মানুষের জীবনের সব কিছুই খোলাশা নয়। কিছু কিছু ঘটনা আছে, কিংবা বিষয় আছে অথবা মুহুর্ত আছে যা শুধুমাত্র নিজের এবং আর কারো না। যদি এসব কাউকে বলতেও চাই, সেগুলি না বিশ্বাসযোগ্য, না বলার মতো বলে মনে হয় অথচ ঘটেই যায়। এটা সবার জীবনেই ঘটে, হোক সে যুবক কিংবা বৃদ্ধ। যদি যুবক বয়সে ঘটতে থাকে, তখন বৃদ্ধ বয়সে এসে তা জাবর কাটে, আর যদি বৃদ্ধ বয়সে ঘটতে থাকে, তখন অনেকেই এটাকে না মানতে চায়, বা মানাতে চায়। তখন এর নাম হয় ভীমরতি।
কিন্তু একটা কথা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে, মানুষ যখন কষ্টে থাকে তখন তার দরকার পড়ে একজন সাথীর, আবার মানুষ যখন ফুর্তিতে থাকে, তখনো দরকার হয় তার সাথী, অথবা মানুষ যখন নিজে নিজে একা হয়ে যায়, তখনো দরকার হয় তার একজন সাথীর। একজন স্ত্রীর অথবা একজন স্বামীর জন্য স্বামী বা স্ত্রীই যে সর্বদা ম্যাচিং সাথী হবে এমনটা কখনোই না। সারাজীবন এক ছাদের তলায় বসবাস করেও একজন স্ত্রী হয়তো কোনো এক সময়ে এসে সে তার স্বামীকে হয়তো বুঝতেই পারে না, আবার যুগের পর যুগ একসাথে একই বিছানায় ঘুমিয়েও একজন স্বামী তার স্ত্রীকে হয়তো হারিয়েই ফেলে কোনো এক সময়ে। তখন না স্বামী, না স্ত্রী কেহই একে অপরের যোগ্য সাথী হয়।
অন্যদিকে, আজকের দিনে জয়েন্ট ফ্যামিলি যেনো অনেকটা সপ্নের মতই মনে হয়। অথচ একটা জয়েন্ট ফ্যামিলির কেউ না কেউ কারো না কারো সাথীর ভূমিকায় অবতীর্ন হয়ে তাদের শুন্যতাকে ভরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু মানুষ আজকাল এতোটাই ব্যস্ততায় নিজেকে নিয়ে থাকে যে, নিজের অভাব পুরন করতে করতেই তার সময় শেষ হয়ে যায়, অন্যের জন্য খরচ করার সময় তার নাই। হয়তো এর মধ্যেই জুটে যায় অপরিচিত কোনো এক সত্তা যিনি হয়তো সাময়িকভাবে দিতে পারে দুদন্ড শান্তি সেই বনলতার মতো। এই বনলতারা হটাত করেই উদয় হয় একেবারে কোনো এক অজানা জায়গা থেকে। ওরা আসলে এই সমাজেই থাকে কিন্তু কখন যে এরা সবার আড়ালে বনলতা কিংবা পুরুষলতা হয়ে উঠে কেউ জানে না। একেবারে অতি সংগোপনে এরা একে অপরের সাথী হয়ে যায়। কনো ব্যারিয়ার থাকে না এদের মাঝে। শারিরিক, দৈহিক কিংবা আর চরম গোপনীয়তাও এদের মাঝে আর কোনো দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় না। অবশ্য বনলতারা সব সময় থাকেও না, একটা সময় আসে তারাও এক বৃক্ষ থেকে আরেক বৃক্ষে, এক সমতল থেকে আরেক মালভূমিতে কিংবা কোন এক জনপদ থেকে আরেক জনপদে তারা একেবারেই হারিয়ে নতুন কারো সাথে জোড়া বাধে। এই বনলতারা কেউ কাউকেই আঘাতে বিশ্বাস করে না আবার কেউ আজীবন তাদের জীবনটাকেই বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকে।
আমার জীবনেও এমন কেউ এসেছিলো বা আসতে চেয়েছিলো। অরু, মেঘলা, সন্ধ্যারানি, রেনু কিংবা শারমিন অথবা সানা এরা এ সমাজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রেস্ট্রিক্টেড প্রানী যাদের মুখাবয়ব সমাজে পুরুপুরি উম্মুক্ত নয় কিন্তু সবার সামনেই ওরা চলাচল করে। এরা সবাই কোথাও না কোথাও অসুখী মানুষ। আবার কেউ কেউ অসুখী কিনা সেটাও বুঝতে পারেনা, ভাবে ঠিকই তো আছে। ফলে এদের মধ্যেও একতা শ্রেনীভাগ আছে। কেউ সাহসী, কেউ একেবারেই ভীতু, কেউ ধর্ম ভীরু, কেঊ সমাজভীরু, কেউ ব্যক্তিভীরু আবার কেউ পরিবারের জন্য ভীতু। অরুরা ছিলো ডেস্পারেত, মেঘলারা ছিল মডারেত, সন্ধ্যারানীরা ছিলো আত্তগোপনের মতো কেউ, রেনুরা সমাজের কোথাও না কোথাও রাজত্ব করতে গিয়ে পারায় বড় আপু হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকাএ মানুষের মত, শারমিনেরা অদ্ভুত আচরনের ধারায় সবাইকে হতাশ করে আবার অন্যত্র বাসা বাধে। কিন্তু সানারা সুখী না হলেও কোনো রিস্ক নিতে ইচ্ছুক না। তাই এই সানারা সব সময় থাকে একা। তবে যাইই হোক, অনেক অসুখী মানুষেরা যখন একত্রে যাত্রা করে, তাদের আর অসুখী মানুষের দল হিসাবে ভাবা যায় না। তারা সবাই একটা মানের মধ্যে পরিপুর্ন। যেমন অরুর কথাই বলি-সে প্রথম জীবনে যা পেয়েছে, তার মধ্য জীবনে পেয়েছে গোলাভরা ধান আর মাঠ ভরা ফসলের মতো প্রচুর ধন সম্পদ। দুহাতে বিলিয়েও সেটা শেষ করা যায় নাই। আবার অরু যখন সেই পর্যাপ্ত সুখের জীবনে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলো, তখন তার কাছে সেই জীবনটাই আবার একঘেয়েমিতে ভরে উঠেছিলো। তার অন্তর সন্ধ্যান করতে চেয়েছিলো এমন এক সমতল যেখানে সে নিজেই একজন অপরিচিত মানুষ বা আগন্তক। কেউ তো ছিলো যে তাকে হাতছানী দিয়েছিলো কোনো এক অলৌকিক আনন্দের ভরষায়। অতঃপর সে দল ছেড়েছিলো। এরপর তার কি হয়েছিলো, সেটা আমার এ জীবনে জানা হয়নি।
যখন অরুলতা প্রস্থান করে, প্রকৃতির নিয়মে সেই স্থান দখলে চলে যায় ভীরুলতার কাছে, আর সেটা সানা নাম ধরে বিচরন করে সমাজে। কিন্তু ভীরুলতা সেই অরুলতার মতো এতো এগ্রেসিভ ছিলো না যে, তার স্থান দখল করলেও একই প্রভাব রাখতে পারেনি। এই দুই লতার, ভীরুলতা আর অরুলতার মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ধর্মালয়ের ন্যাচারীক রকম মনে হলেও একজন আরেকজনের প্রায় বিপরীত ছিলো। অথচ দুজনেই চেয়েছিলো অসীম কোন আনন্দের ফোয়ারা। পেয়েছিলো কি?
হয়তো পেয়েছিলো কিন্তু সেটা অন্তত আমার এই জীবনে জানা যায়নি। কিন্তু জানা হয়েছিলো কিছু “হ্যাপি” মানুশের কিংবা জ্যোৎস্না কাননের একচ্ছত্র মালিকের জীবনী থেকে যে, ওরা কোনো রকমে জীবনের সবগুলি অংশ পার হয়ে যেখানে থিতু হয়েছিলো সেটা এক রকমের বেচে থাকার মতো। ফলে ওরাও সুখের হাতছানীতে এমন কিছু বাস্তবিক কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলো এবং গিয়েছিলো যা প্রকাশের বহির্ভুত কিন্তু সেটাও বাস্তব। কোথায় যেনো জীবন শেষ পর্যন্ত কোনো না কোনো পরিস্থিতির কাছে পরাস্ত হয়ই। কেউ আসলে সুখী নয়, টাকাওয়ালা, স্বামীওয়ালা, স্ত্রীওয়ালা, সুন্দুরী, কিংবা রাজ্যের প্রতাপ্সহালী কেউ, কেউ সুখী নয়। আমরা যা দেখি সেটা ভুল। যা দেখি না, সেটাই সত্য কিন্তু রেস্ট্রিক্টেড ইভেন্টস। ভীরুলতাকে অনেক বার হাতছানিতে ডাকলেও সে ছিলো প্রান্তি চাষির মতো। সে কখনোই তার ক্ষেত থেকে বেরিয়ে আইলে উঠতে চায় নাই। কিন্তু ক্ষেতে বসেই আইলে গজানো মিষ্টি কলার সাধটা চেয়েছিল। কিন্তু কলা গাছের একটা বাহ্যিক বৈশিষ্ট ছিলো যে, সে যতোক্ষন না তার সাথে লেপ্টে থাকে, তার মিষ্টি কলার ভাগ সে কাউকে দিতে নারাজ। তাই ভীরুলতা যা পেতে চেয়েছিল-হটাতই সেটা হাতছাড়া হয়ে উঠে।
প্রতিটি মানুষের একটা ইতিহাস আছে। সে পাগল হলেও তার একটা ইতিহাস আছে। কেনো পাগল হল, কিসের কারনে সে পাগল, কিংবা কে তারে পাগল করলো অথবা তার পাগলামীর কি রহস্য অথবা অর্থ সেই সবকিছুর একটা ইতিহাস কোথাও না কোথাও তো আছেই।
একটা ব্যাপার আমার প্রায়ই মনে আসে, আমরা কেমন একটা যুগে বেচে আছি? উত্তর খুব কঠিন না। দূর্ভাগ্যবশত আমরা আসলে এমন একটা যুগে পদার্পন করে বেচে আছি যেখানে জঘন্যতম অপরাধও স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে আর গভীরতম সম্পর্কগুলি হয়ে যাচ্ছে মুল্যহীন। আর এসব চরমপন্থী যুগ আর বৈষম্য মুলক সমাজ ব্যবস্থায় আমরাও মানুষেরা নিজেদের আচরনে স্বাভাবিকতাকে ঝেড়ে ঝুড়ে এমন কিছু ঘটনায় আকড়ে যাচ্ছি যা আসলে অন্যের কাছে ভাগাভাগি করে নেয়া যায় না। অথচ ব্যাপারগুলি ঘটছে। কিছু কিছু ঘটনা থাকে যার কোনো প্রমান থাকে না, কোনো সাক্ষী নাই, কোন প্রত্যক্ষ মানুষের চোখে পড়ে নাই, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, কোনো ঘটনাই ঘটে নাই। এটা যদি ক্রাইম হয়, তাতেও পারফেক্ট ক্রাইম বলা যাবে না কারন পার্ফেক্ট ক্রাইম বলতে কিছুই নাই। হয়তো ইনভেষ্টিগেশন তাকে ছুতে পারেনি। এর মানে এটা আন্সল্ভড কেস নয়। আর যদি এসব কাহিনি হয়ে থাকে কোন যুগপদ মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত চেষতায় তাহলে সেখানে ইনভেষ্টিগেশন খুব একটা পৌঁছায় না। আর এই গোপন ব্যাপারগুলিই মানুষের জীবনে কনো না কোনো সময় রেষ্ট্রিক্টেড ঘটনা হয়ে পড়ে থাকে একেবারেই আন্সল্ভড ফাইলের কেসের মত।
ব্যাপারটা অনেকটা মিসিং কেসের মতো। একজন মিসিং হলোকিন্তু কেউ মিসিং কেস করলোই না। হয়তো কেউ তার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে। অথবা কেউ জানেই না তাদের কেউ মিসিং হয়েছে। অথবা হয়তো জানে কিন্তু কেউ মিসিং কমপ্লেইন করলোই না। একজন হারিয়ে যাওয়া মানুষ মাঝে মাঝে জিক্স পাজেলের মতো এদিক সেদিক ক্ষনে ক্ষনে ঘুরে বেড়ায় দেশ থেকে দেশান্তরে, অথবা লোক চক্ষুর আড়ালে। তার আশেপাশের মানুষ এমন কি তার পরিবারের মানুষেরাও জানে না আসলে গল্পটা কি। তারা হয়তো জানেই না এই হারিয়ে যাওয়ার পিছনের গল্পটা কি এবং কোথায় শুরু।