২০/০৯/২০১৭ -অগ্নিশর্মা বাবু

Categories

অগ্নিশর্মা বাবু সুদুর আফ্রিকার জঙ্গলে ভ্রমন করিতে গিয়া অনেক সুন্দর একখানা ফলের চারা দেখিয়া সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিলেন। ভাবিলেন, আহা, আমার বাগানে ইহা লালন পালন করিয়া আরো সুন্দর করিয়া তুলিবো। জঙ্গলে অপরিচর্যায়ই যখন এতো সুন্দর করিয়া উহা বাড়িয়া উঠে, পরিচর্যা পাইলে না জানি আরো কতো সুন্দর করিয়া আপনার বাগানকে আরো সৌন্দর্য বর্ধন করিবে। কতলোক দেখিতে আসিবে, কতলোক ইহার কাহিনী শুনিয়া তাহাকে পাইতে স্বপ্নে বিভোর হইয়া থাকিবে। কিন্তু উহা আর কারো কাছেই নাই শুধু তাহার বাগান ছাড়া। ইহাই যেনো অগ্নিশর্মা বাবুর একটি অতীব শান্তি।

-আনিলেন।
-লাগাইলেন
-শখের চারা। মালির পরিবর্তে তিনি নিজেই উহার পরিচর্যার ভার নিলেন

-প্রতিদিন উহার বাড়িয়া উঠার সব রকমের উপকরন রীতিমতো দিতে থাকিলেন। কখনো দুস্টু লোকের হাতছানীর হাত হইতে রক্ষার জন্য খাচা বানাইয়া, কখনো বৃষ্টির কবল হইতে বাচাইবার জন্য ছাউনী দিয়া, কখনো আবার উলুপোকার উপদ্রব হইতে বাচাইবার জন্য চারার গায়ে সুই ফুটাইয়া ঔষধ লাগাইয়া দিলেন।

দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, অগ্নিশর্মা বাবু দেখিলেন, উহা বাড়তির দিকে না যাইয়া শুধু অধোপতনের দিকে যাইতে লাগিলো। তিনি চিন্তিত হইয়া গেলেন। তাহার ঘুম নষ্ট হইতে লাগিলো, ঘুম নষ্ট হইবার সাথে সাথে সপ্নও ভাঙিতে লাগিলো। তাহার বাগানের অন্যান্য অনেক সুন্দুরী ফলের গাছ, ফুলের চারার উপর অগ্নিশর্মা বাবুর মনোযোগ ক্রমশ কমিতে লাগিলো। তাহার এই অমনোযোগের কারনে বাগানের শ্রী যেনো ধীরে ধীরে আরো খারাপ হইতে লাগিলো। সাজানো বাগানে যেনো ইদুর মরার গন্ধ বাহির হইতে লাগিলো। মরা গাছের ঢাল ক্রমেই বাড়িতে লাগিলো। কি সর্বনাশ!! এই এক আফ্রিকার চারার জন্য অগ্নিশর্মা বাবুর এতো দিনের বাগানের হাল কি হইতে কি হইয়া গেলো?

তাহার পরেও মন বলিয়া কথা। অনেক উচ্ছাস আর আবেগ লইয়া যে চারাটি অগ্নিশর্মা বাবু রোপন করিয়াছিলেন।  উহার এমন অকাল মৃত্যু হইতেছে ইহা তিনি কখনো ভাবিতে পারেন নাই। এমন নয় যে, চাড়াটিতে তিনি কম জল ঢালিয়াছেন, কিংবা তাহার তাহার যত্ন কম নিয়াছেন, কিংবা এমন নয় যে, সময়ের সাথে সাথে উহার কোনো পরিচর্যার অভাব হইয়াছিলো তবুও চারাটি মরিতে শুরু করিয়াছে। কি হইতে পারে উহার এই রকমের পতনের কারন? মনের এই খুতখুতি হইতে রেহাই পাইবার জন্য অগ্নিশর্মা বাবু অনেক গবেষণাও করিলেন।

কি কারনে ইহার অধোপতন হইতে পারে তাহার সবরকমের সম্ভাব্য কারন লইয়া ভাবিতে লাগিলেন। টব পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর টবের মধ্যে তিনি তাহা রাখিয়াছিলেন। সুতরাং টব উহার মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়। মালী যত্ন নেয় নাই এইরূপ দোসারূপ তিনি করিতে পারিবেন না কারন মালী তিনি নিজেই ছিলেন। তদারকীর কোনো গাফিলতি ছিলো না। বিজ্ঞ নার্সারির একদল বিশিষ্ট গবেষকের দ্বারা পরীক্ষা করাইয়া দেখিলেন, উহা যেই জাতের চারা, তাহার সব কিছুই ঠিক আছে বলিয়া মন্তব্য করিলেন। তবে তাহার মন্তব্যের নীচে একটি ছোট নোট লিখিতে ভুলিয়া যান নাইঃ

“অধিককাল উহা স্বাভাবিক আলো–

বাতাস বিবর্জিত এমন এক স্যতস্যাতে গোমট ছায়াতল পরিবেশে বড় হইয়াছে, ফলে ঊহার ভিতরের শিরা উপশিরা, জীবন প্রনালীর ধারা স্বাভাবিক ধারা হইতে পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। ফলে চারাটি আর বর্তমান সুস্থ পরিবেশের সহিত খাপ খাওয়াইয়া চলিতে অপারগ। ইহার বনজ গুনাবলী পুরুপুরি পরিবর্তিত হইয়া বন্য গুনাবলিতে রুপান্তরীত হইয়া গিয়াছে বিধায় সার্বক্ষণিকপরিচর্যায়ও আর কোনো লাভ হইবে বলিয়া মনে হয় না। উহার সমগোত্রীয় চারার জন্য যে আদর্শিক পরিবেশ দরকার তাহা উক্ত চারাটির জন্য প্রযোজ্য হইবে না। তবে যদি পুনরায় উহাকে আলো–বাতাস বিবর্জিত, স্যাতস্যাতে গোমটযুক্ত পূর্বেকার পরিবেশে ফেলিয়া রাখা যায়, উহা অতি তাড়াতাড়ি বাড়িয়া উঠিবে। ইহার জন্য স্বাভাবিক বাগানের পরিবেশ প্রযোজ্য নহে। তবে সেক্ষেত্রে ইহার উপর কোনো ভার, কিংবা কোন কোন লতাপতার ভর দেওয়া যাইবে না কারন উহা এইরূপ কোন ভাড় নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে নাই। “

–মন্তব্য পড়িয়া অগ্নিশর্মা বাবু বুঝিলেন, চারাটিকে আর তাহার বাগানের অন্যান্য ফল, ফুলাদি কিংবা অন্যান্য চারাদের সাথে রাখা সম্ভব হইবে না। আর শুধুমাত্র এই চারাটিকে বাচাইয়া রাখার জন্য বাকী সব চারাদের মুল উৎপাটন করা তাহার পক্ষে সম্ভব হইবে না। রাগে দুঃখে টব সমেত অগ্নিশর্মা বাবু অগ্নিরূপ ধারন করিয়া সেই সুদুর আফ্রিকা থেকে সংগ্রহ করা দেখিতে সুন্দর কিন্তু বিষাক্ত চারাটিকে তিনি বাগানের বহুদূরে নিক্ষেপ করিয়া রাগ সামাল দিলেন। একবার ফিরিয়া তাকাইবার ইচ্ছা হইতেছিলো বটে কিন্তু উহাকে আর দেখিতেও মন চাহিলো না। উহার আফ্রিকার জঙ্গল হইতে আনিবার পর এই বাগানের চত্তরের ইতিহাস চিরতরে নির্মূল করিয়া মালিকে উচ্চস্বরে আদেশ করিলেন, আর বলিলেন, বাগানের প্রবেশ পথে ” আফ্রিকার যতো সুন্দর গাছ কিংবা চারা, কিংবা ফল অথবা ফুলের যে কোনো চারাই হোক না কেনো, ইহা এই বাগানে প্রবেশ নিষিদ্ধ” লিখিয়া দাও।

মালি কোনো কথা না বলিয়া শুধু অবাক হইয়া অগ্নিশর্মা বাবুর দিকে তাকাইয়া তাহার প্রস্থানের দৃশ্য অবলোকন করিলেন। বাবু যাওয়ার পর মালি একটু পরে হাতের কাছে জলের বালতি লইয়া অন্যান্য গাছের গোড়ায় জল ঢালিতে লাগিলেন আর ভাবিতে লাগিলেন, আফ্রিকার জঙ্গলটি কোথায়? জঙ্গলে কি বাগান চাষ হয়?  

১০/০৯/২০১৭-পাপ্পু স্যারের মা

Categories

প্রায় ৯৫ বছর বয়সী একজন অতি সাধারন কিন্তু অসামান্য ব্যক্তিত্তের অধিকারীনি বাঙালি মহিলা যিনি প্রতিক্ষনে শুধু ধন্যবাদ নন, সম্মানও প্রাপ্য। গত কয়েকদিন আগে তিনি হতাত করে শরীরের ব্যাল্যান্স ঠিক রাখতে না পেরে তার রুমে পা পিছলে পরে যান এবং মাথায় বেশ বড় ধরনের আঘাত পান। খবর পেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম, তিনি আমার বাসার ঠিক উপরের তালায় থাকেন। ওনাকে দেখলেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। অবিকল আমার মায়ের মতো চেহারা এবং ঠিক সেই রকমের ধৈর্য। অসম্ভব প্রকারের আত্মনির্ভরশীল এবং আদর পরায়ন। কেউ তার জন্য বিরক্ত হোক তিনি তা চান না। ফলে যতোটুকু সম্ভব এই বয়সে নিজের কাজটা, পরিবারের অনেক ছোটখাটো কাজ যা তিনি করতে পারেন, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করেন। যদিও ওনাকে কেউ কোনো কজ করতে দিতে চান না। বাসার সবাইকে নিয়ে তিনি অনেক ভালো একজন সেতুবন্ধন হিসাবে কাজ করেন। এমন কি কাজের মেয়ের প্রতিও তিনি এতোটাই সহানুভুতিশীল যে, কাজের মেয়েও সে এই পরিবারের একজন মুল্যবান সদস্য হিসাবে মনে করে।

তার যোগ্যসন্তান পাপ্পু স্যার। আর আরেক যোগ্য বৌমা, পাপ্পু স্যারের স্ত্রী। মায়ের প্রতি ভালোবাসা কার নাই? কমবেশী সব সন্তানই মাকে ভালোবাসে কোনো শর্ত ছাড়া। আর এই ভালোবাসা দিনে দিনে স্থায়ীই হয় যদি মা তার নীতির মধ্যে তার সন্তানকে লালন করে থাকেন। পাপ্পু স্যার ওই ধরনের একজন সন্তান। যে মা সন্তানকে ভালোবাসেন, সে মা তার সন্তানের সংসারকেও ভালোবাসেন। সে মা তার সন্তানের স্ত্রীকেও ভালোবাসেন, পরের বাড়ির মেয়েকে সন্তানের স্ত্রী হিসাবে এনে নিজের মেয়ের মতো আদর করেন, তাকে তার কোলে মাথা রাখার অধিকার দেন। ছেলেকে মা যদি ভালোবাসেন, সেই মা তার ছেলের বউকেও ভালোবাসার কথা ঠিক তার ছেলেকে যেভাবে তিনি ভালোবাসেন সেইভাবে। ছেলেকে যদি মা ভালোবাসেন, ছেলের সন্তান, ছেলের স্ত্রী, ছেলের প্রতিটি সদস্যকে ভালোবাসেন ঠিক একই রকমভাবে যেভাবে তিনি ভালোবাসেন তার ছেলেকে। আর এখানেই রহস্যটা লুকিয়ে থাকে মা-সন্তানের সংসারের বন্ধনটা। ছেলে যদি একটা নেড়ী কুকুরকেও ভালোবাসে, তাহলে দেখা যাবে, সেই ভালো মা সেই নেড়ি কুকুরটাকে অতি আদরের সাথে যত করছেন। কারন তার ছেলে ওই নেড়ি কুকুরটাকেও ভালোবাসে। এই হলো প্রক্রিত মা। পাপ্পু স্যারের মা ঠিক এই রকমের একজন আদর্শ মা। এর মানে এই নয় যে, ছেলের অলসতাকে তিনি প্রশ্রয় দিয়ে, অথবা তার অন্যায় আবদারকে প্রশ্রয় দিয়ে তাকে নৈতিকতার বাইরে লালন করে মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা প্রদর্শন করেছেন। সেটাকে ভালোবাসা বলে না। পাপ্পু স্যা্রের মা ঠিক দায়িত্তটা তার ছেলের উপর পালন করেছেন বলেই পাপ্পু স্যার আজকে অনেকের কাছেই একজন আদর্শ টিচার এবং ব্যক্তিত্ত। সকালে উঠার অভ্যাস করিয়েছেন, সৃষ্টি কর্তার নাম দিয়ে দিনের কাজ শুরু করার শিক্ষা দিয়েছেন, কোথায় কি কার দায়িত্ব কিভাবে পালন করতে হবে সেই শিক্ষা দিয়েছেন। সময়কে কিভাবে কাজে লাগাইতে হবে তার পুরু দিক্ষা তিনি তার সন্তানকে দিয়েছেন। আদরের পাশাপাশি শাসন করেছেন। অন্ধ ভালোবাসা দিয়ে তার জীবন গড়িয়ে দেন নাই। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কখনো তাকে আদর্শের কাছে হেরে যেতে দেন নাই।

আমি পাপ্পু স্যারকে দেখেছি, মায়ের জন্য কি পরিমান পাগল। আমি এটাও দেখেছি, পাপ্পু স্যারের স্ত্রীও তার শাসুড়ির জন্য একই পরিমানে পাগল। আমি জানি না তিনি তার নিজের মাকে কতোটা তুষ্ট করেন, কিন্তু শাসুড়ির বেলায় পাপ্পু স্যারের স্ত্রী যতোটা হওয়া দরকার কখনো কখনো তার থেকেও বেশি করেন। তার শাশুড়ি তাকে যতোটা আদর করেন, তার থেকেও বেশী শাসুড়িকে তিনি সম্মানের সহিত লালন করেন। মিস্টি একটা বন্ধন। আর এই বন্ধন তৈরিতে কারিগড় হচ্ছেন পাপ্পু স্যারের মা নিজে। তিনি যেমনটি চেয়েছেন, একটি সুখি পরিবার, তিনি তেমনটি দিতে পেরেছেন বলেই আজ তিনিও তার ফলভোগ করছেন এই ৯৫ বছর বয়সে। এই রকমের একটি সন্তানই যথেষ্ট কোনো মা তার শেষ বয়সে শান্তিতে থাকার জন্য।

আমিও আমার  মায়ের জন্য এমনই পাগল ছিলাম। পৃথিবী একদিকে, আর মা যেনো আরেক দিকে। আমি ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় মাইলের পর মাইল মাকে কোলে করে গ্রামের রাস্তায় মাকে না হাটিয়ে গ্রামে নিয়ে গেছি। আমার মনে হয়েছে, মায়ের কস্ট হবে হেটে যেতে। মাকে কোলে নিয়ে হাটার কারনে আমার কম্বেট ইউনিফর্ম আমার ঘামে ভিজে একাকার হয়ে যেতো আর আমার মা আমার গলা ধরে আমার মুখের দিকে তাকিয়েই থাকতেন। কি জানি কি দেখতো আমার মা আমার মুখে এইভাবে তাকিয়ে থেকে? আমি মাঝে মাঝে মুচকি হেসে বলতাম, মা, কি দেখছো এইভাবে? মনে হতো, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোনো জিনিস আমি বইয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমার একটুও ক্লান্তি লাগে নাই। আমার মা যতোদিন বেচে ছিলেন, আমি এমন কোনো রাত কাটাই নাই যেই রাতে মায়ের ঘরে মা কিভাবে আছেন, ঘুমিয়েছেন কিনা, বা মায়ের কিছু লাগবে কিনা তা দেখার জন্য গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠি নাই এবং মায়ের রুমে যাই নাই। যদি দেখতাম, মা কোনো কারনে ঘুমিয়ে নাই, মায়ের পাশে বসেই মায়ের সাথে অনেক কথা বলতাম। মায়ের সেই ছোট বেলার মজার মজার কাহিনি। মায়ের সাথে আমার বাবার প্রেমের কাহিনি। মায়ের সাথে আমাদের গ্রামের কাহিনি। মায়ের সাথে আমাদের পুরু পরিবারের কাহিনি। মা বলতেন, মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি আমাদের পরিবারে এসেছিলেন। কখনো মা তার কাহিনী বলতে বলতে খিল খিল করে হাসতেন, আবার কখনো কখনো কোনো ঘটনা বলতে গিয়ে ঢোকরে ঢোকরে কাদতেন। আমি মায়ের অন্তরটায় পৌঁছে যেতাম সেই ছোট একটা বালকের মতো। মা আমার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে খুব আদর করতেন আর বলতেন, অনেক বড় হবি তুই। আমি তখন সেনাবাহিনীতে মাত্র মেজর। মাকে বলতাম, মা, আমার কেনো জানি মনে হয় আসলেই একদিন আমি অনেক বড় হবো, আমার অনেক টাকা হবে কিন্তু আমি সম্ভবত ওই দিন তোমাকে আর পাবো না। আমার লিমিটেড আয়ের মধ্যে আমি চেষ্টা করেছি মাকে সবচেয়ে ভালো জিনিসটা দিতে। আমি কখনো মনে পড়ে না যে, মাকে ছাড়া অফিস থেকে এসে একা লাঞ্চ করেছি। অনেক অনেক দিন আমি মাকে আমার নিজ হাতে খাইয়ে দিতাম। মা বড্ড মজা করে খেতো আমার হাতে। আজ মা নেই, কিন্তু আমি তার ভালোবাসা আজো অনুভব করি। পাপ্পু স্যারের মাকে দেখে আমার ঠিক সেই রকম একজন মহিয়সীর কথাই বারবার মনে পড়ে। আর পাপ্পু স্যারকেও আমি দোয়া করি তিনি যেনো ঠিক যা করছেন তাই করে যান মায়ের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত।

পাপ্পু স্যারের স্ত্রীর শাশুড়ির প্রতি ব্যবহার দেখে আমার স্ত্রীর আমার মায়ের প্রতি ব্যবহারের কথাই মনে পড়ে বারবার। আমি যেদিন প্রথম মাকে আমার ভালোবাসার মেয়েটির কথা জানিয়েছিলাম, মা মেয়েটি কেমন, কই থাকে, তার বাবা মা কি করে, তাদের সাংসারিক অবস্থা কি রকম কিছুই জিজ্ঞেস করেন নাই। শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। কে আগে ভালোবেসেছি। আমি নাকি মেয়েটি। বলেছিলাম, মেয়েটি সম্ভবত। কারন আমিও ভালোবেসেছি কিন্তু প্রথম চিঠিটি এসেছিলো ওর কাছ থেকে। মা আর কিছুই জানতে চান নাই। শুধু বলেছিলেন, সুখি হবি। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিভাবে এতো কনফিডেন্টলি এই কথা মা আমাকে বলতে পারলেন? মা শুধু একটা কথাই বলেছিলেন ব্যখ্যায়, যে তোমাকে ভালোবাসে, সে তোমাকে ছেড়ে যাবে না যদি তুমি না ছেড়ে যাও। সে তোমাকে ভালোবাসে।

অন্যদিকে, আমি আমার এই ছোট্ট জীবনে এমন মাকেও দেখেছি যে, তিনি ছেলেকে ভালোবাসেন, কিন্তু ছেলের বউকে হিংসা করেন, ছেলের সন্তানকে হিংসা করেন, তাদেরকে আদর করে কাছে টানেন না। ভাবেন, পরের বাড়ির মেয়ে, বেশী প্রশ্রয় দিলে যদি মাথায় উঠে যায়? ওইসব মায়েরা ভুলে যান তাদের অতিতের সেই দিনের কথা যেদিন তিনিও তার শশুড় বাড়িতে পরের বাড়ির মেয়ে হয়েই এসেছিলেন। এই সব মায়েরা ছেলে আর তার স্ত্রী, সন্তানের মধ্যে একটা ফারাক সৃষ্টি করে রাখতে পছন্দ করেন। আর শেষ বয়সে এসে এই সব মায়েরাই কোনো না কোনো ভাবে তার আদরের সন্তানদের কাছ থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়েন আর বলেন, তার সন্তানেরা মানুস হয়ে উঠে নাই। 

আবার এমন মাকেও দেখেছি, ছেলেকে তারা মুলধন মনে করে ছেলের বিয়েটাকে একটা ইনভেস্টমেন্ট মনে করেন। মনে করেন যে, পরের বাড়ির মেয়েটা হচ্ছে একটা শিকার, আর নিজের ছেলেটা হচ্ছে একটা শিকারী, আর বিয়েটা হচ্ছে একটা হাতিয়ার। এই সব মায়েরা না জানেন ছেলেদেরকে সপ্ন দেখাতে, না পারেন নিজেরা সপ্ন বুনতে। তারা একটা সময় বালুচরে অট্টালিকা বানানোর দিবা স্বপ্নে দিনশেষে শুধু একটি জিনিসই দেখতে পান, আর তা হলো, উত্থাল ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যাওয়া বালুর তট। 

পাপ্পু স্যারকে আমি অনেক অনেক দোয়া করি যেনো এখন যা আছেন, তাই যেনো থাকেন। আর দোয়া করি তার মহিয়সি মাকে যিনি সংসারের লক্ষি বউমাকে পরের বাড়ি থেকে এনে নিজের মেয়ের আসনে বসিয়ে চমৎকার একটি সংসার উপহার দিয়েছেন তার সন্তানকে। এমন মায়ের পায়ের তলেই হচ্ছে আসল স্বর্গ। স্বর্গটা আসলে মরনের পরে নয়। মায়ের পায়ের তলে সন্তানের স্বর্গ শুরু হয় মায়ের জীবদ্দশায়।

০৯/০৯/২০১৭-একটা সময়, ভাবতাম

Categories

একটা সময় ছিলো, ভাবতাম, আহা কবে বড় হবো? কবে নিজের ইচ্ছেমতো যা খুশী তাইই করবো? তখন আমার বয়স হয়ত ছিলো ১০ কি ১২।

আজ আমার বয়স ৫২ পেরিয়ে গেলো, ৫৩ তে পা রাখলাম। এখন আর ওই প্রশ্নটা করি না, কবে বড় হবো? কবে আমার সব থাকবে? টাকা পয়সা, গাড়ি বাড়ী সব। ভাবতাম, কবে আমি স্বাধীনভাবে যা আমার ইচ্ছে তাইই করতে পারব? সম্ভবত আজ থেকে কয়েক দশক আগে আজকের এই দিনের কথাটাই আমি ভেবেছিলাম।

আজ সেইদিন গুলি আমি অতিবাহিত করছি। কিন্তু!

আমি কি সব আমার ইচ্ছে মতো যা খুশী তাই করতে পারছি? আমার তো এখন আমি যা চেয়েছিলাম, সবই আছে। গাড়ী আছে, বাড়ী আছে, টাকাপয়সা যা আছে তাতে অন্তত আমার ইচ্ছেগুলি পুরন করার মতো সামর্থ্যও আমার আছে। তাঁরপরেও কি আমি স্বাধীন? আমি কি ইচ্ছে করলেই কয়েকদিন উধাও হয়ে যেখানে খুসী চলে যেতে পারি? আমি কি ইচ্ছে করলেই যা মন চায় করতে পারি?

আমি আজকে আরো পরাধীন। এই পরাধী এমন নয় যে, কেউ আমাকে বেধে রেখেছে। এমন নয় যে, আমি জেলখানার চার দেয়ালের মধ্যে বন্ধী হয়ে আছি। অথচ আমি বন্ধী আমার জাগ্রত বিবেকের কাছে, আমি বন্ধী আমার নীতির কাছে, আমি বন্ধী সমাজের নিয়ম কানুনের উপরে। এইখানে যখন যা খুশী সামর্থ্য থাকলেও করা যায় না।

আমি এখন আর বয়স্ক হতে চাই না। আমার ভয় লাগে। আজ যারা আমাকে ঘিরে নৃত্য করছে, যারা আমাকে নিয়ে তোষামোদি করছে, আজ যারা আমাকে স্বপ্নের সিড়ি হিসাবে ব্যবহার করে তাদের আখের গুছাচ্ছে, একদিন হয়ত তারাই আমাকে এমন একটা পরিস্থিতির সামনে দাড় করাবে, যখন মনে হবে, আজকের দিনের এইসব মানুষগুলির চেহারা আমার কাছে কোনোদিনই পরিচিত ছিলো না। তখন সময়টাশুধু আমার, আর আমার অতীতের।

আজ যাকে আমি হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছি, আজ যারা আমার কাধে ভড় করে পাহাড়ের ওই চুড়ায় উঠতে সহযোগিতা নিচ্ছে, আমি যদি আমার বয়সের ভারে আর ওই পাহাড়ের চুড়ায় আর উঠতে না পারি, আমি যত বড় অনুপ্রেরণার ব্যক্তিত্বই হই না কেনো, আমার স্থান আমি নিশ্চিত যে, পাহাড়ের ঢালেই হবে।

তাই মাঝে মাঝে মনে হয়, ওই পাহাড়ের চুড়ায় নয়, পাহাড়ের ঢালেই হোক আমার একাকিত্তের একটি ছোটনীড় যেখানে আর কেউ না থাকুক, কিছু অপরিচিত পথিক তো আশেপাশে থাকবে। হয়ত তারাই হবে আমার ওই সময়ের কিছু কথাবলার সাথী যারা ইতিহাস না জেনেই হয়ত আমাকে সঙ্গ দেবে।

সময় কাউকে ছাড় দেয় নাই এবং দেয়ও না। আর আগামিতে কখনো সে কাউকে ছাড় দিবেও না।  

২৮/০৮/২০১৭-ভবিষ্যৎ দেখতে পাই না

Categories

আমরা ভবিষ্যৎ দেখতে পাই না, আমরা মানুষের ভিতরের চরিত্রকে সরাসরি আয়নার মতো করে দেখতে পাই না। এমন কি আমরা নিজেরাও নিজেদের অনেক সময় চিনতে পারি না। আর এই কারনেই প্রতিবার আমরা প্রেডিকসন অর্থাৎ একটা স্যামপ্লিং এর উপর ভিত্তি করে বারবার সিদ্ধান্ত নেই। শতভাগ সাফল্য আসবে এর কোনো গ্যারান্টি নেই। আজকে যে বস্তুটি আপনার হাতে আসায় আপনি মনে করছেন, এটাই ঠিক যেটা আপনি চেয়েছেন, বা এটাই আপনি খুজছেন, সেটা সঠিক নাও হতে পারে।  আর যদি সঠিক না হয় তখন সংস্কার বা এজাস্টমেন্ট দরকার হয়ে পড়ে।  কখনো কখনো এই এডজাস্টমেন্ট এতো বড় যে, পুরু পরিকল্পনাটাই বদলাতে হয়। আর যারা এই পরিকল্পনাটা পাল্টানোর হিম্মত রাখেন, বাস্তবতা মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার হিম্মত রাখেন, তাদের জন্যই সুন্দর ভবিস্যত। সমাজ তারাই তৈরী করে, সমাজ তাদেরকেই কন্ডারী বলে। এডাপ্টেসন এর মুল থিউরী আসলে তাই। ডাইনোসোর এডাপ্টেসন করতে পারে নাই বলেই সে আজ পৃথিবীতে ইতিহাস কিন্তু তেলাপোকা সর্বত্র সব কিছুতেই এডজাস্ট করতে পারে বলেই এরা বেচে থাকে ৪৬ কোটি বছর। সম্ভবত এই তেলাপোকাই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আয়ুধারী কোনো প্রানী। এরা ওদের বাল-বাচ্চা নিয়ে ওদের মতো করে বেচে থাকে। ভালোই থাকে।

আজকে আমি বা আপনাকে কেউ ভুল বুঝতেছি বলে যে অভিযোগ করে, এটা হয়ত ঠিক এই রকম নয়। হতে পারে এই রকম যে, এখন আমি বা আপনি ভুল বুঝতেছি না, সময়ের ব্যবধানে, স্যামপ্লিং ভুলের কারনে আগেরবার ভুল হয়েছিলো, কিন্তু অন্যান্য স্যামপ্লিং, চারিপাশের অবস্থা, বেশী ফ্যাক্টর সমন্নয়ে আমি বা আপনি বর্তমানটাই ঠিক বুঝতেছেন। ফলে যারা অভিযোগ করছে, তারা ব্যাপারটা মেনে নিচ্ছেন না। আবার এমনো হতে পারে যিনি আমাকে বা আপনাকে “ভুল বুঝতেছি” বলে অভিযোগ করছেন, তার এক্সপেকটেশন অনুযায়ী সেও আমাকে বা আপনাকে আগেরবার ঠিক বুঝেছেন কিন্তু এখন তার এক্সপেক্টেসনের সাথে ক্যাল্কুলেসনে তারতম্যের কারনে আমরা বা আপ্নারা বদলে গেছি বা বদলে গেছেন এই চিন্তায় আমরা ভুল বুঝতেছি বলেই তাদের ডিডাক্সন তৈরী হচ্ছে।

কিন্তু যেটাই হোক, কে ভুল আর কে ঠিক, এই তর্ক, এই যুক্তি, এই ব্যাখ্যা করার সময় মানুষের হাতে খুব বেশি থাকে না। একটা সাব জেক্ট নিয়ে এতো গবেষণা করতে থাকলে, বাকী সাবজেক্ট এর জন্য তো সময় ই দেওয়া যাবে না। জীবনে সময় বড় সীমিত। হয় এডজাস্টমেন্ট করে বেচে যাবেন, নয় খপ্পর থেকে বেড়িয়ে যাবেন। দ্বিধার কোনো কারন থাকলে সবার প্রতিভা যেমন ক্ষতি হবে, তেমনি ক্ষতি হবে বিকাশের।

ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তে ভুল হলে যখনই মনে হবে এখনই সময় সিদ্ধান্ত পাল্টে জীবন সুন্দর করার, তাহলে “এখনি” সেটা। শুধু একটা জিনিষ মনে রাখা দরকার, ঈশ্বর সব ভুলের মধ্যে বড় সাফল্যের ফলাফল নির্ধারণ করেন। তিনি কারো সাথে মস্করা করেন না। তাঁর উপর ভরসা রাখুন। জয় আপনার। এটা দু পক্ষের জন্যই উপদেশ কারন, যার যার গন্ডি থেকে তাঁর তাঁর জন্য ঈশ্বর তাদের সীমানা নির্ধারণ করেন। কেউ কারো সীমানা অতিক্রম করলেই এই বিপত্তি হবে। নদীর জলের মধ্যেও ঈশ্বর তাদের সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। মিঠা পানি এবং নোনা পানিও তাদের সীমা অতিক্রম করে একে অপরের সাথে মিশার অনুমতি ঈশ্বর দেন নাই।

১০/০৮/২০১৭-সন্তান চেনা

Categories

কোথায় যেনো একবার পড়েছিলাম, ছেলেকে চেনা যায় যখন সে বিয়ে করে, মেয়েকে চেনা যায় যখন সে যুবতী হয়, বউকে চেনা যায় যখন স্বামী দরিদ্র অবস্থায় পতিত হন, আর স্বামীকে চেনা যায় বউ যখন গুরুতর অসুস্থ হন। আর সন্তানকে চেনা যায় যখন আপনি বৃদ্ধ হবেন। কিন্তু এই চেনা জানা করতে করতে আমাদের জীবনে আর সময় বেশি বাকি থাকে না। সৌভাগ্যের কাঠি নিয়ে যারা এই পৃথিবীতে জন্ম গ্রহন করে, তাদের বেশীর ভাগ মাতাপিতাই ধনী গোত্রের, কিন্তু সুখি জীবনের অধিকারী মানুষ গুলি সচরাচর মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ গুলিই ভোগ করে। এর কারন, তারা একে অপরের জন্য দুঃখ, ভালবাসা, হাসি, কান্না, অপেক্ষা, যন্ত্রনা, আনন্দ সব কিছু ভাগ করে নেয়।

অনেক মানুষকে বলতে শুনেছি, জীবনতো একটাই। একটা মানুষের একের অধিক গাড়ি থাকতে পারে, একের অধিক বাড়ি থাকতে পারে, একের অধিক ব্যাংকে টাকা পয়সা থাকতে পারে, এমন কি একের অধিক জীবন সাথীও থাকতে পারে, কিন্তু মানুষের জীবন তো একটাই। আনন্দ করুন, মন যা চায় তাই করুন, তারপর মরুন। আমার তখন জানতে ইচ্ছে করে, আনন্দ কোনটা? রাত জেগে জেগে টিভির পর্দায় একা একা নাটক, সিনেমা দেখাই কি আনন্দ? কিংবা ডিজিটালের যুগে সারাদিন ফেসবুক, চ্যাট, ইমু, গেমস, ভাইবার ইত্যাদি নিয়ে বসে থাকাই কি আনন্দ? কিংবা এসি রুমে মন খারাপ করে একা একা বসে থাকাই কি আনন্দ? কিংবা এসি গাড়িতে বসে দুরের কোনো পার্কে অপরিচিত কোন এক যুবক কিংবা যুবতীর জন্য ডেটিং করাই কি আনন্দ? অথবা আনন্দ কি এমন যে, সারাদিন হাসতে হাসতে সময় কাটানো? আর সেটাই যদি হয়, কতক্ষন? আনন্দ কি এটা যে, অন্যায় করে ভুল পথে অনেক টাকা রোজগার করা? কিংবা ব্যাংকে অনেক টাকা আছে, তো যখন তখন বিদেশে গিয়ে কোথাও লাঞ্চ, কিংবা কোথাও ডিনার, অথবা অন্য কোনো দেশে রাত যাপন করা? অথবা আনন্দ কি এইটা যে, গরীব মানুষদের সাথে, কিংবা নিজেদের থেকে একটু নীচের ক্লাসের পাশের বাড়ির প্রতিবেশীদের সাথে না মিশে শুধুমাত্র দেখে দেখে বড় লোকদের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করা? আনন্দ কি এটা যে, ঈশ্বরকে মানলাম না, বিজাতীয় কালচারে যা খুশি করা? আনন্দ কি এইটা যে, পরিবারের কোনো সদস্যদের সাথে কম্প্রোমাইজ আর এডজাস্টমেন্ট না করে শুধু নিজের যা খুসি ইচ্ছে মতো করা? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। আসলে আনন্দটা কি? কোনো কিছু আমার মনের মত হল না, আমি মানতে পারলাম না, আর আমি মানতেও চাই না, আমার যা মনে ধরবে সেটা করতে পারাই কি আনন্দ তাহলে? এ অদ্ভুত এক হিসাব।

আমার কাছে আনন্দে থাকাটা ঐ রকমের কিছু মনে হয় না। আমার কাছে মনে হয়, যখন কোন এক দুঃস্থ পরিবার লজ্জায় কারো কাছেই হাত পাততে পারে না অথচ তার সমস্যার অন্ত নাই, তখন আমার কোনো একটা হাসি, কোনো একটা হাত বারানর সাহাজ্য, কিংবা তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে তার দুঃসময়ের একটু সাথি হতে পারার মধ্যে যে আনন্দ, সেটাই আনন্দ। কিংবা অসচ্ছল কিংবা টেনেটুনে কোনো রকমে নিজের সৎ রোজগারের মধ্যে সীমিত আয়ের মধ্যে সবাইকে নিয়ে ভাগাভাগি করে একটা পর্ব পালন করার যে আনন্দ, সেটাই আনন্দ। অথবা হেটে হেটে রোদে ঘেমে, কিংবা ভিজে ভিজে দুই হাতে বাজার নিয়ে আপন জনের জন্য কিছু বহন করে বাসায় গিয়ে সবাই মিলে এক সাথে আনন্দ করে খাওয়ার যে ত্রিপ্তি সেটাই আনন্দ।

মানুষ কেনো কষ্ট পায়? টাকার অভাবে মানুষ কষ্ট পায়? কিংবা অনেক সম্পদ নাই, এইজন্য কি মানুষ কষ্ট পায়? অথবা কষ্টটা কি এই জন্য যে, সে যার যা খুশি সে মোতাবেক মনের আনন্দে কিছুই করতে পারে না? অথবা এমনকি যে, ঈদে, জন্ম বার্ষিকীতে, বিবাহ অনুষ্ঠানে, অথবা বড় বর শপিং সেন্টারে গিয়ে অনেক অংকের বাজার সদাই না করতে পারায় মনে কষ্ট? আমার কাছে এই রকম মনে হয় না। যদি তাই হতো, তাহলে যারা বিশ্ববিখ্যাত ধনি, যাদের অনেক টাকা আছে, সম্পত্তি আছে, যাদের এইগুলি বাস্তবায়ন করতে কোন বেগ পেতে হয় না, তারা সবাই সব সময় খুশি এবং সুখিই হতো। কিন্তু তারাও তো অনেক কষ্টে থাকে। কখনো পারিবারিক কষ্টে, কখনো শারীরিক কষ্টে, কখনো মনে আনন্দ নাই এই কষ্টে।

০৫/০৮/২০১৭-একটা সময় যখন মানুষ একা

একটা সময় আসে, যখন মানুষ একা থাকতে চায়। আবার একটা সময় আসে মানুষ যখন একাকীত্বকে ভয় পায়। আবার একটা সময় আসে মানুষ বুঝতেই পারে না সেকি একা থাকতে চায় নাকি মানুষের ভীড়ে থাকতে চায়? মানুষ তখন থাকে খুব ঘোরের মধ্যে। ঘোরের মধ্যে থাকা অবস্থাটা একটা বিপদজনক। এটা পশুদের বেলায় হয় না। তাদের পেট ভরা তো সব কাহিনী শেষ। সে তখন কোনো এক নির্জন জঙ্গলে গাছের নীচে একাই ঘুমিয়ে যায় যতোক্ষন তার পেট আবার ক্ষুধার ইঙ্গিত না দেয়। তাদের কাছে কৃষ্ণচূড়ার পাতার রঙ অথবা গোলাপের গন্ধ অথবা মরা জীবের কোনো অসহ্য ঘ্রান কোনো কিছুই বদল করে না। শীত এলে তারা গুহা খোজে, আশ্রয় চায়। বর্ষায় ওরা ভিজে ভিজে একস্থান থেকে অন্যস্থানে পায়েপায়ে অনেক দূর চলে যায়। কোথা থেকে এলো আর কোথায় গিয়ে থামবে, এটা নিয়ে ওদের কোনো মাথা ব্যথা নাই।
কিন্তু মানুষের বেলায়, সে সমাজ চায়, সে মানববসতি চায়। সে নদীর কুল চায়, চায় নদীর সাথে সাথে সভ্যতাও। এই সভ্যতার রেস ধরে মানুষ স্বপ্ন দেখে, ভালোবাসার কথা বলে। একজন আরেকজনের থেকে সুখি, আর খুসি হতে চায়। প্রতিযোগিতা বাড়ে। পছন্দ অপছন্দের হরেক পদের বং বাহারের যুক্তি তুলে কত যে নাটক, সিরিয়াল করে, তার কোনো ইয়ত্তা নাই। সুন্দর থেকে সুন্দরতমের তপস্যা চলে এই মানুষদের। আর এই তপস্যার অন্তরজালে কত কিছুই যে ব্যতিক্রম হয়, কেনো হয় কিভাবে হয় সে রহস্য সন্ধানেও আমরা বেশীরভাগ সময়ে ব্যর্থ হই। প্রতিযোগিতায় সুন্দুরী মেয়েরা সুখের ঘর হারায়, আবার সবচেয়ে অসুন্দর কোনো এক পঙ্গু মহিলা দিব্যি সুখে সংসার করে বেড়ায়। অশিক্ষিত কোনো এক মায়ের কোল ঘেঁষে দুনিয়া কাপানো সন্তানের জন্ম হয়, আবার সবচেয়ে পরিকল্পিত শিক্ষিত মায়ের কোলেই হয়ত বেড়ে উঠে সমাজের সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষটি। কেউ ভালোবাসে, অনেক সপ্নের ভিতর ডুব দিয়ে দিঘির জলের ভেসে বেড়ায়। কেউ কেউ আবার ঐ দিঘির জলের নীল চ্ছটায় কল্পনাকে ভাসিয়ে দিয়ে আকাশের নীলাভ মেঘ দেখে হয়ত ভাবে, কেউ কি তার জন্য অনেকদিন বাচতে চায়? কিংবা এমন কি কেউ আছে যে, তার সমস্তটা দিয়ে নিজের করে ভালোবাসে? সবুজ ক্ষেতের ধারে বসে কোন এক কল্পনায় কোনো এক অপরিচিত রাজপুত্রের সাক্ষাতে কত কথাই না বলাবলি করে। কিন্তু তা নিছক কল্পনার রাজ্যেই থেকে যায়। হয়ত কাউকে রাজপুত্র ভেবে মিথ্যা কোন প্ররোচনায় আবদ্ধ হয়ে সারাটি জীবন মিথ্যার মধ্যেই বসবাস করে। জানে, মনে কষ্ট, জানে হেরে গেছে, জানে এই পথ থেকে বেড়িয়ে যাবার আর কোনো রাস্তা নাই, তারপরেও জীবন তো, চলতেই থাকবে। কিন্তু কোথায় সে রাজপুত্র আর কোথায় গিয়ে এর শেষ? জোছনা রাতের চকচকে আকাশের তারার মেলায় পাখা মেলে ঝি ঝি পোকার মতো করে একগুচ্ছ ঝিনঝিন আওয়াজের মতো কতই না সঙ্গিত রচনা হয়ে আছে বুকের পাজরের মাঝে। যত্ন করে ধরে আছে ভালোবাসা। কিন্তু ঐ ভালোবাসা তো এক তরফা। যন্ত্রনা শুধু বাড়েই। ওটাই কি শেষ? এই মিথ্যা ভালোবাসায় কোনো অংশিদারিত্ত নাই, কম্প্রোমাইজ আছে কিন্তু এডজাস্টমেন্ট নেই, কান্না আছে অনুতাপের কিন্তু শান্তনা নাই, ব্যথা আছে কিন্তু বলার লোক নাই, এই ভালোবাসা শুধু খুসি রাখা আর কিছুই নাই। এখানে ভালোবাসার নির্ঘাত ভালোবাসার পচন ধরেছে। আর এই পচন শুরু হয়ছে অন্তর থেকে, তারপর শরীরে। আর যেদিন থেকে এই পচন শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই অস্থিত্তের পচন ধরেছে। এখন নিজের বাড়িতে, নিজের সমাজে, নিজের গন্ডিতে কেউ তার সাথে থাকতে চায় না। পরাজয় হয় সারা জীবনের।
যে ভালোবাসায় জিততে চায়, তাকে ভালোবাসা দিতে জানতে হবে। আর যে ঘৃণাকে জিয়িয়ে রাখতে চায়, তাকে সাফল্য এনে সেই জায়গায় যেতে হবে যেখানে তাকে স্পর্শ করার আর কারো ক্ষমতাও নাই। দুটুই কঠিন কাজ। কিন্তু এমনো কেউ আছে, যে ভালবাসল, সে হয়ত ভালবাসায় জিততেই পারলো না। এর মানে কিন্তু এই নয় যে, সে ভালোবাসায় হেরে গেলো। হয়ত সে ভুল জায়গায় ভুল জিনিসের সন্ধান করেছে। আজ কোনো এক ভাগ্যের গুনে যদি অনাকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা ফেরত যায়, কাল সে ভালোবাসার কাঙ্গাল হয়েই হারে। অথচ এমনো মানুষ আছে, কখনোই ভালোবাসা কি জিনিস নিজেও জানে না কিন্তু নিজের অজান্তেই সে লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে এমন করে স্থান নিয়ে আছে যে, চারিদিকে ভালোবাসা শুধু মৌ মৌ করে বেড়ায়। এরা এক সময় সমাজ নিয়ন্ত্রন করে, এরা এক সময় সবাইকে নিয়ন্ত্রন করে। আর যখন এটা কেউ মানতে নারাজ হয়, তখন মনে হয়, ঐ যে একবার চুপি চুপি ভালোবাসা এসেছিলো, সেটাই ছিলো জীবনের সবচেয়ে সস্থির সময় যা দেমাগ আর অশালীন ব্যবহারে মানুষ দূরে ঠেলে দিয়েছে। অনুতাপের আর শেষ থাকে না তখন।
আসলে এই পৃথিবীর কোনো কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নাই। আবার সব কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে। কেউ কবি হতে চায়, কেউ বৈজ্ঞানিক হতে চায়, কেউ অনেক ধনী হতে চায়, কেউ রাজনীতিক হতে চায়। আসলে এইগুলি ইচ্ছের উপর কিছুই নিরভর করে না। আবার এইগুলি যে ইচ্ছের উপর নির্ভর করে না, তাও ঠিক নয়। কারন কোথাও না কোথাও এর একটা রদ বদলের পালা আছে। কোথাও না কোথাও এই যোগসূত্রের একটা টার্ন আছে। যা কিছুদুর পর্যন্ত দেখা যায়, আর বড় অংশটাই আমাদের নজরের মধ্যে নাই। সবচেয়ে ট্যালেন্টেড ছাত্রটি আজ হয়ত কোথাও কোনো এক বড় অফিসের কেরানীর চাকুরী করে। অথচ যে সময়ে তাকে ট্যালেন্টেড ভাবা হয়েছিলো, সেটার গতিপথ পাল্টে আরেক দিকে টার্ন নেওয়ার কারনেই আজ সে সাফল্যের যে চূরায় উঠার কথা ছিলো তার থেকে অনেক দূরে। আবার এমনো হতে পারে, ব্যাকবেঞ্চে বসে থাকা সবচেয়ে নিরীহ ছাত্রটি আজ বিসসের কাছে এতোটাই সমাদৃত যে, কোনো সুত্রই মিলছে না। এই সুত্রটাই মিলাতে হবে। কারন কোন কিছুই হতাত করে হয়ে উঠে না। প্রকৃতি তার ধর্ম কখনোই পাল্টায় না। সেই একইভাবে, যে বালকটি একদিন কবি হতে চেয়েছিলো, সে হয়ত আজ সবচেয়ে বড় সমাজসেবি, যে একদিন সমাজসেবি হতে চেয়েছিলো, সে হয়ত আজ কারো কারো জন্যে ত্রাস। যা ঘটে তা সময়ের বিবর্তনের পালাক্রমে কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের মধ্যেই ঘটে। আজ যে রুপের কারনে আমি আপনি অহংকারী, মনে হয় পৃথিবী বুঝি আমার চরনতলে আছড়ে পড়লো। শত শত হিরো, শত শত সুশ্রী মানবীগন না জানি কতদিন কতরাত তাদের ঘুম হারাম করে রাত জেগে জেগে আমার কথা ভাবছে। এটা ভাবা সহজ। হয়ত এমনো হতে পারে, আমাদের এই আজকের দিনের সম্ভাব্য সবকিছু দেখেই কারো চোখ, কারো বুক, কারো লালসার অন্তরালে এমনই ভালবাসার জাল বানিয়ে অক্টোপাসের মতো ঘিড়ে ফেলেছে, যে, কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা ছলনা, বুঝাই দায়। যাকে তোমার আরধ্য, হয়তো দেখা যাবে তোমার চেয়েও অতি কুৎসিত কোনো রমনী তোমার আরধ্য কোনো পুরুষ তার শয্যাশায়ী। ব্যাপারটা হারজিতের নয়, ব্যাপারটা মতবাদেরও নয়, ব্যাপারটা অনেকাংশেই বৈষয়িক, আর কিছুটা তপ্ত বাসনা। ব্যাপারটা পছন্দেরও না অনেকাংশে । যে জামাটি আমি অপছন্দ করে দোকানে রেখে দিয়েছি, হয়তো ওই জামাটাই আরেকজন হন্যে হয়ে খুজছেন।
আজকে যে ট্রেনটায় আপনি উঠেছেন, সে ট্রেনের যে ব্যক্তিটি আপনার হাত ধরে তুলে নিলো, হয়ত সেই ছিলো আপনার সেই আরধ্য মানুষ। আপনি তাকে দেখেছেন কিন্তু হয়তো চিনতে পারেন নাই। কাল যখন আবার ট্রেনে উঠবেন, আপনি সেই ব্যাক্তিকে হয়ত আর কখনোই খুজে পাবেন না। সে অনেক দূর চলে গেছে।

৩/৮/২০১৭-সন্তান

Categories

পৃথিবীতে সকল সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে কাছের সম্পর্ক হচ্ছে সন্তানের সহিত বাবামায়ের। আবার কখনো কখনো এই সম্পর্কটাই সবচেয়ে বোরিং অথবা খুব বিপদজনক হয়ে যায়। বোরিং বা বিপদজনক হয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে, তিলেতিলে গড়ে উঠা দিনের পর দিন এই সম্পর্কটা এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় যে, পিতামাতা না পারেন তার সন্তানকে বুঝতে না পারে সন্তান পিতামাতাকে বুঝতে। পিতামাতা কি চায়, আবার সন্তানও ঠিক কি করলে কি হবে সেটাও বুঝাতে পারে না। কিন্তু এটা ঠিক, এই অবস্থায় সন্তানরা তাদের প্রেক্ষাপট থেকে যেটা বুঝায়, তাতে অনেক ভয়ংকর এমন কিছু থাকে যা পিতামাতার সবধরনের আশঙ্কা শুধু বাড়তেই থাকে। তারা শিহরিত হন সমাজের মানুষগুলোর কাছে মাথা হেট হয়ে যাবে এই আশঙ্কায়, তারা অস্থির হয়ে যান সন্তানের অমঙ্গল হবে এই আশঙ্কায়, তারা ভাবনার চরম দুশ্চিন্তায় হামাগুড়ি দিয়ে শুধু ভাবতে থাকেন এই অবস্থা থেকে পরিত্রানের উপায় কি ইত্যাদি।  

এমন একটা পরিস্থিতিতে মাতাপিতা থাকেন একটা মানসিক কস্টের মধ্যে। একদিকে আদর করে কথা বললেও সন্তানের মেজাজের কাছে হেরে যান, আবার শাসন করে কথা বললেতো ব্যাপারটা আরো সিরিয়াস দিকে টার্ন নিতে থাকে। সম্পর্কে একটা উত্তেজনা তৈরী হয়। ধৈর্যহারা পিতামাতা যেমন সন্তানের উপর থেকে তাদের আদর, মহব্বত, স্নেহ তুলে নিতে পারেন না, আবার সন্তানের উপরও ভরসা করতে পারেন না। আবার অন্যদিকে তারা না পারেন তাদের উপর পিতামাতার দায়িত্ব পালনে বিরত থাকতে। সন্তানের একগুয়েমী যখন চরমে উঠে, তখন পিতামাতা এক সময় হাল ছেড়ে দেন। সম্পর্কটা ধীরে ধীরে এমন জায়গায় গিয়ে দাড়ায় যা ক্রমাগত দূর থেকে দুরেই যেতে থাকে। 

যে সন্তানের জন্য পিতামাতা দিনের পর দিন অমানসিক, শারীরিক, দৈহিক সব ধরনের কষ্ট খুব হাসিমুখে সয্য করতে পেরেছেন, যে পিতামাতা নিজের আনন্দের জন্য কিছুই না রেখে সন্তানের জন্য সব অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন, বিলিয়ে দিয়েছেন তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সুন্দর সময়টা, সুন্দর ক্যারিয়ারটা। যে সন্তানের জন্য নিজে না খেয়ে, নিজের আহ্লাদ, স্বপ্ন কোনো কিছুই পূর্ণ না করে জমিয়ে রেখেছেন নিরাপদ সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য, যখন এই পিতামাতাই দেখেন তার সন্তানেরা তাদের জন্য একবিন্দু পরিমান মহব্বত, ভালোবাসা তাদের অন্তরের মধ্যে নাই, তাদের কথাবার্তায় এমন কিছু ফুটে উঠে যা ভয়ঙ্করের চেয়ে আরো কষ্টের, তখন মনে হয় জীবন পরাজয় বরন করেছে। তখন পিছনের সব কষ্ট, ত্যাগ, আহ্লাদ, অপূর্ণ ইচ্ছেগুলি একসাথে চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়ে শুধু বলতে থাকে, তোমরা কোনো ইতিহাস থেকেই শিক্ষা গ্রহন করো না। তোমরা এই শিক্ষাটা ভুলে গেছো যে, মানুষ একা এই পৃথিবীতে এসেছে, এবং তাকে একা চলার জন্যই ঈশ্বর সেইভাবে গড়ে তোলছেন। তোমাদের এতো কিছুর ত্যাগের কোনো প্রয়োজন ছিলো না। গোস্যা হয় তখন নিজের কাছে, বুকের কোথায় যেনো চিনচিন করে ব্যথা হয় তখন। চোখ ভিজে আসে। কিন্তু কারো উপর রাগ হয় না, রাগ হয় শুধু নিজের উপর। কোথায় যেনো একবার পড়েছিলাম, ছেলেকে চেনা যায় যখন সে বিয়ে করে, মেয়েকে চেনা যায় যখন সে যুবতী হয়, বউকে চেনা যায় যখন স্বামী দরিদ্র অবস্থায় পতিত হন, আর স্বামীকে চেনা যায় বউ যখন গুরুতর অসুস্থ হন। আর সন্তানকে চেনা যায় যখন বাবা মা বৃদ্ধ হবেন। কিন্তু এই চেনা জানা করতে করতে আমাদের জীবনে আর সময় বেশি বাকি থাকে না। এই ধরনের একটা পরিস্থিতি প্রতিটি মানুষের জীবনে হয়ত কখনো কখনো আসেই। এটা একটা চক্রের মতো। কারন, দশ বছর বয়সী কোনো সন্তানকে যদি জিজ্ঞেস করেন, সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি কে? সে বলবে, মা বাবা। যখন তার বয়স চৌদ্দ, সেই বাবা মাই তার কাছে খুব বিরক্তিকর মনে হয়। যখন তার বয়স আঠারো, সে আর বাসার পরিবেশটাকেই আর সহ্য করতে পারেনা, বেরিয়ে যেতে চায়, স্বাধীন জীবনের আশায়। বয়স যখন পচিশ, তখন সে বুঝতে পারে, হয়ত বাবা মাই ঠিক ছিল। ত্রিশ বছর বয়সে এসে অন্তরে এইটা ধীরে ধীরে প্রোথিত হতে থাকে, আহা, আমার ভুলের জন্য যদি বাবা মাকে সরি বলতে পারতাম। পঞ্চাশ বছর বয়সে, বাবা মাকে হারাতে খুব ভয় করে সন্তানের। সত্তর বছর বয়সে এসে বাবা মাকে খুব মিস করে এই সন্তানেরা। কিন্তু তখন আর তারা কেহই এই পৃথিবীতে বেচে নেই। সন্তানের বয়স যতই হোকনা কেনো, কখনো কখনো মনে হয়, বাবা মাকে খুব প্রয়োজন। এটা শতবছর বয়সী কোনো সন্তানের জন্যও প্রযোজ্য। সন্তান বুড়ো হয়ে গেলেও সে বাবা মায়ের কাছে শিশুই থেকে যায়। একমাত্র সন্তানই বুঝতে পারে মায়ের অন্তরের ভিতরে তার অন্তর কিভাবে প্রতিক্রিয়া করে। কারন সে সেখানে অনেক গুলি সময় অতিবাহিত করেছে। জীবনে একটা সময় আসে যখন সন্তানেরা বাবা মায়ের উপদেশকে আর বেদবাক্য মনে করে না বরং বাবা মাই হয়ে যান তাদের জীবনের আদর্শ। সেই সময় অবধি তখন আর বাবা মা তাদের পাশে বেচে নেই।   

মাঝে মাঝে ঐ কথাটা মনে পড়ে যে, সন্তানদেরকে ধনী হবার জন্য কোনো শিক্ষা দিতে নাই, সন্তানদেরকে শিক্ষা দেওয়া দরকার তারা যেনো বুঝে কোনটায় সুখি হওয়া যায়। আমরা এখানেই যেনো বারবার ভুল করি। আমরা সন্তানকে একাধারে কিভাবে ধনী হয়ে নিরাপদ জীবন পায় সেটাও দেখি আবার এটা দেখতে গিয়ে কিভাবে সুখি হওয়া যায় এই বিসয়টা অনেকাংশেই অবহেলা করি। আমাদের উচিত সন্তানদেরকে তাদের চেলেঞ্জগুলোকে মুখোমুখি হতে দেওয়া, তাদেরকে কোনো চেলেঞ্জ থেকে বের করে আনা কোনো মাতাপিতারই সঠিক সিদ্ধান্ত হয়ত নয়। পিতামাতারা তখনই নিজেদেরকে ধন্য মনে করবেন যখন তাদের হাত খালি থাকা সত্তেও তাদের সন্তানেরা দৌড়ে এসে তাদের বুকের মধ্যে আছড়ে পড়বে। এর থেকে আর কি ভালো হতে পারে কোনো পিতামাতার জন্য?  

একজন মা সন্তান জন্ম দেওয়ার বহু আগেই তার সন্তান আসুক এই প্রত্যাশায় বুকভরে শ্বাস নেয়। আর যখন সে পেটে আসে, তখন থেকেই একজন নারী মা হয়ে যান আর ঐ মুহূর্ত থেকেই সে তার অনাগত সন্তানের প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকেন। আর সন্তান জন্ম নেওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে সেই মা তার সন্তানের জন্য মরতেও প্রস্তুত হয়ে যায়। আর এটাই হচ্ছে মা যিনি নয় মাস সন্তানকে পেটে ধরেছেন, তিন বছর তাকে তার বাহুতে রেখেছেন আর সারাজীবন তার অন্তরের ভিতরেই রাখেন। একজন দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মা পৃথিবীর যে কোন গোয়েন্দা সংস্থার থেকেও সাফল্যবান কারন তিনি যা করেন সবটুকু কোনো শর্ত ছারাই তার সন্তানের জন্য করেন। তাতে কোনো খাদ নাই। যেদিন কোল ঘেসে সন্তান আসে, তখন তার নতুন আরেক নাম হয়। তার নাম হয় "মা"। মা ই একমাত্র মানুষ যে, সন্তানের কোনো না বলা কথা বলার আগেই বুঝে নেয়। একটা কৌতুক পড়েছিলাম, মায়েরা সবসময় চান, তার আদরের মেয়ে যেন তার থেকে ভালো স্বামী পায়, আর ছেলের বেলায় মা মনে করেন, ছেলে যেনো তার মতো একজন বউ পায়। এটা কৌতুক শুনালেও এর মাহাত্য একটাই, মা সব সময় সন্তানের সবচেয়ে মঙ্গলটাই চান। আমি বাবাকে উপেক্ষা করছি না। বাবা অন্যরকম এক চরিত্র। প্রতিটি বাবার কাছে তার মেয়েরা একজন প্রিন্সেস, আর ছেলে সন্তানেরা একেকজন প্রিন্স। একজন মেয়ে হয়ত তার জীবনে প্রিন্সেস পাবে কিন্তু বাবা আজীবন কাল তার কাছে রাজা হিসাবেই থাকেন। বাবা হচ্ছেন সন্তানের কাছে সেই ব্যাক্তি যার সুত্র ধরে অন্য কোন পুরুসকে মেয়ে বুঝতে পারে কতটা তফাত বা উন্নত। ছেলে সন্তানের কাছে বাবা হচ্ছেন একজন হিরো, আর মেয়ের কাছে প্রথম ভালোবাসা। আর এটাই হচ্ছে বাবা। একটা সময় হয়ত আসবে যখন "আয় তো মা, কাছে বস", এই কথাটা শুনার জন্যও মন ব্যাকুল হয়ে কোনো কারন ছাড়াই চোখ বিনা দিধায় অশ্রু বিসর্জন দিবে। "লাভ এট ফার্স্ট সাইট" এই আদর্শ বানীটি একমাত্র প্রযোজ্য শুধুমাত্র বাবা মায়ের আর সন্তানের ক্ষেত্রে। পঙ্গু, কালো, নাক বোচা, বেটে বোবা যেমনই হোক না কেনো, বাবা মা ই একমাত্র ব্যক্তিত্ত যারা সন্তানের আগমনে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে। সন্তান জন্ম দেওয়া পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ, বাবা মা হওয়াও খুব সহজ কিন্তু সেই বাবা মা হওয়া খুব কঠিন যা সন্তানের জন্য প্রয়োজন। আজ হয়ত আমাদের সন্তানেরা এই ভালোবাসা উপলব্ধি করবে না, কিন্তু যখন করবে, তখন তারা ইতিমধ্যে পিতামাতা। প্রতিটি সাফল্যবান সন্তানের পিছনে আছেন প্রথমে তার মা, পরেরজন তার বাবা। আমাকে কোনো সন্তান যদি কখনো প্রশ্ন করত, কি করে আমি খুব ভাল একজন সন্তান হবো? আমি হয়ত বলতাম, এই প্রশ্নটা তুমি তোমার দাদা-দাদি অথবা নানা নানিকে করো। হয়ত তারা এই প্রশ্নের উত্তর আমার থেকে ভালো দিতে পারবেন।  

লেখাটা একটা কৌতুক দিয়ে শেষ করিঃ 

মা যখন রান্না ঘরে রাতের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত, এমন সময় তার ছোটছেলে এসে তাকে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিলো। তাতে লেখা ছিলোঃ

গতকাল বাগানে ঘাস কাটার জন্য পাওনা - ৫ টাকা

আমার রুম পরিস্কার করার জন্য পাওনা - ১ টাকা

পাশের দোকান থেকে মায়ের আদেশে ডিম কিনে আনার জন্য পাওনা - ১ টাকা

আমার ছোট বোনকে ১ ঘন্টার জন্য একা বাসায় পাহারা দেওয়ার জন্য পাওনা - ৫ টাকা

ময়লাওয়ালাকে ময়লা তুলে দেওয়ার জন্য পাওনা  - ২ টাকা

স্কুলে ভালো মার্ক শীট পাওয়ার জন্য পাওনা  - ৫ টাকা

টেবিল চেয়ার মুছে দেওয়ার জন্য পাওনা  - ২ টাকা

সর্বমোট ২১ টাকা 

মা চিড়কুটটি পড়ে তার ছেলের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন এবং হাতমুছে একটা কলম নিয়ে লিখলেন 

৯ মাস গর্ভে ধারন করার জন্য - নো চার্জ (ফ্রি)

সারারাত তোমার জর আর কাশির জন্য একা একা যখন জেগে থাকা - নো চার্জ (ফ্রি)

খাবার বানানো- নো চার্জ (ফ্রি)

খেলনা কিনে দেওয়া- নো চার্জ (ফ্রি)                                  

নাক পরিস্কার করা, গোসল করান, পায়খানা প্রশ্রাব পরিস্কার করা ইত্যাদি- নো চার্জ (ফ্রি)

বিছানা ভিজিয়ে দেওয়ায় সারারাত নিজে ভিজা জায়গায় শুয়ে তোমাকে শুকনা জায়গায় রাখা  - নো চার্জ (ফ্রি)

এ ছাড়া আমার ভালোবাসা - নো চার্জ (ফ্রি) 

এই লিখে মা তার ছোট ছেলেটির হাতে চিড়কুটটি দিলেন। ছোট ছেলেটি যখন এই চিরকুটটি পড়ছিলো, তখন তার গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিলো। সে নিসচুপ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে একবার ভাষাহীন চোখে সরাসরি মায়ের দিকে তাকিয়ে শুধু এটাই বলতে পারলঃ 

মা আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। 

এরপর সে একটা কলম নিয়ে চিড়কুটিতে লিখলোঃ  

পেইড ইন ফুল

২৮/০৮/২০১৭-শিশুর একটা গ্রাম লাগে

Categories

একটা শিশু বড় করতে একটা গ্রাম লাগে। কথাটা বলেছিলেন আমার বড় ভাই কোনো এক সময়। তখন কথাটার অর্থ ভালো মতো বুঝতে পারিনি। আজ প্রায় দেড় দশক পরে এসে মনে হলো, কথাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং এর অর্থ অনেক বিশাল। আমার একটা ব্যাখ্যা আছে। একটা ছোট ছেলে শিশুকে দিয়েই একটা উদাহরন টানি।

যেমন ধরুন, একদিন বয়সের একটা ছেলেশিশু সে কথা বলতে পারে না কিন্তু সে ভালো ব্যবহার, আদর, আপ্যায়ন, মুখের অভিব্যক্তি, রাগ ইত্যাদির ইঙ্গিত খুব ভালো করে বুঝে। ফলে দেখবেন, আপনি হাসলে সেও হাসে, আপনি রাগ করলে সেও ভয় পেয়ে যায় ইত্যাদি। কিছু বাচ্চা কয়েক মিনিটের মধ্যেই অপরিচিত এক লোকের কোলে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠে আবার কিছু কিছু লোকের কাছে যেতেই চায় না বা কান্নাকাটি করে। ওই অবুঝ বাচ্চাটির কাছে কোন যুক্তি খাটে না, কে কি ভাবলো সে তাঁর পরোয়া করে না, তাঁর গলা ফাটিয়ে চিতকারে সে লজ্জাও পায় না। সে একেবারে খাটি অনুভুতি প্রকাশ করে।

সেই বাচ্চাটি ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে মায়ের সাথে, ঘরের অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের মধ্যেই বেশীর ভাগ সময় অতিবাহিত করে বলে যেহেতু বাচ্চারা খুবই সংবেদনশীল এবং অনুকরনপ্রিয়, ফলে অনেক অভ্যাস, অনেকগুন, অনেক বদগুন এবং অন্যান্য অনেক গুণাবলী এই বাসার লোকজনের কাছ থেকেই পেয়ে থাকে। স্বার্থপরতা, লোভ, দয়াশীলতা, রাগ, অভিমান, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিষ্ঠুরতাও এই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেই পায় বেশি। তারপরে সে যখন আস্তে আস্তে বাইরে যেতে থাকে, বন্ধুবান্ধব জোটে, ওই বন্ধুবান্ধবদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, তাদের পরিবারের থেকে পাওয়া ওইসব বাচ্চাদের অনেক গুনাবলীও এই বাচ্চাটি কিছু আমদানি করে ফেলে, রপ্ত করে ফেলে।। ফলে নেশাখোর বন্ধুর সাথে মিশলে, নেশায় পড়ে যায়, আবার ভালো বন্ধুদের সাথে মেলামেশায় অনেক উন্নত চরিত্রের অধিকারী হয়।

এখানে আরেকটা বিসয় খুব লক্ষ করা দরকার যে, আলোচ্য শিশুটির পারিবারিক সচ্ছলতার কিছুটা টানাটানিতেও শিশুটির অবুঝ মনে তাঁর অনেক আশা এবং প্রাপ্তির ঘাটতি থেকে যায় বলে তাঁরমধ্যে অন্য শিশুদের চাহিদা এবং তাদের প্রাপ্তির সাথে তুলনা করে সে নিজে নিজেও কিছুটা হতাশ গুণাবলীতে পেচিয়ে যায়। কেনো অন্য বাচ্চাদের এইটা আছে আমার নাই, কেনো অন্য বাচ্চারা যা চাইবে তাই পাবে অথচ আমি কেনো পাবো না ইত্যাদি। তাঁর এই হতাশ গুনাবলী একসময় বাড়তে থাকে এবং সে অন্যান্য শিশুদের তাদের চাহিদা মোতাবেক প্রাপ্তিকে নিজের বা নিজেদের না পাওয়ার ক্ষমতাকে অন্য বাচ্চাদের উপর তাঁর এক ধরনের ক্ষোভ, জিদ, ঘৃণা, কিংবা অপছন্দের কারন হয়ে দাঁড়ায়। তাতে নিজেদের অক্ষমতাকে না বুঝে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার প্রবনতাও বাড়তে থাকে। সমাজের উপর তাঁর ক্ষোভ, বাবা মায়ের উপর তাঁর রাগ, অথবা অপছন্দ কিংবা অশ্রদ্ধাবোধও বলতে পারেন বাড়তে থাকে। ব্যাপারটা এই রকম যেনো, কেনো অন্যবাচ্চারা সব পাবে আর আমি পাবো না। কেনো তাদেরই সব থাকবে আর আমার থাকবে না। কেনো আমার পরিবার আমার চাহিদার মতো সব কিছু দিতে পারবে না যেখানে তাঁরই সমবয়সী আরেক বাচ্চার সব কিছু থাকবে। এটা একটা স্যাডিস্ট ভাবধারা এবং এটা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। হয়ত সে নিজেও জানে না যে, এটা একটা খারাপ লক্ষন।

সচ্ছল বন্ধু বান্ধব্দের সাথে মেলামেশার সময় তাঁর মধ্যে না পাওয়ার প্রতিনিয়ত এই গোপন একটা রহস্যময় জিদ, রাগ কিংবা আচরন এক অন্যরকম চরিত্রে রুপান্তরীত করে ফেলে। আর এটা খুব সুপ্ত অবস্থায় তাঁর ভিতরে প্রতিনিয়ত স্থায়ী হতে থাকে। ইনফেরিওর কমপ্লেক্সে ভোগতে থাকে। ইনফেরিওর কমপ্লেক্স একটা রোগ। তাঁর সবকিছু পাবার একটা সুপ্ত বাসনা সবসময়ই মনের ভিতরে লালিত হয়। যারা নিজের চেস্টায় এই সুপ্ত বাসনাকে বাস্তবে রুপ দেওয়ার চেস্টা করে, তারা হয় পরিশ্রমী, কর্মঠ, এবং খুব হিসেবী। অনেকে এই হিসেবী গুনটাকে কেউ কেউ কিপ্টে বলেও ধরে নেয়। যাই হোক, এই নিজ চেষ্টায় সাধ পুরনের মানুষগুলির প্রতিটি ধাপে লক্ষ্য থাকে কিভাবে এই ঘাটতি নিজের চেষ্টায় পূর্ণ করবে। একসময় তারা সমাজের অনেক বড় একটা জায়গায় নিজেরদের জায়গা করে নেয়। কারন, তাঁর এতোদিনের পরিশ্রমের নীতীটা ইতিমধ্যে অভ্যাসে পরিনিত হয়ে যায় বলে সবসময় সে একই প্রকার পরিশ্রম করতেই থাকে। তাকে আর আটকানো যায় না। সে উঠতেই থাকে। পরিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি এটাই সে আবারো প্রমান করে দেয়। আর যারা এই সপ্ন লালন করে কিন্তু নিজের মেধা, পরিশ্রম দিয়ে এই বাসনা পূর্ণ করতে অলসবোধ করে, তারা সবসময় শর্ট খাট রাস্তা খুজে বেড়ায়। বিকল্প টার্গেট খুজতে থাকে। তারাই এক সময় নীতির বাইরে গিয়ে কাজ করে। অল্প পরিশ্রমে কিভাবে কোথা থেকে কি করলে বাসনাও পূর্ণ হবে আবার কস্টও করতে হবে না এই জাতীয় একটা সুযোগ খুজতে থাকে। এদের কিছুটা লজ্জা কম থাকে, এরা যে কোনো সময়ে নিজেদের স্বার্থে আচার আচরন পাল্টে ফেলতে পারে, এরা স্ট্যাবল থাকে না। যখন সে সুযোগ পায় বা টার্গেট পেয়ে যায় বলে ধারনা করে, তখন যতটা পারা যায়, ততোটাই তাঁর সদব্যবহার করার প্রবনতা থাকে।

এই টার্গেট খোজার ব্যাপারে সবচেয়ে সহজ পন্থা হচ্ছে, সচ্ছল পরিবারে কোনো না কোনো ভাবে ঢোকে পড়া।  অথবা কোনো না কোনোভাবে এমন একটা জবে ঢোকে পড়া যেখানে জবের দোহাই দিয়েই অন্যকে ব্যবহার করা যায়। যদি সচ্ছল পরিবারকে টার্গেট করে এই বাসনা পূর্ণ করার প্রয়াশ থাকে, তখন ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই রকম যে, চাইনা কিন্তু না দিলে মেজাজ খারাপ থাকে, চাই না কিন্তু দিলে কি হতো? চাইবো না কিন্তু দিবেন না কেনো ইত্যাদি। আর যদি জবে ঢোকে, তাহলে তো ব্যাপারটা যেনো তাঁর মামার বাড়ির হাড়ি পাওয়ার মতো। অন্যকে জিম্মি করে ফেলা এবং তাঁর থেকে ফায়দা লুটা। এই সব ব্যক্তিত্তের সবচেয়ে প্রধান বাহ্যিকপ্রকাশ যে, তারা তাদের সামর্থ্যের বাইরে  নিজেকে জাহির করে, রাগ করার যথেষ্ট কারন থাকা সত্তেও রাগ করে না (কারন রাগ করলে সুযোগ হারিয়ে যেতে পারে একটা ভয় থাকে), খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে, মিথ্যাটাকে সাবলিলভাবে উপস্থাপন করতে পারে যাতে মনে হবে সত্যি বলা হচ্ছে, স্বার্থের কারনে যুক্তির সাথে কথা বলতে পারে , বেশভুষা থাকে সুন্দর ফিটফাট, আর নিজের যা নাই, তাঁর থেকে বেশী দেখানোর প্রবনতা, সেটা যেভাবেই হোক। দেখা যায়, বাড়ির অনেক সমস্যা কিন্তু আইফোন চাই, সামর্থ্য নাই কিন্তু গাড়ি বাড়ি চাই। যোগ্যতা নাই কিন্তু সব পাবার আশা। এরা ধার করে হলেও অন্যকে আকৃষ্ট করার জন্য চাকচিক্য প্রদর্শন করে। এটা দরিদ্র আর ধনীর বাচ্চা বলে কথা নাই। এটা একটা ওরিয়েন্টেসনের অভাব। আর এই ওরিয়েন্টেসনটা প্রথমে আসে পরিবার থেকে। কিছুটা আসে সমাজের কিছু কিছু লোকের কাছ থেকে যাদের সাথে এই বাচ্চাটি ঘনঘন মেলামেশা করে। কিছুটা আসে পরিবেশ থেকে যে পরিবেশে সে চলাফেরা করে। আর এই পুরু ঘর থেকে শুরু করে অন্যান্য পরিবেশটাই আসলে একটা গ্রাম, একটা সমাজ।

এইসব মানুষগুলি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে মন থেকে শ্রদ্ধা করে না, কাউকে অন্তর থেকে সম্মান করে না, কাউকে আপন ভাবে না। এমন কি আজীবন কাল যে মাতাপিতা এদেরকে লালিত পালিত করেছে, তাদের প্রতিও এদের সম্মানবোধ থাকে না। তাদের কাছে প্রাপ্তিটাই বড়। সেটা যেখান থেকেই আসুক সেইই তাঁর কাছে প্রিয়, আর যখন দেখবে যে, কিছু পাবার আর আশা নাই, তখন তাদের চরিত্র আকস্মিকভাবে বদল দেখা যায়। তখন তাদেরকে আর আগের রুপে চেনা যায় না। এরা সব সময় সুযোগ খুজতেই থাকে। আর মজার ব্যাপার হলো, এরা সুযোগ পায়ও।  কারন মানুষের অভিজ্ঞতা সবার একরকম থাকে না বলে বারবার কিছু মানুষ সবসময়ই এই জাতীয় লোভী মানুষের খপ্পরে পড়েই যায়।

১৩/০৭/২০১৭-কোয়েলহোর shout in anger?  

Categories

ব্রাজিলের বিখ্যাত এবং বেস্টসেলার লেখক পাওলো কোয়েলহো তার বিখ্যাত why do we shout in anger? একটি লেখায় লিখেছিলেন, আমরা যখন রাগ করি, তখন এতো কাছাকাছি দুরুত্তে দাঁড়িয়ে থেকেও চেচিয়ে কথা বলি কেনো? তার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় তিনি একটা ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছিলেন যদিও ব্যাপারটায় শারীরিক অনেক হরমুনাল ব্যাপার স্যাপার থাকতে পারে। আর ওইটাই সম্ভবত অনেকটা বৈজ্ঞানিক কারন কেনো আমরা উত্তেজিত হলে কেউ কাছাকাছি থাকলেও আমরা চেচিয়ে কথা বলি। কিন্তু লেখক আরেকটি যুক্তি দাড় করিয়েছেন, সেটাও খুব অযৌক্তিক বলে ফেলা যাবে না। 

"দুটো মানুষ যখন একে অপরের উপর রেগে যায় তখন তারা একে অন্যের অন্তর থেকে দূরে সরে যায়। এই রাগ তাদের অন্তরের মাঝেও দুরত্ব সৃষ্টি করে। সেই দুরত্ব একটু একটু করে যত বাড়তে থাকে ততই তাদের রাগ বা ক্রোধ বেড়ে যায় এবং তখন তাদেরকে আরও চিৎকার করতে হয়, আরও জোরে তর্ক করতে হয়।"

-"আবার যদি আমরা ভেবে দেখি, দুজন মানুষ যখন একে অন্যের প্রেমে পড়ে বা ভালোবাসে তখন কী হয়? তখন ভালোবাসার বন্ধনে থাকা মানুষ দুজন একে অন্যের সাথে ধীরে ধীরে নরম স্বরে, আবেগ নিয়ে কথা বলে। কারণ যারা ভালোবাসে তারা একে অন্যের অন্তরের খুব কাছে থাকে। আর যারা অন্তরের কাছে থাকে তাদের কথা শুনতে হলে চিৎকার করার কোন প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি শুধুমাত্র ফিস্ ফিস্ করেও তারা তখন কথা বলতে পারে।"

"যারা আরও বেশি গভীরভাবে একে অন্যকে অনুভব করতে পারে, ভালোবাসতে পারে তখন কী হয় তা কি আমরা জানি?"-"অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার হলো, তাদের তখন ফিস্ ফিস্ করেও কথা বলতে হয় না। তারা দুজন যখন একে অন্যের চোখের দিকে তাকায় তখনই অন্তরের অনুভূতি, কথা, শব্দমালা সব অনুভব করে ফেলতে পারে। কারণ তখন তাদের অন্তর তাদের কে এক করে ফেলে। তাদের কথা হয় তখন অন্তরে অন্তরে।" 

২৭/০৬/২০১৭-বিংশ শতাব্দির চেহাড়া

Categories

এই বিংশ শতাব্দির আইটির দ্বারপ্রান্তে বসে যখন আমরা ডিজিটাল পৃথিবীর কথা বলছি, তখন আসলে আমরা এই ডিজিটাল বিশ্ব বলতে কি বুঝতেছি সেটা কি আদৌ কেউ সঠিকভাবে উপলব্দি করতে পারছি? আমার ক্ষুদ্র জ্ঞ্যানে যা মনে হয় তা হচ্ছে, এই পৃথিবী আইটির বদৌলতে অনেক এগিয়ে যাবে ঠিকই কিন্তু মানুষকে সেই আগের দিনের অনেক সিস্টেমে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। আগেরদিন বলতে আমি বলতে চাচ্ছি, ঠিক ঐ আগের দিনের কৃষকের চরিত্রে। (আমি এই কৃষক চরিত্রটি বলছি রূপক অর্থে প্রোডাকসন ইউনিটের মালিক হিসাবে)। সম্ভবত সমাজ ঐ দিকেই ধাবিত হচ্ছে। এবং বর্তমান আইটি সেটাই সংকেত দিচ্ছে।

ব্যাপারটা একটা উদাহরন দিয়ে যদি আরো খোলাসা করে বলি।

ব্যাপারটা এইরকম যে, আগেকার দিনে একজন কৃষক তার জমিতে সব ধরনের ফসল ফলিয়ে তাদের অধীনে কর্মরত কিছু লোকবল দিয়ে সরাসসি তার প্রোডাক্ট মার্কেটে অন্য ভোক্তার কাছে বিক্রি করতো। ফলে এই প্রোডাকসন ইউনিট (অর্থাৎ কৃষক আর ভোক্তাবর্গ সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে, কিছু কিছু মধ্যসত্ত্ব দালাল হয়ত এর মাঝে কাজ করেছে কিন্তু সেটা হয়ত একধাপ বা সর্বচ্চ দুইধাপ। অনেক ক্ষেত্রেই মধ্যসত্ত দালালী একেবারেই থাকতো না।) এর ফলে কি হয়েছে যে, কৃষক তার আইটেমের ন্যায্য মুল্যের কিছুটা বেশি হলেই ভোক্তার কাছে সরাসরি তুলে দিতে পারতেন। যদি মধ্যসত্ত্ব দালাল যোগ হতোও, তাহলে ভোক্তাকে কিছুটা হলেও বেশি দাম দিতে হতো কিন্তু সেটা সহনীয় পর্যায়েই ছিলো। কিন্তু যখন দালাল, মধ্যসত্ত্বভোগী কিছু সিন্ডিকেট এর মাঝে জড়িয়ে পরলো, ধাপে ধাপে পন্যের মুল্যও বাড়তে থাকলো এবং যত বেশি মধ্যসত্ত্ব দালাল, কিংবা যতো বেশি ইন্টারমিডিয়ারী কর্মচারী এই কৃষক আর ভোক্তার মাঝে যোগ হতে থাকলো, প্রতিটি আইটেমের মুল্য ক্রমেই বেড়ে চললো। আর ভোক্তাও বেশি চড়া দামে তা কিনতে বাধ্য হলো। এইসব সিন্ডিকেটের ফলে কোথাও মজুত এবং তারপরে চড়া দাম ভোক্তাকে গুনতে হলো। এর ফাকে আবার কোথাও কর্পোরেট অফিস স্থাপিত হলো যেখানে পন্যের মুল্য কোনো না কোনোভাবে বাড়ানোর পায়তাড়া শুরু হলো। কর্পোরেট অফিসের কারনে কেনো পন্যের দাম আরো বেড়ে গেলো? কারন কর্পোরেট অফিসের স্টাফদের পোষা অনেক খরচ। আর এই খরচতো ঐ ভোক্তাদের কাছ থেকেই আদায় হয়। কোনো কিছুতেই এই সব জাল, সিন্ডিকেট, গ্রুপ, কর্পোরেট কনসেপ্ট থামানো যাচ্ছিলো না। এখনো না।

কর্পোরেট অফিসগুলি কিভাবে কাজ করে? তারা অতি এক্সপার্ট কিছু জানেওয়ালা স্টাফ নিয়োগ করেন ধাপে ধাপে বা স্তরে স্তরে। একজনের থেকে আরেকজন, আরেকজনের থেকে আরেকজনের ধাপ। শ্রমিককে কন্ট্রোল করার জন্য ম্যানেজার, ম্যানেজারকে কন্ট্রোল করার জন্য এজিএম, এজিএমকে কন্ট্রোল করার জন্য ডিজিএম, ডিজিএম এর উপর আবার ইডি, ইডির উপরে ডিএমডি, এছাড়া তো কমারশিয়াল, মার্কেটিং, হিউম্যান রিসোর্স, কমপ্লায়েন্স, ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদি আছেই। ফলে প্রতিটি ধাপের স্টাফদের ভরন পোষণ তো ঐ পন্যের মুল্য থেকেই আসে। ভোক্তা যখন পন্যটি হাতে পান তখন কৃষকের উদপাদন মুল্য কিংবা তার দ্বারা বিক্রিত মুল্যের অনেক বেশি পরিশোধ করতে হয় ভোক্তাকে। আমের বাগান থেকে শুরু করে কসমেটিক্স সব কিছুতেই এখন কর্পোরেট ফর্মুলা চালু রয়েছে। কোনো সরকারপ্রধান ইচ্ছে করলেও এই পুরু সিন্ডিকেটটিকে চাপের মধ্যে রাখতে পারছেন না। দামও কমাতে পারছেন না। 

কিন্তু আইটির জগতে এই কাজটি একেবারে সহজভাবেই সমাধান হচ্ছে বলে আমার ধারনা। আর এই আইটি এই সিন্ডিকেটটিকে হাত কড়া পড়িয়ে তাদের একচ্ছত্র মনোপলি ব্যবসা থেকে বের করে দিতে পারছে বলে আমার ধারনা। যদিও ব্যাপারটা ঘটছে খুব ধিরে ধিরে কিন্তু প্রতিনিয়তই ঘটছে। এক সময় এটাই হবে সিস্টেম।

বর্তমানে আইটির কারনে এই প্রোডাকসন ইউনিটের মালিকগন সরাসরি ভোক্তার সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন যেটা এর আগে সম্ভব হচ্ছিলো না। মজার ব্যাপার হলো, যখনই প্রোডাকসন ইউনিটের মালিকগন সরাসরি ভোক্তার সাথে যোগাযোগ হয়, তখন প্রতিটি পন্যের মুল্য অবধারিত ভাবে কমে যায়। সেটা কিভাবে, আমি আরো সাধারন উদাহরন দিয়ে ব্যাপারটা বলি।

একটা সময় ছিলো(ছিলো বলছি কেনো, এখনো আছে),  আমাদের সমাজে ট্যাক্সি ক্যাব চালানোর জন্য অনেক অনেক এজেন্ট নিয়োগ থাকতো যারা মানুষের ব্যবহারের জন্য ট্যাক্সি ক্যাবের ব্যবসা করতো। ভোক্তা একটি গাড়ী ভাড়া করবেন, তো প্রথমে ট্যাক্সি ক্যাবের এজেন্টের কাছে তাদের ডিম্যান্ড প্লেস করবেন। এজেন্ট কিছু গাড়িওয়ালাদেরকে একত্রি করে একটা এসোসিয়েসন করবেন, সেই এসোসিয়েসনের লোকেরা আবার তাদের দ্বারা নিয়োজিত কিছু কর্মচারী নিয়োগ দেবেন ইত্যাদি। ফলে যার ট্যাক্সি, তিনি যা পাবেন, তার থেকে আরো বেশি হয়তো পাবেন এই মধ্যসত্ত্ব দালা বাহিনি বা এজেন্টগন। কিন্তু পরিশেষে কিন্তু এই সার্ভিসের পুরু মুল্যটা জোগান দিচ্ছে ভোক্তা নিজে। কিন্তু এই আইটির যুগে এসে “ঊবার” একেবারে অনলাইনে এইসব ট্যাক্সি ক্যাবের কন্সেপ্ট বা ব্যবসায় নিদারুন ধশ নামিয়ে দিলো। উবার হচ্ছে আইটির বদৌলতে একটি অন লাইন ট্রান্সপোর্ট সরবরাহকারী সিস্টেম। উবারের মালিক নিজেও জানেন না কে বা কারা এই সব গাড়ির মালিক। কিন্তু তারা এক্তি সিস্টেম। পুরুটাই অনলাইন ভিত্তক। যারা উবার সম্পর্কে জানেন, তারা আজকাল আর কোন ট্যাক্সি ক্যাবের জন্য কোন ভোক্তা এজেন্ট খোজ করার চেষ্টা করছেন না। শুধু ঊবারের নাম্বারটা থাকলেই হলো। গাড়ীওয়ালা আর ব্যবহারকারী সরাসরি যোগাযোগ। মাঝখানে অনেক এজেন্ট না থাকায়, অনেক স্টাফ নিয়োজিত না থাকায় শুধুমাত্র ঊবার এর তৈরী একটা আইটি ভিত্তিক সিস্টেমের কারনে ভোক্তা সল্প একটা পারসেন্টেজ উবারকে দিয়ে অনেক সহজে এবং তাড়াতারি আগের থেকে অনেক কমমুল্যে গাড়ির প্রয়োজনীয়তা মিটিয়ে ফেলতে পারছেন। তাহলে এতো ঘটা করে শতশত স্টাফ নিয়োগ করে ট্যাক্সি ক্যাবের এজেন্টগুলি ব্যবসা চালাবে কেনো? ফলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ওইসব ট্যাক্সি ক্যাবের ব্যবসা। উবারের কারনে আজকাল সবাই যারা ট্যাক্সি চালান, সবাই ট্যাকিক্যব এজেন্ট।

আরো একটা উদাহরন দেই, আজকাল অনলাইন মার্কেটিং চালু হওয়াতে অনেক মানুষ আর দোকানে গিয়ে পিজা হাটের পিজাই হোক আর ঈদের জামাকাপর, কোরবানীর গরু মহিষ, কিংবা ব্রান্ডের গাড়ি, অথবা নিত্য নৈমিত্তিক বাজার সদাইও কিনতে যান না। অনলাইনে অর্ডার দিচ্ছেন, দোকানদার গুটি কতক নিম্নবেতনের কর্মচারী দ্বারা তা ক্রেতার বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছেন। এতে যেমন সময় বাচে, পরিশ্রম বাঁচে, বাঁচে মাঝখানের দালালীর খরচ। এতে দুই পক্ষেরই লাভ। আর লাভ বেশি ব্যবহারকারীর।

এখানে আরো একটা মজার ব্যাপার ঘটছে অহরহ। আগে মানুষের চাহিদা ছিলো এক রকম। এখন চাহিদা অন্যরকম। গাড়ীটা পুরানো হয়ে গেছে? তো নতুন মডেলের আরেকটা গাড়ি কিনার শখ। একটা জামা ছয় মাস পড়েছেন? তো আরেকটি জামা না হলেই নয়। ফলে কোয়ালিটির পাশাপাশি পরিবর্তনের চাহিদাটাও বেড়েছে। একটি পন্য বেশীদিন ভোক্তা ব্যবহারও করতে চান না। তিনি চান নতুনত্ব। তাই ভোক্তা চান, কমমুল্যে ভালো একটা পন্য। আগে একটি পন্যের দাম নির্ধারণ হতো এর প্রোডাকশন খরচের সাথে মালিকের কিছু লাভের পারসেন্টেজের যোগে। এইসব সিন্ডিকেট, কর্পোরেট সিস্টেমের কারনে প্রতিটি ধাপেই লাভ এবং খরচ যোগ হয়, ফলে কয়েক দফায় যেমন খরচ বাড়ে, তেমনি কয়েক দফায় লাভের হারও বাড়ে। ফলে বর্তমানে এই প্রক্রিয়ায় প্রোডাকসন খরচের উপর লভ্যাংশ ধরে এবং মধ্যসত্ত্ব দালাল, কর্পোরেট সিস্টেম ইত্যাদির বাড়তি খরচ যোগান দিতে গিয়ে কোনো পন্যের মুল্য নির্ধারণ অনেকাংশে খুব সহজ মনে হচ্ছে না বরং রিস্কের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। ফলে, বর্তমানে সরবরাহকারীগনও ক্রেতার পন্য ক্রয়ের ক্রয়ক্ষমতা এবং চাহিদার উপর মুল্য নির্ধারণ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কিভাবে? একদিকে কর্পোরেট সিস্টেমে দাম কমানো যাচ্ছে না তাদের ওভারহেড খরচ বেড়ে যাওয়াতে, আবার অন্যদিকে কোথাও কোথাও ভোক্তা এবং ক্রেতা সরাসরি সমন্নয় হবার কারনে একই পন্যের মুল্যে বেশ তারতম্য দেখা দিচ্ছে। যেখানে পন্যের মুল্য কম, ভোক্তা সেখানেই ঝোঁকে যাচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে, যে পন্যটি বাংলাদেশের এক দোকানদার ভারত থেকে কিনে এনে এদেশের ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেন, তখন তার মুল্য বেড়ে দাড়ায় প্রায় তিন থেকে চার গুন। ভোক্তা যখন তার হিসাব কিতাব করে দেখেন যে, যদি ভোক্তা নিজেই ভারতে গিয়ে পন্যটি কিনেন তাহলে তার যাতায়ত ভাড়া, থাকা খাওয়ার সব খরচ বাদ দিয়েও লাভে থাকেন। তাহলে কেনো ভোক্তা এদেশে বসে এদেশের বিক্রেতার কাছ থেকে বেশি দামে পন্যটি কিনবেন? তিনি নিজেই পাড়ি দিবেন ভারতে। অথবা এই আইটির বদৌলতে যদি তথ্যটি ভোক্তা পান এবং অনলাইনে পন্যটি হাতে পাবার সুযোগ পান, তাহলে তো আর শারীরিক কষ্টও করতে হবে না। সরাসরি নিজের ঘরে পৌঁছে যাবে তার পন্যটি। যার ফলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের বিক্রেতা তার পন্যের মুল্য আগের তুলনায় কমাতে বাধ্য হবেন। কিন্তু কিভাবে কমাবেন? বিক্রেতা দাম কমানোর জন্যে মাঝখানের যেসব স্টাফ, দালাল, কিংবা ওই যে এক্সপার্ট লোকবলের ব্যয়ভার, সেখানে তিনি হাত দিবেন। আর যখনই ওখানে হাত দিবেন, সরাসরি কিছু ইন্টারমিডিয়ারী লোকবল, স্টাফের চাকুরী যাবে। তিনি পর্যায়ক্রমে ধাপ কমিয়ে দিবেন। দুইটা অফিসের জায়গায় যদি একটা অফিস দিয়েই ব্যবসা কিংবা অফিস চালানো যায়, কিংবা দশজনের জায়গায় যদি পাঁচজন দিয়ে কাজ চালানো যায়, কিংবা জোনাল অফিস, এরিয়া অফিস ইত্যাদি বাদ দিয়েও যদি খরচ কমানো যায়, তিনি তাই করবেন। কারন পন্যের দাম কমাতেই হবে। তাহলে এখানে প্রশ্ন আসে, এইসব ইন্টারমিডিয়ারী লোকবল ছাটাইয়ের কিংবা সেটআপ কমানোর ফলে শতভাগ কাজ চলবে কিভাবে? তাহলে কি এক্সপার্টদের আর প্রয়োজন নাই? না, এক্সপার্টদের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। এর বিকল্প হিসাবে হয়ত দেখা যাবে একজন অতি গুরুত্তপূর্ণ এক্সপার্ট দিয়েই অনেকগুলি কর্পোরেট অফিস চলবে। অথবা হয়তো এই এক্সপার্ট লোকজন ফ্রি ল্যান্স হিসাবে কাজ করবেন সাব কন্ট্রাক্ট হিসাবে অনেক গুলি লোকের জন্য এক সাথে। আর এদের সংখ্যা খুব বেশি হবে না। ফলে বর্তমানে নিয়োগকৃত নিজস্ব এক্সপার্টের আর প্রয়োজন রাখার যুক্তিযুক্ত মনে করবেন না কর্পোরেট অফিসগুলি।

এখানে আরো একটা উদাহরন দেই ব্যাপারটা সহজ করে বুঝানর জন্য।

একটা সময় হয়ত খুব বেশি দেরী নাই যখন মানুষজন আর মোবাইল ফোনের কোম্পানী গুলিকেও টাকা দিয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করবেন না। কারন যে হারে ভাইবার, হোয়াটস আপ, স্কাইপ কিংবা অন্যান্য সোস্যাল মিডিয়া চালু হয়েছে এবং হচ্ছে সারা বিশ্বব্যাপি, তাতে আর মোবাইল ফোন অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজন পড়বে না। যে কাজটি আমি ভাইবার দিয়ে, স্কাইপ দিয়ে, কিংবা ফেসবুকের সিস্টেম দিয়ে অথবা হোয়াটস আপ দিয়ে সমাধা করতে পারছি, কেনো আমি অযথা মোবাইল ফোনে টাকা খরচ করে সেই একই কাজটি করবো? কে তখন আর ইন্টারনেট কিনবেন, কিংবা মোবাইল ব্যালান্স কিনবেন, যেখানে একটা এমএমএস দিয়েই ভাইবার কিংবা হোয়াটস আপ কিংবা স্কাইপ দিয়ে সেই একই কাজটি করতে পারে! আপাতদৃষ্টিতে কিন্তু এর প্রভাব ইতিমধ্যে মোবাইল কোম্পানিগুলিতে পড়তে শুরু করেছে। একটার পর একটা মোবাইল কোম্পানি তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন, অথবা কয়েকটি মোবাইল কোম্পানি মিলে একসাথে মিলিত হয়ে, যুগ্ম এক্সপার্ট নিয়োগ করে তাদের ব্যবসায় অনেক স্তরের কর্মচারী ছাটাই করছেন বা গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের ব্যবস্থা করে লোকবল কমিয়ে দিচ্ছেন। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াবে যে, গ্রামীনফোনের এক্সপার্ট দিয়েই কম্বাইন্ডলি রবি মোবাইল চলবে, কিংবা একজন এক্সপার্টই দুই কোম্পানীর জন্য ফ্রিল্যান্সার হিসাবে কাজ করবেন। তখন আর ইন্টারমিডিয়ারী স্টাফ, ইঞ্জিনিয়ার, এডমিন কিংবা সিস্টেম ম্যানেজারের কোনো পদও থাকবে না। ফলে কর্পোরেট ইউনিটের মাঝখানের অধিকাংশ ইন্টেলেকচুয়ালস, বা এক্সপার্ট বর্গবৃন্দের সংখ্যাটা অনেক অংশে হ্রাস পাবে। কস্টিং মুল্য অনেক কমে যাবে। আজ যারা এসি রুমে বসে বুয়েট পাশ করে, কিংবা বিদেশী ডিগ্রী নিয়ে সাহেব হয়ে নামীদামী অফিসগুলোতে টাই পড়ে হাতের ইশারায় কিংবা নাক উচু করে পায়ের উপর পা তুলে কাজ করছেন, তখন ছাটাই করা এইসব লোকগুলি কোথায় যাবে? তারা তো আর কৃষকের মতো হাটে ঘাটে, এসি বিহীন রুমে কাজ করতে অভ্যস্থ নন। কিংবা তিনি যেই বিষয়ে ডিগ্রী নিয়েছেন, তার বাইরে তো আর কোন কাজও শিখেন নাই!! তাহলে তাদের গন্তব্য কি? আসলে, তাদেরকেও কোনো না কোন প্রক্রিয়ায় একটা সময় কোনো না কোনো প্রোডাক্টিভ ইউনিট খুজে বের করতে হবে যেখানে ওইসব ঘর্মাক্ত গন্ধের মানুষগুলির সমপর্যায়ে এসে দাড়া করাবে তাদের এবং এদেরকে প্রোডাকসন ইউনিটের সেইসব করমচারীর মর্যাদায় নামিয়ে দেবে যারা টাই পড়ে কাজ করেন না অথবা সকাল আত তায় অফিসে আসেন ঠিকই কিন্তু কখন বাসায় যাবেন তার সঠিক সময় তারা জানেন না। কারন ওটা প্রোডাকশন ইউনিট।   

এই ব্যাপারটা সর্বত্র ঘটবে। ঘটবে কৃষি খাতে, ঘটবে শিল্প খাতে, ঘটবে সব জায়গায়।

এইভাবে আস্তে আস্তে মানুষের বিদেশ ভ্রমনও কমে যাবে। এয়ারলাইন্সের ব্যবসায়ও অনেক প্রভাব পড়বে। যেমন ধরুন, যেই কাজটা করার জন্য আমাকে ব্যংকক, সিঙ্গাপুর যেতে হতো, সেটা আর না করে তথ্য আদান প্রদান, ফাইল চালাচালি, তার উপরেই সিদ্ধান্ত গ্রহন অনেক দ্রুত এবং সহজ হয়ে যাবে। তাহলে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে কেনো এয়ারলাইন্সের অফিসে লাইন দিয়ে লোকজন টিকেটের ধান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে? এরমানে এই নয় যে, সবকিছুই বন্ধ হয়ে যাবে। আমি বলতে চাচ্ছি যে, সিস্টেম পালটে যাবে। মধ্যসত্ত্ব স্তরের কর্মীবাহিনী অনেক অংশে হ্রাস পাবে। সবই থাকবে কিন্তু তখন সবাই হয় ভোক্তা আর না হয় সরবরাহকারী। আর এইসব সম্ভব হবে শুধুমাত্র ডিজিটাল যুগের যখন একচ্ছত্র লিডারশীপ চলবে। তখন কৃষক তার ধানবিক্রির  জন্য আর মাঝখানের দালালদের সাহাজ্যের প্রয়োজন মনে করবে না সিন্ডিকেট থাকবে না, ইন্তারমিডিয়ারী লোকবলও থাকবে না। সে নিজেই মালিক, নিজেই জি এম, নিজেই কমার্শিয়াল, নিজেই মার্কেটিং অফিসার এবং তার সাথে কিছু হেল্পিং হ্যান্ডস। এতে যেমন উৎপাদনকারী তার ন্যাজ্য মুল্য পাবেন, আবার ভোক্তাও পন্যটি অনেক কমদামে ভোগ করতে পারবেন। আর ঠিক এটার মাধ্যমেই কস্টিং কমিয়ে ফেলা সম্ভব হবে। এতে করে কি হবে সেই সব কর্পোরেট অফিশিয়ালদের? কি হবে জব মার্কেটের?

কর্পোরেট অফিসগুলি এখন যেসব এক্সপার্ট ইন্টেলেকচুয়ালগুলি নিজস্ব অর্থায়নে লালন পালন করছেন, সেইসব ইন্টেলেকচুয়াল গুলির সাপোর্ট নেবার জন্য কর্পোরেট পলিসি করবেন। হয়ত দেখা যাবে কয়েকটা কোম্পানি মিলে একটি বিসেস এজেন্টের কাছ থেকে সাবকন্ট্রাক্ট বেসিস সাপোর্ট নেবেন। থার্ড পার্টি সোরসিং হবে বেশি বেশি। হাইলি কোয়ালিফাইড ব্যক্তি না হলে আজকাল কর্পোরেট অফিসগুলুতে যেসব এক্সপার্ট চাকুরি করছে তারা চাকুরী হারাবেন। আর এই চাকুরী হারানো ব্যক্তিগুলি তখন কি করবেন? তারা শেষমেস কোনো না কোনো প্রোডাক্টিভ ইউনিটেই কাজ নিতে বাধ্য থাকবেন যেখানে আজকের পরিবেশ আর পাওয়া যাবে না। হোক সেটা কোন মুজার কারখান, বা হোক সেটা কোন রুমালের কারখানা, কিংবা হক সেটা কোনো আম বাগানের আমের ফলনের ব্যবসা। যার ফলে এখন এইসব স্টাফদের উচিত শুধুমাত্র কর্পোরেট অফিসে এক্সপার্ট হিসাবে নিজেকে নিরাপদ মনে না করে বর্তমান কাজের পাশাপাশি এমন কিছু স্কিল তৈরী করা যাতে টাই না পড়ে একেবারে লেবার শ্রেনিতে গিয়ে কাজ করার ক্ষমতা রাখা। সবাইকে শ্রমিক হতে হবে। হাইলি কোয়ালিফাইড এবং সবচেয়ে ভালো র‍্যাংকে না থাকতে পারলে কেহই কাউকে কর্মসংস্থানে আপ্যায়ন করবেনা। তখন একমাত্র ভরসা শ্রমিক হিসাবে কাজ করার মানসিকতা। এই পর্বটি ঠিক এখনি বুঝা যাবেনা। হয়ত এটা ২০২০ সালের মধ্যে ঘটবেই। জব মার্কেট বলে কিছু আর থাকবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। আর যারা জবে থাকবেন, তারা হচ্ছেন এতোটাই কোয়ালিফাইড যে, তাদের ছাড়া এই তথ্যলাইনের কাজও হয়তো হবে না। আর তারা হচ্ছেন ভোক্তা এবং সরবরাহকারীগনের সমন্বয়ক এবং সিস্টেম চালু রাখার একমাত্র বাহক। তাদের লাগবেই। ওটা জব নয়, ওরা সিস্টেম।

একটা সময় হয়ত আসবে যে, পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রীধারী একজন মানুষ হয়ত নিজেই একটা গাড়ি কিনে ট্যাক্সি ক্যাবে চালকের ভুমিকায় আছেন, অথবা বুয়েট থেকে পাশ করে হয়ত দেখা যাবে তিনি তার ক্ষুদ্র কোনো একটি প্রোডাক্টিভ ইউনিট চালাচ্ছেন।

ওইসময় যা ঘটবেঃ

(১)  ডিজিটাল যুগে প্রোডাক্টিভ ইউনিটগুলির মালিকগন হোক সেটা ধান চাষ করার কৃষক, অথবা অতি বড় মাপের কোনো গারমেন্টস ব্যবসায়ীই, তারা মার্কেটিং এ একই কাতারে চলে আসবেন। কোনো দ্বিতীয় মাধ্যম কাজ করবে না।

(২)   ভোক্তা এবং সরবরাহকারী সরাসসি যোগাযোগের কারনে দালালবাহিনী বিলুপ্ত হবে। পন্যের দামও কমে  আসবে।

(৩)   আইটির কারনে অনেক কিছুর বিলুপ্ত হবে যেমন বিলুপ্ত হয়ে গেছে ডিভি, ফ্লপি, সিডি, ক্যাসেটপ্লেয়ার, ক্যামেরা, ইত্যাদি পন্য। আজকাল রেডিও একটা ইতিহাস, আজকাল হাতের ঘড়িও হয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের মতো।    লাইব্রেরী হয়ে যাচ্ছে কম্পিউটার।

   

(৪)  ইনফরমেসন একেবারে হাতের মুঠোয় সবসময় মজুত থাকায় মার্কেটিং কন্সেপ্ট আর লোকাল এলাকা ব্যপ্তি না  হয়ে গ্লোবাল এরিয়াতে চলে যাবে। তখন চাঁদপুরের এক কৃষক নাইজেরিয়ার আরেক ধান আমদানী ব্যবসায়ির কাছে সরাসরি তার পন্য বিক্রিতে জড়িয়ে পড়বেন।

(৫)   মধ্যসত্ত্বভোগী এজেন্ট বা দালাল কিংবা কর্পোরেট অফিসের বর্তমান কন্সেপ্ট পুরুপুরি বদলিয়ে আরেক ধাপে উন্নিত হবে। তখন যারা থাকবে তারা সবাই মালিকপক্ষের লোক আর তাদের সাহাজ্য করবে  একদল থার্ড পার্টি।

(৬) বেকার লোকের সংখ্যা সাময়িক সময়ের জন্য বেড়ে যাবে বটে কিন্তু অচিরেই লোকজন এই সিস্টেমের সহিত   খাপ খাওয়ানোর জন্য সবাই প্রোডাক্টিভ কন্সেপ্টে এডজাস্ট করবে। যারা এখনি শুরু করেছেন,  তারা অনেক দূর এগিয়ে যাবেন, আর যারা শুরু করেন নাই বা ভাবছেন না, তারা অনেক চড়াই উতরাই দিয়ে পার হবেন।

(৭)  ব্যাংকিং সেক্টরে অভুত পরিবর্তন আসবে। সেটা কিভাবে? সেটা হচ্ছে কারেন্সি কন্সেপ্ট। এই কারেন্সি কনসেপ্টে কারেন্সির পরিবরতে পন্য হয়ে উঠবে প্রধান আদান প্রদানের মাধ্যম। এক দেশের তেল দরকার, আরেক দেশের ধান দরকার। জাস্ট বিনিময় হয়ে যেতে পারে পন্যটি। মাঝখানে শুধু পন্য বিনিময়ের মুজুরীটুকু থাকতে পারে।

(৮)  নারী পুরুসের ভেদাভেদে অনেক পার্থক্য কমে আসবে। কারন এখন যেমন ব্যবসা কিংবা এই জাতীয় কোন  সেক্টরে পুরুষের আধিপত্য বেশি কারন সর্বত্র কোথাও না কোথাও নারীদের জন্য সবকিছু সহজ  মনে হয় না। কিন্তু তখন এই কঠিন পরিবেশটি নারীদের জন্য সহজ হয়ে আসবে। 

তাহলে কি করা উচিত?

(১)  প্রতিটি মানুষের উচিত এখন জাপানের মতো প্রোডাক্টিভ ইউনিটে কাজ করা যায় সেই মোতাবেক শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশের আইন তৈরী করা।

২)  দেশ করুক বা না করুক, প্রতিটি পরিবারের উচিত তার সদস্যদেরকে এমন কিছু কিছু সেক্টরে প্রশিক্ষন দেওয়া যাতে ভবিস্যতে শুধু করপরেট সংস্থায় কাজ করার জন্য তৈরী না করে নিজেরা নিজেরা কিছু   কিছু প্রোডাক্টিভ ইউনিটের ব্যবস্থা করা অথবা প্রোডাক্টিভ ইউনিটে কাজ করতে পারে সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে নিজেদের সদস্যদের তৈরী  করা।

(৩) একের অধিক লাইনে এবং পুরুপুরি ভিন্ন প্রকৃতির কাজের জন্য নিজেকে তৈরী করা। আজ কর্পোরেটে আছে, আগামিকাল শ্রমিক হতে তাতে কোনো বাধা থাকবে না এবং সেটা করতে পারার সক্ষমতা।

(৪)   বর্তমানের কর্পোরেট অফিস গুলোর দিকে চাকুরীর জন্য না তাকিয়ে নিজেরা কিছু করা।

 সত্যি সত্যি জব মার্কেট ছোট হয়ে আসছে। এর পরিবর্তন বুঝা যাবে আগামি কয়েক বছরের মধ্যেই।

১১/০৫/২০১৭-অনেকদিন পর লিখতে বসেছি

Categories

 

অনেকদিন পর লিখতে বসেছি। মনটার চেয়ে শরীরটা আরো বেশি খারাপ বলে মনে হচ্ছে। অধিক পরিশ্রমের চেয়ে মানসিক টেনসনের কারনেই শরীরটা বেশি খারাপ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। সারাদিনই ক্ষুধা থাকে, কিন্তু ভালো খেতে পারছিনা, সিগারেট খাওয়ার পরিমানটা অনেক অনেক বেশি বেড়ে গেছে।

জীবনের এতোগুলো বছর চারি পার্শের সমস্ত কুরুক্ষেত্র জয় করে যখন একটা জায়গায় স্থির হয়েছি, ঠিক সেই সময়ে ইদানিং মাঝে মাঝে কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে এমন কোনো জায়গায় হারিয়ে যাই, যেখানে আমাকে কেউ চিনবেনা, আমিকে, কোথা থেকে এসেছি, কেউ জানবে না আমার আসল পরিচয় কি। আমিও আমার আগের সব স্মৃতি, পজিসন, জীবনধারা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা সব ভুলে গিয়ে কোথাও একদম একা একা বাকি সময়টা কাটিয়ে দেই। না থাকুক আমার চাকুরি কিংবা ব্যবসা, না থাকুক আমার এসিরুম, না থাকুক আমার বসগিরি, কি যায় আসে? হয়ত কারো বাসায় দিন মজুর হিসাবে খেটে দেওয়ার বদলে তিনবেলা খাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেলেই হলো। অন্তত রাতে মানসিক যন্ত্রনা ছাড়া ঘুমাতে পারবো। নাহোক সেটা কোন খাট অথবা তোষকেমোড়ানরম বিছানা। হোক না সেটা পরিত্যক্ত কোনো গ্যারেজের অংশ। হয়ত মনিব জান্তেই পারবেনা, কি মানুষটি কি অবস্থায় কি কারনে কেনো এইভাবে দিনযাপনে জীবনটাকে বেছে নিয়েছেন। কোন দুঃখ নাই। কারন, কোনো দায়িত্ব নাই মনে করে আমি পরেরদিনের শুধু আকাশটাতো নিরিবিলিতে বিকালের কোন এক মেঘলা দিনে দেখতে পারবো। তৃতীয় নদীর ধারে বসে আমি অন্তত “নদীর তৃতীয় তীরের” ওপারের নীলদিগন্ত তো দেখতে পাবো। আমার কোনো কিছুই মনে পড়বেনা যে, কেউ আমার জন্য বসে আছে, কেউ আমাকে মিস করছে ইত্যাদি। এই ভাবনা থেকে আমি যখন অনেক দূরে বসে কচিকচি পাতার শিশির বিন্দুর ছোঁয়ায় পায়ের পাতা ভিজিয়ে দেবো, কিংবা উত্তরের হাওয়ায় ভেসে আসা ছাই রঙের মেঘ যখন আমার মুখাবয়ব ভিজিয়ে দিয়ে যাবে, আমার অতিতের কথা মনে করে গড়ে পড়া চোখের পাতার জল আর কারো চোখে পড়বে না। আমার দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, আমার কাছে মানুষের চাহিদা, আর ঐ চাহিদাপুরনে আমার ব্যর্থতার জল আমাকেও আর পীরা দিবেনা যে, কেনো আমি এতোকিছুর পরে হেরে গেলাম। মানুষ নিজের কারনেই শুধু হেরে যায় না, মাঝে মাঝে নিজের সামর্থ্য থাকাসত্তেও মানুষ হেরে যায়। আর তার এই হেরে যাওয়া যখন শুরু হয়, তখন নিজের চোখের সামনে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। এই অসহায়ত্ব একটা শাস্তি। নিজের কাছে নিজের শাস্তি। ছায়ার মতো সারাক্ষন লেগে থাকে। যার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়া বড় কঠিন।

ইচ্ছে ছিলো, অনেক বড় হবো, ইচ্ছে ছিলো আমার চারপাশের আপনজনদেরকে নিয়ে হৈ হুল্লুর করে নেচে গেয়ে শ্রাবনের বৃষ্টিতে কাক ভেজায় ভিজবো, ইচ্ছে ছিলো শীতের কোন এক সকালে দল বেধে পিঠে ব্যাগ নিয়ে কোন এক পাহাড়ের চুড়ায় বসে প্রাকৃতিক বনজংগলে বসে গরম গরম পিঠা খাবো। এতা একটা স্বপ্ন। কিন্তু এই সপ্নটা একা সপ্ন দেখলেই হবেনা। এই সব সপ্ন দলবদ্ধ সপ্ন। এই সব স্বপ্ন একে অপরের সাথে একটা চেইনের মতোবাধা। কোথাও ছিড়ে গেলে এর আর কোনো বাস্তবায়ন থাকেনা। পুরুটাই শিশিরবিন্দুর মতো উবে যায়। তখন আর বুঝা যায় না এইখানে কোনো একজলের বিন্দু থেকে কখনো শিসির জমে ছিলো কিনা।

জীবনটা এতো ছোট যে, এক জিবনে মানুষ তার কোনো কিছুই শেষ করতে পারে না। কিন্তু মানুষ যখন হেরে যায়,  তখন সে আরেকটি জীবনের জন্য আশা করেনা। উত্থানের থেকে পতনের গতি সবসময় বেশি। ফলে জীবনের অধিকাংশ সময় ধরে যখন কেউ শুধু উত্থানের দিকে যেতে থাকে, পতনের সময় তার তখন কোন কিছুতেই ভারসাম্য থাকে না। একদিকে ভারসাম্য রক্ষায় চেষ্টা তো, আরেক দিকে ভারসাম্য হারিয়ে যায়। ওইদিকে নজর দিলে, অন্যদিকে আবার ভারসাম্য হারিয়ে যায়। আর এভাবেই দ্রুত ভারসাম্য হারাতে হারাতে হটাত নিজেকে খাদের অনেক নীচে দাঁড়িয়ে আছি বলেই আবিস্কার করে। তখন আশেপাশে যারা থাকে, তারা হয় সবাই অচেনা, নয় প্রানিকুলের কেউনা। নিজের আপনজনদেরকেও তখন বড় অপরিচিত বলে মনে হয়। উত্থানের ভারসাম্য আর পতনের ভারসাম্য একনয়। তাদের মিলিত বিন্দু একজায়গায় নয়। তাদের ভারসাম্যের কেন্দবিন্দুও একনয়। উত্থানের কেন্দ্রবিন্দু যদি হয় আকাশের চুরায়, পতনের কেন্দ্রবিন্দু হয় পাতালের নীচে।

২০/০৩/২০১৭-একা থাকা

Categories

মাঝে মাঝে আমি যখন একা থাকি, তখন ভাবি, কিভাবে এতোবড় সাগরের মতো সমস্যাগুলি আমি সামাল দিচ্ছি? কোনো সমস্যাই কারো থেকে কম ছোটনা। কিন্তু কনো না কনভাবে আমি সামাল দিচ্ছি। কোনো সমস্যা বিশাল টাকার, কোনো সমস্যা বিশাল ভাবে রাজনীতির, কোনো সমস্যা আবার নিছক ব্যক্তিগত। এতো সমস্যায় জর্জরিত থেকেও আমি একটা জিনিষ বুঝতে পেরেছি, আমার পাশে আসলে কেউ নাই। যে যাই কিছু বলুক, আমি আসলে একা। আমার পরিবার আমার সাথে আছে কিন্তু তারা কি আমার সমস্যায় চোখের জল ফেলাছাড়া আর কিছু করতে পারবে? আমি তাই মাঝে মাঝে ভাবি, আমার অনুপস্থিতিতে ওরা ভালো থাকবেতো? আমার সব কিছুর উপরে আমার পরিবার। এই জায়গায় আমি চরম স্বার্থপর। এখানে আমি কোনো ছাড় দিতে ইচ্ছুক নই।

আমি যেভাবে এগুচ্ছি, তার বেশীর ভাগ সাহসিকতার কারন আমার ইচ্ছাশক্তি আমাকে আমার পরিবারের জন্য কাজ করে। কখনো ওরা আমাকে ভুল বুঝে কিন্তু আমি জানি ওদের ঐ ভুল বুঝাবুঝির কারনে আমি ছেলেমানুষিকরলে ওরা সময়ের স্রোতে ভালো থাকবেনা। তাই সব রাগ, ঝগড়া, বিবাদ নিমিষেই অবুঝ বালকদের বাচ্চামি মনে করে ঝেড়ে ফেলে দেই আর সামনের দিকে এগুনোর চেষ্টা করি। আমি সফল হচ্ছি কিনা আমি জানি না তবে আমার উপর থেকে ধীরে ধীরে যে বিশাল বিশাল বোঝা নেমে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারি। আর এখানেই আমার সার্থকতা।

১৭/০৩/২০১৭-জীবন একটাই

Categories

জীবন একটাই। সবাই জীবনে সুখী হতে চায়, আরাম আয়েস চায়, চায় সম্মান নিয়ে নিরাপদে সুখী পরিবার নিয়ে বেচে থাকার। আর এই সুখ, আরাম, সম্মান, নিরাপত্তা কোনোটাই সহজলভ্য ব্যাপার নয়। এর পিছনে থাকে হাড় ভাঙ্গা খাটুনী, অসহনীয় ধকলেরধাক্কা, আরো অনেক কিছু। তাতেই কি সব পাওয়া যায়? মোটেইনা। অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তিটা মোটেই আনুপাতিক নয়। ফলে মানুষ তার আখাংকার তীব্রতার কাছে ক্রমাগত হেরে যেতে থাকে, আর এই হার থেকে মানুষ অনেক সময়ই ভুলরাস্তা বেছে নেয়, সহজ পথ আঁকড়ে ধরে। যখনই এই ঘটনাটা ঘটতে থাকে, তখন ব্যক্তি আর ব্যক্তিত্বর মধ্যে একটা কনফ্লিক্ট তৈরী হয়। ব্যক্তিত্ব যদি হয় নীতির পরিমাপের একটা আদর্শ, ব্যক্তিত্ব যদি হয় ব্যক্তির সততার একটা মাপকাঠি, ব্যক্তিত্ব যদি হয় নিরপেক্ষতার একটি ইউনিট, তাহলে যখনই এই হারের ঘটনাটা ঘটতে শুরু করবে, তখন ব্যক্তির আখাংকার তীব্রতার কাছে এইসব ব্যক্তি আদর্শ, নীতী, নিরপেক্ষতা হারাতে থাকে। এই উপাদান গুলি আর তখন খুব জোরালো হয়ে কাজ করেনা। যে নীতিসমুহ একজন ব্যক্তিকে ভুলরাস্তা থেকে সরিয়ে নিতে পারতো, তখন সেই নীতিগুলোর অনুপস্থিতে নিমিষের মধ্যেই ব্যক্তি ভুল একটা রাস্তায় প্রবেশ করে ফেলে। আর এই নীতির অনুপস্থিতিটাই হচ্ছে দুর্নীতি। আর একবার যখন কেউ এই ভুল রাস্তায় প্রবেশ করে ফেলে, তখন তাকে আর ফেরানো যায়না। হোক সেটা প্রেমের বেলায়, হোক সেটা অর্থনীতির বেলায়, আর হোক সেটা কোনো সামাজিক কর্মকান্ডের বেলায়। ব্যক্তিটা তখন সবার বেলায় একই আচরন করে। বন্ধু পালটে যায়, সমাজের গন্ডি পালটে যায়, পালটে যায় তার দৃষ্টিভঙ্গির।

যখন কারো দৃষ্টিভঙ্গি পালটে যায়, তখন তার কাছে অনেক কিছু আর স্বাভাবিক মনে হবে না। লাল কাচের ভিতরে রাখা সাদা গোলাপকে সে লাল রঙের গোলাপই মনে করবে, নীল আলোর চত্তরে সে সবুজ গাছের পাতাকে আর সবুজ দেখতে পাবে না। তখন তার স্বাভাবিক চোখ তার মেধার সঙ্গে একাকার হয়ে বাস্তব কিছু থেকে অনেক দূরে সরতে থাকবে। সরতে থাকা প্রেক্ষাপটে তখন অনেক কিছুই সাফল্য বলে মনে হয়। প্রাপ্তির অনুপাতটা মনে হয় শ্রমের থেকে একটু বেশি। দিন মাস, বছর ধরে যদি ক্রমাগত এই পরিবর্তন ঘটতে থাকে, তখন একসময় তার কাছে কোনো কিছুই আর অসম্ভব বলে মনে হয় না। সে হয়ে উঠে অপ্রতিরোধ্য। আর অপ্রতিরোধ্য চরিত্রগুলোই হচ্ছে অন্য সবার জন্য বড় একটা সমস্যা। এই সমস্যা হয়ে উঠে তখন সামাজিক ব্যধির মতো। কারন সে নিজে পালটেছে, সঙ্গে আরো কিছুকে পাল্টায়। এই পাল্টানোর হার যদি বাড়তেই থাকে, তখন পুরু সমাজটাই হয়ে উঠে বিসাক্ত। স্বাভাবিক কোনো কিছুরই আর তখন গ্যারান্টি থাকে না। নারী তখন অসহায় হয়ে উঠে। সব নারীরাই তখন শুধু নারী। মা, বোন স্ত্রী, মেয়ে, কিংবা দাদীর মধ্যে আর কোনো পার্থক্য থাকে না। কিছু পুরুষ তখন হয়ে উঠে অত্যান্ত দুর্দান্ত, আর কিছু পুরুষ হয়ে উঠে নিতান্তই দুর্বল। আইন তখন নীরব থাকে, আইনের রক্ষকেরা তখন নিজেরাই বিভিন্ন চরিত্রে উপনীত হয়।

এখানে একটা জিনিষ খুব ভালোভাবে বুঝা দরকার যে, ভুল করে ভুল রাস্তা বেছে নেওয়ার ব্যক্তিকে ভুল থেকে শোধরানো যায় কিন্তু কেউ যদি ইচ্ছে করে ভুল রাস্তার সন্ধান খুজে নেয়, তাকে সরানো কঠিন। আর সেই ভুল্টা হচ্ছে অন্যায়। ভুল করে ভুল করার পর হয় আফসোস কিন্তু অন্যায় করে ভুল করার কারনে মানুষ হয়ে উঠে মানসিকভাবে দুর্বল। ভুল রাস্তায় জীবন জাপন করে কেউ অধিক কাল বেচে থাকতে পারে নাই, এতে যার যতো সম্পদ, টাকাপয়সা কিংবা যশই থাকুক না কেনো। কারন প্রকৃতি তার নিজের নিয়ম ভেঙ্গে কখনো অন্য কোন নিয়মকে মেনে নেয় নি। ফলে এই সুন্দর পৃথিবীটাকে অধিককাল দেখার সৌভাগ্য হয় শুধু তাদেরই যারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে এক সঙ্গে চলতে পেরেছেন। তাহলে প্রকৃতির সেই প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিটা কি? এক কথায় এর উত্তর হচ্ছে-পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি।

এর বিসদ ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

২০/০২/২০১৭-ছবি

Categories

 

ছবি দেখিলেই যেনো বুক ধক করিয়া উঠে। অতীতের ছবি তো আরো ধকের মাত্রা বারাইয়া দেয়। অতীতে যে ছবিটা ভালো হয় নাই বলিয়া ছিড়িয়া ফেলিয়াছিলাম, আজ সেই অস্পৃশ্য, ঝাপসা স্যাতস্যাতে ছবীতা দেখিলেও ভালো লাগে। একাগ্রচিত্তে ছবিগুলি দেখিলে বারবার শুধু ইহাই মনে হয়, দিন ফুরাইয়া যাইতেছে। সময়ের ক্রমাগত টিকটিক শব্দে আমার দিনও টিকটিক করিয়াই ফুরাইয়া যাইতেছে। ইহাকে কোন বাধনেই আর থামাইয়া রাখা সম্ভব নয়, আর কেউ পারিয়াছে বলিয়াও আজ পর্যন্ত কোনো দলিল নাই, এবং আগামিতেও কেহ পারিবে ইহার স্বপক্ষে কোনো বিজ্ঞান কিংবা দর্শন আবিষ্কৃত হয় নাই। সময়ের এই টিকটিক শব্দ আমি আমার বুকের প্রতিটি ধুকধুক আওয়াজের মধ্যে, ঘুমের ঘোরে, নিশিথে কিংবা যখন একা থাকা হয় তখনো শুনিতে পাই। যখন একা থাকি, তখন “সময়” যেনো আমার কানে কানে ফিসফিস করিয়া বলিয়া যায়, পিছনে তাকাইয়া দেখিয়াছ কত বেলা পার করিয়া আসিয়াছো? তুমি তোমার জন্মেরক্ষন পাড় করিয়া আসিয়াছো, দুরন্ত শৈশব পার করিয়া আসিয়াছো, তোমার অনেক বেলা পার হইয়া গিয়াছে, এখন আর তোমার জন্য সকাল বলিয়া কোন কাল নাই, বিকালের রোদের আমেজ কি তুমি বুঝিতে পারিতেছো? যদি তুমি ইহা অনুধাবন করিতে না পারো, তাহা হইলে, আয়নার সামনে গিয়া দাঁড়াইয়া এক পলক তোমার চোখের নিচে তাকাইয়া দেখো, অথবা হাত পায়ের রক্ত প্রবাহের ধমনীগুলির দিকে তাকাইয়া দেখো। ইহারা অনেক সময় ধরিয়া অবিরাম কাজ করিতে করিতে প্রায় অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে। তোমাকে দেখিয়া কি রাস্তার ঐ অবুঝ বালক আর “ভাই” বলিয়া সম্বোধন করে? না করেনা। এখন তোমাকে অনেকেই “চাচা” বা আংকেল” বলিয়া ডাকিতে পছন্দ করে। আর কয়েকদিন অতিবাহিত হোক, দেখিবে, তুমি এই “চাচা” কিংবা “আংকেল” উপাধিটাও ধরিয়া রাখিতে পারিবেনা। তখন কেউ তোমাকে দাদা কিংবা নানা বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিবে। তোমার এখন পা কাপিতেছে, হাত কাপিতেছে, চোখেও খুব ভালো করিয়া সব দেখিতে পাওনা। বৃহৎ অট্টালিকায় উঠিতে এখন তোমার সাহস আর আগের মতো কাজ করেনা, সমুদ্রে ঝাপ দেওয়ারও আর মন টানেনা। তুমি আস্তে আস্তে নির্জীব পদার্থের ন্যায় হইয়া যাইতেছো। এখন একটুতেই বর্ষার পানিতে সর্দিকাশি বাধিয়া বসে, শীত আসিলেই মনে হয়, এই বুঝি রাজ্যের সব ঠাণ্ডা তোমার সারা শরীরের উপর দিয়া বহিয়া যাইতেছে।

ছবি দেখিতে দেখিতে মনটাই খারাপ হইয়া যায়। মনে হয়, আমি কি সত্যি সত্যি একদিন এই নীল আকাশটা আর দেখিতে পারিবো না? এই ফুলগাছ, এই রাস্তার ধার, এই নদীর ঢেউ, এই শীতের হাড়কাঁপুনি ঝাঁকুনি, কিংবা বৃষ্টির শীতল জলেরচ্ছটা কোণো কিছুই কি আমি আর উপভোগ করিতে পারিবো না? সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর রাতে বাড়ি ফিরিবার আনন্দটা কি আর পাওয়া যাইবে না? অথবা পরিবারের সঙ্গে, বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে চুটিয়ে ঝগড়া কিংবা হৈচৈ করার অবকাশ কি আর কখনোই আমার হইবে না? মন বড় বিষণ্ণ হইয়া উঠে। মনে হয় এই জনমটা কেনো হাজার বছরের জন্য হইলো না? ভগবান বড় নিষ্ঠুর। কেহ হয়ত ভগবান কে বিশ্বাস করিয়া ইহাই মানি নেন, আবার কেহ ভগমান আছে ইহাই বিশ্বাস করেন না। ভগমানকে অবিশ্বাস করিয়া যদি হাজার বছরের অধিক বাচিয়া থাকা যাইতো, তা না হইলে একটা যুক্তি থাকিত, কিন্তু ভগমান আছে বানাই, এই বিশ্বাসের উপর পৃথিবীতে অধিককাল বাচিয়া থাকিবার কোনো উপায়ও নাই।

শৈশবের উচ্ছল চঞ্চলতা, যৌবনের অদম্য বন্যতা আর এখনকার বৈষয়িক ব্যস্ততার মাঝে কখনোই মনে হয় নাই যে, একদিন আমার এই সাম্রাজ্য, আমার এই আধিপত্যতা, কিংবা এই বাহাদুরী, অহংকার একদিন কোনো একটা ছোট বিন্দুর মধ্যে আটকাইয়া যাইবে যেখানে আমার শ্বাস নীরব, আমার মস্তিষ্ক নীরব, আমার হাত নীরব, আমার শরীর নিথর। আমার সবকিছুই নীরব। আমার চারিধারের কোনো কিছুরই পরিবর্তন হইবে না। তখনো ঠিক সময়েই সূর্য উঠিবে, পাখীরা ঠিক সময়েই কিচিরমিচির করিয়া ভোরের আলোকে জাগাইয়া তুলিবে, প্রাত্যাহিক কাজে সবাই যার যার কাজে ঠিক সময়েই ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া আবার ঠিক সময়েই ঘরে ফিরিয়া আসিবে। ঠিক সময়েই সবাই তাহাদের প্রতিদিনের সকালে নাস্তা, দুপুরের খাবার, কিংবা পরিবার পরিজন লইয়া বিকালে শরতের কোন একসন্ধ্যায় বাহির হইয়া পড়িবে, শুধু আমি ছাড়া।

আজ হইতে শতবছর আগেও কেউ না কেউ হয়ত এইভাবেই তাহারা আজকের দিনটার কথা ভাবিয়া ভাবিয়া তাহাদের ঐ সময়ের ব্যথার কথা, এই পৃথিবী ছাড়িয়া যাওয়ার আক্ষেপের কথা, এই পৃথিবী ছাড়িয়া না যাওয়ার আকুতির কথা বলিয়াছিলেন। তাহাদের কেউ হয়ত এই পৃথিবীতে অনেক প্রতাপশালী রাজা ছিলেন, কেউ হয়ত ক্ষমতাশিল সেনাপতি ছিলেন, কেউ হয়ত কোটিপতি ধনকুবের ছিলেন, কিন্তু কেহই এই প্রস্থানের রাহু গ্রাস হইতে মুক্তি পায় নাই। আমার কোন পূর্বসুরী যেমন পায় নাই, আমিও পাইবো না আর আমার পরের কোনো উত্তরসুরীও পাইবে না। আজ যতো সুখ নিয়াই এই পৃথিবীতে বিচরন করি না কেনো, যত অভিযোগ নিয়াই বাচিয়া থাকি না কেনো, কিংবা যত কষ্ট নিয়াই দিন যাপন করিনা কেনো, যখন কেউ থাকে না, তখন তাহার প্রতি মুহূর্তের হাসি, উচ্ছ্বাস, মহব্বত, গালি কিংবা মেজাজের প্রতিধ্বনি শুনিতে পাওয়া যায়। এই প্রতিধ্বনি কখনো কাউকে কাদাইবে, কখনো কাউকে একা একাই হাসাইবে, আবার কাউকে এমন এক জায়গায় নিয়া দাড় করাইবে যেখানে মনে হইবে, হয়ত আমার বাচিয়া থাকাটা তাহাদের জন্য খুব প্রয়োজন ছিলো। হয়ত সব রাগ, অভিমান, অভিযোগ সত্তেও মনে হইবে আমার চলিয়া যাওয়ার কারনে এই শুন্যস্থানটা কেহই পুরন করিবার মতো নয়। তখনো এই ছবিগুলিই নীরবে কথা বলিবে।

কিন্তু তাহার পরেও সবচেয়ে সত্য উপলব্ধি হইতেছে, একদিন, সবাই আমরা একে অপরের হইতে আলাদা হইয়া যাইবো। কেউ আগে আর কেউ পড়ে। আমরা সবাই একদিন একজন আরেকজনকে হারাইয়া ফেলিবো, মিস করিবো। দিন, মাস, বছর কাটিয়া যাইবে, হয়ত কাহারো সাথে আর কাহারো কোনো যোগাযোগ থাকিবে না। একদিন হয়ত আমাদের সন্তানেরা, নাতি নাতিনিরা আমাদের অতিতের সব ছবি দেখিয়া কেহ কেহ তাহাদেরই সাথী লোকেদের প্রশ্ন করিবে, “কে এটা? কে ওটা?” তখন হয়ত অনেকেই চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু অশ্রুজলে অদৃশ্য কোনো এক মুচকি হাসি দিয়া বলিবে, “এরা ছিলো ওই সব লোকজন যাদের সঙ্গে আমি আমার সবচেয়ে ভালো কিছু সময় কাটিয়েছি। আজ ওরা কেউ নাই।” এরই নাম ছবি। কথা বলেনা কিন্তু সময়ের ইতিহাস হয়ে থাকে।

আমি কি কেবলই ছবি? তারা কি কেবলই ছবি যারা আজ থেকে শত বছর আগে এই পৃথিবীতে এসেছিলো এবং এখন যারা আর কোথাও নাই? কেউ কেউ তো আবার কোথাও ছবি হিসাবেও নাই? অথচ তারাও এক সময় আমার মতো এই পৃথিবীর আলো বাতাসে বড় হয়েছে, তাদের মধ্যেও প্রেম এসেছিলো, মহব্বত এসেছিলো। তারাও সংসার করেছে, জীবনের প্রয়োজনে এক জায়গা থেকে অন্যত্র সঞ্চালিত হয়েছে। তারাও নীল আকাশ দেখে, নদীর পানি দেখে, বসন্তের ফুল আর ফুলেল পরিবেশে কখনোকখনো কবিতাও লিখেছে। গ্ন গুন করে গান গেয়েছে। পাখির কোলাহলে তারাও কখনো কখনো আপ্লুত হয়েছে। তাদের সময়েও শীত বসন্ত, বর্ষা, সব ই এসেছে। তারাও কারো না কারো সাথে হাত হাত ধরে জীবনের অনেক পথ পড়ি দিয়েছে। এদের অনেকেই হয়ত আজিকার আমাদের থেকেও অনেক নামি দামী নামুসের মতো ছিলেন। আরো কত কি? কিন্তু ওই সব গুনীজনেরা, মানুষ গুলি আজ কোথাও নেই। কেউ হয়ত কারো কারো ড্রইং রুমে ছবি হয়ে আছে, কিন্তু তার দেহ পচতে পচতে মাটির সাথে মিশে দেহ বলে আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। যেই হাড় গুলি ছিলো, সেগুলিও এদিক সেদিক হতে হতে ও গুলো আর কোথাও খেজে পাওয়া যাবে না। যে কবরে একদিন তাদেরকে শুইয়ে হাজার হাজার লোক, আত্মীয় সজনেরা বিলাপ করেছিলো, সেই সব আত্তীয় সজনেরাও আজ কোথাওহয়ত নাই। ওই কবরেই হয়ত একে একে শুইয়ে আছেন। ওই কবরটাও কারো একচ্ছত্র নয়।

এই পরিসংখ্যানে আমি ও তাহলে নিছক একটা ছবি এবং কোনো এক সময় এই ছবি থেকেও আর কোথাও নাই। আমার ইতিহাস এই পৃথিবীর কেউ মনে রাখবে না। আমার আজকের দিনের এই রাজত্ব, আমার সাম্রাজ্য, আমার রেখে যাওয়া সব সম্পদ আর সম্পুতি হয়ত হাত বদলের মাধ্যমে আমার বংশ পরম্পরায় কারো হাতে সেটা পৌঁছেযাবে কিন্তু আমার নাম, আমার আজিকার দিনের পরিশ্রম, আমার আজিকার দিনের কোনো কিছুই তার কাছে পৌঁছে যাবে না। সে হয়ত জানবেই না, কার সিঙ্ঘাসনে বসে তিনি কার উপরে প্রতিনিধিত্ব করছেন। হয়ত তিনি জান্তেও চাইবেন না।

তাহলে কিসের জন্য? কার জন্য? 

আজ যারা তোমরা আমার এই মন্তব্য গুলি পড়ছো আর ভাবছ, তাহলে কি আমরা সবাই হাত গুটিয়ে কোনো কিছুই ক্করবো না? হ্যা, করবো। শুধু নিজের জন্য আর নিজের আরামের জন্য।

তোম্রাও এক সময় আসবে, আমার মতোই চিন্তা করে আমাকে সালাম জানবেই।

চলো আমার ডায়েরীতে

১৮/০২/২০১৭-তৃতীয় নদীর তীর

Categories

 

আমার বন্ধু মেজর আসাদের একটা নতুন বই এই বইমেলায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। “অন্য ভুবন”। বইটি আমি এখনো পরার সুযোগ হয় নাই তবে আমি না পড়েই বুঝতে পারছি, বইটা একটা চমৎকার লেখনীর প্রকাশ হবে। আমি আসাদের লেখার খুব ভক্ত। আমার এই বন্ধুর লেখা আমার আরেক বন্ধু প্রয়াত মেজর সাহেলকে উদ্দেশ্য করে তার একটা লেখা “নদীর তৃতীয় তীর” পড়তে পড়তে মন বড় আবেশিত হয়ে আছে এই কয়েকদিন যাবত। তারই লেখার কিছুচুম্বক লাইন এইরকম। … “মৃত্যু যখন এসে আমার এই শরীরটাকে স্পর্শ করবে তখন তোমরা সবাই আমার শরীরটাকে একটা ছোট্ট নৌকোয় করে ভাসিয়ে দিয়ো। জলস্রোতে ভেসে যাবে অনাদিকাল ধরে। নদীর নিঃসীম উপকূল ছাড়িয়ে আমি যাব, নদীর ভেতরে, নদী থেকে দূরে, নদীতে।” – (নদীর তৃতীয় তীর, হুয়াও হুইমারেস রোসা), বড় রহস্যভিত্তিক। দক্ষিণ আমেরিকার একজন বিখ্যাত ছোট গল্পকারের নাম হুয়াওহুইমারেস রোসা। ‘THE THIRD BANK OF THE RIVER’ (নদীর তৃতীয় তীর) নামে তাঁর লেখা একটা ছোটগল্প। এই গল্পে এক পরিবারের খুব দায়িত্বশীল একজন পিতা একদিন একটা ডিঙি নৌকা তৈরি করেন। ছোট ডিঙি। গলুইতে শুধুমাত্র এক চিলতে জায়গা। একজনের বেশি মানুষ সেখানে বসতে পারবেনা। বিশাল এবং সুগভীর একটা নদীর তীরে পরিবারের বসতি। নদীটা এতই বিশাল এবং প্রশস্ত যে, অন্য তীর দেখাই যায়না। অতঃপর একদিন তিনি নদী পারের বাড়িতে তার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিশাল, সুগভীর নদীতে তার ডিঙি ভাসিয়ে দিলেন। কোন খাবার বা অন্য কোন রসদও সঙ্গে নিলেন না। এমনকি শেষ বারের মত পরিবারের কাউকে কোন উপদেশও দেবার চেষ্টা করলেন না। অদ্ভুত ব্যাপার হল তিনি আর কখনও ফিরে আসলেন না। কিন্তু আবার কোথাও চলেও গেলেন না! মাঝ–নদী বরাবর অনির্দিষ্টভাবে ঘোরাফেরা করতে লাগলেন। কখনও উজানে। কখনও বা ভাটিতে। কিছু কিছু সময়ে তিনি দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যান। কিন্তু কখনই এমন দূরে নয় যে তার উপস্থিতিটা পরিবারের সদস্যরা অনুভব করতে সক্ষম হবে না। … মৃত্যুই কি নদীর তৃতীয় তীর?

আসলে এই তীর কি, কোথায় তার অবস্থান, কিংবা এটা কি এমন কোনো নদী যার তীর সচরাচর গোচরীভুত হয় না, অথচ আছে? অথবা এই নদীর কি আরো তীর আছে যার নাম হয়ত চতুর্থ তীর? সবুজ গাছ-পালা, আকাবাকা মেঠোপথের শেষপ্রান্তে প্রাকৃতিক বড়সৌন্দর্য পরিবেষ্টিত বিশাল জলাধারের চলমান স্রোতের প্রাবাহমান যদি কোন নদী হয়, সেই নদীর তীর হয়তোবা কখনো এই বিশাল জনরাশির সবার কমন। এখানে সবার রোমাঞ্চ, আশা, বেদনা, সবার কাহিনীর এক মহাপুস্তকের মতো। হয়তোবা এটা কখনো সভ্যতার জীবনধারার বাহকরুপী কোনো সময়ের রাজত্ব হলেও হতে পারে কিংবা কখনো সেই দৃশ্যমান নদী অতীত বর্তমানের সুখ দুঃখের এই বিশ্বভ্রমান্ডের সাক্ষীর ধারকবাহক হলেও হতে পারে। আর সেটাকেই আমরা কখনো নদী, কখনো উপসাগর অথবা কখনো সাগর থেকে মহাসাগরের স্তরে বিন্যাস করে কতোই না উপমা করে থাকি। এই নদীর স্রষ্টা আছে, এর নিয়ন্ত্রণকারী আছে, আর তার উপর সমগ্র মানবকুল একটা মিশ্র বিশ্বাস নিয়েই কেউ এর স্রষ্টাকে পুজা করে, কেউ তাকে অস্বীকার করে আবার কখনো কখনো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মায়াজালে আশা-নিরাশার ভারদন্ড নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। হয়ত এরই নাম “জীবন”, হয়তবা এরই নাম “সভ্যতা”। এই নদীর কিনারা থেকে পালিয়ে বেড়ানো মানে এই নয় যে, জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো, সভ্যতা থেকে হারিয়ে যাওয়া। এই বিশ্বভ্রমান্ডের কোথাও না কোথাও আরেক নদীর তীর আছে যেখানে তার কিনারা পাওয়া যায়। সেখানেও নতুন করে সভ্যতা, জীবন এবং নতুন কাহিনীর রচনা হতে পারে এবং হয়।

কিন্তু সমগ্র বিশ্ব থেকে যখন আমরা মানবকুল সবকিছু ছেড়ে ছোট একটা গন্ডি শুধুমাত্র গুটিকতক আপনজনের পরিসীমায় আবদ্ধ করে একটা মায়াজাল আবিষ্ট করি, তখন দিনের সবকাজ শেষ করে যখন নীড়ে ফিরে এসে হিসাব কষি, তখন সামনে এসে দাঁড়ায় আরেকটি নদী। হয়ত তাঁর নাম “মন-নদী’। এই নদীতে চলমান জলের প্রবাহ নেই, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার নেই, পাহাড় নেই, আকাশ নেই, কিন্তু তারও আছে অনেক তীর। যা কখনো শান্তির মহাখুশিতে জলের ধারা বইয়ে চিকচিক করে জানান দেয়, ‘যা চেয়েছি তাই পেয়েছি’। আবার কখনো কখনো দুঃখের সীমাহীন যন্ত্রনায় সেই একই নদী তার দুই তীর জলের ধারায় শিক্ত করে নীরবে বলে যায়, ‘বড় যন্ত্রনায় আছি’। হয়ত তখন আমরা বলি, দুই নয়নের ধারা। নিজস্ব গন্ডির এই পরিসীমায় এই নদীর একক ধারক বাহক শুধু কিছু আপনজন, নিজে আর ব্যক্তিসত্তার অজানা উপাদানের সব সমীকরন। এখানে ঈশ্বর বাস করেন ক্ষনেক্ষনে, আবার ঈশ্বর উধাওও হয়ে যান ক্ষনেক্ষনে। এখানে ছোট গন্ডির গুটিকতক আপনজনের সার্থকতা, ব্যর্থতা, ভালোবাসা, দায়িত্বশীলতা, নির্ভরতা সবকিছু একেবারেই নিজস্ব। সমগ্র মানবকুলের হিসাব কিতাবের সাথে, সুখ দুঃখের সাথে, চাওয়া পাওয়ার সাথে, লাভ লোকসানের সাথে সব কিছু মিশে থাকে।

 এই নদীতে বাস করে “আমি”, আমার আমিত্ত আর আমার চারিধারের সব আমারত্ত। আর কেউ নেই। এখানে ঈশ্বর আমি, এখানে নিয়মের কোন বালাই নেই। এখানে আকাশের রঙ আমার নিজের মতো করে বানানো, আমার নদীর জল আমার ইচ্ছায় যখন যেভাবে খুশি প্রবাহিত হয়। এখানে আমার ইচ্ছাটাই সব। এখানে আমার ছোট ডিঙ্গী কখনো উজানে, কখনো ভাটিতে, কখনো নিরুদ্দেশে, কখনো জনসম্মুখে, কখনো কাছে কখনো দূরে যেথায় খুশী সেখানে আমার বিচরন। কাউকে আমার কিছু যেমন বলার নেই, কারো কোনো কিছুই আমার পরোয়া করারও কোন প্রয়োজন নেই। এখানে আমার কোন দায়িত্ববোধ নেই, আমার দায়িত্বও কারো উপর নেই। এখানে আমার সব নদীর উপস্থিতি যেমন আছে, তেমনি কোনো নদীর উপস্থিতিও আমাকে বিচলিত করে না। একদিক থেকে দেখলে এই নদীর কোন তীর নেই আবার আরেক দিক থেকে অনুধাবন করলে হয়ত দেখা যাবে এর আছে অজস্র তীর। কখনো উল্লাশের তীর, কখনো আনন্দের তীর, কখনো ব্যর্থতার তীর, কখনো সব হারিয়ে এক অবসন্ন জীবনের তীর। এখানে এই তীরে কেউ প্রবেশের অধিকারও নেই। এখানে আমার রশদের কোনো প্রয়োজন নেই, এখানে সর্বত্র আমি। আমি কি করতে পারতাম, কি করা উচিত ছিলো, কে কি করতে পারতো, কোথায় আমি ভুল করেছি, কোথায় আমার সার্থকতা ছিলো, কি আমার ভুমিকা হতে পারতো, কিংবা কি কারনে আমি আমার সবকিছু নিঃস্বার্থভাবে ছেড়ে আমি আমার তৃতীয় এই নদীতে একা পড়ে আছি, তার কোনো ব্যখ্যা আমি আর খুজতে চাই না। হয়ত কেউই এর কোনো উত্তর মেনেও নিবে না।

এখন আরেকটি প্রশ্ন মনে আসে। তা হলো, এই তৃতীয় নদীটি কোথায়? কারো কাছে এই তৃতীয় নদীটি হয়ত বাস্তবের কোনো এক বিশাল জল প্রবাহমান নদীর বুক, কারো কাছে হয়ত বা ঘন গাছপালায় পরিবেষ্টিত এক নির্জন জঙ্গল, কারো কাছে হয়ত বা এই বিশাল মানবকুলের ঘনবস্তির মধ্যেও একা কোনো জগত। কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই বা করুক, এই নদী সবার আছে, কেউ তাকে গ্রহন করে, কেউ এর সন্ধান জানেও না। এই নদীতে ঝাপ দেওয়ার সামর্থ্য সবার থাকে না। কারন এর যেমন কোনো দৃশ্যমান তীর নেই, আবার সব তীরের ঘাটও এক রকম নয়। এর জলের রঙ সবনদীর মতো নয়। এর কোনো ঋতু নেই, যখন তখন বৃষ্টি, ঝড়, উল্লাস, আনন্দ, কান্না, পরিহাস সবকিছু ঘটে। আর এর একচ্ছত্র অনুভুতি, আস্বাদ, ইতিহাস শুধু নিজের আর কারো নয়। এই তৃতীয় নদীর কিনারে বসে শতবর্সী বয়োবৃদ্ধা তাঁর বাল্যকালের স্বপ্ন দেখেন, আবার কারো কারো অজান্তেই এই নদীর বালুচরে হেটে হেটে কোনো এক উদাসীন কিশোর তাঁর কল্পনার জগত পেরিয়ে শত বর্স পেরিয়ে কোনো এক জন বসতীর সপ্নজাল বুনন করেন। কেউ ফিরে আসে, কেউ আর ফিরে না। এই নদীর তীরে বসা সবাই একা, সবাই সুখী, আবার সবাই বিরহীর মতো। অথচ এতো কাছাকাছি থেকেও এদের মধ্যে কেউ সখ্যতা করেন না, কেউ কাউকে সম্মোহনও করেন না। যেদিন এই মন-নদী অবশান হয়, সেদিন সব তীরের ধারা একসাথে মন-নদীর সাথে তিরোধান হয়। হয়ত তখন হুয়াও হুইমারেস রোসা্র লেখা “নদীর তৃতীয় তীর”টি আর কারো গোচরীতভুতও হয় না। সময়ের বিবর্তনে আমরা সবাই ঐ জেলের মতো হয়ত কোনো কোনো তীর থেকে খসে পড়ি। বৃন্তচ্যুত কলির তীরখসা জীবনের অজস্র তীরের যখন একচ্ছত্র ভিড় ঘনীভুত হয় মহামিলনে বা মহাবেদনায় অথবা মহাপ্রলয়ে, তখন চৈত্রমাসের তাপদাহের পর বৈশাখের কালো হিংস্র ঝড়ে তান্ডবের মতো আমরা শুধু সেটাই দেখি যা শ্রাবনের অঝরধারায় এই মাটির ধরায় সবার পায়ে, মনে, ঘরে বা মানসপটে ভেসে উঠে।  

হুয়াও হুইমারেস রোসা্র লেখা নদীর তৃতীয় তীর, হয়ত সেই নদীর কথাই বলেছেন

১৩/০২/২০১৭-যদি

Categories

 

 “যদি” এমন একটি শব্দ যা অতীত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান এই তিনকালের সব কৈফিয়তের এক আওয়াজ। কোনটা কি করা হলে কি হতে পারতো, কোনটা কি না করা হলে কি না হতে পারতো, এটা না ওটা অথবা ওটা নয় এটা করা হলে ফলাফল কি দাড়াতো ইত্যাদির একটা তুলনামুলক বিচারের প্রয়াস মাত্র। কিন্তু এতে অতীত, কিংবা বর্তমান কিংবা ভবিষ্যৎ কোনোকালের জন্যই বিশেষ কিছু পরিবর্তন আনেনা। তবে এই “যদি” থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্য কেঊ উপকৃত হতে পারে তাতে অনেক কিছুর দ্বন্দ্ব মিটে যায়। আসলে “যদি” একটা অভিজ্ঞতার নাম, “যদি” একটা সময়ের নাম। “যদি” একটা অধ্যায়ের নাম। এই “যদি” থেকে অনেক কিছু শেখার যেমন আছে, তেমনি, এই “যদি” থেকে অনেক ভোগান্তিও আছে।

সময়ের স্রোত ধরে মানুষ যখন আজকের বর্তমানকে পেড়িয়ে আগামীকালের বর্তমানে পদার্পণ করে, তখন এই “যদি” এসে সামনে দাঁড়ায়। সাফল্য আর ব্যর্থতার মাঝামাঝিতে দাঁড়িয়ে “যদি” শুধু এটাই বুঝাতে চায়, “যদি” এইটা এইভাবে না করে ঐভাবে করা হতো, “যদি” অমুকের সাথে ঐ সময় দেখা না হতো কিংবা “যদি” অমুকের সাথে দেখা না হয়ে অন্য কারো সাথে দেখা হতো? “যদি” আরেকটু সাবধান হওয়া যেতো? “যদি” আরো বেশী মনযোগী হয়ে ঐ কাজটা না করে সেই কাজটা করা যেতো? “যদি” এটা না করে ওটা করা হতো ইত্যাদি ইত্যাদি তাহলে হয়ত আজকে যা ঘটছে বা ঘটেছে, সেটা থামানো যেতো কিংবা ফলাফল আরো ভালো হতো। এই “যদি” বড় কঠিন সেতু যাকে ভর করে আর কখনোই সামনে যাওয়া যায় না। অথচ এই “যদি” যদি ঐ সময় ভাবা হতো, তাহলে জীবনের অনেক কিছুই পালটে যেতো। আমরা সবাই এই “যদি”র কাছে সব সময় হেরে যাই।

আজকে মনের ইমোশনাল বিচারে যা করতে হয়েছে, বা করে ফেলা হয়েছে, তখন মনে হয়, আহা “যদি” ঐ সময় এই ইমোশনালটা না হতাম, যদি ঐ কাজটায় আমি বা আমরা আরো কিছু সময় দিয়ে একটা উপায় বের করতাম, যদি আরেকটু সহনশীল হয়ে এইটা না করে ওইটা করতাম, তাহলে হয়তো জীবনটা অন্য রকম হতো। হয়তো এখন যা হয়েছে, তার আর কিছুই হতো না। হয়ত জীবনটাই পালটে যেতো। আজকে যাকে আমার একেবারেই সহ্য হচ্ছে না, যাকে নির্মুল করার জন্য আমি প্রানপনে চেষ্টা করছি, আহা, ‘যদি” ঐ সময়ে ঐ মানুষটির সাথে আমি আরো গভীরভাবে সবকিছু শেয়ার করে সব মিটিয়ে নিতাম, হয়তবা আরো কতই না ভালো হতো। আর এটাই হচ্ছে এই “যদি”র চরিত্র। “যদি”টা সব সময় “যদি”র মধ্যেই থাকে। যারা এই “যদি”কে কাজে লাগায়, তারা ভিন্ন ভিন্ন পথে এবং ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অনেক নতুন নতুন পথের সন্ধান পায়।

“যদি” একটা কম্প্রোমাইজের নাম। “যদি” দ্বারা কেউ যদি কম্প্রোমাইজ করে, সেটা ভবিষ্যতের বড় হারের চেয়ে লাভজনক। “যদি” একটা বিকল্পের নাম। এই যদি দ্বারা অনেক কিছুই শামাল দেওয়া সম্ভব। আর শামালের আরেক নাম “সময়কে ঠেক দেওয়া”। সময় পাল্টায়, আর সময় যখন পালটে যায়, তখন এই অনেক কিছুই আর আগের মতো থাকে না। আজ যে পরিবেশটা অনেক অসহনীয় মনে হয়, সময়ের সাথে সাথে এই পরিবেশ অনেক সহনীয় হয়ে উঠে। আর সহনীয় সময়ের মধ্যে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়। “যদি” থেকে শিক্ষা নেওয়া মানুষ ধৈর্যশীল হতে শিখে। আর ধৈর্যশীলরাই জয়ী হয়।

১৩/০২/২০১৭- ফাল্গুন মাসের মাহাত্য

Categories

ফাল্গুন মাসের কোনো মাহাত্য আমি আজো খুজে পাই নাই। কেনো এই ফাল্গুন মাসবাঙ্গালীর জীবনে অনেক অতিশায়ী আদরের একটা মাস, তাও আমার মনে কখনো জেগে উঠেনাই। ফলে ফাগুনের আগমনে আমার মন কখনো পুলকিত হয়ে জেগে উঠে নাই। কবিদের কথাআলাদা।

বাংলার অন্যান্য মাসের মতোই এই ফাল্গুন মাস আমার কাছে একটাস্বাভাবিক মাসের চেয়ে আর বেশী কিছু নয়। তবে যখন ছোট ছিলাম, বৈশাখ মাসটাকিছুটা হলেও আমার মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতো, কারন এই বৈশাখ মাসেআমাদের গ্রামে মেলা হতো, মেলায় হরেকপদের জিনিসের কেনাবেচা হতো। পকেটে পয়সাথাকুক আর নাই বা থাকুক, দলবেধে অন্তত ঐ মেলায় গিয়ে কিছুটা সময় হলেও আনন্দকরতে পারতাম। অন্যদিকে কালবৈশাখী ঝড়ের কারনেও মাঝে মাঝে কালো আকাশের চেহারাদেখে নিজে আতংকিত না হলেও বড়দের চোখে ঝড়ের আতংক দেখে ভয় পেতাম। কখনো কখনোঝরের তান্ডবলীলায় কচিকচি আম কুড়াবার যে একটা হিরিক পরতো সেটা একেবারেনেহায়েত মন্দ না। হয়ত এইসব কারনেই বৈশাখ মাসটি আমার কাছে ফাল্গুনের থেকেওবেশি মনে পড়ে।

বর্ষাকালও ফাল্গুন মাসের থেকে আমার জীবনে অনেক বেশীমনে রাখার মতো অনেক কারন ছিলো। আমাদের নৌকা ছিলো না, স্কুলে যেতে হতো হাটুপানি ভেঙ্গে। কখনো কখনো পলিথিনের ভিতরে বইপত্র ঢোকিয়ে বৃষ্টির মধ্যে একগাদাকচিকচি পোলাপান মাইল কে মাইল ভিজে স্কুলে যেতে হতো। কখনো কখনো তুমুলবৃষ্টির মধ্যে নাড়ার আটি দিয়ে পেচিয়ে নকল ফুটবল বানিয়ে ইচ্ছেমতো ফুটবলখেলতাম। বকা খেয়েছি বড়দের, শাসন করেছে বারংবার এই বৃষ্টিতে ভিজে খেলার জন্যকিন্তু কে শুনে কার কথা। আর শীতকালের কথা তো সব সময়ই মনে পড়ে। এখনো মনে পড়ে।

এতোকিছুর পরেও আমি কখনো ফাল্গুন মাস যে একটা আলাদা কোন মাস এবংএটা যে একটা আলাদা কোন বিশিষ্ট আছে তা আমি খুব আলাদা করে কখনো বুঝি নাই।হতে পারে এই মাসে গ্রামের সেই চিরাচরিত সর্ষেফুলের বাহার, জংলীফুলেরসমাহার, কাশবনের সাদা ফুলের প্রাকৃতিক বাহার বড় সুন্দর কিন্তু এইগুলিতোছিলো গ্রামের নিত্যদিনের সৌন্দর্য। যা সবসময় চোখে পড়ে সেটা আর নতুন কি।কবিদের মন আলাদা। তারা বিড়াল দেখলে কবিতা লিখে, গ্রামের মেয়ে কলশী কাঁখেনদী থেকে পানি আনা দেখলেই কবিতা লিখে কিংবা টিনের চালে টাপুর টুপুর বৃষ্টিহলেই কবিতা লিখে। কিন্তু আমি কবি ছিলাম না। বৃষ্টির দিনে আমাদের টিনেরচালের সেই টাপুর টুপুর শব্দ তো আমার কানে লাগতোই না বরং আমাদের চালের কোনফুটা দিয়ে অনর্গল বৃষ্টির পানি ফোটায় ফোটায় পরে ঘরের মেঝ নষ্ট করে দিচ্ছে, কিংবা কাথা বালিশ ভিজিয়ে দিচ্ছে বলে হাড়ি দিতেই দিতেই সময় কেটে যেতো। এদিকদিয়ে পানি পড়ে তো এইদিকে হাড়ি লাগাও, ওইদিক দিয়ে পানি পড়ে তো ওইদিকেও হাড়িলাগাও, হাড়ি নাই তো বদনা, বালতি যা আছে তাই লাগাও ইত্যাদি। একদিকে হাড়িদিলে আরেক দিকে হাড়ি দেওয়ার হাড়ি অবশিষ্ট থাকে না। এই অবস্থায় কি আরবৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দ কানে আসে? অথবা ঋতুর চাকচিক্য নিয়ে কি কবিতালিখার বা পুলকিত হবার কোনো কারন থাকে? ফলে আমারও ছিলো না, আবার কখনোউপলব্ধিও করি নাই।

এখন বয়স হয়েছে। গ্রামের সেই ফুটা টিনের বাড়িতেআর থাকা হয় না। ফলে বৃষ্টির দিনে বাড়ির সেই ফুটা দিয়ে পানি যে ঘরের খাট, বইয়ের তাক, মেঝের মাটি ভিজে যাবে সেই ভয়ও নাই, আর ভাঙ্গা হাড়ি ধরার আর কোনঅবকাশও নাই। টিনের চালের টাপুর টুপুর শব্দটা হয়ত এখন মনে নাই। তবে এইঅট্টালিকায় বসে কখনো মনে হয়, আহা, যদি আবার সেই কালবৈশাখী ঝড়টায় আরো কিছুকচি আম গাছের নীচে পড়ে থাকতো, আহা, যদি এমন হতো যে, সেই বৃষ্টির দিনেহাফপ্যান্ট ভিজিয়ে আবার যদি সেই কচি বেলার বন্ধুদের নিয়ে হাটু পানি ভেঙ্গেমাইল কে মাইল পার হতে পারতাম। যে ফাগুন মাসের সেই প্রাকৃতিক কাশবনেরসাদাফুল, জংলিবাহার কিংবা সর্ষেফুলের মনমাতানো হলুদ ক্ষেত কখনো ই আমার চোখেধাধা মিশায় নাই, সেই সৌন্দর্য যদি এখন আবার ফিরে আসতো!! হয়ত এখন তা আমারচোখে পড়তো।

মনে হয় যদি আবার সেই জগতে চলে যেতে পারতাম, হয়ত এখন আমিঅন্যমনস্ক হয়ে ভাবতাম, পরুক না হয় কিছু বৃষ্টির পানি, ভিজিয়ে দিক না আমারকাচা মাটির মেঝ। হয়তো আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির পানি চুইয়ে চুইয়ে আমার সেইটিনের চালের ঢেউ দিয়ে গড়িয়ে পরা পানির সাথে আমার ভিজে আসা চোখের পানিও নাহয় আমার কাচা মাটির মেঝ একটু ভিজিয়ে দিয়ে যাক। আজ আমি শহরের কোনো একঅট্টালিকায় বসে সববয়সি মেয়েদের হলুদ শাড়ির বাহার দেখে বুঝতে পারি, আমাদেরগ্রামে এখন সর্ষেফুল চারিদিকে বাতাসে দোলা খাচ্ছে, আমাদের বাড়ির পাশে সেইজংলীফুল গুলিও বাতাসে নেড়ে চেড়ে উঠছে। হয়ত এখন সেখানে ফাগুন মাস। কিন্তুআমি নেই। তাই এই বিশাল পৃথিবীর অগনিত মানুষের থেকে একেবারে নেই হয়ে যাবারআগে কাল বৈশাখী ঝড়ের মাস, বৃষ্টির মাস, শিটের মাসের মতো আজ এই ফাগুন মাসকেওআমার বড় আপন মনে হলো।

স্বাগতম তোমায় হে ফাগুন মাস। তুমি আমারজিবনে প্রায় ৫০ বছর পর আবির্ভূত হতে পেরেছো। আজ মনে হয়, ফাগুন মাসটাও একটামাস, যাকে আমি কখনো দেখি নাই।

আচ্ছা, ফাগুন মাসে কি চোখ ভিজে? কি জানি, হয়ত ভিজে না। কারো কারো চোখ হয়ত এমনিতেই ভিজে।

১৯/০২/২০১৭-রিলেশনশীপ রুলস

Categories

 

পৃথিবীটা অদ্ভুত একটা অদৃশ্যমান সম্পর্কজনিত তত্ত্বে একে অপরের সাথে এমনভাবে জরিয়ে পেচিয়ে আছে, যা কোনো থিউরী বা সংজ্ঞা মেনে চলে না। প্রতিটি সম্পর্ক একেকটা একেক ধরনের। বৈশিষ্ট আলাদা, এর সাধ আলাদা, মাহাত্য আলাদা, সংজ্ঞা আলাদা, এবং তাদের যন্ত্রনাও আলাদা। মায়ের সাথে বাবার, বাবার সাথে ছেলেমেয়েদের, ছেলেমেয়েদের সাথে পরিবারের, স্বামীর সাথে স্ত্রীর, এক বাড়ির সাথে আরেক বাড়ির, এক পাড়ার সাথে আরেক পাড়ার, এক সমাজের সাথে আরেক সমাজের, দেশ থেকে দেশান্তরের, এমন কি মানুষের সাথে অন্য প্রানীকুলের, জীবিতদের সাথে মৃতদের, শত্রুর সাথে মিত্রের, কিংবা মিত্রের সাথে মিত্রেরও, আরো কতোই না সম্পর্ক। বিধাতার সাথে তার সৃষ্টির সম্পর্কও আরেক পদের। সব সম্পর্কের জন্য একই রুল হতে পারে না, এবং হবেও না। সময়ের পথ ধরে মানুষ এইসব সম্পর্কগুলো নিয়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন চরিত্রের মানুষের জন্য একেকবার একেক রকমের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে কেউ বানী দিয়েছেন, কেউ তত্ত্ব দিয়েছেন, কেউ বা আবার তথ্যের উপর ভিত্তি করে অনেক থিউরীও দিয়ে গেছেন। সবার জ্ঞ্যান, বয়ান, অথবা থিউরী যে সবসময় কোনো একটা নির্দিষ্ট “সম্পর্কের” ক্ষেত্রে সঠিক, সেটাও যেমন শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যাবে না আবার একেবারে সঠিক নয়, এটাও বলা যায় না। যে পরিস্থিতিতে যে সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে কোনো এক ভোক্তভুগী আজ যে ব্যর্থতার মন্তব্য করে গেলেন, ঠিক সেই পরিস্থিতিতে সেই একই প্রকার সম্পর্কের উপর আরেক ভোক্তভুগী হয়ত সাফল্যের কথা বলে যাবেন। অথবা এমনো হতে পারে, আজ যে পরিস্থিতিতে কোনো এক সম্পর্কের মধ্যে ফাটল হয়েছে বলে বলা হলো, হয়তবা সেই ফাটল থেকে ভাঙ্গন-রক্ষার বিকল্প তরিকা আরোপ করে আরেকজন অনায়াশেই উতরে যেতে সক্ষম হন। তাহলে প্রশ্ন আসে, “রিলেসনশীপ রুলস” বলে কি কিছু আছে? কিসের উপর দাঁড়িয়ে একই প্রকার একটা সম্পর্ক সম্বন্ধে সাফল্যের কথা বলে আর কিসের উপর ভিত্তি করে আরেক জন ব্যর্থতার কথা বলে?

প্রত্যেকটি সম্পর্ক একটি স্বাধীন সত্ত্বার মধ্যে, নিজের কাল্পনিক গন্ডির মধ্যে বসবাস করে। মা হবার আগে, মেয়েদের মা হওয়ার কল্পনা আলাদা, বিয়ের আগে যুবতীদের তাদের স্বামীর সাথে কি রকম সম্পর্ক হবে তার ভাবনা আলাদা। কিংবা শাশুড়ি হবার আগে প্রতিটি মেয়েদের একটা নিজস্ব এই কাল্পনিক গন্ডির উপাদানগুলি প্রকৃতপক্ষে সবই অদৃশ্যমান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কল্পনার জগতের সাথে এই বাস্তবের সম্পর্কগুলির মিলমিশের মধ্যে অনেক ফারাক। আর এই ফারাক থেকেই শুরু হয় যতো অঘটন। যদি অন্যভাবে বিশ্লেষণ করা যায়, দেখা যাবে, এর মধ্যে আছে প্রতিটি সত্ত্বার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ, আছে শালিন-অশালীনতার সীমাবদ্ধতা, আছে ইচ্ছা-অনিচ্ছার গ্রহনযোগ্যতার মাপকাঠি, আছে মেজাজ-মর্জির একটা রুপরেখা ইত্যাদি। যেমন, কেউ লাল রঙ পছন্দ করে, আবার তার সাথে এমন একজনের সম্পর্ক হয়েছে যিনি লাল পছন্দ করেন না, তিনি পছন্দ করেন নীল কিংবা সবুজ। কেউ ঝাল খেতে পছন্দ করেন কিন্তু তার সাথে এমন একজনের সম্পর্ক হয়েছে যিনি ঝাল তো পছন্দ করেনই না, হয়ত পছন্দ করেন কড়া মিষ্টি। সারাক্ষন ঘুরতে পছন্দ করা কোনো এক সুন্দরী রমনীর হয়তো স্বামী জুটেছে অলস এক কালো মানুষের যিনি সময় পেলেই হয়ত ঘুমাতে পছন্দ করেন। স্ত্রী ভেবেছিলেন তার স্বামী হবে এইরকম, কিন্তু হয়ে গেছে অন্যরকম, স্বামী ভেবেছিলেন, তার স্ত্রী হবে এই রকম, কিন্তু হয়ে গেছে দাপটে। দুই বন্ধু এক সঙ্গে কতই না দিন রাত এক সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন ছোটবেলায়, এখন এক বন্ধু আরেক বন্ধুর থেকে অনেক উচু স্তরের বাসিন্দা। এখন দেখা করতেও প্রোটোকল লাগে। মা ভেবেছিলেন, সন্তান বড় হয়ে তার সব দুঃখ ঘুচে দেবেন, কিন্তু ছেলে বড় হয়ে এখন আর মায়ের সেই গ্রামিন হাতে ভাত খেতেও পছন্দ করেন না, সঙ্গে জুটেছে আবার আধুনিকা বউ। বউ মনে করে, ঐ গ্রাম্য অশিক্ষিত মায়ের আবার এতো যত্নপাতি করার কি আছে? এই যে অসম চাওয়া এবং পাওয়া, এরই মধ্যে প্রকৃতপক্ষে লুকিয়ে আছে সম্পর্কের যত অঘটন। তাহলে এই অসমগুনের অধিকারী মানুষগুলির মধ্যে কি সব সম্পর্ক সব সময়ই ভেঙ্গে যাবে? তাইতো যাওয়ার কথা। ঘুমে নাক ডাকেন এমন স্ত্রীর স্বামী তো তাহলে কখনোই একসাথে নির্ভেজাল ঘুমে আচ্ছন্ন হতে পারবেন না। শিক্ষিত আধুনিকা বউ যেমন অশিক্ষিত গ্রাম্য শাশুড়িকে শামাল দিতে পারছেন না, তাহলে তো সব কিছুই ভেঙ্গে যাওয়ার কথা! ফলে কিছু কিছু সম্পর্ক ভেঙ্গেই যায় আবার কিছু কিছু সম্পর্ক টিকে থাকার জন্য লড়াই করে যায়। আবার এরই মধ্যে কিছু কিছু সম্পর্ক কোনো অঘটন ছাড়াই জীবনের শেষ অবধি টিকে যায়। তাদের এই এহেনো পরিস্থিতিতে তাদের কিছু অভিজ্ঞতার আলোকে এই সব সম্পর্কের জন্য “রিলেসনশীপ রুলস” নামে কিছু তত্ত্ব, তথ্য, থিউরী দিতেই পারেন। হোক সেটা সাফল্যের বা ব্যর্থতার। তাদের এইসব অভিজ্ঞতার থিউরী তাহলে কি আমরা সর্বত্র এই জাতীয় সম্পর্কের বেলায় শতভাগ কার্যকরী এবং নিয়ম বলেই মেনে নেবো?

যদি তাইই হতো, তাহলে নব্বই বছরের বৃদ্ধ মানুসটি কোন কারনে আশি বছরের থুড়থুড়ে মহিলার প্রেমে তখনো হাবুডুবু খাচ্ছেন? ঐ আশি বছরের মহিলার তো আর রূপ, যৌবন, প্রজনন ক্ষমতার কিছুই বাকী নাই। তার উপর তারও তো এমন অনেক কিছুই ছিলো যা তারসাথে এতো বছর ধরে ঘর করা মানুষটির অনেক কিছুই মিল ছিলো না। তাহলে কেনো টিকে গেলো ঐ সম্পর্ক? কিংবা এমন এক যুগল দম্পতির বন্ধন যেখানে স্ত্রী কিংবা স্বামী দিনের পর দিন পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন, অথচ ভালোবাসার মহব্বত দিয়ে স্বামী কিংবা তার স্ত্রী তাদের সংসার, পরিবার একত্রে ঐ অবস্থায়ই আগলে রেখেছেন। সেটা কিসের আশায়? নিশ্চয় এমন কিছু কারন থাকে যেখানে কম্প্রোমাইজ নামক বস্তুটি কিংবা এডাপ্টেসন নামক তত্ত্বটি খুব জরুরী। তা না হলে কানা এক কালো মহিলার সাথে বোবা এক স্বামীর ঘরতো কখনোই টিকে থাকার কথা নয়! অথবা যদি অন্যভাবে বলি, কি কারনে পঞ্চাশ বছর বৃদ্ধার সাথে ভাষাহীন এক বছরের কচি ছোট শিশুর কি কথা হয় যেখানে দুজনেই আনন্দে ফেটে পরেন? অথবা কোন রিলেসনশীপ রুলের আওতায় একটি বন্য প্রানির সাথে একজন মানুষের সখ্যতা হয়? প্রেম ভালোবাসা সবসময় একই ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে একজনের সাথে আরেকজনের সম্পর্ক গড়ে উঠে না। একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের মিলের থেকে অমিলটাই বেশি, তারপরেও বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে একে অপরের জন্য কোনো না কোনো একটা মাত্র ফ্যাক্টরের উপরও সম্পর্কটা টিকে রাখা যায়। যারা পারে না, তাদের ইতিহাস কেউ মনে রাখে না। আর যারা পারে, তারাই হন এই সমাজের একেকজন প্রতিনিধি যারা “রেলেসনশিপ রুল” শাসন করেন। যে ঘর একবার ভাঙ্গে, তা বারবার ভাঙ্গার প্রবনতার মধ্যে থাকে। যে সম্পর্কের ভীত একবার নড়ে যায়, তার ভীত বারবার নড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

তাহলে এখন বিশাল এক প্রশ্ন মানবকুলের সামনে এসে দাঁড়ায়। আর তা হলো, তাহলে কি “রিলেশনশিপ রুলস” বলতে কিছুই নেই? অথবা রিলেশনশীপ রুলসটা কি? আমার মতে, এটা হচ্ছে নিজের সাথে নিজের সমঝোতা। এই সমঝোতার কথা বললে আরেক ধাঁধা সামনে আসে, কি সেই সমঝোতা?

কোনো এক লেখায় আমি একবার বলেছিলাম, “সময় পাল্টায়”, এখন বলছি, সময় পালটায় না, সময় চলে যায়। আর এই চলে যাওয়া সময়ের প্রেক্ষাপটে অনেক কিছু পাল্টায়। পাল্টায় মানসিকতা, পাল্টায় বোধ, পাল্টায় দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি। আর এই পাল্টানোর মধ্যেই আমরা বলি, সময় পালটেছে বলে এটা হয়েছে। সময়ের প্রতিটি ক্ষনের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিচক্ষনতার পরিবর্তন হয়, ধৈর্যের পরিবর্তন হয়, সাথে সাথে নিজের আত্মম্ভরিতাও বদলে যায়। এই পরিবর্তনের জন্য সময়ের দরকার। কারন সময় মানুষকে নিয়ন্ত্রন করে ইমোশনালী, সময় মানুষকে বুঝতে শিখায় কোনটা বন্য, আর কোনটা অদম্য। সময়ের সাথে সাথে মেধার বিকাশ ঘটে। আর এই মেধাই হচ্ছে সমঝোতার প্রথম নিয়ন্ত্রিত রেখা যার মাধ্যমে অন্যান্য অনিয়ন্ত্রনযোগ্য উপাদানগুলিকে নিয়ন্ত্রন রেখে আপাতদৃষ্টির অনিয়ন্ত্রিত আরেকজনের অদম্য বন্য উচ্ছ্বাসকে মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে প্রতিকুল পরিবেশের বিরুদ্ধে পজিটিভ চিন্তাশীল মন তৈরী করে। আর এই চিন্তাশীল মন নিয়ে কারো জন্যই কখনো দ্বার রুদ্ধ না করে প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টার নামই হচ্ছে সমঝোতা। এখানে সবার দেওয়া উপদেশ বা বয়ান করা “রিলেশনশীপ রুলের” কথা শুনার দরকার আছে, বুঝতে হবে কিন্তু সব সময় তা মেনে নিয়ে ঐ মোতাবেক কাজ করতে হবে এমন যেন না হয়। একটা কথা সব সময় মনে রাখা দরকার, অন্যের দেওয়া থিউরী যে আপনার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে, অন্যের দেওয়া উপদেশটাই যে সঠিক উপদেশ সেটা আজ পর্যন্ত কেউ গ্যারান্টি দিতে পারে নাই আর পারবেও না। জীবন একটাই। আর এই জিবনে সব বন্ধুরুপী মানুসগুলিই আপনার সব সময়ের বন্ধু, তা ঠিক নয়। মনে রাখা দরকার যে, সপ্তাহের সবদিবসই আপনার জন্য হাসি নিয়ে আসার কথা নয়, সব ঋতুই আপনার জন্য নীল আকাশ নিয়ে আসার কথা নয়। এখানে যেমন কান্না থাকে, তেমনি থাকে হাসিও। কেউ কান্না নেবেন না, শুধু হাসিটুকুন নেবেন, তার জন্য ঐ হাসি সঠিক আনন্দের নাও হতে পারে।

পরাজিত কমান্ডারের অপারেসনাল প্ল্যান যতোই ভালো থাকুক, আর জয়ী কমান্ডারের পরিকল্পনা যতোই খারাপ হোক, পৃথিবী সবসময় জয়ী কমান্ডারের পক্ষেই ইতিহাস লিখে। আর সেটাই হয় বেস্ট প্ল্যান। পরাজিত মানুষের কথা কেউ শুনে না, সেটা আপনি যেভাবেই যাকেই বলুন না কেনো।

ফলে কখনো কোনো দ্বার রুদ্ধ করবেন না। খোলা রাখুন সব দ্বার। হতে পারে, এই খোলা দ্বারের মাধ্যমেই একদিন সেই আলো এবং বাতাস প্রবেশ করবে যা আপনি অনেকদিন আগে চেয়েছিলেন। আজকে যাকে আপনি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী বলে তার হাত ধরে বসে চোখের জল ফেলছেন, হয়ত সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে দেখবেন, সেই আসলে আপনার আজকের দিনের সব সম্পর্কের ছেদনের মুল হোতা। মানুষকে ঈশ্বর এমন করে বানিয়েছেন, মানুষ এবং অমানুষের সব কিছু দেখতে এক রকমের, শুধু বুঝার জন্য মেধার প্রয়োজন। আর এই মেধা আসে সময়ের পরিবর্তনের সাথে। অপেক্ষা করুন, সময় পাল্টাবে। কারন সময় পিছিনে ফিরে না, কিন্তু সম্পর্ক যেখান থেকে তাল কাটে, তার থেকে আবার পিছনে ফিরে আসতেই পারে। ধৈর্য ধরুন, পুরু ব্যাপারটা নিয়ে নিজে ভাবুন, অনেক জটলা খুলে যাবে। দর কষাকষির মতো নিজের সাথে সম্পর্ক টিকে রাখার জন্য যুক্তি চালাচালি করুন। নিজেকে উভয় পক্ষের লোক হিসাবে ভাবুন। দেখুন, যে ব্যাপারটা আপনি ছাড় দিচ্ছেন না, সেটা অন্য পক্ষে আপনি থাকলে ছাড় দিতেন কিনা। যাদের আপনি কখনো দেখেন নাই, এমন কিছু ভাল বয়স্ক মানুষের সাথে ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলুন। দেখবেন, কোথায় ছাড় দেওয়া যায়, আর কোথায় কম্প্রোমাইজ করা যায়। উদ্দেশ্য একটাই, লক্ষ ঠিক রাখুন যাতে একবার সম্পর্ক করে ফেলার পর ভাঙতে না হয়। প্রয়োজনে সম্পর্ক করার আগে সম্পর্ক ভাঙ্গার কারন গুলি সাব্যস্থ করুন যেনো সম্পর্কই তৈরী না হয়। আর একবার তৈরী হয়ে গেলে তাকে বাচানোর চেষ্টা করুন। কারন, আপনি সম্পর্ক ত্যাগ করলেও কেউ না কেউ তার সাথে আবার নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠবেই, আর যদি ঐ সম্পর্ক টিকে যায়, তবে বলতে হবে, আপনার মধ্যেই ভুল ছিলো।

তবে এখানে আরো একটা বিশেষ কথা না বললেই নয়। যখন এতো কিছুর পরও মনে হবে, না, এই সম্পর্কটা রাখা যাবে না। যেটুকু সময় অপচয় করলে সম্পর্কটা টেস্ট করা যেতো বলে সাব্যস্থ্য হচ্ছে, সেইটুকু সময় আপনার হাতে নাই। আর সেই সময়ের মধ্যে এটারও কোনো গ্যারন্টি নাই যে ব্যাপারটা সাফল্যের মধ্যেই সমাপ্ত হবে। অথবা এমন একটা আভাস থেকেই যায় যে, সম্পর্কটা বিফলেই যাবে, সেক্ষেত্রে যতো দ্রুত সম্ভব এই ব্যর্থ সম্পর্ক থেকে মুক্তির যতোগুলি পথ খোলা আছে, অত্যান্ত আন্তরিকতার সাথে সেগুলিকে বাস্তবায়ন করে এই ব্যর্থ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়া। তাতে মুক্ত পরিবেশে, মুক্তমনে নতুন করে চিন্তা করার অবকাশ থাকে। শুধু একটা নতুন পরিবেশে, ভেঙ্গে যাওয়া মানসিক পরিস্থিতিতে কাউকেই দোসারুপ না করে পুনরায় এই ভুল সম্পর্ক যেনো না হয় তার জন্য অনেক বেশি সতর্ক থাকা এবং চারিপাশ বিবেচনা করে পুনরায় নতুন কোনো আবেগী সম্পর্কে জড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ। হুট করে কোনো আবেগী সম্পর্ক করা থেকে বিরত থাকা খুব জরুরী। এছাড়া আরো একটি বিষয়ে খুব সতর্ক থাকা জরুরী যে, ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্ক নিয়ে আর নতুন করে কোনো প্রকারের ভাবা উচিত না। “যদি” দিয়ে আর কোনো উপসংহার টানা উচিত হবে না। কে ঠকেছে আর কে জিতেছে এর কোনো তুলনা করা যাবে না। কোনো সম্পর্ক নষ্ট হলে দুই পক্ষই হারে বা ঠকে এটাই ফলাফল।

রিলেসনশীপ রুলস বলতে আসলে কিছু নাই। যেটা আছে, সেটা হচ্ছে আপনি কি চান। আর কিভাবে চান। যদি আপনার স্বাধীন চিন্তা করার শক্তি না থাকে, যদি এমন কোনো ব্যক্তির প্ররোচনায় আপনি আপনার সম্পর্ক কে মুল্যায়ন করেন, কিংবা যদি এমন হয়, আপনি কি করবেন, কিভাবে করবেন, কার সাথে কত টুকু করবেন, এই আশায় আপনার নিজের সম্পর্কের উপর অন্যের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন, তাহলে আপনি নিসচিত থাকুন, আপনার কোনো সম্পর্কই কখনো ভালো যাবে না। সেটা আপনার বন্ধুর বেলায়ই হোক, নিজের স্ত্রীর বেলায়ই হোক, অথবা মা বাবা ভাইবোনের বেলায়ই হোক। সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকে।

খোলা হাতে বেচে থাকার চেয়ে কারো হাত ধরে বেচে থাকার নাম হচ্ছে জীবন। ঝগড়া করার জন্য হলেও একজন মানুষ লাগে। একবার যদি সব শেষ করে দেওয়া হয়, হয়ত অনেকদিন পর নিজে কে নিজে প্রশ্ন করবেন, আহা “যদি” এমনটি না করে এমন টি করতাম, “যদি” আরেকটু নমনীয় হয়ে প্রকৃত জিনিষটা বুঝার জন্য সময় নিতাম, “যদি” এইটা না ভেবে ঐটা ভাবতাম, “যদি” ঐ লোকগুলি আমার জীবনে না এসে অন্য কেউ আমার জিবনে আসতো। অথবা “যদি” আমি ঐ সব লোক গুলিকে না শুনতাম ইত্যাদি।

কিন্তু তখন এই “যদি”র উত্তর আর কেউ দেবার জন্য বসে নাই। কিন্তু সেই ঝগড়া করার মানুসটি যদি আপনাকে প্রতি নিয়ত শুধু ঝগড়াই দিয়ে জীবন আরম্ভ করে আর ঝগড়া দিয়েই জীবন শেষ করে, তাহলে বুঝবেন, সম্পর্কটা ভুল। তখন শুধু একটা কথাই মনে হবে, আহা, যদি এই সম্পর্কটা নাহতো, যদি ওই মানুসটির সাথে কখনোই দেখা না হতো, আহা যদি আরো আগে সব বুঝতে পারতাম, তাহলে হয়তো সম্পর্কটাই করা হতো না। কিন্তু আম্রা দেবতা নই, আমরা ভুল করি, ভুল হাত ধরার চেয়ে ভুল হাত ছেড়ে দেওয়া অনেক উত্তম। আর ভুল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নামই হচ্ছে প্রানি।

০৪/১২/২০১৬-ইমোশনাল ম্যানেজমেন্ট

Categories

 

আমি ঠিক জানি না ইমোশনাল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে মন্তব্য করাটা কতটুকু যুক্তি আছে বা আদৌ কোন যোগ্যতা আমি রাখি কিনা। কিন্তু প্রতিদিন আমার চারিপাশে যা দেখছি, যা ঘটছে, যে ভাবে ঘটছে আর এর বিপরীতে প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি পরিবার, তথা সামাজিকভাবে প্রতিটি স্তর যেভাবে সাফার করছে, তাতে মনে হয়, কোথাও কিছু অসঙ্গতিমুলক রীতি, নীতি এবং সর্বোপরি কিছু বাহ্যিক আচরন কাজ করছে। ফলে প্রতিনিয়ত যারা এর প্লেয়ার এবং যারা এর ভিক্টিম তারা উভয়ই নিজ নিজ চেষ্টায় পরিত্রান পাওয়ার আশা করলেও আশারুপ কোনো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছেনা। আর এ কারনে প্রতিনিয়ত ছোট বালক থেকে শুরু করে প্রবীন বয়স্ক মানুষটিও ক্রমাগত অস্থিরতায় ভোগছেন, সংসারে শান্তি নষ্ট হচ্ছে, পারিবারিক বন্ধন ঢিলে হয়ে যাচ্ছে, আর বাড়ছে ক্রমাগত সামাজিক ক্রাইম এবং জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ। এর থেকে কি পরিত্রানের কোনো উপায় নেই? এই আপদ কি তাহলে হুট করে সৃষ্টি হয়েছে? নাকি এই আপদ আগেও ছিলো, তবে তা নিয়ত্রনে ছিলো বিধায় চোখে পড়ে নাই? অথবা এমন কি কিছু যে আধুনিক সভ্যতার বিকাশের পাশাপাশি এটা ধ্বংসের দিকেও এগিয়ে যাচ্ছে?

বিষয়টি আলোকপাত করার আগে আমি “ইমোশনাল” অনুভুতিটি নিয়ে একটু সংক্ষিপ্ত ভাবতে চাই। এই “ইমোশনাল” বিষয়টি আসলে কি? সবাই মাঝে মাঝে কথায় কথায় কাউকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শুনা যায়, বলেন যে, লোকটি “ইমোশনালি বায়াসড” কিংবা ছেলেটি একটু বেশী “ইমোশনাল”।  এটা কি এমন যে, নদী দেখলেই উদাসীন হয়ে যাওয়া, কিংবা সবুজ ঘাসের মাঠ দেখলেই অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া, কিংবা এটা কি এমন যে, বাবা তার কোন সন্তানের জন্য একটা উপহার নিয়ে আসলেন তো আরেকজনের জন্য আনতে পারলেন না বলে, যে পেলো না সে দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে মন খারাপ করে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকা? অথবা এটা কি এমন কিছু যে, পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করার কারনে মন খারাপ করে আত্তহত্যা করা? অথবা এটা কি এমন কিছু যে, আমার ভালো লাগলো না বলে আমি অন্য কারো মতামতের তোয়াক্কা না করেই উলটা পালটা ব্যবহার করা?

ব্যাপারটা মনে হয় ঠিক এই রকম নয়। আমি ব্যাপারটাকে যেভাবে দেখি সেটা হচ্ছে, “ইমোশনালী বায়াসড” বলতে যেটা বুঝি তা হচ্ছে, যেই বয়সে যে মানুষটি যেভাবে কোনো একটা বিষয় যতটুকু বাস্তবতার সাথে তার বুদ্ধি বিবেচনায় বুঝে তা মেনে নেওয়া দরকার বলে একটা মানদণ্ড থাকে কিংবা সেই মানদণ্ড মোতাবেক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে সবাই মনে করেন, সেটা না করে কেউ যদি যুক্তির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে তার স্বার্থের জন্য, লোভের জন্য, আনন্দের জন্য, কিংবা যে কোনো মুল্যেই হোক সেটা তার পেতে হবেই বলে ঘাট বেধে বসে থাকেন, তাহলেই আমি ধরে নেবো সে ইমোশনালী বায়াসড হয়ে আছেন। মানতে চাইছে না, শুনতে চাইছে না, কিংবা বাস্তবতা বুঝতে চাইছে না। তার মানে কি দাড়ালো? এটা কোন বয়সের মধ্যে পড়ে না। এটা যে কারো ব্যাপারে প্রযোজ্য হতে পারে। হতে পারে পাচ বছরের বাচ্চার ক্ষেত্রে, হতে পারে বারো বয়সের কোন উঠতি বয়সের যুবক- যুবতীর ব্যাপারে, হতে পারে প্রবীন কোনো বয়স্ক লোকের ব্যাপারেও। স্থান কাল পাত্র ভেদে এবং বিষয়ের উপাদানের উপর বিভিন্ন বয়সের মানুষদের জন্য এই ইমোশনাল শব্দটি খাটে।

একটা উদাহরন দেই। ধরুন, আপনি একজন মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ। মাসের উপার্জন আপনি প্রতিটি বিষয়ে এমনভাবে হিসাব করে করতে হয় যে, কোন কারনে যদি কখনো তার বাইরে কোন ইভেন্ট চলে আসে, তাহলে আপনার পুরু সংসারের হিসাবে একটা আমুল পরিবর্তন করতে হয়। পরিকল্পনা করেছিলেন, আপনার বারো বছরের ছোট বাচ্চার এ মাসে জন্মদিনের পার্টিটা কিছু খরচ করে কিছু লোক দাওয়াত করে নিজের বাড়িতে খাওয়াবেন। হয়ত একটা নতুন উপহারও দিবেন ভেবে রেখেছেন। এটা আপনার ছোট বাচ্চাটিও হয়ত জানে এবং সে সে মোতাবেক মনে মনে খুশীতেই আছে। কিন্তু হটাত করে আপনার পরিবারে এমন কিছু ঘটনার আবির্ভাব হলো যেখানে আপনার ছোট বাচ্চার জন্মদিনের বাজেটটাই হয়ত সেই অনাখাঙ্গিত খাতে খরচ করতে হতে পারে এবং ওই মাসে তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান আর পালন করা হয়ত সম্ভবই নয়। এ ক্ষেত্রে কি কি হতে পারে?

হতে পারে-

(১) আপনার ছোট বাচ্চাটি খুব মন খারাপ করবে। আর মন খারাপ করে এমন গো ধরবে যে, তাকে শান্ত করাই খুব কঠিন কাজ। সে হয়ত ঠিকমতো কারো সঙ্গেই ভালো ব্যবহার করবে না, নাওয়া খাওয়া করবে না, পড়াশুনা করবে না, কারো সঙ্গে ভালো ব্যবহারও হয়ত করবে না। সারাক্ষন তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকবে ইত্যাদি।

(২) আপনার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও এমন একটা পরিকল্পনায় ব্যাঘাত হওয়ায় মন খারাপ করতে পারে। একদিকে নিজেদের মন খারাপ, অন্য দিকে আদরের কনিষ্ঠ সদস্যের মন খারাপ হওয়ার কারনে আরো অধিক মন ভারাক্রান্ত হয়ে যাবে। তারা হয়ত আপনার ফাইনান্সিয়াল ক্ষমতার পরিধি জানেন বলে হয়ত বাস্তবতা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করবেন বা করার চেষ্টা করছেন। আদরের ছোট মানুষটিকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন ইত্যাদি।

(৩) আপনার নিজেরও কিন্তু বড্ড মন খারাপ হচ্ছে আপনার আদরের ছোট বাচ্চাটির জন্মদিনটা আপনার সামর্থ্যের মধ্যে করতে না পারার কারনে। কিন্তু বাস্তবতা এইরকম যে, জন্মদিন করতে গেলে ওই আকস্মিকভাবে আবির্ভূত ঘটনা সামাল দেওয়া সম্ভব নয় আবার ওই আকস্মিক ঘটনা সামাল না দিলেও অনেক বড় ক্ষতির সম্ভাবনা। এই অবস্থায় আপনি ভাবছেন, আপাতত আকস্মিক ঘটনাটাকেই প্রথমে সামাল দেওয়া অতিব জরুরী, তাই আপাতত জন্মদিন পালন সাময়িকভাবে বন্ধ কিন্তু মনে মনে আছে, যেভাবেই হোক, অতিদ্রুত অন্য কোনো উপায়ে কিংবা অন্য কোন পরিকল্পনায় কাটছাট করে অচিরেই জন্মদিনটা পালন করার চেষ্টা করবেন।

এইপুরু পরিস্থিতিটা যদি আপামোর সব সদস্যরা (আপনার ছোট বাচ্চা, অন্যান্য সদস্যরা) সবাই খুব পজিটিভলী নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে থাকেন, তাহলে আমি বলবো, খুবই আউটস্ট্যান্ডিং একটি পরিবার। ইমোসন আছে কিন্তু বাস্তবতার নিরীখে সবাই সবার লেবেলে যথেষ্ট পরিপক্ক।

কিন্তু যদি উল্টোটা হয়? কেউ মানতেই চাইছে না, অস্বাভাবিক ঘটনা কিভাবে টেক্যাল দিবেন আর কিভাবে দিবেন না, সেটা আপনার ব্যাপার, বাচ্চার জন্মদিন পালন করাই চাই। তাহলে বলবো, আপনি অনেক গুলি ইমোশনাল বায়াসড কিছু সদস্যদের নিয়ে বসবাস করছেন।

ইমোশনাল বায়াসড পরিবারের লোকজন একে অপরের যুক্তি অযুক্তির পন্থায় মানতে থাকেন। পাশের বাড়ির ঐশ্বর্যকে নিজেদের না থাকার সামর্থ্যকে ছোট করে দেখেন, বিশ্বাসের ঘাটতির সৃষ্টি হয়, কখনো কখনো তা সমাজের নীতির বিরুদ্ধেও কাজ করে। আকাশ দেখে ইমোশনাল হওয়া আর মেঘ দেখে ইমোশনাল হওয়া অথবা কোন একটি সিনেমা দেখে ইমোসনাল হওয়ার মধ্যে হয়ত কোনো বড় রকমের দোষ নাই কিন্তু এই অভ্যাস টা ধীরে ধীরে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায় যখন ব্যক্তিত্ব আর বাস্তবতার মধ্যে বড় ধরনের একটা কনফ্লিক্ট কাজ করে।  

০২/১২/২০১৬-সময়

Categories

 

 “সময়” এমন একটি জিনিষ যে এটি প্রতিটি মানুষ, বস্তু, এবং প্রতিটি ইভেন্টের সঙ্গে প্রতিটি ক্ষনে ক্ষনে সে জড়িত, কিন্তু সে কারোরই বন্ধু নয়। সে টিক টিক করে সবার সঙ্গে বয়ে বেড়ায় কিন্তু সে কারো সঙ্গেই সখ্যতা গড়ে তোলেনা। সে সবার সঙ্গে আছে আবার অন্যদিকে সে কারো সঙ্গেই নাই। সে যেমন কারো জন্যই অপেক্ষা করে না, আবার কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে বলে সে তড়িঘড়িও করে সামনে এগিয়ে আসেনা। বাজারের পন্যের মতো তাকে কোথাও কম বা বেশী দরে কিনে যেমন সঞ্চয় করা যায় না, তেমনি, অতিরিক্ত সময় ব্যয়ের কারনে সেই অপচয় করা “সময়”টি আর ফিরেও পাওয়া যায়না। সময়ের কোন বিকল্প নাই। কারো কাছ থেকে ধার করেও এই “সময়” নামক জিনিষটি কখনো পাওয়াও যায়না। এটা এমন এক জিনিষ যে, কেউ তার নিজের তহবিল থেকে ধারও দিতে পারে না। তার গতি সর্বদা সামনের দিকে, কারো জন্যই সে পিছনে ফিরে আসেনা। আজকের সূর্যাস্ত যদি আপনি না দেখে থাকেন, আর কখনোই আজকের চলে যাওয়া সূর্যাস্ত আপনি আর দেখতে পাবেন না। আপনি হয়ত কোনো একটি “সময়ের” ফ্রেম ক্যামেরায় বন্ধি করে রাখতে পারবেন, কিন্তু ওই সময়ের ওইপরিবেশ, ওই আমেজ, ওই আস্বাদন, ওই অনুভুতি সেটা আপনি কখনোই ফিরে পাবেননা। এটা যেনো সেই জলবিন্দু মতো, যে একবার কোন একস্থান বয়ে সামনে চলে গেছে, সে আর দ্বিতীয়বার ওই স্থানে ফিরে আসার সম্ভাবনা নাই, আর আসেও না। Same drop of water never passes twice through a same bridge.

সময় এমন একটা জিনিষ, যাকে সর্ব পরিস্থিতির মহৌষধও বলা যায়। যার ফলে ইংরেজীতে একটা প্রবাদ আছে, Time is the panacea of all situations. কেউ কেউ আবার একে অন্যভাবেও বলে যে, Time is the panacea of all diseases. কথাটা সত্য। যেমন ধরুন, আজকে অতি আদরের কেউ পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার কারনে মাঝে মাঝে কারো কাছে মনে হবে, সব বুঝি শেষ। দুঃখের আর শেষ নাই, কিংবা কারো এই অসময়ের প্রস্থানে অনেকেই ভেঙ্গে পড়েন, অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিংবা এমন হয় যে, আজকে যে অশান্তি পরিবেশ মানুষকে কাবু করে ফেলেছে, হয়ত সময়ের অবগাহনে সে আবার সব ভুলে, সব কিছু আবার নতুন করে ধীরে ধিরে সাজিয়ে তোলেছে। সময়ের ব্যবধানে শান্ত হয়ে আসে পরিবেশ, শান্ত হয়ে আসে জীবনের অনেক কিছুই। এই “সময়”ই মানুষকে সাবলম্বি করে তোলে, আরোগ্য করে তোলে। “সময়ের” স্রোতে মানুষ আবার ঠিক হয়ে যায়। ক্ষন যায়, দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, মানুষ “সময়ের” স্রোতে আবার শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে। হারিয়ে যাওয়া বেদনার কথা ভুলে যায়, ব্যথার কথা ভুলে যায়, চোখের জল মুছে যায়। আর এজন্যই হয়ত বলা হয় “সময়” মানুষকে বদলে দেয়।

“সময়” মানুষকে অভিজ্ঞ করে তোলে। একই সমস্যা, একই ব্যক্তি, বিভিন্ন সময়ের ব্যবধানে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সমাধান করেন। আর এর কারন একটাই, আর সেটা হচ্ছে, “অভিজ্ঞতা”। যে সমস্যাটা আজ আপনি একভাবে সমাধান করেছেন, সেই একই সমস্যা আগামিকাল একই পদ্ধতিতে আপনি সমাধান নাও করতে পারেন। অথবা সময়ের ব্যবধানে অভিজ্ঞতার কারনে আপনি নিজেও হয়ত সেই একই সমস্যা ওই একই পদ্ধতিতে সমাধান করতে চাইবেন না। আর এটাই হচ্ছে পরিপক্কতার লক্ষন।

“সময়” সবকিছু পালটে দেয়। পালটে দেয় পরিস্থিতি, পালটে দেয় মানসিকতা, পালটে দেয় ব্যবহার, অভ্যাস। এমনকি পালটে দেয় মানুষের পছন্দ, অপছন্দ, এমনকি পালটে দেয় সম্পর্ক পর্যন্ত। আজ আপনি যে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন, হোক সেটা সুখের বা কষ্টের, সময়ের ব্যবধানে সেটা পালটে যেতে পারে। আজ আপনার যে মানসিকতা, “সময়ের” ব্যবধানে আপনার মানসিকতা পুরুটাই পালটে যেতে পারে। যে বয়সে আপনি অনেক দুরন্তপনা করেছেন, কিংবা যে “সময়ে” আপনি আবেগের বশে অনেক কঠিন কঠিন শপথ করে কালবৈশাখী ঝড় মাথায় নিয়ে একা সাহস করে অনেক কিছু মোকাবেলা করেছেন, জীবনের কোনো এক সময়ে এসে মনে হবে, হয়ত সেটা করাই ঠিক হয় নাই,  আবার মনে হতে পারে আজ এই বয়সে ওই একই পরিস্থিতিতে আপনি ওই রকম কোনো কিছুই হয়ত করবেননা। হয়ত আপনিই উপদেশ দিবেন, ধৈর্য ধরতে। কারন, আপনি এখন জানেন, আবেগের বশে অনেক কিছু করা যেতে পারে বটে কিন্তু সবশেষে যা অপেক্ষা করছে তার পরিনতি ঠিক যা আশা করছেন তা হয় নাই বা হয়না। তাই উপদেশ হবে হয়ত “ধৈর্য” ধরুন। আর একেই বলে “অভিজ্ঞতা”। অভিজ্ঞতার সঙ্গে “সময়” একটা যোজন। “সময়” যত পেরুবে, অভিজ্ঞতা তত ভারি হবে। আর অভিজ্ঞতা যত ভারি হবে, আপনি তত শান্ত হয়ে যাবেন। বয়স্ক সবচেয়ে বোকামানুষটিও অল্পবয়সের কোন তথা কথিত চালাক মানুষের থেকে বেশি অভিজ্ঞ। আর তার এই অভিজ্ঞতার কারনে এই বোকামানুষটিও ওই অল্প বয়স্ক মানুষটির থেকে ঢের বেশি জ্ঞ্যান রাখেন। এটা অনেকেই হয়ত মানবেন না কিন্তু এটাই সত্য কথা।

“সময়ের” ব্যবধানে বন্ধু পর্যন্ত পালটে যায়। কখনো কখনো বন্ধু পালটে শত্রু হয়ে যায়, আবার “সময়ের” প্রেক্ষাপটে বাব্যবধানে শত্রু একদিন মিত্র হয়ে যায়। আজ যাকে আপনি আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষ বলে মনে করছেন, হয়ত “সময়ের” ব্যবধানে কাল সে আপনার অনেক দুরের বলে মনে হবে। কিংবা আজ যাকে আপনি সবচেয়ে দুরের কাউকে মনে করছেন, “সময়ের” ব্যবধানে হয়ত সেইই আবার সবচেয়ে কাছে মানুষদের মধ্যে একজন বনে যেতে পারে। আর এটাই বাস্তবতা। তাই আজকের “সময়”টাই শেষ কথা নয়। অপসন খোলা রাখুন যেন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শত্রুকে মিত্র, আর মিত্র থেকে সতর্ক থাকার ক্ষেত্র খোলা থাকে। আজ যে আপনার কষ্টে আপাতদৃষ্টিতে বুক ভাসিয়ে চোখের জল ফেলছে, কাল হয়ত এই চরিত্রটিই আপনার সর্বনাশের জাল বুনছে। আজ যাকে আপনি হৃদয়ের সবটুকু অবিশ্বাস দিয়ে যোজন মাইল দূরে সরিয়ে রাখতে সাচ্ছন্দ বোধ করছেন, হয়ত আগামীকাল মনে হবে, তার কোনো বিকল্পই নাই।

“সময়” বড্ড বেরশিক জিনিষ। সে কাউকে আপন মনে করে না, সে কাউকে পরও মনে করেনা। আসলে “সময়” কারো সঙ্গেই তার সম্পর্ক রাখেনা। সে একা, সবাই তার সঙ্গেই চলার চেষ্টা করে। যে পিছিয়ে যায়, সে পিছিয়েই থাকে, আর যে তার সঙ্গে চলতে চায়, “সময়” তার সঙ্গেই কাধে কাধ মিলিয়ে সামনে এগিয়ে চলে। আপনি আজ হেরে গেছেন? এমনও হতে পারে আগামি কাল আবার আপনি জিতে যাবেন। শুধু “সময়ের” ব্যবধান। “আজ” আর “আগামিকাল”। “সময়ের” ব্যবধানে একদিন হেরেছেন আর আরেকদিন জিতে গেছেন।

আজ থেকে শত বছর আগেও এটাই ঘটেছে, আজো এটাই ঘটছে, এবং আগামি শতকের পর শতক অবধিতাই ঘটবে। এটাই সময়ের নিতি। সে কখনই তার নিতি পরিবর্তন করেনা। সে শুধু তার চারিপাশে যারা আছে, শুধু তাদের পরিবর্তন করে দিয়ে চলে যায়।

“সময়” দুর্বলকে সবল করে, সবলকে দুর্বল করে, শক্তিশালীকে পরাভূত করে, নিষ্পেষিতকে শাসক বানায়। “সময়” এমন এক জিনিষ যে, সে গরীবকে ধনী বানায়, ধনীকে গরীবের কাতারে দাড় করিয়ে দেয়। “সময়’ এমন এক অপ্রতিরোধ্য জিনিষ যে, সে ভালোবাসাকে ঘৃণার স্তরে নিয়ে আসতে পারে, আবার ঘৃণার স্তর থেকে ভালোবাসায় পরিবর্তন করাতে পারে। “সময়” কচি খোকাকে পুরুষে পরিনত করে, ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়েকে জটিল সংসারের হাল ধরতে শিখায়। “সময়” মানুষের সব কিছু পালটে দিয়ে এমন এক পরিস্থিতিতে নিয়ে দাড়া করাতে পারে যেখান থেকে বের হয়ে আসার মতো কোন পথও খোলা না রাখতে পারে। আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আপনি অন্যের পরিস্থিতি উপভোগ করছেন, হয়ত আগামিকাল ঠিক সেখানে দাড়িয়েই অন্য একজন আপনার পরিস্থিতি উপভোগ করবে। “সময়” কখন কার সঙ্গে থাকে, কেউ জানে না।

কোনো একসময় “সময়” চলেছিলো রোমের জন্য, রোম শেষ হয়েছে। তারপর “সময়” চলেছে স্পেনের জন্য, স্পেন শেষ হয়েছে। তারপর “সময়” চলেছে রাশিয়ার জন্য। এখন “সময়” চলছে আমেরিকার জন্য। হয়ত একদিন, এই “সময়”টাও শেষ হয়ে যাবে, হয়ত অন্য কারো জন্য সে আবার চলবে।

০১/১২/২০১৬-ধৈর্য

Categories

আমরা কথায় কথায় একটা উপদেশের বানী বলে থাকি, “ধৈর্য ধরুন” কিন্তু কেউ বলছি না, কিভাবে “ধৈর্য” ধরতে হবে। কিংবা “ধৈর্য” ধরার প্রক্রিয়াটা কি। এটা কি এই রকম যে, চুপচাপ বসে থাকার নাম “ধৈর্য”? নাকি এমন কিছু যে, প্রতিবাদ না করার নাম “ধৈর্য”? অথবা এমন কিছু যে, শুধু সব কিছু মেনে নেওয়ার নাম “ধৈর্য”? প্রকৃতপক্ষে এগুলোর হয়ত কোনোটাই না আবার অন্যদিকে এইসবগুলোই হয়ত একত্রে “ধৈর্যের” উপাদান। “ধৈর্য” ধরার প্রক্রিয়াটাও “সময়” বলে দেয় কিভাবে তার শুরু আর কিভাবে তার শেষ। তবে এইটা ঠিক যে, ধৈর্যের সাথে “সময়” নামক জিনিষটা জড়িত। সমাধান পাচ্ছেননা, তো, ধৈর্য ধরুন। কিভাবে? অপেক্ষা করুন, মানে “সময়” নিন। যুক্তির সাথে পরিবেশ ব্যখ্যা করুন, নিরপেক্ষ বিচারে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করুন, সবার কথা শুনুন, কিন্তু সবার কথা মানতে হবে এমন চিন্তা থেকে বিরত থাকুন। সম্ভাব্য সমাধানে পজিটিভ চিন্তা করুন। সম্ভাব্য সমাধানের পরবর্তী প্রতিটি কার্যকলাপের বিপরীতে তার সম্ভাব্য ফলাফলের কতটা আপনার ভালো হয় বা কতটা আপনি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন তার পূর্ণ একটা চিত্র নিজে নিজে ভাবুন। আর ভাবুন, কে আপনার জন্য আর কে আপনার জন্য নয়। সময়ের সাথে সাথে মানুষের যেহেতু আচার আচরন পরিবর্তন হয়, প্রতিটি মানুষের ভুমিকা বিচার করুন। হতে পারে আপনি ভুল মানুষকে বেশি মুল্যায়ন করছেন অথচ যাকে আপনার মুল্যায়ন করার দরকার সবচেয়ে বেশি, তাকেই আপনি দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। প্রি-কন্সিভ আইডিয়া থেকে সরে আসুন, প্রো-একটিভ কাজ থেকে বিরত থাকুন। নিজের সাথে অন্যের আইডিয়ার মধ্যে কোথায় কি কারনে ব্যবধান হচ্ছে, তার সম্ভাব্য কারন গুলি সনাক্ত করার চেষ্টা করুন। হতে পারে আপনি কিছু মিস করে যাচ্ছেন। আর এই মিসিং জায়গাগুলি পূর্ণ করার জন্য “সময়” নিন। অযথা খাম খেয়ালী করেও কোনো মন্তব্য না করাই মঙ্গল। কারন, “ধৈর্যের” মধ্যে এই সহিষ্ণতাও একটা উপাদান। আমি এভাবেই ব্যাপারগুলি চিন্তা করি। এটাই যে একমাত্র পদ্ধতি সেটাও হয়ত সঠিক নয়, হয়ত আপনার কাছে আরো অন্য ভালো কোন পদ্ধতি থাকতে পারে। সেটা নিয়ে স্টেজ বাই স্টেজ বিশ্লেষণ করুন। ধাপগুলি নিয়ে ভাবুন। কার পরে কি হচ্ছে, কোন কোন পদক্ষেপে কি কি ফলাফল হতে পারে, সব কিছু মিলিয়ে একটা ডিসিসন মেকিং পদ্ধতিতে এগিয়ে যান, দেখবেন, যথেষ্ট স্বচ্ছ একটা চিত্র আপনার কাছে ভেসে উঠছে। এটা একটা পথের মতো। পুরু পথটা দেখার চেষ্টা করুন। আপনার থেকে ভাল বিচারক অন্য একজন নয়। এটা ভাবুন।

০৮/০৯/২০১৬- শুভ জন্মদিন তোমায়

Categories

 

সকাল বেলায় অনেকগুলি এসএমএস দেখে নিজেই খুব মনে মনে হাসছিলাম। কোন এক পল্লিগ্রামে আজ থেকে প্রায় ৫১ বছর আগে আমি আমার এক গ্রাম্য মায়ের কোল জুড়ে নাকি মানিকসোনা হয়ে জন্ম নিয়ে সবার মনে হাসি ফুটিয়েছিলাম। আমি কত জোরে কেদেছিলাম, আর কে কত জোরে হেসেছিল, সেটা আমার কস্মিনকালেও মনে নাই, কিন্তু যারা তখন অনেক অনেক খুশীতে খুশিতে আটখানা হয়ে পুরু গ্রাম, সারা বাড়ি মাতিয়ে তুলেছিলেন, তাদের অনুভুতি আজ এতো বছর পরে এসে আমার বুঝতে একটুও বাকি নাই। ওই যে বিখ্যাত মানুষ ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট আবুল কালাম সাহেব বলেছিলেন, “যেদিন তোমার জন্ম হয়েছিল, সেইদিনই নাকি তোমার মা তোমার কান্নায় শুধু হেসেছিলেন”। মায়েরা সন্তানের কান্নায় কখনো হাসেন না, কিন্তু সন্তানের জন্মেরদিন সন্তানের কান্নায় নাকি মায়েরা আনন্দে হাসেন। কি অদ্ভুদ কথা। তাদেরকে আমি আমার অন্তর থেকে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জানাই। দোয়া করি যেনো তারা স্বর্গীয় হন। 

তাদের অনেকেই আজ এই মিস্টি পৃথিবীতে নাই, কিন্তু আমার সেইদিনের জন্ম নেওয়াক্ষনটিকে আমার উত্তর সুরীরা, আশে পাশের বন্ধুবান্ধবরা, আমার অনুজ, আমার সন্তান, বা সন্তান তুল্য মিস্টি মিস্টি দুষ্টু পোলাপান গুলু বড় মজা করে পালনের নিমিত্তে কেউ গোচরে, কেউ অগোচরে, কেউ এসএমএস দিয়ে, কেউ কেক নিয়ে বসে থেকে আমার অখ্যাত এইজন্মদিনটাকে এমন করে সাজিয়ে দিল যে, বড় আনন্দ হল। আনন্দ করার জন্য কোনো উপলক্ষ লাগে না, আনন্দ পাওয়ার জন্য অনেক পয়সাও খরচ করতে হয়না। কিন্তু একটা নিছক উপলক্ষ থাকলে মানুষগুলুকে কাছে পেতে সুবিধা হয়। আজ সেটাই হল।

আমি যখন বাসায় ফিরেছিলাম, তখন জন্ম তারিখটা পার হয়ে পরের দিনের তারিখ চলে এসেছিলো। কাজের চাপ ছিলো অনেক। জন্মদিন পালনের চেয়ে বাস্তব কাজের চাপে সারাদিন আর মনেই ছিলো না ব্যাপারটা। অত্যন্ত ক্লান্ত শরিরে, ঘুম ঘুম চোখে যখন রাত সারে বারোটায় বাসায় পৌঁছলাম, দরজা খুলতেই হতাত করে একগুচ্ছ মিস্টি কচিকণ্ঠে সুর বেজে উঠলো, “হ্যাপি বার্থ ডে বাবা”। আমার মেয়েরা আর মেয়ের জামাই। সারপ্রাইজ দেওয়ার চোখের মধ্যে চিক চিক করা একটা ভাব থাকে। আমি সেটাই দেখলাম এই পিচ্চিগুলির মধ্যে। মানুষ যখন একটা ধাপ পার হয়ে অন্য ধাপে বিচরন করে, তখন সেই ছোট বেলায় ঘুড্ডি, লজেন্স, চকলেট, কিংবা ফেলে দেওয়া কোনো নিছক পাথর খন্ড অথবা নিজের জন্ম দিন যা এক সময় নিজের কাছে সম্পদ মনে হত, নিজের কাছে একটা বিশাল আবেগের অনুষ্ঠান মনে হত, সেটা আর মাথায়ও থাকে না। কিন্তু সেই এক ই অনুভুতির যখন পুনরাবৃত্তি ফিরে আসে আমাদের উত্তরসুরী প্রজন্ম থেকে, তা দেখে মনে হয়, আমিও তোমাদের মতো একদিন এই রকম উচ্ছল, আবেগতাড়িত বয়স তা পার করে এসেছি। ভাবতে বড্ড ভালো লাগে। ওরা আজ তাই করলো। 

আর রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমার বউ, মিটমিট করা চোখে, মোনালিসার হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে বল্লো, “হ্যাপি  বার্থডে মনি।” কিছুই না কিন্তু। কিন্তু মনে হলো, বাহ, কি আনন্দ, কি প্রশান্তি।

ক্লান্ত শরীর, চোখ ভর্তি ঘুম, রাত অনেক, পেটে ভীষণ ক্ষুধা, কিন্তু তারপরও মনে হলো, মন ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। এটাই আসলে “পরিবার”। “পরিবার” মানুষের জীবনে বড় একটা আশ্রয়স্থল এবং শান্তির প্রয়াশ।

এই ক্লান্ত শরীরেও ওদের আনন্দটাকে ধরে রাখতে চাইলাম। কেক কাটলাম, কেক পাঠিয়েছেন আমার মেয়ের শাশুড়ি। ব্যাপারটা দেখলে কিচ্ছু মনে হবে না, আবার ভাবলে অনেক কিছু। কোনো বড় কিছু আয়োজন নাই, অনেক মানুষের ভিড়ও নাই, মাত্র দুইমেয়ে, মেয়ের জামাই আর আমার বউ। তাতেই মনে হলো, একটা আয়োজন।

পরেরদিন শুক্রবার। জন্মদিন পেরিয়ে একদিন চলে গেছে। মনে হলো, আরো কিছু মানুষ তো আছে, যাদেরকে নিয়ে এই ছোট আনন্দটা বড় করা যায়। সোমা এসেছে শুনলাম, রাজুও এসেছে। মেয়েটা দেশের বাইরে থাকে। ও আমার মেয়ের ননদিনী আর ননদিনীর স্বামী। আমার পরিবারের একটা অংশ এবং আমার ভাল লাগার মানুষগুলুর মধ্যে একজন। খুব শীঘ্রই ওরা আবার বাইরে চলে যাবে। সুতরাং ওদের সঙ্গে ঘরোয়া পরিবেশে দেখা হওয়ার সুযোগ কম। ভাবলাম, হয়ে যাক না একটা ছোট খাটো গেট টুগেদার। সেই গেট টুগেদারের অংশই হচ্ছে আজকের এই ছবিগুলুর ইতিহাস। এটা আমার জন্মদিনের পার্টি কিনা আমি জানি না, কিন্তু এটা একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদার বললেই আমি অভিহিত করতে চাই। দিনটা বেশ কেটেছে।

ধন্যবাদ তোমাদের সবাইকে, আর ধন্যবাদ ওই দুইজন মানুষকে, (আমার বিয়াই আর বিয়াইন) যারা সবসময় আমাকে খুশীতে অনেক আনন্দিত হন। সবাইকে আমার প্রাণঢালা ভালোবাসা। অনেক অনেক ভাল রাখুক আমার এই অনবদ্য, ছোট পরিবারের সব সদস্য গুলিকে। আমি তোমাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি। 

১৯/০৮/২০১৬- পৃথিবীকে বদলে দাও

Categories

উত্তর থেকে দক্ষিন, পূর্ব থেকে পশ্চিম, প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য কিংবা গ্রিস থেকে অন্য কোথাও, ছোট কিংবা বৃহৎ যেদিকেই তাকাবেন কিংবা যেখানেই যাবেন, সর্বত্র একটা লিখিত-অলিখিত শ্লোগান দেখবেন কিংবা শুনবেনঃ পৃথিবীকে বদলে দাও। অথবা চা স্টলে বসলে আলাপ আলোচনায় শুনবেন, “আচ্ছা, মানুষ গুলি বদলাচ্ছে না কেনো?” ইত্যাদি।

আমি মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করিঃ কি বদলাতে হবে? কি পরিবর্তন হয়েছে যা বদলানো দরকার? এই পরিবর্তন কি আগের কোনো এক জমানায় ফিরে যাওয়ার আকুতি? নাকি ভবিষ্যতের কোনো এক নাম না জানা টেকনোলোজির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি?

যদি বলি, আগের জামানাই অনেক ভালো ছিলো, যেখানে সব সম্প্রদায় একই জনগোষ্ঠীর আওতায় একে অপরের সঙ্গে মিলে মিশে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলেছিলেন এবং সৌহার্দমুলক এক সমাজে বাস করতেন। একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হলে কুশল বিনিময় করতেন, ভালো মন্দ যা কিছু আছে তার খোজখবর নিতেন, এক বাড়ির মেয়ে আরেক বাড়িতে গিয়ে কোন এক বিয়ের আসরে বসে গ্রাম্য নৃত্যর সাথে নাচানাচি করতেন। হিন্দু মুসলমান, খ্রিষ্টান কিংবা যে যেই ধর্মেরই হোক না কেনো, তাদের মধ্যে একটা সৌহার্দপূর্ণ সদ্ভাব ছিলো। সত্যকে মিথ্যার সাথে, কিংবা আরালে আবডালে একে অন্যের সমালোচনা না করার মানসিকতা, প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশির একটা বন্ধুত্তপূর্ণ অনুভুতি ইত্যাদি দেখা যেত। আমরা কি সেটার কথা বলছি? তাহলে তো বলবো, তখনো তো পাথরযুগও ছিলো যেখানে জীবন্ত মানুষকে মানুষ মেরে ফেলতো, কিংবা মোঘল সম্রাটদের আমলে তো মানবাধিকারের কোনো বালাইই ছিল না অথবা নীল চাষদের আমলে তো মানুষ আরো খারাপ অবস্থায় না খেয়ে খেয়ে ছিলো। তাহলে কি সেই আগের জমানায় ফিরে যাওয়াই কি বদল হওয়ার কথা বলছি? অথবা এমন কিছু নতুন নতুন টেকনোলোজি যা আগামি প্রজন্মের জন্য ধীরে ধীরে উদ্ভাবিত হচ্ছে যেখানে পুরানোদের নতুনদের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত?

আসলে ব্যাপারটা সম্ভবত এই রকম নয়। অনেক জটিল, শুধু জটিল নয়, সময় সাপেক্ষও বটে।

জটিল কতটুকু সেটা না হয় পড়ে ভাবা যাবে কিন্তু সময় সাপেক্ষ ব্যাপারে বলতে পারি যে, আমার এই অল্প আয়ুর জীবনের মধ্যে দেখেছি, আমরাই এক সময় শীতের মৌসুমে ঈদ পর্ব পালন করেছি আবার বর্ষার সময়ও ঈদ পালন করেছি। কারন, ঋতুর পরিবর্তনের ফল, সময়ের তারতম্যের কারনেই এই পরিবর্তনটা হয়। আর এই পরিবর্তন নিছক এক বছর বা দুই বছরের মধ্যেই ঘটে যায় না। তারজন্য যুগের পর যুগ কেটে যায়। ছোট এই উদাহরন দিয়ে বুঝাতে চেয়েছি যে, পরিবেশ বদল হতেও যুগের পর যুগ লেগে যায়। আর মানুষের সভ্যতা তো আরো সময়ের ব্যাপার। এতে জেনারেশন থেকে জেনারেশন পার হয়ে যায়। ফলে বদল বা পরিবর্তন জিনিসটা একা একটা ফ্যাক্টর নয়। এরসঙ্গে জড়িত সময়, মানুষ, সভ্যতা, মানুষের শিক্ষা, উদ্ভাবনীর সাফল্য, নতুনত্তকে গ্রহন করার মানসিকতা ইত্যাদি। আর পরিবর্তনের জন্য এইসব ফ্যাক্টরগুলি একসঙ্গে হতে হবে। সময়ের সঙ্গে মানুষ, মানুষের সঙ্গে মানুষের সভ্যতা, সভ্যতার সঙ্গে মানুষের শিক্ষা, শিক্ষার সঙ্গে উদ্ভাবনির আবির্ভাব, আর সেই উদ্ভাবনীর সঙ্গে পুরানো রীতিনীতি ছেরে মানুষের নতুন কিছু গ্রহনের আন্তরিকতা ইত্যাদি মিলে আসে এই বদল। এর কোনো একটায় যদি বাধ সাধে, তাহলেই বাধাগ্রস্থ হয় বদল হওয়ার প্রক্রিয়া। আর যখন বদল হওয়ার মানসিকতা তৈরি না হয়, শুরু হয় বদলা নেওয়ার প্রক্রিয়া। সেটাও এক প্রকার বদল কিন্তু তা আমরা কখনোই চাই না।

প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ এই বদল হওয়ার শ্লোগান দিয়ে আসছে। বদল যে হয় নাই তা কিন্তু না। পাথর যুগের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ্য, মোঘল সম্রাটদের একচেটিয়া শাসনতন্ত্র, ইংরেজদের দস্যিপনা, বর্গিদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে “বদল” হওয়ার নিমিত্তে সব আমলেই কিছু না কিছু সাহসী মানুষ কিংবা গোত্র আন্দোলন করেছিলো এবং তার সুফল যে হয় নাই তা নয়। সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়েছে, সহমরন প্রথা বন্ধ হয়েছে, জীবিত কন্যা সন্তান হত্যা করা বন্ধ হয়েছে, বাকস্বাধীনতার উন্নতি হয়েছে, ন্যায়নীতির আইন প্রনয়ন হয়েছে, সামাজিক মুল্যবোধের পরিবর্তন হয়েছে, আরো অনেক কিছু। এগুলু হচ্ছে বৈশ্বয়ীক পরিবর্তনের বড় বড় আলোচনা। কিন্তু এই বড় বড় বৈশ্বয়ীক পরিবর্তনের সুচনা প্রকৃতপক্ষে আরম্ভ হতে হয় একেবারে ছোট ছোট পরিবার থেকে, প্রতিটি মানুষের ব্যবহার থেকে, অথবা অন্য অর্থে যদি বলি, এই পরিবর্তনগুলির প্রারম্ভিক ভিত্তি হচ্ছে প্রতিটি মানুষ। আমরা এই প্রারম্ভিক ভিত্তিতে “বদল” চাই। তাহলেই প্রকারান্তে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বয়ীক পরিবর্তন বা “বদল” কার্যকরী হবে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলোঃ এই প্রারম্ভিক ভিত্তি অর্থাৎ মানুষের পরিবর্তন কিভাবে হবে সেটাই এখন বিবেচ্য বিষয়।

রিক্সায় উঠেছেন? দেখবেন, গল্পের ছলে হয়ত রিকশাওয়ালা বলছে, স্যার দেশটার কি কোনো পরিবর্তন হবে না? চা স্টলে বসেছেন? শুনবেন, তুমুল কথাবার্তা হচ্ছে, সমাজটা কি অধঃপতনে চলে যাচ্ছে? স্কুল কলেজে, মিটিং সেমিনারে বসেছেন? দেখবেন, একদল শিক্ষিত লোক দেশের আইন-শৃঙ্গলা, শিক্ষা-ব্যবস্থা, ছাত্র-ছাত্রদের, শিক্ষক-শিক্ষিকার আদর্শ, যোগ্যতা, ইত্যাদি নিয়ে কথা বলছেন। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে সর্বচ্চ আদালত প্রাঙ্গনে বসেছেন? শুনবেন, ন্যায় নীতির পদস্খলনের অনুতাপ। কোনো বাড়িতে বেড়াতে গেছেন? দেখবেন, প্রতিটি অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিয়ে বিব্রতবোধ করছেন। কেউ অভিযোগ করছেন, তাদের সন্তানগন কথা শুনছে না, কেউ কথা রাখছে না, কেউ আদব-কায়দা শিখছে না, কেউ কেউ আবার তাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট বুঝার চেষ্টা না করে বিপথে চলে যাচ্ছে, ইত্যাদি। কারো অভিযোগ স্কুল কলেজের বিরুদ্ধে, কারো অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে, কারো অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে, কারো অভিযোগ সমাজের বিরুদ্ধে, আবার কারো অভিযোগ নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে। আর এই অভিযোগকারীগন সবাইকে আমরা চিনি। যিনি অভিযোগ করছেন এবং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, সবাই কোনো না কোনভাবে আমরাই। আমার সবাই অভিযুক্ত। আবার অন্যদিকে, আমরাই আবার এই অভিযোগগুলির সমাধান, পরিবর্তন চাই। সবাই চাচ্ছি পরিবর্তন, সবাই চাচ্ছি সস্থি, সবাই চাচ্ছি একটা “বদল”। তাহলে পরিবর্তনটা আসছে না কেনো? কোন জায়গাটায় সমস্যা তাহলে?

সমস্যা আসলে শুধু এক জায়গায়। আমরা সবাই বলছি, সব ভালো হয়ে যাক, সবাই বলছি পরিবর্তন হোক, সবাই বলছি “বদল” হোক, শুধু “আমি ছাড়া”। প্রকৃত সমাধান আসলে এই “আমি”র মধ্যে।

যখন কোনো বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কোনো এক শাশুড়ির এই কথা শুনবেন যে, আমার মেয়ের স্বামীটা অনেক ভালো, সে আমার মেয়ে যা বলে, যা আবদার করে, আমার মেয়ের স্বামী সবকিছু শুনে এবং মেনে চলে। কি লক্ষি মেয়ের স্বামী। কিন্তু আমার নিজের ছেলেটা এতো খারাপ যে, সে বউয়ের কথায় নাচে, উঠে আর বসে। তাহলে আপনি এই শাশুড়ির কাছ থেকে কিভাবে “বদল” চাইবেন? কোনো একটা বিয়ের আসরে গেছেন? পুরানো এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। সে কোনো এক স্কুল কিংবা কলেজে চাকুরী করেন, কিন্তু তার সন্তান তার স্কুলে বা কলেজে পড়েন না। কারন সেখানে খুব ভালো পড়াশুনা নাকি হয় না। তাই তিনি তাদেরকে স্কুল বা কলেজে নিজের সন্তানকে পড়ান না। কিন্তু তিনি অন্যের সন্তানদেরকে ওখানে পড়ান। অন্যের সন্তানকে নিয়ে তার চিন্তা নাই, একরকম করে দিন কাটিয়ে দিলেই হল। তিনি তার সন্তানদের পড়াচ্ছেন এমন এক স্কুল বা কলেজে যেখানে ওই স্কুল কলেজের মাসিক বেতনই হাজার হাজার টাকা। ফলে এই অতিরিক্ত টাকা আয় করার জন্য তো তাঁকে বিকল্প পথ বের করতেই হবে। আর এই বিকল্প পথে টাকা আয় করার জন্য তো তাঁকে তার চাকুরীর সময় থেকেই নিতে হবে। তার সময় কই তার অধীনে অধ্যায়নরত ছাত্রকে সময় নিয়ে শিক্ষা দেওয়ার? আবার তিনিই “বদল” চান এই সমাজের শিক্ষা ব্যবস্থার। তাহলে আপনি কিভাবে কার “বদল” চাইবেন?

পাশের বাড়ির মেধাবী সন্তান জিপিএ-৫ পেয়েছে, সরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং, সরকারী মেডিক্যাল কিংবা ভালো ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়েছেন, কিন্তু ফাঁকি দিয়ে লেখাপড়া না করা আমার সন্তান ভালো ফলাফল করতে না পারায় হয়ত নামকরা কোনো ইন্সটিটিউটে ভর্তি হতে পারছে না, তাতে কি? প্রাইভেট ইন্সটিটিউট তো আছে? শুধু টাকা হলেই সম্ভব। কোথা থেকে আসবে এই অতিরিক্ত টাকা? আমাকে তো ভিন্ন পথে যেতেই হবে, হোক সেটা ন্যায় কিংবা অন্যায়। আমার সন্তান কে তো আর যেই সেই ইন্সটিটিউটে পড়ালে চলবে না। আমার এই অতিরিক্ত টাকার সংস্থান করতে আমাকে অন্যায় কিছু করতেই হবে, হোক সেটা ঘুষ কিংবা অন্য কিছু। আবার এই আমিই ঘুষের বিরুদ্ধে কথা বলছি। তাহলে পরিবর্তনটা আসবে কিভাবে? বৃদ্ধ বাবা বা মাকে নিয়ে বাসে উঠেছেন? সিট খালি নাই। পাশে এক তরুন সিট দখল করে বসে আছেন। কোনো মায়া মমতা, কোনো আদব কায়দা, কিংবা কোনো দয়া দাক্ষিন্যতা দেখিয়েও এই বৃদ্ধ মানুষটির দাঁড়িয়ে থাকার কষ্টের কথা চিন্তা করেও তরুন তার নিজের সিটটা ছেড়ে দিতে নারাজ। কিন্তু এই তরুনই যখন তার নিজের বৃদ্ধ বাবা বা মাকে কোনো একদিন ওইরকম এক পরিস্থিতির সম্মুক্ষিন হবেন, তিনি আক্ষেপ করে বলবেন, দেশটা যাচ্ছে কই? কোনো আদব কায়দা কি কিছুই নাই? এবার আসি পরিবারের ভিতরে। আমি রিপাবলিকান দল করি, কেনো আমার স্ত্রী বা ছেলেমেয়ে রিপাবলিকান দল করবে না? আমারটা খাবে, আমারটা পড়বে, অথচ আমার দল করবে না, তাতো হবে না। আমার দলের বিরুদ্ধে কথা বলবে, এটাতো হবেই না। ছেলে ভালো আর্ট করতে পারে, কিংবা খুব ভালো অংক বুঝে, তাতে কি? আমার খুব শখ আমার সন্তান ডাক্তার হবে। কেনো আমার ছেলের কথায় আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং বানাতে হবে তাঁকে? আপনি কোনো এলাকায় নাম করেছেন, হোক সেটা গ্রাম্য বিচারের বেলায়, কিংবা সালিশীর বেলায়। আপনার গ্রামে করিমুদ্দিনও আপনার মতো আরেক নামীদামী গ্রাম্য বিচারক। করিমুদ্দিন কোনো বিচারে গেলে সেখানে আপনার না যাওয়াই শ্রেয় মনে করছেন কারন দুই নামীদামী বাঘ একসঙ্গে থাকে কিভাবে? কিংবা যদি রায়ের এদিক সেদিকে আপনার মতামতের মুল্যায়ন না থাকে সেই ভয়ে আপনি ন্যায় কিংবা অন্যায় যাই হোক না কেনো, আপনি পুরু বিচার কাজটাকেই অস্বীকার করে ফেললেন। তাহলে পরিবর্তনটা আসবে কিভাবে? আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আপনার মতাদর্শের কোন এক কর্মীকে অন্যায় কাজের জন্য ধরে নিয়ে গেছে? কোনো ব্যাপার না। আপনি সরকারী দল করেন, সব কিছুর উর্ধে আপনি। আইন শৃঙ্খলা বাহিনিকে প্রলুব্ধ করে ছারিয়ে নিয়ে এলেন কয়েক ঘন্টার মধ্যে। আবার যখন আপনার বিরোধী দল সরকারী দল হয়ে যাবে, আপনি যখন সেই একই প্রক্রিয়ায় নিষ্পেষিত হবেন, সেই আপনিই বলবেন, দেশে কি কোনো আইনকানুন নাই? তাহলে পরিবর্তনটা হবে কিভাবে? আজ আমি “বদল” হচ্ছি না অথচ কাল আমি সবাইকে “বদল” হতে বলছি। লাভের আশায় আপনি খাদ্যে ভেজাল মিশাবেন, ফরমালিন দেবেন, মরা মুরগী রেস্টুরেন্টে সাপ্লাই দেবেন? দিন। কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু আগামিকাল আপনার সন্তান সেই ফরমালিনযুক্ত খাবার খেয়ে কিডনী নষ্ট করবে, মরা মুরগির রোষ্ট খেয়ে লিভার নষ্ট করবে। তার শরির খারাপ করবে, অসুস্থ হবে, যাবেন ডাক্তারের কাছে, গিয়ে দেখবেন, প্রশ্নপত্র ফাস করে পাশ করা ডাক্তার, ভেজাল ঔষধ সব আপনার সামনে একত্রে হাজির। অসুখ নিরাময় হবে না। একদিন আপনার আদরের সন্তান আপনার চোখের সামনে মারা যাবে। আর এভাবেই আমরা সবাই ঠকছি। কাকে আসলে ঠকাচ্ছি?

একজন চোরও আরেকজন চোরকে পছন্দ করে না, একজন ঘুষখোরও আরেকজন ঘুষখোরকে পছন্দ করে না। মেয়ে বিয়ে দেবেন, ভালো বংশ চান, ছেলে বিয়ে করাবেন? ভালো মেয়ে এবং ভালো পরিবার চান। আমরা সবাই তাই চাই। কিন্তু আমি আমার নিজের পরিবারকে ভালো একটি পরিবার হিসাবে গড়ে তূলতে পারছি না। আমি আমার সন্তানকে ভালো নীতির শিক্ষা দিচ্ছি না। তাহলে আমি কাকে বলছি, “বদল” হউন? ঘরে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে খারাপ আচরন করবো অথচ সামাজিক সেমিনারে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলবো, নিজে বন্ধুবান্ধব্দের নিয়ে নেশা করবো কিন্তু নিজের সন্তানকে নেশা করতে বারন করবো, নিজে ঘুস নেবো কিন্তু অন্যের বেলায় প্রতিক্রিয়া দেখাবো, তাতে তো “বদল” হবে না কিছুই। আমি কারো ফেলে যাওয়া কলার খোসায় পা পিছলে তার গুষ্ঠি উদ্ধার করবো কিন্তু আমি কলা খেয়ে একটু দূরে ডাস্টবিনে না ফেলে রাস্তায় তা ফেলে যাবো, তাতে তো “বদল” কিছুই হলো না। আমি নিশ্চিত জেনেও যখন কোন অন্যায়কারীর পক্ষে ওকালতি করবো, নিশ্চিত জানবেন, অন্য কেউ আমার উপর অন্যায় করলেও আরো ভুঁড়ি ভুড়ি আইনসেবক পাওয়া যাবে যারা আমার ন্যায়কে অন্যায়ভাবে একই প্রক্রিয়ায় রায় ঘুরিয়ে দিয়ে আমাকে পরাজিত করবে। বৃষ্টির দিনে এসি গাড়ির ভিতরে বসে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে পাশে পায়ে হাটা এক পথচারীর জামা কাপর ভিজিয়ে দেবো, অথচ তারজন্য আমি অনুতপ্তও বোধ করবো না, বরং তার দিকে তাকিয়ে মুচকি তাচ্ছিলের হাসি দিয়ে অথবা “ছোট লোকের দল” বলে গাড়ী হাকিয়ে চলে যাবো, তাহলে তো কোনোদিনই “বদল” বলে কিছু আসবে না।

তাহলে এখন আরো একটি প্রশ্ন আসে। আমরা এখন সত্যি সত্যিই “বদল” হতে চাই। কিভাবে? সহজ পথ। আমরা সবাই সেটা জানি। এক কথায় যদি বলি। তাহলে সেটা দাড়ায় “ইনসাফ”। নিজের প্রতি নিজের ইনসাফ। আর এটাই করতে বলেছে ধর্ম। সেটা যার ধর্মই হোক। কোনো ধর্মই বে-ইনসাফি কাজ করতে আদেশ দেয় নাই। কোনো ধর্মই অন্যায় কাজকে প্রলুব্ধ করে নাই। কোনো ধর্মই মানুষের অধিকারকে হরন করতে বলে নাই। সব ধর্মের নিগুড় উপদেশঃ হত্যা, নিপীড়ন, ঘুষ, সুদ, অপহরণ, অন্যায়, গিবত, অহংকার, মারামারি, লোভ, অশ্লীলতা, নেশা, চুরি ডাকাতি, ভেজাল, ঠকবাজী, হটকারিতা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকুন। আর মানুষের মঙ্গল হয় এমন কাজ করুন। আপনি করুন, মানুষ উপকৃত হবে, মানুষ করবে, আপনি উপকৃত হবেন। এই অভ্যাস এবং কাজগুলি একদিনে হয়ে উঠবে না। আবার আপনি করছেন, কিন্তু অন্য এক জন করছে না দেখে আপ্নিও বিরক্ত হবেন, কিচ্ছু যায় আসে না। আপনি আপনারটা করুন। একদিন এই সংখ্যাটা বাড়বেই। প্রতিদিন এই অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। A smile can be a charity. তাই দিয়েই শুরু করুন।

কেউ কেউ হয়ত আবার প্রশ্ন করবেন, আমরা তো ধর্মকে পালন করছি। আমরা তো জানি ধর্ম কি কি বলেছে। তাহলে এর পরেও বদল হচ্ছে না কেনো? এর বিকল্প কি? এর উত্তর একটাই।

জানার নাম ঈমান নয়, মানার নাম হচ্ছে ঈমান। যদি জানার নাম ঈমান হতো তাহলে ইবলিশই হতো সবচেয়ে বেশী ইমানদার। ইবলিশ জানতো অনেক কিছু, সে মানে নাই, কিন্তু আদম অনেক কিছুই জানতেন না, তিনি মেনেছেন। আমরা ধর্ম মানছি, আমরা ধর্মের সব কিছু পালন করছি না।

সময় শেষ হয়ে যায় নাই। “বদল” সম্ভব। আজ থেকেই সম্ভব।   

১৮/০৮/২০১৬- এইচ এস সি পরীক্ষার ফলাফল

শুনলাম, আজ এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বের হয়েছে। সবাই (ছেলেমেয়ে, পিতামাতা, পরিবারের অন্যান্য সদস্যগন) একযোগে টেনসনে আছেন। যার পরীক্ষা ভালো হয়েছে, সেও টেনসনে আছে, যার পরীক্ষা একটু মনপুত হয় নাই, সেও টেনসনে আছে। আর এটাই হবার কথা। তাই তোমাদের এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আমিও কিছু মুরুব্বিপনা করতে চাই, হয়ত ভালো লাগতেও পারে।

আজ থেকে প্রায় ৩৩ বছর আগে আমি তোমাদের মতই একজন পরীক্ষার্থী ছিলাম। তখন এই যুগের মত জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন-৫ নামক কোনো কিছু ছিলো না। তখন ছিল “স্টার মার্ক” আর বোর্ডে “স্ট্যান্ড” করার মাত্র ২০ জনের তালিকা। কে বা কারা এই দুর্লভ ফলাফলের অধিকারী হন, তাদের অনেককেই অনেকে চিনেন না। কিন্তু আমার সৌভাগ্য যে, তখনকার সময়ে ঢাকা বোর্ডে যে ২০ জন তালিকাভুক্ত মেধাবী ছাত্র ছিলো তাদের ১৮ জনই ছিল আমাদের ক্লাসমেট এবং আমাদের কলেজের। পরবর্তীতে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ক্ষেত্রেও এই ১৮ জনই আবার ঘুরে ফিরে মেধা তালিকার মধ্যে বা তার আশেপাশে ছিলো। কেউ বা ডাবল স্ট্যান্ড আবার কেউ একটা। আমি তার কোনোটার মধ্যেই ছিলাম না।

ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর আমরা ক্যাডেট কলেজ থেকে বিভিন্ন সেক্টরে যে যেখানে যোগ্যতা মতো চান্স পেয়েছি ঢোকে গেছি, কেউ মেডিক্যাল, কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং, কেউ বা আর্মিতে, কেউ বা মেরিনে, কেউ ইউনিভার্সিটিতে ইত্যাদি। তখনো ক্যারিয়ার গড়ার জন্য লেখাপরার মধ্যেই ছিলাম। কে কোনটায় ভর্তি হয়েছি, কিংবা কে কোনটায় গিয়ে কতটুকুন লাভ হয়েছে, তার হিসাব বা পরিসংখ্যান নেবার মতো তখন আমাদের যেমন পরিপক্কতা ছিলো না আবার যাচাই করার সুযোগও ছিলো না। কিন্তু আমরা আমাদের সুযোগ কাজে লাগানোর চেস্টা করেছি যার যার লেবেল থেকে। আজ এই বয়সে এসে কেউ আমাকে Aim in Life রচনা লিখতে বলবে না। বা বলার কারনও নাই। আজ সেগুলো ইতিহাসের মতো। চাকুরী নেবার জন্য আজ আমাকে আর কোথাও ইন্টারভিউ দেওয়ার দরকার পরে না বলে হয়ত কেউ আমাকে আমার লেখাপড়ার যোগ্যাতা নিয়েও প্রশ্ন করবে না। তারপরেও আমরা আমাদের লেখাপড়ার উচ্চতা বাড়ানোর চেষ্টা সব সময়ই করেছি। ওটাও একটা নেশার মতো। যাই হোক।  

আজ প্রায় ৩৩ বছর পর যখন পিছনে তাকাই, তখন একটা মুল্যায়নের কথাই সামনে ভেসে আসে। ৩৩ বছর আগে যারা খুব ভালো করেছিলো তারা যেমন বর্তমানে ভালো জায়গায় আছেন, ভালো চাকুরী করেন, সম্মানের সহিত আছেন, আবার যারা তুলনামূলকভাবে একটু কম ভালো ফলাফল করেছিল (মানে স্ট্যান্ড বা স্টার মার্ক পায় নাই), তারাও খারাপ অবস্থায় নাই। এই দ্বিতীয় দলের অনেকেই আবার প্রোফেসনাল লাইফে হয়ত আরো অনেক বেশি সাফল্য লাভ করেছে প্রথম দলের থেকে বেশী যদিও তারা ওই সময় বোর্ডে স্ট্যান্ড করে নাই কিংবা স্টার মার্ক পায় নাই। আবার এমনও দেখা গেছে যে, অনেক ভালো ফলাফল করেও মধ্যম গোছের যে ছাত্রটি যে কাজে আজকে অধিষ্ঠিত আছেন, সেই একই জায়গায় ওই সময়ে তুলনামুলকভাবে খারাপ ফলাফল করেও সেই ছাত্রটি আজ একই স্তরে অধিষ্ঠিত আছেন। তারমানে এই যে, স্কুল কলেজের ক্যারিয়ার আর প্রোফেসনাল লাইফের ক্যারিয়ার দুটি একেবারে ভিন্ন জিনিষ। প্রোফেসনাল লাইফের ক্যারিয়ারের সাফল্য একমাত্র শুধু পড়াশুনার ফলাফলের উপরই নির্ভর করে না। তারসঙ্গে সুযোগ, পরিস্থিতি, পারিবারিক প্রচেষ্ঠা, নিজের বুদ্ধিমত্তা, ম্যাচিউরিটি, আর তারসঙ্গে লাগে লেখাপড়ার মিনিমাম যোগ্যতা। আজ যারা জিপিএ-৫ বা গল্ডেন-৫ পেয়েছো তারা তো অবশ্যই ভালো একটা যোগ্যতা অর্জন করেছো তাতে কোনো সন্দেহ নাই, তারজন্য তোমাদেরকে সাধুবাদ না জানালে কৃপণতাই হবে, কিন্তু যারা চেষ্টা করেছো কিন্তু জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন-৫ পাও নাই, তাদেরও কোনো রকম মন খারাপ করার অবকাশ নাই। কারন প্রোফেসনাল লাইফে সাফল্য পাওয়ার জন্য মিনিমাম যে যোগ্যতাটা দরকার তা ইতিমধ্যে তোমরা অর্জন করেছো অবশ্যই। এমনও অনেক উদাহরন আছে, যে, মিনিমাম কোয়ালিফিকেসন (অর্থাৎ ফলাফলের দিক দিয়ে) ধারি কোনো এক ছাত্র অনেক মেধাবী ছাত্রকে টপকিয়েও সমাজের অনেক উচূ স্তরের সিড়িতে আসীন আছেন। প্রোফেসনাল ক্যারিয়ার একটা বহুমাত্রিক যোগ্যাত্র বহিরপ্রকাশ। সেখানে নিজের মেধার সাথে নিজের চরিত্র, চালচলন, আচার ব্যবহার, বুদ্ধি বিবেচনা, পরিস্থিত সামাল দেওয়ার ক্ষমতা, ইনোভেটিভ আইডিয়া ইত্যাদির সংমিশ্রণ থাকে। পড়াশুনার মেধার সাথে যখন এই আনুষঙ্গিক মেধাগুলি মিলিত হয়, তখন সে হয়ে উঠে একজন অতি উচ্চমানের প্রোফেসনাল। কিন্তু যারা শুধু পরাশুনার মেধাটাই প্রাধান্য দিয়ে অন্যান্য মেধাগুলিকে চর্চা না করেন, তাদের বেলায় সর্বদা কাঙ্ক্ষিত সাফল্য নাও আসতে পারে। আবার এই তথ্যটাই সব সময় যে ঠিক তাও নয়। কারন, পরিস্থিতি এবং সুযোগও অন্যান্য মেধাবলির সাথে ম্যাচ করতে হবে। সুযোগ এলো না, পরিস্থিতি ও অনুকুলে নাই, এই অবস্থায় অনেক মেধাবী ছাত্রও ক্যারিয়ার নির্মাণে হেরে যান। আর এইজন্য দরকার স্রষ্টার কাছে সর্বদা সাহাজ্য প্রার্থনা করাও। পৃথিবীর নাম করা নাম করা অনেক মানুষের জীবনী অধ্যায়ন করলে যা দেখা যায় যে, সাফল্য আসে পরিশ্রমের হাত ধরে। পরিশ্রমই আসলে সুযোগ তৈরী করে দেয়। অলস মানুষের জন্য সুযোগ সবসময় আসে না। তারা মিস করে।

আজ যারা জিপিএ-৫ পাও নাই অথচ আশা করেছিলে, অথবা আজ যারা একটুর জন্য জিপিএ-৫ মিস করেছো, তাদের জন্য বলছি সেই কথাটা যা আমি একবার কোথায় যেনো পড়েছিলাম যে, “জীবনে তুমি কতবার ফেল করেছো সেটা দিয়ে সাফল্য নির্ভর করে না, সাফল্য নির্ভর করে তুমি কতবার ওই ফেল করা পরিস্থিতি থেকে সাফল্যের সহিত বের হয়ে আসতে পেরেছো তার উপর।”

১৮/০৮/২০১৬ আইনিস্টানিক আই কিউ

Categories

১১ বছরের একটি ছেলে তার আইনিস্টানিক আইকিউ এর মতো বুদ্ধিমত্তার কারনে সব স্কুল কলেজ বাদ দিয়ে সরাসরি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো। বাচ্চা ছেলে, মা অনেক চিন্তিত ছেলেকে নিয়ে। দূরদেশ, কিভাবে থাকবে, কিভাবে খাবে, কিভাবে নিজের যত্ন নিবে, সবভেবে মা অনেক পেরেশানি।

মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় মা অতি যত্ন করে ছেলের কোটের পকেটের ভিতরের দিকে একটা ২৫ সেন্টের মুদ্রা সেলাই করে দিয়ে বললেন, “বাবা, যদি ঐখানে গিয়ে তোমার ভালো না লাগে, মন খারাপ থাকে কিংবা তোমার আর পড়তে ইচ্ছে না হয়, আমার কথা মনে হয়, তাহলে এই ২৫ সেন্ট মুদ্রাটা বের করে ট্রেন ভাড়া দিয়ে আমার কাছে চলে এসো”। ট্রেনভারা ২৫ সেন্টই লাগে বলে মা ২৫ সেন্টই গোপন পকেটে সেলাই করে ছেলের জন্য দিয়ে দিলেন যাতে কোনো কারনে ছেলের মন খারাপ, কিংবা মায়ের কাছে আসতে চাইছে কিন্তু তার কাছে ভাড়া নাই, তাই তিনি ট্রেন ভাড়া হিসাবে অগ্রিম ২৫ সেন্ট গুজে দিলেন তার কোটের পকেটের ভিতরে।

কোনো এক শীতের মৌসুমে ছেলেটি ইউনিভার্সিটিতে চলে এলো। সবাই তাঁকে অনেক অনেক আদর করে, অতি কনিষ্ঠ একজন ছাত্র কিন্তু খুবই মেধাবী। সব শিক্ষকরাও তাঁকে পেয়ে অনেক খুশী এবং তারা সবাই ছেলেটিকে অনেক আদর করেন। তার কথা অনেকেই মনোযগ সহকারে শুনেন। তিনি অনেক কঠিন কঠিন সমস্যার অল্প সময়েই উত্তম সমাধান দিয়ে দিতে পারেন। এমনই মেধাবী সে। কিন্তু ব্যতিক্রম হলো এক স্যারের বেলায়। সে তার ক্লাস টিচার।

তার ক্লাশ টিচার তারসাথে এমনভাব করেন যে, এই ছাত্রটি তার ক্লাশের সবচেয়ে অপ্রিয় একজন ছাত্র এবং তার মতো আহাম্মক আর একটাও নাই, তার কোনো মেধাও নাই। যেই এসাইন্মেন্টই দেওয়া হোক না কেনো, সে যদি সবচেয়ে ভালোও লিখে, তাতেও ক্লাশ টিচারের মন ভড়ে না, গলেও না, তার মেজাজ যেনো সব সময় ছাত্রটির উপর চড়া। কখনো ক্লাশ টিচার তার খাতাপত্র ছিড়ে ফেলেন রাগে, কখনো আবার এসাইন্মেন্ট না পড়েই “কি লিখেছো এসব” বলে সবার সামনে ছুড়ে ফেলে দেন ইত্যাদি।

ক্লাশ টিচারের এইরকম একটা আচরনের কোনো কারন কেউ খুজে পান না। আবার ক্লাশ টিচারের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করবেন, তার সাহসও কারো নাই। ক্রমে ক্রমে দিনে দিনে এই নাবালক ছাত্রটি ইউনিভার্সিটির পড়াকে একটা দুঃসহ জীবনের অভিজ্ঞতার মতো মনে করতে লাগলো। তার মন খারাপ হতে থাকে, শরির খারাপ হতে থাকে, পড়াশুনার উপর তার বিতৃষ্ণা গড়ে উঠতে থাকে।

একরাতে, তার খুব মন খারাপ হয়, মায়ের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে মায়ের দেওয়া ওই ২৫ সেন্টের কথা। বাচ্চা ছেলে, হয়ত আইকিউ বেশি কিন্তু পরিপক্কতা তো আসে নাই। সে তার সব কাপর চোপড় গুছাতে থাকে, বইপত্র ব্যাগে ঢোকাতে থাকে। আজ রাতেই ট্রেন। ট্রেনে করে মায়ের কাছে চলে যাবে। আর ফিরবে না। কাউকেই সে এ কথা বল্লো না। সব গুছানো শেষ। এবার ট্রেনের উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হবার পালা।

যেই না ছেলেটি তার ব্যাগসমেত রুম থেকে বের হবে, ঠিক ওই মুহূর্তে তার ক্লাশ টিচার তার রুমের সামনে এসে হাজির। ক্লাশ টিচারকে দেখে তো ছেলেটির অন্তরাত্মা চমকে উঠলো। গায়ের রক্ত যেনো হিম হয়ে আসতে লাগলো। শীতের ওই রাতেও ছেলেটির মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করতে লাগলো। ভয়ে তার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছিলো না।

-“কি চলে যাচ্ছো নাকি? কোথায় যাচ্ছো? মায়ের কাছে?” ক্লাশ টিচার খুব সহজ করে প্রশ্ন করলেন ছেলেটিকে।

কোনো উত্তর না দিয়ে ছেলেটি শুধু কিছুটা ভয়ে, কিছুটা আবেগে শুধু মাথা নেড়ে “হ্যা সুচক” উত্তর দিলো।

-“চলো, ভিতরে চলো। তোমার সঙ্গে গল্প করি”। বলে ক্লাশ টিচার ছেলেটিকে অতি আদরের সহিত বুকে জড়িয়ে রুমে বসালেন। তারপর বল্লেনঃ

-তোমার কি খুব মন খারাপ? আমার উপর তোমার খুব রাগ? কিন্তু আমি তো তোমার উপর কখনো রাগ করি নাই। তাহলে শুন।

-আজ থেকে বহু বছর আগে, তোমার থেকেও ছোট একটা বয়সে আমি একটা নামীদামী ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলাম। আমার আইকিউও তোমার থেকে বেশি ছিলো। আমিও তোমার মতো সব সমস্যা অনেক দ্রুত এবং সঠিকভাবে সমাধান করতে পারতাম। আমার ক্লাশ টিচার, আমার সহপাঠী সববন্ধুরা, আমার পরিবার, আমার আশেপাশে যারা ছিলেন, তারা আমাকে এতোটাই সমিহ করতেন যে, আমার ভিতরে একটা জড়তার মতো শক্তি কাজ করতে থাকলো। আমার যত ইনোভেটিভ আইডিয়া, আমার যতো মেধা এবং যতোটুকু আমার আরো দেবার দরকার ছিলো তাতে আলসেমির একটা ভাব চলে আসে। মনে হতো, আমি তো সবই জানি, সবই করতে পারি। ফলে আমার চিন্তাশক্তি, চিন্তার মননশীল প্রবাহ স্লথ হয়ে আসে। যতোটুকুন আমি এগিয়ে যেতে পারতাম, তার থেকে আমি অনেক গুন কম অগ্রসর হতে পেরেছি কারন আমার পাশে শুধু চাটুকারের মতো অবুঝ লোকজনই বেশি ছিলো। আমি যখন এটা বুঝতে পারি, তখন নিজের কাছে আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়েছে এই কারনে যে, আমি আমার মেধার যথেষ্ট প্রতিফলন ঘটাতে পারি নাই, আমার মেধার চর্চা হয় নাই। এই সব লোকদের অহেতুক ভালোবাসা আর নির্বোধ স্নেহের কারনে আমি ধীরে ধীরে সাধারন একটা মানুষের সাড়িতে দাড়িয়ে ছিলাম। আজ যখন আমি তোমার দিকে তাকাই, তখন আমার কাছে মনে হয়েছে, তুমি নিজেও ওই সব চাটুকারদের ফাদে আটকে যাচ্ছো যেখান থেকে তুমি তোমার পুরু মেধার ফলাফল পাবে না। আমি ওইসব লোকদের কারনে ঠকেছি কিন্তু আমি তোমাকে ঠকতে দিতে চাই নাই। তাই আমি সবসময় আরো বেশী চাই, আরো বেশী করে তুমি তোমার মেধার শক্তি প্রয়োগ করো সেটাই চেয়েছি। ফলে আমি তোমাকে সবার মত তোমার কৃতকর্মের ফলাফলে তোষামোদি না করে, অহেতুক বাহবা না দিয়ে তোমার ভিতরের মেধাশীল আত্মাটাকে আরো নেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমি আমার ওই ব্যবহারের মাধ্যমে এটা বুঝাতে চাই নাই যে, আমি তোমাকে স্নেহ করি না, ভালোবাসিনা কিংবা আমি তোমার উপর বিরক্ত। আমি তোমাকে সবার থেকে বেশী ভালোবাসি, এটা আমি তোমাকে বুঝতে দিতে চাই নাই। আমি চাই নাই, আমার অতি আদরের মতো একটা শিশু যে অসামান্য মেধা নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছে , সে অন্যসব লোকদের তোষামোদিতে গা ভাসিয়ে দিয়ে মেধার বিকাশ থামিয়ে দিক। আমি যা হতে পারি নাই, আমি তোমার মত একজন অসামান্য সন্তানের কাছ থেকে সেটাই পেতে চেয়েছি। এইটুকু বলে ক্লাশ টিচার থামলেন।

তারপর তিনি আবারো বলতে লাগলেন,

-আজ তোমাকে একটা বাস্তব উপদেশের কথা বলি। যা তুমি বাস্তবে দেখছো, তা তুমি সত্যি দেখছো না সবসময়। যে আজ তোমাকে নিয়ে অনেক গল্প করে, সেই কোনো একদিন তুমি খসে গেলে অন্য রকমের গল্প করবে। যে আজ তোমার অনেক কাছের বন্ধু বলে মনে হবে, সে আসলে তোমার বন্ধু নয়। এর মধ্যে অনেকে আছে যারা তোমার সত্যিকারের বন্ধু বটে কিন্তু তোমার মেধাকে জাগ্রত করতে তাদের মেধা নেই। হয়ত তারা তোমার কোনো ক্ষতি চায় না। কিন্তু তাদের অহেতুক বাহবা কিংবা তোমার মেধা যে বিকশিত হচ্ছে না এটাই হয়ত তারা বুঝতে পারে না। ফলে তাদের অতিরিক্ত স্নেহশীলতা, অতিরিক্ত ভালোবাসা তোমার মেধাশীল চিত্তের ক্ষতি নিশ্চয়ই হবে যা তারা নিজেরাও জানেন না। অন্যদিকে, যাকে তুমি আজ মনে মনে অপছন্দ করছো, হয়তবা সেই তোমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু যাকে তুমি চিনতে পারছো না। চোখ সবসময় সঠিক জিনিষ দেখে না, আর সঠিক জিনিষ না দেখার কারনে মুল্যায়নটাও সঠিক হবে না। তোমাকে আমার মত করে বড় করার জন্য কখনো তোমাকে আগুনের তাপের মত কষ্ট, আমার রাগের মত হিংস্রতা, আমার নির্দয় ব্যবহারের মত মানসিক কষ্ট সহ্য করতে হবে। যদি সহ্য করতে না পারো, তাহলে আমার দেখানো পথে তুমি কিভাবে আরো বড় হবে? তাহলে আমি আমার এই জ্ঞ্যানের সাম্রাজ্য কিভাবে তোমার কাধে দিয়ে যাবো? ওস্তাদের কাজ শাগরেদ গড়ে তোলা, আর সাগরেদের কাজ ওস্তাদের সব কিছুকে পজিটিভভাবে নেওয়া। ব্রুসলী একদিনে তৈরি হয় নাই, নবাব সিরাজ একদিনে সৃষ্টি হয় নাই, অলিম্পিকের একটা গোল্ড মেডাল একবার দৌর দিয়েই পাওয়া যায় না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস তাঁকে চর্চা করতে হয়েছে ঘাম, পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে। সাফল্য চুপে চুপে এসেছে এই তথ্য কেউ কখনো দিতে পারবে না। তারজন্য অনেক ধৈর্য আর সঠিক গুরুর দরকার। এতো অল্পতেই হেরে গেলে চলবে? আমি তো আছি তোমার পাশে।   

এই বলে ক্লাস টিচার ছেলেটিকে বুকে নিয়ে কিছুক্ষন ধরে থাকলেন, তিনি শুনতে পেলেন, তার বুকে মাথা রাখা এক অবুঝ কিন্তু অসামান্য মেধাশীল বালকের ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার শব্দ। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তার জামা ভিজে যাচ্ছে বালকের অশ্রুসিক্ত জলে। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, এই অসামান্য মেধাশীল বালককে আর নতুন করে কিছুই বলার নাই। মেধাই তাঁকে সব অজানা না বলা কথা তার অন্তরে অন্তরে গেথে দিচ্ছে।

ক্লাশ টিচার বালককে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে বুকে আগলে ধরে রাখলেন চরম মমতা দিয়ে। হয়ত তারও এক ফোটা  জল গড়িয়ে পড়ছিল বালকের ক্ষুদ্র কেশবি মাথায়। রাতের ক্ষিন আলোছায়ায় হয়ত তার কিছুই দেখা গেলো না।

সিনেমাটা এখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো।

মোরালঃ মেধাশীল হলেই সাফল্য পাওয়া যাবে তা সঠিক নয়। মেধাশীলদের মেধা চাটুকারদের কিংবা অবুঝদের ফাদে পড়ে সাফল্য বাধাগ্রস্থ হয়, সেটাই সঠিক। কিন্তু যোগ্যব্যক্তির সব ব্যবহার বুঝতে না পাড়লেও কিংবা পছন্দ না হলেও তার আশেপাশে থাকাই হচ্ছে সাফল্যের সোপান। দেখুন, শিখুন এবং বুঝুন কোন ব্যবহার কি কারনে সাফল্যধারি মেধাশীল ব্যক্তি করেন। আর এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে অভিজ্ঞতার ভান্ডার। নিতে পারলে ভালো, আর না নিতে পারলে ক্ষতি তার, যে নিতে পারে নাই।

(এইরুপ একটা জ্ঞ্যানি ব্যক্তি কে তার কাহিনি আমাদের পবিত্রগ্রন্থ “আহজাবে কাহাফ” (সম্ভবত) নামক সুরায়ও বর্ণিত আছে সেখানে হযরত মুসা (আঃ) অবলোকন করেছেন কোনো এক জ্ঞ্যানি ব্যক্তির অনেকগুলি ব্যবহার দেখে, যেখান থেকে তিনি পরবর্তীতে বুঝেছিলেন যে, ওই জ্ঞ্যানি ব্যাক্তি সবগুলি কাজ ভালো নিয়তেই করেছিলেন কিন্তু হযরত মুসা তার মেধার ভিত্তিতে বুঝতে পারেন নাই। পরবর্তীতে তিনি অধৈর্য হয়ে যাওয়াতে ওই জ্ঞ্যানি লোকের সহচর্জ ছাড়তে হয়েছিলো তাঁকে)

১৪/০৮/২০১৬- ৯/১১ এর ফল রাইস ভুইয়া

Categories

 

৯/১১ এর আসল হোতা কে বা কারা, এই তথ্যটা আজো পর্যন্ত জানা না গেলেও বিশ্ববাসী জানে যে, এটার পিছনে মুল পরিকল্পনাকারি যিনি তিনি একজন মুসলমান নামধারি ব্যক্তি। ফলে, ৯/১১ এর পরে হতাৎ করে সারাবিশ্ব মুসলমানদের প্রতি একটা খারাপ ধারনা করে নেয়। কেউ এটাকে কিছু বিচ্যুত ধার্মিক লোকের কাজ বলে মনে করেন, কেউ আবার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এটাই ইসলাম সমর্থন করে বলে মনে করেন ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, ৯/১১ এ যারা প্রান দিয়েছেন, তারা আর যাই হোক, তারা নিরীহ এবং শান্তিপ্রিয় মানুষ ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। তারা তাদের নিজের ধর্ম নিজের মত করেই পালন করতেন, সেখানে কারো সঙ্গে কারো বিরোধ ছিলোনা। ওইসব নিরীহ মানুষগুলুর অসময়ের প্রানত্যাগ আমাদের সবাইকে অনেক অনেক ব্যথিত করে তুলেছিল এবং এখনো ব্যথিত করে। যারা ওইসব মানুগুলুর নিকটাত্মীয় ছিলেন, বন্ধু বান্ধব ছিলেন, যাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক ছিলো তাদের কাছে ওইসব মানুসগুলুর প্রানত্যাগ তো কোনোভাবেই সহ্য করার মত ছিলো না। ফলে কারো মনে ঘৃণা, জিদ, আক্রোশ যে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। আর এই আক্রোশ, ঘৃণা, কিংবা জিদ যাইই বলি না কেনো, তার থেকেই ঘটনা পরবর্তী অনেক কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে। যেমন, মার্ক স্ট্রুম্যানের কিলিং মিশন।

৯/১১ এর ১০ দিন পর, রাইস ভুইয়া মার্ক স্ট্রুম্যানের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হন এবং মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে থাকেন। এখানে রাইস ভুইয়া সম্পরকে কিছু না বললে ভুল হবে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একজন নাগরিক। তিনি সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে বাংলাদেশ এয়ার ফোরসেও যোগদান করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি কম্পিউটার টেকনোলোজি পড়ার জন্য আমেরিকার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন। প্রথমে তিনি নিউইয়র্ক পরে তুলনামূলকভাবে কম খরচের স্ট্যাট ডালাসে চলে যান এবং সেখানে তিনি তার এক বন্ধুর গ্যাস স্ট্যাসনে পার্টনারশিপ ব্যবসায় যোগ দেন।

এবার আসি, মার্ক স্ট্রুম্যান সম্পরকে কিছু কথা। মার্ক স্ট্রুম্যান একজন দৈনিক শ্রমিকের কাজ করতেন ওই ডালাস শহরেই। ৯/১১ ঘটনার পরে মার্ক স্ট্রুম্যান এতোটাই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন মুসলমানদের উপর যে, তিনি আরব বংসোউদ্ভুত কিংবা মধ্যপ্রাচ্য, কিংবা মুসলমান যে কোনো দেশের অধিবাশিই হোক, তাদেরকে খুন করাই ছিলো তার নিশানা।

এই কিলিং মিশন এর এজেন্ডা হিসাবে মার্ক স্ট্রুম্যান ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে ডালাসের এক শব্জি দোকানে ওয়াকার নামে এক পাকিস্থানিকে এবং তার ৬ দিন পর রাইস ভুইয়াকে সরাসরি গুলি করেন। ভাগ্য চরম ভালো যে, জনাব রাইস ভুইয়া প্রানে মারা যান নাই কিন্তু তার ডান চোখের দৃষ্টি হারিয়ে যায় এবং এখনো তার দেহে প্রায় ৩৫টি প্যালেট বিদ্যমান যা অস্ত্রপ্রচারেও বের করা সম্ভব হয় নাই। অবশেষে মার্ক স্ট্রুম্যানকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং বিচারের সম্মুখীন করে।

সবশেষে মার্ক স্ট্রুম্যান এর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু জনাব রাইস ভুইয়া এই মৃত্যুদণ্ডের বিপরিতে আপীল করেন যাতে মার্ক স্ট্রুম্যানকে হত্যা না করা হয়। জনাব রাইস ভুইয়া টেক্সাস এমেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর ডেথ পেনাল্টি আবোলিসন ক্যাম্পেইন এর মাধ্যমে, কোর্টের মাধ্যমে, এমনকি নিজে সশরীরে আদালত প্রাঙ্গনে হাজির হয়ে মার্ক স্ট্রুম্যানের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করানোর জন্য দাঁরে দাঁরে ঘুরেছেন। এইভাবে প্রায় ১০ বছর পার হয়ে গেছে মার্ক স্ট্রুম্যানের বিচার কার্যকরী করতে।

বিশ্বের সবাই অবাক হয়ে শুধু একটা প্রশ্নই জনাব রাইস ভুইয়াকে করেছেন, কেনো তিনি তার ঘাতককে ক্ষমা করে দিচ্ছেন, শুধু ক্ষমাই না, তাকে মুক্তজীবন দান করতে চাচ্ছেন? জনাব রাইস ভুইয়া যা বলেছেন তা আমি হুবহু লিখছি যাতে কোনো কিছু ব্যত্যয় না ঘটে।

Q: Mr. Stroman has admitted trying to kill you. Why are you trying to save his life?

A: I was raised very well by my parents and teachers. They raised me with good morals and strong faith. They taught me to put yourself in others’ shoes. Even if they hurt you, don’t take revenge. Forgive them. Move on. It will bring something good to you and them. My Islamic faith teaches me this too. He said he did this as an act of war and a lot of Americans wanted to do it but he had the courage to do it — to shoot Muslims. After it happened I was just simply struggling to survive in this country. I decided that forgiveness was not enough. That what he did was out of ignorance. I decided I had to do something to save this person’s life. That killing someone in Dallas is not an answer for what happened on Sept. 11.

প্রশ্ন ছিলোঃ মার্ক স্ট্রুম্যান স্বীকার করেছেন যে তিনি আপনাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আপনি কেনো তাকে বাচাতে চাইছেন?

জনাব রাইস ভুইয়ার উত্তর ছিলো; আমি আমার পিতামাতা এবং শিক্ষকদের দ্বারা অতি উত্তম শিক্ষায় মানুষ হয়েছি। তারা আমাকে নীতির মধ্যে এবং শক্ত বিশ্বাসের উপর মানুষ করেছেন। তারা আমাকে অন্যের জায়গায় বসিয়ে তাদের দিকটা বিবেচনা করার শিক্ষা দিয়েছেন। তারা আমাকে শিখিয়েছেন, কেউ যদি তোমাকে দুঃখ দেয়, প্রতিশোধ নেওয়ার দরকার নাই, এবং নিও না। তাদেরকে ক্ষমা করে দাও। সামনে এগিয়ে চলো। এতে তোমার এবং অন্যের উভয়ের মঙ্গল হবে। আমার ধর্ম ইসলামও তাই শিক্ষা দেয়। মার্ক স্ট্রুম্যান যা করেছে, তা একটা যুদ্ধের পরিস্থিতির মতো মনোভাব এবং এই মনোভাবটা অনেক আমেরিকানরাই মনে মনে পোষণ করে যা স্ট্রুম্যান করেছে। হয়ত তারা (আমেরিকানরা) করার সাহস পাচ্ছিলো না কিন্তু মার্ক স্ট্রুম্যান করার সাহস পেয়েছিলো। এই ঘটনা ঘটার পর আমি শুধু নিজেকে এই দেশে বেচে থাকার জন্য সামলে নিয়েছি, অনেক কস্ট করেছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, শুধু তাকে ক্ষমা করাই একমাত্র সমাধান নয়, মার্ক স্ট্রুম্যান যা করেছে তা সে তার নির্বুদ্ধিতার কারনে করেছে, সে বুঝে নাই। এখন আমার কাজ তাকে বাঁচানো। ডালাসে বসে কাউকে খুন করাই সেপ্টেম্বর ১১ তে কি হয়েছে তার সমাধান হবে না।

শেষ পর্যন্ত আদালত মার্ক স্ট্রুম্যানের পূর্বের রেকর্ড, তার চরিত্রের বৈশিষ্ট সবকিছু চুলচেরা বিস্লেসন করে মৃত্যুদণ্ডই বহাল রাখেন এবং ২১ জুন ২০১১ তে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করেন। মৃত্যুর আগে মার্ক স্ট্রুম্যানকে প্রশ্ন করা হয়েছিলোঃ

Q: How are you doing, Mr. Stroman?

A: “I ’ve only 25 days left until Texas Straps me to a gurney and pumps me full of toxic bug juice, But then again, we all face an ending at some time or another. All is well, Spirits are high, I sit here with a cup of coffee and some good ole classic rock playing on my radio, how Ironic, the song ‘Free Bird’ by Lynyrd Skynyrd…”

Q: What do you think of Rais Bhuiyan’s efforts to keep you from being executed? A: “Yes, Mr Rais Bhuiyan, what an inspiring soul…for him to come forward after what I’ve done speaks volume’s…and has really touched my heart and the heart of many others World Wide…especially since for the last 10 years all we have heard about is how evil the Islamic faith can be…its proof that all are Not bad nor evil.”

Q: Tell me what you are thinking now, a few weeks before your scheduled execution.

A: “Not only do I have all my friends and supporters trying to save my life, but now I have The Islamic Community Joining in…Spearheaded by one very remarkable man named Rais Bhuiyan, who is a survivor of my hate. His deep Islamic beliefs have gave him the strength to forgive the un-forgiveable…that is truly Inspiring to me, and should be an example for us all. The Hate, has to stop, we are all in this world together. My jesus faith & Texas Roots have deepened my understanding as well. Its almost been 10 years since the world stopped turning, and we as a nation will never be able to forget what we felt that day, I surely wont, but I can tell you what im feeling today, and that’s very grateful for Rais Bhuiyan’s efforts to save my life after I tried to end his. A lot of people out there are still hurt and full of hate, and as I sit here on Texas Death watch counting down to my own death, I have been given the chance to openly express whats inside this Texas mind and heart, and hopefully that something good will come of this. We need more forgiveness and understanding and less hate.” Mr. Stroman signed off, “Texas Loud & Texas proud…TRUE AMERICAN…. Living to Die – Dying to Live.”

বাংলায় অর্থঃ

মৃত্যু পথযাত্রি মার্ক স্ট্রুম্যানকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো,

(১) আপনি এখন কেমন আছেন?

উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “টেক্সাস আদালতের রায় অনুযায়ী বিষ প্রয়োগ করে আমাকে মেরে ফেলার আর মাত্র ২৫ দিন বাকি আছে। সবাই মরবে, আজ অথবা কাল। সব কিছুই ভাল, বিধাতাও ভালো। আমি এখন এখানে এক কাপ কফি আর কিছু খেলার সরঞ্জামাদিসমেত কিছু কিছু রক মিউজিক শুনছি রেডিওতে। আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে একটা গানের কলি শুনি, আর তা হচ্ছে, পাখিকে মুক্ত করে দাও……”

(২) মার্ক স্ট্রুম্যানকে ২য় প্রশ্ন করা হয়েছিলো যে, আপনাকে বাচিয়ে রাখার জনাব রাইস ভুইয়ার আপ্রান চেস্টা আপনাকে কি মনে করিয়ে দেয়? বা আপনি কিভাবে ভাবছেন জিনিষটা?

উত্তরে মার্ক স্ট্রুম্যান বলেছে, “হ্যা, সত্যি কি স্পিরিচুয়াল (আধ্যাত্মিক) একজন মানুষ। আমি যা করতে চেয়েছিলাম তা তিনি জেনেও কি অবাক যে তিনি আমাকে বাচানোর জন্য আপ্রান চেস্টা করে যাচ্ছেন যা আমাকে এবং আমার মত অনেক আমেরিকানদের তথা বিশ্বাসীর হৃদয় পর্যন্ত ছুয়ে যাচ্ছে। এই গত দশ বছরে আমরা যত খারাপ খবর কিংবা মিথ্যা দর্শন শুনেছি ইসলাম সম্পরকে এবং ইসলাম ধর্ম পালনকারীদের সম্পরকে, তা আসলেই সঠিক নয়। এখন এটাই প্রমান হয় যে, সবাই খারাপ না, সবাই শয়তান নয়।

মার্ক স্ট্রুম্যানকে ৩য় প্রশ্ন করা হয়েছিলো যে, তিনি মৃত্যুর এই কয়েক সপ্তাহ আগে কি ভাবছেন?

উত্তরে মার্ক স্ট্রুম্যান বলেছিলেন, ” এখন শুধু আমার আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধু বান্ধবই আমাকে বাচানোর চেস্টা করছে না, বরং আমার ঘৃণার কারনে আমার দ্বারা গুলিবিদ্ধ এবং গুলিবিদ্ধ মৃত্যু থেকে বেচে আসা জনাব রাইস ভুইয়ার মাধ্যমে পুরু ইস্লামিক কমিউনিটিকে সঙ্গে পাচ্ছি যেনো আমি আমার জীবন আবার ফিরে পাই। তার(জনাব রাইস ভুইয়ার) ধর্মের পরম যে শিক্ষা যে, ক্ষমা করো এমন কি তাকেও যে ক্ষমার জন্যও যোগ্য নয়, তার এই বিশ্বাস আমাকে প্রচন্ড নাড়া দিয়েছে এবং এটা পৃথিবীর কাছে একটা উদাহরন হয়ে থাকবে। এখন আর ঘৃণা নয়, এটাকে থামাতে হবে। আমরা সবাই একই পৃথিবীর লোক। যীশুর এবং টেক্সাস রুটের উপর আমার বিশ্বাস আরো গভির হয়েছে। আজ থেকে ১০ বছর আগে যা ঘটেছিলো তা আমি এবং আমার দেশ কেহই হয়ত কখনো ভুলে যাবে না। এটাও ঠিক যে, ওই সময় আমরা নাগরিক হিসাবে কি ভেবেছি তা এই মুহূর্তেও বলা কঠিন কিন্তু এটা ঠিক যে, আজ এই মুহূর্তে আমি জনাব রাইস ভুইয়ার কাছে কৃতজ্ঞ যাকে আমি ঘৃণার কারনে মারতে চেয়েছিলাম। আমি এটাও জানি যে, আজো অনেক দেশবাসীর মনে কষ্ট আছে, দুক্ষ আছে, যন্ত্রনা আছে, ঘৃণাও আছে। কিন্তু এই ঘৃণা কমাতে হবে, আমাদের আরো সহনশীল হতে হবে। আমি খুব ভাগ্যবান যে, আমি মৃত্যুর আগে অন্তত আমার মনের কথাগুলি এই টেক্সাসবাসিকে বলতে পারলাম। আমি চলে যাচ্ছি। Living to Die – Dying to Live.”

জনাব রাইস ভুইয়ার সঙ্গে আমার কয়েকবার ফেসবুকে কথা হয়েছে। খুব ভালো লেগেছে তার এই মনোভাবের জন্য। তিনি একটা ওয়েব পোর্টাল খুলেছেন, নামটাও সুন্দর, WORLD WITHOUT HATE. আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার ওই ওয়েবপোর্টালের পাচ আঙুলের আইকন দিয়ে তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন। মিনিংটা আরো সুন্দর। আমি অবশ্য এখন তার ওয়েব পোর্টালের একজন সদস্য বটে। সবশেষে তিনি গত রোজায় ওভাল অফিসে দাওয়াত খেয়েছেন প্রেসিডেন্ট ওবামার দাওয়াতে। বিশেষ ইফতারির আয়োজন করা হয়েছিলো জনাব রাইস ভুইয়ার সম্মানে। শুনেছি এখন তাঁকে নিয়ে এই প্রেক্ষাপটে একটা বিশ্বব্যাপি ম্যাসেজ দেওয়ার জন্য ছবি বানানো হবে যেখানে আমাদের রাইস ভুইয়া নিজেই থাকবেন। আমি তার একজন প্রাক্তন সিনিওর ক্যাডেট ভাই হিসাবে নয়, বাংলাদেশী হিসাবে বড় গর্ববোধ করি। আমি তার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

(নোটঃ রাইস ভুইয়াকে বলছি, তোমার অনুমতি ছাড়াই আমি এই কথাগুলি আমার ফেসবুক বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করলাম। আশা করি অপরাধ মার্জনীয়। আর তুমি এটাই করো)।

১৪/০৮/২০১৬- সেই ছোটবেলা

Categories

 

ছোট বেলায় মনে করতাম, আহা, স্কুল ছুটি হবে, ক্লাশ থাকবে না, টিচারদের কাছে আর জ্ঞ্যানগর্ব লেকচার শুনতে হবে না, ইচ্ছেমতো নদীতে গিয়ে বন্ধু বান্ধব্দের নিয়ে লাফঝাপ মারবো, সারাদিন মাঠে গিয়ে যখন তখন খেলাধুলা করবো। সন্ধ্যা হলে আর পড়ার টেবিলে বসতে হবে না, সকাল সকাল আর ঘুম থেকে উঠতে হবে না, আরো কত কি!! মাঝারী বেলায় মনে করতাম, আহা, অফিস ছুটি হলে সারাদিন বাসায় বসে টিভি দেখবো, ঘুমাবো, সন্ধ্যায় আড্ডা দেবো। কি মজা হবে। কোনো অফিস নাই, বসের আদেশ পালনের তারাহুড়া নাই। সকাল সকাল উঠে তাড়াহুরা করে অফিসের জন্য রওয়ানা হতে হবে না। অনেক অনেক মজা করে সময়টা পার হবে। এই বয়সে এসেও মনে হয়, আহা এইবার ছুটিতে অনেক অনেক সময় পাওয়া যাবে। স্টাফদের ফোন আসবে না, সাপ্লাইয়াদের হিসাব কিতাব নিয়ে বসার দরকার হবে না। বাসায়, আত্মীয় স্বজনদেরকে সময় দিতে পারবো, বেশ জমজমাট একটা সময় পার হবে।

অথচ আজ কয়েকদিন যাবত আমি ছুটিতে আছি। কাজ নাই, অফিস নাই, তাড়াহুড়াও নাই। বড়দের চাপ নাই, শিক্ষকদের শাসন নাই, স্টাফদের ফোন কল নাই, সাপ্লাইয়াদের কোনো চাপ নাই, কিন্তু তারপরেও মনে হচ্ছে কি যেনো নাই। আচ্ছা, কি নাই? আমি তো ইচ্ছে করলে এখন পুরানো সেই বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে নদীতে যখন তখন ঝাপ দিতে পারি কারন শাসন করার কেউ নাই, ইচ্ছে করলেই সারাদিন টিভি দেখতে পারি, ইচ্ছে করলেই সারাদিন ঘুমাতেও পারি, কিন্তু তারপরেও আমি তা করতে পারছি না। কি অদ্ভুত!!

এখন মনে হয়, জীবনের কিছু কিছু সময় আছে, সেই সময়ের সঙ্গে আমাদের ছুটির একটা বড় রকমের যোগসুত্র আছে। আজ এই ৫০ বছর বয়সে আমি আর আগের সেই ১২ বছরের বালকের ন্যায় উচ্ছাস নদীতে তরঙ্গলম্ফ দিতে পারি না, ইচ্ছেও করে না। অথবা সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবলের অভাবে নারার-খেরের বল বানিয়ে গুটিকতক অদম্য পোলাপানের মতো গ্রামের সেই স্কুলের মাঠে হৈচৈ করে ভরদুপুরে দৌড়াদৌড়িও করতে পারি না। হয়ত মানায় না। অথবা পাশের বাড়ির পেয়ারা গাছের আধাপাকা পেয়ারাগুলি আর এখন আমাকে লোভ দেখায় না। বয়সটা পেড়িয়ে গেছে। আর তাই বড় আফসোস লাগে, আহা যদি আবার সেই বাল্যকালের শিক্ষকদের শাসনটা ফিরে আসতো! আহা, যদি আবার সেই পুরানো বন্ধু বান্ধবরা আগের রুপে ফিরে আসতো! মাঝে মাঝে আজ খুব হাসি আসে সেই বাচ্চা বয়সের কথা মনে করে। কতই না রাগ করেছি সবচেয়ে ভালো বন্ধুর সাথে। কত যে ঝগড়া করেছি ওদের সাথে। কখনো কারনে, কখনো অকারনে। কখনো আমি দোষ করেই উলটা আমি রাগ করেছি, আবার কখন ওদের দোষের কারনেও রাগ করেছি। এক মিনিট সময় লাগেনি তাকে বলতে যে, আমি তাকে ঘৃণা করি কারন সে আমাকে তার লাল পেন্সিলটা একদিন ব্যবহার করতে দেয় নাই, অথবা নদীতে আমার আগে সে লাফ দিলো কেনো এই কারনে আমি তার সাথে জিদ ধরে কয়েকদিন হয়ত কথাই বলিনি ইত্যাদি। জিদ ধরেছি একে অপরের সঙ্গে, কখনো কখনো আড়ি হয়েছে, কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে, আরো কত কি?

আজ বড় নস্টালজিক মনে হয়, আহা, এমন একটা বয়স যদি আবারো ফিরে আসতো! আমার সেই বন্ধুরাতো আজো আছে, আশেপাশেই আছে। কিন্তু বাল্যকালের সেই উচ্ছ্বাস, সেই অদম্য দুস্টুমিপনা, সেই আবেগ আর নাই। বয়স একধাপ থেকে উঠে আরেক ধাপে চলে গেছে। আগের ধাপের স্মৃতি ধরে রেখেছে কিন্তু কার্যপ্রণালী বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কথা হয় দেশের পরিস্থিতি নিয়ে, জিবনের উৎকণ্ঠা নিয়ে, পরিবারের ভালমন্দ নিয়ে, দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের সংস্কৃতি নিয়ে। এখন আর বৈশাখী মেলায় মাটির ব্যাংক, বাঁশের বাঁশী, ভাজা বুট, চালতার আচার, ইত্যাদি নিয়ে কোনো আবেগ আসে না। অফুরন্ত সময় আছে, খেলার মাঠও সেখানেই আছে, নদীও আগের জায়গায়ই আছে, কিন্তু সেই ফেলে আসা বাল্যকালটা নাই। নদি দেখলে এখন মন চায় যদি ঝাপ দিতে পারতাম, কিন্তু দেওয়া হয় না। সবুজ ধানক্ষেত দেখলে ক্ষেতের আইল ধরে কচিকচি পায়ে দৌর দিয়ে কোথাও হারিয়ে যেতে মন চায় কিন্তু হারিয়ে যাওয়া হয় না। মন মনের জায়গায়ই আছে কিন্তু মনের সঙ্গে শরীর আর শরীরের সঙ্গে মনের মধ্যে এখন বিস্তর ব্যবধান বনে গেছে। তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে “সময়” নামক এক বিশাল অদৃশ্য দেওয়াল। পাশে থাকা বাল্য বয়সের ছেলেমেয়েরা যখন তাদের ইচ্ছার কথাগুলি বলতে থাকে, আমি বুঝতে পারি ওরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে আর কি বলছে। বড্ড ভাল লাগে। মাঝে মাঝে ধমক দেই, মাঝে মাঝে বারন করি, কখনো কখনো রাগও করি। আবার এও জানি, এটাই তো করার কথা ওদের। কিন্তু ওরাও একদিন এই সময়টা হারিয়ে ফেলবে। আজ ওদেরকে শাসন করি, একদিন আমাদেরকেও আমাদের অভিভাবকরা শাশন করতো। অভিভাবকদের ওই শাসনে কখনো মন খারাপ হয়েছে, অনেক আনন্দ মাটি করে ফেলেছি রাগে, দুঃখে মনের কস্টে। জিদ ধরে নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। সারাদিন না খেয়ে কষ্ট হচ্ছে দেখে হয়ত মাও খান নাই, বাবা ছেলের অহেতুক জিদে, মায়ের মনের কষ্টে তার সব শাসন ভুলে হয়ত আমাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন, আর আমি সেটাই আমার বীরত্বই বলি, আর আমার জয়ই বলি, গর্বে আরো ঘাড় বেকে বসে থাকতাম খাবো না বলে। একদম অবুঝের মতো। আজ ওইগুলু মনে পড়লে বড্ড মন খারাপ হয়। আজ ঐ শাসনগুলি খুব মিস করছি। চোখের পাতা ভিজে আসে। কোথায় হারিয়ে গেলো ওইসব?

যখন ছোট ছিলাম, সবচেয়ে অপছন্দের চিঠি ছিল আমার অভিভাবকদের। সেই একই কথা। কোনো চিঠি না খুলেই বলে দিতে পারতাম, বাবা কি লিখেছে বা মা কি বলতে চেয়েছে। একদিন খুব দুস্টুমি করে আমি আমার অভিভাবককে বলেছিলাম, আচ্ছা, কস্ট করে বারবার একই চিঠি লেখার দরকার কি? একটা চিঠি ফটোকপি করে রাখলেই তো হয়। কদিন পরপর শুধু ওটা পোস্ট করে দিবা! কারন কথা তো একই থাকে। কেমন আছো তুমি, ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবে, সন্ধ্যা হওয়ার আগে ঘরে ফিরে আসবে, বেশী রাত জাগবে না, বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে ভালোভাবে মিলেমিশে থাকবে, বড়দেরকে সম্মান করবে, আমাদের জন্য মন খারাপ করো না। এই তো? তাহলে আর বারবার লেখার দরকার কি? অথচ আজ এতো বছর পর মনে হচ্ছে, আমি ওই কথাগুলিই খুব মিস করছি। খুব করে মনে হয়, তোমরা আবারো আমাকে এই একই কথাগুলি লিখে পাঠাও না বাবা! আমি জানি, আজ আমার সন্তানেরাও ঠিক একই কথা বলবে। হয়ত কোনো একদিন আজকের এই দিনের মতো তারাও হয়ত আমার সেই একই কথা শুনার জন্য তাদের মন খারাপ করবে। সব বাবাদের কথা এক হয়, সব মায়েদের সন্তানের জন্য চিন্তা এক হয়। তোমরা যখন বাবা মা হবে, সেদিন হয়ত বুঝবে, আজ আমি কি বলতে চাচ্ছি।

আমি বাসায় আজ একা। আমার মেয়েরা তার মাকে নিয়ে নানি বাড়ি বেড়াতে গেছে। আজই চলে আসার কথা ছিলো কিন্তু রাতে নাকি বারবিকিউ করবে। আমি সবসময় ওদের সঙ্গে যাই কিন্তু আজ যাওয়া হল না। যেতে ইচ্ছে করলো না। না যাওয়ার অনেক ব্যাখ্যা আছে, নাইবা বললাম। যেতে ভালো লাগছিলো না। ওদেরকে মিস করছি। বাসায় থাকলে যে বউ ছেলেমের সঙ্গে অনেক গল্প হয়, কিংবা সারাক্ষন বসে আড্ডা দেই, কিংবা সময় কাটাচ্ছি, তা কিন্তু নয়। কিন্তু ওরা বাসায় নাই বলে মনে হচ্ছে পুরু বাসাটা খালি, কথা বলার লোকজন নাই। উচ্ছল একটা পরিবেশ নাই। আমার শাশুড়ি যখন বেচে ছিলেন, তখন সেখানে যাওয়ার জন্য আমার একটা টান ছিলো। অনেক বয়স্ক একজন মহিলা ছিলেন। আমার ভালো লাগা মানুসগুলুর মধ্যে ওনি একজন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি আমার বাসায় ছিলেন, সেটাই আমার সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ ছিলো। আমি জানতাম, একসময় আমি এই চমৎকার মানুসগুলুকে খুব মিস করবো, তাই আমার সাধ্যির মধ্যে যতটুকু সম্ভব ছিলো করার চেষ্টা করেছি, আর যেটুকু পারি নাই, সেটুকু করেছি আমার ভালোবাসা দিয়ে। ঈদ চলে গেছে একদিন হলো। এই ঈদ পর্বগুলুতে আমি শুধু একজনের কাছ থেকেই ঈদের সালামি পেতাম, তাও আবার ১০ টাকা। আর সেটা সবসময় আমার এই শাসুড়ির কাছ থেকে। আমি এমনিতেই তাদেরকে সালাম করতাম, কারনে-অকারনে সালাম করতাম কিন্তু ঈদের দিনে আমি তাকে সালাম করতাম আর ভাবতাম, কোনো একদিন এই ১০ টাকার সালামিটা বন্ধ হয়ে যাবে। আজ সত্যি সত্যি সেই সালামিটা আমি মিস করি। সালামিটা নেওয়ার সময় তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, তারপর তিনি আমার কপালে চুমু খেতেন। বড্ড মিষ্টি একটা চুমু। তিনি জান্নাতবাসী হয়েছেন কিন্তু প্রতি ঈদে আমি তাকে আমার অন্তর থেকে স্মরণ করি। তিনিও আমার মা ছিলেন। সালাম করতে ইচ্ছে করে আজ। আস্তে আস্তে আমার সালামের মানুষগুলিও কমে যাচ্ছে। একদিন আমাকে আর “তুই” বলে সম্বোধন করার লোকও কমে যাবে এবং যাচ্ছেও। কিংবা আমার সালামের জায়গাগুলি একেবারে শুন্য হয়ে যাচ্ছে। আমি জানিনা তার সন্তানেরা তাকে প্রতিদিন মনে করেন কিনা কিন্তু আমি তার কথা প্রতিদিন মনে করি। এর একটা প্রধান কারন আছে। কারনটা বলতে চাইনা কিন্তু আমার কাছে এমন একটা জিনিষ তিনি রেখে গেছেন যেটা তিনি ব্যবহার করতেন কিন্তু আমি এখন সেটা ব্যবহার করি। আর এই বস্তুটিই আমাকে তার কথা প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয়।

যে বালকটি আজ থেকে ৪০ বছর আগে উচ্ছল, চঞ্চল, দুরন্তপনা, অদম্য সময় কাটিয়েছিলো, ওই সময় যে তোমাদেরকে অনেক কঠিন দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে রাখতো, সময়-অসময় তোমাদের মাথা ব্যথার কারন হয়ে দাঁড়াতো, আজ সেই একই বালক ৪০ বছর পর শান্ত, ধীর এবং অভিভাবকরুপে রূপান্তরিত হয়ে শুধু একটা আবেগের কথাই বলতে চাই, ফিরে এসে দেখে যাও, সে আর আগের মতো দুস্টুমি করে না, হতাত বৃষ্টিতে তোমাদের অগোচরে ভিজে আর অসময়ে জ্বর বাধিয়ে ফেলে না, কিংবা তোমাদের না বলে হতাত করে কিছু দুষ্টু বন্ধুদের নিয়ে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায় না। তোমরা যে ছেলেকে সারাক্ষন ঘরের মধ্যে শান্ত হয়ে থাকতে বলতে। বলতে আর কতজল ফেলবি আমাদের চোখে? আর কত দুসচিন্তায় ফেলবি আমাদের? আজ এই বয়সে এসে আমি তোমাদের শুধু একটা কথাই বলতে পারি, এখন এসো আমার ঘরে, দেখে যাও, তার এখন অফুরন্ত সময় এবং সে এখন সত্যিই শান্ত একটি মিষ্টি ছেলে। এখন আর তোমাদেরকে আমি কোনো দুসচিন্তায় ফেলবো না। আজ আমার ছুটি। লম্বা ছুটি। আমি তোমাদের একজন লক্ষি ছেলে হয়েই ঘরে বসে আছি। কিন্তু তোমরা কই? তোমরা কি আমার কথা শুনতে পাও? আমি তোমাদের খুব ভালবাসি। 

১৩/০৮/২০১৬- কুরবানীর গরু

Categories

 

গত পরশুদিন অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখেই আমাদের কুরবানীর গরুটি কেনা হয়েছিলো। আমার মেয়ের জামাই গরু দামদর করা থেকে বাসায় আনা পর্যন্ত এই কঠিন কাজটি আমার জন্য সহজ করে দিয়েছিলো। খুব একটা সময় পাই নাই ফ্যাক্টরির কাজের জন্য। অবশেষে গতকাল রাত ১০টার পর কুরবানির গরুটাকে নিরিবিলি দেখার সুযোগ হলো।

বেশ সুন্দর একটি গরু। মধ্যবয়সী। বুঝাই যায়, অতি যত্ন করে গরুর মালিক একে বড় করেছেন। পালা গরু। দেশের অনৈতিক প্রচলন হিসাবে গরুর মালিক নিজে কোন অনৈতিক ঔষধ দিয়ে গরুটাকে বড় করেন নি। বেশ মিশুক। মিশুক কথাটা মানুষের জন্যই শুধু প্রযোজ্য নয়, এটা যে কোনো প্রানির জন্যই প্রযোজ্য। আমি কাছে গিয়ে গরুটার মাথায় একটু আলতো করে হাত বুলাতেই সে বুঝতে পারলো, আমি ওকে আদর করছি এবং আমি ওর ক্ষতিকারক কেউ নই। সব প্রানীই ভালোবাসা বুঝে, আসলে ভালোবাসার ভাষা সবার জন্য এক। ভালোবাসা বহিরপ্রকাশের জন্য কোনো ভাষা লাগে না। হোক সেটা মানুষ, হোক সেটা কোনো ভাষাহীন প্রানি। 

গরুটি আমার হাতের পরশে তার শিং আর মাথার তালু দিয়ে আমার হাতটাকেও এমনভাবে স্পর্শ দিচ্ছিলো যে, আমার মনের ভিতরে তারজন্য একটা মহব্বত, একটা স্নেহ, একটা অনুভুতির পরশ বইয়ে যাচ্ছিলো। কিছু ধানের খের দিতেই দেখলাম, অতি আনন্দের সহিত তা খাওয়া শুরু করলো। মনে হলো ওর ক্ষুধা লেগেছে। আমি কয়েক কেজি ভুষি, পানিতে লবন মেখে একটা বালতিতে রাখলাম। মনে হলো, অনেক দিন পর যেন সে তার চেনা পরিচিত একটা খাবার পেলো। ফলে খের খাওয়ার পাশাপাশি ভুষিগুলুও খেতে থাকলো। ওর খাওয়া দেখে আমারই বড্ড ভালো লাগলো।

রাত প্রায় ১১টা। সবাই প্রায় ঘুমের আয়োজন করছে, আশেপাশের মানুষজনও নিস্তব্ধ। আমি গরুটার পাশে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছি। গরুটা কি পরিবেশে বড় হয়েছে, কতগুলু গরু একসঙ্গে বড় হয়েছে, কি তাকে খেতে দেওয়া হত, কিভাবে তাকে খেতে দিলে ও সবচেয়ে বেশী আনন্দ করে খেতো, খাওয়ানোর সময় ওর মালিক কিভাবে ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো কিংবা আদৌ পাশে থাকতো কিনা, তার কোনো কিছুই আমার জানা নাই। কিন্তু এই মুহূর্তে এই ভাষাহীন একেলা নিঃসঙ্গ প্রানিটির পাশে আমি আছি। আমি তার শরীরে, মাথায়, গলায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর ওর ভুষি, খের খাওয়া দেখছি। মাঝে মাঝে ও আমাকে আলতো করে আমার হাতের তালুতে গুতা দিচ্ছে, কিন্তু ব্যাথা দিচ্ছে না। বুঝতে পারছি, আমি ওর বন্ধু হয়ে গেছি।

অনেক সময়ধরে গরুটি অনেক ভুষি আর খের খেলো। তারপর ধীরে ধীরে একটা জায়গায় গিয়ে পিছনের দুই পা সামনের দিকে ভাজ করে আর সামনের দুই পা পিছনের দিকে ভাজ করে ঠিক আমাকে দেখা যায় এমনভাবে শুয়ে পড়লো। জাবর কাটছে গরুটি আর আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একটা চেয়ার নিয়ে খুব কাছেই বসেছিলাম। আমাদের ভাষা ভিন্ন, আমরা আমাদের ভাষায় ওকে কোন কথা বললেও তার বুঝার কোনো ক্ষমতা নেই। মাঝে মাঝে আমি ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর ও তার মাথা আর শিং দিয়ে এমনভাবে সারা দিচ্ছিলো যেনো আমরা কথা বলছি।

এইভাবে কতক্ষন বসে ছিলাম, আমার মনে নাই, কিন্তু এই বসে থাকা অবস্থায় আমি ভাবছি, আগামিকাল সকালে এর জীবননাশ হয়ে যাবে, একে আমি কুরবানী দিবো। এটা ভাবতেই এখন আমার কষ্ট লাগছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার সান্নিধ্য, তাতেই ওর প্রতি আমার একটা মহব্বত, একটা মায়া জন্মেছে। কাল থেকে আর ওকে আমি দেখতে পাবো না কিংবা ও আর এই প্রিথিবীর আলো বাতাশ দেখতে পাবে না, এটা ভাবতেই আমার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমার বিধাতার নির্দেশ, সক্ষম ব্যক্তিদের কুরবানী ওয়াজিব। এখানে আমার মহব্বত কত গভীর, আর আমার কষ্ট কতো প্রকট, সেই আবেগের কোনো স্থান নেই।

একটা সিগারেট ধরিয়ে গরুটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিলাম, আজ থেকে অনেক বছর আগে আল্লাহ ইব্রাহিম (আঃ) কে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিষ, তার ছেলে, ইসমাইল (আঃ) কে কুরবানি করতে বলেছিলেন। তখনো ইসমাইল (আঃ) একজন অপরিনত সুন্দর, নিস্পাপ এবং কচি একটি শিশু। পিতা নিজের আদরের সন্তানকে তার গলায় ছুড়ি দিয়ে জিবন্ত কুরবানী দিবেন, এটাই ছিলো আল্লাহর নির্দেশ। অনেক অনেক কঠিন একটা নির্দেশ। আল্লাহর প্রতি ইব্রাহিম (আঃ) এর ভালোবাসা কতটা গভীর তার প্রমান হিসাবেই আল্লাহ তাকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমন একটা পরীক্ষার কথা ভাবতেই তো গা শিউরে উঠে। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশ, অমান্য করার কোন অবকাশ নাই। কিন্তু মানুষের হৃদয় বলে তো একটা জায়গা আছে। মানতে পারা আর মেনে কাজটা করা যেমন দুরূহ, তেমনি সুযোগ্যও হতে হবে। আর এই কাজটাই আল্লাহ হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর মাধ্যমে আমাদের বাধ্য-অবাধ্যতার পরীক্ষায় ফেলে দিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তার ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, সঙ্গে তার কচি নিস্পাপ ছেলে হযরত ইসমাইলও (আঃ)। 

গরুটার দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি, আল্লাহ কত মহান, তার কি অদ্ভুত পরিকল্পনা, আর কি উদার তিনি যে, তিনি তার রহমত দিয়ে ঐদিন ইব্রাহিম (আঃ) কে তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তানটিকে কুরবানী দিতে নির্দেশ দিলেও মহান আল্লাহ ইব্রাহিম (আঃ) এর অগোচরে ইসমাইল (আঃ) এর পরিবর্তে একটি পশু প্রতিস্থাপন করে কুরবানীকে গ্রহন করেছিলেন এবং প্রতিকী হিসাবে ওই একই কাজ আল্লাহ আমাদেরকে করার নির্দেশ দিয়েছেন। আজ যদি মহান আল্লাহ এই প্রতিকী কুরবানী না জারি রাখতেন, তাহলে আজ আমরা যারা লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে পশু কিনছি, তার আর কোনো প্রয়োজন হতো না। কারন নির্দেশমাফিক, আমাদের পরিবারের সন্তানদেরকে একে একে প্রতি বছর কুরবানী করতে হতো। কতই না কষ্টের কাজটি আমাদের করতে হতো। কুরবানীর ঈদ মানে হয়ে যেতো তখন পরিবারের জন্য একটা ভয়ংকর শোকের দিন, হাহাকারের দিন। সমাজের প্রতিটি ঘরে ঘরে শোনা যেতো আজ কান্নার চিৎকার। আমার সামনে বসে থাকা ভাসাহীন গরুটিকে দেখছি আর ভাবছি, এই কিছু অল্প সময়ের মধ্যেই এই বোবা প্রানিটির সঙ্গে আমার কতই না খাতির হয়ে গেলো, মায়া জন্মে গেলো। অথচ এই মায়ার বন্ধন, মহব্বতের বন্ধন, আবেগের বন্ধন ছিন্ন করে হলেও আগামিকাল আমি ওকে কুরবানী করবো। ওকে আমি ওর জন্ম থেকে আদর দিয়ে বড় করিনি, ওর কোনো কিছুই আমি জানি না। কখন ওর অসুখ হয়েছে, কখন ও কার ক্ষেতে ফসল খেয়ে কোথায় কতদিন খোয়ারে আটক খেয়েছে, কিংবা কতগুলু চটির আঘাত সে সহ্য করেছে। এ সবের আমি কিছুই জানি না। আমি শুধু কিছু টাকা খরচ করে ওই পালক মালিকের কাছ থেকে নগদ কিনে নিয়ে চলে এসছি মাত্র। ওকে প্রতিটি ক্ষনেক্ষনে যে লোকটি ঘাস খাইয়ে, ভুষি খাইয়ে, পানি খাইয়ে, যতন করে গোসল করিয়ে দিনের পর দিন বড় করেছে, এই ভাষাহীন প্রানিটিও তার কাছে তার সন্তানের মতোই। আমি মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য ওকে কাছে পেয়েছি। তাতেই আমার ভিতর অজানা এক মায়ার উদ্রেক হয়েছে। এই সামান্য আবেগেই ওকে কুরবানী দিতে আমার মনে কেমন যেনো একটা কষ্ট অনুভুতি লাগছে। আমি আরো ভাবছি, আজ যদি এটা ভাসাহীন প্রাণী, গরু কিংবা ছাগল কিংবা কোনো দুম্বা না হয়ে আমার আদরের সন্তানটি হতো, তাহলে কি আমি পারতাম ঠিক এভাবে এতো নীরবে, আগামিকালের কুরবানীর নির্দেশটি পালন করতে? পারতে তো হতোই। এটাই তো পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়ত আজ আমাদের পরিবারে এতোক্ষন কান্নার রোল পড়ে যেতো, সমাজে প্রতিটি ঘরে ঘরে আজ হতো সবচেয়ে দুক্ষের দিন হতো। আর যিনি কুরবানি হবেন, তারই বা কি হতো মনের অবস্থাটা? আমার ভাবতেই সারা শরীর শিউরে উঠছে। 

অনেক রাত হয়ে গেছে। বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়ার মত। কিন্তু আমি একা বসে আছি গরুটার পাশে। ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। এমন নয় যে, গরুটি কোন জ্বালাতন করছে কিংবা ডাকাডাকি করছে কিংবা অজানা কোন ভয়ে সে অস্থির। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। জাবর কাটছে প্রতিদিনকার মত। ও হয়ত জানেই না যে, আজ রাতটাই হচ্ছে ওর জীবনের শেষ রাত। ও আর কখনোই এই পৃথিবীর আলো বাতাস উপলব্ধি করতে পারবে না। কারন কাল ওকে আমি সবার সামনে, জোর করে আস্টেপিস্টে বেধে গলায় ছুড়ি দিয়ে আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য কুরবানি করে ফেলবো। কত টাকায় আমি আমার এই ভালোবাসাটা কিনেছি, তার জন্য আমার আল্লাহ বসে নাই, তিনি শুধু বসে আছেন এইটা দেখার জন্য যে, আমি আমার ভিতরের ভালোবাসাটা, আমার অতি আদরের সন্তানের পরিবর্তে প্রতিকী এই প্রানীটিকে কতটা মহব্বত করে আল্লাহর উদ্দেশ্যে এবং তার আদেশ পালন করে তারজন্য কুরবানী করতে প্রস্তুত আছি কিনা। এই গরুটি হচ্ছে আমার সন্তানের বিকল্প একটি প্রাণী। শয়তান আমাকে ধোকা দিচ্ছে বারবার, ধোকা দিচ্ছে অনেকভাবে। কখনো লোক দেখানো, কখনো ধনে-মানে পয়সায় আমি কত বড় তা মানুষের কাছে জাহির করার নিমিত্তে, কখনো অহংকারের নেশায়। অথচ আমাদের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে হাসিল করার জন্য যে ওয়াদা, সেটা আজ প্রায় ভুলতেই বসেছি আমরা সবাই।

সকালে নামাজ পড়ে এসেই অনেক্ষন গরুটার কাছে ছিলাম। আদর করেছি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে, শিংগুলুতে হাতের পরশ বুলিয়ে। আবারো খের ভুষি খাওয়ানোর চেষ্টা করলাম। খুব বেশী খেতে চাইলো না কিন্তু তারপরও সে আমাকে নিরাশ করেনি। আমার শরীর পবিত্র, মাত্র নামাজ পড়ে এসেছি। গরুটাকে আমি ওর গলায় জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষন থাকলাম। গরুটাও মনে হলো আমার এই আলিঙ্গন খুব আদর করে অনুভব করছে। হুজুর চলে এসেছে। এখনই কুরবানী হবে। মনটা বড্ড নাড়া দিচ্ছিলো। আশেপাশের অনেক উৎসুক জনতা কেউ গরুটার চামড়া কত দিয়ে বিক্রি করা হবে তার খবরে অস্থির, কেউ কত টাকায় গরুটা কিনেছিলাম, তার দাম দস্তর জিজ্ঞেস করতে অস্থির, কেউ আবার কিভাবে গরুটা জবাই করা হবে সেটা দেখার জন্য ভিড় করে আছে। কিন্তু আমার ভিতরে প্রচন্ড একটা ব্যথা অনুভব করছি। আমি আবারো গরুটাকে একটু আদর করার জন্য তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম, মনে হচ্ছে যেনো আমার অতি আপন একজন কেউ আমার থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। আমার চোখের পাতা ভিজে আসছিলো, গরুটার মুখের দিকে তাকাতেই আমার মনে হলো, আমার শরীরের সঙ্গে এটে থাকা এই ভাষাহীন প্রানিটিরও চোখের পাতা ভিজে এসেছে। ডাগর ডাগর দুটি চোখ আমার দিকে তাকিয়েই থাকলো।

১২/০৮/২০১৬-কেনো জেনারেশ গ্যাপ হচ্ছে?

Categories

 

জেনারেশন গ্যাপ কেনো হচ্ছে এটা জানতে পারলে আমাদের সমাজের সব শ্রেনির বাবা মায়েরা অন্তত তাদের কি করা উচিত সে ব্যাপারে একটু সচেতন হতে পারতেন। আমরা যারা বারবার বলছি যে, পরিবারে সচেতনাতা বাড়াতে হবে, সমাজে সচেতনতা বাড়াতে হবে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সচেতনাতা বাড়াতে হবে, তাহলে সেই কিসের উপর সচেতনতা বাড়াতে হবে জানা দরকার, তাহলেই সচেতনতাটা বাড়বে। চলুন দেখি তাহলে জেনারেশন গ্যাপ কি কি কারনে হচ্ছে সেটা আগে খুজে বের করি। তারপর এর বিপরিতে আমাদের কি করা উচিত, সেটা বের করা যাবে, হোক সেটা পরিবারের জন্য, হোক সেটা সামাজিকভাবে আর হোক সেটা রাষ্ট্রীয়ভাবে। সেই কার্যপ্রণালী বের করা কঠিন হবে না।

প্রকৃতপক্ষে মোদ্দা কথায় যদি বলি, তাহলে ব্যাপারটা আর কিছুই না, মানুষের পৃথক পৃথক ইন্টারেস্টের কারনে, তাদের নিজস্ব ভ্যালু বিশ্লেষণের কারনে, বয়সের তারতম্য, বাকস্বাধীনতা, মুক্তচিন্তার প্রসার, লাইফ স্টাইল, এস্পিরেসন, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, শিক্ষাব্যবস্থা, সাইকোলোজিক্যাল ডেভেলপম্যান্ট, ফিজিক্যাল পরিবর্তন, ইত্যাদি সবের কারনেই এই জেনারেশন গ্যাপটা তৈরি হয়। আর এইটা একদিনে বা এক সপ্তাহে বা এক মাসের মধ্যেই ঘটে না। এটা ঘটে ধিরে ধিরে, সামস্টিকভাবে, লম্বা সময় ধরে।

ব্যাপারটা আরো সহজ করে যদি বলি, যেমন ধরুন, ৪০ কিংবা ৬০ এর দশকে এমন কি ৭০ কিংবা ৮০ এর দশকেও শিক্ষা ব্যবস্থাটা এমন ছিলো যেখানে চরিত্র গঠন, ডিসিপ্লিন এবং ইউনিফর্মিটি ছিল মুখ্য বিষয়। মুখস্থবিদ্যা দিয়ে অনেকে না বুঝেই অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছেন। তাদের নিজস্ব চিন্তাধারা বিকশিত হতে হতে ইতিমধ্যে তারা একটা এডাল্ট মানুসের রূপ নিয়ে নিয়েছেন। যে সময়টায় এখন ইয়াং জেনারেশন বিপথগামিতে হাটছেন, ওই সময় তারা এই কঠিন ডিসিপ্লিন, নিয়মানুবর্তিতার কারনে সময়টাই পার করে দিয়েছেন। কিন্তু আজকাল শিক্ষা ব্যবস্থায় চরিত্র গঠনের কিংবা ডিসিপ্লিন তথা ইউনিফর্মিটির ব্যাপারটা আর মুখ্য নাই। এখানে মুক্তচিন্তা ধারায় এক ধরনের বিশ্লেষণধর্মী স্বাধীনতা এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আদলে সে নিজে যা সেন্সিব্যাল মনে করে সেটাই শেষ কথা। ফলে সমস্যা নিরসনের ক্ষেত্রে আগের যুগের মানুষের থেকে বর্তমান যুগের ইয়াং জেনারেশনের কাছে মেথডটাই আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ইয়াং জেনারেশনের ভিসন আর ওল্ড জেনারেশনের ওই একই বয়সের তুলনায় ভিসনের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য বনে যাচ্ছে। এটা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ত্রুটি বলতে হবে। এই ব্যাপারে হয়ত আমরা রাষ্ট্রীয় সচেতনতার কথা মাথায় আনবো পরবর্তী পর্বে।

আরেক দিক দিয়ে বলি, ধরুন, ওয়ার্ক প্যাটার্নে ওল্ডার জেনারেশন তাদের সময়ে জব সল্পতার কারনেই হোক আর কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই হোক, তাদের জবটাকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য নিরবিচ্ছিন্ন এবং সততার সহিত দিনের পর দিন অফিস সমুহের যাবতীয় আইনকানুন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও মেনে শেষতক চালিয়ে গেছেন যা আজকালকের ইয়াং জেনারেশন এটার ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ফলে আইনের বাধায় তারা খুব একটা বিদ্ধ হতে চায় না। তারা স্বাধীন, ইচ্ছে হলো কাজ করবেন, ভালো লাগলো তো থাকবেন, আর পছন্দ হয় নাই, কিচ্ছু যায় আসে না, পরের দিনই জব ছেড়ে দিলেন। এই যে একটা খামখেয়ালীপনার মতো স্বাধীনতা, একটা ছিঁড়া ছিঁড়া ভাব, তাতে অনেক কিছুই আর সংঘবদ্ধ থাকে না। না কর্মক্ষেত্রে না বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে না পারিবারিক দায়িত্ববোধে। ধিরে ধিরে এই কোহেসিভনেসটা কমতে থাকে। বন্ধন কমতে থাকে। এর মধ্যে আবার যোগ হয়েছে হাই-টেক। এই হাই-টেকের জন্য ইন্টার-পারসোন্যাল রিলেসনটা হিউম্যান এলিম্যান্ট থেকে আরো দূরে চলে গেছে। এতে বড়দের সাথে গ্যাপটা আরো বেশি বেড়েছে। পরামর্শের জায়গাটা কিংবা মতাদর্শের আদান-প্রদান গুলি আস্তে আস্তে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। এই সচেতনতার বিরুদ্ধে হয়ত আমরা পরবর্তীতে আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে সচেতনতার কথা বলবো।

আরেকটা বিষয় না বললেই না। আর সেটা হচ্ছে মিডিয়া। মিডিয়ার মাধ্যমে যদিও আজকালকের ইয়াং জেনারেশনকে অনেক সুযোগ সুবিধা দিয়ে মার্কেটে কম্পিটিটিভ করে তুলছে কিন্তু অন্যদিকে তাকে ইমোশনাল গ্রাউন্ডে আনপ্লিজেন্টও করে তুলছে। ইয়াং জেনারেশন সবাইকে এই মিডিয়া এক কাতারে নিয়ে এসে প্যারেন্টাল গাইডেন্সের থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়ে একই সমসাময়িক বয়সের গাইডেন্সে আবেশিত করে দিচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। ফলে ট্র্যাডিশনাল ভ্যালুগুলু থেকে ইয়াং জেনারেশন গ্লোবাল হাইপোথিসিসে বা কন্সেপ্টে বেশি করে ঝুকে পড়ছে। আর যখনই ইয়ং জেনারেশন তাদের ট্র্যাডিশনাল ভ্যালুগুলু থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তখনই হচ্ছে বেশি করে বিপত্তি। কালচার, সামাজিক আস্থা, পারিবারিক অবস্থান, নিজস্ব ক্যাপাবিলিটি ইত্যাদির উপর তার তখন নিয়ন্ত্রণ লোপ পেতে থাকে। আর এই লোপ ধিরে ধিরে তাকে তার অবস্থান থেকে অনেক দূরে সরিয়ে প্রতিনিয়ত বিপথগামি অথবা অবাস্তব একটা কোহেলিকার দিকে ঠেলে দেয় যা সে নিজেও বুঝে না।

এর মধ্যে যোগ হয় আবার পরিবারের ইরেসনাল এক্সপেকটেশন। আর এই ইরেসনাল পারিবারিক এক্সপেক্টেসনটা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে জেনারেশন গ্যাপের বেলায়। আর এটা শুরু হয় একেবারে ছোট বয়স থেকেই। যেমন ধরুন, পিতামাতার স্বপ্নের চাহিদা তারা তাদের সন্তানের ইচ্ছা বা খুশির বিনিময়ে হলেও তা তাদের উপর চাপিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেন না। সন্তানের চাহিদার থেকে অভিভাবকের চাহিদা পুরুন করতেই ইয়াং জেনারেশনের জীবন হিমসিম খেতে হচ্ছে। তার ইচ্ছা থাকুক আর নাই বা থাকুক, সে পারুক আর নাই বা পারুক। তার ভাল লাগুক আর নাই বা ভালো লাগুক। সন্তান আর্ট করতে ভালবাসেন, তাকে ডাক্তারি পড়তেই হবে, সন্তান গান শিখতে ভালোবাসেন, তাকে জিওগ্রাফী নিয়ে পড়তেই হবে। পিতামাতারা ভুলেই যান যে, তাদের সন্তানের একটা এস্পিরেসন আছে, তার একটা ভাল লাগার ব্যাপার আছে কিংবা তার নিজস্ব একটা পরিমন্ডল আছে। আর যখনই কোন ইয়াং জেনারেশন তাদের ইচ্ছার এই প্রতিফলনের জন্য বেকে বসবে, তখনই শুরু হবে দুই জেনারেশনের মধ্যে একটা অলিখিত কনফ্লিক্ট। গ্যাপ তো তখনই সৃষ্টি হয়ে গেলো। এই গ্যাপ থেকে তৈরি হয় আরো গ্যাপের। যেমন, পিতামাতা মনে করেন যে, তারা এই বয়সে তাদের বাবা মায়ের সঙ্গে কিভাবে আচরন করেছেন তার তুলনা, তারা এই বয়সে ঐ সময়ে কি ধরনের কাপড় পরিধান করেছেন তার তুলনা, তারা কি কি স্বাধীনতা পেয়েছেন তার একটা খতিয়ান, কিংবা সপ্তাহান্তে বন্ধুর বাড়ীতে বেড়াতে যেয়ে রাত্রি যাপনের অনুমতি দেওয়া না দেওয়ার ব্যাপারে তুলনা, এমন কি কি ধরনের হেয়ার কাট নিতেন আমাদের ওল্ডার জেনারেশন ইত্যাদি যখন পিতামাতা দিতে শুরু করেন, তখন এই দুই জেনারেশন এমন একটা অবস্থায় দাড়ায় যে, মনে হয় একে অপরের বিপরিতে অবস্থান নিয়েছেন, মনে হয় তারা একে অপরের ভাষাই বুঝতে পারছেন না। ফলে পরিবারে সমঝোতা নষ্ট হচ্ছে, শান্তি নষ্ট হচ্ছে আর বেড়ে চলছে একে অপরের থেকে দুরত্ত।

সামাজিক ক্লাস বিভক্তিও কিন্তু ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে গ্যাপ তৈরির একটা ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। একটা সময় ছিলো যে, আমাদের দেশে বিখ্যাত গায়িকা রুনা লায়লা আর সাবিনা ইয়াসমিন কখনো একসঙ্গে এক স্টেজে গান করতেন না। কারন কে কার থেকে বড় সেটা যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠে? ঠিক এমনিভাবে, নিম্নক্লাসের বা গরিব মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে উচ্চবিত্ত ক্লাসের সঙ্গে একটা ক্ল্যাশ সবসময়ই ছিলো। কিন্তু ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে এই ক্লাসভিত্তিক শ্রেনিবিন্যাশ এর প্রবনতাটা অনেকটাই কম। নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একজন ছাত্র যদি ভাল ফলাফল করে বা একজন ভাল গীটার বাজাতে পারে তাকে গানের দলের মধ্যে নেওয়ার মধ্যে কোণ দ্বিধাবোধ করে না। কারন ওল্ডার জেনারেশনের মতো ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে এই নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত সংস্কারে তাদেরকে কোন নেগেটিভ অনুভুতির খোরাক জোগায় না। এই জায়গাটা থেকে ওল্ডার জেনারেশন এখনো সরে আসতে পারে নাই। ফলে ছেলেমেয়ের প্রেম ঘটিত এফেয়ারস নিয়ে, বন্ধুত্ত তৈরি করতে গিয়ে কিংবা একই টেবিলে তাদের সঙ্গে খাবার খাওয়া নিয়ে পরিবারে ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে তার ওল্ডার জেনারেশনের মধ্যে একটা অলিখিত কনফ্লিক্ট তো বাধতেই পারে আর বাধেও।

এই রকম হাজারো হাজারো উদাহরণ টানা যাবে যেখানে খুব সুক্ষ কিন্তু গ্যাপ তৈরির জন্য ঐগুলু যথেষ্ট ভুমিকা রাখে। ধরলাম যে, এই গ্যাপগুলু দুই জেনারেশনের মধ্যে তৈরি হলো। তাতে কি হয়েছে? দেশ নষ্ট হয়ে যাবে? পরিবার নষ্ট হয়ে যাবে? কিংবা সমাজ? কি হবে যদি দুই জেনারেশন আলাদা আলাদা বাস করে? কেউ তো কাউকে ডিস্টার্ব করছে না। তাহলে কি দরকার দুই জেনারেশনের মধ্যে জোর করে আবার মিল করার? ওল্ডার জেনারেসন মরে গেলে তো আর কোনো কনফ্লিক্ট থাকে না। তখন তো শুধু ইয়াং জেনারেশনই থাকলো। তাহলে এতো কথা কেনো?

আছে, কথা আছে। কারন এই গ্যাপের কারনে কি কি ইমপ্যাক্ট হয় তাতো সার্বজনীন। সুদূরপ্রসারী। আর ওখানেই তো সব বিপত্তি। চলুন, আমরা সবাই এই নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট গুলু ধিরে ধিরে বের করি। সবাই কন্ট্রিবিউট করি আমাদের প্রয়োজনে। আমরা এই নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট গুলি বের করতে পারলেই আমরা সহজে বের করতে পারবো আমাদের কোথায় কোথায় সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং কাকে কাকে এই কাজে অংশ গ্রহন আবশ্যক।

 ……… (চলবে পরবর্তী ইমপ্যাক্ট অনুসন্ধানে, আপনিও কন্ট্রিবিউট করুন মতামত দিয়ে)

১০/০৮/২০১৬-জেনারেশন গ্যাপ

Categories

 

আমি একটা জার্নালে একবার একটা আরটিক্যাল লিখেছিলাম, “জেনারেশন গ্যাপ” এর উপর। আজ মনে হচ্ছে, এই জেনারেশন গ্যাপটা আমাদের অনেকদূর নিয়ে যাচ্ছে এবং খুব দ্রুত। আমি আমার সেই আরটিক্যালটার কিছু চুম্বক অংশ আজ আমাদের বন্ধু ফোরামে তুলে ধরতে চাই।

…… জেনারেশন গ্যাপটা আসলে হচ্ছে আধুনিক সময়ের ইয়াং বয়সের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদের ওল্ড জেনারেসনের মানুষগুলুর মধ্যে চিন্তাধারা, জীবনযাত্রা, অভ্যাস, এবং দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্যগুলি। এই জেনারেশন গ্যাপ থাকবেই, আগেও ছিল এবং এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু ভয়ংকর বিষয়টি হয়ে দাড়ায় যখন এই জেনারেশন গ্যাপটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, কালচার, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, এবং সাধারন দৃষ্টিভঙ্গিটায় একটা বিস্তর জাম্প করে। তখন যেটা হয় তা হচ্ছে প্রতিনিয়ত যুবক বয়সের জেনারেসনের সাথে ওল্ড জেনারেশনের মধ্যে মিসম্যাচ, এডজাস্টম্যান্ট, আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইত্যাদির সবকিছুতেই কনফ্লিক্ট করে। অতিতে এই গ্যাপটা ছিলো এবং মাঝে মাঝে যে বিস্তর জাম্প করে নাই তা কিন্তু নয়। সেই পরিস্থিতিতেও জেনারেশন গ্যাপটা কোনো না কোনোভাবে সহনীয় পর্যায়ে সামাল দেওয়া গেছে কারন তখন দুইপক্ষই একটা জায়গায় এসে এডজাস্টমেন্টের মধ্যে সহঅবস্থান করতে চেয়েছিলো এবং পেরেছিল।

এখানে আরো একটা তথ্য সহজ করে বলা ভাল যে, এই জেনারেশন গ্যাপটার মানে কি দাদাদের বয়সের সঙ্গে নাতীদের বয়সের যুগের পার্থক্য? অথবা এইটা কি ৩০ বছর সময়ের কোনো পার্থক্য? কিংবা ৫০ বা ৭০ বছরের সময়ের? আসলে তা না। এটা পিতামাতার এবং সন্তানের তাতক্ষনিক সময়ের মধ্যেও হতে পারে আবার দাদাদের বয়সের সঙ্গে নায়-নাতকুরের বয়সের ফারাকের মধ্যেও হতে পারে। এটা একটা স্পেসিফিক জেনারেশন থেকে আরেকটা স্পেসিফিক জেনারেশনের মধ্যেও হতে পারে।

যেমন উদাহরনসরুপ যদি বলি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পরে এবং রিপাবলিক অব জর্জিয়া যখন স্বাধীনতা পেলো, তখন সোভিয়েত আমলের বাবামায়ের সঙ্গে তাদের ঘরের সন্তানদের মধ্যে বিশাল একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর তফাত সৃষ্টি হলো। জর্জিয়ার উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা পুরুটাই পাশ্চাত্য ধাঁচের আদলে বদল হয়ে গেলো কিন্তু তাদেরই পিতামাতারা আগের দিনের সোভিয়েত কালচার, সভ্যতা নিয়ে ধরে থাকলো। এদের মধ্যে সময়ের পার্থক্যটা ছিলো মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধান। হয়ত ৫ থেকে ১০ বছরের। অথচ কিন্তু এতো অল্প সময়ের ব্যবধানের দুই জেনারেশনের মধ্যে একটা বিস্তর জেনারেশন গ্যাপের সৃষ্টি হয়ে গেলো। এবং দেখা গেলো, একই পরিবারের মধ্যেই এই ঘটনাটা ঘটে গেলো। এই দুই জেনারেশনের মধ্যে তাদের চিন্তাধারা, জীবনযাত্রার দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষাদীক্ষার লেবেল, আচরন, ভবিষ্যৎ চিন্তাধারা, আর্থসামাজিক ভাবধারা সবকিছুই আমুল পালটে গেলো। বর্তমান জেনারেশনের জীবন যাত্রায় চলে এলো মুক্তধারার স্বাধীনতার শক্তি, স্বাধীন চলাফেরা, নাইট ক্লাব, ইন্টারনেট, কম্পিউটার গ্যাম, বিনোদন, মুক্ত-রাজনীতির চর্চা এমন কি বিয়ে সাদির ব্যাপারেও আধুনিক কালের যুবকদের চিন্তাধারা অনেক পার্থক্য। তাদের চাকুরী পছন্দের বিষয়ে, চাকুরি ছাড়ার বিষয়ে, এমন কি অবসর প্লানের বিষয়ে কোনো কিছুই ঘরের পিতামাতাদের সহিত মিলছে না। অন্যদিকে পুরানো দিনের অভ্যাসে গড়া বাবা মায়েরা ধরে থাকলেন ট্র্যাডিসনাল সমাজ ব্যবস্থা। তারা বর্তমান যুগের ছেলেমেয়েদের অনেক সিদ্ধান্তের সঙ্গেই একমত হতে পারছে না, তাদেরকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে দিতে চাইছেন না কিংবা দিতে চাইছেন না বলে বললে ভুল হবে, তারা নিশ্চিত হতে পারছেন না যে, তাদের সন্তানেরা ঠিক হ্যান্ডেল করতে পারবেন কিনা, কিংবা শেষতক আবার তাদের সন্তানেরা দিশেহারা হয়ে যায় কিনা ইত্যাদি।

এর ফলশ্রুতিতে যা হচ্ছে তা হলো বিশাল এক গ্যাপ। আর এই গ্যাপের কারনেই একই পরিবারের মধ্যে যুবক এবং মধ্যবয়সী সদস্যদের মধ্যে বিশাল গ্যাপের সৃষ্টি হচ্ছে। আর সৃষ্টি হচ্ছে ফাটল, সৃষ্টি হচ্ছে সন্দেহ, তিক্ততা ইত্যাদি। ফলে কিছুতেই সুতা এক জায়গায় আবদ্ধ হয়ে নতুন জাল তৈরি না করে শুধু নৈরাজ্যসরুপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবারে কোনো কিছুই অভাব নাই আবার কোনো কিছুতেই ইয়াং বয়সের সদস্যদের মন টানছে না। তারা সস্থিতে নাই। তারা বিসন্ন। যাদের কাছ থেকে সহযোগিতার হাত পাওয়ার কথা তাদের সাথেই তাদের বিরোধ। যাদের কাছে তারা অসহায় মনের ভাব শেয়ার করবে, তারাই তার অসহয়ের কারন। সে কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? ফলে একই মানসিকতার বন্ধু, বান্ধবি, কিংবা তাকে বুঝতে চেস্টা করছে এমন কেউ, সেখানেই সে পায়ে পায়ে হেটে চলে যাচ্ছে তার অভাবহিন ঘর ছেড়ে, তার নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে কোনো একটা জায়গায় যেখানে সে আর কিছুই না পাক, পাচ্ছে মানসিক শান্তি। সেটা ভুল না ভালো না শুদ্ধ, তা তার জানার অপেক্ষা করছে না। আমরা বারবার বলছি পরিবারের সচেতনার কথা, বারবার বলছি কিছু একটা করা দরকার, বারবার বলছি সরকার কেনো দেখছে না, বারবার বলছি কেনো এই রকম এয়াবনরমাল অবক্ষয় হচ্ছে। কিন্তু সমস্যাটার ভিতরে কেউ প্রবেশ করছি না। আমার কাছে মনে হচ্ছে, সমস্যাটা আসলে কোনো রাজনৈতিক কিংবা পার্শ্ববর্তি দেশ, কিংবা কোনো একটা বিশেষ মতবাদের উপর দোষ চাপিয়ে খুব একটা লাভ হবে না। কিংবা চাপিয়ে দিয়েও কোনো লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না যতক্ষন না পর্যন্ত এই সুক্ষ কিন্তু বিস্তর গ্যাপটা সমাধান হচ্ছে।

আমার মনে হচ্ছে এই জেনারেশন গ্যাপটাই এখন আমাদের অত্যান্ত বুদ্ধিমানের সহিত হ্যান্ডেল করে পরিস্থতি আয়ত্তে আনা সম্ভব। এখন কথা হচ্ছে কি কারনে এই জেনারেশন গ্যাপটা হচ্ছে আর কিভাবে এই দুই জেনারেশনের গ্যাপ কমিয়ে এনে সার্বজনীন মতাদর্শ, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ, ইত্যাদি একটা প্লাটফর্মে আনা যায় তার হিসাব করা। বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা আসলে আমাদের পরিবার থেকে শুরু করে যার যার আওতায় বাধতে হবে। কিছু পরিবারের পক্ষে, কিছু সরকারের, কিছু সমাজের কিছু আমাদের চারিপাশের জনগনের। কেউ দায়িত্ব এরাইয়া যাওয়ার কোনো স্কোপ নাই। (চলবে…)

০৭/০৬/২০১৬ -আমার লাল পিকান্ত

বহুদিন পর হটাত করে আজ ওর সঙ্গে আমার দেখা। বুকটা আঁতকে উঠল ওকে দেখেই। আমাকে ও প্রথম দেখতে পায় নাই, ও খুব দ্রুত চলে যাচ্ছিল। আমি ওর পিছন থেকে এক নজর দেখেই চিনতে পেরেছিলাম, কারন ওর একটা পরিচয় বহনকারী কোড নাম্বারটা আমার আজীবন কালের চেনা। আমি ওকে ধরার জন্য ওর পিছন পিছন ছুটছিলাম। দেখলাম আমি যেদিকে যাচ্ছি, ও ঐ দিকেই থামলো। আমি ওর কাছে গেলাম, দেখলাম ওর কোলে ভীষণ সুন্দর একটি ফুটফুটে বাচ্চা বসে আছে। পাশে একজন মধ্য বয়সী যুবক। বাচ্চা মেয়েটি সম্ভবত ঐলোকটারই হবে। অবিকল বাবার চেহারা পেয়েছে। মেয়েটিকে ওর কোল থেকে নিয়ে লোকটি পাশের এক বইয়ের দোকানে ঢুকে গেল।

আমি এই ফাকে একটি সিগারেট ধরিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালাম। ও মুচকি হেসে দিয়ে বলল, এখনো সিগারেট ছাড়োনি? তোমার এই সিগারেটের গন্ধটা আমার খুব পরিচিত। আজও মনে পড়ে তুমি যখন আমার কাছে বসতে, তোমার মন ভাল থাকলেও তুমি একটার পর একটা সিগারেট টানতে আবার মন খারাপ থাকলেও  তুমি একটার পর একটা সিগারেট ফুকতে। তাঁরপরেও আমি তোমার এই সিগারেটের গন্ধটা অপছন্দ করতাম না। আফটার অল তুমি আমার জিবনে প্রথম পুরুষ। তুমি কি এখনো আগের মত করে অনেক রাতে বাড়ি ফিরো? নাকি অভ্যাসটা কিছু পরিবর্তন হয়েছে?

নাহ, আমার যে ব্যস্ততা, তাতে মনে হয়না যে অচিরেই আমার এই রাতে বাড়ি ফিরার অভ্যাসটা পরিবর্তন হবে। তবে ছুটির দিনে এখন আর কোথাও যেতে মন চায় না। বললাম, তুমি যখন আমার কাছে ছিলে, তখন ছুটির দিনেও তোমাকে নিয়ে কোন কারন ছাড়া আমি বহুবার বহুদিন এখানে সেখানে ঘুরেছি বটে তবে এখন নতুন সঙ্গী থাকলেও আর যাওয়া হয় না।

“আমার কথা মনে পড়ে?” জিজ্ঞ্যেস করল ও ।

“কি মনে হয় তোমার?” আমি উত্তর করি। 

কি জানি, হয়ত মনে পড়ে হয়তবা না। এখন তো তোমার নতুন সঙ্গী হয়েছে আমার থেকেও সুন্দর, আমার থেকেও অনেক বড়। কি জানি মনে নাও পরতে পারে। তবে আমি তোমার কথা সব সময় মনে করি। সবচেয়ে বেশি মনে হয় আমার সঙ্গী যখন তোমাদের ঐ ক্যান্টনমেন্টের পথ দিয়ে কখনো আসা যাওয়া করে। তোমার সঙ্গে থাকার সময় আমি কখনো সাধারন পাবলিকের রাস্তায় ঢোকতে হতো না। তুমি সঙ্গে আছো আর সাই সাই করে ক্যান্টনমেন্টের লেন ধরে তুমি হাত নাড়িয়ে পরিচয় দিলেই কর্তব্যরত এমপি সাহেব কড়া একটা স্যালুট দিয়ে সসম্মানে চলে দিতে দিত। আমি কত সাহেব, কত ভিআইপি পাবলিকের গাড়ির পিছনে এসেও শুধু তোমার কারনে সবার আগে টা টা বাই বাই দিয়ে চলে যেতাম। নিজকে সাংঘাতিক ভগ্যবতী মনে হতো। আর এখন? ঘন্টার পর ঘন্টা ঐ সব রিক্সা, ঠেলাগাড়ি, কি সব গাড়ীঘোড়া সবার পিছনে জ্যামের মত ঐ এমপি সাহেবের ক্লিয়ারেন্সের জন্য বসে থাকতে থাকতে আমার আর জান সয় না। আমাকে যেন ঐ এমপি সাহেবও আর চিনতে পারে না। তোমার নতুন সঙ্গী নিশ্চয় এখন এই মজাটা পায়, আমি সেটা জানি।

আমি ওর কথায় হাসি।

“আচ্ছা তোমার চোখের কোনায় এই কাল দাগটা কিসের গো?” আমি ওকে প্রশ্ন করতেই ও চুপ হয়ে গেল।

“কিছু হয়েছে নাকি ওখানে?”

“আর বলো না। আমার নতুন সাহেব একদিন খুব মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরছিল। রাস্তাঘাট ফাকাই ছিল। হটাত কি হলো তাঁর, আল্লাহই জানে, ঘ্যাঁট করে এমন করে সে টার্ন নিল যে, পাশের এক ইলেকট্রিক খাম্বার সঙ্গে দিল লাগিয়ে। আর যায় কোথায়। তখন আমার বাম চোখের পাশে আমি এই ধাক্কাটা খাই, হাসপাতালে যাওয়ার সময় নাই, কারন আঘাতটা গুরুতর বলে মনে হয় নাই বলে আমার সাহেবের ধারনা। সেই থেকে এই ক্ষত নিয়েই চলছি সবার মাঝে।

“তোমার নতুন সঙ্গির সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে না?” বলে যেন সে খিল খিল করে হাসতে থাকলো। কি অদ্ভুত লাগলো আমার কাছে।

আমি বললাম, “নিশ্চয় পরিচয় করিয়ে দেব”। তবে আজ নয়। ওরা আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে নিউ মার্কেটের একটা রেস্টুরেন্টে গেছে।

তোমার সাহেব কি করে? বলতেই আরেকবার চুপ হয়ে গেল বলে মনে হল।

সে আমার উত্তর না দিয়ে আমাকে উল্টো প্রশ্ন করে বসে। “আচ্ছা, তুমি কি আমাকে না ছাড়লেই কি পারতে না? অন্তত সেই লক্ষি বড় মেয়েটির জন্য!!?” ও কতদিন আমার কোলে বসে সুন্দর সুন্দর গান শুনতো। কি মিস্টি মেয়ে। লক্ষি মেয়ে বটে। কি করে এখন ও? শুনেছি ও নাকি এখন মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে। অনেক বড় হয়ে গেছে না? আমার কথা কি ওর মনে পড়ে? 

আমি বললাম, হ্যা, ও এখন ডাক্তারি পড়ছে। আমাদের কাছে থাকে না। মাঝে মাঝে আমি নতুন সঙ্গিকে নিয়ে ওর ওখানে যাই। আমার বড় মেয়ে প্রায়ই তোমার কথা বলে।

এমন সময় দেখা গেল তাঁর সঙ্গী আবার সেই ফুটফুটে মেয়েটিকে নিয়ে চলে এসেছে। আমারও প্রায় সিগারেট খাওয়া শেষ। কোন ফুরসুত না দিয়ে তিনি আমার এই সেই পুরানো বন্ধুটিকে নিয়ে চলে গেলেন। আমার আর তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেয়া হল না।

দেখলাম, সেই পুরান চেহারায় লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ির রঙে রাঙ্গানো আমার সেই ১০৮৬ সিসির পিকান্ত গাড়িটি ধুলা উড়িয়ে আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি ওর ঠিকানাটা আবারও হারিয়ে ফেললাম। আমার প্রথম জীবনের সঙ্গী সে। জীবনে মাঝে মাঝে এমন কিছু বিচ্ছেদ হয় আমাদের যার কোনো কারন থাকে না। এমন নয় যে, আমাদের এই বিচ্ছেদের কারন কোনো অনীহা, বা অপছন্দের কিংবা এক সাথে চলতে না পারার কোনো কাহিনী। অনেক সময় মানুষের জীবনের নিত্য প্রয়োজনেও কাউকে না কাউকে বিসর্জন দিতে হয়। তখন সেই বিসর্জনে থাকে বুক ভরা কষ্ট আর স্মৃতি। কষ্টটা হয়তো সময়ের স্রোতে ভুলে যাওয়া যায় কিন্তু স্মৃতিটুকু সব সময় মনের কোনো এক গহীনে এমনভাবে জমা হয়ে সুপ্ত থাকে যে, অল্পতেই নড়াচরা করলে সেই স্মৃতি পুরানো সেই কষ্টকে জাগিয়ে তোলে। আমার এই কোরিয়ান লাল পিকান্ত গাড়িতা যেনো সেই রকমের কোনো এক বিচ্ছেদের অংশ। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে আমি ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে তাকিয়ে মনে মনে শধু বললাম, I loved you always and I will always love you.

 

   

০৫/০৬/২০১৬- বেলাশেষে

Categories

“বেলাশেষে” একটা বাংলা ছায়াছবির নাম। সংক্ষিপ্ত কাহিনীটা এই রকম-

৬৫ বছরের স্বামী আর ৬০ বছরের স্ত্রী। অনেক নাতি-নাত্নি, মেয়ের জামাই, ছেলেরা মেয়েরা সবাই একসঙ্গে মিলিত হয়েছেন গুরুতর এক সমস্যা নিয়ে। সমস্যাটা হল, স্বামী বলেছেন তিনি এই বয়সে এসে তার স্ত্রীর সঙ্গে পৃথক হতে চান এবং আরেকটি বিয়ে করতে চান। এই বুডো মানুষটির সিদ্ধান্তে অনেকেই হতবাক হলেও কেউ কেউ রাজি আবার কেউ কেউ রাজি নয়। যারা এই সিদ্ধান্তে রাজী না, তারা হতবাক হচ্ছেন, এই বয়সে কেন তিনি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ফলে নায়নাতকুর, ছেলেমেয়ে, মেয়ের জামাই সবাই মিলে পরিকল্পনা করলেন, ঠিক আছে অসুবিধা নাই, তবে তারা নিজেরা একঘরে কয়েক সপ্তায় নিজেরা নিজেরাই আলাপ আলোচনা করুক, ভাবুক, দেখুক তারপর নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিক কোনটা করা উচিৎ। বুড়া-বুড়িও সম্মতি দিলেন, ঝগড়াতো আর হয় নাই, স্বামী স্ত্রীই তো।

তাদের জন্য আলাদা ঘর দেওয়া হল, একদম নিরিবিলি পরিবেশ। কেউ তাদেরকে বিরক্ত করার নাই। কিন্তু সবাই এর মধ্যে একটা কাজ খুব গোপনে করে রাখলো। আর তা হচ্ছে তাদের রুমে গোপন একটা ক্যামেরা লাগিয়ে দিল এই দুই বুড়া বুড়ি কি কথা বলে তা দেখার জন্য। যখনই এই দুই বুড়া বুড়ি তাদের কথাবার্তা বলেন, তখনই দলবেধে অন্য বাড়ি থেকে সবাই মিলে ভিডিওতে তা প্রত্যক্ষ করেন।

পঞ্চাশ বছরের বিয়ের সেই অভিজ্ঞতার কথা, ভাল লাগার কথা, একসঙ্গে কষ্টের কথা, দুঃখের কথা, তাদের মিল অমিলের কথা, রাগের কথা, ভালোবাসার কথা একের পর এক তারা দুইজনে নিরিবিলি একত্রে বসে আলাপ করেন। আর সবাই তাদের এইসব অভিজ্ঞতার কথা শুনে কখনো অন্য সবাই হাসেন, কখনো চোখ মুছেন, কখনো অবাক হয়ে চুপ করে থাকেন। তারা সবাই একটা জিনিষ বুঝতে পারেন যে, সব স্বামীর কাছে তার সংসারটা এক রকমের, আর স্ত্রীর কাছে তার সংসারটা আরেক রকমের। কিন্তু কেউই যে ভুল নন তা ঠিক। স্বামীর কাছে দাম্পত্য জীবনের ভালোবাসাটা এক রকমের আর স্ত্রীর কাছে স্বামী আর সংসারের জন্য ভালোবাসাটা আরেক রকমের। একজন মায়াবী স্বামী সব সময়ই চেয়েছেন, তার অবর্তমানে তার আদরের স্ত্রীর যেনো কোনো কষ্ট না হয়, সে যেনো কারো কাছে হেয়ালীর পাত্র না হন, তার আদুরী স্ত্রী যেনো কোনো অর্থকরী কিংবা সুন্দর জীবন চালানোর জন্য কারো কাছে হাত না পাতেন। সেই দিকটা খেয়াল করে এই ভরষাযুক্ত স্বামী সব সময় চান তার স্ত্রীকে সাবলম্বি করে তুলতে। ফলে স্বামী সব সময়ই চেয়েছেন তার স্ত্রী এটা জানুক যে, তার স্বামী কোথায় কিভাবে কত রোজগার করেন, কত সঞ্চয় করেন, আর কিভাবে সেই কষ্টার্জিত সঞ্চয় থেকে কিভাবে তিনি তার স্ত্রীর মংগলের জন্য কি করছেন এবং তার পুরুপুরী এই পরিকল্পনার অংশ হয়ে যেনো তার স্ত্রী এটা খেয়াল করে সে মোতাবেক প্রস্তুতি নেন এবং তার উপর পারদর্শী হন। অন্যদিকে এই স্বামী দেখছে, তার স্ত্রী তার এইসব ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন হয়ে তাদের সংসারে বেড়ে উঠা ছেলেমেয়ে, নাতি নাতকুর কিভাবে মানুষ হবে, কিভাবে আরামে থাকবে, কিভাবে নিরাপদ থাকবে ইত্যাদি নিয়েই বেশি নজর। স্বামীর কাছে ভালো লাগা ছিল বউকে নিয়া কোথাও রোমাঞ্চের উদ্দেশ্যে একা একা বেরিয়ে পড়া, কিন্তু স্ত্রীর কাছে যেনো সেই রোমাঞ্চের থেকে বেশী জরুরী ছিলো ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা, তাদের কোচিং ক্লাস, তাদের স্বাস্থ্য, তার নিজের ঘর কন্নার কাজ, আত্মীয় সজনদের সেবা শশ্রুসা ইত্যাদির মধ্যে একটা বন্ধন স্রিস্টির লক্ষে সবাই মিলে পারিবারিক সময় কাটানো। স্বামী চেয়েছেন স্ত্রীর কাছ থেকে অনেকটা সময় যে সময়টা তারা ভালোবাসার কথা বলবে, পুরানো দিনের কথা বলবে, কোনো একটা সিনেমা দেখতে দেখতে মন ভরে আনন্দ করবে, বিখ্যাত কোনো কবির কবিতা পড়ে পড়ে তার অন্তর্নিহিত ভাবধারায় সিঞ্চিত হবেন। কিন্তু স্ত্রী তার পরিবারের সবার দিকে একসঙ্গে খেয়াল রাখতে গিয়ে, ছেলেমেয়েদের পরাশুনার দেখভাল করতে গিয়ে, অসুস্থ শ্বশুর শাশুড়ির দিকে নজর দিতে গিয়ে অধিকাংশ সময়টাই চলে গেছে অকাহ্নে, স্বামীর জন্য অফুরন্ত সময়টা আর তিনি বের করতে পারেন নাই।

কেউ দুষী নন, কারো চাওয়ার মধ্যেই অতিরঞ্জিত ছিলো না। অথচ তারা যেনো কোথায় সুখি নন। তারপরেও তারা বহুকাল এই কম্প্রোমাইজের মধ্যেই একটু রাগ, একটু অভিমান, একটু গোস্যা আর বিস্তর জায়গা জুড়ে পরস্পরের ভালোবাসাটা এক সময় অভ্যাসে পরিনত হয়, তখন অভ্যাসটাই যেনো ভালোবাসা। স্বামীর টয়লেট করে আসার পর যে গন্ধটা একদিন স্ত্রীর কাছে দূর্গন্ধ মনে হতো, স্বামীর ঘামের গন্ধে ভরপুর যে গেঞ্জীটা একদিন নাকের কাছে নিলে একটা শুকনা বাজে গন্ধ বলে মনে হতো, একদিন সেই টয়লেটের গন্ধ, ঘামের দূর্গন্ধ আর দুর্গন্ধ মনে হয় না। অন্যদিকে স্ত্রীর ঘুমের মধ্যে ডাকা নাকের শব্ধ যখন কোনো একদিন এতোটাই অসহ্য মনে হতো, বিরক্তিকর মনে হতো, চুলে আধা ভেজা তেলের যে গন্ধ একদিন স্বামীর নাক বুঝে আসতো, সময়ের এতোটা পথ বেয়ে যখন সব গুলি ভালোবাসা একটা অভ্যাসে পরিনত হয়ে যায়, তখন স্ত্রীর সেই নাক ডাকা, আধাভেজা চুলের গন্ধ যেনো একটা সুখের পরশ মনের ভিতর প্রবাহিত হয়ে যায়। এই তো সে তো কাছেই আছে।

৯০ বছরের কোনো এক প্রোড় বুড়ো, ৮৫ বছরের কোনো মহিলার সাথে যখন এক সাথে স্বামী স্ত্রী হিসাবে বসবাস করেন, তখন তাদের এই বয়সে এসে আর সেই যুবক যুবতীর মতো শরীরের চাহিদা, রুপের চাহিদা আর কাজ করে না। কিন্তু তাদের মধ্যে ভালোবাসাটা একটা বিশাল আকার পাহাড় সম ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাহলে সেখানে কি ফ্যাক্টরটা কাজ করে? কাজ করে নির্ভরতা, কাজ করে একে অপরের উপর শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, মায়া আর মহব্বত। কাপা কাপা হাতে যখন ৮০ বছরের বুড়ি এক কাপ চা নিয়ে ৯০ বছরের তার স্বামীর কাছে কাপ খানা হাতে দেন, কিংবা পানের বাটিতে পান আর সুপারী ছেচে যখন এক খিলি পান স্বামী তার ৮০ বছরে সংগিনীর মুখে তুলে দেন, আসলে তিনি শুধু এক কাপ চা কিংবা এক খিলি পানই দেন না, দেন সারা জীবনের মহব্বত আর ভরষা যে, তুমি ছাড়া আমার আর কোনো বড় বন্ধু নাই।

তুমি আমার ভরষা, তুমি আমার নিরাপত্তা, তুমি আমার স্বামী, কিংবা স্ত্রী, তুমি আমার পরামর্শদাতা, বিপদে আপদে তুমিই আমার ডাক্তার কিংবা নার্স। তুমিই আমার সব। ব্যস্ততম রাস্তায় যখন আমি রাস্তা পার হতে গিয়ে আমার বুক কাপে, তোমার হাত ধরলেই আমার সব কাপুনী বন্ধ হয়ে যায়। তুমি আমার মায়ার সংসার। বুকের সব পাজরে পাজরে তুমি গেথে থাকা আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস আর চোখের প্রতিটি বিন্দুজলে নীল আকাশের গাংচিলের মতো তুমি খেলা করো আমার  অন্তরের এমন এক কোটরে যেখান থেকে তোমাকে আলাদা করার কোনো ক্ষমতা আমার নাই।

বেলাশেষে তুমিই আমার আর আমি সেই তোমার।

০৪/০৬/২০১৬-ভিক্ষুকের পাল্লায় আরেক দিন

Categories

আমি জুরাইন রেলগেটের কাছে ট্রেন পাশ দেয়ার জন্য গাড়ীতে বসে আছি। অনেক গাড়ি থেমে আছে, কেউ কেউ আমার ও অনেক আগে থেকেই থেমে আছে। আমার লাইন অনেক পরে। আমি ঠিক যেখানে গারিতে বসে আছি, তার ডান দিকে গুটি কতক হাত দূরে রাস্তার আইল। অখানে এক আখ বিক্রেতা তার চিকন চিকন আঁখগুলো অনেক যত্ন করে খোসা ছারাচ্ছে, তারপর কচি কচি কঞ্চির মত করে একটা তিনের পাতায় এক এক করে সারি দিচ্ছে। তার পাশে ছোট একটা মেয়ে হাপ প্যান্ট পরা অবস্থায় বাবার আখ কাটা দেখছে। তার হাতেও একটা আখের কঞ্চি। আখ বিক্রেতার পাশে এসে এক ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতাও বসে আছে। ওর সব মিলিয়ে দুটু সম্বল, একটা সম্ভবত ফ্লাক্স আর আরেক্তি বিস্কুতের একটি জার। এটা দিয়েই হয়ত ওর সারাদিনের রোজগার, সংসার চলে।

আমার বা পাশ দিয়ে খুব ব্যাস্ত একটি সাইকেল আরোহী উল্টো পথ ধরে পার হবার চেষ্টা করছে, কোন তাড়া আছে হয়ত কিন্তু ওর বয়স আর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না যে ট্রাফিক আইন ভেঙ্গে অন্যান্য গাড়ি গুলো বিপদজনক ভাবে টপকিয়ে এভাবে যাওয়ার মানুষ, তারপরে তিনি করছে, অল্প বয়স, বয়সের একটা গরম আছে। পিছন থেকে অযথা একটি গাড়ি হর্ন বাজিয়ে উঠল যেন বিরক্ত কারো উপর। আমার ড্রাইভার নিজে নিজেই অনেক কথা বলে ফেলছে, ‘কেন কোন সেন্স নাই এত আগে রেল গেত ক্লোজ করে সবাইকে দাড় করাইয়া রাখবে, কি হয় ঠিক টেন আসার আগে দাড় করাইলে? দেশ তারে কেউ ভালবাসে না, কেউ তাদের ডিউটি ঠিক মত করে না। কি হবে এদেশের? বুঝলাম এবার আমার ড্রাইভার দেশ প্রেমিক হয় উঠেছে। অথচ আমার এই ড্রাইভারকেই রঙ সাইড দিয়ে না যাওয়ার জন্য আমাকে অনেক বার বকাও দিতে হয়। সুযোগ পেলেই আমার ড্রাইভার চান্স নেয়।

বাইরে বেশ গরম, বুঝা যাচ্ছে। ঐ অদুরে সারি সারি দোকানে দোকানদার কেউ কেউ হাত পাখা নিয়ে নিজেকে বাতাস করার চেষ্টা করছে, বুঝলাম এলাকায় বিদ্যুৎ নাই। তা না হলে হাত পাখার ব্যবহার হত না এখন। এরই মধ্যে বাস আসার অপেক্ষায় কিছু সাধারন যাত্রি প্রচন্ড খরার মত রৌদ্রে দাড়িয়ে আছে কখন তাদের বাস আসবে। যারা একটু যুবক, তাড়া আবার কেউ কেউ হাতে সিগারেট ধরিয়ে সময়টা কাটানোর চেষ্টা করছে। আমার ড্রাইভার গাড়ির রেডিও তা অন করতেই কোন এক জকির ম্যাকি সুরে কত কথা শুনা গেল।

ঠিক এমন সময় একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে আমার গাড়ীর সামনে এল এবং ভিক্ষা চাইল। আজকাল অনেক পদের ভিক্ষুকের সমাহার এদেশে। কেউ খুরিয়ে খুরিয়ে হাটে, কেউ আবার কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে, পয়সার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে এই সার্টিফিকেট নিয়ে রাস্তায় নামে তার টাকা জোগাড়ের জন্য। কেউ আবার পুরু শরীর উদম করে আসে কোথায় তার ক্ষত আর কোথায় তার শারিরিক সমস্যা মুখে না বলে যেন যিনি ভিক্ষা দেবেন তিনি তাকে দেখেই বুঝে ফেলতে পারেন তার ভিক্ষা চাই। কেউ আবার অনেক প্যান্ট শার্ট পরে খুব ভদ্র ভাবে সামনে এসে চুপি চুপি বলবে যে, তার সব খুইয়ে এখন এমন অচেনা শহরে একা, তার বাড়ীতে যাওয়ার পয়সা নাই কিন্তু তিনি ভিক্ষুক নন। নতুন কৌশল।

যাক গে, আমার সামনে এই মুহূর্তে যে ভিক্ষক টি দাড়িয়ে তাকে দেখেই আমার ভিক্ষা দেয়ার ইচ্ছে হল না। কারন তার যে বয়স, তাতে সে অনেক বাসায় কাজ করতে পারে, কিংবা গার্মেন্টসেও কাজ করতে পারে কিংবা অন্য যে কোন পরিশ্রমের কাজ তার দ্বারা করা সম্ভব। তার ভিক্ষা করার প্রয়োজন হয় না আসলে।কিন্তু নাছোড়বান্দা। বারবার আমার গাড়ীর কাচে নক করছিল। বিরক্ত হয়ে বললাম, প্লিজ মাফ কর। আমার বিরক্তে তার কিহু যায় আসে না। সেও বিরক্ত। এত দেরি করে কেন কাচ খুললাম এই জন্য।

মহিলা রেগে গিয়ে বল্ল, এতক্ষন না করলেন না ক্যান, আমারে খামাখা দাড় করাইয়া রাখলেন? আগে বললেই তো পারতেন?

অবাক হইলাম তার রাগের কারনে। আমি তার সময় নষ্ট করে দিয়েছি বলে। তো, আবার ডাকলাম, ভাব্লাম কিছু কথা বলি।

বললাম, কোলের বাচ্চাটা কে বা কার? অনেকে আবার বাচ্চা ভাড়া করে নিয়ে আসে এবং ভিক্ষা করে। এতে হয়ত অনেক মানুষের একটু বেশি সিম্পেথি পাওয়া যায়, আর ভিক্ষাটাও জমে উঠে হাতে পায়সার ভারে।

মহিলা বল্ল, আমার বাচ্চা। বুঝলাম, তার রাগ কমে নাই, সব ভিক্ষুকেরা সাধারনত স্যার বলে সম্বোধন করে। হয়ত সেও করে কিন্তু সে আমার উপর রাগ।

বললাম, কাজ করোনা কেন?

উত্তরে সে যা বলল সে এক লম্বা ফিরিস্তি। নাই বা বললাম।

আমি আবার বললাম, কয় টাকা পাও প্রতিদিন ভিক্ষা করে? এবার মনে হল, সে আমার কোথায় একটু হলেও রাগ কমেছে অথবা চিন্তা করছে যে সাহেব মনে হয় কিছু বেশি সাহাজ্য করতে পারে ইত্যাদি। ভিক্ষুকরাও কিন্তু সাহেব্দের সাইকোলজি বিশ্লেষণ করে।

সে আমতা আমতা করে বল্ল, হয় স্যার প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পাই প্রতিদিন। এবার সে আমাকে স্যার বলে সম্বোধন করল। বুঝলাম, অনেক্তাই রাগ কমেছে আমার উপর।

আমি আবার বললাম, গতকাল কত টাকা পেয়েছ?

সে বল্ল, স্যার গতকাল প্রায় ২০০ টাকার মত পাইছি।

আমি বললাম, তাহলে তোমার মাসিক ইনকাম প্রায় ৬০০০ টাকা। তোমার তো মাসে ৬০০০ টাকা লাগে না। কয় টাকা হলে তোমার সংসার চলে?

সে কিহুক্ষন চুপ থেকে একবার আকাশের দিকে, একবার আমার দিকে, আবার একটু নিরব থেকে, হাতের কড়া গুনে গুনে বল্ল, স্যার, মোটামোটি হাজার ৫ হলেই আমাদের ছোট সংসার চলে যায়। 

আমি বললাম, ধরো, আমি যদি তোমাকে আজকে ৫০০০ টাকা দেই, তাহলে কি তুমি এখন বাড়ি চলে যাবা? যদি বল, যে, তুমি বাড়ি চলে যাবা, এবং তুমি আর এই মাসে ভিক্ষা করবা না, তাহলে আমি তোমাকে এখনই ৫০০০ টাকা দেব। কিন্তু আমি তোমার উপর লক্ষ রাখব তুমি ভিক্ষা করছ কিনা। সে নিসচুপ হয়ে কিছুক্ষন দারিয়ে থেকে আমার গাড়ীর সামনে থেকে চলে গেল। মনে হল তার এই আয়ে পোষাবে না। তার মানে এই যে, সে ভিক্ষাটা ছারবে না। অথবা এমনও হতে পারে যে, সংখ্যাটা কম বলে ফেলেছে।

………… তার বেশ কয়েক মাস পর,

আমি আবার গুলিস্থানের জিপিও এর সামনে গাড়ীর জ্যামের মধ্যে বসে আছি। হটাত দেখলাম, ঐ সেই একই মহিলা। কোলে একটা বাচ্চা, তবে আজকে ছেলে বাচ্চা নয়, মেয়ে বাচ্চা। আমি মহিলাকে দেখেই চিনতে পেরেছি। কিন্তু মহিলা আমকে দেখে চিনতে পারে নাই। আমার গাড়ীর সামনে এসে সেই একই ভঙ্গিতে ভিক্ষা চাইল। আমি এবার আবারো সেই একই প্রশ্ন গুলো করলাম।

আমি বললাম, তোমার কয় বাচ্চা?

সে বল্ল, স্যার, এই একটাই। বুঝলাম, সে মিথ্যা বলছে। এটা আসলে ওর ভাড়া করা বাচ্চা মনে হয়।

 তারপর আমি শুরু করলাম আমার সে আগের প্রশ্নগুলো।কয় টাকা পায়, কয় টাকা লাগে প্রতিমাসে। কেন কাজ করতে চায় না ইত্যাদি।

এবার মহিলা কিন্তু কম করে ফিগারটা বলে নাই। সে বল্ল, স্যার আমার মাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকা লাগে। স্বামী অসুস্থ ঘরে। আমার বোনের এক বাচ্চা স্কুলে পরে, তাকেও আমার টানতে হয়, নিজেও অসুস্থ, সঙ্গে শ্বশুর শাশুড়িকেও টানতে হয়ইত্যাদি। বুঝলাম, ১৫ হাজারের হিসাবটা তার আগে থেকেই করা।

আমি এবার অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, তোমার সঙ্গে একবার আমার দেখা হয়েছিল জুরাইন রেলগেটে। তখন আমি তোমাকে এই প্রশ্নগুলো করেছিলাম এবং তুমি মাসে ৫০০০ টাকা হলে তোমার হয়ে যায় বলেছিলে, আজ আবার তা ১৫০০০ হাজার টাকা হয়ে গেল ক্যান?

মহিলাটি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমারে এক ঝারি দিয়ে বল্ল, ধুত মরার, খালি আপনার লগেই আমার দেহা হয় ক্যান? অন্য রাস্তা দিয়া যাইতে পারেন না? তারপরযত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার গাড়ী পার হয়ে আরেক জনের কাছে চলে গেল।

 মনে হইল, ভিক্ষা যার পেশা, ভিক্ষা তার নেশাও বটে। নেশা আর পেশা যখন এক হয়ে যায়, তখন আর তাকে ঐ কাজ থেকে সরিয়ে নেয়া সম্ভব না। একজন ভিক্ষুক যত ধনিই হোক না ক্যান, স্বয়ং বিধাতা তাকে সবার সামনে প্রকাশ্যে ফকির বানিয়ে রেখেছে, তাকে বিধাতা দিনের সূর্যের প্রখর তাপে শাস্তি দিচ্ছেন, আবার শীতে কষ্ট দিচ্ছেন, বৃষ্টিতে ভিজিয়ে রাখছেন, অথচ হয়ত তার একটা সুন্দর বাড়ি আছে, তাকে বৃষ্টিতে ভিজতে হত না, শীতে কাঁপতে হত না যদি ভিক্ষা না করতে হত। কিন্তু সে তো ভিক্ষা করবেই। এটা তো পেশা। ভিক্ষুক হয়ত আনন্দ পায় তার সঞ্চিত টাকার সংখ্যা দেখেই। তার ভোগ করার সময় কই? সেটা তো বিধাতা দেবেন না। তার কাছে পূর্ণিমার রাত যা, অমাবস্যার রাতও তা, ওর কাছে বৃষ্টির ঝন ঝন শব্দ কানে ভাসে না, ওর শুধু নজর কখন একটা গাড়ী আসবে আর তার সামনে গিয়ে সে কাতর হয়ে মুখের সবটা যন্ত্রনার অভিব্যক্তির অভিনয়টা করে একটা হাত পেতে বলবে, দেন গো স্যার, আমারে কিছু দেন, দুইদিন কিছু খাই নাই। হয়ত পুরুটাই মিথ্যা কথা।

 আর এইসব ভিক্ষুকের জন্য যারা সত্যি ভিক্ষা করে একটু সস্থি পেতে চায়, তাদের কপাল পুড়ে। শুনেছি, ভিক্ষুকদের এসোসিয়েশন আছে, সেখানে প্রেসিডেন্ট আছে, সেক্রেটারি আছে, সেখানে লাখ লাখ টাকা দিয়ে ইলেক্সন হয়, এবং একদিন তারা আবার এমপি মিনিস্টার পদেও কন্টেস্ট করে।

তখন আমরা তাদের স্যার বলি।  তারপরের কাহিনী অন্য রকম।

০৪/০৬/২০১৬- ভিক্ষুকের পাল্লায়

Categories

প্রতিদিন এই পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার হিসাব সবসময় কেউ রাখে না আর রাখাও দরকার আছে বলিয়া কেউ মনে করেনা।অনেক সময় অনেক অতিকায় বৃহৎ জিনিস নজর এড়াইয়া যায় আবার অনেক সময় অতিকায় তুচ্ছ জিনিসও আমাদের চোখ না এড়াইয়া উহা এমন আবেগের সৃষ্টি করে যা মন এবং হৃদয় উভয়কেই প্রভাবিত করে। আজ এমনই কয়েকটা দৃশ্যের কথা বলছি।

পরিবার নিয়েগ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। দুইদিন পর সবাইকে নিয়া আবার ঢাকায় ফিরছিলাম। আগে গ্রামে যাইতে হইলে বৃষ্টিতে ভিজিয়া, রোদে পুড়িয়া, কিছু দূর হাটিয়া, আবার কিছুদূর কোন এক বটবৃক্ষের তলে জিরাইয়া, পথ হইতে সঙ্গি পাওয়া কিছু হরেক পদের বন্ধু পথচারী লইয়া ঘন্তার পর ঘন্টা হাটিয়া বাড়ি যাইতে হইত। শহর হইতে যদিও খুব দূরে নয় এই আমাদের গ্রামের বাড়ি কিন্তু তাতেই তিন হইতে চার ঘন্টা লাগিয়া যাইত। যখন গ্রামে পৌঁছাইতাম, তখন অনেক দিনের বন্ধু বান্ধব, পারা প্রতিবেশি, এমন করিয়া প্রশ্ন করিত যেন শহরের একজন অতি উচ্চ দরের বাসিন্দা গ্রামে আসিয়াছে। আমাদের সময় শহর ছিল এক ধরনের বিদেশের মত। যেন বিদেশ হইতে আসিয়াছি। আমার মেয়েরা এই শহর আর গ্রামের যে বিস্তর একটা পার্থক্য তাহা তাহারা কখনো বুঝিবে না আর আমিও অনেকবার গ্রামের কথা বলিতে গিয়া দেখিয়াছি, তাহাদের গ্রামের কথা শুনিবার মানসিকতা খুব একটা নাইও। এখন আমি গ্রামে যাই গারিতে চরিয়া, সঙ্গে ড্রাইভার থাকে, আমি অনেক বড় সাহেব। এখন যদিও সেই চেনা পরিচিত লোকগুলো শহরকে আর বিদেশ বলিয়া মনে করে না, তারাও এখন আমি গ্রামে গেলে অতিব খুশি হয়। কারো কারো অনেক অভিযোগ আছে আমার বেশি বেশি গ্রামে না আসার কারনে, কেউ আবার আমার অফিসে দেখা করাই সম্ভব হয় না, দিনের পর দিন অপেক্ষা করিয়াও তাহারা আমার দর্শন পায় না ইত্যাদি ইত্যাদি। সব অভিযোগ যে মিথ্যা তা আমি বলব না কিন্তু অনেক অভিযোগ আছে যা আমার কখনো শুনিতেও ভাল লাগে আবার কিছু কিছু অভিযোগ আছে যাহা সত্যিই সত্য নয়। কিন্তু তাহাতে আমার কিছু যায় আসে বলিয়া আমার মনে হয় নাই। 

এতক্ষন গাড়ী ভালই চলিতেছিল, কোথাও কোন জ্যাম বা রাস্তায় দাঁড়াইতে হয় নাই কিন্তু শাহবাগে আসিয়া দেখি লম্বা এক গাড়ীর সারি। কতক্ষন যে লাগিবে এই জ্যাম শেষ হইতে তা অনুমান করিতে পারতেছিলাম না। রাস্তার জ্যামে সবচেয়ে বড় অসুবিধা যেটা হয় তাহা হইল, কিছুক্ষন পর পর হরেক পদের গল্প লইয়া অতিশয় ক্ষুদ্র বয়স হইতে থুরথুরে বুড়িও আসিয়া গাড়ীর কাঁচ নক করিতে থাকে। নিজের বিরক্ত হইলে তারাও আরও বেশি করিয়া বিরক্ত হয় এবং কখনো কখনো এমন মন্তব্য করিয়া মুখ ভেংচি কাটিয়া চলিয়া যাইবে যেন আমি ই অপরাধ করিয়াছি তাহাকে কোন ভিক্ষা না দিয়া। আজও তার ব্যতিক্রম হইল না। একজন ৪০ কিংবা ৪৫ বয়সের মহিলা আমাদের গাড়ীর সামনে আসিয়া দারাইল। রবি ঠাকুরের মত লিখিলে বলিতে হয় যে, “অতি কাতরতার সহিত তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করিয়া “কিছু দেন স্যার গো” বলিয়া এমন একখান মুখাবয়ব করিল যেন পৃথিবীতে তাহার হইতে আর কোন মানুষ অসহায় নাই আর আমি ছাড়া তাহাকে উদ্ধার করিবার ও যেন আর কেহ নাই।”

আমি সাধারণত সবাইকে ভিক্ষা দেই না। ভিক্ষুকের শারিরিক অবস্থা, মানসিক বিকাস, বয়স কিংবা তার কাজ করিবার ক্ষমতা-অক্ষমতা অনেক কিছু বিবেচনা করিয়াই আমি ভিক্ষা দিতে পছন্দ করি। অনেকে হয়ত বলিবেন, দিবেন তো এক টাকা বা দুই টাকা, তারপরে আবার এত সব কাহিনী বিবেচনা করিয়া ভিক্ষা দিতে হইবে? আসলে ব্যাপারটা ঐ রকম নয়। আমি ভিখা বৃত্তিকে সমর্থন করি না। তারপরেও অনেক ভিক্ষুককে আমি ভিক্ষা দেই। তাতে যে সব সময় আমার ঐ বিবেচনা গুলি থাকে তা কিন্তু নয়। কখনো কখনো আমার মানসিক অবস্থা, আমার ব্যবসায়িক পরিস্থিতি, কিংবা আমার ভাবের উপরও আমি অনেক অযোগ্য ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেই। “ভিক্ষুকের আবার যোগ্যতা”, এই কথা অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করিতে পারেন, কিন্তু সত্যি ভিক্ষা করিবার জন্যও কিন্তু যোগ্যতা লাগে। সবাই ভিক্ষুক হইতে পারে না। শুনেছি, অনেক ভিক্ষুক নাকি অনেক বড় লোক, তারাঅত্যাধুনিক গাড়ী চালায়, বিশাল অট্টালিকায় তাহারা শীততাপ বাড়ীতে ঘুমায়। তাহাদের সেবা করিবার জন্য দাস, চাকরানী সবাই আছে। শুধুমাত্র ভিক্ষা করিবার নিমিত্তে তাহার তাহাদের নির্দিষ্ট এলাকায় গিয়া আবারো সেই পুরানো পোশাক পরিয়া মুখের হাবভাব পরিবর্তন করিয়া মানুষকে ধোঁকা এবং বোকা বানাইয়া সেই একই ভিক্ষা ব্রিতিতে সামিল হন। দিনশেষে আবার তাহারা তাহাদের ঐ বৃহৎ অট্টালিকায় সাহেব বেশে ফিরিয়া আসেন। ইহা একটা ইনভেস্টমেন্ট বিহীন লাভজনক ব্যবসা। যাই হোক, কে ভিক্ষা বৃত্তি করে কত টাকা লাভ করিল বা কে সত্যি সত্যিই ভিক্ষুক এবং জিবিকা নির্বাহের জন্য যে তাহার ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া আর কোন গতি আছে কিনা, এই সব তাত্তিক বা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলার জন্য আমি এই লেখাটি লিখছি না।

আমি এখন শাহবাগে জ্যামের মধ্যে গাড়ীতে বসিয়া আছি এবং ঐ ৪০-৫০ বয়সের মহিলা ভিক্ষুকের দিকে তাকাইয়া আছি। আমার ছোট মেয়ে তার অতি প্রিয় আই প্যাডে এক নজরে কি যেন করিতেছে আর আমার বড় মেয়ে তার কানে হেড ফোন লাগাইয়া কোন দেশের কোন সঙ্গিত শুনিতেছে, তা আমার বা আমাদের গাড়ীতে যাহারা বসিয়া আছি কেহই শুনিতে পাইতেছি না। শুধু মাত্র মেয়ের মাথা নারা দেখিয়া বুঝিতেছি যে আমার বড় মেয়ে সঙ্গিত শুনিয়া সঙ্গিতের জগতে ডুবিয়া আছে। পাশের ভিক্ষুক, আর জ্যামের জন্য তাহার কোন কাজে ব্যঘাত হইতেছে বলিয়া মনে হইতেছে না। আমার প্রিয়তমা পত্নী একটু একটু তন্দ্রা আবার একটু একটু জাগ্রত ভাবে বসিয়া আছে। ড্রাইভার সাহেব অতি সুক্ষ মনোযোগের সহিত কোন ফাক ফোঁকর পাওয়া যায় কিনা এই চিন্তায় গাড়ির স্টেয়ারিং ধরিয়া বসিয়া আছে। আশেপাশের অন্যান্য গারি গুলির অবস্থাও আমার মত।

আমি নরিয়া চরিয়া বসিলাম, আর আমার মানি ব্যাগে হাত দিয়া ঐ মহিলা ভিক্ষুককে কিছু টাকা দিতে উদ্যত হইলাম। আমার এই নড়াচড়ায় আমার ছোট মেয়ে তাহার আই প্যাড হইতে নজর ফিরাইয়া আমার দিকে তাকাইল, আমার বড় মেয়ের এতক্ষন বুঝা চোখ একটু খানি আড় চোখ হইল, আমার পত্নিও একটু নরিয়া বসিল। তাহার সবাই হয়ত এই ভাবিল যে, আমি তো সাধারনত সব ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেই না, এমন কি হইল আজ যে, অতি কর্মক্ষম একজন মহিলা, যাহার কাজ করিবার ক্ষমতা আছে তবুও আমি ভিখা দিতে উদ্যত হইলাম?   

আমি মেয়েদের মনভাব বুঝিতে পারিলাম। বলিলাম,  দেখ , আমি একটা সাইকোলজিক্যাল কাজ করিবার চেষ্টা করিতেছি এইবার। বলিয়াই আমি আমার মানি ব্যাগ হইতে নতুন একটা পাচশত টাকার নোট বাহির করিয়া ঐ মহিলা ভিক্ষুকটির হাতে এমন ভাবে দিলাম যেন, এটা কিছুই না। মহিলা ভিক্ষুকটি প্রথমে টাকাটা হাতে লইল, এবং পরক্ষনেই আমার দিকে তাকাইল। পরক্ষনেই আবার সে তাহার হাতে দেওয়া নোটটির দিকে তাকাইল আবার আমার দিকেও তাকাইল। আমি শুধু তাহার মুখের ভাবটা পরিবর্তনের ব্যাপারটা লক্ষ করিতেছিলাম। হটাত কয়েক মুহূর্তের পর মহিলা ভিক্ষুকটি পিছন ফিরিয়া সোজা দৌর দিল।  যেহেতু সব গারি গুলি জ্যামের মধ্যে দারাইয়া ছিল, ফলে অল্প সময়ের মধ্যে সে বেশ খানিক টা পথ কোন বাধা ছারাই পার হইয়া গেল আড় ইতিমধ্যে সে রাস্তার ঐ পাড়ের ফুটাপাতে পৌঁছাইয়া গেল। ফুতপাতে পৌঁছাইয়া ও সে দৌড়াইতে লাগিল কিন্তু একবার সে আমার দিকে পরক্ষনেই সামনের দিকে দৌড়াইতেছিল। এক সময় মহিলা ভিক্ষুকটি আমাদের চোখের আড়াল হইয়া হাজার মানুষের ভিরে হারাইয়া গেল। 

এতক্ষন আমার ছোট মেয়ে, বড় মেয়ে কেহই কোন কথা বলিতেছিল না। এইবার আমার ছোট মেয়ে আমার দিকে তাকাইয়া আমাকে প্রশ্ন করিল, বাবা, মহিলাটা এমন করিয়া দৌড় দিল ক্যান? ওকি ভয় পাইয়াছে?

আমি বলিলাম, না মা, ও ভয় পায় নাই। এতক্ষন তুমি যাহা যাহা দেখিলে, সেটা একটা সাইকোলজিক্যাল গেম ছিল। সাইকোলজিটা কি তুমি বিঝিতে পার নাই? আমি ব্যাপারটা আমার ছোট মেয়েকে বুঝাইয়া বলার শুরু করিলাম।

মহিলা ভিক্ষুকটি যখন ৫০০ টাকার নোটটা হাতে পাইল, সে তখন বুঝিতে পারে নাই যে, কেউ তাকে ৫০০ টাকার নোট দিয়া ভিক্ষা দিতে পারে। (যদিও অনেকে দেয়, কেউ দেয় না এমন নয় কিন্তু তাহা একটা ব্যতিক্রম ধর্মী ব্যাপার)। কেউ হয়ত দেয় ৫ টাকা, ১০ টাকা, ৫০ টাকা কিংবা ১০০ টাকা কিন্তু একবারে ৫০০ টাকা হয়ত সে কখনই ভিক্ষা পায় নাই। ফলে সে প্রথমে মনে করিয়াছিল যে, আমি ভুল করিয় ৫০০ টাকার একটা নোট দিয়াছি। তাই সে বারবার একবার আমার দিকে আরেকবার ৫০০ টাকার নোটের দিকে তাকাইতেছিল। সে ভাবিতেছিল, সাহেব কি ভুল করিয়া ছোট নোট মনে করিয়া তাহাকে ৫০০ টাকার নোটটি দিয়া দিল নাকি আসলেই সাহেব তাহাকে ৫০০ টাকার নোটটাই ভিক্ষা দিল? এটা কি ভুল নাকি আসল। ভিক্ষুক তাহার নিজের ভিতরে ডিসিসন ম্যাকিং প্রসেসে খুব দ্রুত কি করিবে আড় কি করিবে না এই নিয়া দোলায় ছিল। সে হয়ত ভাবিতেছিল, আমি কি খুব তাড়াতাড়ি আমার ভুলটা বুঝিয়া আবার না ঐ ৫০০ টাকার নোটটা মহিলার কাছ হইতে চাহিয়া লই। অথবা ভাবিতেছিল যে, মহিলা নিজেই কি আমাকে জানাইবে যে, আমি ৫০০ টাকাই দিতে চাহিয়াছি কিনা। তাহার ভিতরে তখন একটা সাইকোলজিক্যাল যুদ্ধ চলিতেছিল এই রকম যে, সে এই ৫০০ টাকার ভিক্ষার ব্যাপারটা যদি নিজে থেকে ক্লিয়ার করে তাহা হইলে সে হয়ত ৫০০ টাকা থেকে বঞ্চিত হইবে। আবার যদি না জানায় তাহলে ব্যাপারটা ঠিক হইতেছে কিনা ইত্যাদি। তাই সে বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না কি করিবে। তাহার এই কিঞ্চিত দুরাবস্থার ইঙ্গিত টা যদিও আমি বুঝিতে পারিতেছিলাম কিন্তু আমি তাহাকে আমার মানসিকতার কোন পরিবর্তন না করিয়া যেন আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না বা আমি ইচ্ছা করিয়া কোন ভুল করি নাই বা করিলেও আমাই তখন ব্যাপারটা বুঝিতে পারিতেছি না। আমার মুখের ভাবের মধ্যে কোন প্রকার পরিবর্তন না দেখিয়া সে আমি বুঝিতে পারিয়াছি কিনা তাহা সে বুঝিতে পারিতেছিল না। লাভ আড় লোকসানের হিসাব করা তাহার ইতিমধ্যে শেষ হইয়াছে, তাই আর কোন রিস্ক না নিয়া নতুন কোন খদ্দরের কাছে আড় কোন ভিক্ষা না চাহিয়া সে যত তাড়াতাড়ি পারিল  আমার কাছ হইতে ছুটে দৌড় দিল যাহাতে আমি আর তাহাকে নাগাল না পাই। সে দৌড়াইতেছিল বটে বটেকিন্তু তখনও সে নিশ্চিত হইতে পারিতেছিল না, যদি আবার আমি তাহাকে ডাক দেই!! টাই সে একবার সামনের দিকে আবার পরক্ষনেই আমার দিকে তাকাইতেছিল।

কিন্তু আমি জানি আমি তাহাকে ৫০০ টাকাই দিয়াছি।  আমার মধ্যে কোন সন্দেহ ছিল না, আমি শুধু দেখিতে চাহিতেছিলাম, ৫০০ টাকা একসঙ্গে পাইলে একজন ভিক্ষুক কি করে। প্রতিদিন হয়ত ও ৫০০ টাকার চেয়েও বেশি কামাই করে কিন্তু একবারে কারো কাছ হইতে ৫০০ টাকা হয়ত ও জিবনে কখনই পায় নাই। ফলে ওর ভিতরে নানা প্রকার সাইকোলজিক্যাল কেল্কুলেসন খেলিতেছিল।  মানুসের মন বড় বিচিত্র। সে যেই হোক। ৫০০ টাকা দিয়া আমার ভালই লাগিয়াছিল এই ভাবিয়া যে, আজ যদি সারাদিন সে অন্য কাহারো কাছ হইতে ভিক্ষা নাও পায়, তাহাতেও ওর কয়েকদিন চলিয়া যাইবে।

দেখিলাম, আমার ছোট মেয়ে অতি দ্রুত ইহারই মধ্যে ভিক্ষুক সমাচার লইয়া একটা ফেসবুকে স্ট্যেটাস দিয়া ফেলিল। ইতিমধ্যে জ্যাম ছুটিএ শুরু করিয়াছে। ড্রাইভার গাড়ি আঁকাবাঁকা করিয়া ফাক ফোঁকর দিয়া কিভাবে আরও দ্রুত চালানো যায় সেইদিকে মনযোগী হইয়া গেল, আমার বড় মেয়ে কোন কিছু না ভাবিয়া আবারো গানের কলি শুনিতে লাগিল। আমি শুধু এই ভিক্ষুকের ঘটনাটা মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম।

মানুষ বড় বিচিত্র।

০৩/০৬/২০১৬-আকাশের চিঠি

Categories

প্রিয় মাধুরী 

শরতের শিশিরাপ্লুত বৃন্তচ্যুত কোন শেফালীর গল্প তোমার জানা আছে মাধুরী? ঐ ফুল দেবতার পূজার কোন কাজে লাগে না, কাজে লাগে না কোন বাসরঘরের ফুলশয্যার শোভাবর্ধনেও। অথচ ঐ শেফালি ফুলেরও এককালে অনেক কদর ছিল, তার গন্ধ ছিল, ছিল একটা সম্ভাবনাময়য় প্রস্ফুটিত আগামিদিন। রবিঠাকুর বেঁচে থাকলে অকালে বৃন্তচ্যুত এই শেফালী ফুলের অসময়ের পতনের উপর হয়ত একটা বিখ্যাত কবিতা বা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারতেন অথবা এই পরিত্যক্ত ফুলের একটা যৌবনময় ছোটগল্পও লিখে ফেলতে পারতেন কিন্তু আমি তো আর রবিঠাকুর নই যে, আমি নিজের আবেগ দিয়ে পার্বতী নদির মত বেগবান কোন এক স্রোতধারার মত হর্ষবোধক, লোমহর্ষক অথবা উচ্ছ্বাসময় কাব্য লিখে ফেলব। জীবনের সঙ্গে গল্পের এই এক জায়গায় বিস্তর ব্যবধান। লেখকগন চুপি চুপি তার অক্ষরসমৃদ্ধ লেখনীতে যত না আবেগ আর কষ্ট দিয়ে ভালবাসার কাহিনী রচনা করেন, বাস্তবে ঐ চরিত্রগুলুর আবেগ, কষ্ট আর ভালবাসা তারথেকেও অনেক বেশি গভীরের এবং মর্মস্পর্শী। লেখনীর কলমের অমোচনীয় কালীর অবগাহনে চরিত্রগুলুর কষ্টের চোখের অশ্রু হয়ত শুস্ক পাতার গল্পের লাইন ভেদ করে গড়িয়ে পরে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না কিন্তু বাস্তবে ঐ চোখের পাতা যথার্থই অস্বাভাবিকভাবেই দৃষ্টিগোচরীভূত হয়। কারো চোখে এরা ধরা পরে আবার শতব্যস্ত পারিপার্শ্বিক অসামঞ্জ্যস্যতায় তা আবার কারো কারো চোখ এড়িয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। এদের পরিসংখ্যান নিতান্তই কম নয়।

তুমি মেয়ে হয়ে জন্মেছ বলে তোমার অন্দর মহল আর আমার অন্দর মহলের গল্প এক নয়। কিন্তু তোমার জন্য আমার অন্দর মহিল যেমন অরক্ষিত ছিল না তেমনি আমার জন্য তোমার অন্দর মহলে প্রবেশের সুযোগও তেমন রক্ষিত ছিল বলে আমি মনে করি না। তার মধ্যে তুমি ছিলে আমার ধর্মীয় অনুশাসনের দিক থেকে আলাদা আরেক মানবী।

হ্যা,  আমার স্পষ্ট মনে পরে ঐ দিনের কথা, ২৯ শে বৈশাখ। তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হইয়াছিল। তুমি বিদেশ পাড়ি দেবার কোন এক অজানা সুখানুভূতিতেই হোক অথবা নির্মলা শান্তির খোঁজেই হোক, বেনি দুলাইয়া, চোখের পাতা অশ্রুসিক্ত করিয়া কোন প্রকার ঘটা না করিয়া আমাদের উঠানের সুবিস্তৃত শ্যাম চিত্রপটটি দিনের আলোকউজ্জ্বল স্পর্শে তোমার বিদায় ঘন্টায় ধূসর শ্যামল পাণ্ডুবর্ণ করিয়া একটি ক্ষুদ্র জীবন নাট্যের ইতি টানিয়া সবাইকে ফাকি দিয়া কোন এক নাম না জানা ঠিকানায় হারিয়ে গেলে। আমি জানি না আমার কি অপরাধ ছিল অথবা আমার কি করিলে কি হইতে পারিত। তোমার চলিয়া যাইবার পর আমি অনেক কিছুই বুঝিতে পারিলাম বটে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও বুঝিলাম যে, আমার স্বর্গীয় মা তার ছেলের সুখের খোঁজে আমাদেরই ঐ পাকা ঘরের তক্তপোষে বসিয়া কোন এক অজানা কুমারী সুন্দুরির মুখখানা মনে ছাপিয়া কোন কোন অলঙ্কার পরিলে তাকে পরিদের মত দেখাইবে বা কোন রঙের শারি পরিলে তাকে গ্রামের আর দশটি গৃহবধু থেকে অতুলনীয় দেখা যাইবে তার হিসাব নিকাস করিতে ব্যস্ত। অথচ তিনি একবারের জন্যও বুঝিতে চাইলেন না, এইমাত্র বৃষ্টিশেষে ক্ষান্তবর্ষণ প্রাতকালের ম্লান রৌদ্র আর খন্ড মেঘের আড়াল করিয়া যে মানুষটি চিরতরে হারিয়ে গেল তার কাছ থেকে আরও নতুন কোন সুখের সন্ধান পাওয়া যাইত কিনা। সুখ বড় রহস্য ঘেরা সোনার হরিন, যিনি পান তিনি জানেন না কেমন করে পাইলেন আর যিনি পান নাই, তিনি জানেন না কোথায় এর প্রাপ্তিস্থান। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হল, হরিনেরা কখনো কোন সোনারখনির সন্ধান দিতে পারিয়াছিল কিনা আমি জানি না, তবে এই সোনার হরিনের সঙ্গে বাস্তবের নিরিহ এই প্রানিকুল হরিনের কোন মিল নেই। এরা নিজেরাও কোন বংশের সঙ্গে যুক্ত নয়।

মানুষ যখন প্রতিশোধ নিতে না পারে, তখন সেই প্রতিশোধ অপমান আকারে এমন বৃহৎ আকারে আবির্ভূত হয় যে, হয় সে নিজের কাছে নিজেই দুরূহ হইয়া পরে অথবা জরাজীর্ণ ইষ্টক প্রাচীরের মত শত খন্ডে বিধ্বস্ত হইয়া নেহাত মাটির ঘরের মত অব্যবহারযোগ্য হইয়া পরে। আমি তোমার বেলায় এর কোনটাই দেখি নাই। শুধু মনে হইয়াছে, হয়ত বা আমার আর যাই থাকুক না কেন, তোমাকে ঠেকাইবার মত শক্তি বা ক্ষমতা অন্তত ঐ সময়ে আমার ছিল। সেটা আমি করিতে পাড়ি নাই। কারন আমি অন্ধ ছিলাম। রবি ঠাকুরের কথাই ঠিক, অন্ধের কাছে অভিমানের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা অতিব দুরূহ।

 সবেমাত্র এমন একটা কঠিন অসুস্থতা হইতে পরিত্রান পাওয়া আমার মা হটাত করে নিজকে অতিশয় সুস্থ এবং সবল মনে করিয়া যারপর নাই অনেকগুলু গুরুতর কাজের ভার নিয়া সামলাইতে না পারিয়া পরদিন আবারো অসুস্থ হইয়া পুনরায় আগের ক্যাবিনেই ভর্তি হইয়া গেলেন। এ যাত্রায় আমি কোন মুখে যে তোমাকে আনিতে যাইব, সে ভরসা আর সাহস আমার এই ক্ষুদ্র হৃদয় শক্তি সঞ্চার করিতে পারে নাই। অগত্যা বাড়ির কাজের বুয়া আর গ্রামের দুঃসম্পর্কের নানির উপরই ভরসা করতে হইল। কিন্তু এবার যমদূত আমার স্বর্গীয় মাকে সঙ্গে না নিয়া একা যাইতে চাননি, ফলে একটানা এক মাসের অধিক সময় বাড়ির সবাইকে সময় অসময় অধিক পরিমান নিপীড়ন করিয়া, গ্রাম শুদ্ধ হইচৈ করাইয়া, সমস্ত ডাক্তারি বিদ্যা মিথ্যা প্রমান করিয়া পৃথিবীর সব সুখ, আলো বাতাস, বাড়ির প্রকান্ড মায়া মহব্বত ছিন্ন করিয়া আমার মা স্বর্গীয় দেবতার কাছে এক নিশ্বাসে হাজির হইয়া গেলেন আর আমাদের সবাইকে চোখের জলে ভাসাইয়া পুরু বাড়িটাকে একটা অরক্ষিত জলাধারে রূপান্তরিত করিয়া নিরব করিয়া দিলেন। আমার আর সুখের ঘর করা হইল না। স্বপ্নের মাধুরী স্বপ্নেই রইয়া গেল, তার আর আমাদের চৌকাঠ পার হইয়া আমাদের সংসারে আসা হয় নাই। তখন মনে হইল আমার যে কয়জন অতি প্রিয়জন ছিল, যারা আমাকে কারনে অকারনে জবাবদিহিতা করিত, যাদের অতিশয় আপ্যায়নে আমার মাঝে মাঝে নিজেকে খুব বিরক্ত মনে হইত, তাদের কেউ আজ আর আমার আশেপাশে রইল না, সেটা আজ নিঃশেষ হইয়া শুন্যে পরিনত হইল। একবার মনে হইয়াছিল যে, তোমার ইউনিভার্সিটিতে গিয়া তোমার খোঁজ করিলেই আমি তোমার ঠিকানাটা পাইব, কিন্তু পরে আবার কি মনে করিয়া আর খোঁজ নেয়া হইল না। আর এই খোঁজ না নিতে নিতেই তো প্রায় ত্রিশ বছর পার হইয়া গেল। আজ এই পঞ্চাশ বছর পর হটাত করিয়া তোমার কথা বারবারই মনে পরিতে লাগিল। তুমি কি আশেপাশে কোথাও আছ? আর থাকিলে কিভাবে আছ? নিশ্চয় এখন তোমার জীব পরিবেশে অনেক শেফালির আরাধনা হয়, নিশ্চয় এখন আর তোমার সেই চিরাচিত কোলাহল নাই, কোমল কোমল শিশুদের আনন্দে তোমার চারিপাশ ভরপুর। আজ আমার অনেক কথা মনে পড়ে। থাক সে কথা। কখনো যদি আবার তোমার সন্ধান পাই, না হয় আবারো আমার এই হারানো বা ক্ষয়ে যাওয়া ত্রিশ বছরের না বলা কাহিনীগুলু তোমাকে বলব। তবে, তোমার ভাল লাগা রবিঠাকুরের সেই “মেঘ ও রৌদ্রের” কিছু কথা লিখে আমার আজকের এই ডায়েরিটা শেষ করবঃ

“………………আকাশে মেঘ রৌদ্রের খেলা যেমন সামান্য, ধরাপ্রান্তে এই দুটি প্রাণীর খেলাও তেমনি সামান্য, তেমনি ক্ষণস্থায়ী। আবার আকাশে মেঘ রৌদ্রের খেলা যেমন সামান্য নহে এবং খেলা নহে, কিন্তু খেলার মত দেখিতে মাত্র। তেমনি এই দুই অখ্যাত্নামা মনুস্যের একটি কর্মহীন বর্ষা দিনের ক্ষুদ্র ইতিহাস সংসারের শত শত ঘটনার মধ্যে তুচ্ছ বলিয়া প্রতিয়মান হইতে পারে কিন্তু ইহা তুচ্ছ নহে………………”

(চলবে……)  

০২/০৬/২০১৬ – মাধুরীর চিঠি

Categories

তোমাকে কি নামে যে সম্বোধন করি তাই বুঝে উঠতে পারছি না এখন। কি লিখব তোমায়? প্রিয় বন্ধু নাকি শুধু প্রিয়? অথবা শুধু তোমার নাম অথবা কিছুই না !! তোমাকে আমি যেই নামেই ডাকি না কেন, তুমি আমার একান্ত প্রিয়জন। কে জানি বলেছিল, বন্ধুর নাম ভুলে গেলেও সমস্যা নেই, কিন্তু শত্রুর নাম ভুলে যাওয়া যাবে না। তোমার বেলায় আমার এই নীতিটা হয়ত সঠিক নয়। আমি তোমার নাম ভুলে গেলে আমার আর কোন কিছুই হয়ত অবশিষ্ট থাকবে না। যাক, তোমাকে আমি কোন সম্বোধন ছাড়াই চিঠিটি লিখছি।

অনেকদিন ভেবেছিলাম তোমার সাথে আমি আর কখনো যোগাযোগ করব না। আর যোগাযোগ করে কিইবা হবে বল? তোমার হয়ত এখন সংসার হয়েছে, বাচ্চাকাচ্চা আছে, অনেক উচু স্তরের মানুষদের মধ্যে এখন তুমি একজন। জানি তুমি ভালই আছ।

তোমার এই শরতবেলার বেলাভুমির প্রাতভ্রমনে আমি হটাত করে সেই পুরানো দিনের কোন এক বর্ষার কাকভেজা বৃষ্টির সন্ধ্যাকালীন শ্বাসরুদ্ধকর রোমাঞ্চের কথা নিয়ে যদি আমি হাজির হই, কিইবা লাভ হবে, তুমিই বল? মাঝখানে হয়ত যেটুকু তুমি আমাকে করুনা করে হলেও মনে রেখেছ, তাও হয়ত আমার ভাগ্যে আর থাকবে না, অকারনে সেটাও হয়ত হারাতে পারি। অনেক কিছু হারিয়ে যদিও এখন হারাবার ভয় আমি করি না কিন্তু স্মৃতির পাতা ধরে স্থান কাল সময় গুনে গুনে যে কয়টা জিনিস আমি এখনো হারাতে চাইনি তার মধ্যে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় একটা। ভেবনা আমি আজ তোমাকে এই পত্র দিয়ে আবার নতুন করে কোন এক সম্ভাবনাময়কে জাগিয়ে তুলছি। অন্তত আমি তাঁর কোন সম্ভাবনা দেখছি না।

আমি জানি পাহারের নিচে দাড়িয়ে যত জোরেই কেউ তাঁর কথা বলুক না কেন, সেই একই সুর, একই শব্দ, সেই একই বানী পাহারের চারিদিকে বাতাসে বাতাসে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে আবারও নিজের কাছেই তা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। অবুঝেরা এটাকে বিধাতার উত্তর হিসাবে ধরে নেয়, আর যারা অবুঝ নয়, তারা জানে প্রকৃতির অবজ্ঞা করে এইসব কিছু ফিরিয়ে দেওয়া কত বড় নির্মম সত্য। এটা কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই বা করুক, অন্তত আজ এতটা বছর পর নতুন করে হিসাব করার প্রয়োজন বলে মনে করছি না। আর যখন ঐ নিষ্ফল প্রতিদ্ধনির আওয়াজ ফিরে আসে, তখন যেন তা আরও শতগুনে কঠিন এবং করুন করে কানে বাজে।

কেউ কারো কোন কথা রাখে না, মনে হয় কেউ কারো জন্য কখন অপেক্ষাও করে না। এর মানে আমি তোমাকে এই বলে যুক্তিও দেখাচ্ছি না যে, আমি কি বলতে চেয়েছিলাম, আর আমি তাঁর প্রতিধ্বনিতে কি পেয়েছি। সময় এমন এক জিনিস, সে সবার সঙ্গে আছে, সবার সঙ্গে থাকে অথচ সে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করে না। কেউ তাঁর সঙ্গে থাকুক আর নাই বা থাকুক, সে তাঁর নিজ গতিতে নিজ আবেশে তাঁর ঠিক গন্তব্যে সবাইকে ছেড়ে একা একাই চলতে থাকে। কোথাও তাঁর বিন্দুমাত্র অলসতা হয় না, কোথাও তাঁর কোন গড়মিল হয় না। পৃথিবীর সব চাইতে সস্তা যেমন সময়, তেমনি সবচেয়ে দামিও বটে। ইচ্ছে করলেই একে হেলাফেলা করে যেখানে সেখানে খরচ করা যায় আবার ইচ্ছে করলেই আবার এক আনা দুই আনা দিয়ে কেনাও যায় না। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা সময়, আর সেই সময়ের চাওয়া-পাওয়ার সাথে হিসাব নিকাশের দেনা পাওনাটাও এই খরচের বিচার্য বুদ্ধিচনায় পরে। চৈত্রের গরমের জন্য কেউ হেমন্তের দুপুরকে দায়ি করে না, কিংবা বর্ষার একটানা বৃষ্টির জন্য কেউ শীতের কনকনে সকালকেও দায়ি করে না। আমিও এখন না সময়, না পরিস্থিতি কিংবা না আইন বা ধর্মকে দায়ী করি।

এই চিঠি পরে তোমার হয়ত মনে প্রশ্ন আসতে পারে আমি কেন তাহলে আমার সেই পূর্বেকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তোমাকে আবার আজকে লিখতে বসলাম। আমার আসলে আর কোথাও কেউ নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই, যেটুকু আছে তা শুধু তুমি। এত বিশাল পৃথিবীর মাঝে কত মানুষ যে কতভাবে অসহায়, আমি নিজেকে দেখে তা বুঝতে পেরেছি।

প্রথম যেদিন আমি তোমাকে দেখেছিলাম, মনে পরে তোমার সেই দিনের কথা?  আমি জানি না আমাকে দেখে তোমার কি মনে হয়েছিল, কিন্তু আমার কাছে সমুদ্রের গভীরতার চেয়ে তোমার চোখের ভাষা আরও বেশি দুর্গম মনে হয়েছিলো, অথচ আমার কেবলই মনে হয়েছে ঐ আখির ভাষা আমার পরিচিত, তোমার মুখের ভাষা আমার পরিচিত। যদিও তোমার কোমল কঠিন দেহখানি আমার কাছে পাহাড়ের শিলাভুমির প্রস্তরখন্ড থেকেও কঠিন মনে হয়েছিল কিন্তু তাঁরপরেও আমার কেবলই মনে হয়েছে কোথায় যেন আমি তোমাকে দেখেছি।

আমি আর পাঁচটি মেয়ের মত নই, সেটা তুমিও জান, আমিও জানি। নীল আকাশের ছায়াপরা কোন এক চকচকে পুকুরের মাঝখানে নীলপদ্ম দেখলেই আমি সবার মত উল্লসিত হয়ে চারিদিক চমকিয়ে দেই না হয়ত কিন্তু আমার ভিতরে যে কোন সাড়াশব্দ হয় না তা নয়। আমার অনেক রাত কেটেছে কোন কিছু ভাবা ছাড়াই, আমার অনেক দিন হয়ত নাওয়াও হয় নাই শুধুমাত্র এই ভেবে, কে তুমি? যেদিন বুঝেছি তুমি কে, সেদিন উপলব্ধি করেছি, আমি স্রোতের বিপরিতে নৌকার গুন টানছি, বুঝতে পেরেছি আমি উল্টো পথে রথে উঠেছি। তারপরেও আমি রয়ে গেছি, আর রয়ে গেছি তোমাকে পাবার জন্য নয়, তুমি আমার কাছাকাছি আছ, এই ভরসায়। এটাই বা কম কিসের? এতসব অপরিচিত মানুষদের মাঝে অন্তত আমি তো একজনকে হলেও চিনি, তোমাকে চিনি, তুমি আছ। তুমি কি কখনো জানতে পেরেছ যে, পৃথিবীর সমস্ত মানবকুলের মধ্যে আমি তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেতাম, এর মানে এই নয় যে তুমি ভয়ংকর। আমার ভয়ের কারন একটাই। তোমার নির্লিপ্ততা। তোমার কোন কষ্টের কারন যেন আমি কখনো না হই সেই ভয়ে আমি সর্বদা ভীত থেকেছি। অথচ আজ আমার ভিতরে কোন প্রকার ভয় নেই, কারন তুমি আমার পাশে কোথাও নেই। আর কোথায় আছ তাও আমি সঠিকভাবে আন্দাজ করতে পারি না। জীবনের এই সায়াহ্নে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তোমাকে। মনে হয়েছে যদি একদিন বা কোথাও একবার আবার তোমার চোখে চোখ রেখে বলতে পারতাম, আমি হারিয়ে যাইনি, অথবা আমি হারিয়ে যেতে চাইনি, আমার কুড়েঘরের সদর দরজার মেঠোপথ তোমার জন্য সবসময় খোলা ছিল এবং এখনো আছে। যদি কখনো দৈবাৎক্রমে আমার এই আশ্রুজলে শিক্ত লেখাটা তোমার হাতে পরে আর যদি তখনো আমার এই দেহে টিমটিম করে হলেও একটু প্রানশক্তি থাকে, তবে জেনে রেখ, আমি তোমাকে হয়ত বলতে চেয়েছি, তুমি এসো আর একবার যদি কখনো তোমার ভিতরটায় শুন্যতায় ভরে গিয়ে হাপিয়ে উঠো। এসে একবার আমার চোখের জলের সাথে তোমার সেই বেদনাবিধুর চোখের অসমাপ্ত কান্নাগুলো দিয়ে বলো, তুমি ভাল আছো। আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমার সেই ক্লান্ত আঁখির শিশিরের টিপটিপ করা ব্যাথাকনাগুলো বয়ে নিয়ে আখি বন্ধ করে দেব। তুমি এক ফোটা জলও দেখতে পাবে না।

আজ এই অবেলায় তোমাকে কত কথা লিখতে ইচ্ছে করছে যেন।

মনে পরে তোমার সেই কাকডাকা ভোরে একবার আমি আর তুমি হারিয়ে গিয়েছিলাম সেই শাওতালদের গ্রামে? ট্রেন আটকা পড়েছে কোন এক বনের ধারে। ট্রেন আবার কখন চলা শুরু করবে কেউ বলতে পারছে না। একেক জনের কাছ থেকে একেক ধরনের খবর পাচ্ছি ট্রেন নষ্ট হবার কারন জানতে গিয়ে। আসলে কেউ বলতে পারছিল না কি কারনে ট্রেন এই মাঝপথে হটাত করে এতগুলো যাত্রি নিয়ে অজানা সময়ের জন্য বিশ্রামে গেল। অনেক যাত্রি ট্রেন থেকে নেমে এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করছে। আমরাও এক সময় সবার দেখাদেখি ট্রেন থেকে নেমে ঘুরতে বেরিয়ে গেলাম। গল্প আর গল্পে কখন যে কোন রাস্তায় হাঁটছিলাম, আমরাও তাঁর রেখাপথ মনে রাখিনি।

শেষমেশ এক শাওতালদের গ্রামে গিয়ে হাজির হয়ে গেলাম। কি অদ্ভুদ এক সমাজ। সবাই সবার আপনজন। সবাই যেন সবার জন্য। সবাই যেন এক পরিবার। গ্রামটা ঘুরতে ঘুরতে কোথাও এক কাপ চা খাওয়ার জন্য একটা দোকান পর্যন্ত পেলাম না। আসলে সাওতালদের কোন পৃথক দোকান নেই ঐ গ্রামে। গ্রামের সরু পথ দিয়ে আমরা দুজনে হাঁটছি, সব ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঘর দুয়ার, এলোপাথারিভাবে সাজানো বাড়িঘর। গরু ছাগলগুলোও যেন স্বাধীন। কোনটাই খোয়ারে বাঁধা নেই। কুকুর, গরু ছাগল, হাস মুরগি মানুষ সব স্বাধীন। গাছগাছালি ভর্তি পুরু গ্রামটা। কোথাও কাদা পেরিয়ে এই বাড়ি থেকে ঐ বাড়ি যেতে হয়। পানির মটকাগুলো একদম উদোম। কয়েকটা পাখী বসে আছে মটকাগুলোর উপর। পাখীগুলোও জানে এখানে কোন সমস্যা নাই। ওরা বরং আমাদের দেখে একটু শঙ্কিত হয়ে এদিক সেদিক উড়াল দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে মোরগগুলো উচ্চ স্বরে অন্যদেরকে জানান দিচ্ছিল এখানে আগন্তক এসেছে, যেনো মোটিভ বুঝা যাচ্ছে না বোধহয়। কয়েকটা বাচ্চাওয়ালা মুরগি তরিঘরি করে বাশঝাড়ে লুকিয়ে গেল। আমরা এদের কারো কাছে পরিচিত নই। প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু তাঁদের স্বকীয়তায় ব্যতিক্রম পছন্দ করে না। বড় ভাল লাগছিল ব্যাপারটা উপভোগ করতে। কতক্ষন কেটে গিয়েছিল আমরা বুঝতেই পারিনি, হটাত অল্প দূর অপেক্ষামান ট্রেনের সচল হবার সংকেত দিয়ে আমাদের চারিদিকে ছরিয়ে থাকা যাত্রিদেরকে মনে করিয়ে দিল আমরা ট্রেনে ছিলাম এবং এখন আবার সেখানে যেতে হবে। তা না হলে ঐ যে বললাম, সময়ের সাথে সাথে এবার ট্রেন হাত জুটি বেধে পুনরায় তাঁর সেই গন্তব্যের দিকে ছুটে যাবে। যারা তাঁর সাথে নেই, তারা থেকে যাবে যেখানে সে আছে সেখানেই।

ফিরতে গিয়ে আমরা বুঝলাম, আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। কোন রাস্তায় এই শাওতাল গ্রামে ঢোকেছিলাম, এখন আর সেই আগের রাস্তাটা পরিচিত মনে হচ্ছেনা, মনে হচ্ছে ভুল পথে ট্রেনের দিকে যাচ্ছি, আদৌ ট্রেনের দিকে যাচ্চি কিনা তাও বুঝতে পারছি না। ট্রেনের হুইসেলটা মনে হচ্ছে আরও দূর থেকে কানে আসছে। দ্রুত হাটতে হবে, তা নাহলে নির্ঘাত ট্রেন মিস করব। আর ট্রেন মিস করলে এর পরের অধ্যায়টা আমার অন্তত জানা নাই। তুমি দ্রুত হাঁটছ, আমি তোমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অত দ্রুতও হাটতে পারছি না। রাস্তাটা আমার কাছে অমসৃণ গিরিপথের মত মনে হতে লাগলো। আমার সাড়া শরীর ঘামে যেন ভিজে আসছিল। চুলের ভিতর থেকে কেমন একটা গরম আভা বের হচ্ছিল। আমার কপাল দিয়ে শিশিরের ফোটার মত করে একটু একটু ঘাম বেরিয়ে চোখের জলের ফোটার মত আমার কানের পাশ দিয়ে বুকের ওড়নায় পড়ছিল। আমি যেন আর হাটতে পারছিলাম না। তুমি আমার হাত ধরলে।

এই প্রথম তুমি আমার হাত ধরলে। আমি তোমার হাতের অনুভুতিটা তখন কিছুই বুঝতে পারিনি, শুধু মনে হয়েছে, আমি যেন একটা অবলম্বন পেয়েছিলাম শক্ত করে ধরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। অনেক ক্লান্ত অবশ দেহ আর ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে কোন রকমে যখন আমরা ট্রেনের ধারে ফিরে এলাম, তখন ট্রেন প্রায় ছাড়ি ছাড়ি ভাব। ট্রেনের সিটে বসে অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে আমার ক্লান্ত শরিরের সমস্ত পরিশ্রম যখন বিশ্রামে নিমগ্ন, তখন বুঝলাম, একটু আগে তোমার হাতের যে পরশটা আমার শরিরের বাহুতে লেগেছিল, তা এখন আমার অনুভুতিতে আরেক স্বর্গীয় ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। আমার আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল, শাওতাল গ্রামের ঐ মানুষগুলোর সঙ্গে হারিয়ে গেলেই তো ভাল ছিল। প্রতিনিয়ত আমার মনে হচ্ছিল, ট্রেন চলছে, আমার মন চলছে না। বাইরে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষন। বহুদুরের ঐ গ্রামগুলো কতই না গতিতে আমার দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে নিমিষে। এখন আর সবুজ গ্রাম ভাল লাগছে না, নীল আকাশের খন্ড খন্ড মেঘগুলোও আর আমার কাছে কাব্যিক মনে হচ্ছে না। অথচ একটু আগে এর সবকিছুই ছিল আমার কাছে আমার অনন্তময়ি প্রেমের এক আবেদনের মত। ঐ যে বহু দূর অবধি দেখা যায় আকাশ যেখানে আকাশ আর মাটি দুজনে এক হয়ে গেছে, অথবা এই যে ট্রেনের দুই সমান্তরাল সারি যারা একে অপরের পাশে অনন্তকাল ধরে পাশাপাশি বয়ে যাচ্ছে অথচ কখনই তারা একে অপরের নয়, এমন একটা সম্পর্ক যার ঠিকানা কারো জানা নাই। হয়ত তুমি আর আমি ঠিক তাই। আমরা একই ট্রেনের যাত্রি অথচ গন্তব্য এক নয়, আমরা একই আকাশের নিচে চলছি কিন্তু আমার দিগন্ত আর তোমার ভেজা মেঘ এক নয়। মনটা ভারি হয়ে উঠেছিল সারাটা রাস্তা।

আজ কত কথা মনে পড়ছে আমার। তোমার কি মনে পরে আরও একদিনের কথা?

সেদিন ছিল বর্ষার প্রথম সপ্তাহ। চারিদিকের আকাশ মেঘে ভরা, গুরগুর মেঘের আওয়াজ। থেকে থেকে হাল্কা বৃষ্টি আবার ক্ষনেক্ষনে রোদ। হুমড়ি ধুমড়ি খেয়ে যেন তুমি উচ্ছল হরিন শাবকের মত মেঘলা সেই দুপুরে অস্থির চিত্তে ঘনঘন দরজার কড়া আর কলিং বেল টিপে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করলে যেনো, আর কয়েক সেকেন্ড দেরি করে দরজা খুললে না জানি কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, অথবা কোন এক রাজ্যের রামায়ন তাঁর অপ্রতিরোধ্য মেঘবদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। তোমার সাড়া শরীর ভেজা, চুলগুলো মনে হল কতকাল চিরুনি পরেনি, তারপরেও তোমাকে বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছিল। যতবার আমি তোমাকে দেখেছি, আমি ততবারই যেন কোন এক নতুন মানুষকে দেখেছি। সকালের তুমি বিকালের মত নও, বিকালের তুমি আর পরেরদিনের তুমি সম্পূর্ণ আলাদা এক মানুষ। কখনো তুমি হিমালয়ের মত স্থবির, আবার কখনো তুমি উস্রিংখল ডাহুকের মত জ্বালাময়ী, কখনো তোমাকে দেখেছি আমি এতটাই নির্লিপ্ত যেনো পানকুড়ির মাছধরার ধ্যানের মত স্থির। কখনো দেখেছি আমি অতিশয় ক্ষুদ্র বিষয়ে তুমি অতটাই উত্তেজিত অথচ অতিকায় হস্তিসমেত বিষয়ে তোমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ভগবান মানুষকে দিয়ে কি পরীক্ষা করান তা আমার জানা নাই তবে তোমার বেলায় ভগবান সর্বদা কৃপাশীল ছিলেন অনেকের চেয়ে বেশি। ভালবাসার হৃদয় ভগবান তোমাকে দিয়েছেন কিনা আমার জানা নাই, তবে তোমাকে ভালবাসবে এই এমন কিছু একটা ভগবান তোমার মধ্যে সে চিরস্থায়ী প্রথা হিসাবে নিশ্চয় দান করেছেন। তোমার ভেজা চুলেও যেমন মাদকতা আছে, চিরুনির আচরনে শুকনা চুলেও মাদকতা আছে। চঞ্চলতা যেমন মনকে উতালা করে দিতে পারে, তেমনি তোমার অবসন্ন দেহও মনকে  ভেঙ্গে খান খান করে দিতে পারে। তোমাকে এই প্রথম আমি যেন আরেক তোমাকে আবিস্কার করলাম। তুমি অতিশয় অস্থির, তোমার কথাবার্তায় কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ভাব। অধিক কথা বলার যেন সময় নেই। কোথায় কি কারনে যেন তুমি আর তোমার মধ্যে নেই। অবশ্য ব্যাপারটা একটুপরেই বুঝতে আমার আর বাকি ছিলনা।তোমার মা অসুস্থ।

আমি তোমার একটা জিনিষ সেই প্রথম দিন থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। পৃথিবীর যাবতীয় উচ্ছ্বাস, সুখ, দুঃখ, আর আবেগ যদি হয় একদিকে, তোমার মার জন্য তোমার এই উচ্ছ্বাস, সুখ, দুঃখ, আবেগ অথবা যাই কিছু থাকুক না কেন, তিনি আরেকদিকে। তোমার মায়ের জন্য তুমি সত্যকে মিথ্যা, বা মিথ্যাকে সত্য অথবা ন্যায়কে অন্যায়, বা অন্যায়কে ন্যায়ের দিকে নিয়েও যদি মনে হয় তোমার মা তাতে খুশি, হয়তবা তুমি তাই করার জন্য শারীরিক এবং মানসিকভাবে সর্বদা, সর্বত্র সব কিছুর বিনিময়েও করতে তোমার কোন প্রকার দ্বিধা হবে না। এ এক ব্যাতিক্রমি চরিত্র আমি তোমার মধ্যে প্রকটভাবে দেখেছি। কোন কিছুর সঙ্গেই তাঁর কোন তুলনা তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আর আমার এখানেই সবচেয়ে বেশি ভয় হত যদি কখনো কোন কারনে আমি তোমার এই সবচেয়ে দুর্বলস্থানে একটু হলেও ছোঁয়ার কারনে আমার সমস্ত আরাধনা, আমার ভাললাগার ব্যাক্তিত্ত তোমার কাছে আমি এক নিমিসেই অপরিচিত হয়ে যাই। তোমার সেই মা অসুস্থ। তুমি ঠিক নাই বুঝতেই আমার মনের গভিরে এক চরম উৎকণ্ঠা বোধ হতে লাগলো। দুর্ঘটনা আভাস দিয়ে আসে বটে, কিন্তু সুভাগ্য কোন আগাম সংকেত দিয়ে আসে না। তোমার এই দুর্ভাগ্যে যেন আমার সু-ভাগ্য খুলে গেল। তোমার মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে থাকার মত নির্ভরশীল কোন মানুষ তুমি তোমার জগতের চারিপাশে খুজে পেলে না, প্রথম যার কথা মনে হয়েছিল তোমার, সে আমি। আমি ভাগ্যবতী। তুমি আমাকে কোন সময় না দিয়ে, কোন রকমে কোন প্রকার প্রস্তুতি হওয়ার সময় না দিয়ে এক প্রকার বিদ্যুৎ গতিতেই বের করে নিয়ে হাজির করলে সেই অসামান্য মানুষটির কাছে যার সমতুল্য এই পৃথিবীতে তুমি আর কাউকেই জানোনি।

তুমি চলে গেলে আমাকে রেখে। নিস্তব এক ক্যাবিন।

ডাক্তাররা আসছে ঘন ঘন, নার্স, আয়া, সবাই ব্যাস্ত এই ঘুমন্ত শিশুর মত মানুষটির যত্নে। আমি কে, কি তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তারা অনেকেই জিগ্যেস করলেও আমার বলতে কোন অসুবিধা হয় নাই, কারন তিনি আমার মায়ের মতই একজন মানুষ। আমি তাকে আমার মায়ের সঙ্গেই মিল রেখে পরিচয়টা দিয়েছিলাম যে, আমি তাঁর মেয়ের মতই। আমি এছাড়া আর কি বলতে পারতাম বলো? কি অদ্ভুত এক ব্যাপার। তোমার সাথে তোমার মায়ের কোথাও কোন গড়মিল নেই। সেই ঠোঁট, সেই নাক, সে মুখাবয়ব, চোখের ভ্রুটা পর্যন্ত একদম মিল। আমি বসে আছি তাঁর পাশে। প্রতিনিয়ত আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন তোমাকেই দেখছি। এত কাছ থেকে এত নিরিবিলিতে আমি কখনো তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকিনি। আজ যেন মনে হচ্ছিল আমার সেই না দেখা তোমাকে এত কাছে থেকে দেখছি। কখনো আমি তাঁর হাত দুটো ধরছি, কখনো তাঁর ভ্রুটা, আবার কখনো তাঁর কানের কাছে গিয়ে তাঁর মসৃণ চুলের গন্ধ শুকছিলাম। কখন কিভাবে কি মনে করে জানি না, দেখেছিলাম আমার দুচোখ বেয়ে কয়েক ফোটা জল আমার নিজের অজান্তেই এই ঘুমন্ত মানুষটির বুকের উপর পরেছিল। আমি কি কেদেছিলাম? কোন কিছু ভেবে কি আমার মনে কোন কস্টের উদ্রেক হয়েছিল? না, আমার তা মনে নেই। শুধু মনে হয়েছিল, একবার বুক ভরে যদি আমি এই মানুষটির বুকে পড়ে অনেক্ষন কাদতে পারতাম, হয়ত আমি আরও শান্ত হয়ে কিছুটা দিন কাটাতে পারতাম। আমার মায়ের অনেক স্মৃতি আমার মনে নেই। একজন মা একজন সন্তানের জন্য কি কি করে আমার তা জানা নাই। তবে আমি জানি একজন সন্তান তাঁর মায়ের অভাবে কি কি মিস করে। তোমার কথা মনে হলো। আমি আমার ঈশ্বরের কাছে প্রানভরে আরাধনা করলাম, হে ভগবান, তুমি যাকে ভাগ্যবান করে রেখেছ, তাকে আবার হতভাগা কেন করবে? কি নেই তোমার যে, সামান্য একজন মানুষের অনুপস্থিতি দিয়ে তোমার আরেক প্রিয় একজন আদমকে চোখের জলে ভাসাতে চাও? তোমার হিসাব-কিতাব, তোমার চাওয়া-পাওয়ার মাঝে আমার কোন কৈফিয়ত চাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই কিন্তু আমার আরাধনা যদি কখনো মনজুর করো, তাহলে আজ এইদিনে তুমি এই ঘুমন্ত মানুষটিকে তোমার মত করে আরোগ্য করে দাও। আজ এই প্রথম আমার মনে হল, ঈশ্বর আছেন, ঈশ্বরের কাছে বলার অনেক কিছু আছে। আজ কেন যেন মনে হল, আমি ঈশ্বরকে ভালবাসি কারন ঈশ্বর আমাকে তাকে ভালবাসবার এবং তাঁর সাথে রাগ করার ইচ্ছাশক্তি আমাকে দিয়েছেন। তোমার ঐ কথাটিই আজ আমার কাছে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল যেটা তুমি প্রায়ই বলতে, “আই লাভ গড বিকজ হি হ্যাজ গিভেন মি দি পাওয়ার টু হেট হিম”। কি অদ্ভুত তোমার বলার সাহস আর দাপটতা। তুমি তোমার ধর্মের উপর কিভাবে বিশ্বাস রেখেছ তা আমার বিশদ জ্ঞ্যান হয়ত নাই কিন্তু আজ আমি হাসপাতালের এই নিরব ক্যাবিনে একজন ঘুমন্ত মানুষের সামনে বসে বুঝতে পারছিলাম, ভগবান যেই ধর্মেরই হোক, তিনি সবার জন্য সমান। এই বিশ্বভ্রমান্ডে যা কিছু আছে সব তাঁর। এর রূপ, গন্ধ, এর প্রকৃতির সৌন্দর্য, এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট সবকিছু তিনি তাঁর নিজের মত করে সাজিয়েছন। এর থেকে আরও সুন্দর কিছু হতে হয়ত পারে না। গোলাপের রং শুধু গোলাপিই নয়, এর স্থান কাল তাপমাত্রা ভেদে সে তাকে আরও অনেক রূপে আকার দান করেছে। আকাশ শুধু নীলই হয় নাই, এ কখনো কালো, কখন সাদা, আবার কখনো কতই না রঙে তুমি সাজিয়েছো। কি দরকার ছিল ঐ আফ্রিকার জঙ্গলে অত সুন্দর একটা লাল গোলাপ ফুটিয়ে রাখবার? কার জন্য কেউ জানে না অথচ তা আছে, বাস্তবেই আছে। কি প্রয়োজন ছিল এরিজোনা নদীর তিরে কোন এক ইউকেলিপ্টাস গাছে চুরায় সুন্দর সবুজ টিয়ার বাসা করে দেয়ার? কি প্রয়োজন ছিল ঐ গহিন সমুদ্রে পানির শতশত ফুট নিচে লাল নীল, বিভিন্ন রঙের সারি সারি দুবলা গাছ সৃষ্টি করবার? সবই রহস্য। তাঁর এই রহস্য সন্ধানে আমার শক্তি নাই। আরেক জলজ্যান্ত রহস্য তো এখন আমার সামনে। তিনি তোমার মা। সারাটি বিকাল আমার কেটে গেল কোন এক ঘোরের ভিতর। তুমি এলে সন্ধ্যার পর। ধুপ জ্বালাবার কোন কায়দা নেই এখানে, প্রভুর কাছে রিতি মোতাবেক প্রার্থনা করবার কোন প্রসাদ নাই এখানে। এখানে যার যার ভগবান তাঁর তাঁর অন্তরের একান্ত ভিতরে। এখানে জীবনের আরাধনা চলে, হোক সেটা মৃত্যুর অথবা জন্মের। কেউ হাসিমুখে বাড়ি ফেরে আবার কেউ অশ্রুসিক্ত নয়নে। কি অবাক না!! চোখের জলের ভাষা দুটুইঃ আনন্দের অথবা কষ্টের।

-হন্তদন্ত হয়ে ক্যাবিনে ঢোকেই তুমি প্রথম যে কতাটি জানতে চেয়েছো সেদিন- মাধুরী, মা কি কোন সাড়া শব্দ করেছিল এরই মধ্যে? তোমার তো আজকের দিনটা এখানে মায়ের সঙ্গে থাকতে হবে, আমি তোমার হোস্টেল সুপারকে খবরটা দিয়ে এসেছি যে তুমি আজ আসছ না। আমি তোমার বন্ধুদেরকেও খবরটা দিতে বলেছি। তুমি দুশ্চিন্তা কর না। আমি হয়ত কাল থেকে মায়ের সঙ্গে থাকতে পারব। আমার পরিবর্তে আমার এক খালা আসবে কাল গ্রাম থেকে। তখন তুমি আবার তোমার হোস্টেলে চলে যেতে পারবে।

কথাগুলো তুমি এমন করে বললে যেন, আমি আজকের দিনের জন্যই শুধু প্রয়োজন, কাল থেকে আমার কোন দরকার হবে না। তোমার মন খারাপ হবে ভেবে আমি তোমাকে কিছুই না বলে শুধু বলেছিলাম, আমাকে নিয়ে তুমি চিন্তা করোনা। যতদিন মা এখানে থাকবে, আমি থাকতে পারব। শুধু আমার কিছু পরিধেয় কাপড়চোপড় বাসা থেকে নিয়ে আসতে হবে। আমি আসলে এই অসামান্য মানুষটির পাশে থাকতে চেয়েছিলাম।

অনেক রাত অবধি তুমি ছিলে ওখানে। যাওয়ার সময় মনে হল, তুমি যেন শরীরটা নিয়ে বাসায় যাচ্ছ আর মনটা দিয়ে গেলে আমার হাতে। তোমাকে আমার বড্ড মায়া করতে ইচ্ছে করেছিল। আজকের তুমি কত ভিন্ন। আমি তোমার এই রূপটা কখনো দেখি নাই। কখনো দেখেছি তোমার গলা ধরে এসেছে মায়ের কথা বলতে বলতে, কখনো দেখেছি তোমার চোখের পাপড়িগুলো ভিজে যাচ্ছে চোখের অসংবরিত নোনা জলে, আবার কখনো দেখেছি তুমি কতটা উদার আমার প্রতি যাতে সব কিছুর বিনিময়ে হলেও যেন আমি তোমার মায়ের সমস্ত দেখভালটা করি। কখনো মনে হয়েছে তুমি কতটা স্বার্থপর। শুধু তুমি তোমাকে নিয়েই ভাবো। একবারও ভাবো নাই যে আমিও তো এখানে তোমার মায়ের কষ্টে ব্যথাতুর হয়ে আছি।

তুমি চলে গেলে। আমি একা বসে আছি মায়ের পাশে। দেয়ালে থাকা ফ্লরসেন্ট বাতিটা নিভিয়ে দিয়েছি। টেবিল ল্যাম্পটা জলছে আধোআধো ভাবে। হটাত দেখলাম, মা নড়তে শুরু করেছেন। মনে হল তিনি জেগে উঠছেন। যতই তিনি নড়াচড়া করছেন, আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন ততই কেঁপে কেঁপে উঠছে। কখনো মনের আনন্দে, আবার কখনো অজানা এক ভয়ে। আনন্দ এই কারনে, তাঁর নড়াচড়া আরোগ্য লাভের জন্য ভাল লক্ষন, কিন্তু ভয় এই কারনে তিনি কখনো আমাকে দেখেন নাই। আমি মায়ের ডান হাতটি আলতো করে চেপে ধরলাম। মনে হল একটা অবলম্বন ধরেছি। উত্তাল সমুদ্রে যখন প্রকান্ড জাহাজটি ভেঙ্গেচূরে খান খান হয়ে আশ্রয়ের সমস্ত ভরসা উবে যায়, কেউ যখন আর কোন আশ্রয়ের অবলম্বন না পেয়ে প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর ভয়ে আতংকিত হয়ে উঠে, তখন কোন অজানা দূর থেকে ভেসে আসা হয়ত ঐ জাহাজেরই ছোট্ট একটা কাষ্ঠখন্ডও আতঙ্কের নিরাময় হয়ে স্বস্থির আভাষ হয়ে উঠে। মায়ের হাত ধরাটাও যেনো আমার কাছে তাই মনে হলো। 

মা বেশ কিছুক্ষন পর যেনো তাঁর অসম্ভব ক্লান্তি ছাড়িয়ে চোখ মেললেন। তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। অপলক দৃষ্টিতে তিনি আমাকে দেখছেন। আমিও। কি সুন্দর তাঁর চোখ। কি অদ্ভুত তাঁর চাহনি। আমার ভিতরে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো দিকবিদিক শুন্য এক তান্ডব বয়ে যাচ্ছিল। আমি শুধু তাকিয়েই ছিলাম মায়ের দিকে। মা শুধু অপলক পলখহীনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আমার হাতে ধরা তাঁর হাতটি আরও শক্ত করে ধরে থাকলেন। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, আমি আর তাকে ভালভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কখন যে আমি তাঁর বুকে মাথাটা রেখে জরিয়ে ধরেছিলাম আমার কোন কিছুই মনে পড়ে না। শুধু মনে পরে, কর্তব্যরত নার্স এসে আমাকে বললেন, আপা, আপনি ইচ্ছে করলে পাশে বিছানায়ও কিছুক্ষন বিস্রাম করতে পারেন। আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আমি আর তাকে এটা বলার কোন প্রয়োজন মনে করলাম না যে, আমি ক্লান্ত নৈ, আমি ভাল আছি, কারন মা ভাল আছে। আর মা ভাল থাকলে তুমি ভাল থাকবে। ভগবান বড় রসিক। তাঁর রসিকতায় চোখের জল আর মনের আনন্দ সব একাকার হয়ে যায়।

যে কয়টাদিন আমি মায়ের সঙ্গে থেকেছিলাম, আমার জীবনে ওটা ছিল শ্রেষ্ঠ সময়। আমি জানিনা মা আমাকে কতটা আপন করে নিয়েছিলেন, কিন্তু আমার কাছে মা ছিল একটা শ্রেষ্ঠ উপহার। তুমি ঠিকই বলতে, তোমার মা এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম একজন মা। তাঁর তুলনা তিনি নিজে। সকালে উঠে তিনি প্রতিদিন আমাকে বুকে জরিয়ে চুমু খেয়েছেন। রাতে শোবার সময় বলতেন, আমাকে জড়িয়ে ঘুমাবে। আমার কাদতে ইচ্ছে করত এইভেবে যে, এই একান্ত সময়টা আমার খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। মা আমাকে কখনো কিছু জিজ্ঞ্যেস করতেন না কে আমি বা কি বা আমার সম্পর্ক তোমার সাথে। শুধু প্রথম দিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার পরিবারের কথা। হয়তবা আমার মা স্বর্গীয় হয়েছেন, বাবা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে সুখে আছেন, আমি একটা মহিলা হোস্টেলে থাকি, এই জেনে আর কিছুই তাঁর জানার প্রয়োজন ছিল না। তোমার মা আমাকে আদর করে কি এক অদ্ভুত নামে ডাকতেন যার অর্থ আমি কখনই হয়ত জানব না কিন্তু আমার তাঁর এই দেয়া নামটায় কোন আপত্তি ছিল না বরং আমার খুব মনে ধরেছিল। তোমাকে আজ ঐ নামটা মনে করিয়ে দিতে চাই না কারন তুমি সেটা যে ভুলে যাও নি তা আমি জানি।

মা সেরে উঠলেন চারদিন পর। আমি এই কয়দিনে ভুলেই গিয়েছিলাম আমি হোস্টেলে থাকি, আমাকে আবার হোস্টেলে ফিরতে হবে। মা আমাকে তোমাদের নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। মা আমাকে জোর করেননি, আমাকে যেতে হবে মায়ের সঙ্গে তোমাদের বাসায়, এই কথাটা এমন করে বলেছিলেন যে, আমার সাত জনমেরও সাধ্যি ছিল না এর কোন ব্যাতিক্রম হয়। হাসপাতালের আয়া থেকে শুরু করে নার্স, পাশের ক্যাবিনের রোগীরাও মায়ের এই প্রত্যাবর্তনে যতটা না খুশি হয়েছিল তাঁর থেকে বেশি যেন কষ্ট পেয়েছিল এইভেবে যে, তারা সবাই মাকে মিস করবে। মাকে দেখে বুঝলাম, মানুষকে আপন করে নেওয়ার জন্য অধিক সময়ের দরকার হয় না। দরকার শুধু মানবিকতা আর নিঃস্বার্থ ভালবাসা।

মাকে নিয়ে তুমি তোমাদের বাসায় এলে। সঙ্গে আমি। এই প্রথম আমি তোমাদের বাসায় এলাম। রবিন্দ্রনাথের জমিদার বাড়ির মত না হলেও দেখলাম বাড়িটা অনেক বড়। তোমাদের বাড়ির পশ্চিম পাশে একটা পুকুর ঘাট আছে। পুকুর ঘাটের সামনের রাস্তাটা তোমাদের বাড়ির সদর দরজার ঠিক উল্টো দিকে গিয়ে মিশেছে। কেউ রাতে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেও অসুবিধা নাই, পুকুর ঘাট থেকে সোজা বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছতে পারবে। মাঝে দুইটা সেই পুরানো মডেলের রাজা বাদশার আদলে বাতি আছে। মোটামুটি তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট উচ্চতা। পুকুরের চারিধারে বসবার জন্য কয়েকটি আধা পাকা বেঞ্চের মত করে দেওয়া আছে। প্রতিটি বেঞ্চই কোন না কোন একটা গাছে নিচে। বাড়ির সামনে একটা ছোট বাগান। অনেকদিন এই বাগানে মালির হাত পরেনি বুঝা যাচ্ছে। তাঁরমধ্যে বৃষ্টির সিজন। বর্ষার পানি আর যথেষ্ট পরিমান আলো বাতাস পেয়ে বাগানের আগাছাগুলো লিকলিক করে সবার অন্তরালে অল্প সময়ের মধ্যে যার যার স্থান করে নিয়েছে। বুঝা যায়, বাগানে অনেক অতিথি পোকাদের আনাগোনা হয়েছে। এরাও এই জায়গাটাকে প্রানমুখর করে রেখেছে। বাড়ীটার উত্তর ধারে আছে প্রকান্ড একটা জামগাছ। এখন ফলের সিজন শুরু হয় নাই কিন্তু পাপড়ি, কুড়ি গজানোর সময়। তাই জামগাছেও থোকায় থোকায় কিছু নতুন কুড়ি এসেছে। আর এদের সঙ্গে চিরাচরিত পরকিয়া প্রেমিকের মত কিছু মধু আহরণকারী পোকামাকরের সর্বদা ভীড় রয়েছে। জামগাছটিও আর একা নয়। তাঁর উপরের মগডালে নিতান্তই সাধু বাবার মত, ভদ্র পরিবেশ বানিয়ে কয়েক জোড়া বাবুই পাখী তাঁর সুনিপুণ কৌশলে বানানো ঝুলন্ত কয়েকটি বাসা মোটামুটি পাকাপোক্ত করেই যেন চিরস্থায়ি বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। একপাশে অনেক পুরানো দিনের পরিত্যাক্ত একটা ডোবা। বুঝা যাচ্ছে এই ডোবাতে কেউ নামে না। এলোপাথাড়ি কচুরিপানা, কিছু গাছের মরা ঢাল, বর্জ্য পদার্থ, অনেক কিছুই চোখে আসে। আর এই ডোবাটার ঠিক আশেপাশে কিছু দস্যুপনা পাখির সারক্ষন আনাগোনা থাকে কখন ছোট্ট একটা নলা মাছ, বা কচি প্রানের একটা ব্যাঙের ছানা যেই না উকি মারে অমনি ছো মেরে ঘপ করে মুখে পুরে নেয়। পুরু বাড়িটার মধ্যে একটা প্রানের লক্ষন আছে। সবচেয়ে বেশি লক্ষ করলাম, বাড়িটা নীরবতায় পরিপূর্ণ কিন্তু নিরব নয়। দুদিন থাকতে হল।

আমার কোন বাড়ি নাই। আমার পৈত্রিক বাড়িতে আমার বিশেষ কোন কদর ছিল কিনা আমি জানি না কিন্তু আমার ঐ পৈত্রিক বাড়িটায় আমার কোন নিজস্ব নেশাও জন্মেনি। সেই ছোট বেলায় আমি যখন শেষ বার গিয়েছিলাম, তাঁর স্মৃতি আমি আজও ভুলি নাই। সেটা ছিল এক দুঃসহ এবং ভয়ংকর অনুভুতি। আমরা সবাই সন্ধ্যা পূজায় বসেছি মাত্র। এমন সময় গ্রামের কিছু লোক আর তাঁদের সঙ্গে কিছু বিশ পঁচিশ বছরের যুবক আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। লোকগুলোকে দেখে বেশ উত্তেজিত বলে মনে হলো। আমার মা পুজা ছেড়ে সদর দরজার কাছে এসে একজনকে তাঁদের আগমনের কথা জিজ্ঞ্যেস করতেই পিছন থেকে এক যুবক উত্তেজিত কোথায় মাকে গালিগালাজ করতে লাগলেন। যেন ব্যাপারটা এই রকম , মা কোন অন্যায় করেছেন, তাঁর বিচার চাওয়া হচ্ছে। মা কোন প্রতিবাদ  না করে আগত এক বৃদ্ধ মুরুব্বীকে খুবই  বিনিত স্বরে কি যেনো বললেন। কিন্তু ব্যাপারটা তাতেই মিটে গেল বলে মনে হলোনা। হটাত হট্টগোল শুরু হয়ে গেল, আগত যুবকদের মধ্যে এক অল্প বয়েসি তরুন আমাদের বাসার দরজা আর জানালা উদ্দেশ্য করে এলোপাথাড়ি ঢিল ছুড়তে আরম্ভ করলো। আমার মা যথেষ্ট পরিমানে আহত হলেন, আমরা এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে, পুজামন্ডপ ছেড়ে আমরা সবাই আমাদের ঘরের এককোনে ঝুপটি মেরে বসেছিলাম। অনেকরাতে বাবা বাড়ি ফিরলেন। আমার মা বাবার সঙ্গে কোন কথাই বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। আসলে কি জন্য কি হয়েছিল আমরা কেউ কিছুই জানতে পারলাম না। শুধু পরেরদিন মা বললেন, আমরা সবাই নানু বাড়ি যাচ্ছি। নানু বাড়ি যাচ্ছি শুনে আমার খুব ভাল লাগছিল কিন্তু আমার মায়ের খুব মন খারাপ, ব্যাপারটা আমাকে দোটানায় রেখেছিল, একদিকে নানু বাড়ি যাওয়ার আনন্দ আবার আরেকদিকে মায়ের মনের অবস্থা। ঐ যে শেষবারের মত আমাদের পৈত্রিক বাড়িতে গিয়েছিলাম, আর যাওয়া হয় নাই। আমার বাবাও আর নানুর বাড়িতে কখনো আসেন নাই। আমরা বাবাকে খুব ভয় পেতাম, তাই কি কারনে বাবা আসেন না, তাও আমরা কেউ জানতে পারিনি। মাকে জিজ্ঞ্যেস করলে মা শুধু অন্য প্রসঙ্গে এড়িয়ে যেতেন। অনেক বছর জেনেছিলাম, বাবা অন্য এক নারির সঙ্গে ঘর বেধেছেন।

তোমাদের বাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। সকালের রোদ যেমন অকাতরে তোমাদের পূর্ব উঠোনে এসে আছড়ে পরে, তেমনি বিকালের পড়ন্ত রোদেরও কোন কমতি নেই পশ্চিমের পুকুরঘাট থেকে শুরু করে সদর দরজার আঙ্গিনা পর্যন্ত।

যে কয়টা দিন আমি তোমাদের বাসায় থেকেছিলাম, ঐ কয়দিনের মধ্যেই শুধু তোমাদের বাড়ি নয়, আশেপাশে লোকজনের সঙ্গেও তোমার মা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সামনে পরীক্ষা, তাই কয়েকদিন পরই আমি চলে এলাম। বলতে পারো তুমি, আমি কি বিদায় নিয়ে এসেছিলাম? আমার মনে পরে না এখন। সেদিন আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল এইভেবে যে, আমি ঐ বাড়িটার প্রতিটি মুহূর্ত মিস করবো। আমি সকালের রোদটা মিস করবো, পুকুরঘাট, ঐ ডোবা, বাগান, কাকাতুয়া, বাবুই পাখী, ব্যাঙের ছানার উকি মারা, কিংবা সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া জামের কুড়ি সবই মিস করবো। আর এগুলোকে জড়িয়ে যার সংসার, তোমার মা, তাকে আমি মিস করবো আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে। আমার বুক ভরে কান্না আসছিলো। তোমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরে এই প্রথম তাঁর ডাকা নামটায় আজ আর ডাকলেন না, শুধু বুকে চেপে ধরে আমাকে বললেন, “তুমি আবার এসো মা,”। এতক্ষন কান্নাটা চেপে রাখতে পেরেছিলাম, এখন তোমার মায়ের মুখে আমাকে “মা” সম্বোধনটা আমার বুকে কষ্টে জমিয়ে রাখা ব্যাথাটা ভেঙ্গে শ্রাবনের বারিধারার মত আখির  অজস্র নোনাজলে এর বহিরপ্রকাশ ঘটল।

আমি যতক্ষন প্রশমিত হইনি, তোমার মা আমাকে অতক্ষনই তাঁর বুকে জড়িয়ে রাখলেন। উনি কেদেছিলেন কিনা আমি জানি না, কিন্তু আমি যখন তাঁর বুক থেকে মাথা সরিয়ে মার দিকে তাকালাম, দেখলাম তাঁর মিষ্টি একটা হাসি। প্রানটা যেন এবার সত্য জুড়িয়ে গেল। বুকের ভিতরের ব্যাথাটা এখন অনেক হাল্কা লাগছে, আমি মায়ের পা ছুয়ে আশীর্বাদ নিলাম। তারপর আমি আমার সেই চিরচরিত হোস্টেলে চলে এলাম। আবারও সেই অগোছালো এক বসবাস, একই ধাঁচের সেই নিয়মের বাড়াবাড়ি। কিন্তু কোন উপায় নেই। জীবনের অনেক কিছুই আমাদের ভাল লাগবে না, তাই বলে এই নিয়মগুলো কেটে বের হয়ে যাওয়ারও কোন উপায় নাই, যারা নিয়মগুলো বানায়, তারা নিয়মগুলো হয়ত মানার দরকার নাই বলে এর সংস্কার করারও কোন প্রয়োজন মনে করে না। কে কার জন্য কি পালটাবে বলো?

তোমার সাথে আমার যথারীতি দেখা হয়, কথা হয়, তোমার মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করি, বেশ চলে যাচ্ছে আমার সেই নিঃসঙ্গ একাকী জীবনের কিছুটা সময়। বন্ধুবান্ধব ছিল কিন্তু তারা সব বন্ধুর গন্ডিতেই ছিল। অনেকে আরও গভীরভাবে আমাকে জানতে চেয়েছিল হয়ত, আমি কেন যেন কোন কিছুই বুঝতে চাইনি। আমার সহপাঠী অনেক মেয়েবন্ধুরা এরই মধ্যে বিয়েথা করে সংসার পেতে ফেলেছে, কখনো কারো সুখের কাহিনি শুনে মুগ্ধ হয়েছি আবার কখনো কারো করুন কাহিনি শুনে বড্ড অসহায় মনে হয়েছে। আমরা মেয়ে মানুষ, পুরুসের মন জুগিয়ে চলাই আমাদের প্রধান কাজ। শুধু পুরুষ কেনো, তাঁর সঙ্গে শ্বশুর, শাশুড়ি, আয়া, জায়া, দেবর ননদ সব। এমন কি বাড়ির কাজের মানুষগুলোও অনেক সময় যা পারে আমরা বউরা ঐ কিঞ্চিত ছাড় পাওয়ার আশা করাও অনেক সময় দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। এ দেশের মায়েরা আর শাশুড়িরা এক বংশের নয়। মায়েরা মনে করে, তাঁদের মেয়েটা শ্বশুর বাড়িতে জামাইকে নিয়ে খুব ভাল আছে কারন তাঁর মেয়ে যা আদেশ করে বা বায়না করে তাঁর স্বামী সব অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কিন্তু তাঁর ছেলেটা একেবারে উল্টো। বউ যা আদেশ করে বা বায়না ধরে তা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কেন বাবা, পরের মেয়ের এত আবদার, এত কথা কেন শুনতে হবে? যেন তাঁর ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে অথচ তাঁর মেয়ের জামাইটা কি সুবোধ বালকের মত। যা আদেশ করা হবে সব সে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। এই হচ্ছে আমাদের সমাজ। যেখানে আমরা পরিবর্তনের কথা বলি সবাইকে কিন্তু নিজে পরিবর্তন হই না। আমরা প্রত্যেককেই বলি, কেন সবাই পরিবর্তন হয় না? শুধু বলি না, কেন আমি পরিবর্তন হচ্ছি না। যাক, হয়ত এটাই সামাজিক রীতি। কেউ বদল করে কেউ বদল হয়। আমারও কিছু জিনিসের বদল হলো। শেষ করে ফেললাম আমার শিক্ষার জীবন। হোস্টেল জীবন বদল হয়ে গেল ছাত্রি হিসাবে। আমি জানি না কোথায় এখন আবার আবার নতুন জায়গা হবে। তুমিও কোনদিন আমাকে এই প্রশ্নটা করোনি এরপর কি আমার প্ল্যান, বা কি করলে কি হবে। ছাত্রি থাকা অবস্থায় একবার ফ্রান্সে স্কলারশিপের আবেদন করেছিলাম, এর কি অবস্থা একটু খুটিয়ে দেখার ইচ্ছে হলো। আমি জানি এটা আমার হবে না। আমার জাঁদরেল কোন মামা নেই, আমার বাবার এমন কোন বন্ধু নেই যার কাছে আমি গিয়ে বলতে পারি আমার সাহায্যের প্রয়োজন। অথবা আমার এমন কোন ব্যাক্তির সঙ্গে সখ্যতা নেই যাকে ধরে আমি আমার এই অবৈতনিক ধূসরগণ্ডী পার করতে পারি। তাঁরপরেও একবার খোঁজ নিতে গেলাম ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার অফিসে যদি কোন কিছুর সন্ধান পাওয়া যায়। আমি আশাবাদি নৈ কিন্তু একেবারে অবসর, তাই কিছু একটা করা আর কি। একটা পানির বোতল সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম রেজিস্টারের অফিসের উদ্দেশে।

ভগবান যখন রশিকতা করেন, তাঁর রসিকতায় একটা অদ্ভুত আবেগময়ি স্পর্শ থাকে। আমার বেলায়ও হয়ত তাই হল। কি করে কি হল? আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে শুনলাম, গতকালই নাকি আমার ফ্রান্সে যাবার স্কলারশিপটা মঞ্জুর করেছে। আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না এই খবরটায়। মোট জনাদশেক আবেদন করেছিল, তাঁর মধ্যে শুধুমাত্র আমাদের দুজন এই স্কলারশিপটা পেয়েছে। তাঁর মধ্যে আমি একজন। আনন্দে আত্মহারায় আমার শরীর কাপছিল, আমি কাকে এই খবরটা দেব? কি বলব? কিভাবে বলব? এটা কি আদৌ কোন বড় খবর নাকি কোন খবরই না? আমি আমার পানির বোতলের সবটুকুন পানি খেয়েও যেন আমার তৃষ্ণা মিটছিল না। সত্যি ভগবান বড় রশিক। যখন কারো আর কোন পরিকল্পনা জানা থাকে না, তাঁরজন্য হয়ত ভগবান বিশেষ কিছু করে থাকেন যা সঠিক সময়ে সঠিকস্থানে এবং সঠিক ব্যাক্তিকে তিনি দান করে আশ্বস্ত করেন। আমার এই অপরিকল্পিত জীবনে এই প্রথম মনে হল, “কোথাও কেউ নেই” এই কথাটা সত্য নয়। অন্তত ভগবান আছেন। তিনি সবাইকে তাঁর অফুরন্ত আলো বাতাসের ভান্ডার দিয়ে, এই বিশাল জলরাশির আধার দিয়ে, কোন না কোন অসহায় জীবকে নিজের পরম মমতায় অতিযত্নে সোহাগ করে তুলে নেন আর এমন স্থানে তাকে জায়গা করে দেন যা অতিশয় আরামদায়ক এবং সৌভাগ্যের। হয়ত ভগবান তাঁর নজর আমার কাছ থেকে এখনো সরিয়ে নেন নাই।

আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি, তুমি ছাড়া আর এখন তোমার পরিবার ছাড়া আমার আর কেউ নাই। আমার পৃথিবীর গোটা অঞ্চল ভাগ করলে সেই অঞ্চলে শুধু তোমাদের বাড়িটা ছাড়া আর কোন অঞ্চল এই অংশে দেখা যাবে না। আর সম্ভবত এই কারনেই খবরটা নিয়ে আমি প্রথম যেখানে দৌড়ে গিয়েছিলাম, সেটা তোমার বাসায়। জীবনের মুহূর্তগুলো কিভাবে বদলে যায়, জীবনের আগমুহূর্তটা তাঁর পরের মুহূর্তের মত নয়। প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর নিজ নিজ স্বকীয়তায় পূর্ণ। একটু আগেও আমি ছিলাম ধিরস্থির, আমার কোন নিশানা ছিল না, আমার গন্তব্যের কোন আবাসস্থল ছিল না, অথচ এই মুহূর্তে আমি আর আগের মুহূর্তের মত নৈ। এখন আমি এক চঞ্চলা। মনে মনে গুনগুন করে গান গেতে ইচ্ছে করছে। কোন বিষণ্ণ ধরনের গান নয়। মনে হচ্ছে আমি নিজেই একটা গান নিজের সুরে গাইতে থাকি, “আমি যেন আজ আমি নেই, কোন এক বিশাল জগতের অম্পরা সরীসৃপ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষ কত অদ্ভুত। হয়ত এই কারনেই ভগবান তাঁর অদ্ভুত আচরনে মুচকি মুচকি হাসেন আর তাঁর রসিকতার মজা নেন।

বিকাল চারটার দিকে আমি তোমাদের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। আমি জানি এই সময় তুমি বাসায় থাকো না। তোমার মা হয়ত এই সময় দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নেন। কিন্তু আমার সময় কাটছিল না। আমি হাজির হয়ে গেলাম তোমাদের বাসায়।   

অবাক হলাম মাকে দেখে। মা অন্য দিনের মত আজ দুপুরের পর খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নেননি। কি যেন নিয়ে খুব ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আমি ঢোকতেই একটা সুন্দর মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “এসো মা এসো, ভালই হলো, তুমি এসেছ”। আমি মাকে প্রনাম করে তাঁর পাশে গিয়ে বসতেই আমাকে একটা এ্যালবাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “দেখোত মা, মেয়েটা কি রকম দেখতে?” ধক করে উঠল যেন আমার বুকটা। আমার এতবড় একটা আনন্দের দিনে, মনভরা এতটা সুখি বুকে হটাত করে যেন পিছন থেকে শতটনি একটা গাড়ী আমার পাজরের সবগুলো হাড় চুরমুর করে বাকিয়ে দিচ্ছে। বুঝতেই পারলাম না কোথা থেকে কখন ঐ শত সহস্র ওজনের একটা দানব আমার অজান্তে আমার এত কাছে এসে কত বড় ধাক্কাটা দিয়ে গেল। সামলাতে একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেও ব্যাপারটা নিজের কাছেই লুকিয়ে রাখতে পারলাম। “আকাশের জন্য মেয়ে দেখছি, এগুলো ঐ মেয়েটারই ছবি। দেখোতো মেয়েটা কেমন দেখতে?” আমি ছবিগুলো দেখতে দেখতে মা কথাগুলো বলছিলেন। বড্ড সুন্দর একটা মেয়ে। ঠোটে লাল লিপিস্টিকের পাশ দিয়ে চমৎকার লাইনার টানা। মনে হয় কোন আর্টিস্ট যেন খুব সন্তর্পণে তাঁর ঠোঁটের ঐ লিপিস্টিকগুলি অতিশয় যত্নের সহিত একে দিয়েছেন। মাথার চুলগুলো পরিপাটী করে সাজানো। ক্যামেরার আলো প্রতিফলিত হয়ে চুলের এক অংশে একটা আলোর ঝলকানির সৃষ্টি করেছে। কানের দুলটি গ্রীবার পাশ পর্যন্ত ঠেকে আছে। তাঁরমধ্যে অসংখ্য যাদুকরী কারুকার্য। চোখ দুটো নিরব চাহনি দিয়ে তাঁর মাদকতার রূপ জাহির করছে। অদ্ভুত সুন্দর সে চাহনি। মিস্টি মুখের একটা ছাচ। গোলগাল কিন্তু অপূর্ব মায়াবতী। যে কারোরই পছন্দ হবে মেয়েটিকে। কয়েকটি ছবি পূর্ণ অবয়বে তোলা। বেশ লম্বা বুঝা যায়। আকাশের সঙ্গে মানাবে। একটা ছবিতে একটা ছোট গাছের আড়ালে দাড়িয়ে। আড়াল করে দাড়ালেও তাঁর রুপের কোন অংশই লুকানো সম্ভব হয় নাই। পিছনের সবুজ ঘাসের সঙ্গে আর অপরূপ কিছু রঙ্গিন পাতাগাছের পাশে তাঁর সবুজাভাব শাড়ির অদ্ভুত একটা মিল রয়েছে। নারীরা আসলে সুন্দরের প্রতিক। ভগবান এদের বানিয়েছেন অতি আদর করে , মায়াবতী রূপ দিয়ে। কেউ এদের নোনাজলে ভাসিয়ে কর্দমাক্ত করে দিলেও তাঁর অন্তরের রুপটা হয়ত একেবারে বিলিন হয়ে যায় না। এরা শ্মশানের মত পাষান নয়, আবার মমের থেকেও নরম। এদের গলিয়ে আরেক রূপ দেওয়া যায় আবার শুকিয়ে গেলে বর্জ্য ছাড়া আর কিছুই থাকে না।

বললাম, “মেয়েটি দারুন দেখতে। আকাশের সঙ্গে মানাবে।”

তোমার মা আমাকে চুমু খেয়ে বললেন, “দেখিস, তোর আকাশ সুখি হবে।”

আমার চোখ ভিজে এল মায়ের কথায়। “আমার আকাশ”। হ্যা, তাই তো, তুমি তো আমারই আকাশ। ঐ আকাশেই তো আমার সর্বদা বিচরন। আমি যখন খুশি উড়তে পারি, আবার আমার যখন মন খারাপ থাকে, ঐ আকাশ থেকেই তো বৃষ্টি আসে। আবার কখনো কখনো ঐ আকাশের মাঝে জলন্ত সূর্যটাই তো আমাকে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয়। অনেকক্ষন মায়ের সঙ্গে কাটালাম। আমি আমার খবরটা তখনো মাকে দেই নাই। কি বলব মাকে? আমি চলে যাচ্ছি? আমি কোথায় যাব?

সন্ধে হয়ে এল। হোস্টেলে ফিরতে হবে। অনেক কাজ হয়ত বাকি। রেজিস্ট্রার সাহেব আমাকে একখানা ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। অনেক কাগজপত্র যোগাড় করতে হবে। আমি ফিরার পথে মাকে বললাম, “মা, আমার  স্কলারশিপ হয়েছে, ফ্রান্সে।  খুব শিগ্রই  হয়ত যেতে হবে। তুমি দোয়া কোরো।”

“সে কিরে? আকাশের বিয়েতে তুই থাকবি না?” মা আমার এই খবরটায় যতটা না খুশি হলেন, মনে হল তাঁর থেকে বেশি বিচলিত হলেন আমার চলে যাবার কারনে হয়ত আকাশের বিয়েতে আমার ভুমিকা নিয়ে।

আর যাই হোক মা তো। মায়েরা নিজের সন্তানের অন্তর যতটা বুঝে তারা অন্য সন্তানের অন্তর অতটা হয়ত বুঝেন না। ওনি তো আকাশের মা।

আমি চলে এলাম আমার হোস্টেলে। মনটা আজ নানা কারনে এতটাই আলোড়িত ছিল যে কখনো উত্তপ্ত টাইফুনের মত আবার কখনো ধুম্রজাল নাটকের মত খসখসে, আবার কখনো বৈশাখীর পড়ন্ত বিকালের আমেজের মত, কখনো জানি কেমন বুঝা যাচ্ছে না। আমার স্কলারশিপ আমাকে অতিশয় আবেশিত করে ফেলেছিলো, আবার আকাশের বিয়ের পাত্রি দেখে আমার মন যেনো কোথায় স্থির হয়ে গিয়েছিলো। টিভি অন করে মনটা বদলের চেষ্টা করলাম। প্রথমেই একটা গানের কলি শুনে মনটা আরও বিষণ্ণ হয়ে গেল, নজরুলের ঐ বিখ্যাত গান, “আমার যাবার সময় হল, দাও বিদায়…” পৃথিবীর কোন একটা মুহূর্ত আরেকটি মুহূর্তের মত কখনই নয়। এরা সবাই যার যার বেদনায় বা উল্লাশে ভরপুর। খেতে ভাল লাগছিল না। না খেয়েই শুয়ে পড়লাম।

একটানা এগারো দিন আর আমি তোমার সঙ্গে অথবা তোমাদের বাড়ির সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখিনি। সত্যি আমি আমার স্কলারশিপের যাবতীয় কাগজাদির জন্য হন্যে হয়ে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেরিয়েছি। মনে হয়েছে শুধু আমার হাতে সময় অনেক কম, কেন জানি মনে হয়েছে আমার সময় ফুরিয়ে আসছে। যে করেই হোক আমি তোমার বিয়ের আগে এই সমাজ, এই দেশ, এই রীতিনিতি, এই শাশনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যাবো। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।

আমার স্পষ্ট মনে আছে। দিনটি ছিল ইংরেজির ১৮ তারিখ আর বাংলায় ২৯ শে বৈশাখ। আমার সবকিছু ঠিক হয়ে গেল। আমি চলে যাচ্ছি সেই সুদুর অপরিচিত কোন এক মহলে যেখানে আমি কারো ভাষা বুঝি না, আমার কেউ পরিচিত নাই, আমি ইচ্ছে করলেই মন খারাপ থাকলে তোমার মায়ের মত এমন একজন মানুষের কাছে আমি ছুটে যেতে পারব না। তারপরেও আমি সস্থি পাচ্ছি এই ভেবে, আমার নতুন জীবনে কেউ আমাকেও চিনে না। আমি শেষবারের মত তোমার কাছে এসেছিলাম তোমাদের বাসায়।

মাকে প্রনাম করলাম, বড্ড কান্না পাচ্ছিল। মা আমাকে কত কথা বললেন। খুব আদরে আদরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

তোমাদের বাসা থেকে বের হবার সময় তোমাকে একবার প্রনাম করতে খুব মন চাইছিল। মন যা চাইলো, আমি তাই করলাম, এই প্রথম আমি তোমাকে প্রনাম করতে গেলে তুমি আমাকে বারন করতে গিয়ে জড়িয়ে ধরলে। আমি অবশ শরিরে শুধু কান্নাই করে যাচ্ছিলাম। তুমি আমাকে কখনোই এইভাবে জড়িয়ে ধরো নাই। তুমি আমার আকাশ, এই প্রথম আমি আমার আকাশকে এত কাছ থেকে বুকের মাঝে ধারন করতে পারলাম। তুমি কি আমার ভিতরের কোন কম্পন অনুভব করোনি? তুমি কি কখনোই বুঝতে পারোনি যে আমার ভিতরের মাধুরী আজ তোমার আকাশ থেকে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে? হয়ত বা পেরেছ, হয়ত বা পারোনি।

বিশাল এয়ারপোর্ট। আমি কখনো এই এয়ারপোর্টে আসিনি। আসার দরকার হয় নাই। কত লোক এই এয়ারপোর্ট দিয়ে তাঁদের গন্তব্য পরিবর্তন করে, আমিও আজ আমার জীবনের আরেক গন্তব্যের উদ্দেশে নিজে দেশ ছেড়ে, নিজের সমস্ত স্মৃতি পিছনে ফেলে, যত মায়া মহব্বত, ঘৃণা, আক্রোশ, ক্রোধ, অবিচার, অন্যায়, কিংবা ভালবাসা, আবেগ, অথবা মনের সব জালা জন্ত্রনা ছেড়ে আমি পাড়ি দিচ্ছি অন্য আরেক অপরিচিত দেশে যেখানে আমার কেউ নেই।

প্ল্যান টেকঅফ করেছে। দ্রুত স্থান পরিবর্তন হচ্ছে, ঘাস, গাছ পালা, বিশাল অট্টালিকাগুলো নিমিসের মধ্যেই আমার থেকে পিছনে পরে যাচ্ছে। আমার মনটা একেবারে শান্ত, কিন্তু কোথায় যেন চিনচিন করে ব্যাথা অনুভুত হচ্ছে। আমার পাশে বসা একজন ষাট বছরের বৃদ্ধা তাঁর সিটে আরাম করে বসবার জন্য ঘনঘন নারাচরা করছেন। আমরা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের মাটি ছেড়ে অনেক উপড়ে উঠে গেছি। আমি এখন আকাশে। এই আকাশ আর সে আকাশ এক নয়। আমি ইচ্ছে করলেই এই আকাশে ঝাপ দিয়ে বুকে পড়তে পারি না, তারপরেও এর নাম আকাশ। আকাশ কত বিশাল, চারিদিকে শুধু সাদা মেঘের আভা। মনে হয় যেন সাদা মাটির এক দেশ। কেউ কোথাও নেই, শুধু সাদা মাটি। 

০১/০৬/২০১৬-গল্পটা যদি এমন হতো?

Categories

 

এক যে ছিল রাজকুমার, আর এক যে ছিল রাজকুমারি। রাজকুমার রাজকুমারিকে আর রাজকুমারি রাজকুমারকে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু হটাত করে কোন এক দিন রাজকুমার হারিয়ে যায়। দিন যায়, রাত যায়, মাস যায় বছর আসে, বর্ষা যায় শিত আসে, রাজকুমারি পথ চেয়ে বসে থাকে। কিন্তু রাজকুমারের কোন হদিস মেলে না। চোখের সবগুলো স্বপ্ন নিয়ে আর অশ্রুভরা নেত্রে রাজকুমারি একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে জস্না দেখে, চাদের পানে চেয়ে ঐ চাদের বুরির সঙ্গে একাই কথা বলে।  কত রাজ কুমার এলো গেলো। কিন্তু রাজকুমারীর কোন রাজকুমারের প্রেমেই পরতে পারলেন না। তার রাজ্য চাই না, জহরত চাই না, সোনার পালঙ্ক চাই না। তিনি শুধু রাজকুমারের জন্য পথ চেয়ে থাকেন।

একদিন হটাত কোন এক বসন্তের সকালে মাথা ভর্তি এলো মেলো চুল নিয়ে, উসুখুসু খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি নিয়ে রাজকুমার এসে হাজির। রাজকুমারি তার জীবনের সব আনন্দ আর ভালবাসা দিয়ে রাজকুমারকে জরিয়ে ধরে শুধু বললেন, আমাকে একা ফেলে তুমি কোথায় গিয়েছিলে রাজকুমার? আমি তো তোমার পথ চেয়েই এতটা দিন, এতটা সময় পার করে দিয়েছি, একবারও কি মনে পরে নাই আমায়? তুমি কি আমার ভালোবাসার স্নিগ্ধ ঘ্রান কখনোই পাও নাই রাজকুমার? এই বুকে কান পেতে দেখ, কি উত্তাপ আর কি যন্ত্রনা নিয়ে আমি এই এতগুল বছর তোমার প্রতিক্ষায় অপেক্ষা করে আছি! আমাকে তুমি তোমার বুকের ভিতরে একটু জায়গা দাও রাজকুমার। আমি বড় ক্লান্ত, আমি আজ অনেক অবসন্ন। আমাকে জোর করে ধরে রাখ এবার। আমি তোমাকে আর কখনো হারাতে চাই না কুমার।

রাজকুমার তার পকেট থেকে একটি ছোট ঘাস ফুল বের করে রাজকুমারির ঘন কালো চুলের খোঁপায় গুজে দিয়ে বললেন, এই হোক সাক্ষী আজ তোমার আর আমার প্রেমের আলিঙ্গনের। আমাদের সুতীব্র ভালোবাসার।

দিন যায়, রাত যায়, বড় ভাল জীবন কাটছিল রাজকুমারের আর রাজকুমারির। একদিন হটাত রাজকুমারের অন্তর্ধান হয়। রানী আবারো একা বসে থাকেন ঐ বেলকনির রেলিং ধরে। সন্ধায় চিল কাতুরের ডাকে তার মন ভারি হয়ে আসে। জোনাকির ডাকে তার সব অতিতের কথা মনে হয়। মনে হয় রাজকুমার তার পাশেই হাত ধরে বসে আছেন। কিন্তু না। সব আশা, আহ্লাদ, সব স্মৃতি মলিন করে দিয়ে তার গরভের অনাগত সন্তানের নড়াচড়ায় সম্বিত ফিরে আসে।

আজ নতুন রাজকুমার এসেছে তার জীবনে। হাটি হাটি পা পা করে ছোট রাজকুমার বড় হতে থাকে। একদিন সে কথা বলতে থাকে। ছোট রাজকুমার কে মা রাজকুমারি কতই ই না গল্প শুনিয়ে ঘুম পারিয়ে দেন। কিন্তু রাজকুমারি সব সময় একই গল্প বলতে থাকে……… এক যে ছিল রাজা আর এক যে ছিল রানী। তাদের ছিল এক রাজপুত্তর। রাজপুত্রকে নিয়ে রাজা আর রানী বড় ভালবাসায় জীবন কাতাইতেছিলেন। একদিন হটাত করে রাজা হারিয়ে যান কোন এক গহিন জঙ্গলের ভিতর। রাজপুত্র ধীরে ধীরে বড় হয়। একদিন মাকে জিজ্ঞেস করে, মা আমার বাবা কই? রানী চোখের জল মুছে ছোট রাজপুত্রের কপোলে চুমি খেয়ে বলেন, তোমার বাবা একদিন ঘোড়ায় চরে টকবক করে ঐ গহিন জঙ্গল থেকে আমাদের নিতে আসবেন। তুমি বড় হও। রাজা ফিরে না এলে আমরাই তাঁকে খুজে আনবো। ছোট রাজপুত্র ঐ গহিন জঙ্গলের রহস্য বুজে উঠতে পারেন না। শুধু মাকে জরিয়ে ধরে থাকে আর বলে, মা আমি তোমায় খুব ভালবাসি।

৩১/০৫/২০১৬-যেদিন আকাশের মেঘমালা

Categories

 

যেদিন দেখবেন আকাশের মেঘ মালা আপনার জগতের কাছে শেষ বর্ষণ হয়ে আপনার পায়ের কাছে টাপুর টুপুর করে লাফিয়ে পরছে, যেদিন দেখবেন ঐ পাশের জঙ্গলের ভিতর অবহেলায় কোন এক রজনি গন্ধার সুবাস আপনার নাশারন্দ্রে ভেসে আসছে, যেদিন দেখবেন চারিদিকের মানুষ গুলো আপনাকে দেখে কোন কারন ছারাই আর আপনাকে সেই আগের মত করে দেখছে না কিন্তু মিটি মিটি করে হাসছে আপনার নতুন ভালোবাসার অববয়বে, যেদিন মনে হবে পৃথিবীতে আরও অনেক বছর বাচতে ইচ্ছে করবে, যেদিন মনে হবে পৃথিবীর সব রঙ সুন্দর, যেদিন মনে হবে আপনার হাসতে ভাল লাগে, কাদতে ভাল লাগে, একাকী বসে জানালায় পাখি দেখতে ভাল লাগছে, অথবা যেদিন দেখবেন চোখের জলের মধ্যে অফুরন্ত কষ্টের মাঝেও মন বড় উতালা হয়ে আছে কোন এক অস্পৃশ্য মানুষের জন্য, যেদিন দেখবেন সোনালী রোদ আপনাকে উদ্ভাসিত করে, যেদিন দেখবেন জোড়া শালিক না দেখেও আপনার মনে হবে এই বুঝি আজকে ও আসবে, সেদিন আপনার এই অপেক্ষার পালা শেষ হয়ে দেখবেন মাঘের পরে ঐ দিগন্তে দাড়িয়ে আছেন তিনি যাকে আপনি এতদিন ধরে খুজছেন। আপনার আর কোন কিছুর জন্যই কাউকে কিছুই বলার নাই। শুধু আপনি আর থাকবে বনলতা সেনের মত সেই মানুষটি, বলবেন তখন, ………এতদিন কোথায় ছিলেন? 

বলুন না কোথায় তাঁকে দেখেছেন প্রথমবার?

৩১/০৫/২০১৬- সন্ধার গল্প

৩১/০৫/২০১৬- সন্ধার গল্প

১ম পর্ব

মাঝে মাঝেই আমি তার চোখের কোনায় অশ্রু দেখতে পাই। মাঝে মাঝে আবার আমি তাঁকে অন্যমনস্কও হতে দেখি। নাম ধরে ডাকলে সে হটাত যেন কোন এক ভাবনার জগত থেকে সম্বিত ফিরে পেয়ে আতকে উঠে জিজ্ঞেস করে, কিছু বললাম কি? আমি যখন তাঁকে অনেক আদর করি, আমি যখন তাঁকে অনেক অনেক সপ্নের কথা বলি, তখনো দেখি তারমধ্যে কোথায় যেন একটা নির্বিকার ভাব। আমি যখন তাঁকে অতি আদরের সহিত আলিঙ্গন করে বুঝবার চেষ্টা করি কি হয়েছে তার, তখন বুঝি আখি তার আরও ভেজা, নিঃশ্বাস তার প্রবল ধীর, অথবা পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল মুক্ত পরিবেশের চেয়েও সে আরও চুপচাপ। মনে হয় মনের ভিতরের কোন এক ব্যাথায়  কান্নায় রুপান্তরিত হয়ে কান্নাটা আরও গভীর থেকে ঢেউয়ের মত উপচে পরছে আমার দুই কাধের শিরা দিয়ে, আমার বুকের চারিধার দিয়ে। 

ভয় হয় আমার, চিত্ত শঙ্কিত হয়ে উঠে কোন এক অজানা ভয়ে। নিজেকে প্রশ্ন করি, এমন কিছু কি আছে যা আমার কাছে নাই? এমন কি কিছু আছে যা আমি তাঁকে দিতে পারিনি অথচ সেটা তার অনেক দরকার অথচ সে মুখ ফুটে বলতে পারছে না? এমন কি কিছু আছে যা বলার জন্য সে বুকে সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছে না অথচ বুক ব্যাথায় টনটন করছে? এমন কি কিছু হচ্ছে যা মানতে হচ্ছে অথচ মানা যাচ্ছে না? অনেক অজানা প্রশ্ন জাগে মনে। মাঝে মাঝে নিজেকে বড় দোষী মনে হয়। 

অনেক প্রশ্ন করেছি আমি তাঁকে। উত্তরে কখনো শুধু তার নির্বিকার আর নির্লিপ্ত চোখ আবারো জলে ভেসে গেছে, অথবা আরও নির্লিপ্ত হয়েছে বোবা এক অশরীরী জিবের মত। আবার কখনো উচ্ছল তরঙ্গের ন্যায় আমাকে অভাবিত এক ধাক্কায় নিমিষে ‘কিছুই না’ বলে ধর্তব্যের মধ্যেই বিষয়টি পরে না বলে তা উরিয়ে দিয়েছে। তারপরেও আমি তাঁকে পুনরায় সেই আগের মতই দেখেছি বারংবার, নির্লিপ্ত, ভাবলেশহীন নিথর কোন এক পাথরের মত।

আজ তার কথা শুনে শুধু তারই না, আমারও চোখ ভিজে এল শ্রাবনের ধারার মত।………

” আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। আমার বয়স তখন তের কি চৌদ্দ। সবে মাত্র স্কুল পাশ করে হাই স্কুলে পা রেখেছি। …………….(চলবে)

২য় পর্বঃ

” আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। আমার বয়স তখন তের কি চৌদ্দ। সবে মাত্র স্কুল পাশ করে হাই স্কুলে পা রেখেছি। প্রতিদিন আমি স্কুলে যাই চোখের কোনায় অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখি, অনেক বড় হওয়ার আশা নিয়ে আমি দুরু দুরু পায়ে স্কুলের দিকে হেটে চলি। আমি কখনো স্কুল কামাই করেছি এমন রেকর্ড আমার ছিল না। আমার গন্ডি শুধু স্কুল আর আমার পরিবার, আমার ছোট্ট সে ঘর, যেখানে আমি বাস করি আমাকে নিয়ে আর আমার সাথে থাকে আমার ছোট ছোট কয়েক ভাই বোন।বেশ ভালই কাটছিল আমাদের সংসার।

একদিন আমি স্কুলে ক্লাসে স্যারের পড়া নিয়ে অনেক জটিল অংকের ফরমুলা নিজের মাথায় আটিসাটি করে বুঝার জন্য যখন অনেক মগ্ন, তখন হটাত করে আমার বাবা আমার ছোট ভাইকে দিয়ে স্কুলে খবর পাঠালেন বাড়ীতে যেতে হবে। মনে ভয় হল, কি হয়েছে বাড়ীতে? কারো কোন দুসসংবাদ নাতো? গুটিগুটি পায়ে ছোট ভাইয়ের হাতধরে কাছেই আমার বাড়ীতে পৌঁছে দেখি দলবেধে অনেকলোক আমাদের বাড়ীতে বসে কেউ পান খাচ্ছেন, কেউ আবার খোশ গল্প করছেন। মনটা যে অজানা ভয়ে এতক্ষন সংকিত ছিল তা আর রইল না। খারাপ কিছু হয় নাই তাহলে। কিন্তু আমি অনেক বোকা। আমার জানা ছিল না যে, আমার জন্য আরও কঠিন একটা সংকাজনক অধ্যায় অপেক্ষা করছিল।

আমি বাড়ীতে পা রাখতেই মনে হল, আমাকে নিয়ে যেন সবার একটা বাড়াবাড়ি, সবাই কি নিয়ে যেন কানাঘুষা করছে, মিটিমিটি হাসছেও। কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অথচ আমি তাদেরকে চিনি না, কেউ আবার আমার গালে হাত দিয়ে একটু আলতো করে টিপে দিয়ে বলছে, বাহ কি সুন্দর দেখতে। ইত্যাদি। মাকে বললাম, মা এরা কারা? মা মুচকি মুচকি হেসে দিয়ে বললেন, মা, তোমাকে ওরা দেখতে এসেছে। তাদের ছেলের জন্য।

নিমিষের মধ্যে আমার বুকের চারিপাশটা একটা ওসয্য যন্ত্রনায় আমাকে মুচড়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমার পায়ের তল থেকে সবগুলো মাটি একসঙ্গে সরে যাচ্ছে। আমার চোখ সামনের কিছুই দেখছে না, সব ঝাপসা মনে হচ্ছে। মাকে বললাম, মা আমার পরাশুনা?

মা শুধু বললেন, দেখরে মা, আমরা অনেক বড়লোক নই। আমাদের এতো পরাশুনা করে কি হবে? কে আছে আমাদের? নিজেকে বড় অসহায় মনে হতে লাগলো। আমার বুকে জগদ্দল পাথরের মত একটা বিশাল পাথর এমনভাবে চেপে বসলো যে মনে হল আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কেউ আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চাচ্ছে। আমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমি দুর্বল নই কিন্তু আমি এখন প্রতিবাদ করার মত সাহস ও আমার নাই কিন্তু এটা বুঝতেছিলাম যে, আমাকে এই রাহু গন্ডি থেকে বের হতে হবে যে কোন উপায়ে।

লোকজন আমাকে দেখে গেলো। আমাকে নাকি খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। এই কথার মধ্যেই তারা যাওয়ার সময় আমার বাবা মাকে বলে গেলেন, অচিরেই সম্ভাব্য সব কিছু তারা করে ফেলতে চান। শুভ কাজে নাকি বিলম্ব করতে নাই। কি আমার ভাগ্য। আমি কি চাই, আমার কি স্বপ্ন আর আমাকে নিয়ে সবাই কি স্বপ্ন দেখছে। নিজেকে মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে আমি ভগবানের কাছে অনেক কাদলাম সেই রাতে। আমার ভাল ঘুম হয় নাই। যেটুকু ঘুম আসে, শুধু দেখতে পাই চারিদিকে মানুষগুলো আমাকে ঠাট্টা তামাশা করছে, আর দেখতে পাই আমার সেই সখের স্কুল বেঞ্চ গুলো যেখানে আমার অনেক সপ্নের কথা লেখা আছে আমার কাঠ পেন্সিলের দাগে দাগে।

রাত পোহাতেই আমি বাবাকে বললাম, বাবা, আমাকে তুমি এখন বিয়ে দিও না। আমি পরতে চাই। বাবা খুব সহজ সরল মানুষ। কোন কিছুই অনি কারো উপর জোর করে চাপিয়ে দেন না আবার কেউ তার উপর কেউ কিছু জোর করে চাপিয়ে দিলেও তার প্রতিবাদ করতে শিখেন নাই। অনেক্ষন চুপ করে দাড়িয়ে থেকে বাবা বললেন, আচ্ছা দেখি আমার এক খুব পরিচিত আপন জন আছে তার কাছ থেকে আমি শলা পরামর্শ করে জানাবো। তিনি আমাদের পরিবার কে খুব ভাল করে চিনেন আর খুব জ্ঞ্যানি মানুষদের মধ্যে একজন।

বললাম, তাহলে আমাকেও নিয়ে চল।

বাবা তাই করলেন। ভদ্রলোক খুব বেশি বয়সের নন। খুব বেশি হলে হয়তবা সাতাইশ কি ত্রিশ বছরের হবেন। অসম্ভব ধিরস্থির মানুষ। অনেক লেখাপড়া করেন তার বইয়ের স্তর দেখলেই বুঝা যায়। হাতে চমৎকার একটি সোনালী রঙের ঘড়ি, তার বসার ঘরটাও বেশ সাজানো।

বাবাকে দেখেই বললেন, কি চাচা কেমন আছেন? হটাত কোন আগাম বার্তা না দিয়েই কি জন্য চলে এলেন? আমার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন, কি নাম তোমার?

এমন করে নাম টা জিজ্ঞেস করলেন যেন তিনি আমাকে আরও কয়েকবার দেখেছেন কিন্তু এখন আর মনে করতে পারছেন না।

তিনি আর কেউ নন, তিনি সেই আপনি।

আমার বিয়ের কথা শুনেই আপনি আমার বাবাকে এমন করে ধমক দিলেন যে, আমার বাবার আর কোন বিকল্প পথ ছিল না আপনার কথার বাইরে কিছু করেন।

আমার আবার স্কুলের দরজা চালু হয়ে গেল। খুব ভাল লেগেছিল আপনাকে। পায়ে ধরে আপনাকে আমার সালাম করতে ইচ্ছে করেছিল সেদিন। তারপরের কাহিনী আপনি আর জানে না। কারন সবাই ধরে নিল, আপনাকে দিয়ে আমাদের বাড়ীর আর যাই হোক বেশি উপকার হবে না কারন আপনি একাই সব সিদ্ধান্ত পাল্টে দিতে পারেন, সে ক্ষমতা আপনার আছে ছিল এবং সেটা আমি দেখেছি।

 দিন যায় মাস যায়, আমি তখন মেট্রিক পরীক্ষার ছাত্রী। ইতিমধ্যে অর্ধেক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আর মাত্র দুইটা পরীক্ষা বাকি। ভাল পরীক্ষা হচ্ছে। তারপরেই আমি কলেজে ভর্তি হয়ে যাব। নতুন স্বপ্ন, নতুন দিগন্ত, নতুন ইচ্ছা। ঠিক পরীক্ষার আগের দিন সকাল হতে না হতেই আবার আরেক নতুন দল এসে হাজির আমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমার সারা শরীর ভয়ে হিম হয়ে আসছিল, একটু পরে আমার পরীক্ষা। যাকেই বলি, সে ই বলে, পরীক্ষা দিতে যেতে হবে না। ভাল পাত্র, সারা বছর ঘরের ধানের ভাত খায়। বাড়ীতে পাকা বিল্ডিং আছে। কত কিছু। আমি ঈশ্বরকে শুধু ডাকলাম। আমার মাথা কোন কিছুতেই কাজ করছিল না। কি হবে আমার পরীক্ষার, কি হবে আমার জীবনের? কেন কেউ আমাকে একটুও বুঝতে চাইছে না? আমার চোখ ভোরে শুধু কান্না পাচ্ছিল।

আমার শুধু আপনার কথা মনে হচ্ছিল সারাক্ষন। কিন্তু আমার কাছে না আছে আপনার কোন নাম্বার, না আছে কোন মাধ্যম যোগাযোগের।

মানুষ যখন খুব অন্তর দিয়ে ঈশ্বর কে ডাকে তিনি তার সারা দেন। আমি বাথ রুমের নাম করে কোন কাপড় চোপর না পাল্টিয়ে জুতা ছেড়ে খালি পায়ে সোজা পিছনের দরজা দিয়ে দৌর আর দৌর দিতে থাকলাম। আমার লক্ষ ঐ পরীক্ষার হল। যে করেই হোক আমাকে ই পরীক্ষার হলে পৌঁছতে হবে। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আমি যখন পৌঁছলাম, তখন ইতিমধ্যে দের ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। আমাকে দেখে আমার সব শিক্ষকরা এতটাই অবাক হলেন আর আমার চেহারা, চোখের পানিতে ভেজা আমার নয়ন দেখে তারা এতটাই উদ্বিগ্ন হলেন যে, আমাকে অন্তত আদর করে প্রধান শিক্ষকের রুমে নিয়ে পরীক্ষা তা দেওয়ার সুযোগ করে দিলেন।

আর ওদিকে আমাকে কোথাও না পেয়ে আমি পলায়ন করেছি এই মর্মে সবাই আমাকে প্রচন্ড দোষারোপ করতে কেউ একটুও পিছপা হলেন না। পরীক্ষা দিয়ে আমি আর আমাদের বাসায় ফিরে না গিয়ে আমার এক বন্ধুর বাসায় দুই দিন থেকে পরিক্ষাটা শেষ করলাম। মনে হল অন্তত একটা ধাপ তো পার করলাম?

এবার শুরু হল আরেক নতুন বিপদ। পরীক্ষার ফল বের হয়েছে কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাকে কলেজে ভর্তি করতে নারাজ কারন আমার পরিবারের কেউ আমাকে আর পরাবেন না এবং অন্যত্র বিয়ের ব্যবস্থা করছেন এই মর্মে কলেজ কর্তৃপক্ষকে সাফ জানিয়ে রেখেছেন। যাতে আমার কোন ভর্তি না করানো হয়। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হল। আজ মনে হল, আমি অসহায় নই আমি মানুষের অত্যাচারের কাছে জিম্মি। আমিও সেদিন শপথ করেছিলাম, আমি আমার ইচ্ছাকে অকালে মৃত্যু বরন করতে দেব না। কিন্তু কিভাবে? খুব খুজেছি আমি আপনাকে। কত জায়গায় যে আমি আপনাকে খুজেছি, কত মানুষের পিছন থেকে চেহারা দেখে মনে হয়েছে এই বুঝি আপনি। কত দিন যে আমি ঐ রাস্তার ধারে অপেক্ষা করেছি যদি কোনদিন আপনি ঐ রাস্তায় কখনো আসেন। আপনি কখনো আসেন নাই।

আমি এই ভাবে কতবার যে আমার সেই অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ের আসর ভেঙ্গে বার বার পলায়ন করেছি তার কোন ইয়ত্তা নাই। আর এভাবেই আমার মনে বিয়ে নামক জিনিসটা একেবারে বিরক্ত আর ঘৃণায় ভোরে গেলো। কেউ আমাকে দশ ভরি সোনা দেবে, করো বিয়া, কেউ আমাকে দুই লাখ টাকার কাবিন করবে , তো করো বিয়া, কেউ আবার আমাকে রাজ রানী করে রাখবে, করো তাঁকে বিয়া, কেউ আবার একেবারে বকলম কিন্তু চেহারা সুন্দ, তো করো তাঁকে বিয়া। কি এক অসজ্য যন্ত্রণায় আমি আর পেরে উঠতে পারছিলাম না। তারপরেও আমি আমার সাথে প্রতারনা করতে পারিনি। আমি কলেজের পড়াটাও শেষ করতে পারলাম।

গল্পটা এখানেই শেষ নয়, মাত্র শুরু…

তারপর ……। (চলবে) 

৩য় পর্ব 

কলেজের কেউ আমাকে ভর্তি করছে না। যখনই যাই, তখনই শুনি হয় অমুক স্যার নাই, আজ হবেনা, পরের দিন গেলে বলে আজ ফর্ম নাই, দুইদিন দেরি হবে। আবার যাই, তো শুনি ঐ কাগজ লাগবে তো ঐ কাগজ লাগবে। অনেক বিরম্বনা। মনে হল, কোথায় যেন কি ঠিক নাই। কলেজে ভর্তি হতে কি এমন হয়? তাহলে অন্য সব ছেলেমেয়েরা কি করে এতো সহজে ভর্তি হতে পারল? অথচ আমার বেলায় হচ্ছে না কেন? মন টা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছিল প্রতিদিন। প্রায় প্রতিদিন যাই, আর প্রতিদিন ই মন খারাপ করে ফিরে আসি। একদিন আমার এক ম্যাডাম আমাকে কাছে ডাকে নিয়ে বললেন, শুন সন্ধ্যা, তুমি এই কলেজে ভর্তি হতে পারবেনা কারন কয়েকদিন আগে এখানকার নেতা গোছের একলোক এসেছিল আমাদের কলেজে। এসে বলে গেছে তোমাকে সে ভালবাসে, তোমার সাথে ওর বিয়ে হবে, আর তাই তোমাকে আর তারা পরাতে চায় না। তাই কলেজ থেকে কেউ সাহস করছে না তোমাকে ভর্তি ফর্ম দিতে। আমি যে তোমাকে এ কথাগুলো বললাম, তুমি আমার নাম বল না। যদি সত্যি সত্যি ভর্তি হতে চাও, এমন কাউকে নিয়া আস যাকে এই সব লোকেরা ভয় পায়।

মনটা আমার এতো খারাপ হয়ে গেলো যে, আমার দুচোখ দিয়ে শুধু পানি পরতে লাগলো আর আমার বাবা মার উপর রাগ হতে লাগলো। আমার বাবা বা মা কি কখনোই আমাকে বুঝার চেষ্টা করবে না? আমি কি এতই বোঝা হয়ে উঠেছি তাদের উপর? নিজের কাছে নিজেকে একটা অমানুষ মনে হল আমার। আমার প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো। মনে মনে ভাবলাম, কে আছে এমন যে এই কঠিন একটা বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করতে পারে? আমি আমার জগতের সব আনাচে কানাচে সমুদের সুই খোঁজার মত করে খুজতে লাগলাম, কে আছে এমন সেই ব্যাক্তি? আমাদের কেউ আত্মীয়? বা আমার কোন পরিচিত মানুষ? নাহ, আমি কোথাও ভরসা করার মত কাউকে খুজে পেলাম না। আর যার কথা আমার বহুবার মনে হয়েছে সে আপনি। যখনই আমি কোন বিপদে পরি, আমি শুধু আপনার নামটাই মনে করি। আর ভাবি, কোথায় এই লোকটাকে পাব? আমি তো তার কোন সন্ধান জানি না। সন্ধান যে করি নাই তা নয়।

আমি আপনার অফিসে অনেকবার এসেছিলাম একা একা। কয়েকবার। কিন্তু আমার কি কপাল, কখনোই আমি আপনার নাগাল পাই নাই। হয় আপনি এইমাত্র বের হয়ে গেছেন না হয় ঐদিন আপনি অফিসেই আসেন নাই। ফিরে যেতে যেতে আমি শুধু কেদেছি আর ভেবেহি, আমার কি কেউ নাই? আপনার উপর আমার অহেতুক খুব রাগ হত। মাঝে মাঝে আমি আপনার উপর খুব অভিমান করতাম। মাঝে মাঝে আমি আপনার কাছে মিথ্যা মিথ্যা চিঠি লিখতাম আবার ছিরে ফেলতাম। কেন জানি মনে হত, আপনাকে আমার খুব দরকার। কলেজের ভরতির দিন প্রায় শেষ হয়ে আসছে। এমন সময় আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। সবাইতো আপনাকে চিনে। আর সবাই আপনাকে যে মানে এটা আমি জানতাম। আমি কম্পিউটারে কম্পোজ করে প্রিন্সিপ্যালের নামে একটা চিঠি লিখলাম আপনার নাম দিয়ে। যেখানে বলা ছিল যে, একজন ছাত্রীকে পাঠালাম, আপনার কলেজে ভর্তি করিয়ে নেবেন। বিস্তারিত পরে আলাপ  ইতি আপনার নাম।  

মধুর ন্যায় চিঠিটা কাজে লাগলো। আমি তো অবাক। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব শুধু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আপনাকে কেমন করে চিনি। আমি বেশি কথা না বলে শুধু বললাম, আমি তার আত্মীয়। ঠিক ঐ মুহূর্তে আমি যেন তার কাছে অতি ভক্তির একজন লোক হয়ে গেলাম। আমার ভর্তি হয়ে গেলো। মনটা তৃপ্তিতে ভরে উঠল, আমাদের পরিবারের কেউ জানল না যে আমার কলেজে ভর্তির সব কিছু হয়ে গেছে।

এতদিন যে অভিমান তা আপনার উপর আমার ছিল আজ যেন তা এক ভালবাসায় রূপ নিল। আমার বড্ড ভাল কাটল দিনের বাকি অংশটা। একটা মানুষের মিথ্যা এক খানা চিঠি এতো কাজ করে, তা আমার জানা ছিল না। কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না আসলেই এই চিঠি তার লেখা কিনা। হয়ত কারো মাথায় এটা আসেই না যে, কেউ তার নামে মিথ্যা একটা পত্র নিয়ে এমন জালিয়াতি করতে পারে। আর হতেও তো পারে চিঠিটি অনিই লিখেছে। জিজ্ঞেস করলে যদি আবার তিনি মনে কিছু করেন, তাই হয়ত কেউ জিজ্ঞেস করার সাহসই হয় নাই। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটলো।

কলেজ শুরু হতে হতে কয়েক মাস বাকি। এরমধ্যে আমি কদিন পরপরই বিয়ের সাজে বসি আর আমার সাধ্যমত বিয়ে ঠেকাই। কখনো কান্নাকাটি করে, কখনো বাড়ি থেকে পালিয়ে, আবার কখনো অত্যন্ত বাজে ব্যবহার করে আবার কখনো বড় কে নাজেহাল করে। কি যে এক পরিস্থিতি আমার। এরই মধ্যে গ্রামে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। আমাদের বাড়ীর পাশে প্রিয়াংকা নামের একটি মেয়েকে জোর করে বিয়েতে রাজি করানোর কারনে রাতে কাউকে না বলে সে আত্মাহুতি দিয়ে লিখে গেলো, ……আমি পরতে চেয়েছিলাম, আর তোমরা আমাকে পরতে না দিয়ে বিয়ে দিতে চেয়েছিলে। আমিই যদি ভাল না থাকি তাহলে আমার বিয়ে দিয়ে তোমরা কি সুখে থাকবে? তাই আমি তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে একেবারে সবার থেকে দূরে চলে গেলাম। তোমরা ভাল থেক। তোমরা আমাকে কেউ ভালবাসনি।”

ঘটনাটা গ্রামের চারিদিকে এতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যে, আমি এই ফাকে কিছুদিন যত পদের বিয়ের আয়োজন ছিল তা বন্ধ রইল। শুধু তাই নয়, গ্রামে একটার পর একটা যুবতি মেয়েদের সংসার শুধু ভাঙতে শুরু করল। কেউ স্বামীর অত্যাচারে, কেউ যৌতুকের অত্যাচারে, কেউ শ্বশুর বাড়ীর অত্যাচারে, কেউ অন্য কারনে। আমার ক্লাসে পরত এমন চেনা কয়েক জন স্বামীর ঘর ছেড়ে একেবারে বাপের আগের আস্তানায় ফিরে এল। কেউ সঙ্গে বাচ্চা নিয়ে কেউ আবার একা। বাল্য বিবাহের অনেক দোষ। কনে জানে না কি করে সংসার রক্ষা করতে হয় আবার বরের পক্ষ জানে না এই নিষ্পাপ কনেকে কিভাবে নিজের বাড়ীতে নতুন একজন আদুরে সদস্য করে মানিয়ে নিতে হয়। কেউ ছাড় দেয় না।

আমি আমার কলেজের পরাশুনা চালাতে লাগলাম। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার শুরু হল, সেই পুরানো উপদ্রব। বিয়ে কর আর বিয়ে কর। আমি এই বিয়ে নামক ঘটনাটা আমার মাথায় একটা বিষ ফোড়ার মত ঘুরতে লাগলো। বিয়ে জিনিস টা আমার কাছে এখন আতঙ্কের মত মনে হতে লাগলো। কি হবে এ রকম বিয়ে করে যেখানে একটা মেয়ে তার নিজের কোন দাম নাই, তার নিজস্ব কোন সত্তা নাই? 

বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি এইবার লাগামহীন ভাবে শক্ত হয়ে গেলাম। আমি বিয়ে করব না, আমি জীবনেও বিয়ে করব না এই প্রতিজ্ঞা সবাইকে জানিয়ে দিলাম। আর মনে মনে ভাবলাম, আমি আসলেই বিয়ে করব না।

পরীক্ষার ঠিক কয়েকদিন আগে আমার বড় জ্যাঠা আমাকে এইবার বিয়ে দিয়েই ছারবেন বলে মনঃস্থির করলেন। বাবাকে খুব অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করলেন। বাড়ীর অন্যান্য মানুষগুলো যেন শিকা ছিরে দই পরলে যেমন কুকুর আনন্দ করে ঠিক তার মত মনে হল। আমি ঠায় আমার রুমে দরজা বন্ধ করে বসে রইলাম। আমি কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম ঠিক বুঝতে পারি নাই। হটাত একটা অদ্ভুত শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। দরজার খিল খুলতেই দেখি আমার জ্যাঠা, কাকি, মামি সবাই দরজার সামনে দাড়িয়ে। কাজি এসেছে, আজকেই আমার বিয়ে। আমার আর কোন কিছুই সয্য হচ্ছিল না। নিপীড়নের একটা সিমা থাকে। ওরা সবাই অত্যাচারের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে।

কিছুই বললাম না। আমি জানি এখন আমার কথা কেউ শুনবে না। বাড়ীতে বিয়ের সরঞ্জামাদি চলতে থাকল, পান পাতা দিয়ে ঢালি সাজানো হল, মাছ, দাব, ফল মুল কত কিছু সব তৈরি করা হল। আমি জানি না কে আমার বড়, কোথায় আমার বিয়ে, ছেলে কি করে। আমাকে কোরবানির পশুর মত ঝাপ্টে ধরে গায়ে হলুদের জায়গায় নিয়ে বসান হল। আমার গায়ে হলুদ হয়ে গেলো। সারা শরীরে হলুদের গন্ধ। মনে হচ্ছে মরা মানুষের গায়ে থেকে যেমন গন্ধ আসে, আমার গায়ে হলুদের গন্দে যেন আমার তাই মনে হচ্ছিল। প্রতিটি মুহূর্তে আমি আমার জীবনের কি হতে যাচ্ছে তা কল্পনা করেও কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। আর ভাবছিলাম কি করে এখান থেকে পালানো যায়। আমি শান্ত হয়ে বসে ছিলাম কিন্তু ভিতরে আমার অশান্ত ঝড় চলছে। আমাকে শান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে বাড়ীর সবাই মনে করল, আজ আমার কোন সমস্যা নাই। আমি সব কিছুতেই সহজ করে মেনে নিয়েছি। আর এই সুযোগ টাই আমি নিতে চেয়েছিলাম। আমি বিয়ের আসর থেকে পলাইলাম।

আমার কেউ নাই। কোথায় যাব, কার কাছে যাব। শেষ পর্যন্ত আমি আমার নানিদের বাসায় নানিকে আমার সমস্ত কষ্টের কথা বললাম। নানি আমাকে তাদের ছোট একটা জায়গায় সারাদিন বন্দি থাকতে বললেন আর আমিও তাই করলাম। ছেলেপক্ষ মেয়েকে না পেয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, অনেক আজেবাজে অপবাদ দিয়ে, চরিত্রের সবগুলো কালিমা লেপন করে যা মনে আসে তাইই বলে একেবারে বিদায় নিলেন। আমি পনের দিন পর ঐ গোপন আস্তানা থেকে বের হলাম। কোথায় ছিলাম, কার সঙ্গে পালিয়েছি, কেমন করে পালিয়েছি তার অনেক বিস্তারিত ইতিহাস অনেকেই জানতে চাইলেও আমি আর ঐসব নিয়ে কথা বলার কোন রুচি মনে করি নাই।

কোন রকমে কলেজ পাশ করেছি। এইবার তো আমার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পালা। কিন্তু এটা তো আর আমাদের গ্রামের কলেজের মত নয় যে আবারো আমি আপনার নাম ভাঙ্গিয়ে সরাসরি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাব। এটা আমার জন্য বিশাল পাহারের মত মনে হল। কাউকেই কিছু বলার অবকাশ নাই, কেউ যে আমাকে একটা উপদেশ দিবে সেই মানুষটিও নাই। অথচ আমার কাউকে খুব দরকার। তারপরেও মনে হল, আপনাকে আমি খুজে বের করবই। আপনিই পারবেন এখন আমাকে এই স্থূল এবং বিরাটকায় সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু কোথায় আপনি?

ভাগ্য যখন সুপ্রসন্ন হয়, ভাগ্যদেবি তখন ঘরে পদার্পণ করে। কি আশ্চর্য, গ্রামের চারিদিকে একটা খবর ব্রেকিং নিউজের মত ছরিয়ে পড়ল। আপনি গ্রামে আসবেন। গ্রামের কার কি লাভ হবে আমি জানি না, কিন্তু আমি ঈশ্বরকে এই বলে কত যে প্রনাম করলাম যে, এইবার আমি আপনার সঙ্গে দেখা হবেই।

আপনি আমাদের গ্রামে এলেন এবং খুব ঘটা করেই এলেন। চারিদিকে পোস্টার, চারিদিকে চিঠি বিলি, আপনি আসছেন। গ্রামের কত লোক যে আপনার আসার অপেক্ষায় আছে। কেউ অপেক্ষায় আছে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, কেউ অপেক্ষায় আছে রাজনৈতিক লাভের জন্য, কেউ অপেক্ষায় আছে শুধু আপনাকে ভালবাসে বলে। আমিও তাদের মধ্যে একজন। মনে হল, আমি আপনাকে কত যুগ ধরে চিনি, কত কাছ থেকে চিনি অথচ আপনি আমাকে কখনো মনেও রাখেন নাই।

আপনি এলেন। সঙ্গে কত লোক আপনার। সারিসারি গাড়ি। কেউ নোট বই, কেউ ছাতা ধরা, কেউ আবার আপনার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য এক মুহূর্ত অপেক্ষা। আমি ঠায় দাড়িয়ে আছি ঐ সভাস্থলে। কখন আমি আপনাকে পাই।

আপনার কাজ শেষ। খাওয়া দাওয়া শেষ। আমার বুকের ভিতর কম্পন হচ্ছিল এই বুঝি আমি এতদিনের অপেক্ষার পালাটাকে হারিয়ে ফেলতেছি। আমার বুকে তখন দুরুদুরু কম্পন কিন্তু আমাকে যে পারতেই হবে। সাহস করে আমি আপনার একেবারে কাছে চলে এলাম। আপনি আমাকে দেখলেন। কাছে ডাকলেন। আমার বুক তখন ভুমি কম্পনের মত কাপছে।

আনার চোখে চোখে আমার চোখ পড়ল। আমি মুষড়ে যেতে থাকলাম। আপনি জান্তেও পারলেন না আমার ভিতরে কত বেগে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। আমার দিকে কিছুক্ষ তাকিয়ে থেকে নিজ থেকেই আমাকে ডেকে বললেন, কোথায় যেন আমি তোমাকে দেখেছিলাম?

আমার দুচোখ ভরে শুধু পানি শ্রাবনের ধারার মত ঝরতে লাগলো। আমি বললাম, আমি আপনার অমুক চাচার মেয়ে।

ও আচ্ছা, হ্যা তুমি তো একবার আমার কাছে গিয়েছিলে? কি করছ এখন? কোথায় পরাশুনা করছ? আর তুমি কাদছ কেন?

আমি শুধু কম্পিত গলায় এইটুকু বলতে পেরেছিলাম, আমি পরতে চাই, আমি বিয়ে করতে চাই না। অসংখ্য মানুষের ভিরে আমি কি বলেছি আর কি বলতে চেয়েছি, আমার মনে নাই। অনেক বার আমি বাড়ীতে একা একা কি বলব তা নিজে থেকে অনুশিলনও করেছিলাম কিন্তু সেই অনুশিলন কিছুই কাজে লাগে নাই আপনার সামনে এসে। সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। আমি মাথা নিচু করেছিলাম। বুদ্ধিমান মানুষদের সবকথা বলতে হয় না। আপনি এই দুই কথায় আমার অনেক কথার উত্তর যেন পেয়ে গেলেন। আপনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ঠিক আছে, আমি তোমার সঙ্গে পরে কথা বলব। আপনি আমাকে আপনার ফোন নাম্বারটা দিলেন। কি অদ্ভুদ আমার শিহরন। আমার মনে হয়েছিল, আমাকে আজ পর্যন্ত এই ভাবে কেউ ছুয়ে দেয় নাই। আমাকে আজ অবধি কেউ বলে নাই, ঠিক আছে আমি তোমার কথা শুনব। আজ মনে হল, আপনি আমাকে ছুয়ে দিয়েছেন, আমাকে আদর করেছেন, আমাকে শুনবেন এই আশ্বাস দিয়েছেন। একটা ফোন নাম্বার আর কিছুই না। আমি আপনার ফোন নাম্বার টা যে কতবার লিখেছি, আপনার নাম টা যে আমি কতবার লিখেছি। আমি সেই রাতে ঘুমুতে পারি নাই। শুধু আমার কাছে ঐ যে শিহরন, ঐ যে স্পর্শ, ঐযে চোখের চাহনি, আমাকে অনেক অনেক রাত অবধি জাগিয়ে রেখেছিল। আমি কি আপনাকে ভালবাসি? আমি কি আপনাকে দেবতা বলে জানি? আমি কি কারনে আপনাকে এক মুহূর্তে জন্য ও ভুলতে পারছি না? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? আমি কি কোন অলিক কিছু ভাবছি? আমার বাবা মা, জ্যাঠা, গ্রামের অনেকেই আমার এই অসভ্যতা পছন্দ করে নাই। আমাকে টার জন্য অনেক যন্ত্রনা সজ্য করতে হয়েছে বেশ কয়েকদিন। গ্রামের মানুষ অন্য সব কিছু ফেলে দিয়ে যেন আমার এই ঘটনাতাই আলাপের বস্তু হয়ে দারিয়েছিল। আমি তাতে কিছুই মনে করি নাই। পৃথিবীতে এতো মানুষ, চারিদিকে এতো জন মুখর পরিবেশ, কিন্তু কাউকে কিছু বলবার মত মানুষ পাওয়া বড়ই দায়।

৪র্থ পর্ব 

আমি আপনার ফোন নাম্বার পেয়েছি কিন্তু আমার কোন ফোন নাই। তাই আমি একদিন অনেক সাহস করে পাশে বাজারের এক ফনের দোকান থেকে আপনার নাম্বারে আমি ফোন দিলাম। আমি জানি না ঐ সময়ে আপনাকে ফোন দেওয়া ঠিক ছিল কিনা। অনেক্ষন রিং হল কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ আমার ফোনটা ধরল না। মনে মনে একটা কি ধরনের যেন ভয়-কম্পিত অনুভুতি কাজ করছিল আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু ফোনটা না ধরাতে আবার মনে হল, ভালই হয়েছে।

তারপরের দিন আবার আমি আপনাকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আপনি এবারও ফোন ধরলেন না। প্রথমদিন ফোন না ধরাতে বিশেষ কিছু মনে হয়নি কিন্তু দ্বিতীয় দিন ফোন না ধরাতে আমার কাছে ব্যাপারটায় একটু খটকা লেগেছিল। আমি আবারো ফোন দিয়েছিলাম। অনবরত রিং হচ্ছে কিন্তু পাশে কি কেউ নাই যে ফোনটা ধরে?

এইভাবে আমি আপনাকে দিনের পর দিন অন্তত প্রতিদিন একবার করে ফোন করতে লাগলাম আর বিফল মনোরথে বাড়ীতে ফিরে এলাম। বাজারের ফোনের দোকানদারও একটু বিরক্ত হতে শুরু করলেন। কাকে ফোন দিচ্ছেন যে ফোন ধরে না সে? আমি দোকানদারকে কিছুই বলতে চাইনি কাকে ফোন দিচ্ছি। কারন নাম বললেই দোকানদার তাঁকে চিন্তে পারবে।

এমন করে প্রায় দু সপ্তাহ পার হয়ে গেলো। একদিন দোকানদার আমাকে একটা পরামর্শ দিলেন।

‘দেখুন, এমনও হতে পারে যে তিনি অপরিচিত নাম্বার ধরেন না। তার থেকে একটা এসএমএস করে দিন। ধরলেও ধরতে পারে।

ব্যাপারটা খুব কাজে লাগলো। আমি সংক্ষিপ্ত একটা এসএমএস দিলাম, “আমি সন্ধ্যা, অমুক চাচার মেয়ে”।

ম্যাসেজটা বুলেটের মত কাজ করল। ঠিক কয়েক মিনিটের মধ্যেই আপনি আমাকে ফোন করলেন ঐ বাজারের নাম্বারে। আমি আপনার ফোন পেয়ে আত্তহারা হয়ে গেলাম। এই যে গত কয়েকদিন আমি আপনাকে চেষ্টা করেও পাচ্ছিলাম না, তার সবগুলো কষ্ট আমার এক নিমিষের মধ্যে শেষ হয়ে গেলো।

মনে হল আপনি ব্যাস্ত ছিলেন। আমাকে শুধু বললেন, আগামি অমুক দিন তুমি আমার অফিসে এতটার মধ্যে চলে আস। আমি থাকবো।

আমি আপনার অফিস চিনি। কিন্তু জানি নাই কখন আপনি অফিসে থাকেন। এবার আর মিস হবে না আমি জানি। আমার চিত্ত বিকশিত হয়ে উঠল। দোকানদারকে আমি অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, ভাই, অনেক উপকার করলেন।

আমার আর দিন কাটে না, রাত কাটে না। কবে আসবে সেইদিন। আমি যাব আপনার কাছে। দেখা হবে আপনার সাথে। কথা হবে মুখুমুখি বসে। আমার যত কথা, সব বলব আপনাকে। পারবো তো? (চলবে)

৫ম পর্ব

নির্দিষ্ট দিনটি অবশেষে এলো। খুব ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেছি। আকাশটা আমার মনের মতো ফুরফুরা নয়, একটু মেঘলা। যে কনো সময় ঝুপ করে বৃষ্টি হতে পারে। আমি আমার সব গুলি কাজ যথাসময়ে শেষ করে কাউকে কিছুই না বলে নিজের মতো করে সকাল সকালই বের হয়ে গেলাম। ছাতাটি সঙ্গে নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু যখন পুনরায় মনে হলো, তখন আমি বাড়ী থেকে অনেক দূর হেটে চলে এসেছি। ফিরে গেলে হয়ত দেরী হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় আর ছাতার জন্য ফেরা হল না।

প্রায় আধাঘন্টা ধরে আমি একটা রিক্সায় চড়ে আমি আপনার অফিসের সামনে এলাম। আজ আর আপনাকে না পাওয়ার আশংকা আমার ছিলো না। আমি আজ আপনাকে পাবো, সেটা আমার মন নিশ্চিত ছিলো। আমি আপনার অফিসের গেটে …………(চলবে)

৩০/০৫/২০১৬-সপ্তাহের সাত দিন

Categories

 

ভগবান যদি সপ্তাহের সাত দিনই মানুষের জন্য শুধু আনন্দ অথবা শুধু কষ্টের জন্যই বরাদ্ধ করতেন, তাহলে মানুষের জীবনটা হয়ে যেত এক চরম দুর্বিষহ। আর তাই সব রবিবার একরকম নয়, সব মঙ্গলবারও একরকম নয়। কোন কোন শনিবার সুখের বার্তা নিয়ে আসে আবার কোন কোন মঙ্গলবার অনেক কষ্টের বার্তাও নিয়ে আসে। বর্ষার কোন এক শনিবার যেমন মেঘলা নাও হতে পারে আবার শীতের কোন এক শনিবার চরম বৃষ্টিপাতে ধরনি একাকার হয়ে যেতে পারে। আর এটাই হচ্ছে জীবন।

গতকাল থেকে একটা জিনিস লক্ষ করছি য, তুমি রাতে ঘুমাতে পার নি কোন এক অপেক্ষার পালা বদলে। শুধু তোমার মনে হয়েছে কখন আসবে সেই প্রতিক্ষিত মুহূর্তগুলো যেখানে তার আনন্দের ধারা বইয়ে ভাসিয়ে দেবে তার আহরিত মন আর শান্তিতে ভরিয়ে দেবে এই ধরা। আজ লক্ষ করলাম, তার সেই আনন্দ যথার্থই সুখের বার্তা দিয়ে দিনটিকে স্মরণীয় করে রেখেছে হয়ত। আমি জানিনা কি সেই আনন্দ অথবা কি সেই কাঙ্ক্ষিত কিন্তু অনাবিষ্কৃত আনন্দের বিজলী ধারা।

তবে সুখানুভূতি হচ্ছে এই ভেবে যে, যেভাবে মন আশা করেছিল যদি তা পেয়ে থাকে এর চেয়ে বড় কোন আশীর্বাদ বা উপহার হতে পারে না। নিশ্চয় তা ভগবান শুনেছেন। ভাল থেক সব ঋতুতে, সবদিনে, গাড় নীল বৃষ্টিতে, অথবা সোনালী রোদ্দুরের চিকচিক করা স্বর্ণালি আভায় অথবা কোন এক অস্পৃশ্য মানুষের তৃপ্তিময় ছোঁয়ায়।

জীবনের সবগুলো আনন্দ যেমন এক নয় আবার সবগুলো কষ্টও এক নয়। কোন কষ্ট জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে চলার পথ দেখায় আবার কিছু কিছু সুখ জীবনের সব সুখগুলোকে ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ করতে থাকে। আজ এমন এক মানুষের জীবনের গল্প শুনলাম যার বেশিরভাগ দিনগুলই কেটেছে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার মত। কখনো নিজের সঙ্গে নিজে প্রতারনা করেছে, কখনো নিজেকে বাচিয়ে রাখার জন্য প্রতারিত হয়েছে। তারপরেও তার লক্ষ ছিল এক এবং অটুট।

৩০/০৫/২০১৬-অপেক্ষার অনেক নাম

Categories

অপেক্ষার অনেক নাম। কখনো কষ্ট, কখনো সুখ, কখনো উদাসীনতা আবার কখনো শুধুই ভালবাসা। আজ আপনার এই অপেক্ষার নাম কি সুখ আর ভালবাসা? সার্থক হোক সে মিলন, আর সার্থক হোক আপনার চিত্ত। অহংকারীরা দেখুক আপনার দিবসের মুখদ্ধকর সীমাহীন আনন্দের চ্ছটা আর নিন্দুকেরা জ্বলে পুড়ে মরুক নিজ দাবগাহনে। আপনার ইচ্ছাই আপনাকে নিয়ে যাবে স্বর্গের ঐ নীল জানালায় যেখানে বসে আপনি রাতের কালো আকাশে ধ্রুবতারা দেখবেন আর নিজেকে অস্পৃশ্য কোন এক মানুষের পাশে ঠায় দাড়িয়ে অরুন্ধতী হয়ে কাল পুরুষকে ছারিয়ে সকালের লাল সূর্যের দিগন্ত রেখা ছুয়ে দেবেন। আমার সকল শুভ কামনা রইল আপনার জন্য। আপনার সবার জন্য।

২৯/০৫/২০১৬-এই নীলাকাশ ভেদ করে যেমন

Categories

 

এই নীলাকাশ ভেদ করে যেমন ভগবানকে পাওয়া যায় না, আবার সমুদ্রতল মেথুন করেও কোন দেবদেবির দেখা পাওয়া গেছে এর তেমন কোন হদিসও পাওয়া যায় না। ঠিক তেমনি অন্তরভেদ করে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখলেও এক ফোঁটা ভালোবাসার আলামত পাওয়া যায় না। অথচ কেউ কষ্ট দিলে বুকে ব্যথা লাগে, আনন্দ দিলে অন্তরে সুখের আচ্ছাদন অনুমিত হয়। অনেকদিন ভালোবাসার মানুষকে না দেখলে বুক শুন্য শুন্য মনে হয়। তাহলে এই ভালোবাসার উৎসটা কি বা কোথায়?

“আমি তোমায় ভালবাসি” এর মানে অনেক ব্যাপক। আর এই ব্যাপক অর্থের কারনেই হয়তবা শতবর্ষী যুবকের চোখ অষ্টাদশী বৃদ্ধার জন্য কাদে, কাছে না থাকলে মনে হয় কি যেন নাই তার পাশে। শেষ বিকালে অথবা অষ্টাদশীর চাঁদনী রাতে কিংবা শীতের কোন এক কাকডাকা ভোরে পাশাপাশি বসে এক কাপ চা অথবা গরম গরম কোন ঝাল মিষ্টি টক খাওয়া, অমাবশ্যার রাতে কোন এক শ্মশানের পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার অজনা ভয়ে কুকড়ে থাকা হাত দিয়ে তাকে ধরে রাখার যে ভরসা। এই সবই ভালবাসা। একসময় এই ভালবাসা পরিনত হয় একটা অভ্যাসে। তখন অভ্যাসটাই ভালবাসা।

আজ যে শুধু তোমার মুখ দেখে ভালবাসল, তোমার রূপকে দেখে ভালবাসল, তোমার যৌবনকে দেখে শুধুমাত্র লোভের লালসায় ভালবেসে গেলো, সে আর যাই হোক তার সঙ্গে তোমার ভালোবাসার অভ্যাস হবেনা। কারন ভগবানকে ভালবাসা, একটা গাছকে ভালবাসা অথবা মাকে ভালবাসা আর সেই অপরিচিত মানুষটাকে মনের ভিতরে নিয়ে ভালবাসা এক নয়। তার সঙ্গে জরিয়ে থাকে নিঃশ্বাস, তার সঙ্গে জরিয়ে থাকে ভূতভবিষ্যৎ, তার সঙ্গে জরিয়ে থাকে জীবনের প্রতিটি সুখদুঃখের হাসিকান্নার সবগুলো অধ্যায়। 

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর তোমার অনুপস্থিতিতে যে তোমাকে মনে করে চোখের জল ফেলবে, আজ থেকে আরও শত বছর পর যে তার উত্তরসূরিদের কাছে তোমার নাম স্মরণ করে সেই অতীত জীবনের রোমান্সের কাহিনী শুনাবে, তোমার জীবদ্দশায় অসহায়ত্তের কারনে যে তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে না, যাকে দেখলে মনে হবে, সে তোমাকে নয় তোমার জীবনটাকে ভালবাসে, হোক তুমি পঙ্গু, হও তুমি বিরঙ্গনা অন্তঃসত্ত্বা, হও তুমি বোবা কিংবা বধির, সেটা তার কাছে ভাল না বাসার কোন কৈফিয়ত হতে পারে না। এখানে ভালবাসাটা শুধু শ্রদ্ধার, ভালবাসাটা অন্তরকে বুঝবার আর চারিদিকের হায়েনাদের থেকে ভালোবাসার মানুসটিকে নিরাপদে রাখার আপ্রান চেষ্টা। লম্বাপথ পারি দেওয়ার কোন সঙ্গি নাই তো কি হয়েছে, সে তোমার জন্য অপেক্ষা করবে, নৌকায় আর একজনেরও জায়গা আছে তোমার যাওয়ার জায়গা নাই, তো কি হয়েছে, সে তোমার জন্য নৌকা ছেড়ে পাশে এসে দারাবে, তোমাকে কেউ বিরঙ্গনা করেছে? তো কি হয়েছে? সে তোমার সবকষ্ট ধুয়ে মুছে নিজের ভালবাসা দিয়ে আদর দিয়ে কাছে টেনে নেবে। চিনেছ কি তাঁকে? যদি চিনে থাক, তাহলে নিশ্চিত জেনো, সে তোমাকে ভালবাসে। 

আমরা ভালোবাসার কথা বলি, আমরা স্নেহের কথা বলি, আমরা পারিবারিক বন্ধনের কথা বলি। কখনো কি দেখেছেন, আমাদের কাছ থেকে কে কিভাবে ভালবাসা চায়? আমাদের কাছে থেকে কিভাবে স্নেহ চায়? অথবা কখনো কি খুব কাছ থেকে ভেবেছেন, কেন অনেক আদরে গড়া সোনার সংসার কেন ভেঙ্গে যায়? তার সব গুলো কারন যদি যোগ করেন, দেখবেন, একটাই উত্তর, আমি যেমন ভালবাসা চাই তেমনি সবাই আমার কাছ থেকে ভালবাসা চায়। নিবেন অথচ দিতে জানবো না তাহলে তো একবার পাব আর সেটাও হারিয়ে যাবে ২য় বারের বেলায়। সোনালী, আপনি সুখি হবেন আমার ধারনা। ভাল বাসুন যাকে আপনি ভালবাসেন, ঐ দূর পাহারের প্রতিধ্বনির মত আপনার দেওয়া ভালবাসাও চারিদিকের পাহার থেকে শত গুনে আপনার কাছে বিভিন্ন সুরে, বিভিন্ন রঙে আপনার কাছে ফিরে আসবে।

২৮/০৫/২০১৬- আমরা ভালোবাসার কথা বলি

Categories

 

আমরা ভালোবাসার কথা বলি, আমরা স্নেহের কথা বলি, আমরা পারিবারিক বন্ধনের কথা বলি। কখনো কি দেখেছেন, আমাদের কাছ থেকে কে কিভাবে ভালবাসা চায়? আমাদের কাছ থেকে কিভাবে স্নেহ চায়? অথবা কখনো কি খুব কাছ থেকে ভেবেছেন, কেন অনেক আদরে গড়া সোনার সংসার কেন ভেঙ্গে যায়? তার সবগুলো কারন যদি যোগ করেন, দেখবেন, একটাই উত্তর, আমি যেমন ভালবাসা চাই তেমনি সবাই আমার কাছ থেকে ভালবাসা চায়। নিবেন অথচ দিতে জানবো না তাহলে তো একবার পাব আর সেটাও হারিয়ে যাবে ২য় বারের বেলায়। সোনালী, আপনি সুখি হবেন আমার ধারনা। ভালবাসুন যাকে আপনি ভালবাসেন, ঐ দূর পাহারের প্রতিধ্বনির মত আপনার দেওয়া ভালবাসাও চারিদিকের পাহার থেকে শতগুনে আপনার কাছে বিভিন্ন সুরে, বিভিন্ন রঙে আপনার কাছে ফিরে আসবে।

২৮/০৫/২০১৬-আশ্বিন মাসের ভোরবেলায়

Categories

 

আশ্বিন মাসের ভোরবেলায় অতি ঈষৎ নবিন শীতল বাতাশে নিদ্রোত্থিত দেহে তরুপল্লব যেমন শিহরিত হয়, ভরা গঙ্গার উপর শরত প্রভাতের কাচা সোনা রোদ যেভাবে চাপা ফুলের মত ফুটে উঠে, আজ আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনার দুরন্ত যৌবন জোয়ারের জলের মধ্যে রাজ হাসের মত ভেসে উঠেছে। আপনি এতদিন হয়ত দিনের আলো কিংবা রাত্রির ছায়ায়তা  দেখতে পান নাই, কিন্তু আজিকার এই বর্ষণ আপনার পঞ্জরে পঞ্জরে ঘৃতকুমারি নৌকার মত চারিদিকে ঘুরপাক খেয়ে আপনার চারিগাছি মল অনবদ্য এক প্রেমের সুচনা করেছে। অপেক্ষা করুন সে আসবে, আর সে আপনার জন্যই আসবে। যখন সে আসবে, দেখবেন ঐ দুরের ঘাটে যে ফিঙেটি বাসা বেধেছে সে কোন এক ভোরে উসুখুসু করে জেগে মৎস্যপুচ্ছের ন্যায় তার জোড়াপুচ্ছ দুই চারিবার দ্রুত নাড়াইয়া শিস দিয়া আকাশে উড়িয়া যাইবে। অথবা পাশের বাসায় কোন এক কোকিল উচ্চস্বরে ডাকিয়া কুহু কুহু গানে কলরব করিবে। তখন আপনার এই ইচ্ছা, এই সাধ বৃষ্টিতে ভিজার জন্য আর অপূর্ণ থাকবে না। 

২৭/০৫/২০১৬- বিশ্ব রাজনিতিক এর সাথে

Categories

 

আমার একবার এক বিশ্ব রাজনিতিক এর সাথে খুব কাছ থেকে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। তিনি এই বিশ্ব রাজনীতির সব সমস্যা, সব পলিসি, রাজনৈতিক লীলাখেলার সবগুলুর সঙ্গেই কোন না কোনভাবে জরিত থাকেনই। কোন এক অবসর মুহূর্তে আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তিনি কখনো কষ্টে থাকেন কিনা। আমার এই প্রশ্ন করার কারন ছিল। তার কোন কিছুর অভাব নাই, তার সম্পদের অভাব নাই, তার মানসম্মানের কোন কমতি নাই, তাকে অন্যান্য বিশ্ব রাজনীতিবিদরা কাছে পেলে তাদের নিজের জীবনও ধন্য হয়ে যায় এমন একটা ব্যাপার। তারজন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নামিদামী ডাক্তাররা সবসময় স্ট্যান্ডবাই থাকেন, এমনকি এয়ারফোর্স ওয়ানের মত বিমানও স্ট্যান্ডবাই থাকে। তারজন্য তো কোন কষ্ট থাকার কথা নয়।

তিনি বড্ড রসিকলোক কিন্তু খুব জ্ঞ্যানি লোকও বটে। অনেক্কখন ভেবে চিন্তে এক কাপ কফি নিজের হাতে বানিয়ে আর আরেক কাপ কফি আমার জন্য নিজেই বানিয়ে নিয়ে বললেন-তুমি কি কষ্টে আছো? বললাম, না, ওতটা কষ্টে নাই তবে আজকাল অনেক এই যুগের ছেলেমেয়েদের কথা শুনে মনে হয় তারা অনেক কষ্টে আছে। আপনি তো এই যুগেই এখন বাস করেন, আপনি কোন কারনে কষ্টে আছে কিনা।

একটু মুচকি হেসে বললেন, কয়টা যুদ্ধ দেখেছ জীবনে? আফগানিস্থান দেখেছ, ইরাক দেখেছ, কসভ দেখেছ, কিন্তু কখনো কি নিজের ঘরের পাশে ঐ বস্তির ছেরা কাপড় পড়া এতিম কোন বাচ্চার অথবা পিতামাতার বিচ্ছেদজনিত কারনে কোন শিশুর একাকীত্ব অথবা নিছক পয়সাকরির অভাবে সামাজিক দুর্বল কোন পরিবারে বেড়ে উঠা মানুষদের ভিতরের অনুভুতি দেখেছ? সেটা কোনো যুদ্ধের থেকে কম নয়।

আজ থেকে বহু বছর আগে আমি এই এমন একটা পরিস্থিতিতে তিলে তিলে বড় হয়েছি। কখনো মনে হয়েছে আমার কেউ নাই, কখনো মনে হয়েছে যারা আছে তারা আমাকে কিছুই বুঝে না। একবেলা খাবারের জন্য আমাকে যেমন নিজে উপার্জন করতে হয়েছে কখনো মুটে হয়ে, আবার কখনো পাশের বাড়ীর কোন ফরমায়েশ খেটে। আবার জীবনে বড় হতে হবে এই আখাংখায় আমি স্কুলেও অনুপস্থিত না থাকার চেষ্টা করেছি প্রতিনিয়ত। আমি যাদের সঙ্গে স্কুলে যেতাম, আমি তাদের সৌখিন কাপড় চোপর পড়া দেখে নিজেকে কখনো মনে হয়েছে, আমার এই জন্মের জন্য তো আমি দায়ি নই, অথবা আমার এই দৈন্যের জন্য তো আমি দায়ি নই। আমিও তো হতে পারতাম তাদের কোন এক ধনাঢ্য পিতার একমাত্র সন্তান। কিন্তু না, আমি কোন ধনাড্য বাবার সন্তান ও নই, আবার আমার কোন ধনি আত্মীয়ও নাই। আমাকে দেশ ছারতে হয়েছে কপাল ফেরানোর আশায়। আমি পরভূমে বড় হয়েছি অনেকের ছত্রছায়ায়। এমন কি আমি আমার ধর্মটাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে কোন এক উচু ধাপের সিরিতে উঠার আশায়।

প্রেম কি জিনিস, একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ের যে প্রেমের অনমদনা তা যে আমার ছিল না তা নয় কিন্তু আমার সেই সাধ্য করার মত পরিস্থিতিও ছিল না। মনে হয়েছে সত্যি কষ্টে আছি।

আজ আমার সব হয়েছে। কোন কিছুর কমতি নেই আমার। আমি যা চাই না, তাও আমি পাই। এর থেকে বেশি কেউ পায় তা আমার জানা নাই। কিন্তু হ্যা, এই যে বললে, আমি কখনো কষ্টে থাকি কিনা? আমি যখন কোন এক পল্লিগ্রামে যাই, আমি যখন কোন এক এতিমখানার বস্তিতে যাই, আমি যখন কোন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় যাই, আমার তখন ঐ যে ফেলে আসা আমার অতীত জীবনের যে কষ্ট, যে অনুভুতি আমার এই সারা জীবনের স্মৃতির মধ্যে জমা হয়ে আছে, তারা আবার উঁকি দেয়, আমি তখন সত্য সত্যি কষ্টে থাকি। কিন্তু এ অনুভুতি আমার প্রকাশের কোন ভাষা নাই শুধু কিছু সাহায্যের হাত বারিয়ে দেয়া ছাড়া।

তোমরা এখন কষ্টে থাক এই কারনে যে, হয়ত কোন এক ছেলে কোন এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, হয়ত কষ্টে থাক পিতামাতার অনুশাসনের কারনে, হয়ত তোমরা কষ্টে আছো পরিশ্রম করতে না চাওয়ার ইচ্ছায় অথচ কোন পরিশ্রমের কষ্টের কারনে, হয়তবা কষ্টে আছো তোমরা বেশি ইমোশনাল ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছ না বলে। তোমরা অভিমানি, তোমরা অভিমান করতে পার তাই কষ্টে আছো। স্বাধীনতা কি হয়ত তোমরা জানো না বলে আমি স্বাধীন নই এই মনে করে কষ্টে আছো। একটা গান তোমাদের কষ্টকে বারিয়ে দিতে পারে, একটা মুভি তোমাদের মনকে কয়েকদিন আবেগের বশে কষ্টে রাখতে পারে, একটা পরীক্ষার খারাপ ফলাফল তোমাদের মনকে কষ্টে রাখতে পারে। তোমার ছোটভাই কিংবা বোনের সাথে তোমার বনিবনা হচ্ছে ভেবেও তোমরা আজ অনেক কষ্টে আছো বলে মনে হতে পারে। এগুলু আসলে কোন কষ্টই না। তোমরা অবাধ স্বাধীনতার নামে নিজেদের সতীত্বকে অকালে বিসর্জন দিয়ে কষ্টে থাক, তোমরা সময়ের কাজ না করার কারনে তোমাদের পিতামাতারা তোমাদেরকে একঘরে করে রাখছে বলে কষ্টে আছো। তুমি অঢেল পয়সা খরচ করতে পারছ না বলে হয়ত কষ্টে আছো। তোমার পাশের বন্ধুর দামী জামা দেখে তোমার মন খারাপ হয় বলে তোমরা কষ্টে আছো। কখনো মেঘলা আকাশ দেখলে কষ্টে থাক, আবার ভরা পূর্ণিমায়ও তোমরা কষ্টে থাক। বন্ধুদের সঙ্গ না পেলে কষ্টে থাক আবার বন্ধুদের সঙ্গ পেলেও কষ্টে থাক। কাউকে ভালবেসে কষ্টে থাক আবার ভালবাসা না পেলেও কষ্টে থাক। কোন কিছুতেই তোমরা সুখি নও। সব কিছুতেই তোমরা কষ্টে আছো। কষ্টে আছো এতা বলতেই যেন তোমরা ভাল মনে করো। 

কিন্তু কখনো কি একবারও ভেবেছ যে, কি করা উচিৎ ছিল আর কি করা হচ্ছে? তাহলে এই কষ্টে থাকার জন্য তো তুমি অন্য কাউকেই দায়ি করতে পার না। তোমার এই কষ্ট একটা আধুনিক কালের হতাশা ছাড়া আর কিছুই না। অথচ জীবনে কষ্ট লাঘব করার জন্য তুমি কিছুই করছ না।

তোমার এই কষ্টের জন্য আমি একটুও অনুশোচনা করি না। শুধু আমার কষ্ট হয় তোমরা তোমাদের কষ্টের লাঘবের কোন প্রতিশ্রুতির কথা বল না বলে। আমি অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকলাম তার এই ভাবনার জন্য। কত উচুতে বসে তিনি কত নিচু স্তরের ভাবনার কথা গুলো বলছেন।

আমার আর কিছুই বলার ছিল না।

২৬/০৫/২০১৬-নাম না জানা মানুষ

Categories

 

আমি আপনার ভাল নাম জানি না। জানলেও যে খুব একটা লাভ হবে বা আমার চিন্তার মধ্যে কোন পরিবর্তন আসবে তাও না। আপনার নাম সোনালী না হয়ে রুপালী হলেও যা, পিংকি, সিন্থিয়া, কিংবা সাথী অথবা কবিতা হলেও তা। যাই হোক না কেন, আমি এখন আপনাকে ঐ সোনালীর আদবে একজন অপূর্ব সুন্দর,  বা সুন্দরী (যদি মেয়ে হয়ে থাকেন) লক্ষি, আর ভক্তের ন্যায়ই দেখব। আপনার সাথে আমার মনের মিল আছে কিনা আমি জানতেও চাইব না, আপনার কি রঙ পছন্দ, কি গান আপনি পছন্দ করেন কিংবা কিসে আপনার কষ্ট হয়, অথবা কিসে আপনার কস্ট লাঘব হয় তার কোন দায়দায়িত্বও আমি নিতে চাইব না। কারন আমি প্রকাশ্য কোন মানবের কাছে প্রকাশ্য হতে চাই না। তবে যেটুকু আমার কাছে মনে হয়েছে আপনি রবিঠাকুর এর লেখা পছন্দ করেন, আপনি বনলতাকে ভালবাসেন, আপনি সোনালী রোদ ভালবাসেন। গ্রীষ্মের উষ্ণতা আপনি ভালবাসেন কিনা আমি জানি না, শ্রাবনের ধারা আপনাকে শিহরিত করে কিনা আমি জানি না, অথবা গ্রামের সেই বুড়িমার আচল ধরে পায়ে পায়ে হেটে নদীর ধারে গোসলের আগে কচিকচি পাতা তুলে মিথ্যে মালা গাথতে পছন্দ করেন কিনা আমি জানি না। তবে যে অপূর্ব নামে ছেলেটির মৃন্ময়ীর ভালবাসায় আপ্লূত হয়ে মন্তব্য করতে পারে, যে নাটোরের বনলতাকে বরন করে নিজেকে বনলতার মত গুনগুন করে গান গাইতে পারে, সে আর যাই হোক শ্রাবন নিশ্চয় তার প্রিয় ঋতুর মধ্যে একটা, অথবা বসন্তের বিকালে পায়ে পায়ে না হোক, ছলছল নেত্রে বুড়িমাকে দেখতে যাওয়ার ছলে অস্পৃশ্য কিছুর দেখা হোক তা নিশ্চয় মন থেকে ফেলে দেওয়া যায় না।

অস্পৃশ্য কোন কিছুর দিকে কখনো হাত বারাবেন না। ঐ অস্পৃশ্য জিনিসে যে একবার হাত বাড়িয়েছে, তার নির্ঘাত হয় মৃত্যু হয়েছে প্রেমের দিশানলে, না হয় সে দেবদাসের পার্বতীর মত বাস করেছে রানী হয়ে কিন্তু মন পরে ছিল ঐ কৃষ্ণকুন্ড গ্রামের দেবদাসের ঘরে। আর যদি তার থেকেও আপনি এককাঠি শক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি নিস্চিত থাকুন, আপনার যোগ্য কোন প্রেমিক বা পেমিকা এখনো এই পৃথিবীতে জন্ম নেয় নাই। আপনাকে ঐ অস্পৃশ্য মানুষের আত্তাকে নিয়েই চিরকুমার বা চিরকুমারি হয়ে থাকতে হবে।

ভয় আপনার রয়েই গেলো। ভয় কি আসলেই রয়ে গেলো? ক্ষমা করে দিবেন যদি আমার এই লেখা আপনার চরিত্রের সাথে মিলে গিয়ে থাকে, আর মাফ করে দিবেন যদি আমার এই অনুভুতি আপনার চরিত্রের কথাও না মিল খায়। সবটাই কল্পনা। আর কল্পনার রাজ্য থেকে কারো কোনদিন ফাসি হয়েছে এই তথ্য কোন আদালতে প্রমান পাওয়া যায় নাই।

২৫/০৫/২০১৬- জেগে থাকার অনেক নাম

Categories

 

জেগে থাকার আরও অনেক নাম আছে, কখনো এর নাম কষ্ট, কখনো এর নাম ভালবাসা, কখনো এর নাম আতংক, আবার কখনো এর নাম উদাসীনতা, আবার কখনো এর নাম শুধুই ভাললাগা। আপনি কোন সেই নামের কারনে জেগে আছেন? তবে আমি চাই না আপনার জীবনে ঐ কোন একটা নামের কারনে জেগে থাকেন যা মানুষকে আতংক গ্রস্থ করে তোলে, কিংবা কষ্টে রাখে। আর আমার প্রোফাইলের ছবির কথা বলছেন? এটা কোন কাল্পনিক ছবি নয়। এই ছবির মধ্যে আমার অস্পৃশ্য ছোঁয়া আছে, অস্পৃশ্য নান্দনিক কল্পনা আছে। আর ঐ লকেটের দুই ধারে যে চেইনটা দেখছেন, সেটা দিয়ে বাধা একটা হৃদয় যার দুইটা ধারের এক্তায় আমি আর আরেকটায় সে। ভাল থাকবেন

২৪/০৫/২০১৬-আকাশে বৃষ্টি একটু বাতাস

Categories

 

আকাশে বৃষ্টি, একটু একটু বাতাস, পাশে কফির কাপের কফি অনেক আগেই ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তারপরও সিগারেটের সঙ্গে খেতে মন্দ লাগে না। মনটা এই বৃষ্টির দিনে একটু ভারিই ছিল কিন্তু কথা হল, মনটাও হাল্কা হল। কিন্তু তুমি একই করলে হটাত? তুমি এমন ঝড়ের গতিতে কি করে এতটা পথ পারি দিয়ে উথাল পাতাল মন নিয়ে একেবারে চলে এলে আমার দরজার একেবারে অন্তরের কাছে? কি করে জানলে আমি তয়াম্র জন্য কতদিন ধরে অপেক্ষায় আছি? ভগবান অন্তর্যামী, সে সব জানে, আর সব পারে।

আমি শুধু সারপ্রাইজডই হই নাই, হয়েছি অনেক অনেক খুশি। কিন্তু মনের এক কোনায় আমার বড় একটা প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়ে গেলে আজ…… কেন ঐ চোখের কোনায় বৃষ্টির ফোঁটার মত পানি ঝরল? কোন ব্যাথা? কোন কষ্ট? কোন অপূর্ণ ইচ্ছা? কি সেটা আমার এখনো জানা হয় নাই? আমি কি দিতে চাই না তোমায়? তাহলে কি লুকিয়ে গেলে আজ আমার কাছে?

অমাবশ্যার রাতে আমি তোমার কাছে কোন চাঁদনী রাত দাবি করিনি, শীতের সকালে আমি তোমার কাছে শ্রাবনের ধারার একটা মূর্ছাও চাইনি, অথবা কোন এক চৈতালি দিনে আমি শীতের কুড়কুড়ে আমেজও চাই নাই । আমি শুধু চেয়েছি তুমি সুখি হও, তুমি আমার আদরে বড় হও। তাহলে কেন আজ আমি তোমার ঐ কাজল মাখা মায়াবি নয়নে কয়েক ফোঁটা জলের রেখা দেখলাম!

আমার এই অস্পৃশ্য হাত তোমাকে ছুয়ে দিল, তোমার নয়নে চুমু খেয়ে সব ক্লান্তি, সব দুঃখ, আর সব অবসাদ দূর করে দিল। শুধু শুধালাম, ভাল আছো তো এখন?

মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে ভিজা ভিজা নয়নে বললে আমায়, কতদিন দেখি নাই তোমায়!! তাই দুচোখে জল চলে এসেছিল। কোন কষ্টে নয়, কোন ব্যথায় নয়, কোন কিছু অপূর্ণতায় নয়, আজ এই হটাত পাগলের মত ছুটে না এলে হয়ত আমার সারাটা রাত শুধু শ্রাবনই হত, কিন্তু এইটুকু সময়ের জন্য হলেও এখন মনে হল, আনন্দের সবটুকু নিলিমা দিয়ে তোমার এই অস্পৃশ্য আদর আমার প্রতিটি গালে, প্রতিটি নয়নে, প্রতিটি রন্দ্রে রন্ধ্রে শিতল করে দিল।

মুচকি হেসে বললাম তারে, আমি কি কখনো তোমাকে বলেছি যে আমি তোমায় ভালবাসি?

হ্যা, জেনে রাখ, আমি তোমায় ভালবাসি।

২৪/০৫/২০১৬-ইচ্ছাবিহীন ভুল

Categories

 

ইচ্ছাবিহিন ভুলের কারনে অথবা নিছক একটা মজা করার কারনে আজ আমি তার সহিত অত্যন্ত কষ্টের একটা অনুভুতি উপহার দিয়েছি। এটাকে আমি উপহার বলব উপহাস হিসাবে। ভগবানের কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি কিন্তু মৃদু মৃদু হাসেন আর বলেন, আমি তোমাকে ভালবেসে সৃষ্টি করেছি বলেই তোমার সব অপরাধ আমি ক্ষমা করে দিতে পারি আর তাই দিলাম। আমরা মানুষেরা ভগবান নই, তারপরেও অনেকে ভগবানের এই বৈশিষ্ট অনুকরন করে মহত্তের উদাহরন রাখেন। তুমিও কি পার এই এমন একটা উদাহরন তৈরি করে আমাকে তোমার বন্ধু বলে মেনে নিতে? আমি তোমার কাছে কখনোই এই আকুতি করতাম না যদি না আমি ঐ নিষ্পাপ অরুন্ধতীর মত সোনালীকে ভাল না বাসতাম, কিংবা কোন এক রোদ্দুরের আভায় আমি কোন সোনালী আকাশকে না দেখতাম। সেও কষ্টে আছে তোমার এই কঠিন এক সময়ের অনুভুতিকে ঘিরে। অস্পৃশ্য এই অনুভুতির জন্য অস্পৃশ্য স্নেহ ছাড়া আমার কাছে তোমাকে দেওয়ার কিছুই নাই।

২৩/০৫/২০১৬- মুল্যায়ন

Categories

 

সব ফুল ঈশ্বরের সেবায় কাজে লাগে না যেমন তেমনি একই বাগানের মালি সব ফুলের একই রকমের যত্নবানও নন। এরজন্য ফুলকে যেমন দোষী বলা যাবে না আবার মালিকেও অপরাধে দন্ডিত করা যাবে না। এটাই বাস্তবতা। কিছু ফুল বিকশিত হওয়ার আগেই ঝরে যায় আবার কিছু ফুল বিকশিত হয়েই এমন জায়গায় স্থান পায় যা ফুলের জীবনকে নিয়ে যায় স্মৃতির অমরতায়। এইসব নির্ভর করে ফুল কখন কার হাতে কিভাবে থাকে আর কে কিভাবে কোন ফুলকে বরন করে। ফুলের কোন ভাষা নেই বলে জানা যায় না যে, এক ফুল আরেক ফুলকে হিংসা করে কিনা। কিন্তু মানুষের বেলায় এর পরিনতি অনেক ভয়াবহ।

এই পৃথিবীতে জীবন হচ্ছে একটা জুয়া খেলার মত। একই টেবিলে খেলার একই নিয়মে একজন হারে এবং আরেকজন জিতে। যে হেরে যায় তার কাছে জুয়ার টেবিলের অভিজ্ঞতা, বর্ণনা, কষ্ট, অনুভুতি, প্রভাব কিংবা তার মনোভাব এক রকম কিন্তু যিনি জুয়ার টেবিলে জয়ী হয়েছেন, তার অভিজ্ঞতা, বর্ণনা, আনন্দ, প্রভাব কিংবা মনোভাব একেবারেই বিপরিত। অথচ খেলাটা একই, খেলার টেবিলটা একই, খেলার নিয়মটা একই। কার কাছ থেকে আপনি বুদ্ধি বা পরামর্শ নেবেন? হয়ত বলবেন, জুয়া খেলাটাই তো একটা রিস্ক এবং ভাল জিনিস নয়। জীবনটাও ঠিক তাই। এর মধ্যে ভাল খেলা আছে, খারাপ খেলা আছে, দুটুতেই রিস্ক আছে আবার দুটুতেই লাভ লোকসান আছে। আপনি কি চান, কোনটা চান সেটা এখন আপনার। ভগবানের হিসাব আরেক অধ্যায়। সেটা আরেক তাত্ত্বিক এবং আধ্যাত্মিক বিষয় যা এখানে আমি অন্তত মিন করছি না। 

যদি অন্যভাবে বলি, মানুষ যে কাজটা করতে গিয়ে তার ভুলের কারনে হেরে গিয়ে থাকে, অন্য কেউ সে একই কাজ করে ভুল না করে জীবনে জয়ী হতে পারে। হেরে গিয়ে আপনি কাউকে সাবধান করতে পারেন বটে কিন্তু যদি সেই অন্য কেউ সার্থক হয়ে ফিরে আসে, হেরে যাওয়া আপনি মানুষটি হয় জিতে যাওয়া মানুষটির হিংসায় লিপ্ত হবেন নতুবা আপনি জিতে যাওয়া মানুষের পথ ধরে জয়ী হওয়ার একবার চেষ্টা করবেন। তারপরের নীতিটা নির্ভর করে হেরে যাওয়া মানুষটির অর্ধ গ্লাস পানির বর্ণনায়- হয় হাফ খালি না হয় হাফ ভর্তি তার মানসিকতার উপর। সবাই বক্সিং রিং এ জিতে না। যে জিতে না তার কাছে অনেক কৈফিয়ত থাকতেই পারে কিন্তু হেরে যাওয়া মানুষের কাছে কেউ গল্প শুনতে আসে না। আর এ কারনেই পৃথিবীতে হার জিতের কারনে বন্ধুর প্রতি বন্ধুর, পরিবারের প্রতি পরিবাবের, স্বজন এর উপর স্বজনের দিনদিন হিংসা আর বিরূপ প্রভাব বেড়েই চলে। 

পৃথিবীতে মানুষের রুচি ভেদে তার পরিবর্তন হয়। কেউ মদ বেচে দুধ খায় আবার কেউ দুধ বেচে মদ খায়। রুচি এমন একটা জিনিস যা একজনের সঙ্গে আরেকজনের খুব মিল থাকে না হয়ত তবে মাঝে মাঝে তার মিলের সাদৃশ্য থাকে। আপনি জীবন থেকে কি পেতে চান সেটা যেমন জরুরি, আপনি জীবনে কাকে কি দিতে চান সেটাও খুব জরুরি। জীবনটা একমুখি নয়। দেওয়া আর নেওয়ার মধ্যে এর লাভ লোকসান। আপনি বোয়াল ধরবেন, পুটি মাছের আহার দেবেন, এটা যেমন হবে না, তেমনি চাঁদে যাবেন নৌকায় চরবেন তাও হবে না। ঠিক সময়ে ঠিক ইন্সট্রমেন্ট, ঠিক সময়ে ঠিক যানবাহনে উঠতে হবে। আপনি ঠিক সময় ঠিক কাজটি করেন নাই মানে এই নয় যে ঠিক সময়ে ঐ কাজটি করে সার্থক হল তাকে আপনি আপনার হেরে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বলে পিছিয়ে আনবেন। আপনি অসময়ে সব কাজ করে ফেলবেন, কেন আপনি মনে করেন আপনি সার্থক হবেন? আপনি একসময় সবার কাছ থেকে পিছিয়েই থাকবেন এবং আপনার জন্য কেউ অপেক্ষা করবে না। আপনি যত বুদ্ধিমান আর যত পারফেক্টই হন না কেন। কখনো দেখেছেন বা শুনেছেন যে একই জলের এক বিন্দু ফোঁটা কোন এক ব্রিজের তল দিয়ে দুবার প্রবাহিত হয়েছে? আপনি যদি একবার এক ব্রিজের তল অতিবাহিত করে চলে যান, আপনার জন্য ফেরার কোন সুযোগ নেই। আপনি ভুল করেছেন না ঠিক করেছেন তা দেখার জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই। আপনি অবরুদ্ধ, আপনার মুল্য ঐ ব্রিজের কাছে শুন্য। আর আপনি যখন অবরুদ্ধ হবেন, তখন পৃথিবীটা প্রতি নিয়ত মুহূর্তে মুহূর্তে আপনার থেকে অনেক দূর সরে যাবে। হেরে যাওয়ার গল্প কেউ শুনতে চায় না। মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে আর স্বপ্ন পূরণে ব্রতি হয়। 

পৃথিবীর আসেপাশে তাকিয়ে দেখুন, এটাই নিয়ম। লিকলিকে গাছ সবল গাছকে ধরে আকাশের দিকে বেড়ে উঠে, দুর্বল সবলকে ধরে হেটে চলে, অন্ধ আরেকজনকে অবলম্বন করে ঠিক পথ ধরে হেতে এগিয়ে যায়। আপনি কাকে ধরবেন, আর কাকে ছারবেন সেটা তো আপনার সপ্নের উপর নির্ভর করে। আপনি ভুল স্বপ্ন দেখেছেন বলে আরেক জন কে আপনি তার স্বপ্ন দেখাকে ভুল বলতে পারেন না। তার স্বপ্ন দেখা আর সেই সপ্নকে সফল করার কৌশল তার, আপনি হয়ত সেই কৌশল কখনোই শিখেননি।

আপনি নিজেকে দেখুন, যদি কখনো বিশ্বাস হারিয়ে থাকেন, অথবা কেউ আপনার উপর বিশ্বাস হারিয়ে থাকে, এর মানে হল, আপনি নিজেও কারো বিশ্বাস নিয়ে খেলা করেছেন। নিজেকে বিশ্বাস করুন আর নিজের বিশ্বাসের উপর কাউকে বিশ্বাস করতে দিন। আর এটাই হবে বিজয়ের জন্য প্রথম সোপান। যদি ভাবেন, শেষ হয়ে গেছেন, তাহলে আপনি সত্যি শেষ হয়ে গেছেন। আর যদি ভাবেন, না আপনি পারবেন, আবার শুরু করুন তাকে দিয়ে যে জিততে শুরু করেছে। সব দই চুন নয়, একবার দই মনে করে চুন খেয়েছেন বলে সেটাই যে সব তা কিন্তু নয়। আপোষ করুন, জীতবেন, তবে এবার ধীরে ধীরে। তাহলেই দিন বদল হবে, আর আপনার মুল্য ফিরে আসবে।  

১৫/০৫/২০১৬-রবিঠাকুর তার সমাপ্তি গল্পে

Categories

 

রবিঠাকুর তার সমাপ্তি গল্পে মৃন্ময়ীর বাল্য আর যৌবনকাল কিভাবে দ্বিখণ্ডিত হইয়া গিয়াছিল তার চমৎকার একটা বর্ণনা করিয়াছিলেন ঠিক এইভাবে-” নিপুন অস্ত্রকার এমন সূক্ষ্ম তরবারি নির্মাণ করিতে পারে যে, তদ্বারা মানুষকে দ্বিখণ্ডিত করিলেও সে জানিতে পারে না, অবশেষে নাড়া দিলে দুই অর্ধখন্ড ভিন্ন হইয়া যায়। বিধাতার তরবারি সেইরূপ সূক্ষ্ম, কখন তিনি মৃন্ময়ীর বাল্য ও যৌবনের মাঝখানে আঘাত করিয়াছিলেন সে জানিতে পারে নাই। আজ কেমন করিয়া নাড়া পাইয়া বাল্য- অংশ যৌবন হইতে বিচ্যুত হইয়া পড়িল এবং মৃন্ময়ী বিস্মিত হইয়া ব্যথিত হইয়া চাহিয়া রহিল।”

আমিও যেদিন এই অস্পৃশ্য পুরুষটাকে প্রথম আমার অন্তরদৃষ্টি দিয়া দেখিয়াছিলাম, তখন আমিও ব্যথিত হৃদয়ে বুঝিতে পারিলাম, আমার আর বাল্যকাল বলিয়া কিছুই অবশিষ্ট নাই। আমার বাল্যকাল আমার অজান্তেই আমা হইতে কবে বিদায় নিয়া চলিয়া গিয়াছে, আমি বর্ষার কিংবা শরতের অথবা শীতের কোন ঋতুতেই তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। যখন বুঝিতে পারিলাম, তখন আমার শুধু এইটুকু মনে হইল আম্র কাননের শুভিত কোন পুস্পের জন্য যখন মৌমাছিরা দূর দূরান্ত হইতে উড়িয়া আসে, আমিও তাই। কিন্তু আমার ভ্রম কাটিতে বেশি সময় লাগিল না। আমি যাহাকে পুস্প বলিয়া এতদূর উড়িয়া আসিয়াছি, উহা আসলে অন্য কাহারো বাগানের মৌমাছিমাত্র। সেই বাগানে পুস্প আছে, তাহার সহিত মৌমাছির সঙ্গে তাহার দলবলও আছে। বাগানের মালিও আছে, মালিকও আছে। আমি উহাতে বিচরন করিতে পারি কিন্তু উহা আমার নয়। আমি তাহাকে দূর হইতে আপন ভাবিতে পারি কিন্তু কাছে গিয়া বলিতে পারি না, ইহা আমার। আমি ইহাকে অনুভব করিতে পারি কিন্তু জড়াইয়া ধরিয়া গলা ফাটাইয়া বলিতে পারি না, এই পৃথিবীতে আমি আসিয়াছি শুধুমাত্র ইহার পাজর হইয়া।

আমি যাহা দেখিতে পাইতেছি জগতে তাহা হইতে আরও অধিক সৌন্দর্যের আর অধিক আকর্ষণীয় হয়ত কিছু আছে কিন্তু যাহাকে একবার মনে ধরিয়াছে, তাহা হইতে আরও কোন দামী, আকর্ষণীয় অথবা মূল্যবান হাতের কাছে আনিয়া দিলেও মনে হইবে, আমি উহা চাই নাই। আমি চাহিয়াছি শুধু উহা যাহা আমার কাছে এখন অস্পৃশ্যই। তারপরেও সে আমার। মনের ভিতরের যে জগত সেখানে তো আর এই বায্যিক পৃথিবীর কোন আইন বা আদালতের অস্তিত্ব নাই। তাই নীলিমার আকাশের দিকে তাকাইলেও আমি তাহাকে দেখি আবার ঘন বর্ষার বৃষ্টির ছায়াতলেও আমি তাহাকে দেখি। কখনো সে আমাকে জলের মত ভাসাইয়া লইয়া যায় অতল সমুদ্রের গহিনতলে আবার কখনো সে আমাকে জলের স্রোতে ভাসাইয়া দেয় আমার দুই নয়নের ধারা।    

১৪/০৫/২০১৬-বহুবছর আগে যখন

Categories

 

আজ থেকে বহু বছর আগে যখন তোমার এই পৃথিবীতে আগমন হইয়াছিল, তারও অনেককাল পরে আমি এই পৃথিবীর নীল আকাশ দেখিয়াছিলাম, লাল সূর্য দেখিয়াছিলাম, বাতাসের গন্ধ শুকিয়াছিলাম। কিন্তু তখন আমার কাছে ঐ নীল আকাশ শুধু নীলই ছিল, সূর্য তখন একটা জলন্ত অগ্নিপদার্থ হিসাবেই ছিল, বাতাসের গন্ধ আমি ভাল করে মনেও করিতে পারি নাই। কিন্তু যেদিন তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হইয়াছিল, আমি নীল আকাশের মাঝে নীলমেঘ দেখিয়াছিলাম, ঐ মেঘেরা কিভাবে একস্থান হইতে ভাসিয়া ভাসিয়া অন্যত্র চলিয়া যায় তাহা দেখিয়াছিলাম, ঐ প্রখর সূর্যের আলো আমার অপেক্ষার পালাকেও যন্ত্রনা দিতে পারে নাই, বাতাসের গন্ধের সঙ্গে আমি আরও একটা গন্ধ শুকিয়াছিলাম। আর সেটা তোমার গায়ের গন্ধ, তোমার সুগন্ধির গন্ধ, তোমার ক্লান্তির ঘর্মাক্ত শরীরে গন্ধ।

আজ অনেক বছর হইয়া গেলো, আমি এখনো সূর্যকে দেখি, আমি ঐ নীলাকাশ দেখি, ঐ নীলাকাশের নীল মেঘগুলি দেখি, দক্ষিনা বাতাসের গন্ধও শুকি। সবকিছু আগের মতই আছে বলিয়া মনে হয়। শুধু মনে হয় ঐ বাতাসের সাথে তোমার গায়ের গন্ধটা নাই, তোমার সুগন্ধির গন্ধটা নাই, তোমার গায়ের সেই ক্লান্তির ঘর্মাক্ত গায়ের গন্ধটাও নাই।

আমি অনেক খুজেছি তোমায়, ” শিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে…… “

আচ্ছা তুমি কি কোথাও নাই?

৬/৫/২০১৬-রুনার গল্প 

সেদিন সমস্ত দিন বাহিরে ঝড় বৃষ্টি হইতেছিল। কিন্তু বিকালে আকাশ বড় পরিস্কার নীলদিগন্ত লইয়া, পৃথিবী তাহার সবুজ গাছপালার ঢালপালা সাজাইয়া খুব শান্ত হইয়া বসিয়াছিল। এই ঋতুতে কখন আকাশ মেঘলা হইয়া যায় আবার কখন ঝরঝর করিয়া আগাম কোন সংকেত না দিয়া অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়, তাহার কোন হদিস থাকে না যদিও আজ এই পরন্ত বিকালে কোন সংকেতবিহিন এইরূপ অঘটন ঘটিবে বলিয়া মনে হইতেছে না।   

এমনি এক বিকালে "সুখালয়" এর প্রকান্ড বাড়িটার সামনে সবুজ লনের মধ্যে মা শেলি আর তার অষ্টাদশী রুনা চুপচাপ বসিয়া আছে। কাহারো মুখে কোন কথা নাই। অনেক্ষন ধরিয়াই শেলি কোন কথা না বলিয়া দুরের আকাশের দিকে আনমনে তাকাইয়া কি যেন গভিরভাবে ভাবিতেছে তাহার মুখ দেখিয়া তাহা বুঝিবার উপায় নাই। তবে তাহার মনটা যে বড় বিষণ্ণ এ ব্যাপারে নিশ্চিত করিয়া বলা যায়। পাশেই একটা মেলামিনের কাপে গরম কিছু চা লইয়া তারই অষ্টাদশী চঞ্চলা রুনা মায়ের কথা শুনিবার জন্য বসিয়া আছে। তাহারও মন খুব একটা শান্ত কিংবা চঞ্চলা কিনা বুঝা যাইতেছে না। তবে দুইজনের মনের অবস্থা নিরিক্ষা করিয়া এইটুকুন উপলব্ধি করা যায় যে, কোন এক ঝড়ের পূর্বের থমথমে মেঘময় নীলিমার মত, অথবা ঝড়ের প্রাক্কালে বাতাসেরা যেমন তাহাদের পরবর্তী গতিপথের নিশানা ঠিক করিবার জন্য শল্য পরামর্শ করার তাগিদে একেবারে নিসচুপ হইয়া যায়, অথবা ভুতলের সব বৃক্ষরাজিরা ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার লক্ষে পূর্বপ্রস্তুতিমুলক যতসব কার্যপ্রণালী আছে তাহার ব্যাপক আয়োজন চালায়, ঠিক ঐ রকম একটা থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হইয়াছে।   

রুনা শেলির একমাত্র মেয়ে। বড় চঞ্চল এক চপলা কিশোরী। কিন্তু পিতার অভাবে বড় আদুরের রুনাকে শেলি কখনো কোন কষ্টের ভার নিতে দেয় নাই। এই সমাজ সংসারে যাহা কিছু সম্মান আর আনন্দের সহিত ভোগ করা যায়, তাহার কোনকিছুই শেলি রুনার জন্য কমতি রাখে নাই। একইসঙ্গে শেলি রুনার মা এবং বাবার দায়িত্ব পালনে কখনো ব্যর্থ হন নাই। ভাল স্কুল, দামী গাড়ি, প্রকান্ড বাড়ি, সুন্দর সুন্দর পোশাক-আসাকে শেলি রুনার জীবন একেবারে ভরিয়া রাখিয়াছে। কিন্তু আজ শেলি রুনার কাছে বড় অসহায়। তাহার অষ্টাদশী রুনা আজ শেলিকে এমন কিছুর সামনে আনিয়া দাঁড় করাইয়াছে যেখানে শেলি না পারিতেছে তাহার অতীত জিবনের কাহিনী শুনাইতে, না পারিতেছে তাহার সেই অতীত কাহিনী কোনভাবে লুকাইতে। রুনা পন করিয়াছে, সে তাহার পূর্বপুরুষের ইতিহাস, বিশেষ করিয়া তাহার জন্মদাতা পিতা, পিতামহির কথা তাহাকে জানাইতেই হইবে। না জানিতে পারিলে তাহার এই সমাজে এই সংসারে থাকিবার মত আর কোন গতিও নাই, কাহারো কাছে তাহার মুখ দেখাইবার মত পরিস্থিতিও নাই। আর তাহা না হইলে অচিরেই হয়ত রুনা তাহার যাহা আছে সব কিছু ছারিয়া অন্য কোথাও মুখ লুকাইয়া বাচিয়া যাইবে। এমন একটা পরিবেশে শেলির কাছে সমস্ত মানবজীবন আর বিশ্বরচনা এক দুর্ভেদ্য বলিয়া মনে হইতে লাগিল। কি দিয়া কোথা হইতে কি শুরু করিবে আর কোথায় গিয়া তাহার এই দুর্ভেদ্য রচনা শেষ করিবে, তাহার আগাগোরা কিছুই শেলির মাথায় আসিতেছিল না। 

চায়ের কাপে চুমু দিতে দিতে রুনা মায়ের দিকে কয়েকবার আড় চোখে তাকাইল। মায়ের এই অতিব নিসচুপ বৈশিষ্ট রুনার কাছে আজ প্রথম নয়। মাকে যখন হইতে রুনা বুঝিতে শিখিয়াছে, তখন হইতেই সে দেখিয়াছে তিনি কোথাও বেড়াইতে যান না, তাহার কোন একান্ত বন্ধু বা বান্ধবি আছে তাহাও না, কাহারো সঙ্গে মা খুব একটা মিশেনও না। চাপরাশি, আর্দালি, পিয়ন সবাই যার যার কাজ করিয়া দিয়া যায়, এত বড় ব্যবসার কোথায় কি হইতেছে তাহার প্রতিদিনের হিসাব মা না রাখিলেও ব্যবসা যে ঠিকমতই চলিতেছে মা তাহার হিসাব হয়ত রাখেন। দিনের অধিকাংশ সময়ে মা ঘরেই থাকেন, শুধুমাত্র বিকালে একবার পারভিনের মাকে লইয়া ছাদের ঐ চিলে কোঠায় উঠিয়া বিশাল আকাশের দিকে তাকাইয়া শুধু সূর্যাস্ত দেখেন। এই সময় মায়ের সঙ্গে শুধু পারভিনের মা তাহার একান্ত সঙ্গিনী, আর কাউকেই মা তাহার কাছে রাখিতে পছন্দ করেন না। পারভিনের মা আমাদের বাড়ীতে অনেককাল ধরিয়া আছে, তখনো পারভিনের জন্ম হয় নাই। এখন পারভিন তাহার সংসার লইয়া অনেক দুরের এক শহরে স্বামীর সংসার করিতেছে। পারভিনের বাবাকেও আমি কখনো দেখি নাই। কোন এক অজ্ঞাত কারনে তিনি নিখোঁজ হইয়া রহিয়াছে। এইটুকুই আমি জানি। আমি আমার বাবাকেও দেখি নাই। যতবার মাকে জিজ্ঞসা করিয়াছি, মা কোন না কোনভাবে তাহা এরাইয়া গিয়াছেন। খুব বেশি পিড়াপীড়ি করিলে হয়ত তিনি "তোঁর বাবাকে আমি ..." এইটুকু বলিয়াই অন্য কোন এক প্রসঙ্গ টানিয়া আনিতেন। আমার বাবা কি জিবিত আছেন না মারা গিয়াছেন, তাহার কোন সদুত্তর আমার এখনো জানা নাই। মাকে আমি কখনো বিধবার মত শাড়ি পরিতে দেখি নাই, মাকে আমি বাবার কোন মৃত্যুবার্ষিকী পালন করিতেও দেখি নাই। আমি মাকে কখনো বাবার প্রসঙ্গে কোন কথা বলিতেও দেখি নাই। কি হইয়াছে তাহলে আমার বাবার? আমাদের সারা বাড়ীতে বাবার কিংবা দাদাদাদির কোন একটা ছবিও নাই। আমার মা সবার হইতে এমন আলাদা এক জগত লইয়া যেন বসবাস করিতেছেন। অথচ তিনি এই সমাজেরই একজন অতি গনমান্য মানুষদের মধ্যে একজন। অনেক মানুষের তিনি অসময়ের বন্ধুও বটে।  

আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমার মা এত উদাসিন কেন? কি নাই তাহার? বাড়ি, গাড়ি, মানসম্মান, প্রতিপত্তি, যশ, টাকাপয়সা, ব্যবসা-বানিজ্য, সবই আছে তাহার। এই বয়সেও তিনি অনেক সুন্দরি মায়েদের থেকে অধিকতর সুন্দর।  অনেক দামী শাড়ি হয়ত পরেন না কিন্তু দামী শাড়ি পড়িবার জন্য তাহার আয়েরও কোন কমতি নাই। আজ আমি মাকে বড় ভয় পাইতেছি। কারন আমি মাকে এমন কিছু কথা শুনাইয়া দিয়াছি, হয় মা আমাকে ছারিবেন, না হয় আমি মাকে ছারিব। কিন্তু আমাকে আমার পরিবারের ইতিহাস শুনাইতেই হইবে। তাহা না হইলে আমি কি করিয়া ঐ অপূর্বের বাসায় আমার বংশপরিচয় দেব? আমি তো অপূর্বকে ভালবাসি। আমার বারংবার শুধু এই কথা মনে করিয়া ভয় হইতেছিল যে, মা কি আমাকে এমন কিছু বলিবার জন্য প্রস্তুত যাহা আমি শুনিবার জন্য প্রস্তুত নই? ভয় যখন মানুষের উপর ভর করে, তখন তাহার রক্তের শিরায় শিরায় এক অজানা শিহরন তোলে, মনে হয় বুকের ভিতর কি যেন নাই, বা কি যেন দ্রুত হারাইয়া যাইতেছে। মাথা ভনভন করিতে থাকে, স্বাভাবিক আচরন আর স্বাভাবিক মনে হয় না। 

মা নিরবতা ভাঙ্গিয়া আমার দিকে তাকাইয়া একটু মুচকি হাসিয়া আমার কাছে একটু আগাইয়া আসিয়া আমাকে জড়াইয়া ধরিলেন আর বলিলেন, 'তুমি অপূর্বকে ভালবাস?'

আমি বলিলাম, হ্যা, আমি অপূর্বকে ভালবাসি মা।

-অপূর্ব কি তোমাকে ভালবাসে?

আমিও মাকে জড়াইয়া ধরিয়া হাতের কাপটি মাটিতে রাখিয়া শুধুমাত্র ঘাড় নাড়াইয়া এই বলিয়া সংকেত দিলাম যে, মা যাহা জানিতে চাহিয়াছেন, তাহা সত্য এবং ইহার বাহিরে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। 

মা আমাকে এইবার তাহার বাহুবল হইতে ছাড়িয়া তাহার চেয়ারে হেলান দিয়া জিজ্ঞেস করিলেন, 'রুনা মা, তুমি আমার কাছ হইতে কি জানিতে চাও?'

বুঝিলাম, শতবার এরাইয়া যাওয়ার যে উত্তর আমি জানিতে চাহিয়াছিলাম, আজ মা তাহার সব উত্তর দিতে হয়ত নিজেকে প্রস্তুত করিয়া আমার সামনে হাজির হইয়াছেন। আজ হয়ত তিনি কোন কিছুই এরাইয়া যাইবেন না। হয়ত অন্যদিনের মত বলিবেন না যে, ;আমি তোঁর বাবা...' ইত্যাদি। 

-মা, আমি আমার পরিবারের ইতিহাস জানিতে চাই। আমি আমার পূর্বপুরুষের ইতিহাস জানিতে চাই, আমি আমার বাবার ইতিহাস জানিতে চাই। কথাগুলি বলিতে আমার বুক কাপিতেছিল, আমার হাত কাপিতেছিল, আমার গলা ধরিয়া আসিতেছিল। আমি স্বাভাবিক নই এখন আমার মায়ের সামনে। অথচ এই মা আমার সবচেয়ে কাছের একজন মানুষ যাহাকে আমি কোন কিছুই বলিতে সংকোচবোধ করি না। কিন্তু আজ আমার অনেক ভয় করিতে লাগিল। 

মা অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাহার দুইখানা হাত তাহার বিসন্ন মুখে একবার বুলাইয়া চোখের চশমাটা খুলিয়া শাড়ীর আচল দিয়া মুছিতে মুছিতে দূর আকাশের দিকে তাকাইয়া শুধু বলিলেন,-'মানুষের অনেক পুরানো ইতিহাস না জানাই বর্তমান সময়ের জন্য মঙ্গলকর, তারপরেও যদি কেহ তাহা জানিতে পন করিয়া বসে, তাহা হইলে তাহাকে তাহার অতীত জীবনের সত্যের মুখুমুখি দারাইবার যে জীবনীশক্তি দরকার, তাহা আছে কিনা জানা খুবই প্রয়োজন। তাহা না হইলে বর্তমানকে মানিয়া লইয়া বাচিয়া থাকিবার যে অনুশোচনা তৈরি হইবে তাহার থেকে পরিত্রান পাওয়া বড়ই দুস্কর। আমি তোমাকে এই উভয় সংকট পরিস্থিতে ফেলিতে চাহি নাই। তারপরেও যখন তুমি এতটাই পন করিয়া বসিয়া আছ, তোমার জীবনের কাহিনী তোমাকে আজ আমি শুনাইব। জানিতে পারা আর মানিয়া লইতে পারা সব তোমার উপর নির্ভর করে'। 

আমার বড় ভয় করিতে লাগিল। 

-আজ হইতে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমি তোমার মতই একজন চঞ্চলা যুবতি মেয়ে ছিলাম। কত হইবে আমার বয়স তখন? হয়তবা বাইশ কিংবা তেইশ। আমাদের গ্রামে তখনো বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল। অনেক চরাইউৎরাই পার হইয়া সেই অজপারাগায়ের সমস্ত বাল্যবিবাহের আইন কানুন ভাঙ্গিয়া আমি সবেমাত্র ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হইয়াছি। গ্রামে আমার বাবা অতি ধনি না হইলেও আমরা দরিদ্র ছিলাম না। আমরা তিনবোন, একভাই আর মাকে লইয়া আমার বাবা বেশ ভালই জীবনযাপন করিতেছিলেন। স্কুলের গন্ডি হইতে শুরু করিয়া ঐ ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত আসিতে আমি অনেকবার বিবাহের সম্বন্ধ লইয়া অনেক পেরেশানিতে ভুগিয়াছি। দাদা দাদির ধমক হইতে শুরু করিয়া, জ্যাঠা জ্যাঠির, ফুফা ফুফির সবারই কম বেশি ধমক আর মানসিক নির্যাতন খাইয়াছি। কিন্তু আমার বাবা আমার মনের ইচ্ছার কথা জানিতেন। তাহার হয়ত অনেক সাহস ছিল না কিন্তু তিনি আমাদের সব ভাইবোনদের মধ্যে আমাকে বিশেষ নজরে দেখিতেন বলিয়া আমার ইচ্ছার বাহিরে কখনো মতামত দেন নাই। বিশেষ করিয়া আমার বিবাহের বেলায় তো কখনই জোরাজোরি করেন নাই। গ্রামের পঞ্চায়েত, মুরিব্বিগন, এমন কি আমার দাদা দাদিদের কাছেও আমার বাবাকে আমার এই বিবাহ লইয়া অনেক কঠোর কথা শুনিতে হইয়াছিল। তখন সবেমাত্র দেশ স্বাধীন হইয়াছে, ফলে দেশে খুব একটা আইন শৃঙ্খলা নাই এবং একটা অরাজকতার বিশৃঙ্খলা বিরাজ করিতেছিল। যাহারা দেশ স্বাধীন করিয়া জীবিত ফিরিয়া আসিয়াছে, তাহাদের হইতেই এখন আমাদের সবচেয়ে বিপদের আশংকা বেশি মনে হইতেছিল। কোন এক অমাবশ্যার রাতে আমাদের গ্রামের নদীর ধারে আমার বাবার মৃত দেহখানি পাওয়া গেল।' কে বা কাহারা এই হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত ছিল তাহা আজো অবধি তাহার কোন কূলকিনারা হয় নাই।  

এই বলিয়া মা কিছুক্ষন চুপ করিয়া থাকিলেন। আমার এতক্ষন যে ভয়টা আমাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছিল, তাহা আরও বেশি করিয়া চাপিয়া ধরিল। আমি কি কোন লোমহর্ষক ইতিহাস শুনিতে যাইতেছি? নাকি কোন এক রূপকথার গল্প শুনিতে যাইতেছি? ইহার পরে কি শুনিব যে আমার বাবাও আমার দাদার মত কোন এক অমাবশ্যার রাতে খুন হইয়া লাশ হইয়া গিয়াছিল? আমার শরীর হিম হইয়া আসিতে লাগিল। 

মা বলিতে শুরু করিলেন, 'জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য হইল, সে একদিন মরিবেই। বিধাতাকে কেহ মানুক আর নাইবা মানুক, বিধাতা মানুষের জন্মের দ্বারা একটা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন, আর তাহা হইল, সে একদিন এই সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করিয়া, সমস্ত লোভ লালসা পিছনে রাখিয়া, সমস্ত ধন দৌলত হাত হইতে ছাড়িয়া দিয়া একা একা নিঃসঙ্গভাবে সবার চোখ হইতে চিরতরে আড়াল হইয়া যাইবেই। সময়টা হয়ত কারো শতবছর পর আবার কারো তারও আগে। কয়েকদিন অতি প্রিয়জনেরা তাহাকে লইয়া কান্নাকাটি করিবেন বটে কিন্তু সময়ের স্রোতে একদিন সব বিবর্ণ হইয়া কালের অতল গভীরে হারাইয়া যাইবে। তাহাকে আর কোথাও খুজিয়া পাওয়া যাইবে না। না তাহার উত্তরসূরিদের কণ্ঠে, না পূর্বসূরিদের। ইহাই এই জীবনের তথা পৃথিবীর সরল সমিকরন। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের সংসারটায় যেন অকস্মাৎ ছাদ ভাঙ্গিয়া মাথায় পড়িল।  তিন বোন, এক ছোট ভাই আর মাকে লইয়া আমি যেন দেখিতে পাইলাম, এতদিন যাহারা বিনা দ্বিধায় আমাদের পরিবারে অন্নগ্রাস করিত, আজ তাহারা তাহাদের নিজ নিজ স্বার্থ লইয়া অতিশয় ব্যস্ত, দাদার সম্পত্তি লইয়া ভাগ বাটোয়ারা করিতে চারিদিকে পাঁয়তারাসমেত গোপনে একা কিংবা প্রকাশ্যে দল বাধিয়া শল্যপরামর্শ করিতেছে। পরিশেষে আমাদের ভাগ্যে যাহা জুটিল তাহা দিয়া আর যাহাই হোক, আমাদের লেখাপড়া, সংসার খরচ চলিতে পারে না। আমার মা হিমশিম খাইয়া দিশেহারা হইয়া দিক্বিদিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। আর এরই মধ্যে আরও একটা নব্য উৎপাত শুরু হইল। আমার বিবাহের সম্বন্ধ পাকাপাকি করা। আমার দাদা দাদিরা, ফুফা ফুফিরা, সবাই শক্ত করিয়া আমাদের কি প্রকারে বিশেষ উপকার করা যায় তাহার বুদ্ধি বাহির করিতে লাগিল। ফলশ্রুতিতে যাহা দারাইল, তাহা হইল, সবাই এবার আমার মাকে ঝাঁকিয়া ধরিল যে, এত লেখাপড়া করাইয়া কে কবে কোন লাট সাহেবের বউ হইয়াছিল? ধীরে ধীরে একে একে আমাদের সবার বিবাহ সম্বন্ধ ঠিক করিবার জন্য দিনের পর দিন মানসিকভাবে চাপের মুখে পরিতে হইল। আমরা যেন আর অধিক চাপ বহন করিবার মত শক্তি পাইতেছিলাম না।  

কোন উপায়ন্তর না দেখিয়া একদিন আমি আমার মাকে বলিলাম, 'মা, শুনেছিলাম আমার বাবার এক অতি পরিচিত এক বাল্যবন্ধু আমাদের এই মহল্লায় বাস করত। তার অনেক ব্যবসা ছিল, অনেক দানখয়রাতও করতেন বলে তার সুনাম আজো এই মহল্লায় রয়েছে। তিনি যদিও আর এই মহল্লায় বাস করেন না কিন্তু শুনেছি তিনি নতুন রাস্তার পাশে বিরাট বাড়ি করে ওখানেই বসবাস করেন। খুজে পেতে খুব অসুবিধা হবে বলে তো আমার মনে হয় না। একবার কি তার সাথে দেখা করব?' 

যাহাদের পেটে ক্ষুধা, যাহাদের আশ্রয়স্থল বলিতে এক ভগবান ছাড়া আর কেহ থাকে না, যাহাদের চারিদিকে হায়েনাদের মত অসংখ্য পিশাচ বসবাস করে, যাহাদের সাহায্য করা উতিচ অথচ তাহারাই যদি অত্যাচারি হইয়া যায়, তখন মানুষকুলে যদি এমন কাহারো একবার ক্ষিন সন্ধানের ছিটেফোঁটাও থাকে, যাহাকে ধরিয়া একবার নিরাপদ আশ্রয় পাইতে পারে, তাহা হইলে চেষ্টা করিয়া দেখিতে আপত্তি কি? আমার মা কিছুক্ষন ভাবিয়া আমার হাত ধরিয়া বলিলেন, 'চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।' 

পরদিন আমি আর আমার মা সকাল সকাল ঐ নতুন রাস্তার ধারে আসিয়া হাজির হইলাম। আমাদের ইহাই প্রথম শহরে আসা নয় তারপরেও মনে হইতে লাগিল আজিকার আসা আর আগের বহুবার আসার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রহিয়াছে। শহরের রাস্তায় অসংখ্য মানুষের যাতায়ত, আমাদের গ্রামের দুই একজনের সহিতও আমাদের দেখা হইয়া গেলো। বিশেষ কোন কারন না দেখাইয়া আমরা তাহাদেরকে এক প্রকার এরাইয়াই গেলাম। অনেক খুঁজাখুঁজির পর বাড়িটির সন্ধান পাইলাম বটে কিন্তু তাহার সহিত দেখা করিবার যে তরীকা, তাহাতে আজ ফিরিয়া যাইতেই হইবে বলিয়া আমাদের আশংকা হইল। তিনি বাড়ি নাই বলিয়া গার্ডের সংক্ষিপ্ত উত্তরে আমাদের নতুন করিয়া আরেক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলিয়া দিল। দারোয়ান গেট বন্ধ করিয়া দিল, ভিতরে প্রবেশের কোন সুযোগ রইল না। 

বাড়ি ফিরিয়া যাইবার অপেক্ষায় মা আর আমি দাঁড়াইয়া আছি, এমন সময় কালো একখানা গাড়ি বাড়ীর সুম্মুখে আসিয়া কিঞ্চিত একটি হর্ন বাজাইয়া গেট খুলিবার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া গেল। কালো গ্লাস দিয়া ঢাকা থাকায় ভিতরে কে বা কাহারা বসিয়া আছেন আমরা কিছুই দেখিতে পাইলাম না। দারোয়ান দ্রুত গেট খুলিতে গিয়া গেটের পাশে আমাদের দেখিয়া মনিবের সামনে অতি উচ্চকন্ঠে দূর দূর করিতে লাগিলেন। একটু অপমান বোধ হইতে লাগিল যেন আমরা কোন এক নমশূদ্রের দল এই ব্রাহ্মণ বাড়ীর গেটে আসিয়া দারায়াছি বলিয়া সমস্ত বাড়ীটি অপবিত্র হইয়া গেল। নিজের উপর নিজের খুব রাগ হইতে লাগিল।

     

মনের রাগ, আর অপমানে 'কেন আসিয়াছিলাম' এই অনুশোচনা লইয়া মা মেয়ে ধির পদক্ষেপে বাড়ীর দিকে রওয়ানা হইয়াছি, এমন সময় দারোয়ান আবার হন্তদন্ত হইয়া পিছন হইতে আমাদের ডাকিয়া বলিলেন,-'এই যে শুনছেন? সাহেব আপনাদেরকে ডাকছেন'। এই কথা শুনিয়া মনের ভিতর যেমন একটা আশার সঞ্চার হইল, তেমনি আবার সংশয়েরও সৃষ্টি হইল। কি জানি আবার কোনো অপরাধ হইল কিনা, কিংবা সাহেব আবার কি বলিয়া আমাদের নতুন করিয়া অপমান করিবেন কিনা ইত্যাদি। 

এবার সাহেব নিজেই আগাইয়া আসিলেন এবং জিজ্ঞেস করিলেন, কোথা হইতে আমরা আসিয়াছি। মা তাহার ঘোমটাখানি সরাইবামাত্র মাকে দেখিয়াই সাহেব চিনিতে পারিলেন। অতি উচ্ছ্বসিত হইয়া মায়ের একেবারে কাছে আসিয়া সহাস্যে বলিলেন, 'আরে, এ যে আমাদের বৌদি? কি ব্যাপার এতদিন পর আমাদের মনে পড়ল?' 

আমি লোকটিকে আগে কোথাও দেখিয়াছি কিনা মনে পরিতেছে না কিন্তু কোথাও তাহাকে দেখিয়াছি তাহা আমি নিশ্চিত। তাহার বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ কি তাহার কাছাকাছি হইবে। সুঠাম দেহ, পরিপাটি চুল, সাদা চেকের উপর ফোঁটা ফোঁটা কালো রঙের চেকে পরিহিত একটা শার্ট, হাতে সোনালী রঙের একটি ঘড়ি, বেশ মানাইয়াছে। মাথা ভর্তি চুল। মুচকি হাসিলেও ভাল লাগে আবার অট্টহাসিতেও বেমানান লাগে না। দুই চোখের মাঝখানে একটা কাল তিলক। বেশ হাসিখুশি একজন মানুষ বলিয়া মনে হইল। সাহেব মাকে একরকম পিঠে হাত দিয়া তাহার সহিত তাহাদের অন্দরমহলে লইয়া গেলেন। আমি মাকে শুধু অনুসরন করিয়া আমিও পিছুপিছু অন্দর মহলে প্রবেশ করিলাম। সাহেব বলিলেন, 'তোমরা একটু বস, আমি কয়েক মিনিট পর এসে তোমাদের সাথে কথা বলব'। এই বলিয়া তিনি তাহার ঘরে চলিয়া গেলেন। 

আমরা তাহার ড্রইং রুমে বসিয়া আছি। বিশাল ঘর, চারিদিকে বিদেশী টাইলসের দেয়াল, সাজানো ঘরের মত আঙ্গিনা। পর্দাগুলি এসির বাতাসে ঝিরঝির হাওয়ায় অল্পঅল্প নরিতেছে, ঘরের একপাশে বিশাল একটা একুরিয়াম। রঙ বেরঙের মাছ তাহার ভিতরে খেলা করিতেছে। একুরিয়াম হইতে কখনো কখনো বুদবুদ উঠিতেছে, মনে হইতেছে মাছগুলি ডুবুরিদের মত নিঃশ্বাস ছারিতেছে। দেয়ালের এক কোনায় একটি মহিলার বিশালকায় একটি ছবি টাঙ্গানো আছে। শরীর ভর্তি গহনা। কানে গহনা, গলায় গহনা, নাকে গহনা, মাথার চুলের ঠিক মধ্যিখানে একটি মাথলা টিকি। মনে হইতেছে গহনাগুলি যেন ঠিক জায়গা মত বসিয়া মহিলার রূপ আরও শতগুনে বৃদ্ধি করিয়া দিয়াছে। 

-এটা পারুলের ছবি। মা বলিলেন। 

পারুল সাগর সাহেবের স্ত্রী। অনেক বছর আগে তিনি গত হইয়াছেন। পারুলের মৃত্যুর পর সাগর আর বিয়া করেন নাই। তাদের কোন সন্তানাদিও হয় নাই। পারুল যে বছর মারা গিয়াছে, তাহার পরের বছরই সাগর সাহেব আমাদের মহল্লা ত্যাগ করিয়া নতুন জায়গায় চলিয়া আসিয়াছেন। পারুল আমাদের গ্রামের মেয়ে ছিল। তবে পারুলের বয়স আমাদের হইতেও কম ছিল। 

-'কিভাবে মারা গিয়াছিল'? আমি মাকে প্রশ্ন করিতেই মা বলিলেন, পারুলের প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় পারুল দেহত্যাগ করে। এই পারুলের নামেই পরবরতিতে সাগর সাহেব একখানা দাতব্যালয় দিয়াছিলেন আর ঐ দাতব্যালয় হইতেই তিনি অনেক দান খয়রাত করিতেন। কি কারনে কেন তিনি তার সেই দাতব্যালয় আর চালাইলেন না তাহা আমরা ভাল করিয়া বলিতে পারিব না। কিন্তু তিনি আর বিয়াথাও করেন নাই শুনিয়াছি।    

-'এই যে বৌদি, কি মনে করে আজ এত বছর পর আমাদের মনে পড়ল? তোমরা একা আসলে কেন? দেওয়ান ভাই আসে নাই যে?' 

বলিতে বলিতে আমাদের সামনের সোফায় আসন গ্রহন করিলেন। সাগর সাহেব ইতিমধ্যে তাহার একটু আগে পরিহিত জামা প্যান্ট পাল্টাইয়া একটা সাদা পাঞ্জাবির সঙ্গে মেরুন রঙের স্যালয়ার পড়িয়াছেন, হাতের ঘড়িটি এখন আর নাই। মনে হইল তিনি এইমাত্র স্নান করিয়া আসিয়াছেন। চুলগুলি এখনো ভিজা, গা হইতে একটা পারফিউমের গন্ধ আসিতেছে, তাহার আগমনে ঘরটি যেন সুগন্ধিতে ভরপুর হইয়া গেলো 

তাহার প্রশ্ন শুনিয়া বুঝিতে পারিলাম, তিনি এখন আর আমাদের মহল্লার খবর রাখেন না। আমার বাবা দেওয়ান যে অপঘাতে মৃত্যুবরন করিয়াছে, সেই খবর তাহার জানা নাই। মা নিসচুপ হইয়া বসিয়া আছেন। ক্ষনিকপর মা তাহার জীবনের সমস্ত ঘটনা একে একে খুলিয়া বলিলেন। সাগর সাহেব অনেক্ষন ধরিয়া আমাদের সমস্ত ইতিহাস শুনিলেন। মাঝে মাঝে কিছু প্রস্ন করিলেন বটে কিন্তু তাহা নিতান্তই কিছু না। একসময় সাগর সাহেব আমার দিকে তাকাইয়া যা বলিলেন, তাহা এইরুপ- 

-'তোমার বাবা আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন। আমরা ছোট বেলায় একসঙ্গে একই গ্রামে মানুষ হয়েছি। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে কোনও রকমে একমুঠো ভাত খেয়ে নদীতে গিয়ে ইচ্ছামতো ঐ ধলেশ্বরী নদীতে ডুব পারতাম, কখনো কখনো সন্ধ্যা নাগাদ মাছ ধরতাম। কোন কোন দিন নদীতে না যেয়ে একেবারে স্কুলের মাঠে গিয়ে ভররোদে মেন্ডা গাছের মেন্ডা দিয়ে ফুটবল বানিয়ে দুইজনে ফুটবল খেলতাম। কখনো আবার বড়দের সঙ্গে খেলায় অংশ নিতে গিয়ে আমরা দুজনে শুধুমাত্র গোল কিপার ছাড়া আর কোনখানেই খেলত পারতাম না। যদিও আমার থেকে তোমার বাবা প্রায় তিন চার বছরের বড় হবে কিন্তু তিনি ছিলেন আমার নিত্যদিনের একজন সঙ্গি। তোমার বাবার যখন বিবাহ হল তখন আমার বয়স হইবে বড়জোর চৌদ্দ কি পনের। তার কয়েক বছর পর আমি চলে আসি শহরের এক নামিদামী স্কুলে কিন্তু ছুটির দিনগুলুতে আমি গ্রামের ঐ আমাদের বাড়ীতে তোমার বাবার সঙ্গে সময়টা কাটাতে আমার বড় ভাল লাগত। তোমার বাবার আর পরাশুনা হল না। সারাদিন ক্ষেতের কাজ, খামারের কাজ, অনেক গরু পালত তোমার দাদা, তাদের নিত্যদিনের খাবার যোগার করা, নদীতে নিয়া গোসল করানো, বিকালে আবার তাদের খাবার খাওয়ানো, এসব নিয়ে তোমার বাবা এতটাই সময় কাটাত যে, আমিও একসময় আর ভাল করে সেই স্কুলের মাঠে খেলা করতে পারতাম না, ইচ্ছে করলেই আগের মত আর নদীতে গিয়ে অধিক সময় ধরে ডুবসাতার কাটতে পারতাম না। আস্তে আস্তে আমার কাছে গ্রামটা আর আগের মত মনে হচ্ছিল না। একদিন শুনলাম, আমার বন্ধু বাবা হয়েছে।' এই বলিয়া সাগর সাহেব মুচকি একটু হাসিয়া আমার দিলে আঙ্গুলি তুলিয়া বলিলেন, 'সেই বাচ্চাটি সম্ভবত তুমি। কি নাম তোমার? তোমার তো নাম জানাই আমার হল না।'

আমি এতক্ষন অবাক দৃষ্টিতে সাগর সাহেবের দিকেই তাকাইয়াছিলাম আর তাহার সেই ছোটবেলার আমার বাবার সাথে তাহার শৈশব কালের দিন গুলির কথা শুনিতেছিলাম।

আমার মনে পড়ে, আমি শুধু তাহাকে আমার নামটাই বলেছিলাম, - 'শেলি'।   

  

সাগর সাহেব আবারো তাহার সেই হারানো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করিতে করিতে বলিতে লাগিলেন,

-'এত অল্প বয়সের বাবার কি দায়িত্ব, কি করতে হবে বাবা হিসাবে, তা সে হয়ত জানতই না। কত হবে তখন তার বয়স? হয়ত ষোল কিংবা সতের? তাহার আরও ব্যস্ততা বেড়ে গেলো। আমি গ্রামে গেলে আর আগের মত দিন কাটত না। যাক, সেসব কথা এখন বলে আর কি হবে? অনেক বছর পর আবার যখন তোমার বাবার সঙ্গে আমার দেখা হল, তখন আমি সবেমাত্র বিদেশ হতে পরাশুনা শেষ করে গ্রামে গিয়েছি। অনেক প্রতিবেশিকেই তখন আমি চিনি না। অনেকে দেশ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছেন, গ্রামটা আমুল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল।'  

-আচ্ছা যাক সে ইতিহাস আজ আর না বলি। সাগর সাহেব আমাদের সবকথা শুনিয়া মাকে শুধু এইটুকু আশ্বাস দিলেন যে, তাহার অতিপ্রিয় বন্ধুর দেওয়ান পরিবারের জন্য তাহার যাবতীয় সাহায্য এবং সহযোগিতা যাহা কিছু লাগিবে, তিনি তাহার জন্য কোন কার্পণ্য করিবেন না। একে একে তিনি আমাদের সবার নাম জিজ্ঞাসা করিলেন, কে কোন ক্লাসে অধ্যায়ন করে, কিভাবে কখন কাহার কি লাগে সব আদ্যপান্ত জানিয়া লইলেন।  তিনি আরও বলিলেন যে, যেহেতু তিনি সব সময় নিজে হাজির থাকিয়া সব দেখভাল করিতে পারিবেন না, ফলে লোক মারফত যাহা লাগিবে, তাহা তাহাকে জানাইয়া দিলেই বাকি সব ব্যবস্থা তিনি করিতে পারিবেন। এ ব্যাপারে আর কোন সন্দিহান রহিল না। 

শেলী এই পর্যন্ত বলিয়া রুনার দিকে চাহিয়া এক্তা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আমাদের কষ্টের দিনগুলির সমাপ্তি হইলো, আমাদেরকে সাহাজ্য করার একজন মানব উপস্থিত হইলেন, আর কোনো সমস্যা রইলনা। গল্পটা এইখানে শেষ হইয়া গেলেই ভালো হইতো। কিন্তু গল্পটা আসলে এইখান থেকেই শুরু। 

সাগর সাহেব আমার মাকে কিছু উপার্জনের রাস্তা বাহির করিয়া দিলেন। আমার মা হাতের কাজ জানিতেন বলিয়া কয়েকটি শেলাই মেশিন কিনিয়া দিলেন, বাড়িতে কয়েকটা গাভী কিনিয়া দিলেন যেনো আমরা সবাই মাঝে মাঝে দুধ খাইতে পারি। সবাই ছাত্র তাই তিনি ভাবিলেন আমাদের পুষ্টিকর খাবারের দরকার। আর প্রতি মাসে একটা অনুদানের ব্যবস্থাও করিয়া দিলেন। আমার মা অনুদানের ব্যবস্থাটা গ্রহন করিতে চাহিলেন না, কয়েকটা শেলাই মেশিন আর গাভীর ব্যাপারটাতেই আমাদের সংসার চালাইয়া নিতে পারিবেন বলিয়া আমার মায়ের ধারনা ছিলো কিন্তু সাগর সাহেবের মমতার কোনো কমতি ছিলো না, আর তার এই দানে কিছু কমিয়া যাইবে সেইটাও নয়। ফলে আমার মায়ের অগ্রাজ্য কোনো কাজে আসিলো না। 

আমি আমার ভাইবোনদের লইয়া, আমার মাকে লইয়া আমাদের পরাশুনা লইয়া নতুন এক উদ্যমে আবার নতুন করিয়া জীবনের স্বপ্ন দেখিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, এইবার আর এই সুযোগ হারাইলে চলিবে না, সয়ং বিধাতা আমাদের একটা কুলে আনিয়া রাখিয়া গেলেন। শ্রদ্ধায়, বিনয়ে সাগর সাহেবকে আমার দেবতার মত মনে হইতে লাগিল। কচি মন, তার উপর দারিদ্র্যের উপদ্রপ, সব মিলিয়া মনে হইতে লাগিল, পৃথিবীতে ভালোলকের অভাব ঈশ্বর কম রাখেন নাই। তিনি তাহাদেরকে মাইলস্টোনের মতো এমন এমন জায়গায় রাখিয়া দিয়াছেন যেনো কেউ পথ হারাইয়া গেলে ওই মাইলস্টোন দেখিয়া আবার যাত্রা শুরু করা যায়। 

এই বলিয়া মা অনেকক্ষন নিরব হইয়া রহিলেন। পারভীনের মা আসিয়া আমার মায়ের নীরবতা ভাঙ্গিয়া জিজ্ঞেস করিল- দিদি, আজ চিলে কুঠিতে বেড়াইতে যাইবেন? এই সময়তায় মা আর পারভীনের মা যতো কাজ কর্মই থাকুক, মা আমাদের বাড়ির ছাদের উপর বসিয়া সন্ধ্যার আগের সূর্যাস্ত দেখেন। আমি আজো জানি না, ওই একই জিনিসের উপর মায়ের কি আকর্ষণ, কি সেই অমোঘ টান যে, আজ পর্যন্ত কখনো আমার মাকে অই সূর্যাস্ত দেখা হয় নাই এমন হইয়াছে। চিলে কোঠায় ছোট এক্তা বেলকনি আছে, তাহার উপর টিনের একটা চাল আছে, বৃষ্টিরদিনে ওই চিলে কোঠায় মা আর পারভিনের মা একা বসে বসে তখন হয়ত সূর্যাস্ত দেখেন না কিন্তু বৃষ্টির শব্দ শুনেন। মানুসের জীবনের অনেক রহস্য আছে যা তাহার একান্ত ব্যক্তিগত। হয়ত ইহা কাহারো কাজে লাগিবে কি লাগিবে না তাহার কিছুই যায় আসে না কিন্তু যাহার এই সম্পদ তিনি হয়ত বুঝিয়া থাকিবেন ইহার ভিতরে কি শান্তি আর কি মহিমা। ঈশ্বর মানুষকে অনেক রহস্য রাখিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন। কাহারো সূর্য ভালো লাগে, কাহারো চন্দ্র ভালো লাগে, কেউ আবার চৈত্রের দুপুর ভালো লাগে আবার কারো শিতের সকাল।

(অসমাপ্ত)...

২১/০৪/২০১৬-নবাবের কবরে একদিন

Categories

হ্যালো নবাব, কেমন আছো তুমি?

দেখো কি অবাক করার কান্ড। কোনোদিন কি কখনো ভেবেছো কিংবা আমিই কি ভেবেছি যে, তোমার মতো একজন নবাবের সামনে আমি এভাবে দাঁড়িয়ে সম্ভাষন করবো? তোমার সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কোন সম্ভাবনাই তো ছিল না। তুমি যখন এই পৃথিবীতে জন্মেছিলে তখন আমার পূর্ব পুরুষেরাও হয়ত জন্মগ্রহন করে নাই। কি করে তাহলে তোমার সাথে আমার দেখা হতো? তারপরেও আজ আমার সঙ্গে তোমার দেখা হলো। আমি দাড়িয়ে আছি ঠিক তোমার পাশে, তুমি শুয়ে আছ একদম একা, যদিও সেটা একটা কবর। তোমাকে একা পাবো এবং তোমার মত মানুষের সাথে একা দেখা করা যায় এটা আমার কেন এই ভারতবর্ষের কোন জনগনই তো বিশ্বাস করবে না। তোমার রানী(দের) যেখানে তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য অনুমতি লাগতো সেখানে আমরা কোন ছাড়! কিন্তু দেখো, অদৃশ্য বিধাতার কি ক্ষমতা, তিনি সব পারেন।  তাও আবার প্রায় চারশত বছর পর আমার সঙ্গে তোমার দেখা। আমি জীবিত আর তুমি মৃত। জীব-মৃতের এই খেলা শুধু একজনই পারেন, আর সেটা বিধাতা। তাঁর কাছে সময় যেমন স্থবির, জীবন ও স্থবির। জীবিত আর মৃতের মাঝখানে তিনি শুধু ফারাক রাখেন অদৃশ্য কোনো এক জাল, যা আমরা চোখে দেখি না, কিন্তু শেষে এক জায়গাতেই মিলিত করেন।

যাক সে কথা, ঈশ্বরের ক্ষমতা নিয়ে আমি তোমাকে কোনো প্রশ্ন করতে চাই না, না তোমার কাছে এর কোনো উত্তর আছে। যেহেতু তোমার সঙ্গে আমার আজ দেখা হয়েই গেলো, আমার কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল তোমাকে নবাব। তোমাকে সব কিছুর উত্তর দিতে হবে এমন কোন কারন নাই, কারন তুমি নবাব, অনেক কিছু তুমি আমাদের মত সাধারন মানুষকে নাও জানাতে পার। তবুও যদি সম্ভব হয় শুনতে পারলে হয়ত ভাল লাগবে।

আমি তোমাদের আমলের সেই উপমহাদেশের রাজনীতি বুঝি না, কিভাবে দেশ চালাতে হয়, তাও আবার উপমহাদেশের মত একটি সাম্রাজ্য, তারও কোন আইডিয়া আমার নাই। তারপরেও আমি খুব অবাক হই কি করে তুমি এতবড় একটা উপমহাদেশ তুমি তোমার নিয়ন্ত্রনে রেখেছিলে? তুমি কি কোন ক্যাডার বা রাজনৈতিক দলের মত দল করতে যারা তোমার এইসবে সাহাজ্য করতো? তোমার কোন বিরুধী দল ছিলো কি নবাব? তোমার সম্পদের হিসাব আমি জানি না কিন্তু শুনেছি তোমার নাকি অনেক সম্পদ ছিল। তুমি কি কোন ব্যবসা করতে নাকি নবাবীই তোমার পেশা ছিলো? তুমি কি কখনো কোন বেতন নিয়েছো? আর নিলে কত টাকা করে বেতন নিতে? আচ্ছা নবাব, তোমার কি কোন ব্যাংক একাউন্ট ছিল? সুইস ব্যাংক বা বিদেশী কোন ব্যাংক? তোমার কোনো ক্যাশ টাকা পয়সা লাগতো না? রানীরা তোমার কাছ থেকে কখনো ক্যাশ টাকা পয়সা চাইতো না? প্রজারা কি তোমাকে খুব ভালবাসতো? তোমাকে কি কেউ ঘৃণা করতো কখনো? আর কেউ যদি তোমাকে কখনো ঘৃণা করতো, তাহলে তুমি তাকে কি করতে? মেরে ফেলতে? গুম করে ফেলতে? নাকি বিরোধী মতবাদের কারনে তাকে রাজ্য ছাড়া করতে? তোমাদের সময় কি কোন টক শো হতো? সেই টক শো তে কি কেউ বিজ্ঞজনের মতো তোমাকে বা তোমার শাসন কালকে প্রশ্নবিদ্ধ করতো? নাকি সভাসদ পরিষদে তুমিই শুধু একা কথা বলতে? তুমি কি কখনো ভেবেছিলে তুমি একদিন এই পৃথিবীতে থাকবে না? কখনো কি তোমার এই উপলব্দি হয়েছিল যে তোমার মরনের পর তোমাকে নিয়ে জনগন সমালোচনা করবে? কখনো কি ভেবেছিলে যে, তোমার গড়া এই অট্টালিকা, এই সাম্রাজ্য, তোমার চেয়ার, তোমার খাট, তোমার সবকিছু অন্য একজন ব্যবহার করবে আর তুমি অন্য সবার মত এই ভিজা মাটির নিচে স্যতস্যতে জায়গায় কোন এক অন্ধকার পরিবেশে শুয়ে থাকবে? কখনো কি তোমার জীবদ্দশায় এই উপলব্ধিটা হয়েছিল যে, তুমি আর কখনই এই পৃথিবীর আলো বাতাস, গাছ, ফল মুলাদি, আতর সুগন্ধি, রানী রমণী, সোনা দানা, ক্ষমতা, কোন কিছুই উপভোগ করতে পারবে না? এমন কি তুমি আর ফিরেও আসতে পারবে না? এমন কখনো কি তুমি একবারের জন্যও ভেবেছিলে?

তুমি কি এখনো আগের মত দেশি বিদেশী অনেক পানীয়, রাজ্যের সব সুন্দরীদের সমন্নয়ে বাইজীর আসর, শ্বেত পাথরের কিংবা কষ্টি পাথরে গড়া মোজাইক ফ্লোর, সোনার পালঙ্ক, অনেক মহামুল্যবান হিরের আংটি, জহরতের মালা, আর্দালি, পাইক পেয়াদা যে সব তোমার এখানে একসময় ছিল, তা পাও ওখানে নবাব? তোমার আশেপাশে কি তোমার অতি প্রিয় সেনাপতি, মন্ত্রী মহোদয়, উজির নাজির আছে যারা এক সময় তোমার অংগুলীর ইশারায় সারা দেশ কাপিয়ে দিতো? তোমার একা থাকতে এখন কষ্ট হয় না? তোমার কি আবার ফিরে আসতে ইচ্ছে করে তোমার সেই রাজকীয় প্যালেসে কিংবা ঘুমাতে ইচ্ছে করে ঐ সোনার খাটে যা তুমি পারস্য রাজ্য থেকে ছিনিয়ে এনেছিলে একদিন? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে সব।

জানো নবাব, আমার মাঝে মাঝে তোমাকে বেশ বোকা বোকা বলে মনে হয়। তুমি এতকিছু বুঝতে পেরেছিলে, উপমহাদেশ কিভাবে চালাতে হয়, কিভাবে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্য দখল করতে হয়, কেমন করে বিনা ব্যবসায় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নিজের করে নিতে হয়, অমর হয়ে থাকার জন্য কত বিশাল বিশাল প্যালেস বানাতে হয় কিন্তু তোমার মরনের পর তোমাকে কে দেখভাল করবে, তোমার এই সিংহাসনে যেন কেউ না বসতে পারে, শুধু তোমার আদেশই যেন আজিবন চলে, সেই ব্যবস্থাটা কেন করে যেতে পারলে না নবাব? বিধাতার দেওয়া ধর্ম পাল্টে তুমি ‘দ্বীনে এলাহি’ও করে ফেললে, কোন পরোয়া করলে না। তুমি তোমাকে তাঁর সমকক্ষ ভাবতে পারলে, অথচ তুমি তাঁরসঙ্গে আরও একটু সমঝোতা করলেই কিন্তু তুমি অনেক কিছু করতে পারতে। এটা কিন্তু তুমি বোকামী করেছো।

নবাব থাকা অবস্থায়ন ন্যায় অন্যায়, সৎ অসৎ কোনো কিছুই পরোয়া করলে না, এর মধ্যে কোন ব্যবধান করলে না, মানবাধিকার, ভদ্রতা, সৌজন্যতা, বিচার-অবিচারের মধ্যে তুমি কিছুই ফারাক করলে না, তোমার যা ইচ্ছে তাই তুমি করতে পারলে কিন্তু তুমি কি একবারো ঐ অদৃশ্য বিধাতে কিছু ঘুস দিয়ে তুমি অমরত্ব নিতে পারলে না নবাব? তোমার তো কোন কিছুরই কমতি ছিল না। কি হত যদি উপমহাদেশের কিছু জায়গা, জমি, অথবা সোনা দানা, জহরত, হিরা, সুন্দরি রমণী দিয়ে ঐ অদৃশ্য ভগবানকে বশ করতে? তাহলেই তো তুমি আজ বেচে থাকতে পারতে, তোমার সঙ্গে আজ আমার সরাসরি জীবন্ত শরীরে দেখা হতো।

আচ্ছা নবাব, তুমি তো প্রায় চারশত বছর আগে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছো। তুমি দেখতে কি এখনো আগের মত আছো? তোমার গলায়, তোমার হাতে যেসব সোনাদানা হীরা জহরত ছিল সেগুলি কি তোমার সেনাপতিরা, তোমার উপদেষ্টারা তোমার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলো? তুমি কি ওগুলো এখনো হাতে গলায় মাথায় পড়ে থাকো? নাকি খুলে রেখেছো? কোথায় রেখেছো এখন এগুলো? তুমি কি আরও বৃদ্ধ হয়েছো? নাকি যেহেতু কোন টেনশন নাই, ফলে তুমি আরও সুন্দর হয়েছো? তোমার সেনাপতিরা, তোমার সুন্দুরি রমণীরা তোমার অসংখ্য ছেলেপুলেরা, নাতি নাতকুরেয়াও আজ অনেকেই এই পৃথিবী থেকে চলে গেছে যাদেরকে তুমি খুব ভালবাসতে। তোমার সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে? শুনেছি, মানুষ মরার পরে নাকি কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর সারা শরীর পচন ধরে, পোকারা খেয়ে বিনাশ করে শরীর, তারপর ধীরে ধীরে হাড়ও মাটির সাথে মিশে যায়। মাথার খুলিটা কেউ দেখলে এটাও বুঝা যায় না, সে কি রাজা ছিলো নাকি প্রজা? নাকি মহিলা অথবা পুরুষ? তোমারো কি একই হাল হয়েছে নবাব? নাকি তুমি অনেক শক্তিশালী ছিলে বলে পোকারাও তোমাকে বিনাশ করতে পারে নাই?

জানো নবাব, আমি মাঝে মাঝে খুব অবাক হই এই ভেবে যে, তোমার অনেক বংশধরেরা কিন্তু এখনো এই পৃথিবীতে বেচে আছে। কিন্তু কে কোথায় কিভাবে বেচে আছে তাদের কোন হিসাবও আমরা জানি না। আর তারাও যে কেনো বলে বেড়ায় না যে তারা নবাবের বংশের লোক! কেনো নবাব? কি জানি হয়ত তোমার বংশের লোক বলে জানাজানি হয় গেলে না জানি আবার কি বিপদ হতে পারে এই ভেবে হয়ত বলে না। হয়ত এমনও হতে পারে, তুমি জনগনের উপর টর্চার করেছো এই অভিযোগে তারা এখন তোমার বংশের উপর খুব রাগান্বিত, হয়ত এমনো হতে পারে যে তোমার অবিচার, অন্যায়, মানবাধিকার লঙ্ঘন, তোমার বেহিসাবি খরচের তালিকা ইত্যাদির কৈফিয়ত তারা দিতে পারবে না বলেই এখন নিসচুপ জীবন বেছে নিয়েছে। আবার এমনও হতে পারে তোমার অন্তর্ধানের পর তোমার এই বিশাল সাম্রাজ্য ধরে না রাখার কারনে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় অগোচরে থাকাই ভাল এই যুক্তিতে প্রকাশিত হয় না, আবার এমনও হতে পারে আসলেই কেউ আর বেচে নেই তারা। বড় অবাক লাগে যে, এককালের এতো প্রতাপশালী নবাবেরা এভাবেই বংশসহ হারিয়ে যায় এই পৃথিবীর বুক থেকে। ওদের শুধু ইতিহাস বেচে থাকে কিন্তু বংশ বেচে থাকে না। অথচ তোমার আশেপাশে যারা ছিল তাদের অনেকের বংশধরেরা এখন অনেক বড় লোক, কেউ আবার রাজনীতি করে, কেউ বড় বড় ব্যবসায়ী, ওদের অনেক টাকা, সুইস ব্যাংকে, বিদেশী ব্যাংকে, আরও অনেক দেশের ব্যাংকে। ওরা এক দেশের সরকারের আরেক দেশের সরকারের সঙ্গে বসে গল্প করে, তাস খেলে, মদ খায়, ফুর্তি করে, আরও কত কিছু? কিন্তু তোমার বংশের কোন লোককেই আমি চিনি না নামও জানি না আদৌ ওরা কেউ আছে না নাই।

যাক, নবাব, আমাকে এখানে অনেক সময় থাকতে দিবে না কারন তুমি নবাব, তোমার পাশে অনেক্ষন দাড়াতেও আমাকে দিবে না। আবার কখনো যদি তোমার এখানে আমার আসা হয়, তোমার সঙ্গে আমার আবার কথা হবে, যদি পারো আমাকে একটু জবাবগুলো দিও।

তুমি ভাল থাকো নবাব।      

১৫/০৪/২০১৬- পহেলা বৈশাখের উপলব্ধি

Categories

মীরপুর গোলারটেক, ঢাকা 

শহরের পহেলা বৈশাখ আমার কাছে ভাল লাগুক আর নাই বা লাগুক, যখন দেখি আমার সন্তানেরা তাদের ভাই বোনদের নিয়ে, কাজিনদের নিয়ে কিংবা ছোট বাচ্চাদের নিয়ে এক আনন্দের পরিবেশে হৈচৈ করছে, মনে হয় পহেলা বৈশাখই হোক আর চৈত্র মাসের গরমের অনুষ্ঠানই হোক অথবা কারো জন্ম-বিবাহ কিংবা ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করার উপলক্ষই হোক, খারাপ কি? অন্তত পরিবারের মানুষগুলো তো আনন্দ করছে। সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। মন ভাল হয়ে যায়, যাই রান্না হোক তৃপ্তির সাথে ভাগাভাগি করে হৈহুল্লুর করে সময়টা কেটে যায়। অনেক ব্যস্ততার মধ্যে সবাই কিছুক্ষন সময়ের জন্য হলেও একসঙ্গে থাকা যায়।

আমাদের এই ব্যস্ত সময়ের মধ্যে তিন চার বছরের বাচ্চাটাও তার লেভেলে ব্যস্ত। অংক কোচিং, বাংলা কোচিং, ইংরেজি কোচিং, ক্লাস পরিক্ষা, ফাইনাল পরীক্ষা, পরাশুনা, রুটিন ক্লাস, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, আহ আরও যে কত কিছু। সবাই ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মাঝে তবুও তো ভেলেন্টাইন্স ডে এর নামে, ফাদারস ডে নামে, মাদারস ডে নামে, যেই নামেই হোক না কেন, কিছু তো সময় পরিবারের মানুষগুলো একটা সময় বেছে নেয় যেন পরিবারের সবার সঙ্গে একসাথে একটা সময় কাটানোর উপলক্ষ নিয়ে ছুটে চলে আসে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, দেশ থেকে অন্য দেশে, নিজের মানুষদের দেশে, নিজের পরিবারের দেশে। আগে তো আমরা বড়দের সালাম করতাম আর সালামের জন্য মনে একটা বাসনা থাকতো সালামি পাব, আদর পাব, আদরটা তখন খুব বেশি বুঝতাম না, সালামিটাই ছিল মুখ্য বিষয়। আজ আমি সালামি কেউ না চাইলেও সালামি দিতে পছন্দ করি। আমি আমার সেই ছোট বেলার অনুভুতি গুলোকে মনে করে বিষণ্ণ হলেও মনে এক আনন্দ পাই।

আজকে আমাকে ‘তুই’ বা ‘তুমি’ করে বলার লোকজনও কমে যাচ্ছে, এক সময় হয়ত আসবে ‘তুই’ করে বলার লোকগুলো আর কাছাকাছি থাকবেই না। হয়ত এই ইলিশওয়ালা পহেলা বৈশাখের জন্যই হোক আর যে কোন ডে এর উপলক্ষেই হোক, এইসব আপনজনগুলো তো একটা সময় করে কাছে আসে। আর এই কারনেই কোন ডে এর বিপক্ষে আমি না। নির্মল আনন্দটাই আমি খুজে নিতে চাই এইসব উপলক্ষগুলোর মধ্য থেকে। কোনটা ক্রিস্টিয়ান আর কোনটা এরাবিক কিংবা কোনটা হিন্দুয়ানী আর কোনটা বাঙ্গালির সেভাবে আমি দেখতে চাই না। আমি চাই এই ছবিগুলোর মধ্যে সবার মনে যে আনন্দ, যে ভালবাসা আর যে তৃপ্তির চেহারা ফুটে উঠেছে, সেটাই সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান আমার কাছে। এরা কেউ বিদেশ থেকে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য সময় বেছে নিয়েছে, কেউ পরাশুনা আগে থেকেই শেষ করে নিরঝলা আনন্দের জন্য ভাইবোন, শ্বশুর শাশুড়ি, খালা, খালু, ননদ ননদিনী, দুলাভাই, শ্যালক, সব বয়সের এক অপরূপ পারিবারিক বন্ধনের মধ্যে ছুটে এসেছে। এর থেকে আর বড় কি অনুষ্ঠান হতে পারে? হোক সেটা পান্তা ইলিশের পহেলা বৈশাখ অথবা হোক সেটা ভ্যালেন্টাইন্স ডে। বেলা শেষে এই আনন্দটুকুই দরকার। সবার জন্য আমার ভালবাসা। 

১৪/০৪/২০১৬-পহেলা বৈশাখ

Categories

৬৮/৬, মীরপুর গোলারটেক, ঢাকা-১২১৬ 

আজকাল পহেলা বৈশাখ আমাকে খুব বেশি পুলকিত করে না। কিংবা পহেলা বৈশাখের জন্য আগের দিন বাজার ঘুরে ঘুরে দেশি বা বিদেশী ইলিশ কিনে এনে পরের দিন পহেলা বৈশাখে পান্তা ভাত খেতে হবে এই অনুভুতিতে আমার মনে খুব আনন্দের শিহরন জাগায় না। কিংবা লাল বা হলুদ পাড়ের শাড়ীর অপরূপ সৌন্দর্যে শহরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা রমণীদের দলবেঁধে হাটাহাটি, পার্কে ময়দানে মেলায় ঘুরাঘুরি আমার মনকে যে পুলকিত করে তাও না। এর মানে এই নয় যে পহেলা বৈশাখ আমি মানি না বা কেউ মানলে সেটা আমার পছন্দের নয়। কিন্তু আমি যা মিস করি তা হচ্ছে-পহেলা বৈশাখের দিনে আমার সেই ছোট বেলার আনন্দের মেলার অনুভুতি, মেলার সকালের আয়োজন আর হৈচৈয়ের মুহূর্ত গুলো। হতে পারে এই কারনে যে, এখন বয়স হয়ে গেছে, আমাদের সেই পহেলা বৈশাখের মেলার অনুভুতি এখন আর সেই অনুভুতি নাই কিংবা মেলার ধরন পালটে গেছে এই কারনে।

সকাল থেকে মেলার জায়গায় হরেক রকমের দোলা, কাছের নদীতে নৌকা বাইচের আয়োজন, হাটে হাটে মাঠে ময়দানে মাটির তৈরি পুতুল, বাঁশি, খেলনা, আরও যে কত কিছুর আয়োজন দেখেছি তার কোন পরিসীমা নাই। সকাল হতেই আমরা যারা ছোট ছিলাম, মেলায় যাব এই আনন্দে নদীতে গিয়ে কেউ উলঙ্গ হয়ে কেউ বা আবার কাদায় গড়াগড়ি দিয়ে কিছুক্ষন কি যে লাফালাফি করতাম এখন ভাবলে সত্যি হাসি পায়। আমার মনে পরে না পহেলা বৈশাখের জন্য আমরা বাসায় ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা খেয়েছিলাম কিনা। জীবনের অনেকগুলো বছর আমি আমার গ্রামে কাটিয়েছি কিন্তু কোনদিন দেখি নাই ইলিশ মাছ পহেলা বৈশাখের একটা প্রধান উপকরন হয়েছিল। বরং পুটি মাছের শুটকি দিয়ে মা ঝাল ভর্তা বানাতেন, গরম গরম দেশি চালের ভাত রাঁধতেন, আলু ভর্তা কিংবা ঘরের চালে, গাছের ঢালের ফলন্ত কিছু সবজি কেটে গরম গরম ভাজি দিয়ে মা আমাদের নাস্তা করিয়ে দিতেন। সারাদিন কোথায় থাকি কি খাই, কখন খাই, এই চিন্তায় মা আমাদেরকে পেট পুরে খাওয়াইয়া দিতেন যাতে আনন্দের ছলে কোথাও কিছু না খেলেও ক্ষুধা না লাগে। পান্তা ভাত তো সব সময়ই খাই, এটা কোন বিশেষ উপকরন নয় যে, ঘটা করে পান্তা পেতে রাখতে হবে আর সেই ভাত পহেলা বৈশাখে খেয়ে মেলায় যেতে হবে। চাইনিজ নববর্ষে যেমন চাইনিজরা চাইনিজ তৈরি করে পহেলা চাইনিজ পালন করে না, ইংরেজি নববর্ষে যেমন ইংরেজরা ইংলিশ খাবার তৈরি করে পহেলা জানুয়ারি পালন করে না, তেমনি বাংলাদেশের মুল ধারার বাঙালিরাও পান্তা ভাত খেয়ে পহেলা বৈশাখ পালন করতে আমি দেখি নাই।

এই দিনে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পন্য নিয়ে আমাদেরই গ্রামের চেনাজানা লোকেরা মাথায় বেতের ঝুরি নিয়ে হরেক রকমের মাটির খেলনা, বেতের খেলনা, প্লাস্টিকের খেলনা নিয়ে মেলার মাঠে চলে আসতেন। দেখা যেত আমাদেরই ক্লাসে পরে কোন এক বন্ধু তার বাবার সঙ্গে অই সব সামগ্রী নিয়ে দোকানে বসে গেছে। আমরাও তার সঙ্গে ক্রেতা বিক্রেতা হয়ে যেতাম। বাড়ীর গিন্নীদের বাড়িতে তৈরি গাছের বিভিন্ন ফল মুলাদি দিয়ে বানানো মিস্টি আচার, তেঁতো আচার, কিংবা ঝাল ধরনের আচার বানিয়ে মহিলারাও কেউ কেউ মেলায় নিয়ে আসতেন। আমাদের পকেটের বাজেট হয়ত বা চার আনা, আট আনা, কিংবা বেশি হলে এক টাকা দু টাকাই থাকতো। সেতা আবার পহেলা বৈশাখের অনেক আগে থেকেই বরদের কাছ থেকে চেয়ে কিংবা মায়েদের কাছ থেকে অনুনয় বিনয় করে নিতে হত। নাগরদোলায় উঠার জন্য কত যে লাইন ধরে থাকার অপেক্ষা। পরিচিত কোন এক বড়রা হয়ত আদর করে কাউকে কাউকে বিনা পয়সায়ই দু একবার নাগর দলায় আমাদেরকে সুযোগ করে দিতেন। কোন পয়সা নিতেন না।

চারিদিকে বাঁশীর উচ্ছৃঙ্খল শব্দ, যার যার মত করে যা খুশি বাজিয়েই চলছে, হৈচৈ এর শেষ নাই। যে বাচ্চাটি এক বছরেরও বয়স, পহেলা বৈশাখ না বুঝলেও সেও হয়ত তার বাবা, মা কিংবা বোনের ভাইয়ের কোলে চরে মেলায় চলে এসেছে। হারিয়ে যাওয়ার ভয় নাই, বাড়ীতে ফেরার জন্য পরিচিত লোকের কোন অভাব নাই, চুরি ডাকাতির বালাই নাই, ছিনতাইয়ের কোন মনোভাব নাই, এক অনাবিল আনন্দ আর মেলা।

মেলাশেষে ঘরে ফেরার আরেক রূপ। দলবেধে পাশাপাশি গ্রামের আইল ধরে বাড়ি ফেরা। হাতে হাতে বাঁশি, পুতুল কিংবা অতি নগন্য অথচ মনে হয় অতি প্রিয় কিছু খেলনা হাতে নিয়ে নিয়ে গ্রামের মেঠো পথ ধরে দিনের শেষ বিকালে কিংবা সন্ধার আবছা আলোছায়ায় ঘরে ফেরা, ঘরে ফিরে একে অপরের নব্য কেনা সরঞ্জামাদি দেখাদেখি করে কখনো মন খারাপ করার মত অনুভুতি, যেন, আহা আমি কেন ঐ জিনিসটা কিনতে পারি নাই, কিংবা আহা আমি কেন দেরি করে মেলায় গেলাম যে আমার বন্ধু রহিমের কেনা বাশিটা আমি কেনার আগেই বিক্রি শেষ হয়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

বোনদের কেনাকাটা একরকম, আমাদের ছেলেদের কেনাকাটা ছিল অন্য রকমের। বোনেরা কেউ লিপিস্টিক, মাথার ফিতা, তিব্বত ব্রান্ডের স্নো পাওডার, আলতাও মিস যায় নাই। কেউ কেউ আবার কাছে হরেক রকমের চুড়ি, পায়ে পরার অদ্ভুত ডিজাইনের পায়রা কত কিছুই না কিনত আমাদের বোনেরা। আমার মনে পরে মেলা থেকে কেনা সরঞ্জামাদি আমরা কেউ কেউ ঘুমানোর সময় পাশে বালিশের কাছেই রেখে ঘুমাতাম যেন কতই না মুল্যবান সম্পদ। আবেগটাই আলাদা।

বড়রা কেউ কেউ পাঞ্জাবি পরে একে অপরের সঙ্গে চা বিড়ি টানতে টানতে দিনের অনেকটা সময় পার করে দিয়েছেন। দিনশেষে তারাই হয়তা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কেনা কাটার সামগ্রীর আনন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গ্রামের কিছু জোয়ান ছেলেপেলের দ্বারা আয়োজিত কোন এক গানের আসর কিংবা মল্লযুদ্ধের অনুষ্ঠান করতেন। নৌকা বাইচের শেষে উঠতি বয়সের ছেলেরা পাড়ার মুরুব্বিদের সঙ্গে জিতে আনা পুরুস্কারের সঙ্গে বীর বীর অনুভুতির একটা ভাব থাকতো। এ এক মেলা যার মাধ্যমে এক গ্রামের সঙ্গে আরেক গ্রামের ভাবের সৃষ্টি হত, বন্ধন মজবুত হত, নতুন নতুন সম্পর্কের হাল ধরে আরেক বছরের হালখাতা তৈরি হত। হালখাতা তৈরি হত ব্যবসার, হালখাতা তৈরি হত নতুন নতুন সম্পর্কের। এভাবেই আমি আমার সেই ছেলে বেলার বৈশাখী মেলার আনন্দটা উপভোগ করেছিলাম।

আজ আমি সেটা খুব মিস করি।

১২/০৪/২০১৬–সাফল্য এবং তার পথ নির্দেশনা

Categories

সাফল্যের পথ কখনোই ইস্পাতের মতো এতো নিখুত নয়। এই সাফল্যের দরজায় যেতে হলে অনেক কঠিন দূর্গম পথ বেয়ে বেয়েই উপরে উঠতে হয়। আর এটা একদিনেই হয়ে যাবে এটা আশা করা শুধু বোকামিই নয়, এটা একটা মূর্খতাও। সাফল্যের শেষ প্রান্তে যেতে যেতে পথে কত যে কুকুর, কত যে হিংস্র পশু, কত যে দাবানলের মতো অগ্নিজলা বন, আর প্রাকৃতিক ঝড় পেরুতে হয়, তার কোনো ইয়াত্তা নাই। যারা আজ বড় হয়েছে, তাদের প্রতিটি জীবনের কাহিনী কোথাও না কোথাও এক। সাফল্যের এই গন্তব্যপথে যেতে যেতে একটা কথা মনে রাখা অতীব বাঞ্চনীয় যে, কেউ বন্ধু হয়ে শত্রুর আচরন করতে পারে আবার কেউ শত্রু হয়েও শত্রুর মতো আচরন নাও করতে পারে। অনেক কুকুররুপী মানব, কিংবা অনেক মানরুপী কুকুরও সারাক্ষন ঘেউ ঘেউ করতেই পারে, কিন্তু এসব কুকুরদেরকে, হায়েনাদেরকে প্রতিটি ক্ষেত্রে পাথর মেরে মেরে যদি সামনে এগুতে হয়, তাহলে সাফল্যের গন্তব্যপথের নিশানা ভুলে যাবার সম্ভাবনা থাকে। থাকে দিক নির্দেশনা হারিয়েও যাওয়ারও। তাই, কুকুর থাকবে, কুকুরের ঘেউ ঘেউ থাকবে, তার মানে এ নয় যে, প্রতিটি কুকুর, আর প্রতিটি বাধাকে মনোযোগ দিতে হবে। জানতে হবে ঠিক সথিকভাবে, কোন বাধাকে সরাতে হয়, আর কোন বাধাকে কোনো মনোযোগ দেবার কোনই প্রয়োজন নাই। 

সাফল্যের এই চাবিকাঠির আরেকটা প্রধান দিকনির্দেশনা হচ্ছে, নিজের মুখকে নিয়ন্ত্রন করা। মুখ এবং এর দ্বারা ছুড়ে দেয়া ভাষা এমন এক অস্ত্র যা একবার ছোড়া হয়ে গেলে তা আর ফিরিয়ে নেয়া যায় না। আর এর ফলে টার্গেটে কতটা ক্ষতি হলো তার থেকে বেশি ক্ষতি হয়ে আসে নিজের ফলাফল। যে কোন পরিস্থিতিতেই কেউ যখন এমন এক অবাধ্য যন্ত্রের মতো মুখের বুলি বুলেটের মতো কেউ ছুরে দিয়ে ভাবে, সে অনেক ভাল কাজ করে ফেলেছে, এটা হয়তো মনের শান্তনার জন্য যথেষ্ট কিন্তু সাফল্যের বড় অন্তরায়। ফিরিয়ে নেয়ার কোনো পথা খোলা থাকে না বলে হয় তার জন্য ক্ষমা চাওয়া নতুবা ব্যর্থতার গ্লানি মাথায় নেয়ার সামিল হয়ে উঠে। শুধু তাইই নয়, এটা চিন্তা করাও বোকামি যে, সবাই ছুড়ে দেয়া পরিত্যক্ত বানীর বিপরীতে ক্ষমা মেনে নেবে বা ক্ষমা করে দেবে। এ চিন্তাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই এই সুলভে পাওয়া যন্ত্র দ্বারা অসুভ কোন নির্মম কথাও আমাদের চিরদিনের স্বপ্নের উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে অনেক ভেবে চিনতে এর প্রয়োগ করা উচিত।

সাফল্যের পথে যতো বেশী পরিমান বিশ্বস্ততা অর্জন করা যায়, ততো সহজ হয়ে উঠে দূর্গম গিরিপথের সেই সাফল্য ভ্রমন। আর এই বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য সবচেয়ে বেশী যা কার্যকরী ভুমিকা রাখে তা হল, প্রতিনিয়ত সত্যকে আকড়ে ধরে থাকা। একটা মিথ্যা বা একটা অর্ধ মিথ্যাই যথেষ্ট সব বিশ্বস্ততা হারিয়ে ফেলার জন্য। আর একবার যদি এই মিথ্যার জালে কেউ বাধা পড়ে, তখন আর যাইই হোক সাফল্যের দেখা পাওয়া অনেক আওহজ হয়ে উঠে না।  

আরো একটা অদৃশ্য শক্তি সবার অগোচরে প্রতিনিয়ত কাজ করে। আর সেই মহাশক্তিধর গোপন শক্তিটি হচ্ছে, নিগূড় ভালবাসার বহিরপ্রকাশ। ভালোবাসা হচ্ছে একটা আংটির মতো। এর যে কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ কেউ বলতে পারে না কিন্তু এর উপস্থিতি সার্বোক্ষনিক উপলব্দি করা যায়। ভালোবাসার বহিরপ্রকাশ যতো বেশী প্রখর, বিশ্বস্ততা অর্জন ততো সহজ, বিশ্বস্ততা যতো বেশী সহজ অনিয়ন্ত্রিত ভাষা ততো নিয়ন্ত্রিত। আর এই ভাষা যতো নিয়ন্ত্রিত, ভালো বন্ধুর সংখ্যা ততো বেশী। ভালো বন্ধুর সংখ্যা যতো বেশী, দূর্গম গিরিপথে সহচর ততো বেশি। দূর্গম পথে যতো বেশি ভাল সহচর, পথ ততো সহজ। আর এখানেই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।  তবে একটা ভয়ের মতো উপসর্গ থেকেই যায় এখানে। কেউ কেউ ভাল বন্ধু হতে পারে বটে কিন্তু সবাই ভাল ভ্রমনসংগী হয় না। এই সংগী নির্বাচনে সবচেয়ে বড় ক্রাইটেরিয়া জানা থাকা বড্ড বেশী জরুরী। যেমন, সৌন্দর্য এবং সুন্দর চেহারার সব মানুষই ভাল হবে এই কথাটা ঠিক নয় কিন্তু সব ভাল মানুষই সুন্দর মনের।

সাফল্য যখন ধীরে ধীরে কাছে আসতে থাকে, এর একটা রুপ ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। আর সেটা হচ্ছে ক্ষমতা। সাফল্যের ওজন যতো বেশী, ক্ষমতার ভার ততো বেশী। তাই, যখন ক্ষমতার ধার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, নিজের উপর নিয়ন্ত্রন যদি ততোতা না রাখা যায়, এক সময় অনিয়ন্ত্রীত ভারে তা চুরান্ত রুপ পাবার আগেই ভুমিতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য সবসময় মনের মধ্যে এই ভাবনা থাকা খুব জরুরী যে, ক্ষমতা শুধু মানুষকে ক্ষমতাই দেয় না, এটা দিয়ে মানুষকে ক্ষতিও করা যায়। তাই ক্ষমতার সাথে ভালবাসার শক্তিকে বেধে ফেলা অনেক দরকার। কারন ভালবাসা দিয়ে কোনো মানুষের কখনো ক্ষতি হয়েছে এমন নিদর্শন ইতিহাসে নাই। তাই শুধু ক্ষমতা নয়, ভালবাসার ক্ষমতা প্রয়োগ হচ্ছে সাফল্যের সেই গোপনশক্তি যার দ্বারা জগত সুন্দর হয়। এর দ্বারা সুখী আর আরামদায়ক ফলাফল হাতের মূঠোয় আসে। তাতে আনন্দের সাথে আসে সুখ। সুখী হতে গেলে তাই জীবনে এমন অনেক অপ্রয়োজনিয় জিনিষ ভুলে যেতে হয়।

আমি সব সময় সক্রেটিসের সেই কথাটার সাথে একমত হতে পারি নাঃ যার কাছে টাকা আছে তার কাছে আইন খোলা আকাশের মত আর যার কাছে টাকা নাই তার কাছে আইন মাকড়শার জালের মত। এটা হয়তো কিছু সাময়িক সময়ের জন্য ঠিক কিন্তু লম্বা ইতিহাসে এর সত্যতা অনেকাংশেই বিলুপ্ত হয়েছে। এমন কি সক্রেটিসের বেলায়ও।

০৭/০৪/২০১৬ ফাঁসি

Categories

রাত প্রায় বারোটা। ঘরের কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলিতেই দেখিলাম ১৭-১৮ বয়সের একটি মেয়ে, কাঁধে একটা ঝুলানো ব্যাগ লইয়া দরজার সামনে দাঁড়াইয়া আছে। তাহাকে আমি চিনি না কিন্তু কোথায় যেন তাহাকে দেখিয়াছি আমার ঠিক মনে পরিতেছে না, আবার তাহাকে আমার অপরিচিত বলিয়াও  মনে হইলো না। বাসায় কেউ নাই, আমার মেয়েরা তাহাদের খালার বাসায় মানিকগঞ্জে বেড়াইতে গিয়াছে, সঙ্গে তাহাদের মাও আছেন, আমার অফিসে অনেক কাজ জমা হইয়া গিয়াছিল বলিয়া রাত জাগিয়া জাগিয়া গুটিকতক কাজ শেষ করিতে হইতেছে। তাই আমার পরিবারের সঙ্গে আমার আর বেড়াইতে যাওয়া হয় নাই। ছেলেপুলে আর ঘিন্নি ছাড়া আমার কোনো কিছুই চলেনা। তাহাদের অবর্তমানে আমার এই সময়টা আমি হারে হারে টের পাই। আমি অলস মানুষের মধ্যে একজন। একগ্লাস পানি খাইতেও তাহাদের প্রয়োজন পড়ে। ঘরের মধ্যে যখন ওরা থাকে তখন তাহাদের উপস্থিতি টের পাইনা কিন্তু তাহারা যখন থাকেনা তখন তাহাদের অনুপস্থিতি খুব নজরে আসে বইকি। বাসায় কেহ আসিলে সাধারনত আমার গিন্নিই দরজা খোলার কাজটি করিয়া থাকেন। বাসায় যতো কর্মীবাহিনী আসে, কেহ তাহার রান্নার বুয়া, কেহ আবার পাশের বাসার গিন্নি, কেহ আবার আমাদের ভাড়াটিয়ার মধ্যে একজন ইত্যাদি। হয়ত সময়মতো ভাড়া পরিশোধ করিতে পারিবেন না বলিয়া একটু আবদার, কেহ আবার দান দক্ষিনার জন্য আসে, এইসব। ফলে আমি সবাইকে চিনিও না আর তাহা জানার আমার কোন প্রয়োজনও মনে করি না। আজ তাহারা কেহ বাসায় নাই, তাই আমাকেই এই কর্মটি করিতে হইতেছে।

রাত এগারোটা বাজিলেই আমার গিন্নি ঘরের সব দরজা বন্ধ করিয়া, জানালার পর্দাসমুহ একেবারে আঁটসাঁট করিয়া লাগাইয়া দিয়া, ঘরের যাবতীয় ছিটকানি বন্ধ করিয়া তাহার পর কি যেনো একটা দোয়া পড়িয়া হাতে তিনখান হাততালি দিয়া সম্পূর্ণ ঘরটাকে নিরাপদ করিয়া তাহার পর শুইতে যায়। গিন্নি না থাকিলে আমাকে অবশ্য দোয়াদরূদ পড়িতে বলেনা কিন্তু ঘরের ছিটকানীসমুহ ভালো করিয়া লাগাইয়া যেনো ঘুমাইতে যাই, সেই নির্দেশাবলী দিতে কখনই ভুলিয়া যায়না। আর যদি ছিটকানি লাগাইতে ভুলিয়া যাই, সেইজন্য আগেভাগেই ঘরের স্বয়ংক্রিয় তালাখানা যেনো লাগাইতে ভুলিয়া না যাই তাহা নিশ্চিত করিয়া তারপর ফোন রাখেন। সে জানে আমি অলস মানুষ, তাই মাঝে মাঝে মনে করাইয়াও দেয়। কারন ভুলিয়া যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অন্তত এইদিক দিয়া আমার উপর তাহার আত্মবিশ্বাস একেবারেই নাই, ভরষা তো নাইই।

দরজা খুলিয়া অপরিচিত এই অল্প বয়সের মেয়েটিকে দেখিয়া দরজার পাশে দাঁড়াইয়াই জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কাকে চাই?’

আমি প্রশ্ন করিলেও মেয়েটি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়া ঘটঘট করিয়া খোলা দরজা দিয়া আমার ঘরে প্রবেশ করিল। আমি অগত্যা কিছু না বলিয়া অদুরে ডাইনিং চেয়ারটা টানিয়া দিয়া বলিলাম, তুমি কি আমাদেরকে চিনো বা আমি তোমাকে চিনি?

মেয়েটি হ্যাঁ বা না কোনো উত্তর না দিয়া আমাদের ঘরের চারিদিকে যে কয়টা ছবি ফ্রেমে টাঙ্গানো ছিলো তা দেখিতে থাকিল। ব্যাপারটা যেনো এমন, আহা- কতদিন এই ছবি গুলি দেখা হয় নাই কিংবা এমন যে, আহা, ওই ছবিটা এখানে কেনো ইত্যাদি। আমি তাহার ছবি দেখার ভঙ্গি দেখিয়া কিছু প্রশ্নের আশা করিতেছিলাম বটে কিন্তু সে ইহার কোনো কিছুই বলিলো না। ছবি দেখা হইয়া গেলে, বেশ খানিক্ষন পর মেয়েটি নিজেই ডাইনিং চেয়ারে আসিয়া বসিল এবং টেবিলের উপর রাখা এক যগ পানি হইতে এক গ্লাস পানি ঢালিয়া লইয়া ঢকঢক করিয়া পান করিয়া ঠাস করিয়া হাতের গ্লাসখানি টেবিলে শব্দ করিয়া নামাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস এমন করিয়া ছাড়িলো যেনো পানি খাইতে গিয়া তাহার অনেক পরিশ্রম হইয়াছে অথবা কতজনম ধরিয়া যেনো পানির আশায় বুক ধরফর করিতেছিলো।

– না, আমি আপনাকে চিনি না, কিন্তু আপনি হয়তবা আমাকে চিনিতে পারেন। আসলে আমাকে এখন অনেকেই চিনে, পুরু কাহিনি বলিলে হয়ত আপনিও আমাকে চিনিতে পারিবেন। এই পথ দিয়া যাইতেছিলাম, অনেকরাত, কোথাও কেহ জাগিয়া নাই, দেখিলাম আপনার ঘরে আলো জ্বলিতেছে, তাই এখানে আসা। আমি আপনার কোনো ডিস্টার্ব করিবার মতলবে আসি নাই। কিংবা আপনার কোন ক্ষতিও করিতে আসি নাই। আপনি বিরক্ত হইতেছেন কি? আর ডিস্টার্ব হইলেইবা কি, এখন তো ভিতরে চলিয়াই আসিয়াছি। একনাগাড়ে এতগুলি কথা বলিয়া মেয়েটি আবার আরেক গ্লাস পানি ঢগঢগ করিয়া পান করিয়া লইলো।

কি তাজ্জব ব্যাপার। চিনি না, জানি না, কি কারনে আসিলো, তাও আবার এতোরাতে। আমি একটু নড়িয়া চড়িয়া বসিলাম আর বলিলাম, পুরু কাহিনীটা কি তাহলে? আমিও জানার জন্য উৎসুক হইয়া বলিলাম। আর এতোরাতেই বা তুমি কাহার সাথে কি কারনে বাহির হইলে, আর তোমার পিতামাতাই বা কি রকম যে, এইরকম একটা যুবতী মেয়েকে রাত গভীরে ঘর হইতে বাহির হইবার দয়া করিলেন?

-আরে সাহেব, ভয় পাইতেছেন নাকি? ভয়ের কোনো কারন নাই। আমার নাম শিমা। নিশ্চয় এই নামটা আপনার শুনিবার কথা। ঐ যে মেয়েটি, যে তাহার বাবামাকে রাতের আধারে একসঙ্গে খুন করিয়াছিল? পরেরদিন বড় বড় করিয়া দেশের সব কয়টা পত্রিকায় তাহার লোমহর্ষক গল্প লিখিয়া নাম প্রকাশ হইয়াছিল। আপনি পড়েন নাই সে খবর? যাইহোক, আমি আপনাকে খুন করিতে আসি নাই।

নামটা শুনিয়াই যেনো আমার গলা পর্যন্ত শুকাইয়া গেল। শরিরের শিরায় শিরায় যেন বিদ্যুতের মত এক অনুভূতি খেলিয়া গেলো আর পশমের যে কয়জায়গায় অনুভূতি আঘাত করিতে পারিল না, সব কয়টাই যেন খাড়া হইয়া আমাকে এই সংবাদ দিয়া গেল, কেন তুমি না জানিয়া এমন একটি মেয়েকে তোমার ঘরে ঢুকিতে দিলে? তুমি তো আর পুলিশের ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চে কাজ করোনা যে, এখন একটা ফোন করিলেই তোমার সাহায্যের জন্য গোটাবিশেক পুলিশ আসিয়া তোমাকে উদ্ধার করিবে। নিজেকে একটু আহাম্মক বলিয়া মনে হইতে লাগিল। কিন্তু পরক্ষনেই আবার মনে হইল, আচ্ছা ওতো আর পিস্তল, ছুড়ি লইয়া আসে নাই যে, আমাকে খুন করিয়া ফেলিবে, আমার সঙ্গে ওতো জোরেও পারিবেনা, আবার আমার আশেপাশে আরও লোকজন তো আছে, বিপদ দেখিলে গলা ফাটাইয়া চিৎকার দিলেইতো আর কোন অসুবিধা নাই। পুলিশ না আসুক, অন্তত কিছু মানুষজন তো আসিবেই। মনে একটু বল সঞ্চার হইল।

-তোমার না ফাঁসির আদেশ হইয়াছে? তাহা হইলে তুমি এইভাবে এতরাতে কেমন করিয়া ঘোরাফেরা করিতে পারিতেছ? তুমি কি জেল হইতে পালাইয়া আসিয়াছো? দেখ শিমা, তুমি এখানে আসিয়া আমাকে কোন বিপদের মধ্যে ফেলিবার কোন পরিকল্পনা করিতেছো না তো?

মেয়েটি, যেন মজার একটা কথা বলিলাম, এইভাব করিয়া অট্টহাসিতে লুটাইয়া পরিবার উপক্রম হইলো। ঘরের ভিতর তখন রবিন্দ্রসঙ্গিত বাজিতেছিল… মম চিত্তে … কেযে নাচে তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ… কিন্তু তাহার অট্টহাসিতে রবীঠাকুরের গানের কলিগুলি যেনো গুরুম গুরুম শব্দে কি এক অদ্ভুত আওয়াজে ঘরের চারিদিকে বিহব্বল বাতাশের মতো ঘূর্ণিপাক খাইয়া প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করিলো। তাহাতে আর যাই হোক, চিত্ত নাচিবার কোনো কারন দেখিতেছি না। বরং এক অজানা ভয়ে চিত্ত শুকাইতেছিলো। ইহার পরে আবার আরেক অজানা ভয় ঢোকিতেছিলো যে, এতোরাতে আমার স্ত্রীর অবর্তমানে আমার ঘরে একজন মেয়েলী কণ্ঠে হাসির তামাশা আমাকে আরো শঙ্কায় ফেলিয়া দিলো। আমি ভদ্রমানুষ, সমাজে আমার নামডাক আছে, আমি সমাজের একজন ক্লিন মানুষের মধ্যে একজন। এই এতো রাতে আমার বাসায় কোনো এক অপরিচিত যুবতি মেয়ের প্রবেশ কোনোভাবেই আমি ব্যখ্যা করিতে পারিবো না। অন্তত আমার বউ, আমার পরিবার-পরিজন বিশ্বাস করিলেও অন্য কেউ ইহা সহজে বিশ্বাস করিবে তাহার কোন যুক্তি আমি খুজিয়া পাইতেছিলাম না। শঙ্কায় পড়িয়া আমি মেয়েটিকে একটু শান্ত হইয়া বসিয়া তাহার যাহা বলিবার তাহা যেনো কণ্ঠ সংযত করিয়া বলিতে থাকে সেই অনুরোধ করিলাম। এতো অট্টহাসি দিয়া আমার ঘরের লক্ষ্মী পরিবেশকে সংকিত করিতে মানা করিয়া বলিলাম। অনেকটা আদরের সহিতই বলিলাম,  “মা তুমি আমার মেয়ের বয়সের সমান, আমি অপদস্থ হই, এমন কোনো প্রতিক্রিয়া করিও না।”

-আরেনা বাপু, এতো অস্থির হইবার কোনো কারন নাই। আর আমাকে কেউ জেলখানা হইতে বাহির হইতে দেখেও নাই আবার সকাল না হইতেই আমি আবার আমার কন্ডেমসেলে ঢুকিয়া পরিব। তোমার কোন ভয় নাই। আমি মাঝে মাঝেই এই রকম রাতে বাহির হইয়া থাকি। আজই প্রথম নয়। কয়দিনই বা আর এই পৃথিবীতে বাঁচিবো বলো, এত ভয় করিবার তো কোন কারন দেখিনা। জেলেই তো আছি, জেলের আবার ভয় কিসের? তবে আমার ফাঁসি হওয়াতে আমার মনের অনেক কষ্ট লাঘব হইয়াছে বলিয়া আমি মাঝে মাঝে মনের আনন্দে ঘুরিয়া বেড়াইতে পারিতেছি। অন্তত একটা সুরাহা তো হইয়াছে। পাপীর তো শাস্তি হইয়াছে।

মেয়েটি আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধন না করিয়া  সরাসরি ‘তুমি’ এবং এমনভাবে ‘বাপু’ শব্দটি উচ্চারন করিলো যেনো হটাত করিয়া আমার বুকের কোনো এক জায়গায় একটি মানবিক সম্পর্ক টানিয়া আনিয়া জোড়া লাগাইয়া দিলো। মনে হইলো, আমি বুঝি সত্যিই তাহার ‘বাপু’। অন্তরে একটা শীতলপরশ একঝলকের জন্য বিদ্যুতের ন্যায় আচমকা একটা সাড়া দিয়া নড়িয়া উঠিল। আমি মেয়েটির দিকে অনেক্ষন চাহিয়া থাকিলাম, যেনো কোনো এক সুদূর অচেনা এক দেশ হইতে মেঘের ভেলায় ভাসিয়া আসিয়া আমাকে একখন্ড শিক্ত জলে ভিজাইয়া দিলো। তাহাকে এখন আর আমার আগের মুহূর্তের মতো ভয়ঙ্কর এবং অস্বাভাবিক মনে হইলো না। মনে হইল মেয়েটি আমার পরিবারের যেনো কেহ।

-তোমার ফাঁসি হইয়াছে এই খবরে তুমি এতো আনন্দিত কেন?

শিমা এইবার আর হাসিলো না। অনেকক্ষন চুপচাপ থাকিয়া তাহার ছোট গালের দুইপাশে তাহার দুইহাত ঠেস দিয়া কাধের ব্যাগখানি টেবিলের উপর রাখিয়া আমার চোখের দিকে তাকাইয়া প্রশ্ন করিলঃ তুমি কি কখনো কোন ফাঁসির আসামীর সঙ্গে ফাঁসীর আগের রাতে গল্প করিয়াছো?

-আমি বলিলাম, না, সে সুযোগ আমার আসে নাই। তবে জানিতে অনেকবার মন চাহিয়াছিল তাহাদের মনের অবস্থা কি, জীবন সম্পর্কে তাহাদের উপলব্ধি কি, কিংবা তাহার ওই সময়ের ভাবনা কি, কি নিয়ে তাহারা কিভাবে কি ভাবে বা কাউকে কি কোন কিছু বলিয়া যাইতে ইচ্ছা করে কিনা ইত্যাদি। অথবা এমন কোনো ভাবনা কি আসে, আহা যদি আরেকবার সুযোগ আর স্বাধীনতা পাইতাম, তাহা হইলে ফাসি হয় এমন কোনো কাজ আমি করিবো না, অথবা, আহা এমন কি কোন জায়গা আছে, যেখানে আমি লুকাইয়া গেলে আমাকে আর কেহই খুজিয়া পাইবে না? ফাসি হইবে না?  

– তাহা তো ঠিকই। যুগেযুগে প্রতিদিনই তো আর ফাঁসির কাজটা হয়না যে, আজকে সুযোগ পাইলাম না বলিয়া আগামিকালের ফাঁসিটায় তা উপভোগ করা যাইবে। এইটাতো আর পুকুরপাড়ে গিয়া বরশি দিয়া মাছ ধরিবার মতো ঘটনা না যে, আজ পাইলাম না তো কাল পাইয়াই যাইবো। আর পাইয়া গেলে ওই ধরাশায়ী মাছকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়া লইবো, সে পানির ভিতরে কিভাবে সাতার কাটিতে কাটিতে হটাত করিয়া মানবের বরশির ফাঁদে পা দিয়া তাহার অনবদ্য জলীয় জীবন হইতে এক নিমিষে স্থলের মুক্ত বাতাসে আসিয়া প্রানবিনাস করিয়া পগারপার হইয়া গেলো। মৎস্যদের সাহিত্যক কেহ থাকিলে হয়তো তাহার কোন এক কাব্যগ্রন্থে লিখিত, “স্থলের মুক্ত বাতাস শুধু প্রানের জীবনীশক্তিই জোগায় না, ইহা কখনো কখনো কিছু কিছু প্রানীর প্রানেরনাশের কারনও হইয়া দাড়ায়”।

মেয়েটি অনেক সুন্দর করিয়া গুছাইয়া কথা বলিতে পারে বুঝিতে পারিলাম। “স্থলের মুক্তবাতাস শুধু প্রানের জীবনিশক্তিই জোগায় না, ইহা কখনো কখনো প্রাননাশের কারনও হইয়া থাকে” কথাটা আমার খুব মনে ধরিলো। সে কি মনে করিয়া এই রকম একটা তত্ত্ব কথা বলিলো তা আমার বোধগম্য হইলো না, তবে বাচিয়া থাকিবার জন্য যাহার যেখানে যাহা প্রয়োজন, সে তাহাই সম্ভবত বুঝাইয়া দিলো। আমি এতোক্ষন অফিসের জটিল একটা একাউন্টিং নিয়া কাজ করিতেছিলাম কিন্তু এই মেয়েটি আসিয়া এখন আমাকে আরো জটিল সময়ের মধ্যে ফেলিয়া দিলো বলিয়া আমার মনে হইতে লাগিলো। কিন্তু খারাপ লাগিতেছিলো না। তাই, অফিসের কাজ একপাশে রাখিয়া তাহার সাথে গল্প করিতেই মন চাইলো।

আমি এইবার তাহাকে কিছু খাইবে কিনা জিজ্ঞাসা করিতেই বলিয়া উঠিল যে, “জেলখানায় না গেলে সে বুঝিতে পারিতো না, চার দেওয়ালের ভিতরেও কতো ধরনের নীতি আর কত আকারের দুর্নীতি রহিয়াছে। যাহাদের টাকা আছে, তাহাদের জন্য নীতি এক রকমের, যাহারা বিখ্যাত, তাহাদের জন্য পলিসি আরেক রকমের, যাহাদের কেউ নাই, তাহারা তো কোনো প্রানিকুলের মধ্যেই গন্য হয়না। যাকগে সেইসব কথা, তোমরা থাকিবে এই পৃথিবীতে, যেইভাবে তোমরা আরাম আয়েশ করিতে চাও, সেইভাবেই পলিসি করো কিংবা নীতি পাল্টাও তাহাতে আমারই কি আর আমি বা কে তাহার বিরুদ্ধে নালিশ করিবার? আমি ভালো খাইতে পারিতেছি, আমার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা আছে, ইহাতেই আমি খুশি। এই যেমন, আজ আমি খাইয়াছি ইলিশের তরকারী, ঘনডালের চর্চরী, সঙ্গে ডিমের হালুয়া। খাওয়ার পর আবার আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলো, আমি আরো কিছু খাইতে চাহি কিনা। আমি আইসক্রিম খাইতে খুব পছন্দ করি, বলিতেই দেখি, একটু পরে খুব মজার আইসক্রিম চলিয়া আসিলো। আমি তো ভালোই আছি। একটা জিনিস জানো? কোরবানীর পশুকে তাহাদের মালিক কোরবানী করিবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত অনেক আদর যত্ন করিয়া, ভালো ভালো খাবার খাওয়াইয়া, গোসলপাতি করাইয়া ঠিক সময়মত তাহাকে হুজুর কিংবা পাগড়ীপরা মুসুল্লী দিয়া গলায় ছুরি দিয়া একনিমিষে কতল করিয়া দেয়। আমি হয়তবা সেই রকমের একজন কোরবানীর পশুর গননায় আছি। কোরবানীর পশুকে জবাই করিতে কাহারো হৃদয়ে কোন কম্পন সৃষ্টি হয়না। বরং দল বাধিয়া ছোট ছোট ছেলেমেয়েসহ সব মুরুব্বীরা ঈশ্বরের নাম জপিতে জপিতে তাহাকে প্রানে মারিয়া ফেলে।

আমি একটা সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিলাম, তুমি কি সিগারেট খাও?

-দাও একটা। খাওয়ার অভ্যাস তো ছিলোই, জেলে যাওয়ার পর আর খাইতে পারি নাই। আমি বুঝি না, জেলের মানুষগুলি যাহা চাই, তাহাই আমাকে দেয় কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাকে একটা সিগারেটও দিলো না। অথচ নেশার জগতের সবচেয়ে বড় আভাসভুমি হচ্ছে জেলখানা। দল বাধিয়া সবাই নেশা করে। ঐখানে নেশা করিবার কারনে পুলিশ কখনো কাউকে গ্রেফতার করে না। অবশ্য আমি কখনো সিগারেট চাইও নাই।

শিমা আমার সিগারেটের প্যাকেট হইতে একটা সিগারেট লইয়া আগুন ধরাইয়া একমুখ ধোয়া পুরা রুমের ভিতর ছড়াইয়া দিয়া একটা হাসি দিয়া বলিল- আহ কতোদিন পর এমন করিয়া সিগারেট ফুকি নাই। হয়ত এই সিগারেটের জন্যই তোমাকে আমার মনে থাকিবে। আমার আর মনে থাকিবে কি, আমি তো মরিয়াই যাইবো, বরং মনে থাকিবে তোমার। ওই একই হইলো। তুমি আমাকে মনে রাখিবে না আমি তোমাকে মনে রাখিবো, ইহাতে কোনো কিছুই পরিবর্তন হইবে না। না পরিবর্তন হইবে তোমার অফিসের কাজের, না সমাজের, না অন্য কাহারো। এই পরিবরতনের সাথে আমাদের প্রিথিবী অনেক পরিচিত। ইহাকে আমাদের এই পৃথিবী সাধারন ঘটনার মধ্যে গন্য করিয়াই তাহার মনুস্যকুলকে এক প্রজন্ম হইতে আরেক প্রজন্মে লইয়া যায়। ইহাকেই হয়ত আমরা ইতিহাস বলিয়া চালাইয়া দেই।

এতোক্ষন আমি যেই ভয়টা পাইতেছিলাম, সেই ভয়টা এখন আর নাই। মনে হইতেছিলো শিমা আমার পরিচিত কেউ। বলিলাম, তোমার জেলের ভিতরের অভিজ্ঞতা, ফাঁসির খবরে তোমার প্রতিক্রিয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি বলো তো দেখি শুনি।

-আচ্ছা, তোমার বাসায় কি কফি আছে? খুব কফি খাইতে ইচ্ছা করিতেছে। এই বলিয়া শিমা নিজেই আমাদের রান্না ঘরের ভিতরে ঢূকিয়া গ্যাসের চুলা জ্বালাইয়া দুইকাপ ব্ল্যাক কফি বানাইয়া এককাপ আমাকে আর এককাপ সে নিজের জন্য রাখিয়া গল্প করিতে আরম্ভ করিলো।

-গল্পটা শুরু কবে হইতে শুরু হইয়াছিলো তাহা আমার জানা নাই। তবে আমার জীবনে আদর আর আহ্লাদের কোন কমতি ছিলো না। যখন যাহা চাহিয়াছি, তখনই তাহা আমি আমার মতো করিয়া পাইয়াছি। সুখেই দিনগুলি কাটিতেছিলো। সচ্ছল পরিবার, ছোট পরিবার। খুব একটা বিড়ম্বনা নাই। বন্ধুবান্ধব যাহারা ছিলো, তাহারাও আমার অবস্থা বুঝিয়া মানিয়া চলিতো। লেখাপড়া করিতেছিলাম কিন্তু খুব ভালো লাগিতেছিলো না। বাবা সরকারী চাকুরী করেন কিন্তু সময় যতোটা পাইতেন, তাহা হইতে বেশি বাহিরে থাকিতে পছন্দ করিতেন। মা গৃহিণী মানুষ, অতো চালাক চতুর নহেন, সামান্যতেই তিনি সুখি। আমাদের যত্ন আদিতে তাহার কোন কমতি ছিল না। তারপরেও আমার মাকে মনে হইতো তিনি সংসারে একা। কখনো কখনো আমার মা আমার বাবার সাথে কথা কাটাকাটি করিতো বটে কিন্তু মা ইচ্ছা করিয়াই হারিয়া যাইতেন। সংসারের শান্তি থাকুক এই ভাবিয়াই চুপ থাকিতেন। তাহার সাধ আহ্লাদের মধ্যে যাহা ছিলো তা নিতান্তই কয়েকটা টিভি সিরিয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মাকে আমি খুব ভালোবাসিতাম কিন্তু মায়ের এই কম্প্রোমাইজের গুনটি আমি কখনোই মানিয়া লইতে পারিতাম না। ফলে, বাবার সাথে আমার প্রায়ই খিটখিটে ঝগড়া লাগিয়া থাকিতো। বাবাও আমাকে ভালোবাসিতেন বটে কিন্তু আমার পড়াশুনা লইয়া, আমার আচার আচরনে তিনি মাঝে মাঝে এতোই বাড়াবাড়ি করিতেন যে, মনে হইতো এই লোকটি আমার অপছন্দের তালিকায় শীর্ষে রহিয়াছেন কিন্তু তাহাকে তাহা আমি বুঝাইতে চাহি নাই।

এইভাবেই আমার দিনগুলি কাটিয়া যাইতেছিলো। মাঝে মাঝে বন্ধুদের বাসায় বিশেষ বিশেষ উৎসবের বাহানায় আমি বাসার বাহিরে থাকিতে পছন্দ করিতাম, নাইট ক্লাবে ঘুরিতাম, অনেকরাত পর্যন্ত আড্ডা দিতাম। আমার মা কিছু বুঝিতে পারিলেও খুব একটা উচ্চবাচ্য করিতেন না। করিলে আবার খামাখা সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয় এইভয়ে বাবাকেও মা খুব একটা কানে দিতেন না। বিশেষ করে আমার নেশা করিবার ব্যাপারটা তো তিনি বেমালুম চাপিয়া থাকিতেন। মা আমার অনেকদিন অনেকভাবে একা গায়ে হাত বুলাইয়া, আদর করিয়া, মা-সোনা বলিয়া নেশা না করিবার জন্য অনেক জ্ঞ্যানদান করিতেন কিন্তু নেশা এমন এক জিনিস, একবার শুরু করিলে, শেষে নেশাই তোমাকে টানিয়া লইয়া যাইবে। ঐখান হইতে আর বাহির হইবার জোগার থাকে না। মা আরো বলিতেন- নেশা একটা মনের আনন্দ। নেশায় মন এমন এক জায়গায় চলিয়া যায় যেখানে কোনো বাধা নাই। যেনো শুধু স্বাধীনতা আর স্বাধীনতা। বড় শহরের অনেক অন্ধকার গলিতে যেমন প্রতিরাতে একটা নেশার জগত গড়িয়া উঠে, তেমনি বড় লোকেররা বা তাহাদের সন্তানেরা অন্ধকার গলির বাহিরে আলো ঝক মকে আধুনিক প্রাসাদে সেই নেশার জগত গড়িয়া তোলে। উভয় জায়াগতেই সমাজের অনেক শ্রেনী থেকে অনেক যুবকরা আসিয়া থাকে। তাহার সবাই নিজেদের আত্মীয়স্বজন ছাড়িয়া নিজেদের নেশায় ভাসিয়া থাকে। সভ্য সমাজ এদেরকে দেখিয়াও উপেক্ষা করিয়া যায়। খুব বেশী হইলে হয়তো কেউ কানাঘুষা করে, কিন্তু এদেরকে আটকানো বা শোধরানোর জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয় না। সমাজের এই নীরবতা পরোক্ষভাবে অনেক অপরাধকে আমন্ত্রন জানায়। এই নীরবতার সাথে সাথে আরেকটা সত্যির মুখুমুখি হয় মানুষ, তাঁর নাম অপরাধ। এমন একটা অপরাধ যে, এই নেশয় আধমরা হইয়া থাকা বা উত্তেজিত হইয়া থাকা যুবক যুবতীদের সাথে অন্যান্য সাধারন মানুষেরও প্রান চলিয়া যায়।

আমারো ঠিক তাহাই হইয়াছিলো। আমি প্রায় প্রতিদিন নেশা করিতাম। আমি যে একটা মেয়ে, আমার যে অনেক কিছু লুকাইবার আছে, এইগুলি আমার বিবেক, আমার জ্ঞ্যান আমাকে কখনোই বাধা দেয় নাই, না বাধা শুনিয়াছি আমার মায়ের অথবা ভালো বন্ধু বান্ধবদের। মায়ের বাধা আমার কাছে কোনো বাধাই মনে হইতো না। ফলে নেশারই জয় হইয়াছিলো।

আমি অনেক্ষন ধরিয়া শিমার কথাগুলি শুনিতেছিলাম। এইবার আমি তাহাকে প্রশ্ন করিলাম, ‘আচ্ছা কে তোমাকে এইরুপ সঙ্গ দিতো?’

–অসৎ সঙ্গ দেওয়ার জন্য মানুষের অভাব হয় না। শুধু টাকা হইলেই চলে। দেখিবে, তোমার আশেপাশে এমনসব মানুষের ভীড় জমিয়া গিয়াছে যাহা তোমার মাথাটাকে, তোমার আত্মসম্মানবোধটাকে ভূলুণ্ঠিত করিতে একটু সময়ও অপচয় হয় না। নেশার রেশ ধরিয়া প্রথমে একঘর হইতে আরেকঘর, তাহার পর একবাড়ি হইতে আরেকবাড়ি, এবং ধীরে ধীরে একপাড়া হইতে আরেকপাড়ায় এই বদনাম ছড়াইতেই থাকিবে। আর যদি একবার এই বদনাম ছড়াইতে থাকে আর মন তাহা গ্রাহ্য না করিয়া আরো অদম্য গতিতে তাহার শাখা প্রশাখা বাড়াইতে থাকে তখন বিনাশ ছাড়া আর কিছুই নিজের জন্য বহিয়া আনে না। তখন শুধু চাহিয়া চাহিয়া নিজের সর্বনাশ অবলোকন করা ছাড়া আর কিছুই করিবার থাকে না। একটা কথা না বলিলেই নয়। আসলে এই পৃথিবীর সবাই যার যার মতো। সবাই যার যার থেকে আলাদা। কিন্তু একটা জায়গায় সবার সবার সাথে মিল রহিয়াছে। আর সেটা হইলো, সবাই একা। দলবদ্ধ সমাজই বলি, আর একক পরিবারই বলি, সারাটা জীবন প্রতিটি মানুষ একাই ছিলো আর একাই থাকিবে। এই একাকীত্ততা মানুষের জীবনে একটা আফসোসের পাশাপাশি একটা সুখের অনুভুতিও নিয়া আসে যখন সে ভাবে যে সে যাহা করিতে চায় না, সে সেটা করেই না। আবার সে যেইটা করিতেই চায়, সে সেটাই করেই। আর ঠিক এ কারনেই কেউ দলবদ্ধভাবে সুখীও নয় আবার এককভাবেও নয়। এভাবেই একটা চরম আফসোস লইয়া মানুষ এই নীল আকাশের রুপ, এই নির্জন পাহাড়ের মাদকতা কিংবা কনকনে শীত অথবা বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টির টুং টাং শব্দের মূর্ছনা ছাড়িয়াই বিদায় নেয় যাহাকে কেউ আর কখনোই মনে রাখে না। আমার কাছে ইহাই বার বার মনে হইতো যে, আমি একা। আর আমার একাকীত্বই আমাকে বারবার ওই নেশার জগতে টানিত।

সম্ভবত ইহাই হইয়াছিলো আমার এই ছোট্ট জীবনে। আমি আমার জীবনে যাহা করিয়াছি, এখন ভাবিলে আমার নিজেরও মনে হয়, আমি ইহা কিভাবে করিতে পারিলাম? ইহা করা আমার কখনোই উচিত হয় নাই। কিন্তু যে সাপ একবার তাহার বিষদাত ফুটাইয়া তাহার সমস্ত বিষনালী খালি করিয়া সর্বনাশের কামড় মারিয়া দিয়াছে, তাহা হইতে পরিত্রান পাওয়ার জন্য সাপে যাহাকে কামড় দিয়াছে তাহার চিকিৎসা অনেক জরুরী হইয়া ওঝার প্রয়োজন হইয়া পরে। আমি ওঝার সাহায্য নিতে হইবে ইহাও বুঝিতে পারি নাই। 

এইভাবে আমি যেনো আস্তে আস্তে কোন এক অন্ধকার জীবনের শহরে ঢোকিয়া গেলাম। অন্ধকার আর কালোর মধ্যে একটা তফাত আছে। কালোর একটা রঙ আছে কিন্তু অন্ধকারের কোনো রঙ নাই, আছে অনিশ্চয়তা আর প্রতিনিয়ত বিপদের হাতছানি। কিন্তু বয়স বলিয়া একটা কথা আছে। এই বয়সে তাহার মন আর যুক্তি বাস্তবের সাথে কতটা যে ফারাক, তাহাতে আর যাই হোক তাহার আত্মার শান্তি হয় না। আত্মা, মন, আর যুক্তি যখন একই সুতায় থাকে না, তখন প্রতিনিয়ত শুরু হয় অন্তর্দাহ, আর এই অন্তর্দাহ হইতে শুরু হয় কলহ। আর একবার যদি কলহ বাধিয়া যায়, তাহা আর  নিভিবার উপায় থাকে না। অন্তর্দাহ নিভাইবার জন্য জলভর্তি কলশী কিংবা তীরভর্তি নদীর প্রয়োজন নাই, প্রয়োজন সময়ের সাথে পরিবর্তনের ইচ্ছা। ইহা আমার ছিলো না। ফলে অন্তর্দাহ যেমন নিভিতেছিল না, তেমনি বাতাসের স্পর্শ পাইয়া উহা আরো তীব্র দাবদাহে পরিনত হইতেছিলো। আর এই তীব্র আগুন একদিন আমাদের পরিবারেও ছড়াইয়া গিয়া অনাখাংখিত অঘটন ঘটিতে লাগিলো।

প্রতিদিন সকাল হইলেই আমি কেনো দেরি করিয়া ঘুম হইতে উঠি, কেনো আমার ক্লাশের ফলাফল ভালো নয়, কেনো আমাকে প্রতিদিন বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় যাইতে হইবে, আর তাহাদের সঙ্গে আড্ডায় যাইয়া কেনো রাত অবধি থাকিয়া বাসায় ফিরিতে হইবে, এইসব ব্যাপারে কথা শুনিতে হইতো। বাবার সব কথায় আমি প্রতিবাদ করিতাম না কারন আমি জানিতাম, আমার প্রতিবাদে বাবার কাছ হইতে আমার সাহাজ্য বন্ধ হইয়া যাইবে, আর আমার মায়ের এমন কোনো গুপ্ত তহবিলও ছিলো না যেখান হইতে বাবার সাহাজ্য ছাড়াই আমি আমার যাবতীয় শখের মনোবাঞ্চনা পুরুন করিতে পারিবো। তাই মাঝে মাঝে আমি বাবার অকথ্য গালিগালাজের ব্যাপারটা অনেকটা উপেক্ষা করিয়াই আমি বাবার সাথে এমন ব্যবহার করিতাম যেনো, বাবা ছাড়া আমার এই পৃথিবীতে আর কাউকে আমি বেশী ভালোবাসিনা। বাবার অকথ্য গালিগালাজের পরেও আমি বাবাকে এইটা বুঝাইতে পারিতাম যে, আমার বাবা হইতে আরো ভালো বাবা এই পৃথিবীতে আর একটাও সৃষ্টি হয় নাই। তিনিই যেনো সর্বশ্রেষ্ঠ বাবাদের মধ্যে একজন। ইহা ছিলো একটা নকল ভালোবাসা। হইতে পারে, বাবারা বা মায়েরা নকল ভালোবাসা বুঝিতে পারেন না। তাহাদের ভালোবাসায় কোনো খাদ নাই।

এইভাবেই আমার দিন চলিতেছিলো। আমার রুপের কথা যদি তোমাকে বলিতে যাই, সেইটা মনে হয় আর দরকার নাই। আমিতো তোমার সামনেই এখন বসিয়া আছি। আমি দেখিতে কেমন, কেমন আমার চোখ, নাক, গাল কিংবা আমার মুখমন্ডল, ইহা তোমাকে আর বিশেষণ দিয়া বুঝাইতে হইবেনা। অনেক ছেলেবন্ধুরা আমার এই চেহারার প্রতি অনেক আকৃষ্ট হইয়া হয়ত অনেকে অনেক কবিতা, গল্প লিখিয়া থাকিতে পারে, তাহা আমার জানা নাই। তবে অনেকের রাতের ঘুম যে অনেকাংশেই বিঘ্নিত হইতো সেটা আমি জানিতাম। আমাকে নিয়া ছেলেমহলে অনেকের  সঙ্গে অনেকের দুই একবার অনেক যুদ্ধও যে হয় নাই তাহা নয়। কিন্তু আমি প্রকৃতভাবে কাউকেই এমন করিয়া ভালোবাসি নাই যাহাকে তোমরা আধুনিককালের ছেলে মেয়েদের মধ্যে ভালোবাসার সীমানা টানিয়া থাকো। তবে এইটা ঠিক যে, মনুষ্যকুলে আমি যাহাকে সবচেয়ে বেশী আদর করিতাম তাহা হইলো আমার ছোটভাই। বড় মিস্টি করিয়া আমাকে আপু বলিয়া ডাকে, বড্ড দুস্টুমী করিয়া আমার পাশে আসিয়া তাহার যতো আবদার আছে সব খুলিয়া বলে। আমি তাহাকে কখনো গাল টিপিয়া, কখনো বুকে চাপিয়া ধরিয়া, কখনো আবার মিথ্যা ভয় দেখাইয়া বলিতাম, আমি তোমাকে ছাড়িয়া অনেক দূর চলিয়া যাইবো, তখন দেখিবো তুমি কাহাকে এতো কস্ট দাও। আসলে আমার ভাইটি আমাকে কখনো কষ্টও দেয় নাই। নিছক মজা করিবার জন্য তাহাকে আমি মিথ্যা ভয় দেখাইতাম। বুঝিতে চাহিতাম, আমার সেই কথায় সে কতটুকু বিচলিত কিংবা মন খারাপ করে। অনেকদিন হইলো আমি আমার সেই ছোট ভাইটিকে আর দেখিতে পাই না।

এই বলিয়া শিমা একটু থামিলো বটে কিন্তু পরক্ষনেই বুঝিলাম, সে ফুপিয়া ফুপিয়া কাদিতেছে। নিঝুমরাতে এই অসম বয়সী দুই মনুষ্য যুগলের মধ্যে কোনো ভাষার আদান প্রদান হইতেছিলোনা বটে কিন্তু দুইজনের অন্তরের ভিতরে যাহা ঘটিয়া যাইতেছিলো তাহা অদৃশ্য ঈশ্বরের অজানা ছিলোনা। চিনি না, জানি না, কখনো দেখি নাই, এমন একজন মানুষের গল্প শুনিয়া আমার মনের ভিতরেই বা কেনো ব্যথায় একটু মোচর দিয়া উঠিতেছে? আমি তাহার ভাইয়ের ভালোবাসার কথা মনে করিয়া আমি যেনো তাহার ওই ছোট ভাইটিকেও চোখে দেখিতে পাইতেছি। মনে হইতেছিলো, আহা, আমারও যদি এমন একটা ছোট ভাই থাকিতো? সিমার ছোট ভাইয়ের প্রতি এতো ভালোবাসার অনুভুতি দেখিয়া আমার দুই মেয়ের ছবি ভাসিয়া উঠিল। কি অদ্ভুদ এই ভাইবোনের সম্পর্ক। কখনো ঝগড়া, কখনো হাতাহাতি, কখনো খুব ক্ষুদ্র একটা জিনিষ লইয়া তাহাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি আবার কখনো একসঙ্গে এক টেবিলে বসিয়া রাজ্যের হাসাহাসি, আরো কতো কি? ভালোবাসার মানুষ যখন কাছে থাকে, তখন তাহাকে যতটা না আপন মনে হয়, যখন সে কাছে থাকে না, তখন তাহার জন্য প্রান বড় আনচান করে। মনে হয়, একবার যদি আবার কাছে পাইতাম, তাহা হইলে অনেক আদর করিয়া সব ব্যাথা বেদনার জল তাহার কাছে সমর্পণ করিয়া আরেকবার ক্ষমা চাহিয়া বলিতাম, তোমাকে ছাড়া আমার চলিবেনা। আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।

রাত অনেক হইয়াছে। কেহ জাগিয়া আছে বলিয়া আমার মনে হয়না। মাঝে মাঝে ঐ দূরে নাইট গার্ডের চিৎকার শুনা যায়, কিংবা অনেক রাতের বিমান যাত্রিদের নিয়া কিছু কিছু বিমান নিশাচরের মতো আমাদের এলাকা দিয়া উড়িয়া যাইবার সময় বিকট একটা শব্দ করিয়া কোনো এক অজানা অন্ধকারের রাস্তা ধরিয়া একদেশ হইতে আরেক দেশে মিশিয়া যাওয়ার সেই চেনা শব্দ দূর হইতে ভাসিয়া আসিতেছে। কিন্তু ইহাতে আমাদের মধ্যে কোন বিরক্তবোধ হইতেছে না। দেখিলাম, সিমার চোখে একটু একটু জলের আভা ঘরের আলোতে চিক চিক করিতেছে। চোখের জল যখন পরি পরি করিয়াও পরিতেছে না, তখন তাহা চোখের পাপড়ির সঙ্গে এক হইয়া এমন একটা বিন্দুর সৃষ্টি করে যে, মনে হইবে চোখের দুই ধারে যেনো একটা স্বচ্ছ হিরার খন্ড ঈশ্বর বসাইয়া দিয়াছেন। সিমার চোখের কোনায় তাহার দুঃখের বহিরপ্রকাশ যেনো এমন করিয়াই ঐ একখন্ড হিরার জল চিকচিক করিয়া ফুটিয়া উঠিতেছিল। 

সিমা তাহার চোখের জল আমার কাছ হইতে লুকাইবার কোনো চেষ্টাই করিলো না। আমার দিকে ছলছল নেত্রে তাকাইয়া, দুই হাত দিয়া চোখের জল মুছিয়া অতি সাধারন ভঙ্গিতে বলিল,

– আরেক কাপ কফি খাই? তুমিও কি কফি খাবে?

আমি কফি খাইবো কি খাইবো না, ইহার প্রতিউত্তরের জন্য কোন অপেক্ষা না করিয়াই সিমা চেয়ার ছাড়িয়া নিজেই আমাদের রান্নাঘরে কফি বানাইতে চলিয়া গেলো। সিমা একটা নীল ওড়নার সহিত হলুদের কামিজ পড়িয়াছে। কম্বিনেসন করিয়া হয়ত সাদা স্যালয়ার পরিয়াছে কিন্তু খারাপ লাগিতে ছিলো না। আর জেলখানায় তো নিজের আলমারী থাকে না, হয়ত এই কয়টা জামাই তাহার কাছে রহিয়াছে। কতইবা বয়স তাহার। আমার মনটা বড্ড কেমন কেমন যেনো করিতেছিলো। আঘাত করিলেই শুধু অন্তরে ব্যথা হয় এমন নয়। আমাদের চারিদিকে অহরহ এমন কত কিছু ঘটিতেছে যাহার ইতিহাস শুনিলে আঘাত যিনি পাইয়াছেন, তাহার থেকেও আঘাত বেশী প্রতিয়মান হয় যিনি ঐ ইতিহাস শুনিতেছেন। আমারও তাহাই হইতেছিল। আমিও যেনো কোথায় বিনা কারনে আঘাতপ্রাপ্ত হইতেছিলাম।

অনেক্ষন হইয়া গিয়াছে সিমা কফি বানাইতে গিয়াছে, এতক্ষনে কফি বানানো হইবার কথা। দেরী দেখিয়া আমিও রান্নাঘরে ঢুকিলাম। দেখিলাম, একহাতে সিমা একটি ছোট চামচ লইয়া কফির কাপের মধ্যে কফি শুধু নাড়াচাড়াই করিতেছে, অথচ আর নাড়িবার প্রয়োজন নাই। বুঝিলাম তাহার মনোযোগ ঐ কফির কাপের মধ্যে নাই। সে যেনো কোথায় হারাইয়া গিয়াছে। সে যে একটা অপরিচিত বাসায় এতো রাতে কাহাকেও না বলিয়া আসিয়াছে, তাহার যে অতি তাড়াতাড়ি এইখান হইতে আবার চলিয়া যাইবার তাড়া থাকিবার দরকার, আমি তাহার চোখে মুখে, চেহাড়ায় ইহার কোনো চঞ্চলতা দেখিতে পাইলাম না।

আমার উপস্থিতি টের পাইয়া সিমা যেনো সম্বিত ফিরিয়া পাইলো। বুঝিলাম, এতোক্ষন সময়টা সিমার কাছে থামিয়াই ছিলো। একটু লজ্জা পাইলো বটে কিন্তু মুচকী হাসিতেও হাসিলো না। কফি বানানো হইয়াছে। আমরা যার যার কফি হাতে নিয়া আবারো আমাদের ডাইনিং চেয়ারে বসিলাম।

আরো একটা সিগারেট ধরাইয়া আমি সিমাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তারপর কি হইলো?

সিমা কফির কাপের সাথে সিগারেট টানিতে টানিতে বলিতে লাগিলো-

একদিন আমি অনেক রাত করিয়া বাড়ি ফিরিলে দেখিলাম, আমার বাবা তখনো রাত জাগিয়া বসিয়া আছেন। আমার আসিবার অপেক্ষাতেই যেনো বাবা রাত জাগিয়া বসিয়া আছেন। মায়ের দিকে চোখ পড়িতেই বুঝিলাম, মাকে বাবা শারীরিকভাবে হয়তো আঘাত করিয়াছেন। বাবার উপর আমার প্রচন্ড ঘৃণা হইলো। বাবাকে তো আমি আগে হইতেই ভালোবাসিতাম না, আজ সেই নকল ভালোবাসাটা যেনো তাহার খোলস ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিলো। আমি বাবার দিকে এমন করিয়া তাকাইয়া আমার অগ্নি মুর্তি প্রকাশ করিলাম যেনো যদি বাবা আমাকেও কোনো শারীরিক নির্যাতন করেন, তাহা হইলে আমি এমন কিছু করিয়া বসিতে পারি যাহা তাহার পক্ষে সামাল দোয়া সম্ভব না। বাবা হয়তো আমার প্রতিক্রিয়াটা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। ব্যাপারটা ওখানেই সেই রাতে সমাপ্তি হইয়া গিয়াছিলো। কিন্তু আমার মনের ভিতরের রাগ, ঘৃণা কোনোটারই সমাপ্তি হয় নাই। মনে মনে বাবার উপর চরম প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্প করিয়াছিলাম। কোনো কোনো সময় কিছু কিছু নাটক এমনভাবে বানানো হয় যাহাতে সাধারনের চোখে মনে হইবে এটাই সব সত্যি কিন্তু এর পিছনের মুল উদ্দেশ্য অনেক গভীরে। শুধু ভরসার স্থান তৈরির জন্যই নাটক তৈরী করা হয়। আমিও ঠিক এই রকম একটা নাটক তৈরী করিয়াছিলাম। কিছুদিন এমনভাবে সবার সাথে আচরন করিলাম যেনো সবাই ভাবে, আমি ভালো হইয়া গিয়াছি, নেশা করিতেছি না, সবার খোজ খবর লইতেছি। আমার বাবা মাও খুব খুশী আমার এহেনো আচরনে। আসলে নিজেদের মধ্যে যখন কেউ হিংসা হানাহানিতে জড়াইয়া পড়ে, তখন সেইটাই হয় যাহা রক্তের সাথে রক্তের পাল্লা। ক্ষতি হয় শুধু নিজেদের রক্তের। তাহলে এই খেলায় কে জিতে? কেউ না। হয়তো আমিও জিতি নাই।

একদিন আমি আমার বাবা মাকে নিজ হাতে চা বানাইয়া দিলাম, খাবার টেবিল গুছাইয়া দিলাম। কিন্তু আমার বাবা মা ঘুনাক্ষরেও টের পাইলেন না যে, আমার বানানো চায়ে আমি এমন নেশার ট্যাবলেট মিশাইয়াছি, যাহাতে তাহারা নিমিষেই ঘুমের ঘোরে অচেতন হইয়া যান। তাহারা অল্প সময়ের মধ্যে অবসন্ন দেহে ঘুমাইয়া পড়িলেন। অনেক রাত। আমার নেশা করিতে খুব ইচ্ছা হইলো। গোপনে আনা একটা মদের বোতল খুলিয়া প্রানভরে সে রাতে আমি মদ খাইলাম। নেশার সাথে পাল্লা দিয়া আমার রাগ, আমার গোস্যা, আমার ঘৃণা যেনো আরো বাড়িয়া যাইতেছিলো। ঘরের মধ্যে ছুরি কাচি সবই ছিলো। ঘরের শট রুমে কিছু দড়ি ছিলো, আমি খুব সন্তর্পনে সেই দড়ি গুলি দিয়া আমি আমার বাবার পা দুইটা খাটের সাথে বাধিয়া ফেলিলাম। আমার মায়ের উপর আমার কোনো রাগ ছিলো না, কিন্তু মাকেও আমার ভালো বন্ধু বলিয়া মনে আসিলো না। আমি মাকেও বাবার মতো বাধিয়া ফেলিলাম। আমি ধীরে ধীরে রান্না ঘর হইতে বড় মাপের একটা ছুড়ি আনিয়া প্রথমে বাবার গলায় ছুড়ি বসাইয়া দেই। কোনো প্রকারের কোনো বাধা ছাড়াই যেনো আমি বিয়াল্লিশ বছরের একজন সুপুরুষকে মারিয়া ফেলিলাম। মানুষের রক্ত বড্ড গরম। আমার বাবার গলা হইতে রক্ত এমন করিয়া ফুলিকী দিয়া বাহির হইতেছিলো যেনো কনো একটা কুরবানীর পশুর মতো। আমি তাহার রক্তে এক প্রকার ভিজিয়া গেলাম। বাবার গোংগানীতে মা যেনো অবচেতন্তা হইতে নড়িয়া চড়িয়া উঠিলেন। কোনো কিছু চিন্তা না করিয়ায়ি আমি আমার মায়ের গলাতেও ছুড়ি চালাইয়া দিলাম। কথায় আছে, যখন কোনো মানুষ নেশার ঘোরে জংলী জানোয়ারের মতো কোনো কিছুর সাধ পাইয়া যায়, তখন সে নরখাদকই হইয়া উঠে। আমি সম্ভবত তখন এমনই একজন নরখাদক হইয়া উঠিয়াছিলাম।

ঘরে তখন টিম টিম করিয়া আলো জলিতেছিলো, সারাটা বিছানা, বিছানার চাদর, মেঝের ফ্লোর, আর তাহার সাথে আমার সারাটা শরীর স্যাতস্যাতে রক্তের ছোপ। এই অল্প আলতে রক্ত লাল কিনা আমি বুজিয়া উঠি নাই, কিন্তু মানুষের রক্তের একটা গন্ধ আমি পাইয়াছিলাম। যে রক্ত আমার শরীরে বইতেছিলো, সেই একই রক্ত এখন আমার সারা বাড়িতে এদিক সেদিক গড়াইয়া এক জায়গায় গিয়া জমা হইতেছিলো।

সিমা, এই পর্যায়ে আসিয়া একটু থামিলো। কিছুক্ষন কি যেনো ভাবিলো। আমি সিমার দিকে তাকাইয়া ছিলাম। বাড়িটা নীরবতায় ভর্তি। তারপর আমি সিমাকে বলিলাম,

-সিমা, শুধু কি বাবা মার প্রতি রাগের কারনেই তুমি তাহাদের খুন করিলে? খুন করিবার সময় কি তোমার মন একটুও বিচলিতবোধ করে নাই? তোমার মধ্যে কি একবারের জন্যও মায়া, মহব্বত, তাহাদের আদর, কিংবা এমন কিছু মনে পড়ে নাই যাহাতে তুমি চিরতরে তাহাদের খুন না করিয়া তাহাদের ক্ষমা করিয়া দিয়া অন্তত প্রানে বাচাইয়া দিতে পারিতে? অথবা খুন করিবার পর তোমার মনের অবস্থা কেমন হইয়াছিলো? তুমি কি একটু সময়ের জন্যও কাদিয়াছিলে? অথবা এমন কিছু কি ভাবিয়াছো যে, আহা, আমি ইহা কি করিলাম ইত্যাদি?

সিমা সিগারেটের প্যাকেট হইতে আরো একটি সিগারেট লইয়া ম্যাচের কাঠি কয়েকবার চেষ্টা করিয়া জালাইতে না পারিয়া আমার জলন্ত সিগারেটের আগুন হইতে তাহার সিগারেটখানা ধরাইয়া একগাল ধুয়া ছাড়িয়া বলিতে লাগিলো,

– মানুষ যখন নেশায় থাকে তখন তাহার অবস্থা এক, আর যখন নেশা কাটিয়া যায়, তখন তাহার অবস্থা থাকে অন্য রকম। সিমা আমার দিকে তাকাইয়া প্রশ্ন করিলো, তুমি কি কখনো নেশা করিয়াছো? নেশা মানুষকে শুধু স্বার্থপরই বানায় না, তাহাকে নেশা এমন করিয়া চাপিয়া ধরে যে, তখন তাহার কাছে অন্য আর কিছুই বাস্তব বলিয়া মনে হয় না। সে হয়ে উঠে এক অদম্য অপ্রকৃস্থত প্রানি যাহার না আছে কোনো সমাজ, না আছে কোনো বন্ধন, না আছে কোন মহব্বত, না আছে কোনো সংসার। হয়তোবা আমিও সেই রকম একটা ঘোরের মধ্যেই ছিলাম। তাহাদেরকে আমার আপনজন বলিয়া একটুও মনে হয় নাই। আমার ছোট ভাইটিও তাহাদের পাশেই ছিলো, আমি একবারের জন্যও মনে করিতে পারি নাই যে, আমি না হয় তাহাদের হারাইবো, কিন্তু আমার ছোটভাই যাহাকে আমি আমার প্রানের চেয়েও বেশী ভালোবাসি, সে কেনো তাহার বাবা মাকে হারাইবে? আমার শুধু মনে হইতেছিল যে, তোমরা আমাকে অনেক কষ্ট দিয়াছো, আজ তাহার পরিনাম ভোগ করিবে। এই পরিনাম তাহাদের অপরাধের তুলনায় কত বড় শাস্তি, কিংবা এই পরিনাম আদৌ শাস্তি কিনা অথবা এই পরিনাম প্রকারান্তে আমি আমাকেই আরো অধিক শাস্তি দিতেছি কিনা তাহা আমার মনের অজান্তেও আবির্ভাব হয় নাই। ঈশ্বর যখন কাউকে শাস্তি দিতে চাহেন, তখন তাহার দ্বারাই তাহার শাস্তির পথ প্রসারিত করিয়া দেন। ঈশ্বর সব সময়ই নির্দোষ থাকেন।

-কিভাবে তুমি এমন কাজটি এতো সহজে করিলে? আমি সিমাকে প্রশ্ন করিলে, এইবার সিমা আমার দিকে একটু রাগের সহিতই আচরন করিলো।

-আমার আর এই প্রসঙ্গে কোনো কথা বলিতে ভালো লাগিতেছে না। অন্য কথা বলো।

বুঝিলাম, সিমা বিরক্ত হইতেছে। ওকে আমার বিরক্ত করিবার কোন ইচ্ছাই নাই। শুধু জানিতে মন চাহিতেছিলো, তাই জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। এখন আমার জানিলেও যাহা হইবার তাহাতে কোনো রুপ পরিবর্তন হইবে না, আর না জানিলেও ঘটনার কোনো ব্যতয় হইবে না।

– আচ্ছা, আচ্ছা সিমা, তোমাকে আর আমি এই ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করিবো না। তবে তোমার যাহা বলিবার ইচ্ছা হয় তাহাই আমাকে বলো। তোমার কথা শুনিতে আমার ভাল লাগিতেছে।

সিমা এইবার আপন মনে বলিতে লাগিলো-

– জেলখানায় বসিয়া আমি অনেকবার অনেক কিছু ভাবিয়াছি। মায়ের কথা ভাবিয়াছি, বাবার কথা ভাবিয়াছি, আমার ছোট ভাইয়ের কথা ভাবিয়াছি, আমার বন্ধু বান্ধবদের কথা ভাবিয়াছি, আরো ভাবিয়াছি আমার আত্মীয়স্বজনের কথা। বারবার শুধু এইটুকুই মনে হইয়াছে, আমি যাহাদেরকে শাস্তি দিবার জন্য এতোসব করিয়াছিলাম, আসলে তাহারা কেহই শাস্তি পান নাই, শাস্তি পাইয়াছি আমি নিজে। যাহারা আমাদের ছাড়িয়া চলিয়া গেলো, তাহারা আসলে ছিলো আমার নিজের মানুষ। সেগুলি কি শুধু স্মৃতি নাকি স্বপ্ন? আমি জানি, আমি অপরাধ করিয়াছি। আর আমার এই কাজের জন্য আমার কোনো না কোনোদিন শাস্তি হবেই। অপরাধীর পরনতি হলো আইনের হাতকড়া। দেরীতে হলেও আইন তাকে ধরে ফেলবেই। আমি সেচ্ছায় পরদিন সকালে রক্তমাখা শরীর লইয়াই পাশের থানায় আমার ছোট ভাইকে নিয়া হাজির হইয়া সমস্ত ঘটনার বিবরন দেই। থানার অফিসার প্রথমে আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করিতে পারিতেছিলেন না। তিনি আমাকে আসলে কি ঘটিয়াছে তাহা আবার বলিতে বলিলেন। অতঃপর থানার অফিসার কয়েকজন ফোর্স লিয়া আমাদের বাসায় আসিয়া সমস্ত ঘটনা স্বচক্ষে দেখিলেন। আমি বন্দি হইয়া গেলাম। আমাকে হাজতে পাঠানো হইলো। প্রায় দেড় বছর সময় ধরিয়া আমার এই হত্যাযজ্ঞের বিচার হইলো। অবশেষে বিচারক আমার কৃত কর্মের জন্য আমাকে ফাসির আদেশ শুনাইলেন।  

আমি জানি, আমাকে আজ মুক্ত পৃথিবীর আলোবাতাসে ছাড়িয়া দিলেও আমি আর আগের অবস্থানে ফিরিয়া যাইতে পারিব না। যাহারা আমার জীবনের সব আনন্দ, সব সমস্যা সমাধানের জন্য তাহাদের প্রানের ঝুকি পর্যন্ত নিতে প্রস্তুত ছিলেন, আমি তাহাদেরকে নিজহাতে চিরতরে বিদায় করিয়া দিয়াছি। এখন কেনো জানি বারবার সকাল হইলেই মনে হয়, আহা যদি বাবা আমাকে আবার বকা দিতে আসিতো, আহা যদি মা এসে বলিতো, ‘সিমা এবার বিছানা ছাড়ো, উঠো, অনেক বেলা হইয়াছে, নাস্তা খাবে’। কিংবা আমার ছোট ভাইটি যদি আমার ওড়না টানাটানি করিয়া আমাকে জালাতন করিয়া অতিষ্ঠ করিয়া তুলিত? কিন্তু আমি জানি, আজ আর কেহই নাই। চোখে জল আসে, কিন্তু মুছিয়া দিবার মানুষ নাই। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অসহায় বলিয়া মনে হয়, কিন্তু আদর করিয়া কাছে টানিয়া ভরসার কথা শুনাইবার কোন মানুষ নাই। জেলখানায় বসিয়া যখন পূর্ণিমার আকাশ দেখি, অথবা ঘোর বৃষ্টি নামা দেখি, তখন আমার বাড়ির কথা মনে হয়। মনে হয়, কতদিন নিজের ঘরের জানালার পাশে দাঁড়াইয়া আকাশ দেখা হয় নাই, কতদিন দাদুর বাড়ির টিনের চালে টিপটিপ বৃষ্টির ঝনঝন শব্দ শুনা হয় নাই। কষ্ট হয় না বলিলে মিথ্যা বলা হইবে কিন্তু কি আরো এক অদ্ভুত কারনে জানি দুই চোখ ভিজে আসে। এখন আর নেশা করিতে ইচ্ছা করে না। নেশার প্রতি আর আমার কোন আকর্ষণও নাই। তাহার পরেও মনে হয়, মায়ের বকুনির জন্য আমি আজ নেশাগ্রস্থ, বাবার ধমকের জন্য আজ আমি নেশাগ্রস্থ। জানো? যা হারাইয়া যায়, আর যাহার সব কিছু হারাইয়া যায়, সে জানে কি হারাইয়া গিয়াছে আর কাকে হারাইয়া নিঃস্ব হইয়া গেছে।

আজ শুধু মনে হয়, যদি আমি উহা না করিতাম, যদি এমন কিছু করিতাম যাহা আবার ফিরিয়া পাইতাম, অথবা এমন কিছু যাহা আবার ফিরিয়া আসে। তাহা হইলে আজ শরতের সকাল, শীতের পিঠা, মায়ের অযথা বকুনী, ভাইয়ের অযাচিত আবদার, সেই দাদু বাড়ির আঙ্গিনায় বসিয়া একগুচ্ছ দুরন্ত বালক বালিকার সঙ্গে হৈচৈ, কোনো কিছুই জীবন হইতে হারাইয়া যাইতো না। তোমরা বাচিয়া থাকিবে, হয়ত একদিন সময়ের রেশ ধরিয়া তোমরাও আমার মত এই পৃথিবী হইতে বিদায় লইবে। অনেকেই তোমাদের জন্য কাদিবে, কেউ চিৎকার করিয়া বলিবে, তোমাকে ছাড়িয়া যাইতে আমার বড় কষ্ট। কিন্তু আমি যেদিন বিদায় হইবো, তখন সারা পৃথিবীর মানুষ জানিবে, আমি কোনো এক জঘন্য পাপ কাজ করিয়া এই পৃথিবী হইতে বিদায় নিলাম। আমার জন্য কাদিবার কোনো লোক খুজিয়া পাওয়া যাইবে না। আর যারা আমার জন্য আফসোস করিবে হয়তো তাহাদেরকে আমি চিনি না। আসলে এই পৃথিবী আমার জন্য নয় বিধায় আমাকে তাড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। বড় বড় অক্ষরে তাহার পরের দিন প্রতিটি খবরের কাগজে তোমরা পড়িবে, “বাবা মাকে একসঙ্গে জোড়া খুনের দায়ে আমার ফাসি হইয়াছে”। কেহ কেহ আমাকে ঘৃণা করিবে, কেহ আবার ‘মাফ করিয়া দিলেই পারিত’ বলিয়া মন্তব্য করিবে। আর আমার ছোট ভাইটি যেদিন বুঝিতে পারিবে, তাহার পিতামাতা তাহার বোনের কারনে মৃত্যুবরন করিতে হইয়াছে, সেদিন হয়ত সেও আমাকে আর ক্ষমা করিবে না। অপরাধ একখন্ড জমি নয় যে, কাহারো নামে লিখিয়া দেওয়া যায়। রক্ত চোখের জলের থেকেও বেশী ঘন, তাহার পরেও চোখের জলের বেদনা রক্ত ঝরার থেকেও কষ্টের। আমি তাহাদের রক্ত ঝরাইয়াছি বটে কিন্তু কষ্টটা রহিয়া গিয়াছে আমার চোখের জলে।

আমি যেদিন এই পৃথিবী থেকে বিদায় লইবো, জল্লাদ যখন আমাকে আমার শেষ ইচ্ছার কথা জানিতে চাহিবে, জানো আমি কি বলিতে চাইবো? হয়ত মুচকি হাসি দিয়া বলিবো, “আমি পূর্ণিমার চাঁদ দেখিয়া মরিতে চাহি না, আমি এই পৃথিবীর কোনো আলো বাতাস লইয়া কথা বলিতে চাহি না, আমি জীবনের চরম সুখ বা দুঃখের কথা বলিয়াও কাউকে চমক দিতে চাহিবো না। আমি শুধু একটিবার সবার সামনে উচ্চস্বরে চোখের জল ভাসাইয়া বলিতে চাইবো, “মা আমি তোমাকে ভালোবাসি। বাবা, এই পৃথিবীতে তোমার চেয়ে আর কোনো এমন বাবার জন্ম হইবে কিনা আমি জানি না, তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ বাবাদের মধ্যে একজন। আমি তোমাদের কাছে চলিয়া আসিতেছি। আমার ফাঁসির দড়িটা একটু তাড়াতাড়ি বাধিয়া দাও”।

এই বলিয়া সিমা তাহার মাথাটা নুয়াইয়া টেবিলের উপর রাখিয়া ফুপিয়া ফুপিয়া কাদিতে লাগিলো। আমি নিরন্তর কোনো ভাষাবিহীন এক শ্রোতার মতো শুধু সিমার কথাগুলি শুনিতেছিলাম। আমার চোখের পাতাও ভিজিয়া আসিতেছিল। মনে হইতেছিলো, এই ছোট মেয়েটি যেন তাহার বাবার সামনে বসিয়া তাহার জীবনের সমস্ত কষ্টের কথাগুলি বলিয়া বাবাকে আরেকবার ভিজাইয়া দিয়া অস্থির করিয়া তুলিতেছে।

-এই যে শুনছো, এইভাবে টেবিলের উপর ঘুমাইতেছো কেন? কোনো এক হটাত শারীরিক ধাক্কায় আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেলো। দেখিলাম, অনেক বেলা হইয়াছে। আমার গিন্নি তাহার দল লইয়া মানিকগঞ্জ হইতে সকাল সকাল রওয়ানা হইয়া ইতিমধ্যে বাসায় চলিয়া আসিয়াছে। তাহার সহিত ঘরের চাবি ছিলো, অনেক্ষন কলিং বেল টিপার পরেও যখন আমার ঘুম ভাঙ্গাইতে পারে নাই, তখন তাহার ভ্যানিটি ব্যাগে রক্ষিত আরেক গোছা চাবি দিয়া ঘরের দরজা খুলিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। আমি আশেপাশে কি যেনো খুজিতে লাগিলাম। সিমা কি এখনো আছে নাকি চলিয়া গিয়াছে? যদি মেয়েটি আসিয়াই থাকে তাহলে ঘরের চাবি লাগাইয়া আবার কিভাবে চলিয়া গেলো? তাহার কাছে তো কোনো চাবি ছিলো না? তাহলে কি কেহই রাতে আমার সঙ্গে গল্প করে নাই? আমার টেবিলের উপর তো এখনো দেখিতেছি দুইটা কাপ রহিয়াছে। তাহলে কি সিমা আসিয়াছিলো?

আমার গিন্নি, আমি কি খুজিতেছি জিজ্ঞাসা করিতেই বলিলাম, “সিমা……”

আর শেষ করিতে পারিলাম না। গিন্নি বলিয়া উঠিল, জানো? আজকের পত্রিকায় প্রথম পাতায় ঐ যে মেয়েটি যে তার বাবা মাকে খুন করিয়াছিলো, সিমা, তাহার ব্যাপারে বড় বড় করে সংবাদ আসিয়াছে যে, গতকাল রাত বারোটার পর সিমার ফাসি কার্যকর হইয়াছে”।

বুকটা ধক করিয়া উঠিল।

পত্রিকাটি হাতে লইয়া অনেক্ষন ধরিয়া খবরটি পড়িলাম। কিছুতেই মিলাইতে পারিতেছিলাম না। পত্রিকার সংবাদে সিমার শেষ ইচ্ছা জানিতে চাহিলে সিমা নাকি বলিয়াছিলো, “আমার কোনো কিছুই আর কাহারো কাছ হইতে চাহিবার নাই, শুধু আমার ফাঁসির দড়িটা একটু তাড়াতাড়ি বাধিয়া দাও। আমি আমার বাবা মায়ের কাছে যাইবো। তখন নাকি সিমা অতি উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করিয়া বলিতেছিলো, “মা আমি তোমাকে ভালোবাসি। বাবা, এই পৃথিবীতে তোমার চেয়ে আর কোনো এমন বাবার জন্ম হইবে কিনা আমি জানি না, তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ বাবাদের মধ্যে একজন। আমি তোমাদের কাছে চলিয়া আসিতেছি। আমার ফাঁসির দড়িটা একটু তাড়াতাড়ি বাধিয়া দাও।”

(এই গল্পের সাথে কারো কোনো মিল নাই, এটা নিছক একটা গল্প।)

২৪/০২/২০১৬-আমার প্রিয় মা জননীর দল,

 আমার প্রিয় মা জননীর দল,

আমি জানিনা যখন তোমরা আমার এই পত্রখানা পড়িবে তখন তোমাদের কত বয়স হইবে কিংবা আদৌ তোমরা এই পত্রখানা পরিতে পারিবে কিনা কিংবা পড়িলেও কখনো এর মর্মার্থ তোমরা বুঝিতে পারিবে কিনা। আর বুঝিতে পারিলেও কিভাবে এর অর্থ বুঝিবে তাও আমি জানি না। তবুও আজ মনে হইল তোমাদের উদ্দেশে আমার কিছু কথা বলা দরকার যাহা আমার মা আমাকে প্রায় দুই যোগ আগে বলিয়াছিলেন। আমি আমার  "উচ্ছিষ্ট সময়ের ডায়েরি" নামক ব্যক্তিগত ডায়েরিতে এই মুহূর্ত গুলি লিখিয়াছিলাম। তাহা আমি আজ তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করিতে চাই।

"............আজ হইতে প্রায় দুইযুগ আগে আমি যখন আমার মাকে আমার প্রথম ভালবাসার মেয়ের কথা জানাইয়াছিলাম, তখন তিনি মুচকি হাসিয়া আমাকে বলিয়াছিলেন, কে কাহাকে কত বেশি ভালবাসে তাহা কি তুমি ভাবিয়াছ? তুমি কি তাহাকে বিবাহ করিতে চাও? নাকি শুধু মনের আবেগে তোমার একাকীত্বকে দূর করিবার আখাংকায় তাহার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাইতে চাও? মজার ব্যাপার হইল, আমার মা মেয়েটি কতখানি সুন্দর, তাহার বাবার কি পরিমান সম্পদ বা সম্পত্তি আছে, তাহারা কয় ভাইবোন কিংবা তাহার পারিবারিক আর কোন তথ্য উপাত্ত কিছুই জানিবার জন্য আমাকে প্রশ্ন করিলেন না। শুধু বলিলেন, ব্যাপারে আমি কাল তোমার সঙ্গে আবার কথা বলিব এবং তোমার মনোভাব জানিব

আমার মায়ের সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল এবং আমি তাহার সঙ্গে সব কথাই অকপটে বলিতে পারিতাম। মা কথাগুলি খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলিয়া আমাকে আমার মত করিয়া ভাবিবার সময় দিলেন আমার মা।  আমার মা শিক্ষিত নন। তিনি হয়ত তাহার জীবনে প্রাইমারী স্কুল পার করিয়াছেন কিনা তাহাও আমার জানা নাই। কারন তাহার বিয়ে হইয়াছিল যখন তাহার মাত্র ১০ বছর বয়স। নিতান্তই একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে।  কিন্তু তিনি অসম্ভব বুদ্ধিমতী এবং প্রাক্টিক্যাল একজন মা। আমার বড় প্রিয় মানুষ তিনি

 

পরেরদিন আমি আর আমার মা আমাদের বাড়ির আঙিনায় বসিয়া আছি। বিকালের রোদ অনেকটাই কমিয়া গিয়াছে। সন্ধ্যা হইতে আরও কিছু বাকি। আমাদের বাড়ির বড় বরই গাছের মাথায় অনেক পাখির বাসা আছে। পাখিদের কিচির মিচির শব্দ হইতেছে অহরহ। কিচির মিচির করিয়া পাখিদল যে কি কথা কাহাকে বলিতেছে তাহা বুঝিবার ভাষা বা ক্ষমতা আমাদের কাহারো নাই। এইদিক সেইদিক উরাউরি করিতেছে আর যার যার বাসায় তাদের স্থান করিয়া নিতেছে।  দূরে গাছ গাছালিগুলি আস্তে আস্তে সন্ধ্যার ক্ষিন আলোতে ধুসর থেকে আরও কালো বর্ণের রঙ ধারন করিতেছে, বাড়ির গৃহস্থালিরা তাহাদের নিজ নিজ গরু ছাগল ভেড়া লইয়া গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিতেছে। কেউ কেউ আবার মনের আনন্দে সেই আব্দুল আলিমের ভাটিয়ালী কিছু গানের সুরে গানও গাইতেছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মাঠ হইতে খেলা ছারিয়া কেউ জোড়ায় জোড়ায় আবার কেউ দল বাধিয়া বাড়ির অভিমুখে হারাইয়া যাইতেছে। কিছু বয়স্ক মানুষ মাথায় কিছু মাল সামানা লইয়া হয়ত বা শহর কিংবা কাছের বাজার হইতে সদাই করিয়া তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়া যাইতেছে। দিনের শেষলগ্নে গ্রামের কিছু উঠতি বয়সের বধুরা অদুরে আমাদের ধলেশ্বরী নদী হইতে কাঁখে জল তুলিয়া কলসি ভরতি পানি লইয়া, ভিজা কাপড়ে হেলিয়া দুলিয়া মুচকি মুচকি হাসিতে আবার কখনো কখনো উচ্চস্বর আওয়াজে নিজেদের ঘরে আগমন করিতেছে। অদুরে কোন এক সদ্য প্রসব করা গাভি তাহার অবুঝ বাছুরটির সন্ধান না পাইয়া অবিরত হাম্বা হাম্বা করিতেছে। এমন একটি পরিবেশে আমি আর আমার মা মুখুমুখি বসিয়া আছি। বেশ সময় কাটিতেছে আমার। 

 

মা সর্বদা পান খান, মায়ের পানের বাটি যেন তাহার দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মত একটি অংশ। যেখানে যাইবেন, সেখানেই তিনি তার এই অতিব প্রয়োজনীয় সম্পদটি সঙ্গে রাখিবেন। পানের বাটিটি ব্যতিত যেন মায়ের কোন কিছুই আর এত মুল্যবান সম্পদ আমাদের ঘরের মধ্যে নাই। পানের বাটিতে মা তাহার ছোট পিতলের ডান্ডা দিয়া পান পিষিতেছেন, যেন অনেক যত্নের সহিত তিনি একটি খাদ্য রিসিপি বানাইতেছেন। পানের বাটির সঙ্গে পিতলের ডান্ডাটি ঠক ঠক আওয়াজে এক রকম টুং টাং শব্দ হইতেছে। এই রকম একটি পরিবেশে মা আমার দিকে না চাহিয়াই প্রশ্ন করিলেন, "কে আগে ভালবাসার কথা বলিয়াছিল? তুমি না সে?" মা আমাকে নিতান্ত সহজ সুরে যেন কিছুই হয় নাই এমন ভাব করিয়া প্রশ্নটি করিলেন। আমি বলিলাম, "কে আগে ভালবাসার কথা বলল, এতে কি আসে যায় মা? আমরা দুজন দুজনকেই তো ভালবাসি? সে আমাকে ভালবাসে আর আমিও তাকে ভালবাসি"। মা বলিলেন, আমার উপর ভরসা রাখ। আমি তোমাদের দুইজনকেই ভালবাসি যদিও আমি তাহাকে দেখি নাই কিন্তু তুমি তাহাকে ভালবাস। আর তুমি তাহাকে ভালবাস বলিয়াই আমি তাহাকেও ভালবাসি। কিন্তু তুমি তো আমার প্রশ্নের উত্তর এরাইয়া যাইতেছ বলিয়া আমার মনে হইল।"

আমি বললাম, "না মা। আমি তোমার কোন প্রশ্নের উত্তর এরাইয়া যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করি না। তবে আমি প্রথম তার কাছ থেকে পত্র পাইয়াছিলাম সেইটা বলিতে আমার কোন দ্বিধা নাই। আমি পত্র পাইয়া বুঝিয়াছিলাম, যে, আমি ওকে ভালবাসি কিন্তু আমি বলিতে পারি নাই। সে বলিতে পারিয়াছিল। তাহার মানে এই নয় যে, আমি তাহাকে কম ভালবাসি  বা আমি তাহাকে ভালবাসি নাই।"

মা আমার মাথায় হাত বুলাইয়া, আমার পিঠে তাহার একটি হাত চালাইয়া আমার নাকের ডগায় আলতো করিয়া টীপ দিয়া বলিলেন, "তুমি তোমার জায়গায় ঠিক আছ তো? যদি ঠিক থাক, আমি চাই তুমি তাহাকে শাদি কর। তুমি সুখী হইবে"। 

 

আমি অবাক বিস্ময়ে আমার মায়ের দিকে তাকাইলাম, সন্ধ্যার অল্প অল্প আলোতে আমি তাহার চোখে মুখে যেন এক প্রশান্তির ছায়া দেখিতে পাইলাম, তিনি একদিকে তাহার ঘাড় বাকা করিয়া পানের বাটি হইতে পান লইয়া কিছু পিষিত পান নিজের মুখে পুড়িয়া আর বাকি কিছু পান আমার গালে পুড়িয়া দিয়া বলিলেন, "নে পান খা, ভাল লাগিবে। মায়ের দোয়ায় সন্তান সুখী হয়, তুইও জীবনে সুখী হইবি।" 

আমি পান মুখে লইয়া অবাক দৃষ্টিতে মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, "মা, তুমি কিভাবে আমার পছন্দের মেয়েকে না দেখিয়া, তাহার পরিবারের কারো কোন তথ্য না শুনিয়া, তাহার পরিবারের কোন ইতিহাস না জানিয়া এই সন্ধ্যায় এক নিমিষে জীবনের এত বড় একটা সিদ্ধান্ত দিয়া আমাকে সুখী হইবে বলিয়া আশীর্বাদ করিলে?"

মা পানের পিক ফালাইতে ফালাইতে আমার মাথায় হাত রাখিয়া বলিলেন, " ভালোবাসার স্থায়িত্ব তাহার উপর নির্ভর করেনা, যাহাকে সে ভালবাসে, নির্ভর করে তাহাকে যে ভালবাসে তাহার উপর। সে তোমাকে ভালবাসিয়াছে প্রথম, তোমাকে ছাড়িয়া যাওয়ার কোন কারন না থাকিলে সে তোমাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিবে এইটাই হওয়ার কথা। তুমি যাহাকে ভালবাস তাহাকে নয়, তোমাকে যে ভালবাসে তাহাকে তুমি তোমার জীবন সঙ্গিনী কর। তাহা হইলেই তুমি সুখী হইবে। আর ইহাই হইতেছে দাম্পত্য জীবনের সত্যিকারের রূপরেখা।'

আমি আমার মায়ের এত বড় দর্শন শুনিয়া খুব অবাক হইয়াছি। কি অদ্ভুত দর্শন।

মা বলিতে থাকিলেন, কাউকে কখনো তুমি তোমাকে ভালবাসার জন্য জোর করিবে না, বরং তোমাকে কেউ ত্যাগ করুক সেই ব্যাপারে কাউকে জোর করিতে পার। যখন জোর করিয়াও তাহাকে তুমি ত্যাগ করাইতে পারিবে না, নিশ্চিত থাকিবে যে, সে তোমাকে সত্যি ভালবাসে। তাহাকে তুমি তখন আরও বেশি করিয়া আঁকড়াইয়া ধরিবে কারন সে তোমাকে ভালবাসে। যে তোমাকে সত্যিকার ভাবে ভালবাসে, শত কারন থাকা সত্তেও সে তোমাকে কোনদিন ছাড়িয়া যাইবে না। বরং সে একটিমাত্র কারন খুজিবে যে কারনের দ্বারা সে তোমাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিতে পারে, ত্যাগ করিবার জন্য নয়। আর ইহাই হইতেছে প্রকৃত ভালবাসার দুর্বলতা। তুমি তাহার সঙ্গে জীবনে সুখী হইবে।

আজ এত বছর পর আমি উপলব্দি করিতে পারিতেছি যে, আজ হইতে প্রায় দুই যুগ আগে আমার সেই অশিক্ষিত মা যে দর্শন শুনাইয়াছিলেন, তাহা কতখানি সত্য এবং খাটি। আজ আমি আমার জীবনে এক অদ্ভুত সুখ আর আনন্দ লইয়া প্রতিটি দিন অতিবাহিত করি। কারন আমার সঙ্গে আছে সেই মানুষটি যে আমাকে ভালবাসিয়াছিল এবং আমিও তাহাকে ভালবাসিয়াছিলাম। কিন্তু সে আমাকে প্রথম ভালবাসার কথাটি বলিয়াছিল।

মা আরও একটি আস্ত পান তাহার অতি প্রিয় পানের বাটিতে সুপারি আর মশলা দিয়া পিষিতে লাগিলেন। আমার দিকে না তাকাইয়াই তিনি বলিতে থাকিলেন, তুমি নিশ্চয় জানো, একটা ব্রিজ বানাইবার জন্য যা যা লাগে আর একটা দেওয়াল বানাইবার জন্য যা যা লাগে তা একই উপকরন। কিন্তু একটি ব্রিজ দুইটি প্রান্তকে সংযোগ করে আর একটি দেওয়াল দুইটা প্রান্তকে পৃথক করিয়া দেয়। তোমাদের এই যুগলমিলন হইতে হইবে একটি ব্রিজের সমতুল্য। দেওয়াল নয়। এখন তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হইবে তুমি কোনটা চাও এবং কিভাবে চাও আর কখন চাও। দাম্পত্য জীবনে এমন কিছু সময় আসিবে যখন তোমার কাছে মনে হইবে, সবাই ভুল আর তুমি ঠিক। হয়ত বা তুমিই ঠিক আবার তুমি ঠিক নাও হতে পার। তোমারও ভুল হইতে পারে। মা পানের বাটিতে তাহার পিতলের ডান্ডা দিয়া পান পিষানো একটু সময়ের জন্য থামাইয়া আমার দিকে তাকাইয়া বলিলেন, একটা হাদিসের কথা বলি, 'যে ভুল করে সে মানুষ, আর যে ভুল করিয়া তাহার উপর স্থির থাকে সে শয়তান, আর যে ভুল করিয়া আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, সে মুমিন। ফলে অন্যের কোন কথা শুনিবামাত্রই তাহার উপর উত্তেজিত হইয়া কোন কিছু করিতে যাইও না। কারন, তাহার কথার সত্যতা যাচাই করা তোমার কাজ। তোমার জানা উচিৎ সে তোমাকে ঠিক কথাটিই বলিয়াছে কিনা। সে তোমাকে প্ররোচিতও করিতে পারে। কোন কিছুই বিচার বিবেচনা না করিয়া কোন মন্তব্য করা হইতে সবসময় বিরত থাকিবে। মনে রাখিবা, একবার একটা কথা কিংবা মন্তব্য বলিয়া ফেলিলে উহা আর ফেরত নেওয়ার কোন অবকাশ নাই। তখন শুধু হয় নিজেকে অপরাধী হিসাবে ক্ষমা চাইতে হইবে আর অন্যজন তোমাকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখিবে। নিজের উপর বিশ্বাস রাখ। নিজের শক্তিকে বিশ্বাস কর। নিজের মানুষদের উপর বিশ্বাস রাখ। বিশ্বাস কর যে, তুমি পার এবং তুমি যা পার তা অনেকেই পারে না। আর অনেকেই যা পারে তুমিও তা পার।

আমার মায়ের কথাগুলি আমার কাছে এক অসামান্য দর্শনের মত মনে হইতেছিল। এত কথা মা কোথা হইতে জানিল, বা কে তাহাকে এইসব দর্শনের কথা বলিল আমি আজও ভাবিয়া কুল পাই না।

অনেক্ষন হইল সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। কিন্তু পশ্চিমের আকাশে এখনো লাল আভা দেখা যাইতেছে। খোলা উঠানে বসিয়া আছি বলিয়া চারিদিকের অনেক মশারাও তাহাদের উপস্থিতির কথা জানাইয়া দিতাছে। আমার মা তাহার দ্বিতীয় পানটি মুখে লইয়া কিছুক্ষন চাবাইয়া লইলেন। এবং তাহার চর্ব্য পান হইতে একটু পান বাহির করিয়া আমার মুখে গুজিয়া দিলেন। আমার মায়ের চাবানো পান আমার বড় প্রিয়।   

মা আজ অনেক কথা বলিতেছেন যা আমার কাছে এক নতুন অধ্যায়।

মা বলিতে থাকিলেন, শোন বাবা, জীবনে বড় হইতে হইলে জীবনের সব কয়টি কুরুক্ষেত্রকে তোমার মুখুমুখি হইতে হইবে। তুমি তো অনেক বড় বড় মানুষের জিবনি পড়িয়াছ, তাহাদের দর্শন তথ্য পড়িয়াছ।  আজ তাহলে তোমাকে একটা গল্প বলি। একদিন এক ঈদের দিনে আমার বাবা আমাকে একটা নতুন ফ্রক কিনিয়া দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি তা আমাকে আর দিতে পারেন নাই। হয়ত তাকা পয়সা ছিল না। তাই। আমার খুব মন খারাপ হইয়াছিল। সারাদিন আমার মন আর ভাল হইতেছিলনা। আমার মন খারাপ হইয়াছে দেখিয়া আমার বাবারও মন খারাপ হইয়াছিল। হয়ত তাহারও আমার মত ভিতরে ভিতরে একটা কষ্ট হইতেছিল তাহার এত আদরের মেয়ের মন খারাপ বলিয়া। কি জানি কি হইল আমি জানি না, আমার বাবার এক বন্ধু বিকাল বেলায় আমাদের বাসায় বেড়াইতে আসিলেন। হয়ত বাবাই নিমন্তন্ন করিয়াছিলেন। তিনি আমার বাবার খুব কাছের মানুষের মধ্যে একজন। হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি আমাকে অনেক আদর করিলেন, কেন আমার মন খারাপ তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া তিনি মুচকি হাসিয়া এক বিখ্যাত লেখকের উদ্দ্রিতি দিয়া আমাকে বলিলেন, "আমরা অনেক সময় একজোড়া জুতা না পাওয়ার বেদনায় চোখের পানি ফেলি কিন্তু কখনো কি একবার ভেবে দেখেছ যে, অনেকের তো পা ই নেই?" বলিয়া তিনি আমাকে জড়াইয়া ধরিয়া খুব আদর করিয়া দিলেন। বলিলেন, কালই তিনি আমার জন্য নতুন একটি ফ্রক কিনিয়া দিবেন। তিনি এমন করিয়া আমাকে এই কথাটি বলিলেন, যে, আমি যেন ঐ পা বিহিন মানুষটির চেহারা দেখিতে পাইলাম।  তাই তো, কথাটা আমার খুব মনে ধরিয়াছিল। আমার আর মন খারাপ হয় নাই। আমি আর নতুন ফ্রকের জন্য কখনো মন খারাপ করি নাই। আমি বুঝিতে পারিলাম আমার নিজের অবস্থানটা নিয়ে সন্তুষ্ট না হইলে পৃথিবীর কোন কিছুই আমাকে সন্তুষ্ট করিতে পারিবে না। আমি আমার বাবাকে জরাইয়া ধরিয়া অনেক কাদিয়াছিলাম। দুঃখে নয়, এতক্ষন যে বেদনাটা আমাকে খুব কষ্ট দিতেছিল, সেইটা যে বাবার বাবার বুকের ভিতরে গিয়া বাবাকেও কষ্ট দিতেছিল এই মনে করিয়া আমার চোখ আরও আবেগপ্রবন হইয়া উঠিতেছিল। আমার ছোট্ট বালিকা হৃদয়ের এই অফুরন্ত নিস্পাপ সাবলিল ভালবাসার চোখের জলে আমি আমার বাবাকেও কাদিতে দেখিয়াছিলাম। তাহার কান্নাও কোন কষ্ট হইতে নয়। নিছক ভালবাসার। এইটার নামই পরিবার। এইটার নামই হচ্ছে ভালোবাসা। নিজকে লইয়া সন্তুষ্ট থাক। ইহাতে সুখের পরিমান বাড়িবে। সবসময় একটা উপদেশ মনে রাখিবা যে, নিশ্চয় তোমার সৃষ্টিকর্তা তোমাকে কোন উদ্দেশ্যবিহিন এই পৃথিবীতে প্রেরন করেন নাই। তার উদ্দেশ্য আমাদের স্বপ্নের চেয়ে অনেক উত্তম এবং তাহার রহমত আমার হতাশার থেকেও অনেক বেশি। ঈশ্বরকে বিশ্বাস কর। তিনি তোমাকে কোন কিছুই না থেকে অনেক কিছু পাইয়ে দেবেন, যা আমার তোমার চিন্তা জগতেরও বাইরে। আর কাউকেই অবহেলা কর না। তোমার অবহেলা করার একটাই অর্থ দাঁড়াইবে, আর সেটা হচ্ছে তুমি তাহাকে তোমাকে ছাড়া চলিতে পারার অভ্যস্থ করিয়া তুলিতেছ। সবাই তোমার মতবাদ পছন্দ নাও করিতে পারে, সবাই তোমার মত করিয়া ভাবিতে নাও পারে। তুমি যে শার্টটা পছন্দ কর, সেই শার্টটা অন্য একজনের পছন্দ নাও হইতে পারে। এই পৃথিবীতে কিছু কিছু লোক তোমার জীবনে আসিবে আশীর্বাদ হইয়া, আবার কিছু লোক আসিবে শিক্ষণীয় হইয়া। আর এইটাই জীবন। তুমি আমাকে কিছুক্ষন আগে একটা প্রশ্ন করিয়াছিলে না যে, আমি তোমার পছন্দের মেয়েটির কোন কিছুই না জানিয়া, তাহার পরিবারের কি আছে আর কি নাই এই সব কিছুই না জানিয়া কিভাবে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত দিলাম? জীবনে শুধু টাকা পয়সা দিয়াই সব কিছুর মাপকাঠি হয় না। টাকা পয়সা সব কিছু কিনিতে পারে না। টাকায় তুমি আচরন কিনিতে পারিবে না, টাকায় তুমি সম্মান কিনিতে পারিবে না, টাকা দিয়া তুমি চরিত্র কিনিতে পারিবে না, টাকা দিয়া তুমি বিশ্বাস, ধৈর্য, শ্রদ্ধা, বিনয় এইগুল কিছুই কিনিতে পারিবা না। টাকা দিয়া তুমি ভালবাসাও কিনিতে পারিবা না। আর এইসব গুণাবলীগুলো তো আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের সবচেয়ে জরুরী বিষয়। যে ভালবাসিতে জানে, তাহার টাকার দরকার হয় না। আধামুঠো অন্ন খাইয়াই তাহার মন ভাল থাকে, তাহার দেহ ঠিক থাকে, তাহার আত্মা তৃপ্ত থাকে। ইহার পরেও আরও কথা থাকে। তোমার এই তৃপ্ত জীবনে তোমার পথে অনেক ঘেউ ঘেউ করা কুকুরের মত মানুষজনও পাবে। জীবনে যদি বড় হইতে চাও, এই সব চরিত্র হইতে সাবধান থাকিতে হইবে। কারন সব কুকুরকে তোমার মনোযোগ দেওয়ার সময় তোমার নাই। এরা শুধু তোমার মনোযোগই নষ্ট করিবে না, তোমার বড় হওয়ার পথে এরা সবচেয়ে বড় বাধা হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিবে। ইহাদের মধ্যে অনেকেই এই সমাজের কেউ কর্ণধার বলিয়া মনে হইবে, কাউকে আবার সমাজের বিবেচক বলিয়া মান্য করিবে, কেউ আবার প্রথম সারির লোক বলিয়াও গর্ব করিয়া এইদিক সেইদিক প্রচারনা করিয়া বেড়াইবে। উহারা কেউই তোমার শুভাকাঙ্ঘি নহে। শুভাকাঙ্ক্ষী শুধু তোমার একান্ত পরিবার যাহারা তোমার ব্যথায় ব্যথিত হয়, তোমার আনন্দে আনন্দিত হয়, আর তুমি যখন দিশেহারা হইয়া সঠিক সিদ্ধান্ত লইতে অপারগ হওঁ, তখনো তাহারা তোমাকে ছাড়িয়া চলিয়া যায় না।

তোমাদের জন্য রইল আমার অফুরন্ত ভালোবাসা আর দোয়া।

২৩/০২/২০১৬- বগুড়ার পথে

Categories

বগুড়া যাওয়ার পথে

দুরন্ত গতিতে কখনো আমাদের গাড়ি ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত বেগে চলছে, আবার কখনো কখনো অধিক গাড়ির জটিলতায় একেবারে থেমেই যাচ্ছে। থেমে গেলেও খারাপ লাগছে না। কারন আমি রাস্তার দুই ধারে গ্রামের কি এক অপূর্ব সবুজের রাজত্ব, অনেক দূরে গ্রামের কিনারা দিয়ে বয়ে যাওয়া চিকন চিকন খালের ধারে হরেক রঙের গরু ছাগল, ভেড়া, কচি কচি ঘাস খাওয়ায় মগ্ন, ঐ খালের নোংরা জলে কিছু দুর্দান্ত বালক বালিকা কেউ কাপড় পরে আবার কেউ একেবারে দিগম্বর হয়ে খালের কিনারা থেকে লাফ দিয়ে তাদের বীরত্ব দেখানোর তাগিদে কে কত টুকু দূরে লাফিয়ে পরতে পারে তার প্রাণপণ চেষ্টা করছে ইত্যাদি দৃশ্য আমার মনে এক আনন্দের জয়ার দিচ্ছে। আমি দেখছি, ঐ সব ছোট ছোট বালক বালিকাদের মধ্যে মাঝে মাঝে মধ্য বয়সী কোন অভিভাবক সন্তানের অনিষ্ট না হয় এমন লাফের পায়তারা থেকে উচ্চস্বরে ধমকও দিচ্ছেন। কিন্তু কে কার কথাই বা শুনে। এদের যে বয়স, তাতে দুরন্তপনাই হচ্ছে মূললক্ষ। আমি অনেকক্ষন ধরেই এই অভাবিত দৃশ্য গুলো দেখছি আর আমার সেই শৈশবকালের একই প্রকৃতির দুরন্তপনাগুলো মনে করছি। আহ কি সুন্দর ছিল সেই সব দিনগুলো।

আমার সঙ্গে আমার মেয়েরা আছে। ওরা আধুনিককালের প্রজন্ম। এরা এই সব দৃশ্যের আনন্দের মুহূর্তগুলো বুঝে না। ওরা গাছের সবুজের নিচের আলো বাতাসের খবর রাখে না। ওরা চৈত্রের দুপুরে হেটে হেটে স্কুল থেকে এসে পান্তা ভাতের স্বাদ বুঝে না। ওরা কালবৈশাখী ঝড়ের দিনে আধাপাকা আম কুড়ানোর মজাটা বুঝে না। কিংবা শিলা বৃষ্টির মধ্যে অযথা ছোটখাট বরফের মত শিলা কুড়ানোর মজাটা বুঝে না। ওরা সারাক্ষন ট্যাব আর মোবাইল ফোন নিয়ে রক মিউজিক নিয়ে ব্যস্ত কিংবা কম্পিউটারে গ্রাফিক্সের মাধ্যমে গ্রামের কিছু কিছু অতি সুন্দর পোট্রেট দেখেই মুগ্ধ। কিন্তু সত্যিকারের গ্রামের গা থেকে সোঁদা মাটির যে গন্ধ, পচা বাঁশ পাতার যে একটা টক টক ঘ্রান, কিংবা সন্ধ্যায় শিয়ালের যে ডাক, তারা ওগুলোর কোন স্বাদ বুঝে না। গ্রামের রাস্তা ধরে ক্ষেতের আইল ভেঙ্গে হাটার যে এক অদ্ভুদ রোমান্স, আধাকালো সন্ধ্যায় ভয় ভয় হৃদয়ে শ্মশানের পাশ দিয়ে যাওয়ার যে অনুভূতি তার কোন কিছুই এদের ইন্দ্রিয় বুঝে না। ওরা সুকান্তকে চিনে না, ওরা রবিন্দ্রনাথকে চিনে না, ওরা নজরুলের প্রেমের কবিতা পরেনা। ওরা অনেক কিছুই জানে না। ওরা টাইটানিক দেখে অভিভুত হয় কিন্তু ওরা জ্যাকের ঐ ঐতিহাসিক কথাগুলো বুঝে না যখন সে বলে, “পার্টি? পার্টি যদি মজা করতে হয় তাহলে আস আমার সঙ্গে আমাদের তৃতীয় শ্রেণীর কামরায়, দেখ কিভাবে পার্টির স্বাদ গ্রহন করতে হয়।” রোজ বুঝেছিল কিন্তু আজকের দিনের “রোজেরা” এটা বুঝে না, বুঝতেও চায় না।

যাই হোক, আমরা চলছি আর আমি দেখছি দুই প্রজন্মের মধ্যে কত ফারাক হয়ে যাচ্ছে এই পৃথিবী। আমার কাছে এখনো ঢেঁকি ছাটা চাল খেতে মন উতলা হয়ে উঠে, আমার এখনো বরই গাছের নিছে এবড়ো থেবড়োভাবে পরে থাকা আধাপাকা বরই একদম একটু লবন দিয়ে আবার লবন পাওয়া না গেলে খালি খালিই খেতে মন চায়, আমার কাছে কয়েক টুকরা ধনিয়া পাতা হাত দিয়ে মুচড়ে কাচা মরিচ দিয়ে এক প্লেট পান্তা ভাতের আনন্দ এখনো পেতে ইচ্ছে করে। কি সব দিনগুলো আমি হারিয়ে ফেলেছি, ভাবতেই আমার মন যেন একেবারে ব্যথায় মুচড় দিয়ে উঠে। আমি কি বলি আমার সন্তানেরা বুঝে না, আমার সন্তানেরা কি বলে আমার বুঝতে ভাল লাগে না। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা এখন আর আজকের দিনের ছেলেমেয়েদের কাছে কোন কাব্যই মনে হয় না। রক্তকরবি দেখে ওদের মনে হয় কি সব আবোল তাবোল লেখা লিখে রবিন্দ্রনাথ এত বিখ্যাত হয়ে গেলেন? নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ যেন এক কাল্পনিক কথা, এর কোন রোমান্স আজকের দিনের প্রজন্মের কাছে কোন স্বপ্নই মনে হয় না। ম্যাক্সিম গোরকির “মা” উপন্যাশটি পরার জন্য আমি কতবার পরিক্ষার পড়ায় ছেদ দিয়েছি তার কোন ইয়ত্যা নেই, অথচ আজ যখন আমি আমি আমার প্রজন্মের কাছে এই সব উপন্যাশের কথা বলতে চাই, তারা ম্যক্সিম গরকিকে তাই জানে না।

গান বাজছে আধুনিক। কি সব কথাবার্তা, কোন ভাব গম্ভীরতা নাই, সুর আছে ড্রাম পিটানোর মত, বুকে লাগে এর প্রতিটি আছাড়। কিন্তু হৃদয় ছুয়ে যায় না। (…চলবে) 

২৩/০২/২০১৬- বগুড়ার পথে (২)

Categories

বগুড়া যাওয়ার পথে (২য় পর্ব) 

বগুড়া শহরে এই আমার প্রথম আসা নয়। কর্মস্থল হিসাবে আমি এই অঞ্চলে প্রায় পাঁচ বছর কাটিয়েছি। গ্রামের অধিকাংশ অলি গলি, আনাচে কানাচে ঘুরেছি, কখনো দায়িত্ব পালনের জন্য রাত অবধি জেগে থেকেছি। কখনো আবার নিছক মনের তাগিদে ঘুরে প্রকৃতির সৌন্দর্য আহরণের জন্য দিকবিদিক ঘুরেছি। কখনো আমি গভির রাতে, কখনো রাতের শেষ প্রহর জেগে থেকে শুক্ল পক্ষের চাঁদ দেখেছি। কখনো আমি দেখেছি অমাবশ্যায় আকাশ তার কি রূপে পৃথিবীর কাছে প্রেম নিবেদন করে। কখনো আবার ঘোর বৃষ্টির রাতে যখন সব মানুসেরা তাদের নিজ নিজ আস্তানায় ফিরে গভির ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, যখন পাখীরাও আর কিচির মিচির করে না, আমি তখনও চাঁদহীন মেঘলা আকাশের মুসলধারে বৃষ্টির চ্ছটায় বারান্দায় বসে দেখেছি গাছগুলো কিভাবে বৃষ্টির জলে একা একা খেলা করে, কিভাবে হেলেদুলে একে অপরের আরও কাছে চলে আসে। কোন কথা নাই, নিঃশব্দে নিরবে অবিরত বৃষ্টি এই ঘুমন্ত ধরাকে কিভাবে স্নিগ্ধ চুম্বনে আলিঙ্গন করে। আকাশ মাটি আর বৃষ্টির এই প্রেমের লীলা এক অদ্ভুত রহস্য ঈশ্বরের। শরৎচন্দ্রের সেই বিখ্যাত শ্রীকান্ত উপন্যাসের কিছু অভিব্যাক্তি আমার মনে পরে। ……”অন্ধকারেরও রূপ আছে” । আসলেই আছে। মানুষ দিনের আলোয় যা দেখে না, অন্ধকারে সে টা উপলব্ধি করে, মানুষ দিনের আলোয় যা বিশ্বাস করে না, অন্ধকারের ঘোর নিশানায় সে সেটা বিশ্বাস করে। এখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। গাড়ির আলোতে আমি সামনের রাস্তা দেখছি কিন্তু পাশে ফেলে যাওয়া অনেক কিছুই এখন আর আমার নজরে পরছে না অথচ এই ফেলে যাওয়া রাস্তার ধারেও কতই না সৌন্দর্য পরে আছে। মাঝে মাঝে লাইট পোস্টের কিছু আলোতে কিছু কিছু লোকালয়ের বস্তি চোখে পরে। ওখানেও অনেক অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের অনেক কাহিনি লুকিয়ে আছে যার ইতি বৃত্ত আমাদের অনেকেরই জানা নাই।

অনেক দূর চলে এসছি আমরা। বগুড়া শহর আর বেশি দূরে নাই। গাড়ির তেল ফুরিয়ে গেছে প্রায়, তেল নিতে একটি তেল পাম্পে ঢোকতেই হচ্ছে। ইচ্ছা না থাকা সত্তেও গাড়ি থামাতে হল। আমি নেমেই একটা সিগারেট ধরালাম। একটি ৬-৭ বছরের বাচ্চা সহ একজন মহিলা আমার কাছে এসে বল্ল, স্যার আমার এই ছেলেটার একটা চোখ অন্ধ, আর একটা হাত অবশ। দিন না আমাকে কিছু। বড় মায়া হল। মা তার অন্ধ এবং পঙ্গু ছেলের জন্য কোথায় না ঘুরছে? আমার মায়ের কথা মনে পড়ল।  মনে হল কতকাল আমার মা আমাকে আর আদর করে না, কতকাল আমার মা আমাকে আর খোকা বলে ডাকে না। আমাকে আর শাসনও করে না। অথচ আমি জানি আমার মা আমার কাছে আছেন, আমাকে দেখছেন। আজ আমি বাবা, আমার মেয়েরা আস্তে আস্তে তাদের আরেক জীবনে প্রবেশ করছে। হয়তবা আমিও আর ওদেরকে আর আগের মত শাসন করতে পারবনা, আমি আর আগের মত বুকে জরিয়ে ধরে বলতে পারব না, মা তোমার কি মন খারাপ? হয়ত বা তার সত্যি মন খারাপ, হয়তবা সেও কোথাও বসে কোন এক অমাবস্যার রাতে বৃষ্টির ঘন চ্ছটায় আমাদের কথা মনে করছে, অথচ আমি তার পাশে নাই। তাই মাঝে মাঝে অদেরকে মিস করব বলে আজ এই দিনে অনেক অগোছালো আব্দার আমি মেনেই নিচ্ছি।

যাই হোক, ছেলেটার জন্য প্রচন্ড মায়া হল। মায়ের জন্য আমার বুকটা কোথায় যেন একটু ব্যাথা অনুভব করলাম। বললাম, এটা কি তোমার একমাত্র সন্তান? মা সময় অপচয় না করে বিনা দ্বিধায় উত্তর দিল, “হ্যা গো স্যার, হামাক একটাই পোলা, হামাক বড় আদরের পোলা গো স্যার।” একটা মা, জাস্ট একজন মা। তার পরিচয়, মা। মাকে নিয়ে অনেক কবিতা পড়েছি, মাকে নিয়ে অনেক ইতিহাস রচিত হয়েছে। মাকে নিয়ে ধর্মগ্রন্থেও অনেক বানি রয়েছে। আমি নিজেও মাকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছি যদিও আমি কবি নই। আমার কবিতা কোথাও ছাপা হোক সেটাও আমি চাইনি। তারপরেও মনের আবেগে আমি মাকে নিয়ে অনেক কবিতাও লিখেছি। আজ মনে হচ্ছে মাকে খুব মিস করছি। কোন এক সময় মাকে মিস করে একটা কবিতাও লিখেছিলাম…

আমি এক দস্যুরানীর প্রেমিক
কি এক অদ্ভুদ তার চাহনি, কখন মায়াবতী
কখন বা কঠোর স্পাত কঠিন ভিতি
কি অবাক এক জীবনীযোগে
অতন্দ্র ঘোর অন্ধকারে আমার পানে চাহিয়া সে আলেয়ারে খোঁজে

আবার কখনো টকটকে রৌদ্র স্নানে
কোন এক অজানা ভয়ে কম্পিত হয় শিহরনে
কখনো ভালবাসায় আমাকে ছুরে দেয় অসীম আকাশের দিকে
আবার যদি হারিয়ে যাই এই ভয়ে ঢেকে রাখে তার শারির আচলে

কি অদ্ভুদ সে।
কখনো গাল ভরে চুমু
আবার কখনো ইশা খার মত করা শাসনের ঝুমু
সকাল সন্ধ্যা দিন রাত আমার কোন স্বাধীনতা নাই
আবার আমার কোন কাজে তার কোন বাধাও নাই

মাঝে মাঝে আমার বড় রাগ হয়
আর সে খিলখিলিয়ে হাসে,
আমি যখন হাসি, সে তখন অপরূপ দৃষ্টিতে অশ্রু নয়নে ভাসে
আর বলে, আমি নাকি পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর।
অথচ আমার একটা চোখ নাই, আমি দেখতেও ফর্সা নই।
একদিন অনেক রাতে সেই অমাবশ্যার অন্ধকারে চুপি চুপি আমি তারে প্রশ্ন করেছিলাম

কে গো তুমি আসলে?
সিক্ত নয়নে আমার কাধে হাত রেখে বলেছিল
“তুমি যখন এই পৃথিবীতে প্রথম আস
তখন আমার নতুন পরিচয় হয়েছিল
আমার নতুন নাম হয়েছিল, “মা”

(…… হয়ত চলবে)

১৮/২/২০১৬-আমার বড় মেয়ের সঙ্গে

গত দুইদিন যাবত আমি আমার বড় মেয়ের সঙ্গে যথেষ্ট সময় কাটানোর চেষ্টা করছি। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে। এখনো ছেলেমেয়ের মধ্যে কোন রাত যাপনের সুযোগ আমরা দেই নাই যদিও এটা আমাদের ধর্মের রীতির মধ্যে পরে না কিন্তু আমি খুব বিস্ময়ের সহিত লক্ষ করছি আমাদের এই দুইজন সন্তানও কোন প্রকারের দাবি তুলে নাই তাদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করছি বলে। ওরা নিষ্পাপ মানুষগুলোর মধ্যে একজন।

কিন্তু আমি একটা জিনিস লক্ষ করছি আমার মধ্যে যে, আমার বুকের ভিতর কোথায় যেন একটা ফাকা ফাঁকা ঠেকছে। অথচ কোন কিছুই আমি হারাই নাই। বরং আমি আরও একজন নতুন মানুষ পেয়েছি, আমি আরও একজন সুসন্তান পেয়েছি, অন্যভাবে বলতে হয় যে, আমার যে একজন ছেলে সন্তানের অভাব ছিল আজ মনে হয় যেন আমি একজন ছেলে সন্তান পেয়েছি। কখনো কোনদিন কোনভাবেই আমার অগোচরেও আমার মনে আমার একজন ছেলে সন্তান দরকার এই ভাবনাটা আসে নাই। আজ আমার মেয়ের জামাইকে পেয়ে মনে হল, আমি যেন আজ নতুন করে বাবা হয়েছি। একজন ছেলের বাবা। যে অভিজ্ঞতাটা আমার কখনো ছিল না। কিন্তু তারপরেও প্রতিনিয়ত আমার কাছে মনে হচ্ছে আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। কি সেই পরিবর্তনটা? কাজের ফাকে কারনটা খুজতে চেষ্টা করেছি, অবসরে খুজতে চেষ্টা করেছি, একাএকা ভেবে দেখার চেষ্টা করেছি, চোখ বুঝে ভাবার চেষ্টা করেছি, চোখ খুলে দিনের আলোয় বুঝার চেস্তা করেছি, আমার কোথাও কোন কোন হারায় নাই। অথচ ব্যাপারটা ঘটছে আমার মাথার ভিতর, আর ব্যাথাটা পাচ্ছি অন্তরের ভিতর। এরই মধ্যে আমার মেয়ের বিয়ের কারনে আমার যেন নতুন করে একটা আনন্দ হচ্ছে আমার সর্বত্র। তাহলে কি হয়েছে আমার? ইন্ডাস্ট্রি চলছে আগের মত, ব্যবসা চলছে ঠিক আগের মত, আমি অফিসে যাচ্ছি ঠিক সময়মত, আমার কোন কাজেই আমার কোন হেরফের হচ্ছে না। তারপরেও একটা অনুভূতি কাজ করছে। সেই অনুভুতিটা আজ যেন আমার কাছে কিছুটা স্পষ্ট হল। সম্ভবত এই কারনে যে, একদিন কোন এক শরতের সন্ধ্যায় কিংবা বর্ষার এক ঘনমেঘের দিনে আমার এই মেয়ে আমাকে অঝোর অশ্রু জলে ভাসিয়ে আমারই চোখের সামনে পরিবারের অতিতের সমস্ত আদর আপ্যায়ন ভালোবাসা রাগ গোস্যা, অভিমান, ঝগড়া সব ছেড়ে তার দুই নয়ন ভাসিয়ে আমার হাত ছেড়ে আজকের এই নতুন ছেলের হাত ধরে অন্য কোথাও বাসা বাঁধবে। আমার সব অধিকার থাকা সত্তেও, আমার সব ভালোবাসা ঠিক আগের জায়গায় রেখেই আমার মেয়ে তার আরেক নতুন পৃথিবী তৈরি করবে অন্য এক স্থানে। এই ভাবনা আসতেই যেন আমার চোখের পাতা ভিজে আসে কখনো আনন্দে আবার কখনো মিস করার এক কষ্টে।  আমার বুকে একটা সুখের অনুভুতির সঙ্গে আবার একটা অন্য রকম কষ্টের অনুভূতিও অনুভব হয়।  এটা আসলে কষ্ট নয়, এটাও একটা সুখের কষ্ট। ঐ যে ঐ রকম একটা অনুভুতির মত "তোমার মা তার জীবনে তোমাকে কাদতে দেখে একবারই হেসেছিল, যেদিন তোমার জন্ম হয়েছিল।" কি দারুন কথা না!!

আজ আমার মনে হচ্ছে আমিও হয়ত তোমার চলে যাওয়ার সময় তোমার কান্না দেখে আমি অশ্রুজলে হেসে হেসে আমার অন্তরের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে বলব, তুমি সব সময় ভাল থাকবে আমার এই নবাগত ছেলের হাত ধরে। তাকে তুমি শক্ত করে ধরে রেখ মা, আমিও ওর হাত ধরে রেখেছি যেন ও কোথাও হারিয়ে না যায়। আমার কাছে তো আলো আছে মা। আমি তোমাদের জন্য এক বাসযোগ্য পৃথিবীর আবাসস্থল গড়ে দিয়ে যাব, এই আমার প্রতিজ্ঞা ঈশ্বরের কাছে।

১৪/২/২০১৬-বিশ্ব ভালবাসা দিবস-বিয়ে 

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব 

ফেব্রুয়ারী 

১৪ 

আজ তোমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যা একজন মেয়ের জীবনের বাকি সব পরিচয় সম্পন্ন করার লক্ষে সামাজিক এক প্রত্যায়ন পত্র আর ধর্মীয় রীতিতে মহান আল্লাহতালার আদেশ পালনের মহাজ্ঞা। আর এই প্রত্যায়ন পত্রের মাধ্যমে তুমি আজ সাধারন এক বাবার মেয়ে থেকে অন্য এক পুরুষের স্ত্রী হয়েছ, একটি পরিবারের বউ হয়েছ, কারো ভাবী, কারো ননদিনী এবং আরও অনেক নতুন সম্পর্কের সৃষ্টি করেছ। সময়ের পরিবর্তনে আল্লাহর ইচ্ছায় একদিন তুমি মা হবে, তারপর ক্রমান্বয়ে শাশুড়ি থেকে দাদী এবং তারপরে হয়ত বড়মা ইত্যাদি। আর এইসব সার্থক জীবনের জন্য যা প্রয়োজন তারমাত্র একটি সিঁড়ি তুমি আজ পার করলে। বাকি অধ্যায়গুলো পাওয়ার জন্য তোমাকে আরও অনেক কঠিন কঠিন দিন, সময় এবং ক্ষন পার করে এক অনবদ্য এবং নিরবিচ্ছিন্ন জীবন পার করতে হবে এবং তা পার করতে পারলেই কেবল সার্থক মা, সার্থক শাশুড়ি, সার্থক দাদী কিংবা সার্থক বড়মা হওয়ার যোগ্যতা তুমি অর্জন করতে পারবে। আর তার সঙ্গে তুমি পাবে সামাজিক এক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান এবং হয়ে উঠবে সবার কাছে এক দৃষ্টান্তমুলক ব্যক্তিত্ব।  

এখন যে প্রশ্নটা আসে, এই অনবদ্য এবং নিরবিচ্ছিন্ন জীবন বলতে কি বুঝায়? অনবদ্য জীবন মানেই সমস্যাবিহিন জীবন নয়। বরঞ্চ সমস্যা নিরসনকল্পে কিভাবে কখন কোথায় কেমন করে তা সমাধান করা যায় তার হিসাব। এই জীবনে অনেক সমস্যা আসবে, আর এই সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক চেনা-অচেনা মানুষের ভীর তোমার আশেপাশে দেখতে পাবে। কাউকে মনে হবে তোমার অতি পরিচিত এক বন্ধু, কেউ আসবে তোমার জীবনে এমন বেশ ধরে যে মনে হবে তোমার দুঃখে সে অতি দুঃখিত, কেউ আবার এমন করে তার অনুভুতি তোমার কাছে মেলে ধরবে যেন ঠিক এটাই তুমি চাচ্ছ। এই দলটি প্রথমে তোমাকে ভালবাসার কথা শুনাবে, ভাললাগার কথা বলবে, কাজ না হলে নিজেদের চোখের জলে তোমাকে দুর্বল করার চেষ্টা করবে, এমনও হতে পারে তারা তাদের অসহায়ত্তের কথা বলে তোমার কোমল হৃদয়ে জায়গা করার চেষ্টা করবে, আর কিছুতেই কিছু না হলে তখন তোমার মন কিভাবে পিশিয়ে উঠবে সে চেষ্টা করবে। এই দলটি কখনো বালকসুলভ ভদ্র আচরনে আবার কখনো সে অত্যাচারির রুপে তোমাকে দেখা দেবে, এবং তোমাকে বিপথে নিয়ে যাবে। সাবধান থেক এদের থেকে। মনে প্রানে বিশ্বাস রেখ যে, এরা আসলে কেউ তোমার প্রকৃত বন্ধু নয়। একজনও না। আর এটাই এই অদ্ভুত এই পৃথিবীর আচরন। যখনই তুমি এদের সাথে তোমার জীবনের ব্যক্তিগত সমস্যাবলী শেয়ার করেছ, ঠিক তখনি তুমি সমস্যার আরও জটিল গহব্বরে আটকে যাবে। তোমার সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে তোমার সমস্যা আরও গভির থেকে গভিরে নিয়ে যাবে এবং এক সময় তোমার জীবনটা এরা কুপরামর্শ দিয়ে এতটাই অতিষ্ঠ করে তোলবে যে, আজ যারা তোমার সত্যিকারের বন্ধু, যারা তোমার জিবনটা সুন্দর হয়ে উঠুক বলে প্রতিনিয়ত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, তাদেরকে তোমার কাউকেই আর বন্ধু মনে হবে না। যেদিন তোমার কাছে এই সব শুভাকাঙ্ক্ষী লোকজনকে আর তোমার আপনজন বলে মনে হবে না, সেদিন তোমাকে মনে রাখতে হবে যে চাটুকারের দল তোমাকে ঘিরে ফেলেছে এবং তোমার জীবনের সব সাধ-আহ্লাদ ধ্বংসের পথে। তোমার আর ঐসব পর্ব, সার্থক মা, সার্থক শাশুড়ি কিংবা সার্থক দাদী হওয়ার পথে এক বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। ঐসব বিপথগামী মানুষরূপী শয়তান গুলো এইটাই চেয়েছে। এর মানে এই যে, তোমাকে প্রতিনিয়ত ঐসব চাটুকার, ঐসব হায়েনা, ঐসব বন্ধুতুল্য অপরিচ্ছন্ন মানুষরূপি খারাপ মানুষগুলোর কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। দূরে থাকতে হবে তোমার নিজের ভাল থাকার জন্য, দূরে থাকতে হবে সামাজিক সম্মান আর পরিচ্ছন্ন জীবনের জন্য। আর ঐসব হায়েনাদের কাছ থেকে দূরে থাকার একটাই পথ, আল্লাহর উপর ভরসা করে নিজের মানুষদের উপর বিশ্বাস রেখে নিজেকে সঠিক পথে এবং নিজের আত্মবিশ্বাসকে বিশ্বাস করে। তোমার যা আছে, তাতেই তোমাকে সন্তুষ্ট হয়ে থাকতে হবে। তোমার থেকেও অনেক মানুষের অনেক কিছু নাই, কারো হাত নাই, কারো পা নাই, কারো বাবা মা নাই, কারো থাকার ঘর নাই, কারো আবার কিছুই নাই। তোমার তো অন্তত আমরা আছি, তোমার স্বামী আছে, তোমার খুব ভাল শশুর শাশুড়ি আছে, তোমার উকিল বাবা আছে, তোমার জা, ননদিনী, ভাসুর সবাই আছে। তোমার সুন্দর ঘর আছে, তোমার কি নাই? আল্লাহ তোমাকে অনেক অনেক ভালবাসে বলেই আজ তোমাকে এই রকম একজন সুন্দর মানুষের হাত ধরতে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে যাকে তুমি নিজে ভালবেসেছ এবং তুমি তাকেই পেয়েছ। তোমার জন্য এই মানুষগুলো প্রতিনিয়ত ঈশ্বরের কাছে দোয়া করে, তোমার ভাল চায়। তাদের ভালবাসার মুল্য শুধু একটাই, তোমরা সুখে থাক, তোমরা ভাল থাক। আর কিছুই চায় না এই স্বার্থহীন মানুষগুলো। নিজের স্বামীর কাছে তুমি কতটুকু গ্রহনযোগ্য তা নির্ভর করবে তুমি নিজের কাছে কতটুকুন সৎ এবং তুমি কতটুকুন নিজেকে ভালবাস তার উপর।  

মনে রেখ ভয়, ঘৃণা এবং লোভ কখনো মরে না। এটাকে প্রথম থেকে দূরে রাখতে হবে। আর এর প্রধান উপায় হচ্ছে যখনই কোন ভয়ের উদ্রেক হবে, যখনই কোন ঘৃণার কারন সামনে এসে দারাবে, যখনই কোন লোভের বশবর্তী হবে, ঠিক যার কারনে এইসব ভয়, ঘৃণা এবং লোভের উদ্রেক হবে তা থেকে দূরে থাকতে হবে এবং তার সঠিক ব্যাখ্যা ঠিক লোকের কাছ থেকে সরাসরি জেনে মন পরিস্কার করে নিতে হবে। তাতেই তুমি জয়ি হবে। আর যদি তা না কর, নিশ্চিত জেনো তোমার পরাজয় নিশ্চিত। আর এটাই চেয়েছে ঐসব বন্ধুসুলভ তোমার হায়েনার দল। তুমি যদি জয়ি হওঁ, তবেই তুমি পাবে নিরবিচ্ছিন্ন জীবনের স্বাদ আর তারপরেই পাবে তুমি জীবনের ঐ সব পর্যায়ের সব কিছু। অর্থাৎ সার্থক একজন মা, সার্থক একজন স্ত্রী, সার্থক একজন শাশুড়ি কিংবা দাদির পরিচয়।  

আজ তোমাকে একটি সত্য কথা বলি। তোমার মা আমার জীবনে এক আশীর্বাদ। এটা তুমি নিজেও জানো। এর মানে এই নয় যে তোমার মা একমাত্র সবচেয়ে গুণী ব্যক্তি, তোমার মা একমাত্র সুন্দরী মহিলা। তার মধ্যেও অনেক গুনাবলির অভাব রয়েছে, তার মধ্যেও অনেক দোষ রয়েছে, তার সঙ্গে আমারও অনেক সময় কারনে অকারনে এবং খুব তুচ্ছ জিনিস নিয়েও মনের অমিল হয়। অন্য দিকে আমিও একমাত্র আদর্শবান ব্যক্তি নই, আমারও ১০০% গুনের সমাহার নাই, আমার অনেক ব্যবহারেও তোমার মায়ের রাগ হয়। কিন্তু তারপরের অধ্যায় হচ্ছে যে, আমরা অনেক কিছু কম্প্রোমাইজ করি, আমরা স্বাভাবিক জীবন জাপনের জন্য আমরা উভয়ে কোথায় কোন কারনে আমাদের অসুবিধা হচ্ছে, কি কারনে আমাদের মনের ভিতরে কষ্ট হচ্ছে তা মিলেমিশে কথা বলে নিজের মন পরিস্কার করি বলেই আজ তোমরা আমাদেরকে এই পর্যায়ে দেখতে পাচ্ছ। আমরা সুখী পরিবাবের অংশ। আমি ও চাই তোমরা সুখী হওঁ এবং সার্থক জীবন পার কর।  

নিজেদের শুভাকাঙ্ক্ষী ছাড়া দুইজনের মাঝে তৃতীয় পক্ষ যে আসবে সে আর কেউ না, সে হচ্ছে শয়তান। আর শয়তান কখনোই আমার তোমার বন্ধু নয়। সে শুধু ধোঁকা দেয় সে কখনো আসে বন্ধু হিসাবে, কখনো আসে ঠিক তোমার মন যা চায় সে কথাগুলো নিয়ে, সে আসে এক চতুর বুদ্ধি নিয়ে, যা তোমার আর তোমার পরিবারের শুধু ধ্বংসই চয়, মঙ্গল নয়। তোমার আজকের এই পবিত্র দিনটি মঙ্গলময় হোক, তোমার দাম্পত্য জীবন সুখের হোক এটাই আমার সব সময়ের জন্য প্রার্থনা। আমরা তোমাকে ভালবাসি।

চাঁদ সূর্যের প্রতিস্থাপক নয়, শিশির বৃষ্টির প্রতিস্থাপক নয়, পুকুরের ঘোলা জল নদী বা সাগরের প্রিতিস্থাপক নয় তোমার স্বামী তোমার কাছে সূর্য, তোমার পরিবার তোমার কাছে সাগর, আর তোমার প্রতি তোমার পরিবারের অফুরন্ত ভালবাসা হচ্ছে তোমার উপর ভালবাসার বৃষ্টি।এদের কোন প্রতিস্থাপিক হওঁয় না। শয়তানের দলমাঝে মাঝে তোমাকে চাদের কথা বলে, শিশিরের কাব্য দিয়ে অথবা কর্দমাক্ত পুকুরের ঘোলা জল দিয়েই বিপথগামী করে দিতে পারে। আমি তোমাদের জন্য ঐসব হায়েনাদের কাছে থেকে আমার ইসসর তোমাদের রক্ষা করুক সেটাই দোয়া করি।

 You were not an accidental baby in my life, you are my wanted girl from the Almighty and I prayed for you for almost 5 long years before you were born and then I was blessed with you from HIM. I always wanted a girl, you are that girl in my life. I love you all the time and with all my breath. May Almighty Allah listen to my prayer for your happiness and prosperity in your life.

১৯/০২/২০১৬- বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট

অনেক অনেক দিন পর বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে এলাম। প্রায় ১২ বছর পর। অনেক পরিবর্তন হয়েছে এর চেহারা। শুধু বগুড়া ক্যান্ট এর চেহারা কেন, পুরু বগুড়া শহরের চেহারাই পরিবর্তন হয়েছে অনেক। কোন কিছুরই প্রতিদিনের পরিবর্তন চোখে পরে না কিন্তু কেউ হটাত করে দেখলে পুরু পরিবর্তনটা এক নিমিষেই বলা যায়। আমার কাছে তাই পুরু পরিবর্তনটাই ধরা পরল।

বগুড়া শহরে আসার আমার একটি মাত্র কারন ছিল- আমার মেয়েকে বগুড়া মেডিক্যাল কলেজে রেখে যাওয়া। সদ্য বিবাহিতা আমার মেয়ে তার স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাসুর, ভাসুরের বউ, এবং আমাদের পরিবার সবাই একসঙ্গে এসেছি। অত্যান্ত চমৎকার একটা সময় কাটাচ্ছি সবার সঙ্গে। গতকাল গিয়েছিলাম আমার মেয়ের মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে। চারিদিকে সব ডাক্তার, কেউ  এক বছরের অভিজ্ঞতার ডাক্তার, কেউ দুই বছরের, কেউ বা বা আবার এক প্রফের অভিজ্ঞ ডাক্তার, কেউ আবার দুই হয় নাই তবে প্রায় দুই প্রফের সমান অভিজ্ঞ ডাক্তার। আমার মেয়ের ব্যাচের সবাই এখন প্রায় পৌনে দুই প্রফের অভিজ্ঞ সব ডাক্তার। আমি আমার মেয়ের মেসে এসেছি পুরু পরিবার নিয়ে। আমার মেয়ের বিয়ের মিষ্টি নিয়ে।

ছেলেদের মেসের পরিবেশ আমার জানা আছে কারন প্রায় দেড় যুগের বেশি আমি মেস লাইফ কাটিয়েছি। কখনো কোন মেস মেম্বার মেসের খাবার খেয়ে খুশি হয়েছে কিংবা মেসের খাবারের উপর মন খারাপ করে নাই, এই ইতিহাস মোঘল আমল থেকে খুজলেও কোন বরাত পাওয়া যাবে না। মেসের আমার মেয়ের বান্ধবিদেরও সেই একই অবস্থা। তাদেরও মেসের খাবারের উপর অনেক অভিযোগ আছে, আছে কতই না কষ্টের মনোভাব। সব কিছুই ভাল এখানে শুধু মেসের খাবার নিয়ে যত কষ্ট। তারপরেও আমি জানি একদিন ওরা এই মেস লাইফটা মিস করবে। আর আজকের দিনের এই মেসের খাবারের কষ্টের বিষয়টিই ভবিষ্যতের মজার কাহিনি গুলর মধ্যে একটা হয়ে উঠবে। কারন আমার এই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি যে, ঐ মেস লাইফটা খুব মিস করছি।

পিচ্চি পিচ্চি আমার সব মেয়েরা সবাই ডাক্তারি পরছে, দেখেই শান্তি লাগে। এক গুচ্ছ ডাক্তার চারিদিকে। হৈ চৈ কিচির মিচির আনন্দের উল্লাস এই সব উঠতি ডাক্তারদের কণ্ঠে। বড় ভাল লাগে এদের বাচ্চামি, এদের চালচলন। একদিন ওরাই দেশের সব স্বনামধন্য ডাক্তারদের সাড়িতে দারিয়ে থাকবে, কারো হাত দিয়ে অনেক মানুষের জীবনের পাল পরিবর্তন হয়ে যাবে, অনেক মানুষের ভরসার স্থান হবে এরা। এতগুলো ডাক্তারদের পেয়ে আমারও খুব ভাল লাগছিল। এদের মাথায় এখন সব এনাটমি, ইত্যাদি সব কঠিন কঠিন সাব্জেক্ট মাথায় ঢোকে যাচ্ছে। খাটের নিচে রাখা ট্রাঙ্ক ভরতি সব বই এর লেখা খাটের নিচ থেকে উবে গিয়ে একেবারে মাথার ব্রেনে চলে যাচ্ছে, বইগুল আবার কদিন পর খাটের নিচেই জমা হয়ে যাচ্ছে।

তোমরা সবাই খুব ভাল। ভাল থেক তোমরা। জীবনে তোমরা সবাই সফল হবে।

০৫/০২/২০১৬-জেলফেরত মান্নানকে চিঠি

আমি তোমার উপর রাগ এখনো করি নাই।

কিন্তু আমার জানা ছিল না যে, আমাকে কোন এক সময় তোমার সঙ্গে এইভাবে হিসাব করে বুঝিয়ে দিতে হবে যে আমি তোমার জন্য কি করেছি আর আমি কি করি নাই। একটা জিনিস সর্বদা মনে রাখবা যে, ব্রান্ড নামের একটা মুল্য আছে। আমি তোমার জীবনে একটা ব্রান্ড নাম। এটা তোমার বুঝার ক্ষমতা আছে কিনা আমি জানি না। তবে বুঝাটা উচিৎ। মান্নান আমার জীবনে কোন ব্রান্ড নাম নয়। এটা নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারবা। আমার জীবনে হাবিবুল্লাহ কিংবা হোসেন মাদবর একটা ব্রান্ড নাম।

আমি খুব অবাক হয়েছি যে, ইদানিং জেল থেকে ফেরত আসার পর তোমার মধ্যে অনেক অবাস্তব চিন্তার উদ্ভব হয়েছে যা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয় নাই। এর অনেকগুলো কারন থাকতে পারে, কিন্তু আমার ধারনা ঐ সমস্ত প্রধান কারনের মধ্যে একটা কারন হতে পারে তোমার মেয়ে মাহিদা (সম্ভবত)। তুমি কতটা ভাল বাবা বা কতটা ভাল স্বামী সেটা তুমি ভাল বলতে পারবে, আমি সেটা নিয়ে কখনো তোমাকে সাজেসনও দেব না।  কিন্তু তোমার মেয়ে মাহিদা তোমার জন্য কতটা ভাল মেয়ে সেটা আমি জানি কারন মাহিদা আমাকে তোমার ব্যাপারে কি কি বলেছে সেটা আমি তোমাকে কখনোই বলতে চাই নাই। কারন তোমার মন খারাপ হয়ে যাবে। তোমার সম্পরকে তোমার মেয়ের ধারনা খুব যে ভাল তা আমি বলব না, বরং তার ধারনা যে সম্পূর্ণ ভুল সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু মাহিমা অত্যন্ত একটা ভাল মেয়ে এবং এই কারনেই সব কিছুর পরেও আমি চেয়েছিলাম মাহিমার একটা ভাল ঘরে বিয়ে হোক এবং তোমাদের বলয় থেকে ও বের হয়ে যাক। আর তার জন্যই আমি মাহিমার বিয়েতে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা দিয়ে আমি ওর জীবনটাকে উপহার দিতে চেয়েছিলাম এবং দিয়েছিও। আমি এর আগেও মাহিমার ১ম বিয়েতে গিয়েছিলাম এবং এবার তো আমার যাওয়ার অনেক প্রয়োজন ছিল অবশ্যই। কিন্তু তুমি আমার কিংবা আমার পরিবারের যাওয়ার পথ এমন করে বন্ধ করে দিলে যে আমার সঙ্গে আর যে সব গনমান্য ব্যাক্তিবর্গ যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল আমার না যাওয়ার কারনে সম্ভবত তারাও আর যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে নাই। আমি অবশ্য কাউকে কিছু বলিও নাই। হয়ত কেউ গেছে হয়ত অনেকেই যায় নাই। আমি আর সেটা নিয়ে মাথা ঘামাই নাই।

মান্নান, একটা কথা মনে রাখা খুব দরকার যে, পরিবারের বা বংশের লোকদের থেকে আপন কেউ কখনো হয় না। হ্যা, হয়ত পরিবারের মধ্যে অন্তরকলহ থাকে কিন্তু সেটা আবার সমঝোতাও হয়ে যায়। আমি একটা জিনিস লক্ষ করেছি যে, তুমি জেলে থাকার সময় থেকে যে কোন কারনেই হোক (সেটা তোমার অনুপস্থিতির কারনেই হোক আর তাদের সাহসের কারনেই হোক) আমাদের সমস্ত বংশের লোকজন সরাসরি আমার এবং হাবিব ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে এবং তার মধ্যে অনেকেই সান্নিধ্যেও আসতে পেরেছে। এতে আমি দেখেছি যে, আমাদের বংশের অনেকেই তোমার উপর ঠিক যথোপযুক্ত সন্তুষ্ট নয়। এ প্রসঙ্গটা এখন টানছি না, এটা তোমার বা আমাদের নিতান্তই ব্যক্তি পর্যায়ের ব্যাপার ধরে নিতে পার।

মান্নান, আমি অসৎ নই এটা তুমিও জান। "আমি অসৎ এবং আল্লাহ আমাকে কখনো সাহায্য করবে না আর তোমার কারনেই আজ আমি এতদুর পর্যন্ত আসতে পেরেছি ইত্যাদি ইত্যাদি" তোমার এই কথাটা আমার কোনভাবেই ভাল লাগে নাই। আর আমি কারো উপর নির্ভর করে এই পর্যন্ত আসি নাই। এটা আল্লাহ আমাকে করেছেন। এটা নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই না। আমার সমাজ আলাদা, তোমার সমাজ আলাদা, আমার জগত আলাদা তোমার জগত আলাদা। কে কাকে কিভাবে মুল্যায়ন করবে সেটা যার যার জগতের ব্যাপার। তোমার এসএমএস এর এই ভাবনাটা ভুল। আমি তোমাকে এই ভুল ভাবনা থেকে সরাতেও চাই না, সেটা তোমার হিসাব কিংবা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর তোমার কাছে এটা সত্য বলে মনে হয়েছে বলেই হয়ত তুমি বলতে পেরেছ। এটা নিয়ে আমি তোমাকে আর কৈফিয়তও দিতে চাই না। সৎ এবং অসৎ ব্যাপারটা নিতান্তই নিজস্ব ব্যাপার।  

আমি জানি আমার কি প্ল্যান ছিল তোমাকে নিয়ে আর আমি আমার পুরু প্ল্যানটা আমি তোমাকে বিস্তারিত বলেছিলামও। আমি এটাও বলেছিলাম যে, অচিরেই কোন একটা ছোটখাট ব্যবসা শুরু করতে যেখানে আমি তোমাকে সাহায্য করব আমার সাধ্যমত। আবার এটাও বলেছিলাম যে, যতদিন তোমার কোন গতি না হচ্ছে, আমি মা ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে তোমাকে দেব যাতে তোমার সংসার চলে।

একটা জিনিস মনে রাখবা মান্নান, কোন কালেই আমার জমির উপর লোভ ছিল না এবং এখনো নাই। তুমি যদি মনে কর যে, কিছু জমিজমা পেয়েই আমি অনেক কিছু হয়ে গেছি সেটা একদম ভুল ধারনা। তুমি কি বলতে পার, আজ পর্যন্ত কোন জমিটা আমার ব্যক্তি জীবনে কাজে লেগেছে? বলতে পার কোন জমিটার উপর ভরসা করে আমি ব্যবসা করছি? একটাও না। আর ভবিষ্যতে ওগুলো কোন কাজে আসবে কিনা তাও আমার জানা নাই। বরঞ্চ আমি তোমাকে একটা কথা বলেছিলাম যে, একদিন যে মাদবর বাড়ি ম্লান হয়ে গেছে সেই মাদবর বারিটা আমি আবার অমলদের জমির উপর স্থাপন করে তোমাকেই ওখানে স্থাপন করে দিয়ে যাব। আমার যেহেতু কোন ছেলে নাই, আমি সবসময় মনে করেছি তোমরাই আমার ছেলে আর তোমরাই আমার সব ব্যবসা বানিজ্যের তদারকি করবে। কিন্তু ওটা হয়ত হয় নাই আর হবে কিনা ভবিষ্যতে আমার জানা নাই। যাই হোক, তুমি যদি মনে করে থাক যে, আমি শুধুমাত্র কিছু জমি জমার কারনে তোমাকে আমি আমার কাছে টেনে নিয়েছি, সেটা মারাত্মক ভুল ধারনা। আর এই ভুল ধারনাটা তোমার কাছেই থাকুক। আমি তোমার ভুল ধারনাটা ভাঙ্গাতে চাইও না। তোমার যদি এখনো মনে হয় তুমি আমাকে জমি জমা দিয়ে অনেক সাহায্য করে ফেলেছ, তাহলে বিক্রি করে দাও এবং আমার টাকাগুলো প্লিজ ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা কর, আমি বরং তোমাকে অনুরোধই করছি। I want to get out of everything in future.

তোমার ধারনা আমি তোমাকে অবিশ্বাস করা শুরু করেছি কিনা। এই ধারনাটা তোমার কেন এসেছে আমি জানি না। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে মাহিমার বিয়ের টাকা নেওয়ার আগে ফ্যাক্টরি কর্তৃক মানি ভাউচারে তোমাকে সাইন করতে বলেছে বলে তোমার এই ধারনাটা হয়েছে। আমি অবাক হয়েছি এই জন্য যে, এতদিন যখন তোমাকে আমি টাকা দিয়েছি (সেটা যে কারনেই হোক না কেন), আমি তোমার পক্ষে সাইন করেছি কিন্তু আমাদের সর্বশেষ ফ্যাক্টরি পলিসি মোতাবেক, আমাদের অবর্তমানে যিনি টাকা নিচ্ছেন এখন থেকে উক্ত ব্যক্তিই ফ্যাক্টরি মানি রিসিপ্টে সাইন করে টাকা নিতে হবে, আর এই কারনেই তোমাকে সাইন করতে বলেছে। তাছাড়া তখন আবার অডিট চলতেছিল বলে কোন অবস্থায়ই মানি রিসিপ্ট সাইন করা ছাড়া ফ্যাক্টরি টাকা দিতেও পারতো না। আমার অবাকই লেগেছে যে, মুর্তজা সাহেব যদি টাকা নেওয়ার সময় সাইন করতে পারে, আমি যদি টাকা নেওয়ার সময় সাইন করতে পারি, তুমি মুরতুজা ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার সময় যদি সাইন করতে পার, তাহলে তুমি কেন টাকা নেওয়ার সময় সাইন করতে পারবে না? আর সাইন করতে গিয়েই যদি তুমি মনে কর যে, আমি তোমাকে অবিশ্বাস করছি, তাহলে ত আমার কোন কথা থাকে না।

তুমি DBBL ব্যাংক থেকে ৬০ লক্ষ টাকা লোণ নিয়ে ফ্যাক্টরি করতে চেয়েছ। আমি সত্যি সত্যি খুশি হয়েছি যে তুমি একটা ফ্যাক্টরি করতে চেয়েছ এবং নিজের উদ্যোগে তুমি নিজের ফাইন্যন্স দিয়ে ফ্যাক্টরি করতে চেয়েছ, এটা খুবই ভাল পদক্ষেপ। তবে সতর্ক থাকতে হবে যাতে ব্যাংকের লোণ প্রতি মাসে পে করতে পার। আর পদ্মা ব্রিজের বালুর সরবরাহ পাচ্ছ যেনে আমি আরও খুশি হয়েছি যে অন্তত একটা ভাল কাজের অফার পেয়েছ। আমি তোমার জন্য দোয়া করি তুমি নিজের উদ্যগে ভাল থাক। এবং মানুস তোমাকে তোমার নিজের নামে চিনুক। তোমার এসএমএস টাই ঠিক যে একটা পাখি তার নিজের ডানার শক্তিতে বেচে থাকার নামই স্বাধীনতা, গাছের ঢালের উপর নয়। আর তুমি আরও লিখেছ যে, এখন থেকে তুমি আর মেজরের সঙ্গে নাই। আমি কিছু মাইন্ড করি নাই তাতে। এটা নিতান্তই তোমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত এবং অভিলাষ।

আমি জানি তুমি তোমার কথার বরখেলাপ কর না। আর এই জন্যই আমি কখনো তোমাকে নিয়ে কখনো অবিশ্বাস করার কোন কারনও দেখি নাই। তোমার হয়ত মনে হতে পারে যে আমি এমসিসির জমি নিয়ে চিন্তিত কিনা কিংবা হাবিব ভাইয়ের ৪৭ শতাংশ জমি নিয়ে চিন্তিত কিনা ইত্যাদি। হ্যা, আমি এমসিসির ৩৫ শতাংশ জমি নিয়ে চিন্তিত এই কারনে যে, এই ইজিএম এ যদি কোন কারনে পুরু বোর্ড পরিবরতন হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে একটা নতুন করে ঝামেলা হতেই পারে কিন্তু যারা পাওয়ার অফ এটর্নি দিয়েছে সবাই যেহেতু আমার বন্ধু, সেক্ষেত্রে হয়ত অনেক অসুবিধা হবে না। আর তুমি তোমার দায়িত্ব সম্পর্কে যথেস্ট পরিমানে ওয়াকিবহাল। সেটা আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলার অবকাশ রাখে না। তবে আমি বুঝতে পারি নাই যে, ঐদিন তোমার আন্টির সামনে তুমি এমন একটা ব্যবহার করবে। শেষ পর্যন্ত আমি তোমার আন্টির কাছে অপদস্থই হয়েছি এই কারনে যে, সে হাস্পাতাল থেকে অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজটা করতে এসেছিল, আর যখন কাজটাই হল না, সে আমাকে চার্জ করতেই পারে। এটা নিয়েও আমি তোমাকে আর বিব্রত করব না। তুমি সৎ, তুমি মানুষের বিচার কর, সমাজ তোমাকে অনেক আদর্শবান ব্যক্তি হিসাবে দেখে, তুমি ন্যায্য বিচার কর বলেই তুমি আমাকে এগুলি জানিয়ে এসছো এবং আমিও তাই জানি। কিন্তু তুমি ঐদিন কতটা ন্যায্য করেছ, কিংবা কতটা বিচারিক হিসাবে কাজটি করেছ তা তোমার কাছেই থাকুক। 

যাই হোক মান্নান, আমি যে কাজটা কখনো করতে চাই নাই, কখনোই চাই নাই,  তুমি আমাকে সেই কাজটাই করতে বাধ্য করেছ। আর সেটা হচ্ছে তোমার রাখা হিসাব অনুযায়িই আমি একটা ক্যাল্কুলেসন করেছি। আমি তোমার ব্যাপারে অনেক হিসাব অনেক সময় লিখে রাখি না কিন্তু আমার ফ্যাক্টরি রাখত, আর তার উপরে বেজ করেই একটা হিসাব আমি তোমাকে পাঠাচ্ছি। সব হিসাবের বিপক্ষে বিস্তারিত এক্সকেল শিট আছে, রেজিস্ট্রি খাতা আছে, তুমি যদি চাও, আমি সেগুল ফটকপি করে দিতে পারব। এর মানে এই নয় যে, আমি তোমার কাছে কোন টাকা পয়সা চাচ্ছি পাওনা হিসাবে। এটা শুধু তোমার জানার জন্য দেওয়া। এই হিসাব দিয়ে আমি তোমার কাছ থেকে কোন কিছুই প্রত্যাশা করছি না। কোন টাকা পয়সাও দাবি করছি না। শুধু তোমাকে জানানোর জন্য এই হিসাব পাঠানো। তুমি মাইন্ড করতে পার কিন্তু যেহেতু তুমি বিচার সাল্লিশি কর, তোমার মধ্যে অন্তত একটা বিচারিক ক্ষমতা আছে বলে আমার ধারনা এবং তোমার মাইন্ড করার কথা নয়।  অন্তত সত্যি  জিনিসটা তোমার জানা থাকল। তোমাকে কিছু দিতে হবে না আমাকে, এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাক। আর আমি আমার এই চিঠির উপর কোন মন্তব্য ও আশা করি না। যদি ক্যালকুলেসনে ভুল থাকে শুধু ওটা আমি তোমাকে নিয়ে বসতে পারি, তাছাড়া আমার অন্য কোন মন্তব্যে আমি কোন মন্তব্য আশা করি না। 

 আর একটা ব্যাপার আমার কাছে অবাক লাগছে যে, তুমি আমার এই দুঃসময়েও শুধু নিজের ব্যাপারটাই দেখছ, তোমার কি একটা ফ্রেন্ড ও নাই, একটা কলিগ ও নাই, কিংবা একজন আত্তিয়ও নাই যে তোমাকে কিছু আর্থিক সাহায্য দিয়েও সাহায্য করতে পারে? এই অবস্থাটা ভাল নয়। সব মানুষের বিপদের সময় কেউ না কেউ এগিয়ে আসার জন্য কিছু ফ্রেন্ড, কলিগ, আত্মীয়সজন তৈরি করে রাখতে হয় যারা বিপদের সময় কিছুটা হলেও সাহায্য করতে পারে। আমার কাছে মনে হচ্ছে তোমার এই সার্কেলটা তুমি তৈরি করতে পারন নাই। যাই হোক।  

ভাল থেক। চিঠিটা লম্বা করলাম না। দরকার হলে পরে আবার লিখব। রিভার সাইডের লসের ব্যাপারটা নিয়ে আমরা অনেক চিন্তিত এবং এটা নিয়ে আমরা অনেক অসুবিধায় আছি সন্দেহ নাই। তারপরেও আল্লাহ আছেন। ধন্যবাদ। নিচে একটা সামারি করে দিলাম হিসাব নিকাশের। তুমি তোমার অবসর সময়ে দেখে নিও। আমি জানি তুমি বিচার কাজ কর এবং নিরপেক্ষ কাজ কর। নিজের বিরুদ্ধে কোন ইনফরমেশন গেলেও যে তা মেনে নেয় তাকে বলা হয় নিরপেক্ষতা। এটা তোমাকে আমার শিখানোর দরকার মনে করি না। তুমি আমার থেকেও বুদ্ধিমান, সেটা তুমি নিজেই বলেছ। এবং আমারও তাই ধারনা যে, তুমি আমার থেকে বেশি বুদ্ধিমান।

আখতার

  

মা ইন্ডাস্ট্রিজে প্রতিদিনের কালেকশন আকারে টাকা জমা হয়েছে মোট (Collection) 48231540
মা ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে মান্নান পেটি ক্যাশ আকারে নিয়েছে (Loan to Mannan) 10004618
মান্নান মা ইন্ডাস্ট্রিজকে ফেরত দিয়েছে (Loan Refunded by Mannan) 5328531
মান্নানের কাছে মা ইন্ডাস্ট্রিজ পাবে 4676087
মেজর আখতার কর্তৃক মান্নানকে রিভার সাইড/ব্যাংক থেকে জমি এবং ব্যক্তিগত খরচের জন্য প্রদান করা হয় 2039919
হাবিব ভাইয়ের ২৪৪ এবং ৫৮ শতাংশ, তানির ২৬ শতাংশ, শওকতের ১ বিঘা জমির মোট মুল্য সমন্নয় পূর্বক মান্নান অতিরিক্ত টাকা নিয়েছে 438900
১৭/১/২০০৮ থেকে ১৮/১২/২০১২ পর্যন্ত (৬/২/২০০৯ ৯/৬/২০১২ তারিখের হিসাব ছাড়া) মান্নানকে মেজর আখতার বিভিন্ন সময়ে অমলদের জমি, ইদ্রিসের জমি, বেলা বুয়ার জমি, এবং অন্যান্য বাবদ ক্যাশ প্রদান করেন  4241500
নভেম্বর ২০১৫ জেলে যাওয়ার সময় থেকে জানুয়ারি ২০১৬ পর্যন্ত (মাহিমার বিয়ে, মান্নানের স্ত্রীদের জমি রেজিস্ট্রেসন সহ) ইত্যাদি বাবদমেজর আখতার মান্নানের জন্য খরচ করেন 2024000
নোট-১ এখানে উল্লেখ থাকে যে, ফ্যাক্টরির সর্বশেষ বিদ্যুৎ বিল মোট ১৫ লক্ষ টাকা (বিদ্যুৎ লাইন কাটার পর চেকের মাধ্যমে ১১ লক্ষ টাকা এবং জানুয়ারি ২০১৩ মাসের বিদ্যুৎ বিল ৪৪১০০০ টাকা), ফ্যাক্টরির বকেয়া বেতন ২ লক্ষ টাকা, আবু বকরের দানার বকেয়া বাবদ ৩ লক্ষ টাকা (যা এখনো প্রি মাসে দিচ্ছি), ফ্যাক্টরিতে রক্ষিত সর্বশেষ ফিনিসড মালের দাম সাড়ে ৭ লক্ষ টাকা (মান্নানের হিসাব অনুযায়ি), মার্কেটে বাকি ৫ লক্ষ টাকা (মান্নানের হিসাব অনুযায়ি), ক্রাশ মাল এর দাম ২ লক্ষ টাকা (মান্নানের হিসাব অনুযায়ি), কাইউমের লোহা লক্কর বিক্রির প্রায় ১ লক্ষ টাকা,  আল্লার দান দোকানে বাকি ৩০ হাজার টাকা, ফজল সাহেবের বাকি প্রায় ৪৫ হাজার টাকা, সর্ব সাকুল্যে সোয়া ৩৬ লক্ষ টাকা হয়। 3625000
বর্তমানে মেজর আখতার মান্নানের কাছে পাবে 17045406
নোট-২: মান্নান যদি বর্তমানে আমিরদের জমি ২০৪ শতাংশ, বেলা বুয়ার জমি ২৯ শতাংশ, মান্নানের নিজস্ব জমি ৫৪ শতাংশ, এবং ইদ্রিসদের জমি ৬৬ শতাংশ যা মেজরের নামে কেনা হয়েছে, অমলদের ৪০০ শতাংশ মোট প্রায় ৭০০ শতাংশ জমির মুল্য বাবদ হিসাব করে উক্ত পাওনা সমন্নয় করেও তাতে প্রতি বিঘার জমির মুল্য দাড়ায় 803569.14
এখানে উল্লেখ থাকে যে, এক্সেল শিটে কখন কোন জমির জন্য কত টাকা দেওয়া হয়েছে তা বিশদ ভাবে বিবরন দেওয়া আছে।
অন্যান্য হিসাব
মেসার্স রাবেতা থেকে ২৯ কিস্তিতে মান্নান মোট অগ্রিম এবং মালের সমন্নয় পূর্বক টাকা নিয়েছে (রাবেতার কাছ থেকে অগ্রিম ১০ লক্ষ টাকা নেওয়ার কোন হিসাব মা ইন্ডাস্ট্রিজের রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ নাই) 305900
মা ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে ৭ কিস্তিতে মান্নান নতুন পিকআপ এর ইন্সটলমেন্ট দিয়েছে 360000
মা ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে মাহিদার জন্য ক্যাম্ব্রিয়ান কলেজের জন্য খরচ করা হয়েছে 347000
দুলালের বিদেশ যাওয়ার জন্য মা ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে 463000
মা ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে আলি ভাইকে টাকা দেওয়া হয়েছে 60000
মা ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে কন্সট্রাকসন কাজের জন্য ফজল ভাইকে টাকা দেওয়া হয়েছে 76100

২৯/১২/২০১৫- মালয়েশিয়া ভ্রমন

খুব হাপিয়ে উঠেছিল আমার পরিবারের সদস্যরা। কোথাও বেড়াতে চাচ্ছিল সবাই এক সঙ্গে। বিশেষ করে আমার বড় মেয়ে ডাক্তারি বই পড়তে পড়তে তার আর ভাল লাগছিল না। সব বই, প্র্যাক্টিকেল ক্লাস, আর পরীক্ষা টরিক্ষা এক পাশে ঠেলে রেখে একদম নিরিবিলি কোথাও বেরিয়ে আসার জন্য প্ল্যান করতে চাইলে আমার বউ বলল ” চল মালয়েশিয়ায় যাই, ওখানে আমি যেহেতু অনেকদিন ছিলাম, অনেক জায়গা আমার চেনা, গেলে খারাপ লাগবে না”। কোন দেশে যাব, এটাতে আমার কোন বাড়তি চয়েস ছিল না, কোথাও যাওয়াটাই ছিল আমার কাছে মুখ্য ব্যাপার। আমার অনেকগুলু সমস্যা হাতে ছিল যদিও, (আমার বড় ভাই অনেক বছর পর আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে আসবেন ২৬ ডিসেম্বর, আমার ভাইয়ের বউ বাংলাদেশে ইতিমধ্যে আছেন এবং ২৩ ডিসেম্বর তারিখে আবার চলেও যাবেন, আমি মালয়েশিয়া গেলে ২৩ তারিখে, সেক্ষেত্রে আমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না তার যাওয়ার দিন, আমার মেয়ের দুইটা কার্ড পরীক্ষা মিস হবে, আমার ফ্যাক্টরির উদ্দেশ্যে বায়ার আসবে আমার অবর্তমানে ইত্যাদি ইত্যাদি)। তারপরেও আমি ব্যাপারটা এড়িয়ে প্ল্যানটা জারি রেখেছিলাম কারন, সর্বদা সমস্যা থাকবে আর এই সমস্যা নিয়েই আমাকে কোন না কোন দিন সময় যোগাড় করতেই হবে, আমি অনেক ভেবেচিন্তে ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে মালয়েশিয়ান এয়ার লাইন্সে টিকেট কনফার্ম করে ফেললাম।

আমার ছোট মেয়ে কখনো প্ল্যানে উঠেনি, তার যেমন একটা প্ল্যানে উঠার কৌতূহল ছিল আবার কয়েকদিন আগে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন মিসিং হওয়ার কারনে সে একটা ভীষণ ভয়ের মধ্যেও ছিল। কি হয় কি হয় না, সে ভীষণ ভয়ের মধ্যে প্লেনে উঠেছিল। তার চিত্তের ভিতরে কতটা ভয় কাজ করছিল সেটা আমি বুঝতে পারলাম যখন আমরা সবাই প্লেনে উঠলাম। আমার ছোট মেয়ে কোন এক অজানা ভয়ে একদম চুপসে যাচ্ছিল, তার বিদেশ যাওয়ার খায়েশ যেন আর থাকছিল না। সে বারবার তার মাকে শক্ত করে ধরেছিল, আমাকেও তার পাশে বসিয়ে আমার কোট আর হাত এমন করে ধরেছিল যেন সে কোন এক উচু পাহারের একদম ধারে গিয়ে দারিয়ে কোন মানুষ যা করে সে তাই করছিল। আমার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা কোন লজিক তার ভয়ের উপশমের লাঘবের উপাথ্য হয়ে কাজ করছিল না। তার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পরছিল আর মুখটা এতটাই ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল যে, আমার বড় মায়া হল। ১৩ বছরের একটা ছোট মেয়েকে আমি কি বললে যে তার চিত্ত ঠাণ্ডা হবে বা ভয় কেটে যাবে তার কোন কিছুই আমার জানা ছিল না। এই ব্যাপারটা যাওয়ার সময়ই শুধু হয়নি, বরং ব্যাপারটা আরও কঠিনরুপ ধারন করল যখন এয়ার এশিয়ার একটি প্লেন ২৫ তারিখে ইন্দোনেশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর যাওয়ার পথে হারিয়ে গেল। আমি আমার পরিবারের সময় বাঁচানোর জন্য যেখানে বাসে বা ট্রেনে গেলেও চলে, তার পরিবর্তে আমি সেখানে প্লেনের টিকেট আগেই করে ফেলেছিলাম। যেমন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে লঙ্কাউই, লঙ্কাউই থেকে পেনাং, আবার পেনাং থেকে কুয়ালালামপুর, এই পুরু ভ্রমণগুলোতে আমি বাস বা রিভার ক্রুজ বা ট্রেন বাদ দিয়ে সব স্থান থেকে এয়ারে টিকেট করেছিলাম। এরমধ্যে আবার একটা পরেছে এয়ার এশিয়ার ফ্লাইট। তো বুঝতে আমার অসুবিধা হল না নেক্সট ভ্রমনগুল আমার ছোট মেয়ের জন্য আনন্দের না হয়ে মোটামুটি কষ্টের সময় পার হবে। ভয় এমন একটা জিনিস যাকে একবার ধরে বসে, সে বুঝতে পারে তার ভিতরে কি হয়। এটা বাইরের কেউ তার পরিধি আঁচ করবার উপায় থাকে না। যাক, তারপরেও আমি সিডিউলগুল প্লেনেই ঠিক রাখার চেস্টা করেছিলাম একমাত্র পেনাং থেকে কুয়ালালামপুর ছাড়া। শেষ অবধি পেনাং থেকে কুয়ালালামপুর পর্যন্ত প্লেন বাদ দিয়ে বাসে আসতে হয়েছিল। সেটাও আরেক অভিজ্ঞতা।

বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ার যাওয়ার প্রথম দিনের ঘটনাটা বলি।

সকাল ১১ টায় ফ্লাইট। সম্ভবত আমরাই সবার শেষে ফ্লাইটে উঠলাম। কুয়ালালামপুর পৌঁছলাম লোকাল টাইমে প্রায় তিনটার দিকে। কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে লোক ছিল। ফলে গাড়ির ব্যবস্থা ছিল। কোন অসুবিধা হয় নাই। কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার সময় আমাদের সবার মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল একটা কারনে।  আমাদের ঠিক সামনে একজন বাঙালি ছিল যে কয়েকদিন আগে মালয়েশিয়ায় এসে ইমিগ্রেসন থেকে কোন এক অজ্ঞাত কারনে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। সে জানে না কেন তাকে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেসন থেকে মালয়েশিয়ায় ঢোকতে না দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত  পাঠিয়েছিল। ফলে সে ১৫ দিনের তফাতেই আবারো একটা এটেম্পট নিয়েছিল মালয়েশিয়ায় ঢোকার জন্য। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম এবারো তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। নেহায়েত গরিব মানুষ, গ্রাম থেকে বোধহয় মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে। আমি ইমিগ্রেসন অফিসারে সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম এই জন্যে যে কি কারনে তাকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে তা সঠিক তথ্যটা জানার জন্য। ইমিগ্রেসন অফিসার আমাকে জানালেন যে, কিছু সমস্যা আছে, সিকিউরিটির ব্যাপার। আগেরবার তাকে ওই কারনেই ফেরত পাঠানো হয়েছিল, এবারো তাই। লোকটা ভালভাবে তার অবস্থাটা ব্যাখ্যা করতে পারছিল না ভাষার কারনে। বুঝাই যাচ্ছিল যে সে বড় অসহায়। আমাকে দেখে যেন তার আত্মায় পানি এল। বলল, স্যার, আমাকে একটু সাহায্য করেন। অরা কি বলে আমি ঠিক বুঝতে পারি না আর কি বলতে কি উত্তর দিচ্ছি তাও ভাল মত বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমার এই সাহায্যটা ওনার কাজে লাগলো না ইমিগ্রেসন অফিসারের কারনে। অফিসার আমাকে শুধু প্রশ্ন করল, ওই ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গের কিনা। আমি সত্যি কথাই বললাম যে, সে আমাদের সঙ্গের কেউ না। ফলে ইমিগ্রেসন অফিসার আমাকে রিকুয়েস্ট করলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছু না বলার জন্য। আমি শুধু জিজ্ঞেস করলাম, তাকে পুনরায় ফেরত পাঠানো হচ্ছে কিনা এবং কেন। সে আমাকে জানাল যে, তাকে ফেরত পাঠানো ছাড়া কোন বিকল্প নাই। তার সিকিউরিটির সমস্যা আছে। আমরা চলে এলাম কিন্তু আমাদের সবার মনটা একদম খারাপ হয়ে গেল এই ভেবে যে, নেহায়েত একটা গ্রামের গরিব মানুষ কি কারনে মালয়েশিয়ার কোন নিরাপত্তার হুমকি হয়ে গেল সে নিজেও জানে না অথচ সে হয়ত তার সব কিছু বিক্রি করে তার স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় এসেছে কিন্তু ওই স্বপ্নের দেশে সে ঢোকতে পারছে না। দেশে গিয়ে এখন সে কি করবে বা কি করবে না এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর আমার মেয়েরা আমাকে করেছিল কিন্তু সে উত্তরগুলু আমার জানা ছিল না। লেখাপড়া করাটা যে কত জরুরি, অন্তত নিজের কথাগুলু অন্যকে বুঝানো এবং অন্যের কথাগুলো সঠিকভাবে বুঝা যে কত জরুরি সেটা তখনই সম্ভব যখন কেউ অন্তত ওই টুকুন লেখাপড়া করা দরকার। হয়ত ইমিগ্রেসন অফিসার এমন কোন প্রশ্ন তাকে করেছিল যার প্রশ্ন সে না বুঝেই হ্যা বলেছে আর সে হ্যা উত্তরটাই তার কাল হয়ে দারিয়েছে। বড় দুঃখের ব্যাপার। আমাদের কিছুই করার ছিল না।

এয়ারপোর্ট থেকে আমরা বেরিয়ে গেলাম। বড্ড সুন্দর একটা দেশ। খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, অনেক ফ্লাই ওভার, অনেক রাস্তাঘাট, সুন্দর সুন্দর দালান কোঠা। অনেক দূর থেকে টুইন টাওয়ার চোখে পরে। যে কোন উন্নত দেশের সঙ্গে মালয়েশিয়াকে এখন তুলনা করা চলে। কোন রিক্সা নাই, বাসও চলে না দিনের বেলায়। চারিদিকে ট্যাক্সি আর প্রাইভেট কারের সমারোহ। কোন হর্ন বাজে না। জ্যাম থাকলেও সেটা সাময়িক। বড় ডিসিপ্লিনড দেশ। রাস্তার পাশের বনজঙ্গল গুলুও বেশ গুছানো। নাপিতের ক্ষুরে যেমন মানুসের অতিরিক্ত চুল ছেটে সুন্দর করে রাখা হয়, মালয়েশিয়ার রাস্তার পাশের ঘাসগুলুও যেন সেভাবে সাজানো। অনেক ক্লিনার কাজ করছে, যার যার কাজ সে সে করছে। তাদের উপর কোন তদারকি করছে না কেউ। খুব গুছানো একটা শহর। প্রায় ৩০ মিনিট গাড়িতে থাকার পর হোটেলে এলাম। খুব বেশি খরচ না। থ্রি স্টার স্ট্যান্ডার্ড। প্রতিটি রুম মাত্র ২০০ রিঙ্গিত এর মধ্যে বা তার থেকে একটু বেশি। আমরা দুই ফ্যামিলি তিনটা রুম নিলাম, মাঝখানে কানেক্টেড। আমার ছোট মেয়ের ভয়টা এখন আর নাই, তার চোখে মুখে হাসি আছে, আর আমার বড় মেয়ে কতক্ষণে মোবাইল সিম কিনবে, ফেসবুক ব্রাউজ করবে, তার মালয়েশিয়ার ভ্রমনের ছবি সম্বলিত ম্যাসেজ ট্যাগ করবে, সেই ভাবনায় বারবার কোথায় মবাইলের সিম পাওয়া যায় তার জন্য অস্থির করে ফেলছে। রাত নয়টায় খেতে বের হয়েছি। আমাদের সঙ্গে ড্রাইভার আছে, গাড়িও আছে। একটা পাকিস্তানি হোটেলে খেতে ঢোকলাম। প্রায় বাঙালি খাবার। আমি স্রেফ ভাত ডাল আর সবজি খেয়েই তৃপ্ত বোধ করলাম। মেয়েরা আধুনিক মানুসের ডিজিটাল ধাচের। মুরগি আর বিরিয়ানি ছাড়া তারা কিছুই পছন্দ করে না। সুতরাং তারা ঐটাই খেল আর আমি আমার মেনু।  খাওয়ার পর একটু আশে পাশের মার্কেটে ঘোরাফেরা করলাম, কিছু কেনাকাটাও করলাম। একটা জিনিস খেয়াল করলাম যে, আমার মেয়েরা যা যা জিনিসের প্রতি কেনার খেয়াল তা হচ্ছে সব গিফট, কোন বন্ধুরে কোন গিফট দেয়া যায় সেটা নিয়ে মহা জল্পনা কল্পনা। আমার মেয়ে এবং বউ সিম কিনতে ভুল করল না। অনেক পদের সিম কার্ড। অফারের ছড়াছড়ি। রাত প্রায় ১ টায় আমাদের হোটেলে পৌঁছলাম। সারাদিন ফ্লাইট আর ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফিরে এসে বড্ড ক্লান্ত মনে হল। বিছানায় যেতেই ঘুমিয়ে পরলাম।

পরদিন ২৪ ডিসেম্বর।

সকালে নামাজ পরে নাস্তা করে বেরিয়ে গেলাম কতগুলো বিশেষ স্থান দেখার জন্য। তার মধ্যে প্রথম ছিল গেন্টিং আইল্যান্ড। গেন্টিং আইল্যান্ড সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ২০০০ মিটার উঁচুতে। জায়গাটা সুন্দর। পাহারি এলাকা, তার এক জায়গায় স্ট্রবেরি চাষ হয়। বড্ড সুন্দর। হরেক রকমের স্ট্রবেরি। সবুজ, লাল, মেরুন সাদা আরও কত প্রকারের যে স্ট্র বেরির রঙ। এটাকে একটা স্ট্রবেরির মিউজিয়াম বলা চলে আর কি। ওখানে অনেক বাঙালি ছেলেরা কাজ করে। একটা জিনিস খেয়াল করার মত যে, যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই কোন না কোন বাঙালি লোক পেয়েছি, তাও আবার একজন করে নয়, অনেক বাঙালি। স্ট্রবেরির মিউজিয়ামটা দেখার জন্য আগে থেকে কোন প্ল্যান ছিল না। এটা দেখা হয়েছে গেন্টিং আইল্যান্ডে যাওয়ার কারনে। সারাদিন মেঘে ভরা থাকে জায়গাটা। অনেক দূর থেকে পাহারের কোল ঘেসে মেঘ বলে মনে হলেও কাছে গেলে ওটা কুয়াশাই হয়ে যায়। অত্যন্ত ঘন কুয়াশায় জায়গাটা সারাক্ষন ভিজাই থাকে। খুব সাবধানে গারি চালাতে হয়।  এমনিতেই পাহারি এলাকা, আর তার উপর আবার ভিজা রাস্তা ঘাট। সবার হাতে ছাতি। শুধু আমাদের হাতে কারো কোন ছাতি নাই।

স্ট্রবেরি দেখে পাশেই স্কাই রেল। দারুন জিনিস। শুন্যে ভেসে ভেসে প্রায় কয়েক কিলোমিটার রাস্তা ক্যাবল কার দিয়ে পাহারের উপর দিয়ে উরে যাওয়ার মত। এটাকে ওদের ভাষায় বলে গেন্টিং স্কাই ড্রাইভ। এটাকে আবার “গন্ডলা লিফট”ও বলে। প্রায় ৪ কিলোমিটার লম্বা পথ। এই জায়গাটার নাম করন করা হয় কোন এক প্রাইভেট কম্পানির নামে। ঐ কম্পানির নাম ছিল “গেন্টিং হাই ল্যান্ডস বারহ্যাড” ১৯৬৫ সালে। উক্ত কোম্পানিকে তখন মোট ১৪০০০ হাজার একর জমি ১০০ বছরের জন্য লিজ দিয়েছিল। বেশ মজার একটা ব্যাপার। যাদের হার্টের সমস্যা আছে, বা হাইট ফুবিয়া আছে তাদের না যাওয়াই ভাল, তবে যারা একটু থ্রিল পছন্দ করে, তারা স্কাই ক্যাবলটা আনন্দ পাবে। এই ক্যাবল কারটাকে বর্তমানে “World’s Fastest Mono Cable Car System” নামেও পরিচিত with a maximum speed of 21.6 kilometres per hour (13.4 mph) and the “Longest Cable Car in Malaysia and Southeast Asia maybe”. এখানে 20th Century Fox World কোম্পানির বর্তমানে লোকেশনের কাজ চলছে যা ২০১৬ তে শেষ হবে। তখন দেখা যাবে আরেক চমক। চারিদিকে ঘন জঙ্গল, অনেক উঁচুতে এক একটা ক্যাবল কারে সর্ব মোট চারজন করে করে পাহারের উপর দিয়ে ভেসে পাহাড়ের অনেক উঁচুতে চলে যাওয়ার যে একটা মজার অনুভুতি, মন্দ না। আমার ছোট মেয়েকে নিয়ে আবারো একই সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। যাওয়ার সময় সে কিছুতেই চোখ খুলছিল না, কিন্তু আসার সময় মনে হল, একটু সাহস সঞ্চয় করে চোখ খুলে কিছুটা হলেও পাহাড়ের দৃশ্যটা দেখেছে আর কি।  কিন্তু কেউ একটু নড়লেই তার চিৎকার শোনা যায়। “এই বাবা, তুমি নরাচরা করছ কেন? কিংবা ঐ আপি তুমি ছবি তোলার জন্য নরাচরা করছ কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি”। অসংখ্য ছবি আর ছবি তুলেছে আমার বড় মেয়ে, সঙ্গে তাদের মা। ফ্যামিলি নিয়ে ঘোরাফেরার মধ্যে একটা মজা আলাদা। আমি অনেকবার বিদেশ গিয়েছি কিন্তু তা নিতান্তই ব্যবসার কাজে অথবা চাকুরির কাজে। এবারই প্রথম আমার সপরিবারে সবাইকে নিয়ে বাইরে যাওয়া। মেয়েদের উচ্ছ্বাস দেখে আমার বেশ ভাল লাগছিল। অনেকবার সবাইকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার প্লান করলেও কারো না কারো স্কুল বা কলেজের বা পরিক্ষার কারনে আমাদের যাওয়া হয় নাই।  

ঐ ক্যাবলকার দেখে আমরা সবাই আবার চলে গেলাম পুত্রজায়া দেখার জন্য।  পুত্রজায়া জায়গাটা দেখার মত একটা জায়গা। পুত্র জায়ার প্রধান কনসেপ্টটা হচ্ছে যে, “City in the garden and Intellegent City” পুত্র জায়ায় এখন সরকারি সব অফিস আদালত ট্র্যান্সফার করা হয়েছে (একমাত্র Ministry of International Trade and Industry, Ministry of Defence and Ministry of Works ছাড়া)। কুয়ালালামপুরে জ্যামের কারনে পুরু প্রশাসনিক অফিসগুলো সব এখন এখানে অবস্থিত। ডঃ মহাতিরের মাথায় প্রথম এই কনসেপ্টটা আসে যে, কুয়ালালামপুর থেকে সর ধরনের অফিস এই পুত্রজায়ায় স্থানান্তর করা হয়। মালয়েশিয়ান ভাষায় পুত্র মানে “প্রিন্স” আর জায়া মানে “সাকসেস”। অর্থাৎ প্রিন্সের সাকসেস বা ভিক্টরিই হচ্ছে পুত্রজায়ার অর্থ। ইন্টেলিজেন্স সিটি বলতে বুঝায় যে, এটা একটা ডিজিটাল সিটি। এখানে বলা বাহুল্য যে, ডিজিটাল সিটি বা স্মার্ট সিটিগুলোর মধ্যে Chicago, Boston, Barcelona and Stockholm রয়েছে। As of 2010 Census the population of Putrajaya is 97.4% Muslim, 1.0% Hindu, 0.9% Christian, 0.4% Buddhist, and 0.3% other or non-religious

পুত্র জায়ায় নিম্ন বর্ণিত অফিসগুলো রয়েছেঃ

 পারদানা পুত্র অর্থাৎ office of the Prime Minister

সেরি পারদানা বা official residence of the Prime Minister

শ্রী সাত্রিয়া বা official residence of the Deputy Prime Minister

প্যালেস অফ জাস্টিস

পুত্র জায়া মিনিস্ট্রি অফ ফাইন্যান্স

অইস্মা পুত্র বা Malaysian Ministry of Foreign Affairs.

ম্যালাওাতি জাতীয় প্যালেস

Putrajaya Convention Centre

Perdana Leadership Foundation

Heritage Square

Selera Putra

Souq Putrajaya

Pusat Kejiranan Presint 9

Pusat Kejiranan Presint 16

Putra Mosque

Tuanku Mizan Zainal Abidin Mosque (Iron Mosque (Masjid Besi))

এখানে মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক কনভেনশনাল সেন্টার অবস্থিত। লোকেশনটা সত্যি দেখার মত। যেমন সুন্দর তেমনি মনোরম। এখানে অনেক রাজকীয় জায়গা আছে, আছে চমৎকার একটা মসজিদ, আছে লেক, আছে বিশাল বিশাল বিল্ডিং, আর আছে অনেক বিদেশি পর্যটক। প্রতিটি লাইট পোস্ট, প্রতিটি গাছপালা, প্রতিটি বিল্ডিং ডিজাইন, এমন কি প্রতিটি টাইলস প্ল্যান করে সাজানো। যে বা যারাই এর পিছনে কাজ করুক না কেন, তাদের জবাবদিহিতা ছিল এর সৌন্দর্য এবং সমাপ্তির লক্ষে। কোন একটা জায়গা খামাখা ব্যবহার করা হয় নাই, কোন না কোন লক্ষ্য নিয়ে এর নির্মাণ কাজ হয়েছে, আবার যে জায়গাগুলো ব্যবহার করা হয় নাই, সেগুলোও অত্যান্ত প্লান মাফিক খালি রাখা হয়েছে। যত্রতত্র কোন কিছুই করা হয় নাই। স্পেসের সুষম বন্টন, আর রিসোর্সের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার চোখে পরার মত। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়েছে, আমাদের দেশের অনেক নামি দামি মন্ত্রি, মিনিস্টার, অনেক হাই অফিসিয়ায়ালগন কত বার না এদেশ ভ্রমন করেছে কিন্তু ওদের কি ইচ্ছে করে না আমাদের দেশটাকে এইভাবে সাজানোর? খুব অবাক হয়েছি আমাদের দেশের নেতাদের ইচ্ছা শক্তি আর রুচির অভাব দেখে।

পুত্রজায়ায় নামাজ পরে কিছু খাবার খেয়ে আবারো আমরা কুয়ালালামপুরে হোটেলে চলে এলাম। রাতে খাবার খেয়ে কিছু শপিং করে রাতে আবারো কিছুক্ষনের জন্য বিশ্রাম। পরদিন যেতে হবে লঙ্কাউই আইল্যান্ডে। লংকাউই আইল্যান্ডে যাওয়ার আগে আমরা টুইন টাওয়ার দেখে যাবার প্ল্যান, তাই সকাল সকাল খেয়ে দেয়ে ব্যাগ পাট্টা গুছিয়ে প্লেনের টিকিট পকেটে করে টুইন টাওয়ারের চলে গেলাম। কোন টিকিট নাই আগামি ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ফলে টুইন টাওয়ারে উঠতে পারলাম না, বাইরে থেকেই দেখে আর ছবি টবি তুলে বেরিয়ে গেলাম লংকাউই এর উদ্দেশে এয়ারপোর্ট। যাবার আগে ৩০ ডিসেম্বর তারিখের টিকিটটা কিনে নিয়ে গেলাম যেন লঙ্গাকাউই থেকে ফিরে টুইন টাওয়ারের ভিতর ঢুকতে পারি। এখানে একটা জিনিস বলতে ভুলে গেছি যে, এর আগের দিন পুত্রজায়ায় যাওয়ার আগে আমরা বার্ডস মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম। এটা একটা চিরিয়াখানার মত।  কিন্তু শুধু পাখিদের। এই জু তে ছোট বুলবুলি পাখি থেকে শুরু করে প্যাচা, ইগল, বক কাক, আরও অনেক নাম না জানা পাখির সমারোহ। পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য বটে। ওরা সুখেই আছে, খাওয়া দাওয়ার চিন্তা নাই, সময়মত খাবার পাচ্ছে, উড়ে বেড়ানোর যথেষ্ট জায়গাও আছে, আর সবচেয়ে যেটা আছে তা হচ্ছে এরা নিরাপদ। হেটে হেটে দেখতে হয়, পা ব্যাথা হয়ে যাচ্ছিল আমার। টুইন টাওয়ার সম্পর্কে কিছু বলি।

টুইন টাওয়ারকে বেসিক্যালি পেট্রনাস টাওয়ার বা পেট্রনাস টুইন টাওয়ার বলা হয়। মালয়েসিয়ান ভাষায় একে বলা হয় মিনারা পেট্রনাস। এটা ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার হওয়ার আগ পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বচ্চ টাওয়ার ছিল। সাত বছর লেগেছিল এটা তৈরি করতে। পুরুটাই রেইনফরসড কনক্রিটে করা। পরে এর বাহিরের দিকে ষ্টীল এবং গ্লাস দিয়ে মোড়া হয়। প্রায় ৬ লক্ষ স্কয়ার ফিট জায়গা নিয়ে এই টুইন টাওয়ার। ৪১ এবং ৪২তম টাওয়ার দ্বারা দুইটা মিনার এক সঙ্গে যুক্ত। আর এইটাও বর্তমান পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কানেক্টেড ব্রিজ কোন টুইন বিল্ডিং এর মধ্যে। প্রতিদিন ১০০০ জন লোককে এই টুইন টাওয়ার দেখার জন্য টিকেট বিক্রি করা হয়। দর্শকগন এই ৪১/৪২ এবং ৮৬ তলায় শুধু যেতে পারে, আর অন্য গুলোতে যাওয়ার অনুমতি নাই। এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, টুইন টাওয়ারটা কি কারনে করা হয়েছিল। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত আম্পাং (যেখানে বর্তমানে টুইন টাওয়ারটা অবস্থিত) থেকে সেলানগর টার্ফ ক্লাব (এখন যেটা কেএল সিটি নামে পরিচিত) পর্যন্ত এতটাই ট্রাফিক জ্যাম হত যে, ঘন্টার পর ঘন্টা কোন গাড়ীঘোরা চলতে পারত না। এই অচলবস্থা নিরসন কল্পে মালয়েশিয়ার ৪র্থ প্রেসিডেন্ট ডঃ মহাতির এই প্রজেক্ট হাতে নেন। সেলানগর টার্ফ ক্লাবটা ছিল একটা রেসিং ক্লাব যা ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ উইলিয়াম ম্যাক্সওয়েল এমেচার রেসিং হিসাবে চালু করেন। এক পর্যায়ে এই রেসিং ক্লাব থেকে মালয়েশিয়া হাজার হাজার মিলিওন ডলার আয় করতে শুরু করে বেদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে। পর্যায়ক্রমে এই সিলানগর টার্ফ ক্লাব হয়ে উঠে রেসিং কাম স্পোর্টস সেন্টার। এমনকি এটা পরবর্তীতে কমনওয়েলথ স্পোর্টস ক্লাব হিসাবে রানি এলিজাবেথ-২ এর সময় চালু হয়। কিন্তু শুধুমাত্র জ্যামের কারনে অনেক অসুবিধা হচ্ছিল এর আয়ের উৎসে। ১৯৯৪ সালে এটা (সেলানগর টার্ফ ক্লাবকে) অফিসিয়াল স্পোর্টস ক্লাব হিসাবে মর্যাদা দেয়া হয় যা এখন বিদ্যমান।  

The entire master plan for KLCC project development around freehold prime property (KLCC: 40.5 hectares – Petronas Twin Towers & Retail: 5.8 hectares with 18,000 m2 each tower – 994,000 m2 total Petronas complex) was focused into seven main sections. i.e. Office Buildings, Hotels, Retails, Convention Centre, Residential, Recreational facilities and Infrastructure. The conceptual redevelopment project was to covert site of the former Selangor Turf Club, a 100-acre horse race track located in the center of Kuala Lumpur’s “Golden Triangle, into an integrated, self-contained modern city as well as creating a new landscape for the capital city of Malaysia

The reallocation of the Turf Club was also occurred back in 1992/3.

Today, Petronas has evolved into a turnover of $25.7 billion with a pretax profit of $9.9 billion for the financial year ended on March 31, 2004 – and it was one of the respectful top Fortune 500 company. Four of its subsidiaries are listed on the Malaysian Stock Exchange (renamed as Bursa Saham Malaysia in 2005).

এই গেল টুইন টাওয়ারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

এখানে একটা জিনিস আমার চোখে পড়ল ভীষণভাবে। সব গুল এক্সিট শেষ হয় গিফট দোকান ঘুরে ঘুরে। কেউ কিনুক আর নাই বা কিনুক, তাকে ঐ সব দোকান দিয়েই বের হতে হবে। এটা একটা বিজনেস চালাকি। ছোট ছোট বাচ্চারা সঙ্গে থাকে, সুতরাং কিছু না কিছু কেনা কাটা তো হয়ই।  আর এই সব জায়গায় দাম একটু চরা থাকে।   

যেটা বলছিলাম। আমরা টুইন টাওয়ার বাইরে থেকে দেখে লংকাউই দেখার উদ্দেশ্যে এয়ারপোর্ট চলে এলাম। এটাও একটা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। বড় সুন্দর। আমার ছোট মেয়ের আবার দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেছে। কারন তাকে আবার প্লেনে চরতে হবে। তবে এবার বেশিক্ষন সময়ের জন্য নয়। মাত্র ৪০/৪৫ মিনিট সময়। দেখতে দেখতেই পার হয়ে গেল। আমরা লঙ্গাউইতে পৌঁছলাম যখন তখন রাত ১০টারও বেশি। এখানে যে কোন লোক যারা গাড়ী চালাতে পারে তারা যে কোন দিনের জন্য গাড়ী ভারা নিতে পারে এবং সেলফ-ড্রাইভিং করতে পারে। সস্তাও বেশ। আমরা দুই দিনের জন্য একটা প্রাইভেট গাড়ী ভারা নিয়ে নিলাম। বেশ ভাল। লংকাউই এর একটা সুন্দর নামকরনের ব্যাখ্যা আছে। কেউ কেউ বলে যে, লঙ্কা অর্থ হচ্ছে “সুন্দর” আর “উই” এর অর্থ হচ্ছে “অফুরন্ত”। এর মানে এই যে, লংকাউই মানে “অফুরন্ত সুন্দরের অধিকারি”। আবার কেউ কেউ বলে যে, এটা প্রাচিন থাইল্যান্ডের কেদাহ সম্প্রদায়ের লোকের বসবাস ছিল যারা লাঙ্কাসু প্রভিন্সের বাসিন্দা। এই লংকাসু হচ্ছে প্রাচিন থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার আন্তসংযোগ স্থল। বর্তমানে এটা মালয়েশিয়ার অংশ। আবার অনেকে বলে যে, “লাংক” মানে ইগল এবং “উই” মানে মার্বেল। এর মানে হচ্ছে এই লংকাউই তে প্রুচুর পরিমানে ইগল এবং মার্বেল পাওয়া যায়। এখানে লোকমুখে আরও একটা মিথ চালু আছে। আর সেটা হচ্ছে About 200 years ago, according to the folklore, a young woman, name Mahsuri, was accused of adultery and was executed by the people in spite of her earnest innocence. Just before her death, Mahsuri laid a curse on the island that it will remain barren for seven generations.

এই এলাকায় থাই ভাষা মোটামুটি সবাই বলতে পারে। আসলে কোণটা যে কি তা আমার জানার দরকার নাই, আমি আসলে জায়গাটার সুন্দরের কারনে বিমোহিত।

লংকাউই তে আমরা এবি হোটেল নামে একটা হোটেলে উঠলাম। আগে থেকেই বুক করা ছিল। গিয়ে দেখলাম, আমাদের রুমটা একদম বীচের সঙ্গে লাগানো। খুব ভাল লাগলো। প্রায় অর্ধরাত অবধি আমরা ঐ প্রাইভেট কারে করে প্রায় আশেপাশের এলাকাটা ঘুরলাম। কিন্তু আমাদের জানা ছিল না যে, রাত ১১ তার পর সব খাবার হোটেল বন্ধ হয়ে যায়।  “টমেটো” নামে একটা রেস্টুরেন্ট আছে, সারারাত খোলা থাকে, প্রায় রাত ১২ টার পরে গিয়ে মোটামুটি আমাদের পছন্দের খাবারগুল খেতে পারলাম। এই টমেটো হোটেলে বাংলাদেশের অনেক লোক কাজ করে, দাম ও প্রায় রিজন্যাবল। প্রথমে মনে হয়েছিল শহরতা মনে হয় ছোট্ট একটা দ্বীপের মত, যেমন আমাদের সেন্ট মারটিন দ্বীপ। ভুলটা ভাঙল তার পরেরদিন।

সকাল থেকে আমরা সারাদিন (অর্থাৎ বিকাল ৩ টা পর্যন্ত) বীচে অনেক আইটেম করলাম, প্যারাসুট দিয়ে এক পাহার থেকে আরেক পাহাড়ে গেলাম, স্পিড বোটে করে রিভার ক্রুজ করলাম, সাতার কাটলাম, সবাই মিলে সত্য দারুন কাটল বীচের সময়টা। বেশ এক্সপেন্সিভ সব আইটেম। বীচের বালুগুলো এত মসৃণ যে মনে হয় সারাক্ষন হাতে নিয়ে পাউডারের মত পিসাপিসি করি। বালুর রঙ খুব সুন্দর।

এখানে একটা মজার কান্ড ঘটলো। আমরা সবাই ব্যানানা বোটে উঠেছিলাম এক সঙ্গে। এটা বেসিক্যালি একটা স্পিড বোট দিয়ে অনেক স্পিডে টেনে আরেকটা ব্যানানা সাইজের ভেলাকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনে। কলার শেপে বানান একটা বোট, প্রায় ৬ জন একসঙ্গে বসতে পারে। আমরা খুব ভাল করে ব্যানানা ট্যুরটা শেষ করেছি মাত্র, পাড়ে এসে নেমে পড়ব পড়ব ভাব। কিন্তু ঠিক শেষ পয়েন্টে এসে হটাত করে সামনের স্পিড বোটটা এমন করে বেঁকিয়ে টান দিল যেন ব্যানানা বোটে যারা থাকে সবাই এক ঝটকায় পানিতে পরে যায়। আমরাও পরে গেলাম। আমার ছোট মেয়ে সাতার জানে না, বড় মেয়ে কিছুটা জানে। কিন্তু সবার লাইফ জ্যাকেট পরা ছিল। এটা আমাদের জানা ছিল না যে ওরা এই এমন একটা কাজ করবে। ওরা অবশ্য এমন একটা জায়গায় এই কাজটা করে যেখানে সাতারের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু হটাত করে ঝটকা দিয়ে ফেলে দেয়ায় সবাই একটা আতঙ্কে পরে যায়। ব্যাপারটা আমিও জানতাম না। আমাদের বেলায় এই কাজতা হওয়াতে আমার ছোট এবং বড় মেয়ে সঙ্গে আমার বউ এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে, মনে হয়েছিল এই বুঝি সবাই ডুবে মরছি। কিন্তু ২০-৩০ সেকেন্ড পর যখন পায়ের তলায় মাটি ঠেকে তখন ব্যাপারটা একটা মজার ঘটনায় পরিনত হয়। হটাত আতংক, আবার হটাতই সস্তি।

বিকালের দিকে খেয়ে দেয়ে আমরা “আন্ডার ওয়ার্ল্ড সি” তে গেলাম। এটাও একটা মিউজিয়াম কিন্তু শুধু মাছের। কি নাই এখানে। সব পদের মাছ, গুল্ম, হাঙ্গর, আরও কত কি!! আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, এগুলো সব জীবিত। খুবই সুন্দর একটা জায়গা। দেখার মত। এখানে প্রায় ৫০০০ হাজার পদের মাছের প্রজাতি আছে। ১৯৯৫ সালে এটা তৈরি করা হয়েছিল। The concept and theme of Underwater World Langkawi are geared towards Knowledge, Education and Entertainment. It is built to raise awareness on the importance of conserving our precious aquatic life forms, thus creating understanding of the deep and inseparable bond between man and nature.

প্রতিদিন এই একুরিউয়ামের মত জলাধারগুলোতে ৫ লাখ পরিমান পানি ঢালা হয় ফ্রেশ। এখানে ফটো গ্যালারী আছে, বন্য প্রাণীর গ্যালারী আছে, আর আছে মাছের প্রজাতিদের হরেক রকমের গ্যালারী। হেটে হেটে দেখতে হয়। প্রায় ১৫ মিটার চওরা হাটার পথ। খুব সুন্দর। দেখতে দেখতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল, আমরা সময় করে উঠতে পারছিলাম না সবগুলো আইটেম দেখার জন্য। তার মধ্যে আবার শুরু হয়েছে বৃষ্টি। মালয়েশিয়ায় প্রায়ই বৃষ্টি হয়। তবে আবহাওয়াটা শিতের নয়। এটা সামারের মত একটা সময়।

এই আন্ডার ওয়ার্ল্ড সি শেষ করে আমাদের প্ল্যান ছিল ইগল স্কয়ারে যাওয়ার। এই ইগল স্কয়ারটা কুয়া জেলায় অবস্থিত। লংকাউইটা কত বড় এটা ঐ ইগল স্কয়ারে না গেলে হয়ত বুঝতাম না। এটা প্রথম দিন মনে হয়েছিল আমাদের সেন্ট মারটিন দ্বীপের মত, কিন্তু ইগল আইল্যান্ডের জন্য যেতে গিয়ে বুঝলাম এটা নিতান্তই একটা বড় শহরের সমান। প্রায় ১ ঘন্টা গাড়িতে জার্নি করে ইগল স্কয়ারে পৌঁছলাম। দেখার মত একটা স্কয়ার। ওখানে অনেক বড় আকারের (প্রায় ১২ মিটার) একটা ইগলের ভাস্কর্য করা। খুবই সুন্দর। ইগলের ছবিটা দেখলে মনে হবে ঈগলটা উড়ে যাওয়ার জন্য টেক অফ করছে প্রায়। ঐ যে আগেই বলেছিলাম যে, লোক মুখে একটা মিথ চালু আছে যে, এই লঙ্কাউই একটা অভিশাপের রাজ্য হিসাবে চিহ্নিত আছে কোন এক মহিলার দ্বারা। ডঃ মহাতির এই কন্সেপ্টটাকে ঢেকে দেওয়ার জন্য আর এই শহরটাকে পর্যটকসমৃদ্ধ করার  লক্ষ্যে এই ইগল ভাস্কর্য এবং অন্যান্য সুন্দর সুন্দর জিনিস তৈরি করে ফেলেন। চারিদিকে বিশাল খোলা জায়গা। আশেপাশে একটা জেটি আছে। এটা জেটি পয়েন্ট নামে পরিচিত। বৃষ্টি হচ্ছিল, কিন্তু তারপরেও বের হয়ে গেলাম স্কয়ারটা দেখার জন্য। বেশ সুন্দর। আসলে মালয়েশিয়ায় সব কিছু অত্যন্ত প্ল্যান করে সব কিছু করা হয়েছে আর এটা করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। কোন কিছুর কমতি নাই। অনেক রাত হয়ে গেল ফিরতে ফিরতে। আগামিকাল আবার যেতে হবে পেনাং আইল্যান্ডে। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি আমরা বিছানায় যেতে চাইলেও পারা গেল না। কারন আবারো মার্কেটিং। অনেক রাত অবধি কেনা কাটায় ব্যাস্ত হয়ে গেল আমার পরিবার। অনেক পদের গিফট আইটেমের মার্কেটিং। ভাগ্যিস সঙ্গে ভিসা কার্ড ছিল। তা না হলে যে কি হত আল্লাহ মালুম। আমার পরিবার তো ধরেই নিয়েছে বিশ্বব্যাংক সঙ্গে আছে, মার্কেটিং এ কোন সমস্যা নাই। আমার কাছে তাই মনে হচ্ছিল আর কি। রাত ২ টা পর্যন্ত যে যেভাবে পারে তাদের পছন্দ মত মার্কেটিং করল, আর আমার পায়ের অবস্থাটা এমন মনে হচ্ছিল যে, “আর পারছি না ভাই, এবারের মত মাফ কর” অবস্থা। সঙ্গে সিগারেট ছিল বলে রক্ষা, অন্তত সিগারেট খেয়ে হলেও কিছুটা সময় কাটাতে পারছিলাম আর আমার পরিবারের পিছন পিছন ওদের মার্কেটিং দেখছিলাম।

পরের দিন সকাল, পেনাং বিমান বন্দর। খুব সুন্দর একটা বিমান বন্দর। বেশ গোছালো। গাড়ীখানা হ্যান্ডওভার করে আমরা আবারও পেনাং আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে বিমানে উঠে গেলাম। পেনাং শহরটির নামকরন আসলে হয়েছে সম্ভবত পেং লাং উ থেকে যার অর্থ হচ্ছে সুপারির আইল্যান্ড। এটা এক সময় যখন ব্রিটিশরা ইন্ডিয়ায় রাজত্ব করছিল, তখন এটা তাদের অধিনে ছিল। পরবর্তীতে এটা সরাসরি ব্রিটিশদের অধিনে চলে যায়। সেথেকে ব্রিটিশরা চলে যাবার পরও এরা সায়ত্তশাসিতই থেকে যায় যদিও এটা এখন মালয়েশিয়ার অধিনে। এই অঞ্চলটা আসলে টিন এবং রাবারের জন্য বিখ্যাত। ১ম এবং ২য় বিশ্ব যুদ্ধে এই পেনাং এর উপর অনেক বড় বড় অপারেশন হয়েছে। জাপান যখন যুদ্ধে জরিয়ে পরেছিল, তখন তারা এই পেনাং এর পোতাশ্রয়গুলো অনেক ব্যবহার করত। আর এই কারনে ব্রিটিশ বাহিনি বারবারই এই পেনাং পোতাশ্রয়ে ঘনঘন আক্রমন চালায়। জাপানিজরা এই অঞ্চল ত্যাগ করার সময় তা ব্রিটিশরা দখল করে নেয়। পেনাং জেটি হল সেই বিখ্যাত পোতাশ্রয়। ব্রিটিশরা চলে যাবার পর এটা মালয়েশিয়ার অঙ্গরাজ্য হয়ে যায়। যাক ইতিহাস বলে লাভ নেই। আমার ভ্রমন এর অন্যান্য দিকগুলো বলি।

আমার ছোট মেয়ে সব জায়গায়তেই আনন্দ করছিল কিন্তু একমাত্র বিমান জার্নি ছাড়া। প্লেনে উঠতে হবে এই কথা মনে হলেই তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।  কিন্তু তারপরেও সে চেষ্টা করছিল স্বাভাবিক থাকতে। কিন্তু তার মুখ, চোখ দেখে বুঝা যায় সে প্লেন জার্নিতে মজা পাচ্ছে না। আমরা প্রায় সকাল ১১ তার দিকে পেনাং আইল্যান্ডে পৌঁছে গেলাম। অদ্ভুত সুন্দর একটা শহর। চারিদিকে পাহাড়, আর সাগরের পাশ দিয়ে রাস্তাগুলো সাংঘাতিক সুন্দর একে বেকে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে। খুবই এক্সপেন্সিভ একটা শহর। তারপরেও দেখার মত। এই শহরটা স্বায়ত্তশাসিত। মালয়েশিয়াতে দুইটা শহর স্বায়ত্ত শাসিত। এক পেনাং আরেকটা হচ্ছে মেলাক্কা।

এখানে দেখার মত অনেক কিছু আছে। তার মধ্যে পেনাং-হিল হচ্ছে একটা। এই পেনাং হিলে উঠতে প্রায় কিছু কিছু জায়গায় একেবারে ৯০ ডিগ্রি খাঁড়া উঠতে হয়। কোথাও কোথাও ১০২ ডিগ্রি পর্যন্ত বাক আছে। ১৯০৬ থেকে ১৯২৩ সাল লেগেছে এই সিস্টেমটা চালু করতে। আর তারপর ১৯২৩ সাল থেকে এই পেনাং হিলে উঠার প্রচলন রয়েছে। ট্রেনের মাধ্যমে উঠতে হয়। দেখার মত একটা ব্যাপার। প্রায় এক হাজার মিটার এর চেয়েও বেশি উচু। উঠতে মোট ১০-১৫ মিনিট সময় লাগে। একটি ট্রেনে প্রায় ১০০ জন লোক উঠতে পারে। আমার খুব কৌতূহল হয়েছিল কি করে এই কাজটা তারা করল? এত খাঁড়া এবং এত উচু একটা ট্রেন কিসের বলে উঠে যাচ্ছে আসলে? পরে জানলাম যে এটা একটা সায়েন্টিফিক ফর্মুলা। যাকে বলে “ফানিকুলার ট্রেন”। ফানিকুলার ট্রেনটা আসলে কি তাহলে?

The basic idea of funicular operation is that two cars are always attached to each other by a cable, which runs through a pulley at the top of the slope. Counterbalancing of the two cars, with one going up and one going down, minimizes the energy needed to lift the car going up. Winching is normally done by an electric drive that turns the pulley. Sheave wheels guide the cable to and from the drive mechanism and the slope cars.

চুরায় উঠে আমার মনটাই ভরে গেল। ওখানে একটা মসজিদ আছে, মন্দির আছে, অনেক লোকজন ওখানে বসবাস করে। ওদের কোন এসি লাগে না, ফ্যানও লাগে না। পুরু মালয়েশিয়া দেখা যায় ঐ পেনাং হিল থেকে। পেনাং হিলটা  “এয়ার আইটাম (Air Itam) এলাকায় অবস্থিত। Air Itam মানে হল কাল পানি। কেন এটার নাম কাল পানি হল তা আমি জানার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু লোকাল লোকজন খুব একটা বলতে পারেনি।

চুরায় উঠে আমি এক ইন্ডিয়ান মালয়কে পেলাম যিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে আইসক্রিম বিক্রি করে। দুই রিঙ্গিত দাম এক একটা কোন/কাপ আইস্ক্রিমের। বেশ স্মার্ট ছেলে। তার একটা ছেলে আছে, স্কুলে যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, কিভাবে ওরা স্কুলে যায়? ওদের জন্য সরকার একটা ভাল ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই ফানিকুলার ট্রেন দিয়ে বাচ্চারা কাছের একটাই স্কুল, সেখানে যেতে পারে, এতে মাসিক একটা ভারা বলে দেওয়া আছে। আর অন্যান্য কাজের জন্য ওরা সরু একটা কংক্রিটের রাস্তা আছে, ওটা দিয়ে শুধুমাত্র গুটিকয়েক রেসিডেন্ট যারা ওখানে বসবাস করে তারাই আসা যাওয়া করতে পারে, কোন টুরিস্ট ঐ রাস্তা ব্যবহার করতে পারে না। ঐ রাস্তা তৈরির আরও একটা কারন আমি মনে করি তা হল, কোন কারনে যদি ইমারজেন্সি যাতায়ত করতে হয়, তাহলে সরকার বাহিনির রেস্কিউ পার্টি ঐ পথ ব্যবহার করতে পারবে।

পেনাং হিল থেকে বেরিয়ে গেলাম এবং হোটেলে চলে এলাম। আসতে আসতে দেখলাম আমাদের হোটেলের ঠিক সামনে অসংখ্য দোকান বসেছে যারা রাত ১ টা পর্যন্ত থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এদের অধিকাংশ ই হচ্ছে বাঙালি। অনেক কথা হল বাঙালি ভাইদের সাথে। অনেক কষ্টের কথা আবার অনেকের সাফল্যের কথা। আমরা সবাই মিলে প্রায় রাত ১ টা পর্যন্তই ওখানে বিভিন্ন প্রকারের শপিং করলাম। শপিং শেষে হোটেলে ফিরে এসে আবারো ব্যাগ গুছায়ে সবাই শুয়ে পরলাম, কারন পরদিন আবার কুয়ালালামপুর যেতে হবে। এবার আর প্লেনে নয়। আমার মেয়ে এয়ার এশিয়া হারিয়ে যাবার পর থেকে সে আর প্লেনেই উঠতে চাচ্ছিল না। অগত্যা আমরা প্লেন টিকিট বাতিল করে বাসে আসার প্ল্যান করলাম। ডাবল ডেকার বাস। বাস ছাড়ার কথা সকাল ১১৩০ মিনিটে আর সেই বাস ছাড়ল গিয়ে দুপুর ২ টায়। সবচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার হল, যার যার মাল সে সে লোড করতে হয় এবং কোন টিকিট (লাগেজ টিকিট) দেয়া হয় না। কুয়ালালামপুর পৌঁছানোর কথা বিকাল ৫ টার মধ্যে আর সেই বাস পৌঁছল গিয়ে রাত ১০টায়। মাঝে আবার কোন খাবারের বিরতিও নাই। বাস জার্নিটা ভাল হয় নাই আসলে। বিরক্তি লাগছিল এত লম্বা একটা সময় বসে থাকতে।

ঐ দিন আর আমরা কোথাও বের হই নাই। কারন এক দিকে বৃষ্টি হচ্ছিল আবার রাতও হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং পরেরদিন ২৯ তারিখ ছিল গিয়ে আমাদের আসম শপিং এর দিন। সারাদিন আমার পরিবার এই মার্কেট, ঐ মার্কেট ঘুরে ঘুরে হরেক রকমের গিফট আইটেম কিনছে। ব্যাপারটা এমন যেন আমরা অন্য কারো জন্য মার্কেটিং করতে এসেছি। আমার ছোট মেয়ের আগে থেকেই বায়না ছিল সে একটা ট্যাবলেট কিনবে। এবং কোন কনফিগারেশনের ট্যাবলেট কিনবে তাও সে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল। সারাদিন ঘুরলাম, এর পরেরদিন ছিল ৩০ ডিসেম্বর। মানে আমাদের টুইন টাওয়ার ভিজিটের দিন। ডঃ মহাতির তার ২২ বছরের শাসনামলে সে মালয়েশিয়ার জন্য যা করে গেছে, এই অকল্পনীয় কাজ আর কেউ করতে পারবে কিনা আমার জানা নাই। সম্ভবত এই টুইন টাওয়ারের জন্যই সারা বিশ্ব বারবার মালয়েসিয়াকে স্মরণ করবে। ১৯৮১ থেকে মালয়েশিয়া নতুন এক মালয়েশিয়া হিসাবে ২০০৩ পূর্ণ সুন্দররুপ পেয়েছে। ব্যাক্তি মহাতির তার পারিবারিক জিবনে কত টুকুন সার্থক টা আমার জানা নাই তবে দেশের একজন নেতা হিসাবে তাকে আজিবন স্যালুট না করে কোন মালয়েসিয়ানকে উপায় নেই। কোন একটা কাজও সে অপূর্ণ রাখে নাই। সব কিছু করে দিয়ে তারপর সে নিজ ইচ্ছায় প্রধান মন্ত্রী থেকে বিদায় নিয়েছে। সারা বিশ্ব তার এই ক্ষমতা হস্তান্তরের পালা টা দেখেছে। যে দেশে এই মহাতিররা জন্ম নেয়, সেদেশ ধন্য।

এবার এই ভদ্র লোক সম্পর্কে আমি কিছু বলি। আমার দুইজন বিশিষ্ট পছন্দের ব্যাক্তিদের মধ্যে মহাতির একজন। তিনি আসলে জন্ম গ্রহন করেছিলেন কেদাহ শহরের আলোর সেতার নামে এক গ্রামে ১৯২৫ সালে। তিনি মালয়েশিয়ার ৪র্থ প্রেসিডেন্ট। মোট ২২ বছর তিনি রাজত্ব করে সেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে বের হয়ে যান যার ক্ষমতা হস্তান্তর লাইভ টেলিকাস্ট করেছিল সমস্ত বিশ্ব ২০০৩ সালে। তার বাবা ছিলেন একজন শিক্ষিক। তিনি বাস্তব জিবনে ছিলেন ডাক্তার এবং আর্মির ডাক্তার। ওনার প্রথম জিবনে তিনি যখন রাজনিতিতে প্রবেশ করেন, তখন কয়েকটা বই লিখে সাং ঘাতিক বিতর্কিত হয়ে যান এবং তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান তার সব গুলো বই ব্যান্ড করে দিয়ে রাজনিতিতে তাকে নিষিদ্ধ ঘসনা করেন। ১৯৭০ সালে মিঃ রাজ্জাক প্রধান মন্ত্রী হলে পুন্রায় তিনি মহাতির কে পার্টি তে নিয়ে নেন। এর পর সম্ভবত ১৯৮১ সালে থেকে তিনি কোন প্রতিযোগিতা ছারাই পর পর ৫ বার প্রেসিডেন্ট নিরবাচিত হয়েছিলেন যেটা একটা ইতিহাস। তার প্রথম ইলেকসনে তিনি তদানিন্তর প্রেসিডেন্ট হোসেন কে মাত্র ৫০ ভোটের ও কমে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট হন। প্রকৃত পক্ষে এই বিজয়টা কোর্ট করত্রিক ফয়সালা হয়েছিল।

প্রেসিডেন্ট হবার পর, তার ৯ম দিনে একটা দারুন কাজ করে ফেললেন। নতুন একটা পার্টি ফর্ম করে ফেললেন যার কোন ম্যান্ডেট পাব্লিকের কাছ থেকে ছিল না। তার নতুন পার্টি র নাম হল, ইউএনএমও (বারু)।  তার প্রথম কয়েকটা কাজের মধ্যে একটা ছিল, সব সরকারি সংস্থা গুলোকে তিনি প্রাইভেট সেক্টরে হস্তান্তর করেন এবং এতে দারুন ফলাফল আসে। ১৯৯০ সালের মধ্যে মালয়েশিয়ার পার ক্যাপিটা ইনকাম প্রায় ডাবল হয়ে যায়। মহাতির কে প্রধানত আমেরিকা এবং ব্রিটিশ রা একেবারেই পছন্দ করছিল না, ফলে নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রকায় তার নামে অনেক নেগেটিভ মন্তব্য করার কারনে তিনি সারা দেশে এই দুইট পত্রিকা সারা জিবনের জন্য ব্যান্ড করে দেন। তার ভিসন-২০২০ এর মধ্যে প্রথম তিনটা ফরমুলার কথা বলি।

(১) মহাতির তার প্রথম ক্ষমতার সময় যত সংখ্যক লোক তিনি পেরেছিলেন, বাইরে পাঠিয়েছেন উচ্ছ শিক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশে এই সর্তে যে, ঐ লোকগুলো পরবর্তীতে মালয়েশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে লোকাল মালয়েসিয়ান্দেরকে পরাবেন এবং ফারদার কোন লোক আর বিদেশ পাঠানো হবে না। ফলে যদি তোমরা খেয়াল কর দেখবা, ১৯৯০ দসকে অনেক মালয়েসিন রা আমাদের দেশেও এসেছিল উচ্চ শিক্ষা নিতে যেটা এখন অনেক কম রেসিও তে আছে এখন।

(২) তার এই প্ল্যানের পাশাপাশি তিনি যে কাজটা করলেন তা হল, দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার কাজ। তিনি মালয়েশিয়ার প্রতিটি আনাচে কানাচে, দোকানে, মাঠে ঘাটে, বাজারে, স্যালুনে, বাসে, ট্রেনে, বাসার অয়ালে অয়ালে, সর্বত্র একটা শ্লোগান লিখে রাখতে হবে যে, “আমি মালয়েশিয়ান, আমি মালয়েশিয়ান”। এটা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার জন্য প্রযোজ্য যে যে যেই ধর্মেরই হক, সে শুধু মালয়েশিয়ান। সবার কানে কানে, মনে প্রানে, দিলে হৃদয়ে শুধু “আমি মালয়েশিয়ান” এই কথাটা মনে রাখতে বললেন।

একে বলে জিকিরের মত দেশ প্রেমের ছবক। ঐ সময় ই অনি বললেন, দেশের অর্ধেক লোক বিশেষ করে মহিলারা কাজ না করার কারনে ওরা বাকি অর্ধেক লকের রোজগারের উপর নির্ভরশীল এবং এটা তিনি বুঝাতে সক্ষম হলেন যে মহিলারা কাজ করলে সংসার এবং ব্যাক্তিগত জিবনে ও সচ্ছলতা আসবে। ফলে সর্বত্র যেমন অপারেটর হিসাবে, দোকানি হিসাবে বা সেলস গার্ল হিসাবে, গ্যাস ষ্টেশনে, ক্লিনার, মানে যেখানে যেখানে মেয়েরা কাজ করতে পারে সর্বত্র ওদের অগ্রাধিকার দেয়া হল। একটা রেভুলিসনের মত শুরু হয়ে গেল পুরু ব্যাপারটা। মালয়েশিয়ানরা ও পছন্দ করলেন।

(৩) কিন্তু তিনি আরেকটা জিনিষ নিশ্চিত করতে চাইলেন যে, প্রতিটি হোটেল, দোকান, বাস, বাজার সর্বত্র আরেক টা শ্লোগান লিখার জন্য বাধ্য করলে, ” We will not talk about three things in public place: Woman, Politics and Religion” যে কেউ এই গুলো নিয়ে আলাপ করবে পাব লিক প্লেসে, তার শাস্তি হবে।

বাইরে থেকে যত পদের ইনভেস্টর আছে সবার জন্য দ্বার উম্মুক্ত করে দিলেন।

মহাতির মোহাম্মাদ মালয়েশিয়ার যত পদের করাপসন ছিল সেগুলোর মধ্যে থেকেই তিনি নিজে ডেভেলপ মেন্টের কাজগুলো করিয়ে নিয়েছেন। তার নামে যে খালি ভাল ভাল খবর আছে তা কিন্তু নয়। তার নামে অনেক বিপদ জনক তথ্যও আছে। যেমন, সবাই মনে করে তার পরিবারের কাছে ৩ বিলিওন রিঙ্গিত পরিমান সম্পদ গচ্ছিত আছে। তার তিন ছেলে প্রায় ২০০ টি কোম্পানির মালিক যেখান থেকে তারা প্রায় বছরে কয়েক বিলিওন রিঙ্গিত কামাই করে। তার ২য় ছেলে একাই প্রায় আরাই বিলিওন রিঙ্গিতের মালিক।

শুধু এখানেই শেষ ছিল না। তার প্রথম ৯ দিনের মাথায় তিনি যে পার্টি টা ফর্ম করেছিলেন, সেটা কোর্টের কাছে তার পক্ষে রায় টা হয়ত যাচ্ছিল না। মহাতির এই একটা জায়গায় দারুল বোল্ড এক সনে গেলেন, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচার পতিকে এবং পুরান সব জাদ্রেল রাজিনিতি বিদ যারা তার পার্টিতে ছিল সব গুলোকে বহিস্কার করে দিলেন। বিতর্কিত হয়ে গেলেন মহাতির। কিন্তু দমে জায় নাই ব্যাটা। তার সবচেয়ে ট্রাম কার্ড টা ছিল, ১৯৯৭ সালে যখন এশিয়ায় অর্থনৈতিক মন্দার সুচনা হল, মহাতির তখন এমন একখান চাল দিলে যে, মালয়েশিয়ার অর্থনিতিতে এশিয়ার কোন মন্দা ভাব পরল না। তিনি যে কাজটা করেছিলেন তা হচ্ছে ডলার রেট ফ্লাকচুয়েট করা যাবে না, স্থিতি থাকতে হবে। আইএমএফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক এটাকে নিন্দা করলেও পরে তারা বুঝেছিল মহাতির ঠিক ছিল। মালয়েশিয়া ঠিক এই সময়টায় ই উত্থান করল। পাব লিক তাকে তার সব প্লান কে ধরে নিল মহাতির যা করছে ঠিক করছে।

এর পরেও অনেক স্ক্যান্ডেল আছে মহাতির সম্পর্কে, যা শুনলে অনেকের ই ভাল লাগবে না। সে যত টা ভাল মানুসের মত কাজ করেছে, তার ভিতরে ও অনেক সেলফিস ইচ্ছা টা ও ছিল। বিশেষ করে তার ডেপুটি আনোয়ার এর ব্যাপারে। তাকে নারি কেলেংকারিতে পাওয়ার থেকে নামান হয়েছিল যা প্রকৃত পক্ষে সত্য ছিল না। এটা ইন্দনেশিরার সুহার্থ কে দেখে তার এই ভয় টা আসলে হয়েছিল যে ডেপুটি তাকে হয়ত তার পাওয়ার থেকে বিতারিত করতে পারে, তাই আনয়ারকেই বিতারিত হতে হয়েছিল।

তার শেষ টেনিউরটা আরও ১৮ মাস ছিল, ওনি ইচ্ছে করলে থাকে পারতেন কিন্তু তিনি তা আর করতে চান নাই। কেউ কেউ বলে যে, এটাও একটা রাজনিতির দর্শন। For many younger voters, Mahathir was like a voice from another generation. For many non-Malays, he was the leader of the right-wing brigade and a reminder of all the excesses of the Mahathir era.

যাক এ নিয়ে পরে আরও বিস্তারিত আলাপ করা যাবে।

অনেকক্ষণ বসে ছিলাম এই টুইন টাওয়ারের পাশে। বড় ভাল লাগছিল।

আজ ৩০ তারিখেই আবার ব্যাক করতে হবে। এখন ও আমার দোস্ত নওরোজের বাসায় যাওয়া হয় নাই। বিকাল ৭ টায় ফ্লাইট। এখন বাজে প্রায় বিকাল ২ টা। নওরোজের বাসা সেন্টুলে, যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ইন্সট্রাকশন নওরোজ ফোনে আমাকে দিয়ে দিয়েছে এবং আরও সহজ করার জন্য মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের আগেই কিভাবে বোর্ডিং করে নিতে হয় এয়ারপোর্টে না গিয়ে, সেই বুদ্ধিটাও ও আমাকে দিয়ে দিয়েছে। ফলে অনেক কাজ সহজ হয়ে গিয়েছে।

আমরা বিকালের মধ্যেই আমাদের সব লাগেজ পত্র মালয়েশিয়ান এয়ার লাইন্সে দিয়ে নওরোজের বাসায় গেলাম। নওরোজই আমাদেরকে কেএলসিটি থেকে নিয়ে গেল।

আমি নওরোজের অপেক্ষায় কে এল সিটির লবিতে অপেক্ষা করছিলাম। আর দেখছিলাম কখন আমার বন্ধুটি আসে। নও রোজ ও মনে হয় আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য একটু ক্যামুফ্লাজ করার চেষ্টা করেছিল এবং খুব সন্তর্পণে লোকদের ভিরের মধ্যে দিয়ে আমার পিছন থেকে আমাকে “হাই” বলার জন্য আসতেছিল। কিন্তু নও রোজ তা আর পারে নাই কারন এর আগাএই আমি অকে দেখে ফেলেছিলাম।

নওরোজের সঙ্গে আমার আর্মির জিবনে খুব বেশি ঘনিস্টতা হয়ত বেশি ছিল না কারন ও ছিল ইনফ্যান্ট্রি তে আর আমি ছিলাম আর্টিলারিতে। তারপরেও কোর্সম্যাট হিসাবে ওর সঙ্গে আমার অন্যান্য ইনফ্যান্ট্রি বন্ধুদের থেকে অনেক বেশি ঘনিস্টতা ছিল। আমি ওকে দেখে মনে হল কত দিন পর যে একজন আপনজনকে দেখলাম। মনে হল পথ হারা শিশুর মাকে খুজে পাওয়ার মত আর কি। আমি কবি নই, বা সাহিত্যক ও নই। কিন্তু মানুষ মাঝে মাঝে ঐ ধরনের কোন একটা ভাবের মধ্যে চলে আসে। আমার ও মনে হয়েছিল, If I were a poet, I woiuld write a poem standing on the platform of KLCC regarding a feelings of meeting someone who has the same pulse and nurves of my mind and heart. অনেক বাঙালি দেখেছি, অনেক বন্ধুদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, কিন্তু নও রোজের বাসায় যাওয়ার জন্য আমি আসলেই উদগ্রীব ছিলাম।

কিন্তু কবিতাটা লিখা হল অনেকক্ষণ কোলাকোলির ভাষায়। পরে ওকে নিয়ে ওর বাসার দিকে রয়ানা হলাম। কমুতার ট্রেন। নওরোজের বাসায় যাওয়ার উছিলায় কমুটার ট্রেনেও চড়া হল। সাংঘাতিক সময় মেইন্টেইন করে চলে এই কমুটার ট্রেন অথচ ভারা মাত্র ১ রিঙ্গিত। কাটায় কাটায় আমরা প্রায় ২৫ মিনিট থাকতে পেড়েছিলাম নওরোজের বাসায়। খুব সুন্দর একটা বাসা। আধুনিক এবং চমৎকার। বাচ্চাদের জন্য প্রিথক প্রিথক রুম, সুন্দর। খুব নিরাপদ, সব কিছুই আছে ওখানে। দেখলাম গার্ড আমার বন্ধুকে খুব ভাল করেই স্যালুত করে আমাদের সবাইকে সাদন সম্ভাসন জানাও। খুব ভাল একটা সময় কেটেছে নওরোজের বাসায়। অদ্ভুত একটা ফিলিংস হয়েছিল আমার। অনেক বছরের বন্ধুত্ব। খুব কাছের না হয়ে কি পারে? অনেক দিন পর বাংলাদেশি স্টাইলে ডাল খেলাম, ভাত খেলা, দেশি মুরগি খেলাম, অদ্ভুত পাক করেছিল নওরোজ ভাবি। আর সবচেয়ে ভাল লাগছিল এই জন্যে যে, ওরা খুব ভাল আছে মালয়েশিয়ায়। যে কারনে দেশ ছেড়ে এত দূর যাওয়া, সেটাই যদি না হয় তাহলে কষ্টের আর সীমা থাকে না। ওদের বেলায় এটা ঘটে নাই, ওরা ভাল আছে এটাই সবচেয়ে ভাল লাগলো।  নওরোজ ভাবি আর নওরোজ আমাদেরকে কে এল সিটি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। মনে হল খুব একজন আপনজনকে ছেড়ে যাচ্ছি। আমার প্রায়ই ঐ পোস্টমাস্টার গল্পটা মনে পরছিল, আমরা কমুটার ট্রেনে উঠে গেছি, নওরোজ আর নওরোজ ভাবি কে এল সিটি তে একা বসে আছে, মনে হল আরও একদিন থেকে যাই। অনেক গল্প করতে পারব, একটু আড্ডা মারতে পারব। কিন্তু আমার তো টিকেট করা হয়ে গেয়েছে। চেঞ্জ করার সময়ও পেরিয়ে গেছে। দেখলাম, আমাদের কমুটার ট্রেনটা অনেক স্পিডে সামনের দিকে শত শত যাত্রি নিয়ে কুয়ালালামপুর এয়ার পোর্টের দিকে দ্রুত গতিতে চলছে। তার সময় মত পৌছাতে হবে, তা না হলে মালয়েশিয়ান এয়ার লাইন্সের অনেক যাত্রি ও আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। কারন আমাদের বোর্ডিং পাশ তো আমাদের হাতে। আমরা না গেলে তো প্লেনটাও ছারতে পারবে না। আর অনেক বেশি দেরি হয়ে গেলে হয়ত আমরাও প্লেনে করে দেশে ফিরে আসতে পারব না। সময় বড় আজব জিনিষ। সময় কারো জন্য কখনো অপেক্ষা করে না, সে তমার সঙ্গে থাকবে অতক্ষণ যতক্ষন তুমি তার সঙ্গে আছ। টা না হলে সে একাই চলতে থাকে, তার কোন সঙ্গির প্রয়োজন নাই।

ওর ছেলেমেয়রা অনেক বাস্তববাদি হয়ে উঠেছে। নিজেদের কাজ ওরা নিজেরাই করে এবং সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে যে, ওরা এখন বুঝতে পারে পরিবার কি জিনিষ। এই জিনিসটা আমরা এখনও আমাদের বাচ্চাদেরকে শিখাতে পারি নাই যা ওরা শুধুমাত্র বিদেশে থাকার কারনে জানে, কোনটা নিজেদের কাজ আর কোন কাজটায় বাবা মা কে সাহায্য করার দরকার। ওরা খুব ভাল ভাবে গরে উঠছে। কত টাকার মাইনে পাবে কিংবা কোথায় কত বড় অফিসার হবে সে ভবিষ্যৎ আমাদের কারোই জানা নাই কিন্তু যারা বাস্তবকে চিন্তে শিখছে তাদের কোথাও কোন সমস্যা হবার কথা নয়। ওর বাচ্চারা ঠিক সেভাবেই বড় হচ্ছে। ওরা আসলে একদিন অনেক বড় হবে ইনশাল্লাহ। আমি কুয়ালালামপুর এসে নামাজ পরে সবার জন্য দোয়া করেছি এবং বাই নেম আমি অর পরিবারের জন্য এবং যারা ঐ কুয়ালালামপুরে আছে, সবার জন্য আল্লার কাছে দোয়া করেছি। আল্লাহ আমার দয়া নিশ্চয় কবুল করবেন।   

তারপরের কাহিনি তো বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট। এতা আর নাই বা বললাম। যেখানে সর এয়ারপোর্টে আমরা পৌছার আগেই বেল্টে মাল চলে এসেছিল, সেখানে আমরা বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে এসে প্রায় আড়াই ঘন্টা অপেক্ষার পর ও বেল্টে মাল পাই নাই। কাকে বলব এই ব্যর্থতার কাহিনি? এটা আমার জন্মভুমি বাংলাদেশ। এখানে মানুষ আছে, মনুষ্যত্ব নেই, অফিসার আছে, দায়িত্ত জ্ঞ্যান নেই, স কিছু আছে এখানে, কিন্তু নাই শুধু ভাল হবার লক্ষন। আমরা সবাই বলি, ক্যান দেশটা ভাল হচ্ছে না? কিন্তু আমি ভাল হতে হবে এই কথাটাই কেউ বলে না।তারপরেও এই দেশ টা আমার এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের।

কাস্টম অফিসার প্যাসেঞ্জার দেখলে তার পকেট চুল্কায়, পুলিস অফিসারের দায়িত্ত যেন অনেক বেরে যায় যাতে বেশি বেশি তার ইউনিফরমের পকেত ফুলে উঠে। কিন্তু ওরা জানে না কোন একদিন এই সব অপকরমের হিসাব দিতে হবে নিজকে একা। ডুবন্ত টাইটানিকের পাশে দারিয়ে যে লোক ঘুস খেতে চায়, ও ঐ ডলার নিয়ে মরে কিন্তু ঐ ডলারে কোন কাজ আর হয় না।

৯/০৪/২০১৫- ওমরা

Categories

গত ২৬ মার্চ ২০১৫ তারিখে আল্লাহর নাম নিয়ে আমি আর আমার স্ত্রীকে নিয়ে ওমরা করার জন্য সরাসরি প্রথমে মদিনা এবং পড়ে মক্কা শরিফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলাম। যদিও আমরা ২০০৬ সালে হজ্জ করেছিলাম, তখন প্রথমবার হজ্জ করার কারনে অনেক কিছু দেখার সুযোগ হয় নাই কারন হজ্জের অনেক ফরমালিটিজ থাকে যা পালন করতে গিয়ে ইসলামের অনেক আনুষঙ্গিক ব্যাপারগুলো দেখার বা মনোসংযোগ করার সময় থাকে না বা আমি নিজে পাইনি। এবার নিয়ত করেছিলাম যে, আমি ওমরার পাশাপাশি আরও বেশি কিছু দেখবো এবং ওগুলো নিয়ে পরাশুনা করব।আল্লাহ অনেক সহায়তা করেছেন এবং মন ভরে তা করতে পেরেছি। আলহামদুলিল্লাহ।

নবী করিম (সঃ) এর নামে দরূদ শরিফ পড়লে কি হয় তা আমি জানতাম। যেমন, আবু বকর (রাঃ) বলেছেন যে, দরূদ শরীফ পড়লে পানি যেমন আগুনকে ক্রমাগত দুর্বল করতে করতে এক সময় আগুনকে নিভিয়ে দেয়, ঠিক তেমনি, দরূদ শরীফ পড়লে আমাদের পাপেরও তা ক্রমাগত মুছন শুরু হয়। যতবার এই দরূদ শরীফ পড়া হবে ততবার আমাদের পাপের বিরুদ্ধে এই দরূদ শরীফ পাপ মুছনের কাজ করতে থাকে। তাই বেশি বেশি করে দরূদ শরীফ পড়তে হবে। এটা একটা দাসকে মুক্ত করার চেয়েও বেশি সম্মানিত আল্লাহর কাছে। আরেকটা হাদিসে আছে যে, শুক্রবার দিন দরূদ শরীফ পড়ার আরও কিছু বেশি লাভ আছে। আর তা হচ্ছে, বেহেশত থেকে কিছু ফেরেশতার উপর এই নির্দেশ দেয়া আছে যে, যারা যারা আমাদের নবীর নামে দরূদ শরীফ পরবেন, তাদের নাম সোনার কলমে সিলভারের কাগজের উপর তারা লিখে রাখবেন এবং তা আল্লাহর কাছে পেশ করবেন। আমি আমাদের নবীর রওজা মোবারক দর্শন করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত ক্রমাগত দরূদ শরীফ পড়ে যাচ্ছিলাম। অবশেষে আমাদের নবীর রওজায় এসে পৌঁছলাম। মদিনায় তখন সন্ধ্যা। মাগ্রেবের আজান চলছে। 

নবীর রওজা মোবারক।

আমাদের নবীকে আর মা আয়েশা (আঃ) এর ঘরেই শায়িত করানো হয়েছে। ওটা ছিল মা আয়েশার ঘর। এবার এটার কিছু তথ্য বলি।

আমাদের নবী যখন ওফাত হলেন, তখন অনেকেই তাঁকে জান্নাতুল বাঁকিতে কবর দেওয়ার পরামর্শ দেন, কিন্তু আবু বকর (রাঃ) বললেন যে, তিনি আমাদের নবীর কাছে শুনেছিলেন, রাসুলগন যেখানে ওফাত হন, তাঁদেরকে সেখানেই কবর দেওয়ার নির্দেশ। ফলে মা আয়েশার ঘরেই তার কবর দেওয়া হয়। নবীর ওফাত হওয়ার ২ বছর পর (সম্ভবত) আবু বকর (রাঃ) মারা যান এবং তিনি তখন তার মেয়ে (মৃত্যুর আগে) আয়েশাকে অনুরোধ করেন যেন তাঁকে নবীর পাশে কবর দেওয়া হয়। মা আয়েশা তার অনুরোধ রেখেছিলেন। মা আয়েশার ইচ্ছে ছিল যে আমাদের নবীর কবরের পাশে যেন তার কবর হয় এবং সে মোতাবেক তিনি তার কবরের স্থান নির্ধারণ করে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওমর (রাঃ) যখন এক ক্রিস্টিয়ান দ্বারা তার নাম ছিল ফিরোজ, (আবু লুলু) স্টেবড হন তার ঠিক মৃত্যুর আগে তিনি তার ছেলে আবদুল্লাহকে পাঠান মা আয়েশার কাছে এই বলে যে তাঁকে যেন আমাদের নবীর পাশে কবর দেওয়া হয়। ওমরের এই অনুরোধ তিনি রেখেছিলেন মা আয়েশার নির্ধারিত কবরটা তার জন্য ছেড়ে দিয়ে। তিনি মোহররমের ১ তারিখে মারা যান। ঠিক তার পরপরই মা আয়েশা তার ঘরের সঙ্গে সব কবরের মাঝে একটা পারটিশান দেন। কারন ওমর তার কাছে গায়েরে মোহররম ছিলেন।

এখানে একটা ঘটনার বর্ণনা দেওয়া আবশ্যক। আমাদের নবী প্রতিদিন আসর নামাজের পর সব স্ত্রীদের কাছে তাঁদের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য যেতেন। কিন্তু তার ৪র্থ স্ত্রী মা জয়নবের কাছে গেলে মা জয়নব তাঁকে তার প্রিয় মধু খেতে দিতেন। ফলে কিছুটা সময় বেশি কাটাতেন তিনি তার ঘরে। এই ব্যাপারটা মা আয়েশা এবং মা হাফসা পছন্দ করতেন না। ফলে তারা একদিন পরামর্শ করলেন যে, নবী যখন মা হাফসার ঘর থেকে তাঁদের ঘরে আসবেন, তখন তারা বলবেন যে, তার (আমাদের নবীর) মুখ থেকে ভাল গন্ধ আসছে না। এই কথা শুনে নবী বুঝতে পেরেছিলেন তাদের মনের ইচ্ছা এবং প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি আর মধু খাবেন না। এটা আল্লাহতালাহ পছন্দ করেন নি। তার ঠিক এর ফলে কোরআনে এক আয়াত নাজিল হয়েছিল যার অর্থ এই রকমঃ

O Prophet! Why holdest thou to be forbidden that which Allah has made lawful to thee? Thou seekest to please thy consorts. But Allah is Oft-Forgiving, Most Merciful. Allah has already ordained for you, (O men), the dissolution of your oaths (in some cases): and Allah is your Protector, and He is Full of Knowledge and Wisdom. —Quran, surah 66 (At-Tahrim), ayat 1-2[51]

Word spread to the small Muslim community that Muhammad’s wives were speaking sharply to him and conspiring against him. Muhammad, saddened and upset, separated from his wives for a month. ‘Umar, Hafsa’s father, scolded his daughter and also spoke to Muhammad of the matter. By the end of this time, his wives were humbled; they agreed to “speak correct and courteous words”[52] and to focus on the afterlife.[53]

চার নম্বর কবরটি এখন খালি আছে, এবং বলা হয় যে, ওখানে ইশা (আঃ) কে কবর দেওয়া হবে।

আমার দেখা এবারের কিছু জায়গার বর্ণনা দেই।

মদিনায় আমি মোট পাঁচ ছয় জায়গায় ভিজিট করেছি। তারমধ্যে ওহুদের পাহাড় যেখানে হামজা (রাঃ) শহিদ হয়েছিলেন আবু সুফিয়ানের সঙ্গে যুদ্ধ করে। ঐ যুদ্ধে মোট ৬৯ জন সাহাবা শহিদ হয়েছিলেন এবং হামজার কলিজা খেয়েছিলেন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ। মোট ৬৭ সাহাবার কবর এক জায়গায় এবং মাত্র ২ জনের কবর (একজন হামজা এবং অন্যজন আরেক সাহাবা) একটু দূরে। পুরু জায়গাটি চারিদিকে ওয়াল দিয়ে ঘেরাও করা এবং কবরগুলো শুধুমাত্র কয়েকটি পাথর দিয়ে মার্ক করা। এটা ঠিক যেখানে যুদ্ধটা হয়েছিল ওহুদের সময়, সেই জায়গায় করা হয়েছে। স্থান পরিবর্তন না করে। জায়গাটা দেখলে মন কম্পিত হয়ে উঠে। পরবর্তীতে কিন্তু আবু সুফিয়ান এবং তার স্ত্রী হিন্দ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছিলেন কিন্তু আমাদের নবীর একটা অনুরোধ ছিল হিন্দের প্রতি যে, কখনো যেনো হিন্দ তার জীবদ্দশায় আমাদের নবীর সামনে না আসেন। কারন হিন্দকে দেখলে আমাদের নবীর কষ্ট হত তার চাচা হামজার কলিজা খাওয়ার ঘটনা মনে করে।

ওইখান থেকে আরও ২০-২৫ মাইল দূরে গেলে একটা জায়গা পাওয়া যায় যার নাম হচ্ছে ওয়াদি-ই-জীন। বলা হয় যে, ঐ এলাকাটা জীনদের বসত করার জায়গা হিসাবে পরিচিত। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, ওখানে গেলে গাড়ি কোনো পাওয়ার ছাড়া এবং কোনো গিয়ার ছাড়া ব্রেক ছেড়ে দিলে প্রায় ৯০-১২০ কিমি স্পীডে পাহাড়ের আপহিলেও গাড়ি চলে। ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না। অনেকভাবে পরিক্ষা করে দেখেছি যে ব্যাপারটা সত্য। প্রায় ৭ কিমি কিংবা আরও বেশি মাইল এই ব্যাপারটা ঘটে। ওটা শুধু একদিকে ঘটে, অন্যদিকে হয় না। তাও আবার আপহিলের দিকে হয়। ব্যাপারটার মধ্যে বৈজ্ঞানিক কোন থিওরি কাজ করে কিনা আমি জানি না। তবে ব্যাপারটা নিয়ে আমি সারাক্ষনই ভেবেছি। ব্যাপারটা কি আসলেই মিরাক্যাল? সম্ভবত না। এখানে কোন বিজ্ঞানভিত্তিক লজিক থাকতে হবে। সবাই বলে, জীন গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে নিয়ে যায়। আমি যেহেতু ব্যাপারটা সুরাহা করতে পারি নাই, তাই কোন মন্তব্যও করছি না। তবে আমি দেখেছি যে, কোন পাওয়ার ছাড়া এবং গাড়ি একদম অফ করে দিয়ে নিউট্রালে রেখে গাড়ি প্রায় ৯০ থেকে ১২০ কিমি স্পীডে চলছে। এবং এটা আপহিলেই শুধু যাচ্ছে বলে মনে হয়। কিন্তু এখন আমি জানি কেন এটা হয়। এটা আসলে আপহিল নয়, আপাতত দৃষ্টিতে মনে হয় এটা আপহিল, কিন্তু আসলে এটা প্রায় ১১ ডিগ্রি ডাউনহিল। আর এ কারনেই আপাতত দৃষ্টিতে যেটা আপহিল মনে করা হচ্ছে সেটা আসলে ৭ কিমি পরিধি নিয়ে ১১ ডিগ্রি ডাউন হিল। আর এ কারনেই গাড়ি, পানির বোতল কিংবা পানি সব আপহিলে যায় বলে মনে হয়। বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য পড়ে আলাপ করা যাবে। আমি এইটার পুরু ব্যাখ্যা এখন জানি। এটা কোন জিনের কাজ নয়।

ঐখান থেকে আমরা খন্দক পাহাড়, এবং মক্কায় এসে আমাদের নবী প্রথম যেখানে মসজিদ করেন তার স্থানটি দেখলাম। ওটার নাম “তুবা” মসজিদ। ৩৫০ কিমি পথ আমাদের নবী শুধুমাত্র রাতে রাতে ভ্রমন করে মাত্র ৮ দিনে মদিনায় পৌঁছেন। এর মধ্যে আরও একটা জায়গা আমি দেখতে গিয়েছিলাম। সেটা হচ্ছে, মক্কার উদ্দেশ্যে অপারেশন করার পূর্ব মুহূর্তে আমাদের নবী কর্তৃক ব্যবহৃত অপারেশন ব্রিফিং রুমের স্থানটি। এই স্থানটি আগে আবিষ্কৃত হয়নি কিন্তু মিনায় নতুন করে স্থাপনা করতে গিয়ে পাহাড় কাটার সময় এটা আবিষ্কৃত হয়। ঘরটির কোন ছাদ নাই বর্তমানে এবং শুধু ঐতিহাসিক কারনে এটা এখন একইভাবে সংরক্ষন করা হয়েছে। একতলা একটি বাড়ীর সাইজ। এটা এখন open-roofed mosque in Muzdalifah  নামে পরিচিত। প্রকৃতনাম Masharul Haram (the Sacred Grove).

খন্দকের যুদ্ধটা কেন হয়েছিল তা আমরা অনেকেই জানি। এটলিস্ট প্রমোশন পরিক্ষার আগে এই ব্যাপারে অনেকেই আমরা পড়াশুনা করতে হয়েছে। তবু একটু হিন্টস দেই। 

খন্দকের যুদ্ধটাকে বলা হয় সবচেয়ে বেশি ট্যাক্টিক্স সমৃদ্ধ যুদ্ধ। এখানে ডিপ্লোম্যাসি, রিউমার, এবং ফলস তথ্য দ্বারা যুদ্ধ জয় হবার ন্যায়সঙ্গতা রয়েছে। যুদ্ধটা হয়েছিল ত্রিপক্ষ বেসিস। মানে হল এই যে, আমাদের নবী যখন ইহুদী বংশের নেতাদেরকে (বনু নাদির গোত্র) মদিনা থেকে খায়বারে বিতাড়িত করেন তখন এই নেতাগন (তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সালাম বিন আবু হুকায়েক, সালাম বিন মিশকাম,  কিন্নাহ বিন আর রাবি) মক্কায় কুরাইশ বংশের বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে হাত মিলান নবীকে পরাস্ত করার জন্য। একইভাবে এই ইহুদীগন গাতাফান ট্রাইবদের কাছেও তাঁদের সাপোর্ট এর কথা জানিয়ে আমাদের নবীর বিরুদ্ধে প্রলুব্ধ করেন। তারা সবাই এক হয়ে যায়। আবু সুফিয়ান এই যুদ্ধে লিড দেন। সালমান আল ফার্সি এই প্ল্যানের (অর্থাৎ ট্রেঞ্চ) উদ্যক্তা। মদিনাকে পূর্ব পাশ থেকে ডিচের মাধ্যমে আইসোলেট করা হয়, ডিচের মাধ্যমে শত্রু পক্ষের পানির সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়া হয়।

মদিনা তখন মহিলাদের দ্বারা নিরাপত্তা দেওয়া হয়। যুদ্ধে যারা অংশ নেয় তারা হচ্ছেন, বনু নাদির, বনু ঘাতাফান, বনু সুলাইমান, বনু মোররা, বনু সুজা, বনু খোজা ইত্যাদি। বনু কোরায়জা যদিও শত্রু পক্ষের লোক ছিল কিন্তু তারা ইসলামের প্রতি কিছুটা ঝোঁক ছিল বিধায় তারা আমাদের নবীকে সাপোর্ট করেছিলেন। তাছাড়া বনু কোরায়জার সাথে আমাদের নবীর একটা গোপন প্যাক্টও হয়েছিল যে তারা আমাদের নবীকে সাপোর্ট দেবেন। আর এই দলটি ছিল মদিনার ভিতরে একেবারে ডিফেন্সিভ লাইনের ভিতরে। মদিনার রক্ষার জন্য এরাও একটা অংশ পাহাড়া দিচ্ছিল।

এখানে আমাদের নবী আগে থেকেই একটা জিনিষ আল্লাহ তাঁকে জ্ঞ্যান দিয়েছিলেন যে, মদিনায় যে সময় শস্য হয় তার আগেই তিনি লাগিয়েছিলেন যেন, শত্রু পক্ষ মদিনায় এসে কোন খাবার না পায়। সব শস্য ইতিমধ্যে মদিনাবাসি ঘরে তুলে ফেলেছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে কোরায়েশরা যখন তাঁদের ঘোড়ার কোন খাবার যোগাড় করতে পারছিলেন না এবং ঘোড়াগুলো খাবার না পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছিল, তখন এই ডিচ কোরায়েশ বংশের আমর বিন উদ (যাকে একাই ১০০ সৈনিকের শক্তির সমান মনে করা হত) একমাত্র কোনভাবে ঐ খন্দক অতিক্রম করেন কিন্তু তিনি ল্যান্ড করেন জলাভুমির মত এক জায়গায় যার নাম ছিল “সালা” পাহাড়ের পাদদেশ। যেহেতু তিনি গুটিকতক সৈনিক  নিয়ে ঐ খন্দক অতিক্রম করেন, ফলে আমাদের নবীর বাহিনির সঙ্গে যুদ্ধ করার অবকাশ ছিল না। তাই, আমর বিন উদ মল্যযুদ্ধ্যের আহ্বান করেন। তখন আমাদের নবী আলিকে মল্য যুদ্ধে পাঠানোর মনঃস্থির করেন। যখন মল্যযুদ্ধ শুরু হয়, তখন এক বিশাল ধুলি ঝড়ের আবির্ভাব ঘটে এবং কে যুদ্ধে জিতছেন আর কে হারছেন বুঝা যাচ্ছিল না। হটাত করে যখন “আল্লাহু আকবার” শব্দ আসে তখন দেখা গেল হযরত আলি আমর বিন উদকে পরাস্ত করেন। আর ঠিক এই ধ্বনিতে শত্রু বাহিনী পিছু হটে যায়।

এবার শত্রু পক্ষের নজর চলে যায় এই বনু কোরায়জার দিকে যারা মদিনার ভিতরে নিরাপত্তায় লিপ্ত ছিল।। কোনভাবে যদি বনু কোরায়জাকে কনভিন্স করা যায় যে তারা আর আমাদের নবীর পক্ষে কাজ করবে না, তাহলে আবার শত্রুপক্ষ জিতে যাবে। এই ধারনা থেকে খায়বারিয়ান নেতা এবং বনু নাদিরের গোত্রের হুয়ায় ইবনে আখতাব কোরায়জার কাছে আসেন। রিউমার ছড়ানো হয় যে কোরায়জা বংশ এখন আমাদের নবীর পক্ষে নাই। আসলেও তারা নবীর বিপক্ষে কাজ শুরু করে দিয়েছিল মদিনার ভিতরে। এই খবরে আমাদের নবী শঙ্গিত হয়ে উঠেন। তার কারন হল তিনি তাঁদের উপর নির্ভর করে ঐ অংশে কোন প্রকার ডিফেন্সিভ পেরিমিটার গড়ে তুলেন নাই। চারিদিকে রিউমার ছড়িয়ে পড়ে যে, কোরায়জাররা মদিনায় আমাদের নবীর বিপক্ষে কাজ শুরু করেছেন এবং এতে মদিনাবাসি খুব বিপদের মধ্যে পড়ে যায়। এর বিপক্ষে আমাদের নবী ১০০ সাধারন আনসার এবং ৩০০ ঘোড়াবিহিন আনসার মোট ৪০০ জন আনসার মদিনায় মোতায়েন করেন যারা রাত্রে বেলায় অতি উচ্স্বরে নামাজ পরতেন যাতে এটা প্রমানিত হয় যে অনেক অনেক আনসার ইতিমধ্যে মদিনায় প্রবেশ করেছে। কিন্তু সত্য বলতে কি আমাদের আনসারগন ইতিমধ্যে তাঁদের শারীরিক কার্যক্ষমতা অনেকটা হারিয়ে ফেলছিলেন ক্রমাগত যুদ্ধের  কারনে। আমাদের নবী তখন ঘাতাফানকে এইমর্মে একটা চুক্তিতে আহবান করেন যে, তারা যদি মদিনা থেকে চলে যায়, তবে মদিনায় যে পরিমান খেজুর উৎপন্ন হবে তার তিন ভাগের এক ভাগ তাদেরকে ক্ষতিপুরন দেয়া হবে। কিন্তু মদিনার নেতারা আমাদের নবীর এই শর্ত মানতে রাজি হলেন না এবং যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অটল থাকলেন। এই সময় এক অভুতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেল।

আরবের একজন নেতা যাকে সবাই খুব সমিহ করতেন এবং মানতেন তার নাম নয়াম ইবনে মাসুদ। তিনি গোপনে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে যা কেউ জানত না শত্রুপক্ষ। সবার কাছে তিনি একজন গ্রহনযোগ্য মানুষ ছিলেন। তিনি প্রথমে গেলেন বনু কোরায়জার কাছে এবং বললেন, শত্রুপক্ষ (অর্থাৎ যারা আমাদের নবীর বিপক্ষে যুদ্ধ করছেন তারা), যদি কোন কারনে হেরে যায় তাহলে বনু কোরায়জাকে মোহাম্মাদের (সঃ) কাছে ফেলে রেখেই চলে যাবে এবং সেক্ষেত্রে সব কিছু যা মোহাম্মাদ (সঃ) বলবেন তাই হবে। তখন মদিনাবাসি শুধু বনু কোরায়জাকেই শাস্তি প্রদান করবে। সুতরাং বনী কোরায়জার উচিৎ অন্যান্য বংশের নেতাদেরকে এখন বনী কোরায়জার কাছে হস্টেজ হিসাবে রাখা যাতে যদি কোন কারনে তারা হেরে যায়, ঐ গোত্ররা বনী কোরায়জার লোকদের বিপদে ফেলে চলে যেতে না পারে।  একইভাবে তিনি শত্রু পক্ষের লোকদেরকেও এই বলে খবর দিলেন যে, বনী কোরায়জার লোকজন তাঁদের কিছু গোত্র নেতাদেরকে তাদের নিরাপত্তার জন্য হস্টেজ হিসাবে চাইতে পারে এবং না দিলে তারা মদিনার সাপোর্ট হিসাবেই থাকবে। এই তথ্য কাজে লাগলো, যদিও কোন তথ্যই সত্য নয়। এই দিকে আমাদের আনসারগন ধিরে ধিরে বনু কোরায়জার দলকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলল। ইতিহাস বলে যে, বনু কোরায়জাকে আমাদের দল প্রায় ২৫ দিন ঘিরে রেখেছিল এবং শেষমেশ তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় এবং শত্রুপক্ষের জন্য আর কাজ করে নাই। কিন্তু চুক্তি ভাঙ্গার কারনে বনু কোরায়েজের নেতাদেরকে হত্যা করা হয় এবং মহিলা ও শিশুদেরকে দাস হিসাবে গ্রহন করা হয়।

যাক সে ইতিহাস। সবাই আমরা তা জানি। এখন আর নাই বা বললাম আর।

তারপর আরাফায় গিয়েছিলাম। অবাক হওয়ার মত ব্যাপার যে, আমাদের নবী যেখান থেকে তার বিদায়ী ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটা একটা উচ্চ পাহাড় আর নাম হচ্ছে জাবালে রাহমাহ। অর্থাৎ রহমতের পাহাড়। প্রথমবার হজ্জের সময় আমার এই জায়গাটা দেখার সুযোগ হয় নাই কারন অনেক ভীড় ছিল এবং আমি আরাফার দিন যেখানে ছিলাম তার থেকে এই জাবালে রাহমাহ অনেক দুরেও ছিল। এবার হেটে হেটে ঐ জাবালে রাহমাতে উঠলাম। শরির শিউরে উঠে ঐ সময়কার কথা মনে করলে। কারন আমাদের নবী ঠিক যে জায়গাটায় দাড়িয়ে এই মানব উদ্দেশ্যে তার শেষ বিদায়ি ভাষণ দিয়েছিলেন তার স্থান দেখা এবং ঐ ভাষণ সম্পর্কে ভাবা একটা অদ্ভুত শিহরণ জাগে মনে। জানা যায় যে, প্রায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়েছিল ঐ ভাষনের সময় অথচ কোন মাইক ছিল না, এরপরেও সবাই আমাদের নবীর প্রতিটি কথা স্পষ্টভাবে শুনেছিলেন। এবার ওখানে গিয়ে আরও নতুন একটা তথ্য জানলাম। নবী করিম (সঃ) এর আগমনের বহু পূর্বে প্রায় হাজার বছর পূর্বে বাদশাহ হারুনের স্ত্রী একবার এই আরাফার ময়দানে এসেছিলেন কোন এক ধর্মীয় কারনে। তখন ঐ অঞ্চলে পানির খুব অভাব ছিল। বাদশাহ হারুনের স্ত্রী যখন এই পাহাড়ে এলেন তখন ঐ এলাকার বাসিন্দারা তাঁকে পানির ব্যবস্থার কথা জানালে তিনি তার স্বামী বাদশাহ হারুনকে পানির ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। বাদশা হারুন তার স্ত্রির এই অনুরোধ রক্ষার জন্য সুদুর ইরাক থেকে পানির লাইন টেনে এনে এই এলাকায় পানির ব্যবস্থা করেন যা এখন অবধি লাইনটা রয়ে গেছে। ওটা ছিল এক বিশাল কাজ কিন্তু বাদশাহ কাজটি করেছিলেন। বিকল্প পানির ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত এই পানির সাপ্লাই জারি ছিল এবং বর্তমানে ইরাক থেকে পানি আসছে না বটে কিন্তু ঐ একই পানির লাইন সউদি সরকার ব্যবহার করে সউদি থেকেই পানির সরবরাহ করে থাকে। বলা হয় যে, এই আরাফার ময়দান নাকি হাশরের ময়দানের সঙ্গে যুক্ত একটা ময়দান। হজ্জের সময় আরাফার ময়দানে থাকা ফরজ এবং মাগ্রেব পর্যন্ত এখানে অবস্থান করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু মাগরেব নামাজ এখানে পড়া নিষেধ। এই মাগ্রেব নামাজ পরতে হয় মুজদালেফায় এশার নামাজের সঙ্গে একত্রে। আমি আমর পুরান এক মেইলে হজ্জের বিস্তারিত ব্যাখ্যা লিখেছিলাম কেন কোন রিচুয়াল কিভাবে করা হয়। এখন আর এগুলো এখন লিখছি না।

জাবালে রাহমাহ থেকে আমরা চলে গেলাম মিনায়। যেখানে শয়তানের উদ্ধেস্যে পাথর মারা হয়। আমি জায়গাটা আগেই দেখেছিলাম হজ্জের সময় কিন্তু এবার যে দুইটা জায়গা নতুন করে দেখলাম তা হচ্ছে আবাবিল পাখির দ্বারা পাথর মারার স্থানটি। আবাবিল পাখির ঘটনাটি নিশ্চয়ই আমরা সবাই জানি। তারপরেও আমি একটু পিছনের কাহিনি টানতে চাই সবার মেমোরি ফ্রেশ করার জন্য। ঘটনাটির অবতারনা ঘটে এইভাবে।

আমরা জানি আবু তালিব যদিও শেষ পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন নাই কিন্তু তিনি ইসলামের অন্যতম একজন প্রটেক্টর ছিলেন। তিনি আমাদের নবীকে সর্বত্র সাহায্য করেছেন এই ইসলাম সম্প্রসারণের জন্য। একদিন তিনি তার এই ভাতিজাকে বললেন, হে ভাতিজা, তুমি কি শুধুমাত্র আমাদের কুরাইশ বংশের জন্য প্রেরিত হয়েছ নাকি সমগ্র মানব জাতির জন্য? আমাদের নবী বললেন, আমি সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছি হোক সে সাদা, বা কালো, বলুক সে আরবি ভাষা অথবা অন্য কোন ভাষা, থাকুক সে পাহাড়ে বা সমুদ্রের নিচে, হোক সে বিধর্মী বা না কোন ধর্মের, হোক সে ধনী বা গরিব, আমি সবার জন্য প্রেরিত হয়েছি। এই কথা শুনে কুরাইশ এক সদস্য আবু তালিবকে বললেন, শুনেছ তোমার ভাতিজার কথা? যদি এখন পার্সিয়ান বা রোমের লোকজন এই কথা শুনে তাহলে তো এখনই তারা আমাদের সবকিছু ধংশ করে নিয়ে নিবে এবং তারা আমাদের এই কাবা ঘর যাকে উদ্দেশ্য করে আমাদের ব্যবসা পরিচালিত হয় তারা তা ভেঙ্গে দিবে। তখন এই সুরার আবির্ভাব হয় এবং তার ইতিহাস জানানো হয়।ইতিহাসটা এই রকমঃ

আমাদের নবীর জন্মের কিছুদিন আগে এই হাতি এবং আবাবিল পাখীর ঘটনাটি ঘটে।

ইয়েমেনের আশেপাশের এক রাজা যার নাম ছিল ঢু-নয়াজ। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বদমেজাজি এক রাজা এবং জুলুমকারী। তিনি ছিলেন ইহুদী ধর্মের। তিনি চেয়েছিলেন যে, তার রাজ্যে সব অধিবাসী যেনো ইহুদী ধর্মে দিক্ষিত হয়। আর যারা দিক্ষিত না হবে, তাদেরকে তিনি বিখন্ডিত করেন। এর মধ্যে ছোট এক বালক যার বাড়ি ছিল ইয়েমেনেরই দেশে নাজরান প্রদেশে। পিতামাতা তাঁকে যাদুবিদ্যা শিখার জন্য এই ছোট বালককে নাজরান থেকে ইয়েমেনের শহরে পাঠাতেন প্রতিদিন। পথিমধ্যে এই বালক ক্রিস্টিয়ান এক বৃদ্ধের দেখা পান যিনি খুব ভাল যাদুবিদ্যা জানতেন এবং সব ধরনের রোগ মুক্তির মন্ত্র জানতেন। ফলে ঐ বালকটি গোপনে ঐ বৃদ্ধার কাছে যাদুমন্ত্র এবং রোগমুক্তির বিদ্যা অর্জনে ক্রিস্টিয়ানিটিতে দিক্ষিত হওয়া শুরু করে। এই খবর দ্রুত সবার কাছে পৌঁছে যায়, ফলে রাজা ঢু নুঅয়াজ অতি দ্রুত ঐ বৃদ্ধাকে বিখন্ডিত করেন এবং এই ছোট বালকটিকেও বিখন্ডিত করার আয়োজন করেন। বালকটিকে বাঁধা হয় এবং তীরন্দাজ দ্বারা তাঁকে তির মারা শুরু হয় কিন্তু কোন তীরই তাঁকে স্পর্শ করতে পারছিলো না। ওখানে যতলোক জড়ো হয়েছিল, এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেল, সঙ্গে রাজা নিজেও। তখন বালকটিকে জিগ্যেস করা হল, কেন তাঁকে তীর দিয়ে মারা যাচ্ছে না। বালকটি তখন উত্তর করেছিল যে, তাঁকে মারা একমাত্র সম্ভব যদি ক্রিস্টিয়ান লর্ডের নাম ধরে তাঁকে মারা হয় এবং রাজ্যের অধিকাংশ লোক যদি তার এই তীর মারার দৃশ্য অবলোকন করে তাহলেই তাঁকে মারা সম্ভব। তার এই নির্দেশনা মোতাবেক প্রায় ২০ হাজার লোক অবলোকন করে এবং যারা যারা এই দৃশ্য অবলোকন করে তারা প্রায় সবাই এক সঙ্গে বালকটির নতুন ধর্ম ক্রিস্টিয়ানিটিতে রূপান্তরিত হয়। রাজা ঢু নুঅয়াজ ক্ষিপ্ত হয়ে ঐসব ২০ হাজার মানুষকেই একসঙ্গে গর্ত করে মেরে ফেলেন। কোরআনে এই “People of the Ditch” উপাখ্যানে একটি আয়াত আছে। এই সময় একলোক ঐ স্থান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং সে রোমের রাজার কাছে আশ্রয় চান। রোমের রাজা ছিলেন ক্রিস্টিয়ান। তিনি এই তথ্য জেনে খুব রাগান্বিত হন এই জন্য যে, শুধুমাত্র ক্রিস্টিয়ান ধর্মে দিক্ষিত হওয়ার কারনে রাজা ঢু নুঅয়াজ এতগুলো লোককে মাটিতে পুতে মেরে ফেললেন? তিনি আবিসিনিয়ার রাজাকে চিঠি (তিনিও ক্রিস্টিয়ান ছিলেন) লিখেন যাতে তিনি রোমের সঙ্গে এক হয়ে ইয়েমেনকে আক্রমন করে প্রতিশোধ নেয়। তাই হলো। আবিসিনিয়ার রাজা (আবিসিনিয়া বর্তমানে ইথিওপিয়া নামে পরিচিত) নাজাশি এবং রোমের রাজা একত্রে ইয়েমেন আক্রমন করার পরিকল্পনা করেন। এই কম্বাইন্ড যুদ্ধের জেনারেল ছিলেন রোমের জেনারেল আরিয়াত। আক্রমণ ঠেকাতে না পেরে ইয়েমেন হেরে যায় এবং রাজা ঢু নুঅয়াজ নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। জেনারেল আরিয়াতের (রোম জেনারেল) দখলে চলে আসে ইয়েমেন। রোমের এই জেনারেল ছিল অত্যন্ত কঠিন লোক এবং তিনি ইয়েমেনের ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করলেন। কিন্তু আবিসিনিয়ার আরেক জেনারেল যিনি এই যুদ্ধে রোমের জেনারেল আরিয়াতের সঙ্গে যুদ্দ করেছেন তিনি জেনারেল আরিয়াতের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়ে উঠেন, তার নাম আব্রাহা। তিনি রাজা নাজাশির লোক। পুরু সেনাবাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং প্রায় আত্মঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই আত্মঘাতী পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য জেনারেল আরিয়াত এবং জেনারেল আব্রাহা মল্যযুদ্ধে রাজি হন। শেষ পর্যন্ত আব্রাহা জয়ী হয়। কিন্তু রাজা নাজাশি তার জেনারেল আব্রাহার এই কর্মে খুশি হননি এবং নিজে আরও বেশি সেনাবাহিনী নিয়ে জেনারেল আব্রাহা উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। রাজা নাজাশি বার্তা পাঠালেন যে, যখন তিনি জেনারেল আব্রাহার সঙ্গে দেখা হবে, তখন তিনি তার মাথার চুল ছেটে দেবেন এবং ইয়েমেনের রাজা হওয়ার শখ তিনি মিটিয়ে দেবেন ইয়েমেনের মাটিতে তার মাথা পুতে। জেনারেল আব্রাহা ছিল খুব বুদ্ধিমান। তিনি এই খবর শুনে তিনি নিজেই আগে ভাগে তার মাথার চুল ছেটে ইয়েমেনের মাটি তার মাথায় মেখে একটি ছোট বার্তা পাঠালেন যে তিনি সব সময় রাজা নাজাশির অনুগত আছেন এবং তিনি যা বলবেন সেটাই চূড়ান্ত। এই বার্তায় রাজা নাজাশি খুব খুশি হলেন এবং রাজা নাজাশি জেনারেল আব্রাহাকে ইয়েমেনের শাসক বানিয়ে দিলেন। রাজা নাজাশিকে জেনারেল আব্রাহা খুশি করার জন্য নতুন শাসক জেনারেল আব্রাহা ঘোষণা করলেন যে, তিনি ইয়েমেনে রাজা নাজাশির নামে এক নতুন কাবা ঘর তৈরি করবেন (বহু বছর যাবত আমাদের এই কাবা ঘর ছিল সব ধর্মের কেন্দ্রস্থল এবং ব্যবসার কেন্দ্র)।  ইয়েমেনের নতুন রাজা জেনারেল আব্রাহা নতুন এক কাবাঘর তৈরি করলেন এবং সব ধর্মের লোকদেরকে এই নতুন কাবা ঘরের মধ্যে তাদের উপাসনালয় স্থাপন করে দিলেন এবং এটা হয়ে উঠল ব্যবসার আরেক কেন্দ্রস্থল। এতে আরববাসি খুব খুশি হলেন না।

এই অখুশির জের ধরে এক আরব একদিন ঐ নতুন চার্চের ভিতরে পায়খানা করে তার প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করলেন। রাজা আব্রাহা এতে এতটাই ক্ষিপ্ত হলেন যে, তিনি আরবের পুরাতন কাবা ঘর ভেঙ্গে দেবার পরিকল্পনা করলেন। তিনি বিরাটকায় হাতিসমেত (এই হাতিগুলোর নাম ছিল “মামুদ”) পুরাতন কাবা শরীফ ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে মক্কায় রওয়ানা হলেন এবং কোন শক্তিই তাঁকে থামাতে পারছিল না। কিন্তু কাবা এলাকার কাছাকাছি এসে তিনি কাবাবাসির কাছ থেকে কোন প্রকার সাহায্য পেলেন না। এবং তিনি কাবার প্রকৃত লোকেশনও জানতেন না। শেষে তাইফের এক বাসিন্দার সাহায্য নিয়ে তিনি মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তাইফের এই বাসিন্দার নাম ছিল আবু রজাল। তাঁকে নিয়ে যখন আব্রাহা মক্কার দিকে আসছিলেন, পথিমধ্যে আবু রজাল মারা যায় এবং তাঁকে মক্কা ও তাইফের মাঝামাঝি জায়গায় কবর দেয়া হয়। বর্তমানে যে কোন লোক যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁকে আবু রজালের ভাই বলে আরবে সম্বোধন করা হয়। আমাদের মিরজাফরের নামের মত।

যে কোন ভাবেই হোক, আব্রাহা মক্কার কাছাকাছি চলে আসেন এবং প্রায় ৬-৭ কিমি দূরে তিনি তার ক্যাম্প স্থাপন করেন রাত্রি যাপনের জন্য এবং তিনি আদেশ দেন যে, তাদের খাবার মজুত করার জন্য মক্কার আশেপাশের যত হাস মুরগি, উঠ, গরু, ছাগল আছে তা হস্তগত করো। এই হস্তগত অপারেশনের জেরে আমাদের নবীর দাদা আব্দুল মুত্তালিবের ২০০ উঠও আব্রাহার বাহিনী ক্যাপচার করেন। আব্দুল মুত্তালিব তার ২০০ উঠ ফিরে পাবার জন্য আব্রাহার ক্যাম্পে যান। আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন দেখতে খুব সুন্দর, লম্বা এবং ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোক। তাঁকে দেখে আব্রাহার মধ্যে একটা সম্মান দেখানোর মনোভাব তৈরি হল এবং আব্রাহা তার রাজ আসন থেকে নেমে এসে মাটিতে বসে আব্দুল মুত্তালিবের সঙ্গে কথা বললেন। আব্রহা জানতে চাইলেন কি কারনে আব্দুল মুত্তালিব তার কাছে এসেছে। আব্দুল মুত্তালিব বললেন যে, আব্রহার লোকজন তার ২০০ উঠ নিয়ে এসেছে, সেটা তিনি ফেরত চান। এটা শুনে আব্রহা খুবই অবাক হলে এই কারনে যে, এত ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে আব্দুল মুত্তালিব তার কাছে এসেছে? যেখানে এতলোক কাবাঘর রক্ষার প্রানপন চেষ্টা করছে আর সেখানে আব্দুল মুত্তালিব কাবাঘর নিয়ে কোন প্রকার অনুরোধ বা সংশয় প্রকাশ না করে শুধুমাত্র তার ২০০ উঠের জন্য অনুরোধ করছে? আব্রহা আব্দুল মুত্তালিবকে বললেন, আমি খুব অবাক হচ্ছি যে, সবাই যেখানে কাবাঘর রক্ষায় মারা যাচ্ছে, সেখানে আব্দুল মুত্তালিব কাবাঘর রক্ষার কোন অনুরোধ করলেন না কেন? আব্দুল মুত্তালিব বললেন, আমি ২০০ উঠের মালিক, ঐ ২০০ উঠের নিরাপত্তা আমার উপর বর্তায়। আর কাবাঘরের মালিক “লর্ড” নিজে। লর্ড যদি তার কাবাঘর রক্ষা করতে না পারেন, আমার কি করার আছে? আব্রহা তার ২০০ উঠ ফেরত দিলেন এবং বললেন যে, সবাইকে বলে দিন, আগামিকাল আমি কাবা ঘর গুড়িয়ে দেব, কেউ যেন আশেপাশে না থাকে।

আব্দুল মুত্তালিব তার ২০০ উঠ নিয়ে ফিরে এলেন এবং সবাইকে আব্রাহার ঘোষণা শুনিয়ে নিকটবর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নিলেন পরদিন কি হয় দেখার জন্য। পরদিন আব্রাহা তার হাতিগুলোকে কাবাঘরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন কিন্তু হাতি সামনের দিকে এক কদমও এগুলো না। সবদিকে হাতি যেতে পারছে কিন্তু কাবার দিকে অগ্রসর হতে চাইছিল না। অনেক চেষ্টা করার পরও যখন হাতি নড়ছিল না। তখন হাতিগুলোকে আব্রাহা পাথর দিয়ে আঘাত করতে শুরু করল, তাতেও কোন কাজ হচ্ছিল না। দুপুরের দিকে হটাত করে আবাবিল পাখি মেঘের মত উড়ে এল, সবার দুই পায়ে দুইটা এবং ঠোটে একটা করে মাটির ঢিলা। এই তিনটা করে মাটির ঢিলায় সমস্ত হাতি এবং সৈন্য সামন্ত পরজদুস্থ হয়ে উঠল। শুধু তাই নয়, তারপর শুরু হল বৃষ্টি। মাটি গলে গিয়ে সবাই কাদামাটিতে পুতে গেল এবং তারা আর ওইখান থেকে ফিরে আসতে পারেনি। আব্রাহাসহ সব বাহিনী মারা যায়। আমাদের নবী যখন মাতৃগর্ভে দুই মাসের বয়স, তখন এই ঘটনা ঘটে।

বর্তমানে মিনায় যাওয়ার পথে এই জায়গাটা পড়ে এবং একে অভিশপ্ত জায়গা বলে উল্লেখ করা হয়। সাধারনত কেউ ঐ জায়গা দিয়ে যাতায়ত করতে চায় না। আর অগত্যা করলেও খুব ভয়ে এবং ঘৃণায় যায়। ঠিক এর পরেই ইয়ামেনকে দখল করে পার্সিয়ানরা। 

মদিনা থেকে ৩০ তারিখে আমরা মক্কায় চলে গেলাম। ঐ রাতেই আমি ওমরা শেষ করেছি। মদিনা থেকে এহরাম বেঁধে নিয়েছিলাম।  আমি খুব ভাগ্যবান যে আমার হোটেলটি ছিল, সেটা মক্কার সঙ্গে একদম লাগোয়া। মানে আমার রুম থেকেও মক্কার জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা যায়। হোটেল জমজম। আমার রুম থেকে কাবার ঘর সরাসরি দেখা যেত। এরজন্য আমাকে একটু বেশি ভাড়া গুনতে হয়েছিল বটে কিন্তু আমি খুব আনন্দে ছিলাম এইজন্য যে, হারাম ভিউ পেয়ে। খুব বেশি নড়াচড়া করিনি, সবগুলো নামাজ মক্কা শরিফে গিয়ে পড়ার সুযোগ হয়েছে। মোট পাঁচ বার ওমরা করেছি এই সময়ে। আর প্রতিদিন কয়েকবার করে তাওয়াফ করেছি পবিত্র কাবাঘরকে। মন ভরে এবাদত করেছি যতক্ষন মন চেয়েছে। সবার জন্য দোয়া করেছি।

একদিন শুধু বের হয়েছিলাম মক্কায় বিখ্যাত ইসলামিক জায়গাগুলো দেখার জন্য। তার মধ্যে ছিল আরাফার ময়দান, মুজদালিফা, মিনা, তায়েফ শহর, হেরা গুহা। ইত্যাদি। তায়েফ শহরে গিয়ে আমি ঐ জায়গাগুলো দেখার চেষ্টা করেছি যেখানে ঐ বুড়ি যিনি আমাদের নবীর পথে কাটা বিছিয়ে রাখতেন, ঐ মসজিদ যেখানে আমাদের নবীকে আহত হতে হয়েছিল।

তায়েফের ঘটনা আমরা সবাই হয়ত জানি। সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেছেন আমাদের নবী এই তায়েফ শহরে ইসলামকে প্রচার করতে গিয়ে। তার সঙ্গে তার পালক পুত্র জাইদ (রাঃ) ছিলেন তায়েফে ইসলাম প্রচারের জন্য। তায়েফের লোকজন সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছিলেন আমাদের নবীকে। তার সারা শরীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, তার দন্ত মোবারক শহিদ হয়েছিল এই তায়েফে। তার কষ্ট দেখে জিব্রাইল (আঃ) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি শুধু প্রকাশ করেন এবং অনুমতি দিন, আমি আল্লাহর কাছ থেকে আদেশ প্রাপ্ত হয়েছি, আপনার অনুমতি পেলে আমি নিমিষের মধ্যে এই তায়েফের লোকজনসহ তায়েফ নগরীকে ধ্বংস করে দেই। তখন আমাদের নবী জিব্রাইলকে বলেছিলেন, যদি সব মানুষদেরকে ধংশই করে দেই, তাহলে আল্লাহকে এবাদত করবে কে? একদিন এই তায়েফ নগরির সব মানুষ ইসলাম গ্রহন করবে। তায়েফ শহরটি খুব সুন্দর এবং সত্যি দেখার মত। পাহাড়ের উপরে একটা চমৎকার শহর। 

মক্কায় অবস্থিত জান্নাতুল মাওয়া (কবর স্থান) দেখলাম। হজ্জের সময় খুব ভাল করে দেখার সুযোগ হয় নাই। এখন বর্তমানে অনেক কিছু পরিবর্তন এসেছে। মহিলাদের যাওয়ার সুযোগ নাই। কবর গুলোর ব্যাপারে কিছু বলি।

এখানে যাদের কবর দেওয়া হয় তাদের জন্য আগে থেকেই ইটের কবর বানানো আছে। প্রতি ওয়াক্তেই দাফন করার কাজ চলে। আমি যেটা শুনেছি যে, একটা কবর প্রায় এক বছর পর্যন্ত ইনট্যাক্ট অবস্থায় রাখা হয়। পরের বছর ঐ কবরটা আবার খোলা হয়। যদি কোন লাশ অবিকৃত অবস্থায় থাকে, তাহলে ঐ কবরটা একেবারে শিল্ড করে দেওয়া হয়, ঐ কবরের মধ্যে আর কোন লাশ দাফন করা হয় না। ধরে নেওয়া হয় তিনি শহিদ বা তাঁকে আর কোন ডিস্টারবড করা যাবে না। আর যেগুলোতে লাশ পচে যায়, শুধু সেগুলোতে আবার নতুন লাশ দাফন করা হয়। এইভাবে অনেক কবর একদম বন্ধ করে দেওয়া হয়ে গেছে।  আমি কয়েকটা ছবি দেখাই। তাহলে বুঝতে পারবে। কোন কবরের কোন প্রকার ডেকোরেশন নাই।

৮ তারিখে আমরা ঢাকায় ফিরে আসার জন্য জেদ্দায় রওয়ানা হলাম। দুপুরের দিকে জেদ্দায় আমার এক বন্ধুর বাড়িতে উঠলাম। সে খুব সাদরে আমাদের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখালো তার গাড়ি দিয়ে। তাঁকে আমি আগে থেকে চিনতাম না। ঢাকার উত্তরার মসজিদের খতীব জনাব মামুন সাহেবের পরিচিত। আমাদেরকে ঐ ভদ্রলোক তার নিজের গাড়ি পাঠিয়ে মক্কা থেকে নিয়ে গেলেন। তিনি বিন লাদেন কোম্পানির একজন এনলিস্টেড কনট্রাক্টর ইঞ্জিনিয়ার। অনেক জায়গা দেখালেন। শেষমেশ নিয়ে গেলেন মা হাওয়ার কবর স্থানে। বিশাল একটা কবরস্থান। খুব ভাল লাগলো দেখে। জেদ্দায় যেখানে শিরচ্ছেদ করা হয় কোন আসামির, সেই মসজিদে নিয়ে গেলেন এবং যেখানে শিরচ্ছেদ করানো হয় সেই জায়গাটা দেখালেন। ভয় লাগছিল ভাবতে। প্রতি শুক্রবারে এই স্থানে কোন আসামিদের শিরচ্ছেদ করার রেওয়াজ আছে এখানে এবং প্রকাশ্যে।

রাত ৩;৪৫ মিনিটে আমরা এয়ারপোর্ট আসলাম এবং তারপর ঢাকায়। আলহামদুলিল্লাহ। 

১২/১১/২০১৪- লুতফর আমার বন্ধু

বৃহস্পতিবার, গোলারটেক, মিরপুর

গত তিন চার দিন আগে আমার ক্যাডেট কলেজের এক বন্ধুর জন্মদিন ছিল। ওর নাম লুতফর রহমান। আজকাল মেইল থাকার কারনে কেউ আর জন্মদিনের কার্ড পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানায় না, মেইল বা এসএমএস দিয়েই কাজটা শেষ করে ফেলে। অত্যাধুনিক সিস্টেম। কুলজাত দুটুই রক্ষা হয়। কুলজাত দুটুই রক্ষা হলেও বন্ধুত্তের মাঝে এই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারের ফলে আগের মত আর আবেগের স্থানটুকু থাকে না। কেউ ফিরতি একই ম্যাসেজ দিয়ে দায়িত্তটা পালন করে বড় একখান থ্যাংস জানিয়ে এমন একটা ভাব প্রকাশ করে যেন না জানি কত খুশি হয়েছি। যাক সে কথা, যুগ পাল্টেছে, যুগ আরও পাল্টাবে, ভবিষ্যতে আরও কি হবে তা আর গবেষণার প্রয়োজন বোধ করি না আমার এই লিখার ভিতরে। কিন্তু লুতফরের জন্মদিনে ওকে মেইল করলেও ও আর এগুলোর ধার ধারে না। ও মেইল খুলে না, মেইল পাঠায় না, মেইল পরেও না। ও আর জন্মদিনই পালন করে না। ও পালন করে মৃত্যু দিন। ও হয়ত তাও করে না।

বিডিয়ারের সেই ভয়াবহ এক নৃশংস হত্যাকান্ডে ওর মধ্যবয়সী জীবনটা বলি দিতে হয়েছে। সেদিন ছিল ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ ২০০৯ সাল। আমি যথারীতি অন্যান্য দিনের মত মাত্র ফ্যাক্টরিতে এসেছি। অন্যান্য দিনের মত আমার পিওন এক কাপ ব্ল্যাক কফি দিয়ে বলল, “স্যার, আজকে কি আপনার মেহমান দুপুরে খাবে নাকি সন্ধ্যায় নাস্তা খাবে, কোনটা?” আমি কিছুটা কনফার্ম না করেই বললাম, “দুটুই মাথায় রাখ”  আসলে মেজর হায়দার আমার এখানে আসবে, আজ ওদের দরবার আছে, দরবার শেষ করেই হয়ত আমার এখানে আসার কথা। 

সকাল নয়টার দিকে আমার আরেক বন্ধু আমাকে ফোন করে জানতে চাইল পিলখানায় বিডিআর হেডকোয়ার্টসের ভিতর কিছু হচ্ছে নাকি? ব্যাপারটা আমারও জানা ছিল না। আমি জেনে জানাচ্ছি বলে ফোন কেটে দিয়ে অনেককেই ফোন করলাম। কিন্তু কারো কোন ফোনের মধ্যে ঢোকতে পারছিলাম না। লুতফরকে ফোন করলাম, আবতাবকে ফোন করলাম, না পেয়ে ১৯ লং কোর্সের মেজর হায়দারকেই ফোন করলাম, কারো ফোনই খোলা নাই। একটু অবাক হচ্ছিলা, আবার একটু শঙ্কিতও হচ্ছিলাম। কাউকে না পেয়ে আবার আমি আমার ঐ বন্ধুকেই ফোন করলাম যে একটু আগে আমাকে ফোন করেছিল। ওকেই জিগ্যেস করলাম, আসলে কি শুনেছে ও। ও যা বলল, তাতে আমার একটুও ভাল লাগলো না বরং একটা সাংঘাতিক শঙ্কায় পরে গেলাম। বিডিআর পিলখানায় নাকি সৈনিক আর অফিসারদের মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে। একি কথা!! কি করে সম্ভব এটা? মাঝে মাঝে যে কি হয় মানুষগুলোর, কি কারনে যে হটাত করে সব ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে একে অপরের উপর এমন আচরন করে যে, গতকাল যে মানুষটির সঙ্গে এক সাথে চা খাওয়া হয়েছিল, যার সঙ্গে এক বিছানায় বসে গল্প করা হয়েছিল, যে তাঁর নিজের সুখের বা দুঃখের কতই না কথা একে অপরের কাছে অকপটে ভাগীদার করেছিল, সে আজ কেন বা কি কারনে একেবারে অচেনা হয়ে হিংস্র বাঘের মত, উম্মাদ সিংহির ন্যায় উম্মত্ত আচরনে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়ে একে অপরের প্রান নিতেও অনুশচনা করছে না। মানুষ এমনি এক প্রানি যার পাশে একটা মাত্র “অ” যোগ করলেই তাঁর আমুল সব চরিত্র বদল হয়ে যায়। সে আর মানুষ থাকে না, হয়ে উঠে “অমানুষ” যার সংজ্ঞা প্রানিকুলের কারো কাছেই নাই।

বিডিআর এর হেডকোয়ার্টার এর ভিতর সৈনিক বনাম অফিসারের মধ্যে প্রানঘাতি সংঘাত হচ্ছে বলে টিভির স্ক্রলে দেখাচ্ছে কিন্তু কি হচ্ছে, কার কি অবস্থা, তাঁর কেউ সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারছে না। সবাই তো স্বসস্ত্র, সবাই তো ট্রেনিংপ্রাপ্ত। আমার খুব টেন্সন হতে লাগলো। এই তো গত ২৩ তারিখে আমি বিডিআর এর ভিতরে গিয়েছিলাম। দেখা হয়েছে লুতফরের সঙ্গে। ওর অফিসে চা খেলাম, গল্প করলাম। আমি গরম গরম পুড়ি পছন্দ করি, তাই কোথা থেকে যে ঐ অবেলায় পুড়ি নিয়ে এলো, ভাবাই যায় না। লুতফরের ভবিষ্যতের কত প্ল্যান শুনলাম। সঙ্গে মেজর হায়দার ছিল। এই ছেলেটি কখনো আমাকে স্যার বলত না। বলত “বড়দা”। এক সঙ্গে ৭ ফিল্ড রেজিমেন্টে কাজ করেছি প্রায় দুই বছরের বেশি। সাভারে থাকাকালীন আমি ৬ ফিল্ডে আর হায়দার ১৫ ফিল্ডে। সিনিয়রদের সঙ্গে ন্যায় অন্যায় নিয়ে তর্কের কোন শেষ ছিল না তাঁর। কিন্তু জুনিয়রদের বেলায় ঠিক আমার মতই উদার, সেই উদারতার কোন শেষ লিমিট ছিল বলে আমার জানা ছিল না। গল্পের টেবিলে হায়দার আমাকে বলল, “বড়দা, এই পাসিং আউট প্যারেড শেষ হলেই আমার চাকুরির জীবন ইতি করবো, অফিসে আমার জন্য একখান চেয়ার রাখবেন।” আমি এই ছেলেটাকে যা বলতাম, কোন প্রশ্ন ছাড়া, কোন তর্ক ছাড়া, কোন লজিক ছাড়া মানতে কখনো দিধাবোধ করত না। আমার বড় প্রিয় একজন অফিসার ছিল এই হায়দার। আমাদের আর্ট টিচার শুজা হায়দার স্যারের ছেলে।

সারাদিন খুব টেনশনে থাকছি আর ক্ষনেক্ষনে এখানে সেখানে ফোন করছি জানার জন্য কোথায় কি হচ্ছে। শুনলাম, বিডিআর এর ভিতর সৈনিকেরা অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। অনেক অফিসারদেরকে নাকি জিম্মি করে তাঁদের পরিবারের উপর নির্যাতন করছে। কোন কিছুই ভাল লাগছিল না। দুপুর আনুমানিক তিনটার দিকে একটা ছোট্ট ম্যাসেজ পেলাম। মেজর হায়দারের ফোন থেকে। ”স্যার, মাফ কইরা দিয়েন”। আমার সারা শরীর একটা কাপুনি দিয়ে উঠল। আমি যেন কিছুই পরতে পারলাম না। কি লিখেছে হায়দার? ও কি বলতে চেয়েছে? আমি ফোনব্যাক করলাম। কোন রিস্পন্স পেলাম না, ফোনটা বন্ধ আবারও। বড় অসহায় মনে হল আমাকে। কোথায় যেন একটা ভীষণ ব্যাথা অনুভব করছি। কাকে বলব? কি বলব? কেউ তো কিছুই বলতে পারছে না। এই টেনশনের মধ্যেই আমি আমার অফিসিয়াল কাজের জন্য সেই গাজীপুর আছি। প্রায় রাত হতে যাচ্ছে। কোন খবর পাচ্ছি না।

হায়দারের প্রসংগটা পরে আসি। যা বলছিলাম তা হচ্ছে লুতফরের জন্মদিনের মেইল। আমার এক বন্ধু তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে একটা মেইল করেছে, “লুতফর, আমি জানি তুমি ভাল আছ, ঈশ্বরের কাছে আছ, তারপরেও আজ তোমার এই জন্মদিনে তোমাকে জানাই একরাশ শুভেচ্ছা। ভাল থেক। আমরা সবাই ভাল আছি।” লুতফর আদৌ এই মেইলটা পরার আর কোন সুযোগ বা অবকাশ আছে কিনা আমার জানা নাই তবে ওর জন্মদিনে আমারও খুব ওকে শুভেচ্ছা জানাতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু সেটা হবে নিতান্তই একটা লেখা, ও ওটা পরার কোন অবকাশ আর নাই।

জীবন যখন বিদ্রোহি মৃত্যুর কাছে পরাজয় বরন করে, তখন স্বপ্ন গুলি আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠে না। তাদের কবর রচিত হয় সেই অপ মৃত্যুর সাথে যা কেউ কখনো ভাবে নাই, বা কোনো হোমওয়ার্কও করে নাই। আমরা সবসময় হোম ওয়ার্ক ছাড়াই দিন শুরু করি।

১১ মে ২০১৪-হাসনাবাদ, ইকুরিয়া, ঢাকা

অনেকদিন পর আবার একটু ডায়েরি লিখতে ইচ্ছে হল। এই অভ্যাসটা আমার এক কালে ছিল এবং প্রায়ই ডায়েরি লিখতাম। কিন্তু ইদানিং কাজের চাপে, কম্পিউটার যুগে আর ঘটা করে ডায়েরি লিখা হয় না।

আজ সারাদিন মোটামোটি বেকারের মত দিনটা কাটাচ্ছি। কাজ আছে কিন্তু ঐ রকম প্রেসার নেই। খবরের কাগজ বাসায় ও পরেছি আবার অফিসে এসে অন্য একটি খবরের কাগজও পড়লাম। সামনে অডিট, অনেকগুলো অডিট। কুয়ালিটি অডিট, ACCORD এর অডিট, আবার SGS অডিট। কোনটাই কারো থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আজ মুর্তজা ভাই অফিসে আসেন নাই। ওনি এলে কথাবার্তা বলা যায়, আবার অনেক কাজও হয়। একা একা আসলে কাজে মন জুড়ে না। মুর্তজা ভাই ইদানিং শারীরিক ভাবে একটু অসুস্থ থাকছেন প্রায়ই। এটা ভাল লক্ষন নয়। তবে খুব গুরুতর কিছু না মনে হয় ইনশাল্লাহ, ঠিক হয়ে যাবে।

লাক্সমা নিয়ে একটু ঝামেলায় আছেন, আমরা আবার রিভার সাইড নিয়েও বেশ ঝামেলায় আছি। আমার সবচেয়ে বেশী চিন্তা হয় লাক্সমাকে নিয়ে। মুর্তজা ভাই যাদের কে নিয়ে লাক্সমায় ব্যবসা করেছিলেন, তিনি হয়ত তাদেরকে পূর্বে ভাল করে স্টাডি করতে পারেন নি, এখন টার বুঝার কোন বাকী নেই কখন একজন মানুষ হটাত করে অমানুষ হয়ে যেতে পারে। আমি সর্বাত্মক চেস্টা করছি যেন, মুর্তজা ভাই এই অনাকাঙ্ঘিত সমস্যা থেকে দ্রুত রেহাই পান।     

০৩/০৯/২০১৩-মাসুদ রিমুনাকে চিঠি

০৩/০৯/২০১৩- মাসুদ এবং রিমুনাকে লিখা চিঠি

 

Dear Masud and Rimona

It was indeed a great time for me and my family to have you within us even for a short time. We thank Almighty that we had the blessings to have kid like you in our family who gave us peace in mind with your good gestures and attitudes. Definitely it was a nice and remarkable tour that you presented us. In fact, after all this hassle and many disturbances in your present tour in Bangladesh, I will like to address it as a big lessons both for you and us. Let this mail be read by your great mom and Dad whom I always wanted as part of my souls and in deed they are.

Masud, this mail is very important to let you know about yourself from me and as well as from my family though I didn’t talk to other members while writing this mail on behalf of them. But I know if they read my mail, they will never accuse me about what I posses inside me. Before I write you anything, let me write something about my own experiences in my life.

I told you that after I married your aunty, literally I broke up with whole of my family and it was the most crucial event in my life because in one side I was loving them and in another side I was unable to let your aunty go away from my life. It was a state of anxiety both in mental and physical. I didn’t know if I am taking the right decision. I wasn't sure if I was in the right path. Constantly I was monitoring myself both from a perspective of Major Akhtar and from the perspective of non-Major Akhtar.

I clearly understood that many people love me for many reasons, and not only for beauty or anything. Some loved me fearing God, someone loved me as I was a good person, someone loved me because I help them, and some one loved me because I was a loveable person. All these loves were no meaning to me except the love I always wanted from your Dad and from my family. Still I had the prayer for them to God that I get back the love from them. It took almost 25 years time to understand that they truly loved me even they never expressed it open. I have no confusion now about their loves and sympathy. But within these time frame, I learnt something. , my life had changed; I learnt growing experience for me. It posed as opportunity for learning and growing coz I learned to do things by myself. I learned to have fun by myself. I discovered things I like doing and ways I could be of help to others. And I had been able to distinguish my priorities. The most wonderful thing that happened was that I learned how to be a whole person. I was able to find meaning in life. I learned my lessons well and I believed that when we've learned our lessons well, we moved on to higher or more advanced stages of development. Those events lead me to where I am now. But I was never a complete man without a family where there is a brother for whom I am here, there are sisters for whom I grew well, there is a village from where I stood up. After all this, I felt truly alone. Even many are beside me but still I was alone. A surge of fear gripped me. I was scared to be alone because I was used always to of having them around me all the way, in dreams, in thoughts, in imagination and what not. I didn't know how I would be able to cope life without them. I didn't know what life would be without them especially my mother and your dad and his family where you were also a part, Yusuf is also a part.  I felt like something had been torn from me, like I was no longer whole because I always found my other half when I was with my family. I was hurting so bad. But I had faced the reality knowing that I will, possibly, never again share a joke with them, ask a question only that they can answer, talk to then, be with them or even make loving smile with them. I had faced those things in order to survive and cope life even if it was utterly heart-wrenching.

Through that event, I realized that life is unstable. That life is unsure because I never thought I would be able to survive and cope. I never thought I would be able to overcome that crisis. I never thought that it would lead me to where I am now. It made me aware that I am not in control of all the situations in life. It made me realized that I am capable of being hurt. I was able to understand that life does not totally consist of happiness and unhappiness. Life is unfair as they say because I realized that the more I try to be happy, the more it eludes me. I realized that life is really uncertain; we’ll never know what will happen next. It leads me to a realization to the confrontation of fundamental problem of human existence in a way that I had been able to survive the crisis in the event of my life. I had been able to surpass the critical points because I was determined, strong-willed and had strong faith in God to re-direct my life. I had been able to confront the need of power to defend my life's purposes because I was able to change my life. It brought new meaning to my life. I realized that there was more meaning to it than just a mere experience of hurt and pain.

You know Masud?  The ultimate measure of a man is not where he stands in moments of comfort and convenience, but where he stands at times of challenge and controversy. It's easy to say sorry for what we have done. It's also easy to forgive and forget, but one thing will never be easy, is to trust again after the disappointment. I learnt that happiness comes to those who give love freely and who don't demand that others love them first. It’s like the sun that is just generous which shine without asking first whether people deserve their warmth or not. I got it from your dad and Mom. They are like Sun and give people lights the way they gave you everything you and me needed even we didn’t know their hearts and their pains but they did their parts.

The definition of love is so varieties and so much big in horizon that many things can be derived from single word “LOVE”. Great love can make a weak man strong. True love can make a brave man fall to his knees. But if I like to define its opposite side, it has tremendous set back also. Failure in Great Love can make strong man weak and brave man as apathy in life. No one is important to him then. In such dismissal courses I learnt Masud that LIFE in this world is the hardest course we could ever take and we need someone or bunches of people who loves us unconditionally without any returns. Its hard to judge them always but they are there. Its our responsibility to find them in right time. And most sad part is that to judge and find them is not easy when we are emotional or outraged. But it is always there. Frankly speaking Masud, it could only be taken once. No review, no masteral, no doctorate. We don't have any other DEAN or GOD to find them but heart and soul. And once we have graduated from this school, we are done and gone. Only eternity can tell our rating: PASSED or FAILED. So I will advice you to judge them correctly and also advice you to live each day as if it's your baccalaureate service, because in this course we'll never know the exact date of our closing ceremony. There were hundreds of YESTERDAYS that passed and more TOMORROWS still to come but there's only one TODAY to enjoy. I always live for TODAY Masud and I will advice you to live for only TODAY with whom you are always missing out. You must figure it out whom we miss constantly and truly. I always miss your dad though he is the only person with whom I can be an arrogant and also submissive. I am thankful to Almighty to have your Dad and Mom in my life.

You know Masud? Any relationship apart from what God had planned for us is like the beautiful horizon. It may appear that the sea and the sky meet at some point but we know they are not. You think you are meant for each other only to find out that you are not and you will never be. It is nothing but a mere appearance of an illusion--beautiful yet deceiving... That’s how now I take this relationship Masud. Its like if you paint a good painting, others will enjoy looking at it, but you in painting it, will have learned how to paint. I am just painting everything in my imagination and I have all the choices how I wanna see them and paint. Everything is a trial where a trial can be a success or a failure both. But remember Masud, trials are not reasons to give up or live with, but a challenge to improvement or rejects. Life at times are like a mountain. You know Masud? Mountains aren't easy to climb, but the view from the top is usually the best. I am not mountain or you but within our altitudes of attitudes, we both are like a mountain. A mountain never climbs another mountain, they stay side by side and never meet unless someone bridges them in between. May be your Dad is that bridge where we are both connected. I always consider and ponder to see as a fresh beginning for everthing. Why go on thinking about what had happened, or about what we did yesterday? Life is a river, flowing constantly onward. No drop of it will ever pass the same bridge twice. Now is your chance to do things in new ways, better than ever before. I am doing my best. We always look at our scars as ugly marks. But sometimes, let's try to consider it as a nice thing, as a symbol that something painful in the past had been healed. Do you understand what I meant all through Masud? To be more clear about what I want to mean is that always remember that two things we define our successful life, the way we manage when we have nothing and the way we behave when we have everything. I appreciate your dad when he managed everything well when he had nothing but its your or my turn to manage things well when we have everything ready-made.

Let me cut a joke at the end to flare a smile in your lips, eyes and motions.

There were two friends from Philippines and China. But the Philippines man never speaks Chinese and the Chinese man never speaks English or tagalong. But they were very good friends indeed. With their body language, they could express many feelings. At one time, the Chinese friend got sick and the Phil man went to see him. When the Phil man saw the Chinese friend, he found his condition was really bad with oxygen tube in his nose, many needles in his body and with life support. The Phil friend sat beside the Chinese friend when the Chinese friend was in hospital with such a disastrous condition of health. Suddenly the Chinese friend told him, “ “Li kay wang ki guan” and died. The Phil friend didn’t understand what the Chinese friend meant. So the Phil friend tried to find out actually what his best friend Chinese man wanted to mean. After many years, the Phil friend found another Chinese man and wanted to know what his BEST friend told him before he died. The new Chinese man translated that his friend told him, “Please you are seating on my oxygen tube and I cant breath, Remove yourself from the tube.”

So let we understand our minds and body languages of the family where we all are the BEST friends of everyone. I miss you Masud and I felt truly sad when you left Bangladesh. I am not your biological father but I know you are just like my son masud. My family thinks you are my next kin and you have lots of responsibilities to perform in absence of me and your dad. You are our boy no matter who loves you more but we love you more than anything and without any conditions Masud.

Keep always link and make two steps forward towards the bed where you had lots of memories you left that you will never remember because you were so small to remember those times.

Akhtar

প্রিয় মাসুদ এবং রিমুনা

এটা আমার জন্য খুব ই ভালো সময় ছিল যখন থেকে তোমরা অল্প সময়ের জন্য হলেও বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলে এবং আমাদের সাথে সময় কাটিয়েছো। মহান আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ যে তিনি তোমাদের মতো বাচ্চাদেরকে আমাদের পরিবারে ব্লেসিং হিসাবে দিয়েছেন। তোমার এই অল্প সময়ের সান্নিধ্য টা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের ছিলো। তবে, এই অল্প সময়ের ভ্রমনের উপর ভিত্তি করেই আজকে ...

(চলবে)

১০/০৫/২০১৩-এ জার্নী বাই কার  

“এ জার্নি বাই কার ফ্রম মিরপুর টু পোস্তগোলা“।

তাহলে আমার জার্নি বাই কার ফ্রম মিরপুর টু পোস্তগোলা লিখে ফেলি. এই মাত্র পাসপোর্ট অফিস ক্রস করলাম, খুব একটা জ্যাম মনে হচ্ছে না। রাস্তা ফাকা ফাকা মনে হচ্ছে। রাস্তা ফাকা ফাকা দেখলে আবার মাঝে মাঝে ভয় করে, এমন ফাকা ক্যান? হরতাল মরতাল নাই তো? অথবা সামনে কোন অঘটন>?ফৌজি মানুষ তো!! বেশি ভয় পাই। সাধারন পাবলিকের একটা ভুল ধারনা আছে, সবাই ফৌজকে খুব সাহসি মনে করলেও আসলে ফৌজ কিন্তু খুব ভিতু। এই গোপন রহস্যটা জানে খালি ফৌজ নিজে আর কেউ না। যাক, এখন একটু জ্যাম দেখতে পাচ্ছি, মনে শান্তি লাগলো, কোন হরতাল মরতাল নাই মনে হয়। গুড। অন্তত হরতালের থেকে জ্যাম ভাল। আমার পাশে একটা ছোট এক্স করলা গাড়ী দারিয়ে আছে। জ্যাম সবাইকে দারাতেই হবে। ভিতরে একটা অবুঝ এক দেড় বছরের বাচ্চা। একটু একটু দারাতে পারে মনে হয়। গারির বাইরে উকি ঝুকি দিচ্ছে।খুব সুন্দর তার আচরন। মনে হয় সব কিছুতেই তার চিত্তাকর্ষণ। কিছুই বুঝে না। আর কি যে বুঝতে চাচ্ছে তাও বুঝে না। ওর মা মাঝে মাঝে কোন কারন ছারাই একটা করে চুমু দিচ্ছে। ব্যাপারটা মজার। একটু হাত নাড়বো নাকি? বাহ, ভালই তো। হেসে দিল। একখান দাতও উঠে নাই। ছোট বাচ্চাদের দন্ত বিহিন হাসি খুব মজার কিন্তু বুড়াদের দন্ত বিহিন হাসি অন্য রকম। বাহ বাচ্চাটা আমার হাত নারাতে মনে হয় একটা খেলনা পেয়ে গেল, ও কিন্তু আমারে চিনে না। কিন্তু ভাবখানা এই রকম, আমি আরও অনেক দিনের চেনা। কেন যে আমরা বাচ্চাদের মত হই না। আহারে জ্যামটা কেটে গেল। একটানে চলে এলাম  র‍্যাংস। আমি প্রাইম মিনিস্টার অফিসের সামনে দিয়ে পার হয়ে যাব কারন এই রেংসের ভিরটা অনেকক্ষন ধরে রাখে পুলিস। পুলিশ তো আর মানুষ না। ওরা বুঝে না কোনটা মানুষের গাড়ী আর কোনটা প্রাইম মিনিস্টারের গাড়ী। ওরা খালি বুঝে প্রাইম মিনিস্টারের পথ ক্লিয়ার রাখতে হবে সে যেই যাক। আমার সামনে একটা লেগুনা। প্রায় সবগুলো পুরুষ মানুষ, একজনকে দেখা যাচ্ছে মহিলা। বেচারির অনেক অসুবিধা হচ্ছে বলে আমার ধারনা, আর সব পুরুষ গুলো কিন্তু সবাই এখন মনে মনে নিজেকে রুমিও ভাবতাছে। এই মুহূর্তে কোন গারমেন্টের কর্মীকে রাস্তায় পাওয়া যাবে না। এটা তোমার ভুল।

তুমি সময় মত অফিস কর আর না কর, প্রাইম মিনিস্টার সময় মত অফিস করুক আর নাই করুক, ওরা সময় মত অফিসে যায়।পার হয়ে গেলাম সে বিখ্যাত রেংস। আমি এখন ফার্ম গেটের পুলিস ফারির সামনে। সমরেশ পুলিস আমার পাশে ডিউটি করছে ট্রাফিকের। চোখে একটা নকল রেবনের সানগ্লাস। এখন আমি আনন্দ সিনেমার বরাবর। আসতে আসতে গাড়ীর গতি থেমে গেল। সামনে অনেক হাইলাক্স, পাজেরো, নুহা গাড়ী। আমি এখন ঠিক তেজগাও সরকার বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে।ডানে একটা মিল্ক ভিটার জরুরি শিশু খাদ্য নিয়ে বিপাকে পরেছে মনে হয়। কারন ড্রাইভার ঘন ঘন বিরি ফুকছে। তার ঠিক পিছনে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ী। নিশ্চয়ই চারিদিকে গন্ধ ছরাচ্ছে। আশপাশে লোক জনের নাকে ধরা দেখে মনে হয় তাই। অসুবিধা নাই, আমরা এই গন্ধে অভ্যস্ত। গন্ধের শহর ঢাকা শহর। ঢাকা শহরের অনেক বৈশিষ্ট আছে যেমন, গন্ধের শহর ঢাকা শহর, রিক্সার শহর ঢাকা শহর, জ্যামের শহর ঢাকা শহর, ইয়াবার শহর ঢাকা শহর। ১০০% স্বাধীনতার সহর ঢাকা শহর (এখানে যার যা খুশি করতে পারে, কোন আইন মানার দরকার নাই, বাম লেন বন্ধ করলে ট্রাফিক পুলিস ধরে না, উলটা পথ দিয়ে গাড়ী এলে কেউ কিছু বলে না ইত্যাদি)। ঢাকা শহরে অনেক ভবন আছে যারা এক কালে প্রাচ্যর সভ্যতার মত সভ্য কালচার গুলোর যেমন সাক্ষী আবার এই যুগে এসে আধুনিক আইন না মানা যুগেরও সাক্ষী। ভবনের ইটেরা কথা বলে না। তাই অনেক ইতিহাস আমাদের জানা হয় না। যেমন ধর, হোটেল সুপার স্টার (যার পাশে আমি এখন দারিয়ে আছি) ৫০ বছর আগে নিশ্চয়ই এখানে এই হোটেলটা ছিল না। হয়ত বা ডাহুকের পদচরন ছিল এখানে। সেই ডাহুকের হয়তা বা মৃত্যু হয়েছে আরও ৪০ বছর আগে, তার সন্তান সন্ততিরা ইচ্ছে করলেই আর তাদের দাদা নানা দেড় এই জায়গায় পুনর্মিলনের কোন সুযুগ নাই, কারন এখানে এখন কপোত কপোতীর মত জুগল মানব বসে সুপার স্টার হোটেলে সময় কাটাচ্ছে।কিংবা ধর, TK ভবন (যার পাশে এখন আমি দারিয়ে) এটা নিশ্চয়ই ১০০ বছর আগে ছিল না। অথবা আজ থেকে আরও ২০০ বছর পর এটা থাকবেও না। সময় শুধু বয়ে যায়, কি থাকবে আর কি থাকবে না, সময় শুধু বলে দেবে। সময়টা এমন এক অদ্ভুত জিনিস কোথায় যেন পরেছিলাম যে, এটা সবার সঙ্গে হাটে কিন্তু সে কারো বন্ধু নয়। সে কারো জন্য অপেক্ষা করে না, তুমি তার সঙ্গে যাবে কি যাবে না, তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। সময়ের পিতার নাম সময়, মাতার নাম সময়, সন্তানের নাম ও সময়। এ এক অদ্ভুত পরিবার। তার কোন দিক জ্ঞ্যান নাই, তার কোন বংশ পরিচয় নাই, তার না আছে ক্লান্তি, না আছে অবসর, সে শুধু চলেই যায়, শুধু রেখে যায় কিছু ফুট প্রিন্ট। কেউ তার থেকে কিছু শিখে আবার কেউ এর তোয়াক্কাও করা না। যেমন এই মুহূর্তে আমি কিছু ফুট প্রিন্ট রেখে গেলাম।

আমি এহন হোটেল সোনারগাঁও। এর কত যে ইতিহাস আছে ভিতরে ভিতরে কে জানে। কত মানুষের আশা, হতাশা, সম্ভ্রম, কষ্ট, কত কিছুই না এর ভিতরে জমা হয়ে আছে কে জানে!! কারো কারো ইতিহাস এখান থেকে হয়ত রচনা হয়েছে আবার কারো কারো ইতিহাস এখানেই শেষ হয়ে গেছে। কেউ হয়ত এর পাশ দিয়ে যাবার সময় মুচকি মুচকি হাসে আবার কেউ হয়ত চোখের পানি ফেলে। কিন্তু এই ভবন যে নামেই ডাকা হোক, সাক্ষী সে রয়েই যাবে।আমি এখন প্রধান বিচাপতির বাস ভবনের সামনে । একে বাসভবন না বলে সরাইখানা বললেই যেন ভাল হত।কত বিচারপতি এখানে থেকেছেন, কত বিচারপতিগন আবার এখানে থাকবেন, তার কোন ইয়ত্তা নাই। এই সরাইখানা এমন জিনিস যখন যে আসে সবাই একে নিজের মনে করলে ও এটা তার নয়। তাকে একদিন না একদিন ছেরে যেতেই হবে। কেউ সেটিছফেক সন নিয়ে বের হয় আবার কেউ বের হয় নেক্কার জনক ভাবে। বিচার পতিদের কে নাকি আল্লাহ দুই বার বিচার করবে, আল্লাহ কি করবেন এটা অবশ্য বিচার পতিরা ভাবেন না। তারা ভাবেন, প্রাইম মিনিস্টার কি করবেন। মরার পর কি হবে এটা ভাবার জন্য এখনো কোন আইন করা হয় নাই বলেই হয়ত তারা এটা ভাবতে পারেন না।কবে যে এই আইন টা করা হবে যে মরার পর কি হবে। তাহলে মনে হয় কিছু কিছু আইন আর দরকার পরত না যেমন ঘুস খাওয়ার কারনে শাস্তি, র্যাপ করার কারনে শাস্তি, কারো হোক কেরে নেওয়ার জন্য শাস্তি ইত্যাদি। আচ্ছা আমি এই বিচারপতিদের নিয়ে কেন মন্তব্য করছি? আমি তো লিখছি ঢাকা কাহিনি তাও আবার এ জার্নি বায় কার ফ্রম মিরপুর তো পোস্তগোলা। বিচারপতিরা জানলে আবার কোর্ট অবমাননা করার কারনে আমার এই রাস্তাটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।যাক বিচারপতিদের আবাস স্থল পার হয়ে এসেছি ভাই, এবার আমি কাকরাইল তব্লিক অফিস। বকসির প্রিয় জায়গা।

তবলিক করে বহু মানুষ উপকৃত হয়েছ নিজে নিজে। তবে শুনেছি এতে ব্যক্তিগত ভাবে উপকৃত হলেও অনেক পরিবার এতে উপকৃত হয় নাই। তারা কিভাবে চলবে, কিভাবে চলছে, এটা অনেকেই ভেবে দেখে না। কোন টা যে কার হক অনেকেই তার সঠিক মানে বুঝে না।যাক এটা আমার গবেষণার বিষয় নয় এখন। আমি চলছি ঢাকার রাস্তায়। আমি ঠিক বকসির অফিসের সামনে। কিন্তু ঘুরে আসার জন্য সাহস পাচ্ছি না । অনেক জ্যাম।

ইশা খা হোটেল। আমি তো ঢাকার রাস্তায় দোস্ত। আমি শুধু রাস্তার চারিপাশের বর্ণনা দিচ্ছি আর মাঝে মাঝে কমেন্ট করছি দোস্ত। এটা কি আঙ্গুল ঢোকানো বলে? তবে তাই হোক। রাজমনি সিনেমা হল, বাহ, বিশাল পোস্টার। “ভালবাসার তাজমহল”। আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম, দেখলেই ভয় লাগে। এখানে নাকি সব বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে। আচ্ছা বেওয়ারিশ লাশ কি? যার কোন পরিচয় নাই সে? এই পৃথিবীতে কে এমন আছে যার কোন পরিচয় নাই? বাপ মা নাই? ভাই বোন নাই? কে যে কেমন করে কখন বেওয়ারিশ হয়ে যায় বা কেন হয়ে যায়, আমি বুঝতে পারি না।আমি জানি আমার পরিচয় আছে, আমার বাবা ছিল , আমার মা ছিল, আমার পরিবার আছে, আচ্ছা আমি কি কখনো বেওয়ারিশ হতে পারি? হয়তবা…… কারন আমি বেওয়ারিশের সংজ্ঞা এখনো বিঝি না।আচ্ছা কেউ কি এখন ভাইবারে নাই? খালি আমি ই কথা বলে যাচ্ছি!! আমার এখন অফুরন্ত সময়।

তুমি আজ হারিয়ে গেলে আমরা তোমারে খুজব, কিন্তু তুমিও কোন একদিন বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যেতে পার,। অথচ আমরা তোমারে খুজছি। তবে বেওয়ারিশ লাশ না থাকলে অনেক অসুবিধা হত। যেমন আমার মেয়ে ডাক্তারি পড়ে, তার একটা কঙ্কাল দরকার। কে দেবে এই কঙ্কাল? বেওয়ারিশ লাশ । কে জানে হয়তবা আমারই কোন এক জেনারেসন আমার কঙ্কাল নিয়েই হয়ত পরাশুনা করবে, সে জান্তেও পারবে না, কোন একদিন আমি ওদের পরিবারের একজন ছিলাম। আমার হাড়ের কোন এক অংশই হচ্ছে সে। মানুষ কখনো মানুষ, কখনো লাশ, আবার কখনো কঙ্কাল , কি আজব না?

আমি এখন প্রেসিডেন্টের বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছি। পাশে নবনির্মিত হানিফ ফ্লাই অভার। অনেক পুলিশ পাহারায় থাকে প্রেসিডেন্ট সাহেবের জন্য। অনেক বড় জায়গা। আচ্ছা কবরের মাপ কি সবার জন্য সমান? তাহলে অনারা ওই ছোট্ট কবরে সখিনার সমান মাপের কবরে কেমন করে ঘুমাবেন? সখিনা, তোমার জন্য সুখবর আছে, তোমার কবরের মাপ আর আমাদের প্রেসিডেন্ট সাহেবের কবরের মাপ নাকি সমান। তখন তোমার উপর কেউও ন্যায্য কাজ করতে পারবে না। না বিচারপতিরা, না দেশের স্বাধীনতা, না সময় না কেউ। আমি এখন “দয়া গঞ্জের” মোড়।

কয়েকদিন আগে এখানে আগুন লেগেছিল, অনেকগুলো বস্তিবাসী মারা গিয়েছিল।পরেরদিন খবর হয়েছিল, “বস্তিতে আগুন লেগে ৫ বস্তিবাসি পুরে ছাই”। আমি ওদেরকে চিনি না। কিন্তু যেহেতু আমি প্রতিদিন এইখান দিয়ে যাই, কে জানে হয়তা বা আমি ওদের কোন একজনের সঙ্গে হয়তবা আমার দেখা হয়েছিল!! এই ইতিহাসটা আমার জানা নাই। কিন্তু তবু মাঝে মাঝে এই স্থানটা পার হবার সময় আমার এই কথাট প্রায়ই মনে পড়ে। হয়তবা কোন একদিন আমিও আর এই স্থানটি দিয়ে আর কখনো আসব না। আমার এই গারিটিতে অন্য একজন বসবে, আমি আর এই রাস্তার উপর দিয়ে যাব না। আমার এই রাস্তার উপর দিয়ে যাওয়ার অধিকার হারিয়ে যাবে। আমার স্থান হবে এই রাস্তার মাটির নিচে। খুব কস্টের না? আর এভাবেই শেষ হয়ে যায় আমার “এ জার্নি বাই কার ফ্রম মিরপুর টু পোস্তগোলা”। নাহ বকসি ভাই, আমি শুধু আমার আজকের দিনের পার্থিব কিছু ফিলিংস এর কথা বললাম। এর মাঝে অনেক আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা আছে, অনেক অবিচারের কোথা আছে, অনেক ন্যায্য তার কোথা আছে, অনেক হতাশার কথা আছে। কিন্তু এর প্রতিটি কথার অনেক বিশ্লেষণ আছে যা আমি এই মুহূর্তে করতে চাইনি বকসি ভাই। চলে এসেছি। আমার সেই পুরানো ফ্যাক্টরিতে। এখানে আমি বড় সাহেব। আমাকে হাসতে হয় মেপে মেপে, কথা বলতে হয় অনেক ভেবে চিনতে। আমি এখানে সাধিন নই কন্তু আমাকে কেউ কমান্ড করে না।

দেখা হবে পড়ে আবার। ভাল থেক সবাই।

১৩/০৪/২০১৩- প্রধান মন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি

মীরপুর, গোলার টেক, পাল পাড়া রোড, ঢাকা-১২১৬ 

 প্রধান মন্ত্রী,

তুমি নিশ্চয়ই ভগবানের থেকে বড় না। আমি ভগবানকে তুমি করে বলি। আমি তোমাকেও তুমি করে বলতে পারি। তুমি খুব ভাগ্যবতি, কারন তুমি দেশের প্রধানমন্ত্রী । ভগবান তোমাকে সুস্হ করে বানিয়েছেন, তোমার কোন অঙ্গহানি নাই, তুমি সবল। তুমি কথা বলতে পার, তুমি প্রিথিবির রূপ দেখতে পার, তুমি সূর্য দেখতে পার, তুমি চাঁদ দেখতে পার, তুমি একা একা চলতে পার, তুমি হাযার হাযার মানুষের থেকেও ভাল আছ।  তুমি মেয়ে মানুষ অথচ তুমি অনেক ছেলেদের থেকেও পাওয়ারফুল। তুমি এতিম কিন্তু তুমি এতিমের মত না, তোমাকে মানুষ সম্মান করে, তুমি এদেশের সবচে সিনিওর। ভাবত একবার প্রধানমন্ত্রী! অথচ তুমি অনেক মানুষের সপ্ন বাস্তব দিতে পারছ না।  কেন? তুমি কি চোর? তুমি আমাকে বল তুমি যদি চোর না হও তবে কেন তুমি চোর পাল? কি তোমার ভয়? তুমি হ্মমতা হারাবে? নাহ। তুমি হ্মমতা হারাবে না। এদেশের মানুষ অনেক চালাক, তারা  বুঝতে পারে কি হচ্ছে  কোথায়। তোমাকে আমি মাঝে মাঝে বুদ্ধিমতি বলে মনে করি কিন্তু অনেক সময় তুমি বুদ্ধিমানের মত কাজ কর না। কি তোমার সমস্যা? বলনা  দেশবাসিকে? ওরা তোমাকে ভালবাশে, তুমি কি এটা জান? তুমি কেন হিটলার হতে পার না? তুমি কেন স্তালিন হতে পার না? তুমি কেন আরেকটা মুজিব হতে পারনা? মুজিব তো বলেছিল, আমার কম্বল কই? তুমি কি সে কোথা ভুলে গেছ? মুজিব তো বুলেটের সামনে এসে বলেছিল, কিরে তোরা কি চাস? আহ কি দারুন কথা। তুমি কি তার মেয়ে নও? তুমি বল না আমাদেরকে যে, তোমার পরনে কাপড় নাই, আমরা আমাদের কাপড় তোমাকে দিয়ে দেব, তুমি বলনা, তোমার ঘরে খাবার নাই, আমি  তোমাকে বলছি, আমি খাব না, আমার খাবার আমি তোমাকে দিয়ে দেব। সুধু দেশটাকে বাচাও প্রধানমন্ত্রী । তুমি সমুদ্র জয় করেছ, এর জন্য তোমাকে আমরা পুজা করব, এর জন্য তোমাকে অনুস্টান করে মালা নেবার দরকার নাই। তুমি এত বোকা কেন? তুমি প্যাপার পরনা? তুমি দেখ না যুবক সমাজ কি বলছে? সময় পাল্টে যাচ্ছে, চোখকান খোলা রাখ প্লিয। আমার জীবনে আমি কখন ভোট দেই নাই, এবার প্রথম আমি সুধু তোমার জন্য ভোট দিয়েছি। আমি কি ভুল করেছি ? আমি জানি, আমাদের ভালবাসা তোমার আয়ুস্কাল নির্ভর করে না, কিন্তু  তোমার ভালবাসায় আমদের আয়ুস্কাল নির্ভর করে । তুমি কি ভাল আছ?  তুমি ভাল নাই। কেন তুমি এমন কিছু লোক নাওনা যারা দেশের ভাল করবে, হোক না তারা তোমার শত্রু, কিন্তু তারা যদি দেশটাকে ভালবাসে, নাও  না ওদের। তুমি কেন নেলসন মেনডেলার মত একটা ইতিহাশ তৈরি করনা? তুমি ইতিহাশ হয়ে যাও। তোমার পথ ধরে তোমার সন্তানরা আসবে, তোমার পথ ধরে আমরা আসব, কেন, কেন তুমি পারনা? 

তুমি অগ্নিকন্যা কিন্তু তোমার অগ্নি মানুষকে পোড়ায় না। তাহলে তুমি কেমন আগ্নিকন্যা? আমি রাজনীতি করি না কিন্তু আমি রাজনীতির সব খবর রাখি, আমার ব্যথা লাগে, আমার কষ্ট হয়, তুমি দেখনা প্রধানমন্ত্রী, তুমি পারবে না? তুমি পারবে। তুমি আমাকে খুজনা, আমি রাজনিতিকে ভয় পাই, আমি সুধু চাই আমি অনেক লোকের ভার নিতে চাই না। ওরা তোমাকে চায়, অথচ আমরা তোমার হয়ে কাজ করছি। আমরা তোমাকেও কষ্ট দিতে চাই না। তুমি অনেক ব্যস্ত। সধু তুমি সৎ থাক। এ দেশের মানুষগুলো ভাল, ওরা বাচতে চায়, ওরা তোমার কাছ থেকে টাকা চায় না, ওরা তোমার কাছ থেকে করুনা চায় না, ওরা চায়, ওদের কাজে বাধা দিও না, হরতাল, অবরোধ, ওরা ভয় পায়, তুমি জান এটা? আমি বিরোধী দলকেও ভয় পাই। ওরা আরও অনেক কঠিন কাজ করতে পারে। কিন্তু ওরা কি আমাদের ভালবাসে না? ওরা কার জন্য রাজনীতি করে? যদি রাজনিতি হয়ে থাকে আমাদের জন্য তবে আমদের কথা শোন। আমি অনেক দেশ ঘুরেছি, দেখেছি, নেতা অনেক বড় জিনিস। আমি তোমাদেরকে নেতা মানতে চাই। কে জয়, কে তারেক, এতে আমার কোন  দুঃখ নাই, আমি সুধু চাই, শান্তি আর উন্নতি। তোমারা দুইজন এক সংগে বসনা প্লিয। দেখেবে দেশটা ভাল হয়ে যাবে। এ কাজটা তোমার। ওরা বসবে না, তুমি ওদের বস্তে বাধ্য করবে। না বসলে ওদের লাভ, বসলে তোমার লাভ। 

   

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তুমি কি বোঝতে পারছ দেশের মানুষের কথা? এ দেশের ৫৫% শতাংস লোক তোমাকে ভোট দেয় নাই, কিন্তু তুমি এখন তাদের ও প্রধানমন্ত্রী। তুমি এখন আর তোমার পার্টির কেও নও। তুমি এখন জনগনের সম্পদ। তোমার শরীর খারাপ হলে দেশের প্রত্যেকে জানবে, বিশ্ব জানবে। তুমি কি এটা বুঝ? তাহলে দেশের লোকের শরীর খারাপ হলে, তাদের মন খারাপ হলে, তুমি জানবে না কেন? মানুষ এখন দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। ঘরে নিরাপত্তা নাই, রাস্তায় নিরাপত্তা নাই, অফিসে নিরাপত্তা নাই। যে কোন লোক যখন তখন কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। ওরা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী? তুমি কি কিছু জান? আর না জানলে কেন জানার চেষ্টা করছ না? আর জানলে কেন একসান নিচ্ছ না? কি হল তোমার? সাগর-রুমি মরে গেল, ইলিয়স মিয়া লাপাত্তা, বাসে বাসে রাজনিতির লাশ, বিশ্বজিত সবার সামনে কিভাবে খুন হয়ে গেল, হাজার হাজার কোটি টাঁকা মানুষ লোটপাঁট করে ফেলছে, সবাই তোমার ছাত্রলীগের নামে কলংক দিচ্ছে। তুমি কি পেপার পর না? তুমি কি কিছুই বুঝতেছ না? তুমি আমলাদের, মন্ত্রীদের কথা বলার লাগাম টেনে ধর, ওরা যা তা বলে। মানুষ বিরক্ত হয়। মাঝে মাঝে তুমি ও কথার বেলেন্স হারিয়ে ফেল। আরও সাবধান হওয়া দরকার। সামনে তো তোমার বিরাট পরিক্ষা!! এ দেশের মানুষ বড় বিচিত্র। এরা সময় মত ছুরি মারে। আর একবার ঠিক মত ছুরি মারতে পারলে উঠতে সময় লাগে। তুমি কি ভুলে গেছ যে, ২১ বছর লেগেছিল তোমার উঠতে, এবার কিন্তু আরও বেশি সময় লাগতে পারে। কারন যুবক সমাজ যুদ্ধ দেখেনি, মুজিবকে দেখেনি, এদের মায়া মহব্বত কম। বাপমাকেই এরা জবাব দেয় আর তুমি তো প্রধানমন্ত্রী।   

১৬/০২/২০১৩- রাজপুত্রের “প্রজন্ম চত্বর”

গোলার টেক, পাল পাড়া রোড,  মীরপুর–১২১৬

আমি খুব ভয়ে আছি এই কয়েকদিন যাবত। আর এই ভয়টা জাগিয়ে তুলেছে শাহ্‌বাগের “প্রজন্ম চত্বর”।  কি সুন্দর নাম “প্রজন্ম চত্বর”।

১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এই বীরবাঙ্গালী জাতী যতবার আন্দোলন করেছে, যতবার ঘর থেকে রাস্তায় নেমেছে, সবসময় সুফল নিয়েই ঘরে ফিরেছে বারবার। আর এই জন্য আমরা একটা স্বাধীন ভাষা পেয়েছি, একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি, স্বাধীনতা পেয়েছি। বিশ্বময় আমরা মাথা উচু করে বলতে পারি, আমি বাংলাদেশের ছেলে। আমার দেশের রাজধানীর নাম ঢাকা। কিন্তু ১৯৭১ সলের পর থেকে যতবারই যে কোন আন্দোলন হয়েছে, কোন না কোন ভাবে সেটা কোন না কোন ব্যক্তি বা দলের দখলে চলে গেছে এবং সেটা আবার ছিনিয়ে আনতে নতুন করে আন্দোলন করতে হয়েছে।

১৯৭১ থেকে ২০০০ এর পর যতসব ঘটনা সবার চেহারা এক। আশা ভাঙতে ভাঙতে এখন আর আশাহত হইনা, আশাহীন হয়ে পরেছি। সবসময় ভেবেছি, মিশর বদলিয়ে দিল একদল তরুন, ৪২ বছরের ইতিহাস এক বছরে পাল্টে গেল, লিবিয়া স্বৈরশাসক মুক্ত হয়ে গেল কয়েক দিনের মধ্যে। সিরিয়া, তিউনেসিয়া, আরও অনেক দেশ এখন পাইপ লাইনে চলে এসেছে, সেখানে গনতন্ত্র ছাড়া আর অন্য কোনভিত্তিক শাসন দিয়ে সারা দেশ চালানো সম্ভব নয়। বিশ্ব এখন শুধু হাওয়া বইছে পজিটিভ পরিবর্তনের। অথচ আমরা শুধু “খবর” হয়েছি সারা বিশ্বে হয় বন্যা, না হয় দুর্নীতি, না হয় ক্রসফায়ার, না হয় আভ্যন্তরিন রাজনীতির হিংসাত্তক কর্মকাণ্ডের কারনে। যদিও নোবেল বিজয়ের মত ঘটনাও এ দেশে ঘটেছে, বিজ্ঞান বিষয়ক নতুন উদ্ভাবনী হয়েছে, গারমেন্টস শিল্প  অনেক দূর এগিয়ে গেছে, কিন্তু একই সময় আবার এক পদ্মা সেতু সব অর্জন যেন এক নিমিষে সারা পৃথিবীতে আমাদেরকে আরও এক ধাপ পিছিয়ে দিয়ে গেছে। পিছিয়ে দিয়ে গেছে দেশের উন্নতির একটা ধারাবাহিক স্বপ্নের, পিছিয়ে দিয়ে গেছে সারা  বিশ্বের কাছে আমাদের মাথা উচু করে দাঁড়াবার প্লাটফর্মটা। এটা শুধু একটা লোণ নয়, এটা একটা কলঙ্ক জনক ঘটনা। এটা একটা দেশের চরিত্র, এটা একটা দুঃস্বপ্ন। এই স্বপ্ন ভঙ্গের ব্যথায় কেউ সোচ্চার হলনা, অথচ আমি জানি এটা নিয়ে দেশের ১ম মানুষ থেকে শুরু করে আপামর সব চেয়ে ছোট মানুষটারও বুকে কস্ট আছে। আমি জানি না কেন এমন হল, আমি জানি না কি করলে কি হত। আমার জানা নাই এখানে কার কতটা দোষ বা কার কতটা গাফিলতি। শুধুজানি, স্বপ্নটা সার্থক হতে আরও অনেক সময় পেরিয়ে যাবে। উদ্ধারকারী খুব কাছে কেউ নেই আমাদের।

ঘর থেকে বের হই খুব ভয়ে ভয়ে। এ ঘরে আবার ফিরে আসা হবে তো? নাকি পথে কোন কারন ছাড়া আমি হয়ে যাব লাশ বা বিশ্বসন্ত্রাসী? উচিত কথা বলবার আমার সাহস নাই, এটা আমার দুর্বলতা নয়, এটা আমার একাকিত্তের ফসল। আমি যেন একা। আমার মত সবাই যেন একা। সবাই যেন কোন এক উদ্ধারকারীর অপেক্ষায় আছে, কবে আসবে সেই বীরপুরুষ? আর কেই বা সেই বীর পুরুষ? চারিদিকে নৈরাজ্য, মারামারি, দুর্নীতি, চাপাবাজি, অবিশ্বাস, চারিদিকে হাহাকার, এখানে একটা লাশ এক ভাগ পুঁটি মাছের দামের থেকেও কম, এখানে একটা যুবতির সম্ভ্রম শকুনের ভাগাভাগি করে খাওয়া গলিত শিয়ালের লাশের থেকেও কম গুরুত্তপূর্ণ।

এমন একটা কঠিন সময়ের মধ্যে হটাত করে শাহ্‌বাগের “প্রজন্ম চত্বর” যেন গহিন সমুদ্রের মধ্যে একছটা আলোর মত মনে হয়। আমার মন আবেগে ভরে উঠে। আশায় ভরে উঠে। দেশের আনাচে কানাচে ভিয়েনামের যুদ্ধের মত সব যৌবন আজ জেগেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের মত সব যৌবন আজ টগবগ করে ফুটছে, এখানে ভোর, সকাল, দুপুর, রাত যেন এক হয়ে গেছে। সময় থেমে গেছে। এখানে আজ ৯০ বছরের থুরথুরে বুড়িও যেন আর বুড়ি নয়, এখানে সব দাত পরে যাওয়া ১০০ বছরের দৃষ্টিহীন বুড়ো যেন তোমাদের স্পর্শে ২৫-৩০ বছরের যুবক বনে গেছে। আমি এখন রাস্তায় বেরোলে আমি জানি তোমরা পাহারায় আছ, আমি জানি তোমাদের সামনে কোন বাধায়ই বাধা নয়। কে আছে আমাকে এখন কটু কথা বলবে? কার এমন দুঃসাহস আছে আমাকে ভয় দেখাবে? আমার পাশে তো “প্রজন্ম চত্বর” আছে। তোমরা তো এখন আমার ক্যাপ্টেন। তোমরাই কি সেই বীর পুরুষ নও? মিশরের মত? লিবিয়ার মত? চেগুভার এর মত? নাকি আবারো হতাশায় ভোগাবে? কোনো উদ্আদেশ্মিয নিয়ে এই প্রজন্ম চত্তর নামে সবার হৃদয়ে আবার শুল চালাবে না তো?

আর কাঁদতে চাই না, আমাকে আর আশাহত কর না, আমি বিশ্বাস করতে চাই, ওই আলো আমাদের, ওখানে কোন আর হায়েনারা নাই, দল নাই, ব্যক্তি নাই, তোমরা জেগে থাক একটা একটা সপ্ন নিয়ে, তোমাদের আর ঘুমিয়ে থাকার অবকাশ নেই। তোমরা কি সেই আলো?  তোমরা কি সেই উদ্ধারকারী? হয়ত বা তাই, আমি তাই বিশ্বাস করতে চাই।  এখন আমাকে তোমরা প্রশ্ন করতে পার, তাহলে আমি ভয় পাই কেন? আমি ভয় পাই এই ভেবে যে, যে আলো তোমরা দেখাচ্ছ, সে আলো কি তোমরা ধরে আছ কিনা, যে আলোর তাপ তোমরা বিকিরন করছ, সে আলোর মিছিল একান্তই আমাদের কিনা। আমার ভাল লাগে যখন দেখি তোমার মাথা আঁচড়ানোর সময় নাই, আমার ভাল লাগে যখন দেখি তোমার গায়ে ঘামের গন্ধ, আমার ভাল লাগে যখন দেখি তোমরা যা অ-গ্রহনযোগ্য তা নিমিষে বর্জন করতে পার এবং সত্যিটাকে আগলে রাখ। কিন্তু ভয় লাগে যখন দেখি দেশি-বিদেশি বর্ণচোরা হায়েনারা তোমাদের পাশে ঘুরঘুর করে সুযোগ খুজছে, আমার ভয় করে যখন দেখি তোমার মাথার চুল আর এবড়ো থেবড়ো নয়, বেকব্রাশ করা পরিপাটি চুল, আমার ভয় করে যখন দেখি তোমার ঘর্মাক্ত সার্ট  আর ঘামে ভিজে নেই, অনেক অসাধু সুযোগ সুন্ধানী হায়েনাদের মত ইস্ত্রি করা। আমি তোমাদের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতে চাই, তোমাদের অনেক কাজ। একটা একটা করে করতে হবে, এখানে আশা ভঙ্গ করা মানে, শেষ তলয়ার শেষ হয়ে যাওয়া। তোমরা কি শুনতে পাও ঐ স্বামীহারা স্ত্রীর কান্না যে একা একা গত ৪০ বছর ধরে পরাধীনের মত গ্লানি টেনেছে?  তোমরা কি শুনতে পাও ঐ স্বামীহারা স্ত্রীর স্বামীহীন অসহায় জীবনের একাকীত্ব? তোমারা কি শুনতে পাও কত বিরঙ্গনার আর্তনাদ যারা তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে মরনের আগে শুধু তার সতিত্তের বিচার পাওয়ার জন্য? এরা কেউ তোমার মা, কেউ তোমার বোন, কেউ তোমার মেয়ে। ওরা কারো কাছেই কোন বিচার পাবে বলে আর আশা করে না। আর যারা ঐ ৩০ লাখ তরুন মানুষ তোমাদের ভবিষ্যৎ সুখের জন্য তাদের যৌবন ত্যাগ করেছে, বর্তমান ত্যাগ করেছে, তাদের জন্য কি সুসংবাদ দিবে তোমরা? তোমরা শুধু একটা কাজ করে যাও, তোমরা তোমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা সুন্দর বাংলাদেশ রেখে যাও যা তোমাদের পুর্বসূরিরা তাদের জীবন ত্যাগ করে তোমাদের জন্য করে গেছেন। 

আমি ৭১ দেখেছি কিন্তু ৭১ কি আমি তখন কিছুই বুঝিনি। আমি দেখেছি আমার মা শুধু রাত জেগে বসে থাকতেন কখন আমার বাবা চুপে চুপে রাতের আধারে মার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন, দিন পার হয়ে গেছে, মাস পার হয়ে গেছে, বাবা আর ফিরে আসেন নি। আমার ভাই কতই বা বয়স তার, ১৯ কি ২০ ! কি অদম্য সাহসের সাথে কোন এক রাতে মাকে না বলেই চলে গেলেন ৭১ এর যুদ্ধে। কি হয়েছিল তার? দেশ তো স্বাধীন হয়েছে, কই আমার ভাই কি আর ফিরে আসবে না? হয়ত বাবা আর আমার ভাই এখন এক সঙ্গেই আছেন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, আমার বাবা কি আমাকে মিস করে? আমার ভাই কি আমাকে মিস করে? আমি তাদের খুব মিস করি। আমার মা আমাকে প্রতিদিন হাতির গল্প, ভুতের গল্প, রাজা রানীর গল্প শুনাতেন। ৭১ এর পর আমার মাকে আর কখন কোন দিন আর হাতির গল্প, ভুতের গল্প বলতে শুনিনি। আমার মাকে গল্প বলতে বল্লে শুধু একটা গল্পই বলতেন, “এক ছিল এক রাজা, রাজার ছিল রানী। রাজা-রানির ছিল এক রাজপুত্র। এক দিন রাজা যুদ্ধে মারা গেলেন, রানীও কয়েক বছর পর মারা গেলেন রাজার শোকে। বেঁচে রইল রাজপুত্র”। মা এখনেই গল্পটা শেষ করে দিতেন। আমি বলতাম, তারপর কি হল মা? মা বলতেন, “রাজপুত্র বড় হবে, সেও যুদ্ধ করবে রাজার মত কারন রাজার রক্ত যে রাজপুত্র বহন করে”। আমি বলতাম, কোথায় মা সেই রাজপুত্র? মা কিছুই বলতেন না। আমি আজ তার উত্তরটা জানি। সে এখন “প্রজন্ম চত্বরে”।  

আবার আমার শতভাগ ভুল হলেও হতে পারে। হতেও পারে, যা দেখছি, পুরুটাই ভুল। 

বাঙালি বড় অসহায়।