৬/৯/২০২৩-মনুষত্য যেখানে অমানবিক (ফারুক কাহিনী)

আজকের দিনটাকে ভেবে আগামীকালের দিনগুলি কেমন যাবে, ভালো না আরো ভালো নাকি খারাপ থেকে আরো খারাপ, সেটা বিচার করার বা উপলব্ধি করার কোনো বৈজ্ঞানিক ফর্মুলা মানুষের কাছে নাই।  আজকের রবিবারে হয়তো আপনি খিল খিল করে হাসছেন, আগামী রবিবার হয়তো এমন হতে পারে আপনার চোখের পানি সংবরন করার ক্ষমতাও আপনার নাই। কিংবা আজকে শনিবার যতোটা আপনি পেরেসান হয়তো দেখা যাবে আগামী শনিবারটা আপান্র জন্য এতোই মধুর যা তাঁর আগের দিনেও ভাবেন নি। আর এ জন্য আমি একটা কথা সব সময় বিশ্বাস করি জে, ভগবান সব দিনেই আপনাকে হাসিতে যেমন রাখেন না, তেমনি সব দিনেই আপনি কষ্টেও রাখেন না। এটাই নিয়তির সাথে ভগবানের একটা অদৃশ্য খেলা।

মানুষের মাথার উপর যখন কেউ হাত রাখে, তখন সেই হাতটাকে অনেক বড় অবলম্বন মনে হয়। পাতুক বা না পারুক সমস্ত কিছুর সমাধান দিতে, তারপরেও মনে হবে কেউ তো আছে যার কাছে গিয়ে অন্তত চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষনের জন্যে হলেও কষ্টে কান্না করা যায়, অথবা মুচকী হাসা যায়। আর এই সেই ‘কেউ’ এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ‘কেউ’ হচ্ছে সন্তানের জন্য তাঁর পিতামাতা, স্ত্রীর জন্য দায়িত্বশীল তাঁর স্বামী কিংবা দায়িত্বশীল স্বামীর জন্য কোনো দায়িত্বশীল স্ত্রী কিংবা সন্তান সন্ততিরা।

আজকে এমনই একটা ঘটনার অবতারণা হলো আমার সামনে। ওর নাম ‘ফারুক’। আমারই আপন বোনের ছেলে।

ফারুকের মা আমার আপন বোন শায়েস্তা। বোনদের মধ্যে সে ছিলো দ্বিতীয়। ছোট বেলা থেকেই সে ছিলো খুব মেধাবী। গায়ের রঙ কালো আর খুব জিদ্ধি ছিলো এই শায়েস্তা। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের সংসারে বেশ টানাপোড়েন শুরু হয়। পাঁচ জন বোন, সাথে মা আর আমি এই সদস্যদের নিয়ে আমার বড় ভাই হাবীবুল্লাহ মুটামুটি হিমশিম খাচ্ছে লালন পালনে। তাঁর অবদানের কথা আমরা কেহই অস্বীকার করতে পারবো না।

যাই হোক সেই অবস্থান টা এক সময় আমাদের পরিবর্তন হয়ে আবার কিছুটা থিতু হইলেও আমার বোন শায়েস্তার জীবনে নেমে আসে এক কালো অধ্যায়।

২১/০৫/২০২৩-পরিবার থেকে নিজে বড়

কোনো মতবাদ কিংবা প্রচলিত প্রবাদের বাইরে গিয়েই বলছি- দেশের থেকে সম্ভবত সমাজ বড়, সমাজের থেকে পরিবার আর পরিবারের থেকে বড় নিজে। এটাই সত্য। যখন একাই এসেছি এই দুনিয়ায় তখন আমি দেশ নিয়ে আসিনি, আমি সমাজ নিয়ে আসিনি, না আমি পরিবার সাথে করে নিয়ে এসেছি। আমি সম্পুর্ন একা এবং কোনো কিছু ছাড়াই এই দুনিয়ায় এসেছি। এই দুনিয়ায় এসে আমি যা পেয়েছি- তা হলো, দেশ, সমাজ আর পরিবার। এটা সম্ভবত শুধু মানুষের বেলায়ই প্রযোজ্য।

তাকিয়ে দেখুন একটা বন্য প্রানীর দিকে। তার সমাজ থাকলেও সে সেই সমাজের কোনো আইনের মধ্যে নিবন্দিত নয়। যখন তার যা খুশী সেদিকেই তার বিচরন। ক্ষুধায় তাকে অন্য কোনো প্রানী খাদ্য জোগায় না, শীতে অন্য কোনো প্রানী তাকে গরমে আচ্ছাদিত করে না। সে মরে গেলেও কেউ আফসোস করে না। কিছু কিছু প্রানী হয়তো দল বেধে চলে বটে কিন্তু সেই দলের জন্য কেউ কোনো দায়িত্ত নিয়ে এটা করে না যে, সবাইকে বাচিয়ে নিজে বাচবো। তারা সবাই যার যার জীবন নিয়ে দলবদ্ধভাবে একাই চলে। তারা এটা করতে পারে কারন, তাদের চাহিদা শুধু খেয়ে বেচে থাকার। ওদের পেট ভরে গেলে অতিরিক্ত আর কিছুই সঞ্চয়ের চিন্তা থাকে না, তারা অট্টালিকা, গাড়ি বাড়ি ব্যাংক ব্যালেন্স কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কিছুই রেখে যায় না। এ জন্যই ওরা সর্বদা সুখী। ওরা কারো আক্রমন মনে রাখে না, কাউকে আক্রমন করলেও সেটা নিয়ে আর ভাবে না। ব্যাপারটা সেখানেই মিটে যায় যেখানে শুরু এবং শেষ হয়েছিলো।

আমরা প্রত্যেকেই একা, আর এই একাকীত্ব আমরা বুঝতে পারি বয়সের ভাড়ে যখন আমরা নেতিয়ে যাই। সারাজীবন পরিবারের জন্য আমরন কষ্ট করেও আমরা সেই মানুষ গুলির নাগাল পাই না যাদের জন্য আমরা আমাদের সব সুখ জলাঞ্জলী দিয়ে ভেবেছিলাম-“একদিন আমি সুখী হবো”/ একদিন আমি সুখী হবো-এই মিথ মানুষের জীবনে কখনোই আসে না। আসবেও না। তাহলে কেনো এই মিথ? এটা একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই না।

আমি আজকের দিনের সমাজের কাছে কিংবা পরিবারের কাছে আমার এই মিথ প্রকাশ করা মানে আমি সবার কাছেই একটা নেগেটিভ মাইন্ডেড মানুষের পরিচয় বহন করবো, এটাই এই সমাজের মিথ। কিন্তু একবার ভাবুন তো? আমি সারাজীবন কষ্ট করে আমি একটা সাম্রাজ্য তৈরী করবো, আর সেই সাম্রাজ্যে আমার কিছু পরিবারের সদস্য আমার সমস্ত মিথ ধুলোয় নষ্ট করে দিতে একটু সময় ও কার্পন্য করবে না, তাহলে কেনো আমাকে এই মিথ বিশ্বাস করতে হবে? তাই আমি সব সময় আমার পরিবারের সদস্যদের বলি- আমার মতো করে চলতে না পারলে আমাকে নিয়ে টানাহেচড়া করো না। তোমরা তোমাদের ভাগ্যকে বদলে দাও। আমার ভাগ্যের কোনো কিছুই তোমাদেরকে পাল্টাতে হবে না। না তোমরা আমার ইজ্জতকে বিনা কারনে এতোটুকু নীচে নামিয়ে আনো যেখানে আমি কখনো যেতে চাই না। তোমাদের এই সমাজে আমি যতটুকু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি, আমাকে সেই ততটুকুতেই থাকতে দাও। তোমাদেরকে সাথে নিতে গিয়ে আমাকে যেনো সেই অর্জিত ইজ্জতটুকু আমাকে ক্ষয় করতে না হয় শুধু এটুকু রহম করো। আর যদি সেটাও করতে না পারো- তাহলে তুমি বা তোমরা যেইই হও, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি একা এসেছি, একাই থাকতে অভ্যস্থ হয়েছি।একাই থাকতে পারবো।

১৩/০১/২০২২-Meeting Fourth Generation

গল্পটা কাল্পনিক নয়। গল্পটা সত্যি। আর এখানে যাদের নামগুলি উল্লেখ করা হয়েছে, তারা তাদের নিজের নামেই রয়েছেন। অনেক অজানা কষ্ট আর বেদনা দিয়ে এই পৃথিবী এতোই ভরপুর যে, সবাই এক নাগাড়ে সবার কষ্টের কথা, বেদনার কথা, সাফল্য আর ব্যর্থতার কথা বলতে গেলে সারা পৃথিবীতে শুধু কান্নার রোলই পড়ে যাবে। তারপরেও মানুষ বেচে থাকে আশা নিয়ে, হতাশাকে দূর করে কিছু আনন্দ আর হাসি নিয়ে। এরই নাম জীবন। কেউ হেরে যায়, কেউ পড়ে যায়, কেউবা আবার পরতে পরতে দাঁড়িয়ে যায়। আজ থেকে অনেক জেনারেশন পর সেসব মানুষগুলি হয়তো জানবেই না, কি ছিলো তাদের সেই কষ্টে ভরা তাদের অতীতের পূর্বসুরীদের জীবন, কিংবা কিভাবে আজ তার এই পর্বে আসা। আজকে এই ঘটনার মানুষগুলিকে সেই চরাই উতরাই পার করে সেই সব পূর্বসুরীরা নতুন প্রজন্মের জন্য নব পরিস্থিতি তৈরী করে গেছে। আজকের গল্পের মানুষ গুলিকে এই পর্বে আসতে অন্তত চারটি জেনারেশন পার করতে হয়েছে। এর মধ্যে ১ম জেনারেশনের কেহই জীবিত নেই, ২য় জেনারেশনের অনেকেই গত হয়েছেন, কেউ কেউ এখনো জীবিত আছেন বটে কিন্তু বয়স অনেক হয়ে গেছে তাদের। ৩য় জেনারেশনের এখন পড়ন্ত বিকেলের মতোই। আর ৪র্থ জেনারেশন তারা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, আর সবেমাত্র তাদের মধ্যে একটা সমন্নয় হলো। এবার দেখার বিষয় পরের প্রজন্মের কাহিনী। হয়তো অন্য কেউ লিখবে তার পরের প্রজন্মের ইতিহাস, এমনো হতে পারে, থাক...। 

হামিদা খাতুন আমার মা, বিল্লাল ভাই (বেলায়েত ভাই ) আমার সেই ভাই। বহুদিন একই গ্রামের কাছাকাছি ছিলাম, মাঝে মাঝে এক সাথে দুজনে সিগারেট টানতাম। অতীতের অনেক গল্প শুনতাম। কখনো সেই গল্পে ছিলো হাসি, কখনো ভেজা চোখ আবার কখনো নিগুড় কালো রাতের মতো অন্ধকারের ভীতি সঞ্চারী অনুভুতি। বিল্লাল ভাই মারা গিয়েছেন অনেক বছর আগে। তার সন্তানদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিলো, এখনো আছে তবে খুব ঘন ঘন নয়। কারন তাদের অনেকেই দেশের বাইরে চলে গেছে। বিল্লাল ভাইয়ের স্ত্রী এখনো জীবিত আছেন। তিনিই বা কতটুকু গল্পগুলি জানেন তা আমার জানা নাই। তবে তিনিএখন সার্থক স্ত্রীর মতো সার্থক মাও। তার সন্তান সেলিম বর্তমানে নেভাদায় থাকে। আমার ছোট মেয়ে কনিকা আমেরিকায় যাওয়ার সুবাদে এই প্রথম সেলিমদের এবং তার সনাত্নদের সাথে প্রথম দেখা হলো। এরা ৪র্থ জেনারেশন। আমার ফার্ষ্ট নাতি ওরা। আমার মা আজ বেচে থাকলে আর আমার ভাই বিল্লাল ভাই বেচে থাকলে বড্ড খুশী হতেন। জীবন কত বিচিত্র। কোথাও না কোথাও গিয়ে এর রুট মিলিত হয়ই। 

“কিছু কথা আছে যা বলতে চাই নাই কিন্তু বলা হয়ে যায়, কিছু কথা ছিলো, বলতে চেয়েছি, অথচ বলা যায় নাই, কিছু সপ্ন ছিলো যা দেখতেই চাই নাই কিন্তু দেখতে হয়েছে আবার কিছু এমন সপ্ন ছিলো সব সময় দেখতে চেয়েছি কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় নাই এমন কিছু শখ ছিলো সারাজীবন লালন করেছি কিন্তু জীবনের শেষ তীরে এসেও সেটা ধরা দেয় নাই আবার এমন কিছু ভয় ছিলো যা একেবারেই কাম্য নয় অথচ তা আমি এড়িয়েই যেতে পারিনি কী কারনে আবার এই কিছু কথা না বলতে চেয়েও বলতে হয়েছে, কিছু সপ্ন আমাকে দেখতেই হয়েছিলো অথচ সেটা আমার কাম্য ছিলো না, আবার কিছু স্বপনের ধারে কাছেও আমি যেতে পারিনিএটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস আমি এই আফসোসের ব্যাপারটা নিয়ে বহুবার গবেষনা করেছি কিন্তু জীবনের কাছে রাখা সব উত্তর সবসময় তার প্রশ্নের ন্যায় বিচার করে না। বিশেষ করে প্রশ্নটা যখন এমন হয় যেটা মনকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খায়, আর হৃদয়কে ছুড়ি দিয়ে ফালা ফালা করে দেয়। ফলে কোনোই আমি সেইসব প্রশ্নের উত্তর পাই নি, না আমার কাছে, না যাদের কাছ থেকে উত্তর পাওয়া দরকার ছিলো তাদের কাছ থেকে। আর উত্তর না পেতে পেতে একসময় আমি কোনো উত্তরের আর আশাও করিনি। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার কাছে শতভাগ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো যে, আমার এই অপারগতার কারন না আমি নিজে, না আমার সাথে যারা জড়িত ছিলো তারা না এটা আমার দোষ, না ছিলো তাদের আমি যদি আরো গভীরে গিয়ে এর আনুবীক্ষনিক পর্যালোচনা করি, তাহলে হয়তো আমার আরেকটা আফসোসের কথা প্রকাশ না করলেই নয় যে, আমার সেই অপারগতা কিংবা ঘাটতির কিছুটা হলেও কেউ না কেউ সহজেই হয়তো পুরন করতে পারতো, যা ‘সেই কেউ’রা হয়তো চেষ্টাই করে নাই

উপরের এই কথাগুলি আমার নয়, কথাগুলি একজন এমন মানুষের যাকে আমি আমার মতো করে চিনতে শুরু করেছিলাম আজ থেকে প্রায় ২৪ বছর আগে যখন আমার বয়স প্রায় ২২। কতটুকু আমি তাকে বুঝতে পেরেছিলাম, সেটা আমার জানা নাই, কিন্তু কেনো জানি আমার খুব মায়া হতো, আর এই মায়ায় মাঝে মাঝে আমি নিজেকে তার ভূমিকায় প্রতিস্থাপিত করে দেখতাম কি হয় ভাবাবেগে অথবা মানসপটে। এই সময়টায় আমি খুব ভাবাগেবিত হয়ে যেতাম। ভাবাবেগিত হতাম এটা ভেবে যে, কি পরিমান চাপ কিংবা কষ্ট নিজের বুকের ভিতরে লুকিয়ে রাখা সম্ভব? তখন আরো বেশী মায়া হতো একজনের জন্য নয়, দুজন নিসংগ মানুষের জন্য যাদের উভয়ের বুকেই ছিলো সমান যন্ত্রনা আর ভাগ্যের আক্ষেপ। একজন যেনো পরাজিত, আর অন্যজন সেই পরাজয়ের কারন। এদের একজন আমার “মা” আর আরেকজন ‘বিল্লাল ভাই’ যাকে সবাই ডাঃ বেলায়েত নামেই চিনতো। আমি আজ সেই তাদের কথাই হয়তো বলবো।

আমার ‘মা’র সম্পর্কে আমি অনেকগুলি লেখা ইতিমধ্যে লিখলেও তার সবচেয়ে বড় দূর্বল বিষয়টি আমি কখনো আমার লেখায় আনিনি। আমি জানতাম এবং অনুভব করতাম আমার মায়ের সেই দূর্বলতা। আমার মায়ের এই দূর্বলতা তার নিজের সৃষ্টি যেমন নয়, আবার তিনি ইচ্ছে করলেও তার সেই অপারগতাকে তিনি অনায়াসেই দুহাত দিয়ে এক পাশে সরিয়ে দিতে পারতেন না। এই দূর্বলতা সমাজ সৃষ্টি করেছে, আর সেই সমাজ আজকের দিনের দুটি মানুষকে বিজন বিজন দূরে ঠেলে দিয়ে দুজনকেই অসুখী একটা বলয়ে জীবিত কবর দিয়েছিলো। আমার মায়ের সেই বড় দূর্বলতা ছিলো এই ‘বিল্লাল’ ভাই। পরবর্তিতে প্রায় তিন যুগ পরে যেদিন আমি আমার মায়ের সর্বশেষ ভিডিওটি করি, তখন অনেক প্রশ্নের উত্তর আমি জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু সে প্রশ্নগুলির উত্তর আমাকে আরো ব্যথিত করে দিয়েছিলো। সেই প্রশ্নের উত্তর আমাকে প্রতিটিবার চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিলো, আমার অন্তরের কোথায় যেনো ছট ফট করছিলো কোনো এক অয়াশান্ত অনুভুতিতে। আর যিনি উত্তর দিচ্ছিলেন, আমার মা, তার দ্রিষ্টি কখনো সেই মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে নির্লিপ্ত হয়ে ভাষাহীন কিছু শব্দ তেই শেষ হচ্ছিলো যার সাহিত্যিক নাম- আহা, কিংবা উহু। এসব বেদনার রাজত্তে যিনি ছিলেন, সে আর কেউ নয়, বিল্লাল ভাই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কে এই বিল্লাল ভাই? যদি এর উত্তর খুজতে চাই, তাহলে ফিরে যেতে হবে আজ থেকে বহু বছর আগে যখন আমারও জন্ম হয় নাই। ফলে আমি যা জেনেছি, শুনেছি, তা পুরুই হয় আমার মার কাছ থেকে, কিংবা আমার অগ্রজ ডঃ হাবীবুল্লাহর কাছে বা স্বয়ং বিল্লাল ভাইয়ের কাছ থেকে জানা কিছু তথ্য। কিন্তু আমার কাছে সব ব্যাপারটাই যেনো মনে হয়েছে,  এটা ছিলো একটা ভাগ্য আর সময়ের খেলা।

কেনো ‘ভাগ্য’ আর ‘সময়’ বললাম তারও একটা ব্যাখ্যা আছে। অনেক সময় এমন দেখা যায় যে, “ভাগ্য” আর “সময়” দুটুই কারো জীবনে একসাথে আসে, কিন্তু “ভাগ্য” আর “সময়” ওরা কখনোই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ না। সঠিক ব্যবহারে ভাগ্য পালটাতে পারে বটে কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে ভাগ্যও পালটে যায়। কিন্তু এই ‘সঠিক’ ব্যবহার আবার সবাই সবসময় হয়তো পায়ই না যাতে সেই সঠিক ব্যবহারে তার ভাগ্য পাল্টাতে পারে। কেউ কেউ পারে, আবার কেউ কেউ পারে না। আবার কারো কার ব্যাপারে সুযোগটাই আসেনা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া কোনো ব্যক্তিত্ত সময়ের স্রোতে আবার বেশীদিন অসহায়ও থাকে না। একসময় না একসময় সে ঘুরে দাড়ায়ই যদি তার দৈবক্রম ভাগ্য আবার সেই ঈশ্বর কোনো এক যাদুর কাঠিতে হাল ঘুরিয়ে দেন। শুধু হাল ঘুরিয়ে দিলেই হয়তো তার সেই নির্যাতিত ভাগ্য দৈবক্রম ভাগ্য সঠিক নিশানায় পৌছায় না যদি তার চোখে না থাকে সপ্ন আর প্রবল একটা ইচ্ছাশক্তি। আজকের লেখার প্রধান চরিত্র এই ‘বিল্লাল’ ভাইয়ের ব্যাপারেও সেই দুটু শব্দ প্রায় একই সুরে খেটে যায়। ভাগ্য তাকে সুপ্রস্নন করে নাই, আবার করেছেও। ‘সময়’ তাকে একটা বলয় থেকে ছিটকে ফেলেছিলো বটে কিন্তু আবার সেই ‘সময়’টাই বদলে দিয়েছে তার সব জন্মগত বৈশিষ্ট।

বিল্লাল ভাইয়ের এই ইতিহাস নাতিদীর্ঘ নয়। এই ইতিহাস একটা পূর্ন জীবনের। আর সেই জীবনের বয়স কাল নেহায়েত কমও নয়, প্রায় ৫৫ বছর। এই ৫৫ বছরে পৃথিবী তার অক্ষে ৫৫ বার প্রদক্ষিন করে কত যে ঋতু আর কাল প্রশব করেছে তার কোনো হিসাব নাই। তাই বিল্লাল ভাইয়ের এই ইতিহাস বলার আগে সেই মানুষটির ইতিহাস বলা প্রয়োজন যার জন্য আরেক অধ্যা তৈরী হয়েছিলো বিল্লাল ভাইয়ের। আর তিনিই হচ্ছেন- আমার মা, আর জন্মধাত্রী বিল্লাল ভাইয়ের।

আমার মায়ের পুরু নাম ‘মোসাম্মাত হামিদা খাতুন’। নামটা আমি এভাবেই সবসময় লিখে এসেছি আমার ব্যক্তিগত তথ্যাবলীর মধ্যে। আমার মায়েরা ছিলেন দুই বোন এবং তার কোনো ভাই ছিলো না। আমার মায়ের আরেক বোনের নাম ছিলো ‘মোসাম্মাদ সামিদা খাতুন’। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, গ্রাম্য ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ারিশান সার্টিফিকেটে তাদের দুজনের নামই লিখা হয় যথাক্রমে ‘হামিরন নেছা’ এবং ‘ছামিরন নেছা’। যাই হোক, নাম বিভ্রাটের কারনে আজকাল হয়তো ব্যংকে একাউন্ট করতে জটিলতা থাকতে পারে, কিংবা ক্রেডিট কার্ডে ঝামেলা হতে পারে, কিন্তু এই নামের বিভ্রাটের কারনে আমাদের মুল চরিত্রের মানুষ গুলির জীবনের ইতিহাসে কোনো প্রকার ব্যত্যয় হয় নাই। আর আমার এই লেখাতেও এটা অনেক বড় সমস্যা নয়। আমার নানা অর্থাৎ আমার মায়ের বাবার নাম ছিলো ‘কেরামত আলি’। আজকাল এই নাম গুলি আর কেউ রাখে না। হয়তো ভাবে যে, নাম গুলি আধুনিক নয়। কিন্তু এই নামের মানুষ গুলি ছিলে ভালোবাসার আর ভরষার ভান্ডার। যাই হোক, যদি আরেকটু আগের জেনারেশনে যাই, তাহলে আমরা সেই ‘কেরামত আলি’র বাবার নাম পাবো ‘উম্মেদ আলী মুন্সী’। এই উম্মেদ আলীর বাবা জনাব হাজী আসাদুল্লাহ (পিতা-আহাদুল) এর শাখা প্রশাখা বিশ্লেষন করলে এমন এমন কিছু বর্তমান আত্মীয় সজনের নাম চলে আসবে যা না আমরা অনেকেই মানতে চাইবো, না আমরা তা গ্রহন করবো। তার কারন একটাই-সমাজের স্তরভিত্তিক কেউ এমন জায়গায় আর কেউ এমন স্তরে যা না মিশে বংশে, না মিশ খায় পরিবারে। কিন্তু বাস্তবতাটাই যে অনেক কঠিন এটা মানা আর না মানাতে কিছুই যায় আসে না। না মানার মধ্যে হয়তো থাকতে পারে একটা বড় অহংকার বা সম্পর্ক ছিন্নকারীদের মধ্যে সামিল, কিন্তু বাস্তবতা পালটায় না তাতে। যাই হোক, সেই ৫/৬ জেনারেশন আগে না হয় নাইবা গেলাম।

আমার মায়ের বয়স যখন সবেমাত্র বারো কি তেরো, তখন সমাজের রীতি অনুযায়ী আমার নানা কেরামত আলি বিবাহযোগ্য মেয়ের বোঝায় চাপ অনুভব করে তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। আজ থেকে সেই প্রায় সত্তর বছর আগে যেটা হয়তো ছিলো সমাজের একটা রীতি, আজ তা বাল্যবিবাহের নামে সমাজ তাকে অপরাধের কারন বলে উল্লেখ করে। যেটাই হোক, সমাজের রীতি অনুযায়ী আমার মা, খালাদের বিয়ে ওই বারো তেরো বছর বয়সেই হয়েছিলো। আমার মায়ের সেই স্বামীর নাম ছিলো আব্দুল জলিল (সম্ভবত)। সম্ভবত বলছি এই কারনে যে, নামটা এই মুহূর্তে সঠিক লিখলাম কিনা সিউর হতে পারছি না। তবে সঠিক হবার সম্ভাবনা ৭৫%। ১২ বছরের একজন প্রায় নাবালিকা বিয়ের পর এখন অন্য বাড়ির বউ হয়ে গেলো। এই নববধূর পড়নের কাপড়টাই হয়তো তার থেকে প্রায় তিন গুন লম্বা, সবে মাত্র হায় প্যান্ট ত্যাগ করা বালিকাটি এখন নাকে নোলক, হাতে মেহেদী সমেত চূড়ি, কানে দূল, আর মাথায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই পরিচিত সব মানুষ গুলি থেকে আলাদা হয়ে অন্য এক সংসারে একটা আলাদা পরিচয় নিয়ে বাপের বাড়ি ছেড়ে গেলো। তার শখের পুতুল, ছেড়া বই কিংবা সখীদের অনেক গোপন কিছু মজার স্মৃতি সব ছেড়ে কেদে কেদে নিজের সেই খেলার আংগিনা, কাথা বালিশ আর বাড়ির উঠোনের মায়া ত্যাগ করে অন্য কোথাও যেতেই হলো। এ যেনো পালের একটা পোষাপ্রানী যে কিনা এখনো তার মায়ের দুগ্ধপানও ছাড়ে নাই। এই বয়সের একজন অপরিপক্ক নাবালিকা কি সংসার করছে বা করেছে সেটা আমি আজো বুঝে উঠতে পারিনা কিন্তু বিধাতার সিস্টেমে আমার মা গর্ভবতী হলেন। আর সেই গর্ভধারনের পরে সঠিক সময়ে তিনি সুস্থ্য একটি পুত্র সন্তানও দান করেন তার শ্বশুরালয়ে। এই পুত্রটির নামই হচ্ছে- বিল্লাল হোসেন বা বেলায়েত হোসেন। সবকিছুই ঠিকঠাক মতোই চলছিলো। স্বামী, সংসার, পুত্রযত্ন সবকিছু। নবাগত পুত্র সন্তানের আদরের কোনো কমতি নাই, নব নাম ধারী হামিদা এখন শুধু হামিদাই নয়, সে এখন ‘মা’ও বটে। তার নতুন নাম ’মা’। চারিদিকেই একটা নন্দ যেনো বাতাসের প্রবাহের মতো সারাটা বাড়ি দোলায়িত হচ্ছে, কেউ পুতুল নিয়ে দেখতে আসে, কেউ দোয়া দিতে আসে, কেউবা আবার আসে এম্নিতেই। সব কিছুই ঠিক যেভাবে চলার কথা সেভাবেই চলছিলো। কেরামত আলী তার মেয়ের জন্য গর্বিত, পাড়ার লোকেরাও। কিন্তু বিধাতার পরিকল্পনা মানুষের পরিকল্পনার থেকে অনেক বেশী যেমন রহস্যময়ী, তেমনি অনেক কঠিনও। তিনি কাকে কি দিয়ে সুখবর দিবেন আর কাকে কি দিয়ে দুঃখের অতল গভীরে নিয়ে যাবেন, তার হিসাব কিংবা ছক আমাদের কারোরই বুঝার কথা নয়। আর সে অধিকার ঈশ্বর কাউকে দেন ও নাই। তিনি একাই খেলেন, একাই গড়েন, আবার একাই ভাঙ্গেন। কেনো গড়েন, কেনো ভাজ্ঞেন এর ব্যাখ্যা চাওয়ারও আমাদের কোনো উপায় নাই। ফলে দেখা যায়, একই খবর কারো কাছে যেমন শুভ হয় আবার কারো কাছে তেমনি অশুভও হয়। একই জায়গায় মিলিত হওয়া মানুষের রাস্তা যেমন তিনি আলাদা আলাদা করে দেন, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন রাস্তায় চলাচলকারী অনেক মানুষের রাস্তাও তিনি এক জায়গায় এনে মিলন ঘটান। একই পরিস্থিতিতে যেমন একজন জীবনকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যান, আবার সেই একই পরিস্থিতিতে তিনি আরেকজন জীবনকে অসহায় অবস্থার সাথে বোঝাপড়া করতে ব্যস্ত করে তোলেন। আমার মায়ের বেলাতেও ঠিক এমন একটা পরিস্থিতি হাজির করলেন বিধাতা। আমার মায়ের স্বামী আব্দুল জলিলকে তিনি এই নশ্বর পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন। যে নাটাইটায় একটা গুড়ি নিজের আনন্দে নীল আকাশের হাওয়ায় ভেসে একবার এদিক, আরেকবার ওদিক দোল খাচ্ছিলো, হটাত নাটাইটা বিচ্ছিন্ন করে দিলো ফানুশের মতো উরে থাকা রংগিন ঘুড়িটা। ছন্দে ভরা কতগুলি জীবন এক সাথে যেনো ছন্দ পতনের ধাক্কায় চারিদিক বেশামাল হয়ে গেলো। আমার মা হামিদা ভয়ে আতংগকে আর বিষন্নতায় বোবা হয়ে গেলেন, হামিদার বাবা কেরামত আলী মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনায় মুর্ছা যেতে লাগলেন। আর হামিদার সদ্য জন্মানো পুত্র বিল্লাল কিছুই না বুঝে মায়ের দুধের জন্য বিকট চিতকারে বাড়ি, ঘরময় যেনো আলোড়িত করে দিলো। মাত্র ১৪ বছর বয়সে আমার মা হামিদা খাতুন বিধবার তকমা গলায় পড়ে হাহাকার ঘরে যেনো নির্বাক হয়ে গেলেন।

কোনো নারীর অধিকার তার স্বামীর বাড়িতে স্বামীর বর্তমানে যেমন থাকে, সেই নারীর সেই অধিকার স্বামীর অবর্তমানে আর তেমন থাকে না। হামিদার স্বামীর ইন্তেকালের কয়েকদিন পর বাড়ির অন্যান্য সবাই যখন হামিদার স্বামীর শোকের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে থাকে, ততোই যেনো হামিদার উপর অন্যান্যদের খোটার ভার বাড়তে থাকে। এই বয়সে স্বামীকে বুঝার আগেই যখন কেউ স্বামী হারা হয়, তার নিজের মনের অবস্থার কথা কেউ তো ভাবেই না, বরং সব দোষ যেনো সেই অপয়া হামিদারই। পৃথিবীর কেউ এই নাবালিকা বিধবার মনের ভিতরের কষ্ট কিংবা বেদনার অনুভুতি না বুঝলেও হামিদার বাবা কেরামত আলী ঠিক বুঝতে পারছিলেন কি চলছিলো হামিদার ভিতরে। তিনি কোনো কিছুই চিন্তা না করে দুই অবুঝ, এক হামিদা এবং তার পুত্রকে নিয়ে চলে এলেন নিজের বাড়িতে। হামিদা এখন আবার তার পিত্রালয়ে সেই চেনা পরিবেশে ফিরে এলো। আজকের এই চেনা পরিবেশ যেনো আর আগের সেই পরিবেশ নাই, তার খেলার অনেক সাথীরাই অন্যের বধু। এখন আর দলবেধে কাউকে নিয়ে সেই চেনা পরিচিত নদীতে হৈ হুল্লুর করে জল্কেলীর কোনো সুযোগ নাই। কোথায় যেনো বীনার তার গুলি ছিড়ে গেছে। আর সাথে তো আছেই পুত্র বিল্লাল, যার কাছে দাদা বাড়িই কি, আর নানা বাড়িই কি কোনো কিছুরই কোনো পার্থক্য নাই। শুধু মনের অজান্তে চোখের পানি ঝরছে হামিদার আর তার সাথে অসহায় বিধবা কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা কেরামত আলির। জখম যেনো কিছুতেই ক্ষরন বন্ধের নয়।   

শরীরের কোনো কাটাছেড়া, কোনো বাহ্যিক জখম হয়তো চোখে দেখা যায়, ক্ষুধা হলে খাবারের অভাবে ক্ষুধায় হয়তো পেট গুরগুর করে, কিংবা জ্বর সর্দি, কাশি কিংবা মাথা ব্যথা হলে তার সিম্পটম অনায়াসেই বুঝা যায় কিন্তু অন্তরের জখম কি কখনো চোখে পড়ে? অন্তরে কি কখনো জখম হয় আদৌ? আর এই অন্তরটাই বা শরীরের কোন অংগ? এটা কি এমন কোনো জিনিষ যা মাংশ বা হাড় কিংবা এমন কিছু দিয়ে এর গঠন কাঠামো? অথচ এই জখম অনুভুত হয়, এই কষ্ট নিজেকে প্রতিটি ক্ষনে মনকে বিষন্ন করে দেয়। সেই অদেখা অন্তরে রক্তক্ষরন হয়। এই অন্তর্জালা, রক্তক্ষরন আর কষ্টে মাত্র ১৪/১৫ বছর বয়সের এই অবুঝ বালিকা আরেকটি সদ্যজাত নবাগতকে নিয়ে পৃথিবীর সব মানুষের চোখে যেনো একজন অপরাধি সেজে জীবিত অবস্থায় মৃত হয়ে রইলেন। স্বামীর ম্রিত্যু যেনো তারই অপরাধ। তার এই ঘটনার জন্য যেনো তিনিই দায়ী। একদিকে অবুঝ মন, অন্যদিকে সাথে আরেকটি অবুঝ সন্তান, সব মিলিয়ে চারিদিকে এক মহাশুন্যতা। মেয়ের এমন একটি দুঃসহ শুন্যতা নিজে পিতা হয়ে কেরামত আলী কি করবেন? দিন গড়ায়, রাত যায়, শুন্যতা আরো চেপে বসে হামিদার। তার যে বয়স, সে বয়সে তিনি হয়তো বিয়ের মাহাত্তটাই বুঝে উঠতে পারেন নাই, কিন্তু তাকে এখন বিধমার তকমাটাও বুঝতে হচ্ছে, বুঝতে হচ্ছে একজন অবুঝ সন্তানের মা হিসাবে তার অকাল পরিপক্ক দায়িত্ব।

যখন কোনো মানুষের দুঃখ থাকে, কষ্ট থাকে, তাহলে সে সবসময়ই চাইবে যে, সে অন্য কারো সাথে তার এই দুঃখটা, কষ্টটা শেয়ার করতে। কেউ তো থাকবে যে, ওর কথা শুনবে। বুঝুক না বুঝুক সেটা আলাদা ব্যাপার, কষ্ট লাগব করুক বা না করুক সেটাও আলাদা ব্যাপার। কিন্তু কারো সাথে তো তার এই কষ্টের ব্যাপারগুলি শেয়ার করা দরকার। আর হামিদার এই কষ্টের ভাগীদার কিংবা শ্রোতা হয়ে রইলো শুধু একজন-সেই নাবালক পুত্র ‘বিল্লাল’। চোখ ভিজে আসে তার, মন ভেংগে আসে যন্ত্রনায়, আর মনে হয়-কেনো? কেনো বিধাতা তাকেই এর অংশ করলেন? অন্য কেউ নয় কেনো? সেই অবুঝ পুত্র বিল্লালের কাছে ‘হামিদা’র হয়তো শুধুই একটা জিজ্ঞাসা। নাবালক বিল্লাল হয়তো এর কিছুই বুঝে না, কোনো এক ভিনদেশী ভাষায় হয়তো কিছুক্ষন অদ্ভুত শব্দ করলেও মায়ের সেই কান্নায় ভীত হয়ে নিজের অজান্তেই কেদে দেয় বিকট এক শব্দে যা হয়তো বিধাতার কাছেই তার মায়ের কষ্টের ফরিয়াদ। হয়তো মা ছেলের এই অসহায় কান্নায় বুকে জড়িয়ে ধরে নিজের চোখের জলে কাপা কাপা গলায় বলতে থাকেন- আমি তো আছি তোর পাশে। ভয় নাই। মা আছে। পৃথিবীর কেউ তোর পাশে থাকুক বা না থাকুক, আমি তো আছি। এভাবেই কাটতে থাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এবং এক সময় কয়েক বছর।

জীবন যেখানে যেমন। যে শিশুটি আজ জন্ম নিলো কেউ জানে না তার জন্য এই পৃথিবী কি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিংবা এই প্রিথিবীকে সে কি দিয়ে যাবে। বিধাতা চাইলে যে কোনো কিছুই হতে পারে। হতে পারে আজকে এই শিশুটি হয়তো এই পৃথিবীকে কোনো একসময় কাপিয়েও যেমন দিতে পারে আবার এই পৃথিবী তাকেও নাড়িয়ে দিতে পারে। এই বিশ্বভ্রমান্ডে এমন অনেক শিশুই জন্ম নেয় যারা অনেকেই অনেক ভুমিকা রাখে আবার কেউ কেউ কিছুই রাখে না, না পৃথিবীও তাদেরকে মনে রাখে। এমন মানুষের সংখ্যাই হয়তো নেহায়েত যেমন কম না, তেমনি ভুমিকা রাখে এমন শিশুও কম না। যুগে যুগে তারপরেও অনেক শিশু গোপনে পৃথিবীতে আসে, প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় আর একদিন সবকিছু ফেলে সবার থেকে আলাদা হয়ে আবার কোথাও অদৃশ্য হয়ে যায়। মাঝখানের এই সময়টায় খুব গুটিকতক মানুষ হয়তো নিজের মতো করে কাউকে কাউকে মনে রাখে কিন্তু তাও একসময় মনের স্মৃতি থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়। কিন্তু ‘বিল্লালের বেলাতে এটা ঘটে নাই। তিনি প্রকাশ্যে দিবালোকে এই সমাজে বৈধভাবে পদার্পন করেছিলেন, তার যোগ্য অভিভাবক ছিলো, তার পরিচয় ছিলো, আর ছিলো পাশে থাকা অনেক মানুষ যারা তাকে নিয়ে ভেবেছে, তার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করেছে। কিন্তু বিধাতা তো আর মানুষের মত নন। তার পরিকল্পনা, তার ইচ্ছা, তার কার্যকারিতা সবকিছুই তার মত। বিল্লালের যখন মাত্র দুই থেকে হয়তো একটু বেশী, তখন হামিদাকে ছাড়তে হলো তারই ঔরসে জন্ম নেয়া তার পুত্র বিল্লালকে। সমাজ বড্ড বেরসিক, সমাজের আইনকানুনগুলিও একপেশে। এই আইন মানতে গিয়ে কে কাকে ছেড়ে যাবে, আর কার জীবন কোন আইনের পদাঘাতে পিষ্ঠ হবে সেটা যেনো সমাজের কোনো দায়বদ্ধতা নাই। আর এর সবচেয়ে বেশী আহত হয় সমাজের নারীরা। নারী বা মহিলাদেরকে এই সমাজে সেই প্রাচীনকালের মতো আজো দেবীর সমান তুলনা করে থাকে কিন্তু আফসোস যে, এটা শুধু মন্দির আর পুজার ঘর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। মহিলাদের সাথে আজো লাগাতার অন্যায়, নীপিড়ন, শোষন, অধিকারহীনতা আর অপরাধ ঘটে যাওয়া এটাই প্রমান করে যে, আমাদের সমাজে আমরা যে মহিলাদেরকে দেবী বলি তারা এখনো অনেক দানব দ্বারা ঘিরে রয়েছে যারা তাদের জীবনকে নরক করে তুলেছে। আর এই দানবের প্রথম নাম ‘সমাজ’ আর তার আইন কিংবা ‘মনোভাব’। যে সমাজ ১৩/১৪ বছরের বালিকাকে বিধাতার ইচ্ছায় তারই সংগীকে বিচ্ছেদের কারনে একজন অপয়া কিংবা এই দোষে দোষারুপ করা হয়, সেই সমাজ প্রকৃত কোনো ভরষার স্থান হতে পারে না। সে সমাজে প্রকাশ্যে কোনো মহিলাকে পুড়িয়ে মারা, নির্যাতন করা কিংবা ধর্ষন করা হলেও আজো কেউ হয়তো এগিয়েই আসে না। হামিদা হয়তো সে রকমের একটা অদৃশ্য আগুনে প্রতিদিন পুড়ে অংগার হচ্ছিলেন।

সমাজের এই মনোবৃত্তি আর যাতনায় এবং কন্যাদায়গ্রস্থ কেরামত আলি শেষ পর্যন্ত ১৫ বছরের বিধবা হামিদাকে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার আয়োজন শুরু করেন। হামিদার রুপের কোনো কমতি ছিলো না, আর সবে মাত্র সে কিশোরী। এক সন্তানের মা হলেও বুঝার কোনো উপায় নাই যে, তার অন্য কোথাও একবার বিয়ে হয়েছিলো। ফলে, খুব বেশীদিন অপেক্ষা করতে হয় নাই কেরামত আলিকে। পুরুষ শাসিত সমাজে সব আইন পুরুষেরাই তাদের নিজের সুবিধার কারনে বানায়। এখানে ১৫ বছরের কিশোরীর সাথে ৪০ বছরের বৃদ্ধার বিয়েও কোনো দৃষ্টিকটু নয়। কিংবা কোনো এক প্রতাপশালি ধনী ব্যক্তির পক্ষেও একের অধিক কুমারী কিংবা বিধবা কিশোরীকে বিয়ে করাও কোনো দৃষ্টিকটু নয়। আর সেই প্রতাপ শালী কোন ধনী ব্যক্তি যদি সধবা হন, তাহলে তো তার যেনো বিয়ে করা একটা বৈধ লাইসেন্সের মতোই। হামিদার জীবনে এমনই এক সুপুরুষ-হোসেন আলী মাদবর প্রবেশ করলেন। এই হোসেন আলী মাদবর কোনো কাল বিলম্ব না করে অনেক ঘটা করে বিধবা হামিদাকে বধু হিসাবে নিয়ে আসে তারই সংসারে যেখানে রয়েছে হামিদার থেকেও বয়সে বড় আরো তিনটি পুত্র সন্তান আর চারটি কন্যা সন্তান। কেউ কেউ হামিদার থেকে বয়সে এতো বড় যে, কারো কারো আবার বিয়ে হয়ে তাদের ও সন্তান জন্ম নিয়েছে। তবে একটা ভালো সংবাদ হামিদার জন্য ছিলো যে, তাকে সতীনের ঘর করতে হয় নাই। কারন হোসেন আলি মাদবর ছিলেন সধবা। হোসেন আলী মাদবরের আগের স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় বছর খানেক আগে।

হামিদার যখন প্রথম বার বিয়ে হয়েছিলো, তখন সে পিছনে ফেলে গিয়েছিলো তার খেলার সাথী, খেলার পুতুল আর শৈশবের স্মৃতি। কিন্তু এবার হামিদা ফেলে গেলো একজন অবুঝ পুত্র যে জীবনের কোনো কিছুই বুঝে না। হয়তো সে মা কি জিনিষ তাইই বুঝে না আর বিচ্ছেদ কি জিনিষ সেটা তো তার বুঝবারই কথা নয়। বিল্লাল রয়ে গেলো কেরামত আলীর তত্তাবধানে। বিল্লালের বয়স সবেমাত্র তিনও পূর্ন হয় নাই।  এখন বিল্লাল পুরুই অনাথ, শুধু তার চারিপাশে রইলো কেরামত আলী, আর তার পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু এই অনাথ ‘বিল্লাল’ নামক পুত্রের এখন কি হবে? সে তো আগেই তার পিতাকে হারিয়েছে, আর আজ হারালো তার মাকে, যদিও তার মা জীবিত। মায়ের নতুন সংসারে তার জায়গা নেই।

ওই যে বললাম, স্রিষ্টিকর্তা বড়ই রহস্যময়। হামিদার বাড়ির আলুকান্দার কাছেই ছিলো আরেক গ্রাম, তার নাম ঘোষকান্দা। সেখানেই স্রিষ্টিকর্তা আরেক ধনাঢ্য এক পরিবারকে রেখেছেন অতীব মানসিক কষ্টে। তাকে ঈশ্বর সম্পদের পাহাড় দিয়েছেন, তাকে সুসাস্থ্য দিয়েছেন, আর দিয়েছেন সমাজে প্রতিপত্তিদের মধ্যে সম্মান আর যোগ্যস্থান। কিন্তু তাকে ঈশ্বর যা দেন নাই সেটা হলো কোনো উত্তরাধীকারী। সন্তানহীনা অবস্থায় মানসিকভাবে এই দম্পতি এতোটাই কষ্টে ছিলেন যে, তাদের না আছে কোনো সন্তানসন্ততী, না আছে কোনো উত্তরসুরী। এই ধনাঢ্য পরিবারের হর্তাকর্তার নাম ‘ইদ্রিস আলী’। তিনি কিংবা তার স্ত্রী সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছিলেন কিনা কেউ জানে না, কিন্তু ঈশ্বর হয়তো অন্য কোনো নেশায় তাদের এই ঘর পরিপূর্ন খালী রেখেছিলেন এমন একজন অসহায় মানবের জন্য যার বিপক্ষে দোষারুপ করার কোনো ওজরের কমতি ছিলো না। তাদের অন্তরে ঈশ্বর সব ভালোবাসা রচিত করেছিলেন ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্য, লালিত করেছিলেন এক অদম্য স্পৃহা কিন্তু সেই ভালোবাসা আর স্পৃহা বারংবার শুন্য ঘরেই বাতাসের মধ্যে হারিয়ে যেত সকাল সন্ধ্যায় কিংবা অলস দুপুর কিংবা বর্ষার কোনো ঋতুতে। কষ্ট ছিলো, আখাংকা ছিলো কিন্তু সন্তান লাভ এমন নয় যে, বাজারে গেলেন, দোকান খুজলেন আর পছন্দমত একজন সন্তান কিনে এনে তাকে বড় করতে শুরু করলেন। ইতিহাসের পাতা ঘাটলে এটা দেখা যায় যে, কারো কাছে কোনো মানুষ হয়তো খুবই অপাংতেয়, বোঝা, উপদ্রব, কেউ হয়তো তার দিকে এক নজর নাও তাকাতে পারে। হতে পারে সেই মানুষটা এক পরিবারের জন্য বোঝা, কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোথাও কেউ হয়তো ওই অপাংতেয় মানুষটির জন্যই অধীর চিত্তে অপেক্ষা করছে কখন তার আগমন ঘটবে। তাকে পাওয়াই যেনো সমস্ত সুখ আর শান্তির উৎস খুজে পাওয়া। ঈশ্বর এই দুটো ঘটনাই পাশাপাশি ঘটাচ্ছিলেন বিল্লালকে কেন্দ্র করে।

হামিদা চলে যাওয়ার পর হামিদা যেমন মনের ভিতরে সন্তান বিচ্ছেদে কাতর ছিলেন, তেমনি হামিদার বাবা কেরামত আলীও এই অবুঝ বালককে নিয়ে শেষ পর্যন্ত কি করা যায় সেই চিন্তায় কাতর ছিলেন। শেষ পর্যন্ত কেরামত আলী তার ভায়রা গনি মাদবরের সাথে পরামর্শ করে বিল্লালকে পালক দেয়ার কথা চিন্তা করলেন। আর এতেই যেনো ইদ্রিস আলীর পরিবারে নেমে আসে সেই কাংখিত শুভ সংবাদ যিনি তাকে দত্তক নিতে আগ্রহী। কালক্ষেপন না করে ইদ্রিস আলীর পরিবার যেনো সর্গ থেকে নেমে আসা এক ফুটফুটে পুত্রসন্তান লাভ করে ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে করলেন আর নিয়ে গেলেন হামিদার বুকের সবচেয়ে আদরের ধন ‘বিল্লাল’কে। হামিদার দ্বিতীয় বিয়ের কারনে হামিদার পুত্র বিল্লালকে ইদ্রিস পরিবার যেনো অযাচিত এক ধনের সন্ধান পেলেন। নিজেদের বংশমর্যাদা আর পিতৃপরিচয়ে বিল্লালকে আগাগোড়া মুড়ে দিলেন ইদ্রিস আলী পরিবার। কোনো কিছুর কমতি রাখলেন না তারা তাদের এই হাতে পাওয়া সন্তানের জন্য। কিন্তু মা তো মা-ই। সমস্ত কাজের ফাকে, নিজের অবসর সময়ে বারবারই তো মনে পড়ে হামিদার সেই নাড়িছেড়া সন্তানের জন্য। কিন্তু কি ক্ষমতা আছে তার? না সে সমাজের বিপক্ষে কিছু করতে পারে, না সে সমাজের আইনকে থোরাই কেয়ার করতে পারে। হতাশাগ্রস্থ নেশাখোরের মত ক্ষনেক্ষনেই মা হামিদা নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়তেন বিল্লালের জন্য। কখনো একাই কাদেন, কখনো একাই ভাবেন, আবার কখনবো এইকথা মনে করে শান্তি পান যে, অন্তত তার নাড়িছেড়া ধন কারো জিম্মায় ভালো আছে যারা তার এখন পিতামাতা।

হামিদার নতুন সংসারে সময়ের রেষ ধরে আমাদের জন্ম হতে থাকে একের পর এক সন্তান। আগের স্ত্রীর ঔরসে জন্ম নেয়া পুত্র-কন্যাদের পাশাপাশি হামিদার ঔরসে ক্রমেক্রমে আরো পাচ কন্যা আর দুই পুত্রের আগমন হয়। কেরামত আলী হামিদার নতুন সংসারের যেমন খোজ রাখেন, তেমনি খোজ রাখেন ইদ্রিস আলির পরিবারে দত্তক নেয়া বিল্লালেরও। হামিদা যখন বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসে, তখন হামিদার সৌভাগ্য হয় তার ছেলে বিল্লালকে চোখে দেখার। মা ছেলের এই মিলন বড় সুখের বটে কিন্তু বেদনারও। ফিরে যাওয়ার দিন হামিদার চুমু খাওয়া বিল্লাল হয়তো কিছুই বুঝতে পারে না কি কারনে এই মহিলার চোখে জল আসে। বুঝতে পারে না কেনো বিল্লালের মা কিংবা তার বাবা ইদ্রিস আলী এই মহিলার কাছে এতো ঋণী। শুধু এটুকু বুঝতে পারে মহিলাটা এমন কেউ যাকে পেলে বিল্লালও খুশী হয়। হামিদা বিল্লালকে নিজের হাতে ভাত মেখে খাইয়ে দেয়, গোসল করিয়ে সুন্দর জামা পড়িয়ে দেয়, আর খুব মিষ্টি করে মাথার চুল আচড়ে দিয়ে কখনো কখনো তার বুকে মাথা রাখতে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। হয়তো এই আদরগুলি বিল্লালকে বারবার মহিলার প্রতি বিল্লালের আকর্ষন বাড়িয়ে দেয়। যেদিন হামিদা আবার তার সংসারে চলে যায়, বিল্লালেরও খুব মন খারাপ হয়। (চলবে) 

২/১২/২০২১-পায়ের নীচে পাথরহীন

জীবনের কাছে রাখা সব উত্তর সবসময় তার প্রশ্নের ন্যায় বিচার করে না। বিশেষ করে প্রশ্নটা যখন এমন হয় যেটা মনকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খায়, আর হৃদয়কে ছুড়ি দিয়ে ফালা ফালা করে দেয়। কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তর যখন কারো জীবনের নাশ হয়ে দাঁড়ায় তখন সেই উত্তরের শেষ পরিনতি সম্পর্কে উত্তারদাতার অনেক ভেবেচিন্তে দেয়া উচিত। আমার জীবনেও এমন একটা সময় এসেছিলো। আমার সব প্রশ্নের উত্তর হয়তোবা কারো জীবনের নাশ হবার সম্ভাবনাই ছিলো, ফলে উত্তরদাতা হিসাবে আমি কোনো উত্তরই দেওয়ার চেষ্টা করিনি। চুপ হয়ে থাকাই যেনো মনে হয়েছিলো-সর্বোত্তম উত্তর। আমি সেই “চুপ থাকা” উত্তরেই পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে এমন পরিবেশটাই তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলাম যেনো “কিছুই না ব্যাপারটা”। কিন্তু “ব্যাপারটা” যতো না সত্য ছিলো তার থেকেও বেশী ছিলো “চাপ” আর এই “চাপ” তৈরী করার পিছনে যারা কাজ করেছিলো তারা আর কেহই নয়, আমার দ্বারা পালিত সেই সব মানুষগুলি যাদেরকে আমি ভেবেছিলাম, তারা আমার সব “ওয়েল উইশার্স”। কিন্তু আমার আরো কিছু মানুষ ছিলো যারা আমার জীবনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে এমন করে জড়িয়েছিলো যারা আমার হাড় আর মাংশের মতো। আলাদা করা দুরুহ। সেই হাড় আর মাংশের মতো একত্রে মিলিত মানুষগুলি একটা সময়ে সেইসব তথাকথিত “ওয়েল উইশার্স”দের চক্রান্তে তাদের মস্তিষ্ক এমনভাবে বিগড়ে গিয়েছিলো যে, তাদের “সন্দেহ” টাই যেনো এক সময় তাদের অবচেতন মনে “বিশ্বাসে” পরিনত হয়। আর এই মিথ্যা “বিশ্বাসে” তাদের চারিপাশের শান্ত বাতাসগুলিও যেনো প্রচন্ড ঝড়ের চেহাড়া নিয়ে একটা কাল বৈশাখীতে রুপ নিয়েছিলো। কেউ বুঝতেই চাইতেছিলো না যে, এর শেষ পরিনতি বড়ই ভয়ংকর।

তবে আমি জানতাম সত্যিটা কি। কিন্তু ওইসব পরিস্থিতিতে আমার সব সত্য জানাটাই সঠিক এটা কাউকে যেমন বিসশাস করানো যায় নাই, তেমনি আমিও তাদেরকে বিশ্বাস করাতে চাইওনি। শুধু অপেক্ষা করেছিলাম-কখন ঝড় থামবে, কখন আকাশ পরিষ্কার হবে, আর দিবালোকের মতো সত্যটা বেরিয়ে আসবে। “সময়” পার হয়েছে, ধীরে ধীরে মেঘ কেটে গেছে, আমি আমার সাধ্যমতো সবকিছু আবার গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। গুছিয়েও ফেলেছি সেইসব ক্ষত বিক্ষত আচড়গুলি। কিন্তু আমি এই অযাচিত ঘটনায় একটা জিনিষ পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম যে, মনুষ্য জীবনে আসলে কেউ কারোই নয়। আমরা বাস করি শুধু আমাদের জন্য। একা থাকা যায় না, তাই সমাজ, একা থাকা যায় না, তাই পরিবার। একা অনেক অনিরাপদ, তাই সংসার। কিন্তু এই সমাজ, এই সংসার কিংবা এই পরিবার কোনো না কোন সময় ছাড়তেই হয়, আর সেটা একাই। এই মিথ্যে সমাজ, পরিবার আর সংসারের নামে আমরা যা করি তা নিছক একটা নাটক। জংগলে বাস করলে একদিন সেই জংগল ছাড়তেও কষ্ট হয়। এরমানে এই নয়, আমি জংগলকেই ভালোবাসি। কথায় বলে-ভালোবাসা পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর অনুভুতি, আর এটা যদি বেচে থাকে তাহলে হিংসা, বিদ্বেষ থেকে মানুষ হয়তো মুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু আমরা যারা এই সমাজ নামে, পরিবার নামে, কিংবা সংসার নামে চিহ্নিত করে ভালোবাসার জাল বুনে থাকি সেটা আসলে কোনো ভালোবাসাই নয়। সেখানে থাকে প্রতিনিয়ত নিজের সার্থের সাথে অন্যের লড়াই। অন্যঅর্থে সেটা একটা পাগলামী, লালসা কিংবা একা বাচতে চাওয়ার অনিরাপদের একটা অধ্যায় মাত্র। অথচ আমরা প্রত্যেক মুহুর্তে আমাদের এই নিজের পরিবারকে নিরাপদে রাখার জন্য অনেক অপবাদ, অনেক ভয়ংকর বাধা আর মৃত্যুর মতো রিস্ককে বরন করে থাকি। এ সবই আসলে নিজের সার্থে।

যাই হোক যেটা বলছিলাম, আমার সেই ফেলে আসা অভিজ্ঞতার আলোকে আমি ধীরে ধীরে সে সব “ওয়েল উইশার্স” দেরকে নিজের বেষ্টনী থেকে দূরে রাখার প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেছি। আমি একটা মুহুর্তেও সেই সব দিনের ক্ষত বিক্ষত হবার বেদনার কথা ভুলি নাই। যখনই সেই ব্যথার কথা মনে হয়েছে- আমি বারবার আরো শক্ত হয়েছি। আমি জানি কন এক সময় আবারো তাদের আমার প্রয়োজন হবে, আবারো তারা আমাকে আকড়ে ধরার চেষতা করবে, আবারো তারা তাদের মিথ্যা চোখের পানি ফেলে আমাকে আবেশিত করার চেষ্টা করবে। আমি ততোবার নিজেকে বারন করেছি-আর যেনো সেই একই ফাদে পা না বাড়াই। তাহলে সেটা হবে আমার জীবনের জন্য কালো আধ্যায়।

ওরাও হয়তো ভেবেছিলো- কোনো প্রয়োজন নাই আর আমাকে। আমি কোন দুঃখ পাইনি। শুধু ভেবেছি, খুব ভালো যে, তারাই গুটিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু এই প্রিথিবীর সবচেয়ে বড় বিপত্তি এই যে, বড় বট বৃক্ষের প্রয়োজন কখনো কোনোদিন কোনো কালেই ফুরিয়ে যায় না। হোক সেটা হাজার বছরের পুরানো কোনো বৃক্ষ।

আজ সেই দিনটা এসেছে। অথচ আজ আমার সব দরজা এমন করে খিল দিয়ে আটকানো যে, না আমি খুলতে চাই, না খোলার প্রয়োজন মনে করি। পৃথিবীতে নিমক হারামের চেয়ে বড় পাপ অথবা বড় বিশ্বাসঘাতকরা আর নাই। যে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে কেউ আকাশ দেখে, সেই পাথকে যত্ন করে রাখতে হয়। যদি অযত্নে সেই পাথর কোথাও হারিয়ে যায় বা ব্যবহারের আর উপযোগি না হয়, তাহলে আকাশ যতো সুন্দরই হোক না কেনো, তাকে দেখার ভাগ্য আর হয় না। যদি কেউ আজিবন আকাসের জ্যোৎস্না, আকাসের তারা আর নীল আকাশের মধ্যে তারার মেলা দেখার ভাবনা থাকে, তাহলে সেই পাথকে অতোতাই যত্ন করা দরকার যতোটা মনে হবে তার মনের শখের দরকার। তা না হলে চোখের জলে বুক ভাসবে ঠিক কিন্তু কেউ তার নিজের পাথর দিয়ে তার আকাশ দেখা বন্ধ করে অন্যকে পাথর দিয়ে সাহাজ্য করে না। এতাই নিয়ম।

আজ তারা সেই পাথরটাকে হারিয়ে ফেলেছে বন্ধ দরজার অন্ধকার ঘরে। যেখানে না যায় দরজা খোলা, না যায় পাথরে পা রাখা। তোমাদের জন্য নতুন আরেক অধ্যায় শুরু। এবার এই দুনিয়াটাকে বড্ড অসহায় মনে হবে তোমাদের। তোমাদের প্রতিন মনে হবে- তোমরা কোথায় কি পরিমান ক্ষতি নিজেদের করেছো যার সমাধান কখনোই তোমাদের হাতে ছিলো না। তোমরা ভেবেছিলে- তোমাদের জন্য মায়ের চেয়ে মাসির দরদ সম্ভবত অনেক বেশী। কিন্তু এই দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত মায়ের চেয়ে মাসির দরদ কখনোই বেশী ছিল বলে এটা কেউ যেমন প্রমান করতে পারে নাই, আর এতা সত্যও নয়। যদি সেটাই তোমরা মনে করে থাকো- তাহলে আজ তোমাদের সেই মাসির কাছেই তোমাদের সমস্ত কিছু আবদার, চাহিদা, কিংবা সাহাজ্য চাওয়া উচিত যাকে তোমরা বিনাবাক্যে মনে করেছো, লিডার অফ দি রিং। দেখো, সেই লিডার অফ দি রিং তোমাদের জন্য কোনো সাহাজ্য পাঠায় কিনা। আমার দরজা তোমাদের জন্য আর কখনোই খোলা হবে না। আমি শুধু দেখতে চাই, আসলেই তোমরা কাকে চেয়েছিলে? কার উপরে তোমাদের এতো নির্ভরশীলতা ছিলো আর কার গলায় পা রেখে শ্বাস রোধ করেছিলে। আমি তো সেদিনই মরে গেছি যেদিন তোমরা আমাকে আমার অজান্তে পিছন থেকে চিমটি নয় ছুড়ি মেরেছিলে। আহত লোকের কাছে কোনো সাহাজ্য প্রার্থনা করা উচিত না। এটাই তোমাদের শিক্ষা।

২৮/৬/২০২১-সফুরা খালা

 

এই মানুষগুলি একসময় আর কারো সামনেই থাকবে না। এদের জীবনেও প্রেম এসেছিলো, এরাও কারো না কারো চোখে রানীর মতো ছিলো। বাল্যকালে সাথী সংগীদের নিয়ে এরাও নদীর ঘাটে গিয়ে জিলকেলী করতে করতে সারাটা পরিবেশ মুখরীত করে রাখতো। নীল আকাশের মধ্যে জ্যোৎস্না রাতের তারার মতো তারাও রাত জেগে হয়তো কোনো এক প্রেমিক বরের অপেক্ষায় মনের ভিতর সুখের আস্বাদন করেছেন। এরা বড় বড় সংসারের হাল ধরেছেন, সমাজে এরাও অনেক অবদান রেখেছে। এদের গর্ভে জন্ম নেয়া অনেক সুপুত্র কিংবা সুন্দুরী কন্যারা হয়তো আজো দেশে বিদেশে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু আজ তারা এতো চুপচাপ জীবন যাপন করছেন যেখানে তিনি নিজে ছাড়া আর কেউ পাশে নাই। না তার রাজা আছে, না তিনি এখন রানী আছেন। সময় মানুষকে কত পরিবর্তন করে দেয়। এই সময়ের কাছে আজো কেউ স্বাধীনতা পায় নাই, না পেয়েছে কোনো ক্ষমতা সময়কে পরিবর্তন করার। আদি যুগ থেকে যতো মানুষ এই দুনিয়ায় এসেছে, সবাই কোনো না কোনো সময় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এই পৃথিবীকে ত্যাগ করতে হয়েছে। আমরা যারা পিছনে পড়ে থাকি, তারা শুধু একটা মোহ, একটা স্মৃতি আর একটা কি যেনো নিয়ে শুধু অলীক ভাবনার জগতে অপেক্ষায় থাকি। একদিন আমিও এর থেকে পরিত্রান পাবো না। শুধু সময়টা পালটে যাবে এই রানীদের মতো। 

কিন্তু আমার মনের ভিতরে এই সব রানীরা আজীবন রানীদের কিংবা রাজাদের মাতাই হয়ে থাকবেন। আমি এদেরই বংশের একটি ধারা। আরো বেচে থাকো তোমরা অনেক কাল খালা। 

 

জীবন যেখানে যেমন। যে শিশুটি আজ জন্ম নিলো কেউ জানে না তার জন্য এই পৃথিবী কি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিংবা এই পৃথিবীকে সে কি দিয়ে যাবে। হতে পারে আজকে এই শিশুটি হয়তো এই পৃথিবীকে কোনো এক সময় নাড়িয়েও দিতে পারে বা এই পৃথিবী তাকেও নাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু এমন অনেক শিশুই এই পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয়,  না তারা কোনো ভূমিকা রাখে, না পৃথিবী তাদেরকে মনে রাখে। এমন মানুষের সংখ্যাই বেশী। যুগে যুগে তারপরেও অনেক শিশু প্রকাশ্যে বা গোপনে পৃথিবীতে আসে যারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় আর একদিন সব কিছু ফেলে সবার থেকে আলাদা হয়ে আবার কোথাও অদৃশ্য হয়ে যায়। মাঝখানের এই সময়টায় খুব গুটিকতক মানুষ হয়তো নিজের মতো করে কাউকে কাউকে মনে রাখে কিন্তু তাও একসময় মনের স্মৃতি থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়। আমার সফুরা খালা, সামিদা খালা কিংবা আমার শায়েস্তা বুজি, বা সাফিয়া বুজিরা সম্ভবত এই রকমের কিছু মানুষ যারা সেই বহু বছর আগে শিশু হয়ে জন্ম নিলেও কোনো লাভ হয় নি কারো। তারা আজীবন যেনো এই দুনিয়ার বুকে একটা বোঝা হয়েই ছিলো। অথচ তারা হাজারো মানুষের থেকে অনেক ভালো মানুষ ছিলেন।

প্রায় দু বছর আগে আমি আমার পরিবার নিয়ে আমাদের গ্রাম থেকে বেশ দূরে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। বেশীক্ষন দেরী করি নাই কারন পরিবেশটা ঐ রকমের ছিলো না। কোনো রকমে আনুষ্টানিকতা শেষ করে ভাবলাম, যেহেতু গ্রামের পথেই আছি, যাই আমাদের গ্রামের বাড়িটা ঘুরেই যাই। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো, আলো বেশ কমে গিয়েছিলো। অনেকেই আমাকে চিনে না যদিও আমি এই গ্রামেরই একজন পুরানো বাসিন্দা। কিন্তু সময়ের সাথে আমার অনুপস্থিতি আমাকে আজ এই গ্রামে একজন নবাগত অতিথির মতোই মনে হচ্ছিলো। যারা আমার সমবয়সী ছিলো, তারাও অনেক বুড়ো হয়ে গেছে, অনেকেই চিনতেও ভুল করছিলো, আমি তো ওদের কাউকেই এখন চিনি না। ওদের চেহারা সুরুতে এমন বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে যে, জোয়ানকালে আমি যাদেরকে দেখেছি, তারা এখন দাদা নানার পর্যায়ে। না চেনারই কথা। তারপরেও কাউকে কাউকে আমি চিনতে পারছিলাম। গ্রামের বাড়িটা খা খা করছে, কেউ থাকে না এখানে। আগে মা থাকতেন, এখন থাকে আমার এক ভাগ্নে যে সারাদিন গাজা খায়।

ভাবলাম, আমার এক খালা ছিলো। নাম সফুরা বেগম। উনি কি জীবিত আছেন নাকি আর জীবিত নাই সেই খবরটাও আমার জানা নাই। তাঁকে খুব দেখতে মন চাইলো। মিটুলকে বললাম, চলো একটা বাড়িতে যাই। যদি উনি বেচে থাকেন, তাহলে মায়ের অভাবটা কিছুটা হয়তো পুরন হবে। আর যদি জীবিত না থাকেন, অন্তত জানতে পারবো, কবে থেকে আর তিনি এই পৃথিবীতে নাই। আলুকান্দা তার বাড়ি। অনেক খোজাখুজির পর শেষ অবধি সফুরা খালার বাসায় যেতে পারলাম। তিনি অসুস্থ্য। জর। একটা কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। চার পাঁচ দিন নাকি তিনি কিছুই খাচ্ছেন না। অনেক বয়স হয়ে গেছে। আমার মা যখন বেচে ছিলেন, তখন আমার এই খালা প্রায়ই আমার মায়ের সাথে দেখা করতেন, গল্প করতেন। আমাকে খুব আদরও করতেন। আসলে আমার মা, আমার সামিদা খালা আর এই সফুরা খালা এতোটাই ভালো আর নীরিহ মানুষ ছিলেন যে, তাদের ব্যাপারে আজ অবধি কেউ কোনো অভিযোগ করেছে সে ঘটনা ঘটে নাই। খালাকে ডাকা হলো। উনি ভালো মতো চোখে দেখেন না। এম্নিতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো, তারমধ্যে আবার আকাশ ছিলো খুব মেঘাচ্ছন্ন। বিদ্যুৎ ছিলো না। কোন রকমে খালাদের বাসায় যাওয়ার পর, আমি খালার বিছানায় গিয়ে বসলাম। খালাকে তার পুত্রবধুরা ডেকে তোলার চেষ্টা করলেন। আমাই যাওয়াতে সবাই অনেক খুশী হয়েছে। কি থেকে কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না।

খালাকে যখন আমি বললাম, আমি মেজর আখতার এসছি। খালা এম্নিতেই কানে কম শুনে মনে হয়, তার মধ্যে আমার নাম শুনে যেনো একটা অদ্ভুত মিথ্যা কথা শুনলেন এমন হলো। বল্লো-

কে? হামিদার ছেলে?

বললাম, হ্যা খালা।

উনার জর ছিলো প্রায় ১০৩ ডিগ্রী। আমার কথা শুনে তিনি বিছানা থেকে উঠে বসলেন। খালা প্রায় গত চার পাঁচ দিন বিছানায় উঠে বসতে পারেন না। কিন্তু আজ যেনো কোন অলৌকিক শক্তিতে তিনি একাই বিছানায় উঠে বসে পড়লেন। আমি খালাকে জড়িয়ে ধরলাম, খালাও আমাকে এমন করে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলেন যেনো এইমাত্র বাইরের মেঘাচ্ছন্ন আকাশটা ঘনকালো ঝপ ঝপ বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিলো সারাটা উঠান।

কতটা আদর? কিভাবে আদর করলে ভালোবাসা হয় মায়েদের? আমার সেটা জানা ছিলো। আমার মাও ঠিক এভাবেই আমাকে আদর করতেন।  আমার মুখে দুই হাত দিয়ে একদম চোখের কাছে আমার মুখটা নিয়ে পানভর্তি মুখে ভিজা ভিজা চোখে ফিক করে হেসে দিয়ে বলতেন, অনেক বড় হ বাবা। আমার দোয়া আর দোয়া রইলো। সফুরা খালার ভাষাও এক। কি অদ্ভুদ। আমি তাঁকে কতোক্ষন জড়িয়ে ধরেছিলাম, আমার জানা নাই। সারাটা শরীর হাড্ডি, মাংশ বলতে কিছুই নাই। গরীব ছেলেপেলেরা যতোটা পারে তাদের মায়ের যত্ন নেয় বটে কিন্তু অন্তরের ভালোবাসায় হয়তো অনেক ঘাটতি আছে। তারপরেও তিনি বেচে আছেন যেটুক পান সেটা নিয়েই।

আমার মায়ের বাবার নাম ছিলো কেরামত আলী। আমার মায়ের কোনো ভাই ছিলো না। মাত্র দুইবোন- হামিদা খাতুন আমার মা আর সামিদা খাতুন আমার আপন খালা। কিন্তু সফুরা খালার বাবার নাম ছিলো চেরাগ আলি। তারও কোনো ভাই অথবা কোনো বোন ছিলো না। তিনি একাই একমাত্র কন্যা সন্তান ছিলেন চেরাগ আলীর। এই চেরাগ আলি এবং কেরামত আলি (মানে আমার নানারা) ছিলেন চার ভাই। অন্যান্য আর দুই ভাই ছিলেন সাবেদ আলি এবং লষ্কর আলী। উম্মেদ আলী ছিলেন এই চার ভাইয়ের বাবা। অর্থাৎ আমার মা খালাদের নানা।

আজ তারা কেহই বেচে নাই। শুধুমাত্র আমার সফুরা খালাই বেচে আছেন কালের সাক্ষী হয়ে। খুব ভালোবাসি আমি তোমাদের।

বদি ভাই-এখন তিনি ছবি

১৯৬৮ থেকে ২০১৮, মোট ৫০ বছর।

এই পঞ্চাশ বছরের আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের মধ্যে যে ব্যক্তিটি আমাদের পরিবারের কেউ না হয়েও পরিবারে সবচেয়ে বেশি ভুমিকা পালন করতে এক্যটু ও দ্নিবিধা করেন নাই, তিনি হচ্ছেন বদ্রুদ্দিন তালুকদার ওরফে বদি ভাই। আমার বয়স তখন মাত্র ১০ কি বারো যখন আমি প্রকৃত পক্ষে এই বদি ভাইকে জ্ঞ্যানের মাধ্যমে চিনি। কিন্তু তার আগে থেকেই এই বদি ভাই আমাদের পরিবারের সাথে যুক্ত ছিলেন।

আমার বাবা কবে কিভাবে কি কারনে মারা গেলেন তা আমার কোনো ধারনা নাই। আমার বয়স তখনহয়ত ২ কি আড়াই হয়ত হবে। আমার বাবা ছিলেন অনেক ধনি মানুস, মাদবর মানুস। সমাজে তার গ্রহনযোগ্যতা ছিল অনেক অনেক বেশি। কিন্তু তার শত্রুও ছিল অনেক। বিশেষ করে আমাদের পরিবারের ভিতরেই অনেক শত্রু ছিল। আর তারা হচ্যাছেন আমার সতালু ভাই বোনেরা। বিশেষ করে তাজির আলি নামে যে ভাইটি ছিলেন, সে ছিলো চারিত্রিকভাবে একজন খারাপ মানুষ।  যাই হোক। বাবা মারা যাবার পর আমাদের যাবতিয় জমিজমার আধিপত্যতা এক সপ্তাহের মধ্যেই হাতছাড়া হয়ে যায়। ফলে ক্যাশ টাকা না থাকায় আমাদের পরিবার অনেক সমস্যার মধ্যে পরে। আমার বড় ভাই সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ইউনিভারসিটিতে ভরতি হয়েছেন। ঢাকায় থাকার কোনো জায়গা নাই, মাথার উপর কোনো অভিভাবক নাই এবং তার মধ্যে পাচ বোন এক ভাই এর বোঝা তার উপর। কিভাবে সংসার চালাবেন, কোথা থেকে টাকা আসবে কিংবা নিজেই কিভাবে চলবেন এই চিন্তাই আমার ভাইকে অতিস্ট করে তুল্লো। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর ভাবছেন কি করা যায়, কিভাবে করা যায়।

এই সময় কোনো এক কাকতালিয় ভাবে দেখা হলো এই বদি ভাইয়ের সাথে। তার জীবনটাও এই একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কেটেছে অথবা কাটছে। ওনাকে আর পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করে বেশি বুঝাতে হয় নাই। বদি ভাই চাকুরি করেন ওয়াব্দা অফিসে মাত্র সেক্সন অফিসার হিসাবে। অল্প আয়, বিয়ে করেন নাই। তিনিও একইভাবে তার ভাই বোন মাকে সাপোর্ট করছেন। থাকেন তিনি ১২৪ নং আগাসাদেক রোড। ছোট্ট একটা রুম, তাতে ইতিমধ্যে তিনজন গাদাগদি করে কোনো রকমে থাকেন আর এক বুয়া প্রতিদিন দুপুর আর রাতের জন্য যত সামান্য বেতনে তাদের ভাত তরকারি পাক করে দেন। বদি ভাই হাবিব ভাইকে ওই ১২৪ নং আগাসাদেক রোডে নিয়ে এলেন। সবাই বদি ভাইকে ভাই বলেন না, সম্মানের সহিত তাকে সবাই স্যার বলেন।

যারা এই রুমে থাকেন, তারাসবাই গ্রাজুয়েট এবং জীবন যুদ্ধে লিপ্ত। একে অপরের জন্য যত টুকু দরকার সাপোর্ট করেন। সবার রোজগার যেনো কম্বাইন্ড রোজগার। একসাথে থাকে সব টাকা, যার যখন যত টুকু দরকার সে ততো টুকুই নেন। কিন্তু হিসাব থাকে। আমার মনে আছে ওই একটা ছোট রুম থেকে বদি ভাইয়ের তত্তাবধানে প্রায় ১০/১২ জন গ্রাজুয়েট বের হয়েছেন যারা পরবর্তী সময়ে দেশের শিরশ স্থানে বসেছিলেন। কেউ ইউনিভারসিটির অধ্যাপক, ডিন, কেউ আরো বড়। দেশে এবং বিদেশে।

এভাবেই বদি ভাই হয়ে উঠেন এক কিংবদন্তি স্যার। সব প্রোটেনশিয়াল মেধাবি হেল্পলেস মানুসগুলিকে বুদ্ধি, যতসামান্য চাকুরির পয়সা দিয়েই এইসব মানুসগুলিকে সাহাজ্য করেছেন। বদি ভাই তার চাকুরি জিবনে ডেপুটি ডাইরেক্টর পর্যন্ত উঠেছিলেন। ওয়াব্দায় চাকুরি করলে দুই নম্বরি করলে ছোট কেরানিও কোটিপতি হয়ে যায় কিন্তু বদি ভাই তার জিবনে দুই নম্বরিতো করেনই নাই, তার দ্বারা দুই নম্বরি হবে এটাও তিনি করতে দেন নাই। ফলে একটা সময় এইসব চোর বাটপারদের আমলে চাকুরির পদবির সামনে এগুতে পারেন নাই। অবসর নিয়ে বাসাতেই ছিলেন।

গ্রাজুয়েট মানুষগুলি তাদের যোগ্যতা অনুসারে ধীরে ধীরে সবাই বেশ ভালো ভালো জায়গায় সেটেল হয়ে গেছেন। সবার সাথেই বদি ভাইয়ের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু কাজের চাপেই হোক আর ব্যস্ততার কারনেই হোক ধীরে ধীরে এইসব যোগাযোগও কমে আসে। কিন্তু আমার ভাইয়ের সাথে অন্য একটি কারনে শেষ পর্যন্ত যোগাযোগটা ছিলই। আর সেটা হচ্ছে আমার মা। আমার ভাই যখন উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ গেলেন, তখন আমার মাকে দেখভাল করার কোনো লোকই ছিলো না। আর এর ই মধ্যে আমারো ক্যাডেট কলেজের সুযোগ হ ওয়ায় আমার পক্ষেও মাকে কোন অবস্থায় ই কিছুই করার সুযোগ ছিলো না। আমার মাকে বদি ভাই খুব ই ভালো বাস্তেন। নিজের মায়ের মতো করেই দেখতেন। আমার মায়ের জন্য কোনো কাজ করতে বদি ভাইয়ের কখনো ক্লান্ত হন নাই। 

আমি ধীরে ধীরে ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে ফেললাম, আর্মিতে গেলাম, আমি মাক্যের দায়িত্ত নিলাম। এই সময় বদি ভাই একটু অবসর পেলেন। ফলে এই দীর্ঘ প্রায় দেড় যোগ বদি ভাইয়ের সাথে আমাদের প্রয়োজনেই আমরা তার কাছ থেকে আলাদা হতে পারি নাই। এমন নয় যে বদি ভাইয়ের এখানে কোন স্বার্থ কাজ করেছে। হ্যা, একটা স্বার্থ কাজ করেছে অবশ্য ই। আর সেটা হচ্ছে, বদি ভাই ও তার ভাইদের থেকে অনেক আলাদা ছিলেন। তার পাশে কেউ আসলে ছিলো না। ঊনি ভাবতেন, আমি বা হাবিব ভাই বা আমরা ই তার আপন জন এবং আপদে বিপদে আমরাই তার পাশে আছি। কথাটা ঠিক। কিন্তু পরবর্তীতে যত টুকু আমাদের পাশে থাকার দরকার ছিলো, আমরা আসলে ততো টুকু পাশে থাকতে পারি নাই। এর কারনও হচ্ছে আমাদের বুঝাপড়ার তফাত। হয়ত এটাই এই স্বার্থপর পৃথিবীর নিষ্ঠুর নিয়মের একটি। 

বদি ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম মনোমালিন্য টা হয় আমার বিয়ে নিয়ে। এটা মানতে মানতে আমাদের মধ্যে একটা বিস্তর গ্যাপের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো। কখনো নরমাল, কখনো আধা নরমাল, আবার কখনো মনে হয়েছে সব ঠিকই আছে। আরেকটা কারন ছিলো যে, হাবীব ভাইয়ের প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল মানসিকতা। একবার এটা বলেন তো আরেকবার তার সিদ্ধান্ত বদলে অন্য আরেকটি বলা বা আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে যাওয়া। এইরুপ একটা পরিস্থিতিতে বদি ভাইও আর হাবীব ভাইয়ের ইপর নির্ভর করতে পারছিলেন না। 

একটা সময় চলে এসেছিল যে, আমরা যে যার যার মতো করেই চলছিলাম। ব্যাপারটা এমন হয়ে গিয়েছিলো যে, সাভাবিক অন্য দশ জনের সাথে আমরা যেভাবে চলি, ঠিক সেভাবেই চলছিলাম। সম্পর্ক খারাপ নয় কিন্তু আমরা খুব ঘনিস্ট কেউ আমরা। হাবীব ভাই বদি ভাইকে সব সময় ই শ্রদ্ধা করতেন এবং শেষ পর্যন্ত শ্রদ্ধাই করতেন। কিন্তু বদি ভাইয়ের জন্য হাবীব ভাইয়ের আরো অনেক কিছুই করার ছিলো। সেটা হয়ত হয় নাই। 

আজ বদি ভাইয়ের মৃত্যুতে একটা বড় অধ্যায় শেষ হলো। আমি তাকে মিস করবো সব সময়। যত কষ্টেই তিনি থাকতেন না কেনো, আমি যখন বদি ভাইয়ের কাছে যেতাম, আমি দেখতাম, তার মধ্যে একটা জীবনী শক্তি ফিরে আসতো। অনেক কথা বলতেন। অতীতের কথা, তার সাফল্যের কথা, তার দুঃখের কথা। আমিও শুনতাম। আজ আর তিনি নেই। তাকে আল্লাহ বেহেস্ত নসীব করুন। 

ভিন্ন প্রসঙ্গ–সবার জন্য 

একটা জিনিষ ইদানিং খুব বেশী করে অনুভুত হয় যে, জীবনের সব অধ্যায় এক রকম নয়।  এটা আমার হয়ত বুঝতে দেরী হয়েছে কিন্তু এই সব তত্ত্বকথা মনিষীরা যুগে যুগে বলে গেছেন। মনিষীরা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক তত্ত্বকথাই বলে গেছেন বটে কিন্তু কেউ সে সব তত্ত্বকথা মানে না। হ্যা, মানে তখন যখন কারো জন্য সেসব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং নিজেদের জন্য প্রযোজ্য হয়। সেই সুবাদেই বলছি যে, আমি আপনি ততোক্ষন সবার কাছে যত্নশীল যতোক্ষন আপনি নিঃস্বার্থভাবে দিতে পারবেন কিন্তু পাওয়ার আশা করবেন না। আশা করলে আপনি হেরে যাবেন। এটা নিজের স্ত্রী থেকে শুরু করে সন্তান, পাড়াপ্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবার বেলায় প্রযোজ্য। কেউ মানুক বা না মানুক, এটাই সত্য।

এর থেকে যে শিক্ষাগুলি নেওয়া দরকার তা হচ্ছে,যা কিছু করবেন জীবনে, নিজের জন্য করুন, নিজে সুখী সময় কাটানোর জন্য আয় করুন এবং তা দুইহাত ভরে খরচ করুন। আপনার অনুপস্থিতিতে আপনার সন্তানগন কিভাবে চলবে কিংবা তারা কোথায় কিভাবে বাস করবে তা আপনার চিন্তা থাকতে পারে বটে কিন্তু তারজন্য অনেক কিছু আয় করে সঞ্চয় করে তাকে পঙ্গু করে রেখে যাওয়ার কোনো দরকার আমি মনে করি না। বরং তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দিন, তাতেই সে এই পৃথিবীর কোনো না কোনো স্থানে ঠাই করে নেবে। এই পৃথিবী পরিশ্রমী মানুষের জন্য সুখের আবাস্থল। অলসদের জন্য এখানে সব কিছুই নাগালের বাইরে।  পূর্ব বর্তি জেনারেশনের আহরিত সম্পত্তি উত্তরসূরিদের জন্য কিছুটা আরামদায়ক হলেও একটা সময় আসে, কোনো না কোনো উত্তরসুরীর মাধ্যমেই তা বিনাশ হয়। এই বিনাশ টা হয়ত এক জেনারেশনের মধ্যে ঘটে না। কারো কারো বেলায় এক জেনারেশনেই শেষ হয়ে যায় আবার কারো কারো বেলায় এটা ক্ষয় হতে কয়েক জেনারেশন পার হয়। কিন্তু ক্ষয় হবেই। এর প্রধান কারন, যিনি সম্পদ করলেন, তার যে দরদ, আর যারা বিনা পরিশ্রমে পেলো তাদের দরদ এক নয়। আরেক টা কারনে নস্ট হয়। তারা হলেন যাদের বংশ ধরের মধ্যে ছেলে রি-প্রেজেন্টেটিভ নাই। ওই সব লোকের বেলায় তাদের কস্ট করা সম্পত্তি নিজের ছেলে সন্তানের পরিবর্তে চলে যায় অন্য বাড়ির আরেক ছেলের হাতে যিন সম্পদের মালিকের নিছক মেয়ের স্বামী। এরা দ্রুত সম্পদ হাত ছাড়া করে কারন তারা একদিকে এতাকে ফাও মনে করে, অন্যদিকে যতো দ্রুত সম্ভব সব সম্পত্তিকে নিজের নামে রুপান্তরিত করতে চায়।

যেহেতু আপনি পরিশ্রম করছেন, সুখটা আপনিই করুন। যদি ভাবেন যে, আগে সঞ্চয় করে স্তূপ করি, বাড়ী গাড়ি করি, ব্যাংকে একটা মোটা টাকা সঞ্চয় হোক তাহলে আপনার হাতে একটু সময়ও নেই সকালের সূর্য দেখার অথবা রাতের জ্যোৎস্না দেখার। আপনার ভাগ্যে আছে শুধু বাদরের মতো এই স্থান থেকে অন্য স্থানে লাফিয়ে লাফিয়ে কোথায় ফল পাওয়া যায় তার সন্ধান করা, অথবা পালের বলদের মতো সারাজীবন হাল চাষের মতো চাষির হাল বেয়ে যাওয়া যাতে চাষিই শুধু লাভবান হয়, আর নিজে শুধু জাবর কাটবেন।

এ কথাগুলি কেনো বলছি?

আমার চোখে দেখা এই ছোট্ট জীবনে অনেক ঘটনা। কস্ট করে সম্পত্তি বা এসেট রেখে গেছেন, কিংবা ব্যবসা রেখে গেছেন, জাস্ট তার মরনের পর ওই সব সম্পত্তি কত তাড়াতাড়ি ভাগাভাগি করে নিজেদের মধ্যে নিয়ে নেয়া যায়, তার জন্য তর সয় না। অথচ ওই সব উত্তরসুরীরা এক্টিবার ও তার রুহের মাগ ফিরাত বা ধর্মীয় কোনো উৎসবের একটু ও পয়সা খরচ করতে চায় না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তারাও সেই এক ই ফাদে পা দিয়ে তাদের উত্তরসুরীদের জন্য ই সঞ্চয় করে জমা করে যান এবং নিজেরা ভোগ করেন না।

   

অপ্রিয় সত্যের মুখুমুখি দাঁড়ানো সাহসের প্রয়োজন

কখনো যদি তোমরা দেখো যে, তোমার অপ্রিয় সত্য কথায় কেউ কোনো উত্তর করছে না, কিন্তু তোমার অগোচরে মুখ ভেটকাচ্ছে, তাহলে বুঝবে যে, তোমার আশপাশ চাটুকারে ভরে গেছে। তুমি বিপদের মধ্যে আছো।  এ অবস্থায় তোমার যা করনীয়, তা হচ্ছে, তুমি একা চলার অভ্যাস করো। এই একা চলার মধ্যে যদি কাউকে রাখতে চাও সাথে, তাহলে এমন কিছু মানুষকে রাখো যারা প্রাইমারী স্কুলের দরিদ্র শিক্ষক। তারা নীতি থেকে বিচ্যুত হয় না আর হবেও না। 

আমার খালা

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব 

২০২১

তারিখ 

সামিদা খাতুন

স্বামীঃ আব্দুল গনি মাদবর

তিনি আমার একমাত্র আপন ফার্স্ট জেনারেশন খালা। আমার মায়ের একমাত্র আপন বোন যাকে আমার মা বোন মনে করেন নাই, করেছেন নিজের মায়ের মতো। আমার খালার সাথে কারো কোন বিবাদ হয়েছে এই রেকর্ড সারা গ্রামের মধ্যে নাই। তিনি অত্যান্ত প্রতাপ্সহালী গনি মাদবরের স্ত্রী। এখানে বলা দরকার যে, গনি মাদবরকে ভয় পায় না এমন কন লক আমাদের গ্রামের মধ্যে ছিলো না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তিনি সন্ত্রাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যান্ত ন্যা পরায়ন একজন মাদবর। খুব বুদ্ধিমান। অত্যান্ত অহংকারী এবং একটা ইগো নিয়ে চলতেন। 

আমার খালা শেষ বয়সে কুজো হয়ে হাটতেন। যখন ই শুনেছেন যে, আমি শহর থেকে গ্রামে গিয়েছি, তখনি তিনি কস্ট হলেও খুব সকালে আমাকে দেখার জন্য আমাদের বাড়িতে চলে আসতেন। আমার খালা ও কোন ছবি নাই কিন্তু কোন একদিন আমার ছোট ক্যামেরা দিয়ে একটি মাত্র ছবি তুলেছিলাম যা আমার কাছে একটা অমুল্য রতনের মতো মনে হয় এখন। 

আমার খালা যেদিন মারা যান, আমি এই খবরটা জানতেও পারি নাই। অনেকদিন পর যখন আমি গ্রামের বাড়িতে গেছি, খালার সম্পরকে জানতে চেয়েছি, শুনলাম যে, আমার খালা মারা গেছেন। আমার খুব আফসোস লেগেছিলো। 

আমার খালার ভাগ্য ভালো যে, ঊনি অনেক কস্টে পরার আগেই জান্নাতবাসী হয়েছেন। আমি মাঝে মাঝে খালাকে গোপনে কিছু টাকা দিতাম কিন্তু যেহেতু তিনি নিজে কোনো কিছু কিনতে পারতেন না, ফলে ঊনি টাকা দিয়েও তার মনের মতো কোন কিছু কিনে খেতে পারতেন না। এর আগেই তার অন্যান্য নাতি পুতেরা তার হাতের টাকাগুলি কোনো না কোনো ভাবে ছিনিয়ে নিতেন। বড্ড নিরীহ মানুষ বলে কারো উপর তার কমপ্লেইনও ছিলো না। খুব নামাজি মানুষ ছিলেন আমার খালা। তার কোন ছেলেরাই তাকে ঠিক মতো ভরন পোষণ করার দায়িত্ত নেন নাই। এক সময়ের প্রতাপ্সহালি মাদবরের স্ত্রী শেষ জীবনে কস্টের মধ্যেই জীবন তা অতিবাহিত করছিলেন কিন্তু আমাদের কিছু সাহাজ্য আর তার নিজের স্বামীর যেটুকু আয় ছিলো তার উপর নির্ভর করেই শেষ জীবন তা অতিবাহিত করেছেন। 

১২/০৩/২০২১-ওরা চলে যাবার পর

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব 

মার্চ 

১২ 

বাচ্চারা যখন ছোট থাকে, তখন ওদেরকে কখনো হাতছাড়া করবো এটা মাথাতেই আসে নাই, কারো আসেও না। তখন সময়টা এক রকমের। হোক সেটা ছেলে বা মেয়ে।

যখন ওরা মাত্র বেবি, ওরা যখন কথা বলাও শুরু করে নাই, কিন্তু ঝড়ের গতিতে হাত পা নাড়তো, খুব মজা লাগতো দেখে, ওটাই ছিলো বেবিদের ভাষা। তখন তো মনে হতো, আহা, কি মিষ্টি বাচ্চারা। কথা নাই অথচ হাত পা নেড়েই যেনো সব কথা বলে। এই ভাষাতেই ওরা জানান দিতো, ওদের হাসি, আহলাদ, কিংবা কষ্টের ইংগিত।

ওরা যখন হাটতে শিখলো, তখন তো ওরা যেনো আরো সাধিন। যেখানে খুসী হাটা ধরে, যেনো সারা প্রিথিবী ওদের জন্য। ওরা হয়তো জানেই না কোনটা ওদের জন্য বিপদ আর কোনটা ওদের জন্য ফ্রেন্ডলী। আর এই পার্থক্যটা আমরা পেরেন্টসরা বুঝি বলে সারাক্ষন আমরা আমাদের বাচ্চাদের আগলে রাখি, ধমক দেই, শাসন করি।

ওরা অনেক সময় আমাদের এই শাসনের ভাষা হয়তো বুঝতে পারে না বলে মনের আবেগে চোখের পানি ফেলে, রাগ করে না খেয়ে থাকে, অভিমান করে কথা বলা বন্ধ করে, ডাকলেও শুনে না, আরো কতকি?

টাইম মতো ওরা না ঘুমালে আমরা ওদেরকে হয়তো বকা দেই, গোসল ঠিক মতো করেছে কিনা, ঠিক সময়ে খাবারটা খেলো কিনা, সব বিষয়েই আমরা সর্বদা সজাগ থাকি। জোর করে করাই আর ওরা হৈচৈ করে। অনেক সময় পুরু বাড়িটা হই চই এর মধ্যে রাখে, সরগোল আর চেচামেচিতে বাড়িটায় যেনো একটা শব্দদূশনে পরিনত হয়, চারিদিকে ছেড়া কাগজ, ঘরে বইপত্র অগোছালো করে দিশেহারা করে রাখতো। ওরা মাঝে মাঝে কত আবদার করতো, অনেক আবদার নিছক শখে কিংবা অনেক আবদার না বুঝেই। আর সেটাই হয়তো ওদের সারা রাতের খুসী অথবা কষ্টের কারনে ঘুম নষ্ট হতো। যদি পেতো, সারাটা রাত না ঘুমে আবার যদি না পেতো তাতেও সারা রাত না ঘুমে কাটিয়ে দিতো অভিমান করে।

এই বাচ্চারাই যখন আর ধীরে ধীরে সমাজের বিভিন্ন কর্মকান্ডে ঢোকে যায়, ঘর থেকে বেরিয়ে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, আমরা এই ভাগ্যবান পিতামাতা অভাগার মতো একা হয়ে পড়ি। মন খারাপ হয়, স্মৃতি পাহাড়ের মতো স্তুপ হয়ে যায়। তখন, এই সব আদুরে বাচ্চাদের ফেলে যাওয়া খেলনা, পরিত্যক্ত হাতের লেখার খাতা, কিংবা তার ব্যবহৃত কোনো পোষাক দেখলেই আমাদের বুকে হটাত করে ধক করে উঠে ব্যথায়। তখন তাদের অতীতের পদচারনা আমাদের কানে ঝুমকোর মতো বাজে, ওদের অতীতের একগুয়েমী রাগ কিংবা আব্দারের কথা কিংবা অযথা রাগ অভিমানের স্মৃতির কথা মনে করে আমার চোখের কোন ভিজে উঠে। মনে হয় মাঝে মাঝে, আহা, ঘরটা একসময় কত ভর্তি ছিলো, আজ একেবারেই শুন্য। ঘরকে নোংরা করার জন্য কত বকা দিয়েছি, বাথরুমের সেন্ডেল পড়ে সারা ঘর ঘুরে বেড়ানোর জন্য কত বকা দিয়েছি। অযথা রাগ অভিমান করে খাবার না খাওয়ার জন্য রাগ করেছি, শাসন করেছি, অথচ আজ, আমার বাড়ির প্রতিটি ঘর শুন্য, একদম পরিপাটি যা সব সময় রাখতে চেয়েছিলাম ওরা যখন ছিলো। আজ আর কেউ বাথ রুমের সেন্ডেল পড়ে ঘুরে না, আজ আর কেউ আমার কাছে অনলাইনে শপিং করার জন্য একশত টাকা আবদার করে না, কিংবা হটাত করে পিজার অফার থাকলেও আর অফারের জন্য বায়না ধরে না। সব যেনো নীরব। আমরা তো এটাই চেয়েছিলাম যখন ওরা সাথে ছিলো? আমরা তো এটাই চেয়েছিলাম যেনো ঘরে সবাই শান্ত হয়ে থাকে? আমরা তো এটাই চেয়েছিলাম যেনো ঘর নোংরা না করে সারাক্ষন পরিপাটি করে রাখুক? অথচ আজ ঠিক তেমনটাই তো আছে। কেউ ঘরে নাই, কেউ ঘর নোংরা করে না, কেউ হৈচৈ করে না। কিন্তু তারপরেও কেনো মনে শান্তি নাই? কেনো মনে হয়, ঘরটা নয়, অন্তরটা শুন্য? যেখানেই তাকাই সব ঠিক আছে, শুধু ঘরটাই খালী।

আজ কেনো জানি বারবার মনে হয়, ওরা আবার ফিরে আসুক, ওরা আবার আমার সাথে আবার ঝগড়া করুক, ওরা আবার আমার কাছে অহেতুক বায়না ধরুক, আমি আর কখনো ওদের বকা দেবো না, সব বায়না আমি মেনে নেবো। খুব মনে পড়ে আজ যে, যখন অফিস থেকে এসেই মেয়ের রুম খুলে বলতাম, কিরে মা, কি করিস? হয়তো তখন মেয়ে রুমেও নেই, হয়তো অন্যঘরে আছে বা রান্নাঘরে কিংবা বাথরুমে কিন্তু জানতাম বাসাতেই আছে। আজ যখন অফিস থেকে বাসায় এসে মেয়ের রুমে যাই, মুখ দিয়ে বলতে চাই, কি রে মা কোথায় তুই? কিন্তু ভিতর থেকে অন্তরের কষ্টে আর কথাটাই বের হয় না। জানি, মেয়েটা আর বাসায় নাই। ওর টেবিল, টেবিলের উপর সেই ঘড়িটা, ওর আলমারী, ওর চেয়ার, সবই তো আছে। কিন্তু মেয়েটাই নাই। প্রতিটা টেবিল, বই, খাতা, আল্মারী, সেই পুরানো ঘড়ি কিংবা বিছানার চাদরটায় হাত দিয়ে আমি অনুভব করি আমার সন্তানদের শরীরের সেই চেনা গন্ধ। খুব করে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে সব কিছু।

ভালোবাসি।

সব সময়।

সর্বদা।

চোখের পানির ফোয়ারা দিয়ে যে ভালোবাসা বেরিয়ে আসে, সেখানে রাগটাও হয়তো ছিলো আমার ভালোবাসার আরেক রুপ। হয়তো বকাটাও ছিলো আমার মায়ার আরেক রুপ। দম বন্ধ হয়ে আসে যেনো তোমাদের ছাড়া।

এখন প্রায়ই আমার মায়ের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে আবার বাবার কথা। হয়তো তারাও একদিন আমাকে খুব মিস করেছে, আমি বুঝি নাই। আর আজ আমি তাদেরকে মিস করি কিন্তু ওরা কেউ নেই এই মায়াবী পৃথিবীতে। আজ হয়তো আমিও আমার সন্তানদের মিস করছি। হয়তো কোন একদিন ওরাও আমাকে অনেক মিস করবে। সেদিন হয়তো পৃথিবীতে আরেকটা নতুন ক্যালেন্ডারের “সময়” চলছে।

“সময়” কারোই বন্ধু নয়, অথচ সে সবার সাথে আছে। কিন্তু সময়ের স্মৃতি মানুষকে সব সময় নষ্টালজিক করে রাখে। যেখানেই থাকো, ভালো থেকো। আমার সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে আমি তোমাদের সাথে আছি আর থাকবো।

উতসর্গঃ

(কনিকার ইউএমবিসিতে (ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ড, বাল্টিমোর কাউন্টি) ভর্তির চুড়ান্তে আমার কিছুটা নষ্টালজিকতা)

২৯/০১/২০২১- নাফিজের বিয়ে

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব

জানুয়ারী 

২৯ 

নাফিজ হচ্ছে আমার এক বোনের মেয়ের ছেলে। আমার বোনের নাম শায়েস্তা খাতুন। সেই শায়েস্তা খাতুনের মেয়ে শেফালী। নাফিজ শেফালীর ছেলে। নাফিজের বাবার নাম নেওয়াজ আলী মোল্লা। সে গত ০২/০৯/২০২০ তারিখে মারা গেছে। নাফিজ জাপানে থাকে, ওখানেই কোনো রকমে কাজ করে যতোটুকু পারে পরিবার এবং নিজের ভবিষ্যত গরার চেষ্টা করছে। নাফিজ যখন বিদেশ যায়, তখন আমিই ওকে স্পন্সর করেছিলাম। প্রায় ৩/৪ বছর পর নাফিজ দেশে এসছে। কিন্তু কবে দেশে এসছে, আর কোথায় কিভাবে বিয়ে করছে সেটা নিয়ে সে আমার সাথে কোনো পরামর্শ যেমন করে নাই, তেমনি ও যে ঢাকায় এসছে সেটাও আমাকে জানায় নাই। এগুলি নিয়ে আমার তেমন কোনো মাথা ব্যথাও নাই। আজকে শুনলাম যে, আজ নাফিজের বিয়ে। এটা শুনলাম আমি মিটুলের কাছ থেকেই। ব্যাপারটা নিয়ে আমি একেবারেই সময় কিংবা মাথা খাটানোর চিন্তাও করি নাই কারন যার যার লাইফ তার তার। কে কিভাবে তাদের লাইফ উপভোগ করলো সেটা নিতান্তই তাদের ব্যাপার। আমি সাধারনত এ ব্যাপারে কারো জীবনেই হস্তক্ষেপ করি না কিংবা করতে পছন্দও করি না।

আমি ২০১৭ সাল থেকেই শেফালী মেয়েটাকে আর পছন্দ করি না। এই না পছন্দ করার পিছনে অনেক কারন আছে। সেটা আর এখানে বলছি না। শেফালী আর নাফিজ আজকে মিটুলকে নাকি ফোন করে বলেছে যে, নাফিজের বিয়েতে যেতে হবে। আমি মিটুলকে বললাম, নাফিজ ঢাকায় কবে এসছে? মিটুল নিজেও বলতে পারলো না। আমি বললাম, আমি জানি, নাফিজ প্রায় ১ মাস আগে ঢাকায় এসছে। বাক্তার চর থেকে ঢাকায় যেতে সব সময় আমার অফিস পার হয়েই তারপর ঢাকায় যেতে হয়, নাফিজ যদি আমাকে ইম্পর্ট্যান্ট মনে করতো যে, আমি ওদের বড় কেউ গার্জিয়ান, তাহলে ঢাকায় আসার পরেই হয় আমাকে একটা ফোন করতে পারতো অথবা আমার অফিসে এসে দেখা করতে পারতো। এর মধ্যে আবার ওর কোথায় বিয়ে ঠিক হচ্ছ্যে, কার কি সমস্যা ইত্যাদি নিয়েও সে আমাকে নক করে নাই কিন্তু আমি জানি ওর বিয়ে নিয়ে ওর এক্স গার্ল ফ্রেন্ডদের মধ্যে বিশাল একটা ঝামেলা চলছে। আমি সব খবর পাই কিন্তু যেহেতু আমাকে কেউ কিছু বলছে না, ফলে আমি উপজাজক হয়ে এদের মধ্যে ঢোকতেও চাই না।

আমার করোনা পজিটিভ থাকায় আমি এমনিতেও নাফিজের বিয়েতে যেতাম না, হয়তো আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে পাঠিয়ে দিতাম। কিন্তু আমি চাই না যে, আমি বা আমার পরিবারের কেউ ওর বিয়েতে যাক। আমি জানি আমি না গেলে কি পরিমান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে শেফালী এবং নাফিজকে। ওরা জানেই না যে, পায়ের তলার মাটি সরে গেলে নিজের শরীরের ওজনটাকেও ধরে রাখা সম্ভব হয় না। এটা আমি ওদের বুঝিয়ে দিতে চেয়েছি এবার। শেফালীর বাবা ছিলো না, মা ছিলো না, শেফালির বোন নুরুন্নাহারের থেকে শুরু করে জমজ দুই ভাই লিয়াকত আর শওকাত এদেরকে সেই দুই মাস বয়স থেকে আমরাই লালন পালন করেছি। ওদের বাবার নাম ওরাও হয়তো ভালোভাবে বলতে পারবে না। গ্রামের মানুষ, আশেপাশের মানুষ ওদেরকে এই নামেই চিনে যে, ওরা মেজরের ভাইগ্না ভাগ্নি। আর এটাই ছিলো ওদের সবচেয়ে বড় শিল্ড। আর ওরাই কিনা আজকে আমাকে ইগনোর করার চেষ্টা করেছে।  আমার খারাপ লাগে নাই ততোটা কারন আমি বুঝে গেছি যে, ওরা আসলে নিমক হারামের জাত।

বিয়েতে গেলাম না। আমি না যাওয়াতে কি হলো সেটা আমি জানি। শেফালীকে হাজার প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়েছে কেনো মামা এলো না। আমাদের গ্রামের মানুষ অনেকেই আমাকে দেখে নাই কিন্তু নাম শুনেছে। আবার অনেক পুরানো দিনের মানুষেরা আমার সান্নিধ্যে আসতে চেয়েও আমার অফিস পর্যন্ত আসার স্কোপ না থাকায় দেখাও করতে পারে না। আবার আমার পজিশনাল ফ্যাক্টরের কারনে অনেকে ভয়েই আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছা থাকলেও দেখা করতে পারে না। এমন একটা পরিস্থিতিতে যখন কেউ শুনে যে, আমার কোনো আত্তীয়ের কোনো অনুষ্ঠান, তারা ভাবে যে, এবার নিশ্চয়ই মেজরের সাথে দেখা হবে। ফলে কেউ দাওয়াতে আসে আমার সাথে দেখা হবে বলে, কেউ আবার অপেক্ষা করে আমার সাথে দেখা হবে বলে। কিন্তু যখন আমার আর ওখানে যাওয়া হয় না, তখন কেনো যাই নাই, কি কারনে যাই নাই এই প্রশ্নে জর্জরিত হতে হয় তার যার বাড়িতে অনুষ্ঠান।

এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর যখন আমার সেই আত্তীয় দিতে পারে না, তখন এতোদিন যে নামের ক্ষমতায় সারা গ্রাম চষে বেড়িয়েছে, যে লোকটির ক্ষমতায় সারাটা গ্রামকে ভয়ের মধ্যে রেখেছে, অনেকেই শুধু এই নামটার জন্যই যখন তাদেরকে তোষামোদি করেছে, তারা তখন এই প্রশ্নটাই করে- কই এতোদিন যাদের জোরে এতো তাফালিং, তারা তো আপনাদের কোনো অনুষ্ঠানেই আসে না, তাহলে কিসের এতো বাহাদুরী?

ক্ষমতার রেশ ছুটে যাচ্ছে, অপমানে মুখ দেখানো কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই যে অসহায় একটা পরিস্থিতি, এটা কিন্তু আমি তৈরী করি নাই, করেছে ওরা নিজেরাই। ওদের আর কোনো মনোবল নাই আমার সামনে এসে কোনো দাবী নিয়ে জোর দিয়ে বলতে পারে, যে, আপনি অবশ্যই আসতে হবে আমাদের অনুষ্ঠানে। একদিকে আমাকে না নিতে পারার কষ্ট আর অন্যদিকে মানুষের কাছে হেয় হবার অপমান কোনোটাই কম না।

আজকে আমার বউ আমার কাছে এসে বল্লো, যে, সেফালি অনেক কান্নাকাটি করেছে যে, মামা যদি নাও আসতে পারে, অন্তত আপনি ১০ মিনিটের জন্য হলেও একবার গ্রামে নাফিজের বিয়েতে ঘুরে যান, অন্তত আমি মানুষকে বলতে পারবো যে, মামা অসুস্থ তাই মামী এসেছেন। তা না হলে আমার আর অপমানের শেষ নাই। আমি সবার কাছে যেমন ছোট হয়ে যাবো, তেমনি আমি পরিবেশ গতভাবেও অনেক দূর্বল হয়ে যাবো।

আমি শুধু মিটুলকে বললাম, যদি তুমি যেতে চাও, যাও, আমাকে কোনোভাবেই কনভিন্স করার চেষ্টা করো না যে, আমাকে নাফিজের বিয়েতে যেতে হবে। যে ছেলেটা একটা ফোন করেও আমাকে যেতে বলে নাই, তাদের আবার এতো অপমানের ভয় কিসের? তুমি যেতে চাও, যাও, দরকার হয় আমার যে কোনো গাড়ি নিয়েও তুমিযেতে পারো। 

আসলে আমি একটা পানিশমেন্ট দিতে চেয়েছি এই শেফালীকে। আসলে এটা পানিশ মেন্ট নয়, এটা একতা বাস্তবতাকে তুলে ধরার জন্য তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া যে, কোথায় কোন জিনিষের উপর কতটুকু কদর করা উচিত সেটা বুঝা। আর এখন তারা সেই শাস্তিতাই পাচ্ছে। আমার ধারনা, সেফালী আরো বড় শাস্তির অপেক্ষায় আছে। তাহলে সেই শাস্তিটা কি? ব্যাপারটা হয়তো এভাবে ঘটবে- 

আমি নাফিজকে চিনি। অত্যান্ত দূর্বল চিত্তের একজন মানুষ, ইমোশনাল একটি ছেলে। শক্ত করে কোনো কিছুর প্রতিবাদ করার সাহসও এই ছেলেটার মধ্যে আমি দেখি নাই। সবসময়ই একটা ভাবুক উপলব্ধির মধ্যে থাকে। আজ যে বাড়িতে নাফিজ বিয়ে করছে, সেফালীর ধারনা যে, তার থেকে একটু উচ্চবিত্তের বাড়িতে সম্পর্ক করলে হয়তো বা সমাজে তাদের একটা আলাদা প্রতাপ বাড়বে কিংবা কোনো এক সমস্যায় হয়তো ওরা হাত বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু কুইনিন জ্বর সারালেও কুইনিন সারাবে কে এটা ওদের মাথায় নাই। অর্থাৎ যেদিন এই পরিবারটা নিজেই সেফালীর জন্য একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে, তখন তাদেরকে প্রতিহত করার উপায় কি? লোহাকে লোহা দিয়ে পিটাতে হয়, কাঠ দিয়ে লোহাকে পিটিয়ে কোনো আকারে আনা যায় না। শুনেছি নাফিজের নবাগত স্ত্রী একজন ডাক্তার কিংবা নার্স বিষয়ক সাব্জেক্টে পরাশুনা করে।  ডাক্তার যে না এটা আমি সিউর কারন কোনো এমবিবিএস পড়ুয়া মেয়ে অন্তত নাফিজের মতো ছেলেকে বিয়ে করার রুচী বা পছন্দে আনতে পারে না। হয়তো নার্স হবে। সাধারনত যেটা হয় যে, গ্রাম্য এসব মেয়েগুলি একটু শিক্ষিত হলেই ভাবে যে, তারা অনেক ক্ষমতাশীল এবং ডিমান্ডেড। ফলে ওরা ওদের অনেক কিছুই চাহিদার বাইরে আব্দার বা দাবী করার প্রয়াশ পায়। আর এই কারনেই এই মেয়েটা একদিন ওর যা খুসী তাইই করার স্বাধীনতা রাখবে। ভাববে যে, সে তো নাফিজের থেকেও বেশী যোগ্য। তাই ওর যা দাবী সেটা তো নাফিজকে মানতেই হবে। নাফিজ তাকে তার অক্ষমতার কথা কিংবা দূর্দশার কথা কিংবা কোনো অন্যায় আব্দারের ব্যাপারে রাজী না হয়ে বাধা প্রদান করলে নাফিজের সব কথা সে নাও শুনতে পারে। আর যদি নাফিজ তাকে শাসন করতে যায়, তখন এই নবাগত স্ত্রী তার পরিবার মিলে নাফিজকেই শায়েস্তা করে ফেলবে। এমনো হতে পারে যে, অচিরেই নাফিজের স্ত্রী তার শাশুড়ির সাথে ধীরে ধীরে সম্পর্কটা অনেক দূরে নিয়ে যাবে, আর সেই দূরে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে শুধু সে নিজেই দূরে চলে যাবে না, সাথে নাফিজকেও দূরে নিয়ে যাবে। নাফিজের এতোটা মনোবল শক্ত নয় যে, নাফিজ বউকে ছেড়ে বা বউকে কড়া ভাষায় কথা শুনিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়াবে। ফলে এমন একটা সময় আসবে যে, নাফিজের দেয়া মাসিক ভাতাটাও একদিন সেফালির জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। এই নাফিজের স্ত্রীই করাবে বন্ধ। এবার আসি সেফালীর আরেক ছেলের কথা। সেফালীর অপর ছেলে নাহিদকে দেখে আমার প্রতিবন্ধী মনে হয়। সারাদিন ঘর থেকে বের হয় না। কারো সাথেই সে কোনো কথাবার্তাও বলে না। শুধু রাতের বেলায় উঠোনে নাকি বের হয় আর রাতেই সে গোসল করে। এই এমন একটা ছেলের কাছ থেকেও সেফালির কিছু আশা করা উচিত না। নাহিদ একদিন নিজেকেই নিজে চালাতে পারবে না। যখন নাফিজের দেয়া ভাতা, বা টাকা সেফালীকে দেয়া কমে যাবে বা বন্ধ হয়ে যাবে, সেদিন এই নাহিদ এমনো হতে পারে নিজের জীবন নিজেই নিয়ে নিবে। কারন সে বেশীরভাগ সময়ে এই পৃথিবীর মানুষের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখে না। সমাজের মানুষ যেমন তাকে সচরাচর দেখে না, তেমনি সেও সমাজের সবাইকে ভালমতো চিনেও না। শুধু মুখ দেখে নাম বলতে পারাটাই চিনা নয়। যখন এই পরিস্থিতি আসবে, নিজেকে খুবই অসহায় মনে করবে নাহিদ আর ভাববে- ওর চলে যাওয়াই উচিত। আর থাকলো সেফালির মেয়ে। মেয়েরা যতোক্ষন পর্যন্ত নিজেরা নিজের পায়ে না দাড়ায়, ততোদিন সে না পারে নিজেকে সাহাজ্য করতে, না পারে তার আশেপাশের কাউকে সাহায্য করতে। ফলে ওর মেয়েরও একই অবস্থা হবার সম্ভাবনা আছে। হয়তো নিজের জীবন না নিলেও শুধুমাত্র বেচে থাকার তাগিদে কোনো এক ছেলেকে বিয়ে করে জীবনটা পার করে দেবে। সেখানে কিছুদিন হয়তো সেফালির ঠাই হবে কিন্তু স্থায়ী হবে না।

নাফিজের থেকে সেফালির দূরে চলে যাবার কারন হবে দুটু। (ক) নাফিজের স্ত্রীর সাথে সেফালির শাশুড়ি বনাম পুত্রবধুর সম্পর্কটা সেফালী নিজেই তৈরী করতে পারবে না বা পারার কথা নয়। সেফালীর যে চরিত্র সেটাই আমাকে এ কথা বলার কারন বলে মনে হয়েছে। আর এই শাসুড়ি বনাম পুত্রবধুর সম্পর্ক ভালো না হওয়ার কারনে সারাক্ষন নাফিজের স্ত্রী নাফিজের মার সম্পর্কে কটু কথা, কান কথা লাগাতেই থাকবে। আর সব শেষে গিয়ে নাফিজের স্ত্রী নাফিজকেই দায়ী করতে থাকবে সব কিছুর জন্য এবং একসময় নাফিজ তার মায়ের উপর এতোতাই বিরক্ত হবে যে, কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা সেটা যাচাই করার আর কোনো মানসিকতা নাফিজের থাকবে না। ফলে যেতা হবে তা হচ্ছে- নাফিজ তার স্ত্রীর পক্ষ নিয়াই কথা বলবে। যেহেতু নাফিজ তার স্ত্রীকে কঠিন ভাষায় মায়ের পক্ষে ওকালতি করতে পারবে না, অথবা উচ্চবিত্ত শশুড়ের মুখের সামনেও দাড়াতে পারবে না, ফলে সে তার মাকেই সে ত্যাগ করবে। সেটাই নাফিজের জন্য সহজ পথ। সেফালি একদিন সত্যিই একা হয়ে যাবে আর সে একাকিত্তে নিজের জীবন নিজেই চালাতে গিয়ে ওর মা আজ থেকে ৪৫ বছর আগে যেভাবে জীবনযাপন করেছে, সেফালিকেও ঠিক সেভাবেই জীবনযাপন করতে হতে পারে। অর্থাৎ পরের ক্ষেতে ধান কাটার পর মাঠ ঝারু দিয়ে পরিত্যক্ত ধান কুড়িয়ে ধান আনা, কিংবা অন্যের ক্ষেতে বদলীগিরি করে, কিংবা এই জাতিয় কাজ করেই ওকে নিজের জীবন নিজেকে চালাতে হবে। (খ) আর দ্বিতীয় কারনটি হলো- লিয়াকত। যতোদিন লিয়াকত নিজের পায়ে দাড়াতে না পারবে, সে ততোদিন সেফালির ঘাড়ের উপরে বসেই জীবন বাচাতে হবে। কিন্তু লিয়াকতের বয়স এখন প্রায় ৩৮। সে লেখাপড়াও করেছে। কিন্তু জীবনমুখী নয়। ওর মতো বয়সের একটা ছেলে কোনো না কোনোভাবে নিজের জীবনসহ একটা সংসার চালাতে পারা সক্ষম হওয়া উচিত ছিলো। অনেকভাবে আমিও চেষ্টা করেছি, হাবীব ভাইও চেষ্টা করেছেন, এমন কি আমি ওকে গাজীপুরে একটা কম্পিউটার ট্রেনিং ইন্সটিটুটের মধ্যে লাগিয়েও দিয়েছিলাম, কিন্তু কোথাও সে এডজাষ্ট করতে পারে নাই। শেষতক আবার সেই সেফালির ঘাড়েই গিয়ে পড়েছে। যতোদিন নাফিজ বিয়ে করে নাই, ততোদিন লিয়াকতের হয়তো ততোটা সমস্যায় পড়তে হয় নাই। কিন্তু নাফিজের বিয়ের পর নাফিজের বউ সেফালির বাসায় থাকতে হচ্ছে, আবার অন্যদিকে নাফিজ দেশে নাই। অথচ লিয়াকত একই বাড়িতে থাকে। এটা কোনোভাবেই হয়তো নাফিজের স্ত্রী আরামবোধ করবে না। এই যে নাফিজের স্ত্রীর ভাষায় সে “আরাম বোধ করছি না” এর মানে একটাই- লিয়াকতকে সেফালির বাড়ি থেকে হটাও। সেফালির বাড়ি থেকে যখন লিয়াকত চলে যেতে বাধ্য হবে, তখন হয়তো সেফালি কিছুটা হলেও তার ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে চাইবে। আর এক কথা বলা চাওয়ার মধ্যেই সেই “দূরে” চলে যাওয়ার ব্যাপারটা লুকায়িত। তবে চুড়ান্ত কথা একটাই- যে কোনোভাবেই হোক, সেফালিকে শেষতক একাই থাকতে হবে, নিজের জীবনের জীবিকা তাকে একাই জোগাড় করতে হবে। এটাই হয়তো শেষের অধ্যায়।

এই যে সেফালিকে নাফিজের স্ত্রি ধীরে ধীরে পছন্দ করছে না এটা বুঝার কিছু উপায় আছে। দেখা যাবে যে, মাসের পর মাস নাফিজের স্ত্রী সেফালির বাসায় আসবে না। কারন দেখাবে যে, সে লিয়াকতের কারনে বিব্রত। সে ফ্রি না লিয়াকতের উপস্থিতিতে ইত্যাদি। ফলে লম্বা সময়ের জন্য সেফালির সাথে বিচ্ছেদ। কিংবা যদি সেফালি অসুস্থ্য হয়ে যায়, তখনো নাফিজের স্ত্রী সেফালিকে দেখভাল করতে আসবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। হয়তো কারন দেখাবে- করোনা কিংবা তার নিজের অসুস্থতা। যদি এমন কিছু ঘটতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে যে, প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এটার ভাঙ্গন শুরু। 

অন্যদিকে, যদি নাফিজ আমাকে গার্জিয়ান হিসাবে সামনে রেখে ও ওর বিয়ের সমস্ত তদারকি করাতো, আর যাইই হক, নাফিজের শশুর বাড়ির মানুষের যে বাগাম্বর ভাবটা এখন আছে উচ্চবিত্তের ধারনায়, সেটা আর থাকতো না। কারন সে আমার তুলনায় কিছুই না। আমার মতো এমন একটা গার্জিয়ানের সামনে না নাফিজের স্ত্রী, না নাফিজের শশুড়বাড়ির কোনো লোক মাথা উচু করে কথা বলতে পারতো। সেফালিও তার গলা উভয়ের সামনে ঠিক আগের মতোই ধরে রাখতে পারতো। আমি একদিক থেকে একটা ব্যাপার নিয়ে শান্তিতে আছি যে, আমাকে আর এসব উটকো ঝামেলা আর পোহাতে হবে না।

এখানে আরেকটা কথা না বললেই নয়। কোনো একদিন নাফিজের শশুরবাড়ির লোকেরাও আমাকে হারিকেন জালিয়ে হন্যে হয়ে খুজবে যখন নাফিজের সাথে, নাফিজের স্ত্রী, কিংবা সেফালির সাথে বড় ধরনের কোনো ঝামেলা তৈরী হবে। তখন তারা খুজবে কাকে ধরলে সমস্যা সমাধান হবে। আর সেই "কাকে ধরলে" খুজতে খুজতে ঠিক আমার আস্তানায় চলে আসবে এসব 'উচ্চবিত্তরা"। আমি আসলে সেদিনটার জন্য অপেক্ষা করছি। শাস্তিটা আমি তখন দেবো ঠিক এভাবে যে- Who are you people? Do I know you?

২২/১১/২০২০-বুড়োবেলায় সেই ছোটবেলা

ছোট বেলায় মনে করতাম, আহা, স্কুল ছুটি হবে, ক্লাশ থাকবে না, টিচারদের কাছে আর জ্ঞ্যানগর্ব লেকচার শুনতে হবে না, ইচ্ছেমতো নদীতে গিয়ে বন্ধু বান্ধব্দের নিয়ে লাফঝাপ মারবো, সারাদিন মাঠে গিয়ে যখন তখন খেলাধুলা করবো। সন্ধ্যা হলে আর পড়ার টেবিলে বসতে হবে না, সকাল সকাল আর ঘুম থেকে উঠতে হবে না, আরো চার আনা, আট আনা দিয়ে চালতার আচার যতো খুশী কিনে খাবো। কত কি!!

মাঝারী বেলায় মনে করতাম, আহা, অফিস ছুটি হলে সারাদিন বাসায় বসে টিভি দেখবো, ঘুমাবো, সন্ধ্যায় আড্ডা দেবো। বন্ধু বান্ধদের নিয়ে রাতভর গল্প করবো। লম্বা লম্বা ঈদের ছুটিতে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবো। কি মজা হবে। কোনো অফিস নাই, বসের আদেশ পালনের তাড়াহুড়া নাই। সকাল সকাল উঠে তাড়াহুড়া করে অফিসের জন্য রওয়ানা হতে হবে না। অনেক অনেক মজা করে সময়টা পার হবে। এই বয়সে এসেও মনে হয়, আহা এইবার ছুটিতে অনেক অনেক সময় পাওয়া যাবে। স্টাফদের ফোন আসবে না, সাপ্লাইয়াদের হিসাব কিতাব নিয়ে বসার দরকার হবে না। বাসায়, আত্মীয় স্বজনদেরকে সময় দিতে পারবো, বেশ জমজমাট একটা সময় পার হবে।

অথচ আজ এই ৫৫ বছর বয়সে আমার নিজের অফিস আছে, অফিসে দেরী করে গেলেও কেউ কৈফিয়ত চাবে না জানি, অফিসে না গেলেও কারো কাছে জবাব্দিহি করার নাই, যখন যেথায় খুশী যেতে চাইলেও কেউ আমাকে বাধা দেয়ার নাই। এই কয়দিন যাবত আমি ছুটিতেই আছি। কাজ নাই, অফিস নাই, তাড়াহুড়াও নাই। বড়দের চাপ নাই, শিক্ষকদের শাসন নাই, স্টাফদের ফোন কল নাই, সাপ্লাইয়াদের কোনো চাপ নাই, কিন্তু তারপরেও মনে হচ্ছে কি যেনো নাই। আচ্ছা, কি নাই? আমি তো ইচ্ছে করলে এখন পুরানো সেই বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে নদীতে যখন তখন ঝাপ দিতে পারি কারন শাসন করার কেউ নাই, ইচ্ছে করলেই সারাদিন টিভি দেখতে পারি, ইচ্ছে করলেই সারাদিন ঘুমাতেও পারি, ইচ্ছে করলেই হাড়ি হাড়ি চালতার আচার, কিংবা বন্ধু বান্ধব্দের নিয়ে রাত ভত আড্ডা, গল্প করতে পারি কিন্তু তারপরেও আমি তা করতে পারছি না বা করতে ইচ্ছে করছে না। কি অদ্ভুত না ব্যাপারটা!!

এখন মনে হয়, জীবনের কিছু কিছু সময় আছে, সেই সময়ের সঙ্গে আমাদের ছুটির একটা বড় রকমের যোগসুত্র আছে। আজ এই ৫৫ বছর বয়সে আমি আর আগের সেই ১২ বছরের বালকের ন্যায় উচ্ছাস নদীতে তরঙ্গলম্ফ দিতে পারি না, ইচ্ছেও করে না। অথবা সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবলের অভাবে নারার-খেরের বল বানিয়ে গুটিকতক অদম্য পোলাপানের মতো গ্রামের সেই স্কুলের মাঠে বৃষ্টি বাদলের মধ্যেও হৈচৈ করে, ভরদুপুরে দৌড়াদৌড়িও করতে পারি না। অথবা পাশের বাড়ির পেয়ারা গাছের আধাপাকা পেয়ারাগুলি আর এখন আমাকে লোভ দেখায় না। বয়সটা পেড়িয়ে গেছে। আর তাই বড় আফসোস লাগে, আহা যদি আবার সেই বাল্যকালের শিক্ষকদের শাসনটা ফিরে আসতো! আহা, যদি আবার সেই পুরানো বন্ধু বান্ধবরা আগের রুপে ফিরে আসতো! মাঝে মাঝে আজ খুব হাসি আসে সেই বাচ্চা বয়সের কথা মনে করে। কতই না রাগ করেছি সবচেয়ে ভালো বন্ধুর সাথে। কত যে ঝগড়া করেছি ওদের সাথে। কখনো কারনে, কখনো অকারনে। কখনো আমি দোষ করেই উলটা রাগ করেছি, আবার কখনো ওদের দোষের কারনেও রাগ করেছি। এক মিনিট সময় লাগেনি তাকে বলতে যে, আমি তাকে ঘৃণা করি কারন সে আমাকে তার লাল পেন্সিলটা একদিন ব্যবহার করতে দেয় নাই, অথবা নদীতে আমার আগে সে লাফ দিলো কেনো এই কারনে আমি তার সাথে জিদ ধরে কয়েকদিন হয়ত কথাই বলিনি ইত্যাদি। জিদ ধরেছি একে অপরের সঙ্গে, কখনো কখনো আড়ি হয়েছে, কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে, আরো কত কি? ইশ, কি মিষ্টি ছিলো দিনগুলি!!

আজ বড় নস্টালজিক মনে হয়, আহা, এমন একটা বয়স যদি আবারো ফিরে আসতো! আমার সেই বন্ধুরাতো আজো আছে, আশেপাশেই আছে। কিন্তু বাল্যকালের সেই উচ্ছ্বাস, সেই অদম্য দুস্টুমিপনা, সেই আবেগ আর নাই। বয়স একধাপ থেকে উঠে আরেক ধাপে, আরেক ধাপ থেকে আরো আরেক ধাপে চলে গেছে। আগের ধাপের স্মৃতি ধরে রেখেছে কিন্তু কার্যপ্রণালী বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কথা হয় দেশের পরিস্থিতি নিয়ে, জীবনের উৎকণ্ঠা নিয়ে, পরিবারের ভালমন্দ নিয়ে, দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের সংস্কৃতি নিয়ে। এখন আর বৈশাখী মেলায় মাটির ব্যাংক, বাঁশের বাঁশী, ভাজা বুট, চালতার আচার, নাগরদোলা, ফোটকা বেলুন, বাশের কঞ্চিতে বানানো বাশি ইত্যাদি নিয়ে কোনো আবেগ আসে না। অফুরন্ত সময় আছে, খেলার মাঠও সেখানেই আছে, নদীও আগের জায়গায়ই আছে, কিন্তু সেই ফেলে আসা বাল্যকালটা আর নাই। নদী দেখলে এখন মন চায় যদি ঝাপ দিতে পারতাম, কিন্তু দেওয়া হয় না। সবুজ ধানক্ষেত দেখলে ক্ষেতের আইল ধরে কচিকচি পায়ে দৌড় দিয়ে কোথাও হারিয়ে যেতে মন চায় কিন্তু হারিয়ে যাওয়া হয় না। মন মনের জায়গায়ই আছে কিন্তু মনের সঙ্গে শরীর আর শরীরের সঙ্গে মনের মধ্যে এখন বিস্তর ব্যবধান বনে গেছে। তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে “সময়” নামক এক বিশাল অদৃশ্য দেওয়াল। পাশে থাকা বাল্য বয়সের ছেলেমেয়েরা যখন তাদের ইচ্ছার কথাগুলি বলতে থাকে, আমি বুঝতে পারি ওরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে আর কি বলছে। বড্ড ভাল লাগে। মাঝে মাঝে ধমক দেই বটে, মাঝে মাঝে বারন করি, কখনো কখনো রাগও করি। আবার এও জানি, এটাই তো করার কথা ওদের। কিন্তু ওরাও একদিন এই সময়টা হারিয়ে ফেলবে। আজ ওদেরকে শাসন করি, একদিন আমাদেরকেও আমাদের অভিভাবকরা শাসন করতো। অভিভাবকদের ওই শাসনে কখনো মন খারাপ হয়েছে, অনেক আনন্দ মাটি করে ফেলেছি রাগে, দুঃখে মনের কষ্টে। জিদ ধরে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। সারাদিন না খেয়ে কষ্ট হচ্ছে দেখে হয়ত মাও খান নাই, বাবা ছেলের অহেতুক জিদে, মায়ের মনের কষ্টে তার সব শাসন ভুলে হয়ত আমাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন, আর আমি সেটাই আমার বীরত্বই বলি, আর আমার জয়ই বলি, গর্বে আরো ঘাড় বেকে বসে থাকতাম খাবো না বলে। একদম অবুঝের মতো। আজ ওইগুলু মনে পড়লে বড্ড মন খারাপ হয়। আজ ঐ শাসনগুলি খুব মিস করছি। চোখের পাতা ভিজে আসে। কোথায় হারিয়ে গেলো ওইসব?

যখন ছোট ছিলাম, সবচেয়ে অপছন্দের চিঠি ছিল আমার অভিভাবকদের। সেই একই কথা। কোনো চিঠি না খুলেই বলে দিতে পারতাম, বাবা কি লিখেছে বা মা কি বলতে চেয়েছে। একদিন খুব দুস্টুমি করে আমি আমার অভিভাবককে বলেছিলাম, আচ্ছা, কস্ট করে বারবার একই চিঠি লেখার দরকার কি? একটা চিঠি ফটোকপি করে রাখলেই তো হয়। কদিন পরপর শুধু ওটা পোস্ট করে দিবা! কারন কথা তো একই থাকে। কেমন আছো তুমি, ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবে, সন্ধ্যা হওয়ার আগে ঘরে ফিরে আসবে, বেশী রাত জাগবে না, বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে ভালোভাবে মিলেমিশে থাকবে, বড়দেরকে সম্মান করবে, আমাদের জন্য মন খারাপ করো না। এই তো? তাহলে আর বারবার লেখার দরকার কি? অথচ আজ এতো বছর পর মনে হচ্ছে, আমি ওই কথাগুলিই খুব মিস করছি। খুব করে মনে হয়, তোমরা আবারো আমাকে এই একই কথাগুলি লিখে পাঠাও না বাবা! আমি জানি, আজ আমার সন্তানেরাও ঠিক একই কথা বলবে। হয়ত কোনো একদিন আজকের এই দিনের মতো তারাও হয়ত আমার সেই একই কথা শুনার জন্য তাদের মন খারাপ করবে। সব বাবাদের কথা এক হয়, সব মায়েদের সন্তানের জন্য চিন্তা এক হয়। তোমরা যখন বাবা মা হবে, সেদিন হয়ত বুঝবে, আজ আমি কি বলতে চাচ্ছি।

যে বালকটি আজ থেকে ৫৫ বছর আগে উচ্ছল, চঞ্চল, দুরন্তপনা, অদম্য সময় কাটিয়েছিলো, ওই সময় যে তোমাদেরকে অনেক কঠিন দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে রাখতো, সময়-অসময় তোমাদের মাথা ব্যথার কারন হয়ে দাঁড়াতো, আজ সেই একই বালক ৫৫ বছর পর শান্ত, ধীর এবং অভিভাবকরুপে রূপান্তরিত হয়ে শুধু একটা আবেগের কথাই বলতে চাই, ফিরে এসে দেখে যাও, সে আর আগের মতো দুস্টুমি করে না, হটাত বৃষ্টিতে তোমাদের অগোচরে ভিজে আর অসময়ে জ্বর বাধিয়ে ফেলে না, কিংবা তোমাদের না বলে হটাত করে কিছু দুষ্টু বন্ধুদের নিয়ে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায় না। তোমরা যে ছেলেকে সারাক্ষন ঘরের মধ্যে শান্ত হয়ে থাকতে বলতে। বলতে আর কতজল ফেলবি আমাদের চোখে? আর কত দুসচিন্তায় ফেলবি আমাদের? আজ এই বয়সে এসে আমি তোমাদের শুধু একটা কথাই বলতে পারি, এখন এসো আমার ঘরে, দেখে যাও, তার এখন অফুরন্ত সময় এবং সে এখন সত্যিই শান্ত একটি মিষ্টি ছেলে। এখন আর তোমাদেরকে আমি কোনো দুসচিন্তায় ফেলবো না। আজ আমার ছুটি। লম্বা ছুটি। আমি তোমাদের একজন লক্ষি ছেলে হয়েই ঘরে বসে আছি। কিন্তু তোমরা কই? তোমরা কি আমার কথা শুনতে পাও? আমি তোমাদের খুব ভালবাসি।

২০/১১/২০২০-ভালোবাসি না

Categories

ভালোবাসা কি? ভালবাসা কি কোনো দ্রব্য বা কোনো পদার্থ যা চোখে দেখা যায়, ছোয়া যায় বা স্পর্শ করা যায় বা মাপা যায়? এটা কি এমন যে, ষোল ছটাকে এক কেজি ভালোবাসা হয় অথবা এটা কি এমন যে, চার আনা এক গন্ডায় এক শতাংশ ভালোবাসা হয়? অথবা এটা কি এমন যে, পাখীরা জেগে উঠলে, তাদের কিচির মিচির শব্দে কোনো এক সকালে বা সন্ধ্যায় সন্ধ্যতারা আকাশে উদিত হলে ভালোবাসার জন্ম হয়? কোথাও কি কোনো মহা মনিষী লিখে গেছেন, কি কি ভাব ভংগিতে, কোন কোন সুরে বা কোন কোন আবেগে ভালোবাসা প্রকাশ পায়? ৫৫ বছর বয়স পার হয়ে গেলো আমার, কিন্তু কোনো বিদ্যালয়, কোনো কলেজ, কোনো ধর্মালয় আমাকে কেঊ এই ভালোবাসার বিক্রয়কেন্দ্র অথবা বিনিময় স্থলের নাম দিতে পারলো না। আমি ভালোবাসাকে আজো চোখে দেখি নাই। অনেক দেশ ঘুরেছি আমি। সম্রাট শাহজাহানের গড়া তাজমহল দেখেছি, প্রিন্স আর্চ বিশপ ডাইট্রিচের প্রিন্সেসের সালোমির জন্য গড়া মার্বেল প্যালেস দেখেছি, উইলিয়াম কেলী স্মিথের প্রথম ছেলে সন্তানের জন্য গড়া "ক্যালী কেসেল" দেখেছি। কিন্তু আমি ওখানেও কোনো ভালোবাসার শপিং মল অথবা ভালোবাসা কিনতে পাওয়া যায় এমন কোনো দোকান দেখি নি। যারা ভালোবাসা বুঝে, কিংবা ভালো বাসে, তারা কিছু না কিছু দিয়েই তাদের সেই অদেখা, অচেনা ভালোবাসার সৌধ নির্মান করে কিছু না কিছু স্মৃতি রেখেই প্রমান করে গেছেন যে, তারা ভালোবেসেছে।

এতো বড় বড় অট্টালিকা, তাজমহল, ক্যাসেল, গার্ডেন বানানোর আমার কোনো সামর্থ নাই। আচ্ছা, ভালোবাসা কোথায় খুচরা কিনতে পাওয়া যায়? কোনো সুপার শপে? বা কোনো বড় মলে? অথবা কোনো কারখানায়? আমি তো অনেক মল, অনেক সুপার সপ কিংবা অনেক কারখানায় খুজেছি এই ভালোবাসাকে। অথচ আজো আমি কারো জন্যেই এক ছটাক, এক শতাংশ কিংবা এক পাউন্ড ভালোবাসা কিনে আনতে পারি নাই!! কোথাও পাইও নাই!! তাহলে আমি কি কখনো কাউকে ভালোবাসি নাই? হয়তো তাই। আমি কাউকেই ভালোবাসি নাই হয়তো।

অথচ, আমি কি অবুঝ বারবার। আমি ওদেরকে না ভালোবেসে, বারবার শুধু ওদের জন্য দুশ্চিন্তায় দিন কাটাই। সারাক্ষন ভাবি, ওরা যেনো ভালো থাকে, ওরা যেনো আনন্দে থাকে। ওরা যেনো নিরাপদে থাকে। আর এটা ভেবেই আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুধু ওদের জন্য ঈশ্বরের কাছে ওদের সুস্বাস্থ্যের দোয়া করি। সমগ্র বিসশে যেন ওরা মাথা উচু করে নিজের সম্মানে দাড়াতে পারে তার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করে রোজগার করি। আমার অবর্তমানে যেনো ওরা থাকে সাবলম্বি, তারজন্য আমার সারাটা দিন, সারাটা মাস আর সারাটা জীবন নিজের সকল আরাম, আয়েশ, আর সৌখিনতাকে ত্যাগ করে ওদের জন্য সঞ্চয় করি। নিজের অচল হয়ে যাওয়া মোবাইল ফোনটা, কিংবা খষে যাওয়া জুতার সোউলটা বারবার সেলাই করে, ওদের শখের ইচ্ছাগুলি পুরনে সদা চেষ্টা করি। খাবারের টেবিলে বড় সুসাধু চিংড়ি মাছটি নিজের খেতে ইচ্ছে করলেও সেটা আমি ওদেরকে দিতে পছন্দ করি। দূর থেকে কয়েকদিন বিরহের সময়টা কাটানোর পর যখন সন্তানেরা ঘরে ফিরে, গিন্নী যখন অসুস্থ্যতা থেকে সুস্থ্য হয়ে ঘরে ফিরে, আমি তখন আনন্দে ওদের বুকে জড়িয়ে ধরি আর বুক ভাসিয়ে দেই আমার অবাধ্য চোখের জলে। কোথাও ওদেরকে একা ছাড়তে ভয় পাই। সাতার না জানা আমার ছোট মেয়েটি বা অল্প সাতার জানা আমার বড় মেয়েটি যখন নদীর জলে নামতে চায়, তখন নিজের শরীরে জ্বর নিয়েও আমি ওদের সাথে পানিতে সঙ্গ দেই যেনো ওরা পানিতে ডুবে না যায়। নাইট কোচের কোনো গাড়িতে বসে আমি সারারাত না ঘুমিয়ে গাড়ি ঠিকমত নিরাপদে চলছে কিনা সেই পাহারায় ক্লান্ত শরীর নিয়েও সারাটা রাস্তা জেগেই থাকি। অথচ, ওদেরকে আমি ভালোবাসি কিনা সেটা সবাইকে দেখানোর জন্য আমি কোনো ইমারত তৈরী করতে পারিনা। কারন, আমার ভালোবাসা হয়তো ও রকমের সুউচ্চ ভবনের মতো নয়।

আচ্ছা, মানুষ ভালবেসে কি কখনো কাদে? অথবা মানুষ ভালোবেসে কি খিলখিল করে হাসে? এমন কি হয় যে, মানুষ ভালোবেসে কারো জন্যে মন খারাপ করে বসে থাকে? শুনেছি, ভালোবাসায় নাকি কান্না থাকে, হাসি থাকে, বেদনা থাকে, থাকে আরো অনেক কষ্ট, বিরহ, আবার থাকে আনন্দও। আমারো এ রকম হয়। যখন সে আমার কাছে থাকে না, যখন ওর শরীর খারাপ হয়, যখন ওর মন খারাপ হয়, যখন কোনো কিছুর জন্যে ওদের চোখে পানি আসে, আমারো মন খারাপ হয়, আমারো চোখেও পানি আসে। যখন আমার সন্তানেরা আমার থেকে দূরে থাকে, ওরা নিরাপদে আছে কিনা তারজন্যে আমার ভয় হয়। ওরা ঠিকমতো খেলো কিনা, ওরা ঠিকমতো ঘুমালো কিনা, ওরা ভাল আছে কিনা এই ভাবনায় আমি তখন ওদের জন্য ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাই, ভয় পাই, চোখ ভিজে আসে কান্নায়। আমি ওদের মিস করি। যখন ভাবি, ওরা একদিন আমার থেকে দূরে চলে যাবে, ওদের সংসার হবে, আমি একা হয়ে যাবো, আমারো অনিশ্চিত বিরহে চোখে জল আসে।

এটা কি ভালোবাসা?

যদি এটাই হয় ভালোবাসা, তাহলে আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, তাজমহল নির্মান না করেও, কোনো ক্যাসেল তৈরী না করেও, কোনো অট্টালিকা, কোনো ব্যবিলনের মতো শুন্যদ্যান নির্মান না করেও, সবটুকু মহব্বত দিয়ে, আদর দিয়ে আমি তোমাদেরকে আজীবন শর্তবিহীন ভালোবাসি। যখন আমি তোমাদের উপর রাগ করি, সেটাও আমার ভালোবাসা। যখন আমি অভিমান করি, সেটাও আমার ভালোবাসা, যখন আমি গোস্যা করি সেটাও আমার ভালোবাসা। কারন, আমার সব রাগ বা অভিমানের সব কিছুতেই মিশে আছে কোনো না কোনো দুসচিন্তা, কোনো না কোনো ভয় আর মিশে আছে শতভাগ সেই শর্তহীন ভালোবাসা। আমার প্রতি আমার সেই বাবা মার এই ভালোবাসাটা বুঝতে আমি ৫৫ বছর পার করে বুঝেছি, ছোটবেলার তাদের সেই শাসনেও ভালোবাসা ছিলো, শৈশবের কোনো এক সাধ অপুরনে আমার পিতামাতার অন্তরের ভিতরের কষ্টেও ভালোবাসা ছিলো, স্কুলের পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট না করায় সেই রাগ অভিমানের মধ্যেও ভালোবাসাই ছিলো।

তারা আজ কেউ কোথাও নাই। অথচ, আমি আজ বুকভরা সেই ভালোবাসা নিয়ে বারবার ফিরে যেতে চাই সেই অজপাড়াগায়ে আমার সেই ভিটায় যেখানে কাদামাখা হাতে আমার মা একটা বেত নিয়ে দুরন্ত ছেলেটাকে নদী থেকে উঠে আসার মেকি রাগ মাখা চোখে অথচ সত্যিকারের ভালোবাসা নিয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতো- আর বলতো—

"উঠে আয় বলছি? তা না হলে আয় একবার, এই বেতটা দিয়ে তোকে মারি"।

হয়তো তোমরাও একদিন......

বার বার ফিরে আসে যুগে যুগে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে।

কি অদ্ভুত ভালোবাসা, তাই না?

(পরিবারের সকল সদস্যদের জন্য উতসর্গ করা লেখাটি যাদের আমি ভালোবাসি কোনো শর্তছাড়া)

১৮/১১/২০২০-ভালোবাসি না

Categories

ভালোবাসি না

ভালোবাসা কি?  ভালবাসা কি কোনো দ্রব্য বা কোনো পদার্থ যা চোখে দেখা যায়, ছোয়া যায় বা স্পর্শ করা যায় বা মাপা যায়? এটা কি এমন যে, ষোল ছটাকে এক কেজি ভালোবাসা হয় অথবা এটা কি এমন যে, চার আনা এক গন্ডায় এক শতাংশ ভালোবাসা হয়? অথবা এটা কি এমন যে, পাখীরা জেগে উঠলে, তাদের কিচির মিচির শব্দে কোনো এক সকালে বা সন্ধ্যায় সন্ধ্যতারা আকাশে উদিত হলে ভালোবাসার জন্ম হয়? কোথাও কি কোনো মহা মনিষী লিখেচ গেছেন, কি কি ভাব ভংগিতে, কোন কোন সুরে বা কোন কোন আবেগে ভালোবাসা প্রকাশ পায়? ৫৫ বছর বয়স পার হয়ে গেলো আমার, কিন্তু কোনো বিদ্যালয়, কোনো কলেজ, কোনো ধর্মালয় আমাকে কেঊ এই ভালোবাসার বিক্রয়কেন্দ্র অথবা বিনিময় শ্তলের নাম দিতে পারলো না। আমি ভালোবাসাকে আজো চোখে দেখি নাই। অনেক দেশ ঘুরেছি আমি। সম্রাট শাহজাহানের গড়া তাজমহল দেখেছি, প্রিন্স আর্চ বিশপ ডাইট্রিচের প্রিন্সেসের সালোমির জন্য গড়া মার্বেল প্যালেস দেখেছি, উইলিয়াম কেলী স্মিথের প্রথম ছেলে সন্তানের জন্য গড়া "ক্যালী কেসেল" দেখেছি। কিন্তু আমি ওখানেও কোনো ভালোবাসার শপিং মল অথবা ভালোবাসা কিনতে পাওয়া যায় এমন কোনো দোকান দেখি নি। যারা ভালোবাসা বুঝে, কিংবা ভালো বাসে, তারা কিছু না কিছু দিয়েই তাদের সেই অদেখা, অচেনা ভালোবাসার সৌধ নির্মান করে কিছু না কিছু স্মৃতি রেখেই প্রমান করে গেছেন যে, তারা ভালোবেসেছে।

এতো বড় বড় অট্টালিকা, তাজমহল, ক্যাসেল, গার্ডেন বানানোর আমার কোনো সামর্থ নাই। আচ্ছা, ভালোবাসা কোথায় খুচরা কিনতে পাওয়া যায়? কোনো সুপার শপে? বা কোনো বড় মলে? অথবা কোনো কারখানায়? আমি তো অনেক মল, অনেক সুপার সপ কিংবা অনেক কারখানায় খুজেছি এই ভালোবাসাকে। অথচ আজো আমি কারো জন্যেই এক ছটাক, এক শতাংশ কিংবা এক পাউন্ড ভালোবাসা কিনে আনতে পারি নাই!! কোথাও পাইও নাই!! তাহলে আমি কি কখনো কাউকে ভালোবাসি নাই? হয়তো তাই। আমি কাউকেই ভালোবাসি নাই হয়তো।

অথচ, আমি কি অবুঝ বারবার। আমি ওদেরকে না ভালোবেসে, বারবার শুধু ওদের জন্য দুশ্চিন্তায় দিন কাটাই। সারাক্ষন ভাবি, ওরা যেনো ভালো থাকে, ওরা যেনো আনন্দে থাকে। ওরা যেনো নিরাপদে থাকে। আর এটা ভেবেই আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুধু ওদের জন্য ঈশ্বরের কাছে ওদের সুস্বাস্থ্যের দোয়া করি। সমগ্র বিসশে যেন ওরা মাথা উচু করে নিজের সম্মানে দাড়াতে পারে তার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করে রোজগার করি। আমার অবর্তমানে যেনো ওরা থাকে সাবলম্বি, তারজন্য আমার সারাটা দিন, সারাটা মাস আর সারাটা জীবন নিজের সকল আরাম, আয়েশ, আর সৌখিনতাকে ত্যাগ করে ওদের জন্য সঞ্চয় করি। নিজের অচল হয়ে যাওয়া মোবাইল ফোনটা, কিংবা খষে যাওয়া জুতার সোউলটা বারবার সেলাই করে, ওদের শখের ইচ্ছাগুলি পুরনে সদা চেষ্টা করি। খাবারের টেবিলে বড় সুসাধু চিংড়ি মাছটি নিজের খেতে ইচ্ছে করলেও সেটা আমি ওদেরকে দিতে পছন্দ করি। দূর থেকে কয়েকদিন বিরহের সময়টা কাটানোর পর যখন সন্তানেরা ঘরে ফিরে, গিন্নী যখন অসুস্থ্যতা থেকে সুস্থ্য হয়ে ঘরে ফিরে, আমি তখন আনন্দে ওদের বুকে জড়িয়ে ধরি আর বুক ভাসিয়ে দেই আমার অবাধ্য চোখের জলে। কোথাও ওদেরকে একা ছাড়তে ভয় পাই। সাতার না জানা আমার ছোট মেয়েটি বা অল্প সাতার জানা আমার বড় মেয়েটি যখন নদীর জলে নামতে চায়, তখন নিজের শরীরে জ্বর নিয়েও আমি ওদের সাথে পানিতে সঙ্গ দেই যেনো ওরা পানিতে ডুবে না যায়। নাইট কোচের কোনো গাড়িতে বসে আমি সারারাত না ঘুমিয়ে গাড়ি ঠিকমত নিরাপদে চলছে কিনা সেই পাহারায় ক্লান্ত শরীর নিয়েও সারাটা রাস্তা জেগেই থাকি। অথচ, ওদেরকে আমি ভালোবাসি কিনা সেটা সবাইকে দেখানোর জন্য আমি কোনো ইমারত তৈরী করতে পারিনা। কারন, আমার ভালোবাসা হয়তো ও রকমের সুউচ্চ ভবনের মতো নয়।   

আচ্ছা, মানুষ ভালবেসে কি কখনো কাদে? অথবা মানুষ ভালোবেসে কি খিলখিল করে হাসে? এমন কি হয় যে, মানুষ ভালোবেসে কারো জন্যে মন খারাপ করে বসে থাকে? শুনেছি, ভালোবাসায় নাকি কান্না থাকে, হাসি থাকে, বেদনা থাকে, থাকে আরো অনেক কষ্ট, বিরহ, আবার থাকে আনন্দও। আমারো এ রকম হয়। যখন সে আমার কাছে থাকে না, যখন ওর শরীর খারাপ হয়, যখন ওর মন খারাপ হয়, যখন কোনো কিছুর জন্যে ওদের চোখে পানি আসে, আমারো মন খারাপ হয়, আমারো চোখেও পানি আসে। যখন আমার সন্তানেরা আমার থেকে দূরে থাকে, ওরা নিরাপদে আছে কিনা তারজন্যে আমার ভয় হয়। ওরা ঠিকমতো খেলো কিনা, ওরা ঠিকমতো ঘুমালো কিনা, ওরা ভাল আছে কিনা এই ভাবনায় আমি তখন ওদের জন্য ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাই, ভয় পাই, চোখ ভিজে আসে কান্নায়। আমি ওদের মিস করি। যখন ভাবি, ওরা একদিন আমার থেকে দূরে চলে যাবে, ওদের সংসার হবে, আমি একা হয়ে যাবো, আমারো অনিশ্চিত বিরহে চোখে জল আসে।

এটা কি ভালোবাসা?

যদি এটাই হয় ভালোবাসা, তাহলে আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, তাজমহল নির্মান না করেও, কোনো ক্যাসেল তৈরী না করেও, কোনো অট্টালিকা, কোনো ব্যবিলনের মতো শুন্যদ্যান নির্মান না করেও, সবটুকু মহব্বত দিয়ে, আদর দিয়ে আমি তোমাদেরকে আজীবন শর্তবিহীন ভালোবাসি। যখন আমি তোমাদের উপর রাগ করি, সেটাও আমার ভালোবাসা। যখন আমি অভিমান করি, সেটাও আমার ভালোবাসা, যখন আমি গোস্যা করি সেটাও আমার ভালোবাসা। কারন, আমার সব রাগ বা অভিমানের সব কিছুতেই মিশে আছে কোনো না কোনো দুসচিন্তা, কোনো না কোনো ভয় আর মিশে আছে শতভাগ সেই শর্তহীন ভালোবাসা। আমার প্রতি আমার সেই বাবা মার এই ভালোবাসাটা বুঝতে আমি ৫৫ বছর পার করে বুঝেছি, ছোটবেলার তাদের সেই শাসনেও ভালোবাসা ছিলো, শৈশবের কোনো এক সাধ অপুরনে আমার পিতামাতার অন্তরের ভিতরের কষ্টেও ভালোবাসা ছিলো, স্কুলের পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট না করায় সেই রাগ অভিমানের মধ্যেও ভালোবাসাই ছিলো।

তারা আজ কেউ কোথাও নাই। অথচ, আমি আজ বুকভরা সেই ভালোবাসা নিয়ে বারবার ফিরে যেতে চাই সেই অজপাড়াগায়ে আমার সেই ভিটায় যেখানে কাদামাখা হাতে আমার মা একটা বেত নিয়ে দুরন্ত ছেলেটাকে নদী থেকে উঠে আসার মেকি রাগ মাখা চোখে অথচ সত্যিকারের ভালোবাসা নিয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আর বলতো-

-"উঠে আয় বলছি? তা না হলে আয় একবার, এই বেতটা দিয়ে তোকে মারি"।

হয়তো তোমরাও একদিন...... বার বার ফিরে আসে যুগে যুগে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে।

কি অদ্ভুত ভালোবাসা, তাই না?  

০২/০৯/২০২০-শেফালীর জামাইর ইন্তেকাল

প্রায় দু মাস হলো নেওয়াজ আলী কুয়েত থেকে একেবারে দেশে ফিরে এসেছে। প্রায় ৩২ বছর দেশের বাইরে ছিলো। নেওয়াজ আলি আমার ভাগ্নী শেফালির হাসবেন্ড। সংক্ষিপ্ত আকারে এই নেওয়াজ আলীর ইতিহাসতা না বললেই চলে না।

তখন ১৯৮৭ সাল। আমি সবেমাত্র সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট পদে চাকুরী করছি। মাঝে মাঝে গ্রামে যাই, আগের মতো না। এম্নিতেই গ্রামে এখন আর আগের মতো যাওয়া হয় না, আবার গেলেও আগের মতো বন্ধু বান্ধবরাও খুব একটা ধারে কাছে নাই বিধায় আড্ডাও জমে না। একদিন মা জানালেন যে, শেফালীর তো বিয়ে দেয়া দরকার। শেফালীর জন্য কুমড়া বারীর নেওয়াজ আলী বিয়ের কথা বলছে। ব্যাপারটা ভেবে দেখিস। কুমড়া বাড়ির নেওয়াজ আলীর বাবা জলিল মোল্লাকে আমি মামা বলে ডাকি। তারা কততা আমাদের কাছের বা রক্তের সে হিসাবটা আমি জানি না, আজো না। তবে জলিল মামার বাড়িতে আমাদের অনেকগুলি সম্পর্ক কেমন করে জানি পাচিয়ে গেছে। আমার তিন নাম্বার বোন লায়লার বিয়ে হয়েছে এই কুমড়া বাড়িতে ইসমাইল ভাইয়ের সাথে। আমার মুসল্মানীর সময় দোস্তি হয়েছে নেওয়াজ আলীর ছোট ভাই মোতালেব বা মূর্তুজ আলির সাথে, অন্যদিকে জলিল মোল্লাকে আমরা আবার ডাকি মামা বলে। এখন আবার বিয়ের সম্পর্ক করতে চায় নেওয়াজ আলী আমাদের ভাগ্নি শেফালীর সাথে। একেকটা সম্পর্ক একেকতার সাথে পরস্পর বিরোধি। যদি জলিল মামাকে মামা বলে কেন্দ্র ধরি, তাহলে লায়লার বিয়ের জন্য জলিল মামাকে বলতে হয় ভাই বা বিয়াই। আবার লায়লার বিয়ের সম্পর্ককে যদি কেন্দ্র ধরি, তাহলে জলিল মামাকে আর মামাই বলা যায় না। আবার জলিল মামার পোলা মোতালেবের সাথে আমার দোস্তি পাতার কারনে জলিল মামা হয়ে যায় আমার খালু বা আংকেল। এখন যদি শেফালিকে নেওয়াজ আলীর সাথে বিয়ে দেই, এতোদিন যেই নেওয়ায়জ আলিকে আমি ভাই বলতাম, তাকে এখন আমার বলতে হবে জামাই বাবু আর নেওয়াজ আলি আমাকে বলা শুরু করবে "মামু"। অন্যদিকে আরেকটা ঘটনা প্রায় ঘটেই যাচ্ছিলো, সেটা না হয় নাইবা বললাম। এতো সব প্যাচালো একটা সম্পর্কের মধ্যে আমাকে এবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে শেফালির বিয়ের ব্যাপারটা নেওয়াজ আলীর সাথে।

এবার আসি শেফালীর ব্যাপারে কিছু কথা। শেফালির মা শায়েস্তা খাতুনের প্রথম পক্ষের মেয়ে শেফালী। শেফালীর জন্মের পর শেফালীর বাবা তার দেশে যাওয়ার নাম করে সে আর ফিরে আসে নাই। কেনো ফিরে আসে নাই, আদৌ বেচে আছে কিনা, বা তার একেবারে নিরুদ্দেশ হবার কল্প কাহিনী আজো আমরা কেউ জানি না। শেফালী আমাদের বাড়িতেই বড় হতে লাগলো। শেফালীর মায়ের অন্য আরেক জায়গায় বিয়ে হয়ে গেলো। সেখানে লিয়াকত, শওকাত আর ফারুকের সাথে এক মেয়ে নুরুন্নাহার এর জন্ম হয়।  শেফালী আমাদের বাড়িতেই বাপ মা বিহিন আমার মায়ের কাছে বড় হতে লাগলো। এই ধরনের বাচ্চাদের বেলায় বিয়ে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আমরা মামারা যারা গ্রামের সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছি, তাদের বেলায় এটা অনেকতা উপকারই হয়। তারা এইসব বাচ্চাদের বেলায় মামাদেরকেই আসল গার্জিয়ান ভেবে সম্পর্ক করতে আগ্রহী হয়।

নেওয়াজ আলীর ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন। খুবই সুন্দর একতা ছেলে। কিন্তু অশিক্ষিত। দেশে কাজের কিছু নাই। বেকার। বিদেশ যাওয়ার একতা হিরিক পড়েছে। কিন্তু নেওয়াজ আলীদের বা জলি মোল্লার সামর্থ নাই যে, ছেলেকে বিদেশ পাঠায়। তাই, বিয়ের মাধ্যমে যদি কনে পক্ষ থেকে কিছু ক্যাশ নেওয়া যায়, তাহলে বিদেশ যাওয়ার জন্য একটা আশার পথ খোলে। ফলে শেফালি চেহারায় অনেক কালো হলেও টাকার কাছে এটা কোনো বিশয়ই ছিলো না। তাদের দাবী- ২০ হাজার টাকা দিতে হবে ক্যাশ, নেওয়াজ দেশের বাইরে চলে যাবে বিয়ের পর। দেশের বাইরে যেতে মোট টাকা লাগবে ৩০ হাজার, বাকী ১০ হাজার জলিল মোল্লা জোগাড় করবে। শেফালীর ভুত-ভবিষ্যত অনেক কিছু চিন্তা করে শেষ নাগাদ আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, শেফালীকে আমরা নেওয়াজ আলীর সাথেই বিয়ে দেবো এবং হাজার বিশেক টাকা সহই দেবো। সেই থেকে শেফালির হাজবেন্ড নেওয়াজ আলি জুয়েতেই ছিলো, মাঝে মাঝে দেশে এসছে। এর মধ্যে শেফালির তিন সন্তানের মা, নাফিজ, নাহিদ আর একটা মেয়ে।

নেওয়াজ আলীর প্রায় ৩২ বছরের বিদেশ থাকা অবস্থায় ওর স্বাস্থ্যের অনেক ক্ষতি হবার পাশাপাশি যে, পরিবারের অনেক উন্নতি হয়েছে সেটাও না। অবশেসে নেওয়াজ আলি গত ২ মাস আগে চুরান্তভবে দেশে চলে আসে। এখন তার বয়স প্রায় ৬০ এর কাছাকাছি। ওর বড় ছেলে নাফিজ জাপানে থাকে, ছোট ছেলে নাহিদ মাত্র মেট্রিক দেবে, মেয়ে আরো ছোট। দেশে আসার পর আমার সাথে নেওয়াজ আলীর দেখা হয় নাই। মানে নেওয়াজ আলীর সাথে আমার দেখা হয় নাই প্রায় কয়েক যুগ।

যাই হোক, দুদিন আগে জানতে পারলাম, ৭ বছর আগে নেওয়াজ আলীর যে বাইপাশ সার্জারী হয়েছিলো কুয়েতে, সেই বাইপাস সার্জারীতে আবার নাকি ব্লক। তাকে পুনরায় অপারেশন করাতে হবে। ৩২ বছর বিদেশ চাকুরী করার পরেও তাদের যে খুব একটা সঞ্চয় আছে সে রকমের কিছু না। হয়তো সব মিলে লাখ পাচেক টাকার একটা ক্যাশ ব্যালেন্স থাকলেও থাকতে পারে। গতকাল নেওয়াজ আলি বুকের ব্যথায় উঠানে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো, তড়িঘড়ি করে আজগর আলী হাসপাতালে আনা হয়। তারা নেওয়াজ আলীর ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলো যে, সে ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে আছে। রাখতে চায় নাই। অগত্যা আবার গ্রামে। আসলে মাথার উপর যখন কেউ থাকে না, আর যে মাথা হিসাবে থাকে, যখন তারই কোন বিপদ হয়, তখন সে থাকে সবচেয়ে অসহায় পজিশনে। নেওয়াজ আলীর অবস্থা অনেকটা এ রকমের। অসুস্থ্য শরীর নিয়ে একবার হাসপাতাল, আরেকবার গ্রামে, এই করতে করতেই সে আরো অসুস্থ্য

আজ সকালে আবারো নেওয়াজ আলিকে হাসপাতালে "বারডেম হাসপাতাল" নিয়ে আসা হয়েছে। হার্টের পেসেন্ট, কেনো যে বারডেমে আনা হয়েছে সেটাও আমি জানি না। আর কেনো জানি ব্যাপারটায় আমি জানতেও মন চায় নাই। আর জানতে না চাওয়ার পিছনেও একটা কারন ছিলো, যা এখন আর বলছি না। একটু আগে লিয়াকত (শেফালীর ভাই) ফোনে জানালো যে, সম্ভবত নেওয়াজ আলি বাচবে না। তার অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। খরটা আমার কাছে অন্য দশটা খবরের মতোই মনে হয়েছিলো। তাড়াহুরা ছিলো না। আমার স্ত্রী মিটুলের শরীরটা অনেক খারাপ, তাকে নিয়ে ইবনে সিনায় গিয়েছিলাম, সেখান থেকে গিয়েছিলাম সি এম এইচে। ফেরার পথে আনুমানিক ২ তার দিকে লিয়াকত ফোনে জানাল যে, নেওয়াজ আলি আর নাই, মারা গেছে।

গ্রামে লাশ দাফনের জন্য যাওয়ার দরকার ছিলো, এটা একটা প্রোটকলের মধ্যে পড়ে। কিন্তু আমারো কোমড়ে একটু ব্যথা ছিলো বলে যেতে চাই নাই। আর কোমড়ে ব্যথা না থাকলেও হয়তো যাওয়া হতো কিনা আমার সন্দেহ আছে। মন যেতে চায় নাই।

শেফালি সম্ভবত কাদছে, ওর ছেলেমেরা কাদছে, এই কান্নাটা শুরু হয়েছে। আমি দোয়া করি ওদের যেনো কাদতে না হয় কিন্তু আমি জানি কান্নার ভাষা। আমি তো সেই ছোটবেলা থেকেই বাবা ছাড়া দুর্দশা জীবন থেকেই আজ এখানে এসেছি। তবে একতা বিষয় স্পষ্ট যে, যাদের মাথার উপরের বৃষ্টি অন্যের ছাতায় নিবারন হয়, তাদের উচিত না ওই ছাতাওয়ালা মানুষতাকে কোনোভাবেই ছাটার নীচে থাকতেই হিট করা। তাতে যে ছাতার আবরনটা সরে যেতে পারে এটা যখন কেউ বুঝে না, তখন ছাতাটা যখন সরে যায়, তখন ওই ছাতার মাহাত্য টা হারে হারে টের পাওয়া যায়। আমি হয়তো ওদের জন্য ওই ছাতা ওয়ালাই ছিলাম।

২৮/০৬/২০২০-আমি তাকে ভালোবাসি না

Categories

ভালোবাসা কি? কি করলে ভালোবাসা প্রকাশ পায়? ভালবাসা কি কোনো দ্রব্য বা কোনো পদার্থ যা চোখে দেখা যায়, ছোয়া যায় বা স্পর্শ করা যায়? আমি তো ভালোবাসাকে কখনো চোখে দেখি নাই। তাহলে আমি ওকে কিভাবে ভালোবাসি? আমি ওকে কখনো ভালবাসি নাই। আমি শুধু ওর জন্য কাদি, মন খারাপ হয় আর প্রতিটাক্ষনে আমি ওকে মিস করি। আচ্ছা, ভালোবাসা কোথায় কিনতে পাওয়া যায়? কোনো সুপার শপে? বা কোনো বড় মলে? অথবা কোনো কারখানায়? আমি তো অনেক মল, অনেক সুপার সপ কিংবা অনেক কারখানায় খুজেছি এই ভালোবাসাকে। কই আমি তো ওর জন্যে একবারের জন্যেও কোনো ভালোবাসা কিনে আনতে পারি নাই!! কোথাও পাইও নাই!! তাই আমি আজো ওকে কোনো ভালবাসা দিতে পারি নাই। তাহলে কিভাবে বলি যে, আমি ওকে ভালবাসি?

যখন ওর সাথে আমার কথা না হয়, আমার চোখ ভিজে যায় জলে। যখন ও আমাকে স্পর্শ করে, আমার মন গলে যায় আনন্দে। ওর কাছে যেদিন আমার যাওয়ার কথা থাকে, আমি অধীর আগ্রহে প্রতিটা মুহুর্ত অপেক্ষা করি, কখন যাবো ওর কাছে। আমার আর সময় কাটে না। আমি আয়নার সামনে দাড়াই, নিজে নিজেই কথা বলি। অথচ আমি কখনো ওর জন্য একটু ভালবাসাও কিনে আনতে পারলাম না।

আমি ওকে একটুও ভালবাসি না। আমার শুধু ভয় হয়, ও ভাল আছে তো? কোনো বিপদে যেনো না পড়ে, তাই আমি ওর জন্য সারাক্ষন ঈশ্বরকে ডাকি। ওর শরীর যেনো ভাল থাকে আমি এটার জন্য দোয়া করি। আমি ওকে অনেক ভালোবাসতে চাই। কিন্তু আমি তো জানি না কিভাবে ভালোবাসতে হয়। আমি শুধু জানি, ও যেনো আনন্দে থাকে আমাকে নিয়ে। ও যেনো সমস্ত সুখ পায় আমার এই অন্তর নিয়ে, আমার শরীর নিয়ে, আমার সবকিছু নিয়ে। কতোদিন ভেবেছি, আমি ওকে ভালবাসবো, কিন্তু কখনো আমি ওকে ভালবাসিনি বলেই বারবার মনে হয়। কিভাবে ভালোবাসবো? আমার তো সবসময় দুসচিন্তা হয়েছে, ও যেনো সুস্থ থাকে, সবল থাকে, কোনো অপয়া যেনো ওকে স্পর্শ না করে এই চিন্তায়। সব সময় শুধু এটাই ভেবেছি যে, আমার জীবনের সবকিছু দিয়েও যদি ওর মংগল হয়, ওর সুখ হয়, আমি সেটাই চাই। কখন ভালোবাসবো আমি তাহলে? আমি ওকে আজো ভালোবাসতে পারলাম না। কোথায় পাওয়া যাবে সেই ভালোবাসা যা দিয়ে আমি বলতে পারি, এই দেখো, আমি তোমাকে ভালবাসা দিলাম।

শারমিন একদিন বলেছিলো, ভালবাসা নাকি নেটে পাওয়া যায়। ভালোবাসা নাকি পথে হেটে যাওয়া কোনো এক নারীর বুকের মধ্যে পাওয়া যায়। শারমিন আমাকে ওর বুকের মধ্যে ভালোবাসা দেখিয়েছিলো। কিন্তু আমি তো ওই বুকে কোনো ভালোবাসা দেখি নাই? আমি শুধু শারমিনের বুকে উদাম দুটো স্তন দেখেছিলাম, সাদা ধব্ধবে। শারমিন বলেছিল, ভালবাসা নাকি নারীর কাপড়ের ভিতরে লুকিয়ে থাকে। বারিধারার ওই বিশাল অট্টালিকায় কালো অন্ধকার ঘরে নাকি এই ভালোবাসা উম্মুক্ত করে দেয়। নামহীন পরিচয়হীন মানুষেরা নাকি এই উম্মুক্ত ভালোবাসা দল্বেধে শকুনের মতো খুটে খুটে খায়। তারা নাকি অনেক ভালবাসা দেয়। কিভাবে দেয় ওরা ভালোবাসা? ফুলের গুচ্ছ দিয়ে? নাকি অঢেল টাকা আর পয়সা দিয়ে? অথবা বাড়ি আর গাড়ি দিয়ে? অথবা কোনো এক রাজপ্রাসাদের মতো কার্পেটওয়ালা ঘরের মধ্যে উলংগ করে সারাটা শরীর চুষে চুষে শকুনদের মতো খেয়ে খেয়ে?

কিন্তু আমি তো ওকে আজো কোনো ফুলের গুচ্ছ দিলাম না। আমি তো ওকে অঢেল টাকা বা পয়সাও দিলাম না। যা দেই তা নিতান্তই আদর করে ভবিষ্যতের একটা সাবলম্বিতার জন্য। আমি তো ওকে কোনো গাড়ি বা বাড়িও দিলাম না। তবে আমি ওকে কোনো রাজপ্রাসাদের অন্ধকার ঘরে বন্দি করে ওর শরীর চুষে চূশে শকুনদের মতো উম্মত্ত হই না। আমি শুধু ওকে নিতান্তই একটা ছোট আলোয়ে গভীর মমতায় বুকে জড়িয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে আমার কাধে ওর মাথা রেখে বুকে বুক মিলিয়ে ধরে রাখি। কোন কষ্ট যেনো না পায়, সে রকম আলতো করে আমি ওকে ছুয়ে দেই। ওর নীরিহ বদনে আমি আমার উষ্ণ ঠোটের দ্বারা চুমুতে চুমুতে ভরে দেই। ওর ঘাড়ে আলতো করে আদর দেই। আমি ওইসব শারমিনদের মতো ওকে কখনো ভালবাসা দিতে পারি নাই। আর এজন্য আমার বারবার মনে হয়, আমি আসলে ওকে ভালবাসি না। কারন, শারমিনদের ভালবাসার সাথে আমার কোনো মিল নাই। আমি ওকে জড়িয়ে ধরি, আমি ওর চোখে চোখ রেখে হতবাক হই, ওর নারী শরীর আমাকে আন্দোলিত করে, আমি ক্ষনেক্ষনে ওকে নতুন করে বারবার আবিষ্কার করি। আমি ওর যত্ন নেই তুলতুলে নাকের উপর চিমটি কেটে। ওর নাভিতে শুড়শুড়ি দেই, বুকে জড়িয়ে ধরি। ওর চোখের জল মুছে দেই। ওর হাসিতে আমিও হাসি। অথচ আমি ওকে আজো ভালবাসতেই পারলাম না। আমি ভালবাসাটাই বুঝতে পারি না। ভালোবাসি না হয়তো। কিন্তু ওর কান্নায় আমার বুকে ব্যথা করে। ওর শরীর খারাপ হলে আমি অস্থির হয়ে যাই। ওর খাবার না খেলে আমি অনেক বকা দেই। ও পরাশুনায় গাফিলতি করলে অনেক শাসন করি। কোথাও আমাকে না বলে গেলে রাগ করি। আমি ওকে কারো সাথে অশ্লীল কথা বলতে বারন করি। আমার সেটা ভাল লাগেনা। তাই বারবার মনে হয়, আমি আজো ওকে ভালোবাসতে পারি নাই। আমি আসলে হয়তো ওকে ভালোই বাসি না। আমি যা করি, তা হচ্ছে, আমি এক মুহুর্তও ওকে ভুলে থাকতে পারি না। সারাক্ষন ওর চেহারাটা আমার চোখে ভাসে। ওর সাথে আমার কথা না হলে, ওকে না দেখলে আমার দিনটাই ভাল যায় না। সকালে উঠেই আমার ওর কথা মনে পড়ে, ঘুমাতে যাওয়ার আগেও ওর কথাই আমার মনে পড়ে। অথচ আমি ওকে ভালই বাসি না। এটা কেমন ভালবাসা?

আমি ওকে ভালবাসতে চাই। কারন, আমি ওকে আজ ভালোবাসি নাই।

১০/০৬/২০২০-দুদু মিয়ার ইন্তেকাল

আমি অফিসে বসে ছিলাম। কাজের চাপ ছিলো বটে কিন্তু তারপরেও কাজের চাপ কমে এসেছিলো দুপুরের দিকে। ফ্যাক্টরীর সেলারী দিতে হবে, কাজ প্রায় সম্পন্ন। কফি পান করছিলাম। এমন সময় বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে মিটুল (আমার স্ত্রী) ফোন করলো। ফোন ধরলাম, তার কন্ঠ উৎকণ্ঠায় ভরপুর।

-শুনছো?

-কি শুনবো?

-আরে, ফাতেমা আপার জামাই দুদু ভাই মারা গেছেন।

-বললাম, কখন?

-এইমাত্র ওনার মেয়ে খালেদা জানালো যে, ওর বাবা মারা গেছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

খারাপ লাগলো। কারন গতকালও আমি ওনার সাথে ফোনে কথা বলেছিলাম। বলেছিলো যে, ওনার শরীরটা বেশী ভালো নাই। অথচ আজকে ২৪ ঘন্টা পার হয় নাই, লোকটা আর এই প্রিথিবীতেই জীবন্ত নয়। এটাই জীবন। যার কোনো স্ট্যাবিলিটি নাই। কখন উনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে সেতাও জানি না, আবার কেনো ভর্তি হয়েছিল সেতাও জানি না। দুদু ভাই হার্টের স্ট্রোকের কারনে মারা গেছেন বলে ডাক্তার জানিয়েছে।

দুদু ভাই আর ফাতেমার গল্পটা বলি।

১৯৭৬ সাল। আমি তখন গ্রামে। গ্রামের স্কুলেই লেখাপড়া করি। দেশের অবস্থা বেশ খারাপ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ, কোনো আইন শৃঙ্খলা নাই, তার মধ্যে কয়েকদিন আগে শেখ মুজিব, যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, তাকে সামরিক অভ্যুথানে খুন করা হয়েছে। গ্রামের অনেক লোক বেকার, যে যেভাবে পারে কোনো রকমে দিন চালাচ্ছে। আমরা ৫ বোন আর মা এবং আমি। আমাদের সংসার যার প্রধান মানুষ আমার বড় ভাই হাবীবুল্লাহ। তিনিও সাবলম্বি নন, স্টুডেন্ট থেকে সবেমাত্র ঢাকা ইউনিব্ররসিটিতে লেকচারার হিসাবে যোগ দিয়েছেন। কোনো রকমে আমাদের সংসার চলে। বাড়িতে এতোগুলি বোন আর আমি তো সবেমাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ি, এরকম একটা থমথমে দেশের পরিবেশে ভাইয়ার উপর লোড কম নয়। একদিকে নিরাপত্তা, আরেকদিকে জীবন ধারনের যুদ্ধ। হাবীব ভাই নিজেও তার ক্যারিয়ার গড়ার জন্য বিদেশে যাবেন বলে পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু বোনদের বিয়ে না দেয়া পর্যন্ত তার এই পরিকল্পনায় অনেক কঠিন পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছিলো।

এই সময় দুদু ভাই প্রেমে পড়লেন আমার ৪র্থ বোন ফাতেমার সাথে। গ্রামে ওই সময় প্রেম করা একটা যেমন জঘন্য ব্যাপার বলে মনে করা হতো, তেমনি যারা প্রেম করছেন, তারাও অনেক অসুবিধায় থাকতেন। মনের তীব্র ইচ্ছা দেখা করার কিন্তু না আছে সুযোগ না আছে কোনো অনুমতি। ফলে চিরকুট, চিঠি ইত্যাদি দিয়ে যতোটুকু রোমাঞ্চ করা যায় সেটাই ছিল একমাত্র ভরষা। আমার ৩য় বোন লায়লার বিয়ে হয়ে গেছে, ১ম বোন সাফিয়ার বিয়ে ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে। তার প্রথম স্বামী গত হয়েছেন। আমার মা, ফাতেমা আর দুদু মিয়ার প্রেমের এই গল্পটা ভাইয়ার কাছে একেবারেই গোপন করে রাখলেন। মায়েরও অনেক চিন্তা ছিলো তার মেয়েরদের জন্য ভালো পাত্রের ব্যাপারে।

দুদু ভাই তখন ফুটন্ত যুবক। দেখতে খুবই সুদর্শন আর স্মার্ট। বেকার ছেলে কিন্তু তার বাবার একটা মনোহরী দোকান ছিলো। তিনি হাপানীতে ভোগেন প্রায়ই। ফলে সবসময় বাজারের দিনে তিনি ঠিকমতো বাজারে গিয়ে পসরা বসাতে পারেন না। এই সুযোগে দুদু ভাই তার বাবার ব্যবসাটা দেখভাল করেন।

সময়টা ছিলো বর্ষাকাল। আমাদের গ্রামে বর্ষাকালে হাটে বাজারে যাওয়ার জন্য প্রতিটি গ্রাম থেকে নৌকা বা কোষা লাগতোই কারন বর্ষাকালে গ্রামের একদম কিনার পর্যন্ত পানিতে ভরপুর থাকতো। আমাদের নিজস্ব কোনো নৌকা বা কোষা নাই। ফলে যখনই কোনো নৌকা বা কোষা আমাদের বাড়ির পাশ দিয়া বাজারে যেতো, আমি ওইসব নৌকা বা কোষায় অনুরোধের ভিত্তিতে উঠে যেতাম। দুদু ভাইদের যেহেতু দোকানের অনেক মাল নিয়ে হাটে, বাজারে যেতে হয় পসরা সাজানোর জন্য, ফলে তাদের একটা নিজস্ব নৌকা ছিলো। ঘোষকান্দা থেকে বিবির বাজারে যেতে হলে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই যেতে হয়। ফলে দুদু ভাইদের নৌকা করেই আমি বেশীর ভাগ সময় হাটের দিন আমি হাটে যেতাম। আর দুদু ভাই যেহেতু ফাতেমার সাথে একটু ভাব আছে, তিনিও চাইতেন যেনো কোনো ছলেবলে তার নৌকা আমাদের ঘাটে ভিরুক। তাতে হয়তো কখনো কখনো ফাতেমার সাথে দুদু মিয়ার ক্ষনিকের জন্য হলেও চোখাচোখি হয়। এটাই প্রেম। এভাবে অনেকদিন চলে যায়।

মা একদিন হাবিব ভাইকে ব্যাপারটা খুলে বলেন। আমি ঠিক জানিনা কেনো বা কি কারনে হাবীব ভাই দুদু ভাইদের পরিবারটাকে পছন্দ করতেন না, সে রহস্য আজো আমার কাছে অজানা। হাবীব ভাই ফাতেমার সাথে দুদু মিয়ার বিয়েতে কিছুতেই রাজী ছিলেন না। কিন্তু মায়ের জোরাজোরিতে এবং ফাতেমার প্রবল ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত হাবীব ভাই এই বিয়েতে রাজী হলেন। আমার ধারনা, হাবীব ভাই আরেকটা কারনে তিনি রাজী হয়েছিলেন, আর সেটা হচ্ছে, যেহেতু হাবিব ভাই নিজেও ক্যারিয়ার গড়ার জন্য বিদেশে পাড়ি দিতে চান, এবং তার আগে সব বোনদের বিয়ের ব্যাপারটা নিসচিত করতে চান, ফলে যেমনই হোক, ফাতেমার একটা গতি হচ্ছে এটা ভেবেও দুদু মিয়ার সাথে বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশী বাড়াবাড়ি করেন নাই। কিন্তু তিনি যে নিমরাজী এটা ভালভাবেই হাবিব ভাই প্রকাশ করতে পেরেছিলেন।

অন্যদিকে দুদু মিয়ার খুব একটা মনোযোগ ছিলো না কোনো কাজেই। না বাবার ব্যবসা, না অন্য কিছুতে। ফলে দুদু মিয়ার বাবাও এই মুহুর্তে সে বিয়ে করুক এটাও রাজী ছিলেন না। আরো একটা কারন ছিলো দুদু মিয়ার বাবার এই বিয়েতে রাজী না হবার। আর সেটা হচ্ছে যে, আমাদেরর গ্রামে সব সময়ই ছেলেরা যখন বিয়ে করে, তখন তারা নির্লজ্জের মতো কনে পক্ষ থেকে মোটা দাগে একটা যৌতুক দাবী করে এবং পায়ও। দুদুর বাবাও এ রকমের একটা পন আদায়ের লক্ষে ছিলেন কিন্তু হাবিব ভাইয়ের এক কথা, কোনো যৌতুক দিয়ে আমরা বোনের বিয়ে দেবো না। ফলে দুদু ভাইয়ের বাবারও এই বিয়েতে মতামত ছিলো না। অথচ শেষ পর্যন্ত বিয়েতা হয়েছিলো। দুদু মিয়ার এক্ষেত্রে আমি একটা ধন্যবাদ দেই যে, সে তার বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়েও অনড় ছিলো যে, যৌতুক বা পন বুঝি না, আমি ফাতেমাকেই বিয়ে করবো। গ্রামে এ ধরনের বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্তের বড় অভাব। কিন্তু দুদুর মধ্যে এই সাহসটা ছিলো। ফলে ফাতেমার সাথে দুদুর বিয়ে হলো ঠিকই কিন্তু তার বাবা, বা মা, কিংবা অন্যান্য আত্তীয় সজনেরা এই বিয়েটায় তারা লস করেছে বলে ধরে নিয়েছে। আর এই লসের কারন ফাতেমা। এতে যা ঘটলো তা হচ্ছে, ফাতেমাকে শসুড়বাড়ির অনেক বিড়ম্বনার মুখুমুখি হতে হয়েছে। বিয়েটাকেই টিকিয়ে রাখা কষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো ফাতেমার। কিন্তু আমি আজ দুদু মিয়াকে অনেক ধন্যবাদ দেই যে, যদি দুদু মিয়া বলিষ্ঠ না হতো, তাহলে ফাতেমার পক্ষে ওই বাড়িতে টিকে থাকা সম্ভব হতো না। একটা সময় ছিলো যে, দুদু মিয়া শুধুমাত্র ফাতেমার কারনে তাকে তার পৈত্রিক বাড়ি থেকে উৎখাত হতে হয়েছিলো। আর তখন ফাতেমা আর দুদু মিয়া আমাদের গ্রামের বাড়িতেই থাকা শুরু করেছিলো। এই থাকা অবস্থায় ফাতেমার সব সন্তানদের জন্ম হয়।

দেশের ক্রমবর্তমান খারাপের কারনে দেশে কোনো কাজ নাই। এদিকে দুদুর বাবার ব্যবসাটাও আর তার হাতে নাই। আমাদের গ্রামে তখন দলে দলে লোকজন দেশের বাইরে যাবার হিরিক পড়েছে। কেউ সৌদি, কেউ কুয়েত, কেউ লিবিয়া, কেউ ইতালি আবার কেউ কেউ যেখানে পারে সেখানে। দুদু ভাইও সে লাইনে পড়ে গেলো। বেশ টাকার প্রয়োজন, অন্তত ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। দুদু ভাই নিজের বাবাকে পটিয়ে, কিছু আমাদের থেকে আবার কিছু লোন নিয়ে শেষ অবধি সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন। পিছনে রেখে গেলো ফাতেমাকে, তার ছেলে ফরিদকে, মেয়ে সালেহা, খালেদা আর ছেলে কামাল এবং জামালকে।

কিন্তু যে লোক আরাম প্রিয়, ভারী কাজে অভ্যস্থ নয়, তার পক্ষে ওই সৌদি আরবের গরম বালুর জমিনে, গরু মহিষ চড়ানো কিছুতেই ভাল লাগার কথা নয়। তারমধ্যে এম্নিতেই সৌদি লোকজন ৩য় দেশের বিশেষ করে বাংলাদেশের শ্রমিকদেরকে মিসকিন হিসাবে ট্রিট করে। দুদু মিয়া স্বাধীনচেতা মানুষ, আরামপ্রিয় মানুষ, তার কত টাকা ক্ষতি হলো বা ক্ষতি হচ্ছে এসবের কোন বালাই ছিলো না। তিন মাস না যেতে যেতেই দুদু মিয়া পুনরায় বাংলাদেশে চলে এলেন। এই ঘটনায় দুদু মিয়ার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলো। যেটুকু ভরশা তার বাবা তার উপর করেছিল এবং কিছু লাভের আশায় যে কয়টা টাকা দিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছিলো, পুরুটাই গচ্চা যাওয়ায় দুদু মিয়ার বাবা এবার তাকে মুটামুটি ত্যাজ্য করার মতো অবস্থায় চলে গেলো। দুদু মিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলো, আর দুদু মিয়া কোথাও কোনো জায়গা না পাওয়ায় আমাদের গ্রামের বাড়িতেই স্থায়িভাবে উঠে গেলো।

আমাদের বাড়িটা বড়ই ছিলো। আর যেহেতু মা থাকেন, ফলে আমরা আপাতত মাকে দেখভাল করার জন্য যে একজন লোকের দরকার ছিলো সেটা অন্তত পেলাম। ফাতেমাই মার দেখভাল করেন। মার খাওয়া দাওয়ার খরচ আমরাই দেই কিন্তু ফাতেমা আমাদের বাড়িতে থাকায় মার কখন কি লাগবে, সেটায় ফাতেমাই টেককেয়ার করে। কিন্তু সংসার চালানোর জন্য তো ফাতেমার একটা স্থায়ী সোর্স থাকা দরকার। কখনো আমরা কিছু সাহাজ্য করি, কখনোও দুদু মিয়াও কোথা থেকে কিভাবে টাকা আনে আমরা জানিও না। শুনলাম, দুদু মিয়া একটা আদম ব্যবসা খুলেছে। মানে লোকজনকে বিদেশ পাঠানো। তার সাথে আমাদের গ্রামের একজন লোক পার্টনার হিসাবে আছে। প্রথম প্রথম মনে হলো ব্যবসাটা ভালোই চলছে। কিছু কিছু লোকজনকে তো দেশের বাইরে পাঠাচ্ছে। আবার নতুন লোকের লাইন হচ্ছে, টাকা আসছে। কিন্তু সুখ তার বেশীদিন টিকে নাই। আদম ব্যবসা যারা করেছে, সব সময় এটায় কোনো না কোনো দুই নম্বরী কিছু ছিলোই। কেউ হয়তো সাফল্য পেয়ে তাদের মাধ্যমে বিদেশ চলে যেতে পারছে আবার কেউ মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও বিদেশ যেতে পারছিলো না অথচ টাকা পরিশোধ করা আছে। এ রকম করতে করতে প্রায় অনেক বছর কেটে গিয়েছিলো। পাওনাদাররা এসে ঝামেলা করে, থ্রেট দেয়, ফাতেমাকে পর্যন্ত শাসিয়ে যায়, মামলা করে, আবার কেমন করে যেনো এসব ঝামেলা থেকে দুদু মিয়া পারও পেয়ে যায়।

আমি তখন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। এ রকমের বহু কেস আমার কাছেও এসেছে। কিন্তু সমাধা করতে গিয়ে দেখেছি, দোষটা এই আদম ব্যবসা কোম্পানীর, সাথে দুদু ভাইদের। আমার পক্ষে আনইথিক্যাল করা কিছু সম্ভব হয় নাই বটে কিন্তু আমি সেনাবাহিনীতে আছি এই নাম ভাংগিয়ে দুদু ভাই এবং তার পার্টনার অনেক ফায়দা তো অবশ্যই নিয়েছেন। আমি কখনো এসব নিয়ে না মাথা ঘামিয়েছি না কেউ এলে আমি তার পক্ষে বিপক্ষে কোনো একসানে গিয়েছি।

দুদু ভাইয়ের সন্তানেরা ততোদিনে বড় হয়ে গেছে। বড় ছেলে ফরিদ খুব হিসেবি। নিজের ক্যারিয়ার গড়ার জন্য অনেক পরিশ্রম করছে কিন্তু খুটিতে জোর না থাকলে সব সন্তানের ভাগ্য অতোটা বেড়ে উঠে না যতোটা তার প্রাপ্য। কিন্তু আমি ফরিদের উপর অনেক সহানুভুতিশীল ছিলাম। আমারো ওই রকম ইনকাম নাই যে, যা লাগে সাপোর্ট করতে পারি। ফরিদের গল্পটা পড়ে লিখবো।

দুদু ভাই যতোটা কামাই করে নিজের পরিবারকে সাহাজ্য করতে চান, দেখা গেলো, তার থেকে বেশী ঝামেলায় পড়ে আরো বেশী ক্ষতিপুরন দিতে হচ্ছে। হাত খোলা লোক। যখন টাকা আসে, মনে হয় কতোক্ষনে টাকাটা খরচ করবে। কিন্তু যখন থাকে না, তখন গোল্ডলিফ বা বেনসন সিগারেটের পরিবর্তে স্টার সিগারেটও তিনি খেতে পারেন। লোকটার কথায় আশ্বাস পাওয়া যায় কিন্তু সেই আশ্বাস কতোটা নির্ভরযোগ্য, সেটা অনেকবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে দেখা গেছে। ফলে, একটা সময়ে, তার সন্তানেরা, তার স্ত্রী ফাতেমা সাফ বলে দিয়েছিলো যে, তার কোনো রোজগারের দরকার নাই, শুধু ঝামেলার কোনো কাজে না গেলেই হলো। এভাবেই দুদু ভাই সংসার দেখে, ফরিদ বিদেশ থেকে টাকা পাঠায়, আরো এক ছেলে কামালও কুয়েতে থাকে, সেও পাঠায়। তারা ভালোই ছিলো। হজ্জ করেছে, গ্রামে তার একটা পজিশন তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলো শেষ বয়সে হলেও।

আসলে, মানুষ যখন একা একা অনেক বড় প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে নিজেকে বাচাতে হয়, তখন অনেক সময় কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়, কোনটা করা উচিত আর কোনটা করা উচিত না, এই বিচারে আর যাই চলুক জীবন চলে না। কেউ নিজের থেকে খারাপ কিংবা বদনাম কুড়াতে চায় না। বেশীরভাগ মানুষ পরিস্থিতির শিকার। দুদু ভাই খারাপ লোক ছিলেন না। তার অন্তর বড় ছিলো, তার প্রতিভা ছিল। কিন্তু গরীবের ঘরে সবসময় প্রতিভা আলোকিত হয় না। এটা সেই ফুটন্ত ফুলের মতো, পরাগায়ন না হবার কারনে অকালেই ফল হয়ে না উঠে ঝরে যাওয়ার কাহিনী। এটা কার দোষ? দুদু ভাইয়ের নাকি তার পরিবারের নাকি আমাদের এই ভারসাম্যহীন সমাজের?

অনেক লম্বা একটা সময় দুদু ভাই ছিলো আমাদের সাথে। অনেক রাগ করেছি, বকা দিয়েছি, মাঝে মাঝে আবার ভালোবাসায় আগলেও রেখেছি। আজ প্রায় ৭০ বছর বয়সে এসে দুদু ভাই সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। উনার লাশটা যখন আমার ফ্যাক্টরীর সামনে এসে থামলো, একটা লাশবাহী গাড়িতে কাপড়ে মোড়ানো ছিল দুদু ভাই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে লাশ গ্রামে নিয়ে যাবার সময় আমি তার ছেলে জামাল এবং ভাতিজা আরশাদকে বলেছিলাম যেনো ফ্যাক্টরীর সামনে থামায়। কিছু খরচাপাতি ব্যাপার আছে, যাওয়ার সময় ওদের হাতে তুলে দেবো। কারন এই মুহুর্তে এটা খুব দরকার।

দুদু ভাই অনেকবার আমার এই ফ্যাক্টরিতে এসেছিলেন। খাওয়া দাওয়া করেছে আমার সাথে, হেটে হেটে ঘুরে ঘুরে দেখেছে আমার ফ্যাক্টরি। গত মার্চ মাসেও একবার আমার এই ফ্যাক্টরীতে এসেছিলো খালেদাকে নিয়ে, মিজান (খালেদার জামাই) ছিলো, মিজানের আব্বা, মিজানের চাচা এবং জেঠারা ছিলো। খালেদা ছিলো, জামাল ছিল। একসাথে খেয়েছি। অথচ আজ, দুদু ভাইয়ের কোনো ক্ষমতা নাই লাশবাহী গাড়ি থেকে নেমে আমার সাথে একবার দেখা করেন, তার কোনো শক্তি নাই আরো একবার আমার ফ্যাক্টরীর নতুন মেশিনগুলি হেটে হেটে ঘুরে ঘুরে দেখার। তার এই দুনিয়ার সাথে সমস্ত নেটওয়ার্ক ছিন্ন করা হয়েছে। এই পৃথিবীতে তারজন্য আর কোনো অক্সিজেন বরাদ্ধ নাই, তার পায়ের শক্তি রহিত করা হয়েছে, তিনি আর এই বাজ্যিক পৃথিবীর কেউ নন। উনাকে আমরাও আর আটকিয়ে রাখার কোনো ক্ষমতা নাই, রাখাও যাবে না। লাশবাহী গাড়িটার সামনে গিয়ে দাড়ালাম, দুদু ভাই সাদা একটা কাপড়ের ভিতর একটা জড়ো পদার্থের মতো শুয়ে আছেন গাড়ির সিটের নীচে। যে লোকের জীবন্ত অবস্থায় সিট বরাদ্ধ ছিলো, আজ তার স্থান গাড়ির সিটের নীচে। এটাই জীবন। লাশবাহী গাড়ি চলে গেলো গ্রামের পথে।

তার বড় ছেলে ফরিদের সাথে কথা হল। ফরিদ জাপানে থাকে। বর্তমানে করোনার মহামারী চলছে সারা দুনিয়াব্যাপি। জাপানের সাথে এই মুহুর্তে আমাদের দেশের বিমান চলাচল সাময়ীকভাবে বন্ধ আছে। কিন্তু যদি কেহ আসতে চায়, তাহলে ইন্ডিয়া হয়ে হয়তো আসা যাবে। ফরিদ তার বাবাকে দেখতে ঢাকায় আসতে চাচ্ছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হল, এটা ঠিক হবে না। কারন কোনো কারনে যদি ফরিদ ঢাকায় চলে আসতেও পারে, বলা যায় না, করোনার মহামারীর কারনে বাংলাদেশ সরকার বিদেশ ফেরত যাত্রী হিসাবে ফরিদকে ১৫ দিনের কোয়ারেন্টাইন করে ফেললে ফরিদের পক্ষে আরো ১৫ দিন গ্রামেই আসা হবে না। আর যদি লাশকে এখন আবার ঢাকায় কোনো হাসপাতালে মর্গে রাখতেও যায়, দেখা যাবে কোনো হাসপাতাল সেটা নাও রাখতে পারে। আবার যদি লাশ রাখাও যায়, ফরিদকে কোনোভাবে এয়ারপর্ট থেকে কোয়ারেন্টাইন ছারাও গ্রামে আনা যায়, তাহলে ফরিদের জাপানে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারেও একটা করাকড়ি থাকতে পারে। আবার এই মুহুর্তে আগামী ৩ দিনের মধ্যে কোনো ফ্লাইটও নাই। সব মিলিয়ে আমি ফরিদকে ঢাকায় আসতে বারন করে দিলাম। ফরিদের না আসার সিদ্ধান্তটা যখন কনফার্ম করা হলো, আমি গ্রামের উদ্ধেশ্যে রওয়ানা হলাম দুদু ভাইকে কবর দেওয়ার জন্য। আমি যখন গ্রামে পৌঁছলাম, তখন রাত প্রায় পৌনে আটটা। গ্রামে ফাতেমাকে দেখলাম, ওর অন্যান্য সন্তানদের সাথে কথা বললাম। সবার মন খারাপ, কান্নাকাটি করছে। দুদু ভাইয়ের লাশ ঘিরে অনেক মানুষ উঠানে খাটিয়ার পাশে জড়ো হয়ে বসে আছে।

জন্ম আর মৃত্যুর মধ্যে একটা ভীষন মিল আছে। জন্মের সময়ে নতুন অতিথির চারিদিকে যেমন বাড়ির সবাই বসে হাসিমুখে বরন করে নেয়। এই নতুন অতিথির আগমনে যেমন সবাই বাড়িভর্তি মানুষের ভীড় লেগে যায়, ঠিক তেমনি মৃত্যুর সময়েও বাড়িভর্তি মানুষের ভীড় জমে যায়। কিন্তু এ সময়ে সবাই থাকে ভারাক্রান্ত আর শোক বিহব্বল।

আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন, রাত বেড়ে যাচ্ছে, কবর এখনো খোড়া শেষ হয় নাই। রাতে এশার নামাজের পর জানাজা হবে। এশার নামাজ হবে রাত নয়টায়। ফরিদের শ্বশুর মোল্লা কাকা বাকী সব সামলাচ্ছেন। গোসল, কাফন আর যাবতীয় সব। মাঝে মাঝেই কেউ কেউ উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করছে। কেউ কাদতেছে কাদতে হবে বলে। ফলে উচ্চস্বরেই সে তার সেই বিলাপ লোক সম্মুখে জাহির করার অভিনয়ে এটাই বুঝাতে চাইছে, দুদু মিয়ার শোকে সে এতোটাই বিহব্বল যে, তার বুক ফাটছে, তার অন্তর কাদছে ইত্যাদি। কিন্তু আমার চোখে এই মিথ্যা কান্নাটা ধরা পড়েছে। কিন্তু তারপরেও কাদুক। আবার কেউ নীরবে চোখের পানি ফেলছে, তার এই কান্না অন্তরের ভিতর থেকে। নিঃশব্দ কান্নার কষ্ট হাহাকার করে কান্নার থেকেও অধিক কষ্টের।

ফাতেমা কাদছে নিঃশব্দে, আমাকে দেখে একটু উচ্চস্বরে কান্নার উপক্রম হয়েছিলো, বুঝলাম আবেগ। হবেই তো। নিজের লাইফ পার্টনার চলে গেছে। খারাপ হোক ভালো হোক, একজন লোকতো ছিল যার সাথে অভিমান করা যায়, যার কাছে অভিযোগ করা যায়। আজ সে চলে গেছে। প্রায় ৪৪ বছরের পার্টনারশীপ লাইফে কত কথাই না লুকিয়ে আছে ফাতেমার জীবনে। এই সংসার গুছাইতে কতই না সময় ব্যয় করেছে ওরা।

বললাম ফাতেমাকে- আজ তুমি একা কিন্তু একা নও। আমরা তো আজীবনই ছিলাম, এখনো আছি। নিজের উপর যত্ন নিও, আর কখনো ভেবো না যে, তুমি একা হয়ে গেছো। ভাই আর বোনের সাথে তো নাড়ির সম্পর্ক। তুমি ভাল থাকবা, মনের জোর রাখো আর দোয়া করো এইমাত্র চলে যাওয়া মানুষটার জন্য যার সাথে তুমি নির্দিধায় অন্ধকারেও হাতে হাত ধরে রাস্তা পার হতে পেরেছিলা। আজ তোমার দোয়া তার জন্যে সবচেয়ে বেশী দরকার। মনটা আমারো খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো ফাতেমার চোখের জল দেখে। আজ অনেকদিন পর সেই কথাটা মনে পড়লো-

যদি কখনো তোমার কাদতে ইচ্ছে করে, আমাকে ডেকো,

আমি ওয়াদা করছি, আমি তোমাকে হাসাতে চেষ্টাও করবো না।

কিন্তু আমি তোমার সাথে কাদতে পারবো।

যদি কখনো তোমার কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, আমাকে ডেকো

আমি ওয়াদা করছি, আমি তোমাকে একটুও বাধা দেবো না

কিন্তু আমি তো তোমার সাথে হারিয়ে যেতে পারবো।

যদি কখনো তোমার কারো কথাই শুনতে ইচ্ছে না করে, আমাকে ডেকো

আমি ওয়াদা করছি, আমি তোমার সাথে কোনো কথা বল্বো না, নিসচুপ থাকবো।

কিন্তু কখনো যদি তুমি আমাকে ডেকেছো কিন্তু আমার কাছ থেকে কোন সাড়া পাও নাই,

তুমি এসো                            

হয়তো সেদিন সত্যিই তোমাকে আমার প্রয়োজন।

ফিরে এলাম। জানাজায় শরীক হতে পারি নাই। অনেক রাত হয়ে যাবে। আর সারাটা বাড়িতে এতো বড় করোনার মহামারী সত্তেও কারো মুখে মাস্ক নাই। খুব অসস্থি বোধ করছিলাম।

গাড়িতে উঠে বারবার দুদু ভাইয়ের কথাই মনে পড়ছিল। আজ থেকে আমি ইচ্ছে করলেও তার মোবাইল নাম্বারে ফোন করে কথা বলতে পারবো না। ইচ্ছে করলেও কোনো কারনে বকাও দিতে পারবো না। তিনি আজ সব কিছুর উর্ধে।  

আমরা তার কাছেই ফিরে যাবো যার কাছ থেকে এসেছিলাম। আজ থেকে ৫০ বছর কিংবা ১০০ বছর পর হয়তো কেউ জানবেও না, দুদু নামে কোনো একজন আজ তিরোধান হলো। এই তিরোধানের প্রাকটিস যুগে যুগে সব সময় হয়ে এসেছে, হবেও। আমরা সময়ের স্রোতে একে একে হারিয়ে যাবো। কারন আজ থেকে শত বর্ষ আগেও এখানে এমন দুদু, এমন আখতার, এমন ফাতেমারা এসেছিলো। আজ তারা কেহই নাই। তাদের কোনো ইতিসাহও কোথাও লিখা নাই। আর যেখানে লিখা আছে, তা ঈশ্বরের কাছে। সেখানে আমাদের কোনো পদচারনা নাই।

আল্লাহ আপনার জন্য জান্নাত বরাদ্ধ করুন।

১৭/০৬/২০১৮-ব্রাক এর সিডিএম

Categories

 (সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজমেন্ট) এ একদিন

আজ গিয়েছিলাম ব্রাক এর সিডিএম (সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজমেন্ট) এ। আমার জানা ছিলো না যে, এতো কাছে এতো সুন্দর একটা জায়গা। চারিদিকে সবুজ বনায়ন, এক পাশে মস্ত বড় একটা পুকুর। পুরু ক্যাম্পাসটা ওয়াল দিয়ে ঘেরা একটা সুরক্ষিত চত্তর। নামাজের জায়গা, থাকার জায়গা, খাওয়ার জায়গা, শরীরচর্চা, সবকিছুই একটা পরিকল্পনায় করা। কোনো কোলাহল নাই, পরিবার নিয়ে বেড়ানো যায় এমন জায়গায়ই এটা। খুবই ভালো লেগেছে। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির ১৫ তম ব্যাচের কয়েকজন (আওলাদ ভাই, মুস্তাক আহমেদ রিজভী ভাই, আফরোজা আপা, রোজ, হাসান ভাই, নেসার) ভাইদের সাথে বড্ড একটা ভালো সময় কাটালাম।

আমি জাহাঙ্গীরনগরের কেউ না, কিন্তু আমার স্ত্রীর সুবাদে মূটামুটি তার সব বন্ধুদের সাথেই আমার একটা আলাদা বন্ধুত্ত তৈরী হয়ে গিয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা অনেক বছর পর কোনো অনুষ্ঠানে আসে আর আমাকে হতাত তাদের কোন অনুষ্ঠানে দেখে, প্রায়ই বলে শুনি, দোস্ত তোমার চেহারা আমার মনে নাই কেন? কি জানি তোমার নাম ছিলো ইউনিভার্সিটির লাইফে? আমি মুচকি মুচকি হেসে বলি, আমি তো ফিজিক্সে ছিলাম। আর অন্য বাকীরা যারা আমাকে চিনে অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ে। মন্দ লাগে না।

যাই হোক, আজকে খুব বেশী বন্ধু বান্ধব এই অনুষ্ঠানটায় আসে নাই। গোটা পাচ ছয় জনার একটা দল। সবার সাথে আমি খুব ফ্রি ভাবেই মেশার চেস্টা করি। চেস্টা করি যাতে কেউ না ভাবে যে, প্রথমত আমি একজন সামরীক বাহিনীর অফিসার, এবং দ্বিতীয়ত আমি একজন ব্যবসায়ী। আর ভালো মানুষদের সাথে ভালো থাকাটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। জাহাঙ্গীরনগর এর অনেকেই ব্যবসায়ী, কেউ কেউ ব্যাংকার, কেউ কেউ আবার প্রোফেসর। সব সেক্টরেই আছে। এটা একটা ভালো মিশ্রনের গ্রুপ। প্রায়শ ই যেহেতু আমি এই সব বন্ধুদের সাথে বেড়াতে আসি বা তাদের নিজস্ব অনুষ্ঠান গুলিতে আমি পারটিসিপেট করি, ফলে ব্যক্তিগত অনেক ভিউজ এবং মতামত আদান প্রদান করা হয়। সে রকমই আজো তার ব্যতিক্রম হয় নাই।

আজকের দলটির মধ্যে বেশীরভাগ সময়ে কথাবার্তা হলো হাসান ভাইয়ের সাথে। হাসান ভাই ইঞ্জেক্সন মোল্ডিং এর ব্যবসা করেন। প্লাস্টিক লাইনে। তারও দুটি মেয়ে। একটির বিয়ে হয়েছে প্রায় এক বছর হলো। হাসান ভাইয়ের সাথে একান্ত সময়ে অনেক কথাবার্তা হলো। বেশ ভালো লেগেছিলো তার সাথে অনেক বিসয়ে কথা বলে। আমি যে জিনিসটা নিজে সাফার করে বুঝেছি বা কেউ বুঝে, হাসান ভাই সেটা আগে থেকেই সাফার না করে বুঝেছেন। খুব ইন্টারেস্টিং। কথা হল মেয়েদের নিয়ে, সংসার নিয়ে, ব্যবসা নিয়ে, বুড়ো বয়সের অভিজ্ঞতা নিয়ে, আত্মীয়তার প্রসঙ্গ নিয়ে। অনেক বাস্তবসম্মত চিন্তা ভাবনা হাসান ভাইয়ের। তার সাথে আমার অনেক কিছুই মিলে যাচ্ছিলো এবং আমার মনে হয়েছে তার কথাগুলির মধ্যে কোনো রকমের ভনিতার আশ্রয় নাই। আমাদের আলাপের কিছু চুম্বক অংশ আজ আমার ডায়েরীর পাতায় লিখে রাখার চেস্টা করছি।

তার বক্তব্যটা আমি তুলে ধরিঃ

মেয়ের জামাই (Son in Law) বা তাদের শশুড় বাড়ির প্রসংগে হাসান ভাইয়ের বক্তব্যঃ

…শুনেন আখতার ভাই, মেয়ের জামাই যাকে সান ইন ল (Son in Law) বলা হয়, সে কখনোই সান (Son) হতে পারে না। সে সান (Son) বাই (By) ল (Law)। আমার মা বলতেন, এক গাছের বাকল আরেক গাছে কখনোই লাগে না। এটা যেমন চিরন্তন সত্য, তেমনি সান এবং সান ইন ল কখনোই এক হতে পারে না, এটাও চিরন্তন সত্য। আমি আমার মেয়েদেরকে প্রায়ই বলে থাকি যে, শোন মা, আর যাই হোক, অন্তত আমি আমার কোনো ব্যবসায় আমার কোনো মেয়ের জামাইকে অংশীদার করবো না। না তার কাছে ব্যবসার কোনো কর্তৃত্ব ছেড়ে দেবো। আমার যদি ১০০টি বাড়িও থাকে তারপরও আমি আমার কোনো কিছুই আমি আমার সান ইন ল (Son in Law) কে দিবো না বা দিতে চাই না। আমার নামেই সব থাকবে, বা আমার অবর্তমানে আমার মেয়েদের নামে সব থাকবে। যদি আমার মেয়েরা সব নস্টও করে ফেলে, তারপরেও আমার একটা সান্তনা থাকবে যে, আমার মেয়েরাই নস্ট করেছে। যদি আমার আবার সামর্থ্য থাকে, আমি তাদের জন্য আবার গড়ে দিবো। কিন্তু আমার সান ইন ল (Son in Law) এরা কখনোই আমার তিলে তিলে গড়ে উঠা সম্পদের মাহাত্য বুঝবে না। কেনো বুঝবে না সেটার ব্যাখ্যাও তিনি দিতে ভুলে গেলেন না। আমি যে পরিশ্রম করে, আমার সমস্ত মেধা আর ইমেজ দিয়ে আমার ছোট ব্যবসা আজ একটা পর্যায়ে নিয়ে এসেছি, সেখানে হটাত করে বিনা পরিশ্রমে অন্য বাড়ির একজন অপরিপক্ক মানুষ না বুঝবে এর দরদ না বুঝবে এর বেড়ে ঊঠার ইতিহাস। ফলে চুন থেকে পান খসলেও ব্যবসার প্রয়োজনীয় কিছু কিছু ব্যক্তি বা এলিমেন্টকে তার নিজের ইগোর কারনে নিমিসের মধ্যেই বহিস্কার করতেও বুক কাপবে না। কাকে দরকার, কাকে দরকার নাই, কোন কাজ টি করলে ব্যবসার বা প্রতিষ্ঠানের মংগল হবে সে ধার বা বিচার তার কাছে থাকে না। ফলে পরের ধনে পোদ্দারীর মতো বা স্ত্রী কপালে ধন পাওয়ার কারনে এইসব সম্পত্তির উপর তার শুধু আরামের স্থানটি রচিত হয়, তাকে ধরে রাখার প্রবনতা খুব কম ছেলের থাকে। এক সময় যদি বেশী চালাক হয়, স্বার্থের কারনে নিজের নামে সব পাকাপোক্ত করার বাহানা খুজে। এতে সবচেয়ে যারা বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয় তা হচ্ছে যার নিজের ব্যবসা তার এবং তার পরিবারের। ইতিহাস সেটাই বারবার প্রমান করেছে। ব্যতিক্রম যে নাই তা নয়। কিন্তু সেটাও খুব চোখে পড়ার মতো নয়।  

আমিঃ আপনার অবর্তমানে তো মেয়েরাই তথা মেয়ের জামাইরাই মালিক। তাহলে ওদের দিতে অসুবিধা কই?

হাসান ভাইঃ সাথে সাথে তিনি একটা বাস্তব একটা উদাহরন দিলেন। নামটা এখানে গোপনীয়তা রক্ষা করার কারনেই উল্লেখ করছি না। ধরুন তার নাম মিস্টার এক্স। ভদ্রলোক বেশ নামীদামী ব্যবসায়ী। তার দুটি মেয়ে ছিলো। অতি আদর করে মিস্টার এক্স তার বড় মেয়েকে বিয়ে দিলেন এক সুন্দর রূপসী ছেলের সাথে। ছেলে নাই। আর তিনি নিজে দেশের প্রতিষ্ঠিত একজন মস্ত বড় ব্যবসায়ী হবার কারনে সম্পদের কোনো অভাব নাই। অন্য আরেক কথায় বলা চলে যে, তিনি দেশের অর্থনীতি কন্ট্রোল করে যারা তাদের মধ্যে একজন। ছেলে নাই, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে যেনো তিনি একজন ছেলে পেলেন। ভালোবাসায় তাকে এমন সিক্ত করলেন যে, শ্বশুরের অর্ধেক ব্যবসার মালিক হয়ে রীতিমত বড় বড় দৈনিক পত্রিকা গুলিতে নিউজ হয়ে গেলেন। শ্বশুর মহাশয় তার মুল ব্যবসার অর্ধেক মালিকানা হস্তান্তর করে নিজের সাথে যোগ করে দিলেন। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, চালাক ছেলে। ধীরে ধীরে ছেলেটি শ্বশুরের ব্যবসায় বসে বসে সুযোগটা কাজে লাগাতে শুরু করেন। মেয়ের জামাইও তার মেধা কাজে লাগিয়ে পৃথকভাবে আরো একটা ব্যবসা শুরু করলেন। শশুড়ের তাতে কোনো আপত্তি ছিলো না। তার মেয়ের জামাই আআরো বড় হোক সেটাও তিনি চান। সাথে শ্বশুরের সাথে তো অংশীদারিত্ত আছেই। মাস ঘুরে বছর যায়, দিন পালটাতে থাকে। টুকটাক ছোট খাটো খুনসুটি লাগতে থাকে স্বামী স্ত্রীর মাঝে। সময়ের স্রোতে এই খুন্সুটি আরো জোরালো পর্যায়ে পৌঁছে যায়। মনমালিন্য থেকে এক সময় মুখ চাওয়া চাওয়ি পর্যন্ত দেখা বন্ধ হয়ে যায়। একটা সময় আসে যখন সম্পর্কটা যেনো আর টিকানোই যাচ্ছিলো না। এতো আদরের মেয়ের জামাইকে যেনো শশুড় আর চিন্তেই পারছেন না। তার ব্যবহার, আচরন, কথা বলার হাবভাব এতোটাই বেপরোয়া যে, তাকে আদর তো দুরের কথা সহ্যই করতে পারছিলেন না তার নিজের মেয়ে এবং শশুড়। এদিকে শুরু হয়েছে আরেক যন্ত্রনা যে, শশুড় তো ইতিমধ্যেই তার মেয়ের জামাইকে তার ব্যবসার অর্ধেক শেয়ার হস্তান্তর করে পাকাপোক্ত করে মালিক বানিয়ে দিয়েছেন, ফলে তার নিজের ব্যবসার মধ্যে সব সিদ্ধান্তে এখন তার মেয়ের জামাইয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে যেখানে তিনি একা আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রাখেন না। ধীরে ধীরে তার ব্যবসার অধোপতন শুরু হতে লাগলো। অন্যদিকে মেয়ের জামাইয়ের নিজস্ব যে ব্যবসা তিনি ইতিমধ্যে বিস্তার করে ফেলেছেন, তা ধীরে ধীরে শশুড়ের টাকাতেই দেশের নামীদামি একটা প্রতিষ্ঠানে রুপ নিতে শুরু করেছে। এখন শশুড় মহাশয় না পারছেন জামাইয়ের কাছ থেকে তার দেওয়া শেয়ার ট্রান্সফার করে ফিরিয়ে আনতে না পারছেন জামাইকে বশে আনতে। বছর ঘুরতেই যা হবার তাই হলো। মেয়ের সাথে জামাইয়ের তালাক হয়ে গেলো। অথচ জামাই তখনো তার নিজের ব্যবসার একজন অংশীদার এবং জামাইয়ের নিজের ব্যবসাও রমরমা। না পারছেন জামাইকে নিয়ে একসাথে ব্যবসা করতে, না পারছেন তাকে তার থেকে আলাদা করতে। অতি আদরের জামাই তার চিরশত্রু হয়ে গেলো। এ যেনো নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে নিজেকে ধংশ করে দেওয়ার মতো অবস্থা।

এই পর্যায়ে হাসান ভাই বললেন, দেখেন, যদি আদরের বশে শশুড় এই ব্যবসার অংশীদার না করতেন, তা হলে আজ শ্বশুরের এই অবস্থা হতো না। হ্যা, জামাইকে জামাইয়ের জায়গায় ভালোবাসেন, তাকে তার নিজের যোগ্যতা দিয়ে বড় হতে দিন। সাহায্য করবেন কিন্তু এই রকম নয় যে, শেষতক নিজের অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানিতে পড়েন। জামাই আরেকটা বিয়ে করেছে, অথচ এখনো সে প্রাক্তন শশুড়ের সব ব্যবসায় সমান অংশীদার অথচ জামাইয়ের কোনো কিছুই এখানে ছিলো না। হাসান ভাই আরো বললেন, হ্যা এটা যদি নিজের ছেলে এমনটা করতো, তাহলে কোনো দুঃখ ছিলো না। নিজের ছেলেই তো। আর বাবার অনুপস্থিতিতে নিজের ছেলেই তো এইসব সম্পত্তির মালিক হতো। দুক্ষটা অনেক কম হতো।

হাসান ভাই বলতে থাক্লেন, এই ঘটনা থেকে তিনি শিখেছেন যে, পরের ছেলে কখনো নিজের ছেলে হয় না। আর শশুড় যতো ভালো মানুসই হোন না কেনো, জামাই তাকে নিজের বাবা মনে করে না। যদি কেউ এই সত্য অস্বীকার করে প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যায়, তাদের পরিনতি এই রকমই হয়। হ্যা, এটা ঠিক, যে, কোন বাবা চায় না যে তার মেয়ে সুখি হোক? কোন পিতামাতা চায় না তার সন্তানের জন্য এই পৃথিবীকে আরামদায়ক হোক? আর এই কারনে জামাইদেরকে অতোটুকু দিতে হয় যতোটুকু সে প্রাপ্য। এর মানে এই নয় যে, শশুড় তাকে ভালোবাসবে না। জামাই জামাইয়ের জায়গায়, ব্যবসা ব্যবসার জায়গায়, মেয়ে মেয়ের জায়গায়। সব কিছুতে তার নিজের জায়গায় রাখতে হয়। লিমিট অতিক্রম করলেই প্রচন্ড রকমের একটা ভারসাম্যতা হারিয়ে যাবার ভয় থাকে। আর ভারসাম্যহীন যে কোনো জিনিসই খারাপের দিকে যায়।

আমিঃ (আমি হাসান ভাইয়ের কথাগুলি শুনছিলাম। তারপর আমি বললাম), হাসান ভাই, আমার জীবনেও আমি এমন একজন মেয়ের জামাইকে দেখেছি যিনি তার শশুড়কে নিজের বাবার চেয়েও বেশি মহব্বত করেন। শ্বশুরের অনেক     সব এমন করে ধরে রেখেছে যেনো সব কিছু তার সম্পদ, আবার কোনো কিছুই তার নয়। ঢাকা শহরেই তার বাড়ি আছে এই রকম ৭/৮ টা, ব্যবসা আছে, উত্তরায় অনেক জমি আছে যার দাম কয়েক কোটি টাকা। তার একটা মাত্র মেয়ে। ছেলে ছিলো দুর্ঘটনায় মারা গেছে। ছেলের দুইটা বাচ্চা আছে। মেয়ের জামাই পুরু পরিবারটাকে এক করে ধরে রেখেছে। আমি নিজে দেখেছি যে, এই জামাই তার শহুড়কে গোসল করিয়ে দেয়, খাইয়ে দেয়, সারাক্ষন সংগি দেয়। পেপারটা পড়ে পড়ে শুনায়। জামাইয়ের নিজস্ব ব্যবসা ছিলো, স সব কিছু ছেড়ে এই বুড়া বয়সে শশুড়কে দেখভাল করে। তাহলে এইগুলা কি মেকী?

হাসান ভাইঃ (হাসান ভাই এবার আরো বললেন), না আখতার ভাই, এইগুলা মেকী নয়। তবে এই ধরনের মানসিকতার জামাই লাখেও একটা পাবেন না। আর যেটা স্বাভাবিক নয়, সেটা উদাহরন হতে পারে না। হাসান ভাই বলতে থাকলেন,

…আখতার ভাই, আমি বা আপনি মেয়ের বাবা বলে এমন তো নয় যে, ছেলে বা জামাই বা শশুড় বাড়ির লোক এমন কোন পুন্য করে ফেলেছে যে, আমরা ছোট আর তারা আমাদের পুজনীয়। হ্যা, পুজনিয় হবে তাদের ব্যবহারের কারনে, মানসিকতার কারনে, এই কারনে নয় যে, ছেলের বাবা বা জামাই হবার কারনে। ঈদ পরবনে আমি মেয়ের জামাইয়ের বাড়িতে প্রথমেই গরুর রান টা পাঠাতে চাই না। অডেল গিফট আর পন্য নিয়ে তাদের খুশী করতে চাই না। আমি চাই এতা দুই পক্ষ থেকেই তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী হোক। আর এই করার মধ্যে সবচেয়ে বেশী থাকতে হবে মানসিকতা আর রিস্পেক্ট। একটু এদিক সেদিক হলেই সতর্ক হওয়া খুব জরুরী। যদি সম্পরকটা লম্বা সময়ের জন্য টেনে নিতে হয়, সেখানে ধীরে ধীরে এগুনোই মংগল। আবেগের কোনো স্থান দেওয়া উচিত নয়। বেশী আবগে সম্পর্ক নষ্ট করার চেয়ে বাস্তব্বাদী হয়ে সুখে থাকা মংগলজনক। নিজের করপোরেট অফিসে মেয়ের জমাইকে ঘরে তোলার আগে সে করপোরেট কালচার শিখেছে কিনা তা যাচাই করা অনেক বেশী জরুরী। একটা করপোরেট কালচার এক্তা প্রতিষ্ঠানের স্তম্ভ। আর এই স্তম্ভকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য একটা মানুষই যথেষ্ট। যদি বেশী আবেগী হয়ে থাকেন, তাহলে সেই এক ই ব্যক্তিকে অন্য আরেক টি করপোরেট কালচারে অধিষ্ঠিত কনো অফিস থেকে তাকে শিখিয়ে নিন। কিন্তু কখনোই নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নয়। একবার ছাপ লেগে গেলে তার থেকে বের হয়ে আসা যায় না। বের হতে গেলেই পরিবারে, নিজের জিবনে এবং নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এমন ভাবে আচড় কাটবে যেখানে জায়গায় জায়গায় ভাঙ্গনের রেখা দেখতে পাবেন। সৃষ্টি কর্তা যখন আপনাকে নিজের ছেলে দেন নাই, তাহলে নিজের ছেলে পাবার জন্য অন্য আরেকজনের কাছ থেকে ধারে নেওয়া ছেলেকে নিজের ছেলে বানিয়ে নিয়ে বিরম্বনায় পড়তে চান কেনো?  

আমিঃ (ভাবিয়ে তোলেছে আমাকে। আমি খেয়াল করে দেখেছি, হাসান ভাই অনেক বাস্তব মানুষের মধ্যে একজন। আপাতদৃষ্টিতে হাসান ভাইয়ের কথাগুলি অত্যান্ত নিষ্ঠুর মনে হতে পারে কিন্তু এটাই বাস্তবতা।) তারপরেও আবার প্রশ্ন করলাম, আপনি ও তো কারো না কারো সান ইন ল, তাহলে সেক্ষেত্রে যদি আপ্নার শশুরের ও ঠিক আপনার মতো এই আইডিয়া থাকে বা এক ই পলিসি অনুসরন করেন, তাহলে জামাই হিসাবে আপনার কাছে খারাপ লাগবে না?

হাসান ভাইঃ না আখতার ভাই, আমার খারাপ লাগবে না কারন, আমিও যেহেতু সেই এক ই পলিসি সেই ছোট বেলা থেকে অনুসরন করছি, ফলে আমার খারাপ লাগার কোনো কারন আমি দেখি না। আমি আজ পর্যন্ত কখনো শশুর বাড়ির থেকে আমাকে কি দিলো বা কি দিলো না, বা কি দেওয়া উচিত ছিলো আর কি দেওয়া উচিত ছিলো না, অথবা কোনো পরবনে আমাকে তারা কি দিয়ে খুশী করলো বা করলো না, এই চিন্তাটা কখনো আসে নাই। আমি তাদের কোনো যৌতুক বা উপঢৌকন দিতে চাইলেও নিতে চাই নাই বা নেইও নাই। কারন আমি মনে করি, আমার সংসার আমি আর আমার স্ত্রী মিলে সাজাবো। এর প্রতিটি জিনিস হবে আমার এবং আমাদের। এতে আমার এক্তা নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আছে। কেনো আমি ছট লোকের মতো আরেকজনে দেওয়া গাড়ী, বা ফ্রিজ, বা টিভি, বা অন্যান্য সামগ্রি নেবো? যদি নিজেই এইসব নিজে করতে না পারি, তাহলে আমার অইসব জিনিস উপভোগ করার মানসিকতা ত্যাগ করা উচিত। পরের ধনে বাহাদুরী যারা করে তারা আর যাই হোক পুরুস নয়। আমি পুরুসের মতো আচরনে বিশ্বাস করি।

আমিঃ তাহলে যদি কোনো শশুড় আদর করে তার নিজের মেয়ের জন্য এইসব জিনিস দিতে চায় যেনো তার নিজের মেয়ে একটু ভোগ করুক, তাহলে?

হাসান ভাইঃ আখতার ভাই, আমি যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি, সে যদি আমাকে ভালোবাসে, তাহলে সে আমাকে ছোট করা উচিত নয়। সে যদি মনে করে আমার পছন্দের চেয়ে তার বাবার বাড়ির জিনিস আমার সংসারে এনে উপভোগ করে সে সুখী থাকবে, তাহলে তো সে আমাকে আমার মতো করে সংসার সাজানোর সুযোগ দিলো না। সংসারে এক্তা না গাড়ি থাকা, এক্তা এসি না থাকা, বা ৪০/৭০ ইঞ্চি এল ই ডি টিভি না থাকার নাম অসুখী পরিবার নয়। অসুখী পরিবার হচ্ছে সেটা যেখানে নিজেদের পারস্পরিক সৌহার্দ না থাকে, পারস্পরিক রিস্পেক্ট না থাকে, এবং যেখানে  শসুর বাড়ি থেকে কিছু পেলাম না কেনো অথবা নিজের স্ত্রীর আয় কেনো আমার হাত দিয়ে দেয় না এই সব মানসিকতার স্বামী বা তার পরিবারের মধ্যে যদি থাকে তাহলে বুঝবেন আপনি ভুল নৌকায় উঠে পড়েছেন।  আর যদি আপনি নিজে কিছু দিতে চান, সেতাও হতে হবে তারা নিতে চায় কিনা তার সম্মতির উপর। আপনার আছে বলেই তারা কেনো নিবে? এটাই তো ব্যক্তিত্ব!! আমি অন্তত তাই মনে করি। আপনার মেয়েকেও এই একই প্রকার মানসিকতা থাকতে হবে যে, আমি আমার বাপের কোনো জিনিস নিয়ে কেনো শশুর বাড়ীর লোক গুলিকে ছোট করবো?

আমিঃ তাহলে আমি কখন আমার মেয়েদের সুখের জন্য আমার সম্পত্তির কিছু উপহার সুবিধা দিবো? যদি আমার কোনো সম্পত্তি বা আমার আছে সেসবের কোনো কিছুই আমার মেয়েদের কাজে না লাগেবা আমার আছে এমন জিনিসে ওদের উপভোগ ই না করে, সেক্ষেত্রে আমার এতো কিছু করে লাভ কি?

হাসান ভাইঃ আখতার ভাই, আপনি মনে হয় আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি কিন্তু মেয়েদেরকে বা মেয়েদের জামাইক দিতে না করি নাই। একটা জিনিস তো আপনি মানবেন যে, দাম্পত্য জীবন আসলে শুরু হয় বিয়ের পাচ ছয় বছর পর থেকে। যখন স্ত্রী পুরানো হয়ে যায়, তার দেহের প্রতি আর বিশেষ কোনো আকর্ষণ থাকে না। তখন ছোট খাটো জিনিস থেকেই কিন্তু বড় বড় মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। যখন এই সময়টা অবতীর্ণ হয়, তখন আপনি বুঝবেন আসম মানসিকতা গুলি কি। তখ টেস্ট হয় একচুয়ালি সম্পর্কটা কিভাবে এগোচ্ছিলো। আপনার সম্পদের উপর যদি এই সম্পরক গড়ে উঠে, তাহলে পাচ ছয় বছর ও যাবে না সম্পর্ক টা নস্ট হতে। এর আগেই আপনি টের পেয়ে যাবেন। ওয়েট করেন, দেখেন, বুঝেন, তারপর সব দিন। যেদিন দেখবেন, আপনার শরীর খারাপ হয়েছে, তারা দৌড়ে আপনার হাত ধরেছেন, যেদিন দেখবেন, আপনার বাড়ির মেহমান মানে তারা মনে করবে এটা তাদের বাড়ির মেহমান, যেদিন দেখবেন, আপনার দাওয়াতের অপেক্ষা না করে তারা আপনার বাড়িতে ডাল ভাত দিয়ে ভালো একটা সময় কাটাচ্ছে, যেদিন দেখবেন তারা সমস্যায় আছে জেনেও আপনার কাছ থেকে কোনো কিছু নিতে তাদের আত্মসম্মানে বাধছে, যেদিন দেখবেন যে আপনার কোনো ব্যক্তিগত আচরনে কষ্ট পেয়ে তারা তার প্রতিশোধ আপনার মেয়ের উপর নিচ্ছে না বা তাকে এমন কোনো কথা শুনাচ্ছে না যাতে মনে হবে যে, মেয়েটি শুধু আপনারই নয় , তাদের বউ এর আদলে তাদের নিজস্ব সদস্য, সেদিন বুঝবেন, এবার আপনার পালা তাদেরকে বুকে নিয়ে নিজের মানুষ বলে ধরে নেওয়া। ওই পর্যন্ত টেস্ট না করে যাই করবেন, হারবেন। আর একবার হেরেছেন তো আপ্নিই শুধু হারলেন, তারা নয়। আপনার দেওয়া সেই যে উদাহ র ন দিলেন, পরীক্ষা করে দেখেন যে, ওই ভদ্রলোক হয়ত এটাই করেছেন এবং শেষ তক এই টেস্টে তার একমাত্র মেয়ের জামাই এবং জামাইয়ের পরিবার টিক্তে পেরেছে বলেই আজ সেই জামাইয়ের সব নিজের হয়েছে। শশুর মহাশয় নিজেও মনে করেছে তার যোগ্য উত্তরসুরী সে পেয়েছে। আর এটাই ব্যতিক্রম আখতার ভাই।

বৃদ্ধ বয়সের আলোচনাঃ

সারাদিন আমরা একসাথে ছিলাম। খাওয়া দাওয়া করলাম। জীবন নিয়ে আরো অনেক কথাবার্তা হলো। বৃদ্ধ বয়সের কথাও আলাপ হলো।

হাসান ভাই বলতে থাকলেন, চারিদিকে যেভাবে আধুনিককালের সন্তানেরা তাদের বাবা মায়ের প্রতি উদাসীন হয়ে যাচ্ছ, তাতে এই দেশে একটা সময় আসবে, বয়স্ক মানুষের একমাত্র স্থান হবে বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রমে গেলে ওই বৃদ্ধ মানুসগুলির জীবনের কাহিনী শুনলে গা শিহরিয়া উঠে। তারা অনেকেই দেশের অত্যান্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ছিলেন। কেউ সচীব, কেউ বড় বড় ব্যবসায়ী, কেউ বা আবার প্রোফেসর ইত্যাদি। তারা তাদের সন্তানদের মানুস করার জন্য আজীবন পরিশ্রম করেছেন, সম্পদ গড়েছেন, ভাগ করে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন, এখন আর সন্তানেরা তাদের জন্য কিছুই করেন না। ফলে শেষ আশ্রয়স্থল ওই যে বৃদ্ধাশ্রম।

হাসান ভাই এই বৃদ্ধ বয়সের পরিনতির রুখে দাড়ানোর একটা বেশ চমকপ্রদ কৌশল বললেন যেটা তিনি করছেন এবং করবেন। আর সে মোতাবেক তিনি তার কাজ অব্যাহত রাখছেন। জিজ্ঞেস করলাম, কি সেই কৌশল?

হাসান ভাই বলতে লাগলেন,

-শোনেন আখতার ভাই, বৃদ্ধ বয়সে আপনার আসলে কি দরকার? আপনার দরকার কেউ আপনার খাবারটা সময়মত রান্না করে আপনার সামনে দিক, মেডিসিনগুলি সময়মত আপনাকে খাইয়ে দিক, বাইরে যেতে হলে একটা গাড়ি আর একজন ড্রাইভার থাকুক, রাতে শোবার সময় আপনার মশারীটা টাংগিয়ে দিক। ময়লা কাপড় চোপড়গুলি সময়মত ওয়াস করে দিক। আর এই কাজগুলি করার জন্য আপনার মাত্র গোটা তিনেক লোক হলেই হয়। একজন রান্নাকারী, একজন ড্রাইভার, একজন কাজের ছেলে যে আপনাকে সংগ দেবে সারাক্ষন। আর গোটা এই কয়জন মানুস রাখতে আপনার সর্বসাকুল্যে মাত্র হাজার বিসেক টাকা হলেই হয়। নিজের যদি একটা বাড়ি থাকে বা ফ্ল্যাট, তাহলে অনেক উত্তম। থাকার জন্য আর টেনশন করতে হয় না। এই রকম একটা আয়ের পথ খোলা রেখে অথবা তার থেকে বেশি কিছু সঞ্চয় রেখে অতঃপর সন্তানদের সম্পত্তি ভাগ করা যেতে পারে। তবে, হাসান ভাইয়ের পরিকল্পনা হচ্ছে, তিনি কোনো অবস্থাতেই তার সম্পদ তার জীবদ্দশায় তাদের সন্তানদের ভাগ করে তিনি নিঃস্ব হবেন না। তাতে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনার শামিল হবে। নিজে আয় করেছেন, নিজে ভোগ করবেন। নিজে ভোগ করার পর যদি অবশিষ্ট থাকে সেটা তার সন্তানরা তার অনুপস্থিতিতে এমনিতেই ভাগ করে নেবে। সন্তানদের উপর তিনি নির্ভরশীল হতে চান না। তার থেকে উত্তম কিছু কাজের মানুষের উপর নির্ভরশীল হওয়া। দিন কাল যা পড়েছে তাতে নিজের সন্তানদের উপর আর ভরসা করা যায় না। এই বুড়ো বয়সে এসে আপনার জীবনে সবচেয়ে ভালো বন্ধু যিনি তিনি হচ্ছেন আপনার স্ত্রী। ওই বুড়ো বয়সেও সে আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে। কারন সেও আপনার মতোই একা। আপনাকে ছাড়া তার যেমন কেউ তার পাশে নাই। সে ছাড়াও আপনার জীবনে আপনার আর কেউ নাই।

হাসান ভাইয়ের কৌশলটা আমার ভালো লেগেছে। হাসান ভাইয়ের এই কৌশলটা হয়তো অনেক মধ্যবয়সী মানুষকে বৃদ্ধাশ্রম থেকে বাচিয়ে দেবে।

আমার কাছেও তাই মনে হয়েছে যে, (১) নিজের উচ্ছন্নে যাওয়া সন্তানও পরের বাড়ির ছেলে যে মেয়ের জামাই হয়ে নিজের বাড়িতে আসে তার থেকে উত্তম। (২) নিজের কোনো সম্পত্তি নিজের জীবদ্দশায় ভাগ বাটোয়ারা না করাই উত্তম। (৩) আর যদি করাও হয় তাহলে এমন কিছু অংশ নিজের হাতে রাখা উচিত যা নিজেকে সুরক্ষিত রাখবে। (৪) আর বৃদ্ধবয়সে একজনই সবচেয়ে কাছের বন্ধু হোক সে নিজের মতো বয়স্ক, আর সেটা হচ্ছে নিজের স্ত্রী। সেও নিজের মতোই অসহায়।

ধর্ম নিয়ে আলোচনাঃ

যেহেতু মুসলমান, ফলে আল্লাহকে বিশ্বাস করি, আর আখেরাতকেও বিশ্বাস করি। হাসান ভাই বলতে থাকলেন, আমাদের মরনের পরে আমাদের পরবর্তী জেনারেসন কিভাবে আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাইবে, আদৌ চাইবে কিনা সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। আমাদের মরনের পর তারা আমাদের মনে না রাখলেও কোথায় কোথায় আমাদের সম্পত্তি আছে সেতা খুজে খুজে বের করবে। সেই সম্পদ দিয়ে হয়ত কেউ আমাদের নামে এক্তা মিলাদ ও পরাবেন কিনা তার কোনো গ্যারান্টি নাই। এই অবস্থায় সারাটি জীবন কস্ট করে সম্পদ উপার্জন করলাম, অথচ আমার নিজের জন্য আমি কিছুই নিতে পারলাম না, এটা বড় অন্যায়। তাই আমি ভাবছি-

এক্তা বৃদ্ধাশ্রম করবো যেখানে অসহায় কিছু বৃদ্ধ মানুষ বাস করবে কিন্তু তাদের খাওয়া দাওয়ার কোন কমতি থাকবে না। আরাম আয়েশের ব্যবস্থা থাকবে। নামাজ রোজা করবে, আল্লাহর কাছে তাদের প্রার্থনা করবে। আর পাশাপাশি যদি ছোট ছোট কিছু এতিম ছেলেমেয়ে থাকে যাদেরকে কোর আন হিফজু করানো হবে, হুজুর থাকবে, একটা মসজিদ থাকবে, তাতে বুড়ো মানুসগুলি ছোট ছোট বাচ্চা পাবে, আর ছোট ছোট বাচ্চাগুলি পাবে বয়স্ক মানুসগুলিকে। একটা পরিবার বনে যাবে। যেহেতু মসজিদ থাকবে, হিফজু করার সুযোগ থাকবে, ফলে ফোর ইন ওয়ান নামে একটা ভালো কাজের প্রতিস্টহান গড়ে উঠবে। এইখান থেকে যদি কোনো সওয়াব আল্লাহ দেন, তাহলে তার কিছু অংশ হলেও আমার মরনের পরে আমার কবরে যাবে। আমার সন্তান কিছু না করুক, এরাই হয়তো আমার জন্য দোয়া করবে। আর এই কাজটি করার জন্য খুব বেশি টাকা পয়সারও প্রয়োজন নাই। প্রায় লাখ পঞ্চাশেক টাকা কোনো একটা ব্যংকে ওয়াকফ করলেই ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট এই কাজগুলি খুব দরদ দিয়ে আজীবনকাল করবে।

– আখতার ভাই, জীবনের অনেক তা সময় পার হয়ে গেছে। আনন্দ করার জন্য ভেবেছেন, হয়ত সময় আছে। আর এই সময় আছে করে করেই কিন্তু জীবনের প্রায় ৫০ বছর পার করে দিয়েছেন। এবার আর সময় আছে সময় আছে বলে সময় নস্ট করার কোনো অবকাশ নাই। বেরিয়ে যান নিজের বউকে নিয়ে। যেখানে খুশী। বিদেশ যেতে হবে এমন না। কোনো এক্তা গ্রামের পুকুরের পাড়ে বসে এক মুঠি বাদাম খেতে খেতে নীল আকাশ দেখুন, মাছের সাতার দেখুন। দেখবেন, বড্ড মিস্টি এই পৃথিবী। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে সর্দি কাশি হয়ে যাবে এই বয়স আসার আগেই বৃষ্টিতে ভিজুন, দেখবেন, শরীর শীতল হয়ে আপনাকে ভালো ঘুম পাড়িয়ে দেবে।

বিকাল হয়ে এসেছে। দুজনেই ক্যাফেটেরিয়ায় নাস্তা করতে গেলাম। চারিদিকে কাচের দেওয়ালে ঘেরা একটি কাফেটেরিয়া। ভিতর থেকে সব দেখা যায়,কিন্তু বাইরের কোনো কিছুই ছোয়া যায় না। আমরা এখন একটা কাচের দেওয়াল দেওয়া ঘরে বসে দূরে নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘ দেখছি। আমি ভাবছি, হাসান ভাই কোনো কথাই অযুক্তিক বলেন নাই। জিবনের মানে বুঝতে বুজতে আমরা এক সময় জীবন থেকেই হারিয়ে যাই। তখন জীবন টা কেমন করে গড়তে চেয়েছিলাম সেই অধ্যায়টা আর মনে থাকে না।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বাসায় ফিরতে হবে। আমার এক্তা বাসা এখনো আছে যেখানে আমি নিজের মতো করে থাকি।

ধন্যবাদ হাসান ভাই।

১৪/০৫/২০১৮- মা

Categories

মাকে নিয়ে অনেক লেখা হয়, মাকে নিয়ে হাজার হাজার কাহিনী এবং ইতিহাস রচিত হয়। পৃথিবীর সারা বুকে বিভিন্ন ভাষায় কতভাবে যে রচিত হয়েছে এই মায়ের উপর কাহিনী বা সত্য ভাষণ, তার কোনো ইয়াত্তা নাই। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিটি ফিলিংস বা অনুভুতি একেকটা মোউলিক রচনাই বটে।

পৃথিবীর সব ভাষায় সব বাচ্চারা প্রথম যে শব্দটি শিখে তা হচ্ছে “মা” বা এর প্রতিস্থাপক কোনো শব্দ। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে, সব ভাষায় এই “মা” শব্দটি প্রায় কাছাকাছি তার উচ্চারন। কোথাও মা, কোথাও মাম্মি, কোথাও আম্মু, কোথাও মাম এই রকমের। গত পরশু ছিলো “মা” দিবস। এতা একটা রুপক দিন। “মা” দিবসের কোনো দিন হয় না তার পরেও বছরেরেক্টি দিন “মা” এর জন্য উৎসর্গ করা একটি দিন। প্রানীকুলের মধ্যে সব “মা”ই এক রকমের। সেটা কোনো সিং হীর ই হোক, অথবা কোনো হরিনের কিংবা মানুষের। কোনো তফাত দেখা যায় না। কিভাবে ঈশ্বর এই মাতৃত্ব বোধ কে ঈশ্বর প্রতিটি মায়ের বুকে ছাপ মারিয়া একেবারে খাটি মা বানাইয়া দিয়াছেন তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কারো কাছে নাই।

তিনি আমার মা। মাত্র ১১-১২ বছর বয়সে বিয়ে হয় কিন্তু দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যেই এক ছেলের মা হয়ে বিধবা হন। খুব বড় লোকের মেয়ে নন বটে কিন্তু মাঝারী পরিবারের বনেদি ঘরের মহিলা। যেই সময়ের কথা বলছি, তখন ১৫ বছর অতিক্রম করলেই গ্রামের মধ্যে আই বুড়ি হয়ে আছে মেয়ে এই রকম একটা অপবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তার মধ্যে যদি আবার নিয়তির কারনে কেউ এতো অল্প বয়সেই বিধবা হন, তার তো জীবনটাই যেনো কি রকম দুর্বিষহ হয়ে উঠে তা জানে শুধু যে সাফার করে সে আর জানে সেই পরিবার যেই পরিবারে এটা ঘটছে। 

আমার মা শিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু মানুষ হিসাবে ছিলেন অত্যন্ত ভাল মানুষ। দেখতেও ছিলেন সুন্দরী। আমার মায়ের পরিবারের কাউকেই আমার মনে নাই। বরং বলতে পারেন, আমি কাউকেই দেখি নাই। আমার জন্মের আগেই সব চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আমি না দেখেছি আমার দাদি, দাদা, নানা, বা নানি, কিংবা কোনো মামা, মামিকে। কি আজব, না? আসলেই আজব। এমন্তা কি কখনো হয়? কিন্তু হয়েছে। 

আমার মা কে আমি দেখেছি যে, তিনি তার বড় বোন যার নাম সামিদা খাতুন, তাকে তিনি কতটা ভালোবাস্তেন। আর ওই খালাও আমার মাকে তার নিজের মেয়ের মতোই দেখতেন। 

এতো ধৈর্য, এতো বুদ্ধিমতি আর এতো নিরহংকার মানুষ ছিলেন তিনি, যার কোন তুলনা হয় না। আমার মায়ের সারাটি জীবন কেটেছে কস্টের মধ্যে।যখন তিনি একটু সুখের মুখ দেখবেন বলে আশা করেছিলেন, তার আগেই তিনি ২০০২ সালে জান্নাত বাসি হয়েছেন। 

আমার মায়ের জীবনের গল্পটা তাহলে বলিঃ 

আমার বয়স যখন মাত্র দেড় কি দুই তখন আমার বাবা মারা যান। আমি আমার বাবাকে দেখি নাই, এমন কি আমাদের কারো কাছেই আমার বাবার কোনো ছবিও নাই। আমার মা যখন আমার বাবাকে বিয়ে করেন, তখন তার প্রথম পক্ষের ছেলে বিল্লাল হোসেন (ওরফে ডাঃ বেলায়েত হোসেন) কে আমাদেরই গ্রামের পাশের এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে পালক দিয়ে দেন। আমার মা আমার বাবার এমন একটা সংসারে পদার্পণ করেন যেখানে আমার বাবার আগের পক্ষেরই সন্তান ছিলো গোটা আট জন। তাদের সবার বয়স আমার মায়ের থেকে অধিক। এই সন্তানেরা আমার মাকে কোনদিনই আপন করে ভাবতে পারেন নাই। 

আমার বাবা ছিলেন মাদবর যিনি সারাক্ষনই গ্রামের মাদবরি আর তার জমি জমা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। (চলবে) 

২২/০৩/২০১৮-যেদিন আমি বুড়ো হয়ে যাবো…

Categories

আমি জানি যেদিন আমি বুড়ো হয়ে যাবো, আমি জানি সেদিন আমাকে একাই সব কাজ করতে হবে। সিড়ি বেয়ে অতি ধীরে ধীরে একাই আমাকে পায়ে পায়ে আমার ছোট সেই ঘরে এসে পৌঁছতে হবে। আমার যখন পানির পিপাসা লাগবে, তখন জানি আমাকেই হেটে হেটে খাওয়ার টেবিলে গিয়ে কাপা কাপা হাতে পানির জগ থেকে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে পান করতে হবে। অতি বয়সের কারনে এমনো হতে পারে হাতের গ্লাসটি নীচে পরে ভেঙ্গেও যেতে পারে। ভাঙ্গা কাচ পরিস্কার করার কোন লোকও হয়ত কাছে থাকবে না। আমাকেই রান্না ঘরের কোনো এক কোনা থেকে খুজে খুজে ঝাড়ুটি খুজে বের করে আস্তে আস্তে ঝাড়ু দিয়ে ভাঙ্গা কাচগুলি পরিস্কার করতে হবে।

আমি জানি, আমার সাথে গল্প করার কোন মানুষও হয়ত থাকবে না। কে বুড়ো মানুষদের সাথে বসে গল্প করে বলো? সরাজীবন যাদেরকে মানুষ করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছি, যাদের সুখের জন্য আমার সমস্ত সুখ, আমার সমস্ত আরাম আয়েশ বিসর্জন দিয়ে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন ব্যস্ত থেকেছি, তারাও আজকে আমার পাশে এসে একটু সময় ব্যয় করে বলবে না, চলো তোমার হাত ধরে ধরে তোমাকে শিশু পার্ক দেখিয়ে নিয়ে আসি, অথবা বলবে না, চলো কোথাও একটু ঘুরে আসি।

যদি আমি আমার সন্তানদের এই কথাগুলি বলতে পারতাম-

দেখো, বুড়ো হয়ে যাবার পর আমি যদি আর তোমাদের মতো করে চলতে না পারি, আমার উপর তোমরা একটু সদয় হইও। যদি বলতে পারতাম, কখনো যদি তোমরা আমাকে কয়েকবার ডাকাডাকি করার পরও শুনতে না পাই, আমার প্রতি তোমরা একটু সদয় হইও কারন আমার হয়ত শ্রবন শক্তি লোপ পেয়েছে। 

আমি জানি, তোমরা আমাকে হয়তো উপহাস করছো না কিন্তু আমার তো আর সেই আগের মতো শক্তি নাই যাতে আমি তোমাদের মতো করে সব কিছু করতে পারবো। আমি যেদিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঈশ্বরের দেখা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করবো, তখন্তোম্রা আমার পাশে এক্তূ থেকো।

আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি। আমি প্রথম এবং শেষবারের মতো যেদিন ঈশ্বরের সাথে দেখা করবো, সেদিন আমি ইসসরের কানে কানে এই কথাটিই বলবো যেনো ঈশ্বর তোমাদেরকে মঙ্গল করেন।

আমি আসলেই বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।

২৭/০১/২০১৮-বদি ভাই অসুস্থ্য

Categories

এইমাত্র মান্না, সাদি এবং মিটুলের কাছ থেকে ফোন পেলাম যে, বদি ভাই স্ট্রোক করেছেন এবং সবাই মিলে ওনাকে প্রথমে শ্যামলি ইবনে সিনায় নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু শ্যামলির ইবনে সিনা ওনাকে ওখান থেকে শিফট করে মোহাম্মাদপুর শাখায় নিতে বলেছে। বদি ভাইকে এখন আউ সি ইউ তে নেওয়া হচ্ছে। বদি ভাই বেশ অনেকদিন যাবত খুব অসুস্থ অবস্থায় আছেন। মাঝে মাঝে দেখতে গিয়েছি কিন্তু ঊনার শারিরীক অবস্থা উন্নত করার জন্য আমাদের কিছুই করার নাই। এক সময়কার খুব অনেস্ট সরকারি করমকরতা যিনি ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারতেন কিন্তু কখনো তা তিনি করেন নাই। অবসরের পরে শুধুমাত্র বাড়িভাড়ার উপর যা পেতেন সেটা দিয়েই নিজের ঊসধ এবং সংসার চালানোর চেষ্টা করেছেন।। ছেলেগুলি শহরে থেকেও নিজেদেরকে যোগ্য করে তুলতে পারে নাই।।অথচ ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই হতে পারতো। ছেলেগুলির অবস্থা এই রকম যে, তারা নিজেদের সংসার চালাইতেই হিমশিম খাচ্ছে, বাবা মাকে আধুনিক চিকিতসা দেওয়ার সামর্থ্য কই। আমি এখন বসিলার রাস্তায় আছি, বেশ জ্যাম। রাত বাজে নয়টা বিশ। ভাইয়াকে দেখতে যেতে হবে কিন্তু কখন গিয়ে পউছতে পারি বুঝতে পারছি না। এই মুহুরতে ঊনার জন্য ফাইনানশিয়াল সাহাজ্য ও লাগবে। অথচ আমাদের ফ্যাক্টরিগুলির অবস্থাও খুব ভাল নয়। বেশ বড় বড় বিপদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এই লাস্ট কয়েক মাস যাবত। আল্লাহ যে কিসের পরীক্ষা নিচ্ছেন বুঝতে পারছি না। আমরা আল্লাহর কোনো পরীক্ষায়ই পাশ করার ক্ষমতা রাখি না যদি না তিনি আমাদেরকে রহমত না করেন। আল্লাহ আমাদেরকে সাহাজ্য করো।

২৪/০২/২০১৬-আমার প্রিয় মা জননীর দল,

 আমার প্রিয় মা জননীর দল,

আমি জানিনা যখন তোমরা আমার এই পত্রখানা পড়িবে তখন তোমাদের কত বয়স হইবে কিংবা আদৌ তোমরা এই পত্রখানা পরিতে পারিবে কিনা কিংবা পড়িলেও কখনো এর মর্মার্থ তোমরা বুঝিতে পারিবে কিনা। আর বুঝিতে পারিলেও কিভাবে এর অর্থ বুঝিবে তাও আমি জানি না। তবুও আজ মনে হইল তোমাদের উদ্দেশে আমার কিছু কথা বলা দরকার যাহা আমার মা আমাকে প্রায় দুই যোগ আগে বলিয়াছিলেন। আমি আমার  "উচ্ছিষ্ট সময়ের ডায়েরি" নামক ব্যক্তিগত ডায়েরিতে এই মুহূর্ত গুলি লিখিয়াছিলাম। তাহা আমি আজ তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করিতে চাই।

"............আজ হইতে প্রায় দুইযুগ আগে আমি যখন আমার মাকে আমার প্রথম ভালবাসার মেয়ের কথা জানাইয়াছিলাম, তখন তিনি মুচকি হাসিয়া আমাকে বলিয়াছিলেন, কে কাহাকে কত বেশি ভালবাসে তাহা কি তুমি ভাবিয়াছ? তুমি কি তাহাকে বিবাহ করিতে চাও? নাকি শুধু মনের আবেগে তোমার একাকীত্বকে দূর করিবার আখাংকায় তাহার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাইতে চাও? মজার ব্যাপার হইল, আমার মা মেয়েটি কতখানি সুন্দর, তাহার বাবার কি পরিমান সম্পদ বা সম্পত্তি আছে, তাহারা কয় ভাইবোন কিংবা তাহার পারিবারিক আর কোন তথ্য উপাত্ত কিছুই জানিবার জন্য আমাকে প্রশ্ন করিলেন না। শুধু বলিলেন, ব্যাপারে আমি কাল তোমার সঙ্গে আবার কথা বলিব এবং তোমার মনোভাব জানিব

আমার মায়ের সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল এবং আমি তাহার সঙ্গে সব কথাই অকপটে বলিতে পারিতাম। মা কথাগুলি খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলিয়া আমাকে আমার মত করিয়া ভাবিবার সময় দিলেন আমার মা।  আমার মা শিক্ষিত নন। তিনি হয়ত তাহার জীবনে প্রাইমারী স্কুল পার করিয়াছেন কিনা তাহাও আমার জানা নাই। কারন তাহার বিয়ে হইয়াছিল যখন তাহার মাত্র ১০ বছর বয়স। নিতান্তই একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে।  কিন্তু তিনি অসম্ভব বুদ্ধিমতী এবং প্রাক্টিক্যাল একজন মা। আমার বড় প্রিয় মানুষ তিনি

 

পরেরদিন আমি আর আমার মা আমাদের বাড়ির আঙিনায় বসিয়া আছি। বিকালের রোদ অনেকটাই কমিয়া গিয়াছে। সন্ধ্যা হইতে আরও কিছু বাকি। আমাদের বাড়ির বড় বরই গাছের মাথায় অনেক পাখির বাসা আছে। পাখিদের কিচির মিচির শব্দ হইতেছে অহরহ। কিচির মিচির করিয়া পাখিদল যে কি কথা কাহাকে বলিতেছে তাহা বুঝিবার ভাষা বা ক্ষমতা আমাদের কাহারো নাই। এইদিক সেইদিক উরাউরি করিতেছে আর যার যার বাসায় তাদের স্থান করিয়া নিতেছে।  দূরে গাছ গাছালিগুলি আস্তে আস্তে সন্ধ্যার ক্ষিন আলোতে ধুসর থেকে আরও কালো বর্ণের রঙ ধারন করিতেছে, বাড়ির গৃহস্থালিরা তাহাদের নিজ নিজ গরু ছাগল ভেড়া লইয়া গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিতেছে। কেউ কেউ আবার মনের আনন্দে সেই আব্দুল আলিমের ভাটিয়ালী কিছু গানের সুরে গানও গাইতেছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মাঠ হইতে খেলা ছারিয়া কেউ জোড়ায় জোড়ায় আবার কেউ দল বাধিয়া বাড়ির অভিমুখে হারাইয়া যাইতেছে। কিছু বয়স্ক মানুষ মাথায় কিছু মাল সামানা লইয়া হয়ত বা শহর কিংবা কাছের বাজার হইতে সদাই করিয়া তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়া যাইতেছে। দিনের শেষলগ্নে গ্রামের কিছু উঠতি বয়সের বধুরা অদুরে আমাদের ধলেশ্বরী নদী হইতে কাঁখে জল তুলিয়া কলসি ভরতি পানি লইয়া, ভিজা কাপড়ে হেলিয়া দুলিয়া মুচকি মুচকি হাসিতে আবার কখনো কখনো উচ্চস্বর আওয়াজে নিজেদের ঘরে আগমন করিতেছে। অদুরে কোন এক সদ্য প্রসব করা গাভি তাহার অবুঝ বাছুরটির সন্ধান না পাইয়া অবিরত হাম্বা হাম্বা করিতেছে। এমন একটি পরিবেশে আমি আর আমার মা মুখুমুখি বসিয়া আছি। বেশ সময় কাটিতেছে আমার। 

 

মা সর্বদা পান খান, মায়ের পানের বাটি যেন তাহার দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মত একটি অংশ। যেখানে যাইবেন, সেখানেই তিনি তার এই অতিব প্রয়োজনীয় সম্পদটি সঙ্গে রাখিবেন। পানের বাটিটি ব্যতিত যেন মায়ের কোন কিছুই আর এত মুল্যবান সম্পদ আমাদের ঘরের মধ্যে নাই। পানের বাটিতে মা তাহার ছোট পিতলের ডান্ডা দিয়া পান পিষিতেছেন, যেন অনেক যত্নের সহিত তিনি একটি খাদ্য রিসিপি বানাইতেছেন। পানের বাটির সঙ্গে পিতলের ডান্ডাটি ঠক ঠক আওয়াজে এক রকম টুং টাং শব্দ হইতেছে। এই রকম একটি পরিবেশে মা আমার দিকে না চাহিয়াই প্রশ্ন করিলেন, "কে আগে ভালবাসার কথা বলিয়াছিল? তুমি না সে?" মা আমাকে নিতান্ত সহজ সুরে যেন কিছুই হয় নাই এমন ভাব করিয়া প্রশ্নটি করিলেন। আমি বলিলাম, "কে আগে ভালবাসার কথা বলল, এতে কি আসে যায় মা? আমরা দুজন দুজনকেই তো ভালবাসি? সে আমাকে ভালবাসে আর আমিও তাকে ভালবাসি"। মা বলিলেন, আমার উপর ভরসা রাখ। আমি তোমাদের দুইজনকেই ভালবাসি যদিও আমি তাহাকে দেখি নাই কিন্তু তুমি তাহাকে ভালবাস। আর তুমি তাহাকে ভালবাস বলিয়াই আমি তাহাকেও ভালবাসি। কিন্তু তুমি তো আমার প্রশ্নের উত্তর এরাইয়া যাইতেছ বলিয়া আমার মনে হইল।"

আমি বললাম, "না মা। আমি তোমার কোন প্রশ্নের উত্তর এরাইয়া যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করি না। তবে আমি প্রথম তার কাছ থেকে পত্র পাইয়াছিলাম সেইটা বলিতে আমার কোন দ্বিধা নাই। আমি পত্র পাইয়া বুঝিয়াছিলাম, যে, আমি ওকে ভালবাসি কিন্তু আমি বলিতে পারি নাই। সে বলিতে পারিয়াছিল। তাহার মানে এই নয় যে, আমি তাহাকে কম ভালবাসি  বা আমি তাহাকে ভালবাসি নাই।"

মা আমার মাথায় হাত বুলাইয়া, আমার পিঠে তাহার একটি হাত চালাইয়া আমার নাকের ডগায় আলতো করিয়া টীপ দিয়া বলিলেন, "তুমি তোমার জায়গায় ঠিক আছ তো? যদি ঠিক থাক, আমি চাই তুমি তাহাকে শাদি কর। তুমি সুখী হইবে"। 

 

আমি অবাক বিস্ময়ে আমার মায়ের দিকে তাকাইলাম, সন্ধ্যার অল্প অল্প আলোতে আমি তাহার চোখে মুখে যেন এক প্রশান্তির ছায়া দেখিতে পাইলাম, তিনি একদিকে তাহার ঘাড় বাকা করিয়া পানের বাটি হইতে পান লইয়া কিছু পিষিত পান নিজের মুখে পুড়িয়া আর বাকি কিছু পান আমার গালে পুড়িয়া দিয়া বলিলেন, "নে পান খা, ভাল লাগিবে। মায়ের দোয়ায় সন্তান সুখী হয়, তুইও জীবনে সুখী হইবি।" 

আমি পান মুখে লইয়া অবাক দৃষ্টিতে মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, "মা, তুমি কিভাবে আমার পছন্দের মেয়েকে না দেখিয়া, তাহার পরিবারের কারো কোন তথ্য না শুনিয়া, তাহার পরিবারের কোন ইতিহাস না জানিয়া এই সন্ধ্যায় এক নিমিষে জীবনের এত বড় একটা সিদ্ধান্ত দিয়া আমাকে সুখী হইবে বলিয়া আশীর্বাদ করিলে?"

মা পানের পিক ফালাইতে ফালাইতে আমার মাথায় হাত রাখিয়া বলিলেন, " ভালোবাসার স্থায়িত্ব তাহার উপর নির্ভর করেনা, যাহাকে সে ভালবাসে, নির্ভর করে তাহাকে যে ভালবাসে তাহার উপর। সে তোমাকে ভালবাসিয়াছে প্রথম, তোমাকে ছাড়িয়া যাওয়ার কোন কারন না থাকিলে সে তোমাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিবে এইটাই হওয়ার কথা। তুমি যাহাকে ভালবাস তাহাকে নয়, তোমাকে যে ভালবাসে তাহাকে তুমি তোমার জীবন সঙ্গিনী কর। তাহা হইলেই তুমি সুখী হইবে। আর ইহাই হইতেছে দাম্পত্য জীবনের সত্যিকারের রূপরেখা।'

আমি আমার মায়ের এত বড় দর্শন শুনিয়া খুব অবাক হইয়াছি। কি অদ্ভুত দর্শন।

মা বলিতে থাকিলেন, কাউকে কখনো তুমি তোমাকে ভালবাসার জন্য জোর করিবে না, বরং তোমাকে কেউ ত্যাগ করুক সেই ব্যাপারে কাউকে জোর করিতে পার। যখন জোর করিয়াও তাহাকে তুমি ত্যাগ করাইতে পারিবে না, নিশ্চিত থাকিবে যে, সে তোমাকে সত্যি ভালবাসে। তাহাকে তুমি তখন আরও বেশি করিয়া আঁকড়াইয়া ধরিবে কারন সে তোমাকে ভালবাসে। যে তোমাকে সত্যিকার ভাবে ভালবাসে, শত কারন থাকা সত্তেও সে তোমাকে কোনদিন ছাড়িয়া যাইবে না। বরং সে একটিমাত্র কারন খুজিবে যে কারনের দ্বারা সে তোমাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিতে পারে, ত্যাগ করিবার জন্য নয়। আর ইহাই হইতেছে প্রকৃত ভালবাসার দুর্বলতা। তুমি তাহার সঙ্গে জীবনে সুখী হইবে।

আজ এত বছর পর আমি উপলব্দি করিতে পারিতেছি যে, আজ হইতে প্রায় দুই যুগ আগে আমার সেই অশিক্ষিত মা যে দর্শন শুনাইয়াছিলেন, তাহা কতখানি সত্য এবং খাটি। আজ আমি আমার জীবনে এক অদ্ভুত সুখ আর আনন্দ লইয়া প্রতিটি দিন অতিবাহিত করি। কারন আমার সঙ্গে আছে সেই মানুষটি যে আমাকে ভালবাসিয়াছিল এবং আমিও তাহাকে ভালবাসিয়াছিলাম। কিন্তু সে আমাকে প্রথম ভালবাসার কথাটি বলিয়াছিল।

মা আরও একটি আস্ত পান তাহার অতি প্রিয় পানের বাটিতে সুপারি আর মশলা দিয়া পিষিতে লাগিলেন। আমার দিকে না তাকাইয়াই তিনি বলিতে থাকিলেন, তুমি নিশ্চয় জানো, একটা ব্রিজ বানাইবার জন্য যা যা লাগে আর একটা দেওয়াল বানাইবার জন্য যা যা লাগে তা একই উপকরন। কিন্তু একটি ব্রিজ দুইটি প্রান্তকে সংযোগ করে আর একটি দেওয়াল দুইটা প্রান্তকে পৃথক করিয়া দেয়। তোমাদের এই যুগলমিলন হইতে হইবে একটি ব্রিজের সমতুল্য। দেওয়াল নয়। এখন তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হইবে তুমি কোনটা চাও এবং কিভাবে চাও আর কখন চাও। দাম্পত্য জীবনে এমন কিছু সময় আসিবে যখন তোমার কাছে মনে হইবে, সবাই ভুল আর তুমি ঠিক। হয়ত বা তুমিই ঠিক আবার তুমি ঠিক নাও হতে পার। তোমারও ভুল হইতে পারে। মা পানের বাটিতে তাহার পিতলের ডান্ডা দিয়া পান পিষানো একটু সময়ের জন্য থামাইয়া আমার দিকে তাকাইয়া বলিলেন, একটা হাদিসের কথা বলি, 'যে ভুল করে সে মানুষ, আর যে ভুল করিয়া তাহার উপর স্থির থাকে সে শয়তান, আর যে ভুল করিয়া আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, সে মুমিন। ফলে অন্যের কোন কথা শুনিবামাত্রই তাহার উপর উত্তেজিত হইয়া কোন কিছু করিতে যাইও না। কারন, তাহার কথার সত্যতা যাচাই করা তোমার কাজ। তোমার জানা উচিৎ সে তোমাকে ঠিক কথাটিই বলিয়াছে কিনা। সে তোমাকে প্ররোচিতও করিতে পারে। কোন কিছুই বিচার বিবেচনা না করিয়া কোন মন্তব্য করা হইতে সবসময় বিরত থাকিবে। মনে রাখিবা, একবার একটা কথা কিংবা মন্তব্য বলিয়া ফেলিলে উহা আর ফেরত নেওয়ার কোন অবকাশ নাই। তখন শুধু হয় নিজেকে অপরাধী হিসাবে ক্ষমা চাইতে হইবে আর অন্যজন তোমাকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখিবে। নিজের উপর বিশ্বাস রাখ। নিজের শক্তিকে বিশ্বাস কর। নিজের মানুষদের উপর বিশ্বাস রাখ। বিশ্বাস কর যে, তুমি পার এবং তুমি যা পার তা অনেকেই পারে না। আর অনেকেই যা পারে তুমিও তা পার।

আমার মায়ের কথাগুলি আমার কাছে এক অসামান্য দর্শনের মত মনে হইতেছিল। এত কথা মা কোথা হইতে জানিল, বা কে তাহাকে এইসব দর্শনের কথা বলিল আমি আজও ভাবিয়া কুল পাই না।

অনেক্ষন হইল সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। কিন্তু পশ্চিমের আকাশে এখনো লাল আভা দেখা যাইতেছে। খোলা উঠানে বসিয়া আছি বলিয়া চারিদিকের অনেক মশারাও তাহাদের উপস্থিতির কথা জানাইয়া দিতাছে। আমার মা তাহার দ্বিতীয় পানটি মুখে লইয়া কিছুক্ষন চাবাইয়া লইলেন। এবং তাহার চর্ব্য পান হইতে একটু পান বাহির করিয়া আমার মুখে গুজিয়া দিলেন। আমার মায়ের চাবানো পান আমার বড় প্রিয়।   

মা আজ অনেক কথা বলিতেছেন যা আমার কাছে এক নতুন অধ্যায়।

মা বলিতে থাকিলেন, শোন বাবা, জীবনে বড় হইতে হইলে জীবনের সব কয়টি কুরুক্ষেত্রকে তোমার মুখুমুখি হইতে হইবে। তুমি তো অনেক বড় বড় মানুষের জিবনি পড়িয়াছ, তাহাদের দর্শন তথ্য পড়িয়াছ।  আজ তাহলে তোমাকে একটা গল্প বলি। একদিন এক ঈদের দিনে আমার বাবা আমাকে একটা নতুন ফ্রক কিনিয়া দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি তা আমাকে আর দিতে পারেন নাই। হয়ত তাকা পয়সা ছিল না। তাই। আমার খুব মন খারাপ হইয়াছিল। সারাদিন আমার মন আর ভাল হইতেছিলনা। আমার মন খারাপ হইয়াছে দেখিয়া আমার বাবারও মন খারাপ হইয়াছিল। হয়ত তাহারও আমার মত ভিতরে ভিতরে একটা কষ্ট হইতেছিল তাহার এত আদরের মেয়ের মন খারাপ বলিয়া। কি জানি কি হইল আমি জানি না, আমার বাবার এক বন্ধু বিকাল বেলায় আমাদের বাসায় বেড়াইতে আসিলেন। হয়ত বাবাই নিমন্তন্ন করিয়াছিলেন। তিনি আমার বাবার খুব কাছের মানুষের মধ্যে একজন। হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি আমাকে অনেক আদর করিলেন, কেন আমার মন খারাপ তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া তিনি মুচকি হাসিয়া এক বিখ্যাত লেখকের উদ্দ্রিতি দিয়া আমাকে বলিলেন, "আমরা অনেক সময় একজোড়া জুতা না পাওয়ার বেদনায় চোখের পানি ফেলি কিন্তু কখনো কি একবার ভেবে দেখেছ যে, অনেকের তো পা ই নেই?" বলিয়া তিনি আমাকে জড়াইয়া ধরিয়া খুব আদর করিয়া দিলেন। বলিলেন, কালই তিনি আমার জন্য নতুন একটি ফ্রক কিনিয়া দিবেন। তিনি এমন করিয়া আমাকে এই কথাটি বলিলেন, যে, আমি যেন ঐ পা বিহিন মানুষটির চেহারা দেখিতে পাইলাম।  তাই তো, কথাটা আমার খুব মনে ধরিয়াছিল। আমার আর মন খারাপ হয় নাই। আমি আর নতুন ফ্রকের জন্য কখনো মন খারাপ করি নাই। আমি বুঝিতে পারিলাম আমার নিজের অবস্থানটা নিয়ে সন্তুষ্ট না হইলে পৃথিবীর কোন কিছুই আমাকে সন্তুষ্ট করিতে পারিবে না। আমি আমার বাবাকে জরাইয়া ধরিয়া অনেক কাদিয়াছিলাম। দুঃখে নয়, এতক্ষন যে বেদনাটা আমাকে খুব কষ্ট দিতেছিল, সেইটা যে বাবার বাবার বুকের ভিতরে গিয়া বাবাকেও কষ্ট দিতেছিল এই মনে করিয়া আমার চোখ আরও আবেগপ্রবন হইয়া উঠিতেছিল। আমার ছোট্ট বালিকা হৃদয়ের এই অফুরন্ত নিস্পাপ সাবলিল ভালবাসার চোখের জলে আমি আমার বাবাকেও কাদিতে দেখিয়াছিলাম। তাহার কান্নাও কোন কষ্ট হইতে নয়। নিছক ভালবাসার। এইটার নামই পরিবার। এইটার নামই হচ্ছে ভালোবাসা। নিজকে লইয়া সন্তুষ্ট থাক। ইহাতে সুখের পরিমান বাড়িবে। সবসময় একটা উপদেশ মনে রাখিবা যে, নিশ্চয় তোমার সৃষ্টিকর্তা তোমাকে কোন উদ্দেশ্যবিহিন এই পৃথিবীতে প্রেরন করেন নাই। তার উদ্দেশ্য আমাদের স্বপ্নের চেয়ে অনেক উত্তম এবং তাহার রহমত আমার হতাশার থেকেও অনেক বেশি। ঈশ্বরকে বিশ্বাস কর। তিনি তোমাকে কোন কিছুই না থেকে অনেক কিছু পাইয়ে দেবেন, যা আমার তোমার চিন্তা জগতেরও বাইরে। আর কাউকেই অবহেলা কর না। তোমার অবহেলা করার একটাই অর্থ দাঁড়াইবে, আর সেটা হচ্ছে তুমি তাহাকে তোমাকে ছাড়া চলিতে পারার অভ্যস্থ করিয়া তুলিতেছ। সবাই তোমার মতবাদ পছন্দ নাও করিতে পারে, সবাই তোমার মত করিয়া ভাবিতে নাও পারে। তুমি যে শার্টটা পছন্দ কর, সেই শার্টটা অন্য একজনের পছন্দ নাও হইতে পারে। এই পৃথিবীতে কিছু কিছু লোক তোমার জীবনে আসিবে আশীর্বাদ হইয়া, আবার কিছু লোক আসিবে শিক্ষণীয় হইয়া। আর এইটাই জীবন। তুমি আমাকে কিছুক্ষন আগে একটা প্রশ্ন করিয়াছিলে না যে, আমি তোমার পছন্দের মেয়েটির কোন কিছুই না জানিয়া, তাহার পরিবারের কি আছে আর কি নাই এই সব কিছুই না জানিয়া কিভাবে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত দিলাম? জীবনে শুধু টাকা পয়সা দিয়াই সব কিছুর মাপকাঠি হয় না। টাকা পয়সা সব কিছু কিনিতে পারে না। টাকায় তুমি আচরন কিনিতে পারিবে না, টাকায় তুমি সম্মান কিনিতে পারিবে না, টাকা দিয়া তুমি চরিত্র কিনিতে পারিবে না, টাকা দিয়া তুমি বিশ্বাস, ধৈর্য, শ্রদ্ধা, বিনয় এইগুল কিছুই কিনিতে পারিবা না। টাকা দিয়া তুমি ভালবাসাও কিনিতে পারিবা না। আর এইসব গুণাবলীগুলো তো আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের সবচেয়ে জরুরী বিষয়। যে ভালবাসিতে জানে, তাহার টাকার দরকার হয় না। আধামুঠো অন্ন খাইয়াই তাহার মন ভাল থাকে, তাহার দেহ ঠিক থাকে, তাহার আত্মা তৃপ্ত থাকে। ইহার পরেও আরও কথা থাকে। তোমার এই তৃপ্ত জীবনে তোমার পথে অনেক ঘেউ ঘেউ করা কুকুরের মত মানুষজনও পাবে। জীবনে যদি বড় হইতে চাও, এই সব চরিত্র হইতে সাবধান থাকিতে হইবে। কারন সব কুকুরকে তোমার মনোযোগ দেওয়ার সময় তোমার নাই। এরা শুধু তোমার মনোযোগই নষ্ট করিবে না, তোমার বড় হওয়ার পথে এরা সবচেয়ে বড় বাধা হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিবে। ইহাদের মধ্যে অনেকেই এই সমাজের কেউ কর্ণধার বলিয়া মনে হইবে, কাউকে আবার সমাজের বিবেচক বলিয়া মান্য করিবে, কেউ আবার প্রথম সারির লোক বলিয়াও গর্ব করিয়া এইদিক সেইদিক প্রচারনা করিয়া বেড়াইবে। উহারা কেউই তোমার শুভাকাঙ্ঘি নহে। শুভাকাঙ্ক্ষী শুধু তোমার একান্ত পরিবার যাহারা তোমার ব্যথায় ব্যথিত হয়, তোমার আনন্দে আনন্দিত হয়, আর তুমি যখন দিশেহারা হইয়া সঠিক সিদ্ধান্ত লইতে অপারগ হওঁ, তখনো তাহারা তোমাকে ছাড়িয়া চলিয়া যায় না।

তোমাদের জন্য রইল আমার অফুরন্ত ভালোবাসা আর দোয়া।

২৩/০২/২০১৬- বগুড়ার পথে (২)

Categories

বগুড়া যাওয়ার পথে (২য় পর্ব) 

বগুড়া শহরে এই আমার প্রথম আসা নয়। কর্মস্থল হিসাবে আমি এই অঞ্চলে প্রায় পাঁচ বছর কাটিয়েছি। গ্রামের অধিকাংশ অলি গলি, আনাচে কানাচে ঘুরেছি, কখনো দায়িত্ব পালনের জন্য রাত অবধি জেগে থেকেছি। কখনো আবার নিছক মনের তাগিদে ঘুরে প্রকৃতির সৌন্দর্য আহরণের জন্য দিকবিদিক ঘুরেছি। কখনো আমি গভির রাতে, কখনো রাতের শেষ প্রহর জেগে থেকে শুক্ল পক্ষের চাঁদ দেখেছি। কখনো আমি দেখেছি অমাবশ্যায় আকাশ তার কি রূপে পৃথিবীর কাছে প্রেম নিবেদন করে। কখনো আবার ঘোর বৃষ্টির রাতে যখন সব মানুসেরা তাদের নিজ নিজ আস্তানায় ফিরে গভির ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, যখন পাখীরাও আর কিচির মিচির করে না, আমি তখনও চাঁদহীন মেঘলা আকাশের মুসলধারে বৃষ্টির চ্ছটায় বারান্দায় বসে দেখেছি গাছগুলো কিভাবে বৃষ্টির জলে একা একা খেলা করে, কিভাবে হেলেদুলে একে অপরের আরও কাছে চলে আসে। কোন কথা নাই, নিঃশব্দে নিরবে অবিরত বৃষ্টি এই ঘুমন্ত ধরাকে কিভাবে স্নিগ্ধ চুম্বনে আলিঙ্গন করে। আকাশ মাটি আর বৃষ্টির এই প্রেমের লীলা এক অদ্ভুত রহস্য ঈশ্বরের। শরৎচন্দ্রের সেই বিখ্যাত শ্রীকান্ত উপন্যাসের কিছু অভিব্যাক্তি আমার মনে পরে। ……”অন্ধকারেরও রূপ আছে” । আসলেই আছে। মানুষ দিনের আলোয় যা দেখে না, অন্ধকারে সে টা উপলব্ধি করে, মানুষ দিনের আলোয় যা বিশ্বাস করে না, অন্ধকারের ঘোর নিশানায় সে সেটা বিশ্বাস করে। এখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। গাড়ির আলোতে আমি সামনের রাস্তা দেখছি কিন্তু পাশে ফেলে যাওয়া অনেক কিছুই এখন আর আমার নজরে পরছে না অথচ এই ফেলে যাওয়া রাস্তার ধারেও কতই না সৌন্দর্য পরে আছে। মাঝে মাঝে লাইট পোস্টের কিছু আলোতে কিছু কিছু লোকালয়ের বস্তি চোখে পরে। ওখানেও অনেক অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের অনেক কাহিনি লুকিয়ে আছে যার ইতি বৃত্ত আমাদের অনেকেরই জানা নাই।

অনেক দূর চলে এসছি আমরা। বগুড়া শহর আর বেশি দূরে নাই। গাড়ির তেল ফুরিয়ে গেছে প্রায়, তেল নিতে একটি তেল পাম্পে ঢোকতেই হচ্ছে। ইচ্ছা না থাকা সত্তেও গাড়ি থামাতে হল। আমি নেমেই একটা সিগারেট ধরালাম। একটি ৬-৭ বছরের বাচ্চা সহ একজন মহিলা আমার কাছে এসে বল্ল, স্যার আমার এই ছেলেটার একটা চোখ অন্ধ, আর একটা হাত অবশ। দিন না আমাকে কিছু। বড় মায়া হল। মা তার অন্ধ এবং পঙ্গু ছেলের জন্য কোথায় না ঘুরছে? আমার মায়ের কথা মনে পড়ল।  মনে হল কতকাল আমার মা আমাকে আর আদর করে না, কতকাল আমার মা আমাকে আর খোকা বলে ডাকে না। আমাকে আর শাসনও করে না। অথচ আমি জানি আমার মা আমার কাছে আছেন, আমাকে দেখছেন। আজ আমি বাবা, আমার মেয়েরা আস্তে আস্তে তাদের আরেক জীবনে প্রবেশ করছে। হয়তবা আমিও আর ওদেরকে আর আগের মত শাসন করতে পারবনা, আমি আর আগের মত বুকে জরিয়ে ধরে বলতে পারব না, মা তোমার কি মন খারাপ? হয়ত বা তার সত্যি মন খারাপ, হয়তবা সেও কোথাও বসে কোন এক অমাবস্যার রাতে বৃষ্টির ঘন চ্ছটায় আমাদের কথা মনে করছে, অথচ আমি তার পাশে নাই। তাই মাঝে মাঝে অদেরকে মিস করব বলে আজ এই দিনে অনেক অগোছালো আব্দার আমি মেনেই নিচ্ছি।

যাই হোক, ছেলেটার জন্য প্রচন্ড মায়া হল। মায়ের জন্য আমার বুকটা কোথায় যেন একটু ব্যাথা অনুভব করলাম। বললাম, এটা কি তোমার একমাত্র সন্তান? মা সময় অপচয় না করে বিনা দ্বিধায় উত্তর দিল, “হ্যা গো স্যার, হামাক একটাই পোলা, হামাক বড় আদরের পোলা গো স্যার।” একটা মা, জাস্ট একজন মা। তার পরিচয়, মা। মাকে নিয়ে অনেক কবিতা পড়েছি, মাকে নিয়ে অনেক ইতিহাস রচিত হয়েছে। মাকে নিয়ে ধর্মগ্রন্থেও অনেক বানি রয়েছে। আমি নিজেও মাকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছি যদিও আমি কবি নই। আমার কবিতা কোথাও ছাপা হোক সেটাও আমি চাইনি। তারপরেও মনের আবেগে আমি মাকে নিয়ে অনেক কবিতাও লিখেছি। আজ মনে হচ্ছে মাকে খুব মিস করছি। কোন এক সময় মাকে মিস করে একটা কবিতাও লিখেছিলাম…

আমি এক দস্যুরানীর প্রেমিক
কি এক অদ্ভুদ তার চাহনি, কখন মায়াবতী
কখন বা কঠোর স্পাত কঠিন ভিতি
কি অবাক এক জীবনীযোগে
অতন্দ্র ঘোর অন্ধকারে আমার পানে চাহিয়া সে আলেয়ারে খোঁজে

আবার কখনো টকটকে রৌদ্র স্নানে
কোন এক অজানা ভয়ে কম্পিত হয় শিহরনে
কখনো ভালবাসায় আমাকে ছুরে দেয় অসীম আকাশের দিকে
আবার যদি হারিয়ে যাই এই ভয়ে ঢেকে রাখে তার শারির আচলে

কি অদ্ভুদ সে।
কখনো গাল ভরে চুমু
আবার কখনো ইশা খার মত করা শাসনের ঝুমু
সকাল সন্ধ্যা দিন রাত আমার কোন স্বাধীনতা নাই
আবার আমার কোন কাজে তার কোন বাধাও নাই

মাঝে মাঝে আমার বড় রাগ হয়
আর সে খিলখিলিয়ে হাসে,
আমি যখন হাসি, সে তখন অপরূপ দৃষ্টিতে অশ্রু নয়নে ভাসে
আর বলে, আমি নাকি পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর।
অথচ আমার একটা চোখ নাই, আমি দেখতেও ফর্সা নই।
একদিন অনেক রাতে সেই অমাবশ্যার অন্ধকারে চুপি চুপি আমি তারে প্রশ্ন করেছিলাম

কে গো তুমি আসলে?
সিক্ত নয়নে আমার কাধে হাত রেখে বলেছিল
“তুমি যখন এই পৃথিবীতে প্রথম আস
তখন আমার নতুন পরিচয় হয়েছিল
আমার নতুন নাম হয়েছিল, “মা”

(…… হয়ত চলবে)

২৬/০৩/২০০২- মা আর নাই

জন্মঃ তারিখ জানা নাই

মৃত্যুঃ ১৮ মার্চ ২০০২, ১০ মোহররম, সোমবার

স্থান_ নতুন বাক্তার চর

সেনানীবাসের ৪৯/৪ ষ্টাফ রোডে আমার বাসা। আর্মি হেডকোয়ার্টারে মিলিটারী ট্রেনিং ডাইরেক্টরেটে আমি জেনারেল ষ্টাফ অফিসার-২ হিসাবে কর্মরত আছি। প্রচুর কাজ থাকলেও এখানে একটা ভালো বিষয় হচ্ছে, অফিস আওয়ারের পর খুব বেশী একটা অফ টাইমে অফিসে যেতে হয় না। সাধারনত বিকালের দিকে বেশ ফ্রি থাকি। এই ফাকে আমি নিবাইস ইন্সটিটিউটে এমবিএ এর সন্ধ্যাকালীন কোর্ষে ভর্তি হয়েছি। আমার সাথে আমার কোর্ষমেট মেজর সালাম, মেজর জাবের, মেজর মাসুদ ইকবালও ভর্তি হয়েছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রোফেসর আব্দুল মান্নান নিবাইশ এর মালিক এবং তিনি কয়েকদিন আগেই সবেমাত্র নিবাইশ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি হিসাবে চাউ করেছেন। তিনি আমাদের পেয়ে বেশ উৎফুল্ল মনে হয় কারন আমরা ইতিমধ্যে তার নিবাইস ইন্সটিটিউটে একটা সারা জাগাতে পেরেছি। সপ্তাহে দুইদিন ক্লাস হয়। শুক্রবার আর শনিবার। তাই শুক্রবারটা আমার খুব ব্যস্ত সময় যায় দুটু কারনে, এক, নিবাইশে ক্লাস আর ২য় টা হচ্ছে- আমি প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার মাকে দেখার জন্য গ্রামে যাই।

মাকে ঢাকায় রাখতে চাইলেও মা ঢাকায় থাকতে সাচ্ছন্ধবোধ করেন না। যতোদিন আমার কাছে থাকেন, ভালোই লাগে, কিন্তু যখনই গ্রামে চলে যান, আমি প্রতি সপ্তাহে মাকে দেখার জন্য গ্রামে যাই। নিজের গাড়ি নাই তাই, সকাল বেলা একটা সিএনজি সারাদিনের জন্য ভাড়া করি, সরাসরি গ্রামে যাই, মায়ের সাথে এক বেলা সময় কাটাই, তারপর দুপুরে মায়ের সাথে খাওয়া দাওয়া করে বিকালে ওই একই সিএনজি নিয়ে সরাসরি নিবাইসে ঢোকি ক্লাসের জন্য। রাত ১০টা অবধি ক্লাস চলে। মায়ের সাথে আমার সময়টা কাটাতে বেশ লাগে। গ্রামে যখন হাজির হই, মা জানে আজ আমি যাবো, কিভাবে জানে জানি না। মাকে কখনো আগাম জানিয়ে আমি গ্রামে যাই না। যখনই সময় পাই, চলে যাই। মা আমার আসার কথা ভেবে, দুপুরে বেশ ভালো তরকারী আগে থেকেই রান্না করে রাখেন। আমি আর মা একসাথে খেতে বসি, কিন্তু মা খান না, আমার খাওয়া দেখেন আর সারাক্ষন আমার শরীরে হাত বুলাতে থাকেন। মাঝে মাঝে মাকে আমি প্রশ্ন করি, আচ্ছা মা, আমি কি এখন ছোট যে, তুমি এভাবে সারাক্ষন আমার পিঠে, মাথায়, মুখে হাত বুলিয়ে আদর করো যেনো আমি একটা ছোট বাচ্চা। মা কিছুই বলেন না, হাত বুলাতেই থাকেন, আমার ভালোই লাগে।

এবার গ্রামে গিয়েছিলাম মাকে দেখতে গত ৮ মার্চ ২০০২ তারিখে। বেলা তখন প্রায় ১১ টা বাজে। মাকে দেখলেই আমার প্রান জুড়িয়ে যায়, মন ভালো হয়ে যায়। অনেক গল্প হয় মার সাথে। গ্রামে ঘটে যাওয়া গত সাতদিনের সব খবর আমি মার কাছ থেকে পাই। গল্প করতে করতে দুপুর হয়ে যায়। কখনো কখনো দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর, আমি আর মা এক সাথে গল্প করার জন্য বাইরের বাতাসে আমাদের পুর্ব পাশে রান্না ঘরের বাইরে মাদুর নিয়ে বসি। এবারও তাই হলো। দুপুরটা বেশ সুন্দর কিন্তু রোদের তেজ এতো বেশি যে, ভাবলাম, একটু বেলা পড়ে গেলেই রওয়ানা হবো, ক্লাশ আছে। এই সময়টা মার সাথে গল্প করি। অন্যান্য বারের মতো মা আজো আমাকে তার মুখ থেকে চিবানো পান দিয়ে বল্লো, আগামী সপ্তাহে আবার কবে আসবা? বললাম, আমার তো মা, শুক্রবার ছাড়া আসা হয় না, সারা সপ্তাহ কাজ থাকে। কিন্তু এই আগামী সপ্তাহে ১৫ মার্চ শুক্রবারে মনে হয় আসতে পারবো না। কারন বগুড়া সেনানীবাসে একটা কনফিডেনশিয়াল চিঠি নিয়ে আমাকেই যেতে হবে। কিন্তু ১৫ তারিখের পর ১৮ মার্চ তারিখে আশুরার জন্য সোমবার ছুটি আছে, সেদিন ইনশাল্লাহ চলে আসবো।

মা, আমার খালী পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে একটু নীচু স্বরে কি যেনো বললেন, ভালো বুঝা গেলো না কিন্তু এটা যেনো স্পষ্ট শুনতে পেলাম যে, মা বললেন, ওইদিন আমাকে পাও কিনা, কে জানে?

আমি মায়ের দিকে তাকালাম। বললাম, মা তুমি কি বল্লা?

মা বল্লো, না তেমন কিছু না, তবে গত কয়েকদিন যাবত আমি তোমার বাবাকে বারবার স্বপ্ন দেখছি। তোর বাবা আমাকে বারবার তার সাথে দেখা করতে বলছে। আমিও জানি কেমন করে বলে দিলাম, আমি আসতেছি।

খুব অবাক হলাম মায়ের এরকম বিশ্বাস আর কনফিডেন্স দেখে। বললাম, আপনি কি এগুলি বিশ্বাস করেন? হতে পারে কোনো কারনে আপনার মন খারাপ ছিলো, একাকিত্ত থেকে মানুষ অনেক সময় তার আপনজনকে খুব মিস করা থেকে হয়তো এ ধরনের স্বপ্নের উদ্ভব হয়, তাই হয়ত বাবাকে মনে পড়ছে তোমার। এগুলি বিশ্বাস করা ঠিক না মা। আপনার কিছুই হবে না ইনশাল্লাহ।

মা কিছুই বললেন না বললেন, আমি যখন তোর বাবাকে খুব একটা সপ্নে দেখিনা, কিন্তু যখন সত্যি এমন কিছু আমার জানা দরকার অথচ আমি জানি না, সে রকম কিছু সময়ে আমি তোর বাবাকে সপ্নে দেখি। এটা আমার জীবনে অনেকবার ঘটেছে। সেটা আসলে স্বপ্ন নয়, সেটা আসলেই বাস্তব, হয়তো ব্যাপারটা সপ্নে ঘটে। কিন্তু ব্যাপারটা বাস্তব। মন খটকা লাগলো। মা সাধারনত এ রকমের কথা প্রায়শই বলেন না। কিন্তু যখন বলেন, আমি দেখেছি ব্যাপারটা সত্য হয়। যেমন, আমি যখন খুব গোপনে সবার অগোচরে আর্মিতে পরীক্ষা দিয়ে প্রায় চলে আসবো, ঠিক সে সময় মা কোথা থেকে প্রশ্ন করে বললেন, তুমি কি আমাদেরকে ছেড়ে এমন কোথাও যাচ্ছো যা আমরা কেউ জানি না? আমি অবাক হয়েছিলাম। মা জানলো কিভাবে? আমি মাকে উলটা প্রশ্ন করেছিলাম, কি বলো মা? মা তখন ঠিক আজকের মতো এ রকম কনফিডেন্স নিয়েই বলেছিলো, তোর বাবা সপ্নে আমাকে এ রকমই একটা মেসেজ দিলো যে, "তোর ছোট ছেলে তো কোথাও চলে যাচ্ছে, ওকে ঠেকাও"। যাই হোক, আমি চলে এলাম ঢাকায়। কাউকে কিছুই বলি নাই ব্যাপারটা নিয়ে। আমি আসলে ব্যাপারটা সিরিয়াসলী নেইও নাই।

মাকে নিয়ে আমি সবসময় টেনসনেই থাকি। মা ঝড়কে ভয় পায়, মা রাতে একাকী থাকতে ভয় পায়, মা তার কষ্টের কথা কাউকে বলতে ভয় পায়। মার সাথে আমার টানটা একদম নাড়ির সাথে। দেশে বর্তমানে মোবাইল সবেমাত্র চালূ হয়েছে। গ্রামীন একটা মোবাইল অনেক দাম দিয়ে হলেও কিনেছি। এর প্রধান লক্ষ্য ছিলো যে, মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ রাখা। আমাদের পাশের গ্রামে একজন মহিলা আছেন যার নাম্বারে কল দিলে তিনি তার মোবাইলটা নিয়ে আমাদের বাড়িতে যায়, এবং আমি তখন মায়ের সাথে কথা বলতে পারি। যাই হোক, আমি আমার আগের পরিকল্পনা মাফিক, আমি আসলেই এবার শুক্রবারে ব্যস্ততার কারনে গ্রামে যেতে পারি নাই। তাই আগামী সোমবার আশুরার দিনে মাকে দেখতে যাবো এটাই ছিলো আমার পরিকল্পনা। কিন্তু সে দিনটা আর আমার জীবনেই আসে নাই যেখানে মাকে সত্যি সত্যিই জীবিত পাবো।

১৮ মার্চ ২০০২। আশুরা এবং সরকারী ছুটির দিন। সকাল ৯ টার দিকে গ্রামে যাবো মাকে দেখতে এটা ভেবেই গতকাল রাতে মোটামুটি প্রিপারেশন নিয়েছিলাম। বেলা যখন প্রায় সকাল ৮ টা। আমার পাশের বাসায় মেজর জামাল, এএসসি থাকেন। তিনি নক করলেন আমার বাসার দরজায়। ঘুমিয়ে ছিলাম, ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলতে স্যার আমাকে জানালেন যে, আর্মি এক্সচেঞ্জ থেকে আমাকে কি একটা জরুরী মেসেজ দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছে কিন্তু আমার ফোনের ক্রেডেলটা সম্ভবত ডিস্প্লেস অবস্থায় আছে, তাই এক্সচেঞ্জ ঢোকতে পারছে না। বললাম, কি ব্যাপারে জরুরি মেসেজ স্যার? ওরা কি কিছু বলেছে আপমাকে? তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। মনে খটকা লাগলো।

তাড়াতাড়ি ফোন করলাম আর্মি এক্সচেঞ্জে। আর্মি এক্সচেঞ্জ থেকে আমাকে জানালো যে, বাক্তার চর থেকে মোল্লা নামের এক ভদ্রলোক কি জানি একটা জরুরী মেসেজ দেওয়ার জন্য আমাকে আমার মোবাইল এবং ল্যান্ড লাইন ফোনে চেষ্টা করেছে কিন্তু পাচ্ছে না। আর্মির এক্সচেঞ্জে ফোন অপারেটরকে মোল্লা সাহেব একতা মোবাইল নাম্বার ও দিয়েছে। আমি আরো ঘাবড়ে গেলাম, মার কিছু হয় নাই তো? মোল্লা হচ্ছেন আমাদের ঘরের পাশে প্রতিবেশী। তাকে আমরা কাকা বলে সম্বোধন করি। আমাদের ঘরের সাথে উনার ঘর।

আমি আমার মোবাইল চেক করে দেখি যে, মোবাইল চার্জে দেওয়া ছিলো ঠিকই কিন্তু প্লাগটা অন করতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই সারারাত চার্জ না হয়ে বরং চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষন চার্জ দিয়ে আমি গ্রামে মোল্লা কাকাকে ফোন করলাম। ফোনে যেটা উনি বললেন, তাতে আমার আরো সন্দেহ তৈরী হলো। মোল্লা কাকা বললেন যে, আমার মা খুবই অসুস্থ। তার অবস্থা ভালো না। আমি মোল্লা কাকাকে বললাম, কাকা, ঠিক কথাটা বলতে হবে। মা কি অসুস্থ্য নাকি মা আর নাই? আমি শক্ত মানুষ, আমাকে সত্যটা বলতে হবে কারন যদি মা অসুস্থ্য হন, তাহলে আমার গ্রামে যাওয়ার প্রিপারেশন এক রকম, আর যদি মা আর জীবিত না থাকেন, তাহলে আমার প্রিপারেশন অন্য রকম। আমাকে সত্যিটা বলেন।

এবার মোল্লা কাকা বললেন যে, দাদী মারা গেছেন। তুমি আসো।

আমার সারা শরীর কেপে উঠলো। আমার সেদিনের মায়ের কথাগুলি একদম স্পষ্ট মনে পড়লো যখন মা আমাকে বলেছিলেন যে, মাকে আমি আর জীবিত দেখতে পাই কিনা সন্দেহ আছে। কারন, বাবা নাকি মাকে যেতে বলেছেন। তখন কথাটা একেবারেই আমলে নেই নাই, কিন্তু কথাটা কতটা সত্য ছিলো সেটা আজ যেনো আমার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠলো। আমি দ্রুত মিটুলকে বললাম, মা আর নাই। আমরা দুজনেই হত বিহব্বল হয়ে গেলাম এই আচমকা শোকে। আমি মিটুলকে তাড়াতাড়ি রেডি হতে বললাম। গ্রামে যেতে হবে।

নিজের কোনো গাড়ি নাই। সেদিন আবার সোমবার। সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী সোমবারে গাড়ির লে অফ অর্থাৎ জরুরী এডমিন কাজ ব্যতিত কিংবা ট্রেনিং সঙ্ক্রান্ত কোনো জরুরী বিষয় না হলে আর্মির কোনো গাড়িই সেনানীবাস থেকে বের করার বিধান নাই। মায়ের এ রকম অসময়ের মৃত্যুর কথায় আমার নিজের মাথাও ঠিকমতো কাজ করছিলো না। কোথা থেকে একটা গাড়ি পাওয়া যায় সেটা ভাবতে লাগলাম। হটাত মনে হলো যে, পাশেই মেজর খিজির স্যার (ইএমই) ওয়ার্কশপের ওসি। আমরা এক সাথে হাইতিতে মিশন করেছি। উনাকে বলে দেখি কোনো সাহাজ্য পাই কিনা। যেই আমি মেজর খিজির স্যারকে ব্যাপারটা খুলে বললাম, তিনি ওয়ার্কশপ থেকে একটা ভালো গাড়ি আমাকে দিয়ে বললেন, আগে যাও মাকে দেখার জন্য, পরে দেখা যাবে আইনে কি বলে। গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেলে আমি দ্রুত গোসলে ঢোকি।

কদিন আগে আমি মায়ের একটা ডে লং ভিডিও করেছিলাম। সেখানে আমি মাকে অনেক প্রশ্ন করে করে মায়ের মনের ভিতরের কথা জানার চেষ্টা করেছিলাম। আমি মাকে তার ছোট বেলার কথা, মার সাথে বাবার প্রেমের কথা, মার বিয়ের পর তার শসুর বাড়ির কথা, বাবার মৃত্যুর পর মার মনের কথা, তারপর আমাদের কথা, তার কোন ছেলেমেয়ে তার কাছে কোন পর্যায়ে আছে তার অনেক খবর আমি জানার চেষ্টা করেছিলাম। সেদিন ভিডিও করার সময় আমি মাকে এই প্রশ্নটাও করেছিলাম, যে, মার শেষ ইচ্ছা কি। তার মৃত্যুর পর তিনি কোথায় সমাহিত হতে চান, ইত্যাদি। মায়ের এই তথ্যগুলি আমি এম্নিতেই জানতে চেয়েছিলাম। ভিডিও করার সময় মা কখনো হাসতে হাসতে বিগলিত হয়ে গেছেন আবার কখনো কখনো কষ্টের কথাগুলি বলার সময় তার দুই চোখ দিয়ে অবিরত জল পড়েছিলো। আমি মাকে না হাসায় না কাদায় কোনো বাধা দিয়েছিলাম। বলুক মা।

আজ মাকে কোথায় সমাহিত করতে হবে এই তথ্যটা আমার মাথায় যেনো আসছেই না। এদিকে গ্রাম থেকে বারবার ফোন আসছিলো মাকে কোথায় সমাহিত করা হবে সেটা জানার জন্য। কারন কবর করতে হবে। জায়গাটা না বললে কাজে কেউ হাত দিতে পারছে না। আমি ওয়াসরুমে মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালতে ঢালতে বারবার মনে করার চেষ্টা করছিলাম মায়ের শেষ সমাহিত হবার ইচ্ছেটার কথা। কিন্তু আমার মাথা কিছুতেই আমাকে সাহাজ্য করছিলো না। গোসল শেষ করে আমি ফজরের কাজা নামাজটা পড়তে পড়তে হটাত মনে হলো, হ্যা, মনে পরেছে এবার। আল্লাহই আমাকে মায়ের শেষ ইচ্ছেটা স্মরণে আনতে সাহাজ্য করেছেন। মা বলেছিলেন যে, তিনি তার একমাত্র বোন আমার খালার কবরের পাশে যেনো সমাহিত করি। আমার খালা ছিলো একাধারে আমার মায়ের মার মতো, দিদির মতো, তার একটা বন্ধুর মতো। আমি নামাজ পড়েই মোল্লা কাকাকে ফোন করে বললাম, আমি দ্রুতই গ্রামে আসতেছি, আর মায়ের কবরট যেনো হয় আমার খালার কবরের পাশে। এটা মায়ের শেষ ইচ্ছে ছিলো।

আমি রওয়ানা হয়ে গেলাম গ্রামের উদ্দেশ্যে। অন্য সবসময় যাই, মাকে জীবিত দেখার জন্য, আর আজ যাচ্ছি মাকে সমাহিত করার জন্য। মনটা বড় কষ্টে আছে। সারাক্ষন মার জন্য তাসবিহ পড়ছি, আর মার জন্য দোয়া করছি। একসময় ভাবলাম, আমি কি ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করবো নাকি মাকে সমাহিত করবো? ভাইয়াকে ফোন করলাম। পেলাম না। তার ফোন এনসারিং মেশিনে দেওয়া। ভাইয়া আমেরিকায় থাকেন। ভাবলাম, ভাইয়া আমাকে ফোনব্যাক করবেন নিশ্চয়ই। আমি যখন ভাইয়াকে ফোন করেছি, তখন আমেরিকায় রাত বেশী না, হয়তো ১০ টা বাজে। এই সময় ভাইয়ার কল ধরার কথা। ভাইয়া কল না ধরার কারনে আমি আমার জেঠস যিনি আমেরিকায় থাকেন, শেলি আপা, তাকে ফোন করে বললাম যে, আমার মায়ের মৃত্যুর খবরটা যে করেই হোক ভাইয়াকে জানান।

আমি গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম যখন তখন বেলা প্রায় ১১ টা সকাল। অনেক লোকের সমাগম। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকেই লোকজন এসেছে। মা শুয়ে আছেন একটা নামাজী পাটির মধ্যে কাত হয়ে। জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে মা মারা গেলেন। নুরুন্নাহার আমাকে যেটা বলল তার সার্মর্ম এ রকম যেঃ

মা ফজর নামাজের সময় নামাজে ছিলেন। নামাজের মধ্যেই মা মারা গেছেন। আর উঠেন নাই। নুরুন্নাহার মনে করেছিলো, যে, মা মনে হয় নামাজ পরার পর এম্নিতেই নামাজের পাটিতে শুয়ে আছেন। কিন্তু সকাল ৭টা অবধি যখন মা আর পাটি থেকে উঠছেন না, তখন নুরুন্নাহার মাকে জাগাতে গিয়ে দেখে যে, মার কোনো শ্বাস চলছে না। এরপরেই নুরুন্নাহার পাশের বাসার মোল্লা কাকাকে ব্যাপারটা জানায়।

আমি মায়ের শান্ত বডিটাকে কয়েকবার নাড়া দিয়ে মা বলে ডাকলাম, কানের কাছে গিয়েও ডাকলাম। মা কোনো উত্তর করলেন না। আমি মার হাতের পালস চেক করলাম, তখনো মনে হচ্ছে শরীরটা গরম, ঠান্ডা হয়ে যায় নাই। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো মা নাই। সন্দেহ হলো একবার যে, মা কি আসলেই নাই নাকি ক্লিনিক্যালী কোনো এক অবস্থায় আছেন? আমাদের বাড়িতে পাশেই একজন ডাক্তার ছিলেন। তাকে বললাম, ভালো করে একটু দেখবেন মার অবস্থাটা কি? ডাক্তার সাহেব আমাকে টেনে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বললেন, আখতার ভাই, খালাম্মা আর বেচে নেই। আমি অনেকভাবেই চেক করে দেখেছি। আপনি ঠান্ডা হোন। এখন খালাম্মাকে সমাহিত করার যাবতীয় ব্যবস্থা নিন। জানি আপনার কষ্ট হচ্ছে কিন্তু এটাই বাস্তবতা যে, খালাম্মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

আমার অন্যান্য বোনেরা, মায়ের নায়-নাতকোরগন অনেকেই বিলাপ করে কাদছেন। কিন্তু আমি কাদতে পারছি না। কেনো যেনো আমার কান্নাই পাচ্ছে না। আমি খুব সাভাবিকভাবেই মাকে সমাহিত করার জন্য গোসলের ব্যবস্থা করতে বললাম, কবরের জন্য লোক লাগিয়ে দিলাম। আমার বোন ফাতেমা আর আরেকজন মিলে মাকে গোসল করিয়ে দিল। গোসলের সময়ও আমি কয়েকবার তদন্ত করেছি মা কোন প্রকার নড়াচড়া করেন কিনা। আমার বারবার মনে হচ্ছিলো মা মারা যান নাই। এ রকম সুন্দর একটা নিষ্পাপ মুখ, শান্ত আর সাভাবিক চেহারা যাকে দেখলে মনে হবে তিনি ঘুমিয়ে আছেন। মার চেহাড়াটা আগের থেকে অনেক উজ্জ্বল। মার এই রকম সুন্দর চেহারা আমি কখনই দেখি নাই। গোসলের পর মাকে কাপড় পরানো হবে, আমি আবার মাকে জোরেই ডাক দিলাম। কিন্তু মা আমার ডাকে কোনো সারা দিলেন না। মাকে কাপড় পরানো হলো। সাদা দাফনের কাপড়। মাকে জানাজা পরানো হবে, অনেক লোক অপেক্ষায় আছেন। মাকে জানাজার স্থানে আনা হলো। আমি আবার ওই অবস্থাতেই মাকে ডাকলাম। যদি আবার মা নড়েচড়ে উঠে! এ সময় মোল্লা কাকা আমাকে ধরে বললেন, কাকু, তুমি অস্থির হইও না। দাদি আসলেই মারা গেছেন। তুমি খালি দোয়া করো। তোমাকে দাদি অনেক ভালবাসতো আর ভরষা করতো। তুমি এমন করলে উনি তো আরো কষ্ট পাবেন!!

জানাজা পরানো হয়ে গেল। আমি তখনো ভাইয়ার একটা ফোনকলের জন্য অপেক্ষা করছি, যদি ভাইয়া আমাকে ফোন করেন। ভাইয়াকে আবারো আমার মোবাইল থেকে ফোন করলাম, কিন্তু এবার ভাইয়ার ফোন আর এনসারিং মেশিনে ছিলো না। রিং হচ্ছিলো। কিন্তু যে কোনো কারনেই হোক, ভাইয়া ফোনটা ধরলেন না। আমি আবার শেলী আপাকে ফোন করলাম যদি এরই মধ্যে শেলী আপার সাথে ভাইয়ার কোনো কথা হয়ে থাকে আর ভাইয়া মার মৃত্যুর খবরটা জেনে থাকে সেটা জানার জন্য। শেলী আপা ফোন ধরলেন। আর আমাকে জানালেন যে, ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছে। মার মৃত্যুর সংবাদ ভাইয়াকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাইয়া নাকি বলেছেন, উনি আসতে পারবেন না। খুব বিরক্ত হয়েছিলাম এমন একটা খবরে। ভাইয়ার উপর আমার শ্রদ্ধাবোধটা নিমিষেই শুন্যের কোঠায় চলে এলো। ভাবলাম, আজ যদি উনি শুনতেন যে, উনার শাসুড়ি মারা গেছেন, হয়তো ঠিকই চলে আসতেন।

কাউকে কিছু বললাম না। জানাজার পর মাকে কবরে সমাহিত করা হবে। আমি সবার উদ্দেশ্যে একটা এনাউন্সমেন্ট করলাম যে, আমার মা আজ চলে যাচ্ছেন, কিন্তু আমি রয়ে গেছি মার ছেলে। যদি কখনো আমার মা কাউকে জানা বা অজানা মনে কষ্ট দিয়ে থাকেন, তাহলে যেনো কেউ তার দাবী না রাখেন। মাকে মাফ করে দিবেন। আর যদি কেউ মার কাছ থেকে কোনো পাওনা থাকে, নির্ধিধায় আমাকে জানাবেন, আমি কোনো প্রকার ভেরিফাই করবো না, আমি মায়ের সব দেনা শোধ করে দেবো। আর যদি মা কারো কাছ থেকে কিছু পাবেন বলে জানেন, আজ আমি তার ছেলে হিসাবে সবকিছু মাফ করে দিলাম। শুধু আমার মার জন্য আপ্নারা খাস মনে দোয়া করবেন।

আমরা সবাই মাকে কাধে করে কবরের কাছে নিয়ে গেলাম। আমার এখনো মন মানছে না যে, মা নাই। মাকে যে আমি সত্যি সত্যিই গোরস্থানে সমাহিত করতে যাচ্ছি এটা বিশ্বাসই করতে পারছি না। কবরে শোয়ানোর ঠিক আগমুহুর্তেও আমি মাকে জোরে আরেকবার ডাক দিলাম। কিন্তু মা তো আমার কথা নিশ্চয়ই শুনছেন কিন্তু কোনো সাড়া দিলেন না। খালার কবরের পাশেই মাকে সমাহিত করা হল।

বেলা তখন প্রায় ৩টা যখন সমস্ত আয়োজন শেষ হয়। মাকে কবর দেয়া হয়ে গেছে। আমি বাড়িতে সব বোনদেরকে নিয়া একসাথে বসলাম। সবার মন খারাপ। কেউ কেউ তখনো কাদছে। আমার চোখে এক ফোটা পানিও নাই। যেনো কিছুই হয় নাই। বিকাল হয়ে গেছে। আর্মির গাড়ি নিয়ে এসেছি, আমাকে আবার সন্ধ্যার আগেই ঢাকায় ফিরে যেতে হবে। গাড়িটা পার্ক করা আছে প্রায় ১ মাইল দূরে। আমাদের বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি আসে না তাই। আমার যাওয়ার সময় হয়ে এলো। আমি মিটুলকে বললাম, চলো, ঢাকায় যেতে হবে। আমি আগে আগে হাটছি, মিটুলও বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। আমি হাটতে হাটতে প্রায় ৩০০ গজ যাওয়ার পর ভিতর থেকে এতো কষ্ট আর কান্না আসছিলো যে, আমি আর একটি পাও আগাইতে পারছিলাম না।

প্রতিবার যখন আমি গ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই, আমার মা বাড়ির পিছনে বসে থাকেন যতোক্ষন আমাকে দেখা যায়। আমি মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকাই আর দেখি, মা বসে আছেন, হাত নাড়েন। আমিও হাত নাড়ি। মাকে ফেলে যেতে আমার সবসময় মনে কষ্ট হতো। কিন্তু আজকে আমার মনে বারবার এই ভাবনাটাই আসছে, আজ মা বাড়ির পিছনে বসে নাই, আমি পিছন ফিরে তাকাই, মা নাই। আমার গলা ফাটিয়ে কাদতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু আমার গলা দিয়ে একটু আওয়াজও বের হলো না। আমার চোখ জলে এতোটাই ভরে উঠছিলো যে, আমি এক হাত দূরের রাস্তাটাও দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি বসে গেলাম বিস্তর খালী জমিনে। আমার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিলো। মা আমাকে আজ আর দেখছে না। আমাকে খালী জমিনের উপর বসে পড়তে দেখে আমার বাড়ি থেকে কয়েকজন দৌড়ে এলো। মিটুলও এলো। আমার চোখের পানিতে আমি কাউকেই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার শরিরে কোন শক্তি ছিলো না উঠে বসবার। বুঝলাম, এতোক্ষন যে কষ্টটা আমার বুকের ভিতর শক্ত হয়ে চেপেছিলো, এখন সবগুলি কষ্ট আমাকে চারিদিক থেকে এমন করে ঝাপটে ধরেছে যে, আমার চোখ, আমার কন্ঠ, আমার পা, আমার হাত, আমার মাথা, আমার কান কোনোটাই আর সাভাবিক অবস্থায় নাই। আমি কতোক্ষন চুপ করে বসেছিলাম, আমার মনে নাই।

শক্তি নাই ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কিন্তু আমাকে তো ফিরতেই হবে। মা নাই, কোথায় ফিরে যাবো? এখন এই শুন্যঘরে গিয়ে তো মাকে পাবো না, মায়ের চিবানো পান খাওয়ার আর আমার হলো না। মা বাবার সাথে দেখা করার জন্য চলে গেছেন। আজ হয়তো বাবা অনেক খুসী তার সেই প্রায় ৩০ বছর আগে একা ফেলে যাওয়া প্রেয়সীকে কাছে পেয়ে।

ঢাকায় ফিরতে ফিরতে আমার প্রায় রাত ৮টা বেজে গেলো। মেজর খিজির আমাকে ফোন করে শুধু বললেন যে, খালাম্মার জন্য দোয়া করো। তিনি জান্নাতবাসি হয়েছেন। তিনি আল্লাহ্‌র পাটিতে বসেই জান্নাতে চলে গেছেন, এর থেকে পুন্যের কি হতে পারে? খিজির স্যারকে আমি কখনো তার এই দয়ার ঋণ শোধ করতে পারবো না।

ঢাকায় এসে আমি আমার কম্পিউটারটা খুললাম। মার সেদিনকার ভিডিওটা অন করলাম, উফ, এই তো মা ঠিক আমার সামনেই। তিনি কখনো হাসছেন, কখনো কাদছেন, কখনো আমার দিকে তাকিয়েই আছেন। অনেক রাত অবধি আমি আমার মার ভিডিও টা কয়েকবার আগে পিছে টেনে আবার রিওয়াইন্ড করে করে দেখলাম। অনেক রাত, চারিদিকে শুনশান নীরবতা। কেবল আমার মনের ভিতরেই অত্যান্ত প্রবল আর্তনাদ আমার বন্ধ কবাটির ভিতরে ঘুরপাক খাইতে লাগলো। আমি স্তব্দ তপতীর মতো আমার চেয়ারে ঠেস দিয়া শুধু সেলোলয়েড ফ্রেমে বাধা জীবন্ত মাকে দেখতে লাগলাম বটে কিন্তু মা আমার এখন ঈশ্বরের একদম কাছে চলে গেছে। এখন তার আর ঝড়কে ভয় পাবার কোনো কারন নাই, একা থাকার ভয় নাই, পৃথিবীর কোনো মায়া, কোনো কষ্ট, বা কোনো সুখের প্রভাব নাই। 

সাতদিন পর আমার বড় ভাই আমাকে একটা মেইল করলেনঃ মেইলটা আমি হুবহু আজ এখানেই তুলে দিলাম।

To: Mohammad Akhtar Hossain <makhtar@dotbd.com>
From: "Mohamed Habibullah" <M.HABIBULLAH@neu.edu>
Subject:
MIME-Version: 1.0
Date: Mon, 25 Mar 2002 13:10:31 -0500
Message-ID: <OFF893F0BA.F371BA0B-ON85256B87.0063D6FA@neu.edu>
X-MIMETrack: Serialize by Router on HUB02/Server/NEU(Release 5.07a |May 14, 2001) at 03/25/2002
01:10:51 PM
Content-type: text/plain; charset=us-ascii
Status:
Monday USA time 1:00 P.M.

Dear Akhtar

I just recieved your e-mail. Also.Today, I received a call from Shelly Apa and came to know that Ma died (Inna lillahe wa inna ilaihe rajeoon). I will miss Ma from now on. May Allah keep her in peace in the grave. I know I could not come to see her off. PLease let me know where you buried her. Let me also know everything anout everybody including Badir Bhai, Laila, Fatema and Meherunnesa. Take care.

কি প্রয়োজন এই সব সন্তানের জন্য যাদের হাতে তার জন্মদাত্রী মায়ের মৃত্যুতেও শেষকৃত্য করার জন্য হাতে সময় থাকে না? সম্পর্কের থেকে বেশী যখন নিজের সম্পদের দাম বেড়ে যায়, নিজের জন্মদাত্রির শেষকৃত্য করার জন্য যখন কোনো সন্তানের সময় থাকে না, আল্লাহ বা ঈশ্বর কিংবা ভগবান এইসব কিছুর একটা রেকর্ড রাখেন যাতে কোনো এক সময় যখন তাদের শেষকৃত্য হবে, হয়তো তাদের বেলাতেও এটাই রিপিট হয়। তবে আমি দোয়া করি যেনো, আমার কোন বংশধর অথবা আত্তীয়ের বেলায় এ রকমের শুন্যতা না আসে।

প্রিয় আখতার,

এইমাত্র আমি তোর চিঠি পেলাম। আজকে আমি শেলী আপারও টেলিফোন কল পেয়েছি এবং জানতে পারলাম যে, মা মারা গেছেন (ইন্না নিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহির রাজেউন)। আমি মাকে এখন থেকে অনেক মিস করবো। দোয়া করি আল্লাহ মাকে জান্নাতবাসী করুন। আমি জানি, মার মৃত্যুতে আমি মাকে দেখতে আসতে পারবো না। আমাকে জানাস মাকে কোথায় করব দিলি। বদির ভাই, লায়লা, মেহের এবং ফাতেমাদের সম্পর্কেও আমাকে বিস্তারীত জানাইস। নিজের যত্ন নিস।

৩১/১২/১৯৯৯- অসুস্থ মায়ের পাশে

নতুন বাক্তার চর, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-

গ্রামে এসেছি। ভাইয়া সাথে আছে। মিতুল ও সাথে আছে। মাসুদ কয়েকদিন আগে গ্রামে এসেছিলো বটে কিন্তু এবার আসে নাই। ঢাকায় রয়ে গেছে। বেশ শীত বটে। বিল্লাল ভাইও গ্রামে এসেছে মায়ের কাছে। মা খুব সুস্থ নন। 

রাত হয়ে গেছে। আমরা সবাই খাটের উপর বসে কথা বলছি। বোনেরা আছে, মা বারবার কাশি দিচ্ছেন। ঘরের ওপাশে মা কাথা গায়ে দিয়ে শুইয়ে  আছেন। আমি বারবার মায়ের কাছে যাচ্ছি যেন মায়ের কোন অসুবিধা হলে বুঝতে পারি। বিল্লাল ভাই নিজেও ডাক্তার। ফলে অন্তত একজন ডাক্তার সাথে আছে এটা আমার একটা ভরসা। 

রাত প্রায় ১১টা বাজে। মা খুব ঘনঘন কাশছেন। আমি মায়ের কাশিটা সহ্য করতে পারছিনা। বিল্লাল ভাই, আমার অন্যান্য বোনেরা সবাই মায়ের কাছে এসে বসলেন, কিন্তু হাবীব ভাই মায়ের কাছে এসে বসার আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। আমি একটু রাগের সাথেই হাবীব ভাইকে বললাম, আপনি মায়ের কাছে যাচ্ছেন না কেনো? ঊনি মায়ের কাশিতে ওনার সমস্যা হতে পারে এই কারনে তিনি মায়ের ওখানে যেতে চান না। আমার এম্নিতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলে রাগ উঠে যায়। আর মায়ের ব্যাপারে আমি কোনো কিছুই মানতে পারি না।  রাগ উঠতেছিলো। হাবিব ভাইয়ের প্রতি আমার সম্মানটুকু অনেক কমে গেলো। নিজের মায়ের উপর তার এই ভালবাসা আর শ্রদ্ধ্যা? আমার তো ধারনা যে, মা যদি মারাও যান, হাবিব ভাই আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে আসেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। 

মা হাবিব ভাইয়ের কাছে একটা বোঝা হয়ে দাড়িয়েছে মনে হল। মায়ের উপর হাবিব ভাইয়ের কোনো শ্রধ্যাবোধ নাই মনে হলো। ভাবলাম, ভাইয়া, আপনারও কিন্তু সন্তান আছে, কোনো একদিন দেখবেন, আজকে যে আচরনটা আপনি আপনার মায়ের প্রতি করে যাচ্ছেন, কোনো একদিন আপনার সন্তানেরা যখন এই আচরনটা করবে, তখন আজকের দিনের এই আচরনটা আপনার মনেও পড়বে না হয়ত কিন্তু এইটাই হলো আপনার ফেরত পাবার দান। 

আগামিকাল হাবিব ভাই পুনরায় আমেরিকায় চলে যাচ্ছেন। আর কোনদিন তার সাথে মায়ের কিংবা অন্যান্য কারো সাথে দেখা হয় কিনা আমরা কেউ জানি না। 

উম্মিকা মাসুদের সাথে অনেক এঞ্জয় করেছে। উম্মিকা, মাসুদ এরাই আমাদের প্রথম বংশধর যাদের জন্য আমরা একটা পরিবার পেয়েছি। মিতুল খুব ভালো মেনেজ করেছে পুরু পরিস্থিতিটা। বিল্লাল ভাইয়ের বউও এসেছে। 

০৬/১২/১৯৯৮-মা পরিবারের বন্ডেজ?

রবিবার, মাঝিরা সেনানীবাস, রাতঃ ১১টা ২৩ মিনিট

মাঝে মাঝে আমি একটা অদ্ভুদ ব্যাপার নিয়ে ভাবি। কিন্তু আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাই না। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার মাঝে মাঝে বেশ ভাবতে ইচ্ছে করে। আমরা দুই ভাই, পাচ বোনের মধ্যে এখন চারজন বেচে আছেন। মাও বেচে আছেন। মা গ্রামে থাকেন, আমরা সবাই মাকে কেন্দ্র করেই প্রকৃতভাবে আসলে ঈদে, পর্বে কিংবা যে কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে একত্রিত হই। আমি বগুড়ায় আছি, মিতুলকে ছাড়াও আমি যখন ছুটি নিতে চাই, তার মাঝেও মায়ের সাথে দেখা করার প্রবনতায় আমার ছুটি যেতে ইচ্ছে করে। হাবীব ভাই আমেরিকায় থাকেন, তার সাধারনত সবসময় বাংলাদেশে আসা হয় না। উনি আসতেও হয়তো চান না। হাবীব ভাইয়ার এই যে না আসার অনীহা, কোনো একদিন হয়তো উনাকে এর বড় মাশুল দিতে হতে পারে। এর কারন একটাই। আজ হাবীব ভাই যে সব কারনে তার অনীহা হচ্ছে, যেমন, বোনদের প্রতি উনার আস্থা নাই বললেই চলে, গ্রামের প্রতি উনার অনেক অনীহা কারন গ্রাম তার স্ট্যান্ডার্ড নয়। থাকা অসুবিধা, খাওয়া অসুবিধা, পায়খানা প্রস্রাবে অসুবিধা। পরিবেশ তার মনের অনুকুলে নয়। তার উপর তার সমসাময়ীক কোনো বন্ধুরাও নাই যে, উনি কোথাও আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে পারবেন। একদিক দিয়ে ভাবলে ব্যাপারটা মনে হয় ঠিকই আছে। আবার যদি সুদূরপ্রসারী ভাবনায় ভাবি, এই বিচ্ছিন্নতা কোন একদিন হাবীব ভাইকে হয়তোবা মাশুল দিতে হবে। কেনো বলছি, তার একটা ব্যাখ্যা আছে। মানুষ বড় হয়, তার সম্পদ হয়, একদিন সম্পদের চাহিদা আর থাকে না। তখন দরকার হয়, আসলে দরকার না, এটাই হবে যে, ইচ্ছে হবে সেই চেনা পরিচিত বাল্যকালের জায়গাগুলিতে ফিরে যাই, তারপর সেখানে সেই গ্রাম, সেই আদি নদী, মেঠো পথের ধারে হাটতে হাটতে সময় কাটানোর বাসনা হবে। সবাই ওই সময় একসাথে জীবিত নাও থাকতে পারে, কিন্তু এই সমসাময়ীক বন্ধুদের ডালপালারা অর্থাৎ তাদের বাচ্চা কাচ্চারাও এক সময় বন্ধুতে পরিনত হতে পারে। কিন্তু এটা সম্ভব তখনই যখন অবিচ্ছিন্ন একটা সম্পর্কের মধ্যে কেউ থাকে।

যাই হোক, আমি ঢাকার বাইরে থাকি বিধায় মায়ের উপর সন্তানের যে প্রাত্যাহিক দায়িত্ত, বাজার সদাই, দেখভাল ইত্যাদি করা সম্ভব হয় না। কিন্তু আমাদের বদি ভাই অত্যান্ত আন্তরীকতার সাথেই মায়ের এই যত্নটা করেন। যদিও তিনি আমার আপন সহোদর ভাই নন। মাসে মাসে এককালীন বাজার করে দিয়ে আসেন, মায়ের খোজ খবর নেন। মাকে তিনি মা বলেই জানেন। এই রকম একজন নিঃসার্থবান মানুষ যুগে যুগে পাওয়া যায় না। বদি ভাইয়ের সাথে আমার বোনদের দেখা হয়, কথা হয়, যেদিন তিনি গ্রামে যান, সেদিন সবার সাথেই উনার দেখা সাক্ষাত হয়। এমন কি আমাদের গ্রামের অনেকের সাথেই উনার এখন ব্যক্তিগত পরিচয় আছে। সবাই উনাকে স্যার বলেই সম্বোধন করেন।  

কিন্তু সবচেয়ে বড় ভয় হয় আমার যে, হাবীব ভাই দেশে না আসার কারনে যেমন তার সন্তানদের সাথে আমাদের অন্যান্য ভাই বোনদের সন্তানদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠছে না, তেমনি বদি ভাইও তার সন্তানদেরকে আমাদের এই সম্পুর্ন পারিবারিক সিস্টেমের সাথে বহুমুখী বন্ধনের চেষ্টা করছেন না। ফলে আমাদের বোনদের সন্তানেরা যেমন বদি ভাইয়ের সন্তানদের সাথে বন্ধুত্ত গড়ে উঠছে না, তেমনি হাবীব ভাইয়ের সন্তানদের সাথেও একই অবস্থা। এই বন্ধনটা ছাড়া ছাড়া ভাবের। সতস্ফুর্ততা নাই। আমি যখন ঢাকায় যাই, বেশীর ভাগ সময়ই আমি খেয়াল করেছি যে, আমার সময় কাটে কিছু অংশ মানিকগঞ্জে, কিছু অংশ গ্রামে আর মাঝে মাঝে মীরপুর বদি ভাইয়ের বাসায়। আর সেটাও বেশ অল্প সময়ের জন্য।

হাবীব ভাইয়ের ছেলে মাসুদের সাথেও কারো কোনো সখ্যতা গড়ে উঠছে না। এমনকি আমার সাথেও না। তাতে যেটা হচ্ছে তা হলো, কোনো একদিন, আমরা হয়তো এভাবেই ছাড়া ছাড়া ভাবেই দুনিয়া ত্যাগ করবো। কে যে কখন দুনিয়া থেকে চলে যাবে, তখন পরিবারের অনেকেই হয়তো পাশে থাকবে না। এটা মর্মান্তিক।

আমার কাছে মনে হচ্ছে, মাকে কেন্দ্র করে এখনো কিছুটা বন্ডেজ আমাদের সবার মধ্যে আছে। কিন্তু এই বন্ডেজটা কি খুব শক্ত একটা বন্ডেজ? এই বন্ডেজের সবচেয়ে দূর্বল দিক হচ্ছে, যেদিন মা থাকবেন না, সেদিন এই সেনটার পয়েন্ট "মা" এর অভাবে বাকী সব বন্ডেজ নিমিষেই ভেংগে যেতে পারে। কিন্তু এটা তো কোনো পারিবারিক সম্পর্ক হতে পারে না?

কিন্তু আজ যদি আমরা এমন একটা বন্ডেজ তৈরী করতে পারতাম যেখানে "মা" সেন্টার পয়েন্ট নয়, তাহলে মা যেদিন থাকবেন না, সেদিনও এই পারিবারিক বন্ডেজটায় কোনো প্রকার হুমকীর সম্মুখীন হতো না। কিন্তু আমার ধারনা, আমরা সেটা করছি না। আর এর ফলাফল দূর্বিসহ। আমাদের পরবর্তী জেনারেশন একে অপরের কোনো খোজ রাখবে না, চিনবে না, হয়তো কখনো জানবেও না যে, অতীতে কোনো একসময় আমাদের মধ্যে এমন একটা সম্পর্ক বিরাজ করেছিলো। অথচ তখনই হয়তো এই বন্ডেজটার অনেক প্রয়োজন।

একটা সময় আসবে, হাবীব ভাইয়ের সবকিছু থাকা সত্তেও তিনি অনিরাপদ ফিল করবেন, পাশে কাউকে হয়তো পাবেন কিন্তু তারা তার পরিবারের কেউ না। আমিও হয়তো ভাববো, আহা যদি এই মুহুর্তে আমার পাশে কেউ থাকতো যাদের শরীরে আমার রক্ত বা যারা আমার একান্ত লোক। আমার পরিবারের বাচ্চারাও হয়তো একদিন প্রশ্ন করবে, আমাদের অতীতের জেনারেশন ছিলো না? তারা কোথায়?

আজ আমি একটা হাইপোথিসিস ডায়াগ্রাম তৈরী করে বুঝতে চেয়েছি, আসলে মা সেন্টারড বন্ডেজ কি আর মা ছাড়া বন্ডেজ কি। গা শিউরে উঠে।

০৫/১০/১৯৯৩- মাকে মনে পড়ে

 

মাঝে মাঝে আমার মাকে খুব মনে পড়ে। আমার মা একজন অসামান্য personality সম্পন্ন মহিলা।  তিনি শিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর ভিতরে অনেক গুন আছে। তিনি পাঁচ ওয়াক্কত নামাজ পরেন,  কোন মিথ্যা কথা বলেন না। তাকে আমি ভীষণভাবে ভালবাসি। এইতো কদিন পর আমি ছুটি যাব এবং আমি তাকে দেখতে পাব। কিন্তুঁ এখনি তাকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে। আমার মা আমাকে ভালবাসে তাঁর ছেলে হিসেবে তো অবশ্যই তবে ভালবাসে একজন রক্ষক হিসেবেও। আমি তাঁর পাশে আছি মানে সে আর কোন কিছুই ভয় পায় না। এই মাকে আমি ভালবাসি আমার জীবনের চেয়ে বেশি। আমি আজ পর্যন্ত আর কারও জন্য কাদিনি, কিন্তু আমার মণে হয় আমি মার জন্য অনেক বার কেদেছি কোন কারন ছাড়া। আমি আমার বাবাকে দেখিনি, আমার যখন জ্ঞান হয়েছে, আমি শুধু মাকেই দেখেছি। পাঁচজন কন্যা, আর একজন ছেলে, বড় ছেলে থাকে আমেরিকা এবং তাকে সব সময় ভয়েই থাকতে হয়। এটা কোন সাধারন পরিস্থিতি নয়।  আমার মা তাঁর মেয়েদের ব্যাপারে অনেক কষ্ট তাঁর মনে আছে কিন্তু যার কোন সামর্থ্য নেই, সে কি করতে  পারে? পারে শুধু কানতে আর একা একা বসে ভাবতে । আমরা  সামর্থ্য নেই  মাকে সাহায্য করবার। খুবই অল্প বেতনে চাকরি করি। আমি যখন ছুটিতে আসি, তখন আমার অনেক আজে বাজে কাজ থাকে যার জন্য আমি ঠিকমত সময়ও দিতে পারি না। গ্রামের কিছু অল্প শিক্ষিত বন্ধুবান্ধব যারা আমাকে খুব সমীহ করে, ওদের সঙ্গে  সময় কাটাতে আমার খারাপ লাগে না। গ্রামের সরু পথ, যার দুপাঁশে ঘাস গজে আছে, রোডের পাঁশে কোন আলো নাই, অন্ধকার চারিদিকে, ফেরার পথে হাতে একটা সিগারেট, মন্দ না। পৃথিবীটা অনেক সুন্দর, আর এই সুন্দরের পিছনে মা একটা অনেক বড় ব্যাপার। যার সুন্দর এবং ভাল একটা মা আছে, তার সুন্দর একটা পৃথ্বী আছে। একটা ভাল মা একটা দেশের জন্য অনেক বড় ব্যাপার। সে নেতা  তৈরি করে, সে আরও ভাল মা তৈরি করে, সে পৃথিবীটাকে গড়ে তোলে মধুর একটা পরিবেশ দিয়ে। তার প্রতিটি হাসিতে মায়ামমতা আর ভালবাসা আছে। আমার মা ঠিক তার মত। সে হাসলে আমার প্রান ভরে যায়, তার দুঃখে আমার চোখে জল আসে। আমি তাকে  খুব ভালবাসি। আমি কখনো ভাবতে চাই না আমার কেমন যাবে দিনগুলো যখন আমার মা আর বেঁচে থাকবেন না। এখন আমার হাতে অনেক টাকা নাই, আমি চাইলেও আমি মাকে সাহয্য করতে পারি না কিন্তু আমি জানি একদিন আমার হাতে অনেক টাকা হবে এবং আমার কেন জানি খালি মনে হয়, মা তখন থাকবেন না। এটাই হবে সবচে দুঃখজনক।

০৫/১০/১৯৮৬-বদি ভাইয়ের বউ

                 

৫ কার্তিক, ১৯৯৩

বড় বউদি, তোমাকে আমি সাধারনত কখনো চিঠিপত্র লিখিনি। তুমিও আমাকে কখনো চিঠি লিখনি। এরমানে এই নয় যে আমি কিংবা তুমি আমাকে বা আমি তোমাকে ভালবাসি না। আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি, আমি তোমাকে আমার মায়ের মতই ভালবাসি। আমি একটা জিনিষ লক্ষ করছি যে, তুমি একটা জায়গায় ফেল করছ। আর তা হচ্ছে তুমি তোমার সন্তানদেরকে মানুষ করতে পারছ না। বিশেষ করে শাসন।  পারবে এত দূর নিয়ে যেতে সবাইকে?

একটা সময় আসবে যখন তুমি আর কখনো ওদের শাসন করতে পারবে না। কারন তখন শাসনের বয়সটাই থাকবে না। আজ তুমি যতোটা আদর করে ওদের অনেক অযাচিত আবদার, অনেক শৃঙ্খলা বহির্ভূত আচরণ, অনেক অগ্রহণযোগ্য ব্যবহার গলাদকরন করছো, কোন এক সময় এই অহেতুক আব্দারের প্রেক্ষাপটে তাদের বর হয়ে উঠা, তাদের বিশৃঙ্খল হয়ে বেড়ে উঠার মাশুল শুধু তুমি না, তোমার এই আদরের সন্তানদেরকেও দিতে হবে। তখন হয়ত এরাই তোমার দিকে আঙুল তুলে এইটা বলবে, কেনো আমাদেরকে যখন শাসন করার দরকার ছিলো, সেতা করো নাই? আজ মনে হচ্ছে তুমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাও না। মনে হচ্ছে তুমি আগামী প্রজন্মের যে ধারা এই পৃথিবীতে আসছে, তুমি সেই ধারনার থেকে অনেক পিছিয়ে আছো।

আমি যেদিন গ্রাম থেকে ঢাকায় আসি, সেদিন দেখেছিলাম, আমাদের গ্রাম এই অল্প দূরের ঢাকা শহর থেকে কত পিছিয়ে ছিলো। আর তার সাথে সাথে আমি দেখেছি, গ্রামের গর্ভে যারা তখনো বসবাস করছে, তারা ঢাকার সভ্যতা থেকে কতই না পিছিয়ে আছে। কথার বলার স্টাইল, একে অপরের সাথে ব্যবহার করার অভ্যাসে, কিংবা স্বপ্ন দেখার বাউন্ডারী পর্যন্ত জানে না ঐ সব গ্রামের মানুষগুলি। আমি গ্রাম থেকে এই শহরে এসে পুরুই একটা বেমানান প্রানীতে পরিনত হয়েছিলাম। কিন্তু আমি চলমান ছিলাম, আমি ব্যতিক্রম কি, কোথায় তার প্রতিকার, কি করা উচিত, সেটা ভাবতে বেশী সময় নিতে চাই নাই। আমি খুব দ্রুত ঢাকার পরিবেশের সাথে, মানুষগুলির সাথে, এই শহরের আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিয়েছিলাম। যতোদিন পারি নাই, সেটা আমার ব্যর্থতা নয়, সেটা আমার এডাপটেশনের জন্য সীমারেখার সীমাবদ্ধতা। তারপরে যখন আমি এই শহর থেকে আরো একধাপ এগিয়ে ক্যাডেট কলেজে গেলাম, তখন দেখেছি, সমাজের উচু স্তরের পরিবারের ছেলেমেয়েরা কিভাবে বেড়ে উঠে। তাদের কথাবার্তা, তাদের চলাফেরা ঢাকা শহরের মানুষগুলির থেকেও আলাদা। তাদের চিন্তা ধারা আলাদা, তাদের সব কিছু আলাদা। ঢাকা শহরে তোমাদের বাসায় এর চর্চা নাই। আর না থাকারও কথা। তোমরা সমাজের উচু স্তরের লোক নও। মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষ। আমি সেই অজ পাড়াগায়ের সাথে এই উচু স্তরের পরিবার গুলির মধ্যে যে পার্থক্য, যে দুরুত্ত, সেটা যথাসম্ভব বুঝবার চেষ্টা করেছি এবং আমাকে আমি ঠিক আমার পরিস্থিতির আওতায় তা মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছি। তারপর যখন আমি ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে সেনাবাহিনীর নতুন জগতে প্রবেশ করলাম, দেখলাম, এখানে আরেক জগত। এর সব ধরনের শাখা বা উইং আছে। গ্রামের অজ পাড়াগায়ের লোকজন ও আছে, মধ্যবিত্ত ঘরের অসচ্ছল সসদ্য ও আছে, আবার একেবারে উচু স্তরের সদস্য রাও আছে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, পাশাপাশি, কাছাকাছি, একই ইউনিফর্ম, একই রেশন, একই কমান্ড, অথচ কেউ কারো সাথে ম্যাচ করে না। কিন্তু সিস্টেম কাজ করে। এই এডাপ টেশন টা একটা জটিল বষয় কিন্তু একেবারেই সহজ আমার জন্য। কারন আমি সব গুলি স্তর ইতিমধ্যে নিজে পার হয়ে অভিজ্ঞ হয়ে এসেছি। তলাহীন গ্রামে বড় হয়ে দেখেছি, এখানে যারা ঐ তলাবিহীন সমাজ থেকে এসেছে তাদের কি মনের অবস্থা, তাদের কি চাহিদা। আবার তোমাদের সাথে আমি মধ্যবিত্ত ঘরের সদস্য হিসাবে এতাও অভিজ্ঞতায় পেয়েছি, এই মধ্যবিত্ত মানুষগুলির মানষিক অবস্থা কি, কি তাদের বৈশিষ্ট। ফলে সেনাভিনীর এই মধ্যবিত্ত সদস্যগুলি কে নিয়েও আমার খাপ খাইতে অসুবিধা হয় নাই। আবার ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুবাদে আমি উচু স্তরের মানুষ গুলির ব্যবহার, আচরণ, প্রত্যাশা, বৈশিষ্ঠও আমার জানা ছিলো। ফলে প্রতিটি স্তরের পরিবেশ, মানুষগুলির চাহিদা কিংবা তাদের সাথে উঠাবসা করার কৌশল আমার অনেকটাই জানা। এই সুবিধা গুলি কিন্তু আমাকে কেউ এমনি এমনি দেয় নাই, আমাকে প্রতিটি জিনিষ আহরন করতে হয়েছে, পাওয়ার জন্য আমাকে  সেই চেষ্টা গুলি করতে হয়েছে। 

আমি যদি সেই অজ পাড়া থেকে উঠে এসে এই স্তরে আসতে সক্ষম হই, তাহলে তুমি বা তোমরা কেনো এক ধাপ এগিয়ে থাকা তোমার সন্তানদেরকে আরেক ধাপা এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছো না? তোমার কাজ তো শুধু ঘরের রান্না বান্নাই না। পেটে সন্তান ধরেছো, তাহলে তাদেরকে আধুনিক সমাজের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য কি তোমার বা তোমাদের কিছুই করার নাই? ওরা পিছিয়ে পড়ছে মুল ধারার সমাজ থেকে। ওরা পিছিয়ে যাচ্ছে অবিরত যেখানে সমাজ, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। কোনো এক সময় তুমি বা বদি ভাই এর মাশুল দিয়ে হয়ত এটাই বলবে, দেশের জন্য অনেক কিছুই তো করলাম, কিন্তু নিজের পরিবারের জন্য কি করলাম? দেশ তোমাকে তোমার ঘরে এসে তোমাকে সেবা প্রদান করবে না। দেশের যাবতীয় কাঠামো গত সুবিধা তোমাকে পেতে হলে তোমার সন্তানদেরকে সেই স্তরে উঠিয়ে দিতে হবে। আর যেটা তুমি আজ করছো না। এটাই হচ্ছে তোমাদের ভুল।

 তোমার সঙ্গে হাবিব ভাইয়ের বউয়ের বিশাল একটা পার্থক্য আছে। তুমি কি সেই পার্থক্যটা বুঝো? তুমি সাগরের মত পানি আর সে দিঘিতে রাখা জল। তোমার সাগর সমান পানি অনেক সময় তৃষ্ণা মিটাবে না কারন সাগরের পানি পান করতে গেলেও তাকে অনেক শোধনাগারে শোধন করতে হয়। কিন্তু হাবীব ভাইয়ের বউ দীঘির জলের মতো পরিষ্কার, সেটা শোধনের জন্য অনেক বেশী পরিশ্রমের দরকার নাই। আমার এই কথাগুলি আজ হয়তো কোনো অর্থ বহন করে না কিন্তু হয়তবা আজ থেকে ৩০ বছর পর যদি আমরা বেচে থাকি, তার একটা পার্থক্য ধরা পড়বেই। আজ তোমার সংসার তোমার হাতে, তোমার রান্না করার পরিকল্পনা তোমার হাতে। আজ তোমার সাধ্যের মধ্যে যা কিছু ইচ্ছে হয় তুমি কোনো নাকোনোভাবে সেটা নিজের তরিকায় পুরুন করার ক্ষমতা তোমার হাতেই। কিন্তু কোনো এক সময় তোমার এই সংসার আর তোমার হাতে নাও থাকতে পারে। তখন এর চাবিকাঠি হয়ত অন্য কারো হাতে চলে যাবে। এখন তুমি শক্ত সামর্থবান, কিন্তু যখন তুমি শারীরিকভাবেও দূর্বল হয়ে পড়বে, সংসারের চাবিকাঠি আর তোমার হাতেথাকবে না, তখন মনে হবে, এই সংসার জীবনে কি আমি কিছুই করি নাই? নিজেকে তখন খুব অসহায় মনে হবে। আজ তোমার স্বামী তোমার রাজা। তার উপর তোমার অধিকার শুধু স্বামীহিসাবেই নয়, সে তোমার ধারন করে। কিন্তু কোনো এক সময়, যখন হয়ত সে আর থাকবে না, তখন তুমি অনেকের কাছেই একটা এক্সট্রা মালামালের মতো বোঝা হয়ে পড়বে। আমি আমার মাকে দেখেছি সে কতটা অসহায়। আমি আমার ভাইকে দেখেছি, পট পরিবর্তনে কতটা সময় লাগে। আজকের এই দিনটা আগামীকাল নাও একই থাকতে পারে। 

তুমি ভাল থেক।

০৫/০৯/১৯৮৩-হাবীব ভাইয়ের বিয়ে

ডঃ মোহামেদ হাবীবুল্লাহ আমার বড় ভাই। ওনাকে আমার বড় ভাই বললে ওনার উপর সঠিক মুল্যায়ন হবে না। উনি একাধারে আমার বড় ভাই, পিতার সমতুল্য এবং আমার সকল কিছুর গার্জিয়ান। শুধু আমার নয়, আমাদের পুরু পরিবারের সবার গার্জিয়ান। আমি আমার সমগ্র ধ্যান ধারনা আরোপ করেও কখনো আমার বাবা কেমন ছিলেন, তার কোনো অবয়ব আমি আমার কল্পনায় আনতেও পারি নাই। কারন আমি আমার বাবাকে কখনোই দেখি নাই। আমার বয়স যখন সম্ভবত দুই কিংবা আড়াই, তখন তিনি মারা যান। ফলে ওই বয়সের একটা বাচ্চার কাছে কোনো মুরুব্বী মানুষের চেহারা কেমন ছিলো, কে আমার কি হতো এসব তো মাথায় যেমন থাকার কথা না, তেমনি আমার মাথায়ও নাই। যাই হোক, সে প্রসংগ এখন না টানি।

আমি সবেমাত্র ইন্টার পাশ করে গ্রামে এসেছি। পড়তাম ক্যাডেট কলেজে। সেই ১৯৭৭ সালের ১৯ শে জুন থেকে ১৯৮৩ সাল নাগাদ এক নাগাড়ে ক্যাডেট কলেজে পরাশুনা করে ইন্টার পাশ দিয়ে সবেমাত্র গ্রামে এসেছি। হাবীব ভাই থাকেন আমেরিকা। তিনিও ১৯৭৮ সালে আমেরিকায় গিয়েছিলেন পড়াশুনা করতে, অতপর পরাশুনা শেষে তিনি সেখানেই থেকে গেলেন। প্রায় ৬ বছর পার হয়ে গেছে ভাইয়ার আমেরিকার জীবন। তিনিও দেশে এসেছেন। এই লম্বা সময়ে হাবীব ভাই আর কখনো দেশে আসেন নাই। এবার দেশে এসেছেন প্রধানত বিয়ের উপলক্ষে। হাবীব ভাইয়ের অবর্তমানে আরো একজন মানুষ আছেন যিনি একাধারে হাবীব ভাইয়ের মতোই আমাদের গার্জিয়ান আবার হাবীব ভাইয়ের ও একাধারে  উপদেষতা কাম বন্ধু কাম ভাই কাম গার্জিয়ান বলা চলে। উনার নাম বদ্রুদ্দিন তালুকদার। এই দুজন মানুষকে আমাদের বাড়ির প্রতিটি সদস্য শুধু ভয়ই পায় না, বরং তাদের সামনে কোনো প্রকারের ব্যক্তি স্বাধীনতা আমাদের কারোরই চ্ছিলো না। তারা যদি কোন এক সোমবার কে বলেন আজ রবিবার, তাহলে সেটা রবিবারই।

আমার পাচ বোন, আর আমরা দুই ভাই। এর মধ্যে আমাদের সবার বড় বোন যার নাম সাফিয়া খাতুন, সে ১৯৭৯ সালেই সন্তানহীন অবস্থায় মারা গিয়েছেন। ফলে এখন বর্তমানে দেশে আছি আমরা চার বোন আর আমি, এবার হাবীব ভাই দেশে আসাতে সবাই এক সাথেই গ্রামে রয়েছি। বোনদের সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। যে যার যার যোগ্যতায় যেমনই হোক সংসার পেয়েছে এবং বাংলাদেশের আরো হাজার হাজার পরিবার যেমন থাকে তারাও অভাব কিংবা প্রাচূর্য নিয়া ভালই আছে। বোনদের সবারই বাচ্চা কাচ্চা আছে। আমাদের ভগ্নিপতিরাও এই দুই জন মানুষকে (হাবীব ভাই এবং বদি ভাই) আমাদের মতোই যেমন মুরুব্বি মানেন তেমনি তাদের ও কোনো সাহস নাই যে, মুক্ত বাক স্বাধীনতার। অনেকতা সমীহ করেই সবাই চলেন। আর এতার আরেকটা কারন ছিলো যে, তারা দুজনে শিক্ষিত এবং সময়ে অসময়ে অনেক কাজেই লাগে, হোক সেতা কনো অর্থক্রী সাহাজ্য কিংবা অন্য কোনো বিশয়ে।

আমি ক্যাডেট কলেজে পরার কারনেই হোক আর আমার চরিত্রের বইশিষথের কারনেই হোক, আমি ছোট বেলা থেকেই একটু এক রোখা ছিলাম। যতোটা মুক্ত বাক থাকার দরকার কনো কোনো ক্ষেত্রে আমি তার থেকেও হয়তো বেশী সোচ্চার ছিলাম। হয়তো এটা ইমোশনাল কারনেই হোক আর যুক্তির ধারেই হোক। আমি অন্যান্য বোনদের মতো কিংবা তাদের পতীদের মতো অতোটা নীরব ছিলাম না।

হাবীব ভাইয়ের বিয়ে কোথায় হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, কে সেই মেয়ে যাকে তিনি বিয়ে করবেন তাদের কোথায় বাড়ি কি তাদের স্ট্যাটাস কিংবা কিভাবে কি হচ্ছে এ ব্যাপারে আমরা পরিবারের কোনো সদস্যই কনো কিছু জানতাম না। আর জানলেও এতা কোনো পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধন কিংবা আমাদের কনো মতামতের কোনো দাম বা মুল্যায়নের কোনো বালাই ছিলো না। এখানে হয়তো বদি ভাইয়ের একটা মতামত থাকলেও থাকতে পারে সেতা আমরা কেউ জানিও না। শুধু জানলাম, হাবীব ভাই বিয়ে করবেন, তারিখ ঠিক হয়েছে ৭ আগষ্ট ১৯৮৩।

ঢাকায় আমাদের কোনো বাড়ি নাই। বদি ভাইয়ের একটা স্থায়ী ঠিকানা আছে মীরপুর (৩৮ গোলারটেক) কিন্তু সেতাও একতা টিনের ঘর। মাত্র দুটু রুম, সেতাও আবার মাঝখানে একতা পার্টিশান দিয়ে কোনো রকমে থাকা। নতুন বউ নিয়ে উঠার মতো পরিবেশ নয়।

হাবীব ভাই এবার যখন দেশে এলেন, তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটির টি এস সি ৫ নাম্বার রুমটা আগে থেকেই সম্ভবত বুক করে এসেছিলেন। ফলে হাবীব ভাই বদি ভাইয়ের বাসায় থাকার পরিবর্তে টি এস সি র ৫ নাম্বার রুমেই থাকাটা বেশ সাচ্ছন্ধ বোধ করছিলেন। আমি প্রায় প্রতিদিন টি এস সি তে যাই, ভাইয়ার সাথে দেখা করি। অনেকের সাথেই আমার পরিচয় হয়। তারা অনেক অনেক উচু স্তরের লোক। প্রায় সবাই ইউনিভার্সিটির গনমান্য ব্যক্তিবর্গ। একদিন হাবীব ভাই আমাকে নিয়ে ইব্রাহীম মেমোরিয়াল হাসপাতালে গেলেন। সেখানে ডাঃ মাহবুব সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ইব্রাহীম মেমোরিয়ালের প্রতিষ্ঠাতা সম্ভবত নীলিমা ইব্রাহীম এর সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলেন। শুনলাম যে, ভাইয়ার বিয়ের মূটামূটি যা যা ব্যবস্থা করছেন, এই সেই মাহবুব সাহেব এবং নীলিমা ইব্রাহীম।

আমরা হাবীব ভাইয়ের ভবিতব্য বা হবু স্ত্রীকে বিয়ের আগে দেখি নাই, আর এতা যে আমাদের দেখার দরকার আছে সেটার কোনো প্রয়োজন ও ছিলো না। কারন আমাদের দেখায় পছন্দ অপছন্দের কোনো কিছুই নাই। আমরা আছি, আমরা এভাবেই আছি।

গত ৭ আগষ্টে হাবীব ভাইয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। এই বিয়েতার ব্যাপারে যদিও আমার অতো নাক গলানো বা আমার কোনো মতামত, কোনো ভুমিকার কোন কিছুই যায় আসে না, এমন কি আমার মায়ের ও কোনো মতামতের কোনো বিশয় ছিলো না,। শুধু তাই নয়, আমাদের বোনদের পতীদের সাথেও কোনো শলা পরমর্শ করা কোনো বিশয় ছিলো না। ফলে আমরা নতুন ভাবীর পরিবারের কাছে কিভাবে উত্থাপিত হয়েছি, আদৌ কোনো আত্তীয় ভাবে উত্থাপিত হয়েছি কিনা সেটাও আমাদের বোধগম্য ছিলো না। তারা আমাদের কোন এংগেল থেকে কি রকম আত্তিয়তার সুত্রে বিবেচনা করেছে সেতাও আমাদের কোনো ধারনা ছিলো না। তবে ধীরে ধীরে আমার কাছে একতা জিনিষ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিলো যে, বদি ভাই কোনো না কোনো কারনে হাবীব ভাইয়ের এই বিয়ের উপলক্ষে খুশি ছিলেন না। কেনো ছিলেন না, সেতা যদিও আমার পক্ষে কিছুতেই গোয়েন্দাগিরি করে বের করা সম্ভব ছিলো না কিন্তু বদি ভাই যেহেতু অখুশি ছিলেন, ফলে কিছু কিছু মনের কষ্টের কথা তিনি আমার সাথে এ সময়ে শেয়ার করতেন।

যেদিন হাবীব ভাইয়ের বিয়ের অনুশ্তহান হলো ঢাকার প্রেস ক্লাবে, সেদিন বিয়ের ঠিক পরেই ভাইয়া নতুন বউ নিয়ে বাসর করলেন আজীম পুর কলোনীতে ভাইয়ের আরেক বন্ধু আনোয়ার ভাইয়ের বাসায়। সে বাসাটা আমার আগের থেকেই পরিচিত ছিলো কারন আমি যখন প্রথম ঢাকায় আসি এবং ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে ভর্তি হই, তখন এই বাসায় আমি বেশ কিছুদিন থেকেছিলাম। সেখানে জুয়েনা আপা ছিল (আনোয়ার ভাইয়ের ছোত বোন), নিউটন ছিলো (নিউটন আমার সাথে ওয়েস্ট এড হাই স্কুলেই পড়তো), শরীফ নামে আরেকটা ভাই ছিলো নিউটনের। আমাদের সাথেই পড়তো তবে ওয়েস্ট এন্ড স্কুলে না, অন্য স্কুলে। আনোয়ার ভাই হাবীব ভাইয়ের খুব ভালো বন্ধু ছিলো, আর উনি কাজ করতেন ওয়াপদায়, বদি ভাইও ওয়াপদায় কাজ করতেন।

প্রেস ক্লাব থেকে যখন সরাসরি নতুন বউ নিয়ে হাবীব ভাই আনোয়ার ভাইদের বাসায় উটজলেন, তারপর আমি আর বদি ভাই স রাতে চলে আসি টি এস স্যার সেই ৫ নাম্বার রুমে রাত থাকার জন্য, যেহেতু তখন রুমটা খালি ছিলো। সেই রাতে বদি ভাই আমাকে বেশ কিছু জিনিষ শেয়ার করলেন।

তিনি আমাকে বললেন, আখতার, আমার কাছে মনে হয়, এই বিয়েটা ঠিক হয় নাই। আর আমার ও একেবারে শতভাগ মতামত ছিলো না। কিন্তু হাবীব আমার মতের কোনো মুল্যায়ন ই করলো না। কষ্ট লাগছে।

এ ব্যাপারে যেহেতু আমার কোনো জ্ঞান ছিলো না কি খারাপ আর কি ভালো হয়েছে , ফলে আমার আসলে কোনো গুরু গম্ভীর মতামত ও ছিলো না। কিছুক্ষন পর আমি এম্নিতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। পরেরদিন একটা জিনিষ খেয়াল করলাম যে, বদি ভাই পুনরায় আজিম্পুর হাবীব ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছা প্রকাশ করলেন না। তিনি সরাসরি আমাকে নিয়ে চলে এলেন মীরপুর তার নিজের বাসায়।

এদিকে মা এবং আমার অন্যান্য বোনেরা সেদিনের রাততায় মীরপুরে কাটিয়ে পরদিন সবাই গ্রামে ফিরে ফিরে গিয়েছিলো।

ভাইয়ার শসুর চাকুরী করতেন বুয়েটে। তিনি ছিলেন বুয়েটের প্রোফেসর জনাব আলী আশরাফ। নামকরা লোক। সবাই উনাকে চিনে। তিনি থাকতেন বুয়েট কলোনীতে। কয়েকদন পর ভাইয়া আনোয়ার ভাইয়ের বাসা থেকে সিফট করে উঠে গেলেন বুয়েট কলোনীতে শসুরালয়ে। ভাইয়ার শ্যালক আছে দুজন (একজনের নাম বাবু, আরেক জনের নাম ফার্মি)। ফার্মি আমার জুনিয়র। উনার শ্যালিকা আছেন লুনা আপা। ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্রী। আমি প্রায় প্রতিদিন অই ভাইয়ার শ্বশুর বাড়িতে যেতাম হয় সকাল অথবা বিকালে। এই যাওয়া আসার মধ্যে আমি কন আত্তিয়তার ভালো বন্ধন কখনো দেখি নাই। আমি যে ভাবীর একতা দেবর, এই ভাবতা আমার মধ্যে কখনো তৈরী হয় নাই। মনে হয়েছে যে, আমি ভাইয়ার কাছে যেমন সর্বদা মাথা নীচু করে ছত হয়ে থাকতে হয়, ভয়ে কাচুমাচু হয়ে থাকতে হয়, ভাবীর কাছে আমি ব্যাপারতা এই রকমেরই একটা আচরন দেখতে পাই। শুধু সেতাই নয়, ওই বাড়ির অন্যান্য লোকগুলির মধ্যেও আমরা যেনো একতা সাব স্ট্যান্দার্ড তাইপের কেউ সেতা তাদের চোখে র দিকে তাকালে বুঝা যেতো। ওদের বাড়ির চাকর বাকরেরাও আমাদেরকে মনে হয় সে রকম ভাবেই কাউন্ট করতো। যখন যেতাম, যেনো বহিরাগত কেউ দেখা করতে এসেছে এমন একটা ভাব। হয়তো ড্রইং রুমে বসে আছি তো আছিই। কেউ এক গ্লাস পানি কিংবা চা দিয়ে যে আপ্যায়ন করবে তার কোনো বালাই নাই। নিজের কাছে অসস্থি বোধ করতাম কিন্তু উপায় নাই, মাওতেই হবে। আমরা হাবীব ভাইয়ের উপর নির্ভরশীল। এতা ওরা জানে। আর হাবীব ভাই আমাদের থেকে বেশী এখন ওদের। ওদের দরকার ছিলো হাবীব ভাইকে, আমাদেরকে নয়। ফলে আমাদেরকে আপ্যায়ন করলেই কি, আর না করলেই কি। বুঝতাম ব্যাপারতা। কিন্তু কিছুই করার ছিলো না। হাবীব ভাইও যেনো অই পরিবারে বিয়ে করে একতা জাতে উঠে গিয়েছিলো এমন একটা ভাব তার মধ্যেও ছিলো। ফলে, আমরা ওখানে গেলে হাবীব ভাই নিজেও খুব একতা সস্থি বোধ করতেন না। বরং আমাদের পরিবারের কেউ না গেলেই উনি খুশী। এমনি একতা ফিলিংস আমার মধ্যে মনে হয়েছিলো। যাই হোক, হাবীব ভাইয়ার বিয়ের কয়েকদিন পরে ভাইয়াও আবার নতুন বউ ঢাকায় রেখে আমেরিকায় চলে গেলেন। শুনলাম, ভাইয়া আমেরিকায় গিয়েই দুই এক মাসের মধ্যে ভাইয়া ভাবীকে আমেরিকায় নিয়ে যাবেন।

হাবীব ভাই আমেরিকায় চলে যাবার পর ভাবী একদম একা হয়ে গেলেন। ভাইয়া অনেকবার চেষ্টা করেও ভাবীকে নিতে পারছিলেন না। এর মধ্যে দু দুবার আমেরিকার দুতাবাস থেকে ভাবীর ভিসা রিজেক্ট হয়েছে, আরেকবার রিজেক্ট হলে উনার আমেরিকায় যাওয়াই অনিসচিত হয়ে যাবে। আমি ভাবিকে সময় দেই। ভাবী যেখানে যেতে চান, রিক্সায় করে নিয়ে যাই। ফকির দরবেশ, ওঝা যতো কিছু আছে, আমেরিকার ভিসা পাওয়ার জন্য যেখানে যেখানে যাওয়া লাগে, মানত করা লাগে ভাবী রেগুলার করে যাচ্ছেন, আর আমি ওনাকে সংগ দিচ্ছি।

এরই মধ্যে আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা, মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষা, বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার সবগুলি দিয়ে দিলাম। এখানে আরো একতা কথা বলে রাখা দরকার যে, আমি ক্যাডেট কলেজের ছাত্র বিধায় আমি ইন্টার পাশের পর পরই হাবীব ভাইয়ার ঠিক বিয়ের আগে আর্মিতে কমিশন পদে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করার পরেও যেতে পারি নাই কারন হাবীব ভাই চান নাই যে, আমি আর্মিতে যাই। আমি ১২ লং কোর্ষের সাথে আর্মিতে কমিশন পরীক্ষায় টিকে গেলেঈ ২৭ জুলাই ১৯৮৩ সালে আমার বি এম এ তে যাইয়ার তারিখ ছিলো। কিন্তু হাবীব ভাই আমাকে কিছুতেই আর্মিতে যায়ার অনুমতি দেন নাই। ফলে আমি ১২লং কোর্ষের সাথে আর বি এম এ তে জ্যেন করতে পারি নাই।  

এদিকে যখন ভাবীর ভিসা একের পর এক রিজেক্ট হচ্ছিলো, তখন উপায়ন্তর না দেখে হাবীব ভাই আবারো নভেম্বরের প্ররথম সপ্তাহে ঢাকায় চলে আসেন। এবার তিনি ভাবীকে সাথে করে নিয়ে যাবেন এই পরিকল্পনায় ঢাকায় আসেন। হাবীব ভাই কাউকেই আগাম কোনো খবর দিয়ে এবার ঢাকায় আসেন নাই। ফলে হাবীব ভাই ঢাকায় আসার পর আমি প্রথম ভাবীর কাছে জানতে পারলাম ভাইয়া ঢাকায় এসেছেন। আমি খবরটা বদি ভাইকে মীরপুরে গিয়ে দিয়ে এলাম।

সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার হলো, এই যে বিয়ের পর থেকে এবার হাবীব ভাইয়ের ঢাকায় আসার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত হাবীব ভাইয়ের বউ এক বারের জন্যেও কোনোদিন বদি ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ ও করেন নাই, ওখানে ওনার বাসায় যাওয়ার জন্যে কখনো আমাকেও বলে নাই। এর ফলে এম্নিতেই বদি ভাইয়ার একটু রাগ কিংবা গোস্যা ছিলো তাদের উপর, ভাবীর এরুপ আচরনে বদি ভাই আরো মর্মাহত হলেন। তার উপর আবার হাবিব ভাই কোনো আগাম খবর না দিয়ে যখন ঢাকায় এলেন, তখন ব্যাপারতা প্রকাশ্যেই একটা বিরোধের সৃষ্টি হলো।

আমার ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রায় সব গুলির আউট হয়ে গিয়েছিলো, আমি বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেলাম, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স ডিপার্ট্মেন্টে চান্স পেলাম, কিন্তু বুয়েটে আমার কাংগখিত ফলাফল এলো না। যেদিন হাবীব ভাই ঢাকায় এলেন, আমার ফলাফলে উনি মারাত্তক রেগে গেলেন যখন আমি তার শ্বশুর বাড়িতে গেলাম। অনেকতা খুব রাগারাগি তো করলেনই এবং কিছুটা অপমানিত ও করলেন। মেডিক্যাল উনি পছন্দ করেন না, ফলে মেডিক্যালে পাশ করে কনো লাভ হলো না। ইউনিভার্সিটিতে ইউনিট আমাকে পরাতে চান না, কিন্তু আমেরিকায় নিয়ে যেতে চান, তাই ক্লার্কভাইল ইউনিভার্সিটিতে ভরতির আয়োজন করা যাবে বলে জানালেন।

আমি খুবই অপম্নিত বোধ করলাম, কারন আমি কিন্তু তখন ছোট একটা শিশু নই। আমার এই অপদস্তের ব্যাপারটায় যেনো বাবু ভাই, ফার্মি, লুনা আপা, মজাই পেলেন সেতাই আমার কাছে মনে হলো। আমি দুপুরে কিছু না খেয়েই চলে এসেছিলাম। অনেকটাআ রাগ করেই।

দিন যায়, সপ্তাহ যায়, প্রায় ১৯ দিন পার হয়। ভাইয়া না গেলো মার সাথে গ্রামে দেখা করতে, না গেল বদি ভাইয়ের বাসায় দেখা করতে। এক নাগাড়ে ১৯ দিন তিনি ভাবিদের বুয়েট কলোনীতে থাকলেন। এদিকে মা অপেক্ষা করছেন কবে তার বড় ছেলে গ্রামে যাবে, আর তিনি দেখবেন। মার রাগ হয়েছিলো কিনা আমি জানি না তবে মা কষ্ট পেয়েছিলেন এটা আমি জানি। মা তো মাই।

আমি তখন অস্থায়িভাবে ঢাকা শহীদুল্লাহ হলের দাইনিং কোয়ার্তারে আগে যেখানে হাবীব ভাই থাকতেন, সেখানে মাসুদ নামে আমার এক আত্তীয় থাকতো, তার রুমেই থাকি আর মাঝে মাঝে হাবীব ভাইয়ার শসুর বাড়ি অইখান থেকেই যাই। ২০ তম দিনে মা আর আমার বোনের প্তীরা বেশ কিছু ফল মুল, নারিকেল নিয়ে ঢাকায় এলেন হাবীব ভাইকে দেখার জন্য। কারন মায়ের আর দেরী করা সম্ভব হচ্ছিলো না। তারা গ্রাম থেকে প্রথমে আমার ওইখানে শহীদুল্লাহ হ্লে এলেন। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করলেন। বিকাল ৫ তার দিকে মাকে নিয়ে আমার দুলাভাইয়েরা হাবীব ভাইয়ের শ্বশুর বাসায় বুয়েট কলোনীতে গেলেন। কোনো কারনে আমার তাদের সাথে যাওয়া সম্ভব হয় নাই। ফলে আমার বোনের হাসবেন্ডরা মাকে নিয়ে হাবীব ভাইকে দেখতে গেলেন।