৪/৪/২০২১-রিভার সাইডের ইতিকথা

সনটা ছিলো ২০০৪। 

তখন মীরপুর সেনানীবাসে ৪ ফিন্ড আর্টিলারিতে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে কর্মরত আছি।  আমার প্রমোশন হবার কথা মেজর থেকে লেফটেনেন্ট কর্নেল পদে। কিন্তু মামুলি একটা কারন দেখিয়ে তারা আমাকে প্রমোশন দিলো না। স্টাফ কলেজ করেছি, গানারী স্টাফ করেছি, ডিভ লেভেলে জিএসও -২ (অপারেসন) হিসাবে কাজ করেছি, আর্মি হেড কোয়ার্টারে ও জি এস ও-২ হিসাবে কাজ করেছি। প্রমোশনের জন্য কোনো প্রকার কমতি আমার নাই। কিন্তু তারপরেও আমাকে প্রমোশন না দিয়ে আমার জুনিয়র ১৪ লং কোর্সের মেজর মজিস, যে কিনা ক্যাটেগরি-সি , স্টাফ কলেজ ও করে নাই, গানারী স্টাফ ও করে নাই, সে আমার বদলে প্রমোশন পেয়ে ৪ ফিল্ডে পোস্টিং এসেছে। এটা শুধু মাত্র সে খালেদা জিয়ার সাথে কোনো না কোন ভাবে পরিচিত। শোনা যায় যে, মজিদের বাবা খালেদা জিয়ার বাসায় নাকি মালীর কাজ করতো। আর সে সুবাদেই এই নেপোটিজম। এর কোনো মানে হয়? সিদ্ধান্ত নিলাম, এপেন্ডিক্স-জে (ইচ্ছেকৃতভাবে অবসর নেওয়া) দিয়ে আর্মি থেকে চলে যাবো।  সাথে সাথে এটাও ভাব লাম যে, বাইরে গিয়ে কোনো চাকুরী ও করবো না। কিন্তু কি ব্যবসা করবো সেটা তো কখনো শিখি নাই। একচুয়ালি, আর্মির অফিসার গন, সারাজীবন তাদের ডেডিকেসন থাকে আর্মির যাবতীয় কাজে, সে আর কোনো বিকল্প কাজ শিখেও না। ফলে আমারো তাই হয়েছে। অনেক ভাবছিলাম, কি করা যায়। কিন্তু কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না।

ঠিক এই সময় একটা ঘটনা ঘটে গেলো। কোনো এক কাকতালীয় ভাবে একদিন আমার সাথে  নাজিমুদ্দিনের পরিচয় হয় মীরপুর সেনানীবাসে। আমিই তাকে মীরপুর সেনানিবাসে দাওয়াত করেছিলাম কারন সে আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলো। আমি কখনোই নাজিমুদ্দিনকে সামনাসামনি দেখিও নাই, কথাও বলি নাই যদিও সে আমাদেরই এলাকার লোক। নাজিমুদ্দিন এলাকায় একজন খুব প্রতাপশালী খারাপ মানুষের মধ্যে একজন ছিলো। ধর্মের কোনো বালাই ছিলো না, সারাদিন মদের উপর থাক্তো, আর নারী ছিলো তার প্রিয় ভোগের মধ্যে একটি। সিনেমার জগত থেকে শুরু করে, সঙ্গীত রাজ্যের সব নারীদের এবং সাধারন মেয়েরা কেউ তার হাত থেকে রেহাই পায় নাই। তার টাকা ছিলো, ফলে টাকার জন্য ই সব ক্লাসের অর্থলোভী মেয়েগুলি তাকে দিনে আর রাতে সঙ্গ দিতো। সে বসুন্ধরার প্রোজেক্ট সমুহে মাটি সাপ্লাই দেওয়ার বৃহৎ একচ্ছত্র সাপ্লাইয়ার ছিলো। জমি দখল, অবৈধ ভাবে মাটি কাটা, অন্য মানুষের জমি কম দামে ক্রয় করে বসুন্ধরাকে দেওয়া, এই ছিলো তার কাজ। কিন্তু তার একটি জায়গায় সে কখনো ই বুদ্ধিমান ছিলো না। সে সব সময় পাওয়ার অফ এটর্নি বা আম মোক্তার নিয়ে জমি ক্রয় করত। সেই রকম ভাবে আমাদের গার্মেন্টস বিল্ডিংটা যে জমির উপর অবস্থিত, সেটা জনাব আব্দুল বারেক এবং তার পরিবারের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলো। হয়ত কিছু টাকা বাকী থাকতে পারে। কিন্তু সে জমিটা রেজিস্ট্রি করে নেয় নাই। পরিবর্তে সে বারেক সাহেব এবং তার পরিবারের কাছ থেকে পাওয়ার অফ এটর্নি নিয়ে এখানে দশ তালা ফাউন্ডেসন দিয়ে হাসনাবাদ সুপার মার্কেট নামে আপাতত তিন তালা বিল্ডিং (সাথে একটি বেসমেন্ট) তৈরী করে। 

প্রাথমিকভাবে সে নিজেই একটা গার্মেন্টস দিয়েছিল এবং এর নাম রেখেছিলো "রিভার সাইড সুয়েটারস লিমিটেড", বেশ সুন্দর নাম। নাজিমুদ্দিন সাহেব গার্মেন্টস চালানোর জন্য যে জ্ঞ্যান, যে বিদ্যা থাকা দরকার সেটা তার কিছুই ছিলো না। কিন্তু তার অনেক টাকা ছিলো। ফলে গার্মেন্টস এর জন্য তিনি যাদেরকে অংশীদারী দিয়েছেন, তারা সবাই ছিলো নিজেদের আখের গোছানোর ধান্দায়। ফলে ধীরে ধীরে অত্র গার্মেন্টস শুধু লোক্সানের দিকেই যাচ্ছিলো। এই লোক্সান এক সময় নাজিমুদ্দিনের কাছে খুব বিরক্তিকর মনে হচ্ছিলো বটে কিন্তু সে অন্য দিকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীটা রাখতেও চাচ্ছিলো। 

অনেক কথাবার্তার পর, নাজিমুদ্দিন আমাকে একটা অফার দিলো যে, যদি আমি চাই তাহলে আমি তার রিভার সাইড সুয়েতারস ফ্যাক্টরী টা চালাইতে পারি। তিনি আমাকে ৩০% শেয়ার দিবেন আর তিনি ৭০% শেয়ার নিজে রাখবেন। এদিকে আমি কোনো কিছুই বুঝি না কিভাবে কোথা থেকে গার্মেন্টস এর অর্ডার নিতে হয়, কিভাবে ব্যাংকিং করতে হয়, কোনো কিছুই না। কিন্তু সাহস ছিলো অনেক। পরের দিন আমি রিভার সাইড সুয়েতারস দেখতে গেলাম। প্রায় বন্ধ অবস্থায় আছে ফ্যাক্টরীটা। মাত্র ১৮ জন অপারেটর কাজ করছে। কারেন্ট লাইন বন্ধ কারন প্রায় ৪ মাসের অধিক কারেন্ট বিল বাকী আছে। গ্যাস লাইন ও বন্ধবিল পরিশোধ না করার কারনে। ব্যাংকে প্রায় তিন কোটি টাকা লোনা আছে। ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ না করার কারনে কোন এল সি করা যায় না, সি সি হাইপোর কোনো সুযোগ নাই। এর মানে ফ্যাক্টরীটা একেবারেই লোকসানের প্রোজেক্ট। ব্যাংক ম্যানেজার ছিলেন তখন মিস্তার তাহির সাহেব এবং সোস্যাল ইস লামী ব্যাংকের এম ডি ছিলেন তখন মিস্তার আসাদ সাহেব। ঊনারা দুজনেই একটা উপদেশ দিলেন যে, যদি আমি নিতে চাই, তাহলে ব্যাংক রি সিডিউলিং করতে হবে। ব্যাংক রিসিডিউলিং কি জিনিষ তাও আমি জানি না। যাই হোক, শেষ অবধি আমি রিস্ক নেওয়ার একটা প্ল্যান করলাম। 

ফ্যাক্টরীটা তখন চালাচ্ছিলো জনাব লুতফর রহমান নামে এক ভদ্রলোক। এরও স্বভাবের মধ্যে অনেক খারাপ কিছু ছিলো। সে রীতিমতো জুয়া এবং নারীঘটিত ব্যাপারে খুব আসক্ত ছিলো। সাবকন্ট্রাক্ট করে যে টাকা পেতো, সেটা শ্রমিকদের মুজুরী না দিয়ে জুয়ার আসরেই বসে হেরে আসতো। ফলে প্রতিনিয়ত শ্রমিকগন সবশেষে সেই আবারো নাজিমুদ্দিনের বাসার সামনে গিয়েই বেতনের জন্য আন্দোলন করা ছাড়া কখনো বেতন পাওয়ার সম্ভাবনা থাক্নতো না। নাজিমুদ্দিন এতোটাই বিরক্ত ছিলো যে, কোনোভাবে এটা অন্য কারো হাতে দিতে পারলে সেও যেনো বেচে যায়।

ব্যাংক রিসিডিউলিং করার জন্য মোট ৪০ লাখ টাকার প্রয়োজন। আমার কাছে এতো টাকা ছিলোও না। ফলে আমি আমার পরিচিত কিছু সিনিয়র আর্মি অফিসারদের সাথেও কথা বললাম যারা খুব তাড়াতাড়ি আর্মির চাকুরী ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন। কিন্তু সবাই লাভ চায়, আনসারটেনিটিতে কেউ ইনভেস্ট করতে চায় না। ফলে আমার পরিচিত আর্মি অফিসার গন ক্রমে ক্রমে পিছু হটে গেলেন।

কোন উপায়ন্তর না দেখে আমি আমার বড় ভাই হাবীবুল্লাহ যিনি আমেরিকায় থাকেন, তার কাছ থেকে তখন ৪০ লাখ টাকা ধার নিলাম এবং বাকী সব রি সিডিউলিং করে নিলাম। সাথে ৩০% শেয়ারের সমান টাকা আমি নাজিমুদ্দিন কেও দিয়ে দিলাম (কিছু জমি দিয়ে আর কিছু ক্যাশ দিয়ে)।

এতে আরেকটি সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিলো। আমি ছিলাম রিভার সাইড সুয়েতারস এর চেয়ারম্যান আর নাজিমুদ্দিন ৭০% নিয়ে থাক্লেন এম ডি হিসাবে। কিন্তু নাজিম ভাই অফিশিয়াল কোনো কাজেই ইনভল্ব হলেন না। তার দস্তখত লাগ্লেও তাকে কোথাও খুজেই পাওয়া যায় না। তাছাড়া রুগ্ন এই ফ্যাক্টরিতে অনেক প্রয়োজনেই টাকাও লাগতোকিন্তু নাজিমুদিইন ভাই তার কোন ভাগ ই নিতেন না। আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে সার্বক্ষণিক টাকা ধার করে করে চালাইতে শুরু করলাম বটে কিন্তু একটা সময় আমার পক্ষে আর চালানো সম্ভব হচ্ছিলো না।

উপান্তর না দেখে একদিন আমি নাজিমুদ্দিন ভাইকে বললাম যে, হয় আমার ৩০% শেয়ার আবার তিনি নিয়ে আমার ইনভেস্টমেন্ট ফেরত দিক অথবা বাকী ৭০% শেয়ার একেবারে আমার নামে ট্রান্সফার করে দিক যেনো আমি আমার মতো করে চালাইতে পারি। তখনো ব্যাংকে প্রায় তিন কোটি টাকার মতো বাকী। কিস্তি দিতে পারছি না। এল সি করতে পারছি না। শুধু নিজের পকেট থেকেই টাকা খরচ হচ্ছে। নাজিম ভাই চালাক মানুষ। তিনি সব লোন আমার নামে ট্রান্সফার করে আর কিছু টাকা ক্যাশ নিয়ে পুরু ৭০% শেয়ার বিক্রি করতে রাজী হয়ে গেলেন। ফ্যাক্টরীর এসেট, লায়াবিলিটিজ হিসাব কিতাব করে শেষ পর্যন্ত আমি বাকী ৭০% শেয়ার নিয়ে আরেকবার রিস্ক নেওয়ার সাহস করলাম। আমার সাথে নতুন লোক মিস্তার মোহসীন (যিনি এক সময় এই ফ্যাক্টরীর ডি এম ডি হিসাবে কাজ করতেন) যোগ হলেন। তাকে আমি খুজে বের করেছি এই কারনে যে, তিনি গার্মেন্টস লাইনে বেশ পাকা, বায়ার দের সাথে তার পরিচয় আছে, ব্যাংকিং বুঝে। আমি তাকে বিনে পয়সায় ৩০% শেয়ার লিখে দিয়ে তাকে চেয়ারম্যান করলাম আর আমি এম ডি হয়ে গেলাম।

নতুন করে আবার ইনভেস্টমেন্ট এর পালা। আমি আমার আত্মীয় জনাব মুস্তাক আহ মেদ (আমার স্ত্রীর ছোট ভাই, যিনি আমেরিকায় থাকে) কে গার্মেন্টস এর শেয়ার চায় কিনা জানালে তিনি ২৫% শেয়ার নেওয়ার একটা ইন্টারেস্ট দেখান এবং তিনি প্রায় ৪৫ লাখ টাকা যোগান দেন। এইভাবে আমি আরো অনেক স্থান থেকে ফান্ড যোগার করে করে ফ্যাক্টরীটি চালানোর চেষ্টা করছিলাম। প্রচুর সময় দিচ্ছি, রাত ফ্যাক্টরীতেই কাটাই প্রায়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ফ্যাক্টরিটা ঘুরে দারাচ্ছিলো না। এক সময় আমার মনে হলো, মোহ সীন সাহেব নিজেই ফ্যাক্টরীর উন্নতির জন্য মন দিয়ে খাটছেন না। তিনি যেহেতু নিজে কোনো টাকা ইনভেস্ট করে নাই, ফলে তার সিন্সিয়ারিটি আমার কাছে একটা প্রশ্নের উদ্রেক করলো। সেলারীর সময় তিনি ট্যাব লিকে চলে যান, খুব কম রেটে অর্ডার নেন, কস্টিং প্রাইসের চেয়েও কম রেট। ফলে আমি লোনে ডুবে যাচ্ছিলাম। কিছুতেই আর সামাল দিতে পারছিলাম না। 

অবশেষে ২০০৭ এর শেষে আমি ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিলাম যে, যা লস হবার হয়ে গেছে, এবার আর লস দিতে চাই না। আমি ফ্যাক্টরী বিক্রি করে দেবো এবং ব্যাংকের টাকা শোধ করতে পারলেই হবে। কারন ব্যাংক লোন তো এখন আমার উপরেই একা। যদিও মোহসীন সাহেন ৩০% এর মালিক কিন্তু তার কোনো টাকা নাই এবং তিনি এই ব্যাপারে কোনো সংকিতও নন। আমি মোহসীন ভাইকে বললাম যে, আমি ফ্যাক্টরী বিক্রি করতে চাই। তিনি একজন গ্রাহক আনলেন, নাম মিস্টার মুরতুজা আর শ্রীলংকান এক ভদ্রলোক নাম প্রিয়ান্থা। ঊনারা এমন একটা প্রপোজাল দিলেন, আমি হিসেব করে দেখলাম যে, আমি লোন থেকে বেরিয়ে যেতে পারি।

মিস্টার মুরতুজা এবং মিস্টার প্রিয়ান্থা দুজনেই গার্মেন্টস লাইনে বেশ পাকা এবং তারা প্রফেসনাল। তারা নতুন করে ফ্যাক্টরীটা আবার তাদের মতো করে সাজিয়ে ব্যবসা করবেন এবং এটা সম্ভব।

মুর্তজা ভাই এবং মিস্টার প্রিয়ান্থা ধীরে ধীরে এলাকা সম্পর্কে জানতে জানতে একটা জিনিষ বুঝলেন যে, এই এলাকাটি সভ্য কোনো জায়গা নয় এবং এখানে ব্যবসা করতে গেলে লোকাল সাপোর্ট ছাড়া কোনোভাবেই ব্যবসা করা সম্ভব নয়। এই ফিডব্যাকটা তারা লোকাল এলাকা, বিভিন্ন বন্ধুবান্ধব, এবং স্টাফদের ছাড়াও ব্যাংক থেকে পেলেন যে, হয় মিস্টার নাজিমুদ্দিন অথবা মেজর আখতারকে সাথে না নিলে নিরাপদে এখানে ব্যবসা করা সম্ভব না। এই এলাকাটি আবার আমার নিজের। সবাই আমাকে চিনে। তারমধ্যে আমি একজন আর্মি অফিসার হওয়াতে সবাই আমাকে একটু ভয়েও থাকে।

হতাত করে একদিন মুরতুজা ভাই এবং প্রিয়ান্থা আমার মিরপুরের বাসায় রাত ১১ টায় এসে হাজির। তারা আমাকে এইমর্মে জানালেন যে, তারা ১০০% শেয়ার কিনবেন না। ৯০% শেয়ার কিনবেন এবং ১০% শেয়ার আমাকে রাখতেই হবে। আমি আমার সময়মতো ফ্যাক্টরীতে আসতে পারবো এবং আমি আমার এমডি পোস্টেই থাকবো। সম্মানি হিসাবে আমি তাদের সমান সম্মানিই পাবো। ব্যাপারটা আমি সবশেষে মেনেই গেলাম। অর্থাৎ আমি ১০%, মুরতুজা ভাই ৪৫% আর প্রিয়ান্থা ৪৫% শেয়ার নিয়ে আবার ফ্যাক্টরী রান করতে শুরু করলো। এবার এটা প্রান ফিরে পেলো।

২০১০ সালে প্রিয়ান্থা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৪১ বছর বয়সে মারা যান। ইতিমধ্যে মুরতুজা ভাই আমি কেমন লোক, কেমন চরিত্রের মানুষ, সেটা বুঝে গিয়েছিলেন। আমি আসলে মাত্র ১০% শেয়ার নিয়ে কোনো হস্তক্ষেপই করছিলাম না। কারন ঊনারা ৯০% এর মালিক, সেখানে আমার  মন্তব্য কিংবা আমার কোনো সাজেশন খুব একটা মুল্যায়ন করা হবে কি হবে না সেটা নিয়ে আমি একটু তো সন্দিহান ছিলামই। ফলে আমি জাস্ট নামেমাত্র এমডি হিসাবেই ছিলাম আর লোকাল কোনো সমস্যা হলে সেটা আমি সামাল দিতাম। কোথায় কোন বায়ারের অর্ডার, কিংবা কবে কোন শিপমেন্ট এগুলো নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামাইতাম না।

আমার যখন এই রকম এক্টা অবস্থা, আমি তখন নিজে নিজে কিছু করা যায় কিনা সেটাও ভাবছিলাম। ফলে ডেভেলপারের কাজেও একটা চেষ্টা করছিলাম, যার ফল হচ্ছে বাসাবোতে একটা প্রোজেক্ট। সেটার ইতিহাস অন্য রকম। এটা না হয় পরেই বলবো।

প্রিয়ান্থা মারা যাবার পর, মুরতুজা ভাই প্রিয়ান্থার ৪৫% শেয়ারের মধ্যে তিনি নিলেন ২০% আর আমি নিলাম ২৫%। এতে আমার শেয়ার দাড়ালো ৩৫% আর মুরতুজা ভাইয়ের শেয়ার দাড়ালো ৬৫%। ২৫% শেয়ার নেবার জন্য আমি মুরতুজা ভাইকে ৫৮ শতাংশ জমি লিখে দিতে হলো। এভাবেই বর্তমান পর্যন্ত চলছে। ফ্যাক্টরি ধীরে ধীরে বেশ উন্নত করতে লাগলো। কিন্তু আমার ভিতরে একটা আনসারটেনিটি সবসময় কাজ করতো যে, একটা সময় আসবে যে, মুরতুজা ভাই কোনো না কোনো সময় এর বিকল্প হিসাবে অন্যত্র বেরিয়ে যাবেনই। ফলে আমি নিজেও রিভার সাইড সুয়েটারস এর পাশাপাশি আরো কোনো ব্যবসা করা যায় কিনা আমি একটা বিকল্প খুজছিলাম। হয়ত তার ই একটা বিকল্প প্রোডাক্ট ব্যবসা হিসাবে মা ইন্ডাস্ট্রিজের  জন্ম। ওটাও আরেক ইতিহাস। এটাও পরে বলবো। 

গত ৮ জানুয়ারী মাসে সড়ক ও জনপথ আমাদের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীটির কিছু অংশ ভেঙ্গে দিয়ে যায় কারন আমাদের ফ্যাক্টরী বিল্ডিংটি বিল্ডিং এর মালিক জনাব নাজিমুদ্দিন সাহেব গায়ের জোরে সরকারী জায়গায় কিছুটা অংশ বাড়তি তৈরী করেছিলেন। বর্তমানে পদ্মা সেতু বানানোর কারনে সরকার তার নিজের জায়গা দখল করতে গিয়ে আমাদের বিল্ডিং ভেঙ্গে দিয়ে গেলো। তাতে আমাদের কোন সমস্যা ছিলো না। সমস্যাটা হয়েছে গার্মেন্টস বায়ারদের আসোসিয়েসন একরড আমাদের বিল্ডিংটা আন্সেফ করিয়ে দিলে আর কোনো বায়ার এখানে অর্ডার প্লেস করবেনা। তাতে আমাদের ব্যবসা লাটে উঠবে। আমরা এখানেই পথে নেমে যেতে হবে।

যেদিন সড়ক ও জনপথ আমাদের ফ্যাক্টরী বিল্ডিংটা ভেঙ্গে দিয়ে যায়, সেদিন ছিলো আমাদের জন্য একটা মারাত্মক বিপর্যয়। একদিকে উক্ত বিল্ডিং এবং জমির মালিকানা নিয়ে কয়েকটি দলের সাথে কোন্দল, মামলা, মারামারি এবং সন্ত্রাসী হুমকী ইত্যাদি, অন্যদিকে সড়ক ও জনপথের নিজস্ব জায়গাউদ্ধারের কারনে ভাঙ্গাভাঙ্গি, ফলে মাঝখানে আমরা যারা অনেক টাকা এই বিল্ডিং এ ব্যবসার কারনে ইনভেস্ট করে ফেলেছি সেটা একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। 

যেদিন থেকে জনাব নাজিমুদ্দিন মারা গেলো, তার পরের থেকেই একের পর এক বাহিনী এই জমি এবং বিল্ডিং দখল করে ফেলার জন্য পায়তারা করছে। জনাব বারেক আমাকে উকিল নোটিশ দিয়েছে যেনো তাকে ভাড়া দেওয়া হয়, আবার নাজিমুদ্দিনের তিন বউ সরাসরি ভাড়া চায়, অন্যদিকে জরীফ নামে আরেক লোক পুরু জমি এবং বিল্ডিং এর মালিকানা দাবী করছে। আমার এইখানে এডভান্স দেওয়া আছে প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা। ফলে আমার এই অগ্রিমের টাকাকে ফেরত দেবে তার কোনো দায়ভার কেউ নিতে চাইছে না। তাহলে আমার এতোগুলি টাকার কি হবে? আমি কাউকেই আর ভাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নই। আজ প্রায় ৩৮ মাস হয়ে গেছে আমি কোনো ভাড়া দিচ্ছি না। 

জমি এবং বিল্ডিং নিয়ে নাজিমুদ্দিনের তিন বউ আরেক বাহিনী জনাব বারেক সাহেবের সাথে কখনোই সমঝোতায় পৌছতে পারছিলো না। মিস্টার বারেক, নাজিমুদ্দিনের পরিবার কিংবা বারেকের অন্যান্য পরিবারের সদস্যরা ও আমাকে অফার করেছে যদি আমি কিছু টাকা দিয়ে উক্ত বিল্ডিং এবং জমি বারেক সাহেব্দের কাছ থেকে কিনে নেই কিংবা নাজিমুদ্দিনের পরিবার ও আমাকে এক ই ধরনের অফারকরেছিল।  কিন্তু আমি কোনো ভাবেই প্ররোচিত হইনাই। এর বদলে, আমি চেষ্টা করছিলাম যে, কোনোভাবে মিস্টার বারেক এবং নাজিমুদ্দিনের পরিবারের মধ্যেকোনো ভাবেই সমঝোতা করা যায় কিনা। কেউ ইসমঝোতার কাছাকাছি ছিলেন না। ফলে এটা এভাবেই স্ট্যাল্মেট অবস্থায় চলছিলো, আমিও কোন ভাড়া দিচ্ছিলাম না। কারন আমার অগ্রিম টাকা শোধ করতেই হবে। অনেক টাকা , প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা। 

প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেছে এইওবস্থার। হতাত করে শুনলাম যে, সাইফুল ইসলাম নামে চাদপুরের কোনো এক ৬৯ বছরের মানুষ গত ২০০৭ সালে নাজিমুদ্দিনের কাছ থেকে এই জমি এবং এই বিল্ডিং কিনে নিয়েছিলো। এটা একটা অবাস্তব ঘটনা। কারন আমি গত ২০০৬ থেকে এই ফ্যাক্টরিতে আছি। কখনো বারেক সাহেব কিংবা ওই সাইফুল ইসলাম কখনো এখানে আসে নাই। আর আমার সাথে সর্বশেষ ফ্যাক্টরী চুক্তি হয়েছিলো ২০০৯ সালে। তাহলে নাজিমুদ্দিন কিভাবে ২০০৭ সালে বিক্রি করে? আর আমি তো ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতি মাসে ফ্যাক্টরীর ভাড়া দিয়ে আসছিলাম। তাহলে এতোদিন সাইফুল ইসলাম সাহেব কেনো  ভাড়া নিতে এলেন না? 

মামলা হয়েছে, বারেক সাহেব করেছে, আবার এদিকে সাইফুল ইসলাম সাহেবের দেওয়া পাওয়া অফ এটর্নি পেয়েছে সোহাগ গ্রুপের সাথে জড়িত মালিবাগের জাহাঙ্গীর হাসান মানিক। আর ঊনার প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করছে এলাকার জরীফ নামে এক লোক। সে আমাদের প্রতিনিয়ত খুব ডিস্টার্ব করছিলো এই বলে যে, সে এবং জাহাঙ্গীর হাসান মানিক যেহেতু নতুন মালিক, ফলে তাকে ভাড়া দিতে হবে , তা না হলে এখানে খুবই অসুবিধা। আজকে পানির লাইন বন্ধ করে দেয় তো কাল কারেন্টের লাইন নিয়ে ঝামেলা করে। অথচ আমি জানি সত্যটা কি। কিচ্ছু করার নাই। আমার কোনো ইন্টারেস্ট নাই কে বা কারা মালিক এই বিল্ডিং বা জমির। আমার ইন্টারেস্ট হলো আমার ব্যবসা, আমার অগ্রিম টাকা এবং পিস্ফুল সমাধান। 

আমি এবং মুরতুজা ভাই মেন্টালি খুব ডিস্টারবড হচ্ছিলাম। কিছুতেই ভালো একটা সমাধান করতে পারছিলাম না। 

ঠিক এই সময় সড়ক ও জনপথের অফিসাররা পদ্মা সেতুর কারনে আমাদের ফ্যাক্টরীর প্রায় ১৫-২০ ফুট ভাঙ্গার জন্য বুল ডোজার নিয়ে হাজির। আমরা কেহই ফ্যাক্টরীতে ছিলাম না। আমি যখন এলাম, তখন ইতিমধ্যে প্রায় ৫ থেকে ৭ ফুট ভেঙ্গে ফেলেছে। খুবই ভয়ংকর একটা অবস্থা। আমাদের ফ্যাক্টরীটা একরড সারটিফায়েড। এখন যদি কোনো কারনে একরড জানতে পারে যে, আমাদের ফ্যাক্টরীতে ভাঙ্গা পড়েছে, কোনোভাবেই আমরা একরডের সারটিফিকেট রিটেইন করতে পারবো না। আর যদি সারটিফিকেট রিটেইন করতে না পারি, তাহলে কোনো অবস্থায়ই  আমাদের বায়াররা আমাদের অর্ডার প্লেস করবে না। 

সড়ক ও জনপথের অফিসারদেরকে অনুরোধ করা হলে তারা মালিকপক্ষ ছাড়া কোন কথাই বলবেন না বলে ভাংতেই থাক্লেন। বারেক সাহেবকে ফোনে জানালে ঊনি এমন একটা ভাব করলেন যে, ভাংতে থাকুক। যেটুকু থাকে সেটুকু নিয়েই ঊনি পরবর্তীতে জড়িফের সাথে ফাইট করবেন। জরীফের সাথে কথা বলা হলো, সে মালিকের পক্ষে যেভাবেই হোক একটা প্রক্সি দিলো। বারেক সাহেব অনেক পরে যদিও স্পটে এলেন কিন্তু তিনি জরীফের ভয়েই হোক আর তার অনিহার কারনেই হোক কারো সাথেই আলাপ করলেন না, আবার সড়ক ও জনপথের ম্যাজিস্ট্রেট এর সাথেও কোনো কথা বললেন না। 

আমি বুঝতে পারলাম, এখন ব্যবসা করতে গেলে আমাকে জরীফের লোকজনকেই মালিক বলে মেনে নেওয়া উচিত। মামলার ফলাফল দিবে আদালত। যদি জরীফ গং মামলায় জিতে আসে তাতে আমার কোনো সমস্যা নাই, আবার বারেক জিতে আসে তাতেও আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি শেষ পর্যন্ত জরীফের দলের সাথে একটা চুক্তি করেই ফেললাম। অন্তত তারা আমার অগ্রিম টাকাটার একটা দায়িত্ত নিয়েছেন। যদিও পুরুটার নয়। আমার প্রায় ২৫/৩০ লাখ টাকার লস হবে। 

(চলবে)

৯/১/২০২১- আন-নূরের ইতিহাস

Categories

অবাক করার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে এ কয়দিন। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কি হচ্ছে আসলে। গত ৯ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে একটা ফোন কল এলো আমার এক পরিচিত নেভী অফিসার ফারুকের কাছ থেকে। ছেলেটাকে আমি চিনতাম প্রায় বছর দুয়েক আগে কোনো একটা ব্যবসায়ীক আলাপের মাধ্যমে। সে এসেছিলো আমার কাছে ম্যাগপাই নামে কোনো একটা কোম্পানীর জন্য পলাশপুরে আমার মা ইন্ডাস্ট্রিজের খালী স্পেসটা ভাড়া নেয়ার জন্য। সম্ভবত মোট দুদিন দেখা হয়েছিলো। এরপরে আর কখনোই দেখা হয় নাই। পরে শুনেছিলাম যে, ফারুক আর ওই ম্যাগপাই কোম্পানীতে নাই, সে তার শেয়ার বা মালিকানা ব্যাক করে নিয়ে অন্যত্র চলে গেছে।

এর মধ্যে ওর সাথে আর আমার কোনো কথাবার্তা হয় নাই, না দেখা হয়েছে। খুব একটা ভালো মতো ওকে চিনি বলেও মনে হয় না কিন্তু যেটা বুঝেছিলাম সেটা হলো যে, ছেলেটার মধ্যে একটা জিদ আছে। এর মধ্যে আমিও ওকে ভুলে গিয়েছিলাম, আর ফারুক নিজে থেকেও আর কখনো যোগাযোগ করে নাই। ফারুকের সাথে সেদিন আরেক ভদ্রলোক এসেছিলেন মিষ্টার কাম্রুজ্জামান, তার সাথে আমার এখনো যোগাযোগ আছে কারন ম্যাগপাই কোম্পানীটা এখন তিনিই চালাচ্ছেন আর সেটা আমার পরিত্যাক্ত মা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কমপ্লেক্সেই। অনেকবার আমি নিজে থেকেই ফারুকের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম, কিন্তু খুব বেশী একটা তথ্য কাম্রুজ্জামান সাহেব হয় দিতে চান নাই অথবা যে কোনো কারনেই হোক ফারুক সম্পর্কে তিনি খুব একটা আগ্রহ দেখান নাই।

যাই হোক, অবশেষে, অনেকদিন পর সেদিন ৯ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে হটাত করে ফারুক আমাকে ফোন করেছিলো। ওর ফোন নাম্বারটা আমার কাছে সেভ করা ছিলো, তাই বুঝতে অসুবিধা হয় নাই ফারুকের কল। সাধারনত, আমাকে যারা ফোন দেয়, হয় তারা কোন কাজ চায় অথবা কোনো ধরনের সাহাজ্য বা বুদ্ধিই চায়। অনেক সময় আমি ফোন ধরি, অনেক সময় ফোন ধরিও না। ঠিক একইভাবে সেদিন ৯ ডিসেম্বরে ফারুক যখন সকাল ১১ টার দিকেব আমাকে ফোন করলো, আমি প্রথমে ভাবলাম, হয়তো কোনো সাহাজ্যের জন্যই ফোন করেছে। দিনটায় খুব ব্যস্ত ছিলাম, ভাবলাম, ব্যস্ততা শেষ হলে ফোন ব্যাক করবো। তাই ততক্ষনাত আর ফোনটা ধরতে চাই নাই।

দুপুর পার হয়ে গেলো। আমি একটু ফ্রি হলাম। মোবাইলটা হাতে নিতেই ফারুকের মিস কলটা চোখে পড়লো। একবার ভাবলাম, ওকে একবার ফোন ব্যাক করি। এমনো তো হতে পারে যে, ওর কোনো বিপদ যেখানে হয়তো আমার সাহাজ্য আসলেই দরকার, আবার এমনো তো হতে পারে সে আমাকে এম্নিতেই কেমন আছি জানার জন্য ফোন করেছে কুশল বিনিময় করার জন্য। আবার এমন তো হতে পারে যে, এই ফোন কলটা আমার জন্যই জরুরী!

ফোন দিলাম, ফোনে শুধু ফারুক আমাকে বল্লো যে, স্যার আমার কিছু আত্তীয় আমার বাসায় এসেছে। বাচ্চা মানুষ, কিন্তু বিশাল একটা কাজ হাতে নিয়ে ফেলেছে চায়নীজদের কাছ থেকে, কন্সট্রাকশন রিলেটেড। জিজ্ঞাসা করতে করতে জানলাম যে, যে কোনোভাবেই হোক, ওরা চাইনীজ কোম্পানী “চাইনীজ কন্সট্রাকশন সেভেন্থ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশন কর্পোরেশন লিমিটেড” থেকে বড়সড় একটা ওয়ার্ক অর্ডার পেয়েছে বালু আর ইট সাপ্লাইয়ের কাজে। কিন্তু ওদের টাকা নাই তাই কাজটা করতে পারছে না। ওয়ার্ক অর্ডারের ভ্যালু প্রায় হাজার কোটি টাকার উপরে।

ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত লেগেছে আমার কাছে। আর অদ্ভুত লাগার অনেকগুলি কারনও আছে। বহুদিন যাবত আমি আর মূর্তজা ভাই এই কন্সট্রাকশন লাইনে কিভাবে ঢোকা যায় সেটার একটা হোমওয়ার্ক করছিলাম। মীর আখতার হোসেন গ্রুপের কর্নধার জনাব মীর নাসিরব আমার আত্তীয়। তার কোম্পানীর মাধ্যমে আমি আর মূর্তজা ভাই কয়েকবার কয়েকটা বড় কাজের সন্ধানেও বেরিয়েছিলাম কিন্তু খুব একটা কাজ হয় নাই। কিন্তু এটা বুঝতেছিলাম যে, সারা ওয়ার্ল্ডে এই কন্সট্রাকশন কাজই একমাত্র ব্যবসা যারা উচু কোনো স্তরে পৌঁছে যেতে পেরেছে। কিন্তু এর জন্য সর্বোচ্চ মহলের অনেক প্রকার আশীর্বাদ যেমন লাগে তেমনি লাগে স্পীড মানির ক্ষমতাও। আমাদের দুটুরই কিছু কিছু সুবিধা ছিলো বটে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই কেনো জানি ব্যাপারটা ব্যাটে-বলে সংযোগ হচ্ছিলো না। অনেকবার আমরা আমরাই বেশ কিছু হোম ওয়ার্ক করেছিলাম কিন্তু ব্যাপারটা হোম ওয়ার্কের পর্যায়েই ছিলো। কিন্তু বাংলাদেশের বুরুক্রেটিক সিস্টেমের জন্য আমরা কিছুতেই বুঝতেছিলাম না কিভাবে বড় বড় কন্ট্রাক্ট গুলি ধরা যায়।

ফারুকের ফোনের বিষয়টা মুর্তজা ভাইকে বলার সাথে সাথে ব্যাপারটা বিদ্যুত গতিতে যেনো এগিয়ে যেতে থাকলো। আমার পরিকল্পনা ছিলো, ফারুকের কাছ থেকে ওর আত্তীয়ের কাজের বিষয়টা এর পরেরদিন আমরা দুজনে বসে জেনে নেবো কিন্তু মূর্তজা ভাই যেনো আমার থেকেও বেশী স্পীডি। মূর্তজা ভাইয়ের অনুরোধে আমরা সেদিন রাতেই ফারুক এবং ওর টিমের সাথে মিটিং করলাম মীরপুর ক্যান্টন মেন্টের সিএসডির অভ্যন্তরে। রাত তখন প্রায় ১০টা। । ফারুক নিজে এবং তার দুই আত্তীয় আরিফুজ্জামান রুবেল আর দুলাল মোল্লা নামের দুই জনকেই সেখানে নিয়ে এলো। আরিফ আর দুলালকে দেখে আমার খুব অদ্ভুত লেগেছিলো যে, ওদের বয়স নিতান্তই কম এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা ওই রকমের না যার মাধ্যমে এমন সব কাজ হাতে আসবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ওরা সেই কাজটাই করতে পেরেছে যেটা আমরাও পারি নাই। আমি আর মূর্তজা ভাই ওদের কাছে থাকা চায়নীজদের ওয়ার্ক অর্ডারটা নেড়েচেড়ে দেখলাম, পড়লাম, সবই ঠিক মনে হচ্ছিলো। আবার পরক্ষনেই এটাও উড়িয়ে দিচ্ছিলাম না যে, এটা আবার কোনো ফাদ না হয়ে উঠে। ফারুকের উপর আমার কোনো নেগেটিভ ধারনা ছিলো না। ফলে আমি ফারুককে সরাসরি একটা প্রশ্ন করলাম, কেনো ফারুক এই কাজের সাহাজ্যের জন্য আমাকে সে ফোন করলো বা বেছে নিলো। সেতো ইচ্ছে করলে আরো কাউকে বেছে নিতে পারতো। এই কাজ গুলি করার জন্য হয়তো আরো অনেকেই রাজী হবে এবং হতো। ফারুক সেতা না করে, সে আমাকেই কেনো ফোন করলো?

ফারুক জানালো যে, ফারুক নিজেও কোনো কন্সট্রাকশনের কাজে জড়িত নয়। কিন্তু রুবেল এবং দুলাল তারা ওর শশুড় বাড়ির তরফ থেকে আত্তীয়। ওরাই মাঝে মাঝে জীবন ধারনের জন্য ছোট খাটো ঠিকাদারী, কখনো আবার কোনো সাইটে আবার কখনো কোনো বড় কোম্পানীর জন্য টুক টাক সাপ্লাইয়ের কাজ করে থাকে। এসব করতে গিয়ে যেভাবেই হোক, কিছু কিছু মানুষের সাথে ওদের উঠাবসা আছে। আর এই সুবাদে ওরাও চেষ্টা করেছে তারা নিজেরাই কোনো একটা কাজ বাগিয়ে নিতে পারে কিনা।

বাংলাদেশটা এমন এক দেশ যেখানে পয়সার মান সাদাই হোক আর কালোই হোক, বেশীরভাগ মানুষ আজকাল শুধু টাকার পিছনেই ঘুরে। যখন টাকার গন্ধ চারিদিকে মুর মুর করতে থাকে, তখন কে সচীব আর কে মন্ত্রী এর কোনো লেবেল থাকে না। তাদের সবার উদ্দেশ্য একটাই-টাকাটা ধরা। আর এই ধরাকে বলে কালো টাকার বেসাতী। আমরা আজ অবধি কালো টাকার ধারে কাছেও যেতে চাই নাই আর যেতে চাইও না। তাই হয়তো এই গোপন ব্যাপারটা আমাদের ক্ষমতায় ছিলো না। আর যেহেতু আমাদের যপগ্যতা থাকা সত্তেও আমরা কালো টাকার ধারে কাছে যাই না, ফলে এই দেশের বৃহৎ কোনো প্রোজেক্ট আমাদের হাতে আসেও না। যাইই হোক, আমি ফারুকের সাথে বিস্তারীত কথা বলে জানলাম যে, ফারুকের অন্যত্র যাওয়ার ক্ষমতা বা ইচ্ছা থাকলেও সে চেয়েছিলো এমন একজন মানুষ যারা মিথ্যার বেসাতী করেন না আবার ইন সাফের মুল মন্ত্র নিয়ে কাজ করেন। ফারুকের মনে হয়েছে, আমিই সেই ব্যক্তি যার কাছে পুরু ব্যাপারটা শেয়ার করা যায়। আমি একটা কথা প্রায়ই বলে থাকি-I feel safe in the hands of a pious and justified man. চোর ও কিন্তু চোরকে বিশ্বাস করে না, চোর ও কিন্তু চোরকে পছন্দ করে না। চোর নিজেও চায় একজন ভালো মানুষের সাথে কাজ করুক, সম্পর্ক করুক ইত্যাদি। ফারুক চোর নয়, রুবেল কিংবা দুলাল তারাও চোর নয়, কিন্তু আমাদের আশেপাশে এতো বেশী মুখোশ ধারী চোর রয়েছে যে, তাদের বাজ্যিক চেহাড়া দেখে বুঝবার কোনো উপায় নাই, তারা ইন সাফ করে কিনা। কিন্তু মুখে সারাক্ষন হাদিস কালামের কথা উচ্চারিত হতেই থাকে। কিন্তু এই হাদিস শুনে ভরষা করার কোনো সুযোগ নাই। ঠকবার সম্ভাবনাই বেশী। ফারুকের মনে হয়েছে, আমরা সেই ক্যাটেগরির মানুষ যারা ইন সাফ নিয়ে চলেন, কাউকে ঠকাবার কোনো মানসিকতা কখনোই নাই।

প্রাথমিকভাবে আমি আর মূর্তজা ভাই ওদের কাছ থেকে ইনিশিয়াল তথ্য জেনে বেরিয়ে এলাম। আর বললাম যে, যদি সব কিছু সথিক থাকে, তাহলে হয়তো আমরা ওদেরকে নিয়ে কাজ করবো। ওদের টাকা নাই, কিন্তু আমাদের যা আছে তা দিয়ে তাদের পাওয়া ওয়ার্ক অর্ডারের কাজ করা সম্ভব। হয়তো ৩/৪ কোটী টাকার দরকার। আর সেটা আমাদের আছে। কিন্তু কিভাবে করবো, কাজের ধারা কি হবে, কে কিভাবে পার্টনারশীপ করবে তার একটা বিস্তারীত প্রোফেশনাল গাইড লাইন থাকা দরকার।

ওই যে বলেছিলাম একটু আগে যে, বহু আগে থেকেই কন্সট্রা ক শন কাজের ব্যাপারে আমাদের একটা সুপ্ত বাসনা ছিলো, আর সে মোতাবেক একটা হোম ওয়ার্ক করাই ছিলো। এখন ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়, তাহলে সিদ্ধান্তটা নিতে খুব বেশী একটা সময় ক্ষেপন হবে না বলে আমাদের বিশ্বাস ছিলো। বাসায় এসে আমি আর মুর্তজা ভাই ফোনে আলাপ করলাম যে, এর পরেরদিন অর্থাৎ ১০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে  ফারুক এবং তার টিমের সাথে আমাদের বিস্তারীত আলাপের দরকার। পরেরদিন আমাদের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী হাসনাবাদে একটা সম্মিলিত মিটিং এর দিন ধার্য্য করা হলো।

পরদিন ১০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে ফারুক, রুবেল আর আমি (মাঝে মাঝে মুর্তজা ভাই) এক সাথে বিস্তারীত আলাপ করে জানলাম যে, বড় বড় টেন্দার গুলির মধ্যে সরকারী অফিসের ছোট ছোট কর্ম কর্তাদের মাধ্যমে বড় বড় কর্মকর্তারা একটা সিশটেম করে রেখেছে এমনভাবে যে, বড় বড় নামীদামী কোম্পানিগুলিকে তারা এখন আর পারসেন্টেজে বিশ্বাস করতে পারছে না। প্রায়ই তারা তাদের ন্যয্য কালো টাকার ভাগে কম পড়ছে। আর যেহেতু ব্যাপারটা কালো টাকার খেলা, ফলে সেসব কর্মকর্তারা এমন একটা নতুন পলিসি উদ্ভাবন করেছেন যেখানে তাদের ভাগ নিশ্চিত হয় আবার কাজটাও হয়। এতে প্রোজেক্ট ভ্যালু বেড়ে যায়, তাতে কিছুই যায় আসে না। টাকা তো আসবে গৌরী সেনের পকেট থেকে, অসুবিধা কি? এই সিস্টেমে কেউ কাউকে ঠকায় না। আমাদের রুবেল আর আরিফ সে রকম একটা সিশ্তেমের খোজ জানে। এই সিস্টেমে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদুত থেকে শুরু করে দেশের প্রধান হোমরা চোমড়ারাও আছেন। যাক সে কথা এখানে আর না বলি।

রুবেল গত প্রায় ১ বছর যাবত এই সব সিস্টেমের সাথে চলাফেরা করে করে সেও কিছু কাজ হাতে নিতে পেরেছে। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় সমস্যা দাড়িয়েছে তারদের হাতে ওয়ার্কিং কোনো ক্যাপটাল নাই। ব্যাপারটা খুব মনোযোগ সহকারে বুঝলাম।

এবার আমাদের পক্ষ থেকে কিছু শর্ত জুড়ে দিলাম যে, আমরা কাজ করতে পারবো যদিঃ

ক।      কোনো টাকার মধ্যে অর্থাৎ আমাদের পক্ষে আসা কোনো টাকায় কোনো কালো টাকা না আসে। যেমন কাজে ফাকি দিয়ে অযথা বিল না করা হয়। কিংবা দুই নম্বরী করে কোনো কাজ না করা হয়। আমরা আল্লাহকে ভয় পাই। টাকার অতো বেশী আমাদের দরকার নাই কিন্তু সৎ থাকতে চাই নিজের কাছে, নিজের দেশেরর কাছে আর হালাল টাকা কামাই করতে চাই।

খ।       যে সব কাজ ইতিমধ্যে রুবেল ইঞ্জিনিয়ারিং এর নামে বরাদ্ধ হয়ে গেছে, সে সব কাজ গুলি পুনরায় একটা নতুন কোম্পানী (যেটা আমরা সবাই মিলে ফর্ম করবো) তার নামে আনতে হবে। যদি কোনো কাজ রুবেল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্ক্স থেকে ট্রান্স ফার না করা যায়, তাহলে রুবেল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্ক্স ও আমাদের সবার মালিকানা থাকতে হবে যাতে সেটাও আমাদের পলিসিতে চলে।

গ।       আমরা সব ফাইন্যান্স করবো, এবং এই ফাইন্যান্স কোম্পানীকে আপাতত লোন হিসাবে প্রদান করা হবে যা কোম্পানী তার লভ্যাংশ থেকে আমাদেরকে পুনরায় পরিশোধ করে দেবেন।

ঘ।       কোম্পানীর একটা নাম ফিক্সড করা হলো। আমি সাথে সাথেই বললাম, এই নতুন কোম্পানীর নাম হ ওয়া উচিত আল্লাহর নামে। যেমন- আন নূর।

সবাই এক সাথে নামটা খুব পছন্দ করলেন। আমরা এই নামের বরকতেই ইনশাল্লাহ সৎ ভাবে সঠিক কাজ গুলি করতে পারবো। আন নূরের জন্ম হয়ে গেলো। এই নতুন কোম্পানীর মধ্যে আমরা নতুন এক ব্যবসায়ীক দরজায় দাঁড়িয়ে গেলাম যার-ম্যানেজিং ডাইরেক্টর আমি নিজে, চেয়ারম্যান আমার প্রিয় মূর্তজা ভাই, ডাইরেক্টর হিসাবে ফারুক এবং রুবেল আর শেয়ার হোল্ডার হিসাবে থাকলো দুলাল মোল্লা।

জয়েন্ট স্টক থেকে এর নতুন জন্ম শুরু আলহামদুলিল্লাহ।

১২/০১/২০২০- নির্মান ব্যবসা পীরগঞ্জ ভ্রমন

কোম্পানী ফর্ম করার যাবতীয় কাজ খুব দ্রুত গতিতে চলতে থাকলো। আর নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হলো যে, আন নূর কন্সট্রাকশন লিমিটেড পুরুপুরী অফিশিয়ালভাবে কাজ করার আগ পর্যন্ত আমরা রুবেল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্ক্সকে সাংঘটনীক পরিবর্তনে পীরগঞ্জে পাওয়া চায়নীজদের কাজ তদারকি এবং যাবতীয় সাপ্লাই দেয়া। এই উপলক্ষ্যে আমি আর মূর্তজা ভাই পরিকল্পনা করলাম যে, দিনে দিনে রংপুর-পীরগঞ্জ গিয়ে পুরু ব্যাপারটা একবার দেখা দরকার। তাই ভাবলাম যে, বিমানে সৈয়দপুর বিমান বন্দর নেমে সেখান থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে আমরা রংপুর যাবো, কাজ দেখবো, আবার লাষ্ট ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরে আসবো। সাথে ১৫ লক্ষ টাকাও নিয়ে গেলাম।

১১ মে ২০১৪-হাসনাবাদ, ইকুরিয়া, ঢাকা

অনেকদিন পর আবার একটু ডায়েরি লিখতে ইচ্ছে হল। এই অভ্যাসটা আমার এক কালে ছিল এবং প্রায়ই ডায়েরি লিখতাম। কিন্তু ইদানিং কাজের চাপে, কম্পিউটার যুগে আর ঘটা করে ডায়েরি লিখা হয় না।

আজ সারাদিন মোটামোটি বেকারের মত দিনটা কাটাচ্ছি। কাজ আছে কিন্তু ঐ রকম প্রেসার নেই। খবরের কাগজ বাসায় ও পরেছি আবার অফিসে এসে অন্য একটি খবরের কাগজও পড়লাম। সামনে অডিট, অনেকগুলো অডিট। কুয়ালিটি অডিট, ACCORD এর অডিট, আবার SGS অডিট। কোনটাই কারো থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আজ মুর্তজা ভাই অফিসে আসেন নাই। ওনি এলে কথাবার্তা বলা যায়, আবার অনেক কাজও হয়। একা একা আসলে কাজে মন জুড়ে না। মুর্তজা ভাই ইদানিং শারীরিক ভাবে একটু অসুস্থ থাকছেন প্রায়ই। এটা ভাল লক্ষন নয়। তবে খুব গুরুতর কিছু না মনে হয় ইনশাল্লাহ, ঠিক হয়ে যাবে।

লাক্সমা নিয়ে একটু ঝামেলায় আছেন, আমরা আবার রিভার সাইড নিয়েও বেশ ঝামেলায় আছি। আমার সবচেয়ে বেশী চিন্তা হয় লাক্সমাকে নিয়ে। মুর্তজা ভাই যাদের কে নিয়ে লাক্সমায় ব্যবসা করেছিলেন, তিনি হয়ত তাদেরকে পূর্বে ভাল করে স্টাডি করতে পারেন নি, এখন টার বুঝার কোন বাকী নেই কখন একজন মানুষ হটাত করে অমানুষ হয়ে যেতে পারে। আমি সর্বাত্মক চেস্টা করছি যেন, মুর্তজা ভাই এই অনাকাঙ্ঘিত সমস্যা থেকে দ্রুত রেহাই পান।     

১৮/০৩/২০০৯-প্রিয়ান্থার শেয়ার হস্তান্তর

প্রায় এক বছর। আমি, মুর্তজা ভাই আর প্রিয়ান্থা এক সাথে কোনো রকমে কাজ করছিলাম। তারাই ফ্যাক্টরীর একাউন্ট হ্যান্ডেলিং, অর্ডার নেয়া, শিপমেন্ট করা, সবকিছু করেন। আমি জাষ্ট থাকি। কোনো প্রশ্নও করি না। আর করিই বা কিভাবে? আমার শেয়ারে থাকাটা তো ছিলো এক প্রকার দয়ার মতো। কিন্তু এরমধ্যে আমি একটা কাজ করতে পেরেছিলাম যে, আমি পার্টনার হিসাবে অতোটা ক্রিটিক্যাল নই। মানুষ হিসাবেও সহজ সরল। তাই ওনারা আমাকে কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করতেও পারছিলেন না। আমি ফ্যাক্টরীর এমডি হিসাবেই ছিলাম।

প্রিয়ান্থা ২০০৯ সালে হার্ট এটাকে মারা গেলেন। মাত্র ৪১ বছর বয়সে। প্রিয়ান্থার শেয়ার ছিলো ৪৫% আর মুর্তজা ভাইয়ের শেয়ার ছিলো ৪৫%। আমার ১০%। প্রিয়ান্থার মৃত্যুর কারনে প্রিয়ান্থার ৪৫% শেয়ার এখন অন্য কারো নেয়ার কথা। কিন্তু মুর্তজা ভাই চালাক মানুষ, তিনি চান নাই যে, অন্য আরো কেউ এই ফ্যাক্টরিতে ডাইরেক্টর হয়ে আসুক। ফলে মুর্তজা ভাই একটা প্রোপোজাল দিলেন যে, প্রিয়ান্থার ৪৫% শেয়ার আমরা ভাগ করে নিতে পারি কিনা, বিনিময়ে প্রিয়ান্থার ইনভেষ্টেড প্রায় ৭৫ লাখ টাকা তার স্ত্রীকে ক্যাশ প্রদান করতে হবে। আমার তো আর কোনো টাকাই ছিলো না। কিভাবে আমি শেয়ার নেবো? শেষতক আমি মুর্তজা ভাইকে পলাশপুরের ৫৮ শতাংশ জমির বিনিময়ে যার দাম ধরা হলো ৫০ লাখ টাকা, এর বিনিময়ে আমি ২৫% শেয়ার নিলাম আর মুর্তজা ভাই নিলেন ২০% শেয়ার। তাতে এটা দাড়ালো যে, আমার হয়ে গেলো ৩৫% আর মুর্তজা ভাইয়ের শেয়ারে দাড়ালো ৬৫%। এখন কেনো যেনো মনে হয় যে, সম্মান জনক একটা পজিশনে আছি শেয়ারের কথা ভেবে। আমি এমডিই রয়ে গেলাম আর মুর্তজা ভাই হয়ে গেলেন ফ্যাক্টরীর চেয়ারম্যান।

০১/০১/২০০৮-রিভার সাইড সুয়েটার্স লিমিটেড

রিভার সাইড সুয়েটার্স লিমিটেড একটি ১০০% রপ্তানীমূলক সুয়েটার্স তৈরির প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির সাথে আমি প্রথমে ২০০৫ সালে ৩০% শেয়ার নিয়ে জনাব নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে পার্টনারশীপ ব্যবসা শুরু করি, যদিও অত্র প্রতিষ্ঠান টি ২০০৩ সালে গঠিত হয়। অতঃপর ২০০৬ সালে নাজিমুদ্দিনের কাছ থেকে বাকী ৭০% শেয়ারও ক্রয় করিয়া জনাব নাজিমুদ্দিনকে অব্যাহতি দেই। এই সময়ে জনাব নাজিমুদ্দিনের সাথে আমার হাসনাবাদ সুপার মার্কেটের ভবনের যে স্থানে গার্মেন্টস অবস্থিত, তা ৩ বছরের মেয়াদে ভাড়ায় চুক্তিবদ্ধ একটা চুক্তি হয়। এবং তাহাকে বেশ কিছু বড় অংকের টাকা অগ্রিম প্রদান করি। অতঃপর, ১০০% শেয়ার নেওয়ার সময় আমি বিনা টাকায় জনাব মোহসীন শাহীন নামে এক ভদ্রলোককে আমার পার্টনারশীপ দেই, আর সেটার পরিমান ছিলো ৩০%। তাকে আমি এই ৩০% শেয়ার এইমর্মে বিনা টাকায় দিয়েছিলাম যাতে তিনি গার্মেন্টস ব্যবসাটি সুন্দরভাবে চালান এবং এর উন্নতি করেন। এখানে বলা বাহুল্য যে, জনাব মোহসীন আগে থেকেই এই সেক্টরে কাজ ছিলেন এবং অভিজ্ঞ ছিলেন।

কিন্তু আমার এক্সপেক্টেশনের সাথে জনাব মোহসীন সাহেব গার্মেন্টস এর উন্নতি করতে না পারায় আমি ধীরে ধীরে লস টানতে গিয়ে প্রায় নিঃস্ব হবার উপক্রম হয়। একদিকে নিজের সব সঞ্চিত টাকা, স্ত্রীর যত সঞ্চিত টাকা, এবং অনেক আত্তীয় স্বজনের কাছ থেকে নেওয়া প্রায় ৫০/৬০ লক্ষ টাকার দেনার মধ্যে পড়ি। কোনো উপায়ন্তর না দেখে শেষ অবধি আমি ডিসিশন নেই যে, আমি আর অত্র রিভার সাইড ফ্যাক্টরীটি চালাবো না। এতে যেটা হবে তা হচ্ছে, আমি ব্যাংকের লোনটা (প্রায় ৩ কোটির মতো) আপাতত সামাল দিতে পারবো, কিন্তু আমি যে আমার আত্তীয় স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছি, সেটা দিতে পারবো না। তারপরেও আমি এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। কারন, যদি আমি ফ্যাক্টরী চালাই, তাহলে প্রতিমাসে লস হচ্ছিলো প্রায় ১০ লাখ টাকার মতো। আর যদি না চালাই, তাহলে এই লসটা থেকে বেচে যাই। আর আমার পক্ষে লস দিয়ে টাকার যোগা দেওয়াও আর যাচ্ছিলো না। মোহসীন সাহেব যেহেতু কোনো কন্ট্রিবুসন করেন না বা করতে পারবেনও না, ফলে তার কোনো চিন্তাও নাই আবার ফ্যাক্টরী বন্ধ হোক এটাও তিনি চাচ্ছেন না। কিন্তু আমি বুঝতেছিলাম, আমার উপর দিয়ে কি যাচ্ছে।

এমন সময় মিষ্টার মূর্তজা এবং মিষ্টার প্রিয়ান্থা (শ্রীলংকার) এই দুইজন আমাদের ফ্যাক্টরি মাত্র ২ কোটি টাকার বিনিময়ে কিনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। শর্ত থাকে যে, তারা ব্যাংকের লোন রি-সিডিউলিং করে নেবেন, এবং কিস্তিতে তা পরিশোধ করবেন। আমাদের যতো আউট স্ট্যান্ডিং বকেয়া আছে (যেমন শ্রমিকদের বেতন, গ্যাস বিল, কারেন্ট বিল, এবং অন্যান্য) এর বিপরীতে প্রায় ৭০/৮০ লাখের মতো হবে তা দিয়ে দেবেন। আমার যেহেতু এই ফ্যাক্টরী চালানোর কোনো সক্ষমতা ছিলো না, আর চালাইতেও চাচ্ছিলাম না, ফলে যেই রকম ডিলই হোক, তাতে আমি মেনেই গেলাম।

তারা ধীরে ধীরে ফ্যাক্টরীকে তাদের মতো করে সাজাতে শুরু করলেন, আমি মুটামুটি বেকার। বাসাতেই বেশীর ভাগ সময়কাটাই, কিংবা আশেপাশে ঘুরি। অনেক চিন্তায় ছিলাম, কি করা যায় এটা নিয়ে।

২৬/০৫/২০০৭-মোহসীন এবং রিভারসাইড

 

মোহসীন সাহেব আমার গার্মেন্টস এর পার্টনার। আমার এই লেখাটা লিখার আগে মোহসীন শাহীন সাহেব সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। তিনি অত্যান্ত ধার্মিক একজন মানুষ। সারাদিন পবিত্র কোরআন শরীফ তার সাথে থাকে, তার হাতে তসবিহ থাকে, মাথায় টুপী আর গায়ে আলখেল্লা। মুখভর্তি দাড়ি। খুব ভালো ইংরেজী বলতে পারেন। দেখতে বেশ সুদর্শন। আমি যখন প্রথম রিভার সাইড সুয়েটার্স ফ্যাক্টরিটা জনাব নাজিম উদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে নেই, তখন পর্যন্ত আমার জানা ছিলো না কিভাবে একটা ইন্ডাস্ট্রি চালাতে হয়, তাও আবার গার্মেন্টস এর মতো একটা ঝুকিপুর্ন ইন্ডাস্ট্র। যেহেতু আর্মির মতো এমন একটা প্রেস্টিজিয়াস চাকুরী নিজ ইচ্ছায় ছেড়ে চলে এসেছি, ফলে আমার জিদ ছিল, আর কোনো চাকুরী নয়, এবার নিজের জন্য নিজে কিছু করবো। আল্লাহ আমার সহায় ছিলেন সব সময়। যখন চাকুরী ছেড়ে দেবার কথা ভাবছিলাম, তখন এই জনাব নিজাম উদ্দিন কোনো একটা উছিলায় আমার মীরপুর সেনানীবাসে নিজের থেকেই এলেন দেখা করতে। আমি তাকে জীবনেও দেখি নাই। কিন্তু উনি আমাদের এলাকার একজন নামী মানুষ, যদি তার ট্র্যাক রেকর্ড যথেষথ পরিমান খারাপ। কোনো এক কালে তিনি নাইজ্যা ডাকাত নামে নাকি পরিচিত ছিলেন। এখন তিনি কোটিপতি, লেখাপড়ার কোনো বালাই নাই। একটা নিরক্ষর টাইপের মানুষ।

যাই হোক কিভাবে নাজিম সাহেবের সাথে আমার ব্যবসায়ীক লেনদেন শুরু হয় সেটা আরেক পাতায় লেখা আছে। এখন মোহশীন সাহিনের ব্যাপারেই যখন বলছি, সেটাতেই থাকি। আমি যেহেতু গার্মেন্টস বুঝি না, তাই ফ্যাক্টরী নেয়ার আগে মনে মনে ভাবলাম যে, এই ফ্যাক্টরিতে সফল্ভাবে কাজ করেছে এমন একজন লোক খুজে বের করা। আর সে সুবাদে আমি মোহসীন শাহিনের খবর পাই। আমি মোহসীন শাহীন সাহেবকে খবর দেই যে, উনি গার্মেন্টস করতে চান কিনা। কালের এবং সময়ের বিবর্তনে মোহসীন শাহীন ও বড্ড অসহায় হয়ে সব কিছু হারিয়ে এখন সমাজ সংসার, পরিবার বর্গ ছেড়ে একা একা তাবলিগ করে বেড়ান। ফলে আমার এই সংবাদে তিনি অনেক খুশি হয়েই যতো দ্রুত পারেন চলে এলেন আমার সাথে কথা বলার জন্য। আর এ কাজে সবচেয়ে বেশী সাহাজ্য করেছে হাসনাবাদ এলাকার একটি ভদ্র ছেলে তৌহিদ। ছেলেটা ভালো পরিবারের ছেলে এবং তখন পর্যন্ত তৌহিদ রিভার সাইড সুয়েটার্সেই কাজ করে, বলা যায় কোনো রকমে সে ফ্যাক্টরিটা ধরে রেখেছে।

মোহসীন সাহেব, তৌহিদ এবং আমি এক নাগাড়ে কয়েকদিন এই ফ্যাক্টরীর ভুত-ভবিষ্যত নিয়ে বিস্তর আলাপ করলাম। ফ্যাক্টরিতে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার একটা লোন আছে। এই লোনটা ব্যাংকের মাধ্যমে রি-সিডিউলিং করেই চালানো যায়। আমি তখনো রি-সিডিউল কি, গার্মেন্টস কি, অর্ডার কি, এল সি কি, ব্যাক টু ব্যাক কি, নিটিং কি ইত্যাদির কিছুই জানি না। আমি শুধু মোহসিণ শাহীন সাহেবকে বললাম যে, যদি আমি অর্থ এখানে ইনভেষ্ট করি, তাহলে এর ভবিষ্যত কি। মোহসীন সাহেব কিছুক্ষন খাতা কলমে কি কি ক্যাল কুলেশন করলেন, সাথে তৌহিদ নিজেও হ্যা হু করলো, এরপর তারা উভয়েই আমাকে জানান দিলো যে, ছয় মাসের মধ্যে এই ফ্যাক্টরী থেকে প্রতি মাসে যা আয় হবে সেতা এতো বেশী যে, আর কোনো চিন্তা নাই। কিন্তু এর জন্য প্রায় অর্ধ কোটি টাকা ইনভেষ্ট প্রয়োজন।

আমি যেভাবেই হোক এই টাকার একটা দায়িত্ত নিলাম। মোহসিন সাহেবকে আমি নিঃশর্তভাবে বিনা টাকায় ৩০% শেয়ার হোল্ডার হিসাবে মালিকানার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চেয়ারম্যান বানিয়ে নিলাম। শর্ত ছিলো, গার্মেন্টস তিনিই চালাবেন, আমি প্রশাসনিক দিকটা দেখবো। কোথা থেকে অর্ডার আনা হবে, কিভাবে অর্ডার নেগশিয়েট করা হবে সব করবেন মোহসিন সাহেব। ফ্যাক্টরী শুরু হল। আমি ধীরে ধীরে ব্যবসাটা বুঝার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু আমি একটা ব্যাপার বুঝি নাই যে, মোহসীন সাহেব সব কিছু আমাকে শেয়ার করেন না। আর করতেও চান না সম্ভবত। কিন্তু বছর খানেকের মধ্যে আমি আমার সমস্ত পুজি খালি করেও এটাকে টেনে তুলতে পারছিলাম না। বিভিন্ন জায়গায় এতো লোন হয়ে যাচ্ছিলো যে, আমার একসময় মনে হলো যে, আমার এ যাবত সব সিদ্ধান্ত ভুল। আমার এটা করা ঠিক হয় নাই। মোহসিন সাহেবের মধ্যে একটা উদাসীন ভাব সব সময়ই ছিলো, যেনো কনো কিছুই তাকে স্পর্শ করে না, না ওয়ার্কারদের বেতনের চিন্তা, না অর্ডারের সুরুতহাল, কোনো কিছুই না। এতার একতা কারন অ ছিলো। আর সেটা হচ্ছে, তিনি তো কোনো ইনভেষত মেন্ট করেন নাই। লস যদি হয়, তাতে ওনার কি? কিন্তু আমি তো ওনার মতো উদাসিন হয়ে শান্ত হয়ে থাকতে পারি না।

এরই মধ্যে মোহসীন সাহেব আবার ঘন ঘন তাবলিগ, ইস্তেমা ইত্যাদির সাথে এমনভাবে জড়িয়ে গেলেন যেনো ওটাই আসল কাজ, গার্মেন্টস কোনো কাজই না। ঠিক এই সময় মোহসিন সাহেব ৪০ দিনের বৈদেশিক একটা দলের সাথে চাঁদ (Chad) নামক একটি দেশে পাড়ি জমালেন। আর আমাকে একটা নোট দিয়ে গেলেন যে, জিএমসি নামক একটা বায়িং হাউজ থেকে আমরা স্কিভা নামের বায়ারদের কাছ থেকে বেশ অর্ডার পেয়েছি, সেগুলি টাইম মতো শিপমেন্ট করতে হবে। সবকিছু তিনি এরেঞ্জ করে দিয়ে গেলেন। কোনো কিছুই বাদ রেখে যান নাই। যেহেতু আমি ব্যাপারটা আগে কখনো হ্যান্ডেল করিনি, তাই ব্যাপারটা বুঝিও নাই। আমিও তাকে এলাউ করলাম। অথচ এখন গার্মেন্টের পিক আওয়ার চলছে। এ সময় যতো জরুরীই থাকুক, কোনো গার্মেন্টসের মালিক অর্ডার না কমপ্লিট করে বাসায়ও যেতে চান না, আর তিনি চলে গেলেন সুদুর চাদে। আমি যখন ব্যাপারটা একা হাতে হ্যান্ডেল করতে গেলাম তখন যা বুঝলাম যে, আমি শুধু নদীতে না, সাগরের মাঝখানে হাবুডুবু খাচ্ছি। কোনো কিছুই ঠিক নাই। ইন্টারনেট খোলা, তাই আমি মোহসীন সাহেবকে একটা মেইল পাঠালাম। মেইলটা ছিল এই রকমেরঃ

মোহসিন ভাই,

এ কয়দিন সমস্ত ব্যাপার, ডাটা এনালাইসিস করে আমি যেটা বুঝতে পারছি যে, আমি খুব একটা ভাল পরিস্থিতিতে নাই। আপনি আমার এই মেইল পাওয়ার পর অবশ্যই অবশ্যই জরুরী ভিত্তিতে সবগুলি পয়েন্টের উপর একে একে ব্যাখ্যা করবেন। ব্যাপারটা অতীব জরুরী।

ক।      আপনি জিএমসির মোজাম্মেল সাহেবের বায়িং হাউজ এর মাধ্যমে যে অর্ডারগুলি নিয়েছেন, সেটার ব্রেক-ইভেন-পয়েন্টের অনেক নীচে। এফওবি প্রাইস মাত্র ২২ ডলার যেখানে আমার ফ্যাক্টরীর ওভারহেড কস্ট প্রায় ২৩ ডলার। এই অর্ডারগুলি থেকে সিএম টিকে মাত্র ৯ ডলার। বর্তমানে গার্মেন্টসে পিক আওয়ার চলছে, এবং এটা অফ সিজন নয়। সেক্ষেত্রে কি দেখে আপনি মাত্র ৯ ডলারে কাজগুলি নিলেন? যদি আপনি বলেন যে, জিএমসি এই অর্ডারগুলির মাধ্যমে আমাদেরকে সারাবছর কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেই প্রতিশ্রুতির এগ্রিমেন্ট কই? আর যদি প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর তারা যে তাদের প্রতিশ্রুতি ভেংগে আবার অন্য কোথাও অর্ডার প্লেস করবে না তার কি গ্যারান্টি আছে? আর এই সময়ে আমিই বা কিভাবে ২৩ ডলার ওভারহেড নিয়ে মাত্র ৯ ডলারের কাজ করে শ্রমিকদের বেতন ইউটিলিটি বিল ইত্যাদি সামাল দেবো?

খ।       আপনি তাবলিগে যাওয়ার সময় আমাকে যে নোটটা দিয়ে গেছেন, সেখানে আপনি ক্লিয়ারলি লিখেছেন যে, গার্মেন্টস রিলেটেড সমস্ত ব্যাক টু ব্যাক, এক্সেসরিজ, এপ্রোভাল, স্যাম্পল সবকিছু ওকে করেই আপনি তাবলিগে গেলেন, কিন্তু এখন আমি দেখতে পাচ্ছি যে, না কোনো স্যাম্পল এপ্রোভাল করা আছে, না কোনো এক্সেসরিজের ফয়সালা দেয়া আছে। এলসি মোতাবেক আমাদের শিপমেন্ট তারিখ ২৯ এপ্রিল ২০০৭, আর এখন ২০ মে ২০০৭, তারপরেও কোনো কিছুই আমি সমাধান করতে পারছি না। সেক্ষেত্রে আপনি আমাকে এই ধরনের একটা মিথ্যা ঝুকির মধ্যে রেখে তাবলিগে গেলেন কেনো? আর এর মধ্যে আমিই বা আগামী ১৫ তারিখের মধ্যে ওয়ার্কারদের বেতন দেবো কিভাবে? আপনি কি জানেন না, এখন গার্মেন্টস সেক্টরে ওয়ার্কারদের কি তান্ডব চলছে?

গ। জিএমসির মোজাম্মেল আমাকে জানালো যে, এই অর্ডারের তাদের কমিশন ৪৯৫০০০ টাকা। আর সেটা অর্ডার শিপমেন্ট হোক বা না হোক, আগেই তাদের পে করতে হবে। এটা কোন ধরনের সিস্টেম? যেখানে আমি শিপমেন্টই করতে পারছি না, সেখানে মোজাম্মেল সাহেব প্রতিনিয়ত তাদের কমিশনের জন্য গন্ডোগোল করছে? আমি কি শিপমেন্ট করেছি মাল? যদি বায়ারদের কাছ থেকে টাকাই না পাই, আমি মোজাম্মেলকে কমিশনের টাকা দেবো কোথা থেকে?

ঘ। মোহসীন ভাই, আমি ব্যাংকে গিয়েছিলাম গতকাল। ওখানে গিয়ে দেখলাম যে, আপনি কোনো একটা এক্সেসরিজ কোম্পানির নামে ২০ হাজার ডলারের এক্সেসরিজের ব্যাক টু ব্যাক দিয়েছেন। আমি যখন তাদেরকে ফোন দিলাম, কেউ কোন রিস্পন্স করলো না। পরবর্তীতে আরো অনুসন্ধান করে দেখলাম যে, জিএমসির এমডি মোজাম্মেলকে আপনি ইতিমধ্যে ৪৯৫০০০ টাকা কমিশন দিয়েই দিয়েছেন (?), তাহলে আর বাকী টাকাগুলি কই? যাদের নামে আপনি ব্যাক টু ব্যাক করেছেন, ওই নামের কোনো সংস্থার অস্তিতই নাই। এটা কিভাবে সম্ভব? আপনি যখনই আমাকে কোনো ব্ল্যাঙ্ক চেক সাইন করতে বলেছেন, আমি সেটা অতি বিশ্বাসের উপর কোনোদিন সন্দেহ অনুভব করি নাই কেনো ব্ল্যাঙ্ক চেক সাইন করবো। অথচ আজ দেখলাম যে, তারা আমার এই চেকগুলি দিয়ে এখন সবাই টাকার জন্যে হন্যে হয়ে আমার অফিসে ছুটছে। কি করে এ কাজটা আপনি আমার পার্টনার হয়ে করতে পারলেন? আমি তো আপনাকে আপনার লস্ট ইমেজ আবার পাওয়ার জন্য একটা চেয়ারম্যানের স্ট্যাটাস পর্যন্ত দিয়েছি যেটা আপনার আপন ভাইও করবে না। তাহলে আপনি এগুলি করতে গেলেন কেনো?

চ।        এসবের বাইরেও আমার আরো অনেক কিছু জানার আছে। প্লিজ, আপনি আমার সবগুলি প্রশ্নের উত্তর যতো দ্রুত পারেন, জানান। আর সেগুলি হচ্ছে- আমি আপনাকে টেন্ডেম বায়ারের সাথে এয়ার শিপমেন্ট এর ব্যাপারে সবকিছু সেটেল করে যাবেন বলে বলেছিলাম। আপনি আমাকে বারবার আশ্বস্ত করেছেন যে, এ ব্যাপারে তারা আমাকে নক করবে না। এতা তো পুরুতাই মিথ্যা কথা। আজ আমি আমার অফিসে ওদের এয়ারওয়ে বিল না পাওয়ার কারনে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছে। টেন্ডেম বলেছে, এ ব্যাপারে আপ্নার সাথে ওদের কোনো কথাই হয় নাই। কেনো এসব মিথ্যা কথা বলেছেন আমাকে?

ছ। আরএমএম এর মতো ভালো একটা কোম্পানির সাথেই বা আমরা এমন ব্যবহার কেনো দেখালাম যেখানে ওরা প্রতিনিয়ত আমাদেরকে সাহাজ্য করে যাচ্ছে? রায় ভাই আর মাহিন ভাই তো আমাদের বন্ধুর মতো। তো তাদের সাথে এ রকম একটা ফলস কন্ট্যাক্ট শো করে ব্যাংক থেকে তাকা নেয়ার কি দরকার ছিল? কি মনে করছে তারা এখন? আপনি না ইসলামের নীতিকথা বলেন, তাহলে এখন আবার এসব কেনো? কাকে খুসি করার জন্য সুদুর বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ইসলাম প্রচার করতে গেলেন চাদে? কি প্রচার করবেন ওখানে গিয়ে? নীতি নাকি দূর্নীতি? পোল্যান্ডের বায়ার লিঞ্জেন গার্ল এর মালিক টম এতো খারাপভাবে কেনো আমাদের ফ্যাক্টরী সম্পর্কে কথা বলবে? টম তো ভালো মানুষ। সেতো আমাদেরকে ভালো দামেই অর্ডার প্লেস করেছে, আর প্লেস করেই কিন্তু টিটি দিয়েছে। তাহলে ওর সাথে আমরা এভাবে আচরন করলাম কেনো? ও তো একতা মাল ও নিতে পারছে না সুতার সমস্যার কারনে আর বুতাম লাগে না এর কারনে। এই গার্বেজ কে কিনবে এখন?

জ। আপনি তাবলিগে যাওয়ার প্রাক্কালে আগের ইয়ার্ন কন্ট্রোলার মান্নানকে বাদ দিলেন, আমাকে জানালেন না। তার পরিবর্তে ইউসুফ নামে একজনকে ইয়ার্ন কন্ট্রোলার বানালেন। কে এই ইউসুফ? তার কি কোনো জ্ঞান আছে সুতার ব্যাপারে? না সে জানে লট কি, না জানে ইনভেন্টরী কি। ইয়ার্ন কন্ট্রোলার মান্নান ব্যাংকের ওয়ালি সাহেবের আত্তীয় বলেই কি আপনি তাকে তার পোষ্ট থেকে সরিয়ে দিলেন? আর আপনি কি জানেন যে, এই ইউসুফ বর্তমানে সুতার লট এবং ইস্যু নিয়ে কি তালগোলটা পাকিয়েছে? একতা গার্মেন্টসও ঠিক লট দিয়ে করা হয় নাই। এতো গুলি পিস এখন আমি কি করবো?

ঝ। মিজান হুজুর তো আপনাকে দেবতার মতো ভক্তি করে। মিজান হুজুর তার সমস্ত তল্পিতল্পা নিয়ে একটা হালাল কাজের উদ্দেশ্যে আপনার কাছে এসেছে। তাহলে কেনো তার কাছ থেকে এরুপ লাখ লাখ টাকা নিয়ে তাকেই কাজতা দিলেন না? তিনি তো কাজের জন্যই আপনাকে টাকাগুলি দিয়েছে। কি ইসলামীক নিদর্শন দেখালেন আরেকতা হুজুরের কাছে?

ট। উলসীর আরেক মোহসিন ভাই কি আমাদের জন্য এতোটাই জরুরী যে, যেখানে আমাদের ওয়ার্কাররা কাজ পায় না, অথচ আপনি আমাদের ৩ গেজ মেশিন দিয়ে দিলেন, আবার কাজও দিলেন। কেনো? উলসির মোহসিন ভাই আপনার আত্তিয় আমি জানি, তাই বলে কি নিজের ফ্যাকটরীর ওয়ার্কারদের বাদ দিয়ে অন্য আরেকজনকে এভাবে সাহাজ্য করতে হবে? এটা আপনার ফ্যাক্টরী না? আমি অবাক হচ্ছি মোহসিন ভাই।

মনে রাখবেন, আপনার এই ছলচাতুড়ির জন্য কোনো এক সময় আপনি আপানার কপাল থাপরাবেন। এভাবে ব্যবসা হয় না। সম্ভবত আমার অনেক ভুল ছিলো। আপনি যদি পারেন, তাবলিগ বাদ দিয়ে দেশে চলে আসেন। অনেক ব্যাপার স্যাপার আছে। এমনো হতে পারে, আমি আর ব্যবসাটা চালাবো না। যা লস হবার তো হয়েছেই। কোনো না কোনোভাবে হয়ত আমি উতড়ে যাবো। কিন্তু আপনি কি এই ব্যবসায় আর দাড়াতে পারবেন?

২০/১২/২০০৪- রিভার সাইড সুয়েটার্স ভিজিট

রিভার সাইড সুয়েটার্স লিমিটেড ভিজিট করলাম। অনেক সুন্দর একটা ফ্যাক্টরি। আমি গার্মেন্টসের কিছুই বুঝি না। কিন্তু ওভারঅল পরিবেশ, স্পেস, মেশিনারিজ, সেটআপ দেখে মনে হলো, জিনিষটা সুন্দর। ফ্যাক্টরীর বিভিন্ন সেকসন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তৌহিদ আমাকে দেখালো। সাথে আনসার নামে একজন লোক ছিলো যে, সিকিউরিটি ম্যানেজার হিসাবে কাজ করে, লোকাল। তৌহিদ যেখানেই যায়, এই আনসারকে নিয়েই যায়। শুনলাম, আনসার নাকি তৌহিদের একজন আত্তীয়ও বটে। ফ্যাক্টরীতে ঘুরে দেখার সময় বুঝলাম, কারেন্ট লাইন কাটা। প্রায় ৭/৮ মাসের কারেন্ট বিল না দেয়ায় বিদ্যুৎ অফিস লাইন কেটে দিয়েছে। ফলে কয়েকটা মেশিন চলে জেনারেটর দিয়ে। এদিকে গ্যাস লাইনও বিচ্ছিন্ন কারন গ্যাস বিল দেয়া হয় না প্রায় ৫/৬ মাস যাবত। আজিম গ্রুপের কিছু কাজ চলছে সাবকন্ট্রাক্ট হিসাবে। দেখলাম মোট ১২ থেকে ১৫ জন ওয়ার্কার নীচ তলায় কাজ করছে অথচ এখানে একসময় দুই হাজার শ্রমিক কাজ করতো।  লুতফর রহমান সাহেব ফ্যাক্টরীতে ছিলেন না। উনি হয়তো জানেন না যে, আমি এটার উপর গবেষনা করছি।

ফ্যাক্টরী ভিজিট করার সময় আমি অনেক নতুন নতুন মেশিনারিজ দেখলাম, এটাই আমার ব্যবসায়ীক কোনো প্রতিষ্ঠানে এই প্রথম ভিজিট। ফলে আমি মনে মনে চিন্তা করলাম, যে, এই ফ্যাক্টরী যদি আমি চালানোর জন্য নেই, তাহলে কত টাকা নিয়ে নামতে হবে, আর কিভাবে কিভাবে অর্ডার পাবো, কিভাবে কোথায় বায়ার পাবো ইত্যাদি। মনে মনে এটাও ঠিক করলাম যে, আমার মতো অনেক আর্মি অফিসাররাই বিকল্প কিছু ব্যবসার কথা ভাবছেন এই মুহুর্তে। অনেকের প্রোমোশন হয় নাই, অনেকেই চাকুরী থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য পায়তারা করছে। যদি বাজেটের সমস্যা হয়, তাহলে তো আমি ওইসব অফিসারদের সাথে সমন্নয় করে একটা পার্টনারশীপ করেও ব্যবসাটা চালাইতে পারি। ফলে এ মুহুর্তে যাদের নাম আমার মাথায় এসছিলো তারা হচ্ছেন- ফেরদৌস স্যার, ১০ লং কোর্সের ফারুক স্যার, ১০ লং কোর্সের কে এম সাফিউদ্দিন স্যার। কারন উনারা এক সময় আমাকে ব্যবসার কথা বলেছিলেন। দ্বিতীয় যে পয়েন্টটা আমার মাথায় আসলো, তা হলো, আমার এক আর্মির বন্ধু আছে মেজর মাসুদ ইকবাল। ১৩ লং কোর্সের, তানির হাসবেন্ড। আমার খুব ভালো বন্ধু। ও এখন কোনো গার্মেন্টেসে চাকুরী করে, নাম অর্নব সুয়েটারস। ওরেও তো আমি একটা প্রোপোজাল দিতে পারি যদি আমার সাথে পার্টনারশীপ করে মন্দ কি। তাছাড়া আমাদের এক আত্তীয় লিখন তো বহুদিন যাবত গার্মেন্টস লাইনে আছে, ওর কাছ থেকেও একটা বুদ্ধি পরামর্শ নিতে পারি। লিখন বেক্সিমকোতে আছে। পয়েন্টগুলি আমি লিখে নিলাম।

আজ আরেকটা কাজ করে এসছিলাম যে, আমি পরপর দুটু ডিও লেটার ড্রাফট করে এসছি। একতা সেনাপ্রধানের জন্য, আরেকটা প্রধানমন্ত্রীর জন্য। বাসায় গিয়ে এগুলি আবার আরেকবার চেক করে আমি সরাসরি এই দুইজনকে অফিশিয়ালী পাঠাইতে চাই।

রিভার সাইড সুয়েটারস ফ্যাক্টরীটা আমার গ্রামের পাশে। কিন্তু কোনোদিন আমার চোখে পড়ে নাই যে, এখানে এমন একটা রপ্তানীমুখী কারখানা আছে। অথচ এই পথ দিয়েই আমি আমার গ্রামে যাই। আজ মনে হলো, এতা আমার এতো কাছের একটা ফ্যাক্টরি, হলে তো খুব ভালো হয়। মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনাই করে ফেললাম যে, আল্লাহ যেনো আমাকে রক্ষা করেন। আর্মির চাকুরীটা আর ভালো লাগছে না। আমি এর থেকে পরিত্রান চাই।

১৮/১২/২০০৪-নাজিমুদ্দিনের সাথে বৈঠক

একটা অদ্ভুদ ঘটনা ঘটে গেলো আজ। লোকটাকে আমি চিনি না, কখনো দেখিও নাই। অথচ আজ আমার সাথে এমন একটা বৈঠক হলো তাঁর সাথে, যা আমি এতোদিন মনে মনে খুবই আশা করছিলাম। একটা ব্যবসা। আমি যেনো আজ সেটার একটা আলো দেখতে পেলাম। ব্যাপারটা কাক্তালীয়ভাবে ঘটে গেলো। মান্নান আমার ভাইতিজা। ও কিছুই করে না। অথচ সংসারটা বেশ বড়। আমাকে মান্নান গত কয়েকদিন আগে একটা ব্যাপারে ফোন করে বল্লো, কাকা, আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। বললাম, তাহলে শুক্রবার দিন আসো মীরপুর যেখানে আমি বাড়ি বানাচ্ছি সেখানে। মান্নান আমার কন্সট্রাকসন সাইটে এলো দুপুর বারোটার দিকে। মান্নান যেটা বলতে এসেছিলো সেটা হলঃ

নাজিমুদ্দিন নামে আমাদের ইকুরিয়ায় একজন চেয়ারম্যান আছে যিনি বসুন্ধরা গ্রুপের সাথে জড়িত। নাজিমুদ্দিন আমাদের ওখানে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে জমি ক্রয় করেন, তারপর ওই জমি বসুন্ধরাকে লাভের উপর বিক্রি করে দেয়। তাতে প্রতি শতাংশে নাজিমুদ্দিন পাবলিককে দেয় এক লাখ টাকা, আর বসুন্ধরাকে বিক্রি করার রেট পায় সে আরো ত্রিশ হাজার টাকা বেশি। ফলে প্রতি বিঘায় সে নয় লাখ টাকার মতো লাভ করে। যেহেতু প্রতিটি লোকের কাছে নাজিমুদ্দিনের যাওয়া সম্ভব না, ফলে নাজিমুদ্দিন লোকালি কিছু এজেন্ট রেখেছে যারা প্রতি শতাংশে হাজার দশ টাকা কমিশন পায়, তারাই পাবলিকের কাছ থেকে জমি কিনে নাজিমুদ্দিনকে দেয়। তাতে নাজিমুদ্দিনের আসলে কোনো কাজই করতে হয় না কিন্তু ফাক দিয়ে প্রতি শতাংশ জমিতে বিশ হাজার টাকা লাভ পায়। বসুন্ধরা এখানে প্রায় কয়েকশত একর জমি ক্রয় করার কথা ভাবছে একটা হাউজিং করবে বলে। মান্নান চাচ্ছিল নাজিমুদ্দিনের কাছ থেকে এমন একটা এজেন্টগিরি যেনো পায়। মান্নানের পক্ষে এটা কিছুতেই সম্ভব না, কিন্তু আমি যদি নাজিমুদ্দিনকে বলে দেই, তাহলে এটা অনেক সহজ এবং নাজিমুদ্দিন মান্নানকে এজেন্ট করবে বলে ওর ধারনা। মান্নানের সাথে শামসুদ্দিন এবং জয়নাল নামের আরো দুজন ভদ্রলোক আছেন, যারা মান্নানের সাথে চলে আর এই বুদ্ধিটা আসলে এই দুই ভদ্রলোকই মান্নানকে দিয়েছে বলে মান্নান আমাকে জানালো। মান্নান আরো জানালো যে, সামসুদ্দিন সাহেব নাকি কোনো এক সময় আমার বড় ভাই হাবীব উল্লাহ্‌র সাথে ছোট বেলায় একসাথে কেএল জুবিলী স্কুলে পরাশুনাও করতো। যাই হোক, তিনি হাবীব ভাইয়ের সাথে পড়তো কিনা সেটা আমার যাচাইয়ের বিষয় নয়, আমার বিষয় হচ্ছে নাজিমুদ্দিনের কাছ থেকে মান্নানকে একটা এজেন্টশীপ নিয়ে দেওয়া।

আমি প্রাথমিকভাবে প্রথমে শামসুদ্দিন সাহেব এবং জয়নাল সাহেবের সাথে ব্যাপারটা বুঝার জন্য আমার বাসায় দাওয়াত করি। দেখলাম, ব্যাপারতা সত্য। তাদের কাছ থেকে এতা জানলাম যে, নাজিমুদ্দিন উক্ত এলাকায় একজন অত্যান্ত প্রতাপ্সহালী এবং পয়সাওয়ালা লোক। কিন্তু একেবারেই অশিক্ষিত। তাঁর অক্ষরজ্ঞান বলতে কিছুই নাই। আর সারাক্ষন মদ আর মেয়ের নেশায় থাকে। বিএনপি র রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাদের কাছে সব কথা শুনে আমারো নাজিমুদ্দিনের সাথে দেখা করার একতা ইচ্ছা জেগেছিলো। সেই সুবাদে আমি গত মিটিং এ এই সামসুদ্দিন এবং জয়নাল সাহেবকে বলেছিলাম, নাজিমুদ্দিন সাহেবকে আমার অফিসে দাওয়াত দেয়া যায় কিনা। তারা একতা আগ্রহ প্রকাশ করলেন এবং নাজিমুদ্দিন সাহেবকে আমার অফিসে নিয়ে আসবেন বলে কথাও দিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে আজ নাজিমুদ্দিন সাহেব আমার অফিসে এসেছিলেন। বিকেল তিনটায় মীরপুর এম পি গেট থেকে আমাকে এম পি ফোন দিয়ে জানালো যে, বেশ কয়েকজন গেষ্ট এম পি চেক পোষ্টে আমার কাছে আসতে চায়, তাদের একজনের নাম জনাব নাজিমুদ্দিন। আমি কাল বিলম্ব না করে বললাম, উনাদের আসতে দিন, আমারই গেস্ট।

উনারা আমার অফিসে এলেন, আমি ইউনিফর্ম পড়াই ছিলাম। ফিল্ড মেসে লুচী, মাংশ আর অন্যান্য ফলের অর্ডার দিয়ে বললাম, যতো তাড়াতাড়ি পারে যেনো সার্ভ করে। আমরা অফিসে আলাপে মগ্ন হলাম। জনাব নাজিমুদ্দিন, সামসুদ্দিন, জয়নাল সাহেব, মান্নান আর আরো একজন তাঁর সাথে ছিলো। বুঝলাম, নাজিমুদ্দিন সব সময় একতা দল নিয়ে চলে। ভীষন কালো রঙ এর চেহাড়া, বয়স প্রায় ৫০ এর উপর। লাল লাল চোখ। কিন্তু আদব কায়দা বেশ বুঝে। আমি কুশল বিনিময় করে উনার কথা শুনতে চাইলাম। কিছু বলার আগেই নাজিমুদ্দিন তাঁর কি কি আছে, কি করে, কোথায় আরো কি কি করবে লম্বা একটা ইতিহাস বলা শুরু করলেন। আমারো প্ল্যান ছিলো লোকটা সম্পর্কে জানা এবং বুঝা আসলে তাঁর কি ক্ষমতা আছে আর কি কি করতে পারে সেটা জানা।  কথায় কথায় জানলাম যে, উনার অনেক ব্যবসা আছে। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যবসা হচ্ছে বসুন্ধরার সাথে উনার পার্টনারশীপ। বসুন্ধরার যে মালিক জনাব শাহ আলম (আকবর সোবহান) তাঁর সাথে প্রায় হাজার কোটি টাকার কন্ট্রাক্ট। তাঁর আরো গার্মেন্টস ব্যবসা আছে, ঢাকা টাওয়ারের মালিক উনি, শ্যামলী টাওয়ারের ও মালিক উনি। এটা আমাদের শ্যামলী তে অবস্থিত, যা এখনো আন্ডার কন্সট্রাকসন অবস্থায় আছে। এটার দেখভাল করেন বাবুল ভাই। যিনি আমার অফিসে বর্তমানে হাজির আছেন। বাবুল সাহেব আবার কেরানীগঞ্জের শাখা বিএন র সভাপতিও। এ ছাড়া উনার আরেকতা ব্যবসা আছে পাক-বাংলা সিরামিক। আছে একটা ফিল্ম স্টুডিও, যার নাম নাফিম নাদিম। সারোয়ার নামে এক ভদ্রলোক এই ফিল্ম স্টুডিওটার দেখভাল করেন। তিনিও আমার অফিসে আজ হাজির ছিলেন। গল্প করতে করতে নাজিমুদ্দিন সাহেব বললেন যে, যদিও তিনি একতা গার্মেন্টস ইন্ডাষ্ট্রিজের মালিক কিন্তু এটা এখন ভালো চলে না। প্রতিমাসেই শ্রমিকরা বেতনের জন্য আন্দোলন করে আর তাঁর বাসায় গিয়ে ঝামেলা করে। লুতফর রহমান নামে এক ভদ্রলোক ফ্যাক্টরীটা চালান কিন্তু সে ভদ্রলোক একজন জুয়ারী বলে যেমন কোনো মাল শিপমেন্ট করতেও পারেন না, আর যে সাব কন্ট্রাক্ট করেন সেই টাকা শ্রমিকদের না দিয়ে নিজেই নিয়ে নেন। কারেন্ট বিল পেন্ডিং, গ্যাস বিল পেন্ডিং, শ্রমিকদের সেলারী পেন্ডিং। বেশ লসে আছেন। তাঁর মধ্যে আবার সোসাল ইনভেষ্টমেন্ট ব্যাংকে বড় একটা লোন রয়ে গেছে যেটা গার্মেন্টস চালিয়ে পরিশোধ করার কথা কিন্তু তারা কেউ এটা করছে না। তিনি চাচ্ছেন এখন এই গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিটা কাউকে দিয়ে দেবার জন্য। আমি তাঁর কথা খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম আর অন্য কিছু মনে মনে ভাবছিলামও। 

বুঝলাম, নাজিমুদ্দিন সাহেব গল্প করার মানুষ, খারাপ না তবে তাঁর সাংগপাংগরা একেবারেই যে ভাল মানুষ নয় সেটা বুঝতে আমার সময় লাগে নাই। নাজিমুদ্দিন সাহেব আমার উপর একদিনেই মনে হলো খুব খুশী। কথায় কথায় বলেই ফেললেন, মিয়া ভাই, দেখেন না আপনি ফ্যাক্টরিটা চালাইতে পারেন কিনা। শুনলাম, আপনি নাকি আর চাকুরী করতে চান না, যদি মনে করেন যে, আমার এই ফ্যাক্টরিটা চালাইতে পারবেন, তাহলে নিয়াই নেন। আমিও বেচে যাই।

আমি আসলে এমন একটাই পথ খুজতেছিলাম মনে মনে।  কিন্তু পাচ্ছিলাম না। আমি নাজিমুদ্দিন সাহেবকে বললাম, যদি আমি নেই তাহলে কিভাবে আপনি দিতে চান? নাজিম ভাই আমাকে জানালেন, আপনি একাও চালাতে পারেন আবার আপনি আমাকে রেখেও চালাতে পারেন। সেক্ষেত্রে ব্যাংকে অনেক কিস্তি পেন্ডিং হয়ে আছে, সেটা রিসিডিউল করতে হবে। রিসিডিউল কি আমি সেটাই তো বুঝি না। এটা একটা ব্যাংকিং টার্ম ব্যবসার সাথে জড়িত। হয়তো ব্যাংকে গেলে এ ব্যাপারে আরো বিস্তারীত জানা যাবে। আমরা যারা আর্মিতে চাকুরী করি বা যে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করি তারা ব্যবসার সাথে জড়িত অনেক ব্যাংকিং ফর্মালিটিজ আসলেই বুঝি না। এগুলি বুঝে তারা যারা সরাসরি ব্যবসার সাথে জড়িত।

আমি নাজিম ভাইকে বললাম, তাহলে আমি ফ্যাক্টরীটা সরে জমিনে দেখতে হবে। কি অবস্থায় আছে, কি করা দরকার, ব্যাংকিং সেক্টরে কি কি সমস্যা আছে, সব জেনে আমি জানাতে পারবো আসলে আমি চালাতে পারবো কিনা। তিনি আমাকে বললেন যে, এখন বর্তমানে জনাব লুতফর রহমান চেয়ারম্যান হিসাবে ফ্যাক্টরী চালায়, আর সেটা পুরুটাই সাব কন্ট্রাক্ট বেসিসে। কিন্তু লুতফর রহমান সাহেব নাজিম ভাইকে এ ব্যাপারে কিছুই জানায় না। ব্যাংকের লোন গুলিও পরিশোধ করে না, আবার সময় মতো শ্রমিকদের বেতন ভাতাও দেয় না। এই মিলে প্রতিমাসেই শ্রমিকরা আন্দোলন করতে করতে তাঁর বাসায় গিয়া হাজির হয়, অপারগ হয়ে শেষ পর্যন্ত নাজিম ভাইকেই তাঁর অন্য সোর্স থেকে তাদের পারিশ্রমিক দিতে হয়। ওখানে লুতফর রহমানের সাথে নাজিম ভাইয়ের একজন আত্তীয় তৌহিদ নামের একটি ছেলে প্রোডাক্সনের কাজ করে। তাঁর সাথে কথা বললে হয়তো আরো বিস্তারীত জানতে পারবেন।

আমি নাজিম ভাইকে বললাম, যে, আমার যেহেতু এই মুহুর্তে গাড়ি নাই, আগামীকাল যদি কাউকে দিয়ে আমাকে একতা গাড়ির লিফট দিয়ে ফ্যাক্টরী পরিদর্শন করানো যেতো, হয়তো আমি ব্যাপারটা নিয়ে আরো একটু সিরিয়াসলী ভাবতে পারতাম। তিনি রাজী হলেন পরেরদিন গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন বলে।

নাজিম উদ্দিন ভাইয়ের সাথে কথা বলার পর রাতে আমি তৌহিদের সাথে অনেক ক্ষন টেলিফোনে কথা বললাম, জানলাম, বুঝলাম যে, ফ্যাক্টরিতে এক সময় কারা কারা ছিলো, তখন কত লাভ হতো, অনেক ভালো একটা পজিসনে ছিলো, আর এর মধ্যে অনেক শেয়ার হোল্ডার মালিকগন ছিলেন, যারা ধীরে ধীরে সরে গেছে। বর্তমানে শুধু লুতফর রহমান আর তাঁর ভাই বাবলুর রহমান ১৫% করে মোট ৩০% শেয়ার নিয়ে চেয়ারম্যান-ডাইরেক্টর আর নাজিমউদ্দিন সাহেব ৭০% শেয়ার নিয়ে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হিসাবে আছেন। তৌহিদের ভাষ্য অনুযায়ী যা বুঝলাম যে, যদি আমি আগে যারা এখানে মার্কেটিং এর কাজ করতো তাদের কাউকে আনা যায়, তাহলে এই ফ্যাক্টরী পুনরায় চালু করা কোনো ব্যাপার না। তাছারা নাজিম ভাইয়ের টাকার কনো সমস্যা নাই, সে যদি থাকে তো কোনো সমস্যাই না। নাজিম ভাইয়ের দরকার শুধু ঠিক মতো ফ্যাক্টরীটা যেনো চলে। তাকে লাভ দিতে হবে এমন নয়। আর সবচেয়ে আরেকটা বড় ব্যাপার হচ্ছে যে, ফ্যাক্টরীর ভাড়া দিতে হয় না যেহেতু এটা নাজিম সাহেবের নিজস্ব বিল্ডিং। তৌহিদের সাথে কথা বলে আগামীকালের সময়টা ঠিক করলাম, কিভাবে কিভাবে আগানো যায়। একতা পরিকল্পনাও কাগজের মধ্যে লিখে নিলাম।

১৯/০৫/২০০৪- মোহসীনের সাথে বৈঠক

শেষ পর্যন্ত রিভার সাইডে ডিএমডি হিসাবে কাজ করেছেন যে মোহসীন সাহেব, তাকে পাওয়া গেলো। বয়স প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ এর মতো হবে। বেশ ফর্সা করে লোকটি। পাঞ্জাবী পরিহিত, মাথায় একটা গোল টুপী এবং হাতে সব সময় তসবীহ থাকে। আমার বাসায় তৌহিদ, মোহসীন সাহেব আর আনসার এলো রাত ৮ টার দিকে। মোহসীন সাহেবের বাড়ি বরিশাল। বেশ ভালো ইংরেজী বলতে পারেন। অনেকক্ষন আলাপ করলাম। আসলে এবারই প্রথম আমি মোহসীন সাহেবের সাথে রিভার সাইড সুয়েটারস নিয়ে বিস্তারীত আলাপের একটা সুযোগ পেলাম। আমার যে জিনিষগুলি তাঁর কাছ থেকে জানার ছিলো সেটা এ রকমেরঃ

(১)       ফ্যাক্টরী চালাতে মোট কত টাকা প্রাথমিকভাবে ইনভেস্টমেন্ট করা লাগতে পারে।

(২)       এটার ফিউচার প্রোস্পেক্ট কি?

(৩)      গার্মেন্টস উনি আমাকে নিয়ে চালাইতে পারবেন কিনা।

(৪)       লাভ হবার সম্ভাবনা কেমন।

এই সব প্রশ্নের উত্তর মোহসীন সাহেব দিতে গিয়া একটা নোট খাতায় তৌহিদ আর তিনি একটা ক্যালকুলেশন করলেন। এবং পরিশেষে আমাকে জানালেন যে, মোহসীন সাহেব আমার সাথে জয়েন করলেও তিনি কোনো অর্থ ইনভেস্টমেন্ট করতে পারবেন না। আর তাঁর যে অভিজ্ঞতা আছে, তাতে ছয় মাসের মধ্যে এই ফ্যাক্টরি থেকে কয়েক লাখ টাকা প্রোফিট করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য যা করতে হবে সেটা হচ্ছে, প্রথমে সাবকন্ট্রাক্ট করা, এবং পরবর্তীতে সরাসরি এলসি এর মাধ্যমে বায়ারদের কাজ করা। আর এসব তিনি অনায়াসেই করতে পারবেন। এই ফ্যাক্টরী নাকি প্রাথমিক সময়ে প্রতি মাসে প্রায় ২০ লাখ টাকা করে লাভের মুখ দেখেছিলো। কিন্তু এতো বেশী শেয়ার হোল্ডার ছিলো, তাদের ব্যক্তিগত কোন্দলের কারনে পরে মোহসীন সাহেবকে তারা স্কেপগোট বানিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। আর মোহসীন সাহেব চলে যাবার পর থেকেই এই ফ্যাক্টরীর দূর্দশা শুরু হয়। এটা তৌহিদও আমাকে জানালো, আনসারও সায় দিলো এবং মোহসীন সাহেব নিজ থেকে কিছু না বল্লেও ব্যাপারটা যে এ রকমেরই, সেটা বুঝালেন। আমি এম্নিতেই রিভার সাইড ফ্যাক্টরীটা নেয়ার পক্ষে ছিলাম, এখন তো ব্যাপারটা যেনো আরো পাকা পোক্ত হয়ে গেলো।

অনেক রাত পর্যন্ত মোহসীন সাহেবের সাথে আমার মিটিং হলো। মনটা চাংগা হয়ে গিয়েছিলো। এবার আমার কাজ হবে নাজিম সাহেবকে কিভাবে কনভিন্স করা যায়। কিন্তু নাজিম সাহেবকে পাওয়াই যায় না। আমি কিভাবে আগাবো এবার তৌহিদের সাথে মোহসীন সাহেবও একজন গাইড হিসাবে যোগ হলেন।