০২/০৯/২০২০-শেফালীর জামাইর ইন্তেকাল

প্রায় দু মাস হলো নেওয়াজ আলী কুয়েত থেকে একেবারে দেশে ফিরে এসেছে। প্রায় ৩২ বছর দেশের বাইরে ছিলো। নেওয়াজ আলি আমার ভাগ্নী শেফালির হাসবেন্ড। সংক্ষিপ্ত আকারে এই নেওয়াজ আলীর ইতিহাসতা না বললেই চলে না।

তখন ১৯৮৭ সাল। আমি সবেমাত্র সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট পদে চাকুরী করছি। মাঝে মাঝে গ্রামে যাই, আগের মতো না। এম্নিতেই গ্রামে এখন আর আগের মতো যাওয়া হয় না, আবার গেলেও আগের মতো বন্ধু বান্ধবরাও খুব একটা ধারে কাছে নাই বিধায় আড্ডাও জমে না। একদিন মা জানালেন যে, শেফালীর তো বিয়ে দেয়া দরকার। শেফালীর জন্য কুমড়া বারীর নেওয়াজ আলী বিয়ের কথা বলছে। ব্যাপারটা ভেবে দেখিস। কুমড়া বাড়ির নেওয়াজ আলীর বাবা জলিল মোল্লাকে আমি মামা বলে ডাকি। তারা কততা আমাদের কাছের বা রক্তের সে হিসাবটা আমি জানি না, আজো না। তবে জলিল মামার বাড়িতে আমাদের অনেকগুলি সম্পর্ক কেমন করে জানি পাচিয়ে গেছে। আমার তিন নাম্বার বোন লায়লার বিয়ে হয়েছে এই কুমড়া বাড়িতে ইসমাইল ভাইয়ের সাথে। আমার মুসল্মানীর সময় দোস্তি হয়েছে নেওয়াজ আলীর ছোট ভাই মোতালেব বা মূর্তুজ আলির সাথে, অন্যদিকে জলিল মোল্লাকে আমরা আবার ডাকি মামা বলে। এখন আবার বিয়ের সম্পর্ক করতে চায় নেওয়াজ আলী আমাদের ভাগ্নি শেফালীর সাথে। একেকটা সম্পর্ক একেকতার সাথে পরস্পর বিরোধি। যদি জলিল মামাকে মামা বলে কেন্দ্র ধরি, তাহলে লায়লার বিয়ের জন্য জলিল মামাকে বলতে হয় ভাই বা বিয়াই। আবার লায়লার বিয়ের সম্পর্ককে যদি কেন্দ্র ধরি, তাহলে জলিল মামাকে আর মামাই বলা যায় না। আবার জলিল মামার পোলা মোতালেবের সাথে আমার দোস্তি পাতার কারনে জলিল মামা হয়ে যায় আমার খালু বা আংকেল। এখন যদি শেফালিকে নেওয়াজ আলীর সাথে বিয়ে দেই, এতোদিন যেই নেওয়ায়জ আলিকে আমি ভাই বলতাম, তাকে এখন আমার বলতে হবে জামাই বাবু আর নেওয়াজ আলি আমাকে বলা শুরু করবে "মামু"। অন্যদিকে আরেকটা ঘটনা প্রায় ঘটেই যাচ্ছিলো, সেটা না হয় নাইবা বললাম। এতো সব প্যাচালো একটা সম্পর্কের মধ্যে আমাকে এবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে শেফালির বিয়ের ব্যাপারটা নেওয়াজ আলীর সাথে।

এবার আসি শেফালীর ব্যাপারে কিছু কথা। শেফালির মা শায়েস্তা খাতুনের প্রথম পক্ষের মেয়ে শেফালী। শেফালীর জন্মের পর শেফালীর বাবা তার দেশে যাওয়ার নাম করে সে আর ফিরে আসে নাই। কেনো ফিরে আসে নাই, আদৌ বেচে আছে কিনা, বা তার একেবারে নিরুদ্দেশ হবার কল্প কাহিনী আজো আমরা কেউ জানি না। শেফালী আমাদের বাড়িতেই বড় হতে লাগলো। শেফালীর মায়ের অন্য আরেক জায়গায় বিয়ে হয়ে গেলো। সেখানে লিয়াকত, শওকাত আর ফারুকের সাথে এক মেয়ে নুরুন্নাহার এর জন্ম হয়।  শেফালী আমাদের বাড়িতেই বাপ মা বিহিন আমার মায়ের কাছে বড় হতে লাগলো। এই ধরনের বাচ্চাদের বেলায় বিয়ে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আমরা মামারা যারা গ্রামের সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছি, তাদের বেলায় এটা অনেকতা উপকারই হয়। তারা এইসব বাচ্চাদের বেলায় মামাদেরকেই আসল গার্জিয়ান ভেবে সম্পর্ক করতে আগ্রহী হয়।

নেওয়াজ আলীর ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন। খুবই সুন্দর একতা ছেলে। কিন্তু অশিক্ষিত। দেশে কাজের কিছু নাই। বেকার। বিদেশ যাওয়ার একতা হিরিক পড়েছে। কিন্তু নেওয়াজ আলীদের বা জলি মোল্লার সামর্থ নাই যে, ছেলেকে বিদেশ পাঠায়। তাই, বিয়ের মাধ্যমে যদি কনে পক্ষ থেকে কিছু ক্যাশ নেওয়া যায়, তাহলে বিদেশ যাওয়ার জন্য একটা আশার পথ খোলে। ফলে শেফালি চেহারায় অনেক কালো হলেও টাকার কাছে এটা কোনো বিশয়ই ছিলো না। তাদের দাবী- ২০ হাজার টাকা দিতে হবে ক্যাশ, নেওয়াজ দেশের বাইরে চলে যাবে বিয়ের পর। দেশের বাইরে যেতে মোট টাকা লাগবে ৩০ হাজার, বাকী ১০ হাজার জলিল মোল্লা জোগাড় করবে। শেফালীর ভুত-ভবিষ্যত অনেক কিছু চিন্তা করে শেষ নাগাদ আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, শেফালীকে আমরা নেওয়াজ আলীর সাথেই বিয়ে দেবো এবং হাজার বিশেক টাকা সহই দেবো। সেই থেকে শেফালির হাজবেন্ড নেওয়াজ আলি জুয়েতেই ছিলো, মাঝে মাঝে দেশে এসছে। এর মধ্যে শেফালির তিন সন্তানের মা, নাফিজ, নাহিদ আর একটা মেয়ে।

নেওয়াজ আলীর প্রায় ৩২ বছরের বিদেশ থাকা অবস্থায় ওর স্বাস্থ্যের অনেক ক্ষতি হবার পাশাপাশি যে, পরিবারের অনেক উন্নতি হয়েছে সেটাও না। অবশেসে নেওয়াজ আলি গত ২ মাস আগে চুরান্তভবে দেশে চলে আসে। এখন তার বয়স প্রায় ৬০ এর কাছাকাছি। ওর বড় ছেলে নাফিজ জাপানে থাকে, ছোট ছেলে নাহিদ মাত্র মেট্রিক দেবে, মেয়ে আরো ছোট। দেশে আসার পর আমার সাথে নেওয়াজ আলীর দেখা হয় নাই। মানে নেওয়াজ আলীর সাথে আমার দেখা হয় নাই প্রায় কয়েক যুগ।

যাই হোক, দুদিন আগে জানতে পারলাম, ৭ বছর আগে নেওয়াজ আলীর যে বাইপাশ সার্জারী হয়েছিলো কুয়েতে, সেই বাইপাস সার্জারীতে আবার নাকি ব্লক। তাকে পুনরায় অপারেশন করাতে হবে। ৩২ বছর বিদেশ চাকুরী করার পরেও তাদের যে খুব একটা সঞ্চয় আছে সে রকমের কিছু না। হয়তো সব মিলে লাখ পাচেক টাকার একটা ক্যাশ ব্যালেন্স থাকলেও থাকতে পারে। গতকাল নেওয়াজ আলি বুকের ব্যথায় উঠানে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো, তড়িঘড়ি করে আজগর আলী হাসপাতালে আনা হয়। তারা নেওয়াজ আলীর ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলো যে, সে ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে আছে। রাখতে চায় নাই। অগত্যা আবার গ্রামে। আসলে মাথার উপর যখন কেউ থাকে না, আর যে মাথা হিসাবে থাকে, যখন তারই কোন বিপদ হয়, তখন সে থাকে সবচেয়ে অসহায় পজিশনে। নেওয়াজ আলীর অবস্থা অনেকটা এ রকমের। অসুস্থ্য শরীর নিয়ে একবার হাসপাতাল, আরেকবার গ্রামে, এই করতে করতেই সে আরো অসুস্থ্য

আজ সকালে আবারো নেওয়াজ আলিকে হাসপাতালে "বারডেম হাসপাতাল" নিয়ে আসা হয়েছে। হার্টের পেসেন্ট, কেনো যে বারডেমে আনা হয়েছে সেটাও আমি জানি না। আর কেনো জানি ব্যাপারটায় আমি জানতেও মন চায় নাই। আর জানতে না চাওয়ার পিছনেও একটা কারন ছিলো, যা এখন আর বলছি না। একটু আগে লিয়াকত (শেফালীর ভাই) ফোনে জানালো যে, সম্ভবত নেওয়াজ আলি বাচবে না। তার অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। খরটা আমার কাছে অন্য দশটা খবরের মতোই মনে হয়েছিলো। তাড়াহুরা ছিলো না। আমার স্ত্রী মিটুলের শরীরটা অনেক খারাপ, তাকে নিয়ে ইবনে সিনায় গিয়েছিলাম, সেখান থেকে গিয়েছিলাম সি এম এইচে। ফেরার পথে আনুমানিক ২ তার দিকে লিয়াকত ফোনে জানাল যে, নেওয়াজ আলি আর নাই, মারা গেছে।

গ্রামে লাশ দাফনের জন্য যাওয়ার দরকার ছিলো, এটা একটা প্রোটকলের মধ্যে পড়ে। কিন্তু আমারো কোমড়ে একটু ব্যথা ছিলো বলে যেতে চাই নাই। আর কোমড়ে ব্যথা না থাকলেও হয়তো যাওয়া হতো কিনা আমার সন্দেহ আছে। মন যেতে চায় নাই।

শেফালি সম্ভবত কাদছে, ওর ছেলেমেরা কাদছে, এই কান্নাটা শুরু হয়েছে। আমি দোয়া করি ওদের যেনো কাদতে না হয় কিন্তু আমি জানি কান্নার ভাষা। আমি তো সেই ছোটবেলা থেকেই বাবা ছাড়া দুর্দশা জীবন থেকেই আজ এখানে এসেছি। তবে একতা বিষয় স্পষ্ট যে, যাদের মাথার উপরের বৃষ্টি অন্যের ছাতায় নিবারন হয়, তাদের উচিত না ওই ছাতাওয়ালা মানুষতাকে কোনোভাবেই ছাটার নীচে থাকতেই হিট করা। তাতে যে ছাতার আবরনটা সরে যেতে পারে এটা যখন কেউ বুঝে না, তখন ছাতাটা যখন সরে যায়, তখন ওই ছাতার মাহাত্য টা হারে হারে টের পাওয়া যায়। আমি হয়তো ওদের জন্য ওই ছাতা ওয়ালাই ছিলাম।