটা পুরানো পেপারে প্যাক করে আমাকে দিয়ে বল্লো, "ওয়াইফ, গিভ, আই গিভ ওয়াইফ, লাভলু" অর্থাৎ এর মানে হলো, এটা তুমি তোমার বউকে দিবা। বল্বা আমি দিয়েছি। আর বল্বা, আমি তাকে ভালবাসি। কি অদ্ভুদ ফিলিংস। ভালোবাসা প্রকাশের জন্য অনেক ভাষা জানার দরকার নাই। মানুষের ভালবাসা কথা বলে চোখ, কথা বলে মুখ, কথা বলে অন্তর। আর তার বহির্প্রকাশ সারাটা শড়ির তার নিজের ভাষায় প্রকাশ করে।  

আজ এই চলে যাওয়ার দিনে মনটা ভীষন খারাপ হচ্ছে। সকাল থেকেই সমস্ত জিনিষ্পত্র গুছিয়ে রেখেছিলাম। আমি গালীতে আছি, আমাকে যেতে হবে প্রথমে জুগদিদি সেক্টরে। ওখানে জাতীসংঘের প্রশাসনিক দপ্তর থেকে ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নিয়ে, মালামাল ট্রান্সপোর্ট সেকসনে হস্তান্তর করে শুধুমাত্র আমার একটা হ্যান্ডব্যাগ সাথে নিয়ে সুখুমী থেকে আমাদের নিজস্ব প্লেনে তুরষ্কের এয়ারপোর্টে আসতে হবে।

গালীতে আমি যে রুমটায় থাকতাম, তার ঠিক পাশের রুমেই থাকতো মানানার স্বামী জামাল। অত্যান্ত ভালো একজন মানুষ। মানানাও খুব ভালো একজন মহিলা। সারাক্ষন কাজ করে। আমাদের জন্য রান্না করে, বাজার করে, কাপড় চোপড় ধুয়ে আবার ইস্ত্রী করে রাখে। জামাল কোনো কাজ করে না। ওদের একটা ছেলে আছে। আমি কখনো দেখি নাই। সে থাকে বাকুতে, তার স্ত্রীসহ। মাকে ভালোবাসে ঠিকই কিন্তু কখনো আসে না। না আসার কারন একটাই, ওর পাস্পোর্ট নাই।

(চলবে)  

০২/০৮/২০০৩- জর্জিয়ার টিবলিসিতে ভ্রমন

Categories

গতকাল ২০ দিনের ছুটিতে টিবলিসিতে এসেছি। টিবলিসি শব্দের অর্থ গরম জল। কেনো এই নাম দেয়া সেটা জানা গেলো সোরেনার কাছ থেকে। এখানে প্রচুর সালফিউরিক স্প্রিং আছে। আর এই সালফিউরিক স্প্রিং গুলির কারনে সারা বছরই এলাকাটা গরম থাকে। এই সালফিউরিক স্প্রিং এর কারনেই আসলে টিবলিসির নামকরন। যাই হোক, আমি এখানে কোনো হোটেলে উঠি নাই। যদিও প্রচুর হোটেল আছে।

সোরেনা আমাদের সেক্টরের একজন দোভাষী। ওর সাথে আমার অন্যান্য দোভাষীদের থেকে একটু আলাদা সম্পর্ক। খুবই ভালো একটা মেয়ে। আমি যখন সোরেনাকে বললাম, যে, আমি টিবলিসিতে বেড়াতে যাবো, তখন সোরেনাই আমাকে প্রপোজাল দিলো যে, তার এক খালার বাসা আছে টিবলিসিতে। যদি আমি কিছু মনে না করি, তাহলে আমি ওদের খালার বাসায় থাকতে পারি। রাশিয়ান মানুষেরা খুবই অতিথি পরায়ন। আমি রাজী হলাম। কিন্তু সোরেনা আমার সাথে যেতে পারবে না, ওর ছুটি নাই। ফলে আমাকেই একা যেতে হবে ওর খালার বাসায়। অনেকদিন পর্যন্ত জর্জিয়ায় আছি, ফলে আমি মানুষগুলির স্বভাব, আচরন, ব্যবহার ইত্যাদি সম্পর্কে বেশ জানা আমার। আমার যে কোনো অসুবিধা হবে না, এ ব্যাপারে আমি মূটামুটি নিশ্চিত ছিলাম।

ফলে, টিবলিসি যেতে প্রথমে আমাকে আমার কর্ম ক্ষেত্র গালী সেক্টর থেকে জুগদিদি সেক্টরে আসতে হয়েছে। জুগদিদিতে আমাদের ইউ এন এর জন্য নির্ধারিত এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের নিজস্ব ফ্লাইট দিয়ে সরাসরি টিবলিসিতে এসেছি। আমাদের নিজস্ব প্লেনে আসা যাওয়ায় কনো ভাড়া লাগে না। প্রায় আড়াই ঘন্টা ফ্লাইট। ছোট আন্তোনোভ প্লেন। মাত্র ৪ জন পেসেঞ্জার আমরা। নেমে গেলাম টিবলিসি এয়ারপোর্টে।

সোরেনা আগে থেকেই আমাকে একটা গাইড লাইন দিয়ে রেখেছিলো, কিভাবে টিবলিসি এয়ারপোর্টে নেমে কোনো কোন ইমিগ্রেশন পয়েন্ট দিয়ে বেরিয়ে কোথায় যেতে হবে। এটাও গাইড লাইনে ছিলো যে, এয়ারপোর্টের বাইরে একজন মেয়ে থাকবে আমার জন্য, যাদের বাসায় আমি উঠবো। মেয়েটির নাম দেদুনা বুকিয়া।

আমি এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আমার জন্য অপেক্ষারত মেয়েটির সন্ধান করছিলাম। একটা প্লেকার্ড থাকলে ভালো হতো। কিন্তু সম্ভবত প্লেকার্ডের ধারনাটা ওর নাই। আর আমি মেয়েটাকে চিনিও না। জর্জিয়ার সব মেয়েরাই সুন্দর আর সবাই দেখতে প্রায় একই রকমের। ভাবলাম, আমি তো আর জর্জিয়ানদের মতো নই। ফলে হয়তো মেয়েটা আমাকে দেখলে বুঝতে পারবে।

ঠিক এই সময় ২২/২৩ বয়সের একটি চমৎকার নীল নয়না যুবতী মেয়ে সেন্ডু একটা গেঞ্জি পড়ে আমার সামনে এসে বল্লো, তুমি কি মেজর আখতার?

বুঝলাম, এটাই সেই মেয়ে যার জন্য আমি অপেক্ষা করছি।

আমি হেসে দিয়ে বললাম, হ্যা, আমিই মেজর আখতার। তোমার নাম কি?

সে উত্তরে বলল, তার নাম দেদুনা বুকিয়া। সোরেনার খালাতো বোন।

মেয়েটি অসম্ভব সুন্দুরী, কোকড়ানো চুল, আর তার চোখ সত্যি সত্যিই একদম নীল রঙ এর।

বললাম, চলো।

দেদুনা একতা ট্যাক্সি ভারা করলো, কি যেনো বল্লো, তারপর আমি আর দেদুনা একসাথে ওদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম। দেদুনা বল্লো, ওখান থেকে প্রায় ৪০/৪৫ মিনিটের পথ। একটা পাহাড়ি বা মাল্ভুমিতে ওদের বাসা। ওটা একটা সরকারী কন্ডোমুনিয়াম, থাকতে খারাপ লাগবে না।

কথা হচ্ছিলো দেদুনার সাথে। সুন্দর ইংরেজী বলে। সে আসলে একজন সাংবাদিক। অবিবাহিত।

বললাম, দেদুনা, তোমার চোখের দিকে তাকালেই তো ট্যাক্সী ভারা মাফ হয়ে যাবার কথা। কারন লন্ডনে যাদের চোখের রঙ নীল, তাদের জন্য সবকিছু মাফ। কারন তারা মনে করে, ওরা রয়েল ফ্যামিলির সদস্য। এভাবেই ওর সাথে বেশ অনেকক্ষণ কথা বিনিময়ের পর, একটা মালভুমির মতো এলাকায় গাড়ি ঢোকে গেলো।

জর্জিয়ার সব গুলি বাড়ি প্রায় একই রকম। রাশিয়ার ধাচেই করা। জায়গাতা আমার ভালো লাগলো। এতা একতা সরকারী কোয়ার্তার। দেদুনার মা একটা সরকারী স্বাস্থ্য বিভাগের কনো একটা ডিপার্ট্মেন্টে রেডিওলোজিষ্টের কাজ করেন। অত্যান্ত অমায়িক মহিলা।

বাসায় ঢোকেই দেখলাম, আমার জন্য একতা আলাদা রুম দেয়া হয়েছে। আমার রুমের পাশেই বড় হাইওয়ে রাস্তা দেখা যায়। আমার রুম থেকে বের হলেই দেদুনাদের ড্রইং রুম, সেখানে ২০ ইঞ্চির একতা টিভি আছে, সোফাসেট আছে। সরকারী কোয়ার্তার সব সময়ই বড় সাইজের হয়। আমার পাশেই একটা কমন টয়লেট, তারপাশে থাকে দেদুনা আর ওর আরো দুইবোন, তামারা আর সালোমি। তামারা বড় আর সালোমী ছোট। আমি তো প্রথমে সালোমীকে দেখে বুঝতেই পারি নাই যে, ও ছেলে না মেয়ে। কারন ছোট ছোত চুল, গড়ন দেখে মেয়েলী বুঝা যায় না। সবাই খুব মিশুক। সোরেনা আগে থেকেই সম্ভবত ওদের বলে রেখেছিলো আমার খাবারের অভ্যাস গুলি কি। তাই আমি যখন বাসায় পৌঁছলাম, তখন প্রায় দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গিয়েছিলো। ওরা বেগুন আর ভাত পাক করেছিলো। বাংলাদেশের মতো তো আর খাবার হবে না, কিন্তু খেতে পারলাম।

রাশিয়া বা জর্জিয়ার একটা কথা আগেই বলেছিলাম যে, এরা যে কোনো অতিথিকে "চা চা" নামের এক প্রকার এল্কোহল দিয়ে আপ্যায়ন করে। আমরা যেমন কেউ এলেই চা দেই বা কফি দেই, ওরা দেয় "চা চা" প্রায় ৭৫% এল্কোহল। নিজেরাই বানায়।

আমি ওদের সাথে প্রায় কয়েকদিন থাকার যেহেতু প্ল্যান করেছি, ফলে আমিও চাইছিলাম যে, আমি ওদের মতো করে একেবারে মিশে যাবো। দেদুনাকে বললাম, দেদুনা, একটা সিডিউল করো, আমরা প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাবো, ঘরে থাকবো শুধু রাতের বেলায়। ওরা অনেক ভ্রমন পিয়াসু, খুব পছন্দ করলো। প্রথম দিন আমরা টিবলিসির একটা "ঈগল" রেষ্টুরেন্টে সবাই ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করতে গেলাম। আন্টি গেলেন না। এখানে আমাদের সাথে আরো একজন সাথী জয়েন করেছিলো, সেও দেদুনার খালাতো বোন, নাম রুসুদিন। সে ডাক্তার। কারোরই বিয়ে হয় নাই।

আমরা যেখানেই যাই দল বেধে এই কয়জন যাই। খেতে গেলেও এক সাথে, ঘুরতে গেলেও এক সাথে, গল্প করলেও এক সাথে। অনেক রাতে বাসায় ফিরলাম।

পরদিন খুব ভোরে আমার ঘুম ভাংগলো। দেখলাম, এতো ভোরে ঘুম ভাংগ্লেও সবাই জেগে গেছে। আমি জাগার পর দেদুনা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, নাস্তা খাবো কি খাবার। বললাম, তোমরা যা খাও আমিও সেটাই খাবো। দেদুনা বল্লো, আমরা তো পাউরুটি খাবো।

ওরা একটা পিপায় পাউরুটি রাখে, সাথে একতা ছোট কুড়াল। কারন পাউরুটি গুলি প্রিজার্ভেশনের নিমিত্তে এমন করে বানানো হয় যে, পাউরুটির উপরিভাগ অনেক শক্ত রাখে যা সাধারন হাতে ছিড়া যায় না, একটা ছোট কুড়াল লাগে। যেই পাউরুটির উপরিভাগ কেটে ফেলা হয়, ভিতরের পাউরুটি একদম ফ্রেস থাকে এবং নরম।

দেদুনাকে বললাম, ডিম ভাজি করতে পারো? বল্লো, হ্যা পারি তো।

আমি দেদুনার সাথে রান্না ঘরে গেলাম, দেখলাম কিভাবে ওরা ডিম ভাজে। খুব মজার একটা জিনিষ শুখলাম। ওরা তেল খায় না। প্রায় খায় না বললেই চলে। তাহলে ডিম ভাজে কিভাবে? ওরা যে কাজতা করে, করাইয়ের মধ্যে একটু দুধ দিয়ে দেয় যেটা তেলের কাজ করে। এই দুধের করাইতে ওরা ডিম ভাজে। ব্যাপারটা খারাপ না।

এভাবেই দুইদিন কেটে গেলো।

আমি ভাবলাম, পরোটা খেতে পারলে ভাল হয়। কিন্তু ওরা পরোটা কি তাইই জানে না। আমি বিকালে কিছু ময়দা নিয়ে এলাম, সাথে সোয়াবিন তেল। আমিই সকালে দেদুনাকে নিয়ে আর সালোমিকে নিয়ে ময়দা ছানলাম, তেল দিয়ে করাই গরম করলাম, তারপর কোনো রকমে বিচ্ছিরী সেপের একটা পরোতা বানালাম। কারন পরোতা বানানোর কোনো বেলুনি ছিলো না। যখন আমি তেলের ভেজে পরোটা বানালাম, ওরা ব্যাপারটা খেয়ে খুবই মজা পেলো। শুরু হয়ে গেল পড়োটার নাস্তা প্রতিদিন। এই সময়ে আমার মাথায় একতা বুদ্ধি এলো, আর বুদ্ধিতা হচ্ছে, আমি যদি কিছু বাংলাদেশী খাবার বানাই, তাহলে ওরা হয়তো পছন্দ করতেও পারে। আমি রান্না জানি না, কিন্তু যেহেতু এতো বছর ধরে বাংলাদেশী খাবার খাচ্ছি, ফলে একতা ধারনা তো আছেই।

পরদিন বললাম, তোমরা কি খিচুড়ি খেতে পছন্দ করো? খিচুড়ি কি, সেটা তো ওরা জানে না। কিন্তু এবার ওরা ভাবছে, পরোটা খেয়ে যেহেতু ওরা খুব মজা পাচ্ছে, খিচুড়ি নিশ্চয় আরো কোনো ভাল খাবার হতে পারে। ভাবলাম, খিচুড়িতে কিছু গরুর মাংশ দিলে মন্দ হয় না। কিনে আনলাম কিছু গরুর মাংশ। আমি মুটামুটি তেল আর কিছু মসল্লা (আমি সাথে করে কিছু মসল্লা নিয়ে এসেছিলাম) মেখে মাংশটা কসিয়ে নিয়ে নরম করে তরকারীর মতো করে ফেললাম। তারপর খিচুড়ি পাক করা তো কোনো ব্যাপার না। একটু ঝাল হয়ে গিয়েছিলো। সবাই খেয়ে আরো মজা পেলো কিন্তু ঝালের ব্যাপারটা ওরাই বুঝে নিলো কতটুকু ঝাল দেয়া দরকার।

দেদুনাদের বাসায় আমার খাবার নিয়ে কোনো প্রকারের আর ঝামেলা রইলো না।

আমি প্রতিদিন সবাইকে নিয়ে কখনো পার্কে, কখনো রেষ্টুরেন্টে, কখনো কোনো ঐতিহাসিক স্পটে আবার কখন মার্কেটে, আবার কখনো বীচে যাই। বিকিনী পরা আমার এই বন্ধু গুলিকে আমি কখনো অশ্লীল চোখে দেখার মনোভাব খুজে পাই নাই। এমনো হয়েছে, গলায় গলায় ধরে, আমরা হেটে গিয়েছি, বীচে শুয়েছি, খেলা করেছি। অদ্ভুদ সময়টা কেটেছে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমি এখানে একজন অতিথি।

৫/৬ দিন পর সোরেনা এলো। আরো ভালো সময় কাটলো।

যেদিন আমি চলে আসবো, ওরা আমাকে কাদিয়েছিলো বিরহে। একটা গাড়ি নিয়ে সেই টিবলিসি থেকে সরাসরি আমি যুগদিদিতে এসেছিলাম। কিন্তু আমি সরাসরি আমার বাসায় এলাম না। দেদুনা যুগদিদিতে ওর এক খালার বাসায় আমাকে নিয়ে গেলো। প্রথমে বুঝতে পারি নি ওরা যে এতো গরীব। ওরা আসলে কাউকেই বুঝতে দেয় না ওদের আর্থিক অবস্থার কথা। আমি আর ওর খালু এক রুমে থাকলাম, দেদুনা আর ওর অন্যান্য সব বোনেরা থাকলো আরেক রুমে। রাতে সবার সাথে খাওয়া দাওয়া করলাম। খুব মজা হলো। পরেরদিন সকাল ১০ তাঁর দিকে আমি আমার ২০ নম্বর বাংলাদেশী বাসায় যুগদিদিতে চলে এলাম। সবার কথা আজো আমার খুব মনে পড়ে।

2003- শামসুল বারীকে

Mr. Shamsul Bari, House # 7, Road # 17, Block C, Banani, Dhaka

Phone: 882-1582,

Respected Sir,

Assalamualaikum.

My best regards and respect to you and to your family sir. I don’t know if you could recognize me after a long time. Sir, I am Major Akhtar (from Army Headquarters) who one day accompanied you during one of your guest speaking (on 27th March 2001) at Peace Keeping Operation Training Center (PKOTC), Rajendrapur on “The Role of UN in Peace Keeping Operation”. I visited your house to accompany you till Rajendrapur and came back in the same day later on. The day was very remarkable for me indeed.

Sir, I am now in Republic of Georgia working as Military Observer (MO) under United Nations Observer Mission in Georgia (UNOMIG). I came here as UNMO last year October and hope to continue working till next October sir.  I was in so hurry with some of the official activities that I was quite unable to keep contact with many important respected personalities such as you before I left the country. Moreover, the complex formalities (medical procedure, documentations, and others) for the UN mission abroad kept me quite more busy too. But I always remembered you everywhere with respect. Once I came here in Georgia, I was trying to contact you in many ways but unfortunately I did not have your e-mail address or the home address with me.  After lots of searches of my personal documents at home, my wife could finally send me your e-mail and home address last week. I had tremendous desire to wish you 62nd “Happy Birth Day” on last March but due to non-availability of the contact address, I failed to communicate to you in time.  I wish you a very good health and safe stay sir. Though it is too late but I wish my heartiest feelings and love to you for your 62nd Birth Anniversary.

I am enjoying the work here in Georgia. It is a very beautiful country and people are also not very hostile at the moment. SRSG is from Switzerland, Ms Heidi Tagliavani, and the CMO is from Bangladesh, Maj. Gen Kazi Ashfaq.

I will keep contact with you from now onward. No more today sir. My salaam and respect to you and to your family members.

Sincerely Yours

Major Akhtar Hossain

Military Observer

UNOMIG
Republic of Georgia.

Mail To: baris@citechco.net

Mr. Shamsul Bari, House # 7, Road # 17, Block C

Banani, Dhaka

Phone: 882-1582

শ্রদ্ধ্যেয় স্যার

আসসালামুয়ালাইকুম

আপনার এবং আপনার পরিবারকে আমার গভীর শ্রদ্ধা এবং সুভেচ্ছা রইলো স্যার। আমি জানি না এতোদিন পর আমাকে আপনি চিনতে পারবেন কিনা। স্যার, আমি মেজর আখতার। আপনি যখন রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্টের পিস কিপিং অপারেশন এন্ড ট্রেনিং সেন্টারে গত ২৭/০৩/২০০১ তারিখে “The Role of UN in Peace Keeping Operation" বিষয়ের উপর গেস্ট স্পিকিং করতে গিয়েছিলেন, আমি তখন সারাদিনের জন্য আপনার কন্ডাক্টিং অফিসার হিসাবে আপনাকে সঙ্গ দিয়েছিলাম। খুব ভোরে আমি আপনার বাসায় গিয়ে আপনাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। দিনটি আমার কাছে খুব স্মরণীয় ছিলো।

স্যার, বর্তমানে আমি এখন জাতীসংঘের অধীনে (ইউনিটেড ন্যাশন্স অবজারভার মিশন ইন জর্জিয়া)  রি-পাব লিক অফ জর্জিয়াতে মিলিটারী অবজারভার হিসাবে কাজ করছি। আমি গত অক্টোবরে এখানে এসেছি এবং আরো এক বছর এখানে থাকবো। এখানে আসার আগে আমার খুব ইচ্ছে ছিলো আপনার সাথে দেখা করার কিন্তু আপনি তো ইউ.এন.এইচ.ছি.আর. এ অনেক উচু পদে কাজ করার সুবাদে জানেন যে, মিশনে যাওয়ার প্রাক্কালে কি পরিমান ডকুমেন্টেসন্স, মেডিক্যাল ইত্যাদি সম্পন্ন করার তাগিদে আপনার সাথে আর দেখাই করা হলো না। কিন্তু আমি আপনাকে কখনোই ভুলি নাই এবং সব সময় আপনি আমার মনের মধ্যে ছিলেন।

আমি জর্জিয়ায় আসার পর আপনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও আপনার ফোন নাম্বার অথবা এ-মেইল ঠিকানা না থাকায় কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। অবশেষে ঢাকা থেকে  আমার ব্যক্তিগত ফাইলে আপনার ঠিকানা এবং এ-মেইল ঠিকানা যোগাড় করে এখন আপনাকে মেইল করতে পারছি। প্রকৃত পক্ষে, গত মার্চ মাসে আপনার ৬২তম জন্ম দিনে শুভেচ্ছা জানাতে চেয়েছিলাম। যদিও দেরী হয়ে গেছে, তারপরেও শুভ জন্ম দিন স্যার।

জর্জিয়াতে কাজ করতে বেশ আনন্দের পাশাপাশি অনেক অভিজ্ঞতাও হচ্ছে। এখান কার মানুষ গুলি বেশ ভালো। জাতী সংঘ মিশন চালু করার জন্য যতোটা আইন শৃঙ্খলা খারাপ হ ওয়া দরকার, অটটা খারাপ মনে হয় না এখান কার পরিস্থিতি। এখানে জাতী সংঘের মহা সচীবের স্পেশাল রি প্রেজেন্টেটিভ অফ সেক্রেটারী জেনারেল হিসাবে দায়িত্তে আছেন সুইজার ল্যান্ডের মিস হেইডি তাগলিয়া বেনি। অবিবাহিত একজন অসাধারন মহিলা। আর চীফ মিলিটারী অবজারভার হিসাবে আছেন বাংলাদেশের মেজর জেনারেল কাজী আশফাক আহমেদ।

যাই হোক স্যার, আমি আপনার সাথে আবারো যোগাযোগ করবো। আবারো সালাম আর শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করছি স্যার। ভালো থাকবেন। আজ এখানেই।

ইতি

মেজর আখতার, জর্জিয়া

২৮/০১/২০০৩- জর্জিয়া থেকে সচি ভ্রমন

Categories

বেশ অনেকদিন হয়ে গেলো জর্জিয়ায় এসেছি। গত অক্টোবর মাসে জর্জিয়াতে জাতীসংঘের মিশনে এসেছি। আশেপাশে সারাটা দেশ ঘুরলাম। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ, তারপরেও বেশ সুন্দর। বুঝা যায় যে, সোভিয়েট ইউনিয়নের সময় দেশের অবস্থা যথেষ্ঠ পরিমান মজবুত আর শক্ত ছিলো। বেশ গাছ গাছালী আছে সব জায়গায়। মাঝে মাঝে আমার একটা কথা মনে হয় যে, আমরা যারা বাংগালী নিজের দেশের সবুজ বনায়ন দেখে কত গান, কত কবিতা লিখি যেনো আমাদের দেশটাই শুধু সবুজ গাছগাছালী দিয়ে ঈশ্বর সাজিয়েছেন। কিন্তু সেটা মোটেও সত্য নয়। বিভিন্ন দেশ ঘুরে তো দেখলাম, যে, বরং আমাদের দেশটাই পিছিয়ে আছে। এমন কি এই সবুজ বন্যায়নের দিক দিয়েও। কয়েকদিন যাবতই ভাবছিলাম, পাশেই রাশিয়া, ঘুরে আসি। আমাদের জাতীসংঘের সেনাবাহিনীর কোনো জায়গাতেই যাওয়া আসার জন্য কোনো রেস্ট্রিকসন নাই। ইচ্ছে করলেই ইউনিফর্ম পড়েই যেতে পারি, জাতীসংঘের গাড়ি সেলফ ড্রাইভিং করেই যাওয়া যায় একদেশ থেকে আরেকদেশে। তেলের খরচ লাগে না, গাড়ির জন্য কোনো আলাদা পয়সা লাগে না। বেশ ভালো।

কোনো বাংলাদেশীদের সাথে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। তাদের সাথে গেলে যেটা হয়, হয় বেশি আতেল্গিরি না হয় একটা বোঝা হয়ে দাড়ায়। আনন্দের চেয়ে হয় বিরক্ত আসে অথবা মেহনত বাড়ে। কিন্তু কোনো বিদেশীদের সাথে একোম্পানি করলে ব্যাপারটা অনেক সাচ্ছন্ধবোধ লাগে। এখানে অনেকের সাথেই আমার খুব ভালো খাতির। বিশেষ করে পর্তুগাল, পোল্যান্ড কিংবা তুরুষ্কের অফিসারদের সাথে। জার্মানীর সবার সাথেই আমার বেশ ভাল একটা ফ্রেন্ডশীপ আছে। অনেকেই বেড়াতে যাওয়ার সময় আমাকে সংগী করে নিতে চাইলেও কেনো জানি আমার যাওয়া হচ্ছিলো না। তাই এবার ভাবলাম, রাশিয়া থেকে ঘুরে আসি। জর্জিয়া থেকে সবচেয়ে কাছের যে পোর্ট সিটি তার নাম সচী। আমাদের মিশন এলাকা থেকে বেশীর ভাগ অফিসাররা এই সচীতে গিয়েই সপ্তাহান্তের ছুটিগুলি কাটিয়ে আসে। কেউ যায় সস্তা রাশিয়ান মেয়েদের সাথে সেক্স করতে আবার কেউ যায় জাষ্ট একটা বিনোদনের উদ্দেশ্যে। আমার কোনো শখ নাই রাশিয়ান মেয়েদের সাথে কোনো প্রকার দৈহিক আনন্দের, আর এটা আমি মোটেও পছন্দ করি না। তাই আর যাওয়াও হচ্ছিলো না।

উরুগুয়ের এক বিমান বাহিনীর অফিসার, নাম লিওনার্দো, আমার খুব ভালো বন্ধু। সে একদিন এসে বল্লো, আখতার চলো সচী থেকে ঘুরে আসি। ভাবলাম, যাওয়া যেতে পারে। আমাদের সচী যাওয়ার জন্য যা লাগবে তা হলো একটা গাড়ি, আর অনুমতি। দুটুই সহজ এখানে। সেভাবেই আমি আর লিউনার্দো পরিকল্পনা করলাম ২৪ তারিখেই সচী যাবো। তিনদিনের ছুটিই যথেষ্ট। আমি রাশিয়ান ভাষা একদম বুঝি না, এদিকে আবার লিউনার্দো উরুগুয়ের বাসিন্দা বলে অনর্গল পারুস্কি বা রাশিয়ান ভাষাটা তার দখলে। ফলে আমরা তারিখ করেই ফেললাম যে ২৪ তারিখে আমরা রাশিয়ার সচিতে বেড়াতে যাবো। আমি আর লিউনার্দো খুব ভোর বেলা রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমরা দুজনেই ড্রাইভিং জানি। সুতরাং কিছু সময় আমি আবার কিছু সময় লিউনার্দো ড্রাইভ করতে করতে সচীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তাটা বেশ লম্বা। প্রায় আরাই শ কিলোমিটার। আমাদের রাস্তাটা ছিলো প্রায় এই রকম-

জুগদিদি-গালি-অচামছিড়া-লাব্রা-সুখুমি-গুদাউটা-ঘাগ্রা-সিনাতলে-গান্দিয়াদি-খিবানি-আডলার-খোসতা-খোস্টিনিস্কি হয়ে সচী। পুরু রাস্তাই এ-১৪৭ নামে পরিচিত। খুব সুন্দর রাস্তা।

আমরা যখন সচী পৌঁছলাম, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। পথে অনেকবার থেমেছিলাম, কখনো কফির জন্য, কখনো এম্নিতেই ছবি তোমার জন্য। আবার কখনো কারো সাথে রাস্তার ডাইরেকশন জানার জন্য। শীতকাল। ফলে দ্রুত বেলা পড়ে আসছিলো। আমরা তখনো জানি না কোন হোটেলে যাবো। কিন্তু আগে থেকেই একটা ধারনা ছিলো যেহেতু অনেকেই এখানে আসেন। আমাদের অন্যান্য অফিসাররাও এখানে আগে আসায় তাদের কাছ থেকে আমরা একটা আইডিয়া করে এসছি।

প্লেহানোভা স্ট্রীটে ইম্পেরিয়া নামে মূটামুটি ভালোমানের একটা হোটেল আছে যেখানে অনেক অফিসাররাই এসছিলো, ফলে আমরা সেটার খোজই নিচ্ছিলাম। হোটেলে যাওয়ার পর দেখলাম একেবারে মন্দ না। দামও মুটামুটি সস্তাই। রুমভাড়া মাত্র ২৫ ডলার করে। ডাবল বেড। আমার আর লিউর তাতে হয়ে যায়। আমরা ব্যাগ রুমে পাঠিয়ে দিলাম, আর গাড়িটা হোটেলের গ্যারেজেই দেওয়ার জন্য একটা দরখাস্ত করে ফেললাম। রিসেপসনে যে ভদ্র মহিলা বসেছিলেন, তার বয়স প্রায় ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে হবে। জিজ্ঞেস করলাম, খাবারের ব্যবস্থা কি। আমরা আসলে হোটেলের খাবারের উপর নির্ভর করতে চাই নাই। ফলে আমরা আগেই হোটেল রুম ভাড়া নেওয়ার সময় ফুড পোর্শনটা বাদ দিয়ে ভাড়ার ব্যাপারটা মিটিয়ে নিয়েছিলাম। যেহেতু আমাদের সাথে গাড়ি আছে, ফলে, যে কোনো লং ডিসটেন্সে গিয়েও আমাদের চয়েজ মতো খাবার খেতে পারি।

হোটেলে ঢোকার পর একটু ফ্রেস হয়ে নিলাম। তারপর আবার বেরিয়ে গেলাম বাইরে। লিউ যেহেতু রাশিয়ান ভাষাটা বুঝে ফলে আমার খুব একটা বেগ পেতে হয় নাই। রাশিয়ায় খুবই কম লোক ইংরেজীতে কথা বলতে পারে কিংবা বলে। ফলে আমি কতটুকু ইংরেজীতে দক্ষ তাতে কিছুই যায় আসে না। বরং পুরা বাক্য না বলে যদি কেউ ভেঙ্গে ভেঙ্গে গুটিকতক ইংরেজি শব্দ বলতে পারা যায়, তাহলে হয়তো কেউ কেউ কিছু ইংরেজী ভাষা বুঝতে পারে। গ্রামার দিয়ে শুদ্ধরুপে যেই ইংরেজী বলবেন, সব তালগোল পাকিয়ে ওরা আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। যদি কাউকে বলেন, ডু ইউ নো হাউ টু স্পিক ইংলিশ? কিছুই হয়তো বুঝবে না। তাকে যদি বলেন, স্পিক স্পিক ইংলিশ? তাহলে হয়তো কাজে দিতেও পারে।

প্রথম দিন সচীতে। রাতের বেলায় বেরিয়ে কোনো একটা মার্কেট খুজতেছি। ভালো মার্কেট যে কোথায় সেটা পাওয়া খুবই জটিল মনে হলো। রাত প্রায় ৯টা বেজে গেছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা কোনো রকম রেষ্টুরেন্টে আমি আর লিউনার্দো কিছু একটা আপাতত খেয়ে নিলাম। লিউকে দেখে অনেকটা রাশিয়ান রাশিয়ান মনে হলেও আমি যে এখানে বিদেশী এটা ওদের কারোরই বুঝার বাকী ছিলো না। রাস্তাঘাট বেশ ফাকা। একটা বয়স্ক মহিলা আমাদের কাছে এসে বল্লো, "তেবে নুঝনা দেবুস্কা?" লিউনার্দো আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিয়ে বল্লো, বুঝতে পেরেছো, মহিলা কি বলছে? আমি বললাম, নাহ। লিউনার্দো বল্লো, তোমার কোনো মেয়ে চাই কিনা। তার কাছে ভালো আনাড়ি সুন্দুরী মেয়ে আছে, এবং যুবতী। বুঝলাম, সচী এমন একটা জায়গা যেখানে বেশ্যাবৃত্তি হচ্ছে প্রধান ব্যবসা। একটু পরপরই কেউ না কেউ এসে সেই একই কথা বলে যাচ্ছে, আমাদের কোনো মেয়ে চাই কিনা। কি তাজ্জব।

যাই হোক, আমি আর লিউনার্দো হোটেলে চলে এলাম। আমি লিউকে বললাম, লিউ বেশীদিন তো আর এখানে থাকতে আসিনি, চলো, রাতের রাশিয়া দেখে আসি। লিউ আমার খুব ভক্ত। বল্লো, চলো যাই তাহলে। আমরা গাড়ি নিলাম না। পায়ে হেটেই বেশ কিছুদুর এগুলাম। শুনশান রাস্তা, লাইট পোষ্টগুলি জলছে। কুয়াসায় রাস্তা প্রায় ঢেকে যাচ্ছে। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে লিউকে নিয়ে সচী রিভারের কাছাকাছি চলে এলাম। প্রচুর মানুষ নদীর পারে। দেখলাম, প্রায় সবগুলি মানুষই মাতাল। ছেলেমেয়েরা একে অপরের সাথে প্রেম করছে, মাতামাতি করছে। আর পাশে এক বেহালাবাদক নিজের মনের সুখে বেহালা বাজিয়ে যাচ্ছে। এই বেহালার সুরে আবার কোনো কোনো মাতাল কিছু একটা দিয়ে বাদ্য যন্ত্রের মতো ঢোল পিটাচ্ছে। আর এই ঢোলের তালে তালে আবার কেউ কেউ এমন নাচনী দিচ্ছে, মনে হয় না কোনো কালে সে নাচ শিখেছে। এই নাচ দেখে আবার কেউ কেউ তাকে উতসাহও দিচ্ছে। মানুষ যখন মাতাল হয়, পাশে বসা কুকুরের আওয়াজ ও মধুর সুরের মতো হয়তো মনে হয়। মাতাল অবস্থা একটা দেখার মতো অভিজ্ঞতা।

রাত প্রায় বারোটার দিকে আবার আমি আর লিউনার্দো হেটে হেটেই আমাদের হোটেলে চলে এলাম। এই আসার পথে কমপক্ষে তিন থেকে চার জন আমার কাছে সিগারেট চেয়ে নিলো। এখানে সিগারেট চাওয়া যেনো একটা মামুলি ব্যাপার, হোক সে পরিচিত বা অপরিচিত। একটা জিনিষ খেয়াল করলাম যে, রাস্তায় অনেক লোক নেশা করে হেটে বেড়ায় কিন্তু অসভ্যতা করে না। আমাদের দেশ হলে তো ব্যাপারটা হতো ভয়ংকর। এখানে মাতালেরও একটা নীতি আছে।

হোটেলল রুমে ঢোকেই দেখি দরজার নীচ দিয়ে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬টা ভিজিটিং কার্ড পড়ে আছে। সবগুলি কার্ড সেক্স গার্লদের। রুম সার্ভিস সহ অফার। কি তাজ্জব। সেক্স এখানে এতো জনপ্রিয় আর সস্তা? অনেক রাস্তা আজ ড্রাইভিং করেছি, আবার রাতও কম হয় নাই। টায়ার্ড লাগছে, তাই আমি আর লিউ পাশাপাশি বেডে শুয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।

পরদিন, প্রায় অনেক বেলা হয়ে গেলো ঘুম থেকে উঠতে উঠতে। আমরা যখন ঘুম থেকে উঠলাম, বেলা তখন প্রায় ১১ টা সকাল। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। আমার আসলে ভাত না হলে চলেই না। লিউকে বললাম, লিউ চলো, ভাতের কোনো রেষ্টুরেন্ট পাও কিনা। লিউ আবার এইসব ভাত খেতে পছন্দ করে না। আমাদের ইম্পেরিয়ার পাশেই একটা ছাউনীওয়ালা লোকাল রেষ্টুরেন্ট ছিলো। আমার মনে হলো, সেখানে হয়তো ভাত পাওয়া যেতে পারে। লিউ যেতে চাইলো না। ওর নাকি ক্ষুধা নাই। সে একটা বিয়ার নিয়ে জানালার পাশে বিয়ার খেতে থাকলো। আমি একাই বেরিয়ে গেলাম। বেশী তো আর দূর নয়, এই পাশেই তো। প্রচুর লোক তখনো খাচ্ছে। একটা গমগম ভাব। আমি ঢোকলাম, আমি জানিনা কিভাবে 'ভাত খাবো এটা বলতে হয়'। তো, ওখানে একটা ২০/২২ বছর বয়সী ছেলে খাবার সার্ভ করছিল। আমি ইশারা করতেই সে আমার কাছে এসে, ওদের ভাষায় কি খাবো হয়তো জিজ্ঞেস করলো। আমি আসলে বুঝতে পারি নাই। বললাম, মেন্যু কার্ড?  ছেলেটা আমার কথা বুঝলো। একটা মেন্যু কার্ড নিয়ে এলো। বেশীর ভাগ লেখা রাশিয়ান ভাষায়। এম্নিতেই ভাষা বুঝিনা, তাও আমার লেখা। এটা আমার কাছে থাকা যা, আর না থাকা একই। ছেলেটাকে বললাম, 'রাইস?"

ছেলেটা কি বুঝলো বুঝলাম না, সে একটু পড়ে ফিস কাটলেট নিয়ে হাজির। আমি খুব বিরক্ত হলাম, কারন, আমি ভুলেও ফিস উল্লেখ করি নাই, সে কেনো ফিস নিয়ে এলো? আমার মুখের অভিব্যক্তিতে ছেলেটা বুঝতে পেরেছিলো। সে "প্রোস্তিতে" প্রোস্তিতে, বলতে বলতে আবারো ভিতরে চলে গেলো। এবার কোনো খাবারই সে আনে নাই। এদিকে আমার ক্ষুধায় পেট চু চু করছে। একটু বিরক্তও হচ্ছিলাম। লোকজন তাদের খাবার খেয়ে একে একে বের হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি খাবারের অর্ডারই দিতে পারলাম না।

আবারো আমি ছেলেটাকে বললাম, রাইস রাইস? সে যেন আমার কথা কিছুই বুঝলো না এবার। মাথা নেড়ে যা বল্লো সেটার অর্থ, সে আমার কথা বুঝতে পারছে না। আমি এতোটাই বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম, যে, ভাবলাম, এখানে খাওয়ারই দরকার নাই। আমি উঠতে যাচ্ছিলাম। একটু রাগ আমার চোখে। প্রায় বেরিয়েই যাচ্ছিলাম, এমন সময় খুব চমৎকার ইংলিশে পিছন থেকে একটা ২৪/২৫ বছরের ইয়াং মেয়ে বল্লো, এক্সকিউজ মি স্যার!!

আমি পিছনে তাকিয়ে দেখলাম, মেয়েটার গায়ে একটা এপ্রোন পরা। সম্ভবত রান্না ঘর থেকে এসছে। আমাকে ক্লিন ভাষায় জিজ্ঞেস করলো, ক্যান আই হেল্প ইউ? মনে মনে খুব আশ্বাস পেলাম যে, মেয়েটা মনে হয় ইংরেজী বুঝে।

আমি বললাম, আমি ভাত খেতে চাই, আছে?

মেয়েটা আমার হাত ধরে টেনে রান্না ঘরের দিকে নিয়ে গেলো। সম্ভবত সে 'রাইস' কথাটা বুঝে নাই। অথবা বুঝলেও কেনো আমাকে রান্না ঘরে নিয়ে গেলো সেটা আমার মাথায় আসলো না। রান্না ঘরে যাওয়ার পর সে একেএকে তার ডেকচিগুলি খুলে আমাকে দেখাচ্ছে, কোন খাবারটা আমি খেতে চাই। আমি একটা ডেকচিতে দেখলাম, ভাত আছে। বললাম, এইটা।

মেয়েটা হেসে দিয়ে বল্লো, অহ রিস? বুঝলাম, ওরা রাইস বলে না, বলে রিস।

সে আমাকে আবারো টেবিলে বসতে বল্লো, আর বল্লো, ফাইভ মিনিটস।

বসে আছি, প্রায় ১০ মিনিট পর মেয়েটা শুধুমাত্র এক কাপ ভাত আর একটা খালি প্লেট নিয়ে আমার টেবিলে রাখলো। আমি তো অবাক।

আরে ভাই, ভাতটা খাবো কি দিয়ে?

যাই হোক, মেয়েটা আমার অসহায়ের অবস্থাটা বুঝতে পেরে, প্রথমে ছেলেটা যে ফিসকাটলেটটা নিয়ে এসছিলো, সেটা দিয়ে বল্লো, আপাতত এটা দিয়ে খাও। আমি তোমাকে পরে ভাল খবর দেবো। তুমি কি ইন্ডিয়ান?

মেয়েটি আমাকে তার একটা ভিটিং কার্ড দিয়ে বল্লো, রাখো এটা, কাল আবার তোমার সাথে ঠিক এই সময় এস, কথা বল্বো। কার্ড তা হাতে নিয়ে পড়ে দেখলাম, ওর নাম, এলিজাবেথ (লিজা), ৪র্থ বর্ষ, হোম আর্টস, ইউনিভার্সিটি অফ রাশিয়া।