দ্বিমুখী জীবন (আপডেটেড অন 05 May 2023)

মুক্তার সাহেব ‘পরকীয়া’ করছেন। খবরটি চারিদিকে এমনভাবে ছড়িয়েছে যে, সেটা নিয়েই সবাই মুখরোচক আলাপে মত্ত। চায়ের দোকানে, পাড়ার মহল্লায়, আশেপাশে মানুষের মুখে মুখে যেনো খবরটা একটা ব্রেকিং নিউজের মতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঝড়ো দমকা বাতাসে ছাই ঊড়ার মতো চারিদিকে রটিয়ে বেড়াচ্ছে। ব্যাপারটার সত্যতা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিলো না এ কারনে যে, মুক্তার সাহেবের স্ত্রী আসমানী বেগমই এর প্রথম নালিশদাতা। অতঃপর দিন গড়িয়ে সপ্তাহ আসার আগেই এ বিষয়ে আসমানী বেগমের ঘোর নালিশের কারনে শেষ পর্যন্ত পারিবারিক আইন ও সালিসি আদালতে ঘটনাটি বিচারের সাব্যস্থ হয়। আমি সে সময়ে পারিবারিক আইন ও সালিসি অধিদপ্তরে কাজ করছিলাম। মুক্তার সাহেবের পরকীয়ার ঘটনাটি সরেজমিনে তদন্ত করার ব্যাপারে আমার উপরে দায়িত্ব দেয়া হয়। পরকীয়ার ব্যাপার স্যাপার, তদন্ত করা খুব সহজ কাজ নয়। তারপরেও এমন একটা স্পর্শকাতর ব্যাপারে আভ্যন্তরীন তথ্যাদি উদঘাটনের জন্য কাজটি হাতে নিয়েছিলাম। তারই ধারাবাহিকতার জের ধরে ঘটনায় জড়িত মুক্তার সাহেব, সাবিত্রি এবং আসমানী বেগমের জবানবন্দীসমুহ লিপিবদ্ধ করি। তাদের সবার জবানবন্ধী লিপিবদ্ধ করে এর পুরু সারমর্ম পড়ে আমি নিজে কোনো শুদ্ধ রায়ে উপনীত হতে পারিনি। যদিও আমার রায় দেবার ইখতিয়ার ছিলো না। আমার কাজ ছিলো শুধু তাদের জবানবন্ধী নেয়া। তারপরেও যখন শালিশী বোর্ড আমাকে এক কথায় কার কি অপরাধ সংক্ষীপ্ত সারমর্ম দিতে বলেছিলেন, আমি সেটায় উপনীত হতে পারিনি। কারন এই জবানবন্ধী নিতে গিয়ে আমি একটা নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি যে, অবহেলা যখন দীর্ঘ হয়, উদাসীনতা যখন মানুষের জীবনে একটা কাল হয়ে দাঁড়ায়, ফেরার পথটা তখন হয়তো বন্ধই হয়ে যায়। তখন যে সুরটা বেজে উঠে তা হলো বিচ্ছেদের সুর। বিচ্ছেদ সবসময় শুধু বেদনার হয় এটা সবসময় সত্য নয়, মাঝে মাঝে বিচ্ছেদের মধ্যে মানুষ মুক্তির স্বাদও পায়। সেই স্বাদের মধ্যে পরিপুর্ন শান্তি না থাকলেও কখনো কখনো কোনো এক একাকী সময় অতীতের সেই কিছু বেদনার স্মৃতি  বা রঙ মানুষের জীবনকে কষ্টের মাঝে একটু অন্য রকমের আবেগ হয়তো জীবনের অনেক কিছুই বদলে দেয়।

আমি আরো একটা অনুভুতি উপলব্ধি করেছি, আর সেটা হলো বস্তুবাদ।

এ যুগে এখন আর সেইদিন নেই যে দূরে বসেও মা তার সন্তানের গলার স্বর শুনে বলে দিতে পারেন সে ক্ষুধার্ত। কিংবা কোনো স্ত্রী যদি হেসেও দরজা খোলেন তখন স্বামী তার এই হাসির অন্তরালেও বুঝেন যাবেন তার ভিতরে কোনো কষ্ট লুকিয়ে আছে। এখন আর সেটা হয় না। এখন ভাবনার জায়গা, আবেগের জায়গা সবকিছু বস্তুবাদ দখল করে নিয়েছে। আমরা একে অপরের সাথে একই জায়গায়, একই ছাদের তলে থাকি বটে কিন্তু বেচে থাকি একা। এই অবস্থা সবাইকে একে অপরের থেকে এত দূরে ঠেলে দেয় যে, সবাই একটা একাকীত্বের জগতে প্রবেশ করে যা হয়ত কেউ আন্দাজও করতে পারে না। ফলে শুরু হয় হতাশা আর মনোকষ্টের প্রবনতা। চোখের সামনে আমরা যা দেখি, কিংবা আমাদেরকে যা দেখানো হয়, বাস্তবে হয়তো তারসাথে অনেকাংশেই মিল নাই। এই দেখা আর না দেখার মাঝে যে আবেগী আর বস্তুবাদী জীবন, সে দ্বৈত জীবনটাই আসলে আমরা।

সত্যি কথা বলতে কি, বস্তবাদ শুধু মানুষকে হতাশার মধ্যে একাকিত্তেই ফেলে যায় না, এটা বড় শহরে বড় বড় মানুষের দুনিয়াকেও ছোট করে নিয়ে আসে যেখানে নিজের হাতের উপর, নিজের মাথার উপর কারো হাত থাকা সত্তেও হাত খালিই থেকে যায় বলে মনে হয়, ভরষার স্থান শুন্যই রয়ে যায় বলে মনে হয়। আমরা এখন সবাই কোনো না কোনোভাবে বস্তুবাদের নিয়ন্ত্রনে বাস করি। কিন্তু যারা এই বস্তুবাদ জীবনে নতুন করে প্রবেশ করছি, তাদের বেলায় বিষয়টি অনেক কঠিন। তারা না পারেন বস্তুবাদী হতে, না পারেন সেই আগের আবেগী জীবন থেকে বের হতে। এমনি এক ক্রান্তিলগ্নে কোথাও না কোথাও কেউ বিচারের সম্মুখীন হন, হোক সেটা নিজের কাছে, হোক সেটা সমাজের কাছে কিংবা আদালত। সেই বিচার হয়তো শেষ হয় কিন্তু সেটা ন্যায় পায় কিনা কিংবা সেই রায় কেউ নাড়াচাড়া করে কিনা সেটার আর বিচার হয় না।  আজকের গল্পটি তাদের সেই জবানবন্দীর অনুলিপি মাত্র।

মুক্তার সাহেব একজন নামকরা শিল্পপতি, মোটামুটি বেশ সবার কাছে তার সুনাম আছে। কখনো দানবীর, কখনো কঠিন শাসক, কখনো বা জনহিতকর কাজের নেতা ইত্যাদি নামেই পরিচিত। মুক্তার সাহেবের বিবাহিত স্ত্রী আসমানী বেগমও স্বনামধন্য একজন প্রতিষ্ঠিত নারী। তাকেও সমাজের অনেকেই চিনেন এবং ভালো পরিচিতি আছে তার নিজের। মুক্তার সাহেবের মাধ্যমে স্ত্রী হিসাবে পরিচিতির বাইরেও তিনি একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। অপরদিকে, সাবিত্রী, অল্প বয়সের একজন নারী যার না ছিলো কোনো নামধাম, না ছিলো কোনো সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা, একজন গ্রাম্য এলাকার মেয়ে যে মুক্তার সাহেবের থেকেও প্রায় ৩০ বছরের ছোট। এই সাবিত্রীর সাথে মুক্তার সাহেবের পরকীয়া চলছে বলে চারিদিকে শোনা যাচ্ছে। আজকের ঘটনাবলী তার উপরেই।

আমি কেনো এই তদন্তটা হাতে নিয়েছিলাম সেটারও একটা কারন ছিলো। প্রায় ৩৩ বছর ঘর করার পর, সুখে শান্তিতে একত্রে বসবাস করার পর, ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাওয়ার পরে কেনো এই পরিবারের মধ্যে এমন একটা রহস্য ঢোকে গেলো, সেটা আমার জানার খুবই শখ ছিলো। এই কারনেই আমি এই কেসটার ব্যাপারে উৎসাহী হয়েছিলাম। তবে একটা কথা সত্যি যে, মুক্তার সাহেবের সাথে সাবিত্রী নামের মেয়েটার মধ্যে আমাদের তথাকথিত রীতিতে সংজ্ঞায়িত করলে যাকে আমরা পরকীয়া বলি, সেটার সুষ্পষ্ট প্রমান ছিলো। আর এই প্রমানের জন্য কোনো গোয়েন্দা কাহিনীর প্রয়োজন ছিলো না। কারন এটা মুক্তার সাহেব নিজেও অকপটে স্বীকার করেছেন কোনো রাখঢাকা ছাড়াই। ব্যাপারটা যেনো এমন ছিলো যে, তিনিই যেনো চেয়েছেন সবাই এটা জানুক।

তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ৩৩ বছর একসাথে ঘর করার পর কি কারনে মুক্তার সাহেব আসমানী বেগমের অলক্ষ্যে একান্তে সময় কাটানোর জন্যে সাবিত্রীর সাথে গোপন প্রনয় শুরু করেন?  সেই ইতিহাস না জানলে মনে হবে, হয়তো মুক্তার সাহেব আসলেই একজন চরিত্রহীন এবং দায়িত্বহীন কোনো এক সামাজিক কিট। সমাজে মুক্তার সাহেবই প্রথম ব্যক্তি নন যিনি ঘরে ভালোবাসার সুন্দুরী আসমানিদের রেখেও তার থেকে অনধিক সুন্দুরী বা অনধিক শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী এই সাবিত্রীদের সাথে প্রনয় করেন। কিন্তু অন্য সবার ব্যাপারে এই জাতীয় ঘটনা খুব মুখরোচক না হলেও, মুক্তার সাহেবদের মতো বিখ্যাত মানুষদের এসব খবর যখন নড়েচড়ে উঠে, তখন অনেকে বাসীরুটিও গরম করে খান। সবসময় গরম গরম পরোটাই যে মজাদার তা কিন্তু নয়, মুক্তার সাহেবদের মতো মানুষদের এসব ঘটনা চারিদিকে যখন রটায় তখন গরম গরম পরোটার চেয়েও এ ধরনের বাসীরুটির কদর অনেকগুন বেড়ে যায়। যখন মুখরোচক খবরের ক্ষিদে পায়, তখন রুটি, পরোটা, লুচির মধ্যে আর কোনো তফাত করা যায় না। কিন্তু মুক্তার সাহেবরা তাদের এই ঘটনার জন্য নিজ থেকে কোনো সংবাদের শিকার হতেও চান না। কারন, একদিনের মুখরোচক সংবাদ হবার জন্য কিংবা এই নশ্বর পৃথিবীতে জোরালোভাবে নামডাক থাকুক, ইতিহাস হোক, অথবা বিখ্যাত হোক এ লোভে কেউ এসব কাহিনীর নায়ক হতে চান না। এটা তো ঠিক যে, এই ‘বিখ্যাত হবো’ ধরনের ক্ষুধার জন্য কেউ সারা জীবনের তৈরী করা শব্জীক্ষেত জালিয়ে দেয় না। পাশ্চাত্যের ব্যাপার স্যাপার আলাদা। আমাদের এই দেশে এটা মানানসই নয়। তারপরেও কারনে অকারনে কারো কারো শব্জী বাগান জ্বলে। আর সেটা ভুলেই হোক, আর ইচ্ছায়ই হোক, কিংবা অন্য কারো দ্বারাই হোক, জ্বলতেই থাকে। আর এর প্রধান কারন একটাই, আবর্জনা যেমন সবসময় সাদা কাপড়েই বেশী ফুটে উঠে, তেমনি কিছু কিছু অপবাদও এই মুক্তার সাহেবদের মতো সাদা কাপড়েই বেশী চোখে পড়ে।

হাওয়া যখন কারো নামে গরম হয়, তখন আমরা অনেকেই বলি, শনির দশা চলছে। কিন্তু শনি এমন এক হাওয়ার নাম, যে, এই হাওয়ায় কারো নাম ভাসতে থাকলে তার পিছনের কি ইতিহাস, কি আচরন, সত্য-মিথ্যার চকলেটে মোড়ানো বোরহানীর মতো ঝাল-মিষ্টি-টক সবকিছুই তখন একসাথে যেনো উড়ে বেড়ায়। যে যেটা পছন্দ করে, তখন সে সেটাই ব্রেকিং নিউজের মতো লুফে নিয়ে যতো দ্রুত সম্ভব বাতাসের সাথে মাটিও গরম করে দেয়। তখন চায়ের কাপে, বাজারের দোকানে, কিংবা নদীর ঘাটেও এর পরিব্যপ্তি আর বিস্তার কম হয়না। আর যে বলীর পাঠা হয়, তার যত নামডাকই থাকুক না কেনো, সে তখন হয়ে উঠে বিষাক্ত খাবার। বিষাক্ত খাবার যতো দামিই হোক, তা ফেলেই দিতে হয় হয়ত। কারন যদি তা গোড়া থেকে উপড়ে  ফেলে না দেওয়া যায়, তখন তার মুল্য শুধু বিপদের আশংকাই বাড়িয়ে দেয় তা নয়, সেটা সমাজে একটা আইনের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

কিন্তু মুক্তার সাহেবের মতো ব্যক্তিত্তকে বিষাক্ত খাবার মনে করে আসমানী বেগমেরা তাকে ফেলেও দিতে চান না। তারা চান, কিভাবে এই বিষাক্ত খাবার আবার সিদ্ধ করে পুনরায় ঝলমলে পরিপাটি খাবারের টেবিলে পরিবেশন করা যায়। কারন তাদের ভ্যাল্যু আলাদা, সাথে থাকলে সবারই লাভ। তাই হয়তো এমন গুরুতর অভিযোগের পরেও আসমানী বেগম চান যে, মুক্তার সাহেব ফিরে আসুক, আর সাবিত্রীরা ধংশ হোক। তাতেই হয়তো আসমানী বেগমেরা খুসি।

এসব পরকীয়ার কাহিনীর সাথে সাথে যেহেতু সে ব্যাক্তির পিছনের ইতিহাস, তার আচরন নিয়ে রমরমা পান্ডুলিপি এক হাত থেকে আরেক হাতে ছড়ায়ই, তাই এই মুক্তার সাহেবের অতীত ইতিহাস, কিংবা তার আচরন সম্পর্কে তার কাছ থেকেই জানা ভালো। এতে হয়তো কিছুটা রাখঢাক থাকতে পারে অথবা থাকতে পারে কিছু প্রচ্ছন্ন লুকানো তথ্য। সিংহভাগ তথ্য যখন একে একে সারিবদ্ধভাবে জোড়া লাগানো হয়, আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি কোথায় কোন জায়গায় মুক্তার সাহেব কিছু ছেড়ে গেলেন, আর কোথায় কোন তথ্য নতুন করে আমদানী করলেন। সঠিকতার বিচার পাঠকের উপর। যে যেভাবে পারেন, তিনি তারমতো করে সেসব গড়মিল জায়গাগুলি নিজের মতো তথ্য যোগ করে প্রতিস্থাপন করলেই পূর্নাজ্ঞ গল্পটি নিজের মানসপটে ফুটে উঠবে। সবার বিচারিক ক্ষমতা আলাদা, সবার গ্রহনযোগ্যতাও আলাদা। আমি এই ত্রিপক্ষীয় ত্রিভুজ প্রেমের মধ্যে কার যে কতটা দোষ বা কে যে কার ক্ষতি কতটা করছিলো, নির্ধারন করতে পারিনি। মনে হয়েছে-প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জায়গায় সঠিক। তাহলে শুনি তার নিজের মুখে দেয়া বিচারকের কাছে দেয়া তাঁর পরকীয়ার জবানবন্দী। বিচারকের পক্ষে আমিই সেই ব্যক্তি যে মুক্তার সাহেবের জবানবন্দী রেকর্ড করেছিলাম।

মুক্তার সাহেবের জবান বন্দি-১ম পর্ব

আমি মুক্তার সাহেবের কাছে তার জবানবন্দি নেয়ার জন্য যেদিন যাই, সেদিন বুঝেছিলাম, মুক্তার সাহেবের মধ্যে আমাদের অন্য দশজনের মতোই জীবন। আলাদা কিছু ছিলো না। তারপরেও অনেক কিছু আলাদা ছিলো যা আমরা সাহসের সাথে বলি না, করি না, কিন্তু মুক্তার সাহেব সেটা অকপটে বলেন, করেন এবং স্বীকার করেন।

মুক্তার সাহেবকে আমি তার কিছু বক্তব্য জবানবন্দি আকারে লিখতে বলায় তিনি একটু হেসে দিয়ে বললেন-আপনার যা জানার বা বলার আমাকে অকপটে বলবেন, আমি সব বলে যাবো। আপনিই আমার জবানবন্দি লিখে নিন, আমি সেথায় নিজের দস্তখত করে দায়মুক্তি দিয়ে দেবো।

বললাম- অসুবিধা নাই। আপনি বলুন, আমি নিজেই নোট করে নেবো।

বাইরে একটু একটু গরম বাতাস বইছে। গ্রীষ্মকাল। মাঝে মাঝে আকাশ মেঘলা করে, আবার মাঝে মাঝে অদ্ভুদ আকারের কয়েক ফোটা ব্রিষ্টিও হয়, সাথে দিনের সুর্যকে কোনো প্রকার আড়াল না করে। আমরা গ্রামে ছোটবেলায় এটাকে বলতাম ঃশিয়াল ব্রিষ্ট”। কেনো একে আমরা শিয়াল ব্রিষ্টি বলতাম আজো আমি তার কোনো যৌক্তিক কারন খুজে পাই নাই। যাই হোক, এমন একটা দিনে আমি মুক্তার সাহেবের বাসায় বসে তারই জীবনের পরকীয়ার একটা অধ্যায় নিয়ে কথা বলতে বসেছি।

আমি চুপচাপ বসে আছি মুক্তার সাহেবের মুখ থেকে কথা শোনার জন্য।

মুক্তার সাহেব তার কথা বলার আগে তিনি শুধু বললেন, আমার পুরু জীবনের ঘটনা না জানলে আপনি এই জাবানবন্দির মধ্যে অনেক গড়মিল পাবেন। তাই অনেক আগ থেকেই শুরু করি। কি বলেন? আপনার সময় হবে তো?

বল্লাম-আচ্ছা।

-আমার বয়স তখন সবেমাত্র কুড়ি পেড়িয়েছে। টকবকে যুবক। স্বাধীনতা বলতে যা বুঝায় ঠিক সে রকম। সব প্রকারের মানসিকতা নিয়েই আমি সমাজের প্রতিটি স্তরে অনায়াসেই যাতায়ত করতে পারি। সবার সাথেই ছিলো আমার বন্ধুত্ব। গাজার আসরে যেমন আমি ছিলাম মুক্তার মতো, তেমনি পড়াশুনায় ভালো করার কারনে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তদের কাছে ছিলাম মুক্তোর হারের মতো। আর নিম্নবিত্ত মানুষদের কাছে যতোটা না ছিলাম আদর্শগত মডেল তার থেকে বেশী ছিলাম গোপন হিংসার একটা অদেখা আলাপের বিষয়বস্তু। একটা জিনিষ কি কখনো জেনেছেন যে, কোনো এক সময়ের জমিদার বাড়ির সন্তান যখন নিম্নবিত্ত পরিবারের মতো বেড়ে উঠে, তখন তার প্রাচীন উদ্ধত্তভাবের সাথে দেমাগ আর জিদটা হয়তো বেচেই থাকে যদিও সামর্থ বলতে কিছুই থাকে না। আমার ছিলো সেরকমের একটা জিদ আর দেমাগ। পিতামাতার অঢেল সম্পত্তি থাকা সত্তেও সেগুলি কোনো কাজেই আসেনি আমাদের কারো জীবনে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের জীবন বিলুপ্তির পরে সবই চলে গিয়েছিলো অন্যের দখলে। ফলে অর্ধাহারে, কিংবা অনাহারেও আমরা বেড়ে উঠেছি এই বৈষম্যমূলক সমাজে। আর সেটা আমাদের মতো করেই। অভিযোগ ছিলো কিন্তু সামর্থ ছিলো না তার প্রতিবাদের। যাই হোক, লেখাপড়ার প্রতি অনেক ঝোক ছিলো আমার, তাই, গ্রামের আর দশটা যুবকের থেকে আমি ছিলাম একেবারেই আলাদা। অদুর অতীতে কি ছিলো আর ওসব থাকলেও এখন কি হতে পারতাম, এই চিন্তাটা মাথায় একেবারেই ছিলো না, বা না ছিলো কোনো আফসোস যে, কেনো অন্যদের অনেক কিছু আছে আর আমাদের থেকেও নাই। কিন্তু আখাংকা ছিলো অনেক, যেভাবেই হোক নিজের পরিশ্রমে সৎপথে অনেক বড় কিছু হবার। শুনেছিলাম, সুন্দুরী অনেক যুবতীর সফলতা বড় লোকের বেডরুম দিয়ে আসলেও কোনো বেকার যুবকের সফলতা কোনো বড় লোকের ঘরজামাই থেকে আসে না। আর যাদের আসে, তারা হয় নেহায়েত ভাগ্যবান নয়তো তারা জীবনের জন্য আজীবন মৃৎপ্রায় লাশের মতো সব শর্তাবলী গলায় নিয়েই ভোগবিলাস করেন। আমার এই ধরনের না ছিলো কোনো মানসিকতা আর না ছিলো এর সুযোগের সন্ধান।

২১ বছর বয়সেই আমি, আমার মেধার কারনেই হোক আর শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাইয়েই হোক, দেশের একটি অত্যান্ত প্রতিষ্ঠিত এবং সম্মানজনক সেক্টরে অফিসার পদে চাকুরী পেয়ে যাই। যদিও আমার অন্যান্য সেক্টরে চাকুরী পাবার সম্ভাবনা ছিল আরো ঢের বেশী এবং সেসব সেক্টরেও প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হবার জন্য যে কোর্ষ এবং ডিগ্রী দরকার তার সিলেকসনেও আমি ছিলাম অনেকের থেকে অনেক উপরে। কিন্তু সেই সিলেকশনের পর কোর্ষ বা উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যাবার মতো মসলা বা জোগান হাতে ছিলো না যা বর্তমান সেক্টরে সরাসরি পাওয়া যায় বিধায় আমাকে অনেক সিদ্ধান্ত নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেও পালটাতে হয়েছে। ফলে অন্যান্য সেক্টরের সপ্ন বাদ দিয়ে আমি বর্তমানকেই প্রাধান্য দিলাম যাতে আমি নিজেকে সাপোর্ট দিতে পারি এবং জীবন নিজের মতো করে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।

-আমি মুক্ত্রা সাহেবের কথা খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম। একবার ভাবছিলাম, নোট করি, আবার ভাবলাম, নাহ থাক, নোটের হয়তো প্রয়োজন পড়বে না, আগে পুরু ইতিহাসটা শুনি।

মুক্তার সাহেব কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন।

বললেন, একটা জিনিষ আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে, মাথার উপর ছাদ না থাকলে,  যে দুফোটা বৃষ্টি আকাশ থেকে প্রথমেই ঝরে পড়বে, সেটা আমার মাথায়ই প্রথম পড়বে। আমার না ছিলো কোনো ব্যাকআপ সাপোর্ট, না ছিলো কোনো অবলম্বন। আমাকে সাহায্য করার আসলে কেহই ছিল না তখন। ভেবেছিলাম তখন যে, এখন না হয় আমি একা, পরিবার হয় নাই, বিয়েটাও করি নাই, ফলে দুশ্চিন্তা হয়তো একটু কম, কিন্তু কখনো যদি আমার পরিবার হয়, সন্তান হয়, তখনো আমি জানি, আমাকে দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার অসময়ে বা দুঃসময়ে সাহাজ্য করার কেউ নাই। এই কঠিন বাস্তবতাটা আমার মাথায় এমনভাবে গেথে গিয়েছিলো যে, আমার কখনো ভুল হয়নি এটা মনে রাখবার যে আমি একা। আমার বিকল্প আমিই, আর কেউ নয়। আর মজার ব্যাপারটা হলো- এ সত্যটা আজ অবধি সত্যই।

-এই অবস্থায় আমার সাথে দেখা হয় এই আজকের আসমানীর। কথা থেকে চিঠি, চিঠি থেকে আরো ঘনিষ্ঠতা, আর সেই ঘনিষ্ঠতা থেকে একসময় প্রনয়। আমার কিংবা আসমানীদের পরিবারের অনেকেই আমাদের এই ঘনিষ্টতা পছন্দ করে নাই। এখানে আরেকটা কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে, আমি কিন্তু এতিম ছিলাম না। আমারো মা ছিলো, ভাই ছিলো, বোনও ছিলো, ছিলো শুভাকাংখিও। কিন্তু তাদের অবস্থা এরকম নয় যে, আমার কোনো প্রয়োজনে হাত বাড়িয়ে কোনো আর্থিক সহায়তা করতে পারবেন, আমার পাশে দাড়াতে পারবেন বরং তারা তাদের আর্থিক দুরাবস্থার কারনে আমার দিকেই যেনো তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু এসব শুভাকাংখির একটা বড় সমস্যা হলো যে, নিজেরা কোনো কিছু সাহাজ্য করতে না পারলেও, তারা বিজ্ঞের মতো এমন কিছু মতামত, বা উপদেশ দেন যেনো ওরাই না জানি আমার অভিভাবক বা তাদের পরামর্শ না শুনলে আমার জন্য একটা বড় অপরাধ কিংবা ঘোরতর বিপদের আশংকা আছে। কিন্তু ওই যে বললাম, আমি বরাবর স্বাধীনচেতা মনের মানুষ, আর আমার চিন্তাধারার সাথে কারো চিন্তাধারা মিলুক বা না মিলুক সেটা আমার কাছে বড় কোনো বিবেচ্য বিষয় ছিলো না। আমি শুধু ভাবতাম, আমার সমস্ত কিছুর জন্য আমিই দায়ী। হোক সেটা উত্থানের বা পতনের। আমার উত্থানে হয়তো তখন তারা তাদের ভুল পরামর্শের কারনে চুপ থাকবেন, না হয় আমার পতনের কারনে তারা আরো কিছু শুনিয়ে দেবেন যে, তাদের পরামর্শ না শোনার কারনে আজ আমার এতো অধোপতন। কিন্তু এটাও জানি, সেই অধোপতন থেকে আবার আমাকে টেনে বের করে কোনো এক সঠিক রাস্তায় দাড় করিয়ে দেবার মতো তাদের না আছে সামর্থ বা না আছে কোনো মানষিকতা।

-যাই হোক, আসমানীর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হবার পর আমি নিজেও বুঝতে পারলাম, আমার অবস্থা থেকে আসমানীর অবস্থা আরো গুরুতর। আমি ছেলে মানুষ, কোনো না কোনোভাবে হয়তো অনেক কিছু থেকেই পার পেয়ে যাবো। কিন্তু আসমানী মেয়ে মানুষ, তার অবস্থা আরো শোচনীয় থাকায় তার অবস্থা আরো বিপদজনক। তারও না আছে তেমন শক্ত কোনো অভিভাবক, না আছে বাবা, না আছে এমন কেউ যাকে নির্ভর করে সে তার মেয়েলী জীবনের একটা সুখের স্বপ্নের কথা ভাবতে পারে। তার শুধু একটা ভরষাই ছিল। আর সেটা হলো আগত ভবিষ্যতে তার স্বামীর উপর। তার চাওয়া পাওয়া, আবদার, আর যতো অভিমান যেনো লুকায়িত আছে সেই অনাগত স্বামীকে ঘিরে। আসমানী এটাও জানতো যে, জীবনে এই আদর্শগত স্বামী পেতে হলে তাকেও একটা লেবেল পর্যন্ত যেতে হবে, বিশেষ করে পড়াশুনার দিক দিয়ে। তাই, আসমানীর লক্ষ্য যেমন ছিলো ভালো একটা জীবনের জন্য, তেমনি লক্ষ্যকে সফল করার জন্য তাকে এই সমাজ সংসারে এমন করে পরিশ্রম করতে হবে যেখানে সবচেয়ে কম খরচে সবচেয়ে ভালো কিছু করা যায়। সরকারী ইউনিভার্সিটি হলো সেই লক্ষ্যভেদের একটা সহজ কৌশল। আসমানি তার পূর্ন সদ্ব্যবহার করেছিলো। ফলে একদিকে আসমানী লেখাপড়া চালিয়ে যেতে লাগলো অন্যদিকে আমাকেও সে ধরে রাখলো।

-একটা সময় এলো যে, আমি আর আসমানী একা একাই জীবনসাথী হয়ে গেলাম। আমি আসমানীকে আমার জীবনের বাইরে কখনো ভাবি নাই। আর এই ভাবার মধ্যে ব্যাপারটা এমন ছিলো যে, আমার মতো আসমানীরও কেউ নাই। আমিই আসমানীর দেবতা, আমিই আসমানীর আত্তা, আমিই আসমানীর সর্বত্র। ওর রাগ অভিমান, চাওয়া পাওয়া, সুখ আহলাদ, হাসি কান্না, সবকিছুই আমি। আর আমার বেলায়ও আমি জানি কাউকে আমার কষ্টের কথা, ব্যাথার কথা, কিংবা পরিকল্পনার কথা আসমানিকে ছাড়া কারো সাথেই শেয়ার করা সম্ভব ছিলো না। আমরা আসলে আক্ষরীক অর্থেই অর্ধাংগিনি রুপে একে অপরের জন্য স্থির হয়ে গেলাম। ভাবলাম, একদিন আমাদের সব ঠিক হয়ে যাবে, আমরা সব কিছু আমাদের মতো করেই তৈরী করবো।

মুক্তার সাহেব কিছুক্ষনের জন্য থামলেন। একটা দীর্ঘশাস ছাড়লেন। কিছুক্ষন চুপ করেও রইলেন। আমি বুঝলাম, তিনি ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছেন। মুক্তার সাহেব সিগারেট খেতে পছন্দ করেন। একটা বেনসন এন্ড হেজেস সিগারেটে আগুন ধরিয়ে তারপর আবার শুরু করলেন-

-একটা জিনিষ জানেন? আমরা সবাই সুখী হতে চাই। ভাবি, ‘একদিন’ আমরা সুখী হবোই। এই “একদিন”, অদ্ভুত একটা সময়। সবসময় আমরা ভাবি, ‘একদিন’ আমার সবকিছু আমার মতো করে হবে, ‘একদিন’ আমি সবকিছু নিজের মতো করে পাবো, ‘একদিন’ আমি সবকিছু ছেড়ে নিজের মতো করে এই পৃথিবীকে দেখবো, দেখবো এর বিশালত্ব, এর সৌন্দর্য, এর অপূর্ব রহস্যময়তা। কিন্তু আমি জানি না কবে সেই আমার ‘একদিন’। আমি জানিও না আমার সেই ‘একদিন’ আসলে কবে সেইদিন। আমি কিভাবে জানবো, সেই ‘একদিন’টা কবে আসবে আমার জীবনে? ছোট এই সমাজে যেখানে আমরা দৈনিন্দিন সবাইকে নিয়ে বসবাস করি, আমরা সেখানে চাইলেই সবকিছু করতে পারি না।  শিশুকাল থেকে কৈশোর পার করা অবধি আমরা সবাই ওই ‘একদিন’ এর অপেক্ষায়ই থাকি যেদিন আমার সব ইচ্ছা পূরন হবে, আমি মুক্ত পাখীর মতো এই বিশাল আকাশে হাওয়ায় উড়ে উড়ে মেঘ দেখবো, নীচের সবুজ গাছপালা দেখবো, সাগর দেখবো, পাহাড় দেখবো। কিন্তু ক্রমেই যতো একেকটা স্তর পার করে যখন আরেকটা স্তরে পা রাখি, ততোই সামনে চলে আসে কোনো না কোন দায়িত্ব, কোনো না কোনো নতুন আরেকটা চ্যালেঞ্জ। সেটাকে মোকাবেলা করতে করতেই জীবনের বেশ কয়েকটি স্তর, ধাপ পার হয়ে যায়। আমাদের কারোই সেই ‘একদিন’ সময়টা যেনো আর আসে না। আজ আমরা নিজের সংসারের জন্য বাচি, কাল আমরা স্বামী বা স্ত্রীর জন্য বাচি, তারপর হয়তো সন্তানের জন্য বাচি, আর এভাবেই সামাজিক, পারিবারিক ইত্যাদির দায়বদ্ধতা আর জীবনের তাগিদে আমরা ক্রমশই জীবন নামক নদীতে শুধু ক্লান্ত হয়ে ভাসতেই থাকি। আর ভাবী, নিশ্চয় ‘একদিন’ আমার সব চ্যালেঞ্জ, সব ক্লান্তি কিংবা সব ঝামেলা শেষ হবে, আর তারপর ‘একদিন’ আমার আর কোনো ঝামেলা, সমস্যা কিংবা আমার সুখের নিমিত্তে কোনো বাধা থাকবে না। সেই ‘একদিন’ নিশ্চয় আমি আমার মতো করে সারা দেশ ঘুরতে পারবো, পার্টিতে নাচতে পারবো, পাখীর মতো যেদিকে খুশী মনের আনন্দে উড়ে বেড়াতে পারবো। কিন্তু আমার সেই ‘একদিন” যেনো আর কখনোই আসে না। বারবার কোনো না কোনো বাধা এসেই দাঁড়ায়। আসলে কি জানেন? এই ‘একদিন’ কখনোই আমাদের জীবনে আসে না। কিন্তু যদি জীবনের সবসুত্র, সব মায়াজাল, সব জটিল সমীকরন ছিন্ন করে প্রকৃতির সাথে চলমান ধারাবাহিকতায় সার্থপরের মতো দেখি, তাহলে এটাই চোখে পড়বে যে, আসলে, ‘একদিন’ হচ্ছে আজকের এইদিন, আজই। এই আজকের দিনটাই আসলে আমার সেই ‘একদিন’। আজকের দিনটার জন্যই আমি বাচি। আজকের দিনের পর হয়তো আমার জীবনে আরো একটি দিন নাও আসতে পারে। তাহলে সেই আগামীর একদিনের জন্য আমি কেনো আজকের দিনটাকে বিসর্জন দেই? হয়তো আরো ‘একদিন’ আর কখনোই আমার জীবনে আসবে না। আমার কাছে শুধু ‘একদিন’ই বাকী-আর সেটা আজ। যদি আমার সারাটা ক্যালেন্ডারেকে একটা একটা করে দিন ভাগ করে সিডিউল বানাই, দেখা যাবে, আজকের দিনটাই আমার বাস্তবতা। আর এই আজকের দিনটাই সেই ‘একদিন’। আর বাকী দিনগুলি আমার হাতেও নাই, আর যেগুলি চলে গেছে তাদের আমি কখনো ফিরিয়েও আনতে পারবো না। যেটা আছে আমার কাছে, সেটা আজ- আর এটাই সেই ‘একদিন’। তাই আমি শুধু আজকের দিনটার জন্যই বাচতে চাই। হাসতে চাই, খেলতে চাই, আকাশটা দেখতে চাই, বৃষ্টিতে ভিজতে চাই, পৃথিবীর সব গাছপালা, সব পাহাড় পর্বত, নীল আকাশ, সবকিছু দেখে প্রানভরে বাচতে চাই। আমি শুধু আমার জন্যই আজ বাচতে চাই। কালটা থাকুক অন্য সবার জন্য। আর এটা বুঝতে বুঝতে আমার সময় পেরিয়ে গেছে অনেক অনেকগুলি বছর।

কথাগুলি বলার সময় মুক্তার সাহেব কেমন অন্যমনষ্ক হয়ে গিয়েছিলেন। যে মুক্তার সাহেব তাঁর অফিসে এতো বড় একজন কর্তাবাবু, সবাই তাকে যেমন সমীহ করে, তেমনি তাকে সবাই খুব কঠিন মানুষও মনে করে। অথচ আমার সামনে যিনি বসে আছেন, তাকে দেখে একবারের জন্যও মনে হয় না তিনি ভিতরে এতো কঠিন একজন মানুষ। মানুষ কত বিচিত্র। মুক্তার সাহেবের এই ‘একদিন’ এর ভাবনাটা আমাকে যেনো আজ নতুন করে ভাবিয়ে তুললো। এটা কি আমারো নয়? আমিও কি ঠিক এটাই ভাবি না? আমিও তো ভাবি, একদিন আমি সব পাওয়ার শান্তিতে শুধু রেষ্ট করবো, ঘুরবো, বেড়াবো, আনন্দ করবো। কিন্তু আমিও তো সেই ‘একদিনের’ নাগাল পাইনা। আসলেই তো, তাহলে আমার সেই একদিনটা কবে? মুক্তার সাহেব ঠিকই বলেছে, হয়তো সেই দিনটা আজই। কিন্তু আমি কি পারি ‘আজ’ ঠিক এই মুহুর্তে সবকিছু ছেড়েছূড়ে কোথাও একা চলে যেতে? কিংবা সবকিছু ছেড়ে বেড়িয়ে যাই যতোদিন খুশি ততোদিনের জন্য? অভিনব অতৃপ্তির জীবনে এই ‘একদিন’ একটা মরিচিকা ছাড়া আর হয়তো কিছুই না। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত হয়তো আমরা এই ‘একদিন’ এর জন্যই বাচি কিন্তু সেই ‘একদিন’ কারো জীবনেই আসে না। হয়তো কারো কারো জিবনে আসে, কিন্তু সেটা আমরা উপ্লব্ধি করি না।

-মুক্তার সাহেব একটু দম নিয়ে বললেন, যাই হোক, একটু ইমোশনাল কথা বলে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না। যেটা বলছিলাম, আসমানীর কথা। মুক্তার সাহেব আরো একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর কথা বলতে লাগলেন।

-আমি আসমানীকে পেতে সবাইকেই ছেড়েছিলাম। আমি যে আমার পরিবারের সবাইকেই ছেড়েছিলাম তারা হয়তো কোনোদিন জানতেও পারে নাই কবে থেকে আমি তাদের মন থেকেই ছেড়ে পর করে দিয়েছি। এই ছেড়ে দেয়া আর পর করে দেয়াটা এমন ছিলো যে, না কারো সাথে আমার খারাপ সম্পর্ক, না কারো সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। কিন্তু সম্পর্কটা আছে। সম্পর্কটার চরিত্র এমন ছিলো যে, না আমি তাদের জন্য দায়িত্তশিল, না ওরা আমার জন্য। শুধুমাত্র আমার মা ছিলেন এই নির্বিকার সম্পর্কের বাইরে যিনি প্রকাশ্যেও আমাকে সাপোর্ট করেছিলেন এবং অপ্রকাশ্যেও। আসমানীর সাথে আমার সম্পর্ক স্থায়ী হবার পরে আমার একটাই লক্ষ্য ছিল, নিজেদেরকে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। আর এই প্রতিষ্ঠার একটা বৈশিষ্ট ছিলো। সেটা হলো যে, যদি কোনো কারনে আমার জীবনের হিসাবের সব হোমওয়ার্ক শেষ না হয় এবং তারপুর্বেই আমার মৃত্যুবরন হয়, তাহলে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে আমার এই আসমানী। তাই যেভাবেই হোক, আমার বর্তমানকে কাজে লাগিয়ে আমার প্রথম দায়িত্ত হবে আসমানীকে সাবলম্বি করে তোলা। আমার পক্ষ থেকে যা যা করা দরকার সেটা আমার শক্তির পুরুটা দিয়ে এবং আসমানীর নিজের দক্ষতায় আমি সে চেষ্টায় ব্রত হয়েছিলাম। ওই যে আবারো সেই ‘একদিন’। ‘একদিন’ সব ঠিক হয়ে যাবের মতো। ফলে অনেকটা সময় আমার জীবনে সেই “একদিন” কখনোই আসেনি।

-আসমানী আমার একটা প্রোজেক্ট ছিলো।

আমি পরক্ষনেই জানতে চাইলাম, প্রোজেক্ট ছিলো মানে? এখন কি আর তাহলে সেই প্রোজেক্ট নাই?

মুক্তার সাহেব আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন-

-আগে সবটা শুনুন, তাহলে আপনি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।

-প্রোজেক্ট যেভাবে কেউ তার সর্বশক্তি দিয়ে আর সামর্থ দিয়ে সফল করে, আমি আসমানীকে ঠিক সেভাবেই তিলে তিলে গড়ে তুলছিলাম। কিন্তু আমার একার আর্থিক সচ্চলতার উচ্চতা এমন ছিলো না যে, অচিরেই পাহাড়ের মতো একটা সাবলম্বি পরিস্থিতি তৈরী করে ফেলি। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, আমি আসমানিকে তার নিজের যোগ্যতায় গড়ে তুলতে সক্ষম হই আর সেই সক্ষমতায় আসমানিও একটা সরকারী চাকুরীর সুবাদে প্ল্যাটফর্ম পেয়ে যায়। আসমানীর এই প্লাটফর্মে আরো একটা বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়েছিলো আমার অন্যান্য আত্তীয়সজনের সাথে। যদিও আমার পরিবারের কারো সাথেই আমার তেমন সম্পর্ক টেকসই ছিলো না, তারপরেও আসমানীর চাকুরীটাকে অনেকেই সহজ করে মেনে নিতে পারে নাই। সবসময় তাদের অভিযোগ ছিলো, কেনো আমি আসমানীকে মহিলা হয়েও চাকুরী করার অনুমতি দিলাম, বিশেষ করে এই ইগোতে যে, স্ত্রীর রোজগারের উপর আমার লোভ কিংবা ভরষা, স্ত্রীরা ঘরের বাইরে গেলে তাঁর চরিত্রস্খলনের সম্ভাবনা ইত্যাদি ইত্যাদি।

-আসমানীর উপর আমার শতভাগ আস্থা ছিলো। আজকালকার ছেলেমেয়েদের লাইফ ষ্টাইলের মতো আসমানীর লাইফ ষ্টাইল ছিলো না। আজকাল ছেলেমেয়েরা ওদের জীবনটাকে টাইম পাস মনে করে আর টাইম পাসকে জীবন মনে করে। কাল পর্যন্ত যে গার্লফ্রেন্ড ছিলো আজ সে বোন, আর আজ যে বোন সে কাল হয়ে যায় গার্লফ্রেন্ড। চোখের পলকে প্রেম হয়ে যায়, আবার চোখের পলকে প্রেম ভেঙ্গেও যায়। আসমানির চরিত্র কখনোই এমন ছিলো না। আর আসমানীর উপর আমার সেই আস্থা একদিনে গড়ে উঠে নাই। তার মানসিকতা, তার ভালোবাসার গভীরতা আমাকে কখনো এটা সন্দেহ করার অবকাশ দেয় নাই যে, আসমানী কোনো না কোনো অবস্থায় তার নিজ গন্তব্য আর ভালোবাসা থেকে ছিটকে পড়বে। আর সে ছিটকে পড়েও নাই কখনো। বরং ছিটকে পড়েছিলাম আমি।

-খুব ভালোভাবেই চলছিলো আমাদের। আমাদের সন্তান হলো, সংসারে খরচ বাড়লো বটে কিন্তু দুজনের মিলিত চেষ্টায় আমাদের অন্তত প্রাত্যাহিক জীবনধারনের নিমিত্তে কোনো দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছিলো না। আমরা ধীরে ধীরে আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে শুরু করলাম। ওইযে বললাম, আমার মাথা থেকে কখনো এটা সরে যায় নাই যে, আমার অবর্তমানে আমার নিজস্ব পরিবার যেনো থাকে সুরক্ষিত এবং সাবলম্বি। সেই লক্ষ্যটা থেকে আমি কোনোদিন বিচ্যুত হয় নাই। আগে শুধু আসমানীকে নিয়ে ভাবনা ছিলো, এখন তাঁর সাথে যোগ হলো আমার সন্তানেরা। তাই তাদের স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বাড়ি, নিরাপদে চলার জন্য গাড়ি, কিছু স্থায়ী আর্থিক উৎস যা যা লাগে আমি সেটার ব্যবস্থা করছিলাম। সময়ের সাথে সাথে সেটা আসলেই একটা স্থায়ী রুপও নিয়েছিলো। আর এই লম্বা সময়টার দৈর্ঘ ছিলো প্রায় ২৫ বছর। এই ২৫ বছরে আমি চড়াও উতড়াই পার হয়েই এখানে এসেছি। কেউ আমাকে সাহাজ্য করে নাই। না আমি কারো সাহাজ্যের জন্য পথ চেয়েছিলাম। এখন আমার আসমানি জানে সে সাবলম্বি, আমিও জানি আমার আসমানি সাবলম্বি। সে নিজে নিজে চলতে পারবে। তার একটা স্থায়ী আর্থিক উৎস আছে। এই বিশাল অবস্থানটা করতে আমাকে আমার জীবনের বহু মুল্যবান সময় পার করতে হয়েছে বটে কিন্তু এরই মধ্যে আমি আমার যৌবন পেরিয়ে মধ্য বয়স্ক পুরুহীতে পরিনিত হয়ে গেছি। আমি অনেক খুসী। কিন্তু তারপর…।

এই পর্যায়ে এসে মুক্তার সাহেব আবারো একটা বেনসন এন্ড হেজেস সিগারেট ধরালেন। জবানবন্দি নেবার সময় আমরা মুক্তার সাহেবকে সর্বপ্রকার সুযোগ দিয়েছিলাম যাতে তিনি সাবলীল্ভাবে তাঁর মনের কথা বলতে পারেন। তিনি তার কাজের বুয়া সেলীকে এককাপ করে কফি দিতে বললেন। কফির কাপে চুমু দিলেন। তারপর আমাকে তিনি প্রশ্ন করলেন-

-বলুন তো, একটা মানুষের জীবন সুখী হয় কি কি জিনিষ থাকলে?

আমি বললাম, টাকা থাকলে, সম্পদ থাকলে, সমাজে একটা ভালো পজিসন ইত্যাদি থাকলে আর যদি শরীর সুস্থ থাকে, তাহলে তো সে সুখী মানুষ বলেই গন্য হয়।

মুক্তার সাহেব একটু মুচকী হাসলেন। তারপর বললেন,

-তাহলে কি আপনি বলতে চাচ্ছেন, রাস্তায় যে সব মানুষ ভিক্ষা করে, তারা কেউ সুখী নয়? কিংবা যাদের একফোটা সম্পদ নাই, তারা কি সুখী নয়? অথবা সমাজে যারা অনেক বড় বড় পজিশন নিয়ে বাস করেনা, তারা কি সুখী নয়? অথবা যদি বলি, বিছানায় অবশ হয়ে পড়ে থাকা সব মানুষই কি দুখী? তারা কি কোনো না কোনো স্তরে সুখী না? যদি এমন হতো যে, টাকা আছে, পয়সা আছে, অঢেল সম্পদ আছে, সমাজে মানসম্মান প্রতিপত্তি আছে আবার শারীরকভাবে সুস্থও আছে, তারা তাহলে কিসের নেশায় নিজের ঘরে থাকা সুন্দুরী স্ত্রীকে রেখে পুনরায় পরকীয়ায় মেতে উঠেন? সবাই কি পারভার্ট? নাকি যৌনতাই প্রধান? অথবা যদি বলি যে, ৯০ বছরের এক বৃদ্ধ যখন তার অঢেল টাকা পয়সা ব্যাংক ব্যালেন্স থাকার পরেও নিজের ৮৫ বছরের স্ত্রীর বিয়োগে আরেকটা বিয়ে করতে মানিসকভাবে প্রস্তুতি নেন, যখন তার যৌনতায়ও কোনো ক্ষমতা নাই, সে তাহলে এটা কিসের নেশায় করে? আমি অবিশ্বাস করছি না যে, সবক্ষেত্রেই আমার এই প্রশ্ন সঠিক বা সঠিক নয়, তবে এর অন্তরনিহিত গুররহস্য খুজতে গেলে দেখা যাবে, এসবের কোনটাই এর উত্তর  নয়। উত্তর লুকিয়ে আছে শুধুমাত্র না দেখা একটা অনুভুতিতে। আর সেটা হচ্ছে- একাকীত্ত বা নন একোম্প্যানিয়ন।

আমি কিছু বলতে চেয়েছিলাম, আরে, ব্যাপারটা তো এমন করে কখনো ভেবে দেখিনি? আমি কিছু একটা বলতে গিয়ে মুক্তার সাহেব তার হাতের ইশারায় আমাকে থামিয়ে দিয়ে আবার বলতে লাগলেন-

-হ্যা, হয়তো আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, এই একাকীত্ত কি বা এই নন-একোম্প্যানিয়ন এর মর্মার্থ কি। এটা বুঝবার জন্য আপানাকে কিছু সুক্ষ জিনিষের ভিতরে ঢোকতে হবে। আর সেটা হচ্ছে-অনুভুতি, আবেগ, তার সাথে মানবিক চাহিদা। মানবিক চাহিদার সাথে শারীরিক চাহিদার একটা যোগসুত্র থাকতে পারে যা আমি পরে বল্বো। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি আপনাকে ছোট একটা উদাহরন দেই। কখনো কি উপলব্ধি করেছেন যে, A person can be lonely in a crowdy city? অথবা কখনো কি ভেবেছেন যে, an one-month infant baby who has no idea about the world or even does not know how to talk, does not understand our any of the language, but can be a good accompanist as well!! অর্থাৎ একটা কোলাহলপুর্ন জনসমুদ্রের মধ্যেও কেউ একা থাকে। আশেপাশে হাজার হাজার লোক ঘুরছে, ফিরছে, খাচ্ছে, তামাশা করছে, আনন্দ করছে অথচ কোনো একজন এই ভীড়ের মধ্যেও একা। এই উপলব্ধিটা কখনো ভেবেছেন? আবার অন্যদিকে দেখবেন, অনেক আপন লোকজন আপনার আশেপাশে আছে, কথা শুনার মতো লোকজনও আছে, কিন্তু তাদের থেকে আপনার কাছে মনে হবে একটা অবুঝ বাচ্চা যে কথাই বলতে শিখে নাই, যে আপনার কথার আগামাথা কিছুই বুঝে না, তারসাথেও আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারছেন। আপনি তাঁর কাছে একা নন। সে যেনো আপনার একাকীত্তের একজন ভালো সাথী। তারসাথে আপনি বিজ্ঞান নিয়ে আলাপ করতে পারেন, মহাকাশ নিয়া আলাপ করতে পারেন। হয়তো সে এসবের কিছুই বুঝে না। আপনি একাই তাঁর সাথে অনর্গল কথা বলে সময় অতিবাহিত করতে পারবেন। সে হয়তো কখনো কোনো কারন ছাড়াই কেদে দেবে, কখনো সে চার হাত পা নেড়ে নেড়ে কি জানি ভাব প্রকাশ করবে যার সাথে আপনার বিষয়বস্তুর কোনো মিল নাই, অথচ আপনি খুব ভালো সময় কাটাচ্ছেন। এই নবজাতক এক মাসের বাচ্চাটাও আপনার খুব ভালো সংগি হয়তো। এই অনুভুতি কি বুঝেন? আর এখানেই মানুষের সুখ এবং সাথীর সাথে আপনার চিরবন্ধন। এই বন্ধন থেকে আপনি কখনোই টাকার বিনিময়ে, সম্পদের বিনিময়ে, কিংবা আপনার সামাজিক উচ্চতার মাপকাঠিতে মুক্ত হতে পারবেন না। যতো বিপদই আসুক, যতো খারাপ সময়ই আসুক, এই বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায় না।

কি অবাক করার মতো কথা মুক্তার সাহেবের। ফেলে দেয়া একেবারেই অসম্ভব। যদিও মুক্তার সাহেবের এই যুক্তি বুঝতে আমার বেশ অনেক সময় লেগেছিলো। কিন্তু তার উপলব্ধিটা তো ঠিক। হয়তো আমি আমার ছোট এই মস্তিষ্কে ব্যাপারটা তখনো ধারন করে উঠতে পারি নাই। কিন্তু যখন তিনি তার কাহিনিটার প্রায় শেষে, তখন আমার কাছে ব্যাপারটা কিছুটা যেনো ঝাপসার মধ্যে হালকা পরিষ্কার হয়েছিলো। কারন মুক্তার সাহেব খুব সুক্ষভাবে বলছিলেন-

-যখন কোনো মানুষের দুঃখ থাকে, কষ্ট থাকে, অথবা থাকে ভিতরের কিছু কথা যা বলার জন্য মন ছটফট করে, তাহলে সে সবসময়ই চাইবে যে, সে অন্য কারো সাথে তার এই দুঃখটা, কষ্টটা, কিংবা অনুভুতিটা শেয়ার করতে। কেউ তো থাকবে যে, ওর কথা শুনবে। বুঝুক বা না বুঝুক সেটা আলাদা ব্যাপার, কষ্ট লাঘব করুক বা না করুক সেটাও আলাদা ব্যাপার। কিন্তু কারো সাথে তো তার এই ব্যাপারগুলি শেয়ার করা দরকার। যখন এই লোকগুলি তার কাছে বসে তাকে আর সময় না দেয়, কিংবা যদি এমন হয় যে, তার এই ব্যাপারগুলি সে কারো কাছে আর শেয়ার করতে পারলোই না, তখনই সে অনুভব করে, সে একা। আর এই একাকিত্ত মানুষটাকে ‘সময়’ নামক দানব বা বাহক ধীরে ধীরে সবার থেকে আলাদা করে এমন এক জায়গায় নিয়ে যায়, যেখানে সে খোজে কে আছে তার এই আবেগগুলি শোনার? আর যে শুনবে, তারই জিত, আর যারা শুনবে না, তারাই আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় এই মানুষটার গন্ডি থেকে। সে যেই হোক, হোক তার স্ত্রী, হোক তার প্রানের সন্তান অথবা প্রিয় বন্ধুবান্ধব। অন্যদিকে, আরেকদল, যারা এই সুযোগ লুফে নেয়, সে যতোই অশিক্ষিত হোক বা অসুন্দর, কিংবা তুলনামুলকভাবে নিম্নধাপের, তাতেও কিছুই যায় আসে না, তারাই হয়ে উঠে তার মনের মানুষ, কাছের মানুষ। আর তাই বারবার তার এই একাকিত্তে ভোগা মন ছুটে যায় তাদের কাছে যারা তাকে সময় দেয়, দেয় একটা কম্প্যানিয়ন। আর সেই কম্পেনিয়নের মানুষদের মধ্যে যদি জেন্ডারের পার্থক্য থাকে, তখনই সেটাকে আমরা তৃতীয় নয়নে বলি ‘পরকীয়া’। পরকীয়া মানে শুধু শারিরীক কিছু না। পরকীয়াতে আরো অনেক কিছু থাকে যা অনেক মুল্যবান কিন্তু আমরা একটা শব্দেই তাকে নোংরা করে ফেলি।

মুক্তার সাহেবের লজিক অত্যান্ত ধারালো। মানি বা না মানি, তাকে অগ্রাহ্য করার মতো উলটা লজিক আমার কাছে ছিলো না। তবুও আমি মুক্তার সাহেবকে প্রশ্ন করলাম, তাহলে কি এমন একাকিত্তে আপনি ভোগছিলেন যেখানে শেষ অবধি মনে হলো যে, এই ৩৩ বছর একসাথে থেকেও আপনি আসমানীর থেকে একা? অথবা কি এমন কারন ছিলো যা আপনাকে সবার থেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিয়েছে এই সাজানো সংসার, পাতানো সুখী জীবন থেকে?

মুক্তার সাহেব আবারো মুচকী হেসে বললেন,

-কই নাতো? আমি তো এই সাজানো সংসার বা পাতানো জীবন থেকে সরে যাইনি। ওই যে আপনাকে আগেই বলেছিলাম যে, বলীর সব পাঠা সবসময় বিষাক্ত হয় না। আর যদি হয়ও, আর যদি পাঠাটাকে বলী দিতে গেলে অনেক বিপদের কিংবা অনেক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তাহলে সেই পাঠা বিষাক্ত হলেও তাকে কোনো না কোনোভাবে পুনরায় শুদ্ধ করে ঝলমলে পরিপাটি খাবারের টেবিলেই পরিবেশন করা হয়ই। আমিও ঠিক সেরকম ঝলমলে টেবিলেই এখনো আছি। তবে এই ‘আছি’র মধ্যে অনেক অংশ জুড়ে আছে  আসলেই ‘নাই’ আর অনেক অংশ জুড়ে আছে কিছু দায়িত্তবোধে। আমি ‘আছি’ আর আমি ‘দায়িত্তে আছি’ এই দুয়ের মধ্যে ফারাক বুঝেন? বিস্তর ফারাক। জেলখানায় বন্দি কয়েদির পাশে জেলখানায় বন্দি নয় এমন কোন এক মানুষ যখন বলে, ‘আমি আছি’ তোমার পাশে, এর মানে কি, সেটা তো আপনি নিশ্চয় বুঝেন। এর মানে, কখন তার কি করলে এই জেলখানা থেকে কয়েদির মুক্তি মিলবে তার একটা প্রতিশ্রুতি, অথবা অসুস্থ হলে দূরপাল্লা পথ অতিক্রম করে সে তখন চোখে জলভরা চাহনীতে আপনাকে দেখতে আসবে তার একটা নিশ্চয়তা, আপনার কষ্টে সে ব্যাথিত হবে, আপনাকে সে প্রতিনিয়ত মিস করবে ইত্যাদি। অথবা জেলখানায় বন্দি থাকা অবস্থায় সে আপনার একাকিত্তকে মিস করবে ইত্যাদি। কিন্তু সেই প্রহরী যে কয়েদির দায়িত্তে আছে, সেও কিন্তু কয়েদির পাশেই থাকে। কিন্তু তাঁর ভুমিকা নিশ্চয় এক নয়। কয়েদির দায়িত্তে থাকা প্রহরীর কাজ যেনো কোনোভাবেই এই বন্দিদশা থেকে কয়েদি পালাতে না পারেন, এটাই তার প্রথম দায়িত্ত।  কাছে থাকা আর দায়িত্তে থাকা কখনোই এক নয়। আমার কাজ যেনো সেই দায়িত্ত যাতে আমার এই সাজানো সংসার ভেংগে না যায়, আমার দায়িত্ত সেটা যাতে আমার অন্তত এই জীবদ্দশায় আমার আসমানীর জীবনে কোনো কষ্ট না আসে, আমার সন্তানের কোনো বিপর্জয় না আসে।

মুক্তার সাহেব আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা আগে দিলেন। তারপর তিনি শুরু করলেন আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর। আমি তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি বাক্য এতো তন্ময় হয়ে শুনছিলাম যে, মনে হচ্ছিলো আমি কোনো ফিলোসোফির ক্লাশে উচ্চমানের কোনো তত্তকথা শুনছি। বারবার মনে হচ্ছিলো, মুক্তার সাহেব জীবনকে যেভাবে দেখেন, আমরা হয়তো এর বাইরের প্রাঙ্গণ থেকে দেখি। আমরা যখন অন্দর মহলের আগরবাতির গন্ধটা আনন্দ করি, তখন মুক্তার সাহেব এই আগরের গন্ধের সাথে সাথে আগরের জ্বলে পড়ে ছাই হবার কষ্টটাও দেখেন। আমরা সাধারনভবে যাকে প্রকৃতি বা ন্যাচার বলি, মুক্তার সাহেব এটাকে শুধু ন্যাচার বলে ঘটনাপ্রবাহ এড়িয়ে যান না। তিনি এর অন্তরনিহিত কারনগুলি খোজেন। আর সেই কারনের মধ্যেই যেনো আসল রুপ আর ঘটনা ঘটার সবগুলি উপাদান খুজে পান।

বাইরে কিছুটা সূর্যের আলো কমে আসছিলো। বাতাসের গরম আবহাওয়াতা যেনো ধীরে ধীরে কমে এসছে। কাজের বুয়া আবারো একবার কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করতে এলো। মুক্তার সাহেব, বিকালের নাস্তা দিতে বললেন। তারপর আবার তার কথায় ফিরে এলেন।

-জীবন একটাই। আজ থেকে শতবর্ষ আগে সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী মমতাজের জন্য যখন তাজমহল তৈরী করেন, তার ওই তাজমহল কতটা ভালোবাসা প্রকাশ করেছে সেটা জানার চেয়ে আমরা কি কখনো এভাবে ভেবে দেখেছি যে, সম্রাট কতোটা কষ্ট থেকে এই তাজমহল বানিয়েছেন? তাজমহলের ইমারতে কি সেই কষ্ট আমরা দেখতে পাই? আমরা যা দেখি, তা হচ্ছে শাহজাহানের ভালোবাসার নিদর্সন। যা দেখতে পাই, তা হচ্ছে মুল্যবান রত্নে খচিত একটা দামী প্যালেস। কিন্তু আমি যদি বলি এটা সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসার মৃত্যুর নিদর্সন? তাহলে কি ভুল হবে? যদি বলি এটা ভালোবাসার কষ্ট থেকে নির্বাসিত একাকি এক রাজার মনের কষ্টের আকুতি বা অনুভুতি? তাহলে কি ভুল কিছু বলা হবে? হয়তো দুটুই ঠিক। এখন আমার অনেকগুলি প্রশ্ন জাগে, সম্রাট শাহজাহানের ২য় স্ত্রী ছিলেন এই আরজুমান্দ বানু বেগম ওরফে মমতাজ। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন কান্দাহারী বেগম। রানী মমতাজ ছাড়াও সম্রাটের জীবনে আরো আটজন রানী এসেছিলো। তাহলে সম্রাট শাহজাহান শুধুমাত্র মমতাজের জন্যই এতোবড় একটা বিশ্বনন্দিত মহল তৈরী করলেন কেনো? আর কারো জন্যে নয় কেনো? এর অন্তর্নিহিত অনুভুতি হয়তো শুধু জানেন শাহজাহান নিজে। আমার মাঝে মাঝে এরকম প্রশ্নও জাগে যে, এতো বড় বড় নাম যাদের, তারা কেনো একটিমাত্র নারীকে নিয়ে জীবনে সুখী হতে পারলেন না? শারীরিক চাহিদার কথা যদি বলি, তাহলে এক নারী কি দেয় না যা অন্য নারী দেয়? এর মানে হয়তো শারীরিক চাহিদাই সেখানে মুখ্য নয়। তাদের তো কোনো টাকা পয়সা, ধনদৌলত মান-ইজ্জত, প্রতিপত্তি, ক্ষমতার দাপট কোনো কমতি ছিলো না। তাহলে আবারো আমার ওই যে সেই আগের কথা ফিরে আসতে হয়। শুধু টাকা পয়সা, ধনদৌলত মান-ইজ্জর সম্মান প্রতিপত্তিই সুখী বা খুসী জীবনের একমাত্র ভিত্তিপ্রস্তর নয়। এর বাইরেও কিছু আছে যা যুগে যুগে কারো কারো ক্ষেত্রে প্রমানিত হয়েছে আর বেশীরভাগ মানুষের জীবনে তা প্রমানিত হয়ই নাই।

-আরেকটা ছোট তত্ত আমাদের সবার জানা থাকা দরকার যে, মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে অনেক কিছুই মেনে যায়। আর সেই মেনে যাওয়া আর মেনে নেয়ার মধ্যেও একটা ফিলোসোফি থাকে। মানুষ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোনো কিছুর আশায় হয়তোবা অনেক কিছুই নিজের মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানিয়ে নেয়। কিন্তু যখন মানুষ সেই আশার সফলতা পেয়ে যায়, যখন সে নিরাপদ দুরুত্তে পৌঁছে যায়, তারমধ্যে তখন ‘আমিত্ত’ কাজ করে। তারমধ্যে তখন বৈতরনি পার হয়ে নিরাপদ জোনে চলে আসায় সে তখন  অনেক কিছুই আর আগের মতো অনুগত নাও থাকতে পারে। তখন ‘মেনে যাওয়া’ বা ‘মেনে নেয়ার’ বাধ্যবাধকতায় সে আর আটকে থাকে না। হয়তো ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটেছে আমার আসমানির মধ্যে। আমি বলছি না যে, সে সীমা অতিক্রান্ত করে আমাকে হেয় করছে অথবা সে আর আগের মতো নাই এমন না। কিন্তু একটা ব্যাপার তো সবার জীবনেই আসে, যার নাম ‘শ্লথ’। এই শ্লথ থেকে শুরু হয় নিয়মের মধ্যে নিয়ম ভাংগার সুক্ষ কিছু কর্ম। অর্থাৎ সময়ের সাথে পিছিয়ে যাওয়া, ডিমান্ডের সাথে ক্যাপাসিটির সমন্নয় না হওয়া। আমরা অনেকেই এটাকে বুঝি না। তখন যে কোনো পক্ষের কাছে এটা মনে হয়, মানুষটা যেনো আর আগের মতো নাই। ‘এই আগের মতো নাই’ ব্যাপারটাকে আমরা অনেকেই ভেবে থাকি তাচ্ছিলোতা। আর এটা যে আসমানীর মধ্যে ছিলো না সেটা ফেলে দেবার মতো নয়। আপনি আবার এটা ভাববেন না যে, আমি আসমানীর বিপক্ষে অভিযোগ তুলছি। না, এটা কখনোই হবে না। আসমানীও একজন মানুষ। তাঁর নিজের একটা জীবন আছে, সকীয়তা আছে, সে দাস নয়। আমি তাকে ক্রয় করে আনি নাই। তাহলে আমি আসলে কি বলতে চাচ্ছি?

-কোনো একদা যে আসমানীকে আমি যাই উপদেশ দিয়েছি, বিনা বাক্যে, বিনা দ্বিধায় সে সেটা বেদবাক্য মনে করে অন্ধবিশ্বাসে গভীর শ্রদ্ধার সাথে পালন করেছে। কখনো কখনো আমি আসমানীকে নিয়ে ভরদুপুরে একই বিছানায় শুয়ে কার্টুন ছবি দেখেও খিলখিল করে হেসেছি। অনেক পয়সা ছিলো না, তারপরেও পাশের কোনো এক অখ্যাত রেষ্টুরেন্টে গিয়ে ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়েও তৃপ্তি পেয়েছি। গাড়ি ছিলো না, রিক্সায় ঘুরে বেড়িয়েছি ঘন্টার পর ঘন্টা। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ পড়তে পড়তে কখন আমি অপূর্ব আর আসমানী লাবন্য হয়ে যেতো বুঝতেই পারতাম না। কিন্তু আজ হাতে প্রচুর পয়সা আছে, গাড়ি আছে, কিন্তু আমি সেই আসমানীকে খুজে পাই না। হয়তো আসমানীও সেই মুক্তার সাহেবকে খুজে পান না। এরমানে এইটা নয় যে, সে আমার কথা শুনে না বা শুনতে চায় না। কিন্তু তারমধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। যখন আমাদের অনেক কিছু ছিল না, তখন একটা রিক্সায় করে মাইলকে মাইল ঘুরেও আমাদের আনন্দ হয়েছে যা এখন এসি গাড়িতেও পাওয়া যায় না। একটা সময় ছিল যখন আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা কি করলে কি হবে, কি করলে আরো ভাল হবে, সেটা নিয়ে কোনো তর্কবিহীন আলাপ আলোচনা শলাপরামর্শ হয়েছে। আজ যেটা করা তো দুরের কথা, আলোচনা করার জন্য পরিবেশও নাই। আমি বলতে চাইলেও তার হয়তো সময় নাই শোনার। এরমানে এই নয় যে, সে আমাকে অগ্রাহ্য করছে। আমি বলতে চাচ্ছি, এটা নিয়ে আর কোনো শলাপরামর্শ হয়না। একটা সময় ছিলো যখন, আমার প্রিয় খাবারগুলিই শুধু টেবিলে শোভা পেতো, যা এখন আমাকে বলেই দিতে হয় হয়ত এটা নয় ওটা খাইলেই মনে হয় ভালো লাগতো। কখনো কখনো ইচ্ছে না থাকলেও তাদের পছন্দের খাবারের তালিকাটাই এখন আমার খাবারের তালিকা করে নিতে হয়। এরমানে এই নয় যে, আমি বললে সেটা তৈরী করা হবে না। কিন্তু আগে এটা বলতে হয় নাই। পরিবর্তন সবখানেই আসে, আমাদের সম্পর্কের মধ্যেও এসছে। আর এটার জন্য অভিযোগ করা বোকামী। সমৃদ্ধ জীবনের চেয়ে অভাবী জীবনে অনেক বেশী প্রেম আর ভালোবাসা থাকে। যদিও সেখানে ঝগড়াও থাকে, তবে সেই ঝগড়াটাও একটা ভালোবাসার অন্য রকমের বহির্প্রকাশ।

আমি অবাক হয়ে মুক্তার সাহেবের কথা শুনছিলাম, তার প্রতিটি কথায় আমি যেনো শীতের প্রথম সকালের ঝির ঝির বাতাসের কেমন একটা কটু অনুভুতি অথবা একটা মিষ্টি  আস্বাদন অনুভব করছিলাম। পাশে পুষ্করিনী তীরের পাড়ে দম নেয়া একটা কোলা ব্যাং যেমন তার সমস্ত ধ্যান ধারনাকে একদিকে পাশ কাটিয়ে সেই আগত শীতের রোদের আস্বাদ নিয়ে চোখ বুঝে থাকে, ঠিক তেমন আমিও যেনো মুক্তার সাহেবের তাঁর অনাগত কাহিনীর মর্মটা আস্বাদন করার নিমিত্তে অনেকটা দম নিয়েই বসেছিলাম। আসলে সব চোখ সব কিছু দেখে না, সব আত্মা সবকিছুর আস্বাদন পায় না। আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে আমাদের চাওয়া পাওয়ার সাথে সময়ে ব্যব্ধানে এমন অনেক কিছু এমন ধীরে ধীরে পালটে যায় যে, পরিবর্তনটা চোখেই পড়ে না অথচ প্রতিদিন পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক দিন অন্তরালে হয়তো আমাদের চোখে এই বিশাল পরিবর্তনটা যখন গুচরে আসে, তখন পিছনে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ থাকে না। সেই পরিবর্তন তখন স্থায়ী রুপ ধারন করে ফেলেছে। এটাই হয়তো প্রকৃতির সবচেয়ে নির্দয় অভ্যাস।

 মুক্তার সাহেব তাঁর কথা বলতে থাকেন-

-জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন আপনি জানেন আপনাকে নিয়ে কেউ আর হৈচৈ করেনা, আগের মতো সর্বত্র আপনার সেই ভূমিকার প্রয়োজন নাই কিংবা আপনি যদি চানও সেখানে আপনার উপস্থিতি বা বক্তব্য আর আগের মতো তেমন জায়গা করে নেয় না তখন আপনার এটা মানতে অবশ্যই কষ্ট হয় যে, আপনার প্রয়োজন হয়তো তাদের কাছে ফুরিয়ে গেছে। আপনি যেনো আছেন শুধুমাত্র কারো কারো বিশেষ প্রয়োজন মিটানোর জন্য। আপনার কখন একটু ছাদে হাওয়া খেতে ভাল লাগবে, সেই হাওয়া খাওয়ার সময় আগে তো একজন আসমানীর সংগ পাওয়া যেতো কিন্তু এখন তার জগত অনেক বিশাল। এখানে আপনিই একমাত্র মানুষ নন যাকে ঘিরে তার দিনের সিংহভাগ সময় ব্যস্ততায় কাটবে। এরমানে আবার এই নয় যে, আসমানি অন্য কাউকে মন দিয়ে বসে আছে। আগে আপনার অনুপস্থিতি হয়তো তাকে একা করে দিতো বটে কিন্তু এখন সেটা সেরকম নয়। কেনো যেনো মনে হয় কি যেনো মিসিং। এখন সম্পর্কটা যেনো একটা ডকুমেন্টের মধ্যে নেমে গেছে। মানসিক টর্চারের মতো মনে হয় কিছু কিছু সময়। অল্পতেই যেনো সবকিছু ঘোলাটে হয়ে যায়। সবাই যেনো কেনো অনেক অস্থির। কাউকেই যেনো কেউ সহ্য করতে পারছেন না। সবার মতামত ভিন্ন, সবাই সঠিক, আপনি একাই সঠিক আর সবাই ঠিক নয় এটা আর এমন না। আর এর ফলে আমার কাছে এটাই মনে হয়েছে যে, দূর্বল সময়টা ওরা সবাই পেরিয়ে গেছে বলেই হয়তো এখন আর আগের মতো সব কিছুতেই বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে এমনটা না। ব্যাপারটা জানি কেমন, সব না মানলেও তো সমস্যা তেমন নাই। উত্তর আর প্রতি-উত্তরের জামানা মনে হয় এখন, যেটা আগে ছিলো না। কম্প্রোমাইজ আর সাইলেন্ট থাকাই যেনো এখন সময়। কিন্তু এটা তো আমি চাইনি? আর এখান থেকেই সম্ভবত শুরু হয়, ‘অনীহা’ নামক একটা অনুভুতি।

-একটা জিনিষ সবসময় কারো মনে রাখা উচিত যে, ভালোবাসার যেমন একটা শক্তি আছে, অনিহারও একটা বিপদ আছে। অনিহার অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইমোশন যখন ধীরে ধীরে বুদবুদের মতো অন্তরে জমা হতে থাকে, একসময় সেটা সারা অন্তর জুড়েই এমনভাবে বিচরন করে যেনো ভালোবাসার বুদবুদের আর কোনো স্থানই থাকে না। অথচ আপনি জানেন, আগের সে ভালোবাসার বুদবুদগুলি তখনো মরে যায় নাই, বেচেই আছে কিন্তু কোনঠাসা হয়ে। তখন এই কোনঠাসা ভালোবাসার অতৃপ্ত বুদবুদগুলি জলবিহিন মাছের মতো অতি অল্প পরিসরে ছটফট করতে করতে একসময় কোনো এক দূর্বল ছিদ্র দিয়ে মনের অজান্তেই বেরিয়ে আসে। যখন এই ভালোবাসার বুদবুদগুলি একসাথে ঝাকেঝাকে বেরিয়ে আসে, তখন সেটা খুজতে থাকে কিছু নিরাপদ আশ্রয়। তার তো কোথাও একটা জায়গা দরকার। আর সেই নিরাপদ আশ্রয় হয়ে দাড়ায় সাবিত্রীর মতো কিছু অসহায় মানুষ যারা একে স্থান দেয় সেই পূর্বেকার আসমানীদের মতো যখন আসমানীরা একসময় দূর্বল ছিলো, সাবলম্বি ছিলো না। সেই স্থানটা তখন দখল করে নেয় সাবিত্রীরা। তখনই ঘটে এক বিপ্লব। যে বিপ্লবের নাম, ওই যে বললাম, ‘আমি আছি’ আর  আমি দায়িত্তে আছি’র মতো বিপ্লবে। কেউ কেউ এসব সাবিত্রীদেরকে ডাকে-নোংরা মেয়ে মানুষ, আর যারা এই নোংরা মেয়ে মানুষদের সাথে সময় কাটায় তাকেই আমাদের সমাজ বলে ‘পরকীয়া’। এবার, আপনিই বলেন, এই অতৃপ্ত আত্তা, এই শুষ্ক হৃদয় কখন কোথায় ভিজে আবার উজ্জিবিত হয় সেটার নির্ধারন করে কে তাহলে?

মুক্তার সাহেবের এহেনো প্রশ্নে আমি যেনো রেডি ছিলাম না। একটু ইতস্তত হয়ে সময় নিয়ে বললাম, তাহলে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, এর জন্য শুধু আসমানীরাই দায়ী? তারা কি এটা জেনে শুনে করছে? নাকি তাদের মধ্যে এই সংশয় নাই বলে সুযোগটা আমরা যারা পুরুষ, তারাই গ্রহন করছি?

-না এটা হয়তো আসমানিদের দোষও নয়, না আমাদের মতো মুক্তার সাহেবদেরও। এটা সময়ের একটা চক্র যখন কোনো মরুভুমি আচমকা কোনো অঝর ধারায় বৃষ্টির জলে সবুজ ঘাসের মাঠে রুপান্তিত হয়। তপ্ত বালিকনায়ও তখন সবুজ ঘাসের জন্ম হয়। প্রকৃতি মনে হয় এরকমই। সাবিত্রীরা আসলে দূর সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপ। আর সেই দ্বীপের চারিধারে যেমন নোনাজল থাকে, থাকে তাঁর সাথে সবুজ গাছরাজীরাও। শাখায় শাখায় পাখীরা কিচির মিচির করে, সন্ধ্যে বেলায় সব শান্ত হয়ে যে যার মতো ঘরে আসে। কখনো বাউল বাতাসে তাদের ঘর ভেংগে যায়, কখনো আচমকা ছিটকে পড়ে অথৈ নদীতে হাবুডুব খেতে থাকে। তখন কোনো এক ঘটনাচক্রে আমার মতো মুক্তার সাহেবেরাও সেই সাবিত্রীর কাছে এসে নির্ঝুপ শান্ত একরাতে চোখের অবশিষ্ট জল ফেলে হয়তো নিদ্রায় নিপতিত হয়। সুখ থাকে কিনা সেটা হয়তো মুখ্য ব্যাপার নয়, কিন্তু নিজকে আবিষ্কার করা যায়, আসলে আমরা কারা, আর কিসের নেশায় আমাদের ছুটে চলা। অথবা কোথায় আমরা কি পাই না।

মুক্তার সাহেব তাঁর চশমাটা খুলে একটু মুছে নিলেন, হয়তোবা তাঁর চোখের কোনে কিছু একটা ঝাপসা মনে হয়েছে। মুক্তার সাহেব অনেক শক্ত মানুষ, অল্পতেই তাঁর চোখ ভিজে আসে না হয়তো কিন্তু কষ্টটা তো কোথাও না কোথাও আছে। এতোক্ষন আমি মুক্তার সাহেবের কথাগুলি খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম। কেনো জানি আমার কাছেও মনে হলো, মুক্তার সাহেব যেনো চোখে আংগুল দিয়ে আমাদের অনেকের জীবনের কথাগুলিই বলে যাচ্ছেন। আমিও তো মাঝে মাঝে খুব একা, মাঝে মাঝে তো আমারো মনে হয়, কি যেনো মিসিং! আমার গিন্নীর সাথে, আমার পরিবারের সাথে, আমার অন্য সব সম্পর্কগুলির সাথেও তো আমি এ রকম একটা অনুভুতি পেয়েছি যেখানে আমিও মনে করেছি, আমার প্রয়োজন হয়তো ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে, আমি কারো কারো মনের বাসনা আর আগের মতো সফল করতে পারছি না। আমার হয়তো সাবিত্রি নাই, কিন্তু আমার তো কেহই নাই। কোথাও আমি মুক্তার সাহেবের অপরাধ হয়েছে বলে ধরতে পারছিনা। আবার এটাও মানা যায় না যে, কেনো এতো বছর পর আসমানিরা বদলে যায় কিংবা মুক্তার সাহেবেরা ছিটকে পড়ে যায় আরো একটা আসমানীর কাছে যাদের নাম সাবিত্রী। কেউ চলে যাবার পর হয়তো কিছু পরিবর্তন নজরে আসে। বিশ্বাস আর ভরষার যখন মৃত্যু হয়, তখন শারীরিক দুরুত্ত অনেকগুন বেড়ে যায়। আর এই দুরুত্ত বাড়ার সাথে সাথে তখন ‘সময়’ নতুন সম্পর্ক তৈরী করে। কষ্টের সময় যারা থাকে, তারাই তখন নিজের ফ্যামিলি হয়ে যায়। এই সময় ইচ্ছা থাকুক আর নাইবা থাকুক, অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। মুক্তার সাহেবদেরকে যখন শত ব্যর্থতার কারনেও আসমানীরা ছাড়তে চায় না, তখন হয়তো মেনে নেয় আসমানীরাও, আবার আসমানীরা আছে, এটা জেনেও মেনে নেয় সাবিত্রীরাও। মেনে নিতে শিখতে হয়। বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ দুজন মানুষের মধ্যে যখন ভালোবাসার এই অপুর্নতার সৃষ্টি হয়, তখন কোনো একজন তার কাংখিত সুখ কিংবা একাকিত্ত কাটানোর জন্য সেই সম্পর্কের বাইরে যেতেই পারে। এটা কারো নিজের ইচ্ছায় যে সবসময় হয় তাও না। আর যখনই পা একবার বাইরে ছুটে, তখন, তাকে আর বিয়ে নামক অলিখিত বায়বীয় সম্পর্কটা শক্ত ভীত তৈরী করতে সক্ষম হয় না। প্রবল স্রোতে তীরভাংগা পাড়ের মতো প্রতিটা ক্ষনে এর ভাংগনের শব্দ পাওয়া যায়। আর যখন এই ভাংগা একবার শুরু হয় তখন চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। হয় তাকে মুক্ত করে দিতে হয়, আর তা না হলে মেনেই নিতে হয়। কাউকে জোর করে কিছুক্ষনের জন্য হয়তো চুপ করিয়ে রাখা যেতে পারে কিন্তু সত্য বেশীদিন লুকিয়ে রাখা যায় না। ফলে একদিকে যেমন আসমানীরা তাদের অধিকার ছেড়ে দিতে চায় না, আবার অন্যদিকে  মুক্তার সাহেবদের ধরেও রাখা যায় না। অগাধ সম্পত্তির বিবেচনায় একটা কথা ঠিক যে, পৃথিবীতে এমন কিছু সম্পর্ক আছে যা সব সম্পত্তির থেকেও বড়। আর সে সম্পর্কটা হচ্ছে অনুভুতির সম্পর্ক। আর মুক্তার সাহেবরা হচ্ছেন এমন এক সম্পর্কের নাম, যারা সাফল্যের সিড়ি বেয়ে বেয়ে উপরের তলায় স্থান করে নিয়েছেন। তাদের এই সাফল্যের একটা ফেসভ্যালু থাকায় তাদেরকে সবাই ছেড়েও যেতে চায় না। মুক্তার সাহেবের মতো বলতে গেলে বলতে হয়, সীমা লঙ্ঘন আর সীমা শেষ এক জিনিষ নয়। আসমানি, সাবিত্রী আর মুক্তার সাহেবদের এই ত্রিমাত্রার সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে সিমা লংগন হয়েছে কিন্তু সীমা শেষ হয়ে যায় নাই। তারা সবাই যেনো দুঃখের খাচায় বন্দি। আর এটাই সত্যি। সত্যিটা কখনো কল্পনা হয় না। আর কোনো  কল্পনাকেও সত্যি বলা যায় না। সত্যি কখনো কারো এজেন্ডা হতে পারে না। সত্যি সেটাই যেটা বাস্তব। আসমানী বেগম যেমন বাস্তব, সাবিত্রীও বাস্তব। আর এই দুয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন মুক্তার সাহেব। সেটাও বাস্তব।

মুক্তার সাহেব চশমাটা মুছলেন, আমার দিকে একটু হাস্যোজ্জল নেত্রে তাকিয়ে আরো একটা কাপে কিছু কফি আর আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বলতে লাগলেন,

-একটা জিনিষ কখনো উপলব্ধি করেছেন? আপনি যখন অনেককেই ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন তারা ভালো আছেন, কিন্তু তারা জানেন তাদের সময়টাই ভালো যাচ্ছে না। সত্যি কথাটা বলার জন্যে সাহস থাকলেও সেটা আসলে পুরুপুরি কাউকে যে বুঝাবেন, সেটা মুখের কথায় বুঝানো যায় না। আয়নায় হয়তো আপনি কাউকে চেহারাটা দেখাতে পারবেন, কিন্তু কষ্টটা দেখাবেন কিভাবে? ভিতরের কষ্টটা কাউকে দেখানো যায় না। আর ভিতরটা কেউ দেখেও না, যদিও সত্যিটা ভিতরেই থাকে। সেই কষ্টেভরা সুর শুধু নিজের কান থেকে নিজের অন্তরেই ঘুরাঘুরি করে প্রতিধ্বনি করতে থাকে। অন্য কারো অন্তর কিংবা হৃদয়ে সেটা কোনোভাবেই আপনি পুশ করতে পারবেন না। আসলে একটা কথা আছে-কান্নার আহাজারীতে সুর থাকে না, থাকে বেদনা আর কষ্ট যে কষ্টের কোনো নাম নাই, যে কষ্টের রুপ কাউকে দেখানোও যায় না।

-যেদিন আমি প্রথম আসমানীকে দেখেছিলাম, ঠিক একই রকমভাবে আমি দেখেছিলাম এই সাবিত্রীকে। সাবিত্রীকে আমার খুজে বের করতে হয় নাই। সাবিত্রী ধরনীর ভাসমান এই পৃথিবীর কোন এক অসমতল প্লাটফর্মে একাই দাড়িয়েছিলো। তার কি অতীত কিংবা কি ইতিহাস সেটা আমার জানা ছিলো না। আর আমি জানতেও চাইনি। একটা জিনিষ জানবেন, অনেক সময় এমনটা হয়, কারো মুখ দেখে কারো ভিতরের যন্ত্রনাকে উপলব্দি করতে পারবেন আপনি হয়তো। তখন কারো হয়তো মন চাইবে যে, তার কাছে যেতে, তার মনের কথা জানতে, কিন্তু আমাদের সমাজটা এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যেখানে সচেতন মানুষের মন বলে উঠে ‘মাথা ঘামিও না, যদি কোনো সমস্যায় পড়তে হয়!! যদি বিপদে জড়িয়ে পড়ো?’ এই উপলব্ধিটা হয়তো সবাই করে। সবার মনকেই হয়তো ছুয়ে যায়। কেউ কেউ এগিয়ে আসেই না, আবার কেউ কেউ বিপদ জেনেও ঝাপিয়ে পড়ে। পাখীদের বেলায় কিংবা অন্য কোনো প্রানীদের বেলায় এটা কতটুকু, সেটা আমরা না কখনো ভেবে দেখেছি, না কখনো উপলব্ধি করেছি। ওরা দিনের শুরুতে আহারের খোজে বেরিয়ে যায়, পেট ভরে গেলে কোনো এক গাছের ঢালে বা পাহাড়ের কোনো এক ছোট সুড়ঙ্গে রাত কাটিয়ে দেয়। তাদের অট্টালিকার দরকার পড়ে না, ওরা কেউ কারো শত্রুতা করে না, কোনো পর্বনে বিশেষ কোনো কিছুর আয়োজনেরও দরকার মনে করেনা। কবে ছুটির দিন, কবে ঈদের দিন কিংবা করে কোন মহাযুদ্ধ লেগেছিলো সে খবরেও ওদের কিছুই যায় আসে না। ওদেরও সন্তান হয়, ওরাও দলবেধে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যায়, ওদের কোনো ভিসা বা ইমিগ্রেশনেরও দরকার পড়ে না। টেরিটোরিয়াল বাউন্ডারী ওদের জন্য কোনোদিন দরকার পড়ে নাই, আগামীতেও দরকার পড়বে না। ওরাও কষ্টে কিছুক্ষন হয়তো ঘেউ ঘেউ করে, কিংবা চিন্তিত হয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে চলে যায়, কিন্তু তাকে আকড়ে ধরে বসে থাকে না। ওদের সারাদিনের কর্মকান্ডের জন্য না কারো কাছে জবাব্দিহি করতে হয়, না কারো কাছে ধর্না দিতে হয়, এমনকি ওরা ঈশ্বরের কাছেও তাদের অপকর্মের কিংবা ভালোকর্মের কোনো জবাব্দিহিতা করতে হয় বলে মনে হয় না। কোনো ট্যাক্স ফাইল নাই, কোনো ভ্যাট ফাইল নাই, না আছে কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স, না দরকার তাদের গাড়িঘোড়ার। তাহলে তো ওরাই আসলে শান্তিতে থাকে, মানুষের থেকে অধিক। পশুপাখীরা ওদের জীবনের ব্যর্থতা কিংবা সফলতার ডেবিট-ক্রেডিট করে না। কিন্তু মানুষের বেলায় এটা একেবারেই প্রজোয্য নয়। তাদের বিপদে কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হয়, কারো না কারো সাহাজ্য লাগে। যখন বিপদের এমন মূহুর্তে সে সেটাই পায় যেটা সে মুহুর্তেই দরকার, হয়তো তাতেই তাঁর জীবনটা ঘুরে যায় অন্যদিকে। যখন পায় না, তখন হয়তো আরো অতল গহব্বরে তলিয়ে একেবারেই হারিয়ে যায়।

-সাবিত্রীকে সেদিন দেখে এটাই আমার মনে হয়েছিলো-জীবনের সাথে তাঁর বোঝাপড়ায় সে ব্যর্থ হয়েছে। অদ্ভুদ মায়াবী এক অপলক নেত্রে সে দাড়িয়েছিলো, পরে লক্ষ্য করেছিলাম, ওর মা ওর সাথেই ছিলো ভাষাহীন এক মুর্তির মতো, হয়তো শুধু সঙ্গ দেয়ার জন্যই। এই এমন একটা পরিস্থিতিতে আমার আর সাবিত্রীর মাঝখানে বয়ে যাচ্ছিলো নাম না জানা একটা কৌতূহল। আমি সাবিত্রীর কাছে গিয়ে এমনভাবে দাড়িয়েছিলাম যেনো আমি তার অনেক চেনা একজন মানুষ। সাবিত্রী হয়তো আশাই করে নাই আমার হাত বাড়িয়ে দেবার ব্যাপারটা। মনুষ্যত্তের অবনমন যেমন আছে, মনুষত্যের উত্তোরনও তেমন আছে। সন্দেহের বশে অসুবিধায় রয়েছে এমন মানুষকে দেখে কোনো প্রশ্ন করা মোটেই অহেতুক হস্তক্ষেপ নয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেসব সচেতন মানুষ সামাজিক লাঞ্ছনার ভয়ে সেই কষ্টে থাকা মানুষের পাশে দাড়াতে ভয় পায়। কিন্তু আমি সেটা করতে পারিনি। অসহায় নির্লিপ্ত আমার থেকেও প্রায় ৩০ বছরের ছোট এই সাবিত্রীকে আমি সমাজের ভয়ে একা ছেড়ে দেইনি। তার কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, তার মুখে লুকিয়ে থাকা কষ্টের কথা অথবা তার সাথে ঘটে যাওয়া কোনো অত্যাচার কিংবা লাঞ্ছনার কোনো লুকানো কাহিনীর কথা। আর সেখান থেকেই শুরু হয় আমাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কের অদৃশ্য বন্ধন। আসমানীর সাথে আমার প্রথম পরিচয়ে আমরা ছিলাম শান্ত দীঘির মতো। অনেক দূরের পথের সংগীর মতো। ধীরে হাটলে অসুবিধা নাই। কিন্তু সাবিত্রির সাথে আমার প্রথম পরিচয়ে আমি ছিলাম অশান্ত। মনে হয়েছিল, সময়টা দ্রুত কোথায় যেনো ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমাকে দ্রুত চলতে হবে। আমি ওকে সেই অবহেলিত বিকালে একা ছেড়ে আসতে পারিনি। প্রতিবারই মনে হয়েছে, জলস্রোতের পাশে দাঁড়িয়ে জলের গতিকে আমি থামাতে পারবো না কিন্তু এই খরস্রোতা জলের ধারা থেকে অন্তর কাউকে একটু দূরে সরিয়ে কিছুটা নিরাপদ আশ্রয়ে তো নিতেই পারি। আর সেখানেই ছিলো আমার আর সাবিত্রীর মধ্যে একটা প্রাথমিক দেনা। আর এই দেনার পরিষধ যে এক সময় এতো বট পাওনায় আমাকে পরিশোধ করবে সাবিত্রি আমি সেটা সেদিনের পড়ন্ত বিকেলে কখনোই বুঝতে পারিনি। আমি আমার একাকীত্তকে হয়তো কিছুটা হলেও লাঘব করতে পেরেছি। তাঁর কাছে আমি নিছক মুক্তার সাহেব নই, আমি হয়তো তাঁর কাছে এমন  একজন যাকে আপনি বলতে পারেন-‘অলিখিত ভগবান’।

মুক্তার সাহেবের কথা শুনতে শুনতে আমি যেনো ফিলসোফির ক্লাসের কোনো লেকচার কিংবা রহস্যে ঘেরা জীবনের চর্চাবিহীন কোনো অধ্যায়ের যুক্তিতর্কের তত্ত শুনছিলাম এটাই মনে হচ্ছিলো। মাঝে মাঝে তিনি এমন কিছু কথা বলছিলেন, যার সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত নই কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতাও ছিলো না আমার। আমরা ঈশ্বরের কথা বলি, ভগবানের কথা বলি। কিন্তু কে সেই ঈশ্বর কিংবা ভগবান তাকে আমরা কখনো দেখি না। কিন্তু মনেপ্রানে এ বিশ্বাস থেকে প্রতিনিয়ত আমরা আমাদের সমস্যার কথা, আমাদের আবেগের কথা গোপন প্রার্থনার সাথে তাঁর কাছে বলে হয়তো মনের ভিতরের কষ্ট বেদনা দূর করার চেষ্টা করি। কিন্তু সবসময় কি তা আসলেই লাঘব হয়? দূর্বলই হোক কিংবা সবল, আমরা আমাদের ভাবাবেগের সবউত্তর যখন পাই না, তখন সেই ঈশ্বর কিংবা ভগবানের কাছে সমর্পন ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না জেনেও সেই ঈশ্বরের কাছেই আবার ফেরত আসি। এটা একটা সাইকোলজি। আমরা অনেক কিছু মেনে নেই কিংবা মেনে নিতে হয়। হয়তো সবাই সেটা মেনে নেয় না। মুক্তার সাহেবের বেলায় ব্যাপারটা কোন স্তরের তা নিরুপন করা কঠিন। তিনি যেমন ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন, তেমনি বিশ্বাস করেন মানুষ ঈশ্বরের একটা হাতিয়ার।

অলিখিত ভগবান? এটার ব্যাখ্যা কি? আমি মুক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমার এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি কথা চালিয়ে গেলেন।

-কিছু কিছু সময় আসে মানুষের জীবনে, যখন সবকিছু হাতের কাছে থাকলেও মনের অজান্তে মনে একটা না পাওয়ার আক্ষেপ তৈরী হয়। কি চেয়েছি, আর কি চাইনি, বা কি পেয়েছি আর কি পাইনি এই দুয়ের মধ্যে একটা টানাপোড়েন তৈরী হয়। এই টানাপোড়েন আসলে একটা হতাশা। কিন্তু যিনি বাস্তববাদী, যিনি ঈশ্বর বিশ্বাসী, তিনি এই টানাপোড়েনের ব্যাপারটা সমাধান করেন অন্যভাবে। তিনি ভাবেন-ভগবান মানুষের জন্য প্রতিটি দিন একই রকম করে পরিকল্পনা করেন না। আজ যে রবিবার আপনি হাসছেন, আগামী রবিবার আপনি নাও হাসতে পারেন, হয়তো সেদিন চোখের জলে প্রতিটি মুহুর্ত ভরে থাকবে আপনার। এই সপ্তাহটা হয়তো আপনার জন্য ভয়ানক অস্থির যাচ্ছে, কে জানে আগামী সপ্তাহটা হয়তো হবে একেবারেই সুন্দর ঝরঝরা। তাই হতাশ হবার কোনো কারন নাই। প্রতিটি ঝড় কিংবা বিপদের মাঝেও কিছু না কিছু সুসংবাদ থাকে, কিছু না কিছু ভালো জিনিষ আসে। একটা মৃত ঘড়ির দিকে তাকান, দেখবেন নষ্ট ঘড়িটাও দিনে দুবার একদম সঠিক সময় প্রকাশ করে। অপরিষ্কার জল খাবারের অনুপোযোগী হলেও সেটা আগুন নেভানোর কাজে লাগে। বোবা কিংবা বোকা বন্ধুও আপনার অন্ধ জীবনে রাস্তা দেখিয়ে দিতে পারে। এ রকম আরো অনেক বিকল্প উপায়ে মানুষ হতাশার অন্ধকার থেকে বাচার জন্য সঠিক ঘাটের সন্ধান করেন। যখন তিনি সেখানেও ব্যর্থ হন, তখন তিনি স্থাপিত হন সেই ঘাটে যার আরেক নাম ‘তৃতীয় নদীর ঘাট’। কখনো কি এই “তৃতীয় নদীর ঘাটের” কথা শুনেছেন?

না, আমি তৃতীয় নদীর ঘাটের কথা কখনো শুনিনি। অনেক উপন্যাসে কিংবা সাহিত্যিকরা ‘নদীর তৃতীয় ঘাটে” এর কথা সিম্বলিক হিসাবে কোথাও কোথাও ব্যবহার করেছেন সেটা আমি শুনেছি। তাও আমি ভালোমত এর ব্যাখ্যা দিতে পারবো না। তবে, তৃতীয় নদীর ঘাটের কথাটা আজই আমি প্রথম আপনার কাছে শুনলাম। আমি জানি না এর দ্বারা আপ্নিইবা কি বুঝাতে চেয়েছেন।

আমি বোকার মতো মুক্তার সাহেবকে বললাম, জানেন মুক্তার সাহেব, আমি আপানার কেসটায় না এলে অনেক কথাই বুঝতে এবং জানতে পারতাম না। জীবনে অনেক সাইকোলজিক্যাল কিংবা ফিলোসোফিক্যাল ধারনা আছে যা মানুষের জীবনকে অনেকভাবে প্রভাবিত করে। এটা এতোদিন আমি বইয়ে বা গল্পে শুনেছি, কিন্তু আজকে আমি আপনার সাথে কথা বলে এমন কিছু ব্যাপার খুব কাছ থে উপলব্ধি করতে পারছি, যা আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে অনেকভাবেই প্রভাবিত করে কিন্তু আমরা বুঝি না কিভাবে করে।

সন্ধ্যা নেমে এসছে ইতিমধ্যে। কাজের বুয়া আমাদের রুমের বাতিগুলি জালিয়ে দিয়ে গেলেন। সাথে সন্ধ্যার কিছু নাস্তা। কিছু পাকুড়া ভাজার সাথে ছোলাভুনা আর সদ্য গরম কিছু জিলাপী। পাশেই কফির একটা কেটলী রেখে গেলো।

মুক্তার সাহেব সম্ভবত একটি এলশেশিয়ান কুকুর পালেন। এতোক্ষন পর আমি একটা বিদেশী কুকুরের ঘেউ ঘেউ এর আওয়াজ শুনলাম।

-আসলে আমি প্রতিদিন আমার কুকুরকে নিয়ে বাইরে একটু হাটতে বেরোই। আজ আর যাওয়া হয় নাই। কুকুর নিজেও জানে এখন তাকে নিয়ে বাইরে বেরোবার কথা। হয়তো দেরী হয়ে যাচ্ছে বিধায় কুকুর নিজেই তার মালিককে আওয়াজ দিলো। বড্ড পোষ্মানা একটি কুকুর।

-যাই হোক, যেটা বলছিলাম। ঘাটের কথা।

-মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম হচ্ছে সে প্রতিনিয়ত একটা সঠিক ঘাটের সন্ধ্যান করে। মেয়েরা বিয়ের ব্যাপারে সঠিক পাত্র, ছেলেরা সঠিক পরিবার এবং নিজের পছন্দের পাত্রি, বয়ষ্করা নিজেদের মতো পরিবেশ আর বন্ধু, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ। এসবই এক প্রকারের ঘাট। যতোক্ষন আপনি সঠিক ঘাটের সন্ধান না পাবেন, ততোক্ষন পর্যন্ত আপনি উদ্দেশ্যহীন একজন মাঝি। নৌকা আছে, বৈঠা আছে, আর সেই নৌকা চলার জন্য পর্যাপ্ত নদীও আছে, কিন্তু আপনি ঘাট খুজে পাচ্ছেন না। যতোক্ষন আপনি আপনার মনের মতো সঠিক ঘাট খুজে না পাবেন, তখন মন ছুটে যায় এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে। এই সাবিত্রীর মতো। নিজের মনের মতো করে কেউ যখন কোনো ঘাটের সন্ধান পায়, তখন মন আর অন্য কোনো ঘাটে ফিরে আসতে চায় না। পুরানো ঘাটে ফিরে আসা আর সেই পুরানো ঘাটে নোঙ্গর করার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। হতে পারে আপনি যে ঘাটকে সঠিক ঘাট ভাবছেন, সেটাও ভুল। হতে পারে, সেই ভুলঘাটও আপনাকে ভুলপথে নিয়ে যেতে পারে। এই ভুলঘাট সবসময় একটা বিপদের সংকেত দেয়, কারন কেউ যখন একবার ভুলঘাটে তাঁর মন নোঙ্গর করে, সেখান থেকে হয়তো ফিরে আসার রাস্তাই আর তার জানা থাকে না। রাস্তাটা একেবারেই অচেনা মনে হয়।

-মজার ব্যাপার কি জানেন? অচেনা রাস্তায় অচেনা মানুষের কাছে আপনার চোখের জলের কোনো মুল্য নাই। আর মুল্যহীন জীবনে স্বপ্ন তো দূরের কথা বেচে থাকাই দূরুহ। কষ্ট থেকে বেরিয়ে যাবার তরে আরেক অচেনা দূরুহ রাস্তায় যখন মানুষ বেদনা নিয়ে বেচে থাকে, তখন সে জীবনের প্রতি মায়া হারিয়ে ফেলে, ভগবানের উপর সে আস্থা হারিয়ে ফেলে। ঈশ্বর আছে এটাই তখন আর বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু সময় এমন এক জিনিষ, সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু পালটায়। তবে আপাতদৃষ্টিতে বিবেচিত সঠিক ঘাটেই যেনো সেই মনের সুখ আর শান্তি বিরাজ করে, এটা ভেবেই মানুষ দ্বিতীয়বার নোঙ্গর করে। সাবিত্রীর সাথে আমার দেখা হবার পর, আমার কাছে সাবিত্রীকে আমার একটা বিকল্প ঘাটের সন্ধান বলেই মনে হয়েছিলো। এটা হয়তো সাবিত্রীর বেলাতেও একই উপলব্ধি। ঠিক, বেঠিক, ন্যায়, অন্যায় ইত্যাদির ব্যাপারে আমি কোনো প্রশ্ন করতে চাইনি। হতে পারে সাবিত্রীর কাছেও আমার ঘাটটাই সঠিক বলে মনে হয়েছে। আমরা দুজনেই জানি-এই ঘাটে আরো অনেক সম্পর্ক জড়িত কিন্তু সেই সম্পর্কগুলি যেনো পুরানো সুতায় সব পেচিয়ে দিশেহারা হয়ে আছে। তা দিয়ে আর নতুন জাল বুনানো সম্ভব নয়। আবার যে এলোপাতাড়ি বুনন আছে সেটাও চিরতরে ধংশ করা সম্ভব নয়। এই সম্ভব আর অসম্ভবের মধ্যেই যেনো নতুন আরেকটি বুনন বেধে গিয়েছিলো আমার আর সাবিত্রীর।

মুক্তার সাহেব একটু থামলেন। আরেকটা সিগারেট ধরালেন। নাস্তাটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন, নিজেও নিলেন। মুক্তার সাহেব একবার পাকুড়ায় কামড় দিচ্ছেন, সাথে সিগারেট ও ফুকছেন। যেনো সিগারেটের ধুয়াটাও একটা রেসিপি। বাইরে গাছের ঢালে কয়েকটা পাখী কিচির মিচির করছে। কুকুরটা তখনো থেমে থেমে ঘেঊ ঘেঊ করছে। মুক্তার সাহের উঠে গেলেন তার কুকুরের কাছে। সাথে কয়েকটা জিলাপিও নিলেন। কয়েকমিনিট পর যখন মুক্তার সাহেব ফিরে এলেন, দেখা গেলো, কুকুরটা আর কোনো ঘেউ ঘেউ করছিলো না। মুক্তার সাহেব কি কথা বললেন তার কুকুরের সাথে আর তার এক্সেসিয়ান কুকুর কি বুঝলো তারাই শুধু জানে কিন্তু মনে হলো যে বার্তা মুক্তার সাহেব তার কুকুরকে বুঝাতে চেয়েছেন, তার সেই এলসেশিয়ান কুকুর সঠিকভাবেই বুঝেছে। মুক্তার সাহের ফিরে এলেন। আমার মনের ভিতরে ঘুরপাক খাওয়া সেই কথাটার ব্যাপারে জানতে খুব ইচ্ছে করছিলো। ‘অলিখিত ভগবান’ বা  ‘তৃতীয় নদী’। জিজ্ঞেস করলাম, আমরা নদীর তৃতীয় তীরের কথা অনেক সাহিত্যিকের লেখায় পড়েছি। যেমন হুয়াও হুইমারেস রোসার  ‘দি থার্ড ব্যাংক অফ দি রিভার’। কিন্তু তৃতীয় নদীর তীরটা কি? আমি যেনো বোকার মতো একটা প্রশ্ন করেছি এমনভাবে মুক্তার সাহেব একটা অট্টহাসি দিয়ে একমুখ ধোয়া বের করে বললেন-

-হুয়াও হুইমারেস রোসার সেই বিখ্যাত উপন্যাস ‘দি থার্ড ব্যাংক অফ দি রিভার’টা তাহলে পড়েছেন? গল্পটা কি মনে আছে আপনার? যাক, মনে না থাকলেও সমস্যা নেই। আমি পড়েছি। একটু ঝালাই করি তাহলে।

-হুয়াও হুইমারেস রোসা একজন দক্ষিন আমেরিকার বিখ্যাত ছোট গল্পলেখক। এই গল্পে এক পরিবারের খুব দায়িত্বশীল একজন পিতা একদিন একটা ডিঙি নৌকা তৈরি করেন। ছোট ডিঙি। গলুইতে শুধুমাত্র এক চিলতে জায়গা। একজনের বেশি মানুষ সেখানে বসতে পারবেনা। বিশাল এবং সুগভীর একটা নদীর তীরে পরিবারের বসতি। নদীটা এতোই বিশাল এবং প্রশস্ত যে, অন্য তীর দেখাই যায়না। অতঃপর একদিন তিনি নদীপাড়ের বাড়িতে তার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিশাল, সুগভীর নদীতে তার ডিঙি ভাসিয়ে দিলেন। কোন খাবার বা অন্য কোন রসদও সঙ্গে নিলেন না। এমনকি শেষবারের মত পরিবারের কাউকে কোন উপদেশও দেবার চেষ্টা করলেন না। অদ্ভুত ব্যাপার হলো তিনি আর কখনো ফিরেও আসলেন না। কিন্তু আবার কোথাও চলেও গেলেন না। মাঝ–নদী বরাবর অনির্দিষ্টভাবে ঘোরাফেরা করতে লাগলেন। কখনো উজানে। কখনোবা ভাটিতে। কিছু কিছু সময়ে তিনি দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যান। কিন্তু কখনই এমন দূরে নয় যে তার উপস্থিতিটা পরিবারের সদস্যরা অনুভব করতে সক্ষম না। … মৃত্যুই কি নদীর তৃতীয় তীর? এটাই ছিলো তাঁর কথার সারমর্ম। কিন্তু আমি তাঁরসাথে একমত নই। কেনো জানেন?

আমি উত্তরে বললাম, না জানি না। আপনি বলুন।

-আসলে এই তীর কি, কোথায় তার অবস্থান, কিংবা এটা কি এমন কোনো নদী যার তীর সচরাচর গোচরীভুত হয় না, অথচ আছে? অথবা এই নদীর কি আরো তীর আছে যার নাম হয়ত ‘চতুর্থ তীর’? সবুজ গাছ-পালা, আকাবাকা মেঠোপথের শেষপ্রান্তে প্রাকৃতিক বড় সৌন্দর্য পরিবেষ্টিত বিশাল জলাধারের চলমান স্রোতের প্রাবাহমান যদি কোন নদী হয়, সেই নদীর তীর হয়তোবা কখনো এই বিশাল জনরাশির সবার জন্য একই। এখানে সবার রোমাঞ্চ, আশা, বেদনা, সবার কাহিনীর এক মহাপুস্তকের মতো। হয়তোবা এটা কখনো সভ্যতার জীবনধারার বাহকরুপী কোনো সময়ের রাজত্ব হলেও হতে পারে কিংবা কখনো সেই দৃশ্যমান নদী অতীত বর্তমানের সুখ দুঃখের এই বিশ্বভ্রমান্ডের সাক্ষীর ধারকবাহক হলেও হতে পারে। আর সেটাকেই আমরা কখনো নদী, কখনো উপসাগর অথবা কখনো সাগর থেকে মহাসাগরের স্তরে বিন্যাস করে কতোইনা উপমা করে থাকি। এই নদীর স্রষ্টা আছে, এর নিয়ন্ত্রণকারী আছে, আর তার উপর সমগ্র মানবকুল একটা মিশ্র বিশ্বাস নিয়েই কেউ এর স্রষ্টাকে পুজা করে, কেউ তাকে অস্বীকার করে আবার কখনো কখনো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মায়াজালে আশা-নিরাশার ভারদন্ড নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। হয়ত এরই নাম “জীবন”, হয়তবা এরই নাম “সভ্যতা”। এই নদীর কিনারা থেকে পালিয়ে বেড়ানো মানে এই নয় যে, জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো কিংবা সভ্যতা থেকে হারিয়ে যাওয়া। এই বিশ্বভ্রমান্ডের কোথাও না কোথাও আরেক নদীর তীর আছে যেখানে তার কিনারা পাওয়া যায়। সেখানেও নতুন করে সভ্যতা, জীবন এবং নতুন কাহিনীর রচনা হতে পারে এবং হয়।

-কিন্তু সমগ্র বিশ্ব থেকে যখন আমরা মানবকুল সবকিছু ছেড়ে ছোট একটা গন্ডি শুধুমাত্র গুটিকতক আপনজনের পরিসীমায় আবদ্ধ করে একটা মায়াজাল আবিষ্ট করি, তখন দিনের সবকাজ শেষ করে যখন নীড়ে ফিরে এসে হিসাব কষি, তখন সামনে এসে দাঁড়ায় আরেকটি নদী। হয়ত তাঁর নাম “মন-নদী’। এই নদীতে চলমান জলের প্রবাহ নেই, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার নেই, পাহাড় নেই, আকাশ নেই, কিন্তু তারও আছে অনেক তীর। যা কখনো শান্তির মহাখুশিতে জলের ধারা বইয়ে চিকচিক করে জানান দেয়, ‘যা চেয়েছি তাই পেয়েছি’। আবার কখনো কখনো দুঃখের সীমাহীন যন্ত্রনায় সেই একই নদী তার দুই তীর জলের ধারায় শিক্ত করে নীরবে বলে যায়, ‘বড় যন্ত্রনায় আছি’। হয়ত তখন আমরা বলি, দুই নয়নের ধারা। নিজস্ব গন্ডির এই পরিসীমায় এই নদীর একক ধারকবাহক শুধু কিছু আপনজন, নিজে আর ব্যক্তিসত্তার অজানা উপাদানের সব সমীকরন। এখানে ঈশ্বর বাস করেন ক্ষনেক্ষনে, আবার ঈশ্বর উধাওও হয়ে যান ক্ষনেক্ষনে। এখানে ছোট গন্ডির গুটিকতক আপনজনের সার্থকতা, ব্যর্থতা, ভালোবাসা, দায়িত্বশীলতা, নির্ভরতা সবকিছু একেবারেই নিজস্ব। সমগ্র মানবকুলের হিসাব কিতাবের সাথে, সুখ দুঃখের সাথে, চাওয়া পাওয়ার সাথে, লাভ লোকসানের সাথে সব কিছু মিশে থাকে।

-এই নদীতে বাস করে “আমি”, আমার আমিত্ত আর আমার চারিধারের সব আমারত্ত। আর কেউ নেই। এখানে ঈশ্বর আমি, এখানে নিয়মের কোন বালাই নেই। এখানে আকাশের রঙ আমার নিজের মতো করে বানানো, আমার নদীর জল আমার ইচ্ছায় যখন যেভাবে খুশি প্রবাহিত হয়। এখানে আমার ইচ্ছাটাই সব। এখানে আমার ছোট ডিঙ্গী কখনো উজানে, কখনো ভাটিতে, কখনো নিরুদ্দেশে, কখনো জনসম্মুখে, কখনো কাছে কখনো দূরে যেথায় খুশী সেখানে আমার বিচরন। কাউকে আমার কিছু যেমন বলার নেই, কারো কোনো কিছুই আমার পরোয়া করারও কোন প্রয়োজন নেই। এখানে আমার কোন দায়িত্ববোধ নেই, আমার দায়িত্বও কারো উপর নেই। এখানে আমার সব নদীর উপস্থিতি যেমন আছে, তেমনি কোনো নদীর উপস্থিতিও আমাকে বিচলিত করে না। একদিক থেকে দেখলে এই নদীর কোন তীর নেই আবার আরেক দিক থেকে অনুধাবন করলে হয়ত দেখা যাবে এর আছে অজস্র তীর। কখনো উল্লাশের তীর, কখনো আনন্দের তীর, কখনো ব্যর্থতার তীর, কখনো সব হারিয়ে এক অবসন্ন জীবনের তীর। এখানে এই তীরে কেউ প্রবেশের অধিকারও নেই। এখানে আমার রশদের কোনো প্রয়োজন নেই, এখানে সর্বত্র আমি। আমি কি করতে পারতাম, কি করা উচিত ছিলো, কে কি করতে পারতো, কোথায় আমি ভুল করেছি, কোথায় আমার সার্থকতা ছিলো, কি আমার ভুমিকা হতে পারতো, কিংবা কি কারনে আমি আমার সবকিছু নিঃস্বার্থভাবে ছেড়ে আমি আমার তৃতীয় এই নদীতে একা পড়ে আছি, তার কোনো ব্যখ্যা আমি আর খুজতে চাই না। হয়ত কেউই এর কোনো উত্তর মেনেও নিবে না।

-এখন আরেকটি প্রশ্ন মনে আসে। তাহলো, এই তৃতীয় নদীটি কোথায়? কারো কাছে এই তৃতীয় নদীটি হয়ত বাস্তবের কোনো এক বিশাল জলপ্রবাহমান নদীর বুক, কারো কাছে হয়তবা ঘন গাছপালায় পরিবেষ্টিত এক নির্জন জঙ্গল, কারো কাছে হয়তবা এই বিশাল মানবকুলের ঘনবস্তির মধ্যেও একা কোনো জগত। কেউ বিশ্বাস করুক আর নাইবা করুক, এই নদী সবার আছে, কেউ তাকে গ্রহন করে, কেউ এর সন্ধান জানেও না। এই নদীতে ঝাপ দেওয়ার সামর্থ্য সবার থাকে না। কারন এর যেমন কোনো দৃশ্যমান তীর নেই, আবার সব তীরের ঘাটও এক রকম নয়। এর জলের রঙ সবনদীর মতো নয়। এর কোনো ঋতু নেই, যখন তখন বৃষ্টি, ঝড়, উল্লাস, আনন্দ, কান্না, পরিহাস সবকিছু ঘটে। আর এর একচ্ছত্র অনুভুতি, আস্বাদ, ইতিহাস শুধু নিজের আর কারো নয়। এই তৃতীয় নদীর কিনারে বসে শতবর্সী বয়োবৃদ্ধা তাঁর বাল্যকালের স্বপ্ন দেখেন, আবার কারো কারো অজান্তেই এই নদীর বালুচরে হেটে হেটে কোনো এক উদাসীন কিশোর তাঁর কল্পনার জগত পেড়িয়ে শতবর্ষ পরের কোনো এক জনবসতীর সপ্নজাল বুনন করেন। কেউ ফিরে আসে, কেউ আর ফিরে না। এই নদীর তীরে বসা সবাই একা, সবাই সুখী, আবার সবাই বিরহীর মতো। অথচ এতো কাছাকাছি থেকেও এদের মধ্যে কেউ সখ্যতা করেন না, কেউ কাউকে সম্মোহনও করেন না। যেদিন এই মন-নদী অবশান হয়, সেদিন সব তীরের ধারা একসাথে মন-নদীর সাথে তিরোধানও হয়। হয়ত তখন হুয়াও হুইমারেস রোসা্র লেখা “নদীর তৃতীয় তীর”টি আর কারো গোচরীতভুতও হয় না। সময়ের বিবর্তনে আমরা সবাই ঐ জেলের মতো হয়ত কোনো কোনো তীর থেকে খসে পড়ি। বৃন্তচ্যুত কলির তীরখসা জীবনের অজস্র তীরের যখন একচ্ছত্র ভীড় ঘনীভুত হয় মহামিলনে বা মহাবেদনায় অথবা মহাপ্রলয়ে, তখন চৈত্রমাসের তাপদাহের পর বৈশাখের কালো হিংস্র ঝড়ে তান্ডবের মতো আমরা শুধু সেটাই দেখি যা শ্রাবনের অঝোরধারায় এই মাটির ধরায় সবার পায়ে, মনে, ঘরে বা মানসপটে ভেসে উঠে।

উফ কি অসম্ভব সুন্দর উপস্থাপনা মুক্তার সাহেবের। জীবন সম্পর্কে তাঁর চিন্তাধারা সবার থেকে যেনো অনেক আলাদা কিন্তু অবাস্তব মনে হচ্ছে না। আমি মুক্তার সাহেবের কথা যতোই শুনছি, ততোই যেনো অভিভূত হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে-এগুলি তো আমারো ফিলোসোফি। এসেছিলাম, মুক্তার সাহেবের পরকীয়ার ব্যাপারে জবানবন্দী নিতে। কিন্তু আমি যেনো এখন জবানবন্দী নিচ্ছি জীবনের ফিলোসোফির। কত হাজার প্রকারের ধারনা এই পৃথিবীতে চলমান বায়ুর সাথে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুর্নীপাকের মতো হারিয়ে যাচ্ছে, আবার নতুন ঘুর্নীপাকে নতুন নতুন উপলব্ধি ভেসে আসছে, কেউ আমরা কিছু বুঝি, কেউ না বুঝেই পাস কাটিয়ে যাই আবার কেউ হয়তো বুঝিই না, কি গেলো আর কি এলো। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো মুক্তার সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে। রাতের খাবারের সময় ঘনিয়ে এসছিলো। মুক্তার সাহেব যেনো আজ আর কথা বলতে চাচ্ছিলেন না এমন একটা ইংগিত দিচ্ছিলেন। আমিও ভাবলাম, আজ তো অনেক কথা হলো, অন্য আরেকদিন অনেক সময় নিয়ে আবার কথা বল্বো।

আমি মুক্তার সাহেবকে বললাম, আজ উঠি। আরেকদিন আবার আসবো। বুঝেনই তো, আমাকে আপনাদের ব্যাপারে কিছু কথা আমাকে জানতে বলা হয়েছে। হতে পারে এটা অফিশিয়াল কোনো ইন্টারভিউ কিন্তু আমি জানি আমি যতোটা না আপনাকে ইন্টারভিউ করছি, তার থেকে ঢেড় বেশী যেনো আমি আপনার সাথে কথা বলতে সাচ্ছন্দবোধ করছি। আজ আর আপনাকে বিরক্ত করবো না, তবে কাল বা পরশু আমি আবার আসবো। তবে যাবার আগে আমার মনে খুব একটা জিনিষ ঘুরপাক খাচ্ছে আপনার সেই কথাটা জানার। ‘অলিখিত ভগবান’। এটার ব্যাপারে মুক্তার সাহেবের ফিলোসোপিটা কি আসলে? জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু এবারো তিনি সেটা এড়িয়ে গেলেন। বললেন-এই বাক্যটি যার মুখ থেকে প্রথম আমি শুনেছি, হয়তো সেইই আপনাকে এর সঠিক মর্মার্থটা বলতে পারবেন। আমিও এর সঠিক ব্যাখ্যা জানি না।

অফিসে অনেক কাজ ছিলো এ কয়দিন। দুদিন পরেই মুক্তার সাহেবের কাছে আমার আসার কথা ছিলো কিন্তু আসা হয় নাই। গতরাতে আমি মুক্তার সাহেবকে ফোনে জানিয়েছিলাম, আমি আসবো, তার কোনো আপত্তি আছে কিনা। মুক্তার সাহেব কোনো আপত্তি করেননি।

আজ সকাল সকালই আমি মুক্তার সাহেবের বাসায় এসে হাজির হলাম। তিনি বাগানে গাছে পানি দিচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই বাগানের কাজটা সংক্ষিপ্ত করে আমাকে তার ড্রইং রুমে বসতে বলে ভিতরে চলে গেলেন। কাজের বুয়া এক কাপ চা আর সাথে কিছু ফল দিয়ে গেলেন।

মুক্তার সাহেব চলে এসেছেন। কিছু কূশল বিনিময়ের পর আমরা দুজনেই তার বাগানের এক কোনে বসে চা পান করছি আর দেশের আনাচে কানাচের কিছু বিক্ষিপ্ত খবর নিয়ে সময় কাটালাম। আমি মুক্তার সাহেবের বাসায় আজ তার সাথে কি কি নিয়ে আলাপ করবো তার একটা ছোট নোট লিখে এনেছিলাম যার মধ্যে আমার মনে ঘুরপাক খাওয়া সেই ‘অলিখিত ভগবান’ এর মানে কি জানতে চাওয়া। প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতেই মুক্তার সাহেব হাসতে হাসতে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন

-আপনি দেখি একটুও ভুলেন নাই। থাক সে কথা। আজ না হয় শুধু আপনার কি কি জানার দরকার সেগুলি নিয়ে কথা বলি।

আমি বললাম, আপনিই শুরু করেন কি দিয়ে শুরু করবেন। আমার কোনো পরিকল্পনা মাফিক প্রশ্ন নাই। তবে কয়েকটা ব্যাপারে জানবো যদি আপনি বিশদ ব্যাখ্যা দেন। আর বাকী কথাবার্তা শুনে আপনার কথা থেকেই আমি আমার মতো করে তথ্য সাজিয়ে নেবো। মুক্তার সাহেব আবারো সেই আসমানী এবং সাবিত্রীর প্রসঙ্গ আনলেন। কারন এখানে আসমানী এবং সাবিত্রীর ব্যাপারটা নিয়েই আমাদের সব আলোচনা করার কথা।

মুক্তার সাহেব বললেন-দ্বৈত জীবনের নাম শুনেছেন কখনো?

দ্বৈত জীবন? দারুন একটা ব্যাপার। কোনো ভুতুরে টুতুরে ব্যাপার নাতো আবার? আমি বললাম।

মুক্তার সাহেব হেসে দিলেন।

-আরে না। আমি ভুত প্রেতাত্তা এগুলিকে কখনো বিশ্বাস করিনি। এখনো করিনা। দ্বৈত জীবন, একে অন্য নামেও অনেকে চিনে-‘দিমুখী জীবন’। এই দ্বৈত জীবনের সবচেয়ে বড় গুন কি জানেন? ডান হাত জানে না বাম হাত কি করছে। মন জানে না, অনুভুতি কি করছে, শরীর জানে না তাঁর মস্তিষ্ক কি করছে। সবকিছু থেকে সবকিছু আলাদা। একটা জীবনের দুটু আলাদা আলাদা অধ্যায়। একে অন্যের অপরিচিত এই অধ্যায়গুলি। এই দুটি জীবনের মধ্যে যখন একটা জীবন অতি দুঃখেকষ্টে ভরে উঠে, তখন আরেকটা জীবন হয়তো এর ঠিক বিপরীত দিকে থাকে। হয়তো সেখানে কোনো কষ্টই থাকে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো-এটা কখনোই সম্ভব নয় যে, দ্বৈত জীবনের মধ্যে এক জীবনের প্রভাব অন্য জীবনের উপর পড়বে না। আসমানী ছিলো আমার একটা জীবন আর সাবিত্রী ছিলো দ্বৈত জীবনের আরেকটা। আসমানী ছিলো আমার স্ত্রী কিন্তু সাবিত্রী ছিলো আমার আরেক উপলব্ধি। কখনো স্ত্রী, কখনো মেয়ে, কখনো বন্ধু, কখনো খেলার সাথী, কখনো পাঠক, কখনো অস্তিরতা, কখনো আবার শুধুই একজন বহুদূর পর্যন্ত হেটে যাওয়া কোন কম্পেনিয়ন। জীবনের গাড়ি একটা চাকার উপর টানতে টানতে অনেকেই যখন হাপিয়ে যায়, তখন এর জন্য দরকার হয় আরেকটা চাকার। আর সেই চাকাটার নাম হচ্ছে হয়তো স্ত্রী। কিন্তু মানুষ যখন নিঃসঙ্গতায় ভোগে, আর সেটা কাউকে অনেক বেশী কুড়ে কুড়ে খায়, তখন দরকার হয় একজন সঙ্গীর। যখন ওই সঙ্গীর নেহায়েত প্রয়োজন হয় অথচ তাকে সংগী করা যায় না, তখন সে কিছু একটা তো করেই। আর সেটা যে কেউ শুনলেও কখনো বিশ্বাস করবে না, অথচ ব্যাপারটা সত্যি। সাবিত্রী ছিলো তেমন একটা মানুষ। সে ছিলো আমার দ্বিমুখী জীবনের বাস্তব সত্তা।

আমি মুক্তার সাহেবকে বললাম, জানেন মুক্তার সাহেব, আমি আপনার অনেক কথার অর্থ আমার এই ক্ষুদ্র জ্ঞানে ধরতে পারিনা। কেনো যেনো মনে হয় ব্যাপারটা আমি বুঝতেছি কিন্তু ধরতে পারছিনা। আপনি কি সব সময় এভাবেই সবকিছু দেখেন? আমরা যারা ছাপোষা কেরানীর মতো জীবন চালাই, তাদের কাছে আসলে এই ধরনের অভিজ্ঞতা নাই। হয়তো আমরা সঠিক ব্যাখ্যার বদলে নিছক একটা ভুলভাল অর্থে জ্ঞানকে চালিয়ে দেই। যেমন ধরুন, আমি হয়তো এখন আপনাকে প্রশ্ন করবো, তাহলে আপনি কি এই দ্বিমুখী জীবনে বাস্তব জীবনের থেকেও বেশী সুখী ছিলেন? কিংবা আপনি কি আসমানীর সাথে সেই জীবনে কোনো কারনে আফসোসে ছিলেন?

-কেউ সুখী না। আমিও না, এমনকি আপ্নিও না। আবার সবাই সুখী, সেখানে আমিও সুখী। এই মাত্রাটা সময়ের সাথে সাথে কখনো প্রখর হয় আবার কখনো বুঝাই যায় না সুখের কোন স্টেজে আমরা অবস্থান করছি। এর ফলে যেটা হয় যে, কখনো কখনো নিজের সন্তানকেও নিজেরা চিনতে পারি না, আবার কখনো কখনো আমাদের সন্তানেরাও আমাদের চিনতে পারে না। সবার স্বকীয়তা আলাদা, সবার চিন্তাধারা আলাদা, সবার পছন্দ আলাদা, সবার সুখের সংজ্ঞাও আলাদা। এই আলাদা আলাদা স্বকীয়তা, চিন্তাধারা আর পছন্দের ভীড়ে কারো সাথেই কারো কিছুই মিল নাই বিধায় কোনো না কোনো সময়ে এরা একটি বিন্দুতে এসে কনফ্লিক্ট বা সংঘর্ষ তৈরী করে। এই কনফ্লিক্ট তৈরির বিন্দুটি যদি কেউ খুব সহজে অতিক্রম করে বেরিয়ে যেতে পারে, তারা অন্যের থেকে সুখী। কিন্তু এই বিন্দুটি এড়িয়ে যেতে লাগে অনেক আত্মত্যাগ আর কম্প্রোমাইজ। যতো বেশী ছাড়, ততো বেশী সহজ জীবন। কিন্তু এটা সবসময় পারা যায় না। একটা সময় গিয়ে আপনি আর কতটুকু ত্যাগ করতে পারেন? কতটুকু কম্প্রোমাইজ করতে পারেন? যখন এটা সীমার বাইরে চলে যায় বলে মনে হয়, কেউ সুখী নয়, আপনিও না, আমিও না, কেউ না। তখনই তৈরী হয় এবং শুরু হয় দ্বিমুখী আত্মার। এদিকেও আছি, আবার নাই। অন্যদিকেও আছি আবার সেটা নাইও। এর কারনে, এই পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষই কোনো না কোনো সময়ে দ্বিমুখী জীবনে বসবাস করে। কেউ জেনে করে, কেউ না জেনে। এই দ্বিমুখী জীবনের সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে এর কোনটা আগা আর কোনটা মাথা তার হদিস পাওয়া যায় না। কখনো এর শেষ থেকে শুরু আবার কখনো মাঝপথ থেকে। যাদের দ্বিমুখী জীবন তাদের জীবনের প্রারম্ভেই শুরু হয় তাদের বেলায় এটা বলা অনেক কঠিন তাদের আসল অবয়াববটা কি। এই দ্বিমুখী জীবনের মানুষগুলি সর্বদা একটা বর্নচোরা রুপে এই সমাজে, এই সংসারে এমন করে বাস করেন যাদের মুখ এবং মুখোস কোনোটাই আলাদা করা যায় না। তাদের প্রতিটি দৃষ্টিভংগীতে থাকে আবছা আবছা কিংবা পরিকল্পিত কোনো ছায়ার রুপরেখা যেখানে সামনে থাকা মানুষগুলিকে তারা কখনোই সাধারন মানুষ হিসাবে দেখেন না। তারা যা দেখেন আর যা দেখান পুরুটাই একটা মুখোশ বা মাস্ক। যেদিন এই মাস্ক আলাদা করার মতো পরিস্থিতি আসে, তখন হাজারো রকমের প্রশ্ন মনে জেগে উঠে-কেনো, কিভাবে, কার জন্যে কিংবা কি প্রয়োজনে এই দ্বিমুখী জীবনের আবশ্যকতা? অনেকেই তখন মাস্ক পরিহিত মানুষটাকেই আসল মনে করে আসল মানুষটাকেই আর চিনতে পারেন না। পাশাপাশি কয়েক যুগ একত্রে বসবাস করার পরেও অনেক ক্ষেত্রেই এই দ্বিমুখী জীবনের সন্ধান পাওয়া যায় না অথচ ব্যাপারটা ঘটছে। ঘটছে প্রকাশ্যে, দিবালোকে আর সবার অজান্তেই। এটা যেনো সেই কচুরীপনা যা স্রোতের মধ্যে স্রোতের বিপরীতে চলমান। হটাত করে চোখে পড়ে না কিন্তু যখন নিজের অবস্থান থেকে সেই কচুরীপানা অনেক দূর অবধি চলে যায়, তখন হয়তো ব্যাপারটা দৃশ্যমান হয় কিন্তু তখন সেই কচুরীপানা আর হাতের বা দৃষ্টির মধ্যে থাকে না। সে চলতেই থাকে তারমতো। চলমান সমুদ্রে কিংবা ভরা নদীর বুকে ভেসে থাকলেও এই কচুরীপানা তার নিজের প্রয়োজনে একপেট জল সর্বদা নিজের করে ধরে রাখে যা তার হয়তো প্রয়োজনই নাই। কিন্তু দ্বিমুখী জীবনের মানুষগুলির এই প্রয়োজন আছে বলেই তারা কোনো সুযোগ নেয় না, তারা তাদের প্রয়োজনটাই আগে বিবেচনা করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। পিছনে কার কি হলো, তাতে তাদের ভাবার কোনো আবশ্যকতা মনে করে না। দ্বিমুখী জীবনের ভালোবাসায় প্রচুর খাদ যেমন থাকে তেমনি নিখুত ভালোবাসাও থাকে। ভালোবাসার এই খাদের উপরের চাকচিক্য এমনভাবে প্রতিফলিত হয় যা আসল সোনার রংটাকেই আরো আসল বানিয়ে চোখ ঝলসে দেয়, অন্যের মন আকর্ষন করে তাঁকে আরো কাছে আসার সুযোগ করে দেয়। আর এটাই সেটা যেখানে সমাজের মানুষগুলি প্রতিদিন প্রতারিত হয়। আর যখন নিখুত ভালোবাসার রঙ এর প্রলেপ থাকে, তখন যিনি দেখেন বা পান, তার কাছে সোনার বা পিতলের রঙ এর কোনো পার্থক্য থাকে না। কারন সেটাকে আপনি যে নামেই ডাকেন না কেনো, সেটা মুল বা অরিজিনাল। এখানে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো-দ্বিমুখী জীবনের সব মানুষগুলি আবার এ রকমের মুখোশ পড়ে থাকে না। তারা মুখোশের আড়ালেও বাস্তব। প্রতারনা নাই। আমরা কেহই একক সত্তায় বসবাস করি না। কখনোই এটা সঠিক নয় যে, আমরা শিশুকাল থেকে মরার আগ পর্যন্ত একই সত্তার আচরন নিয়ে বসবাস করেছি। আপনিও না। ফলে যেটা হয়, মেনে নেই, মানিয়ে নেই, সামলিয়ে নেই, কম্প্রোমাইজ করি ইত্যাদি। নিজের উপরে অনেক কিছু চাপিয়ে দেই, অন্যের উপরেও আমরা অনেক কিছু চাপিয়ে দেই।

তাহলে দ্বিমুখী জীবনটা আসলে কি? এটা কি এমন যে, আমরা ক্ষনেক্ষনে পরিবর্তনশীল? যখন কারো সাথে আমাদের বিবেচনা মিল থাকে না, সেটাই কি তাহলে দ্বিমুখীতা?

-না, দ্বিমুখীতা সে রকম কিছু নয়। দ্বিমুখী জীবনেও একে অন্যের সাথে চিন্তায় পার্থক্য থাকে। সেটাও আরেকটা জীবন। আমাদের সাভাবিক জীবনের মতোই আরেকটা লুকায়িত জীবন। দ্বিমুখী জীবনের সত্তা আসলে একের ভিতরেই অন্যটা দ্বিধা বিভক্ত। তাদের দুটুই পাশাপাশি বিচরন করে-ঘৃণা আর মাত্রাতিরিক্ত ভরষা, সত্যতা আর মিথ্যার বেশাত, কঠিনতা আর দূর্বলতা, মায়া এবং হিংসা। এই দ্বিমুখী জীবনের সময় আর অসময় বলে কিছু নাই। যখন প্রয়োজন তখন তারা উভয়ই ব্যবহার করতে কোনো দিধাবোধ করেন না। ফলে দেখা যায় যে, যাকে কেউ কোনোদিন এমন কোনো কাজ, এমন কোনো ভয়ংকর ঘটনা ঘটাতে পারে বলে ভাবেনও নাই, তারাই সেটা করে ফেলে। তখন তারা সবাইকে এমনভাবে তাক লাগিয়ে দেয় যে, সবার মনে এই প্রশ্ন জাগে এটা কিভাবে সম্ভব সেই তার দ্বারা যে কিনা একটা তেলাপোকা দেখলেও ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে থাকতো?

-এখন প্রশ্ন জাগে, যদি সবাই তাদের জীবনে কোনো না কোনো সময়ে এই দ্বিমুখী জীবনে বসবাস করেই থাকেন, তাহলে দ্বিমুখী না কারা? আসলে এর উত্তর খুব কঠিন নয়। সবার দ্বিমুখী জীবনের সংগা এক নয়। কেউ কেউ অতি অল্প বিষয়েই তার দ্বিমুখী জীবনের শুরু আর শেষ আবার কারো কারো এই বৈশিষ্ট এমন যে, প্রতিটি বিষয়েই তারা দ্বিমুখী। কারো দ্বিমুখী জীবনের ধারা শুধুমাত্র বৈষয়িক, আবার কারো কারো দ্বিমুখী জীবন ব্যক্তিগত। কেউ দ্বিমুখী জীবন দিয়ে সমাজকে কলুষ্মুক্ত করেন, আবার কেউ দ্বিমুখী জীবন দিয়ে সমাজকে কলুষিত করেন। দুটু দ্বিমুখী জীবন একসাথেও চলতে পারে যদি তাদের সেই দ্বিমুখী জীবনের গতিপথ হয় একই রেলের উপর। যখন এই দ্বিমুখী জীবনের সাথে ভিন্ন ধারার দ্বিমুখী জীবনের সংযোগ হয়, তখন ভয়ংকর পরিনতি ছাড়া আর কিছুই আশা করা যায় না। যেটা আপনারা দেখছেন আমার আর আসমানীর মধ্যে সাবিত্রীকে নিয়ে।

মুক্তার সাহেবের কথার মারপ্যাচে আমি এক রকম দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলাম। কি নোট করবো, আর কি লিখবো না সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। আমার তো এমন কিছু নোট করা আবশ্যইক যা আমি আমার প্রতিবেদনে উল্লেখ করবো। আমি যা শুনছি তা যেনো সবই অন্য ধারার কথা। অথচ কোনোটাই ফেলে দেয়ার মতো নয়। আমি মুক্তার সাহেবকে নিছক প্রতিবেদকের মতো আবারো প্রশ্ন করি- তাহলে দাম্পত্য জীবনে এই দ্বিমুখী জীবনের প্রভাব কি? এই দ্বিমুখী জীবন কি ভয়ংকর নয় যখন আমরা জানি এটা একটা মুখোশধারী সততার মতো?

-মুক্তার সাহেব বলতে থাকেন

-দাম্পত্য জীবনে এমন কিছু সময় আসে যখন মানুষ পরিস্থিতির কারনে কখনো কখনো দ্বিমুখী চরিত্রে ঢোকে যায়। যখন কোনো মহিলার স্বামী তার স্ত্রীর প্রয়োজনটা বুঝতে না পেড়ে বড়গাড়ি, বড়বাড়ি বড়বড় সপ্নে বিভোর হয়ে সার্বোক্ষন তার নিজের সংসারে উদাসীন থাকে আর অন্যত্র ব্যতিব্যাস্ত হয়ে সময় কাটাতে থাকে, তাহলেই তার নিজের স্ত্রীর দ্বিমুখী জীবনে প্রবেশ করার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায় আর সেই মহিলাও দ্বিমুখী জীবনে তার নিজের অজান্তেই ঢোকে যায়। কারন, যখন একটা মেয়ে একা হয়ে যায়, নিজের ঘরে স্বামীর সংস্পর্শও ধীরে ধীরে অবহেলায় পরিনত হয়, যখন সারাদিন কাজকর্ম করার পর যখন মনে হয় কেউ শুধু হাতটা ধরুক। অথচ কেউ আর পাশে থাকে না, তখন তার একাকিত্ত বাইরে বেরিয়ে আসে। তখন তার চলাফেরা, আচার আচরন, মনোভাব দেখে কারো সন্দেহ থাকে না যে, সে একা। এরপরেই শুরু হয় ভয়ংকরতা। সমাজ তাঁকে স্পর্শ করার জন্য মুখিয়ে থাকে। একসময় সে তাঁর নিজের অজান্তেই দ্বিমুখী চরিত্রে প্রবেশ করে ফেলে। যদি পুরুষের বেলায় বলি-সেটাও একই রকম। পুরুষের বেলায় তখন সাবিত্রিদের আগমন হয়। সাবিত্রিরা শুধু আপনার দেহকেই মুলধন মনে করে না। ওরা মুলধন মনে করে আপনার অসহায়ত্বকে, আপনার একাকীত্বকে, আপনার আফসোসের উপলব্ধিকে। ইতিহাস খুজে দেখলে দেখবেন, বড়বড় মনিষীরা, বড়বড় ব্যবসায়ীরা কিংবা বড়বড় জ্ঞানীরা তাদের শেষ জীবনে এসেই এই আফসোসের সন্ধানটা পান। আর মৃত্যুর বিছানায় শুয়ে শুধু একটা কথাই বলে যান সবার উদ্দেশ্যে যে, আমি কি কারো জন্যেই কিছু করি নাই? কিংবা আমি তাহলে সারাজীবন কাদের জন্য এতো পরিশ্রম করলাম যখন আমার এই মুমুর্ষ সময়ে কেউ পাশে নাই কিংবা আমি যা চাই সেটা আর পাই না? অথবা আমার অনেক অতৃপ্ত কথা শোনার কি কেহই ছিলো না? এটাই মূল কথা। জীবনের শেষ সময়ে কেউ কারো কাছেই থাকে না কারন সবাই আলাদা। সবাই ব্যস্ত। তখন শুধু সামনে থাকে সাবিত্রীরা। হতে পারে এক সাবিত্রী থেকে নতুন আরেক সাবিত্রীর পরিবর্তন হয়। কিন্তু সাবিত্রীরাই শেষ একম্পেনিয়ন। ব্যতিক্রম নাই যে তা নয়। কিন্তু দ্বিমুখী জীবনের বেলায় এটাই ঘটে।

মুক্তার সাহেবকে আমি অনেকভাবেই যেভাবেই প্রশ্ন করছি না কেনো, আমি এখনো ঠিক কি কারনে আর কোন অপরাধে আসমানী বেগমের থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে গিয়েছিলেন, সেই একাকীত্তের পুরু চিরাচরিত ধারনাটা মনে হয় পাইনি। আমি তাই আবারো মুক্তার সাহেব কে প্রশ্ন করলাম, আপনি বলছেন, আসমানী বেগম আপনার কথার অবাধ্য হয় না, তিনি কোনো পর পুরুষের সাথেও খারাপ কিছু করেন না, আবারো বলছেন, তিনি ঠিকই আছেন, তাহলে কোন জায়গায়টায় আপনি একটা দুরুত্ত দেখছেন যেখানে আপনার মনে হয় আপনি বঞ্চিত বা আপনাকে সঠিক আগের মতো আর মুল্যায়ন করছে না?

মুক্তার সাহেব সদাহাস্যের মানুষ। বেশ মিশুক আর জোরালো তার অকপট বক্তব্য। তাঁকে ডাইরেক্ট প্রশ্নও করা যায়। মুক্তার সাহেব আমার এমন ডাইরেক্ট প্রশ্নে আমাকেই উলটা একটা প্রশ্ন করলেন-

-বাংলা একটা সিনেমা আছে। ইন্ডিয়ান। বেলাশেষে। দেখেছেন মুভিটা?

আমি বললাম, আমি খুব একটা মুভি দেখিনা। ছোট বেলায় দেখতাম, তাও কখনো এটা নেশার মতো ছিলো না। আর এখন তো কাজের চাপে সংবাদও দেখা হয় না। সম্ভবত আমি বেলাশেষে মুভিটা দেখি নাই। কি ছিলো এই মুভিতে?

মুক্তার সাহেব বলতে শুরু করলেন

-তাহলে ‘বেলাশেষে’র মুভিটার একটু কাহিনী বলি। হয়তো ব্যাপারটা আপনাকে আরো পরিষ্কার ধারন দিতে পারে।

-৬৫ বছরের স্বামী আর ৬০ বছরের স্ত্রী। অনেক নাতি-নাত্নি, মেয়ের জামাই, ছেলেরা মেয়েরা সবাই একসঙ্গে মিলিত হয়েছেন গুরুতর এক সমস্যা নিয়ে। সমস্যাটা হল, স্বামী বলেছেন তিনি এই বয়সে এসে তার স্ত্রীর সঙ্গে পৃথক হতে চান এবং আরেকটি বিয়ে করতে চান। এই বুডো মানুষটির এমন অবাক করা সিদ্ধান্তে অনেকেই, বিশেষ করে তার মেয়েরা, মেয়ের জামাইরা, নায় নাতুকুররা হতবাক হলেও কেউ কেউ রাজি আবার কেউ কেউ রাজি নয়। যারা এই সিদ্ধান্তে রাজী না, তারা হতবাক হচ্ছেন, এই বয়সে কেন তিনি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। অথচ স্বামী কিছুতেই কারনটা বলছেন না। ওদিকে তার স্ত্রী এটাকে একটা নিছক কৌতুক মনে করে ব্যাপারটা উড়িয়েই দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে তার মেয়ে, নাতী নাতনিদের সাথে খোজ মেজাজে হাস্যরসও করছেন। কিন্তু যেদিন সত্যি সত্যিই কোর্ট থেকে স্বামীর আপীল করা ডিভোর্স লেটার তার স্ত্রীর কাছে এলো, ব্যাপারটা এখন সবার কাছে মহাচিন্তার ব্যাপার হয়ে দাড়ালো। ব্যাপারটা আর হাস্যরসের মধ্যে রইলো না। এবার সবাই কারনটা জানতে চান কেনো স্বামী এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। অথচ স্বামী কারনটা বলতে চাচ্ছেনই না। তখন সবাই এই গোপন কারন কি জানার জন্য নায়নাতকুর, ছেলেমেয়ে, মেয়ের জামাই সবাই মিলে একটা পরিকল্পনা করলেন। ঠিক আছে অসুবিধা নাই। তারা স্বামীকে একটা প্রস্তাব দিলেন যে, সেপারেট হবার আগে তারা নিজেরা সবাই কোনো এক জায়গায় ভ্রমনে যাবেন, একসাথে হইহুল্লুর করবেন ইত্যাদি। তারা সবাই পরিকল্পনা করলো যে, এই বুড়ো বুড়িকে তারা এই ভ্রমনের সময় একঘরে রাখবেন। তারা তখন কি নিয়ে আলাপ করে, কি নিয়ে কথাবার্তা হয় সেটা থেকে কিছুটা হলেও আচ করা যাবে আসল রহস্যটা কি। বুড়া-বুড়িও সম্মতি দিলেন, ঝগড়াতো আর হয় নাই, স্বামী স্ত্রীই তো। তাদের জন্য আলাদা ঘর দেওয়া হল, একদম নিরিবিলি পরিবেশ। কেউ তাদেরকে বিরক্ত করার নাই। কিন্তু সবাই এর মধ্যে একটা কাজ খুব গোপনে করে রাখলো। আর তা হচ্ছে তাদের রুমে গোপন একটা ক্যামেরা লাগিয়ে দিল এই দুই বুড়া বুড়ি কি কথা বলে তা দেখার জন্য। আর সেই ক্যামেরার স্ক্রীন সেট করলো আরেক পাশের ভবনে যেখানে সবাই থাকে। যখনই এই দুই বুড়া বুড়ি তাদের কথাবার্তা বলেন, তখনই দলবেধে অন্য বাড়ি থেকে সবাই মিলে ভিডিওতে তা প্রত্যক্ষ করেন।

-চল্লিশ বছরের বিয়ের সেই অভিজ্ঞতার কথা, ভাল লাগার কথা, একসঙ্গে কষ্টের কথা, দুঃখের কথা, তাদের মিল অমিলের কথা, রাগের কথা, ভালোবাসার কথা একের পর এক তারা দুইজনে নিরিবিলি একত্রে বসে আলাপ করেন। আর সবাই তাদের এইসব অভিজ্ঞতার কথা শুনে অন্য সবাই কখনো হাসেন, কখনো চোখ মুছেন, কখনো অবাক হয়ে চুপ করে থাকেন। তারা সবাই একটা জিনিষ বুঝতে পারেন যে, সব স্বামীর কাছে তার সংসারটা এক রকমের, আর স্ত্রীর কাছে তার সংসারটা আরেক রকমের। কিন্তু কেউই যে ভুল নন তা ঠিক। স্বামীর কাছে দাম্পত্য জীবনের ভালোবাসাটা এক রকমের আর স্ত্রীর কাছে স্বামী আর সংসারের জন্য ভালোবাসাটা আরেক রকমের। একজন মায়াবী স্বামী সব সময়ই চেয়েছেন, তার অবর্তমানে তার আদরের স্ত্রীর যেনো কোনো কষ্ট না হয়, সে যেনো কারো কাছে হেয়ালীর পাত্র না হন, তার আদুরী স্ত্রী তার অবর্তমানে কোনো অর্থকরী কিংবা সুন্দর জীবন চালানোর জন্য কারো কাছে হাত না পাতেন। সেই দিকটা খেয়াল করে এই ভরষাযুক্ত স্বামী সবসময় চান তার স্ত্রীকে সাবলম্বি করে তুলতে। ফলে স্বামী সব সময়ই চেয়েছেন তার স্ত্রী এটা জানুক যে, তার স্বামী কোথায় কিভাবে কত রোজগার করেন, কত সঞ্চয় করেন, আর কিভাবে সেই কষ্টার্জিত সঞ্চয় থেকে কিভাবে তিনি তার স্ত্রীর মংগলের জন্য কি করছেন এবং তার পুরুপুরী এই পরিকল্পনার অংশ হয়ে যেনো তার স্ত্রী এটা খেয়াল করে সে মোতাবেক প্রস্তুতি নেন এবং তার উপর নিজেও পারদর্শী হন। অন্যদিকে এই স্বামী দেখছে, তার স্ত্রী তার এইসব ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন হয়ে তাদের সংসারে বেড়ে উঠা ছেলেমেয়ে, নাতি নাতকুর কিভাবে মানুষ হবে, কিভাবে আরামে থাকবে, কিভাবে নিরাপদ থাকবে ইত্যাদি নিয়েই বেশি নজর। স্বামীর কাছে ভালো লাগা ছিল বউকে নিয়া কোথাও রোমাঞ্চের উদ্দেশ্যে একা একা বেরিয়ে পড়া, কিন্তু স্ত্রীর কাছে যেনো সেই রোমাঞ্চের থেকে বেশী জরুরী ছিলো ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা, তাদের কোচিং ক্লাস, তাদের স্বাস্থ্য, তার নিজের ঘরকন্নার কাজ, আত্মীয় সজনদের সেবা শশ্রুসা ইত্যাদির মধ্যে একটা বন্ধন স্রিস্টির লক্ষে সবাই মিলে পারিবারিক সময় কাটানো। স্বামী চেয়েছেন স্ত্রীর কাছ থেকে অনেকটা সময় যে সময়টা তারা ভালোবাসার কথা বলবে, পুরানো দিনের কথা বলবে, কোনো একটা সিনেমা দেখতে দেখতে মনভরে আনন্দ করবে, বিখ্যাত কোনো কবির কবিতা পড়ে পড়ে তার অন্তর্নিহিত ভাবধারায় সিঞ্চিত হবেন। কিন্তু স্ত্রী তার পরিবারের সবার দিকে একসঙ্গে খেয়াল রাখতে গিয়ে, ছেলেমেয়েদের পরাশুনার দেখভাল করতে গিয়ে, অসুস্থ শ্বশুর শাশুড়ির দিকে নজর দিতে গিয়ে অধিকাংশ সময়টাই চলে গেছে, স্বামীর জন্য অফুরন্ত সময়টা আর তিনি বের করতে পারেন নাই। কেউ দুষী নন, কারো চাওয়ার মধ্যেই অতিরঞ্জিত ছিলো না। অথচ তারা যেনো কোথায় সুখি নন। তারপরেও তারা বহুকাল এই কম্প্রোমাইজের মধ্যেই একটু রাগ, একটু অভিমান, একটু গোস্যা আর বিস্তর জায়গা জুড়ে পরস্পরের ভালোবাসাটা এক সময় অভ্যাসে পরিনত হয়, তখন অভ্যাসটাই যেনো ভালোবাসা। স্বামীর টয়লেট করে আসার পর যে গন্ধটা একদিন স্ত্রীর কাছে দূর্গন্ধ মনে হতো, স্বামীর ঘামের গন্ধে ভরপুর যে গেঞ্জীটা একদিন নাকের কাছে নিলে একটা শুকনা বাজে গন্ধ বলে মনে হতো, একদিন সেই টয়লেটের গন্ধ, ঘামের দূর্গন্ধ আর দুর্গন্ধ মনে হয় না। অন্যদিকে স্ত্রীর ঘুমের মধ্যে ডাকা নাকের শব্দ যখন কোনো একদিন এতোটাই অসহ্য মনে হতো, বিরক্তিকর মনে হতো, চুলে আধা ভেজা তেলের যে গন্ধ একদিন স্বামীর নাক বুঝে আসতো, সময়ের এতোটা পথ বেয়ে যখন সবগুলি ভালোবাসা একটা অভ্যাসে পরিনত হয়ে যায়, তখন স্ত্রীর সেই নাক ডাকা, আধাভেজা চুলের গন্ধ যেনো একটা সুখের পরশ মনের ভিতর প্রবাহিত হয়ে যায়। এই তো সে তো কাছেই আছে। ৯০ বছরের কোনো এক প্রোড় বুড়ো, ৮৫ বছরের কোনো মহিলার সাথে যখন এক সাথে স্বামী স্ত্রী হিসাবে বসবাস করেন, তখন তাদের এই বয়সে এসে আর সেই যুবক যুবতীর মতো শরীরের চাহিদা, রুপের চাহিদা আর কাজ করে না। কিন্তু তাদের মধ্যে ভালোবাসাটা একটা বিশাল আকার পাহাড়সম ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাহলে সেখানে কি ফ্যাক্টরটা কাজ করে? কাজ করে নির্ভরতা, কাজ করে একে অপরের উপর শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, মায়া আর মহব্বত। কাপা কাপা হাতে যখন ৮০ বছরের বুড়ি এক কাপ চা নিয়ে ৯০ বছরের তার স্বামীর কাছে কাপখানা হাতে দেন, কিংবা পানের বাটিতে পান আর সুপারী ছেচে যখন এক খিলি পান স্বামী তার ৮০ বছরে সংগিনীর মুখে তুলে দেন, আসলে তিনি শুধু এক কাপ চা কিংবা এক খিলি পানই দেন না, দেন সারা জীবনের মহব্বত আর ভরষা যে, তুমি ছাড়া আমার আর কোনো বড় বন্ধু নাই। তুমি আমার ভরষা, তুমি আমার নিরাপত্তা, তুমি আমার স্বামী, কিংবা স্ত্রী, তুমি আমার পরামর্শদাতা, বিপদে আপদে তুমিই আমার ডাক্তার কিংবা নার্স। তুমিই আমার সব। ব্যস্ততম রাস্তায় যখন আমি রাস্তা পার হতে গিয়ে আমার বুক কাপে, তোমার হাত ধরলেই আমার সব কাপুনী বন্ধ হয়ে যায়। তুমি আমার মায়ার সংসার। বুকের সব পাজরে পাজরে তুমি গেথে থাকা আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস আর চোখের প্রতিটি বিন্দুজলে নীল আকাশের গাংচিলের মতো তুমি খেলা করো আমার  অন্তরের এমন এক কোটরে যেখান থেকে তোমাকে আলাদা করার কোনো ক্ষমতা আমার নাই। বেলাশেষে তুমিই আমার আর আমি সেই তোমার। কিন্তু সংসারের অতীব ভিন্ন ভিন্ন চাপে আবেগের এই জায়গাগুলিতে কেউ না কেউ সময় কেড়ে নিচ্ছে। কেড়ে নেয় বিকেলের রোদ, সন্ধ্যার আমেজ কিংবা ব্রিষ্টির দিনে মুড়ি মাখা কোনো একটা দুপুর।

-এই যে কাহিনীটা, এটা আসলে আমাদের মতো এই বয়সের মানুষের। আমরা আমাদেরকে আবার সেই প্রথম দিনের মতো করে পেতে চাই, পেতে চাই অফুরন্ত সময়ের তোমাকে। কিন্তু সেই অফুরন্ত সময়ে তুমি আর নাই। আমি একাই খাই, খাবার টেবিলে আছে, তুমি ব্যস্ত অন্য কিছুতে, আমি একাই ঘুমাই, তুমি ব্যস্ত অফিশিয়াল কাজে হয়তো ফোনে, নয়তো মিটিং এ, আমি একাই সারাদিন ছুটি কাটাই, কারন তোমার আর সেই সময়টা হাতে নাই। আমার আজকে অনেক খুশীর দিন, অফিসে ভালো কাজ হয়েছে, সবাই প্রশংসা করেছে, অথচ তোমার সেই আগের উচ্ছাস নাই, হুম বলেই হয়তো এমন একটা গুরুতর সংবাদ নিমিষেই হালকা হয়ে যায়। গল্প করতেও আর গল্প এগোয় না। ফলে এমন একটা পরিবেশে স্বামী ভাবলেন, নতুন করে আবার জীবন শুরু করি। কিন্তু এই নতুন জীবনের মাঝে যেনো তার স্ত্রী কোনো কষ্ট না পায়, তার ব্যবস্থা, তার সুরক্ষা, তার নিরাপত্তা যেনো বিঘ্নিত না হয় সেটাও তিনি করে যাচ্ছেন। মুভিটার শেষটা অবশ্য আরো সুন্দর। যিনি বিচারক ছিলেন, তিনি যেনো কিছুতেই কার কোনো দোষ ধরতে পারছিলেন না। দুজনেই দুজনের দিক দিয়ে সঠিক মনে হয়েছে। তারপরেও মুভিটায় বিচারক একটা রায় দিয়েছিলেন যা ছিলো দুজনের জন্যই শিক্ষামুলক। এবং অবশেষে আবারো মিলন। আমার কাছেও মাঝে মাঝে এরুপটাই মনে হয়। আসমানী আমাকে ঠকায় নাই, আসমানীর কোনো দোষ নাই কিন্তু আমিও তো তাকে কখনো ঠকাই নাই। আমি তো ঠিক এখানেই থেকে যেতে চেয়েছিলাম ঠিক সেই আগের মতো। কিন্তু সেই আগের মতো “সময়”টাই তো আর কাছে নাই। তাহলে আমার সময়টা কাটে কিভাবে? হয়তো এ কারনেই সাবিত্রীরা সময় বিক্রি করে দেয় আমাদের মতো মানুষের কাছে।

আমি এবার মুক্তার সাহেবকে আরো একটা সরাসরি প্রশ্ন করি- কখনো কি আপনার মনে এটা উদ্ভব হয় নাই যে, আপনার মতো এমন একজন ব্যক্তিত্তশীল মানুষের নামে এমন একটা পরকীয়া বিষয়ক খবর যদি রটে যায়, আপনার কেমন লাগবে বা কি হতে পারে?

মুক্তার সাহেব তার যথারীতি খুব স্বাভাবিক বাচনভংগীতে আমার প্রশ্নের উত্তরে বললেন

-আপনার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে আমি কিছু যোগ করি। আপনি কি মনে করেন না যে, একই খবর কারো কাছে শুভ আবার কারো কাছে অশুভ হতে পারে? এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার কে কিভাবে দেখে। একই জায়গায় মিলিত হওয়া মানুষের রাস্তা আলাদা আলাদা হতে পারে। একই পরিস্থিতিতে একজন জীবনে এগিয়ে চলে, আবার আরেকজন জীবনের অসহায় অবস্থার সাথে বোঝাপড়া করে। কেউ কেউ বিন্দু বিন্দু অর্থ সঞ্চয় করে নিজের সপ্ন পুরন করে, অন্যজন তার গড়া সপ্ন বিন্দু বিন্দু ভুলের কারনে নিরুপায় অবস্থায় জন্য তার সপ্ন ভাংতে শুরু করে। কোনো অপরাধই রাতারাতি জন্ম নেয় না। যখন কোনো অপরাধ হয়, তখন আমরা শুধু তার উপরের রুপটাই দেখতে পাই। কিন্তু তার শিকড় অন্য কোথাও অনেক গভীরে হয়। আর শিকড়ের সন্ধান হয় পুলিশ করে অথবা কোনো সচেতন মানুষ, যেমন এখন আপনি করছেন। পুলিশ যখন তদন্ত করে তখন প্রতিটি মানুষকে সে যেভাবে দেখে তা হল, সবাই মুখোশ পড়া ক্রিমিনাল। আর যখন কোনো সচেতন মানুষ অপরাধের সন্ধান করেন, তিনি চারিপাশ ভাবেন, দেখেন, বুঝেন, তারপর মন্তব্য করেন। প্রথমেই সবাই তাঁকে ক্রিমিনাল ভাবেনা। ব্যাপারটা আর কিছুই না, একটা পদ্ধতিগত আর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। আমাকে যারা জানে, যারা চিনে, তারা হয়তো ব্যাপারটায় আমাকে না যতোটা দোষী ভাববেন, তার থেকে অনেক বেশী সহমর্মিতা নিয়ে নিজেরাও কষ্ট অনুভব করবেন। এটা শুধু আমার বেলায় নয়, আসমানীর জন্যেও। কারন আমার সেই পরিচিত গন্ডি না আমাকে না আসমানীকে কষ্টে দেখতে চায়। তারপরেও ঘটনা তো ঘটেই। একটা সময় আসে, দুজনকে একই পরিমান ভালোবাসা, শ্রদ্ধা কিংবা সম্মান দেখাতে চাইলেও তারা কোনো না কোনো পক্ষ অবলম্বন করবেই। আর সেটা নির্ভর করে তাদের নিজস্ব পার্সোনালিটির উপর। আপনার প্রশ্নের উত্তরে আমার মন্তব্য আর কিছুই না, শুধু জেনে রাখুন যে, জীবনের চেয়ে আর কোনো কিছুই বড় নয়। এ জীবন আছে বলেই আকাশ এতো সুন্দর, পাহাড় এতো ভালো লাগে, বৈশাখের ঝড় কিংবা টিনের চালের বৃষ্টির ধ্বনি এতো রোমান্টিক মনে হয়। যদি জীবনটাই দূর্বিসহ হয়ে উঠে, তাহলে কেউ আপনাকে সম্মান করে সুসাধু খাবার দিলেই কি, বা আপানাকে অতি সম্মানের জায়গায় বসিয়ে পুজা করলেই কি। আমি আমাকে নিয়ে ভেবেছি, অন্য কারোর জন্য আমি বাচতে চাইনি। এটা সবার বেলায় প্রযোয্য। হ্যা, মাঝে মাঝে তো খারাপ লাগেই, কিন্তু সেটা আমার ভাল সময় কাটানোর কাছে হয়তো কিছুই না। অন্তত ভালো ঘুম হয়, ভালো বোধ হয়। আমার ভালো লাগাটাই আমার কাছে জরুরী।

আমি মুক্তার সাহেবের যুক্তির মধ্যে যেনো পুরুটাই মিশে গিয়েছিলাম। উনাকে কি প্রশ্ন করবো আর কি প্রশ্ন করবো না সেটাই এখন আমার কাছে যেনো কঠিন বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। জীবনের অর্থ, জীবনের মাহাত্য, কিংবা জীবন সম্পর্কে একটা মানুষের কতো গভীরবোধ থাকতে পারে মুক্তার সাহেবের সাথে কথা না বললে হয়তো আমি বুঝতামই না। আমার এই ছোট চাকুরী জীবনে এ রকম অনেক দাম্পত্য অভিযোগ নিয়ে অনেক পরিবারের সাথে আমার কথাবার্তা হয়েছে। সেখানে যেটা দেখেছি-একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে সারাক্ষন বিস্তর অভিযোগ তুলতেই থাকেন। অভিযোগ করেন নানান বিষয়ে। তারা নিজেদের অপরাধ বুঝতে চান না, তাই তাঁর অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে হাজারো যুক্তি, পালটা যুক্তিতে তর্কবিতর্ক করতে থাকেন, লজিক দেখাতে থাকেন। অথচ এই প্রথম আমি এমন একটা দাম্পত্য কলহের অভিযোগ সামাল দিচ্ছি যেখানে না মুক্তার সাহেব একবারের জন্যেও তাঁর প্রতিপক্ষ আসমানীর কোনো দোষ দিয়ে নিজের সাফাই গাইছেন, না আসমানীর বিরুদ্ধে তিনি ন্যাক্কারজনক কোনো অভিযোগ তুলছেন। উলটা বরং যতটুকু সম্ভব তিনি কোথাও কোথাও আসমানীকে ততোটাই ডিফেন্ড করছেন যে, আসমানীর জন্যই তা অধিক জিতার কারন। কিন্তু এখানে মুক্তার সাহেব কিংবা হয়তো সাবিত্রী কেউ আসমানীকে দোষারুপ না করে জিততেও চাইছেন না। সবকিছু যেনো পৃথিবীর একটা রহস্যজনক নিয়মে একেবারে সিস্টেমের মধ্যেই হচ্ছে ভাবনাটা এরকমের। অপরাধবোধ আছে কিন্তু সেটা অপরাধ করার জন্য না। অনুতপ্ত হচ্ছেন কিন্তু সেটা তাদের কারো দোষেই নয়। এখানে যেনো আসমানী, সাবিত্রী বা মুক্তার সাহেব তিনজনেই কোনো একটা রহস্যজনক পরিস্থিতির শিকার। আমি মুক্তার সাহেবকে আজকের জন্য আর কোনো প্রশ্ন করবো না বলে মনে মনে ভেবে নিয়েছিলাম। তারপরেও আমি আবার মুক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম

জীবন সম্পর্কে আপনার ফিলোসোফি কি?

এতোক্ষনে মুক্তার সাহেব উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। আমি এ যাবত মুক্তার সাহেবকে মুচকি হাসি ছাড়া একবারো এতো উচ্চস্বরে হাসতে দেখিনি। তিনি আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে আমার দিকেও প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন

-নিন একটা ধরান যদি অভ্যাস থাকে।

সিগারেটে আমার অভ্যাস আছে কিন্তু মুক্তার সাহেবের সামনে অথবা অফিশিয়াল ফর্মালিটিজের কারনেই হোক আমি এখনো সিগারেট ধরাইনি। কিন্তু এবার মনে হলো, একটা সিগারেট খেতে খেতে মুক্তার সাহেবের কাছ থেকে জীবনের ফিলোসোফিটা শুনি। পাশেই কফির পট ছিলো, ফ্লাষ্কে গরম পানিও ছিলো। আমরা দুজনেই কফি খেতে খেতে আলাপ করছি। মুক্তার সাহেব কথা বলছেন।

-শোনেন, জীবন অনেক বড়। তার ফিলোসোফি আরো বড়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর ভিন্ন ভিন্ন ফিলোসোফি আছে। আমি তো আর নিজে ফিলোসোফার নই বা এ নিয়ে বিস্তর পড়াশুনাও করিনি যে, আমি সেগুলির একক মর্মার্থ বলতে পারবো। তবে আমি জীবনকে নিয়ে অনেক গবেষনা করেছি, নিজে নিজে ভেবেছি, মানুষের চালচলন লক্ষ করেছি। একটা সময় ছিলো আমি অযথা দোকানের সামনে বসে থাকতাম শুধু বিভিন্ন মানুষের আচার ব্যবহার দেখার জন্য। কে কখন কি পরিস্থিতিতে কি ব্যবহার করে সেটা প্রতিটি মানুষের বেলায় ভিন্ন। তবে যে ফিলোসোফিটা আমাকে সবচেয়ে বেশী তাড়ায় বা নাড়ায় সেটা হচ্ছে মানুষ অতিরিক্তভাবে তাঁর ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করে। আর সেটা তাঁর জন্যে নয়, তাঁর প্রিয় মানুষগুলির জন্য। আর এই ভাবনার পিছনে যে অজানা একটা ভয় কাজ করে সেটা মৃত্যু।

যেমন ধরুন, আজ থেকে ১০০ বছর পর ঠিক এই সময়ে দেখতে পাবেন (যদিও আমরা কেউ সেটা দেখে যেতে পারবো না) আমাদের যুগের বেশীরভাগ অথবা প্রায় শতভাগ মানুষ আর এই পৃথিবীতেই নাই। হয়তো খুবই নগন্য কিছু সৌভাগ্যবান অথবা অন্যঅর্থে দূর্ভাগ্যবানও বলা যেতে পারে, তারা বার্ধক্যের বোঝা মাথায় নিয়ে ক্ষীনদৃষ্টি আর দূর্বল শরীরে এমন কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে যা কখনোই তারা চায় নাই। আর সেটাই ‘মৃত্যু’। এই শতবর্ষে ক্যালেন্ডারের পাতা প্রতিদিন পালটে যাবে, তাঁর সাথে সাথে পালটে যাবে তারিখ, মাস, বছর এবং অতঃপর যুগ। কেউ এটাকে আমরা থামাতে পারি নাই, পারবোও না, আর কেউ (হোক সে কোনো প্রতাপশালী সেনাপতি, হোক সে চৌকস কোনো রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রনায়ক, কোনো বিজ্ঞান কিংবা কোনো বিজ্ঞানি, কোনো সর্বোচ্চ পদধারী ধার্মিক নেতা কিংবা দূধর্ষ সন্ত্রাসী) এই অমোঘ প্রাকৃতিক নিয়মটাকে উপেক্ষা করে অগোচরেও পরিবর্তন করতে পারে নাই, আর করার কোনো ক্ষমতাও রাখে না। এটাই প্রকৃতি আর তার নিয়ম। আজ এই মুহুর্তে যারা পথেঘাটে পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে, তাদের বেশীর ভাগ মানুষকেই আমি চিনি না। এদের কেউ হয়তো কোটটাই পড়া, কেউ হয়তো ফুটপাতে নোংরা চুলে বসা, আবার কেউ হয়তো আমার মতোই স্থবির। কোট টাই পড়া মানুষগুলিকে দেখে পথের ধারে বাস্তহারা মানুষগুলি হয়তো ভাবছে-আহা কতই না সুখে আছেন তারা। আবার হয়তো এটাও ঠিক যে, সেই কোট টাই পড়া মানুষটি হয়তো এই বাস্তহারা মানুষটার থেকেও অধিক দুক্ষে আছে, কে জানে?  মজার কিংবা অবাক করার বিষয় হচ্ছে-সময়ের পথ ধরে আমার আপনার পূর্বপুরুষের কিংবা আমার আপনার প্রয়াত বন্ধুবান্ধবদের পথ ধরে এদেরই কেউ কেউ মহাশ্মশানের সারিসারি পাথরে নাম লেখা কোনো এক নাম ফলকের মধ্যেই এক সময় লুকিয়ে যাবে ঠিক সেইস্থানে যার কথা আমরা আজ ভাবতেও পারি না। সেখানে যেমন কোনো আধুনিক পোষাক বলতে কিছু থাকে না, আর না থাকে কোনো ধার্মিক ব্যক্তির আলখেল্লাটাও। অনেকের বেলায় হয়তো সেই নামফলকটাও থাকবে না। কোথায় আছেন তারা, কার জায়গায় আছেন তারও কোনো হদিস হয়তো পাওয়া যাবে না। আজ যে শরীরটাকে প্রতিদিন নোংরা মনে করে দেশী বিদেশী সাবান শ্যাম্পু দিয়ে সুগন্ধী মাখছি, তখন এই শরীরের মধ্যে হাজারো পোকা মাকড়, কর্দমাক্ত মাটি, নোনা জল, অপরিষ্কার জলের সাথে ভেসে আসা দূর্গন্ধময় আবর্জনায় সারাটা শরীর ভেসে গেলেও তাকে আর সুগন্ধী কেনো, উম্মুক্ত হাত দিয়ে সরানোর মতোও আমাদের কোনো শক্তি থাকবে না। শরীরে মাংশ পচেগলে মিশে যাবে মাটির সাথে, হয়তো কোনো এক কুকুর কিংবা শিয়াল আমাদের শরীরের অবশিষ্ট হাড্ডিটি নিয়ে দূরে কোথাও পচে যাওয়া মাংশটুকু খাওয়ার জন্য দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে। কার সেই কংকাল, কার সেই হাড্ডি, এই পৃথিবীর কোনো জীবন্ত মানুষের কাছে এর কোনো মুল্য নাই। যে ঘরটায় আমি সারাদিনের ক্লান্তি শেষে অবসাদ শরীর নিয়ে মুলায়েম বিছানায় গা হেলিয়ে দেই এখন, সেই ঘরটা হয়তো থাকবে অন্য কারো দখলে। কে তারা, কি তার পরিচয়, সেটাও হয়তো আমাদের জানা হবেনা। যে বাগানটায় আমি প্রায়ই পায়চারী করে করে আকাশ দেখতাম, গাছগাছালীর মধ্যে উড়ে আসা ভ্রমর কিংবা পোকামাকড় দেখতাম, সেই বাগানের দখল এখন কার দখলে কে জানে। বাগানের গাছগাছালীর পরিচর্যার নামে যে পোকামাকড়গুলিকে আমি বিষ দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করতাম, আমি আজ তাদেরই দখলে। যে বাচ্চাদের মুখরীত কোলাহলে আমার ঘর ভরে থাকতো, যাদের আগমনে আমার মন পুলকিত হতো, আজ সেখানে অন্য কেউ মুখরীত হচ্ছে। কতই না সাবধানতায় আগলে রেখেছিলাম আমার সেইঘর, সেই লন, কিংবা আমার যতো আয়েশী জিনিষ, আজ সেগুলি আমার কিছুই নয়। আমার সুন্দুরী স্ত্রী যখন তাঁর লাল শাড়িটা পড়ার পর কিংবা আমিই যখন নতুন কোনো একটা ড্রেস পড়ে বারবার আয়নার সামনে গিয়ে কতবার দেখতে চেয়েছি-কেমন লাগে আমাকে, অথচ আজ সেই আমি বা আমার সেই সুন্দুরী স্ত্রী তাঁর চেহাড়া কেমন দেখায় কাফনের সেই ধবল পোষাকে সেটা দেখার কোনো পায়তারাও নাই। সেই বৃহৎ আয়নাটার আর কোনো মুল্য নাই আমার কাছে। হয়তো সেখানে অন্য কেউ এখন তাঁর চেহাড়া দেখছে, হয়তো লাল শাড়ির পরিবর্তে নীল বা টাইকোট পড়া কোনো এক পুরুষ একটা ভেষ্ট পড়া ব্যাকব্রাস চুলের মহড়া দিচ্ছে। যে গাড়িটা প্রতিদিন আমাকে মাইলকে মাইল ঠান্ডা কিংবা শীততাপ হাওয়ায় বসিয়ে, মিষ্টি মিষ্টি গান শুনিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে গেছে, সেটা আর আমার কোনো প্রয়োজন নাই। না সে আমাকে আর খোজে। কি অবাক না? এখানেই লুকায়িত আছে আমাদের ক্ষনস্থায়ী জীবনের ফিলোসোফি। এখন যে যেভাবে তার ফিলোসোফি বের করে নেয়। জীবনের সব ফিলোসোপি শেষ হয় একটা মৃত্যুতে।

উফ, আমি যতোই মুক্তার সাহেবের সাথে কথা বলছি, আমার ভিতরে কম্পন শুরু হয়। উনি যা বলছেন, নতুন কিছু বলছেন না। কিন্তু এখন তো আমার কাছে সবই জাগ্রত স্পন্দের মতো মনে হচ্ছে সবই নতুন। আমার বুক কেপে উঠছে, আমার চোখ ভিজে আসছে। আমার ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে-আমিও আমার গলা ফাটিয়ে সেই ভগবানের দিকে তাকিয়ে বলি-কেনো, কেনো তুমি আমাকে এতো অল্প সময়ের জন্য এতো কিছু দিয়েও নিয়ে যাচ্ছো? মুক্তার সাহেবের কথা শেষ হয় নাই। তিনি বলেই যাচ্ছেন-

-আমার খুব কষ্ট হয় যখন ভাবি যে, কখন কোথায় কাকে কাকে নিয়ে অথবা আমার নায়নাতকুর আত্তীয়স্বজন স্ত্রী পোলাপান নিয়ে কবে কোথায় কি আনন্দে মেতেছিলাম, সেই ইতিহাস আর কেউ কখনো মনেই রাখবে না। যেমন মনে রাখিনি আমি নিজেও। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কতটা পথ হেটেছিলাম, আর সেই হাটাপথে আমি কতটুকু ঘাম ঝড়িয়ে চূড়ায় উঠে কি তৃপ্তি পেয়ে কি আনন্দে কতটুকু আত্তহারা হয়েছিলাম, সেই তথ্য না কেউ জানবে, না কেউ জানার কোনো আগ্রহ দেখাবে। কার সাথে কি নিয়ে আমার মনোমালিন্য হয়েছিলো, বা কে আমাকে কতটুকু ভালোবেসে কি অবদান রেখেছিলো অথবা কার কোন আগ্রহে আমি কোথায় কি করেছিলাম, কার কারনে আমার অন্তরে জালা উঠেছিলো আর কার কারনে আমার দিন আর রাত একহয়ে গিয়েছিলো, সেই ইতিহাসের কোনো মুল্য আজ বেচে থাকা মানুষগুলির কাছে কোনো অর্থ বহন করে না। না তাদের কাছেও যাদের জন্য এসব অন্তর্জালা ঘটেছে। নতুন প্রজন্ম নতুন পরিবেশ, নতুন সব কাহিনীতে ভরে থাকবে বর্তমান আর আগামীর প্রজন্ম। সেই পুরাতন পরিবেশের কোনো স্থান থাকবে না আজকের এই পরিবর্তীত বন্ধুমহল পরিবেশে। হয়তো কোনো এক ছোট বালিকা আমাদের কথা শুনে, অথবা ভালোবেসে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে আমাদের সেই সমাধিতে দাঁড়িয়ে একটু অন্যমনষ্ক হয়ে পুষ্পস্তবক দিতেও পারে কিন্তু সেটা নিছক একটা মুহুর্তের ইমোশনাল কারনে। সবার বেলায় এটা আবার নাও হতে পারে। কিংবা জন্ম জন্মান্তরের শেষে প্রজন্মের পর প্রজন্মের শেষে আমি এমন করে বিলীন হয়ে যাবো যে, সেই অবুজ বালিকার পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো আর একটা বাসী ফুলও নিয়ে আমার সেই সমাধিতে দাঁড়াবে না। কারন আমি তাদের কোনো ইতিহাসের মধ্যেই নাই। চিরতরেই বিলীন।

মুক্তার সাহেব যখন কথা বলার নেশায় থাকেন, আমি একবারের জন্যেও তাকে কথার ফাকে বাধা দেই না। কারন তার প্রতিটি কথা শোনার জন্য আমার কান, অন্তর যেনো মুকিয়েই থাকে। তারপরেও বললাম, জীবন সম্পর্কে আপনার এমন রুড় বাস্তব চিন্তাধারা কি সেই ছোট বেলা থেকেই লালন করতেন নাকি চড়াই উৎরাই পার হয়ে জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে?

-নাহ, এটা একটা ধারনামাত্র। আমি যা দেখছি, আমি যা ভাবচি তার মধ্যকার একটা চিত্র। যাই হোক যেটা বলছিলাম, আপনি কি জানেন যে, আজ যে সেলফীটা অনেক যত্ন করে তোলা হয়েছে, হাসিমাখা মুখ, চুলের বাহার, পোষাকের পরিপাটিতা, সবকিছু ধীরে ধীরে সেই শতবর্ষ পরে এমন করে মলিন হয়ে যাবে, হয়তো দেখা যাবে, সেই ছবি পরে আছে এমন এক কোনায় যেখানে থাকে পরিত্যাক্ত কোনো কাগজ বা ময়লার বাক্স। কোনো একদিন সেটা হয়তো অপ্রয়োজনীয় হয়েই বেরিয়ে যাবে আমার সেই শখের ঘরের দরজা পেরিয়ে। আমার প্রতিদিনের নেশা সেই সোস্যাল মিডিয়া, হোয়াটসাপ, ইত্যাদি সবকিছু এক নিঃশ্বাসে বন্ধ হয়ে যাবে সারাদিনের আপডেট আর কাহিনি। যে অর্থের জন্য আমি প্রতিদিন সারাটা সময় শুধু পরিশ্রমই করে গেছি, যাদের জন্য আমার সারাটাদিন বাহিত হয়েছে, সেই অর্থ কিংবা মানুষগুলি আজ আমার কোনো কাজেই আসবে না। শতবছর পরে তো আমার অর্থে গড়া কোনো এক ইমারতের কোনো একটা ইটের মধ্যেও আমার কোনো নাম বা অস্তিত্ব থাকবে না। হোক সেটা আমার পরিশ্রমে গড়া কিংবা আমার নিজের। সেখানে হাত বদলে বদলে আমার অস্তিত্তের শেষ পেরেগটুকু মেরে সেখানে হয়তো কোনো এক লোকের নাম লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। যেটা আজ আমার নামে পরিচিত, শত বছর পর সেটা আমার আর নাই, না সেটা আমার নামেও অহংকার করে। কি অদ্ভুত না?

-শত বছরের হিসাবে যেমন আমি আর নাই, হাজার বছরের হিসাবে তো আমি কখনোই নাই। তারপরেও আজ আমি অনেক ব্যস্ততায় দিন কাটাই আগামিকালের জন্য, প্রয়োজনে- অপ্রয়োজনে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অন্যের ধন প্রকাশ্যে অথবা গোপনে চুরি করে বিত্তবান হবার পার্থিব জগতে সুখী হবার নিমিত্তে আগামীকালের শান্তির জন্য মগ্ন। অথচ আগামিকালটাই আমার না। এই পৃথিবী আমাকে কখনোই মনে রাখবে না। কারন সে আমাকে ভালোই বাসে নাই। অথচ আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম আমার জীবনের থেকেও বেশী। আর এটাই এই পৃথিবী। আমার থেকেও অনেক নামীদামী রাজা, মহারথী সময়ের পথ ধরে বিশ্বকে দাপিয়ে গেছেন, তাদেরকেও এই প্রিথিবী মনে রাখে নাই। আসলে এই পৃথিবীর কোনো বর্ষাই আমার না, কোনো শরতই আমার না। এর গাছপালা, এর নীলাকাশ, এর সুগভীর সমুদ্র কিংবা ঘনসবুজ পাহাড় কোনো কিছুই আমার না। এই আসমানি, এই সাবিত্রীও আমার না। আমার ঘরটাও আমার না।

-একবার ভাবুন তো? শতবছর পরে, আমি এক অচেনা, নামহীন, অস্তিত্বহীন মানুষ যে আজকের দিনে বহু ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটিয়ে কিছুটা সময় এই নীল আকাশ, ঘন সবুজ পাহাড় অথবা পাখীদের কিচির মিচির শুনেছিলাম, সেই আমি আর নাই। অথচ এই সময়ে এসে কোনো এক সন্ধ্যায় খুব জানতে ইচ্ছে করে কেউ কি কখনো এটা জানার জন্য উম্মুখ হয়ে জানতে চাবে আজ থেকে শত বছর আগে কি ঠিক এখানে কেউ বসেছিলো কিনা যেখানে আমি এখন বসে আছি? খুব জানতে ইচ্ছে করে-কে সেই ভাগ্যবান যুবক আজ থেকে ঠিক শতবর্ষ পরে এখানে বসে চা কিংবা কফি পান করছে? হয়তো দেখা হবে সবার সাথে কোনো এক নাম না জানা ময়দানে।

তাহলে আরেকটা অনেক বড় প্রশ্ন মনে জেগেই রইলো-আমার স্রিষ্টিকর্তা আমাকে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে তাহলে এই বিশ্ব ভ্রমান্ডে পাঠিয়েছিল? What was the purpose of my life to be created by my Lord? সেটাই আসলে একটা রহস্যময় ফিলোসোফি। আমার সেটা জানা নাই। তাকে পুজা করার জন্যই যদি আমাকে এতোসব কলেরব করে এখানে পাঠালেন, তাহলে আমাকে এতো অনুভুতি, এতো জ্ঞান, এতো সাধ আহলাদ দিয়ে কেনো পাঠালেন? ঈশ্বর হয়তো আমাদের থেকে আরো রশীক।

ড্রইং রুম থেকে মুক্তার সাহেবের বাসার আংগিনার বাগানটা দেখা যায়। আকাশটাও। বেশ মেঘ করেছে আকাশে। একটু আগেও বেশ রোদ ছিলো। এখন আবার মেঘ জমতে শুরু করেছে। ঘরের ভিতরে সম্ভবত একটা গান বাজছে। চমৎকার একটা গান।

‘সাজিয়ে গুজিয়ে দে আমায় ও সজনী তোরা’

সাজিয়ে গুজিয়ে দে মোরে

বরই পাতার গরম জলে, শুয়াইয়া মশারীর তলে,

আতর চন্দন গোপাল মেখে দে সজনী তোরা

সাজিয়ে গুজিয়ে দে মোরে।

কি কঠিন শব্দাবলী গানের কথাগুলিতে। মরনের কথা, শেষ দিনগুলির কথা। মানুষ আসলেই কেনো অল্প সময় নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়?

মনটা খুব ভারাক্রান্ত হয়ে এসছিলো। মুক্তার সাহেব ভিতরে চলে গেছেন। আমি তখনো একাই বাইরের ড্রইং রুমে বসেছিলাম। ভাবলাম, আজকে আর কোনো ব্যাপারে মুক্তার সাহেবের সাথে আলাপ করবো না। আরেকদিন।

প্রায় সপ্তাহখানেক পরে আবার আমি মুক্তার সাহেবের সাথে যোগাযোগ করলাম। আমি নিজেই ফোন করেছিলাম। এমনিতেই এ কয়দিনে তার সাথে একান্তে কথা বার্তা বলায় আমি যেনো তার খুব পরিচিত একজন বন্ধুই হয়ে গিয়েছিলাম। আমি বাসায় আমার স্ত্রীর সাথে মুক্তার সাহেবের ব্যাপারে কোনো কথাই বলি নাই। কিন্তু মুক্তার সাহেবের সাথে কথা হলে বা দেখা হলে আমার পরের দিনগুলিতেও মন কেমন যেনো অন্য রকম থাকে। জীবনের প্রতি, মানুষের আচরনের প্রতি আবার কখনো কখনো নিজের উপরেও যে আমার একটা উপলব্ধি ভিন্ন রকম প্রভাব ফেলে সেটা আমি বুঝতে পারি। তারপরেও কেনো জানি আমার বারবারই মুক্তার সাহেবের সান্নিধ্য পেতে খারাপ লাগে না, বরং একটা টান আসে তার সাথে কথা বলার।

আজ আবারো আমি মুক্তার সাহেবের সাথে বসে আছি। আজকে আমি আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলাম, আসমানীর ব্যাপারে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো না। আজ শুধু তার সাথে আমি জীবন নিয়ে, জীবনের দর্শন নিয়ে আলাপ করবো। আমি মুক্তার সাহেবের বাসায় ঢোকতেই তিনি আমাকে সেই চিরাচরিত বারান্দা ঘেষা বেলকনিতে আপ্যায়ন করলেন। এখান থেকে বাইরের আকাশ দেখা যায়, রাস্তায় দূরে লোকজনের চলাচল দেখা যায়। গাছপালায় বসে থাকা পাখীদের কিচির মিচির শোনা যায়।

টি টেবিলে মুক্তার সাহেবের কাজের বুয়া আমাদের জন্য আগেই ফ্লাস্কে গরম পানি আর চা পানের জন্য বাকী সরঞ্জাম রেখে দিয়েছিলো। মুক্তার সাহেব নিজে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আমার জন্যেও আরেককাপ হাতে দিলেন। চা পান করতে করতেই আমি আমার পরিকল্পনার কথাটা মুক্তার সাহেবকে বললাম, আজ আমরা কারো ব্যাপারেই কোনো আলাপ করবো না। নিছক গল্প করার জন্যই আজ আসা।

-আপনি ব্যস্ত মানুষ। সরকারী কাজে অনেক ব্যস্ত থাকেন। শুধুমাত্র গল্প করার সময় কি আপনাদের আছে? মুক্তার সাহেব ঈষত মুচকী হাসিতে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন।

না, সে রকম না। আজ আমার অফ ডে। ভাবলাম, বাসায় বসে রিপোর্টগুলি সাজাবো কিন্তু সেটা করতে ভালো লাগছিলো না। তাই, একবার ভাবলাম, আপনার সাথে গল্প করলে ভালো লাগবে। তাই আসা।

-তো কি নিয়ে গল্প করতে চান আজ?

আসলে, আমি এ যাবত অনেকের ব্যাপারে অনেক ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে অনেক জটিল তথ্যেও কোনো না কোনোভাবে জোড়াতালী দিয়ে একটা প্রতিবেদন লিখতে পেরেছি কিন্তু আমি যখন আপনাদের ব্যাপারটা জানছি এবং আরো গভীরে ঢোকছি, আমি ততোটাই যেনো মানুষের ভিন্ন একটা দিক আবিষ্কার করছি। যদিও ব্যাপারটা নিছক কোনো নতুন আবিষ্কার না। অথচ ব্যাপারগুলি কিংবা অনুধাবনাগুলি চলমান বাস্তব। জীবনের ফিলোসোপি, সমাজ নিয়ে ভাবনা, সম্পর্ক নিয়ে নতুন চিন্তা ইত্যাদির যেনো একটা খোরাক আমি আবিষ্কার করছি। আমি নিজেও এই চিন্তা, ভাবনা আর ফিলোসোফির বাইরের কেউ না।

-আসলে, আমরা আমাদের চারিপাশ নিয়ে এতোটাই মহাব্যস্ত থাকি যে, আমরা আমাদের জীবন নিয়ে খুব সামান্য সময়ই ব্যয় করি নিজেকে বুঝার, নিজের ব্যাপারে চিন্তা করার। যখন নিজের ব্যাপারে চিন্তাটার জন্য সময় আসে, তখন দেখা যায়, অনেক অনেক দেরী হয়ে গেছে সবকিছু।

জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের এই ফেলে আসা জীবনে আপনার কি চাওয়া পাওয়া ছিলো যা আপনি এখনো মনে করেন পান নাই? কিংবা আপনি কি মনে করেন, কোথাও কোনো কিছুর জন্য আফসোস হয়?

-নাহ, তেমন কোনো আফসোস আমার নাই। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, সময়টাকে বুঝে উঠার আগেই সময়টা পেরিয়ে গেলো। আজ এই বয়সে এসে যদি ‘সময়’ টাকে যেভাবে উপলব্ধি করি সেটা আরো কয়েক যুগ আগে করতাম, হয়তো জীবনের এই স্তরে এসে অনেক কিছুর মধ্যে আফসোস কম থাকতো। আপনি কি নিজেও এটা স্বীকার করেন না যে, ছোট বেলার চার আনায় পাওয়া এক ডজন চকলেট থেকে একশত টাকায় একটা চকলেট এই সময়ের ব্যবধানে আপনিও অনেক পালটে গেছেন, বুড়ো হয়ে গেছেন? এই যে সিগারেটটা খাচ্ছি, এক সময় এটা লুকিয়ে খেতাম, আর এখন প্রকাশ্যে খেয়েও সেই আনন্দটা পাই না, অথচ এই সময়ের ব্যবধানে আমরাও সবাই অনেক পরিবর্তনের সাথে বিশাল একটা সময়কে হারিয়ে ফেলেছি? কখন যে সেই ছোটবেলা, শৈশবকাল মাঝে যুবক থেকে আজ বৃদ্ধ বনে গেলাম, এটাই তো বুঝতে পারলাম না। অথচ পুরু সময়টা আমার চলেই গেলো। একটা সময় শিশু ছিলাম, কখন যে বাবা হয়ে গেলাম, আবার কখন যে শশুড় হয়ে যাচ্ছি, জীবনের প্রথম দিকে বাবা মায়ের, তারপর স্ত্রীর, অতঃপর ফের বাচ্চাদের কথা মতো চলতে চলতে কখন যে আমার সমস্ত দিনের সময়টা ফুরিয়ে গেলো, বুঝতেই তো পারলাম না। এখন আমার খেলনা কেউ ভেংগে দিলে যতোটা না কষ্ট অনুভব করি, তার থেকে অনেক অনেক কষ্ট অনুভব করি যখন কেউ আমার মন ভেংগে দেয়।

-আসলে কি জানেন? মানুষ যখন জন্মায়, তখন তার নাম, যশ, খ্যাতি কিছুই থাকে না। থাকে শুধু শ্বাস প্রশ্বাস। আর মানুষ যখন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়, তখন তার নাম, যশ, খ্যাতি সবই থাকে, থাকে না শুধু শ্বাসপ্রশ্বাসটা। এই যে, নাম আর শ্বাসপ্রশ্বাস এর মাঝের অংশটুকুই হলো আমাদের জীবন। কি আজব না? এর মধ্যে কত সম্পর্ক তৈরী হয় একের সাথে অন্যের, সমাজের সাথে, পরিবার, সন্তান, বন্ধু বান্ধবদের সাথে, অথচ আমরা এমন কোনো একটা সম্পর্ক আজো তৈরী করতে পারি নাই যা আমাদের চোখের মতো একসাথে কাদে, একসাথে হাসে, একসাথে খোলে, একসাথে বন্ধ হয়, একসাথে ঘুমায় অথচ তারা সারাজীবনেও একে অপরকে দেখে না। আমরা প্রায়ই ভুল ট্রেনে উঠে যাই, আর যখন আমরা যে ভুল ট্রেনে উঠে গেছি এটা বুঝার পরেও নামতে ভুল করি। আর এই ভুলে ভুলেই আমরা এমন এক জায়গায় গিয়ে হাজির হই যেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথ অনেক দূর। জীবনের শেষ বেলায় এসে আবার সেই ছোটবেলার দিনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, আবার নতুন করে শুরু করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ইরেজার বলতে জীবনে কোনো পেন্সিল নাই। এটাই জীবন।

মুক্তার সাহেবের প্রতিটি কথা আমাকে নাড়িয়ে যায়। কাল বৈশাখীর ঝড়ের আন্দোলিত বাতাসের মতো আমি নড়ে উঠি। মনে হয়, উনি যেনো আমাদের সবার কথা বলছেন, বলছে জীবনের কাছে পরাজয়ের কোনো এক যুদ্ধার কথা। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সাবিত্রির সাথে দেখা না হলে কি আপনি কখনো আফসোস করতেন কিংবা আসমানীর কিছু কিছু জায়গায় উদাসীনতায় কি আপনি আফসোস করেন?

-আজ না আপনি আসমানী বা সাবিত্রিদের ব্যাপারে কোনো প্রসঙ্গ তুলবেন না বলে গল্প করতে এসেছেন। তাহলে আবার ওর কথা বললেন যে!! যাই হোক যেহেতু আরেকটি প্রশ্নের অবতারনা করলেন, ‘আফসোস’, তাহলে সেটা নিয়েই কথা বলি।

– আচ্ছা, আপনি কি কখনো কোনো কারনে এ যাবতকাল কোনো বিষয়ে আফসোস করেছেন? হোক সেটা নিজের জন্য, হোক সেটা আপনার পরিবারের জন্য কিংবা অন্য যে কোনো কারনে?

আমি একটু হচকচিয়ে গেলাম মুক্তার সাহেবের পালটা প্রশ্নে। এমন করে তো ভাবিনি যে, কি কারনে কোথায় কার জন্যে বা কিসের জন্যে আমার কনো আফসোস আছে কিনা? বললাম, আসলে এই আফসোসের ব্যাপারটা আমি কখনো ভেবে দেখিনি। হয়তো কথায় কথায় আমি শুধু আপনার কাছ থেকে আপনার কনো আফসস আছে কিনা জানতে চেয়েছি। তবে আমাদের যে আফসস নাই, সেটা বললে অবশ্যই মিথ্যা বলা হবে। হয়তো আছে।

-শোনেন, আমাদের জীবনে সবার, প্রায় শতভাগ মানুষের বেলায় যদি বলি, সবার কারো না কারো আফসোস থাকেই। সেটা হোক বৈষয়িক কিংবা জাগতিক কিংবা স্বপ্ন পুরনের। যেমন, কিছু কথা আছে যা বলতে চাই নাই কিন্তু বলা হয়ে যায়, কিছু কথা ছিলো, বলতে চেয়েছি, অথচ বলা যায় নাই, কিছু সপ্ন ছিলো যা দেখতেই চাই নাই কিন্তু দেখতে হয়েছে আবার কিছু এমন সপ্ন ছিলো সবসময় দেখতে চেয়েছি কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় নাই। এমন কিছু শখ ছিলো সারাজীবন লালন করেছি কিন্তু জীবনের শেষ তীরে এসেও সেটা ধরা দেয় নাই আবার এমন কিছু ভয় ছিলো যা একেবারেই কাম্য নয় অথচ তা আমি এড়িয়ে যেতেই পারিনি। এটা আমার দোষ নয়। না আমার অপারগতা। আমি এই আফসোসের ব্যাপারটা নিয়েও বহুবার গবেষনা করেছি কেনো, এবং কী কারনে আবার এই কিছু কথা বলা হয় নাই, কিছু কথা না বলতে চেয়েও বলতে হয়েছে, কিছু সপ্ন আমাকে দেখতেই হয়েছিলো অথচ সেটা আমার কাম্য ছিলো না, আবার কিছু স্বপনের ধারে কাছেও আমি যেতে পারিনি। এই দুনিয়ায় অনেক পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ী, অনেক নামীদামী মানুষের জীবন কিংবা সার্থক কিছু মানুষের জীবনী আমি খুব কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করেছি এজন্য যে, আমি যাদেরকে সুখী আর খুসী দেখছি, তাদের সব চাওয়া পাওয়া কি পূর্ন হয়েছে যা তারা আমার মতো ভেবেছেন এভাবে যে, যা তারা করতে চেয়েছেন সেটা তারা পেরেছেন, কিংবা যা তারা দেখতে চান নাই সেটা আসলেই তারা দেখেন নাই বা যেটা তাদের আজীবনের শখ ছিলো সেটা তারা পেয়েছেন?

না, এটা একেবারেই সত্যি নয়। তারাও পারেন নাই। কারো জীবনে কখনোই এটা হয় নাই, হবেও না। এর একটাই কারন। আর সেটা হচ্ছে সে তার মতো, আর এই পৃথিবীর অন্যান্য সবাই যার যার মতো। সবাই যার যার থেকে আলাদা। কিন্তু একটা জায়গায় সবার সবার সাথে মিল রয়েছে। আর সেটা হলো, সবাই একা। দলবদ্ধ সমাজই বলি, আর একক পরিবারই বলি, সারাটা জীবন প্রতিটি মানুষ একাই ছিলো আর একাই থাকবে। এই একাকীত্ততা মানুষের জীবনে একটা আফসোস। তবে এটার পাশাপাশি এই একাকীত্ব একটা সুখের অনুভুতিও নিয়ে আসে যখন সে ভাবে যে সে যা করতে চায় না, সে সেটা করেই না। আবার সে যেটা করতেই চায়, সে সেটাই করে। আর ঠিক এ কারনেই কেউ দলবদ্ধভাবে সুখীও নয় আবার এককভাবেও নয়। এভাবেই একটা চরম আফসোস নিয়ে মানুষ এই নীল আকাশের রুপ, এই নির্জন পাহাড়ের মাদকতা কিংবা কনকনে শীত অথবা বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টির টুং টাং শব্দের মুর্ছনা ছেড়েই বিদায় নেয় যাকে কেউ আর কখনোই মনে রাখে না। এটাও কিন্তু একটা আফসোস।

-মজার ব্যাপার হলো-প্রতিটি মানুষের মূল্যায়ন তার জীবন শেষ হয়ে যাবার পর শুরু হয়। আর যাদের মূল্যায়ন তাদের জীবদ্দশায় হয়, তারা শুধু জানতে পারেন না যে, তাদেরকে চাটুকারীতা করা হচ্ছে। আর চাটুকারীতা হচ্ছে এটা না জানার কারনেই মনে মনে তারা একটা আলাদা জগতে আরামবোধ তথা গর্ববোধ করেন বটে কিন্তু যখন তিনি আর থাকেন না, তখন কোনো পলিথিনের ভিতরে ঠেসে আটকানো একটা বহুদিনের পচা গলিত মাংশের টুকরার মতো ভিন্ন গন্ধ কিংবা বহুদিন যাবত আটকানো একটা আতরের শুন্য বোতলের মতো যে কোনোটাই ছরাতে পারে। কিন্তু তার তখন কিছুই যায় আসে না। তখন তার সব হিসাব কিতাব শুধু তার আর বিধাতার মধ্যে।

-এ রকম একটা জীবনে আমি তাই আফসোসের ব্যাপারটা খুব মামুলী একটা ঘটনা বলেই চালিয়ে দেই। এতে একটা মজা আছে। আর সে মজাটা হলো এমন- ধরুন আপনার এখন খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করলো, গিন্নীকে বললেন, গিন্নী একটা অজুহাত দেখিয়ে এখন খিচুড়ি খাওয়া যাবে না বলে পাশ কাটিয়ে গেলেন। আপ্নিও ধরে নিন, আপনার ভীষন ইচ্ছাটা খিচুড়ি খাওয়ার দিন আজ নয়। আজ আপনার খিচুড়ি খাওয়ার দরকারই নাই। কোনো আফসোস থাকবে না। অথবা আপনার সাথে আপনার সন্তানের কোনো একটা বিষয়ে মতের অমিল হলো যা আপনি মানতে চান না। কারন আপনি চান আপনার সন্তান আপানার কথামত কাজ করলে তার ভবিষ্যৎ ভালো হবে। কিন্তু সেটা সে মানতে নারাজ। ধরে নিন, আপনি আপনার কাজ করে ফেলেছেন তাঁকে গাইড করার মাধ্যমে। কিন্তু আপনি জানেন এটা হয়তো সময়পোযোগী না। কি আছে? সেটা তার জীবন। তাকেই সাফার করতে দিন। আপনি তো আর সেটা ভোগ করবেন না। অথবা ধরুন, আপনি চান বিশাল কিছু একটা আর্থিক অবলম্বন থাকুক যাতে আপনার অবর্তমানে আপনার আপনজনেরা ভালো থাকে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে এই “বর্তমান” সময়ে আপনি কারো কাছে কিপটা, কারো কাছে কঠিন ইত্যাদিতে ভূষিত হবেন। কি দরকার? ছেড়ে দিন তাদের ভবিষ্যৎ তাদের উপর। আপনি তো আর থাকবেনই না। তখন তারা কি করবে, আর কি করবে না সেটা তাদের ব্যাপার। ঐ যে বললাম, তখন আপনার মূল্যায়ন হবে এইভাবে যে, আহা, বাবা কিংবা স্বামী তো ঠিকই করতে চেয়েছিলেন। আপনি মুল্যায়িত হবেনই। আফসোসের কোনো প্রয়োজনই নাই। আফসোস শেষ হয় জীবনের পরে।

–  আমি মনে করি, আপনার আফসোস হবে তখন যখন আপনার সব কিছু থাকতেও আপনি আপনার নিজস্ব পছন্দকে মূল্যায়ন করেন নাই, আপনার আফসোস হবে তখন যখন আপনি যেটা করতে চেয়েছেন আর করতে পারতেন নিজে মনের সুখের জন্য কিংবা আনন্দের জন্য অথচ আপনি সেটা করেন নাই। সেই আফসোস এর দোষ আপনার। আমি সেটা মানতে নারাজ। আমি জীবনের কাছ থেকে অনেকবার শিক্ষা নিয়ে দেখেছি- আমি যেনো কন আফসোপ্স নিয়ে এই ইহধাম ত্যাগ না করি। কিন্তু সেটা অন্যকে ক্ষতি না করে।

-আপনার ব্যবসায়ীক কোনো পার্টনারের সাথে কোথায় যেনো একটা অমিল হচ্ছে যার জন্য আপনি শান্তিতে নাই। ছেড়ে দিন ততোটুকুই যতোটুকুতে আপ্নার ব্যবসায়ী খুসি থাকে। আপনি শুধু মিলিয়ে নিন, আপনি অতটুকু ত্যাগে কতটুকু ক্ষতিতে পড়লেন। যদি সামলে নেয়া যায়, এটাই ভালো মনে করে শান্তিতে থাকুন। ভালো ঘুম হবে আর ভালো ঘুম একটা আরামের লক্ষন। আপনি তো সাথে করে কিছুই নিতে পারবেন না। যেহেতু নিতেই পারবেন না, তাহলে অযথা সেগুলিকে ধরে রাখার কি ফায়দা? সব তো অন্য কেউই ভোগ করবে!! যদি তাইই হয়, অতটুকুই আপনার দরকার যতটুকুতে আপনি ভালো থাকেন। বাকীটা অন্যের। আফসোসের কোনো কারন নাই। ঐ যে একটু আগে বলেছিলাম, বড় বড় মনিষীরা, বড় বড় ব্যবসায়ীরা কিংবা আরো বড় বড় জ্ঞানীরা তাদের শেষ জীবনে এসেই এই আফসোসের সন্ধানটা পান।

মুক্তার সাহেবের একটা ভালো গুন সব সময়ই খেয়াল করেছি যে, তিনি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলেন। তার কথা শেষ না হওয়া অবধি অন্য কনো প্রশ্ন আমি নিজেও করতে চাই না। আমি তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখছি। শিখছি জীবনের মুল্যবোধ, শিখছি আমরা যারা আমজনতা যেভাবে জীবনকে দেখি, এই পৃথিবীতে অনেক হাজারো হাজারো মানুষ আছে যারা জীবনকে আমাদের মতো করে দেখে না, ভাবে না।

এই মুহুর্তে মুক্তার সাহেবের কাছ থেকে আমার অনেক কিছু আর জানার নাই। যে বিষয়টা আমি পরিষ্কার করতে চেয়েছিলাম তিনি বিবাহ বহির্ভুত কোনো সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন কিনা কিংবা আসমানীর অভিযোগ মুক্তার সাহেবের ব্যাপারে কতটুকু সত্য সেটা। আর এই বিষয়টা মুক্তার সাহেব কখনোই অস্বীকার করেন নাই যে, তিনি সাবিত্রিকে সামাজিক আইনের মাধ্যমে বিয়ে করেছেন, স্ত্রী বানিয়েছেন ইত্যাদি। কিন্তু এটাও তিনি স্বীকার করেছেন যে, সাবিত্রির সাথে তার সম্পর্ক আছে এবং এখনো চলমান। হোক সেটা আইনসিদ্ধ কিনবা আইনের বহির্ভুত। বৈধ আর অবৈধের মাত্রায় তিনি তার এই সম্পর্ককে বিচার করেন না। তার কাছে যেটা মুক্ষ্য বিষয় সেটা হচ্ছে জীবন একটাই, আর এ জীবনে সমাজের ছুতা দিয়ে কিংবা আইনের বাহানায় নিজেকে কষ্ট দেয়ার কোনো বাধ্যবাদকতায় তিনি সীমাবদ্ধ নন।

অসীম এবং সীমাহীন ধনের রাজ্যে একাকী বাস যেমন একটা বিষাদময় জীবন, তেমনি প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা পরিবারে নিজে একাকীত্ব জীবনও প্রায় সেরকমই। যে জীবনের আরামের জন্য আমরা কিশোর, যুবক বয়স পার করে জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও দেখি ‘একদিন’ আমি আনন্দ করবোই অধরা থেকে যায়, সেই জীবন মুক্তার সাহেবের কাছে গ্রহনযোগ্য নয়। তিনি তার মতো করে কাউকে কোনো বিরক্ত না করে নিজের মনের আনন্দে বাচতে চান। তার এই বাচার পলিসিতে কারো কারো সময় খারাপ যেতে পারে, কারো কারো কষ্ট হতে পারে কিংবা কেউ কেউ অন্তরের জ্বালা নিয়ে হয়তো একই ছাদে বাচতে পারেন, তাত মুক্তার সাহেবরা কোনো বিচলিত নন। অন্যদিকে, যে মানুষটি তার সারা জীবনের পরিশ্রম দিয়ে একটা আধুনিক পরিবার গড়ে তোলেন, তার দিকেও অন্য সবার যথেষ্ট পরিমান মনোযোগী হওয়া খুবই দরকার যাতে যার জন্যে অন্য সবার জীবন এতো সাঞ্ছন্দ্যের, তার সঠিক দেখভাল, তার প্রতি আরো মনোযোগ এবং তাকে প্রাধান্য দেয়া। গাছের শিকর যখন দূর্বল হতে থাকে, গাছ তখন তার কান্ডের প্রতি ততোটা শক্তি জোগান দিতে পারে না যতোটা কান্ডের দরকার। একদিন অবশেষে সব কান্ডই শুকনো বাতাসেও ভেংগে পড়ার উপক্রম হয়।

সাবিত্রীর জবানবন্দি

আমি মুক্তার সাহেবের সাথে গত গোটা সপ্তাহ কথা বলার পর বুঝেছিলাম, ঘটনার একটা পিঠের হয়তো কিছু অংশ আমি দেখছিলাম। আরো দুটু অধ্যায় আমার দেখার বাকী ছিলো। একটা পক্ষ ছিলো সাবিত্রী নিজে, আর আরেকটা পক্ষ ছিলো স্বয়ং আসমানী। যেহেতু অভিযোগটা এসেছিলো আসমানীর পক্ষ থেকে, ফলে আমি এবার সিদ্ধান্ত নিলাম, আসমানীর জবানবন্দি নিবো সবার শেষে নিবো। সাবিত্রীর জবানবন্দীর পরে যদি আরো কিছু জানার আমার প্রয়োজন হয় মুক্তার সাহেবের কাছ থেকে, তাহলে সেটাও সেরে ফেলবো।

তাহলে এবার সাবিত্রীর পালা। সাবিত্রীকে খবরটা জানাতেই সাবিত্রী আমার সাথে কথা বলতে রাজী হলো। দিন ক্ষন সাভস্থ্য করলাম কবে কখন কোথায় সাবিত্রীর সাথে আমাদের আলাপ হবে। সাবিত্রী তার নিজের বাসাতেই থাকেন। তাই সাবিত্রী তার বাসাতেই আমাকে আমন্ত্রন জানালেন। সকাল হতেই আমার মনটা বেশ উৎকণ্ঠায় ভরে ছিলো, কিন্তু কেনো আমার সেই উতকন্ঠা কিংবা কেনো আমি এতোটা চঞ্চল অনুভব করছিলাম সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম না। এমনই একটা আবেশে আমি সাবিত্রীর বাসায় হাজির হয়েছিলাম।

সাবিত্রী নীল একটা শাড়ি পড়েছিলো। লম্বা গড়নের একজন মানুষ। আমাদের দেশের স্বাভাবিক মেয়েদের চেয়ে সাবিত্রীর শারিরীক গড়ন এবং উচ্চতা অনেকটাই বেশি। বেশ ফর্সা একজন মেয়ে। বয়স প্রায় ২৬ কিংবা ২৭ হবে। মাথায় একটা স্কার্ফ পড়া, নীল শাড়ির সাথে লাল একটা ব্লাউজ। আমার কলিং বেল টিপতেই সাবিত্রী তার ঘরের দরজা খুলে দিলো। আমি একটু অবাক হলাম প্রথমে এই ভেবে যে, সাবিত্রী কি আমাকে চিনে?

আমার মুখের অবয়ব দেখে সাবিত্রীই আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলো যে, সাবিত্রী আমাকে না চিনলেও তার ব্যাপারে মুক্তার সাহেব বলেছেন। আর যেহেতু আমি ঠিক সময়েই হাজির হয়েছিলাম, ফলে সাবিত্রীর বুঝতে ভুল হয় নাই আমিই সে। যাই হোক, আমরা সাবিত্রীর বাসার সামনে ছোট একটা পোর্চের সামন এ খোলা হাওয়ায় বসলাম। প্রাথমিক কিছু হাই-হ্যালো হবার পর আমিই সাবিত্রীকে বললাম, আমার কিছু জানার ছিলো আপনার কাছ থেকে। সাবিত্রী অবলীলায় যে কোনো কিছু আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে পারি বলে উত্তরও দিলেন।

সাবিত্রীর কাছে আমার প্রথম যে প্রশ্নটা ছিলো-আপনি কি মুক্তার সাহেবের সাথে আপনার পরকীয়ার অভিযোগ স্বীকার করেন যা আসমানী বেগম করেছেন?

সাবিত্রী আমার এমন প্রশ্নে একটু মুচকী হেসে দিয়ে বল্লো-

-পরকীয়ার আসল সংগা আমি জানি না, তবে মুক্তারের সাথে আমার সম্পর্ক আছে সেটা অবাস্তব না। আর সেটা কোন অবৈধ সম্পর্ক বললে ভুল হবে। অন্তত আমি আমাদের এই সম্পর্ককে কখনোই অবৈধ সম্পর্ক বলতে চাই না। যদি আপনি আমাদের এই সম্পর্কের গোড়াপত্তন জানতে চান, তাহলে আপনাকে শুরু করতে হবে সেইদিন থেকে যেদিন আমার জীবন বলি দেয়া হয়েছিলো এই সমাজের আষ্টেপিষ্ঠে বাধা কিছু জঞ্জাল আইন কানুনের মাধ্যমে।

আমি সাবিত্রীকে তার সেই প্রথম দিন থেকেই শুরু করতে বললাম যেনো আসলেই আমি এর গোড়াপত্তন থেকে ব্যাপারটা বুঝতে পারি।

-সেই দিনটা আমার জীবনে যেমন খুবই একটা স্পর্শকাতরের দিন ছিলো, আবার অন্যদিকে এই পুরুষশাসিত নারীর প্রতি একতরফা ভারসাম্যহীন সমাজ টিকিয়ে রাখার জন্যেও আমার জীবন বলি দেয়ার একটা দিন ছিলো। আবার যদি বলি, এটা এমন একটা দিন ছিলো যা কিনা কখনোই আমি হয়তো চাইনি। অথচ আমাকে এইদিনে সেই কাজটাই করতে হয়েছিলো যা আমি নিজের ইচ্ছায় করতেই চাই নাই। কারন আমি ইতিমধ্যে এই সমাজের মুখোসের আড়ালে যে মুখাবয়ব দেখেছিলাম। সেদিন আমি কোনো এক সিড়ি থেকে এমনভাবে পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম এমন একটায় জায়গায় যেখান থেকে না আমি নিজে বা না আমার পরিবার অথবা আমার কেউ সজ্জন টেনে আবার সেই রাস্তাটায় তুলে দিতে পারে যেটা সঠিক রাস্তা। অবশ্য এর জন্য আমি কাউকে এর জন্য দোষারুপ করতে চাই না। কারন মেয়েরা আজো আমাদের এই সমাজে একটা অলিখিত বোঝা। এই বোঝাটাই আমাদের অনেকে মানতে চাননা। এটাই আমাদের বর্তমান সমাজ। আর এই সমাজের বিপক্ষে ‘আমরা মেয়েরা পরিবারের বোঝা না’ এটা বলার সেই সক্ষমতা বা সাহস আমার পরিবারের, এমন কি অনেক পরিবারেরও কারো ছিলো না, আজো নাই। তাহলে কি ছিলো সেই ঘটনা? আপনি কি তাহলে সেখান থেকে শুনতে চান? আমার পুরু জবানবন্দী শুনে আপ্নারা কে কি বিচার করবেন সেটা নিয়ে আমি মোটেই দুসচিন্তাগ্রস্থ নই, না আমি ব্যথিত। কিন্তু কোন ঘটনা কোনদিকে কিভাবে মোড় নিয়ে কোথায় কোন ঝড়ে পরিনত হয় কিংবা কোথায় তা টর্নেডোর রূপ নেয় সেটা হয়তো আপনি উপলব্ধি করলেও করতে পারেন, আর না করলেও আমার জীবনের কোথাও এর প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না।

আমি বুঝতে চাইলাম তাঁর সেই ঘটনা যেখান থেকে আজকের পরিস্থিতির সৃষ্টি। বললাম, আমার হাতে অঢেল সময় আছে, আপনি সময় নিয়ে বলতে পারেন।

সাবিত্রী এবার তাঁর গল্পে মনোযোগ দিলেন-

-আমি তখন সবেমাত্র কিশোরী, কত হবে বয়স? হয়তো পনেরো কিংবা ষোল! আপনাদের শহুরে জীবনের সমাজের সাথে আমাদের গ্রামের জীবনের সমাজের মধ্যে এতো বিস্তর ফারাক যে, একই দেশ, একই আইন, একই সংবিধান তবুও কিছুই যেনো এক না। আপনি আপনার আদরের মেয়েকে লালন পালন করে ততোটুকু বড় করতে চান, কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান, যতটুকুতে আপনি ভাবেন, ততোটুকু করতে আপনি পিছপা হন না। যখন তাঁর সময় হয়েছে বিয়ে দেয়ার মনে করেন কিংবা ভাবেন-আপনার মেয়ে এবার নিজের পায়ে দাড়িয়েছে, তাঁর পাত্র খোজা দরকার, তখনই তাঁর জন্য যোগ্য পাত্র দেখা শুরু করেন। ছেলেপক্ষ থেকে শুরু করে পাত্রের চৌদ্দ গোষ্ঠীই শুধু নয়, তাঁর ইহকাল পরকালের সমস্ত বৃত্তান্ত ঘেটে অতঃপর মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজী হন। শুধু এখানেই শেষ নয়, মেয়ের মন নির্বাচিত পাত্রের জন্য রাজী কিনা সেটাও কয়েকবার তাকে প্রশ্ন করেন। আর পদ্ধতির বিস্তর সময়টা নেহায়েত কম নয়। হয়তোবা বিশ একুশ তো অতিক্রম করেই। কারো কারো বেলায় পচিশও অতিক্রম করে। আপনাদের সমাজে এই পচিশ বছরের অবিবাহিত মেয়েটিকে নিয়ে কেউ অশালীন মন্তব্য করে না, অন্যরকম চোখেও দেখে না। বরং সে যেনো একটা অধ্যাবশায়ের মধ্যে আছে, নিজেকে তৈরী করার পর্বে আছে, এমনটাই সবাই ভাবে। তাকে সম্মান করে, তাকে কেউ ঘুনাক্ষরেও বোঝা মনে করেনা। কিন্তু আমাদের বেলায়? আমাদের গ্রামের একটা মেয়ের বয়স যখন এগারো থেকে পনেরোতে উঠে যায়, সে তখন হয়ে উঠে লক্ষাধিক টন ওজনের একটা বোঝা। আমরাই আমাদের নিজের বোঝা বহন করতে পারি না। আমরা স্কুলে যাই শুধু পাশে একটা স্কুল আছে বলে, তাই। সেই স্কুলে যাওয়ার পিছনে আমার ক্যারিয়ারের কোনো পরিকল্পনা থাকে না, পড়াশুনা করে জজ ব্যারিষ্টার কিংবা ডাক্তার উকিল হবার স্বপ্ন থাকে না। যেটা থাকে সেটা যেনো কোনো রকমে বাজার সদাই করার হিসাবটা জানা। ব্যাপারটা এমন নয় যে, আমরা চাই না বড় হতে। এমন না যে, আমরা উন্নত জীবনের মর্ম বুঝি না। কিন্তু তাতে কি আসে যায়? আমাদের নিজস্ব কোনো চয়েজ নাই, নিজের কোনো স্বপ্ন নাই, না আছে কোনো শক্তি। এমন একটা পরিস্থিতিতে আমাদের অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে শিখতে হয়। আমিও সেটাই করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমার বিয়ে হয়ে গেলো এমন এক মানুষের সাথে যাকে আমি চিনতাম আমার জন্ম লগ্ন থেকেই। সে আমার খালাতো ভাই। তার সাথে আমার কখনোই এমন কোনো সম্পর্ক ছিলো না যাকে আমরা বলি-ভালোবাসা বা প্রেম। হয়তো তার পরিবারের উদারতা কিংবা আমার রুপের মুগ্ধতায় সে আমাকে বরন করতে চেয়েছিলো। কোনো অবস্থাতেই তার সাথে আমার যায় না, অন্তত বিয়ে করে সংসার করার মতো ব্যাপারে তো নাইই।

আমি সাবিত্রীকে কোনো প্রশ্ন করছিলাম না। আমি শুধু সাবিত্রীর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম আর শুনছিলাম সাবিত্রীর জীবনের গল্প।

-ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই হোক আর সামাজিকতা রক্ষার জন্যই হোক, আমি তার সাথে শেষ পর্যন্ত বিয়ে নামক সম্পর্ককে মেনেই নিয়েছিলাম। পড়াশুনার প্রতি আমার প্রচন্ড একটা আকর্ষন ছিলো। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় নাই। এখানে আরো একটা ব্যাপার না বললে হয়তো আমার অবস্থার কথাটা আপনি বুঝবেন না। আমার আরো তিনটা বোন ছিলো। আর ছিলো একটা ছোট ভাই। ভেবেছিলাম, আর যাইই হোক, আমার এই মেনে নেয়ার সিদ্ধান্তে আমার পরিবার বেচে যাবে একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে, আমি বেচে যাবো একটা অপয়া অপবাদ থেকে, কারন আমি সমাজকে ভয় পাই। কিন্তু তখনো আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারি নাই যে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো সম্পর্ক জুড়তে যাওয়া একটা ভয়ংকর পরিবেশের জন্ম দেয়। অনেক সময় প্রতিবেশি বা সমাজের সম্মান বাচানোর জন্য অনেক সময় এই ইচ্ছের বিরুদ্ধে সম্পর্ক গড়ে তোলতে হয় বটে কিন্তু সময়ের পাল্লায় এই সম্পর্ক একটা বোঝা হয়েই দাঁড়ায়। আমাদের সমাজে আজো এমন অনেক বিয়ে হয়ে থাকে যা শুধু পরিবারকে খুশি করার জন্য। যাকে অন্যের বাড়িতে পাঠানোর জন্য আমরা অনেক কিছু করতে পারি। আমরা তখন হাসিখুশী অববয়ব নিয়ে বিয়ের সব ফরমালিটিজ করে সুখী হবার ভান করি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমরা আসলে কেহই সুখী নই।

আমি সাবিত্রীকে এবার প্রশ্ন করি-তাহলে আপনি বিবাহিতা? কিন্তু আপনার এই বিবাহের খবর কি সবাই জানে? কারন, আমি যতটুকু শুনেছি- আপনি কখনোই বিবাহ করেন নাই। এমনটাই শোনা যায়।

সাবিত্রী আমার দিকে না তাকিয়েই ঘরের পূর্ব পাশের জানালা দিয়ে ওই দূরের মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুধু মাথানেড়ে উত্তর দিলো আর মুখে শুধু বল্লো

-ডিভোর্সী।

সাবিত্রী একটু চুপ থেকে আবার বলতে লাগলো

-একটা জিনিষ কি কখনো উপলব্ধি করেছেন? বিয়ের সময় দেখানো খুসি আর ভালোবাসার অভিনয়ে এটা কখনোই প্রমানিত হয় নাই যে, ভবিষ্যতে এই সুম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা বা ঘৃণা আসবে না। কখনো কখনো দেখা যায়, এই দেখানো ভালবাসা আর অভিনয় তাদের মধ্যে প্রকাশ্য ঘৃণা মারাত্তক বিষে রুপান্তরীত হয়। কেনো এমন হয়, আর কি না করলে এমন হতো না এটা আর আমাকে নতুন করে আপনাকে ব্যাখ্যা করার দরকার মনে করি না। এ সমাজের এমন ঘটনা বিরল তো নয়ই বরং অহরহ ঘটে যাচ্ছে আমাদের চারপাশে। এই মারাত্তক বিষ যখন ঘৃণার রুপে সম্পর্কের মধ্যে ঢোকে পড়ে, তখন সম্পর্কটায় তিক্ততার সীমা এমনভাবে ছাড়িয়ে যায়, যেখানে থাকে শুধু রাগ, জিদ আর আফসোস। ভিন্ন সমাজে কি হয় জানি না, তবে আমার কাছে বারবার মনে হয়েছে যে, যখনই এই সীমা বাড়তে বাড়তে অনেক বড় হয়ে সীমার বাইরে চলে যায়, তখন সতর্ক হওয়া প্রয়োজন যে এখন এই সম্পর্ককে শেষ করা উচিত। বুঝেশুনে বেরিয়ে আসা উচিত। যাতে তার আগে কোনো মারাত্তক অঘটন না ঘটে। কেননা প্রায়ই তিক্ত সম্পর্কগুলির ক্ষেত্রে বুদ্ধির জায়গায় হিংসা ঢোকে পড়ে, আর তখন কিসের সমাজ আর কিসের জীবন সেটার শোচনীয় পরাজয় ঘটে। নিজেকে শেষ করে দেয়া বা নিজের ঘৃণার মানুষটাকে শেষ করে দেয়াই যেনো মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এমন অনেক কিছু হয় যে, সেই দম্পতি যে একদিন ভালোবেসে কিংবা উদার মন নিয়ে খুব কাছে এসেছিলো, তারাই সম্পর্কের তিক্ততায় একজন আরেকজনকে চাকু, বন্ধুক চালাতে পিছপা হয় না। আমি সেটা পর্যন্ত আমার এই অসম দাম্পত্য জীবন চালিয়ে নিতে চাই নাই। কিন্তু আমার বাবা মা কখনোই আমার এই মনের ভিতরের আবেগটা বুঝতে চায় নাই। একটা বাবা মা যখন সন্তানের জন্য কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ এটা বুঝতে পারেন না, তাহলে সেই পরিবারে সেই সন্তান একটা অসুস্থ্য পরিবেশেই বড় হতে থাকে। আর অসুস্থ্য পরিবেশ শুধু সাস্থ্যকেই ক্ষতি করে না, মনকেও। আমি আমার নিজের মনের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম। এই জীবনে শুধুমাত্র একটা থাকার জায়গা হলেই হয় না, জীবনে বাচার জন্য নিঃশ্বাস ফেলার একটা জায়গাও লাগে। আমার কাছেও সেটাই একদিন চরমভাবে মনে হয়েছিলো যে, কিছু জিনিষ যা প্রতিনিয়ত মনকে কষ্ট দেয়, মানসিক শান্তি নষ্ট করে, সেসব কাহিনী চিরতরে ভুলে যাওয়াই ভালো। তাতে অন্তরে মানসিক কষ্টটা আর থাকে না।

-আমার জীবনের প্রতিটি দিন যেনো চলছিলো ঠিক এরকম যে, এক শিফটে উনুন, আর আরেক শিফটে বিছানায় কারো জন্যে অপেক্ষা করা যে কখনোই না আমার ছিলো, না আমি তার ছিলাম। এটাই কি গরিবের লাইফ। শ্বশুর বাড়িতে যে খালা আমার শাশুড়ি হিসাবে নতুন জন্ম হলো, তিনি ছাড়া আর কেউ যেনো আমার নয়। স্বামী সারাক্ষন বাইরে বাইরে থাকে, নেশার জগতে তাঁর এতোটাই বিচরন যে, কবে কি দিন, সেটার নাম পর্যন্ত তাঁর মনে থাকে না। যখন সে রাতে বাসায় আসে, মনে হয় শুধু শারিরীক চাহিদাটাই তাঁর প্রধান। সেটাও আমার স্বামীর পুরুপুরি ছিলো না। তারপরেও আমি চেষ্টা করেছিলাম মানিয়ে নেওয়ার। কিন্তু বারবার একটা কথাই আমার মনে, মাথায়, অন্তরে ঘুরপাক খাচ্ছিলো-আমার এই যৌবনের দাম, আমার এই জীবনের দাম যদি শুধু শরীর দিয়েই হয়, তাহলে আমি কেনো এমন জীবন বেছে নেই না যেখানে আমি অন্তত আমার মতো করে বেচে যেতে পারি? আর সেই বাচায় যদি কেউ আমাকে নিঃশ্বাস ফেলার একটা অবকাশও করে দেয়? কে চায় না তার জীবন আরো ভালো থাকুক?

-খুব বেশীদিন টিকে নাই আমার এই বৈবাহিক সম্পর্ক। আমি বদ্ধপরিকরভাবে একতরফা এবার নিজের জন্যেই নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যে জীবনকে সমাজ প্রোটেকশন দেয় না, যে সমাজ ব্যবস্থা আমার মতো কোনো নারীর দায়ভার গ্রহন করে না, যে সমাজে আমি নারী হয়ে একটা বোঝা ছাড়া আর কিছুই না, সে সমাজের কোনো আইন কিংবা নীতি আমার জন্যে না। আমার জীবন আমারই। আমি যদি বেচে থাকি, তাহলে সমাজ আছে, যদি আষ্টেপিষ্ঠে আমি প্রতিনিয়ত আমার সমস্ত অধিকার থেকে নিপীড়িত মানুষের মতো একটা পাশবিকবন্ধি জীবনই এই সমাজের নীতির কারনে মেনে নিয়ে সামনে এগুতে হয়, আমার সে জীবনের কোনো প্রয়োজন নাই, না সেটা আমার জীবন। আমার এ রকম সিদ্ধান্তের কারনে আমি ডিভোর্স চাইলাম। আমার এ সিদ্ধান্তে বারংবার বড় ছোট সবার কাছ থেকেই হরেক রকমের উপদেশ আর প্রশ্নের সম্মুখীন হইয়েছিলাম। কিন্তু সব উত্তর সবসময় তার প্রশ্নের ন্যায় বিচার করে না। বিশেষ করে প্রশ্নটা যখন এমন হয় যেটা মনকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খায়, আর হৃদয়কে ছুড়ি দিয়ে ফালা ফালা করে দেয়। কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তর যখন কারো জীবনের নাশ হয়ে দাঁড়ায় তখন সেই উত্তরের শেষ পরিনতি সম্পর্কে উত্তারদাতার অনেক ভেবেচিন্তে দেয়া উচিত। আমি আমার এই সম্পর্কের শেষ পরিনতি ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছিলাম যে, সমাজের চাপের কারনে নেয়া আমার সেই সম্পর্ক একদিন আমাকে অনেক চড়ামুল্য দিয়ে পরিশোধ করতে হবে। তখনো এই সমাজ আমার পাশে দাঁড়াবে না। তাই সবকিছু আমি অনেক ভেবে চিন্তেই আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম।

সাবিত্রী আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে এবার প্রশ্ন করলো- আচ্ছা বলতে পারেন বিয়েটা আসলে কি? এটা কি শুধু সহবাস? কিংবা জন্মদানের একটা পদ্ধতি? নাকি এর বাইরেও কিছু আছে?

সাবিত্রীর এই প্রশ্নের উত্তর আমি কিভাবে এতো অল্প পরিসরে দেই? সাবিত্রী আমার উত্তরের জন্য বসে রইলো না। আমি উত্তর দিতে উদ্যত হলেও সাবিত্রী যেনো সেই উত্তরের জন্য অপেক্ষায় ছিলো না। হয়তো সে জানে এর উত্তর। সাবিত্রী তাঁর নিজের হাতের বালাটায় একবার সামনে, একবার পিছে করতে করতে বলতে থাকলো-

-এমনিতেই প্রত্যেকটা মানুষ নিজের মতো করে বাচতে চায়। আর এই বাচার জন্য হয়তো অনেক আর্থিক ক্ষমতা না থাকলেও মানুষ যতটুকু ক্ষমতা আছে সেটার উপরেই ভরষা করে নিজের মতো করে নিজে বাচতে চায়। কিন্তু কিছু মানুষের মধ্যে কর্তৃত্ব করার প্রবনতা এমন বেশী থাকে যে, এই ধরনের প্রবৃত্তির কারনে অন্য কিছু মানুষ ধীরে ধীরে সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যেতে থাকে। এক সময় তারা একাই হয়ে যায়। আমিও এক সময় মনে হলো-একাই আমি। আমি যদি আসলে একাই হই, তাহলে পরাজয়ের গ্লানী টানবো কেনো?

-আমি জানি, দুটু মানুষকে জুড়ে দিয়ে একটা নতুন জীবন দেয়ার এই প্রথার নাম বিয়ে। বিয়েও কিন্তু একটা কন্ট্রাক্ট, দায়িত্তের কন্ট্রাক্ট, সরকারী অনুমোদিত একটা কন্ট্রাক্ট। হতে পারে এই কন্ট্রাক্টের মাধ্যমেই দুটু পরিচিত বা অপরিচিত মানুষ একজন আরেকজনের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শপথ করে। কিন্তু কারো হাত ধরে সামনে এগিয়ে যাওয়া মানেই কিন্তু উন্নতির দিকে যাওয়া সেটা কিন্তু নয়। আগে খুব জানা দরকার, হাত ধরা মানুষটি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। সাফল্যের সপ্ন, জীবনের আশা আর পরিশ্রমের পথ যদি যাত্রার পথ একদিকে না হয়, তাহলে আর যাই হোক, সাফল্যকে হাতে পাওয়া যায় না। আই লাভ ইউ বললেই শুধু ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসার বহির্প্রকাশ হয় তার কাজে আর বাস্তবে। অনেকে হয়তো আই লাভ ইউ বললেই ভাবে ভালোবাসা হয়ে গেলো, কিন্তু সেটা কি অন্তরের না শরীরে তা যাচাই করার কোনো দরকার মনে করে না। ভালোবাসা হচ্ছে সেটা যা কাছে থাকলে এর প্রয়োজন অনুভব করা যায় না, মনে হয় আছেই তো। কিন্তু যখনই চোখের আড়ালে যায়, মন শুধু আনচান করে আর প্রতীক্ষায় থাকে, কখন কাছে আসবে। ভালোবাসা, কোনো ড্রেস বা জুতা তো নয় যে ফিটিং হলো না আর শপিংমলে গিয়ে ফেরত দিয়ে আসবো। একটুখানি ময়লা হলো বা ফেটে গেলো তো আলমারীর ভিতর লুকিয়ে রাখলাম। কিন্তু ওই ড্রেস বা জুতু যদি ফিটই না হয় তো তাহলে আমরা কি করবো? আমরা তো সেটা পড়তেই পারবো না। আর যদি পড়তেই না পারি আবার ফেলতেও না পারি তাহলে তো আলমারী ছাড়া আর কোথায় রাখবো? তখন হয়ত অন্যদের মতো আমরা আরেকটা শার্ট বা ড্রেস কিনে পড়ে নেবো যা একদম ফিটিং। কিন্তু যেদিন আমি সমস্ত কিছু একপাশে রেখে ওর সাথে জীবন বেধেছিলাম, সেদিন থেকেই আমি পন করেছিলাম, যাইই হোক, আমি থাকবো। সেদিন থেকে আমি তো অন্য কারো কাছে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি নাই। কারো চোখে তাকানোর কথা ভাবতেই পারি নাই। অন্যের সাথে থাকা, অন্যের হাসি, অন্যের জন্য আমি তো কোনো সপ্নই দেখতে পারি নাই। কিন্তু পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে আমার ভাগ্যকে নিয়ে দাড় করিয়েছিলো যে, আমি হয়তো ওর হাতটা আজীবন ধরেই রাখতে পারতাম, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে, সেক্ষেত্রে আমার হাতটাই হয়তো কাটা যাবে।

-আমি আমার হাত কাটতে চাইনি। আমি আমাদের সম্পর্কটাকে কেটে দিয়েছিলাম। আর সেটা ছিলো শুধুমাত্র আমার একার সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমি জানতাম না, এর পরের কাহিনীটা কি। আমার কাছে কোনো আগাম পরিকল্পনা ছিলো না, না ছিলো কোনো উপায়। আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম অজানা কোনো এক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। আমার মা আমার এরুপ সিদ্ধান্তে অনেক শংকায় ছিলেন। আমার বাবা আমার এহেনো সিদ্ধান্তে আমাকে তাঁর মেয়ে বলেই পরিচয় দিতে যেনো অস্বীকার করছিলেন। আমার বাকী বোনেরা খুব ছোট ছিলো না যে, তারা বুঝে নাই আমার কি অবস্থা। কিন্তু তাদেরই বা কি করনীয় ছিলো? তারাই তো আমার থেকে আরো বেশী অসহায়। আমার বেরিয়ে যাবার সাথে আমার মা আমাকে একা ছাড়তে চান নাই। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেই ষ্টেশনের প্লাটফর্মে। আমি আমার গন্তব্য কোথায় আমি জানি না। আমার মা পাশের দোকানে এক বোতল পানির জন্য অপেক্ষায় ছিলো। আকাশ ভর্তি সাদা সাদা মেঘ এক জায়গা থেকে অন্যত্র উড়ে যাচ্ছিলো, দুপুরের রোদ তখন হালকা হয়ে আসছিলো, শান্ত এক অপরাহ্ণ কিন্তু আমার ভিতরে তখন চলছিলো ভয়ানক ঝড় যার নাম ভয়। কেউ কেউ আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিলো যার চাহনী আমি বুঝি। আমি নারী, আমি যুবতী, আমি তাদের নেশার চোখের অর্থ বুঝি। কেউ দয়ার অন্তর নিয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় নাই। না কেউ জানতে চেয়েছে, আমি এতো বিষন্ন কেনো। ঠিক এই সময়ে যে মানুষটি আমার দিকে এগিয়ে এসেছিলো- তাঁর নাম এই মুক্তার। প্রায় পঞ্চাশ বছরের একজন মানুষ কিন্তু বুঝার কোনো উপায় নাই তাঁর বয়স। পরিপাটি একটা জমকালো নীল শার্ট পড়া ভদ্রমানুষ এই প্রথম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-কে তুমি?

সাবিত্রী কথা বলতে বলতে যেনো হটাত একেবারেই থেমে গেলেন। ভরা নদীর জোয়ারের বানের মতো অকস্মাৎ সাবিত্রীর চোখের কোনে চিকচিক করা অশ্রু ফোটায় ফোটায় ঝরে পড়তে দেখলাম। সাবিত্রী কাদছে। আমি সাবিত্রীকে কিছুই বললাম না। সাবিত্রী তাঁর গায়ের ওড়না দিয়ে চোখের অশ্রুটা মুছলেন। চোখের পানির কোনো রঙ নাই। অন্তর পোড়া চোখের পানির রঙ যেমন, কষ্টে ভরা বেদনায় ঝরে পড়া চোখের পানিও একই রঙ এর। কে জানি বলেছিলো- বেদনার রঙ নাকি নীল। কিন্তু আমি সাবিত্রীর কষ্ট কিংবা বেদনায় সেই নীল রঙ দেখি নাই, শুধু দেখেছিলাম, আকাশটা বড্ড গোমরা আর সাবিত্রীর ভেজা চোখের দলায়িত পাপড়ি। আচ্ছা, সাবিত্রীরা কেনো কাদে?

বললাম-তারপর?

-সেদিন সেই প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে মুক্তার সাহেবের প্রশ্নের উত্তর কি দিয়েছিলাম, আমার আজ ষ্পষ্ট মনে নাই। কিন্তু আমার গলা ফাটিয়ে যেনো বলতে চেয়েছিলাম, আসলেই কে আমি? আমার অস্তিত্তই বা কি? আমার পরিচয়টাইবা কি? কারো মেয়ে? কারো বোন? কারো স্ত্রী? নাকি একটা শরীর যাকে ছিন্নভিন্ন করতে কাক, চিল, শকুনেরা তৈরী? আমার বর্তমানই যখন এতো ভয়ংকর, তাহলে ভবিষ্যত কি হবে আমার? হয়তো  আমি এই পৃথিবীর মধ্যে ভিনগ্রহের নাম না জানা এক অদ্ভুদ কেউ যা আমি নিজেও জানি না। তবে মুক্তার সাহেবের সেই ‘কে আমি’ এই প্রশ্নের মধ্যে যেনো সত্যিই একটা অবাক করার মতো সুর দেখেছিলাম। আমি তাঁর এই প্রশ্নের মধ্যেই যেনো ‘আমি’ লুকিয়েছিলাম। আমি তাঁর চোখের চাহনী পড়তে চেয়েছিলাম, আমি তাঁর আবেগের ভাষা পড়তে চেয়েছিলাম। অপরিচিত এককন্ঠ যেনো আমাকে চারিদিক থেকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো। খুবই অবাক হয়েছিলাম, মুক্তার সাহেবের জন্য। কিন্তু আমার অবাক হবার আরো অনেক কিছুর বাকি ছিলো। মা পানির বোতল নিয়ে আমার পাশে এসে মুক্তার সাহেবকে দেখে আমার মা এমন একটা উত্তর দিলেন যা আমি কখনো ভাবি নাই। আমার মা যেনো এই সমগ্র অসহায় পৃথিবীতে এমন কাউকে দেখলেন যেনো অন্ধকার রাতের দিকবিদিক হারানো কোনো নাবিকের সঠিক দিক পাবার এক আলোকবিন্দু। আমার মা অনেকটা বিহব্বল নেত্রে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন-

-ভাই এটা আমার মেয়ে, সাবিত্রী। কোথায় যাচ্ছে, কার কাছে যাচ্ছে, কি নিয়ে যাচ্ছে, কিছুই জানি না। শুধু এইটুকু জানি যে, সাবিত্রী ঘর ছড়ছে। এই যুবতী মেয়ে কোথায় যাচ্ছে, আমি ভয় পাচ্ছি, না জানি আবার কোথায় কি বিপদের মধ্যে পড়ে।

-সেই থেকে মুক্তার সাহেবের সাথে আমার পরিচয়। তাকে আমি আগে কখনোই দেখিনি। নাম শুনেছিলাম অনেক কিন্তু তাদের মতো মানুষেরা সবার সাথে যেমন মিশেন না, তেমনি অনেকেই তাদের অবস্থানের কথা ভেবে তারাও মিশতে হয়তো দ্বিধা করেন। তিনি আমাদেরই গ্রামের এক বড় ব্যবসায়ী। আমার মা তাকে চিনতেন। আমার মা মুক্তার সাহেবকে একটু আড়ালে নিয়ে কি যেনো বললেন বা বুঝালেন সেটা আমি জানি না। একটু পর তিনি আমাকে আমার নিজ গ্রামে ফিরে যেতে বললেন এই ভরষা দিয়ে যে, খুব অচীরেই তিনি আমাকে আমার মতো করে বাচার একটা সুযোগ করে দিবেন, আমি আবার পড়াশুনা করতে পারবো, নিজের পায়ে দাড়াতে পারবো। ব্যাপারটা ঘটে গিয়েছিলো একেবারে সবার অলক্ষ্যে। মুক্তার সাহেবের চোখে আমি অন্য কিছু কি সেদিন দেখেছিলাম যা অন্য দশটি পুরুষের মধ্যে দেখি? এটাও ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার ভাবনায় একটা কঠিন ছেদ পড়েছিলো। আমি আজো সেই দিনটির কথা ভাবি আর মনকে এটা বুঝাতে সক্ষম হই, জীবন আমার, সমাজ আমার নয়, জীবনের সব দুঃখ আমার আর সেটা আমি সমাজ থেকে পেতে চাই না, জীবনের সুখ আমার আর সেই সুখ আমি নিজের জন্য তৈরী করবো, সমাজের কোনো নিয়মের মধ্যে নয়। কোনো এক ঝড়ের সময় আমার উপড়ে যাওয়া ঘর যখন ঝড়ের শেষে বিলীন হয়ে যায়, সমাজের প্রতিটি মানুষ পাশে এসে শুধু মুখে আর ঠোটেই আহাজারী করে কিন্তু পুনরায় মেরামত করে যে, একটুখানী সহায়তা করবে সেটা আমার এই সমাজ নয়। বরং আমার সেই অসহায়ত্তকে কেন্দ্র করে আমাকে লুটে পুটে খাওয়ার একটা প্লট তৈরী করবে। যদি সেটাই হয়, তাহলে তো আমার সেটাই করা উচিত যা আমার সেই বন্ধুটি আমাকে সম্মানের সাথে বাচাতে চেয়েছিলো। প্রতিদান একটা মনুষত্যের ব্যাপার, আমার যা আছে তার বিনিময়ে সে যদি সত্যিকারভাবেই আমাকে সমাজের বাইরে গিয়ে এমন একটা জীবন দান করে যেখানে এই সমাজেই আমি একজন প্রগতিশীল মানুষ, শুধু নারীই নই, আমি একজন নীতিনির্ধারকও বটে, অথবা এমন একটা জীবন যেখানে সমাজের সব আইন আর কানুন আমার পায়ের নীচে পদায়িত, তাহলে কেনো আমি শুকনো রুটি দিয়ে গলা ফাসাবো? আর জল চাই, আমার ভালো পরিবেশ চাই। জীবন তো একটাই। সেতো আমাকে এটাই বলেছিলো যে, “আমি শুধু তোমার পাশে থাকতে পারি কিন্তু লড়াইটা তোমার, তোমাকেই লড়তে হবে। এটা বিজনেস নয়, এটা তোমার লাইফ।“ আমি যেনো সম্বিত ফিরে পেয়েছিলাম।

আমি সাবিত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম-তাহলে আপনি প্রথম থেকে নিজের ইচ্ছায় জেনে শুনেই কি মুক্তার সাহেবের সাথে একটা পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে যাচ্ছেন এটা জানতেন?

সাবিত্রী আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকী হাসি দিয়ে বললেন-

-‘সময়’ নতুন সম্পর্ক তৈরী করে। আবার “সময়” পুরানো সম্পর্ককে নতুন করে সাজিয়েও দেয়। তখন ওই সম্পর্ক যে আকার আর যে রুপ নিয়ে ফিরে আসে, সেখানে থাকে নতুন চেহারা, নতুন আবেগ, আর নতুন চরিত্র নিয়ে। কষ্টের সময় যারা পাশে থাকে, তারাই হয়তো নিজের ফ্যামিলি হয়ে যায়। সে এখন আমার প্রকৃত পরিবার। আমি ফিরে তাকাতে চেয়েছিলাম সেই গ্রামে, কিন্তু দেখেছি বারবার, গাছটা কেটে গিয়েছিলো হয়তো শিকরটা কেউ কাটতে পারে নাই সত্য। তারপরেও সেই শিকড়ের মায়ায় ঢালপালাহীন বৃক্ষ হয়ে ফিরে যাইনি সেখানে। গ্রামের সাথে আমার সাময়িক বিচ্ছেদ হয়ে গেলো।

আমি বললাম, তাহলে তো আপনি এখন একাই থাকেন। আর এখানে মুক্তার সাহেব নিশ্চয় আসেন, দেখা করেন এবং সময় কাটান, তাই না? আপ্নারা কি বিয়ে করেছেন দুজনে?

সাবিত্রী আমার প্রশ্নগুলি যেনো আগে থেকেই জানে এমন মনে হলো। আমার এমন প্রশ্নে সাবিত্রী না চমকালো, না নার্ভাস হলো। সাবিত্রীর কাছে মুক্তার সাহেবের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল সে ব্যাপারে সাবিত্রী যেনো ঝকঝকে পরিষ্কার ধারনায় ছিলো। কোনো রাখঢাক না করে সাবিত্রী বলতে থাকলো-

-একটা ব্রেকআপ শুধুমাত্র একটা ইংগিত যে, জীবনে রোমান্স ছাড়াও আরো অনেক সুন্দর উপহার আছে। যেগুলিকে আমাদের চিনতে হবে, খুলতে হবে, আর পুরু উপভোগ করতে হবে। আমার জীবনে সে ছিলো ঠিক সে রকমের একটা ব্যক্তিত্ত। আমি নারী, আমার মুল্য কারো কাছে হয়তো ঠিক ততোটা যতোটা আমি সক্ষম অবস্থায় দিতে পারবো। কিন্তু তার কাছে “নারী” ছিলো একটা দায়িত্ত, একটা অপরুপ মায়ার ভান্ডার। কতোটা আমি দিতে চাই, অথবা দিতে ইচ্ছুক সেটা তার কাছে জরুরী ছিলো না, তার কাছে জরুরী ছিলো সেটা যেটা আমার দরকার। একটা সম্মানীত জীবন। সমাজের কাছে আমার মাথা উচু করে দাড়াবার সিড়ি। কিন্তু আমি জানি আমার কি দেবার ক্ষমতা ছিলো। আসলে আমার কাছে কিছুই দেবার ছিলো না তার জন্যে। যা দিতে পারি সেটা তার হাতের কাছেই সারাদিন গড়াগড়ি যায়।

-একটা জিনিষ কি জানেন? জীবনে কাকে কতটা জায়গা দেবো সেটা ঠিক করে ফেলতে পারলে জীবনে আর কোনো সমস্যাই থাকে না। আর কার সাথে কি কমিটমেন্ট করা দরকার তার যদি কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকে, তখন জীবনের স্রোত সবসময় একই থাকে। পিছুটানের আর ভয় থাকে না। আর যখন পিছুটানের ভয় থাকে না, তার সামনে দ্রুত গতির শক্তিটাও ধীর গতি হয় না। যতোক্ষন যেটা ভালো লাগবে, ততোক্ষন সেটা চালিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আর যদি কখনো তাতে কোনো উলটা স্রোতের আভাষ পাওয়া যায়, হয় তাকে সমাধান করতে হবে, নতুবা নিজের পায়ের শক্তিকে জোরদার করতে হবে। কখনো কখনো বিয়েটার দরকার পড়ে না, দরকার হয় একটা সম্পর্কের। আর এই সম্পর্কে তখন গজে উঠে একটা বন্ধুত্তের অভ্যাস, মায়া। তখন যেটা হয়, একজন আরেকজনের কষ্টে বা বিপদে অন্য জন ততোটাই কষ্ট আর বিপদে থাকে যতোটা সে থাকে। অনেক সময় ঠিকানা ভুল হয় কিন্তু ওই ঠিকানায় যারা থাকে তারা হয়তো ঠিক লোক। আর এটাই সেই ঠিকানা যেটা ভুল কিন্তু সেখানে যিনি আসেন বা থাকেন, তিনি আমার জীবনের জন্য সঠিক। ভুল ঠিকানায় আমার সমস্ত জীবনের সঠিক মানুষটি বাস করে।

-আপনি আমাদের বিয়ের কথা জানতে চেয়েছিলেন, তাই না? তাহলে শুনুন। সামাজিক রীতির মাধ্যমে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ দুজন মানুষের মধ্যে কোনো একদিন তারা বিচ্ছেদ ঘটিয়ে মুক্ত হতে পারেন বটে, কিন্তু যখন সেটা ঘটেই না, তাহলে আপনি কিভাবে তা ভাংবেন? আমি এই সমাজের রীতির বাইরে গিয়ে তাঁরসাথে এমন এক সম্পর্কে নিজে চিরদিনের মতো আবদ্ধ হয়ে গেলাম, যেখানে আমি আছি আমার মতো করে, তিনি আছেন তাঁর মতো। অতীত ভুলে যাওয়া যায় না বটে কিন্তু সেই অতীত আমাকে যেনো আর কখনো দুক্ষে ভারাক্রান্ত না করতে পারে সেই বর্তমান আর ভবিষ্যৎ আজকের দিনের মানুষটি আমাকে সম্মানের সাথে গলায় পড়িয়ে দিয়েছে। আমি সুখে আছি। আজ সমাজ আমাকে ঘিরে নীতির ব্যাপারে পরামর্শ করতে চাইলেও আমি এই সমাজকে পরিবর্তনের কোনো উপদেশ দেই না কারন এই সমাজ কারো কোনো উপদেশ শুনে না, এই সমাজ কারো জন্যই কিছু করে না। যদি কেউ কিছু করতে দেখেন, বুঝবেন তাঁর সেই মহৎ উদ্দেশের পিছনে আছে কোনো সার্থপরতা। হতে পারে নাম ফলানোর জন্য, হতে পারে তা প্রচ্ছন্ন কোনো রাজনীতির এজেন্ডা বা হতে পারে তা তাঁর নিছক কোনো নেশা। অসহায় মানুষ গুলি সব সময় অসহায়ই ছিলো, আছে এবং থাকবে। কিন্তু ভগবানের একটা মজার কৌশল হলো-অসহায় মানুষ একদিন কারো না কারো হাত ধরে ঘুরে দাড়ায়ই, এটা সেই ভগবানের একটা লীলাখেলার ক্ষুদ্র অংশ। মুক্তার সাহেব ছিলেন, আমার ‘অলিখিত ভগবান’।

আমার স্পষ্ট মনে পড়লো, মুক্তার সাহেব তাঁর জবানবন্দীতে ঠিক এ রকম একটা শব্দ ব্যবহার করেছিলেন- ‘অলিখিত ভগবান’। সাবিত্রী নিজেও আজ ঠিক এ শব্দটাই ব্যবহার করলেন। খুব জানতে ইচ্ছে করলো এই ‘অলিখিত ভগবান’ কথাটার অর্থ আসলে কি? মুক্তার সাহেবের কাছ থেকে ব্যাপারটা জানতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তাঁর কথার তোড়ে ব্যাপারটা আর জানা হয় নাই। ভালোই হলো, অন্তত সাবিত্রীর কাছে এটার বিশদ ব্যাখ্যা জানা যাবে। আমি সাবিত্রীকে প্রশ্ন করলাম, এই অলিখিত ভগবান মানে কি?

অনেক ক্ষন হলো আমি সাবিত্রীর বাসায় এসেছি। সাবিত্রী নিজেও আমাকে এ যাবত কোনো চা পানি দিয়ে আপ্যায়ন করে নি আর আমিও ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। কিন্তু এখন মনে হলো, এক কাপ চা কিংবা কফি হলে ভালো হতো। সাবিত্রী আমার মনের কথা বুঝতে পারলো কিনা জানি না, কিন্তু সে আমাকে কথার এই ফাকে বল্লো- চলুন, এক কাপ চা খাই আর কথা বলি। ব্যাপারটা একেবারে কাকতালিয় হলেও আমার মনে হলো, সাবিত্রী আমার চায়ের তেষ্টাটা বুঝতে পেরেছে। কি জানি, আমার মুখের মধ্যে চায়ের চেষ্টা ফুটে উঠেছিলো কিনা আমি জানি না, আর কারো মুখে ক্লান্তির ছাপ বুঝা গেলেও চায়ের তেষ্টা কখনো ফুটে উঠে কিনা আমার জানা নাই। আমি মুচকী হেসে বললাম, কিভাবে বুঝলেন যে, আমার আসলেই চা পান করতে একটু ইচ্ছে হচ্ছিলো?

সাবিত্রী কিছুই না বলে রান্না ঘরের দিকে হেটে গেলো। আমি সাবিত্রীর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে বারান্দায় বসে অন্য এক ভাবনায় যেনো ডুবে গেলাম। কি অবাক করার মতো এক সম্পর্কে জড়িয়ে আছে এই দুটু মানুষ। কারো কোনো আফসস নাই, কষ্ট নাই, কনো দুঃখবোধ নাই। তারা নিজেকে নিয়ে নিজেরা খুব ভাল আছে। তারা আশেপাশের কোনো মানুশকে বিরক্ত করে না, কাউকে তাদের এই কষ্টের কিংবা সুখের সাথে ভাগাভাগিও করে না। এমন নয় যে, মুক্তার সাহেব তাঁর নিজের পরিবারকে সময় দেন না বা তাঁর দায়িত্তে কোনো অবহেলা করছেন। তাঁর ব্যবসায়িক কাজেও তিনি যে হেরে যাচ্ছেন তাও না। কোথাও কোনো গড়মিল নাই কিন্তু ব্যাপারটা সাভাবিক ভাবেও সমাজ মেনে নিচ্ছে না। হটাতই মনে হল, আমার কি এই তিনজনের বাইরেও অন্য কোনো কারো সাথে তাদের এমন সম্পর্কের ব্যাপারটা নিয়ে আরো গভীর তথ্য নেয়া দরকার? যেমন, মুক্তার সাহেবের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কিংবা সাবিত্রীর বন্ধু মহলের কাউকে? হতেও তো পারে যে, মুক্তার সাহেবের সাথে সাবিত্রীর এই সম্পর্কের কারনে অন্য কোথাও কিছু না কিছু প্রভাব ফেলছেই? ব্যাপারটা মাথায় এবং আমার নোট বইয়ে লিখে রাখলাম।

-এই নিন চা। সাবিত্রী চা বানিয়ে নিয়ে এসছে। সাথে কয়েকটা ভাজা কিছু।

আমরা ভাজা পুড়ি খেতে খেতে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম।

সাবিত্রী কথা শুরু করলো আবার।

-অলিখিত ভগবান নিয়ে কি যেনো বলছিলেন আপনি?

আমি বললাম, এই শব্দটা আমি মুক্তার সাহেবের কাছ থেকেও একবার শুনেছিলাম। আবার আপ্নিও ঠিক একই শব্দ ব্যবহার করলেন। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব রহস্যময় মনে হলেও খুব ইন্টারেষ্টিং বলে মনে হচ্ছে। যদি আপনি এই ‘অলিখিত ভগবান’ মানে কি বলতেন, তাহলে হয়তো আরো ভালো করে আমি আপনাদের সম্পর্কটার ব্যাপারে বুঝতে পারতাম।

সাবিত্রী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- মুক্তার সাহেব আপনাকে এই ‘অলিখিত ভগবান’ নিয়ে কি ব্যাখ্যা দিয়েছে, আগে সেটা শুনি।

আমি বললাম, মুক্তার সাহেব এই অলিখিত ভগবান শব্দটার কোনো ব্যাখ্যা দেন নাই। এড়িয়ে গেছেন।

সাবিত্রী হাসলো। তারপর বলতে থাকলো,

-দিন হোক আর রাত হোক, প্রাকৃতিক দূর্যোগ থাকুক আর নাইবা থাকুক, কোনো এক “লক্ষ্য”কে সফল করার জন্য যখন কেউ যাত্রা করে, আর যাত্রার পথে যখন সে কোন এক চৌরাস্তার মধ্যে এসে দাড়ায়, তখন লক্ষ্যের দিকে যেতে সে কোন রাস্তা বেছে নিবে সেটা নির্ভর করে রাস্তাটা সে চিনে কিনা বা তার ধারনা আছে কিনা। যদি জানা থাকে, তাহলে মুল লক্ষ্যে যেতে কোন অসুবিধা নাই, কিন্তু যদি সঠিক নিশানা জানা না থাকে, তাহলে তার ভুল রাস্তা বেছে নেবার কারনে তার মুল লক্ষ্য তো দূরের কথা ভুল রাস্তায় গিয়ে আরো কতই না বিড়ম্বনায় পড়তে হতে পারে, সেটা সে ঐ চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে কল্পনাও করতে পারে না। যে যাত্রার উদ্দেশ্য ছিলো মুল লক্ষ্যে পৌঁছানো, তখন আর তার সেই মুল জায়গায় পৌঁছানো হয়ত হয়ে উঠেই না, বরং এরপর থেকেই শুরু হয় প্রতিটি পদক্ষেপ ভুলে ভরা বিড়ম্বনা।  আর সেখানে পৌছতেই যদি না পারা যায়, তাহলে সেই সব যাত্রার কোন মুল্য নাই। তাই চৌরাস্তায় এসে কোনটা নিজের মুল গন্তব্যের রাস্তা তা জানা খুবই প্রয়োজন। নিজের এই চৌরাস্তার সঠিক দিক না জানার কারনে চলার পথে অনেকের কাছেই হয়তো আপনি সঠিক নিশানার দিক জানতে চাইতেই পারেন, কিন্তু সবাই যে আপনাকে সঠিক নিশানা দিতে পারবেন এটাও সঠিক না। হতে পারে কিছু আনাড়ি অপরিপক্ক আর অনভিজ্ঞ জ্ঞানহীন মানুষ সর্বজান্তার মতো মনে মনে আন্দাজ করে আর বুদ্ধিদীপ্ত কালো মুখোশ নিয়ে জ্ঞান গম্ভীর বিবেচনায় আপনাকে একটা ভুল রাস্তার দিকে প্রবেশ করিয়ে দিল। তার তো কোনো ক্ষতি হলো না, কিন্তু তাকে আপনি বিশ্বাস করে আপনি যে ক্ষতির মুখে পতিত হলেন, সেটার মাশুল অনেক বড়। আপনি না জানার কারনে ইচ্ছেমতো আন্দাজ করে যদি ভুল রাস্তায়ও যেতেন আর যতোটা ক্ষতিগ্রস্থ হতেন, এসব বিবেকহীন মানুষের কারনে আপনি একই রকম ক্ষতিগ্রস্থ হবেন সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নাই। তাই, কোন পথটা সঠিক আর কোন পথটা সঠিক নয়, এটা জানা অতীব জরুরী মুল লক্ষে পৌঁছানোর জন্য। এখানে আরো একটা বিষয় মাথায় রাখা দরকার যে, আপনার গন্তব্যস্থানের দিক সঠিকভাবে দেখিয়ে দেয়ার জন্য যে সবসময় বয়স্ক আর বুদ্ধিজীবি মানুষেরই দরকার তা কিন্তু নয়, হতে পারে একটা আনাড়ি বাচ্চাও আপনাকে সঠিক দিকটা দেখিয়ে দিতে পারে যা কোনো বয়স্ক ব্যক্তি যার ঐ রাস্তাগুলির সঠিক গন্তব্য দিক সম্পর্কে কোনো ধারানাও নাই। যেহেতু আপনি চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন, এবং আপনি জানেন না কোনটা আপনার রাস্তা, সেহেতু কারো উপর না কারো উপর আপনাকে নির্ভর করতেই হবে। আমার নিজ গন্তব্যের রাস্তা জানা ছিলো না কিন্তু লক্ষ্যটা জানা ছিলো। আর সেটা হল, আমি ভালোভাবে বাচতে চাই। আমি এই ক্রান্তিলগ্নে সবচেয়ে যার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলাম, সেটা আমার ঈশ্বর, আমার ভগবানের উপর। আর ঠিক সেই সময়েই আমার দেখা হয়েছিলো এই মুক্তার সাহেবের সাথে। তিনি হয়তো ভগবান নন, কিন্তু হয়তো আমার ঈশ্বর কিংবা ভগবান তাকেই প্রথম আমার পথের নিশানা খুজে দেয়ার লক্ষ্যে পাঠিয়েছিলেন। আমি ভুল গন্তব্যে পদার্পন করিনি। আমি অনেকবার মুক্তার সাহেবকে এ কথাটা বলেছিলাম যে, তিনিই আমার অলিখিত ভগবান। আমি ঈশ্বর দেখি নাই, আমি ভগবান দেখি নাই, কিন্তু আমি মুক্তার সাহেবকে দেখেছি। জানেন? আমি একবার মুক্তার সাহেবকে প্রশ্ন করেছিলাম-তিনি কি আমার শরীরের জন্যই আমাকে ধরে রেখেছেন? উনি খুব মন খারাপ করেছিলেন। অনেক দিন আর তিনি আমার কাছে আসেন নাই। কিন্তু যোগাযোগ রেখেছেন, আমার সব দিক মাথায় রেখেছেন, আমার কোনো কিছুতেই কোন অসুবিধা হোক সেটা তিনি হতেই দেন নাই। কিন্তু অনেকদিন আর আমার কাছে আসেন নাই। আমার মনে অনেক বেদনা জমেছিলো, আমি পানিশুন্য বৃক্ষের মতো মরুভূমিতে শুকিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি প্রতিদিন আমার অদৃশ্য ভগবানের কাছে শুধু একটা প্রার্থনাই করেছি-আমাকে আবার আরেকটা সুযোগ দাও হে ঈশ্বর। মুক্তার সাহেব আবার এসেছিলেন যেনো আমার ঈশ্বর আমার সাথে কথা বলছেন, আমাকে জড়িয়ে ধরছেন, সমস্ত মায়া, মহব্বত আর আবেগের চাদর দিয়ে মুড়িয়ে দিয়ে বলেছেন-আমি আছি তো। কিন্তু আমি তোমাকে একটুও ভালোবাসি না।

সাবিত্রী থামলেন। চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো আমার। খালী কাপটা নিয়ে সাবিত্রী আবারো রান্না ঘরে চলে গেলেন। আমি বারান্দায় বসে সাবিত্রীর রান্না ঘর থেকে টুং টাং শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। কিছুক্ষন পর সাবিত্রী ফিরে এলো। আমি সাবিত্রীকে কোনো কিছু বলার আগেই প্রশ্ন করলাম- যদি মুক্তার সাহেব আপনাকে ভালোই না বাসে, তাহলে উনি এখানে কিসের টানে আসতেন?

সাবিত্রী এবার আমার সামনের চেয়ারটায় বসতে গিয়েও বসলেন না। আমাকে কিছুক্ষনের জন্য অপেক্ষা করতে বললেন। এই বলে সাবিত্রী তাঁর অন্য একটি ঘরে প্রবেশ করলেন। প্রায় পনেরো বিশ মিনিট পর সাবিত্রী আবার ফিরে এলেন। তাঁর হাতে একটি কাগজ। বুঝা যাচ্ছে, খুব যত্ন করে রাখা একটি কাগজের বান্ডেল। সাবিত্রী কাগজটা আমার হাতে দিয়ে বললেন,

-নিন এটা পড়ুন। যখন মুক্তার সাহেব অনেকদিন আর আমার কাছে আসেন নাই, তখন তিনি আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। এটা আসলে চিঠি না, এটা মুক্তার সাহেবের ডায়েরীর একটা পাতার অংশ। তিনি সবসময় ডায়েরী লিখেন। যখন তিনি অনেকদিন আমার কাছে আসা বন্ধ করলেন, তখন আমি একবার তাঁর অফিসে গিয়েছিলাম। তিনি অফিসে ছিলেন না। পরে তিনি এই লেখাটা আমাকে পাঠিয়েছিলেন। আমি অনেক যত্ন করে এই লেখাটা রেখে দিয়েছি। তিনি কাকে উদ্দেশ্য করে এই লেখাটা লিখেছিলেন, আমার জানা নাই, তবে এটা তাঁর মনের ভিতরের একটা কষ্টের অনুভুতি ছাড়া আর কিছুই না। আমার যখন ম%

২/১২/২০২১-পায়ের নীচে পাথরহীন

জীবনের কাছে রাখা সব উত্তর সবসময় তার প্রশ্নের ন্যায় বিচার করে না। বিশেষ করে প্রশ্নটা যখন এমন হয় যেটা মনকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খায়, আর হৃদয়কে ছুড়ি দিয়ে ফালা ফালা করে দেয়। কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তর যখন কারো জীবনের নাশ হয়ে দাঁড়ায় তখন সেই উত্তরের শেষ পরিনতি সম্পর্কে উত্তারদাতার অনেক ভেবেচিন্তে দেয়া উচিত। আমার জীবনেও এমন একটা সময় এসেছিলো। আমার সব প্রশ্নের উত্তর হয়তোবা কারো জীবনের নাশ হবার সম্ভাবনাই ছিলো, ফলে উত্তরদাতা হিসাবে আমি কোনো উত্তরই দেওয়ার চেষ্টা করিনি। চুপ হয়ে থাকাই যেনো মনে হয়েছিলো-সর্বোত্তম উত্তর। আমি সেই “চুপ থাকা” উত্তরেই পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে এমন পরিবেশটাই তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলাম যেনো “কিছুই না ব্যাপারটা”। কিন্তু “ব্যাপারটা” যতো না সত্য ছিলো তার থেকেও বেশী ছিলো “চাপ” আর এই “চাপ” তৈরী করার পিছনে যারা কাজ করেছিলো তারা আর কেহই নয়, আমার দ্বারা পালিত সেই সব মানুষগুলি যাদেরকে আমি ভেবেছিলাম, তারা আমার সব “ওয়েল উইশার্স”। কিন্তু আমার আরো কিছু মানুষ ছিলো যারা আমার জীবনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে এমন করে জড়িয়েছিলো যারা আমার হাড় আর মাংশের মতো। আলাদা করা দুরুহ। সেই হাড় আর মাংশের মতো একত্রে মিলিত মানুষগুলি একটা সময়ে সেইসব তথাকথিত “ওয়েল উইশার্স”দের চক্রান্তে তাদের মস্তিষ্ক এমনভাবে বিগড়ে গিয়েছিলো যে, তাদের “সন্দেহ” টাই যেনো এক সময় তাদের অবচেতন মনে “বিশ্বাসে” পরিনত হয়। আর এই মিথ্যা “বিশ্বাসে” তাদের চারিপাশের শান্ত বাতাসগুলিও যেনো প্রচন্ড ঝড়ের চেহাড়া নিয়ে একটা কাল বৈশাখীতে রুপ নিয়েছিলো। কেউ বুঝতেই চাইতেছিলো না যে, এর শেষ পরিনতি বড়ই ভয়ংকর।

তবে আমি জানতাম সত্যিটা কি। কিন্তু ওইসব পরিস্থিতিতে আমার সব সত্য জানাটাই সঠিক এটা কাউকে যেমন বিসশাস করানো যায় নাই, তেমনি আমিও তাদেরকে বিশ্বাস করাতে চাইওনি। শুধু অপেক্ষা করেছিলাম-কখন ঝড় থামবে, কখন আকাশ পরিষ্কার হবে, আর দিবালোকের মতো সত্যটা বেরিয়ে আসবে। “সময়” পার হয়েছে, ধীরে ধীরে মেঘ কেটে গেছে, আমি আমার সাধ্যমতো সবকিছু আবার গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। গুছিয়েও ফেলেছি সেইসব ক্ষত বিক্ষত আচড়গুলি। কিন্তু আমি এই অযাচিত ঘটনায় একটা জিনিষ পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম যে, মনুষ্য জীবনে আসলে কেউ কারোই নয়। আমরা বাস করি শুধু আমাদের জন্য। একা থাকা যায় না, তাই সমাজ, একা থাকা যায় না, তাই পরিবার। একা অনেক অনিরাপদ, তাই সংসার। কিন্তু এই সমাজ, এই সংসার কিংবা এই পরিবার কোনো না কোন সময় ছাড়তেই হয়, আর সেটা একাই। এই মিথ্যে সমাজ, পরিবার আর সংসারের নামে আমরা যা করি তা নিছক একটা নাটক। জংগলে বাস করলে একদিন সেই জংগল ছাড়তেও কষ্ট হয়। এরমানে এই নয়, আমি জংগলকেই ভালোবাসি। কথায় বলে-ভালোবাসা পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর অনুভুতি, আর এটা যদি বেচে থাকে তাহলে হিংসা, বিদ্বেষ থেকে মানুষ হয়তো মুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু আমরা যারা এই সমাজ নামে, পরিবার নামে, কিংবা সংসার নামে চিহ্নিত করে ভালোবাসার জাল বুনে থাকি সেটা আসলে কোনো ভালোবাসাই নয়। সেখানে থাকে প্রতিনিয়ত নিজের সার্থের সাথে অন্যের লড়াই। অন্যঅর্থে সেটা একটা পাগলামী, লালসা কিংবা একা বাচতে চাওয়ার অনিরাপদের একটা অধ্যায় মাত্র। অথচ আমরা প্রত্যেক মুহুর্তে আমাদের এই নিজের পরিবারকে নিরাপদে রাখার জন্য অনেক অপবাদ, অনেক ভয়ংকর বাধা আর মৃত্যুর মতো রিস্ককে বরন করে থাকি। এ সবই আসলে নিজের সার্থে।

যাই হোক যেটা বলছিলাম, আমার সেই ফেলে আসা অভিজ্ঞতার আলোকে আমি ধীরে ধীরে সে সব “ওয়েল উইশার্স” দেরকে নিজের বেষ্টনী থেকে দূরে রাখার প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেছি। আমি একটা মুহুর্তেও সেই সব দিনের ক্ষত বিক্ষত হবার বেদনার কথা ভুলি নাই। যখনই সেই ব্যথার কথা মনে হয়েছে- আমি বারবার আরো শক্ত হয়েছি। আমি জানি কন এক সময় আবারো তাদের আমার প্রয়োজন হবে, আবারো তারা আমাকে আকড়ে ধরার চেষতা করবে, আবারো তারা তাদের মিথ্যা চোখের পানি ফেলে আমাকে আবেশিত করার চেষ্টা করবে। আমি ততোবার নিজেকে বারন করেছি-আর যেনো সেই একই ফাদে পা না বাড়াই। তাহলে সেটা হবে আমার জীবনের জন্য কালো আধ্যায়।

ওরাও হয়তো ভেবেছিলো- কোনো প্রয়োজন নাই আর আমাকে। আমি কোন দুঃখ পাইনি। শুধু ভেবেছি, খুব ভালো যে, তারাই গুটিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু এই প্রিথিবীর সবচেয়ে বড় বিপত্তি এই যে, বড় বট বৃক্ষের প্রয়োজন কখনো কোনোদিন কোনো কালেই ফুরিয়ে যায় না। হোক সেটা হাজার বছরের পুরানো কোনো বৃক্ষ।

আজ সেই দিনটা এসেছে। অথচ আজ আমার সব দরজা এমন করে খিল দিয়ে আটকানো যে, না আমি খুলতে চাই, না খোলার প্রয়োজন মনে করি। পৃথিবীতে নিমক হারামের চেয়ে বড় পাপ অথবা বড় বিশ্বাসঘাতকরা আর নাই। যে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে কেউ আকাশ দেখে, সেই পাথকে যত্ন করে রাখতে হয়। যদি অযত্নে সেই পাথর কোথাও হারিয়ে যায় বা ব্যবহারের আর উপযোগি না হয়, তাহলে আকাশ যতো সুন্দরই হোক না কেনো, তাকে দেখার ভাগ্য আর হয় না। যদি কেউ আজিবন আকাসের জ্যোৎস্না, আকাসের তারা আর নীল আকাশের মধ্যে তারার মেলা দেখার ভাবনা থাকে, তাহলে সেই পাথকে অতোতাই যত্ন করা দরকার যতোটা মনে হবে তার মনের শখের দরকার। তা না হলে চোখের জলে বুক ভাসবে ঠিক কিন্তু কেউ তার নিজের পাথর দিয়ে তার আকাশ দেখা বন্ধ করে অন্যকে পাথর দিয়ে সাহাজ্য করে না। এতাই নিয়ম।

আজ তারা সেই পাথরটাকে হারিয়ে ফেলেছে বন্ধ দরজার অন্ধকার ঘরে। যেখানে না যায় দরজা খোলা, না যায় পাথরে পা রাখা। তোমাদের জন্য নতুন আরেক অধ্যায় শুরু। এবার এই দুনিয়াটাকে বড্ড অসহায় মনে হবে তোমাদের। তোমাদের প্রতিন মনে হবে- তোমরা কোথায় কি পরিমান ক্ষতি নিজেদের করেছো যার সমাধান কখনোই তোমাদের হাতে ছিলো না। তোমরা ভেবেছিলে- তোমাদের জন্য মায়ের চেয়ে মাসির দরদ সম্ভবত অনেক বেশী। কিন্তু এই দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত মায়ের চেয়ে মাসির দরদ কখনোই বেশী ছিল বলে এটা কেউ যেমন প্রমান করতে পারে নাই, আর এতা সত্যও নয়। যদি সেটাই তোমরা মনে করে থাকো- তাহলে আজ তোমাদের সেই মাসির কাছেই তোমাদের সমস্ত কিছু আবদার, চাহিদা, কিংবা সাহাজ্য চাওয়া উচিত যাকে তোমরা বিনাবাক্যে মনে করেছো, লিডার অফ দি রিং। দেখো, সেই লিডার অফ দি রিং তোমাদের জন্য কোনো সাহাজ্য পাঠায় কিনা। আমার দরজা তোমাদের জন্য আর কখনোই খোলা হবে না। আমি শুধু দেখতে চাই, আসলেই তোমরা কাকে চেয়েছিলে? কার উপরে তোমাদের এতো নির্ভরশীলতা ছিলো আর কার গলায় পা রেখে শ্বাস রোধ করেছিলে। আমি তো সেদিনই মরে গেছি যেদিন তোমরা আমাকে আমার অজান্তে পিছন

রুস্তমের চিঠি

আমার ড্রাইভার ছিলো রুস্তম। একবার রুস্তম আমারে বল্লো যে, ওর কাছে যদি ৩ লাখ টাকা থাকে তাহলে ওর জীবন নাকি সে বদলিয়ে ফেলবে। খুব ভালো কথা। বললাম, ৩ লাখ টাকা যদি পাস, তাহলে কি করবি? রুস্তম বল্লো যে, সে ২টা পুরানো সিএনজি কিনবে। একটা নিজে চালাবে আরেকটা ভাড়ায় চালাবে। তাতে প্রতিদিন সে পাবে ১২০০ টাকা। তারমানে মাসে ৩৬ হাজার টাকা। ওর খরচ লাগে মাসে ১৬ হাজার টাকা। তারমানে মাসে সে ২০ হাজার সেভ হবে। বছরে সেভ হবে আড়াই লাখ টাকা। সেই আড়াই লাখ টাকা দিয়া সে আরেকটা পুরানো সিএনজি কিনবে। এভাবে ২/৩ বছর পর সে গাড়ি কিনবে। যদি গাড়ি কিনে, তাহলে ওর প্রতিদিন লাভ হবে ২ হাজার টাকা। এভাবে সে হিসাব করে দেখলো যে, ৫ বছর পর তার হাতে আসবে প্রায় ২০ লাখ টাকা, ৩ টা সিএনজি আর একটা গাড়ি। হিসাবটা একদম ঠিকঠাক ছিলো। কিন্তু শুধু একটা জায়গায় হিসাবটা শুরু করা যাচ্ছিলো না। প্রাথমিক ৩ লাখ টাকা সে পাবে কোথায়?

রুস্তম আমার অনেক দিনের ড্রাইভার। প্রায় ৭ বছর। এই বছর গুলিতে আমি এমনো হয়েছে যে, ব্যবসার জন্য কোটি কোটি টাকাও ওকে দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠিয়েছি। ফ্যাক্টরীর সেলারী আনার সময় কিংবা সাব কন্ট্রাক্ট ফ্যাক্টরীতে ইমারজেন্সী ভাবে টাকা অয়াঠানোর জন্য। কোনোদিন রুস্তমের মধ্যে কোনো গড়বড় দেখি নাই। কিন্তু একদিন-সে আমার ব্যাগ থেকে ৩ লাখ টাকা চুরি করে পালালো।

চুরি করার পর এক মাস পালিয়ে পালিয়ে থাকলো। অনেক খুজাখুজি করেছি, ওর গ্রামের বাড়ি, ওর বর্তমান শশুর বাড়ি, কিংবা ওর প্রাক্তন শশুড় বাড়িতেও। কিন্তু রুস্তমের কোনো হদিস পাওয়া যায় নাই। অগত্যা মনের রাগ মিটানোর জন্য ওর নামে একটা চুরির মামলাও করেছিলাম। কোথাও না পেয়ে আমি ওকে খোজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম এই কারনে যে, রুস্তম যদি ঐ ৩ লাখ টাকা কাজে লাগিয়ে কিছু করতে পারে, তাহলে করুক। ব্যাপারটা নিয়ে আমি আর কোনো আক্ষেপ বা রাগ রাখতে চাই নাই। 

 অতঃপর প্রায় ৫ মাস পরে একদিন আমি একটা বিশাল চিঠি পেলাম। ২২ পাতার চিঠি। চিঠিটা আমি পড়তে চাইনি কিন্তু চিঠিটার প্রথম লাইনেই যে কথাটা লিখা ছিলো, তার জন্যই আমি পুরু চিঠিটা পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। আর সে লাইনটা ছিলো- “যেদিন আপনি চিঠিটা পাবেন, সেদিন হয়তো আমি আর বেচে নেই স্যার। কিন্তু একটা কথা বলে যাই, আপনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু আমার সাহস কম, তাই আর বাচতে পারলাম না। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন”।

 যেদিন আমি চিঠিটা পাই, তার প্রায় ৪ দিন আগে রুস্তম তারের কাটা গলায় ফাসি দিয়ে আত্তহত্যা করেছিলো। আমার প্রায়ই ওর কথা মনে পড়ে। আমি ভাবি যে, যদি রুস্তম সাহস করে আবার আমার কাছে আসতো, আমি ওকে আবার রাখতাম আমার ড্রাইভার হিসাবে। আমি ওরে ক্ষমা করে দিছি। আমিও ওকে ভালোবাসতাম। কিন্তু আমার ভালোবাসা ওকে ঠেকাতে পারে নাই। এটা আমার ব্যর্থ তা নাকি ওর ভীরুতা আজো আমি বুঝতে পারি নাই। কিন্তু এটা ওরও ব্যর্থতা।

 রুস্তম মাঝে মাঝে খুব ভালো কবিতা লিখতো। আর ড্রাইভিং করার সময় আমাকে মুখস্ত ওর লেখা কবিতা শুনাতো। আমি অবাক হতাম, রুস্তম খুব ভালো কবিতা লিখে। প্রথম প্রথম ভাবতাম, সম্ভবত রুস্তম কারো কবিতা চুরি করে, কিন্তু পরে বুঝেছি- রুস্তম আসলেই লিখে।

 রুস্তমের লেখা ২২ পাতার চিঠির কিছু চুম্বক অংশ আমি তুলে ধরি।

 জীবনে সেসব মানুষের সাথে কখনো লুকুচুরী, মিথ্যা, ছলচাতুড়ি, কিংবা কল্পকাহিনী বলে সাময়িকভাবে ভুল বুঝানো উচিত না যারা আমাদের সুখের জীবনের জন্য নিসসার্থভাবে তাদের অনেক মুল্যবান সময়, পরিশ্রম আর অর্থ দিয়া সাহাজ্যের হাত বাড়ায়। যদি পথ চলতে গিয়ে কিংবা তাহাদের নির্দেশনা মানতে গিয়ে কিংবা কোনো লোভে পড়ে নিজের অজান্তে ভুল করে ফেলে, হয়তো সেটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব কিন্তু যদি সেই ভুল হয় ইচ্ছাকৃত, তাহলে সেটা হবে পাপ, অপরাধ এবং ক্ষমার অযোগ্য। যারা আমাকে ভালোবেসে, স্নেহ করে অথবা আমাদের দরিদ্র মানুষের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের পাশে এমনভাবে দাঁড়ান যা হয়তো তাদের দাড়ানোর কোনোই প্রয়োজন ছিলো না, তবুও দাড়ান। তাহাদের সাথে এরূপ কোন ইচ্ছাকৃত অপরাধ আমাদের সারা জীবনের জন্য এমন মারাত্তক হুমকী হয়ে দারায় যা কোনো কিছুর বিনিময়েও আর আগের অবস্থায় ফিরে পাওয়া সম্ভব না। এই মারাত্তক ইচ্ছাকৃত ভুলের জন্য যদি কেউ ক্ষমাও করে দেন, তারপরেও বিশ্বাসের যে ক্ষত সৃষ্টি হয়, তা দগদগে ঘায়ের থেকেও বেশী। তখন তাদের প্রতিনিয়ত মনে হবে, এই মানুষ উপকারের কথা বুঝে না অথবা সে নির্বোধ অথবা সে উপকারীর জন্য অনেক হুমকীস্বরূপ। এই বিবেচনায় কোনো হিতৈষী যদি আমাদের পাশ থেকে নিঃশব্দে সরে যায়, তাকে আর কোনো কিছুর শপথের মাধ্যমেও আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা যায় না। তখন যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, নিজের উপর নিজের রাগ, অভিমান আর কৃতকর্মের জন্য অপরাধবোধ। এই সময় যা হয়, তা হচ্ছে, হতাশা ক্রমশ বাড়তে থাকে, আর এই হতাশা যখন বাড়ে, তাহার সাথে বাড়ে দুশ্চিন্তা। দুসচিন্তা থেকে জন্ম নেয় নিজের উপর নিজেকে ঘৃণা। আর একবার যখন নিজেকে নিজে ঘৃণা করতে কেউ শুরু করে, তখন তার আর বেচে থাকার কোনো লোভ থাকে না। চারিপাশের কোনো মানুষকেই আর ভালো লাগে না, নীল আকাশ ভালো লাগে না, রংগীন আলো ঝলমলের শহরকে তখন বড় অচেনা মনে হয়। মানুষ তখন আত্মহননের দিকে ঝুকে যায়। অথবা সে এমন পথ বেছে নেয়, যা সমাজের চোখে বড়ই অসুন্দর আর কুৎসিত। সব কুতসিত জীবনের কাহিনী প্রায় একই। কোনো না কোন সময়ে তাদের সুযোগ এসেছিলো কিন্তু তারা না বুঝবার কারনে সে সুন্দর জীবন হাতছাড়া করেছে। পাপ কাজ করে কেউ কখনো বড় হতে পারে নাই, আর হয়ও না। তাদের হয়তো টাকার পাহাড় থাকতে পারে কিন্তু তাদের জন্য সমাজ দুঃখবোধও করে না। তারা সারাজীবন সমাজের একটা কালো মানুষ হিসাবেই বেচে থাকে।

স্যার, আমি এই মুহুর্তে ঠিক সে রকম একটা কাল পার করছি। টাকাগুলি আমার কোনো কাজে লাগে নাই। মদ খেতে খেতে কখন বেহুস ছিলাম বুঝি নাই, যখন হুস হয়েছে, দেখলাম সবগুলি টাকা আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে। কে নিয়েছে, কখন নিয়েছে সেই জ্ঞানটুকুও আমার ছিলো না। আমি আপনার থেকে এখন অনেক দূরে। পরিচিতজন মানুষের আশেপাশেও আমি নাই। ড্রাইভিং চাকুরী করতে পারতাম, কিন্তু করতে সাহস করি নাই। কখন আবার আমি আপনার সামনে পড়ে যাই, তাই। প্রতিটা ক্ষন আমি পালিয়ে পালিয়ে থেকেছি। কখনো ক্ষুধা পেটে কোনো এক পরিত্যাক্ত বিল্ডিং এর মশাদের সাথে, কখনো কোনো গাজার আসরে, কখনো একেবারে একা কোনো এক নদীর ধারে সময় কাটিয়েছি। এমন কোনো একটা মুহুর্ত আমার যায়নি, যখন আপনার কথা আমার মনে পড়ে নাই। বারবার ভেবেছি- কি দরকার ছিলো এমনটা করার? যখন যা চেয়েছি, আপনার কাছ থেকে আমি পাইনি এমন ছিলো না। তারপরেও আমার এমনটা করার কোনো দরকার ছিলো না।

চিঠিটা পড়তে পড়তে আমারো খুব খারাপ লাগছিলো। অনেক বড় চিঠি। সব কিছু এখানে হয়তো লিখা সম্ভব নয়। ১৯ পাতার কিছু অংশে এসে আমি একদম নিসচুপ হয়ে গেলাম। রুস্তম লিখেছে-

স্যার, এ কয়দিন বারবার শুধু একটা কথাই আমার মনে হয়েছে। যখন আপনি গাড়িতে উঠতেন, প্রথমেই জিজ্ঞেস করতেন, আমি খেয়েছি কিনা। আজ অবধি কেউ আমাকে এ কথাটা কেউ কখনো জিজ্ঞেস করে নাই। আজ প্রায় ৩ দিনের উপরে পার হয়ে গেছে, আমি একটি দানাও খাই নাই। মুখ ভর্তি দাড়ি, গোসলের কনো জায়গা নাই, এলোমেলো মাথার চুল, নোংরা আমার জামা। আমার সাথে রাস্তার পাগলের মধ্যে কোনো তফাত নাই। যখন আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিতাম, বলতেন- বাসায় গিয়ে রেষ্ট করো, সকালে নাস্তা খেয়ে চলে এসো। আজ আমাকে কেউ বলে না- সকালে চলে এসো। অথচ মনের ভিতরে অদম্য ইচ্ছা, যদি আবার আপনার কাছে চলে আসতে পারতাম? কোথাও আমার কেউ নাই। সম্ভবত আপ্নিই ছিলেন আমার সবচেয়ে কাছের একজন মানুষ যাকে আমি ভালোবাসতাম, আবদার করতাম, জিদ করতাম কিন্তু খুব পছন্দও করতাম। আপনার মেয়েরাও আমাকে খুব সম্মান করতো। কখনো ওরা আমাকে ড্রাইভার হিসাবে দেখে নাই। কি লক্ষী মেয়েগুলি। আংগকেল ছাড়া কখনো ডাকতো না। আজ কেনো জানি মনে হচ্ছে- ইশ, যদি আবার ফিরে আসতে পারতাম!! কিন্তু আমার মনের সাহস নাই, শরীরে বল নাই, আর আপনার সামনে দাড়াবার আমার কোনো জায়গাও নাই। এ কয়দিন মাথায় শুধু একটা জিনিষ ঘুরপাক খাচ্ছে- কি লাভ এ জীবন রেখে? কিন্তু মরার জন্যেও কিছু উপকরন লাগে। ফাসি দিতে হলে দড়ি লাগে, বিষ পান করে মরতে হলে বিষ কিনতে হয়, কিন্তু আমার কাছে বিষ কেনার ও পয়সা নাই। আর সাতার জানা মানুষ নদীতে ঝাপ দিলেও মরে না।

আমি রুস্তমের চিঠিটা পড়ছি, আর খুব ভয় পাচ্ছিলাম। রুস্তম তার চিঠির ২১ পাতায় লিখেছে-

জীবনকে ভালোবাসবার অনেক নাম আছে। কখনো এর নাম চেলেঞ্জ, কখনো এর নাম সততা আবার কখনো এর নাম বিশ্বাস। স্যার,  সব হাসিই হাসি নয়। যেদিন আমি টাকাটা নিয়ে পালিয়েছিলাম, সেদিন আমি হেসেছিলাম আনন্দে। অথচ আজ আমি কাদতেছি কেনো আমি টাকাটা নিয়ে পালালাম। আসলে আমার এই কান্না কান্না নয়। এই কান্নার নাম হয়তো ভয়। আর সব ভয়ের চেহারা এক। যার নাম- আতঙ্ক। এই আতংকে মানুষ অসুস্থ হয়, মানুষের রুচী কমে যায়, এক সময় দেহ দেহ মন দুটুই ভেংগে যায়। দেহ ভাঙ্গার সাথে সাথে মানুষ মানসিকভাবে দূর্বল হয়, এক সময় পানির অভাবে যেমন কচি গাছের মরন হয়, তেমনি এই আতংকগ্রস্থ মানুষগুলিও মৃত্যু বরন করে। তাদের জন্য কেউ আর পিছনে তাকায় না। খুব কষ্ট আর ব্যথা নিয়ে স্যার আমি চলে যাচ্ছি। পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। এর গাছ পালা, আকাশ, নদী, পাহাড় সব সুন্দর। সবচেয়ে সুন্দর ছিলেন স্যার আপনি। আমি আপনাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভালোবাসবো। খুব বাচতে ইচ্ছে করছিলো স্যার কিন্তু যারা সাহসী নয়, তাদের বেচে থাকবার কোনো প্রয়োজন নাই এই পৃথিবীতে। আমি আসতে চেয়েছিলাম আবার আপনার কাছে কিন্তু সম্ভব হলো না। যদি কখনো পারেন- আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। যেদিন আপনি চিঠিটা পাবেন, সেদিন হয়তো আমি আর বেচে নেই স্যার। কিন্তু একটা কথা বলে যাই, আপনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু আমার সাহস কম, তাই আর বাচতে পারলাম না। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। যে তিন লাখ টাকায় আমার এতো হিসাব ছিলো, জীবন সুখের হবে, নিজের গাড়ি হবে, অনেক টাকা হবে, সেই তিন লাখ টাকাই আসলে আমার জীবন একেবারে পালটে দিলো। আপনার সাথে আমার জীবনটা তো ভালোই ছিলো। বিশ্বাস করেন স্যার, আজ ঠিক মৃত্যুর আগ মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আমি একটা জিনিষ শিখে গেলাম, জীবনে সব মানুষের সাথে ছল চাতুড়ি করতে হয় না, এই দুনিয়ায় টাকাই সব নয়। আপনার মতো এমন একটা মানুষের পাশে শুধু থাকলেই হতো। বট বৃক্ষের মতো ছিলেন।

------------------------------------------------------------------------------------

চোখ দিয়ে কখন যে পানি পড়ছিলো, বুঝি নাই। আমিও রুস্তমকে স্নেহ করতাম, ভালোবাসতাম। কিন্তু ওকি একবার সাহস করে আবার ফিরে আসতে পারতো না? আমি ওর শেষ ঠিকানাটা জানলে হয়তো নিজেই ডেকে নিতাম। ভুল তো মানুষ করেই। কিন্তু সেটা জীবন দিয়ে মাশুল দেয়ার মতো শাস্তিতে নয়।

 

(আমি রুস্তমের চিঠিটা ছিড়ে ফেলিনি। আজ আমার সব পরিত্যাক্ত কাগজপত্র ড্রয়ার থেকে পরিষ্কার করতে গিয়ে রুস্তমের সেই ২২ পাতার চিঠিটাও পেলাম। সেটা আজ আমি ছিড়ে ফেললাম।)

 

০৯/০৯/২০২১-১০০ বছর পর আগামীকাল

আজ থেকে ১০০ বছর পর ঠিক এই সময়ে যারা বেচে আছি আমরা, তাদের প্রায় শতভাগ মানুষ আর এই পৃথিবীতেই থাকবো না। হয়তো খুবই নগন্য কিছু সৌভাগ্যবান অথবা অন্য অর্থে দূর্ভাগ্যবানও বলা যেতে পারে, তারা বার্ধক্যের বোঝা মাথায় নিয়ে ক্ষীনদৃষ্টি আর দূর্বল শরীর নিয়ে হয়তো এমন কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকবেন যা তিনি কখনো চান নাই। যার নাম ‘মৃত্যু’।

ক্যালেন্ডারের পাতা প্রতিদিন পালটে যাবে, তাঁর সাথে সাথে পালটে যাবে তারিখ, মাস, বছর এবং অতঃপর যুগ। কেউ এটাকে আমরা থামাতে পারি না, পারবোও না। আর কেউ পারেও নাই। হোক সে কোনো প্রতাপশালী সেনাপতি, হোক সে চৌকস কোনো রাজনীতিবিদ বা রাষ্ট্রনায়ক। শুধু তাই নয়, কোনো বিজ্ঞান কিংবা কোনো বিজ্ঞানিক, কোনো সর্বোচ্চ পদধারী ধার্মিক নেতা কিংবা দূধর্ষ সাহসী সন্ত্রাসী কেউ এই অমোঘ প্রাকৃতিক নিয়মটাকে উপেক্ষা করে অগোচরেও পরিবর্তন করার কোনো ক্ষমতা রাখে না।

আজ যারা পথে ঘাটে আমার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে, তাদের কেউ হয়তো কোট টাই, কেউ হয়তো আধুনিক পোষাক আষাকে, কেউ আবার ফুটপাতে নোংরা চুলে আছেন, আমি তাদের অনেককেই হয়তো চিনিও না আবার হয়তো কাউকে কাউকে আমরা সর্বদাই দেখি, চিনি, এদের কেউও এই নিয়ম থেকে পরিত্রান পাবে না। মহাশ্মশানের সারিসারি পাথরে নাম লেখা কোনো এক নাম ফলকের মধ্যেই আমরা লুকিয়ে যাবো ঠিক সেইস্থানে যার কথা আমরা আজ ভাবতেও পারি না। সেখানে যেমন কোনো আধুনিক পোষাক বলতে কিছু থাকে না, আর না থাকে কোনো ধার্মিক ব্যক্তির আলখেল্লাটাও। অনেকের বেলায় হয়তো সেই নামফলকটাও থাকবে না। কোথায় আছেন তারা, কার জায়গায় আছেন তাঁরও কোনো হদিস হয়তো পাওয়া যাবে না। আজ যে শরীরটাকে প্রতিদিন নোংরা মনে করে দেশী বিদেশী সাবান শ্যাম্পু দিয়ে সুগন্ধী মাখছি, তখন এই শরীরের মধ্যে হাজারো পোকা মাকড়, কর্দমাক্ত মাটি, নোনা জল, অপরিষ্কার জলের সাথে ভেসে আসা দূর্গন্ধময় আবর্জনায় সারাটা শরীর ভেসে গেলেও তাকে আর সুগন্ধী কেনো, সরানোর মতোও আমাদের কোনো শক্তি থাকবে না। শরীরে মাংশ পচে গলে মিশে যাবে মাটির সাথে, হয়তো কোনো এক কুকুর কিংবা শিয়াল আমাদের শরীরের হাড্ডিটি নিয়ে দূরে কোথাও অবশিষ্ঠ মাংশটুকু খাওয়ার জন্য দৌড়ে চলে যাবে অন্যত্র। কার সেই কংকাল, কার সেই হাড্ডি, এই পৃথিবীর কোনো জীবন্ত মানুষের কাছে এর কোনো মুল্য নাই।

যে ঘরটায় আমি সারাদিনের ক্লান্তি শেষে অবসাদ শরীর নিয়ে মুলায়েম বিছানায় গা হেলিয়ে দিতাম, সেই ঘরটা হয়তো থাকবে অন্য কার দখলে। যে বাগানটায় আমি প্রায়ই পায়চারী করে করে আকাশ দেখতাম, গাছ গাছালীর মধ্যে উড়ে আসা ভ্রমর কিংবা পোকামাকড় দেখতাম, সেই বাগানের দখল হয়তো এখন কার দখলে কে জানে। বাগানের গাছ গাছালীর পরিচর্যার নামে যে পোকামাকড়গুলিকে আমি বিষ দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করতাম, আমি আজ তাদের দখলে।

যে বাচ্চাদের মুখরীত কোলাহলে আমার ঘর ভরে থাকতো, যাদের আগমনে আমার মন পুলকিত হতো, আজ সেখানে অন্য কেউ মুখরীত হচ্ছে। কতই না সাবধানতায় আগলে রেখেছি সেই ঘর, সেই লন, কিংবা আমার যতো আয়েশী জিনিষ, আজ সেগুলি আমার কিছুই নয়। আমার সুন্দুরী স্ত্রী যখন তাঁর লাল শাড়িটা পরার পর কিংবা আমিই যখন নতুন কোনো একটা ড্রেস পড়ে বারবার আয়নার সামনে গিয়ে কতবার না দেখতে চেয়েছি-কেমন লাগে আমাকে, অথচ আজ সেই আমি বা আমার সেই সুন্দুরী স্ত্রী তাঁর চেহাড়া কেমন দেখায় কাফনের সেই ধবল পোষাকে সেটা দেখার কোনো পায়তারা নাই। সেই বৃহৎ আয়নাটার আর কোনো মুল্য নাই আমার কাছে। হয়তো সেখানে অন্য কেউ এখন তাঁর চেহাড়া দেখছে, হয়তো লাল শাড়ির পরিবর্তে নীল বা টাই কোট পড়া পোষাকের বদলে একটা ভেষ্ট পড়া ব্যাকব্রাস চুলের মহড়া দিচ্ছে। যে গাড়িটা প্রতিদিন আমাকে মাইলকে মাইল ঠান্ডা কিংবা শীততাপ হাওয়ায় বসিয়ে, মিষ্টি মিষ্টি গান শুনিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে গেছে, সেটা আর আমার কোনো প্রয়োজন নাই। না সে আমাকে আর খোজে।

কখন কোথায় কাকে কাকে নিয়ে অথবা আমার নায়নাতকুর আত্তীয় স্বজন স্ত্রী পোলাপান নিয়ে কবে কোথায় কি আনন্দে মেতেছিলাম, সেই ইতিহাস আর কেউ কখনো মনে রাখবে না। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কতটা পথ হেটেছিলাম, আর সেই হাটা পথে আমি কতটুকু ঘাম ঝরিয়ে চূড়ায় উঠে কি তৃপ্তি পেয়ে কি আনন্দে কতটুকু আত্তহারা হয়েছিলাম, সেই তথ্য না কেউ জানবে, না কেউ জানার কোনো আগ্রহ দেখাবে। কার সাথে কি নিয়ে আমার মনোমালিন্য হয়েছিলো, বা কে আমাকে কতটুকু ভালোবেসে কি অবদান দিয়েছিলো অথবা কার কোন আগ্রহে আমি কোথায় কি করেছিলাম, কার কারনে আমার অন্তরে জালা উঠেছিলো আর কার কারনে আমার দিন আর রাত একহয়ে গিয়েছিলো, সেই ইতিহাসের কোনো মুল্য আজ বেচে থাকা মানুষগুলির কাছে কোনো অর্থ বহন করে না। না তাদের যাদের জন্য এসব ঘটনা ঘটেছে। নতুন প্রজন্ম নতুন পরিবেশ, নতুন সব কাহিনীতে ভরে থাকবে বর্তমান আর আমাদের সেই পুরাতন প্রজন্ম, কিংবা সেই তাদের পুরাতন পরিবেশের কোনো স্থান থাকবে না আজকের এই পরিবর্তীত বন্ধুমহল পরিবেশে। হয়তো কোনো এক ছোট বালিকা আমাদের কথা শুনে, অথবা ভালোবেসে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে আমার সেই সমাধিতে দাঁড়িয়ে একটু অন্যমনষ্ক হয়ে দাঁড়িয়ে পুষ্প স্তবক দিয়ে চলে যাবে। হয়তো সবার বেলায় এটা নাও হতে পারে। কিংবা জন্ম জন্মান্তরের শেষে প্রজন্মের পর প্রজন্মের শেষে আমি এমন করে বিলীন হয়ে যাবো যে, সেই অবুজ বালিকার পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো আর একটা বাশী ফুলও নিয়ে আমার সেই সমাধিতে দাঁড়াবে না। কারন আমি তাদের কোনো ইতিহাসের মধ্যেই নাই। চিরতরেই বিলীন।

আজ যে সেলফীটা কত যত্ন করে তোলা হয়েছে, হাসি মাখা মুখ, চুলের বাহার, পোষাকের পরিপাটিতা সব কিছু ধীরে ধীরে সেই শতবর্ষ পরে এমন করে মলিন হয়ে যাবে, হয়তো দেখা যাবে, সেই ছবি পরে আছে এমন এক কোনায় যেখানে থাকে পরিত্যাক্ত কোনো কাগজ বা ময়লার বাক্স। কোনো একদিন সেটা হয়তো অপ্রয়োজনীয় হয়েই বেরিয়ে যাবে আমার সেই শখের ঘরের দরজা পেরিয়ে।

যে অর্থের জন্য আমি প্রতিদিন সারাটা সময় শুধু পরিশ্রমই করে গেছি, সেই অর্থ আজ আমার কোনো কাজেই আসবে না। শতবছর পরে তো আমার অর্থে গড়া কোনো এক ইমারতের কোনো একটা ইটের মধ্যেও আমার কোনো নাম বা অস্তিত্ব থাকবে না। হোক সেটা আমার পরিশ্রমে গড়া কিংবা আমার নিজের। সেখানে হাত বদলে বদলে আমার অস্তিত্তের শেষ পেরেগটুকু মেরে সেখানে হয়তো কোনো এক লোকের নাম লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। যেটা আজ আমার নামে পরিচিত, শত বছর পর সেটা আমার আর নাই, না সেটা আমার নামেও অহংকার করে।

কি অদ্ভুত না?

শত বছরের হিসাবে যেমন আমি আর নাই, হাজার বছরের হিসাবে তো আমি কখনো ছিলামই না। তারপরেও আজ আমি অনেক ব্যস্ততায় দিন কাটাই আগামিকালের জন্য। অথচ আগামিকালটাই আমার না। এই পৃথিবী আমাকে কখনোই মনে রাখবে না। কারন সে আমাকে ভালোই বাসে নাই। অথচ আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম আমার জীবনের থেকেও বেশী। আর এটাই এই পৃথিবী। এই পৃথিবীর কোনো বর্ষাই আমার না, কোনো শরতই আমার না। এর গাছ পালা, এর নীলাকাশ, এর সুগভীর সমুদ্র কিংবা ঘনসবুজ পাহাড় কোনো কিছুই আমার না। আমার ঘরটাও।

শতবছর পরে, আমি এক অচেনা, নামহীন, অস্তিত্বহীন মানুষ যে আজকের দিনে বহু ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটিয়ে কিছুটা সময় এই নীল আকাশ, ঘন সবুজ পাহাড় অথবা পাখীদের কিচির মিচির শুনেছিলাম।

১৭/০৮/২০২১-রেহালাদের গল্প

রেহালার গল্প

সাহস ছাড়া মানুষ স্বাধীন হতে পারে না, আর স্বাধীনতা ছাড়া মানুষ জীবিত নয়।

একদমই ভাবী নাই যে আজকে আমার অফিসে এমন কেউ আসবে যাকে আমি একসময় চিনতাম কিন্তু গত ৪০ বছরের মধ্যে আর কখনোই দেখা হয় নাই। ওর নাম ‘রেহালা (এটা একটা ছদ্দনাম, আসল নামটা উল্লেখ করলাম না’)। আমি আর রেহালা একই ক্লাশে পড়তাম সেই প্রাইমারী স্কুলসহ হাইস্কুলে। এরপর আমি হাইস্কুল ছেড়ে অন্য কলেজে চলে আসলাম, আর ওরা গ্রামেই রয়ে গেলো। এতো সুকন্ঠী ছিলো এই রেহালা যে, আমরা ওর গান শুনতাম যেখানে সেখানে, দলবেধে। স্কুলের কোনো অনুষ্ঠানে কখনো কখনো রেহালার একক সঙ্গীত পর্যন্ত হতো। খালী কন্ঠেও যে গানের একটা মূর্ছনা আছে, সেটা রেহালার গান শুনলে বুঝা যেত। আর যদি রেহালার রূপের কথা বলি, সেটা আরেক বর্ননা। ওর গায়ের রঙ শ্যামলা, একদম ডায়মন্ডের মতো, চোখগুলি বড় বড়, ঠোটে সবসময় একটা হাসি লেগেই থাকতো। রেহালা হাসলে গালে একটা টোল পড়তো। সম্ভবত এই টোল পড়া গালের জন্যই রেহালার হাসিতে একটা আলাদা মাধুর্য ছিলো। বড্ড মিষ্টি ছিলো রেহালার হাসি। ছিমছাম শরীর, আমাদের সাথে গোল্লাছূট, দাড়িয়াবান্দা, মাঝে মাঝে কাবাডিও খেলতো রেহালা। রেহালাকে কাবাডি খেলায় কুকুপাত করলে ইচ্ছামতো মাথায় চুল ধরে ঝাকুনো মারতো। এক সাথে আমরা গ্রামে বড় হয়েছি, পাশাপাশি বাড়ি ছিলো আমাদের। নদীতে ঝাপ দিতাম এক সাথে, আর অন্যের গাছে উঠে পেয়ারা চুরির সময় রেহালা থাকতো লুক আউটম্যানের মতো। যেই না গাছের মালিকের আসার সময় হতো, রেহালা নিরুদ্দেশ, আর আমরা গাছের মধ্যে নিশ্চুপ। বড্ড মজার দিন ছিলো সে ছোটবেলাটা। সেই রেহালা আজ হটাত করেই আমার অফিসে এসে হাজির।

প্রথমে তো আমি রেহালাকে চিনতেই পারিনি। ওর শরীর অনেক মোটা হয়ে গেছে, রেহালা আগেই শ্যামলা ছিলো, আর এখন ওর চেহারা এতো কালো হয়ে গেছে যে, আগের আর সেই ডায়মন্ডের মতো চেহারাটা নাই। মাথায় চুলে পাক ধরেছে। কতই বা বয়স, তারপরেও মনে হচ্ছে বুড়ি হয়ে গেছে রেহালা। কিন্তু হাসলে ওর গালে এখনো টোল পড়ে। চোখ গুলি এখনো ডাগর ডাগর। কন্ঠে আর সেই সুর এখন নাই রেহালার। রেহালা আমার অফিসে একা আসে নাই। ওর সাথে ওর ছোট বোন এসেছে। ওর ছোট বোন কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বল্লো যে, বুজি (মানে আপা) কানে শুনে না। অনেক জোরে জোরে কথা বললে কিছুটা শুনতে পায়। যেহেতু কানে শুনে না, তাই, অন্যের কথাও বুজি ভালোমতো শুনতে না পাওয়ায় কি কথা বলছে কেউ বুঝতে পারে না। তাই সাহাজ্যকারী হিসাবে বুজি কোথাও গেলে আমিই সাথে যাই।

রেহালা আমার অফিসে বসেই কিছুক্ষন যেনো হাপিয়ে উঠেছিলো। রেহালার প্রথম কয়েক মিনিটের কথার অর্থ এমন ছিলো যে, এতোদিন পর রেহালা আমার সাথে দেখা হওয়ায় যেনো সেই ছোট বেলার রাজ্যের গল্পের পশরা নিয়ে হাজির হয়েছে। ওর বলার উচ্ছাস, মুখের অভিব্যক্তি আর অনর্গল কথার মধ্যেই আমি বুঝতে পারছিলাম রেহালা আজ অনেক অনেক খুসি যে, সে আমার সাথে দেখা হয়েছে। কখনো দুই হাত তুলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে, কখনো নিজের অজান্তেই কি যেনো দোয়া দরুদ পাঠ করছে আবার কোনো কারন ছাড়াই হেসে দিচ্ছে। ঝির ঝির বাতাসে তরু পল্লব কিংবা ক্ষেতের দন্ডায়মান ফসলরাজী যেমন হেলিয়া দুলিয়া এদের মনের সুখ প্রকাশ করে, নির্মল নীলাকাশ যেমন তার একখন্ড মেঘের ভেলাকে এদিক থেকে সেদিকে উড়াইয়া লইয়া যায়, রেহেলা তেমনি আমাকে এতো বছর পর পেয়ে যেনো তার সেই দশাই হলো।  রেহালা মাথার বোরখাটা খুলে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলো। রেহালার আগমনে আমার অফিসে কোনরূপ সমারোহ ছিলো না, কিন্তু আজিকার এই মুহুর্তে সমস্ত বিশ্ব ব্যাপারের সর্বাধিনায়িকা যেনো এই রেহালাই হয়ে দাড়াল। রেহালার এমন উচ্ছাসিত আচরনে আমার যেনো বিস্ময়ের কোনো শেষ ছিলো না।

এখানে আরো একটা ব্যাপার আমাকে রেহালা বিস্মিত করলো। রেহালা ছোটবেলায় আমাকে ‘তুই’ বলেই ডাকতো, কিন্তু আজকে খেয়াল করলাম, রেহালা আমাকে আর তুই; বলছে না, কাকা বলে ‘আপনি’ সম্মোধন করছে। গ্রামের সম্পর্কের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে রেহালার সাথে আমার কাকা ভাতিজারই সম্পর্ক। কিন্তু এই সম্পর্ক কিসের ভিত্তিতে সেটা আমার ছোট বেলায়ও জানা ছিলো না, আজ তো সেটা জানার কোনো ইচ্ছাও নাই। আমি রেহালার বাবাকে ‘ভাই’ বলেই ডাকতাম সেটা আমার মনে আছে। আমি রেহালাকে বললাম যে, সে যেনো আমাকে “তুই বা তুমি” করেই বলে।

আমি জানি রেহালার বাবা এবং অন্যান্য ভাই বোনেরা এখনো জীবিত আছে। আর তারা মাঝে মাঝেই আমার অফিসে কিছু না কিছু সাহাজ্য বা পরামর্শের জন্য আসে। কখনো তাদের সাথে আমার দেখা হয়, আবার কখনো কখনো দেখা হয়ও না। ফলে আমি রেহালাকে ওদের ব্যাপারে কোনো প্রশ্নও করতে চাইনি। একমাত্র রেহালার ব্যাপারেই আমার অনেক কিছু জানা ছিলো না। তাই প্রথমেই রেহালাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, রেহালা কেমন আছে। রেহালা কি শুনলো আর কি বুঝলো আমি জানি না কিন্তু রেহালা বলতে থাকে-

কাকা, তোমারে কতবার যে আমি দেখতে চাইছি মনে মনে, আর আফসোস করছি, ইশ যদি মরার আগে তোমার সাথে আমার একবার দেখা হতো। অনেকের কাছেই আমি তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছি, তুমি কই থাকো, কিংবা কোথায় গেলে তোমাকে পাওয়া যাবে ইত্যাদি কিন্তু কেউ আমাকে তোমার আসল ঠিকানাটা দিতে পারে নাই। শুধু এটুকু জানতাম যে, তুমি এই এলাকাতেই বড় ব্যবসা নাকি করো। একবার শুনেছিলাম, তুমি নাকি গ্রামে গেছো। আমি তখন গ্রামেই ছিলাম। কিন্তু আমি লজ্জায় তোমার সাথে দেখা করার সাহস করি নাই। সেটাও আজ থেকে প্রায় বারো বছর আগের কথা। তখন সবেমাত্র আমি আমার জামাইয়েরে নিজের ইচ্ছায় তালাক দিছি। গ্রামে একজন মহিলার সংসার ভেংগেছে, তালাক হয়েছে এটা যে কত বড় কেলেংকারী, সেটা মেয়ে না হলে আসলে কেউ বুঝতে পারে না। 

আমি রেহালাকে জিজ্ঞেস করলাম, স্বামীকে তালাক দিলি কেনো?

রেহালা সহজেই আমার প্রশ্নটা বুঝতে পেরেছিলো। রেহেলা অনেকক্ষন মাথা নীচু করে কি যেনো ভাবলো। দেখলাম, রেহেলা কাদছে। তাঁর ফুপিয়ে কান্নার একটা শব্দ পেলাম। আমি রেহেলাকে কিছুই বললাম না। রেহেলাকে আমি সময় দিলাম, রেহেলা কাদছে। তারপর টেবিলে রাখা একটি গ্লাস থেকে কয়েক ঢোক পানি গিলে বলতে লাগলো-

কাকা, একটা কথা কি জানেন? বিয়ের সময় খুসি আর ভালোবাসায় এটা প্রমানিত হয় না যে, ভবিষ্যতে এই সুম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা বা ঘৃণা আসবে না। মধুর ভালবাসা যেমন একদিন ঘৃণার বিষে রুপান্তরীত হতে পারে, আবার গভীর ঘৃণাও হয়তো সমস্ত বাধা কাটিয়ে পুনরায় চরম ভালোবাসায় পরিনত হতে পারে। কিন্তু কখনো যদি ভালোবাসার মধ্যে ঘৃণা ঢুকে পড়ে, তিক্ততার সীমা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন যে এখন এই সম্পর্ককে শেষ করা উচিত। বুঝে শুনে বেরিয়ে আসা উচিত। যাতে তার আগে কোনো মারাত্তক অঘটন না ঘটে। কিন্তু আফসোস, প্রায়ই তিক্ত সম্পর্কগুলির ক্ষেত্রে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনা। হোক সেটা সমাজের তথাকথিত লোক লজ্জার ভয়ে অথবা অভিভাবকের অতিরিক্ত চাপের কারনে। তখন এমন হয় যে, সেই দম্পতির যে একদিন ভালোবেসে যারা খুব কাছে এসেছিলো, তারা আজ সম্পর্কের তিক্ততায় একজন আরেকজনকে চাকু, বন্ধুক চালাতে পিছপা হয়না। তখন একজন আরেকজনের প্রান নিতেও দ্বিধাবোধ করেনা অথচ কোনো একদিন তারা তাদেরকে নিজেদের মানুষই ভাবতো। বিয়েটা হয়তো সত্যিই একটা কন্ট্রাক্ট। আর সেই কন্ট্রাক্টের মধ্যে নিহীত থাকে অনেক দায়িত্ব, অনেক কর্ম পরিধি। 

রাহেলার এমন জীবনভিত্তিক কথায় আমিও খুব অবাক হলাম। রাহেলা কি সুন্দর করে তাঁর জীবনের কিছু অভিজ্ঞতার কথা এক নিমিষে বলে গেলো। অনেক পড়াশুনা হয়তো রাহেল করে নাই কিন্তু ওর কথাবার্তা যেনো আমার অন্তরে তীরের মতো বিধে গেলো। আমি রাহেলার কথা খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম।

 রাহেলা বলতে থাকলো-

সেদিন সম্ভবত গুড়িগুড়ি বৃষ্টির দিন ছিলো। আমার স্বামী আমারে বল্লো, চলো, নারায়নগঞ্জ আমার এক বন্ধুর বাসা থেকে বেড়িয়ে আসি। আমার স্বামী আমাকে ভালোবাসে কিনা তা আমি কখনো বুঝি নাই। বিয়ের পর থেকে যে শ্বশুর বাড়িতে ঢূকেছি, সারাক্ষন স্বামী, সংসার, ছেলে মেয়ে ননদ ননদীনির দায়িত্ব পালন করতে করতেই আমার দিন পার হতো। আর এসব দায়িত্ব পালনে কোথাও কোনো ত্রুটি হলেই আমার উপরে চলতো খড়গের মতো আচরন। আমার স্বামী নেশা করতো। বিয়ের আগে নেশা করতো কিনা জানি না, কিন্তু বিয়ের কদিন পরেই বুঝলাম, সে প্রায় রাতেই নেশা করে ঘরে ফিরে। কি তাঁর দুঃখ, কি তাঁর কষ্ট কখনো সেটা আমি বুঝতে পারি নাই। ফলে, সুযোগ আর কোনো ব্যত্যয় কিংবা তাঁর নেশার জগতে একটু ভাটা পড়লেই কারনে অকারনে আমাকে মারধোর করতো। সেই মারধোরের কারনেই আমি আমার কান হারাই। মার খেতে খেতে কানটা একদিন অকেজোই হয়ে গেলো। গরীব বাবা মা, পয়সাকড়ি নাই, যৌতুক যা দেয়ার সেটা দেয়ার পরেও জামাইয়ের মন ভরে নাই। দিনের পর দিন এই অতিরিক্ত যৌতুক আর টাকার জন্য আমাকে মার খেতে হয়েছে। ঘরে ভালোমতো বাজার হয় না, অথচ কেনো ভালোমতো রান্না হয় না সেটা যেনো আমার অপরাধ। সহ্য করে থেকেছি। মুখ বন্ধ করা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিলো না। গরীব পিতামাতার সন্তানেরা নাকি “আগুনে পানি দিয়ে” সংসার করে। আমিও তাই করার চেষ্টা করেছি। যাই হোক, যখন আমার জামাই আমাকে বল্লো, চলো এক বন্ধুর বাসায় বেড়াইয়া আসি, ভাবলাম, হয়তো মনটা তাঁর পরিবর্তন হয়েছে। আমারো মনটা ভালো হয়ে গেলো। আনন্দিতই হয়েছিলাম। কারন যে কখনো আমাকে পাশের দোকানে নিয়ে একটা চকলেটও কিনে খাওয়ায় নাই। আজ তার এহেনো অনুরোধে বেশ পুলকিত বোধ করছিলাম। বললাম, চলেন যাই।

আমি আর আমার স্বামী বিকাল ৫টার পরে কাপড় চোপড় পড়ে নারায়নগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমাদের বাড়ি থেকে নারায়নগঞ্জ খুব বেশী দূরে না। ফলে সন্ধ্যার আগেই আমরা ওর বন্ধুর বাসায় চলে এলাম। রাতের খাবার খেয়ে হয়তো আমরা আবার আমাদের বাড়িতে ফিরে আসবো এটাই ছিলো আমার জানা। আমি আমার ছোট ছেলেকে সাথে নিতে চাইলাম। কিন্তু আমার স্বামী আমাকে নিতে বারন করলেন। ভাবলাম, ভালোই হবে, আমরা নীরিবিলি দুজনে একসাথে রিক্সায় ঘুরতে পারবো। পাশাপাশি বসে গল্প করতে পারবো। সময়টা ভালোই কাটবে। আমরা যখন তাঁর বন্ধুর বাড়িতে পৌঁছলাম, তখন সন্ধ্যার একটু আগে। তার বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে দেখি, বন্ধুর স্ত্রী বাসায় নাই। শুনলাম ছোট বাচ্চাকে নিয়ে নাকি সন্ধ্যার পর আসবে, হয়তো কোথাও কাজে গেছে। চা খেলাম, সাথে কিছু ফলমুলাদি। খারাপ লাগছিলো না। সন্ধার পর হটাত করে আমার স্বামী বাজার থেকে কি জানি আনতে বাইরে যাওয়ার কথা বলে আমাকে একা রেখে চলে গেলেন। একটু ভয় ভয় করছিলো কিন্তু খারাপ কিছু মাথায় আসে নাই। সময় যাচ্ছে, আবারো সময় যাচ্ছে, ঘন্টা, তারপর আরো এক ঘন্টা, কিন্তু আমার স্বামীর ফিরে আসার কোনো লক্ষন দেখলাম না। এদিকে রাত বেশী হয়ে যাচ্ছে, আমি বারবার ওর বন্ধুকে আমার স্বামীর কথা বল্লেও দেখলাম সে খুব একটা কথা আমলে নিচ্ছে না। আমি আমার স্বামীর এই বন্ধুকে আগে থেকে চিনতামও না। রাত প্রায় ১১টার উপরে বেজে গেলো, আমার স্বামীর ফিরে আসার কোনো নামগন্ধও নাই। এবার আমার খুব ভয় করছিলো। জীবনে কোনোদিন শহরেও আসি নাই। আর এখন পুরু একটা অপরিচিত লোকের বাসায় আমি একা। বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চা রেখে এসছি। ওদের জন্য ভীষন দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো।

আমি চারিদিকে কান খারা করে সবকিছু খেয়াল করছিলাম। আমার খুব ভয় লাগছিলো। একটু পরে আমি খেয়াল করলাম, এই বাড়িতে কিছু অপরিচিত লোকের আনাগোনা যেনো বেড়ে গেছে। কেউ কেউ বাইরে ফিসফিস করে যেনো কি কি কথাও বলছে। কেউ কেউ আবার আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছেও। বুঝতে পারলাম, তারা হয়তো আমাকে নিয়ে কোনো আলাপ করছে কিন্তু কি আলাপ করছে বুঝতে পারছিলাম না। তখন রাত প্রায় বারোটা বেজে যাচ্ছিলো।

এক সময় ৩০/৩৫ বছর বয়সের একজন পুরুষ আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো- কি নাম তোমার? আসো ওই ঘরে যাই। এই বলে পাশে একটা ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো।

আমি জিজ্ঞেস করলাম- কে আপনি ভাই? আর আমি ওই ঘরেই বা কেনো যাবো? আমার স্বামী কই? সে এখনো আসছে না কেনো? আমার বাড়ি যাওয়া দরকার। আমার বাচ্চারা একা বাসায়। ওরা হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

আমার কথা শুনে লোকটি পিছনে ফিরে এসে আমাকে সে যা বল্লো, সেটা শুনে তো আমার মাথা খারাপ। আমাকে নাকি আমার স্বামী এখানে দেহ ব্যবসার জন্য বিক্রি করে টাকা নিয়ে চলে গেছে। সে আর ফিরবে না। রাতটা এমনিতেই অন্ধকার ছিলো, লোকটার কথা শুনে এবার যেনো মহাঅন্ধকারের মধ্যে আমাকে আমি মৃত লাশের মতো শ্মশানের মধ্যে দেখতে পেলাম যেখানে আমাকে কিছু জীবন্ত শিয়াল কুকুর তাড়া করছে, অথচ আমার কোনো শক্তি নাই।

আমি চিৎকার করতে লাগলাম, আর বলতে লাগলাম, এটা কি করে সম্ভব? তোমরা আমার স্বামীকে ফিরিয়ে আনো। আমি ওরকম মেয়ে নই যে, তোমরা আমার সাথে এমন আচরন করতে পারো। আমি ভয়ে আরো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে গেলে আমাকে কয়েকজন এসে এমনভাবে জাপটে ধরলো যে, না আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিলো, না আমি কোনোদিকে নড়াচড়া করতে পারছিলাম। কিন্তু আমার চোখ তো আর কোনো কিছুতে বাধা পড়েছিলো না। আমার বাচ্চাদের কথা মনে পড়লো, আমার ছোট ছেলেটা খুব মগা (বোকা), তার কথাই বেশী মনে পড়লো। তার মাত্র ৮ বছর বয়স। সে আমাকে ছাড়া কোথাও যেতে চায় না। ওকে একা ফেলে এসেছি। ছেলেটা মগা হলেও কখনো আমার হাতছাড়া করতো না। ওর মুখটা ভেসে উঠতেই আমার দুচোখ ঝাপ্সা হয়ে আসছিলো। আহা রে বাপ, দেখে যা তোর মা কত অসহায় একটা পরিস্থিতিতে ছটফট করছে। তোর অমানুষ বাবা আমাকে কোথায় ফেলে গেলোরে বাবা।

রেহালা কিছুক্ষন চোখ বুজে থাকল, তার দুচোখের পাশ দিয়ে জলের একটা রেখা যেনো অবিরত জল পড়তেই থাকলো। একটু পর আবার রেহালা বলতে থাকল-

জানো কাকা, কোনো কোনো সময় কিছু কিছু নাটক এমনভাবে বানানো হয় যাতে সাধারনের চোখে মনে হবে এটাই সব সত্যি কিন্তু এর পিছনের মুল উদ্দেশ্য অনেক গভীরে। শুধু ভরসার স্থান তৈরির জন্যই নাটক তৈরী করা হয়। আমার স্বামীও আমার সাথে ঠিক এমনই একটা ভরষার স্থান তৈরী করেছিলো। আর সেটা ছিলো নিছক একটা নাটক যা আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনি। আমি কি এটাই চেয়েছিলাম? আজ দুপুরে যখন সে আমাকে বেড়াতে নিয়ে আসবে বলে জানালো, আমি তো আমার সমস্ত বিশ্বাস নিয়েই তাঁর সাথে অজানা এক বন্ধুর বাড়িতে রওয়ানা হয়েছিলাম। বিকালটা কত সুন্দর ছিলো। চারিদিকের গাছপালা, আশ পাশের দোকানী, মানুষগুলিকে দেখে তো আমার মন অনেক পুলকিতই ছিলো। তাহলে এই হটাত কি গজব আমার উপর আছড়ে পড়লো? আমি কি কখনো আমার স্বামীকে একটিবারের জন্যেও ভালোবাসিনি? কখনো কি আমি ওর বেদনায় কাতর হই নাই? কখনোই কি ও আমাকে স্নেহ কিংবা ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরে নাই? আমি তো আমার জীবনের সবকিছু দিয়ে ওকে ভরষা করেই বাপ মায়ের বাড়ি ছেড়েছিলাম। তাহলে সে এমন নিষ্ঠুর কাজটি কেন আর কিভাবে করতে পারলো? আমি কি ওর বাচ্চার মা নই? আমাকে সে না ভালোবাসুক, ওর বাচ্চাগুলির জন্যেও কি সে আমাকে ছেড়ে দিতে পারতো না? মুখবাধা ঠোট দিয়ে সমস্ত বেদনাগুলি যেনো শুধু গোংগানীর মতোই মনে হচ্ছিলো আমার কাছে। অথচ এই গোংগানির মধ্যে কত যে অস্থিরতা, কত যে আক্ষেপ, কত যে ভালোবাসা আর কষ্ট লুকিয়ে ছিলো তা যেনো আমাকে ঝাপ্টে ধরে রাখা মানুষগুলির কানেই গেলো না।

আমার আল্লাহর কাছে আমি চোখ বন্ধ করে শুধু একটা কথাই প্রার্থনা করলাম, যদি আমি সতীনারী হয়ে থাকি, যদি আমি আমার এক ঈশ্বরকে কখনো কায়মনে ডেকে থাকি, যদি তিনিই হয়ে থাকেন আমার একমাত্র ত্রানকর্তা, যদি আমার প্রভুই হয়ে থাকে সমস্ত বিপদের উদ্ধারকারী, তাহলে আমি আমার সেই একচ্ছত্র প্রভুর কাছে দয়া ভিক্ষা করছি তিনি যেনো আমাকে তাঁর গায়েবী ক্ষমতা দিয়ে এই নরক থেকে বাচিয়ে দেন। হে ঈশ্বর, আমি তোমাকে কখনো দেখিনি, কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছি, তোমার দরবারে আমি প্রতিদিন মাথা নুইয়েছি, তুমি আমাকে বাচিয়ে দাও ঈশ্বর। লোকগুলি ইতিমধ্যে আমার চিৎকার চেচামেচিতে গন্ডোগোল হতে পারে ভেবে, কিংবা আশেপাশের লোকজন কিছু আচ করতে পারে জেনে আমাকে তাদের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়েছিলো। আমার চোখ বন্ধ ছিলো, আর আমি গোল হয়ে মাটিতে নিথর দেহে বসেছিলাম। আর আমার চোখ থেকে অনবরত অশ্রু ঝরছিলো।

তারপর কি হয়েছিলো আমি জানি না। কিন্তু ঐ ৩০/৩৫ বছর বয়সের যুবকটি আমাকে ডেকে বল্লো- এদিকে আসো আমার সাথে। কিন্তু কোনো কথা বলবে না। আমি যা বল্বো, সেটাই করবে। আমি বুঝতে পেরেছি তুমি একটা পিশাচের পাল্লায় পড়েছো। সে জানতে চাইলো, আমার সাথে কোনো টাকা পয়সা আছে কিনা। আমি লোকটির চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম, এটাও ভাবছিলাম, সে আমার সাথে এবার অন্য কোনো চাল চালছিলো কিনা। কাউকে বিশ্বাস করা কিন্তু ভুল নয়। তবে চোখ বন্ধ করে কাউকে বিশ্বাস করা একেবারেই ভুল। তাই আমাদের এটা জানা খুব দরকার যে, সামনের মানুষটাকে বিশ্বাস করবো নাকি করবো না।

তাঁর আচার ব্যবহারে আমার কাছে সে রকম মনে হলো না। মনে হলো আসলেই বুঝি তাঁর মাধ্যমে আমার ঈশ্বর আমাকে সাহাজ্য পাঠিয়েছেন। বললাম, আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নাই। সে আমার কানে কানে চুপিসারে শুধু একটা কথাই বল্লো- আসো, আমি তোমাকে এখান থেকে দ্রুত বের করে দেবো। আমি জানি তুমি খারাপ মেয়ে নও। আমিও তোমার কাছে কোনো শরীরের চাহিদায় আসি নাই। আমি এখানকার একজন এজেন্ট মাত্র। আমাকে আর এর বেশী কিছু জিজ্ঞেস করোনা। আর জিজ্ঞেস করলেও আমি সব কিছুই মিথ্যে বল্বো।

রাহেলা এবার একটু থামলো। সামনে রাখা গ্লাস থেকে সে আরো একবার এক ঢোক পানি পান করলো। রাহেলার চোখে মুখে যেনো এখনো সেই অতীতের ভয়টা স্পষ্ট ফুটে উঠছিলো। মাঝে মাঝে সে শিহরিত হয়ে উঠছিলো। বুঝতে পারছিলাম, রাহেলার সেই ভয়টা এখন আবার যেনো নতুন করে তাঁর সামনে জেগে উঠেছে। রাহেলা তাঁর বোরখার একটা আচল দিয়ে মুখটা মুছে নিলো। দেখলাম, রাহেলা একটু একটু ঘেমে গিয়েছে। আমি আমার রুমের এসিটা অন করে দিয়ে বললাম, তারপর?

কাকা, কিভাবে কি হয়ে গেলো আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। লোকটি আমাকে একশত টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে বল্লো, শীঘ্রই এখান থেকে এই দরজা দিয়ে বের হয়ে যাও। আমি পাহারায় আছি। এই গোপন দরজাটা দিয়ে আমরা বিপদের সময় পালিয়ে যাই। এটাকে আমরা কোডে বলি- (রেহালা নামটা মনে করতে পারলো না।)

এতো অন্ধকার রাত, তারপর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি, অনিশ্চিত একটা পলায়নে আমি কোথায় যাচ্ছি সেটাও আমি জানি না। এটা কি গরম তেল থেকে লাফিয়ে উনুনে নাকি হাজার ফুট উঁচু পাহাড় থেকে বাচার তাগিদে নীচে পতন আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তারপরেও আমি সেই দরজা দিয়ে বের হয়েই পাগলের মতো ছুটছিলাম। কোথায় ছুটছিলাম, কোনদিকে ছুটছিলাম আমি নিজেও জানি না। অনেক রাত, রাস্তায় বেশী লোক ছিলো না। আধো আলয় ভরা শহরের রাস্তার কিছু লাইট পোষ্ট এমন করে রাস্তাকে আলকিত করেছিলো যেনো সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে কন এক ভুতুরে পল্লির মতো দেখাচ্ছে। এম্নিতেই মনে আকুন্ঠ ভয়, তারমধ্যে অজানা এক দুসচিন্তা, তার উপরে রাতের এতো ভয়ংকর রুপ। কিছু লোকজন এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেখা যাচ্ছিলো বটে কিন্তু যারাই ছিলো তারা আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিলো, হয়তো ওরা ভাবছিলো, এতো রাতে আমি দৌড়াচ্ছি কেনো, বা আমি কি পাগল কিনা, অথবা রাতের কোনো চোর কিনা ইত্যাদি। কে কি ভাবলো, আর কে কিভাবে আমার দিকে তাকালো সে ব্যাপারে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিলো না। আমি শুধু দৌড়াচ্ছিলাম আর দৌড়াচ্ছিলাম।  অবশেষে আমি একটা পানবিড়ির দোকানে এসে থামলাম। কয়েকটা উঠতি বয়সের ছেলে ওখানে চা খাচ্ছিলো।

আমি হাপাতে হাপাতে বললাম-

বাবারে আমি খুব বিপদে আছি। আমার স্বামী আমাকে বেড়ানোর নাম করে নিয়ে এসে আমাকে খারাপ জায়গায় বিক্রি করে দিতে এসছিলো। আমি পালিয়ে এসছি। আমার বাড়ি, নগরঘাট (নামটা ছদ্দনাম)। আমি এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, এই জায়গাটা আমি চিনিও না, আর এখান থেকে আমি আমার গ্রামের বাড়ি কিভাবে যাবো, তাও আমার জানা নাই। আমার ছোট ছোট বাচ্চারা হয়তো এখন আমার জন্য কান্নাকাটি করছে। তোমরা আমাকে একটু সাহাজ্য করো বাবারা। আমি ওদের এটাও বললাম, আমার কাছে একশত টাকা আছে। আমাকে সাহাজ্য করো তোমরা।

জানো কাকা, আসলে এই দুনিয়ায় নরপিশাচ যেমন আছে, তেমনি ভালো মানুষও আছে। সেদিন আমি বুঝেছিলাম, মানুষ কি আর নরপিশাচ কি। ছেলেগুলি আমার কথা শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে গিয়ে বল্লো- কে সে, কই সে। চলেন আমরা ওকে এখন ধরবো। আমি বললাম, কিছুই দরকার নাই বাবারা। তোমরা শুধু আমাকে আমার বাচ্চাদের কাছে দিয়ে চলো। আমি তোমাদের মায়ের মতো, আমি আজিবন তোমাদের জন্য আমার সেই পরম ঈশ্বরের কাছে অশ্রুসিক্ত নয়নে দোয়া করবো। আমাকে তোমরা আমার সন্তানের কাছে নিয়ে চলো বাবারা। বলেই আমি দোকানের সামনে ভেজা মাতিতে বসে পড়েছিলাম। আমার পায়ে কন শক্তি ছিলো না, আমার সারা গা বৃষ্টির পানিতে ভিজে গিয়েছিল, আমার দম প্রায় বন্দ হয়ে এসছিলো। তারপরেও আমার হৃৎপিণ্ড সচল ছিলো, আমার প্রানটা জীবিত ছিলো।  

ছেলেগুলি আমাকে টেনে তুলে দোকানের ঝাপের ভিতর নিয়ে গেলো। সব সন্তানের চেহাড়া মনে হয় একই। বিশেষ করে মায়েরদের জন্য। ওরা আমাকে এক কাপ গরম চা দিল, মাথা মুছার জন্য কয়েকটা পুরান পেপার দিলো। আমি যেনো একটু স্থির হচ্ছিলাম। ছেলেগুলির মধ্যে দুইজনের দুইটা হুন্ডা (বাইক) ছিলো। চা খাওয়ার পর, ওরা একটা হুন্ডায় আমাকে আর আরেকটা হুন্ডায় ওরা তিনজন উঠে আমার বাসার অতি নিকটে ছেড়ে গেলো। যেখানে ওরা আমাকে ছেড়ে গেলো, সেই জায়গাটা আমি চিনতাম। সেখান থেকে আমি অনায়াসেই আমার বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমি যখন আমার বাড়িতে আসি, তখন রাত বাজে প্রায় আড়াইটা। সব বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেছে শুধু আমার মগা ছেলেটা বারান্দায় বসে আছে। মশার কামড়ে সে জর্জরীত কিন্তু আমাকে না পেয়ে কখন আমি ফিরবো তারজন্যে একাই বাইরের বারান্দায় বসে আছে। বৃষ্টি হচ্ছিলো, ফোটা ফোটা বৃষ্টিতে ছেলেটার সারা শরীরই প্রায় ভেজা। আমি ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাদলাম। আমার ছেলেটা আমাকে এমন করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদতে লাগলো যে, আশেপাশের মানুষগুলি যারা ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো তারাও সজাগ পেয়ে ছুটে এলো। আমি শুধু কাদছি, কিন্তু কেনো কাদছি, কিসের কষ্টে কাদছি, সেটা আর কাউকেই বলতে পারি নাই। কান্নার আহাজারীতে সুর থাকে না, থাকে বেদনা আর কষ্ট যে কষ্টের কোনো নাম নাই, যে কষ্টের রুপ কাউকে দেখানো যায় না। আমি শুধু কেদেই যাচ্ছিলাম। কষ্টটা ছিলো আমার মনের অনেক গভীরে।

অনেকেই অনেক প্রশ্ন করছিলো, এতো রাতে আমি কোথা থেকে এলাম, কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তরও আমার দিতে ইচ্ছে করছিলো না। আমার স্বামী কই, কিংবা সেতো আমার সাথেই সন্ধ্যার দিকে বেরিয়েছিলো, তার হদিস অনেকেই জানতে চাইলেও আমার কোনো কিছুই বলার মতো অবকাশ তো ছিলোই না বলতেও ইচ্ছে করছিলো না। শুধু আমি আমার সেই এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহকে আকাশের দিকে হাত তুলে বললাম- মহান তুমি, তুমি আছো সর্বদা সবার সাথে, দূর্বলের সাথে, অসহায়ের সাথে। আর তুমি সত্যিই সব পারো মাবুদ। কে বলে ঈশ্বর নাই? যে বলে ঈশ্বর নাই, সে বোকা, আর যিনি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন সে জানে ঈশ্বর কোথায় কিভাবে তার হাত প্রসারিত করে। ঈশ্বর বসবাস করেন সর্বত্র। শ্মশানে, আকাশে, পাহাড়ে, জলে অন্তরীক্ষে, আর থাকেন মনের একেবারে অন্তস্থলে। কান্নায় আমার শুধু বুক ভেসে যাচ্ছিলো।

রাহেলার এমন একটা অতীত জীবনের ইতিহাস শুনে আমি হচকচিয়ে উঠেছিলাম। মহিলাদেরকে আমরা দেবীর সমান তুলনা করে থাকি। কখনো কখনো আমরা তাদেরকে মায়ের আসনে বসিয়ে পুজার বেদী রচনা করে থাকি। কিন্তু আফসোস যে, এটা শুধু মন্দির আর পুজার ঘর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। মহিলাদের সাথে লাগাতার অন্যায় আর অপরাধ ঘটে যাওয়া এটাই প্রমান করে যে, আমাদের সমাজে আমরা যে মহিলাদেরকে দেবী বলি তারা এমন অনেক দানব দ্বারা ঘিরে রয়েছে যারা তাদের জীবনকে নরক করে তুলেছে। প্রকাশ্যে কোনো মহিলাকে পুড়িয়ে মারা হয়, নির্যাতন করা হয়, ধর্ষন করা হয় অথচ কেউ এগিয়ে আসে না। এই সমাজে কেনো মানুষের রক্ত ততক্ষন পর্যন্ত গরম হয় না যতক্ষন না অবধি কোনো সমস্যা তাদের ঘরের ভিতরে চলে না আসে।  হিন্দু শাস্ত্রে নাকি একটা কথা আছে-ইয়ত্রা নারায়স্ত পুজায়ান্তে রামাতে তাপ্তা দেবতা অর্থাৎ  যেখানে নারির পুজো হয়, সেখানে দেবতা বসবাস করে। এটা আসলে শুধু কথার কথা সত্যিটা অন্যকিছু। কোথাও কখনো কোনো নারীর পুজা হয়নি। না হিন্দু শাস্ত্রে, না আমাদের ধর্মে, না অন্য কোথাও।

রেহালা আবারো বলা শুরু করল-

কাকা-সেই সারারাতে আমি একটুও ঘুমাতে পারি নাই ভয়ে। আমার শরীর ভেংগে গিয়েছিলো, অনেক জ্বর এসছিলো, মাথা ব্যথায় আমার মনে হচ্ছিলো মাথাটাই যেনো আমার সাথে নাই। আমার সেই মগা ছেলেটা সারারাত আমার মাথায় পানি ঢেলে আমার মাথা বুলিয়ে দিচ্ছিলো আর খালী একটা কথাই বলে যাচ্ছিলো-মা আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না। তোমাকে ছাড়া আমি ভয় পাই। যতোবার সে আমাকে এই কথাগুলি বলছে, ততোবারই যেনো আমার ভিতরে কে যেনো এক কঠিন হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে আর বলছে- এই স্বাধীনতার মুল্য কি যেখানে খাচায় বন্দি আমি? এই জীবনের কি অর্থ আছে যেখানে আমি কলা, মুলা আর পন্যের মতো অন্যের ইচ্ছায় বিক্রি হয়ে যাই? এই দাম্পত্য জীবনের কি মাহাত্য যেখানে প্রতিদিন আমাকে শুধু অন্যের মন জোগানর জন্য নিজেকে সপে দিতে হয় পিশাচের কাছে? আমার ভিতরে তখন যেনো রাগ, ঘেন্না আর প্রতিশোধের ইচ্ছাতা বেরিয়ে আসছিলো। আমি হিংস্র হয়ে উঠছিলাম।  

রাহেলার এই কথাগুলির সাথে আমি একমত ছিলাম। সত্যি তো। গরীব হওয়া পাপ নয়, উচু সপ্ন দেখাও পাপ নয়, বড় হবার চেষ্টা করাও অপরাধ নয়, কিন্তু অন্য কারো জীবনকে এরুপ নষ্টের দিকে ঠেলে দিয়ে কিংবা অন্যের কোনো আত্মসম্ভরনকে বিকিয়ে দিয়ে কিংবা অন্যের জিনিষকে অন্যায়ভাবে নিজের সার্থের জন্য টাকা রোজগার করা চেষ্টা করা একটা অপরাধ। এই অপরাধের একটা খেসারত আছে। কেউ সাথে সাথে পায়, আর কেউ একটু দেরীতে। কিন্তু প্রাপ্যটা আসেই। লাইফটা কোনো ষ্টক মার্কেটের কোনো শেয়ার নয় যে প্রতিদিন এটার দাম উঠানামা করবে। এটা আসলে সেটা যা একবার উঠে গেলে আর পড়ে না, আবার পড়ে গেলে আর উঠে না।

রাহেলা বলতে থাকে তাঁর সেই রাতের বাকী কথাগুলি।

সকালে আমি উঠানে গেলাম, বসে রইলাম কখন আমার সেই নরপিশাচ স্বামী বাড়িতে আসে। সে হয়তো ইতিমধ্যে জেনে গেছে-আমি আর ঐ নারায়নগঞ্জে নাই। পালিয়েছি। কিছুই খেতে পারলাম না সারাদিন। আর খাওয়ার কিছু ছিলোও না। বমি বমি আসছিলো। দুপুরের দিকে একটু শুয়ে ছিলাম। কিন্তু ঘুমিয়ে ছিলাম না। সেই দুপুরের দিকে আমি ওর পায়ের আওয়াজের সাথে মুখের আওয়াজও শুনলাম। সে ঘরে ঢোকেই চোখ লাল লাল করে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করলো আর আমাকে মেরেই ফেলবে এমন হুংকার দিতে থাকলো। বড় বড় বিস্ফোরণের আগে ছোট ছোট ফুলকীর দিকে নজর দিতে নেই। তাতে বড় বিস্ফোরণের জন্য ব্যাঘাত হয়। আমি একটা শব্দও করলাম না, কোনো উত্তরও করলাম না। কোনো এক শক্তিশালী ঝড়ের আগে যেমন আকাশ থম্থমে হয়ে যায়, গাছপালারা স্থির ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, একটা পাতাও নড়ে না, খালী মাঝে মাঝে গুরুম গুরুম কিছু শুষ্ক ঠাটা পরার মতো আওয়াজ ভেসে আসে কোনো এক দূরবর্তী আকাশ থেকে, ঠিক এমন একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো আমার ঘরে সাথে মনের ভিতরেও। আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম এমন একটা সুযোগের জন্য যাতে আমি আমার বাড়ির পুতাটা দিয়ে ওর মাথায় একটা আঘাত করতে পারি। ওর উপর আমার কোনো প্রকার ভালোবাসা নাই, শ্রদ্ধাবোধ নাই। আমি ওকে যেনো আর চিনি না। কোনো এক সময় যে আমি অর বুকে শুয়েছিলাম সেটাও আমার মনে পড়ল না। সে যে আমার সন্তানের বাবা সেটাও আমার কাছে কোনো অর্থ বহন করে নাই। বারবার মনে হয়েছিলো, এদের বেচে থাকার কোনো মানে হয়না। এরা সর্বদা মানুষের শান্তির জন্য হুমকী, সমাজের জন্য হুমকী। পুতাটা আমি রেডিই করেই রেখেছিলাম আগে।

আমার সেই সুযোগটা এক সময় এলো। আমি একটু সময়ও নষ্ট করিনি। একটা আঘাতই আমি ওর মাথায় করেছিলাম। ও অজ্ঞান হয়ে গেলো। একবার ভাবলাম, ওর গলাটা কেটে দেই, আবার ভাবলাম, না, ওকে এমনভাবে মারবো যাতে সারাজীবন আর সোজা হয়ে দাড়াতে না পারে। আমি ইচ্ছে মতো ওর হাটু আর কোমড়ে পুতা দিয়ে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে থেতলা করে দিয়েছিলাম। আমার কোনো দুঃখ হয় নাই।

আমি রাহেলাকে জিজ্ঞেস করলাম, ও কি মরে গিয়েছিলো?

না কাকা- এই পিচাশটাকে আমি প্রানে একেবারে মেরে ফেলতে চাইনি, আর ও মরেও নাই। কিন্তু ও বেচে গিয়েও আর বেচে থাকবে না এটা আমার বিশ্বাস। তার কয়েকদিন পর আমি ওকে তালাক দিয়ে ওখানেই ছেলেদের সাথে রয়ে গেলাম। কিন্তু বাপের বাড়ি ফিরি নাই। সে এখন পংগু। এটাই ওর বিচার। কিসের সমাজ, কিসের আদালত, কিসের হিউমেনিটি? আমার কোনো আফসোস নাই। একা জীবন অনেক ভালো এসব নরপিশাচের সাথে থাকার চেয়ে। ওকে এভাবে মারার কারনে কেউ আমাকে বাধা দেয় নাই। কারন সবাই জানতো ওর ব্যবহার, আর ওর চরিত্র। তার উপরে যখন সবাই জেনেই গিয়েছিলো গতকাল রাতে সে আমার সাথে কি করেছিলো, ফলে কেউ আমাকে একটু বাধাও দেয় নাই, কোনো থানা পুলিশও করে নাই। ওর নিজের ভাইবোনেরাও এগিয়ে আসে নাই। নরপিশাচেরাও অনেক সময় নরপিশাচের জন্য অনুভুতি প্রকাশ করে না। সে একটা নর পিশাচের থেকেও অধম। একটা কথা বলি কাকা- যে যেমন কর্ম করবে, সে তেমন ফল পাবে এটাই আসল কথা। যে বীজ তুমি আজ বুনবে, সেই বীজের ফল তোমাকেই খেতে হবে। আর সেটা যদি কোনো অপরাধের বীজ হয়, তাহলে তা ধীরে ধীরে যে গাছে রুপান্তরীত হয়, তার নাম “প্রতিশোধ”। আর প্রতিশোধের গাছের কোনো না হয় আকার, না হয় ছায়া। রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে যায় তখন তার পরিনতি তো এটাই হয়। আর ওর সেটাই হয়েছে।

আমি স্বাধীন হয়ে গেলাম। আমার আর কোনো পিছুটান রইলো না। আমার পরিবার ভেংগে গেলো। যখন কোনো পরিবার ভাংগে, তার সাথে ভাংগে সবকিছু যা পরিবারকে বেধে রাখে, আর সেগুলি হচ্ছে বিশ্বাস, আদর, আবেগ, মায়া, ভালোবাসা এবং সবকিছু। একটা পরিবার তৈরী করতে অনেক বছর লেগে যায়, পরিবার আমাদের বেচে থাকার কারন হয়ে দাঁড়ায়, যখন ভাংতে শুরু করে পরিবার তখন সেই পরিবারকে আমরা সবচেয়ে বড় শত্রু বলে মনে করতে থাকি। যে পরিবারের আনন্দ আমাদের বাচার রশদ হয়ে উঠে, রাগ এবং প্রতারনার যন্ত্রনা সেই পরিবারকে আঘাত দিতেই বাধ্য করে তোলে। মানুষ যখন আপনজনকেই ঘৃণা করতে থাকে। আমার সেই স্বামীর বাড়ির প্রতিটি মানুষকে আর কখনো আপন মনে করতে পারিনি। শুধু আমার সন্তানদের ছাড়া।

অপমান আর অবসাদে অবনত হয়ে একদিন আমি আমার স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করে বাপের বাড়িতে এসে পড়ি। আমার বাবা মা বিয়ের আগে যে পরিমান কাছের ছিলো, স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসার পর তাদেরকে আর আমি ততোটা কাছে পেয়েছি বলে মনে হলো না। আমি তাদেরকেও এ ব্যাপারে খুব একটা দোষারুপ করি না। তারাও দরিদ্র, আমিও। আমরা হয়তো একই বৃন্তে ঝুলে ছিলাম। সময়ের স্রোত ধরে এক সময় বুঝতে পারলাম, আমাকে একাই চলতে হবে। এখন একাই থাকি, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, নামাজ পড়ি, কোরআন পড়ি, তসবিহ গুনি আর ভাবি, জীবন বড় রহস্যময়। হয়তো আমি আজ থাকতাম এমন এক জীবনে বন্ধী যেখানে মানুষ আর মানুষ থাকে না।

ঠিক ওই সময়ে কাকা আপনি গ্রামে গিয়েছিলেন শুনেছিলাম। একবার ভেবেছিলাম, আপনার সাথে একবার দেখা করি, আবার ভাবলাম, আপনি কি না কি ভাবেন কে জানে। লজ্জা এমন এক জিনিষ, যাকে না লুকানো যায়, না কাউকে বুঝানো যায়। ভিতরটা কেউ দেখে না যদিও সত্যিটা ভিতরেই থাকে। একটা কথা আছে না কাকা- আয়নায় চেহারা দেখা যায় কিন্তু কষ্ট দেখা যায় না। কিন্তু আমি আমার ভিতরের এই কষ্টটা কাউকেই বুঝাতে পারিনি। না আমার বাবাকে, না আমার মাকে, না আমার আশেপাশের কাউকে। কিন্তু ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া কোনো ব্যক্তিত্ত বেশীদিন অসহায় থাকে না। আমি যতটুকুই লেখাপড়া করেছিলাম, সেটা দিয়েই কিছু করার চেষ্টা করছিলাম, বিশেষ করে ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ানো। কিন্তু খুব একটা এগুতে পারিনি। পরে একটা সেলাই মেশিন নিয়ে মাঝে মাঝে বাচ্চাদের কিছু কাপড় বানিয়ে নিজের সন্তানের ভরন পোষনের চেষ্টা করেছি। প্রায় এক যুগ পার হয়ে গেছে। আমার মগা ছেলেটা এখনো বিয়ে করে নাই। ভারায় গাড়ী চালায়, যা রোজগার করে তা দিয়াই আমাদের সংসার কোন রকমে চলে যায়।

এতোক্ষন ধরে আমি রেহালার সবগুলি কথা খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম। ওর কথার রেশ ধরে আমার সারা শরীর কখনো শিহরিত হয়ে উঠিছিলো, কখনো ভয়ে আবার কখনো রেহালার স্বামীর এহেনো পৈচাশিক কাজের উপর রাগে। সমুদ্রে ভাসমান কোনো নাবিকের কাছে দূরের কোনো তটভুমি যেমন একটা আকর্ষনের বিষয় হয়ে দাড়ায়, রেহালার জীবনে তেমন কোনো কিছুর উপর আকর্ষন আর বাকী আছে বলে আমার মনে হলো না। রেহালা আমার সম্মুক্ষে বসে আমার বিস্তর প্রকান্ড কাচের জানালা দিয়া দূরের নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে বটে কিন্তু ওই নীল শান্ত আকাশের মতো রেহালার অন্তরে তেমন হয়তো শান্তির নীরবতা বিরাজ করছে না। হয়তো ওর মাথা, বুক আর অন্তর একসাথে এমন এক ঘূর্নীঝড়ের মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছিল যার আভাষ ওর চোখের নোনাজলেই বুঝা যাচ্ছে। আমি রেহালাকে আর কোন প্রশ্ন করলাম না। কিছুক্ষন পর রেহালা একটু শান্ত হলে আবার বলতে শুরু করলো-

কাকা-এখন অনেক বয়স হয়ে গেছে। আমার সারা শরীর যেনো রোগের একটা আবাসভুমিতে তৈরী হয়েছে। ডায়াবেটিস, প্রেসার, কানের, চোখের, হার্টে কোনো রোগের যেনো কমতি নাই। মগা ছেলেটা যা কামায়, তাতে হয়তো আমাদের দুজনের খাবার জুটে যায় কিন্তু আমার এই বাড়তি রোগের খরচ, কিংবা পর্বনের কোনো ব্যয়ভার চলে না। রোগটাকে এখন আমার নিত্যসংগী মনে করে কখনো সেই ঈশ্বরের কাছে রোগ মুক্তির দোয়া করি, আর যদি অতিরিক্ত খারাপের দিকে যাই, তখন এই আমার বোনেরা, কিংবা পাড়াপ্রতিবেশীরা হয়তো কিছু দান করে, তাঁর থেকেই কিছু পথ্য কিনে খাই। আগুনের ফুলকী যেমন কীট পতঙ্গকে দূরের আকাশের নক্ষত্র রাজীর লোভ দেখিয়ে আকর্ষন করে, অতঃপর তারা মৃত্যুবরন করে, আমি এখন অদৃশ্য ঈশ্বরের কাছে একটাই প্রার্থনা করি যেনো মরনের লোভ দেখিয়ে ঈশ্বর আমাকে দ্রুত এই জীবনের যবনীপাত করান। সেই ছোটবেলায় কত স্বপ্ন দেখেছি সংসার হবে, স্বপ্ন দেখেছি স্বামীর বুকে মাথা রেখে কত গান শুনাবো, বাচ্চাদের কলকাকলীতে আমার উঠোন ভরে উঠবে আরো কতকি? অথচ আজ শুধু এইটুকুই মনে হয়, জীবন বড্ড জটিল।  এখন শুধু মৃত্যুর ক্ষন ছাড়া আমার যেনো কোনো কিছুর জন্যই আর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নাই। গভীর রাতে একা ঘুমহীন বিছানায় বসে মাঝে মাঝে জীবনের হিসাব মিলাতে চেষ্টা করি, আখাংকা আর কল্পনার রাজ্যে কত মায়াজাল তৈরী করিয়া কত মায়াপুরীর হিসাব করেছিলাম, কিন্তু আজ প্রায়ই মনে হয় যে, আমার জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত, জীবন যৌবন, সুখ দুঃখ, একাল সেকাল সবকিছুই মোমবাতির মতো পুড়িয়া শেষ প্রান্তে এসে হাজির হয়েছে। আমার এই ক্লান্তি, কষ্ট, গ্লানি কিংবা প্রানক্ষয়কর দাহ হয়তো আর বেশিদিন থাকবে না।

আমি রেহালার সাথে আর অনেক কথা বাড়াই না। আমি যাহা বুঝবার সব বুঝে গিয়েছিলাম। শুধু বারবার একটা কথাই ভাবতেছিলাম, আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে আমি আর রেহালা একসাথে একই স্কুলে পড়াশুনা করেছি। তখন রেহালা যে স্বপ্ন দেখেছিলো, তার ভবিষ্যৎ জীবনের, তার সংসার জীবনের, আজ এতো বছর পর এসে রেহালা দেখতে পেলো তার সেই সপ্নগুলি আসলে সব সপ্নই থেকে গেছে। খুব কষ্ট লাগতেছিলো আমার। আমাদের এই সমাজ, আমাদের নীতি নির্ধারকেরা আজো প্রতিটা মেয়েকে বোঝাই মনে করে। সবাই মনে করে-তাদের লেখাপড়ার দরকার নাই, তাদের প্রেমের কোনো মুল্য নাই, তাদের বাকস্বাধীনতা নাই, তাদের নিজস্ব কোনো পছন্দ অপছন্দও নাই। ওরা জন্মায় শুধু কাউকে নিজের অনিচ্ছায়ই হোক আর সেচ্ছাতেই হোক বিয়ে করা। আর সেই বিয়ে টিকার দায়িত্ব শুধু তাদের। ওরা জামাইয়ের মার খাবে, স্বামীরা ওদেরকে নিজের থালা-কলসীর মতো কিছুদিন ব্যবহার করে আবার অন্য কোথাও বিক্রি করে দিবে। অথবা কোনো দায়িত্ব না নিয়াই অন্য আরেকজনের সাথে ফষ্টিনষ্টি কিংবা ঘর করবে। আর মাঝখানের সময়টায় ওরা বছর বছর বাচ্চার জন্ম দিবে। এটাই যেনো ওদের একমাত্র কাজ। রেহালা আমার সামনে বসে আছে বটে কিন্তু ওর দৃষ্টি আমার জানালার বাইরে অনেক দূরের আকাশে। তার মনে কি চলতেছে আমি জানি না, তবে সেই দূরের আকাশে কোনো নতুন স্বপ্ন যে নাই, সেটা স্পষ্ট বুঝা যায়। সে তার এই জীবনের সুখ কিংবা আদর আর প্রত্যাশা করে না। শুধু সময় গুনছে কবে মৃত্যু তাকে লইয়া যাবে। আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই, আমরা আজীবন বাচতে চাই, কেউ এই দুনিয়া ছেড়ে মৃত্যুর মতো একটা অজানা জীবনে যেতে চায় না। অথচ রেহালার ভাষায়, সে প্রতিদিন নামাজ পড়ে সেই স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে যেনো মৃত্যু এসে রেহালাকে নিয়ে যায়।

অনেকক্ষন আমার অফিসে একটা নীরবতা চলছিলো। রেহালার জীবনের কাহিনী বলবার পর যেন সে নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার ভাবনা ভুল প্রমান করে রেহালা আবারো বলিতে থাকে-

-কাকা, আজ অনেক কষ্টের কথা আপনাকে বলতে পেরে নিজেকে অনেক অনেক হালকা মনে হচ্ছে। আমি জানি না, কেনো আমাদের মতো মানুষের এই পৃথিবীতে জন্ম হয়। মা হিসাবে আমরা যেমন অসফল, স্ত্রী হিসাবেও তেমনি অসফল। এই সমাজ আমাদেরকে না কখনো মুল্যায়ন করে, না নিজের ঘরের পিতা মাতা আমাদেরকে বুকে আগলে ধরে রাখে। আমরা যেনো সমাজের সেই প্রানিগুলির মতো, যারা একবার জন্ম নিয়াছে বলে শুধু মৃত্যু না আসা অবধি দেহত্যাগ করে না আবার নিজেরাও নিজেকে শেষ করতে পারে না কারন আত্তহত্যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। অথচ দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অবহেলায় কচূরীপানার মতো আমরা এককুল হতে আরেককূলে শুধু ভেসেই যাই, না কেউ আমাদেরকে তুতুলে নেয়, না কেউ আশ্রয় দেয়। তারপরেও আমরা বেচে থাকি। এখন সত্যিই আর বাচতে ইচ্ছা করে না। আজ আপনার সাথে দেখা হলো-মনটা বড় ভালো লাগলো। মনেই হয় না এর মধ্যে ৪০ বছর পার করে দিয়েছি। মনে হচ্ছে, এই তো সেদিনের কথা। সেই শীতের দিনে জড়োসড়ো হয়ে গায়ের পথ ধরে হেটে বেড়াইতাম, স্কুলে গিয়া একসাথে কত মজা করতাম, বৃষ্টির দিনে ভিজতাম, আজ মনে হয়-আহা যদি আরো একবার আবার সেই পুরান দিনে ফিরে যেতে পারতাম। আহা যদি এই পিশাচের মতো কেউ আমার জীবনে না আসতো, আহা-যদি এমন কেউ আসতো যে আমার সেই গানগুলি শুনে শুনে পাশে বসে হাততালি দিতো। আসলে জীবন মনে হয় এমনই, আবার কেনো জানি মনে হয়, সব জীবন এমন নয়। তাহলে আমাদের জীবন এমন কেনো?

আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। শুধু রেহালাকে বললাম, পৃথিবীটা এমন নয় যা দেখছিস। এই পৃথিবী অনেক অনেক সুন্দর। হয়তো ভুল সময় ভুল মানুষের পাশে গিয়ে ভুলভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছিলি। আর সেই ভুল মানুষটাই তোকে ভুল পথের দিকে তোর নিজের অজান্তে নিয়ে গিয়েছিলো। ভুলে যা সব। বললাম, আজ থেকে বহু বছর আগের আমার গ্রামের একমাত্র মেয়ে খেলার সাথী তুই। তোকে দেখেও আমি অনেক খুশি হয়েছি রেহালা। আসিস যখন মন খারাপ হয়, যখন কোনো রাস্তা না দেখা যায়। আমি তোর কাকাই বলিস আর বন্ধুই বলিস, আসিস। রেহালা তার শাড়ির আচলটা টেনে চোখ দুটি মুছে বের হবার উপক্রম হলো। যাওয়ার সময় হটাতই রেহালা আমার পায়ে সালাম করার জন্য উদ্যত হলে আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তুই আমার শুধু বন্ধু না রেহালা, তুই আমার বোনও। আমার কি হলো জানি না, আমার চোখটাও কেনো জানি ঝাপ্সা হয়ে গেলো।

রেহালা তার চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে গেলো। আমি শুধু ওর যাওয়াটা দেখলাম। আর ভাবিলাম,

প্রতিটা মেয়ে মানুষের উচিত নিজের পায়ের উপর দাঁড়ানো। যতোদিন তারা নিজেরা সাবলম্বি না হবে, তারা আজীবন ভুল সময়ে ভুল মানুষের কাছেই হস্তান্তর হতে থাকবে। হয়তো কতিপয় কিছু অধীক ভাগ্যবান মেয়েরা ছাড়া যাদের সংখ্যা অতীব নগন্য। দোয়া করি-রেহালারা ভালো থাকুক। আর দুঃখ হয় সেইসব বাবা মায়ের জন্য যারা নিজের মেয়ে সন্তানকে তাদের ছেলে সন্তানের মতো একই সাড়িতে ভাবেননা। অথচ দুটাই তাদের সন্তান। কে জানে, সেই বাবা মায়েরও কোনো একদিন এমন এক পরিস্থিতিতে পড়তে হয় যখন এইসব মেয়েদের ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার পথ খোলা হয়তো থাকবে না।

আমি রাহেলার জন্য একটা টাকা প্রতিমাসের জন্য বরাদ্ধ করলাম যাতে অন্তত রাহেলা তার ঔষধগুলি কিনে খেতে পারে। রাহেলার জন্য হয়তো এটা একটা অনেক বড় সাহাজ্য হবে। রাহেলা এখন প্রায় প্রতিমাসেই আমার একাউন্ট অফিসারের কাছ হতে সেই টাকাটা নিতে আসে। কখনো ওর সাথে আমার দেখা হয়, কখনো দেখা হয় না। তারপরেও আমি শান্তি পাই যে, রেহালারা এখনো বেচে আছে।

রেহালার স্বামী এখন পুরুই পংগু। কোনো রকমে ভিক্ষা করে জীবন চালায়। তার পাশে এখন আর কোনো রেহালারা নাই, না আছে তার কোনো মগা সন্তান।

২০/০৭/২০২১***-ভরষা

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব 

২০২১ 

২০ জুলাই 

ভরষা করা দোষের নয়। মানুষ যদি মানুষের উপর ভরষা না করে, তাহলে ধ্বংস বেশী দূরে নেই। কিন্তু কারো উপর ভরষা করার আগে সতর্ক থাকা খুবই জরুরী। ইচ্ছাকে ভালোবাসায়, আর ভালোবাসা থেকে সম্পর্ক তৈরী করার সময় এই সতর্ক থাকা ভীষনই প্রয়োজন। কিন্তু তুমি এসবের কোনো কিছুই না জেনে শুধু ইচ্ছাটাকে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় তুমি সম্পরকটা করেছো যেখানে তুমি কোনো কিছুই ভাবো নাই। তুমি পরিশ্রমী, তুমি সাহসী যদি কেউ পাশে থাকে, তুমি সৎ সেটা নিজের কাছে এবং আর তোমার জীবনের হিসাব তুমি জানো। আর তোমার মনে যে সপ্ন ছিলো সেটা পুরন করার জন্যই তুমি একটা সমঝোতা করেছো নিজের সাথে নিজের। আর সেটা তুমি সততার সাথে পালনও করছো। তোমার জীবনে এই গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আসলে তোমার সামনে কেউ ছিলো না। আর থাকলেও কোনো লাভ হতো না সেটা তুমি হারে হারে জানো। কারন যারা থেকেও ছিলো, তারা আসলে কখনোই তোমাকে মুল্যায়ন করেনি, করতোও না। তুমি অথবা যার সাথে তুমি এমন একটা সম্পর্ক করেছো, তোমরা কখনোই এটাও ভুলে যেতে চাও নাই যে, এই সম্পর্কের সামাজিকভাবে আসলে কোনো স্বীকৃতিও নাই। কিন্তু তোমার চোখ বন্ধ করে ভরষা করার ফল আমি কখনোই সেটা বৃথা যেতে দিতে চাই না। কারন তুমি অন্তত তোমার সব কিছু দিয়েই আমাকে মেনে নিয়েছো। এখানে গাদ্দারী করার কোনো প্রকারের অবকাশ বা সাহস আমার ছিলোনা, নাই আর ভবিষ্যতে থাকবেও না। ভদ্রতার পিছনে আমার কোনো প্রকার মুখোস কিংবা শয়তানীও নাই। কারন আমি জানি, এই জগতে আমাকে ছাড়া তোমার আর কেউ নাই, হোক সেটা তোমার জন্মদাতা বাবা বা মা অথবা তোমার রক্তের কেউ। এই অবস্থায় আমি তোমাকে ফেলে গেলেও আমার চোখ বারবার ফিরে তাকাবে পিছনে যেখানে তুমি পড়ে আছো। আমি সেটা কখনোই করতে পারবো না। ভাবো তো একবার- আমি চলে যাচ্ছি, তুমি চেয়ে চেয়ে দেখছো আমার নিষ্ঠুরতা, আর তুমি ভাবছো, তোমার সারাটা দুনিয়া এখন অন্ধকার। তোমার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে, তুমি ভাষাহীন হয়ে যাবে, তখন তোমার চোখ শুধু কথা বলবে। আর চোখের ভাষা তো একটাই। জল। এই জল দেখার জন্যে আমি কখনো প্রস্তুত নই।

এই প্রিথিবীতে কে আছে তোমার, আর কে নাই তাদের সবার শক্তি, ভালোবাসা আর ভরষা যোগ করলেও সেই ভরষার সাথে একদিকে শুধু আমি, এটাই তোমার কাছে পৃথিবীর সর্বোত্তম শক্তি। আর তুমি এতাই প্রমান করেছো এই পারুর কেসে। সারাটা গ্রাম, আইন, থানা, টাকা পয়সা, নেতা, মাদবরী, সন্ত্রাসী, চোখ রাংগানি একদিকে আর তুমি একাই একদিকে ছিলে। আর সেই শক্তিটাই তুমি প্রতিনিয়ত পেয়েছো এই ভরষার মানুষটার কাছে। কারন তুমি জানো, আর সবাই পালিয়ে গেলেও আমি অন্তত পালাবো না।

কেনো তুমি অন্য কারো চোখে চোখ রাখতে পারো না, কেনো তোমার মনে অন্য কারো স্থান হয় না, কখনো কি এটা খুব মনোযোগ সহকারে নিজেকে প্রশ্ন করেছো? ধর্মের কথা আলাদা, আল্লাহর দোহাই আলাদা ব্যাপার। কিন্তু এর বাইরেও তো অনেক লজিক আছে। সেই লজিক দিয়েও কি কখনো ভেবেছো কেনো হয় না সেগুলি? এর উত্তর একটাই- টোটাল সারেন্ডার। মানে সম্পুর্ন আত্তসমর্পন। যখন কোনো মানুষ তার নিজের মন তৃপ্তিতে থাকে, যখন চোখ ভালো ঘুম পায়, যখন শরীরের চাহিদা পূর্ন হয়, তখন শরীর, দেহ, মন, কিংবা আত্তা কারো দিকে ছুটে যেতে চায় না। যেমন ছুটে যায় না চাঁদ পৃথিবীর বলয় থেকে, কিংবা প্রিথিবী সূর্যের বলয় থেকে। তাদের যতোটুকু শক্ত্র প্রয়োজন তাদের নিজ নিজ অক্ষে চলার, ঠিক ততোটাই তারা পায়। তাহলে আর অন্য কোনো গ্রহের কিংবা নক্ষত্রের দারস্থ হবার কি প্রয়োজন?

মানুষ তখনি ছুটে যায় এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে যখন সে তার সঠিক তরী খুজে না পায়। আর সঠিক ঘাটের সন্ধান যখন একবার কেউ পায়, তার আর অন্য ঘাটে যাওয়ার অর্থ ভুল ঘাটে চলে যাওয়া। ভুল ঘাট মানুষকে ভুল পথেই নিয়া যায়। আর কেউ যখন একবার ভুল পথে যাত্রা শুরু করে, সেখান থেকে ফিরে আসার অন্য কোনো বিকল্প রাস্তা হয়তো তার জানাই নাই। যদি সেই অচেনা রাস্তায় একবার কেউ পড়ে যায়, সেখানে প্রতিটি মানুষ তার অচেনা। অচেনা মানুষের কাছে চোখের জলের কোনো মুল্য থাকে না।

আর মুল্যহীন জীবনে সপ্ন তো দূরের কথা, বেচে থাকাই কষ্টের। কষ্টে ভরা জীবন যখন সামনে চলতে থাকে, তখন মানুষের এই জীবনের প্রতি মায়া হারিয়ে ফেলে, ভগবানের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। ঈশর আছে এটাই তখন আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। তারপরেও দূর্বল চিত্তের মানুষেরা যাদের কোনো কুল কিনারা আর থাকে না, যেমন লামিয়া বা শারমিন, তারা ওই অচেনা, অসুন্দর জীবনকেই মানিয়ে নিতে শুরু করে। সেখানে তখন আর ভগবানের কোনো অস্তিত্ত থাকে না বা তারা ভগবানকে মানেই না। ধর্ম পালন তো দুরের কথা।

তোমার দুষ্টুমি যেমন পাগলামী, আমার কাছে তোমার পাগলামীও তেমন মিষ্টি, তোমার কান্নাও আমার কাছে ঠিক ওই রকমের। তোমাকে ভালো রাখাই আমার কাজ। আর সেই ভালো থাকাটা নির্ভর করে তোমার আত্তার উপর তুমি কতোটা তৃপ্ত। এই প্রিথিবী থেকে চাঁদ যতো সুন্দর মনে হয়, নীল আকাসের সাথে চাদকে যেমন কোনো এক যুবতীর কপালের টীপ মনে হয়, অথবা অনেক দূরের কাশবন যখন সাদা মেঘের মতো হাওয়ায় দুলে দুলে মনকে দোলায়িত করে, যখন ওই চাদে গিয়ে পা রাখা যায়, কিংবা কাশবনের মাঝে হাজির হওয়া যায়, তখন তার আসল রুপ দেখে দম বন্ধ হয়ে আসে। সেই চাঁদ আর কাশবন কেনো জানি মনে হয় এটা একটা খারাপ সপ্ন ছিলো। আমরা সেখানে বসবাস করতে পারি না। আবার ছুটে আসতে চাই এই গাছ গাছালী ভর্তি নোনা সেঁতসেঁতে সোদা গন্ধের মাটিতে যেখানে বর্ষায় গাছের পাতা বেয়ে বেয়ে টিপ টিপ করে ফোটা ফোটা পানি আমাদের নাকের ডগা দিয়ে বুকের ভিতরে এসে অন্তর শীতল করে দেয়।

একটা মানুষের শান্তিতে আর সুখে বসবাসের জন্য এই পৃথিবীর অনেক কিছু লাগে না। প্রিন্সেস ডায়ানার একেকটা নেকলেসের দাম ছিলো কোটি কোটি টাকার। তার একেকটা ড্রেসের দাম ছিলো হাজার হাজার ডলার। সাথে ছিলো রাজ প্রাসাদ। কি ছিলো না তার। ছিলো সবুজ চোখের মনি, ঈশ্বর যেনো তাকে একাই রুপবতী করে পাঠিয়েছিলো। অথচ মনে তার কোনো শান্তিই ছিলো না। সেই শান্তির খোজে শেষতক রাজ প্রাসাদ ছাড়তে হয়েছে। অন্যের হাত ধরতে হয়েছে। আর মাত্র ৩২ বছর বয়সেই তাকে এই প্রিথিবী ছাড়তে হয়েছে। যদি বাড়ি, গাড়ি, জুয়েলারী, আর টাকা পয়সাই হতো সব সুখের মুল চাবিকাঠি, তাহলে ডায়নার থেকে সুখী মানুষ আর এই প্রিথিবীতে কেউ ছিলো না। কিন্তু সেটা কি আসলেই সুখী ছিলো?

একটা তরকারীতে নুন কম হতে পারে, একটা পরোটা পুড়ে যেতে পারে, তার স্বাদ কিংবা মজা হয়তো একটু হেরফের হতেই পারে কিন্তু সেটা হয়তো একদিন বা দুইদিন। কিন্তু ভালোবাসা আর মহব্বতে যখন নুনের কমতি হয়, পুড়ে যায়, তখন জীবনের মজাটাই শেষ হয়ে যায়। আর জীবনের মজা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন এসি রুমেও ভালো ঘুম হয় না। নীল আকাশ দেখেও কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে না। তখন যেটা মনে হয় তা হচ্ছে বিষাদময় রুচী। সেই রুচীতে আর যাই হোক পেট ভরে না। আর পেটে ক্ষুধা রেখে কোনোদিন কারো ভালো ঘুম হয়েছে তার কোনো প্রমান নাই।

আমি তোমার জীবনে সেই রকমের একটা অলিখিত ভরষা। এই ভরষার কোনো ডেফিনিশন নাই। এই ভরষার কোনো আইন গত দিক নাই বটে কিন্তু আমার নিজের অনেক দায়িত্তশীলতা আছে যেখানে আমিই আইনপ্রনেতা, আর আমিই সবচেয়ে বড় বিচারক। হয়তো সমাজকে আমি তুরি দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারবো না, কিন্তু আমি সেটাই করততে পারি যাতে তুমি তুড়ি দিয়ে সবাইকে এটাই করতে পারো যে, তুমি নিজেও একটা শক্তি।

আজ তুমি সেই বিগত বছরগুলির দিকে তাকিয়ে দেখো? তুমি দেখতে পাবে যে, সেইসব বছরগুলিতে অনেক ঝং ধরা ছিলো। আগাছায় ভরা একটা কঠিন পথ ছিলো। কিন্তু আজ থেকে ৫ বছর পরেরদিন গুলি দেখো, সেখানে প্রতিদিন তোমার জীবন মোড় নিয়েছে। বাকেবাকে সমস্যা ছিলো কারন সমস্যা গুলি হয়তো আমার নজরে ছিলো না। কিন্তু আজ তোমার সেই বছরগুলির সাথে তুলনা করলে স্পষ্ট দেখতে পাবে, আকাশের মেঘ তোমার ঘরেই রংধনু হয়ে একটা বাগান তৈরী করেছে। সেই বাগানে তুমি যখন খুসী যেভাবে খুসী বিচরন করতে পারো। এই বাগানের একচ্ছত্র মালিকানা তোমার নিজের। এখানে একটা আম খেলেও শরীর চাংগা হয়ে উঠে, এখানে একটা ডিম খেলেও শতভাগ কাজ করে। অথচ আজ থেকে ৫ বছর আগে সেই একটি আম কিংবা একটি ডিম এমন করে খেলেও শতভাগ কাজ করতো না। কারন তখন ভরষার জায়গাটা ছিলো একেবারেই অনিশ্চিত। যা এখন পুরুটাই উলটা। আর এটাই খাটি ভরষা।

এখানে শুধু একটা ব্যাপারই চিন্তার বিষয় যে, যে মানুষটার কারনে কখনো নিজেদেরকে অসহায় মনে হয় নাই, কোনো দুশ্চিন্তা গ্রাস করে নাই, যখন সেই মানুষটা চলে যায়, তখন সেইই দিয়ে যায় যতো অসহায়ত্ব আর দুশ্চিন্তা। আর এটা আমার মাথায় সব সময় কাজ করে। এর জন্যে সমাধান একটাই- যা আমি অন্যদের বেলায় করেছি। সাবলম্বিতা। এবং দ্রুত। তোমাদের কাজ ভরষা করা আর আমার কাজ সেই ভরষার স্থানটা স্থায়ী করা।

যেদিন মনে হবে তুমি সাবলম্বি, তুমি নিজে নিজে একাই চলার ক্ষমতা রাখো, তোমার সমাজ তোমাকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে দিধা বোধ করবে, সেদিন আসলে আমার দায়িত্ত প্রায় শেষ হয়েছে বলে আমি মনে করবো যেটা এখন প্রায়ই ভাবি আমার এই পক্ষের মানুষগুলির জন্য। তখন যেটা হবে- তুমি স্বাধীন পাখীর মতো এক ঢাল থেকে একাই উড়ে গিয়ে আরেক ঢালে বসতে পারবে। কিন্তু পাখীরা যখন একবার নিরাপদ গাছে বাসা বেধে ফেলে, যতোদিন ওই গাছটা থাকে, কেউ আর কেটে ফেলে না, কিংবা আচমকা কোনো ঝড়ে যখন গাছটা আর ভেংগে পড়ে না, ততোক্ষন অবধি সেই ভাষাহীন অবুঝ পাখীরাও তাদের নীড় পরিবর্তনে মনোযোগ দেয় না না। তারা সেখানে অভয়ারন্য তৈরী করে সেই জংগল সাম্রাজ্যের অধিকর্তা হিসাবেই জীবন পাড় করে দেয়।

ওই গাছটাই তখন তার ভরষা। ওই গাছ জায়গা দেয় বাসা করার, ওই গাছ ঢাল পেতে দেয় নিবিড় করে বসার। ওই পাখী চলে গেলেও গাছের না হয় কোনো ক্ষতি, না হয় তার ফলনে কোনো বিঘ্নতা। ঠিক সময়ে সেই গাছ ফুল দেয়, ফল দেয়, আর দেয় ছায়া। ঝড়ের দিনেও সে হয়তো অন্য আরো অনেক পাখীর জন্যে অভয়ারন্য স্রিষ্টি করে বটে কিন্তু সেই গাছ কোনোদিন অভিযোগ করে নাই, কেনো অন্য আর কিছু পাখী তার ঢাল ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলো। তবে যদি আবারো সে ফিরে আসে, গাছের কোনো অভিযোগ থাকে না। কিন্তু যদি কোনো ঢালই আর খালী না থাকে, সেটা তো আর গাছের দোষ নয়।

ভরষার স্থান কেউ ত্যাগ করলে গাছের কি দোষ!!

১২/০৬/২০২১-রোস্তমের টাকা চুরি-১

Categories

আমার ড্রাইভার ছিলো রুস্তম। খুবই ভালো একজন ড্রাইভার। বিয়ে করেছিলো কিন্তু রোস্তমের অভ্যাসের কারনে ওর বউ ওকে ছেড়ে দেয় কিন্তু ইতিমধ্যে ওদের একটা পুত্র সন্তান হয়ে যায়। ছেলেকে রেখেই রোস্তমের বউ রোস্তমকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করে বিদেশে সেটেল্ড হয় যায়। রোস্তমের দোষ ছিলো রোস্তম প্রায়ই ডিউটি শেষে ওর বন্ধু বান্ধব্দের নিয়ে মদের আড্ডায় বসতো যা ওর বউ পছন্দ করতো না। বউ চলে যাবার পর ছেলেকে নানীর বাড়িতেই রেখে রোস্তম ছেলেকে পালতে শুরু করলেও মদের নেশাটা ছাড়তে পারলো না। বরং মদটা যেনো ওকে আরো পাইয়ে বসলো। আমি জানতাম না যে, রোস্তম মদ খায়। কারন আমার ডিউটি শেষ করার পর রোস্তম কোথায় গেলো আর কি করলো সেটা নিয়ে আমি মোটেই খবর রাখতাম না। 

এভাবেই রোস্তম আমার কাছে প্রায় ৫ বছর ড্রাইভার হিসাবে কাজ করছিলো। বিস্তস্থতা আর কোয়ালিটি ড্রাইভার হিসাবে রোস্তমের উপর আমার কোনো সন্দেহ ছিলো না। মাঝে মাঝে বেতনের বাইরেও আমি ওকে টাকা দেই, যেটা রোস্তম ও জানে যে ফেরত দিতে হবে না। আমিও চাইতাম না। রোস্তমের উপর আমার বিশ্বাস এমন হয়ে গিয়েছিলো যে, মাঝে মাঝে ফ্যাক্টরীর কোটি কোটি টাকাও একা ব্যাংক থেকে আনা নেয়া করাতাম। ভালোই চলছিলো। একদিন রোস্তম বল্লো যে, রোস্তম আসলে একা থাকে বলে ওর খাওয়া দাওয়ায় বেশ সমস্যা হয়, কাপড় চোপড় ধোয়াতেও সমস্যা হয়। ও বিয়ে করতে চায়। আমি ব্যাপারটাইয় সায়ই দিলাম। ওর বিয়ের একটা বাজেট হলো, প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো। আমি বললাম, যে, আমিই ওর বিয়ের পুরু খরচটা দেবো। দিয়েও দিলাম। রোস্তম বিয়ে করে ফেল্লো। আমাদের বাসার পাশেই থাকে রোস্তম, সাথে ওর নতুন বউ। এবার একটা নতুন ঝামেলার সৃষ্টি হলো। নতুন বউ ও নাকি রোস্তমের সাথে এডজাষ্ট করতে পারছে না। জিজ্ঞেস করলাম আশেপাশের মানুষ গুলিকে। যে জিনিষটা আমার কখনোই ভালো করে জানা হয় নাই সেটা আমার নজরে এলো। রোস্তম ডিউটি করে এসেই সারারাত মদের আড্ডায় থাকে। ফলে ৫/৬ মাস যেতে না যেতেই রোস্তমের সাথে এই দ্বিতীয় বউ ও তাঁকে ছেড়ে দিতে মনস্থ করলো। কিন্তু রোস্তম যে বাসায় থাকে সেটা রোস্তমের নতুন বউ এর ভাড়া করা বাসা।ফলে ওর বউ রোস্তমকে বাসা থেকে বের করেই ছাড়লো। 

আমার দয়ার শরীর, তার উপরে রোস্তমকে ছাড়া আমি অচল। ভাবলাম যে, আমার বাসায় একটা গার্ডের রুম আছে, যেটায় কেউ থাকে না। এটাচড বাথ রুম। রোস্তমকে আমার বাসার ঐ গার্ড রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। একদিন যায় দুইদিন যায়, হটাত এক রাতে আমি দেখলাম যে, রোস্তম আমার বাসায় বসেই মদ খাচ্ছে। অনেক রাগারাগি করলাম, নিষেধ করলাম এবং সতর্ক করে দিলাম যে, আর যদি কখনো আমি ওকে মদ খেতে দেখি তাহলে আমি ওকে বাসা থেকে শুধু নয়, আমার ড্রাইভার হিসাবেও ওকে বাদ দিয়ে দেবো। রোস্তম আমার কাছে এক প্রকার প্রতিজ্ঞাই করলো যে, সে আর কখনো মদ খাবে না। কিন্তু মদের যার নেশা, সে মদ ছাড়ে কিভাবে? রাত যখন গহীন হয়, রোস্তম তার মদের বোতলের মুখ খুলে মদ পান করতে থাকে। একদিন আমিও বেশ গহীন রাতে ওর রুমে হটাত করে এসে দেখি, রোস্তম মদ খাচ্ছে। মাথা আমার ঠিক ছিলো না। আমি রোস্তমকে ঐ রাতেই আমার বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলাম। কিন্তু চাকুরীটা বাদ করিনি। রোস্তম নরম্যালি আমার ড্রাইভার হিসাবে আবারো কাজ করতে থাকে। কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হলো না। এভাবেই প্রায় মাস খানেক চলে গেলো। 

গাড়িতে থাকাকালীন আমি প্রায়ই রোস্তমের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এম্নিতেই কথা বলতাম।  একবার রুস্তম আমারে বল্লো যে, ওর কাছে যদি ৩ লাখ টাকা থাকে তাহলে ওর জীবন নাকি সে বদলাইয়া ফেলবে। খুব ভালো কথা। বললাম, ৩ লাখ টাকা যদি পাস, তাহলে কি করবি? রুস্তম বল্লো যে, সে ২টা পুরান সিএনজি কিনবে। একটা নিজে চালাবে আরেকটা ভাড়ায় চালাবে। তাতে প্রতিদিন সে পাবে ১২০০ টাকা। তারমানে মাসে ৩৬ হাজার টাকা। ওর খরচ লাগে মাসে ১৬ হাজার টাকা। তার মানে মাসে সে ২০ হাজার সেভ হবে। বছরে সেভ হবে আড়াই লাখ টাকা। সেই আড়াই লাখ টাকা দিয়া সে আরেকটা সিএনজি কিনবে। এভাবে ২/৩ বছর পর সে গাড়ি কিনবে। তাতে ওর প্রতি দিন লাভ হবে ২ হাজার টাকা। এভাবে সে হিসাব করে দেখলো যে, ৫ বছর পর তার হাতে আসবে প্রায় ২০ লাখ টাকা, ৩টা সিএনজি আর একটা গাড়ি।

আমি ব্যাপারটা খুব সাভাবিকভাবেই নিয়েছিলাম। আগে পিছে কিছুই ভাবি নাই। একদিন আমি রোস্তমকে নিয়ে আমার প্লাষ্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের বেতনভাতা নিয়ে গেলাম ফ্যাক্টরীতে। আমার ব্যাগে তখন দুই জায়গায় মোট ৫ লাখ টাকা ছিলো। আমি গাড়ি থেকে নেমে অফিসে বসার পর আমার অন্যান্য ডাইরেক্টরদেরকে বললাম, আমার ব্যাগে ৫ লাখ টাকা আছে, সেটা নিয়ে আসো। বেতন দিয়ে দাও শ্রমিকদেরকে। সবাই বেতনের জন্য অপেক্ষা করছে। আমার গাড়িটা আমার অফিসের একেবারেই দরজার সামনেই পার্ক করা থাকে। আমার ডাইরেক্টররা গাড়ির কাছে এসে রোস্তমকে খুজে না পেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, রোস্তম সম্ভবত গেটের দোকানে চা খেতে গিয়েছে। ওকে ফোন দিলাম, বল্লো, চা খেয়ে এখুনি আসবে। আসলে ব্যাপারটা ছিলো অন্য রকমের। রোস্তম আমার ব্যাগ থেকে এক পকেটে ৩ লাখ টাকা ছিলো, সেটা সে নিয়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে কিন্তু আমাকে জানিয়েছিলো যে সে চা খেতে গেছে যেটা সে প্রায়ই চা খাওয়ার জন্য গেটের দোকানে যায়। ওর আসতে দেরী হ ওয়াতে আমি বারবার ফোন করতে থাকি। কিন্তু এক সময় দেখলাম রোস্তমের ফোন বন্ধ। আমার সন্দেহ হলো। দোকানে লোক পাঠালাম, রোস্তম সেখানে চায়ের জন্য বসেই নাই। বুঝতে বেশী দেরী হলো না যে, সে আমার ব্যাগ থেকে ৩ লাখ টাকা চুরি করে পালিয়েছে। ফ্যাক্টরীর আশেপাশে সব খানে খোজাখুজি করার পরেও যখন আর পেলাম না, তখন মীরপুর বাসা থেকে ডুপ্লিকেট চাবী এনে আমার গাড়ি খুলতে হলো, ব্যাগ চেক করলাম, এক জায়গায় রাখা তিন লাখ টাকা নাই, অন্য পকেটে রাখা ৩ লাখ টাকা আছে। 

 

 

চুরি করার পর এক মাস পালাইয়া পালাইয়া থাকলো। কোনো সিএনজি, কিংবা কিছুই কিনলো না। প্রতিদিন মদ খাইতো রাতে। একদিন মদ খাওয়ার পর কিছু বন্ধু বান্ধব জেনে গেলো ওর কাছে বেশ কিছু টাকা আছে। এক রাতে মদ খাইয়া বেহুস। ওর সব বন্ধুরা টাকা গুলি নিয়া পালাইলো। রুস্তমের আর কিছুই নাই। খাওয়ার পয়সাও নাই। তারপর একদিন সে ভাবছে, আমার কাছে আবার ফিরে আসবে কিনা। কিন্তু আর সাহস পায় নাই। তারপর না খেয়ে খেয়ে পাগলের মতো অবস্থা। আবার এদিকে পুলিশের ভয়, আমার ভয়।

অতঃপর একদিন

একদিন একতা বিশাল চিঠি লিখলো আমাকে। পোষ্ট অফিসে গেলো চিঠি পোষ্ট করতে। চিঠি পোষ্ট করলো। ২২ পাতার একটা চিঠি।  চিঠির শেষ লাইনে লেখা ছিলো- যেদিন আপনি চিঠিটা পাবেন, সেদিন হয়তো আমি আর বেচে নেই স্যার। কিন্তু একটা কথা বলে যাই, আপনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু আমার সাহস কম, তাই আর বাচতে পারলাম না। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমাকে ক্ষমা কইরা দিয়েন।  যেদিন আমি চিঠিটা পাই, তার প্রায় ৪ দিন আগে রুস্তম তারের কাটা গলায় দিয়ে ফাসি দিয়ে আত্তহত্যা করেছিলো। আমার প্রায়ই ওর কথা মনে পড়ে। আমি ভাবি যে, যদি রুস্তম সাহস করে আবার আমার কাছে আসতো, আমি ওকে আবার রাখতাম আমার ড্রাইভার হিসাবে। আমি ওরে ক্ষমা করে দিছি। আমিও ওকে ভালোবাসতাম। কিন্তু আমার ভালোবাসা ওকে ঠেকাতে পারে নাই। এটা আমার ব্যর্থতা। কিন্তু এটা ওরও ব্যর্থতা।

 এটা কেনো বললাম জানো?

কারন, যে যেই জীবন চায়, সে সেটাই পায়। কেউ জেনে শুনে পায়, কেউ না জেনেই পায়। তোমার লাইফ আমার কাছে যতোটা মুল্যবান, সেই জীবনটা তোমার কাছে কতটা মুল্যবান, তার উপর নির্ভর করবে তোমার পরবর্তী পদক্ষেপ। আর এই পদক্ষেপ কেউ ঠেকাতে পারে না। যার জীবন, মাঝে মাঝে সেও ঠেকাতে পারে না। আমি তোমাকে ১০০% সাধীনতায় বাচিয়ে রাখতে চাই। তুমি জানো তুমি কতটা সাধীনতায় আছো। আর কতটা মনের জোরে আছো। আর কতটা কষ্টে আছো। এটা শুধু জানো তুমি। কিন্তু আমি জানি, আমি তোমার কতটা নিরাপত্তা চাই আর কতোটা কি করলে তোমার বেচে থাকতে ভালো লাগবে। বাকীটা তোমার মন আর অন্তর জানে। আমি তোমাকে মাঝে মাঝে ফান করে বলি যদিও যে, ভাইগা যাইবা কিনা। সেটা আসলেই ফান। কিন্তু কখনো যদি এই ফানটাই বাস্তব হয়, আমি কিন্তু তারপরেও খুসি থাকবো এই কারনে যে, অন্তত তুমি ভালো আছো। আর কিছু না। আর এই ফানটা বাস্তবে সম্ভব হলেও, যেদিন সম্ভব হবে, তার ঠিক এক মাস পরে তোমার মন, তোমার প্রান, তোমার সারাটা অন্তর ঠিক রুস্তম হয়ে যাবে। ফেরার কোনো পথ জানা থাকলেও আর ফেরা হবে না। কারন তখন পা আগাবে না, কিন্তু মন ধাক্কাবে ঠিকই, আবার অন্যদিকে মনের জোরের বিপরীতে কাজ করবে ভয়। ফলে একদিন-

একদিন মনে হবে, বেচে থাকার মুল্যটা আর নাই। হয় সারাজীবন কষ্টে বাচতে হবে নতুবা রুস্তমের মতো ২২ পাতার একটা চিঠি লিখে হয়তো শেষ লাইনে তুমিও লিখবা- বাবা আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু ফিরে আসতে পারলাম না।

রুস্তম আমার বাসা চিনতো, আমার অফিস চিনতো, আমার সব কিছু চিনতো। কিন্তু এই চেনা পথেও রুস্তম আর ফিরে আসতে পারে নাই। যেমন তুমিও চিনতা আজকের এই বাসাটা। ইচ্ছে করলেই আমাকে বলে ১ দিন পর আবার চলে আসতে পারতা। কিন্তু পারো নাই। আর এটাকেই বলে জীবনের কাছে পরাজয়। বড় বড় ঝড়ে মানুষ হয় দালান খোজে, আর যদি দালান না পায়, বড় বড় গাছ খোজে। বড় গাছের নীচে ঝড় কম। উদাহরন দেই, এই যে হ্যাপির ঘটনাটা, তোমাদের সমস্ত পরিবারে একটা ঝড় ছিলো। তছনছের আভাস কিন্তু পেয়েছি হ্যাপির যাওয়ার ২ দিন পর থেকেই। যেভাবে সবাই তোমাদেরকে আস্টেপিষ্টে ধরতেছিলো, কোনো অবস্থাতেই তোমরা আর ঐ গ্রামে থাকতে পারতা না। কিন্তু হয়তো আমি ছিলাম বলে রক্ষা পেয়ে গেছো আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু যদি না থাকতাম? আজ যতোটা শান্তিতে আর বুকের বল নিয়া ঘুরতে পারো, যদি না থাকতাম, তাহলে অতোটা নীচু হয়েই বাস করতে হতো বংশ পরম্পরায়। আর এই কষ্ট দেখটা নিজের চোখে। মাঝে মাঝে মনে হইতো, জীবনের পরাজয় মনে হয় এভাবেই হয়।

আমি এগুলি দেখেছি আমার এই ৫০ বছর বয়সেই। তাই, আমি কাউকে ঠকাই না, কিন্তু আমি ঠকার জন্য রেডি থাকি। কারন আমার ঠকার মতো ক্ষমতা আছে। এটা টাকার জন্য না। এটা একটা মনের বল। নিজের মনের শক্তি। আজমীও তো পালাইতে পারতো। কিন্তু ও নিজেও এখন আর পালাইতে চায় না। তাই আমি সব সময় মানুষকে বলি, পারলে পালিয়ে যাও। আমি ধরে রাখি না। এটা তোমার জন্যেও প্রজোজ্য।

খেয়াল করে দেখো- ঐ সময় ২ লাখ টাকা তোমার কাছে শত কোটির মতো মনে হয়েছে। সেই টাকাটা তোমার কাছে ছিলো একটা শক্তি। কিন্তু আজকে তোমার কাছে প্রায় ২০ লাখ টাকাও মনে হয় না যে, এটা শক্তি। কারন তোমার লাইফ স্টাইল বদলে গেছে। তুমি এখন ইচ্ছে করলেই বন্যার ছেলের জন্য বন্যা টাকা চাইলে না দিয়ে পারবা না। আর যদি না দাও, তুমিও বন্যার কাছে অনর্থক এক পাবলিক। একটা সময় আসবে, মাসে ১ লাখ টাকা কামাই করলেও মনে হবে এটা এনাফ না। তখন দরকার লাখ লাখ টাকা। কে দেবে তোমাকে সেই ভরসার? সব সময় টাকাই ভরসা না। একজন মানুষই কোটি টাকার ভরসা। পালিয়ে যাও, দেখো কার হাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশী নিরাপদ। কার কাছে গেলে ভালো ঘুম হয়। দুসচিন্তা না থাকে। সেই লোক পাওয়া বড় কঠিন। বন্যাকে তুমি হাজার হাজার টাকা দাও না। কিন্তু তুমি বন্যাদের কাছে লাখ টাকার ভরসা। অন্যদিকে সুমীর সেই ভরসাটাও আর নাই। অথচ তুমি একদম কাছেই আছো।

কথাগুলি কঠিন। কিন্তু এই কথাগুলি এতোটাই বাস্তব যে, আজমী এখন বুঝে এটা। সেফালী বুঝে, লিয়াকত বুঝে, খালেদা বুঝে, সুমী বুঝে। কিন্তু একটা সময় ছিলো, তখন বুঝে নাই। ঐ যে বললাম- “যদি আর একবার” এটা একটা অনুশোচনার নাম। হয়তো “যদি আর একবার” এই সুযোগটা কখনোই কারো জীবনে আসে না।

শারমিন কথা

মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় প্রায় তিন বছর আগে। আর এই পরিচয়টা নিছক কোনো কাকতালীয়ভাবে নয়। নিছল প্রোফেশনাল প্রেক্ষাপট থেকেই তার সাথে আমার পরিচয়। ধীরে ধীরে সখ্যতা গড়ে উঠলেও প্রোফেশনাল বাউন্ডারি থেকে জীবনের সব কাহিনী সব সময় জানা হয়ে উঠে না। কিন্তু এই পরিচয়ের মধ্যে প্রোফেশনাল বাউন্ডারীর বাইরেও একটা আলাদা জগতের মধ্যে প্রবেশের পরিবেশ সৃষ্টি হয় যা নিছক ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক।

জীবনের সব কাহিনীর কিছু মোড় থাকে। এই মোড়ে মোড়ে আকাবাকা হয়ে কিছু অব্যক্ত কাহিনী থাকে যা থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। শারমিনের জীবনের ইতিহাসেও এই রকম বেশ কিছু বাক আছে। শারমিনের বিয়ে হয়েছে প্রায় অর্ধ যুগের উপর কিন্তু ঈশ্বর তাকে তিনি অনেক ভাগ্সেয আর আনন্ইদ থেকেই যেনো বিনা কারনে বঞ্চিত করে রেখেছন। কেনো এমন হয়? কেনো ঈশ্বর কাউকে থলে ভরা সম্পদ দেন, ঘর ভর্তি মানুষ দেন কিংবা দুহাত ভরে শান্তি দেন, আবার কারো কারো জন্য ঈশ্বর কিছুই দেন না। এর ব্যাখ্যা বড় জটিল। শারমিনের জীবন টাও যেনো সেই দলে যারা আজীবন শুধু বঞ্চিতই ছিলো। না জোগান দিলেন সি সাধের যেখানে কোনো হাটি হাটি পা পা করে ঘরময় ঘুরে বাড়াচ্ছে ক্ষুদ্র মানুষের পদধ্বনি, না ঝমকালো সম্পদের পাহাড়, অথবা সমাজের উচ্চবিত্তের কোনো অহংকার। ঈশ্বর কাকে কেনো এই সার্থকতা থেকে কি কারনে বঞ্চিত করেন, তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। আপাত দৃষ্টিতে আমাদের কারো কারো সহানুভুতি থাকলেও একটা জিনিষ সঠিক যে, ঈশ্বর তার সৃষ্টির সাথে কখনো মশকরা করেন না। তিনি যার যার সামর্থের উপর, যোগ্যতার উপর তাকে পুরুস্কার করেন। যতোক্ষন না কেউ কোনো কিছুর জন্য মানসিক, এবং মানবিক দিক থেকে প্রস্তুত না হয়, অথবা তাকে প্রস্তুত না করেন, ততোক্ষন পর্যন্ত ঈশ্বর তাকে সেই কাঙ্ক্ষিত পুরুস্কার কে তিনি তার হাতে তুলে দেন না। ঈশ্বর সবচেয়ে ভালো বিচারক। যে যতটুকুর ভার বহন করতে পারে, যে জিনিষের ভার বহন করতে পারবে, ঈশ্বর তাকে সেই জিনিষের ভারই তাকে দেন। অপাত্রে তিনি কোনো কিছুই দান করেন না। হোক তাকে তিনি যতো সুন্দর করেই সৃষ্টি করেন না কেনো।

ঈশ্বর এই জাতীয় মনুষ্য বাহিনীকে যুগে যুগে একটা রেফারেন্স দেওয়ার লক্ষ্যে, তাদেরকে উদারন হিসাবে রাখার জন্য হয়তো মনুষ্য সমাজে নিছক একটা লোভনীয় মুর্তি হিসাবে জাগিয়ে রাখেন।

আইন্ডেন্টিটি (পর্ব-১)

২৪ বছর পর মনিকা জানতে পারলো যাকে সে বাবা বলে চিনত, যাকে সে আদরের ছোট ভাই বলে জানতো, যাকে সে বোন, চাচা, দাদা, জেঠা ফুফু ইত্যাদ বলে জানতো, তারা আসলে মনিকার কেউ না। বাবা বাবা না, দাদা দাদা না, ভাই ভাই না, বোন বোন না, জেঠা, চাচা, এরা ওর কেউ দাদা, ভাই বা বোন কেউ না। অথচ কাকের বাসায় কোকিলের ছানার মতো তার জন্ম হয়েছে, শৈশব কেটেছে, বাল্যকাল কেটেছে, আর এখন সে একজন পুর্ন বয়ষ্ক যুবতী। তাহলে এই ২৪ বছর ধরে যে মনিকা তিলে তিলে তার অন্তর, আত্মা আর মানসিকতা দিয়ে কিসের বালুর এক প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলো যা আজ হটাত করে সমুদ্রের এক জলোচ্ছাসে নিমিষের মধ্যে তছনছ করে মিলিয়ে গেলো?

সব মিথ্যা। এ যাবত মনিকা যা পেয়েছে, যা দেখেছে, যা শুনেছে, আজ সব তার কাছে মিথ্যা বলে সামনে এসে সত্য হাজির হয়েছে। মনিকা কাকে এই প্রশ্নের উত্তর জানাতে বলবে? মিথ্যে হলো সেই জাল যা একটা মানুষ তার নিজের অজান্তেই সে নিজের জন্য বিছায়। কিন্তু মনিকা তো নিজে কোনো মিথ্যার জাল বুনে নাই!! তাহলে তার ব্যাপারে এমনতা হলো কেনো? কথায় বলে, মিথ্যাও কখনো কখনো সত্যি হয়ে যায়। মনিকা আজকের এই মিথ্যাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কোন একটা মিথ্যাকে হাজার বার বললে নাকি মিথ্যাটা সত্য হয়ে যায়। কিন্তু মনিকা জানে, তার এই মিথ্যা বা সত্য যেটাই হোক হাজারবার কেনো আজীবন কাল ধরে আওড়ালেও আর সত্যিটা মিথ্যা আর মিথ্যাটা সত্যি হয়ে যাবে না। হয়তো মিথ্যাটা এ যাবত কাল পর্যন্ত যেভাবে চাপা পড়েছিলো, আজো হয়তো সেটা চাপা দিয়েই মিথ্যাটাকে সত্য বলে চাপিয়ে জীবন চালাতে হবে অথবা, সমস্ত জগত সংসার ছেড়ে আকাশের পানে চেয়ে কোনো এক নামহীন গন্তব্যে সারাজীবনের জন্য হারাইয়া যেতে হবে। কারন সত্যি আর মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করা সব সময় সহজ হয় না।

মনিকা তার পড়ার টেবিলে জল ছাড়া মাছের মতো ছটফট করছে আর বসে  শুধু একা নীরবে এটাই ভাবছিলো তার ভবিষ্যত কি আর তার বেচে থাকার অর্থই কি। ভালোবাসায় যেমন অনেক শক্তি থাকে, তেমনি বদনামেরও একটা ভয় থাকে। সকাল থেকে এই সন্ধ্যা অবধি মনিকা তার সারা জীবনের গল্পটা আর এখন যেনো মিলাতে পারছিলো না। বারংবার মনে হচ্ছিলো, মনিকা, তার বাবা, তার মা, তার পরিবার যেনো একটা মুখোশ পড়েই এই সংসারে চলমান ছিলো। আজ সেই মুখোশ খসে পড়েছে বটে, কিন্তু মনিকা এটাও বারবার ভেবে কোনো কুল কিনারা পাচ্ছিলো না যে, মুখ আর এই মুখোশ তার আলাদা করা কতটা  বুদ্ধিমানের কাজ হলো

মনিকার প্রতিনিয়ত এটাই মনে হচ্ছিলো, এইতো গতকাল রাত পর্যন্ত তো সবই ঠিক ছিলো। অথচ আজ এতোদিনের একটা সম্পর্ক একটা মাত্র 'হ্যা' বলার মধ্যে সব তছনছ হয়ে গেলো? জীবন দাঁড়িয়ে গেলো কোনো এক মুল্যহীন ঘাটের ধারে যেখানে না আছে পারের কোনো খেয়া, না আছে ঘাটের কোনো মাঝি!

এই মর্মান্তিক ঘটনা হটাত করে কেমন করে মনিকার জীবনে ঘটে গেলো? এটাও একটা রহস্যের ব্যাপার ছিলো। জীবনের অনেক কাহিনী আছে যা রহস্যে ঘেরা থাকে। যখন কেউ এই রহস্য ঘেড়া চাদর সরাতে যান, তখন এমন এমন কিছু প্রশ্নের উদয় হতে পারে যা সাভাবিক জীবনের ভিত নড়ে যেতে পারে। এইসব রহস্য ঘেরা প্রশ্ন জানলেও অসুবিধা আবার না জানলেও জীবন সাভাবিক হয়ে উঠে না। এক্ষেত্রে কি জানা উচিত আর কি জানা একেবারেই উচিত না, সেটাই নির্ভর করে পরবর্তী সুখী জীবনের জন্য। মনিকার প্রায়ই মনে হচ্ছিলো যে, অন্য আর ভাই বোনদের সাথে ওর বাবা মার আচরন, ব্যবহার আদর আপ্যায়ন অনেক কিছুই গড়মিল। আর্থিক সচ্চলতার সাথে পরিবারের এই জন্মগত ব্যবহারগুলির মধ্যে কোনো তারতম্য থাকার কথা না। কারন তারা একই গোত্রের, একই পরিবারের। কিন্তু মনিকার মধ্যে এই প্রশ্ন বহুবার মনে উদয় হয়েছিলো, আসলেই এ রকম তারতম্য কেনো? সত্য বেশীদিন লুকিয়ে রাখা যায় না। কোনো একদিন মনিকার মনে হচ্ছিলো, মনের দুক্ষে অনেক কাদবে সে মার সাথে বাবার সাথে। সে রকমেরই একটা পরিস্থিতি গতকাল সৃষ্টি হয়েছিল। কথায় কথায় মনের দুক্ষে আর রাগে যখন মনিকা তার মাকে এই অদ্ভুদ প্রশ্নটি করেই ফেল্লো, "মা, আমি কি তোমাদের আসলেই আসল মেয়ে? নাকি আমাকে তোমরা কোথাও থেকে কুড়াইয়া এনেছো?"

মনিকার এমন প্রশ্নে মানসিকভাবে দূর্বল মা, একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলেন, আর তার মনের অজান্তেই সব সত্যি কথা বলে দিলেন। মনিকা তার বাবার আসল মেয়ে নয়।

ঝড়টার আভাষ অনেক আগেই ছিলো, কিন্তু এবার শুরু হয়ে গিয়েছিলো। আজ এতো বছর পর তাহলে মনিকা কে? আচমকা এই সত্যের মুখুমুখি দাঁড়িয়ে ক্ষনিকের জন্য হলেও মনিকার জ্ঞান হারিয়েছিলো বটে কিন্তু অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে শিখতে হয়। আজ নিশ্চিত জানলো মনিকা যে, জীবনের যাত্রার শুরু থেকে শেষ অবধি মনিকার রাস্তাটা একটা অন্ধকারই ছিলো, ওর জীবনটা ছিলো একটা অন্ধকার টানেল, যেখানে মাঝে মাঝে আলো আসে বটে কিন্তু সে আলোয় কোনো কাজ হয় নাই।  আজ সত্যটা একদম নাকের ডগায় বসে মনিকাকে এমনভাবে চুরমার করে দিলো যে, টাইম টাকে মনে হলো সবচেয়ে বড় ভিলেন। মনিকা  সামনে যা দেখছিলো, তার থেকে অনেক বেশি ঘটনা লুকিয়ে ছিলো তার না দেখার পিছনে। মনিকা এখন এমন একটা বয়সের দ্বার প্রান্তে দাড়িয়েছিলো, যার নাম যৌবন। আর এই যৌবন হলো এমন এক প্রাকৃতিক উপাদান যার দ্বিতীয় নাম শক্তি কিন্তু বড় অসহায়।

কারো পরিবার যখন নিমিষের একটা তথ্যের সার্টিফিকেটে অপরিচিত হয়ে যায়, তখন সবচেয়ে কাছে যে আসে, সে হলো বন্ধুত্তের শক্তি। বন্ধুত্ব আমাদের জীবনের একটা গুরুত্তপুর্ন অংশ। মনিকারও এমন একজন বন্ধু ছিলো, যার না ছিলো কোনো সামাজিক প্রতিপত্তির অভাব, না ছিলো কোনো যশের কমতি। এই গত কিছু বছর যাবত মনিকার সাথে এই প্রতিভাযশি বন্ধুত্বটা এমনভাবে তার জীবনে এসেছিল, মনিকার কখনো মনে হয়েছে সে তার মা, তার বাবা, আবার কখনো মনে হয়েছে সে তার প্রিয়তম। মনিকার কাছে তার এই বন্ধুটি যেনো কোনো এক শিল্প। প্রায়শই মনিকার কাছে এ প্রশ্ন কুরিকুরি অংকুরের মতো উদয় হতো, জীবন শিল্পকে নকল করে নাকি শিল্প জীবনকে নকল করে? ব্যাখার কোনো আর আজ প্রয়োজন পড়লো না। ভঙ্গুর চিত্তে, হতাশ মনিকা, কিছুক্ষন গলা ফাটিয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে বাক্রুদ্ধ হয়ে বসে রইলো। মিথ্যে চোখের জল একটা সময় আর কাজে লাগে না।মনিকার কাছে আজকের দিনের চোখের জলকে পুরুই মিথ্যা মনে হতে লাগলো। যখন কোনো মানুষের দুঃখ থাকে, কষ্ট থাকে, সে সব সময়ই চাবে যে, সে অন্য কারো সাথে তার এই দুক্ষটা, কষ্টটা শেয়ার করতে। কেউ তো থাকবে যে, ওর কথা শুনবে। বুঝুক না বুঝুক সেটা আলাদা ব্যাপার, কষ্ট লাগব করুক বা না করুক সেটাও আলাদা ব্যাপার। কিন্তু কারো সাথে তো তার এই কষ্টের ব্যাপারগুলি শেয়ার করার দরকার। কেউ চলে যাবার পর হয়তো কিছু পরিবর্তন নজরে আসে।

অবশেষে মনিকার যার চেহারাটা প্রথম মনের মানস পটে ভেসে উঠেছিলো, সে আর কেউ নয়, আকাশ। যে আকাশকে একদিন মনিকা তার ঘরের সব দরজা বন্ধ করে দিয়ে পলায়ন করেছিলো, আজ যেনো মনে হলো, এই আকাশই যেনো তার সুরক্ষার ছাদ। ঘরের দরজা বন্ধ হবার সাথে সাথে সবসময় মনের দরজা যে বন্ধ হবে এমন কোনো কথা নাই। একটা ভরষা ছিল ক্ষীন। অবশেষে মনিকা আকাশকেই ফোন করে এটাই বলার চেষ্টা করলো যে, যে বিষয়টায় আশংকা ছিলো, ভয় ছিলো, দুশ্চিন্তা ছিলো সেটাই হয়ে গেলো আজ। মনিকা আজ এক নামবিহীন কোনো এক পরিচয়হীন বেওয়ারিশ মুন্ডুহীন জীবন্ত লাশ। এখন যদি তার কিছু অবশিষ্ঠ থেকে থাকে, তা হল একটা শরীর, কিছু মাংশ আর সমস্ত জীবনভর অনিশ্চয়তা।  মনিকার আর কোথাও যাবার দরজা নাই। মনিকার জীবন হাপিয়ে উঠেছে। কোথাও কেউ নাই। জীবন যেনো একটা নদী।

তারপরেও আবার বারবার মনিকার মনে হচ্ছে, আকাশ নদীটা কি তার জীবনের লক্ষ্য পার হবার জন্য সঠিক নদী? মনিকা বারবার একই প্রশ্ন নিজেকে করেছিলো, কিন্ত কোনো উত্তর আসছিলো না। কারন, আপনি একই নদীতে দুবার পা দিতে পারেন না, দেওয়া যায় না। কিন্তু মনিকার জীবন নদীতে এখন বান ডেকেছে। এই কয়টা মাস খালী জল জমতেই থেকেছে, জমতেই থেকেছে, আর এখন সে জল প্রায় মাথার উপর উঠে গেছে, এখন এই জলের বানেই হয়তো মনিকা ডোবে যাবে। মনিকা হাপিয়ে পড়েছিল। ভয় পেয়েছিলো। মনিকার বারবার এটাই মনে হচ্ছিলো, এখন দরকার তার একটা সেটেলমেন্ট। আকাশের উপর কিছু ঘৃণা জমেছিলো বটে, কিছু রাগ হয়েছিলো বটে কিন্তু আজ মনিকার মনে এটাই বারবার উদিত হচ্ছিলো, অনেক সময় ঠিকানা ভুল হয় কিন্তু ওই ঠিকানায় যারা থাকে তারা হয়তো ঠিক লোক। আকাশের ঠিকানাটা মনিকার জন্য এইমুহুর্ত শুধু নয়, আজীবনের জন্যই হয়ত ভুল, কিন্তু আকাশ ভুল ছিলো না। পরিত্যক্ত ঘুনে ধরা কিছু জরাজীর্ন অন্ধ ভালোবাসার থলিটা নিয়ে মনিকা বুকের পাজরে শক্ত করে ধরে আজকের পরিত্যক্ত নিজের পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে গেলো কোনো এক অজানা গন্তব্যের পথে যেখানে হয়তোবা আকাশ নীল রংগের চাদর বিছিয়ে কিছু মেঘমালা সাজিয়ে দিনের শেষে সুর্যের লাল আভায় তারই আরাধনায় ভজনে লিপ্ত। বারবার মনিকার মনে হয়েছে, এ লোকগুলি আমাকে একের পর এক ঠকিয়েছে। বারবার ঠকিয়েছে। এই ঘরে আমার সমস্ত অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। আমি এদের আর কেউ নই।

কিন্তু আকাসই বা কেনো মনিকার জন্য এভাবে জজ্ঞ করবেন? আবার বিশ্বাস হয়েও ছিলো। অন্ধ বিশ্বাস এমন এক চোরাবালী, যার না আছে একুল, না আছে ওকুল। সেখানে হয়তো কোনো জ্ঞানের আলো পৌছতে পারে, কিন্তু কোনো তর্ক বিহীন আশ্বাস ভর্তি থাকে। মনিকার এবার একটা কথা মনে হলো, বিশ্বাসভাজন হবার জন্য দরকার সেক্রেফাইস, দরকার একনিষ্টতা। আর দরকার নিজের সাথে নিজের সৎ হওয়া। আজ যেখানে মনিকা হারিয়ে গেলো, সেখান থেকেই মনিকাকে আবার নতুন জীবন নিয়ে বেচে উঠতে হবে এই জগত সংসারে। প্রথমবার যখন সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিলো আকাশের সাথে, তখন প্রয়োজন ছিলো সাময়িক। কিন্তু এবার মনিকার কাছে মনে হলো, সম্পর্কটা জীবনে বাচার সাথে এই সম্পর্কটা জরুরী। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সম্পর্ক জুড়তে যাওয়া একটা ভয়ংকর অপরাধের জন্ম দেয়। প্রথমবার যেটা মনে হয়েছিল। কিন্তু এটা আজ আর কোনো ভয়ংকর মনে হলো না। আজ এটাই বারবার প্রমান হচ্ছে যে, সময় নতুন সম্পর্ক তৈরী করে। কষ্টের সময় যারা থাকে, তারাই তখন নিজের ফ্যামিলি হয়ে যায়। আকাশ আমার পরিবার।

সব কিছুরই প্রথমবার আছে। এটা যেমন ভালোবাসার ক্ষেত্রে তেমনি অপরাধের ক্ষেত্রেও। আমি প্রথমবার অপরাধ করেছিলাম আকাশকে ছেড়ে দিয়ে, কিন্তু এই প্রথমবার মনিকার মনে হলো, মনিকা আকাশকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। প্রথমবার মনিকা আকাশের সাথে ক্লোজ হয়েছিল একটা দন্ধমুলক সার্থ নিয়ে। কিন্তু আজ ক্লোজ হয়েছে জীবনকে ভালোবেসে। ক্লোজ হওয়া আর এফেয়ার্স থাকার মধ্যে যথেষ্ঠ পার্থক্য আছে। এবার মনিকা আকাশের এতো কাছে চলে আসে যেখানে এফেরার্স এর জন্ম। আর এই এফেয়ার্স কখনোও খোলাখুলি, কখনো বন্ধ দরজার ভিতরে।

আকাশ অন্য দশজন মানুষের থেকে আলাদা। কারো অতিতকে ঘেটে বর্তমানকে বিচার করাই হয়তো ঠিক কাজ নয়, এটা আকাশ নিজে যেমন মানে, সে অন্যের বেলাতেও বিশ্বাস করে। কিন্তু ভরষা হলো এমন একটা কথা যা বর্তমান আর অতীতের মধ্যে মেলবন্ধন করে, ভবিষ্যতের দিকে অনুমান করে। কোন ব্যক্তি কি করেছিলো, কি করতে চলেছে, এটা নির্ভর করে সে ভবিষ্যতে কি করতে পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, যখন কারো সাথে সম্পর্ক হয়, ব্যবসায়িক বা নিজস্ব, অই ব্যক্তির সম্পুর্ন জীবন একটা দলিল হিসাবে সামনে আসে। তখন আমরাই বিচার করতে পারি যে, সম্পর্ক রাখা উচিত নাকি রাখা উচিত নয়। এটা কোনো চরিত্র বিশ্লেষনের ব্যাপার না, শুধু একটা সম্পর্ক জোড়ার লাভ এবং ক্ষতির প্রশ্ন। মনিকা কোনো কিছুই আর না ভেবে ফিরে এলো সেই পুরানো চৌকাঠের ভিতর যেখান থেকে একদিন আকাশকে না বলে ভোরের অন্ধকার পেরিয়ে সেই পরিবারের কাছে ফিরে গিয়েছিলো, যেটা তার কোনোকালেই ছিলো না, আর আজ তো একেবারেই নাই।

(চলবে)

৩১/০৩/২০২০-যেদিন চলে আসবো-৩

যাই হোক, আমি আমার সংসার ছাড়ার সাথে সাথেই বুঝলাম, আমার সবকিছু মিথ্যা হয়ে গেছে। আমি আমার অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলেছি। অভিমান ছিলো কানায় কানায় ঠিকই কিন্তু এখন আমার অভিমানটা আলো আধারের ছায়ার মতো কষ্ট আর বিষন্নতায় পরিনত হলো। গতকাল সকালে যে একাকীত্ততা নিজের দম বন্ধ করে ফেলেছিলো বলে মনে হয়েছিলো, আজ মনে হল, আমার শ্বাস আর চলছেই না। কারন তুমিই ছিলে আমার অক্সিজেন, আমার শ্বাস। চারিদিকে শত হাজার মানুষের পরিচিত মুখগুলি যেন আমাকে ব্যাঙ্গ করে এটাই বলছিল, 'কি হারাইয়াছো জীবনে? আলো? নাকি কান্ডারী? কি ফেলিয়া আসিয়াছো, কোথায় ফেলিয়াছো?'

বড় একা মনে হচ্ছিলো আমার।

কোথাও আমার কোন শান্তি ছিল না। অথচ শান্তির জন্য বারবার আমি একই ভুল করছিলাম। আবারো আমি সেই অজানা কুচক্রিকেই শান্তনার আধার মনে করে তারসাথে বারবার যোগাযোগ করছিলাম। আর এই কুচক্রি ষড়যন্ত্রকারিনী আমার পিছ তখনো ছাড়ে নাই। আমাকে সর্পবিষ দিয়ে যতোক্ষন না ধংশ করা হচ্ছে, তার যেন নিস্তার নাই। আমার এই কষ্টের কথা, আমার এই দিনদূর্দশার কথা আমি এই গুরুসম সর্পিনী ছাড়া আর কাউকে তো শেয়ার করতেও পারছিলাম না। অথচ তখনো আমি বুঝতে পারি নাই, কি বিষে আমাকে ধংশন করছে। এর নাম, কুচক্রির লালসার বিশ, এর নাম ষড়যন্ত্রকারিনির হিংসার বিশ। আমি সেই লালসার বিষে জর্জড়িত হিংসার ঝড়। অথচ তার সাথে আমার না ছিলো কোনো কালে পরিচয়, না ছিলো তার সাথে আমার কোনো কিছু নিয়ে হিসাবের গড়মিল।

কতবার কেদেছি তার কাছে আমার এই অসহাত্তের চিত্র বর্ননা করে, কতবার কেদেছি এই বলে যে, কোনোভাবে আবার আমি আমার সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে পুনরায় ফিরে যেতে পারি কিনা তোমার কাছে। কিন্তু আমার কুচক্রিকারিনীর এক ফোটা মনও গলে নাই। বারবার আমাকে সে এমন কিছু তথ্য আমার কানে চোখে ঢেলে দিতেছিল যা ছিলো তোমার কষ্টের মুহুর্তের কিছু অভিযোগ। কিন্তু তোমার কষ্টের আবদারগুলি কখনো আমাকে জানিয়ে এই কথাটা বলে নাই যে, আমার বিরহে তুমিও কাতর। আমার বিচ্ছেদে তুমিও শোকাবহুল একজন মৃতলাশ। এটা কখনো সে আমাকে জানতে দেয় নাই, তুমি আকুতি করছো, মিনতি করছো, আমি যেন আবার ফিরে আসি। বরং আমার প্রতি তোমার ঘেন্নার অভিব্যক্তিগুলিই বারবার জানিয়ে এটাই প্রমান করার চেষ্টা করেছে, তোমার জীবনে আমি কিছুই না, আমার সব প্রয়োজন তোমার কাছে ফুরিয়ে গেছে।

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার পৃথিবী থেমে গিয়েছিল। বারবার আমার মনে হয়েছে, আমি কি তোমাকে কখনই ভালবাসি নাই? আমি কি কখনো তোমার মনের ভিতরে এতটুকু স্থানও দখল করি নাই? যদি সেটাই হয়, তাহলে ওইদিন প্রত্যুষ্যে কেনো তুমি বলেছিলে, 'আমি আছি, ভয় পেয়ো না?'।

দিন যায়, রাত আসে আবার দিন আসে। সময় ঠিকই পেরিয়ে যায় সবার কিন্তু আমার সময় একেবারে স্থবির হয়ে দিন আর রাত এক হয়ে গেছে যেখানে না আছে নাওয়া, না আছে খাওয়া, না আছে কোনো সুখ। অবিরত অশ্রুপাতই যেনো আমার এই নয়নের একমাত্র কাজ।  গভীর রাত। কোনো ঘুম নাই আমার চোখে। সবাই ঘুমিয়ে গেছে। আমার বুকের পাজরগুলি যেনো ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে একটা দলা পাকিয়ে আছে। যেখানেই হাত দেই, সেখানেই যেনো একটা চাপা ব্যথা অনুভব করি। আশেপাশের মানুষগুলি আমার কিছু তো একটা হয়েছেই এটা বুঝতে পারছে কিন্তু আমি যতোটা পারছি যেনো কিছুই হয় নাই এমন একটা অভিব্যক্তি মুখে প্রদর্শন করে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু তোমাকে আমি এক মুহুর্তের জন্যেও ভুলি নাই।

বারবার আমি এই কুচক্রিকারিনীর শরনাপন্ন হয়েছি, কোনো মেসেজ, কোনো আকুতি, কোনো মিনতি, কোনো সুখের খবর তোমার কাছ থেকে তার মাধ্যমে আমার জন্য এসেছে কিনা। আমি জানতাম, তুমি এই কুচক্রিকারিনীর সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছো। আমার কারনেই হয়তো রাখছো। ফলে এই সর্পসম ষড়যন্ত্রকারীনীই ছিলো আমার একমাত্র ভরষা যার থেকে কিছু হলেও আমি তোমার ব্যাপারে জানতে পারি। কিন্তু এই কুচক্রিকারিনী বারবার যা সত্য নয় সেটাই সত্য বলে আমাকে জানিয়েছে আর প্রকৃত সত্যটাকে সগোপনে লুকিয়ে আমার আর তোমার মাঝে বিস্তর একটা মরুভুমির অঞ্চল তৈরী করে ফেলেছে।

তুমি হয়তো জানো না, এর মাঝে কত কিছু ঘটে যাচ্ছিল। একদিকে আমার ফিরে যাবার প্রবল ইচ্ছা, অন্যদিকে তোমার না ফিরে আসার প্রবল অপমাননা আমাকে এক রকম দিশেহারা করে ফেলেছিলো। এরই মধ্যে আমার এই কুচক্রিচারিনী আমাকে আরেক পরিকল্পনায় সামিল করে দিলো। যেহেতু আমি তার কোনো পরিকল্পনাই প্রথম থেকে বুঝতে পারি নাই, ফলে ফিরে যাবার প্রবল মানসিকতায় আমি তার প্রতিটি পরিকল্পনাকে আমার জন্য মংগলময় এটা ভেবেই নির্বোধের মতো সায় দিয়ে যেতে থাকলাম। কিন্তু তুমি তো আর নির্বোধ ছিলে না। আমার বেলায় কুচক্রিকারিনী সফল হলেও তোমার বেলায় সে নুন্যতম হারেও সফল হতে পারে নাই। আমাকে নিয়ে তার দ্বিতীয় পর্বের পরিকল্পনা ছিল, কোনো না কোনোভাবে কুচক্রিকারিনী আমাকে তার আবাসস্থলের কাছেই রক্ষিতা সরুপ রেখে দেয়া। কিন্তু শর্ত ছিলো একটা ব্যবসার। আর সেই ব্যবসার মুলধন জোগাবে তুমি যদি তুমি তখনো আমাকে চাও। কি অদ্ভুত আমার ভাগ্য যে, এতোদিন যখন কোনোভাবেই আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না, হটাত করে একদিন তুমি আমাকে আমার এই ভার্চুয়াল লাইনে মেসেজ দিয়ে কত কথাই না বললে। চোখের জল আর ধরে রাখতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি আর আগের মতো তোমাকে ভরষাও করতে পারছিলাম না কারন তুমি ইতিমধ্যে আমাকে আমার অভিযোগের এমন সব প্রমানাদি উপস্থাপন করতেছিলে যা আমি আমার রাগ, অভিমান থেকে তোমার নামে যা সত্য নয় সেটাও বলেছি, আবার যা সত্য সেটাও বলেছি। আমি বুঝতে পারছিলাম না, তুমি এসব মিথ্যা অভিযোগ আর মিথ্যা কল্ কাহিনীর মতো নালিশ শুনে তুমিই বা কতটুকু আর আমার ছিলে।

তুমি আমাকে আবারো ফিরে আসার কথা জানালে আমি একদিকে উড়ে চলে আসার জন্য মানসিকভাবে যেমন প্রস্তুত ছিলাম আবার অন্যদিকে মনে একটা ভয় ছিলো, আবারো দ্বিতীয়বারের মতো এমন কোন মারাত্মক ভুল করছি নাতো যেখানে আবার আমি চিরতরে তোমার রাগের শিকার হই? আমাকে আমার এই বন্ধুস অথচ কুচক্রিকারিনী শিখিয়ে দিয়েছিলো, নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে, আবার প্রত্যাখ্যাত হবার ভয়ে আমি যেনো তোমার কাছ থেকে পুর্বেই এমন কিছু শর্ত আরোপ করি যাতে তুমি যদি আমার সাথে পুনরায় প্রতারনা করেই ফেলো, আমি যেনো পথের মধ্যে আবার পড়ে না থাকি। আর সেটা হল, দশ লক্ষ টাকার একটা ব্যবসা। যার পরিচালনায় থাকবে আমার জ্ঞান দানকারী কুচক্রিকারিনি আর আমি থাকবো তার পাশে। তোমার যখন খুশি আসবে আমার কাছে কিন্তু দেহে দেহে আনন্দ হবে আমার কুচক্রিকারিনীর সাথে। আমাকে আমার জ্ঞান দানকারী কুচক্রীর প্রয়োজন এজন্য যে, সে একা নয়, তার স্বামী আছে। তার দরকার একজন উছিলার মতো মানুষ যেখানে সে নীরবে গোপনে অভিসার করে আবার নিরাপদ্র নিজ গৃহে ফিরে আসতে পারে। আর এক্ষেত্রে আমিই ছিলাম সেই নাটকের সবচেয়ে ভাল স্টেজ। এটাই ছিল তার পরিকল্পনা। আর অন্তরমুখী পরিকল্পনা ছিলো এই কুচক্রীর যে, দশ লাখ টাকা পাওয়ার পর দেখা যাবে আমরা দুইজন মিলে তোমাকে কতটুকু রাস্তায় নামাতে পারি।

তোমাকে রাস্তায় নামানোর এই মহাপরিকল্পনায় আরো অনেক জঘন্য জঘন্য মাষ্টার প্ল্যান ছিলো যা আমি কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না। আর এখানে বলতেও পারছি না। তবে কোন একদিন যদি আবার দেখা হয়, বিনোদনের জন্যে হলেও আমি তোমাকে বল্বো আর মুচকি মুচকি হাসবো। আমি জানি, তুমিও হাসবে। কারন যে মানুষটি এই কুচক্রিকারিনীর পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে সাহাজ্য করছে, ভবিষ্যতেও করবে বলে আশা দিয়ে যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কিভাবে সে এরুপ পরিকল্পনা করতে পারে এটা আমার মাথাতেই আসছিলো না। কিন্তু তুমি তোমার অবস্থান কিভাবে সামাল দিবে সেটা তোমার ব্যাপার বলে আমি আসলেই গভীরভাবে এ ব্যাপারটা নিয়ে কখনো ভাবি নাই। কিন্তু একটা জিনিষ আমি অনেক পড়ে বুঝেছিলাম যে, তুমি বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক, এই কুচক্রীর অবস্থানটা ঠিক ধরতে পেরেছিলে। তুমি ধরতে পেরেছিলে, কে কিভাবে কোন খেলাটা খেলে যাচ্ছে, কিন্তু তোমার কাছে দরকার ছিলো অকাট্য প্রমানের।

যাই হোক, সম্ভবত সেটাই ছিল আমার আর তোমার মধ্যে সর্বশেষ কথাবার্তা যেখানে আমি বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক এই প্রথম তোমার কাছ থেকে দশ লাখ টাকার একটা ব্যবসা চেয়েছিলাম আমার ফিরে আসার শর্তসরুপ। কারন এভাবেই আমার কুচক্রিকারিনি আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল। তুমি সমস্ত কিছু বিচার বিবেচনা করে, আমার ভালো মন্দ বিচার করে, আমাকে যুক্তির সাথে এমন করে বুঝিয়ে দিলে যে, তুমি যদি আমাকে ব্যবসার জন্য দশ লাখ টাকা দিতেও চাও, সেটা হবে একটা ভুল পরিকল্পনা। না হবে ব্যবসা, না হবে জীবন গড়া, না হবে সমাজে সুস্থভাবে বেচে থাকা, আর না থাকবে এই মুলধন অবশিষ্ট। আসলে তুমিই ঠিক ছিলে, আমি ছিলাম একটা ভুলের মধ্যে, একটা অভিশপ্ত মানুষের দ্বারা পরিচালিত। কারন সেদিন তুমি আমাকে যেসব তথ্য আর উপাত্ত দিয়েছিলে, তা আমি শত চেষ্টা করেও আমার আপাত শুভাকাংখী কুচক্রির কাছ থেকে জানতে পারি নাই যদিও সেটা আমার জানার অধিকার ছিলো। বারবার সে আমাকে সব কিছু লুকিয়ে গিয়েছিলো যা সে পাচ্ছিল আর অন্যদিকে আমাকে দিয়ে আরো কিছু বেশি পাওয়া যায় কিনা তার চেষ্টা সে সর্বাত্তকভাবে পরিকল্পনায় লিপ্ত ছিলো। আমি তার কোনো কিছুই বুঝতে পারি নাই। তুমি আমাকে ব্যবসা দিতে রাজি হলে না। ব্যবসার পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো, সম্ভবত আমিও এই প্রথমবার মনে হলো, তুমি কাজটা ঠিকই করেছো আমাকে ব্যবসাটা না দিয়ে। কারন ব্যবসার কোনো কিছুই আমি বুঝি না। তাও আবার অন্যের ঘাড়ে নির্ভর করে তোমার দেয়া আমার টাকার উপর অন্যের হাতে ব্যবসা।

দিন যায়, সপ্তাহ যায়, হটাত একদিন আমার নতুন সম্পর্কের কথা আসে। ছেলে সুদুর বিদেশের মাটিতে সেটেল্ড। আমার প্রত্যাশার বাইরে এমন একটি সম্পর্ক। ছেলেটি অনেক উচ্চমানের পজিশনে থাকা স্বশিক্ষিত এবং ভদ্র সমাজে উপস্থাপন করার মতো একটি প্রপোজাল বটে। আমার বাবা, আমার মা অতিশয় যেনো খুশি। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না, কিভাবে এই সমন্ধটা একেবারে ঘরের কাছে নিজের চৌকাঠ পার হয়ে আমার অবধি নাগাল পেলো। আর কিভাবেই বা আমার পরিবার এই খরচ সংকুলান করবে যেখানে এক লাখ টাকা একত্রে বের করতেই আমার পরিবার হিমশিম খায়।

বুঝলাম, এবারেও আমার সেই তুমি। রাগ হয়েছিলো অনেক বটে যে, আর ফিরে যাওয়া হল না আমার। কিন্তু এবার ফিরে যাচ্ছি আরেক নতুন জীবনে। চোখের অন্তরালে চলে গেলেও তুমি থাকবে আমার চোখের মনিতে। এই তো আর বেশী দিন নাই। আমার যাওয়ার সময় হয়েই এলো। মিস করবো না কারন সারাক্ষন তুমি আমার আত্তার মধ্যেই আছো।

অনেক কিছুই আর আগের মতো নাই। কিন্তু বারবার মনে পড়ে সেই দিনগুলির কথা। খুব মনে পড়ে তোমাকে। মনে পড়ে অলস দুপুরে শুয়ে শুয়ে তোমাকে ভার্চুয়াল মিডিয়ায় দেখা। মনে পড়ে বিড়ালের বাচ্চার মতো ঘুর ঘুর করে তোমার পিছন পিছন চলা। আমি জানি, আমি এখনো আছি তোমার সেই বিশাল প্রশস্থ বুকের কোনো এক গভীরে। আমি এটাও জানি, তুমি আজিবন থাকবে যেমন আমি আছি। হয়তো আমাদের শুধু জায়গাটা পরিবর্তন হয়েছে বটে কিন্তু এখন আমি আর সেই কুচক্রীর থাবানলের মধ্যে নাই যে চেয়েছিল তোমার ধংশ। আর এখন সে নিজেই ধংশ হয়েছে চিরতরে। হায়েনারা সব সময় অন্যের শিকারকেই খায়, নিজেরা কোনো শিকার করে না। এরা হায়েনা। তবে মানুষরুপী হায়েনারা আবার খাবারের তালিকায় যেমন মানুষ রাখে, তেমনি রাখে অন্যের সঞ্চয়পত্র, অন্যের গাড়ি, অন্যের টাকায় জন্মদিন পালন, অন্যের টাকায় গহনা বানানোর লোভ, অন্যের ফার্নিচার বিক্রির টাকায় লোভ, ছলেবলে কৌশলে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে ব্যবসা নেয়া কিংবা দশ বিশ ত্রিশ লাখ টাকার চাহিদা, আবার কখনো কখন আধুনিক কালের ডিজিটাল ব্যবসার মালিকানা থেকে শুরু করে পশু ছাগল ভেরার খামারেও এদের লোভ কম নয়। কিন্তু যতটুকু জানি, শেষ অবধি এদের ভাগ্যে কিছুই জোটে না, না স্বামী সুখ, না সংসারের সুখ, না মা হবার সুখ না সমাজে বাহাদুরী করার সুখ। এরা যুগে যুগে ঠকবেই কিন্তু কখনো বুঝবে না যে, এরা ঠকাতে গিয়েই ঠকে। এরা জীবনেও সুখি হয় না।

তবে এখনো হায়েনাটা মাঝে মাঝে কাছে ঘেষার চেষ্টা করে। আমি এবার তার সব বানানোর কথার অর্থ বুঝি। আমি এটাও বুঝি কোনটা সে সত্য বলছে আর কোনটা  মিথ্যা। যে কথাটি সে বলছে, আসলে সেটাই মিথ্যা। আর যেটা বলছে না, সেতাই সত্য কিন্তু গোপন করছে। কিন্তু আমি এবার সাবধান।    

৩০/০৩/২০২০-যেদিন চলে আসবো-২

যেদিন আমি চলে আসবো বলে মনোস্থির করেছিলাম, সেদিন শ্রাবনের রাত্রি ছিলো না। কিন্তু আমার দুই চোখে ছিলো থমথমে মেঘের আভা। আমি আকাশ দেখি নাই সেই রাতে কিন্তু বুঝেছিলাম, হয়তো আকাশে একটি তারাও নাই। প্রখর ইলেক্ট্রিক লাইটে আমার মনে হচ্ছিলো আমার শরীর-মন একটি অন্ধকার ঘরের মধ্যে বন্ধী। আমার চারিপাশে কোথাও কেউ নাই। শরীরের তাপমাত্রা জরের সমান কিন্তু জর ছিলো কিনা বুঝি নাই। আমি মৃত মানুষের মতো একপাশ হয়ে সারাটা রাত কাটিয়ে দিলাম। সকাল হলেই আমি চলে যাবো আমার এই চেনা পরিচিত ঘর থেকে। এই ঘরের প্রতিটি কনা, প্রতিটি আচর আমার চেনা। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে, আগামিকাল থেকে আমি আর এই ঘরটিতে কখনো ফিরে আসবো না। ভাবতেই আমার হৃদস্পন্দন যেনো থেমে গেলো, চোখ মুদে গেলো। মনে হলো, আমার দুটি নয়ন সমস্ত রুদ্ধ প্রীতি তোমার প্রতি সিঞ্চন করে বারবার অশ্রুপাত করছে।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জানি না। ভোর হতে না হতেই ঘরের বাইরে কে যেনো টোকা দিলো। এতো সকালে আজ পর্যন্ত কেউ আমার এই একা ঘরে টোকা দেয় নাই। শরীরটা বড্ড ভারী মনে হচ্ছিলো। প্রচন্ড এক আলস্য নিয়া দরজা খুলতে পৃথিবীর সমস্ত অবাক করার বিষয়ের মতো আমাকে তুমি হতবাক করে দিয়েছিলে। প্রকাশ্য দিবালোকে তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে। কোনো আগামবার্তা নাই, কোনো কথা নাই, কিছুই না। তুমি এতো সকালে এসে আমার ঘরের দরজায় হাজির।

এমনিতেই শরীরে বল ছিলো না, তারমধ্যে অকস্মাৎ তুমি। আমার সারাটা শরীর কেপে কেপে উঠেছিলো, কিছুটা ভয়ে, কিছুটা কষ্টে আর এতোটাই বেদনায় যে, আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরলে, আমি তোমার বুকে একদম মিশে গেলাম, আমার সেই চেনা পরিচিত প্রশস্থ ভালোবাসার বুক। আমি হারিয়ে ফেলবো হয়তো আর কিছুক্ষন পর। তুমি আমাকে কতো আদরের সাথে জড়িয়ে ধরে কতই না আদর করলে। আমার বুকভরা অভিমান, আমার চোখভরা অশ্রু আর দুর্বল শরীরের কাপুনিতে তুমি কিছুই বুঝতে পারলে না, আমি হারিয়ে যাচ্ছি। শুধু, বললে, 'আমি আছি তো, ভয় পেও না'। হ্যা, তুমিই ঠিক, তুমি আছো, আমার সারাটা জীবনেই তুমি আছো, অন্তর জুড়ে আছ, মন জুড়ে আছো, আমার ভাবনায় আছো, আমার রক্তের প্রতিটা শিরায় আছো। দেহের সাথে মিশে থাকার নামই শুধু ভালোবাসা নয়, হাতে হাত ধরে একসাথে রাস্তা পার হওয়াই এক সাথে নয়, আমার প্রতিটি কল্পনায় তুমি ছায়ার মতো আছো। যেখানে তাকাই, আমি সব জায়গায় তোমাকে দেখতে পাই। হ্যা, তুমি আছো, ছিলে আর থাকবেও। তুমি ছিলে আমার বাবার ভুমিকায়, ছিলে আমার ভাইয়ের ভুমিকায়, ছিলে আমার মায়ের ভুমিকায়, তুমি ছিলে আমার প্রেমিক আর নির্ভরতার সবচেয়ে কাছের মানুষটি। আজো তাইই আছো।

তুমি শেষবারের মতো আমাকে বুকে নিয়া, কপালে, মুখে, নাকে, চোখে, সব জায়গায় আদর দিয়ে কিছুক্ষন পর অবশেষে চলে গেলে। আমি যতদূর দেখা যায়, জানালা দিয়ে এই প্রথম তোমার যাওয়াটা দেখলাম। চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। আর হয়তো কখনো তোমার সাথে আমার দেখা হবে না। তুমি এই সত্যটা না জেনেই সমস্ত ভরষা আর ভালোবাস নিয়েই অন্য দিনের মতো চলে গেলে। তুমি জানলেই না , কি রয়ে গেলো আর কি নিয়ে গেলে আর আমিই বা কি করে এটা করলাম। সারাটা দিন আমি কেদেছিলাম। সেদিন আর আমার যাওয়া হলো না।

কিন্তু বুকভরা অভিমান নিয়ে আমি পরদিন কাউকে কিছু না বলে অতিভোরে আমার চেনা পরিচিত ঘরটি ছেড়ে শেষ পর্যন্ত বেরই হয়ে গেলাম। এ খবরটি জানলো শুধু আমার সেই কুচক্রীকারিনী বন্ধুটি আর জানেন আমার ঈশ্বর। কিসের নেশায় যে আমি এতোটা দিকহারা হয়ে গিয়েছিলাম, আজো আমি মনে মনে ভাবি। আমার কেনো একবারের জন্যেও মনে হয় নাই যে, এই কালো মুখোশধারী সর্পহরিনীর সাথে আমার বিস্তর একটা ফারাক ছিল। তার স্বামী ছিল্‌ তার সংসার ছিল। সে তো এসেছিল অভিসার করতে, সে তো এসেছিল গোপন মিশনে। তার তো হারাবার কিছু ছিল না। যদি তার মিশন সার্থক না হয়, সে তো ফিরেই যাবে তার সেই চেনাগৃহে যেখানে অপেক্ষা না করে থাকলেও সামাজিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্পাপ অথবা আরেক অভিচারী ব্যভিচারক পুরুষ। তাদের মধ্যে ভালোবাসা থাকুক আর নাই বা থাকুক, সেটা কোন মাপকাঠি নয়। তাদের মাপকাঠি সামাজিক একটা বন্ধনে তারা আবদ্ধ। আর এই সামাজিক বন্ধনের কারনেই আমার কুচক্রীকারিনি আজ এই গোপন অভিসারে এসেও ফিরে যেতে পারে নিজ গৃহে। কিন্তু আমি তো ব্যভিচারী ছিলাম না!! আমি তো আমার জায়গাতেই ছিলাম! এই কুচক্রীকারিনী এসেছিলো সদাই করতে, যৌবনের সদাই, ভালোবাসার অভিনয়ের সদাই। আমি কেনো তার কুপরামর্শে আমার সংসার ছাড়লাম? কখনো কি তোমার এ কথাটা মনে হয় নাই যে, যে মহিলা-প্রজাতী তার নিজের স্বামীর অগোচরে নিজের দেহের সদাই করতে কোনো এক অপরিচিতের বাসায় নির্বিঘ্নে পর পুরুষের সাথে নির্ভয়ে আসতে পারে, তার কাছে আবার ভালবাসার মুল্য কি? তোমার কি কখনো মনে হয় নাই, যে, এটাই হয়তো তার প্রথম সদাই নয়? কি করে তুমি ভাবলে যে, সে এই সদাই করতে এসেছে শুধুমাত্র ভালোবাসার কারনে? সে না বুঝে ভালোবাসা, না বুঝে ভালোবাসার কষ্ট। সে শুধু বুঝে তার এই অমুল্য মেয়েলী সম্পদ শুধু লালসার কারনে ভোগ বিলাসের একটা যন্ত্র বিশেষ প্ন্য বটে। আর কিছু না। বেশ্যাদের জীবনের প্রয়োজনে হয়ত বেশ্যাগিরি করতে হয়, এটা অনেকেই করলেও মনে মনে ঘৃণা করে। তারপরেও জীবনের এটা ধরেই নেয়া যেতে পারে যে, সেটা যতোটা না পাপ, তার থেকে বেশি জীবনের প্রয়োজনে বেচে থাকার একটা পথ। কিন্তু এই কুচক্রিকারিনী তো জানতো যে, তাকে দেহ দান করতে হবে, তাকে সব কিছু উজার করে দিতে হবে, কিন্তু তার তো জিবিকার জন্য এইকাজ করার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। এর মানে একটাই, সে প্রফেশনাল। আমি এই প্রফেশনাল কুচক্রির কাছে প্রতিনিয়ত হেরে গিয়েছিলাম কিন্তু নষ্ট হয়ে যাইনি।

৩০/০৩/২০২০-যেদিন চলে আসবো-১

আজ আমার যাওয়ার দিন প্রায় হয়ে গেলো। আমি চলে যাচ্ছি চিরতরে অন্যখানে। সামনে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে আর কি আছে আমি জানিনা। আগে যেমন সন্ধ্যা হলেই অস্থির চিত্তে সন্ধ্যাতারা দেখতাম, পূর্নিমা এলে খোলা হাওয়ায় বসে পুর্ব দিগন্তে বিশাল চাকতির মতো চাদকে দেখতাম, শীতের সকালে শরীরে কাথা মুড়ি দিয়া অগোছালো সপ্নে বিভোর থাকতাম কিংবা বর্ষার রিমঝিম ব্রিষ্টিতে গুনগুন করে একা একাই গান গাইতাম। আজ হতে আর কয়েকদিনের মধ্যে এসব আর আমার হয়ে থাকবে কিনা আমি জানি না। হয়তো ব্যস্ত হয়ে যাবো সংসারের বৈষয়িক কাজে, স্বামীর সেবা শুস্রশায় আর নিজের কিছু একান্ত বেদনাবোধ নিয়ে। তাই আজ এই যাওয়ার সময় আমার বারবার একটা মুখ আমার মানসপটে ভেসে আসছে। আর মনের অজান্তেই দুমড়ে মুচড়ে আসছে একটা কষ্টের অভিজ্ঞতা। বড় কষ্ট হচ্ছে আজ আমার এই ভেবে যে, তোমাকে আমি কষ্ট দিয়েছি। তুমি হয়তো জানলেই না কি কষ্ট আমি নিয়ে আমিও চলে গেলাম, আর আমিও হয়তো শতভাগ জানতে পারলাম না, কি কষ্ট আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম। অপমান আর অবসাদে অবনত হয়ে আজ যাওয়ার সময় আমি তোমাকে আমার কিছু অব্যক্ত কথা এই ভাসমান মন্ডলে, ভার্চুয়াল জগতে রেখে গেলাম। যদি কখনো তোমার গোচরে আসে, যদি কখনো আমার কথা ভেবে তোমার চোখ ভিজে আসে, যদি কখনো আমার জন্য আর এতটুকু ভালোবাসা, মহব্বত আর স্নেহ জেগে থাকে, তাহলে শুধু এটুকু অনুরোধ করবো, তুমি আমাকে ভুলে যেও না। আমি ছোট ছিলাম, আমার অভিমান ছিলো, তাই অধিকার নিয়েই না বুঝে সীমার বাইরে গিয়ে এতোটাই পাগলামী করেছিলাম যা আজ কষ্টে আর অভিমানে ভরে আছে সারাটা অন্তর। কিন্তু এর পিছনে না ছিলো আমার বড় ধরনের কোনো ফাকি, না ছিলো তোমার বড় ধরনের কোনো কুট কৌশলতা। বাস্তবিক পক্ষে আমাদের এই অভিমানকে কেউ তার লালসা দিয়ে পুজি করেছিল, যা আমিও বুঝি নাই, তুমিও না।

চারটি বছর আমি তোমার সাথে ছিলাম। আমি এই চারটি বছরের প্রতিটি মূহুর্তের সময়টুকু বিচার বিশ্লেষন করে দেখেছি, জলের সাথে মাছের যে সম্পর্ক, আমার সাথে তোমার ছিলো সে রকমের একটা সম্পর্ক। আমার প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি নিঃশ্বাস বলে দেয়, আমি ছিলাম তোমার প্রতিটি চিন্তায়, এমন কি অবচেতন মনেও। আমার কোনো কিছুর অভাব ছিলো না, তুমি কোনো কিছুর অভাব রাখোনি। কোনটা সম্পদ আর কোনটা সম্পত্তি, কোনটা আমার আর কোনটা তোমার এই তর্কে আমার কখনোই যাবার যেমন দরকার ছিলো না, তেমনি ছিলো না এসব ব্যাপারে আমার কোন আলাদা হিসাব। তুমি ছিলে আমার ব্যাপারে সদাচিন্তিত, কি করলে আমার ভালো হবে, কি না করলে আমার ক্ষতি হবে। আমার ব্যাপারে আমাকে আর আলাদা করে কখনো ভাবার প্রয়োজন ছিলো না আর থাকলেও আমি এসব নিয়া চিন্তা করলেও কোনো লাভ হতনা। আমি ছিলাম গভীর সুখের ছায়াতলে তোমার সুগভীর সহিষ্ণুতার আবরনে। ফলে, কোনোদিন শোনোনি আমি তোমার কাছে কখনো সম্পদ চেয়েছি, কিংবা আমি তোমার সম্পদের পাগল ছিলাম। আমাকে তুমি আদর দিয়েছো, ভালোবাসা দিয়েছো, আর যখন যা লাগে চাওয়ার আগেই তুমি তা দিয়েছো। আমি সুখি এবং খুসি ছিলাম। আমার কোনো কিছুতেই লোভ ছিলো না।

তুমি ছিলে আমার জীবনের রুপকার, আমি জানি, তোমার অন্তরের ভাষা। কিন্তু আমি সেদিন তোমার মুখের ভাষার যে রূপ দেখেছিলাম, তা আমার কখনো দেখা হয় নাই। তোমার রাগ, তোমার চাহনী আর তোমার অভিব্যক্তি আমাকে উদ্বেল করে দিয়েছিল। এই নতুন রূপ আমার আগে কখনো দেখা হয় নাই। তুমি বারবার আমাকে সম্পদ, সঞ্চয়পত্র, সোনার গহনা, ব্যবসা, চাকুরী ইত্যাদির কথা এমনভাবে প্রশ্ন করতেছিলে, যা না ছিলো আমার মনে, না ছিলো আমার মস্তিষ্কে। আমি সঞ্চয়পত্র কি, এর লাভ কি, এর দ্বারা কি করা যায়, আমার কিছুই জানা ছিলো না। তুমিই আমাকে প্রথম সঞ্চয়পত্রের ধারনা দিয়েছো। অথচ কোনো একদিন, আমারই হয়ে আমারই মোবাইল থেকে আমারই জন্যে আমি নাকি তোমাকে আমার অধিক নিরাপত্তার জন্য তোমার কাছে সঞ্চয়পত্র কেনার বায়না করেছি। তুমি একবার ভাবোতো, আমি কি এতোটাই মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছিলাম যে, গুটিকতক নোটের জন্য আমি আমার সারা জীবনের নিরাপত্তা আর ভালোবাসার মানুষটিকে চিরতরে হারাবো? এটা ছিলো একটা মানুষের নিম্ন মানসিকতার সর্বোচ্চ উদাহরন যেখানে ষড়যন্ত্রকারীর দুষ্টু বুদ্ধির একটামাত্র বিষের ফল। তোমার এই ষড়যন্ত্রকারিনীর নাম তুমি হয়তো এখন জানো। সে ভালোবাসার অভিনয় করে ঘরে ঢোকেছিল, কিন্তু সে না নিজেকে ভালোবেসেছিলো, না আমার এই সম্পর্ককে। আর না সে তোমাকে ভালোবেসেছিলো। ধরে নাও, আমি তার নাম দিলাম 'কুচক্রকারিনী' অথবা 'ষড়যন্ত্রকারিনী'।

হ্যা, আজ একটা জিনিষ আমি বুঝতে পারছি যে, এই বিশাল সময়ের ব্যবধানে সবার যেমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিমান জমতে পারে, আবার কখনো কখনো সেই অভিমান সময়ের স্রোতে রাগেও পর্যবসিত হতে পারে। আমি বুঝতে পারিনি, এই ছোট হৃদয়ে আমার কখন যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিমানগুলি বিচ্ছিন্ন রাগে পরিনত হয়েছিল, কিন্তু সেটা ছিলো নিতান্তই একটা সাময়িক। কিন্তু আমি বুঝিতেই পারিনি যে, 'সমুদ্রের পানিতে নামিয়া তীরের বনরাজীমালাকে যেমন রমনীয় চিত্রবত মনে হয়, সমুদ্র থেকে তীরে উঠিয়া তা আর আগের মতো মনে হয় না' ঠিক তেমনি, আমিও সেই ষড়যন্ত্রকারিণিকে কাছে পেয়ে ভেন্টিলেশনের একটা পথ খুজে পেয়েছি মনে করে যখন আমি আমার সমস্ত রাগ অভিমান ঐ পথ দিয়ে নিষ্কৃতি করলাম, তখন বুঝলাম, রাগের মাথায় আমি যা বলেছিলাম, আমার সেই অভিমান আমার সামনে অভিনয়কারী সেই ষড়যন্ত্রকারীনির কারনে এখন আমার বিপদ হয়েছে। আমি ঘর ছেড়েছি, আমি তোমাকে ছেড়েছি। এই ষড়যন্ত্রকারিনী আমাকে ঘর থেকে পথে নামিয়ে একেবারে খাদের প্রান্তে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমার যখন হুশ ফিরেছে, আমি যখন আবার ফিরতে চেয়েছি, তখন আর আমার ফিরে যাওয়ার উপায় ছিলো না। আমি ঘরহারা হয়ে রাস্তার দুইধার ধার দিয়া আমার সেই অগোছালো অপরিচ্ছন্ন পুরানো বাসভুমেই আবার ফিরে আসা ছাড়া কোনো পথ খোলা ছিলো না। যখন আমি আমার সেই অতি পরিচিত কিন্তু আবার অতি অপরিচিত আবাসভুমে ফিরে এলাম, তখন বুঝলাম, ষড়যন্ত্রকারিনী তার সার্থ সিদ্ধির যা যা করার তা তাই করে সার্থক হয়ে গেলো, আমি শুধু কোনো এক অচেনা খাদের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি।

আমি একা একা ধলেশ্বরী নদীর ধারে বসে সুর্যাস্তের সর্নছায়া দেখতে দেখতে, কখন যে আমার চোখ ভিজে আসতো, আমি বুঝতে পারতাম না। জনশুন্য ধলেশরীর তীরে দিগন্ত প্রসারিত ধুধু বালুকাময় তীর আমাকে ভয়ংকর পথের দিকে ইশারা দিতো। নিস্তব্দতা যখন নিবিড় হয়, তখন কেবল একটা সীমাহীন দিশাহীন শুভ্রতা এবং শুন্যতা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। আমার বেলায় যেনো এটা একেবারে বাস্তব হয়ে চোখের সামনে ধরা দিলো।

আজ একটা কথা বলি, এই প্রিথিবীতে যারা আপন হয়ে ঘরে ঢোকে, তারা সবসময় আপন হয়েই বের হয় না। কখনো কখনো তারা আপন হবার ভান করে কিন্তু হায়েনা হয়ে ঢোকে। তাদের সুপ্ত বাসনাই থাকে অন্যের ক্ষতি করা। আমার বেলায় এই "আপন" ভেবে যাকে বুকে নিয়েছিলাম, সেই আসলে ছিলো আমার মরনের খলনায়ক। কারন, আমার জানা ছিলো না যে, আমি যাকে আপন মনে করে আমার মনের যে কিছু ক্ষোভ ছিলো তাকে বলার পর সেই ক্ষোভ যে আবার আমাকেই দংশন করবে। আমি ছোট ছিলাম, আমার মনের কথাগুলি বলার কোন লোক ছিলো না, তাই, অতীব আপন মনে করে আমি এই সেই কুচক্রী ষড়যন্ত্রকারিনিকে এমনভাবে শেয়ার করেছিলাম যাতে আমার মন কিছুটা হালকা হয়। আর এই সেই কুচক্রীকারিনী তোমার কাছে আমার মনের কষ্টগুলি এমনভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে উপস্থাপন করেছিলো যা তোমাকে আমার থেকে আর আমাকে তোমার থেকে যোজন দূরে এক ঝরের গতিতে ছিটকিয়ে ফেলেছিলো। ঈশ্বর বড় সহায় যে, তোমার অন্তর আর দশটি মানুষের মতো ছিলো না। তাই, অন্তত আমি আজ মাটিবিহীন নই। কোথাও না কোথাও আমাকে তিনি ঠাই করে দিচ্ছেন। আর তার রুপকার আবারো ছিলে সেই তুমি।  

আমার জীবনের সব কাহিনী তুমি জানতে। হয়তো সেই অবহেলার কাহিনী, সেই অনাদরের কাহিনী জেনেই তুমি আমাকে আরো বেশী করে আদর করতে, আমি তোমার আদর বুঝতাম। তারপরেও আমি তোমাকে কিছু কিছু জায়গায় হয়তো ভয় পেতাম। আর এটা কোনো অমুলক ভয় ছিলো না। তোমার মতো পাহাড় সমান ব্যক্তিত্তের কাছে আমি ছিলাম অতি নগন্য। আমার এই ছোট জীবনে কখনো তুমি কেনো, তোমার থেকে অর্ধেক ব্যক্তিত্ত সম্পন্ন লোকেরও কোনোদিন দেখা হয় নাই। একদিকে তোমার পজিশন, তোমার প্রতিপত্তি, তোমার ক্ষমতা আবার অন্যদিকে আমি তোমার সেই ছোট পুতুলের মতো একটা বিড়ালসম, ভয় তো হবেই। অনেক কিছুই হয়ত ভয়ে আমি তোমাকে খোলামেলা করে বলার সাহস পাই নাই। কিন্তু আমার কখনো তোমার উপর ঘেন্না হয় নাই, তবে অভিমান হয়েছে অনেক। এই অভিমানটাকেই আমার আপাত আপন কুচক্রী মানুষটি আমাকে সমুদ্রের তলদেশে ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো।

কুচক্রি মানুষ যখন কাউকে আকড়ে ধরে, তাকে সর্বোপ্রথম আক্রমন করে তার অন্তরে, তার হৃদয়ে, তার যুক্তিক ব্যবহারে তখন অনেক কিছুই অবাস্তব মনে হলেও যুক্তির মতো মনে হয়। এই কুচক্রীর কথায় আমি যেনো বারবার নিজেকে বোকাই মনে করেছিলাম। তার এই কথার যুক্তি ধরে আমারো এক সময় মনে হয়েছিল, আসলেই আমি কি পেয়েছি এ যাবত? সব কিছুই তো বিলিয়ে দিয়েছিলাম অকাতরে। তাহলে দেয়ার সাথে পাওয়ার কেমন যেনো একটা অসামঞ্জস্যই মনে হচ্ছিলো। শয়তান যখন ভর করে, তখন নীতি পালিয়ে যায়, আর দিধা ভর করে। হয়তো আমারো তাইই হয়েছিলো। শয়তান আমাকে অতি কাছ থেকে বারবার প্রলোভন দেখিয়ে আমার সমস্ত মনকে বিষিয়ে দিয়েছিলো। তখন আমাকে ভর করে এই কুচক্রিকারিনী একের পর এক তার হীনসার্থ চরিতার্থ করার জন্য কতই না পরিকল্পনা আটছিলো। লাখ লাখ টাকার সপ্নে সে ছিলো বিভোর। আর তার সাথে ছিলো একটা অভিনয়। একদিকে সে আমাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছিল আর আমাকে গুটির চালের মতো ব্যবহার করছিলো, অন্যদিকে সে তোমাকে একটা মিথ্যা ফেস প্রদর্শন করে এমনভাবে জালটা বিছিয়েছিলো যে, না তুমি ওকে বুঝতে পারছিলে, না আমি। অথচ আমাদের দুইজনের ভিতরে চলছিলো তখন মহাপ্রলয়ের মতো ঝড় আর কষ্ট। এই কুচক্রিকারিনী আমাকে একের পর এক তার বানানো পরিকল্পনা দিয়েই যাচ্ছে, আর সেই পরিকল্পনার অগ্রীম তথ্য তোমাকে দিয়ে সে আমাকে তোমার কাছে অমানুষের মতো চেহাড়াটা দেখিয়ে তোমার কাছে ভাল মনিষী সাজবার চেষ্টা করছে। অথচ সেই ছিলো পুরু পরিকল্পনার মাষ্টারমাইন্ড। অগ্রীম পরিকল্পনা একদিকে আভাষ, অন্যদিকে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখে তোমার এতাই মনে হ ওয়ার কথা, যে, কু চক্রী তোমাকে ভালো উপদেশ, বা তথ্য দুটুই দিচ্ছে। এহেনো পরিস্থিতিতে তার উপর তোমার ভরষা হবারই কথা। আর এর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিলো তার, আমি চিরতরে তোমার কাছ থেকে বহিষ্কৃত হই আর সে আমার স্থানটা চিরতরে দখল করে বাকি জীবনটা আরাম আয়েশে কাটায়। ফলে সেই সঞ্চয়পত্র, সেই ২০ লাখ টাকা, সেই গাড়ির কাহিনি, সেই দোকান কেনার কাহিনী, সেই ফার্নিচার বিক্রির কাহিনী, আমার নতুন জব, খালা বুয়াদের কাছ থেকে আমার নিথ্যা আয়, আমার গোপন মিথ্যা প্রেমের উপখ্যান, ওর জন্মদিনের উপহার দেবার দাবী ইত্যাদি সবই ছিলো একটা জাল। একটা বড় পরিকল্পনার অংশ।

আমার ব্যাপারে তুমি নতুন কিছু তথ্য যা তোমাকে আমার জানানোর দরকার ছিলো বই কি কিন্তু আমার মনে হয় নাই যে, এইসব ছোট খাটো তথ্য যা আসলেই কোন কাজের তথ্য নয়, সেগুলি জানানোর দরকার। ফলে আমার এই ছোট খাটো তথ্য কুচক্রিকারিনী এমনভাবে তোমার কাছে উপস্থাপন করেছিলো যে, আমি আর তোমার বাধ্যগত ভালোবাসার মানুষটি যেনো আর নই। সব কিছু দেবার পরেও যখন তুমি জানতে পারলে যে, আমি তোমার অনুমতি ব্যতিত শুধুমাত্র টাকার লোভে অন্যত্র চাকুরী করি, কিংবা তোমা ব্যতিত আমার আরো অনেক ভালবাসার মানুষ আমার সদর দরজায় ভীড় করে, অথবা তোমার অজানা সত্তেও আমি আমার কাজের মেয়ের কাছ থেকে তার থাকা খাওয়ার খরচ হিসাবে বাড়তি পয়সা নেই যা তুমি বারন করেছিলে, এসব জানার পরে কার না মাথা খারাপ হবে? তোমারও তাই হয়েছিলো বলে সেদিন আমি তোমার রাগের যে চেহারাটা দেখেছিলাম, তা আজো আমি ভুলি নাই। তোমার রাগ হবার শতভাগ যুক্তি ছিলো, যেটা আজ আমি বুঝি। কিন্তু বিশ্বাস করো, এসবই ছিলো মিথ্যা একটা বানোয়াট কাহিনী। আমি কখনো টাকার জন্য কোথাও চাকুরী করি নাই, আমার জন্য বরাদ্ধ কাজের বুয়া থেকেও আমি তার খাওয়া থাকার ভাড়া হিসাবে কোনো টাকা পয়সা গ্রহন করি নাই, কিংবা আমার সতীত্তের দোহাই দিয়েই আজ আমি জোর গলায় বলতে পারি, তুমি ছাড়া আমার জীবনে আর কোনো দ্বিতীয় পুরুষের কখনো আগমন ছিলো না, আর হয়ও নাই। এ সবই ছিলো ঐ কুচক্রিকারিনীর বানানো সব বানোয়াট গল্পের একটা কল্পকাহিনী। সবচেয়ে বড় যে বানোয়াট কাহিনী তুমি জেনেছো, যে, আমি আমার সময়ে আমার যা করার কথা তা না করে সারাদিন উলটাপালটা কাজেই যেনো মনোনিবেশ করে থাকি। তুমি পুরুষ মানুষ, তোমার এহেন তথ্যে আমার উপর আস্থা হারানোই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি না পারছিলাম তোমাকে কিছু বুঝাতে, না পারছিলাম, আমাকে সামাল দিতে। জীবনের প্রতি আমার একটা সময় বিতৃষ্ণা চলে এসেছিলো। মনে হয়েছিলো, আমার আর একদন্ডও তোমার ভালবাসার কাছে কোন স্থান নাই। মানুষ যখন আস্থাহিনতায় ভোগে, তখন তার কোনো হিতাহীত জ্ঞান থাকে না। তখন দরকার হয় একজন মানুষের সাপোর্ট। অথচ আমার ভাগ্যটা এমন যে, কুচক্রিকারিনী কালনাগিনীকেই আমি আমার আস্থা দিয়ে বসেছিলাম। সেই কালনাগিনীকেই আমার মনে হয়েছিলো আমার আস্থার জায়গাটা। একদিকে তুমি আমার উপর প্রবল রেগেছিলে, অন্যদিকে তুমি আমার কোনো কথাই শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলে না। তাহলে আমার বিকল্প কি ছিলো? বিকল্প ছিলো একটা- কোথাও হারিয়ে যাওয়া চিরতরে। আর আমি এই কুচক্রীর উপদেশেই একদিন কিছুই না বলে সত্যি সত্যি হারিয়ে গেলাম। আমাকে বাসা বদলের পরিকল্পনা, যোগযোগের নিমিত্তে ফোন নাম্বার পরিবর্তন করার পরিকল্পনা এবং তোমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার মাষ্টারপ্ল্যান তো ছিলো এই কুচক্রীরই। আমি তোমার উপর রাগে অভিমানে জিদ ধরেছিলাম, আর সেই রাগ আর অভিমানকে পুজি করে এই মানুষরুপি শয়তান তোমার মন আরো বিষিয়ে তুলেছিলো। আর তুমিও আমার সেই সব সট পড়ে পড়ে যখন মন খারাপ করছিলে, আর তার প্রেক্ষাপটে খারাপ খারাপ মেসেজ করে তুমিও এই কুচক্রীকেই আপন মনে করে হয়তো কিছু রাগের কথা বলছিলে। আর এই শয়তান পুনরায় আমাকে তোমার প্রতিটি মেসেজের সট পাঠিয়ে আমারো মন আরো অস্থির করে তুলেছিলো। আমি তো তোমাকে চিনি। তোমার সারাটা শরীর জুড়ে থাকে কলিজা, সেই মানুষটির রাগ আমার উপর ভালোবাসার তুলনায় কিছুই না। আমি জানি তোমার অন্তর আর ভিতর। হয়তো শত ভালবাসার কথার ফাকে কোনো এক কষ্টের মাঝে বেরিয়ে আসা দু একটা রাগের কথা আসতেই পারে। আর সেই রাগের অবস্থানটাই এই কুচক্রী শয়তান আমাকে এবং তোমাকে বাস্তব দেখিয়ে ভালোবাসার মর্মস্পর্সী কথাগুলি গোপন করে আমাদের দুজনের মনকেই বিষিয়ে তুলেছিলো। কিন্তু তোমার মনের অস্থিরতার কান্নার মেসেজগুলি অথবা আমার মনের কষ্টের কথাগুলির মেসেজ আমাদের কাউকেই সে প্রদান করে নাই। আমার শরীর খারাপ থেকে খারাপের দিকে যাচ্ছিলো, অন্যদিকে আমার বিরহে তোমার শরীরও হয়তো আরো অবনতির দিকেই যাচ্ছিল। আর এটাই হবার কথা। আমি যদি জানতাম, তোমার শরীর এতোই খারাপ হয়ে গেছে, তুমি প্রায় মরেই যাচ্ছো, আমি কি পারতাম তোমার কাছে ছুটে না যেতে? আমিও এতো কষ্টে ছিলাম যে, শুধু আত্তহত্যাটাই করি নাই।

৩১/১২/২০১৯-অরু-৫

Categories

আজ অরুর বিয়ে।

মান অভিমানের সাথে পরাস্ত অরু আজ রংগীন সাযে সাজিবে। বর আসিবে, গান বাজিবে, ছোট ছোট বালক বালিকারা নৃত্য করিবে। সবাই আনন্দে উদ্বেলিত হইবে। অথচ আজ অরুর মধ্যে কোনো প্রকারের আনন্দ নাই, না আছে কোনো অশ্রুজল। সব জল যেনো এই কয়দিনে শুকাইয়া মরুভুমি হইয়া গেছে। যেদিকেই অরু তাকায়, সেদিকে সে তাহাকে দেখিতে পায় কিন্তু কোথাও সে নাই। মরিচিকার মতো অরু যেনো শুনতে পায় তাহার ডাক, আবার পরক্ষনে চাহিয়া দেখে, তাহা তাহার ডাক নয়, হয়ত পাশের বাড়ির কোনো এক বয়ো বৃদ্ধ অরুকে আদরের সহিত কাছে ডাকিতেছে। অরুর কিছুতেই বিশ্বাস হইতেছে না, আজ হইতে তাহার নতুন কিছু শুরু হইবে। এই দেহ, এই মন, এই প্রান আর তাহার থাকিবে না। থাকিবে না তাহার জন্যেও যাহাকে অরু একদিন শপথ করিয়া বলিয়াছিল, পৃথিবীর সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করিয়া আজ অরু যেখানে দাড়াইয়ায় আছে, তাহা হইতে অরুকে কখনো পৃথক করা যাইবে না। সেদিনের সেই শপথের কথা আজো অরুর মনে পড়ে, চাদের আলোকে সাক্ষি রাখিয়া অরু নীলের দিকে তাকাইয়া অরু বলিয়াছিলো, আমি আছি , আমি নাই, আর এই আমির মধ্যে শুধু তুমি ছাড়া আর কেউ নাই। কোথায় গেলো এতো শপথ? কোথায় গেলো এতো সব আয়োজনের?

রাত হইয়া গিয়াছে। বর পক্ষ আসিয়াছে বলিয়া চারিদিকে শোরগোল শুনা যাইতেছে। কেউ কেউ গেট রক্ষার তাগিদে আর উপঢোকন পাইবার লক্ষে ছোট ছোট ছেলেমেরা কেউ কঞ্চি, কেউ বা ররেক রকমের রং এর বাহার, আবার কেউ কেউ টাকা গুছানোর রুমাল বাহির করিয়া একাগ্রচিত্তে অপেক্ষা করিতেছে।

বর আসিলেন, যথারীতি বিবাহ শেষ হইয়া গেলো। অরু না দেখিল তাহার নব বরকে, না বর দেখিলো নব বধুকে। অরুর কোন কিছুতেই আর কিছু বলিবার ছিলো না। অরু শুধু আরেকবার চাহিয়াছিল অরুর সমস্ত অভিমানের কথাগুলি তাহাকে আরেকবার বলিয়া সবার কাছ হইতে চিরতরে বিদায় নেওয়া। কিন্তু ইহার কিছুই আর অবশিষ্ট নাই।

অরু চলিয়া যাইতেছে বরের সাথে। পাল্কিতে করে। রাত গভীর হইয়া আসিতেছে। পালকির বাহকদের হুম, হুম শব্দে অরুর কান্নার শব্ধ শুনা যাইতেছে না বটে কিন্তু এক ছোট পাল্কির ভিতরে বসিয়া অরু আরো কিছুক্ষ ভাবিতে লাগিল, আজ তাহার সাথের বন্ধুটি যেনো কোথায় হারাইয়া গেলো। যাওয়ার সময় একটু দেখাও হইলো না। জীবনের বাকী দিন আর কখনো তাহার সহিত দেখা হইবে কিনা তাহারও কোন সম্ভাবনা নাই। হয়তো কোন একদিন এই দুনিয়া ছেড়েই এভাবে চলিয়া যাইতে হইবে। নিশিত অন্ধকারের এই রজনীতে পাল্কিতে বসিয়া অরু শুধু একটা কথাই বুঝিল, জীবনের হিসাব বড় কঠিন।

অরু বরের বাড়ি চলিয়া আসিয়াছে। বাসর ঘরের এতো আলো দেখিয়া অরুর আরো মন খারাপ হইয়া উঠিল। কথা ছিলো, এই রকমের একটি আলো ঝলমলে ঘরে তাহার সহিত অরু সারারাত গল্প করিয়া কাটাইয়া দিবে। কত কথা জমা হইয়া ছিলো। সে বলিয়া ছিলো, এই বাসর রাতে সে সহস্র আরব্য রজনীর গল্প দিয়া তাহাদের বাসর শুরু করিবে। আজ আর সেই আরব্য রজনীর গল্প বলিবার মানুষটি চিরতরে হারাইয়া গিয়াছে। কোথায় গিয়াছে, কেনো গেলো, তার হিসাব আর করিবার কোনো প্রয়োজন নাই।

দরজা খোলার শব্দ হইলো। অরুরু নতুন বর। কিছুই না বলিয়া অরুর নতুন বর ঘরের সমস্ত আলো এক ঝটিকায় নিভাইয়া দিয়া তিনি অরুকে পিছন হইতে জরাইয়া ধরিয়া কানের কাছে আসিয়া বলিল, "অরু, আরব্য রজনীর গল্প দিয়া শুরু করি আজকের এই বাসরের গল্প?"

অরু অজ্ঞান হইবার উপক্রম, তাহার কানকে বিশ্বাস করিতে পারিতেছিলো না। মানে রাগে অভিমানে দুক্ষে কষ্টে, ভালবাসায়, অরু তাহার দুই হাত বরের দিকে ঝাপ্তাইয়া ধরিয়া হুহু করিয়া অবিরাম শ্রাবনের ধারার মতো কাদিয়া তাহার সেই পুরানো বন্ধুর গলা ধরিয়া শুধু কাদিতেই লাগিলো।

অরুর এই কান্না এখন আনন্দের আর ভালবাসার। এতোক্ষন যে চাপা কষ্টটা অরুর বুকে জগদ্দল পাথরের মতো বসিয়া ছিল, এখন অরুর কাছে মনে হইলো, পৃথিবী বড় সুন্দর। বড় বাচতে ইচ্ছে হয় আজীবন।

আমি তোকে ভালোবাসি।  

৩১/১২/২০১৯-অরু-৪

Categories

বুক ভরা অভিমান লইয়া অরু কাউকে কিছু না বলিয়া গত কাল অতিভোরে বাহির হইয়া গিয়াছিলো বটে। কিন্তু এখনো দিন অতিবাহিত হয় নাই, কেবল সন্ধ্যা নামিয়াছে, তাহাতেই অরুর মনে হইতে লাগিল, তাহার যেনো সব কিছু মিথ্যা হইয়া গিয়াছে। যখন অরু ঘর হইতে বাহির হইয়াছিল, তখনো জানালার বাহিরে কাঠালি গাছটার মাথার উপর ভোরের একখন্ড আভা উকি দিয়াছিল, অভিমান ছিল কানায় কানায় পূর্ন কিন্তু এখন দিনের শেষে আকাশের আলো আধারের ছায়ায় অরুর যেন অভিমানটা একটা কষ্টে পরিনত হইয়াছিল। অরুর মনে কোনো সন্ধির বিন্দুমাত্র আভাষ ছিলো। কিন্তু তাহার বুকের ভিতরে অভিমানের স্তুপ শতগুনে বাড়িয়া একটা পাহাড়ের রুপ নিয়াছিল। বড় কষ্ট, আর যন্ত্রনার এক মিছিলে অরুরু দুই গাল বাহিয়া কেবলি অশ্রু আর অশ্রুধার বহিয়া চলতেছিল। যতোই ক্ষন পার হইতেছিলো, অরু বুঝিতে পারিতেছিল, শামুকের সঙ্গে খোলসের  যেমন সম্বন্ধ, অরুর সাথে যেনো ফেলে আসা সেই মানুষটির সম্বন্ধ। অরু যেনো দেহমনে তাহার সহিত আষ্টে পিষ্টে এটে গিয়াছিল। আজ তাহার থেকে অরু বন্ধন ছিন্ন করিয়া কি এক মুক্তির জন্য যেনো উদ্দেশ্যবিহীন কোনো এক গন্তব্যে বাহির হইয়া আসিয়াছিল। কিন্তু অরু কি আসলেই কোনো মুক্তি পাইয়াছে?

অরু বারবার নিজেকে এই প্রশ্নই করিতে লাগিলো। বড্ড একা, বড় অসহায় মনে হইতে লাগিলো চারিপাশ। বিপাশা খালের পাশে একা অরু বসিয়া শুধু তাহার জীবনের এতোগুলি সময়ের হিসাব কষিয়া কিছুই মিলাইতে পারিতেছিলো না। অরুর বারবার সেই সব দিনের কথা একে একে মনে পড়িতে লাগিলো যখন তাহার জন্য পথের পানে চাহিয়া থাকিতেও ভালো লাগিত তাহার অপেক্ষায়, কিংবা তাহার সহিত এক সাথে বসিয়া ইতিহাসের গল্প শুনা, অথবা তাহার বাহুতে বসিয়া কোনো এক অনাগত আবরারের সপ্নের কথা। অরু বাকরুদ্ধ। 

অরুর প্রতি নিয়ত মনে হইতে লাগিল, আমি কি তাহার জন্য কিছুই করি নাই? আমি কি তাহাকে কনো কালেই ভালবাসি নাই? আমি কি কখনোই তাহার মনের ভিতরে ছিলাম না? যদি তাহাই হয় নাই, তাহলে এতোদিন কি ছিলো? অরু আর কিছুই ভাবিতে পারে না। সমস্ত আকাশের সন্ধাকালীন লাল মেঘ মেলাকে অরুর বড় বিষণ্ণ বোধ হইতে লাগিল।

দিন চলিয়া গেলো। রাত নামিবার সাথে সাথেই যেনো অরুর আরো মন খারাপ হইতে লাগিলো। চিৎকার করিয়া কাদিতে মন চাইলো অরুর। কিন্তু অরু যাহার ঘরে এখন বসিয়া আছে, তাহাদের কথা ভাবিয়া আর নিজের অকস্মাৎ অন্তর ধানের খবর লজ্জায় লুকাইবার নিমিত্তে অরুর আর আর্তনাদ করিয়া কাদা হইল না। অরুর বুকের হাহাকার, অরুর চোখের জলের ধারা বারবার অরুকে জীবনের কি মুল্য এই হিসাবের নিকটবর্তী নিয়া আসিয়াছিলো। কিন্তু জীবন শেষ করিয়া দেওয়া কি এতোই সহজ?

অরুর আরো মন খারাপ হইতেছিলো এই ভাবিয়া, যাহাকে সে ছাড়িয়া আসিয়াছে, তাহার এখন মনের অবস্থা কি? তিনিও কি অরুর জন্য এমন করিয়া হাহাকার করিতেছে? তাহার ও অরুর জন্য মন কাদিতেছে? যদি কাদিয়াই থাকিবে, তাহলে আজ সকালে অরুকে কেনো আগলাইয়া ধরিয়া রাখিলো না? যেমন করিয়াই রাখিয়াছিলে, তেমন করিয়াই তো ছিলাম। দুঃখ যে আছে আমার, এ কথা তাহার কি কখনই মনে আসে নাই? মরনের কথা বার বার মনে আসিতেছিল। কিন্তু মরনের কথা মনে হইলেও কোনো এক বাধনের কারনে মরনকেও ভয় হইতেছিল। আমার জন্য না, অরু ভাবিলো, আমার মরন কি তাহাকে জীবিত রাখিতে পারিবে? হয়ত সে আমার থেকেও বেশি অশ্রু পাত করিতেছে।

রাত গভীর। অরুর চোখে ঘুমহীন রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু অরুর চোখে কোনো ঘুমের ছাপ মাত্র নাই। বুকের পাজর গুলি যেনো কুকড়ে গিয়ে আরো ছোত হয়ে গেছে। পেটে ক্ষুধা নাই, মনে শান্তি নাই। অরুর বারবার মনে হইতেছিল, অনাদর আর আদরের কথা। অরু তো তার সর্ব কিছু দিয়া তাহাকে আদর করিয়াছিলো। কিন্তু তাহার প্রতি এতো অনাদর হইলো কেন? অনাদর জিনিষ তাই একটা ছাইয়ের মতো। সে ছাই হয়তো আগুনকে ভিতরে ভিতরে  জমিয়ে রাখে কিন্তু বাইরে থেকে তার তাপটাকে বুঝতে দেয় না। তাহার কাছে অরুর যেনো সম্মান কমিয়া গিয়াছিলো। আত্ত সম্মান যখন কমে যায়, তখন অনাদরকে তো অন্যয্য বলে মনে হয় না। এক সময়ে তাহার আদরে আমার যে জীবন গড়িয়া উঠিয়াছিল আজ যেনো ঠিক সেইভাবেই অনাদরে আমার দুঃখের ব্যথাতা শতগুনে বাড়িয়া উঠিয়াছিল।

সব কিছুর পরেও অরুর বারবার মনে হইতেছিল, আমি কেনো তাহাকে ভুলিতে পারিতেছি না? সেও কি আমার মতো আমা বিহনে এইরুপ সকাল, সন্ধ্যা রাত ঘুমহীন ভাবে কাতাইতেছে। একবার ভাবিলাম, যাই ফিরে যাই। গিয়ে আবার জাপটে ধরে বলি, এই যে, আমি, অরু। তোমার অরু, আবার ফিরিয়া আসিয়াছি। আমি পারি নাই তোমাকে ছাড়িয়া একটি রাত অতিবাহিত করিতে। আমি পারি নাই তোমাকে একটি মুহুর্তে ভুলিয়া থাকিতে। আমি ফিরিয়া আসিয়াছি। আমি প্রতিটি মুহুর্ত বুঝিয়াছি, আমার সারাটা বিশ্ব জুড়িয়া চারিদিকে তুমি। আমি যেদিকে তাকাই, সেদিকেই শুধু তোমাকে পাই, হাত বারাই অথচ তুমি নাই। আমি জীবন্ত লাশ হইয়া চারিদিকে যেন পালাইতে নয়, তোমাকেই খুজিতেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি ফিরিয়া আসিয়াছি।

পরক্ষনেই, সম্বিত ফিরিয়া আসিলে অরু দেখিলো তাহার কপোল গরাইয়া শুধু অশ্রু দিয়াই তাহার কামিজ ভিজিয়া গেছে, তাহার চোখ ফুলিয়া গেছে। অরুর মনে কোনো শান্তি নাই। অথচ কাইকে অরু কিছু বলিতেও পারিতেছে না, কি হইলো, কেন হইলো, আর এখন কি হইবে।

অরুর কত কিছুই না আজ এই একা বসিয়া মনে পড়িতেছে। এই অরু ছিলো তাহার রাতের সাথি, তাহার একাকিত্তের বন্ধু, এই অরুই ছিল তাহার মনের সব কল্পনার রঙ মাখানো বাতিঘর। অথচ আজ অরু কত দূরে বসিয়া একা। কোনো কিছুরই হিসাব মিলাইতে পারিতেছে না অরু। কোথায় গেলো সেই নেশা, কোথায় গেলো সেই গল্প বলার মানুশটা? তাহার চোখের পাতার কথা মনে পড়ে, তাহার হাত ধরার ভালবাসার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে আপলোক চোখে তাকিয়ে অরুর মুখ দেখিয়া অবাক হইবার সেই ভালোবাসার চিহ্ন।

বেদখল জমির মতো আজ অরু তাহার কাছে বেদখল হইয়া পড়িয়াছে। অরুর জীবনের যেনো আর কোনো মুল্য নাই অথচ একদিন ছিলো, অরু ছাড়া তাহার দিন শুরু হইত না, অরু ছাড়া তাহার রাত নামিতো না।

অরুর মনে হইতে লাগিলো, কতদিন যে তাহার সহিত কথা হয় না? কতকাল যেনো অরু তাহাকে দেখিতে পায় নাই? অরুর অন্তর আর কলিজার দুই পাশ ছিড়িয়া ফুলিয়া একাকার হইয়া যাইতেছিলো। 

এদিকে অরুর বিয়ের তোড়জোড় চলিতেছে চারিদিকে। অরুর এখন কি করা উচিত? ফিরিয়া যাইবে সেই তাহার কাছে? নাকি সমস্ত অভিমান আর কষ্ট লইয়াই অরু তাহার জীবনের আরেকটি নতুন অধ্যায় শুরু করিবে। অরু জানে না, কাল তাহার জন্য কি অপেক্ষা করিতেছে। অরু এইটাও জানে না, তাহাকে নিয়া বিধাতা কি খেলা খেলিতেছেন। অরু শুধু ওই নীল আকাশের দিকে তাকাইয়া বহু দূর দেখিতে পাইল একটা অস্পষ্ট আলো জালাইয়া কত সহস্র যাত্রী লইয়া আকাশ পথে একটা উড়ন্ত জাহাজ হারাইয়া যাইতেছে। একটু পর তাহার আর কোনো হদিস থাকিবে না।

২৯/১২/২০১৯ -অরু ডায়েরি-৩

Categories

অরু ভর্তি হয়ে গেলো ইউনিভার্সিটিতে। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, নতুন নতুন সব বন্ধু। গ্রাম থেকে আসা একটি মেয়ে শহরের কতই না ধনাঢ্য পরিবারের ছেলেমেয়েদের সাথে এখন এক সারিতে উঠা বসা করতে হয়। কিন্তু অরুর কি আছে সেই সামর্থ ওই সব পরিবারের বাচ্চাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার? আমি ব্যাপারতা বুঝি। আমি বুঝি কিভাবে কোন স্তরের কোন বাচ্চারা কিভাবে চলে। আমি অরুকে ঠিক আমার সন্তানের মতো করেই চালানোর চেষ্টা করছি। অরু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই খাপ খেয়ে গেলো সবার সাথে। ওর চলন বলন, ওর কথা বার্তা, ওর বেশ ভুষা সব কিছু উচ্চ বিত্ত সমাজের বাচ্চাদের মতোই আমি ব্যালেন্স করছিলাম। ওকে দেখে কোনো বুঝার উপায় নাই যে, ওর বাবা বা মা কেহ ওকে এক বিন্দু পরিমান সাহাজ্য করছে না। ও ভুলেই গেলো ওর আসল বাবা মাকে। এক সময় অরু আমাকে বাবা বলে ডাকতে শুরু করে দিলো।

আমি যাই, আমি দেখা করি, আমিই ওর সব কিছু দেখভাল করি। অরু তার ছোট একটা আলাদা বাসায় তার পড়ার টেবিল, সাজানো ঘর, বিছানা পত্র, ছোত একতা রান্না ঘর আর কাজের এক মায়াবতী সীমাকে নিয়ে ভালই সাজিয়েছে তার আপন গন্ডি, যেখানে আছে তার শুধু বাবা, আর বাবা।

দিন যায়, মাস যায়, বছর পেরিয়ে কয়েক বছর পার হয়ে যায়। অরু এক ইয়ার থেকে আরেক ইয়ারে, আরেক ইয়ার থেকে আরেক ইয়ারে পাশ দেয়। আমার বড্ড ভালো লাগে।

একদিন-

অল্প পরিচিত কোন এক অসচ্চল পরিবারের তার এক বান্ধবী, লুনা, তার নিজের প্রয়োজনেই আশ্রয় নেয় অরুর সাজানো এই ছোট সংসারে। উদ্দেশ্য আর কিছুই না, কয়েকদিনের আবাস। অরুর চালচলন, বেশভুষা, সাজানো সংসার আর চাকচিক্যে লুনার যেনো মন উদাস হয়ে যায়। লুনা তার জীবনের সাথে অরুর জিবনের এতো বড় ফারাক দেখে সারাক্ষনই তার মন উসদাসীন হয়ে থাকে। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার আর বিকালের আরাম আয়েসের সাথে যেনো এই লুনা কিছুতেই মিলাতে পারে না কি নাই ওদের আর কি আছে লুনাদের। ভিতরে ভিতরে লুনার শুরু হয় এক অজানা ক্ষভ আর জিদ। এই জিদ যেন কোন এক এদেখা ঈশ্বরের উপর, এই জিদ যেনো কোন এক সমাজের উপর, সাথে বাড়ে জিদ আমার সেই ছোট জননী অরুর উপর। লুনার সাথে কনো কিছুইই বুঝার আগে লুনা তার জীবনের চরম এক প্রিশোধের আগুনে জ্বলে উঠে। অরুর মতো একজন অসচ্চল গ্রামের চটপটে তরুনী যদি তার তথাকথিত বাবার আদরে এতো কিছু আয়েশী জীবন পায়, তাহলে লুনা কেনো তার জিবনে একই রুপে তা পাবে না, এতাই যেনো হয়ে উথে লুনার এক চরম হিংস্র মানসিকতা। লুনার এই হিংস্র মানসিকতার কিছুই না বুঝে কোনো এক বিকালে অরু হাত ধরে বেরিয়ে যায় বিকালের কোনো এক রাজপথে। হয়ত অরু তাকে নতুন শহর দেখাবে, হয়ত অরু তাকে শহরের সুন্দর বাতিঘর আর আলর রাস্তা দেখাতেই নিয়ে যায়।

রাত পেরিয়ে যায়, রাত গভীর হয়ে যায়, অরু আর ফিরে আসে না। কোথায় অরু?

২৮/১২/২০১৯ -অরু ডায়েরী-২

Categories

ছাত্রী হিসাবে অরু কি রকম ছিলো, ভালো না খারাপ নাকি অন্য রকম, তা আমার কিছুই জানা নাই কিন্তু আমার আশ্বাস আর ভরসায় অরু যেনো সীমাহীন কোনো এক নক্ষত্রের আলোর দিশারার কিনার দেখেছিলো। হয়তো সে নিজের যতটুকু যোগ্যতা ছিলো তার থেকেও আরো বেশী পরিশ্রম করেই এই কঠিনতম ভর্তি পরীক্ষার বৈতরণী পার হয়ে সত্যি সত্যি সরকারী ইউনিভার্সিটির কাঙ্ক্ষিত অর্থনীতি বিষয়েই ভর্তি হয়ে গেলো। এর মাঝে কয়েকমাস যে কেটে গিয়েছিলো আমার নিজেরও মনে নাই। মনে পড়লো সেদিন যেদিন আবার একদিন এই যুদ্ধের বিজয়ীর ফলাফল নিয়ে অরু আমার অফিসে এসে হাজির হলো। 

ভীষন খুশী হয়েছিলাম। কতটা খুশী হয়েছি তা বলতে পারবো না কিন্তু আমার মনে হয়েছিলো, ছোট একটা বীজ থেকে যে বটবৃক্ষের জন্ম, আমি যেনো আজ সেই ছোট বীজটাই হাতে ধরে আছি। আমি এম্নিতেই শিক্ষানুরাগী, তার মধ্যে এমন একটা বীজ আমার হাতে এসে পড়েছে যাকে আমি ইচ্ছেমতো বিকশিত হবার সুযোগ করে দিতে পারি। এখন শুধু হয়তো আমার কিছুটা পানি, কিছুটা সার আর কিছুটা মালীর কাজ করতে হবে, এটাই আমার কাছে বারবার মনে হয়েছিল। ভালোবাসা আর মমতায় আমি অরুকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।

যে ভালোবাসা আর মমতায় আমি ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, আমার এই মমতা আর ভালোবাসার ছোয়ায় আমি ওর বুকের ভিতরের কোনো এক মৃগী রোগীর মতো কাপুনী আর ধকধক আওয়াজের ধনি শুনেছিলাম। ওকে আমার সেই ছোট্ট মেয়েটার মতোই মনে হলো, ও যেনো আমার আরেক মেয়ে যাকে আমি জন্ম দেই নি ঠিক, কিন্তু যেনো কত জনমের চেনা। এতো মমতা আর স্নেহে কি হয়েছিলো আমি জানি না, কিন্তু ওকে আদর করে আমার অফিসের চেয়ারে বসানোর পরেই বুঝলাম অরূ কাদছে, তার মাথা নীচু, আমি শুধু ওর কপাল আর কিছু চোখের জলের ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম। দেখেছিলাম আমি ওর কপোলের ধার বেয়ে বেয়ে অবিরাম চোখের জল। ভাবলাম, হয়তো অতি আনন্দে মানুষ যেমন কাদে, অরুও হয়তো সে রকম এক পরিস্থির ভিতর দিয়েই যাচ্ছে। জল তো আর কারো আদেশের অপেক্ষা করে না। চোখের জলের উপর কারো কোনো আদেশ চলে না। চোখ তার জল দিয়ে খুসী আর আনন্দের অথবা বেদনার রঙ প্রয়াকশ করে। যার চোখ জলে ভর্তী হয়তো সেই জানে এই জলের উৎস কি আনন্দের না বেদনার। একটু পরেই আমার সেই চোখের জলের উৎস ধরা পরলো। ভুল ভাংলো। ভুলটা ভাংলো অরুর কাছে ওর জীবনের অনেক কাহিনী শুনে।

অরু যখন একটু সম্বিত ফিরে পেলো, গালে ঝরে পরা অশ্রু মুছে দিয়ে অরু প্রথম যে কথাটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বল্লো, তা হচ্ছে, "আজ অবধি কেউ আমাকে এই রকম করে স্নেহ আর মমতা দিয়ে বুকে টেনে নেয় নাই। কেউ আমাকে কখনো বলে নাই, মা, আমি তোকে ভালোবাসি। ভালোবাসা কি জিনিষ, আদর কি জিনিষ, স্নেহ কি জিনিষ তা আমি কখনো বুঝি নাই। কখন বড় হয়ে গেছি, কিভাবে বড় হয়ে গেছি, কেউ কোনো খবর রাখে নাই। অগোছালো জীবনের মতো, একতা আগাছার মতো লিকলিকে বড় হয়ে গেছি। সবাই শুধু একটা কথাই ভেবেছে, কবে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। কার সাথে দেবে, কাউকে আমার ভালো লাগলো কিনা, আমার বিয়ের বয়স হলো কিনা এটা কোনো গুরুত্তপূর্ন কারো কাছেই মনে হয় নাই। মেয়ে হয়ে জন্মেছি, এটাই যেনো আমার বড় অপরাধ। পর্ব যায়, বছর যায়, কিন্তু কোন পর্ব কেনো আসে, কেনো যায়, তা আমাদের মতো গ্রামের অসচ্চল পরিবেশে আমাদের সাধ আহলাদের কোনো মুল্য যেমন নাই, তেমনি আমাদের কথা কারো শোনার মতো কোনো অবকাশও নাই। কতবার গ্রাম ছেড়েছি, কতবার ঘর ছেড়েছি সেই দূর্বিসহ বিয়ের আসর থেকে, তা আমার মনে নাই। কতবার শুধু খালী পায়ে পাগলের মতো বন্দি বাড়ি থেকে দৌড়ে গেছি সেই কাঙ্ক্ষিত আমার পরীক্ষার হলে, আমার এখনো মনে আছে। বাড়ির কোন গপন কক্ষে কতক্ষন পালিয়ে বেচেছিলাম ওই সব বিবেক হীন মানুষ গুলির ভুল সিদ্ধান্ত থেকে বাচার জন্য, তার কোনো ইয়াত্তা নাই। আমার এই পিঠে খোজ করলে হয়ত আজো কোনো না কোন ক্ষতের দাগ হয়তো খুজে পাওয়া যাবে আমার অবিবেচক অভিভাবকের সিদ্ধন্তের বাইরে দারাবার জন্য। সবাই তাই আমাকে গ্রামের একজন অবাধ্য মেয়ে, ঘরের সবাই আমাকে অবাধ্য সন্তানই বলে ধারনা করে। কিন্তু আজ অবধি কেউ আমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো না, আমার মনে কি, আমার অন্তরে কি, আমার চাহিদা কি আর আমার সপ্নই কি। অনেক খুজেছি আমি আপনাকে আবারো। দৌড়ে ছুটে চলে এসেছি আমি আপনার অফিসের এই ঘরের দরজায়, কিন্তু আপনার কাছে পৌঁছে যাবার মতো না ছিলো আমার কোনো ক্ষমতা, না ছিলো আমার কোন অবকাশ। আমার পাশে দারাবার কেউ নাই। নিজের উপর বারবার রাগ, জিদ আর গোস্যা হয়েছিলো আমার। কিন্তু আমি হাল ছাড়ি নি। আমি একাই চেষ্টা করেছিলাম এটা ভেবে যে, আজ হোক কাল হোক কোনো একদিন আপনাকে কাছে পাবো আমার এই জীবন যুদ্ধে। আজ আমার সেই দিন। আমার চোখ তো জল ঝরাবেই।  

কতটা অবহেলায় আর অনাদরে অরু গ্রামে এতোটুকু বয়স পার করে ফেলেছে তার গভীর মর্মার্থটা যেনো নিমিষেই আমার চোখে ধরা পড়লো। কারন সেটা তো আমারই গ্রাম। আমার জীবনের কাহিনী তো এমনই ছিলো আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে যখন আমি দেখেছি সব হায়েনাদের ভীড়, দেখেছিলাম একটা পরিবার কিভাবে তিলে তিলে নিশপেসিত হয় কোনো ভুল করা ছাড়াই।

একটা ছেলে সন্তান মানুষ করার চেয়ে একটা মেয়ে সন্তান মানুষ করা অনেক বেশী কঠিন। একটা মেয়ে যখন বাল্যকালে পা রাখে, তাকে শিখাতে হয় কোন টা করা যাবে আর কোনটা করা যাবে না, তাকে শিখাতে হয় কে কে তার বন্ধু হতে পারে আর কে কে নয়। তাকে শিখাতে হয় সমাজের সবাই তার দিকে যেভাবেই তাকাক, সেই চাহনীর ভাষা কি। তাকে অন্ধকারে পথ চলতে শুধু হারিকেনের আলো হলেই হবে না, তার সাথে থাকতে হবে আলোর সাথে পাশে কেউ।  

(চলবে)

-----------------------------------------------------------------------------------------------

অরু চলে গেলো। আমি বুঝলাম, আমি হয়তো অরুকে আর কখনো ফিরে পাবো না। বড় আশ্চর্যই মনে হলো। অরু চলে যাবার ঘটনাট যেনো আমার দইনিন্দিন ঘটনার মত মনে হলো না। মনের মধ্যে কেমন যেনো একটা শুষ্ক অসাড়তার সঞ্চার হলো। মনে হলো, পৃথিবী তে ভালোবাসা আর মায়া একটা মিথ্যা এবং শুন্য জিনিষ। হেমন্তের সমস্ত অতীত, গ্রীষ্মের সমস্ত চিহ্ন, কিংবা শীতের সমস্ত সজীব ভালোবাসা আজ আমার কেবল মনে হতে লাগ্লো, অতায়ন্ত নীরস এবং কঠিন। মনে হলো, যে ভালোবাসা আর মায়াকে এতোখানি বলে মনে হত, যে আদর যে মোহ এতখানি গাড় মনে হতো,  যার তিলমাত্র বিচ্ছেদকে মনেও আসে নাই, কিংবা যার অবসান জন্মান্তরেও মল্পনা করা যায় নাই, সেই ভালোবাসা এই? সেই মমতা এই? কোন সার্থের কারনে কিংবা কোন আঘাতের কারনে এমন একটি অসীম ভালোবাসা নিমিষেই চূর্ন হয়ে এক মুষ্টি ধুলি হয়ে বাতাসের সাথে মিশে গেলো?

অরু একটু আগেও বলেছিলো, পৃথিবীর কোনো কিছুই তাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না, অথচ এখনো সেই দিনটাই শেষ হয় নাই, পাপিয়ারা এখনো ডালে বসিয়া গান করছে, দক্ষিনের বাতাস এখনো গাছে ঢাল পালাকে এদিক সেদিক দোলা দিতেছে, একটু পরেই হয়তো জ্যোৎস্না সুখ শ্রান্ত সুপ্ত সুন্দুরীর মতো বাতায়ন বর্তী পালঙ্গের এক প্রান্তে নিলীন হয়ে পড়ে থাকবে। সমস্তই মিথ্যা। ভালোবাসা আমার অপেক্ষাও মিথ্যাবাদি, মিথ্যাচারী।    

২৭/১২/২০১৯-অরু ডায়েরী-১

Categories

যেদিন সেই প্রথম অরু আমার অফিসে এসেছিলো, তখন অরু সবেমাত্র ইন্টার পাশ করেছে। সনটা ছিলো ২০১৬। আমি অরুকে সম্ভবত একবার দেখেছিলাম আমাদের গ্রামে। আমার ভালো করে মনেও নাই ওর চেহাড়া। কিন্তু যেদিন ও আমার অফিসে এলো, দেখলাম বেশ চটপট করে কথা বলে, গুছিয়ে কথা বলে। বুঝা যায় না যে, অরু গ্রামের এমন একটা অসচ্ছল পরিবেশ থেকে এসেছে। দূর থেকে ছবিতে গ্রাম যত ভাল লাগুক, আর যতো সবুজ শ্যামলাই মনে হোক, এই সুবুজ শ্যামলা বড় ছোট হরেক রকম ফল মুলাদির ফাক ফোকর দিয়েও অনেক সুন্দর সুন্দর জংলী ফুল অনেক অবহেলায় কখন যে বেড়ে উঠে তার যেমন কেউ হিসাব রাখে না, ঠিক তেমনি অরূকে দেখেও আমার মনে হইলো, এমনি একটি শিশির ভেজা অজানা ফুল বাতাসে হেলে দুলে বেচে আছে। সেই ফুলটি এখন আমার সামনেই যেনো কোনো এক শহরের ড্রয়িং রুমের মধ্যে সাজানো একটি গন্ধবিহিন ফুল। অথচ তার গন্ধ আছে মিষ্টি, চেখে দেখার মানুষ নাই।

অফিসে সারাক্ষনই কাজ থাকে, নিবিড় ভাবে এককালীন একটা অখন্ড সময় দিতে পারছিলাম না। অরু কালো একটা বোরকা পড়ে আপাদ মস্তক ঢেকেই সে আমার অফিসে এসেছিল। লম্বা একটি মেয়ে, ছিমছাম দেহ, গ্রামের বালিকাদের মতো একেবারে ওই রকম না। খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিলো, তাই অরুকে নিয়ে আমার টেবিলে একসাথে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিলাম। প্রকৃত পক্ষে এই খাবারের সময়টাতেই আমি অরুকে বেশ একটা সময় দিতে পারলাম। অরু আমার ছোটবেলার বন্ধুর মেয়ে।

জিজ্ঞেস করলাম, কি কারনে সে আমার কাছে এসেছে। খুব আমতা আমতা করে আমার দিকে ভয়ে ভয়ে চোখ নিয়ে অরু বল্লো, কাকা, আপনার কি আমার কথা কিছু মনে আছে?

বললাম, খুব একতা বেশি মনে পড়ে না। কিন্তু এমন কিছু কি আছে যে মনে করার মতো?

অরু বল্লো, আজ থেকে প্রায় ৪ বছর আগে আমার বাবা আপনার কাছে এসেছিলো আমার বিয়ের ব্যাপারে পরামর্শ নিতে। আপনি বাবাকে আমার বিয়ে দিতে না করেছিলেন। আবার আমারো বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে ছিলো না। আমি সবে মাত্র ক্লাশ নাইনে উঠেছি। আমার পরার খুব শখ ছিলো। বাবা আপনাকে অনেক সম্মান করেন আর সমীহ করেন। আপনার কথাটা বাবা রেখেছিলো। কিন্তু মাঝে মাঝেই যে আবার এই ভুতটা নড়েচরে উঠতো না তা নয় কিন্তু আমি বারবার আমার বিয়েটা এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। আমি এবার ইন্টার পাশ করেছি, ইউনিভার্সিটিতে পরার খুব শখ।

কথাগুলি শুনে আমার খুব ভালো লাগলো যে, গ্রামের একটি মেয়ে তার পরাশুনাটা চালানোর জন্য কত আপ্রান চেষতা করছে। আমি অরুকে বললাম, অরু তুমি যতো পড়তে চাও, পড়ো, দরকার হয় আমি তোমাকে সাহাজ্য করবো।

খুব খুশী হলো অরু।

কিন্তু আমি অরুকে এই সাহাজ্যের জন্য একটা শর্ত আরোপ করে দিলাম। আর সেই শর্তটা ছিলো, তাকে যে করেই হোক অর্থনীতির মতো একতা বিষয় নিয়ে পড়তে হবে।

(চলবে)

২৬/১২/২০১৯- লিসা ফিরে গেছে

Categories

আজ থেকে সেই কয়েক বছর আগের কথাই বারবার আমার মনে পড়ছে। যা বুঝতেও পারি নাই, আমাকে বুঝতেও দেয় নাই। আমি বহুবার ভেবে দেখার চেষ্টা করেছিলাম, কেনো শেষ পর্যন্ত ওর সাথে সম্পর্কটা রইলোই না। খুব জোরালো কোনো যুক্তি খুজে পাই নাই বটে কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার হচ্ছিলো। আর সেটা হচ্ছে নির্ভরতা। একজন বিদেশী, যা ছিল তার, তা হয়ত অনেক না, আবার আশেপাশের যারাই ওকে একটু ভরষা দিতে পারতো, তারাও তার গোত্রের মত কেউ না। একটা শুন্যতা, একটা শংকা, একটা ঘেন্না বোধ কাজ করেছিল ওর চাহিদার আর পাওয়ার মধ্যে। মানুষ তার নিজস্ব পথে তার হিসাব নিকাষ করে। হয়তবা সে চেক এন্ড ব্যালেন্স করে একটা হিসাবের খতিয়্যান বের করেছিল যে, জিবনে ভালভাবে বেচে থাকার জন্য শুধু ধর্ম, সংসার আর বর্তমান নিয়ে চলে না। নীতি আর পলিসি দিয়েও চলে না। তার জন্য দরকার একটা নিশ্চিত ভবিস্যতের গ্যারান্টি। এটা যেই দিক তাতে কিছু যায় আসেনা। এটা আমার জানা ছিলো না। কিন্তু কথা তো সত্য।

ক্ষুধা পেটে ভালো মানুষের সাথে ভালোবেসে রাস্তায় রাস্তায় বহুদুর যাওয়া যায় না। আবার নিজের যোগ্যতার চেয়ে শুধুমাত্র সংসার বা বন্ধনের নামে একজন অযোগ্য ব্যক্তির হাত ধরেও অনেক দূর যাওয়া যায় না। কারন সেখানে থাকে যোগ্যতা আর অযোগ্যতার প্রকান্ড এক বিভেদের দেয়াল যা যেমন যোগ্য ব্যক্তিও টপকাইতে পারেনা আবার  অযোগ্য ব্যক্তিও ব্যালেন্স করতে পারে না। কিন্তু ভরপেটে আরামদায়ক এসি গাড়িতে হাই স্পীডে প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে দেখতে কোনো এক অসম অসুন্দর বিত্তবানের সাথেও জীবন আনন্দময় হয়ে উঠে। সেটা হোক না যে কোন বিনিময়ের মাধ্যম। যা একজন এম্নিতেই ছিনিয়ে নেবে বিনা পয়সায়, তাই যদি কেউ ছিনিয়ে নয় আপোষেই নিয়ে এক আয়েসীর জীবন দেয়, তো ক্ষতি কি? ঈশ্বরের সাথে বুঝাপরা ভিন্ন। ওগুলি আজকাল আর কেউ আমলে নেয় না। আর আমলে নেবার জন্য কেউ বসেও নাই। যদি তাইই হতো, তাহলে পৃথিবীতে এতো সুন্দর সুন্দর রমনীরা দেহবৃত্তি করতো না। এতো এতো শিক্ষিত জনপদ এইসব সুন্দুরী মেয়েদের তাদের জীবন সাথী পাবার জন্য অনেক বেগ পেতে হয় না, কিন্তু তারপরেও তারা সুন্দর নর বা ভালো নরকে নয়, তারা চায় সুন্দর জীবনের প্রতিশ্রুতি।

লিসা ফিরে গেছে সম্ভবত তার সেই ভাবনা থেকেই। সে ফিরে গেছে তার সেই পুরানো জায়গায় যেখানে ওর জন্য প্রস্তুত রয়েছে অফুরন্ত আয়েশের উৎস, রয়েছে নিরাপত্তার গ্যারান্টি, আর তার সাথে আছে নিজ দেশের মাটির সাথে বন্ধন। জীবন একটাই। তাকে আনন্দময় করে কাটানোর অধিকার সবার আছে।

ঘৃণা কার নাই? সংসার জিবনে কি ঘ্রিন্না নাই? দম্পতিদের জীবনে কি ঘৃণা নাই? আছে। তারপরেও সবাই যার যার মতো করে ঘৃণাটুকু বাদ দিয়েই যেটা দরকার সেটা নিয়েই আনন্দে বাচে। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই মানুষ তার গতিপথ বদলাতে পারে। আর এই গতিপথ বদলানোর জন্য যে ক্ষমতা দরকার, আগে সেটাই খুব দরকার যার নাম- যোগ্যতা আর অর্থের প্ল্যাটফর্ম। লিসাকে কোনোভাবেই এখন আর দোষ দেইনা। কি দিতে পারতাম? পারতাম কি তাকে ওই সেন্ট লুইসের একটা সুইটে নিয়ে গিয়ে জাপানিজ এক্সপার্টদের সাথে বসিয়ে এক কাপ চা খাওয়াতে? কিংবা পারতাম কি লিসাকে ওই দুবাইয়ের বুরুজ রেস্টুরেন্টে একদিনের জন্য বেড়াতে নিতে যার ব্যয় ৫ বছরের এক্ত্রিত সঞ্চয় এর সমান? লিসা ঠিক বুঝেছিলো যে, স্বামী, সংসার, আর নিঘাত একটা দৃশ্যমান ভালোবাসায় আর যাই হোক, জীবনের সব চাওয়া পাওয়ার সাধ মিটে না। হিসাব তার পরিস্কার। আর সেই হিসাবে লিসা তার দিক থেকে ঠিক কাজটাই করেছে। আগে ভুল হয়েছিল, বা সরি হয়েছি এইটুকুর ওজন অনেক। যে সময় মত এর আবেদন করতে পারে, সেইই আবার জিতে যায় পরাজিত জীবনের কাছে। তখন আবার নতুন করে জীবনের খাতা শুরু হয় সেই পুরানো ধাচেই আর তখন আবার সপ্নের সব অট্টালিকা থেকে দেখতে পাওয়া যায় ওই দূরের আকাশের রাতের ঝিকিমিকি তারা গুলি, যেখানে মাঝখানে ঝরের মতো হারিয়ে যাওয়া কিছু সময়ের মুল্য আর চোখেই পড়ে না।

লিসা ফিরে গেছে এটাই বাস্তবতা।

২৩/১২/২০১৯-অপেক্ষার প্রহর লম্বা

কিছু কিছু অপেক্ষার প্রহর অনেক লম্বা। এই প্রহরগুলি কাটতে চায় না। মন উতালা করে, মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। আবার এই মনই নিজেকে শান্তনা দেয়। অদ্ভুত না এই "মন" বিষয়ক ব্য্যাপারটা?? কখনো কখনো হাজার বছর এক সাথে থেকেও কেউ কেউ আপন হয় না। আবার কেউ কেউ ক্ষনিকের মধ্যেই কেনো যেনো মনে হয়, আরে এই তো সে, কই ছিলো? কিন্তু এটাও হয়তো সত্য নয়। আবার সত্যও হতে পারে। মানুষের বাচার জন্য চাই একজন সুরক্ষাকারী বটবৃক্ষ। আর দরকার সেই বটবৃক্ষের তলায় হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকার মতো কেউ একজন।

অনেক সাধ আমাদের জীবনে, কিন্তু সাধ্য না থাকায় মাঝে মাঝে মনে হয়, এমন কি কেউ নাই যে আমাকে একটা পথ বাতলে দেয় যে, এখানে এইটা করো, তবেই না পাবে তুমি তোমার মনের ইচ্ছা পুরনের চাবিটা!! শুধু খেয়ে পড়ে বেচে থাকার নামই জীবন না। এর বাইরেও কিছু থাকে। নতুন নতুন জায়গায় অনুসন্ধান করে জীবন শুধু পিছিয়্যেই পড়ে, সামনে যেনো আগাইতেই চায় না। জীবনে সম্ভবত স্থিতি আসা খুব জরুরী। হোক সেটা কোনো এক মান্দাতার আমলের আদলেই। তাই হয়তো পরান জায়গাতেই আসল সুখের সন্ধান রয়েই যায় যা প্রথম চোখে পড়ে নাই। সব সময় পরিস্কার আকাশই মানুষকে উদ্বেলিত করে না, কোনো কোনো সময় মেঘলা আকাশও মানুষকে উদ্বেলিত করে। কিন্তু আমি সবসময়ই ঝড়ো আকাশকে ভয় পাই। ভয় পাই এই কারনে যে, থাক......

০৬/১২/২০১৯-সেদিনের কথা মনে পড়ে

সেদিনের কথা আজো আমার মনে পড়ে। কোনোদিন তোমাকে আমি দেখিনি। কোনোদিন চিনিও নাই। অদ্ভুদ পরিপাটি হয়ে তুমি নিকোলাসের সাথে আমার অফিসে এসেছিলে। কোনো কারন ছিলো না আমার তোমার উপরে চোখ রেখে পৃথিবী থেকে লক্ষ মাইল দূরের কোনো এক চাঁদকে দেখার। নিকোলাস ছিলো নিতান্তই একটা সাধারন লোক। তারপরেও আমি নিকোলাসকে সাদরে গ্রহন করেছিলাম। আর তার কারনটা ছিলে শুধু তুমি। কি এক মোহ নিয়ে যেনো আমার চারিদিক একটা মন্ত্রের মতো তুমি যাদুবন্দি করে রেখেছিলে, আমি বুঝতেও পারিনি। তুমি আমাকে চাঁদ দেখিয়েছিলে। আমি চাদের কলংক বুঝি নাই, চাদের অসমান পাথরও দেখি নাই, চাদে যে বাতাসও নাই, সেটাও বুঝি নাই। তারপরেও আমি এই শুকনা মাটি আর বাতাসবিহীন মৃত্যুসম পরিবেশকে উপেক্ষা করেই বন্ধু ভেবে সাদরে গ্রহন করেছিলাম আমার ভবিষ্যৎ পরাজয়কে। আমি শুধু দেখেছিলাম চাদের মতো আলো আর ভারসাম্যহীন চাদের বুড়ির চাহনী। কি যে মাদকতা আর নেশা ছিলো আমি বুঝি নাই, আমাকে নামিয়ে দিলে আমার আকাশ ছোয়ার স্বপ্ন থেকে। আমি বিভোর হয়েছিলাম।

ঠিক তার পরেই আমার মোহটা কেটে গিয়েছিলো কারন তুমি আর আমার আকাশে উদিত হও নাই। ডুবে যাওয়া চাদকে কেউ দেখতে চায় না। আমিও ভুলতে বসেছিলাম সেদিন দেখা এক চাদের রুপ আর তার আলো। অতঃপর আবার তুমি উদিত হলে আরো একদিন। এবার নিকোলাস নয়, তার স্ত্রী অর্থাৎ তোমার মা জেসিকা এলো তোমাকে নিয়ে। উদ্দেশ্য তো ছিলোই। তোমার উদ্দেশ্য ছিলো জীবনকে গড়ার আর আমার উদ্দেশ্য ছিলো তোমাকে আবিষ্কার করার। একে একে সব কিছু খুব কাছ থেকে ঘটে যেতে থাকলো অনেক ঘটনা।

কতগুলি বছর? অনেকগুলি। প্রতিটি প্রহর আমার কেটেছে এই চাদের বুড়ির নেশায়, আমার সমস্ত জীবনীশক্তি দিয়ে আমি বাচাতে চেয়েছিলাম এই চাদের বুড়িটাকে। কারন চাদের বুড়িটাই ছিলো আমার সমস্ত নেশার এক জগত। কোনো কিছুই আমি লুকাই নাই এই চাদের বুড়িটাকে বাচাবার জন্য। অথচ আমি জানতেও পারি নাই, এই চাদের বুড়িটা আমাকে নিজের চড়কাটায় কখনো বসার জন্য একটু স্থানও রাখে নাই। আমি ক্লান্ত ছিলাম না, আমি আমার সমস্ত আত্তা দিয়ে এই চাদের বুড়িটাকে কতটা আগলে রেখেছিলাম, আমার সাধের বুড়িটিও জানে নাই। একদিন এই চাদের বুড়িটি কোনো কিছুই না বলে সবার অগোচরে চলে গেলো? সে হারিয়ে যায় নাই, কিন্তু আমার কাছে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলো। অথচ একটিবারও জানা হলো না আমার কি অপরাধ ছিলো। সে চলেই গেলে। দেশটাকে আর ভালো লাগছিলো না। এর গাছ পালা, এর বিরাট বিরাট অট্টালিকা, আর মুখরীত জনপদ আমার কাছে দম বন্ধ হয়ে আমাকে প্রতি নিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো। তারপরেও একটা ক্ষীন আশা ছিলো, হয়তো কোনো না কোনো মোহে তুমি ফিরে আসবেই। তারপরেও রয়ে গেলাম আরো অনেকগুলি মাস।

হটাত একদিন-

দেখা হলো ইউসিকারোস্কি ট্রেন ষ্টেশনের এক প্লাটফর্মের অপেক্ষাগারে। বিধ্বস্ত তোমার সেই কোমল মুখাবয়ব, এলোমেলো উস্কুখুস্কু চুল। আমিই প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম। খুব জানতে মন চেয়েছিল, তুমি কেমন আছো? কিন্তু আমার ট্রেন চলে আসায় আর তোমাকে ছোয়া হয়নি আমার। ছুয়ে বলা হয়্য নাই, আমি সেই আগের মানুষটাই আছি। ফিরে এসো আমার এই শুন্য বুকে। এটা এখনো শুন্য্যই আছে। আমি জানি, তুমি ভালো নাই, আমি জানি, তুমি আসলেই ভালো নাই। তারপরেও যদি কখনো দুচোখ জলে ভরে এসে একবার বলো, আমাকে তুমি ওই পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাও, ওই কল্পনার মানুষটার সাথে, আমি তাও করে দিতাম আর পিছনে না ফিরে নিজেকে শান্তনা দেবো এই ভেবে যে, অন্তত তুমি তো ভালো আছো!! এটাই আমার সবচেয়ে আনন্দের। আমিও আর তোমাকে খুজি নাই কিন্তু বারবার মনে হয়েছে, আমি কি তোমার জন্য কখনোই কিছু করি নাই?

মনে কষ্টটা ছিলই। কখনো কমে নাই। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধে আমি আর পেরে উঠতে পারছিলাম না। তাই, একদিন সব ছেড়ে সেই নাড়ির টানে আবার পাড়ি দিলাম অসহায় নিজের পলিমাটির দেশে যেখানে আমার জন্য কোনো লিসা আর অপেক্ষায় নাই।

অনেক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই চকচকে এয়্যারপোর্টের লবিতে। এই বুঝি তুমি এলে। আমার ভালোবাসার টানেই হয়ত তুমি আসবে। এমনটাই আমার কল্পনায় ছিলো। অথচ তুমি এলে না। আর তুমি আসবেই বা কেনো? তুমি তো জানোই না যে, আজ তোমার এই অপরিকল্পিত সপ্ন পুরুষটি চিরতরে চলে যাচ্ছে। আমার ফ্লাইট প্রায় বিলম্ব হয়েই যাচ্ছিলো, ফিরে আসতে মন চায় নাই। কিন্তু আসতেই হয়েছে একরাশ না বলা কথা পিছনে ফেলে। যখন আমি শেষ পদদলিটা উঠিয়ে নিয়ে সেই বাহনের পিঠে চড়ে বসলাম, আমার মনে হয়্যেছিলো, গোটা ১৮ টি বছর এই শহরে থাকার পরেও শহরটা আমার হলো না। এই দেশটা আমার হলো না। চোখে এতো জল এতোদিন কোথায় ছিলো? প্লেনের ভিতরে উঠলাম। পাশে ৫ বছরের একটি বাচ্চা বসেছিলো তার মায়ের পাশে। অনেক কান্নাকাটি করছিলো। হয়তো তার কষ্টটা অন্য রকমের। ভাবলাম, আহা, যদি আমিও ওর মত এইরকম করে বুকফাটা কান্নায় কিছুক্ষন কাদতে পারতাম। বাচ্চাটার কান্নায় শব্দ ছিলো, চোখে জলও ছিলো। অথচ আমার চোখের জল ছিলো সাগরের থেকেও উত্তাল নিঃশব্দে।

আমি সহ্য করতে শিখছি, আমি অভ্য্যস্থ হতে শিখছি। এখনো সম্বিত ফিরে নাই, মোহটা আছে। কিন্তু ভালোবাসাটা এখনো কাচা। এই কাচা ক্ষতে বারবার মনে হয় হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার মতো ভালোবাসারও কি ট্রান্সপ্লান্ট করা যায়? যদি যায় তাহলে আমি আবারো একবার না দেখে, না বুঝে ভালোবাসতে চাই। তার আগে চাই আমার পায়ের তলার মাটি। আর সেই মাটি এবার আমি তৈরী করবো আমার দেশের দুব্বা ঘাসের উপর দিয়ে। অন্য কারো গোলামি করে আমি বেশীদিন বাচতেও চাই না। আমি চাই এমন একটা প্লাটফর্ম যা আমার নিজের হবে, যেখানে আমি হবো আমার স্বাধীনতার ধারক। আমি জানি আমার সময় লাগবে এই যুদ্ধে। কিন্তু আমি পারবো। আমি এটাও জানি, আমার এই যুদ্ধে পাশে কেউ নাই। তারপরেও আমি আমার জন্যই বাচবো। আমার এখন একটাই সংকল্প- নিজের পায়ে আবার ঘুরে দাড়াও আর যদি পারো কাউকে তোমার পাশে নাও। কিন্তু সেই পাশের মানুষের উপর হাত রেখে যুদ্ধের ক্ষমতা বাডানোর কোনো সংকল্প নয়। যদি সেও আমার মতো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বুক উচু করে সামনে এসে বলে, আমিও পারবো, তাহলেই হবে বিশ্বাসের আরেক স্তম্ভ। আর এবারের এই ভালোবাসার মানুষটি হবে আগুনে পোড়া সোনার মতো। কথার ফুলঝুরি নয়, দেখার তৃপ্তিতে নয়, এবার ভালোবাসাটা হবে সত্য কাহিনীর উপর নির্মিত সেই জাপানিজ ছবিটার মতো- She Never Saw Him but loved Till Death. তোমাকে আমি ভালোবাসতে চাই এই এমন একটা কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে। দেখা নাই, সুম্মুখ কোনো কথা নাই, তবু হৃদয়ে ভালোবাসো জেগে থাকে কিনা। যদি এই রকমের অদৃশ্য বোবার মতো নিঃশব্দে আর গোপনে ভালোবাসো, তাহলে আমাকে না দেখেই মনের বিশ্বাসে ভালোবাসো। অন্তরের চোখ দিয়ে যদি ভালোবাসো, যদি বিশ্বাসের চোখ দিয়ে ভালবাসো, তাহলে ভালবাসো ঠিক সেভাবেই , আমাকে না জেনে, না দেখে, না কথা বলে। হয়তো এটাই হবে দুজনের জন্যই পরীক্ষার প্রথম ভাগ। কতকাল অপেক্ষা করতে পারবে এই না দেখা মানুষের জন্য? কতদিন শক্তি নিয়ে সমস্ত সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে উচ্চকন্ঠে বলতে পারবে-----আমি তাকে ভালোবাসি কিন্তু তাকে আমি চিনি না। সে আমাকে ভালোবাসে, সেও আমাকে দেখে নাই????? সেই জাপানিজ ছবির নায়িকার মতো কখনো কি বলতে পারবে-天国で会いましょう

(Tengoku de aimasho). যার মানে হলো, See youin heaven তোমার সাথে আমার দেখা হবে হেভেনে (বেহেশতে)।

যদি পারো, তাহলে মন তৈরী করো, প্ল্যাটফর্ম তৈরী করার জন্য হাত বাড়িয়ে দাও, দুজনে হাটি এক সাথে।  গন্তব্য হয়তো এক।

২৭/১১/২০১৯-সব মানুষের সাথে লুকুচুরী নয়

জীবনে সেই সব মানুষের সাথে কখনো লুকুচুরী, মিথ্যা কথা, ছলচাতুড়ি, কিংবা কল্পকাহিনী বলিয়া সাময়িকভাবে ভুল বুঝানো উচিত না যাহারা তোমার সুখের জীবনের জন্য নিসসার্থভাবে তাহাদের অনেক মুল্যবান সময়, পরিশ্রম আর অর্থ দিয়া সাহাজ্যের হাত বাড়ায়। যদি পথ চলিতে গিয়ে কিংবা তাহাদের নির্দেশনা মানিতে গিয়া নিজের অজান্তে ভুল করো, হয়তো সেইটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব কিন্তু যদি সেই ভুল হয় ইচ্ছাকৃত, তাহা হইলে সেইটা হইবে পাপ, অপরাধ এবং ক্ষমার অযোগ্য। তাহারা তোমাকে ভালোবাসিয়া, স্নেহ করিয়া অথবা তোমার বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করিয়া তোমার পাশে এমনভাবে দাঁড়াইয়াছেন যাহা হয়তো তাহার দাড়ানোর কোনোই প্রয়োজন ছিলো না, তবুও দাড়াইয়াছেন। তাহাদের সাথে এইরূপ কোন ইচ্ছাকৃত অপরাধ তোমার সারা জীবনের জন্য এমন মারাত্তক হুমকী হইয়া দাঁড়াইবে যাহা কোনো কিছুর বিনিময়েও আর আগের অবস্থায় ফিরিয়া পাওয়া যাইবে না। এই মারাত্তক ইচ্ছাকৃত ভুলের জন্য যদি কেউ ক্ষমাও করিয়া দেয়, তাহার পরেও যে ক্ষত সৃষ্টি হইয়া যায় তাহা দগদগে ঘায়ের থেকেও বেশী। তখন প্রতিনিয়ত মনে হইবে, এই মানুষ উপকারের কথা বুঝে না অথবা সে নির্বোধ অথবা সে উপকারীর জন্য অনেক হুমকীস্বরূপ। এই বিবেচনায় কোনো হিতৈষী যদি তোমার পাশ হইতে নিঃশব্দে সরিয়া যায়, তাহাকে আর কোনো কিছুর শপথের মাধ্যমেও ফিরিয়া আনা যায় না। তখন যাহা দাঁড়ায় তাহা হইতেছে, নিজের উপর নিজের রাগ, অভিমান আর কৃতকর্মের জন্য অপরাধবোধ। কিন্তু তাহা দিয়াও আর জলের স্রোতকে পিছনে ফিরাইয়া আনা যায় না। এই সময় যাহা হয়, তাহা হইতেছে, হতাশা ক্রমশ বাড়িতেই থাকে, আর এই হতাশা যখন বাড়ে, তাহার সাথে বাড়ে দুশ্চিন্তা। দুসচিন্তা থেকে জন্ম নেয় নিজের উপর নিজেকে ঘৃণা। আর একবার যখন নিজেকে নিজে ঘৃণা করিতে শুরু করে কেহ, তখন তাহার বাচিয়া থাকিবার আর কোনো লোভ থাকে না। চারিপাশের মানুষকে আর ভালো লাগে না, নীল আকাশ ভালো লাগে না, রংগীন আলো ঝলমলের শহরকে তখন বড় অচেনা মনে হয়। মানুষ তখন আত্মহননের দিকে ঝুকিয়া যায়। অথবা সে এমন পথ বাছিয়া নেয় যাহা সমাজের চোখে বড়ই অসুন্দর আর কুৎসিত। সব কুতসিত জীবনের কাহিনী প্রায় একই। কোনো না কোন সময়ে তাহাদের সুযোগ আসিয়াছিলো যাহা তাহারা না বুঝিবার কারনে হাতছাড়া হইয়াছে। কেউ কখনো এইরুপে বড় হইতে পারে নাই, আর হয়ও না। তাহাদের জন্য সমাজ দুঃখবোধও করে না। তাহারা সারাজীবন সমাজের একটা কালো মানুষ হিসাবেই বাচিয়া থাকে। কেউ সমাজে দাগী হিসাবে বাচে আবার কেউ সনাক্ত না হইয়াই আড়ালে আবডালে বাচে। তাহারা সংখ্যায় নেহায়েত কম না অবশ্য সমাজে।

আমার মাঝে মাঝে এইসব মানুষগুলির জন্য খুব দুঃখ হয়, কেনো এই সুন্দর প্রিথিবীতে তাহারা জন্ম নেয়? কি প্রয়োজন ছিলো এইভাবে এই নির্মল পৃথিবীর বুকে জন্ম নেওয়ার যখন সে নিজেই এই পৃথিবীর কোনো ভালো উপাদান সে হজম করিতে পারেনা? ইহাদের আয়ুষ্কাল অবশ্য বেশীদিন থাকেও না। তাহারা সমাজে আগাছার মতো বাড়িয়া উঠে, আবার কোনো এক ক্ষুরধার মালীর আঘাতে তাহারা বিকশিত হইবার আগেই শিকরচ্যুত হয়। তবে অতীত বর্তমান অভিজ্ঞতায় একটা বিশেষ লক্ষনে ইহাদেরকে শনাক্ত করা সহজ যাহা শুধুমাত্র অভিজ্ঞতাশীল ব্যক্তিবর্গরাই অতীব দ্রুত তাহাদের সনাক্ত করিতে পারেন। কোনো বই পুস্তকে ইহাদের ব্যাপারে সঠিক লক্ষন কোথাও লিপিবদ্ধ না থাকিলেও কিছু কিছু উপসর্গ প্রায় একই। যেমন, এই সব মানুষেরা সহজেই অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষনে পারদর্শী হয়, তাহাদের কথা বার্তা অনেক গুছাল হয়, তাহারা বিপরীত মানুষটির মনোভাব অতিব সহজেই নিজের ভিতরে আয়ত্তে নিয়া আসিয়া ঠিক তিনি যাহা চাহেন, সেইভাবেই উপস্থাপন করিতে সক্ষম হন। এই মানুষগুলির আরেকটি উপসর্গ হইলো যে, তাহারা অল্প তথ্যেই আগে পিছে আরো সামান্য কিছু কাল্পনিক তথ্য যোগ করিয়া একতা সম্পুর্নবিশ্বাস যোগ্য কাহিনী বানাইয়া ফেলিতে পারেন। তাহারা যাহা বলিতেছে বা উপস্থাপন করিতেছে, তাহা তাহারা নিজেরাও বিশ্বাস করে না যদিও এই সব কল্প কাহিনীর মধ্যেও অনেক জ্ঞান লুকায়িত থাকে। উক্ত জ্ঞান তাহাদের কর্ন কুহরে প্রবেশ করে না। ইহাদের সহিত মুনাফেকের একতা বিশেষ মিল দেখা যায়। ইহাদের লোভ আছে কিন্তু প্রকাশ করিতে চাহে না অথচ সেই লোভের লাভ পাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত পরিকল্পনা করিতেই থাকে। তাহারা কারো বন্ধু নহেন কিন্তু বন্ধু হইয়াছেন, এইরুপ ভাব সর্বদা করেন। তাহাদের মধ্যে ধর্মের কিছু বাহ্যিক উপকরন সর্বদা ব্যবহার করেন যাহাতে তাহাদেরকে অতি সহজেই মুনাফেক ভাবা না হয়। অথচ তাহারা ধর্ম কখনোই পালন করেন না। তাহাদের কাছে কনো মতামত চাহিলে যেই মতামতে আপনি খুশী হইবেন, তাহারা সেই মতামতটাই দিতে থাকিবেন যাহাতে আপনি আরো কিছু তথ্য তাহার কাছে আপনার অজান্তে বাহির করিয়া দেন।   

কথাগুলির অর্থ যদি তুমি না বুঝিয়া থাকো, বারবার পড়ো, বারবার। একসময় যখন চোখের জলে বুক ভাসিয়া যাইবে, তখন বুঝিবে তুমি হয়তো বুঝো নাই তবে তোমার অন্তর বুঝিয়াছে কিন্তু তোমার অন্তর তাহা প্রকাশ করিতে পারিতেছে না। যদি সেইটাই হয়, তখন তুমি একটা জিনিষ বুঝিবে যে, তুমি বাইরে এক, আর ভিতরে আরেক মানুষ। সেক্ষেত্রে আমার উপদেশ, অন্তরের মতো হও। বাইরে তোমাকে যা দেখা যায় সেটা তুমি নও, সেটা তোমার প্রেতাত্মা। আর প্রেতাত্মারা কখনোই মানুষের সমাজে স্বীকৃত নহে।

আমি তোমাকে সেই রকমের আদর আর ভালোবাসা দিয়ে পরিবর্তন করিতে চাহিয়াছিলাম। আমি দেখাইতে চাহিয়াছিলাম যে, যাহারা তোমাকে অবহেলা করিয়া সমাজের এক পাশে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছিলো, আসলে তুমি তাহা নও। আমার থেকে বেশী আর কেউ তোমাকে ভালোবাসিয়াছে কিনা আমার তাহা জানা নাই, আমার থেকে বেশী উদবিগ্ন ছিলো কেউ, সেটা আমার জানা নাই। কিন্তু আজ আমি একটা জিনিষ বুঝিয়াছি, তুমি আমার বিশ্বাস, আমার সততা আর আমার সরলতা নিয়ে এমন কিছু মানুষের জন্য নিজের সত্তাকে বিসর্জন দিয়াছো যাহা তোমার জন্য হুমকিস্বরূপ। এতোবড় অনিরাপদ পরিস্থিতি সামনে রাখিয়া, এতো বড় আশংকার পৃথিবী জানিয়াও যখন কেহ নিজের আশংকার কথা ভাবে না, তাহাদের জন্য অন্ধকার প্রিথিবীটাই প্রযোজ্য।

জীবনকে ভালোবাসিবার আরেক নাম চেলেঞ্জ। জীবনকে ভালোবাসিবার আরেক নাম সততা। জীবনকে ভালোবাসিবার আরেক নাম বিশ্বাস। সব হাসিই হাসি নয়, আবার সব কান্নাই কান্না নয়। মানুষ অধিক আনন্দেও কাদে। আবার মানুষ অধীক দুঃখেও কাদে না। তবে মানুষ সব ভয়েই কাতর হয়। আর সব ভয়ের চেহারা এক। যার নাম- আতঙ্ক। এই আতংকে মানুষ অসুস্থ হয়, মানুষের রুচী কমিয়া যায়, এক সময় দেহ ভাঙ্গিয়া আসে। দেহ ভাঙ্গার সাথে সাথে মানুষ মানসিকভাবে দূর্বল হয়, এক সময় পানির অভাবে যেমন কচি গাছের মরন হয়, তেমনি এই আতংকগ্রস্থ মানুষগুলিও মৃত্যু বরন করে। তাহাদের জন্য কেউ আর পিছনে তাকায় না।

২৩/০১/২০১৯-সে আমার অলিখিত ভগবান।

এক বছর আগের আজকের এই দিনটা অর্থাৎ ২৩/০১/২০১৮ তারিখটা আমার জীবনে যেমন খুবই একটা স্পর্শকাতরের দিন, আবার অন্যদিকে আমার জীবনকে এই মানুষশাসিত নারীর প্রতি একতরফা ভারসাম্যহীন সমাজে টিকিয়ে রাখার জন্যেও আমার জীবন বলি দেয়ার একটা দিন। আবার যদি বলি, এটা এমনো একটা দিন ছিলো যা কিনা কখনোই আমি হয়তো চাইনি। অথচ আমাকে এই দিনে সেই কাজটাই করতে হয়েছিলো যা আমি নিজের ইচ্ছায় করতেই চাই নাই। কারন আমি ইতিমধ্যে এই সমাজের মুখোসের আড়ালে যে মুখাবয়ব দেখেছিলাম যা এক কথায় যদি বলি সেটা হচ্ছে- মেয়েরা আজো আমাদের এই সমাজে একটা অলিখিত বোঝা।

অনেকেকেই কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন তারা ভালো আছেন, কিন্তু তারা জানেন তাদের সময়টাই ভালো যাচ্ছে না। সত্যি কথাটা বলার জন্যে সাহস থাকলেও সেটা আসলে পুরুপুরি কাউকে যে বুঝাবেন, সেটা মুখের কথায় বুঝানো যায় না। আয়নায় চেহারা দেখা যায় কিন্তু কষ্ট দেখা যায় না। ভিতরটা কেউ দেখে না যদিও সত্যিটা ভিতরেই থাকে। সেই কষ্টে ভরা সুর শুধ্য নিজের কান থেকে নিজের অন্তরেই ঘুরাঘুরি করে প্রতিধ্বনি করতে থাকে। অন্য কারো অন্তর কিংবা হৃদয়ে সেটা কোনোভাবেই পুশ করা যায় না। আসলে একটা কথা আছে-কান্নার আহাজারীতে সুর থাকে না, থাকে বেদনা আর কষ্ট যে কষ্টের কোনো নাম নাই, যে কষ্টের রুপ কাউকে দেখানো যায় না।

আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগে কোনো এক সিড়ি থেকে পিছলে পড়ে আমি এমন একটায় জায়গায় পতিত হয়েছিলাম যেখান থেকে না আমি নিজে বা না আমার পরিবার অথবা আমার কেউ সজ্জন টেনে আবার সেই রাস্তাটায় তুলে দিতে পারে। আর সেই সখমতা তাদের কারো ছিলোও না।  অনেক সময় কারো মুখ দেখে কারো ভিতরের যন্ত্রনাকে উপলব্দি হয়তো করা যায়। তখন কারো হয়তো মন চায় যে তার কাছে যেতে, তার মনের কথা জানতে, কিন্তু আমাদের সমাজটা এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যেখানে সচেতন মানুষের মন বলে উঠে “মাথা ঘামিও না, যদি কোনো সমস্যায় পড়তে হয়!! বিপদে জড়িয়ে পড়লে?” উপলব্ধি সবাই করে। সবার মনকেই ছুয়ে যায়। কেউ কেউ ঝাপিয়েও পড়ে। মনুষ্যত্তের অবনমন যেমন আছে, মনুষত্যের উত্তোরনও তেমন আছে। এমনটি হতেও পারে যে আপনি কোনো মানুষকে দেখে বুঝতে পারলেন সে সমস্যায় রয়েছে। তার মুখে লুকিয়ে থাকা কষ্টকে বুঝলেন আর জানতে পারলেন যে তার পিছনে অত্যাচারের এক ঘৃণ্য কাহিনী বা অন্য কোনো কাহিনী লুকিয়ে আছে। সন্দেহের বশে অসুবিধায় রয়েছে এমন মানুষকে দেখে কোনো প্রশ্ন করা মোটেই অহেতুক হস্তক্ষেপ নয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেই সব সচেতন মানুষ সামাজিক লাঞ্ছনার ভয়ে সেই কষ্টে থাকা মানুষের পাশে দাড়াতে ভয় পায়। আমার বেলাতেও ঠিক সে রকম একটা পরিস্থিতির স্রিষ্টি হয়েছিলো। আমার মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝা হয়তো গিয়েছিলো, আমি ভালো নেই, কষ্টে আছি কিন্তু পর নির্ভর আমার এই পরিবারের কোনো সদস্যদের এইটুকু ক্ষমতা ছিলো না যে, তথাকথিত আমাদের এই সমাজের ভাবধারাকে এড়িয়ে কেউ আমার জীবনে এসে দাঁড়ায়। এমন একটা পরিস্থিতিতে আমাদের অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে শিখতে হয়। আমিও সেটাই করতে বাধ্য হয়েছিলাম- আমার বিয়ে হয়ে গেলো এমন এক মানুষের সাথে যাকে আমি চিনতাম আমার জন্ম লগ্ন থেকেই। তার সাথে আমার কখনোই এমন কোনো সম্পর্ক ছিলো না যাকে আমরা বলি- ভালোবাসা বা নির্ভরতা। হয়তো তার উদারতা কিংবা আমার রুপের মুগ্ধতায় সে আমাকে বরন করতে চেয়েছিলো। কোনো অবস্থাতেই তার সাথে আমার যায় না, অন্তত বিয়ে করে সংসার করার মতো ব্যাপারে তো নাইই।

ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই হোক আর সামাজিকতা রক্ষার জন্যই হোক, আমি তার সাথে শেষ পর্যন্ত বিয়ে নামক সম্পর্ককে মেনেই নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আর যাইই হোক, আমার এই মেনে নেয়ার সিদ্ধান্তে আমার পরিবার বেচে যাবে একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে, আমি বেচে যাবো একটা অপয়া অপবাদ থেকে, কারন আমি সমাজকে ভয় পাই। কিন্তু তখনো আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারি নাই যে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো সম্পর্ক জুড়তে যাওয়া একটা ভয়ংকর পরিবেশের জন্ম দেয়। অনেক সময় প্রতিবেশি বা সমাজের সম্মান বাচানোর জন্য অনেক সময় এই ইচ্ছের বিরুদ্ধে সম্পর্ক গড়ে তোলতে হয় বটে কিন্তু সময়ের পাল্লায় এই সম্পর্ক একটা বোঝা হয়েই দাঁড়ায়। আমাদের সমাজে আজো এমন অনেক বিয়ে হয়ে থাকে যা শুধু পরিবারকে খুশি করার জন্য। যাকে অন্যের বাড়িতে পাঠানোর জন্য আমরা অনেক কিছু করতে পারি। আমরা তখন হাসিখুশী অববয়ব নিয়ে বিয়ের সব ফরমালিটিজ করে সুখী হবার ভান করি। কিন্তু আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করা উচিত যা আমি দেখেছি চাক্ষুষ নিজের বেলায়। বিয়ের সময় দেখানো খুসি আর ভালোবাসার অভিনয়ে এটা প্রমানিত হয় না যে, ভবিষ্যতে এই সুম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা বা ঘৃণা আসবে না। একসময় দেখা যায়, এই দেখানো ভালবাসা প্রকাশ্য ঘৃণার বিষে রুপান্তরীত হয়। এই বিষে যখন ঘৃণা ঢোকে পড়ে, তিক্ততার সীমা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন যে এখন এই সম্পর্ককে শেষ করা উচিত। বুঝে শুনে বেরিয়ে আসা উচিত। যাতে তার আগে কোনো মারাত্তক অঘটন না ঘটে। কেননা প্রায়ই তিক্ত সম্পর্কগুলির ক্ষেত্রে বুদ্ধির জায়গায় হিংসা ঢোকে পড়ে, আর তখন কিসের সমাজ আর কিসের জীবন সেটার পরাজয় ঘটে। নিজেকে শেষ করে দেয়া বা নিজের ঘৃণার মানুষতাকে শেষ করে দেয়াই যেনো মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এমন অনেক কিছু হয় যে, সেই দম্পতি যে একদিন ভালোবেসে কিংবা উদার মন নিয়ে খুব কাছে এসেছিলো, তারাই সম্পর্কের তিক্ততায় একজন আরেকজনকে চাকু, বন্ধুক চালাতে পিছপা হয় না। আমি সেটা পর্যন্ত আমার এই অসম দাম্পত্য জীবন চালিয়ে নিতে চাই নাই। কিন্তু আমার বাবা মা কখনোই আমার এই মনের ভিতরের আবেগতা বুঝতে চায় নাই। একটা বাবা মা যখন সন্তানের জন্য কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ এটা বুঝতে না পারে, তাহলে সেই পরিবারে সেই সন্তান একটা অসুস্থ্য পরিবেশেই বড় হতে থাকে। আর অসুস্থ্য পরিবেশ শুধু সাস্থ্যইকেই ক্ষতি করে না, মনকেও। আমি আমার নিজের মনের আওয়াজ শুনোট পেয়েছিলাম। এই জীবনে শুধুমাত্র একটা থাকার জায়গা হলেই হয় না, জীবনে বাচার জন্য নিঃশ্বাস ফেলার একটা জায়গাও লাগে। ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া কোনো ব্যক্তিত্ত বেশীদিন অসহায় থাকে না। আমার কাছেও সেতাই একদিন চরমভাবে মনে হয়েছিলো যে, কিছু জিনিষ যা প্রতিনিয়ত মনকে কষ্ট দেয়, মানসিক শান্তি নষ্ট করে, সে সব কাহিনী চিরতরে ভুলে যাওয়াই ভালো। তাতে অন্তর মানসিক কষ্টটা আর থাকে না। আমার জীবনের প্রতিটি দিন যেনো চলছিলো ঠিক এরকম যে, এক শিফটে উনুন, আর আরেক শিফটে বিছানাইয় কারো জন্যে অপেক্ষা করা যে কখনোই না আমার ছিলো, না আমি তার ছিলাম। এটাই কি গরিবের লাইফ। আমার এই যৌবনের দাম, আমার এই জীবনের দাম যদি শুধু শরীর দিয়েই হয়, তাহলে আমি কেনো এমন জীবন বেছে নেই না যেখানে আমি অন্তত আমার মতো করে বেচে যেতে পারি? আর সেই বাচায় যদি কেউ আমাকে নিঃশ্বাস ফেলার একতা অবকাশ ও করে দেয়? কে চায় না তার জীবন আরো ভালো থাকুক?

আমি বদ্ধপরিকরভাবে এক তরফা এবার নিজের জন্যেই নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম- যে জীবনকে সমাজ প্রোটেকশন দেয় না, যে সমাজ ব্যবস্থা আমার মতো কোনো নারীর দায়ভার গ্রহন করে না, যে সমাজে আমি নারী হয়ে একটা বোঝা ছাড়া আর কিছুই না, সে সমাজের কোনো আইন কিংবা নীতি আমার জন্যে না। আমার জীবন আমারই। আমি যদি বেচে থাকি, তাহলে সমাজ আছে, যদি আষ্টেপিষ্ঠে আমি প্রতিনিয়ত আমার সমস্ত অধিকার থেকে নিপীড়িত মানুষের মতো একটা পাশবিক বন্ধি জীবনই এই সমাজের নিতীর কারনে মেনে নিয়ে সামনে এগুতে হয়, আমার সে জীবনের কোনো প্রয়োজন নাই, না সেটা আমার জীবন। আমার এ রকম সিদ্ধান্তের কারনে বারংবার বড় ছোট সবার কাছ থেকেই হরেক রকমের উপদেশ আর প্রশ্নের সম্মুখীন হইয়েছিলাম। কিন্তু সব উত্তর সবসময় তার প্রশ্নের ন্যায় বিচার করে না। বিশেষ করে প্রশ্নটা যখন এমন হয় যেটা মনকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খায়, আর হৃদয়কে ছুড়ি দিয়ে ফালা ফালা করে দেয়। কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তর যখন কারো জীবনের নাশ হয়ে দাঁড়ায় তখন সেই উত্তরের শেষ পরিনতি সম্পর্কে উত্তারদাতার অনেক ভেবেচিন্তে দেয়া উচিত। আমি আমার এই সম্পর্কের শেষ পরিনতি ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছিলাম যে, সমাজের চাপের কারনে নেয়া আমার সেই সম্পর্ক একদিন আমাকে অনেক চড়া মুল্য দিয়ে পরিশোধ করতে হবে। তখনো এই সমাজ আমার পাশে দাঁড়াবে না। তাই সব কিছু আমি অনেক ভেবে চিন্তেই আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম।

এমনিতেই প্রত্যেকটা মানুষ নিজের মতো করে বাচতে চায়। আর এই বাচার জন্য হয়তো অনেক আর্থিক ক্ষমতা না থাকলেও মানুষ যতটুকু ক্ষমতা আছে সেটার উপরেই ভরষা করে নিজের মতো করে নিজে বাচতে চায়। কিন্তু কিছু মানুষের মধ্যে কর্তৃত্ব করার প্রবনতা এমন বেশী থাকে যে, এই ধরনের প্রবৃত্তির কারনে অন্য কিছু মানুষ ধীরে ধীরে সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যেতে থাকে। এক সময় তারা একাই হয়ে যায়। আমিও এক সময় মনে হলো- একাই আমি। আমি যদি আসলে একাই হই, তাহলে পরাজয়ের গ্লানী টানবো কেনো?

দুটু মানুষকে জুড়ে দিয়ে একটা নতুন জীবন দেয়ার এই প্রথার নাম বিয়ে। বিয়েও কিন্তু একটা কন্ট্রাক্ট, দায়িত্তের কন্ট্রাক্ট, সরকারী অনুমোদিত একটা কন্ট্রাক্ট। হতে পারে এই কন্ট্রাক্টের মাধ্যমেই দুটু পরিচিত বা অপরিচিত মানুষ একজন আরেকজনের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শপথ করে। কিন্তু কারো হাত ধরে সামনে এগিয়ে যাওয়া মানেই কিন্তু উন্নতির দিকে যাওয়া সেটা কিন্তু নয়। আগে খুব জানা দরকার, হাত ধরা মানুষটি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। সাফল্যের সপ্ন, জীবনের আশা আর পরিশ্রমের পথ যিদি  যাত্রার পথ একদিকে না হয়, তাহলে আর যাই হোক, সাফল্যকে হাতে পাওয়া যায় না। আই লাভ ইউ বললেই শুধু ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসার বহির্প্রকাশ হয় তার কাজে আর বাস্তবে। অনেকে হয়তো আই লাভ ইউ বললেই ভাবে ভালোবাসা হয়ে গেলো, কিন্তু সেটা কি অন্তরের না শরীরে তা যাচাই করার কোনো দরকার মনে করে না। ভালোবাসা হচ্ছে সেটা যা কাছে থাকলে এর প্রয়োজন অনুভব করা যায় না, মনে হয় আছেই তো। কিন্তু যখনই চোখের আড়ালে যায়, মন শুধু আনচান করে আর প্রতীক্ষায় থাকে, কখন কাছে আসবে। ভালোবাসা, কোনো ড্রেস বা জুতা তো নয় যে ফিটিং হলো না আর শপিংমলে গিয়ে ফেরত দিয়ে আসবো। একটুখানি ময়লা হলো বা ফেটে গেলো তো আলমারীর ভিতর লুকিয়ে রাখলাম। কিন্তু ওই ড্রেস বা জুতু যদি ফিটই না হয় তো তাহলে আমরা কি করবো? আমরা তো সেটা পড়তেই পারবো না। আর যদি পড়তেই না পারি আবার ফেলতেও না পারি তাহলে তো আলমারী ছাড়া আর কোথায় রাখবো? তখন হয়ত অন্যদের মতো আমরা আরেকটা শার্ট বা ড্রেস কিনে পড়ে নেবো যা একদম ফিটিং। কিন্তু যেদিন আমি সমস্ত কিছু একপাশে রেখে ওর সাথে জীবন বেধেছিলাম, সেদিন থেকেই আমি পন করেছিলাম, যাইই হোক, আমি থাকবো। সেদিন থেকে আমি তো অন্য কারো কাছে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি নাই। কারো চোখে তাকানোর কথা ভাবতেই পারি নাই। অন্যের সাথে থাকা, অন্যের হাসি, অন্যের জন্য আমি তো কোনো সপ্নই দেখতে পারি নাই। কিন্তু পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে আমার ভাগিকে নিয়ে দাড় করিয়েছিলো যে, আমি হয়তো ওর হাতটা আজীবন ধরেই রাখতে পারতাম, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে, সেক্ষেত্রে আমার হাতটাই হয়তো কাটা যাবে।

আমি বারবার আমার সেই ফেলে আসা কয়েকটা বছরের প্রতিটি মুহুর্ত বিচার আর বিশ্লেষন করে দেখছিলাম। আমার সেই পুরানো বন্ধু যার কারনে আজ আমার এই সমাজে এতো নাজেহাল অবস্থা। কিন্তু সেই নাজেহাল হবার কারনটায় তার কোনো ভুমিকা ছিলো না। সে তো চেয়েইছিলো আমি কিভাবে ভালো থাকি। যা হয়েছে তা শুধু এক তরফা আমার ভুলের কারনে। আমি আজো সেই দিন গুলির কথা ভাবি আর মনকে এটা বুঝাতে সক্ষম হই, জীবন আমার, সমাজ আমার নয়, জীবনের সব দুঃখ আমার আর সেটা আমি সমাজ থেকে পেতে চাই না, জীবনের সুখ আমার আর সেই সুখ আমি নিজের জন্য তৈরী করবো, সমাজের কোনো নিয়মের মধ্যে নয়। কোনো এক ঝড়ের সময় আমার উপড়ে যাওয়া ঘর যখন ঝড়ের শেষে বিলীন হয়ে যায়, সমাজের প্রতিটি মানুষ পাশে এসে শুধু মুখে আর ঠোটেই আহাজারী করে, কিন্তু পুনরায় মেরামত করে যে, একটুখানী সহায়তা করবে সেটা আমার এই সমাজ নয়। বরং আমার সেই অসহায়ত্তকে কেন্দ্র করে আমাকে লুটে পুটে খাওয়ার একতা প্লট তৈরী করবে। যদি সেটাই হয়, তাহলে তো আমার সেটাই করা উচিত যা আমার সেই বন্ধুটি আমাকে সম্মানের সাথে বাচাতে চেয়েছিলো। প্রতিদান একটা মনুষত্যের ব্যাপার, আমার যা আছে তার বিনিময়ে সে যদি সত্যিকারভাবেই আমাকে সমাজের বাইরে গিয়ে এমন একটা জীবন দান করে যেখানে এই সমাজেই আমি একজন প্রগতিশীল মানুষ, শুধু নারীই নই, আমি একজন নীতিনির্ধারক ও বটে, অথবা এমন একটা জীবন যেখানে সমাজের সব আইন আর কানুন আমার পায়ের নীচে পদায়িত, তাহলে কেনো আমি শুকনো রুটি দিয়ে গলা ফাসাবো? আর জল চাই, আমার ভালো পরিবেশ চাই। জীবন তো একটাই। সেতো আমাকে এতাই বলেছিলো যে, “আমি শুধু তোমার পাশে থাকতে পারি কিন্তু লড়াইটা তোমার, তোমাকেই লড়তে হবে। এটা বিজনেস নয়, এটা তোমার লাইফ।“ আমি যেনো সম্বিত ফিরে পেয়েছিলাম।

সময় নতুন সম্পর্ক তৈরী করে। আবার “সময়” পুরানো সম্পর্ককে নতুন করে সাজিয়েও দেয়। তখন ওই সম্পর্ক যে আকার আর যে রুপ নিয়ে ফিরে আসে, সেখানে থাকে আগের করা সব ভুল আর মানসিকতা বিবর্জিত। কষ্টের সময় যারা থাকে, তারাই তখন নিজের ফ্যামিলি হয়ে যায়। সে আমার প্রকৃত পরিবার ছিলো। আমি ফিরে তাকাতে চেয়েছিলাম এবার নতুন আংগিকে। যখন ফিরে তাকালাম, দেখলাম, গাছটা কেটে দিয়েছিলো কিন্তু শিকরটা কেউ কাটতে পারে নাই। সেই শিকর থেকে আবারো নতুন ঢাল পালা আর নতুন পাতার জন্ম নিচ্ছিলো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, একটা সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়া মানে জীবনটাই শেষ হয়ে যাওয়া নয়। একটা রোমান্টিক সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া নাতো মানুষকে কাপুরষ বানিয়ে দেয়, আর না ছোট করে। একটা ব্রেক আপ শুধুমাত্র একটা ইংগিত যে, জীবনে রোমান্স ছাড়াও আরো অনেক সুন্দর উপহার আছে। যেগুলিকে আমাদের চিনতে হবে, খুলতে হবে, আর পুরু উপভোগ করতে হবে। আমার জীবনে সে ছিলো ঠিক সে রকমের একতা ব্যক্তিত্ত। আমি নারী, আমার মুল্য কারো কাছে হয়তো ঠিক ততোটা যতোটা আমি সক্ষম অবস্থায় দিতে পারবো। কিন্তু তার কাছে “নারী” ছিলো একটা দায়িত্ত, একটা অপরুপ মায়ার ভান্ডার। কতোটা আমি দিতে চাই, অথবা দিতে ইচ্ছুক সেটা তার কাছে জরুরী ছিলো না, তার কাছে জরুরী ছিলো সেটা যেতা আম্র দরকার। একটা সম্মানীত জীবন। সমাজের কাছে আমার মাথা উচু করে দারাবার সিড়ি। কিন্তু আমি জানি আমার কি দেবার ক্ষমতা ছিলো। আসলে আমার কাছে কিছুই দেবার ছিলো না তার জন্যে। যা দিতে পারি সেটা তার হাতের কাছেই সারাদিন গড়াগড়ি যায়।

জীবনে কাকে কতটা জায়গা দেবো সেটা ঠিক করে ফেলতে পারলে জীবনে আর কোনো সমস্যাই থাকে না। আর কার সাথে কি কমিটমেন্ট করা দরকার তার যদি কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকে, তখন জীবনের স্রোত সব সময় একই থাকে। পিছুটানের আর ভয় থাকে না। আর যখন পিছুটানের ভয় থাকে না, তার সামনে দ্রুত গতির শক্তিটাও ধীর গতি হয় না। যতোক্ষন যেটা ভালো লাগবে, ততোক্ষন সেটা চালিয়ে নাও। আর যদি কখনো তাতে কোনো উলতা স্রোতের আবাষ পাওয়া যায়, হয় তাকে সমাধান করতে হবে, নতুবা নিজের পায়ের শকিতে জোরদার করতে হবে। কখনো কখনো বিয়েটা শেষ হয়ে যায়, সম্পর্ক নয়। তখন বেচে থাকে একটা বন্ধুত্তের অভ্যাস, মায়া। তখন যেটা হয়, একজন আরেক জনের কষ্টে বা বিপদে অন্য জন ততোটাই কষ্ট আর বিপদে থাকে যতোতা সে থাকে। অনেক সময় ঠিকানা ভুল হয় কিন্তু ওই ঠিকানায় যারা থাকে তারা হয়তো ঠিক লোক। আর এটাই সেই ঠিকানা যেটা ভুল কিন্তু সেখানে যিনি আসেন বা থাকেন, তিনি আমার জীবনের জন্য সঠিক। ভুল ঠিকানায় আমার সমস্ত জীবনের সঠিক মানুষটি বাস করে।

সামাজিক রীতির মাধ্যমে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ আমরা দুজন মানুষের মধ্যে কোনো একদিন আমি তার বিচ্ছেদ ঘটিয়ে আমি সমাজের রীতির বাইরে গিয়ে এমন এক সম্পর্কে নিজে চিরদিনের মতো আবদ্ধ হয়ে গেলাম, যেখানে আমি আছি আমার মতো করে। অতীত ভুলে যাওয়া যায় না বটে কিন্তু সেই অতীত আমাকে যেনো আর কখনো দুক্ষে ভারাক্রান্ত না করতে পারে সেই বর্তমান আর ভবিষ্যৎ আজকের দিনের মানুষটি আমাকে সম্মানের সাথে গলায় পড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও অতীতের সেই তারিখটা যখন বারবার বছরান্তে ফিরে আসে, আমি হয়তো কখনো সেই মানুষটার জন্য দয়া অনুভব করি, কখনো ঘৃণা অনুভব করি, আর ভাবি, কতোটা পরাজয়ে মানুষ কতোটা ভালো থাকে। এখন শুধু তার সেই অযাচিত ব্যবহার, সমাজের অপনীতি আজ আমাকে শুধু মুচকী হাসিতে ভড়িয়ে দেয়। আমি সুখে আছি। আজ সমাজ আমাকে ঘিরে নিতির ব্যাপারে পরামর্শ করতে চাইলেও আমি এই সমাজকে পরিবর্তনের কোনো উপদেশ দেই না কারন এই সমাজ কারো কোনো উপদেশ শুনে না। আজ সেই তারিখটা আরো এক বছরের জন্য কালের গর্ভে হারিয়ে গেলো কিন্তু মনে করিয়ে দিয়ে গেলো আমার অতীতের অনেক কষ্টের কথা আর আজকের দিনের সুখের মাত্রাটা। অসহায় মানুষ একদিন কারো না কারো হাত ধরে ঘুরে দাড়ায়ই।

সে আমার অলিখিত ভগবান।

২০/০৩/২০১৭-একা থাকা

Categories

মাঝে মাঝে আমি যখন একা থাকি, তখন ভাবি, কিভাবে এতোবড় সাগরের মতো সমস্যাগুলি আমি সামাল দিচ্ছি? কোনো সমস্যাই কারো থেকে কম ছোটনা। কিন্তু কনো না কনভাবে আমি সামাল দিচ্ছি। কোনো সমস্যা বিশাল টাকার, কোনো সমস্যা বিশাল ভাবে রাজনীতির, কোনো সমস্যা আবার নিছক ব্যক্তিগত। এতো সমস্যায় জর্জরিত থেকেও আমি একটা জিনিষ বুঝতে পেরেছি, আমার পাশে আসলে কেউ নাই। যে যাই কিছু বলুক, আমি আসলে একা। আমার পরিবার আমার সাথে আছে কিন্তু তারা কি আমার সমস্যায় চোখের জল ফেলাছাড়া আর কিছু করতে পারবে? আমি তাই মাঝে মাঝে ভাবি, আমার অনুপস্থিতিতে ওরা ভালো থাকবেতো? আমার সব কিছুর উপরে আমার পরিবার। এই জায়গায় আমি চরম স্বার্থপর। এখানে আমি কোনো ছাড় দিতে ইচ্ছুক নই।

আমি যেভাবে এগুচ্ছি, তার বেশীর ভাগ সাহসিকতার কারন আমার ইচ্ছাশক্তি আমাকে আমার পরিবারের জন্য কাজ করে। কখনো ওরা আমাকে ভুল বুঝে কিন্তু আমি জানি ওদের ঐ ভুল বুঝাবুঝির কারনে আমি ছেলেমানুষিকরলে ওরা সময়ের স্রোতে ভালো থাকবেনা। তাই সব রাগ, ঝগড়া, বিবাদ নিমিষেই অবুঝ বালকদের বাচ্চামি মনে করে ঝেড়ে ফেলে দেই আর সামনের দিকে এগুনোর চেষ্টা করি। আমি সফল হচ্ছি কিনা আমি জানি না তবে আমার উপর থেকে ধীরে ধীরে যে বিশাল বিশাল বোঝা নেমে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারি। আর এখানেই আমার সার্থকতা।

১৩/০৬/২০১৬- সরল রেখার হিসাব

Categories

 

কোন একটা কারনে আমি আজ একটু মর্মাহত। মর্মাহত এই জন্য যে, আমি একটা সরলরেখার হিসাব বুঝতে পারি নাই। আমি বুঝতে পারি নাই যে, আমি একটা অবিভক্ত সরলরেখার অংশ যাকে ভাঙবার চেষ্টা চলছে। আমি বুঝতে পারি নাই যে, শত্রু বন্ধুর মত ব্যবহার করলেই সে বন্ধু হয়ে যায় না। বুঝতে পারি নাই যে, শত্রুর শত্রুরাও একসময় তাদের বড় শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য একজোটে বন্ধু হয়ে যায়। আমি বুঝতে পারি নাই যে, নিজের ইচ্ছাগুলো, শখগুলো রক্ষা করার জন্য কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ নয়। আমি এখন বিছানায় শুয়ে আছি আর ভাবছি। মনে হচ্ছে আমি কষ্টে আছি, যত না শারীরিক কষ্ট, তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট মনের ভিতরে। নিজের কাছে নিজেকে খুব বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে এইজন্য যে, কেন আমি এতোটা অবুঝ ছিলাম, কেন আমি ঐ হায়েনাটাকে এতোটাই কাছের লোক বলে মনে করেছিলাম, কেন মনে হয় নাই, সে ওঁত পেতে আছে। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে আজ, নিজের কাছে লজ্জাবোধও কম মনে হচ্ছে না। এই পৃথিবীতে আমি আজ অন্তত একটা মানুষরূপী হায়েনাকে তো চিনতে পারলাম যে আমারই আস্তানার কাছে ঘুপ্টি মেরে বাস করে, সাধু হয়ে চলাচল করে অথচ সে হায়েনার চরিত্র লুকিয়ে রাখে।   জীবনের মানে বুঝবার জন্য অনেক দূর যাওয়ার প্রয়োজন নাই। এই হায়েনাটাকে দেখলেই সব বুঝা যাবে। এই হায়েনারা বন্ধু হয়ে অন্তরের ভিতরে কোকিলের কণ্ঠের মত সুর নিয়ে প্রবেশ করে, সে আসলে সুর নিয়ে নয়, সে জহর নিয়ে প্রবেশ করে। এদেরকে বুঝবার জন্য একটু গভীরে যাওয়া দরকার। তা হলে জীবনের মানে কি তার হিসাব বুঝা যাবে। জন্মের পর যাদের আস্তানার কোন হিসাব ছিল না এবং এখনো নাই, কে বা কারা তার অভিভাবক কিংবা কি নিয়ে তারা পরিচিত হতে হবে এই জনসম্যখ পৃথিবীতে, তাই যখন তাদের নাই। বস্তির ঐ অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে যাদের শ্বাসপ্রশ্বাস চলে, জীবনের মুললক্ষ্য ঠিক করার জন্য অপরের সাহায্য লাগে, পেট পুরে খেতে না পেরে মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পেতে জীবন চলে, রাত নামলেই কোথায় একটু ঘুমানো যাবে সেই ভরসায় পরিচিত কারো বাড়ীর পরিত্যাক্ত ঘরে, বা বারান্দায়, কিংবা ঝুল বারান্দায় থাকতে পারলেই নিজেকে বড্ড সুখি মনে করে, তাদের আবার স্তর কি? ল্যাবেল কি? স্ট্যাটাস কি? তারা আর যাই হোক, কারো বন্ধু হতে পারে না। আর বন্ধু হলেও তাদের বন্ধু তাদের স্তরেরই। আমাদের স্তরের তো নয়ই। এদের প্রতিটি চিন্তায়, প্রতিটি অনুভবে, আর সমগ্র ভাবনায় থাকে কিভাবে কোথায় কি ফায়দা লুটা যায়। তাই তারা কখনো চোখের জলে মানুষকে দেখিয়ে একটা সহানুভুতি, কখনো অতি বন্ধুভাবাপন্ন চরিত্রের রূপধরে মনের খুব কাছাকাছি আসার আকুতি, আবার কখনো সাধু সন্নাসির মত গোবেচারা সেজে মানুষের মনের ভিতরে ঢোকার প্রাণান্ত চেষ্টা, এটাই এদের চিরাচরিত অভ্যাস। এরা ভিক্ষা করে না কিন্তু ভিক্ষার টাকায় চলে, যাকাতের টাকায় চলে, এরা পরিত্যাক্ত কিন্তু ভাবে ভাবে চলে, এরা নামহীন, বংশহীন, গোত্রহীন, কিন্তু এরা বড়বড় নামের লোকের দোহাই দিয়ে চলে, অথচ যাদের নামে ওরা চলে, সেই ওরা এই বংশহীন, নামহীন, গোত্রহীন উচ্ছিষ্ট মানুসগুলকে হয়ত চিনেই না। হয়ত বাপের নামটা পর্যন্তই এরা জানে তাদের আদি এবং শেষ পরিচয় হিসাবে। পিতৃকুলের না আছে কেউ, মাত্রিকুলের না আছে কেউ। এদের রূপ যাই হোক না কেন, এদের অন্তরের ভিতর থাকে সর্বদা জহর। এই জাতীয় মেরুদণ্ডহীন হায়েনারা রাগের চেয়ে হাস্যুজ্জল থাকার চেষ্টা করে থাকে বেশি, অপমানেও ওদের দাতকপাটি বন্ধ হয় না, অপমানিত বোধ না থাকায় নির্লজ্জ তোষামোদি লক্ষণীয়। আর অন্তরের ঐ জহরেই অন্যের সব কিছু নস্ট করে মানসিক শান্তিতে থাকতে চায় এই বিকৃতি মানুষগুলো।  

আমিও আজ এমনি একটা বন্ধুরুপে পাশে থাকা হায়েনার জহরসমেত দংশনের জর্জরিত ব্যথায় কাতরাচ্ছি। আমি বুঝতে পারি নাই আমার পাশে দাড়িয়ে থাকা এই হায়েনাকে। এরা সবাই হায়েনার বংশধর। ছেলে হোক মেয়ে হোক, হোক ওদের পরবর্তী বংশধর, সবাই মানুষের অববয়ব কিন্তু হায়েনার আদর্শ ছাড়া কিছুই নাই তাদের মধ্যে। এটা আমার জন্য একটা শিক্ষা হয়ে রইল। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আমি কেন আমার অবিভক্ত সরলরেখার ঐ প্রান্তে দাড়িয়ে থাকা আমার প্রানপ্রিয় শুভাকাঙ্ক্ষীর সাথে এই নিয়ে আলাপ করি নাই? আমি সেটাও বুঝতে পারি নাই। কি চক্রাকার বিপদের সঙ্গে আমি বসবাস করছিলাম। তবে শান্তিরবার্তা এই যে, কিছুটা রক্তক্ষরণ হয়েছে, কিছুটা আঁচর তো লেগেছেই, কিন্তু আজ অন্তত কিছুটা হলেও জীবনের সাথে জীবনের কোথায় অমিল, সেটা বুঝতে পেরেছি। ফারা কেটে যাবে, আবার বর্ষা আসবে, আবার শরত আসবে, শুধু আসবে না হায়েনাদের জন্য সুজুগের সংবাদ। এই অনাকাঙ্ক্ষিত হিসাব থেকে আমি শিক্ষা নিয়েছি। আমাকে শিক্ষা নিতে হয়েছে, যদি শিক্ষা না নেই, তাহলে জীবনের আরও অনেক পর্ব আসবে, যেখানে মনে হবে ঐ পথ আরও কঠিন এবং উত্তরনযোগ্য নয়। পতন নির্ঘাত নিশ্চিত।  

আজ যারা আমার সঙ্গে অসঙ্গতিমুলক আচরন করেছে, তারা ভাল কি মন্দ এই বিচার হবে সময়ের পথ ধরে ভবিষ্যতে। আমি তৈরি হচ্ছি। আপনারাও তৈরি হউন। আর ঐ হায়েনাটাকে বলছি, তুমিও তৈরি হও। তুমি আর যাই কিছু করো না কেন, তোমার রক্তের পরিচয়, বংশ, সেটা আর নতুন করে গজিয়ে তুলতে পারবে না। তুমি এর চেয়ে ভাল কিছু করে দেখাতেও পারবে না তোমার পরবর্তী হায়েনাদের কাছে। হায়েনা হায়েনাই। আর তৈরি হও ঐদিনের জন্য, যেদিন তুমি তোমার চোখের জলের সব ভান্ডার ঢেলে দিয়েও আমার রোষানল থেকে বেচে যাবার কোন সম্ভাবনাই নাই, আর সমস্ত সুরালয়, কিংবা জরালয় দিয়েও প্রমান করতে পারবে না যে, তুমি হায়েনার বংশধর নও। তুমি আমার কাছে বিষধর সাপের চেয়েও খারাপ।

০১/০৬/২০১৬-গল্পটা যদি এমন হতো?

Categories

 

এক যে ছিল রাজকুমার, আর এক যে ছিল রাজকুমারি। রাজকুমার রাজকুমারিকে আর রাজকুমারি রাজকুমারকে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু হটাত করে কোন এক দিন রাজকুমার হারিয়ে যায়। দিন যায়, রাত যায়, মাস যায় বছর আসে, বর্ষা যায় শিত আসে, রাজকুমারি পথ চেয়ে বসে থাকে। কিন্তু রাজকুমারের কোন হদিস মেলে না। চোখের সবগুলো স্বপ্ন নিয়ে আর অশ্রুভরা নেত্রে রাজকুমারি একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে জস্না দেখে, চাদের পানে চেয়ে ঐ চাদের বুরির সঙ্গে একাই কথা বলে।  কত রাজ কুমার এলো গেলো। কিন্তু রাজকুমারীর কোন রাজকুমারের প্রেমেই পরতে পারলেন না। তার রাজ্য চাই না, জহরত চাই না, সোনার পালঙ্ক চাই না। তিনি শুধু রাজকুমারের জন্য পথ চেয়ে থাকেন।

একদিন হটাত কোন এক বসন্তের সকালে মাথা ভর্তি এলো মেলো চুল নিয়ে, উসুখুসু খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি নিয়ে রাজকুমার এসে হাজির। রাজকুমারি তার জীবনের সব আনন্দ আর ভালবাসা দিয়ে রাজকুমারকে জরিয়ে ধরে শুধু বললেন, আমাকে একা ফেলে তুমি কোথায় গিয়েছিলে রাজকুমার? আমি তো তোমার পথ চেয়েই এতটা দিন, এতটা সময় পার করে দিয়েছি, একবারও কি মনে পরে নাই আমায়? তুমি কি আমার ভালোবাসার স্নিগ্ধ ঘ্রান কখনোই পাও নাই রাজকুমার? এই বুকে কান পেতে দেখ, কি উত্তাপ আর কি যন্ত্রনা নিয়ে আমি এই এতগুল বছর তোমার প্রতিক্ষায় অপেক্ষা করে আছি! আমাকে তুমি তোমার বুকের ভিতরে একটু জায়গা দাও রাজকুমার। আমি বড় ক্লান্ত, আমি আজ অনেক অবসন্ন। আমাকে জোর করে ধরে রাখ এবার। আমি তোমাকে আর কখনো হারাতে চাই না কুমার।

রাজকুমার তার পকেট থেকে একটি ছোট ঘাস ফুল বের করে রাজকুমারির ঘন কালো চুলের খোঁপায় গুজে দিয়ে বললেন, এই হোক সাক্ষী আজ তোমার আর আমার প্রেমের আলিঙ্গনের। আমাদের সুতীব্র ভালোবাসার।

দিন যায়, রাত যায়, বড় ভাল জীবন কাটছিল রাজকুমারের আর রাজকুমারির। একদিন হটাত রাজকুমারের অন্তর্ধান হয়। রানী আবারো একা বসে থাকেন ঐ বেলকনির রেলিং ধরে। সন্ধায় চিল কাতুরের ডাকে তার মন ভারি হয়ে আসে। জোনাকির ডাকে তার সব অতিতের কথা মনে হয়। মনে হয় রাজকুমার তার পাশেই হাত ধরে বসে আছেন। কিন্তু না। সব আশা, আহ্লাদ, সব স্মৃতি মলিন করে দিয়ে তার গরভের অনাগত সন্তানের নড়াচড়ায় সম্বিত ফিরে আসে।

আজ নতুন রাজকুমার এসেছে তার জীবনে। হাটি হাটি পা পা করে ছোট রাজকুমার বড় হতে থাকে। একদিন সে কথা বলতে থাকে। ছোট রাজকুমার কে মা রাজকুমারি কতই ই না গল্প শুনিয়ে ঘুম পারিয়ে দেন। কিন্তু রাজকুমারি সব সময় একই গল্প বলতে থাকে……… এক যে ছিল রাজা আর এক যে ছিল রানী। তাদের ছিল এক রাজপুত্তর। রাজপুত্রকে নিয়ে রাজা আর রানী বড় ভালবাসায় জীবন কাতাইতেছিলেন। একদিন হটাত করে রাজা হারিয়ে যান কোন এক গহিন জঙ্গলের ভিতর। রাজপুত্র ধীরে ধীরে বড় হয়। একদিন মাকে জিজ্ঞেস করে, মা আমার বাবা কই? রানী চোখের জল মুছে ছোট রাজপুত্রের কপোলে চুমি খেয়ে বলেন, তোমার বাবা একদিন ঘোড়ায় চরে টকবক করে ঐ গহিন জঙ্গল থেকে আমাদের নিতে আসবেন। তুমি বড় হও। রাজা ফিরে না এলে আমরাই তাঁকে খুজে আনবো। ছোট রাজপুত্র ঐ গহিন জঙ্গলের রহস্য বুজে উঠতে পারেন না। শুধু মাকে জরিয়ে ধরে থাকে আর বলে, মা আমি তোমায় খুব ভালবাসি।

৩১/০৫/২০১৬-যেদিন আকাশের মেঘমালা

Categories

 

যেদিন দেখবেন আকাশের মেঘ মালা আপনার জগতের কাছে শেষ বর্ষণ হয়ে আপনার পায়ের কাছে টাপুর টুপুর করে লাফিয়ে পরছে, যেদিন দেখবেন ঐ পাশের জঙ্গলের ভিতর অবহেলায় কোন এক রজনি গন্ধার সুবাস আপনার নাশারন্দ্রে ভেসে আসছে, যেদিন দেখবেন চারিদিকের মানুষ গুলো আপনাকে দেখে কোন কারন ছারাই আর আপনাকে সেই আগের মত করে দেখছে না কিন্তু মিটি মিটি করে হাসছে আপনার নতুন ভালোবাসার অববয়বে, যেদিন মনে হবে পৃথিবীতে আরও অনেক বছর বাচতে ইচ্ছে করবে, যেদিন মনে হবে পৃথিবীর সব রঙ সুন্দর, যেদিন মনে হবে আপনার হাসতে ভাল লাগে, কাদতে ভাল লাগে, একাকী বসে জানালায় পাখি দেখতে ভাল লাগছে, অথবা যেদিন দেখবেন চোখের জলের মধ্যে অফুরন্ত কষ্টের মাঝেও মন বড় উতালা হয়ে আছে কোন এক অস্পৃশ্য মানুষের জন্য, যেদিন দেখবেন সোনালী রোদ আপনাকে উদ্ভাসিত করে, যেদিন দেখবেন জোড়া শালিক না দেখেও আপনার মনে হবে এই বুঝি আজকে ও আসবে, সেদিন আপনার এই অপেক্ষার পালা শেষ হয়ে দেখবেন মাঘের পরে ঐ দিগন্তে দাড়িয়ে আছেন তিনি যাকে আপনি এতদিন ধরে খুজছেন। আপনার আর কোন কিছুর জন্যই কাউকে কিছুই বলার নাই। শুধু আপনি আর থাকবে বনলতা সেনের মত সেই মানুষটি, বলবেন তখন, ………এতদিন কোথায় ছিলেন? 

বলুন না কোথায় তাঁকে দেখেছেন প্রথমবার?

৩০/০৫/২০১৬-অপেক্ষার অনেক নাম

Categories

অপেক্ষার অনেক নাম। কখনো কষ্ট, কখনো সুখ, কখনো উদাসীনতা আবার কখনো শুধুই ভালবাসা। আজ আপনার এই অপেক্ষার নাম কি সুখ আর ভালবাসা? সার্থক হোক সে মিলন, আর সার্থক হোক আপনার চিত্ত। অহংকারীরা দেখুক আপনার দিবসের মুখদ্ধকর সীমাহীন আনন্দের চ্ছটা আর নিন্দুকেরা জ্বলে পুড়ে মরুক নিজ দাবগাহনে। আপনার ইচ্ছাই আপনাকে নিয়ে যাবে স্বর্গের ঐ নীল জানালায় যেখানে বসে আপনি রাতের কালো আকাশে ধ্রুবতারা দেখবেন আর নিজেকে অস্পৃশ্য কোন এক মানুষের পাশে ঠায় দাড়িয়ে অরুন্ধতী হয়ে কাল পুরুষকে ছারিয়ে সকালের লাল সূর্যের দিগন্ত রেখা ছুয়ে দেবেন। আমার সকল শুভ কামনা রইল আপনার জন্য। আপনার সবার জন্য।

২৯/০৫/২০১৬-এই নীলাকাশ ভেদ করে যেমন

Categories

 

এই নীলাকাশ ভেদ করে যেমন ভগবানকে পাওয়া যায় না, আবার সমুদ্রতল মেথুন করেও কোন দেবদেবির দেখা পাওয়া গেছে এর তেমন কোন হদিসও পাওয়া যায় না। ঠিক তেমনি অন্তরভেদ করে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখলেও এক ফোঁটা ভালোবাসার আলামত পাওয়া যায় না। অথচ কেউ কষ্ট দিলে বুকে ব্যথা লাগে, আনন্দ দিলে অন্তরে সুখের আচ্ছাদন অনুমিত হয়। অনেকদিন ভালোবাসার মানুষকে না দেখলে বুক শুন্য শুন্য মনে হয়। তাহলে এই ভালোবাসার উৎসটা কি বা কোথায়?

“আমি তোমায় ভালবাসি” এর মানে অনেক ব্যাপক। আর এই ব্যাপক অর্থের কারনেই হয়তবা শতবর্ষী যুবকের চোখ অষ্টাদশী বৃদ্ধার জন্য কাদে, কাছে না থাকলে মনে হয় কি যেন নাই তার পাশে। শেষ বিকালে অথবা অষ্টাদশীর চাঁদনী রাতে কিংবা শীতের কোন এক কাকডাকা ভোরে পাশাপাশি বসে এক কাপ চা অথবা গরম গরম কোন ঝাল মিষ্টি টক খাওয়া, অমাবশ্যার রাতে কোন এক শ্মশানের পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার অজনা ভয়ে কুকড়ে থাকা হাত দিয়ে তাকে ধরে রাখার যে ভরসা। এই সবই ভালবাসা। একসময় এই ভালবাসা পরিনত হয় একটা অভ্যাসে। তখন অভ্যাসটাই ভালবাসা।

আজ যে শুধু তোমার মুখ দেখে ভালবাসল, তোমার রূপকে দেখে ভালবাসল, তোমার যৌবনকে দেখে শুধুমাত্র লোভের লালসায় ভালবেসে গেলো, সে আর যাই হোক তার সঙ্গে তোমার ভালোবাসার অভ্যাস হবেনা। কারন ভগবানকে ভালবাসা, একটা গাছকে ভালবাসা অথবা মাকে ভালবাসা আর সেই অপরিচিত মানুষটাকে মনের ভিতরে নিয়ে ভালবাসা এক নয়। তার সঙ্গে জরিয়ে থাকে নিঃশ্বাস, তার সঙ্গে জরিয়ে থাকে ভূতভবিষ্যৎ, তার সঙ্গে জরিয়ে থাকে জীবনের প্রতিটি সুখদুঃখের হাসিকান্নার সবগুলো অধ্যায়। 

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর তোমার অনুপস্থিতিতে যে তোমাকে মনে করে চোখের জল ফেলবে, আজ থেকে আরও শত বছর পর যে তার উত্তরসূরিদের কাছে তোমার নাম স্মরণ করে সেই অতীত জীবনের রোমান্সের কাহিনী শুনাবে, তোমার জীবদ্দশায় অসহায়ত্তের কারনে যে তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে না, যাকে দেখলে মনে হবে, সে তোমাকে নয় তোমার জীবনটাকে ভালবাসে, হোক তুমি পঙ্গু, হও তুমি বিরঙ্গনা অন্তঃসত্ত্বা, হও তুমি বোবা কিংবা বধির, সেটা তার কাছে ভাল না বাসার কোন কৈফিয়ত হতে পারে না। এখানে ভালবাসাটা শুধু শ্রদ্ধার, ভালবাসাটা অন্তরকে বুঝবার আর চারিদিকের হায়েনাদের থেকে ভালোবাসার মানুসটিকে নিরাপদে রাখার আপ্রান চেষ্টা। লম্বাপথ পারি দেওয়ার কোন সঙ্গি নাই তো কি হয়েছে, সে তোমার জন্য অপেক্ষা করবে, নৌকায় আর একজনেরও জায়গা আছে তোমার যাওয়ার জায়গা নাই, তো কি হয়েছে, সে তোমার জন্য নৌকা ছেড়ে পাশে এসে দারাবে, তোমাকে কেউ বিরঙ্গনা করেছে? তো কি হয়েছে? সে তোমার সবকষ্ট ধুয়ে মুছে নিজের ভালবাসা দিয়ে আদর দিয়ে কাছে টেনে নেবে। চিনেছ কি তাঁকে? যদি চিনে থাক, তাহলে নিশ্চিত জেনো, সে তোমাকে ভালবাসে। 

আমরা ভালোবাসার কথা বলি, আমরা স্নেহের কথা বলি, আমরা পারিবারিক বন্ধনের কথা বলি। কখনো কি দেখেছেন, আমাদের কাছ থেকে কে কিভাবে ভালবাসা চায়? আমাদের কাছে থেকে কিভাবে স্নেহ চায়? অথবা কখনো কি খুব কাছ থেকে ভেবেছেন, কেন অনেক আদরে গড়া সোনার সংসার কেন ভেঙ্গে যায়? তার সব গুলো কারন যদি যোগ করেন, দেখবেন, একটাই উত্তর, আমি যেমন ভালবাসা চাই তেমনি সবাই আমার কাছ থেকে ভালবাসা চায়। নিবেন অথচ দিতে জানবো না তাহলে তো একবার পাব আর সেটাও হারিয়ে যাবে ২য় বারের বেলায়। সোনালী, আপনি সুখি হবেন আমার ধারনা। ভাল বাসুন যাকে আপনি ভালবাসেন, ঐ দূর পাহারের প্রতিধ্বনির মত আপনার দেওয়া ভালবাসাও চারিদিকের পাহার থেকে শত গুনে আপনার কাছে বিভিন্ন সুরে, বিভিন্ন রঙে আপনার কাছে ফিরে আসবে।

২৮/০৫/২০১৬-আশ্বিন মাসের ভোরবেলায়

Categories

 

আশ্বিন মাসের ভোরবেলায় অতি ঈষৎ নবিন শীতল বাতাশে নিদ্রোত্থিত দেহে তরুপল্লব যেমন শিহরিত হয়, ভরা গঙ্গার উপর শরত প্রভাতের কাচা সোনা রোদ যেভাবে চাপা ফুলের মত ফুটে উঠে, আজ আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনার দুরন্ত যৌবন জোয়ারের জলের মধ্যে রাজ হাসের মত ভেসে উঠেছে। আপনি এতদিন হয়ত দিনের আলো কিংবা রাত্রির ছায়ায়তা  দেখতে পান নাই, কিন্তু আজিকার এই বর্ষণ আপনার পঞ্জরে পঞ্জরে ঘৃতকুমারি নৌকার মত চারিদিকে ঘুরপাক খেয়ে আপনার চারিগাছি মল অনবদ্য এক প্রেমের সুচনা করেছে। অপেক্ষা করুন সে আসবে, আর সে আপনার জন্যই আসবে। যখন সে আসবে, দেখবেন ঐ দুরের ঘাটে যে ফিঙেটি বাসা বেধেছে সে কোন এক ভোরে উসুখুসু করে জেগে মৎস্যপুচ্ছের ন্যায় তার জোড়াপুচ্ছ দুই চারিবার দ্রুত নাড়াইয়া শিস দিয়া আকাশে উড়িয়া যাইবে। অথবা পাশের বাসায় কোন এক কোকিল উচ্চস্বরে ডাকিয়া কুহু কুহু গানে কলরব করিবে। তখন আপনার এই ইচ্ছা, এই সাধ বৃষ্টিতে ভিজার জন্য আর অপূর্ণ থাকবে না। 

২৭/০৫/২০১৬- বিশ্ব রাজনিতিক এর সাথে

Categories

 

আমার একবার এক বিশ্ব রাজনিতিক এর সাথে খুব কাছ থেকে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। তিনি এই বিশ্ব রাজনীতির সব সমস্যা, সব পলিসি, রাজনৈতিক লীলাখেলার সবগুলুর সঙ্গেই কোন না কোনভাবে জরিত থাকেনই। কোন এক অবসর মুহূর্তে আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তিনি কখনো কষ্টে থাকেন কিনা। আমার এই প্রশ্ন করার কারন ছিল। তার কোন কিছুর অভাব নাই, তার সম্পদের অভাব নাই, তার মানসম্মানের কোন কমতি নাই, তাকে অন্যান্য বিশ্ব রাজনীতিবিদরা কাছে পেলে তাদের নিজের জীবনও ধন্য হয়ে যায় এমন একটা ব্যাপার। তারজন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নামিদামী ডাক্তাররা সবসময় স্ট্যান্ডবাই থাকেন, এমনকি এয়ারফোর্স ওয়ানের মত বিমানও স্ট্যান্ডবাই থাকে। তারজন্য তো কোন কষ্ট থাকার কথা নয়।

তিনি বড্ড রসিকলোক কিন্তু খুব জ্ঞ্যানি লোকও বটে। অনেক্কখন ভেবে চিন্তে এক কাপ কফি নিজের হাতে বানিয়ে আর আরেক কাপ কফি আমার জন্য নিজেই বানিয়ে নিয়ে বললেন-তুমি কি কষ্টে আছো? বললাম, না, ওতটা কষ্টে নাই তবে আজকাল অনেক এই যুগের ছেলেমেয়েদের কথা শুনে মনে হয় তারা অনেক কষ্টে আছে। আপনি তো এই যুগেই এখন বাস করেন, আপনি কোন কারনে কষ্টে আছে কিনা।

একটু মুচকি হেসে বললেন, কয়টা যুদ্ধ দেখেছ জীবনে? আফগানিস্থান দেখেছ, ইরাক দেখেছ, কসভ দেখেছ, কিন্তু কখনো কি নিজের ঘরের পাশে ঐ বস্তির ছেরা কাপড় পড়া এতিম কোন বাচ্চার অথবা পিতামাতার বিচ্ছেদজনিত কারনে কোন শিশুর একাকীত্ব অথবা নিছক পয়সাকরির অভাবে সামাজিক দুর্বল কোন পরিবারে বেড়ে উঠা মানুষদের ভিতরের অনুভুতি দেখেছ? সেটা কোনো যুদ্ধের থেকে কম নয়।

আজ থেকে বহু বছর আগে আমি এই এমন একটা পরিস্থিতিতে তিলে তিলে বড় হয়েছি। কখনো মনে হয়েছে আমার কেউ নাই, কখনো মনে হয়েছে যারা আছে তারা আমাকে কিছুই বুঝে না। একবেলা খাবারের জন্য আমাকে যেমন নিজে উপার্জন করতে হয়েছে কখনো মুটে হয়ে, আবার কখনো পাশের বাড়ীর কোন ফরমায়েশ খেটে। আবার জীবনে বড় হতে হবে এই আখাংখায় আমি স্কুলেও অনুপস্থিত না থাকার চেষ্টা করেছি প্রতিনিয়ত। আমি যাদের সঙ্গে স্কুলে যেতাম, আমি তাদের সৌখিন কাপড় চোপর পড়া দেখে নিজেকে কখনো মনে হয়েছে, আমার এই জন্মের জন্য তো আমি দায়ি নই, অথবা আমার এই দৈন্যের জন্য তো আমি দায়ি নই। আমিও তো হতে পারতাম তাদের কোন এক ধনাঢ্য পিতার একমাত্র সন্তান। কিন্তু না, আমি কোন ধনাড্য বাবার সন্তান ও নই, আবার আমার কোন ধনি আত্মীয়ও নাই। আমাকে দেশ ছারতে হয়েছে কপাল ফেরানোর আশায়। আমি পরভূমে বড় হয়েছি অনেকের ছত্রছায়ায়। এমন কি আমি আমার ধর্মটাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে কোন এক উচু ধাপের সিরিতে উঠার আশায়।

প্রেম কি জিনিস, একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ের যে প্রেমের অনমদনা তা যে আমার ছিল না তা নয় কিন্তু আমার সেই সাধ্য করার মত পরিস্থিতিও ছিল না। মনে হয়েছে সত্যি কষ্টে আছি।

আজ আমার সব হয়েছে। কোন কিছুর কমতি নেই আমার। আমি যা চাই না, তাও আমি পাই। এর থেকে বেশি কেউ পায় তা আমার জানা নাই। কিন্তু হ্যা, এই যে বললে, আমি কখনো কষ্টে থাকি কিনা? আমি যখন কোন এক পল্লিগ্রামে যাই, আমি যখন কোন এক এতিমখানার বস্তিতে যাই, আমি যখন কোন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় যাই, আমার তখন ঐ যে ফেলে আসা আমার অতীত জীবনের যে কষ্ট, যে অনুভুতি আমার এই সারা জীবনের স্মৃতির মধ্যে জমা হয়ে আছে, তারা আবার উঁকি দেয়, আমি তখন সত্য সত্যি কষ্টে থাকি। কিন্তু এ অনুভুতি আমার প্রকাশের কোন ভাষা নাই শুধু কিছু সাহায্যের হাত বারিয়ে দেয়া ছাড়া।

তোমরা এখন কষ্টে থাক এই কারনে যে, হয়ত কোন এক ছেলে কোন এক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, হয়ত কষ্টে থাক পিতামাতার অনুশাসনের কারনে, হয়ত তোমরা কষ্টে আছো পরিশ্রম করতে না চাওয়ার ইচ্ছায় অথচ কোন পরিশ্রমের কষ্টের কারনে, হয়তবা কষ্টে আছো তোমরা বেশি ইমোশনাল ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছ না বলে। তোমরা অভিমানি, তোমরা অভিমান করতে পার তাই কষ্টে আছো। স্বাধীনতা কি হয়ত তোমরা জানো না বলে আমি স্বাধীন নই এই মনে করে কষ্টে আছো। একটা গান তোমাদের কষ্টকে বারিয়ে দিতে পারে, একটা মুভি তোমাদের মনকে কয়েকদিন আবেগের বশে কষ্টে রাখতে পারে, একটা পরীক্ষার খারাপ ফলাফল তোমাদের মনকে কষ্টে রাখতে পারে। তোমার ছোটভাই কিংবা বোনের সাথে তোমার বনিবনা হচ্ছে ভেবেও তোমরা আজ অনেক কষ্টে আছো বলে মনে হতে পারে। এগুলু আসলে কোন কষ্টই না। তোমরা অবাধ স্বাধীনতার নামে নিজেদের সতীত্বকে অকালে বিসর্জন দিয়ে কষ্টে থাক, তোমরা সময়ের কাজ না করার কারনে তোমাদের পিতামাতারা তোমাদেরকে একঘরে করে রাখছে বলে কষ্টে আছো। তুমি অঢেল পয়সা খরচ করতে পারছ না বলে হয়ত কষ্টে আছো। তোমার পাশের বন্ধুর দামী জামা দেখে তোমার মন খারাপ হয় বলে তোমরা কষ্টে আছো। কখনো মেঘলা আকাশ দেখলে কষ্টে থাক, আবার ভরা পূর্ণিমায়ও তোমরা কষ্টে থাক। বন্ধুদের সঙ্গ না পেলে কষ্টে থাক আবার বন্ধুদের সঙ্গ পেলেও কষ্টে থাক। কাউকে ভালবেসে কষ্টে থাক আবার ভালবাসা না পেলেও কষ্টে থাক। কোন কিছুতেই তোমরা সুখি নও। সব কিছুতেই তোমরা কষ্টে আছো। কষ্টে আছো এতা বলতেই যেন তোমরা ভাল মনে করো। 

কিন্তু কখনো কি একবারও ভেবেছ যে, কি করা উচিৎ ছিল আর কি করা হচ্ছে? তাহলে এই কষ্টে থাকার জন্য তো তুমি অন্য কাউকেই দায়ি করতে পার না। তোমার এই কষ্ট একটা আধুনিক কালের হতাশা ছাড়া আর কিছুই না। অথচ জীবনে কষ্ট লাঘব করার জন্য তুমি কিছুই করছ না।

তোমার এই কষ্টের জন্য আমি একটুও অনুশোচনা করি না। শুধু আমার কষ্ট হয় তোমরা তোমাদের কষ্টের লাঘবের কোন প্রতিশ্রুতির কথা বল না বলে। আমি অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকলাম তার এই ভাবনার জন্য। কত উচুতে বসে তিনি কত নিচু স্তরের ভাবনার কথা গুলো বলছেন।

আমার আর কিছুই বলার ছিল না।

২৬/০৫/২০১৬-নাম না জানা মানুষ

Categories

 

আমি আপনার ভাল নাম জানি না। জানলেও যে খুব একটা লাভ হবে বা আমার চিন্তার মধ্যে কোন পরিবর্তন আসবে তাও না। আপনার নাম সোনালী না হয়ে রুপালী হলেও যা, পিংকি, সিন্থিয়া, কিংবা সাথী অথবা কবিতা হলেও তা। যাই হোক না কেন, আমি এখন আপনাকে ঐ সোনালীর আদবে একজন অপূর্ব সুন্দর,  বা সুন্দরী (যদি মেয়ে হয়ে থাকেন) লক্ষি, আর ভক্তের ন্যায়ই দেখব। আপনার সাথে আমার মনের মিল আছে কিনা আমি জানতেও চাইব না, আপনার কি রঙ পছন্দ, কি গান আপনি পছন্দ করেন কিংবা কিসে আপনার কষ্ট হয়, অথবা কিসে আপনার কস্ট লাঘব হয় তার কোন দায়দায়িত্বও আমি নিতে চাইব না। কারন আমি প্রকাশ্য কোন মানবের কাছে প্রকাশ্য হতে চাই না। তবে যেটুকু আমার কাছে মনে হয়েছে আপনি রবিঠাকুর এর লেখা পছন্দ করেন, আপনি বনলতাকে ভালবাসেন, আপনি সোনালী রোদ ভালবাসেন। গ্রীষ্মের উষ্ণতা আপনি ভালবাসেন কিনা আমি জানি না, শ্রাবনের ধারা আপনাকে শিহরিত করে কিনা আমি জানি না, অথবা গ্রামের সেই বুড়িমার আচল ধরে পায়ে পায়ে হেটে নদীর ধারে গোসলের আগে কচিকচি পাতা তুলে মিথ্যে মালা গাথতে পছন্দ করেন কিনা আমি জানি না। তবে যে অপূর্ব নামে ছেলেটির মৃন্ময়ীর ভালবাসায় আপ্লূত হয়ে মন্তব্য করতে পারে, যে নাটোরের বনলতাকে বরন করে নিজেকে বনলতার মত গুনগুন করে গান গাইতে পারে, সে আর যাই হোক শ্রাবন নিশ্চয় তার প্রিয় ঋতুর মধ্যে একটা, অথবা বসন্তের বিকালে পায়ে পায়ে না হোক, ছলছল নেত্রে বুড়িমাকে দেখতে যাওয়ার ছলে অস্পৃশ্য কিছুর দেখা হোক তা নিশ্চয় মন থেকে ফেলে দেওয়া যায় না।

অস্পৃশ্য কোন কিছুর দিকে কখনো হাত বারাবেন না। ঐ অস্পৃশ্য জিনিসে যে একবার হাত বাড়িয়েছে, তার নির্ঘাত হয় মৃত্যু হয়েছে প্রেমের দিশানলে, না হয় সে দেবদাসের পার্বতীর মত বাস করেছে রানী হয়ে কিন্তু মন পরে ছিল ঐ কৃষ্ণকুন্ড গ্রামের দেবদাসের ঘরে। আর যদি তার থেকেও আপনি এককাঠি শক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি নিস্চিত থাকুন, আপনার যোগ্য কোন প্রেমিক বা পেমিকা এখনো এই পৃথিবীতে জন্ম নেয় নাই। আপনাকে ঐ অস্পৃশ্য মানুষের আত্তাকে নিয়েই চিরকুমার বা চিরকুমারি হয়ে থাকতে হবে।

ভয় আপনার রয়েই গেলো। ভয় কি আসলেই রয়ে গেলো? ক্ষমা করে দিবেন যদি আমার এই লেখা আপনার চরিত্রের সাথে মিলে গিয়ে থাকে, আর মাফ করে দিবেন যদি আমার এই অনুভুতি আপনার চরিত্রের কথাও না মিল খায়। সবটাই কল্পনা। আর কল্পনার রাজ্য থেকে কারো কোনদিন ফাসি হয়েছে এই তথ্য কোন আদালতে প্রমান পাওয়া যায় নাই।

২৫/০৫/২০১৬- একটা কোয়ালিটি পূর্ণ সময়

Categories