০৫/১১/২০২৩-আমার প্রিম্যাচিউরড রিটায়ারমেন্ট

অনেকদিন পর আবারো আমার সেই পুরানো আর্মির কথা মনে পড়লো। যেনো ব্যাপারটা মাত্র সেদিনের ঘটনা। কিন্তু ঘটয়ান মাত্র সেদিনের নয়। ২০ বছর আগের সেই কথা।

প্রায় ২০ বছর সেনাবাহিনীতে চাকুরী করার পর যেদিন সেনাবাহিনী থেকে প্রিম্যাচিউড় বা অকালীন অবসর নিয়ে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে আসি, সেদিন কেউ আমাকে দেখুক বা না দেখুক, কেউ আমার ভিতরের কষ্টটা বুঝুক বা না বুঝুক, আমি বুঝেছিলাম কতটা বেদনা ভর্তি ছিলো আমার মনের ভিতরে। একনাগাড়ে যে ইউনিফর্মটা আমি সকালে উঠেই পড়তে খুব গর্ববোধ করতাম, যে অফিসটায় আমি বসে কত ধরনের মিলিটারী প্ল্যান, কাজকর্ম, কুশল বিনিময় করতাম, সেই ইউনিফর্মটা আমি নিজের ইচ্ছায় খুলে ফেলছি আজ। আমার আর কখনোই সেই অফিসে গিয়ে আমার চেয়ারটায় বসা হবে না। সেই কর্মস্থলটা আর আমার না। আমি এখন শুধু একজন রিটায়ার্ড সামরীক অফিসার। অথচ আমার আরো গোটা ১০/১২ বছর কাজ করার মতো সময় হাতে ছিলো।

নিজেকে অনেক প্রশ্ন করেছিলাম, আমার কি কোনো অন্যায় ছিলো? বা আমার কোনো গাফলতি? কিংবা আমি কি এমন কেউ যাকে আর এই সামরীক বাহিনির কোনো কাজে লাগবে না? আমি যতোগুলি মিলিটারি কোর্ষ একটা তুখুর আর্মি অফিসারের করা দরকার সবগুলি খুব ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছিলাম। যেসব কোর্ষগুলি কমপিটিটিভ অর্থাৎ পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ন হয়ে করার যোগ্যতা লাগে, যেমন আর্মি ষ্টাফ কলেজ, আর্মি গানারি ষ্টাফ কোর্ষ ইত্যাদি সেসব কোর্ষগুলিও আমার করা ছিলো। এসব কোর্ষের জন্য অফিসাররা আপ্রান চেষ্টা করে যেখানে সফল হয় না, আমি সেসব কোর্ষগুলিও করেছিলাম। যদি বলি নিয়োগের বেলায়? তাতেও তো আমার কোনো কমতি ছিলো না। আর্টিলারি অফিসার হয়েও আমি পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল স্টাফ অফিসার (অপারেশন) যাকে জিএসও-২ (অপ্স) বলা হয়, সেটার দায়িত্বও আমি খুব সফল্ভাবে পালন করেছি। শুধু তাইই নয়, আমি খোদ আর্মি হেডকোয়ার্টারেও জেনারেল ষ্টাফ অফিসার-২ (ট্রেনিং) হিসাবে কাজ করে অনেকগুলি আন্তর্জাতীকমানের ইভেন্ট সফল্ভাবে সম্পন্ন করেছিলাম। মাইনর ইউনিটের দায়িত্ব পালন করেছি, মেজর ইউনিটের উপঅধিনায়কের কাজ করেছি। কিন্তু সেগুলির কোন মুল্যায়ন আমার হয়নি। জাতীসংঘ মিশন করেছিলাম পরপর দুটু। একটি হাইতিতে এবং অন্যটি জর্জিয়া মিশনে। এসব মিশনে কাজ করার সময় লেটার অফ এপ্রিশিয়েশনেও ভুষিত হয়েছি স্বয়ং ফোর্স কমান্ডারদের কিংবা এসআরএসজি (স্পেশাল রিপ্রেজেন্টেটিভ অফ সেক্রেটারী জেনারেল) কাছ থেকে।

কোনো কিছুতেই আমার কোনো কমতি ছিল না। আর্মিতে থাকতেই আমি মাস্টার্স অফ সায়েন্স (এমএসসি), মাষ্টার্স অফ বিজনেজ এডমিনিষ্ট্রেশন (এমবিএ), এবং মাষ্টার্স অফ ডিফেন্স স্টাডিস (এমডিএস) করেছি। অর্থাৎ সেনাবাহিনীতে থাকতেই আমি তিনটা মাষ্টার্স সম্পন্ন করেছি। জেনারেল অফিসার কমান্ডিং অর্থাৎ জিওসি এর কাছ থেকে আমি আউটস্ট্যন্ডিং এনুয়াল কনফেডেন্সিয়াল রিপোর্টও (এসিআর) পেয়েছি। এতো সব উপাধী, এতো সব শিক্ষা, এতো সব আউট স্ট্যান্ডিং পারফর্মেন্স ২০০৩/২০০৪ সালে আমার প্রোমোশনের সময় কোনো কাজেই লাগলো না? অবাক হয়েছিলাম। আমার কাছের যে সব সিনিয়ার অফিসারগন আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, যারা আমাকে চিনেন, তারাও আমার উপর এমন আচরনে হতাশ হয়েছিলেন। আমার জুনিয়ার অফিসাররা যারা আমাকে মডেল মনে করে আমার মত হতে চাইতো, তারাও এক প্রকার হতাশই হয়েছিলো। ইউনিটের সৈনিকগনের মধ্যে কেমন যেনো একটা বিষন্নভাব আমি দেখতে পেয়েছিলাম। তারাও আমার প্রোমোশন না হওয়াতে অনেক হতাশ ছিলো। কিন্তু এসবের কোনো মুল্যায়ন কিংবা যোগ্যতার জন্য আমার এসব কোন কিছুই যথেষ্ঠ ছিল না। পরবর্তীতে যেটা বুঝেছিলাম সেটা হলো, আমার দরকার ছিল একটা পলিটিক্যাল লিংকআপ যা আমি কখনোই তৈরী করার চেষ্টা করিনি। সেনাবাহিনির চাকুরিটা হচ্ছে একটা ভিন্ন প্রকৃতির জব। আমি সব সময় মনে প্রানে বিশ্বাস করেছি, এখানে শুধু আনুগত্য থাকবে আমার দেশের প্রতি, জনগনের প্রতি, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি থাকার কথা নয়। অথচ সেটাই কাল হয়ে দাড়িয়েছিল আমার জন্য।

এখানে আরো একটি অলিখিত ফ্যাক্টর আমাদের ১৩ বিএমএ লং কোর্ষের জন্য সামষ্টিক সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছিল। আর সে হচ্ছে আমার কোর্ষমেট মেজর (বর্তমানে লেঃ জেনারেল) ওয়াকার। শেখ ওয়াকারুজ্জামান। ওয়াকার বংশগতভাবেই শেখ বংশের মানুষ, তার উপরে সে বিয়ে করেছিল তদানিন্তন আর্মির চীফ জেনারেল মুস্তাফিজের মেয়েকে। জেনারেল মুস্তাফিজ ছিলেন আওয়ামিলিগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার আপন ফুফা। ওয়াকার একদিকে শেখ বংশের লোক, অন্যদিকে শেখ হাসিনার আপন ফুফাতো বোনের স্বামী। একটা কোর্ষের মধ্যে আওয়ামিলিগের বংশোদ্ভত এমন একজন অফিসার থাকা মানে বিরোধী দলের রাজনীতিকরা তো পুরু কোর্ষকে আওয়ামিলিগ ব্রান্ড করতেই পারে। যদিও ঢালাওভাবে এমন ধারনা পোষন করা কোনো পলিটিক্যাল পার্টিররই থাকা উচিত না। কিন্তু তারপরেও সেটাই হয়ে উঠেছিল আমাদের জন্য একটা অভিশাপ। আমরা কেউ রাজনিতি করি বা না করি, যেহেতু ওয়াকার আওয়ামিলীগের ঘরানার, ফলে আমাদের পুরুকোর্ষ যেনো হয়ে উঠেছিল আওয়ামিলীগের কোর্ষ। এ সময়ে দেশের সরকার হচ্ছে বিএনপি। ফলে ১৩ বিএমএ লং কোর্ষের বেশিরভাগ পোটেনশিয়াল অফিসারগনই পরবর্তী পদে উন্নীত হলেন না। আমিও না।

আমার বেলায় ব্যাপারটা আওয়ামি ঘরানার বাইরেও আরেকটা ব্যাপার ছিলো। তাহলে ব্যাপারটা বলি।

আর্মি স্টাফ কোর্ষের ফলাফলের নিয়ম হলো-যিনি প্রথম হন, তাকে আমেরিকায়, যিনি দ্বিতীয় হন তাকে মালয়েশিয়া আর যিনি তৃতীয় হন তাকে লন্ডনে সেকেন্ড স্টাফ কোর্ষে পাঠানো হয়। সবগুলিই গ্রাটিস কোর্ষ অর্থাৎ এক্সচেঞ্জেবল কোর্ষ। আমাদের অফিসার যাবে সে দেশে, সেই দেশের অফিসাররাও আমাদের দেশে আসবেন। খরচ আদান প্রদান। ওয়াকার আর্মি ষ্টাফ কোর্ষে হয়েছিলো তৃতীয়। কিন্তু দূর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, সম্ভবত ঠিক এই সময়ে লন্ডনের সাথে আমাদের গ্রাটিস কোর্ষের আইনটা আর বহাল ছিল না। ফলে ওয়াকার লন্ডনে দ্বিতীয় ষ্টাফ কোর্ষ করতে যায় সম্পুর্ন বাংলাদেশ সরকারের ফান্ডে। এ সময় আর্মির চীফ ছিলেন জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান যিনি ওয়াকারের শশুর আর ক্ষমতায় ছিলো আওয়ামিলিগ। রাজনীতির পট পরিবর্তনের কারনে যখন বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং আর্মির চীফ হিসাবে মুস্তাফিজ সাহেবের পরিবর্তে জেনারেল হাসান মাসউদ স্থলাভিষিক্ত হন, তখন বাংলাদেশ আর্মি থেকে ওয়াকারের জন্য আর ফান্ড পাঠাচ্ছিল না। এটা বেসিক্যালী পলিটিক্যাল রিভেঞ্জের মতো। আমি তখন আর্মি হেডকোয়ার্টারে ট্রেনিং ডাইরেক্টরীতে কাজ করি। ব্যাপারটা আমি হ্যান্ডেল করছিলাম না। ওটা ফরেন কোর্ষের অধীনে মেজর শাহরিয়ার এবং মেজর তামিম দেখভাল করেন। আমাদের ডিএমটি (ডাইরেক্টর অফ মিলিটারী ট্রেনিং) ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুবীন (পরবর্তিতে তিনি আর্মির চীফ হন)। আমি মুবীন স্যারকে বললাম, ওয়াকারের এহেনো দূর্যগপুর্ন সময়ে লন্ডনে টাকা না পাঠালে ওয়াকার কোর্ষ শেষ করবে কিভাবে? এদিকে জিএসও-২ গনও চীফের নেগেটিভ মনোভাবের জন্য ওয়াকারের ফেভারে কোনো মিনিটস শিট লিখতে ভয় পাচ্ছেন। আমি মুবীন স্যারকে রিকুয়েস্ট করলাম, যেনো আমাকে ফরেন ট্রেনিং উইং এ পোস্টিং করেন। আমি সেখানে পোষ্টিং পেয়েই ওয়াকারকে টাকা পাঠানোর নিমিত্তে একটা মিনিটস শীট রেডি করি। অনেকবার চীফের অফিসে এ ব্যাপারে আমাকে তলব করা হয়েছিল যাতে আমি এ ব্যাপারে পজিটিভ কোনো সাযেশন না দেই। কিন্তু আমি সেটা করিনি। কোন রকমভাবে শেষপর্যন্ত ওয়াকার লন্ডনে কোর্ষ শেষ করে এসেছিল। কিন্তু ঢাকায় এসে ওয়াকার এতোটাই সমস্যায় পড়লো যে, ওর আর্মিতে টীকে থাকাই ওর জন্য দায়। আর্মি হেড কোয়ার্টারেও ওর প্রবেশ যেনো প্রায় নিষিদ্ধ ঘোষনার মত। ওয়াকারের পোস্টিং তখন কুমিল্লায়। যে কোনো কারনেই হোক, ওয়াকার ঢাকায় আর্মি হেডকোয়ার্টারে আসতে চেয়েছে বা এসেছে। আর্মি হেডকোয়ার্টারে ঢোকতে “পাশ” দিতে হয়। ওয়াকার আমাকে ওর জন্য একতা “পাশ” চাইলো। আমি ওয়াকারকে “পাশ” পাঠিয়ে দিলাম। ওয়াকার আমার রুমে এলো। তার ঠিক কিছুক্ষন পর ডাইরেক্টর অফ মিলিটারী ইন্টিলিজেন্স (ডিএমআই) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ স্যার ইন্টারকমে আমাকে জানালেন, আমি কেনো ওয়াকারকে “পাশ” পাঠিয়ে আর্মি হেডকোয়ারর্টারে আসার অনুমতি দিলাম? ওয়াকার তখনো আমার রুমেই বসা। ওয়াকারকে আমি আমার রুমে বসিয়েই রেখে চলে গেলাম ডিএমআই এর অফিসে। গিয়ে আমি বললাম, স্যার, ওয়াকার কি পিএনজি? অর্থাৎ পার্সন্স নন গ্রাটা? বা নিষিদ্ধ? যদি ওকে পিএনজি ঘোষনা না করা হয়, তাহলে আমার “পাশ” দিতে আপত্তি কি? আর সেতো এখনো সার্ভিং আর্মিতে? আর সবচেয়ে বড় কথা, ওয়াকার আমার ব্যাচমেট, আমার কোর্ষমেট, সেতো অন্তত আমার অফিসে আমার সাথে দেখা করতে আসতেই পারে!! ব্রিগেডিয়ার মাহমুদ স্যার খুব ভাল মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, দেখো আখতার, আমার তো কোনো সমস্যা নাই কিন্তু চীফের কানে গিয়েছে যে, ওয়াকার আর্মি হেডকোয়ার্টারে এসছে। তাকে আসতে দেয়া যাবে না আর। কোন কারন নাই, বারন নাই, অথচ এমন একটা অলিখিত আইনের মধ্যে ওয়াকারকে ফেলে দিলো গেরাকলে। আমি মাহমুদ স্যারের অফিস থেকে ফিরে এলাম। তখন প্রায় ছুটি (বেলা আড়াইটা) হয় হয় ভাব। আমি ওয়াকারকে নিয়ে আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে গেলাম। রাস্তায় যেতে যেতে শুধু আমি ওয়াকারকে একটা কথাই বলেছিলাম, “ওয়াকার, যত চাপই আসুক, চাকুরি থেকে নিজের ইচ্ছায় চলে যাবি না। ওরা চায় তুই চলে যা। এটা যেনো না হয়।“ ওয়াকার সবকিছুই বুঝতেছিল। আমাদের কোর্ষে ওয়াকারের মত এতো ভাল, ধার্মিক, সৎ এবং নীতিবান অফিসার খুব কম আছে। ওয়াকার সত্যিই একজন ভাল মানুষ এবং ভাল ছেলে। আমি ওয়াকারকে আর্মিতে আসার আগেই চিনতাম। সেটা আরেক ইতিহাস।

ভাগ্য যখন খারাপ থাকে, তখন অনেক কিছুই আর কাজে লাগে না। একদিকে আমাদের ১৩ বিএমএ লং কোর্ষ আওয়ামিলিগ ঘরানার হিসাবে গন্য, অন্যদিকে আমার ব্যাপারটা তখনো চীফ মাসউদ হাসানের মাথায় জ্যান্ত, সব মিলিয়ে খুব ভাল পজিটিভ সাইডে আমার ফাইল ফাইট করতে পারেনি। প্রথমবার সুপারসিডেড হয়ে গেলাম।

আমাকে পোষ্টিং করা হলো খোলাহাটি ৪ ফিল্ড রেজিমেন্টে। লেঃ কর্নেল ফেরদৌস আমার অধিনায়ক, আমি উপঅধিনায়ক। মিশন থেকে ফিরেছি বটে, কিন্তু খোলাহাটি আমার কাছে খুব বিরক্ত লাগছিল। তবে সুখের খরর ছিল যে, আমাদের ইউনিট খুব শীঘ্রই মীরপুর ট্রান্সফার হবে। আমার কেনো প্রোমোশন হলো না এটা আমি আমার তদানিন্তত রংপুরের জিওসি জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দারকে প্রশ্ন করেছিলাম। উনি খুব ডেশিং টাইপের মানুষ। আমার ইন্টারভিউতে জেনারেল শুধু একটা কথা জানালেন যে, আমার পক্ষে আমারই জাতি ভাইয়েরা বিশেষ করে আর্টিলারি জেনারেলরা খুব একটা সোচ্চার হয়নি। তার মধ্যে ছিলেন জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার (যিনি এখন অস্ত্র মামলায় ফাসির আসামি), জেনারেল মোহাম্মাদ আলি, জেনারেল সিকদার, জেনারেল আমিনুল করিম ইত্যাদি।

প্রথমবার প্রোমোশন না হওয়াতে আমি একটা জিনিষ বুঝে গিয়েছিলাম যে, খুব শিঘ্রই আমাকে এই আর্মির ট্র্যাক থেকে অন্য আরেকটা ট্র্যাকে পরিবর্তন করতে হতে পারে। আমার প্রিপারেশন নেয়া অতীব জরুরী।

মীরপুরে চলে এলাম। সুপারসিডেদ হলেও এখানকার ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোশাররফ আমাকে উপ অধিনায়কের মতো দেখেন না। সব সি অ দের জন্য যেখানে চেয়ার পাতা হয়, কমান্ডার আমার জন্যেও সেখানে চেয়ার রাখেন। আমি ব্রিগেডের প্রুচুর ডিভিশনাল লেবেল যেমন, ষ্টাডি পিরিয়ড, আম্পায়ারগিরি, ইন্টারন্যাশনাল ইভেন্টের সহযোগি ইত্যাদি রাখেন। লেঃ কর্নেল ফেরদৌসও আমাকে খুব একটা ঝামেলা করেন না। ভদ্র মানুষ।

সময় ঘুরে গেলো, আবারো প্রোমোশন বোর্ড। এবারেও আমার প্রোমোশনটা হলো না। উপরন্ত লেঃ কর্নেল ফেরদৌসকে অধিনায়ক থেকে পোষ্টিং দিয়ে আমার জুনিয়ার ১৪ লং কোর্ষের মেজর মজিদকে প্রোমোশন দিয়ে আমার অধিনায়ক বানিয়ে দিলেন। একদিকে আমি সুপারসিডেড অন্যদিকে জুনিয়ারের অধীনে উপঅধিনায়ক। বুঝতেই পারছেন, মনের ভিতরের অবস্থাটা কি। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। কিন্তু একটা কারনে সহ্য করতে হচ্ছিলো। আর সেটা হলো, আমার চাকুরীর বয়স যদি ন্যুনতম ১৮ না হয়, তাহলে সরকারী প্লট পাবো না। এতো কাছে এসে আমি আমার অন্তত এই সুযোগটা হারাতে চাই না।

মজিদ আমাকে অসম্মান করেনা কিন্তু যা হবার তো হয়েই গেছে। (চলবে……)

আর্মির কোর্ষ রিপোর্ট এবং স্কুল কলেজের সার্টিফিকেট

আর্মির কোর্ষ রিপোর্ট এবং স্কুল কলেজের সার্টিফিকেট

 

একটা সময় ছিলো যখন একেকটা কোর্ষ রিপোর্ট, কিংবা গ্রেড রিপোর্ট পাওয়ার জন্য রাতের পর রাত, দিনের পর দিন খেটেছি। সেই ছোট বেলায় অনেকেই হয়তো আমাকে 'আমার জীবনের উদ্দেশ্য' কি এই প্যারাগ্রাফ কিংবা রচনা লিখতে বলতো। আজ এতো বছর পর, হাতের কাছে কতো সার্টিফিকেট, কত কোর্ষ রিপোর্ট, কিন্তু এখন আর আমাকে কেউ আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি সেটা নিয়ে আর কোনো রচনা লিখতে বলে না। এর মানে হলো, আমার এসব সার্টিফিকেটের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এগুলি দিয়ে আমার আর কোনো কাজ হবে না। এটাই জীবনের মজা বা পরাজয় যেটাই বলি। 

 

০২/১২/১৯৯৫- অস্ত্র ক্রয়

শেষ পর্যন্ত আমার আগ্নেয়াস্ত্র টা মনে হয় কেনাই হলো। বেরেটা পিস্তল। খুব সুন্দর। হাতের তালুতেই রাখা যায়। বব নামের একটি দোকান থেকে কিনতে গেলাম। কেনার আগে অনেকগুলি অস্ত্র দেখালো আমাকে। দোকানদারকে আগেই সমস্ত কাগজপত্র ফ্যাক্স করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ভাইয়া। ফলে এই দুইদিন দোকানদার সমস্ত কাগজ ভেরিফাই করে আজকে আমি যেটা কিনতে চাই সেতা কিনতে পারবো বলে দোকানে গিয়েছিলাম। দোকানীদের ছোট একটা এসি করা ফায়ারিং রেঞ্জ আছে। ওখানে টেষ্ট ফায়ার করা যায়। তবে সর্বোচ্চ ৫ রাউন্ড পর্জন্ত ফায়ার করতে পারবেন। আমি টেষ্ট করলাম। মাত্র ২০০ ডলার। খুবই সস্তা। বাংলাদেশ থেকে আমি যে আগ্নেয়াস্ত্রলাইসেন্স পেয়েছিলাম, সেটা করমুক্ত লাইসেন্স। ফলে আমাকে কোনো কর দিতে হবে না। যদি কর দিতে হতো, তাহলে আমাকে ৩৫০% ট্যাক্স দিয়ে এই অস্ত্র কিনতে হতো। তখন এর দাম পড়তো (২০০+ ৭০০)= ৯৫০ ডলার। কিন্তু আমার পড়ছে মোট ২০০ ডলার।

দোকানদার এই মর্মে জানালেন যে, আমি এখনই এই অস্ত্র সাথে করে নিয়ে যেতে পারবো না। ওনারা উক্ত অস্ত্র বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবেন, আমাকে বাংলাদেশ থেকে রিসিভ করতে হবে। কিছুই করার নাই কারন আমেরিকায় আমাই অস্ত্র সহ ঘুড়তে পারবো না, সেই অনুমতি আমার নাই। আবার আমি আমেরিকা থেকে হাইতিতেও অস্ত্র বিশেষ করে ব্যক্তিগত অস্ত্র নিয়ে যেতে পারবো না, হাইতির আইনেও আমি অনুমতি প্রাপ্ত নই। ফলে কবে নাগাদ দোকানদার এই অস্ত্র বাংলাদেশে পাঠাবে, সেই তারিখতা আমাকে বলে দিতে হবে যাতে বাংলাদেশে পৌছার পরেই যেনো বেশি দেরী না করে আমি এয়ারপোর্ট থেকে অস্ত্রটি তুলে নিতে পারি।

আমি তাতক্ষনিকভাবে কোনো নির্দিষ্ট তারিখ বলতে পারলাম না। তবে ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে কনফার্ম তারিখ বলতে পারবো এতা জানালাম। দোকানদার তাতেই মন্তব্য লিখে আমাদেরকে একটা চালান কপি দিয়ে দিলেন।

খুব ভালো লাগছে যে, অনেকদিনের আমার একটা শখের জিনিষ কেনা হলো। এতা দিয়ে আসলেই আমার কোনো উপকার হবে কিনা আমি জানি না কিন্তু শখ বলে কথা। মাসুদ সাথে গিয়েছিলো। ওর হাজার রকমের প্রশ্ন। ও নিজে একটা কিনতে পারবে কিনা, কিনলে কিভাবে এতা চালাইতে হয়। ইত্যাদি।

----------------------------------------------

৩০/১১/১৯৯৫-পিস্তল কেনার প্রস্তুতি

হাইতিতে আসার সময়  বাংলাদেশ থেকে আমি একতা অনুমতি নিয়ে এসেছিলাম যে, যদি আমেরিকায় যাওয়া হয়, তাহলে ওখান থেকে একতা পিস্তল কিনবো। ভাইয়াকে গত সপ্তাহে জানালাম আমেরিকা থেকে পিস্তল কেনা যায় কিভাবে। ভাইয়া কোথায় কোথায় কি কি জানি ফোন করে করে আমাকে জানালেন যে, কেনা যাবে তবে বেশ কিছু কাগজপত্র লাগবে। তাঁর মধ্যে দুটো কাগজ আমার কাছে নাই আর বাকী সবগুলিই আছে। দুটূ কাগজের মধ্যে একটা হচ্ছে আমেরিকার দুতাবাস থেকে ছাড়পত্র এবং আমি যেখানে কাজ করছি (অর্থাৎ হাইতি, সেখানকার কন্টিনজেন্ট কমাডারের অনুমতি পত্র)।

আমি হাইতি থেকে আসার পথে কন্টিনজেন্ট কমান্ডারের কাছে এই ব্যাপারে এপ্লাই করে এসেছিলাম, ফলে ফ্যাক্সের মাধ্যমে চাইলেই সেটা পাওয়া যাবে। কিন্তু আমেরিকার দুতাবাস থেকে ছাড়পত্র কিভাবে নেবো? ভাইয়া, আমেরিকায় বাংলাদেশ দুতাবাসে ফোন করলেন। বাংলাদেশ এম্বেসী অফিসের ডি এ (ডিফেন্স এটাশে) হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুনসুর আহমেদ। এক সময় আমাদের ৯ আর্টিলারী ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন। আমার সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় আছে। ভাইয়া নিজেই কথা বললেন দুতাবাসের সাথে, হাবিলদার আছে একজন, সে ভাইয়ার ফ্যাক্স নাম্বারে ছাড়পত্র আগামী দু একদিনের মধ্যেই পাঠিয়ে দেবেন এবং সাথে সাথেই হার্ড কপিও ডি এইচ এল এর মাধ্যমে আমাদেরকে পাঠিয়ে দেবেন বলে নিশ্চিত করলেন। ফলে আমার অস্ত্র কেনায় আর কোনো ঝামেলা রইলো না। এবার খুজে বের করতে হবে কোথায় অস্ত্র বিক্রি করে। এতাও ভাইয়াই খুব আগ্রহের সাথে এখানে সেখানে যোগাযোগ করছেন। আমার কিছুই করতে হচ্ছে না।