Mitul
১৬/০৮/২০২৩-আমার গিন্নির সংক্ষিপ্ত কথা
আমার গিন্নী শিক্ষক, তাও আবার যেনো তেনো শিক্ষক নন, পুরা অর্থনীতির ডিপার্ট্মেন্টাল হেড। এখন তিনি ভাইস প্রিন্সিপ্যাল।
কোথায় যেনো কোন এক মনিষী বলিয়াছিলেন, কর্মক্ষেত্র অনুপাতে নাকি মানুষের অনেক কিছু জীনগত বেশ পরিবর্তন আসে। যেমন সব ডাক্তাররাই ভাবেন তাদের আশেপাশের সবাই রোগী, সব উকিলরা কাউকে পেলেই কিছু উকালতি বুদ্ধি দিয়া দেন, আবার কেউ পুলিশে চাকুরী করিলে নাকি সবাইকে সন্দেহই করিতে থাকেন, হোক সেটা তাহাদের বউ কিংবা স্বামী অথবা পাড়াপ্রতিবেশী। তো শিক্ষক যাহারা তাহারাও ব্যতিক্রম নন। সবাইকে ছাত্রই মনে করেন। আমার বউ টিচার হিসাবে আমি ছাত্র হিসাবেই নিজেকে মনে করি। উপদেশ তিনি যাহাই আমাকে দেন, আমি শিরধার্য মনে কইরা শান্তশিষ্ট সুবোধ বালকের মতো তা পালনে চেষ্টা করি। এতে লাভ দুইটা। সংসারে অশান্তি হয় না আবার আমার মাথাও ঠান্ডা থাকে।
কিন্তু টিচারদের বড় সমস্যা হচ্ছে-উনারা সংক্ষিপ্ত কথা সংক্ষিপ্ত আকারে কইতে পারেন না। কথার মধ্যে ভূমিকা থাকিবে, যাহা বলিবেন তাহার ব্যাকগ্রাউন্ড ইতিহাস থাকিবে, তারপর মুলকথায় আসিলেও পথিমধ্যে আবার কোনো ইতিহাসের কথা আসিয়া পড়িলে সেইটাতেও ছাড় দিতে নারাজ। উদাহরণ দেই-
আমার গিন্নি কয়েকদিন আগে আমাকে বিমানের একটা টিকেট হোয়াটস আপে পাঠাইয়াছিলেন। পরে বিস্তারীত দেখিবো দেখিবো করিয়া আর সেইটা ভালোমত দেখা হয় নাই। তো গতকাল রাতে খাওয়ার সময় হটাত বলিয়া উঠিল-আমি তো পরশু যাচ্ছি, জানোতো?
আকাশ হইতে পড়িলাম, মুখে পড়োটা ছিলো, চিবাইতেছিলাম, তাহাও বন্ধ হইয়া গেলো, তাহার দিকে অসহায়ের মতো তাকাইয়া বলিলাম, কোথায় যাইতেছো?
তাহার মুখের অভিব্যক্তি দেখিয়া বুঝিলাম, কোথাও আমার এমন কোনো স্মৃতিশক্তি হারাইয়াছে যাহাতে এখুনি বুঝি ১৪ স্কেলের একটা ভূমিকম্প অথবা রুমকম্প হইবার সম্ভাবনা। বুঝিয়াই বলিলাম, উহ হ্যা, তো কিভাবে যাচ্ছো?
বুঝিলাম, তাহাতেও আমার ডজ করিবার উপায় ঠিক ছিলো না। বাহানা করিলেই আমি ধরা খাই, এটা আবারো প্রমানিত। যাক, ভূমিকম্প বা রুম কম্প কিছুই হইলো না।
তিনি বলিতে থাকিলেন, তোমাকে না আমি টিকেটের কপি পাঠাইছিলাম!!
বলিলাম, ওরে, ভুলেই তো গেছিলাম। পড়েছিলাম তো......
তারপর তিনি বলিতে লাগিলেন, তাহার এক কলিগের মেয়ে কিংবা ছেলের বিয়া, তাহাকে নেমন্তন্ন করিয়াছে, যেতে হইবে সেই সুদুর বগুড়া। বিমানে যাইবেন তিনি। তো আমি আবার জিজ্ঞেস করিলাম, কবে আসিবা?
গিন্নীর সোজা উত্তর-তোমাকে না টিকেট পাঠাইছিলাম, টিকেটে লেখা ছিলো না?
বললাম, হ্যা তাই তো। টিকেটে তো লেখাই ছিলো। কি যে অবস্থা, আজকাল সব ভুলে যাই।
তারপর আবার আমার গিন্নীর কথা শুরু হইলো। তিনি কিন্তু কবে আসিবেন, সেইটার উত্তর দিচ্ছেন।
এই ধরো আগামীকাল বিকালে আমাদের ফ্লাইট। তাই কলেজ থেকে একটু আগেই ফিরিবো। এরআগে কলেজের সবকাজ সমাপ্ত করিবো। অনেক কাপড় চোপড় নেবো না, বাসায় এসে গোটা কিছু কাপড় নেবো। ড্রাইভারকে আসতে বলেছি একটু আগেভাগে যেনো এয়ারপোর্টে যেতে আবার বিলম্ব না হয়। যেই জ্যাম আজকাল। কেনো যে এতো জ্যাম বুঝতে পারি না। মানুষগুলি নিজেরা নিজেরাই জ্যাম বাধায়। কোনো আক্কেল নাই। হটাত করিয়া এদিক থেকে রিক্সা, ওদিক থেকে “পাঠাও”, আবার কেউ কেউ সিরিয়াল ভেংগে ওভারটেক করতে গিয়া রাস্তার মুখেই জ্যাম বাধাইয়া দেয়। বাজে সব ড্রাইভারের দল। যাক গে, বাসা থেকে রওয়ানা হবো, আপাকেও বলে রেখেছি যেনো উনিও আগেভাগে রওয়ানা দেয়। তা না হলে ওনার জন্য আবার আমাদের সমস্যায় পড়তে হবে।
বললাম, আরে ফিরবা কবে?
গিন্নী বল্লো- এতো অধইর্য কেন? আগে তো যাইই। গেলামই তো না।
বললাম, তাই তো তুমি তো এখনো এয়ারপোর্টেই গেলা না। তারপর?
তারপর গিন্নী বল্লো-বিমানজার্নী প্রায় ১ ঘন্টা। সন্ধ্যার আগেই নেমে যাবো। নেমেই ওখানে আপার হাজবেন্ড গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবেন। তোমাকে তো বলাই হয় নাই, আপার হাজবেন্ড অমুক জায়গায় চাকুরী করতেন। ওরে বাবা, অনেক ভালো চাকুরী। তাঁর চাকুরীর সময় উনি অনেক মানুষের উপকার করেছেন। খুব অমায়িক মানুষ, আপার সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। খুব সংসারী মানুষ। তাঁকে তাদের গ্রামের মানুষ অনেক শ্রধ্যা করে। এখোনো উনি এই সেই করেন (সংক্ষেপে বললাম আর কি)
বললাম, আরে ভাই, তুমি ফিরবা কবে সেটা তো বললে না।
উফ তোমার সাথে কথা বলতে গেলে এতো অধইর্য হইয়া যাও যে, আসল কথাই বলা হয় না।
বললাম- আরে আসল কথা তো জানতেই চাচ্ছি- ফিরবা কবে?
এদিকে হটাত করে তাঁর মোবাইলে কার যেনো কল বাজিয়া উঠিলো। তিনি কল ধরিলেন, সেই আপা যাহাদের বাসায় তাহার নেমন্তন্ন। এখন আপার সাথেই তিনি কথা বলছেন। আমি বসেই রইলাম কবে তিনি ফিরবেন সেটা জানার জন্য।
আমি টেলিভিশনে রাতের খবর দেখি, ফলে খবরের টাইম প্রায় ছুইছুই। আমি খবর দেখিলাম, রাতে ঘুমাইলাম, পরের দিন অফিস করিলাম, এইমাত্র বাসায় ফিরিলাম। আমার গিন্নী আগামীকাল বগুড়ায় যাইবেন। একদিন পার হয়ে গেলো, আমি এখনো অপেক্ষায় আছি তিনি কবে ফিরবেন সেটা এখনো জানিতে পারি নাই।
১২/০৮/২০২৩-মিটুলের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল পোষ্টিং
আমার গিন্নী সরকারি বাঙলা কলেজ, মীরপুরে অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসাবে কর্মরত। গিন্নীরা চাকুরী করলে স্বামীদের কি হাল হয় সেটা যারা আমার মতো চাকুরীজীবি গিন্নীর স্বামী তারা বুঝতে পারবেন। মাঝে মাঝেই ব্যাচলর মনে হয় কারন ছুটির দিনের দুপুরের খাবারের সময়েও গিন্নীর কর্মস্থলের জরুরী কাজ নিয়ে তিনি মহাব্যস্ত থাকেন। একাই তখন খেতে হয়। আলসেমী করে সকালে একটু ঘুম থেকে দেরী করে উঠলে দেখবেন, গিন্নী নাই, অফিসে চলে গেছেন। আবার আমি অফিস থেকে একটু আগে এলেও দেখি গিন্নী তখনো কলেজের কাজেই ব্যস্ত। উপায় নাই। দেশের কল্যান বলে কথা। স্বামীর কল্যানের জন্য তো আর দেশের অমঙ্গল করা যাবেনা।
এরমধ্যে গিন্নী আবার বিভাগীয় প্রধানের কাজের বাইরে পর পর দুইবার বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক। কলিগরাও বে রশিক। স্বামীর কথা একবারো ভাবেন না। এতো ভোট দিয়ে তাকে জয়ী করাবেন তো স্বামীর কি হাল হয় সেটা কি একবারো ভাববে না? যাই হোক, পর পর দুইবারই তিনি তাঁর নিকটতম প্রতিদন্ধি থেকে ৪০% ভোটে এগিয়ে জয়ী হন। তো বুঝতেই পারেন, বেচারা স্বামীর কি অবস্থা। আমিও ভেবে নেই যে, জগত সংসারে স্বামীদের ছাড়াও এসব কালজয়ী গিন্নীদের আরো অনেক জরুরী কাজ আছে। সুতরাং হে স্বামীগণ, হয় নীরবে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখো, অথবা কৃষকের মতো বাগানে কাজ করো না হয় যদি জার্মান শেফার্ড থাকে তাকে নিয়ে একটু ব্যস্ত থাকো। অভিযোগ কইরা কোনো ফায়দা নাই। নারীরা এখন অনেক প্রতাপ্সহালী। বহু দেশের রাষ্ট্র প্রধান এখন মহিলা।
আমার গিন্নী এবার আবার কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এতো চাপা কষতের মধ্যে মনটা ভরে গেলো। সুখের খবর তো অবশ্যই। তবে এতে যে আমার আরো কিছু সময় ছাড় দিতে হবে সেটা তাই আর ধর্তব্যের মধ্যে নিচ্ছি না। আগে রাতের পরোটা খাইতাম ধরেন ৯ টায়, এখন না হয় খাবো ১০ টায়, এই তো। জীবনে ১ ঘন্টা আর কি আসে যায়। বিয়ের আগে তো এ রকম ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু তাহার চেহাড়া মোবারক দেখার জন্য রাস্তায়, ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গণে অযথাই সময় নষ্ট করেছি। তাঁর তুলনায় এই প্রতিদিন এক ঘন্টা লস তো কোন ব্যালেন্স শীটেই পড়ে না। অবশ্য সম্পর্কটা এখন মাঝে মাঝে ভাই বোনের মতই হইয়া গেছে। স্বামী হিসাবে রাগ না কইরা ভাই হিসাবেই না হয় ক্ষমা কইরা দিলাম। কি বলেন?
যাক গে, যা বলছিলাম, গিন্নী বাঙলা কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হিসাবে নিয়োগ পেয়েছে। খবরটা অনেক গর্বের যেমন, তেমনি আনন্দেরও। তাই সেই সুবাদে বাঙলা কলেজের বেশ কিছু গুনীজন, শিক্ষক এবং কলিগদের নিয়ে গত শুক্রবার একটা ট্রিট দিলেন আমার গিন্নী। (কানে কানে বলে রাখি-বিলটা আবার আমার কার্ডেই গেছে)। আমরাও তাঁর এই সাফল্যের জন্য অতি আনন্দের সাথে তাঁকে একটা সংবর্ধনা দেই। তারই কিছু বিশেষ মুহুর্তের ছবি।
ভালো থেকো আমার গিন্নী, তোমার সাফল্যে আমি সব সময় গর্বিত। তুমি নিশ্চয় আরো উন্নতি করবে এটাই আমার দোয়া।
7/5/2022-ফেসবুকে মিটুলের লেখা ৭ ই মে
আজ ৭মে আমার ও আখতারের জীবনের একটি বিশেষ দিন।বিবাহ বার্ষিকী নয়। তার চেয়েও অনেক মূল্যবান একটি দিন। আমাদের লাভ ডে আজ।লিখতে চেয়েছিলাম না। কিন্তু না লিখে পারলাম না। কেননা আমি আজ সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছি বন্ধুদের সাথে। মনে কিন্তু ঠিকই আছে!! এ কি ভোলার মত বিষয় আপনারাই বলেন!!
আমি অনেক ভালো আছি তাঁর সাথে, বর্ণনা করে বোঝাতে পারবো না।আমিও চেষ্টা করি আমার মানুষটিকে ভালো রাখবার। আসলে আমরা একে অপরকে রেসপেক্ট করি ও বোঝার চেষ্টা করি, যা মনের সুখের খোরাক জোগায় এবং খুবই দরকার। তবে আমার চেয়ে আখতারই বেশি মূল্যায়ন করে আমাকে। আমার আনন্দ গুলো যেমন অন্তর দিয়ে উপভোগ করে, তেমনি আমার মন খারাপ বা কষ্ট কোনটাই তাঁর যেন ভালো লাগে না।অনেক স্বাধীনভাবে জীবন যাপণ করছি। তাই বলে আমি কখনও অবিশ্বাসের কোন কিছু করেছি বলে মনে পড়ছে না।আমাকে সব রকম পরামর্শ দেয় সব সময়, সেটা আর্থিক বা বৈষয়িক যে কোন বিষয়ে। আমার সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গাটি আখতার।আলহামদুলিল্লাহ। আজ এই দূরে বসে সিলেটের লালা খালে তোলা বেশ কিছু ছবি আখতারের জন্য পোস্ট দিলাম।আজকের এই আনন্দগুলোও তাঁর জন্য পেয়েছি।বান্ধবীরা সিলেট যাচ্ছে বলতেই তিনি বলে বসলো-তুমিও যাও!!! অনেক বড় মনের মানুষ আখতার।মহান আল্লাহ ওকে সুস্থ শরীরে মান সম্মানের সাথে দীর্ঘজীবি করুন এবং জানমালের নিরাপত্তা দিন সে দোয়া করি। সবাই আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন প্লিজ প্লিজ।
২৪/০২/২০২১-মিটুলের পোষ্টিং অর্ডার
Categories
মুদ্রার এক পিঠে যদি থাকে আফসোস, হতাশা, মানসিক যন্ত্রনা আর না পাওয়ার বেদনা, ঠিক তেমনি সেই একই মুদ্রার আরেক পিঠে থাকে সাফল্য, পাওয়ার আনন্দ আর খুশীর জোয়ার। মুদ্রার এক পিঠের দিকে তাকাইলে যেমন বুক ধড়ফড় করিয়া হার্টবিট বাড়াইয়া দেয়, নীল আকাশকেও মনে হয় ধূসর মেঘাচ্ছন্ন, তেমনি মুদ্রার আরেক পিঠে তাকাইলে মনে হয় মেঘলা আকাশও ভারী মিষ্টি। আশার জগত যখন নিরাশার বেড়াজাল কাটাইয়া প্রাপ্তির দ্বারপ্রান্তে আসিয়া এই কথা কানে কানে বলে-" আমি আসিয়াছি, যাহা আপনি অনেক দিন ধরিয়া খুজিতেছিলেন, এই সেই আমি"। এই কাঙ্ক্ষিত ঘটনা যখন নিজের চোখের সামনে দাড়াইয়া আলিঙ্গন করে, তখন ইহাকে তো অবশ্যই, যাহারা যাহারা এই কাঙ্ক্ষিত শুভসংবাদ কিংবা সাফল্যমন্ডিত করার পিছনে ভালোবাসায় শ্রম দিয়াছে, তাহাদেরকেও মনে হয় খুব করিয়া বলি- আমি আপনাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ, সবাইকে আমার অন্তর হইতে হৃদয় নিঙড়ানো শ্রদ্ধ্যা আর ভালোবাসা।
এমনি একটা কাঙ্ক্ষিত সংবাদ- আমার বউ এর পোষ্টিং। আজ আমার বউ এর পোষ্টিং হইলো, সরকারী বাঙলা কলেজ, অর্থনীতি বিভাগ, অধ্যাপক হিসাবে। অজস্র শুভাকাঙ্ক্ষী আমার জন্য আর আমার বউ এর জন্য দোয়া করেছেন, কেউ আবার সাহাজ্যও করেছেন, কেউ মনে প্রানে চেয়েছেন, আমাদের ইচ্ছাগুলি পুর্ন হোক। সেটাই অসীম দয়াময় আল্লাহতালাহ এমন একটা শুভ সংবাদ দিয়ে আমাদের সবার মনকে শান্ত আর সুখী করিলেন। (আলহামদুলিল্লাহ)
(মিটুলের পোষ্টিং অর্ডার বাহির হইবার কারনে "অধ্যাপিকা মিটুল চৌধুরী ওরফে আমার বউ" কে উতসর্গ করা।)
২৮/০১/২০২১-মিটুল চৌধুরী আসমা
মিটুল চৌধুরী আসমা তার নাম। তার মুল জন্মস্থান মানিকগঞ্জ। জন্ম ৩১সে ডিসেম্বর ১৯৬৮। মিটুলের বাবার নাম- আলাউদ্দিন চৌধুরী, মায়ের নাম- জেবুন্নেসা চৌধুরী। তারা আট বোন এবং তিনভাই। সে সবার ছোট ভাইবোনদের মধ্যে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে র্অথনীতিতে অনার্স পাশ করে মাস্টার্স করে পরবর্তীতে ১৪বিসিএস দিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে জয়েন করেন। প্রথমে তিনি মাইমেন্সিং এর মোমেনুন্নেসা মহিলা কলেজে জয়েন করেন, অতঃপর ঘিউর সরকারী কলেজ, অতঃপর ঢাকা কমার্শিয়াল কলেজ থেকে রাজবাড়ি কলেজ , মাদারীপুর কলেজ ইত্যাদি হয়ে এনসিটিবি এবং তারপর সরকারী বাঙলা কলেজে চাকুরী করেছেন। তিনি বর্তমানে প্রোফেসর এবং ডিপার্ট মেন্টাল হেড হিসাবে বাঙলা কলেজ, মীরপুরেই কর্মরত আছেন।
দুই মেয়ের মা। বড় মেয়ে আনিকা তাবাসসুম উম্মিকা বগুড়া (শহিদ জিয়া মেডিক্যাল কলেজে) মেডিক্যাল থেকে এম বি বি এস পাশ করেছে। ছোট মেয়ে সাঞ্জিদা তাবাসসুম কনিকা এবার শহীদ আনোয়ারা গার্লস কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ইউ এম বি সি (ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড, বাল্টিমোর কাউন্টি) তে ভর্তি হয়েছে, তার ক্লাশ আগামী আগষ্ট মাস ২০২১ থেকে শুরু হবে। মিটুলের স্বামী সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। মেজর হবার পর স্বইচ্ছায় অবসর নেন এবং নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন। তাদের দুটু এক্সপোর্ট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী (সুয়েটার্স ইউনিট) আছে, ওয়ান টাইমের একটা প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি আছে, আন-নূর কন্সট্রাকশন নামে একটি কন্সট্রাকশন কোম্পানী আছে। মানিকগঞ্জে আল-আব রার মেডিক্যাল ডায়গনোসিস সেন্টার নামে একটি মেডিক্যাল ইউনিটে পার্টনারশীপ ব্যবসা আছে।
মিটুল চৌধুরী তার নিজস্ব বাড়ি মীরপুরে থাকেন। এ ছাড়া তাদের বাসাবোতেও কয়েকটি ফ্ল্যাট আছে। এই গত এক বছরে মিটুল চৌধুরী তার আরো দুই বোনের সাথে জয়েন্ট পার্টনারশীপে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি মানিকগঞ্জে ৬ তালা একটি বিল্ডিং করেছে। আমি জানি সেটায় ওরা কেউ থাকবে না, তার পরেও বড় একটা ইনভেষ্টমেন্ট।
মিটুল চউধুরীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ইতিহাসটা হচ্ছে তার বিয়ের ঘটনা। আর এই বিয়ের ঘটনাটা বিস্তারীত বর্ননা আছে Diary 2 March 2021 datewise.docx#৩০/০৫/১৯৮৮- বিবাহ
অধ্যায়ে।
(চলবে)
১২/০৯/২০২০-মিতুলের করোনা পজিটিভ
Categories
যে ভয়টা পেয়েছিলাম, সেটাই হয়েছে। আজ রাত ১০টায় প্রভা হেলথ সেন্টার যারা গতকাল মিতুলের করোনার টেষ্টের জন্য স্যাম্পল নিয়ে গিয়েছিলো, তারা মেইল করে জানালো যে, মিতুলের করোনা ভাইরাস "পজিটিভ"। মিটুল প্রায় সপ্তাহখানেক যাবত এতোটাই দূর্বল আর অসুস্থ্য হয়ে গিয়েছিলো যে, এটা করোনা ছাড়া আর কোনো কিছুই না। অন্যকোনো কিছুই তার বেঠিক নয় অথচ ওর না আছে শরিরে শক্তি, না খেতে পারছে, না একটু নড়াচরা করতে পারছে। যাইহোক, আশার কথা হচ্ছে যে, মিতুলের "করোনা" আসলে আরো আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো। যা আমরা কেনো, কোনো ডাক্তার কিংবা হাসপাতালও বুঝে নাই। বারংবার বলার পরেও তারা মিতুলের "করোনা" টেষ্ট করানোর প্রয়োজন নাই বলেই তাকে অন্যান্য মেডিকেশন প্রেস্ক্রাইব করেছে। এই করোনা প্যান্ডেমিক পরিস্থিতিতে আমাদের সিএমএইচ অন্তত মিতুলের করোনা টেষ্টটা করানোর জন্য উপদেশ দিতে পারতো। আমরা শুধুমাত্র "করোনা" টেষ্ট করার ব্যাপারেও কথা বলেছিলাম কিন্তু তারা এটাকে "করোনা"র কোনো সিম্পটম নাই বলে আর উৎসাহ দেন নাই। মিতুলের সিম্পটমগুলি খুব ক্রিটিক্যাল। ওর জর নাই, কাশি নাই, অন্যান্য কোনো বাহ্যিক সিম্পটম নাই, অথচ ওর খাবার খেতে অনিহা, ঘ্রান পায় না। আর মাঝে মাঝে "আম আম" পায়খানা হয়। আজ জানলাম, এটা "করোনার" আরেক ক্রিটিক্যাল চেহাড়া। করোনার রোগীর সব সময় জর হতে হবে সেটাও না, আবার কাশি থাকতে হবে সেটাও না, করোনার অনেক চেহাড়া।
যাই হোক, মিতুল সম্ভবত ইতিমধ্যে করোনার যে শক্তিশালী থাবা, সেটা অতিক্রম করে ফেলেছে। এখন ধীরে ধীরে খাওয়ার চেষ্টা করছে। কোথাও ভর্তি করলাম না। বাসায় ট্রিটমেন্ট হচ্ছে। যেহেতু করোনার কোনো ট্রিটমেন্ট নাই, ফলে আমরা চেষ্টা করছি ওকে সাভাবিক খাবার দিতে, গরম পানি আর লেবুর চা, শরবত, সাথে কফের জন্য সুডুকফ নামের একটি সিরাপ, ম্যাগনেশিয়াম টেবলেট, ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট এবং প্যারাসিটামল খাওয়াচ্ছি রুটিন করে। আর তার সাথে স্যুপ, ফল,জুস এবং কিছু শক্ত খাবার বিশেষ করে জাউ,বার্লি, সাগু এবং নরম খিচুড়ি। মিটুল নিজেও চেষ্টা করছে যাতে শরীরে কিছুটা শক্তির সঞ্চার হয় এমন খাবার জোর করেই খেতে।
আমার ছোট মেয়েও কদিন আগে যখন মিটুল অসুস্থ্য হয়ে যায়, তখন কনিকার একটু একটু কাশি ছিলো, জরও ছিলো। ব্যাপারটা খুব আমলে নেই নাই। দুদিন পর দেখলাম, কনিকা আবার সুস্থ্য। ভাবলাম, হয়তো সিজনাল জর বা এসি চালিয়ে ঘুমায় বলে ঠান্ডা লেগেছে। আমার নিজেরও মাঝে একটু খারাপ এগেছিলো, এটাও আমি খুব একটা আমলে নেই নাই। আজ মনে হচ্ছে, করোনা আমাদেরকেও সম্ভবত টাচ করেছিলো, কিন্তু কনিকা বা আমাকে করোনা কাবু করতে পারে নাই।
আমরা এখন সবাই আরো চেষ্টা করছি যাতে অন্তত প্যান্ডেমিক আমাদেরকে আঘাত করতে না পারে। বাকিটা আল্লাহর দয়া।
১১/০৯/২০২০-মিতুলের শরীরটা ইদানিং
পরিবারের সবচেয়ে কর্মঠ মানুষটি যদি কোনো কারনে তার সচলতা কমে যায়, তার শরীর খারাপ হয়ে নিজেই বিছানায় পড়ে যায়, তার নিজের খাবারটুকুও যখন আর বানানোর শক্তি থাকে না, তখন যেটা হয় তা অবর্ননীয়। পরিবারের সবার সুখ নষ্ট হয়, বিরক্ত লাগে, কোনো কিছু যেনো হাতের কাছে পাওয়া যায় না, প্রতিদিনকার রুটিনে একটা বাধাগ্রস্থ হয়। এটা একটা পানির মেইন পাইপের মতো। ফ্লো বাধাগ্রস্ত হতে হতে সবার জীবনের মধ্যে একটা স্থবিরতা, ক্লান্তি নেমে আসে। আমার পরিবারে মিটুলের অসুস্থতা ঠিক তেমন একটা ব্যাপার দাড়িয়েছে। গত ১০/১২ দিন যাবত মিটুল অসুস্থ্য। কিন্তু কি তার রোগ এটাই যেনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। না ডাক্তার না আমি। পর পর তিনটা ইন্সটিটিউসন বদলামাম। প্রথমে ইবনে সিনা, তারপর এপোলো, অতঃপর সিএমএইচ। সবার রিপোর্ট আর ডায়াগনস্টিকে প্রায় একই কনফার্মেশন। এনোরেক্সিয়া, পটাশিয়ামের অভাব, ইলেক্ট্রোলাইট-কে এর অভাব সাথে ম্যাগনেশিয়াম। সবগুলি মেডিসিন এপ্লাই করছি কিন্তু খুব একটা ইম্প্রোভ করছে বলে মনে হয় না। সারাদিন মিটুল শুয়েই থাকে। আমি ওর জন্য অফিসে যেতে পারছি না প্রায় তিনদিন। আমিও চেষ্টা করছি যাতে মিটুল তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায় কিন্তু ব্যাপারটা আমার ইচ্ছার গতির সাথে ওর সুস্থতার গতিতে মিলছে না।
আজ সন্ধ্যায় ডাঃ নিখিলের সাথে কথা বললাম। তিনি আমাদের রিভার সাইড সুয়েটার্স এর ডাক্তার। তিনিও আজ ৪ দিন যাবত পিজিতে করোনার কারনে ভর্তি। মিটুলের যখনই কোনো অসুখ হয়, নিখিলদা ওভার ফোনেই সব প্রেসক্রিপশন করে থাকেন, আর তাতেই আল্লাহর রহমতে মিটুল ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এবারই প্রথম কেনো জানি কিছুতেই মিটুল দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে না।
একটু আগে প্রভা হেলথ কেয়ার-বনানীতে ফোন করে মিটুলের জন্য করোনার টেষ্ট করানোর জন্য হোম সার্ভিসে ফোন করলাম। ওরা আগামিকাল সকাল ১১টার দিকে বাসা থেকে স্যাম্পল নিয়ে যাবে। আমার ধারনা, মিটুলের করোনার হবার সম্ভাবনা আছে। যদিও খুব একটা সিম্পটম দিচ্ছে না। আজই প্রথম ওর জর হলো ১০১, কোনো সর্দি নাই, বুক ব্যথা নাই, কিন্তু সুষ্ক একটা কাশির ভাব আছে। আজকাল করোনাও চালাক হয়ে গেছে। বিভিন্ন মানুষের শরীরে সে বিভিন্ন রুপে আসে। হতে পারে মিটুলের ক্ষুধামন্দা আর একটু জরই হচ্ছে পিজিটিভ হবার লক্ষন। ঘ্রান পায় যদিও করোনার রোগীর ঘ্রান থাকে না। একটু একটু করে খেতে পারে যদিও কোনো টেষ্ট পায় না সে খাবারের মধ্যে। দেখা যাক, আল্লাহ ভরষা।
২৪/৫/২০১৯-এসকে সারিনের সাথে বৈঠক
ইন্সটিটিউট অফ লিভার এন্ড বিলিয়ারী সায়েন্স (আইএলবিএস) দিল্লী তথা এশিয়ার মধ্যে লিভার সংক্রান্ত চিকিৎসায় একটি নামকরা হসপিটাল। S.K. Shirin হচ্ছেন একজন আন্তর্জাতীক এবং ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ পদকপ্রাপ্ত একজন বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক। তার কাছেই আমার ওয়াইফের এপয়েন্টমেন্ট করা ছিল। এর আগে বেশ কিছু স্বাভাবিক টাইপের কিছু টেষ্ট করানোর জন্য ইতিমধ্যে হসপিটালে রক্ত দেয়া হয়েছে। আজ ২৪/৫/২০১৯ তারিখে এস কে সারিনের সাথে সরাসরি বৈঠক হবে আমাদের বিষয়ে। তাঁকে আমরা কখনো দেখি নাই। আমরা হাসপাতালের করিডোরে অন্যান্য রোগীদের মতোই ওয়েটিং এ ছিলাম। আমাদের সিরিয়াল দেয়া ছিলো। একটা রোগা পাতলা লোক হটাত করে আমাদের সামনে দিয়েই যেনো কোথায় যাচ্ছিলেন। তার পিছনে বেশ একটা দল তাঁকে ফলো করছিলো। আমরা তাঁকে চিনি নাই বটে কিন্তু আশেপাশের রোগীদের কাছে জানলাম, তিনিই এস কে সারিন। বেশ লম্বা এবং ফর্সা। আমাদের টার্ন এলো প্রায় আধা ঘন্টার পরে। বিদেশী রোগীদের আলাদা সিরিয়াল, তাই তাড়াতাড়িই হলো। অত্যান্ত সল্পভাষী কিন্তু অধিক সময় দেন তিনি। মিটুলকে বেশ কিছুক্ষন পর্যবেক্ষন করার পর কোনো প্রকারের রিস্ক নিলেন না তিনি। যা যা করনীয় সেটাই করলেন এবং একজন ডাক্তার (তার একান্ত বিশেষ ডাক্তার ডাঃ আদিত্যকে বলে দিলেন যেনো কেসটা নিজেই হ্যান্ডেল করেন। ছবিতে পাশেই অমায়িক ভংগিতে দাঁড়িয়ে আছে ডাঃ আদিত্য। আদিত্য ভালো বাঙলা বলে এবং বুঝে। জিজ্ঞেস করেছিলাম কিভাবে সে এত ভালো বাঙলা বুঝে এবং বলে। পরে জানালো যে, তার মা কলিকাতার আর বাবা দিল্লীর। তাহলে বাঙলা না বুঝার কোনো কারন নাই। ভাল লেগেছে এস কে শিরিনের প্রোফেশনালিজম। A real good doctor in his field. পরে সার্চ করে দেখলাম S. K Shirin কে নিয়ে ওয়াইকিপিডিয়া, গুগল কিংবা বিভিন্ন ওয়েব সাইট গুলিঅনেক কাভারেজ করেছে।
ডাঃ এস কে শিরিন আদিত্যকে আরেকটা ইন্সট্রাকশন দিলেন যে, মিটুলের যেনো ইমিডিয়েটলি লিভার বায়োপ্সি করানো হয় এবং সেই রিপোর্টটা আগামীকাল সকালে যখন তিনি আবার বসবেন, তখনি দেয়া হয়। দেখলাম, ডাঃ এস কে শিরিনের ব্যক্তিগত একটি ইন্সট্রাকশন পুরু হসপিটাল এমনভাবে পালন করে যেনো একটি বেদবাক্য। তিনি যা করলেন আমাদের জন্য, সেটা ধন্যবাদ দেওয়ার মতো না, আরো অনেক বড় কিছু। কোনো প্রকারের ডিলে যেনো না হয় সেটাই তিনি করলেন। আমার কাছে ব্যাপারটা একটু খটকা লাগছিলো। এমন নয় যে, এস কে সারিন এর চেয়ে আর কোনো ভালো ডাক্তার ওখানে নাই। কিন্তু এস কে সারিনকেই কেনো এতো সমীহ? পরে আরো জানলাম যে, আসলে তিনি এই আইএলবিএস হাসপাতালের মালিকদের মধ্যে তিনিও একজন।
মিটুলের বায়োপ্সি করানোর জন্য অনেক গুলি ফর্মালিটিজ করতে হলো। কোথাও টাকা জমার ফর্মালিটিজ, কোথাও আবার ওর কিছু ব্যক্তিগত ফর্ম ফিল আপ, আবার কোথাও এমন হয়েছে যে, ইন্টার ন্যাশনাল রোগি হ ওয়াতে বাড়তি কিছু ঝামেলা। এসব করতে করতে প্রায় অনেক বেলা হয়ে গিয়েছিলো। আমি অনে ডিপার্ট্মেন্টই চিনি না। ওখানে ক্লিনারের কাজ করে এমন এক লোকের সাথে পরিচয় হয়ে গেলো। ভালো বাঙলা সেও বলে। নাম তার মিষ্টিলাল। সেইই আমাদেরকে সবখানে নিয়ে গেলো। বেশী বেগ পেতে হয় নাই। প্রায় ৩ টার দিকে মিটুলের বায়োপ্সি করানো হবে, তাই আমরা এর মধ্যেই কাফেটেরিয়া থেকে যা পেলাম খেয়ে নিলাম। সাবিহা আপার জন্য এ ধরনের কোনো ঈন্সট্রাক্সন ডাক্তার দেন নাই বিধায় তিনি হোটেলে চলে গেলেন। ওনার মেয়ে আর ওনার মেয়ের জামাই (নাম নাঈম) সেও চলে গেলো। আমি আই এল বি এস হাসপাতালে রয়ে গেলাম। মিটুল খুব ভয় পাচ্ছিলো। আমার হাত ধরেছিলো যখন তাঁকে ওটিতে নেয়া হয়। যেখানে বায়োপ্সি করানো হবে, আমি সেই ইন চার্জ ডাক্তারকে আমার পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি থাকতে চাই আমার স্ত্রীর অপারেশনের সময়। তিনি বললেন, খুব ছোট একটা অপারেশন, হয়তো ১০ মিনিটেই শেষ হয়ে যাবে, আর ভয়ের কিছু নাই। যে ডাক্তার মিটুলের বায়োপ্সি করাবেন, তিনিই আমাকে তার রুমে বসিয়ে বললেন, আপনি এখানে রেষ্ট করুন, পাশের রুমেই মিটুলকে তারা অপারেশন করাবেন। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানানো হবে।
প্রায় ৩০ মিনিট পর মিটুল বের হলো, খাটে করে। তাঁকে নেয়া হবে পোষ্ট অপারেটিভ রুমে। সেটা আবার অন্য আরেক জায়গায়। মিষ্টিলাল সাথেই ছিলো। আমরা মিটুলকে পোষ্ট অপারেটিভ রুমে রেখে আসলাম। আমাকে বলা হলো যে, বায়োপ্সি রিপোর্ট টা নিজে গিয়ে তদারকী না করলে এস কে শিরিন বল্লেও সিরিয়ালে থাকার কারনে আগামীকাল হয়তো রিপোর্ট টা পাওয়া নাও যেতে পারে। এর মানে তদবির লাগবে। আমি মিষ্টিলালকে নিয়ে একেবারে পরীক্ষাগারে চলে গেলাম। সেখানে সবার যাওয়া নিষেধ ছিলো। কিন্তু মিষ্টিলাল থাকায় আর আমি বিদেশী হ ওয়ায় একটু সুবিধা হলো। পরীক্ষাগারে যিনি রিপোর্ট টা দিবেন, তাঁকে বললাম, যে, আমাদের খুব তাড়া আছে, যদি আমাদের বায়োপ্সি রিপোর্ট টা একটু প্রাইয়োরিটি দিয়ে দেয়া যায়, তাহলে খুব ভালো হয়। তিনি এটাকে টপ প্রাইয়োরিটি দিয়ে লিখে দিলেন আর বললেন, আগামীকাল সকাল ১০ টার মধ্যে হাতে পেয়ে যাবেন।
আমি এবার আবার মিটুলের পোষ্ট অপারেটিভ রুমে এলাম। দেখলাম অন্যান্য রোগীদের অনেক অভিযোগ। পানি নাই, ডাক্তার ও নাই, কিছু কিছু রোগীর এখুনী ডাক্তারের দরকার কিন্তু কোনো এটেন্ডেন্ট ডাক্তার না থাকায় অনেক রোগী চিল্লা পাল্লা করছে। বুঝলাম, যতোটা না এর সুনাম, এর দূর্নামও আছে। কিন্তু এটা এমন কেনো হবে? মানুষেরা অনেক টাকা পয়সা খরচ করে এ রকম নামীদামি হসপিটালে আসে, তাদের জন্য অবশ্যই এক্সট্রা কেয়ার থাকা উচিত। তা না হলে সরকারী আর প্রাইভেট হস্পিটালের মধ্যে তফাতটা কি? মিটুলের বেশ ব্যথা হচ্ছিলো। ব্যথার মেডিসিন অপারেশনের সময় দেয়া ছিলো কিন্তু সেটা ধীরে ধীরে কার্য ক্ষমতা শেষ হয়ে যাওয়ায় মিটুলের এখন বেশ ব্যথা হচ্ছে বলে আমাকে জানালো। আমি এ কথা কোনো ডাক্তারকে জানানোর জন্য কোনো ডাক্তারকে খুজে পেলাম না। একজন মহিলা নার্স ছিলো। সে একদিকে ডিসচার্জ লেটার লিখছেন, একদিকে নতুন রোগীর ভর্তির ফর্মালিটিজ করছেন, আবার অন্যদিকে সিরিয়াস রোগীদের কাছে যাচ্ছেন, আবার ফোন ধরছেন। আমি তার অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি একা কেনো? আর লোক কই?
উনি বুঝলেন যে, আমি রাগ করিনি কিন্তু তার অসহায়ত্তের ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করছি। নার্স খুব আক্ষেপ করে আমাকে বললেন, দেখেন স্যার, আমি একা কি করবো? স্যারদেরকে ফোন দিচ্ছি, তারা কেউ ফোন ও ধরছে না। আমি এখন কি নতুন রোগীর কাগজ লিখবো, নাকি পুরান রোগীর ডিসচার্জ লেটার লিখবো নাকি রোগীকে এটেন্ডেন্ট করবো। আমরা পেটের দায়ে কাজ করি, কেউ আমাদের অবস্থাটা বুঝে না। রোগীদের মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেছে। তখন রাত প্রায় ৯ টা। আমি আর হোটেলে ফিরে যাই নাই। সারারাত আমি মিটুলের পাশেই ছিলাম। মাঝে মাঝে সিগারেট খাওয়ার জন্য বেরিয়েছি বটে কিন্তু মিটুলের কাছেই ছিলাম, কারন কখন ওর কি লাগে বুঝা যায় না। রাতে মিটুলের ভীষন ক্ষুধা লেগেছিলো। হাসপাতালের খাবার ওর কিছুতেই সহ্য হচ্ছিলো না। খাওয়া মতো ছিলো না আসলে। আমি বাইরে গিয়ে ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে দেখি ক্যাফেওটেরিয়া বন্ধ হচ্ছে প্রায়। জিজ্ঞেস করলাম, এটা সারারাত খোলা থাকে না? তারা বল্লো, এটা বারোটার পর বন্ধ হয়ে যায়। কি তাজ্জব ব্যাপার!! আশেপাশে কোনো খাবারের দোকান ও নাই, তাহলে রোগীরা খাবার পাবে কই কেউ যদি খাবার কিনে আনতে চায়? অত্যান্ত নাজুক একটা প্রশাসনিক ব্যবস্থা। যাই হোক, বিদেশি বলে ওরা আমাকে কিছু খাবার দিলো বন্ধ করার আগে। অন্তত মিটুলকে দিতে পারবো।
পরেরদিন, মিটুলের রিপোর্ট পেতে পেতে প্রায় বিকেল হয়ে গেলো। ফলে পরেরদিন এস কে শিরিনকে রিপোর্ট টা দেখাতে পারলাম না। শুনতে পাচ্ছি যে, এস কে শিরিন নাকি ৬ দিনের জন্য আবার আসবেন না। তাহলে মিটুলের রিপোর্ট চেক করবে কে? আমরা তো এস কে শিরিনের কারনেই এই হাসপাতালে আসা। অন্য কোনো ডাক্তারের জন্য তো এখানে আসি নি। বেশ কয়েক জায়গায় ব্যাপারটা চেক করে জানলাম, এস কে শিরিনের বাইরে যাওয়ার সিডিউল চেঞ্জ হয়েছে, অসুবিধা নাই, আমরা ওনার কাছেই মিটুলকে দেখাতে পারবো।
২৬/৫/২০১৯ তারিখে আমরা এস কে শিরিনের সাথে আবার দেখা করলাম। এর মধ্যে মিটুল পোষ্ট অপারেটিভ থেকে রিলিজ নিয়েছে। এখন ভালো আছে। এস কে শিরিনি মিটুলকে বললেন যে, মিটুলের যে লিভারের সমস্যাটা হচ্ছে এটার ব্যাপারে আজো কোনো মেডিসিন আসলে বের হয় নাই। তবে ফাইজার একটা মেডিসিন প্রায় ৭৫% টেষ্ট করে বের করে ফেলছে যেটা আগামী বছরে বাজারে আসবে। এর জন্য বর্তমানে ঐ মেডিসিনটা প্রায় ১০০ জন হিউম্যান বডিতে এপ্লাই করা হচ্ছে। এখন হয়তো আরো ৩/৪ জন বাকী আছে। এস কে শিরিন সবাইকে এই সুযোগ দেন না। কিন্তু তিনি মিটুলকে এই সুযোগ দিতে চান যে, ঐ মেডিসিনটা এপ্লাই করে দেখা কাজ করছে কিনা।
আমরা আসলে ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না। তিনি বললেন যে, ফাইজার সিংগাপুর হেড অফিসে মিটুলের সমস্ত বায়োপ্সি রিপোর্ট আলাদা করে টেষ্ট করবে, ওনারা ঐ মেডিসিন টা এপ্লাই করবে এবং মাসে একবার করে ইন্ডিয়ায় ফলো আপ করাতে আসতে হবে। এর জন্য ফাইজার সমস্ত খরচ বহন করবে, আসা যাওয়ার এবং যদি কোনো কারনে কোনো পার্শ প্রতিক্রিয়া হয়, তাহলে ফাইজার বাংলাদেশে এসেও মিটুলের চিকিৎসার ভার নিবে। শুধু তাইই নয়, যদি তাদের এই মেডিসিন এপ্লাই করার কারনে মিটুলের শারীরিক কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে প্রায় ৪ কোটি সম পরিমান ক্ষতিপুরন দিতেও বাধ্য থাকবে। মিটুল এস কে সারিনকে জিজ্ঞেস করেছিলো, কেনো তিনি মিটুলকে এই সুযোগটা দিচ্ছেন। তিনি জানালেন, তারা সবাইকে এই সুযোগ দেন না তবে যারা শিক্ষিত এবং প্রাথমিক স্টেজে আছেন রোগের, আর যারা একচুয়াল ফিডব্যাক দিতে পারবেন, তাদেরকেই তিনি এই সুযোগ দিচ্ছেন। এস কে সিরিন ফাইজারের একজন উচ্চমানের কন্সাল্টেন্ট ও বটে।
তিনি এটাও বললেন যে, যদি মিটুল রাজী থাকে, তাহলে আগামীকাল এস কে সিরিনের সাথে সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ফাইজার কোম্পানীর টপ লেবেল মালিকদের সাথে এবং ডাক্তারদের সাথে কথা বলবেন। আমরা আসলে ব্যাপারটাকে ভালোমতো বুঝিই নি। তারপরেও রাজী হয়ে গেলাম। পরদিন মিটুলের সাথে এস কে শিরিনের ভিডিও এর মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে কথা বলবেন। অর্থাৎ মিটুল এবং এস কে শিরিন একদিকে, ফাইজারের অন্যান্য দাক্তার প্লাস মালিক বৃন্দ অন্য প্রান্তে। পরদিন আমরা সেটাও করে ফেললাম। অনেক কাগজ পত্র মিটুল সাইন ও করলো। কিন্তু একটা অপ্সন খোলা ছিলো যে, মিটুল চাইলে যে কোনো সময়ে এটা বাতিল করতে পারে।
আমরা আমাদের হোটেলে চলে এলাম। ব্যাপারটা নিয়ে দুজনে ভাবলাম। কারন প্রতিমাসে ঢাকা থেকে এই আই এল বি এস এ এসে চেক কারানো সহজ কথা নয় যদিও ফাইজার কোম্পানী সমস্ত খরচ বহন করবে। আবার আরেকটা ব্যাপার মাথায় এলো যে, মেডিসিনটা এখনো এপ্রোভড না, কেনো আমরা মিটুলকে গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহার করতে দেবো? আমার মীতুলের যদি কোনো কিছু হয়ে যায়, তাহলে? এবার আমরা একজন ডাক্তার বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। হতাত মনে পড়লো যে, মিটুলের এক বান্ধবী আছে কলিকাতায় থাকে-পরীর জামাই। সে মানিকগঞ্জের মেয়ে। ওনার স্বামী আর বড় মেয়ে দুজনেই দাক্তার। তাঁকে ফোন করলাম, ব্যাপারটা বললাম, তিনি শুনেই কয়েকতা কথা বললেন যে- আখতার ভাই, এস কে শিরিনের চেয়ে ইন্ডিয়ায় হাজার গুনের ভালো ডাক্তার এই লিভার বিষ্যকই আছেন যাদের সমকক্ষ নন এই এস কে শিরিন। আর কেনো মিটুলকে একটা রিস্কের মধ্যে গফেলবেন। তারা আসলে হিউম্যান বডিতে এপ্লাই করার জন্য লোক খুজে পাচ্ছেন না, আর আপ্নাদেরকে শিক্ষিত, সহজ পেয়ে এমন একটা অফার দিয়েছে। কোনো অবস্থাতেই রাজী হবেন না। মনে হলো একটা বোঝা নেমে গেলো। আমরা ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে, আমরা এস কে শিরিনের এই সিদ্ধান্তে রাজী নই। তাঁকে আমরা কিছু বল্বো না কিন্তু রাজীও হবো না। কারন যদি এই মুহুর্তে আমরা এস কে শিরিনের কোনো কথায় রাজী না হই, এম্নো হতে পারে মিটুলের চিকিৎসাটা হয়তো ভালো করে করবেই না।
আমরা আমাদের মতো করে ইন্ডিয়াতে যে কয়দিন লাগে এই এল বি এস থেকে চিকিৎসা টা করিয়েই যাই। এতে প্রায় ৭/৮ দিন কেটে গেলো। বেশ অনেক গুলি মেডিসিন দিলেন এস কে শিরিন। আমরা ৬ মাসের মেডিসিন কিনে ফেললাম যাতে দেশে এসে যদি এই মেডিসিন গুলি না পাই, তাই।
১৮/০৩/২০০৪-মিটুল, মালয়েশিয়া ট্রেনিং
আজ আমি ঢাকায় এলাম একটা বিশেষ কাজে। কাজটা হলো আমার স্ত্রী আগামী কয়েকদিন পরে বিদেশ চলে যাবে ট্রেনিং করতে। তাকে সব কিছু ঠিক ঠাক করতে হলে আমাকে অনেকগুলি এক্সট্রা ব্যবস্থা করা দরকার।
এম্নিতেই আমি থাকি খোলাহাটি, ঢাকা থেকে অনেক দূর। এর মধ্যে আমার স্ত্রী মিটুলের আবার বৈদেশিক একটা ট্রেনিং এর নাম এসছে মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ায় সে ট্রেনিং এ যাবে কিনা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো। আমি এক কথায় বলে দিয়েছি যে, তাঁর মালয়েসিয়ায় ট্রেনিং এ যাওয়া উচিত। মিটুলের সেই ১৯৮৮ সাল থেকে যা যা ক্যারিয়ারে দরকার সাহাজ্য করা তাতে আমার কখনোও কোনো কার্পন্য ছিলো না। আর এর প্রধান কারন হলো, মিটুলকে সাবলম্বি করে তোলা। আমি জানি, আমার আসলে সাহাজ্য করার মতো আশেপাশে কোনো হোমরা চোমড়া নাই। না আছে আমার বাবার দিক থেকে কোনো সাহাজ্য, না আছে আমার শ্বশুর বাড়ির দিক থেকে কোনো সাহাজ্য। ফলে যদি আমাকে কেউ সরাসরি সাহাজ্য করার কেউ থাকে সেতা হচ্ছে আমার স্ত্রী মিটুল। আর সেইই যদি ওই অবস্থায় না থাকে বা নিজের পায়ে দাড়াতে না পারে, তাহলে আমাকে বা আমার পরিবারকে অথবা আমার অনুপস্থিতিতেই বা মিটুল কিভাবে সাহাজ্য করবে? এই চিন্তা ধারা থেকেই আসলে আমি সব সময় চেয়েছি মিটুল গড়ে উঠুক।
মিটুলের মালয়েশিয়ার কোর্স টা শুরু হবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে। প্রায় ছয় মাসের মতো একটা কোর্স। সমস্যা দাঁড়াবে যে, আমিও ঢাকায় আমার বাচ্চাদের কাছে নাই আবার এবার মিটুল ও থাকবে না। উম্মিকার বয়স মাত্র আট বছর আর কনিকার বয়স মাত্র তিন। এই দুইজনের জন্য দেখভাল করার কোনো লোক ও নাই। বাজার করার লোক, রান্না বান্নার লোক, যদি মেয়েরা অসুস্থ হয়, তাদেরকে হাসপাতালে নেওয়ারও কোনো লোক নাই। তারপরেও আমি মিটুলকে মালয়েশিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্তে আওটল থাকলাম। সব কিছু নির্ভর করে আল্লাহর উপর। বাড়িওয়ালা মেজর (অবঃ) ফেরদৌস স্যার ভালো মানুষ। অন্তত দরকারী প্রয়োজনে তাঁর ডাইরেক্ট সাহাজ্য পাওয়া যাবে এটা একটা ভরষার স্থান ছিলো।
নসিরন নামে আমার বাসায় যে কাজের মেয়েটি আছে, সে অত্যান্ত ভালো একজন মেয়ে। তাঁর কোনো আত্তীয় স্বজন নাই, আমরাই তাঁর বাবা, আমরাই তাঁর মা, আমরাই তাঁর সব। আর নসিরন নিজেও এটা জানে আর এতাও জানে আমাদের বাসা ছাড়া ওর আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। সে আমার মেয়েদের কাছেও অনেক প্রিয় একজন নসি আপু। সমস্ত কাজ কর্ম নসি করতে পারে। কিন্তু কথা বলে খুবই কম। সে নিজে অসত নয় এবং তাঁর চাহিদাও অনেক বেশী নয়। আমি যেভাবে মিটুলের অনুপস্থিতিতে ব্যাপারটা সামলাবো বলে ভাবছি সেতা হলো যে, আমি প্রতি সপ্তাহে ঢাকায় এসে নিত্য নৈমিত্তিক শুকনা বাজার গুলি করে দিয়ে যাবো। আর ডেইলী বাজার যদি লাগে, পাশেই দোকান পাট আছে, তাদের কে বলে দিলে ওরাই বাসায় পৌঁছে দেবে। দোকানদারদের সাথে আমার সম্পর্কটা আমি এমনভাবে তৈরী করেছিলাম যাতে আমার বাসা থেকে একটা চিরকুট দিলেও দোকানদারগন মালামাল বাসায় কাউকে দিয়ে পৌঁছে দেন। যদি বাকীতেও হয়, তাতেও যেনো সবাই মালামাল দিয়ে দেন এবং আমি ঢাকায় এসে সমস্ত টাকা পয়সা দিয়ে দেবো।
মিটুলের খুব মন খারাপ। কারন সে অনেকদিন থাকবে না, একটা মানসিক টেনসনে আছে বাচ্চাদের জন্য। এই টেনসনটা হয়তো থাকতো না যদি আমাদের বাসায় এমন কেউ থাকতো মুরুব্বি টাইপের যারা অন্তত বাচ্চাদেরকে আগলে রাখতে পারবে। আমার মন খারাপ নয়, আমি অনেক টেনসনেও নাই কারন আমি এভাবেই জীবনে বড় হয়েছি। যাদের জীবনে অনিশ্চয়তা সব সময়ই থাকে, তারা অনিশ্চয়তাকে জীবনের স্বাভাবিক দোসর হিসাবেই ধরে নিয়ে জীবন চালাতে থাকে। আমিও ঠিক সে রকমের একজন মানুষ।
২৬/১১/১৯৯৯-মিতুলের একক ভাবনা আমি
সুক্রবার, ১১১৫ ঘণ্টা, মাঝিরা সেনানিবাস
সব কিছুর ওপর এটা সত্য, মিতুল আমাকে ছাড়া আর কাওকে ভাবে না। জিবনের শেষে যেমন মৃত্যু সত্য, মিতুলের ভাবনার মধ্যে সুধু আমি, এটাও তাঁরই মতো সত্য। আমি সুখি, মিতুলকে দেখে আমারও মনে হয় সে সুখি। তাঁরপরেও আমাদের দুজনের হয়ত অনেক পারসনাল ভাবনা থাকতে পারে এবং আছেও। এটা কোন পাপ নয়।
১৮/০৪/১৯৯৮- মিতুলকে
MY SWEETEST:
When I was coming back to Bogra after enjoying my last casual leave, I was thinking so many things standing on the platform of the ferry! And most interesting was that I was dreaming about a new baby and you. Every time I was thinking about my family (I always mean my family is yourself, Ummika, myself and mother) I always found your role was extremely significant. Nobody will understand how much sacrifice we made out of our determination and tenacity. All were possible because of you. I always care your demand. You really sacrificed lots of things for me, for us specially. No one can say that someone did something for us. That’s why our understanding became stronger, more meaningful and love becomes the every day’s power of inspiration and power of next day’s power. How many people can boast about their personal life! How many people and couple can strongly declare that both of them (husband and wife) are equally happy in their conjugal life! Even someone tells, a very few percentage may be correct and maximum will be wrong in saying so. But I declare with challenge that we both of us are equally happy and equally satisfied in our life. It is not an only dialogue but the fact of our two men-life. I have been told by lots of people that I look and act like a completely happy man, as I do not have any tension and anxiousness. This happened only because I am really a happy man because of you. 30th may, the most finest and glorious day for both of us. I will be always worshipping this day to almighty God. This is the day for which every body can not just take pride. Only few people like us can tell the story of old days to their grandsons and granddaughters. Don’t you think that this is a history! There are someone who have tremendous set back on this date because they did not want it to be happened. This is one of the reasons why people does not want to come to attend our ceremony even you give them the invitation. But in the same time I enjoy their this pain too. Wish you all the best and my best regards to you. My love and affection will be with you always and always. Have good life and good mind. May Allah make you a very honored lady to everyone in respect to all aspects.
১৮/০৪/১৯৯৮- মিতুলকে
ঢাকা থেকে ছুটি কাটিয়ে বগুরা ফেরার পথে ফেরিতে উঠার প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়েওনেক কিছু ভাবছিলাম। এবং সবচেয়েমজার ব্যাপার হচ্ছে যে, আমি এইবার প্রথম আমার নতুন বাচ্চার কথা ভাবছিলাম এবং সাথে মিটুলের কথা। প্রতিটি মুহূর্তে মি আমার পরিবারের কথাই (আমার পরিবার বলতে আমি মিতুল, উম্মিকা, আমারমা আর আমাকেই মিন করি) ভাবছিলাম। যখনি আমি আমার পরিবারের প্রতি কারকারকি কন্ট্রিবুসন আছে সেটা ভাবি, তখন যা দেখি তা হচ্ছে, তোমার কন্ট্রিবুইসন সবচেয়ে বেশি বলেই আমি মনে করি। কেউ কখনো বুঝতেপারবে না আমরা কোথা থেকে কিভাবে কি ত্যাগ করছি আমাদের ভালোর জন্য, আমাদের ভবিষ্যতের জন্য। অনেক কিছু যা এই মুহূর্তে কঠিন, তা সম্ভভচ্ছেতোমার ত্যাগের কারনে, তোমার অধ্যাবসায়ের কারনে। এটা আম্র ধারনা।
আমি তোমার প্রয়োজনীয় আশা আখাংকার প্রতি খেয়াল রাখার চেষ্টা করি, চেষ্টা করিতোমার সব চাহিদা পুরন করার। আমাদের জন্য কেউ কিছুই করে নাই। আমি চাইও না কেউ আমাদের জন্য কিছু করে আমাদেরকে বাধিত করুক। আমরা যা করছি, তা আমরাই করছি। আমরা যুগল চেস্টায় করছি। আর এই কারনেই আমি মনে করি আমাদের মধ্যে আন্দারস্ট্যান্ডিং ধীরে ধীরে আরো জোরালো হচ্ছে এবং আমরা আরো একিভুত পরিবার হচ্ছি। আমি তোমাকে নিয়ে যেমন খুশি, তেমনি আমি সুখিও বটে। কত জন কাপল আমার মতো বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে তারা সুখি এবং একে অপরের জন্য খুসি? আমি তো বলতে পারছি।
এই সব কিছুর জন্ম হয়েছিল ৩০ মে এর কারনে। এই৩০ মে তারিখটি আমার জীবনে একটা বিশাল স্মরণীয় দিন এবং এই দিন টিকে আমি পুজা করার মতো ভালোবাসি। এই ৩০ তারিখটি তোমাকে নিয়েয়ামার সাথে যে সম্পর্ক টা হয়েছিলো সেতা করতে না দিতে অনেকেই চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এটাও আমরা সার্থক করে আমাদের মধ্যে আনতে পেরেছি। এটা আমদের ইতিহাস। এটা আমার আর তোমার ইতিহাস। আমাদের এই ইতিহাস আমাদের পরবর্তী বংশধরেরা কত টুকু বুঝবে বা বুঝতে পারবে সেতা আমি জানি না কিন্তু তাদের ইতিহাস এই ৩০ মে এর কারনেই হয়েছে সেটা তারা বুঝলেই হল।
০৯/১০/১৯৮৭-মিতুলদের আগমন সেনানিবাসে
আজ শুক্রবার। সকালে আমার ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ইউনিটে অধিনায়ক হটাত করে এক মিটিং ডাকাতে আমার আর যাওয়া হয় নাই। ভেবেছি বিকালে যাবো। মিটিং শেষ হলো সকাল ১০ টায়। আমি মিটিং শেষ করেই ভাবলাম, মেসে যাই, রেডি হৈ এবং পরে ইউনিভার্সিটিতে যাই। আমি মাত্র মেসে আএসেছি, এমন সময় মেসের ফোনে ফোন এলো যে, আমার গেষ্ট এসেছে ইউনিটে। আমি ভেবে পাইলাম না কে হতে পারে আমার গেষ্ট? মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। গেলাম ইউনিটে আবার। গিয়ে দেখি, ঊহ মাই গড। মিতুল, সুরাইয়া পারভীন তানি আর তার আরো কয়েক বন্ধু আমার ইউনিটে এসে হাজির। আমাদের ইউনিট নতুন সাভারে এসেছে বিধায় অফিস, ব্যারাক আর মেস সব এক বিল্ডিং এর মধ্যে। ওরা সব ইয়াং মেয়েরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে মিটিমিটি করে হাসছে আমি যখন রক্সায় করে ইউনিটের কোয়ার্টার গার্ডের সামনে নামছিলাম। লেঃ ওমর শরীফ ইউনিটেই ছিলো, কেরানীগঞ্জের ছেলে। সিও এবং অন্যান্য অফিসাররা সবে মাত্র মিটিং শেষ করে যার যার বাসায় চলে গেছে, ফলে ইমিডিয়েটলী কোনো রি-একশন পাইলাম না বটে কিন্তু আমি জানি এটা একটা ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। কারন মেয়েদেরকে অফিসার মেসে আনা হয়ত সম্ভব কিন্তু খোদ ইউনিটের অফিসে এভাবে আনা যায় না। এটা সাংঘাতিক সামরীক আইনের পরিপন্থি বলে আমাকে সিও সাহেব কড়া নোটিশ দিলেন।
আমি ওদেরকে আপাতত রিক্সায় করে আমার মেসে নিয়ে এলাম, দেখা যাক পড়ে কি হয়। এই ঘটনায় আমি খুবই চাপে পড়ে গেলাম। এফআইইউ ইউনিট আমার পিছনে সারাক্ষন জোকের মতো লেগে গেলো। সিও সাহেব আমাকে খুবই খারাপ নজরে দেখা শুরু করলেন, উপঅধিনায়ক মুখে এক কথা বলেন বটে কিন্তু কাজে অন্য রকম। আমাদের ইউনিটের ক্যাঃ শিহাব স্যার একমাত্র আমাকে একটু মনোবল দিয়ে যাচ্ছেন। ইউনিটে অনেক অফিসাররা আছেন (মেজর খলিল, মেজর শ ওকাত, লেঃ মুনীর, লেঃ সাদাত, আরো অনেকে কিন্তু সব ব্যাপারেই যেনো আমি টার্গেট। ব্যাপারটা আমার কাছে একটা মানসিক কষ্টের কারন হয়ে দাড়িয়েছে। এম্নিতেই আর্মীতে থাকার ইচ্ছাটা মরে যাচ্ছে, তারমধ্যে আবার পরিবেশ এমন হয়ে উঠছে যে, আর্মী থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাটা যেনো তড়িত হলেই বাচি।আমার প্রতিদিনের ডিউটি বেড়ে গেলো। এমন একটা ব্যাপার ঘটলো যে, আমার কোথাও যাওয়ার আর কোনো সময় হয়ে উঠছে না। আমি মিতুলকে আমাদের ইউনিটে আর কখনো এইভাবে না আসার জন্য বলে দিলাম। চাকুরীর প্রতি আর মায়া রাখতে পারছি না। হাপিয়ে উঠেছি। এমনিতেই এই আর্মিতে আমার আসার ইচ্ছে ছিলো না, তারপর আবার এই ধরনের একটা পরিস্থিতি যা আমার চাকুরীর জন্য কোনোভাবেই সুখকর নয়। ইউনিটে যাই করি, পদে পদে সিও খায়রুল স্যার আমার ভুল ধরার চেষ্টা করেন, উপ অধিনায়কও তার সাথে আরো জোগান দেন। ইউনিটের প্রতি আমার টান বা মহব্বত অনেক কমে গেলো। ভাবছি, হাবীব ভাইকে বল্বো যে, আমি আর আর্মিতে থাকতে চাই না। নেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু কথা তো বলতে হবে হাবীব ভাইয়ের সাথে। কিভাবে কথা বল্বো?
আমি আর্মি এক্সচেঞ্জে হাবীব ভাইয়ের আমেরিকার নাম্বারে কল বুক করতে বললাম। মেজর আকবর ওসি সিগন্যাল স্ট্যাটিক। তিনিই এই সব ব্যাপারে সাহাজ্য করতে পারেন। তার সাথে কথা বললাম, তিনি আমাকে আশসাস দিলেন, কথা বলিয়ে দেবেন আমার ভাইয়ের সাথে।
০২/১০/১৯৮৭-মিতুলের সাথে ডেইলী দেখা
সাভার পোষ্টিং হওয়াতে আমার সবচেয়ে যে লাভ তা হয়েছে তা হলো-আমি প্রায় প্রতিদিন মিতুলের সাথে জাহাঙ্গীর নগর ইউনিবার্সিটিতে দেখা করতে যেতে পারি। বিকাল হলেই আমি চলে যাই ইউনিভার্সিটিতে। সন্ধ্যা পর্জন্ত ওখানেই সময় কাটাই। মিতুল জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির ছাত্রী। তারসাথে তার বন্ধুদের মধ্যে সুরাইয়া পারভীন তানি, রোজী, রোজ, রোজী দিপু, কেকা, এই মেয়েগুলির সাথেই আমার খুব বেশি ভালো বন্ধুত্ত। আমার এই প্রতিদিনের যাওয়া আসা নিয়ে সম্ভবত কেউ নজর রাখছে। কিন্তু তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। বেসিক কোর্ষ থেকে যখন হালিশহর ত্যাগ করে যশোরে আসার পথে ঢাকায় অবস্থান করছিলাম, তখন মাসুস ইকবাল আমার সাথে একদিন রাত কাটালো মীরপুরে। ওর বাড়ি রাজশাহী। এর মধ্যে ভাবলাম, আমি যেহেতু ছুটিতেই আছি, দেখা করে আসি মিটুলদের সাথে। গত কয়েকদিন আগে আমি মিটুলের সাথে সেই সাভারে গিয়ে সারাদিন কাটালাম। এটাই আসলে আমার আর মিটুলের প্রথম একান্তে সাক্ষাৎকার। আমি না ধনী পরিবারের ছেলে, না আছে আমার কাছে অনেক জমানো পয়সা। যে কয়টা পোষাক আছে সেগুলিও যে খুব একটা সিলেক্টিভ তাও না। কিন্তু আমার মধ্যে এসবের কোনো বালাই ছিলো না। আমি যা, আমি সেটাই। আমি জানি আমার ভিতরে কি আছে, আর বাইরের পোষাক দিয়ে আমার ভিতরের আমিকে না পারবো লুকাতে, না পারবো কিছু বেশী দেখাতে। মিটুলের অবস্থাও যে আমার থেকে অনেক বেশী উন্নত সেটা আমি বলছি না। আসলে আমরা উভয়েই প্রায় একই রকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। ওর যেমন না ছিলো অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা চাহিদা না সে আমাকে আমার ব্যাপারে কিছু বেশী জানতে চেয়েছে। অনেক দিনের পরিচয় না হলেও যেহেতু পাশাপাশি বাড়িতেই আমরা থাকতাম, হয়তো সে সুযোগে আমার অনেকটা পরিচয় কিংবা ব্যক্তিত্ত সে জেনেই থাকবে।
যেদিন ওর সাথে আমি সাভারে প্রথম দেখা করতে যাই, আসলে আমার পরিকল্পনাই ছিলো কিছুটা সময় কাটানো আর ওর সাথে থাকা। সাভার স্মৃতি সৌধে একটাই রেষ্টুরেন্ট, সে রেষ্টুরেন্টেই আমি আর মিটুল খুব যত সামান্য খাবারই খেয়েছিলাম। এটা নিয়ে না আমার কোনো আফসোস ছিলো, না ওর। আমরা আসলে দুজনে দুজনকেই আজীবনের জন্য পেয়ে গিয়েছি বা আমাদের মধ্যে পৃথক হবার সম্ভাবনার কথা কখনোই মাথায় ছিলো না। এতা আসলে প্রেম ছিলো না। প্রেমটা আগের জনমেই ছিলো, এখন শুধু আবার এক সাথে হয়েছি, ব্যাপারটা এমন।
প্রতিদিন যাই ওর কাছে, না গেলে যেনো দিনটাই সফল হলো না। কি যেনো করা হলো না মনে হয়। অথচ থাকি মাত্র কয়েক হাজার গজ দূরে। এক বিকাল থেকে আরেক বিকাল যেনো কাটে না। আর এর মাঝেই আবার চিঠিও লিখছি মিটুলকে, পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে নয়, ব্যাট্ম্যান আতিয়ারের মাধ্যমেই সব চিঠি আসে আর যায়। ব্যাট্ম্যান আতিয়ারই যেনো হয়ে উঠেছে আমাদের ব্যক্তিগত পোষ্টম্যান। আমাদের এই যুগল সব প্রেম আর গোপন সব কথা, ব্যথা, আনন্দ হাসির সবচেয়ে কাছের যে মানুষটি মিটুলের পাশে ছিলো সেটা সুরাইয়া পারভীন তানি। কবে থেকে যে, তানি আমাকে ‘ছোটদা’ বলে ডাকা শুরু করেছে আমার মনে পড়ে না। তবে আমি ওর আসল না হলেও প্রকৃত একজন ভাই বটে।
২৬/১১/১৯৮৬-মিতুলকে চিঠি
০৯ অগ্রায়ন, ১৩৯৩
মিতুল
এখানে সারাদিন কোলাহল থাকলেও রাত হলেই জায়গাটা একেবারে নিস্তবদ্দ আর নিঃশব্দ হয়ে ওঠে। মনে হয় লোকজন নেই, হয়ত কোনকালে ছিলও না। হাটি হাটি পা পা করে যখন সিঁড়ি বেয়ে ছাদে আসি, খোলা আকাশের নীচে দাড়াই, ঠিক তখনি সমস্ত আঁধার কিংবা জোসনা ভেদ করে নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী কোরে যেন প্রায়ই তুমি এসে হাজির হও আমার পাশে। তুমিও কি একা? রাত বাড়ে, আর তুমিও যেন আরও কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরো। কেন এমনটা হচছে? আমি কিন্তু তোমাকে নিয়ে এমন কোন অসম্ভব ভাবনা ভাবছি না, তারপরেও কেন ইদানিং এ মোহটা আমাকে চারিদিক থেকে আঁশটেপিষ্টে ঘিরে ফেলছে? আগে কোন কিছু হারানোর ভয় আমার মধ্যে কাজ করত না, কিন্তু ইদানিং কিছু একটা হারানোর ভয়ই সারাক্ষন কাজ করে। মনে হয় যদি সারাজীবন এর চাহিদা না থাকে তবে কেন এই চাওয়া? অর্ধপাওয়া যে আরও কষ্ট। আমার এ ভয়টা মূলত তোমাকে নিয়ে। কদিন যাবত আমি তোমার কোন চিঠি পাইনি। আজও পেলাম না। ভাল লাগছে না। তুমি ভাল আছ তো ? বিকেলে একটা পার্টি ছিল, ভাল লাগছিল না, তাই গেলাম না। আমি ভাল গানও গাই না আবার ভাল হারমনিয়ামও বাজাতে পারি না, কিন্তু কিছু কিছু গান হারমুনিয়মে আমি তোলতে পারি। যখন মন খারাপ থাকে, আমি হারমুনিয়ামে ঐ গানগুলো প্রায়ই বাজাই। আজ ঐ গানগোলোও ভাল লাগলো না। ভাবছি আগামী ৪ তারিখে আসব না, কারন ৬/১২/১৯৮৬ তারিখে একটা কনফারেন্স আছে। তোমাকে না পেলে আরও খারাপ লাগবে আমার ঐদিন। আমি ভাল আছি, তুমি ভাল থেক। কি লিখব আর আজ? তুমি ভালভাবে পড়াশুনা করবে, পড়াশোনার ক্ষতি করে রাত জেগে আমাকে চিঠি লেখার দরকার নেই। সময় পেলেই চিঠি লিখবে। আর আমি এটাও জানি, তুমি সময় কোন না কোন ভাবে বের করবেই। তানি ক্যামন আছে? ওকে চিঠি লিখেছিলাম, পেয়েছে কি? ওর প্রতি রইল স্নেহ আর শুভেচছা। আর তোমাকে? এক রাশ সবুজ ফুলের কিছু সুগন্ধিমাখা ভালবাসা।লাল ফুল আমার প্রিয় নয়।
আজ এখানেই।
আখতার
২৮/১০/১৯৮৬-মিতুলকে প্রথম চিঠি
১০ কার্তিক ১৩৯৩
আজকে মিতুলকে নিয়ে অনেকক্ষণ চিন্তা করার চেষ্টা করেছি। ওকে এখনো চিঠি লিখিনি, লিখব লিখব করে লেখা হয়ে ওঠছে না। আমি ভাবছি কি লিখব বা কি দিয়ে লেখাটা শুরু করব। একটা শুরু, এটা আমার কাছে যতটা না জারুরি, এটা মিতুলের কাছে ততটাই জরুরি হয়ে ওঠতে পারে। আজ ভাবছি ওকে চিঠি লিখব। ভাবছি অন্তত প্রথম চিঠিটা আমার ডাইয়েরিতে লিখে রাখব।
প্রিয় মিতুল
আপনার চিঠি পেলাম। এতদিন পর আপনার চিঠি আমাকে বেশ আনন্দ দিলেও আরও বেশি অবাক করেছে যে আপনি আমাকে অনেকদিন ধরে মনে রেখেছেন এবং আপনি আমাকে ভুলে যাননি। ভাবতেই জিনিসটা ভাল লাগছে আর মনটাও ভাল লাগছে। নাহ, আমি আপনাকে ভুলতে ভুলতেও ভুলিনি। তবে আপনার আরেক নাম যে মিতুল তা আমার জানা ছিল না। নামের কারনে চিঠিটা প্রায় হারাতে বসেছিলাম, যাক, শেষ পরযন্ত হাত ছাড়া হয় নাই আর কি। অনেকবার আপনার চিঠিটা পরলাম, তারপরেও চিঠিটা পরতে ভাল লাগছিল। খুব খুশী হয়েছি আপনার চিঠি পেয়ে। ক্যামন কাটছে আপনার ওখানে? আমি আসলে কি লিখব আপনাকে আমি এখনো বুঝে উঠটে পারছি না, তবে আপনাকে লিখতে আমার ভাল লাগছে।
চিঠি লিখবেন, আমি ও আপনাকে চিঠি লিখব। ধন্যবাদ।
আখতার
২৭/১০/১৯৮৬-মিটুলের প্রথম চিঠি
৯ কার্তিক ১৩৯৩
আজ থেকে প্রায় ৫ মাস আগে মীরপুরে যে মেয়েটির সাথে আমার সারারাত টিভি দেখা হয়েছিলো, সেই মেয়ে, মিটুল, তার কাছ থেকে আজ আমি একটা চিঠি পেলাম। আমার জীবনে আজ পর্যন্ত যে কয়টি মেয়ে চিঠি লিখেছে, তার মধ্যে সে দ্বিতীয়। প্রথম জন ছিলো কার্লা। এই কার্লার সাথে আমার চিঠি আদান প্রদান হয় প্রায় ৪ বছর। কোনো ক্লান্তি বোধ করি নাই। বারবার মনে হয়েছে, আমি কখনোই যেনো ক্লান্ত হবো না। কিন্তু শেষ অবধি তার যবনিকা হয়েছে কোনো এক মর্মান্তিক শোকের মাধ্যমে। আমি সেই গল্পটা কখনই কাউকে বলতে চাই না।
চিঠিটি পেয়ে প্রথমেই ভরকে গেলাম। আমি এটা receive করতে দ্বিধা বোধ করছিলাম কারন মিতুল নামে আমি কাউকে চিনিনা। তবুও receive করলাম এবং এটার কারনও ছিল। কারন হল মিতুল নামের ঠিক নিচেই Jahangir Nagar University লেখা ছিল। আর আমি Jahangir Nagar University তে ভর্তি হয়েছে এমন একজনকে চিনি, সেটা হল আসমা। যার কথা আমি আগেও লিখেছি। সত্যি তাই হল চিঠি খোলার পর। মিতুলই আসমা।
খুব সুন্দর চিঠি লিখেছে সে কিন্তু অতি সামান্য কথা।
“ঠিকানা ছিল না আপনাকে দেবার মত, তাই চিঠি লিখতে পারিনি। নিশ্চয়ই ভুলে যান নাই। চিঠি লিখলে খুশী হব। আমাকে লেখার ঠিকানা দিলাম। চিঠির অপেক্ষায় থাকলাম।“
উপরে নীচে কোথাও কোনো সম্বোধন নাই। আমি কি বন্ধু, নাকি ভাই, নাকি প্রিয় কেউ, কিছুই উল্লেখ নাই। এলাকার ভাই হলে এক কথা, নাও না। আবার প্রিয় কেউ হলে অন্য রকমের সম্বোধন হবে। আর ও ট আমার বন্ধু হয়েই উঠেনাই এখনো। হয়তো সময়ই বলে দেবে কি সম্বোধন হবে কোনো এক সময়।
আসলে মিতুলকে আমি প্রথম দিন যতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম ও তার থেকেও বেশি বাস্তববাদী । আর একারনেই ও আমাকে নির্ভয়ে চিঠি লিখেতে পেরেছে। বাংলাদেশটা এখনো অতটা আগায় নাই যেঁ ইচছে করলেই একটা মেয়ে নির্ভয়ে অন্য একটি ছেলেকে চিঠি লিখেতে পারে। এটা একটা সাহসের ব্যপার। এ সমাজে আমরা যারা বাস করি, হয়ত এটা আগের শতাব্দির বা যুগের থেকে অনেক এগিয়ে আছে কিন্তু এর মানে এই নয় যে, প্রকাশ্যে আমরা এতা বলার সাহস করতে পারি যে, আমি অমুককে ভালোবাসি, অথবা অমুক আমাকে ভালবাসে। হয়ত এমন একটা যুগ সামনে এম্নিতেই আসবে যখন বাবা-মাই জিজ্ঞেস করবে, কেনো তাদের বাচ্চাদের কোন প্রিয় মানুষ নাই। এখন যেমন প্রিয় মানুষ থাকলে বাবা মায়েরা, অভিভাবকেরা অসস্থিতে ভোগেন, হয়ত এমন একটা সময় আসবে যখন বাবা মায়েরা কেনো তাদের প্রিয় মানুষ নাই তার জন্য অসস্থিতিতে ভোগবেন। আর এটাই হচ্ছে সময়ের বিবর্তন।
মিটুল আমাকে চিঠি লিখতে পারে নাই কারন তাকে আমার চিঠি যাওয়ার কোনো ঠিকানা সে দিতে পারে নাই। ওর বাসায় আমার চিঠি যাক, এতা যেমন ওর জন্য সস্থিদায়ক নয়, তেমনি আমার জন্যেও নয়। আর এখন যেহেতু সে ইউনিভার্সিটির হলে থাকছে, ফলে ঠিকানা একটা তো পাওয়াই গেলো যেখানে সব কিছুই রক্ষা হয়। যোগাযগের ব্যাপারটা থাকলো কিন্তু বাড়িতে গোপন রইলো। ব্যাপারটা এটাই ঘটেছে ওর বেলায়।
আমাদের বাড়ীর অথবা মিতুলদের বাড়ীর কেউ এখনো জানে না আমাদের এই যোগাযোগের ব্যাপারটা । আমি জানি তারা কেউ এইসব ব্যাপারে জানলে খুব একটা খুশিও হবে না। আর এ ব্যাপারে আমিও খুব একটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নই। কারন আমি আমার পরিবারকে চিনি, আমি বদি ভাইকে চিনি, আমি হাবিব ভাইকে চিনি, তারা আর যাই হোক হিটলারের বংশধর ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু আমি আগাগোড়া নিজের পছন্দেই কাজ করতে ভালোবাসি। আমার মতামতকে আমি সম্মান করি। তাতে অন্য কারো মতামত আমাকে আমার মতামতের উপরে স্থান দেবো সেটা সাবজেক্টের উপর নির্ভর করে। মিটুলের ব্যাপারতা নিয়ে আমি কোনভাবেই দিধাগ্রস্থ নই। কেউ যদি জানেও, আমার এইটুকুন সাহস আছে তা মুখুমুখি হবার।
মিতুল সম্পরকে আমার কিছু মন্তব্য আমি আগেই করেছিলাম যদিও আমি তাকে মাত্র একটা পুরা রাত দেখেছি, একসাথে বসে টিভি দেখেছি। তাতে আমার যে ধারনাটা হয়েছে সেতা আবারো বলি, সে একেবারেই একটা সাধারন গোছের কঠিন প্রত্যয়ের মানুষ। প্রশংসায় খুশী হয়ত হয় কিন্তু সে নিজে জানে কোন প্রশংসা তার জন্য অতিরঞ্জিত আর কোন প্রশংসা তার জন্য প্রযোজ্য নয়। গা ভাসিয়ে দিয়ে আপ্লুত হবার মেয়ে সে নয়। তার মধ্যে আরো একটা গুনাবলী আমি মার্ক করেছি যে, অযাচিত ভাবে কারো ব্যাপারে মন্তব্য করাকে তার পছন্দের মধ্যে পড়ে না। অল্পতেই খুসী থাকার চেষ্টা করে। বলতে গেলে একটু সাহস রাখে সব কিছুতেই। এদেশের অধিকাংশ মেয়েরা হয় বাবা মায়ের নাম বেচে তার অস্তিত্ব জানান দেয়, অথবা যাদের নাই, তারা নিজেকে প্রতিষ্টিত করার চেষতা করে। আমার কাছে মনে হয়েছে মিটুলের ব্যাপারে দ্বিতীয়টা খাটে।
যাই হোক, অনেকদিন পর ওর চিঠি পেয়ে আমারো অনেক ভাল লাগছে, মনে হচ্ছে আমি ওর চিঠির জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। আজ সে চিঠিটা এসেছে। আমি কি ওকে খুজছিলাম? আমি আসলে কাকে খুজছিলাম? আমি ওর জন্যে বা ওর চিঠির জন্য কতোটা অপেক্ষায় ছিলাম, সেটা এই চিঠি পাবার আগে অতোটা খুচিয়ে দেখিনি, তবে মনে হলো, আমি অনেক অনেক খুশি হয়েছি।
কিছু কিছু কথা আমার মাঝে মাঝে “কাকে” যেন বলতে ইচছে করে। কিন্তু সেই “কাকে” পাই কোথায়? বড় বউদিকে মাঝে মাঝে বলি কিন্তু সব কি আর তার সাথে বলা যায়? কখন কখন এমদাদ কে শেয়ার করি, কিন্তু সে তো আর সেই “কাকে” নয় ।
মিতুল অনেক কিছু জানতে চেয়েছে। আমি কেমন আছি, আমার দিন কেমন যাচ্ছে, ইত্যাদি। কি জানাবো ওকে? আমি যদি বলি, আমি ভাল নেই, কি হবে এতে? আমি যদি বল, আমি মাঝে মাঝে হারিয়ে যাই, কিভাবে নেবে সে? আমি যদি বলি, আমি কাওকে ভালবাসতে চাই, কি করতে পারবে সে? আমি সেই “কাকে” চাই। ও কি সেই “কাকে”?
তারপরেও আমি ওকে চিঠি লিখব।
১৮/০৯/১৯৮৬-৭ই মে এর সেই মেয়েটা

মিটুল চৌধুরী, এটাই সেই ৭ মে তে দেখা মেয়েটি।
হটাত করে মনে পড়ে গেল একদিন একটা মেয়ের সাথে আমার দেখা হয়েছিল ৭ মে তে। কেনো দেখা হলো, কি কারনে দেখা হলো এই প্রশ্ন অবান্তর। পাশাপাশি বাসা, কেনো আগে দেখা হয়নি সেতাও যেনো একটা প্রশ্ন। বাইরে ছিলাম। যশোর সেনানীবাস থেকে ১০ দিনের ছুটিতে আছি, বেসিক কোর্ষের কারনে। এখান থেকেই আমি হালিশহর যাবো প্রায় এক বছরের একটা কোর্ষ করতে। কোনো কাজ নাই, সারাক্ষনই বাইরে বাইরে থাকি। লেঃ ভাওয়ালী আমার খুব ভালো বন্ধু, ফলে বেশীর ভাগ সময় আমি ওর সাথেই ঢাকার বিভিন্ন বন্ধুদের বাসায় আড্ডা দেই। কখনো দুপুরে ফিরি, কখনো ফিরতে ফিরতে রাত ও হয়ে যায়। বদি ভাই কিছু বলেন না, আর বলার কোনো কারন ও নাই। আমি কোনো অন্যায় করে বেরাচ্ছি না। আজ কোথাও যাওয়া হয় নাই। হয়তো দুপুর গড়িয়ে গেলে বিকালের দিকে বের হবার সম্ভাবনা আছে। বাসাতেই ছিলাম কিন্তু বদি ভাইয়ের সাথে বাজারে গিয়ে সকাল ১০ টার দিকেই বাসায় হাজির আমি। তখনি ওর সাথে দেখা হয়েছিলো। ভাবীর সাথে কি যেনো গল্পে গল্পে কিছু রান্নাবান্নার কাজে শরিক হয়েছিলো। সেদিন ওর মধ্যে একটা জিনিষ আমি লক্ষ্য করেছিলাম, ও ভাল মা হবে। ভাল বউ হবে কিনা জানিনা, আমিতো আর বিয়ে করিনি যে বুঝবো কি দেখলে বোঝা যাবে ভাল বউ হবে কিনা। তবে সব মানুষের উঠতি বয়সের কিছু লক্ষন ভবিষ্যতের কিছু লক্ষন তো থাকেই। আমি যেদিন ওকে দেখেছিলাম, বুঝেছিলাম যে, অন্য ১০ টি মেয়ের মতো ওর উচ্চাকাংখ্যা এই রকম নয় যে, যে করেই হোক, আমাকে বড় হতে হবে, আমাকে ধনী হতে হবে অথবা পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝি বা না বুঝি আমার এই চাই আমার ঐ চাই, ইত্যাদির মতো মনে হয় নাই।
কিছু কিছু মানুষ বড় হয় মনে মনে। "মনে মনে বড় হওয়া" আবার কি জিনিষ? এটা হচ্ছে সেটা যা আমার মনে আছে আমি করবো, আমি হবো, বা আমি ওটা করে ঐটা করতে চাই। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আবার অসত উপায়েও সেটা অর্জন করতে নারাজ। ফলে, প্রতিদিনের কর্মে, প্রতিদিনের চেষ্টায় একটা প্রত্যয় সব সময়েই থাকে মনের গোপন স্বপ্নগুলিকে নিজের ক্ষমতায় রূপ দেয়া। এর জন্য যা যা প্রয়োজন, যতোটুকু চেষ্টার প্রয়োজন, সেটা নিয়ে লেগে থাকা। যদি এই চেষ্টায় সফল হয় তো ইচ্ছে পুরুন হয়ে গেলো। আর যদি চেষ্টা সফল না হয়, তাতেও কোনো দুঃখ নাই, কারন ক্ষমতা তো ছিলোই না সব সপ্নগুলি পুরনের। কারো উপরই দোষ চাপিয়ে দেয়া যায় না সপ্ন না পুরন হবার জন্য। আমি ওর মধ্যে এই রকম একটা উজ্জ্বল মনোভাব দেখেছি। আমার এই কথার মানে কিন্তু এটা নয় যে, সে অতি মানবী। হতে পারে কোনো একদিন হয়তো ও ওর স্বপ্নগুলিকে বাস্তবায়ন করতে পারবে। আমি ওর অন্যান্য সব বোনগুলিকে দেখি নাই কিন্তু যে দুজন বোন মীরপুরে আমাদের বাসার পাশে থাকে তাদের দেখেছি। বিস্তর একটা ফারাক চোখে পড়ে। ওরা ৮ বোন আর ৩ ভাই। আমি কাউকেই (শুধুমাত্র মীরপুরের ২ বোন ছাড়া) দেখি নাই। শুধু সেই রাতে ওর সাথে কথা বলে যা বুঝেছি, তা হলো, মনে মনে বড় হবার একটা তীব্র আখাংকা আছে।
একটু একটু করে ভাবছি ওকে, আবার একটু একটু করে মনেও করছি। একটু একটু ভালোও লাগছে।