জেবুন্নেসা চৌধুরী (আমার শাসুড়ী)

Categories

তিনি আমার শাশুড়ি। মোট আট মেয়ে আর তিন ছেলের সার্থক মা। অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ। আমার কাছে তিনি আমার আপন মায়ের মতোই ছিলেন। আমার মাকে আর আমার এই শাশুড়িকে আমি কনোদিনই পার্থক্য করি নাই। তিনি আমাকে প্রতি ঈদে ১০ টাকার সালামি দিতেন। কি যে ভালো লাগতো ঊনার কাছ থেকে এই ১০টাকা সালামি নিতে।

চলবে…

আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী

Categories

আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী

তিনি আমার শ্বশুর।

আমি আমার শ্বশুর কেও জীবিত অবস্থায় দেখি নাই। আমার স্ত্রী যখন অষ্টম ক্লাসে পড়ে, তখন তার বাবা মারা যান। আমি যখন আমার স্ত্রীকে বিয়ে করি, তখন আমার স্ত্রী সবে মাত্র ইন্তারমিডিয়েট পাশ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির তোড়জোর করছেন। ফলে আমার বিয়ে হবার প্রায় ৪/৫ বছর আগে আমার শ্বশুর মারা যান। আমার শ্বশুরের প্রাথমিক তথ্য গুলি এ রকমেরঃ

নামঃ আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী

পিতাঃ সোনাম উদ্দিন চৌধুরী (সোনাম উদ্দিন চৌধুরীর পিতার নাম ছিল, ফাজেল আহম্মদ চৌধুরী)

স্ত্রীর নামঃ জেবুন্নেসা চৌধুরী

আমার শ্বশুরের ছিল আট কন্যা সন্তান এবং তিন পুত্র সন্তান।

আমার স্ত্রী ছিলো তাদের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ।

তাদের ওয়ারিশ নামা যদি লিখি তাহলে দাঁড়ায় এ রকমেরঃ

৪/৪/২০২১-ছোটভাবী মারা গেলেন

Categories

বিকেল ৩ টায় মিটুল আমাকে ফোন করে জানালো যে, ছোট ভাবী হটাত করে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন এবং এইমাত্র ওনাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে। মাত্র ২ ঘন্টার ব্যবধানে আরেকটা খবর পেলাম যে, ছোট ভাবী ক্লিনিক্যালি ডেড। ঠিক সাড়ে ৫ টায় জানলাম, ছোট ভাবী আর নাই।

বড্ড আফসোস হচ্ছিলো ছোট ভাবীর জন্য। মানুষটা যতোটা না চালাক ছিলো, তার থেকে বেশী ছিলো সহজ এবং বোকা। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞান ছিলো না যা তিনি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে এমন কিছু হতে পারতেন যা একটা মহিলার জীবনের জন্য অপুরনীয় পাওয়া। তার সবচেয়ে বড় যে গুনটা আমি দেখেছি, তিনি যাকে পছন্দ করতেন, তার ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন নাই। সে একেবারে অনেক ঊর্ধে রাখেন তাঁকে।

ছোট ভাবীর সাথে আমার অনেক ভালো একটা সম্পর্ক ছিলো যা হয়তো এই পৃথিবীর অনেক মানুষের ছিলো অজানা। তিনি এখন আর এই দুনিয়ায় নাই, তাই তাঁকে আমি আমার অন্তর থেকে ভালোবেসে মন থেকে জান্নাতের সুপারিশ করে বিদায় দিলাম। যদি কখনো আমার কারনে আপনার কোনো বিচারের সুম্মুক্ষিন হতে হয়, আমি সেদিন কোনো প্রশ্ন ছাড়া এই সুপারিশ হয়তো করবো মহান আল্লাহর কাছে-তাকে মুক্তি দিন। একটা নিস্তব্ধ অপরাধ অথবা  যাইই বলি সেটা তো হয়েছেই।

২৯/০১/২০২১- নূরজাহান আপা

Categories

নুর জাহান আপা আমার জেঠস ছিলেন। অর্থাৎ আমার স্ত্রীর আপন বোন। তিনি একজন শিক্ষিকা ছিলেন, মীরপুরের সিদ্ধান্ত স্কুলের শিক্ষিকা। আমি নুরজাহান আপাকে চিনি আমারও বিয়ের প্রায় অনেক বছর আগ থেকে কারন আমরা গোলারটেকেই থাকতাম পাশাপাশি। আমি যেহেতু সবার সাথে খুব একটা মিশতাম না তাই বিয়ের আগে ঊনাদের সাথেও আমার খুব বেশি ঊঠানামা ছিল না। জাস্ট  চিনতাম, ঊনারাও আমাকে চিনতেন। তার স্বামীর নাম জয়নাল চৌধুরী, তিনি প্ল্যানিং কমিশনে চাকুরী করতেন এক সময়। বর্তমানে অবসর নিয়েছেন। ভালো মানুষ একজন।

নুর জাহান আপা অনেকদিন যাবত লিভারের সমস্যায় ভুগছিলেন। আপা নিজে খুব পহেজগার মহিলা ছিলেন। তার দুই মেয়ে, সোমা এবং সনি আর এক ছেলে, নাঈম আহমদ। দুইজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছেলে থাকে আমেরিকায়। সেও বিয়ে করেছে।

আপার শরীরটা আস্তে আস্তে খারাপ হবার সাথে সাথে তিনি প্রথমে ইন্ডিয়া যান চিকিতসা করাতে। ওখানকার ডাক্তাররা বলেছিলেন যে, তার লিভার ট্রান্সপ্লান্টেসন করাতে হবে, তানা হলে তাকে আর বেশিদিন বাচানো যাবে না। ব্যাপারটা প্রায় ঠিকই ছিলো। ইন্ডিয়া থেকে আসার পর আপা দ্রুত খারাপের দিকে যেতে শুরু করলেন। শেষে তার লিভার ট্রান্সপ্লান্টেসন করাবেন এই সিদ্ধান্তই নেওয়া হলো। কিন্তু জটিল ইন্ডিয়ান সিস্টেমের কারনে ইন্ডিয়া গিয়েও তার লিভার ট্রান্সপ্লান্টেসন করা সম্ভব হয় নাই। 

অতঃপর আপা আবারো আমেরিকায় তার নিজের ছেলের কাছে গিয়ে আমেরিকার উন্নত মানের চিকিতসার জন্য। কিন্তু আমেরিকায় যাওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। তার মৃত দেহ আমেরিকায় সতকার করা হয়। তার মানে নূরজাহান আপাকে আমরা দেশে কবর দিতে পারি নাই।

২৭/০১/২০২১-ভাবীর দাফন সম্পন্ন

আমি গত কয়েকদিন যাবত করোনায় ভুগছি। সাথে আমার বড় মেয়েও। কিভাবে ঘটনাটা হলো তা আমার এখনো জানা নাই। সে ব্যাপারটা পরে আসছি। বড় ভাবী (অর্থাৎ লিখনের মা) গতকাল ইন্তেকাল করেছেন। আজ তাকে মানিকগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়েছে মানিকগঞ্জ গোরস্থানে দাফন করার জন্য। আমি যেতে চেয়েছিলাম কিনা জানিনা, যেহেতু করোনায় ভুগছি, তাই কেহ আমাকে যেতেও বলে নাই। আর আমি যাওয়ার কোনো কারনও দেখিনা।বড় ভাবীর মৃত্যুর ঘটনায় আমার বেশ কিছু অব্জারভেশন চোখে পড়েছেঃ

ক।      লিখন আমেরিকায় ভিসা জটিলতায় এমনভাবে আটকে আছে যে, লিখন ইচ্ছে করলে ওর মাকে দেখতে আসতে পারতো ঠিকই কিন্তু হয়তো আর আমেরিকায় ফিরে যেতে পারবে না। এই ভয়ে লিখন ওর মাকে আর দেখতেই এলো না। ওর মাকে দেখার চেয়ে হয়তো ওর আমেরিকায় থাকাটা জরুরী মনে হয়েছে বিধায় লিখন আর ওর মাকে শেষবারের মতো দেখতে আসে নাই। প্রথিবীটা অনেক ছোট, আর কে কখন কোথায় থাকবে এটার ফয়সালা আল্লাহর হাতে। আমেরিকাতেই থাকতে হবে আমি এটা বিশ্বাস করি না। এই বাংলাদেশেও অনেক বিখ্যাত মানুষেরা বাস করে এবং অনেক পয়সা ওয়ালারা বাস করে। আমেরিকা কোনো সর্গরাজ্য নয় যে ওখানেই সেটেল হতে হবে সব আত্তীয়সজন বাদ দিয়ে। এই যে, আজকে লিখন তার মাকে শেষবারের মতো ও দেখতে পারলো না, ওর মা লিখনের হাতের মাটিও পেলো না, এর কোনো মানে হয় না। আমি জানি না আমার মৃত্যুর সময় আমার বাচ্চারাও আমাকে দেখতে আস্তে পারবে কিনা কিংবা আমি ওদের হাতে মাটি পাবো কিনা, তবে আমি মনে করি এমন কোনো জটিল পরিস্থিতিতে যেনো আল্লাহ আমাকে বা আমার সন্তানকে না ফেলেন যে, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় আমি আমার সন্তানদের কাছে না পাই।

খ।       বড় ভাবী যখন করোনায় আক্রান্ত, তখন দেশে তার সব ছেলেরা ছিলো। মারুফ ছিলো, তুহীন ছিলো, মুবীন ছিলো, ইমন ছিলো, সবাই ছিলো। একমাত্র মুবীন সারাক্ষন হাসপাতালে ওর মার জন্য ডিউটি করেছে। আর বাকী ছেলেরা খুব একটা দেখতেও যেত না আবার হাসপাতালেও ছিলো না। যেহেতু মায়ের করোনা, তাই সবাই দূরে দূরেই ছিলো। খুবই হতাশার কথা হচ্ছে, যখন বড় ভাবী মারা গেলেন, তখন মানিকগঞ্জে তার লাশের সাথে কে যাবে, বা কারা যাবে এটা নিয়েও একটা কনফিউশন ছিলো। ইমন, তুহীন কিংবা মারুফ তারা ওর মায়ের সাথে যাবে কি যাবে না তারা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না। লিখন দেশে থাকলে লিখন কি সিদ্ধান্ত নিতো সেটা আমি জানি না, তবে, খুব একটা সুখকর অভিজ্ঞতা হতো বলে আমার জানা নাই। বড্ড খারাপ লাগলো কথাতা শুনে যে, যে মা আজীবন ছেলেদের জন্য জীবন দিয়ে দিলো, যে মা এতোটা বছর ওদেরকে বুকে পিঠে মানুষ করলো সেই মাকে করোনায় মারা যাওয়ার কারনে মানিকগঞ্জে গোরস্থানে একমপ্যানি করবে কি করবে না সেটাই এখন সবচেয়ে যেনো বড় প্রশ্ন। আসলেই পৃথিবীটা খুবই সার্থপর একটা জায়গা। এখানে মানুষ নিজেকে ছাড়া আর কারো কথাই সে ভাবে না।

গ।       লিজি আপা যখন বিল্ডিং বা বাড়ি বানানোর জন্য তার বাবার সম্পত্তির উপর সবার কাছে অনুমতি চাইলেন, তখন সব ভাইবোনেরা রাজী থাকলেও শুধুমাত্র লিখনদের পরিবার লিজি আপাকে তার বাবার সম্পত্তি থেকে উতখাত করার জন্য একেবারে উঠেপড়ে লেগেছিলো। লিখনের সাথে একজোট হয়েছিলো ওর স্ত্রী শিল্পীও, যদিও শিল্পি লিজি আপার আপন বোনের মেয়ে। লিজি আপার এই বাড়ি বানানো নিয়ে লিখন এবং তার পরিবার (বড় ভাবী সহ) এমন একটা সিচুয়েশ তৈরী করে ফেলেছিলো যে, তুহীন বলেছিলো- যদি লিজি ওখানে বাড়ি বানায়, তাহলে লিজিকে সে খুন করে ফেলবে, মারুফ বলেছিলো যে, লিজিকে সে লাথি লাথিতে ওখান থেকে বের করে দেবে, আর অন্যান্রা বলেছিলো, তারা কখনোই আর মানিকগঞ্জে যাবে না। ইত্যাদি। আমি আর মিটুল সব সময় চেয়েছি যে, লিজি আপা যেনো ওখানে বাড়িটা করে। এর জন্য আমি নেপথ্যে থেকে যতো প্রকার সাহাজ্য করার দরকার, আমি সেটাই করেছি। আজ ঠিক এই মুহুর্তে মানিকগঞ্জে লিজি আপার ৬ তালা বিল্ডিং সায় দাঁড়িয়ে। বড় ভাবীর মৃত্যু দিয়ে আল্লাহ এমন সময় ওদেরকে মানিকগঞ্জে নিয়ে গেলেন যখন ওরা সবাই দেখল লিজি আপার ৬ তালা বাড়ি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, আজ সেই লিজি আপার বাড়িতেই সবার আশ্রয়। কি অদ্ভুদ না? আল্লাহ জুলুমকারীকে এবং অহংকারীকে কিছুতেই পছন্দ করেন না। সমস্ত দম্ভ ভেংগে দিয়ে আজ আল্লাহ এইসব সদস্যদেরকে একেবারে সেই লিজি আপার বাড়িতেই উঠাইলো। কিছু কি শিখতে পারলো ওরা?

ঘ।       মজার ব্যাপার হলো, যেদিন লিজি আপা মানিকগঞ্জে বিল্ডিং এর কাজে হাত দিলেন, ঠিক সেই সময়ে লিখন আমেরিকায় গিয়েছিলো রুটিন ভিজিটে। কি এক অদৃশ্য শক্তিতে আল্লাহ লিখনকে ভিসা জটিলতায় এমনভাবে আটকে দিলো যে, লিখন আর বাংলাদেশেই আসতে পারলো না। লিখন বলেছিলো যে, সে যদি দেশে থাকে তাহলে লিজি আপা কিভাবে বাড়ি বানায় সেটা সে দেখে নেবে। লিজি আপার পিতার ভিটা, তার নিজের হকের জমি, লিখনের জমিও না, অথচ লিখনের এই রকম দাম্ভিকতা আল্লাহ নিশ্চয় পছন্দ করেন নাই। কোনো না কোনো অজুহাতে আল্লাহ ঠিক তার ম্যাকানিজমে একেবারে সুদুর আমেরিকায় এমন করে বন্দি করে দিলো যে, ওর বাংলাদেশের চাকুরীটাও আর নাই, আর আমেরিকায় ৭/১১ দোকান গুলিতে খুবই সস্তায় একটা জব করতে বাধ্য হলো। এই ঘটনাটা আর যে কেউ যেভাবেই দেখুক, আমি দেখি আল্লাহর ন্যায় বিচারের নমুনা।

ঙ।       এখানে একটা কথা না বললেই না। মারুফের ছেলের বয়স মাত্র ৩ বছর। বড় ভাবী তার নায় নাতকুরের জন্য ছিলেন ডেডিকেটেড। সারাক্ষন তাদেরকে খাওয়ানো, পরানো, বাইরে নিয়ে গুরিয়ে আনা, কোথাও বেড়িয়ে আনা ইত্যাদি কাজগুলি খুব আদরের সাথে করতেন। আর তার নাতি নাতকুরেরাও বড় ভাবীর প্রতি খুবই ভক্ত ছিলো। কিন্তু যেদিন বড় ভাবীর করোনা ধরা পড়লো, ঠিক সেদিন থেকে মারুফের ৩ বছরের ছেলে মশারী তাংগীয়ে যে এক ঘরে বসে গেলো, ভুলেও সে আর তার দাদীর কাছে আসে নাই। সে বারবার বলতো যে, সে করোনায় ভয় পায় এবং সে তার দাদীর কাছে আসতে চায় না। বড় ভাবীর মরার আগ পর্যন্ত এই অবুঝ বাচ্চাটাও আর ভাবীর কাছে আসে নাই। কি নির্মম তাই না?

যাই হোক, আমি এই কথাগুলি বলে কাউকে ছোট করতে কিংবা আল্লাহ ওদেরকে শাস্তি দিয়েছেন এটা ভাবি না। শুধু ভাবী যে, মানুষের উচিত বান্দার হক সব সময় ফিরিয়ে দেয়া। এ জগতে কেউ থাকে না, থাকবেও না। কিন্তু আজ যে কর্মগুলি আমরা রেখে গেলাম, সেটার ফলাফল সে পাবেই।

এইমাত্র মিটুল বড় ভাবীর দাফনের পর বাসায় এলো। বেশ কিছু জানতে ইচ্ছে করল। যেমন, লিখন আমেরিকায় আছে, ওর মা মারা গেলেন, লিখন কি রকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, ছটফট করেছে কিনা, না আসার কারনে, কিংবা অনেক মন খারাপ করে ওর মার জন্য কান্নাকাটি করছে কিনা ইত্যাদি। মিটুল জানালো যে, যখন ভাবীকে দাফনের নিমিত্তে কবরে নামানো হবে, তখন অনেকেই ভাবীকে দেখার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলো। কেউ কেউ আবার ভিডিও ও করেছিলো। ওই সময় নাকি ইমন এবং মুবীন লিখনকে ফোন করে জানিয়েছিলো লিখন ভাবীর ভিডিও দেখতে চায় কিনা, কিংবা কিছু বলতে চায় কিনা। লিখন নাকি উত্তর দিয়েছিলো যে, সে কনো কিছুই দেখতেও চায় না, না ওর ছেলেমেদেরকে দেখতে দিতে চায়। এই ব্যবহারের অর্থ শুধু জানে লিখন। যাই হোক, ইতিহাস এটাই।

আজ থেকে হাসমত আরা (ভাবীর নাম) নামে কোনো মহিলার আনাগোনা এই দুনিয়া থাকলো না। কয়েকদিন সবাই তাকে নিয়ে হয়তো গল্প করবে, হাহুতাশ করবে, কেউ কেউ হয়তো তার অভাব ফিল করবে, কেউ আবার তার কথা ভুলেই যাবে। সময় তাকে আরো বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। এক সময় হাস মত আরা নামে কোনো মহিলা এই দুনিয়ায় ছিলো এটাই কেউ জানবে না। মানিকগঞ্জের বাড়িই বা কি, সন্তানই বা কি কোনো কিছুই আর নাই।  এটাই জীবন। জীবন সব সময় মৃত্যুর কাছেই পরাজয় বরন করেছে, আর করবেও। বড় ভাবী এখন ৩ হাত মাটির নীচে অন্ধকার কবরে একা এবং তার সাথে আর কেহই নাই। না তার সাধের বিছানা, না নায় নাতকোর, না আমেরিকার কোন সুসংবাদের কাহিনী।

আমি সব সময় মৃত মানুষের জন্য দোয়া করি।  ভাবীর জন্যেও আমি দোয়া করি। তার উপরে আমার কোনো রাগ নাই।

২৬/০১/২০২১-লিখনের মা মারা গেল

সারাদিন বাসাতেই ছিলাম। এ কদিন বাসাতেই ছিলাম আসলে কারন আমি কোনো কিছুতেই গন্ধ পাচ্ছিলাম না। দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়েছিলাম। ফোনটা সাইলেন্ট করা ছিলো। ফলে অনেকেই ফোন করেছিলো বুঝতে পারি নি। এই মাত্র ১০ মিনিট আগে ঘুম থেকে উঠে কিছু নাস্তা করলাম। দেখলাম অনেকক্ষন যাবত মিটুল ওর ভাই বোনদের সাথে কথা বলছিলো। বিষয় ছিলো ‘বড় ভাবীর অসুস্থতা”। বড় ভাবী বেশ কয়েকদিন যাবত করোনার কারনে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। লাইফ সাপোর্টে ছিলো। হটাতই মিটুলের চিৎকার শুনলাম। বুঝলাম, ভালো খবর নাই।

কানতে কানতেই ড্রইং রুম থেকে আমার রুমে এসে বল্লো যে, “বড় ভাবী আর নাই”। ইন্না নিল্লাহে পড়ে বললাম, ভাবীর জন্য দোয়া করো, এ ছাড়া তো আর কারো কিছুই করার নাই।

মৃত মানুষের উপর কোনো রাগ রাখতে নাই। এই মুহুর্তে বড় ভাবীর উপরেও আমার কোনো রাগ নাই। তবে যতোদিন উনি জীবিত ছিলেন, তার উপর আমার একটা প্রচ্ছন্ন রাগ ছিলো। আর রাগটা নিতান্তই আমার কারনে নয়। মানুষ যখন জেনে শুনে ইনসাফ করে না, তার জন্য আমার রাগ হয়। বড় ভাবীর উপরেও আমার এই একটা কারনে বেশ রাগ ছিলো।

বড় ভাবীর ছেলে লিখন ভালো চাকুরী করে। কিন্তু তার চাকুরীর সমমর্যাদার মতো তার মধ্যে ইনসাফের অনুপাতটা একই রকম ছিলো না। লিজি আপা যিনি কিনা বাবার হক প্রাপ্য এবং লিজি আপাকে এই লিখন এবং তার পরিবার যে কোনো ভাবেই হোক, তার সেই বাবার হক থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে যতটুকু শক্তি প্রয়োগ করা যায়, সেটাই করার চেষ্টা করেছিলো। আমি এই অন্যায়টা যেনো না হয় তার ১০০% বিপরীতে দাড়িয়েছিলাম। শেষ অবধি লিজি আপারই জয় হয়েছিলো আল্লাহর রহমতে। কোনো একদিন আমি বড় ভাবীকে একটা কথা বলেছিলাম যে, যেদিন মারা যাবেন, সেদিন যেনো সবার হক সবাই পেয়েছে কিনা সেটা মন থেকে জেনে তারপর মারা যান। তানা হলে এর কৈফিয়ত দিতে দিতে আল্লাহর কাছে ঘেমে যাবেন। যদি লিখন কোনো অন্যায় করে থাকে, তাহলে মা হিসাবে লিখনকে বুঝানো দরকার যে, এটা অন্যায়। এটুকু বল্লেও আপনার পক্ষে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা হয়, আপনি বেচে যাবেন।

আজ বড় ভাবীর সমস্ত ফাইল ক্লোজড। উনি মাত্র ১০ মিনিট আগে ইন্তেকাল করলেন। (রাত সাড়ে আটটায়)। লিখনকে কোনো প্রতিবাদ করেছিলেন কিনা জানি না। তারপরেও আমি তার জন্যে দোয়া করি তিনি যেনো জান্নাতবাসী হোন।

লিখন আমেরিকায় ভিসা জটিলতায় এমনভাবে আটকে আছে যে, না সে ঢাকায় আসতে পারতেছে, না ওখানেও ভালো কোনো জব করতে পারতেছে। ছেলেটার মধ্যে ভীষন রকমের খারাপ কিছু এটিচুড আছে যা ওর সাথে মানায় না। যাই হোক, যে যেভাবে চলে হয়তো ঈশ্বর তাকে তার পূর্ন প্রতিদান সেভাবেই দেন। কারো জন্য বদদোয়া আমি করি না। কিন্তু আমি সবার জন্য ইনসাফ করতে সর্বদা আগ্রহী।

আল্লাহ ভাবীকে জান্নাত বাসী করুন।

২৬/০১/২০২১-ভাবীর (লিখন) শেষ অনুষ্ঠান

গত ১/১২/২০১৯ তারিখে কোরবানীর পরপরই আমাদের বাসায় একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান ছিলো। সেদিনই ছিলো বড় ভাবীর জন্য তার জীবনে আমাদের বাসায় শেষ অনুষ্ঠান। আর আজ ২৬/০১/২০২১ তারিখ। এই দুইটি তারিখের মধ্যে মোট দিন ছিলো ৪২২ দিন অর্থাৎ ১ বছর ১ মাস ২৫ দিন।

আমরা প্রায়ই বলি, আমাদের আয়ুষ্কাল নাম্বারড। কিন্তু কোন তারিখ থেকে এই নাম্বারটা কাউন্ট ডাউন হচ্ছে সেটা আমাদের কারোরই জানা নাই। সেদিন ১/১২/২০১৯ তারিখে বড় ভাবীকে আমরা খুব স্বাভাবিক একজন সুস্থ্য মানুষ হিসাবেই আনন্দে মেতেছিলেন দেখেছিলাম। উনি আসলেন, সভাবসুলভভাবেই সবার সাথে কথা বললেন, দেখা করলেন, খাওয়া দাওয়া করলেন, সবার সাথে ছবি তুল্লেন, একসময় সবার সাথে বাসায়ও চলে গেলেন।

উনি কেমন মানুষ ছিলেন সেটার বিবেচনার ভার আজকের দিনের প্রতিটি মানুষের কাছে ভিন্ন। কারো কাছে তিনি দেবীর মতো, কারো কাছে তিনি অতি প্রিয়জন, কারো কাছে আবার অপ্রিয় মানুষের মতো কিংবা কারো কাছে হয়তো কিছুই না। আমি তাকে সব সময়ই পছন্দ করতাম। কিন্তু একটা জিনিষ আমার কাছে সারা জীবন ঈসশরের কাছে রহস্যের মতো প্রশ্ন থেকেই ছিলো। আর সেটা হচ্ছে, কেনো ঈশ্বর কোনো অবলা মেয়ে মানুষকে তার সংগীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অনেকদিন বাচিয়ে রাখেন? এর উল্টাটা তো হতে পারতো বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে? এসব মহিলাদের অনেক কষ্ট থাকে একা একা বেচে থাকার। কেনো বলছি এ কথাটা?

এর কারন, যখন কোনো অবলা নারী তার সংগীর বা স্বামীর অনেক পরে তার জীবন অবসান ঘটান, তাদের অনেক বেদনা থাকে, অনেক চাওয়া থাকে কিন্তু তার সেই বেদনার অংশীদার তিনি কাউকে না দিতে পারেন, না বলতে পারেন। নিজের মনের মধ্যেই সব চেপে রাখেন। তার সংগী যখন আর বেচে থাকে না, তখন তার অনেক ইচ্ছা অনিচ্ছার মুল্যায়ন আর প্রাধান্য থাকে না। আমি এই তথ্য কথাটা বড় ভাবীর ব্যাপারে বলছি না। আমি আমার মাকেও দেখেছি। আমার বাবার অনুপস্থিতিতে আমার মাকেও কারো না কারো উপরে এমনভাবে নির্ভরশীল হতে হয়েছিলো যেখানে নিজের বাক স্বাধীনতা কিংবা ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারতেন না। তাই, একটা বিধবা মহিলার থেকে অসহায় আর কোনো মানুষ হয় না। এই অসহায়ত্ত খাবারের জন্য নয়, এই অসহায়ত্ত কোনো স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নয় যে, তিনি তার ইচ্ছেমতো যেখানে সেখানে ঘুরে ফিরতে পারেন না এমন। এই অসহায়ত্ত অন্য রকমের। অনেক কিছুই আর নিজের থাকে না যা এক সময় ছিলো। সংগীর অবর্তমানে যেনো সব কিছু হারিয়ে যায়। চাপিয়ে রাখে নিঃশ্বাস, দমন করে রাখেন আশ্বাস, কিংবা অন্ধ হয়ে থাকেন তার নিজের বিশ্বাস থেকে অথবা কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধেও। কিন্তু সব কিছু তারা বুঝেন, জানেন, ভাবেন কিন্তু বলার শক্তি থাকে না।

যাক যা বলছিলাম, সেই ১/১২/২০১৯ থেকে ভাবী কি জানতেন যে, তার দিনগুলি ক্রমশ ফুরিয়ে যাচ্ছে? তিনি যদি জানতেন যে, আজ এই ১৬/১/২০২১ তারিখের পর আর এই পৃথিবীর কোনো কিছুই তার থাকবে না, তাহলে হয়তো তিনি গুনতেন একটি একটি করে দিন, ক্ষন সেকেন্ড আর মুহূর্ত যে, তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন শেষ দিনটার জন্য। ঈশ্বর এই দুটু তারিখ মানুষের বা প্রানীর জীবন থেকে এমনভাবে লুকিয়ে রেখেছেন যে, আজ অবধি কারোরই, হোক সে ক্ষমতাধর কোনো সম্রাট, কিংবা অতি জাদরেল বিচারপতি কিংবা সম্পদের অঢেল মালিক, জানার কোনো উপায় নাই। ভাবীও জানতেন না যে, গত ১/১২/২০১৯ তারিখে যে, ভাবীর আর মাত্র ৪২২ দিন ব্যালেন্স ছিলো।

হয়তো এমনি একটা মুহুর্ত আমার জীবনেও আসবে যার ইতিহাস এবং আমার জীবনের নাম্বারটা আজ থেকে কত ব্যালেন্স আছে বা ছিলো সেটা হয়তো কেউ লিখবেন।

(বড় ভাবীর জন্য জান্নাত কামনায় তাকে উতসর্গ করা এই লেখা)

  

৩১/০৫/২০২০-চৌধুরী বাড়ির অসমাপ্ত গল্প

ইহা কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, শুধু চরিত্রের নামগুলি কাল্পনিক

চৌধুরী বাড়ির মেয়ে অনন্যা। আর অনন্যা আমার স্ত্রী। আমি যখন প্রথম ওকে দেখি, কতটুকু ভালো লাগিয়াছিল সেটা আমি আজ এই মুহুর্তে বলিতে পারিব না, কিন্তু আমার ভালো না লাগিলে বিবাহের দিন আমি এতদূর পাগলের মত পথ পারি দিয়া, বলা যায় সাত সমুদ্র তেরো নদী আর ঝড় জান্ডা পারি দিয়া অনন্যাকে একা একাই বিয়ে করিতে আসিতাম না। যাই হোক, যখন আমি অনন্যাদের সাথে পরিচিত হই, তখন খুব যতসামান্যই ওদের পরিবার সম্পর্কে জানিতাম। আর ওদের পরিবার সম্পর্কে আমার জানারো কোনো আগ্রহ তেমন ছিলো না। আমি শুধু অনন্যাকে চাহিয়াছিলাম, আর কিছুই না। ওদের জগত কি রকম, ওদের পরিবার কি রকম, ওদের আত্তিয় সজনের মধ্যে কার কি রকম সম্পর্ক, ভালো না খারাপ, তা আমার কাছে কোনো মুল বিষয় ছিলো না, আজো নাই। কিন্তু আজ অনন্যার সাথে আমার ৩২ বছর দাম্পত্য জীবন পার হইলো। এই ৩২ বছরে আমি না জানিতে চাহিলেও কোনো কিছুই আর জানার বাকী রয় নাই। ফলে আজ কেনো জানি মনে হইলো, আজকের এইদিনে অনন্যাদের পরিবারের কিছু ইতিহাস তুলে ধরি, যা হয়তো পরবর্তী কোনো জেনারেশনের জন্য জানিতে ভালোই লাগিবে হয়তো। আর যদি কেউ নাও জানিতে চান, তাহাতেও কিছুই যায় আসে না।

                          

এনাম উদ্দিন ছিলেন অনন্যার দাদা চিলেন। তার তিনপুত্র, সালাউদ্দিন চৌধুরী, আজিমুদ্দিন চৌধুরী এবং ডাঃ লতুব উদ্দিন চৌধুরী। সালাউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন সবার বড়, আজিমুদ্দিন সাহেব ২য়। লতুবউদ্দিন সাহেব ছিলেন তদানিন্তন ইষ্ট পাকিস্থানের খুব নামকড়া সরকারী ডাক্তার। এনাম উদ্দিনের সব সন্তানেরা মোটামুটি ভালোভাবেই যার যার সংসার নিয়া আনন্দের সাথেই একান্নবর্তী পরিবার হিসাবে বসবাস করিতেছিলেন। এনামুদ্দিন সাহেব ছিলেন অনেক রাগী একজন মানুষ, বুদ্ধিমান এবং বৈষয়িক। তাহার এই তিন ছেলেরাও রুপগঞ্জে, তাহাদের পৈত্রিক জন্মস্থানে বেশ সুপরিচিত মানুষ। দেশ স্বাধীনের কালে সবাই অনেক ভুমিকা রাখিয়াছেন। তাহারা প্রকৃতপক্ষেই ভালো মানুষ হিসাবে বেশ পরিচিত ছিলেন। কিন্তু এই ভালো মানুষগুলির শান্তি বেশীদিন টিকিলো না। আর ইহার প্রধান কারন এনাম উদ্দিন চৌধুরীর দ্বিতীয় ছেলে আজিম উদ্দিনের কয়েক বছর আগে বিবাহিত রমনীর কারনে।

গল্পটার পটভূমিকা যদি আরম্ভ করি, তাহা হইলে এইরুপ দাড়ায়ঃ

এনাম উদ্দিনের তিন ছেলেই বিবাহিত। তবে সালাউদ্দিন চৌধুরীর বিয়ে হয়েছে অনেক বছর আগে। সালাউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী জয়তুন্নেসা চৌধুরীকে অতি স্নেহ করিয়া এবং আট দশটা সুন্দুরী মেয়ের থকে বাছাই করিয়া এনাম উদ্দিন চৌধুরী সালাউদ্দিন চৌধুরীর ধুমধাম করে বিয়া করাইয়াছিলেন। এই সংসারের প্রানবন্ত যে সদস্যটি ছিলেন, জয়তুন্নেসা চৌধুরীকে বলা হইলে কোনো ভুল হইবে না। কোরবানীর গরুটা কেমন কেনা হইয়াছে, কিংবা হাটে গিয়া আজ কাহার জন্য কি কিনিলে কে কতটুকু খুশী হইবে, এমন এমন অনেক বিশয়ে জয়তুন্নেসা চৌধুরীর মতামত না লইলে যেনো কাজটা সঠিক হইয়াছে কিনা এনাম উদ্দিন চৌধুরীর যেনো মন ভরে না। জয়তুন্নেসা চৌধুরীর গর্ভের সন্তানগুলিও যেনো এনাম উদ্দিনের প্রিয়তমা মানুষগুলির মধ্যে অন্যতম।

আজিম উদ্দিনের বিয়াও এনাম উদ্দিন চৌধুরী নিজের ইচ্ছামতোই তাহার পছন্দসই মেয়ে খুজিয়া বাহির করিলেন। আজিম উদ্দিনের বিয়া হইয়া গেলো। ধরি আজিম উদ্দিন চৌধুরীর সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর নাম জাহুরুন্নেসা। অন্যদিকে অতি স্বনামধন্য ডাক্তার লতুব উদ্দিন চৌধুরীর বিয়াটা অবশ্য এনামউদ্দিনের ইচ্ছাতে হইলো না। লতুবউদ্দিন তাহার কর্মস্থলে তাহার অধীনেই কর্মরত এক নার্সকে বিয়া করিয়া স্ত্রী করিয়া বসিলেন। সেই গল্প আরেকদিন করিবো। আজ সালাউদ্দিন চৌধুরীর গল্প করিতে বসিয়াছি, তোমাদেরকে তাহার গল্পটাই বলি।

দিন যায়, রাত যায়, মাস যায় বছর যায়। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে এনাম উদ্দিনের পরিবারেও ঋতু পরিবর্তনের মতো কিছু কিছু পরিবর্তন আসিতে দেখা গেলো। এই বিশ্বভ্রমান্ডে কালের বিবর্তনে যেমন নেতা পরিবর্তন হইয়াছে, তেমনি পরিবর্তন হইয়াছে নেতাদের চিন্তাধারা, রুচী এবং তাহাদের পাশে উপবিষ্ট উপদেষ্টাদেরও। আর এই পরিবর্তনের মাঝে যা যা পরিবর্তিত হয় তাহা অনেকের চোখে হটাত করিয়া ধরা না পড়িলেও এনাম উদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের কিছু পরিবর্তন কারো চোখকেই এরাইয়া যাইতে পারে নাই। যে পরিবারে কখনো কেহ হটাত করিয়া তাহার মতামত ব্যক্ত করিবার সাহস করিতে পারিত না, কেহ তাহার পছন্দ অপছন্দ প্রকাশ করিবার ক্ষমতা দেখাইতে পারিত না, সেই পরিবারেই সবার অলক্ষে কোনো এক প্রবক্তা যেনো হটাত করিয়া মাথাচারা দিয়া উঠিয়াছিলো। ক্ষমতার পরিবর্তনের ধারা এই পৃথিবীতে সবসময়ই একটা মীরজাফরীর ছলচাতুরির মধ্য দিয়া হইয়াছে, হোক সেটা প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে, কিন্তু ইহাই সত্য যে, এইরুপই ঘটিয়া থাকে। যতোক্ষন ইহার প্রভাব কাহারো উপর সুর্যালোকের রশ্মির ন্যায় সরাসরি মাথায় পতিত না হয়, ততোক্ষন ব্যাপারটা কাহারো নজরে হয়তো পড়ে না, কিন্তু যখন নজরে পড়ে, তখন ইহার উতপত্তি কখন আর কোথা হইতে হইলো ইহার ইতিহাস খুজিতে গেলে দেখা যাইবে, ইহার বীজ বপন হইয়াছিলো অনেককাল আগে। হয়তো কারো নজরে ইহার ধীরে ধীরে বাড়িয়া উঠার গল্পটা চোখে পড়ে নাই। এই গল্পেরও সেইরুপ একটা ইতিহাস রচিত হইয়াছিলো যেদিন এনাম উদ্দিনের দ্বিতীয় পুত্রের বিবাহ হইয়াছিলো সেইদিন থেকে। জাহুরুন্নেসা যেদিন এনাম উদ্দিনের সংসারে পদার্পন করিয়াছিলো, জাহুরুন্নেসা তাহার চোখ কান খোলা রাখিয়া ইহা বুঝিতে একটুও কষ্ট হয় নাই যে, যদিও সালাউদ্দিন চৌধুরী আর আজিম উদ্দিন চৌধুরী দুই পিঠাপিঠি সহোদর ভাই, কিন্তু কোনো না কোনো কারনে তাহার শশুড়ের কাছে সালাউদ্দিন চৌধুরীর উপর তাহার শশুড়ের ভরষা কিংবা নির্ভরতা যেনো তাহার স্বামী আজিম উদ্দিনের থেকে ঢেড় বেশী। ইহার আরেকটি কারন হইলো যে, আজিম উদ্দিন সংসারের অনেক কিছুরই দায়ভাড় তাহার কাধে তুলিয়া নিতে রাজী ছিলেন না। আরাম আয়েশের জীবন থাকিতে কে বা কারা অযথা সংসারের গ্লানী টানিতে চায়? আজিম উদ্দিন ছিলেন ওই রকমের একজন ব্যক্তিত্ত। কিন্তু আজিম উদ্দিনের স্ত্রী মোটেই তেমন প্রকৃতির ছিলো না। তাহার উদ্দিপনা আর ছলচারুরিতা ছিলো সবার থেকে একটু আলাদা। সালাউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী যদি এনাম উদ্দিন চৌধুরীর সংসারের সব হালকাঠি নাড়িতে পারেন, তাহা হইলে জহুরুন্নেসার কি এমন গুনের অভাব ছিলো যে, তিনি তাহা করিতে পারিবেন না? মনে মনে এই সংকল্প করিয়াই তিনি তাহার গুন আর দক্ষতার পরিচয় দিয়া ধীরে ধীরে শসুড় এনাম উদ্দিনের মন কিভাবে আরো বেশী জয় করা যায়, তাহার দিকে নজর দিলেন। আর ইহার প্রভাব যেনো দ্রুত কোনো ভ্যাক্সিনের মতো তাহার কার্যকারিতা প্রদর্শন করিতে লাগিলো।

সকালে নাস্তা খাইবার আগে কখন এনাম উদ্দিনের চা পানের তৃষা পাইলো, আর জহুরুন্নেসা কখন তাহার জা এর আগে এনাম উদ্দিন সাহেবকে উক্ত চা বানাইয়া জেবুন্নেসার আগে তাহার সম্মুখে পৌঁছাইয়া দিবেন ইহার সময়কাল অতি নিখুতভাবে পরিকল্পনা করিয়া কর্মটি করিয়া জহুরুন্নেসা একটা একটা করে সম্মুখ পয়েন্টে আগাইয়া রহিলেন বলিয়া ভাবিলেন। এইরুপে দুপুরে খাইবার পূর্বে শসুড়ের গোসলের পানি, দুপুরে খাইবার পর তাহার পানের বাটি কিংবা কোথাও বাহির হইবার আয়োজনে তাহার পাঞ্জাবীখানা ভালো মতো ইস্ত্রি করিয়া পরিপাটি করিয়া রাখিয়া শসূর এনাম উদ্দিনের একের পর এক মর্মিতা আদায় করিয়া নিতে লাগিলেন। অন্যদিকে জহুরুন্নেসা আসায় আর শশুড়ের দিকে একটু অধিক খাতির যত্ন করাতে জেবুন্নেসাও যেন ইহাকে ভালো রুপ মনে করিয়াই জহুরুন্নেসাকে তাহার প্রাপ্য ধন্যবাদটুকু দিতে ভুলিলেন না। কিন্তু জয়তুন্নেসা ইহার গুড় রহস্য আর পরিনতি সম্পর্কে কিছুই অবহিত ছিলেন না। আগে যেমন খাইবার আগে শসুড় মহোদয় জেবুন্নেসাকে ছাড়া খাইতে বসিতেন না, কোথাও যাইতে হইলে যেনো তাহাকে না বলিয়া গেলে যেনো যাওয়াটাই সার্থক হইবে না ইত্যাদির একটা রেশ মনে মনে খসখস করিত, ইদানিং ইহাতে বেশ ভাটা পড়িয়াছে বলিয়া মনে হইলো। বরং উক্ত স্থানটি ক্রমশই জয়তুন্নেসা হারাইতে লাগিলো আর জহুরুন্নেসা যেনো ইহার উত্তরাধিকারী প্রাপ্ত হইতে লাগিলেন। এই ক্ষমতার পালাবদলে যাহা হইলো তাহা বড় নিদারুন। এখানে একটা কথা না বলিলেই চলে না যে, এনাম উদ্দিনের সবচেয়ে খারাপ গুনের মধ্যে একটি ছিল, তিনি কানকথা শুনিতেন। আর এই কানকথার সত্যতা অসত্যতা কোনো কিছুই যাচাই বাচাই না করিয়া কান ভারী হইয়া গেলে যাহা হয়, তিনি তাহাই করেন। জুহুরুন্নেসাও তাহার শশুড়ের এই বদগুন টির সদ্ব্যবহার করিয়া শশূরের কাছাকাছি যাইবার জন্য শশুড়ের কর্নে যাহা যাহা গর্ভপাত করিলে উত্তম ফল পাওয়া যাইবে, তাহা জহুরুন্নেসা প্রয়োগ করিতে বিন্দুমাত্র কার্পন্য করিলেন না। যাহা সত্য তাহাও ঢালিলেন, যাহা সত্যের কাছাকাছিও নহে, তাহাও ঢালিলেন। ইহাতে বসন্তের সুবাতাসের মতো জহুরুন্নেসার জন্য আশীর্বাদ হইয়া আসিলেও জয়তুন্নেসার জন্য চৈত্রের হাহাকার মম কু-বাতাশই চারিদিকে বহিয়া আনিয়া মাঠ, ঘাট আর সংসারের উত্তাপ ছরাইতে লাগিলো। একটা সময় আসিলো যখন এনাম উদ্দিন যেনো আর জয়তুন্নেসার ছায়া পর্যন্ত মারাইতে চাহিতেন না। জয়তুন্নেসা ক্রমশই এনাম উদ্দিন চৌধুরীর কাছে একটা বিষময় চরিত্রে আর জহুরুন্নেসা যেনো একটা অমৃত শরবতে পরিনত হইতে লাগিলেন। এই জহর আর অমৃতের খেলায় শেষ পরিনতি যেদিকে যাইতেছিলো তাহা বড় বিপদজনক। কারন এনাম উদ্দিন এখন আর না জয়তুন্নেসাকে সহ্য করিতে পারেন, না সালাউদ্দিন চৌধুরীকে সহ্য করিতে পারিতেছেন। ইহার রেশে সালাউদ্দিন চৌধুরীর সন্তান্দাদি যাহারা এনাম উদ্দিনের বুকের পরম ধন হইয়া কিছুদিন আগেও আছাড় খাইয়া আসিয়া বুকে পড়িত তাহারা এখন তাহাদের দাদার সামনে উপস্থিত হইলেও তিনি দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দেন। আর এই অবুঝ বাচ্চাগুলিও ধুরু ধুরু বুকে তাহাদের দাদার নিকট হইতে কয়েক পলক দূরে গিয়া ইহাই ভাবিতে থাকে, কি হইলো দাদার? আর কি কারনেই বা তাহাদের আর তিনি ভালবাসেন না? এই প্রশ্নের উত্তর তাহারা তাহাদের পিতামাতাকে শতবার জিজ্ঞাসা করিয়াও কোনো ভালো জবাব পান নাই। অন্যদিকে সালাউদ্দিনের সন্তানদের স্থলাভিষিক্ত হইয়া জহুরুন্নেসার সন্তানগন কচ্ছপ গতিতে নয়, বরং উড়ন্ত কোনো ধুমকেতুর ন্যায় সেই কোনো অজানা মহা বিশ্ব থেকে হাজার মাইল বেগে উল্কা পিন্ডের মতো ধপাস করিয়া এনাম উদিন চৌধুরীর বুকে আসন গ্রহন করিতে কোনো বেগ পাইতে হইতেছে না। আর এই মহা উতসবে যেনো জউরুন্নেসার সন্তান গন পেটুক কোনো ঈগল পাখীর মতো গরম গরম খরগোসের নরম নরম দেহভোজন করিতেছে, আবার কেহ কেহ এইমাত্র নামানো গামলা থেকে ময়রার মিষ্টি ভান্ডার হইতে মিষ্টি নামাইয়া রসগোল্লা ভক্ষন করিতেছে। কেউ আবার আপেল চিবাইয়া রসাসসাধন করিতেছেন।

ধীরে ধীরে পরিস্থিতি এমন হইয়া দাড়াইলো যে, এনাম উদ্দিন তাহার দুই ছেলে ব্যতিত যেনো বড় ছেলে সালাউদ্দিন চৌধুরীকে ছেলে বলিয়াই আর মানিয়া নিতে পারিতেছিলেন না। অথচ সালাউদ্দিন চৌধুরী কিংবা জয়তুন্নেসা চৌধুরী কিংবা তাহাদের সন্তানেরা ইহার পিছনে কোন মহাবিপর্যয় বা কোন মহামারী কাজ করিতেছে ইহার আভাষ পর্যন্ত বুঝিতে পারিলেন না। এতো কাছ হইতে যে জহুরুন্নেসা নামক একটি প্রলয়ংকারী ঘুর্নীঝড় এতো দ্রুত বেগে তাহাদের সবার অলক্ষে ধাবিত হইতেছিলো ইহার বিন্দুমাত্র আভাষ না সালাউদ্দিন চৌধুরী, না আজিম উদ্দিন কিংবা না এতো নামকরা চিকিৎসক লতুব উদ্দিন কেহই বুঝিতে পারিলেন। তাহাদের সবার সম্পর্কটা যেনো এখন অনেক দূরের কেউ। এনাম উদ্দিন চৌধুরী কারনে অকারনে, যেখানে সেখানে, যার তার কাছে যখন খুশী যেভাবে খুশী এক তরফা সালাউদ্দিন চৌধুরীকে সর্বত্র, সব বিষয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিলো করিয়া তেনোভাবে অপমান করিয়া যেমন মনের সাধ মিটাইয়া মজা পাইতেছিলেন, অন্যদিকে সালাউদ্দিন চৌধুরী এবং তাহার স্ত্রী পরিজন সন্তান সন্ততীরা শংকিত হইয়া ঘরকুনো ব্যাংগের মতো দিনানিপাত করিয়া এই ভরষায় সময় পার করিতেছিলেন, কখন এনাম উদ্দিন চৌধুরীর রাগ আর জিদ কমিয়া আসে। কিন্তু এনাম উদ্দিন চৌধুরীর রাগ বা জিদ কিংবা ঘৃণা কোনোটাই কমিবার লক্ষন নাই। মহাসমুদ্রের গহীন অঞ্চল হইতে উত্থাপিত ঘুর্নিঝড় সাত প্যাচে পেচাইয়া যখন ইহা মহাপ্রলয়ংকের রুপ ধারন করিয়া জলভুবন ছাড়িয়া স্থলে প্রবেশ করে, তখন তাহা নিজ আবাসস্থল হারানোর কারনে যেনো সমস্ত রাগ আর জিদ সাথে অভিমানের আক্রোশ লইয়া তাহার চলমান রাস্তায় যাহাই পরুক না কেনো কেউ যেমন ইহার প্রলয়কারী ধ্বংসযজ্ঞ হইতে রেহাই পায় না, তেমনি এনাম উদ্দিন চৌধুরীর মনের ভিতর হইতে উত্থিত রাগ আর জিদ যেনো ক্রমশই বাড়িতে বাড়িতে এমন এক চূরায় উত্তির্ন হইয়াছিলো যে, ইহার ফলশ্রুতিতে সালাউদ্দিন চৌধুরীর রান্না ঘর পর্যন্ত আলাদা হইয়া গেলো, শোবার ঘর আলাদা হইয়া গেলো, তাহার বাল বাচ্চাদের মুখরীয় পদচারনা সীমিত হইতে আরো সিমিত হইয়া শুধুমাত্র একটা ছোট ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ হইয়া গেলো। একসময় এমন হইয়া গেলো যে, এনাম উদ্দিন চৌধুরী তাহাদের সাথে কথা বলাও বন্ধ করিয়া দিলেন। যদিও এনাম উদ্দিন ঘরের মধ্যে কথা বলা বন্ধ করিলেন কিন্তু ঘরের বাহিরে তাহাদের সম্পর্কে বিস্তর কথা বলিতে লাগিলেন। সমাজের যাহারা সালাউদ্দিন চৌধুরীকে চিনিতেন, তাহারা ব্যথিত হইতে লাগিলেন, আর যাহারা এনাম উদ্দিনকে চিনিতেন, তাহারা এনাম উদ্দিনের এইরুপ আচরনে যার পর নাই বিব্রত বোধ করিয়া কেহ কেহ তাহার সহিত সম্পর্ক ছিন্ন না করিতেও দিধাবোধ করিলেন না। আর যাহাদের সহিত এনাম উদ্দিন চৌধুরীর সম্পর্ক বজায় রহিলো, তাহা নাম মাত্র চোখের ইশারা কিংবা কদাচিত দেখা হইলে 'কেমন আছেন,' বা 'কোথায় যাওয়া হইতেছে' ইত্যদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হইয়া রহিলো। 

এনাম উদ্দিন বনাম সালাউদ্দিন চৌধুরীর বাপ-বেটার এইরুপ তিক্ত সম্পর্ক মধুর না হোক, অন্তত কোনো রকমের একটা সুসম্পর্ক বজায় থাকুক এই চিন্তায় সমাজের অনেক গনমান্য ব্যক্তি, এনাম উদ্দিন চৌধুরীর শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুবান্ধব এবং তাহার অতি নিকটস্থ আত্মীয়স্বজনগন কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো গোপনে ডাকিয়া এনাম উদ্দিন চৌধুরীকে জ্ঞান দিতে চেষ্টা করিয়ায়াও খুব একটা সফল তো হইলেনই না বরং উলটা ফল হইলো। এনাম উদ্দিন এবার সালাউদ্দিন চৌধুরী এবং তাহার সব বাল-বাচ্চাদেরকে তাহার ঘরভিটা হইতে উচ্ছেদের হুকুম করিলেন।

চারিদিকে বর্ষাকাল, যখন তখন আকাশ ভর্তি মেঘের ভেলা ভাসিয়া বেড়ায়, কখনো কখনো অগ্রিম কোনো সংকেত না দিয়াই মেঘের ভারে আকাশ তাহার গর্ভ থেকে অবিরত বৃষ্টির জলে এই ধরাকে প্লাবিত করিয়া পরবর্তী ভেলার টানে গুড় গুড় করিতেই থাকে। এমন অবস্থায় সালাউদ্দিন চৌধুরীর পক্ষে অন্য কোথাও তাহার পরিবার লইয়া স্থানান্তর করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি ইহা একটি মানবিক সিদ্ধান্তও হইতে পারে না। সালাউদ্দিন চৌধুরী এতোদিন তাহার বাবার এইরুপ উতপাত কিংবা কঠোর ভতর্সনা কিংবা সত্য মিথ্যার ইতিহাস লইয়া কোনো মাথা ঘামান নাই। ভাবিয়াছিলেন, পিতার বয়স হইয়াছে, মাঝে মাঝে ছোট অবুঝ বাচ্চাদের মতো হয়তো সীমার অতিরিক্ত রাগ করিতেছেন, কিংবা অযথা পাগলামি করিতেছেন, কোন একসময় আবার হয়তো ঠিক হইয়া তাহাকে এবং তাহার পরিবারকে আগের মতো বুকে টানিয়া লইবেন। কিন্তু ইদানিংকালের ঘরবাড়ি হইতে উচ্ছেদের যে আদেশ এনাম উদ্দিন সালাউদ্দিন চৌধুরীকে দিলেন, আর ইহার অগ্রগতির জন্য যেইরুপ চাপের লক্ষন দেখা গেল তাহাতে তিনি শংকিত হইয়া তাহার সহোদর দুইভাই আজিম উদ্দিন এবং ডাঃ লতুব উদ্দিনের সাথে শলা পরামর্শ করিলেন। তাহার দুই সহোদর ভাইয়েরাও তাহাদের পিতার এহেনো অমানিবিক কার্যকলাপে খুশি ছিলেন না। তাই, তাহারা এই ভাবনা হইতে সিদ্ধান্ত নিলেন, তাহারা তাহার পিতাকে বুঝাইবেন এবং তাহাদের বড় ভাই সালাউদ্দদিন চৌধুরীর উপর এইরুপ অহেতুক নির্যাতন বন্ধের অনুরোধ জানাইবেন।

সকল ভ্রাতারা মিলিয়া তাহাদের পিতাকে সবিনয় অনুরোধ করিলেও কোনো কাজ হইলো না। বরং অবস্থার আরো অবনতিই ঘটিলো। এনামউদ্দিন চৌধুরী তাহার দুই ছেলে আজিম উদ্দিন চৌধুরী আর ডাঃ লতুব উদ্দিন চৌধুরীর সম্মুক্ষেই এই বলিয়া আরো অধিক আইন শুনাইয়া দিলেন যে, আগামি সপ্তাহ খানেকের মধ্যে যদি সালাউদ্দিন চৌধুরী তাহার ভিটা ছাড়িয়া অন্যত্র চলিয়া যায়, তাহা হইলে তিনি আইনের দারস্থ হইবেন এবং আইনের সাহাজ্যেই তিনি তাহাকে ঘর মাটি হইতে বিতাড়িত করিবেন।

পিতার এহেনো সিদ্ধান্তে বাড়ির সবাই এমন মর্মাহত হইলেন যে, কাহারো মনে না আছে শান্তি , না আছে কোনো উচ্ছাস। জয়তুন্নেসা চৌধুরী সকল কিছু ভাবিয়াও কোনো কুল কিনারা পাইলো ন যে, কি কারনে বা কোন অপরাধে আজ তাহাদেরকে এইরুপ একটা অমানবিক শাস্তির মোকাবেলা করা হইতেছে। এমন কোনো ব্যবহার, এমন কোনো অনৈতিক আবদার কিংবা এমন কোনো আচরন কি তিনি বা তাহার স্বামী সালাউদ্দিন তাহাদের গোচড়ে বা অগোচড়ে করিয়াছেন যাহাতে তাহার পিতৃতুল্য শ্বশুর মনে আঘাত পাইয়াছেন বা কষ্ট পাইয়াছেন? অদূর অতীতের সমস্ত দিন কাল ক্ষন কিংবা কাল ক্ষনে ক্ষনে খুজিয়াও এমন কোনো কিছুই পাইলেন না যাহাতে তাহাদের উপর তাহার শ্বশুর মহাশয় এতটাই অমানবিক হইতে পারেন। বরং যেদিন হইতে তাহার শ্বশুর তাহাদের সহিত এই রুপ বিরুপ আচরন করিতে শুরু করিলেন, সেই সময় হইতে তাহারা আরো অধিক ভাল আচরন, কিংবা কি করিলে শশূরের মন মেজাজ ভালো থাকিবে সেই প্রচেষ্টাই করিতেছিলেন। এখানে একটা কথা না বলিলেই নয় যে, সালাউদ্দিন চৌধুরী তাহার অন্যান্য ভ্রাতাদের হইতে অনেক বেশী তিনি তাহার পিতার প্রতি যত্নশীল। তাহার পিতার জর হইয়াছে? তো সালাউদ্দিন চৌধুরী রাত নাই দিন নাই, যেখান হইতে পারেন ডাক্তার আনিয়া আগে পিতার সেবা করিয়াছেন। পিতার প্রতি অন্য দুই ভ্রাতা যতোটা না সংবেদনশীল, যত্নশীল, তাহা হইতে অধিক গুন বেশী সংবেদনশীল এবং যত্নবান সালাউদ্দিন সাহেব। এই কয়েক মাস ধরিয়া এনাম উদ্দিন চৌধুরী যতভাবেই সালাউদ্দিন সাহেবকে মানুষের কাছে হেয় করিবার কিংবা তাহাকে ছোট করিবার নিমিত্তে যতোভাবেই অপমান করিবার চেষ্টা করিয়াছেন, সালাউদ্দিন সাহেব কখনোই ইহার প্রতিবাদ তো দূরের কথা, একবার ইহা লইয়া কাহারো সাথে আলাপ অ করেন নাই এবং কেউ যদি কোনো বিরুপ মন্তব্য করিবার প্রয়াস করিয়াছেন, ততক্ষনাত সালাউদ্দিন সাহেব উহার প্রতিবাদ করিয়া পিতাকে কেহ হেয় করিবে ইহা হইতে দেন নাই। আজো তিনি তাহার সেই সভাবের কনো ব্যতিক্রম করিলেন না। বরং অতিশয় বিনয়ের সহিত তিনি তাহার পিতার সামনে গিয়া দুই হাত জোর করিয়া ইহাই প্রার্থনা করিলেন যে, তাহার ছোট ছোত ছেলেমেয়রা পিতার এই বাড়িছারার আদেশে সংকিত হইয়া কেউ কেউ পীড়িত হইয়া গিয়াছে। সালাউদ্দিন সাহেব আরো মিনতি করিলেন যে, তাহারা তো তাহার পিতারই বংশধর, নায় নাতকুর। কোথায় যাইবে তাহারা এই বাড়ি ছাড়িয়া? এমতাবস্থায় যেনো পিতা তাহাকে কোনো ভুল ত্রুটি হইলে ক্ষমা করিয়া তাহার সমস্ত রাগ, গোস্যা, অভিমান ভুলিয়া গিয়া আবারো এই চির পরিচিত ভিতায় থাকিবার দয়া করেন।

কিন্তু এনাম সাহেবের রাগের কোনো সীমা ছিলো না। তিনি এতোটাই উত্তেজনা লইয়া রাগান্বিত স্বরে কম্পিত গলায় সালাউদ্দিন চৌধুরীকে এমনরুপে হুংকার দিলেন যে, চৌধুরী বাড়ির অজস্র ঘুমন্ত গাছপালা, পানির কুয়া আর টিনের চালেও ইহার মর্মরধ্বনি প্রতিধ্বনি হইয়া চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলো। যাহারা অন্য মনষ্ক ছিলেন, তাহারাও এই আওয়াজ শুনিতে পাইলেন। একটা প্রচন্ড তীব্র বেগ লইয়া অল্প সময়ের জন্য মনে হইলো একটা চৌধুরী বাড়ির সমস্ত ভিটায় ভুমিকম্প ঘটিয়া গেলো। যাহাদের আত্তায় পানি ছিলো তাহা শুকাইয়া গেলো, আর যাহারা আগেই শুষ্ক ছিলেন, তাহাদের অবস্থা যেনো মৃগী রোগীর মতো ছটফট করিতে লাগিলো। শুধুমাত্র বাড়ির কোনো একটি ঘরে জয়তুন্নেসা মনে মনে শান্তি লইয়া একখিলি পান চিবাইয়া ফুরুত করিয়া একমুখ পানের রস চৌধুরী বাড়ির মস্ত বড় উঠানে ফেলিয়া মৃদু আনন্দ পাইলেন যাহার খবর একমাত্র বিধাতা ছাড়া আর কাহারো গোচরে আসিলো না। এনাম সাহেবের তখনো রাগের পরিসীমা উর্ধমুখী এবং তিনি চিৎকার করিয়া বলিতে লাগিলেন- আজ হইতে সালাউদ্দিন চৌধুরী নামে আমার কনো সন্তান এই পৃথিবীতে ছিলো না, আর নাইও। আজ আমি তাহাকে ত্যাজ্য বলিয়া ঘোষনা করিলাম। আমি কালই ভোরে এই মর্মে আদালতে বয়ান দিবো যে, আমি আমার সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি হইতে সালাউদ্দিন নামক কোনো কু-পুত্রকে বঞ্চিত করিয়া ইতিহাস করিয়া যাইবো।

সালাউদ্দিন চৌধুরী পিতার রাগ আরো বাড়িয়া যাইবে এই ভাবিয়া কোনো উত্তর না করিয়া নীরবে মাথা নীচু করিয়া পিতার সম্মুখ হইতে প্রস্থান করিলেন বটে কিন্তু এই কয়দিনের যতো অপমান, যতো অপবাদ তাহার পিতা তাহাকে দিয়াছে, আজ যেনো সব কিছুকে ছাড়িয়া এমন এক স্তরে গিয়া ঠেকিলো যে, সালাউদ্দিন চৌধুরীর সমস্ত বুক চিড়িয়া উচ্চস্বরে চিৎকার করিতে ইচ্ছা হইলো। কিন্তু তিনি তাহার কিছুই করিলেন না। শুধু চোখের দুইধারে কষ্টের একটা পাহাড় লইয়া অশ্রু ফেলিতে ফেলিতে নিজ ঘরে ফিরিয়া আসিলেন। মনে হইলো পৃথিবীর তাবত মানবকুল আজ সালাউদ্দিন সাহেবের দিকে কটাক্ষ দ্রিষ্টিতে তাকাইয়া অট্টহাসি হাসিতেছে। তাহার নিজ ঘরে আজ যেনো তিনি এক পরাভুত কোন ক্ষত বিক্ষত সৈনিক যাহার যুদ্ধ করিবার শেষ অস্ত্রটুকুও আজ কেউ যেনো কাড়িয়া লইয়াছে।

পরদিন সকাল বেলায় প্রত্যুষে ডাঃ লতুব উদ্দিন তাহার কর্মস্থলে ফিরিয়া যাইবার সময় বড় ভাই সালাউদ্দিনকে এইমর্মে একটি শলাপরামর্শ দিয়া গেলেন যে, যেহেতু তাহাদের পিতা কাহারো কোনো কথা বা উপদেশ শুনিতেছেন না, তুমি বরং কোনো এক উকিলের সাথে সমস্ত বিষয়াদি লইয়া আলাপ করো। হয়তো বা কোনো একটা সুরাহা হইতেও পারে। এই বলিয়া ভারাক্রান্ত মনে লতুব উদ্দিন চৌধুরীও বড় ভাইয়ের গলায় জড়াইয়া ধরিয়া একত্রে কিছুক্ষন অশ্রুপাত করিয়া একে অপরের হইতে বিদায় লইলেন।

শুনিয়াছি, এই পৃথিবীর আদি লগ্ন হইতেই সম্পদ আর নারী বিষয়ক ঘটনা লইয়া ভাইয়ে ভাইয়ে, বা আপন জনের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়, কিন্তু চৌধুরী বাড়ির সন্তানদের মধ্যে কোনো সম্পদ লইয়া না ভাইয়ে ভাইয়ে, না বোনে বোনে এমন কোনো বিদ্বেষ সৃষ্টি হইয়াছে। কিন্তু তাহার পরেও কেনো, কি নিয়া এতো বিদ্বেষ সৃষ্টি হইলো ইহার কোনো গোড়াপত্তন বা ইতিহাস কাহারো জানা নাই। যে রোগের কোনো ঔষধ নাই, তাহার জন্য এক মাত্র ঈশ্বরই ভরষা। এখন সবাই যেনো সেই ঈসশরের কৃপার উপরই নির্ভর করা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখিতে পাইলেন না।

সালাউদ্দিন চৌধুরীর একটা সুনাম অত্র অঞ্চলে সব সময়ই ছিলো। এলাকার জজ ব্যারিস্টার, উকিল মুক্তার সবাই একনামে সালাউদ্দিন চৌধুরীকে চিনিত। যে কোনো জনকল্যাণকর কাজে যেমন সালাউদ্দিন সাহেবকে সবাই কাছে পাইত, তেমনি তাহার দ্বারা কিংবা তাহার ব্যবহারে কেউ কখনো মনে কষ্ট পাইয়াছেন কিংবা ব্যথিত হইয়াছেন এমন কোনো ইতিহাসও কেহ বলিতে পারিবে না। ভাইয়ের এহেনো পরামর্শে সালাউদ্দিন চৌধুরী তাহার অতি পরিচিত গঞ্জের এক ব্যারিস্টারের কাছে শলাপরামর্শ করিতে গিয়া সালাউদ্দিন চৌধুরী আরো একটা খবরে তাহার চিত্ত ভাংগিয়া পড়িলো। তিনি জানিতে পারিলেন যে, গত কয়েকদিন আগে তাহার পিতা এনাম উদ্দিন চৌধুরী কোর্টে আসিয়া একখানা ওয়াকফা দলিল করিয়াছেন। আর সেই ওয়াকফা দলিলে তাহার সমস্ত আওলাদদেরকে বংশ পরাম্পরায় মোতায়াল্লী নিযুক্ত করিলেও উক্ত ওয়াকফা দলিলে সালাউদ্দিন চৌধুরীকে চিরতরে বাদ দিয়া এমন কি সালাউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে-পুলে নায়নাতকুর এবং তাদের যে কোনো স্তরের প্রজন্মকেই এনাম চৌধুরীর বংশের বাহিরে রাখিয়া তিনি দলিল সম্পন্ন করিয়াছেন। ইহার নিগুড় অর্থ দাড়াইলো যে, পক্ষান্তরে এনাম চৌধুরী আক্ষরীক অর্থেই সালাউদ্দিন চৌধুরী এবং তাহার বংশধরদেরকে ত্যাজ্য বলিয়া ঘোষনা করিলেন। এনাম চৌধুরীর কোর্ট কাছারির সংবাদ এখানেই শেষ ছিলো না। তিনি কোর্টের কাছে এইমর্মে আরো একটি নোটিশ দিয়াছেন যে, আগামি একমাসের মধ্যে যেন সালাউদ্দিন চৌধুরী তাহার ভিটাবাড়ি ত্যাগ করিয়া খালি করিয়া দেয়, অন্যথায় এনাম চৌধুরী আইনের আওতায় সালাউদ্দিন চৌধুরীর বিপক্ষে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করিতে পারিবেন।

এতো কিছু শোনার পরেও সালাউদ্দিন চৌধুরী তাহার সেই পরিচিত ব্যারিষ্টার বন্ধুকে কি করা যাইতে পারে তাহার ব্যাপারে একটা বুদ্ধি চাহিলেন।  ব্যারিস্টার বন্ধু সালাউদ্দিন সাহেবকে শুধু এই মর্মে পরামর্শ দিলেন যে, এনাম চৌধুরী যাহা করিতেছেন, তাহা কোনোভাবেই ঠিক কাজ করিতেছেন না। কিন্তু যেহেতু আইনে ত্যাজ্য করিবার একটা বিধান রহিয়াছে, ফলে মানবিক দিক দিয়া সমস্ত আচরন গর্হিত হইলেও আইন তাহাকে বাধা দিতে পারেন না। তারপরেও ব্যারিস্টার বন্ধু আইনের কাছে আরো কিছু সময় চাহিয়া একটা প্রার্থনা করিবার অনুরোধ করিতেই পারেন। হইতে পারে এনাম চৌধুরীর এক মাসের আইনী নোটিশ কোর্ট মানবতার দিক চিন্তা করিয়া সময়টা বাড়াইয়া দিতে পারেন।

সালাউদ্দিন চৌধুরী মন ভারাক্রান্ত লইয়া সন্ধ্যার একটু আগে বাড়িতে ফিরিয়া আসিলেন। আকাশ বেশ মেঘাচ্ছন্ন, মাঝে মাঝে আকাসে বিদ্যুৎ চমকাইতেছে। বাতাস যেনো থানিয়া আছে। হয়তো বা অচিরেই ঘন কোনো বৃষ্টির দলা অবিশ্রান্ত মুষলধারে বহিবার নিমিত্তে আকাশ আরো কিছু রশদ জোগার করিতেছে। চৌধুরী বাড়ির গাছে গাছে এখনো কিছু পাখীর কিচির মিচির শোনা যাইতেছে। বাড়ির ছেলেমেয়েরা যার যার পরার টেবিলে পরা লইয়া বসিবার জন্য বাতি হারিকেন জালাইয়া পরার বইপত্র গুছাইতেছে। চারিদিকে একতা থম্থমে ভাব। সালাউদ্দিন চৌধুরী তাহার ছোট ভাই আজিম উদ্দিনের কাছে বসিয়া নীরবে চুপ হইয়া আছে।

আজিম উদ্দিন নীরবতা ভাঙ্গিয়া সালাউদ্দিন চৌধুরীকে কি যেনো বলিতে গিয়াও আবার বলিতে পারিলেন না। শুধু আমতা আমতা করিয়া কি যেনো বিড়বির করিয়া একটা সিগারেট ধরাইয়া আবারো চুপ করিয়া গেলেন। পৃথিবীতে এমন অনেক রহস্য চারিদিকে চাদরের মতো এমন করিয়া সুপ্ত অবস্থায় থাকে যাহা হইতে কোনো অনিষ্ট হইতে পারে বলিয়া কখনোই কেহ ভাবিতে পারে না, অথচ সেই তাহার সাথেই আমাদের অনেকের বসবাস। উহা এমন এক দূর্ভেদ্য চাদর যাহার অন্তরালে অতি কাছেই অনিষ্ট লুকাইয়া থাকে বটে কিন্তু যাহার দ্বারা সেই অনিষ্ট হইবে তাহাকে কেহই ধরিতে পারে না। আর ইহার মধ্যে যখন এই তথ্য কোনোভাবে ফাস হইয়া কিছুটা আংশিক সত্য প্রকাশ পায়, যিনি জানেন আর যাহাকে যিনি জানিলেন তাহাদের মধ্যে যদি এমন এক বন্ধন তৈয়ারি হইয়া থাকে যাহা না ভাংগা যায়, না রাখা যায় আবার না অন্য কাহারো সাথে তাহা ভাগাভাগি করিয়া উহা বিনাশ করা যায়। বিনাশ করিতে গেলে হয় সম্পূর্ন ভীত নড়িয়া উঠে, আর যদি ভীত ঠিক রাখিয়া কোনোভাবে বিনাশের চেষ্টা করা হয় উহা আর আগের অবস্থায় ফিরিয়া আসে না। উহা নড়বড়ে সেই দাতের মতো যাহা এককালে শক্ত পাথর পর্যন্ত ভাঙ্গিয়া ফেলিতে সক্ষম হইলেও ইহা এখন একটু নারাচারায় এমন তীব্র ব্যথা অনুভুত হয় যে, জীবন আর মরনের মধ্যে ফারাক খুব সামান্য বলিয়া মনে হয়। আজিম উদ্দিন যেনো আজ সেই রকমের একটা তীব্র ব্যথা লইয়া শুধু বিরি ফুকিতে লাগিলেন। তিনি যে তাহার এই বিড়ি পান করিয়া কোনো এক অসীম দুসচিন্তায় মগ্ন, তাহা অন্য কেহ বুঝিতে না পারিলেও বিষণ্ণ আকাশের বুঝিতে কনই কষ্ট হইলো না। অঝোর ধারায় ব্রিষ্টি আসিয়া দুই ভাইকে যেনো অকস্মাৎ ভিজাইয়া দিয়া গেলো।

রাত অনেক হইয়াছে। সবাই যার যার ঘরে যার যার চিন্তায় মগ্ন হইয়া কেউ ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, কেউ ঘুম না আসিবার ফলে বিছানার বালিশ লইয়া এপাশ ওপাশ করিতেছে। আবার কেউ অঝোর ধারার বৃষ্টির ফোটায় টিনের চালের রিমঝিম সুর উপভোগ করিতেছে। সালাউদ্দিন চৌধুরীর দুইচোখে যেনো আজকের কালো রজনী হইতে আর কোনো রজনী ইতিপুর্বে আসিয়াছিলো কিনা তাহার মনে পড়ে না। ঘরের বাহিরের জলের ধারার সাথে সালাউদ্দিন চৌধুরীর নয়নের ধারার মধ্যে আজ যেন কোনো পার্থক্য তিনি বুঝিতে পারিলেন না। বাহিরের বৃষ্টির জল উত্তপ্ত ভুমিকে শীতল করিতে পারিলেও সালাউদ্দিন চৌধুরীর নয়নের জল তাহার অন্তরকে শীতল করিতে পারিতেছে বলিয়া মনে হইলো না।

ঠিক এমনই এক মুহুর্তে, হটাত ঘরে জোরে জোরে করা নাড়ার শব্দে সালাউদ্দিন চৌধুরীর ধ্যান ভাঙ্গিয়া গেলো। তিনি জাগিয়াই ছিলেন। দরজা খুলিতেই তিনি তাহার বৃদ্ধ মাকে হাতে একখানা কুপি লইয়া দরজার ওপাড়ে দাড়াইয়া থাকিতে দেখিলেন। কুপির আলোতে খুব ভালো করে স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন, তাহার মা সমস্ত কিছুর জন্য হয়তো একটু আগেও চোখের জলে বুক ভাসাইয়া আসিয়াছেন। কিন্তু বাংগালি মায়েদের যতোটা ভালোবাসার জোর অন্তরে আছে, সন্তানদের বিপদের সময় তাহাদের হাত ততোটাই শক্তিশালি নয় বিধায় তাহারা শুধু চোখের জলেই ঈশ্বরের কাছে এই বলিয়া শুধু প্রার্থনা করিয়া সন্তানের মংগল কামনা করেন যে, হে ঈশ্বর, তুমি আমার আদরের সন্তানদেরকে ভালো রাখো, আর ভালো রাখো তাদের জীবনধারাকে।। ইহা ছাড়া আর কিছুই করিবার থাকে না এই মমতাময়ি মায়েদের। মায়ের হাতের কুপিটা নিজের হাতে লইয়া সালাউদ্দিন সাহেব তাহার মাকে জড়াইয়া ধরিয়া রহিলেন আর বলিলেন, 'মা, তুমি আমাকে মাফ করিয়া দিও। আমি অতিসত্তরই এই বাড়ি ছাড়িয়া অন্যত্র চলিয়া যাইবো। তুমি বাবাকে দেখিয়া রাইখো। বাবা অনেক একাকী একজন মানুষ। তুমি ছাড়া হয়তো বাবার আর কেহই নাই। তবে যেখানেই থাকি না কেনো মা, যে কোনো প্রয়োজনে, তোমার বা আমার বাবার জন্য আমি আজিবন আমার জীবন উতসর্গ করিয়া যাইবো। আমি কখনো ভাবি নাই যে, আমার দ্বারা এমন কোনো কাজ হইবে যাহাতে আমার প্রানপ্রিয় পিতা বা ভাইয়েরা কোনো কষ্ট পাইবে। অথচ আমি আজ জানিতেই পারিলাম না, কি আমার দোষ বা কি আমার অপরাধ'। মা হু হু করিয়া কান্নায় ভাঙ্গিয়া পড়িলেন। সন্তানের কষ্টে মা আজ এতোটাই আপ্লুত যে, না তিনি তাহার স্বামীকে মানাইতে পারিতেছেন, না তিনি সন্তানকে ছাড়িয়া দিতে পারিতেছেন। মমতাময়ী মায়েদের সবচেয়ে বড় কষ্ট যখন একদিকে সন্তান আর অন্যদিকে থাকে তাহার নিজের স্বামী। ইহা যেনো সেই আদালতের দোয়া চয়েজ, তুমি কি ফাসিতে মরিতে চাও নাকি বিষ পানে? মরিতে তোমাকে হইবেই, হোক সিতা ফাসি অথবা বিষপান। কোনটা রেখে মা কোনটা ফেলবেন তিনি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারেন না। উভয় পরিস্থিতি তাহার জন্য একই। সংকটাপন্ন। না তিনি মরিতে চাহেন, না তিনি বাচিয়া রহিলেন।

সালাউদ্দিনের মাতা বুক ভরা ব্যাথা নিয়া কেনো এতো রাতে ছেলে সালাউদ্দিনের ঘরে আসিলেন তাহাঁর কারনটা ব্যক্ত করিলেন যে, তিনি তাহার স্বামীর মনোভাব বুঝিতে পারিয়াছেন। আগামীকাল ভোর হইলেই তাহার স্বামী পুত্র সালাউদ্দিন এবং তাহার সব সন্তান সান্ততীদেরকেসহ একটি ফৌজদারি মামলা করিতে যাইবেন বলিয়া মনোস্থির করিয়াছেন। তাহাতে যাহা হইতে পারে যে, যদি কোনো কারনে আদালত মামলায় জামিন না মুঞ্জুর করেন তাহা হইলে এই ছোট ছোট নায়নাতকুরগুলির কি অবস্থা হইবে? সালাউদ্দিনের মা এই গহীন রাতে আরো একবার তাহার পিতার কাছে যে কোনোভাবেই হোক, পায়ে ধরিয়া, কান্না করিয়া আগামিকালের মামলা করা হইতে বিরত রাখিতে হইবে বলিয়া সালাউদ্দিনকে তাহার পিতার ঘরে যাওয়ার অনুরোধ করিলেন। কিন্তু সালাউদ্দিন জানিতেন, যদি তিনি পুনরায় তাহার পিতার সম্মুক্ষিন হনও, তাহা হইলে হতে আরো বিপরীত হইবার সম্ভাবনাই রহিয়াছে। ঈশ্বরের উপর ভরষা করিবার জন্য মাকে আরেক তরফা বুঝাইয়া সালাউদ্দিন তাহার মাকে পিতার ঘরে পাঠাইয়া দিলেন।

ঈশ্বর বোকা নন, বোবাও নন, কানাও নন, কালাও নন। তাহাঁর কাছে এই জগতের সব রহস্যা সর্বদা উম্মুচিত। গোপন কোনো কিছুই তাহাঁর কাছে নাই। তিনি অতি ক্ষুদ্র পিপিলিকার জন্য যেমন ন্যায় বিচার করেন, তেমনি বৃহৎ হস্তীসমুহের বেলায়ও কোনো পার্থক্য করেন না। জগতের কোন বৃক্ষরাজি পানির অভাবে শুষ হইয়া যাইতেছে, আর সেখানে কিভাবে তিনি জলপতন করাইয়া সেই শুষ্ক মর্মর পাতাকে আবার জীবন্ত করিয়া তুলিবেন, এই নৈপুণ্যতা ঈশ্বরের কাছে কোনো হেয়ালী বিশয় যেমন নয়, তেমনি কঠিন ব্যাপারও নয়। গহীন অরন্যে কোথায় কোন মেষশাবক তাহাঁর দল হইতে দলচ্যুত হইয়া পথা হারাইয়া ফেলিয়াছে, আর তাহাকে কি প্রকারে আবার পথ দেখাইয়া নিজের আস্তানায় ফিরাইয়া লইতে হইবে ইহার বৈজ্ঞানিক দিকদর্শন ওই মেষশাবকের কাছে না থাকিলেও ঈশ্বর কোনো না কোনোভাবে তাহাকে পথ দেখাইয়া ঠিক নিজের পরিচিত গন্তব্যে লইয়া যাইবেনই। ইহাই ঈশ্বর। তাবত জগতের অধিপতি। কারো উপরই তিনি জুলুম বা মশকরা করেন না। ঠিক এমনি একটা ঘটনা ঈশ্বর পরদিন সকাল বেলায় সবার অগোচরে ঘটাইয়া দিলেন।

অতি প্রত্যুষে এনাম উদ্দিন চৌধুরীর বুক ব্যথা হইতে উপসর্গটা আরম্ভ হইয়া কিছুক্ষনের মধ্যে প্রায় দম বন্ধ হইয়া যাইবার উপক্রম হইলো। তিনি তাহাঁর বিছানা ছাড়িয়া যেনো উঠিবার শক্তি হারাইয়া ফেলিয়াছেন। বাড়িশুদ্ধ মানুষের মধ্যে নানান রকমের গুঞ্জন আরম্ভ হইয়াছে। কেহ কেহ তাহাঁর শাস্তি শুরু হইয়াছে বলিয়া মনে মনে প্রীত হইতেছেন, কেহ কেহ আবার এনাম চৌধুরীর শেষ নিঃশ্বাস শেষ হইবার পূর্বেই সম্পদের ভাগ বাটোয়ারা কিভাবে হইলে কাহার কত লাভ হইবে সেই হিসাব কষিতেছেন, কেউ আবার নির্লিপ্ত হইয়া দেখি কি হয়, কোন ঘাটের জল কোথায় গিয়া পড়ে এই ভাবিয়া দাত কেলাইতেছেন। হন্তদন্ত হইয়া কেউ আবার এনাম উদ্দিন চৌধুরীর ডাক্তার ছেলে লতুব উদ্দিন চৌধুরীকে কোনো একলোক মারফত কিভাবে খবরটা পৌঁছানো যায় সে ভাবনায় অস্থির হইয়া পায়চারী করিতেছেন। এনাম উদ্দিন চৌধুরী নিথর দেহে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় তাহাঁর বিছানায় যেনো একজন মৃত মানুষের মতো পড়িয়া আছেন। তাহাঁর আজ মোকদ্দমায় যাওয়ার কথা ছিলো। সেই অভিলাষ এনাম চৌধুরীর এখন মনে আছে কিনা বুঝা যাইতেছে না। তবে ইহা স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে, তিনি অমানসিক যন্ত্রনার মধ্যে আছেন।

সালাউদ্দিন চৌধুরী ভোরেই নামাজ পড়িয়া অডুরে নদীর ধারে সকালের মুক্ত বাতাসে একটু হাওয়া খাইতে গিয়াছিলেন। তাহাঁর মন মেজাজ সস্তির হইয়াছিলো সারারাত। ঘাটের কেউ তাহাকে সবেমাত্র একতা খবর দিলো যে, তাহাদের বাড়িতে কেউ নাকি খুবই গুরুতর অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছেন, আর সিটা সম্ভবত তাহাঁর বাবা। খবর পাইয়া দ্রুত সালাউদ্দিন চৌধুরী তাহাদের বাড়ির আংগিনায় আসিয়া দেখিলেন, বেশ মানুষের উপস্থিতি। এম্ননিতেই বুকে বল ছিলো না, সারারাত প্রায় জাগিয়াই ছিলেন, তাই শরীরটাও খুব মজবুত নয়। বাড়িতে কাহার কি হইয়াছে জিজ্ঞাসা করিতেই জয়তুন্নেসা এনাম চৌধুরীর অসুস্থের কথা জানাইলেন। সালাউদ্দিন চৌধুরী সরাসরি তাহাঁর পিতার মাথার কাছে গিয়া দেখিতে পাইলেন, নিথর শরীর লইয়া তাহাঁর বাবা বিছানায় পড়িয়া আছেন। তিনি পিতার মুখখানা তাহাঁর হাতে ধরিয়া কয়েকবার 'বাবা, বাবা, বলিয়া ডাকিলেন বটে কিন্তু এনাম উদ্দিন চৌধুরী না সালাউদ্দিন চৌধুরীর ডাকে কোনো সাড়া দিলেন, না তিনি চোখ খুলিয়া জগতে এই মুহুর্তে কি ঘটিতেছে তাহা বুঝিবার জন্য নেত্র উম্মোচন করিলেন। বাবাকে বুকের কাছে জড়াইয়া ধরিয়া সালাউদ্দিন চৌধুরী যেনো অঝোর ধারায় কাদিতে লাগিলেন। পাশে সালাউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রি জয়তুন্নেসা তালপাতার একটা পাখা লইয়া ঘনঘন বাতাস আর সাথে ভিজা একখানা গামছা দিয়া শশুড়ের মুখখানি বারংবার মুছিয়া দিতে দিতে চোখের জল ফেলিতে লাগিলেন। জহুরুন্নেসা তাহাঁর প্রত্যাহিক কর্মের একটি, খাচার পালিত কবুতরগুলিকে মুঠিমুঠি খুদের চাল বিলি করিয়া খাওয়াইতে খাওয়াইতে যেনো মনে মনে কি ভাবিতে লাগিলেন। আজিম উদ্দিন বাবার পাশে আসিয়া বসিয়াছিলেন বটে কিন্তু তাহাঁর কোনো কর্ম নাই বিধায় অধিক্ষন এখানে আর বসিয়া থাকিতে পারিলেন না। তিনিও উঠোনের পাশে পানির কুয়ায় বসিয়া জহুরুন্নেসার কবুতরের সেবা দেখিতে লাগিলেন। অন্যদিকে সালাউদ্দিন চৌধুরী বাবার এইরুপ শারীরিক অসুস্থতায় গভীর আশংকা বোধ করিয়া তিনি দ্রুত গঞ্জের সদর হাসপাতালে লইয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করিলেন।

যখন সদর হাস্পাতালে পৌঁছিলেন, ডাক্তারবাবু দ্রুত এনাম উদ্দিন চৌধুরীর হাত পা চোখ মুখ, জিব্বা চেক করিয়া বুঝিলেন যে, তিনি হার্টের একটা কঠিন অস্বাভাবিক চক্করের মধ্যে পড়িয়া গিয়াছেন। এখানে তাহাঁর কোনো চিকিৎসা নাই। দেরী হইলে আরো সমস্যা হইতে পারে বলিয়া দ্রুত উন্নত কোথাও লইয়া না গেলে অচিরেই অবস্থার আরো অবনতি হইতে পারে বলিয়া জানাইয়া দিলেন। গঞ্জ হইতে শহরের দুরুত্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার। এতো দূর রাস্তা যাইতে যাইতে পথেই কোনো অঘটন ঘটিয়া যায় কিনা এই আশংকায় সালাউদ্দিন সাহেবও কি করিবেন বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না। বাড়ির সব বউঝিরা নতুন কোনো আশংকায় সবাই চিন্তিত হইয়া কিংকর্তব্য বিমুখ হইয়া যেনো ভাষাহীন হইয়া সময় পার করিতেছিলেন। সালাউদ্দিন চৌধুরী তাহাঁর সহোদর ভাই ডাঃ লতুব উদ্দিনের আগমনের অপেক্ষায় রহিলেন।

বিকালের দিকে এনাম উদ্দিন চৌধুরীর অবস্থার আরো অবনতি দেখা দিল এবং তাহাঁর জবান প্রায় বন্ধই হইয়া গেলো। রাত নাগাদ ডাঃ লতুব উদ্দিন হাসপাতালে আসিয়া বাবাকে দেখিয়া তাহাঁর বুঝিতে একটুও কষ্ট হইলো না যে, তিনি হার্ট এটাক করিয়াছিলেন এবং তিনি এখন প্রায় প্যারালাইসিসের দিকে যাইতেছেন।

এনাম উদ্দিন চৌধুরী সত্যি সত্যিই প্যারালাইসিস হয়ে গেলেন। তিনি আর আগের মতো তাহাঁর ডান হাত এবং ডান পা কিছুতেই নাড়াইতে পারেন না। তাহাঁর বাক রুদ্ধ হইয়া তিনি বোবা হইয়া গেলেন। ঘাড় কিংবা শরীর ও ভালোমতো নিয়ন্ত্রন করিতে পারেন না।

প্রায় একমাস কাল এইরুপে গঞ্জের সদর হাসপাতালে চিকিতসার পর এনাম উদ্দিন চৌধুরীকে ওই প্যারালিসিস অবস্থাতেই বাড়িতে নিয়া আসা হইলো। এখন এনাম উদ্দিন চৌধুরী আর নিজের থেকে কিছুই করিতে পারেন না। তাহাকে কেহ উঠাইয়া দিলে বিছানায় বসিতে পারেন, কেহ খাবার খাওয়াইয়া দিলে খাইতে পারেন, কেহ তাহাকে গোসল করাইয়া দিলে তিনি গোসল করিতে পারেন, পায়খানা প্রস্রাবটুকু শুধু এনাম উদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী করাইয়া থাকেন। সবল এবং সচল একজন মানুষ যতটা সংসারের জন্য শক্তি, অবলা এবং অচল সেই একজন মানুষ যে কতটা নিজের জন্য নিজে অসহায় এবং পরিবারের জন্য কতটা বোঝা, তাহা এই এনাম উদ্দিন চৌধুরীকে না দেখিলে হয়তো চৌধুরীর বাড়ির কোনো সদস্যই বুঝিয়া উঠিতে পারিতো না।

অসুস্থ হইবার পর প্রথম প্রথম পরিবারের সবাই যার যার জায়গা হইতে এনাম উদ্দিন চৌধুরীর যত্ন্যাদির কোনো কমতি ছিলো না। কিন্তু অসুস্থতা যখন লম্বা সময়ের জন্য শরীরে ভর করে, আর কবে নাগাদ ইহার পরিসমাপ্তি হইবে বলিয়া কাহারো কোনো ধারনা থাকে না। তখন সেই যত্ন্যাদিতে ধীরে ধীরে ভাটা পড়বেই এবং এটাই ঘটিতে লাগিলো এনাম উদ্দিন চৌধুরীর বেলায়। তাহাঁর বিছানার পাশে এখন আর আগের মতো দল বাধিয়া লোকজন বসিয়া থাকে না, তাহাঁর প্রাত্যাহিক অনেক কার্যে আগের মতো আর সঠিক নিয়মাবলী স্থির রহিলো না। সকালের গোসলের সময় গড়াইয়া দুপুর হইয়া যায়, দুপুরের খাবার খাইতে খাইতে এখন বিকাল হইয়া যায়, রাতের সব আয়োজন এখন প্রায়ই বিরতিতে পড়িয়া যায়। কিন্তু সালাউদ্দিন চৌধুরী এবং তাহাঁর স্ত্রীর খাটাখাটনীর মধ্যে আগে যেমন ছিলো এখনো তেমনি রহিলো। সালাউদ্দিন চৌধুরী তাহাঁর অবর্তমানে বাবারদিকে যেনো সারাক্ষন কেউ না কেউ নজর রাখে তাহাঁর জন্য তিনি তাহাঁর স্ত্রী এবং ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে তাহাদের দাদার পাশে বসিয়াই পড়াশুনা কিংবা মেয়েরা পুতুল খেলা করুক এই নির্দেশ দিয়া দিলেন। জহুরুন্নেসা, আজিম উদ্দিন কিংবা তাহাদের সন্তানেরা আগেও যেমন দূরে দুরেই থাকিতো, এখনো সেইরুপ অবস্থানেই আছে। তবে এইখানে একটা জিনিষ খুব করিয়া চোখে পড়িলো যে, যেহেতু এনাম উদ্দিন চৌধুরী সালাউদ্দিন চৌধুরীকে তাহাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তিতে ত্যাজ্য করিয়া আইনের মাধ্যমে উইল করিয়াছিলেন, এবং তাহাঁর দ্বিতীয় পুত্র আজিম উদ্দিনকেই এনাম উদ্দিন চৌধুরীর অক্ষমতায় মোতো ওয়াল্লি নিযুক্ত করিয়াছিলেন, ফলে আজিম উদ্দিনের স্ত্রী জহুরুন্নেসাই এখন একচ্ছত্র কর্ত্রী হিসাবে চৌধুরীর বাড়ির জমি জমা, এবং অন্যান্য স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির দেখভাল করেন। কখন কাহাকে কোন জমি বর্গা দিতে হইবে, কখন কোন বর্গাদার কত টাকা জমা রাখিল ইহার সমস্ত হিসাব এখন জহুরুন্নেসাই করিয়া থাকেন।

আজ প্রায় পনেরো বছর পার হইয়া গেলো এনাম উদ্দিন চৌধুরী প্যারালাইসিস অবস্থাতেই বিছানায় পড়িয়া আছেন। বয়স এবং রোগ দুইটাই বাড়িয়া চলিতেছে বিধায় এনাম উদ্দিন চৌধুরীর আর সুস্থ্য হইয়া উঠিবার কোনো লক্ষন দেখা দিতেছিলো না। সালাউদ্দিন চৌধুরীর মাতা গত হইয়াছেন প্রায় দুই বছর হইলো। সালাউদ্দিন চৌধুরীর ছোট ছোট বাচ্চারা এখন বেশ বড় হইয়া কয়েক মেয়ের বিয়া পর্যন্ত হইয়া গেছে, আর ছেলেরা অনেকেই পড়াশুনা শেষ করিয়া কেহ সরকারী আবার কেউ প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী লইয়া বিয়া সাদী করিয়া ভালই আছে। আজিম উদ্দিন, এবং লতুব উদ্দিনের মধ্যে বাবার পাওয়া সম্পত্তির অংশ সমান দুইভাগে ভাগাভাগি করিয়া লইয়া তাহাদের সীমানা গাড়িয়া দিয়াছেন। তাহাদের সংসার এখন সম্পুর্নই আলাদা। যে যার জায়গায় সংসার পাতিয়া বহাল তবিয়তে আছেন। শুধুমাত্র সালাউদ্দিন চৌধুরী কোন অংশ না পাইয়াও তিনি এবং তাহাঁর পরিবার এনাম উদ্দিন চৌধুরীর পুরানো সেই ঘরে থাকিয়া বাবার সেবা চালাইয়া যাইতেছেন। যদিও অনেকবার ডাঃ লতুব উদ্দিন তাহাঁর বাবার উইল খানাকে পরিবর্তন করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন যাহাতে তাহাঁর বড় ভাই সালাউদ্দিন চৌধুরীও অন্যান্যদের মতো পিতার সম্পত্তির ভাগীদার হইতে পারেন। কিন্তু যেহেতু এনাম উদ্দিন চৌধুরীর বাক রুদ্ধ হইয়াছিলো এবং তিনি কোনো কিছুই পরিবর্তনের পর্যায়ে ছিলেন না, বিধায় আজ থেকে পনেরো বছর আগে করা উইল খানীও পরিবর্তন করা সম্ভব হইতেছিলো না। আজিম উদ্দিন চৌধুরীর যদিও এই পরিবর্তনে কোন অভিযোগ ছিলো না কিন্তু জহুরুন্নেসা মনে মনে ইহা না হোক সেই ইচ্ছাই বারবার ইনিয়ে বিনিয়ে প্রকাশ করিবার বহু ইংগিত দিয়া থাকেন।  

ইদানিং এনাম উদ্দিন চৌধুরীর শরীর খুব ভাল যাইতেছে না। প্রায়ই তার চোখের কোনায় পানি ছলছল করিয়া পড়িতে দেখা যায় কিন্তু বাকরুদ্ধ এই দাপুটে মানুষটি কোনো কথা বলিতে পারেন না, কোনো কিছু লিখিয়াও বুঝাইতে পারেন না, তাহাঁর হাত আর পা যেনো সবসময় থর থর করিয়া কাপিতেই থাকে। যেদিন হইতে এনাম উদ্দিন প্যারালাইসিস হইয়া বাকরুদ্ধ হইয়াছেন, সেদিন হইতেই হয় সালাউদ্দিন চৌধুরী অথবা তাহাঁর স্ত্রী জয়তুন্নেসা চৌধুরী নিজ হাতে এনাম উদ্দিন চৌধুরীকে খাওয়াইয়া দিতেন, মুখ মুছাইয়া দিতেন। ইদানিং সালাউদ্দিন চৌধুরী লক্ষ্য করিলেন, তাহাঁর বাবার খাবারে বেশ অনিহা, জোর করিলেও বেশী খাইতে চাহেন না। বাবাকে দেখিলে তাহাঁর বড় মায়া হয়। এই বাবা যে তাহাকে কত কষ্ট দিয়াছে, অপমান করিয়াছে, ঘর ছাড়া করিতে চাহিয়াছিলো, তাহাঁর সন্তানদের কতই না অপমান করিয়া দুরদুর করিয়া তাড়াইয়া দিয়াছিলো, সেই কারনেও আজ সালাউদ্দিন চৌধুরীর কোনো অভিযোগ নাই। তিনি তো তাহাঁর বাবা। বাবার দিকে তাকাইয়া সালাউদ্দিন চৌধুরীর বড় মায়া হয়, কষ্ট লাগে। বাবাকে জড়াইয়া ধরেন সালাউদ্দিন সাহেব। অনেক্ষন জড়াইয়া ধরিয়া বারবার যেনো একই কথা বলিতে থাকেন, 'বাবা তুমি আমাকে মাফ করিয়া দিও। তোমার কোন সম্পত্তি, কোন ঘর, কোনো ভিটা আমার দরকার নাই। আমি তোমার হাত ধরিয়া প্রথম যখন হাটিতে শিখিয়াছি, সেইদিন থেকে আমি তোমাকে নিজের মনের অনেক গভীরে একমাত্র আরাধনার পুজনিয় ব্যক্তি বলিয়াই মানিয়াছি। আমি তোমার কাছে অনেক হয়তো অপরাধ করিয়াছি, কিন্তু কি অপরাধ করিয়াছি, কখন করিয়াছি, আমি জানি না, কিন্তু সেই অজানা অপরাধের কারনে তুমি আমাকে অন্তত তোমার সন্তানের মহব্বত হইতে বঞ্চিত করিও না। আমি তোমাকে সবসময় ভালবাসিয়াছিলাম, আজো অনেক ভালোবাসি'। চোখের জল টপটপ করিয়া হয়তো এনাম উদ্দিন চৌধুরীর টাক মাথায় পড়ে। এনাম সাহেব বুঝিতে পারেন। তিনি তাহাঁর একটি হাত বহু কষ্টে উপরে তুলিতে চাহেন, কিন্তু হাতের জোর যেনো সালাউদ্দিন চৌধুরীর মুখ পর্যন্ত উঠিয়া তাহাকে একটু স্পর্শ করিবে সেই শক্তি আর নাই। এনাম উদ্দিন চৌধুরীর চোখের জলও হয়ত তাহাঁর বালিশ ভিজিয়া যায়।

ইদানিং এনাম উদ্দিন চৌধুরী কি জানি বলিতে চাহেন, বিড়বিড় করেন। তাহাঁর সব কথা ভালোমত বুঝাও যায় না। তবে একটা জিনিষ ইদানিং দেখা গেল, তিনি তাহাঁর বাম হাত নারানোর চেষ্টা করেন, কিছু লিখার চেষ্টা করেন, কিন্তু সবকিছু লেখা বুঝাও যায় না। এম্নিতেই তিনি কখনো বাম হাতে লিখেন নাই, আর এবার কিছু লেখা বাম হাতে লিখিবার চেষ্টায় সব বুঝা না গেলেও ইহার কিছু অর্থ উদ্ধার করা যায়।

এইভাবেই আরো তিন বছর পার হইয়া যায়। এনাম চৌধুরী আগের থেকে অনেক সুস্থ। তিনি বিড় বিড় করিয়া কথা বলিলেও কিছু কিছু লেখা লিখে বুঝাইতে পারেন। ঈশ্বরের খেলা বড় রহস্যময়। কখন তিনি কাকে কি দিয়া শাস্তি দেন আর কি কারনে কোথায় কার জন্য কি বরাদ্ধ রাখেন কেহই বলিতে পারে না। কোনো এক বিকালে তিনি তাহাঁর সেই উকিল বন্ধুকে খবর দিতে বলিলেন যিনি আজ হইতে আঠারো বছর আগে এক তরফা একটা উইল করে তাহাঁর অতি আদরের সালাউদ্দিন চৌধুরীকে তাহাঁর সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তিতে হইতে বঞ্চিত করিয়াছিলেন, যদিও আজ আর সালাউদ্দিন চৌধুরীর কোনো কিছুরই প্রয়োজন নাই। তাহাঁর শুধু সবিনয় প্রার্থনা যেনো তাহাঁর বাবা সুস্থ হইয়া আবার তাহাকে বুকে জরাইয়া ধরিতে পারেন। সুস্থ বাবার কাছে তিনি আবারো সেই ছত সালাউদ্দিন সাজিয়া কায়মনে ক্ষমা চাহিতে পারেন।

বন্ধু উকিল আসিলেন। এনাম সাহেব তাহাঁর হাতের ইশারা ঘরের দরজা বন্ধ করিতে বলিলেন। উকিল বাবু সবাইকে ঘর হইতে বাহির করিয়া ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া এনাম সাহেবের পাশে আসিয়া বসিলেন। এনাম সাহেব তাহাঁর তোষকের নীচ হইতে একখানা খাতা বাহির করিয়া উকিল বন্ধুর হাতে দিলেন, যেখানে প্রথমে খুব কাপা কাপা বাকা অক্ষরে, কোথাও কোথাও অষ্পষ্ট ভাবে হলেও তাহাঁর অর্থ যাহা দারায় তাহা ছিল এইরুপঃ 

'আমি আমার পূর্বের উইল পরিবর্তন করিয়া এই নতুন উইলটি করিতে চাই, তুমি আমার জীবদ্দশায় ইহা পরিবর্তন করিয়া অন্তত আমার এই বিগত বছরের কষ্টের প্রায়শ্চিত্ত করিতে চাই।'

উকিল বাবু, কাগজটি পড়িলেন,

আমি আমার পূর্বের ওয়াকফ দলিলে আমি অন্যের প্ররোচনায় পড়িয়া আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র সালাউদ্দিন ও তাহাঁর সন্তান সন্ততীদেরকে অতিশয় নির্দয় ভাবে আমার সমস্ত সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত করিয়াছি। এক্ষনে আমার সমস্ত ভুল ভাংগিয়াছে। আমি একটি জিনিষ খুব ভালো করিয়া বুঝিয়াছি যে, আমি যখন অর্ধাংগ অবস্থায় মরনাপন্ন হইয়া বিছানায় পড়িয়াছিলাম, তখন হইতে অদ্যাবধি বুঝিয়াছি যে, আমার জ্যেষ্ঠপুত্র এবং তাহাঁর স্ত্রী সন্তানেরা নিসশার্থভাবে দিবা রাত্রী সেবাযত্ন করিয়া যেভাবে আমার প্রান রক্ষা করিয়াছে এবং এখনো করিতেছে তাহাঁর উদাহরণ বিরল। আমি তাহাদের মানবিকতায় অতিশয় মুগ্ধ হইয়াছি এবং তাহাদিগকে আমার স্বউপার্জিত সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত করার জন্য হৃদয়ে অনেক আঘাত পাইয়াছি। আমি আমার এই শারীরিক অক্ষমতার সময় স্পষ্ট বুঝিয়াছি কে বা কাহারা আমাকে ভালোবাসিয়াছে আর কে বা কাহারা আমার সম্পদকে ভালবাসিয়াছে। আমার হয়তো আর বেশি সময় হাতে বাকী নাই। আমি কাউকেই আমার সম্পত্তি হইতে আর বঞ্চিত করিতে চাহি না। যদিও অনেকেই আমার প্রতি তাহাদের দায়িত্ত পালন করে নাই। তাই এক্ষনে পিতা হিসাবে আমি আর কাউকেই কোন কিছু হইতে বঞ্চিত করিবো না। আমার উক্ত দলিল পরিবর্তন করিয়া আমার বড় সন্তান সালাউদ্দিন এবং তাহাঁর সন্তান সন্ততিদের সবার জন্য যার যার হিস্যায় সবাইকে হকদার করিয়া দিলাম। আর এক্ষনে আমি আমার বড় সন্তান সালাউদ্দিনের কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি যে, আমার দ্বারা যে অশান্তি আমি তাহাকে দিয়াছি, তাহাঁর জন্য পিতা হিসাবে পুত্রের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

  

উকিল বাবু কাগজখানি পড়িয়া এনাম সাহেবের হাত ধরিয়া শুধু একটা কথাই বলিলেন, আমাকে শুধু মাত্র একটি দিন সময় দিন। আপনার এহেনো সিদ্ধান্তে আপনার পরিবারের থেকেও বেশী খুশী আমি হইয়াছি যে, এতোদিন আমিও একতা মানসিক অশান্তিতে ভোগিয়াছিলাম যে, এমন একতা উইল কেনো আমার দ্বারা আজ হইতে বিগত আঠারো বছর আগে করিতে গিয়াছিলাম। আমি কায় মনে সর্বদা এই দোয়াটাই করিতাম, কখনো যদি আবারো এইদিন তা আসে যে, আমার দারাই আবার আপনার উক্ত দল্লটা পরিবর্তন হইয়া ন্যায় একতা দলিল হোক। আমি কালই ইহার ব্যবস্থা করিতেছি।

পরেরদিন উকিল বাবু সমস্ত দলিল পরিবর্তন করিয়া যখন ইহার সপ্তাহ খানেক পরে সরকারী স্ট্যাম্প লাগাইয়া কোর্ট কর্ত্রিক সত্যায়িত করিয়া আনিলেন, তখন সালাউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারে যেমন সুখের জল পড়িলো তেমনি জহুরুন্নেসার বুক ভাসিয়া গেলো তাহাঁর চোখের জলে। তাহারা কিছুতেই যেনো এই সিদ্ধান্ত মানিয়া লইতে পারিলেন না। তাহারা বারবার এই কথাই প্রচার করিতে লাগিলেন যে, সেবার নাম করিয়া সালাউদ্দিন চৌধুরী এবং তাহাঁর পরিবার এনাম উদ্দিন চৌধুরীর কাছ হইতে পুনরায় সব কিছু ভাগাভাগি করিয়া লইলেন, যেনো তাহা তাহাদের কোনো কালেই প্রাপ্য ছিলো না।  গোপনে গোপনে এই জহ্রুন্নেসা এবং তাহাঁর পরিবার সালাউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের আজীবিন বিপক্ষ হইয়াই রহিলেন