Tours & Travels
২৪/০২/২০০৩-স্ট্যালিন ঢাছা
আবখাজিয়ার রিটসা লেকের ধারের সেই “স্ট্যালিন ঢাছা”- একটি মর্মান্তিক ইতিহাস
আবখাজিয়ায় আমার নতুন পোষ্টিং বেশ মাস খানেক হলো। আসার পর অনেকবার যেতে চেয়েছিলাম “গোরি”তে যেখানে স্ট্যালিন জন্ম গ্রহন করেছে। এখন জায়গাটা আর আগের মতো নাই। এটা এখন মিউজিয়াম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। গিয়েছিলাম কয়েকদিন আগে। কিন্তু আরেকটা জায়গা দেখার খুব শখ হচ্ছিলো- স্ট্যালিন ঢাছা।
স্ট্যালিনের শিশু জীবন কেটেছে খুবই অনিরাপদ এবং গরীব এক পরিবারে। এই অনিরাপদ পরিবেশে তিন ভাই বোনের মধ্যে স্ট্যালিনই একমাত্র বেচেছিলো। তার পিতা ছিলো একজন জুতা মেরামতকারী কিন্তু প্রচন্ড মদ্যপানকারী বদরাগী মানুষ যে প্রতিদিন সে তার সন্তান স্ট্যালিনিকে কারনে অকারনে মারধোর করতেন। স্ট্যালিনের বয়স যখন ১০, তখন তার পিতা মারা যায়। তার মা ছিলো হাউজ ওয়াইফ। তার মা স্ট্যালিনের বুদ্ধিমত্তা দেখে তিনি তাকে এক সেমিনারীতে ভর্তি করে দেন এবং তিনি চেয়েছিলেন স্ট্যালিন প্রিস্ট হিসাবে বড় হোক।
স্ট্যালিন খুব মেধাবী ছাত্র ছিলো এবং প্রায় ৮ বছর পড়াশুনা করে স্ট্যালিন তার ভিন্ন মার্ক্সিজমের মতাদর্শের কারনে স্কুল তাকে বহিষ্কার করে দেয়। এরপর স্ট্যালিন একটি রেভুলুসনারী গ্রুপে তদানীন্তন জারের বিরুদ্ধে জয়েন করেন এবং রেভুলিউশনারী গ্রুপের হয়ে স্ট্যালিন নিজ হাতে তার মতের বাইরের লোকদেরকে একের পর এক হত্যা করতে শুরু করেন। এরপর বলসেভিক গ্রুপ। স্ট্যালিনের একচেটিয়া মনোভাব আর হত্যার মতো দুধর্ষ কাজের মাধ্যমে তিনি বলসেভিক গ্যাং এর খুব প্রতাপশালী নেতা হয়ে উঠেন। শুরু হয় ব্যাংক ডাকাতি, গ্রামে আগুন লাগানো, লোকদেরকে হত্যা করা ইত্যাদি।
যখন বলসেভিক ক্ষমতায় এলো, তখন বলসেভিক পার্টির নেতা লিউনার্দো তাকে বলসেভিক পার্টির অন্যতম একজন নেতার পদ দেন। কিন্তু লিউনার্দো পরবর্তিতে তার মৃত্যুর আগে এটা বুঝে গিয়েছিলেন যে, স্ট্যালিনকে আর বেশী ক্ষমতা দেয়া যাবে না কারন সে ডেস্ট্রাকটিভ এবং অত্যান্ত উগ্রপন্থির মানুষ এবং এতোটাই যে, তাকে সর্বনয় ক্ষমতায় তিনি তাকে দেখতে চাননি। কিন্তু তারপরেও সেটা হয়েছিলো।
রাশিয়ান রেভুলিউশনের সময় “স্ট্যালিন” এই নামটি নিজেই গ্রহন করেন যার অর্থ স্টিলম্যান বা ম্যান অফ স্টিল। তার আসল নাম ছিলো ভিসারিউনভিচ। স্ট্যালিন চেয়েছিলো আল্টিম্যাট টোটালেরিয়ান ডিকটেটর হিসাবে পরিচিত হতে এবং সেটা কমিউনিজমের মাধ্যমে। তার ধারনা ছিলো কমিউনিজমের মাধ্যে সে তার দেশের সমস্ত মানুষকে ডিসিপ্লিন্ড, শক্তিশালী , ওবিডিয়েন্ট এবং সভ্য মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা আর তার আদেশ অন্ধভাবে পালন করা। এই প্রোজেক্ট সফল করার জন্য স্ট্যালিনকে যা যা করা দরকার সেটাই সে একচ্ছত্রভাবে এগিয়ে গিয়েছিলো যেখানে পুরানো সব ভিন্ন মতাদর্শকে সমুলে খতম এবং তার মতাদর্শকে আরোপ করা। সে মনে করতো তার এই প্রোজেক্ট সফল করার জন্য যদি দেশের অর্ধেক মানুষকেও হত্যা করতে হয়, তাতেও তার করতে হবে এটাই ছিলো তার একমাত্র সপ্ন। স্ট্যালিন এই প্রোসেসকে সফল করার জন্য প্রায় দেড় বছর এক নাগাড়ে নীরবে এবং গোপনে একটা ‘গ্রেট পার্জ’ নামে সায়েন্টিফিক এবং মেটিকুলাস মেথড ব্যবহার করেছেন। ‘গ্রেট পার্জ” এর জন্য তার প্রয়োজন ছিলো এমন একজন লোক যিনি স্ট্যালিনের সমস্ত আদেশ অন্ধভাবে বিসশাস করবে, পালন করবে এবং তা পালন হয়েছে কিনা নিশ্চিত করবে। আর এর জন্য তিনি বেছে নেন নিকোলাই ইয়েজভ নামে একজন তিন ক্লাশ পর্যন্ত পড়ুয়া মানুষকে। যাকে পরবর্তিতে মানুষ চিনতো “ব্লাডি ডয়ার্ফ” নামে। এই নিকোলাই ইয়েজভ ছিলো স্ট্যালিনের সিক্রেট পুলিশের চীফ। সে নিজে সাত লক্ষ সত্তুর হাজার নীরীহ এবং ভিন্ন মতালম্বী মানুষকে স্ট্যালিনের “গ্রেট পার্জ” এর আওতায় গুলি করে হত্যা করা হয়।
জুলাই ১৯৩৭ থেকে নভেম্বর ১৯৩৮ এর মাঝখানে স্ট্যালিন প্রায় ৮ লক্ষ মানুষকে এভাবে হত্যা করেন। অর্থাৎ প্রতিদিন ১৫০০ মানুষ অথবা প্রতি ৫৭ সেকেন্ডে একজন। আর এভাবেই স্ট্যালিন নভেম্বর ১৯৩৮ এর শেষের দিকে মনে করেন তার আর কোনো কাল্পনিক বা দৃশ্যমান কোনো প্রতিদন্ধি থাকলো না এবং “এবসিউলুট পাওয়ার” এর অধিকারী হন স্ট্যালিন। আগেই বলেছিলাম, স্ট্যালিন ছিলো অত্যান্ত মেধাবী এবং হিসাবী। তিনি তার এই হত্যার কৃত কর্মের ভার কখনোই নিজের ঘাড়ে নিতে চান নাই। তার সেটাও পরিকল্পনায় ছিলো। এ ব্যাপারে একটু পরেই আমরা আলোচনা করবো।
স্ট্যালিনের ১ম স্ত্রী ছিলেন একাতেরিনা যিনি অসুস্থতার কারনেই যুবতী অবস্থায় মারা যান। তার ২য় স্ত্রী ছিলো নাদিয়া। ১৩ বছর স্ট্যালিনের সাথে সংসার করার পর ১৯৩২ সালে নাদিয়া নিজে আত্তহত্যা করেন। স্ট্যালিনের সাথে ১৩ বছর সংসার করার পর নাদিয়া একটা জিনিষ বুঝতে পেরেছিলেন যে, স্ট্যালিন একজন স্বাভাবিক মানুষ নন যা তিনি বিয়ের সময় ভেবেছিলেন। কারন নাদিয়া দেখতে পাচ্ছিলো যে, স্ট্যালিন নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য নিজের আপন মানুষদেরকেও তার হত্যা করতে কোনো দিধাবোধ নাই। এরই ধারাবাহিকতায় নাদিয়া দেখছিলেন, তার সমস্ত আত্তীয়স্বজন, তার স্বামীর বাড়ির আত্তীয় স্বজনেরা একে একে কোথায় যেনো গুম হয়ে যাচ্ছে আর কেউ ফিরে আসছে না। নাদিয়ার বোন এভগেনিয়ার স্বামীকে স্ট্যালিন বিষপানে, এভগেনিয়াকে এবং তার আরেক বোন মারিয়াকে স্ট্যালিন সাইবেরিয়ার “গুলা” তে ডিপোর্টেশনে পাঠান। “গুলা”র তাপমাত্রা শীতকালে যা থাকে মাইনাস ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মতো। শুধু তাইই নয়, স্ট্যালিন নাদিয়ার ছোট ভাই পাভেলকে ২ নভেম্বর ১৯৩৮ সালে বিষপানে হত্যা করেন। এভগেনিয়ার মেয়ে “কিরা”, তার বড় বোন আনাকেও স্ট্যালিন “গুলা”তে নির্বাসনে পাঠান। এভাবেই ‘আনা’র স্বামী স্ট্যানিস্লাভ, ১ম স্ত্রীর ভাই আলেক্সজান্ডারকেও স্ট্যালিন গুলি করে হত্যা করেন। নাদিয়া এসবের চাপ আর নিতে পারছিলেন না। ফলে সে স্বামীর আনুগত্য হারিয়ে ফেলে। নাদিয়া তার গর্ভের তিন বাচ্চা, ছেলে ইয়াকভ, মেয়ে ভ্যাসিলি আর এসভেটলানাক পিছনে রেখে আত্তহত্যা করেন। আত্তহত্যার পুর্বে নাদিয়া তার এক ভাইকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলো যে, সে কেনো আত্তহত্যা করতে যাচ্ছে। কারন নাদিয়ার পালানোর কোনো জায়গা ছিলো না। নাদিয়া পালিয়ে অন্য কোথাও গেলেও স্ট্যালিন তাকে যেভাবেই হোক খুজে বের করে আনতে সক্ষম। আত্তহত্যাই ছিলো তার মুক্তির একমাত্র পথ। স্ট্যালিনকে বাইরে থেকে মানুষ যা দেখে চোখের অন্তরালে স্ট্যালিন আরেক মানুষ যা মানুষ দেখে না। তাই, নাদিয়া নিজে নিজে তার পথ বেছে নেয়।
নাদিয়ার মৃত্যুর পর স্ট্যালিন আরো নিষ্ঠুর হয়ে উঠে কিন্তু স্ট্যালিন সবার থেকে একেবারে আলাদা হয়ে যান। সবসময় সবার থেকে আলাদা হয়ে একা বসবাস করার পরিকল্পনা করেন। স্ট্যালিন দক্ষন মস্কোর কয়েক কিলোমিটার দূরে এক বিশাল গহীন জংগলের ভিতর রাজ প্রাসাদ বানান যার নাম দেন “স্ট্যালিন ডাচা”। এই স্ট্যালিন ডাচা সুরক্ষার জন্য এক কোম্পানী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং ৩০০ এর অধীক সৈনিক মোতায়েন থাকতো। ‘শট্যালিন ডাচা’য় স্ট্যালিনের নিজের অনুমতি ছাড়া অন্য কারো প্রবেশের অনুমতি ছিলো না। তিনি শুধু একাই সেখানে থাকতেন। আর থাকতো তার গভর্নেস “ভ্যেলেন্টিনা”। ভেলেন্টিনাই স্ট্যালিনের সমস্ত কাজ করতো, খাওয়া দাওয়া, দেখভাল, কুরিয়ারের কাজ এমন কি তার সাথে রাতের সংগী হিসাবে। ভেলেন্টিনাকে স্ট্যালিন সবচেয়ে বেশী বিশ্বাস করতেন। ভ্যালেন্টিনাই শুধু ক্রেমলিন থেকে আসা কাগজপত্রগুলি গ্রহন করতেন এবং ভোর বেলায় তা স্ট্যালিনকে হস্তান্তর করতেন। স্ট্যালিন সারা রাত কাজ করতেন এবং তার ঘুমের সময় হতো সকাল ৭ টা থেকে সকাল ১০ পর্যন্ত।
সারারাত স্ট্যালিন একটা কাজ একেবারে নিজের হাতে করতেন কারো কোনো পরামর্শ ছাড়া। আর সেটা হচ্ছে তার কাল্পনিক এবং দৃশ্যমান শত্রুদেরকে ডেথ সেন্টেন্স দেয়ার অনুমতি। তিনি সারারাত বাছাই করতেন কাকে কখন মারা হবে অথবা সাইবেরিয়ায় বা গুলাতে ডিপোর্টেশনে পাঠানো হবে। কাজটা খুব সহজ ছিলো না। কিন্তু স্ট্যালিন এই কাজটা খুব মনোযোগের সাথে করতেন এবং নামের পাশে একের পর এক টিক দিতেন কার ভাগ্যে মৃত্যু আর কার ভাগ্যে ডিপোর্টেশন। স্ট্যালিন যখন কোনো মানুষকে মেরে ফেলার জন্য আদেশ দিতেন, তখন তার সাথে তার গোটা পরিবারকেও তিনি খতম করে দিতেন। ৬০ বছর বয়সে স্ট্যালিন সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হন যেখানে তার আর কোনো বিপক্ষের লোক ছিলো না। স্ট্যালিন মাঝে মাঝে ‘স্ট্যালিন ডাচা” থেকে বেরিয়ে এসে ক্রেমলিনেও অফিস করতেন যেখানে তার চার জন মহিলা সেক্রেটারী ছিলো। কিন্তু এই সেক্রেটারীদেরকেও স্ট্যালিন কখনো বিশ্বাস করতো না। শুধুমাত্র একজন সেক্রেটারী (একাতেরিনাও তার নাম) ছাড়া সবাই স্ট্যালিনের রোষানলে জীবন দিতে হয়েছে। কিন্তু স্ট্যালিন তার এই মহা হত্যার জজ্ঞ নিজের ঘাড়ে যেহেতু নিতে চান নাই আর তার কাজ প্রায় শেষের পথে। তাই তিনি ২৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৩৮ তারিখে তার সর্বশেষ নিধন লিষ্ট অনুমোদন দেন।
আজ সেই ঐতিহাসিক ২৪ ফেব্রুয়ারী আবারো ফিরে এসছে ১৯৩৮ থেকে ২০০৩ এ। এদিন অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৩৮ তারিখে স্ট্যালিন তার “গ্রেট পার্জ” এ নিধন হত্যার সর্বশেষ লিষ্ট অনুমোদনে তার অন্যায় এমন এক লোকের উপর অর্পিত করেন, যার নাম “ব্লাডি ডয়ার্ফ” বা সিক্রেট পুলিশ চীফ নিকোলাই ইয়েজভ। এই নিকোলাই লুবিয়াংকা জেল খানায় সে নিজেই প্রায় লক্ষাধিক মানুষকে গন হত্যা করেছেন।
স্ট্যালিন সকাল সাড়ে সাতটায় নিকোলাইকে তার ‘স্ট্যালিন ডাচ’য় ডেকে পাঠান। আজকের দিনে স্ট্যালিন সেই তাকেই সবার কাছে কালার করে প্রচার করে দিলেন যে, সব গন হত্যার পিছনে ছিলো এই চীফ এবংতিনি জাপানিজ, ব্রিটিস এবং আমেরিকান স্পাই হিসাবেও কাজ করছেন। তাকে মরতেই হবে। আর নিকোলাই জানতেন এর থেকে কোনো পরিত্রান নাই। তার ভাগ্য ইতিমধ্যে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। সে শুধু তার একমাত্র ১০ বছরের মেয়ের জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন যার নাম নাতালিয়া। নাতালিয়াকে স্ট্যালিন শেষ পর্যন্ত মারেননি একশর্তে যে নাতালিয়া আর কখনো তার বাবার নামের “ইয়েজভ” উপাধিটি ব্যবহার করতে পারবেন না। নিকোলাই ইতিহাসের পাতায় একজন ক্রিমিনাল হয়েই বেচে রইলেন।
নোটঃ ১লা মার্চ ১৯৫৩ তারিখে স্ট্যালিন সারাদিন কারো সাথেই কোনো কথা বলেন নাই, কোথাও বেরও হন নাই। আর তাকে কেঊ ডাকবে, কিংবা তিনি কি করছেন এটা দেখার মতো কারো সাহসও নাই। অবশেষে যখন ক্রেমলিন কুরিয়ার তার অফিসে ঢোকলেন, তখন দেখা গেলো স্ট্যালিন হার্ট স্ট্রোক করে মেঝেতে পড়ে আছেন। তখন তার বয়স ৭৫।
স্ট্যালিন যেভাবে রাজ্য পরিচালনা করতেন তিনি ঠিক সেভাবেই মারা গেলেন। ২০ মিলিয়ন মানুষকে তিনি তার শাসনামলে হত্যা করেছিলেন। প্রায় ৩০ বছর এককভাবে রাজত্ত করেছেন স্ট্যালিন। স্ট্যালিন ৩০ বছর ইউএসএসআর পরিচালনা করেছেন যেখানে ১৫ টি ছিলো রিপাব্লিক। পৃথিবীর ৬ ভাগের এক ভাগ ছিলো এই ইউএসএস আর। সে সময়ে মোট ১১টি টাইম জোন ছিলো। Biggest Empire of all times.
২৩/০২/২০২৩-আমেরিকার ভিসা প্রাপ্তি
অনেকবার আমেরিকা যাওয়ার জন্য ভিসা পেয়েছিলাম কিন্তু যাওয়া হয়েছে মাত্র একবার। বাকী সম্ভবত আরো দুবার ভিসা ছিলো (দূটু মিলিয়ে প্রায় ৮ বছর মেয়াদিতে) কিন্তু যাওয়া হয় নাই। আমেরিকা আমাকে আসলেই টানে না। অনেকের কাছে এটাকে সর্গপুরী মনে করেন বটে কিন্তু আমার কাছে কোনো বিদেশই টানে না। আর সেটেল হবার তো কোনো প্রশ্নই জাগে না।
এবার আমেরিকার ভিসা পাওয়ার ব্যাপারে আমার বেশ সন্দিহান ছিলো। তারা আবার নাক উচা। ভিসা দিয়েছে কিন্তু যাইনি, তাতে ওরা ইন্সাল্ট ফিল করে। এমতাবস্থায় আমাকে ৪র্থ বার ভিসা দেয় কিনা সেটা নিয়ে আমার পুরুই সন্দেহ ছিলো। তারপরেও ছোট মেয়ে আমেরিকা থাকে, মেয়ের মায়ের ভিসা হয়ে গেছে, আমার হয় নাই, আমার যাওয়া হবে না ইত্যাদির চাপে শেষ পর্যন্ত ভিসার আবেদন করেছিলাম। কিন্তু মনে একটা কঠিন প্রত্যয় ছিলো যে, ভিসা দিলেই যেতে হবে কিংবা সুযোগ না থাকায় যেতে পারি নি এটা পরবর্তী ভিসা না পাওয়ার জন্য একটা ডিস ক্রেডিট হতে পারে না। যদি আমাকে ভিদা রিজেক্ট করে, আমি অবশ্যই এর কৈফিয়ত চাইবো তাদের কাছ থেকে কেনো এবং কোন কারনে আমার ভিসা রিজেক্ট করছে। আর যেহেতু আমার খুব একটা টান নাই, ফলে আমার ভিসা পাইলেই কি আর না পাইলেই কি। মিটুলের তো অন্তত ভিসা আছে, তাতেই চলবে। কোনো কারনে যদি কনিকার কাছে যেতে হয়, মিটুল একাই সামলে নিতে পারবে।
যথারীতি আমি ইন্টারভিউ এর জন্য দাড়ালাম। অবাক করার ব্যাপার হলো, আমার কোনো কাগজ পত্র তারা চেক করার প্রয়োজন মনে করলো না। আমি আর্মিতে ছিলাম এটা নিয়েই তাদের অনেক প্রশ্ন ছিলো। প্রশ্নগুলি আমাকে ধরার জন্য নয় বরং যা দেখলাম তারা আর্মির যে কোনো লোককে খুবই মুল্যায়ন করে। আর্মিতে আমি কোথায় কোথায় চাকুরী করেছি, সেটা তাদের জানার খুব শখ হচ্ছিলো। বলেছি জাতীসংঘের সাথে প্রায় আড়াই বছরের উপর হাইতি আর জর্জিয়ায় মিশনে ছিলাম, তখনই একবার আমেরিকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম।
আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো আমার মেয়ে তার পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরে আসবে কিনা। আমি বলেছি- সেটা আমি জানি না তবে আমার যে ব্যবসা আছে সেটায় সে হাল ধরলে আমি খুব খুশী হবো। কি ব্যবসা আমার যখন জিজ্ঞেস করলো, আমি বললাম রপ্তানীমুলক গার্মেন্টস। প্রায় ২ হাজার কর্মচারী আছে শুনে আরো খুশী হলো। বাৎসরিক টার্ন ওভার জিজ্ঞেসের পর অফিসার একটু যেনো হচকচিয়ে গেলেন কারন টার্ন ওভার টা ঝুব কম নয়- ২২৫ থেকে আড়াইশো কোটির মতো।
খুব খুশী হয়েছে তারা পুরু ব্যাপারটা জেনে। অবশ্য আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল কেনো আমি আগের ভিসা গুলিতে আমেরিকায় যাইনি। আমি খুব সাবলিল ভাবেই বলেছিলাম যে, আসলে সেটা ইচ্ছে করে না যাওয়ার কোনো কারন নাই। আমি আমার নতুন ব্যবসাটা গুছিয়ে উঠতে সময় দিতে পারছিলাম না। তাই আর যাওয়া হয় নাই। কিন্তু এবার তো যাওয়া হবেই কারন মাঝে মাঝে আমার মেয়ের জন্য তো আমার মন ছুটেই যায় তাকে দেখার জন্য।
কোনো দ্বিমত করলেন না অফিসার। শুধু একতা কথাই বল্ল০ ইউ আর এ গুড ফাদার। অফ কোর্ষ, ইউ নিড টু গো।
বলে ভিসা দিয়ে ধন্যবাদ জানালো। ভালো লাগলো অফিসারের ব্যবহার। ফেরার পথে একটা স্যালুট দিলাম, আর একটু হাসলাম।
২০/০২/২০২৩-পতেঙ্গা ভ্রমন
কথায় আছে, Defense Life is a man’s life and a soldier once is always a soldier. অন্য কারো বেলায় এটা কতটুকু সত্য সেটা আমার জানা নাই, কিন্তু এই অকাট্য বাক্যটা আমার বেলায় শতভাগ প্রযোজ্য। ২০৪৪ সালে ভলান্টারিলি আর্মি থেকে অবসর নেয়ার পর থেকে আমি আজো মনে মনে শতভাগ যে ফৌজ সেটা আমি মনেপ্রানে উপলব্ধি করি। কোথাও কাউকে ইনুফর্ম পড়া দেখলে আজো আমি যেচে কথা বলি, ভালো লাগে। কেউ আমার এই আর্মি বা ডিফেন্স বাহিনীর ব্যাপারে কথা বললে এখনো আমার গায়ে লাগে। কেউ ভালো বললে আমি আজো এর কৃতিত্তের অংশটুকু যেনো নিজের সেটা উপলব্ধি করি।
প্রায় ৩০ বছর পর আমি আবারো আমাদের সেই ডিফেন্স ফোর্সের অধীন নৌ বাহিনীর বিভিন্ন স্থান সমুহে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আর এর পিছনে যার সবচেয়ে বেশী অবদান- সেটা হলো আমারই ছোট ভাই সমতুল্য রিয়ার এডমিরাল মামুন যে বর্তমানে ComChit (অর্থাৎ কমান্ডার চিটাগাং) হিসাবে দায়িত্বরত। মামুন সদ্য চট্টগ্রামে পোষ্টিং গিয়েছে, সম্ভবত মামুন ওখানে না থাকলে এবারো আমার যাওয়া হতো না। মামুনের আথিথেয়তার কোনো বর্ননা চলে না। ওর নিজের বাসায় আমার থাকার জায়গা করে দেয়া, অফিসার মেসে ভি আই পি রুমে আমাদের সবার জন্য ব্যবস্থা করা, সারাক্ষন গাড়ির ব্যবস্থা, বিভিন্ন নৌ জাহাজে আমাদেরকে অভিনন্দন দেয়া সব কিছু ছিল অত্যান্ত সাবলিল এবং চমৎকার।
খুবই অল্প একটা সময়ের জন্য ছিলাম, মাত্র এক রাত দুই দিন কিন্তু তারপরেও মনে হয়েছে অনেকদিন বেড়ালাম। একটা পরিপূর্ন ভ্রমন বলা যায়।
কাপ্তাইয়ে লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম ঘাটিতে চমৎকার একটা সময় কাটিয়েছি। লেঃ কমান্ডার ইফতেকার এবং তার টিমকে অসংখ্য ধন্যবাদ। বিএনএস বংগবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান এর লেঃ কমান্ডার রাসেল, লেঃ কমান্ডার সাহেদ, মামুনের এডিসি লেঃ ফকরুল সহ সবাইকে আমার আন্তরিক ভালোবাসা দেয়া ছাড়া আসলে আমার হাতে কিছু ছিলো না। আমার পরিবার এবং আমি খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম গত ৩০ বছর পর আবারো এমন একটা পরিবেশে কিছুক্ষন সময় কাটানোর জন্য।
আমরা যারা ডেফিন্সে কাজ করি, করতাম, এবং করেছেন, তাদের অবদান অসামান্য যদিও এর মুল্যায়ন সব সময় আমাদের সাধারন জনগন হয়তো অতোটা জানেন ও না। আমাদের পরিবার বর্গ যে কি পরিমান তাদের পারিবারিক জীবনকে উতসর্গ করেন আমাদের এই জীবনকে সার্থক আর দেশের জন্য তা শুধু তারাই জানেন যারা এই সব অফিসার, জোয়ান আর কর্মের সাথে জড়িত। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তাদেরকে পরিবারের বাইরেই দেশের জন্য সময় ব্যয় করতে গিয়ে নিজের জন্য বা পরিবারকে দেয়ার জন্য অবশিষ্ঠ কোনো সময়ই হাতে থাকে না। তারপরেও এই সব অফিসাররা হাসিমুখে সব সময় অন্যের সাথে সময় দেন।
পরিশেষে, আবারো আমি রিয়ার এডমিরাল মামুন এবং তার সকল টিমকে আমার প্রানঢালা ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জানাই।
23/02/2022-২০০৩ সালের কিয়েভে
আমি ২০০৩ সালে ইউক্রেনের কিয়েভে বেড়াতে গিয়েছিলাম একবার। তখন আমি জর্জিয়ায় জাতিসঙ্ঘ মিশনে কর্মরত ছিলাম। ইউক্রেনের এক মেজরের বাসায় উরুগুয়ের এক পাইলটকে সাথে নিয়ে তাঁর বাসায় বেড়াতে গিয়ে কিয়েভ সম্পর্কে আমার ধারনা একেবারে পালটে গিয়েছিলো। মানুষগুলি খুবই শান্তপ্রিয় আর শহরটাও মানুষগুলির মতো একেবারে শান্ত। কোনো কোলাহল নাই, সবাই ব্যস্ত আর খুবই মিশুক। মাত্র সপ্তাহখানেক ছিলাম।
উরুগুয়ের ওই পাইলটের সাথে এখনো আমার যোগাযোগ থাকলেও ইউক্রেনের সেই মেজরের সাথে আমার যোগাযোগ নাই। গতকাল সেই ইউক্রেনের উপর রাশিয়া আক্রমন করেছে শুনে খুব কষ্ট লাগলো মনে। ক্রেমলিন দেখার খুব শখ ছিলো। আমি ক্রেমলিনেও ভিজিট করতে গিয়েছিলাম। যেহেতু মিলিটারী অবজারভার হিসাবে কর্মরত ছিলাম, ফলে আমার সাথে কর্মরত একজন রাশিয়ান আর্মি অফিসারের সহায়তায় আমরা ক্রেমলিনের কিছুটা অংশ আমি সেখানে ভিজিট করতে পেরেছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম, কতই না শক্তিশালী এসব ক্রেমলিন। আজ যেনো এটাই মনে আসলো দ্বিতীয়বার।
বিশ্ব রাজনীতির অভ্যন্তরে অনেক দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক এজেন্ডা লুকিয়ে থাকে বিধায় আমরা যা নগ্ন চোখে দেখি সেটা আসলে সেটা না যেটা দেখি। তাঁর ভিতরে হয়তো লুকিয়ে থাকে আরো ‘গভীর কিছু’। কিন্তু এই ‘গভীর কিছুর’ দ্বারা সংঘটিত কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা পুরু বিশ্বকে অগোছালো করে ফেলে যদিও এই ‘গভীর কিছু সংঘটিত’ বিষয়ে অনেকেই জড়িত থাকেন না। ছোট বা বড় কোনো দেশই এর থেকে পরিত্রান পায় না। ছোয়া লাগেই। ইউক্রেনকে আক্রমন করে রাশিয়া কতটুকু উপকৃত হবে বা ইউক্রেন কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হবে সেটা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু আমাদের মতো দেশ যারা এর আশেপাশেও নাই তাঁদের কি কি হতে পারে?
আমাদের দেশ অনেকটাই আমদানী-রপ্তানী নির্ভর একটি দেশ। আর এই আমদানী-রপ্তানী বেশীরভাগ হয় ইউরোপের অনেকগুলি দেশের মধ্যে। ইউরোপে মোট ২৮ টি দেশ আলাদা আলাদা হলেও বাস্তবিক হচ্ছে এরা একটা গুচ্ছগ্রামের মতো। ফলে ইউরোপের একটি দেশের ভিসা পেলেই আমরা অনায়াসে অন্য দেশগুলি ভ্রমনের সুবিধা পাই। কারেন্সীও একটা ‘ইউরো’ যদিও সবার আলাদা আলাদা কারেন্সী আছে। ইউরোপের এই দেশ গুলি কোনো কোনো ন্যাচারাল সম্পদে বেশ উন্নত। ফলে একটা দেশে যদি এ রকম গোলমাল চলতে থাকে, সাভাবিকভাবেই অন্য এলাকায় এর প্রভাব পড়েই। প্রভাব পড়বে জ্বালানীর দামে, গ্যাসের দামে, বেড়ে যাবে আমদানী রপ্তানী খরচ যা প্রকারান্তে সাধারন মানুষের উপরেই বর্তাবে। প্রভাব পড়বে উগ্র পন্থীদের যারা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে আশেপাশের দেশ সমুহে। প্রভাব পড়বে ‘মুক্ত ও গনতান্ত্রিক বিশ্ব কন্সেপ্টে’ যদিও ‘মুক্ত ও গনতান্ত্রিক বিশ্ব কন্সেপ্ট’ এখন আছে বলে মনে হয় না। প্রভাব পড়বে সাইবার সিস্টেমে, শেয়ার মার্কেটে, ভোগ্য পন্যে, ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রভাব পড়বে বন্দরগুলিতে।
বাংলাদেশ যদিও এর অনেক দূরের একটি দেশ কিন্তু ইউরোপে রপ্তানী করা পোষাক শিল্প একটা ঝুকির মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা প্রচুর। আর যারা সরাসরি ইউক্রেনের সাথে আমদানী-রপ্তানীতে যুক্ত তাঁদের অবস্থা এখন খুবই আতংকের। আমাদের দেশ ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে অনেক ভোগ্যপন্য আমদানী করে যেমন মটর, সোয়াবিন, গম, ইত্যাদি, সেটা আরো উর্ধ গতি হতে পারে দামে। এ ছাড়াও আমাদের রপ্তানীকারক মালামাল যেমন প্লাষ্টিক, চামড়া, চামড়া জুতা, হিমায়িত খাবার, পাট বা পাটের দ্রব্য এসব রপ্তানীতে ঘটবে প্রচুর ব্যাঘাত। এমন একটা পরিস্থিতিতে আসলে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হবো তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
অন্যদিকে বড় বড় পরাশক্তি যতোই পিউনেটিভ একশন নিবে বলে যত প্রতিশ্রুতিই দেন না কেনো, যা ক্ষতি হবার তাঁর বেশীরভাগ ক্ষতি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। জাতিসঙ্ঘ, ন্যাটো, কিংবা অন্যান্য অক্সিলারী ফোর্স গ্রাউন্ডে যেতে যেতে রাশিয়ার উদ্দেশ্য হাসিল হয়েই যাবে। তারমধ্যে ইউক্রেন ন্যাটোর কোনো সদসই না।
ভবিষ্যৎ কি হবে এই মুহুর্তে বলা খুব দূরুহ।
২২/০৫/২০১৯-Cottage, Yes Please এ
শেষ অবধি আমার ইন্ডিয়ার ভিসাটা খুব তাড়াতাড়িই হয়ে গেলো। মোট ৩ দিনে ভিসা পেলাম। রওয়ানা হয়ে গেলাম ইন্ডিয়াতে। বাসায় থাকলো উম্মিকা, কনিকা, নসিরন আর ওর মেয়েরা। সাথে অনেক ডলার নিয়ে গেলাম। যদিও আমি মিটুলের সাথে যতোটা দরকার ডলারের তার থেকে বেশীই সাথে করে দিয়েছিলাম, তারপরেও আমি আমার সাথে করেও বেশ কিছু ডলার নিয়ে গেলাম। ক্রেডিট কার্ডেও প্রায় হাজার আটেক ডলার ছিলো। টাকা পয়সা নিয়ে যাতে কোনো প্রকার টেনসনে থাকতে না হয় সেটা আমার দায়িত্ব ছিলো। কারন কখন মিটুলের জন্য কি লাগে আমার জানা ছিলো না। মিটুল আর সাবিহা আপা ইতিমধ্যে আই এল বি এস এ ডাক্তার এস কে সারিনের সাথে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে কথা বলে বেশ কিছু টেষ্ট ও করিয়ে ফেলেছে, রিপোর্ট পেতে এখনো সময় লাগবে। এর মধ্যে মিটুল আর সাবিহা আপা তাদের আগের হোটেলটা পরিবর্তন করে নতুন একটা হোটেলে উঠে গেছে আজি। নাম “কটেজ, ইয়েস প্লিজ” অদ্ভুত নাম মনে হলো। আমি যখন দিল্লিতে নামলাম (ডাইরেক্ট ফ্লাইট ছিলো বাংলাদেশ বিমানে) তখন রাত হয়ে গেছে। সেখান থেকে আমি সরাসরি একটা মাইক্রো গাড়ি নিয়ে পাহাড়্গঞ্জের উদ্দেশ্যে র ওয়ানা হয়ে গেলাম। ১ হাজার রুপী নিলো। ওরা নাকি আমার কাছ থেকে বেশীই নিয়েছে। সেটা আমার কাছে কোনো বিষয় ছিলো না। আগে তো মিটুলের কাছে যাই। প্রায় ১ ঘন্টা জার্নির পর আমি মিটুলের দেখা পাই। হোটেল “কটেজ, ইয়েস প্লিজ” টা খারাপ না। মেইন রাস্তার উপরেই। সাথে সাথেই হোটেলের একটা কার্ড নিয়ে নিলাম। ঠিকানাটা 1843, Lakshmi Narayan St, Aram Bagh, Paharganj, New Delhi, Delhi 110055, India।
দোতালায় দুটু রুম নেয়া আছে। একটা রুমে তিন জন থাকা যায়, আর আরেকটা রুমে দুজন। সাবিহা আপার মেয়ে এবং মেয়ের স্বামী এক রুমে আর আমি, সাবিহা আপা আর মিটুল এক রুমে থাকবো। আসলে বেশীরভাগ সময়ে তো আমরা বাইরে বাইরেই থাকবো, খালী রাতের বেলাতে ঘুমানোর জন্য রুমে থাকা।
মিটুল আর সাবিহা আপার মেডিক্যাল রিপোর্ট পেতে আরো দু একদিন দেরী হবে। তাই আমরা ভাবলাম, এই দুইদিনে ঐ অঞ্চলে কোথায় কি দর্শনীয় স্থান আছে দেখে ফেলি। আমার খুব একটা ইচ্ছা নাই এসবে কিন্তু মিটুল আর সাবিহা আপার কৌতূহলের শেষ নাই। হোটেলের ঠিক উলটা পাশেই এসব স্থান দেখানোর জন্য অনেক এজেন্ট আছে যারা গাড়ি সহ গাইড দিয়ে দেয়। খারাপ না। পরিকল্পনা হলো যে, আমরা হরিদ্বার, এবং আশেপাশের সব জায়গুলি দেখবো। রোজার দিন ছিলো কিন্তু এখানে রোজা রাখা সম্ভব না। তাই প্রতিদিন সকালে পাশেই রেষ্টুরেন্টে আমরা খেতে যাই। একটা জিনিষ আমার কিছুতেই ভালো লাগছিলো না যে, ইন্ডিয়ানরা এতো বেশী মসল্লা খায় যে, যদি দাঁড়িপাল্লা দিয়ে গ্রাম করে মাপা যায় দেখা যাবে ৭০% হলো মসল্লা আর ৩০% তরকারী বা শব্জী। কিছুতেই খেতে পারছিলাম না। ফলে আমরা একটা প্ল্যান করলাম যে, শুধু ডাল, ডিম আর মসল্লা ছাড়া যে কোনো তরকারী খাবো। একটা নির্দিষ্ট হোটেলেই খাবো যাতে ওরা আমাদের ফুড হ্যাবিটটা বুঝতে পারে।
এই দিল্লীতে কেউ ভালো বাঙলা বলে না আবার আমরা হিন্দি বলতে পারি না। কিছু কিছু শব্দ যা বাঙলা আর হিন্দিতে প্রায় সমার্থক, সেটা দিয়েই ওদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করছি। দারুন উপভোগ করছিলাম আমাদের এই অলিখিত মিশ্রি বান্দি বা বাঙলা +হিন্দি ভাষা। কিন্তু মিটুলের নাদি ভাষায় আমরা সবাই হাসতে হাসতে খুন। দোকানীও মজা পাচ্ছিলো বেশ। ভালো কর্ডিয়াল হিসাবেই ওরা নিচ্ছিলো আমাদের এই বান্দি ভাষাটা।
এই সময় ইন্ডিয়ার তাপমাত্রা প্রায় ৪৩ বা ৪৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস। পুরু শহর যেনো ওভেন। শরীরের উপর দিয়ে বাতাস গেলে মনে হয় চুলার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। হোটেলে রুমের ভিতর এসি আছে বলে রুমে থাকলে খারাপ লাগে না কিন্তু যখনই গাড়িতে উঠি, ভীষন গরম। এসি গাড়ি সব সময় পাওয়া যায় না। আবার ইন্ডিয়ানরা এতো কিপ্টে যে, এসি থাকলেও এসি ছাড়তে চায় না। এসি গাড়ির ভাড়া বেশী হলেও এসি ছাড়লে আবার এক্সট্রা টাকা চায়। কি তাজ্জব। এদেশের মানুষেরা এখনো এক টুকরা ইলিশ মাছ কিংবা ৫০ গ্রাম আম কিনতে পারে। তারা পুরু আমটাও কিনে না। তো তাদের কাছ থেকে তো এটা আশা করাই যায়।
ইন্ডিয়ায় এখন নরেন্দ্র মুদীর ইলেকশন চলছে। খুব বিরক্ত মানুষ নরেন্দ্র মোদীর শাসনকাল নিয়ে। আসলে নরেন্দ্র মোদী নিজেও একটা কট্টর পন্থী মানুষ যারা কিনা বাংলা অথবা মুসলমানের বিরুদ্ধে।
২৪/৫/২০১৯-এসকে সারিনের সাথে বৈঠক
ইন্সটিটিউট অফ লিভার এন্ড বিলিয়ারী সায়েন্স (আইএলবিএস) দিল্লী তথা এশিয়ার মধ্যে লিভার সংক্রান্ত চিকিৎসায় একটি নামকরা হসপিটাল। S.K. Shirin হচ্ছেন একজন আন্তর্জাতীক এবং ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ পদকপ্রাপ্ত একজন বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক। তার কাছেই আমার ওয়াইফের এপয়েন্টমেন্ট করা ছিল। এর আগে বেশ কিছু স্বাভাবিক টাইপের কিছু টেষ্ট করানোর জন্য ইতিমধ্যে হসপিটালে রক্ত দেয়া হয়েছে। আজ ২৪/৫/২০১৯ তারিখে এস কে সারিনের সাথে সরাসরি বৈঠক হবে আমাদের বিষয়ে। তাঁকে আমরা কখনো দেখি নাই। আমরা হাসপাতালের করিডোরে অন্যান্য রোগীদের মতোই ওয়েটিং এ ছিলাম। আমাদের সিরিয়াল দেয়া ছিলো। একটা রোগা পাতলা লোক হটাত করে আমাদের সামনে দিয়েই যেনো কোথায় যাচ্ছিলেন। তার পিছনে বেশ একটা দল তাঁকে ফলো করছিলো। আমরা তাঁকে চিনি নাই বটে কিন্তু আশেপাশের রোগীদের কাছে জানলাম, তিনিই এস কে সারিন। বেশ লম্বা এবং ফর্সা। আমাদের টার্ন এলো প্রায় আধা ঘন্টার পরে। বিদেশী রোগীদের আলাদা সিরিয়াল, তাই তাড়াতাড়িই হলো। অত্যান্ত সল্পভাষী কিন্তু অধিক সময় দেন তিনি। মিটুলকে বেশ কিছুক্ষন পর্যবেক্ষন করার পর কোনো প্রকারের রিস্ক নিলেন না তিনি। যা যা করনীয় সেটাই করলেন এবং একজন ডাক্তার (তার একান্ত বিশেষ ডাক্তার ডাঃ আদিত্যকে বলে দিলেন যেনো কেসটা নিজেই হ্যান্ডেল করেন। ছবিতে পাশেই অমায়িক ভংগিতে দাঁড়িয়ে আছে ডাঃ আদিত্য। আদিত্য ভালো বাঙলা বলে এবং বুঝে। জিজ্ঞেস করেছিলাম কিভাবে সে এত ভালো বাঙলা বুঝে এবং বলে। পরে জানালো যে, তার মা কলিকাতার আর বাবা দিল্লীর। তাহলে বাঙলা না বুঝার কোনো কারন নাই। ভাল লেগেছে এস কে শিরিনের প্রোফেশনালিজম। A real good doctor in his field. পরে সার্চ করে দেখলাম S. K Shirin কে নিয়ে ওয়াইকিপিডিয়া, গুগল কিংবা বিভিন্ন ওয়েব সাইট গুলিঅনেক কাভারেজ করেছে।
ডাঃ এস কে শিরিন আদিত্যকে আরেকটা ইন্সট্রাকশন দিলেন যে, মিটুলের যেনো ইমিডিয়েটলি লিভার বায়োপ্সি করানো হয় এবং সেই রিপোর্টটা আগামীকাল সকালে যখন তিনি আবার বসবেন, তখনি দেয়া হয়। দেখলাম, ডাঃ এস কে শিরিনের ব্যক্তিগত একটি ইন্সট্রাকশন পুরু হসপিটাল এমনভাবে পালন করে যেনো একটি বেদবাক্য। তিনি যা করলেন আমাদের জন্য, সেটা ধন্যবাদ দেওয়ার মতো না, আরো অনেক বড় কিছু। কোনো প্রকারের ডিলে যেনো না হয় সেটাই তিনি করলেন। আমার কাছে ব্যাপারটা একটু খটকা লাগছিলো। এমন নয় যে, এস কে সারিন এর চেয়ে আর কোনো ভালো ডাক্তার ওখানে নাই। কিন্তু এস কে সারিনকেই কেনো এতো সমীহ? পরে আরো জানলাম যে, আসলে তিনি এই আইএলবিএস হাসপাতালের মালিকদের মধ্যে তিনিও একজন।
মিটুলের বায়োপ্সি করানোর জন্য অনেক গুলি ফর্মালিটিজ করতে হলো। কোথাও টাকা জমার ফর্মালিটিজ, কোথাও আবার ওর কিছু ব্যক্তিগত ফর্ম ফিল আপ, আবার কোথাও এমন হয়েছে যে, ইন্টার ন্যাশনাল রোগি হ ওয়াতে বাড়তি কিছু ঝামেলা। এসব করতে করতে প্রায় অনেক বেলা হয়ে গিয়েছিলো। আমি অনে ডিপার্ট্মেন্টই চিনি না। ওখানে ক্লিনারের কাজ করে এমন এক লোকের সাথে পরিচয় হয়ে গেলো। ভালো বাঙলা সেও বলে। নাম তার মিষ্টিলাল। সেইই আমাদেরকে সবখানে নিয়ে গেলো। বেশী বেগ পেতে হয় নাই। প্রায় ৩ টার দিকে মিটুলের বায়োপ্সি করানো হবে, তাই আমরা এর মধ্যেই কাফেটেরিয়া থেকে যা পেলাম খেয়ে নিলাম। সাবিহা আপার জন্য এ ধরনের কোনো ঈন্সট্রাক্সন ডাক্তার দেন নাই বিধায় তিনি হোটেলে চলে গেলেন। ওনার মেয়ে আর ওনার মেয়ের জামাই (নাম নাঈম) সেও চলে গেলো। আমি আই এল বি এস হাসপাতালে রয়ে গেলাম। মিটুল খুব ভয় পাচ্ছিলো। আমার হাত ধরেছিলো যখন তাঁকে ওটিতে নেয়া হয়। যেখানে বায়োপ্সি করানো হবে, আমি সেই ইন চার্জ ডাক্তারকে আমার পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি থাকতে চাই আমার স্ত্রীর অপারেশনের সময়। তিনি বললেন, খুব ছোট একটা অপারেশন, হয়তো ১০ মিনিটেই শেষ হয়ে যাবে, আর ভয়ের কিছু নাই। যে ডাক্তার মিটুলের বায়োপ্সি করাবেন, তিনিই আমাকে তার রুমে বসিয়ে বললেন, আপনি এখানে রেষ্ট করুন, পাশের রুমেই মিটুলকে তারা অপারেশন করাবেন। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানানো হবে।
প্রায় ৩০ মিনিট পর মিটুল বের হলো, খাটে করে। তাঁকে নেয়া হবে পোষ্ট অপারেটিভ রুমে। সেটা আবার অন্য আরেক জায়গায়। মিষ্টিলাল সাথেই ছিলো। আমরা মিটুলকে পোষ্ট অপারেটিভ রুমে রেখে আসলাম। আমাকে বলা হলো যে, বায়োপ্সি রিপোর্ট টা নিজে গিয়ে তদারকী না করলে এস কে শিরিন বল্লেও সিরিয়ালে থাকার কারনে আগামীকাল হয়তো রিপোর্ট টা পাওয়া নাও যেতে পারে। এর মানে তদবির লাগবে। আমি মিষ্টিলালকে নিয়ে একেবারে পরীক্ষাগারে চলে গেলাম। সেখানে সবার যাওয়া নিষেধ ছিলো। কিন্তু মিষ্টিলাল থাকায় আর আমি বিদেশী হ ওয়ায় একটু সুবিধা হলো। পরীক্ষাগারে যিনি রিপোর্ট টা দিবেন, তাঁকে বললাম, যে, আমাদের খুব তাড়া আছে, যদি আমাদের বায়োপ্সি রিপোর্ট টা একটু প্রাইয়োরিটি দিয়ে দেয়া যায়, তাহলে খুব ভালো হয়। তিনি এটাকে টপ প্রাইয়োরিটি দিয়ে লিখে দিলেন আর বললেন, আগামীকাল সকাল ১০ টার মধ্যে হাতে পেয়ে যাবেন।
আমি এবার আবার মিটুলের পোষ্ট অপারেটিভ রুমে এলাম। দেখলাম অন্যান্য রোগীদের অনেক অভিযোগ। পানি নাই, ডাক্তার ও নাই, কিছু কিছু রোগীর এখুনী ডাক্তারের দরকার কিন্তু কোনো এটেন্ডেন্ট ডাক্তার না থাকায় অনেক রোগী চিল্লা পাল্লা করছে। বুঝলাম, যতোটা না এর সুনাম, এর দূর্নামও আছে। কিন্তু এটা এমন কেনো হবে? মানুষেরা অনেক টাকা পয়সা খরচ করে এ রকম নামীদামি হসপিটালে আসে, তাদের জন্য অবশ্যই এক্সট্রা কেয়ার থাকা উচিত। তা না হলে সরকারী আর প্রাইভেট হস্পিটালের মধ্যে তফাতটা কি? মিটুলের বেশ ব্যথা হচ্ছিলো। ব্যথার মেডিসিন অপারেশনের সময় দেয়া ছিলো কিন্তু সেটা ধীরে ধীরে কার্য ক্ষমতা শেষ হয়ে যাওয়ায় মিটুলের এখন বেশ ব্যথা হচ্ছে বলে আমাকে জানালো। আমি এ কথা কোনো ডাক্তারকে জানানোর জন্য কোনো ডাক্তারকে খুজে পেলাম না। একজন মহিলা নার্স ছিলো। সে একদিকে ডিসচার্জ লেটার লিখছেন, একদিকে নতুন রোগীর ভর্তির ফর্মালিটিজ করছেন, আবার অন্যদিকে সিরিয়াস রোগীদের কাছে যাচ্ছেন, আবার ফোন ধরছেন। আমি তার অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি একা কেনো? আর লোক কই?
উনি বুঝলেন যে, আমি রাগ করিনি কিন্তু তার অসহায়ত্তের ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করছি। নার্স খুব আক্ষেপ করে আমাকে বললেন, দেখেন স্যার, আমি একা কি করবো? স্যারদেরকে ফোন দিচ্ছি, তারা কেউ ফোন ও ধরছে না। আমি এখন কি নতুন রোগীর কাগজ লিখবো, নাকি পুরান রোগীর ডিসচার্জ লেটার লিখবো নাকি রোগীকে এটেন্ডেন্ট করবো। আমরা পেটের দায়ে কাজ করি, কেউ আমাদের অবস্থাটা বুঝে না। রোগীদের মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেছে। তখন রাত প্রায় ৯ টা। আমি আর হোটেলে ফিরে যাই নাই। সারারাত আমি মিটুলের পাশেই ছিলাম। মাঝে মাঝে সিগারেট খাওয়ার জন্য বেরিয়েছি বটে কিন্তু মিটুলের কাছেই ছিলাম, কারন কখন ওর কি লাগে বুঝা যায় না। রাতে মিটুলের ভীষন ক্ষুধা লেগেছিলো। হাসপাতালের খাবার ওর কিছুতেই সহ্য হচ্ছিলো না। খাওয়া মতো ছিলো না আসলে। আমি বাইরে গিয়ে ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে দেখি ক্যাফেওটেরিয়া বন্ধ হচ্ছে প্রায়। জিজ্ঞেস করলাম, এটা সারারাত খোলা থাকে না? তারা বল্লো, এটা বারোটার পর বন্ধ হয়ে যায়। কি তাজ্জব ব্যাপার!! আশেপাশে কোনো খাবারের দোকান ও নাই, তাহলে রোগীরা খাবার পাবে কই কেউ যদি খাবার কিনে আনতে চায়? অত্যান্ত নাজুক একটা প্রশাসনিক ব্যবস্থা। যাই হোক, বিদেশি বলে ওরা আমাকে কিছু খাবার দিলো বন্ধ করার আগে। অন্তত মিটুলকে দিতে পারবো।
পরেরদিন, মিটুলের রিপোর্ট পেতে পেতে প্রায় বিকেল হয়ে গেলো। ফলে পরেরদিন এস কে শিরিনকে রিপোর্ট টা দেখাতে পারলাম না। শুনতে পাচ্ছি যে, এস কে শিরিন নাকি ৬ দিনের জন্য আবার আসবেন না। তাহলে মিটুলের রিপোর্ট চেক করবে কে? আমরা তো এস কে শিরিনের কারনেই এই হাসপাতালে আসা। অন্য কোনো ডাক্তারের জন্য তো এখানে আসি নি। বেশ কয়েক জায়গায় ব্যাপারটা চেক করে জানলাম, এস কে শিরিনের বাইরে যাওয়ার সিডিউল চেঞ্জ হয়েছে, অসুবিধা নাই, আমরা ওনার কাছেই মিটুলকে দেখাতে পারবো।
২৬/৫/২০১৯ তারিখে আমরা এস কে শিরিনের সাথে আবার দেখা করলাম। এর মধ্যে মিটুল পোষ্ট অপারেটিভ থেকে রিলিজ নিয়েছে। এখন ভালো আছে। এস কে শিরিনি মিটুলকে বললেন যে, মিটুলের যে লিভারের সমস্যাটা হচ্ছে এটার ব্যাপারে আজো কোনো মেডিসিন আসলে বের হয় নাই। তবে ফাইজার একটা মেডিসিন প্রায় ৭৫% টেষ্ট করে বের করে ফেলছে যেটা আগামী বছরে বাজারে আসবে। এর জন্য বর্তমানে ঐ মেডিসিনটা প্রায় ১০০ জন হিউম্যান বডিতে এপ্লাই করা হচ্ছে। এখন হয়তো আরো ৩/৪ জন বাকী আছে। এস কে শিরিন সবাইকে এই সুযোগ দেন না। কিন্তু তিনি মিটুলকে এই সুযোগ দিতে চান যে, ঐ মেডিসিনটা এপ্লাই করে দেখা কাজ করছে কিনা।
আমরা আসলে ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না। তিনি বললেন যে, ফাইজার সিংগাপুর হেড অফিসে মিটুলের সমস্ত বায়োপ্সি রিপোর্ট আলাদা করে টেষ্ট করবে, ওনারা ঐ মেডিসিন টা এপ্লাই করবে এবং মাসে একবার করে ইন্ডিয়ায় ফলো আপ করাতে আসতে হবে। এর জন্য ফাইজার সমস্ত খরচ বহন করবে, আসা যাওয়ার এবং যদি কোনো কারনে কোনো পার্শ প্রতিক্রিয়া হয়, তাহলে ফাইজার বাংলাদেশে এসেও মিটুলের চিকিৎসার ভার নিবে। শুধু তাইই নয়, যদি তাদের এই মেডিসিন এপ্লাই করার কারনে মিটুলের শারীরিক কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে প্রায় ৪ কোটি সম পরিমান ক্ষতিপুরন দিতেও বাধ্য থাকবে। মিটুল এস কে সারিনকে জিজ্ঞেস করেছিলো, কেনো তিনি মিটুলকে এই সুযোগটা দিচ্ছেন। তিনি জানালেন, তারা সবাইকে এই সুযোগ দেন না তবে যারা শিক্ষিত এবং প্রাথমিক স্টেজে আছেন রোগের, আর যারা একচুয়াল ফিডব্যাক দিতে পারবেন, তাদেরকেই তিনি এই সুযোগ দিচ্ছেন। এস কে সিরিন ফাইজারের একজন উচ্চমানের কন্সাল্টেন্ট ও বটে।
তিনি এটাও বললেন যে, যদি মিটুল রাজী থাকে, তাহলে আগামীকাল এস কে সিরিনের সাথে সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ফাইজার কোম্পানীর টপ লেবেল মালিকদের সাথে এবং ডাক্তারদের সাথে কথা বলবেন। আমরা আসলে ব্যাপারটাকে ভালোমতো বুঝিই নি। তারপরেও রাজী হয়ে গেলাম। পরদিন মিটুলের সাথে এস কে শিরিনের ভিডিও এর মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে কথা বলবেন। অর্থাৎ মিটুল এবং এস কে শিরিন একদিকে, ফাইজারের অন্যান্য দাক্তার প্লাস মালিক বৃন্দ অন্য প্রান্তে। পরদিন আমরা সেটাও করে ফেললাম। অনেক কাগজ পত্র মিটুল সাইন ও করলো। কিন্তু একটা অপ্সন খোলা ছিলো যে, মিটুল চাইলে যে কোনো সময়ে এটা বাতিল করতে পারে।
আমরা আমাদের হোটেলে চলে এলাম। ব্যাপারটা নিয়ে দুজনে ভাবলাম। কারন প্রতিমাসে ঢাকা থেকে এই আই এল বি এস এ এসে চেক কারানো সহজ কথা নয় যদিও ফাইজার কোম্পানী সমস্ত খরচ বহন করবে। আবার আরেকটা ব্যাপার মাথায় এলো যে, মেডিসিনটা এখনো এপ্রোভড না, কেনো আমরা মিটুলকে গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহার করতে দেবো? আমার মীতুলের যদি কোনো কিছু হয়ে যায়, তাহলে? এবার আমরা একজন ডাক্তার বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। হতাত মনে পড়লো যে, মিটুলের এক বান্ধবী আছে কলিকাতায় থাকে-পরীর জামাই। সে মানিকগঞ্জের মেয়ে। ওনার স্বামী আর বড় মেয়ে দুজনেই দাক্তার। তাঁকে ফোন করলাম, ব্যাপারটা বললাম, তিনি শুনেই কয়েকতা কথা বললেন যে- আখতার ভাই, এস কে শিরিনের চেয়ে ইন্ডিয়ায় হাজার গুনের ভালো ডাক্তার এই লিভার বিষ্যকই আছেন যাদের সমকক্ষ নন এই এস কে শিরিন। আর কেনো মিটুলকে একটা রিস্কের মধ্যে গফেলবেন। তারা আসলে হিউম্যান বডিতে এপ্লাই করার জন্য লোক খুজে পাচ্ছেন না, আর আপ্নাদেরকে শিক্ষিত, সহজ পেয়ে এমন একটা অফার দিয়েছে। কোনো অবস্থাতেই রাজী হবেন না। মনে হলো একটা বোঝা নেমে গেলো। আমরা ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে, আমরা এস কে শিরিনের এই সিদ্ধান্তে রাজী নই। তাঁকে আমরা কিছু বল্বো না কিন্তু রাজীও হবো না। কারন যদি এই মুহুর্তে আমরা এস কে শিরিনের কোনো কথায় রাজী না হই, এম্নো হতে পারে মিটুলের চিকিৎসাটা হয়তো ভালো করে করবেই না।
আমরা আমাদের মতো করে ইন্ডিয়াতে যে কয়দিন লাগে এই এল বি এস থেকে চিকিৎসা টা করিয়েই যাই। এতে প্রায় ৭/৮ দিন কেটে গেলো। বেশ অনেক গুলি মেডিসিন দিলেন এস কে শিরিন। আমরা ৬ মাসের মেডিসিন কিনে ফেললাম যাতে দেশে এসে যদি এই মেডিসিন গুলি না পাই, তাই।
১৯/০৫/২০১৯-আইএলবিএস হাসপাতালে গমন
মিটুলের শরীরটা মাঝে মাঝেই কেনো জানি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ওর শরীরের ইম্মিউন সিশটেমটা অনেক দূর্বল। মিটুল যখন শারীরিকভাবে কোনো সমস্যায় না থাকে, অনেক পরিশ্রম করার ক্ষমতা রাখে এবং করে। সকালে উঠে নামাজ পড়ে কাজ শুরু করে, তার পর থেকে কাজের বুয়ার জন্য নির্দেশনা, তার সাথে হাতে হাতে কাজ সেরে ফেলা, কলেজে যাওয়া, অফিস করা, সংসারের যাবতীয় দেখভাল, মেয়েদের দিকে খেয়াল রাখা, বাজার করা, বাড়ি ওয়ালী হিসাবে সব ভাড়াটিয়াদের সাথে সমন্নয় করা, বিদ্যুৎ বিল দেয়া, পানির বিল দেয়া, বাড়ি ওয়ালী হিসাবে বাড়ি রক্ষনাবেক্ষন করা, ছাত্রদের পরীক্ষার খাতা দেখা, সারাক্ষন আত্তীয়সজনের খেয়াল রাখা, কি করে না মিটুল!! সপব কাজেই সে আছে। আমি তো খালী অফিস করি আর বাসায় আসি। বাড়ির কোনো কাজই আমি করি না এক মাত্র বাগান করা ছাড়া। এই মিটুল যদি অসুস্থ্য হয়ে বিছানায় পড়ে যায়, আমি আর নাই। তাই ওর শরীর খারাপ হলে সবচেয়ে বেশী টেনশনে পড়ি আমি। রাগ ও করি যে, সারাক্ষন এতো কাজ, আর এতো দেখভাল করার দরকার কি? বিশেষ করে বাকী আত্মীয়স্বজনের জন্য? ওর বাড়ির সব আত্তীয় স্বজন মনে করে, কোনো সমস্যা? মিটুলের সাথে যোগাযগ করো, কোনো দরকারী তথ্য? মিটুলের সাথে যোগাযগ করো। কারো কোনো সাহাজ্য? মিটুলের সাথে যোগাযোগ করো। কেউ টাকা পাঠাবে বিদেশ থেকে? মিটুলের সাথে যোগাযোগ করো। কেউ টাকা নিয়ে যাবে বিদেশে? মিটুলের সাথে যোগাযোগ করো। এত বললাম ওদের আত্মীয়স্বজনের কথা। কিন্তু ওর কলেজের ছাত্র বা কল্গদের কথাই বলি!! একই অবস্থা। কারো কোনো ডকুমেন্ট গেজেটেড অফিসার দ্বারা সত্যায়িত করতে হবে? রাত বারোটা বাজলেও মিটুলের সাথে যোগাযোগ করো। কারো চাকুরী দরকার? মিটুলের সাথে যোগাযোগ করো। ভাড়াটিয়ার কোনো সমস্যা? ম্যাডামের সাথে যোগাযোগ করো। কি যে একটা অবস্থা। আমি কোনো কিছুতেই মিটুলকে বাধা দেই না। করুক। ভালো কাজই তো। কিন্তু এই সব কাজ করতে গিয়ে মিটুলের কোনো প্রকারের রেষ্ট হয় না। সকাল থেকে শুরু করে রাত ১ টা অবধি চলে এই যজ্ঞ। মাঝে মাঝে আমি ওকে ফান করে বলি- ভয়েস অফ আমেরিকা (ভিওএ)। একটা তথ্য ভান্ডার।
মিটুল বেশ মাঝে মাঝেই কয়দিন যাবত ওর শরীর খালী দূর্বল লাগে এই অভিযোগটা আমাকে করছে। আমি নিজেও দেখতে পাচ্ছি- মিটুল অসুস্থ্য হয়ে যাচ্ছে। সি এম এইচে অনেকবার অনেক টেষ্ট করালাম, অনেক মেডিসিন দিলো, ডায়াবেটিস আছে, এসজিপিটি বেশী অর্থাৎ লিভারে একটু সমস্যা আছে কিন্তু খুব একটা যে কঠিন কিছু সেটা ডাক্তাররাও বলছে না। অথচ মিটুল আসলেই অসুস্থ্য হয়ে যাচ্ছে। তাই এবার ভাবলাম, আমাদের সিএমএইচে নয়, বাইরের কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখাই। আমাদের বাসায় ভাড়া থাকেন পাপ্পু নামের এক টিচার। ভালো মানুষ। তার স্ত্রী আমার বউ কে জানালো যে, আজগর আলী হাসপাতালটা নাকি বেশ ভালো। ভাবলাম, আগে সেখানে যাই, দেখি ডাক্তার কি বলে।
আজগর আলী হাসপাতালের একজন ডাক্তার মিটুলের লিভারের টেষ্ট করিয়ে দেখলো যে, ওর লিভারে আসলে সমস্যা আছে যা কিনা স্টেজ-২ এর কাছাকাছি। এই অবস্থায় উনি ইন্ডিয়ার এসকে সারিনার শরনাপন্ন হতে বললেন কারন এই উপমহাদেশে এসকে সারিন নাকি অত্যান্ত নামকরা একজন লিভার সহ অন্যান্য রোগের বিশেষজ্ঞ। তিনি বসেন আইএলবিএস অর্থায় ইন্সটিটিউট অফ লিভার এন্ড বিলিয়ারী সায়েন্স হাসপাতালে।
দেরী করতে চাইনি। কারন আমি মিটুলের স্বাস্থ্য নিয়ে আসলেই চিন্তিত ছিলাম। ওর ভিসা লাগে না কারন সরকারী কর্মকর্তা। ওরই কলেজের আরেক মহিলা কলিগ সাবিহা আপার ও একই সমস্যা বহুদিন যাবত। ওনার সমস্যাটা মিটুলের থেকেও বেশী একিউট। তাই ওরা দুইজনেই আই এল বি এসে যাওয়ার পরিকল্পনা করলো। আমি যেতে চাচ্ছিলাম কিন্তু আমার ভিসা লাগবে, তাই ভিসা ফর্মালিটিজ না হ ওয়া অবধি আমি ইন্ডিয়ায় যেতে পারবো না। মিটুলরা ১৯ মে ২০১৯ তারিখে ইন্ডিয়ার জন্য রওয়ানা হয়ে গেলো। আমি ভিসার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
সকালে রওয়ানা দিয়ে ওরা প্রায় রাত ৮ টার দিকে দিল্লীর পাহাড়্গঞ্জের লক্ষী নারায়ন রোডে একটি হোটেলে উঠে গেলো। সাবিহা আপার মেয়েও সাথে ছিলো এবং সাবিহা আপার মেয়ের স্বামী ও তাদের সাথে আছেন। রাতে ওদের সাথে কথা বললাম। কিন্তু যে হোটেলে ওরা উঠেছে সেটা নাকি ততোটা স্বাস্থ্য সম্মত নয়। বললাম- তাড়াতাড়ি হোটেল পাল্টাও কারন আগে থাকার জায়গা হতে হবে নিরাপদ এবং হাইজিনিক। মিটুল আর সাবিহা আপার জন্য আসলে কোনো গাইড লাগে না, কারন তারা নিজেরাই দায়িত্তশীল এবং অফিসার বনাম বুঝে কোথায় কিভাবে কি ম্যানেজ করতে হবে। তাছাড়া ছেলে মানুষ হিসাবে সাবিহা আপার মেয়ের স্বামী তো সাথেই আছে। আমার দুশ্চিন্তা চিলো না। আমি ইন্ডিয়ার ভিসার জন্য চেষ্টা করে যতো দ্রুত ভিসা পাওয়া যায় সেটা করছি। মিটুল জানে আমি ইন্ডিয়ায় আসছি না কারন ফ্যাক্টরীতে বেশ কাজের চাপ। কিন্তু আমি জানি আমি যাচ্ছি যখনই ভিসা পাবো। আগে পরিবার, তারপর দেখা যাবে কোনটা কিভাবে সামাল দেয়া যায়। ফ্যাক্টরীর জন্য তো আমার পার্টনার আছেই। রোজা চলছে।
০৯/০৪/২০১৮- থানচি ভ্রমন
Categories
আবারো চলে এলাম থানচিতে। এবার পরিবার নিয়ে নয়, আমি আর মুর্তজা ভাই। জানজটের শহরের ভ্রমনের সময় যেভাবে জানজটের কারনে সময় নষ্ট হয়, সেটা এবার হয় নাই। বিকেল সাড়ে চারতায় বাংলাদেশ বিমানে সোজা চলে এলাম শাহ আমানত ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। মাত্র ৩০/৩৫ মিনিট লাগলো। সন্ধ্যার আগেই চট্টগ্রাম।
আমাদের সাথে আরেক বন্ধু যোগ হয়েছিলো এয়ারপোরট থেকে। এই তিনজনে মিলে একটা প্রাইভেট কার ভাড়া করে সোজা চলে এলাম বান্দরবান। পথে হোটেল হিল ভিউ ম্যানেজারকে ফোন করে একটা রুম নিয়ে নিলাম। মোটামূটি রাত নটার আগেই হোটেলে ঢোকে গেলাম। তিনজন মিলে খাওয়া দাওয়া করে পায়ে হেটে আশেপাশের জায়গা গুলি দেখলাম। বড্ড সুন্দর রাতে বান্দরবান।
পরদিন আমরা সবাই আরেকটা প্রাইভেট কার নিয়ে সোজা চলে গেলাম নীলগিরিতে। এবার আমার দেখার সাধ ছিলো থানচি আর বড় পাথর এলাকা। নীলগিড়িতে আমরা সবাই মোটামুটি কয়েকঘন্টা সময় কাটালাম। মুর্তজা ভাইয়ের এটাই প্রথম আসা নীলগিড়িতে। ঊনিও খুব পছন্দ করছিলেন জায়গাগুলি। যেহেতু আমাদের গন্তব্য স্থান ছিলো থানচি, তাই বেশীক্ষন দেরী করার অবকাশ ছিলো না। দুপুরের আগেই আমরা রওয়ানা হয়ে গেলাম থানচির উদ্দেশ্যে।
পথে বলিপাড়া ক্যাম্প বা জোন যেটাই বলি না কেন, সেখানে কর্নেল হাবীবের সাথে একসাথে নাস্তা করলাম। শুক্রবার ছিলো বিধায় হাবীবের ব্যাতালিয়ানে জুম্মার নামাজটা পড়লাম। অতপর আবার থানচির উদ্ধেস্য যাত্রা।
থানচি পৌঁছলাম প্রায় বিকালের দিকে। বিজিবি অবকাশ রিসোর্ট। খুব সুন্দর। আমাদের জন্য কর্নেল হাবীব আগে থেকেই তার অধিনে বিজিবি অবকাশে আমাদের জন্য রুম রেখে দিয়েছিলো। অনেকদিন পর মেসে থাকা। বেশী দেরি করলাম না। ওখানকার হেডম্যান, কারবারিকে সাথে নিলাম। আশ্রাফ ভাই সাথে ছিলেন। সবাইকে ঊনি চিনেন এবং সবাইও ঊনাকে চিনে। দারুন মানুষ আশ্রাফ ভাই। চলে গেলাম ডিম পাহাড়ে, মুন পাহাড়ে। ভীসন উচু একটা পাহাড়। গাড়ি উঠতে বুঝা যায় কি পরিমান শক্তির দরকার এইসব ডিম পাহাড়ে উঠার জন্য। প্রায় সন্ধ্যার দিকে ফিরে এলাম। অনেক বৃষ্টি হলো। থানচিতে এই বছরে নাকি এটাই প্রথম বৃষ্টি।
পরের দিন খুব ভোরে আমরা সবাই বড় পাথর এলাকায় রওয়ানা হলাম। বিজিবির সৈনিকগন সাথে ছিলো। আমার জীবনে এতো বড় বড় পাথর আর কখনো দেখি নাই। কোনো কোনো পাথরকে আদিবাসিরা রাজা পাথর, কোনো কোনো পাথরকে তারা রানী পাথর হিসাবেও পুজা করে। বড় পাথর এলাকায় গিয়ে ওখানে এক আদিবাসির দোকানে গরম গরম ভাত, আর সাঙ্গু নদীর তাজা মাছের ঝোল দিয়ে নাস্তা করলাম।
০৮/০৪/২০১৮-পরিবার নিয়ে কক্সবাজার…
Categories
গত ২৬ মার্চ ২০১৮ তারিখ থেকে আমি আমার পুরু পরিবার নিয়ে কক্সবাজার, হিমছড়ি, নাইক্ষংছড়ি, আলিকদম, ফসিয়াখালি, বান্দরবান, বে ওয়াচ বিচ, ইনানী বিচ, স্বর্ণ মন্দির, ১০০ ফুট বৌদ্ধ মূর্তি, সাঙ্গু নদি ভ্রমন, নীলগিরি, মেঘলা, নীলাচল, শইল্ল্যকুপা ঘুরে এলাম। প্রায় ২৮ বছর পর আমি আবার হিল ট্র্যাক্স এলাকায় গেলাম। আমার কাছে প্রতিটি জিনিষ নতুন মনে হচ্ছিলো।
একটা সময় নব্বই এর দশকে আমরা যখন হিলে চাকুরী করতাম, তখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় হেটে হেটে পেট্রোলিং করে করে যেতাম। হোক সেটা ছুটির জন্য নেমে আসা, অথবা ছুটি থেকে আবার ক্যাম্পে যাওয়া, অথবা খাবারের রেশন আনা। এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে যেতে সময় লাগতো প্রায় ছয় সাত দিন। ২০/২৫ জনের একটা পেট্রোল নিয়ে অস্ত্র হাতে অতি সন্তর্পণে প্রান বাচিয়ে বাচিয়ে ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে যেতে হতো। একদিকে মশার কামড়, ম্যালেরিয়ার ভয়, আরেক দিকে শান্তি বাহিনীর অতর্কিত হামলার ভয়। খুব সহজ ছিলো না জীবন। অথচ আজ এবার গিয়ে দেখলাম, প্রতিটি জায়গায় গাড়ি যায়। স্থানে স্থানে বিশাল আকারের রিসোর্ট হয়ে গেছে। মানুষ এখন হিলে যায় সময় কাটাতে, আনন্দ করতে, ফুর্তি করতে। আর আমাদের সময় আমরা প্রতিদিন আতংকে কাটিয়েছি কখন শান্তি বাহিনীর সাথে আমাদের গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। কে কখন জীবন না নিয়ে ফিরে আসে এই ভয়ে।
সময় কি জিনিষ। সব কিছুর সাক্ষী। সময় পালটে দেয় যুগ, যুগ পালটে দেয় মানুষ, মানুষ পালটে দেয় সভ্যতা। আর সব কিছুই হচ্ছে ইতিহাস। আমি যেনো সেই আদিম কালের সভ্যতার সাথে বর্তমান কালের সভ্যতাটাকে তুলনা করছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম। যে পথ দিয়ে আমার শরীরের ঘাম ঝরেছে হেটে হেটে, সেই পথ এখন পিচ ঢালা। যে পথে যেতে আমি সর্বদা আমার ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে পার হয়েছি, কোনো লোকারন্য ছিলো না, মানুষ জনের চলাচল ছিলো না, সেখানে এখানে নতুন টেকনোলজি এসেছে, নতুন সভ্যতা এসেছে, মানুষের কোলাহলের সেস্নাই। এখানে জীবন আর আগের মতো নাই। এসি বাস চলে, বিদ্যুৎ আছে, নানা রকমের ফল মুল অনায়াসেই পাওয়া যায়, যখন তখন বের হওয়া যায়, কি অদ্ভুত পরিবর্তন। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগের তোলা ছবির সাথে আজকে তোলা ছবির কতইনা তফাত অথচ জায়গাটা এক, গাছগুলিও এক, পাহাড়গুলিও এক। যে ঝর্নাটা আজ থেকে ৩০ বছর আগেও যেভাবে পানির ধারা প্রবাহিত করতো, সেই একই ঝর্নাটা আগের মতোই পানির ফোয়ারা দিয়ে যাচ্ছে। যে মেঘ মালা পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঘেঁষে এক স্থান্থেকে উরে উরে আরেক পাহাড়ের গায়ে গিয়ে থমকে যেতো, সেই এক ই মেঘের ভেলা আজো সেই রকম করেই আক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে থমকে যাচ্ছে, কিন্তু আগে সেই নিঃশব্দে বহমান ঝর্নার পানি, অথবা মেঘের সেই অদ্ভুত পাগ লামী যার অপূর্ব শোভা দেখার কেউ ছিলো না, আজ হাজার হাজার দর্শনার্থী ঐ ঝর্নার পাশে, ঐ পাহাড়ের মেঘের সাথে কতইনা অঙ্গভঙ্গি করে স্মৃতি করে রাখছে। ঝরনার মধ্যেও যেনো একটা প্রান এসেছে। আজো মশারা আছে, হয়তো আমার মতো সেইসব জোয়ান মশারা আজকে বুড়ো হয়ে শেষ হয়ে গেছে, তাদের কাছেও হয়ত পাহাড় আর আগের মতো নাই। অনেক মানুষের গায়ে তারা তাদের ইতিহাস লিখে দিচ্ছে।
একটা সময় ছিলো, হাতে গোনা কিছু মানুষ এই অঞ্চলে ঘোরাফেরা করতো, তাও আবার সেনাবাহিনীর সহায়তায় যারা কাজ করতো তারা। অথচ এখন বড় বড় বিজনেসম্যান, চাকুরীজীবি, সবাই পরিবারসহ নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কত হোটেল হয়েছে, রিসোর্ট হয়েছে, রেস্টুরেন্ট হয়েছে, কত যে গাড়ি চলাচল করছে তার কোনো ইয়াত্তা নাই। আর এর মাঝখানে আমার বয়স পার হয়ে গেছে আরো ৩০ বছর। নতুন কমান্ডারগন এসেছে, নতুন জোয়ানরা এসেছে, তাদের হাতে এখন আর আগের দিনের অস্ত্র থাকে না, থাকে আধুনিক কালের টেকনোলজি। তারা তাদের আপন জনের কাছ থেকে দূরে নয়। নিমিষেই সবাই সবার সাথে যোগাযোগ করতে পারে। অথচ আমরা আজ থেকে ৩০ বছর আগে কিছুই করতেপারতাম না। পোস্ট অফিসের মাধ্যমে একদিনের লেখা চিঠি পনেরো দিন পরে হয়তো পেতাম। জরুরী কোনো ব্যাপারে যখন আমাদের কাছে আপনজনেরা চিঠি পাঠাত, তখন ইতিমধ্যে ব্যাপারটা তার জরুরীতা হারিয়ে ফেলেছে। তাতে কত লোকের যে প্রান হানী হয়েছে, কত সম্পদ যে হাত ছাড়া হয়ে গেছে, কত জীবন যে কত কষ্টে লালিত হয়েছে তার কোনো হিসাব নাই। এখানে এখন রাজনীতি ঢোকে গেছে, মানুষ অধিকারের কথা বলে, সাম্যের কথা বলে, একজন আরেক জনের কথা শুনে। এখানে এখন আদিবাসি, বা পাহাড়ি বা বাঙালি সব এক সমাজের। এখন আর এক সেনাবাহিনির কোন সদস্যকে দেখে কোনো পাহাড়ি যেমন ভয় পায় না, তেমনি কোন সেনাবাহিনীর সদস্য ও কোনো পাহাড়িকে দেখে আতংকের মধ্যে থাকে না। ভালো লেগেছে দেখে ব্যাপারটা। ইতিহাস যখন বদলায়, মানুষ তখন ইতিহাসের সাথেই বদলায়। আমি এতো বছর পর এসে ইতিহাস বদলের পালাটা দেখলাম। হয়ত অনেকেই বিশ্বাস করবে না আজ থেকে ৩০ বছর আগের সেই পরিস্থিতি, সেই ইতিহাস। আলম গীর টিলা কেনো নাম হলো, লুকু পাহার কেনো নাম দেওয়া হলো, এই ইতিহাস এখন শুধু ইতিহাস। কিন্তু আমরা যারা ঐ সময় ছিলাম, তখন হৃদয়ের অন্তরস্থল থেকে কি পরিমান রক্ত ঝরেছিলো তার সাক্ষী কেবল আমরা। দেশ স্বাধীন হয়, অধিকার আদায় হয়, কিন্তু যারা এই স্বাধীনতার জন্য প্রান দেয়, এই অধিকারের জন্য রক্ত দেয়, তারা শুধু দিয়েই যায়। তাদেরকে কেউ মনে রাখে না। হয়ত বার্ষিকী পুজা হয় কিন্তু তার অবদানের কথা কেউ মনে রেখে তার ফেলে যাওয়া পরিবারকে কেউ বুকে টেনে নেয় না। এটাই ইতিহাস। যাই হোক…
আমার মেয়েরা, আমার স্ত্রী পুরু ভ্রমনটা আনন্দ করেছে পাহাড়ের সুন্দরতম দৃশ্যগুলি দেখে দেখে। আর আমি আনন্দ করেছি সময়ের স্রোতে পেরিয়ে যাওয়া সময়ের সাথে বর্তমান হিলের সুন্দরতম দৃশ্যগুলি যা আগের মতোই হয়ত আছে কিন্তু এর যে সৌন্দর্যটা ছিলো যা কখনো আগে দেখার সুযোগ হয় নাই, সেটা দেখে দেখে। তুলনা করে করে। নস্টালজিক হয়ে যেতাম মাঝে মাঝে। যে মেঘ একবার আমাকে আলিঙ্গন করেছিলো আজ থেকে ৩০ বছর আগে, হয়ত সেই মেঘ এতোদিন পর তার সেই পুরানো বাসিন্দাকে পেয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আমাকে ভিজিয়ে দিয়েছে। আমার চোখ ভিজিয়ে দিয়েছে, আমার গায়ের গন্ধ শুকে নিয়েছে। যে পাহাড়ের পাশ দিয়ে আমি নিরবিক পথিকের মতো ধুরু ধুরু মন নিয়ে গোটা বিশেক জোয়ান নিয়ে রাতের কোনো এক আধারে হেটে গিয়েছি, ঘাম ঝরিয়েছি, হয়ত সেই ঝরানো ঘামের গন্ধে পাহাড় গুলি তার পুরানো সেই অতিথিকে চিনে নিতে পেরেছে। দুপাশের ভগ্ন পাহাড়ের পাথর গুলি হয়তো আমাকে স্থিত ভাবে দেখে দেখে চিৎকার করে বলেও থাকবে, “এতোদিন কোথায় ছিলেন”?।
বয়স হয়ে গেছে, তাই উঠতি বয়সের মেয়েদের সাথে আমার হাটাহাটি হয়ত অনেক ধীর গতি ছিলো কিন্তু চেষ্টা করেছি পুরু সময়টা ওদেরকে দিতে। ওরা কখনো এই পাহাড়তা বেশী সুন্দর, দৌড়ে চলে গেছে ক্যামেরা নিয়ে। ছবি তুল্বে। কখনো বলেছে, বাবা, দেখো, ঐ পাহাড়তা আরো সুন্দর। আমি শুধু হাসি। আর বলি, সব পাহাড় সুন্দর মা। সবগুলি পাহাড় আমার বন্ধুর মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে যার যার জায়গায়। আজ এতো বছর পর মনে হলো, পাহাড়্গুলি আমাকে দেখছে আর আনন্দে উদ্বেলিত হচ্ছে। অথচ এই পাহাড় গুলিই একদিন আমার কাছে কতই না বিরক্তিকর ছিলো। ভয়ানক আতংকের মতো ছিলো। আজ কেনো জানি মনে হচ্ছে, আমি ওদের অনেক আপন জন। পাহাড় আমাকে ডাকে, পাহাড় আমাকে শুভেচ্ছা দেয়। মেঘের আভায় আমার চোখ ভিজে যায়। কোনটা জল আর কোনটা অশ্রু, সব এক হয়ে যায়। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ি কোনো এক পাহাড়ের ঢালুতে, বড় আপন মনে হয়।
আমার পরিবার বেশ আনন্দ করেছে। আর এই আনন্দের মাত্রাটা বাড়িয়ে দিয়েছে আরো বেশী আমার খুব কাছের বন্ধু মেজর জেনারেল মাকসুদ। প্রথম দিন থেকেই মাকসুদ তার নিজের পাজেরো গাড়িটা আমাদের জন্য স্পেয়ার করে দিয়েছে যেনো যেখানে খুশী যেতে পারি, সাথে ছিলো সেনাবাহিনীর কিছু লোক। অসম্ভব আপ্যায়ন করেছে আমার দোস্ত। জেনারেল মাকসুদ বর্তমানে ১০ ডিভিশনের জিওসি। ওর এডিসি ক্যাপ্টেন গালিব খুব অমায়িক ছেলে। ভালো লেগেছে। মাক সুদের মতো জেনারেলের কাছে গালিবের অনেক কিছু শিখার যেমন আছে, তেমনি, গালিব একটা চৌকস জেনারেলের সাথে আছে বলে সে একটা গার্জিয়ানও পেয়েছে।
নীলগিরিতে গেলাম। ওখানে আকাশ আর পাহাড় এক সাথে খেলা করে। দিনের নীল গিড়ি আর রাতের নীল গিরি এক নয়। মেঘেরা শরীর ছুয়ে যায়, রঙ ধনুরা তার সব কটি রঙ মেলে ধরে ময়ুরের মতো পেখম মেলে অভিনন্দন জানায়। বড্ড মিষ্টি মনে হয় তখঞ্জীবন টাকে। মনে হয়, এতো অল্প সময় নিয়ে কেউ পৃথিবীতে আসে? নীল গিরিতে একদিকে আকাশ, আরেকদিকে দূরে সাগরের প্রবাহমান দৃশ্য, আর তার উপরে বিশাল আকাশ যেনো ছাতির মতো দাঁড়িয়ে আছে। এক সময় এই নীল গিরিতে আসার কথা মনে হলে মনে আতংক আর শারীরিক পরিশ্রমের কাস্টে মাথা ব্যথা করতো, অথচ আজ হাজার হাজার মানুষ কয়েক ঘন্তার জন্য সেই বান্দরবান থেকে গাড়িতে করে এসে আবার ফিরেও যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার রাত্রিজাপন ও করছে নিমিষেই।
এই নীল গিরিতে এসে দেখা হয়েছে একজন চমৎকার মানুষের সাথে। তার নাম আশ্রাফ ভাই। অনেক আলাপ করলাম, মজা করলাম। তিনি আর্মির কন্সট্রাক্সন কাজগুলি করেন। খুব ক্রিয়েটিভ মানুষ এবং অনেক মিশুক মানুষ। সমাজ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হলো তার সাথে, সাথে সাথে এই হিলের ভবিষ্যৎ নিয়েও আলাপ হলো। আমাদের থাকার জায়গা ছিলো নীল গিরিতে, কিন্তু আল তাফ সাহেব যিনি অনেক পুরানো সৈনিক, কিছুতেই আমাকে অন্য কোনো রুমে থাকতে দেবেন না। খুব পরিস্কার মানুষ মনের দিক থেকে। এরাই সেনাবাহিনীর সেই প্রাথমিক সময়ের সব কিছুর সাক্ষী। তিনি আমাকে এবং আমার পরিবার কে ভি আই পি রুম, “মেঘদূত” বরাদ্দ করে দিলেন। অত্যান্ত ভালো একটা কটেজ। মাঝে মাঝে প্রধান মন্ত্রি, প্রেসিডেন্ট সাহেব এই কটেজে থাকেন। রাত ভরে পরিবারকে নিয়ে নীল গিরির সেই মেঘ, আলোছায়া, আর শীতল বাতাস আমাদের সবাইকে বড্ড আপন করে নিলো। আমার ছোত মেয়ের কত যে আবিস্কারের পালা। মেঘের মধ্যে তার ছায়া পড়া, লাইটের মধ্যে তার রঙ ধনুর মেলা, সব কিছুই যেনো তার কাছে নতুন নতুন আবিস্কার।
আমার পরিবারকে নিয়ে থানছি এবং ডিম পাহাড়, মুন পাহাড় দেখার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু সময়ের অভাবে আর ওইদিকে যাওয়া হলো না। থানচিতে জোন কমান্দার হিসাবে আছেন লেঃ কঃ হাবিব। থানচি শব্দের অর্থ হচ্ছে ডোন্ট গো। আর যেও না। অর্থাৎ এটাই বাংলাদেশের শেষ উপজেলা এবং শেষ গ্রাম। জোন কমান্দার লেঃ কঃ হাবীব আমাদের মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ছেলে। শেষমেস নীলগিরি থেকে ব্যাক করে বান্দরবানে এসে রাতের বেলায় সোজা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম।
২৯/১২/২০১৫- মালয়েশিয়া ভ্রমন
খুব হাপিয়ে উঠেছিল আমার পরিবারের সদস্যরা। কোথাও বেড়াতে চাচ্ছিল সবাই এক সঙ্গে। বিশেষ করে আমার বড় মেয়ে ডাক্তারি বই পড়তে পড়তে তার আর ভাল লাগছিল না। সব বই, প্র্যাক্টিকেল ক্লাস, আর পরীক্ষা টরিক্ষা এক পাশে ঠেলে রেখে একদম নিরিবিলি কোথাও বেরিয়ে আসার জন্য প্ল্যান করতে চাইলে আমার বউ বলল ” চল মালয়েশিয়ায় যাই, ওখানে আমি যেহেতু অনেকদিন ছিলাম, অনেক জায়গা আমার চেনা, গেলে খারাপ লাগবে না”। কোন দেশে যাব, এটাতে আমার কোন বাড়তি চয়েস ছিল না, কোথাও যাওয়াটাই ছিল আমার কাছে মুখ্য ব্যাপার। আমার অনেকগুলু সমস্যা হাতে ছিল যদিও, (আমার বড় ভাই অনেক বছর পর আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে আসবেন ২৬ ডিসেম্বর, আমার ভাইয়ের বউ বাংলাদেশে ইতিমধ্যে আছেন এবং ২৩ ডিসেম্বর তারিখে আবার চলেও যাবেন, আমি মালয়েশিয়া গেলে ২৩ তারিখে, সেক্ষেত্রে আমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না তার যাওয়ার দিন, আমার মেয়ের দুইটা কার্ড পরীক্ষা মিস হবে, আমার ফ্যাক্টরির উদ্দেশ্যে বায়ার আসবে আমার অবর্তমানে ইত্যাদি ইত্যাদি)। তারপরেও আমি ব্যাপারটা এড়িয়ে প্ল্যানটা জারি রেখেছিলাম কারন, সর্বদা সমস্যা থাকবে আর এই সমস্যা নিয়েই আমাকে কোন না কোন দিন সময় যোগাড় করতেই হবে, আমি অনেক ভেবেচিন্তে ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে মালয়েশিয়ান এয়ার লাইন্সে টিকেট কনফার্ম করে ফেললাম।
আমার ছোট মেয়ে কখনো প্ল্যানে উঠেনি, তার যেমন একটা প্ল্যানে উঠার কৌতূহল ছিল আবার কয়েকদিন আগে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন মিসিং হওয়ার কারনে সে একটা ভীষণ ভয়ের মধ্যেও ছিল। কি হয় কি হয় না, সে ভীষণ ভয়ের মধ্যে প্লেনে উঠেছিল। তার চিত্তের ভিতরে কতটা ভয় কাজ করছিল সেটা আমি বুঝতে পারলাম যখন আমরা সবাই প্লেনে উঠলাম। আমার ছোট মেয়ে কোন এক অজানা ভয়ে একদম চুপসে যাচ্ছিল, তার বিদেশ যাওয়ার খায়েশ যেন আর থাকছিল না। সে বারবার তার মাকে শক্ত করে ধরেছিল, আমাকেও তার পাশে বসিয়ে আমার কোট আর হাত এমন করে ধরেছিল যেন সে কোন এক উচু পাহারের একদম ধারে গিয়ে দারিয়ে কোন মানুষ যা করে সে তাই করছিল। আমার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা কোন লজিক তার ভয়ের উপশমের লাঘবের উপাথ্য হয়ে কাজ করছিল না। তার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পরছিল আর মুখটা এতটাই ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল যে, আমার বড় মায়া হল। ১৩ বছরের একটা ছোট মেয়েকে আমি কি বললে যে তার চিত্ত ঠাণ্ডা হবে বা ভয় কেটে যাবে তার কোন কিছুই আমার জানা ছিল না। এই ব্যাপারটা যাওয়ার সময়ই শুধু হয়নি, বরং ব্যাপারটা আরও কঠিনরুপ ধারন করল যখন এয়ার এশিয়ার একটি প্লেন ২৫ তারিখে ইন্দোনেশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর যাওয়ার পথে হারিয়ে গেল। আমি আমার পরিবারের সময় বাঁচানোর জন্য যেখানে বাসে বা ট্রেনে গেলেও চলে, তার পরিবর্তে আমি সেখানে প্লেনের টিকেট আগেই করে ফেলেছিলাম। যেমন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে লঙ্কাউই, লঙ্কাউই থেকে পেনাং, আবার পেনাং থেকে কুয়ালালামপুর, এই পুরু ভ্রমণগুলোতে আমি বাস বা রিভার ক্রুজ বা ট্রেন বাদ দিয়ে সব স্থান থেকে এয়ারে টিকেট করেছিলাম। এরমধ্যে আবার একটা পরেছে এয়ার এশিয়ার ফ্লাইট। তো বুঝতে আমার অসুবিধা হল না নেক্সট ভ্রমনগুল আমার ছোট মেয়ের জন্য আনন্দের না হয়ে মোটামুটি কষ্টের সময় পার হবে। ভয় এমন একটা জিনিস যাকে একবার ধরে বসে, সে বুঝতে পারে তার ভিতরে কি হয়। এটা বাইরের কেউ তার পরিধি আঁচ করবার উপায় থাকে না। যাক, তারপরেও আমি সিডিউলগুল প্লেনেই ঠিক রাখার চেস্টা করেছিলাম একমাত্র পেনাং থেকে কুয়ালালামপুর ছাড়া। শেষ অবধি পেনাং থেকে কুয়ালালামপুর পর্যন্ত প্লেন বাদ দিয়ে বাসে আসতে হয়েছিল। সেটাও আরেক অভিজ্ঞতা।
বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ার যাওয়ার প্রথম দিনের ঘটনাটা বলি।
সকাল ১১ টায় ফ্লাইট। সম্ভবত আমরাই সবার শেষে ফ্লাইটে উঠলাম। কুয়ালালামপুর পৌঁছলাম লোকাল টাইমে প্রায় তিনটার দিকে। কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে লোক ছিল। ফলে গাড়ির ব্যবস্থা ছিল। কোন অসুবিধা হয় নাই। কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার সময় আমাদের সবার মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল একটা কারনে। আমাদের ঠিক সামনে একজন বাঙালি ছিল যে কয়েকদিন আগে মালয়েশিয়ায় এসে ইমিগ্রেসন থেকে কোন এক অজ্ঞাত কারনে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। সে জানে না কেন তাকে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেসন থেকে মালয়েশিয়ায় ঢোকতে না দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছিল। ফলে সে ১৫ দিনের তফাতেই আবারো একটা এটেম্পট নিয়েছিল মালয়েশিয়ায় ঢোকার জন্য। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম এবারো তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। নেহায়েত গরিব মানুষ, গ্রাম থেকে বোধহয় মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে। আমি ইমিগ্রেসন অফিসারে সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম এই জন্যে যে কি কারনে তাকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে তা সঠিক তথ্যটা জানার জন্য। ইমিগ্রেসন অফিসার আমাকে জানালেন যে, কিছু সমস্যা আছে, সিকিউরিটির ব্যাপার। আগেরবার তাকে ওই কারনেই ফেরত পাঠানো হয়েছিল, এবারো তাই। লোকটা ভালভাবে তার অবস্থাটা ব্যাখ্যা করতে পারছিল না ভাষার কারনে। বুঝাই যাচ্ছিল যে সে বড় অসহায়। আমাকে দেখে যেন তার আত্মায় পানি এল। বলল, স্যার, আমাকে একটু সাহায্য করেন। অরা কি বলে আমি ঠিক বুঝতে পারি না আর কি বলতে কি উত্তর দিচ্ছি তাও ভাল মত বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমার এই সাহায্যটা ওনার কাজে লাগলো না ইমিগ্রেসন অফিসারের কারনে। অফিসার আমাকে শুধু প্রশ্ন করল, ওই ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গের কিনা। আমি সত্যি কথাই বললাম যে, সে আমাদের সঙ্গের কেউ না। ফলে ইমিগ্রেসন অফিসার আমাকে রিকুয়েস্ট করলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছু না বলার জন্য। আমি শুধু জিজ্ঞেস করলাম, তাকে পুনরায় ফেরত পাঠানো হচ্ছে কিনা এবং কেন। সে আমাকে জানাল যে, তাকে ফেরত পাঠানো ছাড়া কোন বিকল্প নাই। তার সিকিউরিটির সমস্যা আছে। আমরা চলে এলাম কিন্তু আমাদের সবার মনটা একদম খারাপ হয়ে গেল এই ভেবে যে, নেহায়েত একটা গ্রামের গরিব মানুষ কি কারনে মালয়েশিয়ার কোন নিরাপত্তার হুমকি হয়ে গেল সে নিজেও জানে না অথচ সে হয়ত তার সব কিছু বিক্রি করে তার স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় এসেছে কিন্তু ওই স্বপ্নের দেশে সে ঢোকতে পারছে না। দেশে গিয়ে এখন সে কি করবে বা কি করবে না এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর আমার মেয়েরা আমাকে করেছিল কিন্তু সে উত্তরগুলু আমার জানা ছিল না। লেখাপড়া করাটা যে কত জরুরি, অন্তত নিজের কথাগুলু অন্যকে বুঝানো এবং অন্যের কথাগুলো সঠিকভাবে বুঝা যে কত জরুরি সেটা তখনই সম্ভব যখন কেউ অন্তত ওই টুকুন লেখাপড়া করা দরকার। হয়ত ইমিগ্রেসন অফিসার এমন কোন প্রশ্ন তাকে করেছিল যার প্রশ্ন সে না বুঝেই হ্যা বলেছে আর সে হ্যা উত্তরটাই তার কাল হয়ে দারিয়েছে। বড় দুঃখের ব্যাপার। আমাদের কিছুই করার ছিল না।
এয়ারপোর্ট থেকে আমরা বেরিয়ে গেলাম। বড্ড সুন্দর একটা দেশ। খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, অনেক ফ্লাই ওভার, অনেক রাস্তাঘাট, সুন্দর সুন্দর দালান কোঠা। অনেক দূর থেকে টুইন টাওয়ার চোখে পরে। যে কোন উন্নত দেশের সঙ্গে মালয়েশিয়াকে এখন তুলনা করা চলে। কোন রিক্সা নাই, বাসও চলে না দিনের বেলায়। চারিদিকে ট্যাক্সি আর প্রাইভেট কারের সমারোহ। কোন হর্ন বাজে না। জ্যাম থাকলেও সেটা সাময়িক। বড় ডিসিপ্লিনড দেশ। রাস্তার পাশের বনজঙ্গল গুলুও বেশ গুছানো। নাপিতের ক্ষুরে যেমন মানুসের অতিরিক্ত চুল ছেটে সুন্দর করে রাখা হয়, মালয়েশিয়ার রাস্তার পাশের ঘাসগুলুও যেন সেভাবে সাজানো। অনেক ক্লিনার কাজ করছে, যার যার কাজ সে সে করছে। তাদের উপর কোন তদারকি করছে না কেউ। খুব গুছানো একটা শহর। প্রায় ৩০ মিনিট গাড়িতে থাকার পর হোটেলে এলাম। খুব বেশি খরচ না। থ্রি স্টার স্ট্যান্ডার্ড। প্রতিটি রুম মাত্র ২০০ রিঙ্গিত এর মধ্যে বা তার থেকে একটু বেশি। আমরা দুই ফ্যামিলি তিনটা রুম নিলাম, মাঝখানে কানেক্টেড। আমার ছোট মেয়ের ভয়টা এখন আর নাই, তার চোখে মুখে হাসি আছে, আর আমার বড় মেয়ে কতক্ষণে মোবাইল সিম কিনবে, ফেসবুক ব্রাউজ করবে, তার মালয়েশিয়ার ভ্রমনের ছবি সম্বলিত ম্যাসেজ ট্যাগ করবে, সেই ভাবনায় বারবার কোথায় মবাইলের সিম পাওয়া যায় তার জন্য অস্থির করে ফেলছে। রাত নয়টায় খেতে বের হয়েছি। আমাদের সঙ্গে ড্রাইভার আছে, গাড়িও আছে। একটা পাকিস্তানি হোটেলে খেতে ঢোকলাম। প্রায় বাঙালি খাবার। আমি স্রেফ ভাত ডাল আর সবজি খেয়েই তৃপ্ত বোধ করলাম। মেয়েরা আধুনিক মানুসের ডিজিটাল ধাচের। মুরগি আর বিরিয়ানি ছাড়া তারা কিছুই পছন্দ করে না। সুতরাং তারা ঐটাই খেল আর আমি আমার মেনু। খাওয়ার পর একটু আশে পাশের মার্কেটে ঘোরাফেরা করলাম, কিছু কেনাকাটাও করলাম। একটা জিনিস খেয়াল করলাম যে, আমার মেয়েরা যা যা জিনিসের প্রতি কেনার খেয়াল তা হচ্ছে সব গিফট, কোন বন্ধুরে কোন গিফট দেয়া যায় সেটা নিয়ে মহা জল্পনা কল্পনা। আমার মেয়ে এবং বউ সিম কিনতে ভুল করল না। অনেক পদের সিম কার্ড। অফারের ছড়াছড়ি। রাত প্রায় ১ টায় আমাদের হোটেলে পৌঁছলাম। সারাদিন ফ্লাইট আর ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফিরে এসে বড্ড ক্লান্ত মনে হল। বিছানায় যেতেই ঘুমিয়ে পরলাম।
পরদিন ২৪ ডিসেম্বর।
সকালে নামাজ পরে নাস্তা করে বেরিয়ে গেলাম কতগুলো বিশেষ স্থান দেখার জন্য। তার মধ্যে প্রথম ছিল গেন্টিং আইল্যান্ড। গেন্টিং আইল্যান্ড সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ২০০০ মিটার উঁচুতে। জায়গাটা সুন্দর। পাহারি এলাকা, তার এক জায়গায় স্ট্রবেরি চাষ হয়। বড্ড সুন্দর। হরেক রকমের স্ট্রবেরি। সবুজ, লাল, মেরুন সাদা আরও কত প্রকারের যে স্ট্র বেরির রঙ। এটাকে একটা স্ট্রবেরির মিউজিয়াম বলা চলে আর কি। ওখানে অনেক বাঙালি ছেলেরা কাজ করে। একটা জিনিস খেয়াল করার মত যে, যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই কোন না কোন বাঙালি লোক পেয়েছি, তাও আবার একজন করে নয়, অনেক বাঙালি। স্ট্রবেরির মিউজিয়ামটা দেখার জন্য আগে থেকে কোন প্ল্যান ছিল না। এটা দেখা হয়েছে গেন্টিং আইল্যান্ডে যাওয়ার কারনে। সারাদিন মেঘে ভরা থাকে জায়গাটা। অনেক দূর থেকে পাহারের কোল ঘেসে মেঘ বলে মনে হলেও কাছে গেলে ওটা কুয়াশাই হয়ে যায়। অত্যন্ত ঘন কুয়াশায় জায়গাটা সারাক্ষন ভিজাই থাকে। খুব সাবধানে গারি চালাতে হয়। এমনিতেই পাহারি এলাকা, আর তার উপর আবার ভিজা রাস্তা ঘাট। সবার হাতে ছাতি। শুধু আমাদের হাতে কারো কোন ছাতি নাই।
স্ট্রবেরি দেখে পাশেই স্কাই রেল। দারুন জিনিস। শুন্যে ভেসে ভেসে প্রায় কয়েক কিলোমিটার রাস্তা ক্যাবল কার দিয়ে পাহারের উপর দিয়ে উরে যাওয়ার মত। এটাকে ওদের ভাষায় বলে গেন্টিং স্কাই ড্রাইভ। এটাকে আবার “গন্ডলা লিফট”ও বলে। প্রায় ৪ কিলোমিটার লম্বা পথ। এই জায়গাটার নাম করন করা হয় কোন এক প্রাইভেট কম্পানির নামে। ঐ কম্পানির নাম ছিল “গেন্টিং হাই ল্যান্ডস বারহ্যাড” ১৯৬৫ সালে। উক্ত কোম্পানিকে তখন মোট ১৪০০০ হাজার একর জমি ১০০ বছরের জন্য লিজ দিয়েছিল। বেশ মজার একটা ব্যাপার। যাদের হার্টের সমস্যা আছে, বা হাইট ফুবিয়া আছে তাদের না যাওয়াই ভাল, তবে যারা একটু থ্রিল পছন্দ করে, তারা স্কাই ক্যাবলটা আনন্দ পাবে। এই ক্যাবল কারটাকে বর্তমানে “World’s Fastest Mono Cable Car System” নামেও পরিচিত with a maximum speed of 21.6 kilometres per hour (13.4 mph) and the “Longest Cable Car in Malaysia and Southeast Asia maybe”. এখানে 20th Century Fox World কোম্পানির বর্তমানে লোকেশনের কাজ চলছে যা ২০১৬ তে শেষ হবে। তখন দেখা যাবে আরেক চমক। চারিদিকে ঘন জঙ্গল, অনেক উঁচুতে এক একটা ক্যাবল কারে সর্ব মোট চারজন করে করে পাহারের উপর দিয়ে ভেসে পাহাড়ের অনেক উঁচুতে চলে যাওয়ার যে একটা মজার অনুভুতি, মন্দ না। আমার ছোট মেয়েকে নিয়ে আবারো একই সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। যাওয়ার সময় সে কিছুতেই চোখ খুলছিল না, কিন্তু আসার সময় মনে হল, একটু সাহস সঞ্চয় করে চোখ খুলে কিছুটা হলেও পাহাড়ের দৃশ্যটা দেখেছে আর কি। কিন্তু কেউ একটু নড়লেই তার চিৎকার শোনা যায়। “এই বাবা, তুমি নরাচরা করছ কেন? কিংবা ঐ আপি তুমি ছবি তোলার জন্য নরাচরা করছ কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি”। অসংখ্য ছবি আর ছবি তুলেছে আমার বড় মেয়ে, সঙ্গে তাদের মা। ফ্যামিলি নিয়ে ঘোরাফেরার মধ্যে একটা মজা আলাদা। আমি অনেকবার বিদেশ গিয়েছি কিন্তু তা নিতান্তই ব্যবসার কাজে অথবা চাকুরির কাজে। এবারই প্রথম আমার সপরিবারে সবাইকে নিয়ে বাইরে যাওয়া। মেয়েদের উচ্ছ্বাস দেখে আমার বেশ ভাল লাগছিল। অনেকবার সবাইকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার প্লান করলেও কারো না কারো স্কুল বা কলেজের বা পরিক্ষার কারনে আমাদের যাওয়া হয় নাই।
ঐ ক্যাবলকার দেখে আমরা সবাই আবার চলে গেলাম পুত্রজায়া দেখার জন্য। পুত্রজায়া জায়গাটা দেখার মত একটা জায়গা। পুত্র জায়ার প্রধান কনসেপ্টটা হচ্ছে যে, “City in the garden and Intellegent City” পুত্র জায়ায় এখন সরকারি সব অফিস আদালত ট্র্যান্সফার করা হয়েছে (একমাত্র Ministry of International Trade and Industry, Ministry of Defence and Ministry of Works ছাড়া)। কুয়ালালামপুরে জ্যামের কারনে পুরু প্রশাসনিক অফিসগুলো সব এখন এখানে অবস্থিত। ডঃ মহাতিরের মাথায় প্রথম এই কনসেপ্টটা আসে যে, কুয়ালালামপুর থেকে সর ধরনের অফিস এই পুত্রজায়ায় স্থানান্তর করা হয়। মালয়েশিয়ান ভাষায় পুত্র মানে “প্রিন্স” আর জায়া মানে “সাকসেস”। অর্থাৎ প্রিন্সের সাকসেস বা ভিক্টরিই হচ্ছে পুত্রজায়ার অর্থ। ইন্টেলিজেন্স সিটি বলতে বুঝায় যে, এটা একটা ডিজিটাল সিটি। এখানে বলা বাহুল্য যে, ডিজিটাল সিটি বা স্মার্ট সিটিগুলোর মধ্যে Chicago, Boston, Barcelona and Stockholm রয়েছে। As of 2010 Census the population of Putrajaya is 97.4% Muslim, 1.0% Hindu, 0.9% Christian, 0.4% Buddhist, and 0.3% other or non-religious
পুত্র জায়ায় নিম্ন বর্ণিত অফিসগুলো রয়েছেঃ
পারদানা পুত্র অর্থাৎ office of the Prime Minister
সেরি পারদানা বা official residence of the Prime Minister
শ্রী সাত্রিয়া বা official residence of the Deputy Prime Minister
প্যালেস অফ জাস্টিস
পুত্র জায়া মিনিস্ট্রি অফ ফাইন্যান্স
অইস্মা পুত্র বা Malaysian Ministry of Foreign Affairs.
ম্যালাওাতি জাতীয় প্যালেস
Putrajaya Convention Centre
Perdana Leadership Foundation
Selera Putra
Souq Putrajaya
Pusat Kejiranan Presint 9
Pusat Kejiranan Presint 16
Putra Mosque
Tuanku Mizan Zainal Abidin Mosque (Iron Mosque (Masjid Besi))
এখানে মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক কনভেনশনাল সেন্টার অবস্থিত। লোকেশনটা সত্যি দেখার মত। যেমন সুন্দর তেমনি মনোরম। এখানে অনেক রাজকীয় জায়গা আছে, আছে চমৎকার একটা মসজিদ, আছে লেক, আছে বিশাল বিশাল বিল্ডিং, আর আছে অনেক বিদেশি পর্যটক। প্রতিটি লাইট পোস্ট, প্রতিটি গাছপালা, প্রতিটি বিল্ডিং ডিজাইন, এমন কি প্রতিটি টাইলস প্ল্যান করে সাজানো। যে বা যারাই এর পিছনে কাজ করুক না কেন, তাদের জবাবদিহিতা ছিল এর সৌন্দর্য এবং সমাপ্তির লক্ষে। কোন একটা জায়গা খামাখা ব্যবহার করা হয় নাই, কোন না কোন লক্ষ্য নিয়ে এর নির্মাণ কাজ হয়েছে, আবার যে জায়গাগুলো ব্যবহার করা হয় নাই, সেগুলোও অত্যান্ত প্লান মাফিক খালি রাখা হয়েছে। যত্রতত্র কোন কিছুই করা হয় নাই। স্পেসের সুষম বন্টন, আর রিসোর্সের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার চোখে পরার মত। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়েছে, আমাদের দেশের অনেক নামি দামি মন্ত্রি, মিনিস্টার, অনেক হাই অফিসিয়ায়ালগন কত বার না এদেশ ভ্রমন করেছে কিন্তু ওদের কি ইচ্ছে করে না আমাদের দেশটাকে এইভাবে সাজানোর? খুব অবাক হয়েছি আমাদের দেশের নেতাদের ইচ্ছা শক্তি আর রুচির অভাব দেখে।
পুত্রজায়ায় নামাজ পরে কিছু খাবার খেয়ে আবারো আমরা কুয়ালালামপুরে হোটেলে চলে এলাম। রাতে খাবার খেয়ে কিছু শপিং করে রাতে আবারো কিছুক্ষনের জন্য বিশ্রাম। পরদিন যেতে হবে লঙ্কাউই আইল্যান্ডে। লংকাউই আইল্যান্ডে যাওয়ার আগে আমরা টুইন টাওয়ার দেখে যাবার প্ল্যান, তাই সকাল সকাল খেয়ে দেয়ে ব্যাগ পাট্টা গুছিয়ে প্লেনের টিকিট পকেটে করে টুইন টাওয়ারের চলে গেলাম। কোন টিকিট নাই আগামি ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ফলে টুইন টাওয়ারে উঠতে পারলাম না, বাইরে থেকেই দেখে আর ছবি টবি তুলে বেরিয়ে গেলাম লংকাউই এর উদ্দেশে এয়ারপোর্ট। যাবার আগে ৩০ ডিসেম্বর তারিখের টিকিটটা কিনে নিয়ে গেলাম যেন লঙ্গাকাউই থেকে ফিরে টুইন টাওয়ারের ভিতর ঢুকতে পারি। এখানে একটা জিনিস বলতে ভুলে গেছি যে, এর আগের দিন পুত্রজায়ায় যাওয়ার আগে আমরা বার্ডস মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম। এটা একটা চিরিয়াখানার মত। কিন্তু শুধু পাখিদের। এই জু তে ছোট বুলবুলি পাখি থেকে শুরু করে প্যাচা, ইগল, বক কাক, আরও অনেক নাম না জানা পাখির সমারোহ। পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য বটে। ওরা সুখেই আছে, খাওয়া দাওয়ার চিন্তা নাই, সময়মত খাবার পাচ্ছে, উড়ে বেড়ানোর যথেষ্ট জায়গাও আছে, আর সবচেয়ে যেটা আছে তা হচ্ছে এরা নিরাপদ। হেটে হেটে দেখতে হয়, পা ব্যাথা হয়ে যাচ্ছিল আমার। টুইন টাওয়ার সম্পর্কে কিছু বলি।
টুইন টাওয়ারকে বেসিক্যালি পেট্রনাস টাওয়ার বা পেট্রনাস টুইন টাওয়ার বলা হয়। মালয়েসিয়ান ভাষায় একে বলা হয় মিনারা পেট্রনাস। এটা ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার হওয়ার আগ পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বচ্চ টাওয়ার ছিল। সাত বছর লেগেছিল এটা তৈরি করতে। পুরুটাই রেইনফরসড কনক্রিটে করা। পরে এর বাহিরের দিকে ষ্টীল এবং গ্লাস দিয়ে মোড়া হয়। প্রায় ৬ লক্ষ স্কয়ার ফিট জায়গা নিয়ে এই টুইন টাওয়ার। ৪১ এবং ৪২তম টাওয়ার দ্বারা দুইটা মিনার এক সঙ্গে যুক্ত। আর এইটাও বর্তমান পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কানেক্টেড ব্রিজ কোন টুইন বিল্ডিং এর মধ্যে। প্রতিদিন ১০০০ জন লোককে এই টুইন টাওয়ার দেখার জন্য টিকেট বিক্রি করা হয়। দর্শকগন এই ৪১/৪২ এবং ৮৬ তলায় শুধু যেতে পারে, আর অন্য গুলোতে যাওয়ার অনুমতি নাই। এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, টুইন টাওয়ারটা কি কারনে করা হয়েছিল। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত আম্পাং (যেখানে বর্তমানে টুইন টাওয়ারটা অবস্থিত) থেকে সেলানগর টার্ফ ক্লাব (এখন যেটা কেএল সিটি নামে পরিচিত) পর্যন্ত এতটাই ট্রাফিক জ্যাম হত যে, ঘন্টার পর ঘন্টা কোন গাড়ীঘোরা চলতে পারত না। এই অচলবস্থা নিরসন কল্পে মালয়েশিয়ার ৪র্থ প্রেসিডেন্ট ডঃ মহাতির এই প্রজেক্ট হাতে নেন। সেলানগর টার্ফ ক্লাবটা ছিল একটা রেসিং ক্লাব যা ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ উইলিয়াম ম্যাক্সওয়েল এমেচার রেসিং হিসাবে চালু করেন। এক পর্যায়ে এই রেসিং ক্লাব থেকে মালয়েশিয়া হাজার হাজার মিলিওন ডলার আয় করতে শুরু করে বেদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে। পর্যায়ক্রমে এই সিলানগর টার্ফ ক্লাব হয়ে উঠে রেসিং কাম স্পোর্টস সেন্টার। এমনকি এটা পরবর্তীতে কমনওয়েলথ স্পোর্টস ক্লাব হিসাবে রানি এলিজাবেথ-২ এর সময় চালু হয়। কিন্তু শুধুমাত্র জ্যামের কারনে অনেক অসুবিধা হচ্ছিল এর আয়ের উৎসে। ১৯৯৪ সালে এটা (সেলানগর টার্ফ ক্লাবকে) অফিসিয়াল স্পোর্টস ক্লাব হিসাবে মর্যাদা দেয়া হয় যা এখন বিদ্যমান।
The entire master plan for KLCC project development around freehold prime property (KLCC: 40.5 hectares – Petronas Twin Towers & Retail: 5.8 hectares with 18,000 m2 each tower – 994,000 m2 total Petronas complex) was focused into seven main sections. i.e. Office Buildings, Hotels, Retails, Convention Centre, Residential, Recreational facilities and Infrastructure. The conceptual redevelopment project was to covert site of the former Selangor Turf Club, a 100-acre horse race track located in the center of Kuala Lumpur’s “Golden Triangle, into an integrated, self-contained modern city as well as creating a new landscape for the capital city of Malaysia
The reallocation of the Turf Club was also occurred back in 1992/3.
Today, Petronas has evolved into a turnover of $25.7 billion with a pretax profit of $9.9 billion for the financial year ended on March 31, 2004 – and it was one of the respectful top Fortune 500 company. Four of its subsidiaries are listed on the Malaysian Stock Exchange (renamed as Bursa Saham Malaysia in 2005).
এই গেল টুইন টাওয়ারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
এখানে একটা জিনিস আমার চোখে পড়ল ভীষণভাবে। সব গুল এক্সিট শেষ হয় গিফট দোকান ঘুরে ঘুরে। কেউ কিনুক আর নাই বা কিনুক, তাকে ঐ সব দোকান দিয়েই বের হতে হবে। এটা একটা বিজনেস চালাকি। ছোট ছোট বাচ্চারা সঙ্গে থাকে, সুতরাং কিছু না কিছু কেনা কাটা তো হয়ই। আর এই সব জায়গায় দাম একটু চরা থাকে।
যেটা বলছিলাম। আমরা টুইন টাওয়ার বাইরে থেকে দেখে লংকাউই দেখার উদ্দেশ্যে এয়ারপোর্ট চলে এলাম। এটাও একটা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। বড় সুন্দর। আমার ছোট মেয়ের আবার দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেছে। কারন তাকে আবার প্লেনে চরতে হবে। তবে এবার বেশিক্ষন সময়ের জন্য নয়। মাত্র ৪০/৪৫ মিনিট সময়। দেখতে দেখতেই পার হয়ে গেল। আমরা লঙ্গাউইতে পৌঁছলাম যখন তখন রাত ১০টারও বেশি। এখানে যে কোন লোক যারা গাড়ী চালাতে পারে তারা যে কোন দিনের জন্য গাড়ী ভারা নিতে পারে এবং সেলফ-ড্রাইভিং করতে পারে। সস্তাও বেশ। আমরা দুই দিনের জন্য একটা প্রাইভেট গাড়ী ভারা নিয়ে নিলাম। বেশ ভাল। লংকাউই এর একটা সুন্দর নামকরনের ব্যাখ্যা আছে। কেউ কেউ বলে যে, লঙ্কা অর্থ হচ্ছে “সুন্দর” আর “উই” এর অর্থ হচ্ছে “অফুরন্ত”। এর মানে এই যে, লংকাউই মানে “অফুরন্ত সুন্দরের অধিকারি”। আবার কেউ কেউ বলে যে, এটা প্রাচিন থাইল্যান্ডের কেদাহ সম্প্রদায়ের লোকের বসবাস ছিল যারা লাঙ্কাসু প্রভিন্সের বাসিন্দা। এই লংকাসু হচ্ছে প্রাচিন থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার আন্তসংযোগ স্থল। বর্তমানে এটা মালয়েশিয়ার অংশ। আবার অনেকে বলে যে, “লাংক” মানে ইগল এবং “উই” মানে মার্বেল। এর মানে হচ্ছে এই লংকাউই তে প্রুচুর পরিমানে ইগল এবং মার্বেল পাওয়া যায়। এখানে লোকমুখে আরও একটা মিথ চালু আছে। আর সেটা হচ্ছে About 200 years ago, according to the folklore, a young woman, name Mahsuri, was accused of adultery and was executed by the people in spite of her earnest innocence. Just before her death, Mahsuri laid a curse on the island that it will remain barren for seven generations.
এই এলাকায় থাই ভাষা মোটামুটি সবাই বলতে পারে। আসলে কোণটা যে কি তা আমার জানার দরকার নাই, আমি আসলে জায়গাটার সুন্দরের কারনে বিমোহিত।
লংকাউই তে আমরা এবি হোটেল নামে একটা হোটেলে উঠলাম। আগে থেকেই বুক করা ছিল। গিয়ে দেখলাম, আমাদের রুমটা একদম বীচের সঙ্গে লাগানো। খুব ভাল লাগলো। প্রায় অর্ধরাত অবধি আমরা ঐ প্রাইভেট কারে করে প্রায় আশেপাশের এলাকাটা ঘুরলাম। কিন্তু আমাদের জানা ছিল না যে, রাত ১১ তার পর সব খাবার হোটেল বন্ধ হয়ে যায়। “টমেটো” নামে একটা রেস্টুরেন্ট আছে, সারারাত খোলা থাকে, প্রায় রাত ১২ টার পরে গিয়ে মোটামুটি আমাদের পছন্দের খাবারগুল খেতে পারলাম। এই টমেটো হোটেলে বাংলাদেশের অনেক লোক কাজ করে, দাম ও প্রায় রিজন্যাবল। প্রথমে মনে হয়েছিল শহরতা মনে হয় ছোট্ট একটা দ্বীপের মত, যেমন আমাদের সেন্ট মারটিন দ্বীপ। ভুলটা ভাঙল তার পরেরদিন।
সকাল থেকে আমরা সারাদিন (অর্থাৎ বিকাল ৩ টা পর্যন্ত) বীচে অনেক আইটেম করলাম, প্যারাসুট দিয়ে এক পাহার থেকে আরেক পাহাড়ে গেলাম, স্পিড বোটে করে রিভার ক্রুজ করলাম, সাতার কাটলাম, সবাই মিলে সত্য দারুন কাটল বীচের সময়টা। বেশ এক্সপেন্সিভ সব আইটেম। বীচের বালুগুলো এত মসৃণ যে মনে হয় সারাক্ষন হাতে নিয়ে পাউডারের মত পিসাপিসি করি। বালুর রঙ খুব সুন্দর।
এখানে একটা মজার কান্ড ঘটলো। আমরা সবাই ব্যানানা বোটে উঠেছিলাম এক সঙ্গে। এটা বেসিক্যালি একটা স্পিড বোট দিয়ে অনেক স্পিডে টেনে আরেকটা ব্যানানা সাইজের ভেলাকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনে। কলার শেপে বানান একটা বোট, প্রায় ৬ জন একসঙ্গে বসতে পারে। আমরা খুব ভাল করে ব্যানানা ট্যুরটা শেষ করেছি মাত্র, পাড়ে এসে নেমে পড়ব পড়ব ভাব। কিন্তু ঠিক শেষ পয়েন্টে এসে হটাত করে সামনের স্পিড বোটটা এমন করে বেঁকিয়ে টান দিল যেন ব্যানানা বোটে যারা থাকে সবাই এক ঝটকায় পানিতে পরে যায়। আমরাও পরে গেলাম। আমার ছোট মেয়ে সাতার জানে না, বড় মেয়ে কিছুটা জানে। কিন্তু সবার লাইফ জ্যাকেট পরা ছিল। এটা আমাদের জানা ছিল না যে ওরা এই এমন একটা কাজ করবে। ওরা অবশ্য এমন একটা জায়গায় এই কাজটা করে যেখানে সাতারের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু হটাত করে ঝটকা দিয়ে ফেলে দেয়ায় সবাই একটা আতঙ্কে পরে যায়। ব্যাপারটা আমিও জানতাম না। আমাদের বেলায় এই কাজতা হওয়াতে আমার ছোট এবং বড় মেয়ে সঙ্গে আমার বউ এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে, মনে হয়েছিল এই বুঝি সবাই ডুবে মরছি। কিন্তু ২০-৩০ সেকেন্ড পর যখন পায়ের তলায় মাটি ঠেকে তখন ব্যাপারটা একটা মজার ঘটনায় পরিনত হয়। হটাত আতংক, আবার হটাতই সস্তি।
বিকালের দিকে খেয়ে দেয়ে আমরা “আন্ডার ওয়ার্ল্ড সি” তে গেলাম। এটাও একটা মিউজিয়াম কিন্তু শুধু মাছের। কি নাই এখানে। সব পদের মাছ, গুল্ম, হাঙ্গর, আরও কত কি!! আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, এগুলো সব জীবিত। খুবই সুন্দর একটা জায়গা। দেখার মত। এখানে প্রায় ৫০০০ হাজার পদের মাছের প্রজাতি আছে। ১৯৯৫ সালে এটা তৈরি করা হয়েছিল। The concept and theme of Underwater World Langkawi are geared towards Knowledge, Education and Entertainment. It is built to raise awareness on the importance of conserving our precious aquatic life forms, thus creating understanding of the deep and inseparable bond between man and nature.
প্রতিদিন এই একুরিউয়ামের মত জলাধারগুলোতে ৫ লাখ পরিমান পানি ঢালা হয় ফ্রেশ। এখানে ফটো গ্যালারী আছে, বন্য প্রাণীর গ্যালারী আছে, আর আছে মাছের প্রজাতিদের হরেক রকমের গ্যালারী। হেটে হেটে দেখতে হয়। প্রায় ১৫ মিটার চওরা হাটার পথ। খুব সুন্দর। দেখতে দেখতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল, আমরা সময় করে উঠতে পারছিলাম না সবগুলো আইটেম দেখার জন্য। তার মধ্যে আবার শুরু হয়েছে বৃষ্টি। মালয়েশিয়ায় প্রায়ই বৃষ্টি হয়। তবে আবহাওয়াটা শিতের নয়। এটা সামারের মত একটা সময়।
এই আন্ডার ওয়ার্ল্ড সি শেষ করে আমাদের প্ল্যান ছিল ইগল স্কয়ারে যাওয়ার। এই ইগল স্কয়ারটা কুয়া জেলায় অবস্থিত। লংকাউইটা কত বড় এটা ঐ ইগল স্কয়ারে না গেলে হয়ত বুঝতাম না। এটা প্রথম দিন মনে হয়েছিল আমাদের সেন্ট মারটিন দ্বীপের মত, কিন্তু ইগল আইল্যান্ডের জন্য যেতে গিয়ে বুঝলাম এটা নিতান্তই একটা বড় শহরের সমান। প্রায় ১ ঘন্টা গাড়িতে জার্নি করে ইগল স্কয়ারে পৌঁছলাম। দেখার মত একটা স্কয়ার। ওখানে অনেক বড় আকারের (প্রায় ১২ মিটার) একটা ইগলের ভাস্কর্য করা। খুবই সুন্দর। ইগলের ছবিটা দেখলে মনে হবে ঈগলটা উড়ে যাওয়ার জন্য টেক অফ করছে প্রায়। ঐ যে আগেই বলেছিলাম যে, লোক মুখে একটা মিথ চালু আছে যে, এই লঙ্কাউই একটা অভিশাপের রাজ্য হিসাবে চিহ্নিত আছে কোন এক মহিলার দ্বারা। ডঃ মহাতির এই কন্সেপ্টটাকে ঢেকে দেওয়ার জন্য আর এই শহরটাকে পর্যটকসমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে এই ইগল ভাস্কর্য এবং অন্যান্য সুন্দর সুন্দর জিনিস তৈরি করে ফেলেন। চারিদিকে বিশাল খোলা জায়গা। আশেপাশে একটা জেটি আছে। এটা জেটি পয়েন্ট নামে পরিচিত। বৃষ্টি হচ্ছিল, কিন্তু তারপরেও বের হয়ে গেলাম স্কয়ারটা দেখার জন্য। বেশ সুন্দর। আসলে মালয়েশিয়ায় সব কিছু অত্যন্ত প্ল্যান করে সব কিছু করা হয়েছে আর এটা করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। কোন কিছুর কমতি নাই। অনেক রাত হয়ে গেল ফিরতে ফিরতে। আগামিকাল আবার যেতে হবে পেনাং আইল্যান্ডে। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি আমরা বিছানায় যেতে চাইলেও পারা গেল না। কারন আবারো মার্কেটিং। অনেক রাত অবধি কেনা কাটায় ব্যাস্ত হয়ে গেল আমার পরিবার। অনেক পদের গিফট আইটেমের মার্কেটিং। ভাগ্যিস সঙ্গে ভিসা কার্ড ছিল। তা না হলে যে কি হত আল্লাহ মালুম। আমার পরিবার তো ধরেই নিয়েছে বিশ্বব্যাংক সঙ্গে আছে, মার্কেটিং এ কোন সমস্যা নাই। আমার কাছে তাই মনে হচ্ছিল আর কি। রাত ২ টা পর্যন্ত যে যেভাবে পারে তাদের পছন্দ মত মার্কেটিং করল, আর আমার পায়ের অবস্থাটা এমন মনে হচ্ছিল যে, “আর পারছি না ভাই, এবারের মত মাফ কর” অবস্থা। সঙ্গে সিগারেট ছিল বলে রক্ষা, অন্তত সিগারেট খেয়ে হলেও কিছুটা সময় কাটাতে পারছিলাম আর আমার পরিবারের পিছন পিছন ওদের মার্কেটিং দেখছিলাম।
পরের দিন সকাল, পেনাং বিমান বন্দর। খুব সুন্দর একটা বিমান বন্দর। বেশ গোছালো। গাড়ীখানা হ্যান্ডওভার করে আমরা আবারও পেনাং আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে বিমানে উঠে গেলাম। পেনাং শহরটির নামকরন আসলে হয়েছে সম্ভবত পেং লাং উ থেকে যার অর্থ হচ্ছে সুপারির আইল্যান্ড। এটা এক সময় যখন ব্রিটিশরা ইন্ডিয়ায় রাজত্ব করছিল, তখন এটা তাদের অধিনে ছিল। পরবর্তীতে এটা সরাসরি ব্রিটিশদের অধিনে চলে যায়। সেথেকে ব্রিটিশরা চলে যাবার পরও এরা সায়ত্তশাসিতই থেকে যায় যদিও এটা এখন মালয়েশিয়ার অধিনে। এই অঞ্চলটা আসলে টিন এবং রাবারের জন্য বিখ্যাত। ১ম এবং ২য় বিশ্ব যুদ্ধে এই পেনাং এর উপর অনেক বড় বড় অপারেশন হয়েছে। জাপান যখন যুদ্ধে জরিয়ে পরেছিল, তখন তারা এই পেনাং এর পোতাশ্রয়গুলো অনেক ব্যবহার করত। আর এই কারনে ব্রিটিশ বাহিনি বারবারই এই পেনাং পোতাশ্রয়ে ঘনঘন আক্রমন চালায়। জাপানিজরা এই অঞ্চল ত্যাগ করার সময় তা ব্রিটিশরা দখল করে নেয়। পেনাং জেটি হল সেই বিখ্যাত পোতাশ্রয়। ব্রিটিশরা চলে যাবার পর এটা মালয়েশিয়ার অঙ্গরাজ্য হয়ে যায়। যাক ইতিহাস বলে লাভ নেই। আমার ভ্রমন এর অন্যান্য দিকগুলো বলি।
আমার ছোট মেয়ে সব জায়গায়তেই আনন্দ করছিল কিন্তু একমাত্র বিমান জার্নি ছাড়া। প্লেনে উঠতে হবে এই কথা মনে হলেই তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তারপরেও সে চেষ্টা করছিল স্বাভাবিক থাকতে। কিন্তু তার মুখ, চোখ দেখে বুঝা যায় সে প্লেন জার্নিতে মজা পাচ্ছে না। আমরা প্রায় সকাল ১১ তার দিকে পেনাং আইল্যান্ডে পৌঁছে গেলাম। অদ্ভুত সুন্দর একটা শহর। চারিদিকে পাহাড়, আর সাগরের পাশ দিয়ে রাস্তাগুলো সাংঘাতিক সুন্দর একে বেকে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে। খুবই এক্সপেন্সিভ একটা শহর। তারপরেও দেখার মত। এই শহরটা স্বায়ত্তশাসিত। মালয়েশিয়াতে দুইটা শহর স্বায়ত্ত শাসিত। এক পেনাং আরেকটা হচ্ছে মেলাক্কা।
এখানে দেখার মত অনেক কিছু আছে। তার মধ্যে পেনাং-হিল হচ্ছে একটা। এই পেনাং হিলে উঠতে প্রায় কিছু কিছু জায়গায় একেবারে ৯০ ডিগ্রি খাঁড়া উঠতে হয়। কোথাও কোথাও ১০২ ডিগ্রি পর্যন্ত বাক আছে। ১৯০৬ থেকে ১৯২৩ সাল লেগেছে এই সিস্টেমটা চালু করতে। আর তারপর ১৯২৩ সাল থেকে এই পেনাং হিলে উঠার প্রচলন রয়েছে। ট্রেনের মাধ্যমে উঠতে হয়। দেখার মত একটা ব্যাপার। প্রায় এক হাজার মিটার এর চেয়েও বেশি উচু। উঠতে মোট ১০-১৫ মিনিট সময় লাগে। একটি ট্রেনে প্রায় ১০০ জন লোক উঠতে পারে। আমার খুব কৌতূহল হয়েছিল কি করে এই কাজটা তারা করল? এত খাঁড়া এবং এত উচু একটা ট্রেন কিসের বলে উঠে যাচ্ছে আসলে? পরে জানলাম যে এটা একটা সায়েন্টিফিক ফর্মুলা। যাকে বলে “ফানিকুলার ট্রেন”। ফানিকুলার ট্রেনটা আসলে কি তাহলে?
The basic idea of funicular operation is that two cars are always attached to each other by a cable, which runs through a pulley at the top of the slope. Counterbalancing of the two cars, with one going up and one going down, minimizes the energy needed to lift the car going up. Winching is normally done by an electric drive that turns the pulley. Sheave wheels guide the cable to and from the drive mechanism and the slope cars.
চুরায় উঠে আমার মনটাই ভরে গেল। ওখানে একটা মসজিদ আছে, মন্দির আছে, অনেক লোকজন ওখানে বসবাস করে। ওদের কোন এসি লাগে না, ফ্যানও লাগে না। পুরু মালয়েশিয়া দেখা যায় ঐ পেনাং হিল থেকে। পেনাং হিলটা “এয়ার আইটাম (Air Itam) এলাকায় অবস্থিত। Air Itam মানে হল কাল পানি। কেন এটার নাম কাল পানি হল তা আমি জানার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু লোকাল লোকজন খুব একটা বলতে পারেনি।
চুরায় উঠে আমি এক ইন্ডিয়ান মালয়কে পেলাম যিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে আইসক্রিম বিক্রি করে। দুই রিঙ্গিত দাম এক একটা কোন/কাপ আইস্ক্রিমের। বেশ স্মার্ট ছেলে। তার একটা ছেলে আছে, স্কুলে যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, কিভাবে ওরা স্কুলে যায়? ওদের জন্য সরকার একটা ভাল ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই ফানিকুলার ট্রেন দিয়ে বাচ্চারা কাছের একটাই স্কুল, সেখানে যেতে পারে, এতে মাসিক একটা ভারা বলে দেওয়া আছে। আর অন্যান্য কাজের জন্য ওরা সরু একটা কংক্রিটের রাস্তা আছে, ওটা দিয়ে শুধুমাত্র গুটিকয়েক রেসিডেন্ট যারা ওখানে বসবাস করে তারাই আসা যাওয়া করতে পারে, কোন টুরিস্ট ঐ রাস্তা ব্যবহার করতে পারে না। ঐ রাস্তা তৈরির আরও একটা কারন আমি মনে করি তা হল, কোন কারনে যদি ইমারজেন্সি যাতায়ত করতে হয়, তাহলে সরকার বাহিনির রেস্কিউ পার্টি ঐ পথ ব্যবহার করতে পারবে।
পেনাং হিল থেকে বেরিয়ে গেলাম এবং হোটেলে চলে এলাম। আসতে আসতে দেখলাম আমাদের হোটেলের ঠিক সামনে অসংখ্য দোকান বসেছে যারা রাত ১ টা পর্যন্ত থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এদের অধিকাংশ ই হচ্ছে বাঙালি। অনেক কথা হল বাঙালি ভাইদের সাথে। অনেক কষ্টের কথা আবার অনেকের সাফল্যের কথা। আমরা সবাই মিলে প্রায় রাত ১ টা পর্যন্তই ওখানে বিভিন্ন প্রকারের শপিং করলাম। শপিং শেষে হোটেলে ফিরে এসে আবারো ব্যাগ গুছায়ে সবাই শুয়ে পরলাম, কারন পরদিন আবার কুয়ালালামপুর যেতে হবে। এবার আর প্লেনে নয়। আমার মেয়ে এয়ার এশিয়া হারিয়ে যাবার পর থেকে সে আর প্লেনেই উঠতে চাচ্ছিল না। অগত্যা আমরা প্লেন টিকিট বাতিল করে বাসে আসার প্ল্যান করলাম। ডাবল ডেকার বাস। বাস ছাড়ার কথা সকাল ১১৩০ মিনিটে আর সেই বাস ছাড়ল গিয়ে দুপুর ২ টায়। সবচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার হল, যার যার মাল সে সে লোড করতে হয় এবং কোন টিকিট (লাগেজ টিকিট) দেয়া হয় না। কুয়ালালামপুর পৌঁছানোর কথা বিকাল ৫ টার মধ্যে আর সেই বাস পৌঁছল গিয়ে রাত ১০টায়। মাঝে আবার কোন খাবারের বিরতিও নাই। বাস জার্নিটা ভাল হয় নাই আসলে। বিরক্তি লাগছিল এত লম্বা একটা সময় বসে থাকতে।
ঐ দিন আর আমরা কোথাও বের হই নাই। কারন এক দিকে বৃষ্টি হচ্ছিল আবার রাতও হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং পরেরদিন ২৯ তারিখ ছিল গিয়ে আমাদের আসম শপিং এর দিন। সারাদিন আমার পরিবার এই মার্কেট, ঐ মার্কেট ঘুরে ঘুরে হরেক রকমের গিফট আইটেম কিনছে। ব্যাপারটা এমন যেন আমরা অন্য কারো জন্য মার্কেটিং করতে এসেছি। আমার ছোট মেয়ের আগে থেকেই বায়না ছিল সে একটা ট্যাবলেট কিনবে। এবং কোন কনফিগারেশনের ট্যাবলেট কিনবে তাও সে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল। সারাদিন ঘুরলাম, এর পরেরদিন ছিল ৩০ ডিসেম্বর। মানে আমাদের টুইন টাওয়ার ভিজিটের দিন। ডঃ মহাতির তার ২২ বছরের শাসনামলে সে মালয়েশিয়ার জন্য যা করে গেছে, এই অকল্পনীয় কাজ আর কেউ করতে পারবে কিনা আমার জানা নাই। সম্ভবত এই টুইন টাওয়ারের জন্যই সারা বিশ্ব বারবার মালয়েসিয়াকে স্মরণ করবে। ১৯৮১ থেকে মালয়েশিয়া নতুন এক মালয়েশিয়া হিসাবে ২০০৩ পূর্ণ সুন্দররুপ পেয়েছে। ব্যাক্তি মহাতির তার পারিবারিক জিবনে কত টুকুন সার্থক টা আমার জানা নাই তবে দেশের একজন নেতা হিসাবে তাকে আজিবন স্যালুট না করে কোন মালয়েসিয়ানকে উপায় নেই। কোন একটা কাজও সে অপূর্ণ রাখে নাই। সব কিছু করে দিয়ে তারপর সে নিজ ইচ্ছায় প্রধান মন্ত্রী থেকে বিদায় নিয়েছে। সারা বিশ্ব তার এই ক্ষমতা হস্তান্তরের পালা টা দেখেছে। যে দেশে এই মহাতিররা জন্ম নেয়, সেদেশ ধন্য।
এবার এই ভদ্র লোক সম্পর্কে আমি কিছু বলি। আমার দুইজন বিশিষ্ট পছন্দের ব্যাক্তিদের মধ্যে মহাতির একজন। তিনি আসলে জন্ম গ্রহন করেছিলেন কেদাহ শহরের আলোর সেতার নামে এক গ্রামে ১৯২৫ সালে। তিনি মালয়েশিয়ার ৪র্থ প্রেসিডেন্ট। মোট ২২ বছর তিনি রাজত্ব করে সেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে বের হয়ে যান যার ক্ষমতা হস্তান্তর লাইভ টেলিকাস্ট করেছিল সমস্ত বিশ্ব ২০০৩ সালে। তার বাবা ছিলেন একজন শিক্ষিক। তিনি বাস্তব জিবনে ছিলেন ডাক্তার এবং আর্মির ডাক্তার। ওনার প্রথম জিবনে তিনি যখন রাজনিতিতে প্রবেশ করেন, তখন কয়েকটা বই লিখে সাং ঘাতিক বিতর্কিত হয়ে যান এবং তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান তার সব গুলো বই ব্যান্ড করে দিয়ে রাজনিতিতে তাকে নিষিদ্ধ ঘসনা করেন। ১৯৭০ সালে মিঃ রাজ্জাক প্রধান মন্ত্রী হলে পুন্রায় তিনি মহাতির কে পার্টি তে নিয়ে নেন। এর পর সম্ভবত ১৯৮১ সালে থেকে তিনি কোন প্রতিযোগিতা ছারাই পর পর ৫ বার প্রেসিডেন্ট নিরবাচিত হয়েছিলেন যেটা একটা ইতিহাস। তার প্রথম ইলেকসনে তিনি তদানিন্তর প্রেসিডেন্ট হোসেন কে মাত্র ৫০ ভোটের ও কমে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট হন। প্রকৃত পক্ষে এই বিজয়টা কোর্ট করত্রিক ফয়সালা হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট হবার পর, তার ৯ম দিনে একটা দারুন কাজ করে ফেললেন। নতুন একটা পার্টি ফর্ম করে ফেললেন যার কোন ম্যান্ডেট পাব্লিকের কাছ থেকে ছিল না। তার নতুন পার্টি র নাম হল, ইউএনএমও (বারু)। তার প্রথম কয়েকটা কাজের মধ্যে একটা ছিল, সব সরকারি সংস্থা গুলোকে তিনি প্রাইভেট সেক্টরে হস্তান্তর করেন এবং এতে দারুন ফলাফল আসে। ১৯৯০ সালের মধ্যে মালয়েশিয়ার পার ক্যাপিটা ইনকাম প্রায় ডাবল হয়ে যায়। মহাতির কে প্রধানত আমেরিকা এবং ব্রিটিশ রা একেবারেই পছন্দ করছিল না, ফলে নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রকায় তার নামে অনেক নেগেটিভ মন্তব্য করার কারনে তিনি সারা দেশে এই দুইট পত্রিকা সারা জিবনের জন্য ব্যান্ড করে দেন। তার ভিসন-২০২০ এর মধ্যে প্রথম তিনটা ফরমুলার কথা বলি।
(১) মহাতির তার প্রথম ক্ষমতার সময় যত সংখ্যক লোক তিনি পেরেছিলেন, বাইরে পাঠিয়েছেন উচ্ছ শিক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশে এই সর্তে যে, ঐ লোকগুলো পরবর্তীতে মালয়েশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে লোকাল মালয়েসিয়ান্দেরকে পরাবেন এবং ফারদার কোন লোক আর বিদেশ পাঠানো হবে না। ফলে যদি তোমরা খেয়াল কর দেখবা, ১৯৯০ দসকে অনেক মালয়েসিন রা আমাদের দেশেও এসেছিল উচ্চ শিক্ষা নিতে যেটা এখন অনেক কম রেসিও তে আছে এখন।
(২) তার এই প্ল্যানের পাশাপাশি তিনি যে কাজটা করলেন তা হল, দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার কাজ। তিনি মালয়েশিয়ার প্রতিটি আনাচে কানাচে, দোকানে, মাঠে ঘাটে, বাজারে, স্যালুনে, বাসে, ট্রেনে, বাসার অয়ালে অয়ালে, সর্বত্র একটা শ্লোগান লিখে রাখতে হবে যে, “আমি মালয়েশিয়ান, আমি মালয়েশিয়ান”। এটা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার জন্য প্রযোজ্য যে যে যেই ধর্মেরই হক, সে শুধু মালয়েশিয়ান। সবার কানে কানে, মনে প্রানে, দিলে হৃদয়ে শুধু “আমি মালয়েশিয়ান” এই কথাটা মনে রাখতে বললেন।
একে বলে জিকিরের মত দেশ প্রেমের ছবক। ঐ সময় ই অনি বললেন, দেশের অর্ধেক লোক বিশেষ করে মহিলারা কাজ না করার কারনে ওরা বাকি অর্ধেক লকের রোজগারের উপর নির্ভরশীল এবং এটা তিনি বুঝাতে সক্ষম হলেন যে মহিলারা কাজ করলে সংসার এবং ব্যাক্তিগত জিবনে ও সচ্ছলতা আসবে। ফলে সর্বত্র যেমন অপারেটর হিসাবে, দোকানি হিসাবে বা সেলস গার্ল হিসাবে, গ্যাস ষ্টেশনে, ক্লিনার, মানে যেখানে যেখানে মেয়েরা কাজ করতে পারে সর্বত্র ওদের অগ্রাধিকার দেয়া হল। একটা রেভুলিসনের মত শুরু হয়ে গেল পুরু ব্যাপারটা। মালয়েশিয়ানরা ও পছন্দ করলেন।
(৩) কিন্তু তিনি আরেকটা জিনিষ নিশ্চিত করতে চাইলেন যে, প্রতিটি হোটেল, দোকান, বাস, বাজার সর্বত্র আরেক টা শ্লোগান লিখার জন্য বাধ্য করলে, ” We will not talk about three things in public place: Woman, Politics and Religion” যে কেউ এই গুলো নিয়ে আলাপ করবে পাব লিক প্লেসে, তার শাস্তি হবে।
বাইরে থেকে যত পদের ইনভেস্টর আছে সবার জন্য দ্বার উম্মুক্ত করে দিলেন।
মহাতির মোহাম্মাদ মালয়েশিয়ার যত পদের করাপসন ছিল সেগুলোর মধ্যে থেকেই তিনি নিজে ডেভেলপ মেন্টের কাজগুলো করিয়ে নিয়েছেন। তার নামে যে খালি ভাল ভাল খবর আছে তা কিন্তু নয়। তার নামে অনেক বিপদ জনক তথ্যও আছে। যেমন, সবাই মনে করে তার পরিবারের কাছে ৩ বিলিওন রিঙ্গিত পরিমান সম্পদ গচ্ছিত আছে। তার তিন ছেলে প্রায় ২০০ টি কোম্পানির মালিক যেখান থেকে তারা প্রায় বছরে কয়েক বিলিওন রিঙ্গিত কামাই করে। তার ২য় ছেলে একাই প্রায় আরাই বিলিওন রিঙ্গিতের মালিক।
শুধু এখানেই শেষ ছিল না। তার প্রথম ৯ দিনের মাথায় তিনি যে পার্টি টা ফর্ম করেছিলেন, সেটা কোর্টের কাছে তার পক্ষে রায় টা হয়ত যাচ্ছিল না। মহাতির এই একটা জায়গায় দারুল বোল্ড এক সনে গেলেন, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচার পতিকে এবং পুরান সব জাদ্রেল রাজিনিতি বিদ যারা তার পার্টিতে ছিল সব গুলোকে বহিস্কার করে দিলেন। বিতর্কিত হয়ে গেলেন মহাতির। কিন্তু দমে জায় নাই ব্যাটা। তার সবচেয়ে ট্রাম কার্ড টা ছিল, ১৯৯৭ সালে যখন এশিয়ায় অর্থনৈতিক মন্দার সুচনা হল, মহাতির তখন এমন একখান চাল দিলে যে, মালয়েশিয়ার অর্থনিতিতে এশিয়ার কোন মন্দা ভাব পরল না। তিনি যে কাজটা করেছিলেন তা হচ্ছে ডলার রেট ফ্লাকচুয়েট করা যাবে না, স্থিতি থাকতে হবে। আইএমএফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক এটাকে নিন্দা করলেও পরে তারা বুঝেছিল মহাতির ঠিক ছিল। মালয়েশিয়া ঠিক এই সময়টায় ই উত্থান করল। পাব লিক তাকে তার সব প্লান কে ধরে নিল মহাতির যা করছে ঠিক করছে।
এর পরেও অনেক স্ক্যান্ডেল আছে মহাতির সম্পর্কে, যা শুনলে অনেকের ই ভাল লাগবে না। সে যত টা ভাল মানুসের মত কাজ করেছে, তার ভিতরে ও অনেক সেলফিস ইচ্ছা টা ও ছিল। বিশেষ করে তার ডেপুটি আনোয়ার এর ব্যাপারে। তাকে নারি কেলেংকারিতে পাওয়ার থেকে নামান হয়েছিল যা প্রকৃত পক্ষে সত্য ছিল না। এটা ইন্দনেশিরার সুহার্থ কে দেখে তার এই ভয় টা আসলে হয়েছিল যে ডেপুটি তাকে হয়ত তার পাওয়ার থেকে বিতারিত করতে পারে, তাই আনয়ারকেই বিতারিত হতে হয়েছিল।
তার শেষ টেনিউরটা আরও ১৮ মাস ছিল, ওনি ইচ্ছে করলে থাকে পারতেন কিন্তু তিনি তা আর করতে চান নাই। কেউ কেউ বলে যে, এটাও একটা রাজনিতির দর্শন। For many younger voters, Mahathir was like a voice from another generation. For many non-Malays, he was the leader of the right-wing brigade and a reminder of all the excesses of the Mahathir era.
যাক এ নিয়ে পরে আরও বিস্তারিত আলাপ করা যাবে।
অনেকক্ষণ বসে ছিলাম এই টুইন টাওয়ারের পাশে। বড় ভাল লাগছিল।
আজ ৩০ তারিখেই আবার ব্যাক করতে হবে। এখন ও আমার দোস্ত নওরোজের বাসায় যাওয়া হয় নাই। বিকাল ৭ টায় ফ্লাইট। এখন বাজে প্রায় বিকাল ২ টা। নওরোজের বাসা সেন্টুলে, যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ইন্সট্রাকশন নওরোজ ফোনে আমাকে দিয়ে দিয়েছে এবং আরও সহজ করার জন্য মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের আগেই কিভাবে বোর্ডিং করে নিতে হয় এয়ারপোর্টে না গিয়ে, সেই বুদ্ধিটাও ও আমাকে দিয়ে দিয়েছে। ফলে অনেক কাজ সহজ হয়ে গিয়েছে।
আমরা বিকালের মধ্যেই আমাদের সব লাগেজ পত্র মালয়েশিয়ান এয়ার লাইন্সে দিয়ে নওরোজের বাসায় গেলাম। নওরোজই আমাদেরকে কেএলসিটি থেকে নিয়ে গেল।
আমি নওরোজের অপেক্ষায় কে এল সিটির লবিতে অপেক্ষা করছিলাম। আর দেখছিলাম কখন আমার বন্ধুটি আসে। নও রোজ ও মনে হয় আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য একটু ক্যামুফ্লাজ করার চেষ্টা করেছিল এবং খুব সন্তর্পণে লোকদের ভিরের মধ্যে দিয়ে আমার পিছন থেকে আমাকে “হাই” বলার জন্য আসতেছিল। কিন্তু নও রোজ তা আর পারে নাই কারন এর আগাএই আমি অকে দেখে ফেলেছিলাম।
নওরোজের সঙ্গে আমার আর্মির জিবনে খুব বেশি ঘনিস্টতা হয়ত বেশি ছিল না কারন ও ছিল ইনফ্যান্ট্রি তে আর আমি ছিলাম আর্টিলারিতে। তারপরেও কোর্সম্যাট হিসাবে ওর সঙ্গে আমার অন্যান্য ইনফ্যান্ট্রি বন্ধুদের থেকে অনেক বেশি ঘনিস্টতা ছিল। আমি ওকে দেখে মনে হল কত দিন পর যে একজন আপনজনকে দেখলাম। মনে হল পথ হারা শিশুর মাকে খুজে পাওয়ার মত আর কি। আমি কবি নই, বা সাহিত্যক ও নই। কিন্তু মানুষ মাঝে মাঝে ঐ ধরনের কোন একটা ভাবের মধ্যে চলে আসে। আমার ও মনে হয়েছিল, If I were a poet, I woiuld write a poem standing on the platform of KLCC regarding a feelings of meeting someone who has the same pulse and nurves of my mind and heart. অনেক বাঙালি দেখেছি, অনেক বন্ধুদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, কিন্তু নও রোজের বাসায় যাওয়ার জন্য আমি আসলেই উদগ্রীব ছিলাম।
কিন্তু কবিতাটা লিখা হল অনেকক্ষণ কোলাকোলির ভাষায়। পরে ওকে নিয়ে ওর বাসার দিকে রয়ানা হলাম। কমুতার ট্রেন। নওরোজের বাসায় যাওয়ার উছিলায় কমুটার ট্রেনেও চড়া হল। সাংঘাতিক সময় মেইন্টেইন করে চলে এই কমুটার ট্রেন অথচ ভারা মাত্র ১ রিঙ্গিত। কাটায় কাটায় আমরা প্রায় ২৫ মিনিট থাকতে পেড়েছিলাম নওরোজের বাসায়। খুব সুন্দর একটা বাসা। আধুনিক এবং চমৎকার। বাচ্চাদের জন্য প্রিথক প্রিথক রুম, সুন্দর। খুব নিরাপদ, সব কিছুই আছে ওখানে। দেখলাম গার্ড আমার বন্ধুকে খুব ভাল করেই স্যালুত করে আমাদের সবাইকে সাদন সম্ভাসন জানাও। খুব ভাল একটা সময় কেটেছে নওরোজের বাসায়। অদ্ভুত একটা ফিলিংস হয়েছিল আমার। অনেক বছরের বন্ধুত্ব। খুব কাছের না হয়ে কি পারে? অনেক দিন পর বাংলাদেশি স্টাইলে ডাল খেলাম, ভাত খেলা, দেশি মুরগি খেলাম, অদ্ভুত পাক করেছিল নওরোজ ভাবি। আর সবচেয়ে ভাল লাগছিল এই জন্যে যে, ওরা খুব ভাল আছে মালয়েশিয়ায়। যে কারনে দেশ ছেড়ে এত দূর যাওয়া, সেটাই যদি না হয় তাহলে কষ্টের আর সীমা থাকে না। ওদের বেলায় এটা ঘটে নাই, ওরা ভাল আছে এটাই সবচেয়ে ভাল লাগলো। নওরোজ ভাবি আর নওরোজ আমাদেরকে কে এল সিটি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। মনে হল খুব একজন আপনজনকে ছেড়ে যাচ্ছি। আমার প্রায়ই ঐ পোস্টমাস্টার গল্পটা মনে পরছিল, আমরা কমুটার ট্রেনে উঠে গেছি, নওরোজ আর নওরোজ ভাবি কে এল সিটি তে একা বসে আছে, মনে হল আরও একদিন থেকে যাই। অনেক গল্প করতে পারব, একটু আড্ডা মারতে পারব। কিন্তু আমার তো টিকেট করা হয়ে গেয়েছে। চেঞ্জ করার সময়ও পেরিয়ে গেছে। দেখলাম, আমাদের কমুটার ট্রেনটা অনেক স্পিডে সামনের দিকে শত শত যাত্রি নিয়ে কুয়ালালামপুর এয়ার পোর্টের দিকে দ্রুত গতিতে চলছে। তার সময় মত পৌছাতে হবে, তা না হলে মালয়েশিয়ান এয়ার লাইন্সের অনেক যাত্রি ও আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। কারন আমাদের বোর্ডিং পাশ তো আমাদের হাতে। আমরা না গেলে তো প্লেনটাও ছারতে পারবে না। আর অনেক বেশি দেরি হয়ে গেলে হয়ত আমরাও প্লেনে করে দেশে ফিরে আসতে পারব না। সময় বড় আজব জিনিষ। সময় কারো জন্য কখনো অপেক্ষা করে না, সে তমার সঙ্গে থাকবে অতক্ষণ যতক্ষন তুমি তার সঙ্গে আছ। টা না হলে সে একাই চলতে থাকে, তার কোন সঙ্গির প্রয়োজন নাই।
ওর ছেলেমেয়রা অনেক বাস্তববাদি হয়ে উঠেছে। নিজেদের কাজ ওরা নিজেরাই করে এবং সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে যে, ওরা এখন বুঝতে পারে পরিবার কি জিনিষ। এই জিনিসটা আমরা এখনও আমাদের বাচ্চাদেরকে শিখাতে পারি নাই যা ওরা শুধুমাত্র বিদেশে থাকার কারনে জানে, কোনটা নিজেদের কাজ আর কোন কাজটায় বাবা মা কে সাহায্য করার দরকার। ওরা খুব ভাল ভাবে গরে উঠছে। কত টাকার মাইনে পাবে কিংবা কোথায় কত বড় অফিসার হবে সে ভবিষ্যৎ আমাদের কারোই জানা নাই কিন্তু যারা বাস্তবকে চিন্তে শিখছে তাদের কোথাও কোন সমস্যা হবার কথা নয়। ওর বাচ্চারা ঠিক সেভাবেই বড় হচ্ছে। ওরা আসলে একদিন অনেক বড় হবে ইনশাল্লাহ। আমি কুয়ালালামপুর এসে নামাজ পরে সবার জন্য দোয়া করেছি এবং বাই নেম আমি অর পরিবারের জন্য এবং যারা ঐ কুয়ালালামপুরে আছে, সবার জন্য আল্লার কাছে দোয়া করেছি। আল্লাহ আমার দয়া নিশ্চয় কবুল করবেন।
তারপরের কাহিনি তো বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট। এতা আর নাই বা বললাম। যেখানে সর এয়ারপোর্টে আমরা পৌছার আগেই বেল্টে মাল চলে এসেছিল, সেখানে আমরা বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে এসে প্রায় আড়াই ঘন্টা অপেক্ষার পর ও বেল্টে মাল পাই নাই। কাকে বলব এই ব্যর্থতার কাহিনি? এটা আমার জন্মভুমি বাংলাদেশ। এখানে মানুষ আছে, মনুষ্যত্ব নেই, অফিসার আছে, দায়িত্ত জ্ঞ্যান নেই, স কিছু আছে এখানে, কিন্তু নাই শুধু ভাল হবার লক্ষন। আমরা সবাই বলি, ক্যান দেশটা ভাল হচ্ছে না? কিন্তু আমি ভাল হতে হবে এই কথাটাই কেউ বলে না।তারপরেও এই দেশ টা আমার এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের।
কাস্টম অফিসার প্যাসেঞ্জার দেখলে তার পকেট চুল্কায়, পুলিস অফিসারের দায়িত্ত যেন অনেক বেরে যায় যাতে বেশি বেশি তার ইউনিফরমের পকেত ফুলে উঠে। কিন্তু ওরা জানে না কোন একদিন এই সব অপকরমের হিসাব দিতে হবে নিজকে একা। ডুবন্ত টাইটানিকের পাশে দারিয়ে যে লোক ঘুস খেতে চায়, ও ঐ ডলার নিয়ে মরে কিন্তু ঐ ডলারে কোন কাজ আর হয় না।
৯/০৪/২০১৫- ওমরা
Categories
গত ২৬ মার্চ ২০১৫ তারিখে আল্লাহর নাম নিয়ে আমি আর আমার স্ত্রীকে নিয়ে ওমরা করার জন্য সরাসরি প্রথমে মদিনা এবং পড়ে মক্কা শরিফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলাম। যদিও আমরা ২০০৬ সালে হজ্জ করেছিলাম, তখন প্রথমবার হজ্জ করার কারনে অনেক কিছু দেখার সুযোগ হয় নাই কারন হজ্জের অনেক ফরমালিটিজ থাকে যা পালন করতে গিয়ে ইসলামের অনেক আনুষঙ্গিক ব্যাপারগুলো দেখার বা মনোসংযোগ করার সময় থাকে না বা আমি নিজে পাইনি। এবার নিয়ত করেছিলাম যে, আমি ওমরার পাশাপাশি আরও বেশি কিছু দেখবো এবং ওগুলো নিয়ে পরাশুনা করব।আল্লাহ অনেক সহায়তা করেছেন এবং মন ভরে তা করতে পেরেছি। আলহামদুলিল্লাহ।
নবী করিম (সঃ) এর নামে দরূদ শরিফ পড়লে কি হয় তা আমি জানতাম। যেমন, আবু বকর (রাঃ) বলেছেন যে, দরূদ শরীফ পড়লে পানি যেমন আগুনকে ক্রমাগত দুর্বল করতে করতে এক সময় আগুনকে নিভিয়ে দেয়, ঠিক তেমনি, দরূদ শরীফ পড়লে আমাদের পাপেরও তা ক্রমাগত মুছন শুরু হয়। যতবার এই দরূদ শরীফ পড়া হবে ততবার আমাদের পাপের বিরুদ্ধে এই দরূদ শরীফ পাপ মুছনের কাজ করতে থাকে। তাই বেশি বেশি করে দরূদ শরীফ পড়তে হবে। এটা একটা দাসকে মুক্ত করার চেয়েও বেশি সম্মানিত আল্লাহর কাছে। আরেকটা হাদিসে আছে যে, শুক্রবার দিন দরূদ শরীফ পড়ার আরও কিছু বেশি লাভ আছে। আর তা হচ্ছে, বেহেশত থেকে কিছু ফেরেশতার উপর এই নির্দেশ দেয়া আছে যে, যারা যারা আমাদের নবীর নামে দরূদ শরীফ পরবেন, তাদের নাম সোনার কলমে সিলভারের কাগজের উপর তারা লিখে রাখবেন এবং তা আল্লাহর কাছে পেশ করবেন। আমি আমাদের নবীর রওজা মোবারক দর্শন করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত ক্রমাগত দরূদ শরীফ পড়ে যাচ্ছিলাম। অবশেষে আমাদের নবীর রওজায় এসে পৌঁছলাম। মদিনায় তখন সন্ধ্যা। মাগ্রেবের আজান চলছে।
নবীর রওজা মোবারক।
আমাদের নবীকে আর মা আয়েশা (আঃ) এর ঘরেই শায়িত করানো হয়েছে। ওটা ছিল মা আয়েশার ঘর। এবার এটার কিছু তথ্য বলি।
আমাদের নবী যখন ওফাত হলেন, তখন অনেকেই তাঁকে জান্নাতুল বাঁকিতে কবর দেওয়ার পরামর্শ দেন, কিন্তু আবু বকর (রাঃ) বললেন যে, তিনি আমাদের নবীর কাছে শুনেছিলেন, রাসুলগন যেখানে ওফাত হন, তাঁদেরকে সেখানেই কবর দেওয়ার নির্দেশ। ফলে মা আয়েশার ঘরেই তার কবর দেওয়া হয়। নবীর ওফাত হওয়ার ২ বছর পর (সম্ভবত) আবু বকর (রাঃ) মারা যান এবং তিনি তখন তার মেয়ে (মৃত্যুর আগে) আয়েশাকে অনুরোধ করেন যেন তাঁকে নবীর পাশে কবর দেওয়া হয়। মা আয়েশা তার অনুরোধ রেখেছিলেন। মা আয়েশার ইচ্ছে ছিল যে আমাদের নবীর কবরের পাশে যেন তার কবর হয় এবং সে মোতাবেক তিনি তার কবরের স্থান নির্ধারণ করে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওমর (রাঃ) যখন এক ক্রিস্টিয়ান দ্বারা তার নাম ছিল ফিরোজ, (আবু লুলু) স্টেবড হন তার ঠিক মৃত্যুর আগে তিনি তার ছেলে আবদুল্লাহকে পাঠান মা আয়েশার কাছে এই বলে যে তাঁকে যেন আমাদের নবীর পাশে কবর দেওয়া হয়। ওমরের এই অনুরোধ তিনি রেখেছিলেন মা আয়েশার নির্ধারিত কবরটা তার জন্য ছেড়ে দিয়ে। তিনি মোহররমের ১ তারিখে মারা যান। ঠিক তার পরপরই মা আয়েশা তার ঘরের সঙ্গে সব কবরের মাঝে একটা পারটিশান দেন। কারন ওমর তার কাছে গায়েরে মোহররম ছিলেন।
এখানে একটা ঘটনার বর্ণনা দেওয়া আবশ্যক। আমাদের নবী প্রতিদিন আসর নামাজের পর সব স্ত্রীদের কাছে তাঁদের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য যেতেন। কিন্তু তার ৪র্থ স্ত্রী মা জয়নবের কাছে গেলে মা জয়নব তাঁকে তার প্রিয় মধু খেতে দিতেন। ফলে কিছুটা সময় বেশি কাটাতেন তিনি তার ঘরে। এই ব্যাপারটা মা আয়েশা এবং মা হাফসা পছন্দ করতেন না। ফলে তারা একদিন পরামর্শ করলেন যে, নবী যখন মা হাফসার ঘর থেকে তাঁদের ঘরে আসবেন, তখন তারা বলবেন যে, তার (আমাদের নবীর) মুখ থেকে ভাল গন্ধ আসছে না। এই কথা শুনে নবী বুঝতে পেরেছিলেন তাদের মনের ইচ্ছা এবং প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি আর মধু খাবেন না। এটা আল্লাহতালাহ পছন্দ করেন নি। তার ঠিক এর ফলে কোরআনে এক আয়াত নাজিল হয়েছিল যার অর্থ এই রকমঃ
O Prophet! Why holdest thou to be forbidden that which Allah has made lawful to thee? Thou seekest to please thy consorts. But Allah is Oft-Forgiving, Most Merciful. Allah has already ordained for you, (O men), the dissolution of your oaths (in some cases): and Allah is your Protector, and He is Full of Knowledge and Wisdom. —Quran, surah 66 (At-Tahrim), ayat 1-2[51]
Word spread to the small Muslim community that Muhammad’s wives were speaking sharply to him and conspiring against him. Muhammad, saddened and upset, separated from his wives for a month. ‘Umar, Hafsa’s father, scolded his daughter and also spoke to Muhammad of the matter. By the end of this time, his wives were humbled; they agreed to “speak correct and courteous words”[52] and to focus on the afterlife.[53]
চার নম্বর কবরটি এখন খালি আছে, এবং বলা হয় যে, ওখানে ইশা (আঃ) কে কবর দেওয়া হবে।
আমার দেখা এবারের কিছু জায়গার বর্ণনা দেই।
মদিনায় আমি মোট পাঁচ ছয় জায়গায় ভিজিট করেছি। তারমধ্যে ওহুদের পাহাড় যেখানে হামজা (রাঃ) শহিদ হয়েছিলেন আবু সুফিয়ানের সঙ্গে যুদ্ধ করে। ঐ যুদ্ধে মোট ৬৯ জন সাহাবা শহিদ হয়েছিলেন এবং হামজার কলিজা খেয়েছিলেন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ। মোট ৬৭ সাহাবার কবর এক জায়গায় এবং মাত্র ২ জনের কবর (একজন হামজা এবং অন্যজন আরেক সাহাবা) একটু দূরে। পুরু জায়গাটি চারিদিকে ওয়াল দিয়ে ঘেরাও করা এবং কবরগুলো শুধুমাত্র কয়েকটি পাথর দিয়ে মার্ক করা। এটা ঠিক যেখানে যুদ্ধটা হয়েছিল ওহুদের সময়, সেই জায়গায় করা হয়েছে। স্থান পরিবর্তন না করে। জায়গাটা দেখলে মন কম্পিত হয়ে উঠে। পরবর্তীতে কিন্তু আবু সুফিয়ান এবং তার স্ত্রী হিন্দ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছিলেন কিন্তু আমাদের নবীর একটা অনুরোধ ছিল হিন্দের প্রতি যে, কখনো যেনো হিন্দ তার জীবদ্দশায় আমাদের নবীর সামনে না আসেন। কারন হিন্দকে দেখলে আমাদের নবীর কষ্ট হত তার চাচা হামজার কলিজা খাওয়ার ঘটনা মনে করে।
ওইখান থেকে আরও ২০-২৫ মাইল দূরে গেলে একটা জায়গা পাওয়া যায় যার নাম হচ্ছে ওয়াদি-ই-জীন। বলা হয় যে, ঐ এলাকাটা জীনদের বসত করার জায়গা হিসাবে পরিচিত। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, ওখানে গেলে গাড়ি কোনো পাওয়ার ছাড়া এবং কোনো গিয়ার ছাড়া ব্রেক ছেড়ে দিলে প্রায় ৯০-১২০ কিমি স্পীডে পাহাড়ের আপহিলেও গাড়ি চলে। ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না। অনেকভাবে পরিক্ষা করে দেখেছি যে ব্যাপারটা সত্য। প্রায় ৭ কিমি কিংবা আরও বেশি মাইল এই ব্যাপারটা ঘটে। ওটা শুধু একদিকে ঘটে, অন্যদিকে হয় না। তাও আবার আপহিলের দিকে হয়। ব্যাপারটার মধ্যে বৈজ্ঞানিক কোন থিওরি কাজ করে কিনা আমি জানি না। তবে ব্যাপারটা নিয়ে আমি সারাক্ষনই ভেবেছি। ব্যাপারটা কি আসলেই মিরাক্যাল? সম্ভবত না। এখানে কোন বিজ্ঞানভিত্তিক লজিক থাকতে হবে। সবাই বলে, জীন গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে নিয়ে যায়। আমি যেহেতু ব্যাপারটা সুরাহা করতে পারি নাই, তাই কোন মন্তব্যও করছি না। তবে আমি দেখেছি যে, কোন পাওয়ার ছাড়া এবং গাড়ি একদম অফ করে দিয়ে নিউট্রালে রেখে গাড়ি প্রায় ৯০ থেকে ১২০ কিমি স্পীডে চলছে। এবং এটা আপহিলেই শুধু যাচ্ছে বলে মনে হয়। কিন্তু এখন আমি জানি কেন এটা হয়। এটা আসলে আপহিল নয়, আপাতত দৃষ্টিতে মনে হয় এটা আপহিল, কিন্তু আসলে এটা প্রায় ১১ ডিগ্রি ডাউনহিল। আর এ কারনেই আপাতত দৃষ্টিতে যেটা আপহিল মনে করা হচ্ছে সেটা আসলে ৭ কিমি পরিধি নিয়ে ১১ ডিগ্রি ডাউন হিল। আর এ কারনেই গাড়ি, পানির বোতল কিংবা পানি সব আপহিলে যায় বলে মনে হয়। বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য পড়ে আলাপ করা যাবে। আমি এইটার পুরু ব্যাখ্যা এখন জানি। এটা কোন জিনের কাজ নয়।
ঐখান থেকে আমরা খন্দক পাহাড়, এবং মক্কায় এসে আমাদের নবী প্রথম যেখানে মসজিদ করেন তার স্থানটি দেখলাম। ওটার নাম “তুবা” মসজিদ। ৩৫০ কিমি পথ আমাদের নবী শুধুমাত্র রাতে রাতে ভ্রমন করে মাত্র ৮ দিনে মদিনায় পৌঁছেন। এর মধ্যে আরও একটা জায়গা আমি দেখতে গিয়েছিলাম। সেটা হচ্ছে, মক্কার উদ্দেশ্যে অপারেশন করার পূর্ব মুহূর্তে আমাদের নবী কর্তৃক ব্যবহৃত অপারেশন ব্রিফিং রুমের স্থানটি। এই স্থানটি আগে আবিষ্কৃত হয়নি কিন্তু মিনায় নতুন করে স্থাপনা করতে গিয়ে পাহাড় কাটার সময় এটা আবিষ্কৃত হয়। ঘরটির কোন ছাদ নাই বর্তমানে এবং শুধু ঐতিহাসিক কারনে এটা এখন একইভাবে সংরক্ষন করা হয়েছে। একতলা একটি বাড়ীর সাইজ। এটা এখন open-roofed mosque in Muzdalifah নামে পরিচিত। প্রকৃতনাম Masharul Haram (the Sacred Grove).
খন্দকের যুদ্ধটা কেন হয়েছিল তা আমরা অনেকেই জানি। এটলিস্ট প্রমোশন পরিক্ষার আগে এই ব্যাপারে অনেকেই আমরা পড়াশুনা করতে হয়েছে। তবু একটু হিন্টস দেই।
খন্দকের যুদ্ধটাকে বলা হয় সবচেয়ে বেশি ট্যাক্টিক্স সমৃদ্ধ যুদ্ধ। এখানে ডিপ্লোম্যাসি, রিউমার, এবং ফলস তথ্য দ্বারা যুদ্ধ জয় হবার ন্যায়সঙ্গতা রয়েছে। যুদ্ধটা হয়েছিল ত্রিপক্ষ বেসিস। মানে হল এই যে, আমাদের নবী যখন ইহুদী বংশের নেতাদেরকে (বনু নাদির গোত্র) মদিনা থেকে খায়বারে বিতাড়িত করেন তখন এই নেতাগন (তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সালাম বিন আবু হুকায়েক, সালাম বিন মিশকাম, কিন্নাহ বিন আর রাবি) মক্কায় কুরাইশ বংশের বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে হাত মিলান নবীকে পরাস্ত করার জন্য। একইভাবে এই ইহুদীগন গাতাফান ট্রাইবদের কাছেও তাঁদের সাপোর্ট এর কথা জানিয়ে আমাদের নবীর বিরুদ্ধে প্রলুব্ধ করেন। তারা সবাই এক হয়ে যায়। আবু সুফিয়ান এই যুদ্ধে লিড দেন। সালমান আল ফার্সি এই প্ল্যানের (অর্থাৎ ট্রেঞ্চ) উদ্যক্তা। মদিনাকে পূর্ব পাশ থেকে ডিচের মাধ্যমে আইসোলেট করা হয়, ডিচের মাধ্যমে শত্রু পক্ষের পানির সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়া হয়।
মদিনা তখন মহিলাদের দ্বারা নিরাপত্তা দেওয়া হয়। যুদ্ধে যারা অংশ নেয় তারা হচ্ছেন, বনু নাদির, বনু ঘাতাফান, বনু সুলাইমান, বনু মোররা, বনু সুজা, বনু খোজা ইত্যাদি। বনু কোরায়জা যদিও শত্রু পক্ষের লোক ছিল কিন্তু তারা ইসলামের প্রতি কিছুটা ঝোঁক ছিল বিধায় তারা আমাদের নবীকে সাপোর্ট করেছিলেন। তাছাড়া বনু কোরায়জার সাথে আমাদের নবীর একটা গোপন প্যাক্টও হয়েছিল যে তারা আমাদের নবীকে সাপোর্ট দেবেন। আর এই দলটি ছিল মদিনার ভিতরে একেবারে ডিফেন্সিভ লাইনের ভিতরে। মদিনার রক্ষার জন্য এরাও একটা অংশ পাহাড়া দিচ্ছিল।
এখানে আমাদের নবী আগে থেকেই একটা জিনিষ আল্লাহ তাঁকে জ্ঞ্যান দিয়েছিলেন যে, মদিনায় যে সময় শস্য হয় তার আগেই তিনি লাগিয়েছিলেন যেন, শত্রু পক্ষ মদিনায় এসে কোন খাবার না পায়। সব শস্য ইতিমধ্যে মদিনাবাসি ঘরে তুলে ফেলেছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে কোরায়েশরা যখন তাঁদের ঘোড়ার কোন খাবার যোগাড় করতে পারছিলেন না এবং ঘোড়াগুলো খাবার না পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছিল, তখন এই ডিচ কোরায়েশ বংশের আমর বিন উদ (যাকে একাই ১০০ সৈনিকের শক্তির সমান মনে করা হত) একমাত্র কোনভাবে ঐ খন্দক অতিক্রম করেন কিন্তু তিনি ল্যান্ড করেন জলাভুমির মত এক জায়গায় যার নাম ছিল “সালা” পাহাড়ের পাদদেশ। যেহেতু তিনি গুটিকতক সৈনিক নিয়ে ঐ খন্দক অতিক্রম করেন, ফলে আমাদের নবীর বাহিনির সঙ্গে যুদ্ধ করার অবকাশ ছিল না। তাই, আমর বিন উদ মল্যযুদ্ধ্যের আহ্বান করেন। তখন আমাদের নবী আলিকে মল্য যুদ্ধে পাঠানোর মনঃস্থির করেন। যখন মল্যযুদ্ধ শুরু হয়, তখন এক বিশাল ধুলি ঝড়ের আবির্ভাব ঘটে এবং কে যুদ্ধে জিতছেন আর কে হারছেন বুঝা যাচ্ছিল না। হটাত করে যখন “আল্লাহু আকবার” শব্দ আসে তখন দেখা গেল হযরত আলি আমর বিন উদকে পরাস্ত করেন। আর ঠিক এই ধ্বনিতে শত্রু বাহিনী পিছু হটে যায়।
এবার শত্রু পক্ষের নজর চলে যায় এই বনু কোরায়জার দিকে যারা মদিনার ভিতরে নিরাপত্তায় লিপ্ত ছিল।। কোনভাবে যদি বনু কোরায়জাকে কনভিন্স করা যায় যে তারা আর আমাদের নবীর পক্ষে কাজ করবে না, তাহলে আবার শত্রুপক্ষ জিতে যাবে। এই ধারনা থেকে খায়বারিয়ান নেতা এবং বনু নাদিরের গোত্রের হুয়ায় ইবনে আখতাব কোরায়জার কাছে আসেন। রিউমার ছড়ানো হয় যে কোরায়জা বংশ এখন আমাদের নবীর পক্ষে নাই। আসলেও তারা নবীর বিপক্ষে কাজ শুরু করে দিয়েছিল মদিনার ভিতরে। এই খবরে আমাদের নবী শঙ্গিত হয়ে উঠেন। তার কারন হল তিনি তাঁদের উপর নির্ভর করে ঐ অংশে কোন প্রকার ডিফেন্সিভ পেরিমিটার গড়ে তুলেন নাই। চারিদিকে রিউমার ছড়িয়ে পড়ে যে, কোরায়জাররা মদিনায় আমাদের নবীর বিপক্ষে কাজ শুরু করেছেন এবং এতে মদিনাবাসি খুব বিপদের মধ্যে পড়ে যায়। এর বিপক্ষে আমাদের নবী ১০০ সাধারন আনসার এবং ৩০০ ঘোড়াবিহিন আনসার মোট ৪০০ জন আনসার মদিনায় মোতায়েন করেন যারা রাত্রে বেলায় অতি উচ্স্বরে নামাজ পরতেন যাতে এটা প্রমানিত হয় যে অনেক অনেক আনসার ইতিমধ্যে মদিনায় প্রবেশ করেছে। কিন্তু সত্য বলতে কি আমাদের আনসারগন ইতিমধ্যে তাঁদের শারীরিক কার্যক্ষমতা অনেকটা হারিয়ে ফেলছিলেন ক্রমাগত যুদ্ধের কারনে। আমাদের নবী তখন ঘাতাফানকে এইমর্মে একটা চুক্তিতে আহবান করেন যে, তারা যদি মদিনা থেকে চলে যায়, তবে মদিনায় যে পরিমান খেজুর উৎপন্ন হবে তার তিন ভাগের এক ভাগ তাদেরকে ক্ষতিপুরন দেয়া হবে। কিন্তু মদিনার নেতারা আমাদের নবীর এই শর্ত মানতে রাজি হলেন না এবং যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অটল থাকলেন। এই সময় এক অভুতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেল।
আরবের একজন নেতা যাকে সবাই খুব সমিহ করতেন এবং মানতেন তার নাম নয়াম ইবনে মাসুদ। তিনি গোপনে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে যা কেউ জানত না শত্রুপক্ষ। সবার কাছে তিনি একজন গ্রহনযোগ্য মানুষ ছিলেন। তিনি প্রথমে গেলেন বনু কোরায়জার কাছে এবং বললেন, শত্রুপক্ষ (অর্থাৎ যারা আমাদের নবীর বিপক্ষে যুদ্ধ করছেন তারা), যদি কোন কারনে হেরে যায় তাহলে বনু কোরায়জাকে মোহাম্মাদের (সঃ) কাছে ফেলে রেখেই চলে যাবে এবং সেক্ষেত্রে সব কিছু যা মোহাম্মাদ (সঃ) বলবেন তাই হবে। তখন মদিনাবাসি শুধু বনু কোরায়জাকেই শাস্তি প্রদান করবে। সুতরাং বনী কোরায়জার উচিৎ অন্যান্য বংশের নেতাদেরকে এখন বনী কোরায়জার কাছে হস্টেজ হিসাবে রাখা যাতে যদি কোন কারনে তারা হেরে যায়, ঐ গোত্ররা বনী কোরায়জার লোকদের বিপদে ফেলে চলে যেতে না পারে। একইভাবে তিনি শত্রু পক্ষের লোকদেরকেও এই বলে খবর দিলেন যে, বনী কোরায়জার লোকজন তাঁদের কিছু গোত্র নেতাদেরকে তাদের নিরাপত্তার জন্য হস্টেজ হিসাবে চাইতে পারে এবং না দিলে তারা মদিনার সাপোর্ট হিসাবেই থাকবে। এই তথ্য কাজে লাগলো, যদিও কোন তথ্যই সত্য নয়। এই দিকে আমাদের আনসারগন ধিরে ধিরে বনু কোরায়জার দলকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলল। ইতিহাস বলে যে, বনু কোরায়জাকে আমাদের দল প্রায় ২৫ দিন ঘিরে রেখেছিল এবং শেষমেশ তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় এবং শত্রুপক্ষের জন্য আর কাজ করে নাই। কিন্তু চুক্তি ভাঙ্গার কারনে বনু কোরায়েজের নেতাদেরকে হত্যা করা হয় এবং মহিলা ও শিশুদেরকে দাস হিসাবে গ্রহন করা হয়।
যাক সে ইতিহাস। সবাই আমরা তা জানি। এখন আর নাই বা বললাম আর।
তারপর আরাফায় গিয়েছিলাম। অবাক হওয়ার মত ব্যাপার যে, আমাদের নবী যেখান থেকে তার বিদায়ী ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটা একটা উচ্চ পাহাড় আর নাম হচ্ছে জাবালে রাহমাহ। অর্থাৎ রহমতের পাহাড়। প্রথমবার হজ্জের সময় আমার এই জায়গাটা দেখার সুযোগ হয় নাই কারন অনেক ভীড় ছিল এবং আমি আরাফার দিন যেখানে ছিলাম তার থেকে এই জাবালে রাহমাহ অনেক দুরেও ছিল। এবার হেটে হেটে ঐ জাবালে রাহমাতে উঠলাম। শরির শিউরে উঠে ঐ সময়কার কথা মনে করলে। কারন আমাদের নবী ঠিক যে জায়গাটায় দাড়িয়ে এই মানব উদ্দেশ্যে তার শেষ বিদায়ি ভাষণ দিয়েছিলেন তার স্থান দেখা এবং ঐ ভাষণ সম্পর্কে ভাবা একটা অদ্ভুত শিহরণ জাগে মনে। জানা যায় যে, প্রায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়েছিল ঐ ভাষনের সময় অথচ কোন মাইক ছিল না, এরপরেও সবাই আমাদের নবীর প্রতিটি কথা স্পষ্টভাবে শুনেছিলেন। এবার ওখানে গিয়ে আরও নতুন একটা তথ্য জানলাম। নবী করিম (সঃ) এর আগমনের বহু পূর্বে প্রায় হাজার বছর পূর্বে বাদশাহ হারুনের স্ত্রী একবার এই আরাফার ময়দানে এসেছিলেন কোন এক ধর্মীয় কারনে। তখন ঐ অঞ্চলে পানির খুব অভাব ছিল। বাদশাহ হারুনের স্ত্রী যখন এই পাহাড়ে এলেন তখন ঐ এলাকার বাসিন্দারা তাঁকে পানির ব্যবস্থার কথা জানালে তিনি তার স্বামী বাদশাহ হারুনকে পানির ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। বাদশা হারুন তার স্ত্রির এই অনুরোধ রক্ষার জন্য সুদুর ইরাক থেকে পানির লাইন টেনে এনে এই এলাকায় পানির ব্যবস্থা করেন যা এখন অবধি লাইনটা রয়ে গেছে। ওটা ছিল এক বিশাল কাজ কিন্তু বাদশাহ কাজটি করেছিলেন। বিকল্প পানির ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত এই পানির সাপ্লাই জারি ছিল এবং বর্তমানে ইরাক থেকে পানি আসছে না বটে কিন্তু ঐ একই পানির লাইন সউদি সরকার ব্যবহার করে সউদি থেকেই পানির সরবরাহ করে থাকে। বলা হয় যে, এই আরাফার ময়দান নাকি হাশরের ময়দানের সঙ্গে যুক্ত একটা ময়দান। হজ্জের সময় আরাফার ময়দানে থাকা ফরজ এবং মাগ্রেব পর্যন্ত এখানে অবস্থান করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু মাগরেব নামাজ এখানে পড়া নিষেধ। এই মাগ্রেব নামাজ পরতে হয় মুজদালেফায় এশার নামাজের সঙ্গে একত্রে। আমি আমর পুরান এক মেইলে হজ্জের বিস্তারিত ব্যাখ্যা লিখেছিলাম কেন কোন রিচুয়াল কিভাবে করা হয়। এখন আর এগুলো এখন লিখছি না।
জাবালে রাহমাহ থেকে আমরা চলে গেলাম মিনায়। যেখানে শয়তানের উদ্ধেস্যে পাথর মারা হয়। আমি জায়গাটা আগেই দেখেছিলাম হজ্জের সময় কিন্তু এবার যে দুইটা জায়গা নতুন করে দেখলাম তা হচ্ছে আবাবিল পাখির দ্বারা পাথর মারার স্থানটি। আবাবিল পাখির ঘটনাটি নিশ্চয়ই আমরা সবাই জানি। তারপরেও আমি একটু পিছনের কাহিনি টানতে চাই সবার মেমোরি ফ্রেশ করার জন্য। ঘটনাটির অবতারনা ঘটে এইভাবে।
আমরা জানি আবু তালিব যদিও শেষ পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন নাই কিন্তু তিনি ইসলামের অন্যতম একজন প্রটেক্টর ছিলেন। তিনি আমাদের নবীকে সর্বত্র সাহায্য করেছেন এই ইসলাম সম্প্রসারণের জন্য। একদিন তিনি তার এই ভাতিজাকে বললেন, হে ভাতিজা, তুমি কি শুধুমাত্র আমাদের কুরাইশ বংশের জন্য প্রেরিত হয়েছ নাকি সমগ্র মানব জাতির জন্য? আমাদের নবী বললেন, আমি সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছি হোক সে সাদা, বা কালো, বলুক সে আরবি ভাষা অথবা অন্য কোন ভাষা, থাকুক সে পাহাড়ে বা সমুদ্রের নিচে, হোক সে বিধর্মী বা না কোন ধর্মের, হোক সে ধনী বা গরিব, আমি সবার জন্য প্রেরিত হয়েছি। এই কথা শুনে কুরাইশ এক সদস্য আবু তালিবকে বললেন, শুনেছ তোমার ভাতিজার কথা? যদি এখন পার্সিয়ান বা রোমের লোকজন এই কথা শুনে তাহলে তো এখনই তারা আমাদের সবকিছু ধংশ করে নিয়ে নিবে এবং তারা আমাদের এই কাবা ঘর যাকে উদ্দেশ্য করে আমাদের ব্যবসা পরিচালিত হয় তারা তা ভেঙ্গে দিবে। তখন এই সুরার আবির্ভাব হয় এবং তার ইতিহাস জানানো হয়।ইতিহাসটা এই রকমঃ
আমাদের নবীর জন্মের কিছুদিন আগে এই হাতি এবং আবাবিল পাখীর ঘটনাটি ঘটে।
ইয়েমেনের আশেপাশের এক রাজা যার নাম ছিল ঢু-নয়াজ। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বদমেজাজি এক রাজা এবং জুলুমকারী। তিনি ছিলেন ইহুদী ধর্মের। তিনি চেয়েছিলেন যে, তার রাজ্যে সব অধিবাসী যেনো ইহুদী ধর্মে দিক্ষিত হয়। আর যারা দিক্ষিত না হবে, তাদেরকে তিনি বিখন্ডিত করেন। এর মধ্যে ছোট এক বালক যার বাড়ি ছিল ইয়েমেনেরই দেশে নাজরান প্রদেশে। পিতামাতা তাঁকে যাদুবিদ্যা শিখার জন্য এই ছোট বালককে নাজরান থেকে ইয়েমেনের শহরে পাঠাতেন প্রতিদিন। পথিমধ্যে এই বালক ক্রিস্টিয়ান এক বৃদ্ধের দেখা পান যিনি খুব ভাল যাদুবিদ্যা জানতেন এবং সব ধরনের রোগ মুক্তির মন্ত্র জানতেন। ফলে ঐ বালকটি গোপনে ঐ বৃদ্ধার কাছে যাদুমন্ত্র এবং রোগমুক্তির বিদ্যা অর্জনে ক্রিস্টিয়ানিটিতে দিক্ষিত হওয়া শুরু করে। এই খবর দ্রুত সবার কাছে পৌঁছে যায়, ফলে রাজা ঢু নুঅয়াজ অতি দ্রুত ঐ বৃদ্ধাকে বিখন্ডিত করেন এবং এই ছোট বালকটিকেও বিখন্ডিত করার আয়োজন করেন। বালকটিকে বাঁধা হয় এবং তীরন্দাজ দ্বারা তাঁকে তির মারা শুরু হয় কিন্তু কোন তীরই তাঁকে স্পর্শ করতে পারছিলো না। ওখানে যতলোক জড়ো হয়েছিল, এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেল, সঙ্গে রাজা নিজেও। তখন বালকটিকে জিগ্যেস করা হল, কেন তাঁকে তীর দিয়ে মারা যাচ্ছে না। বালকটি তখন উত্তর করেছিল যে, তাঁকে মারা একমাত্র সম্ভব যদি ক্রিস্টিয়ান লর্ডের নাম ধরে তাঁকে মারা হয় এবং রাজ্যের অধিকাংশ লোক যদি তার এই তীর মারার দৃশ্য অবলোকন করে তাহলেই তাঁকে মারা সম্ভব। তার এই নির্দেশনা মোতাবেক প্রায় ২০ হাজার লোক অবলোকন করে এবং যারা যারা এই দৃশ্য অবলোকন করে তারা প্রায় সবাই এক সঙ্গে বালকটির নতুন ধর্ম ক্রিস্টিয়ানিটিতে রূপান্তরিত হয়। রাজা ঢু নুঅয়াজ ক্ষিপ্ত হয়ে ঐসব ২০ হাজার মানুষকেই একসঙ্গে গর্ত করে মেরে ফেলেন। কোরআনে এই “People of the Ditch” উপাখ্যানে একটি আয়াত আছে। এই সময় একলোক ঐ স্থান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং সে রোমের রাজার কাছে আশ্রয় চান। রোমের রাজা ছিলেন ক্রিস্টিয়ান। তিনি এই তথ্য জেনে খুব রাগান্বিত হন এই জন্য যে, শুধুমাত্র ক্রিস্টিয়ান ধর্মে দিক্ষিত হওয়ার কারনে রাজা ঢু নুঅয়াজ এতগুলো লোককে মাটিতে পুতে মেরে ফেললেন? তিনি আবিসিনিয়ার রাজাকে চিঠি (তিনিও ক্রিস্টিয়ান ছিলেন) লিখেন যাতে তিনি রোমের সঙ্গে এক হয়ে ইয়েমেনকে আক্রমন করে প্রতিশোধ নেয়। তাই হলো। আবিসিনিয়ার রাজা (আবিসিনিয়া বর্তমানে ইথিওপিয়া নামে পরিচিত) নাজাশি এবং রোমের রাজা একত্রে ইয়েমেন আক্রমন করার পরিকল্পনা করেন। এই কম্বাইন্ড যুদ্ধের জেনারেল ছিলেন রোমের জেনারেল আরিয়াত। আক্রমণ ঠেকাতে না পেরে ইয়েমেন হেরে যায় এবং রাজা ঢু নুঅয়াজ নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। জেনারেল আরিয়াতের (রোম জেনারেল) দখলে চলে আসে ইয়েমেন। রোমের এই জেনারেল ছিল অত্যন্ত কঠিন লোক এবং তিনি ইয়েমেনের ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করলেন। কিন্তু আবিসিনিয়ার আরেক জেনারেল যিনি এই যুদ্ধে রোমের জেনারেল আরিয়াতের সঙ্গে যুদ্দ করেছেন তিনি জেনারেল আরিয়াতের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়ে উঠেন, তার নাম আব্রাহা। তিনি রাজা নাজাশির লোক। পুরু সেনাবাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং প্রায় আত্মঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই আত্মঘাতী পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য জেনারেল আরিয়াত এবং জেনারেল আব্রাহা মল্যযুদ্ধে রাজি হন। শেষ পর্যন্ত আব্রাহা জয়ী হয়। কিন্তু রাজা নাজাশি তার জেনারেল আব্রাহার এই কর্মে খুশি হননি এবং নিজে আরও বেশি সেনাবাহিনী নিয়ে জেনারেল আব্রাহা উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। রাজা নাজাশি বার্তা পাঠালেন যে, যখন তিনি জেনারেল আব্রাহার সঙ্গে দেখা হবে, তখন তিনি তার মাথার চুল ছেটে দেবেন এবং ইয়েমেনের রাজা হওয়ার শখ তিনি মিটিয়ে দেবেন ইয়েমেনের মাটিতে তার মাথা পুতে। জেনারেল আব্রাহা ছিল খুব বুদ্ধিমান। তিনি এই খবর শুনে তিনি নিজেই আগে ভাগে তার মাথার চুল ছেটে ইয়েমেনের মাটি তার মাথায় মেখে একটি ছোট বার্তা পাঠালেন যে তিনি সব সময় রাজা নাজাশির অনুগত আছেন এবং তিনি যা বলবেন সেটাই চূড়ান্ত। এই বার্তায় রাজা নাজাশি খুব খুশি হলেন এবং রাজা নাজাশি জেনারেল আব্রাহাকে ইয়েমেনের শাসক বানিয়ে দিলেন। রাজা নাজাশিকে জেনারেল আব্রাহা খুশি করার জন্য নতুন শাসক জেনারেল আব্রাহা ঘোষণা করলেন যে, তিনি ইয়েমেনে রাজা নাজাশির নামে এক নতুন কাবা ঘর তৈরি করবেন (বহু বছর যাবত আমাদের এই কাবা ঘর ছিল সব ধর্মের কেন্দ্রস্থল এবং ব্যবসার কেন্দ্র)। ইয়েমেনের নতুন রাজা জেনারেল আব্রাহা নতুন এক কাবাঘর তৈরি করলেন এবং সব ধর্মের লোকদেরকে এই নতুন কাবা ঘরের মধ্যে তাদের উপাসনালয় স্থাপন করে দিলেন এবং এটা হয়ে উঠল ব্যবসার আরেক কেন্দ্রস্থল। এতে আরববাসি খুব খুশি হলেন না।
এই অখুশির জের ধরে এক আরব একদিন ঐ নতুন চার্চের ভিতরে পায়খানা করে তার প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করলেন। রাজা আব্রাহা এতে এতটাই ক্ষিপ্ত হলেন যে, তিনি আরবের পুরাতন কাবা ঘর ভেঙ্গে দেবার পরিকল্পনা করলেন। তিনি বিরাটকায় হাতিসমেত (এই হাতিগুলোর নাম ছিল “মামুদ”) পুরাতন কাবা শরীফ ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে মক্কায় রওয়ানা হলেন এবং কোন শক্তিই তাঁকে থামাতে পারছিল না। কিন্তু কাবা এলাকার কাছাকাছি এসে তিনি কাবাবাসির কাছ থেকে কোন প্রকার সাহায্য পেলেন না। এবং তিনি কাবার প্রকৃত লোকেশনও জানতেন না। শেষে তাইফের এক বাসিন্দার সাহায্য নিয়ে তিনি মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তাইফের এই বাসিন্দার নাম ছিল আবু রজাল। তাঁকে নিয়ে যখন আব্রাহা মক্কার দিকে আসছিলেন, পথিমধ্যে আবু রজাল মারা যায় এবং তাঁকে মক্কা ও তাইফের মাঝামাঝি জায়গায় কবর দেয়া হয়। বর্তমানে যে কোন লোক যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁকে আবু রজালের ভাই বলে আরবে সম্বোধন করা হয়। আমাদের মিরজাফরের নামের মত।
যে কোন ভাবেই হোক, আব্রাহা মক্কার কাছাকাছি চলে আসেন এবং প্রায় ৬-৭ কিমি দূরে তিনি তার ক্যাম্প স্থাপন করেন রাত্রি যাপনের জন্য এবং তিনি আদেশ দেন যে, তাদের খাবার মজুত করার জন্য মক্কার আশেপাশের যত হাস মুরগি, উঠ, গরু, ছাগল আছে তা হস্তগত করো। এই হস্তগত অপারেশনের জেরে আমাদের নবীর দাদা আব্দুল মুত্তালিবের ২০০ উঠও আব্রাহার বাহিনী ক্যাপচার করেন। আব্দুল মুত্তালিব তার ২০০ উঠ ফিরে পাবার জন্য আব্রাহার ক্যাম্পে যান। আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন দেখতে খুব সুন্দর, লম্বা এবং ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোক। তাঁকে দেখে আব্রাহার মধ্যে একটা সম্মান দেখানোর মনোভাব তৈরি হল এবং আব্রাহা তার রাজ আসন থেকে নেমে এসে মাটিতে বসে আব্দুল মুত্তালিবের সঙ্গে কথা বললেন। আব্রহা জানতে চাইলেন কি কারনে আব্দুল মুত্তালিব তার কাছে এসেছে। আব্দুল মুত্তালিব বললেন যে, আব্রহার লোকজন তার ২০০ উঠ নিয়ে এসেছে, সেটা তিনি ফেরত চান। এটা শুনে আব্রহা খুবই অবাক হলে এই কারনে যে, এত ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে আব্দুল মুত্তালিব তার কাছে এসেছে? যেখানে এতলোক কাবাঘর রক্ষার প্রানপন চেষ্টা করছে আর সেখানে আব্দুল মুত্তালিব কাবাঘর নিয়ে কোন প্রকার অনুরোধ বা সংশয় প্রকাশ না করে শুধুমাত্র তার ২০০ উঠের জন্য অনুরোধ করছে? আব্রহা আব্দুল মুত্তালিবকে বললেন, আমি খুব অবাক হচ্ছি যে, সবাই যেখানে কাবাঘর রক্ষায় মারা যাচ্ছে, সেখানে আব্দুল মুত্তালিব কাবাঘর রক্ষার কোন অনুরোধ করলেন না কেন? আব্দুল মুত্তালিব বললেন, আমি ২০০ উঠের মালিক, ঐ ২০০ উঠের নিরাপত্তা আমার উপর বর্তায়। আর কাবাঘরের মালিক “লর্ড” নিজে। লর্ড যদি তার কাবাঘর রক্ষা করতে না পারেন, আমার কি করার আছে? আব্রহা তার ২০০ উঠ ফেরত দিলেন এবং বললেন যে, সবাইকে বলে দিন, আগামিকাল আমি কাবা ঘর গুড়িয়ে দেব, কেউ যেন আশেপাশে না থাকে।
আব্দুল মুত্তালিব তার ২০০ উঠ নিয়ে ফিরে এলেন এবং সবাইকে আব্রাহার ঘোষণা শুনিয়ে নিকটবর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নিলেন পরদিন কি হয় দেখার জন্য। পরদিন আব্রাহা তার হাতিগুলোকে কাবাঘরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন কিন্তু হাতি সামনের দিকে এক কদমও এগুলো না। সবদিকে হাতি যেতে পারছে কিন্তু কাবার দিকে অগ্রসর হতে চাইছিল না। অনেক চেষ্টা করার পরও যখন হাতি নড়ছিল না। তখন হাতিগুলোকে আব্রাহা পাথর দিয়ে আঘাত করতে শুরু করল, তাতেও কোন কাজ হচ্ছিল না। দুপুরের দিকে হটাত করে আবাবিল পাখি মেঘের মত উড়ে এল, সবার দুই পায়ে দুইটা এবং ঠোটে একটা করে মাটির ঢিলা। এই তিনটা করে মাটির ঢিলায় সমস্ত হাতি এবং সৈন্য সামন্ত পরজদুস্থ হয়ে উঠল। শুধু তাই নয়, তারপর শুরু হল বৃষ্টি। মাটি গলে গিয়ে সবাই কাদামাটিতে পুতে গেল এবং তারা আর ওইখান থেকে ফিরে আসতে পারেনি। আব্রাহাসহ সব বাহিনী মারা যায়। আমাদের নবী যখন মাতৃগর্ভে দুই মাসের বয়স, তখন এই ঘটনা ঘটে।
বর্তমানে মিনায় যাওয়ার পথে এই জায়গাটা পড়ে এবং একে অভিশপ্ত জায়গা বলে উল্লেখ করা হয়। সাধারনত কেউ ঐ জায়গা দিয়ে যাতায়ত করতে চায় না। আর অগত্যা করলেও খুব ভয়ে এবং ঘৃণায় যায়। ঠিক এর পরেই ইয়ামেনকে দখল করে পার্সিয়ানরা।
মদিনা থেকে ৩০ তারিখে আমরা মক্কায় চলে গেলাম। ঐ রাতেই আমি ওমরা শেষ করেছি। মদিনা থেকে এহরাম বেঁধে নিয়েছিলাম। আমি খুব ভাগ্যবান যে আমার হোটেলটি ছিল, সেটা মক্কার সঙ্গে একদম লাগোয়া। মানে আমার রুম থেকেও মক্কার জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা যায়। হোটেল জমজম। আমার রুম থেকে কাবার ঘর সরাসরি দেখা যেত। এরজন্য আমাকে একটু বেশি ভাড়া গুনতে হয়েছিল বটে কিন্তু আমি খুব আনন্দে ছিলাম এইজন্য যে, হারাম ভিউ পেয়ে। খুব বেশি নড়াচড়া করিনি, সবগুলো নামাজ মক্কা শরিফে গিয়ে পড়ার সুযোগ হয়েছে। মোট পাঁচ বার ওমরা করেছি এই সময়ে। আর প্রতিদিন কয়েকবার করে তাওয়াফ করেছি পবিত্র কাবাঘরকে। মন ভরে এবাদত করেছি যতক্ষন মন চেয়েছে। সবার জন্য দোয়া করেছি।
একদিন শুধু বের হয়েছিলাম মক্কায় বিখ্যাত ইসলামিক জায়গাগুলো দেখার জন্য। তার মধ্যে ছিল আরাফার ময়দান, মুজদালিফা, মিনা, তায়েফ শহর, হেরা গুহা। ইত্যাদি। তায়েফ শহরে গিয়ে আমি ঐ জায়গাগুলো দেখার চেষ্টা করেছি যেখানে ঐ বুড়ি যিনি আমাদের নবীর পথে কাটা বিছিয়ে রাখতেন, ঐ মসজিদ যেখানে আমাদের নবীকে আহত হতে হয়েছিল।
তায়েফের ঘটনা আমরা সবাই হয়ত জানি। সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেছেন আমাদের নবী এই তায়েফ শহরে ইসলামকে প্রচার করতে গিয়ে। তার সঙ্গে তার পালক পুত্র জাইদ (রাঃ) ছিলেন তায়েফে ইসলাম প্রচারের জন্য। তায়েফের লোকজন সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছিলেন আমাদের নবীকে। তার সারা শরীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, তার দন্ত মোবারক শহিদ হয়েছিল এই তায়েফে। তার কষ্ট দেখে জিব্রাইল (আঃ) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি শুধু প্রকাশ করেন এবং অনুমতি দিন, আমি আল্লাহর কাছ থেকে আদেশ প্রাপ্ত হয়েছি, আপনার অনুমতি পেলে আমি নিমিষের মধ্যে এই তায়েফের লোকজনসহ তায়েফ নগরীকে ধ্বংস করে দেই। তখন আমাদের নবী জিব্রাইলকে বলেছিলেন, যদি সব মানুষদেরকে ধংশই করে দেই, তাহলে আল্লাহকে এবাদত করবে কে? একদিন এই তায়েফ নগরির সব মানুষ ইসলাম গ্রহন করবে। তায়েফ শহরটি খুব সুন্দর এবং সত্যি দেখার মত। পাহাড়ের উপরে একটা চমৎকার শহর।
মক্কায় অবস্থিত জান্নাতুল মাওয়া (কবর স্থান) দেখলাম। হজ্জের সময় খুব ভাল করে দেখার সুযোগ হয় নাই। এখন বর্তমানে অনেক কিছু পরিবর্তন এসেছে। মহিলাদের যাওয়ার সুযোগ নাই। কবর গুলোর ব্যাপারে কিছু বলি।
এখানে যাদের কবর দেওয়া হয় তাদের জন্য আগে থেকেই ইটের কবর বানানো আছে। প্রতি ওয়াক্তেই দাফন করার কাজ চলে। আমি যেটা শুনেছি যে, একটা কবর প্রায় এক বছর পর্যন্ত ইনট্যাক্ট অবস্থায় রাখা হয়। পরের বছর ঐ কবরটা আবার খোলা হয়। যদি কোন লাশ অবিকৃত অবস্থায় থাকে, তাহলে ঐ কবরটা একেবারে শিল্ড করে দেওয়া হয়, ঐ কবরের মধ্যে আর কোন লাশ দাফন করা হয় না। ধরে নেওয়া হয় তিনি শহিদ বা তাঁকে আর কোন ডিস্টারবড করা যাবে না। আর যেগুলোতে লাশ পচে যায়, শুধু সেগুলোতে আবার নতুন লাশ দাফন করা হয়। এইভাবে অনেক কবর একদম বন্ধ করে দেওয়া হয়ে গেছে। আমি কয়েকটা ছবি দেখাই। তাহলে বুঝতে পারবে। কোন কবরের কোন প্রকার ডেকোরেশন নাই।
৮ তারিখে আমরা ঢাকায় ফিরে আসার জন্য জেদ্দায় রওয়ানা হলাম। দুপুরের দিকে জেদ্দায় আমার এক বন্ধুর বাড়িতে উঠলাম। সে খুব সাদরে আমাদের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখালো তার গাড়ি দিয়ে। তাঁকে আমি আগে থেকে চিনতাম না। ঢাকার উত্তরার মসজিদের খতীব জনাব মামুন সাহেবের পরিচিত। আমাদেরকে ঐ ভদ্রলোক তার নিজের গাড়ি পাঠিয়ে মক্কা থেকে নিয়ে গেলেন। তিনি বিন লাদেন কোম্পানির একজন এনলিস্টেড কনট্রাক্টর ইঞ্জিনিয়ার। অনেক জায়গা দেখালেন। শেষমেশ নিয়ে গেলেন মা হাওয়ার কবর স্থানে। বিশাল একটা কবরস্থান। খুব ভাল লাগলো দেখে। জেদ্দায় যেখানে শিরচ্ছেদ করা হয় কোন আসামির, সেই মসজিদে নিয়ে গেলেন এবং যেখানে শিরচ্ছেদ করানো হয় সেই জায়গাটা দেখালেন। ভয় লাগছিল ভাবতে। প্রতি শুক্রবারে এই স্থানে কোন আসামিদের শিরচ্ছেদ করার রেওয়াজ আছে এখানে এবং প্রকাশ্যে।
রাত ৩;৪৫ মিনিটে আমরা এয়ারপোর্ট আসলাম এবং তারপর ঢাকায়। আলহামদুলিল্লাহ।
২৯/০৩/২০১২-মূর্তজা ভাই এর সাথে চীন ভ্রমন
Categories
বৃহস্পতিবার, ১৫ চৈত্র ১৪১৮
গত ২০ মার্চ আমি পঞ্চম বারের মত চীন গিয়েছিলাম। চীন দেশটা বড় সুন্দর, রাস্তা ঘাঁট খুব সুন্দর, মানুষ গুলো ভাল, সারকার খুব কঠিন বলে মনে হল। ঢাকা এয়রপোর্ট থেকে রাত ১২৪০ মিনিটে সাউদারন বিমানে ফ্লাইট । ২০ মার্চ বাংলাদেশ আর ভারতের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা ছিল, বাংলাদেশ জিতল। ২২ তারিখে বাংলাদেশ আর পাকিস্তান ফাইনাল খেলা খেলবে। আর সেদিন বাংলাদেশ মাত্র ২ রানে হেরে গেল।
আমি চীনে এসে HUA CHEN BUSINESS HOTEL এ উঠেছি। RUIN CITY র Wenzhou town এ ।এবারই এই হোটেলে প্রথম ওঠলাম। খুব ভাল না ভেবেছিলাম প্রথমে কিন্তু পরে দেখলাম, হোটেল তা একেবারে Mr Zhang Xuan এর office এর কাছে এবং হোটেলের কর্মচারী গুলো খুব ভাল। এখানে মনে রাখার মত অনেক কিছু আছে। এই হোটেলের একজন মেয়ে (চাইনিজ) রিসেপসনিস্ত হিসাবে কাজ করে। আমার রুমটা ঠিক তার উল্টা দিকে। আমার একটা সুবিধা হয়েছে। যখনি যা লাগে, শুধু ডাক দিলেই হয়। কিন্তু সে ইংরেজি ভাষা কিছুই বুঝে না। আবার আমি তাদের চাইনিজ ভাষা কিছুই বুঝি না। তারপরেও একটা ভাষা আছে, সেটা বডী লেঙ্গুয়েজ। ও আমাকে ভীষণ আদর করল। ও আমাকে খুব পছন্দ করেছে। অথচ আমি ওর নামটাই জনি না। আবার যদি আমি কখন চায়না যাই আমি আবারো এই হোটেলেই উঠবো। আর উঠবো শুধু ওর জন্য।
Auto Bricks Industry করার কাজে এসেছি। এর আগে Mr Zhang Xuan এর কাছ থেকে মা পলাস্তিক ইন্ডাঁশ্রি করার কাজে এসেছিলাম। আমার গার্মেন্টস এর পারটনার মুরতুজা ভাই ও এসেছে কিন্তু ওঁনি হংকং থেকে চীনে এসেছে। Mr Zhang Xuan আমাকে যেঁ পরিমান সমীহ করে এবং ভালবাসে আমি তার এক অংশ ফেরত দিতে পারব না । সব সময় সে নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে আমাকে এখানে ওখানে নিয়ে যাচ্ছে, কোন খাবারের বিল দিতে দেয় না, কি যেঁ কারবার !
২১ তারিখে চীন পৌঁছেছি, ২১ তারিখেই HUA CHEN BUSINESS HOTEL এ মনে রাখার মত ঘটনা ঘটল। ভাল লেগেছে। ২২ তারিখে আগে Mr Zhang Xuan এর office এ অনেক কাজ করলাম, Auto Bricks Industry র জন্য অনেক খবর নিলাম, আজ মুরতুজা ভাই আসবেন। ২২ তারিখে মুরতুজা ভাই আসলেন, খুব ভাল লাগল।
২২ তরিখে আমি, মুরতুজা ভাই, কেরল এবং Mr Zhang Xuan সবাই মিলে HANZHOU গেলাম। হাই স্পীডট্রেন। কত সুন্দর ওদের ট্রেন বেবস্থা। HANZHOU শহরটাও সুন্দর। রাত হয়ে গেল ওখানে পৌছতে। বেশ শীত। রাতে খাবারটা খেলাম। চাইনিজ খাবার, মাফ চাই, প্রায়ই কাচা। আমি যেহেতু আরও কয়েকবার এসেছি, তাই আমি বেশি করে সুধু সবজি খেলাম। অন্তত সবজী কাচা হলে ও খাওয়া যায়। খাবার পর মুরতুজা ভাই একটু মার্কেটে যেতে চাইলেন। গেলাম। কিছুই কেনা হল না। ফিরে এলাম রুমে, ঘুম আসছিল না। তাই, আমি আর মুরতুজা ভাই মিলে একটা সিনেমা দেখলাম টিভিতে Inkheart. মজার সিনেমা। বেশ রাত হল ঘুমাতে। সকালটায় ওঠতে হবে, একটা প্রজেক্ট দেখতে যেতে হবে। ঠিক যা ভেবেছিলাম, তাই হল, আমরা ঘুম থেকে ওঠতে দেরি হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি Restaurant এ গেলাম খেতে, নাশতা শেষ। Restaurant এর মহিলা যেভাবেই হোক নাস্তার ব্যবস্তা করলেন। নাস্তার পর আমরা চলে গেলাম প্রজেক্ট দেখতে।
১৮/০৩/২০১২-রাশিয়ায় ব্যবসায়ীক ভ্রমন
উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব
মার্চ
১৮
সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে স্টল গুছিয়ে ভাবলাম আবারেকবার রাশিয়া ঘুরে যাই। ফলে আমি, রাজীব ভাই (ওরফে সজীব ভাই) আর মূর্তজা ভাই তিনজনেই আমরা ট্রেনে সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে সরাসরি রাশিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। এমন একটা সময় যে, সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে রাশিয়ায় যাওয়ার জন্যে খুব ভালো ট্রেন সূচী তো নাইই, বরং মারাত্তক ট্রেন বিপর্যয় হয়েছে এই সময়। তারপরেও বিদেশী হিসাবে অনেক কষ্ট করে আমরা তিনটা টিকেট জোগাড় করতে পারলাম। এখানে একটা জিনিষ খুব নজরে পড়লো যে, এমন কি যারা রাশিয়ার নাগরীক, সবাই রাশিয়ায় যেতে পারেন না, আর পারলেও তারা কয়েকদিনের জন্য এমনভাবে সরকারী অনুমতি লাগে যে, তিন দিন বা চারদিনের জন্য। ফলে রাশিয়ায় প্রবেশ করার এবং বের হবার সময় এটা খুব কড়াকড়িভাবে সরকারী কর্মচারীরা চেক করেন যেনো কেউ অনির্দিষ্টকালের জন্য রাশিয়ায় থাকা চলবে না। এটা সম্ভবত রাশিয়ায় যাতে অন্য শহরের মানুষ এসে অযাচিত ভীর না করে এবং ঘন বসতির সৃষ্টি না করে সেজন্য। ব্যাপারটা আমার কাছে কিছু মন্দ লাগেনি। আমাদের ঢাকা শহরের জন্যেও এমন ব্যবস্থা হলে অন্তত ঢাকা একটা বসবাসের শহর হিসাবে গড়ে উঠতো।
যাই হোক, আমরা একটা হোটেল খুজতে গিয়ে খুবই বিড়ম্বনায় পড়লাম। ট্যাক্সি ড্রাইভার একবার এই হোটেলে, আরেকবার ওই হোটেলে নিয়ে যেতে লাগলো, কোথাও ভালো রুমের হদিস পাচ্ছিলাম না। অনেক পর্যটক সম্ভবত এই সময়, কোথাও খালি পাচ্ছিলাম না। অতঃপর একটা স্বাভাবিক মানের হোটেলেই উঠলাম। আমরা তিনজনেই একরুমে উঠলাম। রাত তখন প্রায় ৩টা। কিছু খাবার সাথেই ছিলো, সেটাই আমরা তিনজনে ভাগ করে খেয়ে নিলাম। তারপর ঘুম। আগামীকাল এই রাশিয়ান এয়ারপর্ট থেকেই আমরা ফিরে যাবো ঢাকায়, বিকেল ৪ টায় ফ্লাইট। এর মধ্যেই যতোটুকু রাশিয়ার আশেপাশে দেখা যায় সেটাই ভালো।
সকালে রাজীব ভাই অন্যত্র চলে গেলেন। আমি আর মূর্তজা ভাই পায়ে হেটে অদূরে ক্রেমলিন দেখতে যাবো। যেহেতু ভালো মতো চিনিনা, তাই একটা গাড়ি ভাড়া করলাম। পরে দেখলাম, আসলে আমাদের হোটেল থেকে ক্রেমলিন অতো কাছে নয়। আমরা যখন ক্রেমলিনের চত্তরে পৌঁছলাম, তখন মাত্র সকাল ১০ টা হবে। বিশাল চত্তর সামনে। অনেক নাম শুনেছিলাম এই ক্রেমলিনের, আজ নিজের চোখে দেখে মনে হলো, এটা পরাশক্তির একটা হেড কোয়ার্টার। জীবনে আল্লাহ অনেক কিছু দেখালেন। আমেরিকা দেখেছি, এবার রাশিয়ার ক্রেমলিনও দেখলাম।
ক্রেমলিনের সামনে অনেক সিকিউরিটির লোক থাকে, কিন্তু তারা কাউকে কিছুই বলেনা। যারা দর্শানার্থী, তারা নির্বিঘ্নে ক্রেমলিনের বাইরের বিশাল চত্তরে আনাগোনা করছে। মনে মনে ভাবলাম, এদের অনেকেই আছে গুপ্তচর যাদের হয়তো আমরা চিনি না কিন্তু তাদের কাজের ব্যাপার স্যাপারই আলাদা।
অনেকক্ষন থাকলাম, দেখলাম, ছবি নিতে কোনো বাধা নাই তবে মাঝে মাঝেই লেখা আছে, 'এই এলাকায় ছবি তোলা নিষেধ"। খুব গোপনেই কয়েকটা ছবি নিলাম, বলা যায় না কোথায় কোন ক্যামেরা ফিট করা আছে, আবার কেউ আমাদের সন্দেহ করে ধরেও নিয়ে যেতে পারে এই ছবি তোলার জন্য। আশেপাশে কোনো দোকান পাট নাই, ভীষন পানির পিপাসা লেগেছিলো, সাথে অল্প একটু পানি ছিলো, তাতেই পানির পিপাসা মিটাতে হলো।
ক্রেমলিন থেকে আমরা পায়ে হেটে আশেপাশে বেশ দূরে কিছু শপিংমল আছে। সেখানে গেলাম। মূর্তজা ভাই একটা স্পোর্টস দোকানে ঢোকলেন, তাঁর বাচ্চাদের জন্য কিছু স্পোর্টস গিয়ার কিনবেন। আমিও ভাবলাম কিছু কিনি। ওরে ভাই, এতো দাম? তারপরেও পকেটে ডলার ছিলো বেশ, আর এগুলি ঢাকায় ফিরিয়ে নেবার ইচ্ছা ছিলো না। তাই প্রায় ১৫০০ ডলার দিয়ে আমিও কিছু স্পোর্টস গিয়ার কিনলাম মুর্তজা ভাইয়ের দেখাদেখি। হয়তো আমার পরিবার এগুলি ব্যবহার করে কিনা জানি না, আবার করতেও পারে। ব্যবহার করলে ভালো লাগবে আর না করলে পুরা টাকাটাই গচ্চা।
একটা রেষ্টুরেন্টে ঢোকে আমরা কিছু খেয়ে নিলাম। বিকাল ৩ তাঁর দিকে এয়ারপোর্টে গেলেই হবে। ওই সময় রাজীব ভাইও আমাদের সাথেই ঢাকায় ফিরবেন। আমরা খাওয়া দাওয়া করে বিকাল তিনটার আগেই এয়ারপোর্টে চলে এলাম, বিশাল এয়ারপোর্ট। চমৎকার জায়গা। খুব ভালো লাগলো। অনেক দেশ ঘুরে একটা জিনিষ বুঝেছি যে, আমাদের দেশের এয়ারপর্ট বিদেশের লোকাল এয়ারপোর্টের থেকেও খারাপ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায়, ডেকোরেশনে, সুযোগ সুবিধা সবকিছু মিলিয়ে আমাদের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপর্ট কোনো অবস্থাতেই ইন্তারন্যাশনাল পর্যায়ে পড়ে না। যাইহোক, আমরা চেকিং করে ফেললাম। আমাদের সাথে যে স্যাম্পলগুলি সেন্ট পিটার্সবার্গে নিয়ে এসেছিলাম, সেগুলি আমরা সেন্ট পিটার্সবার্গেই দান করে এসেছিলাম। ওগুলি আর দেশে ফিরিয়ে আনার কোনো মানে হয় না। কারন তাতে আমাদের অনেক লাগেজ খরচ বহন করতে হতো।
একটা কথা না বললেই নয় যে, আমরা যে উদ্দেশ্যে এই সেন্ট পিটার্সবার্গে স্টল খুলেছিলাম, আসলে এটার কোনো সাফল্য আসে নাই। আমরা ভেবেছিলাম যে, এখানে বায়াররাও আসে। ফলে আমরা অনেক অর্ডার পাবো দেশ বিদেশ থেকে। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম যে, আসলে এখানে খুচরা ক্রেতা বেশী। অর্থাৎ এক পিস দুই পিচ কেনার ক্রেতা। আমরা তো এটা চাই নাই। পুরুটাই আসলে একটা অসফল ফেয়ার ছিলো। আমি মুর্তজা ভাইকে বললাম, যে, এরপরে এভাবে আর আমরা কোনো স্টল দেয়া উচিত না। তাতে খুব লাভ হয় না।
আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম।
১৭/০৩/২০১২-সেন্ট পিটার্সবার্গ
উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব
মার্চ
১৭
গত কয়েকদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম এই সেন্ট পিটার্সবার্গে ফ্যাশন মেলায় আসার জন্য। 39th International Exhibition of Textile and Light Industry এর মেলাটার সময়কাল ১৫ থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত। কোনো পরিকল্পনা ছিলো না আগে থেকে। হটাত করেই মূর্তজা ভাই বললেন, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে একটা মেলা হচ্ছে, বাংলাদেশের অনেকেই যাবে, আমরা যাবো কিনা?
সেন্ট পিটারসসবার্গের কথা অনেক পড়েছিলাম আমাদের বই পুস্তকে সেই ছোট বেলা। যখন ছাত্র ছিলাম তখন আবার রাজপুটিনের গল্প শুনতে শুনতে এই সেন্ট পিটার্সবার্গের ব্যাপারে অনেক বাসনা ছিলো মনে। আমাদের ক্লাস এইটের একটা বইয়ের মধ্যে একটা ছোট বালকের গল্প পড়েছিলাম যে, তাঁর বাবাকে রাশিয়ার কোনো এক রাজা শাস্তিসরুপ এই সেন্ট পিটার্সবার্গে পাঠিয়েছিলো। কারন সাইবেরিয়ার মতো নাকি এখানে প্রায় সারা বছর বরফ থাকে আর যাতায়তের তেমন কোনো ভালো ব্যবস্থা নাই। তারপর সেই বাবাকে দেখার জন্য তাঁর ছোট ছেলে একাই পরিকল্পনা করে যতো বরফই থাকুক আর যতো খারাপ রাস্তাই হোক, সে তাঁর বাবার সাথে দেখ করবেই। যখন গল্পটা পড়েছিলাম, তখন আমারও একবার এই সাইবেরিয়া অথবা সেন্ট পিটার্সবার্গে যাওয়ার খুব শখ হয়েছিল।
মূর্তজা ভাই যখন আমাকে ব্যাপারটা বললেন, আমি যতোটা না ব্যবসার প্রসার হবে তাঁর থেকে বেশী আগ্রহী ছিলাম এই সেন্ট পিটার্সবার্গ দেখার ব্যাপারে। খরচ কত হবে সেটা জিজ্ঞেস করতেই পুরু প্যাকেজের দাম পড়বে প্রায় লাখ বিশেক টাকা ভেন্যু ভাড়া, এয়ার টিকেট, হোটেল ভাড়া, অন্যান্য সব মিলিয়ে প্রায় ২০ লাখের মত। কম না। তারপরেও আমরা আমাদের ফ্যাক্টরীর বাজেট পর্যালোচনা করে দেখলাম, সম্ভব প্ল্যান করা। ব্যবসা কতটুকু পাবো জানি না, কিন্তু যাওয়া যেতেই পারে।
গতকাল আমরা সেন্ট পিটার্সবার্গে অনেক স্যাম্পল নিয়ে এসেছি। সারাদিন বুথ সাজানোর কাজে ছিলাম। প্রুচুর ঠান্ডা। তবে দেশটা এতো সুন্দর, সেটা আমার কল্পনায়ও ছিলো না। সারাদিন কাজের শেষে আমি আর মুর্তজা ভাই সাথে বাংলাদেশের আরেকজন সজীব ভাই, একসাথে বের হলাম। আমরা বাংলাদেশ থেকে অনেকেই এখানে এসেছি। কেউ জ্যাকেটের ব্যবসা, কারো শার্ট প্যান্টের ব্যবসা, কারো আমাদের মতো সুয়েটার্স এর ব্যবসা।
সারাদিনই গুড়ি গুড়ি বরফ পড়ছে বাইরে। এটা অনেকটা গুড়িগুড়ি বরফ পরার বৃষ্টির মতো। রাস্তাঘাট সারাক্ষনই ভিজা, গাছের পাতাগুলি ঝরে পড়ে পড়ে গাছের নীচে একটু একটু পচন ধরায় কেমন জানি একটা গন্ধ আসে। রাস্তায় সবাই গাড়ি, কিংবা বাইক বা স্কুটি নিয়ে চলে। সবার হাতেই ছাতা আছে। রাশিয়ান মেয়েরা অনেক সুন্দর হয়, সেন্ট পিটার্সবার্গ সে রকম।অনেক লম্বা হয় এদেশের মেয়েরা।
এসেই একটা মোবাইল ফোন কিনেছিলাম। খুব ছোট একটা মোবাইল ফোন, দেখতে অদ্ভুত সুন্দর। আসলে আমার কেনার দরকার ছিলো না, কনিকা ছোট ছোট জিনিষ পছন্দ করে, তাই এটা কেনা। রাতের সেন্ট পিটার্সবার্গ দেখতে গিয়ে যা চোখে পড়লো, সেটা অভাবনীয়। প্রতিটি রাস্তায় পর্যাপ্ত পরিমানে লাইট। মানুষজন খুব কম কিন্তু যারা বাইরে বেরিয়েছেন, তাদের বেশীরভাগ মানুষই পর্যটক। লোকাল লোকজন বেশ কম। প্রচন্ড বাতাস। সন্ধ্যা হলেই সব অফিস আদালত বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু সবগুলি বিল্ডিং এর বাইরের দিকে এমনভাবে আলোকিত যে, মনে হয় অভিনব রকমের সুন্দর। যেখানেই তাকাই, সবকিছুই এতো চোখ জুরানো সুন্দর, ভাবাই যায় না। যেসব জায়গায় পার্ক আছে সে গুলিতে গাছে গাছেও বেশ চমৎকার করে আলোকিত করা। গাড়ির তেমন ভীড় নাই, আবার কিছু কিছু ট্যাক্সি ক্যাব আছে, যারা ছোট ছোট ট্রিপ দেয়।
আমরা একটা নদীর ধারে দাড়ালাম। নদীর দূর প্রান্তের ওপারে যে ছোট শহরের মতো দেখা যায়, মনে হচ্ছে একটা ছবি। আমরা গুড়ি গুড়ি বরফের কুচিতে ভিজে যাচ্ছিলাম বটে কিন্তু আশ্রয় নিতে ইচ্ছে করছিলো না। সিগারেট ধরিয়েছি, খুব সাবধানে টানছি যাতে সিগারেট ভিজে না যায়। সজীব ভাই আর মূর্তজা ভাই একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছেন। আমিও মাঝে মাঝে তাদের সাথে জয়েন হচ্ছি কিছু ছবি তোলার জন্যে। বেশ ভালো সময় যাচ্ছে।
রাত প্রায় বারোটা বাজে। সাথে আমাদের গাড়ি নাই। যখন বেরিয়েছিলাম, সাথে গাড়ি ছিলো, ভারা করা গাড়ি। এবার হোটেলে ফিরে যাবো, এমন সময় একটা ট্যাক্সী ক্যাব আমাদের সামনে এসে দাড়ালো। যুবক একটা ছেলে। ভালো ইংরেজি বলে। জিজ্ঞেস করলাম, সে ভাড়ায় যাবে কিনা। সে বেসিক্যালি ভাড়ায় যায় না, এমনিতেই সে ঘুরতে বেড়িয়েছিলো। আমাদের এতো রাতে এই নির্জন জায়গায় দেখে গাড়ি থামিয়েছে। সে একজন আইটি বিভাগের লোক। ব্যক্তিগত একটা ছোট ফার্ম আছে। সে বল্লো যে, সেন্ট পিটার্সবার্গে অধিক রাত নিরাপদ নয়। আমাদের হোটেলে ফিরে যাওয়া উচিত। কারন এখানে অনেক খারাপ লোক রাতে বিচরন করে। আমরা সবাই একটু ভয় পেয়ে গেলেও যেহেতু সবাই একসাথে আছি, ফলে মনে সাহস ছিলো।
বললাম, কি নাম তোমার?
সে তাঁর নাম আলেক্স বল্লো।
আমরা বললাম, আলেক্স, তুমি কি আমাদেরকে আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিতে পারবা? আমরা তোমাকে যা ভাড়া আসে সেটাই দিয়ে দেবো। সে একটু হেসে দিয়ে বল্লো, তাঁর ভাড়া লাগবে না, কিন্তু সে যে ইংরেজীতে আমাদের সাথে কথা বলতে পারছে এটাই তাঁর লাভ। কারন এখানে সে কারো সাথে ইংরেজিতে কথা বলার মানুষ পায় না। অথচ সে ভালই ইংরেজী বলতে পারে। আমরা তাঁর গাড়িতে উঠে গেলাম, অনেক ফান করলাম তাঁর সাথে, সেও খুব মজা পেলো বলে মনে হলো। সে আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিয়ে বল্লো যে, যদি তারা আগামীকাল আরো সুন্দর সুন্দর জায়গায় যেতে চায়, তাহলে তাঁর নাম্বারে ফোন দিলে বিনে পয়সায়ই সে আমাদের ঘুরিয়ে দেখাবে। আলেক্স ছেলেটাকে ভালো লাগলো। বললাম, ঠিক আছে, আগামীকাল বিকাল পাচতার পর আমরা ফ্রি হবো, আলেক্স যদি ফ্রি থাকে সে যেনো আমাদেরকে আবার এইখান থেকেই পিক করে নিয়ে যায়। কথামতো সে রাজী হলো।
পরেরদিন ঠিক সময়েই আলেক্স চলে এলো। আমরা আলেক্সকে বললাম, কোথায় কোথায় যাওয়া যায় সে যেনো আমাদেরকে নিয়ে যায়। আলেক্স বল্লো, বেশি জায়গা হয়তো সে ঘুরিয়ে দেখাতে পারবে না, তাহলে অনেক রাত হয়ে যাবে তবে দিনের আলোয় যে কয়টা দর্শনীয় স্থান দেখা সম্ভব সেটা সে প্ল্যান করে রেখেছে, আর রাতে একটা ব্রিজ দেখাতে নিয়ে যাবে যা দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে আসে। ব্রিজটা রাত দেড়টার পরে খোলা শুরু হয় আর ভোর পাচটার আগেই আবার বন্ধ করে দেয়া হয় যাতে স্বাভাবিক গাড়ি ঘোড়া আবার চলতে পারে। মানে ব্রিজটা দিখন্ডিত হয়ে যায় রাত দেড়টার পর। আমি কখনো এই ধরনের ব্রিজ দেখি নাই। ব্রিজটি নেভা রিভারে।
আলেক্স আমাদেরকে প্রথমেই নিয়ে গেলো, সেন্ট আইজাক ক্যাথেড্রালে, ভীষন সুন্দর দেখতে। তারপর গেলাম চার্চ অফ দি সাভিউর অন স্পিল্ড ব্লাড এ, তারপর নিয়ে গেলো আলেক্সজান্ডার কলাম ইন পেলেস স্কোয়ারে। প্রতিটি জায়গা সুন্দর। এর মধ্যেই রাত প্রায় আটটা বেজে গিয়েছিলো।
সেন্ট আইজাক ক্যাথেড্রালঃ
আলেক্সজেন্ডার-১ এর আমলে, সেন্ট আইজাক ডালমাটিয়ার নামে উতসর্গকৃত এই ক্যাথেড্রালটি 'পিটার দি গ্রেট' এর চীফ পেট্রোন 'সেন্ট আইজাক' এর নামে করা। এটা বর্তমানে মিউজিয়ামে রুপান্তরীত করা হয়েছে। ১৮৫৮ সালে তৈয়ারি করা এই ক্যাথেড্রালটি সন্ধ্যার পরে বন্ধ হয়ে যায় বিধায় আমরা এর ভিতরে ঢোকতে পারি নাই কিন্তু বাইরেও বহু দর্শানার্থির জন্য দেখার বেশ কিছু আছে। আমরা বেশীক্ষন এখানে থাকতে পারি নাই কারন আমরা এমনিতেই বেশ দেরী করে বের হয়ে আরো বেশ কিছু জিনিষ দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। আর আমরা এই সেন্ট পিটার্সবার্গে দিনের বেলায় বের হবার সম্ভাবনা নাই কারন আমাদের মেলায় আমাদের সারাক্ষন থাকতে হয়। কিছু ছবি তুলে বেরিয়ে গেলাম আলেক্সজেন্ডার পেলেসের উদ্দেশ্যে। কারন ওখানে আবার বেশী রাতে ঢোকার অনুমতি নাই।
আলেক্সজেন্ডার কলাম ইন প্যালেস স্কোয়ার দর্শনঃ
ফ্রান্সের নেপোলিয়ানের সাথে যুদ্ধবিজয়ের পর আলেক্সজেন্ডার-১, এটা তৈরী করেন। প্রায় ১৫০ ফুট উচু এই কলামের উচ্চতা। এতো বিশাল খালি জায়গা এর সামনে, দাড়ালেই মন ভরে যায়। খুব পরিষ্কার করে রাখা জায়গাটি। একদম উপরে একটা এঞ্জেল একটা ক্রস ধরে আছে। কেনো এই ক্রস কিংবা কিসের কারনে এই সিম্বল দেয়া, সেতা আমাদের গাইড আলেক্স ভালো বলতে পারলো না। তবে একটা কথা আলেক্স বল্লো যে, এঞ্জেলের মুখখানা আলেক জেন্ডার-১ এর মুখের আকৃতি স্বরূপ করা। কিছুক্ষন থাকার পর আমরা আরেকটি দর্শনীয় জায়গার জন্য র ওয়ানা হয়ে গেলাম। আসলে কোনো স্থানই আমাদের ভালো করে দেখা হচ্ছিলো না কারন এমনিতেই রাত হয়ে যাচ্ছিলো আবার আমাদের হাতে দিনের বেলাতেও সময় নাই। অন্যদিকে আর এখানে এসেছি মাত্র ৪/৫ দিনের জন্য।
চার্চ অফ দি সেভিউর অন স্পিল্ড ব্লাডঃ প্রকৃত পক্ষে এটা একটা ইমোশনাল জায়গা রাশিয়ানদের জন্য। আলেক্সজেন্ডার-২ কে হত্যা করা হয়েছিলো তারই কোনো প্রতিপক্ষের মানুষ। 'নিহিলিস্ট' মুভমেন্টের সময় আলেকজান্ডার-২ কে হত্যা করা হয় যার কোনো বেসিক ভিত্তি ছিলো না। এই সেই একই জায়গায় রুমানভ ইম্পেরিয়াল পরিবার আলেকজান্ডার-২ এর স্মৃতি রক্ষায় একটি মনুমেন্ট তৈরী করেন যা এখন চার্চে পরিনত হয়েছে।
নেভা রিভার ব্রিজঃ
এই নদীতে একটা ব্রিজ রয়েছে যা গভীর রাতে বড় বড় শিপ, একপাশ থেকে আরেক পাশে যাওয়ার জন্য খুলে দেয়া হয়। স্বয়ংক্রিয় ভাবে এটা খুলে যায় দুইধারে। আবার ভোর পাচটার আগেই পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয় যাতে দিনের বেলায় স্বাভাবিক গাড়ি ঘোড়া চলতে পারে। আমরা যখন এই নেভা নদীর তোরে এলাম, দেখালম, প্রচুর লোকজন এই ব্রিজ কখন খুলবে সেটা দেখার জন্য বেশ ভীড়। আমরা প্রচন্ড বাতাসের মধ্যে দাড়িয়েছিলাম। কিন্তু কোনো বৃষ্টি বা গুড়ি গুড়ি বরফের কোনো কুচি ছিলো না। অনেক শীত। প্রায় রাত দুটুর দিকে একটা বেশ বড় সড় সাইরেন বাজলো। বুঝলাম এখন হয়তো ব্রিজ খুলবে। ব্রিজ খোলার আগে তারা একতা জিনিষ নিশ্চিত করেন যে, দুই পারের কোনো গাড়ি আছে কিনা বা ব্রিজের উপরে কোনো গাড়ি আটকা পড়লো কিনা। ব্রিজ খোলার আগে তারা সমস্ত এন্ট্রি বন্ধ করে দেয় এবং একটা সাইরেন বাজানো হয়। যদি কোনো গাড়ি খুব কাছাকাছি থাকে যাদের পার হবার জন্য ব্রিজের দিকে আসবে, তারা ওই সাইরেন বাজার ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে এসে গেলে পার হবার সুযোগ পাবে আর এর পরে ভোর পর্যন্ত গাড়ি পারাপারের কোনো সুযোগ নাই। এই টাইম টেবিলটা এখানকার মানুষজন জানে বিধায় সেভাবেই চলাফেরা করেন। দেখলাম, ব্রিজটা খুব ধীরে ধীরে তাঁর মধ্যস্থল থেকে দিখন্ডিত হয়ে দুই পাশে একদম প্রায় ৬০/৭০ ডিগ্রী খারা হয়ে যায়। ফলে যে কোনো বড় বড় শীপ ও এই দুই ফাক দিয়ে ক্যানাল্টায় প্রবেশ করতে পারে। অদ্ভুদ টেকনোলোজি। আমরা বন্ধ্যের ব্যাপারটা আর দেখতে চাই নাই কারন তাতে প্রায় রাত পার হয়ে যাবে। সেখান থেকে হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় তিনটা বেজে গেলো।
পুটিনের বাবার বাড়ি পরিদর্শনঃ
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্লাদিমির পুতিন আসলে এই সেন্ট পিটার্সবার্গের ছেলে। সেন্ট পিটার্সবারকে বলা হতো এক সময় লেনিনগ্রাড। এটাই এখন সেন্ট পিটার্সবার্গ। ব্লাদিমির পুতিনের বাড়িতা খুব সাধারন গোছের একতা বাড়ি। চারিদিকে বেশ গাছপালা, পাশেই নদী। ভাবছিলাম, দুই পরাশক্তির একজন এই ব্লাদিমির পুতিনের আজ থেকে প্রায় ৪০/৪৫ বছর আগেও এই এলাকার অনেকেই ভাবেন নাই যে, পুতিন একটা সদাহারন বালক এই রকমের পরাশক্তির চেয়ারে বসে দুনিয়া কাপিয়ে তুলবেন। অনেক কিছুর সাক্ষি এই সব জায়গার মানুষ গুলি। ব্লাদিমির পুতিনের বাবা ছিলেন একজন অতি সাধার ফোরম্যান, আর মা ছিলেন গৃহিণী। ভাবাই যায় না এই রকমের একটা পরিবার থেকে ব্লাদিমির পুতিনের মতো এতো বড় পরাশক্তির হেড হয়। তারপরেও ইতিহাস বলে কথা। আর এটাই বাস্তবতা। পুতিন এখানে থাকেন না, তিনি এখন মস্কোর বাসিন্দা।
০৮/১০/২০০৩- জর্জিয়া ত্যাগ
Categories
সেই পহেলা অক্টোবর ২০০২ তারিখে আমি জর্জিয়ার জাতীসংঘ মিশনে এসেছিলাম। আজ সেই জর্জিয়া থেকে চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছি। আর কখনো এই দেশে ফিরে আসা হয় কিনা জানি না। যেদিন প্রথম এদেশে ল্যান্ড করেছিলাম, সেদিন দেশটাকে যতোটা না আপন মনে হয়েছিলো, আজ দেশে ফিরে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছে, কিছুটা মায়া ধরেছে, অনেক লোকের সাথে পরিচয় হয়েছে, অনেক পরিবারের সাথে অনেক সখ্যতা হয়েছে, তাদের কারো কারো মুখখানা একেবারে চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলজ্বল করছে। এদের সাথে হয়তো আর কখনোই দেখা হবে না।
সোরেনা গামছাখুরদিয়ার পরিবারটা ছিলো আমার সবচেয়ে কাছের একটি পরিবার। ওর সাথে দেখা হলো না। দেদুনা বুকিয়া, রুসুদিন, কিংবা ওদের আরো অন্যান্য সদস্যরাও যেমন সালোমী, তামারা সবাই জানে আজ আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু দেখা করবার মতো কোনো উপায় নাই। ওরা কেউ কেউ থাকে সেই সুদূর টিবলিসিতে, কেউ আবার জুগদিদিতে, আবার কেউ গালীতে। যুদ্ধ বিপর্যস্ত এলাকায় আসলে কোনো কিছুই সঠিক নিয়মে চলে না।
এদেশের মানুষগুলি খুব ভালো ছিলো। ছোট ছোট বাচ্চারা বেশ মিশুক, মেয়েগুলি ওয়েষ্টার্নদের মতো ড্রেস পড়লেও উচ্ছৃঙ্খল নয়। তারা আমাদের দেশের মেয়েদের থেকেও অনেক রুচিশীল এবং পরিবারকেন্দ্রিক। এরা একটি মাত্র বিয়েতেই সুখী। পরিবার নিয়ে সুখে বসবাস করার জন্য যেভাবে স্বামীকে মেনে চলতে হয়, যেভাবে বাচ্চাদের নিয়ে চলতে হয়, ঠিক সেটাই করে। মেয়েরাই বেশীরভাগ সময় সংসারের হাল ধরে রাখে, আর পুরুষগুলি মদের নেশায় পড়ে থাকে।
একটা সময় ছিলো, রাশিয়ার আমলে এরা খুবই সাবলীল এবং বিলাসবহুল লাইফ লিড করেছে। কিন্তু পোষ্ট কোল্ড ওয়ার এর পরে রাশিয়ার অর্থনইতিক বিপর্যয়ের সাথে সাথে ওরা সবাই নিম্নবিত্ত পরিবারের মতো হয়ে গেছে কিন্তু আচার ব্যবহার রয়ে গেছে সেই আগের বিলাসবহুল পর্যায়ের। জুগদিদিতে থাকার সময় আমার ল্যান্ড লেডি ছিলো জুলি। তার দুইটা ছেলে আছে, নাম গোগা আর লেবানী। জুলির স্বামী আলেক একজন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু একটু ট্রিকি। একসময় প্রুচুর পয়সাকড়ি ছিলো। এখন হাতে কোনো পয়সাকড়ি আসে না। আমরা যে ভাড়াটা দেই, তাতেই ওদের সংসার চলে। গালী সেক্টরে থাকার সময় ল্যান্ড লেডি ছিলো মানানা। আর তার স্বামী ছিলো জামাল। ওদের সাথে আমার অনেক স্মৃতি জরিয়ে আছে। জুলির বয়স প্রায় পঞ্চাশ। মায়ের মতো। একদম ইংরেজী পারে না কিন্তু যেভাবে ইংরেজী বলে তাতে ওর কথা বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না।
এইতো গত ৪ অক্টোবর ২০০৩ তারিখে আমি আবারো জুলির বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। এক রাত থাকলাম। জুলি জানে আমি এক সপ্তাহ পরেই দেশে ফিরে আসবো। রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গলো একটা চমৎকার ছোয়ায়। আমি চোখ খুলতেই দেখলাম, জুলি আমার কপালে ঘুমন্ত অবস্থায় চুমু খেলো। আমার ঘুম ভেংগে গেলো। চোখ মেলতেই দেখলাম, জুলি আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখ তার ছলছলে। আমি তার দিকে তাকাতেই সে ফিরে যাচ্ছিলো। আমি বললাম, মামা, এদিকে আসো। মামা মানে মা, জুলি আমাকে জড়িয়ে ধরে একেবারে কান্নায় ভেংগে পড়লো। বল্লো, নো সি, নাহ? কাম এগেইন সন। অর্থাৎ তোমার সাথে আর কখনো কি দেখা হবে না? আবার এসো আমার ছেলে। কিছুই বলা গেলো না। সকালটাই একটা কষ্টের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিলো। ওরা খুব ভালো মানুষ। আমি আমার অনেক মালামাল কিছুই আনলাম না। একটা টেপ রেকর্ডার কিনেছিলাম, দিয়ে এলাম, অনেকগুলি গিফট কিনেছিলাম দেশে আনবো বলে। সব কিছু দিয়ে দিলাম। ওরা এক সময় অনেক ধনী ছিলো, ওদের এসবের কোনো প্রয়োজন ছিলো না রাখার, কিন্তু আমিই জোর করে দিলাম। খুব খুসি হলো। জুলি তার আলমারী থেকে ৬ টা গ্লাস সেট বের করে অতি যত্নের সাথে একটা পুরানো পেপারে প্যাক করে আমাকে দিয়ে বল্লো, "ওয়াইফ, গিভ, আই গিভ ওয়াইফ, লাভলু" অর্থাৎ এর মানে হলো, এটা তুমি তোমার বউকে দিবা। বল্বা আমি দিয়েছি। আর বল্বা, আমি তাকে ভালবাসি। কি অদ্ভুদ ফিলিংস। ভালোবাসা প্রকাশের জন্য অনেক ভাষা জানার দরকার নাই। মানুষের ভালবাসা কথা বলে চোখ, কথা বলে মুখ, কথা বলে অন্তর। আর তার বহির্প্রকাশ সারাটা শড়ির তার নিজের ভাষায় প্রকাশ করে।
আজ এই চলে যাওয়ার দিনে মনটা ভীষন খারাপ হচ্ছে। সকাল থেকেই সমস্ত জিনিষ্পত্র গুছিয়ে রেখেছিলাম। আমি গালীতে আছি, আমাকে যেতে হবে প্রথমে জুগদিদি সেক্টরে। ওখানে জাতীসংঘের প্রশাসনিক দপ্তর থেকে ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নিয়ে, মালামাল ট্রান্সপোর্ট সেকসনে হস্তান্তর করে শুধুমাত্র আমার একটা হ্যান্ডব্যাগ সাথে নিয়ে সুখুমী থেকে আমাদের নিজস্ব প্লেনে তুরষ্কের এয়ারপোর্টে আসতে হবে।
গালীতে আমি যে রুমটায় থাকতাম, তার ঠিক পাশের রুমেই থাকতো মানানার স্বামী জামাল। অত্যান্ত ভালো একজন মানুষ। মানানাও খুব ভালো একজন মহিলা। সারাক্ষন কাজ করে। আমাদের জন্য রান্না করে, বাজার করে, কাপড় চোপড় ধুয়ে আবার ইস্ত্রী করে রাখে। জামাল কোনো কাজ করে না। ওদের একটা ছেলে আছে। আমি কখনো দেখি নাই। সে থাকে বাকুতে, তার স্ত্রীসহ। মাকে ভালোবাসে ঠিকই কিন্তু কখনো আসে না। না আসার কারন একটাই, ওর পাস্পোর্ট নাই।
(চলবে)
০২/০৮/২০০৩- জর্জিয়ার টিবলিসিতে ভ্রমন
Categories
গতকাল ২০ দিনের ছুটিতে টিবলিসিতে এসেছি। টিবলিসি শব্দের অর্থ গরম জল। কেনো এই নাম দেয়া সেটা জানা গেলো সোরেনার কাছ থেকে। এখানে প্রচুর সালফিউরিক স্প্রিং আছে। আর এই সালফিউরিক স্প্রিং গুলির কারনে সারা বছরই এলাকাটা গরম থাকে। এই সালফিউরিক স্প্রিং এর কারনেই আসলে টিবলিসির নামকরন। যাই হোক, আমি এখানে কোনো হোটেলে উঠি নাই। যদিও প্রচুর হোটেল আছে।
সোরেনা আমাদের সেক্টরের একজন দোভাষী। ওর সাথে আমার অন্যান্য দোভাষীদের থেকে একটু আলাদা সম্পর্ক। খুবই ভালো একটা মেয়ে। আমি যখন সোরেনাকে বললাম, যে, আমি টিবলিসিতে বেড়াতে যাবো, তখন সোরেনাই আমাকে প্রপোজাল দিলো যে, তার এক খালার বাসা আছে টিবলিসিতে। যদি আমি কিছু মনে না করি, তাহলে আমি ওদের খালার বাসায় থাকতে পারি। রাশিয়ান মানুষেরা খুবই অতিথি পরায়ন। আমি রাজী হলাম। কিন্তু সোরেনা আমার সাথে যেতে পারবে না, ওর ছুটি নাই। ফলে আমাকেই একা যেতে হবে ওর খালার বাসায়। অনেকদিন পর্যন্ত জর্জিয়ায় আছি, ফলে আমি মানুষগুলির স্বভাব, আচরন, ব্যবহার ইত্যাদি সম্পর্কে বেশ জানা আমার। আমার যে কোনো অসুবিধা হবে না, এ ব্যাপারে আমি মূটামুটি নিশ্চিত ছিলাম।
ফলে, টিবলিসি যেতে প্রথমে আমাকে আমার কর্ম ক্ষেত্র গালী সেক্টর থেকে জুগদিদি সেক্টরে আসতে হয়েছে। জুগদিদিতে আমাদের ইউ এন এর জন্য নির্ধারিত এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের নিজস্ব ফ্লাইট দিয়ে সরাসরি টিবলিসিতে এসেছি। আমাদের নিজস্ব প্লেনে আসা যাওয়ায় কনো ভাড়া লাগে না। প্রায় আড়াই ঘন্টা ফ্লাইট। ছোট আন্তোনোভ প্লেন। মাত্র ৪ জন পেসেঞ্জার আমরা। নেমে গেলাম টিবলিসি এয়ারপোর্টে।
সোরেনা আগে থেকেই আমাকে একটা গাইড লাইন দিয়ে রেখেছিলো, কিভাবে টিবলিসি এয়ারপোর্টে নেমে কোনো কোন ইমিগ্রেশন পয়েন্ট দিয়ে বেরিয়ে কোথায় যেতে হবে। এটাও গাইড লাইনে ছিলো যে, এয়ারপোর্টের বাইরে একজন মেয়ে থাকবে আমার জন্য, যাদের বাসায় আমি উঠবো। মেয়েটির নাম দেদুনা বুকিয়া।
আমি এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আমার জন্য অপেক্ষারত মেয়েটির সন্ধান করছিলাম। একটা প্লেকার্ড থাকলে ভালো হতো। কিন্তু সম্ভবত প্লেকার্ডের ধারনাটা ওর নাই। আর আমি মেয়েটাকে চিনিও না। জর্জিয়ার সব মেয়েরাই সুন্দর আর সবাই দেখতে প্রায় একই রকমের। ভাবলাম, আমি তো আর জর্জিয়ানদের মতো নই। ফলে হয়তো মেয়েটা আমাকে দেখলে বুঝতে পারবে।
ঠিক এই সময় ২২/২৩ বয়সের একটি চমৎকার নীল নয়না যুবতী মেয়ে সেন্ডু একটা গেঞ্জি পড়ে আমার সামনে এসে বল্লো, তুমি কি মেজর আখতার?
বুঝলাম, এটাই সেই মেয়ে যার জন্য আমি অপেক্ষা করছি।
আমি হেসে দিয়ে বললাম, হ্যা, আমিই মেজর আখতার। তোমার নাম কি?
সে উত্তরে বলল, তার নাম দেদুনা বুকিয়া। সোরেনার খালাতো বোন।
মেয়েটি অসম্ভব সুন্দুরী, কোকড়ানো চুল, আর তার চোখ সত্যি সত্যিই একদম নীল রঙ এর।
বললাম, চলো।
দেদুনা একতা ট্যাক্সি ভারা করলো, কি যেনো বল্লো, তারপর আমি আর দেদুনা একসাথে ওদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম। দেদুনা বল্লো, ওখান থেকে প্রায় ৪০/৪৫ মিনিটের পথ। একটা পাহাড়ি বা মাল্ভুমিতে ওদের বাসা। ওটা একটা সরকারী কন্ডোমুনিয়াম, থাকতে খারাপ লাগবে না।
কথা হচ্ছিলো দেদুনার সাথে। সুন্দর ইংরেজী বলে। সে আসলে একজন সাংবাদিক। অবিবাহিত।
বললাম, দেদুনা, তোমার চোখের দিকে তাকালেই তো ট্যাক্সী ভারা মাফ হয়ে যাবার কথা। কারন লন্ডনে যাদের চোখের রঙ নীল, তাদের জন্য সবকিছু মাফ। কারন তারা মনে করে, ওরা রয়েল ফ্যামিলির সদস্য। এভাবেই ওর সাথে বেশ অনেকক্ষণ কথা বিনিময়ের পর, একটা মালভুমির মতো এলাকায় গাড়ি ঢোকে গেলো।
জর্জিয়ার সব গুলি বাড়ি প্রায় একই রকম। রাশিয়ার ধাচেই করা। জায়গাতা আমার ভালো লাগলো। এতা একতা সরকারী কোয়ার্তার। দেদুনার মা একটা সরকারী স্বাস্থ্য বিভাগের কনো একটা ডিপার্ট্মেন্টে রেডিওলোজিষ্টের কাজ করেন। অত্যান্ত অমায়িক মহিলা।
বাসায় ঢোকেই দেখলাম, আমার জন্য একতা আলাদা রুম দেয়া হয়েছে। আমার রুমের পাশেই বড় হাইওয়ে রাস্তা দেখা যায়। আমার রুম থেকে বের হলেই দেদুনাদের ড্রইং রুম, সেখানে ২০ ইঞ্চির একতা টিভি আছে, সোফাসেট আছে। সরকারী কোয়ার্তার সব সময়ই বড় সাইজের হয়। আমার পাশেই একটা কমন টয়লেট, তারপাশে থাকে দেদুনা আর ওর আরো দুইবোন, তামারা আর সালোমি। তামারা বড় আর সালোমী ছোট। আমি তো প্রথমে সালোমীকে দেখে বুঝতেই পারি নাই যে, ও ছেলে না মেয়ে। কারন ছোট ছোত চুল, গড়ন দেখে মেয়েলী বুঝা যায় না। সবাই খুব মিশুক। সোরেনা আগে থেকেই সম্ভবত ওদের বলে রেখেছিলো আমার খাবারের অভ্যাস গুলি কি। তাই আমি যখন বাসায় পৌঁছলাম, তখন প্রায় দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গিয়েছিলো। ওরা বেগুন আর ভাত পাক করেছিলো। বাংলাদেশের মতো তো আর খাবার হবে না, কিন্তু খেতে পারলাম।
রাশিয়া বা জর্জিয়ার একটা কথা আগেই বলেছিলাম যে, এরা যে কোনো অতিথিকে "চা চা" নামের এক প্রকার এল্কোহল দিয়ে আপ্যায়ন করে। আমরা যেমন কেউ এলেই চা দেই বা কফি দেই, ওরা দেয় "চা চা" প্রায় ৭৫% এল্কোহল। নিজেরাই বানায়।
আমি ওদের সাথে প্রায় কয়েকদিন থাকার যেহেতু প্ল্যান করেছি, ফলে আমিও চাইছিলাম যে, আমি ওদের মতো করে একেবারে মিশে যাবো। দেদুনাকে বললাম, দেদুনা, একটা সিডিউল করো, আমরা প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাবো, ঘরে থাকবো শুধু রাতের বেলায়। ওরা অনেক ভ্রমন পিয়াসু, খুব পছন্দ করলো। প্রথম দিন আমরা টিবলিসির একটা "ঈগল" রেষ্টুরেন্টে সবাই ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করতে গেলাম। আন্টি গেলেন না। এখানে আমাদের সাথে আরো একজন সাথী জয়েন করেছিলো, সেও দেদুনার খালাতো বোন, নাম রুসুদিন। সে ডাক্তার। কারোরই বিয়ে হয় নাই।
আমরা যেখানেই যাই দল বেধে এই কয়জন যাই। খেতে গেলেও এক সাথে, ঘুরতে গেলেও এক সাথে, গল্প করলেও এক সাথে। অনেক রাতে বাসায় ফিরলাম।
পরদিন খুব ভোরে আমার ঘুম ভাংগলো। দেখলাম, এতো ভোরে ঘুম ভাংগ্লেও সবাই জেগে গেছে। আমি জাগার পর দেদুনা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, নাস্তা খাবো কি খাবার। বললাম, তোমরা যা খাও আমিও সেটাই খাবো। দেদুনা বল্লো, আমরা তো পাউরুটি খাবো।
ওরা একটা পিপায় পাউরুটি রাখে, সাথে একতা ছোট কুড়াল। কারন পাউরুটি গুলি প্রিজার্ভেশনের নিমিত্তে এমন করে বানানো হয় যে, পাউরুটির উপরিভাগ অনেক শক্ত রাখে যা সাধারন হাতে ছিড়া যায় না, একটা ছোট কুড়াল লাগে। যেই পাউরুটির উপরিভাগ কেটে ফেলা হয়, ভিতরের পাউরুটি একদম ফ্রেস থাকে এবং নরম।
দেদুনাকে বললাম, ডিম ভাজি করতে পারো? বল্লো, হ্যা পারি তো।
আমি দেদুনার সাথে রান্না ঘরে গেলাম, দেখলাম কিভাবে ওরা ডিম ভাজে। খুব মজার একটা জিনিষ শুখলাম। ওরা তেল খায় না। প্রায় খায় না বললেই চলে। তাহলে ডিম ভাজে কিভাবে? ওরা যে কাজতা করে, করাইয়ের মধ্যে একটু দুধ দিয়ে দেয় যেটা তেলের কাজ করে। এই দুধের করাইতে ওরা ডিম ভাজে। ব্যাপারটা খারাপ না।
এভাবেই দুইদিন কেটে গেলো।
আমি ভাবলাম, পরোটা খেতে পারলে ভাল হয়। কিন্তু ওরা পরোটা কি তাইই জানে না। আমি বিকালে কিছু ময়দা নিয়ে এলাম, সাথে সোয়াবিন তেল। আমিই সকালে দেদুনাকে নিয়ে আর সালোমিকে নিয়ে ময়দা ছানলাম, তেল দিয়ে করাই গরম করলাম, তারপর কোনো রকমে বিচ্ছিরী সেপের একটা পরোতা বানালাম। কারন পরোতা বানানোর কোনো বেলুনি ছিলো না। যখন আমি তেলের ভেজে পরোটা বানালাম, ওরা ব্যাপারটা খেয়ে খুবই মজা পেলো। শুরু হয়ে গেল পড়োটার নাস্তা প্রতিদিন। এই সময়ে আমার মাথায় একতা বুদ্ধি এলো, আর বুদ্ধিতা হচ্ছে, আমি যদি কিছু বাংলাদেশী খাবার বানাই, তাহলে ওরা হয়তো পছন্দ করতেও পারে। আমি রান্না জানি না, কিন্তু যেহেতু এতো বছর ধরে বাংলাদেশী খাবার খাচ্ছি, ফলে একতা ধারনা তো আছেই।
পরদিন বললাম, তোমরা কি খিচুড়ি খেতে পছন্দ করো? খিচুড়ি কি, সেটা তো ওরা জানে না। কিন্তু এবার ওরা ভাবছে, পরোটা খেয়ে যেহেতু ওরা খুব মজা পাচ্ছে, খিচুড়ি নিশ্চয় আরো কোনো ভাল খাবার হতে পারে। ভাবলাম, খিচুড়িতে কিছু গরুর মাংশ দিলে মন্দ হয় না। কিনে আনলাম কিছু গরুর মাংশ। আমি মুটামুটি তেল আর কিছু মসল্লা (আমি সাথে করে কিছু মসল্লা নিয়ে এসেছিলাম) মেখে মাংশটা কসিয়ে নিয়ে নরম করে তরকারীর মতো করে ফেললাম। তারপর খিচুড়ি পাক করা তো কোনো ব্যাপার না। একটু ঝাল হয়ে গিয়েছিলো। সবাই খেয়ে আরো মজা পেলো কিন্তু ঝালের ব্যাপারটা ওরাই বুঝে নিলো কতটুকু ঝাল দেয়া দরকার।
দেদুনাদের বাসায় আমার খাবার নিয়ে কোনো প্রকারের আর ঝামেলা রইলো না।
আমি প্রতিদিন সবাইকে নিয়ে কখনো পার্কে, কখনো রেষ্টুরেন্টে, কখনো কোনো ঐতিহাসিক স্পটে আবার কখন মার্কেটে, আবার কখনো বীচে যাই। বিকিনী পরা আমার এই বন্ধু গুলিকে আমি কখনো অশ্লীল চোখে দেখার মনোভাব খুজে পাই নাই। এমনো হয়েছে, গলায় গলায় ধরে, আমরা হেটে গিয়েছি, বীচে শুয়েছি, খেলা করেছি। অদ্ভুদ সময়টা কেটেছে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমি এখানে একজন অতিথি।
৫/৬ দিন পর সোরেনা এলো। আরো ভালো সময় কাটলো।
যেদিন আমি চলে আসবো, ওরা আমাকে কাদিয়েছিলো বিরহে। একটা গাড়ি নিয়ে সেই টিবলিসি থেকে সরাসরি আমি যুগদিদিতে এসেছিলাম। কিন্তু আমি সরাসরি আমার বাসায় এলাম না। দেদুনা যুগদিদিতে ওর এক খালার বাসায় আমাকে নিয়ে গেলো। প্রথমে বুঝতে পারি নি ওরা যে এতো গরীব। ওরা আসলে কাউকেই বুঝতে দেয় না ওদের আর্থিক অবস্থার কথা। আমি আর ওর খালু এক রুমে থাকলাম, দেদুনা আর ওর অন্যান্য সব বোনেরা থাকলো আরেক রুমে। রাতে সবার সাথে খাওয়া দাওয়া করলাম। খুব মজা হলো। পরেরদিন সকাল ১০ তাঁর দিকে আমি আমার ২০ নম্বর বাংলাদেশী বাসায় যুগদিদিতে চলে এলাম। সবার কথা আজো আমার খুব মনে পড়ে।
২৮/০১/২০০৩- জর্জিয়া থেকে সচি ভ্রমন
Categories
বেশ অনেকদিন হয়ে গেলো জর্জিয়ায় এসেছি। গত অক্টোবর মাসে জর্জিয়াতে জাতীসংঘের মিশনে এসেছি। আশেপাশে সারাটা দেশ ঘুরলাম। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ, তারপরেও বেশ সুন্দর। বুঝা যায় যে, সোভিয়েট ইউনিয়নের সময় দেশের অবস্থা যথেষ্ঠ পরিমান মজবুত আর শক্ত ছিলো। বেশ গাছ গাছালী আছে সব জায়গায়। মাঝে মাঝে আমার একটা কথা মনে হয় যে, আমরা যারা বাংগালী নিজের দেশের সবুজ বনায়ন দেখে কত গান, কত কবিতা লিখি যেনো আমাদের দেশটাই শুধু সবুজ গাছগাছালী দিয়ে ঈশ্বর সাজিয়েছেন। কিন্তু সেটা মোটেও সত্য নয়। বিভিন্ন দেশ ঘুরে তো দেখলাম, যে, বরং আমাদের দেশটাই পিছিয়ে আছে। এমন কি এই সবুজ বন্যায়নের দিক দিয়েও। কয়েকদিন যাবতই ভাবছিলাম, পাশেই রাশিয়া, ঘুরে আসি। আমাদের জাতীসংঘের সেনাবাহিনীর কোনো জায়গাতেই যাওয়া আসার জন্য কোনো রেস্ট্রিকসন নাই। ইচ্ছে করলেই ইউনিফর্ম পড়েই যেতে পারি, জাতীসংঘের গাড়ি সেলফ ড্রাইভিং করেই যাওয়া যায় একদেশ থেকে আরেকদেশে। তেলের খরচ লাগে না, গাড়ির জন্য কোনো আলাদা পয়সা লাগে না। বেশ ভালো।
কোনো বাংলাদেশীদের সাথে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। তাদের সাথে গেলে যেটা হয়, হয় বেশি আতেল্গিরি না হয় একটা বোঝা হয়ে দাড়ায়। আনন্দের চেয়ে হয় বিরক্ত আসে অথবা মেহনত বাড়ে। কিন্তু কোনো বিদেশীদের সাথে একোম্পানি করলে ব্যাপারটা অনেক সাচ্ছন্ধবোধ লাগে। এখানে অনেকের সাথেই আমার খুব ভালো খাতির। বিশেষ করে পর্তুগাল, পোল্যান্ড কিংবা তুরুষ্কের অফিসারদের সাথে। জার্মানীর সবার সাথেই আমার বেশ ভাল একটা ফ্রেন্ডশীপ আছে। অনেকেই বেড়াতে যাওয়ার সময় আমাকে সংগী করে নিতে চাইলেও কেনো জানি আমার যাওয়া হচ্ছিলো না। তাই এবার ভাবলাম, রাশিয়া থেকে ঘুরে আসি। জর্জিয়া থেকে সবচেয়ে কাছের যে পোর্ট সিটি তার নাম সচী। আমাদের মিশন এলাকা থেকে বেশীর ভাগ অফিসাররা এই সচীতে গিয়েই সপ্তাহান্তের ছুটিগুলি কাটিয়ে আসে। কেউ যায় সস্তা রাশিয়ান মেয়েদের সাথে সেক্স করতে আবার কেউ যায় জাষ্ট একটা বিনোদনের উদ্দেশ্যে। আমার কোনো শখ নাই রাশিয়ান মেয়েদের সাথে কোনো প্রকার দৈহিক আনন্দের, আর এটা আমি মোটেও পছন্দ করি না। তাই আর যাওয়াও হচ্ছিলো না।
উরুগুয়ের এক বিমান বাহিনীর অফিসার, নাম লিওনার্দো, আমার খুব ভালো বন্ধু। সে একদিন এসে বল্লো, আখতার চলো সচী থেকে ঘুরে আসি। ভাবলাম, যাওয়া যেতে পারে। আমাদের সচী যাওয়ার জন্য যা লাগবে তা হলো একটা গাড়ি, আর অনুমতি। দুটুই সহজ এখানে। সেভাবেই আমি আর লিউনার্দো পরিকল্পনা করলাম ২৪ তারিখেই সচী যাবো। তিনদিনের ছুটিই যথেষ্ট। আমি রাশিয়ান ভাষা একদম বুঝি না, এদিকে আবার লিউনার্দো উরুগুয়ের বাসিন্দা বলে অনর্গল পারুস্কি বা রাশিয়ান ভাষাটা তার দখলে। ফলে আমরা তারিখ করেই ফেললাম যে ২৪ তারিখে আমরা রাশিয়ার সচিতে বেড়াতে যাবো। আমি আর লিউনার্দো খুব ভোর বেলা রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমরা দুজনেই ড্রাইভিং জানি। সুতরাং কিছু সময় আমি আবার কিছু সময় লিউনার্দো ড্রাইভ করতে করতে সচীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তাটা বেশ লম্বা। প্রায় আরাই শ কিলোমিটার। আমাদের রাস্তাটা ছিলো প্রায় এই রকম-
জুগদিদি-গালি-অচামছিড়া-লাব্রা-সুখুমি-গুদাউটা-ঘাগ্রা-সিনাতলে-গান্দিয়াদি-খিবানি-আডলার-খোসতা-খোস্টিনিস্কি হয়ে সচী। পুরু রাস্তাই এ-১৪৭ নামে পরিচিত। খুব সুন্দর রাস্তা।
আমরা যখন সচী পৌঁছলাম, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। পথে অনেকবার থেমেছিলাম, কখনো কফির জন্য, কখনো এম্নিতেই ছবি তোমার জন্য। আবার কখনো কারো সাথে রাস্তার ডাইরেকশন জানার জন্য। শীতকাল। ফলে দ্রুত বেলা পড়ে আসছিলো। আমরা তখনো জানি না কোন হোটেলে যাবো। কিন্তু আগে থেকেই একটা ধারনা ছিলো যেহেতু অনেকেই এখানে আসেন। আমাদের অন্যান্য অফিসাররাও এখানে আগে আসায় তাদের কাছ থেকে আমরা একটা আইডিয়া করে এসছি।
প্লেহানোভা স্ট্রীটে ইম্পেরিয়া নামে মূটামুটি ভালোমানের একটা হোটেল আছে যেখানে অনেক অফিসাররাই এসছিলো, ফলে আমরা সেটার খোজই নিচ্ছিলাম। হোটেলে যাওয়ার পর দেখলাম একেবারে মন্দ না। দামও মুটামুটি সস্তাই। রুমভাড়া মাত্র ২৫ ডলার করে। ডাবল বেড। আমার আর লিউর তাতে হয়ে যায়। আমরা ব্যাগ রুমে পাঠিয়ে দিলাম, আর গাড়িটা হোটেলের গ্যারেজেই দেওয়ার জন্য একটা দরখাস্ত করে ফেললাম। রিসেপসনে যে ভদ্র মহিলা বসেছিলেন, তার বয়স প্রায় ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে হবে। জিজ্ঞেস করলাম, খাবারের ব্যবস্থা কি। আমরা আসলে হোটেলের খাবারের উপর নির্ভর করতে চাই নাই। ফলে আমরা আগেই হোটেল রুম ভাড়া নেওয়ার সময় ফুড পোর্শনটা বাদ দিয়ে ভাড়ার ব্যাপারটা মিটিয়ে নিয়েছিলাম। যেহেতু আমাদের সাথে গাড়ি আছে, ফলে, যে কোনো লং ডিসটেন্সে গিয়েও আমাদের চয়েজ মতো খাবার খেতে পারি।
হোটেলে ঢোকার পর একটু ফ্রেস হয়ে নিলাম। তারপর আবার বেরিয়ে গেলাম বাইরে। লিউ যেহেতু রাশিয়ান ভাষাটা বুঝে ফলে আমার খুব একটা বেগ পেতে হয় নাই। রাশিয়ায় খুবই কম লোক ইংরেজীতে কথা বলতে পারে কিংবা বলে। ফলে আমি কতটুকু ইংরেজীতে দক্ষ তাতে কিছুই যায় আসে না। বরং পুরা বাক্য না বলে যদি কেউ ভেঙ্গে ভেঙ্গে গুটিকতক ইংরেজি শব্দ বলতে পারা যায়, তাহলে হয়তো কেউ কেউ কিছু ইংরেজী ভাষা বুঝতে পারে। গ্রামার দিয়ে শুদ্ধরুপে যেই ইংরেজী বলবেন, সব তালগোল পাকিয়ে ওরা আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। যদি কাউকে বলেন, ডু ইউ নো হাউ টু স্পিক ইংলিশ? কিছুই হয়তো বুঝবে না। তাকে যদি বলেন, স্পিক স্পিক ইংলিশ? তাহলে হয়তো কাজে দিতেও পারে।
প্রথম দিন সচীতে। রাতের বেলায় বেরিয়ে কোনো একটা মার্কেট খুজতেছি। ভালো মার্কেট যে কোথায় সেটা পাওয়া খুবই জটিল মনে হলো। রাত প্রায় ৯টা বেজে গেছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা কোনো রকম রেষ্টুরেন্টে আমি আর লিউনার্দো কিছু একটা আপাতত খেয়ে নিলাম। লিউকে দেখে অনেকটা রাশিয়ান রাশিয়ান মনে হলেও আমি যে এখানে বিদেশী এটা ওদের কারোরই বুঝার বাকী ছিলো না। রাস্তাঘাট বেশ ফাকা। একটা বয়স্ক মহিলা আমাদের কাছে এসে বল্লো, "তেবে নুঝনা দেবুস্কা?" লিউনার্দো আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিয়ে বল্লো, বুঝতে পেরেছো, মহিলা কি বলছে? আমি বললাম, নাহ। লিউনার্দো বল্লো, তোমার কোনো মেয়ে চাই কিনা। তার কাছে ভালো আনাড়ি সুন্দুরী মেয়ে আছে, এবং যুবতী। বুঝলাম, সচী এমন একটা জায়গা যেখানে বেশ্যাবৃত্তি হচ্ছে প্রধান ব্যবসা। একটু পরপরই কেউ না কেউ এসে সেই একই কথা বলে যাচ্ছে, আমাদের কোনো মেয়ে চাই কিনা। কি তাজ্জব।
যাই হোক, আমি আর লিউনার্দো হোটেলে চলে এলাম। আমি লিউকে বললাম, লিউ বেশীদিন তো আর এখানে থাকতে আসিনি, চলো, রাতের রাশিয়া দেখে আসি। লিউ আমার খুব ভক্ত। বল্লো, চলো যাই তাহলে। আমরা গাড়ি নিলাম না। পায়ে হেটেই বেশ কিছুদুর এগুলাম। শুনশান রাস্তা, লাইট পোষ্টগুলি জলছে। কুয়াসায় রাস্তা প্রায় ঢেকে যাচ্ছে। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে লিউকে নিয়ে সচী রিভারের কাছাকাছি চলে এলাম। প্রচুর মানুষ নদীর পারে। দেখলাম, প্রায় সবগুলি মানুষই মাতাল। ছেলেমেয়েরা একে অপরের সাথে প্রেম করছে, মাতামাতি করছে। আর পাশে এক বেহালাবাদক নিজের মনের সুখে বেহালা বাজিয়ে যাচ্ছে। এই বেহালার সুরে আবার কোনো কোনো মাতাল কিছু একটা দিয়ে বাদ্য যন্ত্রের মতো ঢোল পিটাচ্ছে। আর এই ঢোলের তালে তালে আবার কেউ কেউ এমন নাচনী দিচ্ছে, মনে হয় না কোনো কালে সে নাচ শিখেছে। এই নাচ দেখে আবার কেউ কেউ তাকে উতসাহও দিচ্ছে। মানুষ যখন মাতাল হয়, পাশে বসা কুকুরের আওয়াজ ও মধুর সুরের মতো হয়তো মনে হয়। মাতাল অবস্থা একটা দেখার মতো অভিজ্ঞতা।
রাত প্রায় বারোটার দিকে আবার আমি আর লিউনার্দো হেটে হেটেই আমাদের হোটেলে চলে এলাম। এই আসার পথে কমপক্ষে তিন থেকে চার জন আমার কাছে সিগারেট চেয়ে নিলো। এখানে সিগারেট চাওয়া যেনো একটা মামুলি ব্যাপার, হোক সে পরিচিত বা অপরিচিত। একটা জিনিষ খেয়াল করলাম যে, রাস্তায় অনেক লোক নেশা করে হেটে বেড়ায় কিন্তু অসভ্যতা করে না। আমাদের দেশ হলে তো ব্যাপারটা হতো ভয়ংকর। এখানে মাতালেরও একটা নীতি আছে।
হোটেলল রুমে ঢোকেই দেখি দরজার নীচ দিয়ে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬টা ভিজিটিং কার্ড পড়ে আছে। সবগুলি কার্ড সেক্স গার্লদের। রুম সার্ভিস সহ অফার। কি তাজ্জব। সেক্স এখানে এতো জনপ্রিয় আর সস্তা? অনেক রাস্তা আজ ড্রাইভিং করেছি, আবার রাতও কম হয় নাই। টায়ার্ড লাগছে, তাই আমি আর লিউ পাশাপাশি বেডে শুয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
পরদিন, প্রায় অনেক বেলা হয়ে গেলো ঘুম থেকে উঠতে উঠতে। আমরা যখন ঘুম থেকে উঠলাম, বেলা তখন প্রায় ১১ টা সকাল। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। আমার আসলে ভাত না হলে চলেই না। লিউকে বললাম, লিউ চলো, ভাতের কোনো রেষ্টুরেন্ট পাও কিনা। লিউ আবার এইসব ভাত খেতে পছন্দ করে না। আমাদের ইম্পেরিয়ার পাশেই একটা ছাউনীওয়ালা লোকাল রেষ্টুরেন্ট ছিলো। আমার মনে হলো, সেখানে হয়তো ভাত পাওয়া যেতে পারে। লিউ যেতে চাইলো না। ওর নাকি ক্ষুধা নাই। সে একটা বিয়ার নিয়ে জানালার পাশে বিয়ার খেতে থাকলো। আমি একাই বেরিয়ে গেলাম। বেশী তো আর দূর নয়, এই পাশেই তো। প্রচুর লোক তখনো খাচ্ছে। একটা গমগম ভাব। আমি ঢোকলাম, আমি জানিনা কিভাবে 'ভাত খাবো এটা বলতে হয়'। তো, ওখানে একটা ২০/২২ বছর বয়সী ছেলে খাবার সার্ভ করছিল। আমি ইশারা করতেই সে আমার কাছে এসে, ওদের ভাষায় কি খাবো হয়তো জিজ্ঞেস করলো। আমি আসলে বুঝতে পারি নাই। বললাম, মেন্যু কার্ড? ছেলেটা আমার কথা বুঝলো। একটা মেন্যু কার্ড নিয়ে এলো। বেশীর ভাগ লেখা রাশিয়ান ভাষায়। এম্নিতেই ভাষা বুঝিনা, তাও আমার লেখা। এটা আমার কাছে থাকা যা, আর না থাকা একই। ছেলেটাকে বললাম, 'রাইস?"
ছেলেটা কি বুঝলো বুঝলাম না, সে একটু পড়ে ফিস কাটলেট নিয়ে হাজির। আমি খুব বিরক্ত হলাম, কারন, আমি ভুলেও ফিস উল্লেখ করি নাই, সে কেনো ফিস নিয়ে এলো? আমার মুখের অভিব্যক্তিতে ছেলেটা বুঝতে পেরেছিলো। সে "প্রোস্তিতে" প্রোস্তিতে, বলতে বলতে আবারো ভিতরে চলে গেলো। এবার কোনো খাবারই সে আনে নাই। এদিকে আমার ক্ষুধায় পেট চু চু করছে। একটু বিরক্তও হচ্ছিলাম। লোকজন তাদের খাবার খেয়ে একে একে বের হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি খাবারের অর্ডারই দিতে পারলাম না।
আবারো আমি ছেলেটাকে বললাম, রাইস রাইস? সে যেন আমার কথা কিছুই বুঝলো না এবার। মাথা নেড়ে যা বল্লো সেটার অর্থ, সে আমার কথা বুঝতে পারছে না। আমি এতোটাই বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম, যে, ভাবলাম, এখানে খাওয়ারই দরকার নাই। আমি উঠতে যাচ্ছিলাম। একটু রাগ আমার চোখে। প্রায় বেরিয়েই যাচ্ছিলাম, এমন সময় খুব চমৎকার ইংলিশে পিছন থেকে একটা ২৪/২৫ বছরের ইয়াং মেয়ে বল্লো, এক্সকিউজ মি স্যার!!
আমি পিছনে তাকিয়ে দেখলাম, মেয়েটার গায়ে একটা এপ্রোন পরা। সম্ভবত রান্না ঘর থেকে এসছে। আমাকে ক্লিন ভাষায় জিজ্ঞেস করলো, ক্যান আই হেল্প ইউ? মনে মনে খুব আশ্বাস পেলাম যে, মেয়েটা মনে হয় ইংরেজী বুঝে।
আমি বললাম, আমি ভাত খেতে চাই, আছে?
মেয়েটা আমার হাত ধরে টেনে রান্না ঘরের দিকে নিয়ে গেলো। সম্ভবত সে 'রাইস' কথাটা বুঝে নাই। অথবা বুঝলেও কেনো আমাকে রান্না ঘরে নিয়ে গেলো সেটা আমার মাথায় আসলো না। রান্না ঘরে যাওয়ার পর সে একেএকে তার ডেকচিগুলি খুলে আমাকে দেখাচ্ছে, কোন খাবারটা আমি খেতে চাই। আমি একটা ডেকচিতে দেখলাম, ভাত আছে। বললাম, এইটা।
মেয়েটা হেসে দিয়ে বল্লো, অহ রিস? বুঝলাম, ওরা রাইস বলে না, বলে রিস।
সে আমাকে আবারো টেবিলে বসতে বল্লো, আর বল্লো, ফাইভ মিনিটস।
বসে আছি, প্রায় ১০ মিনিট পর মেয়েটা শুধুমাত্র এক কাপ ভাত আর একটা খালি প্লেট নিয়ে আমার টেবিলে রাখলো। আমি তো অবাক।
আরে ভাই, ভাতটা খাবো কি দিয়ে?
যাই হোক, মেয়েটা আমার অসহায়ের অবস্থাটা বুঝতে পেরে, প্রথমে ছেলেটা যে ফিসকাটলেটটা নিয়ে এসছিলো, সেটা দিয়ে বল্লো, আপাতত এটা দিয়ে খাও। আমি তোমাকে পরে ভাল খবর দেবো। তুমি কি ইন্ডিয়ান?
মেয়েটি আমাকে তার একটা ভিটিং কার্ড দিয়ে বল্লো, রাখো এটা, কাল আবার তোমার সাথে ঠিক এই সময় এস, কথা বল্বো। কার্ড তা হাতে নিয়ে পড়ে দেখলাম, ওর নাম, এলিজাবেথ (লিজা), ৪র্থ বর্ষ, হোম আর্টস, ইউনিভার্সিটি অফ রাশিয়া।
১২/১০/২০০২-ট্র্যাবজন থেকে জর্জিয়া
Categories
ট্র্যাবজনে যখন পৌছলাম, তখন রাত প্রায় দশটা। ছোট একটা এয়ারপোর্ট। একেবারেই নিস্তব্ধ। গুটি কতক লোক যেনো পুরু এয়ারপোর্ট টাকে আগলে রেখেছে। দোকান পাট যাও আছে, খদ্দরের অভাবে সে গুলিও প্রায় বন্ধের মতো। এয়ারপোর্ট যতোই নিস্তব্ধ হোক, এর ভিতরের একটা রুপ আছে। সুন্দর, পরিপাটি ফ্লোর, দোকান পাট বন্ধ থাকলেও এদের বাইরের সাইন বোর্ড আর বিজ্ঞাপন চোখে পড়ার মত। এখানে যে সব দোকান পাট খোলা, তারা যেনো নিরাপত্তার মতো ব্যাপারটা মাথায়ই নাই, কোনো চোর ডাকাতের ভয় নাই। এটা একটা আরেক জগত।
এয়ারপোর্টের ভিতরেই টাকা ভাঙ্গানোর এক্সচেঞ্জ গুলি বসে আছে। সুদুর ঢাকা থেকে ডলার নিয়ে এসেছি কিছু। কোথাও কিছু খেতে গেলে বা কিনতে গেলেও লোকাল কারেন্সি লাগবে। তাই মেজর ইরশাদ বল্লো, স্যার, কিছু দলার চেঞ্জ করে নেই। খারাপ বলে নাই, ভাবলাম, শ পাছে ডলার ভাংগিয়ে নিয়ে যাই। আবার ভাবলাম, আগামী কালই তো চলে যাবো তুরস্ক ছেড়ে, এতো ডলার এক্সচেঞ্জ করা কি ঠিক হবে? যাই হোক, সিদ্ধান্ত নিলাম, তিনশত ডলার আপাতত এক্সচেঞ্জ করি। বাকিটা জর্জিয়া গেলে তো ওখানকার লোকাল কারেন্সি লাগবে।
এখানে একটা মজার ব্যাপার ঘটে গেলো যা আমার বা মেজর ইরশাদের অভিজ্ঞতার বাইরে। ডলার ভাঙ্গাতে গিয়ে হতবাক হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না। এদের মুদ্রার নাম লীরা। আর এখানে এক ডলার দিয়ে প্রায় এক লক্ষ ষাট হাজার লিরা পাওয়া যায়। তার মানে আমি যদি এখন ৫০০ ডলার ভাঙ্গাই, তাহলে কত লীরা হবে বুঝতে পারছিলাম না। একি দেশ? তারপরেও, নিলাম। এখন কত পাইলাম, আর কত পাওয়া উচিত ছিলো, আদৌ সব ঠিক মতো পাইলাম কিনা এই অবেলায় ক্ষুধার্থ পেটে আর মাথা কাজ করছিলো না। সারাদিনের প্রচন্ড জার্নীতে শরীর প্রায় অবশ। এখন তাড়াতাড়ি কোনো একতা হোতেলে গিয়ে উঠতে পারলেই যেনো বাচি। প্রায় এক ব্যাগ লীরা নিয়ে এয়ারপোর্ট ছেড়ে ট্র্যাবজন শহরের দিকে ছুটলাম। তখন রাত প্রায় ১১ টার কাছাকাছি। শহরও প্রায় নির্জন হয়ে এসছে।
একটা ভাড়া করা গাড়িতে আমি আর মেজর ইরশাদ ট্র্যাবজন শহরে চলে এলাম, পথে ঘাটে লোকজন নাই বললেই চলে। গাড়ির ড্রাইভার আমাদেরকে একতা সাধারন হোটেলের সামনে এনে কাকে যেনো উচ্চস্বরে ডাক দিলো। যেহেতু আমরা ওদের ভাষা বুঝি না কিন্তু আকার ইংগিতে এটা বুঝলাম যে, সম্ভবত হোটেলের কোনো এক কর্মচারীকে নতুন খদ্দর নিয়া এসেছি এটা জানান দিলো।
একটু পর মধ্য বয়সী একজন লোক এসে তাদের মধ্যে কি কি কথাবার্তা জানি হলো, আমাদেরকে একতা ক্যাল্কুলেটরের মাধ্যমে বুঝাইলো যে, হোটেল ভাড়া এক রুম প্রতি দিনের জন্য প্রায় ৫০ ডলারের সমান। কিছু করার ছিলো না। কারন রাত অনেক, শরীরের উপর অনেক ধকল, এদিকে আবার অন্য কোথাও গিয়ে রুম পাই কিনা, পাইলেও এর থেকে ভালো এবং সস্তায় হবে কিনা জানি না, তাই রাজী হয়ে গেলাম। ড্রাইভারকে ভাড়া দিতে গিয়াও কারেন্সীর হিসাব নিয়া বড় বেসামাল। একেকতা নোত এক লক্ষ লীরার সমান। নোটের মধ্যে এতো বড় বড় সংখ্যা যে, পড়তে গেলে এক দুই তিন করে করে খালী শুন্যই গুনতে হয়।
আমি আর ইরশাদ মালামাল নামিয়ে হোটেলে উঠে গেলাম। শীত টা ঝাকালো না কিন্তু আবার কম ও না। ল্যাপ কম্বল সব বুঝে নিলাম। আমরা হাত মুখ ধুয়ে বাইরে খাওয়ার জন্য বেরিয়ে গেলাম। পাশেই একতা ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে এমন একতা রেষ্টুরেন্ট আছে। আমরা বেশি ঘুরাঘুরি না করে পাশের রেষ্টুরেন্টেই খাওয়ার জন্য ঢোকে গেলাম।
রেষ্টুরেন্টের ভিতরে মাত্র দুজন মানুষ বসে আছে। একজন মহিলা আর আরেক জন পুরুষ। এ গুলি নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নাই। কিন্তু পরে অনুভব করলাম, আমাদের যদিও তাদের নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নাই, কিন্তু তাদের মাথা ব্যথা ছিলো আমাদের নিয়ে। তাদের মধ্যে পুরুষ ব্যক্তিটি আমাদের টেবিলে এসে বসলেন। ভালো ইংরেজী বলতে পারেন। সালাম দিয়ে আমাকেরকে জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে এসেছি।
এখানে একতা কথা বলে রাখা ভাল যে, মিশনে আসার আগে আমরা তুরস্ক নিয়েও একতা ফিডব্যাক নিয়ে এসছিলাম। এখানকার লোক গুলি নাকি অনেক ফ্রড, সুযোগ আর সময় পেলেই বিদেশি পর্যটকদের ঠকাইতে ছাড়ে না। আমাদের মাথায় এতা ছিলো। ফলে, খুব সহজেই কারো ট্র্যাপে পড়ে যাবো এতা ভাবি না। যাই হোক, লোকটার আমাদের টেবিলে বসার উদ্দেশ্য নিয়ে আমার এবং মেজর ইরশাদের দুজনের মধ্যেই একই রকম সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিলো। আমরা মোটামুটি একতা সাধারন খাবারের অর্ডার দিয়ে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছি, আর এই ফাকে ভদ্রলোক আমাদের বিনোদনের জন্য এমন কিছু লাগবে কিনা জানালেন। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝি নাই।
বললাম, সিগারেট দরকার। কোথায় পাই?
লোকটি হেসে দিয়ে বললেন, আরে সিগারেট পাওয়া যাবে, সাথে কোনো সাথী লাগবে কিনা, লাগলে বলেন।
বুঝলাম, এরা মেয়ে ঘটিত কোনো ব্যাপার নিয়ে আলাপ করছে।
বললাম, না ভাই, আমরা মুসলমান, এসব ব্যাপারে আমরা আলাপ করতে চাই না। তারপর আগাইয়া এলেন সেই ভদ্র মহিলা। ব্যাপারটা ভালো ঠেকছিলো না। আর হোটেলটার মধ্যে লোক জন একেবারেই নাই। একটু নার্ভাস লাগছিলো যে, এরা আবার কোনো সংঘবদ্ধ গ্যাং কিনা কে জানে। ঠি এই সময়ে তৃতীয় একজন খদ্দর এলেন খাবারের জন্য। মনে হলো তিনীও আমাদের মতো এখানে নতুন।
আমাদের সালাম দিয়ে বললেন, আনারা কি এখানে আজই এসেছেন? বললাম, জী, আমরা জাতী সংঘের লোক। জর্জিয়ায় যাচ্ছি কাল ভোরে। কি মনে হলো, আর কি জানি হলো, আগের দুইজন লোক (মহিলা আর পুরুষটী০ এই নতুন লোকটিকে দেখার পর চলে গেলো।
আমরা মোটামুটি খেয়ে হোটেলে চলে এলাম।
আগামীকাল খুব ভোরে আমাদের ফ্লাইট, তাই কোনো বাক্সই আর খুললাম না। বাথ রুম করে শুয়ে পড়বো, কিন্তু বাথ রুমে গিয়ে দেখি পানি নাই। অনেক দাকাডাকি করেও কাউকে পেলাম না। ফোন আছে রুমে, কাউকে ফোন করেও পাওয়া গেলো না। রিসেপ্সন একটা আছে, কিন্তু কোনো লোক নাই। এয়ারপোর্ট থেকে দুই বোতল পানি কিনেছিলাম, আপাতত সেই পানি দিয়াই সব কাজ সারা হল। মেজাজ খারাপ করার কোনো উপায় নাই। একদিকে ভাষা বুঝি না। অন্যদিকে কেউ নাই যার সাথে রাগ দেখাতে পারি। ফলে আমি আর মেজর ইরশাদ তুরুষ্কের সরকারকে কিছুক্ষন গালাগালি করেই মনের শান্তি লাভ করিয়া ল্যাপ গায়ে দিয়া ঘুমাইয়া পড়িলাম।
১০/১০/২০০২- জর্জিয়ায় আগমন
Categories
গত ৪ অক্টোবর ২০০২ তারিখে আমি দ্বিতীয় বারের মতো জাতীসংঘের অধীনে শান্তিরক্ষা বাহিনীর অধীনে মিশনে এলাম। এবার মিশন এককালে রাশিয়ার অধীনে থাকা জর্জিয়ায়। ইউরেশিয়ার ককেশিয়ান রিজিয়নের মধ্যে ওয়েষ্টার্ন এশিয়া আর ইষ্টার্ন ইউরোপের মধ্যে অবস্থিত এই দেশটি। পশ্চিমে ব্ল্যাক সি, উত্তরে রাশিয়া আর দক্ষিনে আছে তুরস্ক আর আর্মেনিয়া। দক্ষিন পূর্বে আছে আজারবাইজান।
৪ অক্টোবর ২০০২ এ ঢাকা থেকে সুদুর জর্জিয়ায় কিভাবে কিভাবে এলাম, এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। রোজার দিন। আমি আর মেজর ইরশাদ (আমার জুনিয়ার, ১৭ লং কোর্ষের) আমরা একসাথে মিশনের উদ্দেশে ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়েছিলাম দুপুরের দিকে। আমি কর্মরত আছি আর্মি হেডকোয়ার্টারে এমটি পরিদপ্তরে আর মেজর ইরশাদ কর্মরত ছিলো এএফডি তে (আর্ম ফোর্সেস ডিভিশন)। দুটুই পাশাপাশি অফিস।
গত কয়েকদিনে মিশন এলাকার ব্যাপারে ওখানে থাকা মেজর আখতার শহীদের সাথে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। মিশন এলাকায় সিএমও (চীফ মিলিটারী অবজারভার) হিসাবে আছেন আমাদের বাংলাদেশের জেনারেল আশফাক। স্যারের সাথেও অনেকবার মেইলে চিঠি আদান প্রদান হয়েছে। একটা আভাষ পাওয়া গেছে মিশন এলাকার ব্যাপারে। সে মোতাবেক মোটামুটি প্রিপারেশন নিয়ে বাক্স পেটরা গুছিয়ে নিয়েছি।
আমাদের ফ্লাইটটি ছিল ঢাকা থেকে ইস্তানবুল (তুরষ্ক) হয়ে, তুরষ্কেরই আরেকটি প্রদেশ ট্রাবজনে যাওয়া। সেই ট্রাবজনে আমাদের জন্য স্পেশাল ফ্লাইট থাকবে জাতীসংঘের। সেটা দিয়ে আমরা পরেরদিন জর্জিয়ার রাজধানী টিবলিসি শহরে পৌছব। টিবলিসি থেকে আরেকটি ফ্লাইটে আমরা পরের কয়েকদিন পর জর্জিয়ায় যাবো। এই পুরু ভ্রমনটা ঢাকা থেকে জর্জিয়ায় পৌঁছানোর সময় ছিলো মাত্র দুইদিন। অর্থাৎ ৬ তারিখের মধ্যেই আমাদেরকে আমাদের মিশন এরিয়াতে হাজির হইতে হবে।
আমরা যথারীতি রওয়ানা হয়ে গেলাম। পরিবারের সবার কাছ থেকে একটা আবেগঘন বিদায় হলো। আমার দুই মেয়ে ঊম্মিকা আর কনিকা। উম্মিকার বয়স সবেমাত্র ৮ বছর হয় নাই, আর কনিকার বয়স তো মাত্র ৩ ও হয় নাই। আমি জানি মিটুল দায়িত্তশীল মহিলা, সব সামাল দিতে পারবে। বাসা সেনানীবাসের ভিতরেই স্টাফ রোড ১৪৯/৪ নং বাসা। ফলে ওদের নিরাপত্তা নিয়া আমি চিন্তিত ছিলাম না। তারপরেও প্রায় এক বছরের জন্য যাচ্ছি, একটু তো মন খারাপ হবেই, তাইই হয়েছিলো আমার।
রোজা ছিলাম বলে প্লেনের ভিতরে কোনো কিছুই খেতে পারি নাই। প্লেন প্রায় ৫ ঘন্টা উরে গিয়ে সন্ধ্যার দিকে ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে নামলো। তুরুষ্কে এটাই আমার প্রথম পদার্পন। বিশাল একটা এয়ারপোর্ট। প্রুচুর লোকের আনাগোনা, কেউ ল্যান্ড করেছে, কেউ আবার ফিরে যাওয়ার জন্য লবিতে বসে আছে, ছোট বড় সব বয়সের মহিলা পুরুষের বিস্তর একতা ভদ্র মেলার মতো। কোনো কোনো সৌখিন মহিলারা ট্যাক্স ফ্রি পছন্দের সই কেনা কাটা করছে, কেউ আবার কেনার সামর্থ না থাকলেও দেখাদেখির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বার, মদের দোকান, সবই আছে। নেশাখোরদের জন্য এটা একতা ভালো ব্যবস্থা। প্রকাশ্যে নেশা করলেও কেউ কিছু বলবে না বিধায় পেটপুরে যতটুকু পানিয় খেলে কন্ট্রোলে থাকা যায় তাতেই বেশ আনন্দ সহকারে খেয়ে নিচ্ছে। কেউ কেউ আবার ফ্লাইট দেরীর কারনে অলস ভাবে কোন এক লোহার চেয়ারে হেলান দিয়ে, কেউ আবার দুই পা তুলে সঠান হয়ে লম্বা একখান ঘুম দিয়ে নিচ্ছে। যারা পেটুক স্বভাবের, তারাও কম যায় না, পেটে জায়গার অভবে যেনো সব কিছু খাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও খাওয়া যাচ্ছে না ভেবে আফসোস করছে। কেউ কেউ আবার কম্পিউতার যন্ত্রের সাথে এমনভাবে লেপ্টে আছে, যেনো ইহাইয়া তাহার একমাত্র সাথী আর সংগী। যাই হোক সব কিছু মিলে কিছু কোলাহল, কিছু নীরবতা মিলে বেশ সুন্দর। বাংলাদেশের এয়ারপর্ট দেখলে এয়ারপোর্ট সম্পর্কে যা ধারনা হয়, এই এয়ারপোর্ট দেখলে নিজের দেশের দুরাবস্থার কথা মনে হয়। অথচ দুটুই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে আমাদের একটা কানেক্টিং ফ্লাইট ছিলো সরাসরি ট্রাব্জন এয়ারপোর্টের জন্য। আমি আর ইরশাদ দ্রুত সেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য এখান থেকে সেখানে, লাগেজ নেওয়া ইত্যাদি করতে করতেই আর ইফতারির কথা ভুলে গিয়েছিলাম। অথচ তখন রাত বাজে প্রায় নয়টা। এখানে একতা কথা জানিয়ে রাখা ভালো যে, আমরা সূর্যের অপোজিটে যাচ্ছিলাম বলে যদিও আমরা লোকাল টাইমে রাত নয়টা দেখছি কিন্তু বাংলাদেশ টাইমে আসলে ওটা ছিলো আরো বেশি। ফলে আমাদের রোজার সময়তা এতো বেশি বড় হয়ে গিয়েছিলো আর এতো ধকল যাচ্ছিলো যে, পেটের ক্ষুধায় মনে হচ্ছিলো আর পারছিলাম না। তারপরেও কাজের কারনে বিশেষ করে কানেক্টিং ফ্লাইটের কারনে আমাদের খাওয়া হয় নাই।
আমরা কানেক্টিং ফ্লাইটে উঠে গেলাম ট্রাবজনে যাবো। ছোট একটা তুর্কী বিমান। বেশ লোকজন আছে। একটা জিনিষ খুব খেয়াল করলাম যে, তুরষ্ক একটা মুসলমান দেশ, তার মধ্যে এখন রোজার মাস কিন্তু মেয়েদের কাপড় চোপরের স্টাইল একেবারেই ওয়েষ্টার্ন দেশের মতো। কিছুইতেই বুঝা যাচ্ছিলো না যে, এরা মুসল্মান কালচার ধারন করে।
কিছুক্ষন পর, আমাদের কানেক্টিং ফ্লাইট উড়ে চল্লো ট্রাবজনের উদ্দেশ্যে।
২৯/১১/১৯৯৭-ষ্টাফ কলেজ থেকে ভারত ভ্রমন
Categories
গত ২৩/১১/১৯৯৭ থেকে ছয় দিনের শিক্ষা সফরে মীরপুর ষ্টাফ কলেজ থেকে দেশী-বিদেশী ছাত্রদের নিয়ে আমরা পাশের দেশ ভারতে গিয়েছিলাম। আমাদের ষ্টাফ কলেজের ব্যাচে প্রায় শতাধিক ছাত্র বিধায় ছাত্রদেরকে তিনটি গ্রুপ করে ভাগ করা হয়েছে। কেউ কেউ ভারত, কেউ কেউ শ্রীলংকা আবার কেউ কেউ নেপাল। এটাই ষ্টাফ কলেজ থেকে প্রথম শিক্ষা সফর দেশের বাইরে। আর এটা এ বছরই চালু হলো। আমি ভারতে যাওয়ার চয়েজ দিয়েছিলাম। সে মোতাবেক গত ২৩ নভেম্বরে আমরা প্রায় ৩৭ জন স্টুডেন্ট ভারতের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করলাম। আমাদের সাথে আছেন ডিএস (ডাইরেক্টিং ষ্টাফ) লেঃ কর্নেল শফিক, লেঃ কর্নেল তানভীর, চীফ ইন্সট্রাকটর কর্নেল জহির, চীফ ইন্সট্রাকটর মইন ইউ আহমেদ এবং আরো কিছু। আমাদের শিক্ষা সফরটা একটা ডিপ্লোমেটিক ভিজিট হিসাবে গন্য ছিলো। আগে থেকে আমাদের বেশ কিছু অফিশিয়াল ভিজিট কনফার্ম করা ছিলো।
আমরা সকাল বেলায় যার যার ব্যাগ পেটরা নিয়ে জিয়া ইন্টার ন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম। ষ্টাফ কলেজ থেকে বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। ভারতে এটাই আমার প্রথম ভ্রমন। ভারতে গন্ডোগোল চলছে। বেশ ভালই গন্ডোগোল। কিন্তু তাতে আমরা শংকিত নই। আমাদেরকে প্রোটেকশন দেয়া ভারত সরকারের দায়িত্ত। আমরা কলকাতার গ্রান্ড হোটেল "হোটেল ইন" এ সবাই উঠেছি। কলকাতার পরিবেশ মূটামূটি ভালো। শান্ত। একটা জিনিষ খেয়াল করলাম যে, কলকাতা আর আমাদের ঢাকার গুলিস্থানের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নাই। সব জায়গায় বাংলা কথা বলার লোক। খায়ও বাংগালীদের মতো ডাল ভাত। তবে এখানে ঢোশাটা বেশ জনপ্রিয়। আমাদের হোটেলের পাশেই একটা সিনেমা হল আছে। ওখানে "দিল তো পাগল হ্যা" ছবিটি মাত্র রিলিজ হয়েছে। ৮ম লং কোর্ষের মেজর মোর্শেদ স্যার আমাদের স্টুডেন্ট কোঅর্ডিনেটরের কাজ করছেন। তাকে সাহাজ্য করছেন ৯ম লং কোর্ষের মেজর হক স্যার। কঠিন লোক বটে। সন্ধ্যা হতে না হতেই ডাক পড়লো যে, রাত আটটায় আমরা ইন্ডিয়ার ডিফেন্স এটাচির আমন্ত্রনে তার অফিশিয়াল বাসভবনে যেতে হবে। ড্রেস হবে সিরিমনিয়াল। মানে এসডি (সার্ভিস ড্রেস)। তড়িঘড়ি করে রেডি হতে হলো। বেশী দূর নয়, মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। পড়ে বুঝলাম, আসলে এটা ডিফেন্স এটাচির বাসা নয়, এটা এয়ারফোর্সের একটা মেস।
পৃথিবীর সকল আর্মির আস্তানাগুলি প্রায় একই ড্রিল অনুসরন করে। মেস ওয়েটারগন আমাদের দেশের মেস ওয়েটারদের মতোই ড্রেস আপ করা, মেসগুলিও প্রায় একই প্যাটার্নের, কালচার বা প্রাকটিসও তাই। ইন্ডিয়ার বেশ কিছু হাই অফিশিয়াল আমাদের উদ্ধ্যশ্যে কিছু কথা বললেন বটে কিন্তু কি বললেন, ভালো মতো বুঝাও গেলো না। আমরা অনেকেই যার যার গল্পে মশগুল ছিলাম। এরমধ্যে ধীরে ধীরে খাবার আসতে লাগলো, সফট ড্রিংক্স, হট ড্রিংক্স, সবই ছিলো। যে যার মতো যা খুশি খেতে পারেন। কোনো বাধা নাই। এর মধ্যে একজন মেস ওয়েটারের সাথে কথা হলো, নাম, জামিলুর। তার বাড়ি বাংলাদেশের চাপাইনবাবগঞ্জে। সে নাকি আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে তার বাবার সাথে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছিলো, আর বাংলাদেশে যায় নাই। এখন সে এয়ারফোর্স মেসে মেস ওয়েটারের কাজ করে। বাংলাদেশী কিছু অফিসার বেড়াতে এসেছে এখানে, তাতেই তার অনেক আনন্দ। যেনো বাড়ির মেহমান এসেছে বহুদিন পর।
রাতে ডিনার শেষ হলো। অনেক অফিসাররা ফ্রিতে বিয়ার আর মদ পেয়ে নাক ডুবিয়ে যেনো খেয়েই যাচ্ছিলো। রাত প্রায় সারে দশটায় আমাদের অনুষ্ঠান শেষ হলো। ফিরে এলাম হোটেলে। আমি, মেজর আকবর, মেজর আফতাব আর নাইজেরিয়ার মেজর লালা একরুমে থাকি। হটাত দেখি, কিছু অফিসার এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছেন। জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপারটা কি? পড়ে শুনলাম, কিছু অফিসাররা পাশের সিনেমা হলে 'দিল তো পাগল হায়" দেখার জন্যে যাচ্ছেন। এতো রাতে আবার সিনেমা? যাক, অসুবিধা নাই। আমি আর গেলাম না। তার কিছুক্ষন পর আবার একটা কেওয়াস শুনলাম। অফিসাররা সিনেমা হলে গিয়ে গেঞ্জাম করেছেন। কারন ইতিমধ্যে হলে সিনেমা শুরু হয়ে গিয়েছিলো, আবার কোনো সিটও খালি ছিলো না। তারা অনেকটা মাতাল অবস্থাতেই সিনেমা হলের ম্যানেজারকে জোর জবরদস্তি করে হলে ঢোকে সিনেমা দেখবেনই এই রকমের নাকি একটা আচরন করেছেন, যা অফিশিয়াল অভিযোগ হিসাবে ইতিমধ্যে দাখিল হওয়াতে বাংলাদেশের একজন দুতাবাসের কর্মকর্তা (নাম মেজর ফজলে আকবর) মধ্যস্ততা করে ব্যাপারটা মিটিয়ে দিয়েছেন। খুব দুক্ষজনক ব্যাপারটা। নতুন আদেশ জারী হলো যে, কোর্স ডিএস এর অনুমতি ছাড়া কেউ অযথা বাইরে যেতে পারবেন না। কিন্তু কেউ কি কারো কথা শুনে?
পরেরদিন আমাদের ভিজিট ছিলো ফোর্ট উইউলিয়াম দুর্গে। সকাল ১১ টায় সেখানে যেতে হবে। আমরা তার আগেই সেখানে পৌঁছে গেলাম। আগে অনেক নাম শুনেছি। কিন্তু এবার দেখলাম দূর্গ কি জিনিষ। চারিপাশ প্রায় ২০/২৫ ফুট উচু দেয়াল ঘেরা এবং দেয়ালের প্রশস্থতা প্রায় ৩০/৪০ ফুট। যার দ্বারা প্রচুর গাড়ি ঘোড়া চলে। ভিতরে দালান কোঠা সেই ব্রিটিশ আমলের। একেকটা বিল্ডিং এর উচ্চতা প্রায় ২০ ফুটের মতো। ফ্যানগুলি অনেক লম্বা লম্বা ডান্ডা দিয়ে ঝুলানো। প্রচুর গাছপালা। কমান্ডার ইন চীফ এলেন প্রায় একটার দিকে। নিজে আর তার এডিসি। কোনো ড্রাইভার দেখলাম না। তার নিজের গাড়িতেই স্টার আছে, সাথে আছে এম্বুলেন্সের মতো হর্ন। এডিসি গাড়ি ড্রাইভ করে এলেন, আর সেকেন্ড সিটার হলেন কমান্ডার। শীখ মানুষ। বেশ ফর্সা। অদ্ভুদ লাগলো ব্যাপারটা। আমাদের দেশে হলে গাড়ির বহরে আর এমপির গাড়ির ঠেলায় ভীর লেগে যেতো, কিন্তু এতো বড় অফিসার এলেন তাও আবার মাত্র এডিসি আর তিনি নিজে। ড্রাইভার ও নাই। ঘুরে ঘুরে বিল্ডিংগুলি আর আশপাশ দেখছিলাম। অফিসারদের থাকার জায়গাগুলিও বেশ অদ্ভুদ। এখানে যিনি ইনচার্জ, তার কোনো এসি রুম নাই। তবে গরমের দিনে যেনো পরিবেশ ঠান্ডা থাকে তার জন্য এক ধরনের পানির পাইপের মাধ্যমে সারাক্ষন পানির সঞ্চালন করে থাকে, তাতে বাতাস ঠান্ডা থাকে। আর আমাদের দেশ হলে তো এসির কারনেই পরিবেশ গরম হয়ে যেতো যদিও কমান্ডার নিজে ঠান্দায় থাকতেন। ইন্ডিয়া কেনো বড় হবে না? তাদের প্রতিটি কাজের মধ্যে ইকোনোমিক্যাল একটা বাজেট থাকে। এই যেমন কমান্ডার যখন এলেন, তিনি ইন্ডিয়ায় তৈরী মার্সিডিস গাড়িই নিয়ে এলেন। সেটা আবার এসি করা নয়। আর আমাদের দেশে তো জাপানিজ এসি গাড়ি না হলেই তার মান সম্মান থাকে না।
৩য় দিনে আমাদের যাওয়ার কথা দিল্লী। কিন্তু ভারত জুড়ে এতো গন্দগোল যে, আমরা যাবো কিভাবে সেটাই এখন বড় ধরনের প্রশ্ন হয়ে দাড়িয়েছে। বিজেপি, এক ধরনের বক্তব্য, কংগ্রেস আরেক ধরনের পালটাপাল্টি বক্তব্য এবং রামাবাই কিলিং নিয়ে অনেক বিতর্কিত আলোচনা টিভি জুড়ে চলছেই। আমাদের যাওয়ার কথা ছিল এয়ারপোর্ট হয়ে দিল্লিতে কিন্তু একেক বার একেক সংবাদ আসায় আমাদের মুড অফ জার্নি নিয়ে একটা অচলবস্থা তৈরী হলো। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো যে, আমরা বাসে করে কলকাতা থেকে দিল্লী যাবো। প্রায় ২২ ঘন্তার জার্নি। কলকাতা থেকে আমরা বাসে করে দিল্লী রওয়ানা হলাম। রাস্তা বেশ ভালো কিন্তু বেশ ফাকাও। আমাদের প্রোটেকসনের জন্য ইন্ডিয়ান আর্মির স্কট ছিলো, আর ছিলো হেলিকপ্টার দিয়ে আকাশ পথে টহলের ব্যবস্থা। প্রায় সন্ধ্যার দিকে দিল্লীতে পৌঁছলাম। হোটেল "সেরেনা" তে আমাদের থাকার জায়গা।
দিল্লীর শহর আসলেই আধুনিক একটা শহর। লাইফ যথেষ্ট পরিমান ফাষ্ট। দিল্লীতে ডিফেন্স মিনিশট্রি থেকে আমাদের জন্য একটা ভিজিট রেখেছেন। তাদের ডিফেন্স মিনিশট্রারের প্রতিনিধি আমাদের ব্রিফ করবেন। আমাদেরকে ডেকে আমাদের ডিএস জানালেন, আমরা যেনো কোন সেনসেটিভ প্রশ্ন না করি। এখানে আমরা ডিপ্লোমেটিক আলোচনায় আসিনি, তাই এমন কোনো প্রশ্ন যেনো আমরা না করি যাতে পরিবেশ অন্যদিকে টার্ন নেয়। কিন্তু কাজের বেলায় ঠিক সে রকম হয় নাই। মেজর হক স্যার এমন এক প্রশ্ন করে বসলেন, যা কিনা বেশ ভালই বিতর্কের জোগান দেয়। সেটা আর এখানে নাইবা বললাম। পড়ে এক সময় আবার বলা যাবে। আমরা দিল্লী ঘুরে বেড়ালাম। "ভাই" টেমপলে গেলাম। জায়গাটা বেশ সুন্দর। "ভাই টেমপল"টা হচ্ছে তিন ধর্মের জন্য একটা কমন প্রার্থনার স্থান। অদ্ভুত কন্সেপ্ট। এটা নাকি সম্রাট আকবরের সময় করা। ইন্ডিয়া গেট দেখলাম। এই জায়গায় ইন্ডিয়ার সব রাজনৈতিক নেতাদের বসবাস।
দিল্লী থেকে আমরা পরের দুপুরে আগ্রায় গেলাম। আগ্রায় "আকবরিয়া" হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা যখন বাস থেকে নামলাম, তখন একদল বাদ্যবাদক ড্রাম, পাইপার বাজিয়ে আমাদেরকে অভিবাধন জানালেন। দেখলাম, হোটেলের ঠিক সামনেই বিশাল করে ফুল আর ফুলের পাপড়ি দিয়ে ওয়েলকাম বাংলাদেশ লেখা। ভালো লাগলো। আমাদের বাক্সপেটরা নিয়ে গেলেন হোটেলের কর্মচারীরা। আসলে এটা ছিলো সম্রাট আকবরের নিজস্ব প্যালেস। এই প্রথম আমার জিবনে কোনো প্যালেসে রাত্রিজাপন করবো।
সম্রাট আকবরের প্যালেসটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বিশাল বিশাল রুম। খুবই সুন্দর। আমাদের আসার কারনে এখানে কোন গেষ্ট এলাউ করেনি সরকার। মানে শুধু আমরাই থাকবো এখানে দুই দিন আর এক রাত। আমরা জমায়েত হলাম সম্রাট আকবরের খাস কামরা সেটা ছিলো সেখানে। গিয়ে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। ওখানে যে ঝাড় বাতিটা আছে সেটার সাইজ প্রায় ডাবল রুমেরও বড়। আর এটার যে ডান্ডাটা সেটা একটা বিশাল পিলারের সমান। এই খাস কামরার যাওয়ার পর যেটা দেখালাম, এর পাশ দিয়ে একটা বেশ চওড়া রাস্তা গেছে, যার হাইট একটা লম্বা মানুষের সমান উচ্চতা। জিজ্ঞেস করলাম, এই রাস্তাটা কেনো যেখানে আরো রাস্তা বা প্রবেশ দ্বার আছে? আমাদের যে গাইড ছিলেন, তিনি বললেন যে, সম্রাট যখন হেরেমে বসতেন, তখন কোনো কারনে যদি তার রানী এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয় তাহলে এই হেরেম খানায় কি ঘটছে সেটা যেনো তার নজরে না আসে, সেই জন্য শুধুমাত্র রানির ব্যবহারের জন্য এই উচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা রাস্তাটা তৈরী। বুঝলাম, এমনি এম্নিতেই তো আর আকবর সাহেব সম্রাট হন নাই।রাতেই আগ্রার অনেক জায়গা ঘুরলাম। কিন্তু বেশী রাত হয়ে যাচ্ছে বলে বেশী দূর যাওয়া হচ্ছিলো না। রাতেই আবার আকবরিয়ায় ফিরে এলাম। আগামীকাল গাইড আমাদেরকে তাজমহল এবং আগ্রার আরো কিছু জায়গা আমাদের দেখাবেন। সকালেই আমাদের ভিজিট শুরু হবে। প্রথমে তাজমহল দিয়ে।
২৬/১১/১৯৯৭- কুতুব মিনার ভিজিট
দিল্লিতে থাকাকালে আমাদের সাথে থাকা গাইড কুতুব মিনার নিয়ে গিয়েছিলেন। লাল বেলে পাথরে তৈরী এই মিনারটি ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেকের আদেশে কুতুব মিনারের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে, তবে মিনারের উপরের তলাগুলোর কাজ সম্পূর্ণ করেন ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। প্রখ্যাত সুফি কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। কুতুব মিনার দেখার সময় আমাদের পাশেই একদল ছাত্রদের নিয়ে কিছু ভারতীয় টিচার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কুতুব মিনারের ইতিহাস বুঝাচ্ছিলেন। আমরাও তার কিছু কিছু তথ্য বিভ্রাটে ছিলাম। আমার মনে হলো যে, ঐ টিচাএ এই ভারতীয় ছাত্রদেরকে কুতুব মিনারের আসল সত্যটা না বলে এমন কিছু মন গড়া তথ্য দিচ্ছিলেন, যা কিনা কুতুব মিনারের নামে নেগেটিভ ভাব প্রকাশ পায়। আমরা কিছু বলি নাই কারন ইতিহাস তার নিজের ধারায় উম্মোচিত হয়। তবে কুতুব মিনারের ভঙ্গুর দশা দেখে আমার কাছে মনে হলো, এক সময় এই কুতুব মিনারটির আর কোনো অস্থিত্ত হয়তো থাকবে না।
২৬/১১/১৯৯৭- সম্রাট আকবর প্যালেস।
উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব
নভেম্বর
২৬
সম্রাট আকবরের প্যালেসে আমরা যখন পৌছাই তখন বেলা প্রায় ১২টা বাজে। সম্রাট আকবরের প্যালেসে ঢোকার সময়েই একটা হলঘর আছে যার মধ্যে আছে একটা ঝাড়বাতি। বিশাল বড়। এতো বড় ঝাড়বাতি আমি কখনো দেখিও নাই, আর কেউ কখনো বানিয়েছে কিনা আমার জানাও নাই। এই হল ঘরেই সম্রাট তার সহচরীদের নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করতেন। এখানে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে, আমরা যেখানে যেখানে ভিজিটে যাচ্ছি, সেখানে সেখানেই সেদিন অন্য কোনো আউট সাইডার ভিজিটর এলাউ ছিল না। ফলে আমরাই গাইডের সাহাজ্যে খুব নিরিবিলিতে পুরু জিনিষগুলি দেখার সুযোগ পাচ্ছিলাম, কোনো কোলাহল ছিলো না, কোনো ভীড়ও ছিলো না।
যাই হোক, সম্রাট আকবরের প্যালেসে এসে বেশ কিছু অটোমেটিক নিরাপদ বলয়ের ব্যবস্থা সম্রাটগন আগে থেকেই করে রেখেছেন। সেটা দেখলাম। যেমন-
(১) আগেকার দিনে সব সম্রাটগনই তাদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য, প্রতিটি মেইন গেট এমনভাবে তৈয়ার করেছেন যে, কোনো অতর্কিত হামলায় যেনো বেশ কিছু সময় পাওয়া যায়, এই ব্যবস্থাগুলি করা। আগেকার দিনে হাতী ছিলো শক্তির একটা প্রতিক। যখন কোনো বহির্গমন শত্রু হামলা করতে আসতো, তারা হাতীর ব্যবহার বেশী করতেন। তার সাথে করতেন ঘোড়ার ব্যবহার। হাতী এবং ঘোড়া যখন তার সমস্ত শরীর দিয়ে কোনো একটা বাধা ধাক্কা দিতে চায়, সেক্ষেত্রে তাকে একটা গতির মোমেন্টাম তৈরী করতে হয়। সম্রাটগন এই অংকটা জানতেন। তাই তাদের বাসস্থান এমন একটা উচু জায়গায় করতেন যার উচ্চতা স্বাভাবিক উচ্চতার থেকে প্রায় ১০০ /১৫০ ফুট উপরে। আর এই ১০০/১৫০ ফুট উপরে উঠতে কয়েক ধাপে ঢালুর ব্যবস্থা থাকতো। এই ঢালুগুলি এই রকম করে ঝিকজ্যাক করে তৈরী করা যাতে বাক থাকে, আর প্রতিটি বাক একেবারে ৯০ ডিগ্রী বাকানো। যাতে হাতি বা ঘোড়া কিছুদুর গিয়ে তাকে পুরুপুরি ৯০ ডিগ্রী ঘুরতে হয় এবং সে আবার শুন্য গতিতে চলে আসে। তাতে হাতী বা ঘোড়ার শক্তিও শুন্য হয়ে যায়। ফলে সম্রাট শাহজাহানের প্যালেসে কিংবা সমারট আকবরের প্যালেসে ঢোকতেও ঠিক এই রকমের কিছু প্রতিবন্ধকতা দিয়েই প্রবেশ পথ সুরক্ষিত। এইরকম প্রায় ৫ থেকে ৬টা বাক আছে, আর প্রবেশ পথগুলি একেবারেই মসৃণ নয়। হাতী বা ঘোরা এই অমসৃণ পথে চলতে তাদের পায়ে ব্যথা অনুভব করতো, ফলে পায়ে ব্যাথা পাবার কারনেও হাতী বা ঘোড়া সঠিক গতিতে আসতে পারতো না। এবড়ো থেবড়ো কংক্রিটের রাস্তা। আমরাই স্বাভাবিক জুতা নিয়ে ঐ রাস্তায় হাটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। প্রতিটা রাস্তার দুই ধারে আবার ছোট ছোট পটহোল আছে, যেখানে সেন্ট্রিরা রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো যাতে কোনো শত্রু ঢোকতে গেলে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মারা যায়।
(২) আমরা উঠে গেলাম সম্রাটের বাসভবনে। উঠেই দেখি, আরেক জগত। বিশাল চত্তর, চারিদিকে গাছগাছালীতে ভরা। একটা মালভূমির মতো। ঠিক মাঝখানে একটা পিতলের বিশাল বড় কলসি। এই কলসীটা এতো বড় যে, অনায়াসে ১০ বারো জন মানুষ এর মধ্যে খেলা করতে পারে। গাইড জানালো যে, শীতের দিনে সম্রাট এই কলসীতে পানি ভরে রাখতেন, সুর্যের তাপে এই পানি গরম হতো, আর রানী তার সহচরীদেরকে নিয়ে এই গরম পানিতে জলকেলি করতেন আর স্নান করতেন। রানী বলে কথা। তখন আমরা প্রশ্ন করলাম, তাহলে গরমের দিনে রানী কিভাবে ঠাণ্ডা জলে স্নান করতেন? গাইড জানালো, আমরা ওইটাও দেখবো কিভাবে সম্রাট রানীর জন্য ঠাণ্ডা জলের ব্যবস্থা করেছিলেন। রানী যেখানে স্নান করতেন, সেখানে কোনো সরাসরি প্রহরী নিয়োগ থাকতো না যাতে তারা দেখতে পায় রানীর গোসল বা জলকেলী। কিন্তু এলাকাটা এমনভাবে ঘেরাও করা যে, বাইরের থেকে কোনো বিপদের সম্ভাবনা নাই। সেভাবেই আউটার চত্তরে গার্ড নিয়োগ করা আছে। যাও আবার গার্ড, তারা আবার নপুংসক সব গার্ড। যাতে কেউ যদি শারীরিকভাবে উত্তেজিত হয়েও যায়, তাতে কোনো সক্ষম পুরুষ রানী কিংবা রানীরে দলবলের কোন ক্ষতির আশংকা না থাকে। শুধু এটাই শেষ নয়। কোনো কারনে যদি বৃষ্টি হয়, ঝড়ো পরিবেশ থাকে অথচ রানী গরম জলেই নিরাপদে অন্যত্র স্নান করতে পারেন, তারও ব্যবস্থা সম্রাট করে রেখেছিলেন। আরেকটি কামরা আছে যেখানে সূর্যের আলোক রশ্মি এমনভাবে ঐ রুমে পতিত হয় যেনো ঐ বড় কলসীতে রাখা পানি ঘরের ভিতরেই ধীরে ধীরে গরম হতে থাকে। সেখানে থাকতো মহিলা নিরাপত্তার বেষ্টনী। আর নিরাপদ দুরুত্তে নপুংসক কিছু রাইফেলধারী প্রহরী।
(৩) এবার গেলাম আমরা আরেকটি কামরায় যেখানে রানী তার সহচরীদের নিয়ে ঠান্ডা জলে গরমের দিনে স্নান করতেন। পাশেই গঙ্গা নদী। ঐ নদী থেকে পানির পাইপ দিয়ে সারাক্ষন ঠাণ্ডা পানির প্রবাহ থাকতো যাতে কামড়াটা সারাক্ষন জলীয় বাস্পের মাধ্যমে ঠাণ্ডা থাকে। আর এই ঠান্ডা পরিবেশে কলসীতে রাখা পানিও বেশ ঠাণ্ডা থাকে। রানী গরমের দিনে এই শীতল পানিতে স্নান করেন।
পুরু জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম, আর ভাবলাম, কোনো এক সময় এই সম্রাটদের পদচারনা এ সব স্থানে পড়েছে। তারা পুরু ভারতবর্ষ এসব প্রাসাদ থেকে পরিচালনা করতেন। এখানে সবার প্রবেশের কোনো অনুমতিও ছিলো না। অথচ আজ এতো বছর পর যে কেঊ ১০০ টাকার টিকেট কেটেই যখন তখন ঢোকে যেতে পারে। রাজা নাই, সম্রাট নাই, কোনো প্রহরী নাই, আছে তাদের সমস্ত স্মৃতি আর ইতিহাস। এখান থেকে তাজমহলের চুড়াগুলি দেখা যায়। গাইড বললেন যে, সম্রাট শাহজাহানের পরিকল্পনা ছিলো এই গংগার পাড়ে শাহজাহান মহল তৈরী করার। কিন্তু তার সে পরিকল্পনা বাস্তবরূপ নেবার আগেই তিনি তার ছেলের হাতে বন্দি হন এবং বন্দি অবস্থাতেই মারা যান। সম্রাট শাহজাহানের দেহ সমাধী করা হয় তাজমহলে নূরজাহানের কবরের পাশে। আর এই কবরটাই হচ্ছে একমাত্র আইটেম যা ব্যতিক্রম। আর এর ফলে তাজমহলের সেমিট্রিক্যাল চরিত্রকে আর সেমিট্রিক্যাল রাখে নাই। অর্থাৎ তাজমহলকে যেখান দিয়েই দুইভাগ করা হোক না কেনো, শাহজাহানের সমাধির কারনে এটা দুই ভাগের যে কোনো এক ভাগে থেকে যায় সম্রাটের দেহ, সব কিছুই আর সমান সমান থাকে না। সম্রাট শাহজাহান এমনভাবে তাজমহলটাকে গড়েছিলেন যে, যে কোনো দিক থেকেই কেউ প্রবেশ করুক না কেনো, তাজমহলের দুই পাশে সব সময় একই জনিষের একটি করে আইটেম পড়বে। এমন কি গাছগুলিও।
এই ছবিতে আমার পিছনে যে বিশাল চত্তরটা দেখা যাচ্ছে, এর ঠিক মাঝখানেই একতা বড় পিতলের থালা আছে যেখানে অনায়াসেই ৬/৭ জন মহিলা একসাথে পানিতে সাতার কাটতে পারেন। এখানেই রানী শীতকালে তার সহচড়িদেরকে নিয়ে জল কেলী করতেন। এতো বছর আগেও তারা তাদের জীবনের সবটুকু আনন্দ করেই এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। রাজা বা সম্রাটের কাছ থেকে তারা আক্ষরীক অর্থে কতটুকু মহব্বত আর ভালোবাসা পেয়েছে সেটা জানতেন শুধুমাত্র এ সব রানীরা কিন্তু বাহ্যিক ভাবে যদি দেখা যায়, তারা হয়তো মনের কষ্টকে আরাল করেই দিন পার করেছে। এটাই বা কম কিসের?
যখন ফিরে আসছিলাম, অনেক ভাবনা মনে আসছিলো। মনে হচ্ছিলো যেনো, এই মাত্র নবাবের সাথে আমরা দেখা করেই এলাম। কেনো মনে হচ্ছিলো এ রকম?
২৬/১১/১৯৯৭- তাজমহল ভিজিট
আমরা পরদিন (২৬ নভেম্বর) সকালে তাজমহলের উদ্দেশ্যে সবাই এক সাথে রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমাদের সাথে কোনো এক ইউনিভার্সিটির টিচার গাইড হিসাবে ছিলেন যিনি খুব ভালো ইতিহাস জানেন এবং ভাল ইংরেজি বলতে পারেন। তিনি একে একে তাজমহলের প্রবেশদ্বার থেকে সবকিছু বলতে থাকলেন কেনো এটা প্রিথিবিতে ৭ম আশ্চর্যের মধ্যে একটা স্থান পেয়েছিলো। আমরাও এর অনেক কারন জানতাম না। আমি এখানে কিছু কিছু ব্যাখ্যা তুলে ধরি তিনি আমাদেরকে কি কি বলেছিলেন।
প্রথমেই তিনি তাজমহল সৃষ্টির কারনগুলি উল্লেখ করলেন। মমতাজের আসল নাম ছিলো আরজুমান্দ বানু বেগম। মহলটির কাজ শুরু হয়েছিলো ১৬৩২ সালে আর শেষ হয়েছিলো ১৬৫৩ সালে। প্রায় ২১ বছর। শিল্পনৈপুণ্যসম্পন্ন একদল নকশাকারক ও কারিগর সৌধটি নির্মাণ করেছিলেন যারা উস্তাদ আহমেদ লাহুরির সাথে ছিলেন, যিনি তাজমহলের মূল নকশাকারক হওয়ার প্রার্থীতায় এগিয়ে আছেন। তাজমহলকে (কখনও শুধু তাজ নামে ডাকা হয়) মুঘল স্থাপত্যশৈলীর একটি আকর্ষণীয় নিদর্শন হিসেবে মনে করা হয়, যার নির্মাণশৈলীতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। যদিও সাদা মার্বেলের গোম্বুজাকৃতি রাজকীয় সমাধীটিই বেশি সমাদৃত, তাজমহল আসলে সামগ্রিকভাবে একটি জটিল অখণ্ড স্থাপত্য। এটি ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল। মমতাজ ছিলো সম্রাট শাহজাহানের ২য় স্ত্রী।
তাজমহলের সামনের চত্বরে একটি বড় চারবাগ (মুঘল বাগান পূর্বে চার অংশে বিভক্ত থাকত) করা হয়েছিল। ৩০০ মিটার X ৩০০ মিটার জায়গার বাগানের প্রতি চতুর্থাংশ উঁচু পথ ব্যবহার করে ভাগগুলোকে ১৬টি ফুলের বাগানে ভাগ করা হয়। মাজার অংশ এবং দরজার মাঝামাঝি অংশে এবং বাগানের মধ্যখানে একটি উঁচু মার্বেল পাথরের পানির চৌবাচ্চা বসানো আছে এবং উত্তর-দক্ষিণে একটি সরলরৈখিক চৌবাচ্চা আছে যাতে তাজমহলের প্রতিফলন দেখা যায়। এছাড়া বাগানে আরও বেশ কিছু বৃক্ষশোভিত রাস্তা এবং ঝরনা আছে। চারবাগ মানেই যাতে স্বর্গের বাগানের প্রতিফলন ঘটবে। তাজমহলের চত্বরটি বেলে পাথরের দুর্গের মতো দেয়াল দিয়ে তিনদিক থেকে বেষ্টিত। নদীর দিকের পাশটিতে কোনো দেয়াল নেই। এই দেয়ালবেষ্টনির বাইরে আরও সমাধি রয়েছে যার মধ্যে শাহজাহানের অন্য স্ত্রীদের সমাধি এবং মুমতাজের প্রিয় পরিচারিকাদের একটি বড়ো সমাধি রয়েছে।
(১) তাজমহলে ঢোকতে মোট চারটা গেট আছে, প্রতিটি গেট থেকে মেইন তাজমহল একই রকম দেখা যায়। একই রাস্তা, একই গাছ, গাছের সংখ্যাও সমান। প্রশস্ত, এবং দুরত্ত সমান। সব গাছ একই গাছ।
(2) যে গাছগুলি তাজমহলের প্রবেশ পথ থেকে মেইন বিল্ডিং পর্যন্ত লাগানো আছে, সেই গাছগুলি এমন একটা উচ্চতা পর্যন্ত বড় হবে যা রানীর জন্য সুবিধাজনক। গাছগুলিতে ফুল ফুটলে যেনো রানীর মাথা নুয়ে ফুল তুলতে না হয়, সখীদের নিয়ে হাটতে হাটতে ফুল তুলতে পারেন, ঠিক সেই পরিমান বড় হয়ে গাছ গুলি আর বড় হবে না। কি অদ্ভুদ।
(৩) তাজমহলের প্রবেশ পথে দাডিয়ে মেইন বিল্ডিং এ তাকালে চোখে পড়বে "লা ইলাহা ইল্লাললাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ"। এই লেখাটা যদি কাছে গিয়া দেখা যায়, দেখা যাবে যে, প্রতিটি অক্ষর কিন্তু সমান নয়। কিন্তু তাজমহলের প্রবেশ পথে দাড়াইয়া দেখলে প্রতিটি অক্ষর সমান মনে হবে। আর এটা সূর্যের আলোর প্রতিসরনাংকের ফর্মুলা কাজে লাগিয়ে করা হয়েছে। এটা খুবই সুক্ষ একটা গনিতের ফর্মুলা। এটা এই তাজমহলে এপ্লাই করা হয়েছে।
(৪) তাজমহলের যেখান দিয়াই কেউ ঢোকুক না কেনো, তাকে যদি দুই ভাগ করা হয়, তাহলে প্রতিভাগে সমান সংখ্যক গাছ, সমান সংখ্যক রাস্তা, সমান সংখ্যক বিল্ডিং, সমান সব কিছু হবে। তাই একে বলা হয় সিমেট্রিক্যাল কন্সট্রাকশন বা স্ট্রাকচার।
(৫) তাজমহলে একপাশে একটা মসজিদ আছে। তাজমহলের এই সিমেট্রিক্যাল হবার জন্য পাশাপাশি দুটো মসজিদ বানানোর নিয়ম নাই বলে, একপাশে একটা মসজিদ আর আরেকপাশে মসজিদের ন্যায় একটা জাওয়াব বানানো হয়েছে। বাহ্যিকভাবে দেখে বুঝার উপায় নাই, কোনটা মসজিদ আর কোনটা জাওয়াব । জাওয়াব আলাদা শুধু এর মেহরাম নেই আর এর মেঝে নকশা করা যেখানে মসজিদের মেঝে ৫৬৯ জন মুসল্লির নামাজ পড়ার জন্য কালো পাথর দিয়ে দাগ কাটা। তাজমহল দেয়াল ঘেরা আগ্রা শহরের দক্ষিণ অংশের একটি জমিতে তৈরি করা হয়েছিল যার মালিক ছিলেন মহারাজা জয় শিং। শাহজাহান তাকে আগ্রার মধ্যখানে একটি বিশাল প্রাসাদ দেওয়ার বদলে জমিটি নেন।
(৬) তাজমহলের চার পাশে চারটা বড় বড় পিলার আছে। স্বাভাবিক চোখে দেখলে মনে হবে যে, পিলারগুলি সোজা এবং খাড়া, কিন্তু আসলে এই পিলারগুলি একেবারেই সোজা খাড়া না। এই পিলারগুলি একটু বাইরের দিকে হেলিয়ে বানানো। কোনো কারনে যদি প্রাকৃতিক কারনে পিলারগুলি ভেঙ্গে পড়ে, পিলারগুলি যেনো কোনো অবস্থাতেই তাজমহলের ভিতরের সাইডে না পড়ে সেভাবে বানানো। এটা তার ওজনেই তাজমহলের বাইরের দিকে পড়ে যাবে, যাতে তাজমহলের কোনো ক্ষতি না হয়।
(৭) এবার যাই তাজমহলের ভিতরের অংশে। ভিতরে রঙ বেরংগের পাথর দিয়ে অনেক ইতিহাস লেখা। কখনো যৌবনের প্রতিক, কখনো কোনো প্রেমের কাহিনী। বিভিন্ন কালারের পাথর দিয়ে দিয়ে সমন্নয় করে একটা পাথর আরেকটা পাথরের সাথে নেচারালী লাগানো। কথিত আছে, সম্রাট শাহজাহান একটা পাথরও কেটে লাগাতে দেন নাই। অবিকল পাথরগুলি যেভাবে ছিলো সেটাই একটার সাথে আরেকটা খাপে খাপ মিলিয়ে মিলিয়ে সংযোগ করে লাগানো এবং প্রতিটি পাথর একে অপরের সাথে নিখুতভাবে লাগানো। কত বছর যে লেগেছে এই পাথর বাছাই করার জন্য, এবং তার সাথে রঙ এবং সাইজ মেলানোর জন্য, তার কোনো ইয়াত্তা নাই। ২১ বছর শুধু এম্নিতে এম্নিতেই লাগে নাই এই তাজমহল বানাতে।
(৮) পাথরগুলি সেমিট্রান্সপারেন্ট। যদি ওয়ালের বা দেয়ালের এক পাশ থেকে টর্চের লাইট দেয়া হয়, ওয়াল বা দেয়ালের উলটো দিকে এই লাইট বেশ প্রবাহিত হতে পারে।
(৯) রানী যেখানে শুয়ে আছেন, অর্থাৎ তার কবর, সেটায় যেনো কোনো ভিজিটর ভিজিট এর কারনে রানি বিরক্তবোধ না করেন, তার জন্য একই ডিজাইনে, একই তরিকায় ঠিক এমন জায়গায় আরেকটি কবরের মতো কবর বানানো হয়েছে যে, যেদিক থেকেই তাজমহলকে ভাগ করা হোক, একদিকে রানীর অরিজিনাল কবর আর অন্যভাগে রানীর রেপ্লিকা অর্থাৎ ফেক কবর ভাগে পড়বে। সমস্ত ভিজিটরদেরকে রানীর এই রেপ্লিকা কবর পর্যন্তই যেতে দেয়া হয়। কিন্তু আমরা যেহেতু ভারতের রাষ্ট্রীয় গেষ্ট হিসাবে বিবেচিত ছিলাম, ফলে আমরা খুব ভাগ্যবান যে, আমরা রানীর অরিজিনাল করব পর্যন্ত ভিজিট করার অনুমতি ছিলো। দেখে বুঝার উপায় নাই, কোনটা নূরজাহানের অরিজিনাল করব আর কোনটা নূরজাহানের ডুপ্লিকেট। দুটুর ডিজাইন, স্টাইল এবং সব কিছুই এক।
(১০) একষ্টিক থিউরী ব্যবহার করা হয়েছে এই তাজমহলের ভিতরে। একষ্টিক থিউরী হচ্ছে বাইরের কোনো শব্দ তার কোন সুর, কিংবা আওয়াজ নষ্ট না হয়ে বক্তা যে আওয়াজে যে সুরে কথা বলবেন, ঠিক সেতাই শুনা যাবে এই তাজমহলের ভিতরে বসেও। এটা দেখার জন্য আমাদে গাইড জানালেন যে, সম্রাট শাহজাহান, চেয়েছিলেন, যখন বাইরে আজান পড়বে, রানির ঘর থেকে যেনো অই আজানটা অবিকল কোনো শব্দ ডিসটরসন না হয় এবং রানি নূরজাহান ঠিক ঐ আওয়াজটাই শুনতে পান। এটা প্রমান করার জন্য গাইড প্রথমে আমাদেরকে একটা সুমধুর আওয়াজের অডিও শুনালেন বাইরে দাড় করিয়ে, তারপর নিয়ে গেলেন, রানীর কবরের পাশে। আবারো সেই সুমধুর আওয়াজটা বাজানো হলো। আসলেই ঠিক তাই, যে সাউন্ডটা আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম, তদ্রুপ রানীর ঘর থেকেও একই আওয়াজ শুনা যাচ্ছিলো।
(১১) তাজমহল একটা জাইরো সিস্টেমে তৈরী করা। অর্থাৎ পুরা তাজমহল কোনো কারনে যদি ভুমিকম্পের কবলে পড়ে তাহলে এটা অর্থাৎ পুরু তাজমহল প্রায় একদিকে সারে সাত ডিগ্রি অন্য দিকে সারে সাত ডিগ্রী হেলে গেলেও তাজমহলের কোনো ক্ষতি হবে না। অর্থাৎ দুই দিকে মিলে তাজমহল প্রায় ১৫ ডিগী হেলতে পারে। এর ফলে তাজমহল প্রায় ৭ রেক্টর স্কেলের ভুমিকম্প সহ্য করার মতো একটা স্ট্রাকচারাল ডিজাইন হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাজ মহল এর মধ্যে নাকি পর পর দুবার প্রায় এই সম পরিমান ভুমি কম্পে পড়েছিলো কিন্তু এই হেলতে পারা জাইরোর কারনে তাজমহলের কোনো ক্ষতিই হয় নাই।
(১২) তাজমহলে দাঁড়িয়ে যদি সকালবেলা পূর্ব দিকে সুর্য উঠা দেখেন, তাহলে সুর্য শাহজাহান মহল থেকে যেনো উদিত হচ্ছে এটাই বুঝা যাবে, এটা বছরের যে কোনো সময়ের জন্যই প্রযোজ্য। আবার শাহজাহান মহলে কেউ দাড়াইয়া যদি সুর্যাস্ত দেখেন, তাহলে বছরের যে কোনো সময় মনে হবে যে, সুর্য মমতাজ মহলের উপর দিয়ে সুর্যাস্ত হচ্ছে।
এই রকমের আরো অনেক বৈজ্ঞানিক কারন রয়েছে যার কারনে তাজমহল বিশ্ববাসীর কাছে ৭ম আশ্চর্যের মধ্যে একটা স্থান করে নিয়েছে। এটা কোনো স্বাভাবিক বিল্ডিং বা স্ট্রাকচার নহে। আমরা প্রায় ঘন্টা তিনেক তাজমহলে থাকার পর বেরিয়ে গেলাম সম্রাট আকবরের আস্তানায়।
০৬/০৩/১৯৯৬-ডমিনিকান ভ্রমন
Categories
হাইতিতে জাতী সংঘের অধীনে মিশন করতে এসে আশে পাশের অনেক গুলি দেশ বেরানর ইচ্ছা প্রথম থেকেই আমার ছিলো। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইচ্ছে ছিলো ডমিনিকান দেশটি ঘুরে দেখার। এর প্রধান কারন হলো, এতা হিসপানিওয়ালার একটি দেশ। অনেক ছোট বেলায় পড়েছিলাম ইবনে বতুতার কথা, তারপর সেই আমেরিকা আবিষ্কারের কথা। আমেরিকা আবিষ্কার যিনি করেছিলেন যেই জাহাজতা দিয়ে তিনি এসেছিলেন, এটা নাকি এই ডমিনিকানে এখনো আছে। এই রকম আরো অনেক কাহিনী ছোট বেলায় পরেছিলাম। স্বাভাবিক কারনেই এতো কাছে এসে ডমিনিকানে যাবো না, এটা হবে একতা অন্যায় বা অপরাধ।
যাই হোক, আমরা একতা গ্রুপ করে ফেললাম ডমিনিকানে যাওয়ার জন্য। গাড়ির পথ। হাইতির পাশাপাশি দেশ। আমাদের নিজস্ব গাড়ি আছে। ইউ এন এর গাড়ি। কোনো ভিসার দরকার নাই। ডমিনিকানের চেক পোষতে গিয়ে আমাদের জাতীসংঘের স্টাফ হিসাবে পরিচয় দিলেই আমরা ঢোকতে পারবো এতাই আমাদেরকে জানানো হয়েছিলো কন্সুলেট অফিস থেকে।
আমি, মেজর ইশতিয়াক (৯ম লং কোর্ষ), মেজর মোসাদ্দেক (১১ তম লং কোর্ষের), মেজর ফরিদ (১১তম লং কোর্ষের), মেজর ইলিয়াস (১৭ তম লং কোর্ষের) মেজর ফারুক (১০ম লং কোর্শগের) আর নেভীর একজন অফিসার মিলে আমরা সবাই বেরিয়ে গেলাম ডমিনিকানের উদ্দেশ্যে।
আকাবাকা পাহাড়ি সরু রাস্তা, আশেপাশে কোনো গ্রাম চোখে পড়লো না খুব একটা। মাঝে মাঝে কিছু লকের আনাগোনা দেখা গেছে আমাদের দেশের পাহাড়ি অঞ্চলের মতো কিন্তু তারা কোথা থেকে কই যায় বা কোথায় থাকে এ ব্যাপারে খুব একটা জানা হলো না। আমরা ছুটে চলছি তো চলছিই। ক্যারিবিয়ান পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূরা এখানেই অবস্থিত যার নাম পিকো ডুয়ার্তো। সেন্ট ডমিনিকের নামানুসারেই এই দ্বীপ টির নাম হয়েছিলো। এর রাজধানির নাম সেন্ট ডমিনিগো। বর্তমানে ডমিনিকানের প্রেসিডেন্ট হিসাবে আছেন লিওনেল ফার্নেন্দেজ।
প্রায় ৪ ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে প্রায় সকাল ১১ তার দিকে আমরা ডমিনিকান চেক পোষ্টে পৌঁছে গেলাম। খুব একটা সুরক্ষিত বর্ডার বলে মনে হলো না। আমাদের দেশের কিছু বিডি আর সেনাদের মতো লেথাজিক কিছু সৈনিক দিয়ে ডমিনিকা বর্ডারটার চেক পোষ্ট পাহাড়া দেয়া আছে। তবে মেইন গেটে কাতা তারের বেড়ায় কোনো লোক ঢোকতে পারে না এটা ঠিক। আমরা ইউ এন এর গাড়ি গেটের সামনে থামতেই গুটি কয়েক ডমিনিকান সৈনিক আমাদের কাছে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের আসার হেতু কি। হাইতি এবং ডমিনিকানের সাথে যে কমন শহর, তার নাম আসলে মন্ট ক্রিষ্টি। যদিও মন্ট ক্রিষ্টি ডমিনিকানেরই একটি শহর কিন্তু আমরা সেখানকার কো-বর্দার দিয়েই ডমিনিকানে ঢোকেছি।
এখানে একতা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম যে, হাইতিতে প্রায় ৯০% মানুষ কালো আর ডমিনিকানের প্রায় ৯০% লোক সাদা চামড়ার। পাশাপাশি দেশ কিন্তু বিস্তর তফাত। হেসিয়ান লোকগুলি অনেক অস্থির, চালাক আর ফ্রড জাতীয় কিন্তু ডমিনিকানের লোকগুলি ধীর স্থির, কো-অপারেটিভ, ভদ্র বলেই মনে হলো। গেটের সৈনিকগুলি আমাদের সবার পাস পর্ট নিয়ে চলে গেলো ভিতরে। প্রায় ৪০ মিনিট পর এসে জানালো যে, তারা আমাদের পাস্পোর্ট এখুনি ফেরত দিবে না, যখন আবার ব্যাক করবো, তখন গেট থেকে নিয়ে গেলেই হবে। আমরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, যে, যেহেতু আমরা ইউ এন এর গাড়ি নিয়েই ভিতরে যাবো, তখন যদি কোনো প্রশাসন কিংবা আইন বিভাগের কোনো কর্মকর্তা আমাদেরকে কিভাবে ডমিঙ্কানে প্রবেশ করলাম জিজ্ঞেস করে, তাহলে কি বল্বো? আমাদের কোনো সমস্যা হবে কিনা। ব্যাপারটা তারা বুঝতে পারলেন। ফলে আমাদের সাথে তাদেরই একজন একোম্পানি করবেন বলে রাজী হলেন। এতে আমাদের লাভ হলো দুটু। একজন বিনে পয়সায় গাইড পাওয়া গেলো আবার কোনো ঝামেলা হলে সেইই ব্যবস্থা নিবে।
আমরা ঢোকে গেলাম ডমিনিকানে। খুব সাজানো গুছান একতা দেশ। গরমের সিজন। দেখলাম, ছেলেমেয়েরা খুব নিরাপদেই গাছের ছায়ায় কেউ ঘুমাচ্ছে, আবার কেউ কেউ আড্ডা মারছে। সবাই খুব ভদ্র। আমাদেরকে দেখে অনেকেই এগিয়ে এলেন, হাত মিলালেন, হাসিখুসিতে অনেকে আবার ছবিও তুল্লেন/ ব্যাপারটা খুব মজার। অনেকেই ইংরেজী বলতে পারেন কিন্তু তাদের প্রধান ভাষা হচ্ছে স্প্যানিশ।
ডমিনিকানের প্রধান ধর্ম হচ্ছে রোমান ক্যাথোলিজম। এদের মুদ্রার নাম ডমিনিকান পেসো। আমাদের কাছে ডলার ছিলো, এদেশে ডলার চলে। কিন্তু কোনো কিছু কিনতে গেলে ডলার নেয় ঠিকই কিন্তু দেয় পেসো। আর এক ডলার সমান প্রায় ১৫০০ পেসোর সমান। হাইতিতে অবশ্য ওদের এক হেসিয়ান ডলারের সমান প্রায় ৫ হেসিয়ান ডলার। এদিক দিয়ে ডমিনিকান দের কারেন্সীর অবমুল্যায়ন ধরা যায়। ডমিনিকানে হেসিয়ান ডলার ও চলে। তবে বেশী আগ্রহী অয় তারা। আমরা খুব বেশী মার্কেটিং করার ইচ্ছায় এখানে আসি নাই, তাই এটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথ ব্যথাও নাই।
আমরা আশেপাশের কিছু জায়গা ঘুরে দেখলাম। আমরা আসলে মন্টি ক্রিষ্টি শহরের মধ্যেই ছিলাম। এর বাইরে যাওয়া সম্ভব হয় নাই কারন আমরা আবার সেদিনই হাইতিতে ফিরে যেতে হবে আর আমাদের রাত থাকার অনুমতি ছিলো না। দুপুরের দিকে আমরা একতা দোকান থেকে কিছু ড্রাই ফুড খেয়েই আবার বিকাল দুইতার দিকে হাইতির উদ্দেশ্যে র ওয়ানা দিয়ে চলে এলাম হাইতিতে।
আমাদের সেই হিস্পানিওয়ালার জাহাজ দেখা হয় নাই। কিংবা আরো বড় বর যে ইতিহাস পড়েছিলাম, তার কিছুই দেখা হয় নাই। এ জীবনে আর কখনো এদেশে আসা হয় কিনা আমার জানা নাই তারপরেও ভাবলাম, ডমিনিকান এর বর্ডার টা তো ছুয়ে গেলাম।
১৮/১২/১৯৯৫- হাইতির প্রেসিডেন্সিয়াল ভোট
Categories
অনেক চড়াই উতড়াইপার হয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা হাইতিতে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন করতে পারলাম। গতকাল ১৭/১২/১৯৯৫ তারিখে প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন হয়ে গেলো। এখানে মুলত ১৪ জন ক্যান্ডিডেটস ছিলো যার মধ্যে মুলত তিন জনের মধ্যেই লড়াইটা হয়েছে। প্রথম জন রেনে গারসিয়া প্রিভাল (যাকে সবাই রেনে প্রিভাল নামেই চিনে), তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্তে ছিলেন। অত্যান্ত অমায়িক একজন মানুষ। প্রায়ই তিনি আমাদের বেস ক্যাম্পে আসেন, সবার সাথে কথা বলেন, সন্ধায় এলে সবাই আমরা মিলে চা কফি খাই। বেশ সাধারন একজন মানুষ। একটা দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট যে এতো সাধারনভাবে আমাদের ক্যাম্পে আসেন, বুঝাই যায় না। এখানে তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারটা নিয়ে তিনি একেবারেই উদ্বিগ্ন নন। কারন পুরু বেস ক্যাম্পটাই নিরাপদ। এই ভাইস প্রেসিডেন্ট রেনে প্রিভাল গতকাল ইলেকশনে প্রায় ৮৮% ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছেন এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরিস্টিডের স্থলাভিষিক্ত হবেন আগামি ৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬ তারিখ থেকে। ভাইস প্রেসিডেন্ট রেনে প্রিভাল "ল্যাভালাস পলিটিক্যাল অরগ্যানাইজেশন" (যাকে সক্ষেপে বলা হয় ওপিএল) থেকে দাড়িয়েছিলেন। মুখ ভর্তি দাড়ি। দেখলে অনেকটা আমাদের এশিয়ান এশিয়ান টাইপের মনে হয়।
২য় ব্যক্তি ক্যান্ডিডেট হিসাবে ছিলেন লিও জুন। তিনি সতন্ত্র দল বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট থেকে দাড়িয়েছেন। ভোটের দিক দিয়ে তিনি মোট ভোট পেয়েছেন প্রায় ২.৫% । তাকে আমরা দেখি নাই। অন্তত আমি এখনো দেখি নাই। আর ৩য় ব্যক্তি যিনি ক্যান্ডিডেট হয়েছিলেন তাঁর নাম ছিলো ভিক্টোর বিনোত। তিনি দাড়িয়েছিলেন "কোনাকমঃ (KONAKOM) পার্টি থেকে। কোনাকম পার্টি আসলে মডারেট সোশ্যালিস্ট পলিটিক্যাল পার্টি যার ইংরেজী নাম হচ্ছে ন্যাশনাল কংগ্রেস অফ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং হেসিয়ানরা একে চিনে কোনাকম নামে। তাঁর ভোটের পরিমান ছিলো সবচেয়ে কম, মাত্র ২.৩%
বাকী ১১ জনের নাম ও আমরা প্রায় আগে খুব ভালভাবে শুনেছি বলে মনে হয় না। তাদের নাম গুলি এই রকমেরঃ
রেনে জুলিয়েন,
ক্লার্ক প্যারেন্ট- হেসিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি
ইদি ভোলেল - ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাটিক র্যালি
রিচার্ড ব্লাদিমির -প্যারাদাইস পার্টি
ফ্রান্সিস জীন - রিভুলেশনারী মিলিটারি ফোর্স
জীন আর্নল্ড ডুমাস-ন্যাশনাল পার্টি অফ ওয়ার্কার্স ডিফেন্স
জুলিও লারোসিলেরী-
মিষ্টার জোসেফ- হেসিয়ান সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি
গেরাল্ড ডাল্ভিয়াস - অল্টারনেটিভ পার্টি অফ হেসিয়ান ডেভেলপমেন্ট পার্টি
রকফেলার গুরি - ইউনিয়ন অফ ডেমোক্র্যাটিক প্যাট্রিওটস
ফার্মিন জীন লুইস
মজার ব্যাপার হলো বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরিস্টিড এই ইলেকশনে অংশ গ্রহন করেন নাই। করলে হয়ত তিনি পাশ করতেন। কিন্তু হেসিয়ান সংবিধানের বাধ্যবাদকতার জন্য তিনি অংশ গ্রহন করেন নাই। তবে তাঁর মনোনীত এবং তারই অধীনে ভাইস প্রেসিডেন্ট রেনে প্রিভালকে তিনি মনোনীত করেছেন। এবং ফলাফল তাইই হয়েছে যে, রেনে প্রিভাল জয়ী হয়েছেন। সেক্ষেত্রে ধরা যায় যে, যদি এরিস্টিড দাড়াতে পারতেন, তাহলে এবারো তিনিই প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন।
আমি বহুবার এই ধর্মজাজক মানুষটির সাথে মিশেছি। আমি তাঁর প্যালেসে প্রায় তিন মাস একটানা ডিউটি করেছি। মাঝে মাঝেই আমি তাঁর খুব কাছ থেকে অনেক সান্নিধ্য পেয়েছি।
০৫/১২/১৯৯৫-নর্থইষ্টার্ন এবং এমআইটি ভিজিট
Categories
ভাইয়া নর্থ ইষ্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে প্রোফেসারি করেন। এর ঠিক উলটো দিকেই হচ্ছে এম আই টি ইউনিভার্সিটি। ভাইয়া আমাকে ওনার ইউনিভার্সিটি তে নিয়ে গেলেন। আজ একটু শীত কম পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। বিশাল বড় একটা ইউনিভার্সিটি। ভাইয়ার অফিসে গেলাম, ভাইয়ার আরো অনেক কলিগ, তাদের অফিসেও গেলাম। এরা সবাই অনেক উচু দরের মানুষ। ভাইয়া আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, তুই ইউনিভার্শিটিটা ঘুরে ঘুরে দেখতে পারিস। কিন্তু ক্যাম্পাসের বাইরে যাস না। দুপুরে একসাথে অন্যান্য কলিগদের সাথে ক্যাফেটেরিয়ায় লাঞ্চ করবো। এর মাঝে আমি কিছু কাজ সেরে নেই, আর তুইও ঘুরে ঘুরে দেখ। ভালোই হলো। ভাইয়া সাথে থাকলে আমার সিগারেট খাওয়া হয় না। এবার আনন্দের সাথে সিগারেট খাওয়া যাবে।
আমি ভাইয়ার অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রথমেই যেখানে পৌঁছলাম, সেতাই আসলে স্টুডেন্ট ক্যাফেটেরিয়া। দেখলাম, অনেক ছেলেমেয়েরা একটা বোর্ডের সামনে বেশ সুন্দর করে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অদূরে দাঁড়িয়ে একতা সিগারেট ধরালাম। এখানে সিগারেট খাওয়া যায় কিনা আগে আমি চেক করে নিয়েছি। আমি দেখেছি এক ভদ্রলোক, সম্ভবত ছাত্রই হবে, সে সিগারেট খাচ্ছিলো। ফলে আমার ধারনা যে, এই স্থানে সিগারেট খাওয়া যায়। আমি সিগারেট খাচ্ছি আর ঐ জটলা ছেলেমেয়েদেরকে দেখছি। একজন একজন করে তারা কি যেনো একটা নোটিশ বোর্ডে পিন দিয়ে লাগাচ্ছে। লাগিয়েই আবার চলে যাচ্ছে।
আমার সিগারেট খাওয়া শেষ হলে আমি বোর্ডটির কাছে গিয়ে দেখি তখন মাত্র দুজন ছাত্র দাঁড়িয়ে। ওরা ইলেকশন পোষ্টার লাগাচ্ছে। কয়েকটি দলের ছাত্র ওরা। পোষ্টার দেখে বুঝলাম।
খুব মজার ব্যাপার হলো, যে যেই দলই করুক, তাদের নিজেদের মধ্যে কোনো দন্দ দেখলাম না। হানাহানি, হিংস্রতা, কিংবা একে অন্যের উপর রেষারেষি তো নাইই। আমাদের দেশে হলে ইতিমধ্যে মারামারি লেগে যেতো।
২৯/১১/১৯৯৫-আমেরিকায় সেল
Categories
একটা মজার কথা না বললেই হচ্ছে না। আজ প্রায় ১৫ দিন পার হয়ে গেলো আমি ভাইয়ার বাসায় আমেরিকাতে এসেছি। এর মধ্যে অনেক জায়গায় গিয়ে অনেক পদের মার্কেটিং করছি ভাবিকে নিয়ে। বেশীরভাগ মার্কেটিং করছি কসমেটিক্স আর কিছু নিত্য ব্যবহারের জিনিষ। যখনই আমি ঐ যে এয়ারপর্ট থেকে পাওয়া কার্ডটি দিচ্ছি, সবাই খুব অবাক হচ্ছে। কারন এই কার্ডধারী খুব একজন সাধারন মানুষ হতে পারে না। যতোবারই কার্ড তা দেখিয়েছি, আমি লাইনে থাকা মানুষ গুলির মধ্যে প্রাইয়োরিটি পাচ্ছি, আর কোনো প্রকারের ভ্যাট, ট্যাক্স দিতে হচ্ছে না। এখানে প্রায় ৩০% ট্যাক্স দিয়ে সব কিছু কিনতে হয়। এর মানে আমি যদি ১০০ ডলারের একটা জিনিষ কিনি, আমাকে পে করতে হবে ১৩০ ডলার। কিন্তু আমার বেলায় ১০০ ডলারের জিনিষ ১০০ ডলারই। দারুন একতা ব্যাপার। এতা যখনই ভাইয়ার ক্লজ বন্ধু বান্ধবদের কাছে জানাজানি হয়ে গেলো, অনেকেই আমার এই কার্ড ব্যবহার করে অনেক মার্কেটিং করে নিলো। আমারো খুব ভালো লাগছিলো যে, আমি অন্তত একটা ব্যতিক্রমী জিনিষ উপহার দিতে পারছিলাম।
আরেকটি জিনিষ আমার কাছে খুব অবাক লাগলো যে, প্রায় সারা বছরই আমেরিকার দোকানগুলিতে "সেল" লেগেই থাকে। "সেল" মানে হচ্ছে ডিস কাউন্টে কোনো কিছু ছেড়ে দেওয়া। হিড়িক পড়ে যায় তখন। আবার এমন হয়েছে যে, গতকাল আমি একটা জিনিষ কিনেছি, কিন্তু সেল" হয়েছে আজ থেকে ঐ আইটেমটার উপর। আমি যদি গতকালের রিসিপ্ট নিয়ে ঐ দোকানে যাই, তারা আবার আজকের দিনের "সেল" এর হিসাব ধরে টাকা হিসাব করে আমাকে বাকী টাকা ফেরত দিবে। কি তাজ্জব ব্যাপার এই দেশে। শুধু তাই না। আরো একতা মজার কাহিনী চোখে পড়লো যে, প্রায় ১৫ দিন আগে কেউ একটা শার্ট বা প্যান্ট কিনে নিয়ে গেছে, ব্যবহার করেছে, ১৫ দিন পরে এসে দোকানে বল্লো যে, আমার এই শার্ড় টা আর ভালো লাগছে না, আমি ফেরত দিতে চাই, ওমা, তারা সব তাকা ফেরত দিয়ে দিচ্ছে আবার "সরি" ও বলছে যে, জিনিষটা ক্রেতার পছন্দ হয় নাই বলে। বাংলাদেশ হলে বাঙ্গালীরা সারা বছর খালী এভাবে মাগনা মাগনা কিনতো আর বদল করে করে নতুন জিনিষ নিয়ে আবার বদল করতো। এটা আমেরিকা। কোনো যুক্তি ছাড়া এরা দুই নম্বরী করে না।
২৫/১১/১৯৯৫-বোষ্টনে বাঙ্গালির দাওয়াত
Categories
সন্ধার সময় ভাইয়া আজকে আমাকে নিয়ে একটি বাঙ্গালী পরিবারে বেরাতে নিয়ে গেলেন। ভাইটির নাম বশীর। তিনি পাকিস্থানী। কিন্তু আপা আমাদের ঢাকার তেজকুনী পাড়ার মেয়ে। বহু বছর আগে তারা দেশ ছেড়েছে। আগে থেকেই সম্ভবত তারা জানতেন যে, আমি আসবো। ফলে আমার সুবাদে এবং ভাইয়ার সুবাদে আরো অনেক বাঙ্গালী পরিবারের কেউ কেউ এসেছেন। আমি কাউকে চিনি না বলে খুব একটা সখ্যতা গড়ে তুওলতে পারছি না। কিন্তু এদের মধ্যে অনেকেই আমাকে একটি প্রশ্ন বারবার করছিলেন যে, আমার ভাই আমেরিকার এতো বড় একতা ইউনিভার্সিটিতে প্রোফেসর কিন্তু আমি আর্মীতে গেলাম কেনো? আর্মী একতা ভালো প্রোফেশন না। তারা মনে করেন, Why should someone to choose a profession to kill someone to survive himself? Its risky and not a good profession.
আমি হেসে হেসেই বলছিলাম, কাউকে না কাউকে তো দেশের আর্মীতে যেতে হবে, সেতা না হয় আমরা কজন গেলামই।
পার্টিতে হাতে বানানো মিষ্টি খেলাম, পোলাও করেছিলো, সবাই খুব আনন্দের সাথে ত্রিপ্তি করে খেয়ে বল্লো, যাক, ছোট ভাইয়ের সুবাদে আজ নাকি তারা বাঙ্গালি খাবার খেলো।
২০/১১/১৯৯৫- বোষ্টন
Categories
এই কয়দিন ভাইয়ার বাসায় আছি। শীতের প্রকোপ কমছে না। বাইরে গেলেই তুষারপাত। গতকাল সবাই মিলে একটি ছবি দেখলাম। দি রেইন ম্যান। একটা অটিষ্টিক বাচ্চার কাহিনী। ইউসুফের সাথে প্রচন্ড মিল রয়েছে। সকালের দিকে আমি মাসুদের স্ক্লে গিয়েছিলাম। সুন্দর একটা স্কুল। কো-এডুকেশন অবশ্য। স্কুলে গিয়ে বুঝলাম মাসুদ খুব জনিপ্রিয়। ওর ক্লাশ টিচারের নাম মিস ম্যাপল। মাসুদ আমাকে ওর ক্লাশ টিচারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর ঊনি আমাকে বললেন যে, আমার পক্ষে সম্ভব কিনা হাইতির উপর একটা ছোট খাটো প্রেজেন্টেশন দেওয়া। আমি আসলে একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। তারপরেও বললাম, যদি ম্যাপ থাকে তাহলে আমি হয়ত চেষ্টা করতে পারি।
যেই বলেছি যে, আমি ৩০/৪০ মিনিটের একটা ক্লাশ নেবো, অমনি সব ছাত্ররা তাদের টেবিল চেয়ার রুমের একদিকে টানাটানি করে সরিয়ে দিলো, একটা হল ঘর হয়ে গেলো। এই চেয়ার টানাটানির সময় আমি আর মাসুদ মিলে ওদের কম্পিউটার থেকে হাইতির একটা ম্যাপ বের করে ফেললাম। আর আমি একটা ছোট নোট লিখে ফেললাম কি কি বল্বো আর কি কি বল্বো না।
বাচ্চারা খুব হাসি খুশীতে সবাই বসে পড়লো। আমারো খুব ভালো লাগছিলো এই সব পটেনশিয়াল বাচ্চাদেরকে কিছু একটা বলতে।
তাদের হাইতি সম্পর্কে যতোতা না উতসাহ, তাঁর থেকে বেশি উতসাহ দেখলাম আর্মীর জীবন নিয়ে। কি হয়, কিভাবে থাকি, কিভাবে অস্ত্র চালাই, সব অস্ত্র চালাইতে পারি কিনা। একটা গুলি করলে কতজন মরে, আমি শত্রুদেরকে কিভাবে ঘায়েল করি। আকাশ থেকে লাফ দিয়ে পড়তে পারি কিনা। যদি পারি, আর যদি আর না বাচি তাহলে কিভাবে কি আরো কতো যে কি?
হাইতিতে আমি কতজনকে এরেষ্ট করেছি, ওরা আমাদেরকে মারে কিনা, ওদের কি অস্ত্র আছে, সরকার সবাইকে একসাথে ধরে মেরে ফেলে না কেনো ইত্যাদি। ৪০ মিনিটের ক্লাস হয়ে গেলো প্রায় দেড় ঘন্টার। মিস ম্যাপেল শেষে এসে বললেন, মাসুদ এবং আমাকে অনেক ধন্যবাদ ওদেরকে সুন্দর কিছু বলার জন্য এবং আমি টাইম দেওয়ার জন্য।
ওদের স্কুল দেখে একটা জিনিষ বুঝলাম, স্কুলের প্রতিটি দেওয়ালে দেওয়ালে হরেক রকমের ইনফর্মেশন, ম্যাপ, বিভিন্ন সংবাদ এবং বিশেষ ব্যক্তিদের ছবি সহ তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী। মাসু মাত্র ক্লাস এইটে পড়ে। ওদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক বাস্তব ধর্মী। বিভিন্ন ধর্মের ছেলেমেয়েরা আহে। কয়েকজন মুসলমান ছাত্রো এবং ছাত্রীকে দেখলাম। ছাত্রীরা ছোট ছোট হেজাব পড়ে আছে। আমাকে দেখে সালামও দিয়েছে।
সুন্দর একতা সময় কাটলো আজ কে মাসুদের স্কুলে।
১৬/১১/১৯৯৫-আমেরিকা গমন- উইজার্ড ৯৫
Categories
বহুদিন ধরেই আমেরিকায় যাবো যাবো করে যাওয়া হচ্ছে না। এখান থেকে আমেরিকা মাত্র ৪৫ মিনিটের ফ্লাইট জার্নি। হাবীব ভাইয়ের সাথে প্রায়ই কথা হয়। হাবিব ভাইও আমাকে বারবার যাওয়ার জন্য বলছেন। অনেকে আবার একবার আমেরিকার ভিসা লাগানোর কথা বলছেন। এ জাতীয় ব্যাপারে আমি বড় উদাসীন। তারপরেও এতো কাছাকাছি এসে ভাইয়ার কাছে যাবো না এটা হয় না। তাই ভিসার জন্য এপ্লাই করেছিলাম, ভিসা পেয়েছি এক বছরের মাল্টিপ্যাল ভিসা। কেএলএম বিমানে টিকেট কাটা হয়েছে, ১৫ নভেম্বর, অর্থাৎ গতকাল। আমার ফ্লাইট সিডিউল হচ্ছে হাইতি-লোগান (বোষ্টন) সরাসরি।
যেহেতু বিমান বন্দরের সবাই আমাকে চিনে এবং এখানেই আমার ডিউটির জায়গা। ভাবলাম, শেষ মুহুর্তে গেলেও কোনো অসুবিধা নাই। আমার ফ্লাইট বিকাল ৫ টায়। ভিভিআইপির মতো ইমিগ্রেশনে গেলাম প্রায় সাড়ে চারটায়।
ওমা। গিয়ে দেখি বিমানের ডোর ইতিমধ্যে ক্লোজ হয়ে গেছে। ওরা তো আর জানতো না যে, আমি এই বিমানের যাত্রী। তাদেরকে আমি আগে থেকেও জানাই নাই। ফলে দোষটা যে আমার এটাতে কোনো সন্দেহ নাই। ইমিগ্রেশন অফিসার জানালো যে, স্যার, এখন তো আর কোনোভাবেই আপনাকে ঢোকানো সম্ভব না। আপনি এক কাজ করেন, নেক্সট ফ্লাইট আছে রাত আটটায়। কিন্তু ওটা সরাসরি না গিয়ে জেএফকে হয়ে তারপর কানেক্টিং ফ্লাইটে বোষ্টন এয়ারপোর্ট লোগানে যেতে হবে। কিছুই করার নাই।
ফলে আমি ওদেরকে বললাম, সেভাবেই তাহলে আমার ইমিগ্রেশন করে রাখেন। ওরা আমাকে একটু আগেভাগেই এম্বারকেশন টিকেট হাতে ধরিয়ে দিলো। কিন্তু এবার যাচ্ছি আমেরিকান এয়ারলাইন্সে। কেএলএম বাদ। আমার ভাই জানেন যে, আমি কেএলএম বিমানে সরাসরি ফ্লাইটে লোগানে নামবো। আমি এই চেঞ্জটা আর ভাইয়াকে জানাই নাই কারন যেহেতু যাচ্ছিই আর আমি যে এই রকম একটা বোকার মতো কাজ করে ফেলেছি সেটা আর জানাতে চাই নাই।
ঠিক সময় মতো আমেরিকান এয়ারলাইন্স বিমান জেএফকে এর উদ্দ্যেশে ছেড়ে দিলো। কাছাকাছি আসার পর পাইলট জানালেন, লোকাল আবহাওয়া অত্যান্ত খারাপ, বরফে আচ্ছাদিত এয়ারপোর্ট। আমরা নামার চেষ্টা করছি। কয়েকবার এটেম্পট নেবার পরেও পাইলট সম্ভবত নামার ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছিলো না। প্লেন নামলো রাত মোটামুটি সাড়ে নয়টায় এবং আমাদের লাগেজ পেতে পেতে আরো আধা ঘন্টা সময় পেড়িয়ে গেলো। যেহেতু এটা সরাসরি ফ্লাইট ছিলো না, ফলে জেএফকে থেকে আরেকটা আমেরিকান এয়ারলাইন্সের প্ল্যান ছেড়ে যাবার কথা রাত সোয়া দশটায়। আমি খুব তাড়াহুরা করছি। অনেক পেসেঞ্জার ইমিগ্রেশনের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করা যাবে না।
জেএফকে এয়ারপোর্টে পেসেঞ্জার লাইনে পেসেঞ্জারদের ইমিগ্রেশন সুবিধার জন্য কর্তৃপক্ষ চারটি লেনে সাইন বোর্ড দিয়ে রেখেছেন। প্রথম সারি হচ্ছে যারা প্রথম আমেরিকায় এসেছেন তাদের জন্য, ২য় সারি হচ্ছে যারা ডিপ্লোম্যাট তাদের জন্য, তৃতীয় সারি হচ্ছে যারা ২য় বার আমেরিকায় এসেছেন তাদের জন্য। আর ৪র্থ সারি হচ্ছে শুধুমাত্র আমেরিকানদের জন্য।
আমার বুঝতে কোনো অসুবিধা নাই। আমি ১ম আমেরিকায় এসেছি। ফলে আমি ১ম সারিতেই ঢোকে গেলাম। খুব বেশি লোক নয়। আমার টার্ন আসতে মাত্র ৪ জন বাকি। যেইমাত্র আমি ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে দাড়ালাম, তিনি একজন বয়স্ক মহিলা, আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালেন। আমি জিন্সের একটা প্যান্ট পড়া একটা ওভারকোট কাধে ঝুলানো। হাতে ছোট একটা ব্যাগ।
মহিলা অনেক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে কি যেনো ভাবলেন। প্রেমে পড়েছে কিনা বুঝতে পারছি না, আর প্রেমে পড়লেও লাভ নাই, আমার স্ত্রী এই বয়ষ্ক মহিলার থেকে ঢেড় সুন্দুরী। কিন্তু ওনার চোখ মুখ প্রেমের কথা বলছেনা, বলছে কিছু একটা ভুল হচ্ছে আমার সাথে। তিনি আমাকে একটু ভিতরে ডেকে নিয়ে গেলেন এবং ইমিগ্রেশন পুলিশকে কি যেনো বললেন।
হটাত করে তিন চার জন ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাকে এমনভাবে জেরা করা শুরু করলেন, আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ইংরেজী ভাষা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নাই, আমি ইংরেজীটা বাংলার মতোই ভালো বলতে পারি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ করে রেগে গেলে আমি বাংলার চেয়ে ইংরেজিতেই বেশি কথা বলতে সাচ্ছন্দ বোধ করি। তাই আমারও জেরা করতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তাদের ধারনা, আমি জাল ভিসা নিয়ে আমেরিকায় ঢোকার চেষ্টা করছি। এই ভিসা আমার নয়।
আমি বললাম, কেনো জাল ভিসা হবে?
তারা বল্লো যে, তারা বাংলাদেশ, পাকিস্থান, ইন্ডিয়ার পাসপোর্ট দেখলেই অনেক বেশী সতর্ক হয়ে যান, কারন বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এই তিন দেশের লোকেরা জাল ভিসা নিয়ে আমেরিকায় আসার চেষ্টা করে।
আমি বললাম, কে কি করলো, সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। আমি জাল ভিসা নিয়ে আমেরিকায় ঢোকবো কেনো? আমেরিকা এমন কি মধুর দেশ যে, আমাকে এই কাজ করতে হবে? তোমরা আমেরিকাকে কি মনে করো? সর্গরাজ্য?
আমার এমন কথায় পুলিশ একটু সতর্ক হয়ে গেলো। আমার কথার মধ্যে কোনো জড়তা ছিল না বরং ছিলো প্রচন্ড রাগ। তারা আমাকে আবার বল্লো যে, আমার ছবির সাথে নাকি আমার পাশপোর্টের ছবি মিল নাই। আমার মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো।
আমি বললাম, তাহলে পাশপোর্টে কি আমার দাদার ছবি নাকি আপনাদের প্রেসিডেন্টের ছবি লাগানো লাগানো যে আমাকে চেনা যাচ্ছে না? তারা আসলেই আমাকে নিয়ে বেকায়দায় পড়ে গেলো। এই রকম টাস তাস করে তো জাল ভিসাধারী কথা হয়ত কখনো বলে নাই বা বলে না। তাহলে কি কোনো ভুল হচ্ছে আমার সাথে?
আমি বললাম, আমার কানেক্টিং ফ্লাইট আছে সাড়ে দশটায়। যদি মিস করি, আমি আপনাদের দায়ী করবো এবং আমি সময়মতো আমার নেক্সট ষ্টেশনে পৌছতে চাই।
এবার আরো কিছু নতুন পুলিশ আসলো। আমাকে দেখলো, আমার পাস্পোর্ট দেখলো, তারপর বল্লো, স্যার আপনার কাছে কি আরো কোনো ছবি আছে? তারা আমার সাথে কোনো প্রকার ফালতু ব্যবহার করছে না, বরং আমিই একটু উত্তেজিত হয়ে কথা বলছি। কারন, আমি খুব এম্বেরাসড হচ্ছিলাম মনে মনে।
বললাম, দেখতে হবে, আমার ব্যাগে ছবি আছে কিনা। আমি ব্যাগ চেক করতে গিয়ে প্রথমে বেরিয়ে এলো আমার জাতিসংঘের আইডি কার্ড। পুলিশ সাথে সাথে ঐ আইডি কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখে বল্লো, স্যার আপনি কি জাতিসংঘে কাজ করেন?
বললাম, হ্যা।
এবার তাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলে গেলো। এবার তারা আমাকে বল্লো, ওহ স্যার, আপনি আগে কেনো বলেন নাই যে, আপনি জাতীসংগে কাজ করেন, তাহলে তো এতো বিরম্বনা হতো না?
আমাকে এবার তারা এতো সমীহ করে কথা বলা শুরু করলেন যে, তারা যেনো এখন অপরাধি আর আমি পুলিশ। বলি এবার ব্যাপারটা কোথায় তাদের ধান্দায় ফেলেছিলো।
ব্যাপারটা দাড়িয়েছিলো এই রকমঃ
আমি যখন আমেরিকার ভিসার জন্য এপ্লাই করি, হাইতির কন্সুলেট অফিস আমাকে ডিপ্লোম্যাট ভিসা ইস্যু করেছিল। যেহেতু আমি ডিপ্লোমেটিক হিসাবেই জাতীসংগে কাজ করছি। এটা আমার জানা ছিলো না। আমার ডিপ্লোমেটিক ভিসার কারনে আমার দাড়ানোর কথা ২য় সারিতে। যেহেতু আমি জানতাম না যে আমি ডিপ্লোমেট ভিসায় এসেছি, ফলে আমি এইবারই যেহেতু প্রথম আমেরিকায় এসেছি, ফলে আমি ২য় সারিতে না দাঁড়িয়ে দাড়িয়েছিলাম ১ম সারিতে। এতে ঐ বয়স্ক মহিলার প্রথম সন্দেহ হয় যেহেতু বাংলাদেশী পাসপোর্ট, আবার ভুল জায়গায় দাড়িয়েছি। বয়স্ক মহিলা বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন কারন আমার বয়স অল্প, ডিপ্লোম্যাট হবার মতো নয়। এদিকে সাধারনত ডিপ্লোম্যাটরা স্যুট টাই পড়ে এক্সিকুইটিভ হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে চলাচল করেন, আর আমি জিন্সের একটা প্যান্ট তাও আবার ওভারকোট যেটা নিয়েছি সেটা কাউ বয়ের মতো কাধে ঝুলিয়ে দাড়িয়েছি।
এতোগুলি অসামঞ্জস্যতা মহিলা সমন্নয় করতে পারছিলো না। ফলে তাঁর সন্দেহ হবারই কথা। তিনি আমাকে পুলিশের কাছে পাঠিয়েছিলেন ব্যাপারটা ভেরিফাই করার জন্য। কিন্তু এটা তো আর আমার জানার কথাও না আবার দোষও না।
আমি রীতিমত অফেন্ডেড ফিল করছিলাম এবং বললাম, আপনাদের কমপ্লেই রেজিস্টার আনুন, আমি আন্তর্জাতীক পেসেঞ্জার হিসাবে এয়ারপোর্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবো। আমি জানতাম, যদি আমাকে এইভাবে হেনস্থা করার জন্য যদি মিলিয়ন ডলারের মামলা করি, সরকার সেটা আমাকে দিতে বাধ্য এবং ইমিগ্রেশন পুলিশেরও শাস্তি হবে। তারা ব্যাপারটা ততক্ষনাত সামাল দেওয়ার জন্য আমাকে অনেক অনুনয় বিনয় করে বল্লো, স্যার, আমরা আসলে বুঝতে পারি নাই ব্যাপারটা। অভিযোগ আপনি করতে পারেন কিন্তু আমরা দুক্ষিত।
তারা তাদের ভুলটা যে একেবারে অমুলক নয় সেটা প্রমান করার জন্য আমাকে অনেক অনুরোধ করে প্রায় ৫০ গজ দূরে একটা রুমে নিয়ে গেলেন। কফি খাওয়ালেন এবং ঐ রুমে নিয়ে আমাকে যা দেখালেন, তা দেখে আমি হতবাগ। সেখানে বেশ কিছু বাঙ্গালী, পাকিস্তানী এবং ইন্ডিয়ান পেসেঞ্জারকে পিছনে হাত বেধে রাখা হয়েছে জাল ভিসার কারনে। তাদেরকে প্রপার ইন্টারোগেশন করে প্রমান করেছে যে তারা জাল ভিসায় আমেরিকায় ঢোকার চেষ্টা করেছে। এখন তাদেরকে আগামী কাল ফিরতি ফ্লাইটে যার যার দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
যাই হোক, আমি ব্যাপারটা বুঝেও না বুঝার ভান করলাম। এবার আরো সিনিয়র একজন পুলিশ এসে আমাকে বল্লো, স্যার, আজ সমস্ত কানেক্টিং ফ্লাইট বন্ধ কারন এতো তুষারপাত হচ্ছে যে, কোনো এয়ারপোর্টই ক্লিয়ারেন্স দিতে পারছে না। গত ২৫ বছরেও আমেরিকায় এতো পরিমান তুষারপাত হয় নাই। তাই আজকের এই তুষারপাতের কারনে এর নাম দেওয়া হইয়েছে "উইজার্ড ৯৫"। আগামিকাল বলা যাবে কখন কোন কোন ফ্লাইট যেতে পারবে। ইতিমধ্যে কয়েকটা ফ্লাইট নামার সময় মারাত্তক দূর্ঘটনায় পতিত হয়েছে। আজকে আপ্নারা যারা আমেরিকায় এসেছেন, তাদেরকে এই এয়ারপোর্টেই থাকতে হবে অথবা আপনাদেরকে রুম দেওয়া হবে, সেখানে আপনি থাকতে পারবেন। তবে স্যার, যেহেতু আপনার সাথে আমাদের একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে, আমরা আপনাকে একটা কিছু দিয়ে অনার করতে চাই যদি অভিযোগ না করেন।
আমি কিছুই বললাম না। এরপর সে আমাকে আরো একটি রুমে নিয়ে গেলেন। বেশ কিছুক্ষন পর আমার হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি যে কয়দিন এখানে থাকবেন, এই কার্ডটি দিয়ে যাইই কিনবেন, সব ট্যাক্স মাফ। এটা আমেরিকার ট্রেজারী ব্রাঞ্চ থেকে এবং এস এস ডিপার্টমেন্ট থেকে আপনার জন্য অনার। তারা আরো একটা অনার আমাকে করলেন, সেটা হল তাদের কাছে কিছু ভিআইপি রুম থাকে সেখানে নেক্সট ফ্লাইট না ছাড়া পর্যন্ত আমি থাকতে পারবো। যখন কোনো ফ্লাইট লোগানে যাবে, তারাই আমাকে ডেকে ফ্লাইটে তুলে দেবেন।
দেখলাম, খামাখা কেচাল করে লাভ নাই। আর আমি অভিযোগ করার পর আবার কোন ঝামেলায় পরে যাই তাই কি দরকার এইসব করে যখন তারা আমাকে এতো করে সম্মান দেখাচ্ছেন। আমি কার্ডটি নিলাম। আমি তখনো জানি না এই কার্ডের আসল মাহাত্য কি। তারপরেও সাথে করে নিয়ে গেলাম। কার্ডে আমার ছবি আছে যেটা ওনারা ইমিগ্রেশন করার সময় ওয়েব ক্যামে নিয়েছিলেন।
আমি ইমিগ্রেশন অথোরিটির নির্ধারিত স্যুটে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি ৬ ফুট লম্বা আরেক নিগ্রো পুলিশ অফিসারও আমার সাথে আছেন। তিনি ঐ স্যুটের দায়িত্তে।
আমি পুলিশ অফিসার (নাম তাঁর ফ্রান্সিস) কে জিজ্ঞেস করলাম, আমি যেনো সিগারেট খেতে পারি এমন একটা রুম দেয়। সে জানালো, এখানে সিগারেট খাওয়া যায় না। কিন্তু একটা করিডোর আছে সেখানে গিয়ে খাওয়া যায়। সে নিজেও সিগারেট খায় বলে মুচকি হেসে দিয়ে বল্লো, You Major must be a bad man like me, because we both smoke.
তখন রাত বেজে গেছে প্রায় বারোটার উপরে। আমি করিডরে দাঁড়িয়ে দেখালাম, বাইরে অনেক সাদা সাদা বরফ। আমার জীবনে আমি কখনো বরফ দেখি নাই। এইই প্রথম। ছুতে চাইলাম, ফ্রান্সিস আমাকে বল্লো, তুমি ওখানে যেও না, প্রচন্ড ঠাণ্ডা। চারিদিকে বিমান বন্দরের আলো কিন্তু এতো বরফ পড়ছে যে, বেশিদূর দেখা যায় না। বরফের বৃষ্টি এইই আমি প্রথম দেখে খুব ভালো লাগছিলো।
ভাবলাম, এবার ভাইয়াকে একটা ফোন করে বলি যে, আমি জেএফকে এয়ারপোর্টে আটকা পড়েছি, চিন্তা করো না। কারন ইতিমধ্যে আমার সিডিউল অনুযায়ী আমার লোগানে থাকার কথা। অনেকবার চেষ্টা করেও ভাইয়াকে পেলাম না। বারবার ভুল নাম্বারে চলে যাচ্ছে ফোন। ওপাশে যিনি ফোন ধরছেন, তিনি একসময় বিরক্ত হয়ে কি যেনো বলছিলো আমাকে, সেটা আমি ভালোমত বুঝতেও পারছিলাম না। কিছু আমেরিকানরা ভালোমত ইংরেজীও বলতে পারে না। নোয়াখালি টাইপের ইংরেজী বললে কি আর আমি বুঝবো? সে মনে হয় আমেরিকান নোয়াখালির লোক।
যাক, রাতে আর ঘুমানোর প্ল্যান করছিলাম না যদিও আমার রুম আছে। বাইরেই ফ্রান্সিসের সাথে প্রায় ১ ঘন্টা সিগারেট খেয়ে গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। ভালোই লাগছিলো। সে আসলে আমেরিকার অরিজিনাল লোক নয়। সে জ্যামাইকার মাইগ্রেটেড অফিসার। প্রায় ১৫ বছর আগে তাঁর পরিবার এখানে মাইগ্রেট করেছিলো। অনেক গল্প বল্লো। তাঁর ছেলেমেয়েদের কথা। তাঁর পরিবারের কথা। আর আমি বললাম, আমার আজকের ইমিগ্রেশনের বাজে ইন্সিডেন্টের কথা। সে খুব হাসলো। বল্লো, তুমি তো ইচ্ছে করলে অভিযোগ করলে বেশ কিছু কম্পেন্সেশন পেতে পারতা। আমেরিকা এইসব অভিযোগকে খুব ভয় পায়। ফ্রান্সিস জানালো, তাঁর ডিউটি আছে, যেতে হবে।
ফ্রান্সিস যাবে এমন সময় একজন মহিলা কোথা থেকে উদয় হয়ে আমাকে সিগারেট খেতে দেখে লাইটারের জন্য এগিয়ে এলো। বুঝলাম, সে সিগারেট খায়। এটাও আমার কাছে নতুন একটা অভিজ্ঞতা। মহিলারা স্মোকার। সেও আটকা পড়েছে এই উইজার্ড-৯৫ এ। যাবে ডেনভার। আমি এখানের কোনো রাজ্যই চিনি না।
ফ্রান্সিস চলে গেলো আর বলে গেলো, সিগারেট খাওয়া হয়ে গেলে যেনো রুমে চলে যাই, ওখানে কিছু ড্রাই ফুড আছে, ইচ্ছে করলে আমি সেসব বিনে পয়সায় খেতে পারি, কোনো বিল উঠবে না। আর এও বলে গেলো, ফ্লাইট চালু হলে সে আমাকে নিয়ে যাবে, কোনো অসুবিধা নাই। এখন মনে হচ্ছে, ইমিগ্রেশনে ঝামেলা হয়ে ভালোই হয়েছে। সুফল পাচ্ছি।
মহিলা আমার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে আর আমি কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাবো, কি করি, এইবারই আমেরিকায় প্রথম কিনা ইত্যাদি গল্প জুরে দিলো। যখন সে শুনলো আমি মেজর এবং জাতীসংগে কাজ করছি, তিনি একটু খুশী হয়েছেন বলে মনে হলো। কারন তাঁর একটা ছেলে আছে যে, আমেরিকার নেভিতে কাজ করে। বর্তমানে সে মালয়েশিয়া আছে। মহিলার নাম লিন্ডা।
আমি বললাম, আপনার এতো বড় ছেলে আছে যে কিনা নেভীতে কাজ করে? আপনাকে দেখে তো সে রকম মনে হয় না?
সে বেশ খুশি হলো মনে মনে যে, আমি তাকে অনেক ইয়াং বলে ভাবছি বলে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, বলেন তো, আমার বয়স কত হবে?
মনে মনে ভাবলাম, পৃথিবীর সমস্ত মহিলারা তাদের বয়স বাড়তে দেয় না। বয়স যাই হোক, সে সেটা গোপন রেখেই কম বয়সটা বলে থাকে আর কেউ তাকে ইয়াং বলুক সেটাই চায়। এটা হোক বাঙ্গালী মেয়ে আর হোক আমেরিকার ইংরেজী বলা কোন নারী। আমি চিন্তা করলাম, যদি উনার ছেলে নেভীতে কাজ করে, তাহলে কমপক্ষে ছেলের বয়স ২০। আর এই মহিলা যদি অন্তত ২০ বছর বয়সেও বিয়ে করেন, তাহলে মহিলার বয়স এখন প্রায় ৪০!। আমি বললাম, আপনার বয়স হয়তোবা ৪০ হবে।
ওরে বাপ, তাঁর চেহাড়াই বদল হয়ে গেলো। মনে হলো তাকে ৪০ বলায় তিনি ক্ষিপ্ত। হয়ত আশা করেছিলো আমি ২৫ বা ৩০ বল্বো।
লিন্ডা বল্লো, আমি কি এতোই বুড়া দেখাচ্ছি মেজর?
বুঝলাম, ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু এখন তো আর শোধরানোর কোনো পথ দেখি না। আমি বললাম, যদিও তোমার বয়স ৪০ হতে পারে কিন্তু তোমাকে ৩০ এর বেশী লাগে না।
খুশী হলো না। সিগারেট খাওয়া শেষ হলেই লিন্ডা আমাকে কোনো প্রকার সম্মোধন ছাড়াই বিদায় নিলো। আর বল্লো, ধন্যবাদ লাইটারের জন্য। বাই। বলে গট গট করে তাঁর হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে চলে গেলো। একবার পিছন ফিরে তাকালোও না। হায়রে মহিলাদের বয়স।
আরেক অভিজ্ঞতা হলো। বয়স যাই হোক, আমি আর কোনো মহিলাকে ৩০ এর বেশী বলব না বলে শিক্ষা পাইলাম। তাঁর বয়স ৯০ হলেই কি আর ৩০ হলেই কি। আমার তো কিছু যায় আসে না। কিন্তু খুশী তো করা গেলো কাউকে!! এইবা কম কি। কিসের পাল্লায় পড়লাম রে ভাই। প্রতি ক্ষনে ক্ষনে অভিজ্ঞতা বাড়ছে।
রাত তিনটার দিকে ফ্রান্সিস এলো রুমে। এসেই বল্লো, মেজর, তুমি কি এখন যাবা? একটা ফ্লাইট যাচ্ছে বোষ্টনে। লোকাল ফ্লাইট। ইথিউপিয়ান এয়ারলাইন্স। যদি যাও তাহলে ১০ মিনিটে রেডি হও, আমি নিয়ে যাবো। বললাম, এতো রাতে গিয়ে কি করবো। সকালে কোনো ফ্লাইট নাই?
ফ্রান্সিস বল্লো, সেটা এখনো ডিক্লেয়ার দেয় নাই। আমার মনে হয় তোমার যাওয়া উচিত কারন পুরু বিমান বন্দরে যে পরিমান যাত্রী আটকা পড়েছে, সকালের ফ্লাইট না ধরে তুমি বরং লোগানে গিয়ে নেমে যাও। আমরা তোমাকে ট্যাগ করে দেই যদি ওখানে রেষ্ট করার জন্য কোনো রুম লাগে সেটাও পাবা। আমরা তোমাকে একটা স্লিপ দিয়ে দেবো, সেটা লোগানে দেখালেই তুমি একটা ভালো রুম পাবে যদি চাও। সিদ্ধান্ত নিলাম, চলেই যাই। ফ্রান্সিস আমাকে চট করে একটা এয়ার ট্যাক্সিতে করে একেবারে বিমানের সামনে নিয়ে গেলো। ব্যাগপত্র ফ্রান্সিস নিজেই ক্যারি করে নিয়ে গেলো। আমি ইথুপিয়ান বিমানে উঠে গেলাম।
ফ্রান্সিসকে বিদায় দিতে আমার কষ্ট হচ্ছিলো, হয়তো ওর সাথে আমার আর দেখা হবে না। হ্যান্ডশেখ করতে গিয়ে বললাম, ফ্রান্সিস, তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমি তোমাকে মনে রাখবো। ফ্রান্সিস হেসে দিয়ে বল্লো, এটাই মজা। মিসিং পিপল সো সেডলী। তুমিও ভালো থেকো। একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে দিলো যদি কখনো এখানে আবার আসি, যেনো ওর মোবাইলে কল করি। কার্ডটা যত্ন করে পকেটে রাখলাম। আমি এখন প্লেনে বসে পড়েছি। অনেক পেসেঞ্জার, যদিও লোকাল প্লেন কিন্তু বেশ বড়। বেশীরভাগ মানুষই মনে হচ্ছে লোগানের বাসিন্দা। আমি একজন বয়স্ক মহিলার পাশে বসেছি। বয়স তাঁর প্রায় ৬০ এর কাছাকাছি।
প্রায় আরো ৪০ মিনিট ফ্লাই করে লোগানের উপর দিয়ে প্লেন হোবার করছে। এখানেও নামতে মনে হয় দেরী হবে। অনেক বরফে জমে আছে বিমান বন্দর। পাইলট জানালেন, আমরা নামতে নামতে আরো ১৫ মিনিট দেরী হবে।
আমরা শেষতক খুব নিরাপদেই নামলাম। লাগেজ নিতে যেতে হবে অনেক দূরে। প্রায় ১ কিলোমিটার দূর আমাদের লাগেজ ডেলিভারী পয়েন্ট। আমরা নেমেছি সি ব্লকে। একেকটা ব্লক এতো বড়? আমাদের জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টও তো ওদের একটা ব্লকের সমান না!!
লাগেজ নিলাম। এবার ভাইয়াকে ফোন করা উচিত। এয়ারপোর্টেই টেলিফোন বুথ আছে। পঞ্চাশ সেন্ট ড্রপ করে কথা বলা যায়। আমার কাছে মাত্র একটা কয়েন আছে। ডলার আছে কিন্তু আমার কাছে তো আমেরিকার কয়েন নাই। এদিকে কয়েন ছাড়া ফোন করা সম্ভব না। যাই হোক, কোথায় কয়েন পাবো সেটাও জানি না। যে কয়েনটা ছিলো সেটা দিয়েই চেষ্টা করলাম। ঐ একই সমস্যা। ভুল নাম্বারে ফোন চলে যাচ্ছে এবং একই বাসায় যাচ্ছে। আমি ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতেছিনা, আরে বাবা, যদি ভুল নাম্বারেই যাবে, তাহলে একই নাম্বারে যাচ্ছে কেনো?
এইবার ঐ পাশের ভদ্রলোক মনে হয় ব্যাপারটা বুঝতে পারছে যে, আমি কিছু একটা ভুল করছি। সে আমাকে বল্লো, আমি আসলে কোথায় ফোন করছি? এবার তাঁর কথাগুলি আমার কাছে ক্লিয়ার মনে হলো। আমি বললাম, এটা কি এই নাম্বার?
সে বল্লো, হ্যা, এটা এই নাম্বারই যেটা আমি বলেছি।
বললাম, আমি আসলে আমার ভাইকে ফোন করছিলাম যিনি থাকে বোস্টনে। এবার তিনি ব্যাপারটা বুঝে ফেললেন। বললেন, আপনি যেখানে আছেন, সেটা লোগান, যদিও ম্যাসাচুসেট এর অধীনে। আপনি আপনার নাম্বারের সাথে একটা ১ যোগ করেন, তারপর ডায়াল করেন, আপনি আপনার ভাইকে পেয়ে যাবেন। যদি ১ যোগ না করেন, তাহলে বারবার আমার নাম্বারেই কল আসতে থাকবে। আর এরইমধ্যে আমার কয়েন শেষ, লাইন কেটে গেলো। আমার কাছে আর কোনো কয়েনও নাই। কি মুশকিল। ভালো লাগলো অন্তত এটা জেনে যে, এবার আর ভুল হবে না। ভাইয়াকে ফোনে অন্তত পাওয়া যাবে।
কোথায় পাই কয়েন? একটা দোকানে ঢোকলাম এইভেবে যে, কিছু কিনি এবং কয়েন নেই। কিন্তু কোনো চেষ্টাই সফল হচ্ছে না। কয়েনের যোগাড় হচ্ছে না। হটাত দেখলাম, একজন পুরুষ ক্লিনার ফ্লোর ক্লিন করছে। ভাবলাম, তাকে জিজ্ঞেস করে দেখি সে আমাকে কিছু কয়েন দিতে পারে কিনা। লোকটিকে বলার সাথে সাথে সে বল্লো, তাঁর কাছে ৩ ডলার পরিমান কয়েন আছে। সেটা সে ৫ ডলার হলে দিয়ে দেবে। আরেক অভিজ্ঞতা। সব দেশের ৪র্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের এই এক সমস্যা। ধান্দাবাজী। মেনে নিলাম। কারন আমার কাছে এক টাকাও যা, এক ডলারও তা সেটাই মনে হচ্ছে এখন পর্যন্ত। আমি তাকে ৫ ডলারের একটা নোট দিয়ে ৩ ডলার সম পরিমাণ কয়েন নিলাম।
আমি ঐ ভদ্রলোকের কথা মতো ভাইয়ার বাসার নাম্বারের আগে ১ যোগ করে যেই না ডায়াল করেছি, অপর প্রান্ত থেকে আমার ভাবী ফোন ধরলেন। তিনি এতোই অবাক হলেন আমার ফোন পেয়ে যেনো কেদেই দিলেন। ভাবী বললেন, তুমি বেচে আছো? আমি বললাম, কেনো? আমি মরবো কেনো? কি ব্যাপার?
ভাবী বললেন, আরে ভাই, তুমি যেই প্ল্যানে লোগানে নামার কথা কাল, কেএলএম বিমান, সেটা নামার সময় ক্রাশ করেছে, বহু লোক চরম ভাবে আহত/নহত হয়েছে, কেউ কেউ বলছে মারাও গেছে এবং এখনো রেস্কিউ চলছে। তোমার ভাই তো তোমাকে খুজে খুজে পাগলের মতো অবস্থা। তুমি এখন কোথায় আছো?
আমি বললাম, আমি তো সি ব্লকে আছি। আর আমি তো জানি না যে, কেএলএম ক্রাশ করেছে। কোনো এক কারনে আমি তো ঐ ফ্লাইট মিস করে পরে আমেরিকান এয়ারলাইন্সে এসেছি জেএফকে হয়ে। এখন ইথুপিয়ান এয়ারলাইন্সে একটু আগে নামলাম। আমি ভালো আছি। এবার বলেন, ভাইয়াকে পাবো কিভাবে?
ভাবী এতোটাই আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন আমার সাথে কথা বলে যে, ভালোমতো কথাই বলতে পারছিলেন না। মরা মানুষের খোজ পাওয়া, চারটিখানি কথা তো আর না। ভাবী বললেন, তুমি যেখানে আছো সেখানেই থাকো, কোথাও যাবে না, আমি তোমার ভাইকে জানাচ্ছি। যেহেতূ তোমার কাছে মোবাইল নাই, তুমি কিন্তু ওখানেই থাকো। আর পারলে একটু পরে আমাকে তোমার কারেন্ট লোকেশানটা জানাও।
প্রায় ২০ মিনিট পর ভাইয়া হাজির। কি যে ভালো লাগলো ভাইয়াকে পেয়ে। ভাইয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, অনেক প্রেসারে ছিলাম তোকে নিয়ে। যাক আল্লাহর রহমত যে, তোকে ভালোভাবে পেলাম। তুই এখানে দাড়া, আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।
ভাইয়াকে নিয়ে আমি বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম। ভাইয়া নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। দুই ভাই, অনেক গল্প করতে করতে গাড়িতে আসছিলাম। চারিদিকে বরফ, রাস্তায় অনেক গাড়ি দিয়ে লোকজন রাস্তা ক্লিয়ার রাখার চেষ্টা করছে। প্রায় ৪০ মিনিট ড্রাইভ করে আমি আর ভাইয়া ভাইয়ার বাসার এসে হাজির হইলাম।
শান্তি। এক মাস থাকবো এখানে। মাসুদের সাথে দেখা হলো, ইউসুফের সাথে দেখা হলো। তখন বেলা প্রায় ১১টা দিন কিন্তু সূর্য মামার কোনো খবর নাই। চারিদিকে বরফের বৃষ্টি। গাছের চেহাড়া দেখলে মনে হয়, বরফের গাছ, আশেপাশের সবকিছু বরফে ঢেকে আছে। কি দেশ রে বাবা।
সারাদিন গল্প করলাম, বাইরে যাওয়ার কোনো স্কোপ নাই। ঘরের ভিতরে হিট করে ঘর গরম রাখা হচ্ছে। আমি আর মাসুদ এক রুমে থাকার প্ল্যান করেছি। ইউসুফ অন্য ঘরে। পুরু ঘরটাই কার্পেটে মোড়ানো। হাইতিতে গরম অথচ এখানে এসে পড়েছি উইজার্ড-৯৫ এর পাল্লায়। মানে শীতের দেশ।
১০/১০/১৯৯৫- হাইতিতে মায়ের ডাক
হাইতিতে মিশন করতে এসে প্রায় প্রতিদিনই ইদানিং ঝুকিপূর্ন এলাকায় পেট্রোলিং করতে যেতে হচ্ছে। হাইতির সাধারন জনগন বাংলাদেশের কন্টিঞ্জেন্টের উপরই মনে হচ্ছে একটু ভরষা রাখতে পারছে আর বাকী ব্যাটালিয়ন গুলির (যেমন, পাকিস্থান ব্যাটালিয়ান, ইন্ডিয়ান ব্যাটালিয়ান, ক্যানাডিয়ান কন্টিনজেন্ট, অথবা ঈগল ক্যাম্প নামে আমেরিকান কন্টিনজেন্ট) উপর তেমন একটা ভরষা করতে পারছে না। ফলে এখানে যিনি এস আর এস জি (স্পেশাল রিপ্রেজেন্টেটিভ অফ সেক্রেটারি জেনারেল) হিসাবে দায়িত্বরত আছেন, মিষ্টার লাখদার ব্রাহিমী, তিনি সব ফোর্সের সাথে বাংলাদেশের কাউকে না কাউকে অংশ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। সে মোতাবেক, আমি এখন কিউ আরএফ (কুইক রি-একশন ফোর্স) এর একজন। আমার কাজ হচ্ছে যেখানেই কোনো সমস্যা শোনা যাবে, তাতক্ষনিকভাবেই আমার দল নিয়ে ক্যানাডিয়ান, অথবা আমেরিকান অথবা অন্যান্য ফোর্স কে অগম্যান্ট করা। জাগোয়ার রেডি, গাড়ি সব সময় স্ট্যান্ডবাই থাকে। আমরাও মোটামুটি এনটিএম ১০ (অর্থাৎ ১০ মিনিটের মধ্যে নোটিশ টু মুভ) অবস্থায় থাকি।
গতকালও একটা অপারেশনে গিয়েছিলাম। জায়গাটার নাম ডেলমাস। খুব ঘন বসতি একটা জায়গা। অনেকটা বস্তির মতো। লোকজন ও খুব ডিসিপ্লিন না। সারাক্ষন নেশার মধ্যে থাকে অধিকাংশ লোক। এটা আসলে একটা মাদকের আড্ডাখানা আর কুখ্যাত লোকদের আশ্রয়স্থল। গতকালের গোপন খবরে জানা গেলো যে, এখানে অভ্যুথানকারী জেনারেল সেড্রাসের একটা বাহিনী কুছু আর্মস ডিল করবে।
সকালে আমি ঈগল ডেনে গেলাম ব্রিফিং ছিলো। বেশ কিছু গোপন তথ্য আমাকে এবং আমার অন্যান্য দল সমুহ যারা কাজ করবে, তাদের সবাইকে জানানো হলো। নির্দেশ ছিলো যে, যদি কেউ আমাদেরকে হুমকীর মধ্যে ফেলে দেয়, তাহলে যেনো আমরা সাথে সাথে ফায়ার ওপেন করি। মিশনে আসার পর আজ অবধি কখনো এই রকম একটা আদেশ পাই নাই যে, আমরা আমাদের ফায়ার আর্মস দিয়ে কাউকে গুলি করতে পারি। আজ পেলাম। ফলে মনে হলো অপারেশন টা খুব একটা সাধারন অপারেশন নয়।
সকাল ১১ তাঁর দিকে প্রথমে আমি আমার টিম নিয়ে ডেলমাসের উদ্ধেশ্যে পজিশন নিয়ে নিলাম। তাঁর ৫/৭ মিনিট পর পজিশন নিলো পাকিস্থান বাহিনীর একটা দল। আমাদের সবার এরিয়া ভাগ করা ছিলো। কোথায় আমেরিকানরা থাকবে আর কোথায় অন্যান্য টিম থাকবে। অপারেশনের মেইন দায়িত্তে ছিলো ঈগল বেসের। মানে আমেরিকানদের আন্ডারে। ওরা অনেক সতর্ক থাকে, কোনো কিছুই হেলাফেলা করে এগোয় না। ব্যাপারটা যেনো এমন, যে কোনো মুহুর্তে যে কোনো ঘটনায় তারা যেনো কুইক পালটা রি-একশনে যেতে পারে ঠিক তাই।
আমি একটা একতলা ভাংগা চুড়া বিল্ডিং এর ঠিক নীচে অস্ত্র আর ওয়াকি টকি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার থেকে প্রায় ১০ গজ দূরে আমাদের বাঙ্গাদেশি একজন সার্জেন্ট রুহুল আমাকে কাভার দিচ্ছে। আমার আরেক পাশে প্রায় ৩/৪ গজ দূরে আমার ওয়্যারলেস অপারেটর দাঁড়িয়ে সারাক্ষন এদিক সেদিক লক্ষ্য রাখছে। হাইতির আবহাওয়া সব সময়ই গরম থাকে। এখানে কখনোই শীত পড়ে না। মানে এখানে কোনো শীত কাল নাই।
সকাল ১১ টা থেকে হাইতিতে প্রচন্ড রোদ থাকে বিধায় সারাক্ষন ঘামতে থাকি। ইউনিফর্ম ভিজে যায়। তারমধ্যে কোনো গাছ গাছালী নাই। এই দেশের লোকজন গাছ কাটতে কাটতে দেশতাই প্রায় উদ্ভিদ শুন্য হয়ে গেছে। দূরের পাহাড়ের মধ্যেও কোনো গাছ গাছালি নাই। ছায়া দিতে পারে এই রকম আছে শুধু আম গাছ। কারন এখানে সারা বছর আম ধরে। আম ওদের একটা অর্থকরী ফসল। তাই শুধু এই আম গাছ গুলিকেই ওরা কাটে না। এতো গরমের মধ্যে কোথাও ছায়া না থাকায় আমি যেখানে দাঁড়িয়ে পরিবেশ পর্যালোচনা করছি, সেতা একতলা একটি বিল্ডিং, তাঁর দুই ধার দিয়ে দুটো ছোট ছোট রাস্তা বা গলি চলে গেছে। কেউ গলি থেকে বের হলে কিংবা গলি দিয়ে প্রবেশ করলে আমার নজরে পড়বেই।
টার্গেট ধরার জন্য যেখানে ঈগল টিম কাজ করছে, আমরা তাঁর থেকে প্রায় ১০০ গজের মধ্যেই আছি। আমাদের কাজ, ওদের কে প্রোটেকশন দেওয়া এবং যদি বাইরে থেকে কেউ প্রবেশ করতে চায়, তাদেরকে প্রতিহত করা। এখানে কোনো যুদ্ধ চলছে না। অনেক সাধারন মানুষ হয়তো জানেই না কেনো আমরা এখানে কি কাজে অপারেশন চালাচ্ছি। এতা প্রায়ই হয় বিধায় ওরাও ব্যাপারতা বেশি আর গুরুত্ব দেয় না। ওপারেশন কে ওরা স্বাভাবিক ভাবেই নেয়।
প্রায় ১৫ মিনিট যাবত আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি যেখানে ছিলাম। হটাত আমার মনে হলো, কে যেনো আমার নাম ধরে ডাকলেন। আমি যেনো স্পষ্ট শুনতে পেলাম আমার মায়ের গলা। ঠিক এইভাবে উনি ডাকলেন, "এই বাবা..." খুব হতবাগ হয়ে আমি শব্দটা যেই ডাইরেকশন থেকে শুনতে পেয়েছি বলে মনে হলো, সেদিকে একটু নড়ে ঘাড় ঘুরালাম। হয়ত ২/৩ ফুট হবে। ঘাড় ঘুরাইয়া উকি মারতে গেলে একটা মানুষের যেটুকুন জায়গার পরিবর্তন হয় আর কি, ঠিক সেটুকুই হয়ত হবে। ঠিক এই সময়েই আবার আমি সার্জেন্ট রুহুল যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো, সেও "স্যার" বলে অত্যান্ত উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো। ফলে আমি আরো ২/৩ ফুট স্বরে গেলাম ওর ডাকে। আর ঠিক এই মুহুর্তেই দেখলাম, আমি যেখানে দাড়িয়েছিলাম, সেই বিল্ডিং এর ছাদ থেকে প্রায় ৩০/৪০ কেজির একটা কংক্রিটের স্লাব মাটিতে ধপাস করে পড়লো। আমি ওদিকে তাকাতেই দেখি কে একজন দ্রুত গতিতে এক ছাদ থেকে লাফ দিয়ে অন্য ছাদে গিয়ে পড়ে দৌড়াতে লাগলো।
আমরা ওকে দৌড়াইয়া ধরতে ধরতেই সে গলি থেকে গলি, এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি, এবং হারিয়ে গেলো। তাকে আর আমরা ধরতেই পারলাম না। ব্যাপারটা আমার কাছে অত্যান্ত চমকিয়ে দিলো। কে লোকটা? আর ঐ কংক্রিটের স্লাব তা যদি আমার মাথায় পড়ত, আমি সাথে সাথে মারা যেতাম। লোকটা আসলে আমাকে উদ্দেশ্য করেই ছাদ থেকে কংক্রিটের স্লাব তা আমার মাথায় পড়ুক এই উদ্দেশ্য নিয়ে ফেলেছিলো।
আমি ঘটনাটা আমাদের বাংলাদেশ কমান্ডারকে ওয়্যারলেস সেটে এবং অপারেশনের দায়িত্তে থাকা ঈগল কমান্ডারকে জানালাম। তারা দ্রুত আমার এখানে চলে এলেন। আর জানালেন যে, ওনারা যেখানে টার্গেট আছে বলে ইনফর্মার প্রতিবেদন দিয়েছিলো, আসলে সেটা ভুল ছিলো। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আসলে সেতাই ছিলো টার্গেটের মুল স্থান। আমরা যখন ওখানে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা পর্যালোচনা করছিলাম, অবজার্ভ করছিলাম, টার্গেট আমাদেরকেই টার্গেট করে কাউকে হতাহত করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।
আমাদের অপারেশন বিফল হয়েছে।
আমি আমার রুমে ফিরে এসে অনেক্ষন একটা ব্যাপার নিয়ে খুব ভাবহিলাম। আর সেতা হচ্ছে, আমি কিভাবে আমার মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আমার কাছে কেনো মনে হলো যে, আমার মা আমাকে ডাকছেন? মা তো বাংলাদেশে। আর আমি হাইতি। মার ডাক তো কিছুতেই আমার শুনার কথা না। এটা কিভাবে হলো? আমি আসলে আমার মায়ের কণ্ঠস্বর শুনেই কিন্তু প্রথমে ২/৩ ফুট স্বরে গিয়েছিলাম। তাঁর সাথে সার্জেন্ট হারুনের ডাকে আরো ২/৩ ফুট স্বরে গিয়েছিলাম। এতে মোট প্রায় ৫/৬ ফুট জায়গা পরিবর্তন হয়েছে। উপর থেকে কংক্রিটের যে স্লাব টা আমার মাথায় পরার কথা, আমার এই ৫/৬ ফুট জায়গা সরার ফলে ওটা আমার মাথায় না পড়ে খালি জায়গায় পড়েছিল আর আমি জীবন ফিরে পেলাম। আমি কিছুতেই ব্যাপারটা কাকতালীয় ভাবে নিতে পারছিলাম না। এখানে বলে রাখি যে, বাংলাদেশের সাথে হাইতির সময়ের ব্যবধান ১০ ঘন্টা। অর্থাৎ আমি যখন দিনের ১১ টায় হাইতিতে ডিউটিতে ছিলাম, তখন বাংলাদেশে রাত ১ টা বাজে। মা হয়ত ঘুমাচ্ছেন, অথবা তাহাজ্জুত নামাজ পড়ছেন।
আমি সন্ধ্যায় ঢাকায় আমার বউ এর কাছে ফোন দিয়ে বললাম, মা কেমন আছে? আমার মা আমার বউ এর সাথে থাকেন। মার সাথে কথা বললাম। মা প্রথমেই যা বললেন, আমার গা শিউরে উঠলো। মা বললেন, গতকাল রাতে আমি একটা খুব বাজে স্বপ্ন দেখেছিলাম। দেখলাম, কে যেনো তোমাকে পিছন থেকে মারার চেষ্টা করছে। আমার ঘুম ভাংগার ঠিক পর পরই আমি তাহাজ্জুতের নামাজে তোমার জন্য আল্লাহর কাছে অনেক দোয়া করেছি। যেনো তোমাকে আল্লাহ সব রকমের বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। এ কথা বলে মা খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন আমাকে নিয়ে এটাও প্রকাশ করলেন।
আমি হিসাব করে দেখলাম, যে মুহুর্তে মা তাহাজ্জুতের নামাজে রত ছিলেন এবং যখন আল্লাহর কাছে আমার নিরাপত্তার জন্য দোয়া করছিলেন, ঘটনাতা ঠিক ঐ মুহুর্তেই ঘটেছিলো।
মায়ের দোয়া সন্তানের জন্য সাথে সাথে আল্লাহ কবুল করেন, এতাই তাঁর প্রমান। মার দোয়ায় আল্লাহ যেনো কোনো এক গায়েবী আওয়াজে আমার কানে মায়ের স্বর পৌঁছে দিয়ে আমাকে মাত্র কয়েক ফুট সরিয়ে দিলেন। আর সেই ৩/৪ ফুট সরে যাওয়ার কারনেই এতো বড় একটা কংক্রিটের স্লাব ছাদের উপর থেকে ফালানো আমার উপর না পড়ে পড়লো খালী জায়গায়।
এই মায়েদের দোয়া আমি যেনো সারাজীবন পাই, সেই তৌফিক দান করুন আল্লাহ আমাকে। আমার মাকে তুমি সারাক্ষণ হেফাজত করো আর আমার মাথার উপরে যেনো তিনি ছায়ার মতো থাকেন সেই তৌফিক দান করো।
১৬/০৯/১৯৯৫, হাইতি- শনিবার
Categories
আজ ছুটির দিন। বেশ দেরী করে ঘুম থেকে উঠেছি। ক্যাঃ মুনীর সারাক্ষন গান বাজিয়ে ক্যাম্পটাকে মাতিয়ে রাখে। একটু চটপটেই সে। দেশে ফোন করার একতাই নিয়ম, ট্রেসকম টেলিকোম্পনি থেকে প্রি-পেইড কার্ড কিনতে হয়। খুবই এক্সপেন্সিভ। তাই সব সময় কথা বলা যায় না। এখানে আরেকটা সমস্যা হলো, আমরা এখানে মাত্র ২৫% সেলারী পাই। দুপুরের পর আমার নিজের পেট্রোলিং আছে।
জাতিসংঘের আইডি কার্ড এখনো হাতে পাই নাই। ইউ এন হেড কোয়ার্টার আমাদের বেস ক্যাম্প থেকে বেশী দূরে নয়। ওখানে যেতে হবে আইডি কার্ড করার জন্য। অনেকেই করে ফেলেছে কিন্তু আমার এখনো যাওয়া হয় নাই। যদিও আজ বন্ধ্যের দিন কিন্তু আই ডি কার্ডের অফিসটা খোলা। ভাবছি, আজ পেট্রোলিং এ যাওয়ার পথে ইউ এন হেড অফিসে গিয়ে কাজগুলি শেষ করে ফেল্বো। আজ ভীড় একটু কম থাকবে। ড্রাইভার জাহাঙ্গীর আমাদের ড্রাইভার। কুজো হয়ে গাড়ি চালায় কিন্তু ভালো গাড়ি চালায়। ওকে আসতে বলেছি বিকাল তিনটায়। প্রায় তিন ঘন্তার পেট্রোলিং।
এই পেট্রোলিং এ আমাদের কাজ আসলে খুব সীমিত। আমরা গাড়ি চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যায়। কোথাকার কি পরিস্থিতিসেতা অবলোকন করি। কোনো অঘটন দেখা হলে আমরা সেখানে থামি। এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলি। ব্যাপারতা কন্ট্রোলে রাখার চেষ্টা করি। কোনো বেগতিক দেখলে আমরা সেটা তাতক্ষনিক আমাদের বেস ক্যাম্পে রিপোর্ট করি, সে মোতাবেক আমরা পরবর্তী কাজ গুলি করি।
০৭/০৯/১৯৯৫-পোর্ট অ প্রিন্স এয়ারপোর্টে
Categories
আমাকে পোস্টিং করা হয়েছে এয়ারপোর্ট দেখভাল করার। পোর্ট অ প্রিন্স এয়ার পোর্ট। বিমান বন্দরে প্রতিদিন সকালে যাই, সারা অফিস চত্তর একবার করে ঘুরে আসি। আমার সাথে আছে মেজর ফরিদ (১১ লং কোর্সের), ক্যাঃ শেখ মুনীরুজ্জামান ( মেহেরপুরের, আমার সাথে ৬ ফিল্ডে ছিলো) আর আছে ক্যাঃ জাহিদ। দুটি বড়বড় সৌদি তাবুতে আমরা আছি। তিন নম্বর তাবুটা আমাদের রিক্রেশন রুম। তাতে একটা দাবার সেট আছে, টিভিও আছে, ভিসিডি আছে, আর আছে একটা ছোট ফ্রিজ। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের তাবুতেও একটা করে টিভি আছে। আমরা শুয়ে শুয়েই টিভি দেখতে পারি। আমরা আমাদের এই ক্যাম্পে নামাজের জন্য আরেকটা তাবু করে দিয়েছি। এখানে নামাজের ব্যবস্তাহ আছে। বেশ গরম হাইতীর আবহাওয়া। এখানে নাকি কোনো শীতকাল নাই। সারা বছর আম ধরে। এদের কারেন্সি হেসিয়ান ডলার যার মান ১ ইউ এস ডলার দিলে ৫ হেসিয়ান ডলার পাওয়া যায়। আর এক ডলার দিয়ে প্রায় ৮ থেকে ১০ টা বড় বড় আম পাওয়া যায়। মানুষ গুলি খুব গরীব, আর পানির সংকট প্রচন্ড অথচ পাশেই ক্যারিবিয়ান সমদ্র।
০৩/০৯/১৯৯৫- ২য় দিন হাইতি
Categories
সকালে উঠেই অফিসে যেতে হলো। অনেক ফরমালিটিজ। জাতিসংঘের নিয়ম অনুসারে মেডিক্যাল কার্ড, নিহের ফর্ম পুরন করা, আইডি কার্ডের জন্য আরেক অফিসে যাওয়া, ভ্যাকসিন নেওয়া, অরিয়েন্টেশন ক্লাশ করা ইত্যাদির ভারে সারাটি দিন বেশ ভালই চাপের মধ্যে গেলো। আমরা হাইতির ভাষা বুঝি না, তাই দোভাষী এলো। একজনের নাম নাতাশা। প্রায় ৪০ বছরের মতো হবে। এখানকার সবাই ব্ল্যাক। প্রায় ৯৫% মানুষ ব্ল্যাক। আমি কখনো ব্ল্যাক মানুষ এতো কাছ থেকে দেখিনাই।
এদের দেখলে কোনো অবস্থাতেই ভালো লাগে না। নোংরা নোংরা মনে হয়। মেয়েগুলির নিতম্ব এতো বড় আর বুক পেট এতো উচু তাঁর সাথে মুখের চেহারা এতো বিদ্গুটে যে, এদের আমার ভালোই লাগছিলো না। কিন্তু আমি পজিটিভ মানুষ। তাদেরকে আমার ভালো লাগতে হবে এটাই সবচেয়ে বড় কথা। আমি এদের সাথে এদের জন্য এদের দেশে কাজ করবো অথচ আমি এদের কে পছন্দ করবো না, এটা অন্যায়, এবং করা উচিত না।
আমরা কে কোথায় কি ডিউটি করবো এটা এখনো কন্টিনজেন্ট কমান্ডার ভাগ করে দেন নাই বিধায় আমরা সবাই আপাতত বেস ক্যাম্পেই থাকছি, আর ক্যারাবানে ঘুমাচ্ছি।
০২/০৯/১৯৯৫- হাইতি গমন
Categories
২০ জুলাই ১৯৯৫ তারিখে আমাকে ৭ ফিল্ড রেজিমেন্ট থেকে ১ ফিল্ড রেজিমেন্টে পোস্টিং করা হয়েছিলো ১ ফিল্ডের সাথে হাইতিতে জাতিসঙ্ঘ মিশনে যাওয়ার জন্য। ১ ফিল্ডের নতুন নামকরন করা হয়েছে ব্যানব্যাট। এর মানে হলো বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন। আজ আমরা হাইতিতে আগমন করলাম। জাতিসঙ্ঘ মিশনে এটাই আমার প্রথম মিশন। আমাদের কোর্সের মেজর সাকির আমাদের সাথে আছে। ১২ লং কোর্সের মেজর জাহিদ (সিরিয়াল-১৪ নামে বেশী পরিচিত) আছে। ১১ লং কোর্সের মেজর ফরিদ, মেজর মোসাদ্দেক, ১০ লং কোর্সের মেজর ফারুক, ৯ লং এর মেজর ইশ্তিয়াক এবং মেজর সারোয়ার, ১৬ লং এর মেজর আলী (সুন্দর আলী নামেই সে বেশি পরিচিত)। এয়ারফোর্সের স্কোয়াড্রন লিডার শফিক স্যার (নায়ক রাজ রাজ্জাকের মেয়ে ময়নার জামাই) ও আছেন। আর্মি, এয়ারফোর্স এবং নেভী মিলিয়ে প্রায় ৬/৭ শত জোয়ান।
হাইতিতে আসার আগেই এর মধ্যে দুই দফায় দুটি দল ইতিমধ্যে চলে এসেছিল। তাদের কাজ ছিলো মেইন বডি আসার আগে সমস্ত বাসস্থান রেডি করা। শুধু তাইই নয়, এর আগে যে ইউনিট ছিলো বাংলাদেশের তাঁর থেকে সমস্ত মালামাল, গাড়ী, অস্ত্র ইত্যাদি বুঝে নেওয়া।
আমাদের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার কর্নেল ফরিদ (আর্টিলারী), তাঁর সাথে আরো ৬ জন লেঃ কর্নেল আছেন। আমরা প্লেন থেকে নেমে সবাই পোর্ট অ প্রিন্স বিমান বন্দরেই সবাই সারিবদ্ধ হয়ে প্রথমে ওকে রিপোর্ট নেয়া হলো। আমরা সবাই বাংলাদেশী ইউনিফর্ম পড়া। এই প্রথম ইউনিফর্ম পড়ে কোনো ভিন দেশে আমার আগমন। সারাদিন প্লেন জার্নিতে টায়ার্ড লাগছিলো। ক্ষুধাও ছিলো পেটে। আমাদের বেস ক্যাম্পে আসতে আসতে প্রায় রাত ৯ টা বেজে গেলো। আমরা সবাই পর্বে পর্বে বেস ক্যাম্পে এলাম।
কোনো স্যহায়ী বিল্ডিং নাই, প্লাস্টিকের ডোঙ্গার মতো ছোট ছোট ক্যারাবান। একটা ক্যারাবানে প্রায় ১৫ থেকে ২০ টির মতো রুম। আমার রুম মেট ১০ লং কোর্সের মেজর ফারুক স্যার। দুজনেই সিগারেট খাই। সুতরাং রুমে সিগারেটের ধুয়ায় প্রথম দিনই ভরে গেলো।
ইউনিফর্ম চেঞ্জ করে মেসে খেতে গেলাম। খেতে খেতে রাত প্রায় ১২ টা বাজলো।
১৮/১০/১৯৯১-নিউলংকার ক্যাম্প-পর্ব ৪
জ্যোৎস্না সন্ধ্যায় যখন আমি ক্যাম্পের উঠোনের ঠিক মাঝখানে বসি, তখন দেখিতে পাই আকাশের মেঘমালা একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়া পাহাড়ি বাতাসের সাথে একাকার হইয়া কাধে কাধ লাগাইয়া, এক জায়গা হইতে অন্য জায়গায় দ্রুত স্থান পরিবর্তন করিতেছে। কখনো কখনো এই মেঘমালা চাদের কিরনকে পরিবেষ্টিত করিয়া আমার পুরু ক্যাম্পকে আবছা অন্ধকারে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করে, আবার কখনো কখনো মেঘগুলি এতো নীচু দিয়া প্রবাহিত হয় যে, আমার সারা শরীর ভিজিয়া যায়, আমার হাতে থাকা সিগারেটটাও সিক্ত হইয়া আসে। আর্মিতে আসিবার পর আমি অনেক রাত একা একা নির্জন কোনো গায়ের পথ ধরিয়া মাইলের পর মাইল হাটিয়া গিয়াছি। গহীনরাতে আমি সেই মেঠোপথে পেচাদের ডাক শুনিয়াছি। কখনো কখনো আলো আধারে ঘেরা কোনো এক পুকুরের পাশে বসিয়া ব্যংগ সমুহের নাক ডাকা শব্দও শুনিয়াছি। এই পৃথিবীর রুপ দেখিয়া আমি দিনের আলোয় জেগে উঠা পৃথিবীর রুপের কোনো মিল খুজিয়া পাই নাই। আসলে ঘুমন্ত পৃথিবীর একটা রুপ আছে। জ্যোৎস্নায় ইহার রুপ এক রকম, আবার অমাবশ্যায় ইহার রুপ অন্য রকম। জাগ্রত পৃথিবীর রুপ ঘুমন্ত পৃথিবীর রুপের মতো নয়।
এখন রাত প্রায় বারোটা। আমার ক্যাম্পের সেন্ট্রিপোষ্টের প্রহরী ছাড়া আর সবাই ঘুমিয়ে আছে। আমার থেকে অনতিদূরের ঘরটায় নূর মোহাম্মাদ ওয়্যারলেস অপারেটর মৃদু হারিকেনে ঝিমাইতেছে। নূর মোহাম্মাদের পাশে থাকা ওয়্যারলেস যন্ত্রটা মাঝে মাঝে বেশ সিজিত হইয়া অন্য কোনো ষ্টেশন থেকে "হ্যালো হ্যালো" বার্তা দিয়া নীরবতা ভঙ্গ করিতেছে। আমি আকাশ থেকে ঝরে পরা নির্মল জ্যোৎস্নায় স্নান করিতেছি একা।
হটাত কারো পায়ের আওয়াজ পাইলাম। ঘাড় ঘুরাইয়া দেখিতে পাইলাম, হাবিলদার আব্দুর রহমান রুম হইতে বাহির হইলো। জিজ্ঞেস করিলাম, কোথায় কি কারনে বাহির হইলো। আমাকে একা উঠানে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া আব্দুর রহমানও একটু হচকচিয়ে গেলো। এতো রাতে তো আমাকে এই উঠনে দেখার কথা নয়। সালাম দিয়া বলিল, স্যার, ঘুম আসিতেছে না? আমি রহমানকে কিছুই বলিলাম না। প্রায় মিনিট পাচেক পর আব্দুর রহমান বাথরুম করিয়া আবারো তাহার ঘরে প্রবেশ করিতে যাইবে, এমন সময় আমার মনে হইল, আব্দুর রহমানের সাথে কিছু কথা বলি। আমি তাহাকে ডাকিয়া বলিলাম, -রহমান, কাল তোমার কি ডিউটি? অফ ডিউটি নাকি কোনো ডিউটি আছে?
আব্দুর রহমান সাবলিল ভংগিতে জানালো, -স্যার আগামিকাল আমার কোনো ডিউটি নাই। পরপর কয়েকদিন আমি ডিউটি করার কারনে আগামি দুইদিন আমার অফ ডিউটি। কিন্তু স্যার ক্যাম্পের মধ্যে অফ ডিউটি আর অন ডিউটির মধ্যে আসলে কোনো তফাত নাই। যেখানে থাকার ঘর তার পাশেই ডিউটির ঘর, আবার তার পাশেই রান্না ঘর তো তারই পাশে টিভি রুম। কতটুকুই বা জায়গা স্যার।
বললাম, বসো। আচ্ছা রহমান, তুমি সারাদিন জাল বুনো কেনো? এটা কি তোমার নেশা? আব্দুর রহমান পাশেই একটা ছোট কাঠের গুড়ি নিয়া আমার সামনে বসিয়া পড়িলো। আগেই একবার বলিয়াছিলাম যে, বিডিআর সৈনিকেরা আমাদের আর্মির সৈনিকের চেয়ে ঢেড় বেশী ফ্রি। তাহারা আমাদের আর্মির সৈনিকের চেয়ে অনেক বেশি পরিপক্ক। আব্দুর রহমান, কাঠের গুড়িটায় বসিয়া বলিতে লাগিলো-
স্যার, জাল বুনা আমার নেশা না। এটা বলতে পারেন আমার একটা ইনকামের পথ। আমি প্রতি তিনদিনে একটা জাল বুনি। এ যাবত কাল আমার ট্রাংকের মধ্যে প্রায় ৫০ টার বেশী জাল বুনা আছে। আমি যেদিন ছুটি যাবো, আমি এই জালগুলি সাথে করে নিয়ে যাবো। প্রতিটা জালে আমি প্রায় একশত করে টাকা লাভ করতে পারবো। তাতে আমি ৫০টি জালে হাজার পাচেক টাকা লাভ করবো। আমার পরিবারের জন্য টাকাটা অনেক কাজে লাগবে। আমার বড় ছেলেটা এবার মেট্রিক দেবে। মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। ভাল আছি স্যার সব মিলিয়ে।
আব্দুর রহমানের কথায় আমি খুবই অবাক হইলাম। মাত্র হাজার পাচেক টাকা তো বিডিআর সৈনিকের কাছে কিছুই না। যে পরিমান অবৈধ পন্য, চোরা কারবারীর মাল ,কিংবা বর্ডার সুরক্ষার নামে যে পরিমান অবৈধ নারকোটিক্স পাচার হয়, তাতে তো কোটি টাকার খেলা। আর এই আব্দুর রহমান কিনা মাত্র ৫ হাজার টাকাতেই এতো খুসি? আব্দুর রহমান এই নিশব্দ রাতে, একাকী আমাকে যাহা যাহা বলিলো, তাহাতে আমার রহমানের প্রতি বিনম্র ভালোবাসা আর শ্রধ্যায় মাথা হেট হইয়া আসিলো।
স্যার, যেদিন আমি প্রথম এই কর্মজীবনে আসি, আমি দেখেছি, কি হরিলুট হয় আমাদের এই কর্মজিবনে। এমনো হয়েছে যে, এক রাতের ইনকাম হয় লাখ লাখ টাকা। আমি আজ পর্যন্ত কোনোদিন কখনো কোনো অবস্থাতেই একটি টাকাও অবৈধভাবে কামাই করি নাই, খাইও নাই। অনেক সময় আমার সহকর্মীরা ভাগ বাটোয়ারা করে হয়ত আমার ভাগেরটা আমার তোষকের নীচে রেখে গেছে, আমি সেটা কোনোদিন খুজেও দেখি নাই, ধরেও দেখি নাই। কেউ যদি এই অবৈধ টাকা আমার তোশকের তল থেকে চুরী করেও নিয়া যায়, বা গেছে, তাতেও আমার কোনো কিছুই যায় আসে না। টাকাটাই তো আমার না। আমি সবসময় সৎ রোজগারে বিশ্বাসী ছিলাম, এখনো আছি, আল্লাহই যথেষ্ঠ আমার শান্তি আর সুখের জন্য। নামাজ পড়ি, রোজা করি, কারো সাথে ঝামেলায় যাই না, আমি আমার কাজগুলি ঈমানের সাথে করার চেষ্টা করি। কয়দিনই বা বাচবো স্যার। তারপর কি? আমি কি আমার এই সব সম্পদ, টাকা পয়সা সাথে করে নিয়ে যেতে পারবো? স্যার আমি মরনকে দেখেছি খুব কাছ থেকে। আমি দেখেছি কত বিত্তবান মানুষ অঢেল সম্পত্তির উপর শুয়ে থেকেও তার ওই সব টাকা কোনো কাজেই লাগে নাই। তাহলে কি লাভ এই পচা, অবৈধ আর দূষিত টাকা কামানো? তার থেকে আমি এই যে প্রতি তিন দিনে একটা জাল বানাই। আর যা লাভ হয়, সেটায় অনেক বেশী বরকতময় স্যার। আমার সাথে কারোই বনে না বলে ওরা আমাকে রদ্দিমাল বলেই কেউ কেউ টিটকারী করে, কেউ আবার বোকা বলে, কেউ আবার আমার কিছুই নাই বলে ফকিরন্নীও বলে। আমি তাতে কোনো কিছুই মাইন্ড করি না। আমি শুধু জানি, আমাকে সম্মানীত করার মালিক একমাত্র আমার প্রভু, আল্লাহ।
আব্দুর রহমান কথাগুলি বলিয়া চলিয়া গেলো। আর আমাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলো, স্যার, অনেক রাত হয়েছে, ঘুমাইয়া পরেন। খোলা আকাশে এভাবে বসে থাকলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। পাহাড়িয়া এলাকা, কেউ অসুস্থ্য হলেও তাকে সুস্থ্য করবার লোক আশেপাশে থাকে না। আব্দুর রহমান চলিয়া গেলো।
কি অদ্ভুত দর্শন আব্দুর রহমানের। টাকাই যদি সমস্ত সুখের মূল হইতো তাহলে আজ থেকে শত বর্ষ আগে যে সব রাজ রাজারা সমস্ত ভুখন্ডের মালিক ছিলো, তারা তো আর আজীবন কাল যেমন বাচিয়া নাই, তাদের বংশ ধরেরাও হয়তো আর রাজ রাজাদের মতো বিলাশ বহুল জীবনেও নাই। আমি আরো অনেক ক্ষন সেই জোস্নাস্নাত রাতের আলোতেই ক্যাম্পের উঠোনে বসিয়া রইলাম। পাশেই কোনো এক বাদুরগোছের কোনো নিশাচর হয়তো একটা গাছ হইতে আরেকটা গাছের ডালে যাইবার জন্য কুহুকুহু শব্দের মতো শব্দ করিয়া স্থান পরিবর্তন করিলো। লোকচক্ষুর অন্তরালে, ঘুমন্ত পৃথিবীর চরনতলে, একা একা কত ঘটনা, কত ইতিহাস, কত যে, গল্প তৈরী হয়, তাহা অনেকের হয়তো জানা নাই কিন্তু জীবন্ত পৃথিবীর তুলনায় ঘুমন্ত প্রিথিবীতেই বেশির ভাগ ইতিহাসের সুত্রপাত।
আমি আকাশের দিকে চাহিয়া ভগবানকে দেখার চেষ্টা করিলাম। আসলেই কি ভগবান অই আকাশের উর্ধতলে থাকেন? নাকি তাহার বিচরন ওই আকাশের উর্ধতল থেকে শুরু করিয়া আমার ক্যাম্পের এই সেন্ত্রিপোষ্টের একটি খাম্বার পাশেও থাকেন, অথবা ওই যে বাজপাখীটা এইমাত্র স্থান পরিবর্তন করিলো ইহার মনের ভিতরেও আছেন। সারাটি পৃথিবীর মানুষ যখন ঘুমায়, ভগবানের এতো বড় দুনিয়ায় তখন হয়ত অন্য কোনো গ্রহে, অন্য কোন নক্ষত্রে কিংবা অন্য কোনো এক অপরিচিত জগতে আমার মতো হয়ত কেউ আরেকট নিউলংকার ক্যাম্পে মাঝরাতে বসিয়া সেই ভগবানের রহস্য লইয়া ভাবিতেছে। কে জানে।
দুনিয়া বড় রহস্যময় স্থান। এর দিন আর কাল যেমন সদা পরিবর্তনশীল, জীবন ও একদিন সব কিছু পরিবর্তন করিয়া তাহার নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়া স্থিত হইবে। তখন ইহার আগের ইতিহাস কেউ হয়তো আর মনেও রাখিবে না যেমন আজ থেকে হয়তো আরো ৫০ বছর কিংবা ৫ বছর পরে কেউ মনে রাখিবে না যে, আমি ঠিক এই স্থানে এক রাতে ঈশ্বরের কথা ভাবিয়া অনেকতা সময় পার করিয়াছি।
১২/১০/১৯৯১-নিউলংকার ক্যাম্প-পর্ব-৩
নিউ লংকার ক্যাম্প-পর্ব-৩
ক্যাম্প লাইফ ভীষন বোরিং। কতক্ষন একটা ছোট জায়গায় বন্দি হয়ে থাকা যায়? ভাবলাম, পাশের গ্রামগুলিতে মাঝে মাঝে ঘুরতে যাবো। ওদের সাথে একটা সামাজিক বন্ধন তৈরী করলে অসুবিধা কি? আমরা তো সমাজের বাইরে কেউ না। আর আমি তো এখানে আছিই এই সেতুবন্ধনের মতো একটা ভালো পরিবেশ তৈরী করে এই এলাকাকে নিরাপদ করা। সে মোতাবেক, আমি একটা সিডিউল করলাম, কিভাবে কখন কি নিয়ে ওদের সাথে আলাপ করা যায়, কিভাবে ওদের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ হওয়া যায়। যে যতো কিছুই বলুক, আর্মির উপস্থিতি কোনো উপজাতী পছন্দ করে না। এটা তারা মনে করে তাদের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ। অনেকে হয়তো সরাসরি কিছু বলে না, কিন্তু তাদের আকার ইংগিত আর চালচলনে এটা খুবই স্পষ্ট। ওরা আসলেই আমাদের আর্মিকে পছন্দ করে না। কিন্তু বন্দুকের নলের সামনে আর যাই হোক, বাহাদুরী চলে না। তাই ইচ্ছা না থাকলেও ভালো সম্পর্ক আছে এটাই প্রকাশ করতে হয় প্রতিটি উপজাতীকে। অথচ আমি হয়তো বুঝতে পারছি না, কোন আচরনটা তাদের শুদ্ধ আর কোন আচরনটা আসলে লোক দেখানো। সত্য এবং মিথ্যার বসতির এই সম্পর্কের মধ্যে না জানা যেমন অনেক কথা থাকে, তেমনি অনেক বিপদের গন্ধও থাকে। না বলা কথা না জানার চেয়ে বিপদের গন্ধটা আচ করতে পারাটা অনেক বেশী জরুরী। তাই আমিও সচেতন হয়েই কিছুকিছু সময় পাশে পাংখু এলাকায় গ্রাম বাসীদের সাথে মেলামেশার চেষ্টা করছি। কিন্তু চোখ কান খোলা আছে।
আমি ক্যাম্প লাইফটাকে আরো সহজ এবং আরামদায়ক করার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। তার মধ্যে একটা হচ্ছে- ক্যাম্পে মাটি কেটে কেটে মাটির উপরেই ম্যাপের মত বিভিন্ন স্থান তৈরী করা যা বর্তমান আমার এলাকায় আছে। যেমন কার বাড়ির পাশে কার বাড়ি, কোন গ্রামের পর কোন গ্রাম, কোন কোন রাস্তা আছে কোন কোন জায়গায় যেতে, কোথায় টংঘর, কোথায় রুট প্রোটেকশন ক্যাম্পগুলি আছে ইত্যাদি। ক্যাম্পের সৈনিকদের বেশ সারা পাওয়া গেলো। আমরা যার যার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটা মুটামুটি মাটির অপারেশন রুম বানিয়ে ফেললাম।
আমার ক্যাম্পটা খুব বেশী বড় না। মোট ৫টা ঘর। একটা আমার ঘর, একটা মসজিদ, একটা ছোট ওয়্যারলেস রুম কাম সৈনিকের থাকার জায়গা, একটা টিভি রুম। আরেকটা ঘর বেশ বড় সেখানে সৈনিকেরা থাকে, সাথে একটা ক্যান্টিন। রান্নাঘর, বাথরুম, এগুলি সব আলাদা। প্রচুর গাছপালা আছে। ক্যাম্পের অদূরেই আরেকটা হিলটপ আছে যেখানে আমরা হেলিপ্যাড বানিয়েছি। যখন হেলিসর্টি হয়, তখন এই হেলীপ্যাডেই হেলিকপ্টার ল্যান্ড করে। আমাদের হেলিপ্যাডটা আমাদের সেন্ট্রিপোষ্ট এর অস্ত্র দ্বারা কাভার করা। এটা খুবই জরুরী। আমার রুমটা যেখানে, সেটা মেইন গেটের একদম সাথে। আমার ঘরটার পিছন দিয়ে ছোট একটা রাস্তা গেছে যাতে আমি অন্যান্য সেন্ট্রি পোষ্টগুলিতে অনায়াসেই যেতে পারি। ক্যাম্প সুরক্ষার জন্য আমি মোট তিনটা জায়গায় ইন্টারলক সিস্টেমে সেন্ট্রিপোষ্ট লাগিয়েছি। দিনের বেলায় সেন্ট্রি পোষ্টগুলিতে একজন আর রাতের বেলায় দুইজন করে ডিউটি করে। সবার কাছে একটা করে হুইসেল আর টর্চ লাইট দেয়া আছে। সেন্ট্রিপোষ্টের অস্ত্রটি একটি লোহার চেইন দিয়ে বাধা যাতে কোনো কারনে রাতের বেলায় সেন্ট্রি তার অগোচরে ঘুমিয়ে পড়ে, তাহলে শান্তিবাহিনী অস্ত্রটি তুলে নিয়ে যেতে না পারে।
আমি ক্যাম্পের তিনপাশেই তিনটা বেতের চেয়ারের মতো করে বাশের কঞ্চি দিয়ে দিয়ে চেয়ার বানিয়েছি যাতে আমি ওখানে বসতে পারি। পড়ন্ত বিকালে কিংবা খুব সকালে এই জায়গাগুলিতে বসে প্রাকৃতিক সউন্দর্য দেখতে বড্ড মিষ্টি মনে হয়। খুব ভোরের আকাশ আর সুর্যাস্তের আকাশে একটা বড্ড মিল আছে। দুটি সময়েই আকাশকে বড় নির্মল মনে হয়। লাল আভায় ফুটে উঠে চারিদিকের পাহাড়। সুর্যের প্রথম আলো যখন আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের উপর প্রতিফলিত হয়, তখন মেঘের রঙেও একটা শৈল্পিক রুপ ধারন করে। দূরের পাহাড়ের গাছপালাগুলি আমার ক্যাম্প থেকে দেখলে এমন মনে হয় যেনো, আমি পুরু পাহাড়টার উপর থেকে নীচের বনরাজ্যকে দেখছি। আমার ক্যাম্প থেকে বঙ্গোপসাগরের পানি দেখা যায়। সেই সুদুর সাগর, নীল আকাশ আর পাশের পাহাড় একসাথে মিলে কি যে এক অদ্ভুদ নৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টি করে ভাবাই যায় না।
মাঝে মাঝে সারাদিন বৃষ্টি হয়। মুষল্ধারে যখন বৃষ্টি হয়, তখন কোথা থেকে যে কয়েকটি কাক আমার ঠিক ঘরের নীচে বেল্কনীর মতো একটা জায়গায় এসে আশ্রয় নেয় জানি না। হয়তো আশেপাশেই এর বাসা। ব্রিষ্টির কারনে আবহাওয়া একটু ঠান্ডা থান্ডা ভাব থাকে, শীত শীত ভাব থাকে। আমি তখন কম্বল গায়ে দিয়ে ব্রিষ্টির পানি পড়তে দেখি। আমার গ্রামের কথা মনে পড়ে, আমার মায়ের কথা মনে পড়ে, আমার বাড়ির কথা মনে পড়ে।
এবার বলি আমি এই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাথে কিভাবে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনাটা করলাম। পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষিত লোক নাই এটা বললে একেবারেই ভুল হবে। এদের সমাজের মধ্যেও এরা কাউকে মানে, কাউকে গুরু মনে করে আবার কাউকে শসাওন ও করে। এদের নিজস্ব একটা বলয় আছে যা আমাদের তথাকথিত সমাজের বাইরে। আমি এখানকার হেড ম্যানকে মাঝে মাঝে ডাকা শুরু করলাম। তাকে আমিও হেড ম্যান হিসাবে অথবা একটা গুরুজন হিসাবে দেখা শুরু করলাম। সে যখন ক্যাম্পে আসে, আমি তাকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়ার চেষ্টা করতে থাকলাম। ওরা অনেক কষ্ট করে যে ফসল ফলায়, তার থেকে কিছু ফসল নিজেদের জন্য রেখে সেই বহুদূর বাকীটা বিক্রি করে। আমরা অবশ্য আমাদের সব খাবার দাবার হেলি সর্টির মাধ্যমে চিটাগাং থেকে আসে বিধায় আমরা ইচ্ছা করলেও আমরা পাহাড়ি উপজাতীর কাছ থেকে সব পন্য কিনতে পারি না। তারপরেও আমি দেখেছি আমার সৈনিকেরা মাঝে মাঝে কিছু পন্য ওদের থেকে কিনে থাকে। তাই ভাবলাম, আমরা পরিকল্পনা করে যদি কিছু জিনিষ পত্র কিনতে থাকি, তাহলে ওরাও আর কষ্ট করে এতোদূর হাটে গিয়ে পন্য বিক্রি করতে হয় না। যারা এই পন্য ক্যাম্পের পাশেই বিক্রি করতে পারবে, তারাও ধীরে ধীরে ক্যাম্পের মানুষ গুলির সাথে একটা বন্ধুত্ত তৈরী করবে। এছাড়া আরেকটা বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি যে, প্রায়ই ওরা কিছু না কিছু ট্রাইবাল অনুষ্ঠান করে। আমি ওদেরকে বলেছি যে, যখন কোনো সাহাজ্য লাগবে আমি কিছু কিছু সাহাজ্য করতে পারবো, যেমন রঙ্গিন বেলুন দেয়া, কিংবা কিছু টাকা পয়সা দেয়া ইত্যাদি। এসবের একটাই কারন ছিলো যাতে ওরা মনে করে আমরা ওদেরকে নিষ্পেষিত করতে এখানে আসি নাই, আমরা আর ওরা একই দেশের নাগরিক। আমরা একে অপরের জন্য। দেশটা আমার যেমন, এই দেশটা তাদেরও। আমার এই কর্মশালা ভীষন কাজে দিলো। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝে গেলাম যে, আমরা যখন ওদের গ্রামে পেট্রোল করতে যাই, তাদের আচরন পালটে গেছে, তাদের ব্যবহার আগের থেকে অনেক বেশী আন্তরীক।
ভালোবাসা কে বুঝে না? একটা অবুঝ শিশু ও ভালোবাসা বুঝে যে হয়তো কোনো ভাষাই জানে না। একটা বোবা পশু ও ভালোবাসা বুঝে যে কিনা আমাদের মানুষের সমাজের কোনো আইনের ধার ধারে না। কিন্তু ভালোবাসায় অনেক ভালো ফল পাওয়া যায়। ক্যাম্প লাইফটা আগের থেকে অনেক ভালো লাগছিলো। এখন আর খুব একটা বোরিং লাগে না। কেউ না কেউ ক্যাম্পে আসেই। কখনো যুবক, কখনো মহিলা, কখনো বয়ষ্ক ব্যক্তিরা। মাঝে মাঝে কয়েক জন মিলেও ক্যাম্প দেখতে আসে। আমি নিরাপত্তার ব্যাপারটা মাথায় রেখে যতোটা সম্ভব তাদেরকে আপ্যায়ন করি। ওরা খুসি মনেই আবার ফেরত যায়। ওরা একটা জিনিষ বুঝে গেছে আমরা ওদের কোনো ক্ষতি করবো না। ওরাও আর আমার ক্ষতি করতে পারে এটার ঝুকিটাও কমে গেছে।
০৮/১০/১৯৯১-নিউলংকার ক্যাম্প-পর্ব ২
নিউ লংকার ক্যাম্প- পর্ব-২
উপকার করার মানসিকতা আর উপকার করার ইচ্ছা যদি কারো থাকে, কোনো না কোন একটা উপায় বের হয়েই যায়। ক্যাম্প গুলিতে যে সব সৈনিক রা থাকে, তারা অনেকটা সমাজের একেবারে বাইরের কোনো এক আলাদা সমাজের মতো। এরাই একটা আলাদা সমাজ। কিন্তু এদের পরিবার আছে, সন্তান আছে, নিজেদের বাবা মা আছে, আছে বন্ধু বান্ধব। এদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছুটি নিয়ে। একবার যদি কেউ এই পাহাড়ে ঢুকে যায়, তারা যেনো আর কারো মনের ভিতরেই থাকে না। আমার কাছে দুটু ক্যাম্পের সৈনিকরাই তাদের একতা আবদার বারবার পেশ করে যাচ্ছিলেন, ছুটি কিভাবে রেগুলার করা যায়। সাজেক আর ওল্ডলংকারের সৈনিকদের ছুটির ব্যাপারে আমি ক্রমাগত মাথা খেলাচ্ছিলাম কিভাবে এসব সৈনিকদের ছুটিটার ব্যবস্থা করা যায়। একদিন পেট্রোল করতে গিয়া আমি উভয় ক্যাম্পের সৈনিকদের সাথে কিভাবে কি করা যায় এটা নিয়ে বিস্তারীত আলাপ করি। কারন তারা ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ককে আমার মতো কনভিন্স করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। সাজেকের এক সৈনিক আমাকে একটা সাজেশন দিলো যে, স্যার কোনোভাবে কি ইন্টারক্যাম্প সৈনিকের পোষ্টিং করা যায় যাতে কিছু সৈনিক আপনার ক্যাম্প থেকে আপনার সৈনিক হিসাবে হেলিসর্টির মাধ্যমে ছুটিতে যেতে পারে?
মাথায় বুদ্ধিটা এলো। কিন্তু আসলেই ইন্টারক্যাম্প সৈনিক পোষ্টিং তো আমার হাতে নাই, এটা করতে পারে ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক। তারপরেও আইডিয়াটা খারাপ মনে হলো না। ব্যাটালিয়ানের অধিনায়কেরও তো সৈনিকের ছুটিছাটা নিশ্চিত করার নৈতিক দায়িত্ত আছে। হতে পারে, আমার এই আইডিয়াটা অধিনায়ক মেনে নিতে পারে। ভাবলাম, এটা ওয়্যারলেস সেটে কথা না বলাই ভালো। অধিনায়ক যখন ক্যাম্প ভিজিটে আসবে, তখন তার সাথে বিস্তারীত আলাপ করবো।
আল্লাহর কি রহমত, এরই মধ্যে খবর পেলাম, বিডিআর ক্যাম্পগুলিতে সয়ং জিওসি ভিজিট করবেন। ভাবলাম, এটাই সুযোগ। আমি কি জিওসিকে সরাসরি সৈনিকদের এই পয়েন্টটা দিবো কিনা। আবার দিলে কি প্রতিক্রিয়া হয় সেটাও ভাবা দরকার। সব মিলিয়ে আমি সরাসরি জিওসিকে না বলাই উত্তম মনে করলাম। বরং আমি ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক মেজর জিয়াকে সৈনিকদের ছুটির এই সমস্যাটা তুলে ধরলাম যে, জিওসির ভিজিটের সময় যদি কোনো সৈনিক তার ছুটির সমস্যাটা তুলে ধরেন, তাতে ব্যাটালিয়ানের ইমেজ খারাপ হতে পারে এবং অধিনায়কের ব্যাপারেও জিওসির ধারনা খারাপ হতে পারে যে, এই ইউনিটে সৈনিকের এডমিন ভালোভাবে দেখা হচ্ছে না। মেজর জিয়া এবার ব্যাপারটা কিভাবে সমাধান করা যায়, সেটাও তিনি আমাকে ভাবতে বললেন। জিয়া স্যার চান না যে, ছুটির এই ব্যাপারটা জিওসির কানে আসুক। আমি মেজর জিয়াকে বললাম, যে, স্যার, যদি এমন হয় যে, আমার পাশের দুই ক্যাম্পের সৈনিকদেরকে পর্যায়ক্রমে আমার ক্যাম্পে ইন্টারচেঞ্জ করা যায়, তাহলে পাইলটদের বলে আমি ৩ জনের জায়গায় হয়ত ৪ জন তুলে দিতে পারবো। বিশেষ করে যখন এমআই ১৭ হেলি এখানে আসে। এমআই ১৭ হেলিতে বেশ কিছু অতিরিক্ত পেসেঞ্জার তোলা যায়। মেজর জিয়া ব্যাপারটা বুঝে রাজী হয়ে গেলেন। তার মানে দাড়ালো এটা যে, যারা যারা ছুটি যাবে ওই সাজেক এবং ওল্ডলংকার থেকে, শুধুমাত্র তারাই আমার ক্যাম্পে বদলি হবেন হেলিসর্টির আগে। বাকীটা আমরা এরেঞ্জ করে নেবো। এভাবেই আমি আমার ক্যাম্প, অল্ডলংকার এবং সাজেকের অনেক সৈনিকের বহুত আখাংকিত ছুটির একটা ফয়সালা করে ফেললাম। তাতে একটা মজার ব্যাপার ঘটে গেল যে, যদিও আমি সাজেক কিংবা ওল্ড লংকারের ক্যাম্প কমান্ডার না, কিন্তু আনঅফিশিয়ালি সৈনিকেরা ক্রমান্নয়ে যেন আমিই তাদের কমান্ডার এরুপ আচরন করে প্রচুর সমস্যা শেয়ার করতে লাগলো। দেখা গেলো, আমি যেদিন পেট্রোলে যাবো হয় সাজেক বা ওল্ডলংকারে, সেদিন যেনো ক্যাম্পগুলির সৈনিকেরা একটা আনন্দের মধ্যে থাকে যে, আমি যাচ্ছি তাই। আমিও যেনো অলিখিতভাবে ওদের ক্যাম্প কমান্ডারই ভাবতে লাগলাম।
সৈনিক জীবনের মতো জীবন কোথাও নাই। আর এই জীবন কারো পক্ষেই কোথাও কৃত্তিম ভাবে পালন করা সম্ভব নয়। হাতে অস্ত্র আছে, সাথে আছে বুলেট, আর যার কাছে এটা সরকার বৈধ ভাবে সারাক্ষন রাখার লাইসেন্স করে দিয়েছেন, তারা সবাই প্রশিক্ষিত। অথচ ট্রিগারটা টিপার আগে সেই সৈনিক হাজারবার চিন্তা করে। সব তার হাতে কিন্তু কন্ট্রোলিং ক্ষমতা কমান্ডারের মনে। কি অদ্ভুত না!! আমি যতোক্ষন এই সৈনিক দের সাথে থাকি, বুক ভরা ভরষা আর নিরাপত্তা বোধ করি অথচ এরা আমার পরিবারের কেউ না, না কোনো আত্তীয় স্বজন। অথচ আমার পিপাসায় ওরা ব্যস্ত হয়ে উঠে, নিজের পানির বোতলের পানি নিজে পান না করে সেই পানিটা আমার জন্যে হাত বাড়ায়। আমার শরীরের গন্ধে ভরা ইউনিফর্মটা যতো তাড়াতাড়ি পারে ধুয়ে আবার সঠিক জায়গায় রেখে যায়। এর মতো মহব্বতের কম্রেড শীপ আমি কোথাও দেখি নাই। ওরা যখন ছুটি যায়, আর ছুটি থেকে ফিরে আসে, তখন যা ঘটে সেটা আনন্দের একটা ফিলিংস। ওরা এখন মনের সুখে বাড়ি যায়, জানে ওরা যতোদিন আমি আছি, ওদের আর ছুটির কোনো সমস্যা নাই। আবার যখন ফিরে আসে, তখন কেউ কেউ কিছু না কিছু যেনো নিয়ে এসে আমার হাতে দিতে পারলে মনে হয় যেনো কিছু একটা আনন্দ পেলো। ইউনিফর্মের মতো প্রেস্টিজিয়াস কিছু আর নাই। হোক সেটা বিডি আর অথবা আনসার কিংবা আর্মি। পুলিশের ব্যাপারটা আলাদা। ওদের মধ্যে এই বিশেষায়িত জীবনের লক্ষ্য সব সময় থাকে টাকার। টাকা যেখানে মূল, সেখানে মৌলিক গুনাবলী অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। পুলিশ কোনো ইউনিফর্মের ধার ধারে না। তাদের ইউনিফর্মে থাকে শুধু মানুষের অভিশাপের টাকা আর বেদনা।
০৫/১০/১৯৯১-নিউলংকার ক্যাম্প-পর্ব-১
নিউলংকার ক্যাম্প- পর্ব-১
পাহাড়ি জীবনের একটা আলাদা সৌন্দর্জ আছে। এই সৌন্দর্জ সমতল ভুমির সাথে কিছুতেই মিল নাই। এখানে পাহাড় কথা বলে, আকাশ কথা বলে, এখানকার গাছ গাছালিও কথা বলে। দিনের বেশীরভাগ সময় পাহাড় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে একেবারে নিস্তব্দ হয়ে, কখনো কখনো পাহাড় হয়ে উঠে গম্ভীর আবার কখনো কখনো মেঘের সাথে এই পাহাড়ের মধ্যে মিতালিও হয়। আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘমালা পাহাড়ের চুরায় চুরায় বসে থাকে, কখনো আবার রঙধনু হয়ে আকাশের সাথে দূর পাহাড়ের মধ্যে একটা সেতু বন্ধন গড়ে তোলে। বিধাতার কি অপরুপ খেলা।
এই পাহারের সর্বোচ্চ চূরায় বসে আমি যখন উচ্চস্বরে কথা বলি, পাহাড় তার প্রতিধ্বনি দিয়ে আমাকে সেই একই কথা আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দেয়। আমি মাঝে মাঝে উদাসীন হয়ে ক্যাম্পের কোনো এক স্থানে বসে বসে বন মোরগের ডাক শুনি, আবার মাঝে মাঝে পূর্নিমার রাতে হরিন শাবকের কচিকচি ঘাস খেতে দেখি। বানরেরা এখানে ঠিক বানরের মতো অসভ্য নয়। মানুষ দেখলে তারা মুখ ভেংচি করে দৌড় দিয়ে পালিয়ে যায় না। আবার বন্ধু মনে করে একেবারে কাছেও আসে না। কিছু কিছু অদ্ভুদ পাখী নজরে পড়ে। কোথা থেকে এরা উড়ে আসে আমি জানি না। কিন্তু বেশ সুন্দর। লম্বা লম্বা ঠোট আর বিভিন্ন রঙ এর।
অফিসার হিসাবে আমি একাই এই ক্যাম্পে আছি। আর আমার সাথে আছে প্রায় ৪০ জন বিডিআরের সৈনিক। আর্মির সৈনিকদের সাথে বিডিআরের সৈনিকদের মধ্যে আলাদা একটা পার্থক্য খুব সহজেই ধরা পড়ে। আর সেটা হচ্ছে, কনিষ্ঠতম বিডিআর সৈনিকও অফিসারের সাথে আর্মির সৈনিকের থেকে বেশী মিশুক। এখানে ওয়ারলেস অপারেস্টর হিসাবে সার্বোক্ষনিক কাজ করে নূর মোহাম্মাদ। ছেলেটা বেশ চটপটে। আমার যে রানার, তার নাম জসিম। আর্মির সৈনিকের চেয়ে এরা অফিসারেদেরকে অনেক বেশী সার্ভিস দেয়।
যখন পেট্রোল করে আসি, সারা শরীর ঘেমে একাকার, আর পা যেনো বিষিয়ে উঠে। প্রায় ২/৩ হাজার ফুট পাহাড় বেয়ে ক্যাম্পে উঠতেই তো জীবন শেষ। যখন ক্যাম্পে ফিরে আসি, একটা জিনিশ লক্ষ্য করলাম যে, জসীম দ্রুত আমার পায়ের বুট খুলে দেয়, মাঝে মাঝে আমার পাও এমনভাবে মালিশ করে দেয় যেনো কাজটা করতে ওর বেশ ভালই লাগছে। আমার কেমন যেনো ইতস্তত বোধ হয়, কিন্তু জসীম প্রায় জোর করেই কাজটা করে আর বলে, স্যার, আপনি হচ্ছেন, আমাদের নেতা। এটা আমার দায়িত্ত আপনাকে ভালো রাখা।
ক্যাম্পে একটা ছোট মসজিদ আছে। কে বা কারা এই মসজিদ প্রথম উদ্ভোধন করেছিলো আমার জানা নাই। তবে এখানে ৫ ওয়াক্ত নামাজ হয়। নামাজের ইমামতি করেন আমাদের সিনিয়র এক জেসিও। হাবিলদার রহমান নামে একজন হাবিলদার আছে আমার ক্যাম্পে, সে সারাক্ষন যখন ক্যাম্পে থাকে সুতা দিয়ে জাল বুনতে থাকে। হাবিলদার অন্যের সাথে খুব একটা মিশেও না। ব্যাপারটা আমার চোখ এড়ায় নাই।
প্রতিদিন পেট্রোল করতে হয় না। সপ্তাহে তিনদিন আমরা আশেপাশের এলাকায় পেট্রোল করি। এই কয়দিনে আমি প্রায় প্রতিটা জায়গা যা আমাদের এরিয়ার অন্তর্গত, সবখানেই গিয়েছি। যেদিন পেট্রোল থাকে না, সেদিন আমি প্রায় সারাক্ষনই সৈনিকদের সাথে কোনো না কোন ব্যাপার নিয়ে আলাপ করি, গল্প করি। আর বিকাল বেলায় একমাত্র ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভিতে ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট দেখি। ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট বা ক্রিকেট খেলাটা আমার কখনোই বেশী পছন্দের ছিলো না। কিন্তু ক্যাম্পের এই বেকার জীবনে এই একটি মাত্র বিনোদন যন্ত্রতে যা দেখানো হয় সেটাই বিনোদনের অংশ হিসাবে আনন্দ নেবার চেষ্টা করি।
আমার উত্তরে যে ক্যাম্পটা আছে সেটা সাজেক, আর দক্ষিনে যে ক্যাম্পটা আছে সেটার নাম ওল্ড লংকার। সাজেকে প্রচুর কমলা হয়। আর এর পাশ দিয়ে চলে গেছে সাজেক রিভার। সাজেক রিভার পার হলেই ভারতের মিজোরাম শহর। কোনো ক্যাম্পেই অফিসার নাই। আমরা যেদিন উত্তরে যাই, সেদিন সাজেক আর যেদিন দক্ষিনে যাই সেদিন ওল্ড লংকারে যাই। এই যাওয়া আসার মাঝে অনেকগুলি গ্রাম পড়ে। এখানে বেশীর ভাগ ট্রাইব পাংখু। চাকমা খুব কম। পাংখু উপজাতীরা বেশ স্মার্ট। কেউ কেউ জিন্সের প্যান্ট আর গিটারও বাজায়। এখানে যিনি হেডম্যান, তিনি বেশ দয়ালু। সে পারা প্রতিবেশীদের খবরাখবর রাখে। তার বাড়িতে আমরা প্রায়ই যাই, খুব বেশি দুরেও না।
ক্যাম্পে যেহেতু আমার অঢেল সময় হাতে থাকে। ভাবলাম, দুটু প্রোজেক্ট হাতে নেয়া যায়। (এক) আমি ইংরেজীতে যতটুকু পারি চর্চা করবো যাতে আমার ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়ে। তাই ভাবলাম, ঢাকা কুরিয়ার নামে একটা টেবলয়েড ইংরেজী পত্রিকা সের দরে কিনে আনি। আমি সেগুলি পড়তে থাকি। পড়তে পড়তেই একসময় আমার ভোকাভেলুয়ারী বাড়বে। আর এর মধ্যে আমি বিবিসির ইংরেজী প্রোগ্রামটা রীতিমতো শুনবো তাতে কিভাবে ইংরেজীতে আরো ফ্লুয়েন্ট কথা বলা যায় সেটাও বাড়বে। আর আমার দ্বিতীয় প্রোজেক্ট হলো যে, আমি বাংলায় পবিত্র কোরান শরীফটা পড়বো এবং শেষ করবো। অন্তত জানতে পারবো আমাদের পবিত্র কোরান শরীফ আমাদের জন্য কি কি বার্তা দিয়েছেন।
বিডিআর এর সৈনিকরা ইতিমধ্যে আমার সাথে অনেক বেশী ফ্রেন্ডলী হয়ে গেছে। আর আমিও ওদেরকে যথেষ্ট পরিমানে আমার নিজের সৈনিকের মতোই দেখার চেষ্টা করি। অবসর সময়ে আমি কখনো কখনো ওদের সাথে তাশ, ক্যারম, কিংবা অন্য যে খেলাগুলি ক্যাম্পে বসে খেলা যায়, সেগুলি করি। ওরাও বেশ মজা পায়।
সন্ধ্যার পর আমরা বেশীরভাগ লোক খাওয়া দাওয়ার পর এশার নামাজের পর জিকিরে বসি। একটা পবিত্রতা আসে। জসীম, আমার রানার, আমাকে যতোটুকু সার্ভিস দেয়া যায়, দেয়।
একদিন জসীম আমাকে বল্লো, স্যার, আজ প্রায় ৬ মাস হয়ে গেলো ছুটি যাই না। বাড়িতে বউ আছে, ছোট একটা বাচ্চাও আছে। কোনো যোগাযোগ করতে পারি না। আমার মতো এ রকম অনেক সৈনিক আছে যারা ছুটির জন্য বসে আছে কিন্তু ব্যাটালিয়ান থেকে আমাদেরকে নামানো হচ্ছে না। দেখেন না স্যার, আপনি কিছু করতে পারেন কিনা। এ ব্যাপারটা আমার নজরে ছিলো না। আমি পরেরদিন আমার দোস্ত ক্যাপ্টেন মাহফুজের (ব্যাটালিয়ানের উপঅধিনায়ক) সাথে আলাপ করলাম। মাহফুজ যেটা জানালো সেটা একটা জাষ্ট মামুলি ব্যাপার। মানে, কোনো একটা সৈনিককে ক্যাম্প থেকে নামিয়ে ছুটি দিতে হলে দুটু পেট্রোল করতে হয়। এক, যে নামবে তার জন্য একটা, আর যে প্রতিস্থাপিত হবে তার জন্য একটা। ফলে সব সময় এই পেট্রোল করার লোক থাকে না। আবার সব সময় প্রতিস্থাপকের লোকও থাকে না। আমি যদি প্রতিস্থাপকের জন্য চাপ না দেই, তাহলে তারা ছুটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না।
ব্যাপারটা আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হলেও এর একটা সমাধান তো দরকার। কি করা যায়, এটা নিয়ে আমি আমার ক্যাম্পের সৈনিকদের সাথে পরামর্শ করলাম। ওয়্যারলেস অপারেটর চমৎকার একটা পরামর্শ দিল যে, স্যার, আমাদের ক্যাম্পে যখন হেলিসর্টি হয়, যদি আপনি ওই হেলিসর্টির সাথে একজন দুইজন করে আনা নেওয়া করতে পারেন, তাহলে এক্সট্রা কোন পেট্রোল করতে হয় না। আর আমরা তো রতিন পেট্রোল করি না। আর যখন পেট্রোল করি, যাই মাত্র ২০ জনের মতো, কোনো কারনে যদি ছুটির কারনে ২/৩ জন কম ও থাকে বাকি ১৬/১৭ জন দিয়ে ক্যাম্প প্রোটেক্সন দেয়া কোনো ব্যাপার না। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হল।
আমার ক্যাম্পে যারা হেলিসর্টি দেয়, সেসব পাইলট সবাই আমার কোর্সমেট। তার মধ্যে আছে ফ্লাইট লেঃ রেজা, ফ্লাইট লেঃ কামরুল, ফ্লাইট লেঃ পাশা, আর ফ্লাইত লেঃ হাসান মাসুদ। আমি বললাম সবাইকে যে, ঠিক আছে, তোমরা সবাই একটা লিষ্ট করো কে কখন কখন ছুটি কয়দিনের জন্য যেতে চাও। সবাই একসাথে ছুটিতে যেতে চাইলে সেটা সম্ভব হবে না। যেহেতু পাইলট সবাই আমার বন্ধু মানুষ, আমি হয়তো ব্যাপারটা এরেঞ্জ করতে পারবো।
যখন এর পরেরবার হেলিসর্টি এলো, আমার বন্ধু কামরুল আসলো। আমি ওকে বললাম, ব্যাপারটা। ও আমাকে একটা ভালো বুদ্ধি দিল যে, এর পরেরবার যখন হেলিসর্টি হবে, তুমি তোমার ক্যাম্প থেকে কে নামতে চায় সেটা হেলিসর্টির মধ্যে যেনো ইনক্লুড করে দেই। এটা একতা ডিভিশনাল ফর্মালিটিজ। তা না হলে সেও কোনো পেসেঞ্জার নিতে পারবে না।
যেই কথা, সেই কাজ। আমি ব্যাপারটা সহজ করে ফেললাম। অধিনায়ক মেজর জিয়া প্রথমে একটু নারাজ ছিলেন কিন্তু আমার বলিষ্ঠ প্রতিবাদে সেও মানতে রাজী হলো। আমি বললাম, আমার প্রতিস্থাপকের দরকার নাই। আমাই ২/৩ জন কম সৈনিক নিয়েও সুন্দরমতো ক্যাম্প চালাতে পারবো। অধিনায়ক রাজী না হলে এই ব্যাপারটা সৈনিক নামানো সহজ ছিলো না।
এখানে একটা কথা বলা খুব দরকার যে, কেনো মেজর জিয়া আমার কথায় রাজী হতে বাধ্য হলেন। তিনি নিজে একজন অসত লোক। বিডিআর এর অনেক সোর্সমানি, জংগল কাটার টাকা, কিংবা সৈনিকের বাৎসরিক ছুটির টাকা নিজের একাউন্টে রেখে ইন্টারেষ্ট খাওয়া সবই তার ছিলো যেটা একতা নিষিদ্ধ কাজ, কিন্তু আমি জানতাম মেজর জিয়া এটা করেন। যখন তিনি রাজী হচ্ছিলেন না, আর নীতির কথা শুনাচ্ছিলেন, তখন আমি এক পর্যায়ে দূর্নীতির কথা বলে তার এই দুর্বল চারিত্রিক দিকটা আমি তুলে ধরেছিলাম। আর এই কথাগুলি আমার অপারেটর নূর মোহাম্মাদ তথা ক্যাম্পের সবাই জেনে গিয়েছিলো। আমার এ রকম প্রতিবাদী কথায় আমার সৈনিকেরা অনেক সাহস আর আমার উপর একটা ভরষার স্থান তৈরী করে ফেলেছিলো। তারা আমার এ রকম একটা ব্যবস্থাপনায় এতোটাই খুশি ছিলো যে, আমি যেনো তাদের সাক্ষত ত্রানকর্তা রুপে আবির্ভাব হয়েছিলাম।
প্রথম হেলিসর্টিতে নামানো হলো আমার রানার জসীমকে, সাথে আরো একজন। ব্যাপারটা যখন বাস্তবায়ন হচ্ছিলো, সবাই একটা হোপ করছিলো যে, আগামি কয়েক দিনের মধ্যে কারো না কারো টার্ন আসবেই। আর ব্যাপারতা তাইই ঘটতে লাগল। প্রতি হেলিতে আমি তিনজন করে ছুটিতে পাঠাতে লাগলাম। কোনো প্রতিস্থাপক ছারাই আমি আমার সৈনিকদেরকে ছুটিতে পাঠানো শুরু করলাম।
যখনই কোনো সৈনিক ছুটি থেকে আবার ক্যাম্পে ফিরে আসে, তখন কেউ না কেউ আমার জন্য কিছু না কিছু গিফট নিয়ে আসে। কেউ এক প্যাকেট সিগারেট, কেউ একটা ভালো পত্রিকা, কেউ দুটু ব্যাটারি, ইত্যাদি।
এ কাজটা করতে গিয়ে আমি আরো একটা সমস্যায় পরলাম। সাজেক এবং ওল্ড লংকারের সৈনিকেরা জেনে গেলো যে, আমার ক্যাম্প থেকে সৈনিকেরা এখন পালা করে ছুটিতে যেতে পারছে। কিন্তু ওই দুই ক্যাম্প থেকে তারা এ সুযোগটা পেতে চায়। কিন্তু এখন উপায়? উপায় তো একটা বের করতেই হবে। (চলবে)
২৩/০৯/১৯৯১- বরকল আগমন
Categories
মানুষ যখন একে অপরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠে। তখন প্রথমে বিদ্রোহ হয় তাকে মন থেকে গ্রহনের বর্জনতায়। তারপর এটা সংক্রমিত হয় একজন থেকে আরেকজনে। এভাবেই কিছু সংখ্যক বিদ্রোহী যখন একটা দল হয়ে উঠে, তারা তখন তাদের ইথিক্যাল ভ্যালুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সেই এলাকার অন্যান্য মানুষের মনেও বিষ্ক্রিয়া চালাতে থাকে। বিষের মাত্রা যখন প্রায় সহনীয় পর্যায়ের থেকে বেশী মাত্রায় চলে যায়, তখন কমিউনিটি সংক্রমন হতে বাধ্য। আর যখনই কমিউনিটি সংক্রমন বাড়তে থাকে, তখন দেশের প্রচলিত নিয়মে এসব দলকে শায়েস্তা করার জন্য সরকার একের পর এক আইন বানাতে থাকে। আবার এই আইনের বার্তায় বিদ্রোহীরাও নতুন নতুন কৌশল স্রিষ্টি করে সরকার বাহাদুরকেও তাক লাগানর বাহাদুরি বা আস্পরা দেখাতে আহলাদি হয়ে উঠে। আর এই আহলাদির নাম- যুদ্ধ।
হিলে এখন সেই যুদ্ধ চলছে। শান্তিবাহিনীর স্বাধিকার আন্দোলনের চেয়ে যেনো মনে হয় ব্যাপারটা এখন গুটিকতক উপজাতীর নিজস্ব দেমাগে পরিনত হয়েছে। কেনো বললাম বা কেনো আমার কাছে এটা মনে হয়েছে সেটা বলি। আজই দুপুরের দিকে আমি বরকল পৌঁছেছি। চট্টগ্রাম থেকে আসা অবধি যতো ব্রিফিং শুনেছি, তার সবগুলি ব্রিফিং প্রায় একই রকম। কিন্তু এই বরকলে এসে ব্যাপারটা আমার কাছে অন্যরকম একটা ধারনা দিল। এখানে সবাই বিদ্রোহী নয়। শুধুমাত্র চাকমা গোষ্ঠীটাই এই বিদ্রোহের প্রধান হোতা। এখানে পাংখু আছে, মার্মা আছে, ত্রিপুরা আছে আরো অন্যান্য ট্রাইবস যারা শান্তিপূর্ন জীবন চায়। এর মানে হলো, আমরা যদি শুধুমাত্র এই চাকমা ট্রাইবটাকে আইসোলেশন করতে পারি, তাহলে সংখ্যাটা অনেক অংশে কমে যায়। যাই হোক, ব্যাপারটা আরো নিবিড়ভাবে দেখা এবং বুঝা দরকার। এখনি সব কল্পনা বাস্তব বলে উপসংহারে আসা যাবে না।
বরকলে আসার জন্য সেনাবাহীনি পেট্রোল বোট ইউজ করে। কিন্তু সাধারন মানুষজন ব্যবহার করে বটবটি নামে ইঞ্জিন চালিত নৌকা। এতোক্ষন আমরা যারা বিডিআর এর সাথে সংযুক্তিতে ছিলাম, তারা একইসাথে ছিলাম। তাদের মধ্যে যারা ছিলো তারা হচ্ছে ৬ ফিল্ডের শাহরিয়ার (সে মদনে পোষ্টিং), আমি নিউলংকারে, ক্যাপ্টেন জামাল ১৪২০ ক্যাম্পে, তাসওয়ার রাজা (হাসন রাজার নাতি) আরেক ক্যাম্পে, ইকবাল (সিগ্ন্যালের) সেও মদনের আরেক ক্যাম্পে। ফলে আমি আর জামাল স্পীড বোটে রওয়ানা হলাম বরকলের উদ্ধেশ্যে। চমৎকার একটা লেক। খুবই সুন্দর। আমাদের স্পীড বোট প্রায় ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে কাপ্তাই থেকে রওয়ানা দিয়ে বরকলের দিকে যাচ্ছে। এতো লম্বা পথ হাই স্পীড বোটে আমার এটাই প্রথম। আশেপাশে উপজাতীদের কিছু কিছু বাড়িঘর চোখে পড়ে। অবাক লাগে, এরা কোথায় বাজার করে, কোথায় বেচাকেনা করে, কার কাছে করে আমার জানা নাই। আমরা সবাই ইউনিফর্ম পরা অস্ত্র নিয়ে বসে আছি। আমি জানি না যদি কোনো শত্রু আমাদেরকে এই অবস্থায় আক্রমন করে, আমরা কতটুকুই বা সামাল দিতে পারবো। শুনলাম আমাদের যাওয়ার রাস্তার দুই ধারে নাকি রুট প্রোটেক্সন আছে, চোখেও পড়েছে অনেক রুট প্রোটেক্সন ক্যাম্প।
৪০ মিনিট চলার পর আমাদের বোট একটা ঘাটে এসে থামলো। এটাই ৪৪ ইষ্ট বেংগলের প্রধান ব্যাটালিয়ান। আমরা নেমে গেলাম। সিনিয়র জেসিও মোজাম্মেল আমাদেরকে ঘাট থেকে রিসিভ করলেন। আমরা (আমি আর ক্যাপ্টেন জামাল) নিজেদের ব্যাগ বোটেই রেখে নেমে গেলাম। কারন আমাদের ব্যাগ নেওয়ার লোক আছে। ৪৪ ইষ্ট বেঙ্গলে যাওয়ার পর দেখলাম, প্রায় সবগুলি ঘরই বাশের বেড়া দিয়ে ঘেড়া। একদিকে সিও সাহেব তার পরিবার নিয়ে থাকেন, সেটা আবার মাটির প্রলেপে ওয়াল দেয়া। আর বাকী সবগুলি ঘর নিঘাত বাশের। আমরা অফিসার ফিল্ড মেসে ঢোকলাম। গিয়ে দেখলাম, ক্যাপ্টেন ইসমাত (১১ লং কোর্ষের) স্যার ভিডিওতে ইন্ডিয়ান ছবি দেখছেন। একটু পরে এলো আমার কোর্ষ্ম্যাট লেঃ তারেক। সে আমাদের ক্যাডেট কলেজের এক বছর সিনিয়র ছিলো। কিন্তু এখন আমাদের কোর্ষের সাথে কমিশন পাওয়ায় আমি আর আগের সম্পর্কটা ধরে তাকে ভাই বলি না। তুমি করেই সম্মোধন করি। সাথে আরো দুই কোর্ষম্যাট মামুন আর আব্দুল্লাহও এলো। ভালো লাগলো ওদের দেখে। একটু ভরষাও যেনো পেলাম। আমি আর্টিলারীর লোক, এখানে ওরিয়েন্টেশন করবো সেটা ওরা কিভাবে নেয় জানি না, তবে আমার কোর্সম্যাটদের দেখে একটু ভালো লাগলো।
ইসমাত স্যার এই ইউনিটের এডজুটেন্ট। আমরা ছবি দেখতে দেখতে ইসমাত স্যার বললেন, সিও সাহেব সন্ধ্যায় কথা বলবেন। সিও সাহেবের নাম, লেঃ কর্নেল আশফাক। স্যার এটাও বললেন, তার সামনে স্মার্ট হইও না কারন মানুষ বেশি সুবিধার না। একটু ভরকে তো গেলামই। উপঅধিনায়কের পদে আছেন মেজর মিজান স্যার। বেশ তোতলামিতে ভরপুর। আমার মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে, কমিশন পাবার সময় কি বিএমএ তে স্যারের এই তোতলামী ধরা পরে নাই? কিন্তু মানুষ হিসাবে বেশ ভালো। সিও সাহেবের কথার বাইরে যাবার কোনো অবকাশ নাই। তার দুই মেয়ে। লাঞ্চের পরে অনেক আলাপ করলাম ফিল্ড মেসে বসেই।
আলাপ আলোচনার পর আমরা আমাদের ব্যারাকে চলে গেলাম। কি এক অবস্থা। সৈনিকের সাথেই থাকা আর তাদের একই খাবার সবার জন্য। তবে আমরা ইচ্ছা করলে অফিসার মেসেও খেতে পারি। একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম যে, কোম্পানি কমান্ডারগন যার যার কোম্পানীর সাথেই ডাইনিং করেন। তাতে একটা লাভ হলো, কোনো টাকা লাগে না। হয়তো এই কিছু টাকা বাচানোর জন্যেও অফিসাররা সৈনিকদের সাথেই ডাইনিং করেন।
রাতে সিও সাহেবের সাথে আমাদের দেখা হলো। তিনি অনেক কিছু বললেন না, শুধু বললেন, আমাদের জন্য ওরিয়েন্টেশনের প্রোগ্রাম করা হয়েছে কিনা, আর করে থাকলে সেটা যেনো আমাদেরকে দিয়ে দেয়া হয়। আগামিকাল থেকেই পেট্রোল চলবে। আর প্রতিদিন পেট্রোল রিপোর্ট সিও সাহেবকে দেখাতে হবে।
আমরা যার যার ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের একটা করে কপি হাতে নিয়ে আবারো চলে এলাম যার যার ঘরে। আগামীকাল ভোর ৪ টায় আমার একটা পেট্রোল আছে।
২২/০৯/১৯৯১-রাংগামাটিতে গমন
Categories
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই রেডি হলাম। ২১ রাইফেল ব্যটালিয়ানের কোত থেকে একটা এস এম জি (সাব মেশিন গান) আমার নামে বরাদ্ধ করা হলো। এটা বিডিআর এর সাথে সংযুক্তি থাকা অবস্থায় আমার জিম্মায় থাকবে। সাথে এক বান্ডেল পোচ এমুনিশন। রাংগামাটিতে যেতে হলে একটা সিংগেল গাড়ি যাওয়ার নিয়ম নাই কারন এলাকাটা ঝুকিপুর্ন। তাই অন্তত দুটু গাড়ির একটি বহর নিয়ে যেতে হয়। সপ্তাহে দুইদিন ওই ঝুকিপুর্ন এলাকায় রুট প্রোটেকশনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর লোকজন চলাচল করে। এই রুট প্রোটেকশনের ব্যাপারটা আমার আগে জানা ছিলো না। রুট প্রোটেক্সন হচ্ছে, যখন কোনো কনভয় হিলে ঝুকিপুর্ন জায়গায় যায় বা আসে, তখন রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় আর্মি, বিডিআর এবং আনসার সম্বলিত প্রায় তিনজন করে একেকটা পয়েন্টে কিছু ভিজিবল রাস্তা বা একটা দায়িত্তপুর্ন এলাকা প্রোটেকশন দেয়া, যাতে শান্তিবাহিনী কোনো অপারেশন করলে দ্রুততম সময় এই বাড়তি লোকজন সামাল দিতে পারে অথবা দায়িত্তপুর্ন এলাকাটি নিরাপদ আছে সেটা নিশ্চিত করা।
রাংগামাটি যেতে রাংগামাটি আর চিটাগাং এর মাঝামাঝি একটা জায়গা আছে যার নাম, আমতলি। এখানে সবাই নেমে আর্মস লোড করে, একটা ব্রিফিং হয় এবং এই আমতলী থেকেই ঝুকিপুর্ন এলাকা বলে এয়ারমার্ক করা। আমতলি পর্যন্ত হিল আসলে বুঝা যায় না। প্রায় সমতলের মতো। এখান থেকেই বড় বড় পাহারের উতপত্তি। আমরা সবাই আর্মস লোড করে নিলাম। পিকআপ গাড়িতে একটা এলএমজি (লং মেশিন গান) ফিট করা, আর পিকআপের দুই ধারে সৈনিকরা এমনভাবে বসে, যাতে সবাই বাইরের দিকে তাদের আর্মস তাক করা থাকতে পারে। আকাবাকা রাস্তা। দুইধারে বিশাল বিশাল পাহাড়। কখনো গাড়ি নীচে নামছে, কখনো গাড়ী আবার পাহাড়ের কোল ঘেষে একেবারে চুড়ায় উঠে যাচ্ছে। ঈশ্বর তার সৃষ্টি এমন করে চোখের আড়ালে এতো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন, দেখলেই মন ভরে যায়। কখনো কখনো দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে দুরের আকাশ দেখা যায়। একটু ভয়ও লাগে। আবার এই ভয়কে উপচিয়ে প্রকৃতির সউন্দর্য এমনভাবে মনকে পুলকিত করে যা আমার হৃদয়ে কি যেনো পরম অনুভুতি জাগিয়ে দেয়। আমি ভয়বিসন্ন অন্তর নিয়ে একট মিশ্রিত ভালো লাগার অনুভুতিতে পুরু রাস্তাটা পার করলাম। যেহেতু শান্তিবাহিনী কখনো চোখে দেখি নাই, তাদের তান্ডবলীলাও আমার জানা নাই ফলে শান্তিবাহিনীর ধংসাত্তক কার্যকলাপের চিহ্ন আমার মনের মধ্যে ভেসে উঠে নাই বরং বর্তমান সময়ে প্রকৃতির রুপটাই আমাকে বেশী বিমোহিত করেছিল। কখনো কখনো মনে হয়েছিলো, একবার গাড়ি থেকে নেমে পাহাড়ের এই অদ্ভুদ রুপকে প্রানভরে দেখি, কিন্তু রুট প্রোটেকশনের নীতিমালা অনুযায়ী এটা করার কোনো নিয়ম না থাকায় দ্রুত গতিতেই একটার পর একটা দৃশ্য যেনো সিনেমার পর্দার মতো চোখের পলকে হারিয়ে যাচ্ছে।
দূরে কোথাও মেঘের ভেলা দেখা যাচ্ছে, আবার পরক্ষনেই সেই মেঘের ভেলা যেনো একেবারে আমাদের গাড়ির নিকটবর্তী হয়ে একটা উড়ন্ত বকের ঝাকের মতো পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। পাহাড়ের আকৃতির কারনে রাস্তাগুলিও একবার উত্তর থেকে দক্ষিনে, আবার কখনো কখনো পুর্ব থেকে পশ্চিমে লম্বা সারি হয়ে আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে। কখনো সূর্য ঠিক মাথার উপর, আবার কখনো সূর্য আমাদের পিছনে চলে যাচ্ছে। দূর পাহাড়ের কোল ঘেষে ঝর্না দেখা যায়, ভারতের পাহাড়গুলি আর আমাদের দেশের পাহাড়্গুলির মধ্যে একটা যোগসুত্র আছে। এদেশের পাহাড় যেখানে শেষ, হয়তো ভারতের পাহাড়গুলি সেখানেই শুরু। এই পাহাড়দের মধ্যে কোনো আঞ্চলিক বিরোধ নাই। তাদের একটা দেহের কিছু অংশ এদেশে থাকলেই কি আর ভারতে থাকলেই কি, এরা একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা যারা টেরিটরিয়াল বাউন্ডারি করে এদের পরিচয়ে বাধা দিয়ে বলি এটা আমাদের আর ওটা ওদের, তাদের এই পাহাড়দের কিছুই যায় আসে না। কোনো পাহাড় টেরিটরিয়াল আইন মানে না। তারা অনবরত একটা অবিচ্ছেদ্য অংশই হয়ে থাকে আজীবন।
প্রায় দুই ঘন্টা হাইস্পীডে গাড়ি চালিয়ে শেষ অবধি আমরা পাহাড়ের চুড়া থেকে নেমে রাংগামাটির প্লেন ল্যান্ডে চলে এলাম। এই রাংগামাটি শহরটা কি কখনো আগে পাহাড়ের মতো ছিলো কিনা আমি জানি না, কিন্তু দেখলে বুঝা যায় যে, এরাও তাদের পুর্বসত্তাকে হারিয়ে ফেলেছে মানুষের ক্ষুরধার কোনো বুল্ডজার বা সাবলের আঘাতে। এখন সে একটা সমতল ভুমি। অনেক পিচঢালা রাস্তা, বিল্ডিং এ ছড়াছড়ি। অনেক নিয়ন লাইট আর হরেক রকমের বিজ্ঞাপনে ভর্তি এই শহর। মানুষের মধ্যে কোনো আতংক নাই, কেউ বাজার করছে, বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে, কেউ আবার স্কুল থেকে ফিরে যাচ্ছে। দোকানীরা তাদের পন্য বেচাকেনায় মগ্ন। আশেপাশে কয়েকটা বিডিআর কিংবা আর্মির গাড়ি অলসভাবে টহল দিচ্ছে। আমরা রাংগামাটির বুকে এখন। প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। আমরা বিডিআর রেষ্ট হাউজে চলে এলাম। ভীষন সুন্দর একটা রেষ্ট হাউজ। ক্যাপ্টেন আখতার (১১ লং কোর্ষের), তিনি আমাদের রিসিভ করলেন। বিডিআর রেষ্ট হাউজটা একটা লেকের পাশে, আবার লেকের ঠিক পরেই পাহাড়। রেলিং দেয়া চারিদিকে। রেলিং এ দাড়ালে মনে হয় পানির উপরে দাঁড়িয়ে আছি। অদ্ভুদ সুন্দর রেষ্ট হাউজটা। আমরা খাবারের জন্য তৈরী হলাম। আগে থেকেই সম্ভবত আমাদের খাবারের কথা বলা হয়েছিলো। খেতে গিয়ে দেখলাম, বড় বর মাছের খন্ড। জিজ্ঞেস করতেই মেস ওয়েটার জানালো যে, এই মাছ কাপ্তাই লেকের থেকে আনা। এখানে জ্যান্ত মাছ পাওয়া যায় আর সেটা বেশ সস্তাই। অনেক ক্ষুধা লেগেছিলো। ভয়ের একটা গুন আছে। পেটে যতোই ক্ষুধা থাকুক, ভয় যখন ভর করে তখন পেটও তার ক্ষুধার কথা জানান দেয় না। যেই ভয় দূর হয়ে যায়, তখন পেটের ভিতর যতো ক্ষুধা এতোক্ষন চুপ করেছিলো, তা একঝাকে জেগে উঠে। মারাত্তক উগলে উঠে পেট খাবারের জন্য। আমাদেরও তাই হল। এতোক্ষন ক্ষুধাটা বুঝি নাই। এখন মনে হচ্ছে, রাজ্যের ক্ষুধায় পেট চু চু করছে। আমরা বেশ আনন্দের সাথেই দুপুরের খাবার খেলাম।
আমাদের খাবারের পর ক্যাপ্টেন সাফিন (জিএসও-৩ অপারেশন) আমাদেরকে জানালো যে, রাত আটটায় কমান্ডারের ব্রিফিং হবে। সবাইকে ব্রিগেড অফিসে রাত আটটার মধ্যে থাকতে হবে। অনেক সময় হাতে। ভাবলাম, রাংগামাটি শহরটা ঘুরে দেখা যেতে পারে। আমাদের অনুরোধ রাখা হলো। আমরা দলবেধে ঘন্টাখানেক পর একটা স্কর্ট আর একটা পিকআপ নিয়ে রাংগামাটির বেশ কিছু জায়গা দেখলাম। ঝুলন্ত ব্রিজ, পরিত্যাক্ত পাহাড়ের কিছু অংশ, লেক, হাইড্রোলিক পাম্প, এবং জলবিদ্যুৎ এরিয়া সবগুলিই আমাদেরকে দেখানো হলো।
পানির যে কি শক্তি এই হাইড্রোলিক পাম্প এবং জলবিদ্যুত কেন্দ্র না দেখলে বুঝা যাবে না। অফুরন্ত পানির প্রবাহের একটা শব্দ আছে, অনবরত এই শব্দ মানুষকে বিমোহিত করে। হাজার হাজার টন পানি যখন একসাথে বেরিয়ে যাবার জন্য প্রতিযোগীতা করে তখন তার সামনে কি আছে আর কি নাই এটা কোনো ব্যাপার না। জলোচ্ছাস কি, তার কি তান্ডব, আর্টিফিশিয়ালভাবে এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কিছু আভাষ পাওয়া যায়। খুব অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে, দেশের সিংহভাগ বিদ্যুৎ এই কাপ্তাইয়ের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরবরাহ হয়। কোনো কারনে যদি এই জলাধার আর না থাকে, বা শুকিয়ে যায় বা কোনো আকস্মিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তাহলে দেশের অন্যান্য সব অঞ্চল অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়বে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। এটা ভাবতেই মাথা ঘুরে যায়। দেশের এই মুল্যবান সপদ এমন এক জায়গায় যেখানে সারা বছর ঝুকিপুর্ন। রাংগামাটি শহর দেখা হল। মন ভরলো না। আবার কবে আসি জানি না কিন্তু এর বিস্ময়কর স্মৃতি আমার মাথায় পুরে থাকল।
রাত আটটায় আমরা ব্রিগেড অফিসে গেলাম। কমান্ডার আসেন নাই। কিন্তু অপারেশন অফিসার মেজর লিয়াকত আমাদেরকে প্রায় এক ঘন্টা কিভাবে কি অপারেশন করতে হবে, কিভাবে পেট্রোল করতে হবে, শান্তিবাহিনির ট্রেন্ড কি, তারা কিভাবে কিভাবে অপারেশন করে, কোন কোন দল এখানে কাজ করে, তাদের কমান্ডাদের নাম এবং সংঘটন সম্পর্কে একটা ধারনা দিলেন। সন্টু লার্মা যিনি এই শান্তিবাহিনীর কমান্ডার তার সম্পর্কেও অনেক কথা জানলাম। কিছু নোট করলাম, কিছু মাথায় নিলাম, আবার অনেক কিছুই মাথার উপরে দিয়ে গেলো বলে মনে হল। ক্যাপ্টেন নিজাম স্যার কেনো এম্বুসে মারা গেলেন এই উদাহরন বারবার টানা হলো। ক্যাপ্টেন নিজামের কাহিনীটা কোনো এক সময়ে বিস্তারীত লিখবো। চলে এলাম রেষ্ট হাউজে। তখন রাত প্রায় ১১ টা। আমি যে রুমে আছি, সে রুমেই থাকে ক্যাপ্টেন আখতার। অনেক রাত অবধি স্যারের সাথে গল্প হলো। স্যার নতুন বিয়ে করেছেন, ভাবীর কথা অনেক আলাপ করলেন। তার মনের কষ্টের কথা, তার ভালো লাগার কথা, তার একাকিত্তের কথা অনেক বললেন। পাহাড়িয়া এলাকায় সব অফিসারের একটা আলাদা জগত আছে। এই জগতের কথা সবাই জানে না। এটা নিতান্তই নিজের আর গোপন। যাই হোক, আগামীকাল আমরা বরকলে অবস্থিত ৪৪ ইষ্ট বেংগলে ওরিয়েন্টেশনের জন্য রওয়ানা হবো। এই কয়দিনে আমি যেনো যাযাবরের মতো আজ এখানে, কাল ওখানে দিনকাল কাটাচ্ছি। কোনো স্থানের অভিজ্ঞতাই যেনো এক নয়।
প্রায় দেড়টার দিকে ঘুমিয়ে গেলাম।