Pandu Lipi
০৪/০৮/২০২৩-মানুষ একাই ছিলো, একাই থাকবে
এক যুগের অধিক কোনো একটা স্থানেও যদি কেউ বসবাস করে, সেই জায়গার গাছপালা, রাস্তাঘাট, আশেপাশের চেনা পথচারী, বাড়িঘরকেও মানুষ ভালোবাসতে শুরু করে। হোক সেটা কোনো ভাড়াটে জায়গা বা কোনো বিদেশভূমি। আর কেউ যখন এক নাগাড়ে কারো সাথে যুগের অধিক মারামারি, কাটাকাটি করেও একসাথে এক ছাদের নীচে বসবাস করে, তাকে তো দূরে সরিয়ে দেয়া আরো সহজ হবার কথা নয়। আর যদি সেই যুগল বন্ধন হয়ে থাকে কোনো এক সময়ের উজ্জিবিত ভালোবাসার কারনে, তাহলে এই বিচ্ছেদে সেটাই হবার কথা যেনো নিজের অনিচ্ছায় নাড়ির ভিতর থেকে সমস্ত অনুভুতিকে টেনে হিচড়ে জীবন্ত কেটে ফেলার মতো। যদি এরুপ ঘটনা আপনার চোখের সামনে ঘটতে দেখেন, তাহলে বুঝতে হবে যে, হয় (ক) সম্পর্কটা কখনোই নিজের ছিলো না এবং এই সম্পর্কের মধ্যে পারষ্পরিক ভালোবাসা আর মহব্বতের পাশাপাশি এমন কোনো সার্থ ছিলো যা বৈষয়িক এবং অনেকটাই লোভের। সেই লোভ হতে পারে দৈহিক, হতে পারে কোনো সম্পদ বা সম্পত্তি, হতে পারে কোনো সিড়ি যা কিনা নিজের ব্যবহারের জন্য শুধু একটা অবলম্বন হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিলো। অথবা (খ) আরেকটা হতে পারে যে, সম্পর্কটাকে কেউ সম্মানই করেনি। তিলেতিলে গড়ে উঠা ছোট ছোট বিদ্বেষ, ছোট ছোট অবহেলা, কিংবা নির্যাতন পুরু সম্পর্কটাকে এমন স্থানে নিয়ে গেছে যেখানে কেউ কাছে আসার জন্য আর কেউ চেষ্টাই করে নাই। তারা সব সময় এক সাথে থেকেও আলাদাই ছিলো। অথবা আরেকটা হতে পারে (গ) এই সম্পর্কের মধ্যে এমন আরেকজন ঢোকে পড়েছে যা অতীতের সব মোহ, সব ভালোবাসা, সব আবেগকে মিথ্যা প্রমানিত করে বর্তমানের সাময়িক মোহ, অনুভুতি কিংবা তার পারিবারিক পরিস্থিতির উপর ভর করে বসেছে। সবচেয়ে করুন যেটা হতে পারে সেটা আমাদের কারো হাতের মধ্যে থাকে না। আর সেটা হলো (ঘ) সম্পর্কে জড়ানো কারো যদি হটাত অসময়ে ম্রিত্যুর মতো কোনো ঘটনা ঘটে।
সর্বশেষ পরিস্থিতি বাদ দিয়ে অন্য যে কোনো পরিস্থিতির আলোকে বলছি- যদি এমন কোনো সম্পর্ক-বিচ্ছেদের মধ্যে কেউ আবর্তিত হয়েই যায়, মনে রাখা উচিত, নতুন সেই সম্পর্কটাও একদিন এমনভাবে ফিকে হয়ে যাবে, যা আজকের দিনের ফিকে হওয়ার চেয়েও খারাপ। তাই, একবার কখনো যদি কোনো সম্পর্কের মধ্যে কেউ ঘোলাজলের অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, তাকে নতুন আরেকটা সম্পর্কে জড়ানোর আগে উভয়ের আদিপান্ত সব কিছু চুলচেরা বিশ্লেষন করে অতঃপর সম্পর্কে জড়ানো উচিত। বিশ্লেষন করা উচিত কিসের ভিত্তিতে আসলে নতুন এই সম্পর্কটা তৈরী হচ্ছে। সব সময় এর অন্তর্নিহীত কারন হয়তো বের করা সম্ভব হবে না কিন্তু যথেষ্ঠ পরিমানে সময় নিয়ে, আবেগের স্থানটুকু, মোহের কারনগুলি নিঃশেষ হতে দিন, তারপর নির্যাস টুকু বুঝার চেষ্টা করুন। হয়তো কিছুটা হলেও আচ করা সম্ভব। কেননা, উপরের যে তিনটা কারনের কথা বলছি, সেটা যে আপনার জীবনেও ঘটবে না, তা আপনি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না। হতে পারে, আপনার থেকেও তার মতে উত্তম আরো কেউ চলে আসবে এই সম্পর্কের ভিতর যেখানে আপনি তার কাছে, তার মোহের কাছে, তার লোভের কাছে, তার ভাবনার কাছে কিছুই না। হয়তো বা নতুন মানুষটি তাকে আবারো কোনো এক নতুন সপ্ন দিয়ে হাতছানী দিচ্ছে। হতে পারে আপনার কাছ থেকে যতটুকু সে আশা করেছিলো তার হয় প্রাপ্তি শেষ অথবা আর কিছু পাবার সম্ভাবনা নাই বা হতে পারে সেই পুরানো অভ্যাস, অবহেলা, কুরুচী ইত্যাদি আবার তার মধ্যে জাগ্রত হয়েছে যা আপনি কখনো ভাবেনই নাই।
এটা শুধু মানুষের বেলাতেই ঘটে। এরুপ ঘটনার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে করতে মানুষ এক সময় এতোটাই অভিজ্ঞ হয়ে উঠে যে, তখন কাউকে শুধু উপদেশ দেয়া ছাড়া নিজের জন্য আর কোনো কিছুই করার থাকে না। মানুষ আবারো একাই হয়ে যায়।
মানুষ সবসময় একাই ছিলো। পারিপার্শিক দায়বদ্ধতার কারনে, নিজেদের একা থাকার বিপদজনক পরিস্থিতি থেকে রক্ষার কারনে আর কিছুটা মোহের কারনেই মানুষ দলবদ্ধ হয়, সংসারী হয়। পৃথিবীতে হাজার হাজার উদাহরন আছে যেখানে মানুষ লোকারন্যে থেকেও একাই জীবন যাপন করেছে এবং করছে। এই আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় এর সংখ্যা ধীরে ধীরে আরো বেড়ে যাবে, কেউ কারোই থাকবে না তখন।
০৩/০৭/২০২৩-মাধুরীর চিঠি-২
অনেক অনেক দিন পার হয়ে গেলো। না আমি আর তোমার সাথে কোনো যোগাযোগ করেছি, না তুমি। জীবনের ব্যস্ততা মানুষকে এমনভাবে কোনো এক চক্রএর মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ায় সেটা বুঝা খুব সহজ না। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন মানেই কি পিছলে পড়া পথে হাটু গেড়ে বসে পড়া? নাকি সেই পিচ্ছিল পথ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে কোনো এক পাহাড়ের পাদদেশে এসে পতিত হয়ে আবার সেখান থেকে নতুন করে বেড়ে উঠা? হয়তো দুটুই ঠিক। কেউ পাহাড়ের চূড়ায় উথে নামার ভয়ে হাহাকার করে, আবার কেউ পাহাড়ে উঠতে না পেড়ে হাহাকার করে। কেউ কারো অবস্থানে সুখী নয়।
যাই হোক, এসব কথা আর না বলি। তবে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কি এখনো খুব সহজে সব কিছু ভুলে যাও? কিংবা হাতের কাছে তোমার দরকারী কাগজটি না থাকলে কোথায় রেখেছো সেটার জন্য আমার নাম ধরে চেচামেচি করো? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। তখন হয়তো এরকমের চেচামেচি ভালো লাগতো না, কিন্তু আজকে মনে হয় তোমার সেই চেচামেচিকে আমি খুব মিস করি। মনে হয় খুজে খুজে তোমার ঠিকানাটা বের করে আরো একবার যদি তোমার সেই কন্ঠসরটা শুনতে পেতাম!! কিছু একটা খোজার বাহানা করে আমি সারাক্ষন মাঝে মাঝে আসলে হয়তো এখনো তোমাকেই এই আজব পৃথিবীর মানুষগুলির মধ্যে খুজি। আমি জানি না হটাত কখনো যদি তোমার সাথে আমার আবার দেখা হয়ে যায়, তখন আমি কি করবো। জড়িয়ে ধরবো? নাকি এড়িয়ে যাবো? নাকি দূর থেকে তোমার চলে যাওয়া দেখবো। আমি জানি, তুমি আমাকে ভুলে যেতে চেয়েছিলে, কিন্তু আমার জগতে তুমিই ছিলে একমাত্র মানুষ যাকে আমি কখনো ভুলতে চাই নি। আমি তোমাকে পাইনি বটে কিংবা তুমি আমাকে ছেড়েছো বটে কিন্তু পেরেছো কি? আমি পারিনি।
বৃষ্টি ভেজা রাতে নীরবে যখন আমি আমার বারান্দায় বসে অতীতের ভালো লাগা কোনো একটা গানের কলি শুনি, আমাকে নিয়ে যায় সেই রাতে যখন আমি তোমার হাতে হাত রেখে উচ্ছল ধরনীর শীতল মাটিতে নেচে বেড়াতাম। আমার ভেজা চুল বেয়ে বেয়ে জোনাকীর মতো পানির ফোটা ঝরে পড়তো, আর তুমি সেটা চিপে চিপে ধরে বলতে –আহা, কি সুন্দর, যেনো মুক্তার মত। তোমার ছাদের কোনায় কি এখনো অই ছোট জবা ফুলের গাছটা আছে? আমি লাগিয়েছিলাম। তুমি কাটাজাতীয় ফুল পছন্দ করো না জেনেও আমি গাছটা লাগিয়েছিলাম। কতদিন জবা ফুল তুলতে গিয়ে হাতে কাটা বিধেছিলো আর তুমি বারবার আমার হাতে মলম লাগিয়ে বলতে কেনো কাটা গাছটাই রাখতে হবে ছাদে? অথচ তুমি গাছটা নিজেও কখনো কেটে ফেলোনি, বরং প্রতিদিন এর গোড়ায় পানি দিতে। কি আজব না? তোমার অপছন্দের একটা গাছ, তুমি কেটে দিলে না, পানি দাও, এটাকে বড় করো, যত্ন করো, অথচ তাকে তুমি পছন্দ করো না। আমাকে তুমি পছন্দ করতে, আদর করতে, আমার কষ্টে তোমার কষ্ট হতো, আমার আনন্দে তুমি আনন্দিত হতে, অথচ তুমি আমাকে চিরতরে কেটে দিলে। কাটতে পেরেছো? ওই জবা ফুলের গাছটার কাছে গেলে তোমার মন উদাসীন হয়ে উঠে না? হয়তো গাছটা আর নাই, অথবা আছেও। আমি তো আর জবা গাছ নই। আমার ভাষা ছিলো, অনুভুতি ছিলো, সব ছিলো, তাতেও তো আমি তোমাকে আমার ভিতরের অনুভুতি দিয়ে বুঝাতে পারিনি, কি ছিলে তুমি আমার। আর সেটা তো একটা ভাষাহীন জবা গাছ। সে তো তোমার কিছুই ছিলো না। আছে গাছটা? তাড়িয়ে দাও নি তো?
মাঝে মাঝে আমার খুব তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে। কেনো দেখতে ইচ্ছে করে, সেই সঠিক উত্তর আমার জানা নাই। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, চিৎকার করে হাউমাউ করে কাদি। যদিও জানি, আজকালকের মানুষগুলির আবেগ, অনুভুতি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এখন মানুষেরা আর হাউমাউ করে কাদে না, মানুষ কি ভাববে বলে। প্রান খুলে হাসে না, লোকে বোকা ভাববে বলে। এই চাপা হাসি আর বোবা কান্না মানুষ গুলি এতো অসহায়। তাই মানুষগুলি একা একাই বেচে থাকার মধ্যে প্রান খুজে বেড়ায়। আসলে আমরা সবাই একাই। এই একা জীবনে আড্ডা দেয়া যায়, গল্প করা যায়, কিন্তু সে পর্যন্তই। এর মানে যে, নিঃসঙ্গতা যে কাজ করে না এমন নয়। এই নিঃসঙ্গ জীবনের ও একটা মাধুর্যতা আছে। সেখানে আমিই সব। এর মানে এই নয় যে, আমি রক্তমাংশে গড়া কোনো আপনজনের অভাব অনুভব করিনা।
আমি এখনো মাঝে মাঝে ভাবি- আমি কি অন্য দশজন মেয়ের মতো জীবন সংগী বেছে নিঃসঙ্গতা কাটাতে পারতাম না? হয়তো পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করতে পারিনি। কারন আমরা আমাদের জীবনসংগী বাছাই করি কথা শোনার জন্য, কথা বলার জন্য, যার সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগে, যার কথা শুনলে বছরের পর বছর সুখে দিন পার করা যায়। কিন্তু এটাও ঠিক যে, মাঝে মাঝে আমরা জীবনসাথী বাছাই করি তার রুপ, তার সউন্দর্য, তার অর্থবৈভব, তার সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি বিবেচনা করে। কিন্তু আমরা মাঝে মাঝে এটা ভুলেই যাই, সেই জীবনসাথী যাকে আমরা বাছাই করলাম, তার সাথে কারনে অকারনে, সময়ে অসময়ে আমার মনের কথাগুলি তাকে বলতে পারবো কিনা কিংবা সে আমার সেই সব ছোট ছোট অনুভুতি গুলির মুল্যায়ন করবে কিনা। যদি এর কোনো পরিবর্তন হয়, আর ঠিক তখন দেখা যায় যে, আমার বাছাই করা সাথী আমার কথাগুলি শুনতেই তার বিরক্ত লাগছে, কথায় কথায় ঝগড়া লেগে যাচ্ছে, আর তখন সম্পর্কগুলিতে মরচে ধরা শুরু করে। এটা একটা অনিশ্চিত পরীক্ষা। যাকে চিনিনা, যাকে কখনো অন্তরে রাখিনি, যে আমাকে জীবনের ৩০ বছর কোথাও জায়গা দেয় নি, হটাত করে তার সেই অন্দর মহলে আমি ঢোকে কতটা স্থান দখল করতে পারবো? সেখানে তো আরো হাজার হাজার ভাবনা, হাজার হাজার বিক্ষিপ্ত অনুভুতি, কিংবা অনেকের বসবাস রয়েছে। আমি কি হটাত করে এসেই তার সেই সব ভাবনা, অনুভুতি, আর অন্য মানুষদের পদরেখা ধুয়ে মুছে আমার নিজের করে দখল নিতে পারবো? হয়তো এটা কখনোই সম্ভব না। তাই আর আমার কোথাও যাওয়াওই হলো না।
একটা জিনিষ জানো? লেখকের কোনো লেখা পড়ে যতোটা পাঠক মুগ্ধ হয়, তার থেকে বেশী মুগ্ধ হয় পাঠক যখন তার সাথে সামনে বসে কথা বলে।
২৭/০৪/২০২৩-অসুস্থ্য সমাজ
বয়স হয়ে গেছে প্রায় ৬০ এর কাছাকাছি। অনেক লম্বা সময়।
সেই শিশুকাল, কিশোর কিংবা যৌবনের সময়টা এখনো যেনো খুব পরিষ্কার মনে পড়ে। গ্রামের মেঠোপথ ধরে স্কুল মাঠ থেকে ঘর্মাক্ত শরীরে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা, কাধের উপর থরে থরে সাজানো বই নিয়ে স্কুলে যাওয়া, বৈশাখী মেলায় হরেক রকমের বাশি বাজিয়ে বাজিয়ে হই হুল্লুর করা, বৃষ্টির দিনে দুরন্ত কিছু বাল্যবন্ধুকে নিয়ে মাঠে ফুটবল খেলা, স্কুলে শিক্ষকদের পড়া না পাড়ার কারনে শাসিত হওয়া, আরো কত কি!! সবকিছু পরিষ্কার মনে আছে।
এই লম্বা সময়ে পরিবারের অনেকের সাথে, পাড়া পড়শী কিংবা জানা অজানা কত বন্ধুবান্ধবদের সাথে অনেকগুলি সময় কাটিয়েছি, কেউ কেউ এর মধ্যে জীবনের সব লেনদেন শেষ করে একে একে ওপারে চলে গেছে, আর সাথে নতুন জীবন নিয়ে আরো অনেক নতুন মুখ আমাদের সাথে যোগ হয়েছে। আমরা যারা আজো বেচে আছি, তারা সেই চলে যাওয়া মানুষগুলির সাথে আর নতুন মানুষদের যোগ হবার মধ্যে একটা সেতু বন্ধন করে আছি। আমরা সেই চলে যাওয়া মানুষগুলির কথা নতুনদের মাঝে আদান প্রদান করলেও তাদের সময়ের চিত্র আজকের দিনের মানুষগুলিকে শতভাগ বুঝানো হয়তো যায় না। কিন্তু আমাদের স্মৃতির পাতায় সেগুলি এখনো উজ্জ্বল হয়ে রয়ে গেছে। আমরাও একদিন তাদের মতো চলে যাবো, আর আজকের নতুন যোগ দেয়া মানুষগুলিও সেই একই সেতু বন্ধনের মতো কাজ করে আগত নতুন মুখগুলির সাথে একটা ব্রীজ তৈরী করবে। এভাবে ক্রমাগত একটা সাইকেল চলবে।
এরমধ্যে যুগ পালটে যাচ্ছে, এই যুগের মানুষগুলির সাথে সেই যুগের মানুষগুলির মধ্যে অনেক ফারাক হয়ে গেছে। সন্ধায় এখন আর আড্ডা বসে না, মাঠে আর বড়রা গোল হয়ে বসে তাস খেলে না, ছোট ছোট পোলাপানেরা এখন আর ডাংগুলি খেলে না, মেয়েরা এখন আর দলবেধে কলশী কাখে নিয়ে নদী থেকে ভিজা কাপড়ে জল তুলে আনে না, রাখালেরা এখন আর সেই ভাটিয়ালী গান গেয়ে গেয়ে বাড়ি ফেরে না। এখন সবাই সবাইকে নিয়ে একা একাই সময় কাটাতে পছন্দ করে। ফোনের ভিতরে চলে গেছে আজকের দিনের মানুষগুলির জীবন। যে জরুরী খবরটা মাসীকে দেয়ার জন্য, কিংবা জরুরী কাজের নিমিত্তে কাউকে হাট বাজার থেকে ডেকে আনার জন্য রোদ পেড়িয়ে মাইলের পর মেইল হেটে গিয়ে কাজটা করতে হতো, সেটা আর এখন দরকার পড়ে না। শুধু একটা মিসকল দিলেই কিংবা মেসেজ ঠুকে দিলেই সব যেনো হয়ে যাচ্ছে। এতো কিছু থাকতেও আমরা আজকে জেনারেশন থেকে জেনারসনে ডিসকানেক্টেড হয়ে যাচ্ছি। অথচ আরো বেশী কানেক্টেড থাকার কথা ছিলো।
সবাই ক্লান্ত এখন। সবাই অসুস্থ্য বোধ করে এখন। বড়রা ক্লান্ত, ছোটরা ক্লান্ত, মালিকেরা ক্লান্ত, শ্রমিকেরা ক্লান্ত, রোগীরা ক্লান্ত, ডাক্তাররা ক্লান্ত, ছাত্ররা ক্লান্ত, শিক্ষকরাও ক্লান্ত। ঘরে স্ত্রী ক্লান্ত, স্বামীও ক্লান্ত, কাজের বুয়া শুধু আজো ক্লান্ত নয়। হয়তো সেও কয়েকদিন পর ক্লান্ত হয়ে যাবে। পোষ্টম্যান বেকার, পোষ্টমাষ্টার বেকার, অথচ তাদের কারোরই সময় নাই হাতে। সবাই ব্যস্ত। ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত, বাবা মায়েরাও ব্যস্ত, আত্তীয় স্বজনেরা ব্যস্ত, বন্ধুবান্ধবেরাও ব্যস্ত অথচ সারাদিন কিংবা বেশীরভাগ সময় তারা একই জায়গায় থাকে। ছাত্ররা প্রচুর পড়াশুনা করে কিন্তু বই পড়ে না। প্রচুর লেখালেখি করে কিন্তু বই আকারে প্রকাশ হয় না। সমাজ নিয়ে অনেক গবেষনা করে কিন্তু কোনো আবিষ্কার হাতে আসে না।
একটা অসুস্থ্য সমাজ গড়ে উঠছে প্রতিদিন। মায়া মহব্বতবিহীন, দায়িত্ববিহীন এবং একাকীত্ব জীবন সমৃদ্ধ একটা সমাজ গড়ে উঠছে দ্রুত। আর এই অসুস্থ্য সমাজের মধ্যে আমরাও নেতিয়ে যাচ্ছি ক্রমাগত কম্প্রোমাইজ আর এডজাষ্টমেন্ট করতে করতে।
১০/০১/২০২৩-আজ থেকে শত বছর পর আমার এই লেখা
আজ থেকে শত বছর পরে আমার এই লেখাটা যারা পড়বেন তাদের মধ্যে আজকের দিনের আর কেউ বেচে নেই। অথচ আজকের দিনের জীবিত মানুষগুলি কিংবা আমার আগের শতবছরের মানুষগুলি যে বিষয়গুলি নিয়ে একে অপরের সাথে পরস্পরে বিবাদ, মনোমালিন্য, যুদ্ধ, অভিমান, মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি করেছি, সেগুলি আর আমরা কেহই মনে রাখতে পারবো না, আমরা একেবারেই ভুলে যাবো। পুরুটাই ভুলে যাবো। এসবের আর কোনো মাহাত্য আমাদের কাছে কোনো কিছুই আর অবশিষ্ঠ থাকবে না।
আমরা যদি আরো শতবছর আগে ফিরে যাই, ধরি সেটা ১৯২২ সাল। সেই দিনের পৃথিবী কেমন ছিলো আর সেই পৃথিবীর মানুষের মধ্যে কি নিয়ে ভয়, শংকা, মারামারি, হানাহানি নিয়ে তাদের মস্তিষ্কে কি ভাবনার খেলা চলছিলো, তাদের মুখের চাহনীতে কি চিত্র ফুটে উঠেছিলো সেই চিত্র কিন্তু আজকের দিনের কোনো মানুষের মাথায় বা মস্তিষ্কেও নাই। আর ইতিহাসের কল্পনায় থাকলেও সেই বাস্তবতার নিরিখে তার আসল চিত্রের ধারে কাছে আমরা তা আচ করতে পারি না।
জাষ্ট একবার ভাবুন তো! সেই অতীত দিনের কোনো এক পরিবারের সদস্যগন হয়তো তাদের পারিবারিক জমাজমি, কিংবা সম্পদের রেষারেষিতে যখন এক ভাই আরেক ভাইকে, কিংবা এক বোন আরেক ভাই বা বোনের বিরুদ্ধে চরম রেষারেষিতে একে অপরকে খুন, জখম বা আঘাত করেছে, কিংবা নিজের লোভের কারনে অন্যের কোনো সম্পত্তি দখল করার জন্য চরম আঘাত করেছে কিংবা এক অংশীদার আরেক অংশীদারকে সমুলে বিনাশ করতে মরিয়া ছিলেন, সেই সম্পদ কিংবা সেই অর্থ এখন কার কাছে? আর সেই বা কোথায়? পাহাড় পরিমান সম্পদ গড়া হয়েছিলো, ব্যাংক ভর্তি টাকা, সোনাদানা হয়তো জমা করা হয়েছিলো, সেই হিসাবের খাতা এখন আর কোনো গোপন নাই, না আছে তাকে যক্ষের মতো ধরে রাখার কোনো আকুতি বা পেরেসানি। কারন আমি সেই জগতেই নাই। আমাদের গড়ে যাওয়া সম্পদ যেখানে, তার থেকে আমরা এত দূর যে, তাকে কোনো অবস্থাতেই আর স্পর্শ পর্যন্ত করার কোনো অলৌকিক শক্তিও নাই। এটাই মানুষের জীবন। সে যাইই কিছু আকড়ে ধরুক না কেনো, সময়ের কোনো এক স্তরে গিয়ে সে আর কোনো কিছুই নিজের জন্য আজীবন আগলে রাখতে পারে না। যদি বলি-সেগুলি পরিবার পাবে, পরিবারের পরিবার বংশ পরম্পরায় পাবে, সেটাও সঠিক নয় কারন পরিবার গঠন হয় অন্য পরিবারের মানুষ নিয়েই যারা পিউর পরিবার বলতে কিছুই থাকে না। এটা অনেকের কাছে শুনতে অবাক বা যুক্তিহীন মনে হলেও এটাই ঠিক যে, আত্মকেন্দ্রিক এই পৃথিবীতে নিজের সন্তানও নিজের মতো না, নিজের পরিবারও নিজের মতো না। আমাদের নিজের চিন্তাভাবনা নিজের সন্তানের চিন্তাভাবনা, বা নিজের পরিবারের চিন্তাভাবনা কখনোই একই সমান্তরালে বহমান নয়। আর ঠিক তাই, এক পরিবার আরেক পরিবারের সাথে মিশ্রন হতে হতে প্রাচীন পরিবারটিও একদিন তার নিজের সত্ত্বা হারিয়ে খান বংশের মানুষেরা, সৈয়দ বংশ, সৈয়দ বংশ বঙ্গানুক্রমে মাদবর কিংবা চৌধুরী বংশে রুপান্তরীত হয়ে যায়। আমাদের আমিত্ব পর্যন্ত আর কেউ রাখতে পারেনা।
যাক যেটা বলছিলাম শত বছরের বিবর্তনের কথা।
ছোট একটা উদাহরন দেই। আজ থেকে সবেমাত্র ৩০/৪০ বছর আগের কথা যখন আমরা বা আমি ছোট ছিলাম, স্কুলে লেখাপড়া করতাম। তখনো স্কুলের ক্লাস ক্যাপ্টেন হবার জন্য কিংবা কলেজের ফুটবল টীমে নাম লিখার জন্য এক সহপাঠির সাথে আরেক সহপাঠির মধ্যে কতই না কোন্দল কিংবা বিরুপ সম্পর্কে পতিত হতাম, আজ প্রায় সেই ৩০/৪০ বছর পর সেই স্কুলের কেইবা মনে রেখেছে কে স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলো বা সেই দিনের সেই ফুটবল টীমের আমি একজন সদস্য ছিলাম? আজব ব্যাপার হচ্ছে-আমি যে সেই স্কুলের একজন দাপুটে এবং অতীব জনপ্রিয় ছাত্র ছিলাম, সেটাই বা কয়জন এখন আবিষ্কার করতে গিয়ে তাদের সময় অপচয় করছে কিংবা মনে রাখার চেষ্টা করছে? যদি সেটাই হয়, ভাবুন তো আজ থেকে শতবছর পর তাহলে আমার বা আমাদের অস্তিত্বটা কোথায়? কোথাও নাই। আর এই শতবছর পেরিয়ে যখন আরো শতবছর পেরিয়ে যাবে, তখন যেটা হবে সেটা হলো-আমি যে এই পৃথিবীতে ছিলাম, সেটাই বিলীন হয়ে যাবে। এখন আমরা যারা যাদেরকে এই পৃথিবীতে গর্ব করে মনে রাখি তারা হয়তো অতীব ব্যতিক্রম। তারা তাদের সময়ে সম্পদের কারনে নয়, কর্মের কারনে ‘সময়’টাকে আলাদা করে যুগে যুগে সেই কর্মের ফল ভোগ করতে পারে এমন কিছু কর্ম হয়তো পিছনে ফেলে গিয়েছেন বিধায় হয়তো শতবছর পরেও আমরা তাদের সেই কর্মফল ভোগকারীরা কিছুটা মনে রাখি। এটার হার অতীব এবং নিছক খুব বেশী না। আমরা সেই তাদের দলে পড়ি না।
হয়তো অনেকেই বলবেন, আজকের দিনের ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা আমাদের আজকের দিনের সমস্ত মেমোরী সংরক্ষন করে রাখতে পারি যা যুগে যুগে আমাদের বংশ পরম্পরায় এর সংরক্ষন করে আমাদেরকে জীবিত রাখবেন। এটা কোনোভাবেই সত্য না। এ ব্যাপারে একটা আরো ছোট উদাহরন দেই- জগত বিখ্যাত সঙ্গীতরাজ মাইকেল জ্যাকসন যিনি ২০০৯ সালে মারা যান। খুব বেশীদিন নয়, এটা মাত্র ১৩ বছর আগের কথা। এই মাইকেল জ্যাকসন সারা দুনিয়ায় এমন কোনো জায়গা ছিলো না যে যুবসমাজ, কিংবা শিক্ষিত সমাজ তাকে না চিনতো। তার বিচরন ছিলো সর্বত্র। তার চলাফেরা, পোষাকাদি, তার অঙ্গভঙ্গিও তখনকার দিনের প্রতিটি যুবক যেনো মডেল হিসাবে নিয়ে নিজেরাও সে রকমের পোষাক, আচরন ভঙ্গীতে অনুসরন করতো। একবার ভাবুনতো, এ যুগের কতজন যুবক আজ সেই মাইকেল জ্যাকসনের নামটা পর্যন্ত জানে? তাহলে আজ থেকে শতবছর পরের চিত্রটা কি হবে? হতে পারে, এই মাইকেল জ্যাকসনের নামটা সারা সঙ্গীত শুধু নয়, আর কোথাও হয়তো প্রতিধ্বনিতে বেজে উঠবে না। অথচ এক সময় সেইই ছিলো ঐ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় একটা ইমেজ। আরো খুব কাছের একটা উদাহরন দেই।
প্রতিদিন আমরা অসংখ্য ছবি তুলছি, আমরা তা আমাদের ফেসবুক, সোস্যাল মীডিয়ায় তা প্রতিদিন পোষ্ট করছি। আমরাই গত পাচ বছরের আমাদের ছবিগুলিই পুনরায় রিভিউ করে দেখার সময় পাই না নতুন নতুন ইভেন্টের ছবির কারন। যা একবার তোলা হয়েছে, যা একবাএ দেখা হয়েছে, তার আর খুব একটা সংরক্ষন করে বারবার দেখার স্পৃহাই আমাদের নাই, তাহলে আমার এসব স্মৃতিময় ইভেন্টের সেই স্মৃতি অন্য আরেকজন রাখবে এটা ভাবা বোকামি। হতে পারে আমার বা আমাদের অন্তর্ধানে সাময়িকভাবে সেগুলি খুব কাছের কিছু লোক একবার দুইবার দেখে কিছু স্মৃতি রোমন্থন করবেন। আর ব্যাপারটা এখানেই শেষ।
আর এটাই জীবন। আমাদের এই ছোট আধুনিক জীবনে আমরা আসলে একে অপরের সাথে হয়তো কন্টাক্টে আছি, কিছু সেই কন্ট্যাক্ট মানে কিন্তু এটা নয় যে, আমরা একে অপরের সাথে কানেক্টেড। একই ঘরে বসবাস করে, কিংবা একই প্লাটফর্মে একসাথে থাকার নাম হয়তো কন্ট্যাক্ট, কিন্তু এর মানে কানেকশন নয়। আমরা ধীরে ধীরে একে অপরের থেকে কানেকশনবিহীন হয়ে পড়ছি। আর এমন একটা কানেকশনবিহীন সম্পর্কে কেনো আমরা একে অপরের সাথে বিদ্বেষ নিয়ে বেচে থাকছি?
এটাই যদি হয় আমাদের জীবনের চিত্র, তাহলে পরিশেষে চলুন আমরা আমাদের জীবনটাকে একটু অন্যরকম করে ভাবী। জীবনটাকে একেবারে সহজ করে ফেলি। কেউ এই পৃথিবী থেকে জীবন্ত ফিরে যেতে পারবো না। কেউ জীবন্ত ফিরে যেতে পারেও নাই, না আজীবনকাল এই প্রিথীবিতে থাকতে পেরেছে। আজকের দিনের যে গাড়িটা কিংবা অত্যাধুনিক ফোনটা আমরা ব্যবহার করছি সেটাও একদিন জাংক হিসাবেই শেষ হবে। কোনো কিছুই আর রিলেভেন্ট মনে হবে না। তাই যে সম্পদের জন্য আমরা আজ এতো হাহাকার করছি, একে অপরের উপর ক্ষিপ্ত হচ্ছি, এইসব কিছুই আসলে নিরর্থক, অকেজো। হ্যা, জীবনের চাহিদার অতিরিক্ত কোনো কিছুই আমাদের দরকার নাই। আমাদের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রন করা আবশ্যিক, একে অপরের ভালোবাসার মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে তুলি, কারো উপর কারো বিদ্বেষ না রাখি, কারো সম্পত্তির উপর কিংবা কারো হকের উপর আমরা কেউ লোভ না করি। না কারো উপর কোনো জুলুম করি, না কাউকে নিজের সার্থের কারনে কোনো ক্ষতি করি। যতক্ষন আমরা অন্যের সাথে নিজের সাথে তুলনা না করি, ততোক্ষন পর্যন্ত সম্ভবত আমরা নিজের লোভের কাছে পরাভূত হবো না।
আমাদের সবার গন্তব্য স্থান পরিশেষে একটাই-কবর। কেউ হয়তো আগে কেউ হয়তো পরে। হোক সে মসলমান, হোক সে অন্য কোনো ধর্মের। কোনো কিছুই সাথে নিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। শতবছর পরে এমনিতেও আমরা হারিয়েই যাবো। যখন নিজেরাই হারিয়ে যাবো, তাহলে আমাদের অসাধু উপায়ে হানাহানি, মারামারি কিংবা জোর করে ছিনিয়ে নেয়া গড়ে তোলা সাম্রাজ্যই বা রাখবো কার জন্যে আর কেনো? কিছুই থাকবে না, রাখতেও পারবো না।
শতবছর পরেও এই আকাশ নীলই থাকবে, পাহাড় সবুজই থাকবে, সাগর সেই শতবছর আগের মতোই কখনো কখনো উত্তালই হবে। শুধু আমাদের নামের সম্পদগুলি অন্য আরেক নতুন নামে লিপিবদ্ধ হবে, আমার শখের সব কিছু অন্য আরেকজন তার নিজের মতো করে ব্যবহার করবে। আমার বলতে কিছুই নাই। আজ যে ক্ষমতার মসনদে বসে আমি হাতের ইশারায় জুলুম উপভোগ করছি, সেই ক্ষমতার মসন্দে বসেই হয়তো অন্য কোনো এক সময়ে আমারই বংশধর কারো দ্বারা শাসিত হচ্ছে, কে জানে। এর পার্থিব অনেক নমুনা আমরা দেখেছি মীর জাফরের বংশে, হিটলারের পতনে, কিংবা মুসুলিনি বা অনেক রাজার জীবনে। আজ তারা সবাই এক কাতারে।
এটা যেনো সেই বাল্ব গুলির মতো-কেউ শত ওয়াটের বাল্ব, কেউ হাজার পাওয়ারের বাল্ব, কেউবা কয়েক হাজার ওয়াটের বাল্ব কিন্তু ফিউজ হয়ে যাওয়ার পরে সবাই সেই ডাষ্টবিনে একসাথে। সেখানে কে শত ওয়াটের আর কে হাজার পাওয়ারের তাতে কিছুই যায় আসে না। না তাদেরকে আর কেউ খুজে দেখে।
২৭ আগষ্ট ২০২২-নতুন আর পুরাতন প্রজন্ম
অনেকদিন পর আজ ডায়েরী লিখতে বসলাম।
প্রতিদিন আমাদের সবার জীবন খুব দ্রুত পালটে যাচ্ছে। কতটা দ্রুত সেটা আজ যারা ঠিক এই সময়ে বাস করছি, হয়তো তারা বলতে পারবেন। আমাদের সময়টাই মনে হচ্ছে সেই শেষ সময় যেখানে এখনো আমরা পুরানো বন্ধু বা চেনা লোকের সাথে দেখা হলে তিনি কেমন আছেন জিজ্ঞেস করি, একটু সময় ব্যয় করি, সুখ দুঃখের আলাপ করি। সমস্যার কথা বলে কিছু উপদেশ বিনিময়ও করি। আমরাই সম্ভবত সেই শেষ যুগের কিছু মানুষ যারা এখনো পরানো খবরের কাগজটা অন্তত কিছুদিন ঘরে রাখি, একই খবর হয়তো বারবার পড়ি। আমরা এখনো সামাজিক দায়বদ্ধতাকে ভয় পাই, পাশের বাড়ির সাথে সুসম্পর্ক রাখি। আমাদের প্রাভেসী বলতে কিছু ছিলো না। যা ছিলো সবই খোলামেলা। আমরা সেই শরৎচন্দ্রের লেখা উপন্যাস পড়ে কখনো কেদেছি, কখনো হেসে গড়াগড়ি করেছি, রবী ঠাকুরের ‘বলাই’ আমাদের মনে দাগ কেটে যায়, কিংবা ‘পোষ্টমাষ্টার’ গল্পের ছোট বালিকার কথায় বড্ড কষ্ট লেগেছে। ‘দেবদাস’ এখনো আমাদের অনেক প্রিয় একটা গল্প বারবার পড়েছি, বারবার। এখনো এই দলটি কোনো ইনভাইটেশন ছাড়া একে অপরের বাড়িতে বেড়াতে যায়, বেড়াতে গেলে হয়তো কম দামী হলেও হাতে কিছু নিয়ে যায়। এখনো তারা বড়দের পা ছুয়ে সালাম করে। রাতের বা সকালের নাস্তা এখনো এরা একসাথে করার অভ্যাস রাখে। ছেলেমেয়ে, বউ পরিজন একসাথে নাস্তা করুক বা রাতের খাবার খাক, এটাই চায় তারা। ঈদের ছুটিতে তারা এখনো গ্রামের ভালোবাসার টানে সেই কাদাচে গ্রাম, সোদামাখা পরিবেশে ছুটে যেতে সব প্রকার কষ্ট করতেও আনন্দ পায়। আমাদের এই দলটি সম্ভবত খুব বেশীদিন আর নাই এই পৃথিবীতে। হয়তো আগামী ২০ বছরের পর আর কেউ থাকে কিনা কে জানে। এই দলটির মানুষগুলি সকালে উঠে নামাজের জন্য মসজিদে যায়, ঘরে এসে উচ্চস্বরে কোরআন তেলওয়াত করে, হাতে একটা প্লাষ্টিক ব্যাগ নিয়ে নিজে নিজে বাজার করে, হেটে হেটে সেই বাজার বহন করে আনে। বিকালে হয়তো কিছু মানুষ একত্রে বসে মাঠে বা কোনো দোকানের সামনে বসে গালগল্প করে। কোথাও একসাথে খেতে গেলে কে কার আগে রেষ্টুরেন্টের বিল পরিশোধ করবে তার প্রতিযোগিতা চলে। একজন বলে সে দিবে, আরেকজন বিল না দিতে পেরে আবারো হয়তো আরেকটা আড্ডার অগ্রীম দাওয়াত দিয়ে রাখে। এদেরকে আর খুব বেশী দেখা যাবে না একযুগ পরে।
তখন যাদের আনাগোনা হবে তারা সবাই আত্তকেন্দ্রিক একদল। যারা একে অপরের পাশে বসেও হাতের মোবাইলে কুশলাদি বিনিময় করবে, স্বামী স্ত্রীর মধ্যেও বেশীর ভাগ গ্রিটিংস হবে শুধুমাত্র মোবাইলের মেসেজে মেসেজে। কেউ কারো বাড়িতে যেতেও আনন্দ পাবে না, না কেউ তাদের বাড়িতে এলেও খুশী হবে। সন্তানদের সাথে তাদের দুরুত্ত বাড়তে বাড়তে এমন এক পর্যায়ে চলে আসবে যে, কে কখন কি করছে, কেউ তার জবাব্দিহি নেওয়ার মতো অবস্থায় থাকবে না, না থাকতে চাইবে। বাজার হবে মোবাইলে, আনন্দ হবে মোবাইলে মোবাইলে, বন্ধুত্ত গুলির মধ্যে বেশীর ভাগ বন্ধুই কারো চেনা জানা হবে না অতচ বন্ধু বলে ধরা হবে। বড়রা যেমন ছোটদেরকে স্নেহ করার কায়দা জানবে না, ছোটরাও বড়দেরকে সম্মান করার আদব জানবে না। ঘরে ঘরে সবাই একাই থাকবে একজন থেকে আরেকজন। ধর্মের চর্চা ধীরে ধীরে কমে আসবে, কমে আসবে পারিবারিক, আর সামাজিক বন্ধুত্তের গন্ডি। প্রতিবেশীদের মধ্যে কারো সাথেই আজকের দিনের সখ্যতা আর হয়তো থাকবেই না। মুখ চেনা হয়তো থাকবে কিন্তু হয়তো নামটাও জানা হবে না একে অপরের। সন্তানরা বড় হবে মায়ের আদরে নয়, কাজের বুয়াদের নিয়ন্ত্রনে। বৈবাহিক সম্পর্কে চলে আসবে শুধুমাত্র একটা কাগুজে বন্ধনের মধ্যে। স্বামী স্ত্রীর আজীবন কালের ভালোবাসার সম্বন্ধ বা দায়িত্ববোধ হবে শুধুমাত্র দেয়া নেয়ার মধ্যে। ফলে না স্ত্রী স্বামীকে বা স্বামী স্ত্রীকে তার নিজের জীবনের একটা অবিবেচ্ছদ্য অংশ হিসাবে গন্য করবে। সন্তানদের মধ্যে মা বাবার ডিভিশনে তারাও একেবারেই একা হয়ে যাবে। কেউ আসলে কারোরই না। অথচ তারা একই ঘরের ছাদের নীচে বসবাস করবে। ওদের কাছে গ্রাম বলতে একটা অপরিষ্কার পরিবেশ, গ্রামের মানুষগুলিকে মনে হবে অন্য কোনো জাতের মানুষ বলে। এই নতুন প্রজন্মের কাছে মানুষের চেয়ে কুকুর বিড়াল হবে তাদের নিত্য দিনের বন্ধু। সংসার ভেংগে যাওয়ার যে কষ্ট, বা লজ্জা, কিংবা দুঃখের এই প্রজন্মের কাছে এটা খুব মামুলী একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। আজ যে তাদের বন্ধু, কাল হয়তো সে তাকে চিনেই না। আজ যে কারো পাতানো বোন, কাল হয়তো সে হয়ে যাবে তার প্রিয় গার্ল ফ্রেন্ড। এদের অনেক টাকা পয়সা লাগবে, হয়তো থাকবেও। কিন্তু একসাথে কোথাও আড্ডায় খেতে গেলে যার যার বিল সে সেই দিতে থাকবে। এতে কারো কোনো কষ্ট নাই। এটাই যেনো এই প্রজন্মের আড্ডার নিয়ম। জিজ্ঞেসও করবে না হয়তো বিল কে দিবে বা কেউ দিবে কিনা।
এখানে সবচেয়ে বিপদজনক পরিস্থিতি হচ্ছে যে, এই আমাদের প্রজন্ম যখন প্রায় শেষের পথে আর নতুন প্রজন্ম যখন উদিয়মানের পথে, এই ট্রানজিট সময়ে সবচেয়ে বেশী সাফার করবে আমাদের প্রজন্ম। কারন তারা তাদের সব কিছু শেষ করে যখন নতুন প্রজন্মকে তৈরী করছে, তখন আমাদের প্রজন্মের মানুষেরা আসলে আর্থিকভাবে নিঃস্ব। নতুন প্রজন্ম আমাদের প্রজন্মকে আর আমাদের সময়ের মতো করে দায় দায়িত্ব নিতে চায় না। অথচ এখনই পুরানো প্রজন্মের সবচেয়ে খারাপ সময় প্রবাহিত হচ্ছে। বড়রা মনে করছেন, আমাকে তো আমাদের সন্তানেরাই দেখভাল করবে, কিন্তু সন্তানেরা মনে করছেন এটা তাদের দায়িত্তের মধ্যেই পড়ে না। তাহলে শেষ ট্রানজিট সময়টা বড্ড বিপদজনক মনে হচ্ছে। এহেনো অবস্থায় আমাদের প্রজন্মের খুব সতর্ক থাকা দরকার। হতে পারে আমার এই কথায় অনেকেই বিরুপ মন্তব্য করবেন, হয়তো বলবেন, সন্তানদেরকে ধার্মীক জীবনজাপন না করায় কিংবা সঠিক পদ্ধতিতে মানুষ না করার কারনে আমরা এহেনো অবস্থায় পড়ছি। আমি এরসাথে একমত নই। আমরা আজকাল সন্তানদেরকে শুধুমাত্র পরিবার থেকে যথেষ্ঠ শিক্ষা দিলেই সব শিক্ষা তারা পায় না। স্কুলের নিয়ম পালটে গেছে, শিক্ষকের আচরন পালটে গেছে, ধার্মিক লোকদের অভ্যাসও পালটে গেছে, সমাজের নীতিনির্ধারন লোকের মানও কমে গেছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও আর সেই আগের আইনের মধ্যে নাই, বিচারের ন্যায্যতা কমে গেছে, রাজনীতির কারনে মানুষে মানুষে, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লা মহল্লায় সম্পর্কের মধ্যে চীর ধরেছে। এখন শুধু পরিবারের শাসনের উপর কিংবা আইনের উপরেই সন্তানরা বড় হয়ে উঠছে না। নতুন প্রজন্ম আমাদের হাতের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে পুরানো প্রজন্মের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যেই অনেকটা সার্থপরের মতো হতে হবে। নিজের জন্য যথেষ্ঠ সঞ্চয় মজুত রাখুন যাতে কেউ আপনাকে দেখভাল করুক বা না করুক, কেউ পছন্দ করুক বা না করুক, যাতে আপনি আপনার দেখভাল করতে পারেন। নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা (বেশিরভাগ) পুরাতন প্রজন্মকে বোঝাই মনে করে। মা ভাগ হয়ে যায় সন্তানদের মধ্যে ভরন পোষনের জন্য। বাবা ভাগ হয়ে যায় একই ভাবে। ফলে মা–বাবা একে অপরের থেকেও ভাগ হয়ে যান শুধুমাত্র বেচে থাকার কারনে।
বৃদ্ধ বয়সে এসে কারো উপরে নির্ভরশিল না হতে চাইলে, নিজের জন্য যথেষ্ঠ পরিমান অর্থ সঞ্চয় করুন। প্রয়োজনে নিজের এসেট বিক্রি করে হলেও তা করুন। কারন, একটা সময়ে এসে আপনি সেটাও বিক্রি করতে পারবেন না। হয়তো সন্তানেরাই বাধা দেবে অথবা তাদের অংশ দাবী করবে। আর আপনি সারাজীবন কষ্ট করেও শেষ জীবনে এসে সেই অবহেলিতই থাকবেন। হয়তো কারো কারো জায়গা হবে বৃদ্ধাশ্রমে। আর সেই বৃদ্ধাশ্রমে বসে আরেক পরাজিত বুড়ো মানুষের সাথে সারা জীবনের কষতের কথা ভাগাভাগি করবেন, কিন্তু আপনি আসলেই আর ভালো নাই।
১৫/০৭/২০২২-যখন বয়স ছিলো ১২ কি ১৩
যখন বয়স ছিলো ১২ কি ১৩, তখন স্কুলে কিংবা বড়দের আড্ডায় প্রায়ই একটা ব্যাপারে আমাদের মতো ছোটরা ফেস করতাম-“ জীবনে কি হতে চাও? বা জীবনের লক্ষ্য কি অথবা what is your aim in life?” হয়তো তখন জানতামই না আসলে কি হলে ভালো হয়, কি হলে কি হয়। ফলে বড়দের শিখিয়ে দেয়া বা ইম্পোজ করে দেয়া বক্তব্যই হয়তো হয়ে যেতো আমাদের বক্তব্য। যেমন-ডাক্তার হবো মানুষের সেবা করবো, ইঞ্জিনিয়ার হবো দেশ গড়বো, কিংবা শিক্ষক হবো মহৎ কাজে ব্রত হবো বা সেনাকর্মকর্তা হবো দেশপ্রেমের জন্য ইত্যাদি। কেনো হতে চাই, কি কারনে হতে চাই, এসবের কোনো অন্তর্নিহিত তথ্য বা ভাবসম্প্রসারনের কোনো বালাই কিংবা মাহাত্য জানাও ছিলো না। যদি এই প্রশ্ন কোনো সমবয়সী বালিকাকে করা হতো, হয়তো তাঁর উত্তর একটু ব্যতিক্রম তো হতোই। পড়াশুনা করবে, বিয়ে হবে, ভালো স্বামী পাবে, তারপর সন্তান সন্ততী হবে, একসময় বুড়ো হবে, নায়নাতকোর হবে। জীবন আনন্দে কেটে যাবে। এই তো।
আজ ৪০ বছর পর আমি যখন পঞ্চাশোর্ধ এক মানুষ, এখন আর আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে না, আমার জীবনের লক্ষ্য কি। অথবা এটাও কেউ জিজ্ঞেস করে না, কি লক্ষ্য ছিলো, কি হতে পেরেছি আর এখন কোন দিকে যাচ্ছি। এখন সবাই যেটা দেখে, আমাদের গত ৫০ বছরের সাফল্যের ঝুড়ির ভিতরে বর্তমানে কি নিয়ে আমরা বেচে আছি। হোক সেটা বিত্ত, হোক সেটা পজিশন কিংবা হোক সেটা দারিদ্রতা। এই সর্বশেষ ম্যাট্রিক্সটাই হচ্ছে আমাদের জীবনের পাওয়া সাফল্য বা বিফলতা যদিও সেই ছোট বেলার “এইম ইন লাইফের” সাথে এর কোনো মিল নাই বা কিঞ্চিত থাকতেও পারে। স্কুল জীবনে কে কতটা ট্যালেন্ট ছিলো, কে কতটা স্মার্ট ছিলো, কিংবা কে কতটা ভালো রেজাল্ট নিয়ে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির গন্ডি পেরিয়েছে, সেটাই কারো জীবনের আসল সাফল্য না। সবচেয়ে পিছনের বেঞ্চে বসা কোনো এক অমনোযোগী ছাত্র হয়তো এখন এমন এক জায়গায় আছে যেখানে প্রথম সারির মনোযোগী কোনো এক ছাত্র তাঁর ধারে কাছেও না। এই ব্যাপারটা না হয় আরেকদিন লিখবো। এখন যে কারনে আমার লেখাটা, সেটা হচ্ছে-
যে যাইই কিছু করুক, সবার জীবনের একটাই সপ্ন। সবকিছু গুছিয়ে শেষ বয়সে এসে একটু শান্তিতে থাকা। এই যে শান্তি, এটা আসলে কোথায় বা এটা আসলে কি? (ধর্মীয় ব্যাপার এখানে টানতে চাই না, সেটা আরেক প্রকার শান্তি)। এই শান্তি হচ্ছে, আমার খাদ্য, বাসস্থান, সাস্থ্য, নীরাপত্তা আর সাধীনতা যেনো বজায় থাকে, একটু আরামে থাকতে পারি, কোনো টেনশন ছাড়া। কিন্তু আদৌতে কি সেই লক্ষ্যে আমরা পৌছাতে পারি সবাই? বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমি দেখেছি- সেতার থেকে অনেক দূরে আমরা। প্রতিটি মানুষ আলাদা আলাদা সত্তা। কেউ কারোর জন্যই বেশীরভাগ সময়ে অপেক্ষা করে না, হোক সেটা নিজের সন্তান, নিজের আত্তীয় বা নিজের সংগী। অথচ, আজীবন সবার জন্য সবকিছু করতে করতে একটা মানুষ আসলেই নিঃস্ব হয়ে যায়, নিজের জন্য সে আসলেই আর কিছুই রাখে না। এটা সাধারন মানুষ থেকে শুরু করে রাঘব বোয়ালদের বেলাতেও প্রযোজ্য। ফলে দেখা গেছে যে, শেষ বয়সে এসে যে সপ্নের জীবনের কথা ভেবে এ যাবতকাল শরীর, যৌবন, মেধা, সঞ্চয়, অকাতরে বিলিয়ে দেয়া হয়েছে, সেটাই কাল হয়ে যায় নিজের জন্য। অবহেলিত, নির্যাতিত এবং অনিরাপদ জীবন তখন তাঁর সংগী হয়ে যায়। পাশে যাদের থাকার কথা ছিলো, তারা বেশীরভাগ সময়েই আর পাশে থাকে না, আর নিজেরা তখন একেবারেই “একা” হয়ে যান। এই একা জীবনে নিজের নোংরা কাপড়টা ধোয়ার মানুষ থাকে না, খাবারটাও সঠিক সময়ে পরিবেশনের লোক থাকে না, পথ্য খাওয়ানোর কোনো মানুষ আর পাশে থাকে না, এমন কি নিজের যত্ন নিতে যে খরচ দরকার সেটাও আর হাতে থাকে না ইত্যাদি।
কে কিভাবে নিবে জানিনা, আমার মতে, সবার জীবনের সুরক্ষার জন্য সবসময় নিজের জন্য এমন একটা ব্যবস্থা করে রাখা দরকার যখন সব প্রকারের পেইড সার্ভিসে নিজেকে মানুষ সুরক্ষা দিতে পারে। আর সেই পেইড সার্ভিসের জন্য প্রয়োজন একটা ব্যালেন্স সঞ্চয়। এই পেইড সার্ভিসে সঠিক সময়ে পথ্য, কাপড় চোপড় ধোয়ার মানুষ, রান্না বান্নার দক্ষ লোক, যত্নাদি করা লোক সবই থাকতে পারে। যদিও তারা আপন কেউ না।
তাহলে যা দাড়ায়, তা হলো-জীবনের লক্ষ্য সেটাই হওয়া উচিত, “ব্যালেন্স সঞ্চয়” করা যাতে নিজের সব লোক আশেপাশে না থাকলেও সর্বপ্রকার পেইড সার্ভিস নিজেই ব্যবস্থা করতে পারেন এবং জীবন থাকে নিরাপদ। যারা এটা করতে পেরেছেন, তাদেরকে অনেকেই সার্থপর ভাবতে পারেন কিন্তু তারাই সঠিক কাজটি করেছেন বলে আমার বিশ্বাস। বৃদ্ধাশ্রম বলে আর কোনো অপশন আপনার জন্য প্রয়োজন পড়ে না।
নিজের জন্য করুন, নিজে বাচুন, তারপর অন্যের জন্য করুন। জীবন একটাই।
আজকে যাদের হাতে অনেক টাকাকড়ি নাই, কিন্তু হয়তো এসেট আছে। তাদের উচিত, আগে নিজের জন্য যথেষ্ঠ পরিমান ব্যালেন্স সঞ্চয় রেখে বাকীটা তাদের নিজের লোকদের জন্য রাখা। তাতে যেটা হবে, নিজে ভালোভাবে বাচতে পারবেন, কারো মুখাপেক্ষী হতে হবে না। একটা কথা তো ঠিক যে, নিজের অন্তর্ধানের পর এইসব এসেট, এইসব সম্পত্তির কোনো মুল্য আপনার জীবনে নেই। ঐসব তো করাই হয়েছে যাতে নিজে ভালো থাকা যায়, তাহলে দ্বিধা কেনো? কাজটা অনেক অনেক অনেক কঠিন।
একটা জিনিষ আমি সবসময়ই মনে করি যে, আমরা কোনো কিছুই আমাদের উত্তরসুড়িদের জন্য না রেখে গেলেও তারাই তাদের জীবন আলাদা করে গড়িয়ে নেবে, যেমন আমি আপনি গড়িয়ে নিয়েছি। তাদের ভবিষ্যতের চিন্তায় আজকে নিজেদের বর্তমানকে অবহেলা করে নিজেকে করুন জীবনে বসবাস বুদ্ধিমানের কাজ হয়তো নয়। তাতে সাহস কমে যায়, টেনশন বেড়ে যায়, আর এর কারনেই শরীর খারাপ হতে থাকে, আর শরীর খারাপ হতে থাকলেই আপনার সম্পত্তি বা এসেটের ভাগাভাগিতে উত্তরসুরীরা যতো দ্রুত সেটা নিজেদের করে নেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। আপনি আবারো আরেক দফায় একা হবেন। একমাত্র বয়ষ্ক ব্যক্তিরাই আরেক বয়ষ্ক ব্যক্তির ভালো বন্ধু হয়। জেনারেশন গ্যাপে নতুন পুরানো জেনারেশনের সাথে মিশে থাকা যায় বটে কিন্তু সেখানে প্রান থাকে না।
(বয়োবৃদ্ধ একজন অসহায় মানুষের গল্প শুনে এই লেখাটা, এটা কাউকে জ্ঞান কিংবা উপদেশ দেয়ার জন্য নয়। এই ফোরামে সম্ভবত এটাই আমার প্রথম লেখা, ভুল মার্জনীয় )
Protected: 30 June 2022 Diary
You are required to login to view this post or page.
১৫/৫/২০১৯-২০ বছর আগের কিছু স্মৃতি…পর্ব-৩
আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগের কিছু দূর্লভ মূহুর্ত যা এখন অনেক অংশে ইতিহাস। এই ছবিগুলির মধ্যে অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন (আল্লাহ তাদের বেহেস্তবাসী করুন), কেউ কেউ বার্ধক্যে পৌঁছে গেছেন, যারা সেই সময় ছোট পুতুলের মতো পুতুল নিয়ে খেলা করেছে, তারা অনেকেই আজ সমাজে কেউ ডাক্তার, কেউ বড় বড় মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীতে কর্মরত, মেয়েদের মধ্যে অনেকেই মা হয়ে গেছে। ছেলেরাও আজ মাশ আল্লাহ খুব ভালো আছে। এইসব বাচ্চা গুলি, কিংবা বড়রা আমার অনেক কাছে মানুষ, এদের আগমন সব সময়ই আমাকে আনন্দিত করেছে। কিছুটা অবসর সময় ছিলো, তাই আগের দিনের কিছু ভিডিও আর স্থীর চিত্র নিয়ে বসেছিলাম। অতীত সামনে চলে আসে, নস্টালজিক হয়ে যাই। হয়ত কোনো একদিন, আমিও এই ভাবে ইতিহাস হয়ে যাবো, কিছুটা সময় কাছের মানুষেরা মনে রাখবে, এক সময় আমার জন্য এই পৃথিবী শেষ। গুটিকতক মনিষী ছাড়া বেশীর ভাগ মানুষেরাই অজানা ইতিহাসে মিশে গিয়ে বিলীন হয়ে যায়।
এটাই পৃথিবীর বাস্তব নিয়ম।
১৪/০৫/২০২২-প্যারাডিম শিফট-ডমিনো ইফেক্ট
আজকে যে বিষয়টি নিয়ে আমি লিখতে চাচ্ছি- সেটার নাম প্যারাডাইম শিফট। এই প্যারাডাইম শিফটের সাথে ইউক্রেন, ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের একটা সম্পর্ক আমি দেখতে পাই। তাহলে সংক্ষিপ্তভাবে জানা দরকার, এই প্যারাডাইম শিফটটা কি।
যখন সাভাবিক কোনো চিন্তাচেতনা কিংবা কার্যক্রম অন্য কোনো নতুন নিয়ম বা চিন্তা চেতনা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে দেখা যায়, তখন এই প্রতিস্থাপিত নতুন পরিবর্তিত চিন্তা চেতনাকেই প্যারাডাইম শিফট বলা হয়। অন্যঅর্থে যদি বলি-এটা হচ্ছে একটা মডেল, তত্ত্ব, বা দ্রিষ্টিভঙ্গি, ধারনা, কিংবা দৃষ্টান্ত যা প্রকৃত তত্ত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি, কিংবা মডেল থেকে ১৮০ ডিগ্রী উলটা। প্যারাডাইমটা আসলেই আসল জিনিষ না, এটা একটা মানষিক ভাবনার সাথে প্রকৃত সত্যের একটা শুধু কাল্পনিক ছবি। কোনো একটা জিনিষের ব্যাপারে আমরা যা ভাবছি, বা দেখছি এর সাথে সেই জিনিষটার যে রকম প্রকৃত বৈশিষ্ট , এই দুয়ের মাঝেই থাকে প্যারাডাইম তত্তটি। এই প্যারাডাইম দিয়ে মানুষ কোনো একটা ধারনা, চিন্তা চেতনা, কিংবা কোনো একটি জিনিষের ব্যাপারে একটা ধারনা পায়। যার প্যারাডাইম শিফট যত কম, সে ততো অরিজিনাল জিনিষের কাল্পনিক রুপ দেখতে পায়।
একটা উদাহরণ দেই- ধরুন আপনি একটা লোকের চেহাড়া দেখে ভাবলেন যে, সে একটা নিশ্চয় ভয়ংকর সন্ত্রাসী। আপনার মন তাকে সেভাবেই ট্রিট করছে, সেভাবেই আপনি তাকে ওই খারাপ মানুষদের মধ্যে লিষ্ট করে ফেলেছেন। অনেকপরে যখন জানলেন যে, লোকটা ছিলো খুবই ভদ্র, ভালো ও খুবই অমায়িক এবং পরোপকারী। তখন আপনি অনেক মনোকষ্টে ভোগবেন। আফসোস হবে এই কারনে যে, আহ, সব কিছু না জেনে, না বুঝে কেনো আমি এমন একটা ভালো মানুষকে খুবই খারাপ ভেবেছি? এই যে নতুন ভাবনা আপনাকে আগের চিন্তাচেতনা থেকে হটাত করে ১৮০ ডিগ্রী উলটে গিয়ে আরেক নতুন ভাবনায় নিয়ে এলো, সেটাই প্যারাডাইম শিফট। থমাস কুন তার বিখ্যাত-“দি স্রাইাকচার অফ সায়েন্টিক রেভ্যুলেশন” বই এ প্রথম প্যারাডাইম শিফট শব্দটি চালু করেন। প্যারাডাইম যার যতো বেশি নিখুত, তার প্যারাডাইম শিফট ততো কম। আর যাদের এই প্যারাডাইম কোনো কিছুর ব্যাপারে প্রায় কাছাকাছি থাকে, তারা আসলেই জ্ঞানী এবং বাস্তববাদী। বর্তমান জগতে মানুষের প্যারাডাইম অনেক অনেক সত্যের থেকে বেশী দূরে বিধায়, আমাদের সমাজে ভুল সিদ্ধান্তে গন্ডোগোল বাড়ছে।
তাহলে এর সাথে ফিনল্যান্ড অথবা সুইডেনের বা ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগের সম্পর্ক কি?
কিছু খন্ড খন্ড ঘটনাকে খাতায় কষে বিশ্লেষন করলে দেখা যাবেঃ
(১) ইউক্রেন CIS এর এসোসিয়েট মেম্বার। তারা প্রথম ইউরোপিয়ান দেশের সদস্য হবার জন্য অনুরোধ করে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বির মাসে। কিন্তু তাদের সেই অনুরোধ রক্ষা করা হয় নাই বিভিন্ন রাজনৈতিক বিবেচনায়, বিশেষ করে রাশিয়ার নাবোধক জবাবের কারনে। শুধু তাইই নয়, এই আমেরিকাই ইউক্রেনে অবস্থিত নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডসহ পুরু নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করতে সাহাজ্য করেছিলো। তখন কিন্তু আমেরিকা বা পশ্চিমারা ইউক্রেনের প্রতি ততোটা ভালোবাসা প্রকাশ করে নাই। কারন তখন ইউক্রেনকে তাদের প্রয়োজন ছিলো না, প্রয়োজন ছিলো ওয়ার্শ জোট ভাংগার নিমিত্তে রাশিয়াকে খুশী করা। তাতে ইউক্রেনের পারমানিক ক্ষমতা বিলুপ্ত হলেও পশ্চিমাদের লোকসান নাই।
(২) ইউক্রেন একটি সমৃদ্ধ শালী দেশ বিশেষ করে ভোজ্য তেল, খাদ্য কমোডিটি, স্টীল, সিরিয়াল, গম ভুট্টা, নিকেল, আয়রন ইত্যাদি। দিনে দিনে রাশিয়া তার ৯০ শতকের ধ্বস থেকে কাটিয়ে উঠে আবার আগের শক্তিতে ফিরে আসছে যা পশ্চিমাদের জন্য সুখকর নয়। তাই তাঁকে চেপে ধরার একটা এজেন্দা দরকার। ইউক্রেন একটা ভালো অপ্সন। কারন এটা রাশিয়ার একেবারেই গোড় দোরায়।
(৩) আমি, আপনি হয়তো এতো গভীর স্তরে ভাবি না কিন্তু যারা আন্তর্জাতিক খেলোয়ার তারা ঠিকই খবর রাখে কোথায় কি হচ্ছে আর কেনো হচ্ছে। খেয়াল করে দেখলে দেখা যায়, ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করলো, প্রো-ওয়েশটার্ন প্রেসিডেন্ট প্রোসেংকুকে আউট করে দিলো, জর্জয়ায় রাশিয়ার আগ্রাসন কে ঠেকালো না, ওসেটিয়ায়র অবস্থাও একই। চেচনিয়াও তাই। আমেরিকা কিছুই বল্লো না, না ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। একটা অতি জনপ্রিয় কমেডিয়ান এর আবির্ভাব হলো। প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলো যার কনো প্রকার পলিটিক্যাল অভিজ্ঞতাও নাই। কিন্তু সাহস ছিল। হটাত করেই জেলেনেস্কীর আগমন ঘটে নাই সিন গুলিতে। প্রোসেংকুকে আউট করার সময়ই এই আঘাতটা আসার কথা ছিলো কিন্তু তখন ব্যাপারটা ঘটে নাই কারন গ্লোবাল রিসেশনে পসচিমারাও কোন্ঠাসা। ইউরোপ তো আরো কোন্ঠাসা। They take time.
(৪) ইউক্রেনকে ভালোবেসে পশ্চিমারা গদগদ হয়ে এতো সাপোর্ট করছে এটা ভাওব্লে ভুল হবে। নিজদের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন লোন মাথায় রেখে কোনো দেশ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অন্য কোথাও ইনভেষ্ট করতে যায় না। এর পিছনে লাভ অবশ্যই থাকা দরকার। আর সেটার নাম জিরো-সাম গেম। Zero-sum games occur whenever the aggregate gain between winners and losers totals zero. আরেকটু পরিষ্কার করে বলি- জিরো-সাম গেমের সংগা হচ্ছে-নেট জিরো। আমি ধনী কারন আপনি গরীব, আমি গরীব কারন আপনি ধনী। আমি জিতেছি কারন আপনি হেরেছেন, আমি হেরেছি কারন আপনি জিতেছেন, ব্যাপারটা ঠিক এই রকমের। এরমানে এই যে, কোনো একটা ১০০% ভান্ডার থেকে আমি যখন ৫০% নিয়ে নেবো, আপনি আর কখনোই ওই ভান্ডার থেকে ইচ্ছে করলেও ১০০% নিতে পারবেন না। আমি যদি ওই ভান্ডার থেকে পুরু ১০০% নিয়ে নিতে পারি, আপনি পুরু ১০০% ই লস করবেন। আর এই কন্সেপ্টের কারনে পশ্চিমারা কখনো গনতন্ত্রের নামে, কখনো মানবাধীরকার নামে, কখনো বন্ধুপ্রতীম দেশ হিসাবে, কখনো কাউকে আগ্রাসীর বদনামে নিজেরা পাশে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু মুল লক্ষ্য থাকে সেই সাহাজ্যার্থীর টোটাল ধন সম্পদের উপর অথবা তাঁকে সাহাজ্য করার নামে নিজেদের চিহ্নিত শত্রুকে নিঃশেষ করে দেয়া। ফলে যদি দেখেন ইরাক, আফগানিস্থান, বা লিবিয়া, প্যালেষ্টাইন, ইত্যাদির ঘটনাগুলি, সেখানে নিরাপত্তার নামে, সুষ্ঠ গন্তন্ত্রের নামে কিংবা সাধীন জীবনের প্রতিশ্রুতির নামে তাদের জীবনমান, সোস্যাল ফেব্রিক্স, লিভিং স্ট্যান্ডার্ড সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। তাদের ধন সম্পদ লুট করা হয়েছে, এসেট বলতে সব কিছুই লুট করা হয়েছে। লাভ হয়েছে একজনের, সম পরিমান লস হয়েছে ওই দেশ গুলির। ওদের মেরুদন্ড ভেংগে দেয়া হয়েছে, কমান্ড ভেংগে দেয়া হয়েছে। ওখানে এখন কোনো কিছুই আর আগের মতো নাই। এটাই লাভ। আর ততটাই লসে হয়েছে সে সব দেশের যারা জিরো সাম গেমটা বুঝে নাই।
(৫) একবার খেয়াল করে দেখলে দেখা যাবে যে, যে পরিমান হাই লেবেলের রাষ্ট্র প্রধান, সিনেটর, ফার্ষ্ট লেডি, স্পিকার, মিনিষ্টার, সেক্রেটারি এত ঘন ঘন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সাথে বিপদজনক এক্টিভ যুদ্ধক্ষেত্রে শশরীরে দেখা করেছেন, এর কারন কি? এর কারন একটাই, তাঁকে বারবার মনে করিয়ে দেয়া বা তাঁকে বলা যুদ্ধের জন্য শান্তিচুক্তি করা যাবে না। আমরা আছি তোমার পাশে। কোনো সমঝোতা করা যাবে না। তাই না কনো জাতিসংঘের কেউ, না কোনো ডিপ্লোমেট, না কোন পশ্চিমা নায়ক যুদ্ধ বন্ধের কোনো উদ্যোগ নিলেন। তারা যুদ্ধে কোনো সমঝোতা না করার পরামর্শ দিতেই এতো রিস্ক নিয়ে শশরীরে সেই যুদ্ধ ক্ষেত্রে এসেছেন।
(৬) বোকা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট সেই ফাদেই পা দিয়ে নিজের দেশের বেশ ক্ষতি করা শুরু করলেন। যত নিষেধাজ্ঞাই দিক, যত মিষ্টি কথাই বলুক, যত মহড়াই আশেপাশের দেশে কসরত করুক, কেউ কিন্তু ইউক্রেনের মাঠে নামলেন না। ৩০ টা দেশ, ৩০ টা আর্মি, ৩০ টা দেশের প্রধান সব মিলিয়ে তো একটা শক্তি অবশ্যই। যেখানে ন্যাটো তার আন্তর্জাতিক নিয়ম ভেংগে তার সদস্য সংগ্রহ করতে পারে, যেখানে কোনো আইন মানার ব্যাপারে তাদের কোনো পরোয়া নাই, এতো এতো মিউনিস্ক চুক্তি, এতো এতো শান্তি চুক্তি থাকা সত্তেও ন্যাটো বা ইউরোপিয়ানরা তাদের নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে, অথচ ইউক্রেনের যুদ্ধকে কেউ সহজ করে দিলো না। কেউ মাঠে নামলো না। দুনিয়া এদিক সেদিক করে ফেলবে এমন কথাও বললেন তারা, অস্ত্র দিলেন, টাকার পর টাকা দিলেন, আশ্বাস আর শান্তনার বানীর কোনো কমতি নাই। যে কোনো পরিস্থিতিতেই তারা ইউক্রেনের পাশে থাকবেই। কিন্তু একটা ‘নো ফ্লাই জোন করতে পারলেন না, না যুদ্ধ বিমান দিয়ে ইউক্রেনকে সাহাজ্য করা হলো। দিন তারিখ ফিক্সড করে দুনিয়ার সব রিকুয়েষ্ট অগ্রাহ্য করে আফগানিস্থান এটাক করা যায়, ইরাকে বোমার পর বোমা ফেলা যায় অথচ আধুনিক কিছু মিজাইল আর ভাড়াটিয়া এক্সপার্ট দিয়া ইউক্রেনকে সাপোর্ট দিয়ে রাশিয়ার ভিতরে কিংবা রাশিয়ার ইন্টারেষ্টেড স্থানে এটাক করা গেল না। যুদ্ধ যুদ্ধই। করতে পারতো। কিন্তু করা হয় নাই। জেলেনেস্কী বারবার আশাহত হয়েছে। তার ভাবনার সাথে সত্যিটা মিলছিলো না, এখনো মিলছে না। জেলেনেস্কীর জন্য- কি ভেবেছি আর কি হইলো? এটাই প্যারাডাইম শিফট।
(৭) আমি একটা লেখায় লিখেছিলাম যে, তেল গ্যাসের উপর ইউরোপিয়ানরা নিষেধাজ্ঞা দিলো বটে অথচ সেই নিষেধাজ্ঞার সময়ে ইউক্রেন তো ইচ্ছে করলে ১ম দিন থেকে তাদের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গ্যাস বা তেলের পাইপ নিজেরাই বন্ধ করে দিতে পারতো। কিন্তু সেটা কিন্তু করে নাই। না ইউক্রেন করেছে, না ইউরোপিয়ানরা ইউক্রেনকে করতে বলেছে। ইউরোপিয়ানরা সেটা বন্ধ করতে বলে নাই কারন সেটা তাদের দরকার। নিষেধাজ্ঞা থাকবে কিন্তু তারা সেটা নিবেন। তাহলে নিষেধাজ্ঞা কিসের? প্রেসিডেন্ট কি এতো বোকা যে সে তার দেশের উপর দিয়ে যাওয়া পাইপ লাইন বন্ধ করতে পারতো না? তাঁকে আসলে সেটা করতে দেয়া হয় নাই। যুদ্ধের প্রায় ৫৬ দিন পর ইউক্রেন নিজের থেকে তাদের ডোনেস্ক এর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পাইপ লাইন বন্ধ করেছে। তাও আবার কাউকে না বলেই। অনেকটা জিদ্দে। কেউ কি মনে করেন তাতে ইউরোপিয়ানরা জেলেনেস্কীর উপরে খুব খুশী হয়েছে? একেবারেই নয়।
(৮) তাহলে জেলেনেস্কী এটা করলো কেনো? সে না প্রকাশ্যে বলতে পারছে অনেক গোপন কথা, না সে স্বাধীনভাবে নিতে পারছে নিজের সিদ্ধান্ত। ফলে সে একটা জিনিষ খুব ভালো করে বুঝে গেছে যে, যুদ্ধ যতোদিন বেশী চলবে, এই যুদ্ধে প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিজের দেশের জন্য তার কি করার ছিলো এটা যুদ্ধ শেষে তর্জমা হবেই। আর তখন বেরিয়ে আসবে কেনো সে বা তার কেবিনেট একক সিদ্ধান্ত নিতে পারে নাই, অন্তত সেই সব সাধারন নাগরিকদের জীবনের কথা চিন্তা করে যে, অনেক আগেই একটা আপোষের মাধ্যমে দেশটাকে পুরুপুরী ধংশের হাত থেকে বাচানো যেতো। তাই মাঝে মাঝে দেখা যায়, জেলেনেস্কী ইচ্ছামত জাতী সংঘকে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে তাদের অপারগতার কথা বর্ননা করে গালাগালীও করছে। এটাই আসলে প্যারাডাইম শিফট। কিন্তু তার এই প্যারাডিম শিফট আসতে সময় লেগেছে প্রায় দুই মাসের বেশী যে, সে যা ভেবেছিলো, আসলে সেটা সত্যি ছিলো না।
এখন যেটা সুইডেন আর ফিনল্যান্ড ভাবছে, যে, তারা ন্যাটোতে জয়েন করলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তাদেরকে কেউ আঘাত করলে ন্যাটো ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের সব অস্ত্রপাতী নিয়া সুইডেন আর ফিন ল্যান্ডের জন্য ঝাপাইয়া পড়বে ইত্যাদি কিন্তু যেদিন ওরা দেখবে যে, আইনের মার প্যাচে, আর্টিকেল ৫, আর আর্টিক্যাল ১০ এর দোহাই দিয়ে ন্যাটো বলবে, এই আর্টিক্যাল গুলির বাধ্যবাধকতায় তো তারা বাধা, কিভাবে এটম বোম্ব দিয়ে রাশিয়াকে ঘায়েল করবে? তার থেকে নাও ১০০ বিলিয়ন ডলার লোন, কিংবা এই নাও সফিশটিকেটেড রাশিয়ার এন্টি ট্যাংক মিজাইল, মারো রাশিয়াকে, আমরা পাশের দেশে আমাদের আধুনিক যত্রপাতি লইয়া কসরত করিতেছি যেনো রাশিয়া ভয় পায়, কিন্তু রাশিয়া যেহেতু অস্তিত্ব সংকটে আছে, ফলে Do or Die ফর্মুলায় এই দুইদেশকে ক্রমাগত অনেকভাবে বিরক্ত করতেই থাকবে। তখন এই দুইটা দেশের মনে হবে, নাহ নিউট্রাল থাকাই সবচেয়ে ভালো ছিলো। ন্যাটোতে যোগ দেয়া ঠিক হয় নাই। মাঝখান দিয়ে একটা ডেস্পারেট রাশিয়ার রোষানলে নিজের সাজানো দেশটার শুধু ক্ষতিই করলাম। সময় মতো ঐ সব প্রতিশ্রুতদেওয়া দলগুলি একই কাজ করবে যেটা তারা করেছে ইউক্রেনের জন্য। এটাই হবে সুইডেন আর ফিন ল্যান্দের জন্য প্যারাডাইম শিফট।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বা ন্যাটোর এই আন্তরীক আহবানে অভিভুত হয়ে তাদের নিজস্ব চিন্তাধারা থেকে এতোটাই দূরে সরে গিয়েছে যে, মনে হয়েছে ওরাই ঠিক। আর এই ডমিনো ইফেক্টই সুইডেন আর ফিনল্যান্ড এখন ন্যাটোতে যোগদানের করে একটা বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে।
রাশিয়া হয়তো এই মুহুর্তে সরাসরি তাদেরকে আক্রমন নাও করতে পারে কিন্তু পারষ্পরিক বাই লেটারাল সহযোগীতা, তেক গ্যাস, ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই, কমোডিটি, পোর্ট ফ্যাসিলিটি, ইত্যাদি তো নষ্ট হবেই, ২৬০০ কিলোমিটার কমন বর্ডার কখনোই শান্ত থাকবে না।
১৩/৫/২০২২- রকি কাহিনী
আমাদের বাসায় কুকুর পালন কেউ পছন্দ করে না। কিন্তু গত কয়েকমাস আগে হটাত করে কোথা থেকে এক লোকাল কুকুর আমাদের বাসার সামনে এসে হাজির। সারাদিন বাসার সামনেই থাকে, পারলে গ্যারেজের মধ্যে নিজে থেকেই যেনো সেলফ ডিক্লেয়ারড পাহারায় থাকছে। তাঁকে নরম্যাল খাবার দিলে ছুয়েও দেখে না। কয়েকদিন চেষ্টা করেছি, ভাত, রুটি, কিংবা এই জাতীয় জিনিষ খেতে দিতে কিন্তু তার এমন একটা ভাব যেনো, ধুর!! কি দিছো এগুলি?
তারপর মাংস দিয়ে লবন দিয়ে মেখে একটা পরিষ্কার পাত্রে সাথে এক বাটি পানি দিলে উনি ধীরে ধীরে খেতে আসেন। তাও আবার পুরুটা তিনি খান না। একটু পেট ভরে গেলেই বাকী খাবারটা তিনি রেখে অন্যখানে গিয়ে পেট টানটান করে শুয়ে পড়েন। অনেক গবেষনা করছি এটা কোথা থেকে এলো, আর উদ্দেশ্যটা কি? আগেই বা কই ছিলো? শুনলাম পাশেই নাকি কোনো এক বাসায় থাকতো, ওখান থেকে তিনি রাগ করে এই যে এসেছে, ওদিকে সে আর ভুলেও যায় না।
এই কুকুরের আচরনে ইদানিং দেখি আমার বউ ওনার জন্যই শুধু মাংশ পাক করে। নাম রেখেছে আবার 'রকি'। রকি বলে ডাক দিলেও আবার ফিরে তাকায়। আমার ডাক্তার মেয়ে আবার ওর জন্য মাঝে মাঝে খাবারও কিনে নিয়ে আসে। আর আমিও বাদ যাই নি। কয়েকদিন নিউ মার্কেটের "৬৫ টাকায় বিরিয়ানীর দোকান" থেকে বিরিয়ানিও কিনে এনেছিলাম। ফলে আমি যখন বাসায় গিয়া হাজির হই, ব্যাপারটা এখন এমন হয়ে দাড়িয়েছে যে, গাড়ি থেকে নামলেই একেবারে পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করে আর যেনো বলতে থাকে- 'আমার বিরিয়ানির প্যাকেট কই?'
তো গতকাল অনেক বৃষ্টি ছিলো। রকি সারাদিন গ্যারেজেই চার পা চার দিকে ছড়াইয়া নাক ডেকে মনে হয় ঘুমাচ্ছিলো। আমি বাসায় যাওয়ার পর, সে কোনো চোখ না খুলেই খালি লেজ নাড়ছিলো। ধমক দিলাম বটে কিন্তু তিনি এক চোখ খুলে দেখলো আমাকে আর লেজটা আরো একটু বেশী করে নাড়াইলো। ভাবখানা এই রকম, আরে বস, ডিস্টার্ব করো না।
গার্ডকে দিয়ে ওনার জন্য মুরগীর তরকারী আর এক প্লেট ভাত এনে খাওয়ানোর পর দেখি হটাত তার এই শারীরিক কসরত।
7/5/2022-ফেসবুকে মিটুলের লেখা ৭ ই মে
আজ ৭মে আমার ও আখতারের জীবনের একটি বিশেষ দিন।বিবাহ বার্ষিকী নয়। তার চেয়েও অনেক মূল্যবান একটি দিন। আমাদের লাভ ডে আজ।লিখতে চেয়েছিলাম না। কিন্তু না লিখে পারলাম না। কেননা আমি আজ সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছি বন্ধুদের সাথে। মনে কিন্তু ঠিকই আছে!! এ কি ভোলার মত বিষয় আপনারাই বলেন!!
আমি অনেক ভালো আছি তাঁর সাথে, বর্ণনা করে বোঝাতে পারবো না।আমিও চেষ্টা করি আমার মানুষটিকে ভালো রাখবার। আসলে আমরা একে অপরকে রেসপেক্ট করি ও বোঝার চেষ্টা করি, যা মনের সুখের খোরাক জোগায় এবং খুবই দরকার। তবে আমার চেয়ে আখতারই বেশি মূল্যায়ন করে আমাকে। আমার আনন্দ গুলো যেমন অন্তর দিয়ে উপভোগ করে, তেমনি আমার মন খারাপ বা কষ্ট কোনটাই তাঁর যেন ভালো লাগে না।অনেক স্বাধীনভাবে জীবন যাপণ করছি। তাই বলে আমি কখনও অবিশ্বাসের কোন কিছু করেছি বলে মনে পড়ছে না।আমাকে সব রকম পরামর্শ দেয় সব সময়, সেটা আর্থিক বা বৈষয়িক যে কোন বিষয়ে। আমার সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গাটি আখতার।আলহামদুলিল্লাহ। আজ এই দূরে বসে সিলেটের লালা খালে তোলা বেশ কিছু ছবি আখতারের জন্য পোস্ট দিলাম।আজকের এই আনন্দগুলোও তাঁর জন্য পেয়েছি।বান্ধবীরা সিলেট যাচ্ছে বলতেই তিনি বলে বসলো-তুমিও যাও!!! অনেক বড় মনের মানুষ আখতার।মহান আল্লাহ ওকে সুস্থ শরীরে মান সম্মানের সাথে দীর্ঘজীবি করুন এবং জানমালের নিরাপত্তা দিন সে দোয়া করি। সবাই আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন প্লিজ প্লিজ।
০২/০৫/২০২২-আজ রোজার শেষ দিন, কাল ঈদ
আজ এ বছরের রমজান মোবারক শেষ হয়ে যাবে। বয়স বাড়ছে, আর জীবনের উপর ভয়ও বাড়ছে, বাড়ছে দুসচিন্তা, কমছে শরীরের শক্তি, তার সাথে কমে যাচ্ছে নিজের উপর কনফিডেন্স। যেভাবেই হোক আর যখনই হোক, একটা সময় তো আসবেই যেদিন আমি আর থাকবো না। খুব মন খারাপ হয় যখন এটা ভাবি, অন্যের জন্য কতটা মন খারাপ হয় সেটা আমার জানা নাই, কিন্তু নিজের উপরেই বেশী মন খারাপ হয় যে, ইশ, এতো সুন্দর একটা দুনিয়া ছেড়ে শেষ অবধি আমাকে চলেই যেতে হবে এমন একটা গন্তব্যে যার আমি কিছুই জানি না, দেখি নাই, এবং পুরুই খালী হাতে!! আর সবচেয়ে মন খারাপের দিকটা হচ্ছে- কোনো কিছুর বিনিময়েই আমি আর আমার এই পুরানো স্থানে একটি মুহুর্তের জন্য ও ফিরে আসতে পারবো না, কোনো কিছুই আর আমি কারো কাছে দাবীও করতে পারবো না, এমন কি আমার তৈরী করা অট্টালিকা, আমার রেখে যাওয়া ব্যাংক ব্যালেন্স, আমার নিজের সব কিছুর কিছুই না। যখন জীবিত ছিলাম, তখন এগুলির সত্তাধীকারী আমি ছিলাম, কিন্তু যে মুহুর্তে আমি চলে যাবো, এর কোন কিছুই আর আমারটাই আমার না। এমন একটা জীবন ঈশ্বর আমাকে কেন দিলেন? শুধু কি পরীক্ষার জন্যই? আমি তো তার এই পরীক্ষায় কোনোদিনই পাশ করতে পারবো না যদি তিনি সঠিক নিয়য়ে আমার দলিল পত্র দেখতে থাকে। যদি পুরুই হয় আমার পাশের নাম্বার তার অনুগ্রহের উপর, তাহলে তিনি আমাকে আরো লম্বা, আরো লম্বা, তার থেকেও লম্বা একটা জীবন দিলেন না কেনো?
কি জানি? হয়তো এই জীবনের পরে আরেক যে জীবন আমার ঈশ্বর বরাদ্ধ রেখেছেন, সেটা হয়তো আরেক অধ্যায় যা আমাদের কারোই জানা নাই। পরীক্ষার তো অনেক গুলি ধাপ থাকে। হয়তো এই জীবনের শেষ যেই মৃত্যু দিয়ে, হতে পারে সেখান থেকে আরো একটা ধাপ শুরু। কেউ তো আর এ যাবত সেই ধাপ থেকে ফিরে এসে বলে নাই, তার কার্যপ্রনালী কি, কি সেই ধাপের নমুনা।
যাই হোক, যেটা বলছিলাম, খুব সুস্থ্য ভাবে ৩০ টি রোজা করার শক্তি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। আমি প্রতিবছর নিজের বাসায় দুইটা হাফেজ কে দিয়ে কোরান খতম তারাবি করি। কিন্তু গত দুই বছর করোনার কারনে সেটা পালন করা যায় নাই। আমি করতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার স্ত্রী মিটুল তাতে বাধ সেধেছিলো ভয়ে। এবার আর কোনো কথা শুনতে চাইনি। হাফেজ ইসমাইল এবং হাফেজ মেহেদী নামে দুইটি বাচ্চা ছেলে আমাদের তারাবী লীড করেছিলো। ২০ রোজায় আমরা পুরু কোরান খতম করেছি (আলহামদুলিল্লাহ)
দোয়া কবুলের নমুনাঃ
আমার মাথায় আছে, আল্লাহ বলেছিলেন, আমি প্রতিদিন আমার রোজদার বান্দার ইফতারীর সমত যে কোনো ২ টি পজিটিভ ইচ্ছা বা দোয়া কবুল করতে প্রতিশ্রুত বদ্ধ। আমি এটা সব সময় মনে প্রানে বিশ্বাস করি এবং রোজার প্রথম দিন থেকেই আমি মোট ৬০ টি চাওয়া লিখে নেই। আমি জানি আমার জীবনে এই রকম ৬০ টি চাওয়া আসলে নাই। দেখা যায়, হয়তো ঘুরে ফিরে গোটা ১০ টি চাওয়াই থাকে। এ যাবত আমি আমার রবের কাছে কি কি চেয়েছিলাম, সেটা আর এখন বলছি না। তবে আমি স্পষ্ট দেখেছি, আমার প্রায় সব গুলি ইচ্ছা আল্লাহ পুরুন করেছেন। তিনি আমাকে চাকুরীর পর ব্যবসা করতে দিয়েছেন, কারো কাছেই আমার হাত পাততে হয় নাই, আমার সন্তানদেরকে তিনি সুস্থ্য রেখেছেন, মানুষের কাছে তিনি আমাকে সম্মানের সহিত রেখেছেন। অনেক কিছু করেছে আমার রব।
গত বছর আমি খুব মনে প্রানে প্রায় প্রতিটি রোজায় আল্লাহর কাছে এই দোয়াটি করেছিলাম যেনো আমাকে তিনি ঋণ গ্রস্থ জীবন থেকে উদ্ধার করেন। কারন আমি আমার মা ইন্ডাস্ট্রিজে জন্য বেশ কিছু লোনে জর্জ্রীত হয়ে গিয়েছিলাম। এই বছরে রোজার আগেই আল্লাহ আমাকে সম্পুর্ন লোন থেকে মুক্ত করেছে। এবারই প্রথম আমি লোন মুক্ত জীবনে পা দিয়ে একটা বড় সঞ্চয়ের পথে আছি। আমার ছোট মেয়েকে আমি আগামী ২ বছরের অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখেছি আমেরিকায় পরার জন্য। বড় মেয়ের জন্যেও একটা সঞ্চয় আমি করতে পেরেছি। আমার নিজের জন্যেও করতে পেরেছি। এর থেকে আর কত সুখী রাখবেন আমার রব আমাকে? আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।
এবার রোজায় আমি শুধু আমার মৃত আত্তীয় স্বজনের জন্য, আমার মেয়েদের জন্য, আমার স্ত্রীদের জন্য, আর আমার ব্যবসার জন্য প্রতিদিন দোয়া করেছি। আর আমি মনে প্রানে চেয়েছি যে, আমি যেনো সম্পুর্ন হোম ওয়ার্ক করে তারপর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি। আমি আমার সেই হোম ওয়ার্কের মধ্যেই এখন আছি। আমি সেই হোম ওয়ার্কের সময়কাল ধরেছি আরো ৬ বছর। ৬৩ বছর আয়ুষ্কাল পর্যন্ত যেহেতু আমাদের নবী ৬৩ বছরের বেশী বেচে ছিলেন না, তাই আমিও ধরে নিয়েছি আমারো ৬৩ বছরের বেশী বেচে থাকার ইচ্ছা করা উচিত না।
গত ঈদে আমার ছোট মেয়ে আমাদের সাথে ছিলো, এবার সে আমাদের সাথে নাই। সে এখন আমেরিকায়। আগামিতে আবার কে কার সাথে থাকবে না, কে জানে? উম্মিকার একটা বিয়ে হওয়া দরকার। উম্মিকাকে নিয়ে একবার একটা মারাত্তক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বিয়েটা টিকে নাই। তাই এবার আর আমি ওর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্তই দিবো না। এতে যখন ওর বিয়ে হয় হোক। এবার আমি প্রদিন উম্মিকার জন্য ওর বিয়ের জন্য, একটা ভালো পাত্রের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি।
31/04/2020-রহস্য।
You are required to login to view this post or page.
২৮/০৩/২০২২-ন্যাচারাল প্রতিশোধ
You are required to login to view this post or page.
26/03/22- দ্বিমুখী জীবন Full
You are required to login to view this post or page.
Protected: ২০/০৩/২০২২-সেটাই এটা যেটা ভেবেছিলাম
You are required to login to view this post or page.
Protected: ২৬/০৩/২০২২- আরেকটা প্রশ্ন
You are required to login to view this post or page.
23/02/2022-২০০৩ সালের কিয়েভে
আমি ২০০৩ সালে ইউক্রেনের কিয়েভে বেড়াতে গিয়েছিলাম একবার। তখন আমি জর্জিয়ায় জাতিসঙ্ঘ মিশনে কর্মরত ছিলাম। ইউক্রেনের এক মেজরের বাসায় উরুগুয়ের এক পাইলটকে সাথে নিয়ে তাঁর বাসায় বেড়াতে গিয়ে কিয়েভ সম্পর্কে আমার ধারনা একেবারে পালটে গিয়েছিলো। মানুষগুলি খুবই শান্তপ্রিয় আর শহরটাও মানুষগুলির মতো একেবারে শান্ত। কোনো কোলাহল নাই, সবাই ব্যস্ত আর খুবই মিশুক। মাত্র সপ্তাহখানেক ছিলাম।
উরুগুয়ের ওই পাইলটের সাথে এখনো আমার যোগাযোগ থাকলেও ইউক্রেনের সেই মেজরের সাথে আমার যোগাযোগ নাই। গতকাল সেই ইউক্রেনের উপর রাশিয়া আক্রমন করেছে শুনে খুব কষ্ট লাগলো মনে। ক্রেমলিন দেখার খুব শখ ছিলো। আমি ক্রেমলিনেও ভিজিট করতে গিয়েছিলাম। যেহেতু মিলিটারী অবজারভার হিসাবে কর্মরত ছিলাম, ফলে আমার সাথে কর্মরত একজন রাশিয়ান আর্মি অফিসারের সহায়তায় আমরা ক্রেমলিনের কিছুটা অংশ আমি সেখানে ভিজিট করতে পেরেছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম, কতই না শক্তিশালী এসব ক্রেমলিন। আজ যেনো এটাই মনে আসলো দ্বিতীয়বার।
বিশ্ব রাজনীতির অভ্যন্তরে অনেক দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক এজেন্ডা লুকিয়ে থাকে বিধায় আমরা যা নগ্ন চোখে দেখি সেটা আসলে সেটা না যেটা দেখি। তাঁর ভিতরে হয়তো লুকিয়ে থাকে আরো ‘গভীর কিছু’। কিন্তু এই ‘গভীর কিছুর’ দ্বারা সংঘটিত কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা পুরু বিশ্বকে অগোছালো করে ফেলে যদিও এই ‘গভীর কিছু সংঘটিত’ বিষয়ে অনেকেই জড়িত থাকেন না। ছোট বা বড় কোনো দেশই এর থেকে পরিত্রান পায় না। ছোয়া লাগেই। ইউক্রেনকে আক্রমন করে রাশিয়া কতটুকু উপকৃত হবে বা ইউক্রেন কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হবে সেটা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু আমাদের মতো দেশ যারা এর আশেপাশেও নাই তাঁদের কি কি হতে পারে?
আমাদের দেশ অনেকটাই আমদানী-রপ্তানী নির্ভর একটি দেশ। আর এই আমদানী-রপ্তানী বেশীরভাগ হয় ইউরোপের অনেকগুলি দেশের মধ্যে। ইউরোপে মোট ২৮ টি দেশ আলাদা আলাদা হলেও বাস্তবিক হচ্ছে এরা একটা গুচ্ছগ্রামের মতো। ফলে ইউরোপের একটি দেশের ভিসা পেলেই আমরা অনায়াসে অন্য দেশগুলি ভ্রমনের সুবিধা পাই। কারেন্সীও একটা ‘ইউরো’ যদিও সবার আলাদা আলাদা কারেন্সী আছে। ইউরোপের এই দেশ গুলি কোনো কোনো ন্যাচারাল সম্পদে বেশ উন্নত। ফলে একটা দেশে যদি এ রকম গোলমাল চলতে থাকে, সাভাবিকভাবেই অন্য এলাকায় এর প্রভাব পড়েই। প্রভাব পড়বে জ্বালানীর দামে, গ্যাসের দামে, বেড়ে যাবে আমদানী রপ্তানী খরচ যা প্রকারান্তে সাধারন মানুষের উপরেই বর্তাবে। প্রভাব পড়বে উগ্র পন্থীদের যারা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে আশেপাশের দেশ সমুহে। প্রভাব পড়বে ‘মুক্ত ও গনতান্ত্রিক বিশ্ব কন্সেপ্টে’ যদিও ‘মুক্ত ও গনতান্ত্রিক বিশ্ব কন্সেপ্ট’ এখন আছে বলে মনে হয় না। প্রভাব পড়বে সাইবার সিস্টেমে, শেয়ার মার্কেটে, ভোগ্য পন্যে, ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রভাব পড়বে বন্দরগুলিতে।
বাংলাদেশ যদিও এর অনেক দূরের একটি দেশ কিন্তু ইউরোপে রপ্তানী করা পোষাক শিল্প একটা ঝুকির মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা প্রচুর। আর যারা সরাসরি ইউক্রেনের সাথে আমদানী-রপ্তানীতে যুক্ত তাঁদের অবস্থা এখন খুবই আতংকের। আমাদের দেশ ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে অনেক ভোগ্যপন্য আমদানী করে যেমন মটর, সোয়াবিন, গম, ইত্যাদি, সেটা আরো উর্ধ গতি হতে পারে দামে। এ ছাড়াও আমাদের রপ্তানীকারক মালামাল যেমন প্লাষ্টিক, চামড়া, চামড়া জুতা, হিমায়িত খাবার, পাট বা পাটের দ্রব্য এসব রপ্তানীতে ঘটবে প্রচুর ব্যাঘাত। এমন একটা পরিস্থিতিতে আসলে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হবো তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
অন্যদিকে বড় বড় পরাশক্তি যতোই পিউনেটিভ একশন নিবে বলে যত প্রতিশ্রুতিই দেন না কেনো, যা ক্ষতি হবার তাঁর বেশীরভাগ ক্ষতি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। জাতিসঙ্ঘ, ন্যাটো, কিংবা অন্যান্য অক্সিলারী ফোর্স গ্রাউন্ডে যেতে যেতে রাশিয়ার উদ্দেশ্য হাসিল হয়েই যাবে। তারমধ্যে ইউক্রেন ন্যাটোর কোনো সদসই না।
ভবিষ্যৎ কি হবে এই মুহুর্তে বলা খুব দূরুহ।
20/02/2022- গেট টুগেদার এমসিসি
গত ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২২ তারিখে আমার আরেক বন্ধু প্রোফেসর শাহরিয়ার বহুদিন পরে ঢাকায় এসেছিলো কানাডা থেকে। কানাডাতেই সেটেল্ড সে। অনেকদিন দেখা হয় নাই ওর সাথে। তাই আমি আমার সব বন্ধুদেরকে শাহরিয়ারের আগমনে ওয়েষ্টিনে একটা দাওয়াত করেছিলাম। আমাদের মির্জাপুর ক্যাডেট ১৫ তম ব্যাচের ৫৩ জন ক্লাশমেটের মধ্যে ঢাকায় থাকে এমন ১৪ জন মিলিত হয়েছিলাম। জম্পেশ আড্ডা হয়েছিলো। উক্ত গেদারিং এ উপস্থিত ছিলাম- ফিরোজ মাহমুদ (মাইক্রোসফটের কান্ট্রি ডাইরেক্টর) , মেজর আখতারুজ্জামান (বিটিভির ইংরেজী খবর পাঠক), ব্রিগেডিয়ার জাহেদ (ওয়েষ্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং), মেজর আসাদ (বিখ্যাত লেখক), ডাঃ মনজুর মাহমুদ (প্রোফেসর পিজি), আব্দুল্লাহ হেল কাফি (মেরিন ইঞ্জিনিয়ার এন্ড মেরিন ক্যাপ্টেন), আরেক মনজুরুল আলম (স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যংক), রিজওয়ানুল আলম (বিখ্যাত সাংবাদিক এবং প্রোফেসর অন জার্নালিজম), মোর্শেদ এনাম (ইঞ্জিনিয়ার এবং বিখ্যাত লেখক, দাবারু আবুল মনসুরে সাহেবের বড় নাতী) এবং আমার আরেক বন্ধু ফয়সাল। দারুন উপভোগ করেছি সবার সান্নিধ্য।
এদিন আরেকটা ভীষন ভালো একটা ব্যাপার ঘটে গেলো। সেটা একটা অনুবাদ।
তাঁর আগে একটা কথা বলে নেই যে, কোনো বিখ্যাত লেখকের বই অনুবাদ করতে গেলে প্রথমে যেটা প্রয়োজন সেটা হলো, অরিজিনাল লেখক কখন কোন শব্দ বা লাইন বা উক্তি দিয়ে কি বলতে চাইছেন সেটা লেখকের মতো করে বুঝতে শেখা এবং সে মোতাবেক হুবহু ভাষান্তর পাঠকের জন্য তা অনুবাদ করা। যদি এর মধ্যে কোনো ব্যত্যয় ঘটে তাহলে হয় অনুবাদকের নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয় অথবা অরিজিনাল লেখকের মুল বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। শুধুমাত্র আক্ষরীক শব্দকে অন্য ভাষায় রুপান্তরীত করলেই অনুবাদক হওয়া যায় না। জনাব মাহমুদ (আমার মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের বন্ধু এবং খুব প্রিয় আমার একজন মানুষ) একটা কঠিন কাজ হাতে নিয়েছেন। ডঃ ইয়াসির কাদিরের ভিডিও বক্তব্য এবং তাঁর কিছু লিখিত সংস্করণের উপর ভিত্তি করে আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মাদ (সঃ) উপর তিন খন্ডের মধ্যে ১ম খন্ডটি সমাপ্ত করেছেন। বইটির নাম "মহানবী মুহাম্মাদ (সঃ) এর জীবন ও সময়" আমি অনেক অনুবাদ পড়েছি, অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত বই এর বাঙলা কিংবা ইংরেজী অনুবাদ পড়েছি, মাহমুদের এই বইটি একটি অসাধারন অনুবাদ হয়েছে। আমি অন লাইনে ডঃ ইয়াসির কাদির বক্তব্য শুনেছি এবং শুনি। আমার বন্ধু মাহমুদের এই উক্ত অনুবাদটি একদম ডঃ ইয়াসির যা যেভাবে বলতে চেয়েছেন, মাহমুদ সেটা পুনহখানুপুঙ্খ ভাবেই তুলে ধরেছেন।
আমি প্রচূর বই পড়ি, বই পড়া আমার একটা নেশার মতো। আমি মাহমুদের এই বইটার প্রায় ৩০% পড়ে ফেলেছি। নেশার মতো পড়ে যাচ্ছি। অতীব সাবলীলভাবে মাহমুদ অনুবাদটি করেছে। পড়তে খুব ভালো লাগছে।
অনেক ধন্যবাদ তোদের সবাইকে।
আপ্নারা যারা আমাদের মহানবী হজ রত মুহাম্মাদ (সঃ) এর জীবনী এবং তাঁর সময়কালটা আক্ষরীক অর্থে বোধ গম্য ভাষায় জানতে চান, কিনতে পারেন। এটা Worth Buying Good Book.
ধন্যবাদ মাহমুদ তোকে আর ধন্যবাদ শাহরিয়ারকে যার কারনে একটা চমৎকার গুড গেদারিং হয়েছে। আর ধন্যবাদ আমার সব বন্ধুদের যারা সময়টাকে নিয়ে গিয়েছিলো প্রায় ৪৪ বছর আগে। আর মাহমুদের বইটা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলো প্রায় ১৪০০ বছর আগে।
আমি তোদের সবাইকে খুব ভালোবাসি।
১৮/০২/২০২২- আমার বাগানের আলু
বাগান করিতে গিয়া একবার মিষ্টি আলুর কয়েকটা ডগা লাগাইয়াছিলাম। যত্ন করি নাই, পরিচর্যাও তেমন করা হয় নাই। ধীরে ধীরে কবে কখন চোখের আড়ালে মাটির নীচে তিনি এত বড় হইয়া উঠিয়াছে জানিতেও পারি নাই। বাগান আলু পাতায় ভরিয়া উঠিতেছে ভাবিয়া উহা সমুলে নির্মুল করিতে গিয়া এই আলুখানা চোখে পড়িলো। কখন কিভাবে যে এত অনাদরেও সবার অলক্ষ্যে সে এত বড় হইয়া উঠিয়াছে কেহই জানিতে পারে নাই। এখন তাহাদের বংশ সহ জীবন ধংসের মুখে। কেমন যেনো মনে হইতেছিলো। তখন মনে বড্ড কষ্ট হইতে লাগিলো এই ভাবিয়া যে, আহা এই ক্ষুদ্র বোবা উদ্ভিদ তৃনলতার মতো মেরুদন্ডহীন লতাটাকে বাগানে রাখিয়া দিলেও পারিতাম। কারন এরাও ফল দেয়, আর এই ফল মুল্যহীন নয়। বাগানে কেহই অনর্থক বা মুল্যহীন নয়।
চোখ বুজিয়া আমি যেনো আমাদের সমাজের বৃহত বাগানের চিত্রটি দেখিতে পাইলাম। অনেক কিছুই ফুটিয়া উঠিলো। এখানে সবাই কোনো না কোনো সময়ে নিজের আপন চেষ্টায়, গোপনে সবার অলক্ষ্যে বাচিয়ে রাখার চেষ্টা করে। সে যত অবহেলিতই হোক, কিংবা অনাদর। মালি কিংবা মালিক কারো কোনো পরিচর্যা ছাড়াও কোনো কোনো প্রজাতি এই ধরায় অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখার আপ্রান যুদ্ধ করেই পতবর্তী প্রজন্মের জন্য ফল দেয়। কেউ ফেলনা নয়। এটা হয়তো ফিলোসোফির একটা দিক বা মুদ্রার।
কেউ কেউ আবার এই বড় মিষ্টি আলুটির চেহাড়া সুরুত আর সাইজ দেখিয়া ইহাও বলিতে পারেন, এই বেটা একটা আলুই শুধু এতো মোটা আর বড় হইলো কেনো? অন্যগুলি না কেনো? সেই ফিলোসোফি যদি বলি- হতে পারে যে, এই একটা আলুই বাগানের যাবতিয় সুখ আর খাদ্য একাই খাইয়া এতো বড় হইয়াছে যাহার ফলে অন্য আলুগুলির ভাগ্য রোহিংগাদের মতো। এই বড় আলুটি শুধু নিজের কথাই ভাবিয়াছে আর ভাবিয়াছে, এই পৃথিবীতে কে কাহার? আগে নিজে বড় হই, তারপর দেখা যাবে। কিন্তু যখন কোনো গোত্রের মধ্যে বিপদ আসিয়া হাজির হয়, তখন কে কত বড় আর কে কত ছোট তাহা ভাবিয়া বিপদ আসে না। তখন ছোটবড় সবাই একত্রে মরিতে হয়। অথবা যিনি সবচেয়ে বড় তাহাকেই আগে কতল করা হয়।
তাই গোত্রের সবাইকে নিয়া একত্রে বড় হওয়া একটা নিরাপত্তার ব্যাপার থাকে। নতুবা এই ছোট আলুগুলির থেকে বেশী নজর থাকে সবার বড় আলুর দিকে। ইহাকেই আমরা আজ প্রথম সিদ্ধ করিবো। বাকিগুলি হয়তো আবার কোনো না কোনো বন-জংগলে ফেলিয়া দেবো, কারন তাহাদের প্রতি আমাদের মতো মালি বা মালিকের খুব বেশী ইন্টারেস্ট নাই। ফলে, এই কারনে কোনো একদিন তাহারাই আবার বংশ বিস্তার করিয়া তাহাদের অস্থিত্ত বজায় রাখিবে।
আরেক দল আবার ভিন্ন একখানা মতবাদ লইয়া এই আলুর উপর কিছু দোষ চাপাইয়া নিজেরা পার পাইতে চেষ্টা করেন। কারো কারো ব্যক্তিগত দোষের কারন কেনো বা কি মনে করিয়া এই নীরিহ বোবা একটা আলুকে দোষারুপ করেন তাহা আমি আজো বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। কিছু হইলেই মানুষ ‘আলুর দোষ’ বলিয়া চালাইয়া দেন। অথচ এই বোবা আলুটি সারাজীবন সবার অলক্ষ্যেই বসবাস করে। হইতে পারে, গোপনভাবে থাকার এই বইশিষ্ঠই মানুষের আলুর সাথে মিল থাকার সব দোষ এই নন্দ ঘোষের উপর পড়ে।
মোরাল অফ আলুঃ
একাই শুধু খাইয়া বড় হইয়েন না, বিপদ আছে তাহলে।
আলুর প্রতি এতো ঝুকে যাইয়েন না, তাহলেও বিপদ হইতে পারে।
আলুর যত্ন নিন। আলুকে ভালোবাসুন।
১৩/০১/২০২২-Meeting Fourth Generation
গল্পটা কাল্পনিক নয়। গল্পটা সত্যি। আর এখানে যাদের নামগুলি উল্লেখ করা হয়েছে, তারা তাদের নিজের নামেই রয়েছেন। অনেক অজানা কষ্ট আর বেদনা দিয়ে এই পৃথিবী এতোই ভরপুর যে, সবাই এক নাগাড়ে সবার কষ্টের কথা, বেদনার কথা, সাফল্য আর ব্যর্থতার কথা বলতে গেলে সারা পৃথিবীতে শুধু কান্নার রোলই পড়ে যাবে। তারপরেও মানুষ বেচে থাকে আশা নিয়ে, হতাশাকে দূর করে কিছু আনন্দ আর হাসি নিয়ে। এরই নাম জীবন। কেউ হেরে যায়, কেউ পড়ে যায়, কেউবা আবার পরতে পরতে দাঁড়িয়ে যায়। আজ থেকে অনেক জেনারেশন পর সেসব মানুষগুলি হয়তো জানবেই না, কি ছিলো তাদের সেই কষ্টে ভরা তাদের অতীতের পূর্বসুরীদের জীবন, কিংবা কিভাবে আজ তার এই পর্বে আসা। আজকে এই ঘটনার মানুষগুলিকে সেই চরাই উতরাই পার করে সেই সব পূর্বসুরীরা নতুন প্রজন্মের জন্য নব পরিস্থিতি তৈরী করে গেছে। আজকের গল্পের মানুষ গুলিকে এই পর্বে আসতে অন্তত চারটি জেনারেশন পার করতে হয়েছে। এর মধ্যে ১ম জেনারেশনের কেহই জীবিত নেই, ২য় জেনারেশনের অনেকেই গত হয়েছেন, কেউ কেউ এখনো জীবিত আছেন বটে কিন্তু বয়স অনেক হয়ে গেছে তাদের। ৩য় জেনারেশনের এখন পড়ন্ত বিকেলের মতোই। আর ৪র্থ জেনারেশন তারা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, আর সবেমাত্র তাদের মধ্যে একটা সমন্নয় হলো। এবার দেখার বিষয় পরের প্রজন্মের কাহিনী। হয়তো অন্য কেউ লিখবে তার পরের প্রজন্মের ইতিহাস, এমনো হতে পারে, থাক...।
হামিদা খাতুন আমার মা, বিল্লাল ভাই (বেলায়েত ভাই ) আমার সেই ভাই। বহুদিন একই গ্রামের কাছাকাছি ছিলাম, মাঝে মাঝে এক সাথে দুজনে সিগারেট টানতাম। অতীতের অনেক গল্প শুনতাম। কখনো সেই গল্পে ছিলো হাসি, কখনো ভেজা চোখ আবার কখনো নিগুড় কালো রাতের মতো অন্ধকারের ভীতি সঞ্চারী অনুভুতি। বিল্লাল ভাই মারা গিয়েছেন অনেক বছর আগে। তার সন্তানদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিলো, এখনো আছে তবে খুব ঘন ঘন নয়। কারন তাদের অনেকেই দেশের বাইরে চলে গেছে। বিল্লাল ভাইয়ের স্ত্রী এখনো জীবিত আছেন। তিনিই বা কতটুকু গল্পগুলি জানেন তা আমার জানা নাই। তবে তিনিএখন সার্থক স্ত্রীর মতো সার্থক মাও। তার সন্তান সেলিম বর্তমানে নেভাদায় থাকে। আমার ছোট মেয়ে কনিকা আমেরিকায় যাওয়ার সুবাদে এই প্রথম সেলিমদের এবং তার সনাত্নদের সাথে প্রথম দেখা হলো। এরা ৪র্থ জেনারেশন। আমার ফার্ষ্ট নাতি ওরা। আমার মা আজ বেচে থাকলে আর আমার ভাই বিল্লাল ভাই বেচে থাকলে বড্ড খুশী হতেন। জীবন কত বিচিত্র। কোথাও না কোথাও গিয়ে এর রুট মিলিত হয়ই।
“কিছু কথা আছে যা বলতে চাই নাই কিন্তু বলা হয়ে যায়, কিছু কথা ছিলো, বলতে চেয়েছি, অথচ বলা যায় নাই, কিছু সপ্ন ছিলো যা দেখতেই চাই নাই কিন্তু দেখতে হয়েছে আবার কিছু এমন সপ্ন ছিলো সব সময় দেখতে চেয়েছি কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় নাই। এমন কিছু শখ ছিলো সারাজীবন লালন করেছি কিন্তু জীবনের শেষ তীরে এসেও সেটা ধরা দেয় নাই আবার এমন কিছু ভয় ছিলো যা একেবারেই কাম্য নয় অথচ তা আমি এড়িয়েই যেতে পারিনি। কী কারনে আবার এই কিছু কথা না বলতে চেয়েও বলতে হয়েছে, কিছু সপ্ন আমাকে দেখতেই হয়েছিলো অথচ সেটা আমার কাম্য ছিলো না, আবার কিছু স্বপনের ধারে কাছেও আমি যেতে পারিনি। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস। আমি এই আফসোসের ব্যাপারটা নিয়ে বহুবার গবেষনা করেছি। কিন্তু জীবনের কাছে রাখা সব উত্তর সবসময় তার প্রশ্নের ন্যায় বিচার করে না। বিশেষ করে প্রশ্নটা যখন এমন হয় যেটা মনকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খায়, আর হৃদয়কে ছুড়ি দিয়ে ফালা ফালা করে দেয়। ফলে কোনোই আমি সেইসব প্রশ্নের উত্তর পাই নি, না আমার কাছে, না যাদের কাছ থেকে উত্তর পাওয়া দরকার ছিলো তাদের কাছ থেকে। আর উত্তর না পেতে পেতে একসময় আমি কোনো উত্তরের আর আশাও করিনি। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার কাছে শতভাগ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো যে, আমার এই অপারগতার কারন না আমি নিজে, না আমার সাথে যারা জড়িত ছিলো তারা। না এটা আমার দোষ, না ছিলো তাদের। আমি যদি আরো গভীরে গিয়ে এর আনুবীক্ষনিক পর্যালোচনা করি, তাহলে হয়তো আমার আরেকটা আফসোসের কথা প্রকাশ না করলেই নয় যে, আমার সেই অপারগতা কিংবা ঘাটতির কিছুটা হলেও কেউ না কেউ সহজেই হয়তো পুরন করতে পারতো, যা ‘সেই কেউ’রা হয়তো চেষ্টাই করে নাই।“
উপরের এই কথাগুলি আমার নয়, কথাগুলি একজন এমন মানুষের যাকে আমি আমার মতো করে চিনতে শুরু করেছিলাম আজ থেকে প্রায় ২৪ বছর আগে যখন আমার বয়স প্রায় ২২। কতটুকু আমি তাকে বুঝতে পেরেছিলাম, সেটা আমার জানা নাই, কিন্তু কেনো জানি আমার খুব মায়া হতো, আর এই মায়ায় মাঝে মাঝে আমি নিজেকে তার ভূমিকায় প্রতিস্থাপিত করে দেখতাম কি হয় ভাবাবেগে অথবা মানসপটে। এই সময়টায় আমি খুব ভাবাগেবিত হয়ে যেতাম। ভাবাবেগিত হতাম এটা ভেবে যে, কি পরিমান চাপ কিংবা কষ্ট নিজের বুকের ভিতরে লুকিয়ে রাখা সম্ভব? তখন আরো বেশী মায়া হতো একজনের জন্য নয়, দুজন নিসংগ মানুষের জন্য যাদের উভয়ের বুকেই ছিলো সমান যন্ত্রনা আর ভাগ্যের আক্ষেপ। একজন যেনো পরাজিত, আর অন্যজন সেই পরাজয়ের কারন। এদের একজন আমার “মা” আর আরেকজন ‘বিল্লাল ভাই’ যাকে সবাই ডাঃ বেলায়েত নামেই চিনতো। আমি আজ সেই তাদের কথাই হয়তো বলবো।
আমার ‘মা’র সম্পর্কে আমি অনেকগুলি লেখা ইতিমধ্যে লিখলেও তার সবচেয়ে বড় দূর্বল বিষয়টি আমি কখনো আমার লেখায় আনিনি। আমি জানতাম এবং অনুভব করতাম আমার মায়ের সেই দূর্বলতা। আমার মায়ের এই দূর্বলতা তার নিজের সৃষ্টি যেমন নয়, আবার তিনি ইচ্ছে করলেও তার সেই অপারগতাকে তিনি অনায়াসেই দুহাত দিয়ে এক পাশে সরিয়ে দিতে পারতেন না। এই দূর্বলতা সমাজ সৃষ্টি করেছে, আর সেই সমাজ আজকের দিনের দুটি মানুষকে বিজন বিজন দূরে ঠেলে দিয়ে দুজনকেই অসুখী একটা বলয়ে জীবিত কবর দিয়েছিলো। আমার মায়ের সেই বড় দূর্বলতা ছিলো এই ‘বিল্লাল’ ভাই। পরবর্তিতে প্রায় তিন যুগ পরে যেদিন আমি আমার মায়ের সর্বশেষ ভিডিওটি করি, তখন অনেক প্রশ্নের উত্তর আমি জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু সে প্রশ্নগুলির উত্তর আমাকে আরো ব্যথিত করে দিয়েছিলো। সেই প্রশ্নের উত্তর আমাকে প্রতিটিবার চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিলো, আমার অন্তরের কোথায় যেনো ছট ফট করছিলো কোনো এক অয়াশান্ত অনুভুতিতে। আর যিনি উত্তর দিচ্ছিলেন, আমার মা, তার দ্রিষ্টি কখনো সেই মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে নির্লিপ্ত হয়ে ভাষাহীন কিছু শব্দ তেই শেষ হচ্ছিলো যার সাহিত্যিক নাম- আহা, কিংবা উহু। এসব বেদনার রাজত্তে যিনি ছিলেন, সে আর কেউ নয়, বিল্লাল ভাই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- কে এই বিল্লাল ভাই? যদি এর উত্তর খুজতে চাই, তাহলে ফিরে যেতে হবে আজ থেকে বহু বছর আগে যখন আমারও জন্ম হয় নাই। ফলে আমি যা জেনেছি, শুনেছি, তা পুরুই হয় আমার মার কাছ থেকে, কিংবা আমার অগ্রজ ডঃ হাবীবুল্লাহর কাছে বা স্বয়ং বিল্লাল ভাইয়ের কাছ থেকে জানা কিছু তথ্য। কিন্তু আমার কাছে সব ব্যাপারটাই যেনো মনে হয়েছে, এটা ছিলো একটা ভাগ্য আর সময়ের খেলা।
কেনো ‘ভাগ্য’ আর ‘সময়’ বললাম তারও একটা ব্যাখ্যা আছে। অনেক সময় এমন দেখা যায় যে, “ভাগ্য” আর “সময়” দুটুই কারো জীবনে একসাথে আসে, কিন্তু “ভাগ্য” আর “সময়” ওরা কখনোই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ না। সঠিক ব্যবহারে ভাগ্য পালটাতে পারে বটে কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে ভাগ্যও পালটে যায়। কিন্তু এই ‘সঠিক’ ব্যবহার আবার সবাই সবসময় হয়তো পায়ই না যাতে সেই সঠিক ব্যবহারে তার ভাগ্য পাল্টাতে পারে। কেউ কেউ পারে, আবার কেউ কেউ পারে না। আবার কারো কার ব্যাপারে সুযোগটাই আসেনা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া কোনো ব্যক্তিত্ত সময়ের স্রোতে আবার বেশীদিন অসহায়ও থাকে না। একসময় না একসময় সে ঘুরে দাড়ায়ই যদি তার দৈবক্রম ভাগ্য আবার সেই ঈশ্বর কোনো এক যাদুর কাঠিতে হাল ঘুরিয়ে দেন। শুধু হাল ঘুরিয়ে দিলেই হয়তো তার সেই নির্যাতিত ভাগ্য দৈবক্রম ভাগ্য সঠিক নিশানায় পৌছায় না যদি তার চোখে না থাকে সপ্ন আর প্রবল একটা ইচ্ছাশক্তি। আজকের লেখার প্রধান চরিত্র এই ‘বিল্লাল’ ভাইয়ের ব্যাপারেও সেই দুটু শব্দ প্রায় একই সুরে খেটে যায়। ভাগ্য তাকে সুপ্রস্নন করে নাই, আবার করেছেও। ‘সময়’ তাকে একটা বলয় থেকে ছিটকে ফেলেছিলো বটে কিন্তু আবার সেই ‘সময়’টাই বদলে দিয়েছে তার সব জন্মগত বৈশিষ্ট।
বিল্লাল ভাইয়ের এই ইতিহাস নাতিদীর্ঘ নয়। এই ইতিহাস একটা পূর্ন জীবনের। আর সেই জীবনের বয়স কাল নেহায়েত কমও নয়, প্রায় ৫৫ বছর। এই ৫৫ বছরে পৃথিবী তার অক্ষে ৫৫ বার প্রদক্ষিন করে কত যে ঋতু আর কাল প্রশব করেছে তার কোনো হিসাব নাই। তাই বিল্লাল ভাইয়ের এই ইতিহাস বলার আগে সেই মানুষটির ইতিহাস বলা প্রয়োজন যার জন্য আরেক অধ্যা তৈরী হয়েছিলো বিল্লাল ভাইয়ের। আর তিনিই হচ্ছেন- আমার মা, আর জন্মধাত্রী বিল্লাল ভাইয়ের।
আমার মায়ের পুরু নাম ‘মোসাম্মাত হামিদা খাতুন’। নামটা আমি এভাবেই সবসময় লিখে এসেছি আমার ব্যক্তিগত তথ্যাবলীর মধ্যে। আমার মায়েরা ছিলেন দুই বোন এবং তার কোনো ভাই ছিলো না। আমার মায়ের আরেক বোনের নাম ছিলো ‘মোসাম্মাদ সামিদা খাতুন’। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, গ্রাম্য ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ারিশান সার্টিফিকেটে তাদের দুজনের নামই লিখা হয় যথাক্রমে ‘হামিরন নেছা’ এবং ‘ছামিরন নেছা’। যাই হোক, নাম বিভ্রাটের কারনে আজকাল হয়তো ব্যংকে একাউন্ট করতে জটিলতা থাকতে পারে, কিংবা ক্রেডিট কার্ডে ঝামেলা হতে পারে, কিন্তু এই নামের বিভ্রাটের কারনে আমাদের মুল চরিত্রের মানুষ গুলির জীবনের ইতিহাসে কোনো প্রকার ব্যত্যয় হয় নাই। আর আমার এই লেখাতেও এটা অনেক বড় সমস্যা নয়। আমার নানা অর্থাৎ আমার মায়ের বাবার নাম ছিলো ‘কেরামত আলি’। আজকাল এই নাম গুলি আর কেউ রাখে না। হয়তো ভাবে যে, নাম গুলি আধুনিক নয়। কিন্তু এই নামের মানুষ গুলি ছিলে ভালোবাসার আর ভরষার ভান্ডার। যাই হোক, যদি আরেকটু আগের জেনারেশনে যাই, তাহলে আমরা সেই ‘কেরামত আলি’র বাবার নাম পাবো ‘উম্মেদ আলী মুন্সী’। এই উম্মেদ আলীর বাবা জনাব হাজী আসাদুল্লাহ (পিতা-আহাদুল) এর শাখা প্রশাখা বিশ্লেষন করলে এমন এমন কিছু বর্তমান আত্মীয় সজনের নাম চলে আসবে যা না আমরা অনেকেই মানতে চাইবো, না আমরা তা গ্রহন করবো। তার কারন একটাই-সমাজের স্তরভিত্তিক কেউ এমন জায়গায় আর কেউ এমন স্তরে যা না মিশে বংশে, না মিশ খায় পরিবারে। কিন্তু বাস্তবতাটাই যে অনেক কঠিন এটা মানা আর না মানাতে কিছুই যায় আসে না। না মানার মধ্যে হয়তো থাকতে পারে একটা বড় অহংকার বা সম্পর্ক ছিন্নকারীদের মধ্যে সামিল, কিন্তু বাস্তবতা পালটায় না তাতে। যাই হোক, সেই ৫/৬ জেনারেশন আগে না হয় নাইবা গেলাম।
আমার মায়ের বয়স যখন সবেমাত্র বারো কি তেরো, তখন সমাজের রীতি অনুযায়ী আমার নানা কেরামত আলি বিবাহযোগ্য মেয়ের বোঝায় চাপ অনুভব করে তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। আজ থেকে সেই প্রায় সত্তর বছর আগে যেটা হয়তো ছিলো সমাজের একটা রীতি, আজ তা বাল্যবিবাহের নামে সমাজ তাকে অপরাধের কারন বলে উল্লেখ করে। যেটাই হোক, সমাজের রীতি অনুযায়ী আমার মা, খালাদের বিয়ে ওই বারো তেরো বছর বয়সেই হয়েছিলো। আমার মায়ের সেই স্বামীর নাম ছিলো আব্দুল জলিল (সম্ভবত)। সম্ভবত বলছি এই কারনে যে, নামটা এই মুহূর্তে সঠিক লিখলাম কিনা সিউর হতে পারছি না। তবে সঠিক হবার সম্ভাবনা ৭৫%। ১২ বছরের একজন প্রায় নাবালিকা বিয়ের পর এখন অন্য বাড়ির বউ হয়ে গেলো। এই নববধূর পড়নের কাপড়টাই হয়তো তার থেকে প্রায় তিন গুন লম্বা, সবে মাত্র হায় প্যান্ট ত্যাগ করা বালিকাটি এখন নাকে নোলক, হাতে মেহেদী সমেত চূড়ি, কানে দূল, আর মাথায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই পরিচিত সব মানুষ গুলি থেকে আলাদা হয়ে অন্য এক সংসারে একটা আলাদা পরিচয় নিয়ে বাপের বাড়ি ছেড়ে গেলো। তার শখের পুতুল, ছেড়া বই কিংবা সখীদের অনেক গোপন কিছু মজার স্মৃতি সব ছেড়ে কেদে কেদে নিজের সেই খেলার আংগিনা, কাথা বালিশ আর বাড়ির উঠোনের মায়া ত্যাগ করে অন্য কোথাও যেতেই হলো। এ যেনো পালের একটা পোষাপ্রানী যে কিনা এখনো তার মায়ের দুগ্ধপানও ছাড়ে নাই। এই বয়সের একজন অপরিপক্ক নাবালিকা কি সংসার করছে বা করেছে সেটা আমি আজো বুঝে উঠতে পারিনা কিন্তু বিধাতার সিস্টেমে আমার মা গর্ভবতী হলেন। আর সেই গর্ভধারনের পরে সঠিক সময়ে তিনি সুস্থ্য একটি পুত্র সন্তানও দান করেন তার শ্বশুরালয়ে। এই পুত্রটির নামই হচ্ছে- বিল্লাল হোসেন বা বেলায়েত হোসেন। সবকিছুই ঠিকঠাক মতোই চলছিলো। স্বামী, সংসার, পুত্রযত্ন সবকিছু। নবাগত পুত্র সন্তানের আদরের কোনো কমতি নাই, নব নাম ধারী হামিদা এখন শুধু হামিদাই নয়, সে এখন ‘মা’ও বটে। তার নতুন নাম ’মা’। চারিদিকেই একটা নন্দ যেনো বাতাসের প্রবাহের মতো সারাটা বাড়ি দোলায়িত হচ্ছে, কেউ পুতুল নিয়ে দেখতে আসে, কেউ দোয়া দিতে আসে, কেউবা আবার আসে এম্নিতেই। সব কিছুই ঠিক যেভাবে চলার কথা সেভাবেই চলছিলো। কেরামত আলী তার মেয়ের জন্য গর্বিত, পাড়ার লোকেরাও। কিন্তু বিধাতার পরিকল্পনা মানুষের পরিকল্পনার থেকে অনেক বেশী যেমন রহস্যময়ী, তেমনি অনেক কঠিনও। তিনি কাকে কি দিয়ে সুখবর দিবেন আর কাকে কি দিয়ে দুঃখের অতল গভীরে নিয়ে যাবেন, তার হিসাব কিংবা ছক আমাদের কারোরই বুঝার কথা নয়। আর সে অধিকার ঈশ্বর কাউকে দেন ও নাই। তিনি একাই খেলেন, একাই গড়েন, আবার একাই ভাঙ্গেন। কেনো গড়েন, কেনো ভাজ্ঞেন এর ব্যাখ্যা চাওয়ারও আমাদের কোনো উপায় নাই। ফলে দেখা যায়, একই খবর কারো কাছে যেমন শুভ হয় আবার কারো কাছে তেমনি অশুভও হয়। একই জায়গায় মিলিত হওয়া মানুষের রাস্তা যেমন তিনি আলাদা আলাদা করে দেন, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন রাস্তায় চলাচলকারী অনেক মানুষের রাস্তাও তিনি এক জায়গায় এনে মিলন ঘটান। একই পরিস্থিতিতে যেমন একজন জীবনকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যান, আবার সেই একই পরিস্থিতিতে তিনি আরেকজন জীবনকে অসহায় অবস্থার সাথে বোঝাপড়া করতে ব্যস্ত করে তোলেন। আমার মায়ের বেলাতেও ঠিক এমন একটা পরিস্থিতি হাজির করলেন বিধাতা। আমার মায়ের স্বামী আব্দুল জলিলকে তিনি এই নশ্বর পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন। যে নাটাইটায় একটা গুড়ি নিজের আনন্দে নীল আকাশের হাওয়ায় ভেসে একবার এদিক, আরেকবার ওদিক দোল খাচ্ছিলো, হটাত নাটাইটা বিচ্ছিন্ন করে দিলো ফানুশের মতো উরে থাকা রংগিন ঘুড়িটা। ছন্দে ভরা কতগুলি জীবন এক সাথে যেনো ছন্দ পতনের ধাক্কায় চারিদিক বেশামাল হয়ে গেলো। আমার মা হামিদা ভয়ে আতংগকে আর বিষন্নতায় বোবা হয়ে গেলেন, হামিদার বাবা কেরামত আলী মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনায় মুর্ছা যেতে লাগলেন। আর হামিদার সদ্য জন্মানো পুত্র বিল্লাল কিছুই না বুঝে মায়ের দুধের জন্য বিকট চিতকারে বাড়ি, ঘরময় যেনো আলোড়িত করে দিলো। মাত্র ১৪ বছর বয়সে আমার মা হামিদা খাতুন বিধবার তকমা গলায় পড়ে হাহাকার ঘরে যেনো নির্বাক হয়ে গেলেন।
কোনো নারীর অধিকার তার স্বামীর বাড়িতে স্বামীর বর্তমানে যেমন থাকে, সেই নারীর সেই অধিকার স্বামীর অবর্তমানে আর তেমন থাকে না। হামিদার স্বামীর ইন্তেকালের কয়েকদিন পর বাড়ির অন্যান্য সবাই যখন হামিদার স্বামীর শোকের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে থাকে, ততোই যেনো হামিদার উপর অন্যান্যদের খোটার ভার বাড়তে থাকে। এই বয়সে স্বামীকে বুঝার আগেই যখন কেউ স্বামী হারা হয়, তার নিজের মনের অবস্থার কথা কেউ তো ভাবেই না, বরং সব দোষ যেনো সেই অপয়া হামিদারই। পৃথিবীর কেউ এই নাবালিকা বিধবার মনের ভিতরের কষ্ট কিংবা বেদনার অনুভুতি না বুঝলেও হামিদার বাবা কেরামত আলী ঠিক বুঝতে পারছিলেন কি চলছিলো হামিদার ভিতরে। তিনি কোনো কিছুই চিন্তা না করে দুই অবুঝ, এক হামিদা এবং তার পুত্রকে নিয়ে চলে এলেন নিজের বাড়িতে। হামিদা এখন আবার তার পিত্রালয়ে সেই চেনা পরিবেশে ফিরে এলো। আজকের এই চেনা পরিবেশ যেনো আর আগের সেই পরিবেশ নাই, তার খেলার অনেক সাথীরাই অন্যের বধু। এখন আর দলবেধে কাউকে নিয়ে সেই চেনা পরিচিত নদীতে হৈ হুল্লুর করে জল্কেলীর কোনো সুযোগ নাই। কোথায় যেনো বীনার তার গুলি ছিড়ে গেছে। আর সাথে তো আছেই পুত্র বিল্লাল, যার কাছে দাদা বাড়িই কি, আর নানা বাড়িই কি কোনো কিছুরই কোনো পার্থক্য নাই। শুধু মনের অজান্তে চোখের পানি ঝরছে হামিদার আর তার সাথে অসহায় বিধবা কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা কেরামত আলির। জখম যেনো কিছুতেই ক্ষরন বন্ধের নয়।
শরীরের কোনো কাটাছেড়া, কোনো বাহ্যিক জখম হয়তো চোখে দেখা যায়, ক্ষুধা হলে খাবারের অভাবে ক্ষুধায় হয়তো পেট গুরগুর করে, কিংবা জ্বর সর্দি, কাশি কিংবা মাথা ব্যথা হলে তার সিম্পটম অনায়াসেই বুঝা যায় কিন্তু অন্তরের জখম কি কখনো চোখে পড়ে? অন্তরে কি কখনো জখম হয় আদৌ? আর এই অন্তরটাই বা শরীরের কোন অংগ? এটা কি এমন কোনো জিনিষ যা মাংশ বা হাড় কিংবা এমন কিছু দিয়ে এর গঠন কাঠামো? অথচ এই জখম অনুভুত হয়, এই কষ্ট নিজেকে প্রতিটি ক্ষনে মনকে বিষন্ন করে দেয়। সেই অদেখা অন্তরে রক্তক্ষরন হয়। এই অন্তর্জালা, রক্তক্ষরন আর কষ্টে মাত্র ১৪/১৫ বছর বয়সের এই অবুঝ বালিকা আরেকটি সদ্যজাত নবাগতকে নিয়ে পৃথিবীর সব মানুষের চোখে যেনো একজন অপরাধি সেজে জীবিত অবস্থায় মৃত হয়ে রইলেন। স্বামীর ম্রিত্যু যেনো তারই অপরাধ। তার এই ঘটনার জন্য যেনো তিনিই দায়ী। একদিকে অবুঝ মন, অন্যদিকে সাথে আরেকটি অবুঝ সন্তান, সব মিলিয়ে চারিদিকে এক মহাশুন্যতা। মেয়ের এমন একটি দুঃসহ শুন্যতা নিজে পিতা হয়ে কেরামত আলী কি করবেন? দিন গড়ায়, রাত যায়, শুন্যতা আরো চেপে বসে হামিদার। তার যে বয়স, সে বয়সে তিনি হয়তো বিয়ের মাহাত্তটাই বুঝে উঠতে পারেন নাই, কিন্তু তাকে এখন বিধমার তকমাটাও বুঝতে হচ্ছে, বুঝতে হচ্ছে একজন অবুঝ সন্তানের মা হিসাবে তার অকাল পরিপক্ক দায়িত্ব।
যখন কোনো মানুষের দুঃখ থাকে, কষ্ট থাকে, তাহলে সে সবসময়ই চাইবে যে, সে অন্য কারো সাথে তার এই দুঃখটা, কষ্টটা শেয়ার করতে। কেউ তো থাকবে যে, ওর কথা শুনবে। বুঝুক না বুঝুক সেটা আলাদা ব্যাপার, কষ্ট লাগব করুক বা না করুক সেটাও আলাদা ব্যাপার। কিন্তু কারো সাথে তো তার এই কষ্টের ব্যাপারগুলি শেয়ার করা দরকার। আর হামিদার এই কষ্টের ভাগীদার কিংবা শ্রোতা হয়ে রইলো শুধু একজন-সেই নাবালক পুত্র ‘বিল্লাল’। চোখ ভিজে আসে তার, মন ভেংগে আসে যন্ত্রনায়, আর মনে হয়-কেনো? কেনো বিধাতা তাকেই এর অংশ করলেন? অন্য কেউ নয় কেনো? সেই অবুঝ পুত্র বিল্লালের কাছে ‘হামিদা’র হয়তো শুধুই একটা জিজ্ঞাসা। নাবালক বিল্লাল হয়তো এর কিছুই বুঝে না, কোনো এক ভিনদেশী ভাষায় হয়তো কিছুক্ষন অদ্ভুত শব্দ করলেও মায়ের সেই কান্নায় ভীত হয়ে নিজের অজান্তেই কেদে দেয় বিকট এক শব্দে যা হয়তো বিধাতার কাছেই তার মায়ের কষ্টের ফরিয়াদ। হয়তো মা ছেলের এই অসহায় কান্নায় বুকে জড়িয়ে ধরে নিজের চোখের জলে কাপা কাপা গলায় বলতে থাকেন- আমি তো আছি তোর পাশে। ভয় নাই। মা আছে। পৃথিবীর কেউ তোর পাশে থাকুক বা না থাকুক, আমি তো আছি। এভাবেই কাটতে থাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এবং এক সময় কয়েক বছর।
জীবন যেখানে যেমন। যে শিশুটি আজ জন্ম নিলো কেউ জানে না তার জন্য এই পৃথিবী কি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিংবা এই প্রিথিবীকে সে কি দিয়ে যাবে। বিধাতা চাইলে যে কোনো কিছুই হতে পারে। হতে পারে আজকে এই শিশুটি হয়তো এই পৃথিবীকে কোনো একসময় কাপিয়েও যেমন দিতে পারে আবার এই পৃথিবী তাকেও নাড়িয়ে দিতে পারে। এই বিশ্বভ্রমান্ডে এমন অনেক শিশুই জন্ম নেয় যারা অনেকেই অনেক ভুমিকা রাখে আবার কেউ কেউ কিছুই রাখে না, না পৃথিবীও তাদেরকে মনে রাখে। এমন মানুষের সংখ্যাই হয়তো নেহায়েত যেমন কম না, তেমনি ভুমিকা রাখে এমন শিশুও কম না। যুগে যুগে তারপরেও অনেক শিশু গোপনে পৃথিবীতে আসে, প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় আর একদিন সবকিছু ফেলে সবার থেকে আলাদা হয়ে আবার কোথাও অদৃশ্য হয়ে যায়। মাঝখানের এই সময়টায় খুব গুটিকতক মানুষ হয়তো নিজের মতো করে কাউকে কাউকে মনে রাখে কিন্তু তাও একসময় মনের স্মৃতি থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়। কিন্তু ‘বিল্লালের বেলাতে এটা ঘটে নাই। তিনি প্রকাশ্যে দিবালোকে এই সমাজে বৈধভাবে পদার্পন করেছিলেন, তার যোগ্য অভিভাবক ছিলো, তার পরিচয় ছিলো, আর ছিলো পাশে থাকা অনেক মানুষ যারা তাকে নিয়ে ভেবেছে, তার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করেছে। কিন্তু বিধাতা তো আর মানুষের মত নন। তার পরিকল্পনা, তার ইচ্ছা, তার কার্যকারিতা সবকিছুই তার মত। বিল্লালের যখন মাত্র দুই থেকে হয়তো একটু বেশী, তখন হামিদাকে ছাড়তে হলো তারই ঔরসে জন্ম নেয়া তার পুত্র বিল্লালকে। সমাজ বড্ড বেরসিক, সমাজের আইনকানুনগুলিও একপেশে। এই আইন মানতে গিয়ে কে কাকে ছেড়ে যাবে, আর কার জীবন কোন আইনের পদাঘাতে পিষ্ঠ হবে সেটা যেনো সমাজের কোনো দায়বদ্ধতা নাই। আর এর সবচেয়ে বেশী আহত হয় সমাজের নারীরা। নারী বা মহিলাদেরকে এই সমাজে সেই প্রাচীনকালের মতো আজো দেবীর সমান তুলনা করে থাকে কিন্তু আফসোস যে, এটা শুধু মন্দির আর পুজার ঘর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। মহিলাদের সাথে আজো লাগাতার অন্যায়, নীপিড়ন, শোষন, অধিকারহীনতা আর অপরাধ ঘটে যাওয়া এটাই প্রমান করে যে, আমাদের সমাজে আমরা যে মহিলাদেরকে দেবী বলি তারা এখনো অনেক দানব দ্বারা ঘিরে রয়েছে যারা তাদের জীবনকে নরক করে তুলেছে। আর এই দানবের প্রথম নাম ‘সমাজ’ আর তার আইন কিংবা ‘মনোভাব’। যে সমাজ ১৩/১৪ বছরের বালিকাকে বিধাতার ইচ্ছায় তারই সংগীকে বিচ্ছেদের কারনে একজন অপয়া কিংবা এই দোষে দোষারুপ করা হয়, সেই সমাজ প্রকৃত কোনো ভরষার স্থান হতে পারে না। সে সমাজে প্রকাশ্যে কোনো মহিলাকে পুড়িয়ে মারা, নির্যাতন করা কিংবা ধর্ষন করা হলেও আজো কেউ হয়তো এগিয়েই আসে না। হামিদা হয়তো সে রকমের একটা অদৃশ্য আগুনে প্রতিদিন পুড়ে অংগার হচ্ছিলেন।
সমাজের এই মনোবৃত্তি আর যাতনায় এবং কন্যাদায়গ্রস্থ কেরামত আলি শেষ পর্যন্ত ১৫ বছরের বিধবা হামিদাকে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার আয়োজন শুরু করেন। হামিদার রুপের কোনো কমতি ছিলো না, আর সবে মাত্র সে কিশোরী। এক সন্তানের মা হলেও বুঝার কোনো উপায় নাই যে, তার অন্য কোথাও একবার বিয়ে হয়েছিলো। ফলে, খুব বেশীদিন অপেক্ষা করতে হয় নাই কেরামত আলিকে। পুরুষ শাসিত সমাজে সব আইন পুরুষেরাই তাদের নিজের সুবিধার কারনে বানায়। এখানে ১৫ বছরের কিশোরীর সাথে ৪০ বছরের বৃদ্ধার বিয়েও কোনো দৃষ্টিকটু নয়। কিংবা কোনো এক প্রতাপশালি ধনী ব্যক্তির পক্ষেও একের অধিক কুমারী কিংবা বিধবা কিশোরীকে বিয়ে করাও কোনো দৃষ্টিকটু নয়। আর সেই প্রতাপ শালী কোন ধনী ব্যক্তি যদি সধবা হন, তাহলে তো তার যেনো বিয়ে করা একটা বৈধ লাইসেন্সের মতোই। হামিদার জীবনে এমনই এক সুপুরুষ-হোসেন আলী মাদবর প্রবেশ করলেন। এই হোসেন আলী মাদবর কোনো কাল বিলম্ব না করে অনেক ঘটা করে বিধবা হামিদাকে বধু হিসাবে নিয়ে আসে তারই সংসারে যেখানে রয়েছে হামিদার থেকেও বয়সে বড় আরো তিনটি পুত্র সন্তান আর চারটি কন্যা সন্তান। কেউ কেউ হামিদার থেকে বয়সে এতো বড় যে, কারো কারো আবার বিয়ে হয়ে তাদের ও সন্তান জন্ম নিয়েছে। তবে একটা ভালো সংবাদ হামিদার জন্য ছিলো যে, তাকে সতীনের ঘর করতে হয় নাই। কারন হোসেন আলি মাদবর ছিলেন সধবা। হোসেন আলী মাদবরের আগের স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় বছর খানেক আগে।
হামিদার যখন প্রথম বার বিয়ে হয়েছিলো, তখন সে পিছনে ফেলে গিয়েছিলো তার খেলার সাথী, খেলার পুতুল আর শৈশবের স্মৃতি। কিন্তু এবার হামিদা ফেলে গেলো একজন অবুঝ পুত্র যে জীবনের কোনো কিছুই বুঝে না। হয়তো সে মা কি জিনিষ তাইই বুঝে না আর বিচ্ছেদ কি জিনিষ সেটা তো তার বুঝবারই কথা নয়। বিল্লাল রয়ে গেলো কেরামত আলীর তত্তাবধানে। বিল্লালের বয়স সবেমাত্র তিনও পূর্ন হয় নাই। এখন বিল্লাল পুরুই অনাথ, শুধু তার চারিপাশে রইলো কেরামত আলী, আর তার পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু এই অনাথ ‘বিল্লাল’ নামক পুত্রের এখন কি হবে? সে তো আগেই তার পিতাকে হারিয়েছে, আর আজ হারালো তার মাকে, যদিও তার মা জীবিত। মায়ের নতুন সংসারে তার জায়গা নেই।
ওই যে বললাম, স্রিষ্টিকর্তা বড়ই রহস্যময়। হামিদার বাড়ির আলুকান্দার কাছেই ছিলো আরেক গ্রাম, তার নাম ঘোষকান্দা। সেখানেই স্রিষ্টিকর্তা আরেক ধনাঢ্য এক পরিবারকে রেখেছেন অতীব মানসিক কষ্টে। তাকে ঈশ্বর সম্পদের পাহাড় দিয়েছেন, তাকে সুসাস্থ্য দিয়েছেন, আর দিয়েছেন সমাজে প্রতিপত্তিদের মধ্যে সম্মান আর যোগ্যস্থান। কিন্তু তাকে ঈশ্বর যা দেন নাই সেটা হলো কোনো উত্তরাধীকারী। সন্তানহীনা অবস্থায় মানসিকভাবে এই দম্পতি এতোটাই কষ্টে ছিলেন যে, তাদের না আছে কোনো সন্তানসন্ততী, না আছে কোনো উত্তরসুরী। এই ধনাঢ্য পরিবারের হর্তাকর্তার নাম ‘ইদ্রিস আলী’। তিনি কিংবা তার স্ত্রী সন্তান জন্মদানে অক্ষম ছিলেন কিনা কেউ জানে না, কিন্তু ঈশ্বর হয়তো অন্য কোনো নেশায় তাদের এই ঘর পরিপূর্ন খালী রেখেছিলেন এমন একজন অসহায় মানবের জন্য যার বিপক্ষে দোষারুপ করার কোনো ওজরের কমতি ছিলো না। তাদের অন্তরে ঈশ্বর সব ভালোবাসা রচিত করেছিলেন ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্য, লালিত করেছিলেন এক অদম্য স্পৃহা কিন্তু সেই ভালোবাসা আর স্পৃহা বারংবার শুন্য ঘরেই বাতাসের মধ্যে হারিয়ে যেত সকাল সন্ধ্যায় কিংবা অলস দুপুর কিংবা বর্ষার কোনো ঋতুতে। কষ্ট ছিলো, আখাংকা ছিলো কিন্তু সন্তান লাভ এমন নয় যে, বাজারে গেলেন, দোকান খুজলেন আর পছন্দমত একজন সন্তান কিনে এনে তাকে বড় করতে শুরু করলেন। ইতিহাসের পাতা ঘাটলে এটা দেখা যায় যে, কারো কাছে কোনো মানুষ হয়তো খুবই অপাংতেয়, বোঝা, উপদ্রব, কেউ হয়তো তার দিকে এক নজর নাও তাকাতে পারে। হতে পারে সেই মানুষটা এক পরিবারের জন্য বোঝা, কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোথাও কেউ হয়তো ওই অপাংতেয় মানুষটির জন্যই অধীর চিত্তে অপেক্ষা করছে কখন তার আগমন ঘটবে। তাকে পাওয়াই যেনো সমস্ত সুখ আর শান্তির উৎস খুজে পাওয়া। ঈশ্বর এই দুটো ঘটনাই পাশাপাশি ঘটাচ্ছিলেন বিল্লালকে কেন্দ্র করে।
হামিদা চলে যাওয়ার পর হামিদা যেমন মনের ভিতরে সন্তান বিচ্ছেদে কাতর ছিলেন, তেমনি হামিদার বাবা কেরামত আলীও এই অবুঝ বালককে নিয়ে শেষ পর্যন্ত কি করা যায় সেই চিন্তায় কাতর ছিলেন। শেষ পর্যন্ত কেরামত আলী তার ভায়রা গনি মাদবরের সাথে পরামর্শ করে বিল্লালকে পালক দেয়ার কথা চিন্তা করলেন। আর এতেই যেনো ইদ্রিস আলীর পরিবারে নেমে আসে সেই কাংখিত শুভ সংবাদ যিনি তাকে দত্তক নিতে আগ্রহী। কালক্ষেপন না করে ইদ্রিস আলীর পরিবার যেনো সর্গ থেকে নেমে আসা এক ফুটফুটে পুত্রসন্তান লাভ করে ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে করলেন আর নিয়ে গেলেন হামিদার বুকের সবচেয়ে আদরের ধন ‘বিল্লাল’কে। হামিদার দ্বিতীয় বিয়ের কারনে হামিদার পুত্র বিল্লালকে ইদ্রিস পরিবার যেনো অযাচিত এক ধনের সন্ধান পেলেন। নিজেদের বংশমর্যাদা আর পিতৃপরিচয়ে বিল্লালকে আগাগোড়া মুড়ে দিলেন ইদ্রিস আলী পরিবার। কোনো কিছুর কমতি রাখলেন না তারা তাদের এই হাতে পাওয়া সন্তানের জন্য। কিন্তু মা তো মা-ই। সমস্ত কাজের ফাকে, নিজের অবসর সময়ে বারবারই তো মনে পড়ে হামিদার সেই নাড়িছেড়া সন্তানের জন্য। কিন্তু কি ক্ষমতা আছে তার? না সে সমাজের বিপক্ষে কিছু করতে পারে, না সে সমাজের আইনকে থোরাই কেয়ার করতে পারে। হতাশাগ্রস্থ নেশাখোরের মত ক্ষনেক্ষনেই মা হামিদা নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়তেন বিল্লালের জন্য। কখনো একাই কাদেন, কখনো একাই ভাবেন, আবার কখনবো এইকথা মনে করে শান্তি পান যে, অন্তত তার নাড়িছেড়া ধন কারো জিম্মায় ভালো আছে যারা তার এখন পিতামাতা।
হামিদার নতুন সংসারে সময়ের রেষ ধরে আমাদের জন্ম হতে থাকে একের পর এক সন্তান। আগের স্ত্রীর ঔরসে জন্ম নেয়া পুত্র-কন্যাদের পাশাপাশি হামিদার ঔরসে ক্রমেক্রমে আরো পাচ কন্যা আর দুই পুত্রের আগমন হয়। কেরামত আলী হামিদার নতুন সংসারের যেমন খোজ রাখেন, তেমনি খোজ রাখেন ইদ্রিস আলির পরিবারে দত্তক নেয়া বিল্লালেরও। হামিদা যখন বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসে, তখন হামিদার সৌভাগ্য হয় তার ছেলে বিল্লালকে চোখে দেখার। মা ছেলের এই মিলন বড় সুখের বটে কিন্তু বেদনারও। ফিরে যাওয়ার দিন হামিদার চুমু খাওয়া বিল্লাল হয়তো কিছুই বুঝতে পারে না কি কারনে এই মহিলার চোখে জল আসে। বুঝতে পারে না কেনো বিল্লালের মা কিংবা তার বাবা ইদ্রিস আলী এই মহিলার কাছে এতো ঋণী। শুধু এটুকু বুঝতে পারে মহিলাটা এমন কেউ যাকে পেলে বিল্লালও খুশী হয়। হামিদা বিল্লালকে নিজের হাতে ভাত মেখে খাইয়ে দেয়, গোসল করিয়ে সুন্দর জামা পড়িয়ে দেয়, আর খুব মিষ্টি করে মাথার চুল আচড়ে দিয়ে কখনো কখনো তার বুকে মাথা রাখতে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। হয়তো এই আদরগুলি বিল্লালকে বারবার মহিলার প্রতি বিল্লালের আকর্ষন বাড়িয়ে দেয়। যেদিন হামিদা আবার তার সংসারে চলে যায়, বিল্লালেরও খুব মন খারাপ হয়। (চলবে)
৮/০১/২২- জাহাঙ্গীরের পেপার কাটিং
আমার কোর্ষমেট মেজর অবঃ প্রাপ্ত জাহাঙ্গীর এক সময় ইউএন এ জব করতো। হটাত করে সে কেমন যেনো রেডিক্যাল মুসলিমে পরিনত হয়ে গিয়েছিলো। ব্যাপারটা আমরা ওকে অনেক সময় ধরে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, আসলে সে যেটা ভাবছে সেটা একটা মেন্টাল ডিস অর্ডার। এই কনভিন্স করার পিছিনে সবচেয়ে কাছে ব্যক্তি ছিলো আমার আরেক কোর্ষমেট মেজর ইকবাল (নিপু)। শেষ পর্যন্ত জাহাংগীর ওর ভুলট বুঝতে পেরেছে এবং এখন নেপালে থাকে, খুব সাদাসিদা জীবন।
জাহাঙ্গীর সেই সময়ে যে পাগলামিটা করেছিলো, তার পরিপ্রেক্ষিতে একটা নিউজ পেপার কাভারেজ হয়। সেটা এটাঃ
০৭/০১/২০২২-দ্বৈত জীবন-৩
You are required to login to view this post or page.
৬/০১/২০২২-কনিকা এবং হাবীব ভাই
You are required to login to view this post or page.
১৩/১২/২০২১-ইতিহাস থেকে যারা (ফেসবুক)
ইতিহাস থেকে যারা শিক্ষা নেয় না, তাদের পতন বারবার ইতিহাসের সেই একই ধারায় হয়। ঘসেটি বেগমের কারনে, কিংবা মীর জাফরের কারনে, অথবা সেই মায়মুনা কুটনীর কারনেই এই পৃথিবীর অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর জীবনমান অনেক কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে গিয়েছিলো। তাদের লোভ, তাদের লালসার জিব্বা এতো বড় ছিলো যে, তারা সারাটা দুনিয়া হা করে গিলে ফেলতে চেয়েছিল কিন্তু তাদের পেট এতো বড় ছিলো না যে, গোটা বিশ্ব সেই পেটে ধারন করে। ফলে অধিক ভূজনের রসাতলে ন্যয্যভাবে হাতে আসা সব সম্পদ, ক্ষমতা আয়েস করার আগেই তাদের এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে অকালেই প্রান দিতে হয়েছে, অথবা মানুষের হৃদয় থেকে। আর যারা বেচে থাকে তারা ওইসব হায়েনাদের কারো কারো নামের আগে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য যোগ করে দেয়, "নিমকহারামের দেউড়ি", কিংবা "কুটনা বুড়ী আস্তনা" অথবা "হারামখোরের আস্তানা"। আজো তারা এইসব নামেই পরিচিত। কখনো দেখবেন না যে, মীর বংশের কোন বাচ্চার নাম জাফর রাখা হয়েছে। যদিও জাফর বড্ড সুন্দর একটা নাম। কিন্তু মীরজাফর একটা কুলাংগারের নাম। ওর বংশধরেরা আজো তার নামে কলংকিত বোধ করে।
অথচ যুগে যুগে ভিন্ন রুপে এখনো মীরজাফরের থেকেও খারাপ মানুষ এই সমাজে আছে, ঘসেটি বেগমের থেকেও ষড়যন্ত্রকারিনী এখনো অনেক ঘরেই আছে, মায়মুনা কুটনীর মতো মোনাফেক এখনো আমাদের চারিধারে বিধ্যমান। ওদের চেনা কঠিন কারন এইসব মানুষেরা বর্নচোরার মতো আমাদের চারিদিকে একটা আবরন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ভাল মানুষের মতো। সুযোগ পেলেই ছোবল দেবে এবং দেয়, আর এদের এক ছোবলে ধংশ হয়ে যেতে পারে আমার আপনার বহুদিনের বন্ধন, বহুদিনের সম্পর্ক।
১৩/১২/২০২১-একই খবর কারো কাছে শুভ
একই খবর কারো কাছে শুভ আবার কারো কাছে অশুভ হতে পারে। একই জায়গায় মিলিত হওয়া মানুষের রাস্তা আলাদা আলাদা হতে পারে। একই পরিস্থিতিতে একজন জীবনে এগিয়ে চলে, আবার আরেকজন জীবনের অসহায় অবস্থার সাথে বোঝাপড়া করে। কেউ কেউ বিন্দু বিন্দু অর্থ সঞ্চয় করে নিজের সপ্ন পুরন করে, অন্যজন তার গড়া সপ্ন বিন্দু বিন্দু ভুলের কারনে নিরুপায় অবস্থায় জন্য তার সপ্ন ভাংতে শুরু করে।
কোনো অপরাধই রাতারাতি জন্ম নেয় না। যখন কোনো অপরাধ হয়, তখন আমরা শুধু তার উপরের রুপটাই দেখতে পাই। কিন্তু তার শিকড় অন্য কোথাও অনেক গভীরে হয়। আর শিকড়ের সন্ধ্যান হয় পুলিশ করে অথবা কোনো সচেতন মানুষ। পুলিশ যখন তদন্ত করে তখন প্রতিটি মানুষকে সে যেভাবে দেখে তা হল, সবাই মুখোশ পড়া ক্রিমিনাল। আর তাই সে যখন আসল জিনিষ বের করতে চায়, সে কাউকেই কোনো প্রকার ছাড় দিতে নারাজ। আর এ কারনেই হয়তো অনেকেই বলে- বাঘে ছুলে ১৮ ঘা আর পুলিশ ছুলে ৭০ ঘা!!
বিদ্বেষ হিংসা ভালোবাসা আর ঘৃণা এগুলি এমন কিছু আবেগ যা প্রতিটি মানুষের মাঝে পাওয়া যায়। সুযোগ সন্ধানী হওয়াও একটা আবেগ। সুযোগ সন্ধানী হওয়া কোনো খারাপ বিষয় নয়, কিন্তু তার জন্য কিছু সীমা থাকে, কিছু নীতি থাকে। কারো ক্ষতি করে, কারো অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে মানুষ কখনো সামনের দিকে এগুতে পারে না। বাবলা গাছ লাগিয়ে যদি কেউ ভাবে তাতে ফুল ফুটবে, সেটা কোনো পাগলামোর থেকে কম নয়। অবৈধ কোনো শুরু থেকে কোনো সম্পর্ক কখনো বৈধ হতে পারে না, না পারে সেখানে কোনো বৈধ কোনো ফলাফলের আশা। খারাপ পরিস্থিতি, খারাপ মানুষ আর খারাপ ফল এগুলি থেকে পার্থক্য করা শিখতে হবে যে কোনটা আমাদের ব্যক্তিগত বিষয় আর কোন বিশয়টা ব্যক্তিগত বিষয় থেকে আইনের দরজায় নিয়ে যেতে পারে। যখন কোনো মানুষের পরিস্থিতি ঠিক এটাই হয়, তখন অন্যান্য দিনের মতো সকালটা আর তেমন থাকে না যেমন ছিলো আগের কোনো সকালের মতো, না তার সন্ধ্যাটাও আগের মত পরিচিত মনে হয়। পুলিশের প্রথম কাজ হয় ‘এক শান রিপ্লে তৈরী করা’। যেখানে তারা একে একে ক্রিমিনালের সম্ভাব্য সব ক্রিমিনাল পলিসি বিরুদ্ধে পুলিশের করনীয়। ফলে পুলিশ খুব সহজেই ক্রিমিনাল প্লানের একটু এগিয়েই থাকে।
নিজেদের মধ্যে যখন কেউ হিংসা হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ে, তখন আসলে সেটাই হয় যা রক্তের সাথে রক্তের পাল্লা। ক্ষতি হয় শুধু নিজেদের রক্তের। তাহলে এই খেলায় কে জিতে? কেউ না।
মহিলাদেরকে আমরা দেবীর সমান তুলনা করে থাকি কিন্তু আফসোস যে, এটা শুধু মন্দির আর পুজার ঘর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। মহিলাদের সাথে লাগাতার অন্যায় আর অপরাধ ঘটে যাওয়া এটাই প্রমান করে যে, আমাদের সমাজে আমরা যে মহিলাদেরকে দেবী বলি তারা এমন অনেক দানব দ্বারা ঘিরে রয়েছে যারা তাদের জীবনকে নরক করে তুলেছে। প্রকাশ্যে কোনো মিহিলাকে পুড়িয়ে মারা হয়, নির্যাতন করা হয়, ধর্ষন করা হয় অথচ কেউ এগিয়ে আসে না।
আমাদের এ গ্রামে কতজন পুরুষ আর কতজন মহিলা আছে কিংবা কতজন ছেলে আর কতজন মেয়ে আছে এটা কি কোনো প্রশাসন বলতে পারবে? যদি ছেলে আর মেয়ের এই অনুপাত জানা যায়, তাহলে আমাদেরকে নজর দেয়া উচিত সেই জায়গায় যেখানে কতটুকু উন্নতি করা দরকার।
২/১২/২০২১-পায়ের নীচে পাথরহীন
জীবনের কাছে রাখা সব উত্তর সবসময় তার প্রশ্নের ন্যায় বিচার করে না। বিশেষ করে প্রশ্নটা যখন এমন হয় যেটা মনকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খায়, আর হৃদয়কে ছুড়ি দিয়ে ফালা ফালা করে দেয়। কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তর যখন কারো জীবনের নাশ হয়ে দাঁড়ায় তখন সেই উত্তরের শেষ পরিনতি সম্পর্কে উত্তারদাতার অনেক ভেবেচিন্তে দেয়া উচিত। আমার জীবনেও এমন একটা সময় এসেছিলো। আমার সব প্রশ্নের উত্তর হয়তোবা কারো জীবনের নাশ হবার সম্ভাবনাই ছিলো, ফলে উত্তরদাতা হিসাবে আমি কোনো উত্তরই দেওয়ার চেষ্টা করিনি। চুপ হয়ে থাকাই যেনো মনে হয়েছিলো-সর্বোত্তম উত্তর। আমি সেই “চুপ থাকা” উত্তরেই পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে এমন পরিবেশটাই তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলাম যেনো “কিছুই না ব্যাপারটা”। কিন্তু “ব্যাপারটা” যতো না সত্য ছিলো তার থেকেও বেশী ছিলো “চাপ” আর এই “চাপ” তৈরী করার পিছনে যারা কাজ করেছিলো তারা আর কেহই নয়, আমার দ্বারা পালিত সেই সব মানুষগুলি যাদেরকে আমি ভেবেছিলাম, তারা আমার সব “ওয়েল উইশার্স”। কিন্তু আমার আরো কিছু মানুষ ছিলো যারা আমার জীবনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে এমন করে জড়িয়েছিলো যারা আমার হাড় আর মাংশের মতো। আলাদা করা দুরুহ। সেই হাড় আর মাংশের মতো একত্রে মিলিত মানুষগুলি একটা সময়ে সেইসব তথাকথিত “ওয়েল উইশার্স”দের চক্রান্তে তাদের মস্তিষ্ক এমনভাবে বিগড়ে গিয়েছিলো যে, তাদের “সন্দেহ” টাই যেনো এক সময় তাদের অবচেতন মনে “বিশ্বাসে” পরিনত হয়। আর এই মিথ্যা “বিশ্বাসে” তাদের চারিপাশের শান্ত বাতাসগুলিও যেনো প্রচন্ড ঝড়ের চেহাড়া নিয়ে একটা কাল বৈশাখীতে রুপ নিয়েছিলো। কেউ বুঝতেই চাইতেছিলো না যে, এর শেষ পরিনতি বড়ই ভয়ংকর।
তবে আমি জানতাম সত্যিটা কি। কিন্তু ওইসব পরিস্থিতিতে আমার সব সত্য জানাটাই সঠিক এটা কাউকে যেমন বিসশাস করানো যায় নাই, তেমনি আমিও তাদেরকে বিশ্বাস করাতে চাইওনি। শুধু অপেক্ষা করেছিলাম-কখন ঝড় থামবে, কখন আকাশ পরিষ্কার হবে, আর দিবালোকের মতো সত্যটা বেরিয়ে আসবে। “সময়” পার হয়েছে, ধীরে ধীরে মেঘ কেটে গেছে, আমি আমার সাধ্যমতো সবকিছু আবার গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। গুছিয়েও ফেলেছি সেইসব ক্ষত বিক্ষত আচড়গুলি। কিন্তু আমি এই অযাচিত ঘটনায় একটা জিনিষ পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম যে, মনুষ্য জীবনে আসলে কেউ কারোই নয়। আমরা বাস করি শুধু আমাদের জন্য। একা থাকা যায় না, তাই সমাজ, একা থাকা যায় না, তাই পরিবার। একা অনেক অনিরাপদ, তাই সংসার। কিন্তু এই সমাজ, এই সংসার কিংবা এই পরিবার কোনো না কোন সময় ছাড়তেই হয়, আর সেটা একাই। এই মিথ্যে সমাজ, পরিবার আর সংসারের নামে আমরা যা করি তা নিছক একটা নাটক। জংগলে বাস করলে একদিন সেই জংগল ছাড়তেও কষ্ট হয়। এরমানে এই নয়, আমি জংগলকেই ভালোবাসি। কথায় বলে-ভালোবাসা পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর অনুভুতি, আর এটা যদি বেচে থাকে তাহলে হিংসা, বিদ্বেষ থেকে মানুষ হয়তো মুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু আমরা যারা এই সমাজ নামে, পরিবার নামে, কিংবা সংসার নামে চিহ্নিত করে ভালোবাসার জাল বুনে থাকি সেটা আসলে কোনো ভালোবাসাই নয়। সেখানে থাকে প্রতিনিয়ত নিজের সার্থের সাথে অন্যের লড়াই। অন্যঅর্থে সেটা একটা পাগলামী, লালসা কিংবা একা বাচতে চাওয়ার অনিরাপদের একটা অধ্যায় মাত্র। অথচ আমরা প্রত্যেক মুহুর্তে আমাদের এই নিজের পরিবারকে নিরাপদে রাখার জন্য অনেক অপবাদ, অনেক ভয়ংকর বাধা আর মৃত্যুর মতো রিস্ককে বরন করে থাকি। এ সবই আসলে নিজের সার্থে।
যাই হোক যেটা বলছিলাম, আমার সেই ফেলে আসা অভিজ্ঞতার আলোকে আমি ধীরে ধীরে সে সব “ওয়েল উইশার্স” দেরকে নিজের বেষ্টনী থেকে দূরে রাখার প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেছি। আমি একটা মুহুর্তেও সেই সব দিনের ক্ষত বিক্ষত হবার বেদনার কথা ভুলি নাই। যখনই সেই ব্যথার কথা মনে হয়েছে- আমি বারবার আরো শক্ত হয়েছি। আমি জানি কন এক সময় আবারো তাদের আমার প্রয়োজন হবে, আবারো তারা আমাকে আকড়ে ধরার চেষতা করবে, আবারো তারা তাদের মিথ্যা চোখের পানি ফেলে আমাকে আবেশিত করার চেষ্টা করবে। আমি ততোবার নিজেকে বারন করেছি-আর যেনো সেই একই ফাদে পা না বাড়াই। তাহলে সেটা হবে আমার জীবনের জন্য কালো আধ্যায়।
ওরাও হয়তো ভেবেছিলো- কোনো প্রয়োজন নাই আর আমাকে। আমি কোন দুঃখ পাইনি। শুধু ভেবেছি, খুব ভালো যে, তারাই গুটিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু এই প্রিথিবীর সবচেয়ে বড় বিপত্তি এই যে, বড় বট বৃক্ষের প্রয়োজন কখনো কোনোদিন কোনো কালেই ফুরিয়ে যায় না। হোক সেটা হাজার বছরের পুরানো কোনো বৃক্ষ।
আজ সেই দিনটা এসেছে। অথচ আজ আমার সব দরজা এমন করে খিল দিয়ে আটকানো যে, না আমি খুলতে চাই, না খোলার প্রয়োজন মনে করি। পৃথিবীতে নিমক হারামের চেয়ে বড় পাপ অথবা বড় বিশ্বাসঘাতকরা আর নাই। যে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে কেউ আকাশ দেখে, সেই পাথকে যত্ন করে রাখতে হয়। যদি অযত্নে সেই পাথর কোথাও হারিয়ে যায় বা ব্যবহারের আর উপযোগি না হয়, তাহলে আকাশ যতো সুন্দরই হোক না কেনো, তাকে দেখার ভাগ্য আর হয় না। যদি কেউ আজিবন আকাসের জ্যোৎস্না, আকাসের তারা আর নীল আকাশের মধ্যে তারার মেলা দেখার ভাবনা থাকে, তাহলে সেই পাথকে অতোতাই যত্ন করা দরকার যতোটা মনে হবে তার মনের শখের দরকার। তা না হলে চোখের জলে বুক ভাসবে ঠিক কিন্তু কেউ তার নিজের পাথর দিয়ে তার আকাশ দেখা বন্ধ করে অন্যকে পাথর দিয়ে সাহাজ্য করে না। এতাই নিয়ম।
আজ তারা সেই পাথরটাকে হারিয়ে ফেলেছে বন্ধ দরজার অন্ধকার ঘরে। যেখানে না যায় দরজা খোলা, না যায় পাথরে পা রাখা। তোমাদের জন্য নতুন আরেক অধ্যায় শুরু। এবার এই দুনিয়াটাকে বড্ড অসহায় মনে হবে তোমাদের। তোমাদের প্রতিন মনে হবে- তোমরা কোথায় কি পরিমান ক্ষতি নিজেদের করেছো যার সমাধান কখনোই তোমাদের হাতে ছিলো না। তোমরা ভেবেছিলে- তোমাদের জন্য মায়ের চেয়ে মাসির দরদ সম্ভবত অনেক বেশী। কিন্তু এই দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত মায়ের চেয়ে মাসির দরদ কখনোই বেশী ছিল বলে এটা কেউ যেমন প্রমান করতে পারে নাই, আর এতা সত্যও নয়। যদি সেটাই তোমরা মনে করে থাকো- তাহলে আজ তোমাদের সেই মাসির কাছেই তোমাদের সমস্ত কিছু আবদার, চাহিদা, কিংবা সাহাজ্য চাওয়া উচিত যাকে তোমরা বিনাবাক্যে মনে করেছো, লিডার অফ দি রিং। দেখো, সেই লিডার অফ দি রিং তোমাদের জন্য কোনো সাহাজ্য পাঠায় কিনা। আমার দরজা তোমাদের জন্য আর কখনোই খোলা হবে না। আমি শুধু দেখতে চাই, আসলেই তোমরা কাকে চেয়েছিলে? কার উপরে তোমাদের এতো নির্ভরশীলতা ছিলো আর কার গলায় পা রেখে শ্বাস রোধ করেছিলে। আমি তো সেদিনই মরে গেছি যেদিন তোমরা আমাকে আমার অজান্তে পিছন
২২/১১/২০২১-এসআইবিএল-২৬তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী
আমার ব্যবসার জন্মলগ্ন থেকেই একটি মাত্র ব্যাংকেই আমি সমস্ত ব্যবসায়ীক লেনদেন করে এসছি। আর সেটা হলো এসআইবিএল ব্যাংক। আমি অবশ্য এসআইবিএল এর প্রধান কার্যালয়ের সাথে ব্যবসায়ীক লেনদেন করলেও হাসনাবাদ সুপার মার্কেটের এসআইবিএল শাখার সাথে আমাদের ফ্যাক্টরীর সম্পর্ক হচ্ছে আত্মার সাথে আত্মার মতো। ডোর টু ডোর প্রতিষ্ঠান। আমার প্রায় প্রতিটি ষ্টাফ এই ব্যাংকের গ্রাহক। আজ এই ব্যাংকের ২৬তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ছিলো। গতকালই আমার খুবই প্রিয় একজন মানুষ ব্যাংকের ম্যানেজার নিজাম ভাই নিজে এসে আমাকে দাওয়াত করে গিয়েছিলেন যেনো আজকের দিনটায় অন্যান্য দিনের চেয়ে অফিসে একটু আগে এসে তাদের এই মহান দিনটির সাথে আমি শরীক হই। অনেক চমৎকার একটা বিশাল কেক কেটে এই মহান দিনটাকে এসআইবিএল ব্যাংক স্মরণ করেছে। আমি নিজেও গর্বিত এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যবসায়ীক কার্যক্রম পরিচালনা করায়।
ধন্যবাদ নিজাম ভাই, ধন্যবাদ সব কলিগ ভাইদের।
Protected: ২৬/১১/২০২১-মুর্তজা ভাইয়ের নীতি ও আদর্শ (পর্ব-২)
You are required to login to view this post or page.
৫/১১/২০২১-প্যারাডাইম শিফট
যখন সাভাবিক কোনো চিন্তাচেতনা কিংবা কার্যক্রম অন্য কোনো নতুন নিয়ম বা চিন্তা চেতনা দ্বারা সম্পন্ন হতে দেখা যায়, তখন এই প্রতিস্থাপিত নতুন পরিবর্তিত চিন্তা চেতনাকেই প্যারাডাইম শিফট বলা যেতে পারে। অন্যঅর্থে যদি বলি- এটা হচ্ছে একটা মডেল, তত্ত্ব, বা দ্রিষ্টিভঙ্গি, ধারনা, কিংবা দৃষ্টান্ত যা প্রকৃত তত্ত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি, কিংবা মডেল থেকে আলাদা। প্যারাডাইমটা আসলেই আসল জিনিষ না, এটা একটা মানষিক ভাবনার সাথে প্রকৃত সত্যের একটা শুধু ছবি। কোনো একটা জিনিষের ব্যাপারে আমরা যা ভাবছি, বা দেখছি এর সাথে সেই জিনিষটার যে রকম প্রকৃত বৈশিষ্ট , এই দুয়ের মাঝেই থাকে প্যারাডাইম তত্তটি। এই প্যারাডাইম দিয়ে মানুষ কোনো একটা ধারনা, চিন্তা চেতনা, কিংবা কোনো একটি জিনিষের ব্যাপারে একটা ধারনা পায়।
কিন্তু প্যারাডাইম শিফট অনেক বড় জটিল। প্যারাডাইম শিফটের মাধ্যমে কোনো একটা তত্ত্ব, চিন্তাচেতনা বা দ্রিষ্টিভঙ্গি পুরুটাই পালটে যায়। একটা উদাহরণ দেই- ধরুন আপনি একটা লোকের চেহাড়া দেখে ভাবলেন যে, সে একটা নিশ্চয় ভয়ংকর সন্ত্রাসী। আপনার মন তাকে সেভাবেই ট্রিট করছে, সেভাবেই আপনি তাকে ওই খারাপ মানুষদের মধ্যে লিষ্ট করে ফেলেছেন। অনেকপরে যখন জানলেন যে, লোকটা ছিলো খুবই ভদ্র, ভালো ও খুবই অমায়িক এবং পরোপকারী। তখন আপনি অনেক মনোকষ্টে ভোগবেন। আফসোস হবে। এই যে নতুন ভাবনা আপনাকে আগের চিন্তাচেতনা থেকে হটাত করে ১৮০ ডিগ্রী উলটে গিয়ে আরেক নতুন প্যারাডাইমে নিয়ে আসছে, এটাই হলো প্যারাডাইম শিফট।
থমাস কুন তার বিখ্যাত-“দি স্রাইাকচার অফ সায়েন্টিক রেভ্যুলেশন” বই এ প্রথম প্যারাডাইম শিফট শব্দটি চালু করেন। প্যারাডাইম যার যতো বেশি নিখুত, তার প্যারাডাইম শিফট ততো কম। আর যাদের এই প্যারাডাইম কোনো কিছুর ব্যাপারে প্রায় কাছাকাছি থাকে, তারা আসলেই জ্ঞানী এবং বাস্তববাদী। বর্তমান জগতে মানুষের প্যারাডাইম অনেক অনেক সত্যের থেকে বেশী দূরে বিধায়, আমাদের সমাজে গন্ডোগোল বাড়ছে।
১৯/১০/২০২১-হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া
আমি মর্মাহত, আমি আহত, আমি অসুস্থ্য। আমার কোনো ভাষা নাই কোনো মন্তব্য করার। শুধু মন খারাপ হচ্ছে, আর কষ্টে ভোগছি।
গতকাল পেপারে দেখলাম, রংপুর পীরগঞ্জে হিন্দুদের একটি গ্রাম রাতের অন্ধকারে কে বা কারা পুড়িয়ে দিয়েছে। আমি এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাই না যে, কে বা কারা এটা করেছে। সাম্প্রদায়িক হামলা কখনোই হটাত করে সংঘটিত হয়না। এরও একটা মাষ্টারমাইন্ড থাকে, একটা মাষ্টার প্ল্যান থাকে যা দিনের পর দিন কারো না কারো ছত্রছায়ায় সঠিক দিন তারিখ ধার্য করেই তার বাস্তবায়ন করা হয়। আমরা কি এতোটাই পিশাচ হয়ে গেছি যে, একই গ্রামে, একই এলাকায় পাশাপাশি হিন্দু মুসলিম যুগের পর যুগ একত্রে বসবাস করার পরেও শুধুমাত্র ভিন্ন মতালম্বি ধর্মের কারনে আমার সেই চেনা বন্ধু, আমার সন্তানের সেই চেনা খেলার সাথী, কিংবা যে ঠাকুরমা আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে তার ঈশ্বরের কাছে আমার মংগলের জন্য দোয়া করেছেন, তাকে অতর্কিত হামলায় এক নিঃশ্বাসে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে পারি? একবারও অন্তরে দাগ কাটে না যে, এটা ধর্মের উপর নয়, এটা মানবতার উপর চরম আঘাত? এটা কিছু নীরিহ এবং অসহায় মানুষের উপর অত্যাচার?
একবার ভাবুন তো, যে বাড়িগুলিতে আগুন দেয়া হয়েছে, সেখানেও আমার ছেলে-মেয়েদের মতো ছেলে-মেয়েরা রয়েছে, তাদের শখের অনেক কিছু সাজানো ছিলো, দিনের পর দিন সে তার জীবনকে সুন্দর করার জন্য কতই না সময় ব্যয় করেছে, তার স্বপ্ন বিছানো আছে সেখানে পড়তে পড়তে। ঐ বাড়িতে আমার বৃদ্ধ মায়ের মতো কিংবা আমার দাদার নানার মতো একজন মা কিংবা বাবা অথবা ঠাকুরমা রয়েছেন। কি দোষ করেছেন তারা? তারা শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মালম্বি বলেই কি অপরাধী? তাহলে প্যালেষ্টাইন পুড়ছে, সেটা দেখে আমাদের খারাপ লাগে কেনো? নিউজিল্যান্ডে বোমার আঘাতে মুসল্মান মরছে, সেটা দেখলে আমাদের খারাপ লাগে কেনো? তারাও তো একই অপরাধ করে যাচ্ছে। নীরিহ এবং অসহায় মুসলমানদের উপর অত্যাচার করছে। একবার ভাবুন তো, যদি ঐ বাড়িটা যারা আগুন দিয়েছে তাদের হতো, তাদের কেমন লাগতো? তার প্রিয় আদরের মেয়ে, বা ছেলে ভয়ে ধান ক্ষেতে সারারাত পালিয়ে দেখছে তাদের ঘর পুড়ছে, তাদের বই খাতা পুড়ছে, তাদের সবকিছু পুড়ে যাচ্ছে, আর তার সাথে সেও দেখছে যে বাড়িতে আগুন লাগার ধংসাত্তক পরিস্থিতি? একবারও কি তারা এসব ভেবেছে? কি নির্মম।
আমার ৫৫ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এদেশের হিন্দুরা রোজার দিনেও প্রকাশ্যে আমাদের রোজাকে সম্মান দেখিয়ে দিনের বেলায় কোনো খাবার খেতে চায় না। এদেশের হিন্দুরা অন্য দেশের হিন্দুদের মতো নয়। আমার অনেক অনেক হিন্দু বন্ধু আছে, খ্রিষ্টান বন্ধু আছে, আমার তো কখনো এটা মনে হয়নি যে, ওদের প্লেটে আমার খেতে খারাপ লাগে, না ওরা কখনো এটা ভেবেছে। আমার বাসার কোনো পারিবারিক দাওয়াতে তো কিছু মানুষ হলেও হিন্দুরা থাকেন যেমন আমি থাকি তাদের অনুষ্ঠানে। কখনো তো আমি এর কোনো ডিসক্রিমিনেশনে ভোগি নাই? আমার দূর যাত্রায় যখন কোনো হিন্দু বন্ধু বা ভাই সাথে থাকেন, আমি তো তাকেই দাড় করিয়ে কোথাও নামাজে রত হই কিংবা সেও কোনো এক মন্দিরে আমাকে পাশে দাড় করিয়ে একটু প্রনাম করে আসে। কখনো এটা আমার কাছে কোনো প্রশ্নের উদয় হয় নাই। সব ধর্মের মধ্যেই কেউ না কেউ উগ্র থাকে কিন্তু সেটা তো সামগ্রিক জনগোষ্ঠি দায়ী নয়।
আমার প্রানপ্রিয় সন্তান যখন কোথাও অসহায় অবস্থানে পড়ে যায়, আর সেই অপরিচিত স্থানে যখন সে তার পরিচিত কোনো হিন্দু মানুষের দেখা পায়, সে তো তার কাছেই ছুটে যাবে কোনো না কোনো সাহাজ্যের জন্য। সেখানে তো কোনো ধর্ম কাজ করে না? তাহলে আজ আমরা কি দেখছি? কারা তারা যারা আমারই সন্তানতুল্য বাচ্চাদের, ঠাকুরমার বয়সি মুরুব্বিদেরকে এবং তাদের আবাসস্থলে এভাবে আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দিলো। আর কি অপরাধে তাদের এই শাস্তি? কেউ যদি আমাকে আমার কোরআন ধরে শপথ করিয়েও এটা বিশ্বাস করাইতে চায় যে, শারদিয় পুজায় হিন্দুরা আমাদের পবিত্রগ্রন্থ কোরআনকে কোনো এক দেবীর পায়ের নীচে পদদলিল করেছে, আমি কস্মিঙ্কালেও এটা বিশ্বাস করতে চাই না। তারা এমন নয়। তারাও আমার পবিত্রগ্রন্থকে সম্মান করে। এসব একটা উগ্র মানুষের কাজ, আর সে কাজে অবশ্যই কেউ না কেউ মদদ দিয়েছিলো।
আমরা সংখ্যালঘু কিংবা সংখ্যাগুরু নিয়ে কথা বলি। এটাও একটা ভেদাভেদের মতো। এদেশ যেমন আমার, এদেশ তাদেরও। তারা সংখ্যায় কম এটা কোনো অপরাধ নয়। এই অপবাদ মারাত্তক অন্যায়ের যোগান দেয়। আমি অসুস্থ্য হলে তাহলে কেনো হিন্দু- মুসলমান ভেদাভেদে ডাক্তার বিবেচনা করি না? আমি স্কুল কলেজে শিক্ষা নেয়ার সময় তো হিন্দূ শিক্ষক আর মুসলমান শিক্ষকের কোনো ভেদাভেদ করি না? আমি আকাশ পথে ভ্রমনের সময় কেনো হিন্দু মুসলিম পাইলটের বিবেচনা করি না? আমি ব্যবসা করার সময় হিন্দু মুসলিম কেনো বিবেচনা করি না? আমি যখন যুদ্ধে যাই, তখন আমার পাশের হিন্দু সৈনিকের ব্যাপারে কেনো অপবাদ দেই না? আমি যখন একই নদীতে গোসলে যাই, তখন সেই নদীতে হিন্দু মুসলিমের গোসলে কেনো কোনো প্রকার অসস্থি বোধ করি না? অথচ যেই না ধর্মের কথা উঠলো, তারা সনাতন কিংবা আমার ধর্মের না, তাই তারা আমার বিপক্ষের মানুষ। এটা কোনো সুস্থ্য মানুষের চিন্তাধারা?
আমি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। আর সমবেদনা জানাই আমার সেসব ভাইদেরকে যাদের আমরা অনেক ক্ষতি করে ফেলেছি। তাদের এই অপুরনীয় ক্ষতি এবং ক্ষত আমরা কিছুতেই পুরন করতে পারবো না জানি, তবে আমার অনুরোধ যে, কেউ তাদের জন্য একটা তহবিল একাউন্ট খুলুন। সরকার যা পারবেন তাদেরকে সহায়তা করবেন জানি, এর সাথে আমরা যারা তাদের জন্য ক্ষত বিক্ষত হচ্ছি, আমরাও কিছুটা শরীক হতে চাই। কেউ এই উদ্যোগটা নিন আর সোস্যাল মিডিয়ায় জানান। আমরা অনেকেই আপনাদের পাশে আছি। উক্ত তহবিল দিয়ে আমরা আবার আপনাদের জীবনকে কিছুটা হলেও ক্ষত্মুক্ত করতে চাই। জানি পারবো না, তারপরেও একটা উদ্যোগ নিন কেউ।
পরিশেষে আমাদের মহানবী হযরত মোহাম্মাদ (সঃ) এর একটি হাদিস উল্লেখ করতে চাই- “সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকায় সংখ্যালঘু অমুসলিমরা আমানতের মত। যারা তাদের কষ্ট দিবে, কেয়ামতের দিন আমি তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে নালিশ করবো (আবু দাউদঃ ৩০৫২)।“
রুস্তমের চিঠি
আমার ড্রাইভার ছিলো রুস্তম। একবার রুস্তম আমারে বল্লো যে, ওর কাছে যদি ৩ লাখ টাকা থাকে তাহলে ওর জীবন নাকি সে বদলিয়ে ফেলবে। খুব ভালো কথা। বললাম, ৩ লাখ টাকা যদি পাস, তাহলে কি করবি? রুস্তম বল্লো যে, সে ২টা পুরানো সিএনজি কিনবে। একটা নিজে চালাবে আরেকটা ভাড়ায় চালাবে। তাতে প্রতিদিন সে পাবে ১২০০ টাকা। তারমানে মাসে ৩৬ হাজার টাকা। ওর খরচ লাগে মাসে ১৬ হাজার টাকা। তারমানে মাসে সে ২০ হাজার সেভ হবে। বছরে সেভ হবে আড়াই লাখ টাকা। সেই আড়াই লাখ টাকা দিয়া সে আরেকটা পুরানো সিএনজি কিনবে। এভাবে ২/৩ বছর পর সে গাড়ি কিনবে। যদি গাড়ি কিনে, তাহলে ওর প্রতিদিন লাভ হবে ২ হাজার টাকা। এভাবে সে হিসাব করে দেখলো যে, ৫ বছর পর তার হাতে আসবে প্রায় ২০ লাখ টাকা, ৩ টা সিএনজি আর একটা গাড়ি। হিসাবটা একদম ঠিকঠাক ছিলো। কিন্তু শুধু একটা জায়গায় হিসাবটা শুরু করা যাচ্ছিলো না। প্রাথমিক ৩ লাখ টাকা সে পাবে কোথায়?
রুস্তম আমার অনেক দিনের ড্রাইভার। প্রায় ৭ বছর। এই বছর গুলিতে আমি এমনো হয়েছে যে, ব্যবসার জন্য কোটি কোটি টাকাও ওকে দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠিয়েছি। ফ্যাক্টরীর সেলারী আনার সময় কিংবা সাব কন্ট্রাক্ট ফ্যাক্টরীতে ইমারজেন্সী ভাবে টাকা অয়াঠানোর জন্য। কোনোদিন রুস্তমের মধ্যে কোনো গড়বড় দেখি নাই। কিন্তু একদিন-সে আমার ব্যাগ থেকে ৩ লাখ টাকা চুরি করে পালালো।
চুরি করার পর এক মাস পালিয়ে পালিয়ে থাকলো। অনেক খুজাখুজি করেছি, ওর গ্রামের বাড়ি, ওর বর্তমান শশুর বাড়ি, কিংবা ওর প্রাক্তন শশুড় বাড়িতেও। কিন্তু রুস্তমের কোনো হদিস পাওয়া যায় নাই। অগত্যা মনের রাগ মিটানোর জন্য ওর নামে একটা চুরির মামলাও করেছিলাম। কোথাও না পেয়ে আমি ওকে খোজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম এই কারনে যে, রুস্তম যদি ঐ ৩ লাখ টাকা কাজে লাগিয়ে কিছু করতে পারে, তাহলে করুক। ব্যাপারটা নিয়ে আমি আর কোনো আক্ষেপ বা রাগ রাখতে চাই নাই।
অতঃপর প্রায় ৫ মাস পরে একদিন আমি একটা বিশাল চিঠি পেলাম। ২২ পাতার চিঠি। চিঠিটা আমি পড়তে চাইনি কিন্তু চিঠিটার প্রথম লাইনেই যে কথাটা লিখা ছিলো, তার জন্যই আমি পুরু চিঠিটা পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। আর সে লাইনটা ছিলো- “যেদিন আপনি চিঠিটা পাবেন, সেদিন হয়তো আমি আর বেচে নেই স্যার। কিন্তু একটা কথা বলে যাই, আপনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু আমার সাহস কম, তাই আর বাচতে পারলাম না। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন”।
যেদিন আমি চিঠিটা পাই, তার প্রায় ৪ দিন আগে রুস্তম তারের কাটা গলায় ফাসি দিয়ে আত্তহত্যা করেছিলো। আমার প্রায়ই ওর কথা মনে পড়ে। আমি ভাবি যে, যদি রুস্তম সাহস করে আবার আমার কাছে আসতো, আমি ওকে আবার রাখতাম আমার ড্রাইভার হিসাবে। আমি ওরে ক্ষমা করে দিছি। আমিও ওকে ভালোবাসতাম। কিন্তু আমার ভালোবাসা ওকে ঠেকাতে পারে নাই। এটা আমার ব্যর্থ তা নাকি ওর ভীরুতা আজো আমি বুঝতে পারি নাই। কিন্তু এটা ওরও ব্যর্থতা।
রুস্তম মাঝে মাঝে খুব ভালো কবিতা লিখতো। আর ড্রাইভিং করার সময় আমাকে মুখস্ত ওর লেখা কবিতা শুনাতো। আমি অবাক হতাম, রুস্তম খুব ভালো কবিতা লিখে। প্রথম প্রথম ভাবতাম, সম্ভবত রুস্তম কারো কবিতা চুরি করে, কিন্তু পরে বুঝেছি- রুস্তম আসলেই লিখে।
রুস্তমের লেখা ২২ পাতার চিঠির কিছু চুম্বক অংশ আমি তুলে ধরি।
জীবনে সেসব মানুষের সাথে কখনো লুকুচুরী, মিথ্যা, ছলচাতুড়ি, কিংবা কল্পকাহিনী বলে সাময়িকভাবে ভুল বুঝানো উচিত না যারা আমাদের সুখের জীবনের জন্য নিসসার্থভাবে তাদের অনেক মুল্যবান সময়, পরিশ্রম আর অর্থ দিয়া সাহাজ্যের হাত বাড়ায়। যদি পথ চলতে গিয়ে কিংবা তাহাদের নির্দেশনা মানতে গিয়ে কিংবা কোনো লোভে পড়ে নিজের অজান্তে ভুল করে ফেলে, হয়তো সেটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব কিন্তু যদি সেই ভুল হয় ইচ্ছাকৃত, তাহলে সেটা হবে পাপ, অপরাধ এবং ক্ষমার অযোগ্য। যারা আমাকে ভালোবেসে, স্নেহ করে অথবা আমাদের দরিদ্র মানুষের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের পাশে এমনভাবে দাঁড়ান যা হয়তো তাদের দাড়ানোর কোনোই প্রয়োজন ছিলো না, তবুও দাড়ান। তাহাদের সাথে এরূপ কোন ইচ্ছাকৃত অপরাধ আমাদের সারা জীবনের জন্য এমন মারাত্তক হুমকী হয়ে দারায় যা কোনো কিছুর বিনিময়েও আর আগের অবস্থায় ফিরে পাওয়া সম্ভব না। এই মারাত্তক ইচ্ছাকৃত ভুলের জন্য যদি কেউ ক্ষমাও করে দেন, তারপরেও বিশ্বাসের যে ক্ষত সৃষ্টি হয়, তা দগদগে ঘায়ের থেকেও বেশী। তখন তাদের প্রতিনিয়ত মনে হবে, এই মানুষ উপকারের কথা বুঝে না অথবা সে নির্বোধ অথবা সে উপকারীর জন্য অনেক হুমকীস্বরূপ। এই বিবেচনায় কোনো হিতৈষী যদি আমাদের পাশ থেকে নিঃশব্দে সরে যায়, তাকে আর কোনো কিছুর শপথের মাধ্যমেও আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা যায় না। তখন যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, নিজের উপর নিজের রাগ, অভিমান আর কৃতকর্মের জন্য অপরাধবোধ। এই সময় যা হয়, তা হচ্ছে, হতাশা ক্রমশ বাড়তে থাকে, আর এই হতাশা যখন বাড়ে, তাহার সাথে বাড়ে দুশ্চিন্তা। দুসচিন্তা থেকে জন্ম নেয় নিজের উপর নিজেকে ঘৃণা। আর একবার যখন নিজেকে নিজে ঘৃণা করতে কেউ শুরু করে, তখন তার আর বেচে থাকার কোনো লোভ থাকে না। চারিপাশের কোনো মানুষকেই আর ভালো লাগে না, নীল আকাশ ভালো লাগে না, রংগীন আলো ঝলমলের শহরকে তখন বড় অচেনা মনে হয়। মানুষ তখন আত্মহননের দিকে ঝুকে যায়। অথবা সে এমন পথ বেছে নেয়, যা সমাজের চোখে বড়ই অসুন্দর আর কুৎসিত। সব কুতসিত জীবনের কাহিনী প্রায় একই। কোনো না কোন সময়ে তাদের সুযোগ এসেছিলো কিন্তু তারা না বুঝবার কারনে সে সুন্দর জীবন হাতছাড়া করেছে। পাপ কাজ করে কেউ কখনো বড় হতে পারে নাই, আর হয়ও না। তাদের হয়তো টাকার পাহাড় থাকতে পারে কিন্তু তাদের জন্য সমাজ দুঃখবোধও করে না। তারা সারাজীবন সমাজের একটা কালো মানুষ হিসাবেই বেচে থাকে।
স্যার, আমি এই মুহুর্তে ঠিক সে রকম একটা কাল পার করছি। টাকাগুলি আমার কোনো কাজে লাগে নাই। মদ খেতে খেতে কখন বেহুস ছিলাম বুঝি নাই, যখন হুস হয়েছে, দেখলাম সবগুলি টাকা আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে। কে নিয়েছে, কখন নিয়েছে সেই জ্ঞানটুকুও আমার ছিলো না। আমি আপনার থেকে এখন অনেক দূরে। পরিচিতজন মানুষের আশেপাশেও আমি নাই। ড্রাইভিং চাকুরী করতে পারতাম, কিন্তু করতে সাহস করি নাই। কখন আবার আমি আপনার সামনে পড়ে যাই, তাই। প্রতিটা ক্ষন আমি পালিয়ে পালিয়ে থেকেছি। কখনো ক্ষুধা পেটে কোনো এক পরিত্যাক্ত বিল্ডিং এর মশাদের সাথে, কখনো কোনো গাজার আসরে, কখনো একেবারে একা কোনো এক নদীর ধারে সময় কাটিয়েছি। এমন কোনো একটা মুহুর্ত আমার যায়নি, যখন আপনার কথা আমার মনে পড়ে নাই। বারবার ভেবেছি- কি দরকার ছিলো এমনটা করার? যখন যা চেয়েছি, আপনার কাছ থেকে আমি পাইনি এমন ছিলো না। তারপরেও আমার এমনটা করার কোনো দরকার ছিলো না।
চিঠিটা পড়তে পড়তে আমারো খুব খারাপ লাগছিলো। অনেক বড় চিঠি। সব কিছু এখানে হয়তো লিখা সম্ভব নয়। ১৯ পাতার কিছু অংশে এসে আমি একদম নিসচুপ হয়ে গেলাম। রুস্তম লিখেছে-
স্যার, এ কয়দিন বারবার শুধু একটা কথাই আমার মনে হয়েছে। যখন আপনি গাড়িতে উঠতেন, প্রথমেই জিজ্ঞেস করতেন, আমি খেয়েছি কিনা। আজ অবধি কেউ আমাকে এ কথাটা কেউ কখনো জিজ্ঞেস করে নাই। আজ প্রায় ৩ দিনের উপরে পার হয়ে গেছে, আমি একটি দানাও খাই নাই। মুখ ভর্তি দাড়ি, গোসলের কনো জায়গা নাই, এলোমেলো মাথার চুল, নোংরা আমার জামা। আমার সাথে রাস্তার পাগলের মধ্যে কোনো তফাত নাই। যখন আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিতাম, বলতেন- বাসায় গিয়ে রেষ্ট করো, সকালে নাস্তা খেয়ে চলে এসো। আজ আমাকে কেউ বলে না- সকালে চলে এসো। অথচ মনের ভিতরে অদম্য ইচ্ছা, যদি আবার আপনার কাছে চলে আসতে পারতাম? কোথাও আমার কেউ নাই। সম্ভবত আপ্নিই ছিলেন আমার সবচেয়ে কাছের একজন মানুষ যাকে আমি ভালোবাসতাম, আবদার করতাম, জিদ করতাম কিন্তু খুব পছন্দও করতাম। আপনার মেয়েরাও আমাকে খুব সম্মান করতো। কখনো ওরা আমাকে ড্রাইভার হিসাবে দেখে নাই। কি লক্ষী মেয়েগুলি। আংগকেল ছাড়া কখনো ডাকতো না। আজ কেনো জানি মনে হচ্ছে- ইশ, যদি আবার ফিরে আসতে পারতাম!! কিন্তু আমার মনের সাহস নাই, শরীরে বল নাই, আর আপনার সামনে দাড়াবার আমার কোনো জায়গাও নাই। এ কয়দিন মাথায় শুধু একটা জিনিষ ঘুরপাক খাচ্ছে- কি লাভ এ জীবন রেখে? কিন্তু মরার জন্যেও কিছু উপকরন লাগে। ফাসি দিতে হলে দড়ি লাগে, বিষ পান করে মরতে হলে বিষ কিনতে হয়, কিন্তু আমার কাছে বিষ কেনার ও পয়সা নাই। আর সাতার জানা মানুষ নদীতে ঝাপ দিলেও মরে না।
আমি রুস্তমের চিঠিটা পড়ছি, আর খুব ভয় পাচ্ছিলাম। রুস্তম তার চিঠির ২১ পাতায় লিখেছে-
জীবনকে ভালোবাসবার অনেক নাম আছে। কখনো এর নাম চেলেঞ্জ, কখনো এর নাম সততা আবার কখনো এর নাম বিশ্বাস। স্যার, সব হাসিই হাসি নয়। যেদিন আমি টাকাটা নিয়ে পালিয়েছিলাম, সেদিন আমি হেসেছিলাম আনন্দে। অথচ আজ আমি কাদতেছি কেনো আমি টাকাটা নিয়ে পালালাম। আসলে আমার এই কান্না কান্না নয়। এই কান্নার নাম হয়তো ভয়। আর সব ভয়ের চেহারা এক। যার নাম- আতঙ্ক। এই আতংকে মানুষ অসুস্থ হয়, মানুষের রুচী কমে যায়, এক সময় দেহ দেহ মন দুটুই ভেংগে যায়। দেহ ভাঙ্গার সাথে সাথে মানুষ মানসিকভাবে দূর্বল হয়, এক সময় পানির অভাবে যেমন কচি গাছের মরন হয়, তেমনি এই আতংকগ্রস্থ মানুষগুলিও মৃত্যু বরন করে। তাদের জন্য কেউ আর পিছনে তাকায় না। খুব কষ্ট আর ব্যথা নিয়ে স্যার আমি চলে যাচ্ছি। পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। এর গাছ পালা, আকাশ, নদী, পাহাড় সব সুন্দর। সবচেয়ে সুন্দর ছিলেন স্যার আপনি। আমি আপনাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভালোবাসবো। খুব বাচতে ইচ্ছে করছিলো স্যার কিন্তু যারা সাহসী নয়, তাদের বেচে থাকবার কোনো প্রয়োজন নাই এই পৃথিবীতে। আমি আসতে চেয়েছিলাম আবার আপনার কাছে কিন্তু সম্ভব হলো না। যদি কখনো পারেন- আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। যেদিন আপনি চিঠিটা পাবেন, সেদিন হয়তো আমি আর বেচে নেই স্যার। কিন্তু একটা কথা বলে যাই, আপনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু আমার সাহস কম, তাই আর বাচতে পারলাম না। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। যে তিন লাখ টাকায় আমার এতো হিসাব ছিলো, জীবন সুখের হবে, নিজের গাড়ি হবে, অনেক টাকা হবে, সেই তিন লাখ টাকাই আসলে আমার জীবন একেবারে পালটে দিলো। আপনার সাথে আমার জীবনটা তো ভালোই ছিলো। বিশ্বাস করেন স্যার, আজ ঠিক মৃত্যুর আগ মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আমি একটা জিনিষ শিখে গেলাম, জীবনে সব মানুষের সাথে ছল চাতুড়ি করতে হয় না, এই দুনিয়ায় টাকাই সব নয়। আপনার মতো এমন একটা মানুষের পাশে শুধু থাকলেই হতো। বট বৃক্ষের মতো ছিলেন।
------------------------------------------------------------------------------------
চোখ দিয়ে কখন যে পানি পড়ছিলো, বুঝি নাই। আমিও রুস্তমকে স্নেহ করতাম, ভালোবাসতাম। কিন্তু ওকি একবার সাহস করে আবার ফিরে আসতে পারতো না? আমি ওর শেষ ঠিকানাটা জানলে হয়তো নিজেই ডেকে নিতাম। ভুল তো মানুষ করেই। কিন্তু সেটা জীবন দিয়ে মাশুল দেয়ার মতো শাস্তিতে নয়।
(আমি রুস্তমের চিঠিটা ছিড়ে ফেলিনি। আজ আমার সব পরিত্যাক্ত কাগজপত্র ড্রয়ার থেকে পরিষ্কার করতে গিয়ে রুস্তমের সেই ২২ পাতার চিঠিটাও পেলাম। সেটা আজ আমি ছিড়ে ফেললাম।)
০৯/০৯/২০২১-১০০ বছর পর আগামীকাল
আজ থেকে ১০০ বছর পর ঠিক এই সময়ে যারা বেচে আছি আমরা, তাদের প্রায় শতভাগ মানুষ আর এই পৃথিবীতেই থাকবো না। হয়তো খুবই নগন্য কিছু সৌভাগ্যবান অথবা অন্য অর্থে দূর্ভাগ্যবানও বলা যেতে পারে, তারা বার্ধক্যের বোঝা মাথায় নিয়ে ক্ষীনদৃষ্টি আর দূর্বল শরীর নিয়ে হয়তো এমন কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকবেন যা তিনি কখনো চান নাই। যার নাম ‘মৃত্যু’।
ক্যালেন্ডারের পাতা প্রতিদিন পালটে যাবে, তাঁর সাথে সাথে পালটে যাবে তারিখ, মাস, বছর এবং অতঃপর যুগ। কেউ এটাকে আমরা থামাতে পারি না, পারবোও না। আর কেউ পারেও নাই। হোক সে কোনো প্রতাপশালী সেনাপতি, হোক সে চৌকস কোনো রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রনায়ক। শুধু তাই নয়, কোনো বিজ্ঞান কিংবা কোনো বিজ্ঞানিক, কোনো সর্বোচ্চ পদধারী ধার্মিক নেতা কিংবা দূধর্ষ সাহসী সন্ত্রাসী কেউ এই অমোঘ প্রাকৃতিক নিয়মটাকে উপেক্ষা করে অগোচরেও পরিবর্তন করার কোনো ক্ষমতা রাখে না।
আজ যারা পথে ঘাটে আমার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে, তাদের কেউ হয়তো কোট টাই, কেউ হয়তো আধুনিক পোষাক আষাকে, কেউ আবার ফুটপাতে নোংরা চুলে আছেন, আমি তাদের অনেককেই হয়তো চিনিও না আবার হয়তো কাউকে কাউকে আমরা সর্বদাই দেখি, চিনি, এদের কেউও এই নিয়ম থেকে পরিত্রান পাবে না। মহাশ্মশানের সারিসারি পাথরে নাম লেখা কোনো এক নাম ফলকের মধ্যেই আমরা লুকিয়ে যাবো ঠিক সেইস্থানে যার কথা আমরা আজ ভাবতেও পারি না। সেখানে যেমন কোনো আধুনিক পোষাক বলতে কিছু থাকে না, আর না থাকে কোনো ধার্মিক ব্যক্তির আলখেল্লাটাও। অনেকের বেলায় হয়তো সেই নামফলকটাও থাকবে না। কোথায় আছেন তারা, কার জায়গায় আছেন তাঁরও কোনো হদিস হয়তো পাওয়া যাবে না। আজ যে শরীরটাকে প্রতিদিন নোংরা মনে করে দেশী বিদেশী সাবান শ্যাম্পু দিয়ে সুগন্ধী মাখছি, তখন এই শরীরের মধ্যে হাজারো পোকা মাকড়, কর্দমাক্ত মাটি, নোনা জল, অপরিষ্কার জলের সাথে ভেসে আসা দূর্গন্ধময় আবর্জনায় সারাটা শরীর ভেসে গেলেও তাকে আর সুগন্ধী কেনো, সরানোর মতোও আমাদের কোনো শক্তি থাকবে না। শরীরে মাংশ পচে গলে মিশে যাবে মাটির সাথে, হয়তো কোনো এক কুকুর কিংবা শিয়াল আমাদের শরীরের হাড্ডিটি নিয়ে দূরে কোথাও অবশিষ্ঠ মাংশটুকু খাওয়ার জন্য দৌড়ে চলে যাবে অন্যত্র। কার সেই কংকাল, কার সেই হাড্ডি, এই পৃথিবীর কোনো জীবন্ত মানুষের কাছে এর কোনো মুল্য নাই।
যে ঘরটায় আমি সারাদিনের ক্লান্তি শেষে অবসাদ শরীর নিয়ে মুলায়েম বিছানায় গা হেলিয়ে দিতাম, সেই ঘরটা হয়তো থাকবে অন্য কার দখলে। যে বাগানটায় আমি প্রায়ই পায়চারী করে করে আকাশ দেখতাম, গাছ গাছালীর মধ্যে উড়ে আসা ভ্রমর কিংবা পোকামাকড় দেখতাম, সেই বাগানের দখল হয়তো এখন কার দখলে কে জানে। বাগানের গাছ গাছালীর পরিচর্যার নামে যে পোকামাকড়গুলিকে আমি বিষ দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করতাম, আমি আজ তাদের দখলে।
যে বাচ্চাদের মুখরীত কোলাহলে আমার ঘর ভরে থাকতো, যাদের আগমনে আমার মন পুলকিত হতো, আজ সেখানে অন্য কেউ মুখরীত হচ্ছে। কতই না সাবধানতায় আগলে রেখেছি সেই ঘর, সেই লন, কিংবা আমার যতো আয়েশী জিনিষ, আজ সেগুলি আমার কিছুই নয়। আমার সুন্দুরী স্ত্রী যখন তাঁর লাল শাড়িটা পরার পর কিংবা আমিই যখন নতুন কোনো একটা ড্রেস পড়ে বারবার আয়নার সামনে গিয়ে কতবার না দেখতে চেয়েছি-কেমন লাগে আমাকে, অথচ আজ সেই আমি বা আমার সেই সুন্দুরী স্ত্রী তাঁর চেহাড়া কেমন দেখায় কাফনের সেই ধবল পোষাকে সেটা দেখার কোনো পায়তারা নাই। সেই বৃহৎ আয়নাটার আর কোনো মুল্য নাই আমার কাছে। হয়তো সেখানে অন্য কেউ এখন তাঁর চেহাড়া দেখছে, হয়তো লাল শাড়ির পরিবর্তে নীল বা টাই কোট পড়া পোষাকের বদলে একটা ভেষ্ট পড়া ব্যাকব্রাস চুলের মহড়া দিচ্ছে। যে গাড়িটা প্রতিদিন আমাকে মাইলকে মাইল ঠান্ডা কিংবা শীততাপ হাওয়ায় বসিয়ে, মিষ্টি মিষ্টি গান শুনিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে গেছে, সেটা আর আমার কোনো প্রয়োজন নাই। না সে আমাকে আর খোজে।
কখন কোথায় কাকে কাকে নিয়ে অথবা আমার নায়নাতকুর আত্তীয় স্বজন স্ত্রী পোলাপান নিয়ে কবে কোথায় কি আনন্দে মেতেছিলাম, সেই ইতিহাস আর কেউ কখনো মনে রাখবে না। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কতটা পথ হেটেছিলাম, আর সেই হাটা পথে আমি কতটুকু ঘাম ঝরিয়ে চূড়ায় উঠে কি তৃপ্তি পেয়ে কি আনন্দে কতটুকু আত্তহারা হয়েছিলাম, সেই তথ্য না কেউ জানবে, না কেউ জানার কোনো আগ্রহ দেখাবে। কার সাথে কি নিয়ে আমার মনোমালিন্য হয়েছিলো, বা কে আমাকে কতটুকু ভালোবেসে কি অবদান দিয়েছিলো অথবা কার কোন আগ্রহে আমি কোথায় কি করেছিলাম, কার কারনে আমার অন্তরে জালা উঠেছিলো আর কার কারনে আমার দিন আর রাত একহয়ে গিয়েছিলো, সেই ইতিহাসের কোনো মুল্য আজ বেচে থাকা মানুষগুলির কাছে কোনো অর্থ বহন করে না। না তাদের যাদের জন্য এসব ঘটনা ঘটেছে। নতুন প্রজন্ম নতুন পরিবেশ, নতুন সব কাহিনীতে ভরে থাকবে বর্তমান আর আমাদের সেই পুরাতন প্রজন্ম, কিংবা সেই তাদের পুরাতন পরিবেশের কোনো স্থান থাকবে না আজকের এই পরিবর্তীত বন্ধুমহল পরিবেশে। হয়তো কোনো এক ছোট বালিকা আমাদের কথা শুনে, অথবা ভালোবেসে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে আমার সেই সমাধিতে দাঁড়িয়ে একটু অন্যমনষ্ক হয়ে দাঁড়িয়ে পুষ্প স্তবক দিয়ে চলে যাবে। হয়তো সবার বেলায় এটা নাও হতে পারে। কিংবা জন্ম জন্মান্তরের শেষে প্রজন্মের পর প্রজন্মের শেষে আমি এমন করে বিলীন হয়ে যাবো যে, সেই অবুজ বালিকার পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো আর একটা বাশী ফুলও নিয়ে আমার সেই সমাধিতে দাঁড়াবে না। কারন আমি তাদের কোনো ইতিহাসের মধ্যেই নাই। চিরতরেই বিলীন।
আজ যে সেলফীটা কত যত্ন করে তোলা হয়েছে, হাসি মাখা মুখ, চুলের বাহার, পোষাকের পরিপাটিতা সব কিছু ধীরে ধীরে সেই শতবর্ষ পরে এমন করে মলিন হয়ে যাবে, হয়তো দেখা যাবে, সেই ছবি পরে আছে এমন এক কোনায় যেখানে থাকে পরিত্যাক্ত কোনো কাগজ বা ময়লার বাক্স। কোনো একদিন সেটা হয়তো অপ্রয়োজনীয় হয়েই বেরিয়ে যাবে আমার সেই শখের ঘরের দরজা পেরিয়ে।
যে অর্থের জন্য আমি প্রতিদিন সারাটা সময় শুধু পরিশ্রমই করে গেছি, সেই অর্থ আজ আমার কোনো কাজেই আসবে না। শতবছর পরে তো আমার অর্থে গড়া কোনো এক ইমারতের কোনো একটা ইটের মধ্যেও আমার কোনো নাম বা অস্তিত্ব থাকবে না। হোক সেটা আমার পরিশ্রমে গড়া কিংবা আমার নিজের। সেখানে হাত বদলে বদলে আমার অস্তিত্তের শেষ পেরেগটুকু মেরে সেখানে হয়তো কোনো এক লোকের নাম লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। যেটা আজ আমার নামে পরিচিত, শত বছর পর সেটা আমার আর নাই, না সেটা আমার নামেও অহংকার করে।
কি অদ্ভুত না?
শত বছরের হিসাবে যেমন আমি আর নাই, হাজার বছরের হিসাবে তো আমি কখনো ছিলামই না। তারপরেও আজ আমি অনেক ব্যস্ততায় দিন কাটাই আগামিকালের জন্য। অথচ আগামিকালটাই আমার না। এই পৃথিবী আমাকে কখনোই মনে রাখবে না। কারন সে আমাকে ভালোই বাসে নাই। অথচ আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম আমার জীবনের থেকেও বেশী। আর এটাই এই পৃথিবী। এই পৃথিবীর কোনো বর্ষাই আমার না, কোনো শরতই আমার না। এর গাছ পালা, এর নীলাকাশ, এর সুগভীর সমুদ্র কিংবা ঘনসবুজ পাহাড় কোনো কিছুই আমার না। আমার ঘরটাও।
শতবছর পরে, আমি এক অচেনা, নামহীন, অস্তিত্বহীন মানুষ যে আজকের দিনে বহু ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটিয়ে কিছুটা সময় এই নীল আকাশ, ঘন সবুজ পাহাড় অথবা পাখীদের কিচির মিচির শুনেছিলাম।
১৭/০৮/২০২১-রেহালাদের গল্প
রেহালার গল্প
সাহস ছাড়া মানুষ স্বাধীন হতে পারে না, আর স্বাধীনতা ছাড়া মানুষ জীবিত নয়।
একদমই ভাবী নাই যে আজকে আমার অফিসে এমন কেউ আসবে যাকে আমি একসময় চিনতাম কিন্তু গত ৪০ বছরের মধ্যে আর কখনোই দেখা হয় নাই। ওর নাম ‘রেহালা (এটা একটা ছদ্দনাম, আসল নামটা উল্লেখ করলাম না’)। আমি আর রেহালা একই ক্লাশে পড়তাম সেই প্রাইমারী স্কুলসহ হাইস্কুলে। এরপর আমি হাইস্কুল ছেড়ে অন্য কলেজে চলে আসলাম, আর ওরা গ্রামেই রয়ে গেলো। এতো সুকন্ঠী ছিলো এই রেহালা যে, আমরা ওর গান শুনতাম যেখানে সেখানে, দলবেধে। স্কুলের কোনো অনুষ্ঠানে কখনো কখনো রেহালার একক সঙ্গীত পর্যন্ত হতো। খালী কন্ঠেও যে গানের একটা মূর্ছনা আছে, সেটা রেহালার গান শুনলে বুঝা যেত। আর যদি রেহালার রূপের কথা বলি, সেটা আরেক বর্ননা। ওর গায়ের রঙ শ্যামলা, একদম ডায়মন্ডের মতো, চোখগুলি বড় বড়, ঠোটে সবসময় একটা হাসি লেগেই থাকতো। রেহালা হাসলে গালে একটা টোল পড়তো। সম্ভবত এই টোল পড়া গালের জন্যই রেহালার হাসিতে একটা আলাদা মাধুর্য ছিলো। বড্ড মিষ্টি ছিলো রেহালার হাসি। ছিমছাম শরীর, আমাদের সাথে গোল্লাছূট, দাড়িয়াবান্দা, মাঝে মাঝে কাবাডিও খেলতো রেহালা। রেহালাকে কাবাডি খেলায় কুকুপাত করলে ইচ্ছামতো মাথায় চুল ধরে ঝাকুনো মারতো। এক সাথে আমরা গ্রামে বড় হয়েছি, পাশাপাশি বাড়ি ছিলো আমাদের। নদীতে ঝাপ দিতাম এক সাথে, আর অন্যের গাছে উঠে পেয়ারা চুরির সময় রেহালা থাকতো লুক আউটম্যানের মতো। যেই না গাছের মালিকের আসার সময় হতো, রেহালা নিরুদ্দেশ, আর আমরা গাছের মধ্যে নিশ্চুপ। বড্ড মজার দিন ছিলো সে ছোটবেলাটা। সেই রেহালা আজ হটাত করেই আমার অফিসে এসে হাজির।
প্রথমে তো আমি রেহালাকে চিনতেই পারিনি। ওর শরীর অনেক মোটা হয়ে গেছে, রেহালা আগেই শ্যামলা ছিলো, আর এখন ওর চেহারা এতো কালো হয়ে গেছে যে, আগের আর সেই ডায়মন্ডের মতো চেহারাটা নাই। মাথায় চুলে পাক ধরেছে। কতই বা বয়স, তারপরেও মনে হচ্ছে বুড়ি হয়ে গেছে রেহালা। কিন্তু হাসলে ওর গালে এখনো টোল পড়ে। চোখ গুলি এখনো ডাগর ডাগর। কন্ঠে আর সেই সুর এখন নাই রেহালার। রেহালা আমার অফিসে একা আসে নাই। ওর সাথে ওর ছোট বোন এসেছে। ওর ছোট বোন কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বল্লো যে, বুজি (মানে আপা) কানে শুনে না। অনেক জোরে জোরে কথা বললে কিছুটা শুনতে পায়। যেহেতু কানে শুনে না, তাই, অন্যের কথাও বুজি ভালোমতো শুনতে না পাওয়ায় কি কথা বলছে কেউ বুঝতে পারে না। তাই সাহাজ্যকারী হিসাবে বুজি কোথাও গেলে আমিই সাথে যাই।
রেহালা আমার অফিসে বসেই কিছুক্ষন যেনো হাপিয়ে উঠেছিলো। রেহালার প্রথম কয়েক মিনিটের কথার অর্থ এমন ছিলো যে, এতোদিন পর রেহালা আমার সাথে দেখা হওয়ায় যেনো সেই ছোট বেলার রাজ্যের গল্পের পশরা নিয়ে হাজির হয়েছে। ওর বলার উচ্ছাস, মুখের অভিব্যক্তি আর অনর্গল কথার মধ্যেই আমি বুঝতে পারছিলাম রেহালা আজ অনেক অনেক খুসি যে, সে আমার সাথে দেখা হয়েছে। কখনো দুই হাত তুলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে, কখনো নিজের অজান্তেই কি যেনো দোয়া দরুদ পাঠ করছে আবার কোনো কারন ছাড়াই হেসে দিচ্ছে। ঝির ঝির বাতাসে তরু পল্লব কিংবা ক্ষেতের দন্ডায়মান ফসলরাজী যেমন হেলিয়া দুলিয়া এদের মনের সুখ প্রকাশ করে, নির্মল নীলাকাশ যেমন তার একখন্ড মেঘের ভেলাকে এদিক থেকে সেদিকে উড়াইয়া লইয়া যায়, রেহেলা তেমনি আমাকে এতো বছর পর পেয়ে যেনো তার সেই দশাই হলো। রেহালা মাথার বোরখাটা খুলে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলো। রেহালার আগমনে আমার অফিসে কোনরূপ সমারোহ ছিলো না, কিন্তু আজিকার এই মুহুর্তে সমস্ত বিশ্ব ব্যাপারের সর্বাধিনায়িকা যেনো এই রেহালাই হয়ে দাড়াল। রেহালার এমন উচ্ছাসিত আচরনে আমার যেনো বিস্ময়ের কোনো শেষ ছিলো না।
এখানে আরো একটা ব্যাপার আমাকে রেহালা বিস্মিত করলো। রেহালা ছোটবেলায় আমাকে ‘তুই’ বলেই ডাকতো, কিন্তু আজকে খেয়াল করলাম, রেহালা আমাকে আর তুই; বলছে না, কাকা বলে ‘আপনি’ সম্মোধন করছে। গ্রামের সম্পর্কের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে রেহালার সাথে আমার কাকা ভাতিজারই সম্পর্ক। কিন্তু এই সম্পর্ক কিসের ভিত্তিতে সেটা আমার ছোট বেলায়ও জানা ছিলো না, আজ তো সেটা জানার কোনো ইচ্ছাও নাই। আমি রেহালার বাবাকে ‘ভাই’ বলেই ডাকতাম সেটা আমার মনে আছে। আমি রেহালাকে বললাম যে, সে যেনো আমাকে “তুই বা তুমি” করেই বলে।
আমি জানি রেহালার বাবা এবং অন্যান্য ভাই বোনেরা এখনো জীবিত আছে। আর তারা মাঝে মাঝেই আমার অফিসে কিছু না কিছু সাহাজ্য বা পরামর্শের জন্য আসে। কখনো তাদের সাথে আমার দেখা হয়, আবার কখনো কখনো দেখা হয়ও না। ফলে আমি রেহালাকে ওদের ব্যাপারে কোনো প্রশ্নও করতে চাইনি। একমাত্র রেহালার ব্যাপারেই আমার অনেক কিছু জানা ছিলো না। তাই প্রথমেই রেহালাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, রেহালা কেমন আছে। রেহালা কি শুনলো আর কি বুঝলো আমি জানি না কিন্তু রেহালা বলতে থাকে-
কাকা, তোমারে কতবার যে আমি দেখতে চাইছি মনে মনে, আর আফসোস করছি, ইশ যদি মরার আগে তোমার সাথে আমার একবার দেখা হতো। অনেকের কাছেই আমি তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছি, তুমি কই থাকো, কিংবা কোথায় গেলে তোমাকে পাওয়া যাবে ইত্যাদি কিন্তু কেউ আমাকে তোমার আসল ঠিকানাটা দিতে পারে নাই। শুধু এটুকু জানতাম যে, তুমি এই এলাকাতেই বড় ব্যবসা নাকি করো। একবার শুনেছিলাম, তুমি নাকি গ্রামে গেছো। আমি তখন গ্রামেই ছিলাম। কিন্তু আমি লজ্জায় তোমার সাথে দেখা করার সাহস করি নাই। সেটাও আজ থেকে প্রায় বারো বছর আগের কথা। তখন সবেমাত্র আমি আমার জামাইয়েরে নিজের ইচ্ছায় তালাক দিছি। গ্রামে একজন মহিলার সংসার ভেংগেছে, তালাক হয়েছে এটা যে কত বড় কেলেংকারী, সেটা মেয়ে না হলে আসলে কেউ বুঝতে পারে না।
আমি রেহালাকে জিজ্ঞেস করলাম, স্বামীকে তালাক দিলি কেনো?
রেহালা সহজেই আমার প্রশ্নটা বুঝতে পেরেছিলো। রেহেলা অনেকক্ষন মাথা নীচু করে কি যেনো ভাবলো। দেখলাম, রেহেলা কাদছে। তাঁর ফুপিয়ে কান্নার একটা শব্দ পেলাম। আমি রেহেলাকে কিছুই বললাম না। রেহেলাকে আমি সময় দিলাম, রেহেলা কাদছে। তারপর টেবিলে রাখা একটি গ্লাস থেকে কয়েক ঢোক পানি গিলে বলতে লাগলো-
কাকা, একটা কথা কি জানেন? বিয়ের সময় খুসি আর ভালোবাসায় এটা প্রমানিত হয় না যে, ভবিষ্যতে এই সুম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা বা ঘৃণা আসবে না। মধুর ভালবাসা যেমন একদিন ঘৃণার বিষে রুপান্তরীত হতে পারে, আবার গভীর ঘৃণাও হয়তো সমস্ত বাধা কাটিয়ে পুনরায় চরম ভালোবাসায় পরিনত হতে পারে। কিন্তু কখনো যদি ভালোবাসার মধ্যে ঘৃণা ঢুকে পড়ে, তিক্ততার সীমা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন যে এখন এই সম্পর্ককে শেষ করা উচিত। বুঝে শুনে বেরিয়ে আসা উচিত। যাতে তার আগে কোনো মারাত্তক অঘটন না ঘটে। কিন্তু আফসোস, প্রায়ই তিক্ত সম্পর্কগুলির ক্ষেত্রে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনা। হোক সেটা সমাজের তথাকথিত লোক লজ্জার ভয়ে অথবা অভিভাবকের অতিরিক্ত চাপের কারনে। তখন এমন হয় যে, সেই দম্পতির যে একদিন ভালোবেসে যারা খুব কাছে এসেছিলো, তারা আজ সম্পর্কের তিক্ততায় একজন আরেকজনকে চাকু, বন্ধুক চালাতে পিছপা হয়না। তখন একজন আরেকজনের প্রান নিতেও দ্বিধাবোধ করেনা অথচ কোনো একদিন তারা তাদেরকে নিজেদের মানুষই ভাবতো। বিয়েটা হয়তো সত্যিই একটা কন্ট্রাক্ট। আর সেই কন্ট্রাক্টের মধ্যে নিহীত থাকে অনেক দায়িত্ব, অনেক কর্ম পরিধি।
রাহেলার এমন জীবনভিত্তিক কথায় আমিও খুব অবাক হলাম। রাহেলা কি সুন্দর করে তাঁর জীবনের কিছু অভিজ্ঞতার কথা এক নিমিষে বলে গেলো। অনেক পড়াশুনা হয়তো রাহেল করে নাই কিন্তু ওর কথাবার্তা যেনো আমার অন্তরে তীরের মতো বিধে গেলো। আমি রাহেলার কথা খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম।
রাহেলা বলতে থাকলো-
সেদিন সম্ভবত গুড়িগুড়ি বৃষ্টির দিন ছিলো। আমার স্বামী আমারে বল্লো, চলো, নারায়নগঞ্জ আমার এক বন্ধুর বাসা থেকে বেড়িয়ে আসি। আমার স্বামী আমাকে ভালোবাসে কিনা তা আমি কখনো বুঝি নাই। বিয়ের পর থেকে যে শ্বশুর বাড়িতে ঢূকেছি, সারাক্ষন স্বামী, সংসার, ছেলে মেয়ে ননদ ননদীনির দায়িত্ব পালন করতে করতেই আমার দিন পার হতো। আর এসব দায়িত্ব পালনে কোথাও কোনো ত্রুটি হলেই আমার উপরে চলতো খড়গের মতো আচরন। আমার স্বামী নেশা করতো। বিয়ের আগে নেশা করতো কিনা জানি না, কিন্তু বিয়ের কদিন পরেই বুঝলাম, সে প্রায় রাতেই নেশা করে ঘরে ফিরে। কি তাঁর দুঃখ, কি তাঁর কষ্ট কখনো সেটা আমি বুঝতে পারি নাই। ফলে, সুযোগ আর কোনো ব্যত্যয় কিংবা তাঁর নেশার জগতে একটু ভাটা পড়লেই কারনে অকারনে আমাকে মারধোর করতো। সেই মারধোরের কারনেই আমি আমার কান হারাই। মার খেতে খেতে কানটা একদিন অকেজোই হয়ে গেলো। গরীব বাবা মা, পয়সাকড়ি নাই, যৌতুক যা দেয়ার সেটা দেয়ার পরেও জামাইয়ের মন ভরে নাই। দিনের পর দিন এই অতিরিক্ত যৌতুক আর টাকার জন্য আমাকে মার খেতে হয়েছে। ঘরে ভালোমতো বাজার হয় না, অথচ কেনো ভালোমতো রান্না হয় না সেটা যেনো আমার অপরাধ। সহ্য করে থেকেছি। মুখ বন্ধ করা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিলো না। গরীব পিতামাতার সন্তানেরা নাকি “আগুনে পানি দিয়ে” সংসার করে। আমিও তাই করার চেষ্টা করেছি। যাই হোক, যখন আমার জামাই আমাকে বল্লো, চলো এক বন্ধুর বাসায় বেড়াইয়া আসি, ভাবলাম, হয়তো মনটা তাঁর পরিবর্তন হয়েছে। আমারো মনটা ভালো হয়ে গেলো। আনন্দিতই হয়েছিলাম। কারন যে কখনো আমাকে পাশের দোকানে নিয়ে একটা চকলেটও কিনে খাওয়ায় নাই। আজ তার এহেনো অনুরোধে বেশ পুলকিত বোধ করছিলাম। বললাম, চলেন যাই।
আমি আর আমার স্বামী বিকাল ৫টার পরে কাপড় চোপড় পড়ে নারায়নগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমাদের বাড়ি থেকে নারায়নগঞ্জ খুব বেশী দূরে না। ফলে সন্ধ্যার আগেই আমরা ওর বন্ধুর বাসায় চলে এলাম। রাতের খাবার খেয়ে হয়তো আমরা আবার আমাদের বাড়িতে ফিরে আসবো এটাই ছিলো আমার জানা। আমি আমার ছোট ছেলেকে সাথে নিতে চাইলাম। কিন্তু আমার স্বামী আমাকে নিতে বারন করলেন। ভাবলাম, ভালোই হবে, আমরা নীরিবিলি দুজনে একসাথে রিক্সায় ঘুরতে পারবো। পাশাপাশি বসে গল্প করতে পারবো। সময়টা ভালোই কাটবে। আমরা যখন তাঁর বন্ধুর বাড়িতে পৌঁছলাম, তখন সন্ধ্যার একটু আগে। তার বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে দেখি, বন্ধুর স্ত্রী বাসায় নাই। শুনলাম ছোট বাচ্চাকে নিয়ে নাকি সন্ধ্যার পর আসবে, হয়তো কোথাও কাজে গেছে। চা খেলাম, সাথে কিছু ফলমুলাদি। খারাপ লাগছিলো না। সন্ধার পর হটাত করে আমার স্বামী বাজার থেকে কি জানি আনতে বাইরে যাওয়ার কথা বলে আমাকে একা রেখে চলে গেলেন। একটু ভয় ভয় করছিলো কিন্তু খারাপ কিছু মাথায় আসে নাই। সময় যাচ্ছে, আবারো সময় যাচ্ছে, ঘন্টা, তারপর আরো এক ঘন্টা, কিন্তু আমার স্বামীর ফিরে আসার কোনো লক্ষন দেখলাম না। এদিকে রাত বেশী হয়ে যাচ্ছে, আমি বারবার ওর বন্ধুকে আমার স্বামীর কথা বল্লেও দেখলাম সে খুব একটা কথা আমলে নিচ্ছে না। আমি আমার স্বামীর এই বন্ধুকে আগে থেকে চিনতামও না। রাত প্রায় ১১টার উপরে বেজে গেলো, আমার স্বামীর ফিরে আসার কোনো নামগন্ধও নাই। এবার আমার খুব ভয় করছিলো। জীবনে কোনোদিন শহরেও আসি নাই। আর এখন পুরু একটা অপরিচিত লোকের বাসায় আমি একা। বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চা রেখে এসছি। ওদের জন্য ভীষন দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো।
আমি চারিদিকে কান খারা করে সবকিছু খেয়াল করছিলাম। আমার খুব ভয় লাগছিলো। একটু পরে আমি খেয়াল করলাম, এই বাড়িতে কিছু অপরিচিত লোকের আনাগোনা যেনো বেড়ে গেছে। কেউ কেউ বাইরে ফিসফিস করে যেনো কি কি কথাও বলছে। কেউ কেউ আবার আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছেও। বুঝতে পারলাম, তারা হয়তো আমাকে নিয়ে কোনো আলাপ করছে কিন্তু কি আলাপ করছে বুঝতে পারছিলাম না। তখন রাত প্রায় বারোটা বেজে যাচ্ছিলো।
এক সময় ৩০/৩৫ বছর বয়সের একজন পুরুষ আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো- কি নাম তোমার? আসো ওই ঘরে যাই। এই বলে পাশে একটা ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম- কে আপনি ভাই? আর আমি ওই ঘরেই বা কেনো যাবো? আমার স্বামী কই? সে এখনো আসছে না কেনো? আমার বাড়ি যাওয়া দরকার। আমার বাচ্চারা একা বাসায়। ওরা হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমার কথা শুনে লোকটি পিছনে ফিরে এসে আমাকে সে যা বল্লো, সেটা শুনে তো আমার মাথা খারাপ। আমাকে নাকি আমার স্বামী এখানে দেহ ব্যবসার জন্য বিক্রি করে টাকা নিয়ে চলে গেছে। সে আর ফিরবে না। রাতটা এমনিতেই অন্ধকার ছিলো, লোকটার কথা শুনে এবার যেনো মহাঅন্ধকারের মধ্যে আমাকে আমি মৃত লাশের মতো শ্মশানের মধ্যে দেখতে পেলাম যেখানে আমাকে কিছু জীবন্ত শিয়াল কুকুর তাড়া করছে, অথচ আমার কোনো শক্তি নাই।
আমি চিৎকার করতে লাগলাম, আর বলতে লাগলাম, এটা কি করে সম্ভব? তোমরা আমার স্বামীকে ফিরিয়ে আনো। আমি ওরকম মেয়ে নই যে, তোমরা আমার সাথে এমন আচরন করতে পারো। আমি ভয়ে আরো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে গেলে আমাকে কয়েকজন এসে এমনভাবে জাপটে ধরলো যে, না আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিলো, না আমি কোনোদিকে নড়াচড়া করতে পারছিলাম। কিন্তু আমার চোখ তো আর কোনো কিছুতে বাধা পড়েছিলো না। আমার বাচ্চাদের কথা মনে পড়লো, আমার ছোট ছেলেটা খুব মগা (বোকা), তার কথাই বেশী মনে পড়লো। তার মাত্র ৮ বছর বয়স। সে আমাকে ছাড়া কোথাও যেতে চায় না। ওকে একা ফেলে এসেছি। ছেলেটা মগা হলেও কখনো আমার হাতছাড়া করতো না। ওর মুখটা ভেসে উঠতেই আমার দুচোখ ঝাপ্সা হয়ে আসছিলো। আহা রে বাপ, দেখে যা তোর মা কত অসহায় একটা পরিস্থিতিতে ছটফট করছে। তোর অমানুষ বাবা আমাকে কোথায় ফেলে গেলোরে বাবা।
রেহালা কিছুক্ষন চোখ বুজে থাকল, তার দুচোখের পাশ দিয়ে জলের একটা রেখা যেনো অবিরত জল পড়তেই থাকলো। একটু পর আবার রেহালা বলতে থাকল-
জানো কাকা, কোনো কোনো সময় কিছু কিছু নাটক এমনভাবে বানানো হয় যাতে সাধারনের চোখে মনে হবে এটাই সব সত্যি কিন্তু এর পিছনের মুল উদ্দেশ্য অনেক গভীরে। শুধু ভরসার স্থান তৈরির জন্যই নাটক তৈরী করা হয়। আমার স্বামীও আমার সাথে ঠিক এমনই একটা ভরষার স্থান তৈরী করেছিলো। আর সেটা ছিলো নিছক একটা নাটক যা আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনি। আমি কি এটাই চেয়েছিলাম? আজ দুপুরে যখন সে আমাকে বেড়াতে নিয়ে আসবে বলে জানালো, আমি তো আমার সমস্ত বিশ্বাস নিয়েই তাঁর সাথে অজানা এক বন্ধুর বাড়িতে রওয়ানা হয়েছিলাম। বিকালটা কত সুন্দর ছিলো। চারিদিকের গাছপালা, আশ পাশের দোকানী, মানুষগুলিকে দেখে তো আমার মন অনেক পুলকিতই ছিলো। তাহলে এই হটাত কি গজব আমার উপর আছড়ে পড়লো? আমি কি কখনো আমার স্বামীকে একটিবারের জন্যেও ভালোবাসিনি? কখনো কি আমি ওর বেদনায় কাতর হই নাই? কখনোই কি ও আমাকে স্নেহ কিংবা ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরে নাই? আমি তো আমার জীবনের সবকিছু দিয়ে ওকে ভরষা করেই বাপ মায়ের বাড়ি ছেড়েছিলাম। তাহলে সে এমন নিষ্ঠুর কাজটি কেন আর কিভাবে করতে পারলো? আমি কি ওর বাচ্চার মা নই? আমাকে সে না ভালোবাসুক, ওর বাচ্চাগুলির জন্যেও কি সে আমাকে ছেড়ে দিতে পারতো না? মুখবাধা ঠোট দিয়ে সমস্ত বেদনাগুলি যেনো শুধু গোংগানীর মতোই মনে হচ্ছিলো আমার কাছে। অথচ এই গোংগানির মধ্যে কত যে অস্থিরতা, কত যে আক্ষেপ, কত যে ভালোবাসা আর কষ্ট লুকিয়ে ছিলো তা যেনো আমাকে ঝাপ্টে ধরে রাখা মানুষগুলির কানেই গেলো না।
আমার আল্লাহর কাছে আমি চোখ বন্ধ করে শুধু একটা কথাই প্রার্থনা করলাম, যদি আমি সতীনারী হয়ে থাকি, যদি আমি আমার এক ঈশ্বরকে কখনো কায়মনে ডেকে থাকি, যদি তিনিই হয়ে থাকেন আমার একমাত্র ত্রানকর্তা, যদি আমার প্রভুই হয়ে থাকে সমস্ত বিপদের উদ্ধারকারী, তাহলে আমি আমার সেই একচ্ছত্র প্রভুর কাছে দয়া ভিক্ষা করছি তিনি যেনো আমাকে তাঁর গায়েবী ক্ষমতা দিয়ে এই নরক থেকে বাচিয়ে দেন। হে ঈশ্বর, আমি তোমাকে কখনো দেখিনি, কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছি, তোমার দরবারে আমি প্রতিদিন মাথা নুইয়েছি, তুমি আমাকে বাচিয়ে দাও ঈশ্বর। লোকগুলি ইতিমধ্যে আমার চিৎকার চেচামেচিতে গন্ডোগোল হতে পারে ভেবে, কিংবা আশেপাশের লোকজন কিছু আচ করতে পারে জেনে আমাকে তাদের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়েছিলো। আমার চোখ বন্ধ ছিলো, আর আমি গোল হয়ে মাটিতে নিথর দেহে বসেছিলাম। আর আমার চোখ থেকে অনবরত অশ্রু ঝরছিলো।
তারপর কি হয়েছিলো আমি জানি না। কিন্তু ঐ ৩০/৩৫ বছর বয়সের যুবকটি আমাকে ডেকে বল্লো- এদিকে আসো আমার সাথে। কিন্তু কোনো কথা বলবে না। আমি যা বল্বো, সেটাই করবে। আমি বুঝতে পেরেছি তুমি একটা পিশাচের পাল্লায় পড়েছো। সে জানতে চাইলো, আমার সাথে কোনো টাকা পয়সা আছে কিনা। আমি লোকটির চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম, এটাও ভাবছিলাম, সে আমার সাথে এবার অন্য কোনো চাল চালছিলো কিনা। কাউকে বিশ্বাস করা কিন্তু ভুল নয়। তবে চোখ বন্ধ করে কাউকে বিশ্বাস করা একেবারেই ভুল। তাই আমাদের এটা জানা খুব দরকার যে, সামনের মানুষটাকে বিশ্বাস করবো নাকি করবো না।
তাঁর আচার ব্যবহারে আমার কাছে সে রকম মনে হলো না। মনে হলো আসলেই বুঝি তাঁর মাধ্যমে আমার ঈশ্বর আমাকে সাহাজ্য পাঠিয়েছেন। বললাম, আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নাই। সে আমার কানে কানে চুপিসারে শুধু একটা কথাই বল্লো- আসো, আমি তোমাকে এখান থেকে দ্রুত বের করে দেবো। আমি জানি তুমি খারাপ মেয়ে নও। আমিও তোমার কাছে কোনো শরীরের চাহিদায় আসি নাই। আমি এখানকার একজন এজেন্ট মাত্র। আমাকে আর এর বেশী কিছু জিজ্ঞেস করোনা। আর জিজ্ঞেস করলেও আমি সব কিছুই মিথ্যে বল্বো।
রাহেলা এবার একটু থামলো। সামনে রাখা গ্লাস থেকে সে আরো একবার এক ঢোক পানি পান করলো। রাহেলার চোখে মুখে যেনো এখনো সেই অতীতের ভয়টা স্পষ্ট ফুটে উঠছিলো। মাঝে মাঝে সে শিহরিত হয়ে উঠছিলো। বুঝতে পারছিলাম, রাহেলার সেই ভয়টা এখন আবার যেনো নতুন করে তাঁর সামনে জেগে উঠেছে। রাহেলা তাঁর বোরখার একটা আচল দিয়ে মুখটা মুছে নিলো। দেখলাম, রাহেলা একটু একটু ঘেমে গিয়েছে। আমি আমার রুমের এসিটা অন করে দিয়ে বললাম, তারপর?
কাকা, কিভাবে কি হয়ে গেলো আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। লোকটি আমাকে একশত টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বল্লো, শীঘ্রই এখান থেকে এই দরজা দিয়ে বের হয়ে যাও। আমি পাহারায় আছি। এই গোপন দরজাটা দিয়ে আমরা বিপদের সময় পালিয়ে যাই। এটাকে আমরা কোডে বলি- (রেহালা নামটা মনে করতে পারলো না।)
এতো অন্ধকার রাত, তারপর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি, অনিশ্চিত একটা পলায়নে আমি কোথায় যাচ্ছি সেটাও আমি জানি না। এটা কি গরম তেল থেকে লাফিয়ে উনুনে নাকি হাজার ফুট উঁচু পাহাড় থেকে বাচার তাগিদে নীচে পতন আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তারপরেও আমি সেই দরজা দিয়ে বের হয়েই পাগলের মতো ছুটছিলাম। কোথায় ছুটছিলাম, কোনদিকে ছুটছিলাম আমি নিজেও জানি না। অনেক রাত, রাস্তায় বেশী লোক ছিলো না। আধো আলয় ভরা শহরের রাস্তার কিছু লাইট পোষ্ট এমন করে রাস্তাকে আলকিত করেছিলো যেনো সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে কন এক ভুতুরে পল্লির মতো দেখাচ্ছে। এম্নিতেই মনে আকুন্ঠ ভয়, তারমধ্যে অজানা এক দুসচিন্তা, তার উপরে রাতের এতো ভয়ংকর রুপ। কিছু লোকজন এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেখা যাচ্ছিলো বটে কিন্তু যারাই ছিলো তারা আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিলো, হয়তো ওরা ভাবছিলো, এতো রাতে আমি দৌড়াচ্ছি কেনো, বা আমি কি পাগল কিনা, অথবা রাতের কোনো চোর কিনা ইত্যাদি। কে কি ভাবলো, আর কে কিভাবে আমার দিকে তাকালো সে ব্যাপারে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিলো না। আমি শুধু দৌড়াচ্ছিলাম আর দৌড়াচ্ছিলাম। অবশেষে আমি একটা পানবিড়ির দোকানে এসে থামলাম। কয়েকটা উঠতি বয়সের ছেলে ওখানে চা খাচ্ছিলো।
আমি হাপাতে হাপাতে বললাম-
বাবারে আমি খুব বিপদে আছি। আমার স্বামী আমাকে বেড়ানোর নাম করে নিয়ে এসে আমাকে খারাপ জায়গায় বিক্রি করে দিতে এসছিলো। আমি পালিয়ে এসছি। আমার বাড়ি, নগরঘাট (নামটা ছদ্দনাম)। আমি এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, এই জায়গাটা আমি চিনিও না, আর এখান থেকে আমি আমার গ্রামের বাড়ি কিভাবে যাবো, তাও আমার জানা নাই। আমার ছোট ছোট বাচ্চারা হয়তো এখন আমার জন্য কান্নাকাটি করছে। তোমরা আমাকে একটু সাহাজ্য করো বাবারা। আমি ওদের এটাও বললাম, আমার কাছে একশত টাকা আছে। আমাকে সাহাজ্য করো তোমরা।
জানো কাকা, আসলে এই দুনিয়ায় নরপিশাচ যেমন আছে, তেমনি ভালো মানুষও আছে। সেদিন আমি বুঝেছিলাম, মানুষ কি আর নরপিশাচ কি। ছেলেগুলি আমার কথা শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে গিয়ে বল্লো- কে সে, কই সে। চলেন আমরা ওকে এখন ধরবো। আমি বললাম, কিছুই দরকার নাই বাবারা। তোমরা শুধু আমাকে আমার বাচ্চাদের কাছে দিয়ে চলো। আমি তোমাদের মায়ের মতো, আমি আজিবন তোমাদের জন্য আমার সেই পরম ঈশ্বরের কাছে অশ্রুসিক্ত নয়নে দোয়া করবো। আমাকে তোমরা আমার সন্তানের কাছে নিয়ে চলো বাবারা। বলেই আমি দোকানের সামনে ভেজা মাতিতে বসে পড়েছিলাম। আমার পায়ে কন শক্তি ছিলো না, আমার সারা গা বৃষ্টির পানিতে ভিজে গিয়েছিল, আমার দম প্রায় বন্দ হয়ে এসছিলো। তারপরেও আমার হৃৎপিণ্ড সচল ছিলো, আমার প্রানটা জীবিত ছিলো।
ছেলেগুলি আমাকে টেনে তুলে দোকানের ঝাপের ভিতর নিয়ে গেলো। সব সন্তানের চেহাড়া মনে হয় একই। বিশেষ করে মায়েরদের জন্য। ওরা আমাকে এক কাপ গরম চা দিল, মাথা মুছার জন্য কয়েকটা পুরান পেপার দিলো। আমি যেনো একটু স্থির হচ্ছিলাম। ছেলেগুলির মধ্যে দুইজনের দুইটা হুন্ডা (বাইক) ছিলো। চা খাওয়ার পর, ওরা একটা হুন্ডায় আমাকে আর আরেকটা হুন্ডায় ওরা তিনজন উঠে আমার বাসার অতি নিকটে ছেড়ে গেলো। যেখানে ওরা আমাকে ছেড়ে গেলো, সেই জায়গাটা আমি চিনতাম। সেখান থেকে আমি অনায়াসেই আমার বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমি যখন আমার বাড়িতে আসি, তখন রাত বাজে প্রায় আড়াইটা। সব বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেছে শুধু আমার মগা ছেলেটা বারান্দায় বসে আছে। মশার কামড়ে সে জর্জরীত কিন্তু আমাকে না পেয়ে কখন আমি ফিরবো তারজন্যে একাই বাইরের বারান্দায় বসে আছে। বৃষ্টি হচ্ছিলো, ফোটা ফোটা বৃষ্টিতে ছেলেটার সারা শরীরই প্রায় ভেজা। আমি ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাদলাম। আমার ছেলেটা আমাকে এমন করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদতে লাগলো যে, আশেপাশের মানুষগুলি যারা ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো তারাও সজাগ পেয়ে ছুটে এলো। আমি শুধু কাদছি, কিন্তু কেনো কাদছি, কিসের কষ্টে কাদছি, সেটা আর কাউকেই বলতে পারি নাই। কান্নার আহাজারীতে সুর থাকে না, থাকে বেদনা আর কষ্ট যে কষ্টের কোনো নাম নাই, যে কষ্টের রুপ কাউকে দেখানো যায় না। আমি শুধু কেদেই যাচ্ছিলাম। কষ্টটা ছিলো আমার মনের অনেক গভীরে।
অনেকেই অনেক প্রশ্ন করছিলো, এতো রাতে আমি কোথা থেকে এলাম, কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তরও আমার দিতে ইচ্ছে করছিলো না। আমার স্বামী কই, কিংবা সেতো আমার সাথেই সন্ধ্যার দিকে বেরিয়েছিলো, তার হদিস অনেকেই জানতে চাইলেও আমার কোনো কিছুই বলার মতো অবকাশ তো ছিলোই না বলতেও ইচ্ছে করছিলো না। শুধু আমি আমার সেই এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহকে আকাশের দিকে হাত তুলে বললাম- মহান তুমি, তুমি আছো সর্বদা সবার সাথে, দূর্বলের সাথে, অসহায়ের সাথে। আর তুমি সত্যিই সব পারো মাবুদ। কে বলে ঈশ্বর নাই? যে বলে ঈশ্বর নাই, সে বোকা, আর যিনি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন সে জানে ঈশ্বর কোথায় কিভাবে তার হাত প্রসারিত করে। ঈশ্বর বসবাস করেন সর্বত্র। শ্মশানে, আকাশে, পাহাড়ে, জলে অন্তরীক্ষে, আর থাকেন মনের একেবারে অন্তস্থলে। কান্নায় আমার শুধু বুক ভেসে যাচ্ছিলো।
রাহেলার এমন একটা অতীত জীবনের ইতিহাস শুনে আমি হচকচিয়ে উঠেছিলাম। মহিলাদেরকে আমরা দেবীর সমান তুলনা করে থাকি। কখনো কখনো আমরা তাদেরকে মায়ের আসনে বসিয়ে পুজার বেদী রচনা করে থাকি। কিন্তু আফসোস যে, এটা শুধু মন্দির আর পুজার ঘর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। মহিলাদের সাথে লাগাতার অন্যায় আর অপরাধ ঘটে যাওয়া এটাই প্রমান করে যে, আমাদের সমাজে আমরা যে মহিলাদেরকে দেবী বলি তারা এমন অনেক দানব দ্বারা ঘিরে রয়েছে যারা তাদের জীবনকে নরক করে তুলেছে। প্রকাশ্যে কোনো মহিলাকে পুড়িয়ে মারা হয়, নির্যাতন করা হয়, ধর্ষন করা হয় অথচ কেউ এগিয়ে আসে না। এই সমাজে কেনো মানুষের রক্ত ততক্ষন পর্যন্ত গরম হয় না যতক্ষন না অবধি কোনো সমস্যা তাদের ঘরের ভিতরে চলে না আসে। হিন্দু শাস্ত্রে নাকি একটা কথা আছে-ইয়ত্রা নারায়স্ত পুজায়ান্তে রামাতে তাপ্তা দেবতা অর্থাৎ যেখানে নারির পুজো হয়, সেখানে দেবতা বসবাস করে। এটা আসলে শুধু কথার কথা সত্যিটা অন্যকিছু। কোথাও কখনো কোনো নারীর পুজা হয়নি। না হিন্দু শাস্ত্রে, না আমাদের ধর্মে, না অন্য কোথাও।
রেহালা আবারো বলা শুরু করল-
কাকা-সেই সারারাতে আমি একটুও ঘুমাতে পারি নাই ভয়ে। আমার শরীর ভেংগে গিয়েছিলো, অনেক জ্বর এসছিলো, মাথা ব্যথায় আমার মনে হচ্ছিলো মাথাটাই যেনো আমার সাথে নাই। আমার সেই মগা ছেলেটা সারারাত আমার মাথায় পানি ঢেলে আমার মাথা বুলিয়ে দিচ্ছিলো আর খালী একটা কথাই বলে যাচ্ছিলো-মা আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না। তোমাকে ছাড়া আমি ভয় পাই। যতোবার সে আমাকে এই কথাগুলি বলছে, ততোবারই যেনো আমার ভিতরে কে যেনো এক কঠিন হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে আর বলছে- এই স্বাধীনতার মুল্য কি যেখানে খাচায় বন্দি আমি? এই জীবনের কি অর্থ আছে যেখানে আমি কলা, মুলা আর পন্যের মতো অন্যের ইচ্ছায় বিক্রি হয়ে যাই? এই দাম্পত্য জীবনের কি মাহাত্য যেখানে প্রতিদিন আমাকে শুধু অন্যের মন জোগানর জন্য নিজেকে সপে দিতে হয় পিশাচের কাছে? আমার ভিতরে তখন যেনো রাগ, ঘেন্না আর প্রতিশোধের ইচ্ছাতা বেরিয়ে আসছিলো। আমি হিংস্র হয়ে উঠছিলাম।
রাহেলার এই কথাগুলির সাথে আমি একমত ছিলাম। সত্যি তো। গরীব হওয়া পাপ নয়, উচু সপ্ন দেখাও পাপ নয়, বড় হবার চেষ্টা করাও অপরাধ নয়, কিন্তু অন্য কারো জীবনকে এরুপ নষ্টের দিকে ঠেলে দিয়ে কিংবা অন্যের কোনো আত্মসম্ভরনকে বিকিয়ে দিয়ে কিংবা অন্যের জিনিষকে অন্যায়ভাবে নিজের সার্থের জন্য টাকা রোজগার করা চেষ্টা করা একটা অপরাধ। এই অপরাধের একটা খেসারত আছে। কেউ সাথে সাথে পায়, আর কেউ একটু দেরীতে। কিন্তু প্রাপ্যটা আসেই। লাইফটা কোনো ষ্টক মার্কেটের কোনো শেয়ার নয় যে প্রতিদিন এটার দাম উঠানামা করবে। এটা আসলে সেটা যা একবার উঠে গেলে আর পড়ে না, আবার পড়ে গেলে আর উঠে না।
রাহেলা বলতে থাকে তাঁর সেই রাতের বাকী কথাগুলি।
সকালে আমি উঠানে গেলাম, বসে রইলাম কখন আমার সেই নরপিশাচ স্বামী বাড়িতে আসে। সে হয়তো ইতিমধ্যে জেনে গেছে-আমি আর ঐ নারায়নগঞ্জে নাই। পালিয়েছি। কিছুই খেতে পারলাম না সারাদিন। আর খাওয়ার কিছু ছিলোও না। বমি বমি আসছিলো। দুপুরের দিকে একটু শুয়ে ছিলাম। কিন্তু ঘুমিয়ে ছিলাম না। সেই দুপুরের দিকে আমি ওর পায়ের আওয়াজের সাথে মুখের আওয়াজও শুনলাম। সে ঘরে ঢোকেই চোখ লাল লাল করে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করলো আর আমাকে মেরেই ফেলবে এমন হুংকার দিতে থাকলো। বড় বড় বিস্ফোরণের আগে ছোট ছোট ফুলকীর দিকে নজর দিতে নেই। তাতে বড় বিস্ফোরণের জন্য ব্যাঘাত হয়। আমি একটা শব্দও করলাম না, কোনো উত্তরও করলাম না। কোনো এক শক্তিশালী ঝড়ের আগে যেমন আকাশ থম্থমে হয়ে যায়, গাছপালারা স্থির ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, একটা পাতাও নড়ে না, খালী মাঝে মাঝে গুরুম গুরুম কিছু শুষ্ক ঠাটা পরার মতো আওয়াজ ভেসে আসে কোনো এক দূরবর্তী আকাশ থেকে, ঠিক এমন একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো আমার ঘরে সাথে মনের ভিতরেও। আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম এমন একটা সুযোগের জন্য যাতে আমি আমার বাড়ির পুতাটা দিয়ে ওর মাথায় একটা আঘাত করতে পারি। ওর উপর আমার কোনো প্রকার ভালোবাসা নাই, শ্রদ্ধাবোধ নাই। আমি ওকে যেনো আর চিনি না। কোনো এক সময় যে আমি অর বুকে শুয়েছিলাম সেটাও আমার মনে পড়ল না। সে যে আমার সন্তানের বাবা সেটাও আমার কাছে কোনো অর্থ বহন করে নাই। বারবার মনে হয়েছিলো, এদের বেচে থাকার কোনো মানে হয়না। এরা সর্বদা মানুষের শান্তির জন্য হুমকী, সমাজের জন্য হুমকী। পুতাটা আমি রেডিই করেই রেখেছিলাম আগে।
আমার সেই সুযোগটা এক সময় এলো। আমি একটু সময়ও নষ্ট করিনি। একটা আঘাতই আমি ওর মাথায় করেছিলাম। ও অজ্ঞান হয়ে গেলো। একবার ভাবলাম, ওর গলাটা কেটে দেই, আবার ভাবলাম, না, ওকে এমনভাবে মারবো যাতে সারাজীবন আর সোজা হয়ে দাড়াতে না পারে। আমি ইচ্ছে মতো ওর হাটু আর কোমড়ে পুতা দিয়ে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে থেতলা করে দিয়েছিলাম। আমার কোনো দুঃখ হয় নাই।
আমি রাহেলাকে জিজ্ঞেস করলাম, ও কি মরে গিয়েছিলো?
না কাকা- এই পিচাশটাকে আমি প্রানে একেবারে মেরে ফেলতে চাইনি, আর ও মরেও নাই। কিন্তু ও বেচে গিয়েও আর বেচে থাকবে না এটা আমার বিশ্বাস। তার কয়েকদিন পর আমি ওকে তালাক দিয়ে ওখানেই ছেলেদের সাথে রয়ে গেলাম। কিন্তু বাপের বাড়ি ফিরি নাই। সে এখন পংগু। এটাই ওর বিচার। কিসের সমাজ, কিসের আদালত, কিসের হিউমেনিটি? আমার কোনো আফসোস নাই। একা জীবন অনেক ভালো এসব নরপিশাচের সাথে থাকার চেয়ে। ওকে এভাবে মারার কারনে কেউ আমাকে বাধা দেয় নাই। কারন সবাই জানতো ওর ব্যবহার, আর ওর চরিত্র। তার উপরে যখন সবাই জেনেই গিয়েছিলো গতকাল রাতে সে আমার সাথে কি করেছিলো, ফলে কেউ আমাকে একটু বাধাও দেয় নাই, কোনো থানা পুলিশও করে নাই। ওর নিজের ভাইবোনেরাও এগিয়ে আসে নাই। নরপিশাচেরাও অনেক সময় নরপিশাচের জন্য অনুভুতি প্রকাশ করে না। সে একটা নর পিশাচের থেকেও অধম। একটা কথা বলি কাকা- যে যেমন কর্ম করবে, সে তেমন ফল পাবে এটাই আসল কথা। যে বীজ তুমি আজ বুনবে, সেই বীজের ফল তোমাকেই খেতে হবে। আর সেটা যদি কোনো অপরাধের বীজ হয়, তাহলে তা ধীরে ধীরে যে গাছে রুপান্তরীত হয়, তার নাম “প্রতিশোধ”। আর প্রতিশোধের গাছের কোনো না হয় আকার, না হয় ছায়া। রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে যায় তখন তার পরিনতি তো এটাই হয়। আর ওর সেটাই হয়েছে।
আমি স্বাধীন হয়ে গেলাম। আমার আর কোনো পিছুটান রইলো না। আমার পরিবার ভেংগে গেলো। যখন কোনো পরিবার ভাংগে, তার সাথে ভাংগে সবকিছু যা পরিবারকে বেধে রাখে, আর সেগুলি হচ্ছে বিশ্বাস, আদর, আবেগ, মায়া, ভালোবাসা এবং সবকিছু। একটা পরিবার তৈরী করতে অনেক বছর লেগে যায়, পরিবার আমাদের বেচে থাকার কারন হয়ে দাঁড়ায়, যখন ভাংতে শুরু করে পরিবার তখন সেই পরিবারকে আমরা সবচেয়ে বড় শত্রু বলে মনে করতে থাকি। যে পরিবারের আনন্দ আমাদের বাচার রশদ হয়ে উঠে, রাগ এবং প্রতারনার যন্ত্রনা সেই পরিবারকে আঘাত দিতেই বাধ্য করে তোলে। মানুষ যখন আপনজনকেই ঘৃণা করতে থাকে। আমার সেই স্বামীর বাড়ির প্রতিটি মানুষকে আর কখনো আপন মনে করতে পারিনি। শুধু আমার সন্তানদের ছাড়া।
অপমান আর অবসাদে অবনত হয়ে একদিন আমি আমার স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করে বাপের বাড়িতে এসে পড়ি। আমার বাবা মা বিয়ের আগে যে পরিমান কাছের ছিলো, স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসার পর তাদেরকে আর আমি ততোটা কাছে পেয়েছি বলে মনে হলো না। আমি তাদেরকেও এ ব্যাপারে খুব একটা দোষারুপ করি না। তারাও দরিদ্র, আমিও। আমরা হয়তো একই বৃন্তে ঝুলে ছিলাম। সময়ের স্রোত ধরে এক সময় বুঝতে পারলাম, আমাকে একাই চলতে হবে। এখন একাই থাকি, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, নামাজ পড়ি, কোরআন পড়ি, তসবিহ গুনি আর ভাবি, জীবন বড় রহস্যময়। হয়তো আমি আজ থাকতাম এমন এক জীবনে বন্ধী যেখানে মানুষ আর মানুষ থাকে না।
ঠিক ওই সময়ে কাকা আপনি গ্রামে গিয়েছিলেন শুনেছিলাম। একবার ভেবেছিলাম, আপনার সাথে একবার দেখা করি, আবার ভাবলাম, আপনি কি না কি ভাবেন কে জানে। লজ্জা এমন এক জিনিষ, যাকে না লুকানো যায়, না কাউকে বুঝানো যায়। ভিতরটা কেউ দেখে না যদিও সত্যিটা ভিতরেই থাকে। একটা কথা আছে না কাকা- আয়নায় চেহারা দেখা যায় কিন্তু কষ্ট দেখা যায় না। কিন্তু আমি আমার ভিতরের এই কষ্টটা কাউকেই বুঝাতে পারিনি। না আমার বাবাকে, না আমার মাকে, না আমার আশেপাশের কাউকে। কিন্তু ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া কোনো ব্যক্তিত্ত বেশীদিন অসহায় থাকে না। আমি যতটুকুই লেখাপড়া করেছিলাম, সেটা দিয়েই কিছু করার চেষ্টা করছিলাম, বিশেষ করে ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ানো। কিন্তু খুব একটা এগুতে পারিনি। পরে একটা সেলাই মেশিন নিয়ে মাঝে মাঝে বাচ্চাদের কিছু কাপড় বানিয়ে নিজের সন্তানের ভরন পোষনের চেষ্টা করেছি। প্রায় এক যুগ পার হয়ে গেছে। আমার মগা ছেলেটা এখনো বিয়ে করে নাই। ভারায় গাড়ী চালায়, যা রোজগার করে তা দিয়াই আমাদের সংসার কোন রকমে চলে যায়।
এতোক্ষন ধরে আমি রেহালার সবগুলি কথা খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম। ওর কথার রেশ ধরে আমার সারা শরীর কখনো শিহরিত হয়ে উঠিছিলো, কখনো ভয়ে আবার কখনো রেহালার স্বামীর এহেনো পৈচাশিক কাজের উপর রাগে। সমুদ্রে ভাসমান কোনো নাবিকের কাছে দূরের কোনো তটভুমি যেমন একটা আকর্ষনের বিষয় হয়ে দাড়ায়, রেহালার জীবনে তেমন কোনো কিছুর উপর আকর্ষন আর বাকী আছে বলে আমার মনে হলো না। রেহালা আমার সম্মুক্ষে বসে আমার বিস্তর প্রকান্ড কাচের জানালা দিয়া দূরের নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে বটে কিন্তু ওই নীল শান্ত আকাশের মতো রেহালার অন্তরে তেমন হয়তো শান্তির নীরবতা বিরাজ করছে না। হয়তো ওর মাথা, বুক আর অন্তর একসাথে এমন এক ঘূর্নীঝড়ের মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছিল যার আভাষ ওর চোখের নোনাজলেই বুঝা যাচ্ছে। আমি রেহালাকে আর কোন প্রশ্ন করলাম না। কিছুক্ষন পর রেহালা একটু শান্ত হলে আবার বলতে শুরু করলো-
কাকা-এখন অনেক বয়স হয়ে গেছে। আমার সারা শরীর যেনো রোগের একটা আবাসভুমিতে তৈরী হয়েছে। ডায়াবেটিস, প্রেসার, কানের, চোখের, হার্টে কোনো রোগের যেনো কমতি নাই। মগা ছেলেটা যা কামায়, তাতে হয়তো আমাদের দুজনের খাবার জুটে যায় কিন্তু আমার এই বাড়তি রোগের খরচ, কিংবা পর্বনের কোনো ব্যয়ভার চলে না। রোগটাকে এখন আমার নিত্যসংগী মনে করে কখনো সেই ঈশ্বরের কাছে রোগ মুক্তির দোয়া করি, আর যদি অতিরিক্ত খারাপের দিকে যাই, তখন এই আমার বোনেরা, কিংবা পাড়াপ্রতিবেশীরা হয়তো কিছু দান করে, তাঁর থেকেই কিছু পথ্য কিনে খাই। আগুনের ফুলকী যেমন কীট পতঙ্গকে দূরের আকাশের নক্ষত্র রাজীর লোভ দেখিয়ে আকর্ষন করে, অতঃপর তারা মৃত্যুবরন করে, আমি এখন অদৃশ্য ঈশ্বরের কাছে একটাই প্রার্থনা করি যেনো মরনের লোভ দেখিয়ে ঈশ্বর আমাকে দ্রুত এই জীবনের যবনীপাত করান। সেই ছোটবেলায় কত স্বপ্ন দেখেছি সংসার হবে, স্বপ্ন দেখেছি স্বামীর বুকে মাথা রেখে কত গান শুনাবো, বাচ্চাদের কলকাকলীতে আমার উঠোন ভরে উঠবে আরো কতকি? অথচ আজ শুধু এইটুকুই মনে হয়, জীবন বড্ড জটিল। এখন শুধু মৃত্যুর ক্ষন ছাড়া আমার যেনো কোনো কিছুর জন্যই আর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নাই। গভীর রাতে একা ঘুমহীন বিছানায় বসে মাঝে মাঝে জীবনের হিসাব মিলাতে চেষ্টা করি, আখাংকা আর কল্পনার রাজ্যে কত মায়াজাল তৈরী করিয়া কত মায়াপুরীর হিসাব করেছিলাম, কিন্তু আজ প্রায়ই মনে হয় যে, আমার জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত, জীবন যৌবন, সুখ দুঃখ, একাল সেকাল সবকিছুই মোমবাতির মতো পুড়িয়া শেষ প্রান্তে এসে হাজির হয়েছে। আমার এই ক্লান্তি, কষ্ট, গ্লানি কিংবা প্রানক্ষয়কর দাহ হয়তো আর বেশিদিন থাকবে না।
আমি রেহালার সাথে আর অনেক কথা বাড়াই না। আমি যাহা বুঝবার সব বুঝে গিয়েছিলাম। শুধু বারবার একটা কথাই ভাবতেছিলাম, আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে আমি আর রেহালা একসাথে একই স্কুলে পড়াশুনা করেছি। তখন রেহালা যে স্বপ্ন দেখেছিলো, তার ভবিষ্যৎ জীবনের, তার সংসার জীবনের, আজ এতো বছর পর এসে রেহালা দেখতে পেলো তার সেই সপ্নগুলি আসলে সব সপ্নই থেকে গেছে। খুব কষ্ট লাগতেছিলো আমার। আমাদের এই সমাজ, আমাদের নীতি নির্ধারকেরা আজো প্রতিটা মেয়েকে বোঝাই মনে করে। সবাই মনে করে-তাদের লেখাপড়ার দরকার নাই, তাদের প্রেমের কোনো মুল্য নাই, তাদের বাকস্বাধীনতা নাই, তাদের নিজস্ব কোনো পছন্দ অপছন্দও নাই। ওরা জন্মায় শুধু কাউকে নিজের অনিচ্ছায়ই হোক আর সেচ্ছাতেই হোক বিয়ে করা। আর সেই বিয়ে টিকার দায়িত্ব শুধু তাদের। ওরা জামাইয়ের মার খাবে, স্বামীরা ওদেরকে নিজের থালা-কলসীর মতো কিছুদিন ব্যবহার করে আবার অন্য কোথাও বিক্রি করে দিবে। অথবা কোনো দায়িত্ব না নিয়াই অন্য আরেকজনের সাথে ফষ্টিনষ্টি কিংবা ঘর করবে। আর মাঝখানের সময়টায় ওরা বছর বছর বাচ্চার জন্ম দিবে। এটাই যেনো ওদের একমাত্র কাজ। রেহালা আমার সামনে বসে আছে বটে কিন্তু ওর দৃষ্টি আমার জানালার বাইরে অনেক দূরের আকাশে। তার মনে কি চলতেছে আমি জানি না, তবে সেই দূরের আকাশে কোনো নতুন স্বপ্ন যে নাই, সেটা স্পষ্ট বুঝা যায়। সে তার এই জীবনের সুখ কিংবা আদর আর প্রত্যাশা করে না। শুধু সময় গুনছে কবে মৃত্যু তাকে লইয়া যাবে। আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই, আমরা আজীবন বাচতে চাই, কেউ এই দুনিয়া ছেড়ে মৃত্যুর মতো একটা অজানা জীবনে যেতে চায় না। অথচ রেহালার ভাষায়, সে প্রতিদিন নামাজ পড়ে সেই স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে যেনো মৃত্যু এসে রেহালাকে নিয়ে যায়।
অনেকক্ষন আমার অফিসে একটা নীরবতা চলছিলো। রেহালার জীবনের কাহিনী বলবার পর যেন সে নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার ভাবনা ভুল প্রমান করে রেহালা আবারো বলিতে থাকে-
-কাকা, আজ অনেক কষ্টের কথা আপনাকে বলতে পেরে নিজেকে অনেক অনেক হালকা মনে হচ্ছে। আমি জানি না, কেনো আমাদের মতো মানুষের এই পৃথিবীতে জন্ম হয়। মা হিসাবে আমরা যেমন অসফল, স্ত্রী হিসাবেও তেমনি অসফল। এই সমাজ আমাদেরকে না কখনো মুল্যায়ন করে, না নিজের ঘরের পিতা মাতা আমাদেরকে বুকে আগলে ধরে রাখে। আমরা যেনো সমাজের সেই প্রানিগুলির মতো, যারা একবার জন্ম নিয়াছে বলে শুধু মৃত্যু না আসা অবধি দেহত্যাগ করে না আবার নিজেরাও নিজেকে শেষ করতে পারে না কারন আত্তহত্যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। অথচ দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অবহেলায় কচূরীপানার মতো আমরা এককুল হতে আরেককূলে শুধু ভেসেই যাই, না কেউ আমাদেরকে তুতুলে নেয়, না কেউ আশ্রয় দেয়। তারপরেও আমরা বেচে থাকি। এখন সত্যিই আর বাচতে ইচ্ছা করে না। আজ আপনার সাথে দেখা হলো-মনটা বড় ভালো লাগলো। মনেই হয় না এর মধ্যে ৪০ বছর পার করে দিয়েছি। মনে হচ্ছে, এই তো সেদিনের কথা। সেই শীতের দিনে জড়োসড়ো হয়ে গায়ের পথ ধরে হেটে বেড়াইতাম, স্কুলে গিয়া একসাথে কত মজা করতাম, বৃষ্টির দিনে ভিজতাম, আজ মনে হয়-আহা যদি আরো একবার আবার সেই পুরান দিনে ফিরে যেতে পারতাম। আহা যদি এই পিশাচের মতো কেউ আমার জীবনে না আসতো, আহা-যদি এমন কেউ আসতো যে আমার সেই গানগুলি শুনে শুনে পাশে বসে হাততালি দিতো। আসলে জীবন মনে হয় এমনই, আবার কেনো জানি মনে হয়, সব জীবন এমন নয়। তাহলে আমাদের জীবন এমন কেনো?
আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। শুধু রেহালাকে বললাম, পৃথিবীটা এমন নয় যা দেখছিস। এই পৃথিবী অনেক অনেক সুন্দর। হয়তো ভুল সময় ভুল মানুষের পাশে গিয়ে ভুলভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছিলি। আর সেই ভুল মানুষটাই তোকে ভুল পথের দিকে তোর নিজের অজান্তে নিয়ে গিয়েছিলো। ভুলে যা সব। বললাম, আজ থেকে বহু বছর আগের আমার গ্রামের একমাত্র মেয়ে খেলার সাথী তুই। তোকে দেখেও আমি অনেক খুশি হয়েছি রেহালা। আসিস যখন মন খারাপ হয়, যখন কোনো রাস্তা না দেখা যায়। আমি তোর কাকাই বলিস আর বন্ধুই বলিস, আসিস। রেহালা তার শাড়ির আচলটা টেনে চোখ দুটি মুছে বের হবার উপক্রম হলো। যাওয়ার সময় হটাতই রেহালা আমার পায়ে সালাম করার জন্য উদ্যত হলে আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তুই আমার শুধু বন্ধু না রেহালা, তুই আমার বোনও। আমার কি হলো জানি না, আমার চোখটাও কেনো জানি ঝাপ্সা হয়ে গেলো।
রেহালা তার চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে গেলো। আমি শুধু ওর যাওয়াটা দেখলাম। আর ভাবিলাম,
প্রতিটা মেয়ে মানুষের উচিত নিজের পায়ের উপর দাঁড়ানো। যতোদিন তারা নিজেরা সাবলম্বি না হবে, তারা আজীবন ভুল সময়ে ভুল মানুষের কাছেই হস্তান্তর হতে থাকবে। হয়তো কতিপয় কিছু অধীক ভাগ্যবান মেয়েরা ছাড়া যাদের সংখ্যা অতীব নগন্য। দোয়া করি-রেহালারা ভালো থাকুক। আর দুঃখ হয় সেইসব বাবা মায়ের জন্য যারা নিজের মেয়ে সন্তানকে তাদের ছেলে সন্তানের মতো একই সাড়িতে ভাবেননা। অথচ দুটাই তাদের সন্তান। কে জানে, সেই বাবা মায়েরও কোনো একদিন এমন এক পরিস্থিতিতে পড়তে হয় যখন এইসব মেয়েদের ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার পথ খোলা হয়তো থাকবে না।
আমি রাহেলার জন্য একটা টাকা প্রতিমাসের জন্য বরাদ্ধ করলাম যাতে অন্তত রাহেলা তার ঔষধগুলি কিনে খেতে পারে। রাহেলার জন্য হয়তো এটা একটা অনেক বড় সাহাজ্য হবে। রাহেলা এখন প্রায় প্রতিমাসেই আমার একাউন্ট অফিসারের কাছ হতে সেই টাকাটা নিতে আসে। কখনো ওর সাথে আমার দেখা হয়, কখনো দেখা হয় না। তারপরেও আমি শান্তি পাই যে, রেহালারা এখনো বেচে আছে।
রেহালার স্বামী এখন পুরুই পংগু। কোনো রকমে ভিক্ষা করে জীবন চালায়। তার পাশে এখন আর কোনো রেহালারা নাই, না আছে তার কোনো মগা সন্তান।
১২/০৮/২০২১-মেধাপাচার নাকি মেধাবিদায়?
উচ্ছিষ্ট সময়ের রাজত্ব
আগষ্ট
১২
গতকাল আমার ছোট মেয়েকে বিদায় জানাতে গিয়েছিলাম এয়ারপোর্টে। কভিডের কারনে এয়ারপোর্টে ঢোকা প্রায় নিষিদ্ধের মতো কিন্তু মেয়ে একা যাচ্ছে, অনেক দূর, ভয় পাচ্ছিলাম, ফলে যেভাবেই হোক পুরু পরিবারের জন্য প্রায় বেশ অনেকগুলি"পাস" জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমি ওইসব বন্ধু আর সহযোগীদেরকে আন্তরীক ধন্যবাদ জানাই যারা আমাকে আর আমার পরিবারকে এয়ারপোর্টে প্রবেশের জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন।
এয়ারপোর্টে যাওয়ার পর আমি যে জিনিষটা খুবই খেয়াল করলাম হলো, প্রায় ৮০% পেসেঞ্জারদের বয়স ১৬ থেকে ২২ এর মধ্যে। খুব কম লোক দেখেছি যারা একটু বয়স্ক। আমি কয়েকজন ইয়াং পেসেঞ্জারের সাথে খুব নিরিবিলি কথা বলেছি- তাদের প্রত্যেকেই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, কেউ চাকুরী নিয়ে, কেউ স্কলারশীপ নিয়ে কোনো ইউনিভার্সিটিতে, কেউ আবার ১০০% স্কলারশীপে, কেউ আবার নিজেদের খরচে। তাদের সবার ভাষ্যই যেনো একটা- ভয়ংকর দিন সামনে আমাদের জন্য। এ দেশে কোনো ভবিষ্যৎ নাই। এর থেকে যে কোনো ভিন্ন দেশে অন্তত কিছু একটা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে। তাই আগেই চলে যাচ্ছি।
ব্যাপারটা আতংকের। দেশ কি তাহলে মেধাশুন্য হয়ে যাচ্ছে? কারা আমাদের ভবিষ্যৎ তাহলে? যারা এদেরকে পাবে, তারা কি লোড নিচ্ছে নাকি আমরা এদেরকে ছেড়ে দিয়ে লোডমুক্ত হচ্ছি? যারা ওদেরকে সুযোগ দিয়ে এই করোনাকালেও নিয়ে যাচ্ছে, তাদের কি মনে হয় এরা তাদের দেশের জন্য বাড়িতি লোড নিচ্ছে আর আমরা মনে করছি, যাক হাফ ছেড়ে বাচা গেলো!!
আজ টিভির একটা টক শোতে দেখলাম, ৯৬% ছেলেমেয়েরা দেশের ভিতর অনিশ্চয়তার কারনে দেশ ছাড়ছে। আসলেই একটা ভয়ানক ভাববার বিষয়।
১১/০৮/২০২১-রক্তক্ষরন
উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব
আগষ্ট
১১
শরীরের কোনো কাটাছেড়া, কোনো বাহ্যিক জখম চোখে দেখা যায়, ক্ষুধা হলে খাবারের অভাবে পেট গুর গুর করে, কিংবা জ্বর সর্দি, কাশি কিংবা মাথা ব্যথা হলে তার সিম্পটম অনায়াসেই বুঝা যায় কিন্তু অন্তরের জখম কি কখনো চোখে পড়ে? অন্তরে কি কখনো জখম হয় আদৌ? আর এই অন্তরটাই বা শরীরের কোন অংগ? এটা কি এমন কোনো জিনিষ যা মাংশ বা হাড় কিংবা এমন কিছু দিয়ে এর গঠন কাঠামো?
সমস্তটা হৃদপিণ্ড তার স্টকে থাকা রক্ত যখন শরীরের সর্বত্র তার নিয়মের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় সেটাকে বলে সুস্থ্যতা। কিন্তু সেই একই রক্ত যখন তার নিয়মের বাইরে গিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সেটাকে হয়তো বলে দূর্ঘটনা। কিন্তু একই ধমনী, একই শিরায় যখন সেই একই রক্ত একই নিয়মে প্রবাহ হয়, তারপরেও মনে হয় কোথায় যেনো একটা ক্ষরন হচ্ছে, তাহলে এটাকে কি বলে? হয়তো সাহিত্যিকরা বলবেন- এটাকে বলে কষ্ট, এটা হয়তো বেদনা কিংবা হয়তো কেউ বলবেন এটা একটা খারাপ অনুভুতি। তাহলে এই রক্তক্ষরন হয় কোথায়? শিরায়? ধমনীতে? শরীরের কোনো অংগে? আর এই ক্ষরণ হলে কি হয়? আসলে রক্তক্ষরনটা হয় অনুভুতির ভিতরে, ওই সেই অন্তরে যার উপস্থিতি আজো কেউ খুজে পায়নি, বা হাত দিয়ে ধরে দেখেনি। একেবারে ভিতরে, অদৃশ্য। অথচ অনুভুতির এই ভিতরটা কেউ দেখে না। বাইরের চোখে যা দেখা যায়, সেটা ভিতরের অবস্থা না। সত্যটা সবসময় থাকে ভিতরে। আর এই সত্যকে মানুষের কোনো অংগ, না তার হাত, না তার পা, না তার শরীর প্রকাশ করে। এই অদেখা রক্তক্ষরনে হাত অবশ হয়ে যায় না, পা নিস্তব্ধ হয়ে উঠেনা বা কান বধির হয় না। শুধু চোখ সেটাকে লুকাতে পারে না বলে অনবরত সেই নোনা জল দিয়েই হয়তো বলতে থাকে, কোথাও কিছু জ্বলছে, কোথাও কিছু পুড়ছে, কোথাও কিছু ক্ষরন হচ্ছে। না ঠান্দা জল, না কোনো বেদনানাশক ঔষধ না কোনো থেরাপি এই ক্ষরনকে থামাতে পারে। কিন্তু যার চোখ নাই, তারও কি এই ক্ষরন হয়? হ্যা, হয়। তারও এই রক্তক্ষরন হয়। হয়তো তার ভাষা একটু ভিন্ন, স্থিরচিত্তে ক্রয়াগত নীরবতা। তাহলে এই রক্তক্ষরনের সময়কালটা কত? বা কখন এর জন্ম আর কখন তার ইতি? বলা বড্ড মুষ্কিল।
যখন কোনো মানুষ কিছুই না বলে সে তার পরিবার থেকে হটাত করে উধাও হয়ে যায়, তখন ব্যাপারটা অনেক দুসচিন্তার কারন হয়ে দাঁড়ায়। এটা আরো বেশী করে দুশ্চিন্তায় ভোগায় যখন এটা জানা যায় যে, যে মানুষটি চলে গেছে সে সবদিক থেকে অশান্তিতেই ছিলো। এমন অবস্থায় এমনটাই বারবার মনে প্রশ্ন আসে, যে, জীবনের কাছে হেরে যাওয়া মানুষটি আবার মনের কষ্টে কোনো ভুল পদক্ষেপ না নিয়ে বসে। শুরু হয় রক্ত ক্ষরনের প্রক্রিয়া। এই ক্ষরণ অজানা আতংকের।
আবার যখন কোনো মানুষ সবার সামনে থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে চিরতরে ভিন্ন জগতে চলে যায়, তখন দুসচিন্তার প্রকারটা হয়তো অন্য রকমের কিন্তু তারপরেও রক্তক্ষরন হয়। আর সেই ক্ষরণ কখনো ভরষার অভাবের অনুভুতি কিংবা মাথার উপরে থাকা কোনো বট বৃক্ষের অথবা কখনো এটা হয় নিঃসঙ্গতার।
কিন্তু জেনে শুনে, প্রকাশ্যে সবার সামনে দিয়ে যখন বড় কোনো সাফল্যের উদ্দেশ্যে নিজের অতীব প্রিয়জন জীবন্ত চলে যায়, হাসিখুশির অন্তরালে তখন যেনো চলতে থাকে মেঘ-বৃষ্টির খেলা। চলতে থাকে দোদুল্যমান এক অনুভুতি। হাসিখুশি চোখের পাতায়ও তখন দেখা যায় সেই রক্তক্ষরনের এক বেদনাময় কষ্টের অনুভুতি। এই রক্তক্ষরনের প্রধান কারন হয়তো শুন্যতা। তখন যেদিকে তাকাবেন, দেখবেন, সব কিছু ঠিক আগের মতোই আছে, শুধু নাই সেখানে যে বিচরন করতো সেই মানুষটা। তার ঘরের দিকে তাকালে মনে হয়, ওই তো মানুষতা গতকাল ও ওখানে বসেছিল, ওই যে কাপড় টা বাতাসে ঝুলছে, সেটা এখনো সেখানেই ঝুলছে, অথচ সেই মানুষতা আজ ঠিক ওইখানে নাই। আছে অন্য কোথাও, চোখের দৃষ্টির অনেক বাইরে। আর এই দোদুল্যমান অনুভুতি নিয়েই আমি বিদায় জানাতে এসেছি আমার অতীব আদরের ছোট মেয়েকে আজ। বুঝতে পারছি, কোথায় যেনো পূরছে আমার অন্তর, কোথায় যেনো জ্বলছে আমার অনুভুতির সমস্ত স্নায়ুগুলি।
আমি যুদ্ধ দেখেছি, যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছি, আগুনে পূড়ে যাওয়া নগরী দেখেছি, ঘনকালো নির্জন রাতে কোনো পাহাড়ি রাস্তা ধরে একা একা হেটে পার হয়েছি। ভয় আমাকে কাবু করেনি। অথচ আজকে আমি এই শান্ত সুষ্ঠ পরিবেশে নির্মল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে যখন আমার ছোট মেয়েকে সুদুর আমেরিকায় যাওয়ার প্রাক্কালে বিদায় জানাচ্ছি, তখন সারাক্ষন রক্তক্ষরনের পাশাপাশি একটা ভয়, একটা আতংক, একটা শুন্যতার অনুভুতিতে ভোগছি। কেনো জানি মনে হয়, আমার ভয় লাগছে। অথচ আমার শরীর সুস্থ্য, আমার ক্ষুধা নাই, তারপরেও কেনো জানি মনে হচ্ছে- কি যেনো আমি ভালো নাই।
আমার মেয়েটা চলে গেলো আজ। বায়না ধরেছিলো-আমেরিকা ছাড়া সে আর কোথাও পড়াশুনা করবে না। সন্তানরা যখন বায়না করে, জেদ ধরে, তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মা বাবা সেটাকে পুর্ন করার জন্য দায়িত্ত পালন করেন। আমিও সেই বায়নাটা হয়তো পুরন করছি আজ। কিন্তু সেই জিদ বা বায়না আদৌ ঠিক কিনা বা বায়নাটা আদৌ যুক্তিযুক্ত কিনা অনেক ক্ষেত্রে আমরা মা বাবা সেটা বিচার করি না। সন্তান কষ্টে থাকুক বা দুঃখ নিয়ে বড় হোক অথবা তার নির্দিষ্ট পথ থেকে হারিয়ে যাক, তাতে মা বাবা এক মুহুর্ত পর্যন্তও শান্তিতে থাকে না। মা বাবা সবসময় তার সন্তানদেরকে সবচেয়ে ভালোটাই দেয়ার স্বপ্ন দেখে। আসলে সন্তান যতো বড়ই হোক আর বৃদ্ধ, মা বাবার ভুমিকা থেকে আজ অবধি কোনো মা বাবা অবসর গ্রহন করেন নাই। কিন্তু তাদেরও কিছু আশা থাকে, স্বপ্ন থাকে এই সন্তানদের কাছে। আমরা বাবা মায়েরা সন্তানদের কাধে শুধু স্কুল ব্যাগ নয়, বরং মা বাবার অনেক আশা ইচ্ছাও ঝুলিয়ে দেই। হয়তো এটাও সেই রকমের একটা বায়না থেকে আমার দায়িত্ব পালনের পর্ব যেখানে একটা সফল, উজ্জ্বল আর সুরক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য আমি অন্তরের রক্তক্ষরনের মতো বেদনাটাও ধারন করছি। আমি জানি, সব সাফল্যের একটা মুল্য থাকে যেটা কাছের মানুষকেই জোগাতে হয়। আর হয়তো এটা সেটাই।
তবে একটা কথা ঠিক যে, আজকের এই অদেখা কষ্টের রক্তক্ষরনের ইতি বা যবনিকা হয় তখন যখন যে মানুষটির জন্য রক্তক্ষরনের জন্ম, সে যখন জীবনের পাহাড় বেয়ে জয় করে সামনে দাঁড়ায়। তখন আজকের দিনের রক্তক্ষরনের সাথে মিশ্রিত হাসিটায় শুধু ভেসে থাকে হাসিটাই। যেমন পানি আর তেলের মিশ্রনে শুধু ভেসে থাকে পানির চেয়ে দামী সেই তেল। তখনো এই চোখ জলে ভিজে উঠে হয়তো কিন্তু তখন চোখ এটা জানান দেয় না, কোথায় যেনো কি পূরছে, কি যেনো জ্বলছে বরং প্রতিটি উচ্ছল হাসিতে ভরে উঠে আনন্দ ধারা।
আমি সেই প্রত্যাশা নিয়েই আজকের এই রক্তক্ষরনের অধ্যায় যাকে আমি যেই নামেই ডাকি না কেনো, বেদনা, শুন্যতা কিংবা আতংক তা শুধু নীরবে মেনে নিয়েই রক্ত ক্ষরনের সেই পোড়া যন্ত্রনাকে বরন করছি। তোমরা সব সময় ঈশ্বরকে মনে রেখো, নীতির পথে থেকে আর মানবতার থেকে বড় কোনো সম্পদ নাই এটা জেনে সর্বদা সেই মানবিক গুনেই যেনো থাকো, এই দোয়া রইলো।
শরতচন্দ্রের সেই বিখ্যাত উক্তিটাই আজ তোমাদেরকে বলি- ভালোবাসা শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়। ‘যেতে নাহি দিবো’ মন বল্লেও বাধা দেয়ার কোনো শক্তি তখন থাকে না, না বাধা দিতে কোনো পথ আগলে রাখি, বরং মনের ভিতরের ‘যেতে নাহি দেবো জেনেও যাওয়ার সব পথ খুলে দেই সেই সাফল্যের জন্য, যা আমার চোখের মনির ভিতরে খেলা করে সারাক্ষন।
Protected: ০৯/০৮/২০২১-পরিকল্পনার ডেবিট-ক্রেডিট
You are required to login to view this post or page.
০৮/০৮/২০২১-সন্ধ্যা ৮ টা ৩২ মিনিট
উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব
আগষ্ট
৮
খুব ভালো একটা খবর পেলাম আজ। আমার বন্ধু উইং কমান্ডার মাসুদকে বলেছিলাম, যেভাবেই হোক এয়ারপোর্টের জন্য আমাকে যেনো কয়েকটা ‘পাশ’ এর বন্দোবস্ত করে দেয়। কভিডের কারনে প্যাসেঞ্জার ছাড়া অন্য কোনো দর্শ্নার্থীকে এয়ারপোর্টের ভিতরে প্রবেশ করতেই দেয় না। কনিকার সাথে যাওয়ার জন্যে আমরা অনেকভাবে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ইউএস এম্বেসী সব ধরনের ভিসা (শুধু মাত্র স্টুডেন্ট ভিসা ছাড়া) বন্ধ রেখেছে, ফলে আমরা কনিকার সাথে যেতে পারছি না। এদিকে আবার কভিডের কারনে এয়ারপোর্টের ভিতরেও প্রবেশের সুযোগ নাই। যাক, শেষ পর্যন্ত আজকে আমার দোস্ত মাসুদ আমাকে ফোন করে জানালো যে, এভিয়েশনের সিকিউরিটি ডাইরেক্টর আরেক উইং কমান্ডার আজমকে বলা আছে সে আমাদের জন্য ‘পাশ’ এর ব্যবস্থা করবে। আজমের সাথে কথা বললাম, আজম খুব সমীহ করেই জানালো যে, আগামী ১০ তারিখের রাত ৯ টায় যেনো আমি ওকে ফোন দিয়ে একটা কন্ট্যাক্ট নাম্বার সংগ্রহ করি যে কিনা আমাদেরকে এয়ারপোর্টে প্রবেশের সুযোগ করে দেবে। এই মুহুর্তে এর থেকে আর ভালো খবর আমার কাছে কিছুই নাই। খুব ভালো লাগলো যে, কনিকাকে আমি আর আমার স্ত্রী (উম্মিকাসহ) এয়ারপোর্টে সি-অফ করতে পারবো, ওর লাগেজ পত্রগুলি ঠিকমতো বুকিং করে ইমিগ্রেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারবো। মেয়েটা আমেরিকায় চলে যাচ্ছে ৫ বছরের জন্য, পড়াশুনার খাতিরে। ইউএমবিসি (ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ড বাল্টিমোর কাউন্টি) তে যাচ্ছে।
আমার মনে পড়ছে যে, আজ থেকে প্রায় ৩৮ বছর আগেও আমার ভর্তি হয়েছিলো কার্স্কভাইল ইউনিভার্সিটিতে যেখানে আমার বড় ভাই ডঃ হাবীবুল্লাহ চেয়েছিলেন আমি আমেরিকায় গিয়ে পড়াশুনা করি। কিন্তু যে কোনো কারনে হোক, আমার আর যাওয়া হয় নাই, আমি চলে গিয়েছিলাম আর্মিতে। আমার যে আমেরিকায় যাওয়া হয় নাই এটা বল্বো না, আমি তারপরে ১৯৯৫/৯৬ সালে হাইতির জাতিসঙ্ঘ মিশন থেকে একমাসের জন্য আমেরিকায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। তারপরে পর পর দুবার ভিসা পেয়েছিলাম মোট ৬ বছরের জন্য কিন্তু আমাকে আমেরিকা টানে নাই। আগামী ১১ তারিখে আমার ছোট মেয়ে চলে যাচ্ছে সেই সুদুর আমেরিকায়। একটু খারাপ লাগছে কিন্তু সন্তানদের সাফল্যের জন্য তাদেরকে ঘর থেকে ছেড়েই দিতে হয়, এটাই নিয়ম।
কনিকা যাতে কোনো প্রকারের আর্থিক সমস্যায় না থাকে সেজন্য আমি অগ্রিম ওর এক বছরে সমস্ত খরচ (বাড়ি ভাড়া, খাওয়া দাওয়ার খরচ, ইউনিভার্সিটির টিউশন ফি, হাত খরচ, যাতায়ত খরচ, ইন্স্যুরেন্স খরচ ইত্যাদি মিলিয়ে ৩৫ হাজার ডলার দিয়ে দিলাম যাতে আমিও আর এই এক বছর ওকে নিয়ে চিন্তা করতে না হয়। সাথে সিটি ব্যাংকের একটা এমেক্স কার্ড ও দিয়ে দিচ্ছি ২ হাজার ডলারের মতো যাতে খুবই জরুরী সময়ে সে এটা খরচ করতে পারে। আগামীকাল কনিকার কভিড-১৯ টেষ্ট করাতে হবে। ফ্লাইটে উঠার ৪৮ ঘন্টা আগে কভিড টেষ্ট করে ফ্লাইটে উঠতে হয়। পজিটিভ এলে ফ্লাই করতে পারবে না। দোয়া করছি, আল্লাহ যেনো সব কিছু সহী সালামতে এটাও ইনশাল্লাহ নেগেটিভ করে দেন।
বড় মেয়েকেও ইন্সিস্ট করছি সে যেনো কনিকার মতো দেশের বাইরে (পারলে একই ইউনিভার্সিটি, ইউএমবিসি) আমেরিকায় চলে যায়। কিন্তু কোথায় যেনো উম্মিকার একটা পিছুটান অনুভব করছি। তার শখ লন্ডনে যাওয়া। যদি তাও হয়, তাতেও আমি রাজী। ওরা ভালো থাকুক, সেটাই আমি চাই।
আমি জানি একটা সময় আসবে, আমি আসলেই একা হয়ে যাবো। এমন কি আমি মিটুলকেও ধরে রাখতে পারবো কিনা জানি না। কারন যখন দুই মেয়ে দেশের বাইরে থাকবে, আমার ধারনা, মিতুলও প্রায়ই দেশের বাইরে থাকবে তার মেয়েদের সাথে। যদি দুইটা আলাদা আলাদা দেশ হয়, তাতে ওর বাইরে থাকার সময়টা বেড়ে যাবে, আর যদি একই দেশে হয়, তাহলে এক ছুটিতেই দুই মেয়ের সাথে হয়তো সময়টা কাটাবে। আমি ব্যবসা করি, আমাকে দেশেই থাকতে হবে, আর আমি দেশে থাকতেই বেশী পছন্দ করি।
বাকীটা আল্লাহ জানেন।
স্পেসাল নোটঃ
যে মানুষগুলি ১১ আগষ্ট ২০২১ তারিখে এয়ারপোর্টের ভিতরে আমাদেরকে এন্টারটেইনমেন্ট করেছে তারা হচ্ছেন- সার্জেন্ট জুলহাস এবং সার্জেন্ট রাসেল। আমরা সবাই ঢুকতে পেরেছিলাম আর ওরাই আমার মেয়ের জন্য সব ব্যবস্থা করে দিলো একেবারে প্লেন পর্যন্ত। রাসেল আর জুলহাসকে ধন্যবাদ দেয়ার মতো আমার ভাষা নাই। তাদের জন্য আমার এই পেজে ওদেরকে মনে রাখার জন্য ওদের কয়েকটা ছবি রেখে দিলাম। বড্ড ভালো লাগলো ওদের আথিথেয়তা।
ওরা আমার এবং আমার পরিবারের জন্য অনেক সহায়তা করেছে। এয়ারপোর্টের গেট থেকে শুরু করে আমার মেয়ে কনিকাকে ইমিগ্রেশন করা এবং ওর সাথে প্লেন পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ার পুরু কাজটাই করেছে। আমি আমার পরিবার এবং অন্যান্য সবাই অনেক কৃতজ্ঞ। দোয়া করি ওদের জন্যেও।
০৮/০৮/২০২১-What If I were not Born
উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব
আগষ্ট
০৮
মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহন করার থেকে এতো সম্মান নাকি ঈশ্বর তার পাপমুক্ত ফেরেস্তাদেরকেও দেন নাই। সৃষ্টির সেরা জীবদের মধ্যে এই মানুষই নাকি সেরা। এই মানুষের জন্যই ঈশ্বর আকাশ তৈরী করেছেন, সেই আকাশ থেকে তিনি জল-বৃষ্টি বর্ষন করেন, জমির নির্মল গাছ গাছালীকে তিনি সবুজ সতেজ করে রাখেন। তিনি এই মানুষের জন্যই পাহাড় সৃষ্টি করেছেন, দিন আর রাতের তফাত করেছেন, ভালোবাসার মতো সংগী তৈরী করেছেন, অতঃপর তিনি জীবিনের বিভিন্ন স্তরে স্তরে নানাবিধ উপলব্দির জন্য সন্তান, নাতি নাতকোরের মতো মিষ্টি মিষ্টি ফুলের সংসারও তৈরী করেছেন। কি অদ্ভুত ঈশ্বরের সব সাজানো এই পরিকল্পনা। নীল আকাসের দিকে তাকিয়ে কখনো সাদা ফেনার মতো ভেসে যাওয়া মেঘ, কখনো উত্তাল মেঘের অবিরাম বৃষ্টিবরন, হেমন্তে বা শরতের দিনে বাহারী ফুলের সমাহার, পাখীদের কিচির মিচির, শিল্পির গানের মূর্ছনা, সবকিছু যেনো বিমোহিত করার মতো একটা সময়। অথচ এসব কিছু কোনো না কোনো একদিন ছেড়ে আমাদের সবাইকে চলেই যেতে হয়।
আবার অন্যদিকে যদি দেখি, দেখা যায়, এই বাহারী জীবনের সব সুখ আর আস্বাদন ছাড়াও আমাদের এই জীবনে ছেকে বসে দুঃখ বেদনা, হতাশা আর কষ্ট। জীবনের গাড়ি আমাদের জীবন-যানবহনের চাকার উপর টানতে টানতে এক সময় অনেকেই আমরা হাপিয়ে উঠি। বেদনায় ভরে উঠে কষ্টে, দুঃখে ভেসে যায় চোখের জল অথবা রাগে, অভিমানে একে অপরের হয়ে উঠি চরম থেকে চরম শত্রুতায় যেনো ভালোবাসা কোনোকালেই ছিলো না, হোক সেটা বিবাহ বন্ধনের মতো কোনো রোমান্টিক সম্পর্কে, অথবা ব্যবসায়ীক কোনো অংশীদারিত্তে অথবা ক্ষমতার লড়াইয়ের কোনো যুদ্ধমাঠে।
অনেক সময় আমাদের মুখ দেখে এটা বুঝা যায় না কে সুখের বা কষ্টের কোন স্তরে আছি। ভিতরের সুখ কিংবা যন্ত্রনার উপলব্ধিকে আমরা একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করলেও সঠিক স্তরটা কখনোই প্রকাশ করা যায় না। পাখীদের বেলায় কিংবা অন্য কোনো প্রানীদের বেলায় এটা কতটুকু, সেটা আমরা না কখনো ভেবে দেখেছি, না কখনো উপলব্ধি করেছি। ওরা দিনের শুরুতে আহারের খোজে বেরিয়ে যায়, পেট ভরে গেলে কোনো এক গাছের ডালে বা পাহাড়ের কোনো এক ছোট সুড়ঙ্গে রাত কাটিয়ে দেয়। তাদের অট্টালিকার দরকার পড়ে না, ওরা ওরা কেউ কারো শত্রুতা করে না, কোন পর্বনে বিশেষ কোনো কিছুর আয়োজনেরও দরকার মনে করেনা। কবে ছুটির দিন, কবে ঈদের দিন কিংবা করে কোন মহাযুদ্ধ লেগেছিলো সে খবরেও ওদের কিছুই যায় আসে না। ওদেরও সন্তান হয়, ওরাও দলবেধে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যায়, ওদের কোনো ভিসা বা ইমিগ্রেশনেরও দরকার পড়ে না। টেরিটোরিয়াল বাউন্ডারী ওদের জন্য কোনোদিন দরকার পড়ে নাই, আগামীতেও দরকার পড়বে না। ওরাও কষ্টে কিছুক্ষন হয়তো ঘেউ ঘেউ করে, কিংবা চিন্তিত হয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে চলে যায়, কিন্তু তাকে আকড়ে ধরে বসে থাকে না। ওদের সারাদিনের কর্মকান্ডের জন্য না কারো কাছে জবাব্দিহি করতে হয়, না কারো কাছে ধর্না দিতে হয়, এমনকি ওরা ঈশ্বরের কাছেও তাদের অপকর্মের কিংবা ভালোকর্মের কোনো জবাব্দিহিতা করতে হয় না। কোনো ট্যাক্স ফাইল নাই, কোনো ভ্যাট ফাইল নাই, না আছে কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স, না দরকার তাদের গাড়িঘোড়ার। তাহলে তো ওরাই আসলে শান্তিতে থাকে, মানুষের থেকে অধিক।
মানুষ ছাড়া অন্য সব প্রানীকুল প্রত্যেকেই নিজের ক্ষমতার উপর বিশ্বাস রাখে কিন্তু মানুষ তার নিজের একক ক্ষমতার উপর কখনোই সে বিশ্বাস রাখে না বা থাকে না। তার দল লাগে, তার অর্থনৈতিক মেরুদন্ড লাগে, তার আরো বিস্তর আয়োজন লাগে। এতো কিছুর উপরে তার আস্থা রাখতে গিয়ে মাঝে মাঝে সে নিজের উপরেও আস্থা হারিয়ে ফেলে। অথচ সে একা বাস করতে পারে না, না আবার সবাইকে নিয়েও বাস করতে চায়। অদ্ভুত এই মনুষ্যকূলের মধ্যে আমি জন্মে দেখেছি- এতো কিছুর বিনিময়ে অথচ কোনো কিছুই আমার না, এই শর্তে জন্ম নেয়াই যেনো একটা কষ্টের ব্যাপার। যদি কেউ এই পৃথিবীতেই না আসতো, তাহলে হয়তো বিধাতার কাছে এই ক্ষনিক সময়ে এতো কিছুর মাঝে পরিবেষ্ঠিত থেকে আবার চলে যাওয়া, কইফিয়ত দেয়া, ইত্যাদির দরকার হতো না, ক্ষমতার লড়াইয়ে হানাহানি, কারো বিয়োগে মন এতো উতালাও হতো না।
আজ থেকে বহু শতাব্দি আগে কিংবা অদুর অতীতে যারা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে, তারা আসলে আমাদেরই লোক ছিলো। তারা চলে গিয়েছে চিরতরে। কোথায় গেছেন, আর কি অবস্থায় আছেন সে সম্পর্কে আজো কেউ কোনো সম্যখ ধারনা কারো কাছেই নাই। অথচ যখন বেচে ছিলেন, প্রতিটি মুহুর্তে তারা ছিলেন সময়ের থেকেও অধিক ব্যস্ততায়। যখন তারা চলে যান, তারা আমাদের কাছে এমন কোনো ওয়াদাও করে যায়নি যে, তাদের ফেলে যাওয়া সব সম্পত্তির জন্য আবার ফিরে আসবেন, কিংবা এমনো নয় যে, তারা তা আর কখনো দাবী করবেন। এটা না হয় চিরতরে চলে যাওয়ার ব্যাপার হলো। কিন্তু এই জীবনে তো এমনো বিচ্ছেদ হয় যেখানে তারা আছেন কিন্তু আবার নাইও। জীবনের প্রয়োজনে ভউগুলিক বাউন্ডারীর অন্য প্রান্তে যখন কেউ অনেক দিনের জন্য চলে যান, আর তার ফিরে আসার ওয়াদা ভেংগে যায়, তখন আর তার উপরেও আস্থা রাখা যায়না। এমনি কষ্টে মানুষ ভোগের সমস্ত আয়োজনের উপরে থেকেও সেই আপনজনদের জন্য প্রতিনিয়ত হাহুতাশ করতে থাকেন। মনের কোথায় যেনো কি একটা সারাক্ষন খসখস করতেই থাকে। সেই যন্ত্রনায় তখন এমন মনে হয় যেনো- একটা দিনও ঠিকঠাক মতো কাটে না, এমন কি একটা রাতও না। তখন জেগে থাকে শুধু কিছু সদ্য জন্মানো কান্না। আর কান্নার আহাজারীতে সুর থাকে না, থাকে বেদনা আর কষ্ট। আর সেই কষ্টের কোনো নাম থাকে না, না থাকে তার কোনো বর্ননা বা রুপ। আর এই ভিতরের যন্ত্রনাটা কাউকেই দেখানো যায় না অথচ সত্যিটা থাকে এই ভিতরেই। আসলে পৃথিবীতে সম্পর্কের চেয়ে বড় কোনো সম্পত্তি নাই। এতো সুখের জীবনেও যখন এমন অনেক কষ্টের আর বেদনার নীল ছড়িয়েই থাকে, তাহলে কি দরকার জন্মের?
তারপরেও আমরা মানুষ হয়ে সৃষ্টির সেরা জীব হয়েই জন্ম নেই, নিয়েছি যেখানে অবারিত সবুজ ধানক্ষেতের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ার দোলা আমাদের মুখে পরশ জোগায় আবার তেমনি কখনো বিচ্ছেদের মতো যন্ত্রনা, মৃত্যুর মতো বেদনা, আবার কখনো অনিশ্চিত যাত্রার মতো দুশ্চিন্তা নিয়েই আমাদেরকে বাচতে হয়। কেউ যখন চিরতরে জীবনের নিঃশ্বাসকে স্তব্ধ করে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেন, তারজন্য যতোটা না দুশ্চিন্তা আমাদেরকে গ্রাস করে, তার থেকে যখন কোনো প্রিয়জন হটাত করে সেই চেনা পরিচিত আবাসস্থল থেকে কাউকে কিছু না বলে হারিয়ে যান আর ফিরে না আসেন, তারজন্য আরো বেশী দুশ্চিন্তা আর অমঙ্গল চিন্তা মাথা ভনভন করতে থাকে। কিন্তু এরই মতো যখন কোনো প্রিয়জন জেনেশুনে জীবনের প্রয়োজনে অথবা বড় সাফল্যের আশায় একে অপরের থেকে এমন একটা বিচ্ছেদে আপোষ করেন যেখানে টেরিটোরিয়াল বাউন্ডারী আমাদেরকে প্রায় স্থায়ী বিচ্ছেদের স্তরে নিয়ে যায়, তখন আমাদের হাসির অন্তরালে যে বেদনা লুকিয়ে থাকে, তা তুষের অনলের মতো সারাক্ষন তাপদাহে অন্তরে প্রজ্জলিত হতেই থাকে। আশা আর সাফল্যের মতো জল হয়তো সাময়ীকভাবে তা নিবারন করে কিন্তু এই ছোট ক্ষনস্থায়ী জীবনে বারবার এটাই মনে হয়- কি দরকার ছিলো এসবের? তাকে কি আটকানো যেতো না? নাকি আটকানো হয় নাই? আসলে কোনো কিছুই দরকার ছিলো না যদি না আমার জন্মই না হতো এই মানুষ হিসাবে। তখন না দরকার হতো এই বিচ্ছেদের, না প্রয়োজন হতো এই দিনরাতের কষ্টের অথবা না দরকার পড়তো অন্তর জালার তাপদাহের অনুভবতার। তখন কেনো জানি বারেবারেই মনে হয়- What If I were not born?
করোনার প্রাদূর্ভাবে চেনা পরিচিত সব মানুষ যেনো ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে একে একে যেনো বিনা নোটিশে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। এই সেদিন যার সাথে এক টেবিলে বসে হাসাহাসি, আড্ডা, কথা কাটাকাটি, অথবা দল বেধে গায়ের কোনো মেঠো পথে বাচ্চাদের মতো হাটাহাটি করেছি, তার কিছু মুহুর্তের পরই সংবাদ আসে, আর নেই। চলে গেছে। ব্যাংকের টাকা, বিশাল ব্যবসা, কিংবা গাড়ি বহরের সব যাত্রা কোনো কিছুই যেনো তার সামনে দাড়াতে পারছে না। অথচ তাকে না দেখা যায়, না ছোয়া যায়। কখন সে কার সাথে একান্তে বাস করা শুরু করে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আতংকে আছে মন, অসুস্থ্য হয়ে যাচ্ছে শরীর, ভাবনায় ভরে যাচ্ছে সারাটা মাথা। অথচ দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে কুকুর, মনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে পাখীরা, শুধু বন্দি হয়ে আছি আমি “মানুষ”। বারবার মনে হচ্ছে- কোথায় যেনো কি ঠিক নেই, কি যেনো কোথায় একটা গড়মিল হচ্ছে তা বুঝা যাচ্ছে না। কেনো এমনটা হচ্ছে বারবার?
আসলে কোন কবি যেনো একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন- মানুষ হয়ে জন্মই যেনো আমার আজীবনের পাপ। তাই আমারো মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে- What If I were not even born!!
০৭/০৮/২০২১-কনিকার মাত্র ৩দিন বাকী
উচ্ছিষ্ট সময়ের রাজত্ব
আগষ্ট
৭
প্রায় সবগুলি কাজ শেষ। ভিসা আগেই হয়ে গিয়েছিলো, টিকেটও কেনা আছে, টিউশন ফি গতকাল পাঠিয়ে দেয়া হয়ে গেছে। ভ্যাক্সিনেশন যা যা নেয়া দরকার ছিলো, সবই সম্পন্ন করা হয়েছে। ব্যাগপত্র, মালামাল সব কিছুই প্যাকড হয়ে গেছে, আগামী এক বছরের আর্থিক জোগানও শেষ, এখন বাকী শুধু করোনা টেষ্ট আর ফ্লাইটে উঠা। আগামী ১০ তারিখের দিবাগত রাত অর্থাৎ ১১ আগষ্ট এর ভোর বেলায় কনিকার ফ্লাইট। মাত্র তিনদিন বাকী। কনিকার চলে যাওয়ার শুন্যতাটা এখন মাঝে মাঝে অনুভব করছি, উম্মিকা রীতিমত প্রায় প্রতিদিনই কান্নাকাটি করছে কনিকা চলে যাবে বলে। কনিকা এখনো খুব একটা মন খারাপ করছেনা তবে বুঝা যায় সে একটা দুদোল্যমান অনুভুতিতে ভোগছে। কারন একদিকে কনিকা আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারে বেশ খুসী, অন্যদিকে বাড়ি ছাড়ার কষ্ট। মিটুলের অবস্থাটাও প্রায় ওই একই রকমের। আর আমার? আমার শুধু একটাই ভয়, ওরা যেনো ভালো থাকে যেখানেই থাকুক। মন তো খারাপ হচ্ছেই। কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন। আমি মেনে নিয়েছি বাস্তবতা।
বাড়িটায় সারাক্ষন কনিকাই মাতিয়ে রাখতো, বাসায় যতো কথাবার্তা, যতো হইচই কনিকাই করতো। এই পরিবেশটা মিস করবো আমরা। অফিস থেকে আমি বাসায় আসার পর প্রথমেই আমি ঢোকি সাধারনত কনিকার রুমে আর তার সাথে উম্মিকার রুমে। ইদানিং উম্মিকা ডেল্টা মেডিক্যালে জব করে বলে, প্রায়ই আমি খবর নেই মেয়েটা লাঞ্চে খাবার খেয়েছে কিনা বা রাত সাড়ে আটটা বাজলেই মনে করিয়ে দেই, উম্মিকাকে আনতে গাড়ি গেছে কিনা।
আমি জানি, কনিকা যেদিন আমেরিকার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হবে ইনশাল্লাহ, সেদিন আমার ভিতরে কি কি ঘটবে কিন্তু মনকে শক্ত করা ছাড়া কোনো উপায় নাই। যতোক্ষন না কনিকা তার ডেস্টিনেশনে গিয়ে পৌছায় ততোক্ষন আমি জানি ওর ফ্লাইট মনিটর করতে থাকবো। যখন আল্লাহর রহমতে কনিকা আমেরিকায় ওর ডেস্টিনেশনে পৌঁছাবে, হয়তো তখন একটু ভালো লাগবে যে, ওখানেও অনেক আত্তীয় স্বজনেরা আছেন যারা কনিকাকেও অনেক ভালোবাসে, তারা দেখভাল করবে।
কনিকা অনেক খুতখুতে। কিন্তু গোছালো। ওর কোনো কিছুই অগোছালো থাকে না। কোন একটা জিনিষ এদিক সেদিক হলেই ওর সেটা ভালো লাগে না। মেজাজ খারাপ করে। ফলে ভয় পাচ্ছি, নতুন পরিবেশে কতটা দ্রুত কনিকা এডজাষ্ট করতে পারে। ওখানে কনিকাকে সব কিছুই নিজের হাতে করতে হবে। পারবে কিনা জানি না। তবে প্রথম প্রথম কনিকা হোমসিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। এটা কাটিয়ে উঠতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।
আমি কনিকা যেনো আমেরিকায় অন্তত টাকা পয়সা নিয়ে কোনোরুপ সমস্যায় না পরে, সেইটা শতভাগ নিশ্চিত করেছি (আলহামদুলিল্লাহ)। আসলে আমি ইদানিং আমার জীবনের মুল পলিসিটাই বদল করে ফেলেছি। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। যাতে আমি না থাকলেও আমার সন্তানেরা কোথাও কোন সমস্যায় না পড়ে, বাকীটা আল্লাহ ভালো জানেন। আমার জমি জমা, টাকা পয়সার এসেটের থেকে বড় এসেট আমার মেয়েরা। এদের জন্য পয়সা খরচে আমার কোনো কার্পন্য নাই। যতোটুকু আমার সক্ষমতা আছে, আমি ওদেরকে ততোটাই দিতে চাই।
গতকাল রাতে প্রথম দেখলাম, উম্মিকা কনিকা দুজনেই বেশ ইমোশনাল ছিলো। ব্যাপারটা ঘটছে কারন সময়টা খুব কাছাকাছি কনিকার চলে যাওয়ার। ফলে উম্মিকাও অনেকটা খুব বেশী মন খারাপ করে আছে। চৈতী এসছে কনিকার যাওয়ার কারনে। ওরা সবাই খুব কাছাকাছি ছিলো সব সময়। ওদের বয়সের তারতম্য থাকলেও কনিকাই ছিলো যেনো ওদের সবার মধ্যে নেতা। ওর আবদার কেউই ফেলতো না।
বিমানবন্দর ঢোকার জন্য পাশ এর অবস্থা এখন খুব কড়াকড়ি। কোথাও থেকে কোনো পাশ পাচ্ছি না। ব্যাপারটা একটু হতাশার। অনেককেই বলেছি কিন্তু সব জায়গা থেকেই নেগেটিভ ফলাফল আসায় একটু আরো ভয়ে আছি। আমার দোস্ত উইং কমান্ডার মাসুদকে বলেছি যে, সিভিল এভিয়েশন আসোশিয়েসন অফ বাংলাদেশ থেকে অন্তত কয়েকটা পাশ জোগাড় করতে। ওই সংস্থার চেয়ারম্যান হচ্ছে এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান। সে আমাদের থেকে এক কোর্ষ সিনিয়ার কিন্তু আমার সাথে কখনো পরিচয় হয় নাই। যেহেতু মাসুদ এয়ার ফোর্সের, তাই একটা ভরষা মাসুদ দিয়েছে যে, সে পাশ জোগাড় করতে পারবে। কিন্তু ব্যাপারটা আমি এখনো সিউর হতে পারছি না আসলেই মাসুদ পাশ জোগাড় করতে পারবে কিনা।
কনিকা হয়তো ওর বাড়ি ছাড়ার অনুভুতিটা ঠিক এই মুহুর্তে ততোটা উপলব্ধি করতে পারছে না। কিন্তু যেদিন কনিকা স্টেপ আউট করবে, আমি জানি, ওর সবচেয়ে বেশী মন খারাপ থাকবে। যদি এমন হয় যে, পাশ একটাও পাওয়া গেলো না, তাহলে কনিকাকে একাই সব সামাল দিতে হবে। লাগেজ বুকিং, বোর্ডিং পাশ সংগ্রহ, চেক ইন, ইত্যাদি। আর যদি একটা পাশও পাই তাহলে শুধুমাত্র আমি ভাবছি মিটুলকে দিয়ে দেবো যাতে মিটুল সবকিছু ম্যানেজ করে মেয়েকে যতোদূর পারে উঠিয়ে দিতে। তা না হলে প্রশ্নের আর ইঙ্কোয়ারীর প্রশ্নে জর্জরীত হতেই থাকবো। আর যদি দুটু পাই, তাহলে সাথে উম্মিকাকে দিয়ে দেবো। আর যদি বেশী ভাগ্যবান হই, আমিও পাই, তাহলে তো আল্লাহর রহমত, আমরা অকে সবাই এক সাথে বিমানে তুলে দিতে পারবো। কনিকা কাতার এয়ার ওয়েজে যাচ্ছে ইনশাল্লাহ।
আজ শুক্রবার। ভেবেছিলাম, বাইরে কোথাও যাবো। কিন্তু কনিকাকে এই মুহুর্তে বাইরে বের করতে চাই না। চারিদিকে করোনার প্রভাব খুব বেশী। কনিকার করোনা টেষ্ট করাতে হবে ফ্লাইটে উঠার ৪৮ ঘন্টা আগে। তাই খুব একটা বের করতে চাই না কনিকাকে। তাই সবাই চিন্তা করছি- আমাদের ছাদের উপরে ঘরোয়া একটা পার্টি করবো যেখানে শুধুমাত্র আমরাই থাকবো। জাষ্ট একটা আউটিং এর মতো আর কি।
একটা সময় আসবে যেদিন আজকের এই অনুভুতিটা হয়তো আমি আগামী ৪ বছর পর যখন পড়বো, তখন আমার অনুভুতি হয়তো হবে পুরুই ভিন্ন। সফলতার গল্পে আমি হয়তো অনেক গল্প করবো এই কনিকাকে নিয়ে। আমি সব সময় উম্মিকাকেও বলে যাচ্ছি, সেও চলে যাক আমেরিকায়। তাহলে দুইবোন এক সাথে থাকলে আমিও কিছুটা ভরষা পাই। কিন্তু উম্মিকার যাওয়ার ব্যাপারটা খুব ধীর। সে মনে হয় বাইরে মাইগ্রেশন করতে চায় না।
দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় আমাদেরকে নিয়ে যায়। নিশ্চয় আল্লাহ আমাদেরকে ভালোবাসেন।
০৫/০৮/২০২১-অদ্ভুত একটা স্বপ্ন
You are required to login to view this post or page.
২১/০৭/২০২১-ঈদুল আজহা
উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব
২০২১
২১ জুলাই
আজ পালিত হলো ঈদুল আজহা।
এই দিনটা এলে সবচেয়ে আগে যার কথা আমার বেশী মনে পড়ে তিনি হচ্ছেন-আমার মা। মা বেচে থাকাকালীন আমি কখনো শহরে ঈদ করিনি কারন মাও ঈদের সময় গ্রাম ছাড়া ঈদ করতেন না। মা যেহেতু ঈদে গ্রামে থাকতেন, আমিও গ্রামেই ঈদ করতাম। আমি সব সময় ভাবতাম-একটা সময় আসবে, মাকে ছাড়াই আমার ঈদ করতে হবে জীবনে, তাই যে কতগুলি সুযোগ পাওয়া যায়, মায়ের সাথে ঈদ করাটা ছিলো আমার সুযোগের মতো। বাড়িতেই কুরবানী করতাম। ঈদের আগে আমি ইসমাইল ভাই অথবা রশীদ ভাইকে টাকা পাঠিয়ে দিতাম যাতে আগেই গরু কিনে রাখেন। ফাতেমার স্বামী সলিমুল্লাহ ওরফে দুদু ভাইকে আমি কখনোই কুরবানীর গরু কেনার দায়িত্তটা আমি দিতাম না কারন তার উপরে আমার টাকা পয়সা নিয়ে আস্থা ছিলো না। কেনো তার উপরে আস্থা ছিলো না, সে কাহিনী বিস্তর, আজ না হয় এখানে নাইবা বললাম। গরু কেনার ব্যাপারে আমার একটা পলিসি ছিলো যে, মেহেরুন্নেসা (অর্থাৎ আমার ইমিডিয়েট বড় বোন সব সময় গরু পালতো। আমি ইচ্ছে করেই রশীদ ভাইকে বলতাম যাতে ওর গরুটাই আমার জন্যে রেখে দেয়। আমি কখনোই সেটার দাম করতাম না। এই কারনে করতাম না, মেহের যে কয় টাকায় বিক্রি করলে খুশী হয় সেটাই হোক আমার আরেকটা সাহাজ্য। মেহের খুব ভালো একটা মেয়ে।
আজ সেই কুরবানীর দিনটা চলে গেলো। শুনেছিলাম, একটা গরু মোট সাত জনের নামে কুরবানী দেয়া যায়। ফলে আমি সব সময় এই সু্যোগে যে কাজটা করি, তা হলো- এক ভাগ দেই আমি আমার প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মাদ (সঃ) এর নামে, আর বাকী ৬ ভাগ দেই-আমার, মিটুল, আমার ২ মেয়ে, আমার বাবা আর আমার মায়ের নামে। এটাই আমার কুরবানী দেয়ার পলিসি। আজো তাইই করলাম। গরু জবাই, মাংশ কাটাকাটি আর বিলানোর কাজটা আমি নিজ হাতে করি। ৩ টা ভাগ করি, একটা ভাগ নীচেই বিলিয়ে দেই, বাকী ২ ভাগের এক ভাগ আমি রাখি আলাদা করে সমস্ত আত্তীয় সজন আর পাড়া পড়শীর জন্য, আর এক ভাগ থাকে আমার পরিবারের জন্য।
এই কুরবানী এলে আমার আরো একটা কথা প্রায়ই মনে পড়ে। সেই ১৯৭৬-৭৭ সালের কথা। আমাদের তখন কুরবানী দেয়ার মতো পরিস্থিতি ছিলো না। আমি মাত্র ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়ি, আমাদের বাড়িতে ৫ বোন আর মা আর আমি। আমার বড় ভাই তখন সবেমাত্র আমেরিকা গেছেন। আমাদের সব ভরন পোষনের দায়িত্ত আমার বড় ভাইই করেন। কিন্তু শেয়ারে কুরবানী দেয়া কিংবা আলাদা কুরবানী দেয়ার মতো ক্ষমতা আমাদের ছিলো না। ফলে এই কুরবানীর দিন আমার খুব অসস্থি হতো। অসস্থি হতো এই কারনে যে, আমরা না কারো কাছ থেকে মাংশ চেয়ে আনতে পারতাম, না আমাদের সামর্থ ছিলো কুরবানী দেয়ার। ফলে দিনের শেষে যখন সবাই যার যার বাড়িতে গরুর মাংশ পাকে ব্যস্ত, খাওয়ায় ব্যস্ত, আনন্দে ব্যস্ত, তখন হয়তো আমাদের বাড়িতে ঠিক তেমনটা নাও হতে পারে। আমি এই ঈদের দিনের দুপুরের পর আর কোথাও যেতাম না, কারন আমার কেম্ন জানি নিজের কাছে খুব ছোট মনে হতো। কুরবানী দেয়াটা ধর্মের দিক দিয়ে কি, আর কি না, সেটা আমার কাছে হয়তো অনেক বড় মাহাত্য ছিলো না, কিন্তু আমি যখন দেখতাম, আমার বন্ধুদের বাড়িতে সবাই কুরবানীর গরু নিয়ে কাটাকাটিতে ব্যস্ত, বিকালে মাংশ বিলানোতে ব্যস্ত, আমার তখন মনে হতো, আমিই ব্যস্ত না। গরীব হয়ে জন্ম নেয়াটা একটা অসস্থিকর ব্যাপার। তারপরেও অনেকেই আমাদের বাড়িতে কুরবানীর পর মাংশ পাঠাইতো। বিকালে বা সন্ধ্যায় দুদু ভাই, ইসমাইল ভাই, আমাদের খালাদের বাড়ি থেকে, কিংবা জলিল মামাদের বাড়ি থেকে অথবা পাশের কোনো বারি থেকে অনেকেই মাংশ পাঠাইতো যেটা আমার কাছে একটু খারাপ লাগলেও মা নিতেন। কুরবানী বলে কথা। সবাই মাংশ খাবে, আমাদের বাড়ির মানুষেরা একেবারেই কিছু খাবে না, মা হয়তো এটা ভেবেই মাংশ গুলি রাখতেন। দিনটা চলে যেতো, আমার অসস্থির ভাবটাও ধীরে ধীরে কেটে যেতো। আবার এক বছর পর হয়তো এই অসস্থিটা আসবে।
যেদিন আমার ক্ষমতা হলো কুরবানী দেয়ার, আমি সব সময় গ্রামেই কুরবানী দিয়েছি। আর সব সময়ই আমার সেই দিনগুলির কথা মনে করেছি। আমাদের দিন পাল্টেছে, আমাদের পজিসন পাল্টেছে। মা যখন জীবিত ছিলেন, এমনো হয়েছে মাঝে মাঝে আমি দুটু কুরবানীও করেছি একা।
আজ মা নাই, আমার গ্রামে যাওয়া হয় না। কুরবানী নিয়ে এখন আমার তেমন কোনো আগ্রহও নাই। তবে সবসময় ঢাকাতেই আমি কুরবানী দেই, একা। যদি আমি কখনো কুরবানী নাও দেই, কেউ আমাকে আন্ডার এস্টিমেট করবে না কারন সবাই জানে আমার একটা না, অনেকগুলি কুরবানী দেয়ার সক্ষমতাও আছে। হয়তো কোনো কারনে আমি ইচ্ছে করেই কুরবানী হয়তো দেই নাই। কেউ এটা ভাববে না যে, আমার টাকা নাই তাই কুরবানী দেই নাই। “সময়” এমন জিনিষ। সব কিছু পালটে দেয়।
৮/৭/২০২১-জীবনে হতাশ হওয়ার
উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব
২০২১
৮ জুলাই
জীবনে হতাশ হওয়ার কোনো কারন নাই। একদিন নিজেকে নিজেই বলেছিলাম যে, ভগবান মানুষের জন্য প্রতিটি দিন একই রকম করে কাটাতে দেন না। আজ যে রবিবার আপনি হাসছেন, আগামী রবিবার আপনি নাও হাসতে পারেন, হয়তো সেদিন আপনি হাসিতে আপনার প্রতিটি মুহুর্ত ভরে থাকবে। এই সপ্তাহটা হয়তো আপনার জন্য ভয়ানক অস্থির যাচ্ছে, কে জানে আগামী সপ্তাহটা হয়তো হবে একেবারেই সুন্দর। তাই হতাশ হবার কোনো কারন নাই। প্রতিটি ঝড় কিংবা বিপদের মাঝেও কিছু না কিছু সুসংবাদ থাকে, কিছু না কিছু ভালো জিনিষ আসে। একটা মৃত ঘড়ির দিকে তাকান, দেখবেন নষ্ট ঘড়িটাও দিনে দুবার একদম সঠিক সময় প্রকাশ করে। অপরিষ্কার জল খাবারের অনুপোযোগী হলেও সেটা আগুন নেভানোর কাজে লাগে। বোবা কিংবা বোকা বন্ধুও আপনার অন্ধ জীবনে রাস্তা দেখিয়ে দিতে পারে।
তারপরেও একটা সময় আসে যখন শুধু নিজের জন্যেই নিজেকে বাচতে হয়। অন্য কারো জন্যে নয়। আমরা সামাজিক কিংবা পারিবারিক জীবনের কথা বলি। ওটা একটা শুধু কন্সেপ্ট যেখানে মানুষ একা থাকতে পারে না বলে সে এই দলবদ্ধ জীবন বা পারিবারিক জীবনটাতে থাকতে চায়। কিন্তু একটা সময়ে সবাই এই জীবনেও হাপিয়ে উঠে। সন্তান, স্ত্রী কিংবা আশেপাশের সবাই যেনো তখন এক ঘেয়েমীতে ভরে যায়। তখন কেউ কারো আদর্শ কিংবা অভিজ্ঞতাকে আর কাজে লাগাতেও চায় না, বরং যেটা নিজেরা ভাবে সেতাই যেনো পরিশুদ্ধ, আর সেটাই করতে চায় সবাই। সন্তানেরা যখন বড় হয়ে যায়, তখন তাদেরকে তাদের মতো করেই ছেড়ে দেয়া উচিত। তাদের চিন্তা ধারা, তাদের পছন্দ কিংবা আশা নিরাশা সবন কিছু তাদের মতো। তাই, আমরা যারা বড়রা তাদের জন্যে দুশ্চিন্তা করি, এটা হয়তো আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে ভাবি যে, ওরা ভুল করছে বা যা করছে সেটা ঠিক নয়। আর এই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা আমাদের কিছু কন্সেপ্ট বা ধারনা বা উপদেশ ওদের উপর চালাতে চাই যা অহরহই ওরা মানতে চায় না। যখন এমন একটা কনফ্লিক্ট সামনে আসে, তখন আমাদের উচিত আর না এগোনো। সবাইকে যার যার পথে চলতে দিয়ে ঠিক ঐ জায়গাটায় দাড় করানো উচিত যাতে ওরা বুঝতে পারে, আমাদের উপদেশ ঠিক ছিলো কিংবা আমরাই ঠিক ছিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো ঐ সময় কোনো কিছুই আর পিছনে গিয়ে সঠিকটা করা যায় না বলে মনে কষ্ট লাগে বা খারাপ লাগে। কিন্তু ওটা ছাড়া তো আর কিছুই করার নাই। চেয়ে চেয়ে ধ্বংস দেখা ছাড়া যদিও কোনো উপায় নাই, তারপরেও সেটাই করতে দেয়া উচিত যাতে ওরা এটা বুঝতে পারে যে, বড়দের অভিজ্ঞতার দাম ছিলো, উপদেশ গ্রহন করা উচিত ছিলো। তাহলে হয়তো আজকের দিনের এই অধোপতন কিংবা ছেড়াবেড়া জীবনে পড়তে হতো না।
লাইফটায় অনেক পরিবর্তন নিয়ে এসেছি আমি নিজেও। নিজের ঘরে যখন কেউ একাকিত্ত বোধ করে সেখানে সময় একেবারেই স্থবির। সেখানে যেটা চলে সেটা হচ্ছে- সময় মত খাওয়া, আর নিজেকে অন্য কিছুতে ব্যস্ত রাখা। এটা একটা সময়ে সবার জীবনেই আসে। আমি যদি বলি, এটা ইতিমধ্যে আমার জীবনেও শুরু হয়ে গেছে, ভুল বলা হবে না।
কেনো বললাম কথাটা। এর নিশ্চয় কোনো কারন তো আছে। আজকের যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা আমার কাছে কাম্য নয়। না আমি আশা করেছি। আমার সন্তানদের জন্য আমার থেকে বেশী কেউ ভাবে এটা আমি কখনোই বিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু সেই সন্তানেরা যদি কখনো বলে, যে, আমরা তাদের জন্য অভিশাপ,আমরা পশুর চেয়েও খারাপ ব্এযবহার করি, কিংবা আমরা প্ৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বাবা মা ইত্যাদি, এর থেকে বড় পরাজয় আর কিছু হতে পারে না। তবে আমি জানি, জীবনে এ রকমের অনুভুতি সবারই আসে। যখন এই অনুভুতি ভুল প্রমানিত হয়, তখন বেলা এতোটাই বেড়ে যায় যে, কারো কারো জীবনের রাত শেষ হয়ে আরো গভীর রাতে অন্য কোনো জগতে সে চলে যায়।
১৯/০৭/২০২১-ঈদুল আজহার ২দিন আগে
উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব
২০২১
১৯ জুলাই
এই কয়েকমাসে এতো বেশী অভিজ্ঞতা হলো যা আমার জীবনের অনেক প্রাক্টিস আর বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিয়েছে। যাদেরকে আমি মনে করি সবাই আমার মতো। অথবা আর যার সাথে আমরা যাইই করি না কেনো, অন্তত আমরা আমাদের সাথে সেই একই প্রাক্টিস গুলি কখনো করতে পারি না। কিন্তু আমার এই ধারনা সমুলে আঘাত খেয়েছে অনেক গুলি কারনে। তাহলে একা একা বলিঃ
(১) মান্নানের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়েঃ মান্নান যে আমার সাথে লুকুচুড়ি করে সেটা আমি জানি। অনেক সময় ভাবি যে, হয়তো সে একটু ভালো থাকতে চায়, তাই একটু আধটু লুকুচুরি করে। আমার অনেক ক্ষতি না হলেও অর্থের দিক দিয়ে একটু তো লাগেই। কিন্তু যেহেতু আমি সামলে নিতে পারি, তাই অনেক সময় কিছু বলি না বা বলতে চাইও না।
আমি যখনই কোনো জমি কিনেছি, মান্নান সেখানে জমির দামটা এমন করে বাড়িয়ে বলতো যাতে আমার টাকা দিয়েই মান্নান ও কিছু জমি সেখান থেকে কিনতে পারে। আমি সেটা বুঝি কিন্তু কিছু হয়তো বলি না। এভাবে মান্নান অনেক জমি শুধু হয়তো আমার টাকা দিয়েই কিনেছে আর সেটা আমার ক্রয় করা জমির সাথেই। কিন্তু এবার যেটা করেছে সেটা মারাত্তক।
মুজিবুর রহমান খান নামে এক ভদ্রলোক আমাদের পলাসপুরের জমিটা কিনতে আগ্রহী হলে আমিও বিক্রি করতে তৈরী ছিলাম। আমার জমির সাথে আমার পার্টনার মুর্তুজা ভাইয়ের জমি আছে। ফলে আমার জমি আর মুর্তুজা ভাইয়ের জমি সহ একটা রফাদফা হয়েছিলো। এর মধ্যে মান্নান আমাকে জানালো যে, মুজিবুর রহমান খান সাহেবের আরো জমি দরকার যা সেলিম নামে এক জন লোকের জমি আমাদের জমির পাশেই আছে কিন্তু ওর জমিতে যাওয়ার রাস্তা না থাকায় যদি আমাদের জমির সাথে টাই আপ করে খান সাহেবের কাছে বিক্রি করি তাতে আমাদের লাভ হবে। কারন সেলিকমে জমির মুল্য দিতে হবে খান সাহেবের দেয়া জমির দামের অর্ধেক প্রায়। সেলিমদের মোট জমি ছিলো ৩২০ শতাংশ।
এর মধ্যে মান্নান আমাকে জানালো যে, আমরা সেলিমদের জমি থেকে পানি ব্যতিত মোট ১৫১ শতাংশ জমি খান সাহেবকে দিতে পারবো। বাকী ১৬৯ শতাংশ জমি আসলে নদীর পানির মধ্যে যদিও জমিটা রেকর্ডের অন্তর্ভুক্ত। আমি যখন সেলিমদের জমিটা বিনা পরীক্ষায়, বিনা নীরিক্ষায় খান সাহেবকে রেজিষ্ট্রি করে দিলাম, পরে জমি মাপ্তে গিয়ে দেখি যে, মাত্র ৯৮ শতাংশ জমি আছে যা নদীর মধ্যে না। অনেক রাগারাগি আর চাপাচাপির মধ্যে আমি যখন সেলিমদের ধরলাম, শুনলাম আরেক বিরাট ইতিহাস। মান্নান, সেলিম এবং সেলিমের এক চাচাতো ভাই মিলে মোট ৩২০ শতাংশ জমিই কিনে নিয়েছে সেলিমদের আত্তীয় স্বজনের কাছ থেকে অই টাকায় যে টাকা হয় ১৫১ শতাংশের দাম। খান সাহেবকে ১৫১ শতাংশ জমি দেয়ার পর বাকী ১৬৯ শতাংশ জমি ধান্দা করে মান্নানের নামে আর সেলিমের নামে একা পাওয়া অফ এটর্নী নিয়েছে। এর মানে হলো, আমি কোনো লাভ করি নি , লাভ করছিলো মান্নান। যদি অদুর ভবিষ্যতে পানি শুকিয়ে চর জাগে, তাহলে মান্নান এই জমি গুলি চড়া দামে বিক্রি করতে পারবে। অথচ টাকাগুলি খান সাহেবের এবং আমার। খান সাহেব যখন নদীর মধ্যে কোনো জমি নিতে নারাজ হলেন, তখন আমার চর গল্গলিয়া মৌজা থেকে এই বাকী ৫৩ শতাংশ জমি পুরা করে দিতে হবে যার দাম প্রায় তিন কোটি টাকা। এটা কোনোভাবেই আমার সম্ভব হচ্ছিলো না। আমি কেনো এতো গুলি জমি খান সাহেবকে লিখে দেবো যার দাম তিন কোটি টাকার উপরে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত লিখেই দিতে হবে জেনে আমি পলাশপুরের আক্কাসকে ধরে মান্নান আর সেলিমের কাছ থেকে পরবর্তীতে ওই ১৬৯ শতাংশ জমি ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে আমার নিজের নামে নিয়ে নিলাম। জানি আমার ক্ষতি পুরন হবে না যতোক্ষন পর্যন্ত ওই নদীর জমি শুকিয়ে আসল চেহারায় জমি ভেসে না উঠে। আমি মান্নানকে বারবার এই অ বিশ্বাসের কাজটা কেনো করেছে জিজ্ঞেস করলে তার একটাই উত্তর- ভুল হয়ে গেছে। এটা কোনোভাবেই ভুল হতে পারে না। আমি কখনো ভচাবি নাই যে, মান্নান ও আমাকে এভাবে এতো ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে।
পলাশপুরে আমার আরো একতা জমি সরকারের কাছ থেকে লিজ নেয়া ছিলো। আর যেহেতু ওই লিজটা আনতে হয় কোনো দুস্ত মানুষের নামে, তাই আমি মান্নানের ভাই নাসিরের নামেই ১০০ শতাংশ জমি আমার টাকায় লিজ নিয়ে এসেছিলাম। মান্নান আমাকে না জানিয়ে হালিম নামে এক লোকের কাছে ২০ লাখ টাকায় জমিটা গোপনে টাকা নিয়ে নিলো। এটা একটা অসম্ভব ঘটনা বলে আমার কাছে মনে হয়েছিলো। কিন্তু মান্নান কাজটা করেছে আমাকে একটু ও জানতে দেয় নাই। যখ ওরে আমি প্রশ্ন করেছি- মান্নানের একটাই উত্তর যে, আমার নাতির অসুখ ছিলো, টাকার দরকার ছিলো, তাই আমি বিক্রি করে দিয়েছি। আমাকে জানানোর কোনো বাধ্য বাধকতা মনে করলো না।
খান ভাই আমাদের পলাশ পুরের জমিটা কিনার সময়ে মোট ৬৩১ শতাংশ জমির বায়না করেছিলো যার মধ্যে মান্নানের ছিলো ৫১ শতাংশ। আমি খান ভাইকে বারবার বলেছিলাম, কখনো আমাকে ছাড়া টাকা পয়সার লেন দেন করবেন না। কিন্তু ওই যে বললাম, সবাই লাভ চায়!! খান সাহেব মান্নানকে মাঝে মাঝে আমাকে না জানিয়ে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা হ্যান্ড ওভার করে। একদিন খান সাহেব আমাকে জানালো যে, মান্নান জমিটা কাগজে কলমে কোনো বায়নাও করছে না আবার টাকাও চায়। আমি যখন ব্যাপারটার ভিতরে প্রবেশ করলাম, দেখলাম, ওই খানে মান্নানের জমি আছে মাত্র ৪ শতাঙ্ঘস, আর ওর বোন আর ভাই মিলে আছে আরো ৫ শতাংশ, মোট ৯ শতাংশ। বাকী জায়গাটা আক্কাস নামে ওর এক আত্তিয়ের। কিন্তু আক্কাসকে মান্নান উক্ত ৩৫ লাখ টাকা থেকে কখনো ১ টাকাও দেয় নাই, না মান্নান ওনার কাছ থেকে কোনো পাওয়ার অফ এটর্নী কিংবা অগ্রিম কোনো বায়নাপত্র করেছে। আক্কাস সাহেব যখন জানলো যে, মান্নান ইতিমধ্যে ৩৫ লক্ষ টাকা নিয়ে ফেলেছে, সে তখন (৫১ মানাস ৯) ৪২ শতান্সগ জমির বায়না করে ফেল্লো উক্ত খান সাহেবের সাথে। অর্থাৎ মান্নান জানেই না যে, উক্ত জমি মান্নান আর কখনোই খান সাহেবের কাছে বিক্রি করতে পারবে না। আমি যখন আজকে মান্নানকে বললাম, খান সাহেবকে ৫১ শতাংশ জমি লিখে দিচ্ছিস না কেনো? তার অনেক উচা গলায় বল্লো, সে আগামীকালই জমিটা লিখে দিতে পারে। যখন বললাম যে, আক্কাস জমিটা অন্য খানে বিক্রি করে দিয়েছে- তখন দেখলাম ওর মুখের ভাব অনেক রক্তিম। কিন্তু লজ্জায় পড়লো কিনা জানি না। ওর আসলে এগুলিতে কোনো খারাপ লাগে না মনে হয়। টাকাটাই ওর কাছে সবচেয়ে বড় মনে হয়। ভাগ্যিস আমি এই ৫১ শতাংশের ব্যাপারে কাহ্নের সাথে কোনো প্রকার কথা বলি নাই। তাহলে এই ৫১ শতাংশ নিয়েও খান আমাকে চাপ দিতো।
মান্নানের এখন টাকা প্রাপ্তির প্রায় সব গুলি রাস্তাই বন্ধ। কোটি কোটি টাকা আমি ওর হাত দিয়ে খরচ করিয়েছি। বারবার বলেছি, অন্য কোনো একটা সোর্স কর যাতে বিপদের সময় একটা ইন কাম আসে। কখনো ব্যাপারটা আমলে নেয় নাই। এবার মনে হয় খুব হারে হারে টের পাচ্ছে যে, ওর টাকার সব গুলি সোর্স প্রায় একেবারেই বন্ধ। দেখা যাক কি করে। আমার কাছে অনেক গুলি কারন দেখিয়ে কিছু টাকা খসানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু এবার আমি অনেক টাইট হয়ে গেছি। কোনো কিছুতেই কোনোভাবেই আর টাকা দেয়া যাবে না। মান্নানের পিঠ প্রায় দেয়ালের মধ্যে ঠেকে যাচ্ছে। তবে এখান থেকে কিছুটা উত্তোরন হয়তো হবে যদি ধলেশ্বরী গ্রীন ভিলেজ প্রোজেক্ট শুরু হয়। কারন ওখানে আমি ওকে ইন করিয়েছি। কিন্তু ওটার ইন কাম বড্ড স্লো।
এবার আসি আমার পার্টনার মুর্তুজা ভাইয়ের কাছ থেকে আম্নার তিক্ত অভিজ্ঞতার ব্যাপারটাঃ
(To be cont...)
২০/০৭/২০২১***-ভরষা
উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব
২০২১
২০ জুলাই
ভরষা করা দোষের নয়। মানুষ যদি মানুষের উপর ভরষা না করে, তাহলে ধ্বংস বেশী দূরে নেই। কিন্তু কারো উপর ভরষা করার আগে সতর্ক থাকা খুবই জরুরী। ইচ্ছাকে ভালোবাসায়, আর ভালোবাসা থেকে সম্পর্ক তৈরী করার সময় এই সতর্ক থাকা ভীষনই প্রয়োজন। কিন্তু তুমি এসবের কোনো কিছুই না জেনে শুধু ইচ্ছাটাকে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় তুমি সম্পরকটা করেছো যেখানে তুমি কোনো কিছুই ভাবো নাই। তুমি পরিশ্রমী, তুমি সাহসী যদি কেউ পাশে থাকে, তুমি সৎ সেটা নিজের কাছে এবং আর তোমার জীবনের হিসাব তুমি জানো। আর তোমার মনে যে সপ্ন ছিলো সেটা পুরন করার জন্যই তুমি একটা সমঝোতা করেছো নিজের সাথে নিজের। আর সেটা তুমি সততার সাথে পালনও করছো। তোমার জীবনে এই গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আসলে তোমার সামনে কেউ ছিলো না। আর থাকলেও কোনো লাভ হতো না সেটা তুমি হারে হারে জানো। কারন যারা থেকেও ছিলো, তারা আসলে কখনোই তোমাকে মুল্যায়ন করেনি, করতোও না। তুমি অথবা যার সাথে তুমি এমন একটা সম্পর্ক করেছো, তোমরা কখনোই এটাও ভুলে যেতে চাও নাই যে, এই সম্পর্কের সামাজিকভাবে আসলে কোনো স্বীকৃতিও নাই। কিন্তু তোমার চোখ বন্ধ করে ভরষা করার ফল আমি কখনোই সেটা বৃথা যেতে দিতে চাই না। কারন তুমি অন্তত তোমার সব কিছু দিয়েই আমাকে মেনে নিয়েছো। এখানে গাদ্দারী করার কোনো প্রকারের অবকাশ বা সাহস আমার ছিলোনা, নাই আর ভবিষ্যতে থাকবেও না। ভদ্রতার পিছনে আমার কোনো প্রকার মুখোস কিংবা শয়তানীও নাই। কারন আমি জানি, এই জগতে আমাকে ছাড়া তোমার আর কেউ নাই, হোক সেটা তোমার জন্মদাতা বাবা বা মা অথবা তোমার রক্তের কেউ। এই অবস্থায় আমি তোমাকে ফেলে গেলেও আমার চোখ বারবার ফিরে তাকাবে পিছনে যেখানে তুমি পড়ে আছো। আমি সেটা কখনোই করতে পারবো না। ভাবো তো একবার- আমি চলে যাচ্ছি, তুমি চেয়ে চেয়ে দেখছো আমার নিষ্ঠুরতা, আর তুমি ভাবছো, তোমার সারাটা দুনিয়া এখন অন্ধকার। তোমার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে, তুমি ভাষাহীন হয়ে যাবে, তখন তোমার চোখ শুধু কথা বলবে। আর চোখের ভাষা তো একটাই। জল। এই জল দেখার জন্যে আমি কখনো প্রস্তুত নই।
এই প্রিথিবীতে কে আছে তোমার, আর কে নাই তাদের সবার শক্তি, ভালোবাসা আর ভরষা যোগ করলেও সেই ভরষার সাথে একদিকে শুধু আমি, এটাই তোমার কাছে পৃথিবীর সর্বোত্তম শক্তি। আর তুমি এতাই প্রমান করেছো এই পারুর কেসে। সারাটা গ্রাম, আইন, থানা, টাকা পয়সা, নেতা, মাদবরী, সন্ত্রাসী, চোখ রাংগানি একদিকে আর তুমি একাই একদিকে ছিলে। আর সেই শক্তিটাই তুমি প্রতিনিয়ত পেয়েছো এই ভরষার মানুষটার কাছে। কারন তুমি জানো, আর সবাই পালিয়ে গেলেও আমি অন্তত পালাবো না।
কেনো তুমি অন্য কারো চোখে চোখ রাখতে পারো না, কেনো তোমার মনে অন্য কারো স্থান হয় না, কখনো কি এটা খুব মনোযোগ সহকারে নিজেকে প্রশ্ন করেছো? ধর্মের কথা আলাদা, আল্লাহর দোহাই আলাদা ব্যাপার। কিন্তু এর বাইরেও তো অনেক লজিক আছে। সেই লজিক দিয়েও কি কখনো ভেবেছো কেনো হয় না সেগুলি? এর উত্তর একটাই- টোটাল সারেন্ডার। মানে সম্পুর্ন আত্তসমর্পন। যখন কোনো মানুষ তার নিজের মন তৃপ্তিতে থাকে, যখন চোখ ভালো ঘুম পায়, যখন শরীরের চাহিদা পূর্ন হয়, তখন শরীর, দেহ, মন, কিংবা আত্তা কারো দিকে ছুটে যেতে চায় না। যেমন ছুটে যায় না চাঁদ পৃথিবীর বলয় থেকে, কিংবা প্রিথিবী সূর্যের বলয় থেকে। তাদের যতোটুকু শক্ত্র প্রয়োজন তাদের নিজ নিজ অক্ষে চলার, ঠিক ততোটাই তারা পায়। তাহলে আর অন্য কোনো গ্রহের কিংবা নক্ষত্রের দারস্থ হবার কি প্রয়োজন?
মানুষ তখনি ছুটে যায় এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে যখন সে তার সঠিক তরী খুজে না পায়। আর সঠিক ঘাটের সন্ধান যখন একবার কেউ পায়, তার আর অন্য ঘাটে যাওয়ার অর্থ ভুল ঘাটে চলে যাওয়া। ভুল ঘাট মানুষকে ভুল পথেই নিয়া যায়। আর কেউ যখন একবার ভুল পথে যাত্রা শুরু করে, সেখান থেকে ফিরে আসার অন্য কোনো বিকল্প রাস্তা হয়তো তার জানাই নাই। যদি সেই অচেনা রাস্তায় একবার কেউ পড়ে যায়, সেখানে প্রতিটি মানুষ তার অচেনা। অচেনা মানুষের কাছে চোখের জলের কোনো মুল্য থাকে না।
আর মুল্যহীন জীবনে সপ্ন তো দূরের কথা, বেচে থাকাই কষ্টের। কষ্টে ভরা জীবন যখন সামনে চলতে থাকে, তখন মানুষের এই জীবনের প্রতি মায়া হারিয়ে ফেলে, ভগবানের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। ঈশর আছে এটাই তখন আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। তারপরেও দূর্বল চিত্তের মানুষেরা যাদের কোনো কুল কিনারা আর থাকে না, যেমন লামিয়া বা শারমিন, তারা ওই অচেনা, অসুন্দর জীবনকেই মানিয়ে নিতে শুরু করে। সেখানে তখন আর ভগবানের কোনো অস্তিত্ত থাকে না বা তারা ভগবানকে মানেই না। ধর্ম পালন তো দুরের কথা।
তোমার দুষ্টুমি যেমন পাগলামী, আমার কাছে তোমার পাগলামীও তেমন মিষ্টি, তোমার কান্নাও আমার কাছে ঠিক ওই রকমের। তোমাকে ভালো রাখাই আমার কাজ। আর সেই ভালো থাকাটা নির্ভর করে তোমার আত্তার উপর তুমি কতোটা তৃপ্ত। এই প্রিথিবী থেকে চাঁদ যতো সুন্দর মনে হয়, নীল আকাসের সাথে চাদকে যেমন কোনো এক যুবতীর কপালের টীপ মনে হয়, অথবা অনেক দূরের কাশবন যখন সাদা মেঘের মতো হাওয়ায় দুলে দুলে মনকে দোলায়িত করে, যখন ওই চাদে গিয়ে পা রাখা যায়, কিংবা কাশবনের মাঝে হাজির হওয়া যায়, তখন তার আসল রুপ দেখে দম বন্ধ হয়ে আসে। সেই চাঁদ আর কাশবন কেনো জানি মনে হয় এটা একটা খারাপ সপ্ন ছিলো। আমরা সেখানে বসবাস করতে পারি না। আবার ছুটে আসতে চাই এই গাছ গাছালী ভর্তি নোনা সেঁতসেঁতে সোদা গন্ধের মাটিতে যেখানে বর্ষায় গাছের পাতা বেয়ে বেয়ে টিপ টিপ করে ফোটা ফোটা পানি আমাদের নাকের ডগা দিয়ে বুকের ভিতরে এসে অন্তর শীতল করে দেয়।
একটা মানুষের শান্তিতে আর সুখে বসবাসের জন্য এই পৃথিবীর অনেক কিছু লাগে না। প্রিন্সেস ডায়ানার একেকটা নেকলেসের দাম ছিলো কোটি কোটি টাকার। তার একেকটা ড্রেসের দাম ছিলো হাজার হাজার ডলার। সাথে ছিলো রাজ প্রাসাদ। কি ছিলো না তার। ছিলো সবুজ চোখের মনি, ঈশ্বর যেনো তাকে একাই রুপবতী করে পাঠিয়েছিলো। অথচ মনে তার কোনো শান্তিই ছিলো না। সেই শান্তির খোজে শেষতক রাজ প্রাসাদ ছাড়তে হয়েছে। অন্যের হাত ধরতে হয়েছে। আর মাত্র ৩২ বছর বয়সেই তাকে এই প্রিথিবী ছাড়তে হয়েছে। যদি বাড়ি, গাড়ি, জুয়েলারী, আর টাকা পয়সাই হতো সব সুখের মুল চাবিকাঠি, তাহলে ডায়নার থেকে সুখী মানুষ আর এই প্রিথিবীতে কেউ ছিলো না। কিন্তু সেটা কি আসলেই সুখী ছিলো?
একটা তরকারীতে নুন কম হতে পারে, একটা পরোটা পুড়ে যেতে পারে, তার স্বাদ কিংবা মজা হয়তো একটু হেরফের হতেই পারে কিন্তু সেটা হয়তো একদিন বা দুইদিন। কিন্তু ভালোবাসা আর মহব্বতে যখন নুনের কমতি হয়, পুড়ে যায়, তখন জীবনের মজাটাই শেষ হয়ে যায়। আর জীবনের মজা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন এসি রুমেও ভালো ঘুম হয় না। নীল আকাশ দেখেও কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে না। তখন যেটা মনে হয় তা হচ্ছে বিষাদময় রুচী। সেই রুচীতে আর যাই হোক পেট ভরে না। আর পেটে ক্ষুধা রেখে কোনোদিন কারো ভালো ঘুম হয়েছে তার কোনো প্রমান নাই।
আমি তোমার জীবনে সেই রকমের একটা অলিখিত ভরষা। এই ভরষার কোনো ডেফিনিশন নাই। এই ভরষার কোনো আইন গত দিক নাই বটে কিন্তু আমার নিজের অনেক দায়িত্তশীলতা আছে যেখানে আমিই আইনপ্রনেতা, আর আমিই সবচেয়ে বড় বিচারক। হয়তো সমাজকে আমি তুরি দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারবো না, কিন্তু আমি সেটাই করততে পারি যাতে তুমি তুড়ি দিয়ে সবাইকে এটাই করতে পারো যে, তুমি নিজেও একটা শক্তি।
আজ তুমি সেই বিগত বছরগুলির দিকে তাকিয়ে দেখো? তুমি দেখতে পাবে যে, সেইসব বছরগুলিতে অনেক ঝং ধরা ছিলো। আগাছায় ভরা একটা কঠিন পথ ছিলো। কিন্তু আজ থেকে ৫ বছর পরেরদিন গুলি দেখো, সেখানে প্রতিদিন তোমার জীবন মোড় নিয়েছে। বাকেবাকে সমস্যা ছিলো কারন সমস্যা গুলি হয়তো আমার নজরে ছিলো না। কিন্তু আজ তোমার সেই বছরগুলির সাথে তুলনা করলে স্পষ্ট দেখতে পাবে, আকাশের মেঘ তোমার ঘরেই রংধনু হয়ে একটা বাগান তৈরী করেছে। সেই বাগানে তুমি যখন খুসী যেভাবে খুসী বিচরন করতে পারো। এই বাগানের একচ্ছত্র মালিকানা তোমার নিজের। এখানে একটা আম খেলেও শরীর চাংগা হয়ে উঠে, এখানে একটা ডিম খেলেও শতভাগ কাজ করে। অথচ আজ থেকে ৫ বছর আগে সেই একটি আম কিংবা একটি ডিম এমন করে খেলেও শতভাগ কাজ করতো না। কারন তখন ভরষার জায়গাটা ছিলো একেবারেই অনিশ্চিত। যা এখন পুরুটাই উলটা। আর এটাই খাটি ভরষা।
এখানে শুধু একটা ব্যাপারই চিন্তার বিষয় যে, যে মানুষটার কারনে কখনো নিজেদেরকে অসহায় মনে হয় নাই, কোনো দুশ্চিন্তা গ্রাস করে নাই, যখন সেই মানুষটা চলে যায়, তখন সেইই দিয়ে যায় যতো অসহায়ত্ব আর দুশ্চিন্তা। আর এটা আমার মাথায় সব সময় কাজ করে। এর জন্যে সমাধান একটাই- যা আমি অন্যদের বেলায় করেছি। সাবলম্বিতা। এবং দ্রুত। তোমাদের কাজ ভরষা করা আর আমার কাজ সেই ভরষার স্থানটা স্থায়ী করা।
যেদিন মনে হবে তুমি সাবলম্বি, তুমি নিজে নিজে একাই চলার ক্ষমতা রাখো, তোমার সমাজ তোমাকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে দিধা বোধ করবে, সেদিন আসলে আমার দায়িত্ত প্রায় শেষ হয়েছে বলে আমি মনে করবো যেটা এখন প্রায়ই ভাবি আমার এই পক্ষের মানুষগুলির জন্য। তখন যেটা হবে- তুমি স্বাধীন পাখীর মতো এক ঢাল থেকে একাই উড়ে গিয়ে আরেক ঢালে বসতে পারবে। কিন্তু পাখীরা যখন একবার নিরাপদ গাছে বাসা বেধে ফেলে, যতোদিন ওই গাছটা থাকে, কেউ আর কেটে ফেলে না, কিংবা আচমকা কোনো ঝড়ে যখন গাছটা আর ভেংগে পড়ে না, ততোক্ষন অবধি সেই ভাষাহীন অবুঝ পাখীরাও তাদের নীড় পরিবর্তনে মনোযোগ দেয় না না। তারা সেখানে অভয়ারন্য তৈরী করে সেই জংগল সাম্রাজ্যের অধিকর্তা হিসাবেই জীবন পাড় করে দেয়।
ওই গাছটাই তখন তার ভরষা। ওই গাছ জায়গা দেয় বাসা করার, ওই গাছ ঢাল পেতে দেয় নিবিড় করে বসার। ওই পাখী চলে গেলেও গাছের না হয় কোনো ক্ষতি, না হয় তার ফলনে কোনো বিঘ্নতা। ঠিক সময়ে সেই গাছ ফুল দেয়, ফল দেয়, আর দেয় ছায়া। ঝড়ের দিনেও সে হয়তো অন্য আরো অনেক পাখীর জন্যে অভয়ারন্য স্রিষ্টি করে বটে কিন্তু সেই গাছ কোনোদিন অভিযোগ করে নাই, কেনো অন্য আর কিছু পাখী তার ঢাল ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলো। তবে যদি আবারো সে ফিরে আসে, গাছের কোনো অভিযোগ থাকে না। কিন্তু যদি কোনো ঢালই আর খালী না থাকে, সেটা তো আর গাছের দোষ নয়।
ভরষার স্থান কেউ ত্যাগ করলে গাছের কি দোষ!!
৯/৭/২০২১-কনিকার আগাম জন্মদিন এবং পার্টি
উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব
২০২১
৯ জুলাই
পড়াশুনার জন্য কনিকার বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি ধীরে ধীরে প্রায় সমাপ্তির দিকে। ভিসা হয়ে গেছে, টিকেট হয়ে গেছে, ইউএমবিসি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ব্যাপারে সব ফরমালিটিজ শেষ হয়ে ভর্তিও হয়ে গেছে, ওর জন্য এক বছরের আগাম টিউশন এর নিমিত্তে ১৪ হাজার ডলারের মধ্যে ১৩ হাজার ডলার ফিও আমি ছোট ভাই (মোস্তাক আহমেদ) এর কাছে রেখে দিয়েছি, ভ্যাকসিনেশনের সবকটা টীকাও প্রায় নেয়া শেষ। যাওয়ার সময় যে কতগুলি ডলার ওর হাতে দিয়ে দেবো সেটারও প্রায় ব্যবস্থা করে রেখেছি। এখন শুধু আগামী ১০ তারিখের দিবাগত রাত মানে ১১ অগাষ্ট ২০২১ তারিখে ভোর ৪টায় ওর কাতার এয়ার ওয়েজে উঠা বাকী ইনশাল্লাহ। একাই যাবে কারন এই করোনাকালীন সময়ে আমরা কেহই ভিসা পাচ্ছি না বিশেষ করে ভিজিটিং ভিসা। আবার ব্যবসায়ীক ভিসার জন্য যিনি আমাকে আমেরিকা থেকে ইনভাইটেশন পাঠাবেন, তাদের পক্ষেও পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না বিধায় আমি ব্যবসায়ীক ভিসার জন্যেও এপ্লাই করতে পারছি না। ফলে কনিকাকে একাই যেতে হবে আমেরিকায়। একটু অসস্থিতে আছি বটে কিন্তু কনিকার উপর আমার ভরষা আছে যে, কনিকা একাই যেতে পারবে ইনশাল্লাহ।
কনিকার জন্মদিন আসলে এই সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখে হবার কথা। কিন্তু কনিকা তখন দেশেই থাকবে না। গতবার ওর জন্মদিনটা ভালোমতো কভিডের কারনে পালন করতে পারিনি। এটা নিয়ে ওর কোনো কষ্ট ও ছিলো না। কিন্তু এবার যেনো ওর মন খারাপ হচ্ছিলো যে, ইচ্ছে করলেও সে তার জন্মদিনটা ঢাকায় পালন ক্রতে পারবে না বলে। কনিকার আফসোস থাকবে যে, ওর এ বছরের জন্মদিনটা সে আমেরিকায় থাকায় সবার সাথে পালন করা সম্ভব না। মন খারাপ করবে, তাই আমরা ওর আগাম জন্মদিন এবং ওর বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে সবাইকে একবার দাওয়াত করে খাওয়ানোর জন্য যে অনুষ্ঠানটা করার প্ল্যান করেছিলাম, সেটা এক সাথেই করলাম আজ। প্রায় ৫০/৫৫ জন্য গেষ্ট এসেছিলো, আমার ব্যবসায়ীক পার্টনার মুর্তজা ভাই এবং তার স্ত্রীও এসেছিলেন। সময়টা ভালোই কেটেছে।
সাজ্জাদ সোমা ওর বাচ্চারা আর সনি এবং তার জামাই সহ বাচ্চারা সব সময়ই আমাদের বাসায় আসতে পছন্দ করে, ওরাও বাদ যায় নাই। কনিকার জন্য ভালো একটা সময় কেটেছে আমাদের সবার। এমন ঘটা করে হয়তো আগামী ৫ বছর আর ওর জন্মদিন পালন করা হয়তো সম্ভব হবে কিনা জানি না।
কভিড-১৯ এর প্রভাব হটাত করে দেশে মহামারীর লক্ষন দেখা দিচ্ছে বলে সরকার কঠিন লক ডাউন দিয়েছে। যদিও আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের জন্য এটা বাধ্যতামূলক নয়, তারপরেও আমি ইচ্ছে করেই এই কয়দিন ফ্যাক্টরীতে যাচ্ছি না। বাসায় বসে ডায়েরী লিখি আর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ব্যাপারে অনেক পড়াশুনা করছি। সাথে ইউটিউব থেকে সেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভিডিও ফুটেজগুলিও দেখার চেষ্টা করে ঐ সময়টাকে বুঝবার চেষ্টা করছি। আনা ফ্রাংক এর ডায়েরীর উপর একটা মুভি হয়েছে, সেটাও দেখলাম। আইখম্যানের উপর প্রায় শতাধিক ট্রায়াল হয়েছে, সেগুলিও দেখলাম। খুব কঠিন সময় ছিলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়টা।
যাই হোক যেটা বলছিলাম, কনিকার পর্ব। কনিকা তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রায় লাখখানেক টাকার ক্যাশ গিফট পেয়েছে। আমি চাই নাই কেউ ওকে গিফট করুক কারন এসব গিফট আসলে কনিকার জন্য এখন আর খুব একটা প্রযোজ্য নয়, সে এগুলি বিদেশ নিতেও পারবে না আর আমরাও এগুলি আগামী সময়ে সংরক্ষন করতে পারবো না। তাই গেষ্ট যারা এসেছিলো, তারা সবাই কনিকাকে ক্যাশ টাকাই গিফট করেছে। আর এ কারনেই ওর গিফট এর টাকা এতো বেশী উঠেছিলো।
কনিকা খুব ফুরফুরা মেজাজে আছে। কারন ও যা যা চেয়েছে যেমন দেশের বাইরে ভালো একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার, সেটা সে একাই ম্যানেজ করেছে, কোনো কিছুতেই কোনো বাধার সৃষ্টি হয়নি, ওর জন্মদিনটাও ঘটা করে পালন করা হলো, আর আফসোস থাকবে না, আবার বিদেশ যাওয়া উপলক্টাষে সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়ানো হলো, ওর নিজের ও ভালো লেগেছে, সব কিছু আল্লাহর রহমত, বাকীটা ভালোয় ভালোয় সব হলেই আলহামদুলিল্লাহ।
৬/৭/২০২১-কিছু আফসোস
You are required to login to view this post or page.
২৯/০৬/২০২১-আমার গ্রাম (১৯৭৭ সাল)
অফিসেই ছিলাম। কেনো জানি হটাত করে খুব গ্রামে যেতে ইচ্ছে করলো লায়লা আর সফুরা খালাকে দেখার জন্য। বহুদিন গ্রামে যাই না। প্রায় এক যুগ অথচ মাত্র ১৫ মিনিট লাগে গ্রামে যেতে। মা যখন বেচে ছিলেন, তখন গ্রাম আমাকে চুম্বকের মতো টানতো। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার হলেই আমি গ্রামে ছুটতাম মাকে দেখার জন্য যখন মা গ্রামে থাকতেন। কোনো ঈদই আমি শহরে করতাম না। মাকে দেখার সুবাদে আমার গ্রামের সেই পরিচিত মানুষগুলির সাথে আমার দেখা হতো। মানুষগুলি আমাকে বুক ভরা শ্রদ্ধ্যা আর মোহনীয় একটা ভালোবাসার বহির্প্রকাশ করতো। আমি যখন গ্রামে যেতাম, মায়ের সাথে বসে গল্প করতাম, বাড়িটার অবস্থা কি সেটা ভালো করে পরীক্ষা করতাম যাতে ঝড় কিংবা বৃষ্টিতে মায়ের কোনো ভয় না থাকে। মা ঝড়কে খুব ভয় পেতেন। আকাশে ঝড়ের আভাষ দেখলে প্রথমেই আমার মনে পড়তো মায়ের কথা। মা বোধ হয় এখন ভয় পাচ্ছে। সেই ২০০২ সালের কথা। এখন ২০২১ সাল। এর মাঝে দু একবার গ্রামে গিয়েছি নিতান্তই একটা অতিথির মতো। এখন গ্রামে গেলে লায়লার বাসা পর্যন্ত গিয়ে ওর সাথে কথাবার্তা বলেই মনে হয় আমার গ্রামের ভ্রমন শেষ। অনেকবারই একেবারে বাড়ির আস্তানা থেকে ফিরে এসেছি, হয়তো বাড়িতে ঢোকার ইচ্ছেও হয় নাই। এখন বাড়িটাতে থাকে আমার এক অবিবাহিত ভাগ্নে যে সারাদিন শুধু গাজা খায়। গাজায় কি সুখ সেটা আমি জানি, তবে বেশীদিন গাজা খেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। সে তখন নিজেই গাজায় পরিনত হয়। যেতে ভালো লাগে না। চুরি ওর অভ্যাস, গাজা ওর খাবার আর মথ্যা কথা বলা ওর স্বভাব। ফলে ওখানে গেলে মনটা খারাপ হয়ে যায়, যেতে ইচ্ছে করে না।
আজ হটাত করেই আবার ইচ্ছে করে গ্রামে আসলাম। গ্রামটাকে আমি চিনতেই পারছিলাম না। অসংখ্য বাড়িঘর যত্রতত্র এখানে সেখানে উঠে গেছে। পায়ে চলার রাস্তাটাও আর আগের মতো নাই। আমার স্পষ্ট মনে আছে সেই ১৯৭৮/৭৮ সালের আমার গ্রামের বিন্যাশ। গ্রামের একেবারে পুর্ব পাশে ছিলো দৌলত মেম্বারদের বাড়ি যেখানে একটা গুচ্ছ পরিবার থাকতো। তাদের বাড়ির ঠিক পশ্চিম পাশেই ছিলো ইয়াকুবদের বাড়ি। পরে শুনেছি এই ইয়াকুব নাকি মেম্বার হয়েছিলো তাই ওদের বাড়ির নাম এখন ইয়াকুব মেম্বারদের বাড়ি বললেই সবাই চিনে। ইয়াকুবদের বাড়ি পার হয়ে আরো পশ্চিমে এলে পড়ে খালেক এবং সেকান্দরদের বাড়ি। সেকান্দরকে আমি মামু বলে ডাকতাম। এই সেকান্দর মামু এমন একজন মানুষ ছিলেন যে, সবার সাথেই তিনি মিশতে পারতেন। বেশ গরীব হলেও উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন না। প্রতিদিন আমরা স্কুলের মাঠে খেলতে গেলে, তাঁকে সেখানে পাওয়া যেতো। স্কুলের মাঠ ছিলো বড়দের তাশ খেলার আড্ডা আর ছোটদের বল খেলার প্রতিযোগিতা। সরগরম হয়ে উঠতো স্কুলের মাঠ। যারা খেলতেন না, তারাও কেউ কেউ হুক্কা বিড়ি নিয়ে মাঠের চারিদিকে খেলা দেখতো যেনো প্রতিদিনই ম্যারাডোনার আর মেসির খেলা হচ্ছে। এই ফুটবল খেলায় আমি আর মুসা একটা ট্রিক্স সবসময় করতাম যাতে আমি আর মুসা সব সময় একই টিমে থাকি। সেটা পরে বলি। যেই না মাগরেবের আজান পড়লো, সবাই যার যার বাড়িতে যাওয়া। অদ্ভুত একটা সময় পার হয়েছে তখন।
সেকান্দর মামুদের বাড়ির পশ্চিমেই ছিলো আরজুদের বাড়ি। আরজুদের পেশা ছিলো মাছ বিক্রি করা। আরজুরা আমাদের থেকে অনেক বয়সে বড় ছিলো। আমাদের গ্রামের বেশীরভাগ মানুষেরই পেশা ছিলো মাছ ধরা আর মাছ বিক্রি করা। কিন্তু কোনোভাবেই এটা জেলেপাড়ার মতো না। আরজুদের বাড়ির উঠোন ছিলো অনেক বড় আর এই উঠোনের চারিদিকে ছিলো ওদের অন্যান্য পারিবারিক বাড়িঘর। আরজু মাঝে মাঝে এমন করে মদ খেতো যে, বাড়ির বড়রা ওকে অনেক মারলেও আরজু বেহুশ অবস্থায় উঠোনে বৃষ্টিতে ভিজতো। সবাই ভাবতো মদ খেয়ে বেহুস হলে উঠোনে বৃষ্টিতে ভিজিয়ে রাখতে হয় মনে হয়। আরজু তখনো বিয়ে করে নাই। আরজুদের বাড়িকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিন দিকে একটু এগুলেই নতুন একটা বাড়ি উঠেছিলো। ওরা আমাদের গ্রামের বাইরে থেকে মাইগ্রেট করে সবেমাত্র এই গ্রামে এসেছে। সে পেশায় ছিলো গ্রাম্য ডাক্তার, নাম নুরু ডাক্তার। বর্তমানে সেই নুরু ডাক্তারের বাসা রাজেন্দ্রপুর এবং তার এক ছেলে শাহীন উপজেলা চেয়ারম্যান হিসাবে রাজনীতি করে। যাই হোক, আরজুদের বাড়ির পশ্চিমেই ছিলো ফুল্মতি আপারদের বাড়ি। ফুল্মতি আপা আমার খালাতো বোন। তাদের বাড়িটা ফজলুদের বাড়ি নামে পরিচিত ছিলো। ফজলুরা তিন ভাই ছিলো। এখন তারা আর কেউ বেচে নাই। তাদেরও পেশা ছিলো মাছ বিক্রি তবে কৃষি কাজও করতো ওরা। ফুলমতি আপার জামাই এর একটা নেশা ছিলো। মাঝে মাঝেই অন্য মাইয়া লোক নিয়া মসকরা করতো। খারাপ জায়গায়ও মনে হয় যেতো। সবাই ওকে একটু অন্য নজরেই দেখতো বলে আমার ধারনা। ফজলু ভাইদের বাড়ির পশ্চিমে বেশ কিছুটা জায়গা খালি ছিলো। হেটে হেটে এলে প্রথমেই পড়তো জামাল, শাখাওয়াতদের বাড়ি। জামালকে আমি খুব বেশী দেখি নাই। জামাল ১৯৭২ সালের পরে আমাদের গ্রামে আর দেখা যায় নাই। জামাল ছিলো আসল মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে জামাল যুদ্ধে গিয়েছিলো। সম্মুখ সমরে সে অংশ নিয়েছিলো। দেখতে খুব সুন্দর ছিলো জামাল। আর স্বাস্থ্য ছিলো একদম সঠিক যুবকের মতো। অনেকে বলে যে, জামালকে কেউ মেরে ফেলেছে অথবা জামাল ইচ্ছে করেই আর এই গ্রামে ফিরতে চায় নাই। আমার ধারনা, জামালকে কেউ মেরে ফেলেছিলো কারন ১৯৭২ সালে তাঁকে এক পরদেশী মেয়ের সাথে একবার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে দেখা গিয়েছিলো। জামালের ভাই শাখাওয়াত, করিম (ডাক নাম বাছন), রুপচান এরা গ্রামেই থাকতো। বর্তমানে রুপচান বিদেশ থাকে, শাখাওয়াত মারা গেছে। করিম (বাছন)ও মারা গেছে। করিমকে সবাই বাছন বলেই ডাকতো। তিনি আমাদের থেকে অনেক বয়সে বড় ছিলো। বাছনকে আমি কাকা বলে ডাকতাম। আমি যখন আর্মিতে চাকুরী করি কমিশনড অফিসার হিসাবে, হটাত একদিন দেখলাম বাছন কাকা সোনালি ব্যাংক ক্যান্টনমেন্ট কর্পোরেট ব্রাঞ্চে সিকিউরিটির কাজ করেন। আমাকে দেখে উনি খুব খুশী হয়েছিলো যে, তারই এক পরিচিত মানুষ আর্মিতে অফিসার এবং সেই সেনানীবাসেই তার চাকুরী। খুবই সমীহ করতেন আমাকে। আমিও কাকা বলতাম, উনিও আমাকে কাকা বলতেন।
এই জামালদের বাড়ির উত্তর দিকে জরাজীর্ন একটা বাড়ি ছিলো জামালদেরই এক আত্তীয়ের, নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না এই মুহুর্তে। সম্ভবত শাখাওয়াতদের বাড়ি ছিলো ওটা। খুব গরীব ছিলো শাখাওয়াতরা। জামালদের বাড়ি আর ঐ শাখাওয়াতদের বাড়ির মাঝখান দিয়েই গ্রামের হেটে চলা রাস্তাটা পশ্চিম দিকে চলে গেছে। জামালদের বাড়ির পশ্চিমেই ছিলো রফিক মাষ্টারদের বাড়ি। রফিক মাষ্টারকে আমি ভাইও বলতাম আবার স্যারও বলতাম। কারন তিনি আমার বড় ভাইয়ের সমসাময়ীক আবার আমার প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। একটু তোতলা ছিলেন কিন্তু খুব ভালো মানূশ ছিলেন। তার একটা ছেলে ছিলো নাম, কাজল, আর একটা মেয়ে ছিলো। রিফিক ভাইয়ের স্ত্রী খুব মিষ্টি চেহাড়ার ছিলেন। বর্তমানে কাজল একটা দূর্ঘটনায় পড়ে প্রায় প্যারালাইসিস। হামদর্দে চাকুরী করতো। রফিক ভাই চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছেন। অনেক বয়ষ্ক মানুষ, আমার অফিসে প্রায়ই আসেন এবং গল্প হয়, ভালো লাগে। রফিক ভাইদের বাড়ির ঠিক পশ্চিমে ছিলো আরদশ আলীদের বাড়ি। ওরা চার ভাই এবং কোনো বোন নাই ওদের। রফিক ভাইদের বাড়ি থেকে শুরু হয় “বড় বাড়ি”। এই আরদশ আলীর অন্যান্য ভাইয়েরা হলো সার্থক আলী, মোনজর আলী, সুন্দর আলী আর একজন, নামটা মনে পড়ছে না। এই বাড়ির সব বউরা প্রায় আসর নামাজের পর ধান বারা বানতো। ওরা বেশ সচ্ছল ছিলো। এদের বাড়ির দুই ধার দিয়া উত্তর দিকে যাওয়া যেতো। রফিক ভাইদের বাড়ি আর আরদশ আলীদের বাড়ির মাঝে দিয়েও উত্তর দিকে নামা যেত আবার আরদশ আলীদের বাড়ির পশ্চিম ধার দিয়েও উত্তর দিকে নামা যেতো। এই দুই ধারের যে কোনো রাস্তা দিয়েই উত্তর দিকে প্রায় ২০০ গজ হেটে গেলে দুটু বাড়ি পড়তো। একটা আমাদের বাড়ি আর তার সাথে আম্বর আলী কাকাদের বাড়ি। এই দুটু বাড়ি আসলে গ্রাম থেকে একটু আলাদা থাকায় সবাই “টেক্কা বাড়ি” বলে জানতো। আমাদের বাড়ি থেকে গ্রামের দিকে তাকাইলে গ্রামের পুব পাশ থেকে শুরু করে পশ্চিম পাশের বাড়ি পর্যন্ত সব দেখা যেতো। যাই হোক, এই আরদশ আলিদের বাড়ির উঠোন ছিলো বেশ বড়। আমরা ওখানে “কুতকুত” খেলতাম। আর উঠোনের ঠিক দক্ষিনে একটা দোকান ছিলো। এই দোকানে কেউ চা খেতে বসতো, ক্রেউ বিড়ি খাইতো, আর আমি মাঝে মাঝে শুধু মানুষদেরকে লক্ষ্য করার জন্য বসে থাকতাম কারন কোন মানুষ কি কারনে বসে থাকে, বসে বসে কি কথা বলে, কেনো বলে, কার বাড়িতে কি সমস্যা, কার সাথে কার ঝগড়া, কার সাথে কে কি মজা মারতাছে, কোথায় কার কি পরিকল্পনা সব জানা যেত। আমি বেশ ছোট ছিলাম বলে আমাকে একটা বোকা বা আহাম্মক মনে করে আমার সামনেই সবাই সব কথা বলতে পারতো। আমি মনে মনে এসব ভাবতাম আর মানুষ গুলিকে বুঝবার চেষ্টা করতাম। এটা আমার এক প্রকারের নেশাই ছিলো বলা যায়। দোকানটার লাগোয়াই হলো পায়ে চলা গ্রামের বাড়ির ভিতর দিয়ে চলা পথ। রফিক ভাইদের বাড়ির দক্ষিনে গেলে পড়তো বাহারউদ্দিনদের বাড়ি। বাহার উদ্দিন আমার ক্লাসে পড়তো। ওর বাবারা তিন ভাই ছিলো। আক্কেল আলী, বাহারের বাবা আর আলমাস। আক্কেল আলীর পেশা ছিলো “চুরি” করা, আলমাসের পেশা ছিলো “চুরি”র সাথে মাছ ধরাও। শুধু বাহারের বাবাই ছিলো ভালো মানুষ। শুনেছি আক্কেল আলীর সব ছেলেরাই নাকি এখন চুরিই করে। তার মধ্যে হাতিম আলি একজন। আলমাস, আক্কেল আলী এবং বাহারের বাবা কেউ এখন আর বেচে নাই। ওরা রফিক ভাইয়ের চাচাতো ভাই।
আরদস আলীদের বাড়ির পশ্চিম লাগোয়া যে রাস্তাটা গেছে আমাদের বাড়ির দিকে সেই রাস্তার সাথে লাগোয়া ছিলো অরিজিনাল “বড় বাড়ি”। অর্থাৎ গনি মাদবরের বাড়ি। বেশ বড় পরিবার। গনি মাদবরেরাই আসলে গ্রামকে নিয়ন্ত্রন করতো। জমিদার স্টাইলে। গনি মাদবরেরা মোট চার ভাই ছিলো। গনি মাদবর, সিদ্দিকের বাবা (নামটা মনে নাই) হাকিমের বাবা (নামটা মনে নাই), সাত্তারের বাবা (নামটা মনে নাই), ল্যাংরা রফিকের বাবা আর কাদেরের বাবা আজিজ খালু। আজিজ খালু মসজিদে মাঝে মাঝে ইমামতি করতেন। কিন্তু তার ঘরেই সব ছিলো জালিমের মতো সন্তান। কাদের, ইনসান, কুতুব, আরো একজন (নাম মনে নাই) এরা ছিলো আজিজ খালুর পোলা। এই বড় বাড়িটা ছিলো জোয়ান ছেলে দিয়ে ভর্তি। এদের মধ্যে যিনি কাদের নামে পরিচিত ছিলো, সে ছিলো বেশ শ্যামলা কিন্তু ভীষন সুইট চেহারার লোক। সরাসরি ১৯৭১ সালে যুদ্ধে ছিলো। আমি সাধীনতার পরেও দেখেছি তাঁকে হাতে অস্র নিয়ে ঘুরতে। খুবই সাহসী ছেলে ছিলো। এই কাদের ভাই, সামসু ভাই, রফিক (ল্যাংরা রফিক), মাষ্টার রফিক, এরা সবাই সমসাময়িক ছিলো। সাধীনতার ঠিক পর পরই কাদের ভাই একটা ডাকাতী দল গঠন করে ফেলেছিলো। ওরা প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় অস্র দিয়ে ডাকাতি করা শুরু করেছিলো। ওদের ভয়ে কেউ কোনো কথা বলতে পারতো না। আমার ভাই হাবীবুল্লাহ সব সময়ই ওদেরকে এসব খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য উপদেশ দিতো এবং তিনি কখনো এসব কাজকে সাপোর্ট করতেন না। তখন দেশে একটা দূর্ভিক্ষ চলছিলো কিন্তু বড় বাড়ির কখনো দূর্ভিক্ষে সাফার করতে হয় নাই বরং ওদের কাছে সব কিছুই থাকতো সারপ্লাস। এই আজিজ খালু আবার বিয়ে করেছিলো গ্রামের পুর্ব প্রান্তে বসবাসকারী দৌলত মেম্বারের বোন। দৌলত মেম্বারের সাথে এই “বড় বাড়ির” সম্পর্ক সব সময়ই ছিলো সাপে নেউলের মতো। একটা শক্তি আরেকটা শক্তিকে কখনোই মূল্যায়ন করতো না বরং যখনই সুযোগ পায় তখনই এক পরিবার অন্য পরিবারকে আঘাত করার চেষ্টা করতো। এই রেষারেষির ফলে দৌলত মেম্বারের ইমিডিয়েট আপন ছোট ভাই অর্থাৎ মুসার বাবা আর মুসার ছোট ভাই মাসুদকে প্রান দিতে হয়েছিলো। মানে হত্যা। মুসার ভাই মাসুদ ছিলো আমার থেকে ২/৩ বছরের ছোট। একদিন কোনো এক বর্ষাকালে মাসুদকে কুকুরে কামড়ে দিয়েছিলো। ঐ সময় খুব নামকরা ডাক্তার ছিলো একজন হিন্দু লোক, যাকে সবাই “বগা” ডাক্তার নামে চিনতো। আমার স্পষ্ট মনে আছে এই বগা ডাক্তারকে। প্রায়ই তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন। কিন্তু উনি বাস করতেন বিবির বাজার এলাকায়। আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় ৩/৪ কিলমিটার দূরে। তখন বিবির বাজার ছিলো এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাজার। রবিবার আর বৃহস্পতিবার বসতো বাজার। মাসুদকে কুকুরে কামড়ানোর কারনে মাসুদের বাবা মাসুদকে নিয়ে বিবির বাজারের দিকে একটা ছোট কোষা নিয়ে যাচ্ছিলেন। ভরা বর্ষা। পথের মধ্যে হটাত করে বড় বাড়ির সামসু, কাদের আর ল্যাংরা রফিকের সাথে দেখা। ওরাও অন্য নৌকায় ছিলো। তখন সকাল প্রায় ১০ টা। প্রকাশ্য দিবালোক। এই প্রকাশ্য দিবালোকে হটাত করে নদীর মধ্যে সামুসু ভাই এর লিডারশীপে মাসুদের বাবাকে জবাই করা হয় আর মাসুদকে পানিতে আছাড় মারতে মারতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। গ্রামের মানুষ দ্রুত অন্য নৌকা দিয়ে ওদেরকে রক্ষা করতে গিয়েও আর পারে নাই। এর মধ্যেই এরা পালিয়ে যায়। এবার “বড় বাড়ি”র সাথে দৌলত মেম্বারদের বাড়িত শত্রুতাটা একেবারে প্রকাশ্য হয়ে তীব্র আকার ধারন করে। এর ফলশ্রুতিতে মামলা হয়, কেস হয়, বড়রা গ্রাম থেকে পালিয়ে দূরে বাস করতে শুরু করে, আরো অনেক প্রানহানী হয়, সেই সাথে কাদেরও খুন হয়। কাদেরের খুন এখনো একটা রহস্যজনক অবস্থায় আছে। কিভাবে কাদের খুন হলো সেটা পরে বল্বো। এই “বড় বাড়ী’তে তাদের নিজস্ব মসজিদ এবং নিজস্ব করবস্থান ছিলো যা এখন মসজিদটা আরো বড় হয়েছে বটে কিন্তু কবরস্থানটা ধীরে ধীরে ছোট হতে হতে প্রায় বিলীন। ঐ কবরস্থানেই শুয়ে আছেন আমার মা আর আমার খালা। এটা সিদ্দিকদের বাড়ির একেবারেই লাগোয়া আর আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র ৫০/৬০ গজ দূরে।
সিদ্দিক ভাইদের বাড়ির ঠিক পশ্চিম পাশেই লাগোয়া ছিলো পিয়ার আলী নামে ওদের বাড়ি। লম্বা মানুষ, কোনোদিন শার্ট পরেছে কিনা আমার চোখে পড়ে না। মাছ বিক্রি করতো। গ্রামের মধ্যে যে কয়জন গরীব হালের মানুষ ছিলো, পিয়ার আলিরা তার মধ্যে অন্যতম। কোনো রকমে বেচে ছিলো। ঘরটাও খুব জরাজীর্ন ছিলো। কিন্তু মানুষ হিসাবে ছিলো অত্যান্ত ভালো। খুব সকালে দেখতাম পিয়ার আলী, মাথায় মাছের খাড়ি নিয়ে খালী গায়ে মাছ নিয়ে সদরঘাট বা শ্যামবাজারে যেতো। আমাদের গ্রামে আসলে যে কয়জন খুব সকালে দল বেধে মাছের খাড়ি নিয়ে হু হু করে খালী গায়ে ছুটতো শ্যমবাজারের দিকে তারা সবাই আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই যেতো। আম্বর আলী কাকা, পিয়ার আলী, আরজু, আরদস আলীর বড় ভাই, আরো অনেকে। ওরা ফিরে আসতো প্রায় দুপুরের দিকে। তারপর আর ওদের কোনো কাজ থাকতো না। ফলে এই দলটা মাঝে মাঝেই বাঙলা মদ খেতো।
এই পিয়ার আলীদের বাড়ির ঠিক পশ্চিমে ছিলো মংগল মাদবরের বাড়ি। খুব সুশ্রী একজন সুন্দর মানুষ। তার কোনো সন্তান ছিলো না। বড় বউ ছিলেন বাঞ্জা, তাই তিনি সন্তানের আশায় মংগল মাদবর আরেকবার বিয়ে করেন। দুটু বউই ছিলো অসধারান সুন্দুরী। দুই বউ ই পান খেতো। সুন্দুরী মেয়েরা পান খেলে আরো সুন্দর লাগে। গ্রামে যে কয়টা টিউব ওয়েল ছিলো গ্রামের মানুষের পানি নেয়ার জন্য, এই মংগল মাদবরের বাড়িতে ছিলো একটা। আমরা সবসময় এই বাড়ি থেকেই মাটির কলসীতে করে পানি আনতাম। বড় বউ তার সন্তান হবে না জানার পর একটি পালক ছেলে নিয়েছিলেন, যার নাম ছিলো শহীদ। শহীদ আমার ক্লাসেই পড়তো। মংগল মাদবর একবার মেম্বার পদে নির্বাচনে দাড়িয়েছিলেন কিন্তু তিনি পাশ করেন নাই। মংগল মাদবরের নির্বাচনী ক্যাম্পাসে আমরা শহিদ সহ স্লোগান দিতাম টিনের চোঙ্গায় করে। তখন শহীদ নিজেও বলতো- আমার ভাই তোমার ভাই, মংগল ভাই মংগল ভাই। আমরা শহীদকে বলতাম, ঐ মংগল মাদবর না তোর বাপ? ও বলতো, হ আমার বাপই তো। এতো বোকা একতা ছেলে ছিলো যে অনেক মায়া হয় এখন ওর জন্য। কার যে ছেলে ছিলো শহীদ আমরা জানতেই পারতাম না। যাইই হোক, মেম্বার পদে মংগল মাদবর পাশ করে নাই কিন্তু পাশ করেছিলো খুনের চরের লালচান ভাই যিনি পরে লালচান মেম্বার নামে পরিচিত ছিলেন। খুব ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। মংগল মাদবর নিজেও একজন সচেতন এবং ভালো মানুষ ছিলেন। অনেক ধনী ছিলেন তিনি। ছোট বউ এর ঘরে পর পর চার জন মেয়ে হয়েছিলো, পরীর মতো সুন্দুরি মেয়েগুলি। তারমধ্যে নাজমা, সালমা অন্যতম। আজ ওরা কোথায় আমি জানি না। নাজমা আমার থেকে প্রায় ৩/৪ বছরের ছোট ছিলো। মংগল মাদবর আর বাহারের বাবা, রফিক মাষ্টার, আক্কেল আলী, আলমাস, বাছন, জামাল, এরা এক বংশের লোক। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো মংগল মাদবর ঐ সব লোকদের থেকে একটু দূরে বাড়ি বানিয়েছিলেন (প্রায় ২০/২৫টা বাড়ির পরে পশ্চিম দিকে)। ফলে বেশীরভাগ সময়ে তাদের বংশের সাথে মংগল মাদবরের অনেক কিছুই বনিবনা ছিলো না। শুনেছি, শহীদ মারা গিয়েছিলো হার্টের কারনে। সে বিয়ে করেছিলো কিনা আমার আজ মনে নাই। কারন আমি গ্রাম ছেড়েছিলাম সেই ১৯৭৭ সালে যখন আমি ক্যাডেটে ভর্তি হই। এর পরে অনেকের সাথেই আমার আর যোগাযোগ ছিলো না।
(চলবে)
০২/০৭/২০২১-বজলু আমার বাল্যবন্ধু
কম্পিউটার সার্ফ করছিলাম। হার্ড ডিস্ক ক্লিন করার সময় হটাত করে একটা অনেক পুরানো ছবির সন্ধান পেলাম। অনেকক্ষন তাকিয়ে ছিলাম ছবিটার দিকে। মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। একটা ছবি অনেক কথা বলে। একটা ছবি একটা সময়ের ইতিহাস বলে। একটা ছবি না বলা অনেক স্মৃতি মানষ্পটে জাগিয়ে তোলে। আজকের এই ছবিটাও তেমনি একটি ছবি।
আজ থেকে প্রায় ৪০/৪১ বছর আগের কথা আমি যখন গ্রামে ছিলাম সেদিনের কথাগুলি যেনো একে একে স্পষ্ট জেগে উঠতে থাকলো আমার স্মৃতির পাতায়। আমরা কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক ক্লিন করি, তারমধ্যে আবার নতুন কোনো তথ্য লোড করি, পুরানো তথ্যগুলি অনেক সময় আর খুজে পাওয়া যায় না। হয়তো বিশেষ কায়দায় কোনো ছায়া-মেমোরি থাকলেও থাকতে পারে যা থেকে হয়তো আবার সেই ডিলিটেড কোনো তথ্য বিশেষ কায়দায় ডিস্টর্টেড অবস্থায় কিছু পাওয়া গেলে যেতেও পারে কিন্তু আমাদের ব্রেনের মধ্যে সেই শিশুকাল থেকে যতো স্মৃতি এই মেঘা হার্ডডিস্কে লোড হয়েছে, সেটা কোনো না কোনো পরিস্থিতিতে আবার জেগে উঠে অবিকল ঠিক সেই বিন্যাসে যা ক্রমান্নয়ে ঘটেছে বা ঘটেছিলো। এমনি একটা স্মৃতির পাতা আজ আমার মন আর ব্রেনের কোনে ঠিক জাগ্রত হয়ে জীবন্ত আমার দৃষ্টির মধ্যে চলে এলো- বজলু, আমার সেই ছোট বেলার অনেক প্রিয় একজন বন্ধু।
বজলু আমার খুব ভালো একজন বন্ধু ছিলো। আমাদের গ্রামের প্রায় শেষ পশ্চিম প্রান্তে ওদের বাড়ি। একই ক্লাসে পড়তাম, এক সাথে মাঠে খেলাধুলা করতাম। ওরা তিন ভাই ছিলো, বজলুই ছিলো সবার বড়। ওর বাবা ছিলো ধনী কৃষক। ওদের সামাজিক অবস্থা গ্রামের অন্যান্যদের থেকে বেশ ভালো। বজলুর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো যে, ও খুবই তোতলা ছিলো কিন্তু আমার কাছে এটা কোনো ব্যাপার ছিলো না। মজার ব্যাপার হলো, বজলু আমার সাথে যখন থাকতো, আর কথা বলতো, সে প্রায় তোতলামী করতোই না। কিন্তু যেই না অন্য কারো সাথে কথা বলতো, তার তোতলামীটা বেড়ে যেত। আমার সাথে বজলু স্বাভাবিকভাবেই কথা বলতো। ও খুব ভালো গান গাইতো। লেখাপড়ার প্রতি টান থাকলেও কেনো জানি বেশী দূর এগুতে পারে নাই। এমন না যে টাকা পয়সা টানাটানির কারনে বা অভাবের সংসারে ওকে হাল ধরতে হয়েছিলো যার কারনে লেখাপড়া করতে পারে নাই। আমাদের গ্রামের মানুষগুলির বড় সমস্যা হচ্ছে-তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠায়, কিন্তু খবর নেয় না তারা স্কুলে কি পড়ছে, কেমন করছে, কিংবা সন্তানদের কোনো গাইড লাইন দেয়ার দরকার আছে কিনা।
আমার মনে আছে যে, আমি আর বজলু ওদের বাসায় একসাথে পড়াশুনা করতাম। ওর মা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। অনেক সময় দুপুরে খাওয়া দাওয়াও করাতেন। আসলে পৃথিবীর সব মায়েরা তাদের সন্তানদের জন্য সব কিছু করতে পারে। তারা সব সন্তানদেরকে একই রকম করে ভাবেন। আমি বজলুকে অংক শিখাতাম কারন বজলু অংকে আর ইংরেজীতে কাচা ছিলো। ১৯৭৭ সালে আমি ক্লাস সেভেন থেকেই গ্রাম ছাড়ি। তার কারন আমি ক্যাডেট কলেজে চান্স পেয়ে গিয়েছিলাম। সেই থেকে বজলুর সাথে আর আমার স্কুলে পড়া হয় নাই। ক্যাডেট কলেজে বাধাধরা নিয়ম, মাঝে মাঝে ছুটি পাই, তখন বেশীরভাগ সময় আমি গ্রামেই কাটাতাম। বজলু তখনো স্কুলেই পড়ে। ছুটিতে আমার কোনো কাজ থাকতো না, কিন্তু বজলুর থাকতো। ক্ষেতে কাজ করতো, গরুগুলিকে নদীতে নিয়ে গোসল করাতে হতো। ওর বাবাকে সাহাজ্য করতে হতো, ক্ষেতে আলু কিংবা অন্যান্য শশ্য লাগাতে হতো। আমিও ওদের সাথে ওইখানে বসেই আড্ডা দিতাম। কারন গ্রামে আমার বন্ধুর সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিলো।
রাতেও আমি ওদের বাসায় অনেকদিন আড্ডা দিতাম। তোতলা হলেও গান গাওয়ার সময় বজলু কখনো তোতলামী করতো না। প্রচন্ড মায়া ছিলো ওর অন্তরে সবার জন্য। কারো সাথে ঝগড়া করেছে এমনটা দেখি নাই। পড়াশুনার চাপে আর ক্যাডেটে থাকার কারনে ধীরে ধীরে আমার এসব বন্ধুদের থেকে যোগাযোগটা আমার কমে গিয়েছিলো। প্রায় বছর তিনেক পরে আমি যখন একবার ঢাকা থেকে নারায়নগঞ্জ যাবো বলে গুলিস্তান থেকে একটা বাসে উঠেছি, হটাত কে যেনো আমার নাম ধরে ডাক দিলো। ড্রাইভার সিটে বসা একজন লোক। তাকিয়ে দেখি-বজলু। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম বজলুকে দেখে। বল্লাম-কিরে তুই ড্রাইভারি করিস নাকি? বজলু আমার হাত টেনে ধরে বল্লো, আমার পাশে বস। নারায়নগঞ্জ যাবি? বল্লাম-হ্যা। খুব ভালোই হলো। তোর সাথে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। আমার জীবনে এইই প্রথম আমার কোনো খুব কাছের মানুষ ড্রাইভার। খুব আপন মনে হচ্ছিলো। বজলু বলতে থাকলো-
তোরা সব চলে যাবার পর আমার আর পড়াশুনা হয় নাই। গ্রামে আসলে পড়াশুনার পরিবেশও নাই। বাড়ি থেকে বারবার চাপ আসছিলো কিছু একটা করার। গ্রামের বেশীরভাগ ছেলেরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছিলো। আমিও সেই লাইনেই ছিলাম। বিদেশ চলে যাবো। তাই ড্রাইভারি শিখতে হলো। লাইসেন্স পেয়েছি। ঘরে বসে না থেকে হাত পাকা করছি আবার কিছু পয়সাও কামাচ্ছি। পড়াশুনা তো আর হলোই না।
সম্ভবত সেটাই ছিলো বজলুর সাথে আমার সর্বশেষ একান্তে কথা বলা। পরে শুনেছি বজলু জাপান চলে গেছে। সেখানে অনেক বছর চাকুরী করে আবার গ্রামে এসেছিলো। আমাদের গ্রামে আমাদের সাথে পড়তো সুফিয়া নামে একটি মেয়ে ছিলো। ওর বোন সাহিদাকেই বজলু বিয়ে করেছে। তিনটা মেয়ে আছে ওর। আমার সাথে ওদের কারো কোনো যোগাযোগ ছিলো না। মাঝে মাঝে গ্রামে যেতাম ঠিকই কিন্তু ওরা দেশে না থাকায় কারো সাথেই আমার যোগাযোগ হতো না। মা যতোদিন বেচে ছিলেন, গ্রামে যাওয়া হতো কিন্তু মা ইন্তেকাল করার পর গ্রামে যাওয়াটা আমার প্রায় শুন্যের কোটায় পরিনত হয়।
২০১৮ সালে হটাত একদিন আমার ফোনে একটা ফোন এলো। আমি অপরিচিত নাম্বার সাধারনত ধরি না। কিন্তু কি কারনে হটাত করে আমি সেই ফোনটা ধরেছিলাম। অন্য প্রান্ত থেকে দেখি বজলুর কন্ঠ।
কিরে দোস্ত, কেমন আছিস? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-বজলু?
খুব ভালো লাগলো ওর কন্ঠ শুনে এতো বছর পর। বজলু বল্লো, সে দেশে এসেছে। বেশ কয়েকদিন থাকবে। তারপরেও বছর খানেক তো থাকবেই। বজলু ওর পরিবারের অনেক খবর দিলো। ওর স্ত্রী সাহিদা আমাদের প্রাইমারী স্কুলে মাষ্টারী করে। তিনটা মেয়ে, সম্ভবত মেয়েদের বিয়ের আয়োজন করছে। ওর শরীরটা নাকি ইদানিং খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। অনেক কথা মনে পড়লো-
সেই প্রায় ৪০/৪১ বছর আগে এক সাথে মাঠে খেলা করতাম, এক সাথে নদীতে গোসল করতাম, বাজারে যেতাম, মাছ ধরতাম। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে চলে যেতাম, রাত হলে কখনো স্কুলের মাঠেই জ্যোৎস্না রাতে আমরা অনেকে মিলে গান গাইতাম, বজলুই ছিলো প্রধান ভোকালিষ্ট। ওর একটা জাপানিজ গিটার ছিলো, একটা সিন্থেসাইজার ছিলো, জাপান থেকে এনেছিলো। কখনো কখনো এমন হয়েছে যে, আমিই ওদের বাড়িতে থেকে যেতাম ঘুমানোর জন্য। একটা ভীষন মিষ্টি সময় কেটেছে।
বজলু বল্লো- আমি আগামি কয়েকদিন পর তোর অফিসে আসবো। চুটিয়ে গল্প করবো। তোর সাথে খাবো। সারাদিন থাকবো আমি তোর অফিসে। এনামুল, ওয়ালী, মুসা সবাইকে নিয়ে আসবো। সেদিন আমরা সবাই তোর অফিসেই খাবো। খুব ভালো লাগলো ওর কথায়। আমি এখন বড় একটা ব্যবসায়ী, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, আমার কোনো তাড়া নাই, কোনো চাপ নাই। ভালই হবে ওরা এলে। কিন্তু বজলু কোনো তারিখ দেয় নাই কবে আসবে।
বজলুর সাথে কথা বলার পর আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, বজলু আমার অফিসে আসবে কিন্তু কবে কিংবা কখন সেটা আমার মাথাতেই ছিলো না। মনে হয়েছিলো, আসবেই তো। আমি তো অফিসে প্রতিদিনই আসি। আর আমার গ্রাম কিংবা ওরা যেখানে থাকে সেখান থেকে আমার অফিসে আসতে লাগে মাত্র ১৫ মিনিট। ওরা যে কোনো সময় নিজের সময়ে এলেই আমাকে পাবে।
এমনি এক অবস্থায় আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আমাকে কথায় কথায় ফোনে জানালো যে, বজলু নাকি অসুস্থ্য। হাসপাতালে ভর্তি। ছোট খাটো ব্যাপার মনে করতে আমিও আর ওকে দেখতে যাইনি। ভেবেছিলাম, কয়দিন পর তো দেখাই হবে। তখন জেনে নেবো ওর কি হয়েছিলো। কিন্তু তার ৩/৪ দিন পর আমার কাছে এমন একটা ব্রেকিং এবং হার্ট টাচিং নিউজ এলো যা আমি কল্পনাও করতে পারি নাই। বজলু নাকি মারা গেছে।
এই সংবাদটা আমাকে এতোটাই মর্মাহত করেছিলো যে, কেউ যেনো আমার দরজার একদম কাছে এসেও আমার সাথে দেখা করতে পারলো না। অথবা এমন একটা পীড়া যা আমাকে এমনভাবে নাড়া দিলো যা কিনা আমার নজরেই ছিলো না। বজলুকে আমি যেমন ভালোবাসতাম, তেমনি বজলু সর্বদা আমাকে মনে রাখতো। বন্ধুরা কেনো জানি ধিরে ধীরে সব হারিয়ে যাচ্ছে।
২৮/৬/২০২১-সফুরা খালা
এই মানুষগুলি একসময় আর কারো সামনেই থাকবে না। এদের জীবনেও প্রেম এসেছিলো, এরাও কারো না কারো চোখে রানীর মতো ছিলো। বাল্যকালে সাথী সংগীদের নিয়ে এরাও নদীর ঘাটে গিয়ে জিলকেলী করতে করতে সারাটা পরিবেশ মুখরীত করে রাখতো। নীল আকাশের মধ্যে জ্যোৎস্না রাতের তারার মতো তারাও রাত জেগে হয়তো কোনো এক প্রেমিক বরের অপেক্ষায় মনের ভিতর সুখের আস্বাদন করেছেন। এরা বড় বড় সংসারের হাল ধরেছেন, সমাজে এরাও অনেক অবদান রেখেছে। এদের গর্ভে জন্ম নেয়া অনেক সুপুত্র কিংবা সুন্দুরী কন্যারা হয়তো আজো দেশে বিদেশে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু আজ তারা এতো চুপচাপ জীবন যাপন করছেন যেখানে তিনি নিজে ছাড়া আর কেউ পাশে নাই। না তার রাজা আছে, না তিনি এখন রানী আছেন। সময় মানুষকে কত পরিবর্তন করে দেয়। এই সময়ের কাছে আজো কেউ স্বাধীনতা পায় নাই, না পেয়েছে কোনো ক্ষমতা সময়কে পরিবর্তন করার। আদি যুগ থেকে যতো মানুষ এই দুনিয়ায় এসেছে, সবাই কোনো না কোনো সময় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এই পৃথিবীকে ত্যাগ করতে হয়েছে। আমরা যারা পিছনে পড়ে থাকি, তারা শুধু একটা মোহ, একটা স্মৃতি আর একটা কি যেনো নিয়ে শুধু অলীক ভাবনার জগতে অপেক্ষায় থাকি। একদিন আমিও এর থেকে পরিত্রান পাবো না। শুধু সময়টা পালটে যাবে এই রানীদের মতো।
কিন্তু আমার মনের ভিতরে এই সব রানীরা আজীবন রানীদের কিংবা রাজাদের মাতাই হয়ে থাকবেন। আমি এদেরই বংশের একটি ধারা। আরো বেচে থাকো তোমরা অনেক কাল খালা।
জীবন যেখানে যেমন। যে শিশুটি আজ জন্ম নিলো কেউ জানে না তার জন্য এই পৃথিবী কি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিংবা এই পৃথিবীকে সে কি দিয়ে যাবে। হতে পারে আজকে এই শিশুটি হয়তো এই পৃথিবীকে কোনো এক সময় নাড়িয়েও দিতে পারে বা এই পৃথিবী তাকেও নাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু এমন অনেক শিশুই এই পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয়, না তারা কোনো ভূমিকা রাখে, না পৃথিবী তাদেরকে মনে রাখে। এমন মানুষের সংখ্যাই বেশী। যুগে যুগে তারপরেও অনেক শিশু প্রকাশ্যে বা গোপনে পৃথিবীতে আসে যারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় আর একদিন সব কিছু ফেলে সবার থেকে আলাদা হয়ে আবার কোথাও অদৃশ্য হয়ে যায়। মাঝখানের এই সময়টায় খুব গুটিকতক মানুষ হয়তো নিজের মতো করে কাউকে কাউকে মনে রাখে কিন্তু তাও একসময় মনের স্মৃতি থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়। আমার সফুরা খালা, সামিদা খালা কিংবা আমার শায়েস্তা বুজি, বা সাফিয়া বুজিরা সম্ভবত এই রকমের কিছু মানুষ যারা সেই বহু বছর আগে শিশু হয়ে জন্ম নিলেও কোনো লাভ হয় নি কারো। তারা আজীবন যেনো এই দুনিয়ার বুকে একটা বোঝা হয়েই ছিলো। অথচ তারা হাজারো মানুষের থেকে অনেক ভালো মানুষ ছিলেন।
প্রায় দু বছর আগে আমি আমার পরিবার নিয়ে আমাদের গ্রাম থেকে বেশ দূরে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। বেশীক্ষন দেরী করি নাই কারন পরিবেশটা ঐ রকমের ছিলো না। কোনো রকমে আনুষ্টানিকতা শেষ করে ভাবলাম, যেহেতু গ্রামের পথেই আছি, যাই আমাদের গ্রামের বাড়িটা ঘুরেই যাই। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো, আলো বেশ কমে গিয়েছিলো। অনেকেই আমাকে চিনে না যদিও আমি এই গ্রামেরই একজন পুরানো বাসিন্দা। কিন্তু সময়ের সাথে আমার অনুপস্থিতি আমাকে আজ এই গ্রামে একজন নবাগত অতিথির মতোই মনে হচ্ছিলো। যারা আমার সমবয়সী ছিলো, তারাও অনেক বুড়ো হয়ে গেছে, অনেকেই চিনতেও ভুল করছিলো, আমি তো ওদের কাউকেই এখন চিনি না। ওদের চেহারা সুরুতে এমন বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে যে, জোয়ানকালে আমি যাদেরকে দেখেছি, তারা এখন দাদা নানার পর্যায়ে। না চেনারই কথা। তারপরেও কাউকে কাউকে আমি চিনতে পারছিলাম। গ্রামের বাড়িটা খা খা করছে, কেউ থাকে না এখানে। আগে মা থাকতেন, এখন থাকে আমার এক ভাগ্নে যে সারাদিন গাজা খায়।
ভাবলাম, আমার এক খালা ছিলো। নাম সফুরা বেগম। উনি কি জীবিত আছেন নাকি আর জীবিত নাই সেই খবরটাও আমার জানা নাই। তাঁকে খুব দেখতে মন চাইলো। মিটুলকে বললাম, চলো একটা বাড়িতে যাই। যদি উনি বেচে থাকেন, তাহলে মায়ের অভাবটা কিছুটা হয়তো পুরন হবে। আর যদি জীবিত না থাকেন, অন্তত জানতে পারবো, কবে থেকে আর তিনি এই পৃথিবীতে নাই। আলুকান্দা তার বাড়ি। অনেক খোজাখুজির পর শেষ অবধি সফুরা খালার বাসায় যেতে পারলাম। তিনি অসুস্থ্য। জর। একটা কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। চার পাঁচ দিন নাকি তিনি কিছুই খাচ্ছেন না। অনেক বয়স হয়ে গেছে। আমার মা যখন বেচে ছিলেন, তখন আমার এই খালা প্রায়ই আমার মায়ের সাথে দেখা করতেন, গল্প করতেন। আমাকে খুব আদরও করতেন। আসলে আমার মা, আমার সামিদা খালা আর এই সফুরা খালা এতোটাই ভালো আর নীরিহ মানুষ ছিলেন যে, তাদের ব্যাপারে আজ অবধি কেউ কোনো অভিযোগ করেছে সে ঘটনা ঘটে নাই। খালাকে ডাকা হলো। উনি ভালো মতো চোখে দেখেন না। এম্নিতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো, তারমধ্যে আবার আকাশ ছিলো খুব মেঘাচ্ছন্ন। বিদ্যুৎ ছিলো না। কোন রকমে খালাদের বাসায় যাওয়ার পর, আমি খালার বিছানায় গিয়ে বসলাম। খালাকে তার পুত্রবধুরা ডেকে তোলার চেষ্টা করলেন। আমাই যাওয়াতে সবাই অনেক খুশী হয়েছে। কি থেকে কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না।
খালাকে যখন আমি বললাম, আমি মেজর আখতার এসছি। খালা এম্নিতেই কানে কম শুনে মনে হয়, তার মধ্যে আমার নাম শুনে যেনো একটা অদ্ভুত মিথ্যা কথা শুনলেন এমন হলো। বল্লো-
কে? হামিদার ছেলে?
বললাম, হ্যা খালা।
উনার জর ছিলো প্রায় ১০৩ ডিগ্রী। আমার কথা শুনে তিনি বিছানা থেকে উঠে বসলেন। খালা প্রায় গত চার পাঁচ দিন বিছানায় উঠে বসতে পারেন না। কিন্তু আজ যেনো কোন অলৌকিক শক্তিতে তিনি একাই বিছানায় উঠে বসে পড়লেন। আমি খালাকে জড়িয়ে ধরলাম, খালাও আমাকে এমন করে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলেন যেনো এইমাত্র বাইরের মেঘাচ্ছন্ন আকাশটা ঘনকালো ঝপ ঝপ বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিলো সারাটা উঠান।
কতটা আদর? কিভাবে আদর করলে ভালোবাসা হয় মায়েদের? আমার সেটা জানা ছিলো। আমার মাও ঠিক এভাবেই আমাকে আদর করতেন। আমার মুখে দুই হাত দিয়ে একদম চোখের কাছে আমার মুখটা নিয়ে পানভর্তি মুখে ভিজা ভিজা চোখে ফিক করে হেসে দিয়ে বলতেন, অনেক বড় হ বাবা। আমার দোয়া আর দোয়া রইলো। সফুরা খালার ভাষাও এক। কি অদ্ভুদ। আমি তাঁকে কতোক্ষন জড়িয়ে ধরেছিলাম, আমার জানা নাই। সারাটা শরীর হাড্ডি, মাংশ বলতে কিছুই নাই। গরীব ছেলেপেলেরা যতোটা পারে তাদের মায়ের যত্ন নেয় বটে কিন্তু অন্তরের ভালোবাসায় হয়তো অনেক ঘাটতি আছে। তারপরেও তিনি বেচে আছেন যেটুক পান সেটা নিয়েই।
আমার মায়ের বাবার নাম ছিলো কেরামত আলী। আমার মায়ের কোনো ভাই ছিলো না। মাত্র দুইবোন- হামিদা খাতুন আমার মা আর সামিদা খাতুন আমার আপন খালা। কিন্তু সফুরা খালার বাবার নাম ছিলো চেরাগ আলি। তারও কোনো ভাই অথবা কোনো বোন ছিলো না। তিনি একাই একমাত্র কন্যা সন্তান ছিলেন চেরাগ আলীর। এই চেরাগ আলি এবং কেরামত আলি (মানে আমার নানারা) ছিলেন চার ভাই। অন্যান্য আর দুই ভাই ছিলেন সাবেদ আলি এবং লষ্কর আলী। উম্মেদ আলী ছিলেন এই চার ভাইয়ের বাবা। অর্থাৎ আমার মা খালাদের নানা।
আজ তারা কেহই বেচে নাই। শুধুমাত্র আমার সফুরা খালাই বেচে আছেন কালের সাক্ষী হয়ে। খুব ভালোবাসি আমি তোমাদের।
২২/০৬/২০২১-দ্বিমুখী জীবন
You are required to login to view this post or page.
২১/০৬/২০২১- মৃত্যু
মৃত্যুকে মানুষ আধারের সাথে তুলনা করে থাকে। কিন্তু এই আধার কোনো কালো রাত কিংবা অমাবশ্যার নিশি বা দিনের আলোর অভাবে নয়। যা চোখে দেখা যায় না, যার ব্যাপারে আমাদের মন এবং মস্তিষ্ক কোনো ধারনা করতে পারে না, আমাদের কাছে সেটাই একটা আধারের মতো। এই আধার কিন্তু অন্ধকার নয়, এটা এমন একটা আধার যার কোনো রং নাই, যার কোনো বর্ননা আজো কেউ দিতে পারে নাই। মানুষের হাজারো শখ থাকে। বেচে থাকার শখ, সম্পদশালী হবার শখ, অনেক ক্ষমতাধর হবার শখ, কিন্তু আজো পর্যন্ত কেউ এটা শখ করে নাই যে, সে মরতে চায়। যারা আত্তহত্যা করে, তারা ইমোশনাল, তারা শখের বশে মরনকে বরন করে না। মৃত্যু কোনো ইচ্ছে নয় যে, পুরন হবে কি হবে না, মৃত্যু তো একটা সত্য, একটা লক্ষ্য যেখানে সবাইকে যে কোনো মুল্যেই পৌছাতে হবে। আর ওখানকার সমন, গাড়ি অথবা বাহক কখন আসবে, সেটা তো কেহই বলতে পারে না। এই মৃত্যু অনেক সম্পর্ক ছেদ করে আবার এই মৃত্যুই অনেক নতুন সম্পর্ক তৈরী করে। কখনো কখনো মৃত্যুটাই যেনো অনেক সমস্যার সমাধান নিয়ে আসে। যদিও যার বেলায় ঘটে সে সমস্যা ছিলো না।
মৃত্যুর কারনে এমনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যেখানে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয় অথবা মেনে নিতে শিখতে হয়। হোক সেটা ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। যখন কোনো মানুষ কিছুই না বলে সে তার পরিবার থেকে হটাত করে উধাও হয়ে যায়, তখন ব্যাপারটা অনেক দুসচিন্তার কারন হয়ে দাঁড়ায়। এটা আরো বেশী করে দুশ্চিন্তায় ভোগায় যখন এটা জানা যায় যে, যে মানুষটি চলে গেছে সে সব দিক থেকে অশান্তিতেই ছিলো।
কিন্তু কোনো মানুষ যখন কাউকে না বলে চিরতরে আমাদের জীবন থেকে চোখের সামনে মৃত্যুর থাবায় হারিয়ে যায়, আর আমরা তাকে চোখের জলে ভিজিয়ে বিদায় জ্ঞাপন করি, তখন হয়তো তার দ্বারা কোনো ভুল পদক্ষেপের দুশ্চিন্তা আমাদের গ্রাস করে না, কিন্তু তার চলে যাওয়ায় যারা বেচে থাকেন তাদের জীবনে আমুল পরিবর্তন নেমে আসে বলে মাঝে মাঝে মনে হয় রাস্তাটা অন্ধকার, জীবনটা ভয়ংকর এবং আমরা সর্বত্রই একা। তখন একটা দিনও যেনো আমাদের ঠিকঠাক কাটতে চায় না। এমন কি একটা রাতও না। এই সময়ে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে শিখতে হয়। অন্যদিকে দিনের আলোতে এই পার্থিব জগতে বসে মৃত ব্যক্তির ব্যাপারে কোনো ধারনাই করা সম্ভব হয় না আমাদের অথচ মৃত ব্যক্তির যাত্রার শুরু থেকে শেষ অবধি রাস্তাটা তার কাছে হয়তো আমাদের থেকেও ভয়ংকর আর বিভীষিকাময়আরো অন্ধকার। এটা যেনো তার কাছে ঠিক একটা অন্ধকার টানেল, যেখানে মাঝে মাঝে আলো আসে হয়তো কিন্তু সে আলোয় কোনো কাজ হয় কিনা জানা যায় নাই।
এমন অনেক মিথ্যে মৃত্যু আসে কারো কারো জীবনে যেখানে তারা এই পার্থিব জীবনের সাথে সাময়িক সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আরেক কোনো এক অচেনা জগতে বিচরন করতে থাকে। তখন তার আশেপাশে কি হচ্ছে, কারা কি করছে, কিছুই আর তার কাছে পৌছায় না অথচ তার দেহ, তার শরীর পুরুটাই রয়েছে এই পার্থিব জগতে। এই প্রকারের মৃত্যু থেকে ফিরে আসাকে হয়তো বলা যায় কোনো মতে বাচা, হয়তো বা বলা যেতে পারে জীবনের কাছে নিশ্চিত মৃত্যুর পরাজয়, অথবা বলা যেতে পারে যে, জীবনের বেচে থাকার সময়টা এখনো শেষ হয় নাই। যখন এমনটা হয় তখন আমরা কি বলতে পারি যে, সাক্ষাত ম্রতুকে আমরা দেখতে পেয়েছি? এমন অনেক প্রশ্ন থাকতেই পারে কিন্তু আসল মৃত্যু আর মিথ্যা মৃত্যুর মধ্যে নিশ্চয় এমন কোনো ব্যতিক্রম আছে যা প্রকারান্তে একটা মায়াজালের কিংবা মেঘলা আকাশের পিছনে আবছা নীল আকাসের মতো। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারে, যদি অন্তরের দৃষ্টি খুলে যায় তখন জীবিত অবস্থায় মৃত্যুকে দেখা যায়। এটা অনেক বড় স্তরের একটা ধ্যান কিংবা আরাধনা। যারা এটাকে লালন করতে পারেন, তারা স্বাভাবিক মানুষ নন। জীবনটা কিভাবে বাচবে সেটা আমাদের হাতে, আমরা জীবনটাকে দেখতে পাই, কিন্তু এটা কিভাবে দেখবো যে, মৃত্যু কখন আর কিভাবে আসবে? সেটা আজ অবধি কেউ বলতে পারে নাই।
অফিসে যাওয়ার সময় যে মানুষটার উপর নির্ভর করে আমার সকাল হতো, রাতে ঘুমানোর আগে যে মানুষগুলির উপর ভরষা করে আমার ভালো ঘুম হতো। কারনে অকারনে যখন তখন আমাদের মেজাজ কখনো ক্ষিপ্ত কিংবা বিক্ষিপ্ত অথবা উদবেলিত হতো, যখন সে আর কাছে থাকে না, তখন অতীতের অনেক কথাই মনে পড়ে। অনেক মায়া লাগে। মনে হয়, সব কিছু থাকা সত্তেও যেনো কোনো কিছুই নাই। এই মায়া, এই ভরষা কিংবা এই বিক্ষিপ্ত চঞ্চলতার আর কোনো মুক্যই থাকে না সেই ব্যক্তির কাছে যে এই মাত্র সবার গোচরেই উধাও হয়ে গেলো চিরতরে। এই পরিবর্তনশীল সময়ে, অনেকেই হয়তো কথায় কথা বলে তারা ভালো আছেন, আমরা ভালো আছি কিন্তু তারা কিংবা আমরা জানিই না যে, আমাদের সময়টাই যে খারাপ যাচ্ছে। খুব মায়া হয় তখন। কিন্তু কেনো মায়া হয়, তার উত্তর আজো জানি না। যা হাতের মুঠোয় নাই, যা চিরতরে হারিয়ে যায়, অথচ একদিন হাতের কাছেই ছিলো, সেটার জন্য কেনো মায়া হয়, কেনো কষ্ট হয়, কেনো আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে হয়, তার ব্যাখ্যা নাই আমাদের কাছে। এর কিছু ব্যাখ্যা হয়তো দাড় করানো যায় যে, হয়তো পুরানো অভ্যাসে বন্দি মন বারবার আবার সেই পুরানো খাচায়ই ফিরে আসতে চায়। অথবা এমনো হতে পারে যে, কেউ যখন আর কাছে থাকে না, তখন হয়তো এটা পরিষ্কার বুঝা যায় নিজের কতগুলি স্বকীয়তা, অভ্যাস আর পছন্দ কতো নিঃশব্দে সেই চলে যাওয়া মানুষটি নিয়ে অন্তর্ধান হয়ে গেলো, সাথে নিয়ে গেলো তার থেকে ধারে নিয়ে বেচে থাকার আমাদের অনেক পরনির্ভরশীলতার অভ্যাসগুলিও। আর সেটা যখন পরিষ্কার হয় তখন অভাবগুলির সংকট দেখা দেয়। আমরা বিচলিত হই, ভয় পাই, কষ্টে থাকি আর তখনই তার অভাবে আমরা তার উপর মায়ায় চোখ ভিজিয়ে দেই।
তবে আজীবন একটা সত্য বচন এই যে, জীবন মানেই যাত্রা, আর এই যাত্রার শেষ প্রান্তেই থাকে মৃত্যু। অর্থাৎ জীবনের অবসানেই মৃত্যুর যাত্রা শুরু। এই নতুন পর্বের যাত্রা কখন কার কোন সময় শুরু হবে, এটা কোনো বিজ্ঞান, কোনো ডাক্তার, কোনো ধর্ম পুস্তক কিংবা কোনো ধ্যান কখনোই বলতে পারে না।
১২/০৬/২০২১-রোস্তমের টাকা চুরি-১
Categories
আমার ড্রাইভার ছিলো রুস্তম। খুবই ভালো একজন ড্রাইভার। বিয়ে করেছিলো কিন্তু রোস্তমের অভ্যাসের কারনে ওর বউ ওকে ছেড়ে দেয় কিন্তু ইতিমধ্যে ওদের একটা পুত্র সন্তান হয়ে যায়। ছেলেকে রেখেই রোস্তমের বউ রোস্তমকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করে বিদেশে সেটেল্ড হয় যায়। রোস্তমের দোষ ছিলো রোস্তম প্রায়ই ডিউটি শেষে ওর বন্ধু বান্ধব্দের নিয়ে মদের আড্ডায় বসতো যা ওর বউ পছন্দ করতো না। বউ চলে যাবার পর ছেলেকে নানীর বাড়িতেই রেখে রোস্তম ছেলেকে পালতে শুরু করলেও মদের নেশাটা ছাড়তে পারলো না। বরং মদটা যেনো ওকে আরো পাইয়ে বসলো। আমি জানতাম না যে, রোস্তম মদ খায়। কারন আমার ডিউটি শেষ করার পর রোস্তম কোথায় গেলো আর কি করলো সেটা নিয়ে আমি মোটেই খবর রাখতাম না।
এভাবেই রোস্তম আমার কাছে প্রায় ৫ বছর ড্রাইভার হিসাবে কাজ করছিলো। বিস্তস্থতা আর কোয়ালিটি ড্রাইভার হিসাবে রোস্তমের উপর আমার কোনো সন্দেহ ছিলো না। মাঝে মাঝে বেতনের বাইরেও আমি ওকে টাকা দেই, যেটা রোস্তম ও জানে যে ফেরত দিতে হবে না। আমিও চাইতাম না। রোস্তমের উপর আমার বিশ্বাস এমন হয়ে গিয়েছিলো যে, মাঝে মাঝে ফ্যাক্টরীর কোটি কোটি টাকাও একা ব্যাংক থেকে আনা নেয়া করাতাম। ভালোই চলছিলো। একদিন রোস্তম বল্লো যে, রোস্তম আসলে একা থাকে বলে ওর খাওয়া দাওয়ায় বেশ সমস্যা হয়, কাপড় চোপড় ধোয়াতেও সমস্যা হয়। ও বিয়ে করতে চায়। আমি ব্যাপারটাইয় সায়ই দিলাম। ওর বিয়ের একটা বাজেট হলো, প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো। আমি বললাম, যে, আমিই ওর বিয়ের পুরু খরচটা দেবো। দিয়েও দিলাম। রোস্তম বিয়ে করে ফেল্লো। আমাদের বাসার পাশেই থাকে রোস্তম, সাথে ওর নতুন বউ। এবার একটা নতুন ঝামেলার সৃষ্টি হলো। নতুন বউ ও নাকি রোস্তমের সাথে এডজাষ্ট করতে পারছে না। জিজ্ঞেস করলাম আশেপাশের মানুষ গুলিকে। যে জিনিষটা আমার কখনোই ভালো করে জানা হয় নাই সেটা আমার নজরে এলো। রোস্তম ডিউটি করে এসেই সারারাত মদের আড্ডায় থাকে। ফলে ৫/৬ মাস যেতে না যেতেই রোস্তমের সাথে এই দ্বিতীয় বউ ও তাঁকে ছেড়ে দিতে মনস্থ করলো। কিন্তু রোস্তম যে বাসায় থাকে সেটা রোস্তমের নতুন বউ এর ভাড়া করা বাসা।ফলে ওর বউ রোস্তমকে বাসা থেকে বের করেই ছাড়লো।
আমার দয়ার শরীর, তার উপরে রোস্তমকে ছাড়া আমি অচল। ভাবলাম যে, আমার বাসায় একটা গার্ডের রুম আছে, যেটায় কেউ থাকে না। এটাচড বাথ রুম। রোস্তমকে আমার বাসার ঐ গার্ড রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। একদিন যায় দুইদিন যায়, হটাত এক রাতে আমি দেখলাম যে, রোস্তম আমার বাসায় বসেই মদ খাচ্ছে। অনেক রাগারাগি করলাম, নিষেধ করলাম এবং সতর্ক করে দিলাম যে, আর যদি কখনো আমি ওকে মদ খেতে দেখি তাহলে আমি ওকে বাসা থেকে শুধু নয়, আমার ড্রাইভার হিসাবেও ওকে বাদ দিয়ে দেবো। রোস্তম আমার কাছে এক প্রকার প্রতিজ্ঞাই করলো যে, সে আর কখনো মদ খাবে না। কিন্তু মদের যার নেশা, সে মদ ছাড়ে কিভাবে? রাত যখন গহীন হয়, রোস্তম তার মদের বোতলের মুখ খুলে মদ পান করতে থাকে। একদিন আমিও বেশ গহীন রাতে ওর রুমে হটাত করে এসে দেখি, রোস্তম মদ খাচ্ছে। মাথা আমার ঠিক ছিলো না। আমি রোস্তমকে ঐ রাতেই আমার বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলাম। কিন্তু চাকুরীটা বাদ করিনি। রোস্তম নরম্যালি আমার ড্রাইভার হিসাবে আবারো কাজ করতে থাকে। কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হলো না। এভাবেই প্রায় মাস খানেক চলে গেলো।
গাড়িতে থাকাকালীন আমি প্রায়ই রোস্তমের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এম্নিতেই কথা বলতাম। একবার রুস্তম আমারে বল্লো যে, ওর কাছে যদি ৩ লাখ টাকা থাকে তাহলে ওর জীবন নাকি সে বদলাইয়া ফেলবে। খুব ভালো কথা। বললাম, ৩ লাখ টাকা যদি পাস, তাহলে কি করবি? রুস্তম বল্লো যে, সে ২টা পুরান সিএনজি কিনবে। একটা নিজে চালাবে আরেকটা ভাড়ায় চালাবে। তাতে প্রতিদিন সে পাবে ১২০০ টাকা। তারমানে মাসে ৩৬ হাজার টাকা। ওর খরচ লাগে মাসে ১৬ হাজার টাকা। তার মানে মাসে সে ২০ হাজার সেভ হবে। বছরে সেভ হবে আড়াই লাখ টাকা। সেই আড়াই লাখ টাকা দিয়া সে আরেকটা সিএনজি কিনবে। এভাবে ২/৩ বছর পর সে গাড়ি কিনবে। তাতে ওর প্রতি দিন লাভ হবে ২ হাজার টাকা। এভাবে সে হিসাব করে দেখলো যে, ৫ বছর পর তার হাতে আসবে প্রায় ২০ লাখ টাকা, ৩টা সিএনজি আর একটা গাড়ি।
আমি ব্যাপারটা খুব সাভাবিকভাবেই নিয়েছিলাম। আগে পিছে কিছুই ভাবি নাই। একদিন আমি রোস্তমকে নিয়ে আমার প্লাষ্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের বেতনভাতা নিয়ে গেলাম ফ্যাক্টরীতে। আমার ব্যাগে তখন দুই জায়গায় মোট ৫ লাখ টাকা ছিলো। আমি গাড়ি থেকে নেমে অফিসে বসার পর আমার অন্যান্য ডাইরেক্টরদেরকে বললাম, আমার ব্যাগে ৫ লাখ টাকা আছে, সেটা নিয়ে আসো। বেতন দিয়ে দাও শ্রমিকদেরকে। সবাই বেতনের জন্য অপেক্ষা করছে। আমার গাড়িটা আমার অফিসের একেবারেই দরজার সামনেই পার্ক করা থাকে। আমার ডাইরেক্টররা গাড়ির কাছে এসে রোস্তমকে খুজে না পেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, রোস্তম সম্ভবত গেটের দোকানে চা খেতে গিয়েছে। ওকে ফোন দিলাম, বল্লো, চা খেয়ে এখুনি আসবে। আসলে ব্যাপারটা ছিলো অন্য রকমের। রোস্তম আমার ব্যাগ থেকে এক পকেটে ৩ লাখ টাকা ছিলো, সেটা সে নিয়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে কিন্তু আমাকে জানিয়েছিলো যে সে চা খেতে গেছে যেটা সে প্রায়ই চা খাওয়ার জন্য গেটের দোকানে যায়। ওর আসতে দেরী হ ওয়াতে আমি বারবার ফোন করতে থাকি। কিন্তু এক সময় দেখলাম রোস্তমের ফোন বন্ধ। আমার সন্দেহ হলো। দোকানে লোক পাঠালাম, রোস্তম সেখানে চায়ের জন্য বসেই নাই। বুঝতে বেশী দেরী হলো না যে, সে আমার ব্যাগ থেকে ৩ লাখ টাকা চুরি করে পালিয়েছে। ফ্যাক্টরীর আশেপাশে সব খানে খোজাখুজি করার পরেও যখন আর পেলাম না, তখন মীরপুর বাসা থেকে ডুপ্লিকেট চাবী এনে আমার গাড়ি খুলতে হলো, ব্যাগ চেক করলাম, এক জায়গায় রাখা তিন লাখ টাকা নাই, অন্য পকেটে রাখা ৩ লাখ টাকা আছে।
চুরি করার পর এক মাস পালাইয়া পালাইয়া থাকলো। কোনো সিএনজি, কিংবা কিছুই কিনলো না। প্রতিদিন মদ খাইতো রাতে। একদিন মদ খাওয়ার পর কিছু বন্ধু বান্ধব জেনে গেলো ওর কাছে বেশ কিছু টাকা আছে। এক রাতে মদ খাইয়া বেহুস। ওর সব বন্ধুরা টাকা গুলি নিয়া পালাইলো। রুস্তমের আর কিছুই নাই। খাওয়ার পয়সাও নাই। তারপর একদিন সে ভাবছে, আমার কাছে আবার ফিরে আসবে কিনা। কিন্তু আর সাহস পায় নাই। তারপর না খেয়ে খেয়ে পাগলের মতো অবস্থা। আবার এদিকে পুলিশের ভয়, আমার ভয়।
অতঃপর একদিন
একদিন একতা বিশাল চিঠি লিখলো আমাকে। পোষ্ট অফিসে গেলো চিঠি পোষ্ট করতে। চিঠি পোষ্ট করলো। ২২ পাতার একটা চিঠি। চিঠির শেষ লাইনে লেখা ছিলো- যেদিন আপনি চিঠিটা পাবেন, সেদিন হয়তো আমি আর বেচে নেই স্যার। কিন্তু একটা কথা বলে যাই, আপনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু আমার সাহস কম, তাই আর বাচতে পারলাম না। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমাকে ক্ষমা কইরা দিয়েন। যেদিন আমি চিঠিটা পাই, তার প্রায় ৪ দিন আগে রুস্তম তারের কাটা গলায় দিয়ে ফাসি দিয়ে আত্তহত্যা করেছিলো। আমার প্রায়ই ওর কথা মনে পড়ে। আমি ভাবি যে, যদি রুস্তম সাহস করে আবার আমার কাছে আসতো, আমি ওকে আবার রাখতাম আমার ড্রাইভার হিসাবে। আমি ওরে ক্ষমা করে দিছি। আমিও ওকে ভালোবাসতাম। কিন্তু আমার ভালোবাসা ওকে ঠেকাতে পারে নাই। এটা আমার ব্যর্থতা। কিন্তু এটা ওরও ব্যর্থতা।
এটা কেনো বললাম জানো?
কারন, যে যেই জীবন চায়, সে সেটাই পায়। কেউ জেনে শুনে পায়, কেউ না জেনেই পায়। তোমার লাইফ আমার কাছে যতোটা মুল্যবান, সেই জীবনটা তোমার কাছে কতটা মুল্যবান, তার উপর নির্ভর করবে তোমার পরবর্তী পদক্ষেপ। আর এই পদক্ষেপ কেউ ঠেকাতে পারে না। যার জীবন, মাঝে মাঝে সেও ঠেকাতে পারে না।
১১/০৬/২০২১-কালো
Categories
কালোর মতো কোনো রং নেই। কিন্তু এমন কিছু কি আছে যা কালোকে সাদা করতে পারে? আসলে কোনো জিনিষ সাদা বা কালো হয় না। সবটাই আলোর খেলা। কিন্তু এই কালোই যখন কোনো মানুষের গায়ের রং হয় তখন এটা সবচেয়ে বিড়ম্বনার একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। কোনো কালো মানুষের গল্পের কাহিনী যদি কেউ শোনেন, দেখা যাবে গায়ের রং এর কালো মানুষের গল্পটা সবার থেকে আলাদা বিশেষ করে সেই ব্যক্তিটি হয় কোনো মেয়ে মানুষের গল্প। কালো মেয়েদের অনেক কথা তাদের মনেই রয়ে যায়। কাউকে তারা বলতেও পারে না। কে শুনবে তাদের কথা? মেয়েরা কালো হলে সেই ছোট বেলা থেকেই সমাজের সবার আকার- ইংগিতের ভাষায় তারা এটাই মনে করতে থাকে যে, কালো মুখ একটা অপয়ার ছায়া যেনো। আর এই অপবাদ থেকেই তাদের মনে এবং মস্তিষ্কে হীন মন্যতা বাসা বাধে। তাদের নিজের উপর নিজেদের কনফিডেন্স কমতে থাকে। অথচ এই কালো হয়ে জন্মানোর পিছনে তাদের না আছে কোনো হাত, না আছে তাঁকে পরিবর্তন করার কোনো ক্ষমতা। কালো রং, বা শ্যামলা রং যদি অভিশাপই হতো তাহলে “কৃষ্ণের” কালো রং কোনো অভিশাপ নয় কেনো? এই কালো ক্রিষনকে তো তার সমস্ত কালো রং নিয়েও পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ তাঁকে সম্মান করে, ভালোবাসে, পুজা করে। কিন্তু দূর্ভাগ্যের ব্যাপার এটাই যে, কৃষ্ণ ছাড়া পৃথিবীর তাবদ মেয়ে মানুষকে এই কালো রং কে মানুষ তাদের ঘাটতি হিসাবেই দেখা হয়। ফলে নিজের কালো রং এর কারনে অনেক মানুষ ধীরে ধীরে সমাজের সবার কাছেই তাচ্ছিল্যের একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এমনো ধারনা করা হয় যে, ফর্সা মানে সুন্দর আর কালো মানে কুৎসিত। ছেলে সে যতোই কুৎসিত হোক না কেনো তার ও ফর্সা মেয়ে চাই, আর যদি কোনো মেয়ের গায়ের রং হয় কালো, তার তো এম্নিতেই হাজার সমস্যা, তার আবার কালো আর ধলা ছেলে পাওয়ার কোনো স্প্রিহাই তো নাই।
কালো পোষাক পড়লে আমরা নিজেকে সুন্দর মনে করি, কালো টিপকে আমরা শুভ বলে মানি। কথায় আছে কালো টিপ কুনজর থেকে বাচায়। মুখের উপর কালো তিলে আমাদেরকে সুন্দর দেখায়। কিন্তু কোনো মানুষের গায়ের রং যদি কালো হয় তাহলে তাঁকে আমরা কুৎসিত বলতে দ্বিতীয়বার ভাবি না। খুবই আসচর্জ চিন্তাধারা।
সউন্দর্জ আসলে কোনো রং নয়। অথচ এই সউন্দর্জ যেনো সব নির্ভর করে কালো ছাড়া অন্য আর সব রং এর উপরে। কেনো? এর উত্তর একটাই- আমরা কালো আর সুন্দর্জের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না। যখন চোখ শরীর থেকে মনের ভিতরে যায়, তখন মানুষের মনের ভিতরের সউন্দর্য দেখা যায়। আমাদের এই ক্ষমতা সবার থাকে না কিভাবে আমাদের চোখ শরীর থেকে মনের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে। আমাদের নিজের এই গুনের অভাবেই আমরা কোনো কালো মেয়ের ভিতরের রুপ দেখতে পাই না আবার এটাও পাই না যে, কোনো ফর্সা মেয়ের মনের ভিতরে কতটা কুৎসিত চরিত্র রয়েছে। আর দেখতে পাই না বলেই কোনো কালো মেয়ে কারো জীবনে অন্ধকার মনে হয় আর কারো কাছে সে আলোর দুনিয়ার মতো একেবারে পরিষ্কার। আসলে গায়ের রং নয়, যার কর্মকান্ড কালো, সেইই কালো। কালো গায়ের রং কোনোভাবেই দুনিয়ায় অশুভ হতে পারে না।
এটা খুবই জরুরী যে, আমরা এই রং বৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসি, নিজের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসি যাতে প্রকৃতির তৈরী সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি মানুষ তাঁকে দেখতে যেমনি হোক না কেনো তাঁকে সম্মান করি।
১১/০৮/২০২১-কনিকার যাওয়ার সময় উপদেশ
নতুন জায়গায় নতুন দেশের নতুন নিয়মে তুমি সম্পুর্ন আলাদা পরিবেশে একটা নতুন জীবন ধারায় নতুন ক্যারিয়ার তৈরী করার জন্য দেশ ছেড়ে সুদূর আমেরিকায় যাচ্ছো। তুমি এদেশের কোন চাপ, কোনো বিরহ নিয়ে ওখানে বাস করবে না, না কোনো কারনে মন খারাপ করবে। একদম ফ্রেস মাইন্ডে যাবে আর ফ্রেস করে শুরু করবে সব। মন দিয়ে নিজের সপ্ন পুরু করার চেষ্টা করবে কিন্তু সব সময় শরীরের দিকে যত্ন নিতে হবে। আমি শুধু তোমার পাশে থাকতে পারি কিন্তু লড়াইটা তোমার, তোমাকেই লড়তে হবে। এটা বিজনেস নয়, এটা তোমার লাইফ। গল্পটা তোমার, সপ্নটা তোমার। এই আজ থেকে তুমি একটা জার্নি শুরু করলে যার একমাত্র যাত্রী তুমি নিজে। জীবনের মজাটা হচ্ছে- কিছু কিছু জিনিষ এমন হয় যেটা অবিশ্বাস্য লাগে কিন্তু তুমি বুঝতে পার- হ্যা এটা হয়েছে। তখন নিজের থেকেই বিশ্বাস হয়ে যায়।
নতুন কাজ, নতুন পরিবেশ, কিন্তু নিজেকে বদলে ফেলো না। কেউ চলে যাবার পর হয়তো কিছু পরিবর্তন নজরে আসে। তুমি চলে যাবার পর হয়তো আমাদের এখানে অনেক কিছুই পালটে যাবে। পালটে যাবে কোনো এক সন্ধ্যায় পিজা খাওয়ার কিছু আনন্দঘন মুহুর্ত, পালটে যাবে কোনো এক ছুটির দিনে দল্বেধে বাইরে গিয়ে খেতে যাওয়ার আসর কিংবা পালটে যেতে পারে আমাদের অনেক দইনিন্দিন কিছু কর্ম কান্ড ও। আমাদের এই পরিবর্তন কোনো নতুন কিছু হয়তো নয়, এটা একটা এডজাষ্টমেন্ট, যা তোমার অনুপস্থিতিতে আমাদের আনন্দের সাথে বেচে থাকার নিমিত্তে। কিন্তু তোমার বদলে যাওয়া অন্য রকম। তুমি বদলাবে সেটা যাতে তোমার ভালোটা হয়।
আমি তোমাকে কোনো কিছুতেই কখনো আটকাই নাই, না কখনো আটকাবো। কিন্তু তুমি আমার নিজের মেয়ে, আমার বহু আদরের সন্তান। যদি এমন কখনো হয় যে, আমি তোমাদের কারনে দুশ্চিন্তায় থাকি, তখন হয়তো সমস্ত আবেগ, মায়া আর ভালোবাসা উপেক্ষা করেই হয়তো আমি তোমাকে আটকাবো। সেটা যেনো আমাকে করতে না হয়। প্রাইওরিটি ঠিক করতে হবে জীবনে। সব সময় আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখবে। জীবনে ব্যস্ততা থাকবে কিন্তু এতোটা না যাতে ফ্যামিলি ডিপ্রাইভড হয়। তুমি যদি ভালো ফলাফল করতে না পারো, এর মানে এই নয় যে, আমার ভালোবাসা তোমার উপর কমে যাবে। তুমি যদি তোমার ডিজায়ার্ড রেজাল্ট না করতে পারো শত চেষ্টা করার পরেও, আমি তোমাকে কখনোই দোষারুপ করবো না। বরং আমি তোমাকে সারাক্ষন সাহস দেবো, সহযোগীতা করবো কিভাবে তুমি সবার থেকে ভালো ফলাফল করতে পারো। আর ওটাই তোমার বাবা।
একটা জিনিষ সারাজীবন মনে রাখবা যে, সোস্যাল মিডিয়া একটা মেনিপুলেটেড মিডিয়া। এর বেজ মোটেই সত্য নয়। বরং এটা সাজানো সত্যি। কোনো জিনিষ সাদা বা কালো হয় না। সবটাই আলোর খেলা। এই সোস্যাল মিডিয়ায় সেটাই তারা জানাতে চায় যেটা তারা তোমাকে জানাতে চায় কিন্তু তোমার উচিত সেটা জানা যেটা আসল সত্যি। কারন অনেক বড় অপরাধের শিকর অনেক গভীরে থাকে। এই সোস্যাল মিডিয়ার ব্যক্তিত্তরা সবাই মেনিপুলেটেড চরিত্র। এরা ডিটেইল্ড মিথ্যা কাহিনী খুব নিখুতভবে বানায়। তাই কোনো কিছুর ফেস ভ্যালুতে না গিয়ে ডাবল ভেরিফিকেশন জরুরী। জীবনের নিরাপত্তার জন্য নিজের চারিদিকে সবসময় চোখ কান খোলা রাখতে হবে। এই কথাটা খুব জরুরী মনে রাখা যে, প্রকৃতির ইশারার প্রতি সর্বদা সেনসিটিভ থাকা। যেদিন সুনামী হয়, তার আগের দিন জংগলের সমস্ত প্রানিকুল সবাই জাত নির্বিশেসে উচু জায়গায় স্থান নিয়েছিলো, কারন তারা প্রকৃতির সেন্সটা বুঝতে পেরেছিলো। যা মানুষ বুঝতে পারে নাই। ফলে সুনামীতে বন্য প্রানীদের মধ্যে যতো না ক্ষতি হয়েছিলো তার থেকে শতগুন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলো মানুষ। ঠিক এই কারনেই সব সময় মনে রাখা দরকার যে, অপরাধের সুনামী একটা নয়, অনেক সংকেত দেয়, হওয়ার আগে এবং অপরাধ হওয়ার সময়। শুধু সেটা ধরতে হয়।
মানুষের শরীরে একটা জিনিষ থাকে যা পোষ্টমর্টেম করেও পাওয়া যায় না। কিন্তু কোনো সাফল্যে সব থেকে জরুরী হয় সেই জিনিষটার। সেটা “কনফিডেন্স”। এই কনফিডেন্স মানুষকে তৈরী যেমন করতে পারে, তেমনি ভেংগেও দিতে পারে। যখন এটা ভেংগে যায় বা হারিয়ে যায়, তারপরে আর কিছু কাজ করে না। তখন যেটা হয়, তুমি ঠিক করছো নাকি ভুল করছো কিছুই বুঝতে পারবে না। আর যখন কনফিডেন্স চলে যায় বা হারিয়ে যায়, সেই জায়গাটা দখল করে নেয় “কমপ্লেক্স”। এই কমপ্লেক্স যখন গেথে বসে যায় কারো জীবনে, তখন সিম্পল একটা ছবি তুলতেও খারাপ লাগে। কারন কে আপনাকে নিয়ে মজা করবে, কে লেগ পুলিং করবে এই সব ভেবে।
জিবনে এমন কোনো অধ্যায় তোমার থাকা উচিত নয় যা তুমি আর অন্য কেউ শুধু জানো অথচ আমরা জানি না। আমাদের মান, সম্মান, পজিশন, সমাজে মাথা উচু করে বেচে থাকার জন্য শুধু আমাদের গুনাবলীইই যথেষ্ঠ নয়, সেখানে তোমরাও আমাদের সেই জীবনের সাথে জড়িত। ফলে, যেটাই হোক সবকিছুতেই আমাদের কথা মাথায় রাখবে। বাবা মায়ের থেকে বড় ভরষা আর কিছু নাই। আমরা যদি আগে থেকেই জানতে পারতাম আমাদের কর্মফলে কি ফলাফল হয়, তবে কতই না ভালো হতো। কিন্তু সেটা আমাদের স্রিষ্টিকর্তা সুযোগ দেন নাই। তাই সতর্ক থাকাটা খুব দরকার। সতর্ক হওয়া মানে এই নয় যে আমরা শুধু মাত্র পরিনতির বিষয় ভাববো, সতর্ক থাকার অর্থ হলো সঠিক সময়ে নেয়া সেই পদক্ষেপ যা আগামী সমস্যাগুলিকে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। বিশেষত এটা জানা সত্তেও যে আমাদের আগামী কর্মফল খারাপ।
মনে রাখবা এক বন্ধুই আরেক বন্ধুর ক্ষতি করে। তাতে তোমাকে সাহাজ্য করতে আমাদের অনেক অসুবিধা হবে। তুমি শুধু ফোকাস করবে তোমার ক্যারিয়ারে আর সপ্ন পুরনে। তোমাদেরকে নিয়ে আমার সারাটা জীবন অন্য রকমের একটা সপ্ন আছে। আরেকটা কথা মনে রাখবে- ভালোবাসায় অনেক শক্তি থাকে। যদি হতাতই মনের অনিয়ন্ত্রনের কারনে কাউকে ভালোই লেগে যায়, সেখানে নিজের সাথে নিজের বুঝাপড়া করো। সব ভালোবাসার রুপ এক নয়। কেউ ভালোবাসে তোমার শরীরকে, কেউ ভালোবাসে তোমার দূর্বলতাকে, কেউ ভালোবাসে তোমার মেধাকে, আবার কেউ ভালোবাসে তোমার তথা তোমার পরিবারের সম্পদ কিংবা তোমার অস্তিত্বকে। কে তোমাকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে ভালোবাসলো, এই দৃষ্টিকোণ টা খুব ভালো করে বুঝা তোমার দায়িত্ব। কেউ যদি তোমাকে আসল রুপে ভালোবাসে, কখনো সে তোমাকে জোর করবে না কারন সে জানে যদি তুমি তার হও, তুমি যেভাবেই হোক সেটা বুজতে পারবে আর তুমি তার কাছে বিলম্ব হলেও ফিরে যাবে অথবা সে দেরী করে হলেও তোমার কাছেই ফিরে আসবে। যদি সে ফিরে আসে বা তুমি ফিরে যাও, তাহলে বুঝবে এটা সত্যি ছিলো। নতুবা কিছুই সত্য ছিলো না। যা ছিলো সেটা হলো একটা মোহ। মোহ আর ভালোবাসা এক নয়। একটা বাস্তব আর আরেকটা মিথ্যা। এই মিথ্যা ভালোবাসায় পতিত হয় হয়তো মনে অনেক কষ্ট জমা হতে পারে। কিছু জিনিষ যা প্রতিনিয়ত মনকে কষ্ট দেয়, মানসিক শান্তি নষ্ট করে, সে সব কাহিনী চিরতরে ভুলে যাওয়াই ভালো। তাতে অন্তর মানসিক কষ্টটা আর থাকে না। এটা অনেক জরুরী একটা ব্যাপার। সব কিছুরই প্রথমবার আছে। এটা যেমন ভালোবাসার ক্ষেত্রে তেমনি অপরাধের ক্ষেত্রেও। যৌবন হলো অসহায় এবং শক্তির দ্বিতীয় নাম। অপরাধের ক্ষেত্রে বিচার হয় কিন্তু যৌবনের ভালোবাসার প্রতারনায় নিজের অসহায়ত্তের বিচার নিজেকে করতে হয়। তখন নিজের বিরুদ্ধে রায় দেয়া সহজ হয় না। তাই আমি সব সময় একটা কথা বলি- টাইম হচ্ছে মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ভিলেন। তার কাছে পরাজিত হওয়া যাবে না। আবার এই টাইমই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বন্ধু। তুমি এই টাইমকে কিভাবে ব্যবহার করবে সেটা তোমার বিবেচনা। একবার মনে কালো দাগ পড়ে গেলে তা আজীবন নিজেকে কষ্ট দেয়। ব্ল্যাক কফি, ব্ল্যাক ফরেষ্ট কেক, ডার্ক চকোলেট, ঘন জংগল অন্ধকার রাত, সবই কালো কিন্তু সে কালো কোনো কষ্টের নয়। কিছু কালো জীবনের অভিশাপ। কালোর মতো কোনো রং নেই। কিন্তু কিছু কি আছে যা কালোকে সাদা করতে পারে? বিশেষ করে সেই কালো যা জীবনের ধারাবাহিকতায় অভিশাপের মতো রুপ নিয়েছে? তাই, আমি প্রতি নিয়ত তোমাকে নিজের হাতের নিয়ন্ত্রনের বাইরে ছেড়ে দিতে ভয় করলেও তোমার উপর আমার আলাদা একটা ভরষা আছে- তুমি পারবে ঠিক সে রকম করে চলতে যা আমি তোমার জন্য করতে চেয়েছিলাম। এই ভরষায় আমি তোমাকে অনেক দূরে পাঠাতেও দ্বিধা করছি না।
আমার আশা, তোমার মায়ের সপ্ন আর আমাদের পরিবারের সব সম্মান তোমার হাতে দিয়ে এটাই বলতে চাই- আমরা তোমাদের পরিচয়ে সমাজে আরেকবার সম্মানীত হতে চাই। বাকীটা আল্লাহ মালিক জানেন।
Protected: ২১/০৫/২০২১-অফিশিয়াল সারেন্ডার
You are required to login to view this post or page.
টাইটানিক ট্র্যাজেডির শতবর্ষ
এম এ মোমেন
ঢাকা, শনিবার, ১৪ এপ্রিল ২০১২, ১ বৈশাখ ১৪১৯, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৩৩
“শতবর্ষ আগে মহাসমুদ্রের বিস্ময় টাইটানিক উদ্বোধনী যাত্রায় সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্কের পথে চতুর্থ দিন ১৪ এপ্রিল ১৯১২ রাত ১১টা ৪০ মিনিটে আটলান্টিকের ঘাতক আইসবার্গের সঙ্গে সংঘর্ষে বিপন্ন হয়ে পড়ে। অবিরাম এসওএস বার্তা যেতে থাকে টাইটানিক থেকে। দুই ঘণ্টা ৪০ মিনিট পর রাত দুইটা ২০ মিনিটে (তখন ১৫ এপ্রিল) প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং অহংকার নিয়ে টাইটানিক আটলান্টিকে তলিয়ে যায়। টাইটানিকের এক হাজার ৫১৭ জন শীতার্ত যাত্রী ও ক্রু ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উষ্ণতার সমুদ্রজলে অসহায় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
হোয়াইট স্টার লাইনারের সঙ্গে বেলফাস্টের জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হারল্যান্ড এন্ড ওলফের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ১৮৬৭ সাল থেকে। এই প্রতিষ্ঠানেরই তৈরি তিনটি অলিম্পিক ক্লাস জাহাজ; হোয়াইট স্টারের চেয়ারম্যান ব্রুস ইজমে এবং মার্কিনি তহবিলদাতা জে পি মর্গানের ইচ্ছায় এবং উদার ব্যয়ে টাইটানিক হয়ে ওঠে সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে বিলাসবহুল জাহাজ। কেবল সমুদ্রের বিস্ময় নয়, এটাকে মনে করা হয় মর্ত্যের সুন্দরতম ভাসমান প্রাসাদ।
স্পেশাল লাক্সারি স্যুটসহ ‘এম্পায়ার স্টাইল’ প্রথম শ্রেণীর ধারণক্ষমতা ৭৩৯ জন যাত্রী, দ্বিতীয় শ্রেণীর ৬৭৪ জন এবং তৃতীয় শ্রেণীর এক হাজার ২০ জন; জাহাজের ক্রু সদস্য ৯০০; সব মিলিয়ে ২৫ নটিক্যাল মাইল বেগে ধাবমান টাইটানিক তিন হাজার ৩৩৯ জনকে তাঁদের মালামালসহ পরিবহন করতে সক্ষম এবং ঘোষণা করা হয় আরএমএস টাইটানিক আনসিংকেবল—কখনো ডুববে না। ২ এপ্রিল ১৯১২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। ৩১ মে ১৯১১ সাল। দুপুর সোয়া ১২টায় যখন টাইটানিককে সমুদ্রে ভাসানো হয়, তা দেখতে জড়ো হয়েছিল এক লাখ দর্শক। নিউইয়র্কের পথে প্রথম যাত্রায় ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড জন স্মিথের নেতৃত্বে ৮৮৫ জন ক্রু জাহাজে আরোহণ করেন। যাত্রী ছিলেন এক হাজার ৩১৭ জন (প্রথম শ্রেণী ৩২৪, দ্বিতীয় শ্রেণী ২৮৪ এবং তৃতীয় শ্রেণী ৭০৯); ধারণক্ষমতার প্রায় অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নিয়ে টাইটানিকের যাত্রা। ১০ এপ্রিল ১৯১২, দুপুরে সাউদাম্পটন থেকে শুরু হয় পশ্চিমমুখী শুভযাত্রা। শুরুতেই মাত্র চার ফুটের জন্য ‘এসএসসিটি অব নিউইয়র্ক’ জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে সমর্থ হয়। ৭৭ নটিক্যাল মাইল এগিয়ে শেরবুর্গ থেকে ২৭৪ জন যাত্রী তুলে নেয়। ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে ১১টায় আয়ারল্যান্ডের কর্ক পোতাশ্রয় থেকে জাহাজে ওঠেন ১১৩ জন তৃতীয় শ্রেণীর এবং সাতজন দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রী। তারপর তিন দিন কেবল অবিরাম সাগরে চলা। ১৪ এপ্রিল রাতেই আইসবার্গের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে এবং বিশ শতকের অন্যতম প্রধান সামুদ্রিক ট্র্যাজেডি।
তারপর আটলান্টিকের অতলে টাইটানিকের অবস্থান জানার চেষ্টা চলতে থাকে বছরের পর বছর। ১৯৮৫ সালে এর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আনসিংকেবল টাইটানিক এখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ হাজার ৬০০ ফুট নিচে আটলান্টিকের তলদেশে স্থির হয়ে আছে। দ্বিখণ্ডিত জাহাজটির দুটো টুকরো ১৯৭০ ফুট দূরে অবস্থান করছে। টাইটানিকের সম্মুখভাগ সমুদ্রতলে ৬০ ফুট মাটির গভীরে প্রোথিত। ১৪ জুলাই ১৯৮৬, ঘটনার ৭৪ বছর পর টাইটানিক পুনরাবিষ্কৃত হয়। টাইটানিক থেকে উদ্ধার পাওয়া বয়োকনিষ্ঠ যাত্রী মিলভিনা ডিনের বয়স তখন মাত্র নয় সপ্তাহ। ৩১ মে ২০০৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পর টাইটানিক থেকে বেঁচে যাওয়া আর কেউ জীবিত রইলেন না।
টাইটান না টাইটানিকঃ মর্গান রবার্টসনের উপন্যাস ফিউটিলিটি—দ্য রেক অব দ্য টাইটান প্রকাশিত হয় ১৮৯৮ সালে। টাইটান মানুষের তৈরি সর্বশ্রেষ্ঠ ভাসমান জলযান; এটি সর্ববৃহৎ জাহাজও। বিলাসিতার মাপকাঠিতে প্রথম শ্রেণীর হোটেলের যত আয়োজন, তার কোনোটির কমতি নেই টাইটানের কেবিনে।টাইটানের নির্মাণে ব্যবহূত হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এই জাহাজে ১৯টি ওয়াটার-টাইট কম্পার্টমেন্ট। এ বিস্ময়কর জাহাজ কখনো ডোবার নয়। টাইটানের যাত্রী ও ক্রু ধারণক্ষমতা তিন হাজার; পুরোটাই যাত্রীবোঝাই ছিল।যেহেতু এ জাহাজ ডোবার নয়—লাইফবোটের প্রয়োজন নেই। তবু বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, ২৪টি বোট টাইটানে রাখা ছিল।উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে আইসবার্গের সঙ্গে সংঘর্ষে টাইটান ডুবে যায়। মৃত্যু হয় দুই হাজার ৯৮৭ জন যাত্রী ও ক্রুর।মর্গান রবার্টসনের কল্পলোকের টাইটান এবং বাস্তবের টাইটানিক ট্র্যাজেডির কিছু সাদৃশ্য বিস্মিত না করে পারে না।
আলফ্রেড রোর অমঙ্গল আশঙ্কা!
সাউদাম্পটন বন্দর ছেড়ে ফ্রান্সের শেরবুর্গ হয়ে টাইটানিক পৌঁছায় দক্ষিণ আয়ারল্যান্ডের কুইন্সটাউন বন্দরে। কিন্তু অতিকায় টাইটানিকের জন্য জাহাজঘাটটি ছোট এবং বন্দরের জলসীমার গভীরতাও কম। সুতরাং, সমুদ্রেই নোঙর ফেলল টাইটানিক। ছোট জাহাজে করে যাত্রীদের বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়, যাত্রীরা কিছুটা সময় ঘুরেফিরে কেনাকাটা করে, চা খেয়ে আবার ফিরে আসে টাইটানিকে। এদের একজন আলফ্রেড রো, অন্যদের সঙ্গে তিনি নেমেছিলেন। জাহাজে বসে স্ত্রীকে একটি চিঠি লিখে বন্দরের পোস্ট অফিসে দিয়ে জাহাজে ফিরে আসেন।
চিঠিতে টাইটানিকের বিস্ময় নিয়ে কোনো জাঁকালো বর্ণনা দেননি, বরং লিখেছেন, জাহাজটি বাড়াবাড়ি রকমের বড় এবং এতে বিপদের ঝুঁকি আছে। জাহাজ ছাড়ার পর পরই টাইটানিকের উত্তাল ঢেউয়ে অপেক্ষমাণ জাহাজ এসএস নিউইয়র্ক নোঙর ছিঁড়ে টাইটানিকের ওপর এসে পড়েছিল প্রায়, সংঘর্ষ হলে টাইটানিকের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারত, সে কথা লিখলেন রোর। টাইটানিক তাঁর পছন্দ হয়নি। তবে টাইটানিকের টার্কিশ বাথ তিনি বেশ উপভোগ করেছেন।
‘অন বোরড্ আরএনএস টাইটানিক’ শিরোনামের প্যাডে আলফ্রেড রো তাঁর স্ত্রী কনস্ট্যান্সকে চিঠিটি লিখেছিলেন ১১ এপ্রিল ১৯১২; টাইটানিকের প্রথম শ্রেণীর যাত্রী ছিলেন তিনি, বয়স ৫৯, ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, বাড়ি ইংল্যান্ডের লিভারপুলে।
ধারণা করা হয়: টাইটানিক যখন ডুবে যাচ্ছিল, আলফ্রেড সাঁতরে আইসবার্গের এক খণ্ড বরফের ওপর উঠতে পেরেছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড ঠান্ডায় জমে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। পরে একটি উদ্ধারকারী জাহাজ তাঁর বরফশীতল জমাট দেহ উদ্ধার করে।২০০৭ সালে টাইটানিক ট্র্যাজেডির ৯৫তম বছরে আলফ্রেড রোর চিঠি এবং কনস্ট্যান্স রোর ডায়েরি নিলামে ওঠে।
অসংখ্য ‘যদি’ কান্নায় ভেসে আসে
যদি যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে শুরুতেই যাত্রা কয়েক ঘণ্টা পিছিয়ে যেত? যদি আকাশে নতুন চাঁদ না হয়ে পূর্ণিমা রাত হতো—আইসবার্গ তো খালি চোখেই দূর থেকে দেখা যেত।
যদি ৫০টা লাইফবোট থাকত?
টাইটানিক ইজ ইন ডেঞ্জার
বিপদ আঁচ করার পর রেডিও অপারেটর বিলম্ব করেননি। ‘এসওএস টাইটানিক ইজ ইন ডেঞ্জার হেল্প হেল্প এসওএস’—বারবার এই বার্তা পাঠাতে থাকেন। ততক্ষণে ওয়াল্টার লর্ডের বর্ণনা অনুযায়ী, টাইটানিকের বেতারকক্ষে বরফশীতল পানি ঢুকতে শুরু করে। যখন অপারেটরের কোমর পর্যন্ত পানির নিচে তখনো তিনি এসওএস পাঠিয়েই যাচ্ছেন। ওই সময় ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ২০ মিনিট দূরত্বে বিশাল জাহাজ কালিফোর্নিয়ান অবস্থান করছিল, কিন্তু রেডিও সিস্টেম বন্ধ করে ঘুমিয়ে ছিলেন ওই জাহাজের অপারেটর। বার্তা পেয়েছিল অনেক দূরের একটি জাহাজ, কার্পাথিয়া। কার্পাথিয়া সর্বোচ্চ গতিতে এগোতে থাকে টাইটানিকের দিকে। কিন্তু টাইটানিক যে অনেক দূরে!
টাইটানিকের শিশু
উদ্ধারকারী জাহাজ ম্যাকে বেনেটের সাহসী নাবিকেরা আটলান্টিকে তলিয়ে যাওয়া অনেক মৃতদেহ উদ্ধার করেন। অনেককেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়। যাদের শনাক্ত করা যায়নি, তাদের একজন পশমি জ্যাকেট পরা একটি শিশু। কেউ এই শিশুর স্বজন এ দাবি নিয়ে এগিয়ে আসেনি। ফলে এই অশনাক্ত টাইটানিক শিশু হ্যালিফ্যাক্সে সমাহিত হয় ‘অচেনা শিশু’ হিসেবে। লেকহেড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওন্টারিও, নৃতাত্ত্বিক রায়ান পার এবং লেখক অ্যালান রাফম্যানের সম্মিলিত চেষ্টা জনগণের বাধার মুখে কবর খনন করে ক্ষয়ে যাওয়া হাড়ের একাংশ নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। শিশুটির তিনটি দাঁত ছিল। কবরে একটি লকেটও পাওয়া যায়—লকেটে লেখা ‘আওয়ার বেবি—আমাদের শিশু’। অনুমান করা হয়, এই লকেটটি মৃতদেহ সমাহিত করার সময় শিশুটির সঙ্গে দেওয়া হয়। সম্ভাব্য অনেকের সঙ্গে মিলিয়ে দীর্ঘ গবেষণার পর বের হয় এই শিশুটির নাম ইনো। তার বাবা, মা ও চার ভাইও একই সঙ্গে আটলান্টিকে সমাহিত। ১৩ মাস বয়সী এই মেয়েটি ছিল ফিনল্যান্ডের।
একটি বিস্ময়কর টাইটানিক গল্প
নারী ও শিশুদের জন্য লাইফবোট। এই আইন মেনে নিয়েছে সবাই। কিন্তু মানেনি এর মধ্যেও শ্রেণীবৈষম্য। টাইটানিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রায় সব শিশুকেই বাঁচানো হয়েছে, কিন্তু তৃতীয় শ্রেণীর ৭৬ জন শিশুর মধ্যে বেঁচেছে মাত্র ২৩ জন, ৬০ শতাংশ তলিয়ে গেছে আটলান্টিকের গভীরে। জেরোম বার্ক নামের বালকটির জন্ম কর্ক সিটির কাছাকাছি গ্লেনমায়ারে। তার দুই বোন আমেরিকায় চলে গেছে। জেরোমও যেতে চায়। ঠিক করেছে ১৯১২-এর বসন্তকালে যাবে। এদিকে আরেক বোন নোরার বন্ধুত্ব টাইটানিকের টিকিট অফিসের একজন চেকারের সঙ্গে। ছোট ভাইটির জন্য নিজেই বিস্ময়কর জাহাজ টাইটানিকের উদ্বোধনী যাত্রার টিকিট কিনে দেয়। জেরোম কুইন্সটাউন থেকে জাহাজে উঠবে। তার স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে।বাড়ি থেকে কুইন্সটাউনের পথে বের হওয়ার আগে প্রতিবেশী মিসেস ম্যাক ও কোনেল এক বোতল পবিত্র জল নিয়ে এলেন। এর খানিকটা একটা ছোট বোতলে ভরে ছেলেকে দিলেন, ছেলে সঙ্গে নেবে। এক বছর আগে নোরা যখন লাউস সফরে যায়, তখন এই বোতলটি কিনেছিল। জাহাজ কর্ক উপকূলে কুইন্সটাউন বন্দর থেকে ছেড়ে দিল। তার পরের অংশ তো জানাই। ১৪ এপ্রিল রাতে আইসবার্গের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে টাইটানিক ডুবে যেতে থাকে। আড়াই ঘণ্টা পর জাহাজটি দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যায় আটলান্টিকের তলদেশে। তখন ১৫ এপ্রিল। আরও অনেকের মতো জেরোমের পরিবারের সদস্যরা আটলান্টিকের এপারে ওপারে দিন গুনতে থাকে—জেরোম নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। তারপর ভিন্ন প্রত্যাশা—নিশ্চয়ই জেরোমের মৃতদেহটা পাওয়া যাবে। তারপর সব আশা ফুরিয়ে আসে—জেরোম চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে মহাসাগরের অজানা গহিনে। ১৯১৫-এর গ্রীষ্মে ডানকেটল সৈকতের কাছে কুকুর নিয়ে হাঁটার সময় একটি ভিন্ন ধরনের বোতল পান। বোতলের ছিপি খোলার পর ভেতরে একটি প্যাঁচানো কাগজে পেনসিলে লেখা:
১৩/৪/১৯১২,টাইটানিক থেকে সকলকে বিদায় গ্লেনমেয়ারের বার্কদের
কর্ক
ঔৎসুক্য ও গবেষণায় বেরিয়ে এল, বোতলটি সেই পবিত্র জলের, হাতের লেখা জেরোমের। তবে তারিখ লিখতে সম্ভবত সে ভুল করেছে, ১৪ এপ্রিলের বদলে লিখেছে ১৩ এপ্রিল। হয়তো ভালো করে ছিপি এঁটে নিজেই নিক্ষেপ করেছে আটলান্টিকে। তিন হাজার মাইল পরিভ্রমণ করে বোতল ফিরে এসেছে কর্ক বন্দর হয়ে জেরোমের জন্মস্থানে। ১৪ মাস পর বোতলটি মানুষের হাতে পড়েছে। জেরোমের কোনো সমাধি নেই। জেরোমের মা সন্তুষ্ট, অন্তত তার একটা কিছু তো পাওয়া গেছে।
ঘাতক আইসবার্গ
যে আইসবার্গের সঙ্গে সংঘর্ষে টাইটানিকের এই ভয়াবহ পরিণতি, তা কিন্তু অতিকায় নয়। জাহাজটির চেয়ে আকারে অনেক ছোট।যাত্রাপথে যে আইসবার্গ রয়েছে টাইটানিক এ ধরনের ছয়টি সতর্কবার্তা পায়। কিন্তু বেতার অপারেটর যাত্রীদের ব্যক্তিগত বার্তা পাঠানো নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে সতর্কবার্তা আমলে নেননি। যে আইসবার্গের সঙ্গে টাইটানিকের সংঘর্ষ হয় তা আর সব আইসবার্গের মতো সাদা বর্ণের ছিল না। রাতের আকাশে আইসবার্গের প্রতিবিম্বজনিত কালো ছায়ার কারণে এ ধরনের আইসবার্গকে ব্ল্যাকবার্গ বলা হয় এবং খুব কাছাকাছি স্থান থেকেও দেখা যায় না। টাইটানিকের বেলায় আইসবার্গ দেখা ও সংঘর্ষের মাঝখানে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার মতো সময় ছিল মাত্র ৩৭ সেকেন্ড।
টাইটানিক যেন ভাসমান রাজপ্রাসাদ
এমন বিশাল ও জৌলুশপূর্ণ জাহাজ পৃথিবীতে একটিই। টাইটানিককে যাঁরা মহাসাগরের বুকে একটি রাজপ্রাসাদ আখ্যা দিয়েছেন, তাঁরা সে সময়ের প্রেক্ষাপটে খুব বাড়িয়ে বলেননি।
৮৮২ ফুট ছয় ইঞ্চি দীর্ঘ জাহাজটি তিনটি ফুটবল মাঠেরl সমান। তলা থেকে চূড়া পর্যন্ত টাইটানিক ১৭৫ ফুট উঁচু। মোট নয়টি ডেক, কিংবা বলা যায় নয়তলা।
টাইটানিকের ইঞ্জিন প্রতিদিন ৮০০ টন কয়লা পোড়ায়। জাহাজটি সর্বোচ্চ ২৪ নটিক্যাল মাইল কিংবা ঘণ্টায় ২৭ মাইল বেগে ছুটতে পারে।
জাহাজের প্রতিটি কক্ষে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে, ১০ হাজার আবশ্যকীয় বাল্ব সংযোজন করা হয়েছে।
জাহাজে উষ্ণজলের একটি সুইমিংপুল, একটি জিমনেশিয়াম, দুটো পাঠাগার, এবং দুটো চুল কাটার সেলুন রয়েছে।যাত্রী ও ক্রুদের খাওয়াতে টাইটানিকের দরকার হতো ৭৫ হাজার পাউন্ড ওজনের মাংস, ১১ হাজার পাউন্ড মাছ এবং ৪০ হাজার ডিম।
জাহাজ পরিবহন করছে ৪০ মেট্রিক টন আলু, তিন হাজার ৫০০ পাউন্ড পেঁয়াজ, ৩৬ হাজার আপেল এবং এক হাজার পাউরুটি। যাত্রী ও ক্রুদের প্রতিদিনের খাওয়ার পানির পরিমাণ ১৪ হাজার গ্যালন।
তিন হাজার শ্রমিকের দুই বছরের শ্রমে নির্মিত হয়েছে টাইটানিক। নির্মাণকালে পাঁচজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
টাইটানিকের নির্মাণব্যয় হয়েছে ৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার।টাইটানিকের চার ফানেলের তিনটি ছিল ধোঁয়া নির্গমনের জন্য, আরেকটি ছিল অপ্রয়োজনীয়, যা কেবল ফ্যাশন হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে।
টাইটানিক-কাহিনি নিয়ে জেমস ক্যামেরন নির্মাণ করেছেন বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাণিজ্যসফল ছবি টাইটানিক।
সাত খ্যাতিমান, যাঁদের টাইটানিকে চড়া হয়নি
থিওডোর ড্রেইসার
ঔপন্যাসিক থিওডোর ড্রেইসার ইউরোপে ছুটি কাটিয়ে টাইটানিকে আমেরিকা ফেরার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু একজন ইংরেজ প্রকাশক সস্তায় অন্য আরেকটি জাহাজে যাওয়ার পরামর্শ দেন।থিওডোর ড্রেইসার ক্রুনল্যান্ড জাহাজে টাইটানিক দুর্ঘটনার খবর শোনেন।
বেতার আবিষ্কারক মার্কনি
রেডিও আবিষ্কারক এবং ১৯০৯ সালে নোবেল বিজয়ী মার্কনিকে টাইটানিকের ফ্রি টিকিট অফার করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি টাইটানিকের তিন দিন আগে লুসিতানিয়া নামের আরেকটি জাহাজে রওনা হন। কারণ, জাহাজে তাঁর লেখালেখির ব্যাপার ছিল এবং সে জন্য একজন পেশাদার স্টেনোগ্রাফারেরও প্রয়োজন হয়। আর এ জন্য লুসিতানিয়াতে ভ্রমণই তিনি বেছে নেন।
ধনকুবের মিলটন হার্শে
হার্শের মিল্ক চকলেট, সিরাপ ইত্যাদি প্রস্তুতকারক মিলটন হার্শে শীতকালটা ফ্রান্সে কাটিয়ে আমেরিকা ফেরার জন্য টিকিট কিনেছিলেন। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে তিনি ও তাঁর স্ত্রী জার্মান জাহাজ আমেরিকায় চড়ে আগেই রওনা হয়ে যান। এই আমেরিকাই টাইটানিকে বার্তা পাঠিয়েছিল যে পথে আইসবার্গ রয়েছে।
ধনকুবের জে পি মর্গান
ওয়াল স্ট্রিটের নেপোলিয়ন’ নামে খ্যাত, জেনারেল ইলেকট্রিক ও ইউএস স্টিলের প্রতিষ্ঠাতা জেপি মর্গান টাইটানিক জাহাজের সমুদ্রে ভাসানোর উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। জাহাজে তাঁর জন্য একটি ব্যক্তিগত স্যুটের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ফ্রান্সে সকালে শরীর ম্যাসাজ করা বাকি রেখে টাইটানিকের যাত্রী হতে আগ্রহী হননি।
আলফ্রেড ভ্যানডারবিল্ট। ৩৪ বছর বয়স্ক মাল্টিমিলিয়নিয়ার, খেলোয়াড় এবং ভ্যানডারবিল্ট শিপিং ও রেল বাণিজ্যে উত্তরাধিকারী বিশেষ কারণে শেষ মুহূর্তে বুকিং বাতিল করেন। কিন্তু ব্যাপারটা এত দেরিতে করেন যে যাত্রীতালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে মৃতের তালিকায় কোনো কোনো পত্রিকা তাঁর নামও ছেপে দেয়। তিন বছর পর লুসিতানিয়া জাহাজ ডুবে গেলে আলফ্রেড ভ্যানডারবিল্ট মৃত্যুবরণ করেন।
নোবেল বিজয়ী জন মট
টাইটানিক ডোবার অনেক বছর পর ১৯৪৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী জন মট উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন হোয়াইট স্টার লাইনের ফ্রি টিকিট, কিন্তু তিনি তা না নিয়ে ল্যাপল্যান্ড নামের অন্য একটি জাহাজে চেপেছিলেন।
হেনরি ক্লার্ক। পিটসবার্গের ইস্পাত ব্যবসায়ী। স্ত্রীর পায়ের গোড়ালি মচকে যাওয়ার কারণে টাইটানিকের যাত্রা বাতিল করেন।
আমেন-রার অভিশাপ ও টাইটানিক
ঢাকা, শনিবার, ১৪ এপ্রিল ২০১২,
১ বৈশাখ ১৪১৯, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৩৩
১০ এপ্রিল ১৯১২ সাউদাম্পটন বন্দরে পৃথিবীর বিস্ময়কর জাহাজ টাইটানিক ছেড়ে দেওয়ার সিটি বাজাল। বিদায় জানাতে আসা আত্মীয়, শুভানুধ্যায়ী এবং উৎসুক দর্শনার্থীর আনন্দ ও উচ্ছ্বাসে বন্দর গমগম করছে।
এই জাহাজটি ‘আনসিঙ্কেবল’—কখনো ডোবার নয়। দুদিন পেরিয়ে যাচ্ছে। টাইটানিক তখন আটলান্টিকে। সবই ঠিকঠাক। আনন্দ ও হুল্লোড়ের কমতি নেই। আটজনের একটি দল ঢুকল প্রথম শ্রেণীর ধূমপানকক্ষে। সিগারেট ফুঁকছেন আর জীবনের কী মানে, তা নিয়ে বেশ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা জুড়ে দিয়েছেন। তাঁদেরই একজন উইলিয়াম টি স্টেড ইংরেজ সাংবাদিক ও সুপরিচিত অধ্যাত্মবাদী। ভৌতিক গল্পটা তিনিই বললেন। তাঁর এই গল্পের মিথের সঙ্গে টাইটানিকের ডুবে যাওয়া কেমন করে যেন এক হয়ে গেল।
স্টেড গল্পটা শুরু করেন ১২ এপ্রিল রাত ১২টার একটু আগে, গল্পটা শেষ হয় রাত ১২টার পরে। টাইটানিকডুবির সূত্রপাত হয় ১৪ এপ্রিল রাত ১২টার একটু আগে, জাহাজটি আটলান্টিকের গর্ভে তলিয়ে যায় রাত দুইটার দিকে। তখন ১৫ এপ্রিল ১৯১২। এই আটজনের দলের সাতজনই আটলান্টিকে তলিয়ে যান, উইলিয়াম স্টেডও। কেবল একজন ফ্রেড সিওয়ার্ড বেঁচে যান। সাক্ষ্য তাঁরই।
মমির অভিশাপ
যিশুর জন্মের ১৫০০ বছর আগে গ্রিক প্রিন্সেস আমেন-রা কথা জানা যায়। মৃত্যুর পর প্রিন্সেসকে সূক্ষ্ম কারুকাজ করা চমৎকার একটি কাঠের কফিনে ভরে নীল নদের তীরে একটি সুরক্ষিত প্রকোষ্ঠে রেখে দেওয়া হয়। ১৮৯০ দশকের শেষ দিকে খননকাজের সময় মমির এই চমৎকার কফিন কিংবা আধারটি পাওয়া গেলে চারজন ধনী ইংরেজকে তা কিনে নেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। কফিনে রয়েছেন প্রিন্সেস আমেন-রা।বহু মূল্য দিয়ে তাঁদের একজন কিনে নিলেন। তিনি কয়েক হাজার পাউন্ড স্টার্লিং দিয়ে কেনা কফিনটি হোটেলে নিজ কক্ষে নিয়ে এলেন।কয়েক ঘণ্টা পর দেখা গেল তিনি হোটেল থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে মরুভূমির দিকে যাচ্ছেন। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও তিনি আর কখনো ফিরে আসেননি।অবশিষ্ট তিনজনের একজন তাঁর মিসরীয় ভৃত্যের বন্দুক থেকে দুর্ঘটনাক্রমে আকস্মিকভাবে বেরিয়ে আসা গুলিতে জখম হলেন। জখমটা এতই গুরুতর ছিল তার গুলিবিদ্ধ হাতটি কেটে ফেলতে হলো।তৃতীয়জন দেশে ফেরার পর দেখলেন তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় যে ব্যাংকে রেখেছিলেন, সেই ব্যাংকটি সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে গেছে।চতুর্থজনও টাকাপয়সা খোয়ালেন, অসুস্থ হয়ে পড়লেন, চাকরি হারালেন এবং বেঁচে থাকার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাঁকে দেশলাই বিক্রি শুরু করতে হয়।এত কিছুর পরও পথের অনেক দৈব-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রিন্সেস আমেন-রার কফিন লন্ডনে পৌঁছে এবং একজন ধনী ব্যবসায়ী তা কিনে নেন।এর পরপরই ব্যবসায়ীর পরিবারের তিনজন সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়, আগুন লেগে তাঁর বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অগত্যা ব্যবসায়ী কফিনটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে দান করে দেন।ট্রাক থেকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের আঙিনায় যখন কফিন নামানো হচ্ছিল, ট্রাকটি উল্টোদিকে চলতে শুরু করে। একজন পথচারীকে বিপদাপন্ন করে তোলে। যে দুজন শ্রমিক এই কাসকেটটি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিল, হঠাৎ পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলে। অন্যজন বাহ্যত সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হলেও দুদিন পর অজ্ঞাত কারণে মারা যায়।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ‘ইজিপশিয়ান রুম’-এ এটি স্থাপন করার পর একটার পর একটা বিপত্তি ঘটতে শুরু করল।
জাদুঘরের নৈশপ্রহরী কফিনের ভেতর হাতুড়ি পেটানোর এবং ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনতে লাগল। অন্যান্য প্রদর্শিত দ্রব্য রাতের বেলা কেউ ছুড়তে শুরু করল। দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় একজনের মৃত্যু হলো। অন্য প্রহরীরা চাকরি ছেড়ে দিতে চাইল। ক্লিনাররা প্রিন্সেসের কাছে যেতে অস্বীকৃতি জানাল।
শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ এটাকে বেজমেন্টে রেখে আসে এই চিন্তা করে যে এখন থেকে আর কারও ক্ষতি করতে পারবে না। এক সপ্তাহের মধ্যে যা ঘটার ঘটে গেল। বেজমেন্টে পাঠানোর কাজটা যিনি তত্ত্বাবধান করছিলেন তাঁকে তাঁর ডেস্কেই মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল আর বহনে সহায়তাকারীদের একজন ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে পড়ল।
এত দিনে মমির এই ভয়াবহ আচরণের খবর সংবাদপত্রগুলো পেয়ে গেল। একজন ফটোগ্রাফার ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এসে কাসকেটের ছবি তুললেন। ছবিটা যখন হয়ে এল তিনি অবাক হয়ে দেখলেন কফিনের ওপর আঁকা ছবিটা আসলে মানুষের বীভৎস মুখাবয়ব। তিনি বাড়ি ফিরে গেলেন। বেডরুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন এবং নিজের ওপর গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করলেন।কিছুদিন পর জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এই মমি একজন ব্যক্তিগত সংগ্রহকারীর কাছে বেচে দেয়। সেখানেও একের পর এক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু ঘটতে থাকলে মমির ক্রেতা এটাকে চিলেকোঠায় আটকে রাখেন।পরে তিনি এটা বিক্রির চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্রিটেনের কোনো মিউজিয়াম এই মমি নিতে আগ্রহী নয়। মমি নাড়াচাড়ায় নিয়োজিত কুড়িজন মানুষের দুর্ভাগ্যের কথা—বিপন্নতা, দুর্যোগ এবং এমনকি মৃত্যুর খবর এখন সবারই জানা। শেষ পর্যন্ত গোঁয়াড় প্রকৃতির একজন আমেরিকান প্রত্নতত্ত্ববিদ এসব দুর্ভাগ্যের কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন এবং বেশ দাম দিয়ে এটাকে কিনে নিউইয়র্ক নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করলেন।
১৯১২-এর এপ্রিলে কফিনটা জাহাজে তোলা হলো, আমেরিকান মালিকও সঙ্গে আছেন। তিনি জানেন আমেরিকানরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন নয়। হোয়াইট স্টার লাইনের নতুন জাহাজ, এটাই জাহাজের উদ্বোধনী যাত্রা—সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্ক। বিলাসবহুল এই জাহাজের নাম টাইটানিক। আমেরিকান মালিক এবং জাহাজের দেড় হাজার যাত্রী ও টাইটানিক জাহাজটিসহ আমেন-রা সমাহিত হলেন আটলান্টিকের গভীর তলদেশে। কেউ কেউ বলেন উদ্ধারকারী জাহাজ কার্পাথিয়া যখন মানুষ উদ্ধার করছিল, তখনই জাহাজের ক্রুরা কফিনটা জাহাজে তুলে নেয়। আমেন-রা যথারীতি নিউইয়র্ক পৌঁছে। আমেরিকায় এই কফিন একটার পর একটা ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটিয়ে চলে। একসময় সিদ্ধান্ত হয় কফিন আবার ইউরোপে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে। দেড় মাস তখনো পুরো হয়নি। ইউরোপের পথে এমপ্রেস অব আয়ারল্যান্ড জাহাজে তুলে দেওয়া হয়। ১৯১২ সালের ২৯ মে ৮৪০ জন যাত্রী নিয়ে জাহাজটি ডুবে যায়।
মমিটি সে যাত্রায়ও রক্ষা পায়। এর মালিক ঠিক করলেন, তৃতীয় কোনো জাহাজে মমিটি মিসরে পাঠিয়ে দেবেন। সেই তৃতীয় জাহাজের নাম লুসিতানিয়া। জার্মান সাবমেরিনের আক্রমণে জাহাজটি ডুবে যায়। এরপর কী হলো আর জানা নেই। প্রিন্সেস আমেন-রা টাইটানিকে ছিলেন?
না, ছিলেন না। পুরোটাই কল্পকাহিনি। আর এ কাহিনি তৈরির কৃতিত্ব দুজনের—উইলিয়াম স্টেড এবং ডগলাস মারে।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রুম নম্বর ৬২-তে সংরক্ষিত এই মমি ১৮৮৯ সালে মিসেস ওয়ারউইক হান্ট তাঁর ভাই আর্থার এফ হুইলারের পক্ষে ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে উপহার দেন। ১৮৯০ সালের দিকে এই কাসকেট মিউজিয়ামের প্রথম ইজিপশিয়ান রুমে প্রদর্শিত হতো। স্টেড ও মারের অতিপ্রাকৃতিক কাহিনি সম্পূর্ণ বানোয়াট। ১৯৮৫ সালে টাইটানিক হিস্ট্রিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট চার্লস হ্যাম টাইটানিকে পরিবহন করা মালামালের তালিকা দেখার সুযোগ পান। তাতে মমি কিংবা কফিনের কোনো উল্লেখও দেখতে পাননি।
ISIS অথবা ISIL
আইএসআইএস অথবা আইএসআইএল (যাদের পুরু মিনিংটা হচ্ছে ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক এন্ড সিরিয়া, অথবা ইসলামিক ষ্টেট অফ ইরাক এন্ড দি লিভান্ট। এখানে জানা দরকার লিভান্টটা কি। লিভান্ট হচ্ছে তুরুস্কের দক্ষিন অঞ্চল থেকে শুরু করে মিশরসহ সিরিয়া, লেবানন, প্যালেস্টাইন, ইসরায়েল এবং জর্ডান সম্বলিত যে রিজিওনটা হয় সেটা।
এর সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ
যেই নামেই এটাকে ডাকা হোক না কেন, এটা ব্যাসিকেলি আল কায়েদার অবশিষ্ট কিছু গ্রুপের একটা সমন্বিত বাহিনীর মিশ্রণ যারা সুন্নি জিহাদিস্ট দল নামে পরিচিত। আমেরিকা যখন ইরাক আক্রমন করে, তখন আল কায়েদার বাহিনি ছিল এই পুরু দল। কিন্তু লিডারশীপ নিয়ে মারামারিতে সর্ব প্রথম আল কায়েদা পাকিস্তানে এর ভাঙ্গন শুরু হয় ২০০৩ সালে। যদি নাম ধরে ধরে বলা হয় কারা কারা এর অংশ হিসাবে কাজ করছে তাহলে প্রথম যাদের নাম আসবে তারা হলঃ আল কায়েদা (ইরাক), মুজাহিদিন সুরা কাউন্সিল, ইসলামিক ষ্টেট অফ ইরাক, জেইস আল তাইফা আল মান্সুরা, জায়েস আল ফাতিহিন, আল সাহাবা কাটবিয়ান আনসার আল তৌহিদ অয়াল সুন্নাহ, এবং ইরাকের কিছু সুন্নি উপজাতি। ২০০৬ সালের ১৫ অক্টোবর বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পর 'আইএসআই'-এর আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের কথা ঘোষণা করা হয় এবং আবু ওমর আল বাগদাদি গ্রুপটির নেতা বলে জানানো হয়। ২০১০ সালের ১৯ এপ্রিল আবু ওমর নিহত হলে আবুবকর আল বাগদাদি এই জঙ্গি গ্রুপটির নতুন প্রধান হয় এবং মধ্যপ্রাচ্যে গ্রুপটির বিস্তার শুরু হয়। 'নয়া বিন লাদেন' নামে খ্যাত বাগদাদিকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য মার্কিন সরকার দশ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। বাগদাদি ২০০৫ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইরাকের উম্মে কাসর শহরে একটি মার্কিন কারাগারে বন্দি ছিল। ২০০৩ সালের আগেও সে আলয়দার সদস্য ছিল বলে মনে করা হয়। বাগদাদির আরেক নাম ছিল আবু দায়া। ২০০৫ সালে তাকে হত্যা ও অপহরণসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
২০১১ সালে যখন সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হয় তখন অনেক ইরাকি ফাইটারগন সিরিয়ায় গমন করে এবং তারা সিরিয়ান ও অন্যান্য বিদেশী ফাইটারগনের সাথে এক হয়ে কাজ করে। তাঁদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হিসাবে অবজেক্টিভ প্রচারনা করে যে শেষ খিলাফত রক্ষার জন্য শরিয়া বেজড ষ্টেট তৈরি করার জন্য তারা এই যুদ্ধ করছে এবং এটা শুরু হচ্ছে সিরিয়া এবং ইরাকে।
এটার জন্য কে বা কারা টাকা দিচ্ছে এটা বুঝার খুব দরকার। মজার বিষয় হচ্ছে এরা আমেরিকার বিরুদ্ধে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে, আবার টাকা দিচ্ছে সউদি আরব, ইরান, কুয়েত, কাতার এবং সিরিয়া। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, যদিও বলা হয় যে, সিরিয়া সরকার মানে আসাদ সরকার পরোক্ষভাবে এদের সাহাজ্য করছে কিন্তু ওরা সিরিয়ার বিরুদ্ধেও কাজ করছে বলে মনে করা হয়। এর প্রমান হিসাবে আপাতত ধরা যায় যে, কয়েকদিন আগে মুসুল এবং ফালুজার কিছু শহর দখলের পর তারা সিরিয়ার কিছু ইসলামিক গ্রুপকে চ্যালেঞ্জ করেছে। মুসুল দখল করার সময় তারা ৪০০ মিলিয়ন ডলার সমপরিমান টাকা লুট করে ওদের অর্থনৈতিক অবস্থান আরও শক্ত করে ফেলেছে। জানা যায় যে, এদের প্রতি মাসে প্রায় ৮ মিলিয়ন ডলার আয় হয় বিভিন্ন সোর্স থেকে।
সিরিয়ায় কট্টর ইসরাইল-বিরোধী আসাদ সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে পাশ্চাত্য, ইসরাইল এবং তাদের আঞ্চলিক সেবাদাস সরকারগুলোর মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহীদের মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু হলে 'আইএসআই'ও বিদ্রোহীদের পক্ষে যোগ দিয়ে এ যুদ্ধে অংশ নেয়। সিরিয়ায় ২০১১ সালে গঠিত আন নুসরা ফ্রন্টও 'আইএসআইএল'-এর একটি শাখা হিসেবে দেশটির সরকারি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকে। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে আবু বকর আল বাগদাদি এক অডিও বার্তায় জানিয়ে দেয় যে 'জিবহাতুন নুসরা' বা 'আন নুসরা ফ্রন্ট' 'আইএসআই'-এর অর্থ ও সহায়তা নিয়েই গঠিত হয়েছে এবং এই দুই গ্রুপ একত্রিত হয়ে 'আইএসআইএল' নাম ধারণ করেছে।
'আইএসআইএল'-এর যোদ্ধারা গত দশই জুন ইরাকের নেইনাভা প্রদেশের প্রধান শহর মসুলের বেশিরভাগ এলাকা দখল করে নেয়। শহরটি জনসংখ্যার দিক থেকে ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এ ছাড়াও তারা দখল করে ফাল্লুজা ও সাদ্দামের জন্মভূমির শহর তিকরিত। তিকরিত সালাহউদ্দিন প্রদেশের প্রধান শহর। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকিসহ অনেক কর্মকর্তা বলেছেন, ইরাকের একদল সেনা কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ায় এক ষড়যন্ত্রমূলক সমঝোতার আওতায় এই প্রদেশের ৫০ হাজারেরও বেশি সরকারি সেনা কোনো ধরনের বাধা না দিয়েই সন্ত্রাসীদের কাছে শহরটির প্রধান সরকারি ভবন, অস্ত্রাগার, ব্যাংক ও কারাগারগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়।
এতক্ষন যা বললাম তা হচ্ছে দৃশ্যমান কিছু তথ্য। এর মাঝে অনেক অদৃশ্যমান স্ট্রেটেজি রয়েছে যা সাধারন চোখ দিয়ে দেখলে পুরু ব্যাপারটা বোধগম্য হবে না। এটা নিতান্তই আমার মতামত।
আমার মতামতঃ
(১) কেউ কেউ বলে যে আসলে এমআই ৬, মোসাদ অথবা সিআইএ দ্বারা এই আইএসআইএস/এল প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত। এই সংস্থা গুলো উক্ত আইএসআইএস কে তাঁদের ফ্রন্ট অরগ্যেনাইজেসন হিসাবে ব্যবহার করে। এখানে একটু জেনে রাখা ভাল যে, "ফ্রন্ট অরগ্যানাইজেসন" একটা মিলিটারি টার্ম যার অর্থ হচ্ছে এই রকম,
" Front groups are intended to deceive the casual observer by carrying out actions without disclosing who instigated them. They include astroturf (fake 'grassroots' organisations) operated by legitimate companies as well as fronts operated by groups with more questionable legitimacy to provide plausible deniability to as criminal groups, governments or intelligence agencies."
(২) গালফ ওয়ার যারা শেষ হয়ে গিয়েছে বলে মনে করে তারা হয়ত আমার চেয়ে আরও অনেক বেশি ভবিষ্যৎ দেখতে পায় কিন্তু আমি সাধারন সেন্সে বলতে পারি যে, মিডল ইস্টকে যে কোনভাবেই আমেরিকা, ইউ কে বা অন্যান্য যারা এই এলাকার তেলসমৃদ্ধ দেশকে নিজেদের কন্ট্রোলে রাখতে চায় তারা কোন না কোনভাবে গালফওয়ার, বা প্যালেস্টাইন ওয়ার কিংবা সিরিয়া বা ইরান ক্রাইসিস লাগিয়েই রাখবে। এরা যে কোনভাবেই হোক একটা না একটা ছুতা বাহির করবেই। আর এই ছুতার আরেক নাম হচ্ছে আইএসআইএস বা আইএসআইএল। ইরাক থেকে আমেরিকা বা যুক্তরাজ্য বের হয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে তারা আরেকটি প্যারাসাইট তৈরি করেই বের হয়েছিল আর সেটাআই হচ্ছে এটা। ইরাককে এখন শিয়া এবং সুন্নি দুই অংশে ভাগ করে যে কোন একটার দিকে হেলে গিয়ে পুনরায় তাঁদের আধিপত্য বজায় রাখা হচ্ছে এর আসল লক্ষ।
ইরাকে নিউক্লিয়ার অস্র আছে এই প্রোপাগান্ডা ছরিয়ে যেমন গালফ ওয়ারটা হয়েছিল, এখন আইএসআইএস এর চাদরে ইরাককে আবার খন্ড বিখন্ড করা হবে। আর এ কারনেই আমরা দেখলাম যে, rapid march of the ISIS towards Baghdad and its swift takeover of Mosul and Tikrit, and Baiji oil refinery, Fallujah and Ramadi in the Anbar Province,
শুধু তাই নয়, seizure of border crossings into Syria and Jordan are presented by political analysts as a “civil war” fought along sectarian lines, Sunni Arabs versus Shiia Arabs.
এর সঙ্গে দৃশ্যমান ফলাফল অনুমান করা যায় যে, the ethnically different Iraqi Kurds who have enjoyed semi-independence under the US patronage and are now on the verge of declaring complete independence from Baghdad.
এর ফলে ভবিষ্যতে কি হবে তার একটা সরল রেখা টানা খুব সহজ। ইরাক ভেঙ্গে তিন টুকরা হবে। সুন্নি ইরাক, শিয়া ইরাক এবং সাধিন কুরদিস্থান। আর এর ফলে যেটা হবে তা হচ্ছে এই অঞ্চলে ইসরায়েল হবে একমাত্র শক্তিশালি দেশ যার কাছে আছে নিউক্লিয়ার পাওয়ার। আর মিডল ইস্ট এ আছে তেল যা ইসরায়েলের সাহাজ্যে আমেরিকা বা ইউ কে এরা এই চমৎকার ভাগাভাগিতে আনন্দ উল্লাস করবে।
তবে প্রশ্ন আসতে পারে কেন আমেরিকা এই পলিসিটা গ্রহন করল। এটা বুঝবার জন্য তোমাকে একটু দূরে ইতিহাসটা চোখ খুলে তাকাতে হবে।
ওয়ার অন টেরর যখন শুরু হয়, তখন সারা পৃথিবীতে মানুষ কোন না কোনভাবে আমেরিকা বা ইউকে কে এক তরফা ব্লেম করছিল এবং তাঁদের দেশের নাগরিকগন বিশ্ববাসির কাছে অনেকটা ঘৃণা এবং অপদস্ত হচ্ছিল। এতে তাঁদের দেশের নাগরিকরাও তাঁদের দেশের হর্তাকর্তাদের সমালচনা শুরু করে দেয়। ওয়ার অন টেররের মুল উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু শুধুমাত্র মুসলিমদেরকে দমানো বা ওদের শক্তি কমানো। তাই একই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য এবার তারা ভিন্ন পথ ধরেছে বলে আমার ধারনা। তারা এবার মুসলিম বনাম মুসলিম যুদ্ধটা শুরু করেছে যেখানে শিয়া ভার্সেস সুন্নি। এক্ষেত্রে ওয়ার অন টেরর কৌশলটা আর প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। এতে শাপও মরল লাঠিও ভাঙল না। এটাকে আমরা "ওয়ার উইথইন ইসলাম"ও বলতে পারি। অংকের ফলাফলটা একই কিন্তু ফর্মুলাটা ভিন্ন। মাঝখান দিয়ে সারা বিশ্ব আমেরিকা বা ইউকে কে বা তার মিত্রদেরকে কোন প্রকার ব্লেম করার আর সুযুগ পাবে না।
(২) একটা জিনিস খেয়াল করে দেখ যে, ইরাকের আইএসআইএসের বিরুদ্ধে আমেরিকা এয়ার স্ট্রাইক করছে কিন্তু ঐ একই আমেরিকা সিরিয়াতে আইএসআইএস কে সাপোর্ট করছে টাকা দিয়ে, পয়সা দিয়ে তথ্য দিয়ে এবং অস্র দিয়ে। এটা কিন্তু একটা ডাবল গেম। জাস্ট একদম এক ফর্মুলা যখন আমেরিকা আল কায়েদাকে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে লাগিয়ে পরে আবার আল কায়দাকেই ধ্বংস করার আরেক নমুনা। আমি প্যালেস্টাইনের ইন্তিফাদা পত্রিকার কিছু মন্তব্য তুলে ধরছি যা আমার কাছে মনে হয়েছে একদম ঠিক। "... How do we really know what the US is doing in Iraq at the moment? How do we know that they really are carrying out strikes against ISIS? How do US forces know who is ISIS and who isn’t? Do ISIS members wear bright pink uniforms so that they stand out in a crowd and can thus be precision targeted by American fighter jets? For all we know, these air strikes could be targeting Iraqi army and police forces that are fighting against ISIS militants. Maybe the plan is to covertly help ISIS fragment and destabilize Iraq and exacerbate the country’s misery. Perhaps ISIS is being used as leverage against the unreliable puppets in Baghdad; one can picture Obama threatening al-Maliki that if he doesn’t follow Washington’s demands like a blind mule more ISIS fighters will be flooded into the country. This whole thing could also be an Orwellian bluff designed to deflect attention from Israel’s biennial ritual slaughter in Gaza. ISIS’s presence in Iraq is being used as an excuse to continue to bomb that beleaguered and thoroughly victimized nation. Obviously Washington doesn’t give a damn if the people of Iraq fall victim to ISIS; in fact Washington would love nothing more than a few more Iraqi corpses. Only a fool would believe that Washington cares about the well-being of Iraqis after extinguishing the lives of close to two million of them since the genocidal 2003 invasion and relegating millions more to lives of misery and despair. America wants to keep Iraq in a state of perpetual decay, unable to assert its own interests or do much of anything without Washington’s assistance.
(৩) এখানে আমার আরও একটি ব্যক্তিগত মতামত দিতে চাই এই আইএসআইএসের যে নেতা তার সম্পর্কে। যদি তিনি এম আই ৬, কিংবা সিআইএ অথবা মসাদ থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়েই থাকেন, কেন এই ব্যাক্তিকে তারা প্রশিক্ষন দিলেন? এই প্রসঙ্গে আমার আরও একটি পুরান উদাহরন দেওয়ার আছে। আর তা হল, আল কায়েদার বিখ্যাত সেই নেতা যার নাম ছিল আদম গাদান যিনি আল কায়েদার একমাত্র মুখ্যপাত্র ছিলেন। তোমরা কি জান সে কে?
সে ছিল একজন আমেরিকান ইহুদী যার আসল নাম ছিল এডাম পার্লম্যান। ৯/১১ এর সময় তিনি রাতারাতি নাম বদল করে দাড়ি টুপি পড়ে একেবারে ইসলাম দরদি হয়ে যে কোন উপায়ে আল কায়েদার শীর্ষস্থানীয় নেতা বনে গেলেন। এটা আমেরিকার একটা চাল ছিল। এই সেই ব্যাক্তি যিনি "ওয়ার এগেইন্সট আমেরিকা" উচ্চারন করেছিলেন। পরবর্তীতে "অরেঞ্জ" পত্রিকা (একটা আমেরিকার পত্রিকা) এর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে যে তিনি ছিলেন ইহুদিদের সবচেয়ে সমর্থক গোষ্ঠীর কোন এক নেতার নাতি। ঐ দাদা ছিলেন ইহুদীদের সমর্থিত সংস্থার বোর্ড অফ ডাইরেক্টর। এই তথ্য বের হওয়ার পর আদম সাহেবের আর কোন হদিস পাওয়া যায় নাই। একইভাবে আমরা কি করে জানব যে বর্তমান আইএসআইএস এর যে নেতা ডঃ আবু বকর আল বাগদাদিও ঐ রকম একজন নন? ডঃ আবু বকর আল বাগদাদির নাম কিন্তু আসলে সাইমন এলিওট। তার পিতা একজন ইহুদী। তোমাদের আরও কিছু তথ্য আমি দেই যা তোমরা আমাকে বিশ্বাস নাও করতে পার। আর তা হচ্ছে আল কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেন, বা জাওয়াহারি, এরা সবাই মসাদের প্রশিক্ষন প্রাপ্ত গুরু। বর্তমানে হামাস, সেটাও এই মসাদের তৈরি। এগুলো আলাপ করতে গেলে ইতিহাস লিখতে হবে। ইন্দোনেশিয়ার টপ মুসলিম ক্লারিক আবু বকর বশির যদিও মুসলিম পোশাকে সজ্জিত, কিন্তু তিনি মসাদ কর্তৃক পালিত এবং তাঁদের এজেন্ট হিসাবেই কাজ করে। তিনি একজন ক্রিপ্টো ইহুদী এবং ইয়ামেনি বংসধর যিনি বালি বম্বিং এ জরিত ছিলেন । তিনি Abu Bakar Bashir is the leader of the Indonesian Mujahedeen Council, and he is linked to Jemaah Islamiyah and the Mossad-run al Qaeda.।
এই একই প্রসঙ্গে ইন্তিফাদা লিখেছে যে, "...... ISIS’s true intention, many claim, is to incite sectarian divide in Israel’s neighbouring states, thereby advancing Tel Aviv’s Oded Yinon plan for the balkanizing and fracturing of its regional foes. Is it any coincidence that ISIS and its affiliates have targeted Libya, Iraq, Syria and Lebanon with the most furor, while leaving the corrupt, US-backed dictatorships in Egypt, Bahrain, Jordan, Qatar, Kuwait, Saudi Arabia, etc., alone. Not to mention ISIS’s complete lack of action against Israel or the US
(৪) তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, কেউ কেউ মসাদের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হয়ে কিংবা ওদের ল্যাজ ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার পর নিজেরা আবার মতবাদ পরিবর্তন করে ফেলায় ওরাই আবার আমেরিকা বা ইস্রায়েলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। তার মধ্যে লাদেন একজন, ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমেদিনিজাদ একজন। যেমন বিট্রে করেছিল শ্রীলঙ্কার এলটিটিই র বেলুপেল্লাই প্রভাকরন ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে। ইন্ডিয়াই তাকে তৈরি করেছিল খোদ শ্রীলংকার বিরুদ্ধে কাজ করবার জন্য। কিন্তু পড়ে বেলুপেল্লাই প্রভাকরন আর নিজেকে ইন্ডিয়ার ছা পোষা হয়ে থাকতে চান নি এবং নিজে নিজে তার এক শক্ত বাহিনি গড়ে তোলায় ইন্ডিয়া নিজেও বেলুপেল্লাই প্রভাকরণকে মেরে ফেলার যত ষড়যন্ত্র আছে করেছিল এমনকি শ্রীলংকাকেও সাহায্য করেছিল।
(৫) আই এস আই এস কি ইসরায়েল কে থ্রেড করে?
পৃথিবীর বিখ্যাত এই টেররিস্ট দলকে ইসরায়েল এখনো নিষিদ্ধ ঘোষণাও করে নি এবং এর বিরুদ্ধে কোন কমেন্টও করে নি। শধু নরম ভয়েসে একবার মিডিয়াতে বলেছে যে, এরা যা করছে তা ন্যায়সঙ্গত নয়। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে আইএসাইএস ও কিন্তু ইস্রায়েলের বিরুদ্ধে কিছুই বলছে না।
আমি যদি এখন অন্যান্য ভেটো পাওয়ার ধারি দেশ গুলোর দিকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখি, তাহলে দেখা যাবে যে, রাশিয়া বা চায়না এরা একটা দারুন কনফিউসনাল স্ট্যাট দেখিয়ে কি করা উচিৎ তা সরাসরি কিছু বলছে না আর বল্লেও সে বলার মধ্যে যেন কেমন একটা নির্লিপ্ত ভাব আছে। সিরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সরাসরি খাতির। আসাদ সরকারকে রাশিয়া সরাসরি সমর্থন করে। আবার আইএসাইএস সিরিয়াতে যুদ্ধ করছে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে। তাহলে তো রাশিয়ার উচিৎ আইএসাইএস কে রাশিয়া কন্ডেম করা। অন্য দিকে সিরিয়ায় যুদ্ধ কিংবা গণ্ডগোল লেগে থাকলে রাশিয়া ক্রমাগত সিরিয়াতে অস্ত্র বিক্রির একটা খনি থাকে। তো এমন একটা খনি রাশিয়াই বা কেন বর্জন করবে যেখানে রাশিয়াকে ইদানিং এক ঘরে করে দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা আমেরিকা? এটা তো রাশিয়ার জন্য একটা অর্থকরী বাজার!! আবার এখনো ব্যাপারটা একদম ক্লিয়ার না আসলে আইএসাইএস কি আসলেই সিরিয়ার বিরুদ্ধে কিনা।
অন্য দিকে চায়নার ভিতরেও অনেক মুসলমান রয়েছে। তার নিজের শাসন ক্ষমতার মধ্যেও পুরুপুরি তারা গণতন্ত্র চর্চা করতে দেয় না ফলে চায়না কখনই চায় না আরেকটা অযাচিত সমস্যা নিয়ে নিজের দেশে একটা সমস্যা তৈরি হোক। তার মধ্যে ইদানিং আবার হং কোং নিয়ে তারা আরও বেশ নাজুক অবস্থায় পরে আছে। এ ছারাও চায়নাও চায় না যে, এই অঞ্চলে আইএসাইএস দ্বারা আরেকটি পাওয়ার গ্রুপ তৈরি হোক। এর মানে হচ্ছে চুপ থাক বাবা। চায়না ও কিন্তু রাশিয়ার মত সিরিয়ার সমর্থক। চায়না কিন্তু একটা কথা ইতিমধ্যে সরাসরি বলে দিয়েছে যে, তারা আইএস আই এস এর এন্টি কোয়ালিশন যুদ্ধে আমেরিকার সঙ্গে নাই তবে সর্বাত্মক মোড়াল সাপোর্ট দিতে প্রস্তুত। যেন ধরি মাছ না ছুই পানি। বিশ্ব রাজনিতি ভাই।
(৬) এখানে একটা ব্যাপার মনে রাখা দরকার যে, আইএসাইএস বাহিনিতে প্রুচুর পরিমানে আমেরিকান এবং বিদেশী যোদ্ধা আছে। এদেরকে আসলে প্ল্যান্ট করা হয়েছে বিশেষ ট্রেনিং দিয়ে। যদি কোন কারনে এই সব লোক গুলোকে এক সময় নিজের দেশে ফিরিয়ে আনতে হয় তাহলে এরা হয়ত বা নিজেরাই নিজের দেশে একদিন টেররিস্ট হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে অনেক বুদ্ধিজীবী রা আমেরিকা এবং ইউ কে কে সতর্ক করে দিয়ে ও লাভ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
(৭) এখানে একটা বিশেষ ধর্মীয় সত্ত্বার রক্ষার একটা দিক কাজ করছে আর তা হল, আইএসাইএস হল সুন্নি সম্প্রদায়ের একটা দল যারা শেষ খেলাফতকে রক্ষার নামে জিহাদ করছে বলে ঘোষণা দিয়েছে। আবার ও দিকে ইরান হচ্ছে শিয়া প্রধান দেশ। ইরান কিন্তু তার ধর্মীয় দিক থেকেই আইএসাইএস কে সমর্থন দেবার কোথা নয়। আর এ কারনে ইরান আইএসাইএস এর বিরুদ্ধে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে আমেরিকা যেহেতু ইরাক আইএসাইএস কে টার্গেট করে ওদের মারার চেষ্টা করছে বলে ভাব দেখাচ্ছে, এর মানে ওরা এটাও দেখাতে চাবে যে অতি শিগ্রই সিরিয়ার আইএসাইএস কেও টারগেত করবে। এতে চির শত্রু ইরানের সঙ্গেও আমেরিকার একটা অলিখিত বন্ধুত্ব হবে বলে একটা আভাস দেওয়ার সিগন্যাল মনে করা হচ্ছে। কিন্তু আসলেই কি তাই? খুব কমপ্লিকেটেড সিচুয়েসন এই আইএসাইএস।
ডলারের নোটের ব্যাখ্যা
আমিও আমেরিকার ডলারের এত ব্যাখ্যা জানতাম না, তুমি বলার পর আমি ইন্টারনেটে গিয়ে কিছু পরাশুনা করে দেখলাম ব্যাপারটা বেশ মজার। আমি যেটুকুন জেনেছি সেটা আমি বলছি। তবে আমি বাংলাদেশের টাকার ব্যাপারটাও জানার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু খুব একটা কিছু পাওয়া যায় নাই। তাই ডলার নোটের সম্পর্কেই বলছি যা একটা রিসার্চ করার মত ব্যাপার। ধৈর্য সহকারে পরতে হবে ভাই।
আমেরিকার ১ ডলার নোটের বিবরনটা এই রকমঃ
(১) ১৯৫৭ সালে প্রথম বের করা হয়।
(২) কটন এবং সিল্ক (এটা লাল এবং নিল সিল্কের ব্লেডেড)।
(৩) একটা স্পেশাল কালি ব্যবহার করা হয়েছে যা পানি বা কোন ক্যামিকেল দিয়ে ধুলে উঠে যায় না। প্রথমে যত ছবি বা ইমেজ আছে তার উপরে এই লেখাগুলো প্রিন্ট করা আছে এবং তারপর এগুলো পানি প্রুফ করে স্টার্চ করা।
(৪) ১ ডলারের সামনের অংশে ইউনাইটেড স্টেটস এর ট্রেজারি সিল দেয়া। এবং একটা পাল্লা আছে যা সুবিচার নির্দেশ করে। অনেকে এই পাল্লার ব্যাখ্যা করে যে এটা ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের ব্যালেন্স অব কারেন্সি বুঝায় তা ঠিক না।
(৫) মাঝখানে কারপেন্টারস টি-স্কয়ার বুঝায় যে, এখানে ১৩ টি স্টার আছে এবং এই ১৩ টি স্টার দিয়ে আমেরিকার প্রথম ১৩টি কলোনিকে বুঝানো হয়েছে।
(৬) ডলারের পিছনের অংশগুলো জানার ব্যাপারঃ
(ক) দুইটা বৃত্ত আছে যা একত্রে করলে আমেরিকার সিল হবে।
(খ) একটা জিনিস এখানে মনে রাখা দরকার যে, আমেরিকা ১৭৭৬ সালে কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস হিসাবে আধিপত্যতা ছিল বলে তার শাসন প্রনালি ছিল কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস হিসাবে। ৪র্থ জুলাই ১৭৭৬ সালে এই কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস লুপ্ত হয়ার সময় আমেরিকার জাতীয় একটা সিল তৈরি করার প্লান করা হয়। তখন ফ্রাঙ্কলিন এর নেতৃতে আরও পাচজন ( তারা হচ্ছেন এডাম, থমসন জেফারসন, এবং আরও দুই জন) যারা এই সিল তৈরির কাজের কমিটি হিসাবে নির্বাচিত হন। আর এই সালটাই লেখা আছে ঠিক পিরামিডের নিচে রোমান অক্ষরে।
(গ) বাম দিকের বৃত্ত খেয়াল করলে দেখতে পাবা যে, একদিকে পিরামিড যেটার ফেস আলোকিত কিন্তু এর পশ্চিম পাশটা আলোকিত নয়। এর মানে হচ্ছে আমেরিকা Western Side নিয়ে অন্ধকারে আছে। পিরামিড দিয়ে ওরা বুঝাতে চেয়েছে যে, ঐ অঞ্চল এখনো ওদের আয়ত্তে আসে নাই। এদের কাজ এখনো ঐ অঞ্চলে শেষ হয় নাই। এই ব্যাখ্যাটা অফিসিয়াল ভাবে গ্রহনযোগ্য নয়। তবে কেউ কেউ মনে করে এটা হতে পারে। আরেকটা ব্যাখ্যা অনেকে করেন যে, পিরামিড হচ্ছে শক্তির প্রতিক এবং বহুদিন টিকে থাকার প্রতিক।
(ঘ) ক্যাপসটোনের ভিতরে যে চোখ দেখা যায় একে বলা হয় "অল সিইং আই"। এর ব্যাখ্যা আসলে অফিসিয়ায়ালি কেউ জানে না। তবে ধারনা করা হয় যে, ফ্রাঙ্কলিন সম্ভবত এটা বুঝাতে চেয়েছেন যে, ইসরায়েলের দামাল ছেলেমেয়েদের সব হিংস্রাত্তক কর্মকাণ্ডসহ দেবতা তার সমস্ত পৃথিবীর কর্মকান্ড দেখতে পান সর্বদা। ফ্রাংলিন ইহুদি ছিলেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, এই পিরামিড এবং চোখ যীশুর প্রতিক।
(ঙ) পিরামিডের ঠিক নিচে লেখা আছে NOUVAS ORDO SECLURUM, এর মানে হচ্ছে নতুন যুগ শুরু হয়েছে।
(চ) সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে ইগলের ছবি এবং তার ব্যাখ্যা। ডান দিকের বৃত্তে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, একটা ইগলের ছবি আছে যাতে ইগলটি তার বাম দিকে ফেস করে আছে। একটু ভাল করে লক্ষ করে দেখ যে, ইগলের দুই পায়ে দুই ধরনের সিম্বল আছে। একটায় সবুজ অলিভ শাখার আটি আর একটায় ১৩ টি এরো। ডলার নোটের এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সিলের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই ইগলের ফেসের উপর। প্রেসিডেন্টের সিলে ইগলের ফেস এরো র দিকে আর সম্ভবত ডলারের ইগলের ফেস ওই অলিভ আটির উপর। এর মানে হচ্ছে এই যে, আমেরিকা একটি শান্তির দেশ এবং আমেরিকা তার প্রতিরক্ষার জন্য সে এরো অর্থাৎ শক্তি ব্যবহার করতে পারে। আগে ডলারের এবং প্রেসিডেন্টের সিল একই ছিল কিন্তু ১৯৪৫ সালে ট্রুম্যান (সে ১৯৪৫ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিল) এই ইগলের ফেস বদলিয়ে দেন। The official meaning is that the olive branch and the arrows "denote the power of peace & war."
এখানে আরও একটা জিনিস লক্ষণীয় যে, এই সিলটা কারো উপরে দাড় করান হয় নাই। মানে আনসাপোর্টেড। এর অর্থ এই যে, আমেরিকা এখন নিজে নিজে সয়ং সম্পূর্ণ।
(ছ) সিল্ডের পিছনে দেখা যায় যে, এটা রেড এবং সাদা স্ট্রিপ আছে যার উপরে একটা নিল বার আছে। এই সবগুলো কালার নেয়া হয়েছে আমেরিকার পতাকার রঙ থেকে। the red represents hardiness and valor, the white represents purity and innocence, and the blue, vigilance, perseverance, and justice.
(জ) ইগলের ঠিক উপরে ১৩ টি তারকা আছে যা ওই সময় আমেরিকার অধিনে মোট ১৩ টি কলোনি ছিল এবং এই স্টারগুলোর উপরে মেঘের একটা আভা আছে যাকে বলা হয় আরও কলোনি হয়ত ভবিষ্যতে যোগ হতে পারে। এটাও ঠিক ব্যাখ্যা নয় অফিসিয়ালি (মেঘের ব্যাপারটা)।
(ঝ) সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ডলার নোটে ১৩ এর সংখ্যার ব্যবহার। অনেকে ১৩কে আনলাকি বলে থাকে বটে কিন্তু এই ডলার নোটে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে ১৩ সংখ্যার একটা জাল। যেমন, ১৩টি স্টার (কলোনি বুঝাতে), ১৩ জন সিগ্নেটরি (আমেরিকার স্বাধীনতার দলিলে ১৩ জন সাইন করেছিল), ১৩ টি কালারের ব্যবহার, ১৩ টি এরো, ফ্লাগের ১৩ টি স্ট্রিপ্স, পিরামিডের ১৩ টি সিঁড়ি অর্থাৎ 13 original colonies, 13 signers of the Declaration of Independence, 13 stripes on flag, 13 steps on the Pyramid, 13 letters in the Latin above, 13 letters in "E Pluribus Unum", 13 stars above the Eagle, 13 plumes of feathers on each span of the Eagle's wing, 13 bars on that shield, 13 leaves on the olive branch, 13 fruits, and if you look closely, 13 arrows. And for minorities: the 13th Amendment.
আফিম যুদ্ধ
১৮৩৯ থেকে ১৯৪২ সালে এই যুদ্ধটা হয়েছিল। যুক্তরাজ্য আর চিনের মধ্যে এই যুদ্ধটা হয়। প্রধান কারন ছিল আসলে ট্রেড ডেফিসিট। চাউনিজরা ব্যাঙ খেলে কি হবে, এদের মাথায় বুদ্ধি ছিল সব সময়। কি একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখতে পাবা যে, কোন এক বয়স্ক চায়নিজকে দেখলে মনে হবে না যে এরা বুড়া হয়ে গেছে। এর কারণটা কি কেউ জান? Its like anti-aging
যাক যেটা বলছিলাম। চায়নারা তখনকার দিনে অনেক সিল্ক, মসল্লা, চা, ইতায়দি পয়দা করত। আর এগুলোর প্রুচুর মার্কেট ছিল ইউরোপিয়ান মার্কেটে। কিন্তু অন্য দিকে ইউরপিয়ান্দের প্রডাক্ট চায়নায় চায়নিজরা একেবারেই ইম্পরট করত না। এর কারন চায়নিজরা নিজেরাই সব কিছুতে সেলফ সাফিসিয়েন্ট ছিল। আর চায়নিজ সরকার তাদের ট্রেড আইন দ্বারা বাইরে থেকে বিদেশী ইম্পরট বন্ধ করে রেখেছিল। শুধুমাত্র সিল্ভার আর সোনা চায়নিজরা আমদাই করতে পারত যা ইউরপিয়ান্দের কাছে ছিল অনেক। আর শুধুমাত্র এই সোনা আর সিল্ভারের মাধ্যমে ব্যবসা আদান প্রদান করতে গিয়ে ইউরোপে সোনা আর সিল্ভারের দ্রুত স্টক ফুরিয়ে আসছিল।
কিন্তু ইউরোপিয়ানরা বসে থাকে না। যেটা আজকে ওরা বুঝে, ইন্ডিয়ানরা বুঝে কাল আর বাঙালি বুঝে ৬ মাস পর। ইয়রপিয়ানরা দেখল, যে, চায়নিজরা প্রচুর আফিম খায়। আর আফিম ছিল ইউরোপে নিষিদ্ধ। ইউরোপিয়ানরা করল কি সিল্ভার আর সোনার পাশাপাশি এই আফিমকে আরেকটা ট্রেড আইটেম বানিয়ে প্রচুর পরিমান আফিম চায়নায় রপ্তানি করা শুরু করল। দিনে দিনে চায়নায় আফিমের বিস্তার এতটাই হয়ে উঠছিল যে, কোন সরকার ই এই আফিম খাওয়ানো বন্ধ করতে পারছিল না।
চায়নিজ সরকার প্রতিটি স্থানে চেক পয়েন্ট বসিয়ে দিল কোথা থেকে কিভাবে এই আফিম চায়নায় ঢুকছে তা বন্ধ করার জন্য। একবার কোন এক ব্রিটিশ ব্যবসায়ির কাছ থেকে কাস্টম প্রায় ৩০ লক্ষ পাউন্ড আফিম জব্দ করল। ব্রিটিশ হচ্ছে হারামির জাতের গুরু। যদিও চায়নাকে আফিম প্রতিরোধ করার আইনকে চ্যালেঞ্জ করেনি কিন্তু এই জব্দ হওয়া আফিম তারা অবজেকসন দিল এবং পরবর্তীতে এইসুত্র ধরেই সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল। এর ফলে ১৮৪২ সালে ট্রিটি অফ নাঙ্কিং হয় যা ছিল এক তরফা একটা বিচার। এর মাধ্যমে চায়নাকে চায়নার পাচটি পোর্ট খুলে দিতে হয়, এবং হংকং হাত ছাড়া করতে হয়। আর এটাকে বলে অয়ার অব আফিম (১ম আফিম যুদ্ধ)। ২য় আরেক্তা আফিম যুদ্ধ হয়েছিল ১৮৫৬-১৮৬০ সালে।
আর ওটা ও ছিল আরেক ধাপ বড় যেখানে হারামি ব্রিটিশ চায়নাকে বাদ্ধ করেছিল উক্ত ৫ টা পোর্টের বদলে চায়নার সব পোর্ট খুলে দিতে এবং আফিমকে অফিসিয়াল আইটেম হিসাবে ডিক্লেয়ার দিতে। তখন রাজা ছিল কিং ডাইনেস্টি। জাঁদরেল রাজা। ঐ যে বললাম চায়নারা ব্যাঙ খাইলেও ওদের মাথায় একদম খারাপ ব্রেইন নাই। তারা করল কি যারা যারা ব্রিটিশ দের সঙ্গে এই আফিমের ব্যবসাটা করে তাদের সবাইকে টার্গেট করে। আগের চুক্তির (ট্রিটি অফ নাংকিং) খুব একটা আদলে নিচ্ছে না দেখে ব্রিটিশরা "মোস্ট ফেবারড নেশন" নামে একটা বানিজ্যক টার্ম ব্যবহার করে যার মানে হচ্ছে বানিজ্যক সুবিধা দেয়া। এতে চায়নিজ আফিম আমদানিকারকগন ব্রিটিশদের কাছ থেকে আফিম টেক্স ছাড়া কিনতে পারে। আর তখন কিং ডাইনেস্টি চায়নিজ ব্যবসায়িদেরকেও ধরা শুরু করল যে যারা যারা ব্রিটিশ জাহাজে করে এই আফিম আনবে তারা আনঅফিসিয়ালি ধরা খাবে। ব্রিটিশরা আরও হারামি। তারা করল কি ঐ সব চায়নিজদেরকে এই সুবিধাও দিল যে অনেক চায়নিজ ব্যবসাই ব্রিটিশ জাহাজের মালিকান রেজিস্ট্রি পেয়ে যায়। যাতে চায়নিজ কিন্তু ব্রিটিশ জাহাজ আবার আফিম আনতে পারবে। রাজনিতি কি খারাপ, স্বার্থ ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না
তখন একটা ব্রিটিশ জাহাজ যার নাম ছিল "এরো"। এটা বেসিক্যালি ব্রিটিশ জাহাজ কিন্তু চায়নিজ ব্যবসায়ির নামে রেজিস্ট্রেসন করা। কিন্তু ১৮৫৬ সালে ঐ ব্রিটিশ জাহাজটি যদিও চায়নিজ এক ব্যবসায়ির নামে নতুন করে রেজিস্ট্রেসন করে দিয়েছিল আফিম ব্যবসাটা চালিয়ে নেবার জন্য কিন্তু ঐ বছর তখনো ব্রিটিশ ফ্ল্যাগটা ব্যবহার করছিল। আর যায় কই। কিং ডাইনেস্টি সুযোগটা হাতছারা করে নি। সিজ করে ফেলল ঐ "এরো" নামক জাহাজটি। অনেক তদবির তদবির করে জাহাজের ক্রুগুলোকে চায়নাদের কাছ থেকে ছারিয়ে নিয়ে গেলে ও চায়না কোনভাবেই ব্রিটিশদেরকে ক্ষমাও করেনি, ক্ষমাও চাননি। তখন যেহেতু হংকং ছিল ব্রিটিশদের আধিনে এবং হংকং এর শাসক ছিলেন ব্রিটিশ। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রির আদেশ ছারাই হংকং শাসক চায়নার ক্যন্টন আক্রমন করে বসে। বললাম না ব্রিটিশরা হচ্ছে হারামির জাত। এই অবৈধ আক্রমণকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রি পালমাস্টোন তার অফিসিয়াল সায় দিয়ে যুদ্ধটা বাধিয়েই দিলেন যা ২য় আফিম যুদ্ধ বা এরো যুদ্ধ ও বলা হয়। ।
হ্যালি ধুমকেতু
১৭০৫ সালে এডমন্ড হেলি নিউটনের "ল অব মোশন" এর ভিত্তিতে এই ধূমকেতুর আবির্ভাব নিয়ে কিছু তথ্য দিয়েছিলেন যাতে বলা হয়েছিল যে, এতা ১৫৩১, ১৬০৭, ১৬৮২ এবং ১৭৫৮ সালে এতা দেখা যাবে। তার বক্তব্যের সত্যতা তার জীবদ্দশায় ১৫৩১ এবং ১৬৮২ ঠিক ছিল কিন্তু ১৬৮২ সাল ঠিক থাকবে কিনা এটা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল যে, সত্যি যে ঐ ধুমকেতুটি তার মৃত্যুর পর ১৭৫৮ সালে দেখা গিয়েছিল এবং তার পর থেকেই তার সম্মানে এই ধুকেতুর নাম রাখা হত হ্যালি।
প্রতি ৭৬ বছর পর পর এই ধুকেতুটি আসে কিন্তু সময়ের হের ফেরে বা ধুমকেতুটির নিঃসরণের কারনে তার গতির কিছু হেরফের হয় বলে বলা হয় যে এটা ৭৬ থেকে ৮০ বছর এই দুই অংকের মদ্ধে থাকে। এটার দাইমেন সন হচ্ছে প্রায় ১৬ বায় ৮ বায় ৮ মাইল।
যদি কোন কারনে এই ধুমকেতুটি কখন পৃথিবীর সাথে হটাত আকর্ষিক ধাক্কা লেগে যায়, তাহলে এর বিপর্যয় হবে এক মারাত্মক। এতে পুরু পৃথিবী ধ্বংস অ হয়ে যেতে পারে কারন এর স্পীড এবং সাইজের জন্য। তাই মাঝে মাঝে বৈজ্ঞানিক গন একে "এটম বম্ব ফর নাগাসাকি" না বলে বলে থাকেন "এটম বম্ব ফর ওয়ার্ল্ড"। তাই হ্যালির ধূমকেতুর আবির্ভাবে খুব বেশি খুশি হবার কোন কারন নাই বরং এতা পৃথিবীর জন্য অত্যান্ত ব