০৩/১২/২০২২-কোকো, আমাদের প্রথম জার্মান শেফার্ড

কুকুর পালার শখ আমার কখনোই ছিলো না। বরং মানুষ কেনো কুকুর পালে, সে ব্যাপারে আমার অনেক নেগেটিভ মতবাদ ছিলো। অথচ এখন আমি নিজেই কুকুর পালা শুরু করেছি। কেনো এমনটা হলো, সে ব্যাপারটাই এখন বলছি।

সম্ভবত গত বছরের প্রথম দিকে হটাত করে কোথা থেকে একটা কুকুর আমাদের বাসায় এসে হাজির। কথা নাই বার্তা নাই, সে আর কোথাও যেতেও চায় না। সারাদিন আমাদের বাসার সামনেই বসে থাকে, গেটে বসে থাকে, কোথাও যায় না। মাঝে মাঝে আমি বা আমার পরিবার ওকে কিছু খাবার দেয়া শুরু করে। খুব যে খায় তাও না। যতটুকু লাগে ততটুকুই খায়, আর কিছু খাবার রেখেও দেয়, পরবর্তী সময়ে আবার সেটা ক্ষুধা লাগলে খায়। ব্যাপারটা খুব অবাক লাগছিলো।

সারারাত বিশেষ করে রাত ১১ টার পর আমরা যখন মেইন গেট লাগিয়ে দেই, তাকে আমরা জোর করেই গ্যারেজের ভিতর থেকে বের করে দেই, কিন্তু খুব সকালে আবার এসে হাজির হয়। এভাবে প্রায় ৬/৭ মাস পার হবার পর একদিন শুনি ওর নাম রাখা হয়েছে ‘রকি”। সম্ভবত এই নামটা দেয়া হয়েছে আমার বড় মেয়ের দ্বারা। এখন সবাই ওকে ‘রকি’ নামেই ডাকে। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে, কুকুরটাও মনে করে আমরা ওর মালিক, আমাদের কথা শুনে, ডাকটাও সে রেস্পন্স করে। এখন ওকে আমরা সবাই একটা মায়ার মধ্যে বেধে ফেলেছি। অফিস থেকে বাসায় আসার পরই দেখি, আমার গাড়ীর সামনে এসে দাঁড়ায়, সকালে গেট খুললেই মাথা দিয়ে গেট ধাক্কা দিতে শুরু করে কখন সে গ্যারেজে ঢোকবে।

এর মধ্যে আমার ফ্যাক্টরীর ছাদে হটাত দেখি জার্মান শেফার্ডের পাচটি বাচ্চা। পিচ্চি পিচ্ছি, চোখ ফুটে নাই। জরীফ নামে এক লোক যে আমাএ ফ্যাক্টরী বিল্ডিং এর ভাড়া নেয়। দেখে ভালো লেগেছে। মনে হলো, একটা বাচ্চা পালা যায়। সেই থেকে জার্মান শেফার্ড পালার শখ হয়েছে।

গত ১২ অক্টোবর ২০২২ থেকে আমি এই জার্মান শেফার্ডের বাচ্চাটা আমি নিয়ে এসেছি। ওর সেদিন বয়স হয়েছে একেবারে তিন মাস। আমি যখন ওকে গাড়িতে করে নিয়ে আসি, দেখেছিলাম, ওর শরীরের হাড্ডিগুলি পর্যন্ত দেখা যায়। আমি জানি না কিভাবে কুকুর পালতে হয়। কিন্তু অন লাইনে গিয়ে বা ইউটিউবে গিয়ে এ ব্যাপারে বেশ কিছু ধারনা পাওয়া গেলো।

পরেরদিন ওর একটা নাম দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম। আমার ছোট মেয়ে (যে আমেরিকায় থাকে) সে তো কুকুর পালবো এটা শুনেই আনন্দে আত্তহারা। বড় মেয়েও তাই। কিন্তু বউ একেবারে নারাজ। কিছুই যায় আসে না। কুকুরের জন্য ঘর বানিয়েছি ২টা। একটা গ্যারেজে আরেকটা ছাদে।

ওর নামটা দিলো আমার ছোট মেয়ে।

নাম কোকো।

এখন আমরা ওকে কোকো নামেই ডাকি। এই এক মাস হয় নাই, এর মধ্যে কোকোর ওজন বেড়েছে প্রায় ২ কেজি। প্রচুর খায়, মাশ আল্লাহ, খেলে, আমাদের ঘরে আসে। আমার কেয়ার টেকারের সাথে ওর বেশী শখ্যতা মনে হয়। কারন সারাদিন তো কোকো ওর সাথেই থাকে, খেলে, বেড়ায়।

আমাকে একটু ভয় পায় কারন মাঝখানে আমি ওকে কিছু কথা না শোনার কারনে লাঠি দিয়ে ভয় দেখিয়েছি। আমার মনে হয়েছে, কোকো কাউকে ভয় পাক এটাও দরকার আছে।

কোকোকে সব গুলি ভ্যাক্সিন দেয়া হয়েছে। ডি-ওয়ার্মিং করার জন্য একটা কৃমির ট্যাবলেট ও খাওয়ানো হয়েছে। আরেকটা খাওয়াতে হবে। আমি ওকে প্রতি শুক্রবারে সাবান শ্যাম্পু দিয়ে খুব ভালো করে গোসল করাই।

কুকুর পালা থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। একটা বোবা প্রানীকে বশ মানানো, কথা শোনানো সহজ ব্যাপার না। তবে কুকুর অত্যান্ত প্রভুভক্ত প্রানী। দেখা যাক কোকোর বেলায় কি হয়। এটাই কোকো।

১২/০৭/২০২২-ওয়াকফ সম্পত্তি কি এবং কার

বেশ কয়েকদিন যাবত একটা বিষয় নিয়ে লিখবো বলে ভাবছিলাম। কারন এই বিষয়টার ব্যাপারে আমরা হয়তো অনেকেই জানি কিন্তু না জানার মতো। আমি এই বিষয়টা নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসকের সাথে বিস্তারীত কথা বলার পরে, এবং এ বিষয়ে বিস্তারীত আইন কানুন সম্পর্কে জানতে পেরে আমি নিজেও এই ওয়াকফ ব্যাপারটা নিয়ে খুবই সন্তুষ্ঠ।

ওয়াকফ হচ্ছে নিজের মালিকানাধীন সম্পদকে আল্লাহর মালিকানায় নিবেদিত করা। এর মাধ্যমে সম্পদের মালিকানা ব্যক্তির কাছ থেকে বিলুপ্ত হয়। অর্থাৎ ওয়াকফকৃত বস্তু কারো মালিকানায় প্রবেশ করা থেকে বেরিয়ে যাবে, শুধু বস্তুর উপকার যাদের জন্য ওয়াকফ করা হয়েছে তাদের জন্য নির্ধারিত হবে।

ওয়াকফ দুই ধরনের হয়ঃ
(ক) ওয়াকফ ই লিল্লাহ
(খ) ওয়াকফ আল আওলাদ

ওয়াকফ-ই-লিল্লাহ জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত সম্পত্তি। এই সম্পদ থেকে তিনি বা তার বংশধর কোনো মুনাফা ফিরে পেতে পারে না। অন্যদিকে কোনো সম্পত্তির মালিক তার সম্পত্তি নির্দিষ্ট অংশ ধর্মীয়, সৎকাজ বা জনহিতকর কাজের জন্য ব্যয় করার উদ্দেশে দলিলের মাধ্যমে উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তি দান করলে তাকে ওয়াকফ-আলাল-আওলাদ বলে।

যেভাবেই ওয়াকফ করা হোক, ওয়াকফ সম্পত্তির মালিক ওয়াকফ প্রশাসক।

যিনি ওয়াকফ করলেন (যাকে বলা হয় ওয়াকিফ) তাঁর জীবদ্দশাতেও তিনি আর সেই ওয়াকফ করা সম্পত্তির মালিকানা থাকেন না। তিনিও আর ইচ্ছে করলে সেই ওয়াকফ করা সম্পত্তি কখনোই ফেরত নিতে পারেন না। একবার যদি কার্যকরীভাবে ওয়াকফ সম্পাদিত হয় তাহলে তা প্রত্যাহার কিংবা বাতিল করা যায় না, যাবেও না। উক্ত সম্পত্তির মালিক তখন ওয়াকফ প্রশাসক।

ওয়াকফ আল আওলাদের ব্যাপারে শুধুমাত্র যাদের জন্য ওয়াকফ করা হয়েছে, তারা ওয়াকিফের জীবদ্ধশায় এবং ওয়াকিফের মৃত্যুর পরেও ওয়াকফ দলিল মোতাবেক সম্পত্তিতে উপকার পেতে পারেন। আর সেটাও নিশ্চিত করেন এই ওয়াকফ প্রশাসক।

ওয়াকফ প্রশাসকের তত্তাবধানে এবং ওয়াকফ দলিলে উল্লেখিত ওয়াকিফের শর্ত অনুযায়ী ওয়াকফ প্রশাসন ‘মুতোয়াল্লী” নিয়োগ করেন যিনি ওয়াকফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধান ও ব্যবস্থাপনার জন্য নিযুক্ত। মুতাওয়ালি্ল কেবল সম্পত্তির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আওলাদ হলেও সম্পত্তির মালিক নন। তিনি শুধু ওয়াকফ দলিলে উল্লেখিত তার জন্য নির্ধারিত অংশের ভোগকারী।

ওয়াকফকৃত সম্পত্তি কারো নিকট বিক্রয়, কিংবা একে হেবা বা মিরাসের (ওয়ারিশি) বিষয়বস্তু করা যায় না। তবে ওয়াকফ প্রশাসন যদি ক্ষেত্র বিশেষে এরুপ কোনো পদক্ষেপ নিতে চান, তা শুধুমাত্র ওয়াকফ প্রশাসক আইনের মধ্যে তা করতে পারেন।

ওয়াকফ আল আওলাদের ব্যাপারে বেশ কয়েকটি ব্যাপার জানা অবশ্যই প্রয়োজনঃ

১. ওয়াকফ দলিলে যে নিয়ম পদ্ধতি লেখা হয় তার কোনো প্রকার ব্যতিক্রম করা যাবে না।

২. দলিলে সৎ কাজের জন্য যে অংশ নির্দিষ্ট আছে সে অংশ ঐসব কাজে ব্যায় বা ব্যবহার করতে হবে।

৩. শরীকদের বা আওলাদদের জন্য "ওয়াকফ আল আওলাদ" দলিলে যেভাবে ভোগ দখলের নিয়ম উল্লেখ থাকবে শরীকগন/ আওলাদগন ঠিক সেভাবেই ভোগ দখলের অধিকারী হবে। কোনো আওলাদ কিংবা শরীক অন্য কোনো আওলাদ বা শরীকের ভোগ দখলে কোনো প্রকার বাধা দিতে পারবে না। তবে যদি কোনো আওলাদ তাঁর প্রাপ্য অংশের সুবিধা ভোগ করা থেকে অন্য কোনো আওলাদ বা শরীক দ্বারা প্রবঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করেন, তাহলে ভুক্তভোগী আওলাদ শুধুমাত্র ওয়াকফ প্রশাসনের কাছে তিনি তাঁর নালিশ পেশ করতে পারেন। এখানে উল্লেখ থাকে যে, যেহেতু ওয়াকফ করা সম্পত্তির মালিক ওয়াকফ প্রশাসন নিজে এর মালিক কোনো আওলাদ নহেন, ফলে ওয়াকফ প্রশাসনের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত বলে ধরে নেয়া যায়।

৪. ওয়াকফ আল আওলাদের ওয়াকফ সম্পত্তির মধ্যে ওয়াকিফের আওলাদ কিংবা আওলাদের আওলাদগন শুধুমাত্র তাদের জন্য নির্ধারিত অংশেই ভোগ করার ক্ষমতা রাখেন। অন্য আওলাদ কিংবা আওলাদের আওলাদগন কোনো অংশেই অন্য কোনো আওলাদ বা তাদের আওলাদগনের ভোগ দখলের কোনো সুযোগ নাই, কিংবা বাধা দেয়ারও কোনো সুযোগ নাই। যদি কোনো আওলাদ এরুপ কোনো কাজ করতে চান, তাহলে তিনি অন্যের সম্পত্তি দখলের পায়তারার মামলায় অপরাধী সাব্যস্থ্য হবেন। আর এখানে মামলা হবে দেশ (ওয়াকফ প্রশাসন) বনাম উক্ত অপরাধী।

৫. ওয়াকফ আল আওলাদ সম্পত্তিতে ওয়াকিফ কর্তৃক যদি কোনো জেনারেশন উল্লেখ করে সীমাবদ্ধ না করেন (যেমন ৩য় জেনারেশন অবধি কিংবা ৪র্থ জেনারেশন অবধি ওয়াকফ আল আওলাদ করা হলো ইত্যাদি), তাহলে আওলাদের বংশধরগন বংশ পরম্পায় ভোগ দখলের জন্য উপযুক্ত থাকবেন।

৬. সম্পত্তি দেখাশুনার জন্য যেভাবে মোতাওয়াল্লী নিয়োগের বিধান রাখা হয় সেভাবে মোতায়াল্লী নিয়োগ হবে। কোনো কারনে যদি দলিলে উল্লেখিত শর্ত মোতাবেক মোতোয়াল্লী না পাওয়া যায়, তাহলে ওয়াকফ প্রশাসন তাঁর ইখতিয়ারে মোতোয়াল্লী নিয়োগ করতে পারবেন।

৭. ওয়াক্ফ কমিশনারের অনুমতি সাপেক্ষে মোতাওয়ালী ওয়াকফ সম্পত্তির উন্নতির জন্য আংশিক হস্তান্তর করতে পারবেন। অনুমতি ছাড়া হস্তান্তর হলে গ্রহীতার অনুকূলে স্বত্ত সৃষ্টি হবে না।

৮ মোতোয়াল্লী ওয়াকফ সম্পত্তির সচীবের ন্যায় বা অনেক সময় মেজিষ্ট্রেটের ন্যায় দায়িত্ব পালন করেন। ওয়াকফ প্রশাসনের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হচ্ছেন মোতোয়াল্লী। যে কোনো প্রকারের অভিযোগ, সমস্যা, পরামর্শ সরাসরি মোতোয়াল্লীর মাধ্যমে ওয়াকফ প্রশাসনের কাছে প্রেরন করতে হয়।

এখানে সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা হচ্ছে-ওয়াকফ করা সম্পত্তিতে যে যাই কিছু করুক না কেনো, সেটা অবশ্যই ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমতিতে করতে হবে, কারন ওয়াকফ করা সম্পত্তির মাটির উপরে এবং নীচে অবস্থিত প্রতিটি বস্তু, মাটি, গাছপালা, কিংবা অন্যান্য পদার্থ সব কিছু ওয়াকফ সম্পত্তির মালিক হিসাবে ওয়াকফ প্রশাসনের । উদাহরন দেই-

ধরুন, ওয়াকফ আল আওলাদ হিসাবে কেউ তাদের অংশে বসবাসের জন্য যদিও অনুমোদিত কিন্তু তারাও ঐ সম্পদের উপর যে কোনো কিছু করার আগে ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক। যদি ওয়াকফ দলিলে আওলাদদের দ্বারা বিল্ডিং কিংবা ইমারত তৈরির অনুমতিও থাকে সেটাও ওয়াকফ প্রশাসকের অনুমতিসমেত করা আবশ্যক। অনুমতি ছাড়া যদি তারা ওখানে গাছ পালা বা বৃক্ষরাজীও লাগান, কিংবা অস্থায়ী কোনো দেয়ালও দেন, সেটা তারা দিতেই পারেন, কিন্তু সেটাও তখন ওয়াকফ প্রশাসনের সম্পত্তি বলে গন্য হবে। ফলে কেউ যদি সেই আরোপিত গাছ/বৃক্ষ কিংবা দেয়াল নিজেদের ইচ্ছায় কেটে ফেলতে বা ভাংতে চান, তাহলে ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমতি বাধ্যতামুলক। কারন ওয়াকফ করা সম্পত্তি ওয়াকফ প্রশাসনের। মালিক তারা। আওলাদগন কোনো অবস্থাতেই মালিক নন, তারা শুধু ভোগকারী। এখানে আরো একটি বিষয় পরিষ্কার করা বাঞ্চনীয় যে, ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমতি ব্যাতিত ওয়াকফ সম্পত্তিতে কোনো কিছু করা অন্যের জমিতে বিনা অনুমতিতে করার শামিল।

ব্যাপারটা এমন যে, কেউ রাস্তার ধারে কয়েক শত গাছ লাগালো , গাছগুলি বড় হলো, কিন্তু সেই ব্যক্তি সেই গাছগুলি আর নিজের ইচ্ছায় কাটতে পারে না, তখন রাস্তার ধারে লাগানো গাছগুলি সরকারের মালিকানায় চলে আসে। এটা যেইই লাগাক।

 

১৩/৫/২০২২- রকি কাহিনী

আমাদের বাসায় কুকুর পালন কেউ পছন্দ করে না। কিন্তু গত কয়েকমাস আগে হটাত করে কোথা থেকে এক লোকাল কুকুর আমাদের বাসার সামনে এসে হাজির। সারাদিন বাসার সামনেই থাকে, পারলে গ্যারেজের মধ্যে নিজে থেকেই যেনো সেলফ ডিক্লেয়ারড পাহারায় থাকছে। তাঁকে নরম্যাল খাবার দিলে ছুয়েও দেখে না। কয়েকদিন চেষ্টা করেছি, ভাত, রুটি, কিংবা এই জাতীয় জিনিষ খেতে দিতে কিন্তু তার এমন একটা ভাব যেনো, ধুর!! কি দিছো এগুলি?

তারপর মাংস দিয়ে লবন দিয়ে মেখে একটা পরিষ্কার পাত্রে সাথে এক বাটি পানি দিলে উনি ধীরে ধীরে খেতে আসেন। তাও আবার পুরুটা তিনি খান না। একটু পেট ভরে গেলেই বাকী খাবারটা তিনি রেখে অন্যখানে গিয়ে পেট টানটান করে শুয়ে পড়েন। অনেক গবেষনা করছি এটা কোথা থেকে এলো, আর উদ্দেশ্যটা কি? আগেই বা কই ছিলো? শুনলাম পাশেই নাকি কোনো এক বাসায় থাকতো, ওখান থেকে তিনি রাগ করে এই যে এসেছে, ওদিকে সে আর ভুলেও যায় না।

এই কুকুরের আচরনে ইদানিং দেখি আমার বউ ওনার জন্যই শুধু মাংশ পাক করে। নাম রেখেছে আবার 'রকি'। রকি বলে ডাক দিলেও আবার ফিরে তাকায়। আমার ডাক্তার মেয়ে আবার ওর জন্য মাঝে মাঝে খাবারও কিনে নিয়ে আসে। আর আমিও বাদ যাই নি। কয়েকদিন নিউ মার্কেটের "৬৫ টাকায় বিরিয়ানীর দোকান" থেকে বিরিয়ানিও কিনে এনেছিলাম। ফলে আমি যখন বাসায় গিয়া হাজির হই, ব্যাপারটা এখন এমন হয়ে দাড়িয়েছে যে, গাড়ি থেকে নামলেই একেবারে পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করে আর যেনো বলতে থাকে- 'আমার বিরিয়ানির প্যাকেট কই?'

তো গতকাল অনেক বৃষ্টি ছিলো। রকি সারাদিন গ্যারেজেই চার পা চার দিকে ছড়াইয়া নাক ডেকে মনে হয় ঘুমাচ্ছিলো। আমি বাসায় যাওয়ার পর, সে কোনো চোখ না খুলেই খালি লেজ নাড়ছিলো। ধমক দিলাম বটে কিন্তু তিনি এক চোখ খুলে দেখলো আমাকে আর লেজটা আরো একটু বেশী করে নাড়াইলো। ভাবখানা এই রকম, আরে বস, ডিস্টার্ব করো না।

গার্ডকে দিয়ে ওনার জন্য মুরগীর তরকারী আর এক প্লেট ভাত এনে খাওয়ানোর পর দেখি হটাত তার এই শারীরিক কসরত।

7/5/2022-ফেসবুকে মিটুলের লেখা ৭ ই মে

আজ ৭মে আমার ও আখতারের জীবনের একটি বিশেষ দিন।বিবাহ বার্ষিকী নয়। তার চেয়েও অনেক মূল্যবান একটি দিন। আমাদের লাভ ডে আজ।লিখতে চেয়েছিলাম না। কিন্তু না লিখে পারলাম না। কেননা আমি আজ সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছি বন্ধুদের সাথে। মনে কিন্তু ঠিকই আছে!! এ কি ভোলার মত বিষয় আপনারাই বলেন!!

আমি অনেক ভালো আছি তাঁর সাথে, বর্ণনা করে বোঝাতে পারবো না।আমিও চেষ্টা করি আমার মানুষটিকে ভালো রাখবার। আসলে আমরা একে অপরকে রেসপেক্ট করি ও বোঝার চেষ্টা করি, যা মনের সুখের খোরাক জোগায় এবং খুবই দরকার। তবে আমার চেয়ে আখতারই বেশি মূল্যায়ন করে আমাকে। আমার আনন্দ গুলো যেমন অন্তর দিয়ে উপভোগ করে, তেমনি আমার মন খারাপ বা কষ্ট কোনটাই তাঁর যেন ভালো লাগে না।অনেক স্বাধীনভাবে জীবন যাপণ করছি। তাই বলে আমি কখনও অবিশ্বাসের কোন কিছু করেছি বলে মনে পড়ছে না।আমাকে সব রকম পরামর্শ দেয় সব সময়, সেটা আর্থিক বা বৈষয়িক যে কোন বিষয়ে। আমার সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গাটি আখতার।আলহামদুলিল্লাহ। আজ এই দূরে বসে সিলেটের লালা খালে তোলা বেশ কিছু ছবি আখতারের জন্য পোস্ট দিলাম।আজকের এই আনন্দগুলোও তাঁর জন্য পেয়েছি।বান্ধবীরা সিলেট যাচ্ছে বলতেই তিনি বলে বসলো-তুমিও যাও!!! অনেক বড় মনের মানুষ আখতার।মহান আল্লাহ ওকে সুস্থ শরীরে মান সম্মানের সাথে দীর্ঘজীবি করুন এবং জানমালের নিরাপত্তা দিন সে দোয়া করি। সবাই আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন প্লিজ প্লিজ।

০৮/০৮/২০২১-What If I were not Born

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব 

আগষ্ট 

০৮

মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহন করার থেকে এতো সম্মান নাকি ঈশ্বর তার পাপমুক্ত ফেরেস্তাদেরকেও দেন নাই। সৃষ্টির সেরা জীবদের মধ্যে এই মানুষই নাকি সেরা। এই মানুষের জন্যই ঈশ্বর আকাশ তৈরী করেছেন, সেই আকাশ থেকে তিনি জল-বৃষ্টি বর্ষন করেন, জমির নির্মল গাছ গাছালীকে তিনি সবুজ সতেজ করে রাখেন। তিনি এই মানুষের জন্যই পাহাড় সৃষ্টি করেছেন, দিন আর রাতের তফাত করেছেন, ভালোবাসার মতো সংগী তৈরী করেছেন, অতঃপর তিনি জীবিনের বিভিন্ন স্তরে স্তরে নানাবিধ উপলব্দির জন্য সন্তান, নাতি নাতকোরের মতো মিষ্টি মিষ্টি ফুলের সংসারও তৈরী করেছেন। কি অদ্ভুত ঈশ্বরের সব সাজানো এই পরিকল্পনা। নীল আকাসের দিকে তাকিয়ে কখনো সাদা ফেনার মতো ভেসে যাওয়া মেঘ, কখনো উত্তাল মেঘের অবিরাম বৃষ্টিবরন, হেমন্তে বা শরতের দিনে বাহারী ফুলের সমাহার, পাখীদের কিচির মিচির, শিল্পির গানের মূর্ছনা, সবকিছু যেনো বিমোহিত করার মতো একটা সময়। অথচ এসব কিছু কোনো না কোনো একদিন ছেড়ে আমাদের সবাইকে চলেই যেতে হয়।

আবার অন্যদিকে যদি দেখি, দেখা যায়, এই বাহারী জীবনের সব সুখ আর আস্বাদন ছাড়াও আমাদের এই জীবনে ছেকে বসে দুঃখ বেদনা, হতাশা আর কষ্ট। জীবনের গাড়ি আমাদের জীবন-যানবহনের চাকার উপর টানতে টানতে এক সময় অনেকেই আমরা হাপিয়ে উঠি। বেদনায় ভরে উঠে কষ্টে, দুঃখে ভেসে যায় চোখের জল অথবা রাগে, অভিমানে একে অপরের হয়ে উঠি চরম থেকে চরম শত্রুতায় যেনো ভালোবাসা কোনোকালেই ছিলো না, হোক সেটা বিবাহ বন্ধনের মতো কোনো রোমান্টিক সম্পর্কে, অথবা ব্যবসায়ীক কোনো অংশীদারিত্তে অথবা ক্ষমতার লড়াইয়ের কোনো যুদ্ধমাঠে।

অনেক সময় আমাদের মুখ দেখে এটা বুঝা যায় না কে সুখের বা কষ্টের কোন স্তরে আছি। ভিতরের সুখ কিংবা যন্ত্রনার উপলব্ধিকে আমরা একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করলেও সঠিক স্তরটা কখনোই প্রকাশ করা যায় না। পাখীদের বেলায় কিংবা অন্য কোনো প্রানীদের বেলায় এটা কতটুকু, সেটা আমরা না কখনো ভেবে দেখেছি, না কখনো উপলব্ধি করেছি। ওরা দিনের শুরুতে আহারের খোজে বেরিয়ে যায়, পেট ভরে গেলে কোনো এক গাছের ডালে বা পাহাড়ের কোনো এক ছোট সুড়ঙ্গে রাত কাটিয়ে দেয়। তাদের অট্টালিকার দরকার পড়ে না, ওরা ওরা কেউ কারো শত্রুতা করে না, কোন পর্বনে বিশেষ কোনো কিছুর আয়োজনেরও দরকার মনে করেনা। কবে ছুটির দিন, কবে ঈদের দিন কিংবা করে কোন মহাযুদ্ধ লেগেছিলো সে খবরেও ওদের কিছুই যায় আসে না। ওদেরও সন্তান হয়, ওরাও দলবেধে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যায়, ওদের কোনো ভিসা বা ইমিগ্রেশনেরও দরকার পড়ে না। টেরিটোরিয়াল বাউন্ডারী ওদের জন্য কোনোদিন দরকার পড়ে নাই, আগামীতেও দরকার পড়বে না। ওরাও কষ্টে কিছুক্ষন হয়তো ঘেউ ঘেউ করে, কিংবা চিন্তিত হয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে চলে যায়, কিন্তু তাকে আকড়ে ধরে বসে থাকে না। ওদের সারাদিনের কর্মকান্ডের জন্য না কারো কাছে জবাব্দিহি করতে হয়, না কারো কাছে ধর্না দিতে হয়, এমনকি ওরা ঈশ্বরের কাছেও তাদের অপকর্মের কিংবা ভালোকর্মের কোনো জবাব্দিহিতা করতে হয় না। কোনো ট্যাক্স ফাইল নাই, কোনো ভ্যাট ফাইল নাই, না আছে কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স, না দরকার তাদের গাড়িঘোড়ার। তাহলে তো ওরাই আসলে শান্তিতে থাকে, মানুষের থেকে অধিক।

মানুষ ছাড়া অন্য সব প্রানীকুল প্রত্যেকেই নিজের ক্ষমতার উপর বিশ্বাস রাখে কিন্তু মানুষ তার নিজের একক ক্ষমতার উপর কখনোই সে বিশ্বাস রাখে না বা থাকে না। তার দল লাগে, তার অর্থনৈতিক মেরুদন্ড লাগে, তার আরো বিস্তর আয়োজন লাগে। এতো কিছুর উপরে তার আস্থা রাখতে গিয়ে মাঝে মাঝে সে নিজের উপরেও আস্থা হারিয়ে ফেলে। অথচ সে একা বাস করতে পারে না, না আবার সবাইকে নিয়েও বাস করতে চায়। অদ্ভুত এই মনুষ্যকূলের মধ্যে আমি জন্মে দেখেছি- এতো কিছুর বিনিময়ে অথচ কোনো কিছুই আমার না, এই শর্তে জন্ম নেয়াই যেনো একটা কষ্টের ব্যাপার। যদি কেউ এই পৃথিবীতেই না আসতো, তাহলে হয়তো বিধাতার কাছে এই ক্ষনিক সময়ে এতো কিছুর মাঝে পরিবেষ্ঠিত থেকে আবার চলে যাওয়া, কইফিয়ত দেয়া, ইত্যাদির দরকার হতো না, ক্ষমতার লড়াইয়ে হানাহানি, কারো বিয়োগে মন এতো উতালাও হতো না।

আজ থেকে বহু শতাব্দি আগে কিংবা অদুর অতীতে যারা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে, তারা আসলে আমাদেরই লোক ছিলো। তারা চলে গিয়েছে চিরতরে। কোথায় গেছেন, আর কি অবস্থায় আছেন সে সম্পর্কে আজো কেউ কোনো সম্যখ ধারনা কারো কাছেই নাই। অথচ যখন বেচে ছিলেন, প্রতিটি মুহুর্তে তারা ছিলেন সময়ের থেকেও অধিক ব্যস্ততায়। যখন তারা চলে যান, তারা আমাদের কাছে এমন কোনো ওয়াদাও করে যায়নি যে, তাদের ফেলে যাওয়া সব সম্পত্তির জন্য আবার ফিরে আসবেন, কিংবা এমনো নয় যে, তারা তা আর কখনো দাবী করবেন। এটা না হয় চিরতরে চলে যাওয়ার ব্যাপার হলো। কিন্তু এই জীবনে তো এমনো বিচ্ছেদ হয় যেখানে তারা আছেন কিন্তু আবার নাইও। জীবনের প্রয়োজনে ভউগুলিক বাউন্ডারীর অন্য প্রান্তে যখন কেউ অনেক দিনের জন্য চলে যান, আর তার ফিরে আসার ওয়াদা ভেংগে যায়, তখন আর তার উপরেও আস্থা রাখা যায়না। এমনি কষ্টে মানুষ ভোগের সমস্ত আয়োজনের উপরে থেকেও সেই আপনজনদের জন্য প্রতিনিয়ত হাহুতাশ করতে থাকেন। মনের কোথায় যেনো কি একটা সারাক্ষন খসখস করতেই থাকে। সেই যন্ত্রনায় তখন এমন মনে হয় যেনো- একটা দিনও ঠিকঠাক মতো কাটে না, এমন কি একটা রাতও না। তখন জেগে থাকে শুধু কিছু সদ্য জন্মানো কান্না। আর কান্নার আহাজারীতে সুর থাকে না, থাকে বেদনা আর কষ্ট। আর সেই কষ্টের কোনো নাম থাকে না, না থাকে তার কোনো বর্ননা বা রুপ। আর এই ভিতরের যন্ত্রনাটা কাউকেই দেখানো যায় না অথচ সত্যিটা থাকে এই ভিতরেই। আসলে পৃথিবীতে সম্পর্কের চেয়ে বড় কোনো সম্পত্তি নাই। এতো সুখের জীবনেও যখন এমন অনেক কষ্টের আর বেদনার নীল ছড়িয়েই থাকে, তাহলে কি দরকার জন্মের?

তারপরেও আমরা মানুষ হয়ে সৃষ্টির সেরা জীব হয়েই জন্ম নেই, নিয়েছি যেখানে অবারিত সবুজ ধানক্ষেতের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ার দোলা আমাদের মুখে পরশ জোগায় আবার তেমনি কখনো বিচ্ছেদের মতো যন্ত্রনা, মৃত্যুর মতো বেদনা, আবার কখনো অনিশ্চিত যাত্রার মতো দুশ্চিন্তা নিয়েই আমাদেরকে বাচতে হয়। কেউ যখন চিরতরে জীবনের নিঃশ্বাসকে স্তব্ধ করে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেন, তারজন্য যতোটা না দুশ্চিন্তা আমাদেরকে গ্রাস করে, তার থেকে যখন কোনো প্রিয়জন হটাত করে সেই চেনা পরিচিত আবাসস্থল থেকে কাউকে কিছু না বলে হারিয়ে যান আর ফিরে না আসেন, তারজন্য আরো বেশী দুশ্চিন্তা আর অমঙ্গল চিন্তা মাথা ভনভন করতে থাকে। কিন্তু এরই মতো যখন কোনো প্রিয়জন জেনেশুনে জীবনের প্রয়োজনে অথবা বড় সাফল্যের আশায় একে অপরের থেকে এমন একটা বিচ্ছেদে আপোষ করেন যেখানে টেরিটোরিয়াল বাউন্ডারী আমাদেরকে প্রায় স্থায়ী বিচ্ছেদের স্তরে নিয়ে যায়, তখন আমাদের হাসির অন্তরালে যে বেদনা লুকিয়ে থাকে, তা তুষের অনলের মতো সারাক্ষন তাপদাহে অন্তরে প্রজ্জলিত হতেই থাকে। আশা আর সাফল্যের মতো জল হয়তো সাময়ীকভাবে তা নিবারন করে কিন্তু এই ছোট ক্ষনস্থায়ী জীবনে বারবার এটাই মনে হয়- কি দরকার ছিলো এসবের? তাকে কি আটকানো যেতো না? নাকি আটকানো হয় নাই? আসলে কোনো কিছুই দরকার ছিলো না যদি না আমার জন্মই না হতো এই মানুষ হিসাবে। তখন না দরকার হতো এই বিচ্ছেদের, না প্রয়োজন হতো এই দিনরাতের কষ্টের অথবা না দরকার পড়তো অন্তর জালার তাপদাহের অনুভবতার। তখন কেনো জানি বারেবারেই মনে হয়- What If I were not born?  

করোনার প্রাদূর্ভাবে চেনা পরিচিত সব মানুষ যেনো ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে একে একে যেনো বিনা নোটিশে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। এই সেদিন যার সাথে এক টেবিলে বসে হাসাহাসি, আড্ডা, কথা কাটাকাটি, অথবা দল বেধে গায়ের কোনো মেঠো পথে বাচ্চাদের মতো হাটাহাটি করেছি, তার কিছু মুহুর্তের পরই সংবাদ আসে, আর নেই। চলে গেছে। ব্যাংকের টাকা, বিশাল ব্যবসা, কিংবা গাড়ি বহরের সব যাত্রা কোনো কিছুই যেনো তার সামনে দাড়াতে পারছে না। অথচ তাকে না দেখা যায়, না ছোয়া যায়। কখন সে কার সাথে একান্তে বাস করা শুরু করে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আতংকে আছে মন, অসুস্থ্য হয়ে যাচ্ছে শরীর, ভাবনায় ভরে যাচ্ছে সারাটা মাথা। অথচ দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে কুকুর, মনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে পাখীরা, শুধু বন্দি হয়ে আছি আমি “মানুষ”। বারবার মনে হচ্ছে- কোথায় যেনো কি ঠিক নেই, কি যেনো কোথায় একটা গড়মিল হচ্ছে তা বুঝা যাচ্ছে না। কেনো এমনটা হচ্ছে বারবার?

আসলে কোন কবি যেনো একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন- মানুষ হয়ে জন্মই যেনো আমার আজীবনের পাপ। তাই আমারো মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে- What If I were not even born!!

০৭/০৮/২০২১-কনিকার মাত্র ৩দিন বাকী

উচ্ছিষ্ট সময়ের রাজত্ব 

আগষ্ট 

৭ 

প্রায় সবগুলি কাজ শেষ। ভিসা আগেই হয়ে গিয়েছিলো, টিকেটও কেনা আছে, টিউশন ফি গতকাল পাঠিয়ে দেয়া হয়ে গেছে। ভ্যাক্সিনেশন যা যা নেয়া দরকার ছিলো, সবই সম্পন্ন করা হয়েছে। ব্যাগপত্র, মালামাল সব কিছুই প্যাকড হয়ে গেছে, আগামী এক বছরের আর্থিক জোগানও শেষ, এখন বাকী শুধু করোনা টেষ্ট আর ফ্লাইটে উঠা। আগামী ১০ তারিখের দিবাগত রাত অর্থাৎ ১১ আগষ্ট এর ভোর বেলায় কনিকার ফ্লাইট। মাত্র তিনদিন বাকী। কনিকার চলে যাওয়ার শুন্যতাটা এখন মাঝে মাঝে অনুভব করছি, উম্মিকা রীতিমত প্রায় প্রতিদিনই কান্নাকাটি করছে কনিকা চলে যাবে বলে। কনিকা এখনো খুব একটা মন খারাপ করছেনা তবে বুঝা যায় সে একটা দুদোল্যমান অনুভুতিতে ভোগছে। কারন একদিকে কনিকা আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারে বেশ খুসী, অন্যদিকে বাড়ি ছাড়ার কষ্ট। মিটুলের অবস্থাটাও প্রায় ওই একই রকমের। আর আমার? আমার শুধু একটাই ভয়, ওরা যেনো ভালো থাকে যেখানেই থাকুক। মন তো খারাপ হচ্ছেই। কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন। আমি মেনে নিয়েছি বাস্তবতা।

 বাড়িটায় সারাক্ষন কনিকাই মাতিয়ে রাখতো, বাসায় যতো কথাবার্তা, যতো হইচই কনিকাই করতো। এই পরিবেশটা মিস করবো আমরা। অফিস থেকে আমি বাসায় আসার পর প্রথমেই আমি ঢোকি সাধারনত কনিকার রুমে আর তার সাথে উম্মিকার রুমে। ইদানিং উম্মিকা ডেল্টা মেডিক্যালে জব করে বলে, প্রায়ই আমি খবর নেই মেয়েটা লাঞ্চে খাবার খেয়েছে কিনা বা রাত সাড়ে আটটা বাজলেই মনে করিয়ে দেই, উম্মিকাকে আনতে গাড়ি গেছে কিনা।

আমি জানি, কনিকা যেদিন আমেরিকার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হবে ইনশাল্লাহ, সেদিন আমার ভিতরে কি কি ঘটবে কিন্তু মনকে শক্ত করা ছাড়া কোনো উপায় নাই। যতোক্ষন না কনিকা তার ডেস্টিনেশনে গিয়ে পৌছায় ততোক্ষন আমি জানি ওর ফ্লাইট মনিটর করতে থাকবো। যখন আল্লাহর রহমতে কনিকা আমেরিকায় ওর ডেস্টিনেশনে পৌঁছাবে, হয়তো তখন একটু ভালো লাগবে যে, ওখানেও অনেক আত্তীয় স্বজনেরা আছেন যারা কনিকাকেও অনেক ভালোবাসে, তারা দেখভাল করবে।

কনিকা অনেক খুতখুতে। কিন্তু গোছালো। ওর কোনো কিছুই অগোছালো থাকে না। কোন একটা জিনিষ এদিক সেদিক হলেই ওর সেটা ভালো লাগে না। মেজাজ খারাপ করে। ফলে ভয় পাচ্ছি, নতুন পরিবেশে কতটা দ্রুত কনিকা এডজাষ্ট করতে পারে। ওখানে কনিকাকে সব কিছুই নিজের হাতে করতে হবে। পারবে কিনা জানি না। তবে প্রথম প্রথম কনিকা হোমসিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। এটা কাটিয়ে উঠতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।

আমি কনিকা যেনো আমেরিকায় অন্তত টাকা পয়সা নিয়ে কোনোরুপ সমস্যায় না পরে, সেইটা শতভাগ নিশ্চিত করেছি (আলহামদুলিল্লাহ)। আসলে আমি ইদানিং আমার জীবনের মুল পলিসিটাই বদল করে ফেলেছি। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। যাতে আমি না থাকলেও আমার সন্তানেরা কোথাও কোন সমস্যায় না পড়ে, বাকীটা আল্লাহ ভালো জানেন। আমার জমি জমা, টাকা পয়সার এসেটের থেকে বড় এসেট আমার মেয়েরা। এদের জন্য পয়সা খরচে আমার কোনো কার্পন্য নাই। যতোটুকু আমার সক্ষমতা আছে, আমি ওদেরকে ততোটাই দিতে চাই।

গতকাল রাতে প্রথম দেখলাম, উম্মিকা কনিকা দুজনেই বেশ ইমোশনাল ছিলো। ব্যাপারটা ঘটছে কারন সময়টা খুব কাছাকাছি কনিকার চলে যাওয়ার। ফলে উম্মিকাও অনেকটা খুব বেশী মন খারাপ করে আছে। চৈতী এসছে কনিকার যাওয়ার কারনে। ওরা সবাই খুব কাছাকাছি ছিলো সব সময়। ওদের বয়সের তারতম্য থাকলেও কনিকাই ছিলো যেনো ওদের সবার মধ্যে নেতা। ওর আবদার কেউই ফেলতো না।

বিমানবন্দর ঢোকার জন্য পাশ এর অবস্থা এখন খুব কড়াকড়ি। কোথাও থেকে কোনো পাশ পাচ্ছি না। ব্যাপারটা একটু হতাশার। অনেককেই বলেছি কিন্তু সব জায়গা থেকেই নেগেটিভ ফলাফল আসায় একটু আরো ভয়ে আছি। আমার দোস্ত উইং কমান্ডার মাসুদকে বলেছি যে, সিভিল এভিয়েশন আসোশিয়েসন অফ বাংলাদেশ থেকে অন্তত কয়েকটা পাশ জোগাড় করতে। ওই সংস্থার চেয়ারম্যান হচ্ছে এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান। সে আমাদের থেকে এক কোর্ষ সিনিয়ার কিন্তু আমার সাথে কখনো পরিচয় হয় নাই। যেহেতু মাসুদ এয়ার ফোর্সের, তাই একটা ভরষা মাসুদ দিয়েছে যে, সে পাশ জোগাড় করতে পারবে। কিন্তু ব্যাপারটা আমি এখনো সিউর হতে পারছি না আসলেই মাসুদ পাশ জোগাড় করতে পারবে কিনা।

কনিকা হয়তো ওর বাড়ি ছাড়ার অনুভুতিটা ঠিক এই মুহুর্তে ততোটা উপলব্ধি করতে পারছে না। কিন্তু যেদিন কনিকা স্টেপ আউট করবে, আমি জানি, ওর সবচেয়ে বেশী মন খারাপ থাকবে। যদি এমন হয় যে, পাশ একটাও পাওয়া গেলো না, তাহলে কনিকাকে একাই সব সামাল দিতে হবে। লাগেজ বুকিং, বোর্ডিং পাশ সংগ্রহ, চেক ইন, ইত্যাদি।  আর যদি একটা পাশও পাই তাহলে শুধুমাত্র আমি ভাবছি মিটুলকে দিয়ে দেবো যাতে মিটুল সবকিছু ম্যানেজ করে মেয়েকে যতোদূর পারে উঠিয়ে দিতে। তা না হলে প্রশ্নের আর ইঙ্কোয়ারীর প্রশ্নে জর্জরীত হতেই থাকবো। আর যদি দুটু পাই, তাহলে সাথে উম্মিকাকে দিয়ে দেবো। আর যদি বেশী ভাগ্যবান হই, আমিও পাই, তাহলে তো আল্লাহর রহমত, আমরা অকে সবাই এক সাথে বিমানে তুলে দিতে পারবো। কনিকা কাতার এয়ার ওয়েজে যাচ্ছে ইনশাল্লাহ।

আজ শুক্রবার। ভেবেছিলাম, বাইরে কোথাও যাবো। কিন্তু কনিকাকে এই মুহুর্তে বাইরে বের করতে চাই না। চারিদিকে করোনার প্রভাব খুব বেশী। কনিকার করোনা টেষ্ট করাতে হবে ফ্লাইটে উঠার ৪৮ ঘন্টা আগে। তাই খুব একটা বের করতে চাই না কনিকাকে। তাই সবাই চিন্তা করছি- আমাদের ছাদের উপরে ঘরোয়া একটা পার্টি করবো যেখানে শুধুমাত্র আমরাই থাকবো। জাষ্ট একটা আউটিং এর মতো আর কি।

একটা সময় আসবে যেদিন আজকের এই অনুভুতিটা হয়তো আমি আগামী ৪ বছর পর যখন পড়বো, তখন আমার অনুভুতি হয়তো হবে পুরুই ভিন্ন। সফলতার গল্পে আমি হয়তো অনেক গল্প করবো এই কনিকাকে নিয়ে। আমি সব সময় উম্মিকাকেও বলে যাচ্ছি, সেও চলে যাক আমেরিকায়। তাহলে দুইবোন এক সাথে থাকলে আমিও কিছুটা ভরষা পাই। কিন্তু উম্মিকার যাওয়ার ব্যাপারটা খুব ধীর। সে মনে হয় বাইরে মাইগ্রেশন করতে চায় না।

দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় আমাদেরকে নিয়ে যায়। নিশ্চয় আল্লাহ আমাদেরকে ভালোবাসেন।

২১/০৭/২০২১-ঈদুল আজহা

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব 

২০২১ 

২১ জুলাই 

 

 

আজ পালিত হলো ঈদুল আজহা।

এই দিনটা এলে সবচেয়ে আগে যার কথা আমার বেশী মনে পড়ে তিনি হচ্ছেন-আমার মা। মা বেচে থাকাকালীন আমি কখনো শহরে ঈদ করিনি কারন মাও ঈদের সময় গ্রাম ছাড়া ঈদ করতেন না। মা যেহেতু ঈদে গ্রামে থাকতেন, আমিও গ্রামেই ঈদ করতাম। আমি সব সময় ভাবতাম-একটা সময় আসবে, মাকে ছাড়াই আমার ঈদ করতে হবে জীবনে, তাই যে কতগুলি সুযোগ পাওয়া যায়, মায়ের সাথে ঈদ করাটা ছিলো আমার সুযোগের মতো। বাড়িতেই কুরবানী করতাম। ঈদের আগে আমি ইসমাইল ভাই অথবা রশীদ ভাইকে টাকা পাঠিয়ে দিতাম যাতে আগেই গরু কিনে রাখেন। ফাতেমার স্বামী সলিমুল্লাহ ওরফে দুদু ভাইকে আমি কখনোই কুরবানীর গরু কেনার দায়িত্তটা আমি দিতাম না কারন তার উপরে আমার টাকা পয়সা নিয়ে আস্থা ছিলো না। কেনো তার উপরে আস্থা ছিলো না, সে কাহিনী বিস্তর, আজ না হয় এখানে নাইবা বললাম। গরু কেনার ব্যাপারে আমার একটা পলিসি ছিলো যে, মেহেরুন্নেসা (অর্থাৎ আমার ইমিডিয়েট বড় বোন সব সময় গরু পালতো। আমি ইচ্ছে করেই রশীদ ভাইকে বলতাম যাতে ওর গরুটাই আমার জন্যে রেখে দেয়। আমি কখনোই সেটার দাম করতাম না। এই কারনে করতাম না, মেহের যে কয় টাকায় বিক্রি করলে খুশী হয় সেটাই হোক আমার আরেকটা সাহাজ্য। মেহের খুব ভালো একটা মেয়ে।

আজ সেই কুরবানীর দিনটা চলে গেলো। শুনেছিলাম, একটা গরু মোট সাত জনের নামে কুরবানী দেয়া যায়। ফলে আমি সব সময় এই সু্যোগে যে কাজটা করি, তা হলো- এক ভাগ দেই আমি আমার প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মাদ (সঃ) এর নামে, আর বাকী ৬ ভাগ দেই-আমার, মিটুল, আমার ২ মেয়ে, আমার বাবা আর আমার মায়ের নামে। এটাই আমার কুরবানী দেয়ার পলিসি। আজো তাইই করলাম। গরু জবাই, মাংশ কাটাকাটি আর বিলানোর কাজটা আমি নিজ হাতে করি। ৩ টা ভাগ করি, একটা ভাগ নীচেই বিলিয়ে দেই, বাকী ২ ভাগের এক ভাগ আমি রাখি আলাদা করে সমস্ত আত্তীয় সজন আর পাড়া পড়শীর জন্য, আর এক ভাগ থাকে আমার পরিবারের জন্য।

এই কুরবানী এলে আমার আরো একটা কথা প্রায়ই মনে পড়ে। সেই ১৯৭৬-৭৭ সালের কথা। আমাদের তখন কুরবানী দেয়ার মতো পরিস্থিতি ছিলো না। আমি মাত্র ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়ি, আমাদের বাড়িতে ৫ বোন আর মা আর আমি। আমার বড় ভাই তখন সবেমাত্র আমেরিকা গেছেন। আমাদের সব ভরন পোষনের দায়িত্ত আমার বড় ভাইই করেন। কিন্তু শেয়ারে কুরবানী দেয়া কিংবা আলাদা কুরবানী দেয়ার মতো ক্ষমতা আমাদের ছিলো না। ফলে এই কুরবানীর দিন আমার খুব অসস্থি হতো। অসস্থি হতো এই কারনে যে, আমরা না কারো কাছ থেকে মাংশ চেয়ে আনতে পারতাম, না আমাদের সামর্থ ছিলো কুরবানী দেয়ার। ফলে দিনের শেষে যখন সবাই যার যার বাড়িতে গরুর মাংশ পাকে ব্যস্ত, খাওয়ায় ব্যস্ত, আনন্দে ব্যস্ত, তখন হয়তো আমাদের বাড়িতে ঠিক তেমনটা নাও হতে পারে। আমি এই ঈদের দিনের দুপুরের পর আর কোথাও যেতাম না, কারন আমার কেম্ন জানি নিজের কাছে খুব ছোট মনে হতো। কুরবানী দেয়াটা ধর্মের দিক দিয়ে কি, আর কি না, সেটা আমার কাছে হয়তো অনেক বড় মাহাত্য ছিলো না, কিন্তু আমি যখন দেখতাম, আমার বন্ধুদের বাড়িতে সবাই কুরবানীর গরু নিয়ে কাটাকাটিতে ব্যস্ত, বিকালে মাংশ বিলানোতে ব্যস্ত, আমার তখন মনে হতো, আমিই ব্যস্ত না। গরীব হয়ে জন্ম নেয়াটা একটা অসস্থিকর ব্যাপার। তারপরেও অনেকেই আমাদের বাড়িতে কুরবানীর পর মাংশ পাঠাইতো। বিকালে বা সন্ধ্যায় দুদু ভাই, ইসমাইল ভাই, আমাদের খালাদের বাড়ি থেকে, কিংবা জলিল মামাদের বাড়ি থেকে অথবা পাশের কোনো বারি থেকে অনেকেই মাংশ পাঠাইতো যেটা আমার কাছে একটু খারাপ লাগলেও মা নিতেন। কুরবানী বলে কথা। সবাই মাংশ খাবে, আমাদের বাড়ির মানুষেরা একেবারেই কিছু খাবে না, মা হয়তো এটা ভেবেই মাংশ গুলি রাখতেন। দিনটা চলে যেতো, আমার অসস্থির ভাবটাও ধীরে ধীরে কেটে যেতো। আবার এক বছর পর হয়তো এই অসস্থিটা আসবে।

যেদিন আমার ক্ষমতা হলো কুরবানী দেয়ার, আমি সব সময় গ্রামেই কুরবানী দিয়েছি। আর সব সময়ই আমার সেই দিনগুলির কথা মনে করেছি। আমাদের দিন পাল্টেছে, আমাদের পজিসন পাল্টেছে। মা যখন জীবিত ছিলেন, এমনো হয়েছে মাঝে মাঝে আমি দুটু কুরবানীও করেছি একা।

আজ মা নাই, আমার গ্রামে যাওয়া হয় না। কুরবানী নিয়ে এখন আমার তেমন কোনো আগ্রহও নাই। তবে সবসময় ঢাকাতেই আমি কুরবানী দেই, একা। যদি আমি কখনো কুরবানী নাও দেই, কেউ আমাকে আন্ডার এস্টিমেট করবে না কারন সবাই জানে আমার একটা না, অনেকগুলি কুরবানী দেয়ার সক্ষমতাও আছে। হয়তো কোনো কারনে আমি ইচ্ছে করেই কুরবানী হয়তো দেই নাই। কেউ এটা ভাববে না যে, আমার টাকা নাই তাই কুরবানী দেই নাই। “সময়” এমন জিনিষ। সব কিছু পালটে দেয়।

৮/৭/২০২১-জীবনে হতাশ হওয়ার

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব 

২০২১ 

৮ জুলাই 

জীবনে হতাশ হওয়ার কোনো কারন নাই। একদিন নিজেকে নিজেই বলেছিলাম যে, ভগবান মানুষের জন্য প্রতিটি দিন একই রকম করে কাটাতে দেন না। আজ যে রবিবার আপনি হাসছেন, আগামী রবিবার আপনি নাও হাসতে পারেন, হয়তো সেদিন আপনি হাসিতে আপনার প্রতিটি মুহুর্ত ভরে থাকবে। এই সপ্তাহটা হয়তো আপনার জন্য ভয়ানক অস্থির যাচ্ছে, কে জানে আগামী সপ্তাহটা হয়তো হবে একেবারেই সুন্দর। তাই হতাশ হবার কোনো কারন নাই। প্রতিটি ঝড় কিংবা বিপদের মাঝেও কিছু না কিছু সুসংবাদ থাকে, কিছু না কিছু ভালো জিনিষ আসে। একটা মৃত ঘড়ির দিকে তাকান, দেখবেন নষ্ট ঘড়িটাও দিনে দুবার একদম সঠিক সময় প্রকাশ করে। অপরিষ্কার জল খাবারের অনুপোযোগী হলেও সেটা আগুন নেভানোর কাজে লাগে। বোবা কিংবা বোকা বন্ধুও আপনার অন্ধ জীবনে রাস্তা দেখিয়ে দিতে পারে।

তারপরেও একটা সময় আসে যখন শুধু নিজের জন্যেই নিজেকে বাচতে হয়। অন্য কারো জন্যে নয়। আমরা সামাজিক কিংবা পারিবারিক জীবনের কথা বলি। ওটা একটা শুধু কন্সেপ্ট যেখানে মানুষ একা থাকতে পারে না বলে সে এই দলবদ্ধ জীবন বা পারিবারিক জীবনটাতে থাকতে চায়। কিন্তু একটা সময়ে সবাই এই জীবনেও হাপিয়ে উঠে। সন্তান, স্ত্রী কিংবা আশেপাশের সবাই যেনো তখন এক ঘেয়েমীতে ভরে যায়। তখন কেউ কারো আদর্শ কিংবা অভিজ্ঞতাকে আর কাজে লাগাতেও চায় না, বরং যেটা নিজেরা ভাবে সেতাই যেনো পরিশুদ্ধ, আর সেটাই করতে চায় সবাই। সন্তানেরা যখন বড় হয়ে যায়, তখন তাদেরকে তাদের মতো করেই ছেড়ে দেয়া উচিত। তাদের চিন্তা ধারা, তাদের পছন্দ কিংবা আশা নিরাশা সবন কিছু তাদের মতো। তাই, আমরা যারা বড়রা তাদের জন্যে দুশ্চিন্তা করি, এটা হয়তো আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে ভাবি যে, ওরা ভুল করছে বা যা করছে সেটা ঠিক নয়। আর এই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা আমাদের কিছু কন্সেপ্ট বা ধারনা বা উপদেশ ওদের উপর চালাতে চাই যা অহরহই ওরা মানতে চায় না। যখন এমন একটা কনফ্লিক্ট সামনে আসে, তখন আমাদের উচিত আর না এগোনো। সবাইকে যার যার পথে চলতে দিয়ে ঠিক ঐ জায়গাটায় দাড় করানো উচিত যাতে ওরা বুঝতে পারে, আমাদের উপদেশ ঠিক ছিলো কিংবা আমরাই ঠিক ছিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো ঐ সময় কোনো কিছুই আর পিছনে গিয়ে সঠিকটা করা যায় না বলে মনে কষ্ট লাগে বা খারাপ লাগে। কিন্তু ওটা ছাড়া তো আর কিছুই করার নাই। চেয়ে চেয়ে ধ্বংস দেখা ছাড়া যদিও কোনো উপায় নাই, তারপরেও সেটাই করতে দেয়া উচিত যাতে ওরা এটা বুঝতে পারে যে, বড়দের অভিজ্ঞতার দাম ছিলো, উপদেশ গ্রহন করা উচিত ছিলো। তাহলে হয়তো আজকের দিনের এই অধোপতন কিংবা ছেড়াবেড়া জীবনে পড়তে হতো না।

লাইফটায় অনেক পরিবর্তন নিয়ে এসেছি আমি নিজেও। নিজের ঘরে যখন কেউ একাকিত্ত বোধ করে সেখানে সময় একেবারেই স্থবির। সেখানে যেটা চলে সেটা হচ্ছে- সময় মত খাওয়া, আর নিজেকে অন্য কিছুতে ব্যস্ত রাখা। এটা একটা সময়ে সবার জীবনেই আসে। আমি যদি বলি, এটা ইতিমধ্যে আমার জীবনেও শুরু হয়ে গেছে, ভুল বলা হবে না।

কেনো বললাম কথাটা। এর নিশ্চয় কোনো কারন তো আছে। আজকের যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা আমার কাছে কাম্য নয়। না আমি আশা করেছি। আমার সন্তানদের জন্য আমার থেকে বেশী কেউ ভাবে এটা আমি কখনোই বিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু সেই সন্তানেরা যদি কখনো বলে, যে, আমরা তাদের জন্য অভিশাপ,আমরা পশুর চেয়েও খারাপ ব্এযবহার করি, কিংবা আমরা প্ৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বাবা মা ইত্যাদি, এর থেকে বড় পরাজয় আর কিছু হতে পারে না। তবে আমি জানি, জীবনে এ রকমের অনুভুতি সবারই আসে। যখন এই অনুভুতি ভুল প্রমানিত হয়, তখন বেলা এতোটাই বেড়ে যায় যে, কারো কারো জীবনের রাত শেষ হয়ে আরো গভীর রাতে অন্য কোনো জগতে সে চলে যায়।

১৯/০৭/২০২১-ঈদুল আজহার ২দিন আগে

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব 

২০২১ 

১৯ জুলাই 

এই কয়েকমাসে এতো বেশী অভিজ্ঞতা হলো যা আমার জীবনের অনেক প্রাক্টিস আর বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিয়েছে। যাদেরকে আমি মনে করি সবাই আমার মতো। অথবা আর যার সাথে আমরা যাইই করি না কেনো, অন্তত আমরা আমাদের সাথে সেই একই প্রাক্টিস গুলি কখনো করতে পারি না। কিন্তু আমার এই ধারনা সমুলে আঘাত খেয়েছে অনেক গুলি কারনে। তাহলে একা একা বলিঃ

(১) মান্নানের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়েঃ মান্নান যে আমার সাথে লুকুচুড়ি করে সেটা আমি জানি। অনেক সময় ভাবি যে, হয়তো সে একটু ভালো থাকতে চায়, তাই একটু আধটু লুকুচুরি করে। আমার অনেক ক্ষতি না হলেও অর্থের দিক দিয়ে একটু তো লাগেই। কিন্তু যেহেতু আমি সামলে নিতে পারি, তাই অনেক সময় কিছু বলি না বা বলতে চাইও না।

আমি যখনই কোনো জমি কিনেছি, মান্নান সেখানে জমির দামটা এমন করে বাড়িয়ে বলতো যাতে আমার টাকা দিয়েই মান্নান ও কিছু জমি সেখান থেকে কিনতে পারে। আমি সেটা বুঝি কিন্তু কিছু হয়তো বলি না। এভাবে মান্নান অনেক জমি শুধু হয়তো আমার টাকা দিয়েই কিনেছে আর সেটা আমার ক্রয় করা জমির সাথেই। কিন্তু এবার যেটা করেছে সেটা মারাত্তক।

মুজিবুর রহমান খান নামে এক ভদ্রলোক আমাদের পলাসপুরের জমিটা কিনতে আগ্রহী হলে আমিও বিক্রি করতে তৈরী ছিলাম। আমার জমির সাথে আমার পার্টনার মুর্তুজা ভাইয়ের জমি আছে। ফলে আমার জমি আর মুর্তুজা ভাইয়ের জমি সহ একটা রফাদফা হয়েছিলো। এর মধ্যে মান্নান আমাকে জানালো যে, মুজিবুর রহমান খান সাহেবের আরো জমি দরকার যা সেলিম নামে এক জন লোকের জমি আমাদের জমির পাশেই আছে কিন্তু ওর জমিতে যাওয়ার রাস্তা না থাকায় যদি আমাদের জমির সাথে টাই আপ করে খান সাহেবের কাছে বিক্রি করি তাতে আমাদের লাভ হবে। কারন সেলিকমে জমির মুল্য দিতে হবে খান সাহেবের দেয়া জমির দামের অর্ধেক প্রায়। সেলিমদের মোট জমি ছিলো ৩২০ শতাংশ।

এর মধ্যে মান্নান আমাকে জানালো যে, আমরা সেলিমদের জমি থেকে পানি ব্যতিত মোট ১৫১ শতাংশ জমি খান সাহেবকে দিতে পারবো। বাকী ১৬৯ শতাংশ জমি আসলে নদীর পানির মধ্যে যদিও জমিটা রেকর্ডের অন্তর্ভুক্ত। আমি যখন সেলিমদের জমিটা বিনা পরীক্ষায়, বিনা নীরিক্ষায় খান সাহেবকে রেজিষ্ট্রি করে দিলাম, পরে জমি মাপ্তে গিয়ে দেখি যে, মাত্র ৯৮ শতাংশ জমি আছে যা নদীর মধ্যে না। অনেক রাগারাগি আর চাপাচাপির মধ্যে আমি যখন সেলিমদের ধরলাম, শুনলাম আরেক বিরাট ইতিহাস। মান্নান, সেলিম এবং সেলিমের এক চাচাতো ভাই মিলে মোট ৩২০ শতাংশ জমিই কিনে নিয়েছে সেলিমদের আত্তীয় স্বজনের কাছ থেকে অই টাকায় যে টাকা হয় ১৫১ শতাংশের দাম। খান সাহেবকে ১৫১ শতাংশ জমি দেয়ার পর বাকী ১৬৯ শতাংশ জমি ধান্দা করে মান্নানের নামে আর সেলিমের নামে একা পাওয়া অফ এটর্নী নিয়েছে। এর মানে হলো, আমি কোনো লাভ করি নি , লাভ করছিলো মান্নান। যদি অদুর ভবিষ্যতে পানি শুকিয়ে চর জাগে, তাহলে মান্নান এই জমি গুলি চড়া দামে বিক্রি করতে পারবে। অথচ টাকাগুলি খান সাহেবের এবং আমার। খান সাহেব যখন নদীর মধ্যে কোনো জমি নিতে নারাজ হলেন, তখন আমার চর গল্গলিয়া মৌজা থেকে এই বাকী ৫৩ শতাংশ জমি পুরা করে দিতে হবে যার দাম প্রায় তিন কোটি টাকা। এটা কোনোভাবেই আমার সম্ভব হচ্ছিলো না। আমি কেনো এতো গুলি জমি খান সাহেবকে লিখে দেবো যার দাম তিন কোটি টাকার উপরে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত লিখেই দিতে হবে জেনে আমি পলাশপুরের আক্কাসকে ধরে মান্নান আর সেলিমের কাছ থেকে পরবর্তীতে ওই ১৬৯ শতাংশ জমি ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে আমার নিজের নামে নিয়ে নিলাম। জানি আমার ক্ষতি পুরন হবে না যতোক্ষন পর্যন্ত ওই নদীর জমি শুকিয়ে আসল চেহারায় জমি ভেসে না উঠে। আমি মান্নানকে বারবার এই অ বিশ্বাসের কাজটা কেনো করেছে জিজ্ঞেস করলে তার একটাই উত্তর- ভুল হয়ে গেছে। এটা কোনোভাবেই ভুল হতে পারে না। আমি কখনো ভচাবি নাই যে, মান্নান ও আমাকে এভাবে এতো ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে।

পলাশপুরে আমার আরো একতা জমি সরকারের কাছ থেকে লিজ নেয়া ছিলো। আর যেহেতু ওই লিজটা আনতে হয় কোনো দুস্ত মানুষের নামে, তাই আমি মান্নানের ভাই নাসিরের নামেই ১০০ শতাংশ জমি আমার টাকায় লিজ নিয়ে এসেছিলাম। মান্নান আমাকে না জানিয়ে হালিম নামে এক লোকের কাছে ২০ লাখ টাকায় জমিটা গোপনে টাকা নিয়ে নিলো। এটা একটা অসম্ভব ঘটনা বলে আমার কাছে মনে হয়েছিলো। কিন্তু মান্নান কাজটা করেছে আমাকে একটু ও জানতে দেয় নাই। যখ ওরে আমি প্রশ্ন করেছি- মান্নানের একটাই উত্তর যে, আমার নাতির অসুখ ছিলো, টাকার দরকার ছিলো, তাই আমি বিক্রি করে দিয়েছি। আমাকে জানানোর কোনো বাধ্য বাধকতা মনে করলো না।

খান ভাই আমাদের পলাশ পুরের জমিটা কিনার সময়ে মোট ৬৩১ শতাংশ জমির বায়না করেছিলো যার মধ্যে মান্নানের ছিলো ৫১ শতাংশ। আমি খান ভাইকে বারবার বলেছিলাম, কখনো আমাকে ছাড়া টাকা পয়সার লেন দেন করবেন না। কিন্তু ওই যে বললাম, সবাই লাভ চায়!! খান সাহেব মান্নানকে মাঝে মাঝে আমাকে না জানিয়ে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা হ্যান্ড ওভার করে। একদিন খান সাহেব আমাকে জানালো যে, মান্নান জমিটা কাগজে কলমে কোনো বায়নাও করছে না আবার টাকাও চায়। আমি যখন ব্যাপারটার ভিতরে প্রবেশ করলাম, দেখলাম, ওই খানে মান্নানের জমি আছে মাত্র ৪ শতাঙ্ঘস, আর ওর বোন আর ভাই মিলে আছে আরো ৫ শতাংশ, মোট ৯ শতাংশ। বাকী জায়গাটা আক্কাস নামে ওর এক আত্তিয়ের। কিন্তু আক্কাসকে মান্নান উক্ত ৩৫ লাখ টাকা থেকে কখনো ১ টাকাও দেয় নাই, না মান্নান ওনার কাছ থেকে কোনো পাওয়ার অফ এটর্নী কিংবা অগ্রিম কোনো বায়নাপত্র করেছে। আক্কাস সাহেব যখন জানলো যে, মান্নান ইতিমধ্যে ৩৫ লক্ষ টাকা নিয়ে ফেলেছে, সে তখন (৫১ মানাস ৯) ৪২ শতান্সগ জমির বায়না করে ফেল্লো উক্ত খান সাহেবের সাথে। অর্থাৎ মান্নান জানেই না যে, উক্ত জমি মান্নান আর কখনোই খান সাহেবের কাছে বিক্রি করতে পারবে না। আমি যখন আজকে মান্নানকে বললাম, খান সাহেবকে ৫১ শতাংশ জমি লিখে দিচ্ছিস না কেনো? তার অনেক উচা গলায় বল্লো, সে আগামীকালই জমিটা লিখে দিতে পারে। যখন বললাম যে, আক্কাস জমিটা অন্য খানে বিক্রি করে দিয়েছে- তখন দেখলাম ওর মুখের ভাব অনেক রক্তিম। কিন্তু লজ্জায় পড়লো কিনা জানি না। ওর আসলে এগুলিতে কোনো খারাপ লাগে না মনে হয়। টাকাটাই ওর কাছে সবচেয়ে বড় মনে হয়। ভাগ্যিস আমি এই ৫১ শতাংশের ব্যাপারে কাহ্নের সাথে কোনো প্রকার কথা বলি নাই। তাহলে এই ৫১ শতাংশ নিয়েও খান আমাকে চাপ দিতো।

মান্নানের এখন টাকা প্রাপ্তির প্রায় সব গুলি রাস্তাই বন্ধ। কোটি কোটি টাকা আমি ওর হাত দিয়ে খরচ করিয়েছি। বারবার বলেছি, অন্য কোনো একটা সোর্স কর যাতে বিপদের সময় একটা ইন কাম আসে। কখনো ব্যাপারটা আমলে নেয় নাই। এবার মনে হয় খুব হারে হারে টের পাচ্ছে যে, ওর টাকার সব গুলি সোর্স প্রায় একেবারেই বন্ধ। দেখা যাক কি করে। আমার কাছে অনেক গুলি কারন দেখিয়ে কিছু টাকা খসানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু এবার আমি অনেক টাইট হয়ে গেছি। কোনো কিছুতেই কোনোভাবেই আর টাকা দেয়া যাবে না। মান্নানের পিঠ প্রায় দেয়ালের মধ্যে ঠেকে যাচ্ছে। তবে এখান থেকে কিছুটা উত্তোরন হয়তো হবে যদি ধলেশ্বরী গ্রীন ভিলেজ প্রোজেক্ট শুরু হয়। কারন ওখানে আমি ওকে ইন করিয়েছি। কিন্তু ওটার ইন কাম বড্ড স্লো।

এবার আসি আমার পার্টনার মুর্তুজা ভাইয়ের কাছ থেকে আম্নার তিক্ত অভিজ্ঞতার ব্যাপারটাঃ

(To be cont...)

২০/০৭/২০২১***-ভরষা

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব 

২০২১ 

২০ জুলাই 

ভরষা করা দোষের নয়। মানুষ যদি মানুষের উপর ভরষা না করে, তাহলে ধ্বংস বেশী দূরে নেই। কিন্তু কারো উপর ভরষা করার আগে সতর্ক থাকা খুবই জরুরী। ইচ্ছাকে ভালোবাসায়, আর ভালোবাসা থেকে সম্পর্ক তৈরী করার সময় এই সতর্ক থাকা ভীষনই প্রয়োজন। কিন্তু তুমি এসবের কোনো কিছুই না জেনে শুধু ইচ্ছাটাকে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় তুমি সম্পরকটা করেছো যেখানে তুমি কোনো কিছুই ভাবো নাই। তুমি পরিশ্রমী, তুমি সাহসী যদি কেউ পাশে থাকে, তুমি সৎ সেটা নিজের কাছে এবং আর তোমার জীবনের হিসাব তুমি জানো। আর তোমার মনে যে সপ্ন ছিলো সেটা পুরন করার জন্যই তুমি একটা সমঝোতা করেছো নিজের সাথে নিজের। আর সেটা তুমি সততার সাথে পালনও করছো। তোমার জীবনে এই গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আসলে তোমার সামনে কেউ ছিলো না। আর থাকলেও কোনো লাভ হতো না সেটা তুমি হারে হারে জানো। কারন যারা থেকেও ছিলো, তারা আসলে কখনোই তোমাকে মুল্যায়ন করেনি, করতোও না। তুমি অথবা যার সাথে তুমি এমন একটা সম্পর্ক করেছো, তোমরা কখনোই এটাও ভুলে যেতে চাও নাই যে, এই সম্পর্কের সামাজিকভাবে আসলে কোনো স্বীকৃতিও নাই। কিন্তু তোমার চোখ বন্ধ করে ভরষা করার ফল আমি কখনোই সেটা বৃথা যেতে দিতে চাই না। কারন তুমি অন্তত তোমার সব কিছু দিয়েই আমাকে মেনে নিয়েছো। এখানে গাদ্দারী করার কোনো প্রকারের অবকাশ বা সাহস আমার ছিলোনা, নাই আর ভবিষ্যতে থাকবেও না। ভদ্রতার পিছনে আমার কোনো প্রকার মুখোস কিংবা শয়তানীও নাই। কারন আমি জানি, এই জগতে আমাকে ছাড়া তোমার আর কেউ নাই, হোক সেটা তোমার জন্মদাতা বাবা বা মা অথবা তোমার রক্তের কেউ। এই অবস্থায় আমি তোমাকে ফেলে গেলেও আমার চোখ বারবার ফিরে তাকাবে পিছনে যেখানে তুমি পড়ে আছো। আমি সেটা কখনোই করতে পারবো না। ভাবো তো একবার- আমি চলে যাচ্ছি, তুমি চেয়ে চেয়ে দেখছো আমার নিষ্ঠুরতা, আর তুমি ভাবছো, তোমার সারাটা দুনিয়া এখন অন্ধকার। তোমার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে, তুমি ভাষাহীন হয়ে যাবে, তখন তোমার চোখ শুধু কথা বলবে। আর চোখের ভাষা তো একটাই। জল। এই জল দেখার জন্যে আমি কখনো প্রস্তুত নই।

এই প্রিথিবীতে কে আছে তোমার, আর কে নাই তাদের সবার শক্তি, ভালোবাসা আর ভরষা যোগ করলেও সেই ভরষার সাথে একদিকে শুধু আমি, এটাই তোমার কাছে পৃথিবীর সর্বোত্তম শক্তি। আর তুমি এতাই প্রমান করেছো এই পারুর কেসে। সারাটা গ্রাম, আইন, থানা, টাকা পয়সা, নেতা, মাদবরী, সন্ত্রাসী, চোখ রাংগানি একদিকে আর তুমি একাই একদিকে ছিলে। আর সেই শক্তিটাই তুমি প্রতিনিয়ত পেয়েছো এই ভরষার মানুষটার কাছে। কারন তুমি জানো, আর সবাই পালিয়ে গেলেও আমি অন্তত পালাবো না।

কেনো তুমি অন্য কারো চোখে চোখ রাখতে পারো না, কেনো তোমার মনে অন্য কারো স্থান হয় না, কখনো কি এটা খুব মনোযোগ সহকারে নিজেকে প্রশ্ন করেছো? ধর্মের কথা আলাদা, আল্লাহর দোহাই আলাদা ব্যাপার। কিন্তু এর বাইরেও তো অনেক লজিক আছে। সেই লজিক দিয়েও কি কখনো ভেবেছো কেনো হয় না সেগুলি? এর উত্তর একটাই- টোটাল সারেন্ডার। মানে সম্পুর্ন আত্তসমর্পন। যখন কোনো মানুষ তার নিজের মন তৃপ্তিতে থাকে, যখন চোখ ভালো ঘুম পায়, যখন শরীরের চাহিদা পূর্ন হয়, তখন শরীর, দেহ, মন, কিংবা আত্তা কারো দিকে ছুটে যেতে চায় না। যেমন ছুটে যায় না চাঁদ পৃথিবীর বলয় থেকে, কিংবা প্রিথিবী সূর্যের বলয় থেকে। তাদের যতোটুকু শক্ত্র প্রয়োজন তাদের নিজ নিজ অক্ষে চলার, ঠিক ততোটাই তারা পায়। তাহলে আর অন্য কোনো গ্রহের কিংবা নক্ষত্রের দারস্থ হবার কি প্রয়োজন?

মানুষ তখনি ছুটে যায় এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে যখন সে তার সঠিক তরী খুজে না পায়। আর সঠিক ঘাটের সন্ধান যখন একবার কেউ পায়, তার আর অন্য ঘাটে যাওয়ার অর্থ ভুল ঘাটে চলে যাওয়া। ভুল ঘাট মানুষকে ভুল পথেই নিয়া যায়। আর কেউ যখন একবার ভুল পথে যাত্রা শুরু করে, সেখান থেকে ফিরে আসার অন্য কোনো বিকল্প রাস্তা হয়তো তার জানাই নাই। যদি সেই অচেনা রাস্তায় একবার কেউ পড়ে যায়, সেখানে প্রতিটি মানুষ তার অচেনা। অচেনা মানুষের কাছে চোখের জলের কোনো মুল্য থাকে না।

আর মুল্যহীন জীবনে সপ্ন তো দূরের কথা, বেচে থাকাই কষ্টের। কষ্টে ভরা জীবন যখন সামনে চলতে থাকে, তখন মানুষের এই জীবনের প্রতি মায়া হারিয়ে ফেলে, ভগবানের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। ঈশর আছে এটাই তখন আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। তারপরেও দূর্বল চিত্তের মানুষেরা যাদের কোনো কুল কিনারা আর থাকে না, যেমন লামিয়া বা শারমিন, তারা ওই অচেনা, অসুন্দর জীবনকেই মানিয়ে নিতে শুরু করে। সেখানে তখন আর ভগবানের কোনো অস্তিত্ত থাকে না বা তারা ভগবানকে মানেই না। ধর্ম পালন তো দুরের কথা।

তোমার দুষ্টুমি যেমন পাগলামী, আমার কাছে তোমার পাগলামীও তেমন মিষ্টি, তোমার কান্নাও আমার কাছে ঠিক ওই রকমের। তোমাকে ভালো রাখাই আমার কাজ। আর সেই ভালো থাকাটা নির্ভর করে তোমার আত্তার উপর তুমি কতোটা তৃপ্ত। এই প্রিথিবী থেকে চাঁদ যতো সুন্দর মনে হয়, নীল আকাসের সাথে চাদকে যেমন কোনো এক যুবতীর কপালের টীপ মনে হয়, অথবা অনেক দূরের কাশবন যখন সাদা মেঘের মতো হাওয়ায় দুলে দুলে মনকে দোলায়িত করে, যখন ওই চাদে গিয়ে পা রাখা যায়, কিংবা কাশবনের মাঝে হাজির হওয়া যায়, তখন তার আসল রুপ দেখে দম বন্ধ হয়ে আসে। সেই চাঁদ আর কাশবন কেনো জানি মনে হয় এটা একটা খারাপ সপ্ন ছিলো। আমরা সেখানে বসবাস করতে পারি না। আবার ছুটে আসতে চাই এই গাছ গাছালী ভর্তি নোনা সেঁতসেঁতে সোদা গন্ধের মাটিতে যেখানে বর্ষায় গাছের পাতা বেয়ে বেয়ে টিপ টিপ করে ফোটা ফোটা পানি আমাদের নাকের ডগা দিয়ে বুকের ভিতরে এসে অন্তর শীতল করে দেয়।

একটা মানুষের শান্তিতে আর সুখে বসবাসের জন্য এই পৃথিবীর অনেক কিছু লাগে না। প্রিন্সেস ডায়ানার একেকটা নেকলেসের দাম ছিলো কোটি কোটি টাকার। তার একেকটা ড্রেসের দাম ছিলো হাজার হাজার ডলার। সাথে ছিলো রাজ প্রাসাদ। কি ছিলো না তার। ছিলো সবুজ চোখের মনি, ঈশ্বর যেনো তাকে একাই রুপবতী করে পাঠিয়েছিলো। অথচ মনে তার কোনো শান্তিই ছিলো না। সেই শান্তির খোজে শেষতক রাজ প্রাসাদ ছাড়তে হয়েছে। অন্যের হাত ধরতে হয়েছে। আর মাত্র ৩২ বছর বয়সেই তাকে এই প্রিথিবী ছাড়তে হয়েছে। যদি বাড়ি, গাড়ি, জুয়েলারী, আর টাকা পয়সাই হতো সব সুখের মুল চাবিকাঠি, তাহলে ডায়নার থেকে সুখী মানুষ আর এই প্রিথিবীতে কেউ ছিলো না। কিন্তু সেটা কি আসলেই সুখী ছিলো?

একটা তরকারীতে নুন কম হতে পারে, একটা পরোটা পুড়ে যেতে পারে, তার স্বাদ কিংবা মজা হয়তো একটু হেরফের হতেই পারে কিন্তু সেটা হয়তো একদিন বা দুইদিন। কিন্তু ভালোবাসা আর মহব্বতে যখন নুনের কমতি হয়, পুড়ে যায়, তখন জীবনের মজাটাই শেষ হয়ে যায়। আর জীবনের মজা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন এসি রুমেও ভালো ঘুম হয় না। নীল আকাশ দেখেও কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে না। তখন যেটা মনে হয় তা হচ্ছে বিষাদময় রুচী। সেই রুচীতে আর যাই হোক পেট ভরে না। আর পেটে ক্ষুধা রেখে কোনোদিন কারো ভালো ঘুম হয়েছে তার কোনো প্রমান নাই।

আমি তোমার জীবনে সেই রকমের একটা অলিখিত ভরষা। এই ভরষার কোনো ডেফিনিশন নাই। এই ভরষার কোনো আইন গত দিক নাই বটে কিন্তু আমার নিজের অনেক দায়িত্তশীলতা আছে যেখানে আমিই আইনপ্রনেতা, আর আমিই সবচেয়ে বড় বিচারক। হয়তো সমাজকে আমি তুরি দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারবো না, কিন্তু আমি সেটাই করততে পারি যাতে তুমি তুড়ি দিয়ে সবাইকে এটাই করতে পারো যে, তুমি নিজেও একটা শক্তি।

আজ তুমি সেই বিগত বছরগুলির দিকে তাকিয়ে দেখো? তুমি দেখতে পাবে যে, সেইসব বছরগুলিতে অনেক ঝং ধরা ছিলো। আগাছায় ভরা একটা কঠিন পথ ছিলো। কিন্তু আজ থেকে ৫ বছর পরেরদিন গুলি দেখো, সেখানে প্রতিদিন তোমার জীবন মোড় নিয়েছে। বাকেবাকে সমস্যা ছিলো কারন সমস্যা গুলি হয়তো আমার নজরে ছিলো না। কিন্তু আজ তোমার সেই বছরগুলির সাথে তুলনা করলে স্পষ্ট দেখতে পাবে, আকাশের মেঘ তোমার ঘরেই রংধনু হয়ে একটা বাগান তৈরী করেছে। সেই বাগানে তুমি যখন খুসী যেভাবে খুসী বিচরন করতে পারো। এই বাগানের একচ্ছত্র মালিকানা তোমার নিজের। এখানে একটা আম খেলেও শরীর চাংগা হয়ে উঠে, এখানে একটা ডিম খেলেও শতভাগ কাজ করে। অথচ আজ থেকে ৫ বছর আগে সেই একটি আম কিংবা একটি ডিম এমন করে খেলেও শতভাগ কাজ করতো না। কারন তখন ভরষার জায়গাটা ছিলো একেবারেই অনিশ্চিত। যা এখন পুরুটাই উলটা। আর এটাই খাটি ভরষা।

এখানে শুধু একটা ব্যাপারই চিন্তার বিষয় যে, যে মানুষটার কারনে কখনো নিজেদেরকে অসহায় মনে হয় নাই, কোনো দুশ্চিন্তা গ্রাস করে নাই, যখন সেই মানুষটা চলে যায়, তখন সেইই দিয়ে যায় যতো অসহায়ত্ব আর দুশ্চিন্তা। আর এটা আমার মাথায় সব সময় কাজ করে। এর জন্যে সমাধান একটাই- যা আমি অন্যদের বেলায় করেছি। সাবলম্বিতা। এবং দ্রুত। তোমাদের কাজ ভরষা করা আর আমার কাজ সেই ভরষার স্থানটা স্থায়ী করা।

যেদিন মনে হবে তুমি সাবলম্বি, তুমি নিজে নিজে একাই চলার ক্ষমতা রাখো, তোমার সমাজ তোমাকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে দিধা বোধ করবে, সেদিন আসলে আমার দায়িত্ত প্রায় শেষ হয়েছে বলে আমি মনে করবো যেটা এখন প্রায়ই ভাবি আমার এই পক্ষের মানুষগুলির জন্য। তখন যেটা হবে- তুমি স্বাধীন পাখীর মতো এক ঢাল থেকে একাই উড়ে গিয়ে আরেক ঢালে বসতে পারবে। কিন্তু পাখীরা যখন একবার নিরাপদ গাছে বাসা বেধে ফেলে, যতোদিন ওই গাছটা থাকে, কেউ আর কেটে ফেলে না, কিংবা আচমকা কোনো ঝড়ে যখন গাছটা আর ভেংগে পড়ে না, ততোক্ষন অবধি সেই ভাষাহীন অবুঝ পাখীরাও তাদের নীড় পরিবর্তনে মনোযোগ দেয় না না। তারা সেখানে অভয়ারন্য তৈরী করে সেই জংগল সাম্রাজ্যের অধিকর্তা হিসাবেই জীবন পাড় করে দেয়।

ওই গাছটাই তখন তার ভরষা। ওই গাছ জায়গা দেয় বাসা করার, ওই গাছ ঢাল পেতে দেয় নিবিড় করে বসার। ওই পাখী চলে গেলেও গাছের না হয় কোনো ক্ষতি, না হয় তার ফলনে কোনো বিঘ্নতা। ঠিক সময়ে সেই গাছ ফুল দেয়, ফল দেয়, আর দেয় ছায়া। ঝড়ের দিনেও সে হয়তো অন্য আরো অনেক পাখীর জন্যে অভয়ারন্য স্রিষ্টি করে বটে কিন্তু সেই গাছ কোনোদিন অভিযোগ করে নাই, কেনো অন্য আর কিছু পাখী তার ঢাল ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলো। তবে যদি আবারো সে ফিরে আসে, গাছের কোনো অভিযোগ থাকে না। কিন্তু যদি কোনো ঢালই আর খালী না থাকে, সেটা তো আর গাছের দোষ নয়।

ভরষার স্থান কেউ ত্যাগ করলে গাছের কি দোষ!!

২৮/৬/২০২১-সফুরা খালা

 

এই মানুষগুলি একসময় আর কারো সামনেই থাকবে না। এদের জীবনেও প্রেম এসেছিলো, এরাও কারো না কারো চোখে রানীর মতো ছিলো। বাল্যকালে সাথী সংগীদের নিয়ে এরাও নদীর ঘাটে গিয়ে জিলকেলী করতে করতে সারাটা পরিবেশ মুখরীত করে রাখতো। নীল আকাশের মধ্যে জ্যোৎস্না রাতের তারার মতো তারাও রাত জেগে হয়তো কোনো এক প্রেমিক বরের অপেক্ষায় মনের ভিতর সুখের আস্বাদন করেছেন। এরা বড় বড় সংসারের হাল ধরেছেন, সমাজে এরাও অনেক অবদান রেখেছে। এদের গর্ভে জন্ম নেয়া অনেক সুপুত্র কিংবা সুন্দুরী কন্যারা হয়তো আজো দেশে বিদেশে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু আজ তারা এতো চুপচাপ জীবন যাপন করছেন যেখানে তিনি নিজে ছাড়া আর কেউ পাশে নাই। না তার রাজা আছে, না তিনি এখন রানী আছেন। সময় মানুষকে কত পরিবর্তন করে দেয়। এই সময়ের কাছে আজো কেউ স্বাধীনতা পায় নাই, না পেয়েছে কোনো ক্ষমতা সময়কে পরিবর্তন করার। আদি যুগ থেকে যতো মানুষ এই দুনিয়ায় এসেছে, সবাই কোনো না কোনো সময় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এই পৃথিবীকে ত্যাগ করতে হয়েছে। আমরা যারা পিছনে পড়ে থাকি, তারা শুধু একটা মোহ, একটা স্মৃতি আর একটা কি যেনো নিয়ে শুধু অলীক ভাবনার জগতে অপেক্ষায় থাকি। একদিন আমিও এর থেকে পরিত্রান পাবো না। শুধু সময়টা পালটে যাবে এই রানীদের মতো। 

কিন্তু আমার মনের ভিতরে এই সব রানীরা আজীবন রানীদের কিংবা রাজাদের মাতাই হয়ে থাকবেন। আমি এদেরই বংশের একটি ধারা। আরো বেচে থাকো তোমরা অনেক কাল খালা। 

 

জীবন যেখানে যেমন। যে শিশুটি আজ জন্ম নিলো কেউ জানে না তার জন্য এই পৃথিবী কি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিংবা এই পৃথিবীকে সে কি দিয়ে যাবে। হতে পারে আজকে এই শিশুটি হয়তো এই পৃথিবীকে কোনো এক সময় নাড়িয়েও দিতে পারে বা এই পৃথিবী তাকেও নাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু এমন অনেক শিশুই এই পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয়,  না তারা কোনো ভূমিকা রাখে, না পৃথিবী তাদেরকে মনে রাখে। এমন মানুষের সংখ্যাই বেশী। যুগে যুগে তারপরেও অনেক শিশু প্রকাশ্যে বা গোপনে পৃথিবীতে আসে যারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় আর একদিন সব কিছু ফেলে সবার থেকে আলাদা হয়ে আবার কোথাও অদৃশ্য হয়ে যায়। মাঝখানের এই সময়টায় খুব গুটিকতক মানুষ হয়তো নিজের মতো করে কাউকে কাউকে মনে রাখে কিন্তু তাও একসময় মনের স্মৃতি থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়। আমার সফুরা খালা, সামিদা খালা কিংবা আমার শায়েস্তা বুজি, বা সাফিয়া বুজিরা সম্ভবত এই রকমের কিছু মানুষ যারা সেই বহু বছর আগে শিশু হয়ে জন্ম নিলেও কোনো লাভ হয় নি কারো। তারা আজীবন যেনো এই দুনিয়ার বুকে একটা বোঝা হয়েই ছিলো। অথচ তারা হাজারো মানুষের থেকে অনেক ভালো মানুষ ছিলেন।

প্রায় দু বছর আগে আমি আমার পরিবার নিয়ে আমাদের গ্রাম থেকে বেশ দূরে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। বেশীক্ষন দেরী করি নাই কারন পরিবেশটা ঐ রকমের ছিলো না। কোনো রকমে আনুষ্টানিকতা শেষ করে ভাবলাম, যেহেতু গ্রামের পথেই আছি, যাই আমাদের গ্রামের বাড়িটা ঘুরেই যাই। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো, আলো বেশ কমে গিয়েছিলো। অনেকেই আমাকে চিনে না যদিও আমি এই গ্রামেরই একজন পুরানো বাসিন্দা। কিন্তু সময়ের সাথে আমার অনুপস্থিতি আমাকে আজ এই গ্রামে একজন নবাগত অতিথির মতোই মনে হচ্ছিলো। যারা আমার সমবয়সী ছিলো, তারাও অনেক বুড়ো হয়ে গেছে, অনেকেই চিনতেও ভুল করছিলো, আমি তো ওদের কাউকেই এখন চিনি না। ওদের চেহারা সুরুতে এমন বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে যে, জোয়ানকালে আমি যাদেরকে দেখেছি, তারা এখন দাদা নানার পর্যায়ে। না চেনারই কথা। তারপরেও কাউকে কাউকে আমি চিনতে পারছিলাম। গ্রামের বাড়িটা খা খা করছে, কেউ থাকে না এখানে। আগে মা থাকতেন, এখন থাকে আমার এক ভাগ্নে যে সারাদিন গাজা খায়।

ভাবলাম, আমার এক খালা ছিলো। নাম সফুরা বেগম। উনি কি জীবিত আছেন নাকি আর জীবিত নাই সেই খবরটাও আমার জানা নাই। তাঁকে খুব দেখতে মন চাইলো। মিটুলকে বললাম, চলো একটা বাড়িতে যাই। যদি উনি বেচে থাকেন, তাহলে মায়ের অভাবটা কিছুটা হয়তো পুরন হবে। আর যদি জীবিত না থাকেন, অন্তত জানতে পারবো, কবে থেকে আর তিনি এই পৃথিবীতে নাই। আলুকান্দা তার বাড়ি। অনেক খোজাখুজির পর শেষ অবধি সফুরা খালার বাসায় যেতে পারলাম। তিনি অসুস্থ্য। জর। একটা কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। চার পাঁচ দিন নাকি তিনি কিছুই খাচ্ছেন না। অনেক বয়স হয়ে গেছে। আমার মা যখন বেচে ছিলেন, তখন আমার এই খালা প্রায়ই আমার মায়ের সাথে দেখা করতেন, গল্প করতেন। আমাকে খুব আদরও করতেন। আসলে আমার মা, আমার সামিদা খালা আর এই সফুরা খালা এতোটাই ভালো আর নীরিহ মানুষ ছিলেন যে, তাদের ব্যাপারে আজ অবধি কেউ কোনো অভিযোগ করেছে সে ঘটনা ঘটে নাই। খালাকে ডাকা হলো। উনি ভালো মতো চোখে দেখেন না। এম্নিতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো, তারমধ্যে আবার আকাশ ছিলো খুব মেঘাচ্ছন্ন। বিদ্যুৎ ছিলো না। কোন রকমে খালাদের বাসায় যাওয়ার পর, আমি খালার বিছানায় গিয়ে বসলাম। খালাকে তার পুত্রবধুরা ডেকে তোলার চেষ্টা করলেন। আমাই যাওয়াতে সবাই অনেক খুশী হয়েছে। কি থেকে কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না।

খালাকে যখন আমি বললাম, আমি মেজর আখতার এসছি। খালা এম্নিতেই কানে কম শুনে মনে হয়, তার মধ্যে আমার নাম শুনে যেনো একটা অদ্ভুত মিথ্যা কথা শুনলেন এমন হলো। বল্লো-

কে? হামিদার ছেলে?

বললাম, হ্যা খালা।

উনার জর ছিলো প্রায় ১০৩ ডিগ্রী। আমার কথা শুনে তিনি বিছানা থেকে উঠে বসলেন। খালা প্রায় গত চার পাঁচ দিন বিছানায় উঠে বসতে পারেন না। কিন্তু আজ যেনো কোন অলৌকিক শক্তিতে তিনি একাই বিছানায় উঠে বসে পড়লেন। আমি খালাকে জড়িয়ে ধরলাম, খালাও আমাকে এমন করে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলেন যেনো এইমাত্র বাইরের মেঘাচ্ছন্ন আকাশটা ঘনকালো ঝপ ঝপ বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিলো সারাটা উঠান।

কতটা আদর? কিভাবে আদর করলে ভালোবাসা হয় মায়েদের? আমার সেটা জানা ছিলো। আমার মাও ঠিক এভাবেই আমাকে আদর করতেন।  আমার মুখে দুই হাত দিয়ে একদম চোখের কাছে আমার মুখটা নিয়ে পানভর্তি মুখে ভিজা ভিজা চোখে ফিক করে হেসে দিয়ে বলতেন, অনেক বড় হ বাবা। আমার দোয়া আর দোয়া রইলো। সফুরা খালার ভাষাও এক। কি অদ্ভুদ। আমি তাঁকে কতোক্ষন জড়িয়ে ধরেছিলাম, আমার জানা নাই। সারাটা শরীর হাড্ডি, মাংশ বলতে কিছুই নাই। গরীব ছেলেপেলেরা যতোটা পারে তাদের মায়ের যত্ন নেয় বটে কিন্তু অন্তরের ভালোবাসায় হয়তো অনেক ঘাটতি আছে। তারপরেও তিনি বেচে আছেন যেটুক পান সেটা নিয়েই।

আমার মায়ের বাবার নাম ছিলো কেরামত আলী। আমার মায়ের কোনো ভাই ছিলো না। মাত্র দুইবোন- হামিদা খাতুন আমার মা আর সামিদা খাতুন আমার আপন খালা। কিন্তু সফুরা খালার বাবার নাম ছিলো চেরাগ আলি। তারও কোনো ভাই অথবা কোনো বোন ছিলো না। তিনি একাই একমাত্র কন্যা সন্তান ছিলেন চেরাগ আলীর। এই চেরাগ আলি এবং কেরামত আলি (মানে আমার নানারা) ছিলেন চার ভাই। অন্যান্য আর দুই ভাই ছিলেন সাবেদ আলি এবং লষ্কর আলী। উম্মেদ আলী ছিলেন এই চার ভাইয়ের বাবা। অর্থাৎ আমার মা খালাদের নানা।

আজ তারা কেহই বেচে নাই। শুধুমাত্র আমার সফুরা খালাই বেচে আছেন কালের সাক্ষী হয়ে। খুব ভালোবাসি আমি তোমাদের।

১১/০৮/২০২১-কনিকার যাওয়ার সময় উপদেশ

নতুন জায়গায় নতুন দেশের নতুন নিয়মে তুমি সম্পুর্ন আলাদা পরিবেশে একটা নতুন জীবন ধারায় নতুন ক্যারিয়ার তৈরী করার জন্য দেশ ছেড়ে সুদূর আমেরিকায় যাচ্ছো। তুমি এদেশের কোন চাপ, কোনো বিরহ নিয়ে ওখানে বাস করবে না, না কোনো কারনে মন খারাপ করবে। একদম ফ্রেস মাইন্ডে যাবে আর ফ্রেস করে শুরু করবে সব। মন দিয়ে নিজের সপ্ন পুরু করার চেষ্টা করবে কিন্তু সব সময় শরীরের দিকে যত্ন নিতে হবে। আমি শুধু তোমার পাশে থাকতে পারি কিন্তু লড়াইটা তোমার, তোমাকেই লড়তে হবে। এটা বিজনেস নয়, এটা তোমার লাইফ। গল্পটা তোমার, সপ্নটা তোমার। এই আজ থেকে তুমি একটা জার্নি শুরু করলে যার একমাত্র যাত্রী তুমি নিজে। জীবনের মজাটা হচ্ছে- কিছু কিছু জিনিষ এমন হয় যেটা অবিশ্বাস্য লাগে কিন্তু তুমি বুঝতে পার- হ্যা এটা হয়েছে। তখন নিজের থেকেই বিশ্বাস হয়ে যায়। 

নতুন কাজ, নতুন পরিবেশ, কিন্তু নিজেকে বদলে ফেলো না। কেউ চলে যাবার পর হয়তো কিছু পরিবর্তন নজরে আসে। তুমি চলে যাবার পর হয়তো আমাদের এখানে অনেক কিছুই পালটে যাবে। পালটে যাবে কোনো এক সন্ধ্যায় পিজা খাওয়ার কিছু আনন্দঘন মুহুর্ত, পালটে যাবে কোনো এক ছুটির দিনে দল্বেধে বাইরে গিয়ে খেতে যাওয়ার আসর কিংবা পালটে যেতে পারে আমাদের অনেক দইনিন্দিন কিছু কর্ম কান্ড ও। আমাদের এই পরিবর্তন কোনো নতুন কিছু হয়তো নয়, এটা একটা এডজাষ্টমেন্ট, যা তোমার অনুপস্থিতিতে আমাদের আনন্দের সাথে বেচে থাকার নিমিত্তে। কিন্তু তোমার বদলে যাওয়া অন্য রকম। তুমি বদলাবে সেটা যাতে তোমার ভালোটা হয়।

 আমি তোমাকে কোনো কিছুতেই কখনো আটকাই নাই, না কখনো আটকাবো। কিন্তু তুমি আমার নিজের মেয়ে, আমার বহু আদরের সন্তান। যদি এমন কখনো হয় যে, আমি তোমাদের কারনে দুশ্চিন্তায় থাকি, তখন হয়তো সমস্ত আবেগ, মায়া আর ভালোবাসা উপেক্ষা করেই হয়তো আমি তোমাকে আটকাবো। সেটা যেনো আমাকে করতে না হয়। প্রাইওরিটি ঠিক করতে হবে জীবনে। সব সময় আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখবে। জীবনে ব্যস্ততা থাকবে কিন্তু এতোটা না যাতে ফ্যামিলি ডিপ্রাইভড হয়। তুমি যদি ভালো ফলাফল করতে না পারো, এর মানে এই নয় যে, আমার ভালোবাসা তোমার উপর কমে যাবে। তুমি যদি তোমার ডিজায়ার্ড রেজাল্ট না করতে পারো শত চেষ্টা করার পরেও, আমি তোমাকে কখনোই দোষারুপ করবো না। বরং আমি তোমাকে সারাক্ষন সাহস দেবো, সহযোগীতা করবো কিভাবে তুমি সবার থেকে ভালো ফলাফল করতে পারো। আর ওটাই তোমার বাবা।

একটা জিনিষ সারাজীবন মনে রাখবা যে, সোস্যাল মিডিয়া একটা মেনিপুলেটেড মিডিয়া। এর বেজ মোটেই সত্য নয়। বরং এটা সাজানো সত্যি। কোনো জিনিষ সাদা বা কালো হয় না। সবটাই আলোর খেলা। এই সোস্যাল মিডিয়ায় সেটাই তারা জানাতে চায় যেটা তারা তোমাকে জানাতে চায় কিন্তু তোমার উচিত সেটা জানা যেটা আসল সত্যি। কারন অনেক বড় অপরাধের শিকর অনেক গভীরে থাকে। এই সোস্যাল মিডিয়ার ব্যক্তিত্তরা সবাই মেনিপুলেটেড চরিত্র। এরা ডিটেইল্ড মিথ্যা কাহিনী খুব নিখুতভবে বানায়। তাই কোনো কিছুর ফেস ভ্যালুতে না গিয়ে ডাবল ভেরিফিকেশন জরুরী। জীবনের নিরাপত্তার জন্য নিজের চারিদিকে সবসময় চোখ কান খোলা রাখতে হবে। এই কথাটা খুব জরুরী মনে রাখা যে, প্রকৃতির ইশারার প্রতি সর্বদা সেনসিটিভ থাকা। যেদিন সুনামী হয়, তার আগের দিন জংগলের সমস্ত প্রানিকুল সবাই জাত নির্বিশেসে উচু জায়গায় স্থান নিয়েছিলো, কারন তারা প্রকৃতির সেন্সটা বুঝতে পেরেছিলো। যা মানুষ বুঝতে পারে নাই। ফলে সুনামীতে বন্য প্রানীদের মধ্যে যতো না ক্ষতি হয়েছিলো তার থেকে শতগুন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলো মানুষ। ঠিক এই কারনেই  সব সময় মনে রাখা দরকার যে, অপরাধের সুনামী একটা নয়, অনেক সংকেত দেয়, হওয়ার আগে এবং অপরাধ হওয়ার সময়। শুধু সেটা ধরতে হয়।

মানুষের শরীরে একটা জিনিষ থাকে যা পোষ্টমর্টেম করেও পাওয়া যায় না। কিন্তু কোনো সাফল্যে সব থেকে জরুরী হয় সেই জিনিষটার। সেটা “কনফিডেন্স”। এই কনফিডেন্স মানুষকে তৈরী যেমন করতে পারে, তেমনি ভেংগেও দিতে পারে। যখন এটা ভেংগে যায় বা হারিয়ে যায়, তারপরে আর কিছু কাজ করে না। তখন যেটা হয়, তুমি ঠিক করছো নাকি ভুল করছো কিছুই বুঝতে পারবে না। আর যখন কনফিডেন্স চলে যায় বা হারিয়ে যায়, সেই জায়গাটা দখল করে নেয় “কমপ্লেক্স”। এই কমপ্লেক্স যখন গেথে বসে যায় কারো জীবনে, তখন সিম্পল একটা ছবি তুলতেও খারাপ লাগে। কারন কে আপনাকে নিয়ে মজা করবে, কে লেগ পুলিং করবে এই সব ভেবে।

জিবনে এমন কোনো অধ্যায় তোমার থাকা উচিত নয় যা তুমি আর অন্য কেউ শুধু জানো অথচ আমরা জানি না। আমাদের মান, সম্মান, পজিশন, সমাজে মাথা উচু করে বেচে থাকার জন্য শুধু আমাদের গুনাবলীইই যথেষ্ঠ নয়, সেখানে তোমরাও আমাদের সেই জীবনের সাথে জড়িত। ফলে, যেটাই হোক সবকিছুতেই আমাদের কথা মাথায় রাখবে। বাবা মায়ের থেকে বড় ভরষা আর কিছু নাই। আমরা যদি আগে থেকেই জানতে পারতাম আমাদের কর্মফলে কি ফলাফল হয়, তবে কতই না ভালো হতো। কিন্তু সেটা আমাদের স্রিষ্টিকর্তা সুযোগ দেন নাই। তাই সতর্ক থাকাটা খুব দরকার। সতর্ক হওয়া মানে এই নয় যে আমরা শুধু মাত্র পরিনতির বিষয় ভাববো, সতর্ক থাকার অর্থ হলো সঠিক সময়ে নেয়া সেই পদক্ষেপ যা আগামী সমস্যাগুলিকে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। বিশেষত এটা জানা সত্তেও যে আমাদের আগামী কর্মফল খারাপ।

মনে রাখবা এক বন্ধুই আরেক বন্ধুর ক্ষতি করে। তাতে তোমাকে সাহাজ্য করতে আমাদের অনেক অসুবিধা হবে। তুমি শুধু ফোকাস করবে তোমার ক্যারিয়ারে আর সপ্ন পুরনে। তোমাদেরকে নিয়ে আমার সারাটা জীবন অন্য রকমের একটা সপ্ন আছে। আরেকটা কথা মনে রাখবে- ভালোবাসায় অনেক শক্তি থাকে। যদি হতাতই মনের অনিয়ন্ত্রনের কারনে কাউকে ভালোই লেগে যায়, সেখানে নিজের সাথে নিজের বুঝাপড়া করো। সব ভালোবাসার রুপ এক নয়। কেউ ভালোবাসে তোমার শরীরকে, কেউ ভালোবাসে তোমার দূর্বলতাকে, কেউ ভালোবাসে তোমার মেধাকে, আবার কেউ ভালোবাসে তোমার তথা তোমার পরিবারের সম্পদ কিংবা তোমার অস্তিত্বকে। কে তোমাকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে ভালোবাসলো, এই দৃষ্টিকোণ টা খুব ভালো করে বুঝা তোমার দায়িত্ব। কেউ যদি তোমাকে আসল রুপে ভালোবাসে, কখনো সে তোমাকে জোর করবে না কারন সে জানে যদি তুমি তার হও, তুমি যেভাবেই হোক সেটা বুজতে পারবে আর তুমি তার কাছে বিলম্ব হলেও ফিরে যাবে অথবা সে দেরী করে হলেও তোমার কাছেই ফিরে আসবে। যদি সে ফিরে আসে বা তুমি ফিরে যাও, তাহলে বুঝবে এটা সত্যি ছিলো। নতুবা কিছুই সত্য ছিলো না। যা ছিলো সেটা হলো একটা মোহ। মোহ আর ভালোবাসা এক নয়। একটা বাস্তব আর আরেকটা মিথ্যা। এই মিথ্যা ভালোবাসায় পতিত হয় হয়তো মনে অনেক কষ্ট জমা হতে পারে। কিছু জিনিষ যা প্রতিনিয়ত মনকে কষ্ট দেয়, মানসিক শান্তি নষ্ট করে, সে সব কাহিনী চিরতরে ভুলে যাওয়াই ভালো। তাতে অন্তর মানসিক কষ্টটা আর থাকে না। এটা অনেক জরুরী একটা ব্যাপার। সব কিছুরই প্রথমবার আছে। এটা যেমন ভালোবাসার ক্ষেত্রে তেমনি অপরাধের ক্ষেত্রেও। যৌবন হলো অসহায় এবং শক্তির দ্বিতীয় নাম। অপরাধের ক্ষেত্রে বিচার হয় কিন্তু যৌবনের ভালোবাসার প্রতারনায় নিজের অসহায়ত্তের বিচার নিজেকে করতে হয়। তখন নিজের বিরুদ্ধে রায় দেয়া সহজ হয় না। তাই আমি সব সময় একটা কথা বলি- টাইম হচ্ছে মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ভিলেন। তার কাছে পরাজিত হওয়া যাবে না। আবার এই টাইমই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বন্ধু। তুমি এই টাইমকে কিভাবে ব্যবহার করবে সেটা তোমার বিবেচনা। একবার মনে কালো দাগ পড়ে গেলে তা আজীবন নিজেকে কষ্ট দেয়। ব্ল্যাক কফি, ব্ল্যাক ফরেষ্ট কেক, ডার্ক চকোলেট, ঘন জংগল অন্ধকার রাত, সবই কালো কিন্তু সে কালো কোনো কষ্টের নয়। কিছু কালো জীবনের অভিশাপ। কালোর মতো কোনো রং নেই। কিন্তু কিছু কি আছে যা কালোকে সাদা করতে পারে? বিশেষ করে সেই কালো যা জীবনের ধারাবাহিকতায় অভিশাপের মতো রুপ নিয়েছে? তাই, আমি প্রতি নিয়ত তোমাকে নিজের হাতের নিয়ন্ত্রনের বাইরে ছেড়ে দিতে ভয় করলেও তোমার উপর আমার আলাদা একটা ভরষা আছে- তুমি পারবে ঠিক সে রকম করে চলতে যা আমি তোমার জন্য করতে চেয়েছিলাম। এই ভরষায় আমি তোমাকে অনেক দূরে পাঠাতেও দ্বিধা করছি না।

আমার আশা, তোমার মায়ের সপ্ন আর আমাদের পরিবারের সব সম্মান তোমার হাতে দিয়ে এটাই বলতে চাই- আমরা তোমাদের পরিচয়ে সমাজে আরেকবার সম্মানীত হতে চাই। বাকীটা আল্লাহ মালিক জানেন।

শেষ বিদায়

আজকে সেই দিন যেদিন সবাই আমার কারনেই সবাই একত্রে মিলিত হয়েছে। মিলিত হয়েছে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে। কিন্তু এখন আমি সম্পূর্ণ স্থবির আর শান্ত। বাড়িঘর সব ভড়ে গেছে একের পর এক চেনা জানা এবং অচেনা অনেক লোকের ভীড়ে। উজ্জ্বল দিবালয়ে, অথবা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে অশান্ত হৃদয়ে কেহ কেহ লাল নীল জামা পড়ে মাথায় টুপি পড়ে, কেহ আবার হাতে তসবিহ নিয়ে মুখে দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে হাহুতাশ করছে, কেউ চোখের জলে বুক ভাসিয়ে জ্ঞান হারাচ্ছে, কেউ আবার মনে মনে যার যার মিশ্র অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। কেহ কেহ আমাকে কোথায় দাফন করবে, কে বা কারা সে দাফনের নিমিত্তে কোথায় আমার কবরখানা রচিত হবে এই ব্যস্ততায় এদিক সেদিক ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। কেউ আমাকে পেয়ে হারালো, আবার কেউ আমাকে না পেয়েই হারালো। কেউ কেউ আবার অধিকার নিয়ে মনে মনে ছক কষে অশান্ত রুপ ধরিয়া বিলাপ করবে, কেউ আবার অধিকার পুনরুদ্ধার হবে এই আশঙ্কায় প্রহর গুনবে। কারো জন্য আমার এই প্রস্থান হবে মর্মান্তিক আবার কারো জন্য হবে অতীব সুখের।

এদিনে সমস্ত সিডিউল মোতাবেক সব ঠিক থাকলেও আমার জন্য আর কেউ অপেক্ষা করবে না। প্রতিদিনের ব্যস্ততার ক্যালেন্ডারটি আর আগের মতো সরব হয়ে উঠবে না। ঘরির কাটায় কমবেশি হলেও তাতে কিছুই যাবে আসবে না আজ আমার, আজ আমার কোনো কিছুতেই তাড়াহুড়াও থাকবে না। সারাবিশ্ব যেইভাবে চলতেছিলো ঠিক আগের মতোই এ জগতের সব কিছুই চলবে। এক মুহূর্তের জন্যও দিনের সময়কাল পরিবর্তিত হবে না, না চাঁদ তার উদিত হবার বা ডুবে যাবার কোনো ব্যতিক্রমী নিদর্শন প্রকাশ করবে। না নদীর জোয়ার ভাটার কোনো দিক বা গতি পরিবর্তন হবে। না সুর্য এক সেকেন্ড পরে বা আগে উত্থিত হবে। পাখিরা সময় মতোই নিজের নীড় হতে খাদ্যানেসে বের হয়ে যাবে, রাখালগন তাদের গরূ বাছুর নিয়ে ভাটিয়ালী গান গাইতে গাইতে কোনো এক মেঠো পথে হারিয়ে যাবে। এমনটিই তো হয়ে এসছে বরাবর প্রতিটি মানুষের জীবন সায়াহ্নে।

যে সম্পদ আমি আমার সারাজীবন ধরে আহরন করেছি, যা প্রতিনিয়ত রক্ষা করবার জন্য চারিপাশে সতর্ক দ্রিস্টি দিয়া পাহাড়া দিয়াছি, তা ওইদিন অন্য কারো হাতে চলে যাবে। সেটা নিয়ে বা কে নিলো, কেনো নিলো এই নিয়ে আমার কোনো কিছুই করবার থাকবে না। আমাকে যারা কখনোই ভালোবাসে নাই, যারা আমাকে প্রতিনিয়ত কষ্টে দেখার পায়তারা করত, তাদের উদ্ধত চাহনী কিংবা দ্রিস্টিভঙ্গি আমাকে আর কোনোভাবেই আজ আহত করবে না। না আমি তাদের প্রতি কোনো ভ্রূক্ষেপ করবো। যে তর্কে জিতবার জন্য আমি খন্ড খন্ড যুক্তি প্রকাশ করে আত্মতৃপ্ত হয়ে হাসিমুখে চারিদিকে বীরের মতো চলমান থাকতাম, সেই তর্ক এখন আর আমার কোনো কিছুই আনন্দ দান করবে না। আমার প্রতিদিনের জরুরি মেইল কিংবা টেক্সট ম্যাসেজের প্রতি আমার আর কোনো তাড়াহুড়া থাকবে না। যাদের বিরুদ্ধে আমার কতইনা রিগ্রেটে ছিলো, জিদ ছিলো, প্রতিশোধের আগুনে যা আমি বহুকাল নিদ্রাবিহিন রাত কাটিয়ে দিয়েছি, সেটার আর কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখা দিবে না, না আমার মনের মধ্যে এইসবের কোন প্রভাব ফেলবে।

আমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে, আমার ওজন বেড়ে যাবে এই ভেবে আমার রোজকার দিনের খাদ্যাভ্যাসে কোন পরিবর্তন কিংবা আমার সাদা চুলে কালো করবার বাসনা এসব কিছুর আর কোনো প্রয়োজন হবে না, না এসব আমাকে আর বিচলিত করবে। আমার ব্যবসা, আমার সম্মান, আমার প্রতিপত্তি যার জন্য আমি প্রতিনিয়ত ভাবিয়া ভাবিয়া, নিদ্রাবিহিন কষ্ট করেছি, কিংবা কিভাবে কি করলে আমার সব কলেবর বৃদ্ধি হবে ইত্যাদির জন্য প্রানপন চেষ্টায় লিপ্ত ছিলাম, সেই ব্যবসা, সম্মান কিংবা প্রতিপত্তি আজ হতে রহিত হয়ে তা অন্যের হাত ধরেই চলতে থাকবে। ছোট কিংবা বড় যতো বড়ই অনুশোচনা হোক না কেনো, ক্লান্তি কিংবা কষ্ট যাই হোক না কেন, তাহা আজ আর কোন কিছুই আমাকে স্পর্শ করবে না। না আমাকে আর রাত জাগাইয়া তা নিয়া ভাববার কোন অবকাশ দিবে। জীবনের রহস্যময়তা, কিংবা মৃত্যুর উদাসিনতা যা আমার মন বহুবার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে, তা আজ এক নিমিষের মধ্যেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে। জীবন কি, মৃত্যু কি, জিবনের পরে মৃত্যুর কি গন্তব্য যা নিয়া আমি বহুবার তর্কে লিপ্ত হয়েছিলাম, যুক্তি খুজেছিলাম, আজ সব কিছুর সঠিক তথ্য আমার কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে। ঈশ্বর কি, ঈশ্বর আদৌ আছেন কিনা, ধর্ম কি, এ জগত কি, কিসের উপর এই বিশ্ব ভ্রমান্ড দাঁড়িয়ে আছে, কি তার রহস্য, কি তার পরিচালক, আমার জীবনের মুল কি উদ্দেশ্য ছিলো যার জন্য এই প্রিথিবীতে আসা, আজ সব কিছু আমার কাছে দিনের আলোর মতো ফকফকা হয়ে যাবে।

আমার অনেক অসমাপ্ত কাজ যা করবার জন্য আমি জল্পনাকল্পনা পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম, তা আজ সব কিছুর ইতি টানিয়া আমাকে নিয়ে যাবে কোনো এক সুদুর অজানা একস্থানে যা আমি এর আগে একবারের জন্যও বিচরন করি নাই।

আজ এই শান্ত শরীরে আমার চারিপাশের সবাইকে যেনো অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করতেছে কিন্তু আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়েছে, আমার কণ্ঠনালি রুদ্ধ হয়ে গেছে, আমার বাহু, আমার পা, আমার চোখ, আমার যাবতীয় ক্ষমতা আজ রহিত হয়ে একটি ছোট খাটিয়ায় আমি এমন করে পংগু বোবা হয়ে শুয়ে আছি যা অবশ্যই হবে বলে আমি একদা জানতাম কিন্তু ইহা যে আজই তা আমি কখনো মনে মনে কিংবা শারীরিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। অথচ আমার এই দিনের জন্য একবারের মতোও কি প্রস্তুতু নেয়া দরকার ছিল না? বা আমার কি কি করনীয় ছিলো সেই ব্যাপারে আমি কখনোই নিজেকে তৈরী করি নাই কেনো? যে সব সম্পত্তি, যশ, সম্পদ অথবা লোভ যাই বলি না কেনো, সেইসব  কারনে আজকের দিনের কোনো প্রুস্তুতি  আমার নেয়া হয় নাই, অথচ এইসব সম্পত্তি কিংবা সম্পদের বিনিময়েও আজ আমি এই পরিস্থিতি হইতে মুক্ত হতে পারছি না, পারবোও না।

যে ঘরটিতে একচ্ছত্র আমার অধিকার ছিলো, যার প্রতিটি কোনায় কোনায় আমার হাতের স্পর্শ, আমার পরিকল্পনায় গড়ে উঠেছিলো, তার থেকে আজ আমাকে বিচ্ছিন্ন করা হবে। যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে আমি জুতা মাড়িয়ে, সিগারেট ফুকে পায়ে দলিয়া পিছনে ফেলে ফেলকনি খাটে বসে আরাম করে বসতাম, আজ সেই ফেলকনি খাট আমার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে ওই জুতা মাড়ানো স্থানটিই আমার জন্য বরাদ্ধ হয়ে রয়েছে। আমি আমার নামটিও আজ হারিয়ে ফেলেছি। আমাকে আর কেহই আমার সেই প্রিয় নামটি ধরে, কিংবা আমার ছোট মেয়ের অতি আদরের ডাকটি ধরে আমাকে গলা জড়িয়ে সম্বোধন করবে না। আমি নিতান্তই একটি লাশের নামে পরিচিত হয়ে এই উজ্জ্বল নীলাকাশ সমৃদ্ধ প্রিথিবী হতে সবার আড়ালে চলে যাবো।

অফিসে যাবার প্রাক্কালে যে সুন্দরী বউটি বারবার জিজ্ঞাসা করত কখন আবার বাসায় ফিরবো, কিংবা আজ অফিস হতে ফিরতে দেরী হবে কিনা, অথবা বিদেশে যাত্রাকালে মেয়েদের এই আবদার, ওই আব্দারের লিস্ট সম্বলিত দাবীনামার মতো আজ আর কেহই আমাকে কিছুই জিজ্ঞেসা করবে না, কখন আবার বাসায় ফিরে আসবো, কিংবা কেহ আমার সাথে যাবার জন্যও বায়না ধরবে না। ইহা এমন এক যাত্রা যেথায় কেহই কাহারো সাথী হতে ইচ্ছুক নহে।

যারা আমাকে অনেক ভালোবেসেছে, আর যারা আমাকে ঘৃণা করেছে, তাদের উভয় পক্ষই আজ আমার এই শেষ যাত্রায় হয়ত শামিল হয়ে যার যার ভাবনায় লিপ্ত থাকবেন। পাড়া প্রতিবেশিরা অনেকেই বিলাপ করে, কেউ আবার ফিস ফিস করে কত অজানা তথ্য নিজ থেকে মনগড়া কাহিনী বলে আত্মতৃপ্তি পাবেন, যার প্রতিবাদ করার ক্ষমতা আমার আর থাকবে না। অনেক মনগড়া কাহিনী সুর আর তাল হয়ে বাতাসের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে আবার অনেক বীর বাহাদুরের মতো অনেক কল্পকাহিনীও তার সাথে মুখে মুখে প্রচারিত হবে, হয়ত তার কোনোটাই আমার প্রাপ্য নয়। মজার ব্যাপার হলো যে, দিনের আলো অন্যান্য দিনের মতোই সঠিক নিয়মে তার সিডিউল চলতে থাকবে, পাখিরা সন্ধ্যায় যার যার নীড়ে ফিরে আসবে, পথিক তার নিজ গন্তব্যে সঠিক সময়েই ঘরে ফিরে যাবে, শুধু আমার বেলায় আর কোনো কিছুই আগের মতো চলবে না। এক সময় সবাই আমাকে কাধে করে, ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে কোনো একস্থানে মাটির তলে পুতে এসে চা চক্রে লিপ্ত হবেন। এক সময় রাত ঘনিয়ে আসবে, চাঁদ উঠবে, হয়ত বৃষ্টিও হতে পারে। আমি বৃষ্টির পানিতে গলিয়া যাওয়া মাটির সাথে মিশিয়া একাকার হয়ে যাবো। তখন হয়ত কেউ টিভির সামনে বসে কোনো এক আনন্দঘন সিরিয়াল দেখতে দেখতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়বেন। আর আমি একা অন্ধকার একটি মাটির গর্তে সারা জীবিনের জন্য ঘুমিয়ে থাকবো। সময়ের আবর্তে এক সময় আমি যে ছিলাম এই পৃথিবীতে সেটা সবার মন এবং মস্তিস্ক থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। এটাই যদি হয় জীবন, তাহলে কিসের নেশায় আমি এতো মসগুল? সব কিছুই ভুল এই পৃথিবীর। একাই এসেছি, একা যাওয়ার জন্যই এসেছি। মাঝে যাদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, তারাও একাই এবং তারা আমার মতোই একদিন ভুলের ইতিহাসে বিলীন হয়ে যাবেন।  

আমি জানি আমি তোমাদেরকে আর কিছুই বলতে পারব না। যদি ইহাই হয়ে থাকে, তাহলে আজ আমার জীবনের শেষ বার্তাটুকু তোমাদের বলে যাই, আর ক্ষমা প্রার্থনা করি যে, যদি কারো মনে, অন্তরে, শরীরে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, স্বার্থের কারনে বা বিনা স্বার্থে আমার অগোচরে কোনদিন আঘাত করে থাকি, যদি আমার দ্বারা এমন কোনো কাজ হয়ে থাকে যা উচিত ছিলো না, যা অধিকার খর্ব হয়েছে বলে মনে হয়, কিংবা আমার দ্বারা জুলুম হয়েছে বলে মনে মনে অনেক অভিশাপ দিয়াছেন, আমাকে সবাই খাস হৃদয়ে অনুশোচনাপূর্বক ক্ষমা করে দিবেন। আমিও আপনাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম। আমি আমার দায়িত্ত কতটুকু পালন করতে পেরেছি,, সেই বিশ্লেষণ আমার উত্তরসুরী, আমার পরিবার, আমার সমাজের উপর। আমার পরিবার, আমার সমাজ আমাকে কতটুকু দিয়াছিলো সেই বিশ্লেষণ আমার কাছে আর নাই তবে আমি আপনাদের সহিত ভালো একটা সময় কাটিয়ে গেলাম এটাই আমার জন্য অনেক ছিলো। 

যুগে যুগে এই প্রিথিবীতে আমার মতো সব উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, রাজা বাদশা, হুজুর কামেল কিংবা দস্যু সবাই খালি হাতেই কেউ ভালবাসায় সিক্ত হয়ে কেউ আবার করুনার জল নিয়েই এই অসীম নীলাকাশ, গভীর সমুদ্র কিংবা পাহারের ঘন শ্যামল সুন্দর ছবি বুকেই নিয়া একাই সব ছেড়ে চলে গেছেন। এই শ্যামল ভালোবাসা, সম্পদ, সম্মান, কিংবা যশের জন্য কোনো রাজা, সম্রাট কিংবা শাসক কখনোই আর ফিরে আসে নাই। আমিও আর তোমাদের এই সমাজে ফিরবো না। তবে জায়গাটা ছেড়ে যেতে আজ আমার বড্ড মায়া আর কষ্ট হচ্ছে। ভালো থেকো তোমরা।

বদি ভাই-এখন তিনি ছবি

১৯৬৮ থেকে ২০১৮, মোট ৫০ বছর।

এই পঞ্চাশ বছরের আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের মধ্যে যে ব্যক্তিটি আমাদের পরিবারের কেউ না হয়েও পরিবারে সবচেয়ে বেশি ভুমিকা পালন করতে এক্যটু ও দ্নিবিধা করেন নাই, তিনি হচ্ছেন বদ্রুদ্দিন তালুকদার ওরফে বদি ভাই। আমার বয়স তখন মাত্র ১০ কি বারো যখন আমি প্রকৃত পক্ষে এই বদি ভাইকে জ্ঞ্যানের মাধ্যমে চিনি। কিন্তু তার আগে থেকেই এই বদি ভাই আমাদের পরিবারের সাথে যুক্ত ছিলেন।

আমার বাবা কবে কিভাবে কি কারনে মারা গেলেন তা আমার কোনো ধারনা নাই। আমার বয়স তখনহয়ত ২ কি আড়াই হয়ত হবে। আমার বাবা ছিলেন অনেক ধনি মানুস, মাদবর মানুস। সমাজে তার গ্রহনযোগ্যতা ছিল অনেক অনেক বেশি। কিন্তু তার শত্রুও ছিল অনেক। বিশেষ করে আমাদের পরিবারের ভিতরেই অনেক শত্রু ছিল। আর তারা হচ্যাছেন আমার সতালু ভাই বোনেরা। বিশেষ করে তাজির আলি নামে যে ভাইটি ছিলেন, সে ছিলো চারিত্রিকভাবে একজন খারাপ মানুষ।  যাই হোক। বাবা মারা যাবার পর আমাদের যাবতিয় জমিজমার আধিপত্যতা এক সপ্তাহের মধ্যেই হাতছাড়া হয়ে যায়। ফলে ক্যাশ টাকা না থাকায় আমাদের পরিবার অনেক সমস্যার মধ্যে পরে। আমার বড় ভাই সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ইউনিভারসিটিতে ভরতি হয়েছেন। ঢাকায় থাকার কোনো জায়গা নাই, মাথার উপর কোনো অভিভাবক নাই এবং তার মধ্যে পাচ বোন এক ভাই এর বোঝা তার উপর। কিভাবে সংসার চালাবেন, কোথা থেকে টাকা আসবে কিংবা নিজেই কিভাবে চলবেন এই চিন্তাই আমার ভাইকে অতিস্ট করে তুল্লো। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর ভাবছেন কি করা যায়, কিভাবে করা যায়।

এই সময় কোনো এক কাকতালিয় ভাবে দেখা হলো এই বদি ভাইয়ের সাথে। তার জীবনটাও এই একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কেটেছে অথবা কাটছে। ওনাকে আর পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করে বেশি বুঝাতে হয় নাই। বদি ভাই চাকুরি করেন ওয়াব্দা অফিসে মাত্র সেক্সন অফিসার হিসাবে। অল্প আয়, বিয়ে করেন নাই। তিনিও একইভাবে তার ভাই বোন মাকে সাপোর্ট করছেন। থাকেন তিনি ১২৪ নং আগাসাদেক রোড। ছোট্ট একটা রুম, তাতে ইতিমধ্যে তিনজন গাদাগদি করে কোনো রকমে থাকেন আর এক বুয়া প্রতিদিন দুপুর আর রাতের জন্য যত সামান্য বেতনে তাদের ভাত তরকারি পাক করে দেন। বদি ভাই হাবিব ভাইকে ওই ১২৪ নং আগাসাদেক রোডে নিয়ে এলেন। সবাই বদি ভাইকে ভাই বলেন না, সম্মানের সহিত তাকে সবাই স্যার বলেন।

যারা এই রুমে থাকেন, তারাসবাই গ্রাজুয়েট এবং জীবন যুদ্ধে লিপ্ত। একে অপরের জন্য যত টুকু দরকার সাপোর্ট করেন। সবার রোজগার যেনো কম্বাইন্ড রোজগার। একসাথে থাকে সব টাকা, যার যখন যত টুকু দরকার সে ততো টুকুই নেন। কিন্তু হিসাব থাকে। আমার মনে আছে ওই একটা ছোট রুম থেকে বদি ভাইয়ের তত্তাবধানে প্রায় ১০/১২ জন গ্রাজুয়েট বের হয়েছেন যারা পরবর্তী সময়ে দেশের শিরশ স্থানে বসেছিলেন। কেউ ইউনিভারসিটির অধ্যাপক, ডিন, কেউ আরো বড়। দেশে এবং বিদেশে।

এভাবেই বদি ভাই হয়ে উঠেন এক কিংবদন্তি স্যার। সব প্রোটেনশিয়াল মেধাবি হেল্পলেস মানুসগুলিকে বুদ্ধি, যতসামান্য চাকুরির পয়সা দিয়েই এইসব মানুসগুলিকে সাহাজ্য করেছেন। বদি ভাই তার চাকুরি জিবনে ডেপুটি ডাইরেক্টর পর্যন্ত উঠেছিলেন। ওয়াব্দায় চাকুরি করলে দুই নম্বরি করলে ছোট কেরানিও কোটিপতি হয়ে যায় কিন্তু বদি ভাই তার জিবনে দুই নম্বরিতো করেনই নাই, তার দ্বারা দুই নম্বরি হবে এটাও তিনি করতে দেন নাই। ফলে একটা সময় এইসব চোর বাটপারদের আমলে চাকুরির পদবির সামনে এগুতে পারেন নাই। অবসর নিয়ে বাসাতেই ছিলেন।

গ্রাজুয়েট মানুষগুলি তাদের যোগ্যতা অনুসারে ধীরে ধীরে সবাই বেশ ভালো ভালো জায়গায় সেটেল হয়ে গেছেন। সবার সাথেই বদি ভাইয়ের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু কাজের চাপেই হোক আর ব্যস্ততার কারনেই হোক ধীরে ধীরে এইসব যোগাযোগও কমে আসে। কিন্তু আমার ভাইয়ের সাথে অন্য একটি কারনে শেষ পর্যন্ত যোগাযোগটা ছিলই। আর সেটা হচ্ছে আমার মা। আমার ভাই যখন উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ গেলেন, তখন আমার মাকে দেখভাল করার কোনো লোকই ছিলো না। আর এর ই মধ্যে আমারো ক্যাডেট কলেজের সুযোগ হ ওয়ায় আমার পক্ষেও মাকে কোন অবস্থায় ই কিছুই করার সুযোগ ছিলো না। আমার মাকে বদি ভাই খুব ই ভালো বাস্তেন। নিজের মায়ের মতো করেই দেখতেন। আমার মায়ের জন্য কোনো কাজ করতে বদি ভাইয়ের কখনো ক্লান্ত হন নাই। 

আমি ধীরে ধীরে ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে ফেললাম, আর্মিতে গেলাম, আমি মাক্যের দায়িত্ত নিলাম। এই সময় বদি ভাই একটু অবসর পেলেন। ফলে এই দীর্ঘ প্রায় দেড় যোগ বদি ভাইয়ের সাথে আমাদের প্রয়োজনেই আমরা তার কাছ থেকে আলাদা হতে পারি নাই। এমন নয় যে বদি ভাইয়ের এখানে কোন স্বার্থ কাজ করেছে। হ্যা, একটা স্বার্থ কাজ করেছে অবশ্য ই। আর সেটা হচ্ছে, বদি ভাই ও তার ভাইদের থেকে অনেক আলাদা ছিলেন। তার পাশে কেউ আসলে ছিলো না। ঊনি ভাবতেন, আমি বা হাবিব ভাই বা আমরা ই তার আপন জন এবং আপদে বিপদে আমরাই তার পাশে আছি। কথাটা ঠিক। কিন্তু পরবর্তীতে যত টুকু আমাদের পাশে থাকার দরকার ছিলো, আমরা আসলে ততো টুকু পাশে থাকতে পারি নাই। এর কারনও হচ্ছে আমাদের বুঝাপড়ার তফাত। হয়ত এটাই এই স্বার্থপর পৃথিবীর নিষ্ঠুর নিয়মের একটি। 

বদি ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম মনোমালিন্য টা হয় আমার বিয়ে নিয়ে। এটা মানতে মানতে আমাদের মধ্যে একটা বিস্তর গ্যাপের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো। কখনো নরমাল, কখনো আধা নরমাল, আবার কখনো মনে হয়েছে সব ঠিকই আছে। আরেকটা কারন ছিলো যে, হাবীব ভাইয়ের প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল মানসিকতা। একবার এটা বলেন তো আরেকবার তার সিদ্ধান্ত বদলে অন্য আরেকটি বলা বা আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে যাওয়া। এইরুপ একটা পরিস্থিতিতে বদি ভাইও আর হাবীব ভাইয়ের ইপর নির্ভর করতে পারছিলেন না। 

একটা সময় চলে এসেছিল যে, আমরা যে যার যার মতো করেই চলছিলাম। ব্যাপারটা এমন হয়ে গিয়েছিলো যে, সাভাবিক অন্য দশ জনের সাথে আমরা যেভাবে চলি, ঠিক সেভাবেই চলছিলাম। সম্পর্ক খারাপ নয় কিন্তু আমরা খুব ঘনিস্ট কেউ আমরা। হাবীব ভাই বদি ভাইকে সব সময় ই শ্রদ্ধা করতেন এবং শেষ পর্যন্ত শ্রদ্ধাই করতেন। কিন্তু বদি ভাইয়ের জন্য হাবীব ভাইয়ের আরো অনেক কিছুই করার ছিলো। সেটা হয়ত হয় নাই। 

আজ বদি ভাইয়ের মৃত্যুতে একটা বড় অধ্যায় শেষ হলো। আমি তাকে মিস করবো সব সময়। যত কষ্টেই তিনি থাকতেন না কেনো, আমি যখন বদি ভাইয়ের কাছে যেতাম, আমি দেখতাম, তার মধ্যে একটা জীবনী শক্তি ফিরে আসতো। অনেক কথা বলতেন। অতীতের কথা, তার সাফল্যের কথা, তার দুঃখের কথা। আমিও শুনতাম। আজ আর তিনি নেই। তাকে আল্লাহ বেহেস্ত নসীব করুন। 

ভিন্ন প্রসঙ্গ–সবার জন্য 

একটা জিনিষ ইদানিং খুব বেশী করে অনুভুত হয় যে, জীবনের সব অধ্যায় এক রকম নয়।  এটা আমার হয়ত বুঝতে দেরী হয়েছে কিন্তু এই সব তত্ত্বকথা মনিষীরা যুগে যুগে বলে গেছেন। মনিষীরা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক তত্ত্বকথাই বলে গেছেন বটে কিন্তু কেউ সে সব তত্ত্বকথা মানে না। হ্যা, মানে তখন যখন কারো জন্য সেসব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং নিজেদের জন্য প্রযোজ্য হয়। সেই সুবাদেই বলছি যে, আমি আপনি ততোক্ষন সবার কাছে যত্নশীল যতোক্ষন আপনি নিঃস্বার্থভাবে দিতে পারবেন কিন্তু পাওয়ার আশা করবেন না। আশা করলে আপনি হেরে যাবেন। এটা নিজের স্ত্রী থেকে শুরু করে সন্তান, পাড়াপ্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবার বেলায় প্রযোজ্য। কেউ মানুক বা না মানুক, এটাই সত্য।

এর থেকে যে শিক্ষাগুলি নেওয়া দরকার তা হচ্ছে,যা কিছু করবেন জীবনে, নিজের জন্য করুন, নিজে সুখী সময় কাটানোর জন্য আয় করুন এবং তা দুইহাত ভরে খরচ করুন। আপনার অনুপস্থিতিতে আপনার সন্তানগন কিভাবে চলবে কিংবা তারা কোথায় কিভাবে বাস করবে তা আপনার চিন্তা থাকতে পারে বটে কিন্তু তারজন্য অনেক কিছু আয় করে সঞ্চয় করে তাকে পঙ্গু করে রেখে যাওয়ার কোনো দরকার আমি মনে করি না। বরং তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দিন, তাতেই সে এই পৃথিবীর কোনো না কোনো স্থানে ঠাই করে নেবে। এই পৃথিবী পরিশ্রমী মানুষের জন্য সুখের আবাস্থল। অলসদের জন্য এখানে সব কিছুই নাগালের বাইরে।  পূর্ব বর্তি জেনারেশনের আহরিত সম্পত্তি উত্তরসূরিদের জন্য কিছুটা আরামদায়ক হলেও একটা সময় আসে, কোনো না কোনো উত্তরসুরীর মাধ্যমেই তা বিনাশ হয়। এই বিনাশ টা হয়ত এক জেনারেশনের মধ্যে ঘটে না। কারো কারো বেলায় এক জেনারেশনেই শেষ হয়ে যায় আবার কারো কারো বেলায় এটা ক্ষয় হতে কয়েক জেনারেশন পার হয়। কিন্তু ক্ষয় হবেই। এর প্রধান কারন, যিনি সম্পদ করলেন, তার যে দরদ, আর যারা বিনা পরিশ্রমে পেলো তাদের দরদ এক নয়। আরেক টা কারনে নস্ট হয়। তারা হলেন যাদের বংশ ধরের মধ্যে ছেলে রি-প্রেজেন্টেটিভ নাই। ওই সব লোকের বেলায় তাদের কস্ট করা সম্পত্তি নিজের ছেলে সন্তানের পরিবর্তে চলে যায় অন্য বাড়ির আরেক ছেলের হাতে যিন সম্পদের মালিকের নিছক মেয়ের স্বামী। এরা দ্রুত সম্পদ হাত ছাড়া করে কারন তারা একদিকে এতাকে ফাও মনে করে, অন্যদিকে যতো দ্রুত সম্ভব সব সম্পত্তিকে নিজের নামে রুপান্তরিত করতে চায়।

যেহেতু আপনি পরিশ্রম করছেন, সুখটা আপনিই করুন। যদি ভাবেন যে, আগে সঞ্চয় করে স্তূপ করি, বাড়ী গাড়ি করি, ব্যাংকে একটা মোটা টাকা সঞ্চয় হোক তাহলে আপনার হাতে একটু সময়ও নেই সকালের সূর্য দেখার অথবা রাতের জ্যোৎস্না দেখার। আপনার ভাগ্যে আছে শুধু বাদরের মতো এই স্থান থেকে অন্য স্থানে লাফিয়ে লাফিয়ে কোথায় ফল পাওয়া যায় তার সন্ধান করা, অথবা পালের বলদের মতো সারাজীবন হাল চাষের মতো চাষির হাল বেয়ে যাওয়া যাতে চাষিই শুধু লাভবান হয়, আর নিজে শুধু জাবর কাটবেন।

এ কথাগুলি কেনো বলছি?

আমার চোখে দেখা এই ছোট্ট জীবনে অনেক ঘটনা। কস্ট করে সম্পত্তি বা এসেট রেখে গেছেন, কিংবা ব্যবসা রেখে গেছেন, জাস্ট তার মরনের পর ওই সব সম্পত্তি কত তাড়াতাড়ি ভাগাভাগি করে নিজেদের মধ্যে নিয়ে নেয়া যায়, তার জন্য তর সয় না। অথচ ওই সব উত্তরসুরীরা এক্টিবার ও তার রুহের মাগ ফিরাত বা ধর্মীয় কোনো উৎসবের একটু ও পয়সা খরচ করতে চায় না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তারাও সেই এক ই ফাদে পা দিয়ে তাদের উত্তরসুরীদের জন্য ই সঞ্চয় করে জমা করে যান এবং নিজেরা ভোগ করেন না।

   

অপ্রিয় সত্যের মুখুমুখি দাঁড়ানো সাহসের প্রয়োজন

কখনো যদি তোমরা দেখো যে, তোমার অপ্রিয় সত্য কথায় কেউ কোনো উত্তর করছে না, কিন্তু তোমার অগোচরে মুখ ভেটকাচ্ছে, তাহলে বুঝবে যে, তোমার আশপাশ চাটুকারে ভরে গেছে। তুমি বিপদের মধ্যে আছো।  এ অবস্থায় তোমার যা করনীয়, তা হচ্ছে, তুমি একা চলার অভ্যাস করো। এই একা চলার মধ্যে যদি কাউকে রাখতে চাও সাথে, তাহলে এমন কিছু মানুষকে রাখো যারা প্রাইমারী স্কুলের দরিদ্র শিক্ষক। তারা নীতি থেকে বিচ্যুত হয় না আর হবেও না। 

আগামিকালটা কত দিনের?

অনেকেই বলেন, ঈশ্বর বড় উদাসীন। আসলেই কি তিনি উদাসিন? না, তিনি উদাসিন নন। তিনি তার কাজ ঠিক সময় মত করেন, তার কোন কিছুই ঊলট পালট নয়, ঊনি আমগাছে জাম ফল দেন না, কিংবা কাঁঠাল গাছে আনারস ফলান না। বৈশাখ মাসে তিনি কনকনে শীত প্রচলন করেন না, আবার কড়া ভর চৈত্র মাসে তিনি শীতের প্রবাহ করান না। তারপরেও আমরা তাকে অনেক সময় কোন কিছুই বিবেচনা না করে বলে থাকি, ঈশ্বর বড় উদাসিন, ওনি উদাসীন শুধু তাঁর বিশ্বকে নিয়ে। কিন্তু কখনো আমরা নিজেকে প্রশ্ন করি না, আমরা কি উদাসিন? আর আমরা উদাসীন আমাদের অতিত নিয়ে। কেউ অতিত নিয়ে ভাবতে চাইনা, ভাবি শুধু আগামিকালের কথা। কিন্তু এই আগামিকালটা কত দিনের?

গত সপ্তাহে আমি একটি পার্টিতে গিয়েছিলাম বেরাতে। অনেক নামিদামি মানুষজন এসেছিল। কেউ সচিব, কেউ পুলিশের বড় কর্মকর্তা, কেউ আবার ব্যবসায়ী, আবার কেউ সাধারন মানুসদের মধ্যে অনেকে। তাহলে এখন আবার প্রশ্ন করে বসবে, সাধারন মানুষ আর ঐ ক্লাসিফাইড ব্যক্তিগুলোর মধ্যে পার্থক্য কি? ব্যবসায়ী কি সাধারন মানুসের মধ্যে পরে না? কিংবা পুলিশের বড়কর্তা, সচিব ইত্যাদি মানুষগুলো কি সাধারন মানুষ নয়? আমার কাছে এর উত্তর একদম সহজ এবং সরল। না, ওরা সাধারন মানুসের মধ্যে পরে না। তাঁদের সমাজ আলাদা, কথাবার্তা আলাদা, লাইফ স্টাইল আলাদা। সাধারন মানুসের জীবন আর তাঁদের জীবন এক কাতারে পরে না। একজন সাধারন মানুষ তাঁর অপকর্মের কথা ফাস হয়ে গেলে তাঁর আর জীবনের মুল্য থাকে না। সে কোন অন্যায় কাজ করে ফেললে প্রতিনিয়ত তাঁর ভিতরে একটা অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে, সে নিজে নিজে একা একা দহিত হতে থাকে, লোক লজ্জার ভয়ে কেমন যেন নিজের মধ্যে সুপ্ত হয়ে থাকে, আর তাতেই সে অসুস্থ হয়ে জীবননাস হতে পারে। কিন্তু ঐ ক্লাসিফাইড লোকগুলো খুব স্পস্টবাদি, তারা তাঁদের অনেক অপকর্ম প্রকাশ্যে একে অন্যের সঙ্গে খুব সহজেই শেয়ার করে। মাঝে মাঝে ঐ অপকর্মগুলো একটা গুনের বহিরপ্রকাশ হিসাবেও নিজেদের অহংকার হিসাবে ধরে নেয়। এই যেমন, একজন আইনজ্ঞ সাহেব সেদিন পার্টিতে খুব ফলাও করে বলছিলেন, তিনি প্রতিদিন প্রায় লক্ষ টাকার উপর আয় করেন। আমি তাকে খুব ভাল করে চিনি না। আমার একবন্ধু তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বললেন, বন্ধু, ওনি হচ্ছেন ডিস্ট্রিক্ট জজ লুতফুল কবির। খুব মাই ডিয়ার লোক। অনেক পয়সার মালিক। ধান্মন্ডিতে দুটু বাড়ি আছে, সাভারে কয়েক একর জমি আছে, নিজের জন্য একটা গাড়ি, বউয়ের জন্য একখান গাড়ি। আশুলিয়ায় প্লট কিনেছেন দশটার উপরে। সব ক্যাশ টাকা দিয়ে। আল্লাহ তাকে তিনখান বাচ্চা দিয়েছেন। দুইজন তো খুব ভাল করছে পরাশুনায়। অনেক মানুষের উপকার করেন তিনি, সমাজে বেশ দান খয়রাত করেন, শুধু তাই নয়, তিনি আগামিতে এমপি ইলেকশনেও দাঁড়াবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঝখানে ১/১১ তে খামাকা দুদক তাকে অনেক হয়রানি করেছিল। আয় বহির্ভূত নাকি অনেক আয়ের তিনি বৈধ না হওয়ায় প্রায় মাস খানেক এদিক সেদিক থাকতে হয়েছিল। আইনজীবী হয়েও আইনের পাল্লায় পরে গিয়েছিলেন। তবে ওটা বেশিদিন লুতফুল ভাই জিইয়ে রাখেন নাই। একেবারে মাল পানি ঢেলে বীজ উপড়ে ফেলেছেন। এখন একদম ক্লিন আমাদের এই লুতফুল ভাই।

শুনে আমার খুব ভাল লাগলো। পরিচয় হয়ে আমারও খুব ভাল লাগলো। তিনিও মনে হল আমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে প্রীত হলেন। একসময় কফি খেতে খেতে বললাম, আইন ব্যবসা ছাড়া আর কোন ব্যবসা করেন নাকি লুতফল ভাই? তিনি অত্যন্ত মৃদু ভাষায় বললেন, না ভাই, এই একটার জন্য সময় দিতে গিয়েই হিমশিম খাচ্ছি, আবার অন্য ব্যবসা কেমন করে করি? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করল, তাহলে আপনি প্রতিদিন কি এমন করেন যে, প্রায় এক লাখ টাকার আয় হয়?

লুতফুল সাহেব ভাল মানুষ। ওনি কথা বলেন সরাসরি। কোন রাখঢাক নাই। বললেন, আমার কোর্টে আমি কাউকে জামিন দেই না। সে যেই মামলাই হোক। “বেলএব্যাল” কেস হলেও আমি জনা প্রতি বিশ হাজার আর হেভি টার্গেট হলে তো কথাই নাই। খাসা পাঁচ লাখ। মাসে সব মিলিয়ে গরপরতা ত্রিশ পয়ত্রিশ লাখ টাকা থাকে। ভাই, নিবই যখন, তখন আর রাখঢাক করে লাভ কি? মাঝে মাঝে কিছু মিথ্যা কেস কেউ কেউ নিয়া আসে। আমি বুঝতে পারি। ঐ কেসগুলোর জন্য পয়সা বেশী পাওয়া যায়। সবসময় ওগুলো পাওয়া যায় না, তবে একবার পেলে সোনারখনি হাতে পাওয়ার মত। ঝুলিয়ে রাখবেন, আবার পয়সা নিবেন। পয়সা দিবে না? কোন অসুবিধা নাই। অপোজিট পার্টিকে  হাত করে ফেলার একটা হুমকি দিয়ে রাখবেন। জানেন ভাই, মানুসের একটা দুর্বল পয়েন্ট আছে, তারা হুজুরদেরকে বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করে আর করে এই আইনজীবী লোকদেরকে। ডাক্তারকেও তারা এতটা বিশ্বাস করে না। আর এই দুর্বলতার সুযোগটাই আমরা অনেকে নেই। এটা তো আমার কাজ, তাই না ভাই? ঘুস তো আর খাই না, আমি মুজুরি নেই। কাজের মুজুরি। এতে তো আর দোষের কিছু নাই।

ঠিক কথা বলেছেন লুতফুল সাহেব। নেবেনই যখন, তখন আর রাখঢাক করে লাভ কি? আর ওনি তো কাজের মুজুরি নিচ্ছেন। আর সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের জায়গা তো একটাই, আদালত। আর এই আদালতেই তো তিনি কাজ করেন। অন্যায় যে করে আর সত্যের পথে যে আছে, তাঁদের মধ্যে বিবাদ হলে তো দু পক্ষেরই আইনজীবী লাগবে। লুতফুল সাহেব কেসটা না নিলে তো আরেকজন নিবেই। তাহলে ওনার নিতে অসুবিধা কই?

অনেক কথা হল লুতফুল ভাইয়ের সঙ্গে। আমার মনে হল, লুতফুল ভাই যে মানসিকতায় বেড়ে উঠছেন, আর যে উপলব্ধি থেকে সমাজে তিনি আজ অনেক বড় একজন বিত্তশালি হয়ে উঠছেন, তাঁর অনেক গলদ রয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর চারিপাশের কোন বন্ধু, বা আত্মীয়সজন, কিংবা সহকর্মী কিংবা তাঁর খুব কাছে কোন লোক কেউ তাকে শুধরানোর পথ বলে দিচ্ছেন না। একটা সময় আসে, যখন পয়সা মানুসের জিবনে সৎ উপদেশের পথ রুদ্ধ করে দেয়। তখন শুধু চাটুকারদের দল কাছে ভিরে তাকে আরও গভির থেকে গভিরে নিয়ে যায় যেখান থেকে ফিরবার আর কোন পথ থাকে না। লুতফুল সাহেবের অবস্থা দেখে আমার তাই মনে হল।

পার্টি প্রায় শেষ। আরেক কাপ কফি খাচ্ছি আমরা সবাই মিলে। আমি লুতফুল ভাইকে কফি খেতে খেতে বললাম, লুতফুল ভাই, একটা প্রশ্ন করি?

ওনি মাই ডিয়ার লোক, বললেন, আরে ভাই, করেন না, করেন। যদি বলেন কি রঙের আন্ডারওয়ার পরে এসছি, সেটাও বলে দেব। খালি জিজ্ঞেস করে দেখেন না…… বড় মজার লোক।

বললাম, লুতফুল ভাই, আজ থেকে ৫০০ বছর আগের আপনার বংশের কারো নাম জানেন?

প্রশ্ন শুনে ওনি এমন করে হেসে উঠলেন যে তাঁর হাতে থাকা কফি কাপটা প্রায় আমার উপর পরতে যাচ্ছিল আর কি। হাসতে হাসতেই বললেন, কি করে সম্ভব আখতার ভাই যে ৫০০ বছর আগের বংশের কারো নাম মনে রাখা? আপনি কি বলতে পারবেন ৫০০ বছর আগের কারো নাম?

বললাম, আমার প্রশ্নটা শেষ হয় নাই লুতফুল ভাই। ওনি আমার কথার আওয়াজ শুনে গম্ভির হয়ে গিয়ে আবার প্রশ্ন শুনতে চাইলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, থাক, ৫০০ বছর দরকার নাই, ৪০০ বছর আগের কেউ? বা ৩০০ বছরের আগের কেউ, অথবা ২০০ বছর আগের কেউ? কারো কথা কি আপনার মনে আছে?

এবার তিনি হাসলেন না। বললেন, না আখতার ভাই, ঐ অতো বছর আগের ফ্যামিলির কারো নামই আমি জানি না। তবে আমার দাদার বাবার নাম আমার জানা আছে। ওনি প্রায় আজ থেকে ৬০ বছর আগে মারা গেছেন।

আমি কফিতে চুমু দিতে দিতে বললাম, তাঁর মানে প্রায় ৬০ বছর আগের ইতিহাস। কিছুটা এখনো জেগে আছে। আচ্ছা লুতফুল ভাই, আজ থেকে ২০০ বছর পরে তাহলে কেউ কি আপনার কথা মনে রাখবে? বা ৩০০ বছর পর? অথবা ৪০০ বছর পর? আজ আমি আপনে এবং সবাই যে এমন একটা চাঁদনী রাতে কি মজা করে কফি খাচ্ছি, কত সুন্দর টাই-স্যুট পরে এখানে সমাবেশ করছি, এই কি বিশাল সুন্দর বিল্ডিং করেছি, এসি গাড়িতে চরছি, এর কোন কথাই কেউ জানবে না বা মনে রাখবে না আজ থেকে ১০০ বছর পরে। লুতফুল সাহেব খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শুনছিলেন বটে কিন্তু ওনার যে মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমি বুঝতে পারছিলাম।

আমি বলতে থাকলাম, “অথচ জানেন লুতফুল ভাই, আপনার আমার মরার ৫০০ বছর পরেও আমাদের রেখে যাওয়া এই সাভারের জমি, ধানমণ্ডির বাড়ি, আশুলিয়ার প্লট এইসব নিয়ে আমাদের সব পর্যায়ের জেনারেশনরা একে একে দাবিদার হয়ে মারামারিও করতে পারে। কিন্তু কেউ ঐ সম্পত্তি বিক্রি করে বা তাঁর একটা আয় থেকে কখনও আমাদের আত্তার মাগফেরাত কামনা করে একবেলা মিলাদ পরাবে কিনা সন্দেহ আছে। আয় করে যাবেন আপনি, এর সব দায়দায়িত্ব (ন্যায় পথে অথবা অন্যায় পথে আয় যাই হোক না কেন) আপনার, অথচ, আপনার কোন কাজেই তা লাগবে না। তাহলে এই সম্পত্তির কি ভ্যালু আছে? কার জন্যে রেখে যাচ্ছেন এই দায় দায়িত্ব?

লুতফুল ভাই এতক্ষন চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন। মনে হল তিনি এখন কিছুটা অসস্থিবোধ করছেন। ওনার হাতে ধরা কফির কাপটায় যে কফিগুলো এতক্ষন গরম একটা সুগন্ধি ছরাচ্ছিল, এখন তা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

আমি আমার কথা চালিয়ে যেতে লাগলাম।

এই দেখেন লুতফুল ভাই, সামান্য এক কড়া শাসক নামে পরিচিত ১/১১ এর সরকার। তাঁর কাছেই আমরা আমাদের সম্পদের হিসাব সম্পূর্ণ তুলে ধরতে না পারার কারনে কতই না এদিক সেদিক পালিয়ে বেড়ানো। হয়ত ঘুষ পয়সা দিয়ে আপাতত ম্যানেজ করা গেছে। সামান্য এক কেয়ার টেকার সরকারের কাছেই আমরা আমাদের সত্যকারের হিসাবটা দিতে হিমশিম খাচ্ছি। আর এই বিশাল জগতের যিনি মালিক, যার আওতার বাইরে যাওয়ার আমাদের কোন শক্তি নাই, যিনি কোন টাকা-পয়সা, ক্ষমতা বা এই জাতিয় কিছুই পরোয়া করেন না, তাঁর কাছ থেকে আমাদের এই অঢেল দুই নম্বরি সম্পত্তির হিসাব কিভাবে দেব? আর এই সম্পত্তির হিসাব শুধু আমাকে আপনাকেই দিতে হবে। এর জন্য আমার কোন উত্তরসুরি, আমার কোন প্রিয় মানুষ তাঁর উত্তরের জন্য বা জবাব্দিহিতার জন্য দায়ি নন। যদি তাইই হয়, তাহলে কি আমার আজকের এই বাহাদুরি করে করা সম্পদ আমার জন্য কোন সুখের বিষয়? আমি তো এগুলোর এক কানাকড়িও সঙ্গে নিতে পারব না!! প্লট পরে থাকবে আশুলিয়ায়, জমি পরে থাকবে সাভারে, ধান্মন্ডির বাসায় আমার লাশটা শুধু গ্যারেজের মধ্যে একদিন রেখেই পুতে দেওয়া হবে ঐ জঙ্গলটায় যেখানে আমি এখন ভুলেও পা রাখি না।

লুতফুল ভাই কোন কিছুই বললেন না। রাত অনেক হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরতে হবে। আমরা যার যার কাছে বলে কয়ে যার যার বাড়ি ফিরে এলাম। লুতফুল ভাই আমার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে আমার সাথে হাত মেলালেন। কোন কথা বললেন না। শুধু বললেন, আমার ছোট মেয়েটার জন্য দোয়া করবেন। ও ক্যান্সারে ভুগছে।

তাঁর এই ছোট মেয়ের ক্যান্সারের কথা তা আমি আগে জানতে পারিনি। আমার বন্ধুটিও বলে নাই। আর জানলেও হয়ত এটা নিয়ে আমি কোন কথা বলতাম না। কিন্তু, আমার কেন যেনো মনে হল লুতফুল ভাই যদি আজ সৎ মনে সৎ রোজগারে সৎ পথে ঈশ্বরকে ডেকে বলতে পারতেন, হে ঈশ্বর, আমি তো তোমার কোন আদেশ অমান্য করি না, আমি তো তোমার দেওয়া হালাল রিজিক খাই, আমি তো কোন অন্যায় পথে আমার রিজিক উপার্জন করি না, আমি তোমার সব আদেশ, নিষেধ যেভাবে পালন করতে বলেছ, সেভাবেই করছি, তাহলে তুমি আমার এই ছোট মেয়ের ক্যান্সার দিয়ে আমার মনকে এতটা উতলা করে দিলে কেন? কেন তুমি আমার নিস্পাপ এই ছোট আদরের মেয়েটিকে তুমি এমনভাবে কষ্ট দিচ্ছ যার ভার আমি বহন করতে পারছি না? তুমি তো সবচেয়ে বড় ইন্সাফ কর্তা, তুমি তো সবচেয়ে বেশী আছানদাতা, তাহলে তুমি আমাকে কেন এই রকম একটা কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছ?

কিন্তু আজ লুতফুল ভাই হয়ত সেই ঈশ্বরের কাছে কিছুই বলতে পারবেন না। কারন ঈশ্বর তাকে যা যা করতে বলেছেন, তাঁর অনেক ন্যায় কাজই লুতফুল সাহেব করেননি। ঈশ্বরের সাথে তর্ক করবার সাহস আজ লুতফুল সাহেব হারিয়েছেন। তারপরেও হয়ত আমি বলতে পারতাম, লুতফুল ভাই, হয়তোবা সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। আপনি ঈশ্বরের কাছে দেখা করুন। তাঁর দেখা পাওয়ার রাস্তা তিনি বাতলে দিয়েছেন অনেক আগেই। লুতফুল সাহেবের জন্য সময় এখনো হাতে আছে যদি তিনি তাঁর ঈশ্বরের কাছে আবার নতজানু হয়ে সব অবৈধ সম্পদ ত্যাগ করে পুনরায় ঈশ্বরকে সাহায্য করতে বলেন, হয়তা তাঁর ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করে দিয়ে সব শান্তির মত আরামদায়ক করে দেবেন। কতটা আরামদায়ক করবেন, সেটা নির্ভর করে এখন লুতফুল সাহেব কতটা আত্মসমর্পণ করেন ঈশ্বরের কাছে তাঁর উপর। ঈশ্বর খুবই দয়াশিল এবং ক্ষমাশিল। তিনি উদাসীন নন।

আমার খালা

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব 

২০২১

তারিখ 

সামিদা খাতুন

স্বামীঃ আব্দুল গনি মাদবর

তিনি আমার একমাত্র আপন ফার্স্ট জেনারেশন খালা। আমার মায়ের একমাত্র আপন বোন যাকে আমার মা বোন মনে করেন নাই, করেছেন নিজের মায়ের মতো। আমার খালার সাথে কারো কোন বিবাদ হয়েছে এই রেকর্ড সারা গ্রামের মধ্যে নাই। তিনি অত্যান্ত প্রতাপ্সহালী গনি মাদবরের স্ত্রী। এখানে বলা দরকার যে, গনি মাদবরকে ভয় পায় না এমন কন লক আমাদের গ্রামের মধ্যে ছিলো না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তিনি সন্ত্রাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যান্ত ন্যা পরায়ন একজন মাদবর। খুব বুদ্ধিমান। অত্যান্ত অহংকারী এবং একটা ইগো নিয়ে চলতেন। 

আমার খালা শেষ বয়সে কুজো হয়ে হাটতেন। যখন ই শুনেছেন যে, আমি শহর থেকে গ্রামে গিয়েছি, তখনি তিনি কস্ট হলেও খুব সকালে আমাকে দেখার জন্য আমাদের বাড়িতে চলে আসতেন। আমার খালা ও কোন ছবি নাই কিন্তু কোন একদিন আমার ছোট ক্যামেরা দিয়ে একটি মাত্র ছবি তুলেছিলাম যা আমার কাছে একটা অমুল্য রতনের মতো মনে হয় এখন। 

আমার খালা যেদিন মারা যান, আমি এই খবরটা জানতেও পারি নাই। অনেকদিন পর যখন আমি গ্রামের বাড়িতে গেছি, খালার সম্পরকে জানতে চেয়েছি, শুনলাম যে, আমার খালা মারা গেছেন। আমার খুব আফসোস লেগেছিলো। 

আমার খালার ভাগ্য ভালো যে, ঊনি অনেক কস্টে পরার আগেই জান্নাতবাসী হয়েছেন। আমি মাঝে মাঝে খালাকে গোপনে কিছু টাকা দিতাম কিন্তু যেহেতু তিনি নিজে কোনো কিছু কিনতে পারতেন না, ফলে ঊনি টাকা দিয়েও তার মনের মতো কোন কিছু কিনে খেতে পারতেন না। এর আগেই তার অন্যান্য নাতি পুতেরা তার হাতের টাকাগুলি কোনো না কোনো ভাবে ছিনিয়ে নিতেন। বড্ড নিরীহ মানুষ বলে কারো উপর তার কমপ্লেইনও ছিলো না। খুব নামাজি মানুষ ছিলেন আমার খালা। তার কোন ছেলেরাই তাকে ঠিক মতো ভরন পোষণ করার দায়িত্ত নেন নাই। এক সময়ের প্রতাপ্সহালি মাদবরের স্ত্রী শেষ জীবনে কস্টের মধ্যেই জীবন তা অতিবাহিত করছিলেন কিন্তু আমাদের কিছু সাহাজ্য আর তার নিজের স্বামীর যেটুকু আয় ছিলো তার উপর নির্ভর করেই শেষ জীবন তা অতিবাহিত করেছেন। 

জেবুন্নেসা চৌধুরী (আমার শাসুড়ী)

Categories

তিনি আমার শাশুড়ি। মোট আট মেয়ে আর তিন ছেলের সার্থক মা। অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ। আমার কাছে তিনি আমার আপন মায়ের মতোই ছিলেন। আমার মাকে আর আমার এই শাশুড়িকে আমি কনোদিনই পার্থক্য করি নাই। তিনি আমাকে প্রতি ঈদে ১০ টাকার সালামি দিতেন। কি যে ভালো লাগতো ঊনার কাছ থেকে এই ১০টাকা সালামি নিতে।

চলবে…

আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী

Categories

আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী

তিনি আমার শ্বশুর।

আমি আমার শ্বশুর কেও জীবিত অবস্থায় দেখি নাই। আমার স্ত্রী যখন অষ্টম ক্লাসে পড়ে, তখন তার বাবা মারা যান। আমি যখন আমার স্ত্রীকে বিয়ে করি, তখন আমার স্ত্রী সবে মাত্র ইন্তারমিডিয়েট পাশ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির তোড়জোর করছেন। ফলে আমার বিয়ে হবার প্রায় ৪/৫ বছর আগে আমার শ্বশুর মারা যান। আমার শ্বশুরের প্রাথমিক তথ্য গুলি এ রকমেরঃ

নামঃ আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী

পিতাঃ সোনাম উদ্দিন চৌধুরী (সোনাম উদ্দিন চৌধুরীর পিতার নাম ছিল, ফাজেল আহম্মদ চৌধুরী)

স্ত্রীর নামঃ জেবুন্নেসা চৌধুরী

আমার শ্বশুরের ছিল আট কন্যা সন্তান এবং তিন পুত্র সন্তান।

আমার স্ত্রী ছিলো তাদের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ।

তাদের ওয়ারিশ নামা যদি লিখি তাহলে দাঁড়ায় এ রকমেরঃ

৪/৪/২০২১-রিভার সাইডের ইতিকথা

সনটা ছিলো ২০০৪। 

তখন মীরপুর সেনানীবাসে ৪ ফিন্ড আর্টিলারিতে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে কর্মরত আছি।  আমার প্রমোশন হবার কথা মেজর থেকে লেফটেনেন্ট কর্নেল পদে। কিন্তু মামুলি একটা কারন দেখিয়ে তারা আমাকে প্রমোশন দিলো না। স্টাফ কলেজ করেছি, গানারী স্টাফ করেছি, ডিভ লেভেলে জিএসও -২ (অপারেসন) হিসাবে কাজ করেছি, আর্মি হেড কোয়ার্টারে ও জি এস ও-২ হিসাবে কাজ করেছি। প্রমোশনের জন্য কোনো প্রকার কমতি আমার নাই। কিন্তু তারপরেও আমাকে প্রমোশন না দিয়ে আমার জুনিয়র ১৪ লং কোর্সের মেজর মজিস, যে কিনা ক্যাটেগরি-সি , স্টাফ কলেজ ও করে নাই, গানারী স্টাফ ও করে নাই, সে আমার বদলে প্রমোশন পেয়ে ৪ ফিল্ডে পোস্টিং এসেছে। এটা শুধু মাত্র সে খালেদা জিয়ার সাথে কোনো না কোন ভাবে পরিচিত। শোনা যায় যে, মজিদের বাবা খালেদা জিয়ার বাসায় নাকি মালীর কাজ করতো। আর সে সুবাদেই এই নেপোটিজম। এর কোনো মানে হয়? সিদ্ধান্ত নিলাম, এপেন্ডিক্স-জে (ইচ্ছেকৃতভাবে অবসর নেওয়া) দিয়ে আর্মি থেকে চলে যাবো।  সাথে সাথে এটাও ভাব লাম যে, বাইরে গিয়ে কোনো চাকুরী ও করবো না। কিন্তু কি ব্যবসা করবো সেটা তো কখনো শিখি নাই। একচুয়ালি, আর্মির অফিসার গন, সারাজীবন তাদের ডেডিকেসন থাকে আর্মির যাবতীয় কাজে, সে আর কোনো বিকল্প কাজ শিখেও না। ফলে আমারো তাই হয়েছে। অনেক ভাবছিলাম, কি করা যায়। কিন্তু কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না।

ঠিক এই সময় একটা ঘটনা ঘটে গেলো। কোনো এক কাকতালীয় ভাবে একদিন আমার সাথে  নাজিমুদ্দিনের পরিচয় হয় মীরপুর সেনানীবাসে। আমিই তাকে মীরপুর সেনানিবাসে দাওয়াত করেছিলাম কারন সে আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলো। আমি কখনোই নাজিমুদ্দিনকে সামনাসামনি দেখিও নাই, কথাও বলি নাই যদিও সে আমাদেরই এলাকার লোক। নাজিমুদ্দিন এলাকায় একজন খুব প্রতাপশালী খারাপ মানুষের মধ্যে একজন ছিলো। ধর্মের কোনো বালাই ছিলো না, সারাদিন মদের উপর থাক্তো, আর নারী ছিলো তার প্রিয় ভোগের মধ্যে একটি। সিনেমার জগত থেকে শুরু করে, সঙ্গীত রাজ্যের সব নারীদের এবং সাধারন মেয়েরা কেউ তার হাত থেকে রেহাই পায় নাই। তার টাকা ছিলো, ফলে টাকার জন্য ই সব ক্লাসের অর্থলোভী মেয়েগুলি তাকে দিনে আর রাতে সঙ্গ দিতো। সে বসুন্ধরার প্রোজেক্ট সমুহে মাটি সাপ্লাই দেওয়ার বৃহৎ একচ্ছত্র সাপ্লাইয়ার ছিলো। জমি দখল, অবৈধ ভাবে মাটি কাটা, অন্য মানুষের জমি কম দামে ক্রয় করে বসুন্ধরাকে দেওয়া, এই ছিলো তার কাজ। কিন্তু তার একটি জায়গায় সে কখনো ই বুদ্ধিমান ছিলো না। সে সব সময় পাওয়ার অফ এটর্নি বা আম মোক্তার নিয়ে জমি ক্রয় করত। সেই রকম ভাবে আমাদের গার্মেন্টস বিল্ডিংটা যে জমির উপর অবস্থিত, সেটা জনাব আব্দুল বারেক এবং তার পরিবারের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলো। হয়ত কিছু টাকা বাকী থাকতে পারে। কিন্তু সে জমিটা রেজিস্ট্রি করে নেয় নাই। পরিবর্তে সে বারেক সাহেব এবং তার পরিবারের কাছ থেকে পাওয়ার অফ এটর্নি নিয়ে এখানে দশ তালা ফাউন্ডেসন দিয়ে হাসনাবাদ সুপার মার্কেট নামে আপাতত তিন তালা বিল্ডিং (সাথে একটি বেসমেন্ট) তৈরী করে। 

প্রাথমিকভাবে সে নিজেই একটা গার্মেন্টস দিয়েছিল এবং এর নাম রেখেছিলো "রিভার সাইড সুয়েটারস লিমিটেড", বেশ সুন্দর নাম। নাজিমুদ্দিন সাহেব গার্মেন্টস চালানোর জন্য যে জ্ঞ্যান, যে বিদ্যা থাকা দরকার সেটা তার কিছুই ছিলো না। কিন্তু তার অনেক টাকা ছিলো। ফলে গার্মেন্টস এর জন্য তিনি যাদেরকে অংশীদারী দিয়েছেন, তারা সবাই ছিলো নিজেদের আখের গোছানোর ধান্দায়। ফলে ধীরে ধীরে অত্র গার্মেন্টস শুধু লোক্সানের দিকেই যাচ্ছিলো। এই লোক্সান এক সময় নাজিমুদ্দিনের কাছে খুব বিরক্তিকর মনে হচ্ছিলো বটে কিন্তু সে অন্য দিকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীটা রাখতেও চাচ্ছিলো। 

অনেক কথাবার্তার পর, নাজিমুদ্দিন আমাকে একটা অফার দিলো যে, যদি আমি চাই তাহলে আমি তার রিভার সাইড সুয়েতারস ফ্যাক্টরী টা চালাইতে পারি। তিনি আমাকে ৩০% শেয়ার দিবেন আর তিনি ৭০% শেয়ার নিজে রাখবেন। এদিকে আমি কোনো কিছুই বুঝি না কিভাবে কোথা থেকে গার্মেন্টস এর অর্ডার নিতে হয়, কিভাবে ব্যাংকিং করতে হয়, কোনো কিছুই না। কিন্তু সাহস ছিলো অনেক। পরের দিন আমি রিভার সাইড সুয়েতারস দেখতে গেলাম। প্রায় বন্ধ অবস্থায় আছে ফ্যাক্টরীটা। মাত্র ১৮ জন অপারেটর কাজ করছে। কারেন্ট লাইন বন্ধ কারন প্রায় ৪ মাসের অধিক কারেন্ট বিল বাকী আছে। গ্যাস লাইন ও বন্ধবিল পরিশোধ না করার কারনে। ব্যাংকে প্রায় তিন কোটি টাকা লোনা আছে। ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ না করার কারনে কোন এল সি করা যায় না, সি সি হাইপোর কোনো সুযোগ নাই। এর মানে ফ্যাক্টরীটা একেবারেই লোকসানের প্রোজেক্ট। ব্যাংক ম্যানেজার ছিলেন তখন মিস্তার তাহির সাহেব এবং সোস্যাল ইস লামী ব্যাংকের এম ডি ছিলেন তখন মিস্তার আসাদ সাহেব। ঊনারা দুজনেই একটা উপদেশ দিলেন যে, যদি আমি নিতে চাই, তাহলে ব্যাংক রি সিডিউলিং করতে হবে। ব্যাংক রিসিডিউলিং কি জিনিষ তাও আমি জানি না। যাই হোক, শেষ অবধি আমি রিস্ক নেওয়ার একটা প্ল্যান করলাম। 

ফ্যাক্টরীটা তখন চালাচ্ছিলো জনাব লুতফর রহমান নামে এক ভদ্রলোক। এরও স্বভাবের মধ্যে অনেক খারাপ কিছু ছিলো। সে রীতিমতো জুয়া এবং নারীঘটিত ব্যাপারে খুব আসক্ত ছিলো। সাবকন্ট্রাক্ট করে যে টাকা পেতো, সেটা শ্রমিকদের মুজুরী না দিয়ে জুয়ার আসরেই বসে হেরে আসতো। ফলে প্রতিনিয়ত শ্রমিকগন সবশেষে সেই আবারো নাজিমুদ্দিনের বাসার সামনে গিয়েই বেতনের জন্য আন্দোলন করা ছাড়া কখনো বেতন পাওয়ার সম্ভাবনা থাক্নতো না। নাজিমুদ্দিন এতোটাই বিরক্ত ছিলো যে, কোনোভাবে এটা অন্য কারো হাতে দিতে পারলে সেও যেনো বেচে যায়।

ব্যাংক রিসিডিউলিং করার জন্য মোট ৪০ লাখ টাকার প্রয়োজন। আমার কাছে এতো টাকা ছিলোও না। ফলে আমি আমার পরিচিত কিছু সিনিয়র আর্মি অফিসারদের সাথেও কথা বললাম যারা খুব তাড়াতাড়ি আর্মির চাকুরী ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন। কিন্তু সবাই লাভ চায়, আনসারটেনিটিতে কেউ ইনভেস্ট করতে চায় না। ফলে আমার পরিচিত আর্মি অফিসার গন ক্রমে ক্রমে পিছু হটে গেলেন।

কোন উপায়ন্তর না দেখে আমি আমার বড় ভাই হাবীবুল্লাহ যিনি আমেরিকায় থাকেন, তার কাছ থেকে তখন ৪০ লাখ টাকা ধার নিলাম এবং বাকী সব রি সিডিউলিং করে নিলাম। সাথে ৩০% শেয়ারের সমান টাকা আমি নাজিমুদ্দিন কেও দিয়ে দিলাম (কিছু জমি দিয়ে আর কিছু ক্যাশ দিয়ে)।

এতে আরেকটি সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিলো। আমি ছিলাম রিভার সাইড সুয়েতারস এর চেয়ারম্যান আর নাজিমুদ্দিন ৭০% নিয়ে থাক্লেন এম ডি হিসাবে। কিন্তু নাজিম ভাই অফিশিয়াল কোনো কাজেই ইনভল্ব হলেন না। তার দস্তখত লাগ্লেও তাকে কোথাও খুজেই পাওয়া যায় না। তাছাড়া রুগ্ন এই ফ্যাক্টরিতে অনেক প্রয়োজনেই টাকাও লাগতোকিন্তু নাজিমুদিইন ভাই তার কোন ভাগ ই নিতেন না। আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে সার্বক্ষণিক টাকা ধার করে করে চালাইতে শুরু করলাম বটে কিন্তু একটা সময় আমার পক্ষে আর চালানো সম্ভব হচ্ছিলো না।

উপান্তর না দেখে একদিন আমি নাজিমুদ্দিন ভাইকে বললাম যে, হয় আমার ৩০% শেয়ার আবার তিনি নিয়ে আমার ইনভেস্টমেন্ট ফেরত দিক অথবা বাকী ৭০% শেয়ার একেবারে আমার নামে ট্রান্সফার করে দিক যেনো আমি আমার মতো করে চালাইতে পারি। তখনো ব্যাংকে প্রায় তিন কোটি টাকার মতো বাকী। কিস্তি দিতে পারছি না। এল সি করতে পারছি না। শুধু নিজের পকেট থেকেই টাকা খরচ হচ্ছে। নাজিম ভাই চালাক মানুষ। তিনি সব লোন আমার নামে ট্রান্সফার করে আর কিছু টাকা ক্যাশ নিয়ে পুরু ৭০% শেয়ার বিক্রি করতে রাজী হয়ে গেলেন। ফ্যাক্টরীর এসেট, লায়াবিলিটিজ হিসাব কিতাব করে শেষ পর্যন্ত আমি বাকী ৭০% শেয়ার নিয়ে আরেকবার রিস্ক নেওয়ার সাহস করলাম। আমার সাথে নতুন লোক মিস্তার মোহসীন (যিনি এক সময় এই ফ্যাক্টরীর ডি এম ডি হিসাবে কাজ করতেন) যোগ হলেন। তাকে আমি খুজে বের করেছি এই কারনে যে, তিনি গার্মেন্টস লাইনে বেশ পাকা, বায়ার দের সাথে তার পরিচয় আছে, ব্যাংকিং বুঝে। আমি তাকে বিনে পয়সায় ৩০% শেয়ার লিখে দিয়ে তাকে চেয়ারম্যান করলাম আর আমি এম ডি হয়ে গেলাম।

নতুন করে আবার ইনভেস্টমেন্ট এর পালা। আমি আমার আত্মীয় জনাব মুস্তাক আহ মেদ (আমার স্ত্রীর ছোট ভাই, যিনি আমেরিকায় থাকে) কে গার্মেন্টস এর শেয়ার চায় কিনা জানালে তিনি ২৫% শেয়ার নেওয়ার একটা ইন্টারেস্ট দেখান এবং তিনি প্রায় ৪৫ লাখ টাকা যোগান দেন। এইভাবে আমি আরো অনেক স্থান থেকে ফান্ড যোগার করে করে ফ্যাক্টরীটি চালানোর চেষ্টা করছিলাম। প্রচুর সময় দিচ্ছি, রাত ফ্যাক্টরীতেই কাটাই প্রায়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ফ্যাক্টরিটা ঘুরে দারাচ্ছিলো না। এক সময় আমার মনে হলো, মোহ সীন সাহেব নিজেই ফ্যাক্টরীর উন্নতির জন্য মন দিয়ে খাটছেন না। তিনি যেহেতু নিজে কোনো টাকা ইনভেস্ট করে নাই, ফলে তার সিন্সিয়ারিটি আমার কাছে একটা প্রশ্নের উদ্রেক করলো। সেলারীর সময় তিনি ট্যাব লিকে চলে যান, খুব কম রেটে অর্ডার নেন, কস্টিং প্রাইসের চেয়েও কম রেট। ফলে আমি লোনে ডুবে যাচ্ছিলাম। কিছুতেই আর সামাল দিতে পারছিলাম না। 

অবশেষে ২০০৭ এর শেষে আমি ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিলাম যে, যা লস হবার হয়ে গেছে, এবার আর লস দিতে চাই না। আমি ফ্যাক্টরী বিক্রি করে দেবো এবং ব্যাংকের টাকা শোধ করতে পারলেই হবে। কারন ব্যাংক লোন তো এখন আমার উপরেই একা। যদিও মোহসীন সাহেন ৩০% এর মালিক কিন্তু তার কোনো টাকা নাই এবং তিনি এই ব্যাপারে কোনো সংকিতও নন। আমি মোহসীন ভাইকে বললাম যে, আমি ফ্যাক্টরী বিক্রি করতে চাই। তিনি একজন গ্রাহক আনলেন, নাম মিস্টার মুরতুজা আর শ্রীলংকান এক ভদ্রলোক নাম প্রিয়ান্থা। ঊনারা এমন একটা প্রপোজাল দিলেন, আমি হিসেব করে দেখলাম যে, আমি লোন থেকে বেরিয়ে যেতে পারি।

মিস্টার মুরতুজা এবং মিস্টার প্রিয়ান্থা দুজনেই গার্মেন্টস লাইনে বেশ পাকা এবং তারা প্রফেসনাল। তারা নতুন করে ফ্যাক্টরীটা আবার তাদের মতো করে সাজিয়ে ব্যবসা করবেন এবং এটা সম্ভব।

মুর্তজা ভাই এবং মিস্টার প্রিয়ান্থা ধীরে ধীরে এলাকা সম্পর্কে জানতে জানতে একটা জিনিষ বুঝলেন যে, এই এলাকাটি সভ্য কোনো জায়গা নয় এবং এখানে ব্যবসা করতে গেলে লোকাল সাপোর্ট ছাড়া কোনোভাবেই ব্যবসা করা সম্ভব নয়। এই ফিডব্যাকটা তারা লোকাল এলাকা, বিভিন্ন বন্ধুবান্ধব, এবং স্টাফদের ছাড়াও ব্যাংক থেকে পেলেন যে, হয় মিস্টার নাজিমুদ্দিন অথবা মেজর আখতারকে সাথে না নিলে নিরাপদে এখানে ব্যবসা করা সম্ভব না। এই এলাকাটি আবার আমার নিজের। সবাই আমাকে চিনে। তারমধ্যে আমি একজন আর্মি অফিসার হওয়াতে সবাই আমাকে একটু ভয়েও থাকে।

হতাত করে একদিন মুরতুজা ভাই এবং প্রিয়ান্থা আমার মিরপুরের বাসায় রাত ১১ টায় এসে হাজির। তারা আমাকে এইমর্মে জানালেন যে, তারা ১০০% শেয়ার কিনবেন না। ৯০% শেয়ার কিনবেন এবং ১০% শেয়ার আমাকে রাখতেই হবে। আমি আমার সময়মতো ফ্যাক্টরীতে আসতে পারবো এবং আমি আমার এমডি পোস্টেই থাকবো। সম্মানি হিসাবে আমি তাদের সমান সম্মানিই পাবো। ব্যাপারটা আমি সবশেষে মেনেই গেলাম। অর্থাৎ আমি ১০%, মুরতুজা ভাই ৪৫% আর প্রিয়ান্থা ৪৫% শেয়ার নিয়ে আবার ফ্যাক্টরী রান করতে শুরু করলো। এবার এটা প্রান ফিরে পেলো।

২০১০ সালে প্রিয়ান্থা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৪১ বছর বয়সে মারা যান। ইতিমধ্যে মুরতুজা ভাই আমি কেমন লোক, কেমন চরিত্রের মানুষ, সেটা বুঝে গিয়েছিলেন। আমি আসলে মাত্র ১০% শেয়ার নিয়ে কোনো হস্তক্ষেপই করছিলাম না। কারন ঊনারা ৯০% এর মালিক, সেখানে আমার  মন্তব্য কিংবা আমার কোনো সাজেশন খুব একটা মুল্যায়ন করা হবে কি হবে না সেটা নিয়ে আমি একটু তো সন্দিহান ছিলামই। ফলে আমি জাস্ট নামেমাত্র এমডি হিসাবেই ছিলাম আর লোকাল কোনো সমস্যা হলে সেটা আমি সামাল দিতাম। কোথায় কোন বায়ারের অর্ডার, কিংবা কবে কোন শিপমেন্ট এগুলো নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামাইতাম না।

আমার যখন এই রকম এক্টা অবস্থা, আমি তখন নিজে নিজে কিছু করা যায় কিনা সেটাও ভাবছিলাম। ফলে ডেভেলপারের কাজেও একটা চেষ্টা করছিলাম, যার ফল হচ্ছে বাসাবোতে একটা প্রোজেক্ট। সেটার ইতিহাস অন্য রকম। এটা না হয় পরেই বলবো।

প্রিয়ান্থা মারা যাবার পর, মুরতুজা ভাই প্রিয়ান্থার ৪৫% শেয়ারের মধ্যে তিনি নিলেন ২০% আর আমি নিলাম ২৫%। এতে আমার শেয়ার দাড়ালো ৩৫% আর মুরতুজা ভাইয়ের শেয়ার দাড়ালো ৬৫%। ২৫% শেয়ার নেবার জন্য আমি মুরতুজা ভাইকে ৫৮ শতাংশ জমি লিখে দিতে হলো। এভাবেই বর্তমান পর্যন্ত চলছে। ফ্যাক্টরি ধীরে ধীরে বেশ উন্নত করতে লাগলো। কিন্তু আমার ভিতরে একটা আনসারটেনিটি সবসময় কাজ করতো যে, একটা সময় আসবে যে, মুরতুজা ভাই কোনো না কোনো সময় এর বিকল্প হিসাবে অন্যত্র বেরিয়ে যাবেনই। ফলে আমি নিজেও রিভার সাইড সুয়েটারস এর পাশাপাশি আরো কোনো ব্যবসা করা যায় কিনা আমি একটা বিকল্প খুজছিলাম। হয়ত তার ই একটা বিকল্প প্রোডাক্ট ব্যবসা হিসাবে মা ইন্ডাস্ট্রিজের  জন্ম। ওটাও আরেক ইতিহাস। এটাও পরে বলবো। 

গত ৮ জানুয়ারী মাসে সড়ক ও জনপথ আমাদের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীটির কিছু অংশ ভেঙ্গে দিয়ে যায় কারন আমাদের ফ্যাক্টরী বিল্ডিংটি বিল্ডিং এর মালিক জনাব নাজিমুদ্দিন সাহেব গায়ের জোরে সরকারী জায়গায় কিছুটা অংশ বাড়তি তৈরী করেছিলেন। বর্তমানে পদ্মা সেতু বানানোর কারনে সরকার তার নিজের জায়গা দখল করতে গিয়ে আমাদের বিল্ডিং ভেঙ্গে দিয়ে গেলো। তাতে আমাদের কোন সমস্যা ছিলো না। সমস্যাটা হয়েছে গার্মেন্টস বায়ারদের আসোসিয়েসন একরড আমাদের বিল্ডিংটা আন্সেফ করিয়ে দিলে আর কোনো বায়ার এখানে অর্ডার প্লেস করবেনা। তাতে আমাদের ব্যবসা লাটে উঠবে। আমরা এখানেই পথে নেমে যেতে হবে।

যেদিন সড়ক ও জনপথ আমাদের ফ্যাক্টরী বিল্ডিংটা ভেঙ্গে দিয়ে যায়, সেদিন ছিলো আমাদের জন্য একটা মারাত্মক বিপর্যয়। একদিকে উক্ত বিল্ডিং এবং জমির মালিকানা নিয়ে কয়েকটি দলের সাথে কোন্দল, মামলা, মারামারি এবং সন্ত্রাসী হুমকী ইত্যাদি, অন্যদিকে সড়ক ও জনপথের নিজস্ব জায়গাউদ্ধারের কারনে ভাঙ্গাভাঙ্গি, ফলে মাঝখানে আমরা যারা অনেক টাকা এই বিল্ডিং এ ব্যবসার কারনে ইনভেস্ট করে ফেলেছি সেটা একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। 

যেদিন থেকে জনাব নাজিমুদ্দিন মারা গেলো, তার পরের থেকেই একের পর এক বাহিনী এই জমি এবং বিল্ডিং দখল করে ফেলার জন্য পায়তারা করছে। জনাব বারেক আমাকে উকিল নোটিশ দিয়েছে যেনো তাকে ভাড়া দেওয়া হয়, আবার নাজিমুদ্দিনের তিন বউ সরাসরি ভাড়া চায়, অন্যদিকে জরীফ নামে আরেক লোক পুরু জমি এবং বিল্ডিং এর মালিকানা দাবী করছে। আমার এইখানে এডভান্স দেওয়া আছে প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা। ফলে আমার এই অগ্রিমের টাকাকে ফেরত দেবে তার কোনো দায়ভার কেউ নিতে চাইছে না। তাহলে আমার এতোগুলি টাকার কি হবে? আমি কাউকেই আর ভাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নই। আজ প্রায় ৩৮ মাস হয়ে গেছে আমি কোনো ভাড়া দিচ্ছি না। 

জমি এবং বিল্ডিং নিয়ে নাজিমুদ্দিনের তিন বউ আরেক বাহিনী জনাব বারেক সাহেবের সাথে কখনোই সমঝোতায় পৌছতে পারছিলো না। মিস্টার বারেক, নাজিমুদ্দিনের পরিবার কিংবা বারেকের অন্যান্য পরিবারের সদস্যরা ও আমাকে অফার করেছে যদি আমি কিছু টাকা দিয়ে উক্ত বিল্ডিং এবং জমি বারেক সাহেব্দের কাছ থেকে কিনে নেই কিংবা নাজিমুদ্দিনের পরিবার ও আমাকে এক ই ধরনের অফারকরেছিল।  কিন্তু আমি কোনো ভাবেই প্ররোচিত হইনাই। এর বদলে, আমি চেষ্টা করছিলাম যে, কোনোভাবে মিস্টার বারেক এবং নাজিমুদ্দিনের পরিবারের মধ্যেকোনো ভাবেই সমঝোতা করা যায় কিনা। কেউ ইসমঝোতার কাছাকাছি ছিলেন না। ফলে এটা এভাবেই স্ট্যাল্মেট অবস্থায় চলছিলো, আমিও কোন ভাড়া দিচ্ছিলাম না। কারন আমার অগ্রিম টাকা শোধ করতেই হবে। অনেক টাকা , প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা। 

প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেছে এইওবস্থার। হতাত করে শুনলাম যে, সাইফুল ইসলাম নামে চাদপুরের কোনো এক ৬৯ বছরের মানুষ গত ২০০৭ সালে নাজিমুদ্দিনের কাছ থেকে এই জমি এবং এই বিল্ডিং কিনে নিয়েছিলো। এটা একটা অবাস্তব ঘটনা। কারন আমি গত ২০০৬ থেকে এই ফ্যাক্টরিতে আছি। কখনো বারেক সাহেব কিংবা ওই সাইফুল ইসলাম কখনো এখানে আসে নাই। আর আমার সাথে সর্বশেষ ফ্যাক্টরী চুক্তি হয়েছিলো ২০০৯ সালে। তাহলে নাজিমুদ্দিন কিভাবে ২০০৭ সালে বিক্রি করে? আর আমি তো ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতি মাসে ফ্যাক্টরীর ভাড়া দিয়ে আসছিলাম। তাহলে এতোদিন সাইফুল ইসলাম সাহেব কেনো  ভাড়া নিতে এলেন না? 

মামলা হয়েছে, বারেক সাহেব করেছে, আবার এদিকে সাইফুল ইসলাম সাহেবের দেওয়া পাওয়া অফ এটর্নি পেয়েছে সোহাগ গ্রুপের সাথে জড়িত মালিবাগের জাহাঙ্গীর হাসান মানিক। আর ঊনার প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করছে এলাকার জরীফ নামে এক লোক। সে আমাদের প্রতিনিয়ত খুব ডিস্টার্ব করছিলো এই বলে যে, সে এবং জাহাঙ্গীর হাসান মানিক যেহেতু নতুন মালিক, ফলে তাকে ভাড়া দিতে হবে , তা না হলে এখানে খুবই অসুবিধা। আজকে পানির লাইন বন্ধ করে দেয় তো কাল কারেন্টের লাইন নিয়ে ঝামেলা করে। অথচ আমি জানি সত্যটা কি। কিচ্ছু করার নাই। আমার কোনো ইন্টারেস্ট নাই কে বা কারা মালিক এই বিল্ডিং বা জমির। আমার ইন্টারেস্ট হলো আমার ব্যবসা, আমার অগ্রিম টাকা এবং পিস্ফুল সমাধান। 

আমি এবং মুরতুজা ভাই মেন্টালি খুব ডিস্টারবড হচ্ছিলাম। কিছুতেই ভালো একটা সমাধান করতে পারছিলাম না। 

ঠিক এই সময় সড়ক ও জনপথের অফিসাররা পদ্মা সেতুর কারনে আমাদের ফ্যাক্টরীর প্রায় ১৫-২০ ফুট ভাঙ্গার জন্য বুল ডোজার নিয়ে হাজির। আমরা কেহই ফ্যাক্টরীতে ছিলাম না। আমি যখন এলাম, তখন ইতিমধ্যে প্রায় ৫ থেকে ৭ ফুট ভেঙ্গে ফেলেছে। খুবই ভয়ংকর একটা অবস্থা। আমাদের ফ্যাক্টরীটা একরড সারটিফায়েড। এখন যদি কোনো কারনে একরড জানতে পারে যে, আমাদের ফ্যাক্টরীতে ভাঙ্গা পড়েছে, কোনোভাবেই আমরা একরডের সারটিফিকেট রিটেইন করতে পারবো না। আর যদি সারটিফিকেট রিটেইন করতে না পারি, তাহলে কোনো অবস্থায়ই  আমাদের বায়াররা আমাদের অর্ডার প্লেস করবে না। 

সড়ক ও জনপথের অফিসারদেরকে অনুরোধ করা হলে তারা মালিকপক্ষ ছাড়া কোন কথাই বলবেন না বলে ভাংতেই থাক্লেন। বারেক সাহেবকে ফোনে জানালে ঊনি এমন একটা ভাব করলেন যে, ভাংতে থাকুক। যেটুকু থাকে সেটুকু নিয়েই ঊনি পরবর্তীতে জড়িফের সাথে ফাইট করবেন। জরীফের সাথে কথা বলা হলো, সে মালিকের পক্ষে যেভাবেই হোক একটা প্রক্সি দিলো। বারেক সাহেব অনেক পরে যদিও স্পটে এলেন কিন্তু তিনি জরীফের ভয়েই হোক আর তার অনিহার কারনেই হোক কারো সাথেই আলাপ করলেন না, আবার সড়ক ও জনপথের ম্যাজিস্ট্রেট এর সাথেও কোনো কথা বললেন না। 

আমি বুঝতে পারলাম, এখন ব্যবসা করতে গেলে আমাকে জরীফের লোকজনকেই মালিক বলে মেনে নেওয়া উচিত। মামলার ফলাফল দিবে আদালত। যদি জরীফ গং মামলায় জিতে আসে তাতে আমার কোনো সমস্যা নাই, আবার বারেক জিতে আসে তাতেও আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি শেষ পর্যন্ত জরীফের দলের সাথে একটা চুক্তি করেই ফেললাম। অন্তত তারা আমার অগ্রিম টাকাটার একটা দায়িত্ত নিয়েছেন। যদিও পুরুটার নয়। আমার প্রায় ২৫/৩০ লাখ টাকার লস হবে। 

(চলবে)

৪/৪/২০২১-ছোটভাবী মারা গেলেন

Categories

বিকেল ৩ টায় মিটুল আমাকে ফোন করে জানালো যে, ছোট ভাবী হটাত করে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন এবং এইমাত্র ওনাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে। মাত্র ২ ঘন্টার ব্যবধানে আরেকটা খবর পেলাম যে, ছোট ভাবী ক্লিনিক্যালি ডেড। ঠিক সাড়ে ৫ টায় জানলাম, ছোট ভাবী আর নাই।

বড্ড আফসোস হচ্ছিলো ছোট ভাবীর জন্য। মানুষটা যতোটা না চালাক ছিলো, তার থেকে বেশী ছিলো সহজ এবং বোকা। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞান ছিলো না যা তিনি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে এমন কিছু হতে পারতেন যা একটা মহিলার জীবনের জন্য অপুরনীয় পাওয়া। তার সবচেয়ে বড় যে গুনটা আমি দেখেছি, তিনি যাকে পছন্দ করতেন, তার ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন নাই। সে একেবারে অনেক ঊর্ধে রাখেন তাঁকে।

ছোট ভাবীর সাথে আমার অনেক ভালো একটা সম্পর্ক ছিলো যা হয়তো এই পৃথিবীর অনেক মানুষের ছিলো অজানা। তিনি এখন আর এই দুনিয়ায় নাই, তাই তাঁকে আমি আমার অন্তর থেকে ভালোবেসে মন থেকে জান্নাতের সুপারিশ করে বিদায় দিলাম। যদি কখনো আমার কারনে আপনার কোনো বিচারের সুম্মুক্ষিন হতে হয়, আমি সেদিন কোনো প্রশ্ন ছাড়া এই সুপারিশ হয়তো করবো মহান আল্লাহর কাছে-তাকে মুক্তি দিন। একটা নিস্তব্ধ অপরাধ অথবা  যাইই বলি সেটা তো হয়েছেই।

কেরানীগঞ্জ মাইগ্রেশন-ষ্টাইল-৪

Categories

আমার বাবা যখন শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, আমাদেরকে যে কোনো ভাবেই হোক, যতো দ্রুত আদি নিবাস মুনশিগঞ্জ, সিরাজদিখানের কয়রাখোলা থেকে কেরানিগঞ্জে স্থান্তান্তর করতেই হবে। আমার খালুর সাথে আমার বাবা অতি গোপনে বিস্তারীত ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই স্থানান্তরের সবচেয়ে কঠিন বিষয়টা হচ্ছে গোপনীয়তা রক্ষা এবং কাজটা করতে হবে কেউ বুঝে উঠার আগেই। যদি ১ম পক্ষের কেউ বিন্দুমাত্র আভাষ পায়, তাহলে তাজির আলী, কিংবা অন্যান্যরা কিছুতেই আমাদেরকে কেরানিগঞ্জে আস্তে দিবে না, বাধা দিবে এবং এটা একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির স্রিষ্টি করবে যা ভাবাই যায় না।

আমার খালু ছিলেন কেরানিগঞ্জের বাক্তার চর এলাকার অনেক প্রতাপশালি একজন ধনাঢ্য মাদবর। আমার খালু (গনি মাদবর) এবং আমার বাবা হোসেন আলী মাদবর দুজনে একটা ব্যাপারে একমত হলেন যে, যেদিন তাজির আলী কয়রাখোলার বাইরে থাকবে, হোক সেটা কোনো এক রাতের জন্য বা দুই রাত, সেই সময়ে পুরু বাড়িটা না ভেংগে কয়েক শত লোক নিয়ে এক রাতের মধ্যে বাড়িটা কেরানীগঞ্জে শিফট করা। এদিকে খালু তার নিজের একটা জমিতে আমাদের কয়রাখোলার বাড়ির অবিকল মাপে মাপে সব কিছু খুড়ে রাখবেন যাতে এক রাতের মধ্যেই পুরু বারিটা স্থাপন করা সম্ভব হয়। কিন্তু সমস্যা হলো কয়রাখোলা থেকে বাক্তার চরে আসার মাঝপথে একটা নদী আছে। সেই নদী এতো বড় আস্ত একটা বাড়ি কিভাবে পার করা সম্ভব? এটার ও একটা বিহীত হলো। পরিকল্পনা হলো যে, খালু ২/৩ শত কলা গাছ দিয়ে নদীর উপর ভেলা বানিয়ে রাখবেন যাতে ঘর সমেত লোকজন পার হতে পারে।

এবার শুধু অপেক্ষার পালা, কবে তাজির আলী অন্য কোথাও বেরাতে যায়। ব্যাপারটা বেশীদিন সময় নিলো না। সমস্ত লোকজন ঠিক করা ছিলো, ভেলার জন্য কলা গাছ ও রেডি করা ছিলো, শুধুমাত্র আদেশের অপেক্ষা। তাজির আলী তার শশুড় বাড়িতে তিন চারদিনের জন্য বেড়াতে যাওয়ার আওয়াজ শুনা গেলো। এদিকে বাবা এবং খালু সেই সময়তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

ঠিক যেদিন তাজির আলি তার শশুড় বাড়ি চলে গেলো, ওই দিন রাতেই একদিকে আমার বাবা তার দলবল নিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি তুলে ফেলার ব্যবস্থা করলেন, খালূ নদীর উপর ভেলা সাজিয়ে ফেললেন, আর এদিকে আমার ভাই বাক্তার চরে পুরু বাড়িটা প্রতিস্থাপনের জন্যে দায়িত্তে থাকলেন।

মাত্র একটি রাত।

আর এই রাতের গহীন অন্ধকারেই আমার বাবা তার চার শতাধিক কর্মীবাহিনীকে নিয়ে, আমার খালু আরো দুই শতাধিক কর্মীবাহিনী নিয়ে আর অন্য দিকে আমার ভাই আরো প্রায় গোটা বিশেক পচিশেক লোক নিয়ে পুরু বাড়িটা ভোর হবার আগেই বাক্তার চরে সেট করে ফেললেন। গ্রামের মানুষ যখন ঘুম থেকে উঠলেন, তখন তারা একটা জিনিষ দেখলেন যে, কয়রাখোলায় আর বাড়ি নাই, অথচ বাক্তার চরে নতুন একটা বাড়ি দাঁড়িয়ে ছিলো। এটা কোনো আলাদিনের দৈত্যের কাহিনীকেও হার মানিয়েছে।

আমরা নতুন ঠিকানায় চলে এলাম। অন্যদিকে যখন তাজির আলীরা এই সংবাদ পেলো, তারা অনেক হৈচৈ লরেছে বটে কিন্তু ততোক্ষনে সব কিছু ওদের হাতের বাইরে চলে গেছে। এই নতুন ঠিকানায় এসে সবচেয়ে বড় কষ্টে ছিলেন আমার বাবা। তার সাম্রাজ্য ছেড়ে এখন তিনি নতুন এলাকায় কোনো কিছুই না। ভাগ্যের কি পরিহাস। গতকালের রাজা আজ অন্য কোথাও আরেকজনের প্রজা।

এখানে আমার (মেজর আখতার) একটা কমেন্ট করার খুব ইচ্ছে হলোঃ

শুধুমাত্র একটা বাড়ি তুলে আনাই কি মাইগ্রেশন? আর বাড়িতা তুলে না এনে কেনো আমার বাবা তার অর্থ খরচ করে বাক্তার চরে আরেকটা বাড়ি করলেন না? একটা নতুন বাড়ি করার পরেই তো তিনি আমাদের সবাইকে বাক্তার চরে মাইগ্রেট করাইতে পারতেন। এই জায়গাটায় আমার সাথে আমার বাবার বা খালুর বুদ্ধির সাথে এক হলো না। নিশ্চয়ই এর ভিতরে আরো কোনো মাহাত্য ছিলো যা এই মুহুর্তে আমার জানা নাই।

সাময়ীক তিরোধ্যান-ষ্টাইল-৩

Categories

আমার বাবা যদিও অত্র কয়রাখোলা এলাকার খুবই নামীদামী এবং প্রতাপ শালী একজন মাদবর ছিলেন কিন্তু তিনি তার ঘরের মধ্যে একটা বিষয় নিয়ে খুবই অসফল লোক ছিলেন। আর সেটা হলো তারই নিজের ১ম পক্ষের ছেলে মোঃ তাজির আলীকে নিয়ন্ত্রণ করা। তাজির আলী ছিলেন আমাদের স্টেপ ব্রাদারদের মধ্যে ২য় ভাই। প্রথম জনের নাম ছিলো নজর আলী, ২য় জনের নাম এই তাজির আলী এবং ৩য় ভাইয়ের নাম ছিলো মোহসীন আলী। তাজির আলী ভাইয়ের সবচেয়ে বেশী রাগ ছিলো আমার মায়ের উপর। কারন তিনি আমার মাকে কোনোভাবেই তার ২য় মা হিসাবে মেনেই নেন নাই। তার মধ্যে আমাদের এই পক্ষে আরো গোটা ৫ বোন আর ২ ভাই ইতিমধ্যে জন্ম গ্রহন করে ফেলেছি। আমার বাবার ছিলো অঢেল জমিজমা। আর বিশাল বাড়ি। তাজির আলী যখন বিয়ে করে, তখন থেকেই সে অতিমাত্রায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলো। এর কারন হলো তাজির আলীর শশুড় বারীও ছিলো একটা খারাপ বংশের মানুষ। তারা মানুষের কাছে ডাকাতের সমপর্যায়ের শ্রেনী হিসাবেই গন্য হতো। এমতাবস্থায় শশুড় বাড়ির আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে তাজির আলী এতোটাই উছ্রিখল হয়ে উঠেছিলো যে, এক সময়ে সে এটাই ভেবে নিলো যে, ২য় পক্ষের আমাদের সবাইকেই সে হত্যা করবে। যদি দরকার হয়, সে তার বাবা অর্থাৎ আমার বাবাকেও হত্যা করে সমস্ত সম্পত্তি তাদের নামে লিখে নেয়া। আমরা তখন খুবই ছোট ছোট। শুধুমাত্র আমার বড় ভাই ডঃ হাবীবুল্লাহ সবেমাত্র ইন্টার পাশ করছেন। হাবীব ভাইয়ের এই ইন্টার পাশ করাও যেনো তার অনেক হিংসা এবং রাগ। বাবা ব্যাপারটা কিছুতেই সামাল দিতে পারছিলেন না। আমার বাবা ছিলেন আসলেই খুব জ্ঞানী মানুষ। তিনি জানতেন, তাজির আলী যতোই হামকি ধামকি দিক, বাবার জিবদ্দশায় যে তাজির আলী কিছুই করতে পারবেন না সেটা তিনি নিসচিত। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর তাজির আলীর কিংবা আমাদের অন্যান্য স্টেপ ব্রাদারদের কার কি ভুমিকা হবে এটা নিয়ে তার অনেক শংকা ছিলো। তাই তিনি দেখতে চাইলেন, তার অনুপস্থিতিতে কার কি ভুমিকা হয়। এতা তার একটা টেষ্ট করা দরকার।

বিশয়টা নিয়ে বাবা আমার ভাই হাবীবুল্লাহ্র সাথে বিস্তারীত আলাপ করলেন। আমার ভাইয়ের সাথে আমার বাবার ছিলো খুবই বন্ধুত্তের সম্পর্ক। ফলে, তারা দুজন মিলে একটা বুদ্ধি করলেন। বুদ্ধিটা এরকমের যে, হতাত বাবা উধাও হয়ে যাবেন। তখনকার দিনে তো আর মোবাইল ছিলো না, আবার ল্যান্ড লাইনের ফোন ও ছিলো প্রায় দুষ্কর, তাই বাবা যদি হটাত করে কোথাও কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যান, তাহলে সবাই ধরে নিবে যে, বাবা হয়তো কোথাও গিয়ে দূর্ঘটনায় মারা গেছেন। এই সময়টায় কাদের কি কি ভুমিকা হয় সেটার আপডেট বাবা ভাইয়ার কাছ থেকে নিবেন। ব্যাপারটা জানবে শুধুমাত্র আমার ভাই আর বাবা। এমনকি আমার মাও জানবেন না। খুবই একটা গোপন বিষয়। আমার ভাই তখন সবেমাত্র ইন্তার পাশ করে জগন্নাথে ভর্তি হয়েছেন। বাবা ঢাকাতেই থাকবেন, কিন্তু কারো কাছেই প্রকাশ্যে আসবেন না। আমার ভাই মাঝে মাঝে গ্রামে গিয়ে ব্যাপারতা কে কিভাবে নিচ্ছে সেটা অব্জার্ভ করবেন এবং বাবাকে ফিডব্যাক দিবেন।

প্ল্যান মোতাবেক, বাবা একদিন সুদুর চট্টগ্রামে যাবেন বিধায় সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গ্রাম ছাড়লেন। কিন্তু আর তিনি ফিরে এলেন না। একদিন যায়, বাবা আসেন না, দুইদিন যায় বাবা আসেন না। এভাবে সবাই খুব দুসচিন্তা করতে লাগলো। বাবাকে খোজা শুরু হলো। কোথাও বাবাকে পাওয়া গেলো না। আসলে যিনি লোক চক্ষের আড়ালে পালিয়ে থাকতে চান, তাকে যেভাবেই খোজা হোক, তাকে তো প্রকাশ্যে পাওয়া যাবেই না। কিন্তু বাবা আছেন, সুস্থই আছেন। আর এ খবরটা জানেন শুধু আমার ভাই। তারা প্রতিদিন শ্যাম বাজার শরীর চর্চার ঘাটে দেখা করেন। ভাইয়া বাবাকে তার তরোধানের পর গ্রামের খবরাখবর দেন। বাবা সেই খবরের উপর ভিত্তি করে তিনি তার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আটেন।

দিনের পর দিন দিন যখন বাবা আর গ্রামে ফিরে এলেন না, মা খুবই চিন্তায় পড়ে গেলেন। আমার অন্যান্য ভাওবোনেরাও চিন্তা করতে লাগলেন। গ্রামের গনমান্য ব্যক্তিরাও কোনো কিছু আছ করতে না পেরে প্রায় মাস তিন চার পর ধরে নিলেন যে, বাবা হয়তো কোথাও দূর্ঘটনায় মারা গেছেন। খবরতা এবার বেশ পাকাপোক্ত হয়ে গেলো। আর অরিজিনাল প্ল্যানের কার্যক্রমটা যেনো এখান থেকেই শুরু।

তাজির আলি ভাইয়ের দাপটের চোটে, তার সাথে আমার অন্যান্য স্টেপ ব্রাদার এবং বোনদের দাপট এতোটাই চরমে উঠলো যে, আমাদের ২য় পক্ষের সব ভাই বোনেরা এখন জীবন নিয়ে শংকিত। বাবা প্রতিদিন তার বাড়ির খবর পেতে থাকলেন এবং মনিটর করতে লাগলেন যেনো ব্যাপারটা কোনো অবস্থাতেই অনেক খারাপের দিকে না টার্ন নেয়।

তারপর......

তারপর একদিন বাবা সব বুঝে যাওয়ার পর ভাবলেন, ওনার যা বুঝার তিনি বুঝে গেছেন যে, তার মৃত্যুর পর আমাদের ২য় পক্ষের ভাইবোনদের কি অবস্থা হবে। তিনি হটাত করে গ্রামে এসে হাজির হলেন। সবাই তো অবাক। কোথায় ছিলো এতোদিন এই হোসেন আলী মাদবর? বাবা কাউকেই কিছু বললেন না, শুধু বললেন যে, সুদুর চট্টগ্রামে গিয়ে তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। যেহেতু কারো মাধ্যমেই খবর দেয়া সম্ভব হয় নাই, তাই আর বলা হয় নাই। কিন্তু তিনি মনে মনে জানেন কি হয়েছে আর এখন তাকে কি করতে হবে।

বাবা ভাবলেন, আমাদেরকে আর মুনশীগঞ্জে রাখাই যাবে না। আমাদেরকে মাইগ্রেট করে অন্যত্র নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে যে কোনো সময়ে বড় ধরনের অঘটন ঘটে যাবে। বাবা আমার খালু গনি মাদবরের সাথে ব্যাপারটা বিস্তারীত আলাপ করলেন। আমার খালু গনি মিয়া ছিলেন আরেক মাদবর এবং খুবই প্রতাপ শালী মানুষ। যার অঢেল সম্পত্তিও ছিলো কিন্তু সবই কেরানীগঞ্জ। বাবা ভাবলেন আমাদেরকে খালুর দেশেই নিয়ে আসবেন।

কিন্তু বিপত্তি হবে যখন আমার স্টেপ ব্রাদার এবং বোনেরা জানবে যে, বাবা আমাদেরকে মুনশীগঞ্জ থেকে কেরানিগঞ্জে নিয়ে আসবেন তখন। তাতে মারামারি কাটাকাটিও হতে পারে। এই ব্যাপারটা নিয়েও বাবা ভাইয়ার সাথে আর খালুর সাথে আরেকটা বিস্তারীত পরিকল্পনা করলেন কিভাবে সব মারামারি, কাটাকাটি হানাহানি পরিত্যাগ করে নির্বিঘ্নে মুনশী গঞ্জ থেকে একদিনের মধ্যে কেরানীগঞ্জে আনা যায়। কিন্তু এইটা ঠিক যে, আমাদেরকে খালুর দেশে কেরানীগঞ্জে আনতেই হবে আমাদের নিরাপত্তার জন্য।

বাবার মাদবরী স্টাইল-২

Categories

আগেই বলেছিলাম যে, আলী হোসেন সরকার আর আমার বাবা কন টেম পোরারী সময়ে প্রায় একই পর্যায়ের মাদবর ছিলেন। কেউ কাউকে হেয় না করলেও তারা কখনোই এক সাথে কাধে কাধ লাগিয়ে চলতেন না। কে সুপেরিয়র আর কে সুপেরিয়র নন এটা বুঝানো যাবে না আবার কেউ কারো থেকেও কম না এটাই আসলে তাদের মধ্যে ছিলো একতা অলিখিত দন্ধ। আলী হসেন সরকারের বাড়িতে কোনো বড় অনুষ্ঠান হলে হোসেন আলী মাদবরে যেমন দাওয়াত থাকতো তেমনি হোসেন আলী মাদবরের বাড়িতেও কোনো অনুষ্ঠান হলে আলী হোসেন সরকারের ও দাওয়াত থাকতো। কিন্তু তারা কখনোই একে অপরের দাওয়াতে আসতেন না। এটাও এক রকমের গ্রাম্য রাজনীতর একটা বড় ঢং বলা যায়।

তো একবার আমার বাবা আসলেই চেয়েছিলেন যে, আলী হোসেন সরকার যেনো আমাদের বাড়িতে কোনো একটা অনুষ্ঠানে দাওয়াতে আসেন। আমার বাবা জানতেন যে, তথাকথিত দাওয়াতে আলী হোসেন সরকার না আসারই কথা। তাই বাবা যা করলেন তাতে আলী হোসেন সরকারের না এসেও পারেন নাই। বাবা তার ইগো ঠিক রাখার জন্যেও তিনি নিজে আলী হোসেন সরকারের বাড়িতে গিয়ে তাকে দাওয়াত দিলেন না। যদিও তিনি সেটা করতে পারতেন। যাই হোক, বাবা, তার নিজের হাতের লাঠিটা এক পত্রবাহককে দিয়ে তার সাথে একটা চিরকুট লিখলেন-

জনাব আলী হোসেন সরকার, আমার সালাম নিবেন। আমার বাড়িতে আপনার দাওয়াত ছিলো। আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করছি আপনি আজ আমার বাড়িতে দাওয়াতে আসবে। আমি আমার হাতের লাঠিটি পাঠালাম, সাথে এই পত্রটি। ধরে নিবেন, লাঠিটি আমি নিজে এবং পত্রটি আমার কথা। আপনি আসবেন।

আলী হোসেন সরকারও সেই লেবেলের বুদ্ধিমান লোক, তিনি বুঝলে এর মর্মার্থ। তিনি বাবার হাতের লাঠিটি পত্র বাহকের কাছ থেকে রেখে দিলেন, সাথে পত্রটিও। তিনি রীতিমত পরিপাটি সাজগোছ করলেন। তারপর ঠিক সময় মতো বাবার হাতের লাঠিটি সাথে নিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে র ওয়ানা হলেন। আলী হোসেন সরকার যখন প্রায় আমাদের বাড়ির ঘাটে, আমার বাবা হোসেন আলী মাদবর নিজে ঘাটের কাছে গিয়ে আলী হোসেন সরকারকে অভ্যর্থনা জানালেন আর আলী হোসেন সরকার ও তার সেই অভ্যর্থনায় কোলাকুলি করে একটা যুগান্তকারী ব্যাপার ঘটিয়ে দিলেন।

আসলে তাদের মধ্যে সব সময় বন্ধুত্বই ছিলো, কোনো রেষারেসি ছিলো না। তারা কারো সম্পদ হজম করতেন না, গ্রাম বাসী ও তাদেরকে যথেষ্ঠ সম্মান করতেন। তারা জানতেন এই সব মাদবরদের একটা ওজন আছে, তাদের কথার ভ্যালু আছে, তাদের নীতি আছে। হ্যা, একে অপরের সিদ্ধান্ত সব সময় মেনে নেবেন সেটা হয়তো ছিলো না কিন্তু গ্রাম একটা সঠিক নেত্রিত্তের মধ্যে ছিলো।

আজো তারা সবার মুখে মুখে আছেন। প্রায় ৫০ বছর পার হয়ে গেছে, তাদের কথা আজো গ্রাম বাসী মনে রেখেছেন। আমরা আজো তাদের হেরডিটি উপভোগ করি। যখন কেউ জানে যে, আমরা হোসেন আলী মাদবরের বংশধর, মানুষ এখনো অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করেন আর বলেন তাদের সেই পুরানো ঐতিহ্যের কথা। ভালো লাগে।

বাবার মাদবরী স্টাইল-১

Categories

সিরাজদিখানে যতোগুলি মাদবর আমার বাবার আমলে প্রতাপ শালী ছিলেন, তার মধ্যে আমি প্রায়ই যার নাম শুনেছি তার নাম আলী হোসেন সরকার। আমার বাবার নাম ছিলো হোসেন আলী মাদবর, আর ওই ব্যক্তির নাম ছিলো আলী হোসেন সরকার। তারা সরকার বাড়ির লোক। ভাইয়ার কাছ থেকে শুনেছিলাম যে, সরকার বাড়ির মানুষেরা কোনো না কোনোভাবে আমাদের বংশেরই আওতাধীন ছিলো। যাই হোক সেটা এখন আর বড় ব্যাপার নয়।

এই আলী হোসেন সরকার আর আমার বাবা হোসেন আলী মাদবরের মধ্যে গ্রাম্য পলিটিক্সের বেড়াজালে একটা অলিখিত আক্রোশ ছিলো। কিন্তু সেই আক্রশ তা এমন নয় যে, কোনো জমি জমা নিয়ে, বা পারিবারিক কোনো কোন্দল নিয়ে। এটা ছিলো নিতান্তই পাওয়ার পলিটিক্স। যেখানে হোসেন আলী মাদবর কোনো শালিসীতে থাকতেন, সেখানে আলী হোসেন সরকার থাকতেন না। আবার যেখানে আলী হোসেন সরকার থাকতেন সেখানে হোসেন আলী মাদবর থাকতেন না। প্রকৃত পক্ষে ওনারা ওনাদের কোনো সিদ্ধান্তে কেউ বাধা হয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আক্রোশে সম্পর্কটাকে বিপদজনক করেন নাই।

এখানে মজার একটা ব্যাপার চলছিলো এই দুই পরিবারের মধ্যে। শুধুমাত্র আলী হোসেন সরকার আর হোসেন আলী মাদবরের মধ্যে যাইই থাকুক না কেনো, এই দুই পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা খুব মিলেমিশেই থাকতেন। একজনের ভাতের হাড়ির কিছু অংশ যে আরেক জনের বাড়িতে যেতো না এমন নয়। এরা আবার আসলেই একে অপরের বন্ধুও ছিলো। কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে নয়। কি রকমের একটা সম্পর্ক সেটা একটা উদাহরণ না দিলে ব্যাপারটা ঠিক বুঝা যাবে না।

আমার ভাই হাবীবুল্লাহ যখন লেখাপড়া করছিলেন, তখন আমার অন্য পক্ষের ভাইয়েরা এটাকে কোনোভাবেই ভালো লক্ষন হিসাবে নেন নাই। বিশেষ করে তাজির আলী ভাই। তার সব সময় টার্গেট ছিলো যে কোনো মুহুর্তে হাবীব ভাইয়াকে ক্ষতি করা, বিপদে ফেলা কিংবা মেরে ফেলা। এটা আমার বাবা খুব ভালো করে জানতেন। একদিন, আমার বাবা আলী হোসেন সরকারকে ব্যাপারটা শেয়ার করলেন যে, তিনি হাবীব ভাইয়ার জীবন নিয়ে তাজির আলির থেকে শংকিত। কি করা যায় পরামর্শ দরকার।

কি অদ্ভুত!!

হোসেন আলী সরকার কোনো কিছুই চিন্তা না করে আমার বাবাকে বললেন, শোনো হোসেন আলী মাদবর, তোমার ছেলে আর আমার ছেলের মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না এবং রাখীও না। আমার বাড়ি তোমার ছেলের জন্য ১০০% নিরাপদ। আগামীকাল থেকে তোমার ছেলেকে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দাও। এখানেই খাবে, এখানেই পড়বে, এখানেই ঘুমাবে। তোমার যখন দরকার তখন আসবা, ওর যখন যেখানে যাবে ওর সাথে আমার ছেলেরা থাকবে।

সেই থেকে আমার ভাই আলী হোসেন সরকারের বাড়িতে থেকেই  অনেক দিন পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে। এরাই আসলে মাদবর, এরাই আসলে বুদ্ধিমান। এরা যখন কোথাও শালিসিতে যেতো সেদিন ওনারা কারো পক্ষের বাড়িতে পানিও খেতেন না, কারন কোনো পক্ষপাতিত্ত তারা করতেন না।

মন্তব্যঃ

আজকাল গ্রামের উঠতি মাদবরদের বয়স দেখলে মনে হয় ওদের এখনো মোছ দাড়িও গজায় নাই। কেউ আওয়ামীলীগের সভাপতি, কেউ ছাত্রনেতা, কেউ এটা কেউ সেটা। এরাই মাদবর। এরা না করে বড়দের সম্মান, না করে ছোটদের আদর। ওরা প্রতিনিয়ত ঘুষের টাকায় চলে, ঘুষের কারনে ওরা রায় বদলায়। এদেরকেও কেউ সম্মান করে না।

আমার বাবা।

Categories

আমি আমার বাবাকে কখনো দেখিনি এবং তার চেহাড়া কেমন ছিলো, খাটো নাকি লম্বা, যুবক না বৃদ্ধ, ফর্সা নাকি কালো কোনো কিছুই আমার জানা নাই। তবে আমার বড় ভাই ডঃ হাবীবুল্লাহর কাছে আমি আমার বাবার অনেক গল্প শুনাতেন যার থেকে আমি বাবার একটা কাল্পনিক চরিত্র মনে গেথে গেছে। আমার দাদার নাম ছিলো হিসাবদি মাদবর। আমরা মাদবর বংশের লোক।

বাবার সম্পর্কে আমি অনেক চমৎকার চমৎকার গল্প শুনেছি ভাইয়ার কাছে। তবে তার প্রাথমিক তথ্যের মধ্যে জরুরী তথ্য হলো যে, আমার বাবার প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি আমার মাকে বিয়ে করেন। বাবার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ঘরে মোট তিন জন ছেলে সন্তান আর তিনজন কন্যা সন্তান ছিলো। এই মোট ছয় সন্তান থাকার পরে আমার বাবা আমার মাকে বিয়ে করেন। তখন আমার মায়ের বয়স ছিলো বেশ কম। আগের সব সন্তানেরাই আমার মায়ের থেকে বয়সে বড় ছিলো। কেউ কেউ আবার ইতিমধ্যে বিয়েও করে ফেলেছিলেন। এমন একটা পরিস্থিতিতে আমার মা যেমন একটু অসুবিধায় ছিলেন, তেমনি আমার বাবাও বেশ অসুবিধায় ছিলেন।

কিভাবে আমার বাবা এই দুমুখী অসুবিধাগুলি তার জ্ঞানের দ্বারা সমাধান করেছিলেন, সেই গল্প গুলিও আমি হোসেন আলী মাদবরের পর্বসমুহে একে একে লিখবো।

০২/০২/২০২১-কনিকার বাল্টিমোরে ভর্তি

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব 

ফেব্রুয়ারী 

০২

ইন্টার পরীক্ষার ফলাফলের আগে থেকেই কনিকা আসলে এদেশে পড়বেনা বলে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলো। কনিকার সমস্যা হচ্ছে, ও যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তার অধিকাংশ সিদ্ধান্ত আমি বদল করতে পারি না, মাঝে মাঝে বদল করতেও চাইনা আসলে। ইন্টার ফলাফল পাওয়ার পর দেখা গেলো কনিকা সবগুলি সাব্জেক্টেই এপ্লাস মানে গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছে। এতে আরো সুবিধা হয়ে গেলো যে, ওর পরীক্ষার ফলাফলে যে কোনো ইউনিভার্সিটিতেই ভর্তি হবার সম্ভাবনা বেড়ে গেলো। এর মধ্যে অনেকগুলি ইউনিভার্সিটিতে এপ্লিকেশন করেছে। কোনো ইউনিভার্সিটিই ওকে রিজেক্ট করে নাই বরং কনিকা ফাইনান্সিয়াল এইডের কারনে সে নিজেই বেশ কিছু ইউনিভার্সিটির এক্সেপ্টেন্স রিজেক্ট করেছে।

প্রথমে কনিকা সবগুলি ইউনিভার্সিটি চয়েজ করেছিলো বোষ্টন বেজড। কারন আমার বড় ভাই বোষ্টনে থাকেন। একটা সময় আমার মনে হলো যে, আসলে আমার বড় ভাইয়ের উপরে নির্ভর করে কনিকাকে এতোদূরে পাঠানো ঠিক হবে কিনা। তিনিও বুড়ো হয়ে গেছেন, অনেক কিছুই তার পক্ষে এখন সামাল দেয়া সম্ভব হয় না। অনেক সময় তিনি অনেক কিছু ভুলেও যান। প্রায়শ ক্ষেত্রেই আমি দেখেছি যে, আমার বড় ভাইয়ের উপর অনেক ব্যাপারে ভরষা করা যায় না। কোনো কিছুতেই আমার বড় ভাই না করেন  না বটে কিন্তু ঠিক শেষ মুহুর্তে এসে দেখা যাবে তিনি আর পারেন না অথবা তার অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয় বা করেন। বিশেষ করে যখন কোনো ফাইনান্সিয়াল কোনো ব্যাপার থাকে সেখানেই তার সব বিপত্তি। তাই ভাইয়ার উপরে আমার ভরষা আমার ছোট মেয়েকে পাঠানো উচিত হবেনা বলে আমার কাছে মনে হলো। দেখা গেলো যখন কনিকার কোনো প্রয়োজন হবে ঠিক তখন কনিকার জন্য সাহাজ্য আর আসছে না।

আমি মতামত চেঞ্জ করে কনিকাকে বললাম যে, তুমি শুধু বোষ্টনের জন্য এপ্লাই না করে আমাদের আরো আত্তীয়সজন যেখানে বেশী আছে, সেখানেও এপ্লাই করো। আমেরিকাতে বাল্টিমোরে থাকে লুসিরা, ছোটভাই, এবং আরো অনেকেই। ফলে আমি কনিকাকে বাল্টিমোরের জন্যেও এপ্লাই করতে বললাম। আজই উনিভারসিটি অফ ম্যারিল্যান্ড, বাল্টিমোর কাউন্টি (ইউএমবিসি) থেকে সরাসরি ওর ভর্তির ব্যাপারে চিঠি এসছে যে, ওরা কনিকাকে নিতে আগ্রহী এবং যত দ্রুত সম্ভব ওরা আই-২০ ফর্ম পাঠাতে চায়। শুনলাম, ওখানে লুসির ছেলেও আবেদন করেছে। লুসিরা খুব খুসি যে, কনিকা ওখানে পড়তে যাবে।

আপডেটঃ ১১ মার্চ ২০২১

আজ কনিকার আই-২০ ফর্ম এসছে ইউএমবিসি (ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড, বাল্টমোর কাউন্টি) থেকে। ইউএমবিসি বাল্টিমোরের সবচেয়ে ভালো একটা ইউনিভার্সিটির মধ্যে একটি। আর সবচেয়ে এক্সপেন্সিভও বটে। আমি খুশী যে, কনিকা নিজে নিজেই সবগুলি কাজ করেছে এবং খুবই স্মার্টলী ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করেছে। এবার ওর দূতাবাসে দাড়ানোর পালা। যদি ইনশাল্লাহ সব কিছু ঠিক থাকে, তাহলে আগামী জুলাই মাসে কনিকা আমেরিকায় চলে যাবে। এটা যেমন একদিকে আমার জন্য ভালো খবর, অন্যদিকে একটু কষ্টও লাগছে যে, মেয়েটা অনেক দূর চলে যাবে। ইচ্ছা করলেই আর ওর সাথে রাত জেগে জেগে আলাপ করা যাবে না। বাচ্চারা এভাবেই কাছ থেকে দূরে বেরিয়ে যায়। 

২৯/০১/২০২১- নাফিজের বিয়ে

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব

জানুয়ারী 

২৯ 

নাফিজ হচ্ছে আমার এক বোনের মেয়ের ছেলে। আমার বোনের নাম শায়েস্তা খাতুন। সেই শায়েস্তা খাতুনের মেয়ে শেফালী। নাফিজ শেফালীর ছেলে। নাফিজের বাবার নাম নেওয়াজ আলী মোল্লা। সে গত ০২/০৯/২০২০ তারিখে মারা গেছে। নাফিজ জাপানে থাকে, ওখানেই কোনো রকমে কাজ করে যতোটুকু পারে পরিবার এবং নিজের ভবিষ্যত গরার চেষ্টা করছে। নাফিজ যখন বিদেশ যায়, তখন আমিই ওকে স্পন্সর করেছিলাম। প্রায় ৩/৪ বছর পর নাফিজ দেশে এসছে। কিন্তু কবে দেশে এসছে, আর কোথায় কিভাবে বিয়ে করছে সেটা নিয়ে সে আমার সাথে কোনো পরামর্শ যেমন করে নাই, তেমনি ও যে ঢাকায় এসছে সেটাও আমাকে জানায় নাই। এগুলি নিয়ে আমার তেমন কোনো মাথা ব্যথাও নাই। আজকে শুনলাম যে, আজ নাফিজের বিয়ে। এটা শুনলাম আমি মিটুলের কাছ থেকেই। ব্যাপারটা নিয়ে আমি একেবারেই সময় কিংবা মাথা খাটানোর চিন্তাও করি নাই কারন যার যার লাইফ তার তার। কে কিভাবে তাদের লাইফ উপভোগ করলো সেটা নিতান্তই তাদের ব্যাপার। আমি সাধারনত এ ব্যাপারে কারো জীবনেই হস্তক্ষেপ করি না কিংবা করতে পছন্দও করি না।

আমি ২০১৭ সাল থেকেই শেফালী মেয়েটাকে আর পছন্দ করি না। এই না পছন্দ করার পিছনে অনেক কারন আছে। সেটা আর এখানে বলছি না। শেফালী আর নাফিজ আজকে মিটুলকে নাকি ফোন করে বলেছে যে, নাফিজের বিয়েতে যেতে হবে। আমি মিটুলকে বললাম, নাফিজ ঢাকায় কবে এসছে? মিটুল নিজেও বলতে পারলো না। আমি বললাম, আমি জানি, নাফিজ প্রায় ১ মাস আগে ঢাকায় এসছে। বাক্তার চর থেকে ঢাকায় যেতে সব সময় আমার অফিস পার হয়েই তারপর ঢাকায় যেতে হয়, নাফিজ যদি আমাকে ইম্পর্ট্যান্ট মনে করতো যে, আমি ওদের বড় কেউ গার্জিয়ান, তাহলে ঢাকায় আসার পরেই হয় আমাকে একটা ফোন করতে পারতো অথবা আমার অফিসে এসে দেখা করতে পারতো। এর মধ্যে আবার ওর কোথায় বিয়ে ঠিক হচ্ছ্যে, কার কি সমস্যা ইত্যাদি নিয়েও সে আমাকে নক করে নাই কিন্তু আমি জানি ওর বিয়ে নিয়ে ওর এক্স গার্ল ফ্রেন্ডদের মধ্যে বিশাল একটা ঝামেলা চলছে। আমি সব খবর পাই কিন্তু যেহেতু আমাকে কেউ কিছু বলছে না, ফলে আমি উপজাজক হয়ে এদের মধ্যে ঢোকতেও চাই না।

আমার করোনা পজিটিভ থাকায় আমি এমনিতেও নাফিজের বিয়েতে যেতাম না, হয়তো আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে পাঠিয়ে দিতাম। কিন্তু আমি চাই না যে, আমি বা আমার পরিবারের কেউ ওর বিয়েতে যাক। আমি জানি আমি না গেলে কি পরিমান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে শেফালী এবং নাফিজকে। ওরা জানেই না যে, পায়ের তলার মাটি সরে গেলে নিজের শরীরের ওজনটাকেও ধরে রাখা সম্ভব হয় না। এটা আমি ওদের বুঝিয়ে দিতে চেয়েছি এবার। শেফালীর বাবা ছিলো না, মা ছিলো না, শেফালির বোন নুরুন্নাহারের থেকে শুরু করে জমজ দুই ভাই লিয়াকত আর শওকাত এদেরকে সেই দুই মাস বয়স থেকে আমরাই লালন পালন করেছি। ওদের বাবার নাম ওরাও হয়তো ভালোভাবে বলতে পারবে না। গ্রামের মানুষ, আশেপাশের মানুষ ওদেরকে এই নামেই চিনে যে, ওরা মেজরের ভাইগ্না ভাগ্নি। আর এটাই ছিলো ওদের সবচেয়ে বড় শিল্ড। আর ওরাই কিনা আজকে আমাকে ইগনোর করার চেষ্টা করেছে।  আমার খারাপ লাগে নাই ততোটা কারন আমি বুঝে গেছি যে, ওরা আসলে নিমক হারামের জাত।

বিয়েতে গেলাম না। আমি না যাওয়াতে কি হলো সেটা আমি জানি। শেফালীকে হাজার প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়েছে কেনো মামা এলো না। আমাদের গ্রামের মানুষ অনেকেই আমাকে দেখে নাই কিন্তু নাম শুনেছে। আবার অনেক পুরানো দিনের মানুষেরা আমার সান্নিধ্যে আসতে চেয়েও আমার অফিস পর্যন্ত আসার স্কোপ না থাকায় দেখাও করতে পারে না। আবার আমার পজিশনাল ফ্যাক্টরের কারনে অনেকে ভয়েই আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছা থাকলেও দেখা করতে পারে না। এমন একটা পরিস্থিতিতে যখন কেউ শুনে যে, আমার কোনো আত্তীয়ের কোনো অনুষ্ঠান, তারা ভাবে যে, এবার নিশ্চয়ই মেজরের সাথে দেখা হবে। ফলে কেউ দাওয়াতে আসে আমার সাথে দেখা হবে বলে, কেউ আবার অপেক্ষা করে আমার সাথে দেখা হবে বলে। কিন্তু যখন আমার আর ওখানে যাওয়া হয় না, তখন কেনো যাই নাই, কি কারনে যাই নাই এই প্রশ্নে জর্জরিত হতে হয় তার যার বাড়িতে অনুষ্ঠান।

এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর যখন আমার সেই আত্তীয় দিতে পারে না, তখন এতোদিন যে নামের ক্ষমতায় সারা গ্রাম চষে বেড়িয়েছে, যে লোকটির ক্ষমতায় সারাটা গ্রামকে ভয়ের মধ্যে রেখেছে, অনেকেই শুধু এই নামটার জন্যই যখন তাদেরকে তোষামোদি করেছে, তারা তখন এই প্রশ্নটাই করে- কই এতোদিন যাদের জোরে এতো তাফালিং, তারা তো আপনাদের কোনো অনুষ্ঠানেই আসে না, তাহলে কিসের এতো বাহাদুরী?

ক্ষমতার রেশ ছুটে যাচ্ছে, অপমানে মুখ দেখানো কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই যে অসহায় একটা পরিস্থিতি, এটা কিন্তু আমি তৈরী করি নাই, করেছে ওরা নিজেরাই। ওদের আর কোনো মনোবল নাই আমার সামনে এসে কোনো দাবী নিয়ে জোর দিয়ে বলতে পারে, যে, আপনি অবশ্যই আসতে হবে আমাদের অনুষ্ঠানে। একদিকে আমাকে না নিতে পারার কষ্ট আর অন্যদিকে মানুষের কাছে হেয় হবার অপমান কোনোটাই কম না।

আজকে আমার বউ আমার কাছে এসে বল্লো, যে, সেফালি অনেক কান্নাকাটি করেছে যে, মামা যদি নাও আসতে পারে, অন্তত আপনি ১০ মিনিটের জন্য হলেও একবার গ্রামে নাফিজের বিয়েতে ঘুরে যান, অন্তত আমি মানুষকে বলতে পারবো যে, মামা অসুস্থ তাই মামী এসেছেন। তা না হলে আমার আর অপমানের শেষ নাই। আমি সবার কাছে যেমন ছোট হয়ে যাবো, তেমনি আমি পরিবেশ গতভাবেও অনেক দূর্বল হয়ে যাবো।

আমি শুধু মিটুলকে বললাম, যদি তুমি যেতে চাও, যাও, আমাকে কোনোভাবেই কনভিন্স করার চেষ্টা করো না যে, আমাকে নাফিজের বিয়েতে যেতে হবে। যে ছেলেটা একটা ফোন করেও আমাকে যেতে বলে নাই, তাদের আবার এতো অপমানের ভয় কিসের? তুমি যেতে চাও, যাও, দরকার হয় আমার যে কোনো গাড়ি নিয়েও তুমিযেতে পারো। 

আসলে আমি একটা পানিশমেন্ট দিতে চেয়েছি এই শেফালীকে। আসলে এটা পানিশ মেন্ট নয়, এটা একতা বাস্তবতাকে তুলে ধরার জন্য তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া যে, কোথায় কোন জিনিষের উপর কতটুকু কদর করা উচিত সেটা বুঝা। আর এখন তারা সেই শাস্তিতাই পাচ্ছে। আমার ধারনা, সেফালী আরো বড় শাস্তির অপেক্ষায় আছে। তাহলে সেই শাস্তিটা কি? ব্যাপারটা হয়তো এভাবে ঘটবে- 

আমি নাফিজকে চিনি। অত্যান্ত দূর্বল চিত্তের একজন মানুষ, ইমোশনাল একটি ছেলে। শক্ত করে কোনো কিছুর প্রতিবাদ করার সাহসও এই ছেলেটার মধ্যে আমি দেখি নাই। সবসময়ই একটা ভাবুক উপলব্ধির মধ্যে থাকে। আজ যে বাড়িতে নাফিজ বিয়ে করছে, সেফালীর ধারনা যে, তার থেকে একটু উচ্চবিত্তের বাড়িতে সম্পর্ক করলে হয়তো বা সমাজে তাদের একটা আলাদা প্রতাপ বাড়বে কিংবা কোনো এক সমস্যায় হয়তো ওরা হাত বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু কুইনিন জ্বর সারালেও কুইনিন সারাবে কে এটা ওদের মাথায় নাই। অর্থাৎ যেদিন এই পরিবারটা নিজেই সেফালীর জন্য একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে, তখন তাদেরকে প্রতিহত করার উপায় কি? লোহাকে লোহা দিয়ে পিটাতে হয়, কাঠ দিয়ে লোহাকে পিটিয়ে কোনো আকারে আনা যায় না। শুনেছি নাফিজের নবাগত স্ত্রী একজন ডাক্তার কিংবা নার্স বিষয়ক সাব্জেক্টে পরাশুনা করে।  ডাক্তার যে না এটা আমি সিউর কারন কোনো এমবিবিএস পড়ুয়া মেয়ে অন্তত নাফিজের মতো ছেলেকে বিয়ে করার রুচী বা পছন্দে আনতে পারে না। হয়তো নার্স হবে। সাধারনত যেটা হয় যে, গ্রাম্য এসব মেয়েগুলি একটু শিক্ষিত হলেই ভাবে যে, তারা অনেক ক্ষমতাশীল এবং ডিমান্ডেড। ফলে ওরা ওদের অনেক কিছুই চাহিদার বাইরে আব্দার বা দাবী করার প্রয়াশ পায়। আর এই কারনেই এই মেয়েটা একদিন ওর যা খুসী তাইই করার স্বাধীনতা রাখবে। ভাববে যে, সে তো নাফিজের থেকেও বেশী যোগ্য। তাই ওর যা দাবী সেটা তো নাফিজকে মানতেই হবে। নাফিজ তাকে তার অক্ষমতার কথা কিংবা দূর্দশার কথা কিংবা কোনো অন্যায় আব্দারের ব্যাপারে রাজী না হয়ে বাধা প্রদান করলে নাফিজের সব কথা সে নাও শুনতে পারে। আর যদি নাফিজ তাকে শাসন করতে যায়, তখন এই নবাগত স্ত্রী তার পরিবার মিলে নাফিজকেই শায়েস্তা করে ফেলবে। এমনো হতে পারে যে, অচিরেই নাফিজের স্ত্রী তার শাশুড়ির সাথে ধীরে ধীরে সম্পর্কটা অনেক দূরে নিয়ে যাবে, আর সেই দূরে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে শুধু সে নিজেই দূরে চলে যাবে না, সাথে নাফিজকেও দূরে নিয়ে যাবে। নাফিজের এতোটা মনোবল শক্ত নয় যে, নাফিজ বউকে ছেড়ে বা বউকে কড়া ভাষায় কথা শুনিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়াবে। ফলে এমন একটা সময় আসবে যে, নাফিজের দেয়া মাসিক ভাতাটাও একদিন সেফালির জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। এই নাফিজের স্ত্রীই করাবে বন্ধ। এবার আসি সেফালীর আরেক ছেলের কথা। সেফালীর অপর ছেলে নাহিদকে দেখে আমার প্রতিবন্ধী মনে হয়। সারাদিন ঘর থেকে বের হয় না। কারো সাথেই সে কোনো কথাবার্তাও বলে না। শুধু রাতের বেলায় উঠোনে নাকি বের হয় আর রাতেই সে গোসল করে। এই এমন একটা ছেলের কাছ থেকেও সেফালির কিছু আশা করা উচিত না। নাহিদ একদিন নিজেকেই নিজে চালাতে পারবে না। যখন নাফিজের দেয়া ভাতা, বা টাকা সেফালীকে দেয়া কমে যাবে বা বন্ধ হয়ে যাবে, সেদিন এই নাহিদ এমনো হতে পারে নিজের জীবন নিজেই নিয়ে নিবে। কারন সে বেশীরভাগ সময়ে এই পৃথিবীর মানুষের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখে না। সমাজের মানুষ যেমন তাকে সচরাচর দেখে না, তেমনি সেও সমাজের সবাইকে ভালমতো চিনেও না। শুধু মুখ দেখে নাম বলতে পারাটাই চিনা নয়। যখন এই পরিস্থিতি আসবে, নিজেকে খুবই অসহায় মনে করবে নাহিদ আর ভাববে- ওর চলে যাওয়াই উচিত। আর থাকলো সেফালির মেয়ে। মেয়েরা যতোক্ষন পর্যন্ত নিজেরা নিজের পায়ে না দাড়ায়, ততোদিন সে না পারে নিজেকে সাহাজ্য করতে, না পারে তার আশেপাশের কাউকে সাহায্য করতে। ফলে ওর মেয়েরও একই অবস্থা হবার সম্ভাবনা আছে। হয়তো নিজের জীবন না নিলেও শুধুমাত্র বেচে থাকার তাগিদে কোনো এক ছেলেকে বিয়ে করে জীবনটা পার করে দেবে। সেখানে কিছুদিন হয়তো সেফালির ঠাই হবে কিন্তু স্থায়ী হবে না।

নাফিজের থেকে সেফালির দূরে চলে যাবার কারন হবে দুটু। (ক) নাফিজের স্ত্রীর সাথে সেফালির শাশুড়ি বনাম পুত্রবধুর সম্পর্কটা সেফালী নিজেই তৈরী করতে পারবে না বা পারার কথা নয়। সেফালীর যে চরিত্র সেটাই আমাকে এ কথা বলার কারন বলে মনে হয়েছে। আর এই শাসুড়ি বনাম পুত্রবধুর সম্পর্ক ভালো না হওয়ার কারনে সারাক্ষন নাফিজের স্ত্রী নাফিজের মার সম্পর্কে কটু কথা, কান কথা লাগাতেই থাকবে। আর সব শেষে গিয়ে নাফিজের স্ত্রী নাফিজকেই দায়ী করতে থাকবে সব কিছুর জন্য এবং একসময় নাফিজ তার মায়ের উপর এতোতাই বিরক্ত হবে যে, কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা সেটা যাচাই করার আর কোনো মানসিকতা নাফিজের থাকবে না। ফলে যেতা হবে তা হচ্ছে- নাফিজ তার স্ত্রীর পক্ষ নিয়াই কথা বলবে। যেহেতু নাফিজ তার স্ত্রীকে কঠিন ভাষায় মায়ের পক্ষে ওকালতি করতে পারবে না, অথবা উচ্চবিত্ত শশুড়ের মুখের সামনেও দাড়াতে পারবে না, ফলে সে তার মাকেই সে ত্যাগ করবে। সেটাই নাফিজের জন্য সহজ পথ। সেফালি একদিন সত্যিই একা হয়ে যাবে আর সে একাকিত্তে নিজের জীবন নিজেই চালাতে গিয়ে ওর মা আজ থেকে ৪৫ বছর আগে যেভাবে জীবনযাপন করেছে, সেফালিকেও ঠিক সেভাবেই জীবনযাপন করতে হতে পারে। অর্থাৎ পরের ক্ষেতে ধান কাটার পর মাঠ ঝারু দিয়ে পরিত্যক্ত ধান কুড়িয়ে ধান আনা, কিংবা অন্যের ক্ষেতে বদলীগিরি করে, কিংবা এই জাতিয় কাজ করেই ওকে নিজের জীবন নিজেকে চালাতে হবে। (খ) আর দ্বিতীয় কারনটি হলো- লিয়াকত। যতোদিন লিয়াকত নিজের পায়ে দাড়াতে না পারবে, সে ততোদিন সেফালির ঘাড়ের উপরে বসেই জীবন বাচাতে হবে। কিন্তু লিয়াকতের বয়স এখন প্রায় ৩৮। সে লেখাপড়াও করেছে। কিন্তু জীবনমুখী নয়। ওর মতো বয়সের একটা ছেলে কোনো না কোনোভাবে নিজের জীবনসহ একটা সংসার চালাতে পারা সক্ষম হওয়া উচিত ছিলো। অনেকভাবে আমিও চেষ্টা করেছি, হাবীব ভাইও চেষ্টা করেছেন, এমন কি আমি ওকে গাজীপুরে একটা কম্পিউটার ট্রেনিং ইন্সটিটুটের মধ্যে লাগিয়েও দিয়েছিলাম, কিন্তু কোথাও সে এডজাষ্ট করতে পারে নাই। শেষতক আবার সেই সেফালির ঘাড়েই গিয়ে পড়েছে। যতোদিন নাফিজ বিয়ে করে নাই, ততোদিন লিয়াকতের হয়তো ততোটা সমস্যায় পড়তে হয় নাই। কিন্তু নাফিজের বিয়ের পর নাফিজের বউ সেফালির বাসায় থাকতে হচ্ছে, আবার অন্যদিকে নাফিজ দেশে নাই। অথচ লিয়াকত একই বাড়িতে থাকে। এটা কোনোভাবেই হয়তো নাফিজের স্ত্রী আরামবোধ করবে না। এই যে নাফিজের স্ত্রীর ভাষায় সে “আরাম বোধ করছি না” এর মানে একটাই- লিয়াকতকে সেফালির বাড়ি থেকে হটাও। সেফালির বাড়ি থেকে যখন লিয়াকত চলে যেতে বাধ্য হবে, তখন হয়তো সেফালি কিছুটা হলেও তার ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে চাইবে। আর এক কথা বলা চাওয়ার মধ্যেই সেই “দূরে” চলে যাওয়ার ব্যাপারটা লুকায়িত। তবে চুড়ান্ত কথা একটাই- যে কোনোভাবেই হোক, সেফালিকে শেষতক একাই থাকতে হবে, নিজের জীবনের জীবিকা তাকে একাই জোগাড় করতে হবে। এটাই হয়তো শেষের অধ্যায়।

এই যে সেফালিকে নাফিজের স্ত্রি ধীরে ধীরে পছন্দ করছে না এটা বুঝার কিছু উপায় আছে। দেখা যাবে যে, মাসের পর মাস নাফিজের স্ত্রী সেফালির বাসায় আসবে না। কারন দেখাবে যে, সে লিয়াকতের কারনে বিব্রত। সে ফ্রি না লিয়াকতের উপস্থিতিতে ইত্যাদি। ফলে লম্বা সময়ের জন্য সেফালির সাথে বিচ্ছেদ। কিংবা যদি সেফালি অসুস্থ্য হয়ে যায়, তখনো নাফিজের স্ত্রী সেফালিকে দেখভাল করতে আসবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। হয়তো কারন দেখাবে- করোনা কিংবা তার নিজের অসুস্থতা। যদি এমন কিছু ঘটতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে যে, প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এটার ভাঙ্গন শুরু। 

অন্যদিকে, যদি নাফিজ আমাকে গার্জিয়ান হিসাবে সামনে রেখে ও ওর বিয়ের সমস্ত তদারকি করাতো, আর যাইই হক, নাফিজের শশুর বাড়ির মানুষের যে বাগাম্বর ভাবটা এখন আছে উচ্চবিত্তের ধারনায়, সেটা আর থাকতো না। কারন সে আমার তুলনায় কিছুই না। আমার মতো এমন একটা গার্জিয়ানের সামনে না নাফিজের স্ত্রী, না নাফিজের শশুড়বাড়ির কোনো লোক মাথা উচু করে কথা বলতে পারতো। সেফালিও তার গলা উভয়ের সামনে ঠিক আগের মতোই ধরে রাখতে পারতো। আমি একদিক থেকে একটা ব্যাপার নিয়ে শান্তিতে আছি যে, আমাকে আর এসব উটকো ঝামেলা আর পোহাতে হবে না।

এখানে আরেকটা কথা না বললেই নয়। কোনো একদিন নাফিজের শশুরবাড়ির লোকেরাও আমাকে হারিকেন জালিয়ে হন্যে হয়ে খুজবে যখন নাফিজের সাথে, নাফিজের স্ত্রী, কিংবা সেফালির সাথে বড় ধরনের কোনো ঝামেলা তৈরী হবে। তখন তারা খুজবে কাকে ধরলে সমস্যা সমাধান হবে। আর সেই "কাকে ধরলে" খুজতে খুজতে ঠিক আমার আস্তানায় চলে আসবে এসব 'উচ্চবিত্তরা"। আমি আসলে সেদিনটার জন্য অপেক্ষা করছি। শাস্তিটা আমি তখন দেবো ঠিক এভাবে যে- Who are you people? Do I know you?

২৯/০১/২০২১- নূরজাহান আপা

Categories

নুর জাহান আপা আমার জেঠস ছিলেন। অর্থাৎ আমার স্ত্রীর আপন বোন। তিনি একজন শিক্ষিকা ছিলেন, মীরপুরের সিদ্ধান্ত স্কুলের শিক্ষিকা। আমি নুরজাহান আপাকে চিনি আমারও বিয়ের প্রায় অনেক বছর আগ থেকে কারন আমরা গোলারটেকেই থাকতাম পাশাপাশি। আমি যেহেতু সবার সাথে খুব একটা মিশতাম না তাই বিয়ের আগে ঊনাদের সাথেও আমার খুব বেশি ঊঠানামা ছিল না। জাস্ট  চিনতাম, ঊনারাও আমাকে চিনতেন। তার স্বামীর নাম জয়নাল চৌধুরী, তিনি প্ল্যানিং কমিশনে চাকুরী করতেন এক সময়। বর্তমানে অবসর নিয়েছেন। ভালো মানুষ একজন।

নুর জাহান আপা অনেকদিন যাবত লিভারের সমস্যায় ভুগছিলেন। আপা নিজে খুব পহেজগার মহিলা ছিলেন। তার দুই মেয়ে, সোমা এবং সনি আর এক ছেলে, নাঈম আহমদ। দুইজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছেলে থাকে আমেরিকায়। সেও বিয়ে করেছে।

আপার শরীরটা আস্তে আস্তে খারাপ হবার সাথে সাথে তিনি প্রথমে ইন্ডিয়া যান চিকিতসা করাতে। ওখানকার ডাক্তাররা বলেছিলেন যে, তার লিভার ট্রান্সপ্লান্টেসন করাতে হবে, তানা হলে তাকে আর বেশিদিন বাচানো যাবে না। ব্যাপারটা প্রায় ঠিকই ছিলো। ইন্ডিয়া থেকে আসার পর আপা দ্রুত খারাপের দিকে যেতে শুরু করলেন। শেষে তার লিভার ট্রান্সপ্লান্টেসন করাবেন এই সিদ্ধান্তই নেওয়া হলো। কিন্তু জটিল ইন্ডিয়ান সিস্টেমের কারনে ইন্ডিয়া গিয়েও তার লিভার ট্রান্সপ্লান্টেসন করা সম্ভব হয় নাই। 

অতঃপর আপা আবারো আমেরিকায় তার নিজের ছেলের কাছে গিয়ে আমেরিকার উন্নত মানের চিকিতসার জন্য। কিন্তু আমেরিকায় যাওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। তার মৃত দেহ আমেরিকায় সতকার করা হয়। তার মানে নূরজাহান আপাকে আমরা দেশে কবর দিতে পারি নাই।

২৮/০১/২০২১-মিটুল চৌধুরী আসমা

মিটুল চৌধুরী আসমা তার নাম। তার মুল জন্মস্থান মানিকগঞ্জ। জন্ম ৩১সে ডিসেম্বর ১৯৬৮। মিটুলের বাবার নাম- আলাউদ্দিন চৌধুরী, মায়ের নাম- জেবুন্নেসা চৌধুরী। তারা আট বোন এবং তিনভাই। সে সবার ছোট ভাইবোনদের মধ্যে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে র্অথনীতিতে অনার্স পাশ করে মাস্টার্স করে পরবর্তীতে ১৪বিসিএস দিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে জয়েন করেন। প্রথমে তিনি মাইমেন্সিং এর মোমেনুন্নেসা মহিলা কলেজে জয়েন করেন, অতঃপর ঘিউর সরকারী কলেজ, অতঃপর ঢাকা কমার্শিয়াল কলেজ থেকে রাজবাড়ি কলেজ , মাদারীপুর কলেজ ইত্যাদি হয়ে এনসিটিবি এবং তারপর সরকারী বাঙলা কলেজে চাকুরী করেছেন। তিনি বর্তমানে প্রোফেসর  এবং ডিপার্ট মেন্টাল হেড হিসাবে বাঙলা কলেজ, মীরপুরেই কর্মরত আছেন। 

দুই মেয়ের মা। বড় মেয়ে আনিকা তাবাসসুম উম্মিকা বগুড়া (শহিদ জিয়া মেডিক্যাল কলেজে) মেডিক্যাল থেকে এম বি বি এস পাশ করেছে। ছোট মেয়ে সাঞ্জিদা তাবাসসুম কনিকা এবার শহীদ আনোয়ারা গার্লস কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ইউ এম বি সি (ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড, বাল্টিমোর কাউন্টি) তে ভর্তি হয়েছে, তার ক্লাশ আগামী আগষ্ট মাস ২০২১ থেকে শুরু হবে। মিটুলের স্বামী সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। মেজর হবার পর স্বইচ্ছায় অবসর নেন এবং নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন। তাদের দুটু এক্সপোর্ট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী (সুয়েটার্স ইউনিট) আছে, ওয়ান টাইমের একটা প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি আছে, আন-নূর কন্সট্রাকশন নামে একটি কন্সট্রাকশন কোম্পানী আছে। মানিকগঞ্জে আল-আব রার মেডিক্যাল ডায়গনোসিস সেন্টার নামে একটি মেডিক্যাল ইউনিটে পার্টনারশীপ ব্যবসা আছে।   

মিটুল চৌধুরী তার নিজস্ব বাড়ি মীরপুরে থাকেন। এ ছাড়া তাদের বাসাবোতেও কয়েকটি ফ্ল্যাট আছে। এই গত এক বছরে মিটুল চৌধুরী তার আরো দুই বোনের সাথে জয়েন্ট পার্টনারশীপে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি মানিকগঞ্জে ৬ তালা একটি বিল্ডিং করেছে। আমি জানি সেটায় ওরা কেউ থাকবে না, তার পরেও বড় একটা ইনভেষ্টমেন্ট।

মিটুল চউধুরীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ইতিহাসটা হচ্ছে তার বিয়ের ঘটনা। আর এই বিয়ের ঘটনাটা বিস্তারীত বর্ননা আছে Diary 2 March 2021 datewise.docx#৩০/০৫/১৯৮৮- বিবাহ

অধ্যায়ে।

(চলবে)  

২৮/০১/২০২১- উম্মিকা,আমার বড় মেয়ে

Categories

আনিকা তাবাসসুম উম্মিকা আমার বড়মেয়ে। জন্ম তার ১৬ জানুয়ারী ১৯৯৪ সাল।

তার জন্মের আগে আমার বড় ইচ্ছে ছিলো যে, আমার যেনো একটা মেয়ে হয়। আমি কখনোই ছেলে হোক চাই নাই। আল্লাহ আমার মনের আশা পুরন করেছেন উম্মিকাকে আমার ঘরে দিয়ে। সে খুব ভালো একটা মেয়ে। কিন্তু সে খুব সিম্পল। 

উম্মিকার জন্মের আগে (সম্ভবত ৪/৫ দিন আগে) আমি একটা সপ্ন দেখেছিলাম। তাহলে সপ্নটা বলিঃ

ঢাকা সেনানীবাসের মেস বি তে আমি একটা রুমে আছি। আমার পোষ্টিং ছিলো খাগড়াছড়িতে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের অধীনে। মিটুল পোয়াতি অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। যে কোনো সময় আমার বাচ্চা হবে। আমি ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে ঢাকায় এসেছি শুধু আমার অনাগত বাচ্চার আগমনের জন্যই। নামাজ পড়ি, খাই দাই, আর সারাদিন হাসপাতালে মিটুলের সাথে সময় কাটাই।

একদিন রাতে (ডেলিভারির ৪/৫ দিন আগে) আমি সপ্নে দেখলাম যে, আমি আমাদের গ্রামের কোনো একটা দোকানে বসে আছি। ওখানে আরো অনেক লোকজন ও আছে। হতাত করে সবুজ একটা সুতী কাপড় পড়ে একজন মহিলা কোনো একটা ঘরের ভিতর থেকে বাইরে এসে আমাকে বল্লো, আমাকে আপনি কি চিনেন? আমি তাকিয়ে তাকে বললাম, জী না আমি আপনাকে কখনো দেখি নাই। উত্তরে মহিলাটি আমাকে বললেন, যে, তিনি হযরত আছিয়া বেগম অর্থাৎ মুসা (আঃ) এর মা। আমি তো অবাক। কি বলে এই মহিয়সী মহিলা?

আমি ততক্ষনাত উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে তো আপনার কাছে আমাদের নবীজির অনেক চিঠি থাকার কথা! মহিলা বললেন, হ্যা আছে তো।

এই কথা বলে তিনি আবার ঘরের ভিতরে চলে গেলেন চিঠিগুলি আনার জন্য। আমার ঘুম ভেংগে গেলো। আমি তখন সময়টা দেখলাম, রাত প্রায় শেষের পথে কিন্তু তখনো ফজরের আজান পড়ে নাই।

পরদিন ছিলো শুক্রবার। আমি জুম্মা নামাজ পড়ে ইমামের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বললাম। তিনি প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার স্ত্রী সন্তান সম্ভবনা কিনা। আমি বললাম, আমরা খুব শিঘ্রই বাচ্চার আশা করছি। তিনি বললেন, আপনার মেয়ে হবে এবং খুব ভালো একজন মেয়ে পাবেন আপনি।

তার ৪/৫ দিন পর আমি আসর নামাজের পর কোর আন শরীফ পড়ছিলাম। এমন সময় আমার মেস ওয়েটার তড়িঘড়ি করে আমার রুমে নক করে বল্লো যে, স্যার আপনাকে দ্রুত হাসপাতালে যেতে বলেছে। আমি তখন যেখানে কোর আন আয়াত পড়ছিলাম, ঠিক সেখানেই মার্ক করে কোর আন বন্ধ কত্রে ছুটে গেলাম হাসপাতালে। মিটুলকে ওটিতে নেয়া হচ্ছে, সিজারিয়ান করতে হবে।

প্রায় ঘন্টা খানেক পরে আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার মিষ্টি মেয়েটার জন্ম হলো এই পৃথিবীতে। কি নাম রাখবো সেটা আমি ঠিক করেছিলাম যে, আমি যেখানে কোর আন শরীফ টা পড়া বন্ধ করেছি, আর যে আয়াতে, আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ঠিক সেই আয়াত থেকেই কোনো একটা শব্দ দিয়ে নাম রাখবো। অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে- আমি ওই সময়ে হজরত মুসা (আঃ) এর উপরেই আয়াতগুলি পড়ছিলাম। সেখানে আয়াতে লিখা ছিলো- ইয়া হাইলা আলা উম্মিকা মুসা। অর্থাৎ হে মুসা, আমি তোমার মাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিলাম।

আমি ঠিক এই শব্দতটাই আমার মেয়ের নাম রাখার সিদ্ধান্ত নেই যে, ওর নাম হবে উম্মিকা। অর্থাৎ মা।

আমার সেই উম্মিকার প্রথম শিক্ষা শুরু হয় মীরপুর স্টাফ কলেজের টর্চ কিন্ডার গার্ডেনে। অতঃপর মেথোডিস্ট ইংলিশ মিডিয়াম, তারপর শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজ এবং সেখান থেকে হলিক্রস। হলিক্রস থেকে উম্মিকা এইচএসসি পাশ করে ডাক্তারী পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করে শহীদ জিয়া মেডিক্যালে আল্লাহর রহমতে ইন্টার্নী করে ২০২০ সালে ডাক্তারী পাশ করলো। এটা আমার একটা স্বপ্ন যে সে ডাক্তার হোক। আমার আরেকটা স্বপ্ন হচ্ছে, সে যেনো সেনাবাহিনীর ডাক্তার হয়। তাতে যে লাভটা হবে তা হচ্ছে, বাবার সেনাবাহিনীর জব ছিলো। রাজনীতির প্রতিহিংসায় সে ইচ্ছে করে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছিলেন, জেনারেল পর্যন্ত যেতে পারেন নাই। আমি চাই আমার মেয়ে সেটা হোক। আর ২য় কারন হচ্ছে, আজীবন কাল সে সেনাবাহিনীর সব বেনিফিট গুলি যেনো পায়। কিন্তু বাবাদের সব সপ্ন তো আর সার্থক হয় না। আমার মেয়ে চায় বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সে বেসামরীক লাইফেই থাকে।

২৮/০১/২০২১- কনিকা, আমার ছোট মেয়ে

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব 

জানুয়ারী 

২৮ 

সানজিদা তাবাসসুম কনিকা আমার ছোট মেয়ে। জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ২০০০।

ভাবলাম, করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাসায় আছি, সময়টা কাটছে না খুব একটা। সবার ব্যাপারে কিছু লিখতে থাকি।

কনিকার যেদিন জন্ম হয়, সেদিন আমি জানতাম না যে, আমার আরেকটি মেয়ে হচ্ছে। আমি জানতেও চাই নাই। এটার পিছনে বেশ একটা কারন ছিলো। আর সেটা হচ্ছে যে, আমার শখ ছিলো আমার প্রথম সন্তান মেয়ে হোক। আল্লাহ সেটা আমার বড় মেয়ে উম্মিকাকে দিয়ে সেই শখ পুরা করেছেন। তারপরের সন্তান আমার ছেলে চাই না মেয়ে চাই এটা নিয়ে আমার কোনো কৈফিয়ত কিংবা কোনো প্রকারের হাহুতাশ ছিলো না। শুধু চেয়েছিলাম যেনো আমার সন্তান সুস্থ্য হয়।

মেয়ে হয়েছে, এই খবরটা দেয়ার আগে ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমার প্রথম সন্তান কি? আমি উত্তরে বললাম, যেটাই হোক, মেয়ে হলেও আমি কিছুতেই অখুসি নই। দুটুই আমার সন্তান। এবারো সিজারিয়ান বেবি। মিটুলের অনেক কষ্ট হয়েছে এবার। আমার মা ঢাকার বাসাতেই ছিলেন, আমার মেয়ে হয়েছে শুনে, আমার মায়ের খুব মন খারাপ। আমি হেসেই বাচি না। আমি প্রথমে ব্যাপারটা মজা মনে করে মাকে কিছুই বলি নাই। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখলাম, আমার মা আমার ছোট মের‍্যেকে একেবারেই পছন্দ করেন না। বারবার শুধু একটা কথাই বলে- ওই ত্যুই ছেলে হইতে পারলি না?

আমার মেয়ে তো কিছুই বুঝে না। সে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে আর দাদির লগ্না হচ্ছে। কনিকার যেদিন জন্ম হয়, সেদিন আমার বুকে একটা ধক করে উঠেছিলো। এতো অবিকল চেহারা হয়? একদম আমার মায়ের চেহারা। তার চোখ, মুখ, নাক , কান, মুখের আকৃতি সব কিছু আমার মায়ের চেহারা। আমি মনে মনে ভাবলাম, হে আল্লাহ, তুমি আবার এই ছোট মাকে আমার কোলে দিয়ে আমার বড় মাকে নিয়ে যেও না।

মাকে বললাম, মা , ছোট মেয়ে একেবারে তোমার অবিকল চেহারা পেয়েছে। তুমি যখন থাকবা না, এই মাইয়াটাই আমার কাছে তুমি হয়ে আজীবন বেচে থাকবা। অনেক দিন ছোট মেয়ের নাম রাখা হয় নাই। আমি মাকে দায়িত্ত দিয়েছি মা যেনো ছোত মেয়ের নাম রাখেন। যা খুশী সেতাই রাখুক। অবশেষে একদিন মা, ছোট মেয়ের নাম রাখলেন- কনিকা।

উম্মিকা ছোট অবস্থায় আমার সাথে থাকতে পারে নাই কারন আমি তখন বিভিন্ন সেনানীবাসে খালী পোষ্টিং আর মিশনের কাজে বিদেশ করে বেড়িয়েছি। কিন্তু কনিকার বেলায় বেশ লম্বা একতা সময় এক সাথে থাকার সুযোগ পেয়েছি।

তারপরেও বেশ অনেক গ্যাপ হয়েছে আমার ওদের সাথে থাকার। কনিকা বড় মেয়ের মতো সেও প্রথমে মেথোডিস্ট স্কুল মিডিয়ামে, তারপর মোহাম্মাদপুর প্রিপারেটরী এবং অতঃপর বিআইএস থেকে শহীদ আনোয়ারা গার্লস কলেজে পরাশুনা করে এস এস সি পাশ করেছে। সাংঘাতিক টেনসনবিহীন একটি মেয়ে। অল্পতেই খুব খুতখুতে কিন্তু খুব বুদ্ধিমতি। কনিকা উম্মিকার থেকেও একটু বেশি চালাক কিন্তু ধূর্ত নয়। আমার ইচ্ছে যে, কনিকা এডমিন ক্যাডারে চাকুরী করুক এবং সচীব হয়ে অবসর নিক। অথবা ব্যারিস্টার হোক। তাতে নিজের ব্যবসা নিজেই করতে পারবে, কারো সরনাপন্ন হতে হবে না। 

কিন্তু আমার ইচ্ছাটাই সব কিছু নয়। এই করোনা পেন্ডেমিকের সময় সরকার কর্তৃক অটোপাশের মাধ্যমে কনিকা ইন্টার পাশ করে ফেল্লো। কনিকার দেশে থাকার কোনো ইচ্ছা নাই। এই যে, সবাই আগামীতে কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়বে, কোথায় ভর্তি হবে ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত আর কনিকা সারাদিন ইন্টারনেটে বিদেশের কোনো ইউনিভার্সিটিতে সে পড়বে সেটা খুজতে খুজতে ব্যস্ত। সে মনে প্রানে আর দেশে নাই। অনেক গুলি ইউনিভার্সিটিত থেকে কনিকা ইতিমধ্যে অফার লেটার পেয়েছে। আমি জানি আগামী বছরের মধ্যে কনিকা আর দেশে নাই। বাকী কি হয় কে জানে?

২৭/০১/২০২১-আমার+উম্মিকার করোনা

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব 

২০২১ 

২৭ জানুয়ারী 

 

কোনো কিছুই কোনো কারন ছাড়া ঘটে না, এটাই সত্য। যে ঘটনাটা আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছিলো কেনো গন্ধ পাওয়ার ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেললাম বলে, আজ সেটা পরিষ্কার হলো। আমার করোনা টেষ্টে পজিটিভ এসেছে। আমার বড় মেয়েরও করোনা পজিটিভ। ছোট মেয়ের করোনা নেগেটিভ। উম্মিকার মার তো আগেই একবার করোবা ধরা পড়েছিলো, তাই আর করাইতে দেই নাই। এর মানে হলো, শুধু ছোট মেয়ে ছাড়া আমাদের বাসায় সবার করোনা ধরা পড়লো। আল্লাহ যা করেন নিশ্চয় মংগলের জন্যই করেন। করোনা ধরা পড়ায় একটা জিনিষ মনে হলো যে, আমাদের আর টিকা নেওয়ার দরকার পড়বে না হয়তো।

দেশে টিকা এসেছে, সবাই টিকা নিতে ভয়ও পাচ্ছে, আবার এই টিকা নিয়ে যে কত রাজনীতি হয় তাও দেখা যাবে। এদেশে প্রতিটি জিনিষ নিয়েই রাজনীতি হয়। টিকা নিয়েও লম্বা সময় ধরে রাজনীতি হবে, এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। যারা একবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে এসছেন, হয়তো তারা আর টিকার ব্যাপারে কোনো মাথা ঘামাবে না, তারপরেও হয়তো টিকাটা নেয়া দরকার হতে পারে যেহেতু এটা একটা ভ্যাকসিন।

বাসায় আছি কদিন যাবত। করোনা হবার কারনে আমার শরীরে কোনো প্রকার আলাদা কোনো সিম্পটম নাই। সুস্থই আছি। বড় মেয়ের ঠান্ডাটা একটু বেশি। আমি প্রতিদিন ছাদে রোদে প্রায় ঘন্টা ২/৩ পুড়ি। ভালোই লাগে। কিন্তু বড় মেয়ে বি সি এস পরীক্ষার প্রিপারেশনে রাত জেগে পরাশুনা করে বলে দিনের অর্ধেক সময় পর্যন্ত ঘুমায়।

চারিদিকে বেশ ঠান্ডাও পড়েছে ইদানিং। এবারের ঠান্ডাটা একটু বেশী মাত্রায় পড়েছে বলে মনে হয়।

২৭/০১/২০২১-ভাবীর দাফন সম্পন্ন

আমি গত কয়েকদিন যাবত করোনায় ভুগছি। সাথে আমার বড় মেয়েও। কিভাবে ঘটনাটা হলো তা আমার এখনো জানা নাই। সে ব্যাপারটা পরে আসছি। বড় ভাবী (অর্থাৎ লিখনের মা) গতকাল ইন্তেকাল করেছেন। আজ তাকে মানিকগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়েছে মানিকগঞ্জ গোরস্থানে দাফন করার জন্য। আমি যেতে চেয়েছিলাম কিনা জানিনা, যেহেতু করোনায় ভুগছি, তাই কেহ আমাকে যেতেও বলে নাই। আর আমি যাওয়ার কোনো কারনও দেখিনা।বড় ভাবীর মৃত্যুর ঘটনায় আমার বেশ কিছু অব্জারভেশন চোখে পড়েছেঃ

ক।      লিখন আমেরিকায় ভিসা জটিলতায় এমনভাবে আটকে আছে যে, লিখন ইচ্ছে করলে ওর মাকে দেখতে আসতে পারতো ঠিকই কিন্তু হয়তো আর আমেরিকায় ফিরে যেতে পারবে না। এই ভয়ে লিখন ওর মাকে আর দেখতেই এলো না। ওর মাকে দেখার চেয়ে হয়তো ওর আমেরিকায় থাকাটা জরুরী মনে হয়েছে বিধায় লিখন আর ওর মাকে শেষবারের মতো দেখতে আসে নাই। প্রথিবীটা অনেক ছোট, আর কে কখন কোথায় থাকবে এটার ফয়সালা আল্লাহর হাতে। আমেরিকাতেই থাকতে হবে আমি এটা বিশ্বাস করি না। এই বাংলাদেশেও অনেক বিখ্যাত মানুষেরা বাস করে এবং অনেক পয়সা ওয়ালারা বাস করে। আমেরিকা কোনো সর্গরাজ্য নয় যে ওখানেই সেটেল হতে হবে সব আত্তীয়সজন বাদ দিয়ে। এই যে, আজকে লিখন তার মাকে শেষবারের মতো ও দেখতে পারলো না, ওর মা লিখনের হাতের মাটিও পেলো না, এর কোনো মানে হয় না। আমি জানি না আমার মৃত্যুর সময় আমার বাচ্চারাও আমাকে দেখতে আস্তে পারবে কিনা কিংবা আমি ওদের হাতে মাটি পাবো কিনা, তবে আমি মনে করি এমন কোনো জটিল পরিস্থিতিতে যেনো আল্লাহ আমাকে বা আমার সন্তানকে না ফেলেন যে, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় আমি আমার সন্তানদের কাছে না পাই।

খ।       বড় ভাবী যখন করোনায় আক্রান্ত, তখন দেশে তার সব ছেলেরা ছিলো। মারুফ ছিলো, তুহীন ছিলো, মুবীন ছিলো, ইমন ছিলো, সবাই ছিলো। একমাত্র মুবীন সারাক্ষন হাসপাতালে ওর মার জন্য ডিউটি করেছে। আর বাকী ছেলেরা খুব একটা দেখতেও যেত না আবার হাসপাতালেও ছিলো না। যেহেতু মায়ের করোনা, তাই সবাই দূরে দূরেই ছিলো। খুবই হতাশার কথা হচ্ছে, যখন বড় ভাবী মারা গেলেন, তখন মানিকগঞ্জে তার লাশের সাথে কে যাবে, বা কারা যাবে এটা নিয়েও একটা কনফিউশন ছিলো। ইমন, তুহীন কিংবা মারুফ তারা ওর মায়ের সাথে যাবে কি যাবে না তারা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না। লিখন দেশে থাকলে লিখন কি সিদ্ধান্ত নিতো সেটা আমি জানি না, তবে, খুব একটা সুখকর অভিজ্ঞতা হতো বলে আমার জানা নাই। বড্ড খারাপ লাগলো কথাতা শুনে যে, যে মা আজীবন ছেলেদের জন্য জীবন দিয়ে দিলো, যে মা এতোটা বছর ওদেরকে বুকে পিঠে মানুষ করলো সেই মাকে করোনায় মারা যাওয়ার কারনে মানিকগঞ্জে গোরস্থানে একমপ্যানি করবে কি করবে না সেটাই এখন সবচেয়ে যেনো বড় প্রশ্ন। আসলেই পৃথিবীটা খুবই সার্থপর একটা জায়গা। এখানে মানুষ নিজেকে ছাড়া আর কারো কথাই সে ভাবে না।

গ।       লিজি আপা যখন বিল্ডিং বা বাড়ি বানানোর জন্য তার বাবার সম্পত্তির উপর সবার কাছে অনুমতি চাইলেন, তখন সব ভাইবোনেরা রাজী থাকলেও শুধুমাত্র লিখনদের পরিবার লিজি আপাকে তার বাবার সম্পত্তি থেকে উতখাত করার জন্য একেবারে উঠেপড়ে লেগেছিলো। লিখনের সাথে একজোট হয়েছিলো ওর স্ত্রী শিল্পীও, যদিও শিল্পি লিজি আপার আপন বোনের মেয়ে। লিজি আপার এই বাড়ি বানানো নিয়ে লিখন এবং তার পরিবার (বড় ভাবী সহ) এমন একটা সিচুয়েশ তৈরী করে ফেলেছিলো যে, তুহীন বলেছিলো- যদি লিজি ওখানে বাড়ি বানায়, তাহলে লিজিকে সে খুন করে ফেলবে, মারুফ বলেছিলো যে, লিজিকে সে লাথি লাথিতে ওখান থেকে বের করে দেবে, আর অন্যান্রা বলেছিলো, তারা কখনোই আর মানিকগঞ্জে যাবে না। ইত্যাদি। আমি আর মিটুল সব সময় চেয়েছি যে, লিজি আপা যেনো ওখানে বাড়িটা করে। এর জন্য আমি নেপথ্যে থেকে যতো প্রকার সাহাজ্য করার দরকার, আমি সেটাই করেছি। আজ ঠিক এই মুহুর্তে মানিকগঞ্জে লিজি আপার ৬ তালা বিল্ডিং সায় দাঁড়িয়ে। বড় ভাবীর মৃত্যু দিয়ে আল্লাহ এমন সময় ওদেরকে মানিকগঞ্জে নিয়ে গেলেন যখন ওরা সবাই দেখল লিজি আপার ৬ তালা বাড়ি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, আজ সেই লিজি আপার বাড়িতেই সবার আশ্রয়। কি অদ্ভুদ না? আল্লাহ জুলুমকারীকে এবং অহংকারীকে কিছুতেই পছন্দ করেন না। সমস্ত দম্ভ ভেংগে দিয়ে আজ আল্লাহ এইসব সদস্যদেরকে একেবারে সেই লিজি আপার বাড়িতেই উঠাইলো। কিছু কি শিখতে পারলো ওরা?

ঘ।       মজার ব্যাপার হলো, যেদিন লিজি আপা মানিকগঞ্জে বিল্ডিং এর কাজে হাত দিলেন, ঠিক সেই সময়ে লিখন আমেরিকায় গিয়েছিলো রুটিন ভিজিটে। কি এক অদৃশ্য শক্তিতে আল্লাহ লিখনকে ভিসা জটিলতায় এমনভাবে আটকে দিলো যে, লিখন আর বাংলাদেশেই আসতে পারলো না। লিখন বলেছিলো যে, সে যদি দেশে থাকে তাহলে লিজি আপা কিভাবে বাড়ি বানায় সেটা সে দেখে নেবে। লিজি আপার পিতার ভিটা, তার নিজের হকের জমি, লিখনের জমিও না, অথচ লিখনের এই রকম দাম্ভিকতা আল্লাহ নিশ্চয় পছন্দ করেন নাই। কোনো না কোনো অজুহাতে আল্লাহ ঠিক তার ম্যাকানিজমে একেবারে সুদুর আমেরিকায় এমন করে বন্দি করে দিলো যে, ওর বাংলাদেশের চাকুরীটাও আর নাই, আর আমেরিকায় ৭/১১ দোকান গুলিতে খুবই সস্তায় একটা জব করতে বাধ্য হলো। এই ঘটনাটা আর যে কেউ যেভাবেই দেখুক, আমি দেখি আল্লাহর ন্যায় বিচারের নমুনা।

ঙ।       এখানে একটা কথা না বললেই না। মারুফের ছেলের বয়স মাত্র ৩ বছর। বড় ভাবী তার নায় নাতকুরের জন্য ছিলেন ডেডিকেটেড। সারাক্ষন তাদেরকে খাওয়ানো, পরানো, বাইরে নিয়ে গুরিয়ে আনা, কোথাও বেড়িয়ে আনা ইত্যাদি কাজগুলি খুব আদরের সাথে করতেন। আর তার নাতি নাতকুরেরাও বড় ভাবীর প্রতি খুবই ভক্ত ছিলো। কিন্তু যেদিন বড় ভাবীর করোনা ধরা পড়লো, ঠিক সেদিন থেকে মারুফের ৩ বছরের ছেলে মশারী তাংগীয়ে যে এক ঘরে বসে গেলো, ভুলেও সে আর তার দাদীর কাছে আসে নাই। সে বারবার বলতো যে, সে করোনায় ভয় পায় এবং সে তার দাদীর কাছে আসতে চায় না। বড় ভাবীর মরার আগ পর্যন্ত এই অবুঝ বাচ্চাটাও আর ভাবীর কাছে আসে নাই। কি নির্মম তাই না?

যাই হোক, আমি এই কথাগুলি বলে কাউকে ছোট করতে কিংবা আল্লাহ ওদেরকে শাস্তি দিয়েছেন এটা ভাবি না। শুধু ভাবী যে, মানুষের উচিত বান্দার হক সব সময় ফিরিয়ে দেয়া। এ জগতে কেউ থাকে না, থাকবেও না। কিন্তু আজ যে কর্মগুলি আমরা রেখে গেলাম, সেটার ফলাফল সে পাবেই।

এইমাত্র মিটুল বড় ভাবীর দাফনের পর বাসায় এলো। বেশ কিছু জানতে ইচ্ছে করল। যেমন, লিখন আমেরিকায় আছে, ওর মা মারা গেলেন, লিখন কি রকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, ছটফট করেছে কিনা, না আসার কারনে, কিংবা অনেক মন খারাপ করে ওর মার জন্য কান্নাকাটি করছে কিনা ইত্যাদি। মিটুল জানালো যে, যখন ভাবীকে দাফনের নিমিত্তে কবরে নামানো হবে, তখন অনেকেই ভাবীকে দেখার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলো। কেউ কেউ আবার ভিডিও ও করেছিলো। ওই সময় নাকি ইমন এবং মুবীন লিখনকে ফোন করে জানিয়েছিলো লিখন ভাবীর ভিডিও দেখতে চায় কিনা, কিংবা কিছু বলতে চায় কিনা। লিখন নাকি উত্তর দিয়েছিলো যে, সে কনো কিছুই দেখতেও চায় না, না ওর ছেলেমেদেরকে দেখতে দিতে চায়। এই ব্যবহারের অর্থ শুধু জানে লিখন। যাই হোক, ইতিহাস এটাই।

আজ থেকে হাসমত আরা (ভাবীর নাম) নামে কোনো মহিলার আনাগোনা এই দুনিয়া থাকলো না। কয়েকদিন সবাই তাকে নিয়ে হয়তো গল্প করবে, হাহুতাশ করবে, কেউ কেউ হয়তো তার অভাব ফিল করবে, কেউ আবার তার কথা ভুলেই যাবে। সময় তাকে আরো বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। এক সময় হাস মত আরা নামে কোনো মহিলা এই দুনিয়ায় ছিলো এটাই কেউ জানবে না। মানিকগঞ্জের বাড়িই বা কি, সন্তানই বা কি কোনো কিছুই আর নাই।  এটাই জীবন। জীবন সব সময় মৃত্যুর কাছেই পরাজয় বরন করেছে, আর করবেও। বড় ভাবী এখন ৩ হাত মাটির নীচে অন্ধকার কবরে একা এবং তার সাথে আর কেহই নাই। না তার সাধের বিছানা, না নায় নাতকোর, না আমেরিকার কোন সুসংবাদের কাহিনী।

আমি সব সময় মৃত মানুষের জন্য দোয়া করি।  ভাবীর জন্যেও আমি দোয়া করি। তার উপরে আমার কোনো রাগ নাই।