কেরানীগঞ্জ মাইগ্রেশন-ষ্টাইল-৪

Categories

আমার বাবা যখন শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, আমাদেরকে যে কোনো ভাবেই হোক, যতো দ্রুত আদি নিবাস মুনশিগঞ্জ, সিরাজদিখানের কয়রাখোলা থেকে কেরানিগঞ্জে স্থান্তান্তর করতেই হবে। আমার খালুর সাথে আমার বাবা অতি গোপনে বিস্তারীত ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই স্থানান্তরের সবচেয়ে কঠিন বিষয়টা হচ্ছে গোপনীয়তা রক্ষা এবং কাজটা করতে হবে কেউ বুঝে উঠার আগেই। যদি ১ম পক্ষের কেউ বিন্দুমাত্র আভাষ পায়, তাহলে তাজির আলী, কিংবা অন্যান্যরা কিছুতেই আমাদেরকে কেরানিগঞ্জে আস্তে দিবে না, বাধা দিবে এবং এটা একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির স্রিষ্টি করবে যা ভাবাই যায় না।

আমার খালু ছিলেন কেরানিগঞ্জের বাক্তার চর এলাকার অনেক প্রতাপশালি একজন ধনাঢ্য মাদবর। আমার খালু (গনি মাদবর) এবং আমার বাবা হোসেন আলী মাদবর দুজনে একটা ব্যাপারে একমত হলেন যে, যেদিন তাজির আলী কয়রাখোলার বাইরে থাকবে, হোক সেটা কোনো এক রাতের জন্য বা দুই রাত, সেই সময়ে পুরু বাড়িটা না ভেংগে কয়েক শত লোক নিয়ে এক রাতের মধ্যে বাড়িটা কেরানীগঞ্জে শিফট করা। এদিকে খালু তার নিজের একটা জমিতে আমাদের কয়রাখোলার বাড়ির অবিকল মাপে মাপে সব কিছু খুড়ে রাখবেন যাতে এক রাতের মধ্যেই পুরু বারিটা স্থাপন করা সম্ভব হয়। কিন্তু সমস্যা হলো কয়রাখোলা থেকে বাক্তার চরে আসার মাঝপথে একটা নদী আছে। সেই নদী এতো বড় আস্ত একটা বাড়ি কিভাবে পার করা সম্ভব? এটার ও একটা বিহীত হলো। পরিকল্পনা হলো যে, খালু ২/৩ শত কলা গাছ দিয়ে নদীর উপর ভেলা বানিয়ে রাখবেন যাতে ঘর সমেত লোকজন পার হতে পারে।

এবার শুধু অপেক্ষার পালা, কবে তাজির আলী অন্য কোথাও বেরাতে যায়। ব্যাপারটা বেশীদিন সময় নিলো না। সমস্ত লোকজন ঠিক করা ছিলো, ভেলার জন্য কলা গাছ ও রেডি করা ছিলো, শুধুমাত্র আদেশের অপেক্ষা। তাজির আলী তার শশুড় বাড়িতে তিন চারদিনের জন্য বেড়াতে যাওয়ার আওয়াজ শুনা গেলো। এদিকে বাবা এবং খালু সেই সময়তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

ঠিক যেদিন তাজির আলি তার শশুড় বাড়ি চলে গেলো, ওই দিন রাতেই একদিকে আমার বাবা তার দলবল নিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি তুলে ফেলার ব্যবস্থা করলেন, খালূ নদীর উপর ভেলা সাজিয়ে ফেললেন, আর এদিকে আমার ভাই বাক্তার চরে পুরু বাড়িটা প্রতিস্থাপনের জন্যে দায়িত্তে থাকলেন।

মাত্র একটি রাত।

আর এই রাতের গহীন অন্ধকারেই আমার বাবা তার চার শতাধিক কর্মীবাহিনীকে নিয়ে, আমার খালু আরো দুই শতাধিক কর্মীবাহিনী নিয়ে আর অন্য দিকে আমার ভাই আরো প্রায় গোটা বিশেক পচিশেক লোক নিয়ে পুরু বাড়িটা ভোর হবার আগেই বাক্তার চরে সেট করে ফেললেন। গ্রামের মানুষ যখন ঘুম থেকে উঠলেন, তখন তারা একটা জিনিষ দেখলেন যে, কয়রাখোলায় আর বাড়ি নাই, অথচ বাক্তার চরে নতুন একটা বাড়ি দাঁড়িয়ে ছিলো। এটা কোনো আলাদিনের দৈত্যের কাহিনীকেও হার মানিয়েছে।

আমরা নতুন ঠিকানায় চলে এলাম। অন্যদিকে যখন তাজির আলীরা এই সংবাদ পেলো, তারা অনেক হৈচৈ লরেছে বটে কিন্তু ততোক্ষনে সব কিছু ওদের হাতের বাইরে চলে গেছে। এই নতুন ঠিকানায় এসে সবচেয়ে বড় কষ্টে ছিলেন আমার বাবা। তার সাম্রাজ্য ছেড়ে এখন তিনি নতুন এলাকায় কোনো কিছুই না। ভাগ্যের কি পরিহাস। গতকালের রাজা আজ অন্য কোথাও আরেকজনের প্রজা।

এখানে আমার (মেজর আখতার) একটা কমেন্ট করার খুব ইচ্ছে হলোঃ

শুধুমাত্র একটা বাড়ি তুলে আনাই কি মাইগ্রেশন? আর বাড়িতা তুলে না এনে কেনো আমার বাবা তার অর্থ খরচ করে বাক্তার চরে আরেকটা বাড়ি করলেন না? একটা নতুন বাড়ি করার পরেই তো তিনি আমাদের সবাইকে বাক্তার চরে মাইগ্রেট করাইতে পারতেন। এই জায়গাটায় আমার সাথে আমার বাবার বা খালুর বুদ্ধির সাথে এক হলো না। নিশ্চয়ই এর ভিতরে আরো কোনো মাহাত্য ছিলো যা এই মুহুর্তে আমার জানা নাই।

সাময়ীক তিরোধ্যান-ষ্টাইল-৩

Categories

আমার বাবা যদিও অত্র কয়রাখোলা এলাকার খুবই নামীদামী এবং প্রতাপ শালী একজন মাদবর ছিলেন কিন্তু তিনি তার ঘরের মধ্যে একটা বিষয় নিয়ে খুবই অসফল লোক ছিলেন। আর সেটা হলো তারই নিজের ১ম পক্ষের ছেলে মোঃ তাজির আলীকে নিয়ন্ত্রণ করা। তাজির আলী ছিলেন আমাদের স্টেপ ব্রাদারদের মধ্যে ২য় ভাই। প্রথম জনের নাম ছিলো নজর আলী, ২য় জনের নাম এই তাজির আলী এবং ৩য় ভাইয়ের নাম ছিলো মোহসীন আলী। তাজির আলী ভাইয়ের সবচেয়ে বেশী রাগ ছিলো আমার মায়ের উপর। কারন তিনি আমার মাকে কোনোভাবেই তার ২য় মা হিসাবে মেনেই নেন নাই। তার মধ্যে আমাদের এই পক্ষে আরো গোটা ৫ বোন আর ২ ভাই ইতিমধ্যে জন্ম গ্রহন করে ফেলেছি। আমার বাবার ছিলো অঢেল জমিজমা। আর বিশাল বাড়ি। তাজির আলী যখন বিয়ে করে, তখন থেকেই সে অতিমাত্রায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলো। এর কারন হলো তাজির আলীর শশুড় বারীও ছিলো একটা খারাপ বংশের মানুষ। তারা মানুষের কাছে ডাকাতের সমপর্যায়ের শ্রেনী হিসাবেই গন্য হতো। এমতাবস্থায় শশুড় বাড়ির আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে তাজির আলী এতোটাই উছ্রিখল হয়ে উঠেছিলো যে, এক সময়ে সে এটাই ভেবে নিলো যে, ২য় পক্ষের আমাদের সবাইকেই সে হত্যা করবে। যদি দরকার হয়, সে তার বাবা অর্থাৎ আমার বাবাকেও হত্যা করে সমস্ত সম্পত্তি তাদের নামে লিখে নেয়া। আমরা তখন খুবই ছোট ছোট। শুধুমাত্র আমার বড় ভাই ডঃ হাবীবুল্লাহ সবেমাত্র ইন্টার পাশ করছেন। হাবীব ভাইয়ের এই ইন্টার পাশ করাও যেনো তার অনেক হিংসা এবং রাগ। বাবা ব্যাপারটা কিছুতেই সামাল দিতে পারছিলেন না। আমার বাবা ছিলেন আসলেই খুব জ্ঞানী মানুষ। তিনি জানতেন, তাজির আলী যতোই হামকি ধামকি দিক, বাবার জিবদ্দশায় যে তাজির আলী কিছুই করতে পারবেন না সেটা তিনি নিসচিত। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর তাজির আলীর কিংবা আমাদের অন্যান্য স্টেপ ব্রাদারদের কার কি ভুমিকা হবে এটা নিয়ে তার অনেক শংকা ছিলো। তাই তিনি দেখতে চাইলেন, তার অনুপস্থিতিতে কার কি ভুমিকা হয়। এতা তার একটা টেষ্ট করা দরকার।

বিশয়টা নিয়ে বাবা আমার ভাই হাবীবুল্লাহ্র সাথে বিস্তারীত আলাপ করলেন। আমার ভাইয়ের সাথে আমার বাবার ছিলো খুবই বন্ধুত্তের সম্পর্ক। ফলে, তারা দুজন মিলে একটা বুদ্ধি করলেন। বুদ্ধিটা এরকমের যে, হতাত বাবা উধাও হয়ে যাবেন। তখনকার দিনে তো আর মোবাইল ছিলো না, আবার ল্যান্ড লাইনের ফোন ও ছিলো প্রায় দুষ্কর, তাই বাবা যদি হটাত করে কোথাও কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যান, তাহলে সবাই ধরে নিবে যে, বাবা হয়তো কোথাও গিয়ে দূর্ঘটনায় মারা গেছেন। এই সময়টায় কাদের কি কি ভুমিকা হয় সেটার আপডেট বাবা ভাইয়ার কাছ থেকে নিবেন। ব্যাপারটা জানবে শুধুমাত্র আমার ভাই আর বাবা। এমনকি আমার মাও জানবেন না। খুবই একটা গোপন বিষয়। আমার ভাই তখন সবেমাত্র ইন্তার পাশ করে জগন্নাথে ভর্তি হয়েছেন। বাবা ঢাকাতেই থাকবেন, কিন্তু কারো কাছেই প্রকাশ্যে আসবেন না। আমার ভাই মাঝে মাঝে গ্রামে গিয়ে ব্যাপারতা কে কিভাবে নিচ্ছে সেটা অব্জার্ভ করবেন এবং বাবাকে ফিডব্যাক দিবেন।

প্ল্যান মোতাবেক, বাবা একদিন সুদুর চট্টগ্রামে যাবেন বিধায় সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গ্রাম ছাড়লেন। কিন্তু আর তিনি ফিরে এলেন না। একদিন যায়, বাবা আসেন না, দুইদিন যায় বাবা আসেন না। এভাবে সবাই খুব দুসচিন্তা করতে লাগলো। বাবাকে খোজা শুরু হলো। কোথাও বাবাকে পাওয়া গেলো না। আসলে যিনি লোক চক্ষের আড়ালে পালিয়ে থাকতে চান, তাকে যেভাবেই খোজা হোক, তাকে তো প্রকাশ্যে পাওয়া যাবেই না। কিন্তু বাবা আছেন, সুস্থই আছেন। আর এ খবরটা জানেন শুধু আমার ভাই। তারা প্রতিদিন শ্যাম বাজার শরীর চর্চার ঘাটে দেখা করেন। ভাইয়া বাবাকে তার তরোধানের পর গ্রামের খবরাখবর দেন। বাবা সেই খবরের উপর ভিত্তি করে তিনি তার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আটেন।

দিনের পর দিন দিন যখন বাবা আর গ্রামে ফিরে এলেন না, মা খুবই চিন্তায় পড়ে গেলেন। আমার অন্যান্য ভাওবোনেরাও চিন্তা করতে লাগলেন। গ্রামের গনমান্য ব্যক্তিরাও কোনো কিছু আছ করতে না পেরে প্রায় মাস তিন চার পর ধরে নিলেন যে, বাবা হয়তো কোথাও দূর্ঘটনায় মারা গেছেন। খবরতা এবার বেশ পাকাপোক্ত হয়ে গেলো। আর অরিজিনাল প্ল্যানের কার্যক্রমটা যেনো এখান থেকেই শুরু।

তাজির আলি ভাইয়ের দাপটের চোটে, তার সাথে আমার অন্যান্য স্টেপ ব্রাদার এবং বোনদের দাপট এতোটাই চরমে উঠলো যে, আমাদের ২য় পক্ষের সব ভাই বোনেরা এখন জীবন নিয়ে শংকিত। বাবা প্রতিদিন তার বাড়ির খবর পেতে থাকলেন এবং মনিটর করতে লাগলেন যেনো ব্যাপারটা কোনো অবস্থাতেই অনেক খারাপের দিকে না টার্ন নেয়।

তারপর......

তারপর একদিন বাবা সব বুঝে যাওয়ার পর ভাবলেন, ওনার যা বুঝার তিনি বুঝে গেছেন যে, তার মৃত্যুর পর আমাদের ২য় পক্ষের ভাইবোনদের কি অবস্থা হবে। তিনি হটাত করে গ্রামে এসে হাজির হলেন। সবাই তো অবাক। কোথায় ছিলো এতোদিন এই হোসেন আলী মাদবর? বাবা কাউকেই কিছু বললেন না, শুধু বললেন যে, সুদুর চট্টগ্রামে গিয়ে তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। যেহেতু কারো মাধ্যমেই খবর দেয়া সম্ভব হয় নাই, তাই আর বলা হয় নাই। কিন্তু তিনি মনে মনে জানেন কি হয়েছে আর এখন তাকে কি করতে হবে।

বাবা ভাবলেন, আমাদেরকে আর মুনশীগঞ্জে রাখাই যাবে না। আমাদেরকে মাইগ্রেট করে অন্যত্র নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে যে কোনো সময়ে বড় ধরনের অঘটন ঘটে যাবে। বাবা আমার খালু গনি মাদবরের সাথে ব্যাপারটা বিস্তারীত আলাপ করলেন। আমার খালু গনি মিয়া ছিলেন আরেক মাদবর এবং খুবই প্রতাপ শালী মানুষ। যার অঢেল সম্পত্তিও ছিলো কিন্তু সবই কেরানীগঞ্জ। বাবা ভাবলেন আমাদেরকে খালুর দেশেই নিয়ে আসবেন।

কিন্তু বিপত্তি হবে যখন আমার স্টেপ ব্রাদার এবং বোনেরা জানবে যে, বাবা আমাদেরকে মুনশীগঞ্জ থেকে কেরানিগঞ্জে নিয়ে আসবেন তখন। তাতে মারামারি কাটাকাটিও হতে পারে। এই ব্যাপারটা নিয়েও বাবা ভাইয়ার সাথে আর খালুর সাথে আরেকটা বিস্তারীত পরিকল্পনা করলেন কিভাবে সব মারামারি, কাটাকাটি হানাহানি পরিত্যাগ করে নির্বিঘ্নে মুনশী গঞ্জ থেকে একদিনের মধ্যে কেরানীগঞ্জে আনা যায়। কিন্তু এইটা ঠিক যে, আমাদেরকে খালুর দেশে কেরানীগঞ্জে আনতেই হবে আমাদের নিরাপত্তার জন্য।

বাবার মাদবরী স্টাইল-১

Categories

সিরাজদিখানে যতোগুলি মাদবর আমার বাবার আমলে প্রতাপ শালী ছিলেন, তার মধ্যে আমি প্রায়ই যার নাম শুনেছি তার নাম আলী হোসেন সরকার। আমার বাবার নাম ছিলো হোসেন আলী মাদবর, আর ওই ব্যক্তির নাম ছিলো আলী হোসেন সরকার। তারা সরকার বাড়ির লোক। ভাইয়ার কাছ থেকে শুনেছিলাম যে, সরকার বাড়ির মানুষেরা কোনো না কোনোভাবে আমাদের বংশেরই আওতাধীন ছিলো। যাই হোক সেটা এখন আর বড় ব্যাপার নয়।

এই আলী হোসেন সরকার আর আমার বাবা হোসেন আলী মাদবরের মধ্যে গ্রাম্য পলিটিক্সের বেড়াজালে একটা অলিখিত আক্রোশ ছিলো। কিন্তু সেই আক্রশ তা এমন নয় যে, কোনো জমি জমা নিয়ে, বা পারিবারিক কোনো কোন্দল নিয়ে। এটা ছিলো নিতান্তই পাওয়ার পলিটিক্স। যেখানে হোসেন আলী মাদবর কোনো শালিসীতে থাকতেন, সেখানে আলী হোসেন সরকার থাকতেন না। আবার যেখানে আলী হোসেন সরকার থাকতেন সেখানে হোসেন আলী মাদবর থাকতেন না। প্রকৃত পক্ষে ওনারা ওনাদের কোনো সিদ্ধান্তে কেউ বাধা হয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আক্রোশে সম্পর্কটাকে বিপদজনক করেন নাই।

এখানে মজার একটা ব্যাপার চলছিলো এই দুই পরিবারের মধ্যে। শুধুমাত্র আলী হোসেন সরকার আর হোসেন আলী মাদবরের মধ্যে যাইই থাকুক না কেনো, এই দুই পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা খুব মিলেমিশেই থাকতেন। একজনের ভাতের হাড়ির কিছু অংশ যে আরেক জনের বাড়িতে যেতো না এমন নয়। এরা আবার আসলেই একে অপরের বন্ধুও ছিলো। কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে নয়। কি রকমের একটা সম্পর্ক সেটা একটা উদাহরণ না দিলে ব্যাপারটা ঠিক বুঝা যাবে না।

আমার ভাই হাবীবুল্লাহ যখন লেখাপড়া করছিলেন, তখন আমার অন্য পক্ষের ভাইয়েরা এটাকে কোনোভাবেই ভালো লক্ষন হিসাবে নেন নাই। বিশেষ করে তাজির আলী ভাই। তার সব সময় টার্গেট ছিলো যে কোনো মুহুর্তে হাবীব ভাইয়াকে ক্ষতি করা, বিপদে ফেলা কিংবা মেরে ফেলা। এটা আমার বাবা খুব ভালো করে জানতেন। একদিন, আমার বাবা আলী হোসেন সরকারকে ব্যাপারটা শেয়ার করলেন যে, তিনি হাবীব ভাইয়ার জীবন নিয়ে তাজির আলির থেকে শংকিত। কি করা যায় পরামর্শ দরকার।

কি অদ্ভুত!!

হোসেন আলী সরকার কোনো কিছুই চিন্তা না করে আমার বাবাকে বললেন, শোনো হোসেন আলী মাদবর, তোমার ছেলে আর আমার ছেলের মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না এবং রাখীও না। আমার বাড়ি তোমার ছেলের জন্য ১০০% নিরাপদ। আগামীকাল থেকে তোমার ছেলেকে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দাও। এখানেই খাবে, এখানেই পড়বে, এখানেই ঘুমাবে। তোমার যখন দরকার তখন আসবা, ওর যখন যেখানে যাবে ওর সাথে আমার ছেলেরা থাকবে।

সেই থেকে আমার ভাই আলী হোসেন সরকারের বাড়িতে থেকেই  অনেক দিন পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে। এরাই আসলে মাদবর, এরাই আসলে বুদ্ধিমান। এরা যখন কোথাও শালিসিতে যেতো সেদিন ওনারা কারো পক্ষের বাড়িতে পানিও খেতেন না, কারন কোনো পক্ষপাতিত্ত তারা করতেন না।

মন্তব্যঃ

আজকাল গ্রামের উঠতি মাদবরদের বয়স দেখলে মনে হয় ওদের এখনো মোছ দাড়িও গজায় নাই। কেউ আওয়ামীলীগের সভাপতি, কেউ ছাত্রনেতা, কেউ এটা কেউ সেটা। এরাই মাদবর। এরা না করে বড়দের সম্মান, না করে ছোটদের আদর। ওরা প্রতিনিয়ত ঘুষের টাকায় চলে, ঘুষের কারনে ওরা রায় বদলায়। এদেরকেও কেউ সম্মান করে না।

আমার বাবা।

Categories

আমি আমার বাবাকে কখনো দেখিনি এবং তার চেহাড়া কেমন ছিলো, খাটো নাকি লম্বা, যুবক না বৃদ্ধ, ফর্সা নাকি কালো কোনো কিছুই আমার জানা নাই। তবে আমার বড় ভাই ডঃ হাবীবুল্লাহর কাছে আমি আমার বাবার অনেক গল্প শুনাতেন যার থেকে আমি বাবার একটা কাল্পনিক চরিত্র মনে গেথে গেছে। আমার দাদার নাম ছিলো হিসাবদি মাদবর। আমরা মাদবর বংশের লোক।

বাবার সম্পর্কে আমি অনেক চমৎকার চমৎকার গল্প শুনেছি ভাইয়ার কাছে। তবে তার প্রাথমিক তথ্যের মধ্যে জরুরী তথ্য হলো যে, আমার বাবার প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি আমার মাকে বিয়ে করেন। বাবার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ঘরে মোট তিন জন ছেলে সন্তান আর তিনজন কন্যা সন্তান ছিলো। এই মোট ছয় সন্তান থাকার পরে আমার বাবা আমার মাকে বিয়ে করেন। তখন আমার মায়ের বয়স ছিলো বেশ কম। আগের সব সন্তানেরাই আমার মায়ের থেকে বয়সে বড় ছিলো। কেউ কেউ আবার ইতিমধ্যে বিয়েও করে ফেলেছিলেন। এমন একটা পরিস্থিতিতে আমার মা যেমন একটু অসুবিধায় ছিলেন, তেমনি আমার বাবাও বেশ অসুবিধায় ছিলেন।

কিভাবে আমার বাবা এই দুমুখী অসুবিধাগুলি তার জ্ঞানের দ্বারা সমাধান করেছিলেন, সেই গল্প গুলিও আমি হোসেন আলী মাদবরের পর্বসমুহে একে একে লিখবো।

হোসেন আলী মাদবর (ভুমিকা)

Categories

আমি আমার মাদবর বাড়ীর সব প্রকারের ঐতিজ্য নিয়ে সবসময় গর্ববোধ করি। একটা বাড়ি একটা সমাজ হতে পারে, মাদবর বাড়ি একটা তার প্রমান। কিন্তু ধীরে ধীরে এই মাদবর বাড়ীর তথ্য, অজানা ইতিহাস ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে কে বা কারা এই পরিবারের সদস্য বা তারা কে কোথায় আছে, এর ইতিহাস আজনেকেই জানে না বিধয় মাদবর বাড়ীর সেই পুরানো বংশ আভিজাত্যের ধারা মুছে যেতে চলেছে।হয়ত একসময় এই মাদবর বাড়ি সদস্যগনই জানবে না তারা কে বা কারা। বাংলাদেশ  আমেরিকা নয় যে, কোনো এক ওবামা, বা কোন এক ট্র্যাম্প পৃথিবীর কোনো একস্থান থেকে উদয় হয়ে আমেরিকার মতো বিশাল এক রাজকীয় পরিবেশে উড়ে এসে জুড়ে বসে একেবারে টপ পজিশন ধরে প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবেন। সেটা আমেরিকায় হতে পারে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সব পরিচয় জেনেও কাউকে যদি হেয় করতে মন চায়, তাহলে তার কোনো কিছুই জানার প্রয়োজন হয় না, সে শুধু তার ইচ্ছেটাই প্রকাশ করবে। কিন্তু যদি কেউ আপনার আমার বংশ পরিচয়, আমাদের ইতিহাস, আমাদের ঐতিয্য সব কিছু জানে, তাহলে যে যাই কিছু করুক বা বলুক, অন্তত এইটুকু নিশ্চিত বলা যায় যে, অহেতুক আপনাকে কেউ হয়রানী হয়ত করবে না। কোনো মৃত ব্যাক্তির কাছে পৃথিবীর কোনো কিছুই যায় আসে না, কিন্তু তারপরেও মানুষ ইতিহাস পড়ে আর ইতিহাস লিখে। একমাত্র ইতিহাসটাই সত্য। আর যতো আগামি, বর্তমান, কিংবা সব "যদি" কোনোটাই শতভাগ সত্য নয়। তাই নিজের ইতিহাস টুকু তো জানুন। মনে নাই? আলেক্স হ্যালির সেই রুটস কাহিনীটি? সেটাই ইতিহাস।

                                                               

আমাদের পরিবার “মাদবর” পরিবার হিসাবে পরিচিত। কিন্তু আমরা অনেকেই এই পদবীটা কেনো জানি নামের পাশে ব্যবহার করতে একটু দ্বিধা বোধ করছি। যেমন আমি নিজেও আমার নামের পাশে মাদবর পদবীটা উল্লেখ করি না। কেউ যদি প্রশ্ন করেন যে, কেনো করছি না, আমার কাছে একটা যুক্তি তো অবশ্যই আছে। আর সেটা হচ্ছে-

আমি যখন গ্রামে থাকতাম, তখন দেখেছি যে, আমাদের গ্রামের অনেকেই অনেক প্রকারের মাদবর সেজে আছেন। কেউ বাচ্চু মাদবর, কেউ আজগর আলি মাদবর, কেউ আক্কাস আলি মাদবর ইত্যাদি। এই মাদবর গুলিকে দেখে আমার গা এক প্রকার রি রি করতো কারন তাদের না ছিলো কোনো ইথিক্স, না ছিলো কোনো গুনাগুন। অথচ শুনেছি, আমার বাবা যখন মাদবরি করতেন, তখন তিনি নাকি কারো বাড়িতে গিয়ে এক কাপ চাও খেতেন না। যদি কারো বিচারের বেলায় পক্ষপাতিত্ব হয়ে যায়, তাই! কিন্তু আমার বাবা, বা দাদা কি ধরনের মাদবর ছিলেন আর এখনকার মাদবরগন কি প্রকারের মাদবরি করছেন এই পার্থক্য টা আমার ঐ ছোট বয়সে যেমন বুঝবার ক্ষমতা ছিলো না, তাই আমার বংশের পদবীটা যে এতো মানসম্মানের, সেটা আমার আসলে বুঝার জ্ঞ্যানও ছিলো না। ফলে এই মাদবর উপাধিটা আমার কাছে হাস্যকর মনে হইতো এবং কিছুটা নিম্নজাতীয় উপাধি বলিয়াও মনে হইতো, বিশেষ করিয়া শহুরে সমাজের কাছে। তাই আমি অনেকটা ইচ্ছে করেই আমার সমস্ত স্কুল কলেজের সার্টিফিকেট সমুহের এই নামের পাশের মাদবর পদবীটা একেবারে রহিত করিয়া দিয়াছি।

আমার বড় ভাই জনাব ডঃ মহাম্মাদ হাবিবুল্লাহও কেনো যে এই পদবীটা নিলেন না সেটা আমার বোধ গম্য নয়।

যাক সে কথা।

এবার আসি আমাদের বংশের সংক্ষিপ্ত একটু ইতিহাস নিয়ে।

হিসাব্দি মাদবর ছিলেন আমার দাদা। এই দাদার থেকেই আমার ইতিহাস আমি শুরু করিবো। তিনি ছিলেন অনেক বিচক্ষন একজন ব্যক্তি। তার আমলে তিনি অনেক সম্পদ এবং বুদ্ধির মালিক ছিলেন। আমার দাদির নাম আমি জানি না। জানতে ইচ্ছে করে। হয়ত আমার বড় ভাই জানবেন।