০৫/০৮/২০১৭-একটা সময় যখন মানুষ একা

একটা সময় আসে, যখন মানুষ একা থাকতে চায়। আবার একটা সময় আসে মানুষ যখন একাকীত্বকে ভয় পায়। আবার একটা সময় আসে মানুষ বুঝতেই পারে না সেকি একা থাকতে চায় নাকি মানুষের ভীড়ে থাকতে চায়? মানুষ তখন থাকে খুব ঘোরের মধ্যে। ঘোরের মধ্যে থাকা অবস্থাটা একটা বিপদজনক। এটা পশুদের বেলায় হয় না। তাদের পেট ভরা তো সব কাহিনী শেষ। সে তখন কোনো এক নির্জন জঙ্গলে গাছের নীচে একাই ঘুমিয়ে যায় যতোক্ষন তার পেট আবার ক্ষুধার ইঙ্গিত না দেয়। তাদের কাছে কৃষ্ণচূড়ার পাতার রঙ অথবা গোলাপের গন্ধ অথবা মরা জীবের কোনো অসহ্য ঘ্রান কোনো কিছুই বদল করে না। শীত এলে তারা গুহা খোজে, আশ্রয় চায়। বর্ষায় ওরা ভিজে ভিজে একস্থান থেকে অন্যস্থানে পায়েপায়ে অনেক দূর চলে যায়। কোথা থেকে এলো আর কোথায় গিয়ে থামবে, এটা নিয়ে ওদের কোনো মাথা ব্যথা নাই।
কিন্তু মানুষের বেলায়, সে সমাজ চায়, সে মানববসতি চায়। সে নদীর কুল চায়, চায় নদীর সাথে সাথে সভ্যতাও। এই সভ্যতার রেস ধরে মানুষ স্বপ্ন দেখে, ভালোবাসার কথা বলে। একজন আরেকজনের থেকে সুখি, আর খুসি হতে চায়। প্রতিযোগিতা বাড়ে। পছন্দ অপছন্দের হরেক পদের বং বাহারের যুক্তি তুলে কত যে নাটক, সিরিয়াল করে, তার কোনো ইয়ত্তা নাই। সুন্দর থেকে সুন্দরতমের তপস্যা চলে এই মানুষদের। আর এই তপস্যার অন্তরজালে কত কিছুই যে ব্যতিক্রম হয়, কেনো হয় কিভাবে হয় সে রহস্য সন্ধানেও আমরা বেশীরভাগ সময়ে ব্যর্থ হই। প্রতিযোগিতায় সুন্দুরী মেয়েরা সুখের ঘর হারায়, আবার সবচেয়ে অসুন্দর কোনো এক পঙ্গু মহিলা দিব্যি সুখে সংসার করে বেড়ায়। অশিক্ষিত কোনো এক মায়ের কোল ঘেঁষে দুনিয়া কাপানো সন্তানের জন্ম হয়, আবার সবচেয়ে পরিকল্পিত শিক্ষিত মায়ের কোলেই হয়ত বেড়ে উঠে সমাজের সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষটি। কেউ ভালোবাসে, অনেক সপ্নের ভিতর ডুব দিয়ে দিঘির জলের ভেসে বেড়ায়। কেউ কেউ আবার ঐ দিঘির জলের নীল চ্ছটায় কল্পনাকে ভাসিয়ে দিয়ে আকাশের নীলাভ মেঘ দেখে হয়ত ভাবে, কেউ কি তার জন্য অনেকদিন বাচতে চায়? কিংবা এমন কি কেউ আছে যে, তার সমস্তটা দিয়ে নিজের করে ভালোবাসে? সবুজ ক্ষেতের ধারে বসে কোন এক কল্পনায় কোনো এক অপরিচিত রাজপুত্রের সাক্ষাতে কত কথাই না বলাবলি করে। কিন্তু তা নিছক কল্পনার রাজ্যেই থেকে যায়। হয়ত কাউকে রাজপুত্র ভেবে মিথ্যা কোন প্ররোচনায় আবদ্ধ হয়ে সারাটি জীবন মিথ্যার মধ্যেই বসবাস করে। জানে, মনে কষ্ট, জানে হেরে গেছে, জানে এই পথ থেকে বেড়িয়ে যাবার আর কোনো রাস্তা নাই, তারপরেও জীবন তো, চলতেই থাকবে। কিন্তু কোথায় সে রাজপুত্র আর কোথায় গিয়ে এর শেষ? জোছনা রাতের চকচকে আকাশের তারার মেলায় পাখা মেলে ঝি ঝি পোকার মতো করে একগুচ্ছ ঝিনঝিন আওয়াজের মতো কতই না সঙ্গিত রচনা হয়ে আছে বুকের পাজরের মাঝে। যত্ন করে ধরে আছে ভালোবাসা। কিন্তু ঐ ভালোবাসা তো এক তরফা। যন্ত্রনা শুধু বাড়েই। ওটাই কি শেষ? এই মিথ্যা ভালোবাসায় কোনো অংশিদারিত্ত নাই, কম্প্রোমাইজ আছে কিন্তু এডজাস্টমেন্ট নেই, কান্না আছে অনুতাপের কিন্তু শান্তনা নাই, ব্যথা আছে কিন্তু বলার লোক নাই, এই ভালোবাসা শুধু খুসি রাখা আর কিছুই নাই। এখানে ভালোবাসার নির্ঘাত ভালোবাসার পচন ধরেছে। আর এই পচন শুরু হয়ছে অন্তর থেকে, তারপর শরীরে। আর যেদিন থেকে এই পচন শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই অস্থিত্তের পচন ধরেছে। এখন নিজের বাড়িতে, নিজের সমাজে, নিজের গন্ডিতে কেউ তার সাথে থাকতে চায় না। পরাজয় হয় সারা জীবনের।
যে ভালোবাসায় জিততে চায়, তাকে ভালোবাসা দিতে জানতে হবে। আর যে ঘৃণাকে জিয়িয়ে রাখতে চায়, তাকে সাফল্য এনে সেই জায়গায় যেতে হবে যেখানে তাকে স্পর্শ করার আর কারো ক্ষমতাও নাই। দুটুই কঠিন কাজ। কিন্তু এমনো কেউ আছে, যে ভালবাসল, সে হয়ত ভালবাসায় জিততেই পারলো না। এর মানে কিন্তু এই নয় যে, সে ভালোবাসায় হেরে গেলো। হয়ত সে ভুল জায়গায় ভুল জিনিসের সন্ধান করেছে। আজ কোনো এক ভাগ্যের গুনে যদি অনাকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা ফেরত যায়, কাল সে ভালোবাসার কাঙ্গাল হয়েই হারে। অথচ এমনো মানুষ আছে, কখনোই ভালোবাসা কি জিনিস নিজেও জানে না কিন্তু নিজের অজান্তেই সে লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে এমন করে স্থান নিয়ে আছে যে, চারিদিকে ভালোবাসা শুধু মৌ মৌ করে বেড়ায়। এরা এক সময় সমাজ নিয়ন্ত্রন করে, এরা এক সময় সবাইকে নিয়ন্ত্রন করে। আর যখন এটা কেউ মানতে নারাজ হয়, তখন মনে হয়, ঐ যে একবার চুপি চুপি ভালোবাসা এসেছিলো, সেটাই ছিলো জীবনের সবচেয়ে সস্থির সময় যা দেমাগ আর অশালীন ব্যবহারে মানুষ দূরে ঠেলে দিয়েছে। অনুতাপের আর শেষ থাকে না তখন।
আসলে এই পৃথিবীর কোনো কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নাই। আবার সব কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে। কেউ কবি হতে চায়, কেউ বৈজ্ঞানিক হতে চায়, কেউ অনেক ধনী হতে চায়, কেউ রাজনীতিক হতে চায়। আসলে এইগুলি ইচ্ছের উপর কিছুই নিরভর করে না। আবার এইগুলি যে ইচ্ছের উপর নির্ভর করে না, তাও ঠিক নয়। কারন কোথাও না কোথাও এর একটা রদ বদলের পালা আছে। কোথাও না কোথাও এই যোগসূত্রের একটা টার্ন আছে। যা কিছুদুর পর্যন্ত দেখা যায়, আর বড় অংশটাই আমাদের নজরের মধ্যে নাই। সবচেয়ে ট্যালেন্টেড ছাত্রটি আজ হয়ত কোথাও কোনো এক বড় অফিসের কেরানীর চাকুরী করে। অথচ যে সময়ে তাকে ট্যালেন্টেড ভাবা হয়েছিলো, সেটার গতিপথ পাল্টে আরেক দিকে টার্ন নেওয়ার কারনেই আজ সে সাফল্যের যে চূরায় উঠার কথা ছিলো তার থেকে অনেক দূরে। আবার এমনো হতে পারে, ব্যাকবেঞ্চে বসে থাকা সবচেয়ে নিরীহ ছাত্রটি আজ বিসসের কাছে এতোটাই সমাদৃত যে, কোনো সুত্রই মিলছে না। এই সুত্রটাই মিলাতে হবে। কারন কোন কিছুই হতাত করে হয়ে উঠে না। প্রকৃতি তার ধর্ম কখনোই পাল্টায় না। সেই একইভাবে, যে বালকটি একদিন কবি হতে চেয়েছিলো, সে হয়ত আজ সবচেয়ে বড় সমাজসেবি, যে একদিন সমাজসেবি হতে চেয়েছিলো, সে হয়ত আজ কারো কারো জন্যে ত্রাস। যা ঘটে তা সময়ের বিবর্তনের পালাক্রমে কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের মধ্যেই ঘটে। আজ যে রুপের কারনে আমি আপনি অহংকারী, মনে হয় পৃথিবী বুঝি আমার চরনতলে আছড়ে পড়লো। শত শত হিরো, শত শত সুশ্রী মানবীগন না জানি কতদিন কতরাত তাদের ঘুম হারাম করে রাত জেগে জেগে আমার কথা ভাবছে। এটা ভাবা সহজ। হয়ত এমনো হতে পারে, আমাদের এই আজকের দিনের সম্ভাব্য সবকিছু দেখেই কারো চোখ, কারো বুক, কারো লালসার অন্তরালে এমনই ভালবাসার জাল বানিয়ে অক্টোপাসের মতো ঘিড়ে ফেলেছে, যে, কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা ছলনা, বুঝাই দায়। যাকে তোমার আরধ্য, হয়তো দেখা যাবে তোমার চেয়েও অতি কুৎসিত কোনো রমনী তোমার আরধ্য কোনো পুরুষ তার শয্যাশায়ী। ব্যাপারটা হারজিতের নয়, ব্যাপারটা মতবাদেরও নয়, ব্যাপারটা অনেকাংশেই বৈষয়িক, আর কিছুটা তপ্ত বাসনা। ব্যাপারটা পছন্দেরও না অনেকাংশে । যে জামাটি আমি অপছন্দ করে দোকানে রেখে দিয়েছি, হয়তো ওই জামাটাই আরেকজন হন্যে হয়ে খুজছেন।
আজকে যে ট্রেনটায় আপনি উঠেছেন, সে ট্রেনের যে ব্যক্তিটি আপনার হাত ধরে তুলে নিলো, হয়ত সেই ছিলো আপনার সেই আরধ্য মানুষ। আপনি তাকে দেখেছেন কিন্তু হয়তো চিনতে পারেন নাই। কাল যখন আবার ট্রেনে উঠবেন, আপনি সেই ব্যাক্তিকে হয়ত আর কখনোই খুজে পাবেন না। সে অনেক দূর চলে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *