Literatures
০৩/০৭/২০২৩-মাধুরীর চিঠি-২
অনেক অনেক দিন পার হয়ে গেলো। না আমি আর তোমার সাথে কোনো যোগাযোগ করেছি, না তুমি। জীবনের ব্যস্ততা মানুষকে এমনভাবে কোনো এক চক্রএর মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ায় সেটা বুঝা খুব সহজ না। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন মানেই কি পিছলে পড়া পথে হাটু গেড়ে বসে পড়া? নাকি সেই পিচ্ছিল পথ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে কোনো এক পাহাড়ের পাদদেশে এসে পতিত হয়ে আবার সেখান থেকে নতুন করে বেড়ে উঠা? হয়তো দুটুই ঠিক। কেউ পাহাড়ের চূড়ায় উথে নামার ভয়ে হাহাকার করে, আবার কেউ পাহাড়ে উঠতে না পেড়ে হাহাকার করে। কেউ কারো অবস্থানে সুখী নয়।
যাই হোক, এসব কথা আর না বলি। তবে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কি এখনো খুব সহজে সব কিছু ভুলে যাও? কিংবা হাতের কাছে তোমার দরকারী কাগজটি না থাকলে কোথায় রেখেছো সেটার জন্য আমার নাম ধরে চেচামেচি করো? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। তখন হয়তো এরকমের চেচামেচি ভালো লাগতো না, কিন্তু আজকে মনে হয় তোমার সেই চেচামেচিকে আমি খুব মিস করি। মনে হয় খুজে খুজে তোমার ঠিকানাটা বের করে আরো একবার যদি তোমার সেই কন্ঠসরটা শুনতে পেতাম!! কিছু একটা খোজার বাহানা করে আমি সারাক্ষন মাঝে মাঝে আসলে হয়তো এখনো তোমাকেই এই আজব পৃথিবীর মানুষগুলির মধ্যে খুজি। আমি জানি না হটাত কখনো যদি তোমার সাথে আমার আবার দেখা হয়ে যায়, তখন আমি কি করবো। জড়িয়ে ধরবো? নাকি এড়িয়ে যাবো? নাকি দূর থেকে তোমার চলে যাওয়া দেখবো। আমি জানি, তুমি আমাকে ভুলে যেতে চেয়েছিলে, কিন্তু আমার জগতে তুমিই ছিলে একমাত্র মানুষ যাকে আমি কখনো ভুলতে চাই নি। আমি তোমাকে পাইনি বটে কিংবা তুমি আমাকে ছেড়েছো বটে কিন্তু পেরেছো কি? আমি পারিনি।
বৃষ্টি ভেজা রাতে নীরবে যখন আমি আমার বারান্দায় বসে অতীতের ভালো লাগা কোনো একটা গানের কলি শুনি, আমাকে নিয়ে যায় সেই রাতে যখন আমি তোমার হাতে হাত রেখে উচ্ছল ধরনীর শীতল মাটিতে নেচে বেড়াতাম। আমার ভেজা চুল বেয়ে বেয়ে জোনাকীর মতো পানির ফোটা ঝরে পড়তো, আর তুমি সেটা চিপে চিপে ধরে বলতে –আহা, কি সুন্দর, যেনো মুক্তার মত। তোমার ছাদের কোনায় কি এখনো অই ছোট জবা ফুলের গাছটা আছে? আমি লাগিয়েছিলাম। তুমি কাটাজাতীয় ফুল পছন্দ করো না জেনেও আমি গাছটা লাগিয়েছিলাম। কতদিন জবা ফুল তুলতে গিয়ে হাতে কাটা বিধেছিলো আর তুমি বারবার আমার হাতে মলম লাগিয়ে বলতে কেনো কাটা গাছটাই রাখতে হবে ছাদে? অথচ তুমি গাছটা নিজেও কখনো কেটে ফেলোনি, বরং প্রতিদিন এর গোড়ায় পানি দিতে। কি আজব না? তোমার অপছন্দের একটা গাছ, তুমি কেটে দিলে না, পানি দাও, এটাকে বড় করো, যত্ন করো, অথচ তাকে তুমি পছন্দ করো না। আমাকে তুমি পছন্দ করতে, আদর করতে, আমার কষ্টে তোমার কষ্ট হতো, আমার আনন্দে তুমি আনন্দিত হতে, অথচ তুমি আমাকে চিরতরে কেটে দিলে। কাটতে পেরেছো? ওই জবা ফুলের গাছটার কাছে গেলে তোমার মন উদাসীন হয়ে উঠে না? হয়তো গাছটা আর নাই, অথবা আছেও। আমি তো আর জবা গাছ নই। আমার ভাষা ছিলো, অনুভুতি ছিলো, সব ছিলো, তাতেও তো আমি তোমাকে আমার ভিতরের অনুভুতি দিয়ে বুঝাতে পারিনি, কি ছিলে তুমি আমার। আর সেটা তো একটা ভাষাহীন জবা গাছ। সে তো তোমার কিছুই ছিলো না। আছে গাছটা? তাড়িয়ে দাও নি তো?
মাঝে মাঝে আমার খুব তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে। কেনো দেখতে ইচ্ছে করে, সেই সঠিক উত্তর আমার জানা নাই। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, চিৎকার করে হাউমাউ করে কাদি। যদিও জানি, আজকালকের মানুষগুলির আবেগ, অনুভুতি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এখন মানুষেরা আর হাউমাউ করে কাদে না, মানুষ কি ভাববে বলে। প্রান খুলে হাসে না, লোকে বোকা ভাববে বলে। এই চাপা হাসি আর বোবা কান্না মানুষ গুলি এতো অসহায়। তাই মানুষগুলি একা একাই বেচে থাকার মধ্যে প্রান খুজে বেড়ায়। আসলে আমরা সবাই একাই। এই একা জীবনে আড্ডা দেয়া যায়, গল্প করা যায়, কিন্তু সে পর্যন্তই। এর মানে যে, নিঃসঙ্গতা যে কাজ করে না এমন নয়। এই নিঃসঙ্গ জীবনের ও একটা মাধুর্যতা আছে। সেখানে আমিই সব। এর মানে এই নয় যে, আমি রক্তমাংশে গড়া কোনো আপনজনের অভাব অনুভব করিনা।
আমি এখনো মাঝে মাঝে ভাবি- আমি কি অন্য দশজন মেয়ের মতো জীবন সংগী বেছে নিঃসঙ্গতা কাটাতে পারতাম না? হয়তো পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করতে পারিনি। কারন আমরা আমাদের জীবনসংগী বাছাই করি কথা শোনার জন্য, কথা বলার জন্য, যার সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগে, যার কথা শুনলে বছরের পর বছর সুখে দিন পার করা যায়। কিন্তু এটাও ঠিক যে, মাঝে মাঝে আমরা জীবনসাথী বাছাই করি তার রুপ, তার সউন্দর্য, তার অর্থবৈভব, তার সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি বিবেচনা করে। কিন্তু আমরা মাঝে মাঝে এটা ভুলেই যাই, সেই জীবনসাথী যাকে আমরা বাছাই করলাম, তার সাথে কারনে অকারনে, সময়ে অসময়ে আমার মনের কথাগুলি তাকে বলতে পারবো কিনা কিংবা সে আমার সেই সব ছোট ছোট অনুভুতি গুলির মুল্যায়ন করবে কিনা। যদি এর কোনো পরিবর্তন হয়, আর ঠিক তখন দেখা যায় যে, আমার বাছাই করা সাথী আমার কথাগুলি শুনতেই তার বিরক্ত লাগছে, কথায় কথায় ঝগড়া লেগে যাচ্ছে, আর তখন সম্পর্কগুলিতে মরচে ধরা শুরু করে। এটা একটা অনিশ্চিত পরীক্ষা। যাকে চিনিনা, যাকে কখনো অন্তরে রাখিনি, যে আমাকে জীবনের ৩০ বছর কোথাও জায়গা দেয় নি, হটাত করে তার সেই অন্দর মহলে আমি ঢোকে কতটা স্থান দখল করতে পারবো? সেখানে তো আরো হাজার হাজার ভাবনা, হাজার হাজার বিক্ষিপ্ত অনুভুতি, কিংবা অনেকের বসবাস রয়েছে। আমি কি হটাত করে এসেই তার সেই সব ভাবনা, অনুভুতি, আর অন্য মানুষদের পদরেখা ধুয়ে মুছে আমার নিজের করে দখল নিতে পারবো? হয়তো এটা কখনোই সম্ভব না। তাই আর আমার কোথাও যাওয়াওই হলো না।
একটা জিনিষ জানো? লেখকের কোনো লেখা পড়ে যতোটা পাঠক মুগ্ধ হয়, তার থেকে বেশী মুগ্ধ হয় পাঠক যখন তার সাথে সামনে বসে কথা বলে।
১৭/০৮/২০২১-রেহালাদের গল্প
রেহালার গল্প
সাহস ছাড়া মানুষ স্বাধীন হতে পারে না, আর স্বাধীনতা ছাড়া মানুষ জীবিত নয়।
একদমই ভাবী নাই যে আজকে আমার অফিসে এমন কেউ আসবে যাকে আমি একসময় চিনতাম কিন্তু গত ৪০ বছরের মধ্যে আর কখনোই দেখা হয় নাই। ওর নাম ‘রেহালা (এটা একটা ছদ্দনাম, আসল নামটা উল্লেখ করলাম না’)। আমি আর রেহালা একই ক্লাশে পড়তাম সেই প্রাইমারী স্কুলসহ হাইস্কুলে। এরপর আমি হাইস্কুল ছেড়ে অন্য কলেজে চলে আসলাম, আর ওরা গ্রামেই রয়ে গেলো। এতো সুকন্ঠী ছিলো এই রেহালা যে, আমরা ওর গান শুনতাম যেখানে সেখানে, দলবেধে। স্কুলের কোনো অনুষ্ঠানে কখনো কখনো রেহালার একক সঙ্গীত পর্যন্ত হতো। খালী কন্ঠেও যে গানের একটা মূর্ছনা আছে, সেটা রেহালার গান শুনলে বুঝা যেত। আর যদি রেহালার রূপের কথা বলি, সেটা আরেক বর্ননা। ওর গায়ের রঙ শ্যামলা, একদম ডায়মন্ডের মতো, চোখগুলি বড় বড়, ঠোটে সবসময় একটা হাসি লেগেই থাকতো। রেহালা হাসলে গালে একটা টোল পড়তো। সম্ভবত এই টোল পড়া গালের জন্যই রেহালার হাসিতে একটা আলাদা মাধুর্য ছিলো। বড্ড মিষ্টি ছিলো রেহালার হাসি। ছিমছাম শরীর, আমাদের সাথে গোল্লাছূট, দাড়িয়াবান্দা, মাঝে মাঝে কাবাডিও খেলতো রেহালা। রেহালাকে কাবাডি খেলায় কুকুপাত করলে ইচ্ছামতো মাথায় চুল ধরে ঝাকুনো মারতো। এক সাথে আমরা গ্রামে বড় হয়েছি, পাশাপাশি বাড়ি ছিলো আমাদের। নদীতে ঝাপ দিতাম এক সাথে, আর অন্যের গাছে উঠে পেয়ারা চুরির সময় রেহালা থাকতো লুক আউটম্যানের মতো। যেই না গাছের মালিকের আসার সময় হতো, রেহালা নিরুদ্দেশ, আর আমরা গাছের মধ্যে নিশ্চুপ। বড্ড মজার দিন ছিলো সে ছোটবেলাটা। সেই রেহালা আজ হটাত করেই আমার অফিসে এসে হাজির।
প্রথমে তো আমি রেহালাকে চিনতেই পারিনি। ওর শরীর অনেক মোটা হয়ে গেছে, রেহালা আগেই শ্যামলা ছিলো, আর এখন ওর চেহারা এতো কালো হয়ে গেছে যে, আগের আর সেই ডায়মন্ডের মতো চেহারাটা নাই। মাথায় চুলে পাক ধরেছে। কতই বা বয়স, তারপরেও মনে হচ্ছে বুড়ি হয়ে গেছে রেহালা। কিন্তু হাসলে ওর গালে এখনো টোল পড়ে। চোখ গুলি এখনো ডাগর ডাগর। কন্ঠে আর সেই সুর এখন নাই রেহালার। রেহালা আমার অফিসে একা আসে নাই। ওর সাথে ওর ছোট বোন এসেছে। ওর ছোট বোন কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বল্লো যে, বুজি (মানে আপা) কানে শুনে না। অনেক জোরে জোরে কথা বললে কিছুটা শুনতে পায়। যেহেতু কানে শুনে না, তাই, অন্যের কথাও বুজি ভালোমতো শুনতে না পাওয়ায় কি কথা বলছে কেউ বুঝতে পারে না। তাই সাহাজ্যকারী হিসাবে বুজি কোথাও গেলে আমিই সাথে যাই।
রেহালা আমার অফিসে বসেই কিছুক্ষন যেনো হাপিয়ে উঠেছিলো। রেহালার প্রথম কয়েক মিনিটের কথার অর্থ এমন ছিলো যে, এতোদিন পর রেহালা আমার সাথে দেখা হওয়ায় যেনো সেই ছোট বেলার রাজ্যের গল্পের পশরা নিয়ে হাজির হয়েছে। ওর বলার উচ্ছাস, মুখের অভিব্যক্তি আর অনর্গল কথার মধ্যেই আমি বুঝতে পারছিলাম রেহালা আজ অনেক অনেক খুসি যে, সে আমার সাথে দেখা হয়েছে। কখনো দুই হাত তুলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে, কখনো নিজের অজান্তেই কি যেনো দোয়া দরুদ পাঠ করছে আবার কোনো কারন ছাড়াই হেসে দিচ্ছে। ঝির ঝির বাতাসে তরু পল্লব কিংবা ক্ষেতের দন্ডায়মান ফসলরাজী যেমন হেলিয়া দুলিয়া এদের মনের সুখ প্রকাশ করে, নির্মল নীলাকাশ যেমন তার একখন্ড মেঘের ভেলাকে এদিক থেকে সেদিকে উড়াইয়া লইয়া যায়, রেহেলা তেমনি আমাকে এতো বছর পর পেয়ে যেনো তার সেই দশাই হলো। রেহালা মাথার বোরখাটা খুলে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলো। রেহালার আগমনে আমার অফিসে কোনরূপ সমারোহ ছিলো না, কিন্তু আজিকার এই মুহুর্তে সমস্ত বিশ্ব ব্যাপারের সর্বাধিনায়িকা যেনো এই রেহালাই হয়ে দাড়াল। রেহালার এমন উচ্ছাসিত আচরনে আমার যেনো বিস্ময়ের কোনো শেষ ছিলো না।
এখানে আরো একটা ব্যাপার আমাকে রেহালা বিস্মিত করলো। রেহালা ছোটবেলায় আমাকে ‘তুই’ বলেই ডাকতো, কিন্তু আজকে খেয়াল করলাম, রেহালা আমাকে আর তুই; বলছে না, কাকা বলে ‘আপনি’ সম্মোধন করছে। গ্রামের সম্পর্কের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে রেহালার সাথে আমার কাকা ভাতিজারই সম্পর্ক। কিন্তু এই সম্পর্ক কিসের ভিত্তিতে সেটা আমার ছোট বেলায়ও জানা ছিলো না, আজ তো সেটা জানার কোনো ইচ্ছাও নাই। আমি রেহালার বাবাকে ‘ভাই’ বলেই ডাকতাম সেটা আমার মনে আছে। আমি রেহালাকে বললাম যে, সে যেনো আমাকে “তুই বা তুমি” করেই বলে।
আমি জানি রেহালার বাবা এবং অন্যান্য ভাই বোনেরা এখনো জীবিত আছে। আর তারা মাঝে মাঝেই আমার অফিসে কিছু না কিছু সাহাজ্য বা পরামর্শের জন্য আসে। কখনো তাদের সাথে আমার দেখা হয়, আবার কখনো কখনো দেখা হয়ও না। ফলে আমি রেহালাকে ওদের ব্যাপারে কোনো প্রশ্নও করতে চাইনি। একমাত্র রেহালার ব্যাপারেই আমার অনেক কিছু জানা ছিলো না। তাই প্রথমেই রেহালাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, রেহালা কেমন আছে। রেহালা কি শুনলো আর কি বুঝলো আমি জানি না কিন্তু রেহালা বলতে থাকে-
কাকা, তোমারে কতবার যে আমি দেখতে চাইছি মনে মনে, আর আফসোস করছি, ইশ যদি মরার আগে তোমার সাথে আমার একবার দেখা হতো। অনেকের কাছেই আমি তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছি, তুমি কই থাকো, কিংবা কোথায় গেলে তোমাকে পাওয়া যাবে ইত্যাদি কিন্তু কেউ আমাকে তোমার আসল ঠিকানাটা দিতে পারে নাই। শুধু এটুকু জানতাম যে, তুমি এই এলাকাতেই বড় ব্যবসা নাকি করো। একবার শুনেছিলাম, তুমি নাকি গ্রামে গেছো। আমি তখন গ্রামেই ছিলাম। কিন্তু আমি লজ্জায় তোমার সাথে দেখা করার সাহস করি নাই। সেটাও আজ থেকে প্রায় বারো বছর আগের কথা। তখন সবেমাত্র আমি আমার জামাইয়েরে নিজের ইচ্ছায় তালাক দিছি। গ্রামে একজন মহিলার সংসার ভেংগেছে, তালাক হয়েছে এটা যে কত বড় কেলেংকারী, সেটা মেয়ে না হলে আসলে কেউ বুঝতে পারে না।
আমি রেহালাকে জিজ্ঞেস করলাম, স্বামীকে তালাক দিলি কেনো?
রেহালা সহজেই আমার প্রশ্নটা বুঝতে পেরেছিলো। রেহেলা অনেকক্ষন মাথা নীচু করে কি যেনো ভাবলো। দেখলাম, রেহেলা কাদছে। তাঁর ফুপিয়ে কান্নার একটা শব্দ পেলাম। আমি রেহেলাকে কিছুই বললাম না। রেহেলাকে আমি সময় দিলাম, রেহেলা কাদছে। তারপর টেবিলে রাখা একটি গ্লাস থেকে কয়েক ঢোক পানি গিলে বলতে লাগলো-
কাকা, একটা কথা কি জানেন? বিয়ের সময় খুসি আর ভালোবাসায় এটা প্রমানিত হয় না যে, ভবিষ্যতে এই সুম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা বা ঘৃণা আসবে না। মধুর ভালবাসা যেমন একদিন ঘৃণার বিষে রুপান্তরীত হতে পারে, আবার গভীর ঘৃণাও হয়তো সমস্ত বাধা কাটিয়ে পুনরায় চরম ভালোবাসায় পরিনত হতে পারে। কিন্তু কখনো যদি ভালোবাসার মধ্যে ঘৃণা ঢুকে পড়ে, তিক্ততার সীমা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন যে এখন এই সম্পর্ককে শেষ করা উচিত। বুঝে শুনে বেরিয়ে আসা উচিত। যাতে তার আগে কোনো মারাত্তক অঘটন না ঘটে। কিন্তু আফসোস, প্রায়ই তিক্ত সম্পর্কগুলির ক্ষেত্রে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনা। হোক সেটা সমাজের তথাকথিত লোক লজ্জার ভয়ে অথবা অভিভাবকের অতিরিক্ত চাপের কারনে। তখন এমন হয় যে, সেই দম্পতির যে একদিন ভালোবেসে যারা খুব কাছে এসেছিলো, তারা আজ সম্পর্কের তিক্ততায় একজন আরেকজনকে চাকু, বন্ধুক চালাতে পিছপা হয়না। তখন একজন আরেকজনের প্রান নিতেও দ্বিধাবোধ করেনা অথচ কোনো একদিন তারা তাদেরকে নিজেদের মানুষই ভাবতো। বিয়েটা হয়তো সত্যিই একটা কন্ট্রাক্ট। আর সেই কন্ট্রাক্টের মধ্যে নিহীত থাকে অনেক দায়িত্ব, অনেক কর্ম পরিধি।
রাহেলার এমন জীবনভিত্তিক কথায় আমিও খুব অবাক হলাম। রাহেলা কি সুন্দর করে তাঁর জীবনের কিছু অভিজ্ঞতার কথা এক নিমিষে বলে গেলো। অনেক পড়াশুনা হয়তো রাহেল করে নাই কিন্তু ওর কথাবার্তা যেনো আমার অন্তরে তীরের মতো বিধে গেলো। আমি রাহেলার কথা খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম।
রাহেলা বলতে থাকলো-
সেদিন সম্ভবত গুড়িগুড়ি বৃষ্টির দিন ছিলো। আমার স্বামী আমারে বল্লো, চলো, নারায়নগঞ্জ আমার এক বন্ধুর বাসা থেকে বেড়িয়ে আসি। আমার স্বামী আমাকে ভালোবাসে কিনা তা আমি কখনো বুঝি নাই। বিয়ের পর থেকে যে শ্বশুর বাড়িতে ঢূকেছি, সারাক্ষন স্বামী, সংসার, ছেলে মেয়ে ননদ ননদীনির দায়িত্ব পালন করতে করতেই আমার দিন পার হতো। আর এসব দায়িত্ব পালনে কোথাও কোনো ত্রুটি হলেই আমার উপরে চলতো খড়গের মতো আচরন। আমার স্বামী নেশা করতো। বিয়ের আগে নেশা করতো কিনা জানি না, কিন্তু বিয়ের কদিন পরেই বুঝলাম, সে প্রায় রাতেই নেশা করে ঘরে ফিরে। কি তাঁর দুঃখ, কি তাঁর কষ্ট কখনো সেটা আমি বুঝতে পারি নাই। ফলে, সুযোগ আর কোনো ব্যত্যয় কিংবা তাঁর নেশার জগতে একটু ভাটা পড়লেই কারনে অকারনে আমাকে মারধোর করতো। সেই মারধোরের কারনেই আমি আমার কান হারাই। মার খেতে খেতে কানটা একদিন অকেজোই হয়ে গেলো। গরীব বাবা মা, পয়সাকড়ি নাই, যৌতুক যা দেয়ার সেটা দেয়ার পরেও জামাইয়ের মন ভরে নাই। দিনের পর দিন এই অতিরিক্ত যৌতুক আর টাকার জন্য আমাকে মার খেতে হয়েছে। ঘরে ভালোমতো বাজার হয় না, অথচ কেনো ভালোমতো রান্না হয় না সেটা যেনো আমার অপরাধ। সহ্য করে থেকেছি। মুখ বন্ধ করা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিলো না। গরীব পিতামাতার সন্তানেরা নাকি “আগুনে পানি দিয়ে” সংসার করে। আমিও তাই করার চেষ্টা করেছি। যাই হোক, যখন আমার জামাই আমাকে বল্লো, চলো এক বন্ধুর বাসায় বেড়াইয়া আসি, ভাবলাম, হয়তো মনটা তাঁর পরিবর্তন হয়েছে। আমারো মনটা ভালো হয়ে গেলো। আনন্দিতই হয়েছিলাম। কারন যে কখনো আমাকে পাশের দোকানে নিয়ে একটা চকলেটও কিনে খাওয়ায় নাই। আজ তার এহেনো অনুরোধে বেশ পুলকিত বোধ করছিলাম। বললাম, চলেন যাই।
আমি আর আমার স্বামী বিকাল ৫টার পরে কাপড় চোপড় পড়ে নারায়নগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমাদের বাড়ি থেকে নারায়নগঞ্জ খুব বেশী দূরে না। ফলে সন্ধ্যার আগেই আমরা ওর বন্ধুর বাসায় চলে এলাম। রাতের খাবার খেয়ে হয়তো আমরা আবার আমাদের বাড়িতে ফিরে আসবো এটাই ছিলো আমার জানা। আমি আমার ছোট ছেলেকে সাথে নিতে চাইলাম। কিন্তু আমার স্বামী আমাকে নিতে বারন করলেন। ভাবলাম, ভালোই হবে, আমরা নীরিবিলি দুজনে একসাথে রিক্সায় ঘুরতে পারবো। পাশাপাশি বসে গল্প করতে পারবো। সময়টা ভালোই কাটবে। আমরা যখন তাঁর বন্ধুর বাড়িতে পৌঁছলাম, তখন সন্ধ্যার একটু আগে। তার বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে দেখি, বন্ধুর স্ত্রী বাসায় নাই। শুনলাম ছোট বাচ্চাকে নিয়ে নাকি সন্ধ্যার পর আসবে, হয়তো কোথাও কাজে গেছে। চা খেলাম, সাথে কিছু ফলমুলাদি। খারাপ লাগছিলো না। সন্ধার পর হটাত করে আমার স্বামী বাজার থেকে কি জানি আনতে বাইরে যাওয়ার কথা বলে আমাকে একা রেখে চলে গেলেন। একটু ভয় ভয় করছিলো কিন্তু খারাপ কিছু মাথায় আসে নাই। সময় যাচ্ছে, আবারো সময় যাচ্ছে, ঘন্টা, তারপর আরো এক ঘন্টা, কিন্তু আমার স্বামীর ফিরে আসার কোনো লক্ষন দেখলাম না। এদিকে রাত বেশী হয়ে যাচ্ছে, আমি বারবার ওর বন্ধুকে আমার স্বামীর কথা বল্লেও দেখলাম সে খুব একটা কথা আমলে নিচ্ছে না। আমি আমার স্বামীর এই বন্ধুকে আগে থেকে চিনতামও না। রাত প্রায় ১১টার উপরে বেজে গেলো, আমার স্বামীর ফিরে আসার কোনো নামগন্ধও নাই। এবার আমার খুব ভয় করছিলো। জীবনে কোনোদিন শহরেও আসি নাই। আর এখন পুরু একটা অপরিচিত লোকের বাসায় আমি একা। বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চা রেখে এসছি। ওদের জন্য ভীষন দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো।
আমি চারিদিকে কান খারা করে সবকিছু খেয়াল করছিলাম। আমার খুব ভয় লাগছিলো। একটু পরে আমি খেয়াল করলাম, এই বাড়িতে কিছু অপরিচিত লোকের আনাগোনা যেনো বেড়ে গেছে। কেউ কেউ বাইরে ফিসফিস করে যেনো কি কি কথাও বলছে। কেউ কেউ আবার আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছেও। বুঝতে পারলাম, তারা হয়তো আমাকে নিয়ে কোনো আলাপ করছে কিন্তু কি আলাপ করছে বুঝতে পারছিলাম না। তখন রাত প্রায় বারোটা বেজে যাচ্ছিলো।
এক সময় ৩০/৩৫ বছর বয়সের একজন পুরুষ আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো- কি নাম তোমার? আসো ওই ঘরে যাই। এই বলে পাশে একটা ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম- কে আপনি ভাই? আর আমি ওই ঘরেই বা কেনো যাবো? আমার স্বামী কই? সে এখনো আসছে না কেনো? আমার বাড়ি যাওয়া দরকার। আমার বাচ্চারা একা বাসায়। ওরা হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমার কথা শুনে লোকটি পিছনে ফিরে এসে আমাকে সে যা বল্লো, সেটা শুনে তো আমার মাথা খারাপ। আমাকে নাকি আমার স্বামী এখানে দেহ ব্যবসার জন্য বিক্রি করে টাকা নিয়ে চলে গেছে। সে আর ফিরবে না। রাতটা এমনিতেই অন্ধকার ছিলো, লোকটার কথা শুনে এবার যেনো মহাঅন্ধকারের মধ্যে আমাকে আমি মৃত লাশের মতো শ্মশানের মধ্যে দেখতে পেলাম যেখানে আমাকে কিছু জীবন্ত শিয়াল কুকুর তাড়া করছে, অথচ আমার কোনো শক্তি নাই।
আমি চিৎকার করতে লাগলাম, আর বলতে লাগলাম, এটা কি করে সম্ভব? তোমরা আমার স্বামীকে ফিরিয়ে আনো। আমি ওরকম মেয়ে নই যে, তোমরা আমার সাথে এমন আচরন করতে পারো। আমি ভয়ে আরো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে গেলে আমাকে কয়েকজন এসে এমনভাবে জাপটে ধরলো যে, না আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিলো, না আমি কোনোদিকে নড়াচড়া করতে পারছিলাম। কিন্তু আমার চোখ তো আর কোনো কিছুতে বাধা পড়েছিলো না। আমার বাচ্চাদের কথা মনে পড়লো, আমার ছোট ছেলেটা খুব মগা (বোকা), তার কথাই বেশী মনে পড়লো। তার মাত্র ৮ বছর বয়স। সে আমাকে ছাড়া কোথাও যেতে চায় না। ওকে একা ফেলে এসেছি। ছেলেটা মগা হলেও কখনো আমার হাতছাড়া করতো না। ওর মুখটা ভেসে উঠতেই আমার দুচোখ ঝাপ্সা হয়ে আসছিলো। আহা রে বাপ, দেখে যা তোর মা কত অসহায় একটা পরিস্থিতিতে ছটফট করছে। তোর অমানুষ বাবা আমাকে কোথায় ফেলে গেলোরে বাবা।
রেহালা কিছুক্ষন চোখ বুজে থাকল, তার দুচোখের পাশ দিয়ে জলের একটা রেখা যেনো অবিরত জল পড়তেই থাকলো। একটু পর আবার রেহালা বলতে থাকল-
জানো কাকা, কোনো কোনো সময় কিছু কিছু নাটক এমনভাবে বানানো হয় যাতে সাধারনের চোখে মনে হবে এটাই সব সত্যি কিন্তু এর পিছনের মুল উদ্দেশ্য অনেক গভীরে। শুধু ভরসার স্থান তৈরির জন্যই নাটক তৈরী করা হয়। আমার স্বামীও আমার সাথে ঠিক এমনই একটা ভরষার স্থান তৈরী করেছিলো। আর সেটা ছিলো নিছক একটা নাটক যা আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনি। আমি কি এটাই চেয়েছিলাম? আজ দুপুরে যখন সে আমাকে বেড়াতে নিয়ে আসবে বলে জানালো, আমি তো আমার সমস্ত বিশ্বাস নিয়েই তাঁর সাথে অজানা এক বন্ধুর বাড়িতে রওয়ানা হয়েছিলাম। বিকালটা কত সুন্দর ছিলো। চারিদিকের গাছপালা, আশ পাশের দোকানী, মানুষগুলিকে দেখে তো আমার মন অনেক পুলকিতই ছিলো। তাহলে এই হটাত কি গজব আমার উপর আছড়ে পড়লো? আমি কি কখনো আমার স্বামীকে একটিবারের জন্যেও ভালোবাসিনি? কখনো কি আমি ওর বেদনায় কাতর হই নাই? কখনোই কি ও আমাকে স্নেহ কিংবা ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরে নাই? আমি তো আমার জীবনের সবকিছু দিয়ে ওকে ভরষা করেই বাপ মায়ের বাড়ি ছেড়েছিলাম। তাহলে সে এমন নিষ্ঠুর কাজটি কেন আর কিভাবে করতে পারলো? আমি কি ওর বাচ্চার মা নই? আমাকে সে না ভালোবাসুক, ওর বাচ্চাগুলির জন্যেও কি সে আমাকে ছেড়ে দিতে পারতো না? মুখবাধা ঠোট দিয়ে সমস্ত বেদনাগুলি যেনো শুধু গোংগানীর মতোই মনে হচ্ছিলো আমার কাছে। অথচ এই গোংগানির মধ্যে কত যে অস্থিরতা, কত যে আক্ষেপ, কত যে ভালোবাসা আর কষ্ট লুকিয়ে ছিলো তা যেনো আমাকে ঝাপ্টে ধরে রাখা মানুষগুলির কানেই গেলো না।
আমার আল্লাহর কাছে আমি চোখ বন্ধ করে শুধু একটা কথাই প্রার্থনা করলাম, যদি আমি সতীনারী হয়ে থাকি, যদি আমি আমার এক ঈশ্বরকে কখনো কায়মনে ডেকে থাকি, যদি তিনিই হয়ে থাকেন আমার একমাত্র ত্রানকর্তা, যদি আমার প্রভুই হয়ে থাকে সমস্ত বিপদের উদ্ধারকারী, তাহলে আমি আমার সেই একচ্ছত্র প্রভুর কাছে দয়া ভিক্ষা করছি তিনি যেনো আমাকে তাঁর গায়েবী ক্ষমতা দিয়ে এই নরক থেকে বাচিয়ে দেন। হে ঈশ্বর, আমি তোমাকে কখনো দেখিনি, কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছি, তোমার দরবারে আমি প্রতিদিন মাথা নুইয়েছি, তুমি আমাকে বাচিয়ে দাও ঈশ্বর। লোকগুলি ইতিমধ্যে আমার চিৎকার চেচামেচিতে গন্ডোগোল হতে পারে ভেবে, কিংবা আশেপাশের লোকজন কিছু আচ করতে পারে জেনে আমাকে তাদের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়েছিলো। আমার চোখ বন্ধ ছিলো, আর আমি গোল হয়ে মাটিতে নিথর দেহে বসেছিলাম। আর আমার চোখ থেকে অনবরত অশ্রু ঝরছিলো।
তারপর কি হয়েছিলো আমি জানি না। কিন্তু ঐ ৩০/৩৫ বছর বয়সের যুবকটি আমাকে ডেকে বল্লো- এদিকে আসো আমার সাথে। কিন্তু কোনো কথা বলবে না। আমি যা বল্বো, সেটাই করবে। আমি বুঝতে পেরেছি তুমি একটা পিশাচের পাল্লায় পড়েছো। সে জানতে চাইলো, আমার সাথে কোনো টাকা পয়সা আছে কিনা। আমি লোকটির চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম, এটাও ভাবছিলাম, সে আমার সাথে এবার অন্য কোনো চাল চালছিলো কিনা। কাউকে বিশ্বাস করা কিন্তু ভুল নয়। তবে চোখ বন্ধ করে কাউকে বিশ্বাস করা একেবারেই ভুল। তাই আমাদের এটা জানা খুব দরকার যে, সামনের মানুষটাকে বিশ্বাস করবো নাকি করবো না।
তাঁর আচার ব্যবহারে আমার কাছে সে রকম মনে হলো না। মনে হলো আসলেই বুঝি তাঁর মাধ্যমে আমার ঈশ্বর আমাকে সাহাজ্য পাঠিয়েছেন। বললাম, আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নাই। সে আমার কানে কানে চুপিসারে শুধু একটা কথাই বল্লো- আসো, আমি তোমাকে এখান থেকে দ্রুত বের করে দেবো। আমি জানি তুমি খারাপ মেয়ে নও। আমিও তোমার কাছে কোনো শরীরের চাহিদায় আসি নাই। আমি এখানকার একজন এজেন্ট মাত্র। আমাকে আর এর বেশী কিছু জিজ্ঞেস করোনা। আর জিজ্ঞেস করলেও আমি সব কিছুই মিথ্যে বল্বো।
রাহেলা এবার একটু থামলো। সামনে রাখা গ্লাস থেকে সে আরো একবার এক ঢোক পানি পান করলো। রাহেলার চোখে মুখে যেনো এখনো সেই অতীতের ভয়টা স্পষ্ট ফুটে উঠছিলো। মাঝে মাঝে সে শিহরিত হয়ে উঠছিলো। বুঝতে পারছিলাম, রাহেলার সেই ভয়টা এখন আবার যেনো নতুন করে তাঁর সামনে জেগে উঠেছে। রাহেলা তাঁর বোরখার একটা আচল দিয়ে মুখটা মুছে নিলো। দেখলাম, রাহেলা একটু একটু ঘেমে গিয়েছে। আমি আমার রুমের এসিটা অন করে দিয়ে বললাম, তারপর?
কাকা, কিভাবে কি হয়ে গেলো আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। লোকটি আমাকে একশত টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বল্লো, শীঘ্রই এখান থেকে এই দরজা দিয়ে বের হয়ে যাও। আমি পাহারায় আছি। এই গোপন দরজাটা দিয়ে আমরা বিপদের সময় পালিয়ে যাই। এটাকে আমরা কোডে বলি- (রেহালা নামটা মনে করতে পারলো না।)
এতো অন্ধকার রাত, তারপর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি, অনিশ্চিত একটা পলায়নে আমি কোথায় যাচ্ছি সেটাও আমি জানি না। এটা কি গরম তেল থেকে লাফিয়ে উনুনে নাকি হাজার ফুট উঁচু পাহাড় থেকে বাচার তাগিদে নীচে পতন আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তারপরেও আমি সেই দরজা দিয়ে বের হয়েই পাগলের মতো ছুটছিলাম। কোথায় ছুটছিলাম, কোনদিকে ছুটছিলাম আমি নিজেও জানি না। অনেক রাত, রাস্তায় বেশী লোক ছিলো না। আধো আলয় ভরা শহরের রাস্তার কিছু লাইট পোষ্ট এমন করে রাস্তাকে আলকিত করেছিলো যেনো সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে কন এক ভুতুরে পল্লির মতো দেখাচ্ছে। এম্নিতেই মনে আকুন্ঠ ভয়, তারমধ্যে অজানা এক দুসচিন্তা, তার উপরে রাতের এতো ভয়ংকর রুপ। কিছু লোকজন এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেখা যাচ্ছিলো বটে কিন্তু যারাই ছিলো তারা আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিলো, হয়তো ওরা ভাবছিলো, এতো রাতে আমি দৌড়াচ্ছি কেনো, বা আমি কি পাগল কিনা, অথবা রাতের কোনো চোর কিনা ইত্যাদি। কে কি ভাবলো, আর কে কিভাবে আমার দিকে তাকালো সে ব্যাপারে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিলো না। আমি শুধু দৌড়াচ্ছিলাম আর দৌড়াচ্ছিলাম। অবশেষে আমি একটা পানবিড়ির দোকানে এসে থামলাম। কয়েকটা উঠতি বয়সের ছেলে ওখানে চা খাচ্ছিলো।
আমি হাপাতে হাপাতে বললাম-
বাবারে আমি খুব বিপদে আছি। আমার স্বামী আমাকে বেড়ানোর নাম করে নিয়ে এসে আমাকে খারাপ জায়গায় বিক্রি করে দিতে এসছিলো। আমি পালিয়ে এসছি। আমার বাড়ি, নগরঘাট (নামটা ছদ্দনাম)। আমি এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, এই জায়গাটা আমি চিনিও না, আর এখান থেকে আমি আমার গ্রামের বাড়ি কিভাবে যাবো, তাও আমার জানা নাই। আমার ছোট ছোট বাচ্চারা হয়তো এখন আমার জন্য কান্নাকাটি করছে। তোমরা আমাকে একটু সাহাজ্য করো বাবারা। আমি ওদের এটাও বললাম, আমার কাছে একশত টাকা আছে। আমাকে সাহাজ্য করো তোমরা।
জানো কাকা, আসলে এই দুনিয়ায় নরপিশাচ যেমন আছে, তেমনি ভালো মানুষও আছে। সেদিন আমি বুঝেছিলাম, মানুষ কি আর নরপিশাচ কি। ছেলেগুলি আমার কথা শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে গিয়ে বল্লো- কে সে, কই সে। চলেন আমরা ওকে এখন ধরবো। আমি বললাম, কিছুই দরকার নাই বাবারা। তোমরা শুধু আমাকে আমার বাচ্চাদের কাছে দিয়ে চলো। আমি তোমাদের মায়ের মতো, আমি আজিবন তোমাদের জন্য আমার সেই পরম ঈশ্বরের কাছে অশ্রুসিক্ত নয়নে দোয়া করবো। আমাকে তোমরা আমার সন্তানের কাছে নিয়ে চলো বাবারা। বলেই আমি দোকানের সামনে ভেজা মাতিতে বসে পড়েছিলাম। আমার পায়ে কন শক্তি ছিলো না, আমার সারা গা বৃষ্টির পানিতে ভিজে গিয়েছিল, আমার দম প্রায় বন্দ হয়ে এসছিলো। তারপরেও আমার হৃৎপিণ্ড সচল ছিলো, আমার প্রানটা জীবিত ছিলো।
ছেলেগুলি আমাকে টেনে তুলে দোকানের ঝাপের ভিতর নিয়ে গেলো। সব সন্তানের চেহাড়া মনে হয় একই। বিশেষ করে মায়েরদের জন্য। ওরা আমাকে এক কাপ গরম চা দিল, মাথা মুছার জন্য কয়েকটা পুরান পেপার দিলো। আমি যেনো একটু স্থির হচ্ছিলাম। ছেলেগুলির মধ্যে দুইজনের দুইটা হুন্ডা (বাইক) ছিলো। চা খাওয়ার পর, ওরা একটা হুন্ডায় আমাকে আর আরেকটা হুন্ডায় ওরা তিনজন উঠে আমার বাসার অতি নিকটে ছেড়ে গেলো। যেখানে ওরা আমাকে ছেড়ে গেলো, সেই জায়গাটা আমি চিনতাম। সেখান থেকে আমি অনায়াসেই আমার বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমি যখন আমার বাড়িতে আসি, তখন রাত বাজে প্রায় আড়াইটা। সব বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেছে শুধু আমার মগা ছেলেটা বারান্দায় বসে আছে। মশার কামড়ে সে জর্জরীত কিন্তু আমাকে না পেয়ে কখন আমি ফিরবো তারজন্যে একাই বাইরের বারান্দায় বসে আছে। বৃষ্টি হচ্ছিলো, ফোটা ফোটা বৃষ্টিতে ছেলেটার সারা শরীরই প্রায় ভেজা। আমি ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাদলাম। আমার ছেলেটা আমাকে এমন করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদতে লাগলো যে, আশেপাশের মানুষগুলি যারা ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো তারাও সজাগ পেয়ে ছুটে এলো। আমি শুধু কাদছি, কিন্তু কেনো কাদছি, কিসের কষ্টে কাদছি, সেটা আর কাউকেই বলতে পারি নাই। কান্নার আহাজারীতে সুর থাকে না, থাকে বেদনা আর কষ্ট যে কষ্টের কোনো নাম নাই, যে কষ্টের রুপ কাউকে দেখানো যায় না। আমি শুধু কেদেই যাচ্ছিলাম। কষ্টটা ছিলো আমার মনের অনেক গভীরে।
অনেকেই অনেক প্রশ্ন করছিলো, এতো রাতে আমি কোথা থেকে এলাম, কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তরও আমার দিতে ইচ্ছে করছিলো না। আমার স্বামী কই, কিংবা সেতো আমার সাথেই সন্ধ্যার দিকে বেরিয়েছিলো, তার হদিস অনেকেই জানতে চাইলেও আমার কোনো কিছুই বলার মতো অবকাশ তো ছিলোই না বলতেও ইচ্ছে করছিলো না। শুধু আমি আমার সেই এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহকে আকাশের দিকে হাত তুলে বললাম- মহান তুমি, তুমি আছো সর্বদা সবার সাথে, দূর্বলের সাথে, অসহায়ের সাথে। আর তুমি সত্যিই সব পারো মাবুদ। কে বলে ঈশ্বর নাই? যে বলে ঈশ্বর নাই, সে বোকা, আর যিনি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন সে জানে ঈশ্বর কোথায় কিভাবে তার হাত প্রসারিত করে। ঈশ্বর বসবাস করেন সর্বত্র। শ্মশানে, আকাশে, পাহাড়ে, জলে অন্তরীক্ষে, আর থাকেন মনের একেবারে অন্তস্থলে। কান্নায় আমার শুধু বুক ভেসে যাচ্ছিলো।
রাহেলার এমন একটা অতীত জীবনের ইতিহাস শুনে আমি হচকচিয়ে উঠেছিলাম। মহিলাদেরকে আমরা দেবীর সমান তুলনা করে থাকি। কখনো কখনো আমরা তাদেরকে মায়ের আসনে বসিয়ে পুজার বেদী রচনা করে থাকি। কিন্তু আফসোস যে, এটা শুধু মন্দির আর পুজার ঘর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। মহিলাদের সাথে লাগাতার অন্যায় আর অপরাধ ঘটে যাওয়া এটাই প্রমান করে যে, আমাদের সমাজে আমরা যে মহিলাদেরকে দেবী বলি তারা এমন অনেক দানব দ্বারা ঘিরে রয়েছে যারা তাদের জীবনকে নরক করে তুলেছে। প্রকাশ্যে কোনো মহিলাকে পুড়িয়ে মারা হয়, নির্যাতন করা হয়, ধর্ষন করা হয় অথচ কেউ এগিয়ে আসে না। এই সমাজে কেনো মানুষের রক্ত ততক্ষন পর্যন্ত গরম হয় না যতক্ষন না অবধি কোনো সমস্যা তাদের ঘরের ভিতরে চলে না আসে। হিন্দু শাস্ত্রে নাকি একটা কথা আছে-ইয়ত্রা নারায়স্ত পুজায়ান্তে রামাতে তাপ্তা দেবতা অর্থাৎ যেখানে নারির পুজো হয়, সেখানে দেবতা বসবাস করে। এটা আসলে শুধু কথার কথা সত্যিটা অন্যকিছু। কোথাও কখনো কোনো নারীর পুজা হয়নি। না হিন্দু শাস্ত্রে, না আমাদের ধর্মে, না অন্য কোথাও।
রেহালা আবারো বলা শুরু করল-
কাকা-সেই সারারাতে আমি একটুও ঘুমাতে পারি নাই ভয়ে। আমার শরীর ভেংগে গিয়েছিলো, অনেক জ্বর এসছিলো, মাথা ব্যথায় আমার মনে হচ্ছিলো মাথাটাই যেনো আমার সাথে নাই। আমার সেই মগা ছেলেটা সারারাত আমার মাথায় পানি ঢেলে আমার মাথা বুলিয়ে দিচ্ছিলো আর খালী একটা কথাই বলে যাচ্ছিলো-মা আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না। তোমাকে ছাড়া আমি ভয় পাই। যতোবার সে আমাকে এই কথাগুলি বলছে, ততোবারই যেনো আমার ভিতরে কে যেনো এক কঠিন হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে আর বলছে- এই স্বাধীনতার মুল্য কি যেখানে খাচায় বন্দি আমি? এই জীবনের কি অর্থ আছে যেখানে আমি কলা, মুলা আর পন্যের মতো অন্যের ইচ্ছায় বিক্রি হয়ে যাই? এই দাম্পত্য জীবনের কি মাহাত্য যেখানে প্রতিদিন আমাকে শুধু অন্যের মন জোগানর জন্য নিজেকে সপে দিতে হয় পিশাচের কাছে? আমার ভিতরে তখন যেনো রাগ, ঘেন্না আর প্রতিশোধের ইচ্ছাতা বেরিয়ে আসছিলো। আমি হিংস্র হয়ে উঠছিলাম।
রাহেলার এই কথাগুলির সাথে আমি একমত ছিলাম। সত্যি তো। গরীব হওয়া পাপ নয়, উচু সপ্ন দেখাও পাপ নয়, বড় হবার চেষ্টা করাও অপরাধ নয়, কিন্তু অন্য কারো জীবনকে এরুপ নষ্টের দিকে ঠেলে দিয়ে কিংবা অন্যের কোনো আত্মসম্ভরনকে বিকিয়ে দিয়ে কিংবা অন্যের জিনিষকে অন্যায়ভাবে নিজের সার্থের জন্য টাকা রোজগার করা চেষ্টা করা একটা অপরাধ। এই অপরাধের একটা খেসারত আছে। কেউ সাথে সাথে পায়, আর কেউ একটু দেরীতে। কিন্তু প্রাপ্যটা আসেই। লাইফটা কোনো ষ্টক মার্কেটের কোনো শেয়ার নয় যে প্রতিদিন এটার দাম উঠানামা করবে। এটা আসলে সেটা যা একবার উঠে গেলে আর পড়ে না, আবার পড়ে গেলে আর উঠে না।
রাহেলা বলতে থাকে তাঁর সেই রাতের বাকী কথাগুলি।
সকালে আমি উঠানে গেলাম, বসে রইলাম কখন আমার সেই নরপিশাচ স্বামী বাড়িতে আসে। সে হয়তো ইতিমধ্যে জেনে গেছে-আমি আর ঐ নারায়নগঞ্জে নাই। পালিয়েছি। কিছুই খেতে পারলাম না সারাদিন। আর খাওয়ার কিছু ছিলোও না। বমি বমি আসছিলো। দুপুরের দিকে একটু শুয়ে ছিলাম। কিন্তু ঘুমিয়ে ছিলাম না। সেই দুপুরের দিকে আমি ওর পায়ের আওয়াজের সাথে মুখের আওয়াজও শুনলাম। সে ঘরে ঢোকেই চোখ লাল লাল করে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করলো আর আমাকে মেরেই ফেলবে এমন হুংকার দিতে থাকলো। বড় বড় বিস্ফোরণের আগে ছোট ছোট ফুলকীর দিকে নজর দিতে নেই। তাতে বড় বিস্ফোরণের জন্য ব্যাঘাত হয়। আমি একটা শব্দও করলাম না, কোনো উত্তরও করলাম না। কোনো এক শক্তিশালী ঝড়ের আগে যেমন আকাশ থম্থমে হয়ে যায়, গাছপালারা স্থির ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, একটা পাতাও নড়ে না, খালী মাঝে মাঝে গুরুম গুরুম কিছু শুষ্ক ঠাটা পরার মতো আওয়াজ ভেসে আসে কোনো এক দূরবর্তী আকাশ থেকে, ঠিক এমন একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো আমার ঘরে সাথে মনের ভিতরেও। আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম এমন একটা সুযোগের জন্য যাতে আমি আমার বাড়ির পুতাটা দিয়ে ওর মাথায় একটা আঘাত করতে পারি। ওর উপর আমার কোনো প্রকার ভালোবাসা নাই, শ্রদ্ধাবোধ নাই। আমি ওকে যেনো আর চিনি না। কোনো এক সময় যে আমি অর বুকে শুয়েছিলাম সেটাও আমার মনে পড়ল না। সে যে আমার সন্তানের বাবা সেটাও আমার কাছে কোনো অর্থ বহন করে নাই। বারবার মনে হয়েছিলো, এদের বেচে থাকার কোনো মানে হয়না। এরা সর্বদা মানুষের শান্তির জন্য হুমকী, সমাজের জন্য হুমকী। পুতাটা আমি রেডিই করেই রেখেছিলাম আগে।
আমার সেই সুযোগটা এক সময় এলো। আমি একটু সময়ও নষ্ট করিনি। একটা আঘাতই আমি ওর মাথায় করেছিলাম। ও অজ্ঞান হয়ে গেলো। একবার ভাবলাম, ওর গলাটা কেটে দেই, আবার ভাবলাম, না, ওকে এমনভাবে মারবো যাতে সারাজীবন আর সোজা হয়ে দাড়াতে না পারে। আমি ইচ্ছে মতো ওর হাটু আর কোমড়ে পুতা দিয়ে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে থেতলা করে দিয়েছিলাম। আমার কোনো দুঃখ হয় নাই।
আমি রাহেলাকে জিজ্ঞেস করলাম, ও কি মরে গিয়েছিলো?
না কাকা- এই পিচাশটাকে আমি প্রানে একেবারে মেরে ফেলতে চাইনি, আর ও মরেও নাই। কিন্তু ও বেচে গিয়েও আর বেচে থাকবে না এটা আমার বিশ্বাস। তার কয়েকদিন পর আমি ওকে তালাক দিয়ে ওখানেই ছেলেদের সাথে রয়ে গেলাম। কিন্তু বাপের বাড়ি ফিরি নাই। সে এখন পংগু। এটাই ওর বিচার। কিসের সমাজ, কিসের আদালত, কিসের হিউমেনিটি? আমার কোনো আফসোস নাই। একা জীবন অনেক ভালো এসব নরপিশাচের সাথে থাকার চেয়ে। ওকে এভাবে মারার কারনে কেউ আমাকে বাধা দেয় নাই। কারন সবাই জানতো ওর ব্যবহার, আর ওর চরিত্র। তার উপরে যখন সবাই জেনেই গিয়েছিলো গতকাল রাতে সে আমার সাথে কি করেছিলো, ফলে কেউ আমাকে একটু বাধাও দেয় নাই, কোনো থানা পুলিশও করে নাই। ওর নিজের ভাইবোনেরাও এগিয়ে আসে নাই। নরপিশাচেরাও অনেক সময় নরপিশাচের জন্য অনুভুতি প্রকাশ করে না। সে একটা নর পিশাচের থেকেও অধম। একটা কথা বলি কাকা- যে যেমন কর্ম করবে, সে তেমন ফল পাবে এটাই আসল কথা। যে বীজ তুমি আজ বুনবে, সেই বীজের ফল তোমাকেই খেতে হবে। আর সেটা যদি কোনো অপরাধের বীজ হয়, তাহলে তা ধীরে ধীরে যে গাছে রুপান্তরীত হয়, তার নাম “প্রতিশোধ”। আর প্রতিশোধের গাছের কোনো না হয় আকার, না হয় ছায়া। রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে যায় তখন তার পরিনতি তো এটাই হয়। আর ওর সেটাই হয়েছে।
আমি স্বাধীন হয়ে গেলাম। আমার আর কোনো পিছুটান রইলো না। আমার পরিবার ভেংগে গেলো। যখন কোনো পরিবার ভাংগে, তার সাথে ভাংগে সবকিছু যা পরিবারকে বেধে রাখে, আর সেগুলি হচ্ছে বিশ্বাস, আদর, আবেগ, মায়া, ভালোবাসা এবং সবকিছু। একটা পরিবার তৈরী করতে অনেক বছর লেগে যায়, পরিবার আমাদের বেচে থাকার কারন হয়ে দাঁড়ায়, যখন ভাংতে শুরু করে পরিবার তখন সেই পরিবারকে আমরা সবচেয়ে বড় শত্রু বলে মনে করতে থাকি। যে পরিবারের আনন্দ আমাদের বাচার রশদ হয়ে উঠে, রাগ এবং প্রতারনার যন্ত্রনা সেই পরিবারকে আঘাত দিতেই বাধ্য করে তোলে। মানুষ যখন আপনজনকেই ঘৃণা করতে থাকে। আমার সেই স্বামীর বাড়ির প্রতিটি মানুষকে আর কখনো আপন মনে করতে পারিনি। শুধু আমার সন্তানদের ছাড়া।
অপমান আর অবসাদে অবনত হয়ে একদিন আমি আমার স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করে বাপের বাড়িতে এসে পড়ি। আমার বাবা মা বিয়ের আগে যে পরিমান কাছের ছিলো, স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসার পর তাদেরকে আর আমি ততোটা কাছে পেয়েছি বলে মনে হলো না। আমি তাদেরকেও এ ব্যাপারে খুব একটা দোষারুপ করি না। তারাও দরিদ্র, আমিও। আমরা হয়তো একই বৃন্তে ঝুলে ছিলাম। সময়ের স্রোত ধরে এক সময় বুঝতে পারলাম, আমাকে একাই চলতে হবে। এখন একাই থাকি, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, নামাজ পড়ি, কোরআন পড়ি, তসবিহ গুনি আর ভাবি, জীবন বড় রহস্যময়। হয়তো আমি আজ থাকতাম এমন এক জীবনে বন্ধী যেখানে মানুষ আর মানুষ থাকে না।
ঠিক ওই সময়ে কাকা আপনি গ্রামে গিয়েছিলেন শুনেছিলাম। একবার ভেবেছিলাম, আপনার সাথে একবার দেখা করি, আবার ভাবলাম, আপনি কি না কি ভাবেন কে জানে। লজ্জা এমন এক জিনিষ, যাকে না লুকানো যায়, না কাউকে বুঝানো যায়। ভিতরটা কেউ দেখে না যদিও সত্যিটা ভিতরেই থাকে। একটা কথা আছে না কাকা- আয়নায় চেহারা দেখা যায় কিন্তু কষ্ট দেখা যায় না। কিন্তু আমি আমার ভিতরের এই কষ্টটা কাউকেই বুঝাতে পারিনি। না আমার বাবাকে, না আমার মাকে, না আমার আশেপাশের কাউকে। কিন্তু ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া কোনো ব্যক্তিত্ত বেশীদিন অসহায় থাকে না। আমি যতটুকুই লেখাপড়া করেছিলাম, সেটা দিয়েই কিছু করার চেষ্টা করছিলাম, বিশেষ করে ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ানো। কিন্তু খুব একটা এগুতে পারিনি। পরে একটা সেলাই মেশিন নিয়ে মাঝে মাঝে বাচ্চাদের কিছু কাপড় বানিয়ে নিজের সন্তানের ভরন পোষনের চেষ্টা করেছি। প্রায় এক যুগ পার হয়ে গেছে। আমার মগা ছেলেটা এখনো বিয়ে করে নাই। ভারায় গাড়ী চালায়, যা রোজগার করে তা দিয়াই আমাদের সংসার কোন রকমে চলে যায়।
এতোক্ষন ধরে আমি রেহালার সবগুলি কথা খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম। ওর কথার রেশ ধরে আমার সারা শরীর কখনো শিহরিত হয়ে উঠিছিলো, কখনো ভয়ে আবার কখনো রেহালার স্বামীর এহেনো পৈচাশিক কাজের উপর রাগে। সমুদ্রে ভাসমান কোনো নাবিকের কাছে দূরের কোনো তটভুমি যেমন একটা আকর্ষনের বিষয় হয়ে দাড়ায়, রেহালার জীবনে তেমন কোনো কিছুর উপর আকর্ষন আর বাকী আছে বলে আমার মনে হলো না। রেহালা আমার সম্মুক্ষে বসে আমার বিস্তর প্রকান্ড কাচের জানালা দিয়া দূরের নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে বটে কিন্তু ওই নীল শান্ত আকাশের মতো রেহালার অন্তরে তেমন হয়তো শান্তির নীরবতা বিরাজ করছে না। হয়তো ওর মাথা, বুক আর অন্তর একসাথে এমন এক ঘূর্নীঝড়ের মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছিল যার আভাষ ওর চোখের নোনাজলেই বুঝা যাচ্ছে। আমি রেহালাকে আর কোন প্রশ্ন করলাম না। কিছুক্ষন পর রেহালা একটু শান্ত হলে আবার বলতে শুরু করলো-
কাকা-এখন অনেক বয়স হয়ে গেছে। আমার সারা শরীর যেনো রোগের একটা আবাসভুমিতে তৈরী হয়েছে। ডায়াবেটিস, প্রেসার, কানের, চোখের, হার্টে কোনো রোগের যেনো কমতি নাই। মগা ছেলেটা যা কামায়, তাতে হয়তো আমাদের দুজনের খাবার জুটে যায় কিন্তু আমার এই বাড়তি রোগের খরচ, কিংবা পর্বনের কোনো ব্যয়ভার চলে না। রোগটাকে এখন আমার নিত্যসংগী মনে করে কখনো সেই ঈশ্বরের কাছে রোগ মুক্তির দোয়া করি, আর যদি অতিরিক্ত খারাপের দিকে যাই, তখন এই আমার বোনেরা, কিংবা পাড়াপ্রতিবেশীরা হয়তো কিছু দান করে, তাঁর থেকেই কিছু পথ্য কিনে খাই। আগুনের ফুলকী যেমন কীট পতঙ্গকে দূরের আকাশের নক্ষত্র রাজীর লোভ দেখিয়ে আকর্ষন করে, অতঃপর তারা মৃত্যুবরন করে, আমি এখন অদৃশ্য ঈশ্বরের কাছে একটাই প্রার্থনা করি যেনো মরনের লোভ দেখিয়ে ঈশ্বর আমাকে দ্রুত এই জীবনের যবনীপাত করান। সেই ছোটবেলায় কত স্বপ্ন দেখেছি সংসার হবে, স্বপ্ন দেখেছি স্বামীর বুকে মাথা রেখে কত গান শুনাবো, বাচ্চাদের কলকাকলীতে আমার উঠোন ভরে উঠবে আরো কতকি? অথচ আজ শুধু এইটুকুই মনে হয়, জীবন বড্ড জটিল। এখন শুধু মৃত্যুর ক্ষন ছাড়া আমার যেনো কোনো কিছুর জন্যই আর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নাই। গভীর রাতে একা ঘুমহীন বিছানায় বসে মাঝে মাঝে জীবনের হিসাব মিলাতে চেষ্টা করি, আখাংকা আর কল্পনার রাজ্যে কত মায়াজাল তৈরী করিয়া কত মায়াপুরীর হিসাব করেছিলাম, কিন্তু আজ প্রায়ই মনে হয় যে, আমার জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত, জীবন যৌবন, সুখ দুঃখ, একাল সেকাল সবকিছুই মোমবাতির মতো পুড়িয়া শেষ প্রান্তে এসে হাজির হয়েছে। আমার এই ক্লান্তি, কষ্ট, গ্লানি কিংবা প্রানক্ষয়কর দাহ হয়তো আর বেশিদিন থাকবে না।
আমি রেহালার সাথে আর অনেক কথা বাড়াই না। আমি যাহা বুঝবার সব বুঝে গিয়েছিলাম। শুধু বারবার একটা কথাই ভাবতেছিলাম, আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে আমি আর রেহালা একসাথে একই স্কুলে পড়াশুনা করেছি। তখন রেহালা যে স্বপ্ন দেখেছিলো, তার ভবিষ্যৎ জীবনের, তার সংসার জীবনের, আজ এতো বছর পর এসে রেহালা দেখতে পেলো তার সেই সপ্নগুলি আসলে সব সপ্নই থেকে গেছে। খুব কষ্ট লাগতেছিলো আমার। আমাদের এই সমাজ, আমাদের নীতি নির্ধারকেরা আজো প্রতিটা মেয়েকে বোঝাই মনে করে। সবাই মনে করে-তাদের লেখাপড়ার দরকার নাই, তাদের প্রেমের কোনো মুল্য নাই, তাদের বাকস্বাধীনতা নাই, তাদের নিজস্ব কোনো পছন্দ অপছন্দও নাই। ওরা জন্মায় শুধু কাউকে নিজের অনিচ্ছায়ই হোক আর সেচ্ছাতেই হোক বিয়ে করা। আর সেই বিয়ে টিকার দায়িত্ব শুধু তাদের। ওরা জামাইয়ের মার খাবে, স্বামীরা ওদেরকে নিজের থালা-কলসীর মতো কিছুদিন ব্যবহার করে আবার অন্য কোথাও বিক্রি করে দিবে। অথবা কোনো দায়িত্ব না নিয়াই অন্য আরেকজনের সাথে ফষ্টিনষ্টি কিংবা ঘর করবে। আর মাঝখানের সময়টায় ওরা বছর বছর বাচ্চার জন্ম দিবে। এটাই যেনো ওদের একমাত্র কাজ। রেহালা আমার সামনে বসে আছে বটে কিন্তু ওর দৃষ্টি আমার জানালার বাইরে অনেক দূরের আকাশে। তার মনে কি চলতেছে আমি জানি না, তবে সেই দূরের আকাশে কোনো নতুন স্বপ্ন যে নাই, সেটা স্পষ্ট বুঝা যায়। সে তার এই জীবনের সুখ কিংবা আদর আর প্রত্যাশা করে না। শুধু সময় গুনছে কবে মৃত্যু তাকে লইয়া যাবে। আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই, আমরা আজীবন বাচতে চাই, কেউ এই দুনিয়া ছেড়ে মৃত্যুর মতো একটা অজানা জীবনে যেতে চায় না। অথচ রেহালার ভাষায়, সে প্রতিদিন নামাজ পড়ে সেই স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে যেনো মৃত্যু এসে রেহালাকে নিয়ে যায়।
অনেকক্ষন আমার অফিসে একটা নীরবতা চলছিলো। রেহালার জীবনের কাহিনী বলবার পর যেন সে নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার ভাবনা ভুল প্রমান করে রেহালা আবারো বলিতে থাকে-
-কাকা, আজ অনেক কষ্টের কথা আপনাকে বলতে পেরে নিজেকে অনেক অনেক হালকা মনে হচ্ছে। আমি জানি না, কেনো আমাদের মতো মানুষের এই পৃথিবীতে জন্ম হয়। মা হিসাবে আমরা যেমন অসফল, স্ত্রী হিসাবেও তেমনি অসফল। এই সমাজ আমাদেরকে না কখনো মুল্যায়ন করে, না নিজের ঘরের পিতা মাতা আমাদেরকে বুকে আগলে ধরে রাখে। আমরা যেনো সমাজের সেই প্রানিগুলির মতো, যারা একবার জন্ম নিয়াছে বলে শুধু মৃত্যু না আসা অবধি দেহত্যাগ করে না আবার নিজেরাও নিজেকে শেষ করতে পারে না কারন আত্তহত্যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। অথচ দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অবহেলায় কচূরীপানার মতো আমরা এককুল হতে আরেককূলে শুধু ভেসেই যাই, না কেউ আমাদেরকে তুতুলে নেয়, না কেউ আশ্রয় দেয়। তারপরেও আমরা বেচে থাকি। এখন সত্যিই আর বাচতে ইচ্ছা করে না। আজ আপনার সাথে দেখা হলো-মনটা বড় ভালো লাগলো। মনেই হয় না এর মধ্যে ৪০ বছর পার করে দিয়েছি। মনে হচ্ছে, এই তো সেদিনের কথা। সেই শীতের দিনে জড়োসড়ো হয়ে গায়ের পথ ধরে হেটে বেড়াইতাম, স্কুলে গিয়া একসাথে কত মজা করতাম, বৃষ্টির দিনে ভিজতাম, আজ মনে হয়-আহা যদি আরো একবার আবার সেই পুরান দিনে ফিরে যেতে পারতাম। আহা যদি এই পিশাচের মতো কেউ আমার জীবনে না আসতো, আহা-যদি এমন কেউ আসতো যে আমার সেই গানগুলি শুনে শুনে পাশে বসে হাততালি দিতো। আসলে জীবন মনে হয় এমনই, আবার কেনো জানি মনে হয়, সব জীবন এমন নয়। তাহলে আমাদের জীবন এমন কেনো?
আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। শুধু রেহালাকে বললাম, পৃথিবীটা এমন নয় যা দেখছিস। এই পৃথিবী অনেক অনেক সুন্দর। হয়তো ভুল সময় ভুল মানুষের পাশে গিয়ে ভুলভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছিলি। আর সেই ভুল মানুষটাই তোকে ভুল পথের দিকে তোর নিজের অজান্তে নিয়ে গিয়েছিলো। ভুলে যা সব। বললাম, আজ থেকে বহু বছর আগের আমার গ্রামের একমাত্র মেয়ে খেলার সাথী তুই। তোকে দেখেও আমি অনেক খুশি হয়েছি রেহালা। আসিস যখন মন খারাপ হয়, যখন কোনো রাস্তা না দেখা যায়। আমি তোর কাকাই বলিস আর বন্ধুই বলিস, আসিস। রেহালা তার শাড়ির আচলটা টেনে চোখ দুটি মুছে বের হবার উপক্রম হলো। যাওয়ার সময় হটাতই রেহালা আমার পায়ে সালাম করার জন্য উদ্যত হলে আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তুই আমার শুধু বন্ধু না রেহালা, তুই আমার বোনও। আমার কি হলো জানি না, আমার চোখটাও কেনো জানি ঝাপ্সা হয়ে গেলো।
রেহালা তার চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে গেলো। আমি শুধু ওর যাওয়াটা দেখলাম। আর ভাবিলাম,
প্রতিটা মেয়ে মানুষের উচিত নিজের পায়ের উপর দাঁড়ানো। যতোদিন তারা নিজেরা সাবলম্বি না হবে, তারা আজীবন ভুল সময়ে ভুল মানুষের কাছেই হস্তান্তর হতে থাকবে। হয়তো কতিপয় কিছু অধীক ভাগ্যবান মেয়েরা ছাড়া যাদের সংখ্যা অতীব নগন্য। দোয়া করি-রেহালারা ভালো থাকুক। আর দুঃখ হয় সেইসব বাবা মায়ের জন্য যারা নিজের মেয়ে সন্তানকে তাদের ছেলে সন্তানের মতো একই সাড়িতে ভাবেননা। অথচ দুটাই তাদের সন্তান। কে জানে, সেই বাবা মায়েরও কোনো একদিন এমন এক পরিস্থিতিতে পড়তে হয় যখন এইসব মেয়েদের ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার পথ খোলা হয়তো থাকবে না।
আমি রাহেলার জন্য একটা টাকা প্রতিমাসের জন্য বরাদ্ধ করলাম যাতে অন্তত রাহেলা তার ঔষধগুলি কিনে খেতে পারে। রাহেলার জন্য হয়তো এটা একটা অনেক বড় সাহাজ্য হবে। রাহেলা এখন প্রায় প্রতিমাসেই আমার একাউন্ট অফিসারের কাছ হতে সেই টাকাটা নিতে আসে। কখনো ওর সাথে আমার দেখা হয়, কখনো দেখা হয় না। তারপরেও আমি শান্তি পাই যে, রেহালারা এখনো বেচে আছে।
রেহালার স্বামী এখন পুরুই পংগু। কোনো রকমে ভিক্ষা করে জীবন চালায়। তার পাশে এখন আর কোনো রেহালারা নাই, না আছে তার কোনো মগা সন্তান।
টাইটানিক ট্র্যাজেডির শতবর্ষ
এম এ মোমেন
ঢাকা, শনিবার, ১৪ এপ্রিল ২০১২, ১ বৈশাখ ১৪১৯, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৩৩
“শতবর্ষ আগে মহাসমুদ্রের বিস্ময় টাইটানিক উদ্বোধনী যাত্রায় সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্কের পথে চতুর্থ দিন ১৪ এপ্রিল ১৯১২ রাত ১১টা ৪০ মিনিটে আটলান্টিকের ঘাতক আইসবার্গের সঙ্গে সংঘর্ষে বিপন্ন হয়ে পড়ে। অবিরাম এসওএস বার্তা যেতে থাকে টাইটানিক থেকে। দুই ঘণ্টা ৪০ মিনিট পর রাত দুইটা ২০ মিনিটে (তখন ১৫ এপ্রিল) প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং অহংকার নিয়ে টাইটানিক আটলান্টিকে তলিয়ে যায়। টাইটানিকের এক হাজার ৫১৭ জন শীতার্ত যাত্রী ও ক্রু ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উষ্ণতার সমুদ্রজলে অসহায় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
হোয়াইট স্টার লাইনারের সঙ্গে বেলফাস্টের জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হারল্যান্ড এন্ড ওলফের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ১৮৬৭ সাল থেকে। এই প্রতিষ্ঠানেরই তৈরি তিনটি অলিম্পিক ক্লাস জাহাজ; হোয়াইট স্টারের চেয়ারম্যান ব্রুস ইজমে এবং মার্কিনি তহবিলদাতা জে পি মর্গানের ইচ্ছায় এবং উদার ব্যয়ে টাইটানিক হয়ে ওঠে সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে বিলাসবহুল জাহাজ। কেবল সমুদ্রের বিস্ময় নয়, এটাকে মনে করা হয় মর্ত্যের সুন্দরতম ভাসমান প্রাসাদ।
স্পেশাল লাক্সারি স্যুটসহ ‘এম্পায়ার স্টাইল’ প্রথম শ্রেণীর ধারণক্ষমতা ৭৩৯ জন যাত্রী, দ্বিতীয় শ্রেণীর ৬৭৪ জন এবং তৃতীয় শ্রেণীর এক হাজার ২০ জন; জাহাজের ক্রু সদস্য ৯০০; সব মিলিয়ে ২৫ নটিক্যাল মাইল বেগে ধাবমান টাইটানিক তিন হাজার ৩৩৯ জনকে তাঁদের মালামালসহ পরিবহন করতে সক্ষম এবং ঘোষণা করা হয় আরএমএস টাইটানিক আনসিংকেবল—কখনো ডুববে না। ২ এপ্রিল ১৯১২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। ৩১ মে ১৯১১ সাল। দুপুর সোয়া ১২টায় যখন টাইটানিককে সমুদ্রে ভাসানো হয়, তা দেখতে জড়ো হয়েছিল এক লাখ দর্শক। নিউইয়র্কের পথে প্রথম যাত্রায় ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড জন স্মিথের নেতৃত্বে ৮৮৫ জন ক্রু জাহাজে আরোহণ করেন। যাত্রী ছিলেন এক হাজার ৩১৭ জন (প্রথম শ্রেণী ৩২৪, দ্বিতীয় শ্রেণী ২৮৪ এবং তৃতীয় শ্রেণী ৭০৯); ধারণক্ষমতার প্রায় অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নিয়ে টাইটানিকের যাত্রা। ১০ এপ্রিল ১৯১২, দুপুরে সাউদাম্পটন থেকে শুরু হয় পশ্চিমমুখী শুভযাত্রা। শুরুতেই মাত্র চার ফুটের জন্য ‘এসএসসিটি অব নিউইয়র্ক’ জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে সমর্থ হয়। ৭৭ নটিক্যাল মাইল এগিয়ে শেরবুর্গ থেকে ২৭৪ জন যাত্রী তুলে নেয়। ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে ১১টায় আয়ারল্যান্ডের কর্ক পোতাশ্রয় থেকে জাহাজে ওঠেন ১১৩ জন তৃতীয় শ্রেণীর এবং সাতজন দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রী। তারপর তিন দিন কেবল অবিরাম সাগরে চলা। ১৪ এপ্রিল রাতেই আইসবার্গের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে এবং বিশ শতকের অন্যতম প্রধান সামুদ্রিক ট্র্যাজেডি।
তারপর আটলান্টিকের অতলে টাইটানিকের অবস্থান জানার চেষ্টা চলতে থাকে বছরের পর বছর। ১৯৮৫ সালে এর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আনসিংকেবল টাইটানিক এখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ হাজার ৬০০ ফুট নিচে আটলান্টিকের তলদেশে স্থির হয়ে আছে। দ্বিখণ্ডিত জাহাজটির দুটো টুকরো ১৯৭০ ফুট দূরে অবস্থান করছে। টাইটানিকের সম্মুখভাগ সমুদ্রতলে ৬০ ফুট মাটির গভীরে প্রোথিত। ১৪ জুলাই ১৯৮৬, ঘটনার ৭৪ বছর পর টাইটানিক পুনরাবিষ্কৃত হয়। টাইটানিক থেকে উদ্ধার পাওয়া বয়োকনিষ্ঠ যাত্রী মিলভিনা ডিনের বয়স তখন মাত্র নয় সপ্তাহ। ৩১ মে ২০০৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পর টাইটানিক থেকে বেঁচে যাওয়া আর কেউ জীবিত রইলেন না।
টাইটান না টাইটানিকঃ মর্গান রবার্টসনের উপন্যাস ফিউটিলিটি—দ্য রেক অব দ্য টাইটান প্রকাশিত হয় ১৮৯৮ সালে। টাইটান মানুষের তৈরি সর্বশ্রেষ্ঠ ভাসমান জলযান; এটি সর্ববৃহৎ জাহাজও। বিলাসিতার মাপকাঠিতে প্রথম শ্রেণীর হোটেলের যত আয়োজন, তার কোনোটির কমতি নেই টাইটানের কেবিনে।টাইটানের নির্মাণে ব্যবহূত হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এই জাহাজে ১৯টি ওয়াটার-টাইট কম্পার্টমেন্ট। এ বিস্ময়কর জাহাজ কখনো ডোবার নয়। টাইটানের যাত্রী ও ক্রু ধারণক্ষমতা তিন হাজার; পুরোটাই যাত্রীবোঝাই ছিল।যেহেতু এ জাহাজ ডোবার নয়—লাইফবোটের প্রয়োজন নেই। তবু বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, ২৪টি বোট টাইটানে রাখা ছিল।উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে আইসবার্গের সঙ্গে সংঘর্ষে টাইটান ডুবে যায়। মৃত্যু হয় দুই হাজার ৯৮৭ জন যাত্রী ও ক্রুর।মর্গান রবার্টসনের কল্পলোকের টাইটান এবং বাস্তবের টাইটানিক ট্র্যাজেডির কিছু সাদৃশ্য বিস্মিত না করে পারে না।
আলফ্রেড রোর অমঙ্গল আশঙ্কা!
সাউদাম্পটন বন্দর ছেড়ে ফ্রান্সের শেরবুর্গ হয়ে টাইটানিক পৌঁছায় দক্ষিণ আয়ারল্যান্ডের কুইন্সটাউন বন্দরে। কিন্তু অতিকায় টাইটানিকের জন্য জাহাজঘাটটি ছোট এবং বন্দরের জলসীমার গভীরতাও কম। সুতরাং, সমুদ্রেই নোঙর ফেলল টাইটানিক। ছোট জাহাজে করে যাত্রীদের বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়, যাত্রীরা কিছুটা সময় ঘুরেফিরে কেনাকাটা করে, চা খেয়ে আবার ফিরে আসে টাইটানিকে। এদের একজন আলফ্রেড রো, অন্যদের সঙ্গে তিনি নেমেছিলেন। জাহাজে বসে স্ত্রীকে একটি চিঠি লিখে বন্দরের পোস্ট অফিসে দিয়ে জাহাজে ফিরে আসেন।
চিঠিতে টাইটানিকের বিস্ময় নিয়ে কোনো জাঁকালো বর্ণনা দেননি, বরং লিখেছেন, জাহাজটি বাড়াবাড়ি রকমের বড় এবং এতে বিপদের ঝুঁকি আছে। জাহাজ ছাড়ার পর পরই টাইটানিকের উত্তাল ঢেউয়ে অপেক্ষমাণ জাহাজ এসএস নিউইয়র্ক নোঙর ছিঁড়ে টাইটানিকের ওপর এসে পড়েছিল প্রায়, সংঘর্ষ হলে টাইটানিকের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারত, সে কথা লিখলেন রোর। টাইটানিক তাঁর পছন্দ হয়নি। তবে টাইটানিকের টার্কিশ বাথ তিনি বেশ উপভোগ করেছেন।
‘অন বোরড্ আরএনএস টাইটানিক’ শিরোনামের প্যাডে আলফ্রেড রো তাঁর স্ত্রী কনস্ট্যান্সকে চিঠিটি লিখেছিলেন ১১ এপ্রিল ১৯১২; টাইটানিকের প্রথম শ্রেণীর যাত্রী ছিলেন তিনি, বয়স ৫৯, ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, বাড়ি ইংল্যান্ডের লিভারপুলে।
ধারণা করা হয়: টাইটানিক যখন ডুবে যাচ্ছিল, আলফ্রেড সাঁতরে আইসবার্গের এক খণ্ড বরফের ওপর উঠতে পেরেছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড ঠান্ডায় জমে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। পরে একটি উদ্ধারকারী জাহাজ তাঁর বরফশীতল জমাট দেহ উদ্ধার করে।২০০৭ সালে টাইটানিক ট্র্যাজেডির ৯৫তম বছরে আলফ্রেড রোর চিঠি এবং কনস্ট্যান্স রোর ডায়েরি নিলামে ওঠে।
অসংখ্য ‘যদি’ কান্নায় ভেসে আসে
যদি যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে শুরুতেই যাত্রা কয়েক ঘণ্টা পিছিয়ে যেত? যদি আকাশে নতুন চাঁদ না হয়ে পূর্ণিমা রাত হতো—আইসবার্গ তো খালি চোখেই দূর থেকে দেখা যেত।
যদি ৫০টা লাইফবোট থাকত?
টাইটানিক ইজ ইন ডেঞ্জার
বিপদ আঁচ করার পর রেডিও অপারেটর বিলম্ব করেননি। ‘এসওএস টাইটানিক ইজ ইন ডেঞ্জার হেল্প হেল্প এসওএস’—বারবার এই বার্তা পাঠাতে থাকেন। ততক্ষণে ওয়াল্টার লর্ডের বর্ণনা অনুযায়ী, টাইটানিকের বেতারকক্ষে বরফশীতল পানি ঢুকতে শুরু করে। যখন অপারেটরের কোমর পর্যন্ত পানির নিচে তখনো তিনি এসওএস পাঠিয়েই যাচ্ছেন। ওই সময় ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ২০ মিনিট দূরত্বে বিশাল জাহাজ কালিফোর্নিয়ান অবস্থান করছিল, কিন্তু রেডিও সিস্টেম বন্ধ করে ঘুমিয়ে ছিলেন ওই জাহাজের অপারেটর। বার্তা পেয়েছিল অনেক দূরের একটি জাহাজ, কার্পাথিয়া। কার্পাথিয়া সর্বোচ্চ গতিতে এগোতে থাকে টাইটানিকের দিকে। কিন্তু টাইটানিক যে অনেক দূরে!
টাইটানিকের শিশু
উদ্ধারকারী জাহাজ ম্যাকে বেনেটের সাহসী নাবিকেরা আটলান্টিকে তলিয়ে যাওয়া অনেক মৃতদেহ উদ্ধার করেন। অনেককেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়। যাদের শনাক্ত করা যায়নি, তাদের একজন পশমি জ্যাকেট পরা একটি শিশু। কেউ এই শিশুর স্বজন এ দাবি নিয়ে এগিয়ে আসেনি। ফলে এই অশনাক্ত টাইটানিক শিশু হ্যালিফ্যাক্সে সমাহিত হয় ‘অচেনা শিশু’ হিসেবে। লেকহেড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওন্টারিও, নৃতাত্ত্বিক রায়ান পার এবং লেখক অ্যালান রাফম্যানের সম্মিলিত চেষ্টা জনগণের বাধার মুখে কবর খনন করে ক্ষয়ে যাওয়া হাড়ের একাংশ নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। শিশুটির তিনটি দাঁত ছিল। কবরে একটি লকেটও পাওয়া যায়—লকেটে লেখা ‘আওয়ার বেবি—আমাদের শিশু’। অনুমান করা হয়, এই লকেটটি মৃতদেহ সমাহিত করার সময় শিশুটির সঙ্গে দেওয়া হয়। সম্ভাব্য অনেকের সঙ্গে মিলিয়ে দীর্ঘ গবেষণার পর বের হয় এই শিশুটির নাম ইনো। তার বাবা, মা ও চার ভাইও একই সঙ্গে আটলান্টিকে সমাহিত। ১৩ মাস বয়সী এই মেয়েটি ছিল ফিনল্যান্ডের।
একটি বিস্ময়কর টাইটানিক গল্প
নারী ও শিশুদের জন্য লাইফবোট। এই আইন মেনে নিয়েছে সবাই। কিন্তু মানেনি এর মধ্যেও শ্রেণীবৈষম্য। টাইটানিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রায় সব শিশুকেই বাঁচানো হয়েছে, কিন্তু তৃতীয় শ্রেণীর ৭৬ জন শিশুর মধ্যে বেঁচেছে মাত্র ২৩ জন, ৬০ শতাংশ তলিয়ে গেছে আটলান্টিকের গভীরে। জেরোম বার্ক নামের বালকটির জন্ম কর্ক সিটির কাছাকাছি গ্লেনমায়ারে। তার দুই বোন আমেরিকায় চলে গেছে। জেরোমও যেতে চায়। ঠিক করেছে ১৯১২-এর বসন্তকালে যাবে। এদিকে আরেক বোন নোরার বন্ধুত্ব টাইটানিকের টিকিট অফিসের একজন চেকারের সঙ্গে। ছোট ভাইটির জন্য নিজেই বিস্ময়কর জাহাজ টাইটানিকের উদ্বোধনী যাত্রার টিকিট কিনে দেয়। জেরোম কুইন্সটাউন থেকে জাহাজে উঠবে। তার স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে।বাড়ি থেকে কুইন্সটাউনের পথে বের হওয়ার আগে প্রতিবেশী মিসেস ম্যাক ও কোনেল এক বোতল পবিত্র জল নিয়ে এলেন। এর খানিকটা একটা ছোট বোতলে ভরে ছেলেকে দিলেন, ছেলে সঙ্গে নেবে। এক বছর আগে নোরা যখন লাউস সফরে যায়, তখন এই বোতলটি কিনেছিল। জাহাজ কর্ক উপকূলে কুইন্সটাউন বন্দর থেকে ছেড়ে দিল। তার পরের অংশ তো জানাই। ১৪ এপ্রিল রাতে আইসবার্গের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে টাইটানিক ডুবে যেতে থাকে। আড়াই ঘণ্টা পর জাহাজটি দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যায় আটলান্টিকের তলদেশে। তখন ১৫ এপ্রিল। আরও অনেকের মতো জেরোমের পরিবারের সদস্যরা আটলান্টিকের এপারে ওপারে দিন গুনতে থাকে—জেরোম নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। তারপর ভিন্ন প্রত্যাশা—নিশ্চয়ই জেরোমের মৃতদেহটা পাওয়া যাবে। তারপর সব আশা ফুরিয়ে আসে—জেরোম চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে মহাসাগরের অজানা গহিনে। ১৯১৫-এর গ্রীষ্মে ডানকেটল সৈকতের কাছে কুকুর নিয়ে হাঁটার সময় একটি ভিন্ন ধরনের বোতল পান। বোতলের ছিপি খোলার পর ভেতরে একটি প্যাঁচানো কাগজে পেনসিলে লেখা:
১৩/৪/১৯১২,টাইটানিক থেকে সকলকে বিদায় গ্লেনমেয়ারের বার্কদের
কর্ক
ঔৎসুক্য ও গবেষণায় বেরিয়ে এল, বোতলটি সেই পবিত্র জলের, হাতের লেখা জেরোমের। তবে তারিখ লিখতে সম্ভবত সে ভুল করেছে, ১৪ এপ্রিলের বদলে লিখেছে ১৩ এপ্রিল। হয়তো ভালো করে ছিপি এঁটে নিজেই নিক্ষেপ করেছে আটলান্টিকে। তিন হাজার মাইল পরিভ্রমণ করে বোতল ফিরে এসেছে কর্ক বন্দর হয়ে জেরোমের জন্মস্থানে। ১৪ মাস পর বোতলটি মানুষের হাতে পড়েছে। জেরোমের কোনো সমাধি নেই। জেরোমের মা সন্তুষ্ট, অন্তত তার একটা কিছু তো পাওয়া গেছে।
ঘাতক আইসবার্গ
যে আইসবার্গের সঙ্গে সংঘর্ষে টাইটানিকের এই ভয়াবহ পরিণতি, তা কিন্তু অতিকায় নয়। জাহাজটির চেয়ে আকারে অনেক ছোট।যাত্রাপথে যে আইসবার্গ রয়েছে টাইটানিক এ ধরনের ছয়টি সতর্কবার্তা পায়। কিন্তু বেতার অপারেটর যাত্রীদের ব্যক্তিগত বার্তা পাঠানো নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে সতর্কবার্তা আমলে নেননি। যে আইসবার্গের সঙ্গে টাইটানিকের সংঘর্ষ হয় তা আর সব আইসবার্গের মতো সাদা বর্ণের ছিল না। রাতের আকাশে আইসবার্গের প্রতিবিম্বজনিত কালো ছায়ার কারণে এ ধরনের আইসবার্গকে ব্ল্যাকবার্গ বলা হয় এবং খুব কাছাকাছি স্থান থেকেও দেখা যায় না। টাইটানিকের বেলায় আইসবার্গ দেখা ও সংঘর্ষের মাঝখানে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার মতো সময় ছিল মাত্র ৩৭ সেকেন্ড।
টাইটানিক যেন ভাসমান রাজপ্রাসাদ
এমন বিশাল ও জৌলুশপূর্ণ জাহাজ পৃথিবীতে একটিই। টাইটানিককে যাঁরা মহাসাগরের বুকে একটি রাজপ্রাসাদ আখ্যা দিয়েছেন, তাঁরা সে সময়ের প্রেক্ষাপটে খুব বাড়িয়ে বলেননি।
৮৮২ ফুট ছয় ইঞ্চি দীর্ঘ জাহাজটি তিনটি ফুটবল মাঠেরl সমান। তলা থেকে চূড়া পর্যন্ত টাইটানিক ১৭৫ ফুট উঁচু। মোট নয়টি ডেক, কিংবা বলা যায় নয়তলা।
টাইটানিকের ইঞ্জিন প্রতিদিন ৮০০ টন কয়লা পোড়ায়। জাহাজটি সর্বোচ্চ ২৪ নটিক্যাল মাইল কিংবা ঘণ্টায় ২৭ মাইল বেগে ছুটতে পারে।
জাহাজের প্রতিটি কক্ষে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে, ১০ হাজার আবশ্যকীয় বাল্ব সংযোজন করা হয়েছে।
জাহাজে উষ্ণজলের একটি সুইমিংপুল, একটি জিমনেশিয়াম, দুটো পাঠাগার, এবং দুটো চুল কাটার সেলুন রয়েছে।যাত্রী ও ক্রুদের খাওয়াতে টাইটানিকের দরকার হতো ৭৫ হাজার পাউন্ড ওজনের মাংস, ১১ হাজার পাউন্ড মাছ এবং ৪০ হাজার ডিম।
জাহাজ পরিবহন করছে ৪০ মেট্রিক টন আলু, তিন হাজার ৫০০ পাউন্ড পেঁয়াজ, ৩৬ হাজার আপেল এবং এক হাজার পাউরুটি। যাত্রী ও ক্রুদের প্রতিদিনের খাওয়ার পানির পরিমাণ ১৪ হাজার গ্যালন।
তিন হাজার শ্রমিকের দুই বছরের শ্রমে নির্মিত হয়েছে টাইটানিক। নির্মাণকালে পাঁচজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
টাইটানিকের নির্মাণব্যয় হয়েছে ৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার।টাইটানিকের চার ফানেলের তিনটি ছিল ধোঁয়া নির্গমনের জন্য, আরেকটি ছিল অপ্রয়োজনীয়, যা কেবল ফ্যাশন হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে।
টাইটানিক-কাহিনি নিয়ে জেমস ক্যামেরন নির্মাণ করেছেন বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাণিজ্যসফল ছবি টাইটানিক।
সাত খ্যাতিমান, যাঁদের টাইটানিকে চড়া হয়নি
থিওডোর ড্রেইসার
ঔপন্যাসিক থিওডোর ড্রেইসার ইউরোপে ছুটি কাটিয়ে টাইটানিকে আমেরিকা ফেরার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু একজন ইংরেজ প্রকাশক সস্তায় অন্য আরেকটি জাহাজে যাওয়ার পরামর্শ দেন।থিওডোর ড্রেইসার ক্রুনল্যান্ড জাহাজে টাইটানিক দুর্ঘটনার খবর শোনেন।
বেতার আবিষ্কারক মার্কনি
রেডিও আবিষ্কারক এবং ১৯০৯ সালে নোবেল বিজয়ী মার্কনিকে টাইটানিকের ফ্রি টিকিট অফার করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি টাইটানিকের তিন দিন আগে লুসিতানিয়া নামের আরেকটি জাহাজে রওনা হন। কারণ, জাহাজে তাঁর লেখালেখির ব্যাপার ছিল এবং সে জন্য একজন পেশাদার স্টেনোগ্রাফারেরও প্রয়োজন হয়। আর এ জন্য লুসিতানিয়াতে ভ্রমণই তিনি বেছে নেন।
ধনকুবের মিলটন হার্শে
হার্শের মিল্ক চকলেট, সিরাপ ইত্যাদি প্রস্তুতকারক মিলটন হার্শে শীতকালটা ফ্রান্সে কাটিয়ে আমেরিকা ফেরার জন্য টিকিট কিনেছিলেন। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে তিনি ও তাঁর স্ত্রী জার্মান জাহাজ আমেরিকায় চড়ে আগেই রওনা হয়ে যান। এই আমেরিকাই টাইটানিকে বার্তা পাঠিয়েছিল যে পথে আইসবার্গ রয়েছে।
ধনকুবের জে পি মর্গান
ওয়াল স্ট্রিটের নেপোলিয়ন’ নামে খ্যাত, জেনারেল ইলেকট্রিক ও ইউএস স্টিলের প্রতিষ্ঠাতা জেপি মর্গান টাইটানিক জাহাজের সমুদ্রে ভাসানোর উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। জাহাজে তাঁর জন্য একটি ব্যক্তিগত স্যুটের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ফ্রান্সে সকালে শরীর ম্যাসাজ করা বাকি রেখে টাইটানিকের যাত্রী হতে আগ্রহী হননি।
আলফ্রেড ভ্যানডারবিল্ট। ৩৪ বছর বয়স্ক মাল্টিমিলিয়নিয়ার, খেলোয়াড় এবং ভ্যানডারবিল্ট শিপিং ও রেল বাণিজ্যে উত্তরাধিকারী বিশেষ কারণে শেষ মুহূর্তে বুকিং বাতিল করেন। কিন্তু ব্যাপারটা এত দেরিতে করেন যে যাত্রীতালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে মৃতের তালিকায় কোনো কোনো পত্রিকা তাঁর নামও ছেপে দেয়। তিন বছর পর লুসিতানিয়া জাহাজ ডুবে গেলে আলফ্রেড ভ্যানডারবিল্ট মৃত্যুবরণ করেন।
নোবেল বিজয়ী জন মট
টাইটানিক ডোবার অনেক বছর পর ১৯৪৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী জন মট উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন হোয়াইট স্টার লাইনের ফ্রি টিকিট, কিন্তু তিনি তা না নিয়ে ল্যাপল্যান্ড নামের অন্য একটি জাহাজে চেপেছিলেন।
হেনরি ক্লার্ক। পিটসবার্গের ইস্পাত ব্যবসায়ী। স্ত্রীর পায়ের গোড়ালি মচকে যাওয়ার কারণে টাইটানিকের যাত্রা বাতিল করেন।
আমেন-রার অভিশাপ ও টাইটানিক
ঢাকা, শনিবার, ১৪ এপ্রিল ২০১২,
১ বৈশাখ ১৪১৯, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৩৩
১০ এপ্রিল ১৯১২ সাউদাম্পটন বন্দরে পৃথিবীর বিস্ময়কর জাহাজ টাইটানিক ছেড়ে দেওয়ার সিটি বাজাল। বিদায় জানাতে আসা আত্মীয়, শুভানুধ্যায়ী এবং উৎসুক দর্শনার্থীর আনন্দ ও উচ্ছ্বাসে বন্দর গমগম করছে।
এই জাহাজটি ‘আনসিঙ্কেবল’—কখনো ডোবার নয়। দুদিন পেরিয়ে যাচ্ছে। টাইটানিক তখন আটলান্টিকে। সবই ঠিকঠাক। আনন্দ ও হুল্লোড়ের কমতি নেই। আটজনের একটি দল ঢুকল প্রথম শ্রেণীর ধূমপানকক্ষে। সিগারেট ফুঁকছেন আর জীবনের কী মানে, তা নিয়ে বেশ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা জুড়ে দিয়েছেন। তাঁদেরই একজন উইলিয়াম টি স্টেড ইংরেজ সাংবাদিক ও সুপরিচিত অধ্যাত্মবাদী। ভৌতিক গল্পটা তিনিই বললেন। তাঁর এই গল্পের মিথের সঙ্গে টাইটানিকের ডুবে যাওয়া কেমন করে যেন এক হয়ে গেল।
স্টেড গল্পটা শুরু করেন ১২ এপ্রিল রাত ১২টার একটু আগে, গল্পটা শেষ হয় রাত ১২টার পরে। টাইটানিকডুবির সূত্রপাত হয় ১৪ এপ্রিল রাত ১২টার একটু আগে, জাহাজটি আটলান্টিকের গর্ভে তলিয়ে যায় রাত দুইটার দিকে। তখন ১৫ এপ্রিল ১৯১২। এই আটজনের দলের সাতজনই আটলান্টিকে তলিয়ে যান, উইলিয়াম স্টেডও। কেবল একজন ফ্রেড সিওয়ার্ড বেঁচে যান। সাক্ষ্য তাঁরই।
মমির অভিশাপ
যিশুর জন্মের ১৫০০ বছর আগে গ্রিক প্রিন্সেস আমেন-রা কথা জানা যায়। মৃত্যুর পর প্রিন্সেসকে সূক্ষ্ম কারুকাজ করা চমৎকার একটি কাঠের কফিনে ভরে নীল নদের তীরে একটি সুরক্ষিত প্রকোষ্ঠে রেখে দেওয়া হয়। ১৮৯০ দশকের শেষ দিকে খননকাজের সময় মমির এই চমৎকার কফিন কিংবা আধারটি পাওয়া গেলে চারজন ধনী ইংরেজকে তা কিনে নেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। কফিনে রয়েছেন প্রিন্সেস আমেন-রা।বহু মূল্য দিয়ে তাঁদের একজন কিনে নিলেন। তিনি কয়েক হাজার পাউন্ড স্টার্লিং দিয়ে কেনা কফিনটি হোটেলে নিজ কক্ষে নিয়ে এলেন।কয়েক ঘণ্টা পর দেখা গেল তিনি হোটেল থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে মরুভূমির দিকে যাচ্ছেন। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও তিনি আর কখনো ফিরে আসেননি।অবশিষ্ট তিনজনের একজন তাঁর মিসরীয় ভৃত্যের বন্দুক থেকে দুর্ঘটনাক্রমে আকস্মিকভাবে বেরিয়ে আসা গুলিতে জখম হলেন। জখমটা এতই গুরুতর ছিল তার গুলিবিদ্ধ হাতটি কেটে ফেলতে হলো।তৃতীয়জন দেশে ফেরার পর দেখলেন তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় যে ব্যাংকে রেখেছিলেন, সেই ব্যাংকটি সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে গেছে।চতুর্থজনও টাকাপয়সা খোয়ালেন, অসুস্থ হয়ে পড়লেন, চাকরি হারালেন এবং বেঁচে থাকার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাঁকে দেশলাই বিক্রি শুরু করতে হয়।এত কিছুর পরও পথের অনেক দৈব-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রিন্সেস আমেন-রার কফিন লন্ডনে পৌঁছে এবং একজন ধনী ব্যবসায়ী তা কিনে নেন।এর পরপরই ব্যবসায়ীর পরিবারের তিনজন সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়, আগুন লেগে তাঁর বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অগত্যা ব্যবসায়ী কফিনটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে দান করে দেন।ট্রাক থেকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের আঙিনায় যখন কফিন নামানো হচ্ছিল, ট্রাকটি উল্টোদিকে চলতে শুরু করে। একজন পথচারীকে বিপদাপন্ন করে তোলে। যে দুজন শ্রমিক এই কাসকেটটি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিল, হঠাৎ পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলে। অন্যজন বাহ্যত সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হলেও দুদিন পর অজ্ঞাত কারণে মারা যায়।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ‘ইজিপশিয়ান রুম’-এ এটি স্থাপন করার পর একটার পর একটা বিপত্তি ঘটতে শুরু করল।
জাদুঘরের নৈশপ্রহরী কফিনের ভেতর হাতুড়ি পেটানোর এবং ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনতে লাগল। অন্যান্য প্রদর্শিত দ্রব্য রাতের বেলা কেউ ছুড়তে শুরু করল। দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় একজনের মৃত্যু হলো। অন্য প্রহরীরা চাকরি ছেড়ে দিতে চাইল। ক্লিনাররা প্রিন্সেসের কাছে যেতে অস্বীকৃতি জানাল।
শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ এটাকে বেজমেন্টে রেখে আসে এই চিন্তা করে যে এখন থেকে আর কারও ক্ষতি করতে পারবে না। এক সপ্তাহের মধ্যে যা ঘটার ঘটে গেল। বেজমেন্টে পাঠানোর কাজটা যিনি তত্ত্বাবধান করছিলেন তাঁকে তাঁর ডেস্কেই মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল আর বহনে সহায়তাকারীদের একজন ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে পড়ল।
এত দিনে মমির এই ভয়াবহ আচরণের খবর সংবাদপত্রগুলো পেয়ে গেল। একজন ফটোগ্রাফার ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এসে কাসকেটের ছবি তুললেন। ছবিটা যখন হয়ে এল তিনি অবাক হয়ে দেখলেন কফিনের ওপর আঁকা ছবিটা আসলে মানুষের বীভৎস মুখাবয়ব। তিনি বাড়ি ফিরে গেলেন। বেডরুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন এবং নিজের ওপর গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করলেন।কিছুদিন পর জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এই মমি একজন ব্যক্তিগত সংগ্রহকারীর কাছে বেচে দেয়। সেখানেও একের পর এক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু ঘটতে থাকলে মমির ক্রেতা এটাকে চিলেকোঠায় আটকে রাখেন।পরে তিনি এটা বিক্রির চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্রিটেনের কোনো মিউজিয়াম এই মমি নিতে আগ্রহী নয়। মমি নাড়াচাড়ায় নিয়োজিত কুড়িজন মানুষের দুর্ভাগ্যের কথা—বিপন্নতা, দুর্যোগ এবং এমনকি মৃত্যুর খবর এখন সবারই জানা। শেষ পর্যন্ত গোঁয়াড় প্রকৃতির একজন আমেরিকান প্রত্নতত্ত্ববিদ এসব দুর্ভাগ্যের কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন এবং বেশ দাম দিয়ে এটাকে কিনে নিউইয়র্ক নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করলেন।
১৯১২-এর এপ্রিলে কফিনটা জাহাজে তোলা হলো, আমেরিকান মালিকও সঙ্গে আছেন। তিনি জানেন আমেরিকানরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন নয়। হোয়াইট স্টার লাইনের নতুন জাহাজ, এটাই জাহাজের উদ্বোধনী যাত্রা—সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্ক। বিলাসবহুল এই জাহাজের নাম টাইটানিক। আমেরিকান মালিক এবং জাহাজের দেড় হাজার যাত্রী ও টাইটানিক জাহাজটিসহ আমেন-রা সমাহিত হলেন আটলান্টিকের গভীর তলদেশে। কেউ কেউ বলেন উদ্ধারকারী জাহাজ কার্পাথিয়া যখন মানুষ উদ্ধার করছিল, তখনই জাহাজের ক্রুরা কফিনটা জাহাজে তুলে নেয়। আমেন-রা যথারীতি নিউইয়র্ক পৌঁছে। আমেরিকায় এই কফিন একটার পর একটা ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটিয়ে চলে। একসময় সিদ্ধান্ত হয় কফিন আবার ইউরোপে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে। দেড় মাস তখনো পুরো হয়নি। ইউরোপের পথে এমপ্রেস অব আয়ারল্যান্ড জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। ১৯১২ সালের ২৯ মে ৮৪০ জন যাত্রী নিয়ে জাহাজটি ডুবে যায়।
মমিটি সে যাত্রায়ও রক্ষা পায়। এর মালিক ঠিক করলেন, তৃতীয় কোনো জাহাজে মমিটি মিসরে পাঠিয়ে দেবেন। সেই তৃতীয় জাহাজের নাম লুসিতানিয়া। জার্মান সাবমেরিনের আক্রমণে জাহাজটি ডুবে যায়। এরপর কী হলো আর জানা নেই। প্রিন্সেস আমেন-রা টাইটানিকে ছিলেন?
না, ছিলেন না। পুরোটাই কল্পকাহিনি। আর এ কাহিনি তৈরির কৃতিত্ব দুজনের—উইলিয়াম স্টেড এবং ডগলাস মারে।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রুম নম্বর ৬২-তে সংরক্ষিত এই মমি ১৮৮৯ সালে মিসেস ওয়ারউইক হান্ট তাঁর ভাই আর্থার এফ হুইলারের পক্ষে ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে উপহার দেন। ১৮৯০ সালের দিকে এই কাসকেট মিউজিয়ামের প্রথম ইজিপশিয়ান রুমে প্রদর্শিত হতো। স্টেড ও মারের অতিপ্রাকৃতিক কাহিনি সম্পূর্ণ বানোয়াট। ১৯৮৫ সালে টাইটানিক হিস্ট্রিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট চার্লস হ্যাম টাইটানিকে পরিবহন করা মালামালের তালিকা দেখার সুযোগ পান। তাতে মমি কিংবা কফিনের কোনো উল্লেখও দেখতে পাননি।
ISIS অথবা ISIL
আইএসআইএস অথবা আইএসআইএল (যাদের পুরু মিনিংটা হচ্ছে ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক এন্ড সিরিয়া, অথবা ইসলামিক ষ্টেট অফ ইরাক এন্ড দি লিভান্ট। এখানে জানা দরকার লিভান্টটা কি। লিভান্ট হচ্ছে তুরুস্কের দক্ষিন অঞ্চল থেকে শুরু করে মিশরসহ সিরিয়া, লেবানন, প্যালেস্টাইন, ইসরায়েল এবং জর্ডান সম্বলিত যে রিজিওনটা হয় সেটা।
এর সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ
যেই নামেই এটাকে ডাকা হোক না কেন, এটা ব্যাসিকেলি আল কায়েদার অবশিষ্ট কিছু গ্রুপের একটা সমন্বিত বাহিনীর মিশ্রণ যারা সুন্নি জিহাদিস্ট দল নামে পরিচিত। আমেরিকা যখন ইরাক আক্রমন করে, তখন আল কায়েদার বাহিনি ছিল এই পুরু দল। কিন্তু লিডারশীপ নিয়ে মারামারিতে সর্ব প্রথম আল কায়েদা পাকিস্তানে এর ভাঙ্গন শুরু হয় ২০০৩ সালে। যদি নাম ধরে ধরে বলা হয় কারা কারা এর অংশ হিসাবে কাজ করছে তাহলে প্রথম যাদের নাম আসবে তারা হলঃ আল কায়েদা (ইরাক), মুজাহিদিন সুরা কাউন্সিল, ইসলামিক ষ্টেট অফ ইরাক, জেইস আল তাইফা আল মান্সুরা, জায়েস আল ফাতিহিন, আল সাহাবা কাটবিয়ান আনসার আল তৌহিদ অয়াল সুন্নাহ, এবং ইরাকের কিছু সুন্নি উপজাতি। ২০০৬ সালের ১৫ অক্টোবর বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পর 'আইএসআই'-এর আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের কথা ঘোষণা করা হয় এবং আবু ওমর আল বাগদাদি গ্রুপটির নেতা বলে জানানো হয়। ২০১০ সালের ১৯ এপ্রিল আবু ওমর নিহত হলে আবুবকর আল বাগদাদি এই জঙ্গি গ্রুপটির নতুন প্রধান হয় এবং মধ্যপ্রাচ্যে গ্রুপটির বিস্তার শুরু হয়। 'নয়া বিন লাদেন' নামে খ্যাত বাগদাদিকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য মার্কিন সরকার দশ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। বাগদাদি ২০০৫ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইরাকের উম্মে কাসর শহরে একটি মার্কিন কারাগারে বন্দি ছিল। ২০০৩ সালের আগেও সে আলয়দার সদস্য ছিল বলে মনে করা হয়। বাগদাদির আরেক নাম ছিল আবু দায়া। ২০০৫ সালে তাকে হত্যা ও অপহরণসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
২০১১ সালে যখন সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হয় তখন অনেক ইরাকি ফাইটারগন সিরিয়ায় গমন করে এবং তারা সিরিয়ান ও অন্যান্য বিদেশী ফাইটারগনের সাথে এক হয়ে কাজ করে। তাঁদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হিসাবে অবজেক্টিভ প্রচারনা করে যে শেষ খিলাফত রক্ষার জন্য শরিয়া বেজড ষ্টেট তৈরি করার জন্য তারা এই যুদ্ধ করছে এবং এটা শুরু হচ্ছে সিরিয়া এবং ইরাকে।
এটার জন্য কে বা কারা টাকা দিচ্ছে এটা বুঝার খুব দরকার। মজার বিষয় হচ্ছে এরা আমেরিকার বিরুদ্ধে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে, আবার টাকা দিচ্ছে সউদি আরব, ইরান, কুয়েত, কাতার এবং সিরিয়া। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, যদিও বলা হয় যে, সিরিয়া সরকার মানে আসাদ সরকার পরোক্ষভাবে এদের সাহাজ্য করছে কিন্তু ওরা সিরিয়ার বিরুদ্ধেও কাজ করছে বলে মনে করা হয়। এর প্রমান হিসাবে আপাতত ধরা যায় যে, কয়েকদিন আগে মুসুল এবং ফালুজার কিছু শহর দখলের পর তারা সিরিয়ার কিছু ইসলামিক গ্রুপকে চ্যালেঞ্জ করেছে। মুসুল দখল করার সময় তারা ৪০০ মিলিয়ন ডলার সমপরিমান টাকা লুট করে ওদের অর্থনৈতিক অবস্থান আরও শক্ত করে ফেলেছে। জানা যায় যে, এদের প্রতি মাসে প্রায় ৮ মিলিয়ন ডলার আয় হয় বিভিন্ন সোর্স থেকে।
সিরিয়ায় কট্টর ইসরাইল-বিরোধী আসাদ সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে পাশ্চাত্য, ইসরাইল এবং তাদের আঞ্চলিক সেবাদাস সরকারগুলোর মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহীদের মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু হলে 'আইএসআই'ও বিদ্রোহীদের পক্ষে যোগ দিয়ে এ যুদ্ধে অংশ নেয়। সিরিয়ায় ২০১১ সালে গঠিত আন নুসরা ফ্রন্টও 'আইএসআইএল'-এর একটি শাখা হিসেবে দেশটির সরকারি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকে। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে আবু বকর আল বাগদাদি এক অডিও বার্তায় জানিয়ে দেয় যে 'জিবহাতুন নুসরা' বা 'আন নুসরা ফ্রন্ট' 'আইএসআই'-এর অর্থ ও সহায়তা নিয়েই গঠিত হয়েছে এবং এই দুই গ্রুপ একত্রিত হয়ে 'আইএসআইএল' নাম ধারণ করেছে।
'আইএসআইএল'-এর যোদ্ধারা গত দশই জুন ইরাকের নেইনাভা প্রদেশের প্রধান শহর মসুলের বেশিরভাগ এলাকা দখল করে নেয়। শহরটি জনসংখ্যার দিক থেকে ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এ ছাড়াও তারা দখল করে ফাল্লুজা ও সাদ্দামের জন্মভূমির শহর তিকরিত। তিকরিত সালাহউদ্দিন প্রদেশের প্রধান শহর। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকিসহ অনেক কর্মকর্তা বলেছেন, ইরাকের একদল সেনা কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ায় এক ষড়যন্ত্রমূলক সমঝোতার আওতায় এই প্রদেশের ৫০ হাজারেরও বেশি সরকারি সেনা কোনো ধরনের বাধা না দিয়েই সন্ত্রাসীদের কাছে শহরটির প্রধান সরকারি ভবন, অস্ত্রাগার, ব্যাংক ও কারাগারগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়।
এতক্ষন যা বললাম তা হচ্ছে দৃশ্যমান কিছু তথ্য। এর মাঝে অনেক অদৃশ্যমান স্ট্রেটেজি রয়েছে যা সাধারন চোখ দিয়ে দেখলে পুরু ব্যাপারটা বোধগম্য হবে না। এটা নিতান্তই আমার মতামত।
আমার মতামতঃ
(১) কেউ কেউ বলে যে আসলে এমআই ৬, মোসাদ অথবা সিআইএ দ্বারা এই আইএসআইএস/এল প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত। এই সংস্থা গুলো উক্ত আইএসআইএস কে তাঁদের ফ্রন্ট অরগ্যেনাইজেসন হিসাবে ব্যবহার করে। এখানে একটু জেনে রাখা ভাল যে, "ফ্রন্ট অরগ্যানাইজেসন" একটা মিলিটারি টার্ম যার অর্থ হচ্ছে এই রকম,
" Front groups are intended to deceive the casual observer by carrying out actions without disclosing who instigated them. They include astroturf (fake 'grassroots' organisations) operated by legitimate companies as well as fronts operated by groups with more questionable legitimacy to provide plausible deniability to as criminal groups, governments or intelligence agencies."
(২) গালফ ওয়ার যারা শেষ হয়ে গিয়েছে বলে মনে করে তারা হয়ত আমার চেয়ে আরও অনেক বেশি ভবিষ্যৎ দেখতে পায় কিন্তু আমি সাধারন সেন্সে বলতে পারি যে, মিডল ইস্টকে যে কোনভাবেই আমেরিকা, ইউ কে বা অন্যান্য যারা এই এলাকার তেলসমৃদ্ধ দেশকে নিজেদের কন্ট্রোলে রাখতে চায় তারা কোন না কোনভাবে গালফওয়ার, বা প্যালেস্টাইন ওয়ার কিংবা সিরিয়া বা ইরান ক্রাইসিস লাগিয়েই রাখবে। এরা যে কোনভাবেই হোক একটা না একটা ছুতা বাহির করবেই। আর এই ছুতার আরেক নাম হচ্ছে আইএসআইএস বা আইএসআইএল। ইরাক থেকে আমেরিকা বা যুক্তরাজ্য বের হয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে তারা আরেকটি প্যারাসাইট তৈরি করেই বের হয়েছিল আর সেটাআই হচ্ছে এটা। ইরাককে এখন শিয়া এবং সুন্নি দুই অংশে ভাগ করে যে কোন একটার দিকে হেলে গিয়ে পুনরায় তাঁদের আধিপত্য বজায় রাখা হচ্ছে এর আসল লক্ষ।
ইরাকে নিউক্লিয়ার অস্র আছে এই প্রোপাগান্ডা ছরিয়ে যেমন গালফ ওয়ারটা হয়েছিল, এখন আইএসআইএস এর চাদরে ইরাককে আবার খন্ড বিখন্ড করা হবে। আর এ কারনেই আমরা দেখলাম যে, rapid march of the ISIS towards Baghdad and its swift takeover of Mosul and Tikrit, and Baiji oil refinery, Fallujah and Ramadi in the Anbar Province,
শুধু তাই নয়, seizure of border crossings into Syria and Jordan are presented by political analysts as a “civil war” fought along sectarian lines, Sunni Arabs versus Shiia Arabs.
এর সঙ্গে দৃশ্যমান ফলাফল অনুমান করা যায় যে, the ethnically different Iraqi Kurds who have enjoyed semi-independence under the US patronage and are now on the verge of declaring complete independence from Baghdad.
এর ফলে ভবিষ্যতে কি হবে তার একটা সরল রেখা টানা খুব সহজ। ইরাক ভেঙ্গে তিন টুকরা হবে। সুন্নি ইরাক, শিয়া ইরাক এবং সাধিন কুরদিস্থান। আর এর ফলে যেটা হবে তা হচ্ছে এই অঞ্চলে ইসরায়েল হবে একমাত্র শক্তিশালি দেশ যার কাছে আছে নিউক্লিয়ার পাওয়ার। আর মিডল ইস্ট এ আছে তেল যা ইসরায়েলের সাহাজ্যে আমেরিকা বা ইউ কে এরা এই চমৎকার ভাগাভাগিতে আনন্দ উল্লাস করবে।
তবে প্রশ্ন আসতে পারে কেন আমেরিকা এই পলিসিটা গ্রহন করল। এটা বুঝবার জন্য তোমাকে একটু দূরে ইতিহাসটা চোখ খুলে তাকাতে হবে।
ওয়ার অন টেরর যখন শুরু হয়, তখন সারা পৃথিবীতে মানুষ কোন না কোনভাবে আমেরিকা বা ইউকে কে এক তরফা ব্লেম করছিল এবং তাঁদের দেশের নাগরিকগন বিশ্ববাসির কাছে অনেকটা ঘৃণা এবং অপদস্ত হচ্ছিল। এতে তাঁদের দেশের নাগরিকরাও তাঁদের দেশের হর্তাকর্তাদের সমালচনা শুরু করে দেয়। ওয়ার অন টেররের মুল উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু শুধুমাত্র মুসলিমদেরকে দমানো বা ওদের শক্তি কমানো। তাই একই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য এবার তারা ভিন্ন পথ ধরেছে বলে আমার ধারনা। তারা এবার মুসলিম বনাম মুসলিম যুদ্ধটা শুরু করেছে যেখানে শিয়া ভার্সেস সুন্নি। এক্ষেত্রে ওয়ার অন টেরর কৌশলটা আর প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। এতে শাপও মরল লাঠিও ভাঙল না। এটাকে আমরা "ওয়ার উইথইন ইসলাম"ও বলতে পারি। অংকের ফলাফলটা একই কিন্তু ফর্মুলাটা ভিন্ন। মাঝখান দিয়ে সারা বিশ্ব আমেরিকা বা ইউকে কে বা তার মিত্রদেরকে কোন প্রকার ব্লেম করার আর সুযুগ পাবে না।
(২) একটা জিনিস খেয়াল করে দেখ যে, ইরাকের আইএসআইএসের বিরুদ্ধে আমেরিকা এয়ার স্ট্রাইক করছে কিন্তু ঐ একই আমেরিকা সিরিয়াতে আইএসআইএস কে সাপোর্ট করছে টাকা দিয়ে, পয়সা দিয়ে তথ্য দিয়ে এবং অস্র দিয়ে। এটা কিন্তু একটা ডাবল গেম। জাস্ট একদম এক ফর্মুলা যখন আমেরিকা আল কায়েদাকে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে লাগিয়ে পরে আবার আল কায়দাকেই ধ্বংস করার আরেক নমুনা। আমি প্যালেস্টাইনের ইন্তিফাদা পত্রিকার কিছু মন্তব্য তুলে ধরছি যা আমার কাছে মনে হয়েছে একদম ঠিক। "... How do we really know what the US is doing in Iraq at the moment? How do we know that they really are carrying out strikes against ISIS? How do US forces know who is ISIS and who isn’t? Do ISIS members wear bright pink uniforms so that they stand out in a crowd and can thus be precision targeted by American fighter jets? For all we know, these air strikes could be targeting Iraqi army and police forces that are fighting against ISIS militants. Maybe the plan is to covertly help ISIS fragment and destabilize Iraq and exacerbate the country’s misery. Perhaps ISIS is being used as leverage against the unreliable puppets in Baghdad; one can picture Obama threatening al-Maliki that if he doesn’t follow Washington’s demands like a blind mule more ISIS fighters will be flooded into the country. This whole thing could also be an Orwellian bluff designed to deflect attention from Israel’s biennial ritual slaughter in Gaza. ISIS’s presence in Iraq is being used as an excuse to continue to bomb that beleaguered and thoroughly victimized nation. Obviously Washington doesn’t give a damn if the people of Iraq fall victim to ISIS; in fact Washington would love nothing more than a few more Iraqi corpses. Only a fool would believe that Washington cares about the well-being of Iraqis after extinguishing the lives of close to two million of them since the genocidal 2003 invasion and relegating millions more to lives of misery and despair. America wants to keep Iraq in a state of perpetual decay, unable to assert its own interests or do much of anything without Washington’s assistance.
(৩) এখানে আমার আরও একটি ব্যক্তিগত মতামত দিতে চাই এই আইএসআইএসের যে নেতা তার সম্পর্কে। যদি তিনি এম আই ৬, কিংবা সিআইএ অথবা মসাদ থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়েই থাকেন, কেন এই ব্যাক্তিকে তারা প্রশিক্ষন দিলেন? এই প্রসঙ্গে আমার আরও একটি পুরান উদাহরন দেওয়ার আছে। আর তা হল, আল কায়েদার বিখ্যাত সেই নেতা যার নাম ছিল আদম গাদান যিনি আল কায়েদার একমাত্র মুখ্যপাত্র ছিলেন। তোমরা কি জান সে কে?
সে ছিল একজন আমেরিকান ইহুদী যার আসল নাম ছিল এডাম পার্লম্যান। ৯/১১ এর সময় তিনি রাতারাতি নাম বদল করে দাড়ি টুপি পড়ে একেবারে ইসলাম দরদি হয়ে যে কোন উপায়ে আল কায়েদার শীর্ষস্থানীয় নেতা বনে গেলেন। এটা আমেরিকার একটা চাল ছিল। এই সেই ব্যাক্তি যিনি "ওয়ার এগেইন্সট আমেরিকা" উচ্চারন করেছিলেন। পরবর্তীতে "অরেঞ্জ" পত্রিকা (একটা আমেরিকার পত্রিকা) এর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে যে তিনি ছিলেন ইহুদিদের সবচেয়ে সমর্থক গোষ্ঠীর কোন এক নেতার নাতি। ঐ দাদা ছিলেন ইহুদীদের সমর্থিত সংস্থার বোর্ড অফ ডাইরেক্টর। এই তথ্য বের হওয়ার পর আদম সাহেবের আর কোন হদিস পাওয়া যায় নাই। একইভাবে আমরা কি করে জানব যে বর্তমান আইএসআইএস এর যে নেতা ডঃ আবু বকর আল বাগদাদিও ঐ রকম একজন নন? ডঃ আবু বকর আল বাগদাদির নাম কিন্তু আসলে সাইমন এলিওট। তার পিতা একজন ইহুদী। তোমাদের আরও কিছু তথ্য আমি দেই যা তোমরা আমাকে বিশ্বাস নাও করতে পার। আর তা হচ্ছে আল কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেন, বা জাওয়াহারি, এরা সবাই মসাদের প্রশিক্ষন প্রাপ্ত গুরু। বর্তমানে হামাস, সেটাও এই মসাদের তৈরি। এগুলো আলাপ করতে গেলে ইতিহাস লিখতে হবে। ইন্দোনেশিয়ার টপ মুসলিম ক্লারিক আবু বকর বশির যদিও মুসলিম পোশাকে সজ্জিত, কিন্তু তিনি মসাদ কর্তৃক পালিত এবং তাঁদের এজেন্ট হিসাবেই কাজ করে। তিনি একজন ক্রিপ্টো ইহুদী এবং ইয়ামেনি বংসধর যিনি বালি বম্বিং এ জরিত ছিলেন । তিনি Abu Bakar Bashir is the leader of the Indonesian Mujahedeen Council, and he is linked to Jemaah Islamiyah and the Mossad-run al Qaeda.।
এই একই প্রসঙ্গে ইন্তিফাদা লিখেছে যে, "...... ISIS’s true intention, many claim, is to incite sectarian divide in Israel’s neighbouring states, thereby advancing Tel Aviv’s Oded Yinon plan for the balkanizing and fracturing of its regional foes. Is it any coincidence that ISIS and its affiliates have targeted Libya, Iraq, Syria and Lebanon with the most furor, while leaving the corrupt, US-backed dictatorships in Egypt, Bahrain, Jordan, Qatar, Kuwait, Saudi Arabia, etc., alone. Not to mention ISIS’s complete lack of action against Israel or the US
(৪) তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, কেউ কেউ মসাদের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হয়ে কিংবা ওদের ল্যাজ ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার পর নিজেরা আবার মতবাদ পরিবর্তন করে ফেলায় ওরাই আবার আমেরিকা বা ইস্রায়েলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। তার মধ্যে লাদেন একজন, ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমেদিনিজাদ একজন। যেমন বিট্রে করেছিল শ্রীলঙ্কার এলটিটিই র বেলুপেল্লাই প্রভাকরন ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে। ইন্ডিয়াই তাকে তৈরি করেছিল খোদ শ্রীলংকার বিরুদ্ধে কাজ করবার জন্য। কিন্তু পড়ে বেলুপেল্লাই প্রভাকরন আর নিজেকে ইন্ডিয়ার ছা পোষা হয়ে থাকতে চান নি এবং নিজে নিজে তার এক শক্ত বাহিনি গড়ে তোলায় ইন্ডিয়া নিজেও বেলুপেল্লাই প্রভাকরণকে মেরে ফেলার যত ষড়যন্ত্র আছে করেছিল এমনকি শ্রীলংকাকেও সাহায্য করেছিল।
(৫) আই এস আই এস কি ইসরায়েল কে থ্রেড করে?
পৃথিবীর বিখ্যাত এই টেররিস্ট দলকে ইসরায়েল এখনো নিষিদ্ধ ঘোষণাও করে নি এবং এর বিরুদ্ধে কোন কমেন্টও করে নি। শধু নরম ভয়েসে একবার মিডিয়াতে বলেছে যে, এরা যা করছে তা ন্যায়সঙ্গত নয়। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে আইএসাইএস ও কিন্তু ইস্রায়েলের বিরুদ্ধে কিছুই বলছে না।
আমি যদি এখন অন্যান্য ভেটো পাওয়ার ধারি দেশ গুলোর দিকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখি, তাহলে দেখা যাবে যে, রাশিয়া বা চায়না এরা একটা দারুন কনফিউসনাল স্ট্যাট দেখিয়ে কি করা উচিৎ তা সরাসরি কিছু বলছে না আর বল্লেও সে বলার মধ্যে যেন কেমন একটা নির্লিপ্ত ভাব আছে। সিরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সরাসরি খাতির। আসাদ সরকারকে রাশিয়া সরাসরি সমর্থন করে। আবার আইএসাইএস সিরিয়াতে যুদ্ধ করছে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে। তাহলে তো রাশিয়ার উচিৎ আইএসাইএস কে রাশিয়া কন্ডেম করা। অন্য দিকে সিরিয়ায় যুদ্ধ কিংবা গণ্ডগোল লেগে থাকলে রাশিয়া ক্রমাগত সিরিয়াতে অস্ত্র বিক্রির একটা খনি থাকে। তো এমন একটা খনি রাশিয়াই বা কেন বর্জন করবে যেখানে রাশিয়াকে ইদানিং এক ঘরে করে দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা আমেরিকা? এটা তো রাশিয়ার জন্য একটা অর্থকরী বাজার!! আবার এখনো ব্যাপারটা একদম ক্লিয়ার না আসলে আইএসাইএস কি আসলেই সিরিয়ার বিরুদ্ধে কিনা।
অন্য দিকে চায়নার ভিতরেও অনেক মুসলমান রয়েছে। তার নিজের শাসন ক্ষমতার মধ্যেও পুরুপুরি তারা গণতন্ত্র চর্চা করতে দেয় না ফলে চায়না কখনই চায় না আরেকটা অযাচিত সমস্যা নিয়ে নিজের দেশে একটা সমস্যা তৈরি হোক। তার মধ্যে ইদানিং আবার হং কোং নিয়ে তারা আরও বেশ নাজুক অবস্থায় পরে আছে। এ ছারাও চায়নাও চায় না যে, এই অঞ্চলে আইএসাইএস দ্বারা আরেকটি পাওয়ার গ্রুপ তৈরি হোক। এর মানে হচ্ছে চুপ থাক বাবা। চায়না ও কিন্তু রাশিয়ার মত সিরিয়ার সমর্থক। চায়না কিন্তু একটা কথা ইতিমধ্যে সরাসরি বলে দিয়েছে যে, তারা আইএস আই এস এর এন্টি কোয়ালিশন যুদ্ধে আমেরিকার সঙ্গে নাই তবে সর্বাত্মক মোড়াল সাপোর্ট দিতে প্রস্তুত। যেন ধরি মাছ না ছুই পানি। বিশ্ব রাজনিতি ভাই।
(৬) এখানে একটা ব্যাপার মনে রাখা দরকার যে, আইএসাইএস বাহিনিতে প্রুচুর পরিমানে আমেরিকান এবং বিদেশী যোদ্ধা আছে। এদেরকে আসলে প্ল্যান্ট করা হয়েছে বিশেষ ট্রেনিং দিয়ে। যদি কোন কারনে এই সব লোক গুলোকে এক সময় নিজের দেশে ফিরিয়ে আনতে হয় তাহলে এরা হয়ত বা নিজেরাই নিজের দেশে একদিন টেররিস্ট হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে অনেক বুদ্ধিজীবী রা আমেরিকা এবং ইউ কে কে সতর্ক করে দিয়ে ও লাভ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
(৭) এখানে একটা বিশেষ ধর্মীয় সত্ত্বার রক্ষার একটা দিক কাজ করছে আর তা হল, আইএসাইএস হল সুন্নি সম্প্রদায়ের একটা দল যারা শেষ খেলাফতকে রক্ষার নামে জিহাদ করছে বলে ঘোষণা দিয়েছে। আবার ও দিকে ইরান হচ্ছে শিয়া প্রধান দেশ। ইরান কিন্তু তার ধর্মীয় দিক থেকেই আইএসাইএস কে সমর্থন দেবার কোথা নয়। আর এ কারনে ইরান আইএসাইএস এর বিরুদ্ধে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে আমেরিকা যেহেতু ইরাক আইএসাইএস কে টার্গেট করে ওদের মারার চেষ্টা করছে বলে ভাব দেখাচ্ছে, এর মানে ওরা এটাও দেখাতে চাবে যে অতি শিগ্রই সিরিয়ার আইএসাইএস কেও টারগেত করবে। এতে চির শত্রু ইরানের সঙ্গেও আমেরিকার একটা অলিখিত বন্ধুত্ব হবে বলে একটা আভাস দেওয়ার সিগন্যাল মনে করা হচ্ছে। কিন্তু আসলেই কি তাই? খুব কমপ্লিকেটেড সিচুয়েসন এই আইএসাইএস।
ডলারের নোটের ব্যাখ্যা
আমিও আমেরিকার ডলারের এত ব্যাখ্যা জানতাম না, তুমি বলার পর আমি ইন্টারনেটে গিয়ে কিছু পরাশুনা করে দেখলাম ব্যাপারটা বেশ মজার। আমি যেটুকুন জেনেছি সেটা আমি বলছি। তবে আমি বাংলাদেশের টাকার ব্যাপারটাও জানার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু খুব একটা কিছু পাওয়া যায় নাই। তাই ডলার নোটের সম্পর্কেই বলছি যা একটা রিসার্চ করার মত ব্যাপার। ধৈর্য সহকারে পরতে হবে ভাই।
আমেরিকার ১ ডলার নোটের বিবরনটা এই রকমঃ
(১) ১৯৫৭ সালে প্রথম বের করা হয়।
(২) কটন এবং সিল্ক (এটা লাল এবং নিল সিল্কের ব্লেডেড)।
(৩) একটা স্পেশাল কালি ব্যবহার করা হয়েছে যা পানি বা কোন ক্যামিকেল দিয়ে ধুলে উঠে যায় না। প্রথমে যত ছবি বা ইমেজ আছে তার উপরে এই লেখাগুলো প্রিন্ট করা আছে এবং তারপর এগুলো পানি প্রুফ করে স্টার্চ করা।
(৪) ১ ডলারের সামনের অংশে ইউনাইটেড স্টেটস এর ট্রেজারি সিল দেয়া। এবং একটা পাল্লা আছে যা সুবিচার নির্দেশ করে। অনেকে এই পাল্লার ব্যাখ্যা করে যে এটা ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের ব্যালেন্স অব কারেন্সি বুঝায় তা ঠিক না।
(৫) মাঝখানে কারপেন্টারস টি-স্কয়ার বুঝায় যে, এখানে ১৩ টি স্টার আছে এবং এই ১৩ টি স্টার দিয়ে আমেরিকার প্রথম ১৩টি কলোনিকে বুঝানো হয়েছে।
(৬) ডলারের পিছনের অংশগুলো জানার ব্যাপারঃ
(ক) দুইটা বৃত্ত আছে যা একত্রে করলে আমেরিকার সিল হবে।
(খ) একটা জিনিস এখানে মনে রাখা দরকার যে, আমেরিকা ১৭৭৬ সালে কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস হিসাবে আধিপত্যতা ছিল বলে তার শাসন প্রনালি ছিল কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস হিসাবে। ৪র্থ জুলাই ১৭৭৬ সালে এই কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস লুপ্ত হয়ার সময় আমেরিকার জাতীয় একটা সিল তৈরি করার প্লান করা হয়। তখন ফ্রাঙ্কলিন এর নেতৃতে আরও পাচজন ( তারা হচ্ছেন এডাম, থমসন জেফারসন, এবং আরও দুই জন) যারা এই সিল তৈরির কাজের কমিটি হিসাবে নির্বাচিত হন। আর এই সালটাই লেখা আছে ঠিক পিরামিডের নিচে রোমান অক্ষরে।
(গ) বাম দিকের বৃত্ত খেয়াল করলে দেখতে পাবা যে, একদিকে পিরামিড যেটার ফেস আলোকিত কিন্তু এর পশ্চিম পাশটা আলোকিত নয়। এর মানে হচ্ছে আমেরিকা Western Side নিয়ে অন্ধকারে আছে। পিরামিড দিয়ে ওরা বুঝাতে চেয়েছে যে, ঐ অঞ্চল এখনো ওদের আয়ত্তে আসে নাই। এদের কাজ এখনো ঐ অঞ্চলে শেষ হয় নাই। এই ব্যাখ্যাটা অফিসিয়াল ভাবে গ্রহনযোগ্য নয়। তবে কেউ কেউ মনে করে এটা হতে পারে। আরেকটা ব্যাখ্যা অনেকে করেন যে, পিরামিড হচ্ছে শক্তির প্রতিক এবং বহুদিন টিকে থাকার প্রতিক।
(ঘ) ক্যাপসটোনের ভিতরে যে চোখ দেখা যায় একে বলা হয় "অল সিইং আই"। এর ব্যাখ্যা আসলে অফিসিয়ায়ালি কেউ জানে না। তবে ধারনা করা হয় যে, ফ্রাঙ্কলিন সম্ভবত এটা বুঝাতে চেয়েছেন যে, ইসরায়েলের দামাল ছেলেমেয়েদের সব হিংস্রাত্তক কর্মকাণ্ডসহ দেবতা তার সমস্ত পৃথিবীর কর্মকান্ড দেখতে পান সর্বদা। ফ্রাংলিন ইহুদি ছিলেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, এই পিরামিড এবং চোখ যীশুর প্রতিক।
(ঙ) পিরামিডের ঠিক নিচে লেখা আছে NOUVAS ORDO SECLURUM, এর মানে হচ্ছে নতুন যুগ শুরু হয়েছে।
(চ) সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে ইগলের ছবি এবং তার ব্যাখ্যা। ডান দিকের বৃত্তে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, একটা ইগলের ছবি আছে যাতে ইগলটি তার বাম দিকে ফেস করে আছে। একটু ভাল করে লক্ষ করে দেখ যে, ইগলের দুই পায়ে দুই ধরনের সিম্বল আছে। একটায় সবুজ অলিভ শাখার আটি আর একটায় ১৩ টি এরো। ডলার নোটের এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সিলের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই ইগলের ফেসের উপর। প্রেসিডেন্টের সিলে ইগলের ফেস এরো র দিকে আর সম্ভবত ডলারের ইগলের ফেস ওই অলিভ আটির উপর। এর মানে হচ্ছে এই যে, আমেরিকা একটি শান্তির দেশ এবং আমেরিকা তার প্রতিরক্ষার জন্য সে এরো অর্থাৎ শক্তি ব্যবহার করতে পারে। আগে ডলারের এবং প্রেসিডেন্টের সিল একই ছিল কিন্তু ১৯৪৫ সালে ট্রুম্যান (সে ১৯৪৫ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিল) এই ইগলের ফেস বদলিয়ে দেন। The official meaning is that the olive branch and the arrows "denote the power of peace & war."
এখানে আরও একটা জিনিস লক্ষণীয় যে, এই সিলটা কারো উপরে দাড় করান হয় নাই। মানে আনসাপোর্টেড। এর অর্থ এই যে, আমেরিকা এখন নিজে নিজে সয়ং সম্পূর্ণ।
(ছ) সিল্ডের পিছনে দেখা যায় যে, এটা রেড এবং সাদা স্ট্রিপ আছে যার উপরে একটা নিল বার আছে। এই সবগুলো কালার নেয়া হয়েছে আমেরিকার পতাকার রঙ থেকে। the red represents hardiness and valor, the white represents purity and innocence, and the blue, vigilance, perseverance, and justice.
(জ) ইগলের ঠিক উপরে ১৩ টি তারকা আছে যা ওই সময় আমেরিকার অধিনে মোট ১৩ টি কলোনি ছিল এবং এই স্টারগুলোর উপরে মেঘের একটা আভা আছে যাকে বলা হয় আরও কলোনি হয়ত ভবিষ্যতে যোগ হতে পারে। এটাও ঠিক ব্যাখ্যা নয় অফিসিয়ালি (মেঘের ব্যাপারটা)।
(ঝ) সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ডলার নোটে ১৩ এর সংখ্যার ব্যবহার। অনেকে ১৩কে আনলাকি বলে থাকে বটে কিন্তু এই ডলার নোটে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে ১৩ সংখ্যার একটা জাল। যেমন, ১৩টি স্টার (কলোনি বুঝাতে), ১৩ জন সিগ্নেটরি (আমেরিকার স্বাধীনতার দলিলে ১৩ জন সাইন করেছিল), ১৩ টি কালারের ব্যবহার, ১৩ টি এরো, ফ্লাগের ১৩ টি স্ট্রিপ্স, পিরামিডের ১৩ টি সিঁড়ি অর্থাৎ 13 original colonies, 13 signers of the Declaration of Independence, 13 stripes on flag, 13 steps on the Pyramid, 13 letters in the Latin above, 13 letters in "E Pluribus Unum", 13 stars above the Eagle, 13 plumes of feathers on each span of the Eagle's wing, 13 bars on that shield, 13 leaves on the olive branch, 13 fruits, and if you look closely, 13 arrows. And for minorities: the 13th Amendment.
আফিম যুদ্ধ
১৮৩৯ থেকে ১৯৪২ সালে এই যুদ্ধটা হয়েছিল। যুক্তরাজ্য আর চিনের মধ্যে এই যুদ্ধটা হয়। প্রধান কারন ছিল আসলে ট্রেড ডেফিসিট। চাউনিজরা ব্যাঙ খেলে কি হবে, এদের মাথায় বুদ্ধি ছিল সব সময়। কি একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখতে পাবা যে, কোন এক বয়স্ক চায়নিজকে দেখলে মনে হবে না যে এরা বুড়া হয়ে গেছে। এর কারণটা কি কেউ জান? Its like anti-aging
যাক যেটা বলছিলাম। চায়নারা তখনকার দিনে অনেক সিল্ক, মসল্লা, চা, ইতায়দি পয়দা করত। আর এগুলোর প্রুচুর মার্কেট ছিল ইউরোপিয়ান মার্কেটে। কিন্তু অন্য দিকে ইউরপিয়ান্দের প্রডাক্ট চায়নায় চায়নিজরা একেবারেই ইম্পরট করত না। এর কারন চায়নিজরা নিজেরাই সব কিছুতে সেলফ সাফিসিয়েন্ট ছিল। আর চায়নিজ সরকার তাদের ট্রেড আইন দ্বারা বাইরে থেকে বিদেশী ইম্পরট বন্ধ করে রেখেছিল। শুধুমাত্র সিল্ভার আর সোনা চায়নিজরা আমদাই করতে পারত যা ইউরপিয়ান্দের কাছে ছিল অনেক। আর শুধুমাত্র এই সোনা আর সিল্ভারের মাধ্যমে ব্যবসা আদান প্রদান করতে গিয়ে ইউরোপে সোনা আর সিল্ভারের দ্রুত স্টক ফুরিয়ে আসছিল।
কিন্তু ইউরোপিয়ানরা বসে থাকে না। যেটা আজকে ওরা বুঝে, ইন্ডিয়ানরা বুঝে কাল আর বাঙালি বুঝে ৬ মাস পর। ইয়রপিয়ানরা দেখল, যে, চায়নিজরা প্রচুর আফিম খায়। আর আফিম ছিল ইউরোপে নিষিদ্ধ। ইউরোপিয়ানরা করল কি সিল্ভার আর সোনার পাশাপাশি এই আফিমকে আরেকটা ট্রেড আইটেম বানিয়ে প্রচুর পরিমান আফিম চায়নায় রপ্তানি করা শুরু করল। দিনে দিনে চায়নায় আফিমের বিস্তার এতটাই হয়ে উঠছিল যে, কোন সরকার ই এই আফিম খাওয়ানো বন্ধ করতে পারছিল না।
চায়নিজ সরকার প্রতিটি স্থানে চেক পয়েন্ট বসিয়ে দিল কোথা থেকে কিভাবে এই আফিম চায়নায় ঢুকছে তা বন্ধ করার জন্য। একবার কোন এক ব্রিটিশ ব্যবসায়ির কাছ থেকে কাস্টম প্রায় ৩০ লক্ষ পাউন্ড আফিম জব্দ করল। ব্রিটিশ হচ্ছে হারামির জাতের গুরু। যদিও চায়নাকে আফিম প্রতিরোধ করার আইনকে চ্যালেঞ্জ করেনি কিন্তু এই জব্দ হওয়া আফিম তারা অবজেকসন দিল এবং পরবর্তীতে এইসুত্র ধরেই সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল। এর ফলে ১৮৪২ সালে ট্রিটি অফ নাঙ্কিং হয় যা ছিল এক তরফা একটা বিচার। এর মাধ্যমে চায়নাকে চায়নার পাচটি পোর্ট খুলে দিতে হয়, এবং হংকং হাত ছাড়া করতে হয়। আর এটাকে বলে অয়ার অব আফিম (১ম আফিম যুদ্ধ)। ২য় আরেক্তা আফিম যুদ্ধ হয়েছিল ১৮৫৬-১৮৬০ সালে।
আর ওটা ও ছিল আরেক ধাপ বড় যেখানে হারামি ব্রিটিশ চায়নাকে বাদ্ধ করেছিল উক্ত ৫ টা পোর্টের বদলে চায়নার সব পোর্ট খুলে দিতে এবং আফিমকে অফিসিয়াল আইটেম হিসাবে ডিক্লেয়ার দিতে। তখন রাজা ছিল কিং ডাইনেস্টি। জাঁদরেল রাজা। ঐ যে বললাম চায়নারা ব্যাঙ খাইলেও ওদের মাথায় একদম খারাপ ব্রেইন নাই। তারা করল কি যারা যারা ব্রিটিশ দের সঙ্গে এই আফিমের ব্যবসাটা করে তাদের সবাইকে টার্গেট করে। আগের চুক্তির (ট্রিটি অফ নাংকিং) খুব একটা আদলে নিচ্ছে না দেখে ব্রিটিশরা "মোস্ট ফেবারড নেশন" নামে একটা বানিজ্যক টার্ম ব্যবহার করে যার মানে হচ্ছে বানিজ্যক সুবিধা দেয়া। এতে চায়নিজ আফিম আমদানিকারকগন ব্রিটিশদের কাছ থেকে আফিম টেক্স ছাড়া কিনতে পারে। আর তখন কিং ডাইনেস্টি চায়নিজ ব্যবসায়িদেরকেও ধরা শুরু করল যে যারা যারা ব্রিটিশ জাহাজে করে এই আফিম আনবে তারা আনঅফিসিয়ালি ধরা খাবে। ব্রিটিশরা আরও হারামি। তারা করল কি ঐ সব চায়নিজদেরকে এই সুবিধাও দিল যে অনেক চায়নিজ ব্যবসাই ব্রিটিশ জাহাজের মালিকান রেজিস্ট্রি পেয়ে যায়। যাতে চায়নিজ কিন্তু ব্রিটিশ জাহাজ আবার আফিম আনতে পারবে। রাজনিতি কি খারাপ, স্বার্থ ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না
তখন একটা ব্রিটিশ জাহাজ যার নাম ছিল "এরো"। এটা বেসিক্যালি ব্রিটিশ জাহাজ কিন্তু চায়নিজ ব্যবসায়ির নামে রেজিস্ট্রেসন করা। কিন্তু ১৮৫৬ সালে ঐ ব্রিটিশ জাহাজটি যদিও চায়নিজ এক ব্যবসায়ির নামে নতুন করে রেজিস্ট্রেসন করে দিয়েছিল আফিম ব্যবসাটা চালিয়ে নেবার জন্য কিন্তু ঐ বছর তখনো ব্রিটিশ ফ্ল্যাগটা ব্যবহার করছিল। আর যায় কই। কিং ডাইনেস্টি সুযোগটা হাতছারা করে নি। সিজ করে ফেলল ঐ "এরো" নামক জাহাজটি। অনেক তদবির তদবির করে জাহাজের ক্রুগুলোকে চায়নাদের কাছ থেকে ছারিয়ে নিয়ে গেলে ও চায়না কোনভাবেই ব্রিটিশদেরকে ক্ষমাও করেনি, ক্ষমাও চাননি। তখন যেহেতু হংকং ছিল ব্রিটিশদের আধিনে এবং হংকং এর শাসক ছিলেন ব্রিটিশ। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রির আদেশ ছারাই হংকং শাসক চায়নার ক্যন্টন আক্রমন করে বসে। বললাম না ব্রিটিশরা হচ্ছে হারামির জাত। এই অবৈধ আক্রমণকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রি পালমাস্টোন তার অফিসিয়াল সায় দিয়ে যুদ্ধটা বাধিয়েই দিলেন যা ২য় আফিম যুদ্ধ বা এরো যুদ্ধ ও বলা হয়। ।
হ্যালি ধুমকেতু
১৭০৫ সালে এডমন্ড হেলি নিউটনের "ল অব মোশন" এর ভিত্তিতে এই ধূমকেতুর আবির্ভাব নিয়ে কিছু তথ্য দিয়েছিলেন যাতে বলা হয়েছিল যে, এতা ১৫৩১, ১৬০৭, ১৬৮২ এবং ১৭৫৮ সালে এতা দেখা যাবে। তার বক্তব্যের সত্যতা তার জীবদ্দশায় ১৫৩১ এবং ১৬৮২ ঠিক ছিল কিন্তু ১৬৮২ সাল ঠিক থাকবে কিনা এটা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল যে, সত্যি যে ঐ ধুমকেতুটি তার মৃত্যুর পর ১৭৫৮ সালে দেখা গিয়েছিল এবং তার পর থেকেই তার সম্মানে এই ধুকেতুর নাম রাখা হত হ্যালি।
প্রতি ৭৬ বছর পর পর এই ধুকেতুটি আসে কিন্তু সময়ের হের ফেরে বা ধুমকেতুটির নিঃসরণের কারনে তার গতির কিছু হেরফের হয় বলে বলা হয় যে এটা ৭৬ থেকে ৮০ বছর এই দুই অংকের মদ্ধে থাকে। এটার দাইমেন সন হচ্ছে প্রায় ১৬ বায় ৮ বায় ৮ মাইল।
যদি কোন কারনে এই ধুমকেতুটি কখন পৃথিবীর সাথে হটাত আকর্ষিক ধাক্কা লেগে যায়, তাহলে এর বিপর্যয় হবে এক মারাত্মক। এতে পুরু পৃথিবী ধ্বংস অ হয়ে যেতে পারে কারন এর স্পীড এবং সাইজের জন্য। তাই মাঝে মাঝে বৈজ্ঞানিক গন একে "এটম বম্ব ফর নাগাসাকি" না বলে বলে থাকেন "এটম বম্ব ফর ওয়ার্ল্ড"। তাই হ্যালির ধূমকেতুর আবির্ভাবে খুব বেশি খুশি হবার কোন কারন নাই বরং এতা পৃথিবীর জন্য অত্যান্ত বিপদজনক। কিন্তু যেহেতু স্রষ্টা আছেন, তিনি এর গতিপথ নির্ধারণ করে দেন কখন এটা কার সুবিধা অ সুবিধা হবে সেটা। যেমন ধরুন, বলা হয় যে, হ্যালির ধূমকেতুর আগমনের কারনে ব্যাটল অফ হেস্টিংস হয়েছিল যেখানে ১০৬৬ সালে কিং হ্যারল্ড কে উতখাত করে উইলিয়াম হয়েছিলেন রাজা। ১৪৫৬ সালে তুরুস্কের সেনাবাহিনি বেল্গ্রেডে পরাজিত হয়েছিল ইত্যাদি।
হ্যালির ধুমকেতুটি আবার দেখা যাবে আবার ২০৬২ সালে। তখন শুধু বেচে থাকবে জুনিয়র
রিপ ভ্যান উইঙ্কেল
রিপ ভ্যান উইঙ্কেল নিউ ইয়র্ক শহরের কোন এক গ্রামে বাস করতেন। সে শহরের মানুষদের কাছে খুব প্রিয় একজন মানুষ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। বিসেস করে বাচ্চাদের কাছে। কারন সে বাচ্চাদেরকে গল্প বলতেন। কিন্তু তার স্ত্রি ছিল খুব জাঁদরেল। সারাক্ষন খালি কানাঘুষা করতেন আর কানের কাছে ভন ভন করত। একদিন তার স্ত্রীর এই ভন ভনানি থেকে রেহাই পাবার জন্য শিতের এক সকালে পাশের এক পাহারের কাছে পালিয়ে গেল আর সেখানে গিয়ে একদল অপরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল যারা ঐ এলাকার বাসিন্দা নন কিন্তু অদ্ভুত অলংকারে ভূষিত ছিলেন এবং তারা ৯-পিন নামক একটা খেলা খেলতেছিল।
মজার ব্যাপার ছিল যে, রিপ ওদের নাম জানতেন না কিন্তু ওরা রিপের নাম জানত। রিপ ওদের সঙ্গে মদ্য পান করেছিল এবং ঘুমিয়ে গিয়েছিল। যখন তার ঘুম ভাঙল, সে দেখল যে, তিনি তার চারিপাশে কিছুই চিনেন না। তার দাড়ি গোঁফ এতই বড় হয়ে গেছে যে পা সমান লম্বা প্রায়। ঘুমের আগের যে রাজা ছিলেন কিং জরজ-৩য়, সে আর নাই, বরন ওয়াশিংটন হয়ে গেছেন তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।
গ্রামে ফিরে আসার পর রিপ কে কেউ আর চিনতে ছিল না, এবং আরও মজার ব্যাপার হল যে, ঐ খানে আরও একজন রিপ ভ্যান ওয়িঙ্কেল হয়ে গেছে যে তার ছেলে। সে এখন অনেক বড় একজন পোলা। অবশেষে গ্রামের একজন অতি বৃদ্ধা রিপকে চিনলেন এবং তার মেয়েকে বললেন যে, এতা তার বাবা। রিপ একনাগারে ২০ বছর ঘুমিয়ে ছিল বলে জানা জায়। রিপ তার পরেও অনেক দিন বেচে ছিল এবং আগের মত ই বেচে ছিল।
এই গল্পটা বেসিক্যালি একটা রুপক। এর মানে অনেকঃ
(১) রিপ একজন রুপক মানুষ সমাজের যারা সমাজের অনেক কিছু থেকে পালিয়ে গিয়ে কোথাও চুপ করে বাচতে চায়,
(২) রিপ একজন মানুষ যে সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে না থেকেও সমাজে বেচে আছে।
(৩) রিপ সেই এক জন রুপক মানুষ যে, সরকারের প্রাথমিক শাসনে কিছুই বুঝে না এবং প্রায় অনেক বছর পর বুঝতে পারে যে, তাদের মদ্ধে সএকার অনেক কিছু পরিবর্তন করে ফেলেছে আর এই সব পরিবর্তন সব বড় বড়।
মার্ক পোলো
দুইজন ভিয়েতনামি ধনী ব্যবসায়ী ভাই (একজন নিকোলো আরেক জন মেটিও) পূর্ব থেকে ইউরোপে ১২৬০ সালে ভ্রমনে বের হয়েছিল। তখন তো আর এখনকার মত প্ল্যেন ছিল না অহরহ যে ইচ্ছে করল আর অনলাইনে আরব এমিরাটস এ বুকিং দিয়ে দিল আর অমনি তারিখ মত উরে চলে গেল এক দেশ থেকে আরেক দেশে। তারা জাহাজে করেই ভ্রমনে বের হত এবং তারা সবাই তাই করতে হয়েছিল। ১২৬৫ এর দিকে তারা কেইফেং (চায়নার এক অঙ্গরাজ্য) পৌঁছাল। কেইফেংটা হচ্ছে বর্তমান হেনান প্রভিন্স এর পাশে) আগে এটা নর্থ সং ডাইনেস্টি নামে পরিচিত ছিল। তারও আগে এটাকে বলা হত ক্যাপিটাল অব কুবলাই খান (গ্রেট খান নামেও ডাকা হয় এটাকে)। আর গ্রেট খান ছিল তখনকার দিনে মঙ্গল সম্রাট। ১২৬৯ সালে এই দুই ভাই মঙ্গল সম্রাট খানের বেশ ব্যক্তিগত সম্পর্কের কাছাকাছি চলে এসেছিলেন। সম্রাট খান তাদেরকে এতটাই বিশ্বাস করতেন যে, একবার এই দুই ভাইয়ের মাধ্যমে ইউরোপের পোপের কাছে মঙ্গলদেরকে মঙ্গলিয়ান থেকে কনভার্ট করার লক্ষে ১০০ মিশনারিজ পাঠাতে বলেছিলেন যদিও শেষমেশ পোপ ঐ অনুরোধ রাখেন নাই।
পরবর্তীতে নিকোলো যখন একা ইতালির ভেনিসে আসেন তখন সে জানতে পারে যে, তাঁর ১৫ বছরের একমাত্র পুত্র মার্ক পলোকে রেখে তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন। বেচারা ধনী হলে কি হবে? তখন তো আর সাকিরের স্মার্ট ফনের মত সম্রাটের কোন ফোন ছিল না যে, বাটন টিপলেই রানি পাওয়া যাবে। সুতরাং তিনি ওখানে না আশা পর্যন্ত জানতেন না যে তাঁর স্ত্রী আর জীবিত নেই। কি আর করা, মরা বউয়ের জন্য তো আর নিজের সব কাজ ফেলে সারাদিন কান্নাকাটি করা যাবে না, আর সব কাজ ফেলে তাজমহল ও গড়া যাবে না। আর করেও লাভ নেই এই কারনে প্রেমের নিদর্শন বল আর নামের কারনেই বল তাজমহল বানানর জন্য যে পরিমান অর্থ আর লোকবলের দরকার আমাদের এই পোলো পরিবারের তা ছিল না যদিও তারা অনেক ধনী ছিলেন।
অতঃপর এই দুই ভাই আবারও মার্ক পোলোকে সঙ্গে করে পূর্বের সেই খানের কাছে ফিরে আসেন। এটা সম্ভবত ১২৭৫ সালে। সম্রাট খান মার্ক পোলোকে খুব পছন্দ করেছিল। আর এই ভাল লাগা থেকেই সম্রাট খান মার্ক পোলোকে রাজকীয় কাজকর্মে নিয়োজিত করেন। পরিবারতন্ত্র আর পছন্দতন্ত্র সবখানেই সবসময়ই ছিল। খামাখা আমরা আজকে বিএনপি অথবা আওয়ামি লিগকে দোষ দেই। আরে বাবা ওরা তো আগের রাজা মহারাজদের পথই অনুসরণ করেন!! যাক, খুব অল্প বয়সেই মার্ক পলো অনেক বড় বড় সরকারি পজিশনে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান, এবং কখন কখন রাষ্ট্রদূত হিসাবেও নিয়োগ পান। শুধু তাই নয়, মার্ক পলো ইয়াঞ্জু শহরের গভর্নর হিসাবেও নিয়োগ পান।
গ্রেট খানের মেয়ে অর্থাৎ প্রিন্সেস তিনি এই পোলো পরিবারের কাছে খুব সেইফ মনে করছিলেন বলে তিনি আস্তে আস্তে তাঁর কন্যাসহ মার্ক পোলো এবং তাঁর বাবা চাচাদের সঙ্গে দক্ষিন চায়না দিয়ে তাদেরকে ইউরোপ পার হয়ে যাবার জন্য একটা বড় জাহাজ দেন (যার নাম ছিল আরমাদা, আরমাদা হচ্ছে একটা যুদ্দ জাহাজ যা আর্মড এবং জাহাজ এর নামের মিশ্রন, আর তাই এর নাম হয় আরমাদা)। এই পার করে দেয়ার কারন হল পার্সিয়ান গালফে গ্রেট খানের আরেক আত্মীয় যার সঙ্গে তিনি তাঁর মেয়ের বিয়ে দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। আর ঐ মেয়ে অর্থাৎ প্রিসেসও ঐ রাজকুমারকে বিয়ে করার জন্য রাজী ছিলেন। ঐ জাহাজে প্রায় ৬০০ সৈন্য ছিল, প্রায় ১৪ থেকে ১৫ তা আরও ক্ষুদ্র নৌকা ছিল। এই আরমাদা ইন্দোনেশিয়া হয়ে শ্রীলংকা দিয়ে ভারত বর্ষ পার হয়ে হরমুজ প্রনালি দিয়ে পার্সিয়ান গালফে আসে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে রাজ কন্যার সঙ্গে আর ঐ রাজ পুত্রের বিয়ে হয় নাই কারন ইতিমধ্যে রাজপুত্র মারা যান। পরিশেষে ঐ রাজকন্যা তাঁরই আরেক ভাইকে বিয়ে করেন।
মার্ক পোলো পরবর্তীতে ভেনিসে এসে আর্মিতে যোগদান করেন জেনোয়া রিপাবলিককে রক্ষা করার জন্য। তখন ওখানে একটা যুদ্ধ হচ্ছিল। ইতালির এই শহরটা তখন তাদের নিজস্ব স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছিল। কিন্তু জেনোয়া স্বাধীনতা পায় এবং মার্ক পোলো বন্দি হন। তাঁর দুই বছরের জেল হয়। আর এই জেলখানায় বসেই তিনি তাঁর বিখাত বই The Travels of Marco Polo বইটি লিখেন। প্রকৃতপক্ষে অনেক বিখ্যাত বই জেলখানায় বসে লেখা হয়েছে। যেমন গ্লিমসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্টোরি (নেহেরু), দি ট্রাভেলস অব মার্ক পোলো (মার্ক পোলো), মেইন কেম্ফ (হিটলার), লি মর দি আরথার (Le Morte d'Arthur ) স্যার টমাস মেলরির লেখা, মিগুয়েল দি সারভেন্টেজ এর লেখা "ডন কুইকজট" (Don Quixote), দনেটিন আলফসের লেখা "জাস্টিন, ফিলসফি ইন দি বেডরুম" ইত্যাদি।
বকসি ভাই, তোমার জেল খাটার শখ আছে? না থাকলে তুমি বইও লিখতে পারবা না, মার্ক পোলোও হতে পারবা না। যাক, জেলে মেলে যাবার দরকার নাই।
তিনি তাঁর এই লেখাটা আরেক বন্দি রাস্টিচেলোর কাছে দিয়ে রেখেছিলেন। পরবর্তীতে এই রাস্টেচেলোই ফ্রান্স ভাসায় এই বইটি প্রকাশ করে। বইটির অনেক চ্যাপ্টারের মধ্যে মানুষ খেকো লেজওয়ালা মানুষের অনেক বর্ণনা আছে, এশিয়ার অনেক ভৌগলিক বর্ণনা আছে। এশিয়ার মানুষেরা কিভাবে বিয়ে করে, সেক্স করে এবং কিভাবে মানুষ মানুষকে কবর দেয় তাঁর বিস্তারিত বর্ণনা আছে। তাঁর সঙ্গে আছে বিস্তারিত ধর্মীয় আচার ব্যবহারের বিশদ বর্ণনা। সে সেকেন্ড হ্যান্ড রেফারেন্স হিসাবে তাঁর সঙ্গে থাকা অনেক জাপানিজ এবং মাদাগাস্কার বন্দিদের তথ্য নিয়ে তিনি ঐ দেশ সমুহের কিছু তথ্য ও সংযজন করেছিলেন।
সক্রেটিসের এ্যাপোলজি
যে কয়েকটি সংলাপ ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে তার মধ্যে একটি হলো এ্যপোলজি (Apology)। আধুনিক ইংরেজীতে Apology অর্থ ক্ষমা প্রার্থনা করা। কিন্তু গ্রীক ভাষায় Apology-অর্থ ভিন্ন। সেখানে Apology-অর্থ defense। আদালতে বিচারের সময় আত্মপক্ষ সমর্থন করে সক্রেটিস যে ভাষণ দেন এ সংলাপ তারই বর্ণনা। Apology-কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে সক্রেটিস আত্মপক্ষ সমর্থন করছিলেন এবং এই পর্যায়ে মিলেটাসকে জেরা করেন ও ডেলফির মন্দিরে নিজের দৈববাণী পাওয়ার বিষয়টি সবিস্তারে বর্ণনা করেন। দ্বিতীয় অংশে রয়েছে রায়, এবং তৃতীয় অংশে শাস্তি। বিচারকদের মধ্যে ছিলেন গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ এনিটাস, কবি মেলিটাস, বাগ্মী লাইকন।
সক্রেটিসের সংলাপ (উল্লেখযোগ্য অংশ)
“বলতে পারেন সক্রেটিস, যে কাজ করার জন্য অতঃপর আপনার অকাল মৃত্যু হতে যাচ্ছে, সেইসব কাজ করার জন্য আপনি কি লজ্জ্বিত নন? তাকে আমি ন্যায্যভাবে উত্তর দিবোঃ এখানেই আপনি ভুল করছেন, যে ব্যক্তি মানুষের মঙ্গল সাধনের জন্য মাঠে নেমেছে, তাকে নিহত হবার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতেই হয়, এই নিয়ে তিনি তেমন চিন্তিত নন, তিনি ভাবেন কেবল একটি বিষয় - যা করছেন তা ঠিক করছেন না ভুল করছেন, ভালো মানুষের কর্ম সম্পাদন করছেন না খারাপ মানুষের কর্ম সম্পাদন করছেন।“
“হে এথেন্সবাসীগণ, আমি আপনাদের শ্রদ্ধা করি, আমি আপনাদের ভালোওবাসি, কিন্তু আমি আপনাদের কথা শুনবো না, আমি শুনবো আমার ইশ্বরের কথা। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত আমার জীবন ও শক্তি রয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি দর্শন চর্চা ও শিক্ষাদান থেকে বিরত হবো না।“
“আপনাদের জানাতে চাই যে, যদি আপনারা আমার মত একজন মানুষকে হত্যা করেন, তাহলে আমার যে পরিমান ক্ষতি হবে, তার চেয়ে আপনাদের অধিক ক্ষতি হবে। কোন কিছুই আমার ক্ষতি করতে পারবে না, মিলেটাস নয়, এনিটাসও নয়। কারণ একজন ভালো মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা ঈশ্বর দুষ্টলোককে দেননি। দুষ্টলোক শুধু নিজেদেরই ক্ষতি করতে পারে। আমি অস্বীকার করিনা যে, এনিটাস তার চেয়ে একজন ভালো মানুষকে হত্যা করতে পারে বা তাকে নির্বাসনে পাঠাতে পারে, বা রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে; এবং সে কল্পনা করতে পারে যে, এরূপ করে সে তার যথেষ্ট ক্ষতি করেছে, অন্যেরাও সেরূপ মনে করতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি তাদের সাথে ঐক্যমত পোষণ করিনা। অন্যায়ভাবে একজনকে হত্যা করে সে নিজের যে পরিমান অকল্যাণ করবে তা নিহত ব্যক্তির অকল্যান থেকে অনেক বেশি।“
রায় এবং শাস্তি
বিচারের জুরি সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করলো খুব সামান্য ভোটের ব্যবধানে মহাজ্ঞানী সক্রেটিসকে দোষী সাব্যস্ত করা হলো। ৫০০ জন বিচারকদের মধ্যে সক্রেটিসের বিরুদ্ধে জুরি ছিলেন ২৮০ জন, পক্ষে ছিলেন ২২০ জন। তারপর সেই সময়কার রীতি অনুযায়ী তাঁকে দ্বিতীয়বার বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ দেয়া হলো। এথেনীয় জুরিসপ্রুডেন্স (jurisprudence) রীতি অনুযায়ী অভিযোক্তারা একটি দন্ড প্রদান করে, এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি তার চাইতে কম শাস্তি প্রার্থনা করে বিতর্কে অবতীর্ন হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, অভিযুক্তকে যদি মৃত্যুদন্ড দেয়া হতো, তাহলে এটাই প্রচলিত ছিলো যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডের স্থলে নির্বাসন প্রার্থনা করতো। অর্থাৎ প্রতিটি মামলায়ই দেয় দন্ডাজ্ঞার চাইতে কম শাস্তি প্রার্থনা করা হতো। মহাজ্ঞানী সক্রেটিসকে দ্বিতীয় বক্তৃতাটি দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিলো যেন তিনি তাঁকে প্রদত্ত মৃত্যুদন্ডের চাইতে কম শাস্তি প্রার্থনা করতে পারেন। কিন্তু মহাজ্ঞানী সক্রেটিস এই মর্মে বিতর্ক করেছিলেন যে, তিনি একটি মহান দায়িত্ব পালন করে এথেন্স রাষ্ট্রের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, যা হলো এথেন্সের স্বতন্ত্র নাগরিকদের ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনা করা, সুতরাং যথাযথ শাস্তি হবে এই যে, তিনি যেন বাকী জীবন এই মহান দায়িত্ব পালন নির্বিঘ্নে করতে পারেন সেই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাঁর জন্য ভাতার ব্যবস্থা করা। এতে সিনেটররা ক্ষুদ্ধ হয়, ও তারা সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ডাদেশই বহাল রাখে।
ব্যাটল অফ এমাগেদ্দন
পৃথিবীতে চূড়ান্ত একটা যুদ্ধ হবে যার নাম ব্যাটল অফ এমাগেদ্দন। তো প্রশ্ন হতে পারে যে এই যুদ্ধে কে কে খেলবে বা কারা কারা লড়বে? বলা হয় যে, রাশিয়া, ইরান এবং সিরিয়া একত্রে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়বে। একটা জিনিস খুব ভাল করে লক্ষ করে দেখবা যে, যেহেতু মধ্য প্রাচ্য এখন সাংঘাতিক হট বেড এর মত হয়ে আছে, এবং ইরান নিউক্লিয়ার পাওয়ারের অধিকারি হতে যাচ্ছে বলে আমেরিকা এবং ব্রিটিশ মনে করে, ফলে ইসরায়েল এই সুবাদে ব্যাটল অফ এমাগেদ্দন প্রায় সমাগত বলে প্রচার করে অনেক তুল কালাম কাণ্ডই ঘটাতে পারে বলে ইসরায়েল ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করে। এটা আমেরিকা, এবং ব্রিটিশদের পক্ষে ইসরায়েল কাজ করছে বলে তারা সর্বদাই মনে করে।
বাইবেলে এই এমাগেদ্দন শব্দটা হয়েছে আরমাগেদ্দন। আর এটা একবার ই বাইবেলে অনুসৃত হয়েছে। আর এইটা পাওয়া যায় শুধুমাত্র Revelation 16:12 to 20 এ
তো দেখা যাক ১৬/১২ থেকে ২০ পর্যন্ত তে কি লিখা আছে
(১২) ৬স্ট এঞ্জেল তার থেকে এমন একটি নিঃশ্বাস ফেলবে ইউফ্রেটিস নদিতে যাতে ইউফ্রেটিস নদীর সব পানি শুকিয়ে যাবে।
(১৩) তারপর তিনটি অশুভ ইঙ্গিত পাওয়া যাবে যার একটা হচ্ছে ড্রাগনের মুখ থেকে, পশুদের মুখ থেকে এবং মিথ্যা প্রফেটের মুখ থেকে ব্যাঙ বেরিয়ে আসবে।
(১৪) এই তিনটি অশুভ স্পিরিট ব্যাসিকেলি শয়তানের প্রতিনিধিত্ব করবে যারা অনেক যাদুর মত মিরাক্যাল দেখাবে এবং পূর্বের রাজার আবাসন পর্যন্ত পৌঁছাবে। এক সময় এই অশুভ স্পিরিট গুলো সারা বিশ্বকে ঘিরে ফেলবে। আর এতেই ঈশ্বরের সহিত একটা যুদ্ধ হবে ঈশ্বর বনাম শয়তান।
(১৫) এমন সময় তিনি আসবেন, চোরের মত আসবেন যেন কেউ দেখতে না পায়। (বাইবেলে ঠিক এই কথাটা ই বলা আছে (Behold, I come as a thief), তার সমস্ত কাপর চোপড় খুলে তিনি আসবেন, একদম উলঙ্গ, সবাই তার লজ্জার স্থান দেখতে পাবে, এটাই তার আগমনের পরিচয়।
(১৬) তিনি এসে সবাইকে ডেকে একত্রে করবেন হিব্রু ভাষায় ওই স্থানে যার নাম আরমাগেদ্দন।
(১৭) অতঃপর, ৭ম এঞ্জেল একটি নিঃশ্বাস ফেলবেন বাতাসে যার মাধ্যমে বেহেশত এবং রাজার দরবার থেকে প্রচারিত হবে যে, যা করবার তা করা হয়ে গেছে।
(১৮) ঠিক তার পরেই শুরু হবে বিজলীপাত, ভুমিধ্বস এবং ভুমিকম্প।
(১৯) অতঃপর শহরটি তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে খন্ডখন্ড হয়ে। তখন বেবিলন শহর থেকে ঈশ্বরকে এক কাপ মদ দেয়া হবে যেন তিনি শান্ত হন।
(২০) ওই সময় সমস্ত দ্বীপ গুলো হারিয়ে যাবে, পাহার গুলো কোথাও উধাও হয়ে যাবে, এরপর বেহেশত থেকে পাথর নিক্ষিপ্ত হবে ক্রমাগত মানুষদের উপর। জাজমেন্ট ডে শুরু।
মজার ব্যাপার হল যে, পৃথিবীতে আরমাগেদ্দন নামে কোন জায়গা নেই। গ্রিকরা এই শব্দটাকে একটা সিলেবি করেছে এই ভাবে, হিব্রুতে har megiddo মানে মাউন্টেইন অব মেজিদ্দু। আর এই মেজিদ্দু হচ্ছে প্যালেস্টাইনে। The Mount of Megiddo is located in the plain of Esdraelon or Jezreel, a valley fourteen by twenty miles in size located to the southwest of Nazareth. Here, it is thought by many, that the great final battle of Armageddon will be fought at the end of time.
বলা হয় যে, বুক অব রেভেলিসন এ যা যা লেখা আছে কেউ যদি এতার এক টি শব্দ ও বদলায় তাহলে সে হবে জাহান্নামী এবং সে তার সমস্ত পরিবার বর্গ নিয়ে এক সঙ্গে জাহান্নান্মে যাবে। সাংঘাতিক কথা।
ওয়ার এগেইন্সট টেরর হচ্ছে এই ব্যাটল অব আরমাগেদ্দনের আরেক রূপক। এটা মিডল ইস্ট কে ঘিরেই করতে হবে এবং এটা বাইবেলের নির্দেশ। এটাই মনে করে ইসরায়েল এবং খ্রিস্টিয়ানরা
কেন আমেরিকা ইসরায়েলকে
কেন আমেরিকা ইসরায়েলকে অন্ধভাবে সমর্থন করে, এই প্রশ্নটা আমি অনেককেই করতে দেখেছি। অনেকের অনেক রকম ধারনা আছে যার মধ্যে একটা হচ্ছে যে, সবাই মনে করে আমেরিকাতে ইহুদীদের প্রভাব বেশি এবং তারা যদি আমেরিকার ভোটের সময় বেকে বসে তাহলে কোন ব্যাক্তিই আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট হতে পারবে না। অথবা ইহুদীরা ভোটের সময় হয়ত প্রচুর টাকাপয়সা দান করে যার জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ক্যান্ডিডেটরা ইহুদীদেরকে হাতে রাখতে চায়। হয়ত এই কারনে আমেরিকা ইসরায়েলকে অন্ধভাবে সমর্থন করে, আসলে ব্যাপারটা একদমই এইরকম নয়।
ইহুদীরা টাকা পয়সা দানের ব্যাপারে অত্যন্ত কঞ্জুষ। এরা পারতপক্ষে কাউকে কোন দান করে না। এমনকি তাদের গরিব আত্মীয়সজনকেও না। আর আমেরিকার ভোটের সময় কোন ক্যান্ডিডেটকে অনেক টাকা পয়সা দিয়ে সাপোর্ট করার মত মানসিকতাও ওদের নেই। আর যদি বলি যে, ইহুদীরা আমেরিকায় অনেক সংখ্যাগরিস্ট তাও নয়। ইহুদীরা আসলে নিউইয়র্কভিত্তিক বেশি। আর শুধু নিউইয়র্ক দিয়ে পুরু আমেরিকায়, আর যাই হোক, প্রেসিডেন্ট হিসাবে জয়ি হওয়া সম্ভব নয়। আবার যদি বলি যে, ইসরায়েলকে সমর্থন করে অন্ধভাবে অনেক আমেরিকান তাও নয়, বরং ইসরায়েলকে সমর্থন করে না এমন লোকের সংখ্যাই বেশি। তাহলে প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন আমেরিকা ইসরায়েলকে এত অন্ধভাবে সমর্থন করে? বা কারা করে?
উত্তরটা খুব সহজ নয় তবে বুঝবার বিষয় আছে। এটা অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়।
আমেরিকায় দুই ধরনের খ্রিস্টিয়ান বাস করে, এক হচ্ছে ফান্ডামেন্টালিস্ট খ্রিস্টিয়ান এবং দুই হচ্ছে ক্যাথলিক। ফান্ডামেন্টালিস্ট খ্রিস্টিয়ানগন তাদের ধর্ম বিশ্বাসে অটুট থাকতে হলে ধর্মের জন্য তাদের ইনকামের ১০% টাকা দান করতেই হবে। এটা নিয়ম। আর এটা যদি না করা হয় তাহলে বাইবেলের তথ্য মতে ঐ ফান্ডামেন্টালিস্ট খ্রিস্টিয়ানদেরকে ঈশ্বর দোজখের আগুনে পুরিয়ে মারবেন। ফান্ডামেন্টালিস্ট খ্রিস্টিয়ানগন এই নিয়মটা ১০০% মেনে চলেন যদিও অনেকে চার্চে যান না। আর এখানেই হচ্ছে সেই ভোটের ট্রাম কার্ড।
আমেরিকায় ফান্ডামেন্টালিস্ট খ্রিস্টিয়ান এত বেশি যে, কোন ক্যান্ডিডেটই ফান্ডামেন্টালিস্ট খ্রিস্টিয়ানদের ভোট ছাড়া জয় পাবার কোনই সম্ভাবনা নাই। ক্যাথলিক খ্রিস্টিয়ানরা সংখ্যায় অনেক কম এবং এরা খুব একটা বাইবেল পড়ে না যেমনটা পড়ে ফান্ডামেন্টালিস্ট খ্রিস্টিয়ানরা। ছোট একটা উদাহরন দিয়ে আমি যদি বলি যে, ফান্ডামেন্টালিস্ট খ্রিস্টিয়ানরা হচ্ছে আমাদের সুন্নিদের মত আর ক্যাথলিক খ্রিস্টিয়ান রা হচ্ছে আমাদের শিয়া মুসলমানদের মত। সুন্নি মুসলমানরা কোরআন বেশি পড়ে এবং কোর আনে যা লিখা আছে তা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করে কিন্তু শিয়ারা কোর আনের পাশাপাশি তাদের ধর্ম গুরুর কোথাও কোরআনের মত মেনে চলে যেমন হয্রত আলির অনুসারিরা। Fundamentalist Christians are all Protestants. The largest group is the Baptists. Whereas the Jews are divided in their support of Israel, the Fundamentalist Christians are united in their support of Israel. This explains why no political candidate can be elected in America who is opposed to Israel. Now, the key question is: Why do the Fundamentalist Christians support Israel?
ফান্ডামেন্টালিস্ট খ্রিস্টিয়ানরা বিশ্বাস করে যে, বাইবেলে যা যা বলেছে তা সব সত্য এবং এটা মানা তাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। Their support for Israel comes directly from the Bible. Most importantly, it comes from the Book of Revelation, the last book of the Bible, chapters 16 to 21
বাইবেলের মতে জিশুর ২য় বার আগমনের জন্য কতগুলো ঘটনা ঘটবে। ১ম ঘটনা হতে হবে যে, ইহুদীরা জেরুজালেমে ফিরে আসতে হবে যা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। তারপর প পড় আরও অনেক অঘটন ঘটবে, যেমন চাদের রং লাল হয়ে যাবে, তারপর "ব্যাটল অব আমাজেদ্দন" হবে, তারপর শয়তান রা জেরুজালেমে যুদ্ধ ঘোষণা করবে (প্যালেস্টাইনকে ওরা শয়তান মনে করে)। বাইবেল বলে যে, এই যুদ্ধে জেরুজালেমের অনেক ক্ষতি সাধিত হবে এবং জেরুজালেমের উপাশনালয়ের কিছুটা ধ্বংস হবে। বাইবেল আরও বলে যে, এই ব্যাট ল অব আমাজেদ্দনে ইহুদীরা অনেক দুর্বল হয়ে পরবে এবং ঠিক ঐ সময়ে যীশু আসবেন। এই ব্যাটল অব আমাজেদ্দনে যীশু আসার পড় ইহুদীরা পুনরায় জয়ি হবে এবং সব ক্যাথলিক ক্রিস্টিয়ানরা ফান্ডামেন্টালিস্ট খ্রিস্টিয়ান হয়ে যাবে। এই সব কিছু সম্ভব হবে তখন ই যখন জেরুজালেম তাদের হাতে থাকবে। জেরুজালেম হাতে না থাকলে যীশু আসতে পারবেন না এবং ইহুদীরা সমুলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আর এই জেরুজালেম এক মাত্র উদ্ধার এবং রক্ষা করতে পারে শুধু মাত্র ইসরায়েল। আর ঠিক এই কারনে ইসরায়েলের সব চেষ্টা এবং একটিভিটিজ হোক সেটা শয়তান (প্যালেস্টাইন) মারা, হোক সেটা অন্য কোন এক্ট ইত্যাদি করাকে সব ফান্ডামেন্টালিস্ট খ্রিস্টিয়ানরা সমর্থন করবেই। এটা ওদের জন্য ফরজ কাজ ধর্মের নামে। আরও একটা মজার কাহিনি হল যে, ফান্ডামেন্টালিস্ট খ্রিস্টিয়ানদের ধর্ম উপদেস্ঠা জেরি ফলওয়েল এর চিন্তা ধারা বাইবেলের এই সব ব্যাখ্যা কে আর ও জোরালো এবং সমর্থন যোগ্য করে দিয়েছে এই সব ফান্ডামেন্টালিস্ট খ্রিস্টিয়ান দের কে। কে সে এই জেরি? সেটা আরেক মজার গল্প। আমার কাছে এটা গল্পই বটে। পড়ে বলব যদি সময় এবং মুড থাকে।
ম্যাগনা কার্টা
ম্যাগনা কার্টা বেসিক্যালি একটা চুক্তিপত্র যার মাধ্যমে দেশের সমস্ত লোকজনের বেসিক রাইটসকে সমুন্নত রাখবে এবং অক্ষুন্ন রাখবে। আর এটা করা হয়েছিল রাজা জনের আমলে রুন্নিমেড এলাকায় জুনের ১২১৫ সালে। এই চুক্তিটা আসলে যুক্তরাজ্যের অধিবাসিদের জন্য এক ধরনের ব্যাক্তি স্বাধীনতার দলিল। যার প্রধান উদ্দেশ্য হল, King is not above the Law and its like a Bill of Rights for Mediaval England. প্রকৃত দৃশ্য ছিল যে, The King often lived above the law, violating both feudal and common law, and was heavily criticized for his foreign policy and actions within England. আর এই কারনেই যুক্ত রাজ্যের মানুষ গুলো ছিল রাজাদের উপর খুব বিরক্ত। বিশেষ করে ব্যারনরা। এটার মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের অধিনে যে সব কলোনিগুলো ছিল প্রায় সব দেশেই অবশেষে এই দলিলটি একটি মহামান্নিত দলিল হিসাবে গৃহীত হয় এবং অনেক দেশের লিগ্যাল সিস্টেম এর উপরই বেজ করে তৈরি করা হয়।
গল্পটা এই রকমঃ
১২০৯ থেকে ১২১২ সাল পর্যন্ত তখনকার রাজা জন এর আমলে যুক্তরাজ্যের কিছু অধিবাসীগণ যাদেরকে ব্যারন (member of a specific rank of nobility, esp the lowest rank in the British Isles) নামে ডাকা হত সেই সব সিটিজেনের জন্য এবং তাদের অধিকার রক্ষার জন্য এই দলিলটি রাজা জন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১২১৫ সালে অনেক ব্যারনরা এবং চার্চের লোকেরা রাজার এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কন্সপিরেসি শুরু করে। তারা রাজা জনকে সিংহাসন থেকে বিতারিত করতে চাইছিলেন না কারন রাজা জনের পরে অন্য কেউ যে রাজা হবেন সেই লোকটি ছিল না। কেন ছিল না, বা কে হতে পারত এটা আরেক গল্প। ঐ গল্পে গুম আছে, ডিপ্লোম্যাটিক রাজনীতি আছে, ধর্ম আছে, সে গল্পে এখন যাচ্ছি না। এই ম্যাগনা কার্টার প্রথম নাম ছিল 'The Unknown Charter of Liberties', later appeared as 'Articles of the Barons' and the Runnymede Charter.
মীরজাফর এর মত লোক সবসময় সবখানেই ছিল এবং এই রাজা জনও এমন একজন লোক ছিলেন। যেই না 'The Unknown Charter of Liberties', অথবা 'Articles of the Barons' ব্যারনরা পেল এবং ব্যারনরা সানন্দে আবার রাজা জনকে অভিসিক্ত করলেন, অভিষিক্ত হয়েই এই রাজা মশাই ঐ দলিল খানা বাতিল করে দেন। আবারো শুরু হল যুদ্ধ। শেষ অবধি এই রাজা মারা গেলেন ১২১৬ সালে এবং তাঁর পুত্রধন হেনরি-৩য় রাজার স্থলে অভিষিক্ত হলেন। কিন্তু পুত্রটি ছিল বাপের থেকে একটু চালাক। তিনি বাপের বাতিল করা আর্টিকেলটি পুনরায় বহাল করেন এবং তখনই এর সংস্কারকৃৎ নতুন নামটি হয় ম্যাগনা কার্টা ।
এখন তাহলে এই মুল্যবান দলিল দিয়ে কি হয় আসলে তা বুঝার ব্যাপার। যেহেতু এই দলিলটি অনেক দেশেই চলমান, ফলে অনেক দেশ একচুয়ালি একই কন্সটিটিউসন ব্যবহার করে বলে লিগ্যাল সিস্টেমগুলো প্রায় এক।
দ্বিতীয়তঃ এই দলিলের বলে "ব্যালেন্স অব পাওয়ার" যদি বলি অনেকটা "ব্যালেন্স" করে। কার কার মধ্যে ব্যালেন্স করে? দেশ থেকে দেশে এবং পাবলিক ও জনগনের মধ্যে।
তৃতীয়তঃ কোন রাজাই এখন আর প্রশ্নের উর্ধে নয়, সবার জন্য আইন সমান সে রাজাই হোক আর প্রজাই হোক। সে ক্ষমতায় থাকুক আর ক্ষমতায় নাই বা থাকুক। আসলে এটা হওয়া দরকার ছিল বাংলাদেশে। এটা থাকলে আর কেয়ার টেকার সরকারের দরকার পরত না।
৪র্থ হল যে, এই ম্যাগনা কার্টার মাধ্যমে চার্চকে একেবারে স্বাধীন করে দেয়া হয়েছে। চার্চ তাঁর নিজস্ব পলিসি বানাতে পারবে রাজার কোন ভুমিকা নেই। মোদ্দা কথা হচ্ছে এই উপরের আইন বা স্বাধীনতাগুলো ছাড়া বা সহকারে আমি যদি নিম্নআকারে লিখি তাহলেও ম্যাগনা কার্টা ভালভাবে বুঝা যাবে।
ক। Shifted the power from the monarchs to the people in Britain
খ। Required British royalty to obey the same laws as other English people.
গ। Limited the power of the people in the British government.
ঘ. Gave the power in the British government to members of Parlia
এখন অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের রুলস অব বিজনেজকেও অনেক সময় ম্যাগনা কার্টা বলে অভিহিত করে। অর্থাৎ মালিক এবং কর্মচারী একই আইনের অধিনে। সবার অধিকার সমান তাদের যোগ্যতার বলে। এবং সেই সংস্থায় ধর্ম বলে কোন কিছুই ফিক্সড করে দেয়া নাই। যে যার ধর্মকে পালন করতে পারবে। কোন বৈষম্য নাই। আর এটাই হচ্ছে ম্যাগনা কার্টা।
বাইবেলে রঙ
বাইবেলে সাদা, কালো, হলুদ এবং সম্ভবত মিক্সড এই কয়েকটি কালারের কথা বোলা আছে। অনেকদিন আগে আমি বাইবেলের প্রায় ৭টা ভার্সন পরেছিলাম। লুকের, মেথিউজ, আর্কের এবং অল্ড টেস্টামেন সহ নিউ টেস্টামেন্ট।
অল্ড এবং নিউ টেস্টামেন্ট টা অনেকে হয়ত বুঝবে কিনা আমি জানি না তবে এটা জানা ভাল। তো আমি পড়ে এটা সম্পর্কে একটু ধারনা দেব যদি কেউ জানতে চায়।
তো বলি এবার, কালারের কথাগুলো।
বাইবেলের কোন এক জায়গায় লিখা আছে যে, "ইয়াহি অনেক দূর থেকে তোমাদের জন্য এক রাজ্য নিয়ে আসবে যে দেশের লোক হবে খুবই তড়িৎগতি সম্পুন্ন ইগলের মত, যাদের ভাষা তোমরা বুঝতে পারবে না এবং যারা হবে যুদ্ধ প্রিয় মানুষ। তারা বড়দের সম্মান করবে না, এবং ছোটদেরকেও এরা কোন ফেবার করবে না। তারা প্রুচুর মাংশভুজি হবে, তারা তোমাদের জন্য কোন শস্যক্ষেত খালি রাখবে না মদ তৈরির করার জন্য। এদেরকে বোলা হয়েছে হলুদ মানুষ। এখানে আরও একটা কথা বোলা দরকার যে, বাইবেল বলে যে, ঐ সময় জেসাস এসে তোমাদের সাহায্য করবেন এবং নতুন রাজ্য সৃষ্টি করবেন যার নাম হবে মিলেনিয়াম রাজ্য।
বাইবেলের আরেক ভার্সনে বোলা আছে যে, "তোমার যত পূর্বে যাবে তত হলুদ বিপদের মানুষের সঙ্গে তোমাদের দেখা হবে"। ইন ফ্যাক্ট এই মিথ তাঁর অর্থ অনেক রকমের। কেউ মনে করে এই মিথ টা এসেছে " দি কিংস ফ্রম দি ইস্ট" কনসেপ্ট থেকে। এর মানে এই যে, ইউফ্রেটিস নদির পূর্ব তীরের মানুষ গুলোর কথা বোলা হয়েছে। এর মানে চীন। কিন্তু অনেকে আরও দূর ব্যাখ্যা দিয়ে বলে যে চীনের পর এবং পূর্বেও হচ্ছে আমেরিকা।আবার অনেকে মনে করে যে, ইউফ্রেটিসের পূর্বে বাগদাদ বা তেহরানও আছে যারা ইসলামিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে দিনে দিনে।
এখানে বাইবেলের অন্যান কালারের ব্যাপারে আরও কিছু মজার মিথ প্রচলন আছে। যেমন, ঈশ্বর যখন প্রথম মানুষ তৈরি করেন, তখন তাঁর কালার খুবই কাল হয়ে গিয়েছিল। তখন তিনি আবার আরও একজন মানুষ তৈরি করেন, তখন সেটা হয়ে ছিল অনেক সাদা। তখন তিনি তৃতীয় বার চেস্টার পর যে মানুষটি তৈরি হল, সেতা না কাল না সাদা। ওটা প্রায় এসিয়ান টাইপের। এটা অনেকে জোক মনে করেন কারন এই কনসেপ্টটা সব ভার্সনে পাওয়া যায় না।
তবে অরিজিনাল বাইবেলে মাত্র ৪ বার হলুদ কালারটা ব্যবহার করা হয়েছে। ৩ বার ই ব্যবহার হয়েছে ধর্ম জাজকের দ্বারা রোগ নির্ণয় করার কারনে বা ব্যাপারে। আর ৪র্থ বার ব্যবহার করা হয়েছে ইয়েলো গোল্ড বুঝানোর জন্য।
কোন একটা ভার্সনে (আমার ঠিক মনে নাই এখন) বলা হয়েছে যে, Gold or Yellow: Symbolizes the Glory of God ; divine nature; holiness; eternal deity; the Godhead; Purification; majesty; righteousness; divine light; kingliness; trial by fire; mercy; power; His Deity; Glory. Yellow or Gold is also primary. It always speaks of trial and purging. "That trial of your faith, being much more precious than of gold that perishes, though it be tried with fire, might be found unto praise and honour and glory at the appearing of Jesus Christ"
বাইবেলের বিশেষ করে লেভিক্টাসে কালারের কিছু মিনিগ সরাসরি বোলা হয়েছিল। যেমন ধরঃ কাল মানে পাপ, মৃত্যু, খোঁড়া, দুঃখ কিন্তু এখানে চুল কে ওর মধ্যে ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে।
নিল কালারকে বোলা হয়েছে যে, পবিত্র জায়গায় যা যা রাখা হবে তাঁর কালার হতে হবে নীল। এটা ধনী ব্যাক্তির জন্য ও ব্যবহার করার রিতি আছে। এটা হচ্ছে হেভেনলি কালার।
সবুজ কালারকে জীবনের কালার বোলা হয় অর্থাৎ যা সবুজ তাতেই প্রান আছে বোলা হয়।
The color red in the Bible means love, forgiveness, or even blood sacrifice. Red in the Bible meant the chosen people whose doors were paintef red were to be kept alive and the doors that were not painted were killed
এবার আসি অল্ড টেস্টামেন্ট এবং নিউ টেস্টামেন্ট কি
একদম সবচেয়ে বিশাল পার্থক্য হচ্ছে অল্ড টেস্টামেন্টে জিশুর আবির্ভাব আর নিউ টেস্টামেন্টে এটার অভাব। The Old Testament provides the history of a people; the New Testament focus is on a Person. The Old Testament shows the wrath of God against sin (with glimpses of His grace); the New Testament shows the grace of God toward sinners (with glimpses of His wrath). The Old Testament predicts a Messiah (see Isaiah 53), and the New Testament reveals who the Messiah is (John 4:25–26). The Old Testament records the giving of God’s Law, and the New Testament shows how Jesus the Messiah fulfilled that Law (Matthew 5:17; Hebrews 10:9). In the Old Testament, God’s dealings are mainly with His chosen people, the Jews; in the New Testament, God’s dealings are mainly with His church (Matthew 16:18). Physical blessings promised under the Old Covenant (Deuteronomy 29:9) give way to spiritual blessings under the New Covenant (Ephesians 1:3). The Old Testament saw paradise lost for Adam; the New Testament shows how paradise is regained through the second Adam (Christ). The Old Testament declares that man was separated from God through sin (Genesis 3), and the New Testament declares that man can be restored in his relationship to God (Romans 3—6). The Old Testament predicted the Messiah’s life. The Gospels record Jesus’ life, and the Epistles interpret His life and how we are to respond to all He has done. In summary, the Old Testament lays the foundation for the coming of the Messiah who would sacrifice Himself for the sins of the world (1 John 2:2). The New Testament records the ministry of Jesus Christ and then looks back on what He did and how we are to respond. Both testaments reveal the same holy, merciful, and righteous God who condemns sin but desires to save sinners through an atoning sacrifice.
হিটলার
১৮৮৯ সালের ২০ এপ্রিল সকাল ৬:৩০ মিনিটে অস্ট্রিয়ার কোনো এক নাম না জানা ব্রাউনুন গ্রামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহানায়ক এডলফ হিটলারের জন্ম হয়। তার বাবার নাম ছিলো এলুইস এবং মায়ের নাম ছিলো ক্লারা। বাবা মায়ের ৪র্থ সন্তান ছিলেন হিটলার। কিন্তু তার আগের তিনজনই তার জন্মের আগে মারা গিয়েছিলেন। হিটলারের পরে তার আরো দুইজন ভাইবোন ছিলো। তাদের নাম ছিলো এডমাউন্ড এবং পউলা। হিটলারের দাদামহ কে ছিলেন সেটা আজো ইতিহাস সঠিক তথ্য দিতে পারে নাই। তবে বলা হয় যে, হিটলারের বাবা এলুইস ছিলেন মারিয়া আন্না নামের কোনো এক মহিলার সন্তান এবং তারপাশের বাড়ির দুধ বিক্রেতা জোহান জর্জ হেইডলার ছিলেন এলুইসের বাবা। এলুইস যে একজন অবৈধ সন্তান এটা তখনকার দিনে ওই সমাজে খুব একটা অপ্রীতিকর ব্যাপার ছিলো না বলে এলুইস কখনোই তার পরিচয় গোপন করার চেষ্টা করেন নাই। কিন্তু তিনি তার মায়ের শেষ নামটাই সবসময় ব্যবহার করতেন। আর সেটা ছিলো সিক্লগ্রুবার। পরবর্তীতে অস্ট্রিয়ায় ১৮৭৬ সালে অফিশিয়াল জন্ম নিবন্ধনের সময় তিনি তার এক চাচার "হেইডলার" নামের সাথে ম্যাচ করে এলুইস হেইডলার নামকরনে অভিষিক্ত হন। তখন তার বয়স ছিলো ৩৯। কিন্তু সরকারী খাতায় "হেইডলার" নামটি ভুলভাবে লিপিবদ্ধ হয় "হিটলার" হিসাবে। আর পারিবারিক নামের জের ধরেই পরবর্তীতে এই মহানায়কের নামেও এডলফ হেইডলারের পরিবর্তে এডলফ হিটলার হিসাবেই আজ বিশ্ববাসি জানে।
১৮৯৫ সালে হিটলার তার ছয় বছর বয়সে ক্লাশ ওয়ানে ভর্তি হন গ্রামের কোনো এক স্কুলে। হিটলার সপ্ন দেখতেন তিনি একজন আর্টিস্ট হবেন। ফলে হিটলার ক্লাসিক্যাল কোনো এক স্কুলে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার বাবা এলুইস চাইতেন যে, হিটলার সরকারী কোনো কর্মচারী হিসাবে ক্যারিয়ার গড়ে তুলক। ফলে তার বাবা হিটলারকে ক্লাসিক্যাল স্কুলের পরিবর্তে টেকনিক্যাল স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। হিটলার তার বাবাকে খুব ভয় পেতেন। ১৯০৩ সালে হতাত করে হিটলারের বাবা ফুস্ফুসের ক্যান্সারে মারা যান। তার বাবার মৃত্যুর পর হিটলার পুরুপুরি স্বাধীনতা পেয়ে যান। কোনো দায়িত্ববোধ বলে কিছু ছিলো না তার। এমনকি নিজের জন্যেও না। ফলে বাউন্ডেলে জীবনের মত হিটলার অস্ট্রিয়ার আনাচে কানাচে বিভিন্ন মিউজিয়ামে, অপেরা পার্টির সঙ্গে এখানে সেখানে ঘুরে বাড়াতে লাগলেন। আর এভাবে হিটলার তার লেখাপড়ায় মোটামোটি একটা ইতিই টেনে ফেলছিলেন। এইভাবে করতে করতে, ১৯০৭ সালে হিটলার সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি ভিয়েনা একাডেমিতে ফাইন আর্টসে ভর্তি হবেন। কিন্তু তিনি খুব খারাপভাবে ভর্তি পরিক্ষায় ফেল করলেন এবং ভিয়েনা একাডেমিতে আর ভর্তি হতে পারলেন না। মনের দুঃখে তিনি পুনরায় ভিয়েনা থেকে তার নিজের বাড়ীতে মায়ের কাছে ফিরে এলেন। কিন্তু তখন তার মা আন্না ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ১৯০৭ সালের ডিসেম্বরে তার মা আন্না ক্যান্সারে মারা যান।
১৯০৮ সালে হিটলার পুনরায় ভিয়েনা একাডেমিতে আবারো ফাইন আর্টসে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দেন, কিন্তু আগেরবারের চেয়ে ফলাফল এবার আরো খারাপ হওয়ায় ভিয়েনা একাডেমি তাঁকে পরবর্তী সব ভর্তি পরীক্ষার জন্য স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করেন। হতাশ হিটলারের আর কোনো কিছুই করার ছিলো না। মায়ের সঞ্চিত যা ছিল, তাই দিয়ে হিটলার রাস্তায় রাস্তায় এদিক সেদিক ঘুরে বাড়াতে লাগলেন। কখনো পার্কে, কখনো ষ্টেশনে, কখনো বা গাছের তলায়। আস্তে আস্তে মায়ের রাখা সঞ্চয়ও শেষ হতে থাকে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতেও হিটলার রেগুলার কোনো একটা কাজের সন্ধান করেন নাই। শেষতক, হিটলার কাজ না খুজে মানুষের কাছে হাত পাতা শুরু করলেন, আক্ষরিক অর্থে যাকে বলে ভিক্ষা। এইভাবে আর যখন চলছিলো না, তখন হিটলার ১৯০৯ সালের ডিসেম্বরে "হোমলেস শেল্টার" এ আশ্রয় নেন।
১৯১৩ সালে অস্ট্রিয়ায় যখন বাধ্যতামুলক সেনাবাহিনীতে ভর্তির আদেশ করা হয়, তখন সেনাবাহিনীতে ভর্তি না হবার জন্য চালাকী করে হিটলার তার পিতৃভুমি জার্মানির মিউনিখে চলে আসেন। কিন্তু অস্ট্রিয়ান সরকার ১৯১৪ সালে তার এই চাতুরী ধরে ফেলেন। চতুর হিটলার তার চাতুরীর জন্য এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলভোগের সাজা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হিটলার অস্ট্রিয়ান কনসুলেটকে তার দারিদ্র্যের বর্ণনা দিয়ে অতি আবেগময় একখানা পত্র লিখেন। অস্ট্রিয়ান কনস্যুলেট হিটলারের পত্রের আবেগময় ভাষা এবং তার নিবেদন খুব পছন্দ করেন এবং তাঁকে শাস্তি না দিয়ে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেন সেনাবাহিনীতে ভর্তির জন্য। কিন্তু হিটলার ইচ্ছে করে সেনাবাহিনীর লিখিত পরিক্ষায় খুব খারাপভাবে ফেল করেন এবং তাঁকে আর অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীতে কখনোই যোগ দিতে হয় নাই।
২৮ জুন ১৯১৪ সালে যখন এক সারবিয়ান আততায়ীর হাতে অস্ট্রিয়ার রাজা ফারদিন্যান্ড মারা যান, তখন জার্মানির চ্যান্সেলর কায়জার অইলহ্যাম অস্ট্রিয়াকে সারবিয়ান্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য চাপ দেন এবং অস্ট্রিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করে। পহেলা আগস্ট ১৯১৪ সালে যখন জার্মান যুদ্ধ ঘোষণা করে, তখন মিউনিখে সবার সাথে হিটলার নিজেও ওই আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন।
এই সময় রাশিয়া অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে তাদের সৈন্যসামন্ত মোতায়েন করেন, অন্যদিকে জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের সৈন্যসামন্ত মোতায়েন করেন। আবার আরেক দিকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড জার্মানির বিরুদ্ধে তাদের সৈন্যসামন্ত মোতায়েন করে বসেন। তার মানে এই দাড়ালো যে, অস্ট্রিয়া ও জার্মানি একদিকে, অন্যদিকে সার্বিয়া, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড।
অস্ট্রিয়ার রাজা যখন সার্বিয়ার আততায়ীর হাতে খুন হন, তখন হিটলার এতোটাই দেশপ্রেমিক বনে যান যে, তিনি এইবার জার্মানির ভ্যাবারিয়ান রেজিমেন্টে স্ব ইচ্ছায় যোগ দেন। হিটলার সার্বিয়ানদেরকে এবং অন্যান্য বিদেশীদেরকেও জার্মানিতে সহ্য করতে পারছিলেন না। হিটলার সেনাবাহিনীর সদস্য হিসাবে মোটেও একজন খাপ খাওয়ানোর মতো লোক ছিলেন না। ঢিলাঢালা, অলস এবং খুবই অপরিচ্ছন্ন সদস্য হিসাবে গন্য ছিলেন। কিন্তু তার একটা ভালো গুন ছিলো। সে বহুবার অল্পের জন্য মৃত্যু থেকে বেচে গেলেও তার সাহসী কাজে খুব উৎসাহ ছিলো এবং তিনি ওইসব কাজে নিজে থেকেই এগিয়ে আসতে চাইতেন। হিটলার কখনো খাবারের জন্য অভিযোগ করেন নাই, কিংবা ব্যারাকে থাকার অবস্থা ভালো নয় এইজন্য তার কোন অভিযোগ ছিলো না, কিংবা তিনি কখনো মেয়েঘটিত ব্যাপার নিয়ে নাক গলান নাই। আর হিটলার কখনো ছুটির জন্যও আবেদন করতেন না।
১৯১৬ সালের ৭ অক্টোবরে কোনো এক যুদ্ধে ( ব্যাটল অফ সুম্মি) তে হিটলার গুরুতর পায়ে আঘাত পান এবং জার্মানির এক হাসপাতালে ভর্তি হন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এটাই হিটলারের প্রথম অনুপস্থিতি। আরোগ্য লাভের পর হিটলারকে তখন হাল্কা কাজ দেওয়া হয় আর তিনি তখনো মিউনিখেই থাকেন। এদিক সেদিক ঘুরে বাড়ান, বার্লিনে এই প্রথম হিটলার ঘুরতে যান। ১৯১৮ সালের ১০ নভেম্বরে হিটলার খবর পান যে, জার্মানির পরাজয় হয়েছে। হিটলারের বয়স তখন ২৭। এই টকবগে তরুন হিটলার জার্মানির এই পরাজয় কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তার বারবার মনে হচ্ছিলো যে, জার্মানির পরাজয় সামরিক বাহিনীর অক্ষমতার জন্য হয় নাই, বরং পরাজয়টা হয়েছে অযোগ্য রাজনীতিবিদদের কারনে, বিশেষ করে ইহুদীদের কারনে। হিটলারের মনে ইহুদীদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড ক্ষোভ জন্ম নিতে থাকলো।
১৯১৯ সালের ২৮ জুন জার্মানির পরাজয়ের কারনে মিত্রপক্ষ "ভারসাই চুক্তি" নামে একটি চুক্তি করে যেখানে সম্পূর্ণ দায়ভার জার্মানির উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং যুদ্ধে যার যা ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতিপুরন হিসাবে জার্মানিকে কি কি করতে হবে তা ওই চুক্তির মধ্যে লিপিবদ্ধ করা হয়। এই চুক্তির বলে জার্মানিকে তাদের নিজস্ব কিছু ভূখণ্ডও পোল্যান্ড এবং ফ্রান্সকে দিয়ে দিতে হয়। শুধু তাই নয়, চুক্তি মোতাবেক বলা হয় যে, জার্মানি তার সেনাবাহিনী কোনো অবস্থাতেই একলাখের বেশী সৈন্য সামন্ত বাড়াতে পারবে না, তাদের কোনো মিলিটারী বিমান থাকতে পারবে না, এমনকি সাবমেরিন জাতীয় কোন নৌজানও রাখতে পারবে না। এটা ছিলো বিশ্ববাসীর সামনে জার্মানির একটা অপমানসুচক চুক্তি।
হিটলার তখনো জার্মানির গোয়েন্দা বাহিনীতে একজন "ইনফরমার" হিসাবে কাজ করছিলেন এবং তিনি মিউনিখেই থাকতেন। কিছুদিন পর হিটলারকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে "পলিটিক্যাল ইনডক্ট্রিনেসন" কোর্সে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। আর ওখানেই হিটলার তার জীবনের একটা মোড় ঘুড়িয়ে ফেলতে সক্ষম হন। সেখানে তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজর কাড়েন। হিটলার তার নিজের লেখা "মেইন ক্যাম্প" এ লিখেছিলেন, "একদিন আমি ওই কোর্স করার সময় অনেক ছাত্রদের মিলিত সভায় ইহুদীদের ব্যাপারে আমার কিছু কথা বলার সুযোগ হয়েছিল যেখানে অধিকাংশ ছাত্ররা আমার মতের পক্ষেই সমর্থন দেয়। আর এর ফলশ্রুতিতেই আমাকে সেনাবাহিনি থেকে মিউনিখ রেজিমেন্টে .এডুকেসনাল অফিসার" হিসাবে প্রেসনে পাঠায়।"
১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে মিউনিখের "জার্মান ওয়ার্কার পার্টি"র কোনো এক ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে হিটলারকে তদন্ত করতে পাঠানো হয়। ওই সময় এই "জার্মান ওয়ার্কার পার্টি"টি ছিলো মুলত একটি ছোট নাম না জানা "আলাপচারিতা দলের" মত। খুব কমসংখ্যক লোক এরসঙ্গে জড়িত এবং এদের কোনো এজেন্ডা ছিলো না। হিটলার সূক্ষ্মভাবে ভাবলেন যে, এই ছোট দলটি দিয়েই একটা কিছু করা সম্ভব এবং একে সাংঘটনিকভাবে সাজাতে হবে। এদের প্রতিটি সদস্যই ইহুদীদের বিপক্ষে। হিটলার নিয়মিত এই "আপালচারিতা দল"টিকে একটা রাজনৈতিক দলের আদলে তৈরী করা শুরু করলেন। এই দলটির পক্ষে মাঝে মাঝে হিটলার বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করলেন যেনো এর পরিচিতি বাড়ে। এমনই এক সময়, ১৬ অক্টোবর ১৯১৯ সালে, হিটলার তার এই ক্ষুদ্র দলের সদস্যদের উদ্দ্যেশে এমন এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন যে, তার এই বক্তব্য, তার এই ইহুদী বিরোধী মনোভাব অনেক জার্মান নাগরিককে উক্ত দলে এসে হিটলারের ভাষণ শুনার জন্য প্রলুব্ধ করে। আর এই সুযোগ নিয়ে ১৯২০ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারীতে প্রায় ২০০০ হাজার জার্মান নাগরিকের সম্মুখে হিটলার ২৫টি দাবী সম্বলিত এক আশাবাদী এবং জ্বালাময়ী বক্তৃতা রাখেন। এই বক্তব্যে প্রধানত হিটলার ইহুদী বিরোধী বক্তব্যের সঙ্গে "ভারসাই চুক্তি" বাতিল, ফ্রান্স এবং পোল্যান্ডকে দেওয়া ভুখন্ড ফেরত, প্রতি বছর মিলিওন মিলিওন ডলারের ক্ষতিপুরন বন্ধ, ইহুদীদের অনধিকার অধিকার, জার্মানিদের দুরাবস্থা ইত্যাদি তুলে ধরেন। হিটলার আরো বলেন যে, যুদ্ধের পরে যে সব ইহুদীগন জার্মানিতে বসবাস শুরু করেছে, তাদেরকে যতো দ্রুত সম্ভব বিতাড়িত করতে হবে।
হিটলারের এই অভিপ্রায়ে জার্মানির অধিকাংশ নাগরিক এমনভাবে সমর্থন দিলেন যে, হিটলার এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চান নাই। তিনি অতিদ্রুত আগের "ওয়ার্কার পার্টি" নাম বদল করে একে "ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি" হিসাবে নাম পরিবর্তন করেন। যাকে আমরা পরবর্তীতে "নাজি" পার্টি হিসাবে জানি। এই পার্টির তিনি একটি লাল পতাকার মধ্যে সোয়াস্টিকাও লেপ্টে দেন পার্টির সিম্বল হিসাবে। অবশেষে হিটলার উক্ত পার্টির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন ১৯২১ সালে, যদিও তিনি এক্সিকিউটিভ কমিটির মধ্যে ছিলেন ৭ম।
হিটলার ভ্যাবারিয়ান সরকারের কিছু রাজনীতিবিদদের সমন্নয়ে ১৯২৩ সালে ৮ নভেম্বরে মিউনিখে একটি আন্দোলনের সুচনা করেন যেখানে পরিকল্পনা ছিলো যে, তৎকালীন বার্লিন সরকারকে উতখাত করবেন হিটলার এবং তার মিত্র লুদেনদ্রফ। কারন বার্লিন সরকারে অধিকাংশই ছিলো ইহুদী এবং কমিউনিস্ট। কিন্তু তাদের ওই আন্দোলন সার্থক না হয়ে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। বার্লিন সরকার হিটলার এবং লুদেনদ্রফকে পাচ বছর করে জেল দেন। কিন্তু জার্মানির বিচারক উভয় হিটলার এবং লুদেনদ্রফকে যুদ্ধের সময় জার্মানির জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার জন্য ৫ বছরের স্থলে মাত্র ৮ মাস জেল খাটার ব্যবস্থা করেন। জেল থেকে বের হবার পর, হিটলার এইবার আন্দোলনের মাধ্যমে নয়, রাজনীতিকভাবে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করলেন এবং তিনি তার নব্যদলকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
তার "নাজি" পার্টি ধীরে ধীরে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত করলেন এবং ১৯৩৩ সালের জানুয়ারিতে হিটলার তার পার্টি নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিলেন। কিন্তু তার প্রতিপক্ষ ১ম বিশ্বযুদ্ধের নামকরা পল ভন হিন্ডেনবার্গকে হিটলার হারাতে পারলেন না। কিন্তু পল ভন হিন্ডেনবার্গও এককভাবে সরকার গঠন করার মতো জয়ী হলেন না। ফলে কোয়ালিসন সরকারের মতবাদে হিটলার পল ভনের সহিত সরকারের সাথে আতাত করলেন যেখানে পল ভন হিন্ডেনবার্গ হলেন জার্মানির চ্যান্সেলর।
কিন্তু হিটলার বসে থাকার লোক নন। তিনি সময় অসময়, ন্যায়-অন্যায় ভাবে, যেভাবেই খুশী অধিস্টিন চ্যান্সেলরকে ভয় ভিতী, অসহযোগ অনেকভাবেই বিব্রত করতে লাগলেন যাতে তিনি বাধ্য হন হিটলারকে চ্যান্সেলর হিসাবে ডিক্লেয়ার করতে।
পরিশেষে ১৯৩৩ সালের ৩০ শে জানুয়ারিতে পল ভন হিন্ডেনবার্গ বাধ্য হয়ে হিটলারকে জার্মানির চ্যান্সেলর হিসাবে মেনে নেন।
তার পরের কাহিনি তো মাত্র শুরু। হিটলার চ্যান্সেল হওয়ার দিন থেকেই তিনি তার "নাজি" দলের বিশাল প্রচার, তাদের দলের আখাংকা, তাদের করনীয় কাজসমুহ, জনসম্মুখে জাহির করতে থাকলেন। জেনারেল গোয়েব্যালস ছিলেন হিটলারের এইসব প্রচারনার মুল হোতা। আর পুরানো যারা পল ভনের সময়ে ক্ষমতায় ছিলেন তারা কিছুটা ভয়ে, কিছুটা আতংকে আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকেন। এইবার হিটলার তার বহুল আখাংকিত কাজ, "ইহুদী নিধন" শুরু করেন। আর তিনি এই কাজটি শুরু করেন ১৯৩৩ সালের ১ এপ্রিল থেকে যেদিন তিনি ইহুদীদের কে জার্মানিতে "বয়কট" এর নির্দেশ দিলেন।
তারপরের কাহিনী আমরা অনেকেই জানি।
ফান্ডামেন্টালিজম
ফান্ডামেন্টালিজম শব্দটি একটি প্রোটেস্টেন টার্ম। এটি "দি ফান্ডামেন্টালসঃ এ টেস্টিমনি টু দি ট্রুথ" নামক ১৯০৯ সালের একটা পাব্লিকেসন থেকে নেওয়া। আর এই টাইটেলটি বিশেষভাবে ইভানজেলিক্যাল প্রোটেস্টাইন ক্রিশ্চিয়ানদের জন্যই প্রযোজ্য। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের দিকে যখন বিভিন্ন স্পিরিচুয়াল ধর্মজাযকগন তাদের যোগপোযোগী মনগড়া আধ্যাত্মিক বিশ্বাসসমুহকে বাইবেলের মধ্যে একে একে অন্তর্গত করছিলেন, শুধু তাই নয়, ওই সময়ে ডারউইনের থিউরি, এবং তখনকার আধুনিক বিব্লিক্যাল মতবাদ এবং তারসঙ্গে স্পিরিচুয়াল ধর্মযাজকদের আরোপিত এবং রচিত মতবাদে বাইবেলের নিজস্ব স্বকীয়তা অনেকটাই ম্লান হতে বসেছিলো। তখন ক্রিশ্চিয়ানদের এই অংশটি ওইসব বাইবেলের উপর থেকে সরে এসে একটি গোত্র কিংবা অন্য কথায় সাব-কালচার তৈরি করেন আর এদেরকেই তখন "ফান্ডামেন্টাল" নামে মুল্যায়ন করা হয়। তাদের মতে, বাইবেল একটি পবিত্র গ্রন্থ, ঈশ্বরের বানী, তারমধ্যে কোনো কিছুই যোজন বা বিয়োজন করার অবকাশ নাই এবং এটা ভুল থেকে মুক্ত।
খোদ আমেরিকার দুইভাই কার্টিস লি এবং মিল্টন স্টুয়ার্ড উভয়ে যৌথভাবে উক্ত ফান্ডামেন্টালিস্ট দলটিকে একত্রিভুত করেন। তাদের প্রথম এবং প্রাইমারী দায়িত্ব ছিলো পবিত্র বাইবেলের স্বকীয়তাকে বিকৃত হওয়া থেকে রক্ষা করা। অতঃপর ১৯৬০ সালে ভেটিকান-২ সম্মেলনে এই ক্রিশ্চিয়ানদেরকে স্থায়ীভাবে "ফান্ডামেন্টালিস্ট" হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই মূল শব্দটি অথবা অন্য কথায় যারা ফান্ডামেন্টালিস্ট, তাঁরা পাঁচটি ব্যসিক বিশ্বাসের উপর দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলো। সেগুলু হচ্ছেঃ (১) The Virgin Birth (2) The Physical Resurrection of Jesus (3) The Infallibility of the Scruptures (4) The Substitutional Atonement (5) The Physical Second Coming of Christ. ফান্ন্ডমেন্টালিস্টরা মনে করেন যে, ধর্মচ্যুত করা বা ধর্মচ্যুত হওয়া অন্যায় এবং তাদের ধর্মের বাইরে অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদ বিশ্বাস করাও অন্যায়। অন্য কথায় এরা গোঁড়া।
এখন ক্রিশ্চিয়ান ধর্মাবলম্বীদের না হয় আমরা ফান্ডামেন্টালিস্ট নামে অভিহিত করলাম, অন্যধর্মে তাহলে কি এই জাতীয় রক্ষণশীল ধার্মিক গোত্র নাই? তাহলে তাদেরকে কি বলা হয়? তারাও কি "ফান্ডামেন্ডালিস্ট"? যেমন, হিন্দুদের বেলায় বলা হয় "হিন্দুৎভা" বা "হিন্দুইজম"। কিন্তু "হিন্দুৎভা" মতবাদে Hindutva is understood as a way of life or a state of mind and is not to be equated with or understood as religious Hindu fundamentalism তাদের "হিন্দুৎভা"র নিজস্ব স্বকীয়তা রক্ষার জন্য পৃথক কোনো রক্ষণশীল গোত্র সৃষ্টি হয় নাই। তাদের বেলায় যা হচ্ছে তা নিতান্তই ধর্মপালনকে একটা রীতিনীতির মধ্যে সিমাবদ্ধ। যেমন, কেউ যদি হিন্দুত্ব ছেড়ে অন্য কোনো ধর্মকে আলিঙ্গন করতেও চান, তাতে তাদের ধর্মের মধ্যে কোনো বড় ধরনের আইনগত বাধা নাই। কিংবা হিন্দুধর্মের একক কোনো ঈশ্বরও নাই। একেক বিষয়ে তাঁরা একেক জনকে প্রধান ঈশ্বর মেনে থাকেন। অন্যদিকে The importance of Hindu fundamentalism lies in its very contemporary and nationalistic scope, compared to other, more regional expressions
ইহুদিদের বেলায় ধর্মের নামে এই রক্ষণশীল ফান্ডামেন্টালিজম এর সংজ্ঞা আবার ভিন্ন। ইহুদিরা বিশ্বাস করে যে, তাদের ধর্মবচন "টানাক" বা ট্রেডিসনালি যাকে আমরা "ওল্ড টেস্টামেন্ট" বলি তার অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা বা শিক্ষাই হচ্ছে মুখ্যবিষয়। অল্প কিছু ইহুদি (যেমন কেরাইটেস গোত্র) যারা তাওরাদ ধর্মগ্রন্থের বানীসমুহ সরাসরি "টানাক" ধর্মবচনের মত অবিকল ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী নয়। কেউ কেউ হয়ত ভাবেন যে, অর্থোডক্স বা হাছিডিক ইহুদিরা এক ধরনের ফান্ডামেন্টালিস্ট। তারপরেও তাঁরা ক্রিশ্চিয়ান ফান্ডামেন্টালিস্টদের মতো অতোটা গোঁড়া নয়। তাঁরা মনে করে, তাওরাতে মোট ৬১৩টি ভিন্ন পথের মাধ্যমে ঈশ্বরকে পাওয়া সম্ভব বলে পথ বাৎলে দিয়েছে। আবার যারা ইহুদি ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাসী নয় তাঁরাও অন্যপথে ঈশ্বরকে খুজে পাবেন বলে বিশ্বাস করেন। ওদিকে বৌদ্ধধর্মের মধ্যে ধর্মের চেয়ে জাতিভিত্তিক বা গোত্র বা এলাকাভিত্তিক দলবদ্ধটাই বেশি চোখে পড়ে। তার অর্থ দাড়ায় তাদেরকে ধর্মের পরিপ্রেক্ষিতে ফান্ডামেন্টালিস্ট হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা সঠিক কাজ হবে না। এইটুকু আলোচনা থেকে কিন্তু আমরা এই ধারনা পাই যে, শুধুমাত্র ধর্মের পবিত্র গ্রন্থের স্বকীয়তাকে বজায় রাখার জন্যই শুধু ক্রিশ্চিয়ান সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি পৃথক রক্ষণশীল গোত্র তৈরি হয়েছিলো যারা ফান্ডামেন্টালিস্ট নামে পরিচিত এবং অন্য কোনো ধর্মে এই প্রবনতাটা ছিলো না।
এবার যদি ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিজম সম্পর্কে বলি, তাহলে Fundamentalist Islam is simply the conservative wing of Islam, just as fundamentalist Christianity is the conservative wing of Christianity. এই দুইটি দলই কিছুটা ধার্মিক প্রকৃতির গোঁড়া। ক্রিশ্চিয়ানদের বেলায় যেমন উপরে উল্লেখিত পাঁচটি মূলস্তম্ভ অনুসরন করে, ইসলামের বেলায়ও এই রক্ষণশীল মুসলমানেরা এক আল্লাহকে বিশ্বাস করেন, হজরত মুহাম্মাদ (সঃ) কে নবী মানেন, তাঁকে অনুসরন করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য প্রতিনিয়ত মসজিদে যাতায়ত করেন, রোজা, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি মূলস্তম্ভ হিসাবে অপরিহার্য হিসাবে পালন করেন। কোরআন এবং নবী যা যা করতে বলছেন, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলার রীতিই হচ্ছে মুসলমানদের জন্য সঠিক ধর্মপালন। এই মুসলমান সম্প্রদায়টি তাদের পবিত্রগ্রন্থ আল কোরআন বিকৃতি হওয়ার বা একে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, কিংবা যোজন- বিয়োজন, পরিবর্ধন করার কোনো প্রকার চেষ্টা যেমন কখনো কেউ করার চেষ্টা করেন নাই বা করার প্রয়োজনও মনে করেন না। ব্যসিক মূলমন্ত্র গুলি পালনই হচ্ছে মুসলমানদের জন্য সত্য ধর্মপালনকারী। কেউ স্ট্রিক্টলি পালন করেন আবার কেউ ঢিলেঢালাভাবে। কিন্তু মূলমন্ত্র এক। তাহলে কেউ শুদ্ধভাবে এবং স্ট্রিক্টলি প্রতিনিয়ত মূলস্তম্ভ সমুহের পালনকারী ধার্মিক হলেই কি তাদেরকে ফান্ডামেন্টালিস্ট নামে অভিহিত করা হবে? ব্যাপারটা আসলে কখনোই এই রকম নয়। সঠিকভাবে ইসলামের সব আদব কায়দা পালনকারী মুসলমান কখনো ফান্ডামেন্টালিস্ট নন এবং তিনি গোঁড়াও নন। তাঁরা অন্য কারো ধর্ম নিয়েও বাধা নিষেধ দেন না। কারন খোদ ইসলাম অন্য ধর্মের প্রতিনিধিকে যথারীতি সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশনা দিয়েছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, প্রকৃত মুসলমান পূর্ববর্তী সব প্রধান ধর্মগ্রন্থসমুহকে না মানলে বরং তিনি সহিহ মুসলমান হিসাবে গন্য হবেন না এটাই ইসলাম শিক্ষা দেয়। তারমানে তাওরাদ, জবুর, ইঞ্জিল, এবং কোরআন সব আল্লাহর পবিত্রগ্রন্থ যা পূর্ববর্তী নবীসমুহের উপর অবতীর্ণ হয়েছে এটা সয়ং কোরআন নিজে সাক্ষী দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে ওইসব পবিত্র গ্রন্থ গুলি এখন আর অরিজিনাল ভাবে নাই। অনেকাংশেই পরিবর্ধন, পরিবর্তন হয়ে গেছে।
এখানে একটি সুক্ষ বিষয় মাথায় রাখা দরকার। বিশেষ করে মুসলমানদের বেলায়। প্রতিটি মুসলমান তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন এবং তৎসংলগ্ন পাঁচটি মূলমন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই মুলস্তম্ভের মধ্যে কোনো প্রকারের দ্বিধা নাই। তাহলে মুসলমানদের মধ্যেই এতো গোত্রের আবির্ভাব হল কেনো? আর এই গোত্রগুলিই বা কারা? যেহেতু পবিত্র কোরআন একটি বৈজ্ঞানিক এবং আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের জন্য পুরনাংগো জীবন ব্যবস্থা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। (তাহলে প্রশ্ন আস তে পারে যে, পূর্ববর্তী আল্লাহ প্রদত্ত গ্রন্থ গুলি কি কোর আনের মতো মানুষের জন্য পুরনাংগ জীবন ব্যবস্থা ছিলো না? হয়ত ছিলো কিন্তু তা আর আমাদের কাছে অরিজিনাল হিসাবে না থাকায় তার সত্যতা নিরুপন সম্ভব নয়)। ফলে ব্যক্তি জীবনে, সমাজ ব্যবস্থায় তথা রাষ্ট্রীয় বিধি ব্যবস্থায় সর্বত্র এই রিলিজিয়াস আইনসমুহকেই (যাকে আমরা শারিয়াহ আইন বলি) মেনে চলার বিধান বলা হয়েছে, সেকুল্যার আইনকে নয়। আর এই শারিয়াহ আইন সমুহগুলি হচ্ছে ওই সময়ের যা আমাদের নবীজির আমলে বা তাঁর আমলে পালিত হওয়া বিধিমালা অর্থাৎ সালাফি নামে আমরা যা বুঝি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁর মৃত্যুর পর এই সালাফি আইনসমুহই কিছু কিছু রি-ফরম হয়েছে যার কারনে বিভিন্ন গোত্রের বা দলের সৃষ্টি হয়। কিন্তু তাদের সবারই কিন্তু মূলমন্ত্র বা স্তম্ভসমুহ এক। অর্থাৎ এখানে সঠিক কিছু সালাফি আইনের ব্যাখ্যার কারনে বা পার্থক্যের কারনে ব্যক্তি, সমাজ ব্যবস্থা বা রাষ্ট্রীয় আইন কানুনের বিধি নিষেধের মধ্যে বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়। যেমন, শিয়া, সুন্নি, কাদিয়ানী, ইত্যাদি। কিন্তু তাদের মূলস্তম্ভ ঠিক থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই পরিবর্তনগুলি আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী শুধুমাত্র ইসলামপন্থীদের মধ্যেই সিমাবদ্ধ না, এই ট্রেন্ডস সব ধর্মের মধ্যেই ধীরে ধীরে অন্তরভুক্তি হতে শুরু করে এবং এখানে আরো মজার ব্যাপার হলো, এটা আবার আর শুধুমাত্র ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নাই। প্রতিনিয়তই বিবর্তনের মতো সর্বত্র একটা পরিবর্তন আসতে থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্মের স্বকীয়তা রক্ষার নামেই নয়, ধর্মের বাইরে গিয়েও এই পরিবর্তনটা কেনো আসে, সেটা নিয়েও গবেষণা হয়।
অবশেষে, The American Academy of Arts and Sciences সাড়া পৃথিবী থেকে অধিকস্তর বিশিষ্ট স্কলারদের সমন্নয়ে একটা গবেষণামুলক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সেই গবেষণামুলক পরিক্ষায় তাঁরা তথাকথিত ফান্ডামেন্টালিজম এবং ফান্ডামেন্টালিজমের বাইরে পরিবর্তনের পক্ষে-বিপক্ষে যেসব তথ্য পেয়েছেন তাঁর সারমর্মে দেখা যায় যে, উক্ত ফান্ডামেন্টালিজম চিন্তাধারাটি শুধুমাত্র আর ধর্মের গোঁড়ামির উপর স্থায়ী হয়ে রয় নাই। তাদের মতে,
(১) তাঁরা আধুনিক কালচারকে পছন্দ করেন না। কারন তারা মনে করেন ধর্ম দ্বারা যা পালিত হওয়ার কথা, অথবা যে রীতিনীতিগুলি ধর্মগ্রন্থ থেকে চালিত হওয়ার কথা তা না হয়ে স্যাকুলার কিছু মনগড়া বৈষম্যমুলক আইনের মাধ্যমে চালিত হচ্ছে বিধায় ধর্মের সঠিক কাজটি পালিত হচ্ছে না এবং এইভাবে একদিন ধর্মটাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে এই আশংকা করেন। তার উপর আধুনিক কালচারের সমাজ ব্যবস্থায় তাঁরা মনে করেন যে, একটা বৈষম্যমুলক সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন হচ্ছে যেখানে অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নবিত্ত সমাজের মানুষেরা তাদের ন্যায্য মুল্যায়ন, অধিকার, সুযোগ, সুবিধা ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
(২) এই মধ্যবিত্ত, কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের মানুষদের ন্যায্য মুল্যায়ন, অধিকার, সুযোগ, সুবিধা ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হওয়ার চিন্তাধারায় রিলিজিয়াস আইডোলোজির পাশাপাশি তখন ব্যক্তিগত এবং কম্যুউনাল আইডেন্টিটিও কাজ করে। এই ব্যক্তিগত এবং কম্যুউনাল সত্ত্বা কাজ করার কারনে পলিটিক্যাল উচ্চাকাখাংকাও জড়িয়ে যায়। আর যখন এই পলিটিক্যাল উচ্চাকাখাংকা বেড়ে যায়, তখন দলভিত্তিক রাজনীতিকিকরনের কাজটি আরম্ভ হয়ে যায়, তখন শুরু হয় বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের অনুপ্রবেশ যেখানে কমন কিছুর মিল থাকতে হয়, যেমন প্রথমে ধর্ম, পরে একই ধর্ম পালনকারী জাতী বা দেশ ইত্যাদি। এইগুলি তখন হয়ে উঠে একটা পারস্পরিক যোগাসুত্রের মাধ্যম কিন্তু উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষমতা বা প্রভাব খাটানোর একটা অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়া। আর যখন ক্ষমতা বা প্রভাব খাটানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়, তখন বিশ্বরাজনীতিতে একটা সক্রিয় ভুমিকা তৈরি হয় যেখানে প্রধান নিয়ামকের দায়িত্ব পালনে অনেক প্রভাবশালী দেশ, দল যুক্ত হয়ে যায়। তখন আর এটা রিলিজিয়াস ফান্ডামেন্টালিস্ট বা ফান্ডামেন্টালিজমের মধ্যে থাকে না। তখন এটা হয়ে যায় আন্তর্জাতিক একটা বহুমাত্রিক পরিকল্পনা। তখন ক্ষেত্রটা ভিন্ন। কিন্তু তাঁর এজেন্ডায় তখনো রিলিজিয়াস লেভাসটা থেকেই যায়। আর এই লেভাসের পিছনে যা থাকে তা হচ্ছে They are ‘reactive’, ‘they are dualist’, ‘they believe in Holy Book’, ‘they are selective’, and ‘they are millennialist’
বর্তমানে এই ফান্ডামেন্টালিস্ট শব্দটি বহুলঅংশে ব্যবহৃত হয় ধর্মের নামে আধিপত্য বিস্তারের নিমিত্তে গোঁড়া কিছু স্প্লিনটার গ্রুপকে বুঝানোর জন্যই। কখনো এটা ইসলামিক টেরোরিস্ট, কখনো রিলিজিয়াস টেরোরিস্ট, কখনো রিভাইভালিস্ট (যখন বৌদ্ধ, মুসলিম, কিংবা হিন্দু সম্প্রদায়ের বেলায়) ইত্যাদি। কিন্তু পিছনের উদ্দেশ্য একেবারেই আলাদা, আর সেটা নিতান্তই প্রভাব বিস্তার।
প্রাথমিকভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠীসমুহ যারা উক্ত লেভাসের নাম দিয়ে কিছু ফায়দা লুটে নিতে চেয়েছিলেন, হয়ত তা পেয়েছেনও কিন্তু ইতিমধ্যে এই লেভাসে মোড়া শক্তিশালী টুলসটি অর্থাৎ গোষ্ঠীটি ইতিমধ্যে প্রাপ্ত শিক্ষা আর প্রশিক্ষনের দ্বারা তারাই এখন নিজের নিয়ন্তা হিসাবে এমনভাবে আবির্ভূত হয়েছেন যে, অন্যের জন্য নয় শুধু নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্তা হিসাবে কাজ করছে। এখানে ধর্মটাই এখন আর মুখ্যবিষয় নয়, মুখ্যবিষয় হয়ে দাড়িয়েছে প্রভাব খাটানো এবং আধিপত্য বিস্তারের। এদেরকে আর নিয়ন্ত্রন করবার জন্য অন্য কোনো অপসন পূর্ববর্তী চালকদের হাতে নাই। তাঁরা এখন টেরর। যে নামেই আমরা একে এখন ডাকি না কেনো। ফলে এখন যেটা দাড়িয়েছে তা হচ্ছে, ওয়্যার এগেইনস্ট টেরর।
একটাই পথ এখন ......
ইংরেজদের ব্রেক্সিটের
আজ ইংরেজদের ব্রেক্সিটের গনভোটের রায়ের উপর ইত্তেফাকে দারুন একটা নিউজ পরে নিজের কাছে খুব পুলকিত মনে হলো যদিও আমার এই পুলকিত হওয়া মানে আনন্দিত নয়। ইত্তেফাকের নিউজটা ছিলো এই রকম, " ব্রিটিশ ভোটারদের আক্ষেপ!" খবরটার কিছু কথা এই রকম, ..."যেঁ সব ব্রিটিশ এই গনভোটে হ্যা ভোট দিয়েছেন, তারা কি মনে করছেন? তারা কি জেনে শুনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন? ব্রিটিশরা যারা অনেকেই ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, তারা অনেকেই জানে না কেনো তারা ভোট দিয়েছেন। বরং গনভোটের হ্যা রায়ের বিপরিতে ভবিষ্যতের অর্থনীতিতে যেঁ ঝুকি সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে এখন সব ব্রিটিশ নাগরিকেরা শঙ্কিত"। এদিকে অন্য আরেকটি পত্রিকা এই একই খবর ভিন্ন ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছে। করেছে এইভাবে, " ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে থাকার আশা এখনো জিইয়ে রেখেছে ব্রিটেনের জনগন। ঐতিহাসিক এই বিচ্ছেদ আটকাতে এখন দ্বিতীয়বার গন ভোট চাইছে।" ওদিকে পাশাপাশি আরেকটি খবর ছাপা হয়েছে, যেঁ, "ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়ার ব্যাপারে তুরস্কে গন ভোট হতে পারে।"
কি আশ্চর্য, একজন ছাড়ার জন্য ভোট দিচ্ছে, আরেকজন যোগ দেওয়ার জন্য ভোট দিচ্ছে। একজন ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বুঝেছে যেঁ, তারা ভীষণ ভুল করেছে, এখন আবার ইইউতে থাকার জন্য অনুরধ করছে, আক্ষেপ করছে। এই পরিস্থিতে আমার তর্জমা হচ্ছে, কেউ না কেউ ঐ সব ব্রিটিশদেরকে কোনো না কোনো যুক্তি দেখিয়ে ইইউ ছেড়ে দেওয়াই হবে বেশি লাভ, এই যুক্তি দেখিয়েছিল বা এমন কিছু লোকের পাল্লায় তারা পরেছিল যেঁ, কেউই বুঝে নাই কি করা উচিত আর কি করা উচিত না। দুই পক্ষই ছিল নাদান এবং অপরিপক্ক। এখন যখন বিচ্ছেদের রায় হয়ে গেছে, তখন জিবিনের সব স্বপ্ন, সব আরাম, সব চাহিদার মধ্যে অনেক বেশি গরমিল মনে হচ্ছে বলে নিজেকে নিজেদের অনেক বেশি অপরাধী মনে করছেন। এবং আসলেই তারা অপরাধী। আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনেও আমি এমন কিছু লোকের সম্মুখীন হয়েছি, যারা এক ইঞ্চি দুরের লাভটাই দেখেন, কিন্তু দুরের লসের অংশটা চোখে দেখেন না, বুঝেও না। ফলে এক ইঞ্চি পরিশর লাভ নিয়ে যখন রায় দিয়ে উল্লসিত হয় বা জিতে গেছি বলে পুলকিত হয় আর নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমিয়ে যায়। পরদিন ঘুম থেকে উঠে যখন দেখে তাদের সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে, সব আরাম ধুলিস্যাত হয়ে গেছে, ঐ দুরের অনেক ক্ষতির আভাস গুলু যখন একে একে উম্মচিত হতে থাকে এবং লসের পরিমান গুলু যখন একের পর এক জমা হতে থাকে, তখন তাদের আত্তা কাপে, ভয় লাগে, সব হিসাব নিকাশ ভুল হয়েছে বলে সারাক্ষন আক্ষেপ করে, তখন যারা এই ধরনের ভুল করতে চায় নাই, তাদের এক প্রকার পুলকিতই হয়। কারন এই ভাবনাটা তারা অনেক আগেই করেছিল কিন্তু বোকার দলেরা বুঝে নাই। তাই, আগে নিজের ভালোটা বুঝুন। তারপর অন্যের ঘেউ ঘেউ শুনুন। গন্তব্যপথে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি ঘেউ ঘেউ করা প্রানিদের প্রতি ঢিল মারতে থাকা মানে খুব দ্রুত গন্তব্যদিক হারিয়ে ফেলা। ঘেউ ঘেউ প্রানি থাকবে, তাদের ঘেউ ঘেউও থাকবে, মাঝে মাঝে বিরক্ত হবেন, মনে হবে উচিত শিক্ষা দেই। কিন্তু না, গন্তব্য স্থানে না পৌঁছানো অবধি ধৈর্য ধরা অত্যান্ত প্রয়োজন। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার মত লোকের অভাব নাই, কিন্তু ডুবে যাওয়া ব্যক্তিকে টেনে তোলার লোকের অনেক অভাব আছে। বিচ্যুতিতে সবচেয়ে ক্ষতি নিজের। তৈরি করা সাম্রাজ্যে রাজাগিরি করা যতোটা সহজ, নিজে সাম্রাজ্য তৈরি করা ততোটা সহজ নয়। আজ ব্রিটিশরা বুঝে, তাদের দিন এবং রাত দুটুই খারাপ। কোনো এক ব্রিটিশ পূর্ব পুরুষেরা ব্রিটিশকে উচ্চ শিখরে তুলে দিয়ে গিয়েছিল। ঐ সব ব্রিটিশ রা মুসলমানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে তাদের নিজের ফায়দা লুতার জন্য, অপেক্ষা করেছে বেশ কিছুটা সময় যেনো সব কিছু হাতের মধ্যে এসে যায়। এই অপেক্ষার সময়ে ব্রিটিশদের কে জারজ সন্তানের গালিও খেতে হয়েছে। তো কি হয়েছে? তার উদ্দেশ্য তো ছিল এই বিশ্বকে রোল করা। তারা তাই করেছিল। কিন্তু আজ এই যুগের বলদ কিছু আহাম্মক ব্রিটিশরা সেইদিনের পূর্ব পুরুসদের রচিত সাম্রাজ্য বোকার মত সিদ্ধান্ত দিয়ে তার সমাধি করলো। কারন এই যুগের ব্রিটিশরা সাম্রাজ্য গরে তোলে নাই। তাই ধ্বংস ও তাদের মনে আঘাত হানে না। এখন আঘাত হানে এই কস্টে যেঁ, তারা আর আগের মতো আরাম করতে পারবে না, আগের মতো চাকচিক্য পাবে না। এটা হচ্ছে পাপের ফল।
হোড়লে বাড়ি
অষ্টাদশ পার হইলে আমরা বলি আশি বা আশি পার হইয়া যাইতেছে এমন কিছু। কিন্তু যিনি নব্বই পার হইয়া শতায়ুর দিকে প্রতি মুহূর্তে একএক করিয়া প্রহর কাটাইয়া তাহার বয়স বিধাতা ক্রমাগত বাড়াইয়া চলিয়াছেন, তাহাকে আমরা আর যাহাই বলিয়া সম্বোধন করি না কেন, তাহার সঙ্গে ভালবাসিয়া মনের মাধুরী লাগাইয়া ছুটির দিন পরিত্যাগ করিয়া ঘটা করিয়া কোন এক শীতের সকাল কিংবা চৈত্রের কোন এক নির্জন দুপুর বরাদ্ধ করিয়া মনে আলপনা মাখিয়া কেহ তাহার সহিত গল্প করিতে ছুটিয়া আসিবেন তাহা হয়ত খুব স্বাভাবিক নয়। অথচ কোন একটা সময় ছিল, যখন এই শতায়ুর কাছাকাছি বৃদ্ধারও একটা যৌবন ছিল, তাহাকে দেখিবার জন্য কোন না কোন এক পুরুষের হৃদয়ে বসন্তের হাওয়া লাগিয়াছিল, তাহাকে নিয়া হয়ত অনেকেই কতই না অপ্রকাশিত প্রেমের কবিতা লিখিয়া যাইত, সহপাঠীদের মধ্যে হয়ত কেউ কেউ আবার তাহাকে অতি আপনজন মনে করিয়া কিংবা মনে মনে শুধুই আমার নিজের সম্পত্তি মনে করিয়া গুনগুন করিয়া গানের কলি গাহিত কে বা জানে। আমি আজ এমনি একজন অতি বৃদ্ধার সামনে হটাত করিয়া বসিয়া আছি।
তাহার দেখিয়া বুঝা যায় অতি অল্পবয়সে তাহার গায়ের রঙ কাচা হলুদের মত ছিল, তাহার মুখের গড়ন, চোখের পাপড়ি, নাকের আকার দেখিয়া বুঝা যায় তাহার শৈশবকালে তাহার মাতাপিতা তাহাকে লোক চক্ষুর কুদৃষ্টির আড়াল হইতে বাচাইয়া রাখার জন্য কতই না প্রানান্ত চেষ্টা করিতেন হয়ত বা। এই শেষসময় আসিয়া প্রায় একশত বছরের আগের কোন এক রূপসীর মত দেখিতে ক্ষনসুন্দরের প্রতিক যুবার সহিত আমার দৈবাৎ দেখা হইয়া গেল। কিভাবে দেখা হইল সেটা আমি কিঞ্চিত খোলাসা করিয়া বলিতেও চাহি না। তবে ইহা নিতান্তই ঠিক যে, আমিও তাহাকে দেখিবার জন্য আমার মহামুল্যবান সময় নষ্ট করিয়া ছুটির দিন পরিত্যাগ করিয়া গাড়ি হাকাইয়া এতদূর অবধি আসি নাই। কোন এক সন্ধ্যা বেলা বউ বাচ্চা নিয়া অলস কিছু সময় কাটাইবার জন্য আমি আমার বন্ধু আলালের সঙ্গে তাহাদের গ্রামের একটি গৃহস্থালি বাড়ীতে বেড়াইতে আসিয়াছিলাম। আর ওইখানেই আমার সঙ্গে এই প্রউরার দেখা।
আমি যাহার সঙ্গে ঐ গ্রামের বাড়ীতে গিয়াছিলাম, ঐ আলাল, তিনি তাহারই মা। আলালও বয়স্ক মানুষদের মধ্যে একজন। তাহারও মুখের দাঁড়ি পাকিতে শুরু করিয়াছে, তিনিও কম হলে ষাট বছর ধরিয়া এই পৃথিবীর আলো বাতাস গ্রহন করিতেছেন। এখন তাহাকেও আর যুবক বলিয়া কেহই গননা করিবে না।
তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। গ্রামের চারিদিকে ঘনকালো অন্ধকার। রাস্তায় আশেপাশে কয়েকটা বাতি জ্বলিতেছে বটে কিন্তু ঐ ক্ষীণকায় বাতির আলোতে এত সুবিশাল বৃক্ষরাজীর অন্ধকার আলোকিত করিতে পারে এমন সাধ্য তাহাদের নাই, ফলে বড় বড় কৃষ্ণকলি গাছগুলো আশেপাশের লতাগুল্মের অযাচিত ভালোবাসার জড়াজড়িতে আলো অন্ধকারের ন্যায় এক ভুতুরে পরিবেশ সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছে। এই অঞ্চলে খুব একটা জোনাকি পোকা দেখা যায় না, তাই জোনাকির ঝি ঝি শব্দটা কানে আসে না বলিলেই চলে, তবে আশেপাশের ছেলেমেয়েদের কিছু কিছু কলকাকলি শোনা যায় না এমন নয়।
এই আলো অন্ধকার ভুতুরে আবৃত গায়ের মেঠো পথ পার হইয়া আমরা আলালের বাড়ীতে পৌঁছাইলাম। বাড়িটা বেশ সুন্দর। প্রশস্ত উঠান, সেই মান্দাতা আমলের ধাঁচে করা সিঁড়ি সম্বলিত একটা স্কুল ঘরের মত পাকা বিল্ডিং। বিল্ডিং ঘরখানা পার হইয়া আরও একখান ছোট উঠান, সেই উঠান পার হইলেই চোখে পড়ে ঘোর কালো অন্ধকার। এই ঘোর অন্ধকার উঠানের চারপাশে কয়েকটি গাছ ঠায় অন্ধকারকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া আকাশের তারাগুলিকে নিশানা করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। হটাত করিয়া আলো হইতে আসিয়া যেন কালো অন্ধকার উঠানটিকে আরও কচকচে কালো রঙের মত সীমাহীন অন্ধকার বলিয়া মনে হইল, আর আমি ঠায় চোখে কিছু না দেখিতে পাইয়া দাঁড়াইয়া গেলাম। সামনে কিছুই দেখিতে পাইতেছিলাম না কিন্তু আমার বন্ধুটি অতি অনায়াশেই এই কালো অন্ধকার ভেদ করিয়া অতি সহজেই আরেকটি আধা পাকা বিল্ডিং এর দরজার সামনে আসিয়া হাজির হইয়া গেলেন। আমি কোন রকমে হামাগুড়ি দিবার মত ভঙ্গিতে পায়ে পায়ে টিপিয়া টিপিয়া এক কদম এক কদম করিয়া আগাইয়া আসিয়া তাহার কাছে পৌঁছলাম। বাড়ীর ভিতরে কেউ আছেন বলিয়া মনে হইল না। বারান্দায় একটি ছোট পাওয়ারের বাল্ব জ্বলিতেছে। গ্রিল দেওয়া একটি ঘর। ঘরটির কাছে আসিয়া আমার ঐ বন্ধু আলাল 'মা' বলিয়া দুইবার ডাকিলেন। চারিদিকে কোন সারাশব্দ নাই, বেশ গরম পড়িয়াছে, কোন বাতাসও বহিতেছে না। আমার বন্ধুটি আবারো শব্দ করিয়া 'মা' বলিয়া ডাকিলেন।
রাত্রির নিস্তব্দতা ভাঙ্গিয়া, ক্যাচ করিয়া লোহার একখান দরজার খিল খুলিলে যেই ধরনের শব্দ হয় তাহার মত শব্দ করিয়া কোন একজন তাহার দরজা খুলিলেন। দরজা খুলিতেই দেখিতে পাইলাম, অতি বয়স্ক একজন মহিলা তাহার শরিরের কাপড় গুছাইতে গুছাইতে শরিরের ভারসাম্য রক্ষা করার নিমিত্তে কাপিতে কাপিতে দরজার হেসবলটি খটাশ করিয়া খুলিয়া ফেলিলেন। খুলিয়াই বড় আদরের সহিত অস্ফুট স্বরে বলিলেন, ও তুই বাবা? এত রাতে কথা হইতে আইলি?
বুকটা ধক করিয়া উঠিল যেন। আমার মাও থক এমন করিয়াই আমাকে সম্বোধন করিত। অনেক দিন হইয়াছে আমার মা প্রয়াত হইয়াছেন। মাকে মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। কিন্তু এই বয়সে আসিয়াও আমার মাকে আমি খুব কাছে থেকে মিস করি এই ভাবনা অনেকেই মানিয়া লইতে পারেন না। আমি মানিয়া লইয়াছি। কি মিষ্টি সেই সম্বোধন। মাকে নিয়া পৃথিবীতে এত বেশি গল্প রচিত হইয়াছে, এত গান, এত বায়স্কোপ, এত উপন্যাস রচিত হইয়াছে যে, তারপরেও মাকে নিয়া আরও হাজার হাজার কবিতা, হাজার হাজার উপন্যাশ রচনা করিবার অবকাশ রহিয়াছে। মায়ের কথার সুর আলাদা, তার চাহনি আলাদা, তাহার হাতের স্পর্শ আলাদা, তাহার শাসন আলাদা, তাহার আদরের ভাষা আলাদা। তাহার অনুপ্রেরনার শক্তি আলাদা, তাহার ভালোবাসার মহব্বত আলাদা। কোন কিছুই তাহার সহিত পারিয়া উঠিবে বলিয়া আমার মনে হয় না আর হইবেও না। আমার সামনে যিনি দাঁড়াইয়া আছেন, তিনি আলালের মা। আমারও মা।
আমাকে দেখিতে পাইয়াছে বলিয়া মনে হইল না। ঘরের বাতির আলো হইতে বাহির হইলে স্বাভাবিক কারনেই বাহিরের অন্ধকার আরও বেশি ঘুটঘুটে অন্ধকার হইয়া চোখে এমন ধাধার সৃষ্টি করে যে, বাহিরে কি আছে বা কাহারা আছে তাহা হটাত করিয়া চোখে না পড়ারই কথা। উম্মুক্ত দরজা ধরিয়া আমি আর আমার বন্ধু আলাল ঘরে ঢোকিলাম। বৃদ্ধা অনেক ধীরে ধীরে তাহার বিছানায় গিয়া উঠিয়া বসিলেন। আমরা তাহার পাশে অদুরে রক্ষিত দুইটা চেয়ার খরখর শব্দ করিয়া টানিয়া বসিলাম।
তাহার ঘরের মধ্যে অনেক আসবাবপত্র নাই তবে কমও নাই। একটা ড্রেসিং টেবিলের মত একটা টেবিল। তার কিয়ত অংশ জুরিয়া একটি ছোট আয়না। দেখিয়াই বুঝা যায় অনেক দিন এই আয়নায় কেউ দাঁড়াইয়া তাহার মুখখানা দেখিয়াছে কিনা সন্দেহ আছে। আয়নার ঠিক উপরে একখানা ছোট গামছা যার সারা শরীরব্যাপী অনেক ধুলা জমাইয়া ফ্যানের বাতাসে মনের আনন্দে একটু একটু ঘুরপাক খাইতেছে। বৃদ্ধার খাটখানা বেশ প্রশস্থ, তোষকের জাজিম, তাহার উপরে একখানা চাদর। মনে হইতেছে চাদরখানা বেশ কয়েকবার ব্যবহার করিবার কারনে কিছুটা দুমড়ে মোচরে আছে। খাটের পাশেই পরপর দুইখানা কাঠের আলমারি সটান হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। উপরে একটি ফ্যান চক্রাকারে ঘুরিতেছে। খাটের একদম লাগোয়া ছোট একটি টেবিল রহিয়াছে। তাহার উপরে এবং নিচে কয়েকটি অতি পুরাতন টিনের অথবা ম্যালামাইনের বাসন, বাসনগুলির উপর কয়েকটি গ্লাস উপুড় করিয়া রাখা আছে। সম্ভবত এইসব বাসন আর গ্লাস বৃদ্ধার খাবারের জন্য ব্যবহৃত হয়। ঘরের আলমারি, খাট, টেবিল চেয়ার সবগুলিতেই ভ্রাম্যমাণ ধুলাবালিতে এক প্রকার দাগ পরিয়া আছে। কেহ তাহা পরিস্কার করিয়া দিবার নাই। আর পরিস্কার করিলেও দায়সারা ভাবে যে পরিস্কার করিয়াছে তাহা স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে। দেয়ালের একপাশে একটি মশারি তাহার দুই কোনা লোহার দুইটি প্যারেকের মধ্যে গাঁথিত হইয়া নৌকার পালের মত ফ্যানের বাতাসে ক্রমাগত একবার এদিক একবার ওদিক হেলিতেছে।
বৃদ্ধার সঙ্গে আমার গল্প করিতে খুব ইচ্ছা হইতে লাগিল। কিন্তু তাহার কোমরে ব্যথা বলিয়া বারংবার উল্লেখ করিতেছেন বলিয়া আমারও এক প্রকার সংকোচ বোধ হইতে লাগিল। সংকোচবোধ হইতেছিল এই কারনে যে, আমরা কি এই অসময়ে আসিয়া বৃদ্ধার বিশ্রাম নষ্ট করিয়া দিলাম? আমি তারপরেও তাহাকে অতি আপনজনের মত প্রশ্ন করিলাম, কিছু খাইয়াছেন কি? আমরা আসিয়া কি আপনাকে বিরক্ত করিলাম কিনা ইত্যাদি।
তিনি অতি বিচক্ষন মহিলা বলিয়া আমার মনে হইল। তিনি বলিলেন, আমি এখনো বাচিয়া আছি বলিয়াই তো তোমরা আসিলা। কেউ আসিলে আমার খারাপ লাগে না। বরং কিছুটা সময় কিছু মানুষের সঙ্গে কাটিয়া যায় বলিয়া আমার সস্থি লাগে। এখন তো আর কাহারো সময় নাই আমাদের মত মানুষের সঙ্গে সময় কাটাইবার। আজকাল যুগের ছেলেমেয়েরা, তাহাদের পিতা মাতারা স্নতান সন্ততিরা কেহই আর আগের দিনের পিতামাতার মত নয়। অতি অল্পতেই তাহারা ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে, বিরক্ত হইয়া উঠে, কোন কিছুতেই তাহারা সন্তুষ্ট নহেন। আদব কায়দার ধার ধারে না। সত্য মিথ্যার ধার ধারে না। লাভের হিসাবটা যেখানে বেশি, তাহাকেই তাহারা নীতি বলিয়া মানিয়া লইয়া আপাতত লাভের আশায় যাহা কিছু করিতে হয় তাহাই তাহারা করিতে ইতস্তত বোধ করে না।
-আমরা যখন ছোট ছিলাম, আমরা কতই না আমাদের দাদা দাদিদের সঙ্গে গল্প করিতাম। ভুতের গল্প, সেই রাজরানির গল্প, পড়া ফাকি দিয়া কখন দাদুর কোলে মাথা রাখিয়া নাম না জানা পরীদের গল্প শুনিতাম। এখনকার ছেলেমেয়েরা ভুত আছে বলিয়া বিশ্বাস করে না কিন্তু ভুতের গল্প শুন্তেও ভয় পায়। আমাদের সময় আমরা পাশের বাড়ীর বরই গাছের আধাপাকা বরই, পেয়ারা, কচি কচি আম চুরি করিয়া আনিয়া দাদুর পানের বাটিতে লুকাইয়া রাখিতাম, আর এখনকার নাতি নাতকুরেরা দাদা দাদির পানের বাটি হইতে সুপারি পর্যন্ত না বলিয়া লইয়া যায়। ইহাকে চুরি বলে কিনা আমি বলিতে পারিব না কিন্তু যখন দেখি আমার আচলে রাখা কয়েকটা ছোট বড় নোট যখন কোথায় হাওয়া হইয়া অদৃশ্য হইয়া যায় তাহা যখন আর বুঝিতে পারি না, তখন মনে হয় সময়টা পাল্টাইয়া গিয়াছে, অথচ কাহাকেও কিছু বলিবার আমার যোগার নাই।
বুড়ি আরও গল্প করিতে লাগিলেন, যেন মনে হইল তিনি আস্তে আস্তে তাহার শৈশবকালে ফিরিয়া যাইতেছেন।
-আমি যেদিন এই বাড়ীতে বউ হইয়া আসি, তখন আমার কতইবা বয়স। হয়ত আট কিংবা নয়। স্বামী কি জিনিস, শাশুড়ি কি জিনিস, কিংবা ভাসুর, কিংবা শ্বশুর, কাহাকে কেমন করিয়া সামলাইতে হইবে আমরা কিছুই জানিতাম না। বাবার বাড়ীতে যে ছোট মেয়েটি সকাল অবধি ঘুমাইত, সেই ছোট বালিকাটি হটাত করিয়া শ্বশুর বাড়ীতে আসিয়া এক রাতের মধ্যে মহিলা হইয়া জন্মিল। যেন তিনি আর ছোট বালিকাটি নন। তাহার অনেক দায়িত্ত। স্বামীর দায়িত্ত, পরিবারের ঘর ঘুছানো , উঠোন পরিস্কার করা, গোয়াল ঘরে গরুর খাবারের জন্য গাদা গাদা পানি দেওয়া, শাশুড়ির জন্য শীতের দিনে ওজুর গরম পানি করে বদনা দিয়ে রাখা, কত কি। ঐ ছোট বয়সে আমার শরিরের থেকে দায়িত্তের পরিমান অনেক ঢের বেশিই ছিল, তারপরেও বাবাকে খুশি রাখিবার জন্য, মাকে আনন্দে রাখিবার জন্য আমার এই ছোট হাতগুলি দিয়া যতটুকুন পারিতাম সংসারের গুরু লঘু সব দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকিতাম। পাছে আমার শশুর কোন কাজ ঠিক মত হয় নাই, কিংবা কোন কাজ করিতে ভুল হইয়া গেছে এই লজ্জায় পড়ি, সেই ভয়ে নিজে দুপুরের খাওয়া, দিনের নাওয়া কোনকিছুই সময় মত করিতে পারিতাম না। দিনশেষে যখন একটু বিশ্রাম করিবার সময় হইত, আমার অতিপ্রিয় এই খাটের পাশে আসিয়া বসিতাম, তখন তোমাদের জামাই বাবুর মন জয় করিবার জন্য আমাকে আবার নতুন বউয়ের মত মুখে হাসি ফুটাইয়া, চোখে প্রেমের চাহনি দিয়া চাঁদনী রাতের আকাশের মত আমাকে রাঙ্গা বউ সাজিতে হইত। এভাবেই আমার দিনকাল কাটিয়া একদিন দেখিলাম আমি মা হইয়াছি। একে একে আলাল, জালাল, শাহিদা, রোকেয়া, সখিনা, সবাই আমার ঘর আলোকিত করিয়া আমার সংসার ভরিয়া তুলিল।
সংসার বড় কঠিন এক কর্মক্ষেত্র। স্বামীর মন যোগাইয়া, শাশুড়ির সব কাজ শেষ করিয়া, শ্বশুরের ঘর ঘুছাইয়া, দিনের কাজ সব শেষ করিয়া ছেলেপুলেদের সব হিসাব নিকাশ, আবদার মিটাইয়া যখন আমি প্রায় এক রকম অভ্যস্থ হইয়া দিনের কর্ম ব্যস্ততায় সময় কাটাইতেছি, তখন আমার বয়স গুনিয়া দেখিলাম, আমি নিজেও এখন শাশুড়ি হইবার সময় হইয়াছে। কিন্তু যাহার শশুর হইবার কথা তিনি সবাইকে তাক লাগাইয়া, গ্রামের সব প্রিয় বন্ধু বান্ধব্দের রাখিয়া আমাকে শ্রাবনের অজশ্র বারিধারার মত চোখের জ্বলে ভাসাইয়া তিনি এই পৃথিবীর সমস্ত বন্ধন শেষ করিয়া আমাদের হইতে অনেক দূরে চলিয়া গেলেন। কি তার অভিমান, কি তার কষ্ট, কি তার চাহিদা কিছুই আর অবশিষ্ট না রাখিয়া সংসারের সমস্ত দায়ভার আমার কাঁধে তুলিয়া দিয়া স্বার্থপরের মত আমাকে একা রাখিয়া বহুদুর চলিয়া গেলেন। আজ অনেকদিন পর মনে হইল, আমি শুধু এই বাড়ীর বউ হইয়াই আসি নাই, আজ মনে হইল, আমি আজ সংসারে মা আর তার উপর বাবার দায়িত্বও পালন করিতে এই সংসারে ঢুকিয়াছিলাম। শুধু তাই নয়, যে ননদিনীকে আমি আমার সই বলিয়া মনে করিতাম, আমি আজ তাহারও মা হইয়া বসিয়াছি। যে দেবরকে আমি আমার ছোট লক্ষি ভাই বলিয়া আদর করিয়া শাসন করিতাম, আজ আমি তাহার মা বলিয়া অনুভব হইতেছে। উহারা সবাই আমার অতিপ্রিয় সন্তানের মত আমাকে আরও নিবির করিয়া আঁকড়াইয়া ধরিল। আমার আর কোথাও যাওয়ার সম্ভাবনা রহিল না। না বাপের বাড়ি, না পৃথিবীর মায়া কাটাইয়া আমার স্বামীর দেশে। আমি বাড়ীর প্রতিটি অংশ, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি প্রাণীর মা হইয়া গেলাম। চুলায় কখন আগুন ধরাইতে হইবে, কখন কাহাকে কোথায় পাঠাইতে হইবে, কখন ধান কাটার মৌসুম হইলে কোথা হইতে কতজন কামলা নিতে হইবে, মটরশুটি পাকিয়াছে কিনা, পাকিলে কখন কাটিতে হইবে, সব হিসাব আমাকেই রাখিতে হইত। বাড়ীর উঠোন কখন ঝারু দিতে হইবে, রাতে কাহাকে কখন কি ঔষধ খাওয়াইতে হইবে তার সবদিক আমাকে অতি সূক্ষ্মতার সহিত হিসাব করিয়া পালন করিতে হইতেছিল।
এই যে বাড়িটা দেখিতেছ? এখানে এত ঘর বাড়ি ছিল না। বড় একটা উঠান ছিল, পাশে হরেক রকমের গাছগাছালি ছিল। ঐ যে আমাদের দক্ষিন পাশটা আছে, সেখানে অতি মস্তবড় একখানা গাব গাছ ছিল। অতি গরমের সময় আমার স্বামী কড়া দুপুরে একখানা মাদুর বিছাইয়া হাতে একখানা তালপাতার পাখা লইয়া তাহার হরেক পদের ব্যবসার হিসাব লইয়া বসিত। আরও কত কি! তখন ক্যালকুলেটর ছিল না, বাঁশের কঞ্চিতে কালি মাখাইয়া দিস্তা কাগজের মোড়ায় একখানা খাতা লইয়া তাহার ব্যবসার লেনদেনের অনেক হিসাব কষিয়া লাভ ক্ষতির বিবরন লিখিয়া রাখিতেন। গাব গাছটার দিকে তাকাইলে আমার এখনো তাহার কথা মনে পড়ে। মনে হয়, এই বুঝি তিনি আসিয়া আমার কাছে পান আছে কিনা জিজ্ঞেসা করবেন। হয়তবা কোন এক পলকে আসিয়া বলিবেন, কই গো শুনছো, আমি একটু বাজার হইতে ঘুরিয়া আসি। কিছু আনিতে হইবে কি? আমি অপলক দৃষ্টিতে ঐ গাব গাছটির দিকে তাকাইয়া থাকি আর তাহার কথা মনে করি। গাছের কোথা বলিবার ভাষা নাই। থাকিলে হয়ত আমাকে প্রশ্ন করিত, কি গো তাহার কোথা মনে পরিতেছে? আমার ও তাহার কথা মনে পরিতেছে। মন তা খারাপ হইয়া যায়। সে আমাক্র কথা হয়ত ভাবে না, হয়ত বা ভাবেও।
আমি তাহার গল্পের বর্ণনা শুনিয়া বুঝিতে পারিলাম, তিনি এই ঘোর অন্ধকারের মধ্যেও তার ঐ সময়ের সব স্মৃতি দিনের আলোর মত ফকফকা হইয়া তাহার চোখে পরিতেছে আর তিনি ঐ দৃশ্য অনাবিল ভঙ্গিতে আজ এই ঘনকালো অন্ধকারের মধ্যে অকপটে বলিয়া যাইতেছেন। আমি যেন তাহার চোখের এই দিবাকালিন অতীত বর্তমানের বর্ণনা নিজের চোখে দেখিতে পাইতেছি। তাহার গল্প শুনিতে আমার বড় ভাল লাগিতেছিল।
আমি বলিলাম, তারপর কি হইল?
তিনি আমার প্রশ্ন শুনিতে পাইলেন কিনা আমি বুঝিতে পারিলাম না, কিন্তু তিনি তাহার গল্পের কোন ছেদ না করিয়াই বলিতে লাগিলেন, এরই মধ্যে আমার এই আলালের বিয়া হইয়া গেল। আমাদের সংসারে কোন অভাব ছিল না কিন্তু আমার স্বামীর অন্তর্ধানের পর অনেক হিসাব কিতাবই আর আগের মত চলিতেছিল না। যাহাদের কাছে আমরা টাকা পয়সা পাইতাম, তাহারাও আর আগের মত বন্ধুসুলভ নাই, আবার যাহারা আমাদের কাছে টাকা পয়সা পাইত, তাহারও আমাদের দয়া করিয়া যে ছাড় দিবে তাহাও হইল না। ফলে একদিকে প্রাপ্য টাকা না পাইয়া হাত শুন্য হইয়া বসিয়া আছি, অন্যদিকে ঋণগ্রস্থ হইয়া আমাদের সংসারে একটু ভাটা পরিল বলিয়াই আমার মনে হইল। আলাল কোন রকমে একটা সরকারি চাকুরী সন্ধান করিয়া সংসারের হাল ধরিলবটে কিন্তু তাহাকে সোজা করিয়া দাড়া করাইয়া রাখা যেন কঠিন হইতে কঠিনতর হইয়া উঠিল। অনেক ঈদ পর্বন, অনেক মেলা, অনেক শখের আহ্লাদ আমাদের আর আগের মত করিয়া উৎযাপন করিতে পারি নাই। মনে হইয়াছে ছেলেমেয়েরা বড় হউক, একদিন আমার এই সব দুঃখের দিন শেষ হইবে। তখন নায় নাতকুর লইয়া আবার আমি আগের মত হই চই করিয়া বেড়াইব, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের লইয়া আনন্দে গ্রাম ঘুরিয়া বেড়াইব। কত কি?
এই বলিয়া বুড়ি অনেক্ষন চুপ থাকিলেন। মনে হইল আজ এত বছর পর তাহার সমস্ত ইতিহাস, সমস্ত কাহিনী তাহার মনের অতি গোপন স্থান হইতে উকি দিয়া জনসম্মুখে প্রকাশ হইবার জন্য এক লম্বা লাইন ধরিয়া আছে। বৃদ্ধার গলা ধরিয়া আসিতেছিল, তাহার চোখের কোনা হয়ত ভিজিয়া আসিতেছিল, তিনি আর বেশিক্ষন আবেগ ধরিয়া রাখিতে পারিতেছেন না। আমার বন্ধু আলালের চোখেও একটু একটু অশ্রুর রেখা দেখা যাইতেছিল। রাতের এই ছোট পাওয়ারের আলোতে হয়ত আমি পুরু চোখ দেখিতে পাইতেছিলাম না তবে এইটুকু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আলালের আধাপাকা দাঁড়ি গড়াইয়া তাহার চিবুক ঘেঁষিয়া হয়ত কয়েক ফোঁটা জল পরিয়া থাকিবে। বৃদ্ধার গল্প থামিবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হইল এখানে হটাত আলো থামিয়া গিয়াছে, এখানে ভাষা থমকে দাঁড়াইয়াছে, শুধু উপরে ফ্যান খানা নীরস যন্ত্রের মত চারিদিকে অসম্ভব দ্রুত গতিতে ঘোরপাক খাইতেছে।
আলালের বউ যখন আমাদের বাড়ীতে আসিল, আমার সেই ছোট বেলার বউ সাজিবার সবঘটনা মনে পরিতে লাগিল। লাল টুকটুকে শাড়ি, হাতে মেন্দি, মাথায় সব সময় বড় বড় ঘোমটা, আরও কত কি। আমি কোথায় কোথায় কি অসুবিধার মধ্যে পরিয়া কি কি কারনে মনে কষ্ট পাইতাম, কি করিয়া আমি আবার ঐ মনের কষ্ট দূর করিবার জন্য কি করিতাম, সব মনে পরিতে লাগিল। আলালের বউয়ের কার্যকলাপ দেখিয়া মাঝে মাঝে আমি খিল খিল করিয়া হাসিতাম, আবার মাঝে মাঝে খুব লক্ষির মত তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিতাম, আমরা মেয়ের জাত, সংসার আমাদের ধর্ম, ইহাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া স্বামীর ভিটায় লাশ হইয়া বাহির হইতে পারিলেই আমাদের মেয়ে জীবন সার্থক। আর যদি ইহার কোথাও কোন ব্যত্যয় ঘটে, তখন আর কোন কাজেই আসিবে না। এইরূপ, এই যৌবন একদিন শেষ হইয়া যাইব। সংসার ছাড়া মেয়েদের আর কিছুই নাই। ইহাকে আপন করিয়া ধরিয়া রাখ।
আলালের বউকে পাইয়া আমি যেন আবার আমার সেই ছোট বেলার একজন সাথী পাইলাম এমন একজন মানুষ হইয়া গেলাম, আবার আমি তাহার শাশুড়ি এই কথাটাও ভুলিয়া গেলাম না। আলালের বউ যখন ভুল করিত, আমি তখন মনে মনে হাসিয়া ভাবিতাম, আহারে, আমিও কি তোমার মত এই ভুলগুলি করি নাই? করিয়াছি তো। কখনো কৃত্রিম রাগবর্ষণ করিয়া ভতরসনা করিতাম কিন্তু অধিক রাগ করিতাম না। ক্রমেক্রমে ও আমার একজন ভাল বন্ধু হইয়া উঠিল। সরকারী চাকুরী, আলালকে তাই কখনো অনেক দুরের শহরে থাকিতে হয়। আবার কখনো দুই একদিনের জন্য বাড়ীতে আসিতে হয়। নতুন বউ, আমি বুঝিতে পারিতাম তাহাদের মনের আকুতির কথা, তাদের মনের কথা। কিন্তু বাস্তব যখন ঘরের কাছে আসিয়া নিজের পেটের ক্ষুধার কথা স্মরণ করাইয়া দেয়, তখন প্রেমের কথা আর বেশি করিয়া মনে করিয়াও কোন লাভ হয় না। বিরহ তখন নিত্যদিনের সঙ্গি হিসাবে মানিয়াই নিতে হয়। এখনকার দিনের মত যুগ ছিল না তখন যে মন খারাপ হইয়াছে তো একখান মোবাইলে টিপ দিলেই মনের মানুষের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘণ্টা আলাপ করিয়া মনের কথা বলিয়া একটু সস্থি পাওয়া যাইবে। তখন পোস্ট অফিস ছিল, আবার হাতে লিখিয়া চিঠি পাঠাইতে গেলেও অনেক সময় লোক মারফত চিঠি পোস্ট করিবার লোক পাওয়া যাইত না, নিজে হাটিয়া গিয়াও চিঠিখানা পোস্ট করিবার উপায় ছিল না। তাই যোগাযোগটাও ছিল বেশ কঠিন আর যখন একবার দেখা হইত, তখন প্রেমের কথা বলিবার চেয়ে সংসারের সমস্যা সমাধানের জন্যই সময়টা কাটিয়া যাইত বেশি। যেদিন আলাল তাহার বউকে নিয়া তাহার কর্মস্থলে যাইত কিছুদিন থাকিবার জন্য, আমার বড্ড মন খারাপ হইত। একা একা বোধ হইত। মনে হইত কি যেন আমার সঙ্গে নাই, কে যেন আমার কাছ হইতে হারাইয়া গিয়াছে।
এইবার বৃদ্ধা নড়িয়া চড়িয়া বসিলেন। মাথা একটু উচু করিয়া আমাদের দিকে তাকাইয়া মুচকি হাসিয়া বলিলেন, একদিন আলাল মিষ্টি লইয়া বাড়ীতে আসিয়া আমার হাতে মিস্টির একটি প্যাকেট দিয়া বলিল, তোমার বৌমা অসুস্থ। আমি হচকচিয়ে উঠিলাম, একটু ভয়ও পাইলাম। ওমা, কি রে কি হইয়াছে? লাজুক আমার আলাল কিছুই না বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গিয়া উঠানের গাব গাছটির তলায় গিয়া সবার কাছ হইতে যেন পালাইয়া বাচিল। আলালের বউ সঙ্গে আসিয়াছিল। কাছে তানিয়া বুকে লইয়া জিজ্ঞাস করিলাম, কি হইয়াছে তোমার? শিক্ষিত নেয়ে, অবুঝ নয়, মুচকি হাসিয়া যাহা ইঙ্গিত করিল, বুঝিলাম, আমি দাদি হইতে চলিয়াছি। আমার চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। ঘরের প্রতিটি কাপ, গ্লাস, জানাল দরজা যেন খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। আমার উঠানের গাছগুলিও যেন বাতাসের দোলায় নাচিয়া বলিতে লাগিল, তুমি আরও এক ধাপ আগাইয়া জিবনের আরেক দায়িত্ব পালনে তৈরি হইয়া যাও। আমার বড় ভাল লাগিল।
সময় বড় নিষ্ঠুর, সে সবার সাথে চলিয়া বেড়ায় বটে কিন্তু কাহারো সঙ্গে সে সখ্যতা করে না। সে কাহারো জন্য অপেক্ষা করে না। তাহার তারা নাই কিন্তু তাহার দেরি করার সময়ও নাই। সে কাহারো হাত ধরিয়া সামনে আগাইয়া চলে না, সে তাহার নিজ গতিতে বহমান। তাহাকে তুমি বশ করিতে পারিবে না। সে কাহাকেও বশ করে না। তাহার সহিত কেহ চলতে চাহিলে সে তাহার সহিত যুগযুগ ধরিয়া একত্রে চলিতে পারে আবার কেহ যদি তাহার সহিত চলিতে না পারে, তাহাতে তাহার কোন বিপত্তি হয় হয় না। সে একাই আপন গতিতে চলিতে থাকে। আর এই বহমান সময়ের স্রোত ধরিয়া আলালের ঘরে সোমা আসিল, রুবেল আসিল, জালালের ঘরে তিন্নি, মিন্নি সবাই আসিল, আর ঘর হইতে আমার সব প্রিয় মেয়েরা অন্য পুরুষের স্ত্রী হইয়া চোখের জ্বলে নিজেরা ভাসিয়া আর আমাকেও কাদাইয়া যে যার যার সংসারে চলিয়া গেল।
এখন তাহারা যার যার সংসার লইয়া, নিজেদের পরিকল্পনা লইয়া, শহর বন্দর খুজিয়া খুজিয়া নিজেদের আশ্রয়স্থল লইয়া নিজ নিজ সংসার পাতিয়া বসিয়াছে। একটি ঘর হইতে দুইটি, দুইটি হইতে চারটি, ঘর বাড়িয়াছে। বাড়ি বাড়াইতে গিয়া অনেক গাছ গাছালির জীবন দিতে হইয়াছে। আগের গোহাল ঘর সরাইয়া আরও দূরে লইয়া যাইতে হইয়াছে, এক বাড়ীর সীমানা আলাদা করিবার জন্য আরেক বাড়ীর সীমানা প্রাচির তৈরি হইয়াছে। ভাইয়ে ভাইয়ে আলাদা আলাদা প্রাচির ঘেরা বাড়ি বানাইয়া একে অপরের হইতে অনেক কিছু গোপন রাখিয়া দূরত্ব বজায় রাখিয়া চলিতেছে। তাহারা আর আগের মত এক সঙ্গে নদীর ধারে গলাগলি করিয়া গোসল করিতে যায় না, ঐ গাব গাছের তলে বসিয়া গল্প করে না। আগে এক হাঁড়িতে ভাত পাক করিলে সবাই মিলিয়া কাড়াকাড়ি করিয়া খাইয়া ফেলিত, কখনো তরকারীর জোগান কম হইয়া যাইত, আবার কখন মেহমান আসিলে শেষে যিনি খাইতে বসিতেন তাহার ভাগে কমই জুটিত। তারপরেও আনন্দ ছিল অঢেল, হাসি ছিল অফুরন্ত। এক ঘরে জায়গা না হইলে ছেলেরা মেয়েরা ভাগাভাগি করিয়া শুইয়া পরিত। নিজেদের মধ্যে মারামারি, খুন্টুশি যে হইত না তাও নয়, কিন্তু তাহাও ছিল এক আনন্দের অফুরন্ত ভান্ডার। আজ সবার সংসার হইয়াছে, সবার হাঁড়িপাতিল আলাদা। কেহ মুরগীর তরকারি খাইয়া ঢেকোর তুলিতেছে, কেহ আবার নিছক শাকপাতা খাইয়া পেটের পীড়ায় ভুগিতেছে। একজনের সন্তান দেশ বিদেশ ঘুরিতেছে, আরেক জনের সন্তান মাঠে কঠিন রোদে পুড়িয়া, বৃষ্টিতে ভিজিয়া সারা বছরের ফসল ফলাইবার জন্য প্রানান্ত চেষ্টা করিতেছে। বউদের যেমন সময় নাই, তাহাদের সন্তানদেরও সময় নাই। আমরা যারা আজ অনেক বুড়া হইয়া গিয়ছি, আমরা যখন আর আগের মত আর চলিতে পারি না, আমাদের দেখার জন্য তাহাদের হাতে ওত সময় কই?
আজ যখন দেখি সারা উঠোন গাছের মরা পাতায় এখানে সেখানে ছরাইয়া ছিতাইয়া এলোপাথাড়ি পড়িয়া আছে, হাটিবার রাস্তাটাও অনেক ময়লায় ভরিয়া আছে। তখন মনে হয়, আমার সংসার আলাদা হইয়া গিয়াছে, যার যার জায়গায় তারা শুধু গাছের পাতা, ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করিয়াই খালাস। আমার শাশুড়ি বলিতেন, সকাল বেলায় পরিবারের সদস্যরা ঘরের বাহির হইবার আগেই যে একবার ঘর বাড়ি উঠোন ঝাউ দিতে হয়, তা না হলে অলক্ষুণেরা ভর করে, সেই ভয়ে আজও আমি সকাল হলেই একটা ঝারু লইয়া সবার আগে ঘুম হইতে উঠিয়া সমস্ত বাড়ীটি কল্যাণময় করিয়া তুলি। এটা আমারই তো সংসার, তাহারা হয়ত নিজেদের জায়গা সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করিয়া আপন মনে করিয়া সাজাইয়া লয়াছে, কিন্তু এক সময় তো তাহারা সবাই একই হাঁড়ির ভাত খাইয়াছে, একই ছাদের তলায় গাদাগাদি করিয়া ঘুমাইয়াছে। তাহারা সবাই তো আমারই রক্তের মধ্য হইতে তিলে তিলে আজ এত বড় হইয়াছে। তাহার আমাকে মানুক আর নাই বা মানুক, তাহারা আমাকে যত্ন করুক আর নাই বা করুক। এটা তো আমার স্বামীর ভিটা। আমার দ্বিতীয় জন্মের বাড়ি। আমি তো আর তাহাদের আলাদা করিয়া ভাবিতে পারি না। আজকাল আমাদের নায়নাতকুরেরা আর আগের মত বড়দের সঙ্গে সম্মানের সহিত কথা বলে না, একে অপরের সহিত আদবের সহিত মন খুলিয়া কথা বলে না। কাহাকে আমি কি বলিব? আজ এত বছর পর আমার মনে হইতেছে, আমি এখানে আজ শুধু আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করিয়া আছি। আমি অপেক্ষা করিয়া আছি কখন আমি আমার সেই প্রিয়তম স্বামীর সঙ্গে দেখা করিব। কখন আবার আমার সেই শাশুড়ি মা আমাকে জরিয়ায়া ধরিয়া বলিবে, হোরলে বাড়ি, আর পিরনে নারী। অর্থাৎ বাড়ি চিনিবে ঝারু দেওয়া দিয়া আর নারী চিনিবে তাহার পিরনের কাপড় দেখিয়া। তাই এখনো আমি এই বয়সে সবার মঙ্গলের কোথা ভাবিয়া সকালে সবার উঠার আগেই এক খানা ঝারু লইয়া আমার সব উঠোন পরিস্কার করিয়া লই, আর তাহাতেই আমার কোমর খানা প্রতিনিয়ত ব্যাথায় ভরিয়া উঠে। হয়ত আমাকে এই কাজ করিয়াই যাইতে হইবে আমার শেষ নিঃশ্বাস থাকা অবধি। এটা যে আমার বাড়ি, আমার স্বামীর বাড়ি। এখানে আমার শাশুড়ি শুইয়া আছেন, এখানে আমার শশুর ঘুমাইয়া আছেন। কি বলিব আমি যখন আমার সাথে তাহাদের দেখা হইবে? জানো তো একটা জিনিস, অনাদরে মানুষ বাচিলে তার একটা গুন আছে। আর তাহা হইল তাহাকে ব্যমোও ধরিতে আসে না। মরার সদর রাস্তা গুলি একেবারেই বন্ধ হইয়া যায়। সবার কাছেই তখন নিজেকে আপদ বলিয়াই মনে হয়। এই আমার আলাল তাহার সব টুকু শক্তি দিয়া আমাকে আগলাইয়া রাখিয়াছে বটে কিন্তু আর বাকি সব যে যাহার হিসাব লইয়া এত টাই ব্যস্ত হইয়া আছে যে তাহাদের ভবিষ্যৎ কি হইবে তাহারা আজ না বুঝিলেও হয়ত কোন একদিন আমার আজকের এই দিনের কষ্টটা হয়ত বুঝিবে। এই বলিয়া তিনি আলালের হাতটি ধরিয়া অনেক্কখন চুপ থাকিয়া বসিয়া রহিলেন।
অনেক রাত হইয়া গিয়াছে। বুড়ি আর কোন কথা বলিতে পারিতেছিলেন না। আমি তাহার আরও কাছে গিয়া বসিলাম। তাহার গায়ে হাত রাখিয়া তাহাকে জরাইয়ায়া ধরিবার আমার খুব ইচ্ছা হইল। মনে হইল তিনি ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাদিতেছেন। কেহই তাহাকে বকা দেয় নাই, আমারাও তাহাকে এমন কোন কথা বলি নাই যাহাতে তাহার মন খারাপ হইতে পারে, কিন্তু জিবনের সব পাওয়া যখন নিরাশায় পতিত হয়, যখন এত কষ্টের পরিশ্রমে গড়া নিজের সংসার আর নিজের আয়ত্তে থাকে না, যখন সেই সব ছেলেমেয়েদের লইয়া কোন একদিন ভবিষ্যতের সুখের জন্য আজিকার সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়া এতগুলি বছর পার করিয়া জিবনের বেলাশেষে হিসাব নিকাশ করিয়া কোন কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না বলিয়া মনে হয়, তখন চোখের জল ছাড়া প্রতিবাদ করার আর কোন ভাষা থাকে না। নিজের সংসার কে আর নিজের বলিয়া মনে হয় না। তাহা অন্য কেহ দখল করিয়া লইয়াছে। আমি সেখানে শুধু একজন প্রাণী যার জীবন আছে কিন্তু জিবনের কোন মুল্য আছে বলিয়া মনে হয় না। কেউ কেউ এখনো আঁকড়াইয়া ধরে বটে কিন্তু সমস্ত সংসারটা আর আগের মত মনে হয় না।
আজ হইতে হয়ত আরও অনেক বছর পর আবার যখন আমার এই বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা হইবে, আদৌ দেখা হয় কিনা আমি জানি না, তখন হয়ত আমার এই আজকের রাতটির কথা বারবার মনে পরিবে যে এইখানে একশত বছর পুরানো কোন এক কাহিনী আমি শুনিয়াছিলাম, যার ইতিহাস লিখার কোন প্রয়োজন নাই, আর সে ইতিহাস সমাজের, দেশের কিংবা রাষ্ট্রের কোন কাজেও আসিবে না। হয়তবা আজ হইতে আরও একশত বছর পর আজকের এই কান্নাজরিত সুর কোন একদিন আজ যারা নিরবিকার হইয়া বসিয়া প্রাচির দেওয়া দেয়ালের মধ্যে নিসচুপ হইয়া বসিয়া আছেন, তাহারাও অনুভব করিবেন কিন্তু তাহাদের ইতিহাস শুনিবার জন্য, তাহাদের অশ্রুভেজা চোখের পাতা দেখিবার জন্য আর কেহই অবশিষ্ট থাকিবে না।
খুব ভারাক্রান্ত মন লইয়া আমি আমার বউ বাচ্চাদের নিয়া বাসায় ফিরিলাম। বিকালে একটা অলস সময় কাটাইতে গিয়াছিলাম কিন্তু সময়টা ভাল কাটিলেও মনের ভিতরে কোথায় যেন একটি বেদনার কিন্তু কষ্টের অনুভুতি আমাকে বার বার তারা করিয়া বেড়াইতেছিল। রাতে কোন কিছু আর খাওয়া হইল না। ক্ষনে ক্ষনেই আমার বারংবার মনে হইতেহিল 'হোরলে বাড়ি, আর পিরনে নারী'।
ভারত বর্ষের জনাব আগন্তক
আমি খুব খুশি হয়েছি যে, আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগের কোন এক বাদশার পাশে আপনি এসে কিছুক্ষন দাড়িয়ে ছিলেন এবং আপনি আমাকে অনেক গুলো প্রশ্নও করে গেছেন। আমি জানি না কিভাবে আমি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর গুলো দেব কিন্তু আমার কিছু প্রশ্ন আপনার কাছে ছিল।
আমি কিভাবে দেশ চালিয়েছি সেটা আপনার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল বলে আপনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন। জনাব, আমি কি আপনাকে উল্টো একটা প্রশ্ন করতে পারি? এখন আপনাদের সময়ে দেশ কিভাবে চলে সেটা কি আপনি জানেন? আমাদের সময় গনতন্ত্র বলতে কিছু ছিল না, সংবিধান বলতে কিছু ছিল না সেটা আমি মানি। বরং আমি যা বলতাম তাই ছিল সংবিধান। হয়ত এটা ছিল অটক্রাটিক একটা সময়। সেটা তো ঐ সময়ের নীতিই ছিল এটা। তাই বলে কি আমরা একটুও মানবাধিকারের কোন কাজ করি নাই? আমার সময়ে রাজত্ব ছিল বিশাল, মোবাইল ফোন ছিল না। বিশ্বাস ঘাতকের দল ছিল আরও বেশি শক্তিশালি। যে কোন সময় যে কোন রাজা দেশের যে কোন অংশ দখল করে নিয়ে নিতে পারত। আমরা তো তার প্রতিরক্ষা দিয়েছি। কই তার পরেও তো আমাদের সময় ব্যবসায়িরা আপনাদের সময়ের মত এত অসৎ ছিল না। এখন এক জন ব্যবসায়ী নিজেই রাজ্য চালাতে চান পর্দার আড়াল থেকে। আমাদের সময় ক্ষমতা ছিল আমার হাতে, আর এখন? আপনাদের সময় তো ক্ষমতা কার হাতে তাও তো জানেন না।
আমি খুব খুশি হয়েছি যে, আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগের কোন এক বাদশার পাশে আপনি এসে কিছুক্ষন দাড়িয়ে ছিলেন এবং আপনি আমাকে অনেক গুলো প্রশ্নও করে গেছেন। আমি জানি না কিভাবে আমি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর গুলো দেব কিন্তু আমার কিছু প্রশ্ন আপনার কাছে ছিল।
আমি কিভাবে দেশ চালিয়েছি সেটা আপনার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল বলে আপনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন। জনাব, আমি কি আপনাকে উল্টো একটা প্রশ্ন করতে পারি? এখন আপনাদের সময়ে দেশ কিভাবে চলে সেটা কি আপনি জানেন? আমাদের সময় গনতন্ত্র বলতে কিছু ছিল না, সংবিধান বলতে কিছু ছিল না সেটা আমি মানি। বরং আমি যা বলতাম তাই ছিল সংবিধান। হয়ত এটা ছিল অটক্রাটিক একটা সময়। সেটা তো ঐ সময়ের নীতিই ছিল এটা। তাই বলে কি আমরা একটুও মানবাধিকারের কোন কাজ করি নাই? আমার সময়ে রাজত্ব ছিল বিশাল, মোবাইল ফোন ছিল না। বিশ্বাস ঘাতকের দল ছিল আরও বেশি শক্তিশালি। যে কোন সময় যে কোন রাজা দেশের যে কোন অংশ দখল করে নিয়ে নিতে পারত। আমরা তো তার প্রতিরক্ষা দিয়েছি। কই তার পরেও তো আমাদের সময় ব্যবসায়িরা আপনাদের সময়ের মত এত অসৎ ছিল না। এখন এক জন ব্যবসায়ী নিজেই রাজ্য চালাতে চান পর্দার আড়াল থেকে। আমাদের সময় ক্ষমতা ছিল আমার হাতে, আর এখন? আপনাদের সময় তো ক্ষমতা কার হাতে তাও তো জানেন না।
সাদ্দাম হোসেনের ছেলে উদয় এর সত্যি কাহিনী
কয়েকদিন আগে নেট জিও তে একটা প্রোগ্রাম দেখছিলাম ইরাকের উপর, প্রোগ্রাম টার নাম হল Escape to Freedom. এটা মুলত সাদ্দামের ছেলে উদয় সাদ্দামের কার্যকলাপের উপর। লোমহর্ষক। সাদ্দামের পতনের পিছনে অনেক কারনের মধ্যে ওর পরিবারের অনেক ভুমিকা ছিল। সাধারন মানুষের যখন আর কোথাও কোন বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, এবং চারিদিকে সর্বত্র যখন অবিচার আর জুলুমের রাজত্ত কায়েম হয়ে যায়, তখন আল্লাহ যে কোন বিধর্মীর মুনাজাতও কবুল করেন যদি তা সত্য হয়, তখন তাঁর আবদার হয়ে উঠে সৃষ্টিকর্তা আর সৃষ্ট জিবের। ওখানে তখন আর ধর্ম কোন বড় ইস্যু হয়ে উঠে না। ধর্ম মানছি কি মানছি না এটা নিতান্তই ব্যক্তি এবং সৃষ্টিকর্তার মাঝে ফয়সালা। কিন্তু যখন সমাজকে গননা করা হবে তাঁর মধ্যে ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন কালচার, ভিন্ন মতবাদ সব বিচার্য। সাদ্দামের ছেলে উদয় সাদ্দামের কাহিনি ঐ রকম একটা সমাজ বিরুদ্ধ। আমি শেষ পর্যন্ত প্রগ্রামটা দেখেছি এবং আমি উদয় সাদ্দমের শেষ পরিনতিটাও দেখলাম, আমার মধ্যে মনে হয়েছে ভগবান, আল্লাহ, ঈশ্বর বা রাম যাই বল না কেন, কেউ আছে।
১৯৮৭ সালে যখন ইরাক ইরান যুদ্ধ হচ্ছিল, তখন ফ্রন্ট লাইনে যুদ্ধে থাকা এক সৈনিকের কাছে সরাসরি চিঠি আসে, তাঁর নাম লতিফ। তাকে সাদ্দামের প্রাসাদে যেতে হবে, কেন যেতে হবে, কি কারনে যেতে হবে কেউ জানে না। লতিফ কিংবা যুদ্ধে থাকা কমান্ডার কিংবা লতিফের পরিবার কেউ আচ করতে পারছিল না কেন হটাত করে এই নিরিহ সৈনিকের কাছে সাদ্দাম হোসেন সরাসরি অফিসিয়ায়ল চিঠি পাঠিয়ে তাকে সাদ্দমের প্রাসাদে আসতে বলা হয়েছে।
সৈনিক ভয়ে ভয়ে প্রাসাদে গেলেন, সৈনিক লতিফ এর আগে কখন সাদ্দামের প্রাসাদ এত কাছে থেকে দেখার সুযোগ পায় নাই, অথচ আজ সৈনিক লতিফ সরাসরি সাদ্দামের প্রাসাদে ঢুকে, সাদ্দামের সাথে একত্রে বসে কথা বলবেন যেখানে সাদ্দাম ছাড়া আর কেউ নাই। ভীষণ ভয়ে আছে সৈনিক লতিফ। তাঁরপরেও তো সাদ্দামের তলব। না গেলে আগেই মরন, গেলে হয়ত মরলেও কিছুদিন পড়ে মরতে হবে। কি এক অজানা ভয়, গা শির শির করছে, কত বড় প্রাসাদ!!!! কি রঙিন কি সুন্দর, লতিফের কাছে এটা কোন বাড়ি, বা প্রাসাদ বা অন্য কিছু মনে হয় নাই, মনে হয়েছে এটা একটা স্বপ্ন যা ও কোনদিন ভাবে নাই, বা ভাবার শক্তিও রাখে নাই। এটা সাদ্দামের প্রাসাদ। চারিদিকে সুনশান, নিরাপত্তার বাহিনি, যেন মশারাও শঙ্কিত। গাছের পাতা বিবর্ণ হলে যেন গাছেরও শাস্তি হতে পারে এই ভয়ে কোন পাতাও তাঁর রং পরিবর্তন করে না। সবাই সাদ্দামকে মানে। এই মানার মধ্যে কোন আইন আছে তা কেউ জানে না, শুধু সবাই জানে ওরা আর কিছুদিন এই পৃথ্বীর চাঁদটা দেখতে চায়, সূর্য কখন কোথায় থাকে সেই দৃশ্যটা আরও কিছুদিন দেখতে চায়। সাদ্দাম বিশাল এক অবর্ণনীয় সুন্দর একটা সোনালী রঙের টেবিলে বসে আছে। তাঁর অবধি পৌছাতে প্রায় ২০ থেকে ৩০ গজ মার্বেল খচিত ফ্লোর পারি দিতে হয়।
তিনি সাদ্দাম হোসেন, ঐ যে সাদ্দাম হোসেন বসে আছে। লতিফের মাথা ঠিক কাজ করছে কিনা বুঝা যাচ্ছে না, বিমোহিত, শঙ্কিত, আশ্চর্য এক অনুভূতি। লতিফ কি তাকে সালাম করবে? নাকি স্যালুট করবে, নাকি পায়ে পড়ে যাবে? কি করবে সে এখন? কি করলে লতিফ ঠিক কাজটা করবে এটাই সে বুঝে উঠতে পারছে না। তাঁরপরও সে হেটে যাচ্ছে সাদ্দামের দিকে। এখন লতিফ আর তাঁর বুকের স্পন্দন শুনতে পাচ্ছে না। হয়ত একটু পড়ে আর কখনই সে তাঁর বুকের স্পন্দন শুন্তেই পারবে না। কি অসহনিয় এক মুহূর্ত।
সাদ্দাম ঘার বাকিয়ে লতিফের দিকে তাকালেন। লতিফ আর হাটতে পারলেন না, কি কারনে থেমে গেল তা সে বুঝে উঠতে পারল না। এবার সাদ্দাম হাটছে লতিফের দিকে.........
লতিফ, হতভাগা লতিফ এখন ঠিক সাদ্দামের সামনে দাড়িয়ে। চমৎকার গোঁফ, সুঠাম দেহ, পলিশড করা ইউনিফর্ম, বিশাল ঘরের মধ্যে বাতাসও প্রবেশ করে না, ঠাণ্ডা একটা শিতল আবহাওয়া, হয়তো নিঃশব্দ এসির পারফিউমড বাতাস। এই বাতাস ইরাক-ইরান যুদ্ধের খোলা বাতাসের মত নয়। বারুদের কোন গন্ধ নাই, মুহুর্মুহু আর্টিলারি শেলের বিকট শব্দ এর ভিতরে ঢুকে না। সাদ্দাম শান্ত পরিবেশে কাজ করতে পছন্দ করেন, দেশে যত অশান্ত পরিবেশই বিরাজ করুক না কেন। দেশের ইন্টারেস্ট আর সাদ্দামের ইন্টারেস্ট এক হতে হবে এই বিশ্বাস সাদ্দাম করবে কেন? সাদ্দাম কি একাই দেশ প্রেমিক হবেন? কেন পুরু ইরাক হবে না? তাই, দেশের লোককে প্রকৃত দেশ প্রেমিক বানানর জন্য তিনি ইরানের সঙ্গে এক কারনবিহীন যুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছেন যেখানে অধিকাংশ ইরাকি যানে না কেন তারা ফ্রন্ট লাইনে ইরানের সঙ্গে যুদ্দ করছে। যাক, সেটা দেশের নাগরিকরা বিবেচনা করবে। এখন লতিফের সামনে আমাদের সাদ্দাম দাড়িয়ে আছেন, এটাই বাস্তবতা।
সাদ্দাম তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তার বা হাত উচিয়ে লতিফের কাধে রাখলেন, সাদ্দামের চোখ লতিফের চোখে, লতিফ যেন সাদ্দামের নিঃশ্বাসের গন্ধও পাচ্ছিলেন।
"লতিফ, ঈশ্বর আমাকে দুটু ছেলে দিয়েছেন, আমি খুশি, আর তুমি এখন আমার তিন নম্বর ছেলে।" সাদ্দাম লতিফের কাধে হাত রেখে বললেন।
লতিফ বুঝে উঠতে পারছিল না কি তাঁর বলা উচিৎ। লতিফ কি খুশিতে হেসে দেবেন নাকি আত্মহারা হয়ে তাঁর নতুন বাবাকে জরিয়ে ধরবেন? লতিফ শুধু এক অজানা ভয়ে আরও সংকিত হয়ে কুচকে যেতে লাগলেন যেমন করে অনেক শক্তিশালি আগুনের কাছে একখন্ড প্লাস্টিক নিমিষেই গলে তাঁর অস্তিত্ব হারিয়ে শুধু এক তরল বর্জ্য পদার্থে পরিনত হয়।
'লতিফ, তুমি আজ থেকে আমার আরেক উদয়। উদয়ের প্রতিচ্ছবি। কারন তোমার সঙ্গে আমার উদয়ের চেহারা অদ্ভুত এক মিল রয়েছে। আজ থেকে তুমি উদয়ের বিকল্প হবে।' সাদ্দাম বললেন।
লতিফ জানত, সারা ইরাকের মানুষ ভগবানকে ভয় না পেলেও উদয়কে ভয় পায় না এমন লোক তাঁর জানা নাই। উদয় যখন যাকে খুশি খুন করতে দ্বিধা করেন না। মদ আর নারীর মধ্যে তিনি কোন ভেদাভেদ করেন না। তিনি টাকার লোভী নন, তিনি শুধু যখন যা খুশি করতে ইচ্ছে করেন তাই করেন। এতে রাজ্য গেল নাকি কারো প্রান গেল, সেটা দেখা তাঁর দায়িত্ত নয়। তাঁর ইচ্ছা আর অনিচ্ছাই প্রধান। লতিফ এখন উদয় হয়ে যাবেন। পৃথিবীর সব চেয়ে ঘৃণিত ব্যাক্তির প্রতিচ্ছবি। তাও আবার জীবন্ত।
মুনায়েম উদয়ের পিএস। তিনি সাদ্দামের ঘরে ঢুকে লতিফকে নিয়ে গেলেন। নিয়ে গেলেন উদয়ের নিজ ঘরে। এ আরেক রাজ্য? এখানে দেয়ালগুলো হরেক কালারের। কোনটা উৎকট লাল, কোনটা গাড় সবুজ, উপরে ঝারবাতিগুলো কেমন যেন। বাহিরে যাবার পথ মাটির নিচ দিয়ে, কেন যে সরাসরি উপর দিয়ে না, এটা লতিফ বুঝে কিন্তু লতিফ উদয় হয়ে গেলে তাঁর জন্য অনেক পথ খোলা হয়ে যাবে, ঐ গোপন রাস্তাগুলো তাঁর নিজের হয়ে যাবে। এটা কি ভাগ্যবানের লক্ষন না অশুভ তা লতিফ মেলাতে পারছিল না। কোন জনমে ওর পিতা মাতা বা পিতামহরা এত পুন্য করেছিল যে রাজকিয় রক্ত না বহন করেও আজ লতিফ রাজার ছেলে হয়ে গেল? অংকটা মেলান বড় কঠিন হয়ে গেল লতিফের জন্য। তাঁর পরেও বাস্তবতা হচ্ছে এখন লতিফ স্বয়ং সাদ্দামের ছেলে উদয়ের ঘরে বসে আছে। তাঁর গায়ে সেই যুদ্ধ ক্ষেত্রের খসখসা ইউনিফর্ম। লতিফ এত শিতল ঘরেও একটু একটু করে ঘামছেন।
"হা হা হা" বিকট এক কর্কশ হাশি, হাসিও এত কর্কশ হয় তা লতিফের জানা ছিল না। ঘার ঘুরিয়ে লতিফ দেখল, উদয় একহাতে এক শক্ত লোহার বার এবং অন্য হাতে চুরুট নিয়ে বুকের তিনটা বুতাম খোলে হেলেদুলে তাঁর নিজের রুমে ঢুকছেন আর লতিফকে দেখে খুব মজা করে এই কর্কশ হাসিটা দিচ্ছেন। লতিফ এই প্রথম সাদ্দামের এত প্রতাপশালি ছেলে উদয়কে এত কাছে থেকে দেখলেন। লতিফের বুকে যেটুকু সাহস এতক্ষন ছিল তা নিমিষেই করপুরের মত উবে গেল।
লতিফ দেখল তাঁর সামনে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতাপশালি রাজার এক যুবরাজ 'উদয়' তাঁর সামনে উদিয়মান। লতিফ নিজেও এখন যুবরাজ কিন্তু আসল যুবরাজ নন, তাতে কি? তাঁর দাতগুলোও তো আসল যুবরাজের মত, তাঁর হাত পা, তাঁর চুল, তাঁর মুখের অববয়বও তো এই আসল যুবরাজের মতই ঠিক ছবিতে যেমন দেখেছেন তাকে ঠিক তাই। খোচা খোচা দাড়ি, ঠোটের নিচে একটা কাটা দাগ, অবশ্য লতিফের ঠোটের নিচে এই দাগটা নাই, হয় তো অচিরেই এটা তাঁর ঠোটে লাগিয়ে দেয়া হবে। কি অদ্ভুত না? লতিফ কিছুই ভাবতে পারছে না।
আহহহহহ......
শক্ত একটা লোহার দন্ডে তাঁর কাধটা যেন অবশ হয়ে গেল আর সম্বিত ফিরে এল লতিফের, উদয় তাঁর হাতে থাকা লোহার রডটি দিয়ে লতিফের ঘারে একটা বাড়ি দিয়ে বল্ল, "আজ থেকে তুমি হবে আমার জীবন্ত শিল্ড। হিউম্যান শিল্ড। মুনায়েম, লতিফকে শিখিয়ে দাও আমি কিভাবে হাটি, কিভাবে চুরুট টানি, কিভাবে মানুষের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ি, কিভাবে গাড়ি চালাই, কিভাবে গাড়িতে বসি, সব শিখিয়ে দাও।"
লতিফ তাঁর সমস্ত শক্তি দিয়ে এবার প্রথম কথা বলার চেষ্টা করল। "স্যার আমি তো অভিনেতা নই, আমি আপনি হতে পারব না। আমার পরিবার আছে, আমার মা আছে, আমার বোন আছে, আমার বাবা আছেন, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি নিতান্তই একজন সাধারন মানুষ। আমি বাচতে চাই স্যার।"
মানুষ যখন অতল সমুদ্রে পড়ে হাবুডুবু খায়, তাঁর তখন হিতাহিত জ্ঞ্যান থাকে না। লতিফেরও ছিল না। কিন্তু তাঁরপরেও লতিফের যতটুকু জ্ঞ্যান অবশিষ্ট ছিল, হয়ত ঐ অবচেতন মনই লতিফকে এই দুঃসাহসী কথাগুলো উদয়ের কাছে বলতে পেরেছিল। কিন্তু উদয় তো আর যে সে যুবরাজ নয়। ৪০ বছর রাজত্ত করা এক রাজার ছেলে। যার জন্ম হয়েছে প্রাসাদে, যার প্রতিটি ক্ষন কেটেছে প্রাসাদের কৃত্তিম বাতাস আর চির ধরা ঠোটের মেকি হাসির পরিবেশে। সে কি করে বুঝবে পরিবার কি? সে কি করে বুঝবে ভাইয়ের কাছে একটা বোনের মর্যাদা কি? সে কি করে বুঝবে বাবার সাথে ছেলের কি কারনে ঝগড়াও হয় আবার কারনে অকারনে বাবা-পুত্র মিলে নিঃশব্দে কেদে বুকের জামা ভিজে যায়? উদয় শুধু জানে সুন্দর কিছু নারী মুখের পিছনে শুধু আছে নির্লজ্জ ধর্ষণ, আছে পরিত্যাক্ত ঘৃণার কিছু নোনা জল। আর আছে মদের নেশায় এক উন্মত্ত বর্বরতা। ওর কাছে ঐ নারীর চোখের ভাষার কোন দাম নাই, বোনের মমতার কোন মুল্য নাই, বাবা-মার আদর আর পরিবারের যে বন্ধন সেটা তাঁর জিবনে কোন ভগবানই রাখেন নাই। হতভাগা যুবরাজ।
"নিয়ে যাও ওকে ওখানে যেখানে মানুষ তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে নত শিকার করে, নিয়ে যাও ওকে ঐখানে যেখানে কুকুর এবং মানুষের বসবাস একই দেয়ালের মধ্যে।" যুবরাজ উদয় মুমেনকে বলে দিলেন আর মনের সুখে আরও কয়েক প্যাগ মদ তাঁর উদরে ঢেলে দিলেন।
লতিফের স্থান হল ১ মিটার বাই ১ মিটার এক রুমে। পুরু দেয়ালটা উৎকট লালরঙ্গে রাঙা। চোখ ঝলসে আসে, মাথা ধরে যায়, কোন ভেন্টিলেটার নাই, বাতাস ঢুকবার কোন প্রবেশ পথ নাই। প্রতি ঘন্টায় শুধু ৫ মিনিটের জন্য ফ্রেশ বাতাস আসার ব্যাবস্থা করা হয়। লতিফ যুবরাজ না হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করায় এখন তাঁর মরার প্রস্তুতি চলছে। আর যদি এর মধ্যে লতিফ তাঁর শির নত না হয় তাহলে লতিফের বাবার প্রান যাবে, বোন ইজ্জত হারাবে, মাকে আর বাঁচানো যাবে না, লতিফ তো আর থাকবেই না। কে বলে ঈশ্বর আছে? লতিফ উচ্চস্বরে ঐ ১ বাই ১ মিটার রুমের মধ্যে গলা ফাটিয়েই তাঁর ঈশ্বরের কাছে বলতে থাকে, "কই তুমি হে ঈশ্বর? কে বলে তুমি আছ? কোথায় তুমি এখন তাহলে? আমার এ জনমের সব প্রার্থনা তাহলে কি সব মিথ্যা? তুমি কাকে ভয় পাও? তোমার কি চোখ নাই? আমার ঈশ্বর কি এতটাই অন্ধ যে সে ১ বাই ১ মিটারের রুম দেখতে পায় না? হে ঈশ্বর আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি তোমার সাহায্য চাই, তুমি আমাকে রক্ষা কর।" কিন্তু ঈশ্বর আসেন না। ঈশ্বর তাঁর কথার কোন উত্তর করেন না, শুধু লতিফের কথাগুলোই ঐ ছোট্ট ১ বাই ১ মিটার রুমের দেওয়ালে আঘাত খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার ফেরত আসে। সঙ্গে ফেরত আসে উদয়ের পিএস মুনায়েম।
লতিফ শেষমেশ রাজী হল সে উদয় হবে। লতিফ রাজী হয়েছে। এই সুখবরে উদয় আরও কয়েক জোড়া সুন্দরি রমনি নিয়ে মদের আড্ডায় বসে গেল আর দেখতে থাকল লতিফ কিভাবে উদয় হয়, কিভাবে লতিফ উদয় হবার প্রশিক্ষন নেয় তা দেখার জন্য।
উদয়ের হাটার ভঙ্গি, চুরুট খাওয়ার স্টাইল, কারো সঙ্গে কথা বলার স্টাইল, মানুষদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ার স্টাইল ঘার বাকিয়ে কাউকে দেখার কৌশল, গাড়ি চালানোর কৌশল, ইত্যাদি সবই ভিডিও করা আছে, তা লতিফ শিখে নিচ্ছে আর কোথাও ব্যাতয় হলে প্র্যাক্টিকেল দেখিয়ে দিচ্ছে জনাব স্বয়ং আসল যুবরাজ উদয়। এই প্রশিক্ষন যতটা সহজ মনে হয়েছিল অতটা সহজ হয়নি। আসলে ট্রেইনিং কখন সহজ নয়। এর মধ্যে শাস্তি আছে, আছে চরম লাঞ্ছনা, আছে নিপীড়ন, আছে ভয় মৃত্যুর। লতিফের বেলায়ও এর কোন ব্যাতিক্রম হয় নাই। তবে এর মধ্যে যে কাজগুলো লতিফকে অত্যান্ত পীড়া দিয়েছিল তা হচ্ছে লতিফকে উদয় হতে গিয়ে তাঁর ঠোট কাটতে হয়েছে, তাঁর দাতগুলো চাঁচতে হয়েছে, তাঁর কানের কাছে ড্রিল মেশিন দিয়ে একটা কালো কালো ফুটু করতে হয়েছে। লতিফের এই সুন্দর অবয়বের প্রতি কোন মোহ ছিল না শুধু তাঁর কষ্ট হচ্ছিল এই সুন্দর অবয়ব করতে গিয়ে লতিফের শারিরিক কষ্টটা।
নয় মাস পেরিয়ে গেছে ট্রেনিং এর। লতিফ অনেকটা উদয় হয়ে গেছে। কিন্তু এক জায়গা ছাড়া। উদয় লতিফকে এক সুন্দরি মেয়ে ধরিয়ে দিয়ে বল্ল, যাও, তুমি এখন উদয়, ওকে নিয়ে ঐ ঘরে যাও। কিন্তু লতিফ তো লতিফ , সেতো আর উদয়ের মত রক্তে পরিবর্তন হয়ে যায় নাই। লতিফ পারেনি নিরিহ এক নিস্পাপ মেয়েকে নিয়ে ফস্টিনস্টি করতে। আসল যুবরাজ অত্যান্ত রাগ লতিফের উপর। আর এইটা কিভাবে করতে হয় তাঁর ডেমো দেখাতে গিয়ে আসল যুবরাজ উদয় তৎক্ষণাৎ পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া দুই দিনের এক দম্পতির মেয়েটিকে সবার সামনে বলাৎকার করলেন, পাশে লতিফ, উদয়ের বডিগার্ড, তাঁর পিএস, এবং মহামুল্যবান রাজপ্রসাদ। সবাই এর সাক্ষী। সাধারন মানুষ তো আর উদয়ের সাথে পেরে উঠবে না আর বিচারের কথা বললে তো হবে না। উদয় নিজে যা করে সেটাই বিচার। কিন্তু সাধারন মানুষের কাছে আরও একটা পথ খোলা ছিল। তা হচ্ছে বিচারবিহীন আত্মহত্যা। আর সেটাই করে গেল ঐ সাধারন দম্পতির অসহায় মেয়েটি। এতে উদয়ের কি আসে যায় আর রাজপ্রাসাদেরই বা কি আসে যায়। এমন কত নারী এখানে গলা ফাটিয়েছে, কত নিরিহ প্রান এখান থেকে পালানর জন্য আত্মাহুতি দিয়েছে। রাজপ্রাসাদের ইটের কোন ভাষা নেই, ওরা নিরব সাক্ষী থাকে, কথা বলার জন্য দরকার একজন লেখকের। উদয়ের প্রাসাদে কোন লেখক প্রবেশ করে না।
১৯৮৮ সাল। ইরাক ইরান যুদ্দ শেষ হয়ে গেছে। ইরাকে বিশাল এক ফুটবল খেলার সমাপ্তি ঘোষণা আজ। সঙ্গে পুরুস্কার বিতরণী। আর আজই হবে লতিফের প্রথম টেস্ট। আজ লতিফকে যুবরাজ উদয় সেজে জনসম্মুখে ফুটবল খেলার সমাপ্তি ঘোষণা করতে হবে এবং নকল যুবরাজ আসল যুবরাজের হয়ে পুরুস্কার বিতরন করবে। যদি ভালোয় ভালোয় লতিফ পাশ করে যান, তো টিকে গেলেন আর যদি পাশ না করেন লতিফ তাঁর পুরু পরিবার নিয়ে সকাল আর সূর্যের মুখ দেখতে পারবেন না। ---------
অনুষ্ঠান শুরু হল, লতিফ রাজকিয় গাড়ি আর চৌকশ সিরিমনিয়াল প্যারেডের মধ্য দিয়ে উদয় সেজে ফুটবল সমাপ্তি অনুষ্ঠানে হাত নেড়ে, ঘার বাকিয়ে ডায়াসে আসলেন। মনে তাঁর অনেক দ্বিধা, অনেক চঞ্চলতা, সবচেয়ে শক্তিশাললি আসন অথচ সবচেয়ে দুর্বল মন নিয়ে লতিফ একে একে সবাইকে পুরুস্কার দিলেন, মনের আনন্দে নয় অধুম্পায়ি লতিফ ধুম্পায়ি উদয়ের চরিত্রে একের পর এক চুরুট টেনে যাচ্ছেন। অন্যদিকে লাইভ ক্যামেরায় আসল যুবরাজ পাশে কতক নবান্নের আউসের মত আধা পাকা কিছু লাজুক এবং ভীত সন্ত্রস্ত তরুনিকে নিয়ে অনেক দূরে এক প্রাসাদে বসে আসল যুবরাজ উদয় ভোগে লিপ্ত রয়েছেন আর লতিফের অভিনয় দেখছেন।
লতিফ পাশ করেছে।
দিন যায় মাস যায়। ১৯৯১ সাল। গালফ ওয়ার শুরু। সাদ্দাম হোসেন তাঁর ছেলে উদয়ের জীবননাসের আসংকা করছে ইরানিয়ান এবং আমেরিকান উভয়ের কাছ থেকেই। সিদ্দান্ত হল, আসল যুবরাজ উদয় সুইজারল্যান্ডে চলে যাবেন আর নকল যুবরাজ ইরান-ইরাক বর্ডারে গুলিতে মারা যাবে। এই সিদ্দান্তটা আসল যুবরাজ জানলেও নকল যুবরাজ জানলেন না।
আসল উদয় সুইজারল্যান্ডে যাবার আগে ও ওর মৃত্যু সংবাদ আন্তরজাতিক পত্রিকাগুলোতে দেখে তারপর সুইজারল্যান্ডে যেতে চান। তাই, প্রথমে নকল যুবরাজকে ইরান-ইরাক বর্ডারে পাঠানো হল কিন্তু খবরটাও দেয়া হল যে উদয় দেশ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে বর্ডার পারি দিয়ে। সন্ধায় খবর এল, উদয় গুলি খেয়েছে কিন্তু মরেন নাই।
হাসপাতালে নকল যুবরাজ তাঁর একটা আঙ্গুল হারান, কিন্তু নকল যুবরাজকে আঙ্গুল হারালে যে আবার আসল যুবরাজেরও একটা আঙ্গুল কেটে ফেলতে হবে তাই আসল যুবরাজ ডাক্তারদেরকে জানালেন, ঐ আঙ্গুল না লাগান গেলে ডাক্তারদের কল্লা যাবে।
এইভাবে ২০০৩ পর্যন্ত লতিফ আসল যুবরাজের মুখুস পড়ে অনেক অত্যাচার আর নিপিরনের মধ্য দিয়ে নিজ পরিবার ছেড়ে কোন এক প্রাসাদে নিতান্তই জাজাবরের মত নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে লাগলেন যেখানে তাঁর কোন কিছুরই অভাব ছিল না, শুধু অভাব ছিল জিবনের নিরাপত্তা আর ছিল নিসসঙ্গতা।
সবশেষে ২০০৩ সালের কোন এক সময় আসল যুবরাজ আর নকল যুবরাজ মুখুমুখি দাড়িয়ে যান। দুজনের হাতেই সেম পিস্তল, দুজনেই উদয়, দু জনেই প্রাসাদে, কিন্তু একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী।
চলল গুলি, দুজনেই আহত, নকল উদয় আসল উদয়ের গাড়ি, চুরুট আর পিস্তল নিয়ে কোন রকমে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে বর্ডার ক্রস করে পারি দিলেন তুরস্কে। আর আমাদের আসল যুবরাজ ইরানিয়ান/আমেরিকানদের হাতের পড়ে মারা যান।
পৃথিবী এক জঘন্য পিচাশকে হারাল। লতিফ এখন ইউরপে তাঁর পরিবার নিয়ে ব্যবসা করছে। তিনি জীবিত আছেন,
০২/০৪/২০২১-কামুক সিরিয়াল কিলার
একটা ইংরেজী মুভি দেখছিলাম। মুভিটা ছিলো একটা কামুক সিরিয়াল কিলারের উপর। আমি এই জাতীয় মুভি খুব একটা দেখি না। কিন্তু ট্রেইল দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলাম, পরে পুরু ছবিটাই দেখলাম। ছবিটা দেখে কিছু লিখতে ইচ্ছে করলো। তাঁরই উপর ভিত্তি করে আজকে আমার এই লেখাটা।
কামুক সিরিয়াল কিলারের লোকগুলি এক ধরনের পাগল, খানিকটা অবসেসড। এদেরকে কোনোভাবেই এবনরম্যাল ভাবা যায় না। এরা সমাজে সব খানে খুব স্বাভাবিক গতিতে এবং নীতিতে সবার সাথে বসবাস করে। ওদের দেখে পাশের কোনো ব্যক্তি কখনোই বুঝতে পারবে না, তার মনের ভিতরে কি চলছে আর তার পরবর্তী মুহুর্তে কি পরিকল্পনা। এরা সারাক্ষন ওদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্যই বাচে। এদের নির্দিষ্ট একটা প্যাটার্ন থাকে। খুব যত্ন করে এরা নিখুত কাজ করে। ওদের পরিকল্পনায় একটা ধরন হচ্ছে, এরা সব সময় চায় প্রোটেক্টেড সাইট, যেমন নিরাপদ কিলিং জোন, কিংবা সেক্সের সময় নিরাপদ থাকার নিমিত্তে কন্ডোম ব্যবহার। ওদের টার্গেটেও বিশেষ ধরনের প্যাটার্ন থাকে। ওরা একটা নির্দিষ্ট প্রোফাইলের টার্গেটকে বেছে নেয়। ওদের টার্গেট করারও একটা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট আছে। এইসব বৈশিষ্টগুলি কেউ খুব সুক্ষভাবে পর্যালোচনা না করলে তাদের এবনরমালিটিগুলি চোখেই পড়ে না। তাই সিরিয়াল কিলারদের ব্যাপারে ছোট একটা লিড থাকলেও তা গুরুত্তের সাথে বিবেচনা করা উচিত।
এই সিরিয়াল কিলাররা বা কামুক সিরিয়াল কিলাররা কিছু কিছু ড্রাগের ব্যাপারে খুব নলেজে রাখে। যেটা ওরা সব টার্গেটের উপর ইউজ করে। আর বারবার ওরা একই ড্রাগস ইউজ করে। খুব কদাচিত তারা তাদের এই ড্রাগস পরিবর্তন করে। আবার এই ড্রাগসটা পরিবর্তনের নিমিত্তে কিছু নীতিও ফলো করে, যেমন, যখন পরিচিত ড্রাগসটা আর তার কাছে থাকে না বা পাওয়া যায় না বা তার হাতে টার্গেটকে খতম করার সময় খুব কম থাকে, তখন ঐ একই কাজ করে এমন কিছু নতুন ড্রাগস সে ব্যবহার করে।
সিরিয়াল কিলাররা নিজের নিরাপত্তা নিয়ে সব সময় চিন্তা করে। তাই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ওরা টার্গেটকে খতম করে দেয় বটে কিন্তু এটাও দেখা গেছে যে, সবসময় এরা সব টার্গেটকে মেরে ফেলে না। যদি সরিয়াল কিলার অতিরিক্ত কামুক হয়, তাহলে খুনটা হয় শুধু ওর বেচে যাওয়ার জন্য একটা পন্থা। কিন্তু এই কামুক সিরিয়াল কিলারের অব্জেক্টিভ থাকে শুধু সেক্স। এটা তো সার্বোজনীন যে, সেক্সের চাহিদা একটা বদ অভ্যাস, বিশেষ করে যখন অনঅনুমোদিত সেক্সের উৎস হয়। আর এটাই ওদের অবসেসন। এটা একটা লাগামহীন ঘোড়ার মত। কিন্তু এখানেই ওদের চাহিদাটা মিটে না। ইনভেষ্টিগেশনকে বিভ্রান্ত করার জন্যেও ওদের একটা প্যাটার্ন থাকে। ওরা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা আশেপাশের লোকগুলিকেও বিভ্রান্ত করার জন্য আপ্রান চেষ্টা করে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এই সিরিয়াল কিলারকে কোথায় কোথায় খুজবে সেটা তারা আগে থেকেই জানে বা সেই মোতাবেক পরিকল্পনা করে রাখে।
এটা একটা নিশ্চিত যে, এরা নির্দিষ্ট কোনো পরিচয় নিয়ে থাকে না। তারা নাম বদল করে, তারা পোষাক বদল করে, তারা পেশা বদল করে। এরা একটা স্প্লিট পারসোনালিটি। এরা সব সময় আইডেন্টিটি লুকিয়ে রাখে প্রতিটি টার্গেটের কাছে। ফলে কোনো একটা টার্গেট যদি বেচেও যায়, সেই টার্গেটের বর্ননা দিয়ে খুব সহজেই এই সব কামুক সিরিয়াল কিলারের পর্যন্ত সহজে পৌঁছানো যায় না।
ওরা যখন সেক্স করে, ওরা এই জন্য কন্ডোম পরে না যে, পুলিশ তার সিমেন ট্রেস করতে পারে। সে আসলে সচেতন থাকে যাতে কোনো ছোয়াচে রোগে সে না ভোগে। এরা পরিষ্কার থাকার একটা অবসেসন থাকে। এরা ততোটাই নিজের খেয়াল রাখে যতোটা ভিক্টিমের। ওরা ক্রাইম সিনে কোনো প্রমান রাখতে চায় না বরং কিছু প্রমান ইচ্ছে করে রেখে যায় যা সবাইকে বিভ্রান্ত করতে পারে।
সিরিয়াল কিলাররা পরিকল্পনাটা এমন নিখুতভাবে করার চেষ্টা করে যেখানে কোনদিন, কোন জায়গায়, বা কখন কাজটা করবে তার পুরু পরিকল্পনাটা মাথায় রাখে। এমন কি ওরা যে জায়গায় ঘটনাটা ঘটাবে, সে পুরু এলাকাটা ভালো করে স্টাডি করে। মজার ব্যাপার হলো, ওরা একই শহরে বা এলাকায় একটার বেশী টার্গেট চয়েজ করে না। বিভিন্ন শহর বা এলাকায় তারা এটা করে থাকে। ওদের প্রমান যা ভিক্টিমের পাশে রাখতে হবে এসব দ্রব্যাদি সংগ্রহের জন্য ওরা পরিকল্পনা করে চুরিও করে। ওরা যদি চুরিও করে, সেখানেও একটা প্যাটার্ন ইউজ করে। সে আলাদা আলাদা জায়গায় চুরি করে। ফলে তারা শুধু খুন করার জন্যই ট্রাভেল করে না। এরা চুরি করার জন্যেও ট্রাভেল করে। এরা অনেক দূর দূর পর্যন্ত যায় এই চুরির উদ্দেশ্যে। চুরি করার টার্গেটকেও এরা অনেক জেনে বুঝে বাছাই করে। যাদেরকে সে চুরি করবে তাদের সাথে ওরা ভাব করে, বন্ধুত্ব করে, তারপর চুরি করে। তারা এটা নিশ্চিত করে যে, ঐ সব লোকেরা যাদের কাছে কিছু চুরি করবে, ওইসব লোকগুলি ঐ এলাকায় যাচ্ছে না বা থাকে না যেখানে সে কাউকে খুন করবে বা ভিক্টিম চয়েজ করবে। এখানে আরো একটা মজার ব্যাপার হলো যে, এই সিরিয়াল কিলাররা সবসময় ভিক্টিমের সব কিছু চুরি করে না। তারা সেইসব জিনিষগুলিই ভিক্টমের কাছ থেকে চুরি করে যার দ্বারা সে ডিজিটালী ধরা পড়বে না। যেমন ফোন, ল্যাপটপ, কিংবা এই জাতীয় জিনিষ তারা সাথে করে নিয়ে যায় না। অর্থাৎ ট্রেস হতে পারে এমন সব জিনিষ সে সাথে করে নিয়ে যায় না।
তারা টার্গেট সিলেক্ট করার সময় এমনসব টার্গেট সিলেক্ট করে যাদের আসলে খুব বেশী দূর পর্যন্ত যাওয়ার সম্ভাবনা নাই কিংবা একাই থাকে বা ছিন্নমুল মানুষ অথবা পরিবার থেকে আলাদা থাকে। কামুক সিরিয়ালদের চরিত্রের একটা লক্ষনীয় ব্যাপার হলো, তাদের ব্যবহারে, আচার আচরনে এমন একটা প্রকাশ থাকে যেখানে মহিলারা ওর সাথে কম্ফোর্টেবল ফিল করায়। বা ফাসায়। তারপরেও হয়তো অনেক মহিলারা তাদের নিজস্ব চারিত্রিক কারনে অন্তত সেক্সুয়াল এফেয়ার্স থেকে দূরে থাকে। আবার কেউ কেউ সহজেই এসব সিরিয়াল কামুক দের কাছে সহজে ধরা দেয়। ঘটনার বিবরনে দেখা যায় যে, এই কামুক সিরিয়াল কিলাররা ওদের সেক্সুয়াল ডিজায়ারটা সরাসরি বলতে পারে না বা ইঙ্গিত না বুঝার কারনে হয়তো অনেক মহিলারা চট করে সপর্পন করে না। এই সব মহিলাদের জন্যই তারা বেশীরভাগ সময়ে ড্রাগস ইউজ করে, সেক্স করে তারপর মেরে ফেলে।
এদের সেক্সুয়াল নিড গুলি নরম্যাল নয়। এরা রেড লাইট এরিয়ায় যায় কারন রেড লাইট এরিয়ায় টাকার বিনিময়েই ওরা সেক্সটা পেয়ে যায়। ফলে ওদের ওখানে ওরা কাউকে খুন করার মানসিকতাই দেখায় না। এরা রোল প্লে করায়, এর মানে এমন হয় যে, এমন কিছু মহিলার প্রতি আসক্ত যাদের জন্য ওরা খুব ছটফট করে, কিন্তু হাতের নাগালের বাইরে। তাই ওরা ওইসব জায়গায় গিয়ে ওইসব আসক্তিওয়ালা মহিলার রোল প্লে করায় যেনো সেই সেক্স ওয়ার্কারই তার আসক্তির সেই মহিলা। এসব কামুক সিরিয়াল কিলাররা ঐসব রোল প্লে করা মহিলাদেরকে সেই আসক্তওয়ালা মহিলার নামেই মাঝে মাঝে সম্মোধন করে। ওদের ফ্যান্টাসিগুলি অবসেসড মাইন্ডে সেক্স ওয়ার্কারদের দিয়ে পুরন করায়।
এসব কামুক সিরিয়াল কিলাররা দেখতে অনেক ভয়ংকর হয় না। এরা মার্জিত, পরিশোধিত এবং ভদ্রভাবে চলাফেরা করে। যাতে মহিলারা দেখে ভয় পায় না বরং কাছে আসে। ধীরে ধীরে সে অনেকের মধ্যে হয়তো একটা দুইটা মহিলাকে টার্গেট করে। একই জায়গায় আবার এরা একটার বেশী মহিলাকে টার্গেট করে না।
কিছু মহিলাদেরকে ওরা মেরে ফেলে আর কিছু মহিলাদেরকে ওরা ছেড়ে দেয়। কেনো? গবেষনায় দেখা গেছে যে, তারা ঐসব মহিলাদেরকেই মেরে ফেলে যারা সিরিয়াল কিলারের কাছে সারেন্ডার করে না। হয়তো সেক্সের বদলে ওরা একটা সম্পর্ক চায়। কিন্তু এরা কোনো সম্পর্কে জড়াতেই চায় না। যদিও জড়ায়, খুব বেশীদিন একসাথে থাকে না। ওরা কোনো ইমোশনাল রিলেশন চায়ই না। আর এর প্রধান কারন হলো, একবার শারীরিক সম্পর্ক হয়ে গেলে ঐ মহিলা আর তাদের কাছে কোনো গুরুত্তই রাখে না। সেটা তাদের কাছে একেবারেই বর্জ।
মাঝে মাঝে আবার এসব সিরিয়াল কিলাররা কোনো কোনো ভিক্টিমকে সেক্স না করেই মেরে ফেলে। এর ও একটা কারন আছে। এরা মহিলাদেরকে একটা জেতার বস্তু মনে করে। যদি একবার জিতে যায়, তাহলে আরো এগিয়ে যায়। আর ঠিক এ কারনেই তারা সেক্স ওয়ার্কারদেরকে খুন করে না। কারন টাকা দিয়েই তারা তাদেরকে পেয়ে যায়। কোনো চেলেঞ্জ থাকে না। কিন্তু যাদেরকে টাকা দিয়েও পায় না, এক সময় তারাই হয়ে উঠে এসব কামুক সিরিয়াল কিলারের প্রধান লক্ষ্যবস্তু যেখানে আর সেক্স নয়, ঐ মহিলাদের উপর জিতবার নেশা।
এসব কামুক সিরিয়াল কিলারদেরকে যখন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ট্রেক করে, আসলে তখন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এইসব সিরিয়াল কিলারদের এই উপরোক্ত ভাবনাগুলিকে ট্রেক করে ইনভেষ্টিগেশনে আগায়। অনেক কঠিন একতা কাজ। শেষ মেষ যদি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এদের কাউকে ধরতেও পারে, ওরা সব কিছু অকপটে স্বীকার করে। এদের মরবার বা শাস্তির ভয় অনেক কম।
এই পৃথিবীতে ঈশ্বর কত প্রকারের মানুষ যে সৃষ্টি করেছেন তার কোনো ইয়াত্তা নাই। আমরা মানুষ রুপী হায়েনাদের সাথেও বাস করি, আবার ঈশ্বরের ভয়ে প্রকম্পিত অনেক ভালো মানুষের পাশেও বাস করি। কার মনে কি পরিকল্পনা রয়েছে, তা আমাদের কখনোই জানা সম্ভব নয়। তাই, আমাদের উচিত, প্রতিটি মুহুর্তে কোন কিছুই উপেক্ষা না করা আর সেটা যতো ছোতই হোক বা তুচ্ছ। মানুষের থেকে ভয়ংকর কোনো প্রানি ঈশ্বর তৈরী করেন নাই।
০৮/০৩/২০২১-টাকা
Categories
টাকা যদি কাছে থাকে, তখন জীবনটা খুব সহজ হয়। মানুস নিজের সব সপ্ন পুরন করতে পারে। সেটা যেমন করেই হোক, সব সুখ আদায় করে নেয়। টাকা যদি কাছে থাকে তাহলে দুক্ষ অনেক পিছনে পড়ে থাকে। আর আমরা অনেক এগিয়ে যেতে পারি। তাই শুধু টাকা থাকা দরকার। টাকা সবার চাই। যতো বেশী টাকা, তাকে পাওয়ার চাহিদাও ততো বেশী। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি যে, টাকা গাছে হয় না। কিন্তু অনেকেই এই সপ্ন দেখেন যে, যদি টাকা গাছে হতো!! আর সেই গাছটা নিজের হতো। টাকা আসে অনেক পথে, চুরি, লোপাট, ডাকাতি, ক্ষেত বা চাষবাস অথবা ভাগ্যবসে কোনো লটারী বা বিজনেস।
যে বিজনেজ আপনি বুঝবেন না, তাতে ইনভেষ্ট করবেন না। কিন্তু অপ্রিয় সত্য হলো যে, মানুষ প্রতিদিনই শিকার হয় একটি সপ্নের যে, টাকা গাছে ফলতে পারে। একজন বুদ্ধিমান ভালো মানুষও এই সপ্নের ছায়ায় অন্ধ, কালা, বোবা হয়ে যান। কোনো প্রশ্নই করতে পারেন না। আর ফ্রড নিজের চোখের সামনে হচ্ছে দেখেও তার ইংগিত শুনতে পান না। ফ্রড তার চালাকী খুব চালাকীর সাথেই করে। সে তার জাল অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়। তারপর তার পরিকল্পনা মানুষের কাছে এতো মিষ্টি করে বিক্রি করে যে, তারা জানতেই পারে না যে তাদের ফাসানো হচ্ছে। পায়ে পায়ে বেনিফিট। যখন কোনো মানুষ এটা বলে যে, সে এই স্কীমে এতো টাকা পেয়েছে, এতো বেনিফিট পেয়েছে, তখন অন্যরা ভাবে যে, এই স্কীমে নিশ্চয়ই কোনো সোনার খনি আছে। যদি সে পেয়ে থাকে তাহলে আমরাও পাবো। প্রতারকরা সেইসব মানুষের সুযোগ নিয়ে থাকে যারা তাদের মিথ্যা স্কীমকে সত্য বলে ধরে নেয়। প্রায়শই শিক্ষাদীক্ষা করা মানুষেরা এই ধরনের প্রতারনার শিকার হয়ে যান। কারন টাকার গাছ হবে, এই সপ্নটা সবাই দেখে। এই যে ‘যুবক’, ‘ইউনিপেটু’, কিংবা ডেস্টিনি ইত্যাদি এই ফ্রড কোম্পানীগুলির মূলনীতি সাধারনত একই রকম ছিলো। মুলনীতিটা যেনো এরুপ ছিলো- ইনভেষ্টরদের আসল টাকার প্রথম সুদের কিস্তি দিয়ে দাও, নতুন সদস্য আনার জন্য বোনাস দাও, আর তারপর ইনভেষ্টদের বিনিয়োগের বাকী টাকা লুট করে নাও। যেটা হয় যে, ২য় রাউন্ডের ইনভেষ্টদের ১ম জন অনেক টাকা কামিয়েছে, আর সেই লোভে পড়ে সেও অনেক টাকা ইনভেষ্ট করে। পুরু দেশ থেকে যখন কোটি কোটি টাকা কোম্পানীগুলির কাছে চলে আসে, তখন এই ফ্রড কোম্পানীগুলি এক রাতের মধ্যে সমস্ত টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। ভুয়া কোম্পানী, জাল ঠিকানা, ফ্রড ফ্রন্ট অফিস, আর দেশের বাইরে থেকে অপারেশন হলো এইসব কোম্পানির আসল মুলমন্ত্র। ফিনান্সিয়াল করাপ্সন জব্দ করা খুবই কঠিন কাজ, আর সবচেয়ে বেশী কঠিন হয় ইনভেষ্টদের টাকা রিকভার করা।
সাধারন মানুষের কাছে টাকা আয় করা রাস্তা একটাই আছে, আর সেটা হলো সততার সাথে পরিশ্রমের রাস্তা।
০৮/০৩/২০২১-হীরা
Categories
হীরা একটি খুবই মুল্যবান জিনিষ। আর এর ব্যবসা! রহস্যে আবৃত চুপিসারে হয়ে চলা কোটি কোটি টাকার বিজনেস। এই হীরে এমন এক জিনিষের নাম যা সৌভাগ্য আর দূর্ভাগ্য দুটুই আনতে পারে। নিখুত নিরাপত্তা আর কঠিন শততাই এই হীরে ব্যবসার প্রধান স্তম্ভ। কে কখন বেইমানী করবে তার কোনো ভরষা নাই। এসব ব্যবসাতেই সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক অবিশ্বাসের কাজটা করে থাকে। অথচ এই ব্যবসাটা শুধুমাত্র বিশ্বাস আর কাজের পারদর্শিতার উপরই চলে। মজার ব্যাপার হলো, আনপলিসড হীরাও হীরা। তার ও একটা মুল্য আছে যা সোনার থেকেও দামী। আর যদি সেই হীরা পলিসড করা হয়, তাহলে সেটার চাহিদা হয় অনেকগুন বেশী। হীরে চিনতে মানুষের ভুল হতে পারে। কিন্তু খারাপ হীরে, অচল পয়সা, আর ধুর্তলোক একদিন না একদিন ওদের সত্যতা বেরিয়ে আসেই। আর ধরা পড়ে যায়। একটা সময় আসে, যখন এই নকল হীরা, অচল পয়সা কিংবা ধুর্তমানুষগুলি কানাগলিতেই হারিয়ে যায়। ওদের ব্যাপারে কেউ আর মনে রাখতে চায় না। এমনকি নিজেদের লোকেরাও না। যাই হোক, যাকে এই ব্যবসায় কাজ দেয়া হয় তার উপর কনফিডেন্স থাকাটা নির্ভর করে যিনি কাজটা নেন তার চরিত্র আর স্বভাবের উপর। আগে থেকে জানলে কেউ আর ঠকবাজী করতে পারে না, অথবা একবার যদি কোনো কারনে কারো উপরে এমন সন্দেহের উদ্রেক হয় যে, ন্যনুতম কোনো আচ পাওয়া যায় যেখানে বিশ্বাস নিয়ে খেলা হয়, তখন দ্বিতীয়বার আর ভরষা করা কখনোই সম্ভব না কারন এখানে বিশ্বাসের মুল্য এতো বেশী যা কল্পনা করা যায় না। দ্বিতীয়বার ঠকার মুল্য এতো বেশি যে, হয় এটা জীবনকে শেষ করে দেয়, নতুবা জীবনকে পরিশুদ্ধ করে তোলে। এ জন্য যতো ধরনের যাচাই বাছাই দরকার, কমিটমেন্ট করার আগেই সেটা করতে হয়। যদি সেই যাচাই বাছাইয়ের মধ্যে কোনো গাফিলতি থাকে তখন যেদিন কোনো ঘটনা নিজের সাথে হবে সেদিন আফসোস ছাড়া আর কোনো কিছুই অবশিষ্ঠ থাকে না। কিন্তু একটা মজার ব্যাপার হলো, এই ঠকবাজগুলি বোকা। এদের ব্যাপারে অনেকে অনেক বড় বড় সুযোগের সুবিধা দেয়ার পরিকল্পনা করলেও ওরা শুধু বর্তমানটা নিয়ে বাচে। আর ভবিষ্যত নিয়ে অলীক কল্পনা করে থাকে যে কল্পনা শুধুই মরিচিকা। কোনো কাজে আসে না সেটা। তাদের উন্নতি করার ইচ্ছা থাকে, করতেও পারতো, কিন্তু নিজেদের বোকামীর জন্য ওরা সেই উন্নতির রেল লাইনটায় এমন একটা দেয়াল তুলে যেখানে নিজেরাই ফেসে যায়।
মানুষের চরিত্র এই হীরের থেকেও অধিক মুল্যবান। যদি হীরে সম্পর্কেই আমাদের নীতি এমন হয়, তাহলে মানুষের চরিত্র, সততা আর একনিষ্ঠতার উপর কি নীতি হওয়া উচিত? অথচ আমরা প্রতিনিয়ত এই আমরা আমাদের মুল্যবোধ, চরিত্র, সততা এবং একনিষ্ঠতা নিয়ে মামুলী খেলা খেলতে থাকি। একজন মহিলার কাছে এই সততা যুগ যুগান্তরের, আর একজন পুরুষের কাছে এই সততা জীবনে সার্থকতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছোবার একমাত্র উপায়। যে যতো বেশী সফল, সে ততো বেশী মুল্যবান।
০২/০৩/২০২১-ব্লাকমেইল-রিভার্স ব্লাকমেইল
সায়েন্সেরই হোক আর কমার্শিয়াল সাব্জেক্টেই হোক, বিজ্ঞবান হোক আর যতো চালাকিই হোক, ব্ল্যাক মেইলের মতো কোনো বিষয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা কখনোই কারো উচিত না। কারন এই সব এক্সপেরিমেন্ট সব সময় বাজে ভাবেই ফেল করে। আর যখন ফেইল করে, তখন মানুষ পিছলা পথের মতো অনেক দূর পিছিয়ে যায়। একবার পিছলে গেলে আবার উঠে দাড়াতে পারবে, কেউ এটা সবসময় ভাবা উচিত নয়। হয়তো সেই একবার পিছলে যাওয়ার কারনেই সারাটা জীবন নষ্ট আর ধ্বংসই হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার হয়তো আর কোনো সুযোগ আসেই না।
বেশীরভাগ মানুষ এই সব এক্সপেরিমেন্ট কিংবা অন্য অর্থে যদি বলি, “প্রতিশোধ” কোনো না কোনো অতীতের ঘটনা থেকেই প্রভাবিত হয়। আসলে, পাষ্ট পাষ্টই হয়। অতীত অতীতেই হারিয়ে যায়। ভালো থাকার জন্য আমাদের সবার আজকের দিনের তথা আগামী দিনের কথাই ভাবা উচিত। অতীতকে ভোলা হয়তো কঠিন হতে পারে কিন্তু অসম্ভব না। কিন্তু কেউ যদি সেই অতীত কোনো অপরাধ আর দুক্ষবোধকে জাগিয়ে হিংসার রুপ দেয়, তাকে থামিয়ে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ, তা না হলে সেই অতীত আজকের দিনের শান্তি আর ভবিষ্যত দিনের আশার মৃত্যু হতে পারে। কেউ যদি মনে করে যে, অতীতের কোনো ঘটনা কারো মাথায় বোঝা হয়ে দাড়িয়েছে, ব্যক্তিত্তের উপর আঘাত হেনেছে, তাহলে এটা বিপদের আভাষ দেয়। অতীতের ভার অপশনাল, বইতে গেলে এটা আসলে ভারী, কিন্তু যদি মন থেকে ঐ বোঝা সরিয়ে ফেলা যায়, তা তুলোর থেকেও হালকা, চট করে হারিয়ে যায়।
আমাদের আজকের দিন তথা ভবিষ্যতের সুখের কথা মাথায় রেখে সব সময় সতর্ক থেকে এমন কিছু করতে হবে যাতে এটা মনে না হয় বা না হয়ে যায় যে, এক জনের শিকল থেকে বেরিয়ে গিয়ে শান্তির আশায় আরেকজনের কাছে এটা উনুন মনে হয়। যদি এটা হয়ে যায়, তখন মনে হয় পুল থেকে বেরিয়ে গিয়ে খাদে পরার মতো অবস্থা। ব্লাকমেইল কিংবা রিভার্স ব্ল্যাকমেইল সব কিছু থেকে দূরে থাকা খুব জরুরী। একটা জিনিষ বারবার মনে করতে থাকুন যে, হাজার হাজার সম্পর্ক ভেংগে যায়, তারপরেও আবার মানুষ নতুন সম্পর্ক করে। আর এই নতুন কোনো সম্পর্ক হয়তো আগামী দিন গুলিকে আসলেই সুন্দর করে তুলতে পারে।
১০/০২/২০২১- অসহায় সিনিয়র সিটিজেন
Categories
একজন অভিভাবক, কিংবা পিতামাতা তার জীবনের সমস্ত আনন্দ, আরাম, আয়েস, শখ আহলাদ বিসর্জন দিয়ে তার সন্তান মানুষ হোক এটাই মনে প্রানে চায় এবং সে মোতাবেক তার ক্যাপাসিটি অনুযায়ী সব কিছুই করে। কিন্তু যখন এই সন্তান বড় হয়, যোগ্য হয়, সমাজের বড় পরিসরে উঠে আসে, গর্বে পিতামাতার বুক ফুলে উঠে ঠিকই কিন্তু সেই সন্তান অনেক সময়ই বাবা মার এই ত্যাগ, এই বিসর্জন সঠিকভাবে মুল্যায়ন করেন না। এটা সব সন্তানের বেলায় যদিও সত্য নয় তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আজকাল এটা যেনো প্রায় একটা রীতি হয়ে যাচ্ছে। এই রীতির আবর্তে পড়ে দেখা যায়, প্রায়শই সেই বৃদ্ধ বাবা মা সন্তানবিহীন একাই দূর্বিসহ জীবন যাপন করেন। তারা একাই থাকেন, কিংবা তাদের কারো কারো আশ্রয় হয়ে যায় সেই নতুন রীতির আবর্তে গড়া ব্রিদ্ধাশ্রম। যারা বৃদ্ধাশ্রমে যান, তারা হয়তো কারো পরোক্ষ যত্নে কিছুটা ভালো থাকেন, কিন্তু যারা সেই ভাগ্য নিয়েও আসেন নাই, তারা পরিপূর্ন একা জীবন যাপন করেন। কেউ তাদের অনেক সময় খোজখবরও নেন না। ফলে একাকীত্ব দূর করার লক্ষ্যে অনেক বয়ষ্ক মানুষেরা এমন কিছু মানুষের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেন যারা কষ্মিঙ্কালেও তাদের বংশের কেউ ছিলো না কিংবা তারা তাদের কেউই না। তারপরেও মরুভূমির মধ্যে শুষ্ক কোনো পাতাবিহীন গাছকেও একটা অবলম্বন মনে করে এই অসহায় মানুষগুলি জীবনের তাগিদে সেই অপরিচিত আপাত বন্ধুসুলভ মানুষগুলিকেই আপন ভাবতে থাকেন। একটা কথা ইদানিংকালের জন্য ঠিক যে, শহরের মধ্যে যতো দ্রুত মানুষ বাড়ছে, ততো দ্রুতই মানুষের মধ্যে মানুষের দূরত্ব বেড়ে চলছে। আমরা প্রায়শই জানতে পারি না যে, আমাদের পাশের বাড়িতে কি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সেইসব বয়ষ্ক মানুষেরা যারা একা থাকেন তারা অপরাধীদের কাছে সহজেই শিকার হয়ে যান। আর যদি সেই অপরাধী কাছের কোনো মানুষ হয়, কিংবা কাছের মানুষের মতো মনে হয়, তাহলে বিপদ আরো বেড়ে যায়। আমাদের একাকী বয়ষ্ক মানুশেরা হয়তো তাদের হতাশা আর একাকীত্বের কারনে তারা তাদের সুখ বেদনার কথা যে কোনো অচেনা মানুষের সাথে ভাগ করে নেয়, কাউকে আপন করে নেন, এটা তাদের দোষ নয়। কিন্তু এত অন্ধবিশ্বাস মাঝে মাঝে খুবই প্রানঘাতিও হয়। ফলে দেখা যায়, সিনিয়র সিটিজেনরাই সমাজে ইদানিং সবচেয়ে বেশী অপরাধের শিকার হচ্ছেন। সমাজের এই অবক্ষয় দ্রুত বেড়ে চলছে আমাদের দেশে।
আমরা যে কথাটা প্রায়ই ভুলে যাচ্ছি যে, যে মা বাবা আমাদের জীবন তৈরী করার জন্য তারা তাদের সারাজীবন উজার করে দিয়ে, সমস্ত আনন্দ, শখ বিলিয়ে দিয়ে জীবনের এই পর্যায়ে এসে দাড়িয়েছেন। সন্তানরা যখন বায়না ধরেছে, জেদ করেছে, আরএইসব মা বাবা সেটাকে পুর্ন করার জন্য দায়িত্ত হিসাবে আপ্রান চেষ্টা করেছেন, তাদের জীবন দেখভাল করা কি আমাদের সন্তানদের কর্তব্য নয়? আমরা যেনো এটা না ভুলে যাই যে, জীবনের এই অধ্যায়ে একদিন না একদিন আমাদেরকেও দাড়াতে হবে।
১৮/১১/২০২০-অডিট ঘর
Categories
আমি এখানে নতুন ভাড়াটিয়া অতিথি। আজই এসেছি। কারো সাথেই আমার এই এলাকার মানুষদের সাথে পরিচয় নাই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা ঘর পাওয়া গেল। কি যে অবস্থা চারিদিকে। অনেকদিন হয়ত কেউ এখানে আসে নাই। বাড়ির মালিকও মনে হয় অনেকদিন পর্যন্ত এই জায়গাটার কোনো খোজ নেন নাই। চারিদিকে ঘাস জঙ্গল হয়ে একাকার। বাড়ির কেয়ারটেকারেরও যেনো জায়গাটা পরিস্কার করে রাখার জন্য খুব একটা খেয়াল আছে বলে মনে হয় না। চারিদিকে দুর্গন্ধ, আবর্জনা, মশা, মাছি, সাপ, তেলাপোকা কোনটা নাই। সবই আছে।
আমি আগে যে এলাকায় থাকতাম, আমি এখানে আসার আগে, সেই এলাকার মানুষজন সবাই মিলে কিছুটা হলেও এই এলাকার ঘরটা পরিস্কার করে দিয়েছিলো। তারাও অনেক কষ্ট করেছে। মায়া মহব্বত আর অনেকদিন থাকার কারনে সবাই আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিলো। আকাশে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব ছিলো, বৃষ্টি নামার আগেই তারা সবাই হাতাহাতি করে কোদাল, সাবল, খুন্তি দিয়ে যে যেভাবে পারে, ঘরটা পরিস্কার করে দিয়েছিলো। এতো হৈ চই হলো অথচ আশেপাশের কোনো ভাড়াটিয়ারা কেউ এলোই না। আশেপাশের ভাড়াটিয়াদের কারো কোন কৌতূহল আছে বলে মনে হচ্ছে না। সবাই যার যার ঘরে। কোন ছোট ছোট বাচ্চা কাচ্চাদেরও খুব একটা আনাগোনা নাই। বেশ নির্জন এলাকাটা।
আমি ঢোকে গেছি আমার ঘরে। মাটির ঘর অথচ মাটির দেয়াল ভেদ করে আমি যেনো আশেপাশের সবাইকে দেখতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি আমার আগের এলাকার আকাশ, আকাশের তারা, গাছপালা আর সেই এলাকার মানুষজনদের যত্রতত্র চলাফেরা। তাদের সাথে আমার সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে।
একটু ঘাড় ঘুরাতেই দেখি, ও মা, একই! এখানে দেখি প্রায় সবার বাড়ির সামনে তাঁদের নাম লেখা!! আর এদের অনেকের সঙ্গেই তো আমার আগের এলাকায় মোটামুটি পরিচয় ছিল। ঐ যে, কাসেমের বাবার ঘর দেখা যাচ্ছে, তাঁর পরেই দেখি আমাদের মেয়রের বাসা। অনেকদিন দেখা হয় নাই কাসেমের বাবার সঙ্গে অথবা মেয়র জনাব আলমের সঙ্গে। আচ্ছা আলম সাহেবের সাথেতো সারাক্ষন সলিম উদ্দিন জোকের মতো লেগে থাকতো, সেই সলিম উদ্দিনকে দেখতে পাচ্ছি না কেনো? আরে, আলম সাহেবের শরীরের উপর কে ওটা? ওতো আমাদের সেই কালা রতন? কালা রতনের তো ফাসি হয়েছিলো জোরা খুনের দায়ে? কালা রতনও এখানে?
ইশ, কি অন্ধকার, আর চারিদিকে কি মশা, পিপড়া আর কি সব পোকামাকড়। ঘরের বাতিগুলি যে কোথায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সুইচের জায়গাটা খুজতে গিয়ে কোথাও পাওয়া গেলো না। ঘরটার কোথাও কোনো সুইচ নাই, কোথাও কোনো বাতিও নাই? দরজাটা একেবারে বন্ধ। কোনো জানালাও নাই? কি ব্যাপার, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না কেনো?
উফ, হটাত করে শরিরটা ভিজে যাচ্ছে কেনো? একি? ছাদ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে!! মনে পরেছে কিছুক্ষন আগে বৃষ্টির লক্ষন দেখেছিলাম। এখন প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু ছাদের উপর থেকে ক্রমাগত পানি আমার ঘরে পড়ে ভরে যাচ্ছে। কি পোকা মাকর!! একদিকে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আবার অন্যদিকে এইসব পোকা মাকড় এলো কোথা থেকে? ভীষন ভয় লাগছে এখন আমার।
উচ্চস্বরে নাসিমার মাকে ডাকতে থাকি। কোথায় গেলে গো তোমরা? আরে, কেউ শুনছো না কেনো? আলোটা জালাও!! কেউ কি আমার ডাক শুনতে পাচ্ছো না? আরে, করিম, ওই সগীর, কই তোরা? আমার গলার ডাক উচ্চ থেকে আরো উচ্চস্বরে চারিদিকে কেপে কেপে উঠছে। আমার আকুতিতে পাশের এলাকার কুকুর গুলীও কি করুন সুরে কাদছে, অথচ আমার ঘরের কি কেউ শুনছে না? আমি আরো জোরে আমার বাড়ির গার্ড শাহিনুরকে ডাকি। গার্ড শাহিনুরও আজ আমার কোনো ডাক শুনতে পায় না? ওই শাহিনুর, আমি তো ভিজে চুপসে যাচ্ছি!! আমার বাকী কাপড় চোপড় কই? আমার সেই ইতালীর ছাতাটা কই? আমার জার্মানীর রেইন কোটটা কইরে শাহিনুর? তোরা সবাই কই?
হটাত বিকট এক শব্দে আমার যেন মাথা ঘুরে গেল। মনে হলো আকাশ ভেঙ্গে জ্যুতির্ময় অবয়বে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো চোখ ঝলসে যাওয়া শতকোটি আলোর চ্ছটার মতো চোখ নিয়ে বিকটকায় দেহধারী আমার এই বদ্ধঘরে প্রবেশ করলেন। আমি তাদের এর আগে কখনো দেখি নাই। আমি ভয়ে চিৎকার করতে গিয়েও আমার কন্ঠনালি থেকে এক ফোটা শব্দও যেনো বেরোলো না। আমি ঠায় শুয়েই রইলাম, সর্বশক্তি দিয়েও আমি উঠে বসতে পারলাম না। আগন্তক দুজন শুধু একটা কথাই বললেন, আপনি আজ থেকে এখানেই থাকবেন। এটাই আপনার চিরকালের ঘর। আমরা ইনকাম ট্যাক্স অফিস থেকে এসেছি। আপনার ফাইলটা আমাদের কাছে আছে। আপ্নার যাবতীয় সব হিসাব কিতাব না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে এখানেই এই বদ্ধঘরে বাতিহীন, জানালাহীন, দরজাবিহীন, এই স্যাতস্যাতে ঘরের মধ্যেই থাকতে হবে। প্রাথমিক অডিট যদি সন্তোষজনক হয়, তাহলে আমাদের মালিকের আদেশে আপনাকে আপাতত অন্যত্র নিয়ে যাবো, নতুবা সব হিসাব এখানেই চুড়ান্ত করা হবে। আর ততোদিন আপনি এখানেই অনাহারে একা সময় কাটাবেন।
খুব ভয়ে ভয়ে অস্ফুট কন্ঠে আমি জিজ্ঞেস করলাম। ভাই, এ স্থানের নাম কি? আমার পরিবারের অন্যরা সবাই কোথায়? আমার পাজেরো গাড়িটা কই, আমার বারো তালা বাড়িটা কি এখান থেকে অনেকদূর? আমার আদরের মেয়ে নাসিমা কই? নাসিমার মা কোথায়? আমি এখানেই বা কেনো? ঘরটা বড় অন্ধকার, একটু আলো জ্বালিয়ে দিন না। কত যে মশা, মাকড়শা আর পোকা মাকড়, একটু এরোসোল দিন না।
কি যেনো ভাষায় আমাকে শুধু আগন্তক এটাই বলে গেলেন, এটা আপনার সাধের ড্রইংরুম কিংবা এসিওয়ালা অফিস ঘর নয়। না এটা কোনো আফগানিস্থা্ন, বা পাকিস্থান কিংবা কাজিকিস্থান কিংবা আমেরিকার কোনো বিলাশ বহুল রেস্তোরা। আর আপনি যেখানে শুয়ে আছেন, তার নাম অডিট ঘর। যদি আপনি প্রিপেইড কার্ডে বিদ্যুতের দাম আগেই দিয়ে থাকেন, যদি আপনি পেট্রোল অকটেন কিংবা গাড়ির জন্যে আগেই মুল্য পরিশোধ করে থাকেন, আপনার ফাইলটা চেক করে আমরা কিছুক্ষনের মধ্যেই সবকিছু, বাতি, গাড়ি, এসি কিংবা শোয়ার জন্যে খাট-পালঙ্গ সব কিছুর ব্যবস্থা করে দেবো। আর যদি আপনি যে এলাকায় আগে বসবাস করতেন, সেখান থেকে কিছুই ট্রান্সফার না করে থাকেন, তাহলে আমাদের পক্ষে আপনাকে কোনো কিছুই সরবরাহ করা সম্ভব নয়। এখানে কোনো কিছুই বিনিময় হয় না। এর নাম গোরস্থান। আর আপনার এই অডিট ঘরের আরেক নাম- "কবর"।
১৫/১১/২০২০- ছবি
Categories
ছবি দেখিলেই যেনো বুক ধক করিয়া উঠে। অতীতের ছবি তো আরো ধকের মাত্রা বাড়াইয়া দেয়। অতীতে যে ছবিটা ভালো হয় নাই বলিয়া ছিড়িয়া ফেলিয়াছিলাম, আজ সেই অস্পৃশ্য, ঝাপসা স্যাতস্যাতে ছবিটা দেখিলেও ভালো লাগে। একাগ্রচিত্তে ছবিগুলি দেখিলে বারবার শুধু ইহাই মনে হয়, দিন ফুরাইয়া যাইতেছে। সময়ের ক্রমাগত টিকটিক শব্দে আমার দিনও টিকটিক করিয়াই ফুরাইয়া যাইতেছে। ইহাকে কোন বাধনেই আর থামাইয়া রাখা সম্ভব নয়, আর কেউ পারিয়াছে বলিয়াও আজ পর্যন্ত কোনো দলিল নাই, এবং আগামিতেও কেহ পারিবে ইহার স্বপক্ষে কোনো বিজ্ঞান কিংবা দর্শন আবিষ্কৃত হয় নাই। সময়ের এই টিকটিক শব্দ আমি আমার বুকের প্রতিটি ধুকধুক আওয়াজের, ঘুমের ঘোরে, নিশিথে কিংবা যখন একা থাকি তখন শুনিতে পাই। যখন একা থাকি, তখন “সময়” যেনো আমার কানে কানে ফিসফিস করিয়া বলিয়া যায়,
"---পিছনে তাকাইয়া দেখিয়াছো কত বেলা পার করিয়া আসিয়াছো? তুমি তোমার জন্মের ক্ষন, দুরন্ত শৈশব, কৈশোর পার করিয়া আসিয়াছো, তোমার অনেক বেলা পার হইয়া গিয়াছে, এখন আর তোমার জন্য সকাল বলিয়া কোন কাল নাই। বিকালের রোদের আমেজ কি তুমি বুঝিতে পারিতেছো? যদি তুমি ইহা অনুধাবন করিতে না পারো, তাহা হইলে, আয়নার সামনে গিয়া দাঁড়াইয়া এক পলক তোমার চোখের নিচে তাকাইয়া দেখো, অথবা হাত পায়ের রক্ত প্রবাহের ধমনীগুলির দিকে তাকাইয়া দেখো। ইহারা অনেক সময় ধরিয়া অবিরাম কাজ করিতে করিতে প্রায় অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে। তোমাকে দেখিয়া কি রাস্তার ঐ অবুঝ বালক আর “ভাই” বলিয়া সম্বোধন করে? না করেনা। এখন তোমাকে অনেকেই “চাচা” বা আংকেল” বলিয়া ডাকিতে পছন্দ করে। আর কয়েকদিন অতিবাহিত হোক, দেখিবে, তুমি এই “চাচা” কিংবা “আংকেল” উপাধিটাও ধরিয়া রাখিতে পারিবেনা। তখন কেউ তোমাকে "দাদা" কিংবা "নানা" বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিবে। তোমার এখন পা কাপিতেছে, হাত কাপিতেছে, চোখেও খুব ভালো করিয়া সব দেখিতে পাওনা। বৃহৎ অট্টালিকায় উঠিতে এখন তোমার সাহস আর আগের মতো কাজ করেনা, সমুদ্রে ঝাপ দেওয়ারও সাহস হয় না। তুমি আস্তে আস্তে নির্জীব পদার্থের ন্যায় হইয়া যাইতেছো। এখন একটু বর্ষার পানিতেই তোমার সর্দিকাশি বাধিয়া বসে, শীত আসিলেই মনে হয়, এই বুঝি রাজ্যের সব ঠাণ্ডা তোমার সারা শরীরের উপর দিয়া বহিয়া যাইতেছে।......
ছবি দেখিতে দেখিতে মনটাই খারাপ হইয়া যায়। মনে হয়, আমি কি সত্যি সত্যি একদিন এই নীল আকাশটা আর দেখিতে পারিবো না? এই ফুলগাছ, এই রাস্তার ধার, এই নদীর ঢেউ, এই শীতের হাড়কাঁপুনি ঝাঁকুনি, কিংবা বৃষ্টির শীতল জলেরচ্ছটা কোণো কিছুই কি আমি আর উপভোগ করিতে পারিবো না? সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর রাতে বাড়ি ফিরিবার আনন্দটা কি আর পাওয়া যাইবে না? অথবা পরিবারের সঙ্গে, বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে চুটিয়ে ঝগড়া কিংবা হৈচৈ করার অবকাশ কি আর কখনোই আমার হইবে না? মন বড় বিষণ্ণ হইয়া উঠে। মনে হয় এই জনমটা কেনো হাজার বছরের জন্য হইলো না? ভগবান বড় নিষ্ঠুর। কেহ হয়ত ভগবানকে বিশ্বাস করিয়া ইহাই মানিয়া নেন, আবার কেহ ভগবান আছে ইহাই বিশ্বাস করেন না। ভগবানকে অবিশ্বাস করিয়া যদি হাজার বছরের অধিক বাচিয়া থাকা যাইতো, তা না হইলে একটা যুক্তি থাকিত, কিন্তু ভগবান আছে বা নাই, এই বিশ্বাসের উপর পৃথিবীতে অধিককাল বাচিয়া থাকিবার কোনো উপায়ও নাই।
শৈশবের উচ্ছল চঞ্চলতা, যৌবনের অদম্য বন্যতা আর এখনকার বৈষয়িক ব্যস্ততার মাঝে কখনোই মনে হয় নাই যে, একদিন আমার এই সাম্রাজ্য, আমার এই আধিপত্যতা, কিংবা এই বাহাদুরী, অহংকার একদিন কোনো একটা ছোট বিন্দুর মধ্যে আটকাইয়া যাইবে যেখানে আমার শ্বাস নীরব, আমার মস্তিষ্ক নীরব, আমার হাত নীরব, আমার শরীর নিথর। আমার সবকিছুই নীরব। আমার চারিধারের কোনো কিছুরই পরিবর্তন হইবে না। তখনো ঠিক সময়েই সূর্য উঠিবে, পাখীরা ঠিক সময়েই কিচিরমিচির করিয়া ভোরের আলোকে জাগাইয়া তুলিবে, প্রাত্যাহিক কাজে সবাই যার যার কাজে ঠিক সময়েই ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া আবার ঠিক সময়েই ঘরে ফিরিয়া আসিবে। ঠিক সময়েই সবাই তাহাদের প্রতিদিনের সকালে নাস্তা, দুপুরের খাবার, কিংবা পরিবার পরিজন লইয়া বিকালে শরতের কোন একসন্ধ্যায় বাহির হইয়া পড়িবে, শুধু আমি ছাড়া।
আজ হইতে শতবছর আগেও কেউ না কেউ হয়ত এইভাবেই তাহারা আজকের দিনটার কথা ভাবিয়া ভাবিয়া তাহাদের ঐ সময়ের ব্যথার কথা, এই পৃথিবী ছাড়িয়া যাওয়ার আক্ষেপের কথা, এই পৃথিবী ছাড়িয়া না যাওয়ার আকুতির কথা বলিয়াছিলেন। তাহাদের কেউ হয়ত এই পৃথিবীতে অনেক প্রতাপশালী রাজা ছিলেন, কেউ হয়ত ক্ষমতাশিল সেনাপতি ছিলেন, কেউ হয়ত কোটিপতি ধনকুবের ছিলেন, কিন্তু কেহই এই প্রস্থানের রাহু গ্রাস হইতে মুক্তি পায় নাই। আমার কোন পূর্বসুরী যেমন পায় নাই, আমিও পাইবো না আর আমার পরের কোনো উত্তরসুরীও পাইবে না। আজ যতো সুখ নিয়াই এই পৃথিবীতে বিচরন করি না কেনো, যত অভিযোগ নিয়াই বাচিয়া থাকি না কেনো, কিংবা যত কষ্ট নিয়াই দিনযাপন করিনা কেনো, যখন কেউ থাকে না, তখন তাহার প্রতি মুহূর্তের হাসি, উচ্ছ্বাস, মহব্বত, গালি কিংবা মেজাজের প্রতিধ্বনি শুনিতে পাওয়া যায়। এই প্রতিধ্বনি কখনো কাউকে কাদাইবে, কখনো কাউকে একা একাই হাসাইবে, আবার কাউকে এমন এক জায়গায় নিয়া দাড় করাইবে যেখানে মনে হইবে, হয়ত আমার বাচিয়া থাকাটা তাহাদের জন্য খুব প্রয়োজন ছিলো। হয়ত সব রাগ, অভিমান, অভিযোগ সত্তেও মনে হইবে আমার চলিয়া যাওয়ার কারনে এই শুন্যস্থানটা কেহই পুরন করিবার মতো নয়। তখনো এই ছবিগুলিই নীরবে কথা বলিবে।
কিন্তু তাহার পরেও সবচেয়ে সত্য উপলব্ধি হইতেছে, একদিন, সবাই আমরা একে অপরের হইতে আলাদা হইয়া যাইবো। কেউ আগে আর কেউ পড়ে। আমরা সবাই একদিন একজন আরেকজনকে হারাইয়া ফেলিবো, মিস করিবো। দিন, মাস, বছর কাটিয়া যাইবে, হয়ত কাহারো সাথে আর কাহারো কোনো যোগাযোগ থাকিবে না। একদিন হয়ত আমাদের সন্তানেরা, নাতি নাতিনিরা আমাদের অতিতের সব ছবি দেখিয়া কেহ কেহ তাহাদেরই সাথী লোকদের প্রশ্ন করিবে, “কে এটা? কে ওটা?”, "উনি কে" বা "উনারা কারা"? তখন হয়ত অনেকেই চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু অশ্রুজলে অদৃশ্য কোনো এক মুচকি হাসি দিয়া বলিবে,
“এরা ছিলো ওইসব লোকজন যাদের সঙ্গে আমি আমার সবচেয়ে ভালো কিছু সময় কাটিয়েছি। আজ ওরা কেউ নাই।”
এরই নাম ছবি।
আমি কি কেবলই ছবি? তারা কি কেবলই ছবি যারা আজ থেকে শত বছর আগে এই পৃথিবীতে এসেছিলো এবং এখন যারা আর কোথাও নাই? কেউ কেউ তো আবার কোথাও ছবি হিসাবেও নাই? অথচ তারাও এক সময় আমার মতো এই পৃথিবীর আলো বাতাসে বড় হয়েছে, তাদের মধ্যেও প্রেম এসেছিলো, মহব্বত এসেছিলো। তারাও সংসার করেছে, জীবনের প্রয়োজনে এক জায়গা থেকে অন্যত্র সঞ্চালিত হয়েছে। তারাও নীল আকাশ দেখে, নদীর পানি দেখে, বসন্তের ফুল আর ফুলেল পরিবেশে কখনোকখনো কবিতাও লিখেছে। গুনগুন করে গান গেয়েছে। পাখির কোলাহলে তারাও কখনো কখনো আপ্লুত হয়েছে। তাদের সময়েও শীত বসন্ত, বর্ষা, সবই এসেছে। তারাও কারো না কারো সাথে হাত হাত ধরে জীবনের অনেক পথ পড়ি দিয়েছে। এদের অনেকেই হয়ত আজিকার আমাদের থেকেও অনেক নামি দামী মানুষের মতো ছিলেন। আরো কত কি? কিন্তু ওই সব গুনীজনেরা, মানুষগুলি আজ কোথাও নেই। কেউ হয়ত কারো কারো ড্রইং রুমে ছবি হয়ে আছে, কিন্তু তার দেহ পচতে পচতে মাটির সাথে মিশে দেহ বলে আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। যেই হাড়গুলি ছিলো, সেগুলিও এদিক সেদিক হতে হতে ওগুলো আর কোথাও খুজে পাওয়া যাবে না। যে কবরে একদিন তাদেরকে শুইয়ে হাজার হাজার লোক, আত্মীয়সজনেরা বিলাপ করেছিলো, সেইসব আত্তীয় সজনেরাও আজ কোথাও হয়ত নাই। ওই কবরেই হয়ত একে একে শুইয়ে আছেন তারাও। ওই কবরটাও কারো একচ্ছত্র নয়।
এই পরিসংখ্যানে আমিও তাহলে নিছক একটা ছবি এবং কোনো এক সময় এই ছবি থেকেও আর কোথাও নাই। আমার ইতিহাস এই পৃথিবীর কেউ মনে রাখবে না। আমার আজকের দিনের এই রাজত্ব, আমার সাম্রাজ্য, আমার রেখে যাওয়া সব সম্পদ আর সম্পত্তি হয়ত হাত বদলের মাধ্যমে আমার বংশ পরম্পরায় কারো হাতে সেটা পৌঁছে যাবে কিন্তু আমার নাম, আমার আজিকার দিনের পরিশ্রম, আমার আজিকার দিনের কোনো কিছুই তার কাছে পৌঁছে যাবে না। সে হয়ত জানবেই না, কার তৈরী করা সিংহাসনে বসে তিনি কার উপরে প্রতিনিধিত্ব করছেন। হয়ত তিনি জান্তেও চাইবেন না।
তাহলে কিসের জন্য? কার জন্য?
আজ যারা তোমরা আমার এই মন্তব্যগুলি পড়ছো আর ভাবছ, তাহলে কি আমরা সবাই হাত গুটিয়ে কোনো কিছুই করবো না? হ্যা, করবো। শুধু নিজের জন্য আর নিজের আরামের জন্য।
তোমাদেরও এক সময় আসবে, আমার মতোই চিন্তা তোমাকে আচ্ছাদিত করবেই। কারন এটাই এই পৃথিবীর আসল রুপ আর বিবেদেচ্ছ্য মায়া। এই প্রিথিবী কাউকেই তার অপ্রয়োজনে মনে রাখে না।
২৮/১০/২০২০-বেঞ্চমার্ক, মাপদন্ড
Categories
কারো জীবনের উন্নতি মাপার পদ্ধতি। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকটা মানুষ নিজের বেঞ্চমার্ক তৈরী করে। এই বেঞ্চমার্কটাই মানুষকে ভিতর থেকে অনুপ্রেরনা দেয়, সামনের দিকে পুষ করে। তাহলে এখন প্রশ্ন জাগে, এই বেঞ্চপার্কটা আসলে কি? এই বেঞ্চমার্কটা আসলে হচ্ছে একটা শক্তি, মনের শক্তি, যোগ্যতার শক্তি আর শক্তি ইচ্ছার। এটা কারো নিজের ভিতর থেকে উতগিরিত হয়। এটা অন্য কেঊ তৈরী করে দিতে পারে না। কিন্তু যখনই এই বেঞ্চমার্ক বা মাপদন্ড কারো জন্য অন্য কারো বেঞ্চমার্কের সাথে তুলনায় মাপদন্ড হয়ে দাঁড়ায়, তখন এই তুলনা করতে করতে আমরা এটা ভুলে যাই যে, আমরা কাউকে এতোটাই হতাশায় ফেলে দেই যার ফলে সেই ব্যক্তি নিজের অক্ষমতা আর যোগ্যতাকে একটা নিছক নিজের দূর্বলতা মনে করে একটা বড় ধরনের ভূল পদক্ষেপ নিয়ে বসে। আর সেই ভুল পদক্ষেপে হয় সে নিজের উপর নয় সেই তুলনাকার বেঞ্চমার্কের উপর প্রতিশোধের নেশায় মেতে উঠে। তাতে আর যাই হোক, হয় একজনের নতুবা দুজনের জীবনেই নেমে আসে সবচেয়ে সামাজিক অবক্ষয়, অপরাধ, অথবা খুন বা আত্মহত্যা।
দুজন মানুষের মাঝে তুলনা করা আর সেটা নিজের মধ্যে নিয়ে নেওয়া প্রত্যেক মানুসের জীবনের একটা অংশ আর তুলনা করা এই বিষয়টা প্রায়ই মানুসের জীবনে একটা বেড ইম্প্যাক্ট ফেলে। ছোট বেলায় পড়াশুনা, যৌবনে রোজগার, ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে তুলনা যার দিকটা একটু দুর্বল হয়ে থাকে সে প্রত্যেকটা মুহুর্তেই একটা হীনমন্যতায় ভোগে। দুটু প্রজাপতি যেমন এক হতে পারে না, সেখানে দুজন মানুষ কি করে এক রকম হবে? ঈসশরই বলুন, আর প্রকৃতিই বলুন, বা নিয়তিই বলুন, তিনি প্রত্যাক মানুষকে আলাদা আলাদা উপহার দিয়েছেন। কেউ সে উপহারের র্যাপার আগে খুলে ফেলে, আবার কারো বা এই উপহারটা আছে এটাই বুঝতে সারা জীবন কেটে যায়। এই সময় যখন কোনো মানুশকে বলা হয় যে, তুমি ওর মতো হতে পারো না? ও তো এই কাজে তোমার থেকে এগিয়ে বা তুমি কেনো ওকে অক্ষরে অক্ষরে ফলো করো না? ওর মতো হবার চেষ্টা করো ইত্যাদি, তখনি আসলে ওই মানুষটা থেকে ঐ উপহারটা ছিনিয়ে নেয়া হয়। তার নিজেকে চেনার চেষ্টাটা কেড়ে নেয়া হয়। গুরুত্ত না দেয়া এই জখম, ভবিষ্যতে কোনো মারাত্তক ক্ষতির কারন হতে পারে।
২০/০৯/২০১৭ -অগ্নিশর্মা বাবু
Categories
অগ্নিশর্মা বাবু সুদুর আফ্রিকার জঙ্গলে ভ্রমন করিতে গিয়া অনেক সুন্দর একখানা ফলের চারা দেখিয়া সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিলেন। ভাবিলেন, আহা, আমার বাগানে ইহা লালন পালন করিয়া আরো সুন্দর করিয়া তুলিবো। জঙ্গলে অপরিচর্যায়ই যখন এতো সুন্দর করিয়া উহা বাড়িয়া উঠে, পরিচর্যা পাইলে না জানি আরো কতো সুন্দর করিয়া আপনার বাগানকে আরো সৌন্দর্য বর্ধন করিবে। কতলোক দেখিতে আসিবে, কতলোক ইহার কাহিনী শুনিয়া তাহাকে পাইতে স্বপ্নে বিভোর হইয়া থাকিবে। কিন্তু উহা আর কারো কাছেই নাই শুধু তাহার বাগান ছাড়া। ইহাই যেনো অগ্নিশর্মা বাবুর একটি অতীব শান্তি।
-আনিলেন।
-লাগাইলেন
-শখের চারা। মালির পরিবর্তে তিনি নিজেই উহার পরিচর্যার ভার নিলেন
-প্রতিদিন উহার বাড়িয়া উঠার সব রকমের উপকরন রীতিমতো দিতে থাকিলেন। কখনো দুস্টু লোকের হাতছানীর হাত হইতে রক্ষার জন্য খাচা বানাইয়া, কখনো বৃষ্টির কবল হইতে বাচাইবার জন্য ছাউনী দিয়া, কখনো আবার উলুপোকার উপদ্রব হইতে বাচাইবার জন্য চারার গায়ে সুই ফুটাইয়া ঔষধ লাগাইয়া দিলেন।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, অগ্নিশর্মা বাবু দেখিলেন, উহা বাড়তির দিকে না যাইয়া শুধু অধোপতনের দিকে যাইতে লাগিলো। তিনি চিন্তিত হইয়া গেলেন। তাহার ঘুম নষ্ট হইতে লাগিলো, ঘুম নষ্ট হইবার সাথে সাথে সপ্নও ভাঙিতে লাগিলো। তাহার বাগানের অন্যান্য অনেক সুন্দুরী ফলের গাছ, ফুলের চারার উপর অগ্নিশর্মা বাবুর মনোযোগ ক্রমশ কমিতে লাগিলো। তাহার এই অমনোযোগের কারনে বাগানের শ্রী যেনো ধীরে ধীরে আরো খারাপ হইতে লাগিলো। সাজানো বাগানে যেনো ইদুর মরার গন্ধ বাহির হইতে লাগিলো। মরা গাছের ঢাল ক্রমেই বাড়িতে লাগিলো। কি সর্বনাশ!! এই এক আফ্রিকার চারার জন্য অগ্নিশর্মা বাবুর এতো দিনের বাগানের হাল কি হইতে কি হইয়া গেলো?
তাহার পরেও মন বলিয়া কথা। অনেক উচ্ছাস আর আবেগ লইয়া যে চারাটি অগ্নিশর্মা বাবু রোপন করিয়াছিলেন। উহার এমন অকাল মৃত্যু হইতেছে ইহা তিনি কখনো ভাবিতে পারেন নাই। এমন নয় যে, চাড়াটিতে তিনি কম জল ঢালিয়াছেন, কিংবা তাহার তাহার যত্ন কম নিয়াছেন, কিংবা এমন নয় যে, সময়ের সাথে সাথে উহার কোনো পরিচর্যার অভাব হইয়াছিলো তবুও চারাটি মরিতে শুরু করিয়াছে। কি হইতে পারে উহার এই রকমের পতনের কারন? মনের এই খুতখুতি হইতে রেহাই পাইবার জন্য অগ্নিশর্মা বাবু অনেক গবেষণাও করিলেন।
কি কারনে ইহার অধোপতন হইতে পারে তাহার সবরকমের সম্ভাব্য কারন লইয়া ভাবিতে লাগিলেন। টব পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর টবের মধ্যে তিনি তাহা রাখিয়াছিলেন। সুতরাং টব উহার মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়। মালী যত্ন নেয় নাই এইরূপ দোসারূপ তিনি করিতে পারিবেন না কারন মালী তিনি নিজেই ছিলেন। তদারকীর কোনো গাফিলতি ছিলো না। বিজ্ঞ নার্সারির একদল বিশিষ্ট গবেষকের দ্বারা পরীক্ষা করাইয়া দেখিলেন, উহা যেই জাতের চারা, তাহার সব কিছুই ঠিক আছে বলিয়া মন্তব্য করিলেন। তবে তাহার মন্তব্যের নীচে একটি ছোট নোট লিখিতে ভুলিয়া যান নাইঃ
“অধিককাল উহা স্বাভাবিক আলো–
বাতাস বিবর্জিত এমন এক স্যতস্যাতে গোমট ছায়াতল পরিবেশে বড় হইয়াছে, ফলে ঊহার ভিতরের শিরা উপশিরা, জীবন প্রনালীর ধারা স্বাভাবিক ধারা হইতে পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। ফলে চারাটি আর বর্তমান সুস্থ পরিবেশের সহিত খাপ খাওয়াইয়া চলিতে অপারগ। ইহার বনজ গুনাবলী পুরুপুরি পরিবর্তিত হইয়া বন্য গুনাবলিতে রুপান্তরীত হইয়া গিয়াছে বিধায় সার্বক্ষণিকপরিচর্যায়ও আর কোনো লাভ হইবে বলিয়া মনে হয় না। উহার সমগোত্রীয় চারার জন্য যে আদর্শিক পরিবেশ দরকার তাহা উক্ত চারাটির জন্য প্রযোজ্য হইবে না। তবে যদি পুনরায় উহাকে আলো–বাতাস বিবর্জিত, স্যাতস্যাতে গোমটযুক্ত পূর্বেকার পরিবেশে ফেলিয়া রাখা যায়, উহা অতি তাড়াতাড়ি বাড়িয়া উঠিবে। ইহার জন্য স্বাভাবিক বাগানের পরিবেশ প্রযোজ্য নহে। তবে সেক্ষেত্রে ইহার উপর কোনো ভার, কিংবা কোন কোন লতাপতার ভর দেওয়া যাইবে না কারন উহা এইরূপ কোন ভাড় নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে নাই। “
–মন্তব্য পড়িয়া অগ্নিশর্মা বাবু বুঝিলেন, চারাটিকে আর তাহার বাগানের অন্যান্য ফল, ফুলাদি কিংবা অন্যান্য চারাদের সাথে রাখা সম্ভব হইবে না। আর শুধুমাত্র এই চারাটিকে বাচাইয়া রাখার জন্য বাকী সব চারাদের মুল উৎপাটন করা তাহার পক্ষে সম্ভব হইবে না। রাগে দুঃখে টব সমেত অগ্নিশর্মা বাবু অগ্নিরূপ ধারন করিয়া সেই সুদুর আফ্রিকা থেকে সংগ্রহ করা দেখিতে সুন্দর কিন্তু বিষাক্ত চারাটিকে তিনি বাগানের বহুদূরে নিক্ষেপ করিয়া রাগ সামাল দিলেন। একবার ফিরিয়া তাকাইবার ইচ্ছা হইতেছিলো বটে কিন্তু উহাকে আর দেখিতেও মন চাহিলো না। উহার আফ্রিকার জঙ্গল হইতে আনিবার পর এই বাগানের চত্তরের ইতিহাস চিরতরে নির্মূল করিয়া মালিকে উচ্চস্বরে আদেশ করিলেন, আর বলিলেন, বাগানের প্রবেশ পথে ” আফ্রিকার যতো সুন্দর গাছ কিংবা চারা, কিংবা ফল অথবা ফুলের যে কোনো চারাই হোক না কেনো, ইহা এই বাগানে প্রবেশ নিষিদ্ধ” লিখিয়া দাও।
মালি কোনো কথা না বলিয়া শুধু অবাক হইয়া অগ্নিশর্মা বাবুর দিকে তাকাইয়া তাহার প্রস্থানের দৃশ্য অবলোকন করিলেন। বাবু যাওয়ার পর মালি একটু পরে হাতের কাছে জলের বালতি লইয়া অন্যান্য গাছের গোড়ায় জল ঢালিতে লাগিলেন আর ভাবিতে লাগিলেন, আফ্রিকার জঙ্গলটি কোথায়? জঙ্গলে কি বাগান চাষ হয়?
১৩/০৭/২০১৭-কোয়েলহোর shout in anger?
Categories
ব্রাজিলের বিখ্যাত এবং বেস্টসেলার লেখক পাওলো কোয়েলহো তার বিখ্যাত why do we shout in anger? একটি লেখায় লিখেছিলেন, আমরা যখন রাগ করি, তখন এতো কাছাকাছি দুরুত্তে দাঁড়িয়ে থেকেও চেচিয়ে কথা বলি কেনো? তার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় তিনি একটা ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছিলেন যদিও ব্যাপারটায় শারীরিক অনেক হরমুনাল ব্যাপার স্যাপার থাকতে পারে। আর ওইটাই সম্ভবত অনেকটা বৈজ্ঞানিক কারন কেনো আমরা উত্তেজিত হলে কেউ কাছাকাছি থাকলেও আমরা চেচিয়ে কথা বলি। কিন্তু লেখক আরেকটি যুক্তি দাড় করিয়েছেন, সেটাও খুব অযৌক্তিক বলে ফেলা যাবে না।
"দুটো মানুষ যখন একে অপরের উপর রেগে যায় তখন তারা একে অন্যের অন্তর থেকে দূরে সরে যায়। এই রাগ তাদের অন্তরের মাঝেও দুরত্ব সৃষ্টি করে। সেই দুরত্ব একটু একটু করে যত বাড়তে থাকে ততই তাদের রাগ বা ক্রোধ বেড়ে যায় এবং তখন তাদেরকে আরও চিৎকার করতে হয়, আরও জোরে তর্ক করতে হয়।"
-"আবার যদি আমরা ভেবে দেখি, দুজন মানুষ যখন একে অন্যের প্রেমে পড়ে বা ভালোবাসে তখন কী হয়? তখন ভালোবাসার বন্ধনে থাকা মানুষ দুজন একে অন্যের সাথে ধীরে ধীরে নরম স্বরে, আবেগ নিয়ে কথা বলে। কারণ যারা ভালোবাসে তারা একে অন্যের অন্তরের খুব কাছে থাকে। আর যারা অন্তরের কাছে থাকে তাদের কথা শুনতে হলে চিৎকার করার কোন প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি শুধুমাত্র ফিস্ ফিস্ করেও তারা তখন কথা বলতে পারে।"
"যারা আরও বেশি গভীরভাবে একে অন্যকে অনুভব করতে পারে, ভালোবাসতে পারে তখন কী হয় তা কি আমরা জানি?"-"অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার হলো, তাদের তখন ফিস্ ফিস্ করেও কথা বলতে হয় না। তারা দুজন যখন একে অন্যের চোখের দিকে তাকায় তখনই অন্তরের অনুভূতি, কথা, শব্দমালা সব অনুভব করে ফেলতে পারে। কারণ তখন তাদের অন্তর তাদের কে এক করে ফেলে। তাদের কথা হয় তখন অন্তরে অন্তরে।"
১৮/০২/২০১৭-তৃতীয় নদীর তীর
Categories
আমার বন্ধু মেজর আসাদের একটা নতুন বই এই বইমেলায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। “অন্য ভুবন”। বইটি আমি এখনো পরার সুযোগ হয় নাই তবে আমি না পড়েই বুঝতে পারছি, বইটা একটা চমৎকার লেখনীর প্রকাশ হবে। আমি আসাদের লেখার খুব ভক্ত। আমার এই বন্ধুর লেখা আমার আরেক বন্ধু প্রয়াত মেজর সাহেলকে উদ্দেশ্য করে তার একটা লেখা “নদীর তৃতীয় তীর” পড়তে পড়তে মন বড় আবেশিত হয়ে আছে এই কয়েকদিন যাবত। তারই লেখার কিছুচুম্বক লাইন এইরকম। … “মৃত্যু যখন এসে আমার এই শরীরটাকে স্পর্শ করবে তখন তোমরা সবাই আমার শরীরটাকে একটা ছোট্ট নৌকোয় করে ভাসিয়ে দিয়ো। জলস্রোতে ভেসে যাবে অনাদিকাল ধরে। নদীর নিঃসীম উপকূল ছাড়িয়ে আমি যাব, নদীর ভেতরে, নদী থেকে দূরে, নদীতে।” – (নদীর তৃতীয় তীর, হুয়াও হুইমারেস রোসা), বড় রহস্যভিত্তিক। দক্ষিণ আমেরিকার একজন বিখ্যাত ছোট গল্পকারের নাম হুয়াওহুইমারেস রোসা। ‘THE THIRD BANK OF THE RIVER’ (নদীর তৃতীয় তীর) নামে তাঁর লেখা একটা ছোটগল্প। এই গল্পে এক পরিবারের খুব দায়িত্বশীল একজন পিতা একদিন একটা ডিঙি নৌকা তৈরি করেন। ছোট ডিঙি। গলুইতে শুধুমাত্র এক চিলতে জায়গা। একজনের বেশি মানুষ সেখানে বসতে পারবেনা। বিশাল এবং সুগভীর একটা নদীর তীরে পরিবারের বসতি। নদীটা এতই বিশাল এবং প্রশস্ত যে, অন্য তীর দেখাই যায়না। অতঃপর একদিন তিনি নদী পারের বাড়িতে তার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিশাল, সুগভীর নদীতে তার ডিঙি ভাসিয়ে দিলেন। কোন খাবার বা অন্য কোন রসদও সঙ্গে নিলেন না। এমনকি শেষ বারের মত পরিবারের কাউকে কোন উপদেশও দেবার চেষ্টা করলেন না। অদ্ভুত ব্যাপার হল তিনি আর কখনও ফিরে আসলেন না। কিন্তু আবার কোথাও চলেও গেলেন না! মাঝ–নদী বরাবর অনির্দিষ্টভাবে ঘোরাফেরা করতে লাগলেন। কখনও উজানে। কখনও বা ভাটিতে। কিছু কিছু সময়ে তিনি দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যান। কিন্তু কখনই এমন দূরে নয় যে তার উপস্থিতিটা পরিবারের সদস্যরা অনুভব করতে সক্ষম হবে না। … মৃত্যুই কি নদীর তৃতীয় তীর?
আসলে এই তীর কি, কোথায় তার অবস্থান, কিংবা এটা কি এমন কোনো নদী যার তীর সচরাচর গোচরীভুত হয় না, অথচ আছে? অথবা এই নদীর কি আরো তীর আছে যার নাম হয়ত চতুর্থ তীর? সবুজ গাছ-পালা, আকাবাকা মেঠোপথের শেষপ্রান্তে প্রাকৃতিক বড়সৌন্দর্য পরিবেষ্টিত বিশাল জলাধারের চলমান স্রোতের প্রাবাহমান যদি কোন নদী হয়, সেই নদীর তীর হয়তোবা কখনো এই বিশাল জনরাশির সবার কমন। এখানে সবার রোমাঞ্চ, আশা, বেদনা, সবার কাহিনীর এক মহাপুস্তকের মতো। হয়তোবা এটা কখনো সভ্যতার জীবনধারার বাহকরুপী কোনো সময়ের রাজত্ব হলেও হতে পারে কিংবা কখনো সেই দৃশ্যমান নদী অতীত বর্তমানের সুখ দুঃখের এই বিশ্বভ্রমান্ডের সাক্ষীর ধারকবাহক হলেও হতে পারে। আর সেটাকেই আমরা কখনো নদী, কখনো উপসাগর অথবা কখনো সাগর থেকে মহাসাগরের স্তরে বিন্যাস করে কতোই না উপমা করে থাকি। এই নদীর স্রষ্টা আছে, এর নিয়ন্ত্রণকারী আছে, আর তার উপর সমগ্র মানবকুল একটা মিশ্র বিশ্বাস নিয়েই কেউ এর স্রষ্টাকে পুজা করে, কেউ তাকে অস্বীকার করে আবার কখনো কখনো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মায়াজালে আশা-নিরাশার ভারদন্ড নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। হয়ত এরই নাম “জীবন”, হয়তবা এরই নাম “সভ্যতা”। এই নদীর কিনারা থেকে পালিয়ে বেড়ানো মানে এই নয় যে, জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো, সভ্যতা থেকে হারিয়ে যাওয়া। এই বিশ্বভ্রমান্ডের কোথাও না কোথাও আরেক নদীর তীর আছে যেখানে তার কিনারা পাওয়া যায়। সেখানেও নতুন করে সভ্যতা, জীবন এবং নতুন কাহিনীর রচনা হতে পারে এবং হয়।
কিন্তু সমগ্র বিশ্ব থেকে যখন আমরা মানবকুল সবকিছু ছেড়ে ছোট একটা গন্ডি শুধুমাত্র গুটিকতক আপনজনের পরিসীমায় আবদ্ধ করে একটা মায়াজাল আবিষ্ট করি, তখন দিনের সবকাজ শেষ করে যখন নীড়ে ফিরে এসে হিসাব কষি, তখন সামনে এসে দাঁড়ায় আরেকটি নদী। হয়ত তাঁর নাম “মন-নদী’। এই নদীতে চলমান জলের প্রবাহ নেই, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার নেই, পাহাড় নেই, আকাশ নেই, কিন্তু তারও আছে অনেক তীর। যা কখনো শান্তির মহাখুশিতে জলের ধারা বইয়ে চিকচিক করে জানান দেয়, ‘যা চেয়েছি তাই পেয়েছি’। আবার কখনো কখনো দুঃখের সীমাহীন যন্ত্রনায় সেই একই নদী তার দুই তীর জলের ধারায় শিক্ত করে নীরবে বলে যায়, ‘বড় যন্ত্রনায় আছি’। হয়ত তখন আমরা বলি, দুই নয়নের ধারা। নিজস্ব গন্ডির এই পরিসীমায় এই নদীর একক ধারক বাহক শুধু কিছু আপনজন, নিজে আর ব্যক্তিসত্তার অজানা উপাদানের সব সমীকরন। এখানে ঈশ্বর বাস করেন ক্ষনেক্ষনে, আবার ঈশ্বর উধাওও হয়ে যান ক্ষনেক্ষনে। এখানে ছোট গন্ডির গুটিকতক আপনজনের সার্থকতা, ব্যর্থতা, ভালোবাসা, দায়িত্বশীলতা, নির্ভরতা সবকিছু একেবারেই নিজস্ব। সমগ্র মানবকুলের হিসাব কিতাবের সাথে, সুখ দুঃখের সাথে, চাওয়া পাওয়ার সাথে, লাভ লোকসানের সাথে সব কিছু মিশে থাকে।
এই নদীতে বাস করে “আমি”, আমার আমিত্ত আর আমার চারিধারের সব আমারত্ত। আর কেউ নেই। এখানে ঈশ্বর আমি, এখানে নিয়মের কোন বালাই নেই। এখানে আকাশের রঙ আমার নিজের মতো করে বানানো, আমার নদীর জল আমার ইচ্ছায় যখন যেভাবে খুশি প্রবাহিত হয়। এখানে আমার ইচ্ছাটাই সব। এখানে আমার ছোট ডিঙ্গী কখনো উজানে, কখনো ভাটিতে, কখনো নিরুদ্দেশে, কখনো জনসম্মুখে, কখনো কাছে কখনো দূরে যেথায় খুশী সেখানে আমার বিচরন। কাউকে আমার কিছু যেমন বলার নেই, কারো কোনো কিছুই আমার পরোয়া করারও কোন প্রয়োজন নেই। এখানে আমার কোন দায়িত্ববোধ নেই, আমার দায়িত্বও কারো উপর নেই। এখানে আমার সব নদীর উপস্থিতি যেমন আছে, তেমনি কোনো নদীর উপস্থিতিও আমাকে বিচলিত করে না। একদিক থেকে দেখলে এই নদীর কোন তীর নেই আবার আরেক দিক থেকে অনুধাবন করলে হয়ত দেখা যাবে এর আছে অজস্র তীর। কখনো উল্লাশের তীর, কখনো আনন্দের তীর, কখনো ব্যর্থতার তীর, কখনো সব হারিয়ে এক অবসন্ন জীবনের তীর। এখানে এই তীরে কেউ প্রবেশের অধিকারও নেই। এখানে আমার রশদের কোনো প্রয়োজন নেই, এখানে সর্বত্র আমি। আমি কি করতে পারতাম, কি করা উচিত ছিলো, কে কি করতে পারতো, কোথায় আমি ভুল করেছি, কোথায় আমার সার্থকতা ছিলো, কি আমার ভুমিকা হতে পারতো, কিংবা কি কারনে আমি আমার সবকিছু নিঃস্বার্থভাবে ছেড়ে আমি আমার তৃতীয় এই নদীতে একা পড়ে আছি, তার কোনো ব্যখ্যা আমি আর খুজতে চাই না। হয়ত কেউই এর কোনো উত্তর মেনেও নিবে না।
এখন আরেকটি প্রশ্ন মনে আসে। তা হলো, এই তৃতীয় নদীটি কোথায়? কারো কাছে এই তৃতীয় নদীটি হয়ত বাস্তবের কোনো এক বিশাল জল প্রবাহমান নদীর বুক, কারো কাছে হয়ত বা ঘন গাছপালায় পরিবেষ্টিত এক নির্জন জঙ্গল, কারো কাছে হয়ত বা এই বিশাল মানবকুলের ঘনবস্তির মধ্যেও একা কোনো জগত। কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই বা করুক, এই নদী সবার আছে, কেউ তাকে গ্রহন করে, কেউ এর সন্ধান জানেও না। এই নদীতে ঝাপ দেওয়ার সামর্থ্য সবার থাকে না। কারন এর যেমন কোনো দৃশ্যমান তীর নেই, আবার সব তীরের ঘাটও এক রকম নয়। এর জলের রঙ সবনদীর মতো নয়। এর কোনো ঋতু নেই, যখন তখন বৃষ্টি, ঝড়, উল্লাস, আনন্দ, কান্না, পরিহাস সবকিছু ঘটে। আর এর একচ্ছত্র অনুভুতি, আস্বাদ, ইতিহাস শুধু নিজের আর কারো নয়। এই তৃতীয় নদীর কিনারে বসে শতবর্সী বয়োবৃদ্ধা তাঁর বাল্যকালের স্বপ্ন দেখেন, আবার কারো কারো অজান্তেই এই নদীর বালুচরে হেটে হেটে কোনো এক উদাসীন কিশোর তাঁর কল্পনার জগত পেরিয়ে শত বর্স পেরিয়ে কোনো এক জন বসতীর সপ্নজাল বুনন করেন। কেউ ফিরে আসে, কেউ আর ফিরে না। এই নদীর তীরে বসা সবাই একা, সবাই সুখী, আবার সবাই বিরহীর মতো। অথচ এতো কাছাকাছি থেকেও এদের মধ্যে কেউ সখ্যতা করেন না, কেউ কাউকে সম্মোহনও করেন না। যেদিন এই মন-নদী অবশান হয়, সেদিন সব তীরের ধারা একসাথে মন-নদীর সাথে তিরোধান হয়। হয়ত তখন হুয়াও হুইমারেস রোসা্র লেখা “নদীর তৃতীয় তীর”টি আর কারো গোচরীতভুতও হয় না। সময়ের বিবর্তনে আমরা সবাই ঐ জেলের মতো হয়ত কোনো কোনো তীর থেকে খসে পড়ি। বৃন্তচ্যুত কলির তীরখসা জীবনের অজস্র তীরের যখন একচ্ছত্র ভিড় ঘনীভুত হয় মহামিলনে বা মহাবেদনায় অথবা মহাপ্রলয়ে, তখন চৈত্রমাসের তাপদাহের পর বৈশাখের কালো হিংস্র ঝড়ে তান্ডবের মতো আমরা শুধু সেটাই দেখি যা শ্রাবনের অঝরধারায় এই মাটির ধরায় সবার পায়ে, মনে, ঘরে বা মানসপটে ভেসে উঠে।
হুয়াও হুইমারেস রোসা্র লেখা নদীর তৃতীয় তীর, হয়ত সেই নদীর কথাই বলেছেন
১৩/০২/২০১৭-যদি
Categories
“যদি” এমন একটি শব্দ যা অতীত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান এই তিনকালের সব কৈফিয়তের এক আওয়াজ। কোনটা কি করা হলে কি হতে পারতো, কোনটা কি না করা হলে কি না হতে পারতো, এটা না ওটা অথবা ওটা নয় এটা করা হলে ফলাফল কি দাড়াতো ইত্যাদির একটা তুলনামুলক বিচারের প্রয়াস মাত্র। কিন্তু এতে অতীত, কিংবা বর্তমান কিংবা ভবিষ্যৎ কোনোকালের জন্যই বিশেষ কিছু পরিবর্তন আনেনা। তবে এই “যদি” থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্য কেঊ উপকৃত হতে পারে তাতে অনেক কিছুর দ্বন্দ্ব মিটে যায়। আসলে “যদি” একটা অভিজ্ঞতার নাম, “যদি” একটা সময়ের নাম। “যদি” একটা অধ্যায়ের নাম। এই “যদি” থেকে অনেক কিছু শেখার যেমন আছে, তেমনি, এই “যদি” থেকে অনেক ভোগান্তিও আছে।
সময়ের স্রোত ধরে মানুষ যখন আজকের বর্তমানকে পেড়িয়ে আগামীকালের বর্তমানে পদার্পণ করে, তখন এই “যদি” এসে সামনে দাঁড়ায়। সাফল্য আর ব্যর্থতার মাঝামাঝিতে দাঁড়িয়ে “যদি” শুধু এটাই বুঝাতে চায়, “যদি” এইটা এইভাবে না করে ঐভাবে করা হতো, “যদি” অমুকের সাথে ঐ সময় দেখা না হতো কিংবা “যদি” অমুকের সাথে দেখা না হয়ে অন্য কারো সাথে দেখা হতো? “যদি” আরেকটু সাবধান হওয়া যেতো? “যদি” আরো বেশী মনযোগী হয়ে ঐ কাজটা না করে সেই কাজটা করা যেতো? “যদি” এটা না করে ওটা করা হতো ইত্যাদি ইত্যাদি তাহলে হয়ত আজকে যা ঘটছে বা ঘটেছে, সেটা থামানো যেতো কিংবা ফলাফল আরো ভালো হতো। এই “যদি” বড় কঠিন সেতু যাকে ভর করে আর কখনোই সামনে যাওয়া যায় না। অথচ এই “যদি” যদি ঐ সময় ভাবা হতো, তাহলে জীবনের অনেক কিছুই পালটে যেতো। আমরা সবাই এই “যদি”র কাছে সব সময় হেরে যাই।
আজকে মনের ইমোশনাল বিচারে যা করতে হয়েছে, বা করে ফেলা হয়েছে, তখন মনে হয়, আহা “যদি” ঐ সময় এই ইমোশনালটা না হতাম, যদি ঐ কাজটায় আমি বা আমরা আরো কিছু সময় দিয়ে একটা উপায় বের করতাম, যদি আরেকটু সহনশীল হয়ে এইটা না করে ওইটা করতাম, তাহলে হয়তো জীবনটা অন্য রকম হতো। হয়তো এখন যা হয়েছে, তার আর কিছুই হতো না। হয়ত জীবনটাই পালটে যেতো। আজকে যাকে আমার একেবারেই সহ্য হচ্ছে না, যাকে নির্মুল করার জন্য আমি প্রানপনে চেষ্টা করছি, আহা, ‘যদি” ঐ সময়ে ঐ মানুষটির সাথে আমি আরো গভীরভাবে সবকিছু শেয়ার করে সব মিটিয়ে নিতাম, হয়তবা আরো কতই না ভালো হতো। আর এটাই হচ্ছে এই “যদি”র চরিত্র। “যদি”টা সব সময় “যদি”র মধ্যেই থাকে। যারা এই “যদি”কে কাজে লাগায়, তারা ভিন্ন ভিন্ন পথে এবং ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অনেক নতুন নতুন পথের সন্ধান পায়।
“যদি” একটা কম্প্রোমাইজের নাম। “যদি” দ্বারা কেউ যদি কম্প্রোমাইজ করে, সেটা ভবিষ্যতের বড় হারের চেয়ে লাভজনক। “যদি” একটা বিকল্পের নাম। এই যদি দ্বারা অনেক কিছুই শামাল দেওয়া সম্ভব। আর শামালের আরেক নাম “সময়কে ঠেক দেওয়া”। সময় পাল্টায়, আর সময় যখন পালটে যায়, তখন এই অনেক কিছুই আর আগের মতো থাকে না। আজ যে পরিবেশটা অনেক অসহনীয় মনে হয়, সময়ের সাথে সাথে এই পরিবেশ অনেক সহনীয় হয়ে উঠে। আর সহনীয় সময়ের মধ্যে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়। “যদি” থেকে শিক্ষা নেওয়া মানুষ ধৈর্যশীল হতে শিখে। আর ধৈর্যশীলরাই জয়ী হয়।
১৯/০২/২০১৭-রিলেশনশীপ রুলস
Categories
পৃথিবীটা অদ্ভুত একটা অদৃশ্যমান সম্পর্কজনিত তত্ত্বে একে অপরের সাথে এমনভাবে জরিয়ে পেচিয়ে আছে, যা কোনো থিউরী বা সংজ্ঞা মেনে চলে না। প্রতিটি সম্পর্ক একেকটা একেক ধরনের। বৈশিষ্ট আলাদা, এর সাধ আলাদা, মাহাত্য আলাদা, সংজ্ঞা আলাদা, এবং তাদের যন্ত্রনাও আলাদা। মায়ের সাথে বাবার, বাবার সাথে ছেলেমেয়েদের, ছেলেমেয়েদের সাথে পরিবারের, স্বামীর সাথে স্ত্রীর, এক বাড়ির সাথে আরেক বাড়ির, এক পাড়ার সাথে আরেক পাড়ার, এক সমাজের সাথে আরেক সমাজের, দেশ থেকে দেশান্তরের, এমন কি মানুষের সাথে অন্য প্রানীকুলের, জীবিতদের সাথে মৃতদের, শত্রুর সাথে মিত্রের, কিংবা মিত্রের সাথে মিত্রেরও, আরো কতোই না সম্পর্ক। বিধাতার সাথে তার সৃষ্টির সম্পর্কও আরেক পদের। সব সম্পর্কের জন্য একই রুল হতে পারে না, এবং হবেও না। সময়ের পথ ধরে মানুষ এইসব সম্পর্কগুলো নিয়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন চরিত্রের মানুষের জন্য একেকবার একেক রকমের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে কেউ বানী দিয়েছেন, কেউ তত্ত্ব দিয়েছেন, কেউ বা আবার তথ্যের উপর ভিত্তি করে অনেক থিউরীও দিয়ে গেছেন। সবার জ্ঞ্যান, বয়ান, অথবা থিউরী যে সবসময় কোনো একটা নির্দিষ্ট “সম্পর্কের” ক্ষেত্রে সঠিক, সেটাও যেমন শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যাবে না আবার একেবারে সঠিক নয়, এটাও বলা যায় না। যে পরিস্থিতিতে যে সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে কোনো এক ভোক্তভুগী আজ যে ব্যর্থতার মন্তব্য করে গেলেন, ঠিক সেই পরিস্থিতিতে সেই একই প্রকার সম্পর্কের উপর আরেক ভোক্তভুগী হয়ত সাফল্যের কথা বলে যাবেন। অথবা এমনো হতে পারে, আজ যে পরিস্থিতিতে কোনো এক সম্পর্কের মধ্যে ফাটল হয়েছে বলে বলা হলো, হয়তবা সেই ফাটল থেকে ভাঙ্গন-রক্ষার বিকল্প তরিকা আরোপ করে আরেকজন অনায়াশেই উতরে যেতে সক্ষম হন। তাহলে প্রশ্ন আসে, “রিলেসনশীপ রুলস” বলে কি কিছু আছে? কিসের উপর দাঁড়িয়ে একই প্রকার একটা সম্পর্ক সম্বন্ধে সাফল্যের কথা বলে আর কিসের উপর ভিত্তি করে আরেক জন ব্যর্থতার কথা বলে?
প্রত্যেকটি সম্পর্ক একটি স্বাধীন সত্ত্বার মধ্যে, নিজের কাল্পনিক গন্ডির মধ্যে বসবাস করে। মা হবার আগে, মেয়েদের মা হওয়ার কল্পনা আলাদা, বিয়ের আগে যুবতীদের তাদের স্বামীর সাথে কি রকম সম্পর্ক হবে তার ভাবনা আলাদা। কিংবা শাশুড়ি হবার আগে প্রতিটি মেয়েদের একটা নিজস্ব এই কাল্পনিক গন্ডির উপাদানগুলি প্রকৃতপক্ষে সবই অদৃশ্যমান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কল্পনার জগতের সাথে এই বাস্তবের সম্পর্কগুলির মিলমিশের মধ্যে অনেক ফারাক। আর এই ফারাক থেকেই শুরু হয় যতো অঘটন। যদি অন্যভাবে বিশ্লেষণ করা যায়, দেখা যাবে, এর মধ্যে আছে প্রতিটি সত্ত্বার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ, আছে শালিন-অশালীনতার সীমাবদ্ধতা, আছে ইচ্ছা-অনিচ্ছার গ্রহনযোগ্যতার মাপকাঠি, আছে মেজাজ-মর্জির একটা রুপরেখা ইত্যাদি। যেমন, কেউ লাল রঙ পছন্দ করে, আবার তার সাথে এমন একজনের সম্পর্ক হয়েছে যিনি লাল পছন্দ করেন না, তিনি পছন্দ করেন নীল কিংবা সবুজ। কেউ ঝাল খেতে পছন্দ করেন কিন্তু তার সাথে এমন একজনের সম্পর্ক হয়েছে যিনি ঝাল তো পছন্দ করেনই না, হয়ত পছন্দ করেন কড়া মিষ্টি। সারাক্ষন ঘুরতে পছন্দ করা কোনো এক সুন্দরী রমনীর হয়তো স্বামী জুটেছে অলস এক কালো মানুষের যিনি সময় পেলেই হয়ত ঘুমাতে পছন্দ করেন। স্ত্রী ভেবেছিলেন তার স্বামী হবে এইরকম, কিন্তু হয়ে গেছে অন্যরকম, স্বামী ভেবেছিলেন, তার স্ত্রী হবে এই রকম, কিন্তু হয়ে গেছে দাপটে। দুই বন্ধু এক সঙ্গে কতই না দিন রাত এক সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন ছোটবেলায়, এখন এক বন্ধু আরেক বন্ধুর থেকে অনেক উচু স্তরের বাসিন্দা। এখন দেখা করতেও প্রোটোকল লাগে। মা ভেবেছিলেন, সন্তান বড় হয়ে তার সব দুঃখ ঘুচে দেবেন, কিন্তু ছেলে বড় হয়ে এখন আর মায়ের সেই গ্রামিন হাতে ভাত খেতেও পছন্দ করেন না, সঙ্গে জুটেছে আবার আধুনিকা বউ। বউ মনে করে, ঐ গ্রাম্য অশিক্ষিত মায়ের আবার এতো যত্নপাতি করার কি আছে? এই যে অসম চাওয়া এবং পাওয়া, এরই মধ্যে প্রকৃতপক্ষে লুকিয়ে আছে সম্পর্কের যত অঘটন। তাহলে এই অসমগুনের অধিকারী মানুষগুলির মধ্যে কি সব সম্পর্ক সব সময়ই ভেঙ্গে যাবে? তাইতো যাওয়ার কথা। ঘুমে নাক ডাকেন এমন স্ত্রীর স্বামী তো তাহলে কখনোই একসাথে নির্ভেজাল ঘুমে আচ্ছন্ন হতে পারবেন না। শিক্ষিত আধুনিকা বউ যেমন অশিক্ষিত গ্রাম্য শাশুড়িকে শামাল দিতে পারছেন না, তাহলে তো সব কিছুই ভেঙ্গে যাওয়ার কথা! ফলে কিছু কিছু সম্পর্ক ভেঙ্গেই যায় আবার কিছু কিছু সম্পর্ক টিকে থাকার জন্য লড়াই করে যায়। আবার এরই মধ্যে কিছু কিছু সম্পর্ক কোনো অঘটন ছাড়াই জীবনের শেষ অবধি টিকে যায়। তাদের এই এহেনো পরিস্থিতিতে তাদের কিছু অভিজ্ঞতার আলোকে এই সব সম্পর্কের জন্য “রিলেসনশীপ রুলস” নামে কিছু তত্ত্ব, তথ্য, থিউরী দিতেই পারেন। হোক সেটা সাফল্যের বা ব্যর্থতার। তাদের এইসব অভিজ্ঞতার থিউরী তাহলে কি আমরা সর্বত্র এই জাতীয় সম্পর্কের বেলায় শতভাগ কার্যকরী এবং নিয়ম বলেই মেনে নেবো?
যদি তাইই হতো, তাহলে নব্বই বছরের বৃদ্ধ মানুসটি কোন কারনে আশি বছরের থুড়থুড়ে মহিলার প্রেমে তখনো হাবুডুবু খাচ্ছেন? ঐ আশি বছরের মহিলার তো আর রূপ, যৌবন, প্রজনন ক্ষমতার কিছুই বাকী নাই। তার উপর তারও তো এমন অনেক কিছুই ছিলো যা তারসাথে এতো বছর ধরে ঘর করা মানুষটির অনেক কিছুই মিল ছিলো না। তাহলে কেনো টিকে গেলো ঐ সম্পর্ক? কিংবা এমন এক যুগল দম্পতির বন্ধন যেখানে স্ত্রী কিংবা স্বামী দিনের পর দিন পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন, অথচ ভালোবাসার মহব্বত দিয়ে স্বামী কিংবা তার স্ত্রী তাদের সংসার, পরিবার একত্রে ঐ অবস্থায়ই আগলে রেখেছেন। সেটা কিসের আশায়? নিশ্চয় এমন কিছু কারন থাকে যেখানে কম্প্রোমাইজ নামক বস্তুটি কিংবা এডাপ্টেসন নামক তত্ত্বটি খুব জরুরী। তা না হলে কানা এক কালো মহিলার সাথে বোবা এক স্বামীর ঘরতো কখনোই টিকে থাকার কথা নয়! অথবা যদি অন্যভাবে বলি, কি কারনে পঞ্চাশ বছর বৃদ্ধার সাথে ভাষাহীন এক বছরের কচি ছোট শিশুর কি কথা হয় যেখানে দুজনেই আনন্দে ফেটে পরেন? অথবা কোন রিলেসনশীপ রুলের আওতায় একটি বন্য প্রানির সাথে একজন মানুষের সখ্যতা হয়? প্রেম ভালোবাসা সবসময় একই ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে একজনের সাথে আরেকজনের সম্পর্ক গড়ে উঠে না। একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের মিলের থেকে অমিলটাই বেশি, তারপরেও বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে একে অপরের জন্য কোনো না কোনো একটা মাত্র ফ্যাক্টরের উপরও সম্পর্কটা টিকে রাখা যায়। যারা পারে না, তাদের ইতিহাস কেউ মনে রাখে না। আর যারা পারে, তারাই হন এই সমাজের একেকজন প্রতিনিধি যারা “রেলেসনশিপ রুল” শাসন করেন। যে ঘর একবার ভাঙ্গে, তা বারবার ভাঙ্গার প্রবনতার মধ্যে থাকে। যে সম্পর্কের ভীত একবার নড়ে যায়, তার ভীত বারবার নড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
তাহলে এখন বিশাল এক প্রশ্ন মানবকুলের সামনে এসে দাঁড়ায়। আর তা হলো, তাহলে কি “রিলেশনশিপ রুলস” বলতে কিছুই নেই? অথবা রিলেশনশীপ রুলসটা কি? আমার মতে, এটা হচ্ছে নিজের সাথে নিজের সমঝোতা। এই সমঝোতার কথা বললে আরেক ধাঁধা সামনে আসে, কি সেই সমঝোতা?
কোনো এক লেখায় আমি একবার বলেছিলাম, “সময় পাল্টায়”, এখন বলছি, সময় পালটায় না, সময় চলে যায়। আর এই চলে যাওয়া সময়ের প্রেক্ষাপটে অনেক কিছু পাল্টায়। পাল্টায় মানসিকতা, পাল্টায় বোধ, পাল্টায় দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি। আর এই পাল্টানোর মধ্যেই আমরা বলি, সময় পালটেছে বলে এটা হয়েছে। সময়ের প্রতিটি ক্ষনের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিচক্ষনতার পরিবর্তন হয়, ধৈর্যের পরিবর্তন হয়, সাথে সাথে নিজের আত্মম্ভরিতাও বদলে যায়। এই পরিবর্তনের জন্য সময়ের দরকার। কারন সময় মানুষকে নিয়ন্ত্রন করে ইমোশনালী, সময় মানুষকে বুঝতে শিখায় কোনটা বন্য, আর কোনটা অদম্য। সময়ের সাথে সাথে মেধার বিকাশ ঘটে। আর এই মেধাই হচ্ছে সমঝোতার প্রথম নিয়ন্ত্রিত রেখা যার মাধ্যমে অন্যান্য অনিয়ন্ত্রনযোগ্য উপাদানগুলিকে নিয়ন্ত্রন রেখে আপাতদৃষ্টির অনিয়ন্ত্রিত আরেকজনের অদম্য বন্য উচ্ছ্বাসকে মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে প্রতিকুল পরিবেশের বিরুদ্ধে পজিটিভ চিন্তাশীল মন তৈরী করে। আর এই চিন্তাশীল মন নিয়ে কারো জন্যই কখনো দ্বার রুদ্ধ না করে প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টার নামই হচ্ছে সমঝোতা। এখানে সবার দেওয়া উপদেশ বা বয়ান করা “রিলেশনশীপ রুলের” কথা শুনার দরকার আছে, বুঝতে হবে কিন্তু সব সময় তা মেনে নিয়ে ঐ মোতাবেক কাজ করতে হবে এমন যেন না হয়। একটা কথা সব সময় মনে রাখা দরকার, অন্যের দেওয়া থিউরী যে আপনার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে, অন্যের দেওয়া উপদেশটাই যে সঠিক উপদেশ সেটা আজ পর্যন্ত কেউ গ্যারান্টি দিতে পারে নাই আর পারবেও না। জীবন একটাই। আর এই জিবনে সব বন্ধুরুপী মানুসগুলিই আপনার সব সময়ের বন্ধু, তা ঠিক নয়। মনে রাখা দরকার যে, সপ্তাহের সবদিবসই আপনার জন্য হাসি নিয়ে আসার কথা নয়, সব ঋতুই আপনার জন্য নীল আকাশ নিয়ে আসার কথা নয়। এখানে যেমন কান্না থাকে, তেমনি থাকে হাসিও। কেউ কান্না নেবেন না, শুধু হাসিটুকুন নেবেন, তার জন্য ঐ হাসি সঠিক আনন্দের নাও হতে পারে।
পরাজিত কমান্ডারের অপারেসনাল প্ল্যান যতোই ভালো থাকুক, আর জয়ী কমান্ডারের পরিকল্পনা যতোই খারাপ হোক, পৃথিবী সবসময় জয়ী কমান্ডারের পক্ষেই ইতিহাস লিখে। আর সেটাই হয় বেস্ট প্ল্যান। পরাজিত মানুষের কথা কেউ শুনে না, সেটা আপনি যেভাবেই যাকেই বলুন না কেনো।
ফলে কখনো কোনো দ্বার রুদ্ধ করবেন না। খোলা রাখুন সব দ্বার। হতে পারে, এই খোলা দ্বারের মাধ্যমেই একদিন সেই আলো এবং বাতাস প্রবেশ করবে যা আপনি অনেকদিন আগে চেয়েছিলেন। আজকে যাকে আপনি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী বলে তার হাত ধরে বসে চোখের জল ফেলছেন, হয়ত সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে দেখবেন, সেই আসলে আপনার আজকের দিনের সব সম্পর্কের ছেদনের মুল হোতা। মানুষকে ঈশ্বর এমন করে বানিয়েছেন, মানুষ এবং অমানুষের সব কিছু দেখতে এক রকমের, শুধু বুঝার জন্য মেধার প্রয়োজন। আর এই মেধা আসে সময়ের পরিবর্তনের সাথে। অপেক্ষা করুন, সময় পাল্টাবে। কারন সময় পিছিনে ফিরে না, কিন্তু সম্পর্ক যেখান থেকে তাল কাটে, তার থেকে আবার পিছনে ফিরে আসতেই পারে। ধৈর্য ধরুন, পুরু ব্যাপারটা নিয়ে নিজে ভাবুন, অনেক জটলা খুলে যাবে। দর কষাকষির মতো নিজের সাথে সম্পর্ক টিকে রাখার জন্য যুক্তি চালাচালি করুন। নিজেকে উভয় পক্ষের লোক হিসাবে ভাবুন। দেখুন, যে ব্যাপারটা আপনি ছাড় দিচ্ছেন না, সেটা অন্য পক্ষে আপনি থাকলে ছাড় দিতেন কিনা। যাদের আপনি কখনো দেখেন নাই, এমন কিছু ভাল বয়স্ক মানুষের সাথে ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলুন। দেখবেন, কোথায় ছাড় দেওয়া যায়, আর কোথায় কম্প্রোমাইজ করা যায়। উদ্দেশ্য একটাই, লক্ষ ঠিক রাখুন যাতে একবার সম্পর্ক করে ফেলার পর ভাঙতে না হয়। প্রয়োজনে সম্পর্ক করার আগে সম্পর্ক ভাঙ্গার কারন গুলি সাব্যস্থ করুন যেনো সম্পর্কই তৈরী না হয়। আর একবার তৈরী হয়ে গেলে তাকে বাচানোর চেষ্টা করুন। কারন, আপনি সম্পর্ক ত্যাগ করলেও কেউ না কেউ তার সাথে আবার নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠবেই, আর যদি ঐ সম্পর্ক টিকে যায়, তবে বলতে হবে, আপনার মধ্যেই ভুল ছিলো।
তবে এখানে আরো একটা বিশেষ কথা না বললেই নয়। যখন এতো কিছুর পরও মনে হবে, না, এই সম্পর্কটা রাখা যাবে না। যেটুকু সময় অপচয় করলে সম্পর্কটা টেস্ট করা যেতো বলে সাব্যস্থ্য হচ্ছে, সেইটুকু সময় আপনার হাতে নাই। আর সেই সময়ের মধ্যে এটারও কোনো গ্যারন্টি নাই যে ব্যাপারটা সাফল্যের মধ্যেই সমাপ্ত হবে। অথবা এমন একটা আভাস থেকেই যায় যে, সম্পর্কটা বিফলেই যাবে, সেক্ষেত্রে যতো দ্রুত সম্ভব এই ব্যর্থ সম্পর্ক থেকে মুক্তির যতোগুলি পথ খোলা আছে, অত্যান্ত আন্তরিকতার সাথে সেগুলিকে বাস্তবায়ন করে এই ব্যর্থ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়া। তাতে মুক্ত পরিবেশে, মুক্তমনে নতুন করে চিন্তা করার অবকাশ থাকে। শুধু একটা নতুন পরিবেশে, ভেঙ্গে যাওয়া মানসিক পরিস্থিতিতে কাউকেই দোসারুপ না করে পুনরায় এই ভুল সম্পর্ক যেনো না হয় তার জন্য অনেক বেশি সতর্ক থাকা এবং চারিপাশ বিবেচনা করে পুনরায় নতুন কোনো আবেগী সম্পর্কে জড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ। হুট করে কোনো আবেগী সম্পর্ক করা থেকে বিরত থাকা খুব জরুরী। এছাড়া আরো একটি বিষয়ে খুব সতর্ক থাকা জরুরী যে, ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্ক নিয়ে আর নতুন করে কোনো প্রকারের ভাবা উচিত না। “যদি” দিয়ে আর কোনো উপসংহার টানা উচিত হবে না। কে ঠকেছে আর কে জিতেছে এর কোনো তুলনা করা যাবে না। কোনো সম্পর্ক নষ্ট হলে দুই পক্ষই হারে বা ঠকে এটাই ফলাফল।
রিলেসনশীপ রুলস বলতে আসলে কিছু নাই। যেটা আছে, সেটা হচ্ছে আপনি কি চান। আর কিভাবে চান। যদি আপনার স্বাধীন চিন্তা করার শক্তি না থাকে, যদি এমন কোনো ব্যক্তির প্ররোচনায় আপনি আপনার সম্পর্ক কে মুল্যায়ন করেন, কিংবা যদি এমন হয়, আপনি কি করবেন, কিভাবে করবেন, কার সাথে কত টুকু করবেন, এই আশায় আপনার নিজের সম্পর্কের উপর অন্যের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন, তাহলে আপনি নিসচিত থাকুন, আপনার কোনো সম্পর্কই কখনো ভালো যাবে না। সেটা আপনার বন্ধুর বেলায়ই হোক, নিজের স্ত্রীর বেলায়ই হোক, অথবা মা বাবা ভাইবোনের বেলায়ই হোক। সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকে।
খোলা হাতে বেচে থাকার চেয়ে কারো হাত ধরে বেচে থাকার নাম হচ্ছে জীবন। ঝগড়া করার জন্য হলেও একজন মানুষ লাগে। একবার যদি সব শেষ করে দেওয়া হয়, হয়ত অনেকদিন পর নিজে কে নিজে প্রশ্ন করবেন, আহা “যদি” এমনটি না করে এমন টি করতাম, “যদি” আরেকটু নমনীয় হয়ে প্রকৃত জিনিষটা বুঝার জন্য সময় নিতাম, “যদি” এইটা না ভেবে ঐটা ভাবতাম, “যদি” ঐ লোকগুলি আমার জীবনে না এসে অন্য কেউ আমার জিবনে আসতো। অথবা “যদি” আমি ঐ সব লোক গুলিকে না শুনতাম ইত্যাদি।
কিন্তু তখন এই “যদি”র উত্তর আর কেউ দেবার জন্য বসে নাই। কিন্তু সেই ঝগড়া করার মানুসটি যদি আপনাকে প্রতি নিয়ত শুধু ঝগড়াই দিয়ে জীবন আরম্ভ করে আর ঝগড়া দিয়েই জীবন শেষ করে, তাহলে বুঝবেন, সম্পর্কটা ভুল। তখন শুধু একটা কথাই মনে হবে, আহা, যদি এই সম্পর্কটা নাহতো, যদি ওই মানুসটির সাথে কখনোই দেখা না হতো, আহা যদি আরো আগে সব বুঝতে পারতাম, তাহলে হয়তো সম্পর্কটাই করা হতো না। কিন্তু আম্রা দেবতা নই, আমরা ভুল করি, ভুল হাত ধরার চেয়ে ভুল হাত ছেড়ে দেওয়া অনেক উত্তম। আর ভুল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নামই হচ্ছে প্রানি।
০৪/১২/২০১৬-ইমোশনাল ম্যানেজমেন্ট
Categories
আমি ঠিক জানি না ইমোশনাল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে মন্তব্য করাটা কতটুকু যুক্তি আছে বা আদৌ কোন যোগ্যতা আমি রাখি কিনা। কিন্তু প্রতিদিন আমার চারিপাশে যা দেখছি, যা ঘটছে, যে ভাবে ঘটছে আর এর বিপরীতে প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি পরিবার, তথা সামাজিকভাবে প্রতিটি স্তর যেভাবে সাফার করছে, তাতে মনে হয়, কোথাও কিছু অসঙ্গতিমুলক রীতি, নীতি এবং সর্বোপরি কিছু বাহ্যিক আচরন কাজ করছে। ফলে প্রতিনিয়ত যারা এর প্লেয়ার এবং যারা এর ভিক্টিম তারা উভয়ই নিজ নিজ চেষ্টায় পরিত্রান পাওয়ার আশা করলেও আশারুপ কোনো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছেনা। আর এ কারনে প্রতিনিয়ত ছোট বালক থেকে শুরু করে প্রবীন বয়স্ক মানুষটিও ক্রমাগত অস্থিরতায় ভোগছেন, সংসারে শান্তি নষ্ট হচ্ছে, পারিবারিক বন্ধন ঢিলে হয়ে যাচ্ছে, আর বাড়ছে ক্রমাগত সামাজিক ক্রাইম এবং জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ। এর থেকে কি পরিত্রানের কোনো উপায় নেই? এই আপদ কি তাহলে হুট করে সৃষ্টি হয়েছে? নাকি এই আপদ আগেও ছিলো, তবে তা নিয়ত্রনে ছিলো বিধায় চোখে পড়ে নাই? অথবা এমন কি কিছু যে আধুনিক সভ্যতার বিকাশের পাশাপাশি এটা ধ্বংসের দিকেও এগিয়ে যাচ্ছে?
বিষয়টি আলোকপাত করার আগে আমি “ইমোশনাল” অনুভুতিটি নিয়ে একটু সংক্ষিপ্ত ভাবতে চাই। এই “ইমোশনাল” বিষয়টি আসলে কি? সবাই মাঝে মাঝে কথায় কথায় কাউকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শুনা যায়, বলেন যে, লোকটি “ইমোশনালি বায়াসড” কিংবা ছেলেটি একটু বেশী “ইমোশনাল”। এটা কি এমন যে, নদী দেখলেই উদাসীন হয়ে যাওয়া, কিংবা সবুজ ঘাসের মাঠ দেখলেই অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া, কিংবা এটা কি এমন যে, বাবা তার কোন সন্তানের জন্য একটা উপহার নিয়ে আসলেন তো আরেকজনের জন্য আনতে পারলেন না বলে, যে পেলো না সে দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে মন খারাপ করে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকা? অথবা এটা কি এমন কিছু যে, পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করার কারনে মন খারাপ করে আত্তহত্যা করা? অথবা এটা কি এমন কিছু যে, আমার ভালো লাগলো না বলে আমি অন্য কারো মতামতের তোয়াক্কা না করেই উলটা পালটা ব্যবহার করা?
ব্যাপারটা মনে হয় ঠিক এই রকম নয়। আমি ব্যাপারটাকে যেভাবে দেখি সেটা হচ্ছে, “ইমোশনালী বায়াসড” বলতে যেটা বুঝি তা হচ্ছে, যেই বয়সে যে মানুষটি যেভাবে কোনো একটা বিষয় যতটুকু বাস্তবতার সাথে তার বুদ্ধি বিবেচনায় বুঝে তা মেনে নেওয়া দরকার বলে একটা মানদণ্ড থাকে কিংবা সেই মানদণ্ড মোতাবেক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে সবাই মনে করেন, সেটা না করে কেউ যদি যুক্তির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে তার স্বার্থের জন্য, লোভের জন্য, আনন্দের জন্য, কিংবা যে কোনো মুল্যেই হোক সেটা তার পেতে হবেই বলে ঘাট বেধে বসে থাকেন, তাহলেই আমি ধরে নেবো সে ইমোশনালী বায়াসড হয়ে আছেন। মানতে চাইছে না, শুনতে চাইছে না, কিংবা বাস্তবতা বুঝতে চাইছে না। তার মানে কি দাড়ালো? এটা কোন বয়সের মধ্যে পড়ে না। এটা যে কারো ব্যাপারে প্রযোজ্য হতে পারে। হতে পারে পাচ বছরের বাচ্চার ক্ষেত্রে, হতে পারে বারো বয়সের কোন উঠতি বয়সের যুবক- যুবতীর ব্যাপারে, হতে পারে প্রবীন কোনো বয়স্ক লোকের ব্যাপারেও। স্থান কাল পাত্র ভেদে এবং বিষয়ের উপাদানের উপর বিভিন্ন বয়সের মানুষদের জন্য এই ইমোশনাল শব্দটি খাটে।
একটা উদাহরন দেই। ধরুন, আপনি একজন মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ। মাসের উপার্জন আপনি প্রতিটি বিষয়ে এমনভাবে হিসাব করে করতে হয় যে, কোন কারনে যদি কখনো তার বাইরে কোন ইভেন্ট চলে আসে, তাহলে আপনার পুরু সংসারের হিসাবে একটা আমুল পরিবর্তন করতে হয়। পরিকল্পনা করেছিলেন, আপনার বারো বছরের ছোট বাচ্চার এ মাসে জন্মদিনের পার্টিটা কিছু খরচ করে কিছু লোক দাওয়াত করে নিজের বাড়িতে খাওয়াবেন। হয়ত একটা নতুন উপহারও দিবেন ভেবে রেখেছেন। এটা আপনার ছোট বাচ্চাটিও হয়ত জানে এবং সে সে মোতাবেক মনে মনে খুশীতেই আছে। কিন্তু হটাত করে আপনার পরিবারে এমন কিছু ঘটনার আবির্ভাব হলো যেখানে আপনার ছোট বাচ্চার জন্মদিনের বাজেটটাই হয়ত সেই অনাখাঙ্গিত খাতে খরচ করতে হতে পারে এবং ওই মাসে তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান আর পালন করা হয়ত সম্ভবই নয়। এ ক্ষেত্রে কি কি হতে পারে?
হতে পারে-
(১) আপনার ছোট বাচ্চাটি খুব মন খারাপ করবে। আর মন খারাপ করে এমন গো ধরবে যে, তাকে শান্ত করাই খুব কঠিন কাজ। সে হয়ত ঠিকমতো কারো সঙ্গেই ভালো ব্যবহার করবে না, নাওয়া খাওয়া করবে না, পড়াশুনা করবে না, কারো সঙ্গে ভালো ব্যবহারও হয়ত করবে না। সারাক্ষন তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকবে ইত্যাদি।
(২) আপনার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও এমন একটা পরিকল্পনায় ব্যাঘাত হওয়ায় মন খারাপ করতে পারে। একদিকে নিজেদের মন খারাপ, অন্য দিকে আদরের কনিষ্ঠ সদস্যের মন খারাপ হওয়ার কারনে আরো অধিক মন ভারাক্রান্ত হয়ে যাবে। তারা হয়ত আপনার ফাইনান্সিয়াল ক্ষমতার পরিধি জানেন বলে হয়ত বাস্তবতা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করবেন বা করার চেষ্টা করছেন। আদরের ছোট মানুষটিকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন ইত্যাদি।
(৩) আপনার নিজেরও কিন্তু বড্ড মন খারাপ হচ্ছে আপনার আদরের ছোট বাচ্চাটির জন্মদিনটা আপনার সামর্থ্যের মধ্যে করতে না পারার কারনে। কিন্তু বাস্তবতা এইরকম যে, জন্মদিন করতে গেলে ওই আকস্মিকভাবে আবির্ভূত ঘটনা সামাল দেওয়া সম্ভব নয় আবার ওই আকস্মিক ঘটনা সামাল না দিলেও অনেক বড় ক্ষতির সম্ভাবনা। এই অবস্থায় আপনি ভাবছেন, আপাতত আকস্মিক ঘটনাটাকেই প্রথমে সামাল দেওয়া অতিব জরুরী, তাই আপাতত জন্মদিন পালন সাময়িকভাবে বন্ধ কিন্তু মনে মনে আছে, যেভাবেই হোক, অতিদ্রুত অন্য কোনো উপায়ে কিংবা অন্য কোন পরিকল্পনায় কাটছাট করে অচিরেই জন্মদিনটা পালন করার চেষ্টা করবেন।
এইপুরু পরিস্থিতিটা যদি আপামোর সব সদস্যরা (আপনার ছোট বাচ্চা, অন্যান্য সদস্যরা) সবাই খুব পজিটিভলী নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে থাকেন, তাহলে আমি বলবো, খুবই আউটস্ট্যান্ডিং একটি পরিবার। ইমোসন আছে কিন্তু বাস্তবতার নিরীখে সবাই সবার লেবেলে যথেষ্ট পরিপক্ক।
কিন্তু যদি উল্টোটা হয়? কেউ মানতেই চাইছে না, অস্বাভাবিক ঘটনা কিভাবে টেক্যাল দিবেন আর কিভাবে দিবেন না, সেটা আপনার ব্যাপার, বাচ্চার জন্মদিন পালন করাই চাই। তাহলে বলবো, আপনি অনেক গুলি ইমোশনাল বায়াসড কিছু সদস্যদের নিয়ে বসবাস করছেন।
ইমোশনাল বায়াসড পরিবারের লোকজন একে অপরের যুক্তি অযুক্তির পন্থায় মানতে থাকেন। পাশের বাড়ির ঐশ্বর্যকে নিজেদের না থাকার সামর্থ্যকে ছোট করে দেখেন, বিশ্বাসের ঘাটতির সৃষ্টি হয়, কখনো কখনো তা সমাজের নীতির বিরুদ্ধেও কাজ করে। আকাশ দেখে ইমোশনাল হওয়া আর মেঘ দেখে ইমোশনাল হওয়া অথবা কোন একটি সিনেমা দেখে ইমোসনাল হওয়ার মধ্যে হয়ত কোনো বড় রকমের দোষ নাই কিন্তু এই অভ্যাস টা ধীরে ধীরে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায় যখন ব্যক্তিত্ব আর বাস্তবতার মধ্যে বড় ধরনের একটা কনফ্লিক্ট কাজ করে।
০২/১২/২০১৬-সময়
Categories
“সময়” এমন একটি জিনিষ যে এটি প্রতিটি মানুষ, বস্তু, এবং প্রতিটি ইভেন্টের সঙ্গে প্রতিটি ক্ষনে ক্ষনে সে জড়িত, কিন্তু সে কারোরই বন্ধু নয়। সে টিক টিক করে সবার সঙ্গে বয়ে বেড়ায় কিন্তু সে কারো সঙ্গেই সখ্যতা গড়ে তোলেনা। সে সবার সঙ্গে আছে আবার অন্যদিকে সে কারো সঙ্গেই নাই। সে যেমন কারো জন্যই অপেক্ষা করে না, আবার কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে বলে সে তড়িঘড়িও করে সামনে এগিয়ে আসেনা। বাজারের পন্যের মতো তাকে কোথাও কম বা বেশী দরে কিনে যেমন সঞ্চয় করা যায় না, তেমনি, অতিরিক্ত সময় ব্যয়ের কারনে সেই অপচয় করা “সময়”টি আর ফিরেও পাওয়া যায়না। সময়ের কোন বিকল্প নাই। কারো কাছ থেকে ধার করেও এই “সময়” নামক জিনিষটি কখনো পাওয়াও যায়না। এটা এমন এক জিনিষ যে, কেউ তার নিজের তহবিল থেকে ধারও দিতে পারে না। তার গতি সর্বদা সামনের দিকে, কারো জন্যই সে পিছনে ফিরে আসেনা। আজকের সূর্যাস্ত যদি আপনি না দেখে থাকেন, আর কখনোই আজকের চলে যাওয়া সূর্যাস্ত আপনি আর দেখতে পাবেন না। আপনি হয়ত কোনো একটি “সময়ের” ফ্রেম ক্যামেরায় বন্ধি করে রাখতে পারবেন, কিন্তু ওই সময়ের ওইপরিবেশ, ওই আমেজ, ওই আস্বাদন, ওই অনুভুতি সেটা আপনি কখনোই ফিরে পাবেননা। এটা যেনো সেই জলবিন্দু মতো, যে একবার কোন একস্থান বয়ে সামনে চলে গেছে, সে আর দ্বিতীয়বার ওই স্থানে ফিরে আসার সম্ভাবনা নাই, আর আসেও না। Same drop of water never passes twice through a same bridge.
সময় এমন একটা জিনিষ, যাকে সর্ব পরিস্থিতির মহৌষধও বলা যায়। যার ফলে ইংরেজীতে একটা প্রবাদ আছে, Time is the panacea of all situations. কেউ কেউ আবার একে অন্যভাবেও বলে যে, Time is the panacea of all diseases. কথাটা সত্য। যেমন ধরুন, আজকে অতি আদরের কেউ পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার কারনে মাঝে মাঝে কারো কাছে মনে হবে, সব বুঝি শেষ। দুঃখের আর শেষ নাই, কিংবা কারো এই অসময়ের প্রস্থানে অনেকেই ভেঙ্গে পড়েন, অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিংবা এমন হয় যে, আজকে যে অশান্তি পরিবেশ মানুষকে কাবু করে ফেলেছে, হয়ত সময়ের অবগাহনে সে আবার সব ভুলে, সব কিছু আবার নতুন করে ধীরে ধিরে সাজিয়ে তোলেছে। সময়ের ব্যবধানে শান্ত হয়ে আসে পরিবেশ, শান্ত হয়ে আসে জীবনের অনেক কিছুই। এই “সময়”ই মানুষকে সাবলম্বি করে তোলে, আরোগ্য করে তোলে। “সময়ের” স্রোতে মানুষ আবার ঠিক হয়ে যায়। ক্ষন যায়, দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, মানুষ “সময়ের” স্রোতে আবার শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে। হারিয়ে যাওয়া বেদনার কথা ভুলে যায়, ব্যথার কথা ভুলে যায়, চোখের জল মুছে যায়। আর এজন্যই হয়ত বলা হয় “সময়” মানুষকে বদলে দেয়।
“সময়” মানুষকে অভিজ্ঞ করে তোলে। একই সমস্যা, একই ব্যক্তি, বিভিন্ন সময়ের ব্যবধানে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সমাধান করেন। আর এর কারন একটাই, আর সেটা হচ্ছে, “অভিজ্ঞতা”। যে সমস্যাটা আজ আপনি একভাবে সমাধান করেছেন, সেই একই সমস্যা আগামিকাল একই পদ্ধতিতে আপনি সমাধান নাও করতে পারেন। অথবা সময়ের ব্যবধানে অভিজ্ঞতার কারনে আপনি নিজেও হয়ত সেই একই সমস্যা ওই একই পদ্ধতিতে সমাধান করতে চাইবেন না। আর এটাই হচ্ছে পরিপক্কতার লক্ষন।
“সময়” সবকিছু পালটে দেয়। পালটে দেয় পরিস্থিতি, পালটে দেয় মানসিকতা, পালটে দেয় ব্যবহার, অভ্যাস। এমনকি পালটে দেয় মানুষের পছন্দ, অপছন্দ, এমনকি পালটে দেয় সম্পর্ক পর্যন্ত। আজ আপনি যে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন, হোক সেটা সুখের বা কষ্টের, সময়ের ব্যবধানে সেটা পালটে যেতে পারে। আজ আপনার যে মানসিকতা, “সময়ের” ব্যবধানে আপনার মানসিকতা পুরুটাই পালটে যেতে পারে। যে বয়সে আপনি অনেক দুরন্তপনা করেছেন, কিংবা যে “সময়ে” আপনি আবেগের বশে অনেক কঠিন কঠিন শপথ করে কালবৈশাখী ঝড় মাথায় নিয়ে একা সাহস করে অনেক কিছু মোকাবেলা করেছেন, জীবনের কোনো এক সময়ে এসে মনে হবে, হয়ত সেটা করাই ঠিক হয় নাই, আবার মনে হতে পারে আজ এই বয়সে ওই একই পরিস্থিতিতে আপনি ওই রকম কোনো কিছুই হয়ত করবেননা। হয়ত আপনিই উপদেশ দিবেন, ধৈর্য ধরতে। কারন, আপনি এখন জানেন, আবেগের বশে অনেক কিছু করা যেতে পারে বটে কিন্তু সবশেষে যা অপেক্ষা করছে তার পরিনতি ঠিক যা আশা করছেন তা হয় নাই বা হয়না। তাই উপদেশ হবে হয়ত “ধৈর্য” ধরুন। আর একেই বলে “অভিজ্ঞতা”। অভিজ্ঞতার সঙ্গে “সময়” একটা যোজন। “সময়” যত পেরুবে, অভিজ্ঞতা তত ভারি হবে। আর অভিজ্ঞতা যত ভারি হবে, আপনি তত শান্ত হয়ে যাবেন। বয়স্ক সবচেয়ে বোকামানুষটিও অল্পবয়সের কোন তথা কথিত চালাক মানুষের থেকে বেশি অভিজ্ঞ। আর তার এই অভিজ্ঞতার কারনে এই বোকামানুষটিও ওই অল্প বয়স্ক মানুষটির থেকে ঢের বেশি জ্ঞ্যান রাখেন। এটা অনেকেই হয়ত মানবেন না কিন্তু এটাই সত্য কথা।
“সময়ের” ব্যবধানে বন্ধু পর্যন্ত পালটে যায়। কখনো কখনো বন্ধু পালটে শত্রু হয়ে যায়, আবার “সময়ের” প্রেক্ষাপটে বাব্যবধানে শত্রু একদিন মিত্র হয়ে যায়। আজ যাকে আপনি আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষ বলে মনে করছেন, হয়ত “সময়ের” ব্যবধানে কাল সে আপনার অনেক দুরের বলে মনে হবে। কিংবা আজ যাকে আপনি সবচেয়ে দুরের কাউকে মনে করছেন, “সময়ের” ব্যবধানে হয়ত সেইই আবার সবচেয়ে কাছে মানুষদের মধ্যে একজন বনে যেতে পারে। আর এটাই বাস্তবতা। তাই আজকের “সময়”টাই শেষ কথা নয়। অপসন খোলা রাখুন যেন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শত্রুকে মিত্র, আর মিত্র থেকে সতর্ক থাকার ক্ষেত্র খোলা থাকে। আজ যে আপনার কষ্টে আপাতদৃষ্টিতে বুক ভাসিয়ে চোখের জল ফেলছে, কাল হয়ত এই চরিত্রটিই আপনার সর্বনাশের জাল বুনছে। আজ যাকে আপনি হৃদয়ের সবটুকু অবিশ্বাস দিয়ে যোজন মাইল দূরে সরিয়ে রাখতে সাচ্ছন্দ বোধ করছেন, হয়ত আগামীকাল মনে হবে, তার কোনো বিকল্পই নাই।
“সময়” বড্ড বেরশিক জিনিষ। সে কাউকে আপন মনে করে না, সে কাউকে পরও মনে করেনা। আসলে “সময়” কারো সঙ্গেই তার সম্পর্ক রাখেনা। সে একা, সবাই তার সঙ্গেই চলার চেষ্টা করে। যে পিছিয়ে যায়, সে পিছিয়েই থাকে, আর যে তার সঙ্গে চলতে চায়, “সময়” তার সঙ্গেই কাধে কাধ মিলিয়ে সামনে এগিয়ে চলে। আপনি আজ হেরে গেছেন? এমনও হতে পারে আগামি কাল আবার আপনি জিতে যাবেন। শুধু “সময়ের” ব্যবধান। “আজ” আর “আগামিকাল”। “সময়ের” ব্যবধানে একদিন হেরেছেন আর আরেকদিন জিতে গেছেন।
আজ থেকে শত বছর আগেও এটাই ঘটেছে, আজো এটাই ঘটছে, এবং আগামি শতকের পর শতক অবধিতাই ঘটবে। এটাই সময়ের নিতি। সে কখনই তার নিতি পরিবর্তন করেনা। সে শুধু তার চারিপাশে যারা আছে, শুধু তাদের পরিবর্তন করে দিয়ে চলে যায়।
“সময়” দুর্বলকে সবল করে, সবলকে দুর্বল করে, শক্তিশালীকে পরাভূত করে, নিষ্পেষিতকে শাসক বানায়। “সময়” এমন এক জিনিষ যে, সে গরীবকে ধনী বানায়, ধনীকে গরীবের কাতারে দাড় করিয়ে দেয়। “সময়’ এমন এক অপ্রতিরোধ্য জিনিষ যে, সে ভালোবাসাকে ঘৃণার স্তরে নিয়ে আসতে পারে, আবার ঘৃণার স্তর থেকে ভালোবাসায় পরিবর্তন করাতে পারে। “সময়” কচি খোকাকে পুরুষে পরিনত করে, ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়েকে জটিল সংসারের হাল ধরতে শিখায়। “সময়” মানুষের সব কিছু পালটে দিয়ে এমন এক পরিস্থিতিতে নিয়ে দাড়া করাতে পারে যেখান থেকে বের হয়ে আসার মতো কোন পথও খোলা না রাখতে পারে। আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আপনি অন্যের পরিস্থিতি উপভোগ করছেন, হয়ত আগামিকাল ঠিক সেখানে দাড়িয়েই অন্য একজন আপনার পরিস্থিতি উপভোগ করবে। “সময়” কখন কার সঙ্গে থাকে, কেউ জানে না।
কোনো একসময় “সময়” চলেছিলো রোমের জন্য, রোম শেষ হয়েছে। তারপর “সময়” চলেছে স্পেনের জন্য, স্পেন শেষ হয়েছে। তারপর “সময়” চলেছে রাশিয়ার জন্য। এখন “সময়” চলছে আমেরিকার জন্য। হয়ত একদিন, এই “সময়”টাও শেষ হয়ে যাবে, হয়ত অন্য কারো জন্য সে আবার চলবে।
০১/১২/২০১৬-ধৈর্য
Categories
আমরা কথায় কথায় একটা উপদেশের বানী বলে থাকি, “ধৈর্য ধরুন” কিন্তু কেউ বলছি না, কিভাবে “ধৈর্য” ধরতে হবে। কিংবা “ধৈর্য” ধরার প্রক্রিয়াটা কি। এটা কি এই রকম যে, চুপচাপ বসে থাকার নাম “ধৈর্য”? নাকি এমন কিছু যে, প্রতিবাদ না করার নাম “ধৈর্য”? অথবা এমন কিছু যে, শুধু সব কিছু মেনে নেওয়ার নাম “ধৈর্য”? প্রকৃতপক্ষে এগুলোর হয়ত কোনোটাই না আবার অন্যদিকে এইসবগুলোই হয়ত একত্রে “ধৈর্যের” উপাদান। “ধৈর্য” ধরার প্রক্রিয়াটাও “সময়” বলে দেয় কিভাবে তার শুরু আর কিভাবে তার শেষ। তবে এইটা ঠিক যে, ধৈর্যের সাথে “সময়” নামক জিনিষটা জড়িত। সমাধান পাচ্ছেননা, তো, ধৈর্য ধরুন। কিভাবে? অপেক্ষা করুন, মানে “সময়” নিন। যুক্তির সাথে পরিবেশ ব্যখ্যা করুন, নিরপেক্ষ বিচারে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করুন, সবার কথা শুনুন, কিন্তু সবার কথা মানতে হবে এমন চিন্তা থেকে বিরত থাকুন। সম্ভাব্য সমাধানে পজিটিভ চিন্তা করুন। সম্ভাব্য সমাধানের পরবর্তী প্রতিটি কার্যকলাপের বিপরীতে তার সম্ভাব্য ফলাফলের কতটা আপনার ভালো হয় বা কতটা আপনি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন তার পূর্ণ একটা চিত্র নিজে নিজে ভাবুন। আর ভাবুন, কে আপনার জন্য আর কে আপনার জন্য নয়। সময়ের সাথে সাথে মানুষের যেহেতু আচার আচরন পরিবর্তন হয়, প্রতিটি মানুষের ভুমিকা বিচার করুন। হতে পারে আপনি ভুল মানুষকে বেশি মুল্যায়ন করছেন অথচ যাকে আপনার মুল্যায়ন করার দরকার সবচেয়ে বেশি, তাকেই আপনি দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। প্রি-কন্সিভ আইডিয়া থেকে সরে আসুন, প্রো-একটিভ কাজ থেকে বিরত থাকুন। নিজের সাথে অন্যের আইডিয়ার মধ্যে কোথায় কি কারনে ব্যবধান হচ্ছে, তার সম্ভাব্য কারন গুলি সনাক্ত করার চেষ্টা করুন। হতে পারে আপনি কিছু মিস করে যাচ্ছেন। আর এই মিসিং জায়গাগুলি পূর্ণ করার জন্য “সময়” নিন। অযথা খাম খেয়ালী করেও কোনো মন্তব্য না করাই মঙ্গল। কারন, “ধৈর্যের” মধ্যে এই সহিষ্ণতাও একটা উপাদান। আমি এভাবেই ব্যাপারগুলি চিন্তা করি। এটাই যে একমাত্র পদ্ধতি সেটাও হয়ত সঠিক নয়, হয়ত আপনার কাছে আরো অন্য ভালো কোন পদ্ধতি থাকতে পারে। সেটা নিয়ে স্টেজ বাই স্টেজ বিশ্লেষণ করুন। ধাপগুলি নিয়ে ভাবুন। কার পরে কি হচ্ছে, কোন কোন পদক্ষেপে কি কি ফলাফল হতে পারে, সব কিছু মিলিয়ে একটা ডিসিসন মেকিং পদ্ধতিতে এগিয়ে যান, দেখবেন, যথেষ্ট স্বচ্ছ একটা চিত্র আপনার কাছে ভেসে উঠছে। এটা একটা পথের মতো। পুরু পথটা দেখার চেষ্টা করুন। আপনার থেকে ভাল বিচারক অন্য একজন নয়। এটা ভাবুন।
১৯/০৮/২০১৬- পৃথিবীকে বদলে দাও
Categories
উত্তর থেকে দক্ষিন, পূর্ব থেকে পশ্চিম, প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য কিংবা গ্রিস থেকে অন্য কোথাও, ছোট কিংবা বৃহৎ যেদিকেই তাকাবেন কিংবা যেখানেই যাবেন, সর্বত্র একটা লিখিত-অলিখিত শ্লোগান দেখবেন কিংবা শুনবেনঃ পৃথিবীকে বদলে দাও। অথবা চা স্টলে বসলে আলাপ আলোচনায় শুনবেন, “আচ্ছা, মানুষ গুলি বদলাচ্ছে না কেনো?” ইত্যাদি।
আমি মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করিঃ কি বদলাতে হবে? কি পরিবর্তন হয়েছে যা বদলানো দরকার? এই পরিবর্তন কি আগের কোনো এক জমানায় ফিরে যাওয়ার আকুতি? নাকি ভবিষ্যতের কোনো এক নাম না জানা টেকনোলোজির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি?
যদি বলি, আগের জামানাই অনেক ভালো ছিলো, যেখানে সব সম্প্রদায় একই জনগোষ্ঠীর আওতায় একে অপরের সঙ্গে মিলে মিশে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলেছিলেন এবং সৌহার্দমুলক এক সমাজে বাস করতেন। একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হলে কুশল বিনিময় করতেন, ভালো মন্দ যা কিছু আছে তার খোজখবর নিতেন, এক বাড়ির মেয়ে আরেক বাড়িতে গিয়ে কোন এক বিয়ের আসরে বসে গ্রাম্য নৃত্যর সাথে নাচানাচি করতেন। হিন্দু মুসলমান, খ্রিষ্টান কিংবা যে যেই ধর্মেরই হোক না কেনো, তাদের মধ্যে একটা সৌহার্দপূর্ণ সদ্ভাব ছিলো। সত্যকে মিথ্যার সাথে, কিংবা আরালে আবডালে একে অন্যের সমালোচনা না করার মানসিকতা, প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশির একটা বন্ধুত্তপূর্ণ অনুভুতি ইত্যাদি দেখা যেত। আমরা কি সেটার কথা বলছি? তাহলে তো বলবো, তখনো তো পাথরযুগও ছিলো যেখানে জীবন্ত মানুষকে মানুষ মেরে ফেলতো, কিংবা মোঘল সম্রাটদের আমলে তো মানবাধিকারের কোনো বালাইই ছিল না অথবা নীল চাষদের আমলে তো মানুষ আরো খারাপ অবস্থায় না খেয়ে খেয়ে ছিলো। তাহলে কি সেই আগের জমানায় ফিরে যাওয়াই কি বদল হওয়ার কথা বলছি? অথবা এমন কিছু নতুন নতুন টেকনোলোজি যা আগামি প্রজন্মের জন্য ধীরে ধীরে উদ্ভাবিত হচ্ছে যেখানে পুরানোদের নতুনদের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত?
আসলে ব্যাপারটা সম্ভবত এই রকম নয়। অনেক জটিল, শুধু জটিল নয়, সময় সাপেক্ষও বটে।
জটিল কতটুকু সেটা না হয় পড়ে ভাবা যাবে কিন্তু সময় সাপেক্ষ ব্যাপারে বলতে পারি যে, আমার এই অল্প আয়ুর জীবনের মধ্যে দেখেছি, আমরাই এক সময় শীতের মৌসুমে ঈদ পর্ব পালন করেছি আবার বর্ষার সময়ও ঈদ পালন করেছি। কারন, ঋতুর পরিবর্তনের ফল, সময়ের তারতম্যের কারনেই এই পরিবর্তনটা হয়। আর এই পরিবর্তন নিছক এক বছর বা দুই বছরের মধ্যেই ঘটে যায় না। তারজন্য যুগের পর যুগ কেটে যায়। ছোট এই উদাহরন দিয়ে বুঝাতে চেয়েছি যে, পরিবেশ বদল হতেও যুগের পর যুগ লেগে যায়। আর মানুষের সভ্যতা তো আরো সময়ের ব্যাপার। এতে জেনারেশন থেকে জেনারেশন পার হয়ে যায়। ফলে বদল বা পরিবর্তন জিনিসটা একা একটা ফ্যাক্টর নয়। এরসঙ্গে জড়িত সময়, মানুষ, সভ্যতা, মানুষের শিক্ষা, উদ্ভাবনীর সাফল্য, নতুনত্তকে গ্রহন করার মানসিকতা ইত্যাদি। আর পরিবর্তনের জন্য এইসব ফ্যাক্টরগুলি একসঙ্গে হতে হবে। সময়ের সঙ্গে মানুষ, মানুষের সঙ্গে মানুষের সভ্যতা, সভ্যতার সঙ্গে মানুষের শিক্ষা, শিক্ষার সঙ্গে উদ্ভাবনির আবির্ভাব, আর সেই উদ্ভাবনীর সঙ্গে পুরানো রীতিনীতি ছেরে মানুষের নতুন কিছু গ্রহনের আন্তরিকতা ইত্যাদি মিলে আসে এই বদল। এর কোনো একটায় যদি বাধ সাধে, তাহলেই বাধাগ্রস্থ হয় বদল হওয়ার প্রক্রিয়া। আর যখন বদল হওয়ার মানসিকতা তৈরি না হয়, শুরু হয় বদলা নেওয়ার প্রক্রিয়া। সেটাও এক প্রকার বদল কিন্তু তা আমরা কখনোই চাই না।
প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ এই বদল হওয়ার শ্লোগান দিয়ে আসছে। বদল যে হয় নাই তা কিন্তু না। পাথর যুগের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ্য, মোঘল সম্রাটদের একচেটিয়া শাসনতন্ত্র, ইংরেজদের দস্যিপনা, বর্গিদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে “বদল” হওয়ার নিমিত্তে সব আমলেই কিছু না কিছু সাহসী মানুষ কিংবা গোত্র আন্দোলন করেছিলো এবং তার সুফল যে হয় নাই তা নয়। সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়েছে, সহমরন প্রথা বন্ধ হয়েছে, জীবিত কন্যা সন্তান হত্যা করা বন্ধ হয়েছে, বাকস্বাধীনতার উন্নতি হয়েছে, ন্যায়নীতির আইন প্রনয়ন হয়েছে, সামাজিক মুল্যবোধের পরিবর্তন হয়েছে, আরো অনেক কিছু। এগুলু হচ্ছে বৈশ্বয়ীক পরিবর্তনের বড় বড় আলোচনা। কিন্তু এই বড় বড় বৈশ্বয়ীক পরিবর্তনের সুচনা প্রকৃতপক্ষে আরম্ভ হতে হয় একেবারে ছোট ছোট পরিবার থেকে, প্রতিটি মানুষের ব্যবহার থেকে, অথবা অন্য অর্থে যদি বলি, এই পরিবর্তনগুলির প্রারম্ভিক ভিত্তি হচ্ছে প্রতিটি মানুষ। আমরা এই প্রারম্ভিক ভিত্তিতে “বদল” চাই। তাহলেই প্রকারান্তে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বয়ীক পরিবর্তন বা “বদল” কার্যকরী হবে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলোঃ এই প্রারম্ভিক ভিত্তি অর্থাৎ মানুষের পরিবর্তন কিভাবে হবে সেটাই এখন বিবেচ্য বিষয়।
রিক্সায় উঠেছেন? দেখবেন, গল্পের ছলে হয়ত রিকশাওয়ালা বলছে, স্যার দেশটার কি কোনো পরিবর্তন হবে না? চা স্টলে বসেছেন? শুনবেন, তুমুল কথাবার্তা হচ্ছে, সমাজটা কি অধঃপতনে চলে যাচ্ছে? স্কুল কলেজে, মিটিং সেমিনারে বসেছেন? দেখবেন, একদল শিক্ষিত লোক দেশের আইন-শৃঙ্গলা, শিক্ষা-ব্যবস্থা, ছাত্র-ছাত্রদের, শিক্ষক-শিক্ষিকার আদর্শ, যোগ্যতা, ইত্যাদি নিয়ে কথা বলছেন। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে সর্বচ্চ আদালত প্রাঙ্গনে বসেছেন? শুনবেন, ন্যায় নীতির পদস্খলনের অনুতাপ। কোনো বাড়িতে বেড়াতে গেছেন? দেখবেন, প্রতিটি অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিয়ে বিব্রতবোধ করছেন। কেউ অভিযোগ করছেন, তাদের সন্তানগন কথা শুনছে না, কেউ কথা রাখছে না, কেউ আদব-কায়দা শিখছে না, কেউ কেউ আবার তাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট বুঝার চেষ্টা না করে বিপথে চলে যাচ্ছে, ইত্যাদি। কারো অভিযোগ স্কুল কলেজের বিরুদ্ধে, কারো অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে, কারো অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে, কারো অভিযোগ সমাজের বিরুদ্ধে, আবার কারো অভিযোগ নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে। আর এই অভিযোগকারীগন সবাইকে আমরা চিনি। যিনি অভিযোগ করছেন এবং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, সবাই কোনো না কোনভাবে আমরাই। আমার সবাই অভিযুক্ত। আবার অন্যদিকে, আমরাই আবার এই অভিযোগগুলির সমাধান, পরিবর্তন চাই। সবাই চাচ্ছি পরিবর্তন, সবাই চাচ্ছি সস্থি, সবাই চাচ্ছি একটা “বদল”। তাহলে পরিবর্তনটা আসছে না কেনো? কোন জায়গাটায় সমস্যা তাহলে?
সমস্যা আসলে শুধু এক জায়গায়। আমরা সবাই বলছি, সব ভালো হয়ে যাক, সবাই বলছি পরিবর্তন হোক, সবাই বলছি “বদল” হোক, শুধু “আমি ছাড়া”। প্রকৃত সমাধান আসলে এই “আমি”র মধ্যে।
যখন কোনো বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কোনো এক শাশুড়ির এই কথা শুনবেন যে, আমার মেয়ের স্বামীটা অনেক ভালো, সে আমার মেয়ে যা বলে, যা আবদার করে, আমার মেয়ের স্বামী সবকিছু শুনে এবং মেনে চলে। কি লক্ষি মেয়ের স্বামী। কিন্তু আমার নিজের ছেলেটা এতো খারাপ যে, সে বউয়ের কথায় নাচে, উঠে আর বসে। তাহলে আপনি এই শাশুড়ির কাছ থেকে কিভাবে “বদল” চাইবেন? কোনো একটা বিয়ের আসরে গেছেন? পুরানো এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। সে কোনো এক স্কুল কিংবা কলেজে চাকুরী করেন, কিন্তু তার সন্তান তার স্কুলে বা কলেজে পড়েন না। কারন সেখানে খুব ভালো পড়াশুনা নাকি হয় না। তাই তিনি তাদেরকে স্কুল বা কলেজে নিজের সন্তানকে পড়ান না। কিন্তু তিনি অন্যের সন্তানদেরকে ওখানে পড়ান। অন্যের সন্তানকে নিয়ে তার চিন্তা নাই, একরকম করে দিন কাটিয়ে দিলেই হল। তিনি তার সন্তানদের পড়াচ্ছেন এমন এক স্কুল বা কলেজে যেখানে ওই স্কুল কলেজের মাসিক বেতনই হাজার হাজার টাকা। ফলে এই অতিরিক্ত টাকা আয় করার জন্য তো তাঁকে বিকল্প পথ বের করতেই হবে। আর এই বিকল্প পথে টাকা আয় করার জন্য তো তাঁকে তার চাকুরীর সময় থেকেই নিতে হবে। তার সময় কই তার অধীনে অধ্যায়নরত ছাত্রকে সময় নিয়ে শিক্ষা দেওয়ার? আবার তিনিই “বদল” চান এই সমাজের শিক্ষা ব্যবস্থার। তাহলে আপনি কিভাবে কার “বদল” চাইবেন?
পাশের বাড়ির মেধাবী সন্তান জিপিএ-৫ পেয়েছে, সরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং, সরকারী মেডিক্যাল কিংবা ভালো ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়েছেন, কিন্তু ফাঁকি দিয়ে লেখাপড়া না করা আমার সন্তান ভালো ফলাফল করতে না পারায় হয়ত নামকরা কোনো ইন্সটিটিউটে ভর্তি হতে পারছে না, তাতে কি? প্রাইভেট ইন্সটিটিউট তো আছে? শুধু টাকা হলেই সম্ভব। কোথা থেকে আসবে এই অতিরিক্ত টাকা? আমাকে তো ভিন্ন পথে যেতেই হবে, হোক সেটা ন্যায় কিংবা অন্যায়। আমার সন্তান কে তো আর যেই সেই ইন্সটিটিউটে পড়ালে চলবে না। আমার এই অতিরিক্ত টাকার সংস্থান করতে আমাকে অন্যায় কিছু করতেই হবে, হোক সেটা ঘুষ কিংবা অন্য কিছু। আবার এই আমিই ঘুষের বিরুদ্ধে কথা বলছি। তাহলে পরিবর্তনটা আসবে কিভাবে? বৃদ্ধ বাবা বা মাকে নিয়ে বাসে উঠেছেন? সিট খালি নাই। পাশে এক তরুন সিট দখল করে বসে আছেন। কোনো মায়া মমতা, কোনো আদব কায়দা, কিংবা কোনো দয়া দাক্ষিন্যতা দেখিয়েও এই বৃদ্ধ মানুষটির দাঁড়িয়ে থাকার কষ্টের কথা চিন্তা করেও তরুন তার নিজের সিটটা ছেড়ে দিতে নারাজ। কিন্তু এই তরুনই যখন তার নিজের বৃদ্ধ বাবা বা মাকে কোনো একদিন ওইরকম এক পরিস্থিতির সম্মুক্ষিন হবেন, তিনি আক্ষেপ করে বলবেন, দেশটা যাচ্ছে কই? কোনো আদব কায়দা কি কিছুই নাই? এবার আসি পরিবারের ভিতরে। আমি রিপাবলিকান দল করি, কেনো আমার স্ত্রী বা ছেলেমেয়ে রিপাবলিকান দল করবে না? আমারটা খাবে, আমারটা পড়বে, অথচ আমার দল করবে না, তাতো হবে না। আমার দলের বিরুদ্ধে কথা বলবে, এটাতো হবেই না। ছেলে ভালো আর্ট করতে পারে, কিংবা খুব ভালো অংক বুঝে, তাতে কি? আমার খুব শখ আমার সন্তান ডাক্তার হবে। কেনো আমার ছেলের কথায় আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং বানাতে হবে তাঁকে? আপনি কোনো এলাকায় নাম করেছেন, হোক সেটা গ্রাম্য বিচারের বেলায়, কিংবা সালিশীর বেলায়। আপনার গ্রামে করিমুদ্দিনও আপনার মতো আরেক নামীদামী গ্রাম্য বিচারক। করিমুদ্দিন কোনো বিচারে গেলে সেখানে আপনার না যাওয়াই শ্রেয় মনে করছেন কারন দুই নামীদামী বাঘ একসঙ্গে থাকে কিভাবে? কিংবা যদি রায়ের এদিক সেদিকে আপনার মতামতের মুল্যায়ন না থাকে সেই ভয়ে আপনি ন্যায় কিংবা অন্যায় যাই হোক না কেনো, আপনি পুরু বিচার কাজটাকেই অস্বীকার করে ফেললেন। তাহলে পরিবর্তনটা আসবে কিভাবে? আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আপনার মতাদর্শের কোন এক কর্মীকে অন্যায় কাজের জন্য ধরে নিয়ে গেছে? কোনো ব্যাপার না। আপনি সরকারী দল করেন, সব কিছুর উর্ধে আপনি। আইন শৃঙ্খলা বাহিনিকে প্রলুব্ধ করে ছারিয়ে নিয়ে এলেন কয়েক ঘন্টার মধ্যে। আবার যখন আপনার বিরোধী দল সরকারী দল হয়ে যাবে, আপনি যখন সেই একই প্রক্রিয়ায় নিষ্পেষিত হবেন, সেই আপনিই বলবেন, দেশে কি কোনো আইনকানুন নাই? তাহলে পরিবর্তনটা হবে কিভাবে? আজ আমি “বদল” হচ্ছি না অথচ কাল আমি সবাইকে “বদল” হতে বলছি। লাভের আশায় আপনি খাদ্যে ভেজাল মিশাবেন, ফরমালিন দেবেন, মরা মুরগী রেস্টুরেন্টে সাপ্লাই দেবেন? দিন। কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু আগামিকাল আপনার সন্তান সেই ফরমালিনযুক্ত খাবার খেয়ে কিডনী নষ্ট করবে, মরা মুরগির রোষ্ট খেয়ে লিভার নষ্ট করবে। তার শরির খারাপ করবে, অসুস্থ হবে, যাবেন ডাক্তারের কাছে, গিয়ে দেখবেন, প্রশ্নপত্র ফাস করে পাশ করা ডাক্তার, ভেজাল ঔষধ সব আপনার সামনে একত্রে হাজির। অসুখ নিরাময় হবে না। একদিন আপনার আদরের সন্তান আপনার চোখের সামনে মারা যাবে। আর এভাবেই আমরা সবাই ঠকছি। কাকে আসলে ঠকাচ্ছি?
একজন চোরও আরেকজন চোরকে পছন্দ করে না, একজন ঘুষখোরও আরেকজন ঘুষখোরকে পছন্দ করে না। মেয়ে বিয়ে দেবেন, ভালো বংশ চান, ছেলে বিয়ে করাবেন? ভালো মেয়ে এবং ভালো পরিবার চান। আমরা সবাই তাই চাই। কিন্তু আমি আমার নিজের পরিবারকে ভালো একটি পরিবার হিসাবে গড়ে তূলতে পারছি না। আমি আমার সন্তানকে ভালো নীতির শিক্ষা দিচ্ছি না। তাহলে আমি কাকে বলছি, “বদল” হউন? ঘরে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে খারাপ আচরন করবো অথচ সামাজিক সেমিনারে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলবো, নিজে বন্ধুবান্ধব্দের নিয়ে নেশা করবো কিন্তু নিজের সন্তানকে নেশা করতে বারন করবো, নিজে ঘুস নেবো কিন্তু অন্যের বেলায় প্রতিক্রিয়া দেখাবো, তাতে তো “বদল” হবে না কিছুই। আমি কারো ফেলে যাওয়া কলার খোসায় পা পিছলে তার গুষ্ঠি উদ্ধার করবো কিন্তু আমি কলা খেয়ে একটু দূরে ডাস্টবিনে না ফেলে রাস্তায় তা ফেলে যাবো, তাতে তো “বদল” কিছুই হলো না। আমি নিশ্চিত জেনেও যখন কোন অন্যায়কারীর পক্ষে ওকালতি করবো, নিশ্চিত জানবেন, অন্য কেউ আমার উপর অন্যায় করলেও আরো ভুঁড়ি ভুড়ি আইনসেবক পাওয়া যাবে যারা আমার ন্যায়কে অন্যায়ভাবে একই প্রক্রিয়ায় রায় ঘুরিয়ে দিয়ে আমাকে পরাজিত করবে। বৃষ্টির দিনে এসি গাড়ির ভিতরে বসে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে পাশে পায়ে হাটা এক পথচারীর জামা কাপর ভিজিয়ে দেবো, অথচ তারজন্য আমি অনুতপ্তও বোধ করবো না, বরং তার দিকে তাকিয়ে মুচকি তাচ্ছিলের হাসি দিয়ে অথবা “ছোট লোকের দল” বলে গাড়ী হাকিয়ে চলে যাবো, তাহলে তো কোনোদিনই “বদল” বলে কিছু আসবে না।
তাহলে এখন আরো একটি প্রশ্ন আসে। আমরা এখন সত্যি সত্যিই “বদল” হতে চাই। কিভাবে? সহজ পথ। আমরা সবাই সেটা জানি। এক কথায় যদি বলি। তাহলে সেটা দাড়ায় “ইনসাফ”। নিজের প্রতি নিজের ইনসাফ। আর এটাই করতে বলেছে ধর্ম। সেটা যার ধর্মই হোক। কোনো ধর্মই বে-ইনসাফি কাজ করতে আদেশ দেয় নাই। কোনো ধর্মই অন্যায় কাজকে প্রলুব্ধ করে নাই। কোনো ধর্মই মানুষের অধিকারকে হরন করতে বলে নাই। সব ধর্মের নিগুড় উপদেশঃ হত্যা, নিপীড়ন, ঘুষ, সুদ, অপহরণ, অন্যায়, গিবত, অহংকার, মারামারি, লোভ, অশ্লীলতা, নেশা, চুরি ডাকাতি, ভেজাল, ঠকবাজী, হটকারিতা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকুন। আর মানুষের মঙ্গল হয় এমন কাজ করুন। আপনি করুন, মানুষ উপকৃত হবে, মানুষ করবে, আপনি উপকৃত হবেন। এই অভ্যাস এবং কাজগুলি একদিনে হয়ে উঠবে না। আবার আপনি করছেন, কিন্তু অন্য এক জন করছে না দেখে আপ্নিও বিরক্ত হবেন, কিচ্ছু যায় আসে না। আপনি আপনারটা করুন। একদিন এই সংখ্যাটা বাড়বেই। প্রতিদিন এই অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। A smile can be a charity. তাই দিয়েই শুরু করুন।
কেউ কেউ হয়ত আবার প্রশ্ন করবেন, আমরা তো ধর্মকে পালন করছি। আমরা তো জানি ধর্ম কি কি বলেছে। তাহলে এর পরেও বদল হচ্ছে না কেনো? এর বিকল্প কি? এর উত্তর একটাই।
জানার নাম ঈমান নয়, মানার নাম হচ্ছে ঈমান। যদি জানার নাম ঈমান হতো তাহলে ইবলিশই হতো সবচেয়ে বেশী ইমানদার। ইবলিশ জানতো অনেক কিছু, সে মানে নাই, কিন্তু আদম অনেক কিছুই জানতেন না, তিনি মেনেছেন। আমরা ধর্ম মানছি, আমরা ধর্মের সব কিছু পালন করছি না।
সময় শেষ হয়ে যায় নাই। “বদল” সম্ভব। আজ থেকেই সম্ভব।
১৮/০৮/২০১৬ আইনিস্টানিক আই কিউ
Categories
১১ বছরের একটি ছেলে তার আইনিস্টানিক আইকিউ এর মতো বুদ্ধিমত্তার কারনে সব স্কুল কলেজ বাদ দিয়ে সরাসরি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো। বাচ্চা ছেলে, মা অনেক চিন্তিত ছেলেকে নিয়ে। দূরদেশ, কিভাবে থাকবে, কিভাবে খাবে, কিভাবে নিজের যত্ন নিবে, সবভেবে মা অনেক পেরেশানি।
মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় মা অতি যত্ন করে ছেলের কোটের পকেটের ভিতরের দিকে একটা ২৫ সেন্টের মুদ্রা সেলাই করে দিয়ে বললেন, “বাবা, যদি ঐখানে গিয়ে তোমার ভালো না লাগে, মন খারাপ থাকে কিংবা তোমার আর পড়তে ইচ্ছে না হয়, আমার কথা মনে হয়, তাহলে এই ২৫ সেন্ট মুদ্রাটা বের করে ট্রেন ভাড়া দিয়ে আমার কাছে চলে এসো”। ট্রেনভারা ২৫ সেন্টই লাগে বলে মা ২৫ সেন্টই গোপন পকেটে সেলাই করে ছেলের জন্য দিয়ে দিলেন যাতে কোনো কারনে ছেলের মন খারাপ, কিংবা মায়ের কাছে আসতে চাইছে কিন্তু তার কাছে ভাড়া নাই, তাই তিনি ট্রেন ভাড়া হিসাবে অগ্রিম ২৫ সেন্ট গুজে দিলেন তার কোটের পকেটের ভিতরে।
কোনো এক শীতের মৌসুমে ছেলেটি ইউনিভার্সিটিতে চলে এলো। সবাই তাঁকে অনেক অনেক আদর করে, অতি কনিষ্ঠ একজন ছাত্র কিন্তু খুবই মেধাবী। সব শিক্ষকরাও তাঁকে পেয়ে অনেক খুশী এবং তারা সবাই ছেলেটিকে অনেক আদর করেন। তার কথা অনেকেই মনোযগ সহকারে শুনেন। তিনি অনেক কঠিন কঠিন সমস্যার অল্প সময়েই উত্তম সমাধান দিয়ে দিতে পারেন। এমনই মেধাবী সে। কিন্তু ব্যতিক্রম হলো এক স্যারের বেলায়। সে তার ক্লাস টিচার।
তার ক্লাশ টিচার তারসাথে এমনভাব করেন যে, এই ছাত্রটি তার ক্লাশের সবচেয়ে অপ্রিয় একজন ছাত্র এবং তার মতো আহাম্মক আর একটাও নাই, তার কোনো মেধাও নাই। যেই এসাইন্মেন্টই দেওয়া হোক না কেনো, সে যদি সবচেয়ে ভালোও লিখে, তাতেও ক্লাশ টিচারের মন ভড়ে না, গলেও না, তার মেজাজ যেনো সব সময় ছাত্রটির উপর চড়া। কখনো ক্লাশ টিচার তার খাতাপত্র ছিড়ে ফেলেন রাগে, কখনো আবার এসাইন্মেন্ট না পড়েই “কি লিখেছো এসব” বলে সবার সামনে ছুড়ে ফেলে দেন ইত্যাদি।
ক্লাশ টিচারের এইরকম একটা আচরনের কোনো কারন কেউ খুজে পান না। আবার ক্লাশ টিচারের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করবেন, তার সাহসও কারো নাই। ক্রমে ক্রমে দিনে দিনে এই নাবালক ছাত্রটি ইউনিভার্সিটির পড়াকে একটা দুঃসহ জীবনের অভিজ্ঞতার মতো মনে করতে লাগলো। তার মন খারাপ হতে থাকে, শরির খারাপ হতে থাকে, পড়াশুনার উপর তার বিতৃষ্ণা গড়ে উঠতে থাকে।
একরাতে, তার খুব মন খারাপ হয়, মায়ের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে মায়ের দেওয়া ওই ২৫ সেন্টের কথা। বাচ্চা ছেলে, হয়ত আইকিউ বেশি কিন্তু পরিপক্কতা তো আসে নাই। সে তার সব কাপর চোপড় গুছাতে থাকে, বইপত্র ব্যাগে ঢোকাতে থাকে। আজ রাতেই ট্রেন। ট্রেনে করে মায়ের কাছে চলে যাবে। আর ফিরবে না। কাউকেই সে এ কথা বল্লো না। সব গুছানো শেষ। এবার ট্রেনের উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হবার পালা।
যেই না ছেলেটি তার ব্যাগসমেত রুম থেকে বের হবে, ঠিক ওই মুহূর্তে তার ক্লাশ টিচার তার রুমের সামনে এসে হাজির। ক্লাশ টিচারকে দেখে তো ছেলেটির অন্তরাত্মা চমকে উঠলো। গায়ের রক্ত যেনো হিম হয়ে আসতে লাগলো। শীতের ওই রাতেও ছেলেটির মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করতে লাগলো। ভয়ে তার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছিলো না।
-“কি চলে যাচ্ছো নাকি? কোথায় যাচ্ছো? মায়ের কাছে?” ক্লাশ টিচার খুব সহজ করে প্রশ্ন করলেন ছেলেটিকে।
কোনো উত্তর না দিয়ে ছেলেটি শুধু কিছুটা ভয়ে, কিছুটা আবেগে শুধু মাথা নেড়ে “হ্যা সুচক” উত্তর দিলো।
-“চলো, ভিতরে চলো। তোমার সঙ্গে গল্প করি”। বলে ক্লাশ টিচার ছেলেটিকে অতি আদরের সহিত বুকে জড়িয়ে রুমে বসালেন। তারপর বল্লেনঃ
-তোমার কি খুব মন খারাপ? আমার উপর তোমার খুব রাগ? কিন্তু আমি তো তোমার উপর কখনো রাগ করি নাই। তাহলে শুন।
-আজ থেকে বহু বছর আগে, তোমার থেকেও ছোট একটা বয়সে আমি একটা নামীদামী ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলাম। আমার আইকিউও তোমার থেকে বেশি ছিলো। আমিও তোমার মতো সব সমস্যা অনেক দ্রুত এবং সঠিকভাবে সমাধান করতে পারতাম। আমার ক্লাশ টিচার, আমার সহপাঠী সববন্ধুরা, আমার পরিবার, আমার আশেপাশে যারা ছিলেন, তারা আমাকে এতোটাই সমিহ করতেন যে, আমার ভিতরে একটা জড়তার মতো শক্তি কাজ করতে থাকলো। আমার যত ইনোভেটিভ আইডিয়া, আমার যতো মেধা এবং যতোটুকু আমার আরো দেবার দরকার ছিলো তাতে আলসেমির একটা ভাব চলে আসে। মনে হতো, আমি তো সবই জানি, সবই করতে পারি। ফলে আমার চিন্তাশক্তি, চিন্তার মননশীল প্রবাহ স্লথ হয়ে আসে। যতোটুকুন আমি এগিয়ে যেতে পারতাম, তার থেকে আমি অনেক গুন কম অগ্রসর হতে পেরেছি কারন আমার পাশে শুধু চাটুকারের মতো অবুঝ লোকজনই বেশি ছিলো। আমি যখন এটা বুঝতে পারি, তখন নিজের কাছে আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়েছে এই কারনে যে, আমি আমার মেধার যথেষ্ট প্রতিফলন ঘটাতে পারি নাই, আমার মেধার চর্চা হয় নাই। এই সব লোকদের অহেতুক ভালোবাসা আর নির্বোধ স্নেহের কারনে আমি ধীরে ধীরে সাধারন একটা মানুষের সাড়িতে দাড়িয়ে ছিলাম। আজ যখন আমি তোমার দিকে তাকাই, তখন আমার কাছে মনে হয়েছে, তুমি নিজেও ওই সব চাটুকারদের ফাদে আটকে যাচ্ছো যেখান থেকে তুমি তোমার পুরু মেধার ফলাফল পাবে না। আমি ওইসব লোকদের কারনে ঠকেছি কিন্তু আমি তোমাকে ঠকতে দিতে চাই নাই। তাই আমি সবসময় আরো বেশী চাই, আরো বেশী করে তুমি তোমার মেধার শক্তি প্রয়োগ করো সেটাই চেয়েছি। ফলে আমি তোমাকে সবার মত তোমার কৃতকর্মের ফলাফলে তোষামোদি না করে, অহেতুক বাহবা না দিয়ে তোমার ভিতরের মেধাশীল আত্মাটাকে আরো নেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমি আমার ওই ব্যবহারের মাধ্যমে এটা বুঝাতে চাই নাই যে, আমি তোমাকে স্নেহ করি না, ভালোবাসিনা কিংবা আমি তোমার উপর বিরক্ত। আমি তোমাকে সবার থেকে বেশী ভালোবাসি, এটা আমি তোমাকে বুঝতে দিতে চাই নাই। আমি চাই নাই, আমার অতি আদরের মতো একটা শিশু যে অসামান্য মেধা নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছে , সে অন্যসব লোকদের তোষামোদিতে গা ভাসিয়ে দিয়ে মেধার বিকাশ থামিয়ে দিক। আমি যা হতে পারি নাই, আমি তোমার মত একজন অসামান্য সন্তানের কাছ থেকে সেটাই পেতে চেয়েছি। এইটুকু বলে ক্লাশ টিচার থামলেন।
তারপর তিনি আবারো বলতে লাগলেন,
-আজ তোমাকে একটা বাস্তব উপদেশের কথা বলি। যা তুমি বাস্তবে দেখছো, তা তুমি সত্যি দেখছো না সবসময়। যে আজ তোমাকে নিয়ে অনেক গল্প করে, সেই কোনো একদিন তুমি খসে গেলে অন্য রকমের গল্প করবে। যে আজ তোমার অনেক কাছের বন্ধু বলে মনে হবে, সে আসলে তোমার বন্ধু নয়। এর মধ্যে অনেকে আছে যারা তোমার সত্যিকারের বন্ধু বটে কিন্তু তোমার মেধাকে জাগ্রত করতে তাদের মেধা নেই। হয়ত তারা তোমার কোনো ক্ষতি চায় না। কিন্তু তাদের অহেতুক বাহবা কিংবা তোমার মেধা যে বিকশিত হচ্ছে না এটাই হয়ত তারা বুঝতে পারে না। ফলে তাদের অতিরিক্ত স্নেহশীলতা, অতিরিক্ত ভালোবাসা তোমার মেধাশীল চিত্তের ক্ষতি নিশ্চয়ই হবে যা তারা নিজেরাও জানেন না। অন্যদিকে, যাকে তুমি আজ মনে মনে অপছন্দ করছো, হয়তবা সেই তোমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু যাকে তুমি চিনতে পারছো না। চোখ সবসময় সঠিক জিনিষ দেখে না, আর সঠিক জিনিষ না দেখার কারনে মুল্যায়নটাও সঠিক হবে না। তোমাকে আমার মত করে বড় করার জন্য কখনো তোমাকে আগুনের তাপের মত কষ্ট, আমার রাগের মত হিংস্রতা, আমার নির্দয় ব্যবহারের মত মানসিক কষ্ট সহ্য করতে হবে। যদি সহ্য করতে না পারো, তাহলে আমার দেখানো পথে তুমি কিভাবে আরো বড় হবে? তাহলে আমি আমার এই জ্ঞ্যানের সাম্রাজ্য কিভাবে তোমার কাধে দিয়ে যাবো? ওস্তাদের কাজ শাগরেদ গড়ে তোলা, আর সাগরেদের কাজ ওস্তাদের সব কিছুকে পজিটিভভাবে নেওয়া। ব্রুসলী একদিনে তৈরি হয় নাই, নবাব সিরাজ একদিনে সৃষ্টি হয় নাই, অলিম্পিকের একটা গোল্ড মেডাল একবার দৌর দিয়েই পাওয়া যায় না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস তাঁকে চর্চা করতে হয়েছে ঘাম, পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে। সাফল্য চুপে চুপে এসেছে এই তথ্য কেউ কখনো দিতে পারবে না। তারজন্য অনেক ধৈর্য আর সঠিক গুরুর দরকার। এতো অল্পতেই হেরে গেলে চলবে? আমি তো আছি তোমার পাশে।
এই বলে ক্লাস টিচার ছেলেটিকে বুকে নিয়ে কিছুক্ষন ধরে থাকলেন, তিনি শুনতে পেলেন, তার বুকে মাথা রাখা এক অবুঝ কিন্তু অসামান্য মেধাশীল বালকের ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার শব্দ। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তার জামা ভিজে যাচ্ছে বালকের অশ্রুসিক্ত জলে। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, এই অসামান্য মেধাশীল বালককে আর নতুন করে কিছুই বলার নাই। মেধাই তাঁকে সব অজানা না বলা কথা তার অন্তরে অন্তরে গেথে দিচ্ছে।
ক্লাশ টিচার বালককে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে বুকে আগলে ধরে রাখলেন চরম মমতা দিয়ে। হয়ত তারও এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ছিল বালকের ক্ষুদ্র কেশবি মাথায়। রাতের ক্ষিন আলোছায়ায় হয়ত তার কিছুই দেখা গেলো না।
সিনেমাটা এখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো।
মোরালঃ মেধাশীল হলেই সাফল্য পাওয়া যাবে তা সঠিক নয়। মেধাশীলদের মেধা চাটুকারদের কিংবা অবুঝদের ফাদে পড়ে সাফল্য বাধাগ্রস্থ হয়, সেটাই সঠিক। কিন্তু যোগ্যব্যক্তির সব ব্যবহার বুঝতে না পাড়লেও কিংবা পছন্দ না হলেও তার আশেপাশে থাকাই হচ্ছে সাফল্যের সোপান। দেখুন, শিখুন এবং বুঝুন কোন ব্যবহার কি কারনে সাফল্যধারি মেধাশীল ব্যক্তি করেন। আর এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে অভিজ্ঞতার ভান্ডার। নিতে পারলে ভালো, আর না নিতে পারলে ক্ষতি তার, যে নিতে পারে নাই।
(এইরুপ একটা জ্ঞ্যানি ব্যক্তি কে তার কাহিনি আমাদের পবিত্রগ্রন্থ “আহজাবে কাহাফ” (সম্ভবত) নামক সুরায়ও বর্ণিত আছে সেখানে হযরত মুসা (আঃ) অবলোকন করেছেন কোনো এক জ্ঞ্যানি ব্যক্তির অনেকগুলি ব্যবহার দেখে, যেখান থেকে তিনি পরবর্তীতে বুঝেছিলেন যে, ওই জ্ঞ্যানি ব্যাক্তি সবগুলি কাজ ভালো নিয়তেই করেছিলেন কিন্তু হযরত মুসা তার মেধার ভিত্তিতে বুঝতে পারেন নাই। পরবর্তীতে তিনি অধৈর্য হয়ে যাওয়াতে ওই জ্ঞ্যানি লোকের সহচর্জ ছাড়তে হয়েছিলো তাঁকে)
১৪/০৮/২০১৬- ৯/১১ এর ফল রাইস ভুইয়া
Categories
৯/১১ এর আসল হোতা কে বা কারা, এই তথ্যটা আজো পর্যন্ত জানা না গেলেও বিশ্ববাসী জানে যে, এটার পিছনে মুল পরিকল্পনাকারি যিনি তিনি একজন মুসলমান নামধারি ব্যক্তি। ফলে, ৯/১১ এর পরে হতাৎ করে সারাবিশ্ব মুসলমানদের প্রতি একটা খারাপ ধারনা করে নেয়। কেউ এটাকে কিছু বিচ্যুত ধার্মিক লোকের কাজ বলে মনে করেন, কেউ আবার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এটাই ইসলাম সমর্থন করে বলে মনে করেন ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, ৯/১১ এ যারা প্রান দিয়েছেন, তারা আর যাই হোক, তারা নিরীহ এবং শান্তিপ্রিয় মানুষ ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। তারা তাদের নিজের ধর্ম নিজের মত করেই পালন করতেন, সেখানে কারো সঙ্গে কারো বিরোধ ছিলোনা। ওইসব নিরীহ মানুষগুলুর অসময়ের প্রানত্যাগ আমাদের সবাইকে অনেক অনেক ব্যথিত করে তুলেছিল এবং এখনো ব্যথিত করে। যারা ওইসব মানুগুলুর নিকটাত্মীয় ছিলেন, বন্ধু বান্ধব ছিলেন, যাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক ছিলো তাদের কাছে ওইসব মানুসগুলুর প্রানত্যাগ তো কোনোভাবেই সহ্য করার মত ছিলো না। ফলে কারো মনে ঘৃণা, জিদ, আক্রোশ যে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। আর এই আক্রোশ, ঘৃণা, কিংবা জিদ যাইই বলি না কেনো, তার থেকেই ঘটনা পরবর্তী অনেক কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে। যেমন, মার্ক স্ট্রুম্যানের কিলিং মিশন।
৯/১১ এর ১০ দিন পর, রাইস ভুইয়া মার্ক স্ট্রুম্যানের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হন এবং মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে থাকেন। এখানে রাইস ভুইয়া সম্পরকে কিছু না বললে ভুল হবে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একজন নাগরিক। তিনি সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে বাংলাদেশ এয়ার ফোরসেও যোগদান করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি কম্পিউটার টেকনোলোজি পড়ার জন্য আমেরিকার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন। প্রথমে তিনি নিউইয়র্ক পরে তুলনামূলকভাবে কম খরচের স্ট্যাট ডালাসে চলে যান এবং সেখানে তিনি তার এক বন্ধুর গ্যাস স্ট্যাসনে পার্টনারশিপ ব্যবসায় যোগ দেন।
এবার আসি, মার্ক স্ট্রুম্যান সম্পরকে কিছু কথা। মার্ক স্ট্রুম্যান একজন দৈনিক শ্রমিকের কাজ করতেন ওই ডালাস শহরেই। ৯/১১ ঘটনার পরে মার্ক স্ট্রুম্যান এতোটাই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন মুসলমানদের উপর যে, তিনি আরব বংসোউদ্ভুত কিংবা মধ্যপ্রাচ্য, কিংবা মুসলমান যে কোনো দেশের অধিবাশিই হোক, তাদেরকে খুন করাই ছিলো তার নিশানা।
এই কিলিং মিশন এর এজেন্ডা হিসাবে মার্ক স্ট্রুম্যান ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে ডালাসের এক শব্জি দোকানে ওয়াকার নামে এক পাকিস্থানিকে এবং তার ৬ দিন পর রাইস ভুইয়াকে সরাসরি গুলি করেন। ভাগ্য চরম ভালো যে, জনাব রাইস ভুইয়া প্রানে মারা যান নাই কিন্তু তার ডান চোখের দৃষ্টি হারিয়ে যায় এবং এখনো তার দেহে প্রায় ৩৫টি প্যালেট বিদ্যমান যা অস্ত্রপ্রচারেও বের করা সম্ভব হয় নাই। অবশেষে মার্ক স্ট্রুম্যানকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং বিচারের সম্মুখীন করে।
সবশেষে মার্ক স্ট্রুম্যান এর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু জনাব রাইস ভুইয়া এই মৃত্যুদণ্ডের বিপরিতে আপীল করেন যাতে মার্ক স্ট্রুম্যানকে হত্যা না করা হয়। জনাব রাইস ভুইয়া টেক্সাস এমেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর ডেথ পেনাল্টি আবোলিসন ক্যাম্পেইন এর মাধ্যমে, কোর্টের মাধ্যমে, এমনকি নিজে সশরীরে আদালত প্রাঙ্গনে হাজির হয়ে মার্ক স্ট্রুম্যানের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করানোর জন্য দাঁরে দাঁরে ঘুরেছেন। এইভাবে প্রায় ১০ বছর পার হয়ে গেছে মার্ক স্ট্রুম্যানের বিচার কার্যকরী করতে।
বিশ্বের সবাই অবাক হয়ে শুধু একটা প্রশ্নই জনাব রাইস ভুইয়াকে করেছেন, কেনো তিনি তার ঘাতককে ক্ষমা করে দিচ্ছেন, শুধু ক্ষমাই না, তাকে মুক্তজীবন দান করতে চাচ্ছেন? জনাব রাইস ভুইয়া যা বলেছেন তা আমি হুবহু লিখছি যাতে কোনো কিছু ব্যত্যয় না ঘটে।
Q: Mr. Stroman has admitted trying to kill you. Why are you trying to save his life?
A: I was raised very well by my parents and teachers. They raised me with good morals and strong faith. They taught me to put yourself in others’ shoes. Even if they hurt you, don’t take revenge. Forgive them. Move on. It will bring something good to you and them. My Islamic faith teaches me this too. He said he did this as an act of war and a lot of Americans wanted to do it but he had the courage to do it — to shoot Muslims. After it happened I was just simply struggling to survive in this country. I decided that forgiveness was not enough. That what he did was out of ignorance. I decided I had to do something to save this person’s life. That killing someone in Dallas is not an answer for what happened on Sept. 11.
প্রশ্ন ছিলোঃ মার্ক স্ট্রুম্যান স্বীকার করেছেন যে তিনি আপনাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আপনি কেনো তাকে বাচাতে চাইছেন?
জনাব রাইস ভুইয়ার উত্তর ছিলো; আমি আমার পিতামাতা এবং শিক্ষকদের দ্বারা অতি উত্তম শিক্ষায় মানুষ হয়েছি। তারা আমাকে নীতির মধ্যে এবং শক্ত বিশ্বাসের উপর মানুষ করেছেন। তারা আমাকে অন্যের জায়গায় বসিয়ে তাদের দিকটা বিবেচনা করার শিক্ষা দিয়েছেন। তারা আমাকে শিখিয়েছেন, কেউ যদি তোমাকে দুঃখ দেয়, প্রতিশোধ নেওয়ার দরকার নাই, এবং নিও না। তাদেরকে ক্ষমা করে দাও। সামনে এগিয়ে চলো। এতে তোমার এবং অন্যের উভয়ের মঙ্গল হবে। আমার ধর্ম ইসলামও তাই শিক্ষা দেয়। মার্ক স্ট্রুম্যান যা করেছে, তা একটা যুদ্ধের পরিস্থিতির মতো মনোভাব এবং এই মনোভাবটা অনেক আমেরিকানরাই মনে মনে পোষণ করে যা স্ট্রুম্যান করেছে। হয়ত তারা (আমেরিকানরা) করার সাহস পাচ্ছিলো না কিন্তু মার্ক স্ট্রুম্যান করার সাহস পেয়েছিলো। এই ঘটনা ঘটার পর আমি শুধু নিজেকে এই দেশে বেচে থাকার জন্য সামলে নিয়েছি, অনেক কস্ট করেছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, শুধু তাকে ক্ষমা করাই একমাত্র সমাধান নয়, মার্ক স্ট্রুম্যান যা করেছে তা সে তার নির্বুদ্ধিতার কারনে করেছে, সে বুঝে নাই। এখন আমার কাজ তাকে বাঁচানো। ডালাসে বসে কাউকে খুন করাই সেপ্টেম্বর ১১ তে কি হয়েছে তার সমাধান হবে না।
শেষ পর্যন্ত আদালত মার্ক স্ট্রুম্যানের পূর্বের রেকর্ড, তার চরিত্রের বৈশিষ্ট সবকিছু চুলচেরা বিস্লেসন করে মৃত্যুদণ্ডই বহাল রাখেন এবং ২১ জুন ২০১১ তে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করেন। মৃত্যুর আগে মার্ক স্ট্রুম্যানকে প্রশ্ন করা হয়েছিলোঃ
Q: How are you doing, Mr. Stroman?
A: “I ’ve only 25 days left until Texas Straps me to a gurney and pumps me full of toxic bug juice, But then again, we all face an ending at some time or another. All is well, Spirits are high, I sit here with a cup of coffee and some good ole classic rock playing on my radio, how Ironic, the song ‘Free Bird’ by Lynyrd Skynyrd…”
Q: What do you think of Rais Bhuiyan’s efforts to keep you from being executed? A: “Yes, Mr Rais Bhuiyan, what an inspiring soul…for him to come forward after what I’ve done speaks volume’s…and has really touched my heart and the heart of many others World Wide…especially since for the last 10 years all we have heard about is how evil the Islamic faith can be…its proof that all are Not bad nor evil.”
Q: Tell me what you are thinking now, a few weeks before your scheduled execution.
A: “Not only do I have all my friends and supporters trying to save my life, but now I have The Islamic Community Joining in…Spearheaded by one very remarkable man named Rais Bhuiyan, who is a survivor of my hate. His deep Islamic beliefs have gave him the strength to forgive the un-forgiveable…that is truly Inspiring to me, and should be an example for us all. The Hate, has to stop, we are all in this world together. My jesus faith & Texas Roots have deepened my understanding as well. Its almost been 10 years since the world stopped turning, and we as a nation will never be able to forget what we felt that day, I surely wont, but I can tell you what im feeling today, and that’s very grateful for Rais Bhuiyan’s efforts to save my life after I tried to end his. A lot of people out there are still hurt and full of hate, and as I sit here on Texas Death watch counting down to my own death, I have been given the chance to openly express whats inside this Texas mind and heart, and hopefully that something good will come of this. We need more forgiveness and understanding and less hate.” Mr. Stroman signed off, “Texas Loud & Texas proud…TRUE AMERICAN…. Living to Die – Dying to Live.”
বাংলায় অর্থঃ
মৃত্যু পথযাত্রি মার্ক স্ট্রুম্যানকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো,
(১) আপনি এখন কেমন আছেন?
উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “টেক্সাস আদালতের রায় অনুযায়ী বিষ প্রয়োগ করে আমাকে মেরে ফেলার আর মাত্র ২৫ দিন বাকি আছে। সবাই মরবে, আজ অথবা কাল। সব কিছুই ভাল, বিধাতাও ভালো। আমি এখন এখানে এক কাপ কফি আর কিছু খেলার সরঞ্জামাদিসমেত কিছু কিছু রক মিউজিক শুনছি রেডিওতে। আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে একটা গানের কলি শুনি, আর তা হচ্ছে, পাখিকে মুক্ত করে দাও……”
(২) মার্ক স্ট্রুম্যানকে ২য় প্রশ্ন করা হয়েছিলো যে, আপনাকে বাচিয়ে রাখার জনাব রাইস ভুইয়ার আপ্রান চেস্টা আপনাকে কি মনে করিয়ে দেয়? বা আপনি কিভাবে ভাবছেন জিনিষটা?
উত্তরে মার্ক স্ট্রুম্যান বলেছে, “হ্যা, সত্যি কি স্পিরিচুয়াল (আধ্যাত্মিক) একজন মানুষ। আমি যা করতে চেয়েছিলাম তা তিনি জেনেও কি অবাক যে তিনি আমাকে বাচানোর জন্য আপ্রান চেস্টা করে যাচ্ছেন যা আমাকে এবং আমার মত অনেক আমেরিকানদের তথা বিশ্বাসীর হৃদয় পর্যন্ত ছুয়ে যাচ্ছে। এই গত দশ বছরে আমরা যত খারাপ খবর কিংবা মিথ্যা দর্শন শুনেছি ইসলাম সম্পরকে এবং ইসলাম ধর্ম পালনকারীদের সম্পরকে, তা আসলেই সঠিক নয়। এখন এটাই প্রমান হয় যে, সবাই খারাপ না, সবাই শয়তান নয়।
মার্ক স্ট্রুম্যানকে ৩য় প্রশ্ন করা হয়েছিলো যে, তিনি মৃত্যুর এই কয়েক সপ্তাহ আগে কি ভাবছেন?
উত্তরে মার্ক স্ট্রুম্যান বলেছিলেন, ” এখন শুধু আমার আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধু বান্ধবই আমাকে বাচানোর চেস্টা করছে না, বরং আমার ঘৃণার কারনে আমার দ্বারা গুলিবিদ্ধ এবং গুলিবিদ্ধ মৃত্যু থেকে বেচে আসা জনাব রাইস ভুইয়ার মাধ্যমে পুরু ইস্লামিক কমিউনিটিকে সঙ্গে পাচ্ছি যেনো আমি আমার জীবন আবার ফিরে পাই। তার(জনাব রাইস ভুইয়ার) ধর্মের পরম যে শিক্ষা যে, ক্ষমা করো এমন কি তাকেও যে ক্ষমার জন্যও যোগ্য নয়, তার এই বিশ্বাস আমাকে প্রচন্ড নাড়া দিয়েছে এবং এটা পৃথিবীর কাছে একটা উদাহরন হয়ে থাকবে। এখন আর ঘৃণা নয়, এটাকে থামাতে হবে। আমরা সবাই একই পৃথিবীর লোক। যীশুর এবং টেক্সাস রুটের উপর আমার বিশ্বাস আরো গভির হয়েছে। আজ থেকে ১০ বছর আগে যা ঘটেছিলো তা আমি এবং আমার দেশ কেহই হয়ত কখনো ভুলে যাবে না। এটাও ঠিক যে, ওই সময় আমরা নাগরিক হিসাবে কি ভেবেছি তা এই মুহূর্তেও বলা কঠিন কিন্তু এটা ঠিক যে, আজ এই মুহূর্তে আমি জনাব রাইস ভুইয়ার কাছে কৃতজ্ঞ যাকে আমি ঘৃণার কারনে মারতে চেয়েছিলাম। আমি এটাও জানি যে, আজো অনেক দেশবাসীর মনে কষ্ট আছে, দুক্ষ আছে, যন্ত্রনা আছে, ঘৃণাও আছে। কিন্তু এই ঘৃণা কমাতে হবে, আমাদের আরো সহনশীল হতে হবে। আমি খুব ভাগ্যবান যে, আমি মৃত্যুর আগে অন্তত আমার মনের কথাগুলি এই টেক্সাসবাসিকে বলতে পারলাম। আমি চলে যাচ্ছি। Living to Die – Dying to Live.”
জনাব রাইস ভুইয়ার সঙ্গে আমার কয়েকবার ফেসবুকে কথা হয়েছে। খুব ভালো লেগেছে তার এই মনোভাবের জন্য। তিনি একটা ওয়েব পোর্টাল খুলেছেন, নামটাও সুন্দর, WORLD WITHOUT HATE. আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার ওই ওয়েবপোর্টালের পাচ আঙুলের আইকন দিয়ে তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন। মিনিংটা আরো সুন্দর। আমি অবশ্য এখন তার ওয়েব পোর্টালের একজন সদস্য বটে। সবশেষে তিনি গত রোজায় ওভাল অফিসে দাওয়াত খেয়েছেন প্রেসিডেন্ট ওবামার দাওয়াতে। বিশেষ ইফতারির আয়োজন করা হয়েছিলো জনাব রাইস ভুইয়ার সম্মানে। শুনেছি এখন তাঁকে নিয়ে এই প্রেক্ষাপটে একটা বিশ্বব্যাপি ম্যাসেজ দেওয়ার জন্য ছবি বানানো হবে যেখানে আমাদের রাইস ভুইয়া নিজেই থাকবেন। আমি তার একজন প্রাক্তন সিনিওর ক্যাডেট ভাই হিসাবে নয়, বাংলাদেশী হিসাবে বড় গর্ববোধ করি। আমি তার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
(নোটঃ রাইস ভুইয়াকে বলছি, তোমার অনুমতি ছাড়াই আমি এই কথাগুলি আমার ফেসবুক বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করলাম। আশা করি অপরাধ মার্জনীয়। আর তুমি এটাই করো)।
১২/০৮/২০১৬-কেনো জেনারেশ গ্যাপ হচ্ছে?
Categories
জেনারেশন গ্যাপ কেনো হচ্ছে এটা জানতে পারলে আমাদের সমাজের সব শ্রেনির বাবা মায়েরা অন্তত তাদের কি করা উচিত সে ব্যাপারে একটু সচেতন হতে পারতেন। আমরা যারা বারবার বলছি যে, পরিবারে সচেতনাতা বাড়াতে হবে, সমাজে সচেতনতা বাড়াতে হবে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সচেতনাতা বাড়াতে হবে, তাহলে সেই কিসের উপর সচেতনতা বাড়াতে হবে জানা দরকার, তাহলেই সচেতনতাটা বাড়বে। চলুন দেখি তাহলে জেনারেশন গ্যাপ কি কি কারনে হচ্ছে সেটা আগে খুজে বের করি। তারপর এর বিপরিতে আমাদের কি করা উচিত, সেটা বের করা যাবে, হোক সেটা পরিবারের জন্য, হোক সেটা সামাজিকভাবে আর হোক সেটা রাষ্ট্রীয়ভাবে। সেই কার্যপ্রণালী বের করা কঠিন হবে না।
প্রকৃতপক্ষে মোদ্দা কথায় যদি বলি, তাহলে ব্যাপারটা আর কিছুই না, মানুষের পৃথক পৃথক ইন্টারেস্টের কারনে, তাদের নিজস্ব ভ্যালু বিশ্লেষণের কারনে, বয়সের তারতম্য, বাকস্বাধীনতা, মুক্তচিন্তার প্রসার, লাইফ স্টাইল, এস্পিরেসন, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, শিক্ষাব্যবস্থা, সাইকোলোজিক্যাল ডেভেলপম্যান্ট, ফিজিক্যাল পরিবর্তন, ইত্যাদি সবের কারনেই এই জেনারেশন গ্যাপটা তৈরি হয়। আর এইটা একদিনে বা এক সপ্তাহে বা এক মাসের মধ্যেই ঘটে না। এটা ঘটে ধিরে ধিরে, সামস্টিকভাবে, লম্বা সময় ধরে।
ব্যাপারটা আরো সহজ করে যদি বলি, যেমন ধরুন, ৪০ কিংবা ৬০ এর দশকে এমন কি ৭০ কিংবা ৮০ এর দশকেও শিক্ষা ব্যবস্থাটা এমন ছিলো যেখানে চরিত্র গঠন, ডিসিপ্লিন এবং ইউনিফর্মিটি ছিল মুখ্য বিষয়। মুখস্থবিদ্যা দিয়ে অনেকে না বুঝেই অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছেন। তাদের নিজস্ব চিন্তাধারা বিকশিত হতে হতে ইতিমধ্যে তারা একটা এডাল্ট মানুসের রূপ নিয়ে নিয়েছেন। যে সময়টায় এখন ইয়াং জেনারেশন বিপথগামিতে হাটছেন, ওই সময় তারা এই কঠিন ডিসিপ্লিন, নিয়মানুবর্তিতার কারনে সময়টাই পার করে দিয়েছেন। কিন্তু আজকাল শিক্ষা ব্যবস্থায় চরিত্র গঠনের কিংবা ডিসিপ্লিন তথা ইউনিফর্মিটির ব্যাপারটা আর মুখ্য নাই। এখানে মুক্তচিন্তা ধারায় এক ধরনের বিশ্লেষণধর্মী স্বাধীনতা এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আদলে সে নিজে যা সেন্সিব্যাল মনে করে সেটাই শেষ কথা। ফলে সমস্যা নিরসনের ক্ষেত্রে আগের যুগের মানুষের থেকে বর্তমান যুগের ইয়াং জেনারেশনের কাছে মেথডটাই আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ইয়াং জেনারেশনের ভিসন আর ওল্ড জেনারেশনের ওই একই বয়সের তুলনায় ভিসনের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য বনে যাচ্ছে। এটা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ত্রুটি বলতে হবে। এই ব্যাপারে হয়ত আমরা রাষ্ট্রীয় সচেতনতার কথা মাথায় আনবো পরবর্তী পর্বে।
আরেক দিক দিয়ে বলি, ধরুন, ওয়ার্ক প্যাটার্নে ওল্ডার জেনারেশন তাদের সময়ে জব সল্পতার কারনেই হোক আর কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই হোক, তাদের জবটাকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য নিরবিচ্ছিন্ন এবং সততার সহিত দিনের পর দিন অফিস সমুহের যাবতীয় আইনকানুন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও মেনে শেষতক চালিয়ে গেছেন যা আজকালকের ইয়াং জেনারেশন এটার ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ফলে আইনের বাধায় তারা খুব একটা বিদ্ধ হতে চায় না। তারা স্বাধীন, ইচ্ছে হলো কাজ করবেন, ভালো লাগলো তো থাকবেন, আর পছন্দ হয় নাই, কিচ্ছু যায় আসে না, পরের দিনই জব ছেড়ে দিলেন। এই যে একটা খামখেয়ালীপনার মতো স্বাধীনতা, একটা ছিঁড়া ছিঁড়া ভাব, তাতে অনেক কিছুই আর সংঘবদ্ধ থাকে না। না কর্মক্ষেত্রে না বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে না পারিবারিক দায়িত্ববোধে। ধিরে ধিরে এই কোহেসিভনেসটা কমতে থাকে। বন্ধন কমতে থাকে। এর মধ্যে আবার যোগ হয়েছে হাই-টেক। এই হাই-টেকের জন্য ইন্টার-পারসোন্যাল রিলেসনটা হিউম্যান এলিম্যান্ট থেকে আরো দূরে চলে গেছে। এতে বড়দের সাথে গ্যাপটা আরো বেশি বেড়েছে। পরামর্শের জায়গাটা কিংবা মতাদর্শের আদান-প্রদান গুলি আস্তে আস্তে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। এই সচেতনতার বিরুদ্ধে হয়ত আমরা পরবর্তীতে আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে সচেতনতার কথা বলবো।
আরেকটা বিষয় না বললেই না। আর সেটা হচ্ছে মিডিয়া। মিডিয়ার মাধ্যমে যদিও আজকালকের ইয়াং জেনারেশনকে অনেক সুযোগ সুবিধা দিয়ে মার্কেটে কম্পিটিটিভ করে তুলছে কিন্তু অন্যদিকে তাকে ইমোশনাল গ্রাউন্ডে আনপ্লিজেন্টও করে তুলছে। ইয়াং জেনারেশন সবাইকে এই মিডিয়া এক কাতারে নিয়ে এসে প্যারেন্টাল গাইডেন্সের থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়ে একই সমসাময়িক বয়সের গাইডেন্সে আবেশিত করে দিচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। ফলে ট্র্যাডিশনাল ভ্যালুগুলু থেকে ইয়াং জেনারেশন গ্লোবাল হাইপোথিসিসে বা কন্সেপ্টে বেশি করে ঝুকে পড়ছে। আর যখনই ইয়ং জেনারেশন তাদের ট্র্যাডিশনাল ভ্যালুগুলু থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তখনই হচ্ছে বেশি করে বিপত্তি। কালচার, সামাজিক আস্থা, পারিবারিক অবস্থান, নিজস্ব ক্যাপাবিলিটি ইত্যাদির উপর তার তখন নিয়ন্ত্রণ লোপ পেতে থাকে। আর এই লোপ ধিরে ধিরে তাকে তার অবস্থান থেকে অনেক দূরে সরিয়ে প্রতিনিয়ত বিপথগামি অথবা অবাস্তব একটা কোহেলিকার দিকে ঠেলে দেয় যা সে নিজেও বুঝে না।
এর মধ্যে যোগ হয় আবার পরিবারের ইরেসনাল এক্সপেকটেশন। আর এই ইরেসনাল পারিবারিক এক্সপেক্টেসনটা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে জেনারেশন গ্যাপের বেলায়। আর এটা শুরু হয় একেবারে ছোট বয়স থেকেই। যেমন ধরুন, পিতামাতার স্বপ্নের চাহিদা তারা তাদের সন্তানের ইচ্ছা বা খুশির বিনিময়ে হলেও তা তাদের উপর চাপিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেন না। সন্তানের চাহিদার থেকে অভিভাবকের চাহিদা পুরুন করতেই ইয়াং জেনারেশনের জীবন হিমসিম খেতে হচ্ছে। তার ইচ্ছা থাকুক আর নাই বা থাকুক, সে পারুক আর নাই বা পারুক। তার ভাল লাগুক আর নাই বা ভালো লাগুক। সন্তান আর্ট করতে ভালবাসেন, তাকে ডাক্তারি পড়তেই হবে, সন্তান গান শিখতে ভালোবাসেন, তাকে জিওগ্রাফী নিয়ে পড়তেই হবে। পিতামাতারা ভুলেই যান যে, তাদের সন্তানের একটা এস্পিরেসন আছে, তার একটা ভাল লাগার ব্যাপার আছে কিংবা তার নিজস্ব একটা পরিমন্ডল আছে। আর যখনই কোন ইয়াং জেনারেশন তাদের ইচ্ছার এই প্রতিফলনের জন্য বেকে বসবে, তখনই শুরু হবে দুই জেনারেশনের মধ্যে একটা অলিখিত কনফ্লিক্ট। গ্যাপ তো তখনই সৃষ্টি হয়ে গেলো। এই গ্যাপ থেকে তৈরি হয় আরো গ্যাপের। যেমন, পিতামাতা মনে করেন যে, তারা এই বয়সে তাদের বাবা মায়ের সঙ্গে কিভাবে আচরন করেছেন তার তুলনা, তারা এই বয়সে ঐ সময়ে কি ধরনের কাপড় পরিধান করেছেন তার তুলনা, তারা কি কি স্বাধীনতা পেয়েছেন তার একটা খতিয়ান, কিংবা সপ্তাহান্তে বন্ধুর বাড়ীতে বেড়াতে যেয়ে রাত্রি যাপনের অনুমতি দেওয়া না দেওয়ার ব্যাপারে তুলনা, এমন কি কি ধরনের হেয়ার কাট নিতেন আমাদের ওল্ডার জেনারেশন ইত্যাদি যখন পিতামাতা দিতে শুরু করেন, তখন এই দুই জেনারেশন এমন একটা অবস্থায় দাড়ায় যে, মনে হয় একে অপরের বিপরিতে অবস্থান নিয়েছেন, মনে হয় তারা একে অপরের ভাষাই বুঝতে পারছেন না। ফলে পরিবারে সমঝোতা নষ্ট হচ্ছে, শান্তি নষ্ট হচ্ছে আর বেড়ে চলছে একে অপরের থেকে দুরত্ত।
সামাজিক ক্লাস বিভক্তিও কিন্তু ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে গ্যাপ তৈরির একটা ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। একটা সময় ছিলো যে, আমাদের দেশে বিখ্যাত গায়িকা রুনা লায়লা আর সাবিনা ইয়াসমিন কখনো একসঙ্গে এক স্টেজে গান করতেন না। কারন কে কার থেকে বড় সেটা যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠে? ঠিক এমনিভাবে, নিম্নক্লাসের বা গরিব মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে উচ্চবিত্ত ক্লাসের সঙ্গে একটা ক্ল্যাশ সবসময়ই ছিলো। কিন্তু ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে এই ক্লাসভিত্তিক শ্রেনিবিন্যাশ এর প্রবনতাটা অনেকটাই কম। নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একজন ছাত্র যদি ভাল ফলাফল করে বা একজন ভাল গীটার বাজাতে পারে তাকে গানের দলের মধ্যে নেওয়ার মধ্যে কোণ দ্বিধাবোধ করে না। কারন ওল্ডার জেনারেশনের মতো ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে এই নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত সংস্কারে তাদেরকে কোন নেগেটিভ অনুভুতির খোরাক জোগায় না। এই জায়গাটা থেকে ওল্ডার জেনারেশন এখনো সরে আসতে পারে নাই। ফলে ছেলেমেয়ের প্রেম ঘটিত এফেয়ারস নিয়ে, বন্ধুত্ত তৈরি করতে গিয়ে কিংবা একই টেবিলে তাদের সঙ্গে খাবার খাওয়া নিয়ে পরিবারে ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে তার ওল্ডার জেনারেশনের মধ্যে একটা অলিখিত কনফ্লিক্ট তো বাধতেই পারে আর বাধেও।
এই রকম হাজারো হাজারো উদাহরণ টানা যাবে যেখানে খুব সুক্ষ কিন্তু গ্যাপ তৈরির জন্য ঐগুলু যথেষ্ট ভুমিকা রাখে। ধরলাম যে, এই গ্যাপগুলু দুই জেনারেশনের মধ্যে তৈরি হলো। তাতে কি হয়েছে? দেশ নষ্ট হয়ে যাবে? পরিবার নষ্ট হয়ে যাবে? কিংবা সমাজ? কি হবে যদি দুই জেনারেশন আলাদা আলাদা বাস করে? কেউ তো কাউকে ডিস্টার্ব করছে না। তাহলে কি দরকার দুই জেনারেশনের মধ্যে জোর করে আবার মিল করার? ওল্ডার জেনারেসন মরে গেলে তো আর কোনো কনফ্লিক্ট থাকে না। তখন তো শুধু ইয়াং জেনারেশনই থাকলো। তাহলে এতো কথা কেনো?
আছে, কথা আছে। কারন এই গ্যাপের কারনে কি কি ইমপ্যাক্ট হয় তাতো সার্বজনীন। সুদূরপ্রসারী। আর ওখানেই তো সব বিপত্তি। চলুন, আমরা সবাই এই নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট গুলু ধিরে ধিরে বের করি। সবাই কন্ট্রিবিউট করি আমাদের প্রয়োজনে। আমরা এই নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট গুলি বের করতে পারলেই আমরা সহজে বের করতে পারবো আমাদের কোথায় কোথায় সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং কাকে কাকে এই কাজে অংশ গ্রহন আবশ্যক।
……… (চলবে পরবর্তী ইমপ্যাক্ট অনুসন্ধানে, আপনিও কন্ট্রিবিউট করুন মতামত দিয়ে)
১০/০৮/২০১৬-জেনারেশন গ্যাপ
Categories
আমি একটা জার্নালে একবার একটা আরটিক্যাল লিখেছিলাম, “জেনারেশন গ্যাপ” এর উপর। আজ মনে হচ্ছে, এই জেনারেশন গ্যাপটা আমাদের অনেকদূর নিয়ে যাচ্ছে এবং খুব দ্রুত। আমি আমার সেই আরটিক্যালটার কিছু চুম্বক অংশ আজ আমাদের বন্ধু ফোরামে তুলে ধরতে চাই।
…… জেনারেশন গ্যাপটা আসলে হচ্ছে আধুনিক সময়ের ইয়াং বয়সের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদের ওল্ড জেনারেসনের মানুষগুলুর মধ্যে চিন্তাধারা, জীবনযাত্রা, অভ্যাস, এবং দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্যগুলি। এই জেনারেশন গ্যাপ থাকবেই, আগেও ছিল এবং এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু ভয়ংকর বিষয়টি হয়ে দাড়ায় যখন এই জেনারেশন গ্যাপটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, কালচার, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, এবং সাধারন দৃষ্টিভঙ্গিটায় একটা বিস্তর জাম্প করে। তখন যেটা হয় তা হচ্ছে প্রতিনিয়ত যুবক বয়সের জেনারেসনের সাথে ওল্ড জেনারেশনের মধ্যে মিসম্যাচ, এডজাস্টম্যান্ট, আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইত্যাদির সবকিছুতেই কনফ্লিক্ট করে। অতিতে এই গ্যাপটা ছিলো এবং মাঝে মাঝে যে বিস্তর জাম্প করে নাই তা কিন্তু নয়। সেই পরিস্থিতিতেও জেনারেশন গ্যাপটা কোনো না কোনোভাবে সহনীয় পর্যায়ে সামাল দেওয়া গেছে কারন তখন দুইপক্ষই একটা জায়গায় এসে এডজাস্টমেন্টের মধ্যে সহঅবস্থান করতে চেয়েছিলো এবং পেরেছিল।
এখানে আরো একটা তথ্য সহজ করে বলা ভাল যে, এই জেনারেশন গ্যাপটার মানে কি দাদাদের বয়সের সঙ্গে নাতীদের বয়সের যুগের পার্থক্য? অথবা এইটা কি ৩০ বছর সময়ের কোনো পার্থক্য? কিংবা ৫০ বা ৭০ বছরের সময়ের? আসলে তা না। এটা পিতামাতার এবং সন্তানের তাতক্ষনিক সময়ের মধ্যেও হতে পারে আবার দাদাদের বয়সের সঙ্গে নায়-নাতকুরের বয়সের ফারাকের মধ্যেও হতে পারে। এটা একটা স্পেসিফিক জেনারেশন থেকে আরেকটা স্পেসিফিক জেনারেশনের মধ্যেও হতে পারে।
যেমন উদাহরনসরুপ যদি বলি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পরে এবং রিপাবলিক অব জর্জিয়া যখন স্বাধীনতা পেলো, তখন সোভিয়েত আমলের বাবামায়ের সঙ্গে তাদের ঘরের সন্তানদের মধ্যে বিশাল একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর তফাত সৃষ্টি হলো। জর্জিয়ার উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা পুরুটাই পাশ্চাত্য ধাঁচের আদলে বদল হয়ে গেলো কিন্তু তাদেরই পিতামাতারা আগের দিনের সোভিয়েত কালচার, সভ্যতা নিয়ে ধরে থাকলো। এদের মধ্যে সময়ের পার্থক্যটা ছিলো মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধান। হয়ত ৫ থেকে ১০ বছরের। অথচ কিন্তু এতো অল্প সময়ের ব্যবধানের দুই জেনারেশনের মধ্যে একটা বিস্তর জেনারেশন গ্যাপের সৃষ্টি হয়ে গেলো। এবং দেখা গেলো, একই পরিবারের মধ্যেই এই ঘটনাটা ঘটে গেলো। এই দুই জেনারেশনের মধ্যে তাদের চিন্তাধারা, জীবনযাত্রার দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষাদীক্ষার লেবেল, আচরন, ভবিষ্যৎ চিন্তাধারা, আর্থসামাজিক ভাবধারা সবকিছুই আমুল পালটে গেলো। বর্তমান জেনারেশনের জীবন যাত্রায় চলে এলো মুক্তধারার স্বাধীনতার শক্তি, স্বাধীন চলাফেরা, নাইট ক্লাব, ইন্টারনেট, কম্পিউটার গ্যাম, বিনোদন, মুক্ত-রাজনীতির চর্চা এমন কি বিয়ে সাদির ব্যাপারেও আধুনিক কালের যুবকদের চিন্তাধারা অনেক পার্থক্য। তাদের চাকুরী পছন্দের বিষয়ে, চাকুরি ছাড়ার বিষয়ে, এমন কি অবসর প্লানের বিষয়ে কোনো কিছুই ঘরের পিতামাতাদের সহিত মিলছে না। অন্যদিকে পুরানো দিনের অভ্যাসে গড়া বাবা মায়েরা ধরে থাকলেন ট্র্যাডিসনাল সমাজ ব্যবস্থা। তারা বর্তমান যুগের ছেলেমেয়েদের অনেক সিদ্ধান্তের সঙ্গেই একমত হতে পারছে না, তাদেরকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে দিতে চাইছেন না কিংবা দিতে চাইছেন না বলে বললে ভুল হবে, তারা নিশ্চিত হতে পারছেন না যে, তাদের সন্তানেরা ঠিক হ্যান্ডেল করতে পারবেন কিনা, কিংবা শেষতক আবার তাদের সন্তানেরা দিশেহারা হয়ে যায় কিনা ইত্যাদি।
এর ফলশ্রুতিতে যা হচ্ছে তা হলো বিশাল এক গ্যাপ। আর এই গ্যাপের কারনেই একই পরিবারের মধ্যে যুবক এবং মধ্যবয়সী সদস্যদের মধ্যে বিশাল গ্যাপের সৃষ্টি হচ্ছে। আর সৃষ্টি হচ্ছে ফাটল, সৃষ্টি হচ্ছে সন্দেহ, তিক্ততা ইত্যাদি। ফলে কিছুতেই সুতা এক জায়গায় আবদ্ধ হয়ে নতুন জাল তৈরি না করে শুধু নৈরাজ্যসরুপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবারে কোনো কিছুই অভাব নাই আবার কোনো কিছুতেই ইয়াং বয়সের সদস্যদের মন টানছে না। তারা সস্থিতে নাই। তারা বিসন্ন। যাদের কাছ থেকে সহযোগিতার হাত পাওয়ার কথা তাদের সাথেই তাদের বিরোধ। যাদের কাছে তারা অসহায় মনের ভাব শেয়ার করবে, তারাই তার অসহয়ের কারন। সে কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? ফলে একই মানসিকতার বন্ধু, বান্ধবি, কিংবা তাকে বুঝতে চেস্টা করছে এমন কেউ, সেখানেই সে পায়ে পায়ে হেটে চলে যাচ্ছে তার অভাবহিন ঘর ছেড়ে, তার নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে কোনো একটা জায়গায় যেখানে সে আর কিছুই না পাক, পাচ্ছে মানসিক শান্তি। সেটা ভুল না ভালো না শুদ্ধ, তা তার জানার অপেক্ষা করছে না। আমরা বারবার বলছি পরিবারের সচেতনার কথা, বারবার বলছি কিছু একটা করা দরকার, বারবার বলছি সরকার কেনো দেখছে না, বারবার বলছি কেনো এই রকম এয়াবনরমাল অবক্ষয় হচ্ছে। কিন্তু সমস্যাটার ভিতরে কেউ প্রবেশ করছি না। আমার কাছে মনে হচ্ছে, সমস্যাটা আসলে কোনো রাজনৈতিক কিংবা পার্শ্ববর্তি দেশ, কিংবা কোনো একটা বিশেষ মতবাদের উপর দোষ চাপিয়ে খুব একটা লাভ হবে না। কিংবা চাপিয়ে দিয়েও কোনো লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না যতক্ষন না পর্যন্ত এই সুক্ষ কিন্তু বিস্তর গ্যাপটা সমাধান হচ্ছে।
আমার মনে হচ্ছে এই জেনারেশন গ্যাপটাই এখন আমাদের অত্যান্ত বুদ্ধিমানের সহিত হ্যান্ডেল করে পরিস্থতি আয়ত্তে আনা সম্ভব। এখন কথা হচ্ছে কি কারনে এই জেনারেশন গ্যাপটা হচ্ছে আর কিভাবে এই দুই জেনারেশনের গ্যাপ কমিয়ে এনে সার্বজনীন মতাদর্শ, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ, ইত্যাদি একটা প্লাটফর্মে আনা যায় তার হিসাব করা। বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা আসলে আমাদের পরিবার থেকে শুরু করে যার যার আওতায় বাধতে হবে। কিছু পরিবারের পক্ষে, কিছু সরকারের, কিছু সমাজের কিছু আমাদের চারিপাশের জনগনের। কেউ দায়িত্ব এরাইয়া যাওয়ার কোনো স্কোপ নাই। (চলবে…)
০৭/০৬/২০১৬ -আমার লাল পিকান্ত
বহুদিন পর হটাত করে আজ ওর সঙ্গে আমার দেখা। বুকটা আঁতকে উঠল ওকে দেখেই। আমাকে ও প্রথম দেখতে পায় নাই, ও খুব দ্রুত চলে যাচ্ছিল। আমি ওর পিছন থেকে এক নজর দেখেই চিনতে পেরেছিলাম, কারন ওর একটা পরিচয় বহনকারী কোড নাম্বারটা আমার আজীবন কালের চেনা। আমি ওকে ধরার জন্য ওর পিছন পিছন ছুটছিলাম। দেখলাম আমি যেদিকে যাচ্ছি, ও ঐ দিকেই থামলো। আমি ওর কাছে গেলাম, দেখলাম ওর কোলে ভীষণ সুন্দর একটি ফুটফুটে বাচ্চা বসে আছে। পাশে একজন মধ্য বয়সী যুবক। বাচ্চা মেয়েটি সম্ভবত ঐলোকটারই হবে। অবিকল বাবার চেহারা পেয়েছে। মেয়েটিকে ওর কোল থেকে নিয়ে লোকটি পাশের এক বইয়ের দোকানে ঢুকে গেল।
আমি এই ফাকে একটি সিগারেট ধরিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালাম। ও মুচকি হেসে দিয়ে বলল, এখনো সিগারেট ছাড়োনি? তোমার এই সিগারেটের গন্ধটা আমার খুব পরিচিত। আজও মনে পড়ে তুমি যখন আমার কাছে বসতে, তোমার মন ভাল থাকলেও তুমি একটার পর একটা সিগারেট টানতে আবার মন খারাপ থাকলেও তুমি একটার পর একটা সিগারেট ফুকতে। তাঁরপরেও আমি তোমার এই সিগারেটের গন্ধটা অপছন্দ করতাম না। আফটার অল তুমি আমার জিবনে প্রথম পুরুষ। তুমি কি এখনো আগের মত করে অনেক রাতে বাড়ি ফিরো? নাকি অভ্যাসটা কিছু পরিবর্তন হয়েছে?
নাহ, আমার যে ব্যস্ততা, তাতে মনে হয়না যে অচিরেই আমার এই রাতে বাড়ি ফিরার অভ্যাসটা পরিবর্তন হবে। তবে ছুটির দিনে এখন আর কোথাও যেতে মন চায় না। বললাম, তুমি যখন আমার কাছে ছিলে, তখন ছুটির দিনেও তোমাকে নিয়ে কোন কারন ছাড়া আমি বহুবার বহুদিন এখানে সেখানে ঘুরেছি বটে তবে এখন নতুন সঙ্গী থাকলেও আর যাওয়া হয় না।
“আমার কথা মনে পড়ে?” জিজ্ঞ্যেস করল ও ।
“কি মনে হয় তোমার?” আমি উত্তর করি।
কি জানি, হয়ত মনে পড়ে হয়তবা না। এখন তো তোমার নতুন সঙ্গী হয়েছে আমার থেকেও সুন্দর, আমার থেকেও অনেক বড়। কি জানি মনে নাও পরতে পারে। তবে আমি তোমার কথা সব সময় মনে করি। সবচেয়ে বেশি মনে হয় আমার সঙ্গী যখন তোমাদের ঐ ক্যান্টনমেন্টের পথ দিয়ে কখনো আসা যাওয়া করে। তোমার সঙ্গে থাকার সময় আমি কখনো সাধারন পাবলিকের রাস্তায় ঢোকতে হতো না। তুমি সঙ্গে আছো আর সাই সাই করে ক্যান্টনমেন্টের লেন ধরে তুমি হাত নাড়িয়ে পরিচয় দিলেই কর্তব্যরত এমপি সাহেব কড়া একটা স্যালুট দিয়ে সসম্মানে চলে দিতে দিত। আমি কত সাহেব, কত ভিআইপি পাবলিকের গাড়ির পিছনে এসেও শুধু তোমার কারনে সবার আগে টা টা বাই বাই দিয়ে চলে যেতাম। নিজকে সাংঘাতিক ভগ্যবতী মনে হতো। আর এখন? ঘন্টার পর ঘন্টা ঐ সব রিক্সা, ঠেলাগাড়ি, কি সব গাড়ীঘোড়া সবার পিছনে জ্যামের মত ঐ এমপি সাহেবের ক্লিয়ারেন্সের জন্য বসে থাকতে থাকতে আমার আর জান সয় না। আমাকে যেন ঐ এমপি সাহেবও আর চিনতে পারে না। তোমার নতুন সঙ্গী নিশ্চয় এখন এই মজাটা পায়, আমি সেটা জানি।
আমি ওর কথায় হাসি।
“আচ্ছা তোমার চোখের কোনায় এই কাল দাগটা কিসের গো?” আমি ওকে প্রশ্ন করতেই ও চুপ হয়ে গেল।
“কিছু হয়েছে নাকি ওখানে?”
“আর বলো না। আমার নতুন সাহেব একদিন খুব মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরছিল। রাস্তাঘাট ফাকাই ছিল। হটাত কি হলো তাঁর, আল্লাহই জানে, ঘ্যাঁট করে এমন করে সে টার্ন নিল যে, পাশের এক ইলেকট্রিক খাম্বার সঙ্গে দিল লাগিয়ে। আর যায় কোথায়। তখন আমার বাম চোখের পাশে আমি এই ধাক্কাটা খাই, হাসপাতালে যাওয়ার সময় নাই, কারন আঘাতটা গুরুতর বলে মনে হয় নাই বলে আমার সাহেবের ধারনা। সেই থেকে এই ক্ষত নিয়েই চলছি সবার মাঝে।
“তোমার নতুন সঙ্গির সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে না?” বলে যেন সে খিল খিল করে হাসতে থাকলো। কি অদ্ভুত লাগলো আমার কাছে।
আমি বললাম, “নিশ্চয় পরিচয় করিয়ে দেব”। তবে আজ নয়। ওরা আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে নিউ মার্কেটের একটা রেস্টুরেন্টে গেছে।
তোমার সাহেব কি করে? বলতেই আরেকবার চুপ হয়ে গেল বলে মনে হল।
সে আমার উত্তর না দিয়ে আমাকে উল্টো প্রশ্ন করে বসে। “আচ্ছা, তুমি কি আমাকে না ছাড়লেই কি পারতে না? অন্তত সেই লক্ষি বড় মেয়েটির জন্য!!?” ও কতদিন আমার কোলে বসে সুন্দর সুন্দর গান শুনতো। কি মিস্টি মেয়ে। লক্ষি মেয়ে বটে। কি করে এখন ও? শুনেছি ও নাকি এখন মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে। অনেক বড় হয়ে গেছে না? আমার কথা কি ওর মনে পড়ে?
আমি বললাম, হ্যা, ও এখন ডাক্তারি পড়ছে। আমাদের কাছে থাকে না। মাঝে মাঝে আমি নতুন সঙ্গিকে নিয়ে ওর ওখানে যাই। আমার বড় মেয়ে প্রায়ই তোমার কথা বলে।
এমন সময় দেখা গেল তাঁর সঙ্গী আবার সেই ফুটফুটে মেয়েটিকে নিয়ে চলে এসেছে। আমারও প্রায় সিগারেট খাওয়া শেষ। কোন ফুরসুত না দিয়ে তিনি আমার এই সেই পুরানো বন্ধুটিকে নিয়ে চলে গেলেন। আমার আর তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেয়া হল না।
দেখলাম, সেই পুরান চেহারায় লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ির রঙে রাঙ্গানো আমার সেই ১০৮৬ সিসির পিকান্ত গাড়িটি ধুলা উড়িয়ে আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি ওর ঠিকানাটা আবারও হারিয়ে ফেললাম। আমার প্রথম জীবনের সঙ্গী সে। জীবনে মাঝে মাঝে এমন কিছু বিচ্ছেদ হয় আমাদের যার কোনো কারন থাকে না। এমন নয় যে, আমাদের এই বিচ্ছেদের কারন কোনো অনীহা, বা অপছন্দের কিংবা এক সাথে চলতে না পারার কোনো কাহিনী। অনেক সময় মানুষের জীবনের নিত্য প্রয়োজনেও কাউকে না কাউকে বিসর্জন দিতে হয়। তখন সেই বিসর্জনে থাকে বুক ভরা কষ্ট আর স্মৃতি। কষ্টটা হয়তো সময়ের স্রোতে ভুলে যাওয়া যায় কিন্তু স্মৃতিটুকু সব সময় মনের কোনো এক গহীনে এমনভাবে জমা হয়ে সুপ্ত থাকে যে, অল্পতেই নড়াচরা করলে সেই স্মৃতি পুরানো সেই কষ্টকে জাগিয়ে তোলে। আমার এই কোরিয়ান লাল পিকান্ত গাড়িতা যেনো সেই রকমের কোনো এক বিচ্ছেদের অংশ। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে আমি ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে তাকিয়ে মনে মনে শধু বললাম, I loved you always and I will always love you.
০৫/০৬/২০১৬- বেলাশেষে
Categories
“বেলাশেষে” একটা বাংলা ছায়াছবির নাম। সংক্ষিপ্ত কাহিনীটা এই রকম-
৬৫ বছরের স্বামী আর ৬০ বছরের স্ত্রী। অনেক নাতি-নাত্নি, মেয়ের জামাই, ছেলেরা মেয়েরা সবাই একসঙ্গে মিলিত হয়েছেন গুরুতর এক সমস্যা নিয়ে। সমস্যাটা হল, স্বামী বলেছেন তিনি এই বয়সে এসে তার স্ত্রীর সঙ্গে পৃথক হতে চান এবং আরেকটি বিয়ে করতে চান। এই বুডো মানুষটির সিদ্ধান্তে অনেকেই হতবাক হলেও কেউ কেউ রাজি আবার কেউ কেউ রাজি নয়। যারা এই সিদ্ধান্তে রাজী না, তারা হতবাক হচ্ছেন, এই বয়সে কেন তিনি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ফলে নায়নাতকুর, ছেলেমেয়ে, মেয়ের জামাই সবাই মিলে পরিকল্পনা করলেন, ঠিক আছে অসুবিধা নাই, তবে তারা নিজেরা একঘরে কয়েক সপ্তায় নিজেরা নিজেরাই আলাপ আলোচনা করুক, ভাবুক, দেখুক তারপর নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিক কোনটা করা উচিৎ। বুড়া-বুড়িও সম্মতি দিলেন, ঝগড়াতো আর হয় নাই, স্বামী স্ত্রীই তো।
তাদের জন্য আলাদা ঘর দেওয়া হল, একদম নিরিবিলি পরিবেশ। কেউ তাদেরকে বিরক্ত করার নাই। কিন্তু সবাই এর মধ্যে একটা কাজ খুব গোপনে করে রাখলো। আর তা হচ্ছে তাদের রুমে গোপন একটা ক্যামেরা লাগিয়ে দিল এই দুই বুড়া বুড়ি কি কথা বলে তা দেখার জন্য। যখনই এই দুই বুড়া বুড়ি তাদের কথাবার্তা বলেন, তখনই দলবেধে অন্য বাড়ি থেকে সবাই মিলে ভিডিওতে তা প্রত্যক্ষ করেন।
পঞ্চাশ বছরের বিয়ের সেই অভিজ্ঞতার কথা, ভাল লাগার কথা, একসঙ্গে কষ্টের কথা, দুঃখের কথা, তাদের মিল অমিলের কথা, রাগের কথা, ভালোবাসার কথা একের পর এক তারা দুইজনে নিরিবিলি একত্রে বসে আলাপ করেন। আর সবাই তাদের এইসব অভিজ্ঞতার কথা শুনে কখনো অন্য সবাই হাসেন, কখনো চোখ মুছেন, কখনো অবাক হয়ে চুপ করে থাকেন। তারা সবাই একটা জিনিষ বুঝতে পারেন যে, সব স্বামীর কাছে তার সংসারটা এক রকমের, আর স্ত্রীর কাছে তার সংসারটা আরেক রকমের। কিন্তু কেউই যে ভুল নন তা ঠিক। স্বামীর কাছে দাম্পত্য জীবনের ভালোবাসাটা এক রকমের আর স্ত্রীর কাছে স্বামী আর সংসারের জন্য ভালোবাসাটা আরেক রকমের। একজন মায়াবী স্বামী সব সময়ই চেয়েছেন, তার অবর্তমানে তার আদরের স্ত্রীর যেনো কোনো কষ্ট না হয়, সে যেনো কারো কাছে হেয়ালীর পাত্র না হন, তার আদুরী স্ত্রী যেনো কোনো অর্থকরী কিংবা সুন্দর জীবন চালানোর জন্য কারো কাছে হাত না পাতেন। সেই দিকটা খেয়াল করে এই ভরষাযুক্ত স্বামী সব সময় চান তার স্ত্রীকে সাবলম্বি করে তুলতে। ফলে স্বামী সব সময়ই চেয়েছেন তার স্ত্রী এটা জানুক যে, তার স্বামী কোথায় কিভাবে কত রোজগার করেন, কত সঞ্চয় করেন, আর কিভাবে সেই কষ্টার্জিত সঞ্চয় থেকে কিভাবে তিনি তার স্ত্রীর মংগলের জন্য কি করছেন এবং তার পুরুপুরী এই পরিকল্পনার অংশ হয়ে যেনো তার স্ত্রী এটা খেয়াল করে সে মোতাবেক প্রস্তুতি নেন এবং তার উপর পারদর্শী হন। অন্যদিকে এই স্বামী দেখছে, তার স্ত্রী তার এইসব ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন হয়ে তাদের সংসারে বেড়ে উঠা ছেলেমেয়ে, নাতি নাতকুর কিভাবে মানুষ হবে, কিভাবে আরামে থাকবে, কিভাবে নিরাপদ থাকবে ইত্যাদি নিয়েই বেশি নজর। স্বামীর কাছে ভালো লাগা ছিল বউকে নিয়া কোথাও রোমাঞ্চের উদ্দেশ্যে একা একা বেরিয়ে পড়া, কিন্তু স্ত্রীর কাছে যেনো সেই রোমাঞ্চের থেকে বেশী জরুরী ছিলো ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা, তাদের কোচিং ক্লাস, তাদের স্বাস্থ্য, তার নিজের ঘর কন্নার কাজ, আত্মীয় সজনদের সেবা শশ্রুসা ইত্যাদির মধ্যে একটা বন্ধন স্রিস্টির লক্ষে সবাই মিলে পারিবারিক সময় কাটানো। স্বামী চেয়েছেন স্ত্রীর কাছ থেকে অনেকটা সময় যে সময়টা তারা ভালোবাসার কথা বলবে, পুরানো দিনের কথা বলবে, কোনো একটা সিনেমা দেখতে দেখতে মন ভরে আনন্দ করবে, বিখ্যাত কোনো কবির কবিতা পড়ে পড়ে তার অন্তর্নিহিত ভাবধারায় সিঞ্চিত হবেন। কিন্তু স্ত্রী তার পরিবারের সবার দিকে একসঙ্গে খেয়াল রাখতে গিয়ে, ছেলেমেয়েদের পরাশুনার দেখভাল করতে গিয়ে, অসুস্থ শ্বশুর শাশুড়ির দিকে নজর দিতে গিয়ে অধিকাংশ সময়টাই চলে গেছে অকাহ্নে, স্বামীর জন্য অফুরন্ত সময়টা আর তিনি বের করতে পারেন নাই।
কেউ দুষী নন, কারো চাওয়ার মধ্যেই অতিরঞ্জিত ছিলো না। অথচ তারা যেনো কোথায় সুখি নন। তারপরেও তারা বহুকাল এই কম্প্রোমাইজের মধ্যেই একটু রাগ, একটু অভিমান, একটু গোস্যা আর বিস্তর জায়গা জুড়ে পরস্পরের ভালোবাসাটা এক সময় অভ্যাসে পরিনত হয়, তখন অভ্যাসটাই যেনো ভালোবাসা। স্বামীর টয়লেট করে আসার পর যে গন্ধটা একদিন স্ত্রীর কাছে দূর্গন্ধ মনে হতো, স্বামীর ঘামের গন্ধে ভরপুর যে গেঞ্জীটা একদিন নাকের কাছে নিলে একটা শুকনা বাজে গন্ধ বলে মনে হতো, একদিন সেই টয়লেটের গন্ধ, ঘামের দূর্গন্ধ আর দুর্গন্ধ মনে হয় না। অন্যদিকে স্ত্রীর ঘুমের মধ্যে ডাকা নাকের শব্ধ যখন কোনো একদিন এতোটাই অসহ্য মনে হতো, বিরক্তিকর মনে হতো, চুলে আধা ভেজা তেলের যে গন্ধ একদিন স্বামীর নাক বুঝে আসতো, সময়ের এতোটা পথ বেয়ে যখন সব গুলি ভালোবাসা একটা অভ্যাসে পরিনত হয়ে যায়, তখন স্ত্রীর সেই নাক ডাকা, আধাভেজা চুলের গন্ধ যেনো একটা সুখের পরশ মনের ভিতর প্রবাহিত হয়ে যায়। এই তো সে তো কাছেই আছে।
৯০ বছরের কোনো এক প্রোড় বুড়ো, ৮৫ বছরের কোনো মহিলার সাথে যখন এক সাথে স্বামী স্ত্রী হিসাবে বসবাস করেন, তখন তাদের এই বয়সে এসে আর সেই যুবক যুবতীর মতো শরীরের চাহিদা, রুপের চাহিদা আর কাজ করে না। কিন্তু তাদের মধ্যে ভালোবাসাটা একটা বিশাল আকার পাহাড় সম ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাহলে সেখানে কি ফ্যাক্টরটা কাজ করে? কাজ করে নির্ভরতা, কাজ করে একে অপরের উপর শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, মায়া আর মহব্বত। কাপা কাপা হাতে যখন ৮০ বছরের বুড়ি এক কাপ চা নিয়ে ৯০ বছরের তার স্বামীর কাছে কাপ খানা হাতে দেন, কিংবা পানের বাটিতে পান আর সুপারী ছেচে যখন এক খিলি পান স্বামী তার ৮০ বছরে সংগিনীর মুখে তুলে দেন, আসলে তিনি শুধু এক কাপ চা কিংবা এক খিলি পানই দেন না, দেন সারা জীবনের মহব্বত আর ভরষা যে, তুমি ছাড়া আমার আর কোনো বড় বন্ধু নাই।
তুমি আমার ভরষা, তুমি আমার নিরাপত্তা, তুমি আমার স্বামী, কিংবা স্ত্রী, তুমি আমার পরামর্শদাতা, বিপদে আপদে তুমিই আমার ডাক্তার কিংবা নার্স। তুমিই আমার সব। ব্যস্ততম রাস্তায় যখন আমি রাস্তা পার হতে গিয়ে আমার বুক কাপে, তোমার হাত ধরলেই আমার সব কাপুনী বন্ধ হয়ে যায়। তুমি আমার মায়ার সংসার। বুকের সব পাজরে পাজরে তুমি গেথে থাকা আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস আর চোখের প্রতিটি বিন্দুজলে নীল আকাশের গাংচিলের মতো তুমি খেলা করো আমার অন্তরের এমন এক কোটরে যেখান থেকে তোমাকে আলাদা করার কোনো ক্ষমতা আমার নাই।
বেলাশেষে তুমিই আমার আর আমি সেই তোমার।
০৪/০৬/২০১৬-ভিক্ষুকের পাল্লায় আরেক দিন
Categories
আমি জুরাইন রেলগেটের কাছে ট্রেন পাশ দেয়ার জন্য গাড়ীতে বসে আছি। অনেক গাড়ি থেমে আছে, কেউ কেউ আমার ও অনেক আগে থেকেই থেমে আছে। আমার লাইন অনেক পরে। আমি ঠিক যেখানে গারিতে বসে আছি, তার ডান দিকে গুটি কতক হাত দূরে রাস্তার আইল। অখানে এক আখ বিক্রেতা তার চিকন চিকন আঁখগুলো অনেক যত্ন করে খোসা ছারাচ্ছে, তারপর কচি কচি কঞ্চির মত করে একটা তিনের পাতায় এক এক করে সারি দিচ্ছে। তার পাশে ছোট একটা মেয়ে হাপ প্যান্ট পরা অবস্থায় বাবার আখ কাটা দেখছে। তার হাতেও একটা আখের কঞ্চি। আখ বিক্রেতার পাশে এসে এক ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতাও বসে আছে। ওর সব মিলিয়ে দুটু সম্বল, একটা সম্ভবত ফ্লাক্স আর আরেক্তি বিস্কুতের একটি জার। এটা দিয়েই হয়ত ওর সারাদিনের রোজগার, সংসার চলে।
আমার বা পাশ দিয়ে খুব ব্যাস্ত একটি সাইকেল আরোহী উল্টো পথ ধরে পার হবার চেষ্টা করছে, কোন তাড়া আছে হয়ত কিন্তু ওর বয়স আর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না যে ট্রাফিক আইন ভেঙ্গে অন্যান্য গাড়ি গুলো বিপদজনক ভাবে টপকিয়ে এভাবে যাওয়ার মানুষ, তারপরে তিনি করছে, অল্প বয়স, বয়সের একটা গরম আছে। পিছন থেকে অযথা একটি গাড়ি হর্ন বাজিয়ে উঠল যেন বিরক্ত কারো উপর। আমার ড্রাইভার নিজে নিজেই অনেক কথা বলে ফেলছে, ‘কেন কোন সেন্স নাই এত আগে রেল গেত ক্লোজ করে সবাইকে দাড় করাইয়া রাখবে, কি হয় ঠিক টেন আসার আগে দাড় করাইলে? দেশ তারে কেউ ভালবাসে না, কেউ তাদের ডিউটি ঠিক মত করে না। কি হবে এদেশের? বুঝলাম এবার আমার ড্রাইভার দেশ প্রেমিক হয় উঠেছে। অথচ আমার এই ড্রাইভারকেই রঙ সাইড দিয়ে না যাওয়ার জন্য আমাকে অনেক বার বকাও দিতে হয়। সুযোগ পেলেই আমার ড্রাইভার চান্স নেয়।
বাইরে বেশ গরম, বুঝা যাচ্ছে। ঐ অদুরে সারি সারি দোকানে দোকানদার কেউ কেউ হাত পাখা নিয়ে নিজেকে বাতাস করার চেষ্টা করছে, বুঝলাম এলাকায় বিদ্যুৎ নাই। তা না হলে হাত পাখার ব্যবহার হত না এখন। এরই মধ্যে বাস আসার অপেক্ষায় কিছু সাধারন যাত্রি প্রচন্ড খরার মত রৌদ্রে দাড়িয়ে আছে কখন তাদের বাস আসবে। যারা একটু যুবক, তাড়া আবার কেউ কেউ হাতে সিগারেট ধরিয়ে সময়টা কাটানোর চেষ্টা করছে। আমার ড্রাইভার গাড়ির রেডিও তা অন করতেই কোন এক জকির ম্যাকি সুরে কত কথা শুনা গেল।
ঠিক এমন সময় একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে আমার গাড়ীর সামনে এল এবং ভিক্ষা চাইল। আজকাল অনেক পদের ভিক্ষুকের সমাহার এদেশে। কেউ খুরিয়ে খুরিয়ে হাটে, কেউ আবার কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে, পয়সার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে এই সার্টিফিকেট নিয়ে রাস্তায় নামে তার টাকা জোগাড়ের জন্য। কেউ আবার পুরু শরীর উদম করে আসে কোথায় তার ক্ষত আর কোথায় তার শারিরিক সমস্যা মুখে না বলে যেন যিনি ভিক্ষা দেবেন তিনি তাকে দেখেই বুঝে ফেলতে পারেন তার ভিক্ষা চাই। কেউ আবার অনেক প্যান্ট শার্ট পরে খুব ভদ্র ভাবে সামনে এসে চুপি চুপি বলবে যে, তার সব খুইয়ে এখন এমন অচেনা শহরে একা, তার বাড়ীতে যাওয়ার পয়সা নাই কিন্তু তিনি ভিক্ষুক নন। নতুন কৌশল।
যাক গে, আমার সামনে এই মুহূর্তে যে ভিক্ষক টি দাড়িয়ে তাকে দেখেই আমার ভিক্ষা দেয়ার ইচ্ছে হল না। কারন তার যে বয়স, তাতে সে অনেক বাসায় কাজ করতে পারে, কিংবা গার্মেন্টসেও কাজ করতে পারে কিংবা অন্য যে কোন পরিশ্রমের কাজ তার দ্বারা করা সম্ভব। তার ভিক্ষা করার প্রয়োজন হয় না আসলে।কিন্তু নাছোড়বান্দা। বারবার আমার গাড়ীর কাচে নক করছিল। বিরক্ত হয়ে বললাম, প্লিজ মাফ কর। আমার বিরক্তে তার কিহু যায় আসে না। সেও বিরক্ত। এত দেরি করে কেন কাচ খুললাম এই জন্য।
মহিলা রেগে গিয়ে বল্ল, এতক্ষন না করলেন না ক্যান, আমারে খামাখা দাড় করাইয়া রাখলেন? আগে বললেই তো পারতেন?
অবাক হইলাম তার রাগের কারনে। আমি তার সময় নষ্ট করে দিয়েছি বলে। তো, আবার ডাকলাম, ভাব্লাম কিছু কথা বলি।
বললাম, কোলের বাচ্চাটা কে বা কার? অনেকে আবার বাচ্চা ভাড়া করে নিয়ে আসে এবং ভিক্ষা করে। এতে হয়ত অনেক মানুষের একটু বেশি সিম্পেথি পাওয়া যায়, আর ভিক্ষাটাও জমে উঠে হাতে পায়সার ভারে।
মহিলা বল্ল, আমার বাচ্চা। বুঝলাম, তার রাগ কমে নাই, সব ভিক্ষুকেরা সাধারনত স্যার বলে সম্বোধন করে। হয়ত সেও করে কিন্তু সে আমার উপর রাগ।
বললাম, কাজ করোনা কেন?
উত্তরে সে যা বলল সে এক লম্বা ফিরিস্তি। নাই বা বললাম।
আমি আবার বললাম, কয় টাকা পাও প্রতিদিন ভিক্ষা করে? এবার মনে হল, সে আমার কোথায় একটু হলেও রাগ কমেছে অথবা চিন্তা করছে যে সাহেব মনে হয় কিছু বেশি সাহাজ্য করতে পারে ইত্যাদি। ভিক্ষুকরাও কিন্তু সাহেব্দের সাইকোলজি বিশ্লেষণ করে।
সে আমতা আমতা করে বল্ল, হয় স্যার প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পাই প্রতিদিন। এবার সে আমাকে স্যার বলে সম্বোধন করল। বুঝলাম, অনেক্তাই রাগ কমেছে আমার উপর।
আমি আবার বললাম, গতকাল কত টাকা পেয়েছ?
সে বল্ল, স্যার গতকাল প্রায় ২০০ টাকার মত পাইছি।
আমি বললাম, তাহলে তোমার মাসিক ইনকাম প্রায় ৬০০০ টাকা। তোমার তো মাসে ৬০০০ টাকা লাগে না। কয় টাকা হলে তোমার সংসার চলে?
সে কিহুক্ষন চুপ থেকে একবার আকাশের দিকে, একবার আমার দিকে, আবার একটু নিরব থেকে, হাতের কড়া গুনে গুনে বল্ল, স্যার, মোটামোটি হাজার ৫ হলেই আমাদের ছোট সংসার চলে যায়।
আমি বললাম, ধরো, আমি যদি তোমাকে আজকে ৫০০০ টাকা দেই, তাহলে কি তুমি এখন বাড়ি চলে যাবা? যদি বল, যে, তুমি বাড়ি চলে যাবা, এবং তুমি আর এই মাসে ভিক্ষা করবা না, তাহলে আমি তোমাকে এখনই ৫০০০ টাকা দেব। কিন্তু আমি তোমার উপর লক্ষ রাখব তুমি ভিক্ষা করছ কিনা। সে নিসচুপ হয়ে কিছুক্ষন দারিয়ে থেকে আমার গাড়ীর সামনে থেকে চলে গেল। মনে হল তার এই আয়ে পোষাবে না। তার মানে এই যে, সে ভিক্ষাটা ছারবে না। অথবা এমনও হতে পারে যে, সংখ্যাটা কম বলে ফেলেছে।
………… তার বেশ কয়েক মাস পর,
আমি আবার গুলিস্থানের জিপিও এর সামনে গাড়ীর জ্যামের মধ্যে বসে আছি। হটাত দেখলাম, ঐ সেই একই মহিলা। কোলে একটা বাচ্চা, তবে আজকে ছেলে বাচ্চা নয়, মেয়ে বাচ্চা। আমি মহিলাকে দেখেই চিনতে পেরেছি। কিন্তু মহিলা আমকে দেখে চিনতে পারে নাই। আমার গাড়ীর সামনে এসে সেই একই ভঙ্গিতে ভিক্ষা চাইল। আমি এবার আবারো সেই একই প্রশ্ন গুলো করলাম।
আমি বললাম, তোমার কয় বাচ্চা?
সে বল্ল, স্যার, এই একটাই। বুঝলাম, সে মিথ্যা বলছে। এটা আসলে ওর ভাড়া করা বাচ্চা মনে হয়।
তারপর আমি শুরু করলাম আমার সে আগের প্রশ্নগুলো।কয় টাকা পায়, কয় টাকা লাগে প্রতিমাসে। কেন কাজ করতে চায় না ইত্যাদি।
এবার মহিলা কিন্তু কম করে ফিগারটা বলে নাই। সে বল্ল, স্যার আমার মাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকা লাগে। স্বামী অসুস্থ ঘরে। আমার বোনের এক বাচ্চা স্কুলে পরে, তাকেও আমার টানতে হয়, নিজেও অসুস্থ, সঙ্গে শ্বশুর শাশুড়িকেও টানতে হয়ইত্যাদি। বুঝলাম, ১৫ হাজারের হিসাবটা তার আগে থেকেই করা।
আমি এবার অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, তোমার সঙ্গে একবার আমার দেখা হয়েছিল জুরাইন রেলগেটে। তখন আমি তোমাকে এই প্রশ্নগুলো করেছিলাম এবং তুমি মাসে ৫০০০ টাকা হলে তোমার হয়ে যায় বলেছিলে, আজ আবার তা ১৫০০০ হাজার টাকা হয়ে গেল ক্যান?
মহিলাটি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমারে এক ঝারি দিয়ে বল্ল, ধুত মরার, খালি আপনার লগেই আমার দেহা হয় ক্যান? অন্য রাস্তা দিয়া যাইতে পারেন না? তারপরযত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার গাড়ী পার হয়ে আরেক জনের কাছে চলে গেল।
মনে হইল, ভিক্ষা যার পেশা, ভিক্ষা তার নেশাও বটে। নেশা আর পেশা যখন এক হয়ে যায়, তখন আর তাকে ঐ কাজ থেকে সরিয়ে নেয়া সম্ভব না। একজন ভিক্ষুক যত ধনিই হোক না ক্যান, স্বয়ং বিধাতা তাকে সবার সামনে প্রকাশ্যে ফকির বানিয়ে রেখেছে, তাকে বিধাতা দিনের সূর্যের প্রখর তাপে শাস্তি দিচ্ছেন, আবার শীতে কষ্ট দিচ্ছেন, বৃষ্টিতে ভিজিয়ে রাখছেন, অথচ হয়ত তার একটা সুন্দর বাড়ি আছে, তাকে বৃষ্টিতে ভিজতে হত না, শীতে কাঁপতে হত না যদি ভিক্ষা না করতে হত। কিন্তু সে তো ভিক্ষা করবেই। এটা তো পেশা। ভিক্ষুক হয়ত আনন্দ পায় তার সঞ্চিত টাকার সংখ্যা দেখেই। তার ভোগ করার সময় কই? সেটা তো বিধাতা দেবেন না। তার কাছে পূর্ণিমার রাত যা, অমাবস্যার রাতও তা, ওর কাছে বৃষ্টির ঝন ঝন শব্দ কানে ভাসে না, ওর শুধু নজর কখন একটা গাড়ী আসবে আর তার সামনে গিয়ে সে কাতর হয়ে মুখের সবটা যন্ত্রনার অভিব্যক্তির অভিনয়টা করে একটা হাত পেতে বলবে, দেন গো স্যার, আমারে কিছু দেন, দুইদিন কিছু খাই নাই। হয়ত পুরুটাই মিথ্যা কথা।
আর এইসব ভিক্ষুকের জন্য যারা সত্যি ভিক্ষা করে একটু সস্থি পেতে চায়, তাদের কপাল পুড়ে। শুনেছি, ভিক্ষুকদের এসোসিয়েশন আছে, সেখানে প্রেসিডেন্ট আছে, সেক্রেটারি আছে, সেখানে লাখ লাখ টাকা দিয়ে ইলেক্সন হয়, এবং একদিন তারা আবার এমপি মিনিস্টার পদেও কন্টেস্ট করে।
তখন আমরা তাদের স্যার বলি। তারপরের কাহিনী অন্য রকম।
০৪/০৬/২০১৬- ভিক্ষুকের পাল্লায়
Categories
প্রতিদিন এই পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার হিসাব সবসময় কেউ রাখে না আর রাখাও দরকার আছে বলিয়া কেউ মনে করেনা।অনেক সময় অনেক অতিকায় বৃহৎ জিনিস নজর এড়াইয়া যায় আবার অনেক সময় অতিকায় তুচ্ছ জিনিসও আমাদের চোখ না এড়াইয়া উহা এমন আবেগের সৃষ্টি করে যা মন এবং হৃদয় উভয়কেই প্রভাবিত করে। আজ এমনই কয়েকটা দৃশ্যের কথা বলছি।
পরিবার নিয়েগ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। দুইদিন পর সবাইকে নিয়া আবার ঢাকায় ফিরছিলাম। আগে গ্রামে যাইতে হইলে বৃষ্টিতে ভিজিয়া, রোদে পুড়িয়া, কিছু দূর হাটিয়া, আবার কিছুদূর কোন এক বটবৃক্ষের তলে জিরাইয়া, পথ হইতে সঙ্গি পাওয়া কিছু হরেক পদের বন্ধু পথচারী লইয়া ঘন্তার পর ঘন্টা হাটিয়া বাড়ি যাইতে হইত। শহর হইতে যদিও খুব দূরে নয় এই আমাদের গ্রামের বাড়ি কিন্তু তাতেই তিন হইতে চার ঘন্টা লাগিয়া যাইত। যখন গ্রামে পৌঁছাইতাম, তখন অনেক দিনের বন্ধু বান্ধব, পারা প্রতিবেশি, এমন করিয়া প্রশ্ন করিত যেন শহরের একজন অতি উচ্চ দরের বাসিন্দা গ্রামে আসিয়াছে। আমাদের সময় শহর ছিল এক ধরনের বিদেশের মত। যেন বিদেশ হইতে আসিয়াছি। আমার মেয়েরা এই শহর আর গ্রামের যে বিস্তর একটা পার্থক্য তাহা তাহারা কখনো বুঝিবে না আর আমিও অনেকবার গ্রামের কথা বলিতে গিয়া দেখিয়াছি, তাহাদের গ্রামের কথা শুনিবার মানসিকতা খুব একটা নাইও। এখন আমি গ্রামে যাই গারিতে চরিয়া, সঙ্গে ড্রাইভার থাকে, আমি অনেক বড় সাহেব। এখন যদিও সেই চেনা পরিচিত লোকগুলো শহরকে আর বিদেশ বলিয়া মনে করে না, তারাও এখন আমি গ্রামে গেলে অতিব খুশি হয়। কারো কারো অনেক অভিযোগ আছে আমার বেশি বেশি গ্রামে না আসার কারনে, কেউ আবার আমার অফিসে দেখা করাই সম্ভব হয় না, দিনের পর দিন অপেক্ষা করিয়াও তাহারা আমার দর্শন পায় না ইত্যাদি ইত্যাদি। সব অভিযোগ যে মিথ্যা তা আমি বলব না কিন্তু অনেক অভিযোগ আছে যা আমার কখনো শুনিতেও ভাল লাগে আবার কিছু কিছু অভিযোগ আছে যাহা সত্যিই সত্য নয়। কিন্তু তাহাতে আমার কিছু যায় আসে বলিয়া আমার মনে হয় নাই।
এতক্ষন গাড়ী ভালই চলিতেছিল, কোথাও কোন জ্যাম বা রাস্তায় দাঁড়াইতে হয় নাই কিন্তু শাহবাগে আসিয়া দেখি লম্বা এক গাড়ীর সারি। কতক্ষন যে লাগিবে এই জ্যাম শেষ হইতে তা অনুমান করিতে পারতেছিলাম না। রাস্তার জ্যামে সবচেয়ে বড় অসুবিধা যেটা হয় তাহা হইল, কিছুক্ষন পর পর হরেক পদের গল্প লইয়া অতিশয় ক্ষুদ্র বয়স হইতে থুরথুরে বুড়িও আসিয়া গাড়ীর কাঁচ নক করিতে থাকে। নিজের বিরক্ত হইলে তারাও আরও বেশি করিয়া বিরক্ত হয় এবং কখনো কখনো এমন মন্তব্য করিয়া মুখ ভেংচি কাটিয়া চলিয়া যাইবে যেন আমি ই অপরাধ করিয়াছি তাহাকে কোন ভিক্ষা না দিয়া। আজও তার ব্যতিক্রম হইল না। একজন ৪০ কিংবা ৪৫ বয়সের মহিলা আমাদের গাড়ীর সামনে আসিয়া দারাইল। রবি ঠাকুরের মত লিখিলে বলিতে হয় যে, “অতি কাতরতার সহিত তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করিয়া “কিছু দেন স্যার গো” বলিয়া এমন একখান মুখাবয়ব করিল যেন পৃথিবীতে তাহার হইতে আর কোন মানুষ অসহায় নাই আর আমি ছাড়া তাহাকে উদ্ধার করিবার ও যেন আর কেহ নাই।”
আমি সাধারণত সবাইকে ভিক্ষা দেই না। ভিক্ষুকের শারিরিক অবস্থা, মানসিক বিকাস, বয়স কিংবা তার কাজ করিবার ক্ষমতা-অক্ষমতা অনেক কিছু বিবেচনা করিয়াই আমি ভিক্ষা দিতে পছন্দ করি। অনেকে হয়ত বলিবেন, দিবেন তো এক টাকা বা দুই টাকা, তারপরে আবার এত সব কাহিনী বিবেচনা করিয়া ভিক্ষা দিতে হইবে? আসলে ব্যাপারটা ঐ রকম নয়। আমি ভিখা বৃত্তিকে সমর্থন করি না। তারপরেও অনেক ভিক্ষুককে আমি ভিক্ষা দেই। তাতে যে সব সময় আমার ঐ বিবেচনা গুলি থাকে তা কিন্তু নয়। কখনো কখনো আমার মানসিক অবস্থা, আমার ব্যবসায়িক পরিস্থিতি, কিংবা আমার ভাবের উপরও আমি অনেক অযোগ্য ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেই। “ভিক্ষুকের আবার যোগ্যতা”, এই কথা অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করিতে পারেন, কিন্তু সত্যি ভিক্ষা করিবার জন্যও কিন্তু যোগ্যতা লাগে। সবাই ভিক্ষুক হইতে পারে না। শুনেছি, অনেক ভিক্ষুক নাকি অনেক বড় লোক, তারাঅত্যাধুনিক গাড়ী চালায়, বিশাল অট্টালিকায় তাহারা শীততাপ বাড়ীতে ঘুমায়। তাহাদের সেবা করিবার জন্য দাস, চাকরানী সবাই আছে। শুধুমাত্র ভিক্ষা করিবার নিমিত্তে তাহার তাহাদের নির্দিষ্ট এলাকায় গিয়া আবারো সেই পুরানো পোশাক পরিয়া মুখের হাবভাব পরিবর্তন করিয়া মানুষকে ধোঁকা এবং বোকা বানাইয়া সেই একই ভিক্ষা ব্রিতিতে সামিল হন। দিনশেষে আবার তাহারা তাহাদের ঐ বৃহৎ অট্টালিকায় সাহেব বেশে ফিরিয়া আসেন। ইহা একটা ইনভেস্টমেন্ট বিহীন লাভজনক ব্যবসা। যাই হোক, কে ভিক্ষা বৃত্তি করে কত টাকা লাভ করিল বা কে সত্যি সত্যিই ভিক্ষুক এবং জিবিকা নির্বাহের জন্য যে তাহার ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া আর কোন গতি আছে কিনা, এই সব তাত্তিক বা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলার জন্য আমি এই লেখাটি লিখছি না।
আমি এখন শাহবাগে জ্যামের মধ্যে গাড়ীতে বসিয়া আছি এবং ঐ ৪০-৫০ বয়সের মহিলা ভিক্ষুকের দিকে তাকাইয়া আছি। আমার ছোট মেয়ে তার অতি প্রিয় আই প্যাডে এক নজরে কি যেন করিতেছে আর আমার বড় মেয়ে তার কানে হেড ফোন লাগাইয়া কোন দেশের কোন সঙ্গিত শুনিতেছে, তা আমার বা আমাদের গাড়ীতে যাহারা বসিয়া আছি কেহই শুনিতে পাইতেছি না। শুধু মাত্র মেয়ের মাথা নারা দেখিয়া বুঝিতেছি যে আমার বড় মেয়ে সঙ্গিত শুনিয়া সঙ্গিতের জগতে ডুবিয়া আছে। পাশের ভিক্ষুক, আর জ্যামের জন্য তাহার কোন কাজে ব্যঘাত হইতেছে বলিয়া মনে হইতেছে না। আমার প্রিয়তমা পত্নী একটু একটু তন্দ্রা আবার একটু একটু জাগ্রত ভাবে বসিয়া আছে। ড্রাইভার সাহেব অতি সুক্ষ মনোযোগের সহিত কোন ফাক ফোঁকর পাওয়া যায় কিনা এই চিন্তায় গাড়ির স্টেয়ারিং ধরিয়া বসিয়া আছে। আশেপাশের অন্যান্য গারি গুলির অবস্থাও আমার মত।
আমি নরিয়া চরিয়া বসিলাম, আর আমার মানি ব্যাগে হাত দিয়া ঐ মহিলা ভিক্ষুককে কিছু টাকা দিতে উদ্যত হইলাম। আমার এই নড়াচড়ায় আমার ছোট মেয়ে তাহার আই প্যাড হইতে নজর ফিরাইয়া আমার দিকে তাকাইল, আমার বড় মেয়ের এতক্ষন বুঝা চোখ একটু খানি আড় চোখ হইল, আমার পত্নিও একটু নরিয়া বসিল। তাহার সবাই হয়ত এই ভাবিল যে, আমি তো সাধারনত সব ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেই না, এমন কি হইল আজ যে, অতি কর্মক্ষম একজন মহিলা, যাহার কাজ করিবার ক্ষমতা আছে তবুও আমি ভিখা দিতে উদ্যত হইলাম?
আমি মেয়েদের মনভাব বুঝিতে পারিলাম। বলিলাম, দেখ , আমি একটা সাইকোলজিক্যাল কাজ করিবার চেষ্টা করিতেছি এইবার। বলিয়াই আমি আমার মানি ব্যাগ হইতে নতুন একটা পাচশত টাকার নোট বাহির করিয়া ঐ মহিলা ভিক্ষুকটির হাতে এমন ভাবে দিলাম যেন, এটা কিছুই না। মহিলা ভিক্ষুকটি প্রথমে টাকাটা হাতে লইল, এবং পরক্ষনেই আমার দিকে তাকাইল। পরক্ষনেই আবার সে তাহার হাতে দেওয়া নোটটির দিকে তাকাইল আবার আমার দিকেও তাকাইল। আমি শুধু তাহার মুখের ভাবটা পরিবর্তনের ব্যাপারটা লক্ষ করিতেছিলাম। হটাত কয়েক মুহূর্তের পর মহিলা ভিক্ষুকটি পিছন ফিরিয়া সোজা দৌর দিল। যেহেতু সব গারি গুলি জ্যামের মধ্যে দারাইয়া ছিল, ফলে অল্প সময়ের মধ্যে সে বেশ খানিক টা পথ কোন বাধা ছারাই পার হইয়া গেল আড় ইতিমধ্যে সে রাস্তার ঐ পাড়ের ফুটাপাতে পৌঁছাইয়া গেল। ফুতপাতে পৌঁছাইয়া ও সে দৌড়াইতে লাগিল কিন্তু একবার সে আমার দিকে পরক্ষনেই সামনের দিকে দৌড়াইতেছিল। এক সময় মহিলা ভিক্ষুকটি আমাদের চোখের আড়াল হইয়া হাজার মানুষের ভিরে হারাইয়া গেল।
এতক্ষন আমার ছোট মেয়ে, বড় মেয়ে কেহই কোন কথা বলিতেছিল না। এইবার আমার ছোট মেয়ে আমার দিকে তাকাইয়া আমাকে প্রশ্ন করিল, বাবা, মহিলাটা এমন করিয়া দৌড় দিল ক্যান? ওকি ভয় পাইয়াছে?
আমি বলিলাম, না মা, ও ভয় পায় নাই। এতক্ষন তুমি যাহা যাহা দেখিলে, সেটা একটা সাইকোলজিক্যাল গেম ছিল। সাইকোলজিটা কি তুমি বিঝিতে পার নাই? আমি ব্যাপারটা আমার ছোট মেয়েকে বুঝাইয়া বলার শুরু করিলাম।
মহিলা ভিক্ষুকটি যখন ৫০০ টাকার নোটটা হাতে পাইল, সে তখন বুঝিতে পারে নাই যে, কেউ তাকে ৫০০ টাকার নোট দিয়া ভিক্ষা দিতে পারে। (যদিও অনেকে দেয়, কেউ দেয় না এমন নয় কিন্তু তাহা একটা ব্যতিক্রম ধর্মী ব্যাপার)। কেউ হয়ত দেয় ৫ টাকা, ১০ টাকা, ৫০ টাকা কিংবা ১০০ টাকা কিন্তু একবারে ৫০০ টাকা হয়ত সে কখনই ভিক্ষা পায় নাই। ফলে সে প্রথমে মনে করিয়াছিল যে, আমি ভুল করিয় ৫০০ টাকার একটা নোট দিয়াছি। তাই সে বারবার একবার আমার দিকে আরেকবার ৫০০ টাকার নোটের দিকে তাকাইতেছিল। সে ভাবিতেছিল, সাহেব কি ভুল করিয়া ছোট নোট মনে করিয়া তাহাকে ৫০০ টাকার নোটটি দিয়া দিল নাকি আসলেই সাহেব তাহাকে ৫০০ টাকার নোটটাই ভিক্ষা দিল? এটা কি ভুল নাকি আসল। ভিক্ষুক তাহার নিজের ভিতরে ডিসিসন ম্যাকিং প্রসেসে খুব দ্রুত কি করিবে আড় কি করিবে না এই নিয়া দোলায় ছিল। সে হয়ত ভাবিতেছিল, আমি কি খুব তাড়াতাড়ি আমার ভুলটা বুঝিয়া আবার না ঐ ৫০০ টাকার নোটটা মহিলার কাছ হইতে চাহিয়া লই। অথবা ভাবিতেছিল যে, মহিলা নিজেই কি আমাকে জানাইবে যে, আমি ৫০০ টাকাই দিতে চাহিয়াছি কিনা। তাহার ভিতরে তখন একটা সাইকোলজিক্যাল যুদ্ধ চলিতেছিল এই রকম যে, সে এই ৫০০ টাকার ভিক্ষার ব্যাপারটা যদি নিজে থেকে ক্লিয়ার করে তাহা হইলে সে হয়ত ৫০০ টাকা থেকে বঞ্চিত হইবে। আবার যদি না জানায় তাহলে ব্যাপারটা ঠিক হইতেছে কিনা ইত্যাদি। তাই সে বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না কি করিবে। তাহার এই কিঞ্চিত দুরাবস্থার ইঙ্গিত টা যদিও আমি বুঝিতে পারিতেছিলাম কিন্তু আমি তাহাকে আমার মানসিকতার কোন পরিবর্তন না করিয়া যেন আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না বা আমি ইচ্ছা করিয়া কোন ভুল করি নাই বা করিলেও আমাই তখন ব্যাপারটা বুঝিতে পারিতেছি না। আমার মুখের ভাবের মধ্যে কোন প্রকার পরিবর্তন না দেখিয়া সে আমি বুঝিতে পারিয়াছি কিনা তাহা সে বুঝিতে পারিতেছিল না। লাভ আড় লোকসানের হিসাব করা তাহার ইতিমধ্যে শেষ হইয়াছে, তাই আর কোন রিস্ক না নিয়া নতুন কোন খদ্দরের কাছে আড় কোন ভিক্ষা না চাহিয়া সে যত তাড়াতাড়ি পারিল আমার কাছ হইতে ছুটে দৌড় দিল যাহাতে আমি আর তাহাকে নাগাল না পাই। সে দৌড়াইতেছিল বটে বটেকিন্তু তখনও সে নিশ্চিত হইতে পারিতেছিল না, যদি আবার আমি তাহাকে ডাক দেই!! টাই সে একবার সামনের দিকে আবার পরক্ষনেই আমার দিকে তাকাইতেছিল।
কিন্তু আমি জানি আমি তাহাকে ৫০০ টাকাই দিয়াছি। আমার মধ্যে কোন সন্দেহ ছিল না, আমি শুধু দেখিতে চাহিতেছিলাম, ৫০০ টাকা একসঙ্গে পাইলে একজন ভিক্ষুক কি করে। প্রতিদিন হয়ত ও ৫০০ টাকার চেয়েও বেশি কামাই করে কিন্তু একবারে কারো কাছ হইতে ৫০০ টাকা হয়ত ও জিবনে কখনই পায় নাই। ফলে ওর ভিতরে নানা প্রকার সাইকোলজিক্যাল কেল্কুলেসন খেলিতেছিল। মানুসের মন বড় বিচিত্র। সে যেই হোক। ৫০০ টাকা দিয়া আমার ভালই লাগিয়াছিল এই ভাবিয়া যে, আজ যদি সারাদিন সে অন্য কাহারো কাছ হইতে ভিক্ষা নাও পায়, তাহাতেও ওর কয়েকদিন চলিয়া যাইবে।
দেখিলাম, আমার ছোট মেয়ে অতি দ্রুত ইহারই মধ্যে ভিক্ষুক সমাচার লইয়া একটা ফেসবুকে স্ট্যেটাস দিয়া ফেলিল। ইতিমধ্যে জ্যাম ছুটিএ শুরু করিয়াছে। ড্রাইভার গাড়ি আঁকাবাঁকা করিয়া ফাক ফোঁকর দিয়া কিভাবে আরও দ্রুত চালানো যায় সেইদিকে মনযোগী হইয়া গেল, আমার বড় মেয়ে কোন কিছু না ভাবিয়া আবারো গানের কলি শুনিতে লাগিল। আমি শুধু এই ভিক্ষুকের ঘটনাটা মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম।
মানুষ বড় বিচিত্র।
০২/০৬/২০১৬ – মাধুরীর চিঠি
Categories
তোমাকে কি নামে যে সম্বোধন করি তাই বুঝে উঠতে পারছি না এখন। কি লিখব তোমায়? প্রিয় বন্ধু নাকি শুধু প্রিয়? অথবা শুধু তোমার নাম অথবা কিছুই না !! তোমাকে আমি যেই নামেই ডাকি না কেন, তুমি আমার একান্ত প্রিয়জন। কে জানি বলেছিল, বন্ধুর নাম ভুলে গেলেও সমস্যা নেই, কিন্তু শত্রুর নাম ভুলে যাওয়া যাবে না। তোমার বেলায় আমার এই নীতিটা হয়ত সঠিক নয়। আমি তোমার নাম ভুলে গেলে আমার আর কোন কিছুই হয়ত অবশিষ্ট থাকবে না। যাক, তোমাকে আমি কোন সম্বোধন ছাড়াই চিঠিটি লিখছি।
অনেকদিন ভেবেছিলাম তোমার সাথে আমি আর কখনো যোগাযোগ করব না। আর যোগাযোগ করে কিইবা হবে বল? তোমার হয়ত এখন সংসার হয়েছে, বাচ্চাকাচ্চা আছে, অনেক উচু স্তরের মানুষদের মধ্যে এখন তুমি একজন। জানি তুমি ভালই আছ।
তোমার এই শরতবেলার বেলাভুমির প্রাতভ্রমনে আমি হটাত করে সেই পুরানো দিনের কোন এক বর্ষার কাকভেজা বৃষ্টির সন্ধ্যাকালীন শ্বাসরুদ্ধকর রোমাঞ্চের কথা নিয়ে যদি আমি হাজির হই, কিইবা লাভ হবে, তুমিই বল? মাঝখানে হয়ত যেটুকু তুমি আমাকে করুনা করে হলেও মনে রেখেছ, তাও হয়ত আমার ভাগ্যে আর থাকবে না, অকারনে সেটাও হয়ত হারাতে পারি। অনেক কিছু হারিয়ে যদিও এখন হারাবার ভয় আমি করি না কিন্তু স্মৃতির পাতা ধরে স্থান কাল সময় গুনে গুনে যে কয়টা জিনিস আমি এখনো হারাতে চাইনি তার মধ্যে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় একটা। ভেবনা আমি আজ তোমাকে এই পত্র দিয়ে আবার নতুন করে কোন এক সম্ভাবনাময়কে জাগিয়ে তুলছি। অন্তত আমি তাঁর কোন সম্ভাবনা দেখছি না।
আমি জানি পাহারের নিচে দাড়িয়ে যত জোরেই কেউ তাঁর কথা বলুক না কেন, সেই একই সুর, একই শব্দ, সেই একই বানী পাহারের চারিদিকে বাতাসে বাতাসে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে আবারও নিজের কাছেই তা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। অবুঝেরা এটাকে বিধাতার উত্তর হিসাবে ধরে নেয়, আর যারা অবুঝ নয়, তারা জানে প্রকৃতির অবজ্ঞা করে এইসব কিছু ফিরিয়ে দেওয়া কত বড় নির্মম সত্য। এটা কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই বা করুক, অন্তত আজ এতটা বছর পর নতুন করে হিসাব করার প্রয়োজন বলে মনে করছি না। আর যখন ঐ নিষ্ফল প্রতিদ্ধনির আওয়াজ ফিরে আসে, তখন যেন তা আরও শতগুনে কঠিন এবং করুন করে কানে বাজে।
কেউ কারো কোন কথা রাখে না, মনে হয় কেউ কারো জন্য কখন অপেক্ষাও করে না। এর মানে আমি তোমাকে এই বলে যুক্তিও দেখাচ্ছি না যে, আমি কি বলতে চেয়েছিলাম, আর আমি তাঁর প্রতিধ্বনিতে কি পেয়েছি। সময় এমন এক জিনিস, সে সবার সঙ্গে আছে, সবার সঙ্গে থাকে অথচ সে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করে না। কেউ তাঁর সঙ্গে থাকুক আর নাই বা থাকুক, সে তাঁর নিজ গতিতে নিজ আবেশে তাঁর ঠিক গন্তব্যে সবাইকে ছেড়ে একা একাই চলতে থাকে। কোথাও তাঁর বিন্দুমাত্র অলসতা হয় না, কোথাও তাঁর কোন গড়মিল হয় না। পৃথিবীর সব চাইতে সস্তা যেমন সময়, তেমনি সবচেয়ে দামিও বটে। ইচ্ছে করলেই একে হেলাফেলা করে যেখানে সেখানে খরচ করা যায় আবার ইচ্ছে করলেই আবার এক আনা দুই আনা দিয়ে কেনাও যায় না। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা সময়, আর সেই সময়ের চাওয়া-পাওয়ার সাথে হিসাব নিকাশের দেনা পাওনাটাও এই খরচের বিচার্য বুদ্ধিচনায় পরে। চৈত্রের গরমের জন্য কেউ হেমন্তের দুপুরকে দায়ি করে না, কিংবা বর্ষার একটানা বৃষ্টির জন্য কেউ শীতের কনকনে সকালকেও দায়ি করে না। আমিও এখন না সময়, না পরিস্থিতি কিংবা না আইন বা ধর্মকে দায়ী করি।
এই চিঠি পরে তোমার হয়ত মনে প্রশ্ন আসতে পারে আমি কেন তাহলে আমার সেই পূর্বেকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তোমাকে আবার আজকে লিখতে বসলাম। আমার আসলে আর কোথাও কেউ নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই, যেটুকু আছে তা শুধু তুমি। এত বিশাল পৃথিবীর মাঝে কত মানুষ যে কতভাবে অসহায়, আমি নিজেকে দেখে তা বুঝতে পেরেছি।
প্রথম যেদিন আমি তোমাকে দেখেছিলাম, মনে পরে তোমার সেই দিনের কথা? আমি জানি না আমাকে দেখে তোমার কি মনে হয়েছিল, কিন্তু আমার কাছে সমুদ্রের গভীরতার চেয়ে তোমার চোখের ভাষা আরও বেশি দুর্গম মনে হয়েছিলো, অথচ আমার কেবলই মনে হয়েছে ঐ আখির ভাষা আমার পরিচিত, তোমার মুখের ভাষা আমার পরিচিত। যদিও তোমার কোমল কঠিন দেহখানি আমার কাছে পাহাড়ের শিলাভুমির প্রস্তরখন্ড থেকেও কঠিন মনে হয়েছিল কিন্তু তাঁরপরেও আমার কেবলই মনে হয়েছে কোথায় যেন আমি তোমাকে দেখেছি।
আমি আর পাঁচটি মেয়ের মত নই, সেটা তুমিও জান, আমিও জানি। নীল আকাশের ছায়াপরা কোন এক চকচকে পুকুরের মাঝখানে নীলপদ্ম দেখলেই আমি সবার মত উল্লসিত হয়ে চারিদিক চমকিয়ে দেই না হয়ত কিন্তু আমার ভিতরে যে কোন সাড়াশব্দ হয় না তা নয়। আমার অনেক রাত কেটেছে কোন কিছু ভাবা ছাড়াই, আমার অনেক দিন হয়ত নাওয়াও হয় নাই শুধুমাত্র এই ভেবে, কে তুমি? যেদিন বুঝেছি তুমি কে, সেদিন উপলব্ধি করেছি, আমি স্রোতের বিপরিতে নৌকার গুন টানছি, বুঝতে পেরেছি আমি উল্টো পথে রথে উঠেছি। তারপরেও আমি রয়ে গেছি, আর রয়ে গেছি তোমাকে পাবার জন্য নয়, তুমি আমার কাছাকাছি আছ, এই ভরসায়। এটাই বা কম কিসের? এতসব অপরিচিত মানুষদের মাঝে অন্তত আমি তো একজনকে হলেও চিনি, তোমাকে চিনি, তুমি আছ। তুমি কি কখনো জানতে পেরেছ যে, পৃথিবীর সমস্ত মানবকুলের মধ্যে আমি তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেতাম, এর মানে এই নয় যে তুমি ভয়ংকর। আমার ভয়ের কারন একটাই। তোমার নির্লিপ্ততা। তোমার কোন কষ্টের কারন যেন আমি কখনো না হই সেই ভয়ে আমি সর্বদা ভীত থেকেছি। অথচ আজ আমার ভিতরে কোন প্রকার ভয় নেই, কারন তুমি আমার পাশে কোথাও নেই। আর কোথায় আছ তাও আমি সঠিকভাবে আন্দাজ করতে পারি না। জীবনের এই সায়াহ্নে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তোমাকে। মনে হয়েছে যদি একদিন বা কোথাও একবার আবার তোমার চোখে চোখ রেখে বলতে পারতাম, আমি হারিয়ে যাইনি, অথবা আমি হারিয়ে যেতে চাইনি, আমার কুড়েঘরের সদর দরজার মেঠোপথ তোমার জন্য সবসময় খোলা ছিল এবং এখনো আছে। যদি কখনো দৈবাৎক্রমে আমার এই আশ্রুজলে শিক্ত লেখাটা তোমার হাতে পরে আর যদি তখনো আমার এই দেহে টিমটিম করে হলেও একটু প্রানশক্তি থাকে, তবে জেনে রেখ, আমি তোমাকে হয়ত বলতে চেয়েছি, তুমি এসো আর একবার যদি কখনো তোমার ভিতরটায় শুন্যতায় ভরে গিয়ে হাপিয়ে উঠো। এসে একবার আমার চোখের জলের সাথে তোমার সেই বেদনাবিধুর চোখের অসমাপ্ত কান্নাগুলো দিয়ে বলো, তুমি ভাল আছো। আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমার সেই ক্লান্ত আঁখির শিশিরের টিপটিপ করা ব্যাথাকনাগুলো বয়ে নিয়ে আখি বন্ধ করে দেব। তুমি এক ফোটা জলও দেখতে পাবে না।
আজ এই অবেলায় তোমাকে কত কথা লিখতে ইচ্ছে করছে যেন।
মনে পরে তোমার সেই কাকডাকা ভোরে একবার আমি আর তুমি হারিয়ে গিয়েছিলাম সেই শাওতালদের গ্রামে? ট্রেন আটকা পড়েছে কোন এক বনের ধারে। ট্রেন আবার কখন চলা শুরু করবে কেউ বলতে পারছে না। একেক জনের কাছ থেকে একেক ধরনের খবর পাচ্ছি ট্রেন নষ্ট হবার কারন জানতে গিয়ে। আসলে কেউ বলতে পারছিল না কি কারনে ট্রেন এই মাঝপথে হটাত করে এতগুলো যাত্রি নিয়ে অজানা সময়ের জন্য বিশ্রামে গেল। অনেক যাত্রি ট্রেন থেকে নেমে এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করছে। আমরাও এক সময় সবার দেখাদেখি ট্রেন থেকে নেমে ঘুরতে বেরিয়ে গেলাম। গল্প আর গল্পে কখন যে কোন রাস্তায় হাঁটছিলাম, আমরাও তাঁর রেখাপথ মনে রাখিনি।
শেষমেশ এক শাওতালদের গ্রামে গিয়ে হাজির হয়ে গেলাম। কি অদ্ভুদ এক সমাজ। সবাই সবার আপনজন। সবাই যেন সবার জন্য। সবাই যেন এক পরিবার। গ্রামটা ঘুরতে ঘুরতে কোথাও এক কাপ চা খাওয়ার জন্য একটা দোকান পর্যন্ত পেলাম না। আসলে সাওতালদের কোন পৃথক দোকান নেই ঐ গ্রামে। গ্রামের সরু পথ দিয়ে আমরা দুজনে হাঁটছি, সব ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঘর দুয়ার, এলোপাথারিভাবে সাজানো বাড়িঘর। গরু ছাগলগুলোও যেন স্বাধীন। কোনটাই খোয়ারে বাঁধা নেই। কুকুর, গরু ছাগল, হাস মুরগি মানুষ সব স্বাধীন। গাছগাছালি ভর্তি পুরু গ্রামটা। কোথাও কাদা পেরিয়ে এই বাড়ি থেকে ঐ বাড়ি যেতে হয়। পানির মটকাগুলো একদম উদোম। কয়েকটা পাখী বসে আছে মটকাগুলোর উপর। পাখীগুলোও জানে এখানে কোন সমস্যা নাই। ওরা বরং আমাদের দেখে একটু শঙ্কিত হয়ে এদিক সেদিক উড়াল দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে মোরগগুলো উচ্চ স্বরে অন্যদেরকে জানান দিচ্ছিল এখানে আগন্তক এসেছে, যেনো মোটিভ বুঝা যাচ্ছে না বোধহয়। কয়েকটা বাচ্চাওয়ালা মুরগি তরিঘরি করে বাশঝাড়ে লুকিয়ে গেল। আমরা এদের কারো কাছে পরিচিত নই। প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু তাঁদের স্বকীয়তায় ব্যতিক্রম পছন্দ করে না। বড় ভাল লাগছিল ব্যাপারটা উপভোগ করতে। কতক্ষন কেটে গিয়েছিল আমরা বুঝতেই পারিনি, হটাত অল্প দূর অপেক্ষামান ট্রেনের সচল হবার সংকেত দিয়ে আমাদের চারিদিকে ছরিয়ে থাকা যাত্রিদেরকে মনে করিয়ে দিল আমরা ট্রেনে ছিলাম এবং এখন আবার সেখানে যেতে হবে। তা না হলে ঐ যে বললাম, সময়ের সাথে সাথে এবার ট্রেন হাত জুটি বেধে পুনরায় তাঁর সেই গন্তব্যের দিকে ছুটে যাবে। যারা তাঁর সাথে নেই, তারা থেকে যাবে যেখানে সে আছে সেখানেই।
ফিরতে গিয়ে আমরা বুঝলাম, আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। কোন রাস্তায় এই শাওতাল গ্রামে ঢোকেছিলাম, এখন আর সেই আগের রাস্তাটা পরিচিত মনে হচ্ছেনা, মনে হচ্ছে ভুল পথে ট্রেনের দিকে যাচ্ছি, আদৌ ট্রেনের দিকে যাচ্চি কিনা তাও বুঝতে পারছি না। ট্রেনের হুইসেলটা মনে হচ্ছে আরও দূর থেকে কানে আসছে। দ্রুত হাটতে হবে, তা নাহলে নির্ঘাত ট্রেন মিস করব। আর ট্রেন মিস করলে এর পরের অধ্যায়টা আমার অন্তত জানা নাই। তুমি দ্রুত হাঁটছ, আমি তোমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অত দ্রুতও হাটতে পারছি না। রাস্তাটা আমার কাছে অমসৃণ গিরিপথের মত মনে হতে লাগলো। আমার সাড়া শরীর ঘামে যেন ভিজে আসছিল। চুলের ভিতর থেকে কেমন একটা গরম আভা বের হচ্ছিল। আমার কপাল দিয়ে শিশিরের ফোটার মত করে একটু একটু ঘাম বেরিয়ে চোখের জলের ফোটার মত আমার কানের পাশ দিয়ে বুকের ওড়নায় পড়ছিল। আমি যেন আর হাটতে পারছিলাম না। তুমি আমার হাত ধরলে।
এই প্রথম তুমি আমার হাত ধরলে। আমি তোমার হাতের অনুভুতিটা তখন কিছুই বুঝতে পারিনি, শুধু মনে হয়েছে, আমি যেন একটা অবলম্বন পেয়েছিলাম শক্ত করে ধরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। অনেক ক্লান্ত অবশ দেহ আর ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে কোন রকমে যখন আমরা ট্রেনের ধারে ফিরে এলাম, তখন ট্রেন প্রায় ছাড়ি ছাড়ি ভাব। ট্রেনের সিটে বসে অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে আমার ক্লান্ত শরিরের সমস্ত পরিশ্রম যখন বিশ্রামে নিমগ্ন, তখন বুঝলাম, একটু আগে তোমার হাতের যে পরশটা আমার শরিরের বাহুতে লেগেছিল, তা এখন আমার অনুভুতিতে আরেক স্বর্গীয় ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। আমার আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল, শাওতাল গ্রামের ঐ মানুষগুলোর সঙ্গে হারিয়ে গেলেই তো ভাল ছিল। প্রতিনিয়ত আমার মনে হচ্ছিল, ট্রেন চলছে, আমার মন চলছে না। বাইরে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষন। বহুদুরের ঐ গ্রামগুলো কতই না গতিতে আমার দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে নিমিষে। এখন আর সবুজ গ্রাম ভাল লাগছে না, নীল আকাশের খন্ড খন্ড মেঘগুলোও আর আমার কাছে কাব্যিক মনে হচ্ছে না। অথচ একটু আগে এর সবকিছুই ছিল আমার কাছে আমার অনন্তময়ি প্রেমের এক আবেদনের মত। ঐ যে বহু দূর অবধি দেখা যায় আকাশ যেখানে আকাশ আর মাটি দুজনে এক হয়ে গেছে, অথবা এই যে ট্রেনের দুই সমান্তরাল সারি যারা একে অপরের পাশে অনন্তকাল ধরে পাশাপাশি বয়ে যাচ্ছে অথচ কখনই তারা একে অপরের নয়, এমন একটা সম্পর্ক যার ঠিকানা কারো জানা নাই। হয়ত তুমি আর আমি ঠিক তাই। আমরা একই ট্রেনের যাত্রি অথচ গন্তব্য এক নয়, আমরা একই আকাশের নিচে চলছি কিন্তু আমার দিগন্ত আর তোমার ভেজা মেঘ এক নয়। মনটা ভারি হয়ে উঠেছিল সারাটা রাস্তা।
আজ কত কথা মনে পড়ছে আমার। তোমার কি মনে পরে আরও একদিনের কথা?
সেদিন ছিল বর্ষার প্রথম সপ্তাহ। চারিদিকের আকাশ মেঘে ভরা, গুরগুর মেঘের আওয়াজ। থেকে থেকে হাল্কা বৃষ্টি আবার ক্ষনেক্ষনে রোদ। হুমড়ি ধুমড়ি খেয়ে যেন তুমি উচ্ছল হরিন শাবকের মত মেঘলা সেই দুপুরে অস্থির চিত্তে ঘনঘন দরজার কড়া আর কলিং বেল টিপে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করলে যেনো, আর কয়েক সেকেন্ড দেরি করে দরজা খুললে না জানি কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, অথবা কোন এক রাজ্যের রামায়ন তাঁর অপ্রতিরোধ্য মেঘবদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। তোমার সাড়া শরীর ভেজা, চুলগুলো মনে হল কতকাল চিরুনি পরেনি, তারপরেও তোমাকে বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছিল। যতবার আমি তোমাকে দেখেছি, আমি ততবারই যেন কোন এক নতুন মানুষকে দেখেছি। সকালের তুমি বিকালের মত নও, বিকালের তুমি আর পরেরদিনের তুমি সম্পূর্ণ আলাদা এক মানুষ। কখনো তুমি হিমালয়ের মত স্থবির, আবার কখনো তুমি উস্রিংখল ডাহুকের মত জ্বালাময়ী, কখনো তোমাকে দেখেছি আমি এতটাই নির্লিপ্ত যেনো পানকুড়ির মাছধরার ধ্যানের মত স্থির। কখনো দেখেছি আমি অতিশয় ক্ষুদ্র বিষয়ে তুমি অতটাই উত্তেজিত অথচ অতিকায় হস্তিসমেত বিষয়ে তোমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ভগবান মানুষকে দিয়ে কি পরীক্ষা করান তা আমার জানা নাই তবে তোমার বেলায় ভগবান সর্বদা কৃপাশীল ছিলেন অনেকের চেয়ে বেশি। ভালবাসার হৃদয় ভগবান তোমাকে দিয়েছেন কিনা আমার জানা নাই, তবে তোমাকে ভালবাসবে এই এমন কিছু একটা ভগবান তোমার মধ্যে সে চিরস্থায়ী প্রথা হিসাবে নিশ্চয় দান করেছেন। তোমার ভেজা চুলেও যেমন মাদকতা আছে, চিরুনির আচরনে শুকনা চুলেও মাদকতা আছে। চঞ্চলতা যেমন মনকে উতালা করে দিতে পারে, তেমনি তোমার অবসন্ন দেহও মনকে ভেঙ্গে খান খান করে দিতে পারে। তোমাকে এই প্রথম আমি যেন আরেক তোমাকে আবিস্কার করলাম। তুমি অতিশয় অস্থির, তোমার কথাবার্তায় কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ভাব। অধিক কথা বলার যেন সময় নেই। কোথায় কি কারনে যেন তুমি আর তোমার মধ্যে নেই। অবশ্য ব্যাপারটা একটুপরেই বুঝতে আমার আর বাকি ছিলনা।তোমার মা অসুস্থ।
আমি তোমার একটা জিনিষ সেই প্রথম দিন থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। পৃথিবীর যাবতীয় উচ্ছ্বাস, সুখ, দুঃখ, আর আবেগ যদি হয় একদিকে, তোমার মার জন্য তোমার এই উচ্ছ্বাস, সুখ, দুঃখ, আবেগ অথবা যাই কিছু থাকুক না কেন, তিনি আরেকদিকে। তোমার মায়ের জন্য তুমি সত্যকে মিথ্যা, বা মিথ্যাকে সত্য অথবা ন্যায়কে অন্যায়, বা অন্যায়কে ন্যায়ের দিকে নিয়েও যদি মনে হয় তোমার মা তাতে খুশি, হয়তবা তুমি তাই করার জন্য শারীরিক এবং মানসিকভাবে সর্বদা, সর্বত্র সব কিছুর বিনিময়েও করতে তোমার কোন প্রকার দ্বিধা হবে না। এ এক ব্যাতিক্রমি চরিত্র আমি তোমার মধ্যে প্রকটভাবে দেখেছি। কোন কিছুর সঙ্গেই তাঁর কোন তুলনা তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আর আমার এখানেই সবচেয়ে বেশি ভয় হত যদি কখনো কোন কারনে আমি তোমার এই সবচেয়ে দুর্বলস্থানে একটু হলেও ছোঁয়ার কারনে আমার সমস্ত আরাধনা, আমার ভাললাগার ব্যাক্তিত্ত তোমার কাছে আমি এক নিমিসেই অপরিচিত হয়ে যাই। তোমার সেই মা অসুস্থ। তুমি ঠিক নাই বুঝতেই আমার মনের গভিরে এক চরম উৎকণ্ঠা বোধ হতে লাগলো। দুর্ঘটনা আভাস দিয়ে আসে বটে, কিন্তু সুভাগ্য কোন আগাম সংকেত দিয়ে আসে না। তোমার এই দুর্ভাগ্যে যেন আমার সু-ভাগ্য খুলে গেল। তোমার মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে থাকার মত নির্ভরশীল কোন মানুষ তুমি তোমার জগতের চারিপাশে খুজে পেলে না, প্রথম যার কথা মনে হয়েছিল তোমার, সে আমি। আমি ভাগ্যবতী। তুমি আমাকে কোন সময় না দিয়ে, কোন রকমে কোন প্রকার প্রস্তুতি হওয়ার সময় না দিয়ে এক প্রকার বিদ্যুৎ গতিতেই বের করে নিয়ে হাজির করলে সেই অসামান্য মানুষটির কাছে যার সমতুল্য এই পৃথিবীতে তুমি আর কাউকেই জানোনি।
তুমি চলে গেলে আমাকে রেখে। নিস্তব এক ক্যাবিন।
ডাক্তাররা আসছে ঘন ঘন, নার্স, আয়া, সবাই ব্যাস্ত এই ঘুমন্ত শিশুর মত মানুষটির যত্নে। আমি কে, কি তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তারা অনেকেই জিগ্যেস করলেও আমার বলতে কোন অসুবিধা হয় নাই, কারন তিনি আমার মায়ের মতই একজন মানুষ। আমি তাকে আমার মায়ের সঙ্গেই মিল রেখে পরিচয়টা দিয়েছিলাম যে, আমি তাঁর মেয়ের মতই। আমি এছাড়া আর কি বলতে পারতাম বলো? কি অদ্ভুত এক ব্যাপার। তোমার সাথে তোমার মায়ের কোথাও কোন গড়মিল নেই। সেই ঠোঁট, সেই নাক, সে মুখাবয়ব, চোখের ভ্রুটা পর্যন্ত একদম মিল। আমি বসে আছি তাঁর পাশে। প্রতিনিয়ত আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন তোমাকেই দেখছি। এত কাছ থেকে এত নিরিবিলিতে আমি কখনো তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকিনি। আজ যেন মনে হচ্ছিল আমার সেই না দেখা তোমাকে এত কাছে থেকে দেখছি। কখনো আমি তাঁর হাত দুটো ধরছি, কখনো তাঁর ভ্রুটা, আবার কখনো তাঁর কানের কাছে গিয়ে তাঁর মসৃণ চুলের গন্ধ শুকছিলাম। কখন কিভাবে কি মনে করে জানি না, দেখেছিলাম আমার দুচোখ বেয়ে কয়েক ফোটা জল আমার নিজের অজান্তেই এই ঘুমন্ত মানুষটির বুকের উপর পরেছিল। আমি কি কেদেছিলাম? কোন কিছু ভেবে কি আমার মনে কোন কস্টের উদ্রেক হয়েছিল? না, আমার তা মনে নেই। শুধু মনে হয়েছিল, একবার বুক ভরে যদি আমি এই মানুষটির বুকে পড়ে অনেক্ষন কাদতে পারতাম, হয়ত আমি আরও শান্ত হয়ে কিছুটা দিন কাটাতে পারতাম। আমার মায়ের অনেক স্মৃতি আমার মনে নেই। একজন মা একজন সন্তানের জন্য কি কি করে আমার তা জানা নাই। তবে আমি জানি একজন সন্তান তাঁর মায়ের অভাবে কি কি মিস করে। তোমার কথা মনে হলো। আমি আমার ঈশ্বরের কাছে প্রানভরে আরাধনা করলাম, হে ভগবান, তুমি যাকে ভাগ্যবান করে রেখেছ, তাকে আবার হতভাগা কেন করবে? কি নেই তোমার যে, সামান্য একজন মানুষের অনুপস্থিতি দিয়ে তোমার আরেক প্রিয় একজন আদমকে চোখের জলে ভাসাতে চাও? তোমার হিসাব-কিতাব, তোমার চাওয়া-পাওয়ার মাঝে আমার কোন কৈফিয়ত চাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই কিন্তু আমার আরাধনা যদি কখনো মনজুর করো, তাহলে আজ এইদিনে তুমি এই ঘুমন্ত মানুষটিকে তোমার মত করে আরোগ্য করে দাও। আজ এই প্রথম আমার মনে হল, ঈশ্বর আছেন, ঈশ্বরের কাছে বলার অনেক কিছু আছে। আজ কেন যেন মনে হল, আমি ঈশ্বরকে ভালবাসি কারন ঈশ্বর আমাকে তাকে ভালবাসবার এবং তাঁর সাথে রাগ করার ইচ্ছাশক্তি আমাকে দিয়েছেন। তোমার ঐ কথাটিই আজ আমার কাছে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল যেটা তুমি প্রায়ই বলতে, “আই লাভ গড বিকজ হি হ্যাজ গিভেন মি দি পাওয়ার টু হেট হিম”। কি অদ্ভুত তোমার বলার সাহস আর দাপটতা। তুমি তোমার ধর্মের উপর কিভাবে বিশ্বাস রেখেছ তা আমার বিশদ জ্ঞ্যান হয়ত নাই কিন্তু আজ আমি হাসপাতালের এই নিরব ক্যাবিনে একজন ঘুমন্ত মানুষের সামনে বসে বুঝতে পারছিলাম, ভগবান যেই ধর্মেরই হোক, তিনি সবার জন্য সমান। এই বিশ্বভ্রমান্ডে যা কিছু আছে সব তাঁর। এর রূপ, গন্ধ, এর প্রকৃতির সৌন্দর্য, এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট সবকিছু তিনি তাঁর নিজের মত করে সাজিয়েছন। এর থেকে আরও সুন্দর কিছু হতে হয়ত পারে না। গোলাপের রং শুধু গোলাপিই নয়, এর স্থান কাল তাপমাত্রা ভেদে সে তাকে আরও অনেক রূপে আকার দান করেছে। আকাশ শুধু নীলই হয় নাই, এ কখনো কালো, কখন সাদা, আবার কখনো কতই না রঙে তুমি সাজিয়েছো। কি দরকার ছিল ঐ আফ্রিকার জঙ্গলে অত সুন্দর একটা লাল গোলাপ ফুটিয়ে রাখবার? কার জন্য কেউ জানে না অথচ তা আছে, বাস্তবেই আছে। কি প্রয়োজন ছিল এরিজোনা নদীর তিরে কোন এক ইউকেলিপ্টাস গাছে চুরায় সুন্দর সবুজ টিয়ার বাসা করে দেয়ার? কি প্রয়োজন ছিল ঐ গহিন সমুদ্রে পানির শতশত ফুট নিচে লাল নীল, বিভিন্ন রঙের সারি সারি দুবলা গাছ সৃষ্টি করবার? সবই রহস্য। তাঁর এই রহস্য সন্ধানে আমার শক্তি নাই। আরেক জলজ্যান্ত রহস্য তো এখন আমার সামনে। তিনি তোমার মা। সারাটি বিকাল আমার কেটে গেল কোন এক ঘোরের ভিতর। তুমি এলে সন্ধ্যার পর। ধুপ জ্বালাবার কোন কায়দা নেই এখানে, প্রভুর কাছে রিতি মোতাবেক প্রার্থনা করবার কোন প্রসাদ নাই এখানে। এখানে যার যার ভগবান তাঁর তাঁর অন্তরের একান্ত ভিতরে। এখানে জীবনের আরাধনা চলে, হোক সেটা মৃত্যুর অথবা জন্মের। কেউ হাসিমুখে বাড়ি ফেরে আবার কেউ অশ্রুসিক্ত নয়নে। কি অবাক না!! চোখের জলের ভাষা দুটুইঃ আনন্দের অথবা কষ্টের।
-হন্তদন্ত হয়ে ক্যাবিনে ঢোকেই তুমি প্রথম যে কতাটি জানতে চেয়েছো সেদিন- মাধুরী, মা কি কোন সাড়া শব্দ করেছিল এরই মধ্যে? তোমার তো আজকের দিনটা এখানে মায়ের সঙ্গে থাকতে হবে, আমি তোমার হোস্টেল সুপারকে খবরটা দিয়ে এসেছি যে তুমি আজ আসছ না। আমি তোমার বন্ধুদেরকেও খবরটা দিতে বলেছি। তুমি দুশ্চিন্তা কর না। আমি হয়ত কাল থেকে মায়ের সঙ্গে থাকতে পারব। আমার পরিবর্তে আমার এক খালা আসবে কাল গ্রাম থেকে। তখন তুমি আবার তোমার হোস্টেলে চলে যেতে পারবে।
কথাগুলো তুমি এমন করে বললে যেন, আমি আজকের দিনের জন্যই শুধু প্রয়োজন, কাল থেকে আমার কোন দরকার হবে না। তোমার মন খারাপ হবে ভেবে আমি তোমাকে কিছুই না বলে শুধু বলেছিলাম, আমাকে নিয়ে তুমি চিন্তা করোনা। যতদিন মা এখানে থাকবে, আমি থাকতে পারব। শুধু আমার কিছু পরিধেয় কাপড়চোপড় বাসা থেকে নিয়ে আসতে হবে। আমি আসলে এই অসামান্য মানুষটির পাশে থাকতে চেয়েছিলাম।
অনেক রাত অবধি তুমি ছিলে ওখানে। যাওয়ার সময় মনে হল, তুমি যেন শরীরটা নিয়ে বাসায় যাচ্ছ আর মনটা দিয়ে গেলে আমার হাতে। তোমাকে আমার বড্ড মায়া করতে ইচ্ছে করেছিল। আজকের তুমি কত ভিন্ন। আমি তোমার এই রূপটা কখনো দেখি নাই। কখনো দেখেছি তোমার গলা ধরে এসেছে মায়ের কথা বলতে বলতে, কখনো দেখেছি তোমার চোখের পাপড়িগুলো ভিজে যাচ্ছে চোখের অসংবরিত নোনা জলে, আবার কখনো দেখেছি তুমি কতটা উদার আমার প্রতি যাতে সব কিছুর বিনিময়ে হলেও যেন আমি তোমার মায়ের সমস্ত দেখভালটা করি। কখনো মনে হয়েছে তুমি কতটা স্বার্থপর। শুধু তুমি তোমাকে নিয়েই ভাবো। একবারও ভাবো নাই যে আমিও তো এখানে তোমার মায়ের কষ্টে ব্যথাতুর হয়ে আছি।
তুমি চলে গেলে। আমি একা বসে আছি মায়ের পাশে। দেয়ালে থাকা ফ্লরসেন্ট বাতিটা নিভিয়ে দিয়েছি। টেবিল ল্যাম্পটা জলছে আধোআধো ভাবে। হটাত দেখলাম, মা নড়তে শুরু করেছেন। মনে হল তিনি জেগে উঠছেন। যতই তিনি নড়াচড়া করছেন, আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন ততই কেঁপে কেঁপে উঠছে। কখনো মনের আনন্দে, আবার কখনো অজানা এক ভয়ে। আনন্দ এই কারনে, তাঁর নড়াচড়া আরোগ্য লাভের জন্য ভাল লক্ষন, কিন্তু ভয় এই কারনে তিনি কখনো আমাকে দেখেন নাই। আমি মায়ের ডান হাতটি আলতো করে চেপে ধরলাম। মনে হল একটা অবলম্বন ধরেছি। উত্তাল সমুদ্রে যখন প্রকান্ড জাহাজটি ভেঙ্গেচূরে খান খান হয়ে আশ্রয়ের সমস্ত ভরসা উবে যায়, কেউ যখন আর কোন আশ্রয়ের অবলম্বন না পেয়ে প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর ভয়ে আতংকিত হয়ে উঠে, তখন কোন অজানা দূর থেকে ভেসে আসা হয়ত ঐ জাহাজেরই ছোট্ট একটা কাষ্ঠখন্ডও আতঙ্কের নিরাময় হয়ে স্বস্থির আভাষ হয়ে উঠে। মায়ের হাত ধরাটাও যেনো আমার কাছে তাই মনে হলো।
মা বেশ কিছুক্ষন পর যেনো তাঁর অসম্ভব ক্লান্তি ছাড়িয়ে চোখ মেললেন। তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। অপলক দৃষ্টিতে তিনি আমাকে দেখছেন। আমিও। কি সুন্দর তাঁর চোখ। কি অদ্ভুত তাঁর চাহনি। আমার ভিতরে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো দিকবিদিক শুন্য এক তান্ডব বয়ে যাচ্ছিল। আমি শুধু তাকিয়েই ছিলাম মায়ের দিকে। মা শুধু অপলক পলখহীনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আমার হাতে ধরা তাঁর হাতটি আরও শক্ত করে ধরে থাকলেন। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, আমি আর তাকে ভালভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কখন যে আমি তাঁর বুকে মাথাটা রেখে জরিয়ে ধরেছিলাম আমার কোন কিছুই মনে পড়ে না। শুধু মনে পরে, কর্তব্যরত নার্স এসে আমাকে বললেন, আপা, আপনি ইচ্ছে করলে পাশে বিছানায়ও কিছুক্ষন বিস্রাম করতে পারেন। আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আমি আর তাকে এটা বলার কোন প্রয়োজন মনে করলাম না যে, আমি ক্লান্ত নৈ, আমি ভাল আছি, কারন মা ভাল আছে। আর মা ভাল থাকলে তুমি ভাল থাকবে। ভগবান বড় রসিক। তাঁর রসিকতায় চোখের জল আর মনের আনন্দ সব একাকার হয়ে যায়।
যে কয়টাদিন আমি মায়ের সঙ্গে থেকেছিলাম, আমার জীবনে ওটা ছিল শ্রেষ্ঠ সময়। আমি জানিনা মা আমাকে কতটা আপন করে নিয়েছিলেন, কিন্তু আমার কাছে মা ছিল একটা শ্রেষ্ঠ উপহার। তুমি ঠিকই বলতে, তোমার মা এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম একজন মা। তাঁর তুলনা তিনি নিজে। সকালে উঠে তিনি প্রতিদিন আমাকে বুকে জরিয়ে চুমু খেয়েছেন। রাতে শোবার সময় বলতেন, আমাকে জড়িয়ে ঘুমাবে। আমার কাদতে ইচ্ছে করত এইভেবে যে, এই একান্ত সময়টা আমার খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। মা আমাকে কখনো কিছু জিজ্ঞ্যেস করতেন না কে আমি বা কি বা আমার সম্পর্ক তোমার সাথে। শুধু প্রথম দিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার পরিবারের কথা। হয়তবা আমার মা স্বর্গীয় হয়েছেন, বাবা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে সুখে আছেন, আমি একটা মহিলা হোস্টেলে থাকি, এই জেনে আর কিছুই তাঁর জানার প্রয়োজন ছিল না। তোমার মা আমাকে আদর করে কি এক অদ্ভুত নামে ডাকতেন যার অর্থ আমি কখনই হয়ত জানব না কিন্তু আমার তাঁর এই দেয়া নামটায় কোন আপত্তি ছিল না বরং আমার খুব মনে ধরেছিল। তোমাকে আজ ঐ নামটা মনে করিয়ে দিতে চাই না কারন তুমি সেটা যে ভুলে যাও নি তা আমি জানি।
মা সেরে উঠলেন চারদিন পর। আমি এই কয়দিনে ভুলেই গিয়েছিলাম আমি হোস্টেলে থাকি, আমাকে আবার হোস্টেলে ফিরতে হবে। মা আমাকে তোমাদের নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। মা আমাকে জোর করেননি, আমাকে যেতে হবে মায়ের সঙ্গে তোমাদের বাসায়, এই কথাটা এমন করে বলেছিলেন যে, আমার সাত জনমেরও সাধ্যি ছিল না এর কোন ব্যাতিক্রম হয়। হাসপাতালের আয়া থেকে শুরু করে নার্স, পাশের ক্যাবিনের রোগীরাও মায়ের এই প্রত্যাবর্তনে যতটা না খুশি হয়েছিল তাঁর থেকে বেশি যেন কষ্ট পেয়েছিল এইভেবে যে, তারা সবাই মাকে মিস করবে। মাকে দেখে বুঝলাম, মানুষকে আপন করে নেওয়ার জন্য অধিক সময়ের দরকার হয় না। দরকার শুধু মানবিকতা আর নিঃস্বার্থ ভালবাসা।
মাকে নিয়ে তুমি তোমাদের বাসায় এলে। সঙ্গে আমি। এই প্রথম আমি তোমাদের বাসায় এলাম। রবিন্দ্রনাথের জমিদার বাড়ির মত না হলেও দেখলাম বাড়িটা অনেক বড়। তোমাদের বাড়ির পশ্চিম পাশে একটা পুকুর ঘাট আছে। পুকুর ঘাটের সামনের রাস্তাটা তোমাদের বাড়ির সদর দরজার ঠিক উল্টো দিকে গিয়ে মিশেছে। কেউ রাতে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেও অসুবিধা নাই, পুকুর ঘাট থেকে সোজা বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছতে পারবে। মাঝে দুইটা সেই পুরানো মডেলের রাজা বাদশার আদলে বাতি আছে। মোটামুটি তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট উচ্চতা। পুকুরের চারিধারে বসবার জন্য কয়েকটি আধা পাকা বেঞ্চের মত করে দেওয়া আছে। প্রতিটি বেঞ্চই কোন না কোন একটা গাছে নিচে। বাড়ির সামনে একটা ছোট বাগান। অনেকদিন এই বাগানে মালির হাত পরেনি বুঝা যাচ্ছে। তাঁরমধ্যে বৃষ্টির সিজন। বর্ষার পানি আর যথেষ্ট পরিমান আলো বাতাস পেয়ে বাগানের আগাছাগুলো লিকলিক করে সবার অন্তরালে অল্প সময়ের মধ্যে যার যার স্থান করে নিয়েছে। বুঝা যায়, বাগানে অনেক অতিথি পোকাদের আনাগোনা হয়েছে। এরাও এই জায়গাটাকে প্রানমুখর করে রেখেছে। বাড়ীটার উত্তর ধারে আছে প্রকান্ড একটা জামগাছ। এখন ফলের সিজন শুরু হয় নাই কিন্তু পাপড়ি, কুড়ি গজানোর সময়। তাই জামগাছেও থোকায় থোকায় কিছু নতুন কুড়ি এসেছে। আর এদের সঙ্গে চিরাচরিত পরকিয়া প্রেমিকের মত কিছু মধু আহরণকারী পোকামাকরের সর্বদা ভীড় রয়েছে। জামগাছটিও আর একা নয়। তাঁর উপরের মগডালে নিতান্তই সাধু বাবার মত, ভদ্র পরিবেশ বানিয়ে কয়েক জোড়া বাবুই পাখী তাঁর সুনিপুণ কৌশলে বানানো ঝুলন্ত কয়েকটি বাসা মোটামুটি পাকাপোক্ত করেই যেন চিরস্থায়ি বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। একপাশে অনেক পুরানো দিনের পরিত্যাক্ত একটা ডোবা। বুঝা যাচ্ছে এই ডোবাতে কেউ নামে না। এলোপাথাড়ি কচুরিপানা, কিছু গাছের মরা ঢাল, বর্জ্য পদার্থ, অনেক কিছুই চোখে আসে। আর এই ডোবাটার ঠিক আশেপাশে কিছু দস্যুপনা পাখির সারক্ষন আনাগোনা থাকে কখন ছোট্ট একটা নলা মাছ, বা কচি প্রানের একটা ব্যাঙের ছানা যেই না উকি মারে অমনি ছো মেরে ঘপ করে মুখে পুরে নেয়। পুরু বাড়িটার মধ্যে একটা প্রানের লক্ষন আছে। সবচেয়ে বেশি লক্ষ করলাম, বাড়িটা নীরবতায় পরিপূর্ণ কিন্তু নিরব নয়। দুদিন থাকতে হল।
আমার কোন বাড়ি নাই। আমার পৈত্রিক বাড়িতে আমার বিশেষ কোন কদর ছিল কিনা আমি জানি না কিন্তু আমার ঐ পৈত্রিক বাড়িটায় আমার কোন নিজস্ব নেশাও জন্মেনি। সেই ছোট বেলায় আমি যখন শেষ বার গিয়েছিলাম, তাঁর স্মৃতি আমি আজও ভুলি নাই। সেটা ছিল এক দুঃসহ এবং ভয়ংকর অনুভুতি। আমরা সবাই সন্ধ্যা পূজায় বসেছি মাত্র। এমন সময় গ্রামের কিছু লোক আর তাঁদের সঙ্গে কিছু বিশ পঁচিশ বছরের যুবক আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। লোকগুলোকে দেখে বেশ উত্তেজিত বলে মনে হলো। আমার মা পুজা ছেড়ে সদর দরজার কাছে এসে একজনকে তাঁদের আগমনের কথা জিজ্ঞ্যেস করতেই পিছন থেকে এক যুবক উত্তেজিত কোথায় মাকে গালিগালাজ করতে লাগলেন। যেন ব্যাপারটা এই রকম , মা কোন অন্যায় করেছেন, তাঁর বিচার চাওয়া হচ্ছে। মা কোন প্রতিবাদ না করে আগত এক বৃদ্ধ মুরুব্বীকে খুবই বিনিত স্বরে কি যেনো বললেন। কিন্তু ব্যাপারটা তাতেই মিটে গেল বলে মনে হলোনা। হটাত হট্টগোল শুরু হয়ে গেল, আগত যুবকদের মধ্যে এক অল্প বয়েসি তরুন আমাদের বাসার দরজা আর জানালা উদ্দেশ্য করে এলোপাথাড়ি ঢিল ছুড়তে আরম্ভ করলো। আমার মা যথেষ্ট পরিমানে আহত হলেন, আমরা এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে, পুজামন্ডপ ছেড়ে আমরা সবাই আমাদের ঘরের এককোনে ঝুপটি মেরে বসেছিলাম। অনেকরাতে বাবা বাড়ি ফিরলেন। আমার মা বাবার সঙ্গে কোন কথাই বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। আসলে কি জন্য কি হয়েছিল আমরা কেউ কিছুই জানতে পারলাম না। শুধু পরেরদিন মা বললেন, আমরা সবাই নানু বাড়ি যাচ্ছি। নানু বাড়ি যাচ্ছি শুনে আমার খুব ভাল লাগছিল কিন্তু আমার মায়ের খুব মন খারাপ, ব্যাপারটা আমাকে দোটানায় রেখেছিল, একদিকে নানু বাড়ি যাওয়ার আনন্দ আবার আরেকদিকে মায়ের মনের অবস্থা। ঐ যে শেষবারের মত আমাদের পৈত্রিক বাড়িতে গিয়েছিলাম, আর যাওয়া হয় নাই। আমার বাবাও আর নানুর বাড়িতে কখনো আসেন নাই। আমরা বাবাকে খুব ভয় পেতাম, তাই কি কারনে বাবা আসেন না, তাও আমরা কেউ জানতে পারিনি। মাকে জিজ্ঞ্যেস করলে মা শুধু অন্য প্রসঙ্গে এড়িয়ে যেতেন। অনেক বছর জেনেছিলাম, বাবা অন্য এক নারির সঙ্গে ঘর বেধেছেন।
তোমাদের বাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। সকালের রোদ যেমন অকাতরে তোমাদের পূর্ব উঠোনে এসে আছড়ে পরে, তেমনি বিকালের পড়ন্ত রোদেরও কোন কমতি নেই পশ্চিমের পুকুরঘাট থেকে শুরু করে সদর দরজার আঙ্গিনা পর্যন্ত।
যে কয়টা দিন আমি তোমাদের বাসায় থেকেছিলাম, ঐ কয়দিনের মধ্যেই শুধু তোমাদের বাড়ি নয়, আশেপাশে লোকজনের সঙ্গেও তোমার মা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সামনে পরীক্ষা, তাই কয়েকদিন পরই আমি চলে এলাম। বলতে পারো তুমি, আমি কি বিদায় নিয়ে এসেছিলাম? আমার মনে পরে না এখন। সেদিন আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল এইভেবে যে, আমি ঐ বাড়িটার প্রতিটি মুহূর্ত মিস করবো। আমি সকালের রোদটা মিস করবো, পুকুরঘাট, ঐ ডোবা, বাগান, কাকাতুয়া, বাবুই পাখী, ব্যাঙের ছানার উকি মারা, কিংবা সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া জামের কুড়ি সবই মিস করবো। আর এগুলোকে জড়িয়ে যার সংসার, তোমার মা, তাকে আমি মিস করবো আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে। আমার বুক ভরে কান্না আসছিলো। তোমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরে এই প্রথম তাঁর ডাকা নামটায় আজ আর ডাকলেন না, শুধু বুকে চেপে ধরে আমাকে বললেন, “তুমি আবার এসো মা,”। এতক্ষন কান্নাটা চেপে রাখতে পেরেছিলাম, এখন তোমার মায়ের মুখে আমাকে “মা” সম্বোধনটা আমার বুকে কষ্টে জমিয়ে রাখা ব্যাথাটা ভেঙ্গে শ্রাবনের বারিধারার মত আখির অজস্র নোনাজলে এর বহিরপ্রকাশ ঘটল।
আমি যতক্ষন প্রশমিত হইনি, তোমার মা আমাকে অতক্ষনই তাঁর বুকে জড়িয়ে রাখলেন। উনি কেদেছিলেন কিনা আমি জানি না, কিন্তু আমি যখন তাঁর বুক থেকে মাথা সরিয়ে মার দিকে তাকালাম, দেখলাম তাঁর মিষ্টি একটা হাসি। প্রানটা যেন এবার সত্য জুড়িয়ে গেল। বুকের ভিতরের ব্যাথাটা এখন অনেক হাল্কা লাগছে, আমি মায়ের পা ছুয়ে আশীর্বাদ নিলাম। তারপর আমি আমার সেই চিরচরিত হোস্টেলে চলে এলাম। আবারও সেই অগোছালো এক বসবাস, একই ধাঁচের সেই নিয়মের বাড়াবাড়ি। কিন্তু কোন উপায় নেই। জীবনের অনেক কিছুই আমাদের ভাল লাগবে না, তাই বলে এই নিয়মগুলো কেটে বের হয়ে যাওয়ারও কোন উপায় নাই, যারা নিয়মগুলো বানায়, তারা নিয়মগুলো হয়ত মানার দরকার নাই বলে এর সংস্কার করারও কোন প্রয়োজন মনে করে না। কে কার জন্য কি পালটাবে বলো?
তোমার সাথে আমার যথারীতি দেখা হয়, কথা হয়, তোমার মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করি, বেশ চলে যাচ্ছে আমার সেই নিঃসঙ্গ একাকী জীবনের কিছুটা সময়। বন্ধুবান্ধব ছিল কিন্তু তারা সব বন্ধুর গন্ডিতেই ছিল। অনেকে আরও গভীরভাবে আমাকে জানতে চেয়েছিল হয়ত, আমি কেন যেন কোন কিছুই বুঝতে চাইনি। আমার সহপাঠী অনেক মেয়েবন্ধুরা এরই মধ্যে বিয়েথা করে সংসার পেতে ফেলেছে, কখনো কারো সুখের কাহিনি শুনে মুগ্ধ হয়েছি আবার কখনো কারো করুন কাহিনি শুনে বড্ড অসহায় মনে হয়েছে। আমরা মেয়ে মানুষ, পুরুসের মন জুগিয়ে চলাই আমাদের প্রধান কাজ। শুধু পুরুষ কেনো, তাঁর সঙ্গে শ্বশুর, শাশুড়ি, আয়া, জায়া, দেবর ননদ সব। এমন কি বাড়ির কাজের মানুষগুলোও অনেক সময় যা পারে আমরা বউরা ঐ কিঞ্চিত ছাড় পাওয়ার আশা করাও অনেক সময় দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। এ দেশের মায়েরা আর শাশুড়িরা এক বংশের নয়। মায়েরা মনে করে, তাঁদের মেয়েটা শ্বশুর বাড়িতে জামাইকে নিয়ে খুব ভাল আছে কারন তাঁর মেয়ে যা আদেশ করে বা বায়না করে তাঁর স্বামী সব অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কিন্তু তাঁর ছেলেটা একেবারে উল্টো। বউ যা আদেশ করে বা বায়না ধরে তা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কেন বাবা, পরের মেয়ের এত আবদার, এত কথা কেন শুনতে হবে? যেন তাঁর ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে অথচ তাঁর মেয়ের জামাইটা কি সুবোধ বালকের মত। যা আদেশ করা হবে সব সে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। এই হচ্ছে আমাদের সমাজ। যেখানে আমরা পরিবর্তনের কথা বলি সবাইকে কিন্তু নিজে পরিবর্তন হই না। আমরা প্রত্যেককেই বলি, কেন সবাই পরিবর্তন হয় না? শুধু বলি না, কেন আমি পরিবর্তন হচ্ছি না। যাক, হয়ত এটাই সামাজিক রীতি। কেউ বদল করে কেউ বদল হয়। আমারও কিছু জিনিসের বদল হলো। শেষ করে ফেললাম আমার শিক্ষার জীবন। হোস্টেল জীবন বদল হয়ে গেল ছাত্রি হিসাবে। আমি জানি না কোথায় এখন আবার আবার নতুন জায়গা হবে। তুমিও কোনদিন আমাকে এই প্রশ্নটা করোনি এরপর কি আমার প্ল্যান, বা কি করলে কি হবে। ছাত্রি থাকা অবস্থায় একবার ফ্রান্সে স্কলারশিপের আবেদন করেছিলাম, এর কি অবস্থা একটু খুটিয়ে দেখার ইচ্ছে হলো। আমি জানি এটা আমার হবে না। আমার জাঁদরেল কোন মামা নেই, আমার বাবার এমন কোন বন্ধু নেই যার কাছে আমি গিয়ে বলতে পারি আমার সাহায্যের প্রয়োজন। অথবা আমার এমন কোন ব্যাক্তির সঙ্গে সখ্যতা নেই যাকে ধরে আমি আমার এই অবৈতনিক ধূসরগণ্ডী পার করতে পারি। তাঁরপরেও একবার খোঁজ নিতে গেলাম ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার অফিসে যদি কোন কিছুর সন্ধান পাওয়া যায়। আমি আশাবাদি নৈ কিন্তু একেবারে অবসর, তাই কিছু একটা করা আর কি। একটা পানির বোতল সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম রেজিস্টারের অফিসের উদ্দেশে।
ভগবান যখন রশিকতা করেন, তাঁর রসিকতায় একটা অদ্ভুত আবেগময়ি স্পর্শ থাকে। আমার বেলায়ও হয়ত তাই হল। কি করে কি হল? আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে শুনলাম, গতকালই নাকি আমার ফ্রান্সে যাবার স্কলারশিপটা মঞ্জুর করেছে। আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না এই খবরটায়। মোট জনাদশেক আবেদন করেছিল, তাঁর মধ্যে শুধুমাত্র আমাদের দুজন এই স্কলারশিপটা পেয়েছে। তাঁর মধ্যে আমি একজন। আনন্দে আত্মহারায় আমার শরীর কাপছিল, আমি কাকে এই খবরটা দেব? কি বলব? কিভাবে বলব? এটা কি আদৌ কোন বড় খবর নাকি কোন খবরই না? আমি আমার পানির বোতলের সবটুকুন পানি খেয়েও যেন আমার তৃষ্ণা মিটছিল না। সত্যি ভগবান বড় রশিক। যখন কারো আর কোন পরিকল্পনা জানা থাকে না, তাঁরজন্য হয়ত ভগবান বিশেষ কিছু করে থাকেন যা সঠিক সময়ে সঠিকস্থানে এবং সঠিক ব্যাক্তিকে তিনি দান করে আশ্বস্ত করেন। আমার এই অপরিকল্পিত জীবনে এই প্রথম মনে হল, “কোথাও কেউ নেই” এই কথাটা সত্য নয়। অন্তত ভগবান আছেন। তিনি সবাইকে তাঁর অফুরন্ত আলো বাতাসের ভান্ডার দিয়ে, এই বিশাল জলরাশির আধার দিয়ে, কোন না কোন অসহায় জীবকে নিজের পরম মমতায় অতিযত্নে সোহাগ করে তুলে নেন আর এমন স্থানে তাকে জায়গা করে দেন যা অতিশয় আরামদায়ক এবং সৌভাগ্যের। হয়ত ভগবান তাঁর নজর আমার কাছ থেকে এখনো সরিয়ে নেন নাই।
আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি, তুমি ছাড়া আর এখন তোমার পরিবার ছাড়া আমার আর কেউ নাই। আমার পৃথিবীর গোটা অঞ্চল ভাগ করলে সেই অঞ্চলে শুধু তোমাদের বাড়িটা ছাড়া আর কোন অঞ্চল এই অংশে দেখা যাবে না। আর সম্ভবত এই কারনেই খবরটা নিয়ে আমি প্রথম যেখানে দৌড়ে গিয়েছিলাম, সেটা তোমার বাসায়। জীবনের মুহূর্তগুলো কিভাবে বদলে যায়, জীবনের আগমুহূর্তটা তাঁর পরের মুহূর্তের মত নয়। প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর নিজ নিজ স্বকীয়তায় পূর্ণ। একটু আগেও আমি ছিলাম ধিরস্থির, আমার কোন নিশানা ছিল না, আমার গন্তব্যের কোন আবাসস্থল ছিল না, অথচ এই মুহূর্তে আমি আর আগের মুহূর্তের মত নৈ। এখন আমি এক চঞ্চলা। মনে মনে গুনগুন করে গান গেতে ইচ্ছে করছে। কোন বিষণ্ণ ধরনের গান নয়। মনে হচ্ছে আমি নিজেই একটা গান নিজের সুরে গাইতে থাকি, “আমি যেন আজ আমি নেই, কোন এক বিশাল জগতের অম্পরা সরীসৃপ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষ কত অদ্ভুত। হয়ত এই কারনেই ভগবান তাঁর অদ্ভুত আচরনে মুচকি মুচকি হাসেন আর তাঁর রসিকতার মজা নেন।
বিকাল চারটার দিকে আমি তোমাদের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। আমি জানি এই সময় তুমি বাসায় থাকো না। তোমার মা হয়ত এই সময় দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নেন। কিন্তু আমার সময় কাটছিল না। আমি হাজির হয়ে গেলাম তোমাদের বাসায়।
অবাক হলাম মাকে দেখে। মা অন্য দিনের মত আজ দুপুরের পর খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নেননি। কি যেন নিয়ে খুব ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আমি ঢোকতেই একটা সুন্দর মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “এসো মা এসো, ভালই হলো, তুমি এসেছ”। আমি মাকে প্রনাম করে তাঁর পাশে গিয়ে বসতেই আমাকে একটা এ্যালবাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “দেখোত মা, মেয়েটা কি রকম দেখতে?” ধক করে উঠল যেন আমার বুকটা। আমার এতবড় একটা আনন্দের দিনে, মনভরা এতটা সুখি বুকে হটাত করে যেন পিছন থেকে শতটনি একটা গাড়ী আমার পাজরের সবগুলো হাড় চুরমুর করে বাকিয়ে দিচ্ছে। বুঝতেই পারলাম না কোথা থেকে কখন ঐ শত সহস্র ওজনের একটা দানব আমার অজান্তে আমার এত কাছে এসে কত বড় ধাক্কাটা দিয়ে গেল। সামলাতে একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেও ব্যাপারটা নিজের কাছেই লুকিয়ে রাখতে পারলাম। “আকাশের জন্য মেয়ে দেখছি, এগুলো ঐ মেয়েটারই ছবি। দেখোতো মেয়েটা কেমন দেখতে?” আমি ছবিগুলো দেখতে দেখতে মা কথাগুলো বলছিলেন। বড্ড সুন্দর একটা মেয়ে। ঠোটে লাল লিপিস্টিকের পাশ দিয়ে চমৎকার লাইনার টানা। মনে হয় কোন আর্টিস্ট যেন খুব সন্তর্পণে তাঁর ঠোঁটের ঐ লিপিস্টিকগুলি অতিশয় যত্নের সহিত একে দিয়েছেন। মাথার চুলগুলো পরিপাটী করে সাজানো। ক্যামেরার আলো প্রতিফলিত হয়ে চুলের এক অংশে একটা আলোর ঝলকানির সৃষ্টি করেছে। কানের দুলটি গ্রীবার পাশ পর্যন্ত ঠেকে আছে। তাঁরমধ্যে অসংখ্য যাদুকরী কারুকার্য। চোখ দুটো নিরব চাহনি দিয়ে তাঁর মাদকতার রূপ জাহির করছে। অদ্ভুত সুন্দর সে চাহনি। মিস্টি মুখের একটা ছাচ। গোলগাল কিন্তু অপূর্ব মায়াবতী। যে কারোরই পছন্দ হবে মেয়েটিকে। কয়েকটি ছবি পূর্ণ অবয়বে তোলা। বেশ লম্বা বুঝা যায়। আকাশের সঙ্গে মানাবে। একটা ছবিতে একটা ছোট গাছের আড়ালে দাড়িয়ে। আড়াল করে দাড়ালেও তাঁর রুপের কোন অংশই লুকানো সম্ভব হয় নাই। পিছনের সবুজ ঘাসের সঙ্গে আর অপরূপ কিছু রঙ্গিন পাতাগাছের পাশে তাঁর সবুজাভাব শাড়ির অদ্ভুত একটা মিল রয়েছে। নারীরা আসলে সুন্দরের প্রতিক। ভগবান এদের বানিয়েছেন অতি আদর করে , মায়াবতী রূপ দিয়ে। কেউ এদের নোনাজলে ভাসিয়ে কর্দমাক্ত করে দিলেও তাঁর অন্তরের রুপটা হয়ত একেবারে বিলিন হয়ে যায় না। এরা শ্মশানের মত পাষান নয়, আবার মমের থেকেও নরম। এদের গলিয়ে আরেক রূপ দেওয়া যায় আবার শুকিয়ে গেলে বর্জ্য ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
বললাম, “মেয়েটি দারুন দেখতে। আকাশের সঙ্গে মানাবে।”
তোমার মা আমাকে চুমু খেয়ে বললেন, “দেখিস, তোর আকাশ সুখি হবে।”
আমার চোখ ভিজে এল মায়ের কথায়। “আমার আকাশ”। হ্যা, তাই তো, তুমি তো আমারই আকাশ। ঐ আকাশেই তো আমার সর্বদা বিচরন। আমি যখন খুশি উড়তে পারি, আবার আমার যখন মন খারাপ থাকে, ঐ আকাশ থেকেই তো বৃষ্টি আসে। আবার কখনো কখনো ঐ আকাশের মাঝে জলন্ত সূর্যটাই তো আমাকে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয়। অনেকক্ষন মায়ের সঙ্গে কাটালাম। আমি আমার খবরটা তখনো মাকে দেই নাই। কি বলব মাকে? আমি চলে যাচ্ছি? আমি কোথায় যাব?
সন্ধে হয়ে এল। হোস্টেলে ফিরতে হবে। অনেক কাজ হয়ত বাকি। রেজিস্ট্রার সাহেব আমাকে একখানা ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। অনেক কাগজপত্র যোগাড় করতে হবে। আমি ফিরার পথে মাকে বললাম, “মা, আমার স্কলারশিপ হয়েছে, ফ্রান্সে। খুব শিগ্রই হয়ত যেতে হবে। তুমি দোয়া কোরো।”
“সে কিরে? আকাশের বিয়েতে তুই থাকবি না?” মা আমার এই খবরটায় যতটা না খুশি হলেন, মনে হল তাঁর থেকে বেশি বিচলিত হলেন আমার চলে যাবার কারনে হয়ত আকাশের বিয়েতে আমার ভুমিকা নিয়ে।
আর যাই হোক মা তো। মায়েরা নিজের সন্তানের অন্তর যতটা বুঝে তারা অন্য সন্তানের অন্তর অতটা হয়ত বুঝেন না। ওনি তো আকাশের মা।
আমি চলে এলাম আমার হোস্টেলে। মনটা আজ নানা কারনে এতটাই আলোড়িত ছিল যে কখনো উত্তপ্ত টাইফুনের মত আবার কখনো ধুম্রজাল নাটকের মত খসখসে, আবার কখনো বৈশাখীর পড়ন্ত বিকালের আমেজের মত, কখনো জানি কেমন বুঝা যাচ্ছে না। আমার স্কলারশিপ আমাকে অতিশয় আবেশিত করে ফেলেছিলো, আবার আকাশের বিয়ের পাত্রি দেখে আমার মন যেনো কোথায় স্থির হয়ে গিয়েছিলো। টিভি অন করে মনটা বদলের চেষ্টা করলাম। প্রথমেই একটা গানের কলি শুনে মনটা আরও বিষণ্ণ হয়ে গেল, নজরুলের ঐ বিখ্যাত গান, “আমার যাবার সময় হল, দাও বিদায়…” পৃথিবীর কোন একটা মুহূর্ত আরেকটি মুহূর্তের মত কখনই নয়। এরা সবাই যার যার বেদনায় বা উল্লাশে ভরপুর। খেতে ভাল লাগছিল না। না খেয়েই শুয়ে পড়লাম।
একটানা এগারো দিন আর আমি তোমার সঙ্গে অথবা তোমাদের বাড়ির সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখিনি। সত্যি আমি আমার স্কলারশিপের যাবতীয় কাগজাদির জন্য হন্যে হয়ে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেরিয়েছি। মনে হয়েছে শুধু আমার হাতে সময় অনেক কম, কেন জানি মনে হয়েছে আমার সময় ফুরিয়ে আসছে। যে করেই হোক আমি তোমার বিয়ের আগে এই সমাজ, এই দেশ, এই রীতিনিতি, এই শাশনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যাবো। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।
আমার স্পষ্ট মনে আছে। দিনটি ছিল ইংরেজির ১৮ তারিখ আর বাংলায় ২৯ শে বৈশাখ। আমার সবকিছু ঠিক হয়ে গেল। আমি চলে যাচ্ছি সেই সুদুর অপরিচিত কোন এক মহলে যেখানে আমি কারো ভাষা বুঝি না, আমার কেউ পরিচিত নাই, আমি ইচ্ছে করলেই মন খারাপ থাকলে তোমার মায়ের মত এমন একজন মানুষের কাছে আমি ছুটে যেতে পারব না। তারপরেও আমি সস্থি পাচ্ছি এই ভেবে, আমার নতুন জীবনে কেউ আমাকেও চিনে না। আমি শেষবারের মত তোমার কাছে এসেছিলাম তোমাদের বাসায়।
মাকে প্রনাম করলাম, বড্ড কান্না পাচ্ছিল। মা আমাকে কত কথা বললেন। খুব আদরে আদরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
তোমাদের বাসা থেকে বের হবার সময় তোমাকে একবার প্রনাম করতে খুব মন চাইছিল। মন যা চাইলো, আমি তাই করলাম, এই প্রথম আমি তোমাকে প্রনাম করতে গেলে তুমি আমাকে বারন করতে গিয়ে জড়িয়ে ধরলে। আমি অবশ শরিরে শুধু কান্নাই করে যাচ্ছিলাম। তুমি আমাকে কখনোই এইভাবে জড়িয়ে ধরো নাই। তুমি আমার আকাশ, এই প্রথম আমি আমার আকাশকে এত কাছ থেকে বুকের মাঝে ধারন করতে পারলাম। তুমি কি আমার ভিতরের কোন কম্পন অনুভব করোনি? তুমি কি কখনোই বুঝতে পারোনি যে আমার ভিতরের মাধুরী আজ তোমার আকাশ থেকে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে? হয়ত বা পেরেছ, হয়ত বা পারোনি।
বিশাল এয়ারপোর্ট। আমি কখনো এই এয়ারপোর্টে আসিনি। আসার দরকার হয় নাই। কত লোক এই এয়ারপোর্ট দিয়ে তাঁদের গন্তব্য পরিবর্তন করে, আমিও আজ আমার জীবনের আরেক গন্তব্যের উদ্দেশে নিজে দেশ ছেড়ে, নিজের সমস্ত স্মৃতি পিছনে ফেলে, যত মায়া মহব্বত, ঘৃণা, আক্রোশ, ক্রোধ, অবিচার, অন্যায়, কিংবা ভালবাসা, আবেগ, অথবা মনের সব জালা জন্ত্রনা ছেড়ে আমি পাড়ি দিচ্ছি অন্য আরেক অপরিচিত দেশে যেখানে আমার কেউ নেই।
প্ল্যান টেকঅফ করেছে। দ্রুত স্থান পরিবর্তন হচ্ছে, ঘাস, গাছ পালা, বিশাল অট্টালিকাগুলো নিমিসের মধ্যেই আমার থেকে পিছনে পরে যাচ্ছে। আমার মনটা একেবারে শান্ত, কিন্তু কোথায় যেন চিনচিন করে ব্যাথা অনুভুত হচ্ছে। আমার পাশে বসা একজন ষাট বছরের বৃদ্ধা তাঁর সিটে আরাম করে বসবার জন্য ঘনঘন নারাচরা করছেন। আমরা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের মাটি ছেড়ে অনেক উপড়ে উঠে গেছি। আমি এখন আকাশে। এই আকাশ আর সে আকাশ এক নয়। আমি ইচ্ছে করলেই এই আকাশে ঝাপ দিয়ে বুকে পড়তে পারি না, তারপরেও এর নাম আকাশ। আকাশ কত বিশাল, চারিদিকে শুধু সাদা মেঘের আভা। মনে হয় যেন সাদা মাটির এক দেশ। কেউ কোথাও নেই, শুধু সাদা মাটি।
৩১/০৫/২০১৬- সন্ধার গল্প
৩১/০৫/২০১৬- সন্ধার গল্প
১ম পর্ব
মাঝে মাঝেই আমি তার চোখের কোনায় অশ্রু দেখতে পাই। মাঝে মাঝে আবার আমি তাঁকে অন্যমনস্কও হতে দেখি। নাম ধরে ডাকলে সে হটাত যেন কোন এক ভাবনার জগত থেকে সম্বিত ফিরে পেয়ে আতকে উঠে জিজ্ঞেস করে, কিছু বললাম কি? আমি যখন তাঁকে অনেক আদর করি, আমি যখন তাঁকে অনেক অনেক সপ্নের কথা বলি, তখনো দেখি তারমধ্যে কোথায় যেন একটা নির্বিকার ভাব। আমি যখন তাঁকে অতি আদরের সহিত আলিঙ্গন করে বুঝবার চেষ্টা করি কি হয়েছে তার, তখন বুঝি আখি তার আরও ভেজা, নিঃশ্বাস তার প্রবল ধীর, অথবা পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল মুক্ত পরিবেশের চেয়েও সে আরও চুপচাপ। মনে হয় মনের ভিতরের কোন এক ব্যাথায় কান্নায় রুপান্তরিত হয়ে কান্নাটা আরও গভীর থেকে ঢেউয়ের মত উপচে পরছে আমার দুই কাধের শিরা দিয়ে, আমার বুকের চারিধার দিয়ে।
ভয় হয় আমার, চিত্ত শঙ্কিত হয়ে উঠে কোন এক অজানা ভয়ে। নিজেকে প্রশ্ন করি, এমন কিছু কি আছে যা আমার কাছে নাই? এমন কি কিছু আছে যা আমি তাঁকে দিতে পারিনি অথচ সেটা তার অনেক দরকার অথচ সে মুখ ফুটে বলতে পারছে না? এমন কি কিছু আছে যা বলার জন্য সে বুকে সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছে না অথচ বুক ব্যাথায় টনটন করছে? এমন কি কিছু হচ্ছে যা মানতে হচ্ছে অথচ মানা যাচ্ছে না? অনেক অজানা প্রশ্ন জাগে মনে। মাঝে মাঝে নিজেকে বড় দোষী মনে হয়।
অনেক প্রশ্ন করেছি আমি তাঁকে। উত্তরে কখনো শুধু তার নির্বিকার আর নির্লিপ্ত চোখ আবারো জলে ভেসে গেছে, অথবা আরও নির্লিপ্ত হয়েছে বোবা এক অশরীরী জিবের মত। আবার কখনো উচ্ছল তরঙ্গের ন্যায় আমাকে অভাবিত এক ধাক্কায় নিমিষে ‘কিছুই না’ বলে ধর্তব্যের মধ্যেই বিষয়টি পরে না বলে তা উরিয়ে দিয়েছে। তারপরেও আমি তাঁকে পুনরায় সেই আগের মতই দেখেছি বারংবার, নির্লিপ্ত, ভাবলেশহীন নিথর কোন এক পাথরের মত।
আজ তার কথা শুনে শুধু তারই না, আমারও চোখ ভিজে এল শ্রাবনের ধারার মত।………
” আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। আমার বয়স তখন তের কি চৌদ্দ। সবে মাত্র স্কুল পাশ করে হাই স্কুলে পা রেখেছি। …………….(চলবে)
২য় পর্বঃ
” আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। আমার বয়স তখন তের কি চৌদ্দ। সবে মাত্র স্কুল পাশ করে হাই স্কুলে পা রেখেছি। প্রতিদিন আমি স্কুলে যাই চোখের কোনায় অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখি, অনেক বড় হওয়ার আশা নিয়ে আমি দুরু দুরু পায়ে স্কুলের দিকে হেটে চলি। আমি কখনো স্কুল কামাই করেছি এমন রেকর্ড আমার ছিল না। আমার গন্ডি শুধু স্কুল আর আমার পরিবার, আমার ছোট্ট সে ঘর, যেখানে আমি বাস করি আমাকে নিয়ে আর আমার সাথে থাকে আমার ছোট ছোট কয়েক ভাই বোন।বেশ ভালই কাটছিল আমাদের সংসার।
একদিন আমি স্কুলে ক্লাসে স্যারের পড়া নিয়ে অনেক জটিল অংকের ফরমুলা নিজের মাথায় আটিসাটি করে বুঝার জন্য যখন অনেক মগ্ন, তখন হটাত করে আমার বাবা আমার ছোট ভাইকে দিয়ে স্কুলে খবর পাঠালেন বাড়ীতে যেতে হবে। মনে ভয় হল, কি হয়েছে বাড়ীতে? কারো কোন দুসসংবাদ নাতো? গুটিগুটি পায়ে ছোট ভাইয়ের হাতধরে কাছেই আমার বাড়ীতে পৌঁছে দেখি দলবেধে অনেকলোক আমাদের বাড়ীতে বসে কেউ পান খাচ্ছেন, কেউ আবার খোশ গল্প করছেন। মনটা যে অজানা ভয়ে এতক্ষন সংকিত ছিল তা আর রইল না। খারাপ কিছু হয় নাই তাহলে। কিন্তু আমি অনেক বোকা। আমার জানা ছিল না যে, আমার জন্য আরও কঠিন একটা সংকাজনক অধ্যায় অপেক্ষা করছিল।
আমি বাড়ীতে পা রাখতেই মনে হল, আমাকে নিয়ে যেন সবার একটা বাড়াবাড়ি, সবাই কি নিয়ে যেন কানাঘুষা করছে, মিটিমিটি হাসছেও। কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অথচ আমি তাদেরকে চিনি না, কেউ আবার আমার গালে হাত দিয়ে একটু আলতো করে টিপে দিয়ে বলছে, বাহ কি সুন্দর দেখতে। ইত্যাদি। মাকে বললাম, মা এরা কারা? মা মুচকি মুচকি হেসে দিয়ে বললেন, মা, তোমাকে ওরা দেখতে এসেছে। তাদের ছেলের জন্য।
নিমিষের মধ্যে আমার বুকের চারিপাশটা একটা ওসয্য যন্ত্রনায় আমাকে মুচড়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমার পায়ের তল থেকে সবগুলো মাটি একসঙ্গে সরে যাচ্ছে। আমার চোখ সামনের কিছুই দেখছে না, সব ঝাপসা মনে হচ্ছে। মাকে বললাম, মা আমার পরাশুনা?
মা শুধু বললেন, দেখরে মা, আমরা অনেক বড়লোক নই। আমাদের এতো পরাশুনা করে কি হবে? কে আছে আমাদের? নিজেকে বড় অসহায় মনে হতে লাগলো। আমার বুকে জগদ্দল পাথরের মত একটা বিশাল পাথর এমনভাবে চেপে বসলো যে মনে হল আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কেউ আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চাচ্ছে। আমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমি দুর্বল নই কিন্তু আমি এখন প্রতিবাদ করার মত সাহস ও আমার নাই কিন্তু এটা বুঝতেছিলাম যে, আমাকে এই রাহু গন্ডি থেকে বের হতে হবে যে কোন উপায়ে।
লোকজন আমাকে দেখে গেলো। আমাকে নাকি খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। এই কথার মধ্যেই তারা যাওয়ার সময় আমার বাবা মাকে বলে গেলেন, অচিরেই সম্ভাব্য সব কিছু তারা করে ফেলতে চান। শুভ কাজে নাকি বিলম্ব করতে নাই। কি আমার ভাগ্য। আমি কি চাই, আমার কি স্বপ্ন আর আমাকে নিয়ে সবাই কি স্বপ্ন দেখছে। নিজেকে মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে আমি ভগবানের কাছে অনেক কাদলাম সেই রাতে। আমার ভাল ঘুম হয় নাই। যেটুকু ঘুম আসে, শুধু দেখতে পাই চারিদিকে মানুষগুলো আমাকে ঠাট্টা তামাশা করছে, আর দেখতে পাই আমার সেই সখের স্কুল বেঞ্চ গুলো যেখানে আমার অনেক সপ্নের কথা লেখা আছে আমার কাঠ পেন্সিলের দাগে দাগে।
রাত পোহাতেই আমি বাবাকে বললাম, বাবা, আমাকে তুমি এখন বিয়ে দিও না। আমি পরতে চাই। বাবা খুব সহজ সরল মানুষ। কোন কিছুই অনি কারো উপর জোর করে চাপিয়ে দেন না আবার কেউ তার উপর কেউ কিছু জোর করে চাপিয়ে দিলেও তার প্রতিবাদ করতে শিখেন নাই। অনেক্ষন চুপ করে দাড়িয়ে থেকে বাবা বললেন, আচ্ছা দেখি আমার এক খুব পরিচিত আপন জন আছে তার কাছ থেকে আমি শলা পরামর্শ করে জানাবো। তিনি আমাদের পরিবার কে খুব ভাল করে চিনেন আর খুব জ্ঞ্যানি মানুষদের মধ্যে একজন।
বললাম, তাহলে আমাকেও নিয়ে চল।
বাবা তাই করলেন। ভদ্রলোক খুব বেশি বয়সের নন। খুব বেশি হলে হয়তবা সাতাইশ কি ত্রিশ বছরের হবেন। অসম্ভব ধিরস্থির মানুষ। অনেক লেখাপড়া করেন তার বইয়ের স্তর দেখলেই বুঝা যায়। হাতে চমৎকার একটি সোনালী রঙের ঘড়ি, তার বসার ঘরটাও বেশ সাজানো।
বাবাকে দেখেই বললেন, কি চাচা কেমন আছেন? হটাত কোন আগাম বার্তা না দিয়েই কি জন্য চলে এলেন? আমার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন, কি নাম তোমার?
এমন করে নাম টা জিজ্ঞেস করলেন যেন তিনি আমাকে আরও কয়েকবার দেখেছেন কিন্তু এখন আর মনে করতে পারছেন না।
তিনি আর কেউ নন, তিনি সেই আপনি।
আমার বিয়ের কথা শুনেই আপনি আমার বাবাকে এমন করে ধমক দিলেন যে, আমার বাবার আর কোন বিকল্প পথ ছিল না আপনার কথার বাইরে কিছু করেন।
আমার আবার স্কুলের দরজা চালু হয়ে গেল। খুব ভাল লেগেছিল আপনাকে। পায়ে ধরে আপনাকে আমার সালাম করতে ইচ্ছে করেছিল সেদিন। তারপরের কাহিনী আপনি আর জানে না। কারন সবাই ধরে নিল, আপনাকে দিয়ে আমাদের বাড়ীর আর যাই হোক বেশি উপকার হবে না কারন আপনি একাই সব সিদ্ধান্ত পাল্টে দিতে পারেন, সে ক্ষমতা আপনার আছে ছিল এবং সেটা আমি দেখেছি।
দিন যায় মাস যায়, আমি তখন মেট্রিক পরীক্ষার ছাত্রী। ইতিমধ্যে অর্ধেক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আর মাত্র দুইটা পরীক্ষা বাকি। ভাল পরীক্ষা হচ্ছে। তারপরেই আমি কলেজে ভর্তি হয়ে যাব। নতুন স্বপ্ন, নতুন দিগন্ত, নতুন ইচ্ছা। ঠিক পরীক্ষার আগের দিন সকাল হতে না হতেই আবার আরেক নতুন দল এসে হাজির আমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমার সারা শরীর ভয়ে হিম হয়ে আসছিল, একটু পরে আমার পরীক্ষা। যাকেই বলি, সে ই বলে, পরীক্ষা দিতে যেতে হবে না। ভাল পাত্র, সারা বছর ঘরের ধানের ভাত খায়। বাড়ীতে পাকা বিল্ডিং আছে। কত কিছু। আমি ঈশ্বরকে শুধু ডাকলাম। আমার মাথা কোন কিছুতেই কাজ করছিল না। কি হবে আমার পরীক্ষার, কি হবে আমার জীবনের? কেন কেউ আমাকে একটুও বুঝতে চাইছে না? আমার চোখ ভোরে শুধু কান্না পাচ্ছিল।
আমার শুধু আপনার কথা মনে হচ্ছিল সারাক্ষন। কিন্তু আমার কাছে না আছে আপনার কোন নাম্বার, না আছে কোন মাধ্যম যোগাযোগের।
মানুষ যখন খুব অন্তর দিয়ে ঈশ্বর কে ডাকে তিনি তার সারা দেন। আমি বাথ রুমের নাম করে কোন কাপড় চোপর না পাল্টিয়ে জুতা ছেড়ে খালি পায়ে সোজা পিছনের দরজা দিয়ে দৌর আর দৌর দিতে থাকলাম। আমার লক্ষ ঐ পরীক্ষার হল। যে করেই হোক আমাকে ই পরীক্ষার হলে পৌঁছতে হবে। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আমি যখন পৌঁছলাম, তখন ইতিমধ্যে দের ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। আমাকে দেখে আমার সব শিক্ষকরা এতটাই অবাক হলেন আর আমার চেহারা, চোখের পানিতে ভেজা আমার নয়ন দেখে তারা এতটাই উদ্বিগ্ন হলেন যে, আমাকে অন্তত আদর করে প্রধান শিক্ষকের রুমে নিয়ে পরীক্ষা তা দেওয়ার সুযোগ করে দিলেন।
আর ওদিকে আমাকে কোথাও না পেয়ে আমি পলায়ন করেছি এই মর্মে সবাই আমাকে প্রচন্ড দোষারোপ করতে কেউ একটুও পিছপা হলেন না। পরীক্ষা দিয়ে আমি আর আমাদের বাসায় ফিরে না গিয়ে আমার এক বন্ধুর বাসায় দুই দিন থেকে পরিক্ষাটা শেষ করলাম। মনে হল অন্তত একটা ধাপ তো পার করলাম?
এবার শুরু হল আরেক নতুন বিপদ। পরীক্ষার ফল বের হয়েছে কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাকে কলেজে ভর্তি করতে নারাজ কারন আমার পরিবারের কেউ আমাকে আর পরাবেন না এবং অন্যত্র বিয়ের ব্যবস্থা করছেন এই মর্মে কলেজ কর্তৃপক্ষকে সাফ জানিয়ে রেখেছেন। যাতে আমার কোন ভর্তি না করানো হয়। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হল। আজ মনে হল, আমি অসহায় নই আমি মানুষের অত্যাচারের কাছে জিম্মি। আমিও সেদিন শপথ করেছিলাম, আমি আমার ইচ্ছাকে অকালে মৃত্যু বরন করতে দেব না। কিন্তু কিভাবে? খুব খুজেছি আমি আপনাকে। কত জায়গায় যে আমি আপনাকে খুজেছি, কত মানুষের পিছন থেকে চেহারা দেখে মনে হয়েছে এই বুঝি আপনি। কত দিন যে আমি ঐ রাস্তার ধারে অপেক্ষা করেছি যদি কোনদিন আপনি ঐ রাস্তায় কখনো আসেন। আপনি কখনো আসেন নাই।
আমি এই ভাবে কতবার যে আমার সেই অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ের আসর ভেঙ্গে বার বার পলায়ন করেছি তার কোন ইয়ত্তা নাই। আর এভাবেই আমার মনে বিয়ে নামক জিনিসটা একেবারে বিরক্ত আর ঘৃণায় ভোরে গেলো। কেউ আমাকে দশ ভরি সোনা দেবে, করো বিয়া, কেউ আমাকে দুই লাখ টাকার কাবিন করবে , তো করো বিয়া, কেউ আবার আমাকে রাজ রানী করে রাখবে, করো তাঁকে বিয়া, কেউ আবার একেবারে বকলম কিন্তু চেহারা সুন্দ, তো করো তাঁকে বিয়া। কি এক অসজ্য যন্ত্রণায় আমি আর পেরে উঠতে পারছিলাম না। তারপরেও আমি আমার সাথে প্রতারনা করতে পারিনি। আমি কলেজের পড়াটাও শেষ করতে পারলাম।
গল্পটা এখানেই শেষ নয়, মাত্র শুরু…
তারপর ……। (চলবে)
৩য় পর্ব
কলেজের কেউ আমাকে ভর্তি করছে না। যখনই যাই, তখনই শুনি হয় অমুক স্যার নাই, আজ হবেনা, পরের দিন গেলে বলে আজ ফর্ম নাই, দুইদিন দেরি হবে। আবার যাই, তো শুনি ঐ কাগজ লাগবে তো ঐ কাগজ লাগবে। অনেক বিরম্বনা। মনে হল, কোথায় যেন কি ঠিক নাই। কলেজে ভর্তি হতে কি এমন হয়? তাহলে অন্য সব ছেলেমেয়েরা কি করে এতো সহজে ভর্তি হতে পারল? অথচ আমার বেলায় হচ্ছে না কেন? মন টা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছিল প্রতিদিন। প্রায় প্রতিদিন যাই, আর প্রতিদিন ই মন খারাপ করে ফিরে আসি। একদিন আমার এক ম্যাডাম আমাকে কাছে ডাকে নিয়ে বললেন, শুন সন্ধ্যা, তুমি এই কলেজে ভর্তি হতে পারবেনা কারন কয়েকদিন আগে এখানকার নেতা গোছের একলোক এসেছিল আমাদের কলেজে। এসে বলে গেছে তোমাকে সে ভালবাসে, তোমার সাথে ওর বিয়ে হবে, আর তাই তোমাকে আর তারা পরাতে চায় না। তাই কলেজ থেকে কেউ সাহস করছে না তোমাকে ভর্তি ফর্ম দিতে। আমি যে তোমাকে এ কথাগুলো বললাম, তুমি আমার নাম বল না। যদি সত্যি সত্যি ভর্তি হতে চাও, এমন কাউকে নিয়া আস যাকে এই সব লোকেরা ভয় পায়।
মনটা আমার এতো খারাপ হয়ে গেলো যে, আমার দুচোখ দিয়ে শুধু পানি পরতে লাগলো আর আমার বাবা মার উপর রাগ হতে লাগলো। আমার বাবা বা মা কি কখনোই আমাকে বুঝার চেষ্টা করবে না? আমি কি এতই বোঝা হয়ে উঠেছি তাদের উপর? নিজের কাছে নিজেকে একটা অমানুষ মনে হল আমার। আমার প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো। মনে মনে ভাবলাম, কে আছে এমন যে এই কঠিন একটা বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করতে পারে? আমি আমার জগতের সব আনাচে কানাচে সমুদের সুই খোঁজার মত করে খুজতে লাগলাম, কে আছে এমন সেই ব্যাক্তি? আমাদের কেউ আত্মীয়? বা আমার কোন পরিচিত মানুষ? নাহ, আমি কোথাও ভরসা করার মত কাউকে খুজে পেলাম না। আর যার কথা আমার বহুবার মনে হয়েছে সে আপনি। যখনই আমি কোন বিপদে পরি, আমি শুধু আপনার নামটাই মনে করি। আর ভাবি, কোথায় এই লোকটাকে পাব? আমি তো তার কোন সন্ধান জানি না। সন্ধান যে করি নাই তা নয়।
আমি আপনার অফিসে অনেকবার এসেছিলাম একা একা। কয়েকবার। কিন্তু আমার কি কপাল, কখনোই আমি আপনার নাগাল পাই নাই। হয় আপনি এইমাত্র বের হয়ে গেছেন না হয় ঐদিন আপনি অফিসেই আসেন নাই। ফিরে যেতে যেতে আমি শুধু কেদেছি আর ভেবেহি, আমার কি কেউ নাই? আপনার উপর আমার অহেতুক খুব রাগ হত। মাঝে মাঝে আমি আপনার উপর খুব অভিমান করতাম। মাঝে মাঝে আমি আপনার কাছে মিথ্যা মিথ্যা চিঠি লিখতাম আবার ছিরে ফেলতাম। কেন জানি মনে হত, আপনাকে আমার খুব দরকার। কলেজের ভরতির দিন প্রায় শেষ হয়ে আসছে। এমন সময় আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। সবাইতো আপনাকে চিনে। আর সবাই আপনাকে যে মানে এটা আমি জানতাম। আমি কম্পিউটারে কম্পোজ করে প্রিন্সিপ্যালের নামে একটা চিঠি লিখলাম আপনার নাম দিয়ে। যেখানে বলা ছিল যে, একজন ছাত্রীকে পাঠালাম, আপনার কলেজে ভর্তি করিয়ে নেবেন। বিস্তারিত পরে আলাপ ইতি আপনার নাম।
মধুর ন্যায় চিঠিটা কাজে লাগলো। আমি তো অবাক। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব শুধু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আপনাকে কেমন করে চিনি। আমি বেশি কথা না বলে শুধু বললাম, আমি তার আত্মীয়। ঠিক ঐ মুহূর্তে আমি যেন তার কাছে অতি ভক্তির একজন লোক হয়ে গেলাম। আমার ভর্তি হয়ে গেলো। মনটা তৃপ্তিতে ভরে উঠল, আমাদের পরিবারের কেউ জানল না যে আমার কলেজে ভর্তির সব কিছু হয়ে গেছে।
এতদিন যে অভিমান তা আপনার উপর আমার ছিল আজ যেন তা এক ভালবাসায় রূপ নিল। আমার বড্ড ভাল কাটল দিনের বাকি অংশটা। একটা মানুষের মিথ্যা এক খানা চিঠি এতো কাজ করে, তা আমার জানা ছিল না। কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না আসলেই এই চিঠি তার লেখা কিনা। হয়ত কারো মাথায় এটা আসেই না যে, কেউ তার নামে মিথ্যা একটা পত্র নিয়ে এমন জালিয়াতি করতে পারে। আর হতেও তো পারে চিঠিটি অনিই লিখেছে। জিজ্ঞেস করলে যদি আবার তিনি মনে কিছু করেন, তাই হয়ত কেউ জিজ্ঞেস করার সাহসই হয় নাই। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটলো।
কলেজ শুরু হতে হতে কয়েক মাস বাকি। এরমধ্যে আমি কদিন পরপরই বিয়ের সাজে বসি আর আমার সাধ্যমত বিয়ে ঠেকাই। কখনো কান্নাকাটি করে, কখনো বাড়ি থেকে পালিয়ে, আবার কখনো অত্যন্ত বাজে ব্যবহার করে আবার কখনো বড় কে নাজেহাল করে। কি যে এক পরিস্থিতি আমার। এরই মধ্যে গ্রামে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। আমাদের বাড়ীর পাশে প্রিয়াংকা নামের একটি মেয়েকে জোর করে বিয়েতে রাজি করানোর কারনে রাতে কাউকে না বলে সে আত্মাহুতি দিয়ে লিখে গেলো, ……আমি পরতে চেয়েছিলাম, আর তোমরা আমাকে পরতে না দিয়ে বিয়ে দিতে চেয়েছিলে। আমিই যদি ভাল না থাকি তাহলে আমার বিয়ে দিয়ে তোমরা কি সুখে থাকবে? তাই আমি তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে একেবারে সবার থেকে দূরে চলে গেলাম। তোমরা ভাল থেক। তোমরা আমাকে কেউ ভালবাসনি।”
ঘটনাটা গ্রামের চারিদিকে এতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যে, আমি এই ফাকে কিছুদিন যত পদের বিয়ের আয়োজন ছিল তা বন্ধ রইল। শুধু তাই নয়, গ্রামে একটার পর একটা যুবতি মেয়েদের সংসার শুধু ভাঙতে শুরু করল। কেউ স্বামীর অত্যাচারে, কেউ যৌতুকের অত্যাচারে, কেউ শ্বশুর বাড়ীর অত্যাচারে, কেউ অন্য কারনে। আমার ক্লাসে পরত এমন চেনা কয়েক জন স্বামীর ঘর ছেড়ে একেবারে বাপের আগের আস্তানায় ফিরে এল। কেউ সঙ্গে বাচ্চা নিয়ে কেউ আবার একা। বাল্য বিবাহের অনেক দোষ। কনে জানে না কি করে সংসার রক্ষা করতে হয় আবার বরের পক্ষ জানে না এই নিষ্পাপ কনেকে কিভাবে নিজের বাড়ীতে নতুন একজন আদুরে সদস্য করে মানিয়ে নিতে হয়। কেউ ছাড় দেয় না।
আমি আমার কলেজের পরাশুনা চালাতে লাগলাম। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার শুরু হল, সেই পুরানো উপদ্রব। বিয়ে কর আর বিয়ে কর। আমি এই বিয়ে নামক ঘটনাটা আমার মাথায় একটা বিষ ফোড়ার মত ঘুরতে লাগলো। বিয়ে জিনিস টা আমার কাছে এখন আতঙ্কের মত মনে হতে লাগলো। কি হবে এ রকম বিয়ে করে যেখানে একটা মেয়ে তার নিজের কোন দাম নাই, তার নিজস্ব কোন সত্তা নাই?
বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি এইবার লাগামহীন ভাবে শক্ত হয়ে গেলাম। আমি বিয়ে করব না, আমি জীবনেও বিয়ে করব না এই প্রতিজ্ঞা সবাইকে জানিয়ে দিলাম। আর মনে মনে ভাবলাম, আমি আসলেই বিয়ে করব না।
পরীক্ষার ঠিক কয়েকদিন আগে আমার বড় জ্যাঠা আমাকে এইবার বিয়ে দিয়েই ছারবেন বলে মনঃস্থির করলেন। বাবাকে খুব অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করলেন। বাড়ীর অন্যান্য মানুষগুলো যেন শিকা ছিরে দই পরলে যেমন কুকুর আনন্দ করে ঠিক তার মত মনে হল। আমি ঠায় আমার রুমে দরজা বন্ধ করে বসে রইলাম। আমি কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম ঠিক বুঝতে পারি নাই। হটাত একটা অদ্ভুত শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। দরজার খিল খুলতেই দেখি আমার জ্যাঠা, কাকি, মামি সবাই দরজার সামনে দাড়িয়ে। কাজি এসেছে, আজকেই আমার বিয়ে। আমার আর কোন কিছুই সয্য হচ্ছিল না। নিপীড়নের একটা সিমা থাকে। ওরা সবাই অত্যাচারের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে।
কিছুই বললাম না। আমি জানি এখন আমার কথা কেউ শুনবে না। বাড়ীতে বিয়ের সরঞ্জামাদি চলতে থাকল, পান পাতা দিয়ে ঢালি সাজানো হল, মাছ, দাব, ফল মুল কত কিছু সব তৈরি করা হল। আমি জানি না কে আমার বড়, কোথায় আমার বিয়ে, ছেলে কি করে। আমাকে কোরবানির পশুর মত ঝাপ্টে ধরে গায়ে হলুদের জায়গায় নিয়ে বসান হল। আমার গায়ে হলুদ হয়ে গেলো। সারা শরীরে হলুদের গন্ধ। মনে হচ্ছে মরা মানুষের গায়ে থেকে যেমন গন্ধ আসে, আমার গায়ে হলুদের গন্দে যেন আমার তাই মনে হচ্ছিল। প্রতিটি মুহূর্তে আমি আমার জীবনের কি হতে যাচ্ছে তা কল্পনা করেও কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। আর ভাবছিলাম কি করে এখান থেকে পালানো যায়। আমি শান্ত হয়ে বসে ছিলাম কিন্তু ভিতরে আমার অশান্ত ঝড় চলছে। আমাকে শান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে বাড়ীর সবাই মনে করল, আজ আমার কোন সমস্যা নাই। আমি সব কিছুতেই সহজ করে মেনে নিয়েছি। আর এই সুযোগ টাই আমি নিতে চেয়েছিলাম। আমি বিয়ের আসর থেকে পলাইলাম।
আমার কেউ নাই। কোথায় যাব, কার কাছে যাব। শেষ পর্যন্ত আমি আমার নানিদের বাসায় নানিকে আমার সমস্ত কষ্টের কথা বললাম। নানি আমাকে তাদের ছোট একটা জায়গায় সারাদিন বন্দি থাকতে বললেন আর আমিও তাই করলাম। ছেলেপক্ষ মেয়েকে না পেয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, অনেক আজেবাজে অপবাদ দিয়ে, চরিত্রের সবগুলো কালিমা লেপন করে যা মনে আসে তাইই বলে একেবারে বিদায় নিলেন। আমি পনের দিন পর ঐ গোপন আস্তানা থেকে বের হলাম। কোথায় ছিলাম, কার সঙ্গে পালিয়েছি, কেমন করে পালিয়েছি তার অনেক বিস্তারিত ইতিহাস অনেকেই জানতে চাইলেও আমি আর ঐসব নিয়ে কথা বলার কোন রুচি মনে করি নাই।
কোন রকমে কলেজ পাশ করেছি। এইবার তো আমার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পালা। কিন্তু এটা তো আর আমাদের গ্রামের কলেজের মত নয় যে আবারো আমি আপনার নাম ভাঙ্গিয়ে সরাসরি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাব। এটা আমার জন্য বিশাল পাহারের মত মনে হল। কাউকেই কিছু বলার অবকাশ নাই, কেউ যে আমাকে একটা উপদেশ দিবে সেই মানুষটিও নাই। অথচ আমার কাউকে খুব দরকার। তারপরেও মনে হল, আপনাকে আমি খুজে বের করবই। আপনিই পারবেন এখন আমাকে এই স্থূল এবং বিরাটকায় সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু কোথায় আপনি?
ভাগ্য যখন সুপ্রসন্ন হয়, ভাগ্যদেবি তখন ঘরে পদার্পণ করে। কি আশ্চর্য, গ্রামের চারিদিকে একটা খবর ব্রেকিং নিউজের মত ছরিয়ে পড়ল। আপনি গ্রামে আসবেন। গ্রামের কার কি লাভ হবে আমি জানি না, কিন্তু আমি ঈশ্বরকে এই বলে কত যে প্রনাম করলাম যে, এইবার আমি আপনার সঙ্গে দেখা হবেই।
আপনি আমাদের গ্রামে এলেন এবং খুব ঘটা করেই এলেন। চারিদিকে পোস্টার, চারিদিকে চিঠি বিলি, আপনি আসছেন। গ্রামের কত লোক যে আপনার আসার অপেক্ষায় আছে। কেউ অপেক্ষায় আছে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, কেউ অপেক্ষায় আছে রাজনৈতিক লাভের জন্য, কেউ অপেক্ষায় আছে শুধু আপনাকে ভালবাসে বলে। আমিও তাদের মধ্যে একজন। মনে হল, আমি আপনাকে কত যুগ ধরে চিনি, কত কাছ থেকে চিনি অথচ আপনি আমাকে কখনো মনেও রাখেন নাই।
আপনি এলেন। সঙ্গে কত লোক আপনার। সারিসারি গাড়ি। কেউ নোট বই, কেউ ছাতা ধরা, কেউ আবার আপনার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য এক মুহূর্ত অপেক্ষা। আমি ঠায় দাড়িয়ে আছি ঐ সভাস্থলে। কখন আমি আপনাকে পাই।
আপনার কাজ শেষ। খাওয়া দাওয়া শেষ। আমার বুকের ভিতর কম্পন হচ্ছিল এই বুঝি আমি এতদিনের অপেক্ষার পালাটাকে হারিয়ে ফেলতেছি। আমার বুকে তখন দুরুদুরু কম্পন কিন্তু আমাকে যে পারতেই হবে। সাহস করে আমি আপনার একেবারে কাছে চলে এলাম। আপনি আমাকে দেখলেন। কাছে ডাকলেন। আমার বুক তখন ভুমি কম্পনের মত কাপছে।
আনার চোখে চোখে আমার চোখ পড়ল। আমি মুষড়ে যেতে থাকলাম। আপনি জান্তেও পারলেন না আমার ভিতরে কত বেগে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। আমার দিকে কিছুক্ষ তাকিয়ে থেকে নিজ থেকেই আমাকে ডেকে বললেন, কোথায় যেন আমি তোমাকে দেখেছিলাম?
আমার দুচোখ ভরে শুধু পানি শ্রাবনের ধারার মত ঝরতে লাগলো। আমি বললাম, আমি আপনার অমুক চাচার মেয়ে।
ও আচ্ছা, হ্যা তুমি তো একবার আমার কাছে গিয়েছিলে? কি করছ এখন? কোথায় পরাশুনা করছ? আর তুমি কাদছ কেন?
আমি শুধু কম্পিত গলায় এইটুকু বলতে পেরেছিলাম, আমি পরতে চাই, আমি বিয়ে করতে চাই না। অসংখ্য মানুষের ভিরে আমি কি বলেছি আর কি বলতে চেয়েছি, আমার মনে নাই। অনেক বার আমি বাড়ীতে একা একা কি বলব তা নিজে থেকে অনুশিলনও করেছিলাম কিন্তু সেই অনুশিলন কিছুই কাজে লাগে নাই আপনার সামনে এসে। সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। আমি মাথা নিচু করেছিলাম। বুদ্ধিমান মানুষদের সবকথা বলতে হয় না। আপনি এই দুই কথায় আমার অনেক কথার উত্তর যেন পেয়ে গেলেন। আপনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ঠিক আছে, আমি তোমার সঙ্গে পরে কথা বলব। আপনি আমাকে আপনার ফোন নাম্বারটা দিলেন। কি অদ্ভুদ আমার শিহরন। আমার মনে হয়েছিল, আমাকে আজ পর্যন্ত এই ভাবে কেউ ছুয়ে দেয় নাই। আমাকে আজ অবধি কেউ বলে নাই, ঠিক আছে আমি তোমার কথা শুনব। আজ মনে হল, আপনি আমাকে ছুয়ে দিয়েছেন, আমাকে আদর করেছেন, আমাকে শুনবেন এই আশ্বাস দিয়েছেন। একটা ফোন নাম্বার আর কিছুই না। আমি আপনার ফোন নাম্বার টা যে কতবার লিখেছি, আপনার নাম টা যে আমি কতবার লিখেছি। আমি সেই রাতে ঘুমুতে পারি নাই। শুধু আমার কাছে ঐ যে শিহরন, ঐ যে স্পর্শ, ঐযে চোখের চাহনি, আমাকে অনেক অনেক রাত অবধি জাগিয়ে রেখেছিল। আমি কি আপনাকে ভালবাসি? আমি কি আপনাকে দেবতা বলে জানি? আমি কি কারনে আপনাকে এক মুহূর্তে জন্য ও ভুলতে পারছি না? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? আমি কি কোন অলিক কিছু ভাবছি? আমার বাবা মা, জ্যাঠা, গ্রামের অনেকেই আমার এই অসভ্যতা পছন্দ করে নাই। আমাকে টার জন্য অনেক যন্ত্রনা সজ্য করতে হয়েছে বেশ কয়েকদিন। গ্রামের মানুষ অন্য সব কিছু ফেলে দিয়ে যেন আমার এই ঘটনাতাই আলাপের বস্তু হয়ে দারিয়েছিল। আমি তাতে কিছুই মনে করি নাই। পৃথিবীতে এতো মানুষ, চারিদিকে এতো জন মুখর পরিবেশ, কিন্তু কাউকে কিছু বলবার মত মানুষ পাওয়া বড়ই দায়।
৪র্থ পর্ব
আমি আপনার ফোন নাম্বার পেয়েছি কিন্তু আমার কোন ফোন নাই। তাই আমি একদিন অনেক সাহস করে পাশে বাজারের এক ফনের দোকান থেকে আপনার নাম্বারে আমি ফোন দিলাম। আমি জানি না ঐ সময়ে আপনাকে ফোন দেওয়া ঠিক ছিল কিনা। অনেক্ষন রিং হল কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ আমার ফোনটা ধরল না। মনে মনে একটা কি ধরনের যেন ভয়-কম্পিত অনুভুতি কাজ করছিল আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু ফোনটা না ধরাতে আবার মনে হল, ভালই হয়েছে।
তারপরের দিন আবার আমি আপনাকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আপনি এবারও ফোন ধরলেন না। প্রথমদিন ফোন না ধরাতে বিশেষ কিছু মনে হয়নি কিন্তু দ্বিতীয় দিন ফোন না ধরাতে আমার কাছে ব্যাপারটায় একটু খটকা লেগেছিল। আমি আবারো ফোন দিয়েছিলাম। অনবরত রিং হচ্ছে কিন্তু পাশে কি কেউ নাই যে ফোনটা ধরে?
এইভাবে আমি আপনাকে দিনের পর দিন অন্তত প্রতিদিন একবার করে ফোন করতে লাগলাম আর বিফল মনোরথে বাড়ীতে ফিরে এলাম। বাজারের ফোনের দোকানদারও একটু বিরক্ত হতে শুরু করলেন। কাকে ফোন দিচ্ছেন যে ফোন ধরে না সে? আমি দোকানদারকে কিছুই বলতে চাইনি কাকে ফোন দিচ্ছি। কারন নাম বললেই দোকানদার তাঁকে চিন্তে পারবে।
এমন করে প্রায় দু সপ্তাহ পার হয়ে গেলো। একদিন দোকানদার আমাকে একটা পরামর্শ দিলেন।
‘দেখুন, এমনও হতে পারে যে তিনি অপরিচিত নাম্বার ধরেন না। তার থেকে একটা এসএমএস করে দিন। ধরলেও ধরতে পারে।
ব্যাপারটা খুব কাজে লাগলো। আমি সংক্ষিপ্ত একটা এসএমএস দিলাম, “আমি সন্ধ্যা, অমুক চাচার মেয়ে”।
ম্যাসেজটা বুলেটের মত কাজ করল। ঠিক কয়েক মিনিটের মধ্যেই আপনি আমাকে ফোন করলেন ঐ বাজারের নাম্বারে। আমি আপনার ফোন পেয়ে আত্তহারা হয়ে গেলাম। এই যে গত কয়েকদিন আমি আপনাকে চেষ্টা করেও পাচ্ছিলাম না, তার সবগুলো কষ্ট আমার এক নিমিষের মধ্যে শেষ হয়ে গেলো।
মনে হল আপনি ব্যাস্ত ছিলেন। আমাকে শুধু বললেন, আগামি অমুক দিন তুমি আমার অফিসে এতটার মধ্যে চলে আস। আমি থাকবো।
আমি আপনার অফিস চিনি। কিন্তু জানি নাই কখন আপনি অফিসে থাকেন। এবার আর মিস হবে না আমি জানি। আমার চিত্ত বিকশিত হয়ে উঠল। দোকানদারকে আমি অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, ভাই, অনেক উপকার করলেন।
আমার আর দিন কাটে না, রাত কাটে না। কবে আসবে সেইদিন। আমি যাব আপনার কাছে। দেখা হবে আপনার সাথে। কথা হবে মুখুমুখি বসে। আমার যত কথা, সব বলব আপনাকে। পারবো তো? (চলবে)
৫ম পর্ব
নির্দিষ্ট দিনটি অবশেষে এলো। খুব ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেছি। আকাশটা আমার মনের মতো ফুরফুরা নয়, একটু মেঘলা। যে কনো সময় ঝুপ করে বৃষ্টি হতে পারে। আমি আমার সব গুলি কাজ যথাসময়ে শেষ করে কাউকে কিছুই না বলে নিজের মতো করে সকাল সকালই বের হয়ে গেলাম। ছাতাটি সঙ্গে নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু যখন পুনরায় মনে হলো, তখন আমি বাড়ী থেকে অনেক দূর হেটে চলে এসেছি। ফিরে গেলে হয়ত দেরী হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় আর ছাতার জন্য ফেরা হল না।
প্রায় আধাঘন্টা ধরে আমি একটা রিক্সায় চড়ে আমি আপনার অফিসের সামনে এলাম। আজ আর আপনাকে না পাওয়ার আশংকা আমার ছিলো না। আমি আজ আপনাকে পাবো, সেটা আমার মন নিশ্চিত ছিলো। আমি আপনার অফিসের গেটে …………(চলবে)
২৩/০৫/২০১৬- মুল্যায়ন
Categories
সব ফুল ঈশ্বরের সেবায় কাজে লাগে না যেমন তেমনি একই বাগানের মালি সব ফুলের একই রকমের যত্নবানও নন। এরজন্য ফুলকে যেমন দোষী বলা যাবে না আবার মালিকেও অপরাধে দন্ডিত করা যাবে না। এটাই বাস্তবতা। কিছু ফুল বিকশিত হওয়ার আগেই ঝরে যায় আবার কিছু ফুল বিকশিত হয়েই এমন জায়গায় স্থান পায় যা ফুলের জীবনকে নিয়ে যায় স্মৃতির অমরতায়। এইসব নির্ভর করে ফুল কখন কার হাতে কিভাবে থাকে আর কে কিভাবে কোন ফুলকে বরন করে। ফুলের কোন ভাষা নেই বলে জানা যায় না যে, এক ফুল আরেক ফুলকে হিংসা করে কিনা। কিন্তু মানুষের বেলায় এর পরিনতি অনেক ভয়াবহ।
এই পৃথিবীতে জীবন হচ্ছে একটা জুয়া খেলার মত। একই টেবিলে খেলার একই নিয়মে একজন হারে এবং আরেকজন জিতে। যে হেরে যায় তার কাছে জুয়ার টেবিলের অভিজ্ঞতা, বর্ণনা, কষ্ট, অনুভুতি, প্রভাব কিংবা তার মনোভাব এক রকম কিন্তু যিনি জুয়ার টেবিলে জয়ী হয়েছেন, তার অভিজ্ঞতা, বর্ণনা, আনন্দ, প্রভাব কিংবা মনোভাব একেবারেই বিপরিত। অথচ খেলাটা একই, খেলার টেবিলটা একই, খেলার নিয়মটা একই। কার কাছ থেকে আপনি বুদ্ধি বা পরামর্শ নেবেন? হয়ত বলবেন, জুয়া খেলাটাই তো একটা রিস্ক এবং ভাল জিনিস নয়। জীবনটাও ঠিক তাই। এর মধ্যে ভাল খেলা আছে, খারাপ খেলা আছে, দুটুতেই রিস্ক আছে আবার দুটুতেই লাভ লোকসান আছে। আপনি কি চান, কোনটা চান সেটা এখন আপনার। ভগবানের হিসাব আরেক অধ্যায়। সেটা আরেক তাত্ত্বিক এবং আধ্যাত্মিক বিষয় যা এখানে আমি অন্তত মিন করছি না।
যদি অন্যভাবে বলি, মানুষ যে কাজটা করতে গিয়ে তার ভুলের কারনে হেরে গিয়ে থাকে, অন্য কেউ সে একই কাজ করে ভুল না করে জীবনে জয়ী হতে পারে। হেরে গিয়ে আপনি কাউকে সাবধান করতে পারেন বটে কিন্তু যদি সেই অন্য কেউ সার্থক হয়ে ফিরে আসে, হেরে যাওয়া আপনি মানুষটি হয় জিতে যাওয়া মানুষটির হিংসায় লিপ্ত হবেন নতুবা আপনি জিতে যাওয়া মানুষের পথ ধরে জয়ী হওয়ার একবার চেষ্টা করবেন। তারপরের নীতিটা নির্ভর করে হেরে যাওয়া মানুষটির অর্ধ গ্লাস পানির বর্ণনায়- হয় হাফ খালি না হয় হাফ ভর্তি তার মানসিকতার উপর। সবাই বক্সিং রিং এ জিতে না। যে জিতে না তার কাছে অনেক কৈফিয়ত থাকতেই পারে কিন্তু হেরে যাওয়া মানুষের কাছে কেউ গল্প শুনতে আসে না। আর এ কারনেই পৃথিবীতে হার জিতের কারনে বন্ধুর প্রতি বন্ধুর, পরিবারের প্রতি পরিবাবের, স্বজন এর উপর স্বজনের দিনদিন হিংসা আর বিরূপ প্রভাব বেড়েই চলে।
পৃথিবীতে মানুষের রুচি ভেদে তার পরিবর্তন হয়। কেউ মদ বেচে দুধ খায় আবার কেউ দুধ বেচে মদ খায়। রুচি এমন একটা জিনিস যা একজনের সঙ্গে আরেকজনের খুব মিল থাকে না হয়ত তবে মাঝে মাঝে তার মিলের সাদৃশ্য থাকে। আপনি জীবন থেকে কি পেতে চান সেটা যেমন জরুরি, আপনি জীবনে কাকে কি দিতে চান সেটাও খুব জরুরি। জীবনটা একমুখি নয়। দেওয়া আর নেওয়ার মধ্যে এর লাভ লোকসান। আপনি বোয়াল ধরবেন, পুটি মাছের আহার দেবেন, এটা যেমন হবে না, তেমনি চাঁদে যাবেন নৌকায় চরবেন তাও হবে না। ঠিক সময়ে ঠিক ইন্সট্রমেন্ট, ঠিক সময়ে ঠিক যানবাহনে উঠতে হবে। আপনি ঠিক সময় ঠিক কাজটি করেন নাই মানে এই নয় যে ঠিক সময়ে ঐ কাজটি করে সার্থক হল তাকে আপনি আপনার হেরে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বলে পিছিয়ে আনবেন। আপনি অসময়ে সব কাজ করে ফেলবেন, কেন আপনি মনে করেন আপনি সার্থক হবেন? আপনি একসময় সবার কাছ থেকে পিছিয়েই থাকবেন এবং আপনার জন্য কেউ অপেক্ষা করবে না। আপনি যত বুদ্ধিমান আর যত পারফেক্টই হন না কেন। কখনো দেখেছেন বা শুনেছেন যে একই জলের এক বিন্দু ফোঁটা কোন এক ব্রিজের তল দিয়ে দুবার প্রবাহিত হয়েছে? আপনি যদি একবার এক ব্রিজের তল অতিবাহিত করে চলে যান, আপনার জন্য ফেরার কোন সুযোগ নেই। আপনি ভুল করেছেন না ঠিক করেছেন তা দেখার জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই। আপনি অবরুদ্ধ, আপনার মুল্য ঐ ব্রিজের কাছে শুন্য। আর আপনি যখন অবরুদ্ধ হবেন, তখন পৃথিবীটা প্রতি নিয়ত মুহূর্তে মুহূর্তে আপনার থেকে অনেক দূর সরে যাবে। হেরে যাওয়ার গল্প কেউ শুনতে চায় না। মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে আর স্বপ্ন পূরণে ব্রতি হয়।
পৃথিবীর আসেপাশে তাকিয়ে দেখুন, এটাই নিয়ম। লিকলিকে গাছ সবল গাছকে ধরে আকাশের দিকে বেড়ে উঠে, দুর্বল সবলকে ধরে হেটে চলে, অন্ধ আরেকজনকে অবলম্বন করে ঠিক পথ ধরে হেতে এগিয়ে যায়। আপনি কাকে ধরবেন, আর কাকে ছারবেন সেটা তো আপনার সপ্নের উপর নির্ভর করে। আপনি ভুল স্বপ্ন দেখেছেন বলে আরেক জন কে আপনি তার স্বপ্ন দেখাকে ভুল বলতে পারেন না। তার স্বপ্ন দেখা আর সেই সপ্নকে সফল করার কৌশল তার, আপনি হয়ত সেই কৌশল কখনোই শিখেননি।
আপনি নিজেকে দেখুন, যদি কখনো বিশ্বাস হারিয়ে থাকেন, অথবা কেউ আপনার উপর বিশ্বাস হারিয়ে থাকে, এর মানে হল, আপনি নিজেও কারো বিশ্বাস নিয়ে খেলা করেছেন। নিজেকে বিশ্বাস করুন আর নিজের বিশ্বাসের উপর কাউকে বিশ্বাস করতে দিন। আর এটাই হবে বিজয়ের জন্য প্রথম সোপান। যদি ভাবেন, শেষ হয়ে গেছেন, তাহলে আপনি সত্যি শেষ হয়ে গেছেন। আর যদি ভাবেন, না আপনি পারবেন, আবার শুরু করুন তাকে দিয়ে যে জিততে শুরু করেছে। সব দই চুন নয়, একবার দই মনে করে চুন খেয়েছেন বলে সেটাই যে সব তা কিন্তু নয়। আপোষ করুন, জীতবেন, তবে এবার ধীরে ধীরে। তাহলেই দিন বদল হবে, আর আপনার মুল্য ফিরে আসবে।
৬/৫/২০১৬-রুনার গল্প
সেদিন সমস্ত দিন বাহিরে ঝড় বৃষ্টি হইতেছিল। কিন্তু বিকালে আকাশ বড় পরিস্কার নীলদিগন্ত লইয়া, পৃথিবী তাহার সবুজ গাছপালার ঢালপালা সাজাইয়া খুব শান্ত হইয়া বসিয়াছিল। এই ঋতুতে কখন আকাশ মেঘলা হইয়া যায় আবার কখন ঝরঝর করিয়া আগাম কোন সংকেত না দিয়া অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়, তাহার কোন হদিস থাকে না যদিও আজ এই পরন্ত বিকালে কোন সংকেতবিহিন এইরূপ অঘটন ঘটিবে বলিয়া মনে হইতেছে না।
এমনি এক বিকালে "সুখালয়" এর প্রকান্ড বাড়িটার সামনে সবুজ লনের মধ্যে মা শেলি আর তার অষ্টাদশী রুনা চুপচাপ বসিয়া আছে। কাহারো মুখে কোন কথা নাই। অনেক্ষন ধরিয়াই শেলি কোন কথা না বলিয়া দুরের আকাশের দিকে আনমনে তাকাইয়া কি যেন গভিরভাবে ভাবিতেছে তাহার মুখ দেখিয়া তাহা বুঝিবার উপায় নাই। তবে তাহার মনটা যে বড় বিষণ্ণ এ ব্যাপারে নিশ্চিত করিয়া বলা যায়। পাশেই একটা মেলামিনের কাপে গরম কিছু চা লইয়া তারই অষ্টাদশী চঞ্চলা রুনা মায়ের কথা শুনিবার জন্য বসিয়া আছে। তাহারও মন খুব একটা শান্ত কিংবা চঞ্চলা কিনা বুঝা যাইতেছে না। তবে দুইজনের মনের অবস্থা নিরিক্ষা করিয়া এইটুকুন উপলব্ধি করা যায় যে, কোন এক ঝড়ের পূর্বের থমথমে মেঘময় নীলিমার মত, অথবা ঝড়ের প্রাক্কালে বাতাসেরা যেমন তাহাদের পরবর্তী গতিপথের নিশানা ঠিক করিবার জন্য শল্য পরামর্শ করার তাগিদে একেবারে নিসচুপ হইয়া যায়, অথবা ভুতলের সব বৃক্ষরাজিরা ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার লক্ষে পূর্বপ্রস্তুতিমুলক যতসব কার্যপ্রণালী আছে তাহার ব্যাপক আয়োজন চালায়, ঠিক ঐ রকম একটা থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হইয়াছে।
রুনা শেলির একমাত্র মেয়ে। বড় চঞ্চল এক চপলা কিশোরী। কিন্তু পিতার অভাবে বড় আদুরের রুনাকে শেলি কখনো কোন কষ্টের ভার নিতে দেয় নাই। এই সমাজ সংসারে যাহা কিছু সম্মান আর আনন্দের সহিত ভোগ করা যায়, তাহার কোনকিছুই শেলি রুনার জন্য কমতি রাখে নাই। একইসঙ্গে শেলি রুনার মা এবং বাবার দায়িত্ব পালনে কখনো ব্যর্থ হন নাই। ভাল স্কুল, দামী গাড়ি, প্রকান্ড বাড়ি, সুন্দর সুন্দর পোশাক-আসাকে শেলি রুনার জীবন একেবারে ভরিয়া রাখিয়াছে। কিন্তু আজ শেলি রুনার কাছে বড় অসহায়। তাহার অষ্টাদশী রুনা আজ শেলিকে এমন কিছুর সামনে আনিয়া দাঁড় করাইয়াছে যেখানে শেলি না পারিতেছে তাহার অতীত জিবনের কাহিনী শুনাইতে, না পারিতেছে তাহার সেই অতীত কাহিনী কোনভাবে লুকাইতে। রুনা পন করিয়াছে, সে তাহার পূর্বপুরুষের ইতিহাস, বিশেষ করিয়া তাহার জন্মদাতা পিতা, পিতামহির কথা তাহাকে জানাইতেই হইবে। না জানিতে পারিলে তাহার এই সমাজে এই সংসারে থাকিবার মত আর কোন গতিও নাই, কাহারো কাছে তাহার মুখ দেখাইবার মত পরিস্থিতিও নাই। আর তাহা না হইলে অচিরেই হয়ত রুনা তাহার যাহা আছে সব কিছু ছারিয়া অন্য কোথাও মুখ লুকাইয়া বাচিয়া যাইবে। এমন একটা পরিবেশে শেলির কাছে সমস্ত মানবজীবন আর বিশ্বরচনা এক দুর্ভেদ্য বলিয়া মনে হইতে লাগিল। কি দিয়া কোথা হইতে কি শুরু করিবে আর কোথায় গিয়া তাহার এই দুর্ভেদ্য রচনা শেষ করিবে, তাহার আগাগোরা কিছুই শেলির মাথায় আসিতেছিল না।
চায়ের কাপে চুমু দিতে দিতে রুনা মায়ের দিকে কয়েকবার আড় চোখে তাকাইল। মায়ের এই অতিব নিসচুপ বৈশিষ্ট রুনার কাছে আজ প্রথম নয়। মাকে যখন হইতে রুনা বুঝিতে শিখিয়াছে, তখন হইতেই সে দেখিয়াছে তিনি কোথাও বেড়াইতে যান না, তাহার কোন একান্ত বন্ধু বা বান্ধবি আছে তাহাও না, কাহারো সঙ্গে মা খুব একটা মিশেনও না। চাপরাশি, আর্দালি, পিয়ন সবাই যার যার কাজ করিয়া দিয়া যায়, এত বড় ব্যবসার কোথায় কি হইতেছে তাহার প্রতিদিনের হিসাব মা না রাখিলেও ব্যবসা যে ঠিকমতই চলিতেছে মা তাহার হিসাব হয়ত রাখেন। দিনের অধিকাংশ সময়ে মা ঘরেই থাকেন, শুধুমাত্র বিকালে একবার পারভিনের মাকে লইয়া ছাদের ঐ চিলে কোঠায় উঠিয়া বিশাল আকাশের দিকে তাকাইয়া শুধু সূর্যাস্ত দেখেন। এই সময় মায়ের সঙ্গে শুধু পারভিনের মা তাহার একান্ত সঙ্গিনী, আর কাউকেই মা তাহার কাছে রাখিতে পছন্দ করেন না। পারভিনের মা আমাদের বাড়ীতে অনেককাল ধরিয়া আছে, তখনো পারভিনের জন্ম হয় নাই। এখন পারভিন তাহার সংসার লইয়া অনেক দুরের এক শহরে স্বামীর সংসার করিতেছে। পারভিনের বাবাকেও আমি কখনো দেখি নাই। কোন এক অজ্ঞাত কারনে তিনি নিখোঁজ হইয়া রহিয়াছে। এইটুকুই আমি জানি। আমি আমার বাবাকেও দেখি নাই। যতবার মাকে জিজ্ঞসা করিয়াছি, মা কোন না কোনভাবে তাহা এরাইয়া গিয়াছেন। খুব বেশি পিড়াপীড়ি করিলে হয়ত তিনি "তোঁর বাবাকে আমি ..." এইটুকু বলিয়াই অন্য কোন এক প্রসঙ্গ টানিয়া আনিতেন। আমার বাবা কি জিবিত আছেন না মারা গিয়াছেন, তাহার কোন সদুত্তর আমার এখনো জানা নাই। মাকে আমি কখনো বিধবার মত শাড়ি পরিতে দেখি নাই, মাকে আমি বাবার কোন মৃত্যুবার্ষিকী পালন করিতেও দেখি নাই। আমি মাকে কখনো বাবার প্রসঙ্গে কোন কথা বলিতেও দেখি নাই। কি হইয়াছে তাহলে আমার বাবার? আমাদের সারা বাড়ীতে বাবার কিংবা দাদাদাদির কোন একটা ছবিও নাই। আমার মা সবার হইতে এমন আলাদা এক জগত লইয়া যেন বসবাস করিতেছেন। অথচ তিনি এই সমাজেরই একজন অতি গনমান্য মানুষদের মধ্যে একজন। অনেক মানুষের তিনি অসময়ের বন্ধুও বটে।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমার মা এত উদাসিন কেন? কি নাই তাহার? বাড়ি, গাড়ি, মানসম্মান, প্রতিপত্তি, যশ, টাকাপয়সা, ব্যবসা-বানিজ্য, সবই আছে তাহার। এই বয়সেও তিনি অনেক সুন্দরি মায়েদের থেকে অধিকতর সুন্দর। অনেক দামী শাড়ি হয়ত পরেন না কিন্তু দামী শাড়ি পড়িবার জন্য তাহার আয়েরও কোন কমতি নাই। আজ আমি মাকে বড় ভয় পাইতেছি। কারন আমি মাকে এমন কিছু কথা শুনাইয়া দিয়াছি, হয় মা আমাকে ছারিবেন, না হয় আমি মাকে ছারিব। কিন্তু আমাকে আমার পরিবারের ইতিহাস শুনাইতেই হইবে। তাহা না হইলে আমি কি করিয়া ঐ অপূর্বের বাসায় আমার বংশপরিচয় দেব? আমি তো অপূর্বকে ভালবাসি। আমার বারংবার শুধু এই কথা মনে করিয়া ভয় হইতেছিল যে, মা কি আমাকে এমন কিছু বলিবার জন্য প্রস্তুত যাহা আমি শুনিবার জন্য প্রস্তুত নই? ভয় যখন মানুষের উপর ভর করে, তখন তাহার রক্তের শিরায় শিরায় এক অজানা শিহরন তোলে, মনে হয় বুকের ভিতর কি যেন নাই, বা কি যেন দ্রুত হারাইয়া যাইতেছে। মাথা ভনভন করিতে থাকে, স্বাভাবিক আচরন আর স্বাভাবিক মনে হয় না।
মা নিরবতা ভাঙ্গিয়া আমার দিকে তাকাইয়া একটু মুচকি হাসিয়া আমার কাছে একটু আগাইয়া আসিয়া আমাকে জড়াইয়া ধরিলেন আর বলিলেন, 'তুমি অপূর্বকে ভালবাস?'
আমি বলিলাম, হ্যা, আমি অপূর্বকে ভালবাসি মা।
-অপূর্ব কি তোমাকে ভালবাসে?
আমিও মাকে জড়াইয়া ধরিয়া হাতের কাপটি মাটিতে রাখিয়া শুধুমাত্র ঘাড় নাড়াইয়া এই বলিয়া সংকেত দিলাম যে, মা যাহা জানিতে চাহিয়াছেন, তাহা সত্য এবং ইহার বাহিরে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই।
মা আমাকে এইবার তাহার বাহুবল হইতে ছাড়িয়া তাহার চেয়ারে হেলান দিয়া জিজ্ঞেস করিলেন, 'রুনা মা, তুমি আমার কাছ হইতে কি জানিতে চাও?'
বুঝিলাম, শতবার এরাইয়া যাওয়ার যে উত্তর আমি জানিতে চাহিয়াছিলাম, আজ মা তাহার সব উত্তর দিতে হয়ত নিজেকে প্রস্তুত করিয়া আমার সামনে হাজির হইয়াছেন। আজ হয়ত তিনি কোন কিছুই এরাইয়া যাইবেন না। হয়ত অন্যদিনের মত বলিবেন না যে, ;আমি তোঁর বাবা...' ইত্যাদি।
-মা, আমি আমার পরিবারের ইতিহাস জানিতে চাই। আমি আমার পূর্বপুরুষের ইতিহাস জানিতে চাই, আমি আমার বাবার ইতিহাস জানিতে চাই। কথাগুলি বলিতে আমার বুক কাপিতেছিল, আমার হাত কাপিতেছিল, আমার গলা ধরিয়া আসিতেছিল। আমি স্বাভাবিক নই এখন আমার মায়ের সামনে। অথচ এই মা আমার সবচেয়ে কাছের একজন মানুষ যাহাকে আমি কোন কিছুই বলিতে সংকোচবোধ করি না। কিন্তু আজ আমার অনেক ভয় করিতে লাগিল।
মা অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাহার দুইখানা হাত তাহার বিসন্ন মুখে একবার বুলাইয়া চোখের চশমাটা খুলিয়া শাড়ীর আচল দিয়া মুছিতে মুছিতে দূর আকাশের দিকে তাকাইয়া শুধু বলিলেন,-'মানুষের অনেক পুরানো ইতিহাস না জানাই বর্তমান সময়ের জন্য মঙ্গলকর, তারপরেও যদি কেহ তাহা জানিতে পন করিয়া বসে, তাহা হইলে তাহাকে তাহার অতীত জীবনের সত্যের মুখুমুখি দারাইবার যে জীবনীশক্তি দরকার, তাহা আছে কিনা জানা খুবই প্রয়োজন। তাহা না হইলে বর্তমানকে মানিয়া লইয়া বাচিয়া থাকিবার যে অনুশোচনা তৈরি হইবে তাহার থেকে পরিত্রান পাওয়া বড়ই দুস্কর। আমি তোমাকে এই উভয় সংকট পরিস্থিতে ফেলিতে চাহি নাই। তারপরেও যখন তুমি এতটাই পন করিয়া বসিয়া আছ, তোমার জীবনের কাহিনী তোমাকে আজ আমি শুনাইব। জানিতে পারা আর মানিয়া লইতে পারা সব তোমার উপর নির্ভর করে'।
আমার বড় ভয় করিতে লাগিল।
-আজ হইতে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমি তোমার মতই একজন চঞ্চলা যুবতি মেয়ে ছিলাম। কত হইবে আমার বয়স তখন? হয়তবা বাইশ কিংবা তেইশ। আমাদের গ্রামে তখনো বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল। অনেক চরাইউৎরাই পার হইয়া সেই অজপারাগায়ের সমস্ত বাল্যবিবাহের আইন কানুন ভাঙ্গিয়া আমি সবেমাত্র ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হইয়াছি। গ্রামে আমার বাবা অতি ধনি না হইলেও আমরা দরিদ্র ছিলাম না। আমরা তিনবোন, একভাই আর মাকে লইয়া আমার বাবা বেশ ভালই জীবনযাপন করিতেছিলেন। স্কুলের গন্ডি হইতে শুরু করিয়া ঐ ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত আসিতে আমি অনেকবার বিবাহের সম্বন্ধ লইয়া অনেক পেরেশানিতে ভুগিয়াছি। দাদা দাদির ধমক হইতে শুরু করিয়া, জ্যাঠা জ্যাঠির, ফুফা ফুফির সবারই কম বেশি ধমক আর মানসিক নির্যাতন খাইয়াছি। কিন্তু আমার বাবা আমার মনের ইচ্ছার কথা জানিতেন। তাহার হয়ত অনেক সাহস ছিল না কিন্তু তিনি আমাদের সব ভাইবোনদের মধ্যে আমাকে বিশেষ নজরে দেখিতেন বলিয়া আমার ইচ্ছার বাহিরে কখনো মতামত দেন নাই। বিশেষ করিয়া আমার বিবাহের বেলায় তো কখনই জোরাজোরি করেন নাই। গ্রামের পঞ্চায়েত, মুরিব্বিগন, এমন কি আমার দাদা দাদিদের কাছেও আমার বাবাকে আমার এই বিবাহ লইয়া অনেক কঠোর কথা শুনিতে হইয়াছিল। তখন সবেমাত্র দেশ স্বাধীন হইয়াছে, ফলে দেশে খুব একটা আইন শৃঙ্খলা নাই এবং একটা অরাজকতার বিশৃঙ্খলা বিরাজ করিতেছিল। যাহারা দেশ স্বাধীন করিয়া জীবিত ফিরিয়া আসিয়াছে, তাহাদের হইতেই এখন আমাদের সবচেয়ে বিপদের আশংকা বেশি মনে হইতেছিল। কোন এক অমাবশ্যার রাতে আমাদের গ্রামের নদীর ধারে আমার বাবার মৃত দেহখানি পাওয়া গেল।' কে বা কাহারা এই হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত ছিল তাহা আজো অবধি তাহার কোন কূলকিনারা হয় নাই।
এই বলিয়া মা কিছুক্ষন চুপ করিয়া থাকিলেন। আমার এতক্ষন যে ভয়টা আমাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছিল, তাহা আরও বেশি করিয়া চাপিয়া ধরিল। আমি কি কোন লোমহর্ষক ইতিহাস শুনিতে যাইতেছি? নাকি কোন এক রূপকথার গল্প শুনিতে যাইতেছি? ইহার পরে কি শুনিব যে আমার বাবাও আমার দাদার মত কোন এক অমাবশ্যার রাতে খুন হইয়া লাশ হইয়া গিয়াছিল? আমার শরীর হিম হইয়া আসিতে লাগিল।
মা বলিতে শুরু করিলেন, 'জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য হইল, সে একদিন মরিবেই। বিধাতাকে কেহ মানুক আর নাইবা মানুক, বিধাতা মানুষের জন্মের দ্বারা একটা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন, আর তাহা হইল, সে একদিন এই সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করিয়া, সমস্ত লোভ লালসা পিছনে রাখিয়া, সমস্ত ধন দৌলত হাত হইতে ছাড়িয়া দিয়া একা একা নিঃসঙ্গভাবে সবার চোখ হইতে চিরতরে আড়াল হইয়া যাইবেই। সময়টা হয়ত কারো শতবছর পর আবার কারো তারও আগে। কয়েকদিন অতি প্রিয়জনেরা তাহাকে লইয়া কান্নাকাটি করিবেন বটে কিন্তু সময়ের স্রোতে একদিন সব বিবর্ণ হইয়া কালের অতল গভীরে হারাইয়া যাইবে। তাহাকে আর কোথাও খুজিয়া পাওয়া যাইবে না। না তাহার উত্তরসূরিদের কণ্ঠে, না পূর্বসূরিদের। ইহাই এই জীবনের তথা পৃথিবীর সরল সমিকরন। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের সংসারটায় যেন অকস্মাৎ ছাদ ভাঙ্গিয়া মাথায় পড়িল। তিন বোন, এক ছোট ভাই আর মাকে লইয়া আমি যেন দেখিতে পাইলাম, এতদিন যাহারা বিনা দ্বিধায় আমাদের পরিবারে অন্নগ্রাস করিত, আজ তাহারা তাহাদের নিজ নিজ স্বার্থ লইয়া অতিশয় ব্যস্ত, দাদার সম্পত্তি লইয়া ভাগ বাটোয়ারা করিতে চারিদিকে পাঁয়তারাসমেত গোপনে একা কিংবা প্রকাশ্যে দল বাধিয়া শল্যপরামর্শ করিতেছে। পরিশেষে আমাদের ভাগ্যে যাহা জুটিল তাহা দিয়া আর যাহাই হোক, আমাদের লেখাপড়া, সংসার খরচ চলিতে পারে না। আমার মা হিমশিম খাইয়া দিশেহারা হইয়া দিক্বিদিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। আর এরই মধ্যে আরও একটা নব্য উৎপাত শুরু হইল। আমার বিবাহের সম্বন্ধ পাকাপাকি করা। আমার দাদা দাদিরা, ফুফা ফুফিরা, সবাই শক্ত করিয়া আমাদের কি প্রকারে বিশেষ উপকার করা যায় তাহার বুদ্ধি বাহির করিতে লাগিল। ফলশ্রুতিতে যাহা দারাইল, তাহা হইল, সবাই এবার আমার মাকে ঝাঁকিয়া ধরিল যে, এত লেখাপড়া করাইয়া কে কবে কোন লাট সাহেবের বউ হইয়াছিল? ধীরে ধীরে একে একে আমাদের সবার বিবাহ সম্বন্ধ ঠিক করিবার জন্য দিনের পর দিন মানসিকভাবে চাপের মুখে পরিতে হইল। আমরা যেন আর অধিক চাপ বহন করিবার মত শক্তি পাইতেছিলাম না।
কোন উপায়ন্তর না দেখিয়া একদিন আমি আমার মাকে বলিলাম, 'মা, শুনেছিলাম আমার বাবার এক অতি পরিচিত এক বাল্যবন্ধু আমাদের এই মহল্লায় বাস করত। তার অনেক ব্যবসা ছিল, অনেক দানখয়রাতও করতেন বলে তার সুনাম আজো এই মহল্লায় রয়েছে। তিনি যদিও আর এই মহল্লায় বাস করেন না কিন্তু শুনেছি তিনি নতুন রাস্তার পাশে বিরাট বাড়ি করে ওখানেই বসবাস করেন। খুজে পেতে খুব অসুবিধা হবে বলে তো আমার মনে হয় না। একবার কি তার সাথে দেখা করব?'
যাহাদের পেটে ক্ষুধা, যাহাদের আশ্রয়স্থল বলিতে এক ভগবান ছাড়া আর কেহ থাকে না, যাহাদের চারিদিকে হায়েনাদের মত অসংখ্য পিশাচ বসবাস করে, যাহাদের সাহায্য করা উতিচ অথচ তাহারাই যদি অত্যাচারি হইয়া যায়, তখন মানুষকুলে যদি এমন কাহারো একবার ক্ষিন সন্ধানের ছিটেফোঁটাও থাকে, যাহাকে ধরিয়া একবার নিরাপদ আশ্রয় পাইতে পারে, তাহা হইলে চেষ্টা করিয়া দেখিতে আপত্তি কি? আমার মা কিছুক্ষন ভাবিয়া আমার হাত ধরিয়া বলিলেন, 'চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।'
পরদিন আমি আর আমার মা সকাল সকাল ঐ নতুন রাস্তার ধারে আসিয়া হাজির হইলাম। আমাদের ইহাই প্রথম শহরে আসা নয় তারপরেও মনে হইতে লাগিল আজিকার আসা আর আগের বহুবার আসার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রহিয়াছে। শহরের রাস্তায় অসংখ্য মানুষের যাতায়ত, আমাদের গ্রামের দুই একজনের সহিতও আমাদের দেখা হইয়া গেলো। বিশেষ কোন কারন না দেখাইয়া আমরা তাহাদেরকে এক প্রকার এরাইয়াই গেলাম। অনেক খুঁজাখুঁজির পর বাড়িটির সন্ধান পাইলাম বটে কিন্তু তাহার সহিত দেখা করিবার যে তরীকা, তাহাতে আজ ফিরিয়া যাইতেই হইবে বলিয়া আমাদের আশংকা হইল। তিনি বাড়ি নাই বলিয়া গার্ডের সংক্ষিপ্ত উত্তরে আমাদের নতুন করিয়া আরেক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলিয়া দিল। দারোয়ান গেট বন্ধ করিয়া দিল, ভিতরে প্রবেশের কোন সুযোগ রইল না।
বাড়ি ফিরিয়া যাইবার অপেক্ষায় মা আর আমি দাঁড়াইয়া আছি, এমন সময় কালো একখানা গাড়ি বাড়ীর সুম্মুখে আসিয়া কিঞ্চিত একটি হর্ন বাজাইয়া গেট খুলিবার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া গেল। কালো গ্লাস দিয়া ঢাকা থাকায় ভিতরে কে বা কাহারা বসিয়া আছেন আমরা কিছুই দেখিতে পাইলাম না। দারোয়ান দ্রুত গেট খুলিতে গিয়া গেটের পাশে আমাদের দেখিয়া মনিবের সামনে অতি উচ্চকন্ঠে দূর দূর করিতে লাগিলেন। একটু অপমান বোধ হইতে লাগিল যেন আমরা কোন এক নমশূদ্রের দল এই ব্রাহ্মণ বাড়ীর গেটে আসিয়া দারায়াছি বলিয়া সমস্ত বাড়ীটি অপবিত্র হইয়া গেল। নিজের উপর নিজের খুব রাগ হইতে লাগিল।
মনের রাগ, আর অপমানে 'কেন আসিয়াছিলাম' এই অনুশোচনা লইয়া মা মেয়ে ধির পদক্ষেপে বাড়ীর দিকে রওয়ানা হইয়াছি, এমন সময় দারোয়ান আবার হন্তদন্ত হইয়া পিছন হইতে আমাদের ডাকিয়া বলিলেন,-'এই যে শুনছেন? সাহেব আপনাদেরকে ডাকছেন'। এই কথা শুনিয়া মনের ভিতর যেমন একটা আশার সঞ্চার হইল, তেমনি আবার সংশয়েরও সৃষ্টি হইল। কি জানি আবার কোনো অপরাধ হইল কিনা, কিংবা সাহেব আবার কি বলিয়া আমাদের নতুন করিয়া অপমান করিবেন কিনা ইত্যাদি।
এবার সাহেব নিজেই আগাইয়া আসিলেন এবং জিজ্ঞেস করিলেন, কোথা হইতে আমরা আসিয়াছি। মা তাহার ঘোমটাখানি সরাইবামাত্র মাকে দেখিয়াই সাহেব চিনিতে পারিলেন। অতি উচ্ছ্বসিত হইয়া মায়ের একেবারে কাছে আসিয়া সহাস্যে বলিলেন, 'আরে, এ যে আমাদের বৌদি? কি ব্যাপার এতদিন পর আমাদের মনে পড়ল?'
আমি লোকটিকে আগে কোথাও দেখিয়াছি কিনা মনে পরিতেছে না কিন্তু কোথাও তাহাকে দেখিয়াছি তাহা আমি নিশ্চিত। তাহার বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ কি তাহার কাছাকাছি হইবে। সুঠাম দেহ, পরিপাটি চুল, সাদা চেকের উপর ফোঁটা ফোঁটা কালো রঙের চেকে পরিহিত একটা শার্ট, হাতে সোনালী রঙের একটি ঘড়ি, বেশ মানাইয়াছে। মাথা ভর্তি চুল। মুচকি হাসিলেও ভাল লাগে আবার অট্টহাসিতেও বেমানান লাগে না। দুই চোখের মাঝখানে একটা কাল তিলক। বেশ হাসিখুশি একজন মানুষ বলিয়া মনে হইল। সাহেব মাকে একরকম পিঠে হাত দিয়া তাহার সহিত তাহাদের অন্দরমহলে লইয়া গেলেন। আমি মাকে শুধু অনুসরন করিয়া আমিও পিছুপিছু অন্দর মহলে প্রবেশ করিলাম। সাহেব বলিলেন, 'তোমরা একটু বস, আমি কয়েক মিনিট পর এসে তোমাদের সাথে কথা বলব'। এই বলিয়া তিনি তাহার ঘরে চলিয়া গেলেন।
আমরা তাহার ড্রইং রুমে বসিয়া আছি। বিশাল ঘর, চারিদিকে বিদেশী টাইলসের দেয়াল, সাজানো ঘরের মত আঙ্গিনা। পর্দাগুলি এসির বাতাসে ঝিরঝির হাওয়ায় অল্পঅল্প নরিতেছে, ঘরের একপাশে বিশাল একটা একুরিয়াম। রঙ বেরঙের মাছ তাহার ভিতরে খেলা করিতেছে। একুরিয়াম হইতে কখনো কখনো বুদবুদ উঠিতেছে, মনে হইতেছে মাছগুলি ডুবুরিদের মত নিঃশ্বাস ছারিতেছে। দেয়ালের এক কোনায় একটি মহিলার বিশালকায় একটি ছবি টাঙ্গানো আছে। শরীর ভর্তি গহনা। কানে গহনা, গলায় গহনা, নাকে গহনা, মাথার চুলের ঠিক মধ্যিখানে একটি মাথলা টিকি। মনে হইতেছে গহনাগুলি যেন ঠিক জায়গা মত বসিয়া মহিলার রূপ আরও শতগুনে বৃদ্ধি করিয়া দিয়াছে।
-এটা পারুলের ছবি। মা বলিলেন।
পারুল সাগর সাহেবের স্ত্রী। অনেক বছর আগে তিনি গত হইয়াছেন। পারুলের মৃত্যুর পর সাগর আর বিয়া করেন নাই। তাদের কোন সন্তানাদিও হয় নাই। পারুল যে বছর মারা গিয়াছে, তাহার পরের বছরই সাগর সাহেব আমাদের মহল্লা ত্যাগ করিয়া নতুন জায়গায় চলিয়া আসিয়াছেন। পারুল আমাদের গ্রামের মেয়ে ছিল। তবে পারুলের বয়স আমাদের হইতেও কম ছিল।
-'কিভাবে মারা গিয়াছিল'? আমি মাকে প্রশ্ন করিতেই মা বলিলেন, পারুলের প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় পারুল দেহত্যাগ করে। এই পারুলের নামেই পরবরতিতে সাগর সাহেব একখানা দাতব্যালয় দিয়াছিলেন আর ঐ দাতব্যালয় হইতেই তিনি অনেক দান খয়রাত করিতেন। কি কারনে কেন তিনি তার সেই দাতব্যালয় আর চালাইলেন না তাহা আমরা ভাল করিয়া বলিতে পারিব না। কিন্তু তিনি আর বিয়াথাও করেন নাই শুনিয়াছি।
-'এই যে বৌদি, কি মনে করে আজ এত বছর পর আমাদের মনে পড়ল? তোমরা একা আসলে কেন? দেওয়ান ভাই আসে নাই যে?'
বলিতে বলিতে আমাদের সামনের সোফায় আসন গ্রহন করিলেন। সাগর সাহেব ইতিমধ্যে তাহার একটু আগে পরিহিত জামা প্যান্ট পাল্টাইয়া একটা সাদা পাঞ্জাবির সঙ্গে মেরুন রঙের স্যালয়ার পড়িয়াছেন, হাতের ঘড়িটি এখন আর নাই। মনে হইল তিনি এইমাত্র স্নান করিয়া আসিয়াছেন। চুলগুলি এখনো ভিজা, গা হইতে একটা পারফিউমের গন্ধ আসিতেছে, তাহার আগমনে ঘরটি যেন সুগন্ধিতে ভরপুর হইয়া গেলো
তাহার প্রশ্ন শুনিয়া বুঝিতে পারিলাম, তিনি এখন আর আমাদের মহল্লার খবর রাখেন না। আমার বাবা দেওয়ান যে অপঘাতে মৃত্যুবরন করিয়াছে, সেই খবর তাহার জানা নাই। মা নিসচুপ হইয়া বসিয়া আছেন। ক্ষনিকপর মা তাহার জীবনের সমস্ত ঘটনা একে একে খুলিয়া বলিলেন। সাগর সাহেব অনেক্ষন ধরিয়া আমাদের সমস্ত ইতিহাস শুনিলেন। মাঝে মাঝে কিছু প্রস্ন করিলেন বটে কিন্তু তাহা নিতান্তই কিছু না। একসময় সাগর সাহেব আমার দিকে তাকাইয়া যা বলিলেন, তাহা এইরুপ-
-'তোমার বাবা আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন। আমরা ছোট বেলায় একসঙ্গে একই গ্রামে মানুষ হয়েছি। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে কোনও রকমে একমুঠো ভাত খেয়ে নদীতে গিয়ে ইচ্ছামতো ঐ ধলেশ্বরী নদীতে ডুব পারতাম, কখনো কখনো সন্ধ্যা নাগাদ মাছ ধরতাম। কোন কোন দিন নদীতে না যেয়ে একেবারে স্কুলের মাঠে গিয়ে ভররোদে মেন্ডা গাছের মেন্ডা দিয়ে ফুটবল বানিয়ে দুইজনে ফুটবল খেলতাম। কখনো আবার বড়দের সঙ্গে খেলায় অংশ নিতে গিয়ে আমরা দুজনে শুধুমাত্র গোল কিপার ছাড়া আর কোনখানেই খেলত পারতাম না। যদিও আমার থেকে তোমার বাবা প্রায় তিন চার বছরের বড় হবে কিন্তু তিনি ছিলেন আমার নিত্যদিনের একজন সঙ্গি। তোমার বাবার যখন বিবাহ হল তখন আমার বয়স হইবে বড়জোর চৌদ্দ কি পনের। তার কয়েক বছর পর আমি চলে আসি শহরের এক নামিদামী স্কুলে কিন্তু ছুটির দিনগুলুতে আমি গ্রামের ঐ আমাদের বাড়ীতে তোমার বাবার সঙ্গে সময়টা কাটাতে আমার বড় ভাল লাগত। তোমার বাবার আর পরাশুনা হল না। সারাদিন ক্ষেতের কাজ, খামারের কাজ, অনেক গরু পালত তোমার দাদা, তাদের নিত্যদিনের খাবার যোগার করা, নদীতে নিয়া গোসল করানো, বিকালে আবার তাদের খাবার খাওয়ানো, এসব নিয়ে তোমার বাবা এতটাই সময় কাটাত যে, আমিও একসময় আর ভাল করে সেই স্কুলের মাঠে খেলা করতে পারতাম না, ইচ্ছে করলেই আগের মত আর নদীতে গিয়ে অধিক সময় ধরে ডুবসাতার কাটতে পারতাম না। আস্তে আস্তে আমার কাছে গ্রামটা আর আগের মত মনে হচ্ছিল না। একদিন শুনলাম, আমার বন্ধু বাবা হয়েছে।' এই বলিয়া সাগর সাহেব মুচকি একটু হাসিয়া আমার দিলে আঙ্গুলি তুলিয়া বলিলেন, 'সেই বাচ্চাটি সম্ভবত তুমি। কি নাম তোমার? তোমার তো নাম জানাই আমার হল না।'
আমি এতক্ষন অবাক দৃষ্টিতে সাগর সাহেবের দিকেই তাকাইয়াছিলাম আর তাহার সেই ছোটবেলার আমার বাবার সাথে তাহার শৈশব কালের দিন গুলির কথা শুনিতেছিলাম।
আমার মনে পড়ে, আমি শুধু তাহাকে আমার নামটাই বলেছিলাম, - 'শেলি'।
সাগর সাহেব আবারো তাহার সেই হারানো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করিতে করিতে বলিতে লাগিলেন,
-'এত অল্প বয়সের বাবার কি দায়িত্ব, কি করতে হবে বাবা হিসাবে, তা সে হয়ত জানতই না। কত হবে তখন তার বয়স? হয়ত ষোল কিংবা সতের? তাহার আরও ব্যস্ততা বেড়ে গেলো। আমি গ্রামে গেলে আর আগের মত দিন কাটত না। যাক, সেসব কথা এখন বলে আর কি হবে? অনেক বছর পর আবার যখন তোমার বাবার সঙ্গে আমার দেখা হল, তখন আমি সবেমাত্র বিদেশ হতে পরাশুনা শেষ করে গ্রামে গিয়েছি। অনেক প্রতিবেশিকেই তখন আমি চিনি না। অনেকে দেশ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছেন, গ্রামটা আমুল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল।'
-আচ্ছা যাক সে ইতিহাস আজ আর না বলি। সাগর সাহেব আমাদের সবকথা শুনিয়া মাকে শুধু এইটুকু আশ্বাস দিলেন যে, তাহার অতিপ্রিয় বন্ধুর দেওয়ান পরিবারের জন্য তাহার যাবতীয় সাহায্য এবং সহযোগিতা যাহা কিছু লাগিবে, তিনি তাহার জন্য কোন কার্পণ্য করিবেন না। একে একে তিনি আমাদের সবার নাম জিজ্ঞাসা করিলেন, কে কোন ক্লাসে অধ্যায়ন করে, কিভাবে কখন কাহার কি লাগে সব আদ্যপান্ত জানিয়া লইলেন। তিনি আরও বলিলেন যে, যেহেতু তিনি সব সময় নিজে হাজির থাকিয়া সব দেখভাল করিতে পারিবেন না, ফলে লোক মারফত যাহা লাগিবে, তাহা তাহাকে জানাইয়া দিলেই বাকি সব ব্যবস্থা তিনি করিতে পারিবেন। এ ব্যাপারে আর কোন সন্দিহান রহিল না।
শেলী এই পর্যন্ত বলিয়া রুনার দিকে চাহিয়া এক্তা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আমাদের কষ্টের দিনগুলির সমাপ্তি হইলো, আমাদেরকে সাহাজ্য করার একজন মানব উপস্থিত হইলেন, আর কোনো সমস্যা রইলনা। গল্পটা এইখানে শেষ হইয়া গেলেই ভালো হইতো। কিন্তু গল্পটা আসলে এইখান থেকেই শুরু।
সাগর সাহেব আমার মাকে কিছু উপার্জনের রাস্তা বাহির করিয়া দিলেন। আমার মা হাতের কাজ জানিতেন বলিয়া কয়েকটি শেলাই মেশিন কিনিয়া দিলেন, বাড়িতে কয়েকটা গাভী কিনিয়া দিলেন যেনো আমরা সবাই মাঝে মাঝে দুধ খাইতে পারি। সবাই ছাত্র তাই তিনি ভাবিলেন আমাদের পুষ্টিকর খাবারের দরকার। আর প্রতি মাসে একটা অনুদানের ব্যবস্থাও করিয়া দিলেন। আমার মা অনুদানের ব্যবস্থাটা গ্রহন করিতে চাহিলেন না, কয়েকটা শেলাই মেশিন আর গাভীর ব্যাপারটাতেই আমাদের সংসার চালাইয়া নিতে পারিবেন বলিয়া আমার মায়ের ধারনা ছিলো কিন্তু সাগর সাহেবের মমতার কোনো কমতি ছিলো না, আর তার এই দানে কিছু কমিয়া যাইবে সেইটাও নয়। ফলে আমার মায়ের অগ্রাজ্য কোনো কাজে আসিলো না।
আমি আমার ভাইবোনদের লইয়া, আমার মাকে লইয়া আমাদের পরাশুনা লইয়া নতুন এক উদ্যমে আবার নতুন করিয়া জীবনের স্বপ্ন দেখিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, এইবার আর এই সুযোগ হারাইলে চলিবে না, সয়ং বিধাতা আমাদের একটা কুলে আনিয়া রাখিয়া গেলেন। শ্রদ্ধায়, বিনয়ে সাগর সাহেবকে আমার দেবতার মত মনে হইতে লাগিল। কচি মন, তার উপর দারিদ্র্যের উপদ্রপ, সব মিলিয়া মনে হইতে লাগিল, পৃথিবীতে ভালোলকের অভাব ঈশ্বর কম রাখেন নাই। তিনি তাহাদেরকে মাইলস্টোনের মতো এমন এমন জায়গায় রাখিয়া দিয়াছেন যেনো কেউ পথ হারাইয়া গেলে ওই মাইলস্টোন দেখিয়া আবার যাত্রা শুরু করা যায়।
এই বলিয়া মা অনেকক্ষন নিরব হইয়া রহিলেন। পারভীনের মা আসিয়া আমার মায়ের নীরবতা ভাঙ্গিয়া জিজ্ঞেস করিল- দিদি, আজ চিলে কুঠিতে বেড়াইতে যাইবেন? এই সময়তায় মা আর পারভীনের মা যতো কাজ কর্মই থাকুক, মা আমাদের বাড়ির ছাদের উপর বসিয়া সন্ধ্যার আগের সূর্যাস্ত দেখেন। আমি আজো জানি না, ওই একই জিনিসের উপর মায়ের কি আকর্ষণ, কি সেই অমোঘ টান যে, আজ পর্যন্ত কখনো আমার মাকে অই সূর্যাস্ত দেখা হয় নাই এমন হইয়াছে। চিলে কোঠায় ছোট এক্তা বেলকনি আছে, তাহার উপর টিনের একটা চাল আছে, বৃষ্টিরদিনে ওই চিলে কোঠায় মা আর পারভিনের মা একা বসে বসে তখন হয়ত সূর্যাস্ত দেখেন না কিন্তু বৃষ্টির শব্দ শুনেন। মানুসের জীবনের অনেক রহস্য আছে যা তাহার একান্ত ব্যক্তিগত। হয়ত ইহা কাহারো কাজে লাগিবে কি লাগিবে না তাহার কিছুই যায় আসে না কিন্তু যাহার এই সম্পদ তিনি হয়ত বুঝিয়া থাকিবেন ইহার ভিতরে কি শান্তি আর কি মহিমা। ঈশ্বর মানুষকে অনেক রহস্য রাখিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন। কাহারো সূর্য ভালো লাগে, কাহারো চন্দ্র ভালো লাগে, কেউ আবার চৈত্রের দুপুর ভালো লাগে আবার কারো শিতের সকাল।
(অসমাপ্ত)...
২১/০৪/২০১৬-নবাবের কবরে একদিন
Categories
হ্যালো নবাব, কেমন আছো তুমি?
দেখো কি অবাক করার কান্ড। কোনোদিন কি কখনো ভেবেছো কিংবা আমিই কি ভেবেছি যে, তোমার মতো একজন নবাবের সামনে আমি এভাবে দাঁড়িয়ে সম্ভাষন করবো? তোমার সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কোন সম্ভাবনাই তো ছিল না। তুমি যখন এই পৃথিবীতে জন্মেছিলে তখন আমার পূর্ব পুরুষেরাও হয়ত জন্মগ্রহন করে নাই। কি করে তাহলে তোমার সাথে আমার দেখা হতো? তারপরেও আজ আমার সঙ্গে তোমার দেখা হলো। আমি দাড়িয়ে আছি ঠিক তোমার পাশে, তুমি শুয়ে আছ একদম একা, যদিও সেটা একটা কবর। তোমাকে একা পাবো এবং তোমার মত মানুষের সাথে একা দেখা করা যায় এটা আমার কেন এই ভারতবর্ষের কোন জনগনই তো বিশ্বাস করবে না। তোমার রানী(দের) যেখানে তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য অনুমতি লাগতো সেখানে আমরা কোন ছাড়! কিন্তু দেখো, অদৃশ্য বিধাতার কি ক্ষমতা, তিনি সব পারেন। তাও আবার প্রায় চারশত বছর পর আমার সঙ্গে তোমার দেখা। আমি জীবিত আর তুমি মৃত। জীব-মৃতের এই খেলা শুধু একজনই পারেন, আর সেটা বিধাতা। তাঁর কাছে সময় যেমন স্থবির, জীবন ও স্থবির। জীবিত আর মৃতের মাঝখানে তিনি শুধু ফারাক রাখেন অদৃশ্য কোনো এক জাল, যা আমরা চোখে দেখি না, কিন্তু শেষে এক জায়গাতেই মিলিত করেন।
যাক সে কথা, ঈশ্বরের ক্ষমতা নিয়ে আমি তোমাকে কোনো প্রশ্ন করতে চাই না, না তোমার কাছে এর কোনো উত্তর আছে। যেহেতু তোমার সঙ্গে আমার আজ দেখা হয়েই গেলো, আমার কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল তোমাকে নবাব। তোমাকে সব কিছুর উত্তর দিতে হবে এমন কোন কারন নাই, কারন তুমি নবাব, অনেক কিছু তুমি আমাদের মত সাধারন মানুষকে নাও জানাতে পার। তবুও যদি সম্ভব হয় শুনতে পারলে হয়ত ভাল লাগবে।
আমি তোমাদের আমলের সেই উপমহাদেশের রাজনীতি বুঝি না, কিভাবে দেশ চালাতে হয়, তাও আবার উপমহাদেশের মত একটি সাম্রাজ্য, তারও কোন আইডিয়া আমার নাই। তারপরেও আমি খুব অবাক হই কি করে তুমি এতবড় একটা উপমহাদেশ তুমি তোমার নিয়ন্ত্রনে রেখেছিলে? তুমি কি কোন ক্যাডার বা রাজনৈতিক দলের মত দল করতে যারা তোমার এইসবে সাহাজ্য করতো? তোমার কোন বিরুধী দল ছিলো কি নবাব? তোমার সম্পদের হিসাব আমি জানি না কিন্তু শুনেছি তোমার নাকি অনেক সম্পদ ছিল। তুমি কি কোন ব্যবসা করতে নাকি নবাবীই তোমার পেশা ছিলো? তুমি কি কখনো কোন বেতন নিয়েছো? আর নিলে কত টাকা করে বেতন নিতে? আচ্ছা নবাব, তোমার কি কোন ব্যাংক একাউন্ট ছিল? সুইস ব্যাংক বা বিদেশী কোন ব্যাংক? তোমার কোনো ক্যাশ টাকা পয়সা লাগতো না? রানীরা তোমার কাছ থেকে কখনো ক্যাশ টাকা পয়সা চাইতো না? প্রজারা কি তোমাকে খুব ভালবাসতো? তোমাকে কি কেউ ঘৃণা করতো কখনো? আর কেউ যদি তোমাকে কখনো ঘৃণা করতো, তাহলে তুমি তাকে কি করতে? মেরে ফেলতে? গুম করে ফেলতে? নাকি বিরোধী মতবাদের কারনে তাকে রাজ্য ছাড়া করতে? তোমাদের সময় কি কোন টক শো হতো? সেই টক শো তে কি কেউ বিজ্ঞজনের মতো তোমাকে বা তোমার শাসন কালকে প্রশ্নবিদ্ধ করতো? নাকি সভাসদ পরিষদে তুমিই শুধু একা কথা বলতে? তুমি কি কখনো ভেবেছিলে তুমি একদিন এই পৃথিবীতে থাকবে না? কখনো কি তোমার এই উপলব্দি হয়েছিল যে তোমার মরনের পর তোমাকে নিয়ে জনগন সমালোচনা করবে? কখনো কি ভেবেছিলে যে, তোমার গড়া এই অট্টালিকা, এই সাম্রাজ্য, তোমার চেয়ার, তোমার খাট, তোমার সবকিছু অন্য একজন ব্যবহার করবে আর তুমি অন্য সবার মত এই ভিজা মাটির নিচে স্যতস্যতে জায়গায় কোন এক অন্ধকার পরিবেশে শুয়ে থাকবে? কখনো কি তোমার জীবদ্দশায় এই উপলব্ধিটা হয়েছিল যে, তুমি আর কখনই এই পৃথিবীর আলো বাতাস, গাছ, ফল মুলাদি, আতর সুগন্ধি, রানী রমণী, সোনা দানা, ক্ষমতা, কোন কিছুই উপভোগ করতে পারবে না? এমন কি তুমি আর ফিরেও আসতে পারবে না? এমন কখনো কি তুমি একবারের জন্যও ভেবেছিলে?
তুমি কি এখনো আগের মত দেশি বিদেশী অনেক পানীয়, রাজ্যের সব সুন্দরীদের সমন্নয়ে বাইজীর আসর, শ্বেত পাথরের কিংবা কষ্টি পাথরে গড়া মোজাইক ফ্লোর, সোনার পালঙ্ক, অনেক মহামুল্যবান হিরের আংটি, জহরতের মালা, আর্দালি, পাইক পেয়াদা যে সব তোমার এখানে একসময় ছিল, তা পাও ওখানে নবাব? তোমার আশেপাশে কি তোমার অতি প্রিয় সেনাপতি, মন্ত্রী মহোদয়, উজির নাজির আছে যারা এক সময় তোমার অংগুলীর ইশারায় সারা দেশ কাপিয়ে দিতো? তোমার একা থাকতে এখন কষ্ট হয় না? তোমার কি আবার ফিরে আসতে ইচ্ছে করে তোমার সেই রাজকীয় প্যালেসে কিংবা ঘুমাতে ইচ্ছে করে ঐ সোনার খাটে যা তুমি পারস্য রাজ্য থেকে ছিনিয়ে এনেছিলে একদিন? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে সব।
জানো নবাব, আমার মাঝে মাঝে তোমাকে বেশ বোকা বোকা বলে মনে হয়। তুমি এতকিছু বুঝতে পেরেছিলে, উপমহাদেশ কিভাবে চালাতে হয়, কিভাবে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্য দখল করতে হয়, কেমন করে বিনা ব্যবসায় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নিজের করে নিতে হয়, অমর হয়ে থাকার জন্য কত বিশাল বিশাল প্যালেস বানাতে হয় কিন্তু তোমার মরনের পর তোমাকে কে দেখভাল করবে, তোমার এই সিংহাসনে যেন কেউ না বসতে পারে, শুধু তোমার আদেশই যেন আজিবন চলে, সেই ব্যবস্থাটা কেন করে যেতে পারলে না নবাব? বিধাতার দেওয়া ধর্ম পাল্টে তুমি ‘দ্বীনে এলাহি’ও করে ফেললে, কোন পরোয়া করলে না। তুমি তোমাকে তাঁর সমকক্ষ ভাবতে পারলে, অথচ তুমি তাঁরসঙ্গে আরও একটু সমঝোতা করলেই কিন্তু তুমি অনেক কিছু করতে পারতে। এটা কিন্তু তুমি বোকামী করেছো।
নবাব থাকা অবস্থায়ন ন্যায় অন্যায়, সৎ অসৎ কোনো কিছুই পরোয়া করলে না, এর মধ্যে কোন ব্যবধান করলে না, মানবাধিকার, ভদ্রতা, সৌজন্যতা, বিচার-অবিচারের মধ্যে তুমি কিছুই ফারাক করলে না, তোমার যা ইচ্ছে তাই তুমি করতে পারলে কিন্তু তুমি কি একবারো ঐ অদৃশ্য বিধাতে কিছু ঘুস দিয়ে তুমি অমরত্ব নিতে পারলে না নবাব? তোমার তো কোন কিছুরই কমতি ছিল না। কি হত যদি উপমহাদেশের কিছু জায়গা, জমি, অথবা সোনা দানা, জহরত, হিরা, সুন্দরি রমণী দিয়ে ঐ অদৃশ্য ভগবানকে বশ করতে? তাহলেই তো তুমি আজ বেচে থাকতে পারতে, তোমার সঙ্গে আজ আমার সরাসরি জীবন্ত শরীরে দেখা হতো।
আচ্ছা নবাব, তুমি তো প্রায় চারশত বছর আগে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছো। তুমি দেখতে কি এখনো আগের মত আছো? তোমার গলায়, তোমার হাতে যেসব সোনাদানা হীরা জহরত ছিল সেগুলি কি তোমার সেনাপতিরা, তোমার উপদেষ্টারা তোমার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলো? তুমি কি ওগুলো এখনো হাতে গলায় মাথায় পড়ে থাকো? নাকি খুলে রেখেছো? কোথায় রেখেছো এখন এগুলো? তুমি কি আরও বৃদ্ধ হয়েছো? নাকি যেহেতু কোন টেনশন নাই, ফলে তুমি আরও সুন্দর হয়েছো? তোমার সেনাপতিরা, তোমার সুন্দুরি রমণীরা তোমার অসংখ্য ছেলেপুলেরা, নাতি নাতকুরেয়াও আজ অনেকেই এই পৃথিবী থেকে চলে গেছে যাদেরকে তুমি খুব ভালবাসতে। তোমার সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে? শুনেছি, মানুষ মরার পরে নাকি কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর সারা শরীর পচন ধরে, পোকারা খেয়ে বিনাশ করে শরীর, তারপর ধীরে ধীরে হাড়ও মাটির সাথে মিশে যায়। মাথার খুলিটা কেউ দেখলে এটাও বুঝা যায় না, সে কি রাজা ছিলো নাকি প্রজা? নাকি মহিলা অথবা পুরুষ? তোমারো কি একই হাল হয়েছে নবাব? নাকি তুমি অনেক শক্তিশালী ছিলে বলে পোকারাও তোমাকে বিনাশ করতে পারে নাই?
জানো নবাব, আমি মাঝে মাঝে খুব অবাক হই এই ভেবে যে, তোমার অনেক বংশধরেরা কিন্তু এখনো এই পৃথিবীতে বেচে আছে। কিন্তু কে কোথায় কিভাবে বেচে আছে তাদের কোন হিসাবও আমরা জানি না। আর তারাও যে কেনো বলে বেড়ায় না যে তারা নবাবের বংশের লোক! কেনো নবাব? কি জানি হয়ত তোমার বংশের লোক বলে জানাজানি হয় গেলে না জানি আবার কি বিপদ হতে পারে এই ভেবে হয়ত বলে না। হয়ত এমনও হতে পারে, তুমি জনগনের উপর টর্চার করেছো এই অভিযোগে তারা এখন তোমার বংশের উপর খুব রাগান্বিত, হয়ত এমনো হতে পারে যে তোমার অবিচার, অন্যায়, মানবাধিকার লঙ্ঘন, তোমার বেহিসাবি খরচের তালিকা ইত্যাদির কৈফিয়ত তারা দিতে পারবে না বলেই এখন নিসচুপ জীবন বেছে নিয়েছে। আবার এমনও হতে পারে তোমার অন্তর্ধানের পর তোমার এই বিশাল সাম্রাজ্য ধরে না রাখার কারনে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় অগোচরে থাকাই ভাল এই যুক্তিতে প্রকাশিত হয় না, আবার এমনও হতে পারে আসলেই কেউ আর বেচে নেই তারা। বড় অবাক লাগে যে, এককালের এতো প্রতাপশালী নবাবেরা এভাবেই বংশসহ হারিয়ে যায় এই পৃথিবীর বুক থেকে। ওদের শুধু ইতিহাস বেচে থাকে কিন্তু বংশ বেচে থাকে না। অথচ তোমার আশেপাশে যারা ছিল তাদের অনেকের বংশধরেরা এখন অনেক বড় লোক, কেউ আবার রাজনীতি করে, কেউ বড় বড় ব্যবসায়ী, ওদের অনেক টাকা, সুইস ব্যাংকে, বিদেশী ব্যাংকে, আরও অনেক দেশের ব্যাংকে। ওরা এক দেশের সরকারের আরেক দেশের সরকারের সঙ্গে বসে গল্প করে, তাস খেলে, মদ খায়, ফুর্তি করে, আরও কত কিছু? কিন্তু তোমার বংশের কোন লোককেই আমি চিনি না নামও জানি না আদৌ ওরা কেউ আছে না নাই।
যাক, নবাব, আমাকে এখানে অনেক সময় থাকতে দিবে না কারন তুমি নবাব, তোমার পাশে অনেক্ষন দাড়াতেও আমাকে দিবে না। আবার কখনো যদি তোমার এখানে আমার আসা হয়, তোমার সঙ্গে আমার আবার কথা হবে, যদি পারো আমাকে একটু জবাবগুলো দিও।
তুমি ভাল থাকো নবাব।
০৭/০৪/২০১৬ ফাঁসি
Categories
রাত প্রায় বারোটা। ঘরের কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলিতেই দেখিলাম ১৭-১৮ বয়সের একটি মেয়ে, কাঁধে একটা ঝুলানো ব্যাগ লইয়া দরজার সামনে দাঁড়াইয়া আছে। তাহাকে আমি চিনি না কিন্তু কোথায় যেন তাহাকে দেখিয়াছি আমার ঠিক মনে পরিতেছে না, আবার তাহাকে আমার অপরিচিত বলিয়াও মনে হইলো না। বাসায় কেউ নাই, আমার মেয়েরা তাহাদের খালার বাসায় মানিকগঞ্জে বেড়াইতে গিয়াছে, সঙ্গে তাহাদের মাও আছেন, আমার অফিসে অনেক কাজ জমা হইয়া গিয়াছিল বলিয়া রাত জাগিয়া জাগিয়া গুটিকতক কাজ শেষ করিতে হইতেছে। তাই আমার পরিবারের সঙ্গে আমার আর বেড়াইতে যাওয়া হয় নাই। ছেলেপুলে আর ঘিন্নি ছাড়া আমার কোনো কিছুই চলেনা। তাহাদের অবর্তমানে আমার এই সময়টা আমি হারে হারে টের পাই। আমি অলস মানুষের মধ্যে একজন। একগ্লাস পানি খাইতেও তাহাদের প্রয়োজন পড়ে। ঘরের মধ্যে যখন ওরা থাকে তখন তাহাদের উপস্থিতি টের পাইনা কিন্তু তাহারা যখন থাকেনা তখন তাহাদের অনুপস্থিতি খুব নজরে আসে বইকি। বাসায় কেহ আসিলে সাধারনত আমার গিন্নিই দরজা খোলার কাজটি করিয়া থাকেন। বাসায় যতো কর্মীবাহিনী আসে, কেহ তাহার রান্নার বুয়া, কেহ আবার পাশের বাসার গিন্নি, কেহ আবার আমাদের ভাড়াটিয়ার মধ্যে একজন ইত্যাদি। হয়ত সময়মতো ভাড়া পরিশোধ করিতে পারিবেন না বলিয়া একটু আবদার, কেহ আবার দান দক্ষিনার জন্য আসে, এইসব। ফলে আমি সবাইকে চিনিও না আর তাহা জানার আমার কোন প্রয়োজনও মনে করি না। আজ তাহারা কেহ বাসায় নাই, তাই আমাকেই এই কর্মটি করিতে হইতেছে।
রাত এগারোটা বাজিলেই আমার গিন্নি ঘরের সব দরজা বন্ধ করিয়া, জানালার পর্দাসমুহ একেবারে আঁটসাঁট করিয়া লাগাইয়া দিয়া, ঘরের যাবতীয় ছিটকানি বন্ধ করিয়া তাহার পর কি যেনো একটা দোয়া পড়িয়া হাতে তিনখান হাততালি দিয়া সম্পূর্ণ ঘরটাকে নিরাপদ করিয়া তাহার পর শুইতে যায়। গিন্নি না থাকিলে আমাকে অবশ্য দোয়াদরূদ পড়িতে বলেনা কিন্তু ঘরের ছিটকানীসমুহ ভালো করিয়া লাগাইয়া যেনো ঘুমাইতে যাই, সেই নির্দেশাবলী দিতে কখনই ভুলিয়া যায়না। আর যদি ছিটকানি লাগাইতে ভুলিয়া যাই, সেইজন্য আগেভাগেই ঘরের স্বয়ংক্রিয় তালাখানা যেনো লাগাইতে ভুলিয়া না যাই তাহা নিশ্চিত করিয়া তারপর ফোন রাখেন। সে জানে আমি অলস মানুষ, তাই মাঝে মাঝে মনে করাইয়াও দেয়। কারন ভুলিয়া যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অন্তত এইদিক দিয়া আমার উপর তাহার আত্মবিশ্বাস একেবারেই নাই, ভরষা তো নাইই।
দরজা খুলিয়া অপরিচিত এই অল্প বয়সের মেয়েটিকে দেখিয়া দরজার পাশে দাঁড়াইয়াই জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কাকে চাই?’
আমি প্রশ্ন করিলেও মেয়েটি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়া ঘটঘট করিয়া খোলা দরজা দিয়া আমার ঘরে প্রবেশ করিল। আমি অগত্যা কিছু না বলিয়া অদুরে ডাইনিং চেয়ারটা টানিয়া দিয়া বলিলাম, তুমি কি আমাদেরকে চিনো বা আমি তোমাকে চিনি?
মেয়েটি হ্যাঁ বা না কোনো উত্তর না দিয়া আমাদের ঘরের চারিদিকে যে কয়টা ছবি ফ্রেমে টাঙ্গানো ছিলো তা দেখিতে থাকিল। ব্যাপারটা যেনো এমন, আহা- কতদিন এই ছবি গুলি দেখা হয় নাই কিংবা এমন যে, আহা, ওই ছবিটা এখানে কেনো ইত্যাদি। আমি তাহার ছবি দেখার ভঙ্গি দেখিয়া কিছু প্রশ্নের আশা করিতেছিলাম বটে কিন্তু সে ইহার কোনো কিছুই বলিলো না। ছবি দেখা হইয়া গেলে, বেশ খানিক্ষন পর মেয়েটি নিজেই ডাইনিং চেয়ারে আসিয়া বসিল এবং টেবিলের উপর রাখা এক যগ পানি হইতে এক গ্লাস পানি ঢালিয়া লইয়া ঢকঢক করিয়া পান করিয়া ঠাস করিয়া হাতের গ্লাসখানি টেবিলে শব্দ করিয়া নামাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস এমন করিয়া ছাড়িলো যেনো পানি খাইতে গিয়া তাহার অনেক পরিশ্রম হইয়াছে অথবা কতজনম ধরিয়া যেনো পানির আশায় বুক ধরফর করিতেছিলো।
– না, আমি আপনাকে চিনি না, কিন্তু আপনি হয়তবা আমাকে চিনিতে পারেন। আসলে আমাকে এখন অনেকেই চিনে, পুরু কাহিনি বলিলে হয়ত আপনিও আমাকে চিনিতে পারিবেন। এই পথ দিয়া যাইতেছিলাম, অনেকরাত, কোথাও কেহ জাগিয়া নাই, দেখিলাম আপনার ঘরে আলো জ্বলিতেছে, তাই এখানে আসা। আমি আপনার কোনো ডিস্টার্ব করিবার মতলবে আসি নাই। কিংবা আপনার কোন ক্ষতিও করিতে আসি নাই। আপনি বিরক্ত হইতেছেন কি? আর ডিস্টার্ব হইলেইবা কি, এখন তো ভিতরে চলিয়াই আসিয়াছি। একনাগাড়ে এতগুলি কথা বলিয়া মেয়েটি আবার আরেক গ্লাস পানি ঢগঢগ করিয়া পান করিয়া লইলো।
কি তাজ্জব ব্যাপার। চিনি না, জানি না, কি কারনে আসিলো, তাও আবার এতোরাতে। আমি একটু নড়িয়া চড়িয়া বসিলাম আর বলিলাম, পুরু কাহিনীটা কি তাহলে? আমিও জানার জন্য উৎসুক হইয়া বলিলাম। আর এতোরাতেই বা তুমি কাহার সাথে কি কারনে বাহির হইলে, আর তোমার পিতামাতাই বা কি রকম যে, এইরকম একটা যুবতী মেয়েকে রাত গভীরে ঘর হইতে বাহির হইবার দয়া করিলেন?
-আরে সাহেব, ভয় পাইতেছেন নাকি? ভয়ের কোনো কারন নাই। আমার নাম শিমা। নিশ্চয় এই নামটা আপনার শুনিবার কথা। ঐ যে মেয়েটি, যে তাহার বাবামাকে রাতের আধারে একসঙ্গে খুন করিয়াছিল? পরেরদিন বড় বড় করিয়া দেশের সব কয়টা পত্রিকায় তাহার লোমহর্ষক গল্প লিখিয়া নাম প্রকাশ হইয়াছিল। আপনি পড়েন নাই সে খবর? যাইহোক, আমি আপনাকে খুন করিতে আসি নাই।
নামটা শুনিয়াই যেনো আমার গলা পর্যন্ত শুকাইয়া গেল। শরিরের শিরায় শিরায় যেন বিদ্যুতের মত এক অনুভূতি খেলিয়া গেলো আর পশমের যে কয়জায়গায় অনুভূতি আঘাত করিতে পারিল না, সব কয়টাই যেন খাড়া হইয়া আমাকে এই সংবাদ দিয়া গেল, কেন তুমি না জানিয়া এমন একটি মেয়েকে তোমার ঘরে ঢুকিতে দিলে? তুমি তো আর পুলিশের ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চে কাজ করোনা যে, এখন একটা ফোন করিলেই তোমার সাহায্যের জন্য গোটাবিশেক পুলিশ আসিয়া তোমাকে উদ্ধার করিবে। নিজেকে একটু আহাম্মক বলিয়া মনে হইতে লাগিল। কিন্তু পরক্ষনেই আবার মনে হইল, আচ্ছা ওতো আর পিস্তল, ছুড়ি লইয়া আসে নাই যে, আমাকে খুন করিয়া ফেলিবে, আমার সঙ্গে ওতো জোরেও পারিবেনা, আবার আমার আশেপাশে আরও লোকজন তো আছে, বিপদ দেখিলে গলা ফাটাইয়া চিৎকার দিলেইতো আর কোন অসুবিধা নাই। পুলিশ না আসুক, অন্তত কিছু মানুষজন তো আসিবেই। মনে একটু বল সঞ্চার হইল।
-তোমার না ফাঁসির আদেশ হইয়াছে? তাহা হইলে তুমি এইভাবে এতরাতে কেমন করিয়া ঘোরাফেরা করিতে পারিতেছ? তুমি কি জেল হইতে পালাইয়া আসিয়াছো? দেখ শিমা, তুমি এখানে আসিয়া আমাকে কোন বিপদের মধ্যে ফেলিবার কোন পরিকল্পনা করিতেছো না তো?
মেয়েটি, যেন মজার একটা কথা বলিলাম, এইভাব করিয়া অট্টহাসিতে লুটাইয়া পরিবার উপক্রম হইলো। ঘরের ভিতর তখন রবিন্দ্রসঙ্গিত বাজিতেছিল… মম চিত্তে … কেযে নাচে তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ… কিন্তু তাহার অট্টহাসিতে রবীঠাকুরের গানের কলিগুলি যেনো গুরুম গুরুম শব্দে কি এক অদ্ভুত আওয়াজে ঘরের চারিদিকে বিহব্বল বাতাশের মতো ঘূর্ণিপাক খাইয়া প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করিলো। তাহাতে আর যাই হোক, চিত্ত নাচিবার কোনো কারন দেখিতেছি না। বরং এক অজানা ভয়ে চিত্ত শুকাইতেছিলো। ইহার পরে আবার আরেক অজানা ভয় ঢোকিতেছিলো যে, এতোরাতে আমার স্ত্রীর অবর্তমানে আমার ঘরে একজন মেয়েলী কণ্ঠে হাসির তামাশা আমাকে আরো শঙ্কায় ফেলিয়া দিলো। আমি ভদ্রমানুষ, সমাজে আমার নামডাক আছে, আমি সমাজের একজন ক্লিন মানুষের মধ্যে একজন। এই এতো রাতে আমার বাসায় কোনো এক অপরিচিত যুবতি মেয়ের প্রবেশ কোনোভাবেই আমি ব্যখ্যা করিতে পারিবো না। অন্তত আমার বউ, আমার পরিবার-পরিজন বিশ্বাস করিলেও অন্য কেউ ইহা সহজে বিশ্বাস করিবে তাহার কোন যুক্তি আমি খুজিয়া পাইতেছিলাম না। শঙ্কায় পড়িয়া আমি মেয়েটিকে একটু শান্ত হইয়া বসিয়া তাহার যাহা বলিবার তাহা যেনো কণ্ঠ সংযত করিয়া বলিতে থাকে সেই অনুরোধ করিলাম। এতো অট্টহাসি দিয়া আমার ঘরের লক্ষ্মী পরিবেশকে সংকিত করিতে মানা করিয়া বলিলাম। অনেকটা আদরের সহিতই বলিলাম, “মা তুমি আমার মেয়ের বয়সের সমান, আমি অপদস্থ হই, এমন কোনো প্রতিক্রিয়া করিও না।”
-আরেনা বাপু, এতো অস্থির হইবার কোনো কারন নাই। আর আমাকে কেউ জেলখানা হইতে বাহির হইতে দেখেও নাই আবার সকাল না হইতেই আমি আবার আমার কন্ডেমসেলে ঢুকিয়া পরিব। তোমার কোন ভয় নাই। আমি মাঝে মাঝেই এই রকম রাতে বাহির হইয়া থাকি। আজই প্রথম নয়। কয়দিনই বা আর এই পৃথিবীতে বাঁচিবো বলো, এত ভয় করিবার তো কোন কারন দেখিনা। জেলেই তো আছি, জেলের আবার ভয় কিসের? তবে আমার ফাঁসি হওয়াতে আমার মনের অনেক কষ্ট লাঘব হইয়াছে বলিয়া আমি মাঝে মাঝে মনের আনন্দে ঘুরিয়া বেড়াইতে পারিতেছি। অন্তত একটা সুরাহা তো হইয়াছে। পাপীর তো শাস্তি হইয়াছে।
মেয়েটি আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধন না করিয়া সরাসরি ‘তুমি’ এবং এমনভাবে ‘বাপু’ শব্দটি উচ্চারন করিলো যেনো হটাত করিয়া আমার বুকের কোনো এক জায়গায় একটি মানবিক সম্পর্ক টানিয়া আনিয়া জোড়া লাগাইয়া দিলো। মনে হইলো, আমি বুঝি সত্যিই তাহার ‘বাপু’। অন্তরে একটা শীতলপরশ একঝলকের জন্য বিদ্যুতের ন্যায় আচমকা একটা সাড়া দিয়া নড়িয়া উঠিল। আমি মেয়েটির দিকে অনেক্ষন চাহিয়া থাকিলাম, যেনো কোনো এক সুদূর অচেনা এক দেশ হইতে মেঘের ভেলায় ভাসিয়া আসিয়া আমাকে একখন্ড শিক্ত জলে ভিজাইয়া দিলো। তাহাকে এখন আর আমার আগের মুহূর্তের মতো ভয়ঙ্কর এবং অস্বাভাবিক মনে হইলো না। মনে হইল মেয়েটি আমার পরিবারের যেনো কেহ।
-তোমার ফাঁসি হইয়াছে এই খবরে তুমি এতো আনন্দিত কেন?
শিমা এইবার আর হাসিলো না। অনেকক্ষন চুপচাপ থাকিয়া তাহার ছোট গালের দুইপাশে তাহার দুইহাত ঠেস দিয়া কাধের ব্যাগখানি টেবিলের উপর রাখিয়া আমার চোখের দিকে তাকাইয়া প্রশ্ন করিলঃ তুমি কি কখনো কোন ফাঁসির আসামীর সঙ্গে ফাঁসীর আগের রাতে গল্প করিয়াছো?
-আমি বলিলাম, না, সে সুযোগ আমার আসে নাই। তবে জানিতে অনেকবার মন চাহিয়াছিল তাহাদের মনের অবস্থা কি, জীবন সম্পর্কে তাহাদের উপলব্ধি কি, কিংবা তাহার ওই সময়ের ভাবনা কি, কি নিয়ে তাহারা কিভাবে কি ভাবে বা কাউকে কি কোন কিছু বলিয়া যাইতে ইচ্ছা করে কিনা ইত্যাদি। অথবা এমন কোনো ভাবনা কি আসে, আহা যদি আরেকবার সুযোগ আর স্বাধীনতা পাইতাম, তাহা হইলে ফাসি হয় এমন কোনো কাজ আমি করিবো না, অথবা, আহা এমন কি কোন জায়গা আছে, যেখানে আমি লুকাইয়া গেলে আমাকে আর কেহই খুজিয়া পাইবে না? ফাসি হইবে না?
– তাহা তো ঠিকই। যুগেযুগে প্রতিদিনই তো আর ফাঁসির কাজটা হয়না যে, আজকে সুযোগ পাইলাম না বলিয়া আগামিকালের ফাঁসিটায় তা উপভোগ করা যাইবে। এইটাতো আর পুকুরপাড়ে গিয়া বরশি দিয়া মাছ ধরিবার মতো ঘটনা না যে, আজ পাইলাম না তো কাল পাইয়াই যাইবো। আর পাইয়া গেলে ওই ধরাশায়ী মাছকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়া লইবো, সে পানির ভিতরে কিভাবে সাতার কাটিতে কাটিতে হটাত করিয়া মানবের বরশির ফাঁদে পা দিয়া তাহার অনবদ্য জলীয় জীবন হইতে এক নিমিষে স্থলের মুক্ত বাতাসে আসিয়া প্রানবিনাস করিয়া পগারপার হইয়া গেলো। মৎস্যদের সাহিত্যক কেহ থাকিলে হয়তো তাহার কোন এক কাব্যগ্রন্থে লিখিত, “স্থলের মুক্ত বাতাস শুধু প্রানের জীবনীশক্তিই জোগায় না, ইহা কখনো কখনো কিছু কিছু প্রানীর প্রানেরনাশের কারনও হইয়া দাড়ায়”।
মেয়েটি অনেক সুন্দর করিয়া গুছাইয়া কথা বলিতে পারে বুঝিতে পারিলাম। “স্থলের মুক্তবাতাস শুধু প্রানের জীবনিশক্তিই জোগায় না, ইহা কখনো কখনো প্রাননাশের কারনও হইয়া থাকে” কথাটা আমার খুব মনে ধরিলো। সে কি মনে করিয়া এই রকম একটা তত্ত্ব কথা বলিলো তা আমার বোধগম্য হইলো না, তবে বাচিয়া থাকিবার জন্য যাহার যেখানে যাহা প্রয়োজন, সে তাহাই সম্ভবত বুঝাইয়া দিলো। আমি এতোক্ষন অফিসের জটিল একটা একাউন্টিং নিয়া কাজ করিতেছিলাম কিন্তু এই মেয়েটি আসিয়া এখন আমাকে আরো জটিল সময়ের মধ্যে ফেলিয়া দিলো বলিয়া আমার মনে হইতে লাগিলো। কিন্তু খারাপ লাগিতেছিলো না। তাই, অফিসের কাজ একপাশে রাখিয়া তাহার সাথে গল্প করিতেই মন চাইলো।
আমি এইবার তাহাকে কিছু খাইবে কিনা জিজ্ঞাসা করিতেই বলিয়া উঠিল যে, “জেলখানায় না গেলে সে বুঝিতে পারিতো না, চার দেওয়ালের ভিতরেও কতো ধরনের নীতি আর কত আকারের দুর্নীতি রহিয়াছে। যাহাদের টাকা আছে, তাহাদের জন্য নীতি এক রকমের, যাহারা বিখ্যাত, তাহাদের জন্য পলিসি আরেক রকমের, যাহাদের কেউ নাই, তাহারা তো কোনো প্রানিকুলের মধ্যেই গন্য হয়না। যাকগে সেইসব কথা, তোমরা থাকিবে এই পৃথিবীতে, যেইভাবে তোমরা আরাম আয়েশ করিতে চাও, সেইভাবেই পলিসি করো কিংবা নীতি পাল্টাও তাহাতে আমারই কি আর আমি বা কে তাহার বিরুদ্ধে নালিশ করিবার? আমি ভালো খাইতে পারিতেছি, আমার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা আছে, ইহাতেই আমি খুশি। এই যেমন, আজ আমি খাইয়াছি ইলিশের তরকারী, ঘনডালের চর্চরী, সঙ্গে ডিমের হালুয়া। খাওয়ার পর আবার আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলো, আমি আরো কিছু খাইতে চাহি কিনা। আমি আইসক্রিম খাইতে খুব পছন্দ করি, বলিতেই দেখি, একটু পরে খুব মজার আইসক্রিম চলিয়া আসিলো। আমি তো ভালোই আছি। একটা জিনিস জানো? কোরবানীর পশুকে তাহাদের মালিক কোরবানী করিবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত অনেক আদর যত্ন করিয়া, ভালো ভালো খাবার খাওয়াইয়া, গোসলপাতি করাইয়া ঠিক সময়মত তাহাকে হুজুর কিংবা পাগড়ীপরা মুসুল্লী দিয়া গলায় ছুরি দিয়া একনিমিষে কতল করিয়া দেয়। আমি হয়তবা সেই রকমের একজন কোরবানীর পশুর গননায় আছি। কোরবানীর পশুকে জবাই করিতে কাহারো হৃদয়ে কোন কম্পন সৃষ্টি হয়না। বরং দল বাধিয়া ছোট ছোট ছেলেমেয়েসহ সব মুরুব্বীরা ঈশ্বরের নাম জপিতে জপিতে তাহাকে প্রানে মারিয়া ফেলে।
আমি একটা সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিলাম, তুমি কি সিগারেট খাও?
-দাও একটা। খাওয়ার অভ্যাস তো ছিলোই, জেলে যাওয়ার পর আর খাইতে পারি নাই। আমি বুঝি না, জেলের মানুষগুলি যাহা চাই, তাহাই আমাকে দেয় কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাকে একটা সিগারেটও দিলো না। অথচ নেশার জগতের সবচেয়ে বড় আভাসভুমি হচ্ছে জেলখানা। দল বাধিয়া সবাই নেশা করে। ঐখানে নেশা করিবার কারনে পুলিশ কখনো কাউকে গ্রেফতার করে না। অবশ্য আমি কখনো সিগারেট চাইও নাই।
শিমা আমার সিগারেটের প্যাকেট হইতে একটা সিগারেট লইয়া আগুন ধরাইয়া একমুখ ধোয়া পুরা রুমের ভিতর ছড়াইয়া দিয়া একটা হাসি দিয়া বলিল- আহ কতোদিন পর এমন করিয়া সিগারেট ফুকি নাই। হয়ত এই সিগারেটের জন্যই তোমাকে আমার মনে থাকিবে। আমার আর মনে থাকিবে কি, আমি তো মরিয়াই যাইবো, বরং মনে থাকিবে তোমার। ওই একই হইলো। তুমি আমাকে মনে রাখিবে না আমি তোমাকে মনে রাখিবো, ইহাতে কোনো কিছুই পরিবর্তন হইবে না। না পরিবর্তন হইবে তোমার অফিসের কাজের, না সমাজের, না অন্য কাহারো। এই পরিবরতনের সাথে আমাদের প্রিথিবী অনেক পরিচিত। ইহাকে আমাদের এই পৃথিবী সাধারন ঘটনার মধ্যে গন্য করিয়াই তাহার মনুস্যকুলকে এক প্রজন্ম হইতে আরেক প্রজন্মে লইয়া যায়। ইহাকেই হয়ত আমরা ইতিহাস বলিয়া চালাইয়া দেই।
এতোক্ষন আমি যেই ভয়টা পাইতেছিলাম, সেই ভয়টা এখন আর নাই। মনে হইতেছিলো শিমা আমার পরিচিত কেউ। বলিলাম, তোমার জেলের ভিতরের অভিজ্ঞতা, ফাঁসির খবরে তোমার প্রতিক্রিয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি বলো তো দেখি শুনি।
-আচ্ছা, তোমার বাসায় কি কফি আছে? খুব কফি খাইতে ইচ্ছা করিতেছে। এই বলিয়া শিমা নিজেই আমাদের রান্না ঘরের ভিতরে ঢূকিয়া গ্যাসের চুলা জ্বালাইয়া দুইকাপ ব্ল্যাক কফি বানাইয়া এককাপ আমাকে আর এককাপ সে নিজের জন্য রাখিয়া গল্প করিতে আরম্ভ করিলো।
-গল্পটা শুরু কবে হইতে শুরু হইয়াছিলো তাহা আমার জানা নাই। তবে আমার জীবনে আদর আর আহ্লাদের কোন কমতি ছিলো না। যখন যাহা চাহিয়াছি, তখনই তাহা আমি আমার মতো করিয়া পাইয়াছি। সুখেই দিনগুলি কাটিতেছিলো। সচ্ছল পরিবার, ছোট পরিবার। খুব একটা বিড়ম্বনা নাই। বন্ধুবান্ধব যাহারা ছিলো, তাহারাও আমার অবস্থা বুঝিয়া মানিয়া চলিতো। লেখাপড়া করিতেছিলাম কিন্তু খুব ভালো লাগিতেছিলো না। বাবা সরকারী চাকুরী করেন কিন্তু সময় যতোটা পাইতেন, তাহা হইতে বেশি বাহিরে থাকিতে পছন্দ করিতেন। মা গৃহিণী মানুষ, অতো চালাক চতুর নহেন, সামান্যতেই তিনি সুখি। আমাদের যত্ন আদিতে তাহার কোন কমতি ছিল না। তারপরেও আমার মাকে মনে হইতো তিনি সংসারে একা। কখনো কখনো আমার মা আমার বাবার সাথে কথা কাটাকাটি করিতো বটে কিন্তু মা ইচ্ছা করিয়াই হারিয়া যাইতেন। সংসারের শান্তি থাকুক এই ভাবিয়াই চুপ থাকিতেন। তাহার সাধ আহ্লাদের মধ্যে যাহা ছিলো তা নিতান্তই কয়েকটা টিভি সিরিয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মাকে আমি খুব ভালোবাসিতাম কিন্তু মায়ের এই কম্প্রোমাইজের গুনটি আমি কখনোই মানিয়া লইতে পারিতাম না। ফলে, বাবার সাথে আমার প্রায়ই খিটখিটে ঝগড়া লাগিয়া থাকিতো। বাবাও আমাকে ভালোবাসিতেন বটে কিন্তু আমার পড়াশুনা লইয়া, আমার আচার আচরনে তিনি মাঝে মাঝে এতোই বাড়াবাড়ি করিতেন যে, মনে হইতো এই লোকটি আমার অপছন্দের তালিকায় শীর্ষে রহিয়াছেন কিন্তু তাহাকে তাহা আমি বুঝাইতে চাহি নাই।
এইভাবেই আমার দিনগুলি কাটিয়া যাইতেছিলো। মাঝে মাঝে বন্ধুদের বাসায় বিশেষ বিশেষ উৎসবের বাহানায় আমি বাসার বাহিরে থাকিতে পছন্দ করিতাম, নাইট ক্লাবে ঘুরিতাম, অনেকরাত পর্যন্ত আড্ডা দিতাম। আমার মা কিছু বুঝিতে পারিলেও খুব একটা উচ্চবাচ্য করিতেন না। করিলে আবার খামাখা সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয় এইভয়ে বাবাকেও মা খুব একটা কানে দিতেন না। বিশেষ করে আমার নেশা করিবার ব্যাপারটা তো তিনি বেমালুম চাপিয়া থাকিতেন। মা আমার অনেকদিন অনেকভাবে একা গায়ে হাত বুলাইয়া, আদর করিয়া, মা-সোনা বলিয়া নেশা না করিবার জন্য অনেক জ্ঞ্যানদান করিতেন কিন্তু নেশা এমন এক জিনিস, একবার শুরু করিলে, শেষে নেশাই তোমাকে টানিয়া লইয়া যাইবে। ঐখান হইতে আর বাহির হইবার জোগার থাকে না। মা আরো বলিতেন- নেশা একটা মনের আনন্দ। নেশায় মন এমন এক জায়গায় চলিয়া যায় যেখানে কোনো বাধা নাই। যেনো শুধু স্বাধীনতা আর স্বাধীনতা। বড় শহরের অনেক অন্ধকার গলিতে যেমন প্রতিরাতে একটা নেশার জগত গড়িয়া উঠে, তেমনি বড় লোকেররা বা তাহাদের সন্তানেরা অন্ধকার গলির বাহিরে আলো ঝক মকে আধুনিক প্রাসাদে সেই নেশার জগত গড়িয়া তোলে। উভয় জায়াগতেই সমাজের অনেক শ্রেনী থেকে অনেক যুবকরা আসিয়া থাকে। তাহার সবাই নিজেদের আত্মীয়স্বজন ছাড়িয়া নিজেদের নেশায় ভাসিয়া থাকে। সভ্য সমাজ এদেরকে দেখিয়াও উপেক্ষা করিয়া যায়। খুব বেশী হইলে হয়তো কেউ কানাঘুষা করে, কিন্তু এদেরকে আটকানো বা শোধরানোর জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয় না। সমাজের এই নীরবতা পরোক্ষভাবে অনেক অপরাধকে আমন্ত্রন জানায়। এই নীরবতার সাথে সাথে আরেকটা সত্যির মুখুমুখি হয় মানুষ, তাঁর নাম অপরাধ। এমন একটা অপরাধ যে, এই নেশয় আধমরা হইয়া থাকা বা উত্তেজিত হইয়া থাকা যুবক যুবতীদের সাথে অন্যান্য সাধারন মানুষেরও প্রান চলিয়া যায়।
আমারো ঠিক তাহাই হইয়াছিলো। আমি প্রায় প্রতিদিন নেশা করিতাম। আমি যে একটা মেয়ে, আমার যে অনেক কিছু লুকাইবার আছে, এইগুলি আমার বিবেক, আমার জ্ঞ্যান আমাকে কখনোই বাধা দেয় নাই, না বাধা শুনিয়াছি আমার মায়ের অথবা ভালো বন্ধু বান্ধবদের। মায়ের বাধা আমার কাছে কোনো বাধাই মনে হইতো না। ফলে নেশারই জয় হইয়াছিলো।
আমি অনেক্ষন ধরিয়া শিমার কথাগুলি শুনিতেছিলাম। এইবার আমি তাহাকে প্রশ্ন করিলাম, ‘আচ্ছা কে তোমাকে এইরুপ সঙ্গ দিতো?’
–অসৎ সঙ্গ দেওয়ার জন্য মানুষের অভাব হয় না। শুধু টাকা হইলেই চলে। দেখিবে, তোমার আশেপাশে এমনসব মানুষের ভীড় জমিয়া গিয়াছে যাহা তোমার মাথাটাকে, তোমার আত্মসম্মানবোধটাকে ভূলুণ্ঠিত করিতে একটু সময়ও অপচয় হয় না। নেশার রেশ ধরিয়া প্রথমে একঘর হইতে আরেকঘর, তাহার পর একবাড়ি হইতে আরেকবাড়ি, এবং ধীরে ধীরে একপাড়া হইতে আরেকপাড়ায় এই বদনাম ছড়াইতেই থাকিবে। আর যদি একবার এই বদনাম ছড়াইতে থাকে আর মন তাহা গ্রাহ্য না করিয়া আরো অদম্য গতিতে তাহার শাখা প্রশাখা বাড়াইতে থাকে তখন বিনাশ ছাড়া আর কিছুই নিজের জন্য বহিয়া আনে না। তখন শুধু চাহিয়া চাহিয়া নিজের সর্বনাশ অবলোকন করা ছাড়া আর কিছুই করিবার থাকে না। একটা কথা না বলিলেই নয়। আসলে এই পৃথিবীর সবাই যার যার মতো। সবাই যার যার থেকে আলাদা। কিন্তু একটা জায়গায় সবার সবার সাথে মিল রহিয়াছে। আর সেটা হইলো, সবাই একা। দলবদ্ধ সমাজই বলি, আর একক পরিবারই বলি, সারাটা জীবন প্রতিটি মানুষ একাই ছিলো আর একাই থাকিবে। এই একাকীত্ততা মানুষের জীবনে একটা আফসোসের পাশাপাশি একটা সুখের অনুভুতিও নিয়া আসে যখন সে ভাবে যে সে যাহা করিতে চায় না, সে সেটা করেই না। আবার সে যেইটা করিতেই চায়, সে সেটাই করেই। আর ঠিক এ কারনেই কেউ দলবদ্ধভাবে সুখীও নয় আবার এককভাবেও নয়। এভাবেই একটা চরম আফসোস লইয়া মানুষ এই নীল আকাশের রুপ, এই নির্জন পাহাড়ের মাদকতা কিংবা কনকনে শীত অথবা বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টির টুং টাং শব্দের মূর্ছনা ছাড়িয়াই বিদায় নেয় যাহাকে কেউ আর কখনোই মনে রাখে না। আমার কাছে ইহাই বার বার মনে হইতো যে, আমি একা। আর আমার একাকীত্বই আমাকে বারবার ওই নেশার জগতে টানিত।
সম্ভবত ইহাই হইয়াছিলো আমার এই ছোট্ট জীবনে। আমি আমার জীবনে যাহা করিয়াছি, এখন ভাবিলে আমার নিজেরও মনে হয়, আমি ইহা কিভাবে করিতে পারিলাম? ইহা করা আমার কখনোই উচিত হয় নাই। কিন্তু যে সাপ একবার তাহার বিষদাত ফুটাইয়া তাহার সমস্ত বিষনালী খালি করিয়া সর্বনাশের কামড় মারিয়া দিয়াছে, তাহা হইতে পরিত্রান পাওয়ার জন্য সাপে যাহাকে কামড় দিয়াছে তাহার চিকিৎসা অনেক জরুরী হইয়া ওঝার প্রয়োজন হইয়া পরে। আমি ওঝার সাহায্য নিতে হইবে ইহাও বুঝিতে পারি নাই।
এইভাবে আমি যেনো আস্তে আস্তে কোন এক অন্ধকার জীবনের শহরে ঢোকিয়া গেলাম। অন্ধকার আর কালোর মধ্যে একটা তফাত আছে। কালোর একটা রঙ আছে কিন্তু অন্ধকারের কোনো রঙ নাই, আছে অনিশ্চয়তা আর প্রতিনিয়ত বিপদের হাতছানি। কিন্তু বয়স বলিয়া একটা কথা আছে। এই বয়সে তাহার মন আর যুক্তি বাস্তবের সাথে কতটা যে ফারাক, তাহাতে আর যাই হোক তাহার আত্মার শান্তি হয় না। আত্মা, মন, আর যুক্তি যখন একই সুতায় থাকে না, তখন প্রতিনিয়ত শুরু হয় অন্তর্দাহ, আর এই অন্তর্দাহ হইতে শুরু হয় কলহ। আর একবার যদি কলহ বাধিয়া যায়, তাহা আর নিভিবার উপায় থাকে না। অন্তর্দাহ নিভাইবার জন্য জলভর্তি কলশী কিংবা তীরভর্তি নদীর প্রয়োজন নাই, প্রয়োজন সময়ের সাথে পরিবর্তনের ইচ্ছা। ইহা আমার ছিলো না। ফলে অন্তর্দাহ যেমন নিভিতেছিল না, তেমনি বাতাসের স্পর্শ পাইয়া উহা আরো তীব্র দাবদাহে পরিনত হইতেছিলো। আর এই তীব্র আগুন একদিন আমাদের পরিবারেও ছড়াইয়া গিয়া অনাখাংখিত অঘটন ঘটিতে লাগিলো।
প্রতিদিন সকাল হইলেই আমি কেনো দেরি করিয়া ঘুম হইতে উঠি, কেনো আমার ক্লাশের ফলাফল ভালো নয়, কেনো আমাকে প্রতিদিন বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় যাইতে হইবে, আর তাহাদের সঙ্গে আড্ডায় যাইয়া কেনো রাত অবধি থাকিয়া বাসায় ফিরিতে হইবে, এইসব ব্যাপারে কথা শুনিতে হইতো। বাবার সব কথায় আমি প্রতিবাদ করিতাম না কারন আমি জানিতাম, আমার প্রতিবাদে বাবার কাছ হইতে আমার সাহাজ্য বন্ধ হইয়া যাইবে, আর আমার মায়ের এমন কোনো গুপ্ত তহবিলও ছিলো না যেখান হইতে বাবার সাহাজ্য ছাড়াই আমি আমার যাবতীয় শখের মনোবাঞ্চনা পুরুন করিতে পারিবো। তাই মাঝে মাঝে আমি বাবার অকথ্য গালিগালাজের ব্যাপারটা অনেকটা উপেক্ষা করিয়াই আমি বাবার সাথে এমন ব্যবহার করিতাম যেনো, বাবা ছাড়া আমার এই পৃথিবীতে আর কাউকে আমি বেশী ভালোবাসিনা। বাবার অকথ্য গালিগালাজের পরেও আমি বাবাকে এইটা বুঝাইতে পারিতাম যে, আমার বাবা হইতে আরো ভালো বাবা এই পৃথিবীতে আর একটাও সৃষ্টি হয় নাই। তিনিই যেনো সর্বশ্রেষ্ঠ বাবাদের মধ্যে একজন। ইহা ছিলো একটা নকল ভালোবাসা। হইতে পারে, বাবারা বা মায়েরা নকল ভালোবাসা বুঝিতে পারেন না। তাহাদের ভালোবাসায় কোনো খাদ নাই।
এইভাবেই আমার দিন চলিতেছিলো। আমার রুপের কথা যদি তোমাকে বলিতে যাই, সেইটা মনে হয় আর দরকার নাই। আমিতো তোমার সামনেই এখন বসিয়া আছি। আমি দেখিতে কেমন, কেমন আমার চোখ, নাক, গাল কিংবা আমার মুখমন্ডল, ইহা তোমাকে আর বিশেষণ দিয়া বুঝাইতে হইবেনা। অনেক ছেলেবন্ধুরা আমার এই চেহারার প্রতি অনেক আকৃষ্ট হইয়া হয়ত অনেকে অনেক কবিতা, গল্প লিখিয়া থাকিতে পারে, তাহা আমার জানা নাই। তবে অনেকের রাতের ঘুম যে অনেকাংশেই বিঘ্নিত হইতো সেটা আমি জানিতাম। আমাকে নিয়া ছেলেমহলে অনেকের সঙ্গে অনেকের দুই একবার অনেক যুদ্ধও যে হয় নাই তাহা নয়। কিন্তু আমি প্রকৃতভাবে কাউকেই এমন করিয়া ভালোবাসি নাই যাহাকে তোমরা আধুনিককালের ছেলে মেয়েদের মধ্যে ভালোবাসার সীমানা টানিয়া থাকো। তবে এইটা ঠিক যে, মনুষ্যকুলে আমি যাহাকে সবচেয়ে বেশী আদর করিতাম তাহা হইলো আমার ছোটভাই। বড় মিস্টি করিয়া আমাকে আপু বলিয়া ডাকে, বড্ড দুস্টুমী করিয়া আমার পাশে আসিয়া তাহার যতো আবদার আছে সব খুলিয়া বলে। আমি তাহাকে কখনো গাল টিপিয়া, কখনো বুকে চাপিয়া ধরিয়া, কখনো আবার মিথ্যা ভয় দেখাইয়া বলিতাম, আমি তোমাকে ছাড়িয়া অনেক দূর চলিয়া যাইবো, তখন দেখিবো তুমি কাহাকে এতো কস্ট দাও। আসলে আমার ভাইটি আমাকে কখনো কষ্টও দেয় নাই। নিছক মজা করিবার জন্য তাহাকে আমি মিথ্যা ভয় দেখাইতাম। বুঝিতে চাহিতাম, আমার সেই কথায় সে কতটুকু বিচলিত কিংবা মন খারাপ করে। অনেকদিন হইলো আমি আমার সেই ছোট ভাইটিকে আর দেখিতে পাই না।
এই বলিয়া শিমা একটু থামিলো বটে কিন্তু পরক্ষনেই বুঝিলাম, সে ফুপিয়া ফুপিয়া কাদিতেছে। নিঝুমরাতে এই অসম বয়সী দুই মনুষ্য যুগলের মধ্যে কোনো ভাষার আদান প্রদান হইতেছিলোনা বটে কিন্তু দুইজনের অন্তরের ভিতরে যাহা ঘটিয়া যাইতেছিলো তাহা অদৃশ্য ঈশ্বরের অজানা ছিলোনা। চিনি না, জানি না, কখনো দেখি নাই, এমন একজন মানুষের গল্প শুনিয়া আমার মনের ভিতরেই বা কেনো ব্যথায় একটু মোচর দিয়া উঠিতেছে? আমি তাহার ভাইয়ের ভালোবাসার কথা মনে করিয়া আমি যেনো তাহার ওই ছোট ভাইটিকেও চোখে দেখিতে পাইতেছি। মনে হইতেছিলো, আহা, আমারও যদি এমন একটা ছোট ভাই থাকিতো? সিমার ছোট ভাইয়ের প্রতি এতো ভালোবাসার অনুভুতি দেখিয়া আমার দুই মেয়ের ছবি ভাসিয়া উঠিল। কি অদ্ভুদ এই ভাইবোনের সম্পর্ক। কখনো ঝগড়া, কখনো হাতাহাতি, কখনো খুব ক্ষুদ্র একটা জিনিষ লইয়া তাহাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি আবার কখনো একসঙ্গে এক টেবিলে বসিয়া রাজ্যের হাসাহাসি, আরো কতো কি? ভালোবাসার মানুষ যখন কাছে থাকে, তখন তাহাকে যতটা না আপন মনে হয়, যখন সে কাছে থাকে না, তখন তাহার জন্য প্রান বড় আনচান করে। মনে হয়, একবার যদি আবার কাছে পাইতাম, তাহা হইলে অনেক আদর করিয়া সব ব্যাথা বেদনার জল তাহার কাছে সমর্পণ করিয়া আরেকবার ক্ষমা চাহিয়া বলিতাম, তোমাকে ছাড়া আমার চলিবেনা। আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।
রাত অনেক হইয়াছে। কেহ জাগিয়া আছে বলিয়া আমার মনে হয়না। মাঝে মাঝে ঐ দূরে নাইট গার্ডের চিৎকার শুনা যায়, কিংবা অনেক রাতের বিমান যাত্রিদের নিয়া কিছু কিছু বিমান নিশাচরের মতো আমাদের এলাকা দিয়া উড়িয়া যাইবার সময় বিকট একটা শব্দ করিয়া কোনো এক অজানা অন্ধকারের রাস্তা ধরিয়া একদেশ হইতে আরেক দেশে মিশিয়া যাওয়ার সেই চেনা শব্দ দূর হইতে ভাসিয়া আসিতেছে। কিন্তু ইহাতে আমাদের মধ্যে কোন বিরক্তবোধ হইতেছে না। দেখিলাম, সিমার চোখে একটু একটু জলের আভা ঘরের আলোতে চিক চিক করিতেছে। চোখের জল যখন পরি পরি করিয়াও পরিতেছে না, তখন তাহা চোখের পাপড়ির সঙ্গে এক হইয়া এমন একটা বিন্দুর সৃষ্টি করে যে, মনে হইবে চোখের দুই ধারে যেনো একটা স্বচ্ছ হিরার খন্ড ঈশ্বর বসাইয়া দিয়াছেন। সিমার চোখের কোনায় তাহার দুঃখের বহিরপ্রকাশ যেনো এমন করিয়াই ঐ একখন্ড হিরার জল চিকচিক করিয়া ফুটিয়া উঠিতেছিল।
সিমা তাহার চোখের জল আমার কাছ হইতে লুকাইবার কোনো চেষ্টাই করিলো না। আমার দিকে ছলছল নেত্রে তাকাইয়া, দুই হাত দিয়া চোখের জল মুছিয়া অতি সাধারন ভঙ্গিতে বলিল,
– আরেক কাপ কফি খাই? তুমিও কি কফি খাবে?
আমি কফি খাইবো কি খাইবো না, ইহার প্রতিউত্তরের জন্য কোন অপেক্ষা না করিয়াই সিমা চেয়ার ছাড়িয়া নিজেই আমাদের রান্নাঘরে কফি বানাইতে চলিয়া গেলো। সিমা একটা নীল ওড়নার সহিত হলুদের কামিজ পড়িয়াছে। কম্বিনেসন করিয়া হয়ত সাদা স্যালয়ার পরিয়াছে কিন্তু খারাপ লাগিতে ছিলো না। আর জেলখানায় তো নিজের আলমারী থাকে না, হয়ত এই কয়টা জামাই তাহার কাছে রহিয়াছে। কতইবা বয়স তাহার। আমার মনটা বড্ড কেমন কেমন যেনো করিতেছিলো। আঘাত করিলেই শুধু অন্তরে ব্যথা হয় এমন নয়। আমাদের চারিদিকে অহরহ এমন কত কিছু ঘটিতেছে যাহার ইতিহাস শুনিলে আঘাত যিনি পাইয়াছেন, তাহার থেকেও আঘাত বেশী প্রতিয়মান হয় যিনি ঐ ইতিহাস শুনিতেছেন। আমারও তাহাই হইতেছিল। আমিও যেনো কোথায় বিনা কারনে আঘাতপ্রাপ্ত হইতেছিলাম।
অনেক্ষন হইয়া গিয়াছে সিমা কফি বানাইতে গিয়াছে, এতক্ষনে কফি বানানো হইবার কথা। দেরী দেখিয়া আমিও রান্নাঘরে ঢুকিলাম। দেখিলাম, একহাতে সিমা একটি ছোট চামচ লইয়া কফির কাপের মধ্যে কফি শুধু নাড়াচাড়াই করিতেছে, অথচ আর নাড়িবার প্রয়োজন নাই। বুঝিলাম তাহার মনোযোগ ঐ কফির কাপের মধ্যে নাই। সে যেনো কোথায় হারাইয়া গিয়াছে। সে যে একটা অপরিচিত বাসায় এতো রাতে কাহাকেও না বলিয়া আসিয়াছে, তাহার যে অতি তাড়াতাড়ি এইখান হইতে আবার চলিয়া যাইবার তাড়া থাকিবার দরকার, আমি তাহার চোখে মুখে, চেহাড়ায় ইহার কোনো চঞ্চলতা দেখিতে পাইলাম না।
আমার উপস্থিতি টের পাইয়া সিমা যেনো সম্বিত ফিরিয়া পাইলো। বুঝিলাম, এতোক্ষন সময়টা সিমার কাছে থামিয়াই ছিলো। একটু লজ্জা পাইলো বটে কিন্তু মুচকী হাসিতেও হাসিলো না। কফি বানানো হইয়াছে। আমরা যার যার কফি হাতে নিয়া আবারো আমাদের ডাইনিং চেয়ারে বসিলাম।
আরো একটা সিগারেট ধরাইয়া আমি সিমাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তারপর কি হইলো?
সিমা কফির কাপের সাথে সিগারেট টানিতে টানিতে বলিতে লাগিলো-
একদিন আমি অনেক রাত করিয়া বাড়ি ফিরিলে দেখিলাম, আমার বাবা তখনো রাত জাগিয়া বসিয়া আছেন। আমার আসিবার অপেক্ষাতেই যেনো বাবা রাত জাগিয়া বসিয়া আছেন। মায়ের দিকে চোখ পড়িতেই বুঝিলাম, মাকে বাবা শারীরিকভাবে হয়তো আঘাত করিয়াছেন। বাবার উপর আমার প্রচন্ড ঘৃণা হইলো। বাবাকে তো আমি আগে হইতেই ভালোবাসিতাম না, আজ সেই নকল ভালোবাসাটা যেনো তাহার খোলস ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিলো। আমি বাবার দিকে এমন করিয়া তাকাইয়া আমার অগ্নি মুর্তি প্রকাশ করিলাম যেনো যদি বাবা আমাকেও কোনো শারীরিক নির্যাতন করেন, তাহা হইলে আমি এমন কিছু করিয়া বসিতে পারি যাহা তাহার পক্ষে সামাল দোয়া সম্ভব না। বাবা হয়তো আমার প্রতিক্রিয়াটা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। ব্যাপারটা ওখানেই সেই রাতে সমাপ্তি হইয়া গিয়াছিলো। কিন্তু আমার মনের ভিতরের রাগ, ঘৃণা কোনোটারই সমাপ্তি হয় নাই। মনে মনে বাবার উপর চরম প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্প করিয়াছিলাম। কোনো কোনো সময় কিছু কিছু নাটক এমনভাবে বানানো হয় যাহাতে সাধারনের চোখে মনে হইবে এটাই সব সত্যি কিন্তু এর পিছনের মুল উদ্দেশ্য অনেক গভীরে। শুধু ভরসার স্থান তৈরির জন্যই নাটক তৈরী করা হয়। আমিও ঠিক এই রকম একটা নাটক তৈরী করিয়াছিলাম। কিছুদিন এমনভাবে সবার সাথে আচরন করিলাম যেনো সবাই ভাবে, আমি ভালো হইয়া গিয়াছি, নেশা করিতেছি না, সবার খোজ খবর লইতেছি। আমার বাবা মাও খুব খুশী আমার এহেনো আচরনে। আসলে নিজেদের মধ্যে যখন কেউ হিংসা হানাহানিতে জড়াইয়া পড়ে, তখন সেইটাই হয় যাহা রক্তের সাথে রক্তের পাল্লা। ক্ষতি হয় শুধু নিজেদের রক্তের। তাহলে এই খেলায় কে জিতে? কেউ না। হয়তো আমিও জিতি নাই।
একদিন আমি আমার বাবা মাকে নিজ হাতে চা বানাইয়া দিলাম, খাবার টেবিল গুছাইয়া দিলাম। কিন্তু আমার বাবা মা ঘুনাক্ষরেও টের পাইলেন না যে, আমার বানানো চায়ে আমি এমন নেশার ট্যাবলেট মিশাইয়াছি, যাহাতে তাহারা নিমিষেই ঘুমের ঘোরে অচেতন হইয়া যান। তাহারা অল্প সময়ের মধ্যে অবসন্ন দেহে ঘুমাইয়া পড়িলেন। অনেক রাত। আমার নেশা করিতে খুব ইচ্ছা হইলো। গোপনে আনা একটা মদের বোতল খুলিয়া প্রানভরে সে রাতে আমি মদ খাইলাম। নেশার সাথে পাল্লা দিয়া আমার রাগ, আমার গোস্যা, আমার ঘৃণা যেনো আরো বাড়িয়া যাইতেছিলো। ঘরের মধ্যে ছুরি কাচি সবই ছিলো। ঘরের শট রুমে কিছু দড়ি ছিলো, আমি খুব সন্তর্পনে সেই দড়ি গুলি দিয়া আমি আমার বাবার পা দুইটা খাটের সাথে বাধিয়া ফেলিলাম। আমার মায়ের উপর আমার কোনো রাগ ছিলো না, কিন্তু মাকেও আমার ভালো বন্ধু বলিয়া মনে আসিলো না। আমি মাকেও বাবার মতো বাধিয়া ফেলিলাম। আমি ধীরে ধীরে রান্না ঘর হইতে বড় মাপের একটা ছুড়ি আনিয়া প্রথমে বাবার গলায় ছুড়ি বসাইয়া দেই। কোনো প্রকারের কোনো বাধা ছাড়াই যেনো আমি বিয়াল্লিশ বছরের একজন সুপুরুষকে মারিয়া ফেলিলাম। মানুষের রক্ত বড্ড গরম। আমার বাবার গলা হইতে রক্ত এমন করিয়া ফুলিকী দিয়া বাহির হইতেছিলো যেনো কনো একটা কুরবানীর পশুর মতো। আমি তাহার রক্তে এক প্রকার ভিজিয়া গেলাম। বাবার গোংগানীতে মা যেনো অবচেতন্তা হইতে নড়িয়া চড়িয়া উঠিলেন। কোনো কিছু চিন্তা না করিয়ায়ি আমি আমার মায়ের গলাতেও ছুড়ি চালাইয়া দিলাম। কথায় আছে, যখন কোনো মানুষ নেশার ঘোরে জংলী জানোয়ারের মতো কোনো কিছুর সাধ পাইয়া যায়, তখন সে নরখাদকই হইয়া উঠে। আমি সম্ভবত তখন এমনই একজন নরখাদক হইয়া উঠিয়াছিলাম।
ঘরে তখন টিম টিম করিয়া আলো জলিতেছিলো, সারাটা বিছানা, বিছানার চাদর, মেঝের ফ্লোর, আর তাহার সাথে আমার সারাটা শরীর স্যাতস্যাতে রক্তের ছোপ। এই অল্প আলতে রক্ত লাল কিনা আমি বুজিয়া উঠি নাই, কিন্তু মানুষের রক্তের একটা গন্ধ আমি পাইয়াছিলাম। যে রক্ত আমার শরীরে বইতেছিলো, সেই একই রক্ত এখন আমার সারা বাড়িতে এদিক সেদিক গড়াইয়া এক জায়গায় গিয়া জমা হইতেছিলো।
সিমা, এই পর্যায়ে আসিয়া একটু থামিলো। কিছুক্ষন কি যেনো ভাবিলো। আমি সিমার দিকে তাকাইয়া ছিলাম। বাড়িটা নীরবতায় ভর্তি। তারপর আমি সিমাকে বলিলাম,
-সিমা, শুধু কি বাবা মার প্রতি রাগের কারনেই তুমি তাহাদের খুন করিলে? খুন করিবার সময় কি তোমার মন একটুও বিচলিতবোধ করে নাই? তোমার মধ্যে কি একবারের জন্যও মায়া, মহব্বত, তাহাদের আদর, কিংবা এমন কিছু মনে পড়ে নাই যাহাতে তুমি চিরতরে তাহাদের খুন না করিয়া তাহাদের ক্ষমা করিয়া দিয়া অন্তত প্রানে বাচাইয়া দিতে পারিতে? অথবা খুন করিবার পর তোমার মনের অবস্থা কেমন হইয়াছিলো? তুমি কি একটু সময়ের জন্যও কাদিয়াছিলে? অথবা এমন কিছু কি ভাবিয়াছো যে, আহা, আমি ইহা কি করিলাম ইত্যাদি?
সিমা সিগারেটের প্যাকেট হইতে আরো একটি সিগারেট লইয়া ম্যাচের কাঠি কয়েকবার চেষ্টা করিয়া জালাইতে না পারিয়া আমার জলন্ত সিগারেটের আগুন হইতে তাহার সিগারেটখানা ধরাইয়া একগাল ধুয়া ছাড়িয়া বলিতে লাগিলো,
– মানুষ যখন নেশায় থাকে তখন তাহার অবস্থা এক, আর যখন নেশা কাটিয়া যায়, তখন তাহার অবস্থা থাকে অন্য রকম। সিমা আমার দিকে তাকাইয়া প্রশ্ন করিলো, তুমি কি কখনো নেশা করিয়াছো? নেশা মানুষকে শুধু স্বার্থপরই বানায় না, তাহাকে নেশা এমন করিয়া চাপিয়া ধরে যে, তখন তাহার কাছে অন্য আর কিছুই বাস্তব বলিয়া মনে হয় না। সে হয়ে উঠে এক অদম্য অপ্রকৃস্থত প্রানি যাহার না আছে কোনো সমাজ, না আছে কোনো বন্ধন, না আছে কোন মহব্বত, না আছে কোনো সংসার। হয়তোবা আমিও সেই রকম একটা ঘোরের মধ্যেই ছিলাম। তাহাদেরকে আমার আপনজন বলিয়া একটুও মনে হয় নাই। আমার ছোট ভাইটিও তাহাদের পাশেই ছিলো, আমি একবারের জন্যও মনে করিতে পারি নাই যে, আমি না হয় তাহাদের হারাইবো, কিন্তু আমার ছোটভাই যাহাকে আমি আমার প্রানের চেয়েও বেশী ভালোবাসি, সে কেনো তাহার বাবা মাকে হারাইবে? আমার শুধু মনে হইতেছিল যে, তোমরা আমাকে অনেক কষ্ট দিয়াছো, আজ তাহার পরিনাম ভোগ করিবে। এই পরিনাম তাহাদের অপরাধের তুলনায় কত বড় শাস্তি, কিংবা এই পরিনাম আদৌ শাস্তি কিনা অথবা এই পরিনাম প্রকারান্তে আমি আমাকেই আরো অধিক শাস্তি দিতেছি কিনা তাহা আমার মনের অজান্তেও আবির্ভাব হয় নাই। ঈশ্বর যখন কাউকে শাস্তি দিতে চাহেন, তখন তাহার দ্বারাই তাহার শাস্তির পথ প্রসারিত করিয়া দেন। ঈশ্বর সব সময়ই নির্দোষ থাকেন।
-কিভাবে তুমি এমন কাজটি এতো সহজে করিলে? আমি সিমাকে প্রশ্ন করিলে, এইবার সিমা আমার দিকে একটু রাগের সহিতই আচরন করিলো।
-আমার আর এই প্রসঙ্গে কোনো কথা বলিতে ভালো লাগিতেছে না। অন্য কথা বলো।
বুঝিলাম, সিমা বিরক্ত হইতেছে। ওকে আমার বিরক্ত করিবার কোন ইচ্ছাই নাই। শুধু জানিতে মন চাহিতেছিলো, তাই জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। এখন আমার জানিলেও যাহা হইবার তাহাতে কোনো রুপ পরিবর্তন হইবে না, আর না জানিলেও ঘটনার কোনো ব্যতয় হইবে না।
– আচ্ছা, আচ্ছা সিমা, তোমাকে আর আমি এই ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করিবো না। তবে তোমার যাহা বলিবার ইচ্ছা হয় তাহাই আমাকে বলো। তোমার কথা শুনিতে আমার ভাল লাগিতেছে।
সিমা এইবার আপন মনে বলিতে লাগিলো-
– জেলখানায় বসিয়া আমি অনেকবার অনেক কিছু ভাবিয়াছি। মায়ের কথা ভাবিয়াছি, বাবার কথা ভাবিয়াছি, আমার ছোট ভাইয়ের কথা ভাবিয়াছি, আমার বন্ধু বান্ধবদের কথা ভাবিয়াছি, আরো ভাবিয়াছি আমার আত্মীয়স্বজনের কথা। বারবার শুধু এইটুকুই মনে হইয়াছে, আমি যাহাদেরকে শাস্তি দিবার জন্য এতোসব করিয়াছিলাম, আসলে তাহারা কেহই শাস্তি পান নাই, শাস্তি পাইয়াছি আমি নিজে। যাহারা আমাদের ছাড়িয়া চলিয়া গেলো, তাহারা আসলে ছিলো আমার নিজের মানুষ। সেগুলি কি শুধু স্মৃতি নাকি স্বপ্ন? আমি জানি, আমি অপরাধ করিয়াছি। আর আমার এই কাজের জন্য আমার কোনো না কোনোদিন শাস্তি হবেই। অপরাধীর পরনতি হলো আইনের হাতকড়া। দেরীতে হলেও আইন তাকে ধরে ফেলবেই। আমি সেচ্ছায় পরদিন সকালে রক্তমাখা শরীর লইয়াই পাশের থানায় আমার ছোট ভাইকে নিয়া হাজির হইয়া সমস্ত ঘটনার বিবরন দেই। থানার অফিসার প্রথমে আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করিতে পারিতেছিলেন না। তিনি আমাকে আসলে কি ঘটিয়াছে তাহা আবার বলিতে বলিলেন। অতঃপর থানার অফিসার কয়েকজন ফোর্স লিয়া আমাদের বাসায় আসিয়া সমস্ত ঘটনা স্বচক্ষে দেখিলেন। আমি বন্দি হইয়া গেলাম। আমাকে হাজতে পাঠানো হইলো। প্রায় দেড় বছর সময় ধরিয়া আমার এই হত্যাযজ্ঞের বিচার হইলো। অবশেষে বিচারক আমার কৃত কর্মের জন্য আমাকে ফাসির আদেশ শুনাইলেন।
আমি জানি, আমাকে আজ মুক্ত পৃথিবীর আলোবাতাসে ছাড়িয়া দিলেও আমি আর আগের অবস্থানে ফিরিয়া যাইতে পারিব না। যাহারা আমার জীবনের সব আনন্দ, সব সমস্যা সমাধানের জন্য তাহাদের প্রানের ঝুকি পর্যন্ত নিতে প্রস্তুত ছিলেন, আমি তাহাদেরকে নিজহাতে চিরতরে বিদায় করিয়া দিয়াছি। এখন কেনো জানি বারবার সকাল হইলেই মনে হয়, আহা যদি বাবা আমাকে আবার বকা দিতে আসিতো, আহা যদি মা এসে বলিতো, ‘সিমা এবার বিছানা ছাড়ো, উঠো, অনেক বেলা হইয়াছে, নাস্তা খাবে’। কিংবা আমার ছোট ভাইটি যদি আমার ওড়না টানাটানি করিয়া আমাকে জালাতন করিয়া অতিষ্ঠ করিয়া তুলিত? কিন্তু আমি জানি, আজ আর কেহই নাই। চোখে জল আসে, কিন্তু মুছিয়া দিবার মানুষ নাই। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অসহায় বলিয়া মনে হয়, কিন্তু আদর করিয়া কাছে টানিয়া ভরসার কথা শুনাইবার কোন মানুষ নাই। জেলখানায় বসিয়া যখন পূর্ণিমার আকাশ দেখি, অথবা ঘোর বৃষ্টি নামা দেখি, তখন আমার বাড়ির কথা মনে হয়। মনে হয়, কতদিন নিজের ঘরের জানালার পাশে দাঁড়াইয়া আকাশ দেখা হয় নাই, কতদিন দাদুর বাড়ির টিনের চালে টিপটিপ বৃষ্টির ঝনঝন শব্দ শুনা হয় নাই। কষ্ট হয় না বলিলে মিথ্যা বলা হইবে কিন্তু কি আরো এক অদ্ভুত কারনে জানি দুই চোখ ভিজে আসে। এখন আর নেশা করিতে ইচ্ছা করে না। নেশার প্রতি আর আমার কোন আকর্ষণও নাই। তাহার পরেও মনে হয়, মায়ের বকুনির জন্য আমি আজ নেশাগ্রস্থ, বাবার ধমকের জন্য আজ আমি নেশাগ্রস্থ। জানো? যা হারাইয়া যায়, আর যাহার সব কিছু হারাইয়া যায়, সে জানে কি হারাইয়া গিয়াছে আর কাকে হারাইয়া নিঃস্ব হইয়া গেছে।
আজ শুধু মনে হয়, যদি আমি উহা না করিতাম, যদি এমন কিছু করিতাম যাহা আবার ফিরিয়া পাইতাম, অথবা এমন কিছু যাহা আবার ফিরিয়া আসে। তাহা হইলে আজ শরতের সকাল, শীতের পিঠা, মায়ের অযথা বকুনী, ভাইয়ের অযাচিত আবদার, সেই দাদু বাড়ির আঙ্গিনায় বসিয়া একগুচ্ছ দুরন্ত বালক বালিকার সঙ্গে হৈচৈ, কোনো কিছুই জীবন হইতে হারাইয়া যাইতো না। তোমরা বাচিয়া থাকিবে, হয়ত একদিন সময়ের রেশ ধরিয়া তোমরাও আমার মত এই পৃথিবী হইতে বিদায় লইবে। অনেকেই তোমাদের জন্য কাদিবে, কেউ চিৎকার করিয়া বলিবে, তোমাকে ছাড়িয়া যাইতে আমার বড় কষ্ট। কিন্তু আমি যেদিন বিদায় হইবো, তখন সারা পৃথিবীর মানুষ জানিবে, আমি কোনো এক জঘন্য পাপ কাজ করিয়া এই পৃথিবী হইতে বিদায় নিলাম। আমার জন্য কাদিবার কোনো লোক খুজিয়া পাওয়া যাইবে না। আর যারা আমার জন্য আফসোস করিবে হয়তো তাহাদেরকে আমি চিনি না। আসলে এই পৃথিবী আমার জন্য নয় বিধায় আমাকে তাড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। বড় বড় অক্ষরে তাহার পরের দিন প্রতিটি খবরের কাগজে তোমরা পড়িবে, “বাবা মাকে একসঙ্গে জোড়া খুনের দায়ে আমার ফাসি হইয়াছে”। কেহ কেহ আমাকে ঘৃণা করিবে, কেহ আবার ‘মাফ করিয়া দিলেই পারিত’ বলিয়া মন্তব্য করিবে। আর আমার ছোট ভাইটি যেদিন বুঝিতে পারিবে, তাহার পিতামাতা তাহার বোনের কারনে মৃত্যুবরন করিতে হইয়াছে, সেদিন হয়ত সেও আমাকে আর ক্ষমা করিবে না। অপরাধ একখন্ড জমি নয় যে, কাহারো নামে লিখিয়া দেওয়া যায়। রক্ত চোখের জলের থেকেও বেশী ঘন, তাহার পরেও চোখের জলের বেদনা রক্ত ঝরার থেকেও কষ্টের। আমি তাহাদের রক্ত ঝরাইয়াছি বটে কিন্তু কষ্টটা রহিয়া গিয়াছে আমার চোখের জলে।
আমি যেদিন এই পৃথিবী থেকে বিদায় লইবো, জল্লাদ যখন আমাকে আমার শেষ ইচ্ছার কথা জানিতে চাহিবে, জানো আমি কি বলিতে চাইবো? হয়ত মুচকি হাসি দিয়া বলিবো, “আমি পূর্ণিমার চাঁদ দেখিয়া মরিতে চাহি না, আমি এই পৃথিবীর কোনো আলো বাতাস লইয়া কথা বলিতে চাহি না, আমি জীবনের চরম সুখ বা দুঃখের কথা বলিয়াও কাউকে চমক দিতে চাহিবো না। আমি শুধু একটিবার সবার সামনে উচ্চস্বরে চোখের জল ভাসাইয়া বলিতে চাইবো, “মা আমি তোমাকে ভালোবাসি। বাবা, এই পৃথিবীতে তোমার চেয়ে আর কোনো এমন বাবার জন্ম হইবে কিনা আমি জানি না, তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ বাবাদের মধ্যে একজন। আমি তোমাদের কাছে চলিয়া আসিতেছি। আমার ফাঁসির দড়িটা একটু তাড়াতাড়ি বাধিয়া দাও”।
এই বলিয়া সিমা তাহার মাথাটা নুয়াইয়া টেবিলের উপর রাখিয়া ফুপিয়া ফুপিয়া কাদিতে লাগিলো। আমি নিরন্তর কোনো ভাষাবিহীন এক শ্রোতার মতো শুধু সিমার কথাগুলি শুনিতেছিলাম। আমার চোখের পাতাও ভিজিয়া আসিতেছিল। মনে হইতেছিলো, এই ছোট মেয়েটি যেন তাহার বাবার সামনে বসিয়া তাহার জীবনের সমস্ত কষ্টের কথাগুলি বলিয়া বাবাকে আরেকবার ভিজাইয়া দিয়া অস্থির করিয়া তুলিতেছে।
-এই যে শুনছো, এইভাবে টেবিলের উপর ঘুমাইতেছো কেন? কোনো এক হটাত শারীরিক ধাক্কায় আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেলো। দেখিলাম, অনেক বেলা হইয়াছে। আমার গিন্নি তাহার দল লইয়া মানিকগঞ্জ হইতে সকাল সকাল রওয়ানা হইয়া ইতিমধ্যে বাসায় চলিয়া আসিয়াছে। তাহার সহিত ঘরের চাবি ছিলো, অনেক্ষন কলিং বেল টিপার পরেও যখন আমার ঘুম ভাঙ্গাইতে পারে নাই, তখন তাহার ভ্যানিটি ব্যাগে রক্ষিত আরেক গোছা চাবি দিয়া ঘরের দরজা খুলিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। আমি আশেপাশে কি যেনো খুজিতে লাগিলাম। সিমা কি এখনো আছে নাকি চলিয়া গিয়াছে? যদি মেয়েটি আসিয়াই থাকে তাহলে ঘরের চাবি লাগাইয়া আবার কিভাবে চলিয়া গেলো? তাহার কাছে তো কোনো চাবি ছিলো না? তাহলে কি কেহই রাতে আমার সঙ্গে গল্প করে নাই? আমার টেবিলের উপর তো এখনো দেখিতেছি দুইটা কাপ রহিয়াছে। তাহলে কি সিমা আসিয়াছিলো?
আমার গিন্নি, আমি কি খুজিতেছি জিজ্ঞাসা করিতেই বলিলাম, “সিমা……”
আর শেষ করিতে পারিলাম না। গিন্নি বলিয়া উঠিল, জানো? আজকের পত্রিকায় প্রথম পাতায় ঐ যে মেয়েটি যে তার বাবা মাকে খুন করিয়াছিলো, সিমা, তাহার ব্যাপারে বড় বড় করে সংবাদ আসিয়াছে যে, গতকাল রাত বারোটার পর সিমার ফাসি কার্যকর হইয়াছে”।
বুকটা ধক করিয়া উঠিল।
পত্রিকাটি হাতে লইয়া অনেক্ষন ধরিয়া খবরটি পড়িলাম। কিছুতেই মিলাইতে পারিতেছিলাম না। পত্রিকার সংবাদে সিমার শেষ ইচ্ছা জানিতে চাহিলে সিমা নাকি বলিয়াছিলো, “আমার কোনো কিছুই আর কাহারো কাছ হইতে চাহিবার নাই, শুধু আমার ফাঁসির দড়িটা একটু তাড়াতাড়ি বাধিয়া দাও। আমি আমার বাবা মায়ের কাছে যাইবো। তখন নাকি সিমা অতি উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করিয়া বলিতেছিলো, “মা আমি তোমাকে ভালোবাসি। বাবা, এই পৃথিবীতে তোমার চেয়ে আর কোনো এমন বাবার জন্ম হইবে কিনা আমি জানি না, তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ বাবাদের মধ্যে একজন। আমি তোমাদের কাছে চলিয়া আসিতেছি। আমার ফাঁসির দড়িটা একটু তাড়াতাড়ি বাধিয়া দাও।”
(এই গল্পের সাথে কারো কোনো মিল নাই, এটা নিছক একটা গল্প।)
২৬/০৪/২০১১-তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন
গতকাল রাতে দশটার দিকে আমার পাশের মসজিদ থেকে মাইকে একটা ঘোষণা এল।
"একটি শোক সংবাদ...গোলারটেক নিবাসী জনাব অমুকের মা জনাবা অমুক আজ রাত আটটার দিকে ইনেকাল ফরমাইয়াছেন (ইন্না নিল্লাহের অয়া ইন্না ইলাইহের রাজেউন। মরহুমার নামাজে জানাজা আগামিকাল সকাল দশটায় গোলারটেক ঈদগাহ মাঠে অনুষ্ঠিত হইবে। জানাজায় শরিক হওয়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি।" ঘোষণাটা কয়েকবার দেওয়া হল।
আজ হরতালের দিন। আমি অফিসে যাই নাই। বাসায় বসেই অফিসের যতগুল কাজ করা যায় তাইই করছি। এখন বাজে দুপুর দুইটা। আবারও একটা ঘোষণা এল, " "একটি শোক সংবাদ...গোলারটেক নিবাসী জনাব অমুকের ভাই জনাব অমুক আজ সকাল এগারটায় ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন (ইন্না নিল্লাহের অয়া ইন্না ইলাইহের রাজেউন। মরহুমার নামাজে জানাজা আগামিকাল বিকাল চারটায় গোলার টেক ঈদগাহ মাঠে অনুষ্ঠিত হইবে। জানাজায় শরিক হওয়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি।"
সকালের জানাজাটা কখন হয়েছিল আমার মনেও নাই। আবারও একটা জানাজার সংবাদ।
আমার বাসায় আমি প্রায় প্রতিদিন না হলেও প্রায় প্রতিনিয়ত এই মসজিদের ইন্তেকালের ফরমায়েশটা প্রায়ই শুনি। ভয় লাগে। হয়ত বা কোন একদিন এমন একটা শোক সংবাদ অনেকেই পাবে যে, " "একটি শোক সংবাদ...গোলারটেক নিবাসী জনাব মেজর মোহাম্মাদ আখতার হোসেন আজ রাত আটটার দিকে ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন (ইন্না নিল্লাহের অয়া ইন্না ইলাইহের রাজেউন। মরহুমের নামাজে জানাজা আগামিকাল সকাল দশটায় গোলার টেক ঈদগাহ মাঠে অনুষ্ঠিত হইবে। জানাজায় শরিক হওয়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি।" তখন হয়ত অনেকেই আসবে, হয়ত অনেকেই আসবে না। জানাজার নামাজটা ঈশ্বর ফরজে কেফায়া হিসাবে নির্দেশ করেছেন অর্থাৎ এটা সবার জন্য ফরজ কিন্তু যদি জানাজার জন্য পর্যাপ্ত পরিমানে লোক আসে তাহলে যারা আসে নাই তারা এই আদেশের বলে অন্যায় হয়েছে বলে দোষী সাব্যস্থ হবেন না।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সাহেলের (১২ লং কোর্সের কিন্তু এমসিসির) জানাজার কথা মনে পড়ল।
আমি যখন আর্মি সিগন্যাল ব্রিগেডের মাঠে গেলাম সাহেলের জানাজা নামাজের জন্য। গিয়ে দেখি সাহেল শুয়ে আছে একটা খাটিয়ায়। নাকে ওর সুগন্ধি দেয়া তুলা, সারা শরির একটা সুন্দর চাদর দিয়ে ঢাকা। আমি একদম কাছে গিয়ে ওর ঠিক মুখের উপর দাড়িয়ে মনে মনে জিজ্ঞ্যেস করেছিলাম, "সাহেল, আমি জানি তোমার এখন নরন চড়নের উপায় নাই। কিন্তু তুমি কি কিছু উপলব্ধি করতে পারছ? তুমি কি দেখতে পাচ্ছ কারা কারা এখানে এখন তোমাকে শেষ বিদায় দেওয়ার জন্য এসছে? অথবা তুমি কি কাউকে ডাকছো এই মুহূর্তে? কিংবা তুমি কি তোমার অসমাপ্ত কোন কাজের পরবর্তী নির্দেশনাগুলো কাউকে দিয়ে যেতে চাচ্ছ? অথবা এমন কি কোন অনুসুচনা হচ্ছে যে কারো কাছে কোন ক্ষমা চাওয়ার? বা এমন কোন বানী যা তোমার পরবর্তী বংশধরদের বলতে চাচ্ছ? আমি অনেকক্ষন তোমার দিকে চেয়ে আছি, মনে পড়ছে আমার সঙ্গে তোমার ১৯৭৮ সালের ঐ রুম নম্বর ১০ এর কথা। তুমি প্রথম ভুতের গল্প বলে সবাইকে এমন একটা আচ্ছন্নতায় ভরিয়ে রেখেছিলে যে সারারাত আমরা কেউ ভয়ে বাথরুমে গিয়ে প্রশাবও করতে যেতে পারিনি। তুমি কি এখন কোন ভুতের ভয় পাচ্ছ? এমন কোন ভুত যা তোমার গল্পের মধ্যে ছিল না!! অথবা এমন কোন বিষয় যা তোমার গল্পের মধ্যে ছিল না যা এখন তুমি নিজেই দেখতে পাচ্ছো?
হটাত যেন সাহেল আমার সঙ্গে কথা বলা শুর করল।
দেখ আখতার, আমার একটা শখ ছিল, আমি আবার সেই ছোট্ট শ্যামলিময় গ্রামে চলে যেতে চাই, সেটা আমি তোমাকে গত পরশু ও বলেছিলাম। আমি আর এই যান্ত্রিকতার মধ্যে বাস করতে চাই না। আমি হাপিয়ে উঠেছি। আমার আর এই যান্ত্রিক মেইলের চিঠি পড়তে ভাল লাগে না। তোমরা আমাকে চিঠি লিখবে সেই পুরানো পোস্ট অফিসের ধারনায়। হাতে লেখা নীল রঙের খামে ভরা চিঠি। ষাট দিন লাগবে আমার হাতে পৌঁছতে, আমি আস্তে আস্তে ভাজটা খুলবো আর ভাববো তোমার চিঠি, তোমাদের চিঠি। সেই ঢাকা থেকে এসেছে। সারাদিন আমি আমার মেঠোপথের অকারন ক্লান্তি দূর করে সন্ধায় হারিকেনের বাতি জ্বালিয়ে আবার তোমাদের চিঠিটা পড়বো আর একে একে লিখে যাব আমার সারাদিনের ব্যস্ততার কথা। আমার পুকুরের মাছগুলোর কথা কিভাবে ওরা সকালে খামাখা কোন কারন ছাড়া ছুটাছুটি করে আবার কোন কারন ছাড়াই দুপুরের দিকে শিক্ষানবিস সাতারুর মত নাক উচু করে ভেসে থাকে এক স্তর পানিতে। আমি ঢিল ছুড়ি, প্রথম প্রথম ওরা আমার এই ঢিল ছোড়াকে ভীষণ ভয় পেত কিন্তু এখন আর করে না। ওরাও আমাকে আর শহরের মানুষ মনে করে না। মনে করে আমি বুঝি মাছ হয়ে গেছি। অথবা লিখব আমার সেই পালের গরুগুলিকে নিয়ে। কে যেন এক অহেতুক কারন ছাড়া ছোট্ট অবুঝ বাছুরটি কথা থেকে দ্রুত দৌড়ে এসে প্রচন্ড রক গতিতে তাঁর মায়ের বানে টান দিয়ে আবার আরেক দিকে ছুট। কি অবাক না? ওরাও হয়ত আমাদের শিশুদের মত খেলা করে কিন্তু ওদের খেলনা নেই, ওদের খেলনা শুধু ওদের পরিবার আর পারিপার্শ্বিক জগত নিয়ে। বৃষ্টি এলে ওরাও বুঝে বের হওয়া যাবে না। কোন কাজ নাই তাই অলস সময়ে যাবর কাটে। মাঝে মাঝে ডাক দেয়...হাম্বা হাম্বা। ওদের সব ডাকের উচ্চারন এক কিন্তু তাঁর মিনিং এক নয়। আমরা যেমন কখনো রাগ করলে চোখ দেখলে বুঝা যায়, হাতের নড়াচরা দেখলে বুঝা যায় আমাদের মানসিক অবস্থা কিন্তু ওদের ভাষার কোন পরিবর্তন নাই। ওরা রাগ করলে গুতা দেয়, অথবা ভয় পেলে কোন দিক না দেখেই দৌড় দেয়। অথবা লিখবো আমার মন খারাপের কথা, আমার মন ভাল লাগার কথা। তোমরা হয় ভুলেই যাবে আমার চিঠির উত্তরের কথা। হটাত কোন একদিন অলস পোস্ট মাস্টার অনেকদিন পর যেন একখান দায়িত্ব পাওয়া গেল এই মর্মে আনাচে কানাচে অনেক উল্টা পালটা গলি পার হয়ে অবশেষে তোমার বাড়ির ঠিকানা পেয়ে আমার সেই চিঠিটা তোমার হাতে পৌঁছে দেবে।
সাহেল আমাকে যেন একটা নাড়া দিয়ে বলল, "ঐ কাজল আসে নাই? কাজল কি জানে যে আমি মারা গেছি?" আমি হাসি সাহেলের কথায়। আমি জিজ্ঞ্যেস করি সাহেলকে, আচ্ছা সাহেল মরার পর তোর অনুভুতি কি? তোর ক্যামন লাগছে মরার পর? সাহেলের সহজ সরল উত্তর-ব্যাপারটা আমি এখনো ভালমত বুঝতে পারছি না। নড়াচরা করতে পারছি না। পাটা যেন অবশ হয়ে আছে, কানের কাছে কি একটা তোরা গুজে দিয়েছিস, ভাল মত শুনতেও পারছি না। হাতের কব্জির উপর একটা মশা বসেছে, বেশ লাগছে, মারতে পারছি না। নাকের কাছে এক অসহ্য দুর্গন্ধময় একটা তুলা দিয়ে তোরা আমার শ্বাস ভারি করে রেখেছিস। তুই কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস?
বললাম, সাহেল তুই কোন ভাষায় কথা বলছিস এখন? আমি তো তোর কোন কথাই বুঝতে পারছি না। মনে হল সাহেলের চোখের দুই পাশে একটু ভেজা ভেজা। সাহেল, তুই কি কাদছিস? নারে ভাই আমি কাদছি না। আমার খুব মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি জানি না আর কখনো তোদের সঙ্গে আর দেখা হবে কিনা, আমি জানি না আমার সেই মাছগুলুর সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে কিনা। আমার জানা নাই, আর কখনো আমি তোদের মত এমন করে আমার সেই ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে আদর করতে পারব কিনা। তুই কি দেখতে পারছিস না ওদের? ওরা কারা? ওরা সবাই আমাকে এভাবে ঘুরে আছে কেন? কেন ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্চে? কথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমার এই বড় রুম, আমার এত কাপর চোপড় কিছুই নিতে দেবে না? কি খাবো আমি ওখানে? কে আছে ওখানে? আমার ভয় করছে ভাই। তোরা কেউ যাসনে প্লিজ।
আমি সাহেলের কোন কথাই আর বুঝতে পারছিলাম না। পাশে নাজমুল দাড়িয়ে ছিল। বলল, কিরে কি দেখছিস এমন করে? আমার সম্বিত ফিরে এল। দেখলাম অনেকে চলে এসেছে। হুজুরও চলে এসেছে। সবাইকে সারি সারি হয়ে জানাজা নামাজের জন্য হুজুর তাড়া দিচ্ছে। এক সময়, হুজুর সবাইকে জিজ্ঞ্যেস করলে, "তিনি কেমন মানুষ ছিলেন? সবাই যেন গদবাধা একখান উত্তর করল, "খুব ভাল মানুষ ছিল"
মরার আগে যিনি এই খেতাবটা শুনে যেতে পারেনি, আজ তাঁর খেতাবের মধ্যে একটা হল ,"তিনি খুব ভাল মানুষ ছিলেন"
তারপর? তারপরের অনুভুতিটা আমি বাসায় গিয়ে আমার ডায়েরিতে লিখে রেখেছি। শুনতে চাও? তাহলে আরেকদিন.........।
০৩/০৩/২০০৬- মানবতা ও নিষ্ঠুরতা
মানবতা এবং নিষ্ঠুরতা তাদের নিজস্ব নিজস্ব ক্ষেত্রে তারা তাদের একটা রুপ নিয়ে অবস্থান করে। একটা বাঘ যখন কোনো একটা হরিনকে শিকার করে, তখন এর দুটু দিক আছে। এর একদিকে আপনি পাবেন বড় নিষ্ঠুরতার চিত্র আরেক দিকে পাবেন বড্ড মমতার দৃশ্য। আপনি যদি ভাবেন যে, একটি বাঘ তার ছোট ছোট বাচ্চাদের খাদ্য অন্বেষণে হরিন শিকার করে, তখন্তাকে আদর্শ মা হিসাবেই দেখবেন। বাঘের বাচ্দেচারা তাদের মায়ের উপর অনেক খুশী। এক্ষেত্রে দেখবেন এর ভিতরের মমতাবোধ। অন্যদিকে, যদি দেখেন যে, আহা, ওই হরন শিকার করে হরিনের বাচ্চাদেরকে এতিম করে দিলো। হরিনের বাচ্তচাদের কাছে বাঘ একটা নিষ্ঠুর কোনো প্রানি ছাড়া আর কিছু নয়। সেখানে দেখবেন এর নিষ্ঠুরতার চিত্র।
যদিও এটা প্রাকৃতিক নিয়মের একটা অংশ। আবার এটাও ঠিক যে, প্রকৃতি একদিকে মানবতা এবং নিষ্ঠুরতা দুটুই একই সময়ে তার নীতিরমধ্যে লালন করে। এখানে কেউ এই নীতি ব্রেক করে না। এখানে আরো একটি নীতি কাজ করে। যেমন ধরুন, কোনো একটি বাঘ যদি শিকার করে তার পেট ভরে যায়, সে পরবর্তী ক্ষুধা না লাগা অবধি ওই বাঘটি আরেকটি হরিন শিকার করে না। বরং শিকার এবং শিকারী তখন পাশাপাশি বিচরন করে। নির্বিঘ্নে পাশাপাশি বসবাস মিত্র এবং শত্রুর। এটাই প্রকৃতির এক অদ্ভুত নীতি।
কিন্তু এই প্রাকৃতিক নীতিটার মধ্যে ব্যাঘাত কিংবা আইন ভঙ্ঘ করে একমাত্র মানুষ। আমরা যখন একজনকে ভালোবাসি, আমাদের নজর থাকে আরেক জনের উপরও। আমরা একজনকে দেখি আরেক জনের সত্তায়ও। ফলে যখনই একজনের উপর আমাদের মন অতৃপ্তিতে ভরে যায়, সাথে সাথে আমরা আমাদের নজর পরবরতী চরিত্রের উপর ফোকাস করে তৃতীয় কোনো মনোবাঞ্চার দিকেও রিজার্ভ করে রাখি। আমরা একই সাথে সুখি নই আবার খুশীও নই। আমরা মানুষের দল একই খাবারে, একই পোষাকে, কিংবা অল্পতেই সুখি নই। আর এখানেই আমাদের মানুসদের ওই বন্য প্রানীদের কাছে অনেক কিছু শিখার আছে। বন্যপ্রানিরা কোনো বাড়িঘড় ছাড়া, টাকা পয়সা ছাড়া, কিংবা রিজার্ভ ফুড ছাড়া সব ঋতুতেই সুখি।
আজ আমি এই স্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছি। যাওয়ার প্রাক্কালে শুধু আমি একটা কথাই বলে যাই যে, এই স্থানটি আমার জন্য একদিকে যেমন বড্ড ভালো লাগার আবার অন্যদিকে অতি ঘৃণারও বটে। চলে যাচ্ছি চিরকালের জন্য এমন কিছুমানুসদের ছেড়ে যারা আমাকে কখনো কখনো ভালোবেসেছিলো আবার কখনো কখনো তারা আমাকে ভালো তো বাসেই নাই বরং ঘৃণার চোখেই দেখেছিলো। এখানে কেউ কেউ আমাকে ভালোবেসেছে শুধুমাত্র কিছু অর্থকরী মুনাফার জন্য।
(চলবে)
২৪/০৯/১৯৮৬-একজন পরিত্যাক্ত মুক্তিযোদ্ধা
প্রচন্ড শক্তিশালী জীবের রাহু থেকে মুক্তি পেয়ে একটী ক্ষুদ্র প্রানির যা হয়, আজকে আমার অবস্থাটা যেন সেই রকম মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার মাথা থেকে একটা বোঝা কমে গেল। কিন্ত কেন মনে হচ্ছে একটা বোঝা কমে গেল এবং কি একটা বোঝা কমে গেল তাও বুঝতেছিনা। সারাদিন ঘুমে কাটাতে চাইলাম কিন্তু ভাল ঘুম হলো না। গতকাল Firing থেকে ফিরে এসেছি। ‘ফায়ারিং’ এর একটা অর্থ আছে। আর সেটা হলো, প্রতি বছর আর্টিলারী ইউনিট গুলি তাদের ‘আর্টিলারী গানগুলি’ লং রেঞ্জ টেষ্টিং করে এবং সাথে অফিসারগনও তাদের বিদ্যা চর্চা করে। আর এই ফায়ারিং একমাত্র হাটহাজারী পাহাড়ি এলাকাতেই করা হয়।
যাই হোক, হাট হাজারী Firing এ গিয়ে এবার একটা দৃশ্য দেখেছি । দৃশ্যটি আমাকে খুব ব্যথিত করেছিল। শুয়ে শুয়ে যেন ঐ কথাগুলো আমার কানে বারবার বেজে উঠছিল। আমি চট্টগ্রামের ভাষাটা বলতে পারি না, তাই আমার মতো করে ঘটনাটা লিখছি।
হাট হাজারী Firing range এর প্রবেশ মুখেই পশ্চিম পাশে একটা চায়ের দোকান আছে। ওখানে চা খেতে গিয়েছিলাম আমি আর আমার এক বন্ধু লেঃ তারেক (ভাল নাম হচ্ছে তারেক মোঃ ভাওয়ালি, ভাওয়ালী সুন্দর গান গায়, বিশেষ করে কাওয়ালী গান, তাই আমরা ওকে ভাওয়ালাই না ডেকে কাওয়ালি বলেও ডাকি অনেক সময়)। চায়ের দোকানে ঢোকতেই চোখে পড়লো, চায়ের দোকানে আরো কিছু অচেনা লোকও বসে আছে। হয়ত এই এলাকার কেউ হবে। দোকানীর বয়স প্রায় ৫০, বানাচ্ছে। মুখে তার ঘন সাদা দাড়ি, খালী গা, গলায় একটা গামছা জড়ানো। বুকের যতোগুলি পশম আছে, সবগুলিই পাকা। মাথায় চুল নাই বল্লেই চলে। দোকানের সাইজের তুলনায় খুব বেশি কাষ্টমার নাই, আমরা যারা এখানে ফায়ারিং করতে আসি, মূলত তারাই তার বেশীরভাগ খদ্দের। আর যারা হাটহাজারী ফায়ারিং রেঞ্জের এই রাস্তাটা ব্যবহার করে, বিশেষ করে স্থানীয়রা, তারাই এই চা দোকানের খদ্দের। আমি আর তারেক চায়ের জন্য বসে আছি। আর এই ফাকে দুজনেই দুজনের অজান্তে বুড়ো লোকটিকে দেখছিলাম। এক সময় তিনজনই একসঙ্গে ব্যাপারটা মার্ক করাতে সবাই যেনো একটু মুচকীতে হেসে দিলাম।
আমার একটা বদ অভ্যাস আছে। বুড়োমানুষ দেখলেই আমার গল্প শুনতে ভাল লাগে। তার অতীত গল্প। আমি এমন অনেক বুড়ো মানুষের সাথে নিছক গল্প করতে করতে এমন কিছু সত্যি কাহিনী জেনেছি, যারা একদা আমাদের সমাজের বা দেশের বড় একটা কাজের সাথে হয়ত জড়িত, অথবা এমনো দেখেছি, যতো নামীদামী মানুষের কথা আমরা জানি তাদের ঐ সব ইতিহাসের পিছনে এসব লুকিয়ে থাকা মানুষের কত কন্ট্রিবিউশন। আমি বুড়ো লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম,
"চাচা আপনার বাড়ি বুঝি এখানেই?" বুড়ো আমার উত্তর না দিয়ে পাল্টা বলতে শুরু করলেন, “পোয়া এর আগে আমাকে এখানে দেখো নাই? "
তাঁর এই কথায় প্রথমে একটু খটকা লাগলো এই ভেবে যে, আমাদের বয়স যতো কমই হোক, যখন সবাই জানে আমরা সামরিক বাহিনীর লোক, অজান্তেই তারা আমাদেরকে ‘স্যার’ সম্বোধন করে। কিন্তু কেউ না করলেও আমার তেমন অসুবিধা হয় না। আমি ব্যাপারটাকে আমলেও নেই না। কিন্তু চা ওয়ালা কোনো কিছু ভাবার আগেই সে আমাকে ‘তুমি’ করেই সম্বোধন করলো। আমার কাছে ব্যাপারটা ভালই লাগলো। যতই হোক, তিনি আমার থেকে তো বয়সে প্রায় দিগুন হবেন।
আমার প্রশ্নের উত্তরে দোকানী পাল্টা যে প্রশ্ন করলেন, তাতে আমি কি উত্তর দেবো? এবারই তো প্রথম এলাম এই ফায়ারিং রেঞ্জে। আমার সামরীক জীবনটাই তো বেশী দিনের না। আগে এলে হয়ত আমার সাথে তার পরিচয় নিশ্চয় হতো। আমার আগে যারা এখানে এসেছেন, তারা নিশ্চয় এই বুড়োকে ভালোভাবেই চিনে। হয়তো অনেকের সাথে তার পরিচয়ও আছে। এতো কিছু না বলে আমি শুধু চাচাকে বললাম, না চাচা, আমি এর আগে এখানে কখনো আসি নাই। তাই হয়তো আপনাকে আমি আগে দেখিনি।
চাচা আমার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললেন, এখানে অনেক অফিসাররা আসে, চা খায়, কিন্তু আজ অবধি কেউ আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, কি করতাম আগে, আমার নাম কি ইত্যাদি কেউই কখনো জিজ্ঞেস করে নাই। তুমিই মনে হয় এই প্রথম আজ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলা। তবে এইটুকু বলি যে, আমি এলাকার লোক নই। আর কখনো এই এলাকায় বাস করবো এটা আমার সপ্নেও ছিলো না। তারপরেও নিয়তি বলে একটা কথা আছে, আমরা তাকে কখনোই হাত দিয়ে দূরে ফেলে দিতে পারি না। কেউ এটা বিশ্বাস করুক আর নাই বা করুক। আমি অন্তত এখন এই ৫০ বছর বয়সে এসে সেটা মনে প্রানে বিশ্বাস করি।
চাচা, কোনো দিকে আর না তাকিয়েই চা বানাতে বানাতে বলতে থাকে-শোন, তোমাদের মতো আমিও একদিন জোয়ান ছিলাম, আজ থেকে ৩০ বছর আগে আমি তোমাদের থেকেও দ্রুত গতিতে দৌড়াতে পারতাম, আমার মাথায় ভর্তি কালো চুল ছিল। সারাক্ষন এই গায়ের কোথায় কি হচ্ছে, আমার নজর কখনই এড়িয়ে যায় নাই। আইউব খানের বিরুদ্দে যুদ্ধ করেছি, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কত শ্লোগান দিয়েছি। সবাই ভাগছে, রাজাকারেরা জয় করতে পারে নাই এদেশ, মুক্তিযোদ্ধা আছিলাম। দেশটারে স্বাধীন করছি। তবে এখন মনে হয় জীবনে অনেক হিসাব কিতাব ঠিকমত করা হয় নাই। আইউব খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোন দরকার ছিল না, ব্রিটিশদের বিপক্ষে এত কথা বলারও দরকার ছিল না, অথবা রাজাকার বলে যাদেরকে আমরা পাত্তাই দেই নাই, তারাই এখন আমাদেরকে দেখে হাসে। সবাইরে খেদাইছি ঠিকই কিন্তু এখন যারা আছে তাগো ভাগাইব কে? আগে তো বাঁচার জন্য চায়ের দোকান দিতে হয় নাই, এখন তো বাঁচার জন্য চায়ের দোকান ছাড়া আর কোন গতিও নাই। যখন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম, আমার বয়স ছিল ৩২ কি ৩৩। বউ আঁকড়িয়ে ধরেছিলো যেনো যুদ্ধে না যাই। সেদিন বউরে কইছিলাম, ভয় পাইস না বউ, ফিরে আসবো। কি লাভ হইছে ফিরে এসে? বউ এখন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। ঔষধের অভাবে বিছানাতেই ছটফট করে। ভাতই দিবার পারি না আবার ঔষধ।“
বুড়া লোকটি একটু থামলেন। আমি চায়ে চুমুক দিচ্ছি আর খুব মনোযোগ সহকারে তাঁর কথা শুনছি।
“ঐ যে পোশাকটা তোমরা পড়ে আছো, এটা পাবার জন্য অনেক জাবিউল মারা গেছে, অনেক জাবিউল চা বিক্রি করে বেঁচে আছে, অনেক রাহিমারা এখন বিছানায় শুয়ে আছে, তাঁদের দেখার কেউ নাই। তোমাদের উপর আমাদের কোন দুঃখ নাই, তোমরা আমাদের নাতিনাতকুরের মতো। কিন্তু আমাদের কি কেউ দেখার নেই?”
বুঝলাম, তাঁর নাম জাবিউল, তাঁর স্ত্রীর নাম হয়ত রাহিমা। তারপর? একটা বেন্সন সিগারেট আমি নিজে নিলাম আর আরেকটা সিগারেট তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম। নেন, একটা বেনসন খান।
জাবিউল বলে চললেন, “আরেক কাপ চা খাইবা?”
আমার চা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিলো। বল্লাম, দেন।
আমার শুনতে ভাল লাগছে জাবিউলের কথা। জাবিউল একজন মুক্তিযোদ্ধা, এটা ভাবতেই আমি যেনো উদাসীন হয়ে কল্পনায় ফিরে যাই সেই ছোটবেলায়। আমি তখন খুব ছোট, মুক্তিযুদ্ধ কি, কারা কি কারনে কি নিয়ে গন্ডোগোল করছে সেটা আমার কাছে কিছুতেই বোধ গম্য হয়নি। কিন্তু দেখতাম, মাঝে মাঝেই গ্রামের সবাই এক সাথে নদীর ওপারে শুকনা খালে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পালিয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে রাতও পার হয়ে যেতো। আসলে সে সময়টাই ছিলো মুক্তিযুদ্ধ। মাদের গ্রামেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলো কিন্তু হটাত করে তারা যেনো কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলো। আমি যখন ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছিলাম, তখন আসল ফ্রন্ট লাইনার মুক্তিযোদ্ধারা কেহই গ্রামে ছিলো না। তারা কোথায় ছিলো বা আছে সে খবরটাও আমি জানি না। হয়তোবা তারা অন্য কোথাও হারিয়ে গেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলো যুবক, অবিবাহিত, আবার কেউ কেউ সেই যুদ্ধ থেকে ফিরেও আসেনি। এখন হয়তোবা আর বেশি জাবিউলরা নাইও এ দেশে। হয়তো কালের ঘুর্নিপাকে একদিন আর কোন জাবিউলকে খুজে পাওয়া যাবেও না। ইতিহাস কতো জায়গায় কতোভাবে চাপা পড়ে আছে, কে রাখে তাঁর খবর? আজ সেই তাদের মধ্যের একজন ফ্রন্ট লাইনার মুক্তিযোদ্ধাকে পেলাম।
জাবিউল বলে যাচ্ছে আর চা বানাচ্ছে-
“দেশ স্বাধীন হল, কি আনন্দ চারদিকে। আমরা এখন শুধু আমরা । ব্রিটিশ গেছে, পাকিস্তান গেছে। আমরা যারা ফিরে এলাম, তারা খুব ভাগ্যবান মনে হলেও এখন মনে হয় যারা ফিরেনি তারা বেশি ভাগ্যবান। ওদের বেঁচে থাকার জন্য চা বেচতে হয় না । ওদের বেঁচে থেকে রাহিমাদের কষ্ট দেখতে হয় না। একটা চাকরীর জন্য অনেক দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি, মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট কোন কাজে আসেনি। পরে ওই সার্টিফিকেট আগুণে পূড়ে ফেলেছি। কি হবে একটা অযৌক্তিক সার্টিফিকেট রেখে? আমার বাড়ি ছিল ঢাকার পাশে বছিলা নামে এক গ্রামে। কত বছর আগে যে ঐ গ্রামটা ছেড়ে এসছি মনে পড়ে না এখন। সেখানে যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমার ওখানে গেলে মন খারাপ হয়ে যায়। পাশে একটা গনকবরের সমাধি আছে। খালি যুদ্ধের কথা মনে পড়ে। খালি মানুষের লাশের গন্ধ আসে নাকে। যেতে চাইলেও মন, শরীর যেতে চায় না। তাই এই জঙ্গলের কাছে পড়ে আছি, বলতে পারো পালিয়ে আছি। জানো কার কাছ থেকে পালিয়ে আছি? নিজের কাছ থেকে নিজে পালিয়ে আছি।"
আমি প্রশ্ন করলাম, পালাতে পারছেন? জবিউল আমার প্রশ্নের আগেই সে উত্তর দিল, "কিন্তু আমি জানি আমি পালাতে পারি নাই। নিজের কাছে নিজে কেউ পালাতে পারে না।"
জবিউল আর কথা বলতে পারে না। তার গলা ভেঙ্গে আসছে, হয়ত তার চোখে পানিও এসে থাকতে পারে কিন্তু সন্ধ্যার নিকষ কালো অন্ধকার সেই অশ্রু সবার চোখ থেকে আড়াল করে রাখলো। সূর্য অনেক আগেই ঢলে পড়েছে। সন্ধ্যা নেমে গেছে। আমি আরও একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে দেখলাম, জাবিউল তাঁর গামছাটা দিয়ে চোখ মুছছে। জাবিউল একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা নাকি এ দেশের সর্বকালের সর্বর্শ্রেষ্ঠ সন্তান। কে বলেছিল এ কথা? জাবিউলরা বেঁচে থাকে না। বেঁচে থাকে রাজাকারেরা। এখন দেশে রাজাকার আর রাজাকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। অনেক রাজকার ৭১ এর পরেও জন্মেছে। রাজাকাররা শুধু দেশের স্বাধীনতায় বাধা দেয় না, যারা এ দেশের মানুষের স্বাধীনতাকে হরন করে, যারা গরিবের ধন চুরি করে, যারা ন্যায় অন্যায় কিছুই বুঝতে চায় না, যারা মানুষের ঘরবাড়ি দখল করে, যারা বিনা অপরাধে মানুষ খুন করে, মেয়েদের ধর্ষণ করে, যারা মানুষের মতামতের কোন সম্মান করে না, যারা জনগনের ট্যাক্সে বেতন পেয়েও তাদের জন্য কাজ করে না, যারা নিজের দেশের টাকা লুট করে অন্য দেশে জমিয়ে পাহাড় বানায়, যারা ভোটেরর অধিকার হরন করে জনগনের অধিকার বিলুপ্ত করে, তারা সবাই রাজাকার।
এই জাবিউলের সামনে আমার ইউনিফর্মটাকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। রাত নেমে এসছে, মেসে ফিরতে হবে, জাবিউলকে শুধু একবার জড়িয়ে ধরা ছাড়া আমার আর কোন কিছুই দেবার নাই। আমি জাবিউলকে তাঁর অজান্তে একটা স্যালুট দিয়ে ফিরে এলাম। মনে হল আজ অন্তত একটা মুক্তিযোদ্ধাকে আমি প্রানভরে ইউনিফর্ম পড়ে স্যালুট করলাম যে আমার এই স্যালুটের জন্য বসে নেই। তাঁরপরেও সে একজন ইতিহাস রচনাকারী মুক্তিযোদ্ধা, যার জন্য আমি আজ একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক এবং যার জন্য আমি আজ একটা স্বতন্ত্র ইউনিফর্ম পেয়েছি। আমি জাবিউলের কাছে ঋণী, দেশ হয়তো নয়।