সনটা ছিলো ২০০৪।
তখন মীরপুর সেনানীবাসে ৪ ফিন্ড আর্টিলারিতে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে কর্মরত আছি। আমার প্রমোশন হবার কথা মেজর থেকে লেফটেনেন্ট কর্নেল পদে। কিন্তু মামুলি একটা কারন দেখিয়ে তারা আমাকে প্রমোশন দিলো না। স্টাফ কলেজ করেছি, গানারী স্টাফ করেছি, ডিভ লেভেলে জিএসও -২ (অপারেসন) হিসাবে কাজ করেছি, আর্মি হেড কোয়ার্টারে ও জি এস ও-২ হিসাবে কাজ করেছি। প্রমোশনের জন্য কোনো প্রকার কমতি আমার নাই। কিন্তু তারপরেও আমাকে প্রমোশন না দিয়ে আমার জুনিয়র ১৪ লং কোর্সের মেজর মজিস, যে কিনা ক্যাটেগরি-সি , স্টাফ কলেজ ও করে নাই, গানারী স্টাফ ও করে নাই, সে আমার বদলে প্রমোশন পেয়ে ৪ ফিল্ডে পোস্টিং এসেছে। এটা শুধু মাত্র সে খালেদা জিয়ার সাথে কোনো না কোন ভাবে পরিচিত। শোনা যায় যে, মজিদের বাবা খালেদা জিয়ার বাসায় নাকি মালীর কাজ করতো। আর সে সুবাদেই এই নেপোটিজম। এর কোনো মানে হয়? সিদ্ধান্ত নিলাম, এপেন্ডিক্স-জে (ইচ্ছেকৃতভাবে অবসর নেওয়া) দিয়ে আর্মি থেকে চলে যাবো। সাথে সাথে এটাও ভাব লাম যে, বাইরে গিয়ে কোনো চাকুরী ও করবো না। কিন্তু কি ব্যবসা করবো সেটা তো কখনো শিখি নাই। একচুয়ালি, আর্মির অফিসার গন, সারাজীবন তাদের ডেডিকেসন থাকে আর্মির যাবতীয় কাজে, সে আর কোনো বিকল্প কাজ শিখেও না। ফলে আমারো তাই হয়েছে। অনেক ভাবছিলাম, কি করা যায়। কিন্তু কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না।
ঠিক এই সময় একটা ঘটনা ঘটে গেলো। কোনো এক কাকতালীয় ভাবে একদিন আমার সাথে নাজিমুদ্দিনের পরিচয় হয় মীরপুর সেনানীবাসে। আমিই তাকে মীরপুর সেনানিবাসে দাওয়াত করেছিলাম কারন সে আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলো। আমি কখনোই নাজিমুদ্দিনকে সামনাসামনি দেখিও নাই, কথাও বলি নাই যদিও সে আমাদেরই এলাকার লোক। নাজিমুদ্দিন এলাকায় একজন খুব প্রতাপশালী খারাপ মানুষের মধ্যে একজন ছিলো। ধর্মের কোনো বালাই ছিলো না, সারাদিন মদের উপর থাক্তো, আর নারী ছিলো তার প্রিয় ভোগের মধ্যে একটি। সিনেমার জগত থেকে শুরু করে, সঙ্গীত রাজ্যের সব নারীদের এবং সাধারন মেয়েরা কেউ তার হাত থেকে রেহাই পায় নাই। তার টাকা ছিলো, ফলে টাকার জন্য ই সব ক্লাসের অর্থলোভী মেয়েগুলি তাকে দিনে আর রাতে সঙ্গ দিতো। সে বসুন্ধরার প্রোজেক্ট সমুহে মাটি সাপ্লাই দেওয়ার বৃহৎ একচ্ছত্র সাপ্লাইয়ার ছিলো। জমি দখল, অবৈধ ভাবে মাটি কাটা, অন্য মানুষের জমি কম দামে ক্রয় করে বসুন্ধরাকে দেওয়া, এই ছিলো তার কাজ। কিন্তু তার একটি জায়গায় সে কখনো ই বুদ্ধিমান ছিলো না। সে সব সময় পাওয়ার অফ এটর্নি বা আম মোক্তার নিয়ে জমি ক্রয় করত। সেই রকম ভাবে আমাদের গার্মেন্টস বিল্ডিংটা যে জমির উপর অবস্থিত, সেটা জনাব আব্দুল বারেক এবং তার পরিবারের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলো। হয়ত কিছু টাকা বাকী থাকতে পারে। কিন্তু সে জমিটা রেজিস্ট্রি করে নেয় নাই। পরিবর্তে সে বারেক সাহেব এবং তার পরিবারের কাছ থেকে পাওয়ার অফ এটর্নি নিয়ে এখানে দশ তালা ফাউন্ডেসন দিয়ে হাসনাবাদ সুপার মার্কেট নামে আপাতত তিন তালা বিল্ডিং (সাথে একটি বেসমেন্ট) তৈরী করে।
প্রাথমিকভাবে সে নিজেই একটা গার্মেন্টস দিয়েছিল এবং এর নাম রেখেছিলো "রিভার সাইড সুয়েটারস লিমিটেড", বেশ সুন্দর নাম। নাজিমুদ্দিন সাহেব গার্মেন্টস চালানোর জন্য যে জ্ঞ্যান, যে বিদ্যা থাকা দরকার সেটা তার কিছুই ছিলো না। কিন্তু তার অনেক টাকা ছিলো। ফলে গার্মেন্টস এর জন্য তিনি যাদেরকে অংশীদারী দিয়েছেন, তারা সবাই ছিলো নিজেদের আখের গোছানোর ধান্দায়। ফলে ধীরে ধীরে অত্র গার্মেন্টস শুধু লোক্সানের দিকেই যাচ্ছিলো। এই লোক্সান এক সময় নাজিমুদ্দিনের কাছে খুব বিরক্তিকর মনে হচ্ছিলো বটে কিন্তু সে অন্য দিকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীটা রাখতেও চাচ্ছিলো।
অনেক কথাবার্তার পর, নাজিমুদ্দিন আমাকে একটা অফার দিলো যে, যদি আমি চাই তাহলে আমি তার রিভার সাইড সুয়েতারস ফ্যাক্টরী টা চালাইতে পারি। তিনি আমাকে ৩০% শেয়ার দিবেন আর তিনি ৭০% শেয়ার নিজে রাখবেন। এদিকে আমি কোনো কিছুই বুঝি না কিভাবে কোথা থেকে গার্মেন্টস এর অর্ডার নিতে হয়, কিভাবে ব্যাংকিং করতে হয়, কোনো কিছুই না। কিন্তু সাহস ছিলো অনেক। পরের দিন আমি রিভার সাইড সুয়েতারস দেখতে গেলাম। প্রায় বন্ধ অবস্থায় আছে ফ্যাক্টরীটা। মাত্র ১৮ জন অপারেটর কাজ করছে। কারেন্ট লাইন বন্ধ কারন প্রায় ৪ মাসের অধিক কারেন্ট বিল বাকী আছে। গ্যাস লাইন ও বন্ধবিল পরিশোধ না করার কারনে। ব্যাংকে প্রায় তিন কোটি টাকা লোনা আছে। ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ না করার কারনে কোন এল সি করা যায় না, সি সি হাইপোর কোনো সুযোগ নাই। এর মানে ফ্যাক্টরীটা একেবারেই লোকসানের প্রোজেক্ট। ব্যাংক ম্যানেজার ছিলেন তখন মিস্তার তাহির সাহেব এবং সোস্যাল ইস লামী ব্যাংকের এম ডি ছিলেন তখন মিস্তার আসাদ সাহেব। ঊনারা দুজনেই একটা উপদেশ দিলেন যে, যদি আমি নিতে চাই, তাহলে ব্যাংক রি সিডিউলিং করতে হবে। ব্যাংক রিসিডিউলিং কি জিনিষ তাও আমি জানি না। যাই হোক, শেষ অবধি আমি রিস্ক নেওয়ার একটা প্ল্যান করলাম।
ফ্যাক্টরীটা তখন চালাচ্ছিলো জনাব লুতফর রহমান নামে এক ভদ্রলোক। এরও স্বভাবের মধ্যে অনেক খারাপ কিছু ছিলো। সে রীতিমতো জুয়া এবং নারীঘটিত ব্যাপারে খুব আসক্ত ছিলো। সাবকন্ট্রাক্ট করে যে টাকা পেতো, সেটা শ্রমিকদের মুজুরী না দিয়ে জুয়ার আসরেই বসে হেরে আসতো। ফলে প্রতিনিয়ত শ্রমিকগন সবশেষে সেই আবারো নাজিমুদ্দিনের বাসার সামনে গিয়েই বেতনের জন্য আন্দোলন করা ছাড়া কখনো বেতন পাওয়ার সম্ভাবনা থাক্নতো না। নাজিমুদ্দিন এতোটাই বিরক্ত ছিলো যে, কোনোভাবে এটা অন্য কারো হাতে দিতে পারলে সেও যেনো বেচে যায়।
ব্যাংক রিসিডিউলিং করার জন্য মোট ৪০ লাখ টাকার প্রয়োজন। আমার কাছে এতো টাকা ছিলোও না। ফলে আমি আমার পরিচিত কিছু সিনিয়র আর্মি অফিসারদের সাথেও কথা বললাম যারা খুব তাড়াতাড়ি আর্মির চাকুরী ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন। কিন্তু সবাই লাভ চায়, আনসারটেনিটিতে কেউ ইনভেস্ট করতে চায় না। ফলে আমার পরিচিত আর্মি অফিসার গন ক্রমে ক্রমে পিছু হটে গেলেন।
কোন উপায়ন্তর না দেখে আমি আমার বড় ভাই হাবীবুল্লাহ যিনি আমেরিকায় থাকেন, তার কাছ থেকে তখন ৪০ লাখ টাকা ধার নিলাম এবং বাকী সব রি সিডিউলিং করে নিলাম। সাথে ৩০% শেয়ারের সমান টাকা আমি নাজিমুদ্দিন কেও দিয়ে দিলাম (কিছু জমি দিয়ে আর কিছু ক্যাশ দিয়ে)।
এতে আরেকটি সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিলো। আমি ছিলাম রিভার সাইড সুয়েতারস এর চেয়ারম্যান আর নাজিমুদ্দিন ৭০% নিয়ে থাক্লেন এম ডি হিসাবে। কিন্তু নাজিম ভাই অফিশিয়াল কোনো কাজেই ইনভল্ব হলেন না। তার দস্তখত লাগ্লেও তাকে কোথাও খুজেই পাওয়া যায় না। তাছাড়া রুগ্ন এই ফ্যাক্টরিতে অনেক প্রয়োজনেই টাকাও লাগতোকিন্তু নাজিমুদিইন ভাই তার কোন ভাগ ই নিতেন না। আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে সার্বক্ষণিক টাকা ধার করে করে চালাইতে শুরু করলাম বটে কিন্তু একটা সময় আমার পক্ষে আর চালানো সম্ভব হচ্ছিলো না।
উপান্তর না দেখে একদিন আমি নাজিমুদ্দিন ভাইকে বললাম যে, হয় আমার ৩০% শেয়ার আবার তিনি নিয়ে আমার ইনভেস্টমেন্ট ফেরত দিক অথবা বাকী ৭০% শেয়ার একেবারে আমার নামে ট্রান্সফার করে দিক যেনো আমি আমার মতো করে চালাইতে পারি। তখনো ব্যাংকে প্রায় তিন কোটি টাকার মতো বাকী। কিস্তি দিতে পারছি না। এল সি করতে পারছি না। শুধু নিজের পকেট থেকেই টাকা খরচ হচ্ছে। নাজিম ভাই চালাক মানুষ। তিনি সব লোন আমার নামে ট্রান্সফার করে আর কিছু টাকা ক্যাশ নিয়ে পুরু ৭০% শেয়ার বিক্রি করতে রাজী হয়ে গেলেন। ফ্যাক্টরীর এসেট, লায়াবিলিটিজ হিসাব কিতাব করে শেষ পর্যন্ত আমি বাকী ৭০% শেয়ার নিয়ে আরেকবার রিস্ক নেওয়ার সাহস করলাম। আমার সাথে নতুন লোক মিস্তার মোহসীন (যিনি এক সময় এই ফ্যাক্টরীর ডি এম ডি হিসাবে কাজ করতেন) যোগ হলেন। তাকে আমি খুজে বের করেছি এই কারনে যে, তিনি গার্মেন্টস লাইনে বেশ পাকা, বায়ার দের সাথে তার পরিচয় আছে, ব্যাংকিং বুঝে। আমি তাকে বিনে পয়সায় ৩০% শেয়ার লিখে দিয়ে তাকে চেয়ারম্যান করলাম আর আমি এম ডি হয়ে গেলাম।
নতুন করে আবার ইনভেস্টমেন্ট এর পালা। আমি আমার আত্মীয় জনাব মুস্তাক আহ মেদ (আমার স্ত্রীর ছোট ভাই, যিনি আমেরিকায় থাকে) কে গার্মেন্টস এর শেয়ার চায় কিনা জানালে তিনি ২৫% শেয়ার নেওয়ার একটা ইন্টারেস্ট দেখান এবং তিনি প্রায় ৪৫ লাখ টাকা যোগান দেন। এইভাবে আমি আরো অনেক স্থান থেকে ফান্ড যোগার করে করে ফ্যাক্টরীটি চালানোর চেষ্টা করছিলাম। প্রচুর সময় দিচ্ছি, রাত ফ্যাক্টরীতেই কাটাই প্রায়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ফ্যাক্টরিটা ঘুরে দারাচ্ছিলো না। এক সময় আমার মনে হলো, মোহ সীন সাহেব নিজেই ফ্যাক্টরীর উন্নতির জন্য মন দিয়ে খাটছেন না। তিনি যেহেতু নিজে কোনো টাকা ইনভেস্ট করে নাই, ফলে তার সিন্সিয়ারিটি আমার কাছে একটা প্রশ্নের উদ্রেক করলো। সেলারীর সময় তিনি ট্যাব লিকে চলে যান, খুব কম রেটে অর্ডার নেন, কস্টিং প্রাইসের চেয়েও কম রেট। ফলে আমি লোনে ডুবে যাচ্ছিলাম। কিছুতেই আর সামাল দিতে পারছিলাম না।
অবশেষে ২০০৭ এর শেষে আমি ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিলাম যে, যা লস হবার হয়ে গেছে, এবার আর লস দিতে চাই না। আমি ফ্যাক্টরী বিক্রি করে দেবো এবং ব্যাংকের টাকা শোধ করতে পারলেই হবে। কারন ব্যাংক লোন তো এখন আমার উপরেই একা। যদিও মোহসীন সাহেন ৩০% এর মালিক কিন্তু তার কোনো টাকা নাই এবং তিনি এই ব্যাপারে কোনো সংকিতও নন। আমি মোহসীন ভাইকে বললাম যে, আমি ফ্যাক্টরী বিক্রি করতে চাই। তিনি একজন গ্রাহক আনলেন, নাম মিস্টার মুরতুজা আর শ্রীলংকান এক ভদ্রলোক নাম প্রিয়ান্থা। ঊনারা এমন একটা প্রপোজাল দিলেন, আমি হিসেব করে দেখলাম যে, আমি লোন থেকে বেরিয়ে যেতে পারি।
মিস্টার মুরতুজা এবং মিস্টার প্রিয়ান্থা দুজনেই গার্মেন্টস লাইনে বেশ পাকা এবং তারা প্রফেসনাল। তারা নতুন করে ফ্যাক্টরীটা আবার তাদের মতো করে সাজিয়ে ব্যবসা করবেন এবং এটা সম্ভব।
মুর্তজা ভাই এবং মিস্টার প্রিয়ান্থা ধীরে ধীরে এলাকা সম্পর্কে জানতে জানতে একটা জিনিষ বুঝলেন যে, এই এলাকাটি সভ্য কোনো জায়গা নয় এবং এখানে ব্যবসা করতে গেলে লোকাল সাপোর্ট ছাড়া কোনোভাবেই ব্যবসা করা সম্ভব নয়। এই ফিডব্যাকটা তারা লোকাল এলাকা, বিভিন্ন বন্ধুবান্ধব, এবং স্টাফদের ছাড়াও ব্যাংক থেকে পেলেন যে, হয় মিস্টার নাজিমুদ্দিন অথবা মেজর আখতারকে সাথে না নিলে নিরাপদে এখানে ব্যবসা করা সম্ভব না। এই এলাকাটি আবার আমার নিজের। সবাই আমাকে চিনে। তারমধ্যে আমি একজন আর্মি অফিসার হওয়াতে সবাই আমাকে একটু ভয়েও থাকে।
হতাত করে একদিন মুরতুজা ভাই এবং প্রিয়ান্থা আমার মিরপুরের বাসায় রাত ১১ টায় এসে হাজির। তারা আমাকে এইমর্মে জানালেন যে, তারা ১০০% শেয়ার কিনবেন না। ৯০% শেয়ার কিনবেন এবং ১০% শেয়ার আমাকে রাখতেই হবে। আমি আমার সময়মতো ফ্যাক্টরীতে আসতে পারবো এবং আমি আমার এমডি পোস্টেই থাকবো। সম্মানি হিসাবে আমি তাদের সমান সম্মানিই পাবো। ব্যাপারটা আমি সবশেষে মেনেই গেলাম। অর্থাৎ আমি ১০%, মুরতুজা ভাই ৪৫% আর প্রিয়ান্থা ৪৫% শেয়ার নিয়ে আবার ফ্যাক্টরী রান করতে শুরু করলো। এবার এটা প্রান ফিরে পেলো।
২০১০ সালে প্রিয়ান্থা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৪১ বছর বয়সে মারা যান। ইতিমধ্যে মুরতুজা ভাই আমি কেমন লোক, কেমন চরিত্রের মানুষ, সেটা বুঝে গিয়েছিলেন। আমি আসলে মাত্র ১০% শেয়ার নিয়ে কোনো হস্তক্ষেপই করছিলাম না। কারন ঊনারা ৯০% এর মালিক, সেখানে আমার মন্তব্য কিংবা আমার কোনো সাজেশন খুব একটা মুল্যায়ন করা হবে কি হবে না সেটা নিয়ে আমি একটু তো সন্দিহান ছিলামই। ফলে আমি জাস্ট নামেমাত্র এমডি হিসাবেই ছিলাম আর লোকাল কোনো সমস্যা হলে সেটা আমি সামাল দিতাম। কোথায় কোন বায়ারের অর্ডার, কিংবা কবে কোন শিপমেন্ট এগুলো নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামাইতাম না।
আমার যখন এই রকম এক্টা অবস্থা, আমি তখন নিজে নিজে কিছু করা যায় কিনা সেটাও ভাবছিলাম। ফলে ডেভেলপারের কাজেও একটা চেষ্টা করছিলাম, যার ফল হচ্ছে বাসাবোতে একটা প্রোজেক্ট। সেটার ইতিহাস অন্য রকম। এটা না হয় পরেই বলবো।
প্রিয়ান্থা মারা যাবার পর, মুরতুজা ভাই প্রিয়ান্থার ৪৫% শেয়ারের মধ্যে তিনি নিলেন ২০% আর আমি নিলাম ২৫%। এতে আমার শেয়ার দাড়ালো ৩৫% আর মুরতুজা ভাইয়ের শেয়ার দাড়ালো ৬৫%। ২৫% শেয়ার নেবার জন্য আমি মুরতুজা ভাইকে ৫৮ শতাংশ জমি লিখে দিতে হলো। এভাবেই বর্তমান পর্যন্ত চলছে। ফ্যাক্টরি ধীরে ধীরে বেশ উন্নত করতে লাগলো। কিন্তু আমার ভিতরে একটা আনসারটেনিটি সবসময় কাজ করতো যে, একটা সময় আসবে যে, মুরতুজা ভাই কোনো না কোনো সময় এর বিকল্প হিসাবে অন্যত্র বেরিয়ে যাবেনই। ফলে আমি নিজেও রিভার সাইড সুয়েটারস এর পাশাপাশি আরো কোনো ব্যবসা করা যায় কিনা আমি একটা বিকল্প খুজছিলাম। হয়ত তার ই একটা বিকল্প প্রোডাক্ট ব্যবসা হিসাবে মা ইন্ডাস্ট্রিজের জন্ম। ওটাও আরেক ইতিহাস। এটাও পরে বলবো।
গত ৮ জানুয়ারী মাসে সড়ক ও জনপথ আমাদের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীটির কিছু অংশ ভেঙ্গে দিয়ে যায় কারন আমাদের ফ্যাক্টরী বিল্ডিংটি বিল্ডিং এর মালিক জনাব নাজিমুদ্দিন সাহেব গায়ের জোরে সরকারী জায়গায় কিছুটা অংশ বাড়তি তৈরী করেছিলেন। বর্তমানে পদ্মা সেতু বানানোর কারনে সরকার তার নিজের জায়গা দখল করতে গিয়ে আমাদের বিল্ডিং ভেঙ্গে দিয়ে গেলো। তাতে আমাদের কোন সমস্যা ছিলো না। সমস্যাটা হয়েছে গার্মেন্টস বায়ারদের আসোসিয়েসন একরড আমাদের বিল্ডিংটা আন্সেফ করিয়ে দিলে আর কোনো বায়ার এখানে অর্ডার প্লেস করবেনা। তাতে আমাদের ব্যবসা লাটে উঠবে। আমরা এখানেই পথে নেমে যেতে হবে।
যেদিন সড়ক ও জনপথ আমাদের ফ্যাক্টরী বিল্ডিংটা ভেঙ্গে দিয়ে যায়, সেদিন ছিলো আমাদের জন্য একটা মারাত্মক বিপর্যয়। একদিকে উক্ত বিল্ডিং এবং জমির মালিকানা নিয়ে কয়েকটি দলের সাথে কোন্দল, মামলা, মারামারি এবং সন্ত্রাসী হুমকী ইত্যাদি, অন্যদিকে সড়ক ও জনপথের নিজস্ব জায়গাউদ্ধারের কারনে ভাঙ্গাভাঙ্গি, ফলে মাঝখানে আমরা যারা অনেক টাকা এই বিল্ডিং এ ব্যবসার কারনে ইনভেস্ট করে ফেলেছি সেটা একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।
যেদিন থেকে জনাব নাজিমুদ্দিন মারা গেলো, তার পরের থেকেই একের পর এক বাহিনী এই জমি এবং বিল্ডিং দখল করে ফেলার জন্য পায়তারা করছে। জনাব বারেক আমাকে উকিল নোটিশ দিয়েছে যেনো তাকে ভাড়া দেওয়া হয়, আবার নাজিমুদ্দিনের তিন বউ সরাসরি ভাড়া চায়, অন্যদিকে জরীফ নামে আরেক লোক পুরু জমি এবং বিল্ডিং এর মালিকানা দাবী করছে। আমার এইখানে এডভান্স দেওয়া আছে প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা। ফলে আমার এই অগ্রিমের টাকাকে ফেরত দেবে তার কোনো দায়ভার কেউ নিতে চাইছে না। তাহলে আমার এতোগুলি টাকার কি হবে? আমি কাউকেই আর ভাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নই। আজ প্রায় ৩৮ মাস হয়ে গেছে আমি কোনো ভাড়া দিচ্ছি না।
জমি এবং বিল্ডিং নিয়ে নাজিমুদ্দিনের তিন বউ আরেক বাহিনী জনাব বারেক সাহেবের সাথে কখনোই সমঝোতায় পৌছতে পারছিলো না। মিস্টার বারেক, নাজিমুদ্দিনের পরিবার কিংবা বারেকের অন্যান্য পরিবারের সদস্যরা ও আমাকে অফার করেছে যদি আমি কিছু টাকা দিয়ে উক্ত বিল্ডিং এবং জমি বারেক সাহেব্দের কাছ থেকে কিনে নেই কিংবা নাজিমুদ্দিনের পরিবার ও আমাকে এক ই ধরনের অফারকরেছিল। কিন্তু আমি কোনো ভাবেই প্ররোচিত হইনাই। এর বদলে, আমি চেষ্টা করছিলাম যে, কোনোভাবে মিস্টার বারেক এবং নাজিমুদ্দিনের পরিবারের মধ্যেকোনো ভাবেই সমঝোতা করা যায় কিনা। কেউ ইসমঝোতার কাছাকাছি ছিলেন না। ফলে এটা এভাবেই স্ট্যাল্মেট অবস্থায় চলছিলো, আমিও কোন ভাড়া দিচ্ছিলাম না। কারন আমার অগ্রিম টাকা শোধ করতেই হবে। অনেক টাকা , প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা।
প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেছে এইওবস্থার। হতাত করে শুনলাম যে, সাইফুল ইসলাম নামে চাদপুরের কোনো এক ৬৯ বছরের মানুষ গত ২০০৭ সালে নাজিমুদ্দিনের কাছ থেকে এই জমি এবং এই বিল্ডিং কিনে নিয়েছিলো। এটা একটা অবাস্তব ঘটনা। কারন আমি গত ২০০৬ থেকে এই ফ্যাক্টরিতে আছি। কখনো বারেক সাহেব কিংবা ওই সাইফুল ইসলাম কখনো এখানে আসে নাই। আর আমার সাথে সর্বশেষ ফ্যাক্টরী চুক্তি হয়েছিলো ২০০৯ সালে। তাহলে নাজিমুদ্দিন কিভাবে ২০০৭ সালে বিক্রি করে? আর আমি তো ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতি মাসে ফ্যাক্টরীর ভাড়া দিয়ে আসছিলাম। তাহলে এতোদিন সাইফুল ইসলাম সাহেব কেনো ভাড়া নিতে এলেন না?
মামলা হয়েছে, বারেক সাহেব করেছে, আবার এদিকে সাইফুল ইসলাম সাহেবের দেওয়া পাওয়া অফ এটর্নি পেয়েছে সোহাগ গ্রুপের সাথে জড়িত মালিবাগের জাহাঙ্গীর হাসান মানিক। আর ঊনার প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করছে এলাকার জরীফ নামে এক লোক। সে আমাদের প্রতিনিয়ত খুব ডিস্টার্ব করছিলো এই বলে যে, সে এবং জাহাঙ্গীর হাসান মানিক যেহেতু নতুন মালিক, ফলে তাকে ভাড়া দিতে হবে , তা না হলে এখানে খুবই অসুবিধা। আজকে পানির লাইন বন্ধ করে দেয় তো কাল কারেন্টের লাইন নিয়ে ঝামেলা করে। অথচ আমি জানি সত্যটা কি। কিচ্ছু করার নাই। আমার কোনো ইন্টারেস্ট নাই কে বা কারা মালিক এই বিল্ডিং বা জমির। আমার ইন্টারেস্ট হলো আমার ব্যবসা, আমার অগ্রিম টাকা এবং পিস্ফুল সমাধান।
আমি এবং মুরতুজা ভাই মেন্টালি খুব ডিস্টারবড হচ্ছিলাম। কিছুতেই ভালো একটা সমাধান করতে পারছিলাম না।
ঠিক এই সময় সড়ক ও জনপথের অফিসাররা পদ্মা সেতুর কারনে আমাদের ফ্যাক্টরীর প্রায় ১৫-২০ ফুট ভাঙ্গার জন্য বুল ডোজার নিয়ে হাজির। আমরা কেহই ফ্যাক্টরীতে ছিলাম না। আমি যখন এলাম, তখন ইতিমধ্যে প্রায় ৫ থেকে ৭ ফুট ভেঙ্গে ফেলেছে। খুবই ভয়ংকর একটা অবস্থা। আমাদের ফ্যাক্টরীটা একরড সারটিফায়েড। এখন যদি কোনো কারনে একরড জানতে পারে যে, আমাদের ফ্যাক্টরীতে ভাঙ্গা পড়েছে, কোনোভাবেই আমরা একরডের সারটিফিকেট রিটেইন করতে পারবো না। আর যদি সারটিফিকেট রিটেইন করতে না পারি, তাহলে কোনো অবস্থায়ই আমাদের বায়াররা আমাদের অর্ডার প্লেস করবে না।
সড়ক ও জনপথের অফিসারদেরকে অনুরোধ করা হলে তারা মালিকপক্ষ ছাড়া কোন কথাই বলবেন না বলে ভাংতেই থাক্লেন। বারেক সাহেবকে ফোনে জানালে ঊনি এমন একটা ভাব করলেন যে, ভাংতে থাকুক। যেটুকু থাকে সেটুকু নিয়েই ঊনি পরবর্তীতে জড়িফের সাথে ফাইট করবেন। জরীফের সাথে কথা বলা হলো, সে মালিকের পক্ষে যেভাবেই হোক একটা প্রক্সি দিলো। বারেক সাহেব অনেক পরে যদিও স্পটে এলেন কিন্তু তিনি জরীফের ভয়েই হোক আর তার অনিহার কারনেই হোক কারো সাথেই আলাপ করলেন না, আবার সড়ক ও জনপথের ম্যাজিস্ট্রেট এর সাথেও কোনো কথা বললেন না।
আমি বুঝতে পারলাম, এখন ব্যবসা করতে গেলে আমাকে জরীফের লোকজনকেই মালিক বলে মেনে নেওয়া উচিত। মামলার ফলাফল দিবে আদালত। যদি জরীফ গং মামলায় জিতে আসে তাতে আমার কোনো সমস্যা নাই, আবার বারেক জিতে আসে তাতেও আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি শেষ পর্যন্ত জরীফের দলের সাথে একটা চুক্তি করেই ফেললাম। অন্তত তারা আমার অগ্রিম টাকাটার একটা দায়িত্ত নিয়েছেন। যদিও পুরুটার নয়। আমার প্রায় ২৫/৩০ লাখ টাকার লস হবে।
(চলবে)