Arundhuty
১৬/০৩/২০২৫-মাল্টার জন্য টাকা জমা দেয়া
শেষ পর্যন্ত আমি ওর জন্য মাল্টায় পড়াশুনার জন্য টাকা পাঠালাম। আমি জানি না শেষ পর্যন্ত ওর কি পরিকল্পনা কিন্তু আমার কাছে বারবার এটাই মনে হচ্ছে যে, ওর বাকী জীবনটা সেই মহাকাশে যাওয়ার জন্য এলিসার জীবনের মতো না হয়। ও আবার আজিবনের জন্য হারিয়ে না যায়। আমি বারবার জানতে চেয়েছিলাম-এরপর কি, এরপর কি? বিয়ে? সে না করেছে। তাহলে এরপর কি? জাষ্ট সেটেলমেন্ট? তাও আবার একা একা? নিজে জব করে টাকা পয়সা কামাই করে জীবন একা একা চালানোর থেকে তো এখানেই সেই জীবনের চেয়ে আরো অধিক সুখের জীবন ছিলো। তাহলে ও এটা গ্রহন করলো না কেন? তাহলে এরপর আসলেই কি? ও কি আমার উপরে বিরক্ত? হতে পারে। কিন্তু আমি ওর কাছে বিরক্ত হবার মতো কোনো কাজ করেছি বলে মনে পড়ে না।
এটাও হতে পারে যে, মানুষের জীবন এভাবেও চলতে পারে না। আমার পরিবারের সদস্য হলেও আমি হয়তো এটা নিজেও মানতে পারতাম না। ওর একটা আলাদা লাইফ আছে, আর জীবন একটাই। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়ায় আর কোথায় গিয়ে পরিস্থিতি থমকে দাঁড়ায়। আমার কোনো কিছুতেই কোনো আপত্তি নাই। শুধু আপত্তি আছে যাতে সে তার জীবনের কোনো ঝুকি না নেয়। আমি ওকে স্নেহ করি।
০৩/০৭/২০২৩-মাধুরীর চিঠি-২
অনেক অনেক দিন পার হয়ে গেলো। না আমি আর তোমার সাথে কোনো যোগাযোগ করেছি, না তুমি। জীবনের ব্যস্ততা মানুষকে এমনভাবে কোনো এক চক্রএর মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ায় সেটা বুঝা খুব সহজ না। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন মানেই কি পিছলে পড়া পথে হাটু গেড়ে বসে পড়া? নাকি সেই পিচ্ছিল পথ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে কোনো এক পাহাড়ের পাদদেশে এসে পতিত হয়ে আবার সেখান থেকে নতুন করে বেড়ে উঠা? হয়তো দুটুই ঠিক। কেউ পাহাড়ের চূড়ায় উথে নামার ভয়ে হাহাকার করে, আবার কেউ পাহাড়ে উঠতে না পেড়ে হাহাকার করে। কেউ কারো অবস্থানে সুখী নয়।
যাই হোক, এসব কথা আর না বলি। তবে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কি এখনো খুব সহজে সব কিছু ভুলে যাও? কিংবা হাতের কাছে তোমার দরকারী কাগজটি না থাকলে কোথায় রেখেছো সেটার জন্য আমার নাম ধরে চেচামেচি করো? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। তখন হয়তো এরকমের চেচামেচি ভালো লাগতো না, কিন্তু আজকে মনে হয় তোমার সেই চেচামেচিকে আমি খুব মিস করি। মনে হয় খুজে খুজে তোমার ঠিকানাটা বের করে আরো একবার যদি তোমার সেই কন্ঠসরটা শুনতে পেতাম!! কিছু একটা খোজার বাহানা করে আমি সারাক্ষন মাঝে মাঝে আসলে হয়তো এখনো তোমাকেই এই আজব পৃথিবীর মানুষগুলির মধ্যে খুজি। আমি জানি না হটাত কখনো যদি তোমার সাথে আমার আবার দেখা হয়ে যায়, তখন আমি কি করবো। জড়িয়ে ধরবো? নাকি এড়িয়ে যাবো? নাকি দূর থেকে তোমার চলে যাওয়া দেখবো। আমি জানি, তুমি আমাকে ভুলে যেতে চেয়েছিলে, কিন্তু আমার জগতে তুমিই ছিলে একমাত্র মানুষ যাকে আমি কখনো ভুলতে চাই নি। আমি তোমাকে পাইনি বটে কিংবা তুমি আমাকে ছেড়েছো বটে কিন্তু পেরেছো কি? আমি পারিনি।
বৃষ্টি ভেজা রাতে নীরবে যখন আমি আমার বারান্দায় বসে অতীতের ভালো লাগা কোনো একটা গানের কলি শুনি, আমাকে নিয়ে যায় সেই রাতে যখন আমি তোমার হাতে হাত রেখে উচ্ছল ধরনীর শীতল মাটিতে নেচে বেড়াতাম। আমার ভেজা চুল বেয়ে বেয়ে জোনাকীর মতো পানির ফোটা ঝরে পড়তো, আর তুমি সেটা চিপে চিপে ধরে বলতে –আহা, কি সুন্দর, যেনো মুক্তার মত। তোমার ছাদের কোনায় কি এখনো অই ছোট জবা ফুলের গাছটা আছে? আমি লাগিয়েছিলাম। তুমি কাটাজাতীয় ফুল পছন্দ করো না জেনেও আমি গাছটা লাগিয়েছিলাম। কতদিন জবা ফুল তুলতে গিয়ে হাতে কাটা বিধেছিলো আর তুমি বারবার আমার হাতে মলম লাগিয়ে বলতে কেনো কাটা গাছটাই রাখতে হবে ছাদে? অথচ তুমি গাছটা নিজেও কখনো কেটে ফেলোনি, বরং প্রতিদিন এর গোড়ায় পানি দিতে। কি আজব না? তোমার অপছন্দের একটা গাছ, তুমি কেটে দিলে না, পানি দাও, এটাকে বড় করো, যত্ন করো, অথচ তাকে তুমি পছন্দ করো না। আমাকে তুমি পছন্দ করতে, আদর করতে, আমার কষ্টে তোমার কষ্ট হতো, আমার আনন্দে তুমি আনন্দিত হতে, অথচ তুমি আমাকে চিরতরে কেটে দিলে। কাটতে পেরেছো? ওই জবা ফুলের গাছটার কাছে গেলে তোমার মন উদাসীন হয়ে উঠে না? হয়তো গাছটা আর নাই, অথবা আছেও। আমি তো আর জবা গাছ নই। আমার ভাষা ছিলো, অনুভুতি ছিলো, সব ছিলো, তাতেও তো আমি তোমাকে আমার ভিতরের অনুভুতি দিয়ে বুঝাতে পারিনি, কি ছিলে তুমি আমার। আর সেটা তো একটা ভাষাহীন জবা গাছ। সে তো তোমার কিছুই ছিলো না। আছে গাছটা? তাড়িয়ে দাও নি তো?
মাঝে মাঝে আমার খুব তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে। কেনো দেখতে ইচ্ছে করে, সেই সঠিক উত্তর আমার জানা নাই। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, চিৎকার করে হাউমাউ করে কাদি। যদিও জানি, আজকালকের মানুষগুলির আবেগ, অনুভুতি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এখন মানুষেরা আর হাউমাউ করে কাদে না, মানুষ কি ভাববে বলে। প্রান খুলে হাসে না, লোকে বোকা ভাববে বলে। এই চাপা হাসি আর বোবা কান্না মানুষ গুলি এতো অসহায়। তাই মানুষগুলি একা একাই বেচে থাকার মধ্যে প্রান খুজে বেড়ায়। আসলে আমরা সবাই একাই। এই একা জীবনে আড্ডা দেয়া যায়, গল্প করা যায়, কিন্তু সে পর্যন্তই। এর মানে যে, নিঃসঙ্গতা যে কাজ করে না এমন নয়। এই নিঃসঙ্গ জীবনের ও একটা মাধুর্যতা আছে। সেখানে আমিই সব। এর মানে এই নয় যে, আমি রক্তমাংশে গড়া কোনো আপনজনের অভাব অনুভব করিনা।
আমি এখনো মাঝে মাঝে ভাবি- আমি কি অন্য দশজন মেয়ের মতো জীবন সংগী বেছে নিঃসঙ্গতা কাটাতে পারতাম না? হয়তো পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করতে পারিনি। কারন আমরা আমাদের জীবনসংগী বাছাই করি কথা শোনার জন্য, কথা বলার জন্য, যার সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগে, যার কথা শুনলে বছরের পর বছর সুখে দিন পার করা যায়। কিন্তু এটাও ঠিক যে, মাঝে মাঝে আমরা জীবনসাথী বাছাই করি তার রুপ, তার সউন্দর্য, তার অর্থবৈভব, তার সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি বিবেচনা করে। কিন্তু আমরা মাঝে মাঝে এটা ভুলেই যাই, সেই জীবনসাথী যাকে আমরা বাছাই করলাম, তার সাথে কারনে অকারনে, সময়ে অসময়ে আমার মনের কথাগুলি তাকে বলতে পারবো কিনা কিংবা সে আমার সেই সব ছোট ছোট অনুভুতি গুলির মুল্যায়ন করবে কিনা। যদি এর কোনো পরিবর্তন হয়, আর ঠিক তখন দেখা যায় যে, আমার বাছাই করা সাথী আমার কথাগুলি শুনতেই তার বিরক্ত লাগছে, কথায় কথায় ঝগড়া লেগে যাচ্ছে, আর তখন সম্পর্কগুলিতে মরচে ধরা শুরু করে। এটা একটা অনিশ্চিত পরীক্ষা। যাকে চিনিনা, যাকে কখনো অন্তরে রাখিনি, যে আমাকে জীবনের ৩০ বছর কোথাও জায়গা দেয় নি, হটাত করে তার সেই অন্দর মহলে আমি ঢোকে কতটা স্থান দখল করতে পারবো? সেখানে তো আরো হাজার হাজার ভাবনা, হাজার হাজার বিক্ষিপ্ত অনুভুতি, কিংবা অনেকের বসবাস রয়েছে। আমি কি হটাত করে এসেই তার সেই সব ভাবনা, অনুভুতি, আর অন্য মানুষদের পদরেখা ধুয়ে মুছে আমার নিজের করে দখল নিতে পারবো? হয়তো এটা কখনোই সম্ভব না। তাই আর আমার কোথাও যাওয়াওই হলো না।
একটা জিনিষ জানো? লেখকের কোনো লেখা পড়ে যতোটা পাঠক মুগ্ধ হয়, তার থেকে বেশী মুগ্ধ হয় পাঠক যখন তার সাথে সামনে বসে কথা বলে।
31/04/2020-রহস্য।
রহস্য।
এমন একটা নাম, যে নিজেই সবার কাছে এক রহস্য। এই পৃথিবীর প্রতিটি প্রানীর নিজস্ব একটা রহস্য থাকে। সে সেই রহস্য বুকে নিয়েই আজীবন প্রকাশ্য দিবালোকে সবার সাথে উম্মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায় যেনো আমরা যা দেখছি সেটাই সব, কিন্তু তার ভিতরে, অন্তরে, মনে বা মগজে হয়তো কিছু না কিছু রহস্যঘেরা জাল রয়েই যায়। এই রহস্যের কোনো কুল কিনারা নাই, না আছে সরল অভিব্যক্তি। এই রহস্য কখনো সত্যতায়, কখনো মিথ্যায় আবার কখনো দুঃখের ভারাক্রান্ত পিপায় কানায় কানায় ভরে থাকে। এটা খুব সহজ নয়, আছে কিনা বাস্তবে তাও সঠিক বুঝা যায় না কিন্তু নাই এটা বলা যাবে না। কোনো ভিক্ষুক আজীবন ভিক্ষে করে খেলেও দেখা যাবে সে আসলে কখনোই ভিক্ষুক ছিলো না, তার কাছে যা ছিলো তা দিয়ে হয়তো আর পাঁচ দশটা মধ্য ক্লাসের পরিবারকে আজীবন লালন করা যায়, অথচ রহস্য হচ্ছে সেই ভিক্ষুক সারাদিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে জরাজীর্ন কাপড় পড়ে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করাই ওর নেশা। এই রহস্য বুঝা মুষ্কিল। আবার দেখা যায়, সদাহাস্য যে মানুষটি আমার আর আপনার সামনে কখনো মন খারাপ করতে দেখা যায় না, হয়তো যখন সে নিতান্তই একা থাকে, অথবা গভীর রাতে যখন তার ঘুম ভাংগে, তখন হয়তো কোনো এক একাকীত্তের বেদনায় তার দুই চোখ জলে ভরে থাকে অথচ দিনের আলোয় তার ঠোটে সব সময়ই থাকে একটা মনকারা হাসি। কি সেই গোপন রহস্য? অরু, শারমিন, মাধুরীর পরিচয়টা আমি ইতিমধ্যে দিয়েছি। কিন্তু এরা কি আসলেই কেউ ছিলো? সবার জীবনেই এমন কেউ থাকে যারা কোথাও না কোথাও অরু, বা শারমিন, মাধুরী, বা ঘষেটি বেগম অথবা মনিকা, বা পারু হয়ে বাচে। এরা মেরুদন্ডসম্পন্ন শক্তিহীন প্রানীর মতো ঠিকই কিন্তু যদি প্রয়োজনিয় পুষ্ঠির জোগান দেয়া যায়, মায়াবী ব্যবহাত্রে মমতায় গড়ে তোলা যায়, তারা লিকলিক করে বড় সুফলা গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে কিন্তু বেশীর ভাগ সময়েই এরা থেকে যায় অপ্রকাশ্যে। রাস্তাঘাটে চলার সময়ে আমি এদের দিকে তাকাই, ভাবি আর আমার কল্পনায় ওরা জীবিত হয়ে উঠে এই ডায়েরীতে। অথচ আমি এদের কাউকেই চিনি না। তবে বড্ড মায়া হয় এদের জন্য। আমিও তো হতে পারতাম ওদের মতো কেঊ?
এইসব ছিন্নমূল মানুষ গুলির জীবনের গল্প আলাদা। এদের কান্নায় ভরে থাকে ভালোবাসা, এদের ভালোবাসায় ভরে থাকে বেদনার মতো অনেক কাহিনী। এটা তো ঠিক যে, কান্নার আহাজারীতে সুর থাকে না, থাকে বেদনা আর কষ্ট যে কষ্টের কোনো নাম নাই, যে কষ্টের রুপ কাউকে দেখানো যায় না। এরা এমনই কিছু মানুষ "অন্য দুনিয়া"য় একাই থাকে। আমাদের মানুষের সবচেয়ে বড় অক্ষমতা হচ্ছে-আমরা ভিতরেরটা দেখি কম, কিন্তু সত্যিটা সব সময় মানুষের ভিতরেই থাকে। এইসব ছিন্নমূল মানুষেরও শৈশব কাল ছিলো, যৌবন ছিলো, হয়তো সেইসব শৈশব কিংবা যৌবন আমাদের অনেকের থেকেই আলাদা। সময়ের সাথে সাথে যে কোনো ডকুমেন্ট পালটে দেয়া যায়, যে কোন ডকুমেন্ট নকল করা যায় হুবহু আসলের মতো কিন্তু কেউ কি কখনো তার অতীতের সেই শৈশব, যৌবন পালটে দিতে পেরেছে? কিন্তু এইসব ছিন্নমুল মানুষগুলির সেটাও পালটে যায়, তাদের মুখাবয়বও পালটে যায়। বাচার জন্য পালটে ফেলতে হয় তাদের সব। তাই এসব "অন্য দুনিয়ার" মানুষগুলির বাহ্যিক চেহারা আমরা দেখতে পাই বটে কিন্তু এদের ভিতরের কষ্টটা আমরা না দেখতে পাই, না বুঝতে পারি। বাচার তাগিদে এরা নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়েও কাজ করে। তারা তাদের জীবনের পাহাড় অতিক্রম করার জন্য আপ্রান চেষ্টায় সারাটি জীবন একাই যুদ্ধ করতে করতে এক সময় হয় অকুল সাগরে ভেসে যায় অথবা হয়তো কোনো কিনারে এসে থেমে যায়। তারপরেও মানবিক গুনাবলীর অংশ হিসাবে এরাও প্রেম করে, এরাও ভালো একটা জীবন পাওয়ার আশায় ঘর বাধার সপ্ন দেখে। কিন্তু বেশীরভাগ সময়েই যখন প্রেম নামক এই দুধটুকু পুড়ে শেষ হয়ে যায়, তখন মনে হয় ঘোড়া এসেছিলো, ঘোড়া জলও খেয়েছিলো, কিন্তু কেউ কোনোদিন ঐ ঘোড়াকে বাস্তবে দেখে না।
এ জগতে সবচেয়ে বড় রহস্য বিধাতা নিজে, আর সেই রহস্যময়ী বিধাতা মানুষের জন্য আরো কিছু রহস্য তৈরী করে জাল বুনে রাখেন। তারমধ্যে অন্যতম "সময়", "সম্পর্ক", "মন", "অন্তর", "মায়া", "ভালোবাসা", আর "চোখের জলের" সাথে "ঠোটের হাসি"। রাগ, গোস্যা, ঘেন্না কিংবা হানাহানি কোনো রহস্য নয়। কেনো নয়? এই রহস্যের কোনো ব্যাখ্যা নাই।
০৮/০৮/২০২১-সন্ধ্যা ৮ টা ৩২ মিনিট
উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব
আগষ্ট
৮
খুব ভালো একটা খবর পেলাম আজ। আমার বন্ধু উইং কমান্ডার মাসুদকে বলেছিলাম, যেভাবেই হোক এয়ারপোর্টের জন্য আমাকে যেনো কয়েকটা ‘পাশ’ এর বন্দোবস্ত করে দেয়। কভিডের কারনে প্যাসেঞ্জার ছাড়া অন্য কোনো দর্শ্নার্থীকে এয়ারপোর্টের ভিতরে প্রবেশ করতেই দেয় না। কনিকার সাথে যাওয়ার জন্যে আমরা অনেকভাবে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ইউএস এম্বেসী সব ধরনের ভিসা (শুধু মাত্র স্টুডেন্ট ভিসা ছাড়া) বন্ধ রেখেছে, ফলে আমরা কনিকার সাথে যেতে পারছি না। এদিকে আবার কভিডের কারনে এয়ারপোর্টের ভিতরেও প্রবেশের সুযোগ নাই। যাক, শেষ পর্যন্ত আজকে আমার দোস্ত মাসুদ আমাকে ফোন করে জানালো যে, এভিয়েশনের সিকিউরিটি ডাইরেক্টর আরেক উইং কমান্ডার আজমকে বলা আছে সে আমাদের জন্য ‘পাশ’ এর ব্যবস্থা করবে। আজমের সাথে কথা বললাম, আজম খুব সমীহ করেই জানালো যে, আগামী ১০ তারিখের রাত ৯ টায় যেনো আমি ওকে ফোন দিয়ে একটা কন্ট্যাক্ট নাম্বার সংগ্রহ করি যে কিনা আমাদেরকে এয়ারপোর্টে প্রবেশের সুযোগ করে দেবে। এই মুহুর্তে এর থেকে আর ভালো খবর আমার কাছে কিছুই নাই। খুব ভালো লাগলো যে, কনিকাকে আমি আর আমার স্ত্রী (উম্মিকাসহ) এয়ারপোর্টে সি-অফ করতে পারবো, ওর লাগেজ পত্রগুলি ঠিকমতো বুকিং করে ইমিগ্রেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারবো। মেয়েটা আমেরিকায় চলে যাচ্ছে ৫ বছরের জন্য, পড়াশুনার খাতিরে। ইউএমবিসি (ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ড বাল্টিমোর কাউন্টি) তে যাচ্ছে।
আমার মনে পড়ছে যে, আজ থেকে প্রায় ৩৮ বছর আগেও আমার ভর্তি হয়েছিলো কার্স্কভাইল ইউনিভার্সিটিতে যেখানে আমার বড় ভাই ডঃ হাবীবুল্লাহ চেয়েছিলেন আমি আমেরিকায় গিয়ে পড়াশুনা করি। কিন্তু যে কোনো কারনে হোক, আমার আর যাওয়া হয় নাই, আমি চলে গিয়েছিলাম আর্মিতে। আমার যে আমেরিকায় যাওয়া হয় নাই এটা বল্বো না, আমি তারপরে ১৯৯৫/৯৬ সালে হাইতির জাতিসঙ্ঘ মিশন থেকে একমাসের জন্য আমেরিকায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। তারপরে পর পর দুবার ভিসা পেয়েছিলাম মোট ৬ বছরের জন্য কিন্তু আমাকে আমেরিকা টানে নাই। আগামী ১১ তারিখে আমার ছোট মেয়ে চলে যাচ্ছে সেই সুদুর আমেরিকায়। একটু খারাপ লাগছে কিন্তু সন্তানদের সাফল্যের জন্য তাদেরকে ঘর থেকে ছেড়েই দিতে হয়, এটাই নিয়ম।
কনিকা যাতে কোনো প্রকারের আর্থিক সমস্যায় না থাকে সেজন্য আমি অগ্রিম ওর এক বছরে সমস্ত খরচ (বাড়ি ভাড়া, খাওয়া দাওয়ার খরচ, ইউনিভার্সিটির টিউশন ফি, হাত খরচ, যাতায়ত খরচ, ইন্স্যুরেন্স খরচ ইত্যাদি মিলিয়ে ৩৫ হাজার ডলার দিয়ে দিলাম যাতে আমিও আর এই এক বছর ওকে নিয়ে চিন্তা করতে না হয়। সাথে সিটি ব্যাংকের একটা এমেক্স কার্ড ও দিয়ে দিচ্ছি ২ হাজার ডলারের মতো যাতে খুবই জরুরী সময়ে সে এটা খরচ করতে পারে। আগামীকাল কনিকার কভিড-১৯ টেষ্ট করাতে হবে। ফ্লাইটে উঠার ৪৮ ঘন্টা আগে কভিড টেষ্ট করে ফ্লাইটে উঠতে হয়। পজিটিভ এলে ফ্লাই করতে পারবে না। দোয়া করছি, আল্লাহ যেনো সব কিছু সহী সালামতে এটাও ইনশাল্লাহ নেগেটিভ করে দেন।
বড় মেয়েকেও ইন্সিস্ট করছি সে যেনো কনিকার মতো দেশের বাইরে (পারলে একই ইউনিভার্সিটি, ইউএমবিসি) আমেরিকায় চলে যায়। কিন্তু কোথায় যেনো উম্মিকার একটা পিছুটান অনুভব করছি। তার শখ লন্ডনে যাওয়া। যদি তাও হয়, তাতেও আমি রাজী। ওরা ভালো থাকুক, সেটাই আমি চাই।
আমি জানি একটা সময় আসবে, আমি আসলেই একা হয়ে যাবো। এমন কি আমি মিটুলকেও ধরে রাখতে পারবো কিনা জানি না। কারন যখন দুই মেয়ে দেশের বাইরে থাকবে, আমার ধারনা, মিতুলও প্রায়ই দেশের বাইরে থাকবে তার মেয়েদের সাথে। যদি দুইটা আলাদা আলাদা দেশ হয়, তাতে ওর বাইরে থাকার সময়টা বেড়ে যাবে, আর যদি একই দেশে হয়, তাহলে এক ছুটিতেই দুই মেয়ের সাথে হয়তো সময়টা কাটাবে। আমি ব্যবসা করি, আমাকে দেশেই থাকতে হবে, আর আমি দেশে থাকতেই বেশী পছন্দ করি।
বাকীটা আল্লাহ জানেন।
স্পেসাল নোটঃ
যে মানুষগুলি ১১ আগষ্ট ২০২১ তারিখে এয়ারপোর্টের ভিতরে আমাদেরকে এন্টারটেইনমেন্ট করেছে তারা হচ্ছেন- সার্জেন্ট জুলহাস এবং সার্জেন্ট রাসেল। আমরা সবাই ঢুকতে পেরেছিলাম আর ওরাই আমার মেয়ের জন্য সব ব্যবস্থা করে দিলো একেবারে প্লেন পর্যন্ত। রাসেল আর জুলহাসকে ধন্যবাদ দেয়ার মতো আমার ভাষা নাই। তাদের জন্য আমার এই পেজে ওদেরকে মনে রাখার জন্য ওদের কয়েকটা ছবি রেখে দিলাম। বড্ড ভালো লাগলো ওদের আথিথেয়তা।
ওরা আমার এবং আমার পরিবারের জন্য অনেক সহায়তা করেছে। এয়ারপোর্টের গেট থেকে শুরু করে আমার মেয়ে কনিকাকে ইমিগ্রেশন করা এবং ওর সাথে প্লেন পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ার পুরু কাজটাই করেছে। আমি আমার পরিবার এবং অন্যান্য সবাই অনেক কৃতজ্ঞ। দোয়া করি ওদের জন্যেও।
৬/৭/২০২১-কিছু আফসোস
কিছু কথা আছে যা বলতে চাই নাই কিন্তু বলা হয়ে যায়, কিছু কথা ছিলো, বলতে চেয়েছি, অথচ বলা যায় নাই, কিছু সপ্ন ছিলো যা দেখতেই চাই নাই কিন্তু দেখতে হয়েছে আবার কিছু এমন সপ্ন ছিলো সব সময় দেখতে চেয়েছি কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় নাই। এমন কিছু শখ ছিলো সারাজীবন লালন করেছি কিন্তু জীবনের শেষ তীরে এসেও সেটা ধরা দেয় নাই আবার এমন কিছু ভয় ছিলো যা একেবারেই কাম্য নয় অথচ তা আমি এড়িয়ে যেতেই পারিনি। এটা আমার দোষ নয়। না আমার অপারগতা। আমি এই আফসোসের ব্যাপারটা নিয়েও বহুবার গবেষনা করেছি কেনো, এবং কী কারনে আবার এই কিছু কথা বলা হয় নাই, কিছু কথা না বলতে চেয়েও বলতে হয়েছে, কিছু সপ্ন আমাকে দেখতেই হয়েছিলো অথচ সেটা আমার কাম্য ছিলো না, আবার কিছু স্বপনের ধারে কাছেও আমি যেতে পারিনি।
এই দুনিয়ায় অনেক পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ী, অনেক নামীদামী মানুষের জীবন কিংবা সার্থক কিছু মানুষের জীবনী আমি খুব কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করেছি এজন্য যে, আমি যাদেরকে সুখী আর খুসী দেখছি, তাদের সব চাওয়া পাওয়া কি পূর্ন হয়েছে যা তারা আমার মতো ভেবেছেন এভাবে যে, যা তারা করতে চেয়েছেন সেটা তারা পেরেছেন, কিংবা যা তারা দেখতে চান নাই সেটা আসলেই তারা দেখেন নাই বা যেটা তাদের আজীবনের শখ ছিলো সেটা তারা পেয়েছেন?
না, এটা একেবারেই সত্যি নয়। তারাও পারেন নাই। কারো জীবনে কখনোই এটা হয় নাই, হবেও না। এর একটাই কারন। আর সেটা হচ্ছে সে তার মতো, আর এই পৃথিবীর অন্যান্য সবাই যার যার মতো। সবাই যার যার থেকে আলাদা। কিন্তু একটা জায়গায় সবার সবার সাথে মিল রয়েছে। আর সেটা হলো, সবাই একা। দলবদ্ধ সমাজই বলি, আর একক পরিবারই বলি, সারাটা জীবন প্রতিটি মানুষ একাই ছিলো আর একাই থাকবে। এই একাকীত্ততা মানুষের জীবনে একটা আফসোসের পাশাপাশি একটা সুখের অনুভুতিও নিয়ে আসে যখন সে ভাবে যে সে যা করতে চায় না, সে সেটা করেই না। আবার সে যেটা করতেই চায়, সে সেটাই করে। আর ঠিক এ কারনেই কেউ দলবদ্ধভাবে সুখীও নয় আবার এককভাবেও নয়। এভাবেই একটা চরম আফসোস নিয়ে মানুষ এই নীল আকাশের রুপ, এই নির্জন পাহারের মাদকতা কিংবা কনকনে শীত অথবা বর্ষার রিম ঝিম বৃষ্টির টুং টাং শব্দের মুরত্রছনা ছেড়েই বিদায় নেয় যাকে কেউ আর কখনোই মনে রাখে না।
কেউ সুখী না। আমিও না। আবার সবাই সুখী, সেখানে আমিও সুখী। এই মাত্রাটা সময়ের সাথে সাথে কখনো প্রখর হয় আবার কখনো বুঝাই যায় না কোন স্টেজে আমরা অবস্থান করছি। এর ফলে যেটা হয় যে, কখনো কখনো নিজের সন্তানকেও নিজেরা চিনতে পারি না, আবার কখনো কখনো আমাদের সন্তানেরাও আমাদের চিনতে পারে না। সবার স্বকীয়তা আলাদা, সবার চিন্তাধারা আলাদা, সবার পছন্দ আলাদা। এই আলাদা আলাদা স্বকীয়তা, চিন্তাধার আর পছন্দের ভীড়ে কারো সাথেই কারো কিছুই মিল নাই বিধায় কোনো না কোনো সময়ে এরা একটি বিন্দুতে এসে কনফ্লিক্ট তৈরী করে। এই কনফ্লিক্ট তৈরির বিন্দুতে যদি কেউ খুব সহজে অতিক্রম করে বেরিয়ে যেতে পারে, তারা সবার থেকে একটু বেশী আত্তত্যাগী আর সুখী। এর মানে সেক্রিফাইসের কোনো বিকল্প নাই। যতো বেশী ছাড়, ততো বেশী জীবন সহজ। কিন্তু এটা সব সময় পারা যায় না।
মজার ব্যাপার হলো-প্রতিটি মানুষের মূল্যায়ন তার জীবন শেষ হয়ে যাবার পর শুরু হয়। আর যাদের মূল্যায়ন তাদের জীবদ্দশায় হয়, তারা শুধু জানতে পারেন না যে, তাদেরকে চাটুকারীতা করা হচ্ছে। আর চাটুকারীতা হচ্ছে এটা না জানার কারনেই মনে মনে তারা একটা আলাদা জগতে আরামবোধ তথা গর্ব বোধ করেন বটে কিন্তু যখন তিনি আর থাকেন না, তখন কোনো পলিথিনের ভিতরে ঠেসে আটকানো একটা বহুদিনের পচা গলিত মাংশের টুকরার মতো ভিন্ন গন্ধ কিংবা বহুদিন যাবত আটকানো একটা আতরের শুন্য বোতলের মতো যে কোনোটাই ছরাতে পারে। কিন্তু তার তখন কিছুই যায় আসে না। তখন তার সব হিসাব কিতাব শুধু তার আর বিধাতার মধ্যে।
এ রকম একটা জীবনে আমি তাই আফসোসের ব্যাপারটা খুব মামুলী একটা ঘটনা বলেই চালিয়ে দেই। এতে একটা মজা আছে। আর সে মজাটা হলো এমন-
ধরুন আপনার এখন খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করলো, গিন্নীকে বললেন, গিন্নী একটা অজুহাত দেখিয়ে এখন খিচুড়ি খাওয়া যাবে না বলে পাশ কাটিয়ে গেলেন। আপ্নিও ধরে নিন, আপনার ভীষন ইচ্ছাটা খিচুড়ি খাওয়ার দিন আজ নয়। আজ আপনার খিচুড়ি খাওয়ার দরকারই নাই। কোনো আফসোস থাকবে না। অথবা আপনার সাথে আপনার সন্তানের কোনো একটা বিষয়ে মতের অমিল হলো যা আপনি মানতে চান না। কারন আপনি চান আপনার সনাত্ন আপানার কথামট কাজ করলে তার ভবিষ্যৎ ভালো হবে। কিন্তু সেটা সে মানতে নারাজ। ধরে নিন, আপনি আপনার কাজ করে ফেলেছেন তাঁকে গাইড করার মাধ্যমে। কিন্তু আপনি জানেন এটা হয়তো সময়পোযোগী না। কি আছে? সেটা তার জীবন। তাকেই সাফার করতে দিন। আপনি তো আর সেটা ভোগ করবেন না। অথবা ধরুন, আপনি চান বিশাল কিছু একটা আর্থিক অবলম্বন থাকুক যাতে আপনার অবর্তমানে আপনার আপনজনেরা ভালো থাকে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে এই “বর্তমান” সময়ে আপনি কারো কাছে কিপটা, কারো কাছে কঠিন ইত্যাদিতে ভূষিত হবেন। কি দরকার? ছেড়ে দিন তাদের ভবিষ্যৎ তাদের উপর। আপনি তো আর থাকবেনই না। তখন তারা কি করবে, আর কি করবে না সেটা তাদের ব্যাপার। ঐ যে বললাম, তখন আপনার মূল্যায়ন হবে এইভাবে যে, আহা, বাবা কিঙ্গাব স্বামী তো ঠিকই করতে চেয়েছিলেন। আপনি মুল্যায়িত হবেনই। আফসোসের কোনো প্রয়োজনই নাই।
আপনার আফসোস হবে তখন যখন আপনার সব কিছু থাকতেও আম্পনি আপনার নিজস্ব পছন্দকে মূল্যায়ন করেন নাই, আপনার আফসোস হবে তখন যখন আপনি যেটা করতে চেয়েছেন আর করতে পারতেন নিজে মনের সুখের জন্য কিংবা আনন্দের জন্য অথচ আপনি সেটা করেন নাই। সেই আফসোস এর দোষ আপনার।
আপনার ব্যবসায়ীক কোনো পার্টনারের সাথে কোথায় যেনো একটা অমিল হচ্ছে যার জন্য আপনি শান্তিতে নাই। ছেড়ে দিন ততোটুকুই যতোটুকুতে আপ্নার ব্যবসায়ী খুসি থাকে। আপনি শুধু মিলিয়ে নিন, আপনি অতটুকু ত্যাগে কতটুকু ক্ষতিতে পড়লেন। যদি সামলে নেয়া যায়, এটাই ভালো মনে করে শান্তিতে থাকুন। ভালো ঘুম হবে আর ভালো ঘুম একটা আরামের লক্ষন। আপনি তো সাথে করে কিছুই নিতে পারবেন না। যেহেতু নিতেই পারবেন না, তাহলে অযথা সেগুলিকে ধরে রাখার কি ফায়দা? সব তো অন্য কেউই ভোগ করবে!! যদি তাইই হয়, অতটুকুই আপনার দরকার যতটুকুতে আপনি ভালো থাকেন। বাকীটা অন্যের। আফসোসের কোনো কারন নাই।
বড় বড় মিনিষীরা, বড় বড় ব্যবসায়ীরা কিংবা আরো বড় বড় জ্ঞানীরা তাদের শেষ জীবনে এসেই এই আফসোসের সন্ধানটা পান। আর মৃত্যুর বিছানায় শুয়ে শুধু একটা কথাই বলে যান সবার উদ্দেশ্যে যে, জীবনে কি পেলাম? আমি কি কারো জন্যেই কিছু করি নাই? কিংবা আমি তাহলে সারাজীবন কাদের জন্য এতো পরিশ্রম করলাম যখন আমার এই মুমুর্ষ সময়ে কেউ পাশে নাই কিংবা আমি যা চাই সেটা আর পাই না?
এটাই মূল কথা। জীবনের শেষ সময়ে কেউ কারো কাছেই থাকে না কারন সবাই আলাদা। সবাই ব্যস্ত।
২২/৬/২০২১-তোমাকে
যে যেই জীবন চায়, সে সেটাই পায়। কেউ জেনে শুনে পায়, কেউ না জেনেই পায়। তোমার লাইফ আমার কাছে যতোটা মুল্যবান, সেই জিবনটা তোমার কাছে কততা মুল্যবান, তার উপর নির্ভর করবে তুমি তোমার জীবনকে তুমি কতোটা ভালোবাসো। জীবনকে বুঝতে বুঝতে মানুষের প্রায় বেশীরভাগ সময়ই পার হয়ে যায়। ফলে যখন সে সত্যিকার অর্থে জীবনকে বুঝতে শিখে তখন সে তার রিসোর্সের প্রায় শতভাগ ব্যবহার করে ফেলে। যদি পরিকল্পিত পরিকল্পনায় জীবন গড়ে উঠে সে আনন্দের সাথে নিসচিন্তে বাকীটা সময় কাটিয়ে দেয়। কিন্তু যদি অপরিকল্পিতভাবে জীবনকে একতরফা এগিয়ে নিয়ে যায়, সে শেষ জীবনে এসে বুঝতে পারে-ফিরে যাবার আর উপায় নাই। তখন সে নিজের উপরেই নিজে রাগ করে, সবার উপরে অভিমান করে আর ভাবে-কোনো কিছুরই প্রয়োজন ছিলো না।
আমি আমার এই ছোট জীবনে একটা বিষয় খুব ভালভাবে বুঝতে শিখেছিলাম যে, আমার আশেপাশে আমি ছাড়া আর কেউ ছিলো না, থাকবেও না এবং এখনো নাই। স্বাধীন আছি কিন্তু আমি পরাধীন আমার নিজের কাছে। নিজ পরাধীনতা আমাকে এটাই শিখিয়েছে যে, মাথা উচু করে, কারো উপর নির্ভরশীল না হয়ে বাচার নামই আসলে পূর্ন স্বাধীনতা। আর এই পূর্ন স্বাধীনতা যখন পূর্নতায় ভরে উঠে তখন নিজের কাছেও আর কেউ পরাধীন থাকে না। আমি আমার সেই স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেই আমি আজীবন ঠিক সেভাবেই নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি যাতে আমি একা, আমি স্বাধীন এবং কারো উপরে আমার নির্ভরশীলতা না থাকে তা নিশ্চিত করা।
আমার সাথে যারা থাকে বা আমার বলয়ে আমাকে ঘিরেই তাদের পরিকল্পনা করে বেচে থাকতে চায়, আমি আমার পুরো পরিকল্পনায় তাদেরকেও প্যাকেজে বেধে ফেলি। ভাবি, সেটাও আমার দায়িত্ব। তাই আমি আমার থেকে তাদেরকে শতভাগ দেয়ার চেষ্টা করি। কেউ আমাকে এই অপবাদটা দিতে পারার কথা নয় যে, আমি স সব মানুষকে কোনো না কোনো কারনে ব্যবহার করেছি বা কাউকে আমি নিজের সার্থে ঠকিয়েছি। আমি ঠকেছি কিন্তু তাদেরকে আমি ঠকাইনি।
তোমার বয়স যখন মাত্র ১৮ কিংবা ১৯, তখন তুমি আমার দরজায় এসেছিলে। ঠিক এই সময়ে তোমার যা ছিলো তা অবাক করার মতো এক বিষয়। অপরিপক্ক এক জীবন্ত মানুষ। নিজের সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নাই, নিজের জেন্ডার সম্পর্কে তোমার কোনো ধারনা নাই। তোমার ক্ষমতা সম্পর্কেও তোমার কোনো আইডিয়া নাই। চারপাশ তোমার চলে যায় একেবারে অর্থহীনভাবে। কে তোমার আপন, কে তোমার আপন নয়, কে তোমার ভালো চায়, কে তোমার ভালো চায় না, কে তোমাকে ভালোবাসে, আর কে তোমাকে ভালোই বাসে না, কি তোমার অধিকার বা কথায় তোমার অধিকার কিংবা কি তোমার আছে বা কি তোমার নাই এসব নিয়ে তুমি কখনো ভাবোও নাই, না তুমি এসবের মধ্যে কখনো ছিলা। সপ্তাহের কোন দিনই তোমার জন্য কোনো চমক নিয়ে আসে নাই, অথবা কোনো ঋতুই তোমাকে এমন এক ভাবনায় নিয়ে যায় নাই যা একজন স্বাভাবিক মানুষের জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে। সকাল হয়, সন্ধ্যা হয়, ঝড় হয়, বৃষ্টি হয়, বন্যা বা শীত যাইই হোক না কেনো, সব কাল তোমার জন্য একই। অথচ এটা কোনো প্রানির বেলাতেও হয় না কিন্তু তোমার বেলায় এটাই হচ্ছিলো। তোমার কাছে কে ছেলে, কে মেয়ে, কে বালিকা বা কে বালক এর কোনো জেন্ডার পার্থক্য ছিলো না। পাখীদের মতো সকাল হয়েছে, আবার পাখীদের মতোই দিনের শেষে রাত নেমেছে তোমার জীবনে। একটা শুধু জায়গা হলেই হয় ঘুমানোর, সেটা মাটি নাকি খাট, নাকি ঘর না বারান্দা কিংবা রান্নাঘর এর মধ্যে কোনো বালাই ছিলো না। যখন ঘুমিয়েছো, ঘুমিয়েছ যেন ঠিক সেভাবে যে, পৃথিবীটা একেবারে নিরাপদ। অথচ তোমার জানা ছিলো না, এই পৃথিবীতে বাস করে হায়েনারা, বাস করে চোরেরা, বাস করে খুনীরা। এটা কোনো মনুষ্য জীবন নয়।
প্রথম যখন আমি তোমাকে দেখেছিলাম, আমি ঠিক এটাআই দেখেছিলাম তোমার জীবনে। কিন্তু অবাক করার বিষয় ছিল যে, আমার এই ধারনা পুরুই ভুল ছিলো। কেনো বললাম, ভুল ছিলো? সেটা বলছি।
সামাজিক প্রেক্ষাপটে আজো আমাদের সমাজে সব প্রানিরা তাদের সন্তানদের উপর একটা নজরদারি করে। হোক সেটা মানুষ কিংবা কুকুর, অথবা মুরগী। সব প্রানীরাই তাদের সন্তানদেরকে তারা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অতোতাই সময় ব্যয় করে যতোদিন না সেই সন্তান সাবলম্বি হয়। এই সময় পর্যন্ত সব প্রানিরা তাদের সন্তানদেরকে চোখে চোখে রাআখে যেন হটাত করে অন্য কারো শিকারে পরিনত না হয়। তারা তাদের সন্তানদেরকে খাবারের যোগান দেয়, কাছাকাছি রাখে, বিপদ কি জিনিষ সেতার শিক্ষা দেয়। মুরগীর বাচ্চা যেমন কাক দেখলে পালিয়ে যায়, মুরগী যেমন শিয়াল দেখলে লুকিয়ে যায়, সাপ যেমন গর্তে লুকিয়ে থাকে ইত্যাদি। কিন্তু আমি তোমার বেলায় পরবর্তীতে যা দেখেছি সেটা লোমহর্ষক। তোমাকে তোমার পিতামাতা এ ব্যাপারে এতোটাই উদাসীন ছিলো যে, তুমি বেড়ে উঠেছো ঠিকই কিন্তু তোমাকে এই পৃথিবীর বিপদ, আপদ কিংবা ভালো খারাপের কন কিছুই শিক্ষা দেয় নাই। যতোটুকু তুমি শিখেছো তা শুধুমাত্র নিজে নিজে। তোমার এই শিক্ষাতা ছিলো তোমার নিজের। এটা আসলেই আমাকে অবাক করেছে। তুমি নষ্ট হয়ে যেতে পারতে নিজের অজান্তে, তুমি পচে যেতে পারতে পরিস্থিতির কারনে, তুমি হারিয়ে যেতে পারতে পথ না চেনার কারনে। কিন্তু আমার এখন মনে হচ্ছে- কেউ তোমাকে অনেক আগলে রেখেছে খুব সজতনে। আর সেটা ঈশ্বর। তোমাকে ঈশ্বর পথ পিছলে পাহাড়ের নীচে পড়তে দেয়নি, তোমাকে ঈশ্বর অচেনা পথে চালিত করেনি। তোমাকে ঈশ্বর নিজে গাইড করেছে সারাক্ষন।
ঈশ্বরের সেই গাইড থেকেই হয়তো তুমি ছিটকে বেরিয়ে এসেছো আমার দরজার সামনে। হয়তো সেইই তোমাকে আমার দরজার সামনে নিয়ে এসেছে।
তোমাকে আমার কোনোই প্রয়োজন ছিলো না। না তোমার মেয়েলী কিছু, না তোমার রুপ, না তোমার ভালোবাসা। আমার এসবের কোনো কিছুই প্রয়োজন ছিলো না। কারন আমার আশেপাশে তোমার যা আছে এ সবেরই ছিলো অঢেল বা ছরাছরি। তুমি আমাকে যা দিতে পারো তা আমি অনায়াশেই পাই হাত বাড়ালে। তাও আবার নিত্য নতুন পন্যের মতো আমার ইচ্ছায় সব কিছুওই এসে হাজির হতে পারে আমার দরজায়। তোমার কাছে নতুন এমন কিছু ছিলো না যা আমার আশেপাশে নাই।
কিন্তু একটা জিনিষ আমি তোমার জীবনে দেখেছি যা আমার কাছে একেবারেই নতুন মনে হয়েছে। আর সেটা হচ্ছে-আমাদের সমাজে এখনো সেই সব মানুষ বিদ্যমান যারা তাদের সন্তানদেরকে সন্তান হিসাবে দেখে না, দেখে একটা জীবন্ত নরাচড়া প্রানী হিসাবে। এদের জন্য কোনো করনীয় নাই, এদের জন্য কোনো পরিকল্পনা নাই, এদের জন্য আলাদা করে কোনো ভালোবাসাও নাই। জগত সংসারে এসব সন্তান হুট করে চলে এসছে তাই ফেলে দেয়া যায় না, তাই মাঝে মধ্যে কিছু খাবার দিয়ে শুধুমাত্র জিইয়ে রাখা। তুমি ছিলে ঠিক সেই পরিস্থিতিতে। কিন্তু এটা কি সম্ভব? তোমাকে কেউ জোর করে হরন করে মনের সুখে আনন্দ করে নিয়ে গেলেও যতোটা কষ্ট একটা পিতামাতার হওয়া উচিত, সেটাও হয়তো হবে না। তোমার শারিরীক অসুস্থ্য কাউকে বিড়ম্বনায় ফেলে না। যেন অসুখ কোন চিন্তার ব্যাপার নয়। আবদার, আহলাদ, নিজের ইচ্ছা, পছন্দ এগুলির তো কোনো জায়গায়ই নাই। তোমার চোখের জলের কোনো মুল্য নাই।
তোমার এমন একটা পরিস্থিতি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিলো। তোমার এ রকমের একটা পরিস্থিতি তোমার আশেপাশে বিরাজমান, সেটা তুমি নিজেও জানো না ভেবে আমার আরো অবাক হতে হয়েছে। তুমি কতটুকু অসহায়, তুমি কতটুকু বিপদের মধ্যে আছো। তুমি কতটা অবহেলায় আছো, সেটা তুমি নিজেও জানো না। আর যদি জেনেও থাক, তার কোনো প্রতিকার তোমার কাছে নাই। তুমি তোমার পরিস্থিতি সঠিকভাবে জানলেও তোমার এর বিরুদ্ধে কি করা উচিত বা কিভাবে করা উচিত সেই ক্ষমতাও তোমার নাই। ফলে আমার কাছে বারবার মনে হয়েছে-তুমি তোমার নিয়তির কাছে শতভাগ আত্তসমর্পন করেই বেচে আচজো যা যে কোনো সময়ে আরো অনেক খারাপের দিকে যেতে বাধ্য।
প্রচন্ড মায়া লেগেছে আমার। যদি তুমি কখনোই আমার সামনে না আসতে, আমি তোমাকে নিয়ে এই মায়ায় কখনোই জাড়াতাম না। তোমাকে মায়া করার জন্য আমি নিজেও প্রস্তুত ছিলাম না। না আমার কোন দরকার ছিলো। দরকারটা ছিলো তোমার। আর সেই দরকারটা তোমার ঈশ্বর আমার দরজায় নিক্ষেপ করে আমার অন্তরে একটা আবেগের ঢেঊ তোলে দিয়েছিলো। তুমি হয়তো সেটা জানোই না।
এখানে আরো একটা আবেগের কথা না বললেই নয় যে, একই ছাদের তলায় বসবাস করে, একই হাড়ির খাবার খেয়ে, কিংবা একই পরিবারে বাস করেও তোমার অধিকারটা ছিলো সর্বনিম্ন। ঈদের চাকচিক্য দিনে কিংবা হাড়কাপুনি শিতে যখন অন্যদের গায়ে নতুন কিছু জুড়ে যায়, তখনো তোমার জন্য কিছুই জোটতো বলে মনে হয় না। তুমি হয়তো এতা কখন উপলব্ধিও করো নাই যে, তুমি আসলে সবার মাঝে বসবাআস করেও একটা আলাদা মানুষ। সবার জন্য ঘুমানর নির্দিষ্ট জায়গা থাকলেও তোমার জায়গার কোনো নির্ধারিত স্থান নাই। সবার প্লেট আলাদা হলেও তোমার প্লেট যেনো সার্বোজনিন, একটা হলেই হলো। তোমার কোনো আইডেন্টিটি নাই। অবাক না?
হ্যা, অবাক করারই বিষয়। আর ঠিক যেদিন আমি এই ঘটনাগুলি বুঝতে পারলাম, সেদিন মনে হয়েছে, তুমি মানুষের চেহারায় আসলে একটা অন্য কিছু হয়ে বড় হচ্ছো। ঈশ্বরের কোনো না কোন পরিকল্পনা তো আছেই তোমাকে নিয়ে। আর সেই পরিকল্পনাটা সম্ভবত তিনি বরাদ্ধ করে রেখেছেন-আমার কাছে তোমার রিজিক।
যখন তুমি আমার কাছে একেবারে চলে এলে, আমি আমার সব পরিকল্পনা আমি পালটে দিলাম তোমার জন্যে। এটা ভালবাস বা কোনো লোভে না। এটা-মায়া। এটা ভালবাসা নয়। এই পৃথিবীতে ভালবাসার থেকে অনেক বেশি ক্ষমতাশীল আবেগ হচ্ছে-মায়া। ভালোবাসা একসময় ঘৃণায় পরিবর্তন হতে পারে, একজনের ভালোবাসা অন্য কারো আরো বেশি ভালবাসায় একসময় একজন থেকে আরেকজনের কাছে সরে যেতে পারে। কিন্তু মায়া এমন এক জিনিষ, যা কখনোই পরিবর্তন হয় না। সময় পেরিয়ে গেলেও মানুষ মায়ার কারনে আবার সব ভুলে বুকের কাছে টেনে নেয়। যার কাছে মায়া আছে, তার ভালবাসার দরকার পড়ে না। তার শরীর দরকার পড়ে না, তার কোনো কিছুরই প্রয়োজন পড়ে না। আর এই মায়ার কারনেই মানুষ চিরস্থায়িভাবে একই জায়গায় পড়ে থাকে।
তোমার আগেও কেউ ছিলো না, আমার পরে তোমার আর কেউ নাইও। এটাই সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। কেউ কেউ বলে-যাদের জীবনে এমন একটা অনিশ্চয়তা আছে তারা সংসার করলেই সব দুঃখ, সব অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। আজ আমার এই ৫৮ বছর বয়সে এসে আমি যেতা বুঝেছি সেতা হল-সংসার একটা পুরুদস্তর মরিচিকা। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ সংসার করে অনেক গুলি কারনে যা পশ্চিমা দেশগুলিতে নাই।
পশ্চিমা দেশ গুলিতে একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে অবাধ মেলামেশার কারনে তারা যেমন অবাধে শারিরীক চাহিদা মিটাতে পারে, সেখানে কেউ কোনো প্রশ্ন তোলে না। অবিবাহিত দুটু ছেলেমেয়ের মেলামেশায় কেউ খারাপ মন্তব্য করে না। তারা যুগের পর যুগ লিভ টুগেদার করেই সংসার না করে একাই স্বাধীন থাকে। ওরা কখনোই একা থাকে না। আজ যাকে নিয়ে লিভ টুগেদার করছে, তাকে আর ভাল না লাগলে কাল আবার আরেক সংগী নিয়ে দিন কাতায়। তাই ওদের একাকীত্ব বলে কিছু থাকে না। ওরা নিজেরা নিজেরা সাবলম্বি হয়, কেউ কারো উপরে নির্ভর করে না। ফলে কোনো সংগী যদি মাত্রার অতিরিক্ত মানসিক চাপে রাখতে চায় কিংবা মোড়ল্পনা করতে চায়, ওরা একে অপরের থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এগুলি সম্ভব না। লুকিয়ে সেক্স করা হলে এটা কোন না কোন সময়ে প্রকাশ পেলে হাজার বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বিয়ে না করলে আজীবন একাকীত্বকে বরন করতে হয়। মেয়েরা খুব কমই নিজেরা সাবলম্বি হয়, ভাবে তার স্বামীই তাকে সব ভরন পোষন করাবে ইত্যাদি। ফলে এদেশে বিবাহ ব্যবস্থাতাই একমাত্র সেই চাহিদার খোরাক। আমাদের সমাজেও যদি পশ্চিমা দেশের মতো এই সিস্টেম চালু হতো, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায়তেও বিবাহ নামক এই প্রথা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যেতো। আমাদের সমাজে এই সংসার করার মুল কারন-(১) সেক্সের প্রয়োজনিতা (২) একাকীত্বকে দূর করা। (৩) কারো না কারো উপরে নির্ভর করা।
আমি এসব নবিবেচনা করেই শেষ অবধি তোমার জন্য আমার পুরু পরিকল্পনা পালটে দিয়েছি। এই পাল্টানোর পিছনে আমার কোন দুর্বলতা কাজ করে নাই। এটা কখনোই আমার মনে আসে নাই যে, এতো কিছু করার পরে যদি তুমি তোমার পরিকল্পনা পালতাও, তাহলে? আমি সেখানেও অনড়। অসুবিধা কোথায়? অন্তত কেউ তো ছিলো তোমার জীবনকে একটা নিশ্চিত গন্তব্যে পরিচালিত করা। সেটা না হয় আমিই হলাম। আমি সুখী এবং খুশি।
আমি তোমাকে ১০০% স্বাধীনতায় বাচিয়ে রাখতে চেয়েছি এবং চাই। তুমি জানো তুমি এই মুহুর্তে তুমি কতটা স্বাধীনতায় আছো। আর কতটা মনের জোরে আছো। তুমি এটাও জানো আমাদের সমাজ ব্যবস্থার নিরিখে তুমি কতটা কষ্টেও আছো। এটা শুধু জানো তুমি। কিন্তু আমি জানি, আমি তোমার কতটা নিরাপত্তা দিতে চাই আর কতোটা কি করলে তোমার বেচে থাকতে ভালো লাগবে। বাকীটা তোমার মন আর অন্তর জানে। আমি তোমাকে মাঝে মাঝে ফান করে বলি যদিও যে, ভাইগা যাইবা কিনা। সেটা আসলেই ফান। কিন্তু কখনো যদি এই ফানটাই বাস্তব হয়, আমি কিন্তু তারপরেও খুসি থাকবো এই কারনে যে, অন্তত তুমি ভালো আছো। আর কিছু না।
আর এই ফানটা বাস্তবে সম্ভব হলেও, যেদিন সম্ভব হবে, তার ঠিক একমাস পরে তোমার মন, তোমার প্রান, তোমার সারাটা অন্তর ঠিক আমার মৃত ড্রাইভার রুস্তমের মতো হয়ে যাবে। রুস্তম মরার ঠিক আগে আবার আমার কাছে ফিরতে চেয়েছিলো। আমার কাছে রুস্তমের ফেরার পথ জানা থাকলেও আর ফেরা হয় নাই। কারন তার তখন পা আমার দিকে এগুতে পারে নাই। মন তাকে বারবার আমার দিকে পুশ করলেও মনের জোরের বিপরীতে কা করে নাই। ভয় করেছে ওর। ফলে একদিন-একদিন রুস্তম সমস্ত আশা হারিয়ে হতাশার উজ্জ্বল দিবালোকে নিজেকে শেষ করে দেয়া ছাড়া আর কোনো পথ সে খুজে পায় নাই।
রুস্তম আমার বাসা চিনতো, আমার অফিস চিনতো, আমার সব কিছু চিনতো। কিন্তু এই চেনা পথেও রুস্তম আর ফিরে আসতে পারে নাই। যেমন তুমিও চিনতা আজকের এই বাসাটা। ইচ্ছে করলেই আমাকে বলে ১ দিন পর আবার চলে আসতে পারতা যখন তুমি পালিয়েছিলে। কিন্তু পারো নাই।
আর এটাকেই বলে জীবনের কাছে মানুষের পরাজয়।
বড় বড় ঝড়ে মানুষ হয় দালান খোজে, আর যদি দালান না পায়, বড় বড় গাছ খোজে। বড় গাছের নীচে ঝড় কম। হ্যাপির ঘটনাটা তার একটা বড় উদাহরন। তোমাদের সমস্ত পরিবারের উপর একটা ঝড় ছিলো। তছনছের আভাস কিন্তু পেয়েছ হ্যাপির যাওয়ার ২ দিন পর থেকেই। যেভাবে সবাই তোমাদেরকে আস্টে পিষ্টে ধরতেছিলো, কোনো অবস্থাতেই তোমরা আর ঐ গ্রামে থাকতে পারতা না। কিন্তু হয়তো আমি ছিলাম বলে রক্ষা পেয়ে গেছো। কিন্তু যদি না থাকতাম? আজ যতোটা শান্তিতে আর বুকের বল নিইয়ে ঘুরতে পারো, যদি না থাকতাম, তাহলে অতোটা নীচু হয়েই বাস করতে হতো বংশ পরম্পরায়। আর এই কষ্ট দেখতে নিজের চোখে। মাঝে মাঝে মনে হইতো, জীবনের পরাজয় মনে হয় এভাবেই হয়।
আমি এগুলি দেখেছি আমার এই ৫৮ বছর বয়সেই। তাই, আমি কাউকে ঠকাই না, কিন্তু আমি ঠকার জন্য রেডি থাকি। কারন আমার ঠকার মতো ক্ষমতা আছে। এটা টাকার জন্য না। এটা একটা মনের বল। নিজের মনের শক্তি।
আজমীও সোহেলের কাছ থেকে পালাইতে চায়। মাত্র ১০ লাখ তাকা হলেই নাকি আজমী সোহেলকে লাথি মেরে চলে যেত। কিন্তু আজমির সেটা নাই আর পালাইতেও পারে না। ও নিজেও এখন আর পালাইতে চায় না। তাই আমি সব সময় মানুষকে বলি, পারলে পালিয়ে যাও। আমি ধরে রাখি না। আমি কাউকেই ধরে রাখি না। মানুষ আমাকে ধরে রাখে। কিন্তু তোমার বেলায়, আমি তোমাকে ধরে রাখতে চাই কারন তোমার পালানোর কোন জায়গাও নাই।
খেয়াল করে দেখো- যেদিন তুমি পালিয়েছিলে, ঐ সময় ২ লাখ টাকা তোমার কাছে শত কোটির মতো মনে হয়েছে। সেই টাকাটা তোমার কাছে ছিলো একটা শক্তি। কিন্তু আজকে তোমার কাছে প্রায় ৬০ লাখ টাকাও মনে হয় না যে, এটা শক্তি। কারন তোমার লাইফ স্টাইল বদলে গেছে। তুমি এখন ইচ্ছে করলেই বন্যার ছেলের জন্য কিংবা বন্যা বা সুমী বা আরবি টিচার টাকা চাইলে না দিয়ে পারবা না। আর যদি না দাও, তুমিও বন্যার, সুমির কাছে কিংবা তোমার পরিবারের কাছেও একটা অসামর্থবান অকাজের অনর্থক এক পাবলিক। একটা সময় আসবে তোমার, মাসে ১ লাখ টাকা কামাই করলেও মনে হবে এটা এনাফ না।
তখন দরকার লাখ লাখ টাকা। কে দেবে তোমাকে সেই ভরসা? সব সময় টাকাই ভরসা না। একজন মানুষই কোটি টাকার ভরসা। চোখ বন্ধ করো, মনে মনে পালিয়ে যাও, দেখো কার হাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশী নিরাপদ। কার কাছে গেলে ভালো ঘুম হয়। দুসচিন্তা না থাকে। সেই লোক পাওয়া বড় কঠিন। বন্যাকে তুমি হাজার হাজার টাকা দাও না। কিন্তু তুমি বন্যাদের কাছে লাখ টাকার ভরসা। অন্যদিকে সুমীর সেই ভরসাটাও আর নাই। অথচ তুমি একদম কাছেই আছো।
কথাগুলি কঠিন। কিন্তু এই কথাগুলি এতোটাই বাস্তব যে, আজমী এখন বুঝে এটা। সেফালী বুঝে, লিয়াকত বুঝে, খালেদা বুঝে, সুমী বুঝে, লামিয়া বুঝে, চইতী এখনো বুঝে নাই কারন চৈতী এখনো বাপের বিল্ডিং এ ভালো আছে। কিন্তু একটা সময় ছিলো, তখন বুঝে নাই। ঐ যে বললাম- “যদি আর একবার” এটা একটা অনুশোচনার নাম। হয়তো “যদি আর একবার” এই সুযোগটা কখনোই কারো জীবনে আসে না।
যদি তুমি মনে করো
যদি তুমি কখনো মনে করো যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি নাই, তুমি ঠিক। আবার যদি কখনো মনে করো যে, আমি তোমাকে খুব ভালোবেসেছি, আমি বলবো আবার যে, তুমি এবারো ঠিক। যদি তুমি মনে করো যে, আমি স্বার্থপরের মতো তোমার কাছ থেকে এমন কিছু চেয়েছি যা তোমার কাছে অত্যান্ত মূল্যবান, কিংবা সেটা দেওয়া তোমার জন্য অনেক ভয়ংকর, আমি বলবো যে, তুমি ঠিক। যদি তুমি মনে করো, আমি তোমাকে ইগনোর করেছি, হ্যা আবারো তুমি ঠিক। তুমি যদি কখনো কনফিউজড হয়ে থাকো যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি কি বাসি না, সেটা তুমি বুঝতেই পারছো না, হ্যা, এবারো তুমি ঠিক।
তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি সব গুলিই ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে আসল সত্য কি? বা আসলে ঠিক কোনটা? আমি বলবো যে, উপরের সবগুলি ই ঠিক। কারন, সত্য ভালোবাসা এমনই যে, কখনো মনে হয় খুব ভালোবাসি,কখনো মনে হয় পুরু সম্পর্ক টাই ঘৃণার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। আবার কখনো কখনো খুব সন্দেহের মধ্যেই দিন কেটে যেতে থাকে।
ঈশ্বর প্রত্যেক কেই স্পেশাল করেই বানিয়েছেন। কারো কারো মধ্যে অথবা প্রতি জনের মধ্যেই ঈশ্বর আলাদা আলাদা গুনাবলী দিয়েই পাঠিয়েছেন। এই ঈশ্বর এমন এক শক্তি যাকেয়াপ্নি, আমি সবাই সব কিছুতেই দায়ী করতেপারি। আবার তার কাছেইখুব গোপনে কাদতেও পারি। আর আমি এই জন্যই ঈসশরকে খুব ভালোবাসি যে, সেয়ামাকে তাকে সব কিছুর জন্য দায়ী করলেও সে কিছুই বলে না। আমি তাকে ঘ্রিনা করলেও সে আমাকে শেষ করে দেয় না। আমি যেমন্তার সাথে যুদ্ধ করতেপারি, তেমনি আমি তার কাছে পুরুপুরি সারেন্ডার ও করতে পারি।
আমাদের জীবনে সবচেয়ে যে জিনিষটা ভালো বা খারাপ হয়ে আসতে পারে তা হচ্ছে, ঈশ্বরের করুনা। আমি ব্যাপারটা যদি এইভাবে বলি যে, তিনি জানেন আমাদের জন্য সবচেয়ে কোনটি সবচেয়ে মঙ্গল। ফলে আজকে কোন কাজটি আমার জন্য দৃশ্যমান খারাপ মনে হলেও হতে পারে কিন্তু বলা যায় না যে, হয়ত এই দৃশ্যমান খারাপটাই হয়ত ভবিষ্যতের কোন এক ভালোর জন্য। অথবা আজকের দিনের কোনো এক দৃশ্যমান মঙ্গল হতে পারে আগামিকালের কোনো এক ভয়ংকর বিপদের কারন। ফলে ঈশ্বরের করুনাটাই সবচেয়ে বড়। হতে পারে আজকে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি, এটাই ভালো আমাদের জন্য। আমি তোমাকে আর তুমি আমাকে মুক্ত মনে মুক্তি দিয়ে রাখো, দেখো ঈশ্বর কোথায় আমাদের নিয়ে যায়। যদি মন ফিরে আসে, যদি প্রান কাদে, তাহলে আবারো আমরা এই পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তই থাকি না কেনো, আবারো আমরা এক সাথে হবো। হয়ত তখন আর এইভুল বুঝাবুঝি গুলি হবেনা।
শারমিন কথা
মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় প্রায় তিন বছর আগে। আর এই পরিচয়টা নিছক কোনো কাকতালীয়ভাবে নয়। নিছল প্রোফেশনাল প্রেক্ষাপট থেকেই তার সাথে আমার পরিচয়। ধীরে ধীরে সখ্যতা গড়ে উঠলেও প্রোফেশনাল বাউন্ডারি থেকে জীবনের সব কাহিনী সব সময় জানা হয়ে উঠে না। কিন্তু এই পরিচয়ের মধ্যে প্রোফেশনাল বাউন্ডারীর বাইরেও একটা আলাদা জগতের মধ্যে প্রবেশের পরিবেশ সৃষ্টি হয় যা নিছক ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক।
জীবনের সব কাহিনীর কিছু মোড় থাকে। এই মোড়ে মোড়ে আকাবাকা হয়ে কিছু অব্যক্ত কাহিনী থাকে যা থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। শারমিনের জীবনের ইতিহাসেও এই রকম বেশ কিছু বাক আছে। শারমিনের বিয়ে হয়েছে প্রায় অর্ধ যুগের উপর কিন্তু ঈশ্বর তাকে তিনি অনেক ভাগ্সেয আর আনন্ইদ থেকেই যেনো বিনা কারনে বঞ্চিত করে রেখেছন। কেনো এমন হয়? কেনো ঈশ্বর কাউকে থলে ভরা সম্পদ দেন, ঘর ভর্তি মানুষ দেন কিংবা দুহাত ভরে শান্তি দেন, আবার কারো কারো জন্য ঈশ্বর কিছুই দেন না। এর ব্যাখ্যা বড় জটিল। শারমিনের জীবন টাও যেনো সেই দলে যারা আজীবন শুধু বঞ্চিতই ছিলো। না জোগান দিলেন সি সাধের যেখানে কোনো হাটি হাটি পা পা করে ঘরময় ঘুরে বাড়াচ্ছে ক্ষুদ্র মানুষের পদধ্বনি, না ঝমকালো সম্পদের পাহাড়, অথবা সমাজের উচ্চবিত্তের কোনো অহংকার। ঈশ্বর কাকে কেনো এই সার্থকতা থেকে কি কারনে বঞ্চিত করেন, তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। আপাত দৃষ্টিতে আমাদের কারো কারো সহানুভুতি থাকলেও একটা জিনিষ সঠিক যে, ঈশ্বর তার সৃষ্টির সাথে কখনো মশকরা করেন না। তিনি যার যার সামর্থের উপর, যোগ্যতার উপর তাকে পুরুস্কার করেন। যতোক্ষন না কেউ কোনো কিছুর জন্য মানসিক, এবং মানবিক দিক থেকে প্রস্তুত না হয়, অথবা তাকে প্রস্তুত না করেন, ততোক্ষন পর্যন্ত ঈশ্বর তাকে সেই কাঙ্ক্ষিত পুরুস্কার কে তিনি তার হাতে তুলে দেন না। ঈশ্বর সবচেয়ে ভালো বিচারক। যে যতটুকুর ভার বহন করতে পারে, যে জিনিষের ভার বহন করতে পারবে, ঈশ্বর তাকে সেই জিনিষের ভারই তাকে দেন। অপাত্রে তিনি কোনো কিছুই দান করেন না। হোক তাকে তিনি যতো সুন্দর করেই সৃষ্টি করেন না কেনো।
ঈশ্বর এই জাতীয় মনুষ্য বাহিনীকে যুগে যুগে একটা রেফারেন্স দেওয়ার লক্ষ্যে, তাদেরকে উদারন হিসাবে রাখার জন্য হয়তো মনুষ্য সমাজে নিছক একটা লোভনীয় মুর্তি হিসাবে জাগিয়ে রাখেন।
আইন্ডেন্টিটি (পর্ব-১)
২৪ বছর পর মনিকা জানতে পারলো যাকে সে বাবা বলে চিনত, যাকে সে আদরের ছোট ভাই বলে জানতো, যাকে সে বোন, চাচা, দাদা, জেঠা ফুফু ইত্যাদ বলে জানতো, তারা আসলে মনিকার কেউ না। বাবা বাবা না, দাদা দাদা না, ভাই ভাই না, বোন বোন না, জেঠা, চাচা, এরা ওর কেউ দাদা, ভাই বা বোন কেউ না। অথচ কাকের বাসায় কোকিলের ছানার মতো তার জন্ম হয়েছে, শৈশব কেটেছে, বাল্যকাল কেটেছে, আর এখন সে একজন পুর্ন বয়ষ্ক যুবতী। তাহলে এই ২৪ বছর ধরে যে মনিকা তিলে তিলে তার অন্তর, আত্মা আর মানসিকতা দিয়ে কিসের বালুর এক প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলো যা আজ হটাত করে সমুদ্রের এক জলোচ্ছাসে নিমিষের মধ্যে তছনছ করে মিলিয়ে গেলো?
সব মিথ্যা। এ যাবত মনিকা যা পেয়েছে, যা দেখেছে, যা শুনেছে, আজ সব তার কাছে মিথ্যা বলে সামনে এসে সত্য হাজির হয়েছে। মনিকা কাকে এই প্রশ্নের উত্তর জানাতে বলবে? মিথ্যে হলো সেই জাল যা একটা মানুষ তার নিজের অজান্তেই সে নিজের জন্য বিছায়। কিন্তু মনিকা তো নিজে কোনো মিথ্যার জাল বুনে নাই!! তাহলে তার ব্যাপারে এমনতা হলো কেনো? কথায় বলে, মিথ্যাও কখনো কখনো সত্যি হয়ে যায়। মনিকা আজকের এই মিথ্যাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কোন একটা মিথ্যাকে হাজার বার বললে নাকি মিথ্যাটা সত্য হয়ে যায়। কিন্তু মনিকা জানে, তার এই মিথ্যা বা সত্য যেটাই হোক হাজারবার কেনো আজীবন কাল ধরে আওড়ালেও আর সত্যিটা মিথ্যা আর মিথ্যাটা সত্যি হয়ে যাবে না। হয়তো মিথ্যাটা এ যাবত কাল পর্যন্ত যেভাবে চাপা পড়েছিলো, আজো হয়তো সেটা চাপা দিয়েই মিথ্যাটাকে সত্য বলে চাপিয়ে জীবন চালাতে হবে অথবা, সমস্ত জগত সংসার ছেড়ে আকাশের পানে চেয়ে কোনো এক নামহীন গন্তব্যে সারাজীবনের জন্য হারাইয়া যেতে হবে। কারন সত্যি আর মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করা সব সময় সহজ হয় না।
মনিকা তার পড়ার টেবিলে জল ছাড়া মাছের মতো ছটফট করছে আর বসে শুধু একা নীরবে এটাই ভাবছিলো তার ভবিষ্যত কি আর তার বেচে থাকার অর্থই কি। ভালোবাসায় যেমন অনেক শক্তি থাকে, তেমনি বদনামেরও একটা ভয় থাকে। সকাল থেকে এই সন্ধ্যা অবধি মনিকা তার সারা জীবনের গল্পটা আর এখন যেনো মিলাতে পারছিলো না। বারংবার মনে হচ্ছিলো, মনিকা, তার বাবা, তার মা, তার পরিবার যেনো একটা মুখোশ পড়েই এই সংসারে চলমান ছিলো। আজ সেই মুখোশ খসে পড়েছে বটে, কিন্তু মনিকা এটাও বারবার ভেবে কোনো কুল কিনারা পাচ্ছিলো না যে, মুখ আর এই মুখোশ তার আলাদা করা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হলো
মনিকার প্রতিনিয়ত এটাই মনে হচ্ছিলো, এইতো গতকাল রাত পর্যন্ত তো সবই ঠিক ছিলো। অথচ আজ এতোদিনের একটা সম্পর্ক একটা মাত্র 'হ্যা' বলার মধ্যে সব তছনছ হয়ে গেলো? জীবন দাঁড়িয়ে গেলো কোনো এক মুল্যহীন ঘাটের ধারে যেখানে না আছে পারের কোনো খেয়া, না আছে ঘাটের কোনো মাঝি!
এই মর্মান্তিক ঘটনা হটাত করে কেমন করে মনিকার জীবনে ঘটে গেলো? এটাও একটা রহস্যের ব্যাপার ছিলো। জীবনের অনেক কাহিনী আছে যা রহস্যে ঘেরা থাকে। যখন কেউ এই রহস্য ঘেড়া চাদর সরাতে যান, তখন এমন এমন কিছু প্রশ্নের উদয় হতে পারে যা সাভাবিক জীবনের ভিত নড়ে যেতে পারে। এইসব রহস্য ঘেরা প্রশ্ন জানলেও অসুবিধা আবার না জানলেও জীবন সাভাবিক হয়ে উঠে না। এক্ষেত্রে কি জানা উচিত আর কি জানা একেবারেই উচিত না, সেটাই নির্ভর করে পরবর্তী সুখী জীবনের জন্য। মনিকার প্রায়ই মনে হচ্ছিলো যে, অন্য আর ভাই বোনদের সাথে ওর বাবা মার আচরন, ব্যবহার আদর আপ্যায়ন অনেক কিছুই গড়মিল। আর্থিক সচ্চলতার সাথে পরিবারের এই জন্মগত ব্যবহারগুলির মধ্যে কোনো তারতম্য থাকার কথা না। কারন তারা একই গোত্রের, একই পরিবারের। কিন্তু মনিকার মধ্যে এই প্রশ্ন বহুবার মনে উদয় হয়েছিলো, আসলেই এ রকম তারতম্য কেনো? সত্য বেশীদিন লুকিয়ে রাখা যায় না। কোনো একদিন মনিকার মনে হচ্ছিলো, মনের দুক্ষে অনেক কাদবে সে মার সাথে বাবার সাথে। সে রকমেরই একটা পরিস্থিতি গতকাল সৃষ্টি হয়েছিল। কথায় কথায় মনের দুক্ষে আর রাগে যখন মনিকা তার মাকে এই অদ্ভুদ প্রশ্নটি করেই ফেল্লো, "মা, আমি কি তোমাদের আসলেই আসল মেয়ে? নাকি আমাকে তোমরা কোথাও থেকে কুড়াইয়া এনেছো?"
মনিকার এমন প্রশ্নে মানসিকভাবে দূর্বল মা, একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলেন, আর তার মনের অজান্তেই সব সত্যি কথা বলে দিলেন। মনিকা তার বাবার আসল মেয়ে নয়।
ঝড়টার আভাষ অনেক আগেই ছিলো, কিন্তু এবার শুরু হয়ে গিয়েছিলো। আজ এতো বছর পর তাহলে মনিকা কে? আচমকা এই সত্যের মুখুমুখি দাঁড়িয়ে ক্ষনিকের জন্য হলেও মনিকার জ্ঞান হারিয়েছিলো বটে কিন্তু অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে শিখতে হয়। আজ নিশ্চিত জানলো মনিকা যে, জীবনের যাত্রার শুরু থেকে শেষ অবধি মনিকার রাস্তাটা একটা অন্ধকারই ছিলো, ওর জীবনটা ছিলো একটা অন্ধকার টানেল, যেখানে মাঝে মাঝে আলো আসে বটে কিন্তু সে আলোয় কোনো কাজ হয় নাই। আজ সত্যটা একদম নাকের ডগায় বসে মনিকাকে এমনভাবে চুরমার করে দিলো যে, টাইম টাকে মনে হলো সবচেয়ে বড় ভিলেন। মনিকা সামনে যা দেখছিলো, তার থেকে অনেক বেশি ঘটনা লুকিয়ে ছিলো তার না দেখার পিছনে। মনিকা এখন এমন একটা বয়সের দ্বার প্রান্তে দাড়িয়েছিলো, যার নাম যৌবন। আর এই যৌবন হলো এমন এক প্রাকৃতিক উপাদান যার দ্বিতীয় নাম শক্তি কিন্তু বড় অসহায়।
কারো পরিবার যখন নিমিষের একটা তথ্যের সার্টিফিকেটে অপরিচিত হয়ে যায়, তখন সবচেয়ে কাছে যে আসে, সে হলো বন্ধুত্তের শক্তি। বন্ধুত্ব আমাদের জীবনের একটা গুরুত্তপুর্ন অংশ। মনিকারও এমন একজন বন্ধু ছিলো, যার না ছিলো কোনো সামাজিক প্রতিপত্তির অভাব, না ছিলো কোনো যশের কমতি। এই গত কিছু বছর যাবত মনিকার সাথে এই প্রতিভাযশি বন্ধুত্বটা এমনভাবে তার জীবনে এসেছিল, মনিকার কখনো মনে হয়েছে সে তার মা, তার বাবা, আবার কখনো মনে হয়েছে সে তার প্রিয়তম। মনিকার কাছে তার এই বন্ধুটি যেনো কোনো এক শিল্প। প্রায়শই মনিকার কাছে এ প্রশ্ন কুরিকুরি অংকুরের মতো উদয় হতো, জীবন শিল্পকে নকল করে নাকি শিল্প জীবনকে নকল করে? ব্যাখার কোনো আর আজ প্রয়োজন পড়লো না। ভঙ্গুর চিত্তে, হতাশ মনিকা, কিছুক্ষন গলা ফাটিয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে বাক্রুদ্ধ হয়ে বসে রইলো। মিথ্যে চোখের জল একটা সময় আর কাজে লাগে না।মনিকার কাছে আজকের দিনের চোখের জলকে পুরুই মিথ্যা মনে হতে লাগলো। যখন কোনো মানুষের দুঃখ থাকে, কষ্ট থাকে, সে সব সময়ই চাবে যে, সে অন্য কারো সাথে তার এই দুক্ষটা, কষ্টটা শেয়ার করতে। কেউ তো থাকবে যে, ওর কথা শুনবে। বুঝুক না বুঝুক সেটা আলাদা ব্যাপার, কষ্ট লাগব করুক বা না করুক সেটাও আলাদা ব্যাপার। কিন্তু কারো সাথে তো তার এই কষ্টের ব্যাপারগুলি শেয়ার করার দরকার। কেউ চলে যাবার পর হয়তো কিছু পরিবর্তন নজরে আসে।
অবশেষে মনিকার যার চেহারাটা প্রথম মনের মানস পটে ভেসে উঠেছিলো, সে আর কেউ নয়, আকাশ। যে আকাশকে একদিন মনিকা তার ঘরের সব দরজা বন্ধ করে দিয়ে পলায়ন করেছিলো, আজ যেনো মনে হলো, এই আকাশই যেনো তার সুরক্ষার ছাদ। ঘরের দরজা বন্ধ হবার সাথে সাথে সবসময় মনের দরজা যে বন্ধ হবে এমন কোনো কথা নাই। একটা ভরষা ছিল ক্ষীন। অবশেষে মনিকা আকাশকেই ফোন করে এটাই বলার চেষ্টা করলো যে, যে বিষয়টায় আশংকা ছিলো, ভয় ছিলো, দুশ্চিন্তা ছিলো সেটাই হয়ে গেলো আজ। মনিকা আজ এক নামবিহীন কোনো এক পরিচয়হীন বেওয়ারিশ মুন্ডুহীন জীবন্ত লাশ। এখন যদি তার কিছু অবশিষ্ঠ থেকে থাকে, তা হল একটা শরীর, কিছু মাংশ আর সমস্ত জীবনভর অনিশ্চয়তা। মনিকার আর কোথাও যাবার দরজা নাই। মনিকার জীবন হাপিয়ে উঠেছে। কোথাও কেউ নাই। জীবন যেনো একটা নদী।
তারপরেও আবার বারবার মনিকার মনে হচ্ছে, আকাশ নদীটা কি তার জীবনের লক্ষ্য পার হবার জন্য সঠিক নদী? মনিকা বারবার একই প্রশ্ন নিজেকে করেছিলো, কিন্ত কোনো উত্তর আসছিলো না। কারন, আপনি একই নদীতে দুবার পা দিতে পারেন না, দেওয়া যায় না। কিন্তু মনিকার জীবন নদীতে এখন বান ডেকেছে। এই কয়টা মাস খালী জল জমতেই থেকেছে, জমতেই থেকেছে, আর এখন সে জল প্রায় মাথার উপর উঠে গেছে, এখন এই জলের বানেই হয়তো মনিকা ডোবে যাবে। মনিকা হাপিয়ে পড়েছিল। ভয় পেয়েছিলো। মনিকার বারবার এটাই মনে হচ্ছিলো, এখন দরকার তার একটা সেটেলমেন্ট। আকাশের উপর কিছু ঘৃণা জমেছিলো বটে, কিছু রাগ হয়েছিলো বটে কিন্তু আজ মনিকার মনে এটাই বারবার উদিত হচ্ছিলো, অনেক সময় ঠিকানা ভুল হয় কিন্তু ওই ঠিকানায় যারা থাকে তারা হয়তো ঠিক লোক। আকাশের ঠিকানাটা মনিকার জন্য এইমুহুর্ত শুধু নয়, আজীবনের জন্যই হয়ত ভুল, কিন্তু আকাশ ভুল ছিলো না। পরিত্যক্ত ঘুনে ধরা কিছু জরাজীর্ন অন্ধ ভালোবাসার থলিটা নিয়ে মনিকা বুকের পাজরে শক্ত করে ধরে আজকের পরিত্যক্ত নিজের পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে গেলো কোনো এক অজানা গন্তব্যের পথে যেখানে হয়তোবা আকাশ নীল রংগের চাদর বিছিয়ে কিছু মেঘমালা সাজিয়ে দিনের শেষে সুর্যের লাল আভায় তারই আরাধনায় ভজনে লিপ্ত। বারবার মনিকার মনে হয়েছে, এ লোকগুলি আমাকে একের পর এক ঠকিয়েছে। বারবার ঠকিয়েছে। এই ঘরে আমার সমস্ত অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। আমি এদের আর কেউ নই।
কিন্তু আকাসই বা কেনো মনিকার জন্য এভাবে জজ্ঞ করবেন? আবার বিশ্বাস হয়েও ছিলো। অন্ধ বিশ্বাস এমন এক চোরাবালী, যার না আছে একুল, না আছে ওকুল। সেখানে হয়তো কোনো জ্ঞানের আলো পৌছতে পারে, কিন্তু কোনো তর্ক বিহীন আশ্বাস ভর্তি থাকে। মনিকার এবার একটা কথা মনে হলো, বিশ্বাসভাজন হবার জন্য দরকার সেক্রেফাইস, দরকার একনিষ্টতা। আর দরকার নিজের সাথে নিজের সৎ হওয়া। আজ যেখানে মনিকা হারিয়ে গেলো, সেখান থেকেই মনিকাকে আবার নতুন জীবন নিয়ে বেচে উঠতে হবে এই জগত সংসারে। প্রথমবার যখন সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিলো আকাশের সাথে, তখন প্রয়োজন ছিলো সাময়িক। কিন্তু এবার মনিকার কাছে মনে হলো, সম্পর্কটা জীবনে বাচার সাথে এই সম্পর্কটা জরুরী। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সম্পর্ক জুড়তে যাওয়া একটা ভয়ংকর অপরাধের জন্ম দেয়। প্রথমবার যেটা মনে হয়েছিল। কিন্তু এটা আজ আর কোনো ভয়ংকর মনে হলো না। আজ এটাই বারবার প্রমান হচ্ছে যে, সময় নতুন সম্পর্ক তৈরী করে। কষ্টের সময় যারা থাকে, তারাই তখন নিজের ফ্যামিলি হয়ে যায়। আকাশ আমার পরিবার।
সব কিছুরই প্রথমবার আছে। এটা যেমন ভালোবাসার ক্ষেত্রে তেমনি অপরাধের ক্ষেত্রেও। আমি প্রথমবার অপরাধ করেছিলাম আকাশকে ছেড়ে দিয়ে, কিন্তু এই প্রথমবার মনিকার মনে হলো, মনিকা আকাশকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। প্রথমবার মনিকা আকাশের সাথে ক্লোজ হয়েছিল একটা দন্ধমুলক সার্থ নিয়ে। কিন্তু আজ ক্লোজ হয়েছে জীবনকে ভালোবেসে। ক্লোজ হওয়া আর এফেয়ার্স থাকার মধ্যে যথেষ্ঠ পার্থক্য আছে। এবার মনিকা আকাশের এতো কাছে চলে আসে যেখানে এফেরার্স এর জন্ম। আর এই এফেয়ার্স কখনোও খোলাখুলি, কখনো বন্ধ দরজার ভিতরে।
আকাশ অন্য দশজন মানুষের থেকে আলাদা। কারো অতিতকে ঘেটে বর্তমানকে বিচার করাই হয়তো ঠিক কাজ নয়, এটা আকাশ নিজে যেমন মানে, সে অন্যের বেলাতেও বিশ্বাস করে। কিন্তু ভরষা হলো এমন একটা কথা যা বর্তমান আর অতীতের মধ্যে মেলবন্ধন করে, ভবিষ্যতের দিকে অনুমান করে। কোন ব্যক্তি কি করেছিলো, কি করতে চলেছে, এটা নির্ভর করে সে ভবিষ্যতে কি করতে পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, যখন কারো সাথে সম্পর্ক হয়, ব্যবসায়িক বা নিজস্ব, অই ব্যক্তির সম্পুর্ন জীবন একটা দলিল হিসাবে সামনে আসে। তখন আমরাই বিচার করতে পারি যে, সম্পর্ক রাখা উচিত নাকি রাখা উচিত নয়। এটা কোনো চরিত্র বিশ্লেষনের ব্যাপার না, শুধু একটা সম্পর্ক জোড়ার লাভ এবং ক্ষতির প্রশ্ন। মনিকা কোনো কিছুই আর না ভেবে ফিরে এলো সেই পুরানো চৌকাঠের ভিতর যেখান থেকে একদিন আকাশকে না বলে ভোরের অন্ধকার পেরিয়ে সেই পরিবারের কাছে ফিরে গিয়েছিলো, যেটা তার কোনোকালেই ছিলো না, আর আজ তো একেবারেই নাই।
(চলবে)
০৯/০৪/২০২১-তুমি ছাড়া আমি
সকালটা আমার খারাপ ছিলো না। প্রতিদিনের মতোই আমার সকাল হয় অন্যসব দিনের মতো একই রুটিনে-ভোরে নামাজ, তারপর কোরআন তেলওয়াত অতঃপর কিছু নাস্তা। নাস্তার পর আমি দীর্ঘ একটা সময় অপেক্ষা করি অতি আখাংকিত এবং জীবনের চেয়েও প্রিয় একটা ফোন কলের জন্য। আর সেটা প্রতিদিনই আসে, কখনো আধা ঘন্টা পর কিংবা কখনো আধা ঘন্টা আগে। কোনো ঋতুতেই এর কোনো ব্যত্যয় হয় নাই। শীতের সকালে আমি যখন একা গরম লেপের ভিতরে জেগে থাকি তখনো আসে, আবার চৈত্রের দাব্দাহনেও আসে। বর্ষার ঘন বৃষ্টিতেও আমার এই প্রিয় ফোন কলটা আসেই। মাঝে মাঝে এমনো হয় আমার সেই কাংগখিত ফোনটা হয়ত দিবসের মধ্যভাগেও আসে, কখনো অতি ভোরেও আসে, তবে আসেই। কোনো উত্তাপ নেই, নাই কোনো তারাহুড়া আমার। আজো সেভাবেই আমি অপেক্ষায় ছিলাম। জানি ফোন আসবে। কারন এটা কোনো মানুষের সাথে আমার দৈব পরিচয় নয় যে আমার জন্য ভাবে না, কিংবা এমন নয় যে, স্রোতে ভাসা কোনো প্রানহীন মাছ যার না আছে এই জগতের প্রতি টান বা কোনো হিসাব-কিতাব। এই ফোন কলটা সব সময় ‘ওয়ান ওয়ে ফোন”।
সে আমার জীবনের সব কিছু। প্রকাশ্য জীবনে তাঁকে আমি চিনি না, কখনো দেখি নাই, এটাই তার সাথে আমার চুক্তি। যখন সে আসে, সে আসে অন্য কোনো নামে বা অন্য কোনো পরিচয়ে। তারপরেও সে আমার দেবতার মতো এক অসীম শক্তি আর বল। আমি জানি এই জীবনে আমি তাঁকে কখনো আমার মতো করে পাবো না, না সে আমাকে স্পর্শ করতে পারে প্রকাশ্য রীতিতে অথচ সেই আমার প্রথম মানুষ যার স্পর্শে আমি হয়ে উঠেছি এক সুখী রমণী। একজন অন্য মানুষ, অন্য জগতের সংসারী। আমার সংসারে সব আছে কিন্তু আমার সমস্ত রমনীকুলের ক্ষমতা থাকা সত্তেও আমি একা, আমি মা নই। সেই আমার সন্তান, আমিই তার মা, আমিই তার মায়া, আমিই তার সহধর্মিনী অথবা আমিই তার এক মাত্র সৈনিক যে কমান্দারের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করে প্রতিটি নিসশাসে এবং ভালোবাসায়। আমার এই সংসারে সুখ আছে, আনন্দ আছে, আমার জীবনের নিশ্চয়তা আছে, তার সাথে আছে অদম্য এক মায়া।
কিছু সম্পর্ক আছে দেবতা তৈরী করেন, কিছু সম্পর্ক আছে সমাজ তৈরী করে আর কিছু সম্পর্ক আছে আমরা মানুষেরা অন্তরে অন্তরে তৈরী করি যার না আছে প্রকাশ্য কোনো স্বীকৃতি, না আছে সামাজিক কোনো গ্রহণযোগ্যতা। তারপরেও এই সম্পর্কের চেয়ে বড় কোনো সম্পর্ক হয় না। আমি একাই ঘুমাই, একাই জাগি, একাই খেলি, একাই কথা বলি শুধু তার সাথে। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ গুলি যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন আমি তার সাথে কথা বলি শত সহস্র দূর থেকে। তাঁকে আমি দেখতে পাই, কিন্তু ছুতে পারি না। তার সাথে আমি কথা বলি কিন্তু স্পর্শ করতে পারি না। তাঁকে আমি সারাক্ষন দেখতে পাই কিন্তু হাত দিয়ে তার হাত ধরে আমি অই রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে যেতে পারি না। অথচ আমি সারাক্ষন তার সাথেই আছি।
আজ যেনো অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে আমার সেই ফোন কলটা আসার। মন একটু একটু অসহিষনু হচ্ছে, বুকের ভিতর কেমন যেনো ধরফড় করছে। বেলা পড়ে যাচ্ছে, খেতে ইচ্ছে করছে না, কখন গোসলের সময় পেরিয়ে গেছে মনেও নাই। রান্নাটা করা হয় নাই, বারবার ফোনের দিকে তাকিয়ে আছি-এই বুঝি ফোনটা এলো।
-হ্যা, ফোনটা বেজে উঠেছে। দৌড়ে ফোনটা হাতে নিতেই দেখি আমার মা। হ্যালো বলছি, মাকে ডাকছি, মা কোনো কথা বলেন না। মায়ের গলা বড্ড ভেজা।
-সে নাই। কিছুক্ষন আগে সে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে। হু হু করে কাদতে কাদতে মা আমাকে এই সংবাদটাই জানালেন। এই প্রিথিবীতে এই এক মাত্র মানুষ যিনি জানেন আমার জীবনের সব কাহিনী আর আমার সুখের ভাণ্ডারের গোপন রহস্য।
আমি ধপ করে বসে গেলাম মাটিতে। কি হলো? আমার মনে হতে লাগলো আমার শরীর থেকে সমস্ত রক্ত বিন্ধু এক ফোটা এক ফোটা করে মাটিতে ঝরে পড়ছে, আমার নিসশাস এক টা একটা করে কমতে শুরু করেছে, ঘরটা যেনো চারিদিকে দুলছে, ফ্যানটা যেনো তার সমস্ত শক্তি দিয়ে আবোল তাবোল শব্দ করছে, আমি বুঝতে পারছি আমার পায়ের নীচের সব কিছু ফস্কে যাচ্ছে, দ্রিষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, আমি জ্ঞান হারাইলাম।
কখন জ্ঞান ফিরেছে আমি জানি না, যখন চোখ খুলেছি, দেখেছি পাশে আমার মা বসে। (Cont....)
২৮/০২/২০২১-ত্রিভুজের চতুর্থ কোন
Categories
মানুষ তার জীবনকে সুন্দর আর শান্তিময় করার জন্যই সমাজ সৃষ্টি করেছিলো যা অন্য বেশীরভাগ বুদ্ধি সম্পন্ন প্রানীরা করে না। আর সেই সমাজ চালানোর জন্য কিছু নিয়ম ও তৈরী করা হয়। এই নিয়ম কানুন এইটা ভেবেই করা হয়েছিলো যে, মানুষ একে অপরের সাথে মিলে মিশে সুন্দরভাবে জীবন কাটাতে পারে। একে অপরের সুখ দুঃখের ব্যাপারে এগিয়ে আসে। তাই, সব সমাজই অনেক শর্ত আর নীতির শিকল দিয়ে মানুষের কল্যানের জন্য অনেক প্রকারের সম্পর্কের ভিত তৈরী করে থাকে। জাত, ধর্ম আর বর্নের স্তর গুলি ঠিক রেখেও কিছু কিছু সমাজ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে হরেক রকমের এই সম্পর্কের বেড়াজালের শর্ত জূড়ে দিয়েছিলো যাতে সামাজিক নিয়মের মধ্যে সবাই যার যার গন্ডির মধ্যে সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু কালের বিবর্তনে ধীরে ধীরে এই সম্পর্কগুলি কিছু কিছু প্রতাপশালী শাসক, ব্যক্তি আর ধর্মজাযকদের প্ররোচনায় তাদের আরাম আয়েশের জন্য, তাদের খায়েস মেটানোর জন্য তারা সুক্ষ থেকে সুক্ষতমভাবে আইন কানুনের কিছু বন্ধন শিথিল করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে গিয়ে প্রথাগুলি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, প্রথা থেকে যায় ঠিকই, রীতি রয়ে যায় ঠিকই কিন্তু যে মানুষগুলির জন্য সম্পর্কের এই ভীত তৈরী করা হয়েছিলো, তারাই বদলে যায়, আর সেই আইনী আর শর্তাবতাবলীর ফাক দিয়ে অনেক সম্পর্কের পরিবর্তিত আদলে মানুষের কল্যান তো দূরে থাকুক, তা কেড়ে নেয় মানুষের সুখ আর জীবনও।
একটা সময় আসে যখন শুধু প্রথার নামে অনেক অশ্লীল আর বেপরোয়া কাজের বৈধতা পায়। এর প্রেক্ষাপটে উদাহরণসরুপ দেখা যায় যেমন বিয়ের প্রথা। বিয়ে নামক প্রথা থেকে মানুষ সরে আসতে আসতে এটা এখন এমন হয়ে গেছে যে, বিয়ের বদলে সহঅবস্থান, সহঅবস্থান থেকে লিভিং টুগেদার, পার্ট টাইম স্টেইং টুগেদার এর মতো প্রথা হয়ে গেছে। এ সবই আসলে টাকা আর লোভের কারনেই হয়। কিন্তু মানুষ সবসময় ভুলে যায় যে, টাকা আর লোভ কোনো সম্পর্ককেরই শক্ত ভীত তৈরী করে না যতোক্ষন এটার মধ্যে সমঝোতা আর শ্রদ্ধাবোধ না থাকে। কিছু মানুষ সম্পর্ক তৈরী করার আগে সবসময় পরিকল্পনা করতে থাকে যে, ভবিষ্যতে তৈরী হওয়া সম্পর্ক থেকে কিভাবে ফায়দা লুটা যায়। এই যে লুকানো একতা লোভ বা বিশ্বাসঘাতকতা, এর আড়ালে যে এফেয়ার্সের জন্ম, কারো কাছে এটা ভালোবাসা আবার কারো কাছে এটা কামনা। আর কারো কাছে এটা একটা চুক্তি। সম্পর্কের দাম যখন টাকার মুল্যে বিচার করা হয়, সেটা একটা ইংগিত যে, এফেয়ার্সের এই গাড়িটা ব্ল্যাক মেইলের লাইনে চলে যাচ্ছে। ভালোবাসার নেশায় কেউ চাদতারা এনে দেয়ার প্রতিশ্রতি দিতে পারে বটে কিন্তু সেই ভালোবাসা বা এফেয়ার্স চাদতারা পাওয়ার জন্য উপযুক্ত কিনা তা খতিয়ে দেখাটা সব পক্ষেরই উচিত। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল আমরা অনেক সময় বুঝেও না বুঝার ভান করি। আবার অনেক সময় বুঝতে চাইলেও বুঝি না। কিন্তু ভুলটা ভুলই। সময়ের স্রোতে এই ভুলটা আমাদেরকে প্রমান করে দেয় যে, আমরা ভুল ছিলাম, এবং বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক আমরা ভুল কাজটাকেই পছন্দ করেছি এবং সেটাই করেছি সম্পর্কের নামের অযুহাতে। অনেক সময় আমরা প্রোফেশনাল আর পার্সোনাল দুটুর সীমাই লংঘন করে ফেলি যখন এই ভুলের মধ্যে থাকি। যখন আমরা এই ভুলটা বুঝতে পারি, তখন অনেক দেরী হয়ে যায় আর কিছু বাকী থাকে না। বাকী থাকে শুধু ভুলের জন্য মাশুলটা। কারন তখন একটা ক্রাইমের সৃষ্টি হয়ে গেছে। ক্রাইম জগতে প্রত্যেক জিনিষের সাথে অন্য জিনিষের লেনদেন থাকে। সত্যিটাকে কখনোই লুকিয়ে রাখা যায় না। সত্য জিনিষটা একটা গন্ধ্যের মতো, এটা বাতাসে বের হয়ই।
এর বাইরে আরো অনেক প্রকারের সম্পর্ক থাকে। কিছু সম্পর্ক ঈশ্বর তৈরী করেন যা রক্তের সম্পর্কের সাথে বাধা থাকে, কিছু সম্পর্ক এই যে একটু আগে বলেছি, সমাজ তৈরী করে যা সমাজের নিয়মের আইন কানুনের শিকলে বাধা থাকে, আর এমনো কিছু সম্পর্ক থাকে যা হৃদয়ের তরীতে সওয়ার হয়ে আকাংখার মাঝ নদীতে সাতার কাটতে থাকে। ঈশ্বর প্রদত্ত সম্পর্কের বেলায় আজো অনেক কিছু যেভাবে চলার কতাহ সেভাবে চলে হয়তো, কিন্তু সমাজ কর্ত্রিক অথবা এই দুই রীতির বাইরে যে সম্নপর্ক গোপনে বা আধা প্রকাশ্যে অথবা প্রকাশ্যেই হোক তৈরী হয় তাদের মধ্যে অনেক কিছুই ধীরে ধীরে খুব ধোঁয়াশা এবং জটিল আকার ধারন করে কারন এই সপর্কগুলি যেখানে খুশী টেনে নেয়া যায়। কখনো তা তীরেও পৌছতে পারে আবার কখনো তা ডুবেও যেতে পারে। তীরে পৌছা অথবা ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনার বেড়াজাল একটা সুপ্ত এঙ্গেল বা কোনের উপর নির্ভরশীল যার নামঃ ত্রিভুজের চতুর্থ কোন।
এই কোন বা এঙ্গেল যেমন দৃশ্যমান থাকে না কিন্তু হিসাবে আনতে হয়। তেমনি এর মান ত্রিভুজের সব কোনের সমষ্টির যোগফলের থেকেও অধিক অথবা শক্তির তৃতীয় সুত্রের মতোই ঋণাত্মকও হতে পারে। এই চতুর্থ কোনের প্রভাব ত্রিভুজের সমষ্টিগত মুল্যায়নে এমন একটা নতুন আদল তৈরী করে যেখানে কবর খুড়ে লাশ বের হয়ে আসা প্রবাদটি পালটে হয়ে যায় কবর খুড়ে লাশ নয়, লাশের ভিতরের কংকালকে বের করে আনা। যেখানে ঐ কংকালের প্রতিটি হাড়ে লেখা থাকে তার ফেলে আসা অনেক না বলা কথা, বেদনা আর ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের টেবিল অফ কন্টেন্টের প্রথম অধ্যায়েই থাকে রোমাঞ্চকর প্রেমের উপখ্যান। কিন্তু যে প্রেমকে যুগে যুগে মানুষ রক্ত, জল, গোলাপের ঘ্রান হিসাবে আখ্যায়িত করতো, সেই প্রেম আসলে শুরু থেকেই ছিলো একটা কলশির দুধের মতো। দুধকে যেমন বেশী করে আচে বসালে উতলে অর্ধেক হয়ে যায়, তেমনি আবার কম আচে বসালেও সেটা আরো গাঢ় হতে থাকে। এক সময় তা গাঢ় হতে হতে পুড়ে সব শেষ হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো, এই কাহিনীর শেষ অধ্যায়ে প্রথম জীবনের প্রেমের দুধ কাহিনী থেকে তখন সবাই একে একে বের হয়ে যাওয়ার আপ্রান চেষ্টা করলেও সবাই সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না। এর প্রধান কারন, যখন কোনো সম্পর্ক ভিতর থেকে ভেংগে যায় কিন্তু ছিড়ে যায় না, তখনি এই দুটু সম্পর্কের পরিভাষাও হয় দুই রকমের। আর এই পরিভাষার নাম; অপরাধের ভাষা।
অপরাধের ছায়া যখন কোনো সম্পর্কের উপর পতিত হয়, পৃথিবীর কোনো শক্তি আর তাকে জোড়া লাগাতে পারেনা। মনের জ্বালা বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে রিভার্স ব্ল্যাক মেইলের মাত্রা। ঈশ্বর মানুষের মনের ভিতরের এই সুপ্ত কাহিনী জানেন, বুঝেন এবং তাকে একটা নির্দিষ্ট লিমিট পর্যন্ত যেতে দেন এই কারনে যদি মনুষত্ত্য কিংবা বাস্তবতার নিরীখে কোনো মানব তার এই রিভার্স ব্ল্যাক মেইল তথা মনের অপরাধের আকাঙ্ক্ষা মিটিয়ে নেয় তো সে হয়তো ডুবতে ডুবতে কিনারায় উঠে যায় কিন্তু যদি সেটা না হয় তার অবস্থা এমন হয় যেনো সে দুটু ফুটূ নৌকায় পা রাখার সামিল। ডোবা তখন গ্যারান্টেড। আজ পর্যন্ত এমন কোনো ডিগ্রী তৈরী হয় নাই যেখানে প্রেমের জ্বালাই বলি আর রিভার্স ব্ল্যাক মেইলই বলি, সেটা নিরুপিত করতে পারে। যখন এই রিভার্স ব্ল্যাক মেইল শুরু হয়, তখন ওখানে হয় অপরাধের পিএইচডি। যখন পিএইচডি শেষ হয়, তখন দেখা যায়, কখন কবে কিভাবে কবরের লাশের কংকাল কোনো এক গাছের সাথে লম্বা হয়ে ঝুলতে আছে। আর যখন কোনো কংকাল নিজে নিজে গাছের সাথে ঝুলতে থাকে, ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের একটুও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই গাছে কংকাল উঠার পিছনে কারো না কারো হাত তো আছে, তার সাথে আছে অনেক রাত জাগা পরিকল্পনাও।
একটা সম্পর্ক যখন গড়ে উঠে, তখন গানিতিক বিশ্লেষনে এর দুটু কম্পোনেন্টই আসলে কাজ করে, একটি হলো “সময়” আরেক”চাহিদা”। সময় একটা যেমন আপেক্ষিক জিনিষ না হয়েও মানুষের অভিলাষের কাছে এটা আপেক্ষিক, তেমনি চাহিদা নিজেই আমৃতকাল পর্যন্ত একটা পরিবর্তনশীল ফ্যাক্টরই ছিলো। সময়ের নিরিখে কারো উপর যখন কারো লোভ তৈরী হয়, চাহিদার মান ততো বেড়ে যায়, আর এই চাহিদাই সেটা যা মানুষের মৌলিক স্বভাবকে আমূল পরিবর্তন করে ত্রিভুজের চতুর্থ কোনে নিয়ে হাজির করায়, যা কখনো দেখা যায় না।
সম্পর্কের গ্রাফের এই স্তরে এসে, একটি শেষ হয়ে যাওয়া সম্পর্ক কিংবা পূর্ব থেকে ঈসশরের দেয়া আইন কানুনে বাধা কোনো সম্পর্ক আরেকটা তৃতীয় চরিত্রের ধারায় এমন কিছু রসায়ন তৈরী করে যা জীবনকে শেষ করেই তারপর শেষ হয়ে যায়। সম্পর্ক যখন ফাপা হয়ে যায়, তখন তার মধ্যে অনেক দূষিত বাতাস ঢোকে যায়, আর দূষিত বাতাসে অক্সিজেনের অভাবে ভরে থাকে শুধু বিষাক্ত গ্যাস। যা শুধু মরনের কারন হয়। আবার এমনো হতে পারে, সম্পর্কটা প্রথম থেকেই ফাপা থাকে কিন্তু হয় কোনো পক্ষ বুঝে অথবা কোনো পক্ষই টের পায় না। তিলে তিলে এই ফাপা জায়গাটা আরো বড় হয়ে আরো বেশী দূষিত বাতাসের ঘনত্ত বেড়ে যায়। দূষিত বাতাসের ছোয়ায় আর সময়ের অবহেলায় এই সম্পর্ক তখন সিমেন্টের গাথুনীর বধলে আজীবন নরম মাটির মতো নরম ভীতে দাঁড়িয়ে থাকে। যখন কোনো সম্পর্ক নরম মাটি দিয়ে গাথা হয়, তখন এটা ভাংতে বেশী সময় লাগে না। ছোট ছোট ঢেউয়ে খুব তারাতাড়ি ধস নামে।
তখন যেটা হয়, যে, ঈশ্বর কর্ত্রিক প্রদত্ত সম্পর্ক, কিংবা সামাজিক রীতিতে বন্ধন কৃত সম্পর্ক অথবা গোপনে তৈরী ব্যক্তিগত সম্পর্ক বলতে আর কোনো কিছুই ফারাক থাকে না। মান ইজ্জত, অভিলাষ, পজিশন, কিংবা ভালোবাসা, আহলাদ, মায়া কিংবা বন্ধন সব টুটে একেবারে ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ে ঐ সমুদ্রে যার গভীরতা মাপার কোনো যন্ত্র আজো মানুষ সৃষ্টি করতে পারে নাই।
এভাবেই চলমান থাকে আইনের কাজ, শাসনের অপব্যবহার আর মনুষত্ত্যের বিলোপ। একদিন এই অবলুপ্তির বিকাসেই মানুষ হারিয়ে ফেলবে তার আসল মনুষত্ত্যের নীতিকথা। প্রতিটি জীবই ধ্বংস হয়ে যাবে নিজেদের কারনে।
২১/০১/২১-তারিখটা চোখে পড়তেই
Categories
তারিখটা চোখে পড়তেই খুব একটা খটকা লাগল। ২০২১ সাল।
যখন এই তারিখটা এমন হবে ২১২০ সাল, তখন প্রায় ১০০ বছর পেরিয়ে গেছে। আমার বয়সের আর কারোরই সম্ভবত এই দুনিয়ায় বেচে থাকার সম্ভাবনা একেবারেই নাই। আজকের দিনের এমডির চেয়ারটায় আর আমি বসে নাই, আজকের দিনে আমার ব্যবহৃত গাড়িটি হয়তো অন্য কেউ ব্যবহার করছে অথবা আর এটা কোনো রাস্তাতেই নাই, অনেক পুরানো বলে। আমার সাধের বাড়িটায় হয়তো অন্য কেউ তার মতো করে বাস করছে, কিংবা কোনো ভাড়াটিয়াও হতে পারে। যে যত্ন করে আমি আমার ছাদ বাগানটা প্রতিদিন যত্ন করি, পানি দেই, গাছগুলির পাতায় হাত বুলিয়ে দেই, সেখানে আর কোনো ছাদ বাগান আদৌ আর থাকবে কিনা কে জানে। ছাদের কোনায় যে পাখীটা বাসা বেধেছিলো, সেটা কবেই মরে গেছে, হয়তো অন্য কোনো পাখী এসে তার জায়গাটা দখল করেছে। অথবা সেখানে আর কোনো বাসাই নাই।
একশত বছর পর, সেই সময়ে চলমান আমার বংশধরেরা বেচে থাকবে, কিন্তু হয়তো আমি ওদের মধ্যে আর বেচে থাকবো না। যেমন বেচে নাই এখন আমার মধ্যে আমার সেই নাম না জানা পূর্বপুরুষেরাও। মাঝে মাঝে আমি তাদের কথা জানতে চাই, তাদের সবার নামও জানতে চাই, তাদের জীবনধারার ধরন জানতে চাই, নিশ্চয়ই তারাও অনেক ব্যস্ত ছিলো, নিশ্চয়ই তারাও প্রাত্যাহিক জীবনে অনেক গল্পগুজব করতো, বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা দিত, হয়তো কখনো জীবনের সমস্যায় জর্জরীত হয়ে মানসিক কষ্টে কিংবা জীবনের কোনো সাফল্যে আনন্দিত হয়ে হয়তো অতিশয় খুশীতে কোনো এক বিকালে গোল করে কোনো অনুষ্ঠান করতো। আর এটাই তো হবার কথা। যেমন হচ্ছে ঠিক আমার এই সময়টায়। খুব জানতে ইচ্ছে করে, কেমন ছিলো আমার দাদীর দাদীমা? অনেক সুন্দুরী? কিংবা অনেক মায়াবী? অথবা কেমন সুপুরুষ ছিলেন আরো একশত বছর আগের আমার দাদার দাদারা? কে কোন মাছ খেতে পছন্দ করতো? বা কার সপ্নের বাসনা কেমন ছিলো? খুব জানতে ইচ্ছে করে, কি ছিলো তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা যা পূর্ন হয় নাই অথচ শখ ছিলো?
সেই একশত বছর আগে হয়তো অনেক জনপদ ছিলো যা কালের বিবর্তনে সব কোথায় যেনো হারিয়ে নতুন জনপদ তৈরী হয়েছে। হতে পারে যে জায়গাটায় আমার পূর্বসুরী কোনো এক দাদা তার প্রেয়সীর টানে হয়তো কোনো এক রাস্তার ধারে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছিলো, আজ সেই জনপদ কোথাও নাই, হয়তো তলিয়ে গেছে কোনো এক নদীর ভাংগনে, অথবা সেই জনপদ বিলুপ্ত হয়ে হয়তো তৈরী হয়েছে আজকের কোনো অসাধারন অট্টালিকা। আজ যদি সেই সব মানুষ গুলিকে আবার ফিরিয়ে আনা যেত, হয়তো বলে উঠতো, ‘ওই যে দেখছিস ওই বড় বিল্ডিংটা, ওখানে ছিলো এক প্রকান্ড খাল, ওখানে আমরা সাতার কাটতাম। ওই যে দেখছিস বড় রাস্তাটা, ওটা ছিলো তখনকার প্রতাপ্সহালী সগীর মিয়ার হারিয়ে যাওয়া কোনো এক প্রাসাদ। আরো কত কি’।
তাদের কারো কথাই আজ কেউ মনে রাখে নাই। মনে রাখার দরকারও মনে করে না। আসলে সময় কাউকেই আজীবন মনে রাখতে দিতে চায় না। কত শতক প্রজন্মকে যেমন টপকে আমরা আজ এই শতকে নিজেদের নিয়ে মশগুল আছি, তেমনি আরো অনেক শতক প্রজন্মও আমাদেরকে টপকে তাদের সময়ে তারা তাদেরকে নিয়ে মশগুল থাকবে এটাই তো হবার কথা। অথচ আজ কতই না ব্যস্ত আমি, আমরা। কতই না প্রতিযোগীতা আমাদের মধ্যে। সম্পদের পাহাড় গড়েও যেনো শান্তি নাই। তারপর?
তার আর পর নাই। আসলেই আর কোনো পর নাই।
২১২০ সালে আমরা এই পৃথিবীর কোনো কিছুই আর দেখার সৌভাগ্য হবে না। অথচ তখনো সূর্য যেভাবে উঠার কথা সেভাবেই উঠবে, সেদিকে ডোবার কথা সেদিকেই ডববে। শুধু আমরা আর কোনো সুর্যদোয় কিংবা সুর্যাস্ত দেখতে পাবো না। পর্যন জায়গা গুলি অন্য কেউ উপভোগ করবে, শীতকালের আমেজ, কিংবা নতুন মহামারীও তাই।
জীবনটা আসলে মানুষের কল্পনার থেকেও ছোট।
৩০/০৯/২০২০-মাইন্ড গেম
একটা ফাদ পাতা হয়েছিলো। প্রথমে প্রেমের অভিনয়, তারপর তাকে অপহরন, তারপর তাকে শেষ করে দেয়া। কিন্তু ঘুনাক্ষরে অপরাধী টের পায় নাই এর শেষ পরিনতি কি। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সম্পর্ক জুড়তে যাওয়া একটা ভয়ংকর অপরাধের জন্ম দেয়। আর এখানে সেটাই এই অপরাধী ঘটিয়েছিলো। সোজা অপহরন। অন্যদিকে, যখন কোনো মানুষ কিছুই না বলে সে তার পরিবার থেকে হটাত করে উধাও হয়ে যায়, তখন ব্যাপারটা অনেক দুসচিন্তার কারন হয়ে দাঁড়ায়। পরিবারের সবার ঘুম নষ্ট হয়ে বিভ্রান্তের মতো দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে চৌহদ্দির বাইরে গিয়েও সর্বাত্তক চেষ্টা চলে হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকে আবার ফিরিয়ে আনা। আর এই ভয়ংকর খোজাখুজির মধ্যে অনেক গোপন তাস প্রকাশ্যে আসে, প্রকাশ্যে আসে গোপন সন্ধি, গোপন লেনদেন, গোপন শর্তাবলি। তবে কিছু তাস সবাই জানলেও বেশীরভাগ তাসই অজানা অন্য সবার কাছে থেকে। এই অজানা তাসের মধ্যে কারো বডি ল্যাঙ্গুয়েজে কিছু তাস আন্দাজ করা হয়, কারো নির্বোধ রাজনীতির কারনে আরো কিছু তাস গোপনে বেরিয়ে আসে আবার কারো আইনের নির্ভিক প্রশাসনিক দক্ষতায় শেষ অবধি অপরাধীর মতো তুরুকের তাসটি একেবারেই হাতে চলে আসে। তবে মজার ব্যাপার হলো, সময়ের পথ চলায় কিন্তু সত্য বেশীদিন লুকিয়ে রাখা যায় না। ধীরে ধীরে এর মুখোশ উম্মোচিত হয়ই। অনেকেই রাজনীতি করেন নিজের যোগ্যতায়, কেউ রাজনীতি করে বাপদাদার পৈত্রিক উত্তরাধীকার সুত্রে। কিন্তু জ্ঞান তো আর উত্তরাধীকার সুত্রে পাওয়া যায় না। এটা অর্জন করতে হয়। পৈত্রিকসুত্রে পাওয়া রাজনীতির পদাধিকারী হয়তো জানেনই না যে, রাজনিতিতে পূর্নিমা আর অমাবশ্যা একসাথে চলে। জোয়ারভাটা এক সাথে চলে, কিন্তু সেটা কখন কিভাবে, কোথায় তার জ্ঞান থাকা দরকার।
আমরা অসহায় ছিলাম, আমাদের না ছিলো পাওয়ার-পলিটিক্সের ক্ষমতা, না ছিলো কারিকারি অর্থ। কিন্তু আমাদের ছিলো অগাধ বিশ্বাস আর ভালোবাসা আর ছিলো দায়িত্তবোধ। কিছু কিছু দায়িত্তশীল মানুষের আশ্বাস, ভরষা আমাদেরকে ক্রমাগত একটা অন্ধকারের দিকেই ঠেলে দিচ্ছিলো, আমরা হারিয়ে যাওয়া আমাদের পরিবারের মানুষটির অজানা ব্যথায় ব্যথিত হচ্ছিলাম বটে কিন্তু সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক করে দেয়া হবে এরুপ ভরষায় আমাদের আতংক দিনে দিনে এতোটাই বেড়ে উঠছিলো যে, আমাদের প্রতিটি পরিবারের জীবন্ত সদস্যরা যেনো মৃত মানুষের মতো বেচেছিলো। বুঝতেছিলাম যে, ঠিকঠাক হওয়া আর ঠিকঠাক দেখানোর মধ্যে কত পার্থক্য, এটা যেনো সত্য আর মিথ্যার মতো। এই দুয়ে চোখ আর মন এক সাথে চলছিলো না। অবশেষে বুঝলাম, বহুদূর অবধি খুজেও যখন কোনো সুত্র পাওয়া না যায় তখন কাছে দেখতে হয়। বুঝেছিলাম যে, সেটা কাছেই চোখের আড়ালে লুকিয়েছিলো। আর সেটা হলো স্থানীয় রাজনিতিকদের মাথায়। প্রশাসনিক দপ্তরের পজিটিভ মনোভাবে হারানো মানুষটাকে পাওয়া গেলো বটে কিন্তু অপরাধী ধরাছোয়ার বাইরেই রয়ে গেলো।
সবাই আমাদেরকে নিয়ে মাইন্ড গেম খেলছিলো। রাজনীতিকসহ। মাইন্ড খেলা বিপদজনক নয় তবে যার জন্য খেলা হয় সে যদি জেনে যায় যে, তাকে নিয়ে কেউ মাইন্ড গেম খেলছে, তাহলে মাইন্ড গেম উলটা ফল দেয়। এটা তখন হয় বুমেরাং কেননা যার উপর মাইন্ড গেম খেলা হচ্ছে সে যখন বুঝেই যায় যে তার উপর মাইন্ড গেম এপ্লাই করা হচ্ছে, তখন সে জেনেশুনে ঐসব উপাত্তগুলিই দেয় যা আসলে মাইন্ড গেমারকে বিভ্রান্ত করতে পারে। আর তাকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এসব উপাত্তগুলি দেয়া হয়। জেনেশুনেই দেয়া হয়। তখন যিনি ছিলেন গেমার, তিনি হয়ে যান সাবজেক্ট, আর যিনি ছিলেন সাব্জেক্ট, তিনি হয়ে যান গেমার। আর তখন আসল মাইন্ড গেমার নিজেই তখন আরেকজনের মাইন্ড গেমের বিষয়বস্তু হয়ে উঠে। এটা বুঝতে একটু সময় লেগেছিলো আমাদের। মনের কষ্টে, বেদনায় আর হতাশায় যেখানে যেখানে ধর্না দিয়েছি, কোথাও যখন এর প্রতিকার হচ্ছিলো না, শেষ প্রতিকার ছিলো অর্থ। অর্থ যে কত বড় শক্তি, সেটা এবার বুঝলাম। মৃত মানুষও এই অর্থের জন্য হাত বাড়ায়। এদেশের ভাগ্য বড় খারাপ যে, দেশমাতা বেশীরভাগ রাজনীতিবিদদেরকে যেনো অপরাধী সন্তান হিসাবেই জন্ম দিয়েছে। সবাই নয়, তবে অধিকাংশ। দেশমাতা নিজেও এর বলীর শিকার। আমাদেরকে এবার তারা সেটাই করতে বললেন যেটা আমরা চেয়েছিলাম, কিন্তু ব্যাপারটা গোপন থাকার শর্তে। এই অতি ধূর্ত মানুষটি দুটু গেম খেলছিলেন দুই দিকে। একটা লুকানো, আরেকটা বিভ্রান্ত। লুকানো গেমে আমরা আর বিভ্রান্তের গেমে তার অনুসারীরা।
অতএব, অপরাধী এলো, তিনি এলেন না। কারন তিনি আসবেন না এটাই ছিলো বিভ্রান্তের মুল লক্ষ্য। শেষতক, যুবরাজ অপরাধী এলেন, ধরা পড়লেন, লালঘরে চলে গেলেন। আর পরদিন সবাইকে আবারো বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে আমাদেরকে এক তরফা শাসিয়ে দিলেন। এটাই রাজনীতি। রাজনীতিতে অনেক সময় অনেক বড় জিনিষ ছোট ভাবেও বলা যায়। এই রাজনীতির খেলায় প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাহিনী বলে কিন্তু সত্যটা থাকে অন্য কিছু। সময় হলো সবচেয়ে বড় ভিলেন। আর এই ভিলেনের সবচেয়ে বড় বন্ধু তারা যারা বারবার মাইন্ড গেম খেলেন এবং খেলান।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
২৮/০৬/২০২০- আমি ফিরে এসেছি আবার
Categories
ঈশ্বর নাই কে বলে? ঈশ্বর আছেন, তিনি অদৃশ্য বটে কিন্তু মানবের সব অন্তরের কথা তিনি শোনেন। রাতজাগা ক্লান্ত পাখীর মতো ভেজা চোখের ক্রন্দনের আরাধনা ঈশ্বর শুনেছেন। আমি ফিরে পেয়েছি আমার সেই পুরানো ঘর, পুরানো জানালা। সেই জানালা দিয়ে আজো সেই আগের বাতাসের গন্ধ আমি পাই। ঘরে যে টিকটিকিটা একদিন দেখেছিলাম, আজ আমার পদচারনায় সেও যেনো অনেক খুশী। ছোট সেই টিকটিকিটা আজ বেশ বড় হয়ে উঠেছে। কতদিন ছিলাম না? মাত্র তো ২৪ টা দিন। কোনো কিছুই তেমন পরিবর্তন হয় নাই, আবার অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমার মন পরিবর্তন হয়ে গেছে, আমার দেহ পরিবর্তন হয়ে গেছে, ছোট সেই টিকটিকিটাও বড় হয়ে গেছে। ঘরের কোনায় একটা মাকড়শা জাল বেধেছে। এটা আগে ছিলো না। বাথরুমের মেঝটা একটু ধুলায় কালো হয়ে গেছে। হয়তো অনেক ব্যকটেরিয়ারা তাদের মতো করে বাসা বেধে ফেলেছে। টেপটা ভালো মতো বন্ধ করা হয় নাই বিধায় অবিরত টপটপ করে ফোটায় ফোটায় পানি পড়ে জায়গাটা কালো হয়ে গেছে। রান্নাঘরের থালা ধোয়ার জায়গাটা শেওলা পড়ে সবুজ হয়ে গেছে। তারপরেও বড্ড আপন মনে হচ্ছে আমার সবকিছু। ঘরের দেয়ালে হাত দিয়ে আমি বুঝতে পারি ওরাও অনেক খুশি। আমি ফিরে এসেছি এই সেই ঘরে যেথায় আমি কতই না অভিমান করতাম, গুনগুন করে গান গাইতাম। ছোট ছোট পায়ে এঘর থেকে ওঘরে হাটাহাটি করতাম। কি শান্তি আর কি সুখ। আমার চোখ ভিজে যায় আনন্দে। আমার অন্তর বিকশিত হয়ে উঠে সুখে। কি অসাধারন আমার এই ছোট ঘরটি।
এই তো, এখানে বসেই তো আমি চুল আচড়িয়েছি কতদিন। এইতো এই টুলটায় বসে আমি কতদিন আকাশ দেখেছি। যেখানে তাকাই, সব আমার মনে হয় আজ। কত আপন মনে হচ্ছে আজ। যেদিন সকালে আমি এই ঘর থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম, বুকের ভিতরে একটা কষ্ট বেধেছিলো, চিনচিন করে ব্যথা লেগেছিলো। ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাওয়া যে কত কষ্টের, যে ঘর ছাড়ে নাই, সে কখনো বুঝবে না পরিচিত ঘর কিভাবে নিঃশব্দে কাদে। সেই কান্না আমিও শুনেছিলাম সেদিন। কিন্তু অভিমানের পাল্লা এতো বেশী ছিলো যে, ঘরের নিঃশব্দ কান্না আমার অন্তরের অভিমানের কাছে হেরে গিয়েছিলো। আজ আমি ফিরে এসেছি। সমস্ত ঘরটা যেনো ফিকফিক করে হেসে উঠলো। এটা আমার ঘর। এই ঘরের প্রতিটি বাতাসে মিশে আছে আমার নিঃশ্বাস, মিশে আছে আমার আকাশের পায়ের ধুলো। ওর শরীরের গন্ধ। আমি চোখ বুঝে নিঃশ্বাস নিলেই যেনো ওর গায়ের গন্ধ পাই। কি অদ্ভুদ না?
ছলনার ফল ভালো হয় না। কিন্তু আমি তো ছলনা করি নাই। যে আমার সাথে ছলনা করেছিলো, যে আমাকে ঘর ছাড়া করেছিলো, যে আমাকে আমার অতীব চেনা এই ঘর থেকে বের করেছিলো, আজ তার ঘর নাই। আজ সে নিজের ছলনায় নিজেই আটকে গেছে। স্ত্রী জাতীরাই আসলে স্ত্রীজাতীর চরম শত্রু। আর এ জন্যেই এক স্ত্রীর ঘর ভাংগে আরেক স্ত্রী জাতীর কারনে। পুরুষ সব সময়ই উদাসীন। তাকে ধরে রাখতে হয়। তার হাত ছাড়তে হয় না। আমি ওর হাত ছেড়ে বুঝেছিলাম, আরেকটা হাত আমার মনের মতো নাও হতে পারে। সেই হাত, সেই আংগুল, সেই হাতের ছোয়া আমার ফেলে যাওয়া হাতের মতো নাও হতে পারে। আমি এই উপলব্দিটা বুঝেছিলাম সেই রাতেই যেদিন আমি আমার আকাশ থেকে ছিটকে পড়েছিলাম। সেদিন বুঝেছি যেদিন রাতে আমি ঘন কালো আকাশ দেখে ভয় পেয়েছিলাম। আমি তো এই কালো আকাশকে চাই নাই। আমি চেয়েছিলাম জোস্নাভরা নীল আকাশ।
আজ আমার ঘরের সেই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূরের ওই নীল আকাশটাকে দেখছি। ফুরফুরা বাতাস আমার জানালায় ঢোকছে আর আমাকে শীতল করে দিচ্ছে। কতদিন এই নির্মল বাতাস আমার এই ঘরে যে প্রবেশ করে নাই কে জানে। আজ বাতাসেরাও আনন্দিত। অফুরন্ত বাতাস। বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়ার মধ্যে কত যে আনন্দ। আমি জানালায় দাঁড়িয়ে আমার আকাশের পানে ওর ভালোবাসার গন্ধ পাচ্ছি।
ঈশ্বর আমাকে আবারো ফিরিয়ে এনেছে আমার সেই পরিচিত ঘরে যেখান থেকে আমি একবার ঝরে পড়েছিলাম, আজ আবারো আমার বাগানে আমি মালী হিসাবেই ফিরে এসেছি। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দেয়ালকে বললাম, জানো দেয়াল, আমি আমার এই দূর্বল শরীর তোমার গায়ে হেলান দিয়ে আবার দাড়াতে চাই, তুমি আমাকে ধরে রেখো। আমি সেই টপটপ করে ফোটায় ফোটায় পানি পরা টেপটাকে বললাম, আমি আবার ফিরে এসেছি, এবার আর তোমাকে ফোটা ফোটা অশ্রু বিসর্জনে কাদতে দেবো না। তুমি আমাকে গরমে শীতল করো আর আমাকে পরিশুদ্ধ করো। আমি আমার সেই পরিচিত রান্নাঘরের চুলাটার কাছে গিয়ে বললাম, যে আগুনে আমি এতোদিন পূরেছি, আজ বুঝতে পারি, তুমি কতোটা আগুনে পূড়ে আমাকে অন্ন দাও, সুমিষ্ট খাবার দাও। আমি আবারো তোমাকে আমার আদরের হাত দিয়ে দিয়ে ভরে দেবো। খাটের কোনায় বসে আমি ভাবী আর ভাবী, এই পুরু সংসারটা আমার। এই সংসারে আছে টিকটিকি, আছে বাতাস, আছে জানালা, আছে রাতের জ্যোৎস্না। আর আছে আমার ভালোবাসা আকাশের জন্য।
আমি আর কখনো আকাশকে ছেরে কোথাও যাবো না।
২৪-০৬-২০২০-কিভাবে থাকা সম্ভব একা?
Categories
দুটু মাত্র রুম। একটিতে আছে রান্না ঘর, আছে ফ্রিজ, আর একটা ছোট টেবিল যা ডাইনিং টেবিল বলা যায় তবে সেটা এখন আর ডাইনিং টেবিল হিসাবে ব্যবহৃত হয় বলে মনে হয় না। সেটা আসলে এখন পরিত্যক্ত হাড়ি পাতিল, গ্লাস কিংবা ভাতের গামলা রাখার কাজেই যেনো বেশী ব্যবহৃত হয়। আর এই রুমটায় আছে একটা রসুন পিয়াজ কিংবা মসল্লা জাতীয় জিনিষ রাখার একটা আলমারী। রুমটায় কোনো ফ্যান নাই, সাথে একটা বারান্দা আছে, অতীব ছোট, তবে ওখানে গিয়ে যে বসে বাইরের রুপ দেখার জন্য বসা যায়, এমন না। এটা নিতান্তই একটা দরজা খোলা রাখার জন্য হয়তো স্পেস হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে।
আরেকটা রুম যেখানে আছে একটা ড্রেসিং টেবিল, আছে একটা পড়ার টেবিল, উল্টাদিকে আছে একটা ওয়ার্ড্রব, ওয়ার্ড্রবের উপরে আছে একটা ছোট টিভি। মেঝের মাঝখানে একটা কারুকার্য করা পাটের কার্পেটের মতো একটা জিনিষ, খাটটা সুন্দর, এই রুমটার সাথে আছে এটাচড বাথ। এটাই হলো অরুর রুম।
থাকার মধ্যে একমাত্র অরুই হচ্ছে বাসিন্দা। একাই থাকে অরু। বাইরের কারোর সাথে অরুর কোন সম্পর্ক নাই, অন্তত এটাই আমি জানি। মাসের বাজার এককালীন করে নিয়ে আসে অরু নিজেই। একা মানুষের জন্য খুব বেশী কিছু লাগে না। তার সারাদিনের কাজের মধ্যে যা আমি বুঝতে পারি সেটা হলো, সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়। তারপর রান্না ঘরে গিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো যা খেতে চায়, সেটাই বানিয়ে কোনো রকমে খেয়ে নেয়। তারপর ঘরটা গুছায়, রান্নার জন্য কিছু আয়োজন করে। গোসল করে, কাপড় চোপড় ধুয়, তারপর কিছুক্ষন পড়াশুনা করে। আর কথা বলার জন্য একমাত্র আমার সাথেই বলে। তাও আবার আমি যদি অনলাইনে আসি, তাহলেই ব্যাপারটা ঘটে।
তার কিছু বান্ধবী আছে, তারাও মাঝে মাঝে অনলাইনে কথা বলে। এইটুকুই। সে কারো প্রতি হয়তো আসক্ত নয়, অর্থাৎ কোনো পুরুষের প্রতি বা অন্য কোনো ছেলের প্রতিও নয়। অন্তত এটাই আমি জানি। এই রকম একা একটা পরিবেশে দিনের পর দিন কি করে সম্ভব একজন মানুষের পক্ষে একটামাত্র ঘরে বসবাস করা?
আমি ওকে নিয়ে গবেষনা করি। আমার এতো বছরের অভিজ্ঞতায় এটা কিছুতেই মাথায় আসে না। মানুষ কি আসলেই এভাবে একা বাচতে পারে? অথচ আমি ওকে দেখি মন খারাপ করে না, হাসে, খায় দায়, ঘুমায়, ভালোই আছে। এর মধ্যে কি কোনো প্রকার বৈজ্ঞানিক রহস্য আছে? নাকি মানবীয় কোনো পরিকল্পনা? নাকি সময়ের সাথে নিজেকে কিছু সময়ের জন্য এডজাষ্টমেন্ট?
আমার এই ব্যাপারটা জানার খুব শখ। আমি এটাকে একটা এক্সপেরিমেন্টাল থিউরী হিসাবে এখন দেখছি যার উপাদান হচ্ছে সময়, তার সাথে নিশ্চিত ভবিষ্যতের একটা গ্যারান্টিসহ আরো কিছু। আমি দেখতে চাই, এর পিছনে আসলে কোন বস্তুটি আসলে কাজ করছে। এটা কি সময়কে কিছুকাল আটকে দেয়া যা হয়তো একটা কিছুর প্রাপ্তির শেষেই এর পরিসমাপ্তি? নাকি আসলেই এটা কোনো নতুন থিউরী যেখানে মানুষ কোটি লোকের ভীরেও একা যা আমি আগে কখনো দেখি নাই অথচ এটা ছিলো। নাকি নিছক একটা এডাপ্টেশন।
সময় বলে দেবে এর রহস্য। তখন পর্যন্ত এটা আমার কাছে নিছক একটা প্রশ্ন বটে। উত্তর আমার জানা নাই।
৩১/০৩/২০২০-যেদিন চলে আসবো-৩
যাই হোক, আমি আমার সংসার ছাড়ার সাথে সাথেই বুঝলাম, আমার সবকিছু মিথ্যা হয়ে গেছে। আমি আমার অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলেছি। অভিমান ছিলো কানায় কানায় ঠিকই কিন্তু এখন আমার অভিমানটা আলো আধারের ছায়ার মতো কষ্ট আর বিষন্নতায় পরিনত হলো। গতকাল সকালে যে একাকীত্ততা নিজের দম বন্ধ করে ফেলেছিলো বলে মনে হয়েছিলো, আজ মনে হল, আমার শ্বাস আর চলছেই না। কারন তুমিই ছিলে আমার অক্সিজেন, আমার শ্বাস। চারিদিকে শত হাজার মানুষের পরিচিত মুখগুলি যেন আমাকে ব্যাঙ্গ করে এটাই বলছিল, 'কি হারাইয়াছো জীবনে? আলো? নাকি কান্ডারী? কি ফেলিয়া আসিয়াছো, কোথায় ফেলিয়াছো?'
বড় একা মনে হচ্ছিলো আমার।
কোথাও আমার কোন শান্তি ছিল না। অথচ শান্তির জন্য বারবার আমি একই ভুল করছিলাম। আবারো আমি সেই অজানা কুচক্রিকেই শান্তনার আধার মনে করে তারসাথে বারবার যোগাযোগ করছিলাম। আর এই কুচক্রি ষড়যন্ত্রকারিনী আমার পিছ তখনো ছাড়ে নাই। আমাকে সর্পবিষ দিয়ে যতোক্ষন না ধংশ করা হচ্ছে, তার যেন নিস্তার নাই। আমার এই কষ্টের কথা, আমার এই দিনদূর্দশার কথা আমি এই গুরুসম সর্পিনী ছাড়া আর কাউকে তো শেয়ার করতেও পারছিলাম না। অথচ তখনো আমি বুঝতে পারি নাই, কি বিষে আমাকে ধংশন করছে। এর নাম, কুচক্রির লালসার বিশ, এর নাম ষড়যন্ত্রকারিনির হিংসার বিশ। আমি সেই লালসার বিষে জর্জড়িত হিংসার ঝড়। অথচ তার সাথে আমার না ছিলো কোনো কালে পরিচয়, না ছিলো তার সাথে আমার কোনো কিছু নিয়ে হিসাবের গড়মিল।
কতবার কেদেছি তার কাছে আমার এই অসহাত্তের চিত্র বর্ননা করে, কতবার কেদেছি এই বলে যে, কোনোভাবে আবার আমি আমার সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে পুনরায় ফিরে যেতে পারি কিনা তোমার কাছে। কিন্তু আমার কুচক্রিকারিনীর এক ফোটা মনও গলে নাই। বারবার আমাকে সে এমন কিছু তথ্য আমার কানে চোখে ঢেলে দিতেছিল যা ছিলো তোমার কষ্টের মুহুর্তের কিছু অভিযোগ। কিন্তু তোমার কষ্টের আবদারগুলি কখনো আমাকে জানিয়ে এই কথাটা বলে নাই যে, আমার বিরহে তুমিও কাতর। আমার বিচ্ছেদে তুমিও শোকাবহুল একজন মৃতলাশ। এটা কখনো সে আমাকে জানতে দেয় নাই, তুমি আকুতি করছো, মিনতি করছো, আমি যেন আবার ফিরে আসি। বরং আমার প্রতি তোমার ঘেন্নার অভিব্যক্তিগুলিই বারবার জানিয়ে এটাই প্রমান করার চেষ্টা করেছে, তোমার জীবনে আমি কিছুই না, আমার সব প্রয়োজন তোমার কাছে ফুরিয়ে গেছে।
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার পৃথিবী থেমে গিয়েছিল। বারবার আমার মনে হয়েছে, আমি কি তোমাকে কখনই ভালবাসি নাই? আমি কি কখনো তোমার মনের ভিতরে এতটুকু স্থানও দখল করি নাই? যদি সেটাই হয়, তাহলে ওইদিন প্রত্যুষ্যে কেনো তুমি বলেছিলে, 'আমি আছি, ভয় পেয়ো না?'।
দিন যায়, রাত আসে আবার দিন আসে। সময় ঠিকই পেরিয়ে যায় সবার কিন্তু আমার সময় একেবারে স্থবির হয়ে দিন আর রাত এক হয়ে গেছে যেখানে না আছে নাওয়া, না আছে খাওয়া, না আছে কোনো সুখ। অবিরত অশ্রুপাতই যেনো আমার এই নয়নের একমাত্র কাজ। গভীর রাত। কোনো ঘুম নাই আমার চোখে। সবাই ঘুমিয়ে গেছে। আমার বুকের পাজরগুলি যেনো ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে একটা দলা পাকিয়ে আছে। যেখানেই হাত দেই, সেখানেই যেনো একটা চাপা ব্যথা অনুভব করি। আশেপাশের মানুষগুলি আমার কিছু তো একটা হয়েছেই এটা বুঝতে পারছে কিন্তু আমি যতোটা পারছি যেনো কিছুই হয় নাই এমন একটা অভিব্যক্তি মুখে প্রদর্শন করে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু তোমাকে আমি এক মুহুর্তের জন্যেও ভুলি নাই।
বারবার আমি এই কুচক্রিকারিনীর শরনাপন্ন হয়েছি, কোনো মেসেজ, কোনো আকুতি, কোনো মিনতি, কোনো সুখের খবর তোমার কাছ থেকে তার মাধ্যমে আমার জন্য এসেছে কিনা। আমি জানতাম, তুমি এই কুচক্রিকারিনীর সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছো। আমার কারনেই হয়তো রাখছো। ফলে এই সর্পসম ষড়যন্ত্রকারীনীই ছিলো আমার একমাত্র ভরষা যার থেকে কিছু হলেও আমি তোমার ব্যাপারে জানতে পারি। কিন্তু এই কুচক্রিকারিনী বারবার যা সত্য নয় সেটাই সত্য বলে আমাকে জানিয়েছে আর প্রকৃত সত্যটাকে সগোপনে লুকিয়ে আমার আর তোমার মাঝে বিস্তর একটা মরুভুমির অঞ্চল তৈরী করে ফেলেছে।
তুমি হয়তো জানো না, এর মাঝে কত কিছু ঘটে যাচ্ছিল। একদিকে আমার ফিরে যাবার প্রবল ইচ্ছা, অন্যদিকে তোমার না ফিরে আসার প্রবল অপমাননা আমাকে এক রকম দিশেহারা করে ফেলেছিলো। এরই মধ্যে আমার এই কুচক্রিচারিনী আমাকে আরেক পরিকল্পনায় সামিল করে দিলো। যেহেতু আমি তার কোনো পরিকল্পনাই প্রথম থেকে বুঝতে পারি নাই, ফলে ফিরে যাবার প্রবল মানসিকতায় আমি তার প্রতিটি পরিকল্পনাকে আমার জন্য মংগলময় এটা ভেবেই নির্বোধের মতো সায় দিয়ে যেতে থাকলাম। কিন্তু তুমি তো আর নির্বোধ ছিলে না। আমার বেলায় কুচক্রিকারিনী সফল হলেও তোমার বেলায় সে নুন্যতম হারেও সফল হতে পারে নাই। আমাকে নিয়ে তার দ্বিতীয় পর্বের পরিকল্পনা ছিল, কোনো না কোনোভাবে কুচক্রিকারিনী আমাকে তার আবাসস্থলের কাছেই রক্ষিতা সরুপ রেখে দেয়া। কিন্তু শর্ত ছিলো একটা ব্যবসার। আর সেই ব্যবসার মুলধন জোগাবে তুমি যদি তুমি তখনো আমাকে চাও। কি অদ্ভুত আমার ভাগ্য যে, এতোদিন যখন কোনোভাবেই আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না, হটাত করে একদিন তুমি আমাকে আমার এই ভার্চুয়াল লাইনে মেসেজ দিয়ে কত কথাই না বললে। চোখের জল আর ধরে রাখতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি আর আগের মতো তোমাকে ভরষাও করতে পারছিলাম না কারন তুমি ইতিমধ্যে আমাকে আমার অভিযোগের এমন সব প্রমানাদি উপস্থাপন করতেছিলে যা আমি আমার রাগ, অভিমান থেকে তোমার নামে যা সত্য নয় সেটাও বলেছি, আবার যা সত্য সেটাও বলেছি। আমি বুঝতে পারছিলাম না, তুমি এসব মিথ্যা অভিযোগ আর মিথ্যা কল্ কাহিনীর মতো নালিশ শুনে তুমিই বা কতটুকু আর আমার ছিলে।
তুমি আমাকে আবারো ফিরে আসার কথা জানালে আমি একদিকে উড়ে চলে আসার জন্য মানসিকভাবে যেমন প্রস্তুত ছিলাম আবার অন্যদিকে মনে একটা ভয় ছিলো, আবারো দ্বিতীয়বারের মতো এমন কোন মারাত্মক ভুল করছি নাতো যেখানে আবার আমি চিরতরে তোমার রাগের শিকার হই? আমাকে আমার এই বন্ধুস অথচ কুচক্রিকারিনী শিখিয়ে দিয়েছিলো, নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে, আবার প্রত্যাখ্যাত হবার ভয়ে আমি যেনো তোমার কাছ থেকে পুর্বেই এমন কিছু শর্ত আরোপ করি যাতে তুমি যদি আমার সাথে পুনরায় প্রতারনা করেই ফেলো, আমি যেনো পথের মধ্যে আবার পড়ে না থাকি। আর সেটা হল, দশ লক্ষ টাকার একটা ব্যবসা। যার পরিচালনায় থাকবে আমার জ্ঞান দানকারী কুচক্রিকারিনি আর আমি থাকবো তার পাশে। তোমার যখন খুশি আসবে আমার কাছে কিন্তু দেহে দেহে আনন্দ হবে আমার কুচক্রিকারিনীর সাথে। আমাকে আমার জ্ঞান দানকারী কুচক্রীর প্রয়োজন এজন্য যে, সে একা নয়, তার স্বামী আছে। তার দরকার একজন উছিলার মতো মানুষ যেখানে সে নীরবে গোপনে অভিসার করে আবার নিরাপদ্র নিজ গৃহে ফিরে আসতে পারে। আর এক্ষেত্রে আমিই ছিলাম সেই নাটকের সবচেয়ে ভাল স্টেজ। এটাই ছিল তার পরিকল্পনা। আর অন্তরমুখী পরিকল্পনা ছিলো এই কুচক্রীর যে, দশ লাখ টাকা পাওয়ার পর দেখা যাবে আমরা দুইজন মিলে তোমাকে কতটুকু রাস্তায় নামাতে পারি।
তোমাকে রাস্তায় নামানোর এই মহাপরিকল্পনায় আরো অনেক জঘন্য জঘন্য মাষ্টার প্ল্যান ছিলো যা আমি কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না। আর এখানে বলতেও পারছি না। তবে কোন একদিন যদি আবার দেখা হয়, বিনোদনের জন্যে হলেও আমি তোমাকে বল্বো আর মুচকি মুচকি হাসবো। আমি জানি, তুমিও হাসবে। কারন যে মানুষটি এই কুচক্রিকারিনীর পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে সাহাজ্য করছে, ভবিষ্যতেও করবে বলে আশা দিয়ে যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কিভাবে সে এরুপ পরিকল্পনা করতে পারে এটা আমার মাথাতেই আসছিলো না। কিন্তু তুমি তোমার অবস্থান কিভাবে সামাল দিবে সেটা তোমার ব্যাপার বলে আমি আসলেই গভীরভাবে এ ব্যাপারটা নিয়ে কখনো ভাবি নাই। কিন্তু একটা জিনিষ আমি অনেক পড়ে বুঝেছিলাম যে, তুমি বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক, এই কুচক্রীর অবস্থানটা ঠিক ধরতে পেরেছিলে। তুমি ধরতে পেরেছিলে, কে কিভাবে কোন খেলাটা খেলে যাচ্ছে, কিন্তু তোমার কাছে দরকার ছিলো অকাট্য প্রমানের।
যাই হোক, সম্ভবত সেটাই ছিল আমার আর তোমার মধ্যে সর্বশেষ কথাবার্তা যেখানে আমি বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক এই প্রথম তোমার কাছ থেকে দশ লাখ টাকার একটা ব্যবসা চেয়েছিলাম আমার ফিরে আসার শর্তসরুপ। কারন এভাবেই আমার কুচক্রিকারিনি আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল। তুমি সমস্ত কিছু বিচার বিবেচনা করে, আমার ভালো মন্দ বিচার করে, আমাকে যুক্তির সাথে এমন করে বুঝিয়ে দিলে যে, তুমি যদি আমাকে ব্যবসার জন্য দশ লাখ টাকা দিতেও চাও, সেটা হবে একটা ভুল পরিকল্পনা। না হবে ব্যবসা, না হবে জীবন গড়া, না হবে সমাজে সুস্থভাবে বেচে থাকা, আর না থাকবে এই মুলধন অবশিষ্ট। আসলে তুমিই ঠিক ছিলে, আমি ছিলাম একটা ভুলের মধ্যে, একটা অভিশপ্ত মানুষের দ্বারা পরিচালিত। কারন সেদিন তুমি আমাকে যেসব তথ্য আর উপাত্ত দিয়েছিলে, তা আমি শত চেষ্টা করেও আমার আপাত শুভাকাংখী কুচক্রির কাছ থেকে জানতে পারি নাই যদিও সেটা আমার জানার অধিকার ছিলো। বারবার সে আমাকে সব কিছু লুকিয়ে গিয়েছিলো যা সে পাচ্ছিল আর অন্যদিকে আমাকে দিয়ে আরো কিছু বেশি পাওয়া যায় কিনা তার চেষ্টা সে সর্বাত্তকভাবে পরিকল্পনায় লিপ্ত ছিলো। আমি তার কোনো কিছুই বুঝতে পারি নাই। তুমি আমাকে ব্যবসা দিতে রাজি হলে না। ব্যবসার পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো, সম্ভবত আমিও এই প্রথমবার মনে হলো, তুমি কাজটা ঠিকই করেছো আমাকে ব্যবসাটা না দিয়ে। কারন ব্যবসার কোনো কিছুই আমি বুঝি না। তাও আবার অন্যের ঘাড়ে নির্ভর করে তোমার দেয়া আমার টাকার উপর অন্যের হাতে ব্যবসা।
দিন যায়, সপ্তাহ যায়, হটাত একদিন আমার নতুন সম্পর্কের কথা আসে। ছেলে সুদুর বিদেশের মাটিতে সেটেল্ড। আমার প্রত্যাশার বাইরে এমন একটি সম্পর্ক। ছেলেটি অনেক উচ্চমানের পজিশনে থাকা স্বশিক্ষিত এবং ভদ্র সমাজে উপস্থাপন করার মতো একটি প্রপোজাল বটে। আমার বাবা, আমার মা অতিশয় যেনো খুশি। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না, কিভাবে এই সমন্ধটা একেবারে ঘরের কাছে নিজের চৌকাঠ পার হয়ে আমার অবধি নাগাল পেলো। আর কিভাবেই বা আমার পরিবার এই খরচ সংকুলান করবে যেখানে এক লাখ টাকা একত্রে বের করতেই আমার পরিবার হিমশিম খায়।
বুঝলাম, এবারেও আমার সেই তুমি। রাগ হয়েছিলো অনেক বটে যে, আর ফিরে যাওয়া হল না আমার। কিন্তু এবার ফিরে যাচ্ছি আরেক নতুন জীবনে। চোখের অন্তরালে চলে গেলেও তুমি থাকবে আমার চোখের মনিতে। এই তো আর বেশী দিন নাই। আমার যাওয়ার সময় হয়েই এলো। মিস করবো না কারন সারাক্ষন তুমি আমার আত্তার মধ্যেই আছো।
অনেক কিছুই আর আগের মতো নাই। কিন্তু বারবার মনে পড়ে সেই দিনগুলির কথা। খুব মনে পড়ে তোমাকে। মনে পড়ে অলস দুপুরে শুয়ে শুয়ে তোমাকে ভার্চুয়াল মিডিয়ায় দেখা। মনে পড়ে বিড়ালের বাচ্চার মতো ঘুর ঘুর করে তোমার পিছন পিছন চলা। আমি জানি, আমি এখনো আছি তোমার সেই বিশাল প্রশস্থ বুকের কোনো এক গভীরে। আমি এটাও জানি, তুমি আজিবন থাকবে যেমন আমি আছি। হয়তো আমাদের শুধু জায়গাটা পরিবর্তন হয়েছে বটে কিন্তু এখন আমি আর সেই কুচক্রীর থাবানলের মধ্যে নাই যে চেয়েছিল তোমার ধংশ। আর এখন সে নিজেই ধংশ হয়েছে চিরতরে। হায়েনারা সব সময় অন্যের শিকারকেই খায়, নিজেরা কোনো শিকার করে না। এরা হায়েনা। তবে মানুষরুপী হায়েনারা আবার খাবারের তালিকায় যেমন মানুষ রাখে, তেমনি রাখে অন্যের সঞ্চয়পত্র, অন্যের গাড়ি, অন্যের টাকায় জন্মদিন পালন, অন্যের টাকায় গহনা বানানোর লোভ, অন্যের ফার্নিচার বিক্রির টাকায় লোভ, ছলেবলে কৌশলে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে ব্যবসা নেয়া কিংবা দশ বিশ ত্রিশ লাখ টাকার চাহিদা, আবার কখনো কখন আধুনিক কালের ডিজিটাল ব্যবসার মালিকানা থেকে শুরু করে পশু ছাগল ভেরার খামারেও এদের লোভ কম নয়। কিন্তু যতটুকু জানি, শেষ অবধি এদের ভাগ্যে কিছুই জোটে না, না স্বামী সুখ, না সংসারের সুখ, না মা হবার সুখ না সমাজে বাহাদুরী করার সুখ। এরা যুগে যুগে ঠকবেই কিন্তু কখনো বুঝবে না যে, এরা ঠকাতে গিয়েই ঠকে। এরা জীবনেও সুখি হয় না।
তবে এখনো হায়েনাটা মাঝে মাঝে কাছে ঘেষার চেষ্টা করে। আমি এবার তার সব বানানোর কথার অর্থ বুঝি। আমি এটাও বুঝি কোনটা সে সত্য বলছে আর কোনটা মিথ্যা। যে কথাটি সে বলছে, আসলে সেটাই মিথ্যা। আর যেটা বলছে না, সেতাই সত্য কিন্তু গোপন করছে। কিন্তু আমি এবার সাবধান।
৩০/০৩/২০২০-যেদিন চলে আসবো-২
যেদিন আমি চলে আসবো বলে মনোস্থির করেছিলাম, সেদিন শ্রাবনের রাত্রি ছিলো না। কিন্তু আমার দুই চোখে ছিলো থমথমে মেঘের আভা। আমি আকাশ দেখি নাই সেই রাতে কিন্তু বুঝেছিলাম, হয়তো আকাশে একটি তারাও নাই। প্রখর ইলেক্ট্রিক লাইটে আমার মনে হচ্ছিলো আমার শরীর-মন একটি অন্ধকার ঘরের মধ্যে বন্ধী। আমার চারিপাশে কোথাও কেউ নাই। শরীরের তাপমাত্রা জরের সমান কিন্তু জর ছিলো কিনা বুঝি নাই। আমি মৃত মানুষের মতো একপাশ হয়ে সারাটা রাত কাটিয়ে দিলাম। সকাল হলেই আমি চলে যাবো আমার এই চেনা পরিচিত ঘর থেকে। এই ঘরের প্রতিটি কনা, প্রতিটি আচর আমার চেনা। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে, আগামিকাল থেকে আমি আর এই ঘরটিতে কখনো ফিরে আসবো না। ভাবতেই আমার হৃদস্পন্দন যেনো থেমে গেলো, চোখ মুদে গেলো। মনে হলো, আমার দুটি নয়ন সমস্ত রুদ্ধ প্রীতি তোমার প্রতি সিঞ্চন করে বারবার অশ্রুপাত করছে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জানি না। ভোর হতে না হতেই ঘরের বাইরে কে যেনো টোকা দিলো। এতো সকালে আজ পর্যন্ত কেউ আমার এই একা ঘরে টোকা দেয় নাই। শরীরটা বড্ড ভারী মনে হচ্ছিলো। প্রচন্ড এক আলস্য নিয়া দরজা খুলতে পৃথিবীর সমস্ত অবাক করার বিষয়ের মতো আমাকে তুমি হতবাক করে দিয়েছিলে। প্রকাশ্য দিবালোকে তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে। কোনো আগামবার্তা নাই, কোনো কথা নাই, কিছুই না। তুমি এতো সকালে এসে আমার ঘরের দরজায় হাজির।
এমনিতেই শরীরে বল ছিলো না, তারমধ্যে অকস্মাৎ তুমি। আমার সারাটা শরীর কেপে কেপে উঠেছিলো, কিছুটা ভয়ে, কিছুটা কষ্টে আর এতোটাই বেদনায় যে, আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরলে, আমি তোমার বুকে একদম মিশে গেলাম, আমার সেই চেনা পরিচিত প্রশস্থ ভালোবাসার বুক। আমি হারিয়ে ফেলবো হয়তো আর কিছুক্ষন পর। তুমি আমাকে কতো আদরের সাথে জড়িয়ে ধরে কতই না আদর করলে। আমার বুকভরা অভিমান, আমার চোখভরা অশ্রু আর দুর্বল শরীরের কাপুনিতে তুমি কিছুই বুঝতে পারলে না, আমি হারিয়ে যাচ্ছি। শুধু, বললে, 'আমি আছি তো, ভয় পেও না'। হ্যা, তুমিই ঠিক, তুমি আছো, আমার সারাটা জীবনেই তুমি আছো, অন্তর জুড়ে আছ, মন জুড়ে আছো, আমার ভাবনায় আছো, আমার রক্তের প্রতিটা শিরায় আছো। দেহের সাথে মিশে থাকার নামই শুধু ভালোবাসা নয়, হাতে হাত ধরে একসাথে রাস্তা পার হওয়াই এক সাথে নয়, আমার প্রতিটি কল্পনায় তুমি ছায়ার মতো আছো। যেখানে তাকাই, আমি সব জায়গায় তোমাকে দেখতে পাই। হ্যা, তুমি আছো, ছিলে আর থাকবেও। তুমি ছিলে আমার বাবার ভুমিকায়, ছিলে আমার ভাইয়ের ভুমিকায়, ছিলে আমার মায়ের ভুমিকায়, তুমি ছিলে আমার প্রেমিক আর নির্ভরতার সবচেয়ে কাছের মানুষটি। আজো তাইই আছো।
তুমি শেষবারের মতো আমাকে বুকে নিয়া, কপালে, মুখে, নাকে, চোখে, সব জায়গায় আদর দিয়ে কিছুক্ষন পর অবশেষে চলে গেলে। আমি যতদূর দেখা যায়, জানালা দিয়ে এই প্রথম তোমার যাওয়াটা দেখলাম। চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। আর হয়তো কখনো তোমার সাথে আমার দেখা হবে না। তুমি এই সত্যটা না জেনেই সমস্ত ভরষা আর ভালোবাস নিয়েই অন্য দিনের মতো চলে গেলে। তুমি জানলেই না , কি রয়ে গেলো আর কি নিয়ে গেলে আর আমিই বা কি করে এটা করলাম। সারাটা দিন আমি কেদেছিলাম। সেদিন আর আমার যাওয়া হলো না।
কিন্তু বুকভরা অভিমান নিয়ে আমি পরদিন কাউকে কিছু না বলে অতিভোরে আমার চেনা পরিচিত ঘরটি ছেড়ে শেষ পর্যন্ত বেরই হয়ে গেলাম। এ খবরটি জানলো শুধু আমার সেই কুচক্রীকারিনী বন্ধুটি আর জানেন আমার ঈশ্বর। কিসের নেশায় যে আমি এতোটা দিকহারা হয়ে গিয়েছিলাম, আজো আমি মনে মনে ভাবি। আমার কেনো একবারের জন্যেও মনে হয় নাই যে, এই কালো মুখোশধারী সর্পহরিনীর সাথে আমার বিস্তর একটা ফারাক ছিল। তার স্বামী ছিল্ তার সংসার ছিল। সে তো এসেছিল অভিসার করতে, সে তো এসেছিল গোপন মিশনে। তার তো হারাবার কিছু ছিল না। যদি তার মিশন সার্থক না হয়, সে তো ফিরেই যাবে তার সেই চেনাগৃহে যেখানে অপেক্ষা না করে থাকলেও সামাজিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্পাপ অথবা আরেক অভিচারী ব্যভিচারক পুরুষ। তাদের মধ্যে ভালোবাসা থাকুক আর নাই বা থাকুক, সেটা কোন মাপকাঠি নয়। তাদের মাপকাঠি সামাজিক একটা বন্ধনে তারা আবদ্ধ। আর এই সামাজিক বন্ধনের কারনেই আমার কুচক্রীকারিনি আজ এই গোপন অভিসারে এসেও ফিরে যেতে পারে নিজ গৃহে। কিন্তু আমি তো ব্যভিচারী ছিলাম না!! আমি তো আমার জায়গাতেই ছিলাম! এই কুচক্রীকারিনী এসেছিলো সদাই করতে, যৌবনের সদাই, ভালোবাসার অভিনয়ের সদাই। আমি কেনো তার কুপরামর্শে আমার সংসার ছাড়লাম? কখনো কি তোমার এ কথাটা মনে হয় নাই যে, যে মহিলা-প্রজাতী তার নিজের স্বামীর অগোচরে নিজের দেহের সদাই করতে কোনো এক অপরিচিতের বাসায় নির্বিঘ্নে পর পুরুষের সাথে নির্ভয়ে আসতে পারে, তার কাছে আবার ভালবাসার মুল্য কি? তোমার কি কখনো মনে হয় নাই, যে, এটাই হয়তো তার প্রথম সদাই নয়? কি করে তুমি ভাবলে যে, সে এই সদাই করতে এসেছে শুধুমাত্র ভালোবাসার কারনে? সে না বুঝে ভালোবাসা, না বুঝে ভালোবাসার কষ্ট। সে শুধু বুঝে তার এই অমুল্য মেয়েলী সম্পদ শুধু লালসার কারনে ভোগ বিলাসের একটা যন্ত্র বিশেষ প্ন্য বটে। আর কিছু না। বেশ্যাদের জীবনের প্রয়োজনে হয়ত বেশ্যাগিরি করতে হয়, এটা অনেকেই করলেও মনে মনে ঘৃণা করে। তারপরেও জীবনের এটা ধরেই নেয়া যেতে পারে যে, সেটা যতোটা না পাপ, তার থেকে বেশি জীবনের প্রয়োজনে বেচে থাকার একটা পথ। কিন্তু এই কুচক্রিকারিনী তো জানতো যে, তাকে দেহ দান করতে হবে, তাকে সব কিছু উজার করে দিতে হবে, কিন্তু তার তো জিবিকার জন্য এইকাজ করার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। এর মানে একটাই, সে প্রফেশনাল। আমি এই প্রফেশনাল কুচক্রির কাছে প্রতিনিয়ত হেরে গিয়েছিলাম কিন্তু নষ্ট হয়ে যাইনি।
৩০/০৩/২০২০-যেদিন চলে আসবো-১
আজ আমার যাওয়ার দিন প্রায় হয়ে গেলো। আমি চলে যাচ্ছি চিরতরে অন্যখানে। সামনে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে আর কি আছে আমি জানিনা। আগে যেমন সন্ধ্যা হলেই অস্থির চিত্তে সন্ধ্যাতারা দেখতাম, পূর্নিমা এলে খোলা হাওয়ায় বসে পুর্ব দিগন্তে বিশাল চাকতির মতো চাদকে দেখতাম, শীতের সকালে শরীরে কাথা মুড়ি দিয়া অগোছালো সপ্নে বিভোর থাকতাম কিংবা বর্ষার রিমঝিম ব্রিষ্টিতে গুনগুন করে একা একাই গান গাইতাম। আজ হতে আর কয়েকদিনের মধ্যে এসব আর আমার হয়ে থাকবে কিনা আমি জানি না। হয়তো ব্যস্ত হয়ে যাবো সংসারের বৈষয়িক কাজে, স্বামীর সেবা শুস্রশায় আর নিজের কিছু একান্ত বেদনাবোধ নিয়ে। তাই আজ এই যাওয়ার সময় আমার বারবার একটা মুখ আমার মানসপটে ভেসে আসছে। আর মনের অজান্তেই দুমড়ে মুচড়ে আসছে একটা কষ্টের অভিজ্ঞতা। বড় কষ্ট হচ্ছে আজ আমার এই ভেবে যে, তোমাকে আমি কষ্ট দিয়েছি। তুমি হয়তো জানলেই না কি কষ্ট আমি নিয়ে আমিও চলে গেলাম, আর আমিও হয়তো শতভাগ জানতে পারলাম না, কি কষ্ট আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম। অপমান আর অবসাদে অবনত হয়ে আজ যাওয়ার সময় আমি তোমাকে আমার কিছু অব্যক্ত কথা এই ভাসমান মন্ডলে, ভার্চুয়াল জগতে রেখে গেলাম। যদি কখনো তোমার গোচরে আসে, যদি কখনো আমার কথা ভেবে তোমার চোখ ভিজে আসে, যদি কখনো আমার জন্য আর এতটুকু ভালোবাসা, মহব্বত আর স্নেহ জেগে থাকে, তাহলে শুধু এটুকু অনুরোধ করবো, তুমি আমাকে ভুলে যেও না। আমি ছোট ছিলাম, আমার অভিমান ছিলো, তাই অধিকার নিয়েই না বুঝে সীমার বাইরে গিয়ে এতোটাই পাগলামী করেছিলাম যা আজ কষ্টে আর অভিমানে ভরে আছে সারাটা অন্তর। কিন্তু এর পিছনে না ছিলো আমার বড় ধরনের কোনো ফাকি, না ছিলো তোমার বড় ধরনের কোনো কুট কৌশলতা। বাস্তবিক পক্ষে আমাদের এই অভিমানকে কেউ তার লালসা দিয়ে পুজি করেছিল, যা আমিও বুঝি নাই, তুমিও না।
চারটি বছর আমি তোমার সাথে ছিলাম। আমি এই চারটি বছরের প্রতিটি মূহুর্তের সময়টুকু বিচার বিশ্লেষন করে দেখেছি, জলের সাথে মাছের যে সম্পর্ক, আমার সাথে তোমার ছিলো সে রকমের একটা সম্পর্ক। আমার প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি নিঃশ্বাস বলে দেয়, আমি ছিলাম তোমার প্রতিটি চিন্তায়, এমন কি অবচেতন মনেও। আমার কোনো কিছুর অভাব ছিলো না, তুমি কোনো কিছুর অভাব রাখোনি। কোনটা সম্পদ আর কোনটা সম্পত্তি, কোনটা আমার আর কোনটা তোমার এই তর্কে আমার কখনোই যাবার যেমন দরকার ছিলো না, তেমনি ছিলো না এসব ব্যাপারে আমার কোন আলাদা হিসাব। তুমি ছিলে আমার ব্যাপারে সদাচিন্তিত, কি করলে আমার ভালো হবে, কি না করলে আমার ক্ষতি হবে। আমার ব্যাপারে আমাকে আর আলাদা করে কখনো ভাবার প্রয়োজন ছিলো না আর থাকলেও আমি এসব নিয়া চিন্তা করলেও কোনো লাভ হতনা। আমি ছিলাম গভীর সুখের ছায়াতলে তোমার সুগভীর সহিষ্ণুতার আবরনে। ফলে, কোনোদিন শোনোনি আমি তোমার কাছে কখনো সম্পদ চেয়েছি, কিংবা আমি তোমার সম্পদের পাগল ছিলাম। আমাকে তুমি আদর দিয়েছো, ভালোবাসা দিয়েছো, আর যখন যা লাগে চাওয়ার আগেই তুমি তা দিয়েছো। আমি সুখি এবং খুসি ছিলাম। আমার কোনো কিছুতেই লোভ ছিলো না।
তুমি ছিলে আমার জীবনের রুপকার, আমি জানি, তোমার অন্তরের ভাষা। কিন্তু আমি সেদিন তোমার মুখের ভাষার যে রূপ দেখেছিলাম, তা আমার কখনো দেখা হয় নাই। তোমার রাগ, তোমার চাহনী আর তোমার অভিব্যক্তি আমাকে উদ্বেল করে দিয়েছিল। এই নতুন রূপ আমার আগে কখনো দেখা হয় নাই। তুমি বারবার আমাকে সম্পদ, সঞ্চয়পত্র, সোনার গহনা, ব্যবসা, চাকুরী ইত্যাদির কথা এমনভাবে প্রশ্ন করতেছিলে, যা না ছিলো আমার মনে, না ছিলো আমার মস্তিষ্কে। আমি সঞ্চয়পত্র কি, এর লাভ কি, এর দ্বারা কি করা যায়, আমার কিছুই জানা ছিলো না। তুমিই আমাকে প্রথম সঞ্চয়পত্রের ধারনা দিয়েছো। অথচ কোনো একদিন, আমারই হয়ে আমারই মোবাইল থেকে আমারই জন্যে আমি নাকি তোমাকে আমার অধিক নিরাপত্তার জন্য তোমার কাছে সঞ্চয়পত্র কেনার বায়না করেছি। তুমি একবার ভাবোতো, আমি কি এতোটাই মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছিলাম যে, গুটিকতক নোটের জন্য আমি আমার সারা জীবনের নিরাপত্তা আর ভালোবাসার মানুষটিকে চিরতরে হারাবো? এটা ছিলো একটা মানুষের নিম্ন মানসিকতার সর্বোচ্চ উদাহরন যেখানে ষড়যন্ত্রকারীর দুষ্টু বুদ্ধির একটামাত্র বিষের ফল। তোমার এই ষড়যন্ত্রকারিনীর নাম তুমি হয়তো এখন জানো। সে ভালোবাসার অভিনয় করে ঘরে ঢোকেছিল, কিন্তু সে না নিজেকে ভালোবেসেছিলো, না আমার এই সম্পর্ককে। আর না সে তোমাকে ভালোবেসেছিলো। ধরে নাও, আমি তার নাম দিলাম 'কুচক্রকারিনী' অথবা 'ষড়যন্ত্রকারিনী'।
হ্যা, আজ একটা জিনিষ আমি বুঝতে পারছি যে, এই বিশাল সময়ের ব্যবধানে সবার যেমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিমান জমতে পারে, আবার কখনো কখনো সেই অভিমান সময়ের স্রোতে রাগেও পর্যবসিত হতে পারে। আমি বুঝতে পারিনি, এই ছোট হৃদয়ে আমার কখন যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিমানগুলি বিচ্ছিন্ন রাগে পরিনত হয়েছিল, কিন্তু সেটা ছিলো নিতান্তই একটা সাময়িক। কিন্তু আমি বুঝিতেই পারিনি যে, 'সমুদ্রের পানিতে নামিয়া তীরের বনরাজীমালাকে যেমন রমনীয় চিত্রবত মনে হয়, সমুদ্র থেকে তীরে উঠিয়া তা আর আগের মতো মনে হয় না' ঠিক তেমনি, আমিও সেই ষড়যন্ত্রকারিণিকে কাছে পেয়ে ভেন্টিলেশনের একটা পথ খুজে পেয়েছি মনে করে যখন আমি আমার সমস্ত রাগ অভিমান ঐ পথ দিয়ে নিষ্কৃতি করলাম, তখন বুঝলাম, রাগের মাথায় আমি যা বলেছিলাম, আমার সেই অভিমান আমার সামনে অভিনয়কারী সেই ষড়যন্ত্রকারীনির কারনে এখন আমার বিপদ হয়েছে। আমি ঘর ছেড়েছি, আমি তোমাকে ছেড়েছি। এই ষড়যন্ত্রকারিনী আমাকে ঘর থেকে পথে নামিয়ে একেবারে খাদের প্রান্তে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমার যখন হুশ ফিরেছে, আমি যখন আবার ফিরতে চেয়েছি, তখন আর আমার ফিরে যাওয়ার উপায় ছিলো না। আমি ঘরহারা হয়ে রাস্তার দুইধার ধার দিয়া আমার সেই অগোছালো অপরিচ্ছন্ন পুরানো বাসভুমেই আবার ফিরে আসা ছাড়া কোনো পথ খোলা ছিলো না। যখন আমি আমার সেই অতি পরিচিত কিন্তু আবার অতি অপরিচিত আবাসভুমে ফিরে এলাম, তখন বুঝলাম, ষড়যন্ত্রকারিনী তার সার্থ সিদ্ধির যা যা করার তা তাই করে সার্থক হয়ে গেলো, আমি শুধু কোনো এক অচেনা খাদের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি।
আমি একা একা ধলেশ্বরী নদীর ধারে বসে সুর্যাস্তের সর্নছায়া দেখতে দেখতে, কখন যে আমার চোখ ভিজে আসতো, আমি বুঝতে পারতাম না। জনশুন্য ধলেশরীর তীরে দিগন্ত প্রসারিত ধুধু বালুকাময় তীর আমাকে ভয়ংকর পথের দিকে ইশারা দিতো। নিস্তব্দতা যখন নিবিড় হয়, তখন কেবল একটা সীমাহীন দিশাহীন শুভ্রতা এবং শুন্যতা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। আমার বেলায় যেনো এটা একেবারে বাস্তব হয়ে চোখের সামনে ধরা দিলো।
আজ একটা কথা বলি, এই প্রিথিবীতে যারা আপন হয়ে ঘরে ঢোকে, তারা সবসময় আপন হয়েই বের হয় না। কখনো কখনো তারা আপন হবার ভান করে কিন্তু হায়েনা হয়ে ঢোকে। তাদের সুপ্ত বাসনাই থাকে অন্যের ক্ষতি করা। আমার বেলায় এই "আপন" ভেবে যাকে বুকে নিয়েছিলাম, সেই আসলে ছিলো আমার মরনের খলনায়ক। কারন, আমার জানা ছিলো না যে, আমি যাকে আপন মনে করে আমার মনের যে কিছু ক্ষোভ ছিলো তাকে বলার পর সেই ক্ষোভ যে আবার আমাকেই দংশন করবে। আমি ছোট ছিলাম, আমার মনের কথাগুলি বলার কোন লোক ছিলো না, তাই, অতীব আপন মনে করে আমি এই সেই কুচক্রী ষড়যন্ত্রকারিনিকে এমনভাবে শেয়ার করেছিলাম যাতে আমার মন কিছুটা হালকা হয়। আর এই সেই কুচক্রীকারিনী তোমার কাছে আমার মনের কষ্টগুলি এমনভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে উপস্থাপন করেছিলো যা তোমাকে আমার থেকে আর আমাকে তোমার থেকে যোজন দূরে এক ঝরের গতিতে ছিটকিয়ে ফেলেছিলো। ঈশ্বর বড় সহায় যে, তোমার অন্তর আর দশটি মানুষের মতো ছিলো না। তাই, অন্তত আমি আজ মাটিবিহীন নই। কোথাও না কোথাও আমাকে তিনি ঠাই করে দিচ্ছেন। আর তার রুপকার আবারো ছিলে সেই তুমি।
আমার জীবনের সব কাহিনী তুমি জানতে। হয়তো সেই অবহেলার কাহিনী, সেই অনাদরের কাহিনী জেনেই তুমি আমাকে আরো বেশী করে আদর করতে, আমি তোমার আদর বুঝতাম। তারপরেও আমি তোমাকে কিছু কিছু জায়গায় হয়তো ভয় পেতাম। আর এটা কোনো অমুলক ভয় ছিলো না। তোমার মতো পাহাড় সমান ব্যক্তিত্তের কাছে আমি ছিলাম অতি নগন্য। আমার এই ছোট জীবনে কখনো তুমি কেনো, তোমার থেকে অর্ধেক ব্যক্তিত্ত সম্পন্ন লোকেরও কোনোদিন দেখা হয় নাই। একদিকে তোমার পজিশন, তোমার প্রতিপত্তি, তোমার ক্ষমতা আবার অন্যদিকে আমি তোমার সেই ছোট পুতুলের মতো একটা বিড়ালসম, ভয় তো হবেই। অনেক কিছুই হয়ত ভয়ে আমি তোমাকে খোলামেলা করে বলার সাহস পাই নাই। কিন্তু আমার কখনো তোমার উপর ঘেন্না হয় নাই, তবে অভিমান হয়েছে অনেক। এই অভিমানটাকেই আমার আপাত আপন কুচক্রী মানুষটি আমাকে সমুদ্রের তলদেশে ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো।
কুচক্রি মানুষ যখন কাউকে আকড়ে ধরে, তাকে সর্বোপ্রথম আক্রমন করে তার অন্তরে, তার হৃদয়ে, তার যুক্তিক ব্যবহারে তখন অনেক কিছুই অবাস্তব মনে হলেও যুক্তির মতো মনে হয়। এই কুচক্রীর কথায় আমি যেনো বারবার নিজেকে বোকাই মনে করেছিলাম। তার এই কথার যুক্তি ধরে আমারো এক সময় মনে হয়েছিল, আসলেই আমি কি পেয়েছি এ যাবত? সব কিছুই তো বিলিয়ে দিয়েছিলাম অকাতরে। তাহলে দেয়ার সাথে পাওয়ার কেমন যেনো একটা অসামঞ্জস্যই মনে হচ্ছিলো। শয়তান যখন ভর করে, তখন নীতি পালিয়ে যায়, আর দিধা ভর করে। হয়তো আমারো তাইই হয়েছিলো। শয়তান আমাকে অতি কাছ থেকে বারবার প্রলোভন দেখিয়ে আমার সমস্ত মনকে বিষিয়ে দিয়েছিলো। তখন আমাকে ভর করে এই কুচক্রিকারিনী একের পর এক তার হীনসার্থ চরিতার্থ করার জন্য কতই না পরিকল্পনা আটছিলো। লাখ লাখ টাকার সপ্নে সে ছিলো বিভোর। আর তার সাথে ছিলো একটা অভিনয়। একদিকে সে আমাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছিল আর আমাকে গুটির চালের মতো ব্যবহার করছিলো, অন্যদিকে সে তোমাকে একটা মিথ্যা ফেস প্রদর্শন করে এমনভাবে জালটা বিছিয়েছিলো যে, না তুমি ওকে বুঝতে পারছিলে, না আমি। অথচ আমাদের দুইজনের ভিতরে চলছিলো তখন মহাপ্রলয়ের মতো ঝড় আর কষ্ট। এই কুচক্রিকারিনী আমাকে একের পর এক তার বানানো পরিকল্পনা দিয়েই যাচ্ছে, আর সেই পরিকল্পনার অগ্রীম তথ্য তোমাকে দিয়ে সে আমাকে তোমার কাছে অমানুষের মতো চেহাড়াটা দেখিয়ে তোমার কাছে ভাল মনিষী সাজবার চেষ্টা করছে। অথচ সেই ছিলো পুরু পরিকল্পনার মাষ্টারমাইন্ড। অগ্রীম পরিকল্পনা একদিকে আভাষ, অন্যদিকে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখে তোমার এতাই মনে হ ওয়ার কথা, যে, কু চক্রী তোমাকে ভালো উপদেশ, বা তথ্য দুটুই দিচ্ছে। এহেনো পরিস্থিতিতে তার উপর তোমার ভরষা হবারই কথা। আর এর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিলো তার, আমি চিরতরে তোমার কাছ থেকে বহিষ্কৃত হই আর সে আমার স্থানটা চিরতরে দখল করে বাকি জীবনটা আরাম আয়েশে কাটায়। ফলে সেই সঞ্চয়পত্র, সেই ২০ লাখ টাকা, সেই গাড়ির কাহিনি, সেই দোকান কেনার কাহিনী, সেই ফার্নিচার বিক্রির কাহিনী, আমার নতুন জব, খালা বুয়াদের কাছ থেকে আমার নিথ্যা আয়, আমার গোপন মিথ্যা প্রেমের উপখ্যান, ওর জন্মদিনের উপহার দেবার দাবী ইত্যাদি সবই ছিলো একটা জাল। একটা বড় পরিকল্পনার অংশ।
আমার ব্যাপারে তুমি নতুন কিছু তথ্য যা তোমাকে আমার জানানোর দরকার ছিলো বই কি কিন্তু আমার মনে হয় নাই যে, এইসব ছোট খাটো তথ্য যা আসলেই কোন কাজের তথ্য নয়, সেগুলি জানানোর দরকার। ফলে আমার এই ছোট খাটো তথ্য কুচক্রিকারিনী এমনভাবে তোমার কাছে উপস্থাপন করেছিলো যে, আমি আর তোমার বাধ্যগত ভালোবাসার মানুষটি যেনো আর নই। সব কিছু দেবার পরেও যখন তুমি জানতে পারলে যে, আমি তোমার অনুমতি ব্যতিত শুধুমাত্র টাকার লোভে অন্যত্র চাকুরী করি, কিংবা তোমা ব্যতিত আমার আরো অনেক ভালবাসার মানুষ আমার সদর দরজায় ভীড় করে, অথবা তোমার অজানা সত্তেও আমি আমার কাজের মেয়ের কাছ থেকে তার থাকা খাওয়ার খরচ হিসাবে বাড়তি পয়সা নেই যা তুমি বারন করেছিলে, এসব জানার পরে কার না মাথা খারাপ হবে? তোমারও তাই হয়েছিলো বলে সেদিন আমি তোমার রাগের যে চেহারাটা দেখেছিলাম, তা আজো আমি ভুলি নাই। তোমার রাগ হবার শতভাগ যুক্তি ছিলো, যেটা আজ আমি বুঝি। কিন্তু বিশ্বাস করো, এসবই ছিলো মিথ্যা একটা বানোয়াট কাহিনী। আমি কখনো টাকার জন্য কোথাও চাকুরী করি নাই, আমার জন্য বরাদ্ধ কাজের বুয়া থেকেও আমি তার খাওয়া থাকার ভাড়া হিসাবে কোনো টাকা পয়সা গ্রহন করি নাই, কিংবা আমার সতীত্তের দোহাই দিয়েই আজ আমি জোর গলায় বলতে পারি, তুমি ছাড়া আমার জীবনে আর কোনো দ্বিতীয় পুরুষের কখনো আগমন ছিলো না, আর হয়ও নাই। এ সবই ছিলো ঐ কুচক্রিকারিনীর বানানো সব বানোয়াট গল্পের একটা কল্পকাহিনী। সবচেয়ে বড় যে বানোয়াট কাহিনী তুমি জেনেছো, যে, আমি আমার সময়ে আমার যা করার কথা তা না করে সারাদিন উলটাপালটা কাজেই যেনো মনোনিবেশ করে থাকি। তুমি পুরুষ মানুষ, তোমার এহেন তথ্যে আমার উপর আস্থা হারানোই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি না পারছিলাম তোমাকে কিছু বুঝাতে, না পারছিলাম, আমাকে সামাল দিতে। জীবনের প্রতি আমার একটা সময় বিতৃষ্ণা চলে এসেছিলো। মনে হয়েছিলো, আমার আর একদন্ডও তোমার ভালবাসার কাছে কোন স্থান নাই। মানুষ যখন আস্থাহিনতায় ভোগে, তখন তার কোনো হিতাহীত জ্ঞান থাকে না। তখন দরকার হয় একজন মানুষের সাপোর্ট। অথচ আমার ভাগ্যটা এমন যে, কুচক্রিকারিনী কালনাগিনীকেই আমি আমার আস্থা দিয়ে বসেছিলাম। সেই কালনাগিনীকেই আমার মনে হয়েছিলো আমার আস্থার জায়গাটা। একদিকে তুমি আমার উপর প্রবল রেগেছিলে, অন্যদিকে তুমি আমার কোনো কথাই শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলে না। তাহলে আমার বিকল্প কি ছিলো? বিকল্প ছিলো একটা- কোথাও হারিয়ে যাওয়া চিরতরে। আর আমি এই কুচক্রীর উপদেশেই একদিন কিছুই না বলে সত্যি সত্যি হারিয়ে গেলাম। আমাকে বাসা বদলের পরিকল্পনা, যোগযোগের নিমিত্তে ফোন নাম্বার পরিবর্তন করার পরিকল্পনা এবং তোমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার মাষ্টারপ্ল্যান তো ছিলো এই কুচক্রীরই। আমি তোমার উপর রাগে অভিমানে জিদ ধরেছিলাম, আর সেই রাগ আর অভিমানকে পুজি করে এই মানুষরুপি শয়তান তোমার মন আরো বিষিয়ে তুলেছিলো। আর তুমিও আমার সেই সব সট পড়ে পড়ে যখন মন খারাপ করছিলে, আর তার প্রেক্ষাপটে খারাপ খারাপ মেসেজ করে তুমিও এই কুচক্রীকেই আপন মনে করে হয়তো কিছু রাগের কথা বলছিলে। আর এই শয়তান পুনরায় আমাকে তোমার প্রতিটি মেসেজের সট পাঠিয়ে আমারো মন আরো অস্থির করে তুলেছিলো। আমি তো তোমাকে চিনি। তোমার সারাটা শরীর জুড়ে থাকে কলিজা, সেই মানুষটির রাগ আমার উপর ভালোবাসার তুলনায় কিছুই না। আমি জানি তোমার অন্তর আর ভিতর। হয়তো শত ভালবাসার কথার ফাকে কোনো এক কষ্টের মাঝে বেরিয়ে আসা দু একটা রাগের কথা আসতেই পারে। আর সেই রাগের অবস্থানটাই এই কুচক্রী শয়তান আমাকে এবং তোমাকে বাস্তব দেখিয়ে ভালোবাসার মর্মস্পর্সী কথাগুলি গোপন করে আমাদের দুজনের মনকেই বিষিয়ে তুলেছিলো। কিন্তু তোমার মনের অস্থিরতার কান্নার মেসেজগুলি অথবা আমার মনের কষ্টের কথাগুলির মেসেজ আমাদের কাউকেই সে প্রদান করে নাই। আমার শরীর খারাপ থেকে খারাপের দিকে যাচ্ছিলো, অন্যদিকে আমার বিরহে তোমার শরীরও হয়তো আরো অবনতির দিকেই যাচ্ছিল। আর এটাই হবার কথা। আমি যদি জানতাম, তোমার শরীর এতোই খারাপ হয়ে গেছে, তুমি প্রায় মরেই যাচ্ছো, আমি কি পারতাম তোমার কাছে ছুটে না যেতে? আমিও এতো কষ্টে ছিলাম যে, শুধু আত্তহত্যাটাই করি নাই।
৩/০৩/২০২০-মাধুরী-আকাশের ভালোবাসা
সম্পর্ক বিচার করলে মাধুরীর সাথে আকাশের ভালোবাসা কিংবা প্রেমের কাহিনী রচিত হতে পারে না। তাদের মধ্যে না আছে ধর্মের সাথে মিল, না আছে বয়সের কোনো মিল অথবা না আছে সামাজিকভাবে কোনো আত্মীয়তার কাছাকাছি বন্ধন। কিন্তু প্রকৃতি অনেক সময় এমন কিছু কাজ করিয়া বসে যাহার মাঝে না আছে কোনো বইজ্ঞানিক সুত্রতা, না আছে ফিলোসোফির কোনো ফর্মুলা। মানব আর মানবীর চরিত্র ধরিয়াই একেকতা সম্পর্ক গোপনে, কিংবা অজান্তে এমন কিছুর মধ্যে আটকে যায়, যাহা কোনো না মানে আইন, না মানে সুত্র বা ফর্মুলা। মাধুরী আর আকাশ সমস্ত কিছু নিয়ম ভাঙ্গিয়া একে অপরের এতো কাছাকাছি চলিয়া আসিয়াছিলো যে, তাহারা আর দুইটি প্রানির একটি আত্তায় রুপান্তরীত হইয়া পড়িল।
আকাশে প্রচন্ড বৃষ্টি, দমকা হাওয়ায় চারিদিকে আকাশের মেঘমালা অস্থির হইয়া দিক বিদিক ভাবে হন্যে হইয়া যে যেখানে খুশী উড়িয়া যাইতেছে, পথে ঘাটে মানুষেরা ভয়ে সন্তস্ত্র হইয়া যাহারা ঘরের বাহির হইয়া ছিলো তাহার ঘরে কিংবা নিরাপদ আশ্রয়ে যাইবার পায়তারা করিতেছে, আর যাহারা ঘরে বসিয়া বাহিরে যাইবার পায়তারা করিতেছিলো তাহারা নুরুপায় হইয়া নিজের মনে অশান্ত চিত্তে কখন আকাশ স্থির হইবে তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। গাড়ি ঘোরা নিরাপদ স্থানে পার্ক খুজিতেছে, এর মাঝেই চঞ্চল আকাশ ক্ষনে ক্ষনে বিদ্যুৎ চমকাইয়া পৃথিবীর সকল প্রানি কুল এবং জন্তু জানোয়ারদেরকে চোখ রাংগাইয়া আরো তান্ডব চলিতে পারে বলিয়া সংকেত দিয়াই যাইতেছে। অথচ ইহারই মধ্যে আমাদের এই দুই প্রানি মাধুরী আর আকাশের মধ্যে আকাশ সমস্ত বিপদ সংকুল সংকেত অমান্য করিয়া দূর্যোগ পূর্ন রাস্তায় একে অপরের সাথে দেখা করিবার অস্থির নেশায় বাহির হইয়া গেলো।
কোথাও কোনো যান বাহনের লেশ দেখা যাইতেছে না। যখনই কোনো যান বাহন হতাত করিয়া আসিয়া পরে, ততক্ষনাত হুড়মুড় করিয়া একের অধিক যাত্রী 'ইহা আমাকে পাইতেই হইবে" এই সংকল্পে উহার চারিদিকে জড়ো হইয়া দাম হাকাইতে থাকে। দূর্যোগ পূর্ন সময়ে এইসব যানবাহনের চালক গন, সুযোগ বুঝিয়া মধ্য প্রাচ্যের তেলের মতো তাহাদের ভারা এমন করিয়া বারাইতেই থাকে যেনো, উহা একটি দায়মন্দের খনি। তাহারা যেনো হীরার মুকুট লইয়া কোনো এক ভগবানের মুখ দর্সন করিয়া পথে বাহির হইয়াছেন। আর ভাবিতে থাকেন, যেভাবেই হোক, আজ তাহার কটিপতি হইয়া যাইবেন। কিন্তু সাধারন মানুষ গনের পকেটের অবস্থার কথাও তো ভাবিতে হইবে!! ফলে যাহারা এতোক্ষন এই উচ্চ মুল্যের যানবাহনের চারিধারে জড়ো হইয়াছিলেন, তাহারা তাহাদের পকেটের দুর্দশার কথা ভাবিয়া আরো একটি যানবাহনের আশায় অপেক্ষা করিতে থাকেন। এই সুযোগতাই আমাদের আকাশ বাবু কাজে লাগাইয়া বিনা বাক্যে চালকের কথায় উঠিয়া গেলেন। তাহার যেনো তর সইতেছিলো না। আকাশ যতোই বিপদ সংকেত দিক, তাহাতে তাহার কিছুই যায় আসে বলিয়া মনে হইতেছে না। তাহার গন্তব্য মাধুরীর আস্তানায়।
গাড়িতে উঠতে না উঠতেই চারিদিকে যেনো আকাশ ভাংগা জল কলসি ভর্তি করিয়া যেমন গংগায় পানি ধালিবার মতো জল পড়িতে লাগিলো। বাতাস ছিলো, পথ ঘাট ছিলো প্রায় মানুষ শুন্য। হুড় হুড় করিয়া চালক আকাশকে লইয়া ছুটিতে লাগিলো। সবে মাত্র সকাল হইয়াছে কিন্তু আকাশ দেখিয়া কিছুতেই বুঝিবার উপায় নাই, ইহা কি সন্ধ্যা নাকি সকাল। চারিদিকে কালো করিয়া আসিতেছে।
প্রায় ঘন্তা খানেক পর আকাশ তাহার গন্তব্যে আসিয়া পায়ে পায়ে সিড়ি পারাইয়া ঘরের অতি কাছে দাড়াইয়া একটি মাত্র টোকা দিতেই যেনো যিনি ঘরে কাতর হইয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন, সাথে সাথে কপাট দরজা খুলিয়া দিয়া আকাশকে বরন করিয়া লইলেন। তিনি, মাধুরী। দারাইয়াই ছিল ঘরের কপাটে মাথা লাগাইয়া।
আকাশ ঘরে ঢোকিলো। তাহার মাথায় ব্রিষ্টির পানিতে ভেজা চুল, জামার অনেকাংশেই ছোপ ছোপ পানির হালকা ভেজা বস্ত্র। পরনের জুতা পাটি আর শুশক তো নাইই। কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করিয়াই আকাশ মাধুরীকে জরাইয়া ধরিলো। যেনো কোন এক মহা সমুদ্র পার হইয়া যুদ্ধা আকাশ মাধুরীকে গহীন জংগল হইতে উদ্ধার করা গিয়াছে। বুকের পাজরে তাহারা এমন করিয়া আবদ্ধ হইয়া রইলেন যেনো তাহারা কতদিন একে অপরের জন্য উদাসীন হইয়া বিরহ জীবন পালন করিতেছিলেন।
গেড়য়া রংগের শাড়ি, হাতে সোনার চুড়ি, পায়ে আলতা আর নাকে নাকফুল সাথে কানের দুল পড়িয়া মাধুরী বউ সাজিয়া বসিয়া ছিলেন। বাহিরের এই রুপ প্রাকৃতিক দূর্যোগের বিরম্বনার মধ্যে এই দুই প্রানীর মনের সুখের সাথে কোনো মিল খুজিয়া পাওয়া যাইতেছে না। তাহারা একে অপরের সাথে বুকে বুক মিলাইয়া অধিক ক্ষন শুধু অন্তরের ধুকধুকানী শান্ত করিতেই ব্যস্ত।
আকাশ মাধুরীকে বুক থেকে সরাইয়া তাহার দুই হাত দিয়া মাধুরীর মুখাবয়ব এমন করিয়া ধরিলেন, যেনো একটি ভরা দুধের বাটি তাহার হাতে, যে কোন সময় একটু অসতর্ক ভাবে নাড়িলেই দুধ সব মাটিতে পড়িয়া যাইবার সম্ভাবনা। এমনি করিয়াই আকাশ সব সময় মাধুরীকে অপলক চোখে দেখিতে থাকে, আজো তাহার কোনো ব্যতিক্রম হইলো না। মাধুরী তাহার চোখ বন্ধ করিয়া শান্ত বিরালের মতো নির্বিকার দারাইয়াই থাকে আর আকাশের চোখের বেষ্টনীতে আবেশিত হইয়া জড় পদার্থের মতো ভালবাসার সাধ গ্রহন করে।
আকাশ মাধুরীর চোখে, নাকে, মুখে, গ্রিবায় অবিরত চুম্বন আর আলিংগনে আবদ্ধ করিয়া একে একে মাধুরীর শহরনে ব্যতিব্যস্ত করিয়া ন্তোলে।
সময় যেনো স্তম্বিত সমুদ্রের মতো একেবারে থামিয়া গেছে মাধুরী কটে। শুন্যতায় ভরা মাধুরী কটে এখন যেনো পরিপুর্ন ভালোবাসায় ঘরের চারিদিক চিক চিক করিতেছে। সামনের আয়নায় আকাশ মাধুরীকে দেখে আর ভাবে, আহা, বিধাতা কতই না মনোযোগ দিয়া তাহার মাধুরীকে সৃষ্টি করিয়াছেন। তাহার রুপ আর যৌবনের মধ্যে বিধাতা এমন একটি সরল্রেখা টানিয়া দিয়াছেন যে, একতাকে বাদ দিয়া আরেকতা অসম্পুর্ন।
আকাশ মাধুরীর দুই হাত ধরিয়া দুই দিকে প্রসারিত করিয়া বুকের মাঝ খানে মুখ লুকাইয়া তাহার যৌবনের উচ্ছৃঙ্খল স্তনের ভাজে নাক ঘশিতে ঘষিতে মাধুরীকে মেয়েলী অনুভুতিতে নাড়িয়া দিলেন। আকাশের হার মাধুরীর বুকের উপর, তাহার মুখ মাধুরীর ঘাড়ের ভাজে আর মুখের জিব্বার সব টুকু অংশ মাধুরীর কানের পাতায় লেহনে লেহনে মাধুরীর শরীর অবশ করিয়া তুলিলো।
গেড়োয়া রঙের যে শাড়িটি এতোক্ষন মাধুরীর রুপ আবৃত করিয়া রাখিয়াছিল, আকাশের তপ্ত হাতের তান্ডবে উহা আর মাধুরী গোপন রুপ লুকাইয়া রাখিবার কোনো উপায় না পাইয়া নিজেই মাধুরীর শরীর হইতে মাটিতে লুতাইয়া পরিলো। মাধুরীর প্রতিটি চামড়ার ভাজ অদ্ভুত। কোথাও কোন দাগ নাই, কোথাও কোন খুত নাই। যেখানেই হাত দিক, উহার মধ্যেই যেনো প্রান লুকাইয়া আছে। আকাশ মাধুরীর দুধের কালো বোতায় বিজ্ঞানিক কিছু আবিশকার না করিতে পারিলেও ঊহাতে যে যৌবনের অনেক রস রহিয়াছে তাহা আবিশকার করিতে একটু ও সময় ক্ষেপন করলো না। চুমুতে চুমুতে মাধুরীর সারা শরীর বাহিরের প্রক্রিতির মতো অস্থির করিয়া তুলিলো।
আকাশ মাধুরীর কপাল থেকে শুরু করিয়া নাক, ঠোট, গ্রিবা, আর তাহার সরল রেখা ধরিয়া স্তনের বোতা আর নাভীর নীচ দিয়া মাধুরীর ত্রিভজাক্রিতির কেশ সমৃদ্ধ যৌবনের সবচেয়ে কোমল অমৃত কে বারবার নিজের সবটুকু অনুভুতি দিয়া লেহন করিতে লাগিলেন। যেনো কোন এক দুষ্প্রাপ্য খনিতে ঢোকিয়া আকাশ এমন কিছু খুজিতেছে কিন্তু তাহার আরো হয়তো মগভীরে যাওয়ার পায়তারা করার অস্থির চেষতা। মাধুরীর চোখ বন্ধ করিয়া দুই পা ফাক করিয়া মাধুরী নিজেও আকাশকে সর্বাত্তক সাহায্য করিতে ব্যস্ত যাহাতে আকাশ মাধুরীর যতো গোপন কিছু আছে, তাহা খুজিয়া বাইহির করুক মাধুরী তাহাই চায়। ইহাই আকাশের মাধুরীর শরীর আবিষ্কারের প্রথম নয়। ইহার আগেও বহুবার আকাশ মাধুরীর এই রুপের নেশায়, মায়ার বাধনে জরাইয়া কতই না জল্কেলীর মতো খেলা করিয়াছে। প্রতিবারই মনে হইয়াছে, আজই প্রথম।
মাধুরীর শরীর যেনো একতি খেলনা, জীবন্ত খেলার পুতুল। আকাশ উহাকে কখন হাতে লইয়া, কখনো পাজরে নিয়া, কখনো দুই পায়ের মাঝখানে রাখিয়া, আবার কখন চারপায়ী বেড়ালের মতো নিজের বুকের নীচে রাখিয়া এমনভাবে সংগম করেন যেনো দেখিয়া মনে হইবে আকাস্ক যেন কোন এক চারুকলার শিল্প তৈরী করিতেছে আর মাধুরী সব ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া চুড়িয়া আবার নতুন মাধুরী হইতেছে।
মাধুরিও কখনো কখনো বজ্র মুষ্টি করিয়া আকাশের সব কলা কৌশল আয়ত্তে আনিয়া নিজেও আম্র কাননের কলির মতো নিমিষেই ফুটিয়া ফুটিয়া আকাশের চারিদিকে এমন করিয়া বিচরন ক্ষেত্র তৈরী করিতেছে যেনো তাহার রুপের কোনো শেষ নাই, তাহার আক্রিতির কোনো সিমা নাই, তাহার স্ত্রী অংগ কাপিয়া কাপিয়া সব কিছু উজার করিয়া বইশখের ঝরের মতো অকালেই সব ছাড়িয়া দিতেছে। কখনো তাহার যোনিপথ ভিজিয়া একাকার, কখনো তাহার বুকের দুধ ফুলিয়া ফাপিয়া উঠিতেছে, কখনো ঘন ঘন নিঃশ্বাসে সদ্য উপড়ে উঠা কেচোর মতো আকাবাকা হইয়া যাইতেছে।
রমনী মন্থন, যোনী মন্থন, পুরুষাঙ্গ মন্তনের মতো নেশা আর কিছু নাই। তান্দব ঝরের গতির থেকে এর তীব্রতা আরো বেশী। সমস্ত শরীর তার দেহের সাথে মিশিয়া একাকার হইয়া একে একে সংগমের সাধ গ্রহন বড়ই নেশা। মাধুরী আর আকাশ আজ সেই নেশায় মগ্ন।
অবশেষে, ঘর্মাক্ত শড়ির দিয়া দুইটি মানুষ নিস্তব্ধ হইয়া একে অপরের উপর এমনভাবে শাত্নত হইয়া রইল যেনো তাহারা বুঝিতে পারে নাই, এই একটি ঘন্তায় বাহিরের প্রিথিবীতে কি কি ঘটিয়া গিয়াছে।
মাধুরী, আকাশ তোমাকে সব কিছুর বিনিময়ে স্নেহ করে, আদর করে, ভালবাসে। কে তোমাকে কিভাবে এই প্রিথিবীতে আনিয়াছিলো সেই প্রশ্নে কোন কৈফিয়ত নাই, নাই কোনো জিজ্ঞাসা। আকাশ শুধু এইতুকুই জানিতে চাহিয়াছিল, মাধুরী আকাশের। এই আকাশে কোনো ধর্ম নাই, কোনো বর্ন নাই, কনো জাত নাই, নাই কোন প্রকারের অভিযোগ কিংবা হতাশা। যদি কোনোদিন এই মাধুরী অন্য কোথাও হারিয়ে যায়, কিংবা আর মাধুরীকে কথাও খুজিয়া পাওয়া না যায়, তখন আকাশ এই রকমের দূর্যোগ মোকাবেলা করিয়াও মাধুরীকে খজুইয়া বাহির করিবে, কারন মাধুরীর জন্ম শুধু আকাশের জন্যই। মাধুরীর পরিচয় শুধু আকাশ। যাহারা তোমাকে এই আকাসের ধরনিতলে বর করিয়াছে, তাহারা শুধু এই টুকুর ধন্যবাদ প্রাপ্য যে, তাহারা এতোদিন আকাশের মাধুরীকে নিঃশ্বাস টুকু নিতে সাহায্য করিয়াছে। আকাশ তাকাহে জীবন দান করিয়া আবার নিজের করিয়াই গড়িয়া তুলিয়াছে। আর বাকি জীবনের সব টুকু আদর আর ভালবাসা দিয়া মাধুরীকে এই সমাজে এমন এক স্তরে তুলিয়া লইবে যেখানে মাধুরীর কাছে গগন বড্ড নীচু।
তুমি ভালো থাক মাধুরী।
২৬/১২/২০১৯- লিসা ফিরে গেছে
Categories
আজ থেকে সেই কয়েক বছর আগের কথাই বারবার আমার মনে পড়ছে। যা বুঝতেও পারি নাই, আমাকে বুঝতেও দেয় নাই। আমি বহুবার ভেবে দেখার চেষ্টা করেছিলাম, কেনো শেষ পর্যন্ত ওর সাথে সম্পর্কটা রইলোই না। খুব জোরালো কোনো যুক্তি খুজে পাই নাই বটে কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার হচ্ছিলো। আর সেটা হচ্ছে নির্ভরতা। একজন বিদেশী, যা ছিল তার, তা হয়ত অনেক না, আবার আশেপাশের যারাই ওকে একটু ভরষা দিতে পারতো, তারাও তার গোত্রের মত কেউ না। একটা শুন্যতা, একটা শংকা, একটা ঘেন্না বোধ কাজ করেছিল ওর চাহিদার আর পাওয়ার মধ্যে। মানুষ তার নিজস্ব পথে তার হিসাব নিকাষ করে। হয়তবা সে চেক এন্ড ব্যালেন্স করে একটা হিসাবের খতিয়্যান বের করেছিল যে, জিবনে ভালভাবে বেচে থাকার জন্য শুধু ধর্ম, সংসার আর বর্তমান নিয়ে চলে না। নীতি আর পলিসি দিয়েও চলে না। তার জন্য দরকার একটা নিশ্চিত ভবিস্যতের গ্যারান্টি। এটা যেই দিক তাতে কিছু যায় আসেনা। এটা আমার জানা ছিলো না। কিন্তু কথা তো সত্য।
ক্ষুধা পেটে ভালো মানুষের সাথে ভালোবেসে রাস্তায় রাস্তায় বহুদুর যাওয়া যায় না। আবার নিজের যোগ্যতার চেয়ে শুধুমাত্র সংসার বা বন্ধনের নামে একজন অযোগ্য ব্যক্তির হাত ধরেও অনেক দূর যাওয়া যায় না। কারন সেখানে থাকে যোগ্যতা আর অযোগ্যতার প্রকান্ড এক বিভেদের দেয়াল যা যেমন যোগ্য ব্যক্তিও টপকাইতে পারেনা আবার অযোগ্য ব্যক্তিও ব্যালেন্স করতে পারে না। কিন্তু ভরপেটে আরামদায়ক এসি গাড়িতে হাই স্পীডে প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে দেখতে কোনো এক অসম অসুন্দর বিত্তবানের সাথেও জীবন আনন্দময় হয়ে উঠে। সেটা হোক না যে কোন বিনিময়ের মাধ্যম। যা একজন এম্নিতেই ছিনিয়ে নেবে বিনা পয়সায়, তাই যদি কেউ ছিনিয়ে নয় আপোষেই নিয়ে এক আয়েসীর জীবন দেয়, তো ক্ষতি কি? ঈশ্বরের সাথে বুঝাপরা ভিন্ন। ওগুলি আজকাল আর কেউ আমলে নেয় না। আর আমলে নেবার জন্য কেউ বসেও নাই। যদি তাইই হতো, তাহলে পৃথিবীতে এতো সুন্দর সুন্দর রমনীরা দেহবৃত্তি করতো না। এতো এতো শিক্ষিত জনপদ এইসব সুন্দুরী মেয়েদের তাদের জীবন সাথী পাবার জন্য অনেক বেগ পেতে হয় না, কিন্তু তারপরেও তারা সুন্দর নর বা ভালো নরকে নয়, তারা চায় সুন্দর জীবনের প্রতিশ্রুতি।
লিসা ফিরে গেছে সম্ভবত তার সেই ভাবনা থেকেই। সে ফিরে গেছে তার সেই পুরানো জায়গায় যেখানে ওর জন্য প্রস্তুত রয়েছে অফুরন্ত আয়েশের উৎস, রয়েছে নিরাপত্তার গ্যারান্টি, আর তার সাথে আছে নিজ দেশের মাটির সাথে বন্ধন। জীবন একটাই। তাকে আনন্দময় করে কাটানোর অধিকার সবার আছে।
ঘৃণা কার নাই? সংসার জিবনে কি ঘ্রিন্না নাই? দম্পতিদের জীবনে কি ঘৃণা নাই? আছে। তারপরেও সবাই যার যার মতো করে ঘৃণাটুকু বাদ দিয়েই যেটা দরকার সেটা নিয়েই আনন্দে বাচে। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই মানুষ তার গতিপথ বদলাতে পারে। আর এই গতিপথ বদলানোর জন্য যে ক্ষমতা দরকার, আগে সেটাই খুব দরকার যার নাম- যোগ্যতা আর অর্থের প্ল্যাটফর্ম। লিসাকে কোনোভাবেই এখন আর দোষ দেইনা। কি দিতে পারতাম? পারতাম কি তাকে ওই সেন্ট লুইসের একটা সুইটে নিয়ে গিয়ে জাপানিজ এক্সপার্টদের সাথে বসিয়ে এক কাপ চা খাওয়াতে? কিংবা পারতাম কি লিসাকে ওই দুবাইয়ের বুরুজ রেস্টুরেন্টে একদিনের জন্য বেড়াতে নিতে যার ব্যয় ৫ বছরের এক্ত্রিত সঞ্চয় এর সমান? লিসা ঠিক বুঝেছিলো যে, স্বামী, সংসার, আর নিঘাত একটা দৃশ্যমান ভালোবাসায় আর যাই হোক, জীবনের সব চাওয়া পাওয়ার সাধ মিটে না। হিসাব তার পরিস্কার। আর সেই হিসাবে লিসা তার দিক থেকে ঠিক কাজটাই করেছে। আগে ভুল হয়েছিল, বা সরি হয়েছি এইটুকুর ওজন অনেক। যে সময় মত এর আবেদন করতে পারে, সেইই আবার জিতে যায় পরাজিত জীবনের কাছে। তখন আবার নতুন করে জীবনের খাতা শুরু হয় সেই পুরানো ধাচেই আর তখন আবার সপ্নের সব অট্টালিকা থেকে দেখতে পাওয়া যায় ওই দূরের আকাশের রাতের ঝিকিমিকি তারা গুলি, যেখানে মাঝখানে ঝরের মতো হারিয়ে যাওয়া কিছু সময়ের মুল্য আর চোখেই পড়ে না।
লিসা ফিরে গেছে এটাই বাস্তবতা।
২৩/১২/২০১৯-অপেক্ষার প্রহর লম্বা
কিছু কিছু অপেক্ষার প্রহর অনেক লম্বা। এই প্রহরগুলি কাটতে চায় না। মন উতালা করে, মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। আবার এই মনই নিজেকে শান্তনা দেয়। অদ্ভুত না এই "মন" বিষয়ক ব্য্যাপারটা?? কখনো কখনো হাজার বছর এক সাথে থেকেও কেউ কেউ আপন হয় না। আবার কেউ কেউ ক্ষনিকের মধ্যেই কেনো যেনো মনে হয়, আরে এই তো সে, কই ছিলো? কিন্তু এটাও হয়তো সত্য নয়। আবার সত্যও হতে পারে। মানুষের বাচার জন্য চাই একজন সুরক্ষাকারী বটবৃক্ষ। আর দরকার সেই বটবৃক্ষের তলায় হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকার মতো কেউ একজন।
অনেক সাধ আমাদের জীবনে, কিন্তু সাধ্য না থাকায় মাঝে মাঝে মনে হয়, এমন কি কেউ নাই যে আমাকে একটা পথ বাতলে দেয় যে, এখানে এইটা করো, তবেই না পাবে তুমি তোমার মনের ইচ্ছা পুরনের চাবিটা!! শুধু খেয়ে পড়ে বেচে থাকার নামই জীবন না। এর বাইরেও কিছু থাকে। নতুন নতুন জায়গায় অনুসন্ধান করে জীবন শুধু পিছিয়্যেই পড়ে, সামনে যেনো আগাইতেই চায় না। জীবনে সম্ভবত স্থিতি আসা খুব জরুরী। হোক সেটা কোনো এক মান্দাতার আমলের আদলেই। তাই হয়তো পরান জায়গাতেই আসল সুখের সন্ধান রয়েই যায় যা প্রথম চোখে পড়ে নাই। সব সময় পরিস্কার আকাশই মানুষকে উদ্বেলিত করে না, কোনো কোনো সময় মেঘলা আকাশও মানুষকে উদ্বেলিত করে। কিন্তু আমি সবসময়ই ঝড়ো আকাশকে ভয় পাই। ভয় পাই এই কারনে যে, থাক......
০৩/০৬/২০১৬-আকাশের চিঠি
Categories
প্রিয় মাধুরী
শরতের শিশিরাপ্লুত বৃন্তচ্যুত কোন শেফালীর গল্প তোমার জানা আছে মাধুরী? ঐ ফুল দেবতার পূজার কোন কাজে লাগে না, কাজে লাগে না কোন বাসরঘরের ফুলশয্যার শোভাবর্ধনেও। অথচ ঐ শেফালি ফুলেরও এককালে অনেক কদর ছিল, তার গন্ধ ছিল, ছিল একটা সম্ভাবনাময়য় প্রস্ফুটিত আগামিদিন। রবিঠাকুর বেঁচে থাকলে অকালে বৃন্তচ্যুত এই শেফালী ফুলের অসময়ের পতনের উপর হয়ত একটা বিখ্যাত কবিতা বা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারতেন অথবা এই পরিত্যক্ত ফুলের একটা যৌবনময় ছোটগল্পও লিখে ফেলতে পারতেন কিন্তু আমি তো আর রবিঠাকুর নই যে, আমি নিজের আবেগ দিয়ে পার্বতী নদির মত বেগবান কোন এক স্রোতধারার মত হর্ষবোধক, লোমহর্ষক অথবা উচ্ছ্বাসময় কাব্য লিখে ফেলব। জীবনের সঙ্গে গল্পের এই এক জায়গায় বিস্তর ব্যবধান। লেখকগন চুপি চুপি তার অক্ষরসমৃদ্ধ লেখনীতে যত না আবেগ আর কষ্ট দিয়ে ভালবাসার কাহিনী রচনা করেন, বাস্তবে ঐ চরিত্রগুলুর আবেগ, কষ্ট আর ভালবাসা তারথেকেও অনেক বেশি গভীরের এবং মর্মস্পর্শী। লেখনীর কলমের অমোচনীয় কালীর অবগাহনে চরিত্রগুলুর কষ্টের চোখের অশ্রু হয়ত শুস্ক পাতার গল্পের লাইন ভেদ করে গড়িয়ে পরে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না কিন্তু বাস্তবে ঐ চোখের পাতা যথার্থই অস্বাভাবিকভাবেই দৃষ্টিগোচরীভূত হয়। কারো চোখে এরা ধরা পরে আবার শতব্যস্ত পারিপার্শ্বিক অসামঞ্জ্যস্যতায় তা আবার কারো কারো চোখ এড়িয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। এদের পরিসংখ্যান নিতান্তই কম নয়।
তুমি মেয়ে হয়ে জন্মেছ বলে তোমার অন্দর মহল আর আমার অন্দর মহলের গল্প এক নয়। কিন্তু তোমার জন্য আমার অন্দর মহিল যেমন অরক্ষিত ছিল না তেমনি আমার জন্য তোমার অন্দর মহলে প্রবেশের সুযোগও তেমন রক্ষিত ছিল বলে আমি মনে করি না। তার মধ্যে তুমি ছিলে আমার ধর্মীয় অনুশাসনের দিক থেকে আলাদা আরেক মানবী।
হ্যা, আমার স্পষ্ট মনে পরে ঐ দিনের কথা, ২৯ শে বৈশাখ। তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হইয়াছিল। তুমি বিদেশ পাড়ি দেবার কোন এক অজানা সুখানুভূতিতেই হোক অথবা নির্মলা শান্তির খোঁজেই হোক, বেনি দুলাইয়া, চোখের পাতা অশ্রুসিক্ত করিয়া কোন প্রকার ঘটা না করিয়া আমাদের উঠানের সুবিস্তৃত শ্যাম চিত্রপটটি দিনের আলোকউজ্জ্বল স্পর্শে তোমার বিদায় ঘন্টায় ধূসর শ্যামল পাণ্ডুবর্ণ করিয়া একটি ক্ষুদ্র জীবন নাট্যের ইতি টানিয়া সবাইকে ফাকি দিয়া কোন এক নাম না জানা ঠিকানায় হারিয়ে গেলে। আমি জানি না আমার কি অপরাধ ছিল অথবা আমার কি করিলে কি হইতে পারিত। তোমার চলিয়া যাইবার পর আমি অনেক কিছুই বুঝিতে পারিলাম বটে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও বুঝিলাম যে, আমার স্বর্গীয় মা তার ছেলের সুখের খোঁজে আমাদেরই ঐ পাকা ঘরের তক্তপোষে বসিয়া কোন এক অজানা কুমারী সুন্দুরির মুখখানা মনে ছাপিয়া কোন কোন অলঙ্কার পরিলে তাকে পরিদের মত দেখাইবে বা কোন রঙের শারি পরিলে তাকে গ্রামের আর দশটি গৃহবধু থেকে অতুলনীয় দেখা যাইবে তার হিসাব নিকাস করিতে ব্যস্ত। অথচ তিনি একবারের জন্যও বুঝিতে চাইলেন না, এইমাত্র বৃষ্টিশেষে ক্ষান্তবর্ষণ প্রাতকালের ম্লান রৌদ্র আর খন্ড মেঘের আড়াল করিয়া যে মানুষটি চিরতরে হারিয়ে গেল তার কাছ থেকে আরও নতুন কোন সুখের সন্ধান পাওয়া যাইত কিনা। সুখ বড় রহস্য ঘেরা সোনার হরিন, যিনি পান তিনি জানেন না কেমন করে পাইলেন আর যিনি পান নাই, তিনি জানেন না কোথায় এর প্রাপ্তিস্থান। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হল, হরিনেরা কখনো কোন সোনারখনির সন্ধান দিতে পারিয়াছিল কিনা আমি জানি না, তবে এই সোনার হরিনের সঙ্গে বাস্তবের নিরিহ এই প্রানিকুল হরিনের কোন মিল নেই। এরা নিজেরাও কোন বংশের সঙ্গে যুক্ত নয়।
মানুষ যখন প্রতিশোধ নিতে না পারে, তখন সেই প্রতিশোধ অপমান আকারে এমন বৃহৎ আকারে আবির্ভূত হয় যে, হয় সে নিজের কাছে নিজেই দুরূহ হইয়া পরে অথবা জরাজীর্ণ ইষ্টক প্রাচীরের মত শত খন্ডে বিধ্বস্ত হইয়া নেহাত মাটির ঘরের মত অব্যবহারযোগ্য হইয়া পরে। আমি তোমার বেলায় এর কোনটাই দেখি নাই। শুধু মনে হইয়াছে, হয়ত বা আমার আর যাই থাকুক না কেন, তোমাকে ঠেকাইবার মত শক্তি বা ক্ষমতা অন্তত ঐ সময়ে আমার ছিল। সেটা আমি করিতে পাড়ি নাই। কারন আমি অন্ধ ছিলাম। রবি ঠাকুরের কথাই ঠিক, অন্ধের কাছে অভিমানের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা অতিব দুরূহ।
সবেমাত্র এমন একটা কঠিন অসুস্থতা হইতে পরিত্রান পাওয়া আমার মা হটাত করে নিজকে অতিশয় সুস্থ এবং সবল মনে করিয়া যারপর নাই অনেকগুলু গুরুতর কাজের ভার নিয়া সামলাইতে না পারিয়া পরদিন আবারো অসুস্থ হইয়া পুনরায় আগের ক্যাবিনেই ভর্তি হইয়া গেলেন। এ যাত্রায় আমি কোন মুখে যে তোমাকে আনিতে যাইব, সে ভরসা আর সাহস আমার এই ক্ষুদ্র হৃদয় শক্তি সঞ্চার করিতে পারে নাই। অগত্যা বাড়ির কাজের বুয়া আর গ্রামের দুঃসম্পর্কের নানির উপরই ভরসা করতে হইল। কিন্তু এবার যমদূত আমার স্বর্গীয় মাকে সঙ্গে না নিয়া একা যাইতে চাননি, ফলে একটানা এক মাসের অধিক সময় বাড়ির সবাইকে সময় অসময় অধিক পরিমান নিপীড়ন করিয়া, গ্রাম শুদ্ধ হইচৈ করাইয়া, সমস্ত ডাক্তারি বিদ্যা মিথ্যা প্রমান করিয়া পৃথিবীর সব সুখ, আলো বাতাস, বাড়ির প্রকান্ড মায়া মহব্বত ছিন্ন করিয়া আমার মা স্বর্গীয় দেবতার কাছে এক নিশ্বাসে হাজির হইয়া গেলেন আর আমাদের সবাইকে চোখের জলে ভাসাইয়া পুরু বাড়িটাকে একটা অরক্ষিত জলাধারে রূপান্তরিত করিয়া নিরব করিয়া দিলেন। আমার আর সুখের ঘর করা হইল না। স্বপ্নের মাধুরী স্বপ্নেই রইয়া গেল, তার আর আমাদের চৌকাঠ পার হইয়া আমাদের সংসারে আসা হয় নাই। তখন মনে হইল আমার যে কয়জন অতি প্রিয়জন ছিল, যারা আমাকে কারনে অকারনে জবাবদিহিতা করিত, যাদের অতিশয় আপ্যায়নে আমার মাঝে মাঝে নিজেকে খুব বিরক্ত মনে হইত, তাদের কেউ আজ আর আমার আশেপাশে রইল না, সেটা আজ নিঃশেষ হইয়া শুন্যে পরিনত হইল। একবার মনে হইয়াছিল যে, তোমার ইউনিভার্সিটিতে গিয়া তোমার খোঁজ করিলেই আমি তোমার ঠিকানাটা পাইব, কিন্তু পরে আবার কি মনে করিয়া আর খোঁজ নেয়া হইল না। আর এই খোঁজ না নিতে নিতেই তো প্রায় ত্রিশ বছর পার হইয়া গেল। আজ এই পঞ্চাশ বছর পর হটাত করিয়া তোমার কথা বারবারই মনে পরিতে লাগিল। তুমি কি আশেপাশে কোথাও আছ? আর থাকিলে কিভাবে আছ? নিশ্চয় এখন তোমার জীব পরিবেশে অনেক শেফালির আরাধনা হয়, নিশ্চয় এখন আর তোমার সেই চিরাচিত কোলাহল নাই, কোমল কোমল শিশুদের আনন্দে তোমার চারিপাশ ভরপুর। আজ আমার অনেক কথা মনে পড়ে। থাক সে কথা। কখনো যদি আবার তোমার সন্ধান পাই, না হয় আবারো আমার এই হারানো বা ক্ষয়ে যাওয়া ত্রিশ বছরের না বলা কাহিনীগুলু তোমাকে বলব। তবে, তোমার ভাল লাগা রবিঠাকুরের সেই “মেঘ ও রৌদ্রের” কিছু কথা লিখে আমার আজকের এই ডায়েরিটা শেষ করবঃ
“………………আকাশে মেঘ রৌদ্রের খেলা যেমন সামান্য, ধরাপ্রান্তে এই দুটি প্রাণীর খেলাও তেমনি সামান্য, তেমনি ক্ষণস্থায়ী। আবার আকাশে মেঘ রৌদ্রের খেলা যেমন সামান্য নহে এবং খেলা নহে, কিন্তু খেলার মত দেখিতে মাত্র। তেমনি এই দুই অখ্যাত্নামা মনুস্যের একটি কর্মহীন বর্ষা দিনের ক্ষুদ্র ইতিহাস সংসারের শত শত ঘটনার মধ্যে তুচ্ছ বলিয়া প্রতিয়মান হইতে পারে কিন্তু ইহা তুচ্ছ নহে………………”
(চলবে……)
০২/০৬/২০১৬ – মাধুরীর চিঠি
Categories
তোমাকে কি নামে যে সম্বোধন করি তাই বুঝে উঠতে পারছি না এখন। কি লিখব তোমায়? প্রিয় বন্ধু নাকি শুধু প্রিয়? অথবা শুধু তোমার নাম অথবা কিছুই না !! তোমাকে আমি যেই নামেই ডাকি না কেন, তুমি আমার একান্ত প্রিয়জন। কে জানি বলেছিল, বন্ধুর নাম ভুলে গেলেও সমস্যা নেই, কিন্তু শত্রুর নাম ভুলে যাওয়া যাবে না। তোমার বেলায় আমার এই নীতিটা হয়ত সঠিক নয়। আমি তোমার নাম ভুলে গেলে আমার আর কোন কিছুই হয়ত অবশিষ্ট থাকবে না। যাক, তোমাকে আমি কোন সম্বোধন ছাড়াই চিঠিটি লিখছি।
অনেকদিন ভেবেছিলাম তোমার সাথে আমি আর কখনো যোগাযোগ করব না। আর যোগাযোগ করে কিইবা হবে বল? তোমার হয়ত এখন সংসার হয়েছে, বাচ্চাকাচ্চা আছে, অনেক উচু স্তরের মানুষদের মধ্যে এখন তুমি একজন। জানি তুমি ভালই আছ।
তোমার এই শরতবেলার বেলাভুমির প্রাতভ্রমনে আমি হটাত করে সেই পুরানো দিনের কোন এক বর্ষার কাকভেজা বৃষ্টির সন্ধ্যাকালীন শ্বাসরুদ্ধকর রোমাঞ্চের কথা নিয়ে যদি আমি হাজির হই, কিইবা লাভ হবে, তুমিই বল? মাঝখানে হয়ত যেটুকু তুমি আমাকে করুনা করে হলেও মনে রেখেছ, তাও হয়ত আমার ভাগ্যে আর থাকবে না, অকারনে সেটাও হয়ত হারাতে পারি। অনেক কিছু হারিয়ে যদিও এখন হারাবার ভয় আমি করি না কিন্তু স্মৃতির পাতা ধরে স্থান কাল সময় গুনে গুনে যে কয়টা জিনিস আমি এখনো হারাতে চাইনি তার মধ্যে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় একটা। ভেবনা আমি আজ তোমাকে এই পত্র দিয়ে আবার নতুন করে কোন এক সম্ভাবনাময়কে জাগিয়ে তুলছি। অন্তত আমি তাঁর কোন সম্ভাবনা দেখছি না।
আমি জানি পাহারের নিচে দাড়িয়ে যত জোরেই কেউ তাঁর কথা বলুক না কেন, সেই একই সুর, একই শব্দ, সেই একই বানী পাহারের চারিদিকে বাতাসে বাতাসে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে আবারও নিজের কাছেই তা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। অবুঝেরা এটাকে বিধাতার উত্তর হিসাবে ধরে নেয়, আর যারা অবুঝ নয়, তারা জানে প্রকৃতির অবজ্ঞা করে এইসব কিছু ফিরিয়ে দেওয়া কত বড় নির্মম সত্য। এটা কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই বা করুক, অন্তত আজ এতটা বছর পর নতুন করে হিসাব করার প্রয়োজন বলে মনে করছি না। আর যখন ঐ নিষ্ফল প্রতিদ্ধনির আওয়াজ ফিরে আসে, তখন যেন তা আরও শতগুনে কঠিন এবং করুন করে কানে বাজে।
কেউ কারো কোন কথা রাখে না, মনে হয় কেউ কারো জন্য কখন অপেক্ষাও করে না। এর মানে আমি তোমাকে এই বলে যুক্তিও দেখাচ্ছি না যে, আমি কি বলতে চেয়েছিলাম, আর আমি তাঁর প্রতিধ্বনিতে কি পেয়েছি। সময় এমন এক জিনিস, সে সবার সঙ্গে আছে, সবার সঙ্গে থাকে অথচ সে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করে না। কেউ তাঁর সঙ্গে থাকুক আর নাই বা থাকুক, সে তাঁর নিজ গতিতে নিজ আবেশে তাঁর ঠিক গন্তব্যে সবাইকে ছেড়ে একা একাই চলতে থাকে। কোথাও তাঁর বিন্দুমাত্র অলসতা হয় না, কোথাও তাঁর কোন গড়মিল হয় না। পৃথিবীর সব চাইতে সস্তা যেমন সময়, তেমনি সবচেয়ে দামিও বটে। ইচ্ছে করলেই একে হেলাফেলা করে যেখানে সেখানে খরচ করা যায় আবার ইচ্ছে করলেই আবার এক আনা দুই আনা দিয়ে কেনাও যায় না। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা সময়, আর সেই সময়ের চাওয়া-পাওয়ার সাথে হিসাব নিকাশের দেনা পাওনাটাও এই খরচের বিচার্য বুদ্ধিচনায় পরে। চৈত্রের গরমের জন্য কেউ হেমন্তের দুপুরকে দায়ি করে না, কিংবা বর্ষার একটানা বৃষ্টির জন্য কেউ শীতের কনকনে সকালকেও দায়ি করে না। আমিও এখন না সময়, না পরিস্থিতি কিংবা না আইন বা ধর্মকে দায়ী করি।
এই চিঠি পরে তোমার হয়ত মনে প্রশ্ন আসতে পারে আমি কেন তাহলে আমার সেই পূর্বেকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তোমাকে আবার আজকে লিখতে বসলাম। আমার আসলে আর কোথাও কেউ নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই, যেটুকু আছে তা শুধু তুমি। এত বিশাল পৃথিবীর মাঝে কত মানুষ যে কতভাবে অসহায়, আমি নিজেকে দেখে তা বুঝতে পেরেছি।
প্রথম যেদিন আমি তোমাকে দেখেছিলাম, মনে পরে তোমার সেই দিনের কথা? আমি জানি না আমাকে দেখে তোমার কি মনে হয়েছিল, কিন্তু আমার কাছে সমুদ্রের গভীরতার চেয়ে তোমার চোখের ভাষা আরও বেশি দুর্গম মনে হয়েছিলো, অথচ আমার কেবলই মনে হয়েছে ঐ আখির ভাষা আমার পরিচিত, তোমার মুখের ভাষা আমার পরিচিত। যদিও তোমার কোমল কঠিন দেহখানি আমার কাছে পাহাড়ের শিলাভুমির প্রস্তরখন্ড থেকেও কঠিন মনে হয়েছিল কিন্তু তাঁরপরেও আমার কেবলই মনে হয়েছে কোথায় যেন আমি তোমাকে দেখেছি।
আমি আর পাঁচটি মেয়ের মত নই, সেটা তুমিও জান, আমিও জানি। নীল আকাশের ছায়াপরা কোন এক চকচকে পুকুরের মাঝখানে নীলপদ্ম দেখলেই আমি সবার মত উল্লসিত হয়ে চারিদিক চমকিয়ে দেই না হয়ত কিন্তু আমার ভিতরে যে কোন সাড়াশব্দ হয় না তা নয়। আমার অনেক রাত কেটেছে কোন কিছু ভাবা ছাড়াই, আমার অনেক দিন হয়ত নাওয়াও হয় নাই শুধুমাত্র এই ভেবে, কে তুমি? যেদিন বুঝেছি তুমি কে, সেদিন উপলব্ধি করেছি, আমি স্রোতের বিপরিতে নৌকার গুন টানছি, বুঝতে পেরেছি আমি উল্টো পথে রথে উঠেছি। তারপরেও আমি রয়ে গেছি, আর রয়ে গেছি তোমাকে পাবার জন্য নয়, তুমি আমার কাছাকাছি আছ, এই ভরসায়। এটাই বা কম কিসের? এতসব অপরিচিত মানুষদের মাঝে অন্তত আমি তো একজনকে হলেও চিনি, তোমাকে চিনি, তুমি আছ। তুমি কি কখনো জানতে পেরেছ যে, পৃথিবীর সমস্ত মানবকুলের মধ্যে আমি তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেতাম, এর মানে এই নয় যে তুমি ভয়ংকর। আমার ভয়ের কারন একটাই। তোমার নির্লিপ্ততা। তোমার কোন কষ্টের কারন যেন আমি কখনো না হই সেই ভয়ে আমি সর্বদা ভীত থেকেছি। অথচ আজ আমার ভিতরে কোন প্রকার ভয় নেই, কারন তুমি আমার পাশে কোথাও নেই। আর কোথায় আছ তাও আমি সঠিকভাবে আন্দাজ করতে পারি না। জীবনের এই সায়াহ্নে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তোমাকে। মনে হয়েছে যদি একদিন বা কোথাও একবার আবার তোমার চোখে চোখ রেখে বলতে পারতাম, আমি হারিয়ে যাইনি, অথবা আমি হারিয়ে যেতে চাইনি, আমার কুড়েঘরের সদর দরজার মেঠোপথ তোমার জন্য সবসময় খোলা ছিল এবং এখনো আছে। যদি কখনো দৈবাৎক্রমে আমার এই আশ্রুজলে শিক্ত লেখাটা তোমার হাতে পরে আর যদি তখনো আমার এই দেহে টিমটিম করে হলেও একটু প্রানশক্তি থাকে, তবে জেনে রেখ, আমি তোমাকে হয়ত বলতে চেয়েছি, তুমি এসো আর একবার যদি কখনো তোমার ভিতরটায় শুন্যতায় ভরে গিয়ে হাপিয়ে উঠো। এসে একবার আমার চোখের জলের সাথে তোমার সেই বেদনাবিধুর চোখের অসমাপ্ত কান্নাগুলো দিয়ে বলো, তুমি ভাল আছো। আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমার সেই ক্লান্ত আঁখির শিশিরের টিপটিপ করা ব্যাথাকনাগুলো বয়ে নিয়ে আখি বন্ধ করে দেব। তুমি এক ফোটা জলও দেখতে পাবে না।
আজ এই অবেলায় তোমাকে কত কথা লিখতে ইচ্ছে করছে যেন।
মনে পরে তোমার সেই কাকডাকা ভোরে একবার আমি আর তুমি হারিয়ে গিয়েছিলাম সেই শাওতালদের গ্রামে? ট্রেন আটকা পড়েছে কোন এক বনের ধারে। ট্রেন আবার কখন চলা শুরু করবে কেউ বলতে পারছে না। একেক জনের কাছ থেকে একেক ধরনের খবর পাচ্ছি ট্রেন নষ্ট হবার কারন জানতে গিয়ে। আসলে কেউ বলতে পারছিল না কি কারনে ট্রেন এই মাঝপথে হটাত করে এতগুলো যাত্রি নিয়ে অজানা সময়ের জন্য বিশ্রামে গেল। অনেক যাত্রি ট্রেন থেকে নেমে এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করছে। আমরাও এক সময় সবার দেখাদেখি ট্রেন থেকে নেমে ঘুরতে বেরিয়ে গেলাম। গল্প আর গল্পে কখন যে কোন রাস্তায় হাঁটছিলাম, আমরাও তাঁর রেখাপথ মনে রাখিনি।
শেষমেশ এক শাওতালদের গ্রামে গিয়ে হাজির হয়ে গেলাম। কি অদ্ভুদ এক সমাজ। সবাই সবার আপনজন। সবাই যেন সবার জন্য। সবাই যেন এক পরিবার। গ্রামটা ঘুরতে ঘুরতে কোথাও এক কাপ চা খাওয়ার জন্য একটা দোকান পর্যন্ত পেলাম না। আসলে সাওতালদের কোন পৃথক দোকান নেই ঐ গ্রামে। গ্রামের সরু পথ দিয়ে আমরা দুজনে হাঁটছি, সব ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঘর দুয়ার, এলোপাথারিভাবে সাজানো বাড়িঘর। গরু ছাগলগুলোও যেন স্বাধীন। কোনটাই খোয়ারে বাঁধা নেই। কুকুর, গরু ছাগল, হাস মুরগি মানুষ সব স্বাধীন। গাছগাছালি ভর্তি পুরু গ্রামটা। কোথাও কাদা পেরিয়ে এই বাড়ি থেকে ঐ বাড়ি যেতে হয়। পানির মটকাগুলো একদম উদোম। কয়েকটা পাখী বসে আছে মটকাগুলোর উপর। পাখীগুলোও জানে এখানে কোন সমস্যা নাই। ওরা বরং আমাদের দেখে একটু শঙ্কিত হয়ে এদিক সেদিক উড়াল দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে মোরগগুলো উচ্চ স্বরে অন্যদেরকে জানান দিচ্ছিল এখানে আগন্তক এসেছে, যেনো মোটিভ বুঝা যাচ্ছে না বোধহয়। কয়েকটা বাচ্চাওয়ালা মুরগি তরিঘরি করে বাশঝাড়ে লুকিয়ে গেল। আমরা এদের কারো কাছে পরিচিত নই। প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু তাঁদের স্বকীয়তায় ব্যতিক্রম পছন্দ করে না। বড় ভাল লাগছিল ব্যাপারটা উপভোগ করতে। কতক্ষন কেটে গিয়েছিল আমরা বুঝতেই পারিনি, হটাত অল্প দূর অপেক্ষামান ট্রেনের সচল হবার সংকেত দিয়ে আমাদের চারিদিকে ছরিয়ে থাকা যাত্রিদেরকে মনে করিয়ে দিল আমরা ট্রেনে ছিলাম এবং এখন আবার সেখানে যেতে হবে। তা না হলে ঐ যে বললাম, সময়ের সাথে সাথে এবার ট্রেন হাত জুটি বেধে পুনরায় তাঁর সেই গন্তব্যের দিকে ছুটে যাবে। যারা তাঁর সাথে নেই, তারা থেকে যাবে যেখানে সে আছে সেখানেই।
ফিরতে গিয়ে আমরা বুঝলাম, আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। কোন রাস্তায় এই শাওতাল গ্রামে ঢোকেছিলাম, এখন আর সেই আগের রাস্তাটা পরিচিত মনে হচ্ছেনা, মনে হচ্ছে ভুল পথে ট্রেনের দিকে যাচ্ছি, আদৌ ট্রেনের দিকে যাচ্চি কিনা তাও বুঝতে পারছি না। ট্রেনের হুইসেলটা মনে হচ্ছে আরও দূর থেকে কানে আসছে। দ্রুত হাটতে হবে, তা নাহলে নির্ঘাত ট্রেন মিস করব। আর ট্রেন মিস করলে এর পরের অধ্যায়টা আমার অন্তত জানা নাই। তুমি দ্রুত হাঁটছ, আমি তোমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অত দ্রুতও হাটতে পারছি না। রাস্তাটা আমার কাছে অমসৃণ গিরিপথের মত মনে হতে লাগলো। আমার সাড়া শরীর ঘামে যেন ভিজে আসছিল। চুলের ভিতর থেকে কেমন একটা গরম আভা বের হচ্ছিল। আমার কপাল দিয়ে শিশিরের ফোটার মত করে একটু একটু ঘাম বেরিয়ে চোখের জলের ফোটার মত আমার কানের পাশ দিয়ে বুকের ওড়নায় পড়ছিল। আমি যেন আর হাটতে পারছিলাম না। তুমি আমার হাত ধরলে।
এই প্রথম তুমি আমার হাত ধরলে। আমি তোমার হাতের অনুভুতিটা তখন কিছুই বুঝতে পারিনি, শুধু মনে হয়েছে, আমি যেন একটা অবলম্বন পেয়েছিলাম শক্ত করে ধরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। অনেক ক্লান্ত অবশ দেহ আর ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে কোন রকমে যখন আমরা ট্রেনের ধারে ফিরে এলাম, তখন ট্রেন প্রায় ছাড়ি ছাড়ি ভাব। ট্রেনের সিটে বসে অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে আমার ক্লান্ত শরিরের সমস্ত পরিশ্রম যখন বিশ্রামে নিমগ্ন, তখন বুঝলাম, একটু আগে তোমার হাতের যে পরশটা আমার শরিরের বাহুতে লেগেছিল, তা এখন আমার অনুভুতিতে আরেক স্বর্গীয় ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। আমার আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল, শাওতাল গ্রামের ঐ মানুষগুলোর সঙ্গে হারিয়ে গেলেই তো ভাল ছিল। প্রতিনিয়ত আমার মনে হচ্ছিল, ট্রেন চলছে, আমার মন চলছে না। বাইরে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষন। বহুদুরের ঐ গ্রামগুলো কতই না গতিতে আমার দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে নিমিষে। এখন আর সবুজ গ্রাম ভাল লাগছে না, নীল আকাশের খন্ড খন্ড মেঘগুলোও আর আমার কাছে কাব্যিক মনে হচ্ছে না। অথচ একটু আগে এর সবকিছুই ছিল আমার কাছে আমার অনন্তময়ি প্রেমের এক আবেদনের মত। ঐ যে বহু দূর অবধি দেখা যায় আকাশ যেখানে আকাশ আর মাটি দুজনে এক হয়ে গেছে, অথবা এই যে ট্রেনের দুই সমান্তরাল সারি যারা একে অপরের পাশে অনন্তকাল ধরে পাশাপাশি বয়ে যাচ্ছে অথচ কখনই তারা একে অপরের নয়, এমন একটা সম্পর্ক যার ঠিকানা কারো জানা নাই। হয়ত তুমি আর আমি ঠিক তাই। আমরা একই ট্রেনের যাত্রি অথচ গন্তব্য এক নয়, আমরা একই আকাশের নিচে চলছি কিন্তু আমার দিগন্ত আর তোমার ভেজা মেঘ এক নয়। মনটা ভারি হয়ে উঠেছিল সারাটা রাস্তা।
আজ কত কথা মনে পড়ছে আমার। তোমার কি মনে পরে আরও একদিনের কথা?
সেদিন ছিল বর্ষার প্রথম সপ্তাহ। চারিদিকের আকাশ মেঘে ভরা, গুরগুর মেঘের আওয়াজ। থেকে থেকে হাল্কা বৃষ্টি আবার ক্ষনেক্ষনে রোদ। হুমড়ি ধুমড়ি খেয়ে যেন তুমি উচ্ছল হরিন শাবকের মত মেঘলা সেই দুপুরে অস্থির চিত্তে ঘনঘন দরজার কড়া আর কলিং বেল টিপে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করলে যেনো, আর কয়েক সেকেন্ড দেরি করে দরজা খুললে না জানি কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, অথবা কোন এক রাজ্যের রামায়ন তাঁর অপ্রতিরোধ্য মেঘবদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। তোমার সাড়া শরীর ভেজা, চুলগুলো মনে হল কতকাল চিরুনি পরেনি, তারপরেও তোমাকে বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছিল। যতবার আমি তোমাকে দেখেছি, আমি ততবারই যেন কোন এক নতুন মানুষকে দেখেছি। সকালের তুমি বিকালের মত নও, বিকালের তুমি আর পরেরদিনের তুমি সম্পূর্ণ আলাদা এক মানুষ। কখনো তুমি হিমালয়ের মত স্থবির, আবার কখনো তুমি উস্রিংখল ডাহুকের মত জ্বালাময়ী, কখনো তোমাকে দেখেছি আমি এতটাই নির্লিপ্ত যেনো পানকুড়ির মাছধরার ধ্যানের মত স্থির। কখনো দেখেছি আমি অতিশয় ক্ষুদ্র বিষয়ে তুমি অতটাই উত্তেজিত অথচ অতিকায় হস্তিসমেত বিষয়ে তোমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ভগবান মানুষকে দিয়ে কি পরীক্ষা করান তা আমার জানা নাই তবে তোমার বেলায় ভগবান সর্বদা কৃপাশীল ছিলেন অনেকের চেয়ে বেশি। ভালবাসার হৃদয় ভগবান তোমাকে দিয়েছেন কিনা আমার জানা নাই, তবে তোমাকে ভালবাসবে এই এমন কিছু একটা ভগবান তোমার মধ্যে সে চিরস্থায়ী প্রথা হিসাবে নিশ্চয় দান করেছেন। তোমার ভেজা চুলেও যেমন মাদকতা আছে, চিরুনির আচরনে শুকনা চুলেও মাদকতা আছে। চঞ্চলতা যেমন মনকে উতালা করে দিতে পারে, তেমনি তোমার অবসন্ন দেহও মনকে ভেঙ্গে খান খান করে দিতে পারে। তোমাকে এই প্রথম আমি যেন আরেক তোমাকে আবিস্কার করলাম। তুমি অতিশয় অস্থির, তোমার কথাবার্তায় কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ভাব। অধিক কথা বলার যেন সময় নেই। কোথায় কি কারনে যেন তুমি আর তোমার মধ্যে নেই। অবশ্য ব্যাপারটা একটুপরেই বুঝতে আমার আর বাকি ছিলনা।তোমার মা অসুস্থ।
আমি তোমার একটা জিনিষ সেই প্রথম দিন থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। পৃথিবীর যাবতীয় উচ্ছ্বাস, সুখ, দুঃখ, আর আবেগ যদি হয় একদিকে, তোমার মার জন্য তোমার এই উচ্ছ্বাস, সুখ, দুঃখ, আবেগ অথবা যাই কিছু থাকুক না কেন, তিনি আরেকদিকে। তোমার মায়ের জন্য তুমি সত্যকে মিথ্যা, বা মিথ্যাকে সত্য অথবা ন্যায়কে অন্যায়, বা অন্যায়কে ন্যায়ের দিকে নিয়েও যদি মনে হয় তোমার মা তাতে খুশি, হয়তবা তুমি তাই করার জন্য শারীরিক এবং মানসিকভাবে সর্বদা, সর্বত্র সব কিছুর বিনিময়েও করতে তোমার কোন প্রকার দ্বিধা হবে না। এ এক ব্যাতিক্রমি চরিত্র আমি তোমার মধ্যে প্রকটভাবে দেখেছি। কোন কিছুর সঙ্গেই তাঁর কোন তুলনা তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আর আমার এখানেই সবচেয়ে বেশি ভয় হত যদি কখনো কোন কারনে আমি তোমার এই সবচেয়ে দুর্বলস্থানে একটু হলেও ছোঁয়ার কারনে আমার সমস্ত আরাধনা, আমার ভাললাগার ব্যাক্তিত্ত তোমার কাছে আমি এক নিমিসেই অপরিচিত হয়ে যাই। তোমার সেই মা অসুস্থ। তুমি ঠিক নাই বুঝতেই আমার মনের গভিরে এক চরম উৎকণ্ঠা বোধ হতে লাগলো। দুর্ঘটনা আভাস দিয়ে আসে বটে, কিন্তু সুভাগ্য কোন আগাম সংকেত দিয়ে আসে না। তোমার এই দুর্ভাগ্যে যেন আমার সু-ভাগ্য খুলে গেল। তোমার মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে থাকার মত নির্ভরশীল কোন মানুষ তুমি তোমার জগতের চারিপাশে খুজে পেলে না, প্রথম যার কথা মনে হয়েছিল তোমার, সে আমি। আমি ভাগ্যবতী। তুমি আমাকে কোন সময় না দিয়ে, কোন রকমে কোন প্রকার প্রস্তুতি হওয়ার সময় না দিয়ে এক প্রকার বিদ্যুৎ গতিতেই বের করে নিয়ে হাজির করলে সেই অসামান্য মানুষটির কাছে যার সমতুল্য এই পৃথিবীতে তুমি আর কাউকেই জানোনি।
তুমি চলে গেলে আমাকে রেখে। নিস্তব এক ক্যাবিন।
ডাক্তাররা আসছে ঘন ঘন, নার্স, আয়া, সবাই ব্যাস্ত এই ঘুমন্ত শিশুর মত মানুষটির যত্নে। আমি কে, কি তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তারা অনেকেই জিগ্যেস করলেও আমার বলতে কোন অসুবিধা হয় নাই, কারন তিনি আমার মায়ের মতই একজন মানুষ। আমি তাকে আমার মায়ের সঙ্গেই মিল রেখে পরিচয়টা দিয়েছিলাম যে, আমি তাঁর মেয়ের মতই। আমি এছাড়া আর কি বলতে পারতাম বলো? কি অদ্ভুত এক ব্যাপার। তোমার সাথে তোমার মায়ের কোথাও কোন গড়মিল নেই। সেই ঠোঁট, সেই নাক, সে মুখাবয়ব, চোখের ভ্রুটা পর্যন্ত একদম মিল। আমি বসে আছি তাঁর পাশে। প্রতিনিয়ত আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন তোমাকেই দেখছি। এত কাছ থেকে এত নিরিবিলিতে আমি কখনো তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকিনি। আজ যেন মনে হচ্ছিল আমার সেই না দেখা তোমাকে এত কাছে থেকে দেখছি। কখনো আমি তাঁর হাত দুটো ধরছি, কখনো তাঁর ভ্রুটা, আবার কখনো তাঁর কানের কাছে গিয়ে তাঁর মসৃণ চুলের গন্ধ শুকছিলাম। কখন কিভাবে কি মনে করে জানি না, দেখেছিলাম আমার দুচোখ বেয়ে কয়েক ফোটা জল আমার নিজের অজান্তেই এই ঘুমন্ত মানুষটির বুকের উপর পরেছিল। আমি কি কেদেছিলাম? কোন কিছু ভেবে কি আমার মনে কোন কস্টের উদ্রেক হয়েছিল? না, আমার তা মনে নেই। শুধু মনে হয়েছিল, একবার বুক ভরে যদি আমি এই মানুষটির বুকে পড়ে অনেক্ষন কাদতে পারতাম, হয়ত আমি আরও শান্ত হয়ে কিছুটা দিন কাটাতে পারতাম। আমার মায়ের অনেক স্মৃতি আমার মনে নেই। একজন মা একজন সন্তানের জন্য কি কি করে আমার তা জানা নাই। তবে আমি জানি একজন সন্তান তাঁর মায়ের অভাবে কি কি মিস করে। তোমার কথা মনে হলো। আমি আমার ঈশ্বরের কাছে প্রানভরে আরাধনা করলাম, হে ভগবান, তুমি যাকে ভাগ্যবান করে রেখেছ, তাকে আবার হতভাগা কেন করবে? কি নেই তোমার যে, সামান্য একজন মানুষের অনুপস্থিতি দিয়ে তোমার আরেক প্রিয় একজন আদমকে চোখের জলে ভাসাতে চাও? তোমার হিসাব-কিতাব, তোমার চাওয়া-পাওয়ার মাঝে আমার কোন কৈফিয়ত চাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই কিন্তু আমার আরাধনা যদি কখনো মনজুর করো, তাহলে আজ এইদিনে তুমি এই ঘুমন্ত মানুষটিকে তোমার মত করে আরোগ্য করে দাও। আজ এই প্রথম আমার মনে হল, ঈশ্বর আছেন, ঈশ্বরের কাছে বলার অনেক কিছু আছে। আজ কেন যেন মনে হল, আমি ঈশ্বরকে ভালবাসি কারন ঈশ্বর আমাকে তাকে ভালবাসবার এবং তাঁর সাথে রাগ করার ইচ্ছাশক্তি আমাকে দিয়েছেন। তোমার ঐ কথাটিই আজ আমার কাছে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল যেটা তুমি প্রায়ই বলতে, “আই লাভ গড বিকজ হি হ্যাজ গিভেন মি দি পাওয়ার টু হেট হিম”। কি অদ্ভুত তোমার বলার সাহস আর দাপটতা। তুমি তোমার ধর্মের উপর কিভাবে বিশ্বাস রেখেছ তা আমার বিশদ জ্ঞ্যান হয়ত নাই কিন্তু আজ আমি হাসপাতালের এই নিরব ক্যাবিনে একজন ঘুমন্ত মানুষের সামনে বসে বুঝতে পারছিলাম, ভগবান যেই ধর্মেরই হোক, তিনি সবার জন্য সমান। এই বিশ্বভ্রমান্ডে যা কিছু আছে সব তাঁর। এর রূপ, গন্ধ, এর প্রকৃতির সৌন্দর্য, এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট সবকিছু তিনি তাঁর নিজের মত করে সাজিয়েছন। এর থেকে আরও সুন্দর কিছু হতে হয়ত পারে না। গোলাপের রং শুধু গোলাপিই নয়, এর স্থান কাল তাপমাত্রা ভেদে সে তাকে আরও অনেক রূপে আকার দান করেছে। আকাশ শুধু নীলই হয় নাই, এ কখনো কালো, কখন সাদা, আবার কখনো কতই না রঙে তুমি সাজিয়েছো। কি দরকার ছিল ঐ আফ্রিকার জঙ্গলে অত সুন্দর একটা লাল গোলাপ ফুটিয়ে রাখবার? কার জন্য কেউ জানে না অথচ তা আছে, বাস্তবেই আছে। কি প্রয়োজন ছিল এরিজোনা নদীর তিরে কোন এক ইউকেলিপ্টাস গাছে চুরায় সুন্দর সবুজ টিয়ার বাসা করে দেয়ার? কি প্রয়োজন ছিল ঐ গহিন সমুদ্রে পানির শতশত ফুট নিচে লাল নীল, বিভিন্ন রঙের সারি সারি দুবলা গাছ সৃষ্টি করবার? সবই রহস্য। তাঁর এই রহস্য সন্ধানে আমার শক্তি নাই। আরেক জলজ্যান্ত রহস্য তো এখন আমার সামনে। তিনি তোমার মা। সারাটি বিকাল আমার কেটে গেল কোন এক ঘোরের ভিতর। তুমি এলে সন্ধ্যার পর। ধুপ জ্বালাবার কোন কায়দা নেই এখানে, প্রভুর কাছে রিতি মোতাবেক প্রার্থনা করবার কোন প্রসাদ নাই এখানে। এখানে যার যার ভগবান তাঁর তাঁর অন্তরের একান্ত ভিতরে। এখানে জীবনের আরাধনা চলে, হোক সেটা মৃত্যুর অথবা জন্মের। কেউ হাসিমুখে বাড়ি ফেরে আবার কেউ অশ্রুসিক্ত নয়নে। কি অবাক না!! চোখের জলের ভাষা দুটুইঃ আনন্দের অথবা কষ্টের।
-হন্তদন্ত হয়ে ক্যাবিনে ঢোকেই তুমি প্রথম যে কতাটি জানতে চেয়েছো সেদিন- মাধুরী, মা কি কোন সাড়া শব্দ করেছিল এরই মধ্যে? তোমার তো আজকের দিনটা এখানে মায়ের সঙ্গে থাকতে হবে, আমি তোমার হোস্টেল সুপারকে খবরটা দিয়ে এসেছি যে তুমি আজ আসছ না। আমি তোমার বন্ধুদেরকেও খবরটা দিতে বলেছি। তুমি দুশ্চিন্তা কর না। আমি হয়ত কাল থেকে মায়ের সঙ্গে থাকতে পারব। আমার পরিবর্তে আমার এক খালা আসবে কাল গ্রাম থেকে। তখন তুমি আবার তোমার হোস্টেলে চলে যেতে পারবে।
কথাগুলো তুমি এমন করে বললে যেন, আমি আজকের দিনের জন্যই শুধু প্রয়োজন, কাল থেকে আমার কোন দরকার হবে না। তোমার মন খারাপ হবে ভেবে আমি তোমাকে কিছুই না বলে শুধু বলেছিলাম, আমাকে নিয়ে তুমি চিন্তা করোনা। যতদিন মা এখানে থাকবে, আমি থাকতে পারব। শুধু আমার কিছু পরিধেয় কাপড়চোপড় বাসা থেকে নিয়ে আসতে হবে। আমি আসলে এই অসামান্য মানুষটির পাশে থাকতে চেয়েছিলাম।
অনেক রাত অবধি তুমি ছিলে ওখানে। যাওয়ার সময় মনে হল, তুমি যেন শরীরটা নিয়ে বাসায় যাচ্ছ আর মনটা দিয়ে গেলে আমার হাতে। তোমাকে আমার বড্ড মায়া করতে ইচ্ছে করেছিল। আজকের তুমি কত ভিন্ন। আমি তোমার এই রূপটা কখনো দেখি নাই। কখনো দেখেছি তোমার গলা ধরে এসেছে মায়ের কথা বলতে বলতে, কখনো দেখেছি তোমার চোখের পাপড়িগুলো ভিজে যাচ্ছে চোখের অসংবরিত নোনা জলে, আবার কখনো দেখেছি তুমি কতটা উদার আমার প্রতি যাতে সব কিছুর বিনিময়ে হলেও যেন আমি তোমার মায়ের সমস্ত দেখভালটা করি। কখনো মনে হয়েছে তুমি কতটা স্বার্থপর। শুধু তুমি তোমাকে নিয়েই ভাবো। একবারও ভাবো নাই যে আমিও তো এখানে তোমার মায়ের কষ্টে ব্যথাতুর হয়ে আছি।
তুমি চলে গেলে। আমি একা বসে আছি মায়ের পাশে। দেয়ালে থাকা ফ্লরসেন্ট বাতিটা নিভিয়ে দিয়েছি। টেবিল ল্যাম্পটা জলছে আধোআধো ভাবে। হটাত দেখলাম, মা নড়তে শুরু করেছেন। মনে হল তিনি জেগে উঠছেন। যতই তিনি নড়াচড়া করছেন, আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন ততই কেঁপে কেঁপে উঠছে। কখনো মনের আনন্দে, আবার কখনো অজানা এক ভয়ে। আনন্দ এই কারনে, তাঁর নড়াচড়া আরোগ্য লাভের জন্য ভাল লক্ষন, কিন্তু ভয় এই কারনে তিনি কখনো আমাকে দেখেন নাই। আমি মায়ের ডান হাতটি আলতো করে চেপে ধরলাম। মনে হল একটা অবলম্বন ধরেছি। উত্তাল সমুদ্রে যখন প্রকান্ড জাহাজটি ভেঙ্গেচূরে খান খান হয়ে আশ্রয়ের সমস্ত ভরসা উবে যায়, কেউ যখন আর কোন আশ্রয়ের অবলম্বন না পেয়ে প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর ভয়ে আতংকিত হয়ে উঠে, তখন কোন অজানা দূর থেকে ভেসে আসা হয়ত ঐ জাহাজেরই ছোট্ট একটা কাষ্ঠখন্ডও আতঙ্কের নিরাময় হয়ে স্বস্থির আভাষ হয়ে উঠে। মায়ের হাত ধরাটাও যেনো আমার কাছে তাই মনে হলো।
মা বেশ কিছুক্ষন পর যেনো তাঁর অসম্ভব ক্লান্তি ছাড়িয়ে চোখ মেললেন। তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। অপলক দৃষ্টিতে তিনি আমাকে দেখছেন। আমিও। কি সুন্দর তাঁর চোখ। কি অদ্ভুত তাঁর চাহনি। আমার ভিতরে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো দিকবিদিক শুন্য এক তান্ডব বয়ে যাচ্ছিল। আমি শুধু তাকিয়েই ছিলাম মায়ের দিকে। মা শুধু অপলক পলখহীনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আমার হাতে ধরা তাঁর হাতটি আরও শক্ত করে ধরে থাকলেন। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, আমি আর তাকে ভালভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কখন যে আমি তাঁর বুকে মাথাটা রেখে জরিয়ে ধরেছিলাম আমার কোন কিছুই মনে পড়ে না। শুধু মনে পরে, কর্তব্যরত নার্স এসে আমাকে বললেন, আপা, আপনি ইচ্ছে করলে পাশে বিছানায়ও কিছুক্ষন বিস্রাম করতে পারেন। আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আমি আর তাকে এটা বলার কোন প্রয়োজন মনে করলাম না যে, আমি ক্লান্ত নৈ, আমি ভাল আছি, কারন মা ভাল আছে। আর মা ভাল থাকলে তুমি ভাল থাকবে। ভগবান বড় রসিক। তাঁর রসিকতায় চোখের জল আর মনের আনন্দ সব একাকার হয়ে যায়।
যে কয়টাদিন আমি মায়ের সঙ্গে থেকেছিলাম, আমার জীবনে ওটা ছিল শ্রেষ্ঠ সময়। আমি জানিনা মা আমাকে কতটা আপন করে নিয়েছিলেন, কিন্তু আমার কাছে মা ছিল একটা শ্রেষ্ঠ উপহার। তুমি ঠিকই বলতে, তোমার মা এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম একজন মা। তাঁর তুলনা তিনি নিজে। সকালে উঠে তিনি প্রতিদিন আমাকে বুকে জরিয়ে চুমু খেয়েছেন। রাতে শোবার সময় বলতেন, আমাকে জড়িয়ে ঘুমাবে। আমার কাদতে ইচ্ছে করত এইভেবে যে, এই একান্ত সময়টা আমার খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। মা আমাকে কখনো কিছু জিজ্ঞ্যেস করতেন না কে আমি বা কি বা আমার সম্পর্ক তোমার সাথে। শুধু প্রথম দিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার পরিবারের কথা। হয়তবা আমার মা স্বর্গীয় হয়েছেন, বাবা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে সুখে আছেন, আমি একটা মহিলা হোস্টেলে থাকি, এই জেনে আর কিছুই তাঁর জানার প্রয়োজন ছিল না। তোমার মা আমাকে আদর করে কি এক অদ্ভুত নামে ডাকতেন যার অর্থ আমি কখনই হয়ত জানব না কিন্তু আমার তাঁর এই দেয়া নামটায় কোন আপত্তি ছিল না বরং আমার খুব মনে ধরেছিল। তোমাকে আজ ঐ নামটা মনে করিয়ে দিতে চাই না কারন তুমি সেটা যে ভুলে যাও নি তা আমি জানি।
মা সেরে উঠলেন চারদিন পর। আমি এই কয়দিনে ভুলেই গিয়েছিলাম আমি হোস্টেলে থাকি, আমাকে আবার হোস্টেলে ফিরতে হবে। মা আমাকে তোমাদের নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। মা আমাকে জোর করেননি, আমাকে যেতে হবে মায়ের সঙ্গে তোমাদের বাসায়, এই কথাটা এমন করে বলেছিলেন যে, আমার সাত জনমেরও সাধ্যি ছিল না এর কোন ব্যাতিক্রম হয়। হাসপাতালের আয়া থেকে শুরু করে নার্স, পাশের ক্যাবিনের রোগীরাও মায়ের এই প্রত্যাবর্তনে যতটা না খুশি হয়েছিল তাঁর থেকে বেশি যেন কষ্ট পেয়েছিল এইভেবে যে, তারা সবাই মাকে মিস করবে। মাকে দেখে বুঝলাম, মানুষকে আপন করে নেওয়ার জন্য অধিক সময়ের দরকার হয় না। দরকার শুধু মানবিকতা আর নিঃস্বার্থ ভালবাসা।
মাকে নিয়ে তুমি তোমাদের বাসায় এলে। সঙ্গে আমি। এই প্রথম আমি তোমাদের বাসায় এলাম। রবিন্দ্রনাথের জমিদার বাড়ির মত না হলেও দেখলাম বাড়িটা অনেক বড়। তোমাদের বাড়ির পশ্চিম পাশে একটা পুকুর ঘাট আছে। পুকুর ঘাটের সামনের রাস্তাটা তোমাদের বাড়ির সদর দরজার ঠিক উল্টো দিকে গিয়ে মিশেছে। কেউ রাতে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেও অসুবিধা নাই, পুকুর ঘাট থেকে সোজা বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছতে পারবে। মাঝে দুইটা সেই পুরানো মডেলের রাজা বাদশার আদলে বাতি আছে। মোটামুটি তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট উচ্চতা। পুকুরের চারিধারে বসবার জন্য কয়েকটি আধা পাকা বেঞ্চের মত করে দেওয়া আছে। প্রতিটি বেঞ্চই কোন না কোন একটা গাছে নিচে। বাড়ির সামনে একটা ছোট বাগান। অনেকদিন এই বাগানে মালির হাত পরেনি বুঝা যাচ্ছে। তাঁরমধ্যে বৃষ্টির সিজন। বর্ষার পানি আর যথেষ্ট পরিমান আলো বাতাস পেয়ে বাগানের আগাছাগুলো লিকলিক করে সবার অন্তরালে অল্প সময়ের মধ্যে যার যার স্থান করে নিয়েছে। বুঝা যায়, বাগানে অনেক অতিথি পোকাদের আনাগোনা হয়েছে। এরাও এই জায়গাটাকে প্রানমুখর করে রেখেছে। বাড়ীটার উত্তর ধারে আছে প্রকান্ড একটা জামগাছ। এখন ফলের সিজন শুরু হয় নাই কিন্তু পাপড়ি, কুড়ি গজানোর সময়। তাই জামগাছেও থোকায় থোকায় কিছু নতুন কুড়ি এসেছে। আর এদের সঙ্গে চিরাচরিত পরকিয়া প্রেমিকের মত কিছু মধু আহরণকারী পোকামাকরের সর্বদা ভীড় রয়েছে। জামগাছটিও আর একা নয়। তাঁর উপরের মগডালে নিতান্তই সাধু বাবার মত, ভদ্র পরিবেশ বানিয়ে কয়েক জোড়া বাবুই পাখী তাঁর সুনিপুণ কৌশলে বানানো ঝুলন্ত কয়েকটি বাসা মোটামুটি পাকাপোক্ত করেই যেন চিরস্থায়ি বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। একপাশে অনেক পুরানো দিনের পরিত্যাক্ত একটা ডোবা। বুঝা যাচ্ছে এই ডোবাতে কেউ নামে না। এলোপাথাড়ি কচুরিপানা, কিছু গাছের মরা ঢাল, বর্জ্য পদার্থ, অনেক কিছুই চোখে আসে। আর এই ডোবাটার ঠিক আশেপাশে কিছু দস্যুপনা পাখির সারক্ষন আনাগোনা থাকে কখন ছোট্ট একটা নলা মাছ, বা কচি প্রানের একটা ব্যাঙের ছানা যেই না উকি মারে অমনি ছো মেরে ঘপ করে মুখে পুরে নেয়। পুরু বাড়িটার মধ্যে একটা প্রানের লক্ষন আছে। সবচেয়ে বেশি লক্ষ করলাম, বাড়িটা নীরবতায় পরিপূর্ণ কিন্তু নিরব নয়। দুদিন থাকতে হল।
আমার কোন বাড়ি নাই। আমার পৈত্রিক বাড়িতে আমার বিশেষ কোন কদর ছিল কিনা আমি জানি না কিন্তু আমার ঐ পৈত্রিক বাড়িটায় আমার কোন নিজস্ব নেশাও জন্মেনি। সেই ছোট বেলায় আমি যখন শেষ বার গিয়েছিলাম, তাঁর স্মৃতি আমি আজও ভুলি নাই। সেটা ছিল এক দুঃসহ এবং ভয়ংকর অনুভুতি। আমরা সবাই সন্ধ্যা পূজায় বসেছি মাত্র। এমন সময় গ্রামের কিছু লোক আর তাঁদের সঙ্গে কিছু বিশ পঁচিশ বছরের যুবক আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। লোকগুলোকে দেখে বেশ উত্তেজিত বলে মনে হলো। আমার মা পুজা ছেড়ে সদর দরজার কাছে এসে একজনকে তাঁদের আগমনের কথা জিজ্ঞ্যেস করতেই পিছন থেকে এক যুবক উত্তেজিত কোথায় মাকে গালিগালাজ করতে লাগলেন। যেন ব্যাপারটা এই রকম , মা কোন অন্যায় করেছেন, তাঁর বিচার চাওয়া হচ্ছে। মা কোন প্রতিবাদ না করে আগত এক বৃদ্ধ মুরুব্বীকে খুবই বিনিত স্বরে কি যেনো বললেন। কিন্তু ব্যাপারটা তাতেই মিটে গেল বলে মনে হলোনা। হটাত হট্টগোল শুরু হয়ে গেল, আগত যুবকদের মধ্যে এক অল্প বয়েসি তরুন আমাদের বাসার দরজা আর জানালা উদ্দেশ্য করে এলোপাথাড়ি ঢিল ছুড়তে আরম্ভ করলো। আমার মা যথেষ্ট পরিমানে আহত হলেন, আমরা এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে, পুজামন্ডপ ছেড়ে আমরা সবাই আমাদের ঘরের এককোনে ঝুপটি মেরে বসেছিলাম। অনেকরাতে বাবা বাড়ি ফিরলেন। আমার মা বাবার সঙ্গে কোন কথাই বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। আসলে কি জন্য কি হয়েছিল আমরা কেউ কিছুই জানতে পারলাম না। শুধু পরেরদিন মা বললেন, আমরা সবাই নানু বাড়ি যাচ্ছি। নানু বাড়ি যাচ্ছি শুনে আমার খুব ভাল লাগছিল কিন্তু আমার মায়ের খুব মন খারাপ, ব্যাপারটা আমাকে দোটানায় রেখেছিল, একদিকে নানু বাড়ি যাওয়ার আনন্দ আবার আরেকদিকে মায়ের মনের অবস্থা। ঐ যে শেষবারের মত আমাদের পৈত্রিক বাড়িতে গিয়েছিলাম, আর যাওয়া হয় নাই। আমার বাবাও আর নানুর বাড়িতে কখনো আসেন নাই। আমরা বাবাকে খুব ভয় পেতাম, তাই কি কারনে বাবা আসেন না, তাও আমরা কেউ জানতে পারিনি। মাকে জিজ্ঞ্যেস করলে মা শুধু অন্য প্রসঙ্গে এড়িয়ে যেতেন। অনেক বছর জেনেছিলাম, বাবা অন্য এক নারির সঙ্গে ঘর বেধেছেন।
তোমাদের বাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। সকালের রোদ যেমন অকাতরে তোমাদের পূর্ব উঠোনে এসে আছড়ে পরে, তেমনি বিকালের পড়ন্ত রোদেরও কোন কমতি নেই পশ্চিমের পুকুরঘাট থেকে শুরু করে সদর দরজার আঙ্গিনা পর্যন্ত।
যে কয়টা দিন আমি তোমাদের বাসায় থেকেছিলাম, ঐ কয়দিনের মধ্যেই শুধু তোমাদের বাড়ি নয়, আশেপাশে লোকজনের সঙ্গেও তোমার মা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সামনে পরীক্ষা, তাই কয়েকদিন পরই আমি চলে এলাম। বলতে পারো তুমি, আমি কি বিদায় নিয়ে এসেছিলাম? আমার মনে পরে না এখন। সেদিন আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল এইভেবে যে, আমি ঐ বাড়িটার প্রতিটি মুহূর্ত মিস করবো। আমি সকালের রোদটা মিস করবো, পুকুরঘাট, ঐ ডোবা, বাগান, কাকাতুয়া, বাবুই পাখী, ব্যাঙের ছানার উকি মারা, কিংবা সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া জামের কুড়ি সবই মিস করবো। আর এগুলোকে জড়িয়ে যার সংসার, তোমার মা, তাকে আমি মিস করবো আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে। আমার বুক ভরে কান্না আসছিলো। তোমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরে এই প্রথম তাঁর ডাকা নামটায় আজ আর ডাকলেন না, শুধু বুকে চেপে ধরে আমাকে বললেন, “তুমি আবার এসো মা,”। এতক্ষন কান্নাটা চেপে রাখতে পেরেছিলাম, এখন তোমার মায়ের মুখে আমাকে “মা” সম্বোধনটা আমার বুকে কষ্টে জমিয়ে রাখা ব্যাথাটা ভেঙ্গে শ্রাবনের বারিধারার মত আখির অজস্র নোনাজলে এর বহিরপ্রকাশ ঘটল।
আমি যতক্ষন প্রশমিত হইনি, তোমার মা আমাকে অতক্ষনই তাঁর বুকে জড়িয়ে রাখলেন। উনি কেদেছিলেন কিনা আমি জানি না, কিন্তু আমি যখন তাঁর বুক থেকে মাথা সরিয়ে মার দিকে তাকালাম, দেখলাম তাঁর মিষ্টি একটা হাসি। প্রানটা যেন এবার সত্য জুড়িয়ে গেল। বুকের ভিতরের ব্যাথাটা এখন অনেক হাল্কা লাগছে, আমি মায়ের পা ছুয়ে আশীর্বাদ নিলাম। তারপর আমি আমার সেই চিরচরিত হোস্টেলে চলে এলাম। আবারও সেই অগোছালো এক বসবাস, একই ধাঁচের সেই নিয়মের বাড়াবাড়ি। কিন্তু কোন উপায় নেই। জীবনের অনেক কিছুই আমাদের ভাল লাগবে না, তাই বলে এই নিয়মগুলো কেটে বের হয়ে যাওয়ারও কোন উপায় নাই, যারা নিয়মগুলো বানায়, তারা নিয়মগুলো হয়ত মানার দরকার নাই বলে এর সংস্কার করারও কোন প্রয়োজন মনে করে না। কে কার জন্য কি পালটাবে বলো?
তোমার সাথে আমার যথারীতি দেখা হয়, কথা হয়, তোমার মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করি, বেশ চলে যাচ্ছে আমার সেই নিঃসঙ্গ একাকী জীবনের কিছুটা সময়। বন্ধুবান্ধব ছিল কিন্তু তারা সব বন্ধুর গন্ডিতেই ছিল। অনেকে আরও গভীরভাবে আমাকে জানতে চেয়েছিল হয়ত, আমি কেন যেন কোন কিছুই বুঝতে চাইনি। আমার সহপাঠী অনেক মেয়েবন্ধুরা এরই মধ্যে বিয়েথা করে সংসার পেতে ফেলেছে, কখনো কারো সুখের কাহিনি শুনে মুগ্ধ হয়েছি আবার কখনো কারো করুন কাহিনি শুনে বড্ড অসহায় মনে হয়েছে। আমরা মেয়ে মানুষ, পুরুসের মন জুগিয়ে চলাই আমাদের প্রধান কাজ। শুধু পুরুষ কেনো, তাঁর সঙ্গে শ্বশুর, শাশুড়ি, আয়া, জায়া, দেবর ননদ সব। এমন কি বাড়ির কাজের মানুষগুলোও অনেক সময় যা পারে আমরা বউরা ঐ কিঞ্চিত ছাড় পাওয়ার আশা করাও অনেক সময় দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। এ দেশের মায়েরা আর শাশুড়িরা এক বংশের নয়। মায়েরা মনে করে, তাঁদের মেয়েটা শ্বশুর বাড়িতে জামাইকে নিয়ে খুব ভাল আছে কারন তাঁর মেয়ে যা আদেশ করে বা বায়না করে তাঁর স্বামী সব অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কিন্তু তাঁর ছেলেটা একেবারে উল্টো। বউ যা আদেশ করে বা বায়না ধরে তা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কেন বাবা, পরের মেয়ের এত আবদার, এত কথা কেন শুনতে হবে? যেন তাঁর ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে অথচ তাঁর মেয়ের জামাইটা কি সুবোধ বালকের মত। যা আদেশ করা হবে সব সে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। এই হচ্ছে আমাদের সমাজ। যেখানে আমরা পরিবর্তনের কথা বলি সবাইকে কিন্তু নিজে পরিবর্তন হই না। আমরা প্রত্যেককেই বলি, কেন সবাই পরিবর্তন হয় না? শুধু বলি না, কেন আমি পরিবর্তন হচ্ছি না। যাক, হয়ত এটাই সামাজিক রীতি। কেউ বদল করে কেউ বদল হয়। আমারও কিছু জিনিসের বদল হলো। শেষ করে ফেললাম আমার শিক্ষার জীবন। হোস্টেল জীবন বদল হয়ে গেল ছাত্রি হিসাবে। আমি জানি না কোথায় এখন আবার আবার নতুন জায়গা হবে। তুমিও কোনদিন আমাকে এই প্রশ্নটা করোনি এরপর কি আমার প্ল্যান, বা কি করলে কি হবে। ছাত্রি থাকা অবস্থায় একবার ফ্রান্সে স্কলারশিপের আবেদন করেছিলাম, এর কি অবস্থা একটু খুটিয়ে দেখার ইচ্ছে হলো। আমি জানি এটা আমার হবে না। আমার জাঁদরেল কোন মামা নেই, আমার বাবার এমন কোন বন্ধু নেই যার কাছে আমি গিয়ে বলতে পারি আমার সাহায্যের প্রয়োজন। অথবা আমার এমন কোন ব্যাক্তির সঙ্গে সখ্যতা নেই যাকে ধরে আমি আমার এই অবৈতনিক ধূসরগণ্ডী পার করতে পারি। তাঁরপরেও একবার খোঁজ নিতে গেলাম ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার অফিসে যদি কোন কিছুর সন্ধান পাওয়া যায়। আমি আশাবাদি নৈ কিন্তু একেবারে অবসর, তাই কিছু একটা করা আর কি। একটা পানির বোতল সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম রেজিস্টারের অফিসের উদ্দেশে।
ভগবান যখন রশিকতা করেন, তাঁর রসিকতায় একটা অদ্ভুত আবেগময়ি স্পর্শ থাকে। আমার বেলায়ও হয়ত তাই হল। কি করে কি হল? আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে শুনলাম, গতকালই নাকি আমার ফ্রান্সে যাবার স্কলারশিপটা মঞ্জুর করেছে। আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না এই খবরটায়। মোট জনাদশেক আবেদন করেছিল, তাঁর মধ্যে শুধুমাত্র আমাদের দুজন এই স্কলারশিপটা পেয়েছে। তাঁর মধ্যে আমি একজন। আনন্দে আত্মহারায় আমার শরীর কাপছিল, আমি কাকে এই খবরটা দেব? কি বলব? কিভাবে বলব? এটা কি আদৌ কোন বড় খবর নাকি কোন খবরই না? আমি আমার পানির বোতলের সবটুকুন পানি খেয়েও যেন আমার তৃষ্ণা মিটছিল না। সত্যি ভগবান বড় রশিক। যখন কারো আর কোন পরিকল্পনা জানা থাকে না, তাঁরজন্য হয়ত ভগবান বিশেষ কিছু করে থাকেন যা সঠিক সময়ে সঠিকস্থানে এবং সঠিক ব্যাক্তিকে তিনি দান করে আশ্বস্ত করেন। আমার এই অপরিকল্পিত জীবনে এই প্রথম মনে হল, “কোথাও কেউ নেই” এই কথাটা সত্য নয়। অন্তত ভগবান আছেন। তিনি সবাইকে তাঁর অফুরন্ত আলো বাতাসের ভান্ডার দিয়ে, এই বিশাল জলরাশির আধার দিয়ে, কোন না কোন অসহায় জীবকে নিজের পরম মমতায় অতিযত্নে সোহাগ করে তুলে নেন আর এমন স্থানে তাকে জায়গা করে দেন যা অতিশয় আরামদায়ক এবং সৌভাগ্যের। হয়ত ভগবান তাঁর নজর আমার কাছ থেকে এখনো সরিয়ে নেন নাই।
আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি, তুমি ছাড়া আর এখন তোমার পরিবার ছাড়া আমার আর কেউ নাই। আমার পৃথিবীর গোটা অঞ্চল ভাগ করলে সেই অঞ্চলে শুধু তোমাদের বাড়িটা ছাড়া আর কোন অঞ্চল এই অংশে দেখা যাবে না। আর সম্ভবত এই কারনেই খবরটা নিয়ে আমি প্রথম যেখানে দৌড়ে গিয়েছিলাম, সেটা তোমার বাসায়। জীবনের মুহূর্তগুলো কিভাবে বদলে যায়, জীবনের আগমুহূর্তটা তাঁর পরের মুহূর্তের মত নয়। প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর নিজ নিজ স্বকীয়তায় পূর্ণ। একটু আগেও আমি ছিলাম ধিরস্থির, আমার কোন নিশানা ছিল না, আমার গন্তব্যের কোন আবাসস্থল ছিল না, অথচ এই মুহূর্তে আমি আর আগের মুহূর্তের মত নৈ। এখন আমি এক চঞ্চলা। মনে মনে গুনগুন করে গান গেতে ইচ্ছে করছে। কোন বিষণ্ণ ধরনের গান নয়। মনে হচ্ছে আমি নিজেই একটা গান নিজের সুরে গাইতে থাকি, “আমি যেন আজ আমি নেই, কোন এক বিশাল জগতের অম্পরা সরীসৃপ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষ কত অদ্ভুত। হয়ত এই কারনেই ভগবান তাঁর অদ্ভুত আচরনে মুচকি মুচকি হাসেন আর তাঁর রসিকতার মজা নেন।
বিকাল চারটার দিকে আমি তোমাদের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। আমি জানি এই সময় তুমি বাসায় থাকো না। তোমার মা হয়ত এই সময় দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নেন। কিন্তু আমার সময় কাটছিল না। আমি হাজির হয়ে গেলাম তোমাদের বাসায়।
অবাক হলাম মাকে দেখে। মা অন্য দিনের মত আজ দুপুরের পর খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নেননি। কি যেন নিয়ে খুব ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আমি ঢোকতেই একটা সুন্দর মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “এসো মা এসো, ভালই হলো, তুমি এসেছ”। আমি মাকে প্রনাম করে তাঁর পাশে গিয়ে বসতেই আমাকে একটা এ্যালবাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “দেখোত মা, মেয়েটা কি রকম দেখতে?” ধক করে উঠল যেন আমার বুকটা। আমার এতবড় একটা আনন্দের দিনে, মনভরা এতটা সুখি বুকে হটাত করে যেন পিছন থেকে শতটনি একটা গাড়ী আমার পাজরের সবগুলো হাড় চুরমুর করে বাকিয়ে দিচ্ছে। বুঝতেই পারলাম না কোথা থেকে কখন ঐ শত সহস্র ওজনের একটা দানব আমার অজান্তে আমার এত কাছে এসে কত বড় ধাক্কাটা দিয়ে গেল। সামলাতে একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেও ব্যাপারটা নিজের কাছেই লুকিয়ে রাখতে পারলাম। “আকাশের জন্য মেয়ে দেখছি, এগুলো ঐ মেয়েটারই ছবি। দেখোতো মেয়েটা কেমন দেখতে?” আমি ছবিগুলো দেখতে দেখতে মা কথাগুলো বলছিলেন। বড্ড সুন্দর একটা মেয়ে। ঠোটে লাল লিপিস্টিকের পাশ দিয়ে চমৎকার লাইনার টানা। মনে হয় কোন আর্টিস্ট যেন খুব সন্তর্পণে তাঁর ঠোঁটের ঐ লিপিস্টিকগুলি অতিশয় যত্নের সহিত একে দিয়েছেন। মাথার চুলগুলো পরিপাটী করে সাজানো। ক্যামেরার আলো প্রতিফলিত হয়ে চুলের এক অংশে একটা আলোর ঝলকানির সৃষ্টি করেছে। কানের দুলটি গ্রীবার পাশ পর্যন্ত ঠেকে আছে। তাঁরমধ্যে অসংখ্য যাদুকরী কারুকার্য। চোখ দুটো নিরব চাহনি দিয়ে তাঁর মাদকতার রূপ জাহির করছে। অদ্ভুত সুন্দর সে চাহনি। মিস্টি মুখের একটা ছাচ। গোলগাল কিন্তু অপূর্ব মায়াবতী। যে কারোরই পছন্দ হবে মেয়েটিকে। কয়েকটি ছবি পূর্ণ অবয়বে তোলা। বেশ লম্বা বুঝা যায়। আকাশের সঙ্গে মানাবে। একটা ছবিতে একটা ছোট গাছের আড়ালে দাড়িয়ে। আড়াল করে দাড়ালেও তাঁর রুপের কোন অংশই লুকানো সম্ভব হয় নাই। পিছনের সবুজ ঘাসের সঙ্গে আর অপরূপ কিছু রঙ্গিন পাতাগাছের পাশে তাঁর সবুজাভাব শাড়ির অদ্ভুত একটা মিল রয়েছে। নারীরা আসলে সুন্দরের প্রতিক। ভগবান এদের বানিয়েছেন অতি আদর করে , মায়াবতী রূপ দিয়ে। কেউ এদের নোনাজলে ভাসিয়ে কর্দমাক্ত করে দিলেও তাঁর অন্তরের রুপটা হয়ত একেবারে বিলিন হয়ে যায় না। এরা শ্মশানের মত পাষান নয়, আবার মমের থেকেও নরম। এদের গলিয়ে আরেক রূপ দেওয়া যায় আবার শুকিয়ে গেলে বর্জ্য ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
বললাম, “মেয়েটি দারুন দেখতে। আকাশের সঙ্গে মানাবে।”
তোমার মা আমাকে চুমু খেয়ে বললেন, “দেখিস, তোর আকাশ সুখি হবে।”
আমার চোখ ভিজে এল মায়ের কথায়। “আমার আকাশ”। হ্যা, তাই তো, তুমি তো আমারই আকাশ। ঐ আকাশেই তো আমার সর্বদা বিচরন। আমি যখন খুশি উড়তে পারি, আবার আমার যখন মন খারাপ থাকে, ঐ আকাশ থেকেই তো বৃষ্টি আসে। আবার কখনো কখনো ঐ আকাশের মাঝে জলন্ত সূর্যটাই তো আমাকে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয়। অনেকক্ষন মায়ের সঙ্গে কাটালাম। আমি আমার খবরটা তখনো মাকে দেই নাই। কি বলব মাকে? আমি চলে যাচ্ছি? আমি কোথায় যাব?
সন্ধে হয়ে এল। হোস্টেলে ফিরতে হবে। অনেক কাজ হয়ত বাকি। রেজিস্ট্রার সাহেব আমাকে একখানা ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। অনেক কাগজপত্র যোগাড় করতে হবে। আমি ফিরার পথে মাকে বললাম, “মা, আমার স্কলারশিপ হয়েছে, ফ্রান্সে। খুব শিগ্রই হয়ত যেতে হবে। তুমি দোয়া কোরো।”
“সে কিরে? আকাশের বিয়েতে তুই থাকবি না?” মা আমার এই খবরটায় যতটা না খুশি হলেন, মনে হল তাঁর থেকে বেশি বিচলিত হলেন আমার চলে যাবার কারনে হয়ত আকাশের বিয়েতে আমার ভুমিকা নিয়ে।
আর যাই হোক মা তো। মায়েরা নিজের সন্তানের অন্তর যতটা বুঝে তারা অন্য সন্তানের অন্তর অতটা হয়ত বুঝেন না। ওনি তো আকাশের মা।
আমি চলে এলাম আমার হোস্টেলে। মনটা আজ নানা কারনে এতটাই আলোড়িত ছিল যে কখনো উত্তপ্ত টাইফুনের মত আবার কখনো ধুম্রজাল নাটকের মত খসখসে, আবার কখনো বৈশাখীর পড়ন্ত বিকালের আমেজের মত, কখনো জানি কেমন বুঝা যাচ্ছে না। আমার স্কলারশিপ আমাকে অতিশয় আবেশিত করে ফেলেছিলো, আবার আকাশের বিয়ের পাত্রি দেখে আমার মন যেনো কোথায় স্থির হয়ে গিয়েছিলো। টিভি অন করে মনটা বদলের চেষ্টা করলাম। প্রথমেই একটা গানের কলি শুনে মনটা আরও বিষণ্ণ হয়ে গেল, নজরুলের ঐ বিখ্যাত গান, “আমার যাবার সময় হল, দাও বিদায়…” পৃথিবীর কোন একটা মুহূর্ত আরেকটি মুহূর্তের মত কখনই নয়। এরা সবাই যার যার বেদনায় বা উল্লাশে ভরপুর। খেতে ভাল লাগছিল না। না খেয়েই শুয়ে পড়লাম।
একটানা এগারো দিন আর আমি তোমার সঙ্গে অথবা তোমাদের বাড়ির সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখিনি। সত্যি আমি আমার স্কলারশিপের যাবতীয় কাগজাদির জন্য হন্যে হয়ে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেরিয়েছি। মনে হয়েছে শুধু আমার হাতে সময় অনেক কম, কেন জানি মনে হয়েছে আমার সময় ফুরিয়ে আসছে। যে করেই হোক আমি তোমার বিয়ের আগে এই সমাজ, এই দেশ, এই রীতিনিতি, এই শাশনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যাবো। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।
আমার স্পষ্ট মনে আছে। দিনটি ছিল ইংরেজির ১৮ তারিখ আর বাংলায় ২৯ শে বৈশাখ। আমার সবকিছু ঠিক হয়ে গেল। আমি চলে যাচ্ছি সেই সুদুর অপরিচিত কোন এক মহলে যেখানে আমি কারো ভাষা বুঝি না, আমার কেউ পরিচিত নাই, আমি ইচ্ছে করলেই মন খারাপ থাকলে তোমার মায়ের মত এমন একজন মানুষের কাছে আমি ছুটে যেতে পারব না। তারপরেও আমি সস্থি পাচ্ছি এই ভেবে, আমার নতুন জীবনে কেউ আমাকেও চিনে না। আমি শেষবারের মত তোমার কাছে এসেছিলাম তোমাদের বাসায়।
মাকে প্রনাম করলাম, বড্ড কান্না পাচ্ছিল। মা আমাকে কত কথা বললেন। খুব আদরে আদরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
তোমাদের বাসা থেকে বের হবার সময় তোমাকে একবার প্রনাম করতে খুব মন চাইছিল। মন যা চাইলো, আমি তাই করলাম, এই প্রথম আমি তোমাকে প্রনাম করতে গেলে তুমি আমাকে বারন করতে গিয়ে জড়িয়ে ধরলে। আমি অবশ শরিরে শুধু কান্নাই করে যাচ্ছিলাম। তুমি আমাকে কখনোই এইভাবে জড়িয়ে ধরো নাই। তুমি আমার আকাশ, এই প্রথম আমি আমার আকাশকে এত কাছ থেকে বুকের মাঝে ধারন করতে পারলাম। তুমি কি আমার ভিতরের কোন কম্পন অনুভব করোনি? তুমি কি কখনোই বুঝতে পারোনি যে আমার ভিতরের মাধুরী আজ তোমার আকাশ থেকে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে? হয়ত বা পেরেছ, হয়ত বা পারোনি।
বিশাল এয়ারপোর্ট। আমি কখনো এই এয়ারপোর্টে আসিনি। আসার দরকার হয় নাই। কত লোক এই এয়ারপোর্ট দিয়ে তাঁদের গন্তব্য পরিবর্তন করে, আমিও আজ আমার জীবনের আরেক গন্তব্যের উদ্দেশে নিজে দেশ ছেড়ে, নিজের সমস্ত স্মৃতি পিছনে ফেলে, যত মায়া মহব্বত, ঘৃণা, আক্রোশ, ক্রোধ, অবিচার, অন্যায়, কিংবা ভালবাসা, আবেগ, অথবা মনের সব জালা জন্ত্রনা ছেড়ে আমি পাড়ি দিচ্ছি অন্য আরেক অপরিচিত দেশে যেখানে আমার কেউ নেই।
প্ল্যান টেকঅফ করেছে। দ্রুত স্থান পরিবর্তন হচ্ছে, ঘাস, গাছ পালা, বিশাল অট্টালিকাগুলো নিমিসের মধ্যেই আমার থেকে পিছনে পরে যাচ্ছে। আমার মনটা একেবারে শান্ত, কিন্তু কোথায় যেন চিনচিন করে ব্যাথা অনুভুত হচ্ছে। আমার পাশে বসা একজন ষাট বছরের বৃদ্ধা তাঁর সিটে আরাম করে বসবার জন্য ঘনঘন নারাচরা করছেন। আমরা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের মাটি ছেড়ে অনেক উপড়ে উঠে গেছি। আমি এখন আকাশে। এই আকাশ আর সে আকাশ এক নয়। আমি ইচ্ছে করলেই এই আকাশে ঝাপ দিয়ে বুকে পড়তে পারি না, তারপরেও এর নাম আকাশ। আকাশ কত বিশাল, চারিদিকে শুধু সাদা মেঘের আভা। মনে হয় যেন সাদা মাটির এক দেশ। কেউ কোথাও নেই, শুধু সাদা মাটি।
০১/০৬/২০১৬-গল্পটা যদি এমন হতো?
Categories
এক যে ছিল রাজকুমার, আর এক যে ছিল রাজকুমারি। রাজকুমার রাজকুমারিকে আর রাজকুমারি রাজকুমারকে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু হটাত করে কোন এক দিন রাজকুমার হারিয়ে যায়। দিন যায়, রাত যায়, মাস যায় বছর আসে, বর্ষা যায় শিত আসে, রাজকুমারি পথ চেয়ে বসে থাকে। কিন্তু রাজকুমারের কোন হদিস মেলে না। চোখের সবগুলো স্বপ্ন নিয়ে আর অশ্রুভরা নেত্রে রাজকুমারি একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে জস্না দেখে, চাদের পানে চেয়ে ঐ চাদের বুরির সঙ্গে একাই কথা বলে। কত রাজ কুমার এলো গেলো। কিন্তু রাজকুমারীর কোন রাজকুমারের প্রেমেই পরতে পারলেন না। তার রাজ্য চাই না, জহরত চাই না, সোনার পালঙ্ক চাই না। তিনি শুধু রাজকুমারের জন্য পথ চেয়ে থাকেন।
একদিন হটাত কোন এক বসন্তের সকালে মাথা ভর্তি এলো মেলো চুল নিয়ে, উসুখুসু খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি নিয়ে রাজকুমার এসে হাজির। রাজকুমারি তার জীবনের সব আনন্দ আর ভালবাসা দিয়ে রাজকুমারকে জরিয়ে ধরে শুধু বললেন, আমাকে একা ফেলে তুমি কোথায় গিয়েছিলে রাজকুমার? আমি তো তোমার পথ চেয়েই এতটা দিন, এতটা সময় পার করে দিয়েছি, একবারও কি মনে পরে নাই আমায়? তুমি কি আমার ভালোবাসার স্নিগ্ধ ঘ্রান কখনোই পাও নাই রাজকুমার? এই বুকে কান পেতে দেখ, কি উত্তাপ আর কি যন্ত্রনা নিয়ে আমি এই এতগুল বছর তোমার প্রতিক্ষায় অপেক্ষা করে আছি! আমাকে তুমি তোমার বুকের ভিতরে একটু জায়গা দাও রাজকুমার। আমি বড় ক্লান্ত, আমি আজ অনেক অবসন্ন। আমাকে জোর করে ধরে রাখ এবার। আমি তোমাকে আর কখনো হারাতে চাই না কুমার।
রাজকুমার তার পকেট থেকে একটি ছোট ঘাস ফুল বের করে রাজকুমারির ঘন কালো চুলের খোঁপায় গুজে দিয়ে বললেন, এই হোক সাক্ষী আজ তোমার আর আমার প্রেমের আলিঙ্গনের। আমাদের সুতীব্র ভালোবাসার।
দিন যায়, রাত যায়, বড় ভাল জীবন কাটছিল রাজকুমারের আর রাজকুমারির। একদিন হটাত রাজকুমারের অন্তর্ধান হয়। রানী আবারো একা বসে থাকেন ঐ বেলকনির রেলিং ধরে। সন্ধায় চিল কাতুরের ডাকে তার মন ভারি হয়ে আসে। জোনাকির ডাকে তার সব অতিতের কথা মনে হয়। মনে হয় রাজকুমার তার পাশেই হাত ধরে বসে আছেন। কিন্তু না। সব আশা, আহ্লাদ, সব স্মৃতি মলিন করে দিয়ে তার গরভের অনাগত সন্তানের নড়াচড়ায় সম্বিত ফিরে আসে।
আজ নতুন রাজকুমার এসেছে তার জীবনে। হাটি হাটি পা পা করে ছোট রাজকুমার বড় হতে থাকে। একদিন সে কথা বলতে থাকে। ছোট রাজকুমার কে মা রাজকুমারি কতই ই না গল্প শুনিয়ে ঘুম পারিয়ে দেন। কিন্তু রাজকুমারি সব সময় একই গল্প বলতে থাকে……… এক যে ছিল রাজা আর এক যে ছিল রানী। তাদের ছিল এক রাজপুত্তর। রাজপুত্রকে নিয়ে রাজা আর রানী বড় ভালবাসায় জীবন কাতাইতেছিলেন। একদিন হটাত করে রাজা হারিয়ে যান কোন এক গহিন জঙ্গলের ভিতর। রাজপুত্র ধীরে ধীরে বড় হয়। একদিন মাকে জিজ্ঞেস করে, মা আমার বাবা কই? রানী চোখের জল মুছে ছোট রাজপুত্রের কপোলে চুমি খেয়ে বলেন, তোমার বাবা একদিন ঘোড়ায় চরে টকবক করে ঐ গহিন জঙ্গল থেকে আমাদের নিতে আসবেন। তুমি বড় হও। রাজা ফিরে না এলে আমরাই তাঁকে খুজে আনবো। ছোট রাজপুত্র ঐ গহিন জঙ্গলের রহস্য বুজে উঠতে পারেন না। শুধু মাকে জরিয়ে ধরে থাকে আর বলে, মা আমি তোমায় খুব ভালবাসি।
৩১/০৫/২০১৬-যেদিন আকাশের মেঘমালা
Categories
যেদিন দেখবেন আকাশের মেঘ মালা আপনার জগতের কাছে শেষ বর্ষণ হয়ে আপনার পায়ের কাছে টাপুর টুপুর করে লাফিয়ে পরছে, যেদিন দেখবেন ঐ পাশের জঙ্গলের ভিতর অবহেলায় কোন এক রজনি গন্ধার সুবাস আপনার নাশারন্দ্রে ভেসে আসছে, যেদিন দেখবেন চারিদিকের মানুষ গুলো আপনাকে দেখে কোন কারন ছারাই আর আপনাকে সেই আগের মত করে দেখছে না কিন্তু মিটি মিটি করে হাসছে আপনার নতুন ভালোবাসার অববয়বে, যেদিন মনে হবে পৃথিবীতে আরও অনেক বছর বাচতে ইচ্ছে করবে, যেদিন মনে হবে পৃথিবীর সব রঙ সুন্দর, যেদিন মনে হবে আপনার হাসতে ভাল লাগে, কাদতে ভাল লাগে, একাকী বসে জানালায় পাখি দেখতে ভাল লাগছে, অথবা যেদিন দেখবেন চোখের জলের মধ্যে অফুরন্ত কষ্টের মাঝেও মন বড় উতালা হয়ে আছে কোন এক অস্পৃশ্য মানুষের জন্য, যেদিন দেখবেন সোনালী রোদ আপনাকে উদ্ভাসিত করে, যেদিন দেখবেন জোড়া শালিক না দেখেও আপনার মনে হবে এই বুঝি আজকে ও আসবে, সেদিন আপনার এই অপেক্ষার পালা শেষ হয়ে দেখবেন মাঘের পরে ঐ দিগন্তে দাড়িয়ে আছেন তিনি যাকে আপনি এতদিন ধরে খুজছেন। আপনার আর কোন কিছুর জন্যই কাউকে কিছুই বলার নাই। শুধু আপনি আর থাকবে বনলতা সেনের মত সেই মানুষটি, বলবেন তখন, ………এতদিন কোথায় ছিলেন?
বলুন না কোথায় তাঁকে দেখেছেন প্রথমবার?
৩০/০৫/২০১৬-সপ্তাহের সাত দিন
Categories
ভগবান যদি সপ্তাহের সাত দিনই মানুষের জন্য শুধু আনন্দ অথবা শুধু কষ্টের জন্যই বরাদ্ধ করতেন, তাহলে মানুষের জীবনটা হয়ে যেত এক চরম দুর্বিষহ। আর তাই সব রবিবার একরকম নয়, সব মঙ্গলবারও একরকম নয়। কোন কোন শনিবার সুখের বার্তা নিয়ে আসে আবার কোন কোন মঙ্গলবার অনেক কষ্টের বার্তাও নিয়ে আসে। বর্ষার কোন এক শনিবার যেমন মেঘলা নাও হতে পারে আবার শীতের কোন এক শনিবার চরম বৃষ্টিপাতে ধরনি একাকার হয়ে যেতে পারে। আর এটাই হচ্ছে জীবন।
গতকাল থেকে একটা জিনিস লক্ষ করছি য, তুমি রাতে ঘুমাতে পার নি কোন এক অপেক্ষার পালা বদলে। শুধু তোমার মনে হয়েছে কখন আসবে সেই প্রতিক্ষিত মুহূর্তগুলো যেখানে তার আনন্দের ধারা বইয়ে ভাসিয়ে দেবে তার আহরিত মন আর শান্তিতে ভরিয়ে দেবে এই ধরা। আজ লক্ষ করলাম, তার সেই আনন্দ যথার্থই সুখের বার্তা দিয়ে দিনটিকে স্মরণীয় করে রেখেছে হয়ত। আমি জানিনা কি সেই আনন্দ অথবা কি সেই কাঙ্ক্ষিত কিন্তু অনাবিষ্কৃত আনন্দের বিজলী ধারা।
তবে সুখানুভূতি হচ্ছে এই ভেবে যে, যেভাবে মন আশা করেছিল যদি তা পেয়ে থাকে এর চেয়ে বড় কোন আশীর্বাদ বা উপহার হতে পারে না। নিশ্চয় তা ভগবান শুনেছেন। ভাল থেক সব ঋতুতে, সবদিনে, গাড় নীল বৃষ্টিতে, অথবা সোনালী রোদ্দুরের চিকচিক করা স্বর্ণালি আভায় অথবা কোন এক অস্পৃশ্য মানুষের তৃপ্তিময় ছোঁয়ায়।
জীবনের সবগুলো আনন্দ যেমন এক নয় আবার সবগুলো কষ্টও এক নয়। কোন কষ্ট জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে চলার পথ দেখায় আবার কিছু কিছু সুখ জীবনের সব সুখগুলোকে ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ করতে থাকে। আজ এমন এক মানুষের জীবনের গল্প শুনলাম যার বেশিরভাগ দিনগুলই কেটেছে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার মত। কখনো নিজের সঙ্গে নিজে প্রতারনা করেছে, কখনো নিজেকে বাচিয়ে রাখার জন্য প্রতারিত হয়েছে। তারপরেও তার লক্ষ ছিল এক এবং অটুট।
৩০/০৫/২০১৬-অপেক্ষার অনেক নাম
Categories
অপেক্ষার অনেক নাম। কখনো কষ্ট, কখনো সুখ, কখনো উদাসীনতা আবার কখনো শুধুই ভালবাসা। আজ আপনার এই অপেক্ষার নাম কি সুখ আর ভালবাসা? সার্থক হোক সে মিলন, আর সার্থক হোক আপনার চিত্ত। অহংকারীরা দেখুক আপনার দিবসের মুখদ্ধকর সীমাহীন আনন্দের চ্ছটা আর নিন্দুকেরা জ্বলে পুড়ে মরুক নিজ দাবগাহনে। আপনার ইচ্ছাই আপনাকে নিয়ে যাবে স্বর্গের ঐ নীল জানালায় যেখানে বসে আপনি রাতের কালো আকাশে ধ্রুবতারা দেখবেন আর নিজেকে অস্পৃশ্য কোন এক মানুষের পাশে ঠায় দাড়িয়ে অরুন্ধতী হয়ে কাল পুরুষকে ছারিয়ে সকালের লাল সূর্যের দিগন্ত রেখা ছুয়ে দেবেন। আমার সকল শুভ কামনা রইল আপনার জন্য। আপনার সবার জন্য।
২৯/০৫/২০১৬-এই নীলাকাশ ভেদ করে যেমন
Categories
এই নীলাকাশ ভেদ করে যেমন ভগবানকে পাওয়া যায় না, আবার সমুদ্রতল মেথুন করেও কোন দেবদেবির দেখা পাওয়া গেছে এর তেমন কোন হদিসও পাওয়া যায় না। ঠিক তেমনি অন্তরভেদ করে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখলেও এক ফোঁটা ভালোবাসার আলামত পাওয়া যায় না। অথচ কেউ কষ্ট দিলে বুকে ব্যথা লাগে, আনন্দ দিলে অন্তরে সুখের আচ্ছাদন অনুমিত হয়। অনেকদিন ভালোবাসার মানুষকে না দেখলে বুক শুন্য শুন্য মনে হয়। তাহলে এই ভালোবাসার উৎসটা কি বা কোথায়?
“আমি তোমায় ভালবাসি” এর মানে অনেক ব্যাপক। আর এই ব্যাপক অর্থের কারনেই হয়তবা শতবর্ষী যুবকের চোখ অষ্টাদশী বৃদ্ধার জন্য কাদে, কাছে না থাকলে মনে হয় কি যেন নাই তার পাশে। শেষ বিকালে অথবা অষ্টাদশীর চাঁদনী রাতে কিংবা শীতের কোন এক কাকডাকা ভোরে পাশাপাশি বসে এক কাপ চা অথবা গরম গরম কোন ঝাল মিষ্টি টক খাওয়া, অমাবশ্যার রাতে কোন এক শ্মশানের পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার অজনা ভয়ে কুকড়ে থাকা হাত দিয়ে তাকে ধরে রাখার যে ভরসা। এই সবই ভালবাসা। একসময় এই ভালবাসা পরিনত হয় একটা অভ্যাসে। তখন অভ্যাসটাই ভালবাসা।
আজ যে শুধু তোমার মুখ দেখে ভালবাসল, তোমার রূপকে দেখে ভালবাসল, তোমার যৌবনকে দেখে শুধুমাত্র লোভের লালসায় ভালবেসে গেলো, সে আর যাই হোক তার সঙ্গে তোমার ভালোবাসার অভ্যাস হবেনা। কারন ভগবানকে ভালবাসা, একটা গাছকে ভালবাসা অথবা মাকে ভালবাসা আর সেই অপরিচিত মানুষটাকে মনের ভিতরে নিয়ে ভালবাসা এক নয়। তার সঙ্গে জরিয়ে থাকে নিঃশ্বাস, তার সঙ্গে জরিয়ে থাকে ভূতভবিষ্যৎ, তার সঙ্গে জরিয়ে থাকে জীবনের প্রতিটি সুখদুঃখের হাসিকান্নার সবগুলো অধ্যায়।
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর তোমার অনুপস্থিতিতে যে তোমাকে মনে করে চোখের জল ফেলবে, আজ থেকে আরও শত বছর পর যে তার উত্তরসূরিদের কাছে তোমার নাম স্মরণ করে সেই অতীত জীবনের রোমান্সের কাহিনী শুনাবে, তোমার জীবদ্দশায় অসহায়ত্তের কারনে যে তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে না, যাকে দেখলে মনে হবে, সে তোমাকে নয় তোমার জীবনটাকে ভালবাসে, হোক তুমি পঙ্গু, হও তুমি বিরঙ্গনা অন্তঃসত্ত্বা, হও তুমি বোবা কিংবা বধির, সেটা তার কাছে ভাল না বাসার কোন কৈফিয়ত হতে পারে না। এখানে ভালবাসাটা শুধু শ্রদ্ধার, ভালবাসাটা অন্তরকে বুঝবার আর চারিদিকের হায়েনাদের থেকে ভালোবাসার মানুসটিকে নিরাপদে রাখার আপ্রান চেষ্টা। লম্বাপথ পারি দেওয়ার কোন সঙ্গি নাই তো কি হয়েছে, সে তোমার জন্য অপেক্ষা করবে, নৌকায় আর একজনেরও জায়গা আছে তোমার যাওয়ার জায়গা নাই, তো কি হয়েছে, সে তোমার জন্য নৌকা ছেড়ে পাশে এসে দারাবে, তোমাকে কেউ বিরঙ্গনা করেছে? তো কি হয়েছে? সে তোমার সবকষ্ট ধুয়ে মুছে নিজের ভালবাসা দিয়ে আদর দিয়ে কাছে টেনে নেবে। চিনেছ কি তাঁকে? যদি চিনে থাক, তাহলে নিশ্চিত জেনো, সে তোমাকে ভালবাসে।
আমরা ভালোবাসার কথা বলি, আমরা স্নেহের কথা বলি, আমরা পারিবারিক বন্ধনের কথা বলি। কখনো কি দেখেছেন, আমাদের কাছ থেকে কে কিভাবে ভালবাসা চায়? আমাদের কাছে থেকে কিভাবে স্নেহ চায়? অথবা কখনো কি খুব কাছ থেকে ভেবেছেন, কেন অনেক আদরে গড়া সোনার সংসার কেন ভেঙ্গে যায়? তার সব গুলো কারন যদি যোগ করেন, দেখবেন, একটাই উত্তর, আমি যেমন ভালবাসা চাই তেমনি সবাই আমার কাছ থেকে ভালবাসা চায়। নিবেন অথচ দিতে জানবো না তাহলে তো একবার পাব আর সেটাও হারিয়ে যাবে ২য় বারের বেলায়। সোনালী, আপনি সুখি হবেন আমার ধারনা। ভাল বাসুন যাকে আপনি ভালবাসেন, ঐ দূর পাহারের প্রতিধ্বনির মত আপনার দেওয়া ভালবাসাও চারিদিকের পাহার থেকে শত গুনে আপনার কাছে বিভিন্ন সুরে, বিভিন্ন রঙে আপনার কাছে ফিরে আসবে।
২৮/০৫/২০১৬- আমরা ভালোবাসার কথা বলি
Categories
আমরা ভালোবাসার কথা বলি, আমরা স্নেহের কথা বলি, আমরা পারিবারিক বন্ধনের কথা বলি। কখনো কি দেখেছেন, আমাদের কাছ থেকে কে কিভাবে ভালবাসা চায়? আমাদের কাছ থেকে কিভাবে স্নেহ চায়? অথবা কখনো কি খুব কাছ থেকে ভেবেছেন, কেন অনেক আদরে গড়া সোনার সংসার কেন ভেঙ্গে যায়? তার সবগুলো কারন যদি যোগ করেন, দেখবেন, একটাই উত্তর, আমি যেমন ভালবাসা চাই তেমনি সবাই আমার কাছ থেকে ভালবাসা চায়। নিবেন অথচ দিতে জানবো না তাহলে তো একবার পাব আর সেটাও হারিয়ে যাবে ২য় বারের বেলায়। সোনালী, আপনি সুখি হবেন আমার ধারনা। ভালবাসুন যাকে আপনি ভালবাসেন, ঐ দূর পাহারের প্রতিধ্বনির মত আপনার দেওয়া ভালবাসাও চারিদিকের পাহার থেকে শতগুনে আপনার কাছে বিভিন্ন সুরে, বিভিন্ন রঙে আপনার কাছে ফিরে আসবে।
২৮/০৫/২০১৬-আশ্বিন মাসের ভোরবেলায়
Categories
আশ্বিন মাসের ভোরবেলায় অতি ঈষৎ নবিন শীতল বাতাশে নিদ্রোত্থিত দেহে তরুপল্লব যেমন শিহরিত হয়, ভরা গঙ্গার উপর শরত প্রভাতের কাচা সোনা রোদ যেভাবে চাপা ফুলের মত ফুটে উঠে, আজ আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনার দুরন্ত যৌবন জোয়ারের জলের মধ্যে রাজ হাসের মত ভেসে উঠেছে। আপনি এতদিন হয়ত দিনের আলো কিংবা রাত্রির ছায়ায়তা দেখতে পান নাই, কিন্তু আজিকার এই বর্ষণ আপনার পঞ্জরে পঞ্জরে ঘৃতকুমারি নৌকার মত চারিদিকে ঘুরপাক খেয়ে আপনার চারিগাছি মল অনবদ্য এক প্রেমের সুচনা করেছে। অপেক্ষা করুন সে আসবে, আর সে আপনার জন্যই আসবে। যখন সে আসবে, দেখবেন ঐ দুরের ঘাটে যে ফিঙেটি বাসা বেধেছে সে কোন এক ভোরে উসুখুসু করে জেগে মৎস্যপুচ্ছের ন্যায় তার জোড়াপুচ্ছ দুই চারিবার দ্রুত নাড়াইয়া শিস দিয়া আকাশে উড়িয়া যাইবে। অথবা পাশের বাসায় কোন এক কোকিল উচ্চস্বরে ডাকিয়া কুহু কুহু গানে কলরব করিবে। তখন আপনার এই ইচ্ছা, এই সাধ বৃষ্টিতে ভিজার জন্য আর অপূর্ণ থাকবে না।
২৬/০৫/২০১৬-নাম না জানা মানুষ
Categories
আমি আপনার ভাল নাম জানি না। জানলেও যে খুব একটা লাভ হবে বা আমার চিন্তার মধ্যে কোন পরিবর্তন আসবে তাও না। আপনার নাম সোনালী না হয়ে রুপালী হলেও যা, পিংকি, সিন্থিয়া, কিংবা সাথী অথবা কবিতা হলেও তা। যাই হোক না কেন, আমি এখন আপনাকে ঐ সোনালীর আদবে একজন অপূর্ব সুন্দর, বা সুন্দরী (যদি মেয়ে হয়ে থাকেন) লক্ষি, আর ভক্তের ন্যায়ই দেখব। আপনার সাথে আমার মনের মিল আছে কিনা আমি জানতেও চাইব না, আপনার কি রঙ পছন্দ, কি গান আপনি পছন্দ করেন কিংবা কিসে আপনার কষ্ট হয়, অথবা কিসে আপনার কস্ট লাঘব হয় তার কোন দায়দায়িত্বও আমি নিতে চাইব না। কারন আমি প্রকাশ্য কোন মানবের কাছে প্রকাশ্য হতে চাই না। তবে যেটুকু আমার কাছে মনে হয়েছে আপনি রবিঠাকুর এর লেখা পছন্দ করেন, আপনি বনলতাকে ভালবাসেন, আপনি সোনালী রোদ ভালবাসেন। গ্রীষ্মের উষ্ণতা আপনি ভালবাসেন কিনা আমি জানি না, শ্রাবনের ধারা আপনাকে শিহরিত করে কিনা আমি জানি না, অথবা গ্রামের সেই বুড়িমার আচল ধরে পায়ে পায়ে হেটে নদীর ধারে গোসলের আগে কচিকচি পাতা তুলে মিথ্যে মালা গাথতে পছন্দ করেন কিনা আমি জানি না। তবে যে অপূর্ব নামে ছেলেটির মৃন্ময়ীর ভালবাসায় আপ্লূত হয়ে মন্তব্য করতে পারে, যে নাটোরের বনলতাকে বরন করে নিজেকে বনলতার মত গুনগুন করে গান গাইতে পারে, সে আর যাই হোক শ্রাবন নিশ্চয় তার প্রিয় ঋতুর মধ্যে একটা, অথবা বসন্তের বিকালে পায়ে পায়ে না হোক, ছলছল নেত্রে বুড়িমাকে দেখতে যাওয়ার ছলে অস্পৃশ্য কিছুর দেখা হোক তা নিশ্চয় মন থেকে ফেলে দেওয়া যায় না।
অস্পৃশ্য কোন কিছুর দিকে কখনো হাত বারাবেন না। ঐ অস্পৃশ্য জিনিসে যে একবার হাত বাড়িয়েছে, তার নির্ঘাত হয় মৃত্যু হয়েছে প্রেমের দিশানলে, না হয় সে দেবদাসের পার্বতীর মত বাস করেছে রানী হয়ে কিন্তু মন পরে ছিল ঐ কৃষ্ণকুন্ড গ্রামের দেবদাসের ঘরে। আর যদি তার থেকেও আপনি এককাঠি শক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি নিস্চিত থাকুন, আপনার যোগ্য কোন প্রেমিক বা পেমিকা এখনো এই পৃথিবীতে জন্ম নেয় নাই। আপনাকে ঐ অস্পৃশ্য মানুষের আত্তাকে নিয়েই চিরকুমার বা চিরকুমারি হয়ে থাকতে হবে।
ভয় আপনার রয়েই গেলো। ভয় কি আসলেই রয়ে গেলো? ক্ষমা করে দিবেন যদি আমার এই লেখা আপনার চরিত্রের সাথে মিলে গিয়ে থাকে, আর মাফ করে দিবেন যদি আমার এই অনুভুতি আপনার চরিত্রের কথাও না মিল খায়। সবটাই কল্পনা। আর কল্পনার রাজ্য থেকে কারো কোনদিন ফাসি হয়েছে এই তথ্য কোন আদালতে প্রমান পাওয়া যায় নাই।
২৫/০৫/২০১৬- জেগে থাকার অনেক নাম
Categories
জেগে থাকার আরও অনেক নাম আছে, কখনো এর নাম কষ্ট, কখনো এর নাম ভালবাসা, কখনো এর নাম আতংক, আবার কখনো এর নাম উদাসীনতা, আবার কখনো এর নাম শুধুই ভাললাগা। আপনি কোন সেই নামের কারনে জেগে আছেন? তবে আমি চাই না আপনার জীবনে ঐ কোন একটা নামের কারনে জেগে থাকেন যা মানুষকে আতংক গ্রস্থ করে তোলে, কিংবা কষ্টে রাখে। আর আমার প্রোফাইলের ছবির কথা বলছেন? এটা কোন কাল্পনিক ছবি নয়। এই ছবির মধ্যে আমার অস্পৃশ্য ছোঁয়া আছে, অস্পৃশ্য নান্দনিক কল্পনা আছে। আর ঐ লকেটের দুই ধারে যে চেইনটা দেখছেন, সেটা দিয়ে বাধা একটা হৃদয় যার দুইটা ধারের এক্তায় আমি আর আরেকটায় সে। ভাল থাকবেন
২৪/০৫/২০১৬-আকাশে বৃষ্টি একটু বাতাস
Categories
আকাশে বৃষ্টি, একটু একটু বাতাস, পাশে কফির কাপের কফি অনেক আগেই ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তারপরও সিগারেটের সঙ্গে খেতে মন্দ লাগে না। মনটা এই বৃষ্টির দিনে একটু ভারিই ছিল কিন্তু কথা হল, মনটাও হাল্কা হল। কিন্তু তুমি একই করলে হটাত? তুমি এমন ঝড়ের গতিতে কি করে এতটা পথ পারি দিয়ে উথাল পাতাল মন নিয়ে একেবারে চলে এলে আমার দরজার একেবারে অন্তরের কাছে? কি করে জানলে আমি তয়াম্র জন্য কতদিন ধরে অপেক্ষায় আছি? ভগবান অন্তর্যামী, সে সব জানে, আর সব পারে।
আমি শুধু সারপ্রাইজডই হই নাই, হয়েছি অনেক অনেক খুশি। কিন্তু মনের এক কোনায় আমার বড় একটা প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়ে গেলে আজ…… কেন ঐ চোখের কোনায় বৃষ্টির ফোঁটার মত পানি ঝরল? কোন ব্যাথা? কোন কষ্ট? কোন অপূর্ণ ইচ্ছা? কি সেটা আমার এখনো জানা হয় নাই? আমি কি দিতে চাই না তোমায়? তাহলে কি লুকিয়ে গেলে আজ আমার কাছে?
অমাবশ্যার রাতে আমি তোমার কাছে কোন চাঁদনী রাত দাবি করিনি, শীতের সকালে আমি তোমার কাছে শ্রাবনের ধারার একটা মূর্ছাও চাইনি, অথবা কোন এক চৈতালি দিনে আমি শীতের কুড়কুড়ে আমেজও চাই নাই । আমি শুধু চেয়েছি তুমি সুখি হও, তুমি আমার আদরে বড় হও। তাহলে কেন আজ আমি তোমার ঐ কাজল মাখা মায়াবি নয়নে কয়েক ফোঁটা জলের রেখা দেখলাম!
আমার এই অস্পৃশ্য হাত তোমাকে ছুয়ে দিল, তোমার নয়নে চুমু খেয়ে সব ক্লান্তি, সব দুঃখ, আর সব অবসাদ দূর করে দিল। শুধু শুধালাম, ভাল আছো তো এখন?
মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে ভিজা ভিজা নয়নে বললে আমায়, কতদিন দেখি নাই তোমায়!! তাই দুচোখে জল চলে এসেছিল। কোন কষ্টে নয়, কোন ব্যথায় নয়, কোন কিছু অপূর্ণতায় নয়, আজ এই হটাত পাগলের মত ছুটে না এলে হয়ত আমার সারাটা রাত শুধু শ্রাবনই হত, কিন্তু এইটুকু সময়ের জন্য হলেও এখন মনে হল, আনন্দের সবটুকু নিলিমা দিয়ে তোমার এই অস্পৃশ্য আদর আমার প্রতিটি গালে, প্রতিটি নয়নে, প্রতিটি রন্দ্রে রন্ধ্রে শিতল করে দিল।
মুচকি হেসে বললাম তারে, আমি কি কখনো তোমাকে বলেছি যে আমি তোমায় ভালবাসি?
হ্যা, জেনে রাখ, আমি তোমায় ভালবাসি।
১৫/০৫/২০১৬-রবিঠাকুর তার সমাপ্তি গল্পে
Categories
রবিঠাকুর তার সমাপ্তি গল্পে মৃন্ময়ীর বাল্য আর যৌবনকাল কিভাবে দ্বিখণ্ডিত হইয়া গিয়াছিল তার চমৎকার একটা বর্ণনা করিয়াছিলেন ঠিক এইভাবে-” নিপুন অস্ত্রকার এমন সূক্ষ্ম তরবারি নির্মাণ করিতে পারে যে, তদ্বারা মানুষকে দ্বিখণ্ডিত করিলেও সে জানিতে পারে না, অবশেষে নাড়া দিলে দুই অর্ধখন্ড ভিন্ন হইয়া যায়। বিধাতার তরবারি সেইরূপ সূক্ষ্ম, কখন তিনি মৃন্ময়ীর বাল্য ও যৌবনের মাঝখানে আঘাত করিয়াছিলেন সে জানিতে পারে নাই। আজ কেমন করিয়া নাড়া পাইয়া বাল্য- অংশ যৌবন হইতে বিচ্যুত হইয়া পড়িল এবং মৃন্ময়ী বিস্মিত হইয়া ব্যথিত হইয়া চাহিয়া রহিল।”
আমিও যেদিন এই অস্পৃশ্য পুরুষটাকে প্রথম আমার অন্তরদৃষ্টি দিয়া দেখিয়াছিলাম, তখন আমিও ব্যথিত হৃদয়ে বুঝিতে পারিলাম, আমার আর বাল্যকাল বলিয়া কিছুই অবশিষ্ট নাই। আমার বাল্যকাল আমার অজান্তেই আমা হইতে কবে বিদায় নিয়া চলিয়া গিয়াছে, আমি বর্ষার কিংবা শরতের অথবা শীতের কোন ঋতুতেই তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। যখন বুঝিতে পারিলাম, তখন আমার শুধু এইটুকু মনে হইল আম্র কাননের শুভিত কোন পুস্পের জন্য যখন মৌমাছিরা দূর দূরান্ত হইতে উড়িয়া আসে, আমিও তাই। কিন্তু আমার ভ্রম কাটিতে বেশি সময় লাগিল না। আমি যাহাকে পুস্প বলিয়া এতদূর উড়িয়া আসিয়াছি, উহা আসলে অন্য কাহারো বাগানের মৌমাছিমাত্র। সেই বাগানে পুস্প আছে, তাহার সহিত মৌমাছির সঙ্গে তাহার দলবলও আছে। বাগানের মালিও আছে, মালিকও আছে। আমি উহাতে বিচরন করিতে পারি কিন্তু উহা আমার নয়। আমি তাহাকে দূর হইতে আপন ভাবিতে পারি কিন্তু কাছে গিয়া বলিতে পারি না, ইহা আমার। আমি ইহাকে অনুভব করিতে পারি কিন্তু জড়াইয়া ধরিয়া গলা ফাটাইয়া বলিতে পারি না, এই পৃথিবীতে আমি আসিয়াছি শুধুমাত্র ইহার পাজর হইয়া।
আমি যাহা দেখিতে পাইতেছি জগতে তাহা হইতে আরও অধিক সৌন্দর্যের আর অধিক আকর্ষণীয় হয়ত কিছু আছে কিন্তু যাহাকে একবার মনে ধরিয়াছে, তাহা হইতে আরও কোন দামী, আকর্ষণীয় অথবা মূল্যবান হাতের কাছে আনিয়া দিলেও মনে হইবে, আমি উহা চাই নাই। আমি চাহিয়াছি শুধু উহা যাহা আমার কাছে এখন অস্পৃশ্যই। তারপরেও সে আমার। মনের ভিতরের যে জগত সেখানে তো আর এই বায্যিক পৃথিবীর কোন আইন বা আদালতের অস্তিত্ব নাই। তাই নীলিমার আকাশের দিকে তাকাইলেও আমি তাহাকে দেখি আবার ঘন বর্ষার বৃষ্টির ছায়াতলেও আমি তাহাকে দেখি। কখনো সে আমাকে জলের মত ভাসাইয়া লইয়া যায় অতল সমুদ্রের গহিনতলে আবার কখনো সে আমাকে জলের স্রোতে ভাসাইয়া দেয় আমার দুই নয়নের ধারা।
১৪/০৫/২০১৬-বহুবছর আগে যখন
Categories
আজ থেকে বহু বছর আগে যখন তোমার এই পৃথিবীতে আগমন হইয়াছিল, তারও অনেককাল পরে আমি এই পৃথিবীর নীল আকাশ দেখিয়াছিলাম, লাল সূর্য দেখিয়াছিলাম, বাতাসের গন্ধ শুকিয়াছিলাম। কিন্তু তখন আমার কাছে ঐ নীল আকাশ শুধু নীলই ছিল, সূর্য তখন একটা জলন্ত অগ্নিপদার্থ হিসাবেই ছিল, বাতাসের গন্ধ আমি ভাল করে মনেও করিতে পারি নাই। কিন্তু যেদিন তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হইয়াছিল, আমি নীল আকাশের মাঝে নীলমেঘ দেখিয়াছিলাম, ঐ মেঘেরা কিভাবে একস্থান হইতে ভাসিয়া ভাসিয়া অন্যত্র চলিয়া যায় তাহা দেখিয়াছিলাম, ঐ প্রখর সূর্যের আলো আমার অপেক্ষার পালাকেও যন্ত্রনা দিতে পারে নাই, বাতাসের গন্ধের সঙ্গে আমি আরও একটা গন্ধ শুকিয়াছিলাম। আর সেটা তোমার গায়ের গন্ধ, তোমার সুগন্ধির গন্ধ, তোমার ক্লান্তির ঘর্মাক্ত শরীরে গন্ধ।
আজ অনেক বছর হইয়া গেলো, আমি এখনো সূর্যকে দেখি, আমি ঐ নীলাকাশ দেখি, ঐ নীলাকাশের নীল মেঘগুলি দেখি, দক্ষিনা বাতাসের গন্ধও শুকি। সবকিছু আগের মতই আছে বলিয়া মনে হয়। শুধু মনে হয় ঐ বাতাসের সাথে তোমার গায়ের গন্ধটা নাই, তোমার সুগন্ধির গন্ধটা নাই, তোমার গায়ের সেই ক্লান্তির ঘর্মাক্ত গায়ের গন্ধটাও নাই।
আমি অনেক খুজেছি তোমায়, ” শিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে…… “
আচ্ছা তুমি কি কোথাও নাই?
২২/০৩/২০০০-কিছুক্ষন বারান্দায়।
হালিশহর মেস, বুধবার, সময়-১৯২৫ ঘন্টা।
আর্টিলারি সেন্টার এন্ড স্কুল, হালিশহর। …
আমি দাড়িয়েছিলাম কিছুক্ষন বারান্দায়। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো তখন। তিনতলা থেকে অনেকদূর পর্যন্ত শহরের আলো দেখা যাচ্ছিলো। বেশ দূর থেকে চট্টগ্রাম শহর থেকে ট্রেনের হুইশেলের আওয়াজ শুনা যাচ্ছিলো। আর্টিলারি মেস হালিশহর, প্রায় ১০/১২ কিলোমিটার দুরে। তারপরেও এখান থেকেই যেনো বুঝতে পারছিলাম ট্রেন প্রায় ছাড়বে ছাড়বে। লোকজন নিশ্চয় খুব ব্যস্ত এখন, কেউ প্লাটফর্মে, কেউ কামড়ার ভিতরে। কেউ হয়ত তার প্রিয়জনকে বিদায় দিতে এসে চোখের জল মুছছে, আবার কেউ হয়ত এই শহর ছেড়ে যেতে পারলেই বাচি বলে চোখ বুজে আছে। দুনিয়া বড় আজব।
আমাদের আর্টিলারি সেন্টার এন্ড স্কুলের রাস্তা দিয়ে দুয়েকটি প্রাইভেট কার চলাফেরা করছে। আমি বারান্দায় একা, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি, আর সিগারেট টানছি। মশারা আমাকে একা পেয়ে বেশ খাবলে খাবলে খাওয়ার চেষ্টা করছে। বিরক্ত হচ্ছি না। আমার মৃত্যুর কথা মনে পরলো।
এটাই মনে হলো যে, এখন যা চলছে, এইসব কিছুই তখনো চলবে। দিনের শেষে অন্ধকার হয়ে যাবে, লোকজন যার যার ঘরে ফিরে আসবে। নিত্য নৈমিত্তিকের মতো খাওয়া দাওয়া করবে, টিভি, সিনেমা সবই চলবে, গল্প করবে, হাসি তামাশা, কিংবা পাখিদের কিচির মিচির, সকালের সূর্য উঠা কিংবা এই একটু আগে যেভাবে সূর্য ডোবে গিয়ে এখন একটা ভুতুরে সন্ধ্যা নামিয়ে দিয়েছে এই রকম করে আবারো ভুতুরে এক সন্ধ্যা তখনো নামবে। এই যে আমি আজ যেখানে দাড়িয়েছিলাম ঠিক এই জায়গাটাতে হয়ত এমনি করেই আরো একজন দাঁড়িয়ে হয়তো আমার মতোই ভাববে। কেইবা জানে, এখন থেকে অতিতে কোনো একসময় আরো একজন কেউ এমন করে ভেবেছিলো কিনা। হয়তো বা কোনোটাই সত্য নয়।
আমার আরো অনেক কিছু ভাবনা, অনেক কিছু কথা মনে আসছিলো। এই আমার মা, আমার বোন, আমার ভাই, আমার বউ, আমার মেয়ে, আমাদের নসিরন, তার সাথে বদিভাই, শিমুল, মোস্তাক ইত্যাদির মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে? কেউ কারো কাছে কোনো কিছুর জন্যই বাধ্য নয়। ছোট বড় সবার জন্য এক পলিসি, তারপরেও নিজেদের টানে, নিজেদের স্বার্থের কারনে একে অপরের কাছে চলে আসে। আবার কোন এক অস্থিরতার মধ্যেই তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। আর এর মাঝেই মানুসজন নিজেদের কারনেই কিছু কিছু কমন নিয়ম কানুন মেনে চলে। সেগুলো নিতান্তই নিজেদের স্বার্থেই।
আজ থেকে হাজার বছর পূর্বের আমার পূর্ব পুরুসের নাম আমি যেমন জানি না, আমার প্রয়োজন নেই তাদের নাম জানার। তারা আমার জীবনে কোনো কাজে আসবেন না, আর এজন্যই আমি তাদের খোজ করি না, নাম জানি না, জানার প্রয়োজন বোধ করিনা। তাহলে আজ থেকে পরের হাজার বছর পরেও কেনো আমার বংশধরেরা আমাকে খোজে বের করবে? কোন যুক্তি আছে? নাই।
অংক একটাই। কবরের পাশে নিজের নাম খোদাই করা থাকলেও তাদের প্রয়োজনেই ওই নাম প্রতিস্থাপক হয়ে আরো নতুন নাম সেখানেই ঢোকবেই। আর একেই বলে রিপ্লেস্মেন্ট। অতএব কোথাও তোমার পদধ্বনি থাকবে বলে আশা করো না। এই পৃথিবী বর্তমানের অধীশ্বর। আমার বলতে কিছু নাই। তোমার বলতেও কিছু নাই।
-হতাত কার হাতের স্পর্শে যেনো সম্বিত ফিরে পেলাম। ঘাড় নেড়ে দেখি, আমার দোস্ত মেজর আকবর। আমরা একসাথে গানারী স্টাফ কোর্স করতে এসেছি। আকবর ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র আর আমি মির্জাপুর ক্যাডে কলেজের। আকবরের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় শহিদুল্লাহ হলের ক্যাম্পাসে।