০৮/০৮/২০২১-What If I were not Born

উচ্ছিষ্ঠ সময়ের রাজত্ব 

আগষ্ট 

০৮

মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহন করার থেকে এতো সম্মান নাকি ঈশ্বর তার পাপমুক্ত ফেরেস্তাদেরকেও দেন নাই। সৃষ্টির সেরা জীবদের মধ্যে এই মানুষই নাকি সেরা। এই মানুষের জন্যই ঈশ্বর আকাশ তৈরী করেছেন, সেই আকাশ থেকে তিনি জল-বৃষ্টি বর্ষন করেন, জমির নির্মল গাছ গাছালীকে তিনি সবুজ সতেজ করে রাখেন। তিনি এই মানুষের জন্যই পাহাড় সৃষ্টি করেছেন, দিন আর রাতের তফাত করেছেন, ভালোবাসার মতো সংগী তৈরী করেছেন, অতঃপর তিনি জীবিনের বিভিন্ন স্তরে স্তরে নানাবিধ উপলব্দির জন্য সন্তান, নাতি নাতকোরের মতো মিষ্টি মিষ্টি ফুলের সংসারও তৈরী করেছেন। কি অদ্ভুত ঈশ্বরের সব সাজানো এই পরিকল্পনা। নীল আকাসের দিকে তাকিয়ে কখনো সাদা ফেনার মতো ভেসে যাওয়া মেঘ, কখনো উত্তাল মেঘের অবিরাম বৃষ্টিবরন, হেমন্তে বা শরতের দিনে বাহারী ফুলের সমাহার, পাখীদের কিচির মিচির, শিল্পির গানের মূর্ছনা, সবকিছু যেনো বিমোহিত করার মতো একটা সময়। অথচ এসব কিছু কোনো না কোনো একদিন ছেড়ে আমাদের সবাইকে চলেই যেতে হয়।

আবার অন্যদিকে যদি দেখি, দেখা যায়, এই বাহারী জীবনের সব সুখ আর আস্বাদন ছাড়াও আমাদের এই জীবনে ছেকে বসে দুঃখ বেদনা, হতাশা আর কষ্ট। জীবনের গাড়ি আমাদের জীবন-যানবহনের চাকার উপর টানতে টানতে এক সময় অনেকেই আমরা হাপিয়ে উঠি। বেদনায় ভরে উঠে কষ্টে, দুঃখে ভেসে যায় চোখের জল অথবা রাগে, অভিমানে একে অপরের হয়ে উঠি চরম থেকে চরম শত্রুতায় যেনো ভালোবাসা কোনোকালেই ছিলো না, হোক সেটা বিবাহ বন্ধনের মতো কোনো রোমান্টিক সম্পর্কে, অথবা ব্যবসায়ীক কোনো অংশীদারিত্তে অথবা ক্ষমতার লড়াইয়ের কোনো যুদ্ধমাঠে।

অনেক সময় আমাদের মুখ দেখে এটা বুঝা যায় না কে সুখের বা কষ্টের কোন স্তরে আছি। ভিতরের সুখ কিংবা যন্ত্রনার উপলব্ধিকে আমরা একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করলেও সঠিক স্তরটা কখনোই প্রকাশ করা যায় না। পাখীদের বেলায় কিংবা অন্য কোনো প্রানীদের বেলায় এটা কতটুকু, সেটা আমরা না কখনো ভেবে দেখেছি, না কখনো উপলব্ধি করেছি। ওরা দিনের শুরুতে আহারের খোজে বেরিয়ে যায়, পেট ভরে গেলে কোনো এক গাছের ডালে বা পাহাড়ের কোনো এক ছোট সুড়ঙ্গে রাত কাটিয়ে দেয়। তাদের অট্টালিকার দরকার পড়ে না, ওরা ওরা কেউ কারো শত্রুতা করে না, কোন পর্বনে বিশেষ কোনো কিছুর আয়োজনেরও দরকার মনে করেনা। কবে ছুটির দিন, কবে ঈদের দিন কিংবা করে কোন মহাযুদ্ধ লেগেছিলো সে খবরেও ওদের কিছুই যায় আসে না। ওদেরও সন্তান হয়, ওরাও দলবেধে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যায়, ওদের কোনো ভিসা বা ইমিগ্রেশনেরও দরকার পড়ে না। টেরিটোরিয়াল বাউন্ডারী ওদের জন্য কোনোদিন দরকার পড়ে নাই, আগামীতেও দরকার পড়বে না। ওরাও কষ্টে কিছুক্ষন হয়তো ঘেউ ঘেউ করে, কিংবা চিন্তিত হয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে চলে যায়, কিন্তু তাকে আকড়ে ধরে বসে থাকে না। ওদের সারাদিনের কর্মকান্ডের জন্য না কারো কাছে জবাব্দিহি করতে হয়, না কারো কাছে ধর্না দিতে হয়, এমনকি ওরা ঈশ্বরের কাছেও তাদের অপকর্মের কিংবা ভালোকর্মের কোনো জবাব্দিহিতা করতে হয় না। কোনো ট্যাক্স ফাইল নাই, কোনো ভ্যাট ফাইল নাই, না আছে কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স, না দরকার তাদের গাড়িঘোড়ার। তাহলে তো ওরাই আসলে শান্তিতে থাকে, মানুষের থেকে অধিক।

মানুষ ছাড়া অন্য সব প্রানীকুল প্রত্যেকেই নিজের ক্ষমতার উপর বিশ্বাস রাখে কিন্তু মানুষ তার নিজের একক ক্ষমতার উপর কখনোই সে বিশ্বাস রাখে না বা থাকে না। তার দল লাগে, তার অর্থনৈতিক মেরুদন্ড লাগে, তার আরো বিস্তর আয়োজন লাগে। এতো কিছুর উপরে তার আস্থা রাখতে গিয়ে মাঝে মাঝে সে নিজের উপরেও আস্থা হারিয়ে ফেলে। অথচ সে একা বাস করতে পারে না, না আবার সবাইকে নিয়েও বাস করতে চায়। অদ্ভুত এই মনুষ্যকূলের মধ্যে আমি জন্মে দেখেছি- এতো কিছুর বিনিময়ে অথচ কোনো কিছুই আমার না, এই শর্তে জন্ম নেয়াই যেনো একটা কষ্টের ব্যাপার। যদি কেউ এই পৃথিবীতেই না আসতো, তাহলে হয়তো বিধাতার কাছে এই ক্ষনিক সময়ে এতো কিছুর মাঝে পরিবেষ্ঠিত থেকে আবার চলে যাওয়া, কইফিয়ত দেয়া, ইত্যাদির দরকার হতো না, ক্ষমতার লড়াইয়ে হানাহানি, কারো বিয়োগে মন এতো উতালাও হতো না।

আজ থেকে বহু শতাব্দি আগে কিংবা অদুর অতীতে যারা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে, তারা আসলে আমাদেরই লোক ছিলো। তারা চলে গিয়েছে চিরতরে। কোথায় গেছেন, আর কি অবস্থায় আছেন সে সম্পর্কে আজো কেউ কোনো সম্যখ ধারনা কারো কাছেই নাই। অথচ যখন বেচে ছিলেন, প্রতিটি মুহুর্তে তারা ছিলেন সময়ের থেকেও অধিক ব্যস্ততায়। যখন তারা চলে যান, তারা আমাদের কাছে এমন কোনো ওয়াদাও করে যায়নি যে, তাদের ফেলে যাওয়া সব সম্পত্তির জন্য আবার ফিরে আসবেন, কিংবা এমনো নয় যে, তারা তা আর কখনো দাবী করবেন। এটা না হয় চিরতরে চলে যাওয়ার ব্যাপার হলো। কিন্তু এই জীবনে তো এমনো বিচ্ছেদ হয় যেখানে তারা আছেন কিন্তু আবার নাইও। জীবনের প্রয়োজনে ভউগুলিক বাউন্ডারীর অন্য প্রান্তে যখন কেউ অনেক দিনের জন্য চলে যান, আর তার ফিরে আসার ওয়াদা ভেংগে যায়, তখন আর তার উপরেও আস্থা রাখা যায়না। এমনি কষ্টে মানুষ ভোগের সমস্ত আয়োজনের উপরে থেকেও সেই আপনজনদের জন্য প্রতিনিয়ত হাহুতাশ করতে থাকেন। মনের কোথায় যেনো কি একটা সারাক্ষন খসখস করতেই থাকে। সেই যন্ত্রনায় তখন এমন মনে হয় যেনো- একটা দিনও ঠিকঠাক মতো কাটে না, এমন কি একটা রাতও না। তখন জেগে থাকে শুধু কিছু সদ্য জন্মানো কান্না। আর কান্নার আহাজারীতে সুর থাকে না, থাকে বেদনা আর কষ্ট। আর সেই কষ্টের কোনো নাম থাকে না, না থাকে তার কোনো বর্ননা বা রুপ। আর এই ভিতরের যন্ত্রনাটা কাউকেই দেখানো যায় না অথচ সত্যিটা থাকে এই ভিতরেই। আসলে পৃথিবীতে সম্পর্কের চেয়ে বড় কোনো সম্পত্তি নাই। এতো সুখের জীবনেও যখন এমন অনেক কষ্টের আর বেদনার নীল ছড়িয়েই থাকে, তাহলে কি দরকার জন্মের?

তারপরেও আমরা মানুষ হয়ে সৃষ্টির সেরা জীব হয়েই জন্ম নেই, নিয়েছি যেখানে অবারিত সবুজ ধানক্ষেতের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ার দোলা আমাদের মুখে পরশ জোগায় আবার তেমনি কখনো বিচ্ছেদের মতো যন্ত্রনা, মৃত্যুর মতো বেদনা, আবার কখনো অনিশ্চিত যাত্রার মতো দুশ্চিন্তা নিয়েই আমাদেরকে বাচতে হয়। কেউ যখন চিরতরে জীবনের নিঃশ্বাসকে স্তব্ধ করে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেন, তারজন্য যতোটা না দুশ্চিন্তা আমাদেরকে গ্রাস করে, তার থেকে যখন কোনো প্রিয়জন হটাত করে সেই চেনা পরিচিত আবাসস্থল থেকে কাউকে কিছু না বলে হারিয়ে যান আর ফিরে না আসেন, তারজন্য আরো বেশী দুশ্চিন্তা আর অমঙ্গল চিন্তা মাথা ভনভন করতে থাকে। কিন্তু এরই মতো যখন কোনো প্রিয়জন জেনেশুনে জীবনের প্রয়োজনে অথবা বড় সাফল্যের আশায় একে অপরের থেকে এমন একটা বিচ্ছেদে আপোষ করেন যেখানে টেরিটোরিয়াল বাউন্ডারী আমাদেরকে প্রায় স্থায়ী বিচ্ছেদের স্তরে নিয়ে যায়, তখন আমাদের হাসির অন্তরালে যে বেদনা লুকিয়ে থাকে, তা তুষের অনলের মতো সারাক্ষন তাপদাহে অন্তরে প্রজ্জলিত হতেই থাকে। আশা আর সাফল্যের মতো জল হয়তো সাময়ীকভাবে তা নিবারন করে কিন্তু এই ছোট ক্ষনস্থায়ী জীবনে বারবার এটাই মনে হয়- কি দরকার ছিলো এসবের? তাকে কি আটকানো যেতো না? নাকি আটকানো হয় নাই? আসলে কোনো কিছুই দরকার ছিলো না যদি না আমার জন্মই না হতো এই মানুষ হিসাবে। তখন না দরকার হতো এই বিচ্ছেদের, না প্রয়োজন হতো এই দিনরাতের কষ্টের অথবা না দরকার পড়তো অন্তর জালার তাপদাহের অনুভবতার। তখন কেনো জানি বারেবারেই মনে হয়- What If I were not born?  

করোনার প্রাদূর্ভাবে চেনা পরিচিত সব মানুষ যেনো ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে একে একে যেনো বিনা নোটিশে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। এই সেদিন যার সাথে এক টেবিলে বসে হাসাহাসি, আড্ডা, কথা কাটাকাটি, অথবা দল বেধে গায়ের কোনো মেঠো পথে বাচ্চাদের মতো হাটাহাটি করেছি, তার কিছু মুহুর্তের পরই সংবাদ আসে, আর নেই। চলে গেছে। ব্যাংকের টাকা, বিশাল ব্যবসা, কিংবা গাড়ি বহরের সব যাত্রা কোনো কিছুই যেনো তার সামনে দাড়াতে পারছে না। অথচ তাকে না দেখা যায়, না ছোয়া যায়। কখন সে কার সাথে একান্তে বাস করা শুরু করে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আতংকে আছে মন, অসুস্থ্য হয়ে যাচ্ছে শরীর, ভাবনায় ভরে যাচ্ছে সারাটা মাথা। অথচ দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে কুকুর, মনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে পাখীরা, শুধু বন্দি হয়ে আছি আমি “মানুষ”। বারবার মনে হচ্ছে- কোথায় যেনো কি ঠিক নেই, কি যেনো কোথায় একটা গড়মিল হচ্ছে তা বুঝা যাচ্ছে না। কেনো এমনটা হচ্ছে বারবার?

আসলে কোন কবি যেনো একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন- মানুষ হয়ে জন্মই যেনো আমার আজীবনের পাপ। তাই আমারো মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে- What If I were not even born!!